বেতাল কহিল, মহারাজ!
ভোগবতী নগরীতে, অনঙ্গসেন নামে, অতি প্ৰসিদ্ধ মহীপাল ছিলেন। চূড়ামণি নামে সৰ্বগুণাকর শুকপক্ষী, সর্ব কাল, তাঁহার সন্নিহিত থাকিত। এক দিন, রাজা কথাপ্রসঙ্গে চূড়ামণিকে জিজ্ঞাসিলেন, শুক! তুমি কি কি জান। সে কহিল, মহারাজ! আমি ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান, কালক্রয়ের বৃত্তান্ত জানি। তখন রাজা কহিলেন, যদি তুমি ত্রিকালজ্ঞ হও, বল, কোন স্থানে আমার উপযুক্ত রমণী আছে। চূড়ামণি নিবেদন করিল, মহারাজ! মগধদেশের অধিপতি রাজা বীরসেনের চন্দ্রাবতী নামে এক কন্যা আছে; সে পরম সুন্দরী ও সাতিশয় গুণশালিনী; তাহার সহিত মহারাজের বিবাহ হইবেক।
রাজা অনঙ্গসেন, শুকের সর্বজ্ঞতা পরীক্ষার্থে, চন্দ্ৰকান্ত নামক সুপ্ৰসিদ্ধ দৈবজ্ঞকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসিলেন, মহাশয়! আপনি গণনা দ্বারা নির্ধারিত করিয়া বলুন, কোন কামিনীর সহিত আমার বিবাহ হইবেক। তিনি জ্যোতির্বিদ্যাপ্রভাবে অবগত হইয়া কহিলেন, মহারাজ! চন্দ্রাবতী নামে এক অতি রূপবতী রমণী আছে; গণনা দ্বারা দৃষ্ট হইতেছে, তাহার সহিত আপনকার পরিণয় হইবেক। রাজা শুনিয়া শুকের প্রতি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; পরে এক সদ্বক্তা, চতুর, বুদ্ধিমান, কাৰ্যদক্ষ ব্ৰাহ্মণকে আনাইয়া, নানা উপদেশ দিয়া, সম্বন্ধস্থিরীকরণার্থে, মগধেশ্বরের নিকট পাঠাইলেন।
চন্দ্রাবতীর নিকটেও মদনমঞ্জরী নামে এক শারিকা থাকিত। তাহারও সর্বজ্ঞতাখ্যাতি ছিল। তিনি, এক দিবস, তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন, শারিকে! যদি তুমি ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সমুদায় বলিতে পার, আমার যোগ্য পতি কোথায় আছেন, বল। শারিকা কহিল, রাজনন্দিনী। আমি দেখিতেছি, ভোগবতী নগরীর অধিপতি রাজা অনঙ্গসেন তোমার পতি হইবেন। ফলতঃ, অনঙ্গসেন ও চন্দ্রাবতী, উভয়েরই, এইরূপে শ্রবণ দ্বারা অন্তরে অনুরাগসঞ্চার হইল, এবং, সমাগমের অভাব নিবন্ধন, উভয়েরই, ক্রমে ক্রমে, পূর্বরাগ সংক্রান্ত স্মরদশার আবির্ভাব হইতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে, অনঙ্গসেনের প্ৰেরিত ব্ৰাহ্মণ, মগধেশ্বরের নিকট উপস্থিত হইয়া, স্বীয় রাজার অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করিলে, তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন এবং, বাগদানের দ্রব্যসামগ্ৰী সমভিব্যাহারে দিয়া, এক ব্ৰাহ্মণকে ঐ ব্ৰাহ্মণের সহিত পাঠাইলেন; কহিয়া দিলেন, তুমি তথা হইতে প্রত্যাগমন না করিলে, আমি কোনও উদ্যোগ করিতে পারিব না। বাগদানের দ্রব্যসামগ্ৰী লইয়া ব্ৰাহ্মণেরা, অনঙ্গসেনের নিকট উপস্থিত হইয়া, সবিশেষ সমস্ত বিজ্ঞাপন করিলে, তিনি আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইলেন, এবং সুবিজ্ঞ দৈবজ্ঞ দ্বারা, বিবাহের দিন নির্ধারিত করিয়া, মগধেশ্বরের প্রেরিত ব্ৰাহ্মণ দ্বারা, তাঁহার নিকট সংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। অনন্তর, নির্ধারিত দিবসে, যথাসময়ে মগধেশ্বরের আলয়ে উপস্থিত হইয়া, অনঙ্গসেন, চন্দ্রাবতীর পাণিগ্রহণপূর্বক, নিজ রাজধানী প্ৰত্যাগমন করিয়া, পরম সুখে কালক্ষেপণ করিতে লাগিলেন।
চন্দ্রাবতী, শ্বশুরালয়ে আগমনকালে, মদনমঞ্জরী শারিকারে সমভিব্যাহারে আনিয়াছিলেন। তিনি তাহাকে সর্বদা আপন সমীপে রাখিতেন। রাজাও, ক্ষণ কালের নিমিত্ত, চূড়ামণিকে দৃষ্টিপথের বহিস্কৃত করিতেন না। এক দিবস, রাজা ও রাজমহিষী অন্তঃপুরে একাসনে উপবিষ্ট আছেন, এবং পিঞ্জীরস্থ শুক-শারিকাও তাঁহাদের সম্মুখে আছে; সেই সময়ে রাজা রাজ্ঞীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, দেখ, একাকী থাকিলে অতি কষ্টে কালব্যাপন হয়; অতএব আমার অভিলাষ, শুকের সহিত তোমার শারিকার বিবাহ দিয়া, উভয়কে এক পিঞ্জরে রাখি; তাহা হইলে, উহারা আনন্দে কালাহরণ করিতে পরিবেক। রাজ্ঞী, ঈষৎ হাসিয়া, অনুমোদনপ্রদর্শন করিলে, রাজা, শুকের সহিত শারিকার বিবাহ দিয়া, উভয়কে এক পিঞ্জরে রাখিয়া দিলেন।
এক দিন, রাজা নির্জনে, রাজমহিষীর সহিত, রসপ্রসঙ্গে কালব্যাপন করিতেছেন, সেই সময়ে শুক শারিকাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিতে লাগিল, দেখ, এই অসার সংসারে ভোগ অতি সার পদার্থ। যে ব্যক্তি, এই জগতে জন্মগ্রহণ করিয়া, ভৌগসুখে পরাঙ্মুখ থাকে, তাহার বৃথা জন্ম। অতএব, কি নিমিত্ত, তুমি ভোগবিষয়ে নিরুৎসাহিনী হইতেছ। শারিক কহিল, পুরুষজাতি আতিশয় শঠ, অধৰ্মী, স্বার্থপর ও স্ত্রীহত্যাকারী; এজন্য, পুরুষসহবাসে আমার রুচি হয় না। শুক কহিল, নারীও অতিশয় চপলা, কুটিলা, মিথ্যাবাদিনী, ও পুরুষঘাতিনী। উভয়ের এইরূপ বিবাদারম্ভ দেখিয়া, রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, হে শুক! হে শারিকে! কেন তোমরা অকারণে কলহ করিতেছি। তখন শারিক কহিল, মহারাজ! পুরুষ বড় অধৰ্মী, এই নিমিত্তে পুরুষজাতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও অনুরাগ নাই। আমি পুরুষের ব্যবহার ও চরিত্র বিষয়ে এক উপাখ্যান কহিতেছি, শ্রবণ করুন।
ইলাপুরে, মহাধন নামে, অতি ঐশ্বর্যশালী এক শ্রেষ্ঠী ছিলেন। বহুকাল অতীত হইয়া গেল, তথাপি তাঁহার পুত্ৰ হইল না; এজন্য, তিনি সর্বদাই মনোদুঃখে কালাহরণ করেন। কিয়ৎ দিন পরে, জগদীশ্বরের কৃপায়, তাহার সহধর্মিণী এক কুমার প্রসব করিলেন। শ্রেষ্ঠী, অধিক বয়সে পুত্ৰমুখনিরীক্ষণ করিয়া, আপনাকে কৃতাৰ্থ বোধ করিলেন, এবং পুত্রের নাম নয়নানন্দ রাখিয়া, পরম যত্নে তাহার লালন পালন করিতে লাগিলেন। বালক পঞ্চমবর্ষীয় হইলে, তিনি তাহাকে, বিদ্যাভ্যাসের নিমিত্ত, উপযুক্ত শিক্ষকের হস্তে সমর্পণ করিলেন। সে, স্বভাবদোষবশতঃ, কেবল দুঃশীল, দুশ্চরিত্র বালকগণের সহিত কুৎসিত ক্রীড়ায় আসক্ত হইয়া, সতত কালব্যাপন করে, ক্ষণমাত্ৰও অধ্যয়নে মনোনিবেশ করে না। ক্রমে ক্রমে যত বয়োবৃদ্ধি হইতে লাগিল, তদীয় কুপ্রবৃত্তি সকল, উত্তরোত্তর, ততই উত্তেজিত হইতে লাগিল।
কিয়ৎ কাল পরে, শ্রেষ্ঠী পরলোক প্রাপ্ত হইলেন। নয়নানন্দ, সমস্ত পৈতৃক ধনের অধিকারী হইয়া, দ্যূতক্ৰীড়া, সুরাপান প্রভৃতি ব্যসনে আসক্ত হইল, এবং কতিপয় বৎসরের মধ্যে, দুষ্ক্রিয়া দ্বারা সমস্ত সম্পত্তি নষ্ট করিয়া, অত্যন্ত দুর্দশায় পড়িল। পরে সে, ইলাপুর পরিত্যাগপূর্বক, নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে, চন্দ্রপুরনিবাসী হেমগুপ্ত শেঠের নিকট উপস্থিত হইয়া, আত্মপরিচয়প্রদান করিল। হেমগুপ্ত তাহার পিতার পরম বন্ধু ছিলেন; উহাকে দেখিয়া, অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন, এবং যথোচিত সমাদর ও সাতিশয় প্রীতিপ্ৰদৰ্শন-পূর্বক, জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস! তুমি, কি সংযোগে, অকস্মাৎ এস্থলে উপস্থিত হইলে।
নয়নানন্দ কহিল, আমি, কতিপয় অর্ণবপোত লইয়া, সিংহল দ্বীপে বাণিজ্য করিতে যাইতেছিলাম। দৈবের প্রতিকূলতা প্রযুক্ত, অকস্মাৎ প্রবল বাত্যা উত্থিত হওয়াতে, সমস্ত অর্ণবপোত জলমগ্ন হইল। আমি, ভাগ্যবলে, এক ফলকমাত্র অবলম্বন করিয়া, বহু কষ্টে প্রাণরক্ষা করিয়াছি। এ পর্যন্ত আসিয়া, আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এমন আশা ছিল না। আমার সমভিব্যাহারের লোক সকল কে কোন দিকে গেল, বঁচিয়াছে, কি মরিয়াছে, কিছুই অনুসন্ধান করিতে পারি নাই। দ্রব্যসামগ্ৰী সমগ্র জলমগ্ন হইয়াছে। এ অবস্থায় দেশে প্ৰবেশ করিতে অতিশয় লজ্জা হইতেছে। কি করি, কোথায় যাই, কোনও উপায় ভাবিয়া পাইতেছি না। অবশেষে, আপনকার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।
এই সমস্ত শ্ৰবণগোচর করিয়া, হেমগুপ্ত মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, আমি অনেক দিন অবধি, রত্নাবতীর নিমিত্ত, নানা স্থানে, পাত্রের অন্বেষণ করিতেছি; কোথাও মনোনীত হইতেছে না; বুঝি, ভগবান কৃপা করিয়া গৃহে উপস্থিত করিয়া দিলেন। এ অতি সদ্বংশজাত, পৈতৃক অতুল অর্থসম্পত্তির ন্যায়, পৈতৃক অতুল গুণসম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হইয়াছে, সন্দেহ নাই। অতএব, ত্বরায় দিন স্থির করিয়া, ইহার সহিত রত্নাবতীর বিবাহ দি। মনে মনে এইপ্ৰকার কল্পনা করিয়া, তিনি শ্রেষ্টিনীর নিকটে গিয়া কহিলেন, দেখ, এক শ্রেষ্ঠীর পুত্ৰ উপস্থিত হইয়াছে; সে সৎকুলোদ্ভব। তাহার পিতার সহিত আমার অতিশয় আত্মীয়তা ছিল। যদি তোমার মত হয়, তাহার সহিত রত্নাবতীর বিবাহ দি।
শ্রেষ্টিনী শুনিয়া সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, ভগবানের ইচ্ছা না হইলে, এরূপ ঘটে না। বিনা চেষ্টায় মনস্কাম সিদ্ধ হওয়া ভাগ্যের কথা। অতএব, বিলম্বের প্রয়োজন নাই; দিন স্থির করিয়া, ত্বরায় শুভ কর্ম সম্পন্ন কর। শ্রেষ্ঠী, স্বীয় সহধর্মিণীর অভিপ্ৰায় বুঝিয়া, মহাধননন্দনের নিকটে গিয়া, আপন অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করিলেন। সে তৎক্ষণাৎ সম্মত হইল। তখন তিনি, শুভ দিন ও শুভ লগ্ন নির্ধারিত করিয়া, মহাসমারোহে কন্যার বিবাহ দিলেন। বর ও কন্যা, পরম কৌতুকে, কালব্যাপন করিতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে, নয়নানন্দ, মনোমধ্যে কোনও অসৎ অভিসন্ধি করিয়া, আপন পত্নীকে বলিল, দেখ, অনেক দিন হইল, আমি স্বদেশে যাই নাই, এবং বন্ধুবর্গেরও কোনও সংবাদ পাই নাই; তাহাতে অন্তঃকরণে কি পৰ্যন্ত উৎকণ্ঠা জন্মিয়াছে, বলিতে পারি না। অতএব, তোমার পিতা-মাতার মত করিয়া, আমায় বিদায় দাও; আর, যদি ইচ্ছা হয়, তুমিও সমভিব্যাহারে চল। পতিব্ৰতা রত্নাবতী, জননীর নিকটে গিয়া, স্বামীর অভিপ্ৰায় ব্যক্তি করিল।
শ্রেষ্টিনী স্বামীর সন্নিধানে গিয়া কহিলেন, তোমার জামাতা গৃহে যাইতে উদ্যত হইয়াছেন। শ্রেষ্ঠ শুনিয়া, ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, সে জন্যে ভাবনা কি; বিদায় করিয়া দিতেছি। তুমি কি জান না, জন, জামাই, ভাগিনেয়, এ তিন, কোনও কালে, আপন হয় না, ও তাহাদের উপর বলপ্ৰকাশ চলে না। জামাতা যাহাতে সন্তুষ্ট থাকেন, তাহাই সর্বাংশে কর্তব্য। তাঁহাকে বল, ভাল দিন দেখিয়া, বিদায় করিয়া দিতেছি। অনন্তর, শ্রেষ্ঠী আপন তনয়াকে হাস্যমুখে জিজ্ঞাসিলেন, বৎসে! তোমার অভিপ্ৰায় কি, শ্বশুরালয়ে যাইবে, না পিত্ৰালয়ে থাকিবে।
রত্নাবতী, কিয়ৎ ক্ষণ, লজ্জায় নম্রমুখী ও নিরুত্তর হইয়া রহিল; অনন্তর, কার্যান্তরব্যাপদেশে, তথা হইতে অপসৃত হইয়া, স্বামীর নিকটে গিয়া কহিল, দেখ, পিতা মাতা সম্মত হইয়াছেন; কহিলেন, তুমি যাহাতে সন্তুষ্ট হও, তাহাই করিবেন। অতএব, তোমায় এই অনুরোধ করিতেছি, কোনও কারণে, আমায় ছাড়িয়া যাইও না; আমি, তোমার অদর্শনে, প্ৰাণধারণ করিতে পারিব না।
পরিশেষে, শ্রেষ্ঠী জামাতাকে, অনেকবিধ দ্রব্যসামগ্রী ও প্রচুর অর্থ দিয়া, মহাসমাদরপূর্বক, বিদায় করিলেন, এবং কন্যাকেও, মহামূল্য অলঙ্কারসমূহে ভূষিতা করিয়া, তাহার সমভিব্যাহারিণী করিয়া দিলেন। নয়নানন্দ, নিরতিশয় আনন্দিত হইয়া, শ্বশ্রূ ও শ্বশুরের চরণবন্দনাপূর্বক, পত্নীর সহিত প্রস্থান করিল।
নয়নানন্দ, এক নিবিড় জঙ্গলে উপস্থিত হইয়া, শ্রেষ্ঠী কন্যাকে কহিল, দেখ, এই অরণ্যে অতিশয় দস্যুভয় আছে; শিবিকায় আরোহণ ও অঙ্গে অলঙ্কারধারণ করিয়া যাওয়া উচিত নহে; অলঙ্কারগুলি খুলিয়া আমার হস্তে দাও, আমি বস্ত্রাবৃত করিয়া রাখি; নগর নিকটবর্তী হইলে, পুনরায় পরিবে। আর, বাহকেরাও, শিবিকা লইয়া, এই স্থান হইতে ফিরিয়া যাউক, কেবল আমরা দুইজনে দরিদ্রবেশে গমন করি; তাহা হইলে, নিরুপদ্রবে যাইতে পারিব।
রত্নাবতী, তৎক্ষণাৎ, অঙ্গ হইতে উন্মোচিত করিয়া, সমস্ত আভরণ স্বামিহন্তে ন্যস্ত করিল, এবং দাস দাসী ও বাহকদিগকে বিদায় করিয়া দিয়া, একাকিনী সেই শঠের সমভিব্যাহারিণী হইয়া চলিল। নয়নানন্দ, এইরূপে মহামূল্য অলঙ্কারসমূহ হস্তগত করিয়া, ক্ৰমে ক্রমে, অরণ্যের অতি নিবিড় প্রদেশে প্রবেশ করিল, এবং তাদৃশ পতিপরায়ণা হিতৈষিণী প্রণয়িনীকে অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত করিয়া, পলায়নপূর্বক, স্বদেশে উপস্থিত হইল। রত্নাবতী, কুপে পতিত হইয়া, হা তাত! হা মাতঃ! বলিয়া, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। দৈবযোগে, এক পথিক, তথায় উপস্থিত হইয়া, তাদৃশ্য নিবিড় অরণ্যমধ্যে অসম্ভাবিত রোদনশব্দ শ্রবণ করিয়া, অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইল, এবং শব্দ অনুসারে গমন করিয়া, কূপের সমীপবর্তী হইয়া, তন্মধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্বক, অবলোকন করিল, এক পরম সুন্দরী নারী, উচ্চৈঃস্বরে রোদন ও পরিবেদন করিতেছে। পথিক দর্শনমাত্র, অতিমাত্র ব্যাকুল হইয়া, পরম যত্নে সেই স্ত্রীরত্নকে কূপ হইতে উদ্ধৃত করিয়া, জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে, কি নিমিত্তে, একাকিনী এই ভয়ঙ্কর কাননে আসিয়াছিলে; কি প্রকারেই বা তোমার এতাদৃশী দুর্দশা ঘটিল, বল।
রত্নাবতী, পতিনিন্দা অতি গৰ্হিত বুঝিয়া, প্রকৃত ব্যাপার গোপনে রাখিয়া কহিল, আমি চন্দ্রপুরনিবাসী হেমগুপ্ত শেঠের কন্যা; আমার নাম রত্নাবতী; আপন পতির সহিত শ্বশুরালয়ে যাইতেছিলাম; এই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র, সহসা কতিপয় দুর্দান্ত দস্যু আসিয়া, প্রথমতঃ, অঙ্গ হইতে সমস্ত অলঙ্কার লইয়া, আমায় এই কূপে ফেলিয়া দিল, এবং আমার পতিকে নিতান্ত নির্দয়ারূপে প্ৰহার করিতে করিতে, লইয়া গেল। তাঁহার কি দশা ঘটিয়াছে, কিছুই জানি না। পান্থ শুনিয়া অতিশয় আক্ষেপ করিতে লাগিল, এবং অশেষবিধ আশ্বাসদান ও অভয়প্ৰদান পূর্বক, অতি যত্নে রত্নাবতীকে সঙ্গে লইয়া, তাহার পিত্ৰালয়ে পঁহুছাইয়া দিল।
রত্নাবতী পিতা-মাতার নিরতিশয় স্নেহপাত্র ছিল। তাঁহারা, তাহার তাদৃশ্য অসম্ভাবিত দুরবস্থা দর্শনে নিতান্ত বিস্ময়াপন্ন ও একান্ত শোকাক্রান্ত হইয়া, গলদশ্রু লোচনে, আকুল বচনে জিজ্ঞাসিলেন, বৎসে! কিরূপে তোমার এরূপ দুৰ্দশা ঘটিল, বল। সে কহিল, এক অরণ্যে, অকস্মাৎ চারিদিক হইতে, অস্ত্ৰধারী পুরুষেরা আসিয়া, বলপূর্বক আমার অঙ্গ হইতে সমুদায় অলঙ্কার খুলিয়া লইল, এবং তাঁহাকে যত সম্পত্তি দিয়া বিদায় করিয়াছিলে, সে সমুদায়ও কাড়িয়া লইল; অনন্তর, আমাকে এক অন্ধকূপে ফেলিয়া দিয়া, তাহার পৃষ্ঠে, নিতান্ত নিষ্ঠুর রূপে, যষ্টিপ্রহার করিতে করিতে, কহিতে লাগিল, আর কোথায় কি লুকাইয়া রাখিয়াছিস, বাহির করিয়া দে। তখন তিনি, নিতান্ত কাতর স্বরে অনেক বিনয় করিয়া বলিলেন, আমাদের নিকট যাহা ছিল, সমস্ত তোমাদের হস্তগত হইয়াছে; আর কিছুমাত্ৰ নাই। তোমাদের প্রহারে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতেছে; চরণে ধরিতেছি ও কৃতাঞ্জলি হইয়া ভিক্ষা করিতেছি, আমায় ছাড়িয়া দাও। তিনি বারংবার এইপ্ৰকার কাতরোক্তিপ্রয়োগ করিতে লাগিলেন; নির্দয় দস্যুরা তথাপি তাঁহাকে রজ্জুবদ্ধ করিয়া লইয়া গেল; তৎপরে ছাড়িয়া দিল, কি মারিয়া ফেলিল, কিছুই জানিতে পারি নাই। তখন তাহার পিতা কহিলেন, বৎসে! তুমি উৎকণ্ঠিত হইও না। আমার অন্তঃকরণে লইতেছে, তোমার পতি জীবিত আছেন। চোরেরা অর্থাপিশাচ, অর্থ হস্তগত হইলে, আর অকারণে প্ৰাণ নষ্ট করে না। এইরূপে অশেষবিধ আশ্বাস ও প্ৰবোধ দিয়া, তাহার পিতা, অবিলম্বে, আর এক প্ৰস্থ অলঙ্কার প্রস্তুত করিয়া দিলেন।
এদিকে, নয়নানন্দ, আপনি আলয়ে উপস্থিত হইয়া, অলঙ্কারবিক্রয় দ্বারা অর্থসংগ্ৰহ করিয়া, দিবারাত্র দূত্যক্রীড়া, সুরাপান প্রভৃতি দ্বারা কালক্ষেপ করিতে লাগিল, এবং কিয়ৎ দিনের মধ্যেই, পুনরায় নিঃস্বভাবাপন্ন ও অন্নবস্ত্রবিহীন হইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিল, আমি যে কুব্যবহার করিয়াছি, তাহা শ্বশুরালয়ে, কোনও প্রকারেই, প্ৰকাশ পায় নাই। অতএব, একটা ছল করিয়া, তথায় উপস্থিত হই; পরে, দুই চারি দিন অবস্থিতি করিয়া, সুযোগক্রমে কিছু হস্তগত করিয়া, পলাইয়া আসিব। মনে মনে এই দুষ্ট অভিসন্ধি করিয়া, সে শ্বশুরালয়ে গমন করিল, এবং বাটীতে প্ৰবেশ করিরামাত্র, সর্বাগ্রে স্বীয় পত্নী রত্নাবতীর দৃষ্টিপথে পতিত হইল।
পতিপ্ৰাণ রত্নাবতী, পতিকে সমাগত দেখিয়া, অন্তঃকরণে চিন্তা করিল, পতি, অতি দুরাচার হইলেও, নারীর পরম গুরু। তাঁহাকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিলেই, নারী ইহলোকে ও পরলোকে চরিতার্থতা প্ৰাপ্ত হয়। আর, যে নারী, কুমতিপরতন্ত্র হইয়া, পরম গুরু স্বামীর কাদাচিৎক কুব্যবহারকে অপরাধ গণ্য করিয়া, তাহার প্রতি কোনও প্রকারে অশ্রদ্ধা বা অনাদর প্রদর্শন করে, সে আপন ঐহিক ও পারলৌকিক সকল সুখে জলাঞ্জলি দেয়। আর, উনি, কেবল ভ্ৰান্তিক্ৰমেই, সেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই। অতএব, আমি, সেই সামান্য দোষ ধরিয়া, উহার চরণে অপরাধিনী হইব না। যাহা হউক, উনি সবিশেষ না জানিয়াই এখানে আসিয়াছেন; আমায় দেখিতে পাইলেই, নিঃসন্দেহ, পলায়ন করিবেন। অতএব, অগ্ৰে উহার ভয়ভঞ্জন করিয়া দেওয়া উচিত।
রত্নাবতী, অন্তঃকরণে, এই সকল আলোচনা করিয়া, ত্বরায় তাহার সন্মুখবর্তিনী হইয়া কহিল, নাথ! তুমি অন্তঃকরণে কোনও আশঙ্কা করিও না। আমি পিতা মাতার নিকট কহিয়াছি, চোরেরা, অলঙ্কারগ্রহণপূর্বক, আমায় কুপে নিক্ষিপ্ত করিয়া, তোমায় বাঁধিয়া লইয়া গিয়াছে। অতএব, সে সকল কথা মনে করিয়া, ভীত হইবার আবশ্যকতা নাই। আমার পিতা মাতা তোমার নিমিত্ত অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত আছেন; তোমায় দেখিলে, যার পর নাই, আহ্লাদিত হইবেন। আর তোমার স্থানান্তরে যাইবার প্রয়োজন নাই; এই স্থানেই অবস্থিতি করা; আমি যাবজ্জীবন তোমার চরণসেবা করিব। এইরূপে তাহার ভয়ভঞ্জন করিয়া, পরিশেষে রত্নাবতী কহিল, আমি পিতা-মাতার নিকট যেরূপ বলিয়াছি, তোমায় জিজ্ঞাসা করিলে, তুমিও সেইরূপ বলিবে।
এইরূপ উপদেশ দিয়া, রত্নাবতী প্রস্থান করিলে পর, সেই ধূর্ত তৎক্ষণাৎ শ্বশুরের নিকটে গিয়া প্ৰণাম করিল। শ্রেষ্ঠী, আলিঙ্গনপূর্বক আশীৰ্বাদ করিয়া, অশ্রুপূর্ণ লোচনে গদগদ বচনে, জামাতাকে সবিশেষ সমস্ত জিজ্ঞাসিতে লাগিলেন। নয়নানন্দ, স্বীয় সহধর্মিণীর উপদেশানুরূপ সমস্ত বৰ্ণনা করিয়া, পরিশেষে কহিল, মহাশয়। যেরূপ বিপদে পড়িয়ছিলাম, তাহাতে প্রাণরক্ষার কোনও সম্ভাবনা ছিল না; কেবল জগদীশ্বরের কৃপায়, ও আপনাদের চরণারবিন্দের অকৃত্ৰিমস্নেহসম্বলিত আশীৰ্বাদের প্রভাবে, এ যাত্ৰা কথঞ্চিৎ পরিত্রাণ পাইয়াছি। যন্ত্রণার পরিসীমা ছিল না। অধিক আর কি বলিব, শত্রুও যেন কখনও এরূপ বিপদে না পড়ে। ইহা কহিয়া, যেন যথার্থই পূরব অবস্থার স্মরণ হইল, এরূপ ভান করিয়া, সে রোদন করিতে লাগিল। সবিশেষ সমস্ত শুনিয়া ও তাহার ভাব দেখিয়া, হেমগুপ্তের অন্তঃকরণে অতিশয় অনুকম্পা জন্মিল।
রজনী উপস্থিত হইল। পতিপ্ৰাণ রত্নাবতী, স্বামিসমাগমসৌভাগ্যমদে মত্ত হইয়া, তদীয় পূর্বতন নৃশংস আচরণ বিস্মরণপূর্বক, তৎসহবাসসুখসম্ভোগের অভিলাষে, মনের উল্লাসে, সর্বাঙ্গে সর্বপ্রকার অলঙ্কার পরিধান করিয়া, শয়নাগারে প্রবেশ করিল। নয়নানন্দ, কিয়ৎ ক্ষণ কৃত্রিম কৌতুকের পর, নিদ্রাবেশ প্রকাশ করিতে লাগিল। তখন রত্নাবতী কহিল, আজ তুমি পথশ্ৰান্ত আছ, আর অধিক ক্ষণ জাগরণক্লেশ সহ্য করিবার প্রয়োজন নাই। শয়ন কর, আমি চরণসেবা করি। সে কহিল, তুমিও শয়ন কর, চরণসেবা করিতে হইবেক না।
অনন্তর উভয়ে শয়ন করিলে, ধূর্তশিরোমণি নয়নানন্দ, অবিলম্বে, কপট নিদ্রার আশ্রয়গ্ৰহণপূর্বক, নাসিক্যধ্বনি করিতে আরম্ভ করিল। রত্নাবতীও, পতিকে নিদ্রাগত দেখিয়া, অনতিবিলম্বে নিদ্রায় অচেতন হইল। তখন, সেই অদ্ভুত দুরাত্মা, অবসর বুঝিয়া, গাত্ৰোখানপূর্বক, আপন কটিদেশ হইতে তীক্ষ্নধার ছুরি বহিস্কৃত করিল, এবং, নিরুপম স্ত্রীরত্ন রত্নাবতীর কণ্ঠনালীচ্ছেদনপূর্বক, সমস্ত আভরণ লইয়া পলায়ন করিল।
ইহা কহিয়া, শারিকা বলিল, মহারাজ! যাহা বর্ণিত হইল, সমস্ত স্বচক্ষে প্ৰত্যক্ষ করিয়াছি। তদবধি, আমার পুরুষজাতির উপর অত্যন্ত অশ্রদ্ধা ও অবিশ্বাস জন্মিয়াছে। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, পুরুষের সহিত বাক্যালাপ করিব না, এবং সাধ্যানুসারে পুরুষের সংসর্গপরিত্যাগে যত্নবতী থাকিব। পুরুষেরা অতি ধূর্ত, অতি নৃশংস, অতি স্বার্থপর। মহারাজ! অধিক আর কি বলিব, পুরুষসহবাস সসৰ্প গৃহে বাস অপেক্ষাও ভয়ানক। এই সমস্ত কারণে, আর আমার পুরুষের মুখাবলোকন করিতে ইচ্ছা নাই।
রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া, শুককে কহিলেন, আহে। চূড়ামণি! তুমি, শ্ৰীজাতির উপর কি নিমিত্তে এত বিরক্ত, তাহার সবিশেষ বর্ণন কর।
তখন শুক কহিল, মহারাজ! শ্ৰবণ করুন,
কাঞ্চনপুর নগরে সাগরদত্ত নামে এক শ্রেষ্ঠী ছিলেন। তাঁহার শ্ৰীদত্ত নামে সুরূপ, সুশীল, শান্তস্বভাব এক পুত্র ছিল। অনঙ্গপুরনিবাসী সোমদত্ত শ্ৰেষ্ঠীর কন্যা জয়শ্ৰীর সহিত তাহার বিবাহ হয়। কিয়ৎ দিন পরে, শ্ৰীদত্ত বাণিজ্যার্থে দেশান্তরে প্রস্থান করিল; জয়শ্ৰী আপনি পিত্ৰালয়ে বাস করিতে লাগিল। দীর্ঘ কাল অতীত হইল, তথাপি শ্ৰীদত্ত প্ৰত্যাগমন করিল না।
একদিন, জয়শ্ৰী আপন প্রিয়বয়স্যার নিকট কহিল, দেখ সখি! আমার যৌবন বৃথা হইল। আজ পর্যন্ত সংসারের সুখ কিছুমাত্র জানিতে পারিলাম না। বলিতে কি, এরূপে একাকিনী কালাহরণ করা কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। তুমি কোনও উপায় স্থির কর। তখন সখী কহিল, প্ৰিয়সখি! ধৈৰ্য ধর, ভগবানের ইচ্ছা হয় ত, অবিলম্বে তোমার প্রিয়সমাগম হইবেক। জয়শ্ৰী, ইচ্ছানুরূপ উত্তর না পাইয়া, অসন্তোষ প্ৰকাশ করিল, এবং তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অপসৃত হইয়া, গবাক্ষদ্বার দিয়া রাজপথ নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। দৈবযোগে, ঐ সময়ে, এক পরম সুন্দর যুবা পুরুষ, অতিমনোহর বেশে, ঐ পথে গমন করিতেছিল। ঘটনাক্রমে, তাহার ও জয়শ্ৰীর চারিচক্ষুঃ একত্রে হইবাতে, উভয়েই উভয়ের মন হরণ করিল। জয়শ্ৰী তৎক্ষণাৎ, আপনি সখীকে কহিল, দেখ, যে রূপে পার, ঐ হৃদয়চোর ব্যক্তির সহিত সংঘটন করিয়া দাও। জয়শ্ৰীর সখী, তাহার নিকটে গিয়া, কথাচ্ছলে তাহার অভিপ্ৰায় বুঝিয়া কহিল, সোমদত্তের কন্যা জয়শ্ৰী তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চান; সন্ধ্যার পর, তুমি আমার আলয়ে আসিবে। এই বলিয়া, সে তাহাকে আপন আলয় দেখাইয়া দিল। তখন সে কহিল, তোমার সখীকে বলিবে, আমি অতিশয় অনুগৃহীত হইলাম; সায়ংকালে, তোমার আবাসে আসিয়া নিঃসন্দেহ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিব।
তদনন্তর সখী, জয়শ্ৰীর নিকটে গিয়া, সবিশেষ সমুদায় তাহার গোচর করিলে, সে অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল, এবং তাহাকে পারিতোষিক দিয়া, অশেষ প্রকার প্রশংসা করিয়া কহিল, যদি তুমি তাহার সহিত মিলন করিয়া দিতে পার, আমায় চিরকালের মত কিনিয়া রাখিবে; আমি, কোনও কালে, তোমার এ ধারা শুধিতে পারিব না। এক্ষণে তুমি আপন আলয়ে গিয়া অবস্থিতি কর; সে আসিবামাত্র আমায় সংবাদ দিবে। এই বলিয়া, সখীকে বিদায় করিয়া, জয়শ্ৰী, উল্লাসিত মনে, ইচ্ছানুরূপ বেশভূষা করিতে বসিল।
শুভ সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হইলে, সেই যুব, রতিপতির আদেশানুরূপ বেশপরিগ্রহ করিয়া, সখীর আলয়ে উপস্থিত হইল। সে, পরম সমাদরে বসিতে আসন দিয়া, জয়শ্ৰীর নিকটে গিয়া, প্ৰিয়তমের উপস্থিতিসংবাদ দিল। জয়শ্ৰী শুনিয়া, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া, কহিল, সখি! কিঞ্চিৎ কাল অপেক্ষা করি; গৃহজন নিদ্রিত হইলেই, তোমার সঙ্গে গিয়া, প্ৰাণনাথের হস্তে আত্মসমৰ্পণ করিয়া, জন্ম সাৰ্থক করিব। অনন্তর, পরিবারস্থ সমস্ত লোক নিদ্রাগত হইলে, জয়শ্ৰী, সখীর সহিত তদীয় আবাসে উপস্থিত হইয়া, অননুভূতপূর্ব, চিরাকাঙ্ক্ষিত মদনরসের আস্বাদন দ্বারা, যৌবনের চরিতার্থতা সম্পাদনা করিয়া, নিশাবসান সময়ে, স্বীয় আবাসে প্ৰতি গমন করিল। সে, এইরূপে, প্রত্যহ, প্রিয়সমাগমসুখে কালযাপন করিতে লাগিল।
কিয়ৎ দিন পরে, তাহার স্বামী, বিদেশ হইতে প্ৰত্যাগত হইয়া, শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হইল। জয়শ্ৰী, শ্ৰীদত্তের সমাগমনে, মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল, এ আপদ আবার, এত দিনের পর, কোথা হইতে উপস্থিত হইল। এখন কি করি, প্ৰাণনাথের নিকটে যাইবার ব্যাঘাত জন্মিল। কতদিন থাকিবেক, কত জ্বালাইবেক, তাহাও জানি না। এই চিন্তায় মগ্ন, ও স্নান, ভোজন প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ে বিমুখ হইয়া, বিষন্ন মনে, সখীর সহিত, নানাপ্রকার মন্ত্রণা করিতে লাগিল।
রজনী উপস্থিত হইল। জয়শ্রীর মাতা, জামাতাকে, পরম সমাদর ও যত্নপূর্বক ভোজন করাইয়া, দাসী দ্বারা, শয়নাগারে গিয়া বিশ্রাম করিতে বলিলেন এবং আপন কন্যাকেও পতিশুশ্রূষার্থে গমন করিতে আদেশ দিলেন। জয়শ্ৰী প্রথমতঃ অসম্মত হওয়াতে, তাহার মাতা, নানাবিধ প্রবোধবাক্য ও ভর্ৎসনা দ্বারা তাহাকে নিরুত্তরা করিয়া বলপূর্বক গৃহপ্রবেশ করাইলেন। তখন সে বিবাশা হইয়া, শয়নাগারে প্রবেশপূর্বক, পল্যাঙ্কে আরোহণ করিয়া, বিবৃত্ত মুখে শয়ন করিয়া রহিল। শ্ৰীদত্ত, স্নিগ্ধ সম্ভাষণ করিয়া, প্ৰণয়িনীর প্রতি নানাপ্রকার প্রীতিবাক্য প্রয়োগ করিতে লাগিল। সে, তাহাতে সাতিশয় বিরক্তি প্ৰকাশ করিয়া, মৌন অবলম্বন করিয়া রহিল। শ্ৰীদত্ত, তাহার সন্তোষ জন্মাইবার নিমিত্ত, নিজানীত নানাবিধ বহুমূল্য অলঙ্কার ও পট্টশাটী প্রভৃতি কামিনীজনকমনীয় দ্রব্য প্রদান করিলে, জয়শ্ৰী, সাতিশয় কোপপ্রদর্শনপূর্বক, তদত্ত সমস্ত বস্তু দূরে নিক্ষিপ্ত করিল। তখন শ্ৰীদত্ত, নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া, ক্ষান্ত রহিল, এবং একান্ত পথশ্ৰান্ত ছিল, তৎক্ষণাৎ নিদ্রাগত হইল।
জয়শ্ৰী, পতিকে নিদ্রায় অচেতন দেখিয়া, মনে মনে আহ্লাদিত হইল, এবং পতিদত্ত বস্ত্র ও অলঙ্কার পরিধান করিয়া, ঘোরতর অন্ধকারাবৃত রজনীতে, একাকিনী নিৰ্ভয়ে প্রিয়তমের উদ্দেশে চলিল। সেই সময়ে, এক তস্কর ঐ পথে দণ্ডায়মান ছিল। সে সর্বালঙ্কারভূষিত কামিনীকে, অর্ধারাত্র সময়ে, একাকিনী গমন করিতে দেখিয়া, বিবেচনা করিতে লাগিল, এই যুবতী, অসহায়িনী হইয়া, নিশীথ সময়ে, নিৰ্ভয়ে কোথায় যাইতেছে। যাহা হউক, সবিশেষ অনুসন্ধান করিতে হইল। এই বলিয়া, সে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল।
এদিকে, জয়শ্ৰীর প্রিয় সখা, সখীর আলয়ে একাকী শয়ন করিয়া, তাহার আগমনপ্ৰতীক্ষায় কালক্ষেপ করিতেছিল। অকস্মাৎ এক কালসৰ্প আসিয়া, দংশিয়া তাহার প্ৰাণসংহার করিয়া গেল। সে মৃত পতিত রহিল। জয়শ্ৰী, তথায় উপস্থিত হইয়া, মৃত প্রিয়তমকে কপটনিদ্রিত বোধ করিয়া, বারংবার আহবান করিতে লাগিল; কিন্তু উত্তর না পাইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিল, আমার আসিতে বিলম্ব হওয়াতে, ইনি অভিমানে উত্তর দিতেছেন না; অনন্তর, তাহার পার্শ্বে শয়ন করিয়া, বিনয় ও প্রিয় সম্ভাষণপূর্বক, বিলম্বের হেতুনির্দেশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে আরম্ভ করিল। চোর কিঞ্চিৎ দূরে দণ্ডায়মান হইয়া, সহাস্য আস্যে, এই রহস্য দেখিতে লাগিল।
নিকটস্থবটবৃক্ষবাসী এক পিশাচও এই কৌতুক দেখিতেছিল। সে, সাতিশয় কুপিত হইয়া, স্থির করিল, ঈদৃশী দুশ্চারিণীকে সমুচিত দণ্ড দেওয়া আবশ্যক; অনন্তর সে, তদীয় প্রিয়তমের মৃত কলেবরে আবিভূতি হইয়া, দন্ত দ্বারা জয়শ্ৰীর নাসিকাচ্ছেদনপূর্বক, আপন আবাসবৃক্ষে প্রতি গমন করিল। চোর, এই সমস্ত নয়নগোচর করিয়া, নিরতিশয় চমৎকৃত হইল।
জয়শ্ৰীর জ্ঞানোদয় হইল। তখন, সে, প্ৰিয়তমকে মৃত স্থির করিয়া, সখীর নিকটে গিয়া, পূর্বাপর সমস্ত ব্যাপার তাহার গোচর করিয়া কহিল, সখি! আমি এই বিষম বিপদে পড়িয়াছি; কি উপায় করি, বল। গৃহে গিয়া, কেমন করিয়া, পিতামাতার নিকট মুখ দেখাইব। তাঁহারা কারণ জিজ্ঞাসিলে, কি উত্তর দিব। বিশেষতঃ, আজি আবার সেই সৰ্বনাশিয়া আসিয়াছে; সেই বা, দেখিয়া শুনিয়া, কি মনে করিবেক। সখি! তুমি আমায় বিষ আনিয়া দাও, খাইয়া প্ৰাণত্যাগ করি; তাহা হইলেই সকল আপদ ঘুচিয়া যায়। এই বলিয়া, জয়শ্ৰী শিরে করাঘাত করিতে লাগিল। সখী শুনিয়া হতবুদ্ধি ও নিরুত্তরা হইয়া রহিল।
কিয়ৎ ক্ষণ পরে, জয়শ্ৰী, উৎপন্নমতিত্ববলে, এক উপায় স্থির করিয়া কহিল, সখি! আর চিন্তা নাই, উত্তম উপায় স্থির করিয়াছি; শুন দেখি, সঙ্গত হয় কিনা। আমি, এই অবস্থায় গৃহে গিয়া, শয়নমন্দিরে প্রবেশপূর্বক, চীৎকার করিয়া রোদন করিতে আরম্ভ করি। গৃহজন, রোদনশব্দে জাগরিত হইয়া, কারণ জিজ্ঞাসার্থে উপস্থিত হইলে, বলিব, আমার স্বামী, অকারণে, ক্ৰোধে অন্ধ হইয়া, নিতান্ত নির্দয়ারূপে বারংবার প্রহার করিয়া, পরিশেষে নাসিকাচ্ছেদন করিয়া দিলেন। সখী কহিল, উত্তম যুক্তি হইয়াছে; ইহাতে সকল দিক রক্ষা হইবেক। অতএব, অবিলম্বে গৃহে গিয়া, এইরূপ কর।
জয়শ্ৰী, সত্বর গৃহে গিয়া, শয়নাগারে প্রবেশপূর্বক, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। গৃহজন, ক্ৰন্দনধ্বনি শ্রবণে ব্যকুল হইয়া, জয়শ্ৰীর শয়নগৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিল, তাহার নাসিকা নাই; সমস্ত গাত্র ও বস্ত্ৰ শোণিতে অভিষিক্ত হইয়াছে; এবং, সে নিজে, ভূতলে পতিত হইয়া, রোদন করিতেছে। অনন্তর, তাহারা, ব্যগ্ৰতাপ্রদর্শন পুরঃসর, বারংবার হেতু জিজ্ঞাসা করাতে, জয়শ্ৰী আপনি স্বামীর দিকে অঙ্গুলিপ্রয়োগ করিয়া কহিল, ঐ দুর্বৃত্ত দস্যু আমার এই দুর্দশা করিয়াছে। তখন সমস্ত পরিবার, একবাক্য হইয়া, শ্ৰীদত্তের অশেষপ্রকার তিরস্কার আরম্ভ করিল।
সুশীল শ্ৰীদত্ত, পূর্বাপর কিছুই জানে না; অকস্মাৎ এতাদৃশি ভয়ঙ্কর কাণ্ড দর্শনে ও নানাপ্রকার তিরস্কারবাক্য শ্রবণে, বিস্ময়াপন্ন হইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, আমি, সবিশেষ না জানিয়া, শ্বশুরালয়ে আসিয়া, যার পর নাই অবিবেচনার কর্ম করিয়াছি। ইহাকে অতি দুশ্চরিত্রা দেখিতেছি। প্রথমতঃ, শত শত চাটুবচনেও, যে ব্যক্তি আলাপ করে নাই; সেই এক্ষণে অনায়াসে, মুক্তকণ্ঠে, মিথ্যাপবাদ দিতেছে। এই নিমিত্তই নীতিজ্ঞেরা কহিয়াছেন, মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, দেবতারাও স্ত্রীলোকের চরিত্র ও পুরুষের ভাগ্যের কথা বুঝিতে পারেন না। জানি না, পরিশেষে কি বিপদ ঘটিবেক। এইরূপ নানাবিধ চিন্তায় মগ্ন হইয়া, মৌন অবলম্বনপূর্বক, সে অধোবদন হইয়া রহিল।
পর দিন, প্ৰভাত হইবামাত্র, জয়শ্ৰীর পিতা, রাজদ্বারে সংবাদ দিয়া, জামাতাকে বিচারালয়ে নীত করিল। প্রাড়্বিবাক, বাদী ও প্রতিবাদী উভয় পক্ষকে পরস্পর সম্মুখবর্তী করিয়া প্রথমতঃ জয়শ্ৰীকে জিজ্ঞাসিলেন, কে তোমার এ দুর্দশা করিয়াছে, বল; আমি সেই দুরাচারের যথোচিত দণ্ডবিধান করিতেছি। জয়শ্ৰী পতি প্ৰতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, ধর্মাবতার। ইনি আমার স্বামী; ইঁহা হইতে আমার এই দুৰ্দশা ঘটিয়াছে। অনন্তর, প্রাড়্বিবাক শ্ৰীদত্তকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি নিমিত্ত এমন দুষ্কৰ্ম করিলে। সে কহিল, ধর্মাবতার। আমি এ বিষয়ের ভালমন্দ কিছুই জানি না; ইহাতে, আপনকার বিচারে, যেরূপ ব্যবস্থা হয়, করুন; এই বলিয়া, কৃতাঞ্জলি হইয়া, বিষন্ন বদনে দণ্ডায়মান রহিল।
প্রাড়্বিবাক, বাদী ও প্ৰতিবাদীর বাক্যশ্রবণান্তে, সকল বিষয়ের সবিশেষ পর্যালোচনা করিয়া, ঘাতকাদিগকে ডাকাইয়া, শ্ৰীদত্তকে শূলে দিতে আদেশ করিলেন। চোর, কিঞ্চিৎ দূরে দণ্ডায়মান হইয়া, পূর্বাপর সমস্ত ব্যাপার, সবিশেষ সতর্কতাপূর্বক, দেখিতেছিল। সে, অকারণে এক ব্যক্তির প্রাণবিনাশের উপক্রম দেখিয়া, প্রাড়্বিবাকের সম্মুখবর্তী হইয়া নিবেদন করিল, মহাশয়! সবিশেষ অনুসন্ধান না করিয়া, বিনা অপরাধে, আপনি এ ব্যক্তির প্রাণদণ্ড করিতেছেন। আপনি ধর্মাবতার, যথার্থ বিচার করুন; ব্যভিচারিণীর বাক্যে বিশ্বাস করিবেন না।
প্রাড়্বিবাক চকিত হইয়া উঠিলেন, এবং চোরের বাক্য শুনিয়া, বারংবার জিজ্ঞাসা ও তথ্যানুসন্ধানপূর্বক, সবিশেষ সমস্ত অবগত হইলেন। তদীয় আদেশ অনুসারে, জয়শ্ৰীর মৃত পতিত উপপতির বক্ত্রমধ্য হইতে, তদীয় ছিন্ন নাসিকা আনীত হইল। তখন তিনি; নিরতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া, চোরকে যথার্থবাদী ও শ্ৰীদত্তকে নিরপরাধ স্থির করিয়া, যথোচিত পারিতোষিক প্রদানপূর্বক, উভয়কে বিদায় দিলেন; এবং জয়শ্ৰীীর মস্তকমুণ্ডন ও তাহাতে তক্রসেচন, তৎপরে তাহাকে গর্দভে আরোহণ ও নগরে পরিভ্রমণ করাইয়া, দেশ হইতে বহিস্কৃত করিলেন।
এইরূপে আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, চূড়ামণি কহিল, মহারাজ। নারী ঈদৃশ প্রশংসনীয় গুণে পরিপূর্ণা হয়।
উপক্রান্ত উপাখ্যান সমাপ্ত করিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! জয়শ্ৰী ও নয়নানন্দ, এ উভয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি অধিক দুরাচার। রাজা কহিলেন, আমার মতে, দুই সমান।
ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।