রেমি খুব নরম খুব সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটছে এখন। পা ডুবে যাচ্ছে কোমল সব স্পর্শের মধ্যে। শিউরে উঠছে গা। চারদিকে কী গভীর সবুজ সব টিলা। মাঝখানে একটা স্বপ্নের মতো অবিশ্বাস্য সুন্দর উপত্যকা। এত সুন্দর যে বিশ্বাস হয় না, ভয় করে। এরকম জায়গায় তো কখনও আসেনি আগে রেমি। কে নিয়ে এল তাকে!
পাশে পাশে একজন পুরুষ হাঁটছে। খুব কাছে। খুব গা ঘেঁষে। টের পাচ্ছে রেমি, কিন্তু তার মুখের দিকে সে তাকায় না। যেন জানে কে। কিংবা যেন জানতে নেই কে। কেউ একটা হবে। তবে পুরুষটির গায়ে কোনও গন্ধ নেই। তার কোনও ছায়া নেই। রেমি তবু নিশ্চিন্ত। এরকমই যেন হওয়ার কথা।
এত সুন্দর জায়গা তবু তারও কি একটু দোষ থাকতেই হবে? না থাকলে হত না? উপত্যকার ঢাল বেয়ে, নরম ঘাস মাড়িয়ে যেখানে এসে পৌঁছল রেমি, সেখানে একটা ছোট নদী। আঁকা বাঁকা। কিন্তু তাতে একটা রক্তিম স্রোত বয়ে যাচ্ছে। একটা ঝোপের ধারে পড়ে আছে একটি প্রাণ-প্রতিম শিশুর নিথর দেহ।
রেমি থেমে সামান্য ভয়ের একটা শব্দ করল। অমনি একটা পুরুষ হাত এসে চেপে ধলল তার মুখ। সেই হাতে সিগারেটের তীব্র গন্ধ। না, সিগারেট নয়। অ্যালকোহল? না, অন্য কিছু।
রেমি লোকটার মুখের দিকে তাকাল না। নদীর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। উলটো দিকে হাঁটতে লাগল। পাশাপাশি গা ঘেঁষে পুরুষটিও।
রেমি বলল, ট্রেন আসতে এত দেরি করছে কেন?
পুরুষের গলাটা গমগম করে বলে উঠল, আজ দেরি হবে।
কোথা দিয়ে ট্রেন আসবে তা জানে না রেমি। এখানে তো কোনও রেল লাইন নেই, স্টেশন নেই। তবু বলো।
না, আছে। ভাবতে না ভাবতেই সে দেখল, একটা ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম। লাল মোরমে ছাওয়া। অনেক কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছ থেকে লাল মোরমে ঝরে পড়ে আছে। একটা সবুজ টিউবওয়েল। কোনও মানুষ নেই। যাত্রী নেই। পয়েন্টসম্যান বা কুলি নেই। স্টেশনের রঙিন ঘর থেকে অবিরল টরেটক্কার শব্দ আসছে।
খুব নির্বিকার মনে রেমি ধীরে ধীরে পুরুষটির পাশাপাশি পায়চারি করতে লাগল মোবমের ওপরে। এ মা, সে জুতো বা চটি পরে আসেনি আজ! খালি পায়ের নীচে মোবমের দানা কিরকির করছে। সুড়সুড়ি দেয়।
সে সরাসরি তাকায় না। কিন্তু পাশ-চোখে লক্ষ করে, তার সঙ্গী পুরুষটি আকাশের দিকে চেয়ে আছে। চেয়ে থাকারই কথা যেন। রেমি নিজেও আকাশের দিকে তাকায়। সেখানে রক্তমেঘ। সমস্ত দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে আছে ভয়াবহ লাল। এত লাল রং কোথাও জড়ো হতে আর দেখেনি রেমি।
প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে লোহার বেড়ার ধারে রেমি একটু দাঁড়ায়। দেখতে পায়, একটা শেয়াল সেই শিশুদেহটি মুখে করে একটা জলা থেকে উঠে আসছে। রেমিকে দেখে শেয়ালটা থমকে দাঁড়ায়। চোখে চোখ রাখে। তারপর অপরাধীর মতো চোখ নামিয়ে নিয়ে হেঁটে চলে যেতে থাকে।
রেমি এবার আর চেঁচায় না। চেঁচানো বারণ।
রেমি বিষণ্ণ গলায় বলল, নিয়ে গেল।
গমগমে পুরুষকণ্ঠ বলে, ঢিল মারছি, দাঁড়াও।
আতঙ্কে রেমি বলে, না থাক। শেয়ালটা পাগল।
তাতে ভয় কী? আমরা বেড়ার মধ্যে আছি।
তবু থাক। আমরা তো চলেই যাব।
যাব কী করে? টিকিট হয়নি যে।
কেন?
টিকিটবাবু নেই।
তা হলে কী হবে?
দেখি, যদি টিকিটবাবু আসে। নইলে এখানেই রাত কাটাব আমরা।
লোকে নিন্দে করবে না?
এখানে লোক নেই। শুধু শেয়ালেরা থাকে।
শুধু শেয়াল! মা গো!
আর কিছু বলল না রেমি। দাঁড়িয়ে রইল। সামনে লাল আকাশ।
বাইরে দেয়ালে পিঠ রেখে দুজনে তখনও দাঁড়িয়ে।
ধ্রুব আর জয়ন্ত।
জয়ন্ত বলছিল, আমি দিদির সম্পর্কে সব খোঁজখবর রাখি, জামাইবাবু।
কী খবর বলো তো?
দিদিকে আপনি নষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন।
তাই নাকি?
সব জানি। নইলে রাজার সঙ্গে ওকে নিয়ে কথাটা উঠত না।
তোমার দিদিকে তোমার চেয়ে আমি একটু বেশি চিনি।
চেনারই কথা। কিন্তু আপনি সত্যিই তো আর দিদিকে চেনার চেষ্টা করেননি। আমার দিদি একটু সরল, হয়তো বোকাও। আপনাকে ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। ও কী করে বুঝবে যে, ইউ হ্যাভ ইভিল ডিজাইনস! তাই কাজটা আপনার কাছে সহজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যদি দিদি তখন একবারও আমাকে জানাত, তা হলে–
তা হলে কী?
তা হলে আপনি আজ এত সুস্থ স্বাভাবিক থাকতেন না। দিদিকেও মরতে হত না।
জয়ন্ত, আজ অনেক কথা হয়েছে। থাক।
আপনার সঙ্গে আমাদের এমনিতেও সম্পর্ক বিশেষ ছিল না। দিদি যদি মরে যায় তা হলে একেবারেই থাকবে না। আমি তো আপনার পরোয়া করি না।
এসব শুনে ধ্রুবর কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল না। রাগ, দুঃখ, অনুতাপ কিছুই নয়। কিন্তু তার খুব অদ্ভুত একটা কথা মনে হচ্ছিল। রেমি যদি মরে যায় তবে নীচের ঘরে একা থাকতে তার কি ভূতের ভয় করবে? এমন নয় যে, ধ্রুবর ভুতের ভয় আছে। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এবার ভূতের ভয় হতেও পারে। রেমি মৃত্যুর পর বোধহয় মাঝে মাঝে এসে হানা দেবে স্বপ্নে। গলা টিপে ধরতে চাইবে কি?
ধ্রুব নড়তে পারছিল না আর-একটা কারণেও। তার পিঠের দিকে মেরুদণ্ডের নীচে দুপাশে একটা তীব্র ব্যথা টের পাচ্ছিল সে। নড়তে গেলেই সেই ব্যথা বর্শার ফলার মতো মাজা ভেদ করতে চায়। সেই সঙ্গে তলপেটটা বড্ড ভারী লাগছে।
ধ্রুব অস্ফুট একটা যন্ত্রণার শব্দ করল। জয়ন্ত একবার ফিরে দেখল তাকে।
কিছু বললেন?
না। আমার কোমরে একটা ব্যথা হচ্ছে।
হচ্ছে?–বলে জয়ন্ত একটু হাসে।
হাসছ কেন? এটা কি মজার কথা?
না, আপনার যে যন্ত্রণা-টন্ত্রণা একটু-আধটু হচ্ছে এটা জেনে নিশ্চিন্ত হলাম। আপনার কিছু হোক, খুব খারাপ কিছু এটা আমি আন্তরিকভাবে চাই।
ধ্রুব মুখটা একটু বিকৃত করল। না, তার রাগ হচ্ছে না। খুব শীত করছে তার।
জগাদা বেরিয়ে এসে চারদিকে চেয়ে হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসে।
এখানে দাঁড়িয়ে কী করছ?
কী করব আর? দাঁড়িয়ে আছি।
ওটা কে? বউদিমণির ভাই না?
জয়ন্ত বলল, হ্যাঁ। কেন? আমি থাকলে অসুবিধে আছে কিছু?
জগা স্থির চোখে জয়ন্তকে একটু মেপে নিয়ে বলে, অসুবিধে আমাদের কেন হবে? বলছিলাম, দাঁড়িয়ে না থেকে ভিতরে গিয়ে বসতেও পারেন।
না, বেশ আছি। দিদি মরলে বাড়ি চলে যাব।
বাঃ, ভাইয়ের উপযুক্ত কথা বটে।
হ্যাঁ। আগে কখনও শোনেননি তো এরকম কথা! এবার শুনে নিন।
শুনছি ভাই। আমি হলাম জগা। সবাই চেনে। সম্পর্কটা এরকম না হলে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে যেত।
আপনি যে জগা তা জানি। একজন পলিটিক্যাল উন্মাদের ভাড়া কবা গুন্ডা। কিন্তু তা বলে অত রুস্তমি দেখাচ্ছেন কেন? আমি আপনাদের মতো লোককে কেয়ার করি না।
জগা স্থির নেত্রে কিছুক্ষণ জয়ন্তকে লক্ষ করে। তার হাত-পা কঠিন হয়ে ওঠে। তবে নিজেকে সে খুব সামলে রাখে।
ধ্রুবর দিকে চেয়ে জগা বলে, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
একটা ব্যথা হচ্ছে।
চলো, ভিতরে গিয়ে বসবে।
না, জগাদা। ঠিক আছি।
ব্যথাটা খুব বেশি হচ্ছে বুঝতে পারছি। তুমি তো সহজে কাতরাও না।
খুব নয়। সহ্য করতে পারব। ওদিককার কোনও খবর আছে?
না। কেউ কিছু বলছে না। কর্তাবাবু খুব কাঁদছেন। ওই যে হোমিয়ো ডাক্তার এসে গেছে। যাই।
একটা নীল গাড়ি এসে থেমেছে। একজন বুড়ো মানুষ লাঠিতে ভর করে নামছিলেন।
ধ্রুব এক পলক দেখেই বিরক্তিতে চোখ সরিয়ে নিল। রেমি মৃত্যুর দিকে কতটা এগিয়ে গেছে তা জানে না ধ্রুব। তবে এটা জানে, এখন ছোট ছোট মিষ্টি ও সুস্বাদু হোমিয়োপ্যাথির বড়ি দিয়ে লড়াইটা চালানো যাবে না।
জগা খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে ডাক্তারকে ধরে ধরে ভিতরে নিয়ে গেল।
ধ্রুবর কোথাও একটু বসতে ইচ্ছে করছিল। বুকের মধ্যে যে একটা চাপ বাঁধা হাঁসফাস ভাব সেটা বায়ুজনিত। একটু বমি করলে চাপটা কমে যেতে পারে। কোমরের ব্যথাটাও। তার স্বাভাবিক শরীর চমৎকার। সহনশীল, চটপটে, শক্তপোক্ত। এইসব ব্যথা-বেদনা ইত্যাদি আনে মদ্যপান। আজকের দিনটায় খেলেই ভাল হত।
লোকলজ্জা ধ্রুবর বড় একটা নেই। সে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেয় এবং ধীরে ধীরে ফুটপাথে উবু হয়ে বসে। গলায় আঙুল চালিয়ে হড়াৎ করে খানিকটা জল তুলে দেয়।
সেই অবস্থাতেই সে লক্ষ করে রেমির তেঁ-এটে খচ্চর ভাইটা একলাফে কয়েক হাত সরে গেল।
বমিটা বেরিয়ে যাওয়ায় খানিকটা ভাল লাগল ধ্ৰুবর। নিজের বমির সামনেই বসে বইল সে। গাড়লের মতো। মাথাটা সামান্য ঘুরছে। তবে হালকা লাগছে।
আত্মীয়স্বজন বড় কম আসেনি। এতক্ষণ বাইরে অনেকে ঘোরাঘুরি করছিল, জটলা পাকাচ্ছিল। এখন কেউ নেই। কয়েকটা গাড়ি শুধু দাঁড়িয়ে আছে।
বলতে কী, ধ্রুবর আজ একটু একা লাগছে। বহুকাল এরকম একা বোধ করেনি সে। কেন এমন মনে হচ্ছে?
ধ্রুব তার অপ্রকৃতিস্থ মাথায় ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা খুঁজতে থাকে। মনে হচ্ছে, রেমির সঙ্গে তার জাগতিক সম্পর্ক ছিঁড়ে যেতে বসেছে বলেই বোধহয় এই একা বোধ। রেমি যদি মরে যায় তা হলে কাল থেকে তার সব বন্ধন গেল। না, একথা ঠিক, রেমি বেঁচে থাকতেও তার কোনও বন্ধন ছিল না। কিন্তু বড় স্টিম লঞ্চের পিছনে বাঁধা গাধাবোটের মতো লেঙুর তো ছিল। স্টিম লঞ্চ হয়তো টেরই পায় না গাধাবোটকে, কিন্তু তবু থাকে তো। এবার সেটুকুও যাচ্ছে। চমৎকার। ধ্রুবর বরং খুশি হওয়ার কথা।
ধ্রুব খুশি যে একেবারেই হচ্ছে না তা নয়। বন্ধনমুক্তি কার কাছে না সুখের! তাছাড়া ভাগ্যবানেরই বউ মরে। কিন্তু তবু একা বোধটাও বড় স্পষ্ট।
ধ্রুব সঁাড়ানোর একটা চেষ্টা করল। কিন্তু হাঁটুর জোড় খুলতে চাইল না। এরকমই হওয়ার কথা। পেটে অঢেল মদ। কিন্তু নেশাটা কেটে গেছে। কিন্তু মদ তো তার ক্রিয়া করবেই। নেশা হয়নি বলেই বরং দ্বিগুণ ক্রিয়া করবে। শোধ নেবে শরীরের নানা জায়গায় ছোবল মেরে। তাই নিচ্ছে।
বাড়ি ফিরে যেতে পারে ধ্রুব। কিন্তু জানে ফিরে গিয়ে ঘুমোতে পারবে না। একা ঘরে আজ তার গা ছমছম করবে। বাড়ি আজ বড় ফাঁকা। প্রায় সবাই এখানে চলে এসেছে।
ধ্রুব একটা বড় শ্বাস ফেলল। নেশা করে বহুবার পথে-ঘাটে পড়ে থেকেছে। তাতে লজ্জা নেই তার। সে তো কিছু টের পায় না তখন। কিন্তু এরকম পরিপূর্ণ সচেতন অবস্থায় রাস্তায় শুয়ে পড়া কি সম্ভব? তার এখন ভীষণ ইচ্ছে করছে শুয়ে একটু চোখ বুজে থাকে।
শোবে? একটু দ্বিধা করে ধ্রুব। তারপর সামান্য হাসল। লোকলজ্জা সংকোচ এসব বিসর্জন দিতে তার দ্বিধা থাকা উচিত নয়।
বমির জায়গাটা থেকে সামান্য সরে গিয়ে ধ্রুব দেয়াল ঘেঁষে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল ফুটপাথে।
আঃ! ভারী আরাম পেল সে। শীত করছিল একটু। সেটা কিছু নয়। ফুটপাথে হাজার হাজার মানুষ কলকাতায় রাত কাটায়। আজ সচেতনভাবে ফুটপাথে শুয়ে নিজেকে তাদের সঙ্গে এক করে ভাবতে পেরে ভারী রোমাঞ্চ হল তার। চমৎকার!
মাথার নীচে আড়াআড়ি ডান হাতখানা রেখে সে চিত হয়ে আকাশের দিকে তাকাল। ফুলঝুরির মতো আলোর কণা ছড়িয়ে আছে আকাশময়। মেঘ নেই, কুয়াশা নেই। রাত্রি চলেছে ভোরের আলোর দিকে। রেমি কি রাতটা কাটাতে পারবে।
এই সুন্দর রাত্রিটিতে ধ্রুবরও খুব মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কোনও কারণ নেই। এমনি। এখন হঠাৎ ফুটপাথে শুয়ে মরে গেলে কেমন হয়?
একটা কুকুর খুব সন্তর্পণে তার বমিটা শুকছে। সন্দেহভরে তাকে একটু চেয়ে দেখো ধ্রুব কুকুরটাকে তাড়ায় না। ওকেও তো টিকে থাকতে হবে। থাক।
ধ্রুব চোখ বোজে। তার ঘুম আসছে।
জামাইবাবু!
উঁ!–ধ্রুব চোখ খুলে বুকের সামনে দুটো পা দেখতে পায়। অনেক উঁচুতে যেন মাথাটা।
শুয়ে আছেন কেন?
এমনি। ভাল লাগছে।
আপনি কি খুব বেশি অসুস্থ?
কেন? জেনে কী হবে?
বলুন না।
আমি অসুস্থ হলে তো তুমি খুশিই হও। তাই না?
আমি হই। কিন্তু দিদি হয় না।
তার মানে?
আমার দিদি আপনাকে বড় ভালবাসত। ডেসপাইট ইয়োর ইভিল ডিজাইনস।
তাই নাকি? হবে। আমি ভালবাসার কথা বেশি জানি না।
আপনার জানার কথাও নয়। যারা পায় তারা মর্ম বোঝে না। আপনার যন্ত্রণাটা কি খুব বেশি?
না। এখন ব্যথাটা নেই। আমাকে একটু ঘুমোতে দাও।
এখানে ঘুমোবেন কেন? কাছেই আপনাদের গাড়ি আছে। ব্যাকসিটে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।
গাড়ির ব্যাকসিটে যে শোওয়া যায় তা আমি জানি। কিন্তু আমার এখানেই ভাল লাগছে।
আপনার রিলেটিভরা দেখতে পেলে রাগ করবে। তাতে তোমার কী? বললাম তো, আমার কিছু না।
দিদির কথা কী বলছিলে?
দিদি আপনাকে ভালবাসত। কাজটা ঠিক করত না। কিন্তু বাসত। অন্ধের মতো, বোকার মতো। দিদি যদি টের পায় আপনি ফুটপাথে শুয়ে আছেন আর আমি আপনাকে ওঠানোর চেষ্টা করছি না তাহলে দিদি খুব দুঃখ পাবে।
রেমি এখন সুখ-দুঃখের ওপারে।
জানি। তবু দিদির কথা ভেবেই আমার অস্বস্তি হচ্ছে।
আমাকে তোমার লাথি মারতে ইচ্ছে করছে না?
না। আমি ইতর নই। আপনি উঠুন।
আমি বেশ আছি, জয়। চমৎকার।
ডাক্তার ডাকব?
না। ডাক্তার কী করবে? আমি একটু ঘুমোই।
জয়ন্ত দ্বিধাভরে দাঁড়িয়ে রইল।
ধ্রুব চোখ বুজল। টের পেল জয়ন্তর রবারসোলের জুতো মৃদু শব্দে সরে যাচ্ছে।
ঘুম এল ঝাঁপিয়ে। যেন একরাশ জল এসে ড়ুবিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাকে। রেমির ট্রেন আসছে না।
সে মৃদুস্বরে বলল, আমার জুতো হারিয়ে গেছে। কিনে দেবে?
গমগমে পুরুষকণ্ঠ বলে, জুতো! সে তো তোমার পায়েই আছে।
রেমি অবাক হয়ে দেখে, ওমা! তাই তো! কী চমৎকার একজোড়া লাল চপ্পল তার পায়ে! মাখনের মতো নরম।
চপ্পলের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চমকে ওঠে রেমি! এ মা গো! রক্ত! রক্ত গড়াচ্ছে যে! চটির রং লাল বটে, কিন্তু রক্তের লাল!
রেমি চেঁচিয়ে উঠে চটিজোড়া পা থেকে ছেড়ে ফেলবার চেষ্টা করছিল। ভীষণ ঝাঁকুনি লাগছিল শরীরে।
সে কি ভুল বকছে? রেমি আবছা ক্ষীণ চোখের আলোয় ছায়া-ছায়া কিছু লোককে দেখতে পায়। অপারেশন থিয়েটার? হ্যাঁ, তাই তো! তবে এতক্ষণ সে কোথায় ছিল? কত দূরে?
আবার কি চলে যাবে রেমি? অস্ফুট এক অভিমানে সে বলে, তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলে ওগো? কোথায়? রাজার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবে বলে? শুনেছ কখনও নিজের বউকে কেউ অন্যের সঙ্গে বিয়ে দেয়?
হ্যাঁ, পাগল ধ্ৰুব একদা তা-ই করেছিল।
বেড়াতে যাওয়ার নাম করে ধ্রুব রেমিকে বের করে আনল বাড়ি থেকে। ট্যাকসিতে তুলে সাঁ করে নিয়ে এল ওয়েলিংটন স্কোয়ারের কাছে একটা বাড়িতে।
ঠিক বাড়ি নয়। একটা রহস্যজনক আস্তানা। পুরনো একটা বাড়ির দোতলায় রেমিকে নিয়ে উঠল ধ্রুব। খুব নোংরা পরিবেশ। পচা তরকারি খোসা, রোদ না লাগা দেয়াল, নর্দমা ইত্যাদির মিশ্র গন্ধে গা ঘুলিয়ে ওঠে।
লোকজন কেউই প্রায় ছিল না। দোতলার বারান্দার শেষপ্রান্তে একটা ঘর। সেই ঘরে রাজা ম্লানমুখে বসে আছে।
রেমি রাজাকে দেখেই আঁতকে উঠে বলে, এ আমাকে কোথায় আনলে তুমি?
ধ্রুব কঠিন স্বরে বলে, জায়গাটা খারাপ নয়, রেমি। তোমাকে মানায়।
তার মানে?
এখানে যতটা নোংরামি তার চেয়ে ঢের বেশি নোংরামি তোমার মনে।
কী বলছ ওসব? আমি যা করেছি শুধু তোমার জন্য।
জানি। বিশ্বাসও করি। কিন্তু তা করতে গিয়ে এ বেচারাকে ড়ুবিয়ে দিয়েছ।
রেমি রুখে উঠে বলে, আমি কাউকে ডোবাইনি।
ওকে জিজ্ঞেস করো ও তোমার প্রেমে পড়ে গেছে কি না।
সে দোষ আমার নয়।
তুমি ওকে প্রশ্রয় দিয়েছ। প্রেম-প্রেম খেলা খেলেছ। আমি এ খেলা অপছন্দ করি।
রেমি হঠাৎ পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠল, না! না! না! না!
ধ্রুব তার মুখ চেপে ধরল জোরালো হাতে। বলল, খবরদার চেঁচাবে না।
রেমি এক ঝটকায় মুখটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, একসোবার চেঁচাব। তুমি এ কাণ্ড কেন করছ তা কি আমি জানি না?
কী জানো?
তুমি শ্বশুরমশাইয়ের ওপর শোধ তুলতে চাও।
তার মানে?
উনি আমাকে ভালবাসেন। খুব বেশি ভালবাসেন। আমাকে ওর কাছ থেকে দূর করে দিয়ে তুমি ওঁকে জব্দ করতে চাও। আমি জানি! সব জানি।
আশ্চর্য এই, ধ্রুব এই কথা শুনে মিইয়ে গেল। তারপর মুচকি একটু হাসল।