পাঁচ
সকালে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মানিক লক্ষ করে, রাতে জমা ঘাসের ডগায় শিশির বিন্দুগুলো সূর্যের আলোয় চিকচিক করে ওঠ। খালি পায়ে পাহাড়ে যাওয়া পাহাড়িদের পাগুলো ভিজিয়ে দেয়। পাহাড়ে এখন চাঞ্চল্য বেশি, জুমের ফসল কাটা হচ্ছে। পরিবারের সবাই ব্যস্ত, সবাই একসাথে কাজ করছে। সকালের সূর্যে তাদের চোখগুলোও শিশির বিন্দুর মতো চিকচিক করে। জুম বাগানের উপরেই থাকে অস্থায়ী মাচাং ঘর, দুপুরে সবাই একসাথে খায় সেখানে ধূলিমাখা হাতে। কচি বাঁশের তরকারিতেই পাহাড়ের ধুলো মিশিয়ে তৃপ্তি নিয়ে খায় তারা। তারপর আবার নেমে যায় কাজে, রাজ্যের ব্যস্ততা তাতে কিন্তু কোনো ক্লান্তি নেই।
সেই তুলনায় বাঙালি বস্তিতে বিড়ি ফুঁকে অলস দিন কাটাচ্ছে পুরুষেরা। জুমের ফসল কাটা শেষ হলে তাদের ব্যস্ততা বাড়বে। বাঙালি বসতির অধিকাংশই ব্যবসায়ী, তাৱা জুমের ফসল কিনে শহরে নিয়ে বিক্রি করবে, সেখান থেকে আবার বিভিন্ন জিনিস কিনে নিয়ে এসে পাহাড়িদের কাছে বিক্রি করবে।
বুক ভরে নিঃশাস নিয়ে সে এগুতে থাকে টিলার উপর তার কর্মক্ষেত্রে। মংওয়াইয়ের কল্যাণে কিছু রোগী ভিড় করে এখন। তার রুমের বাহিরে বেঞ্চটা মাঝে মাঝে সবার জায়গা দিতে পারে না। নার্স ইয়াসমিন বেড়ানোতে ক্ষান্ত দিয়ে তার কাজে যোগ দিয়েছে—
সে জন্য তার বিরক্তির সীমা নেই। ইয়াসমিনের বয়স মধ্য ত্রিশের আশেপাশে, বিয়ে হয়েছে কিন্তু কোনো সন্তান হয়নি। সন্তানের জন্য নিজেই ঘরে সতীন এনেছে, তিন বছর হলো সেই সতীনও উৎপাদনহীন। ইয়াসমিন জগত সংসারের উপর ক্ষেপে আছে এবং তা প্রকাশেও কোনোদিন দ্বিধা করেনি সে, তার মুখে কিছু আটকায় না। সেদিন এক মহিলা রোগী এসেছে লম্বা ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকানো, মানিক কিছু জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দেয় না। মানিক তখন ইয়াসমিনকে পাঠায়, পাশের ঘরে গিয়ে রোগিনীর সমস্যার কথা জানতে। রোগিনী ফিসফিস করে বলে আর ইয়াসমিন মুখ ভেংচিয়ে জোরে জোরে বলে ওঠে—
ও লো মাসিক হয় না কইতে শরম লাগে?
আজও এক মহিলা বাচ্চাকে নিয়ে এসেছেন, ইয়াসমিন জিজ্ঞাসা করল,
দেখলে তো মনে হয় না অসুখ-বিসুখ হইছে, ডাক্তার সাবের রূপ দেখতে আইছস?
মহিলা বিব্রত হয়ে বলল—
বাচ্চার পায়খানা হয় না।
ইয়াসমিন মুখ বাঁকা করে বলল—
তয় ডাক্তার সাব কি করব? কোঁৎ দিব?
মানিক ইয়াসমিনকে ডেকে বলল—
আপনি নাকি রোগীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন, খারাপ কথা বলেন? কয়েকজন ইলিয়াসের কাছে অভিযোগ করেছে, আমাকেও বলেছে।
ইয়াসমিন তার ঈষৎ স্থূল দেহটা কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে বলল—
কোন গোলামের পুত কইছে, কোন মাগীর ঝি বিচার দিছে? আমি কোনো সময় মুখ খারাপ করছি, এই মিছা কতা কেউ কইলে টান দিয়া জিব ছিড়া পুটকিতে ভইরা দিমু না!
মানিক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল, কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তার জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গেছে।
.
ইয়াসমিনের রাগটা শুধু গর্ভবতী মা অথবা বাচ্চা কোলে নতুন মায়েদের প্রতি। নিজের অপূর্ণতাকে তারা মনে করিয়ে দেয়। সে মা হওয়ার জন্য তার স্বামীকে আবারও বিয়ে দিতে রাজি কিন্তু এত দিনে সে বুঝে গেছে ডজন খানেক বিয়ে করলেও লাভ নেই, তার স্বামীই গলদ। তার সতীনটা সম্পর্কে কানাঘুষা করে মানুষেরা। রাত-বিরাতে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। ইয়াসমিন সবই জানে কিন্তু না জানার ভান করে থাকে। একটা সন্তান তার চাই-ই। অবশেষে একদিন তার সতীন এসে বলল, “বুবু তিনমাস হইছে।”
সকাল থেকেই যত রোগী আসছে সবাইকে জিলাপি খাওয়াচ্ছে ইয়াসমিন। সতীনের সন্তান লাভে কেউ এত খুশি হয়? মানিক খুব অবাক হলো, ইলিয়াস তো বলেই ফেলল—
কাউয়ার বাসাত ডিম পাড়লেই কোকিল কা কা করে না।
কথাটা বলেই ইলিয়াস মনে মনে প্রমাদ গুনতে লাগল, আর যাকেই হোক ইয়াসমিনকে এই কথা বলা ঠিক হয় নাই। কিন্তু ইয়াসমিন যেন আজ ভিন্ন মানুষ, সে হেসে বলল—
দুই ফোঁটা বীর্যে কেউ বাপ হয় না, নয় মাস পেটে রাখালে মা হওন যায় না, সারাজীবন বুকে যে রাখে সে-ই মা।
মানিক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো শুনে, পেটে রাখা মাকে সে চিনে না, বুকে আগলে রাখার মতো মাও তার ছিল না।
.
বরকত আলী হাসপাতালের সামনে এসে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, অনেক রোগী বসে আছে। লোকমান কবিরাজের সাথে তার কমিশনের ব্যবসায় ভাটা পড়ার কারণও বুঝতে পারে সে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ইলিয়াস বরকত আলীকে দেখে সালাম দিল—
আসসালামুয়ালিকুম। কেউ সালাম দিলে বরকত আলীর খুব ভালো লাগে, মনে একটু হলেও শান্তি পেল সে। সালামের জবাব দিতে গিয়ে সে মুখ থেকে পানের পিক প্রায় ফেলে দিচ্ছিল। বরকত আলী চেয়ে দেখল মহিলা রোগীদের সংখ্যাই বেশি। ডাক্তারের সৌভাগ্যে খুব হিংসা হয় তার, ডাক্তাররা নাকি মহিলাদের গায়ে টিপেটুপে পরীক্ষা করে।
ইলিয়াস বরকত আলীকে মানিকের ঘরে নিয়ে গেল, বরকত আলীর মুখে পানের পিক জমেছে অনেক, কথা বলতে পারছে না, জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে পিক ফেলতে গিয়ে শিকে লাগিয়ে দিল, পিক ছিটকে পুরো জানালা এবং জানালার সাদা পর্দা লাল হয়ে গেল। বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে সে চেয়ারে বসে বলল—
কেমন আছেন ডাকতর সাব? রোগী তো ভালোই জমাইছেন। কিন্তু সাবধানে থাইকেন, এইখানকার মানুষ খুব খারাপ, ধরেন কেউ রটাইয়া দিব আপনে হাসপাতালে মহিলাদের আজায়গায় কুজায়গায় হাত দেন, ফষ্টিনষ্টি করেন। এক্কেরে জবাই কইরা দিব।
আবার ধরেন পাহাড়ি শান্তি বাহিনী যদি জানে আপনে পাহাড়িগো চিকিৎসার নামে ক্ষতি করছেন তারাও ছাড়ব না, চাইর দিক দিয়া বিপদ আইব। আমি আপনেরে ভালো বুদ্ধি দেই, চেষ্টা-তদবির কইরা অন্যখানে যান। এইখানে কেউ আপনের বন্ধু না, সবাই শত্রু।
মানিক খুব শান্তভাবে বলল—
শত্রু আমি চিনি, আপনার উপদেশের দরকার নেই। আপনি কী কাজে এসেছেন?
বরকত আলী বলল—
শত্রু আপনে চিনেন না, মনে রাইখেন কথাটা। যাক শফিক স্যারে আমারে পাঠাইছে, থানচি হাসপাতালে আপনের নামে চিঠি আসছে ঢাকা থিক্যা, দিতে আইলাম। আপনের কাজেই আসছি। আর আমার কথাগুলান মনে রাইখেন, কাজে দিব।
ভাঁজ করা একটা খাম দিয়ে বরকত আলী চলে গেল। মানিক হলুদ খামের ভাঁজ খুলে দেখল, প্রেরকের জায়গায় কার্তিকের নাম। চিঠিটি পেয়েই তার মনে হলো, সে এত দিন কীভাবে ঢাকাকে ভুলে ছিল? বংশালের সেই ঘরটি কীভাবে ভুলে থেকেছে? পাহাড় কি তাকে আপন করে নিল নাকি সে পাহাড়কে আপন করে নিয়েছে?
মানিক তার বাঁশের ঘরে শুয়ে কার্তিকের চিঠিটি পড়ছে, ঢাকা থেকে আসা চিঠি।
.
প্রিয় মানিক,
তোর খবর নেয়ার জন্য আমি চিঠি লিখছি না, আমার খবর দেয়ার জন্য লিখছি। আমি ভালো আছি, আসলে বেশ ভালো আছি। এই বাসায় আসার পর আমি ফার্মগেটের ভিক্ষাবৃত্তির কাজ ছেড়ে দিয়েছি। ‘বাচ্চু যাত্রা অপেরা’ তে আমি একটা পার্ট পেয়েছি। রহিম রূপবান পালায় আমি তাজেলের সহপাঠী। সংলাপ তেমন নেই, তাজেল যখন রহিমকে ধিক্কার দেয়, তখন আমরা বলি, ঠিক ঠিক। এতটুকুই। তাজেলকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তাজেল রহিমের দিকেই চেয়ে থাকে। এক ভাম রহিমের পার্ট করে। তার গানের গলা শুনে সবাই মুগ্ধ, কারণ তারা কেউ ফার্মগেটে ভিক্ষুকদের গান শুনেনি কোনোদিন। এই রহিমকে ফার্মগেটে দাঁড় করিয়ে দিলে সারাদিনে এক টাকাও ভিক্ষা পাবে না। ঐ ব্যাটার বয়স কম করে হলেও পঁয়তাল্লিশ হবে। তিনটা বাচ্চা আছে, তবুও তাজেল সেই রহিমের সাথেই হেসে হেসে ঢলে পড়ে। মেয়েটির আসল নাম করিমন। একদিন আমি রহিমের পার্ট করব সেদিন তাজেলরা আমার গায়ে হেসে হেসে ঢলে পড়বে।
যাত্রার অধিকারী বাচ্চু সাহেবের চরিত্রে একটু দোষ আছে, মেয়েদের দিকে তিনি তাকিয়েও দেখেন না, কিন্তু ছেলেদের দিকে একটু ঝোঁক আছে। পঁয়তাল্লিশ বছরের ভামকে দিয়ে বারো বছরের বালকের পার্ট করান, অনেকেই কানাঘুষা করে।
এখন ছুটিতে আছি, শীতকালে আবার চলে যাব তাদের সাথে। তখন এই বাসাটা খালিই থাকবে। আমি অবশ্য পাশের বাসার বৌদিকে বলেছি, তিনি যাতে একটু দেখাশুনা করেন। বৌদি খুব ভালো মানুষ, তিনি না থাকলে আবারও চোখে আঠা লাগিয়ে পথে বসতে হতো। এই বাসায় উঠে প্রথম কয়েক দিন কেরামত মিয়ার হোটেলে খেয়ে জমানো অর্থ সব খরচ করে ফেলেছিলাম। পরে রান্নাঘরে চুলা ঠিক করে ভাত রান্না করতাম আর ডিম ভেজে খেতাম। একদিন বৌদি এসে বাটিতে করে তরকারি দিয়ে গেল। তারপর থেকে প্রতিদিন কিছু না কিছু দিয়ে যায়, আমার শুধু কষ্ট করে ভাত রান্না করতে হয়। নারায়ণ বাবুর বৌ মাঝে মাঝেই এটা-সেটা খুঁজতে আসে, আমি দিতে পারি না। পাশের বাসার বুড়োটা বিকেলে চলে আসে, আমার সাথে বসে বিড়ি টানে আর কাশে। এই বুড়োর মনে হয় কাশতে ভালো লাগে। বৌদির ছেলেটি আমাকে কাকু বলে ডাকে, তাকে প্রতিদিন একটা করে ঘুড়ি বানিয়ে দিতে হয়। এই বাসায় বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়তে আমার খুব ভালো লাগে, তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় কী যেন নেই।
ইদানীং বরই গাছের নিচে একটা কালো দাগ দেখতে পাই, এক কলসি পানি ঢেলেছি, দাগটা যায় না। আমার কেন যেন মনে হয় এটা রক্তের দাগ। বদরুল আলম সাহেব নামে এক বৃদ্ধ এসেছিলেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন শুধু এদিক-সেদিক ঘুরেন। তার সাথে আমার খাতির হয়েছে, আমাকে বললেন, তিনি একটা ফার্মেসি দিবেন, আমি যাতে সেখানে বসি। আমি মানা করে দিয়েছি। তাকে যাত্রা দেখার দাওয়াত দিয়েছি, আমার মনে হয় তিনি যাবেন। তাকে বরই গাছের নিচে দাগের কথা বলতেই তিনি হ্যালুসিনেসন না কি যেন বললেন। পুত্রশোকে লোকটার মাথা ঠিক নেই। তবুও তাকে আমার ভালো লাগে।
এখন আর লিখব না, ভাতের পানি ফুটতে শুরু করেছে।
ইতি,
কার্তিক ওরফে মহসিন
(যাত্রাপালায় কাজ নেয়ার জন্য মোসলমানের নাম নিতে হয়েছে, বাচ্চু সাহেব খুব ধার্মিক লোক, হিন্দুদের কাজ দেন না)।
.
চিঠি পড়া শেষ করে মানিকের মনটা হিংসায় ভরে উঠল, কার্তিকের সব ছিল, সব আছে, তার কিছুই নেই। বংশালের সেই বাসাটা মানিককে কোনোদিন গ্রহণ করেনি, প্রতিবেশীরাও তাকে এড়িয়ে চলত, সে কতবার চেষ্টা করেছে সুধীর বাবুর মতো বরই গাছের নিচে কালো দাগ দেখতে, কোনোদিন পারেনি। কার্তিক কোনো কিছুই গভীরভাবে চায় না, তাই সব পেয়ে যায়।
হিংসা শেষে কার্তিকের জন্য মায়া হলো মানিকের, তার অবস্থাও যদি সুধীর বাবুর মতো হয়? মানিকের কেন যেন মনে হয়, এই ঘরটির একটি পরিবার দরকার। শূন্যস্থান পূরণ করা দরকার।
.
আজ আকাশটা মেঘলা, সূর্য এখনো উঁকি দেয়নি। আকাশ মেঘলা হলে পাহাড়ের রূপ যেন আরো বেড়ে যায়। বৃষ্টি হতে পারে, বৃষ্টিতে পাহাড় ভিজে যেন আরো রূপবতী হয়ে যায়। মানিকের সেই ছোট্ট হাসপাতালের সামনের জায়গাটাতে বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ লাগানো হয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটা সূর্যমুখী ফুলও আছে। সেগুলো আজ বিভ্রান্ত, একেকটা একেক দিকে তাকিয়ে আছে। হাসপাতালে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সমস্যা নিয়ে আসে মানুষেরা। একটা দশ-এগারো বছরের ছেলে আসে, কিছুদিন আগে তার বৃদ্ধ দাদা মারা গেছে।
মানিক যখন জিজ্ঞাসা করল কী সমস্যা?
ছেলেটা কাতর হয়ে ছলছল চোখে বলল—
দাদার লাইগা পেট পুড়ে।
মানিক বুঝতে পারল এইসব মানুষদের মন থাকে উদরে। কিন্তু তার কাছে এই রোগের চিকিৎসা নেই, সে নিজেই পেট পোড়া রোগী। ইলিয়াসকে দিয়ে কিছু লজেন্স আনিয়ে দিল। ছেলেটি খেতে খেতে চলে গেল, এরপর থেকে প্রতিদিন এসে বসে থাকে, এখনো তার পেট পুড়ে, দাদার জন্য নাকি লজেন্সের জন্য তা বুঝা যায় না।
কিছু মহিলা আসে সংজ্ঞাহীন, দাঁতে দাঁত লেগে থাকে। স্বামীর সাথে ঝগড়া, অভিমান হলেই তারা মূর্ছা যায়, পানির ঝাপটা দিয়েও তাদের জাগানো যায় না। মানিক সব বুঝে, বিরক্ত হয় না। ইয়াসমিনকে ইশারা দিয়ে চলে যায়। ইয়াসমিন একটু জোর গলায় রোগীর স্বামীকে বলে—
রোগীর অবস্থা তো খুব খারাপ, আপনে করছেন কী?
রোগীর স্বামী অনুনয় করে কাঁদো কাঁদো গলায়, তখন মূর্ছা যাওয়া মহিলার মুখেও কীভাবে যেন মুচকি হাসি ছড়িয়ে পড়ে। ইয়াসমিন তখন বলে,
আর কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে রোগীর চোখে ইঞ্জেকশন দিতে হবে।
ব্যস কিছুক্ষণের মধ্যেই পানির ঝাপটা ছাড়াই রোগী পিটপিট করে চোখ খুলে, চোখ খুলেই স্বামীর দিকে অবজ্ঞা এবং অভিমান ভরে তাকায়। সেই দৃষ্টিতেও ভালোবাসা থাকে, অনেক গভীর ভালোবাসা।
আজও অদ্ভুত একটা রোগী এসেছে, পাহাড়ি মেয়ে। বয়স পনের-ষোল হবে। পায়ে এখনো মাটি লেগে আছে। জুম ক্ষেতে কাজ করছিল, বিশ্রাম নেয়ার জন্য মাচাং ঘরে গিয়েছিল হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠল, মেয়েটার মা গিয়ে দেখল সে পড়ে আছে অজ্ঞান হয়ে।
মানিক ইয়াসমিনকে দেখতে বলল, কোথাও সাপের কামড়ের চিহ্ন আছে কি না। ইয়াসমিন দেখার আগেই মেয়েটার জ্ঞান ফিরে এলো। তার চোখে এখনো ভয়ের চিহ্ন। মানিক বলল—
কী হয়েছিল? কিছু দেখে ভয় পেয়েছ?
মেয়েটা ভীত স্বরে বলল—
তলুঃ তলুঃ
তলুঃ নামটা শুনেই ভয়টা ইয়াসমিন ও মেয়েটার মায়ের চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ল। মানিক চোখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল—
তলু কী?
ইয়াসমিন এই গল্পটা বলার সুযোগ পেলে গলায় একটা ভয়ার্ত ভাব এনে ফেলে, তারপর গম্ভীরভাবে বলে,
স্যার এই গ্রামের নাম আগে বলিপাড়া আছিল না, এই গ্রামের নাম আছিল সৈকংজে। অনেক বছর আগে একবার জুম চাষের সময়, এক পাহাড়ি মাইয়ারে ধইরা নিয়া যায় তলুঃ। মারমারা জঙ্গল মানুষরে তলু কয়। অনেক খুঁইজাও সেই মাইয়ারে পাওয়া যায় নাই।
বছরখানেক পর বাঁশ কাটতে গিয়া ঐ মাইয়ারে দেখে কিছু পাহাড়ি, তারা দলবল মাইয়ারে নিয়া আসে। মাইয়া আছিল পোয়াতি। মাইয়ার ঘরে একটা পোলা হইল। সেই পোলর গায়ে আছিল তলুর মতন বল। একলগে পঞ্চাশ কাঁদি কলা তুলতে পারত।
বাঙাপি তহন নৌকা দিয়া জুমের ফসল কিনতে আইত, একবার পাহাড়িগো লগে ঝামেলা লাগল বাঙালিগো। সেই পোলা একলাই বাঙালিগো নৌকা তুইলা পাহাড়ে রাইখা দিছিল। পোলার বল দেইখা সেই থেইকা বাঙালির এই গ্রামরে বলিপাড়া কয়।
মানিক সব শুনে মেয়েটাকে জিঙ্গাসা করল—
তুমি কি তলুঃকে দেখেছ?
না, পেছন দিয়ে ধরছে, আমি চিল্লান দিছি, আর মনে নাই।
কিছুই মনে নেই?
না, শুধু একটা গন্ধ পাইছিলাম। জর্দার গন্ধ।
মানিক কী মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জঙ্গল মানুষ জর্দা দিয়ে পান খায় কি না সে জানে না, তবে একটা জানোয়ারকে সে চিনে, যে জর্দা দিয়ে পান খায়।
.
শফিক সাহেব চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে সিগারেট খাচ্ছেন। তার রাগ উঠলে তিনি সিগারেট খান। পুরোটা খেতে পারেন না, অর্ধেক খেয়ে ফেলে দেন। তার মুখটা খুব শান্ত দেখাচ্ছে, কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তি দিয়ে মেজাজ বিচার করা যায় না। খুবই ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। বরকত আলী তার সামনে অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। শফিক সাহেব চোখ বন্ধ করেই বললেন—
আমি নারকেল তেলের টিনের কৌটা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম, পরে অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি দিয়েছিলাম। নারায়ণগঞ্জে আমার তিনটা ফ্যাক্টরি ছিল। সবাই বলে আমার ব্যবসায়ের সাফল্য এসেছিল কর্মচারীদের শৃঙ্খলার কারণে। তেরশ কর্মচারীর কেউ একদিনও হরতাল, ধর্মঘট করেনি। আমি সবার খবর রাখতাম, তাই পারেনি। একবার কোম্পানি লসে যাচ্ছিল, আমি দ্বিগুণ বেতন দিয়ে একজন ম্যানেজার রাখলাম। তাকে বললাম, কোম্পানির খরচ যাতে দশ ভাগ কমিয়ে দেয়। সে খুবই দক্ষ এবং শিক্ষিত ছিল—
বিদেশ থেকে পড়াশুনা করে এসেছে, জাপানেও চাকরি করেছে। সে তিন মাসের মধ্যে খরচ পনের ভাগ কমিয়ে আনল। আমি তাকে লাথি দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম কারণ আমি চাই আমি যতটুকু বলব ততটুকুই হবে, বেশিও না কমও না।
সিগারেট অর্ধেক শেষ হওয়ার পর বরকতের দিকে এগিয়ে দিলেন, বরকত সিগারেট নিয়ে বাহিরে ফেলে দিয়ে আবার আগের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। শফিক সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন—
তোমাকে আমি যে কাজে রেখেছি তুমি যেই কাজ করবা। লোকমান কবিরাজের সাথে কমিশনের ব্যবসা করতে আমি তোমাকে চাকরি দেই নাই, নিজ দায়িত্বে তুমি মানিককে হুমকি দিয়ে এসেছ, তোমার এত বড় সাহস কী করে হয়? তোমার সব কর্মকাণ্ডই আমি জানি। তোমার চরিত্রে দোষ আছে সেটাও জানি। তোমাকেও লাথি দেয়ার সময় হয়েছে কিন্তু তোমার ভাগ্য ভালো আমি কাল মাস দুয়েকের জন্য বার্মা চলে যাচ্ছি। আশা করি নিজের ভালো নিজে বুঝবা। এখন আমার চোখের সামনে থেকে যাও।
বরকত আলী মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল, কিন্তু তার মনে একটুও অনুশোচনা হলো না। মালাউন ডাক্তারটা তার নামে বিচার দিয়েছে চিন্তা করেই মাথায় রক্ত উঠে গেল। কিন্তু নিজেকে শান্ত রাখল সে, আর একটা দিন, শফিক সাহেব চলে যাক, তারপর সে তার ফণা তুলবে।