• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

৬৭. অলৌকিক হত্যা ১ (ভলিউম ২৩)

লাইব্রেরি » কাজী আনোয়ার হোসেন » ৬৭. অলৌকিক হত্যা ১ (ভলিউম ২৩)
Current Status
Not Enrolled
Price
Free
Get Started
Log In to Enroll

কুয়াশা ৬৭
প্রথম প্রকাশ: জুন, ১৯৭৭

০১.

 প্রখ্যাত শখের গোয়েন্দা শহীদ খানের বাসভবন।

বাড়ির বাইরে, গেটের সামনে অদ্ভুতদর্শন একটা মটরসাইকেল দাঁড়িয়ে আছে। বাঘের চামড়া দিয়ে মোড়া সীট মটরসাইকেলটার। পিছনের দিকে একটা বাঘের মুণ্ডু, মুখ ব্যাদান করে আছে। প্রকাণ্ড মটরসাইকেলের সর্ব অঙ্গে কম করেও পঞ্চাশটা ছোট বড় নানা রঙের বালবু। আলোক মালায় সজ্জিত মটরসাইকেল ঢাকা শহরে এই একটাই। এটা শহীদ খানের সহকারী কামাল আহমেদের বিখ্যাত মটরসাইকেল।

খোলা গেটের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির চাকর লেবু। আপনমনে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে সে। ছোট সাহেবের অদ্ভুতদর্শন দ্বিচক্রযানটিই তার হাস্যোদ্রেকের কারণ।

কামাল এইমাত্র বাড়ির ভিতর ঢুকেছে। লেবুকে গেটে পাহারায় দাঁড় করিয়ে রেখে গেছে সে। কড়া নির্দেশ দিয়ে গেছে তাকে, মানুষ তো দূরের কথা, পিপঁড়েও যেন বাড়ির ভিতর ঢুকতে না পারে।

পরম বন্ধু শহীদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত কামালের। মাসের অধিকাংশ রাত কাটায় সে এ-বাড়িতে। এ বাড়ির উপর অধিকার তার কারও চেয়ে কম নয়। শহীদের আপন কোন ভাই নেই, তাই মহুয়া কামালকে পেয়ে দেওরের অভাব ভুলে আছে। কামালকে ওরা এবং ওদেরকে কামাল কতটা ভালবাসে, তা ব্যাখ্যা করে বোঝানো সম্ভব নয়।

অন্যান্য দিন মটরসাইকেল নিয়েই বাড়ির ভিতর ঢোকে কামাল। কিন্তু আজ সে গেটের বাইরে মটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে পায়ে হেঁটে ভিতরে ঢুকেছে। গেট খুলে দিয়েছে লেবু। তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করে কিছু খবর জেনে নিয়েছে সে। গেটে তাকে পাহারায় দাঁড় করিয়ে রেখে সন্তর্পণে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করেছে কামাল। যাতে মহুয়া টের না পায় তার আগমন।

গেটের পর দুপাশে বাগান। এই বাগানের পরিচর্যা করে কামালই। কাউকে ফুল ছিঁড়তে দেখলে খেপে গিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে বসে সে। কংক্রিটের প্রশস্ত রাস্তা চলে গেছে গেটের কাছ থেকে গাড়ি-বারান্দা পর্যন্ত। কামাল কিন্তু এই রাস্তা দিয়ে না গিয়ে ঢুকে পড়ল বাগানের ভিতর। দেয়াল ঘেষে, গাছ-পালার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ধীরে ধীরে এগোল সে। বার বার মাথা তুলে তাকাচ্ছে দোতলার জানালাগুলোর দিকে। মহুয়াদি যদি দেখে ফেলে তাকে…!

ওদিকে ডাইনিংরূমে মহুয়া কোমরে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে কড়া শাসনের দৃষ্টি। ডাইনিং টেবিলে সাজানো পনেরো-বিশটা চীনা মাটির প্লেট। প্রত্যেকটিতে সুস্বাদু সুখাদ্য ছিল। বেশিরভাগই এখন খালি, মাত্র দুটি প্লেটে এখনও কিছুটা আছে।

মহুয়ার পাশে একটা চাকাওয়ালা ইনভ্যালিড চেয়ার। সেই চেয়ার জুড়ে বসে আছে সুবিশাল, সুবেশী এক ভদ্রলোক। রাজকীয় চেহারা ভদ্রলোকের। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, চোখে সানগ্লাস, ব্যাকব্রাশ করা চুল। অ্যাশ কালারের কমপ্লিট স্যুট পরনে। বাঁ হাতের কব্জিতে প্রায় পিরিচের মত বড় ডায়ালওয়ালা একটা ঘড়ি। ভদ্রলোকের চেহারাটা এমনই যে হঠাৎ কেউ দেখে ঠাহর করতে পারবে না, ভদ্রলোক কোন দেশী।

লক্ষ্মী বোন আমার— কথা শোন, আর পারব না!

মহুয়া চামচে স্ক্র্যাম্বলড এগ তুলে ভদ্রলোকের মুখের সামনে নিয়ে এল। মুখে কথা নেই, কিন্তু চোখে শাসনের কড়া দৃষ্টি। ভদ্রলোক সাহায্যের প্রত্যাশায় অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক তাকায়। কিন্তু ডাইনিংরূমে আর কেউ নেই। চোখ তুলে মহুয়ার দিকে তাকায় সে। আবার কিছু বলতে গিয়েও সামলে নেয় নিজেকে, হেসে ফেলে, বলে, খাইয়েই মেরে ফেলবি নাকি?

বাজে কথা বোলা না? ভদ্রলোকের মুখে চামচ ঢুকিয়ে দিতে দিতে মহুয়া বলল। সময় মত না খেয়ে খেয়ে খিদেটাকে তো একেবারে নষ্ট করে ফেলেছ। মনে আছে আমার, দশজনের নাস্তা একা খেয়েও তোমার পেট ভরত না। আর এখন তুমি প্রায় অনাহারেই থাকো।

অনাহারে থাকি না, তবে মাত্রাতিরিক্ত আহারও করি না। বেশি খাওয়াটা সবদিক থেকে খারাপ। শরীরের পক্ষে তো বটেই! মানবিক কারণেও খাদ্য অপব্যয় করা উচিত নয়। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় ন্যুনতম খাদ্য পাচ্ছে না রে মহুয়া।

ওই শুরু হলো তোমার মানবতার স্বপক্ষে বক্তৃতা! ওসব আমি শুনতে চাই না। পৃথিবীতে কোন বোনই একথা শুনবে না। এই নাও, দুধটুকু খাও।

আবার দুধ…?

তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। তোমাকে আমি লাইব্রেরী রূমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দেব।

সে কি! কেন?

 বিশ্রাম দরকার, তাই। বেডরূমে যাবার দরজা খোলা থাকবে, কিন্তু ড্রয়িংরূমে যাবার দরজা বন্ধ। শহীদ ফিরছে আজ। কামালও এই এল বলে। ওরা তোমাকে নিয়ে রাজ্যের গল্প জুড়ে দেবে, খুন-খারাবির কাহিনী নিয়ে মেতে উঠবে বারোটা বাজবে তোমার বিশ্রামের। দরকার নেই ওসবে, কড়া শাসনের ভঙ্গিতে বলল মহুয়া।

 আমাকে তুই তাই বলে বন্দী করে রাখবি সত্যি সত্যি? ভদ্রলোক অসহায় শিশুর মত অভিমানভরে জানতে চাইল।

মহুয়া বলল, তা নয়তো কি? বন্দী করে না রাখলে শুনবে তুমি কারও কথা?

ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে মহুয়ার একটা হাত ধরে বলল, মহুয়া, শোন বোন, খুব জরুরী একটা কাজ আছে, অন্তত একঘণ্টার জন্যে আজ একবার আমাকে বাইরে যেতে দিতেই হবে, তা না হলে।

মহুয়া ভুরু কুঁচকে বলল, কাজ? কি কাজ? কোনও কাজ নেই। শরীরটাকে সুস্থ রাখা এখন তোমার সবচেয়ে বড় কাজ। ডাক্তার বলে দিয়েছেন হাঁটাহাঁটি সম্পূর্ণ নিষেধ। কমপ্লিট বেড-রেস্ট নিতে বলেছেন। চেয়ারে বসে যে ঘুরে বেড়াচ্ছ, এটাই তো অন্যায় হচ্ছে!

ভদ্রলোক ওরফে কুয়াশা বলল, কিন্তু মহুয়া, আমি যেতে না পারলে যে…।

বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে, না? হোক। শরীর ভাল হয়ে গেলে সে ক্ষতি পূরণ করে নিতে পারবে। যাওয়া তোমার চলবে না। শোনো, দাদা, তোমার সীমানা পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি আমি। লাইব্রেরী, দক্ষিণ দিকের করিডর, বেডরূমগুলো এবং পিছন দিকের বারান্দা–এই হলো তোমার এলাকা। এর বাইরে গেলে কড়া শাস্তি পেতে হবে তোমাকে।

ড্রয়িংরুমে …?

 না।

কুয়াশা বলল, কিন্তু শহীদ যদি ডাকে বা…।

ডাকবে না। ও এলে আমি ওকে নিষেধ করে দেব। তবু যদি কোন কারণে ড্রয়িংরূমে যাবার প্রয়োজন দেখা দেয়, আগে আমার অনুমতি নিতে হবে। চলো এবার।

লাইব্রেরীতে ঢুকে দরজাগুলো পরীক্ষা করল মহুয়া। ড্রয়িংরুমে ঢোকার দরজাটা অপরদিক থেকে বন্ধ আছে দেখে এদিক থেকে আর বন্ধ করল না ও। বলল, ঠিক সাড়ে দশটায় এসে নিয়ে যাব বাথরূমে। এগারোটার সময় গ্লুকোজ, সাড়ে এগারোটায় হরলিক, বারোটায় ইঞ্জেকশন, সাড়ে বারোটায় লাঞ্চ, একটায় বেডরূমে ঘুম, তিনটের সময় নাস্তা, সোয়া তিনটেয় ইঞ্জেকশন, পাঁচটায় দুধ সাবু…

চা? এক কাপ চা দিবি না?

মহুয়া নির্মমভাবে বলল, না। চা-সিগারেট নিষেধ। সাড়ে সাতটায় ডিনার। সাড়ে নটায় বিছানা–মনে আছে তো সব? নিয়মের এদিক-ওদিক যেন না হয়। কথা না শুনলে বেডরূমের ভিতর বন্ধ করে রাখব চব্বিশ ঘণ্টা।

কুয়াশা বলল, কিন্তু আমি এখন দিব্যি সুস্থ হয়ে গেছি। অনেকদিন তো হলো, আর কেন এভাবে বসে বসে সময় নষ্ট করব? এই দেখ না, কি রকম সুন্দর হাঁটতে পারি আমি…

কুয়াশা চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল, ছুটে এল মহুয়া। কুয়াশার দুকাঁধ ধরে চাপ দিয়ে বসিয়ে রাখল তাকে, খবরদার! দাঁড়ালেই বেডরূমে নিয়ে গিয়ে তালা লাগিয়ে দেব বলে দিচ্ছি…

হেসে ফেলল কুয়াশা। বলল, কিন্তু এভাবে থাকলে আমি যে পঙ্গু হয়ে যাব। হাজার হাজার মানুষ আমার কাছ থেকে নির্দেশ পাবার জন্যে অপেক্ষা করছে। ল্যাবরেটরিতেও ফেরা দরকার আমার। পেরুর বিজ্ঞানী রীলকে কেরো ক্যাম্পার নিরাময়ের একটা ওষুধ আবিষ্কার করেছে আমার লেখা একটা আর্টিকেল থেকে কেমিক্যাল কম্বিনেশন-এর সূত্রের সাহায্যে, সেই ওষুধের গুণাগুণ প্রমাণ করার। দায়িত্ব আমাকে দেবার জন্যে ঢাকায় এসেছে সে। বেচারা কতদিন আর অপেক্ষা করবে বল? ওদিকে দৃক্ষিণ মেরুতে কী এক রহস্যময় কারণে জমাট বরফ হু হু করে গলতে শুরু করেছে, খবর দিয়েছে বিজ্ঞানী আলজের সিমুভিচ। যে হারে বরফ গলছে, মাস দেড়েক যদি এভাবে গলতে থাকে, পৃথিবীর অর্ধেক জমি ডুবে যাবে অকল্পনীয় ব্যায়। রহস্যটা কি, কেন হঠাৎ বরফ গলতে শুরু করেছে, জানতে হলে সরেজমিনে তদন্ত করার জন্যে এক্ষুণি রওনা হয়ে যেতে হয় দক্ষিণ মেরুতে। তারপর, আনতারায় পৌঁছে ওমেনা খবর পাঠিয়েছে বেতারে, সেখানের বিজ্ঞানীরা নাকি প্রমাণ পেয়েছে, দূর মহাশূন্য থেকে কয়েকটা উপগ্ৰহ কক্ষচ্যুত হয়ে ছুটে আসছে আনতারার দিকে, তার মানে পৃথিবীর দিকেও-এ ব্যাপারেও চোখ বুজে থাকা যায় না।

অধৈর্য, অসহিষ্ণু কণ্ঠে মহুয়া বলল, ব্যস, ব্যস! আর বলতে হবে না। দুনিয়ার সব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাতে দিচ্ছি না আর আমি তোমাকে। দুনিয়া রসাতলে যাক, তোমাকে আমি ছাড়ছি না।

 কিন্তু কত দিন?

মাস খানেক তো বটেই। কিন্তু এত অস্থিরতার কি আছে? আমার কাছে থাকতে কি তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে?

কুয়াশা বলল, না, তা নয়। বুঝিস তো, কাজগুলো না করলে।

পরে করবে। আমি ভাবছি, স্থায়ীভাবে তোমাকে আমি আমার কাছে রেখে দেব। শরীরের ওপর অত্যাচারটা অন্তত করতে পারবে না আমার কাছে থাকলে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার শখটাও একটু কমাতে পারব মনে হয়।

কুয়াশা বলল, তোর সব কথা মেনে নেব, শুধু আজ বিকেলে একঘণ্টার জন্যে যদি বাইরে বেরুতে দিস…!

না! বলে করিডরে বেরিয়ে গেল মহুয়া। বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল দরজা।

খুট করে শব্দ হলো একটা। ঘাড় ফিরিয়ে অপর দরজাটির দিকে তাকাল কুয়াশা। দেখল খুলে যাচ্ছে সেটা ধীরে ধীরে। একমুহূর্ত পর উঁকি দিয়ে তাকাল কামাল। মহুয়াকে কোথাও দেখতে না পেয়ে এক গাল হাসল সে। লাইব্রেরীতে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসে দাঁড়াল কুয়াশার সামনে।

কেমন আছ?

ভাল না। মহুয়া নিষ্কৃতি দিচ্ছে না।

কামাল চাপাস্বরে বলল, কঠিন পাত্রী। আমাকে একবার একটানা একুশ দিন এই রকম বন্দী করে রেখেছিল, শেষে জানালার শার্সি ভেঙে রাত একটার সময় পানির পাইপ বেয়ে নিচে নেমে পালিয়ে বাঁচি।

উজ্জ্বল হয়ে উঠল কুয়াশার মুখ, আমিও তাহলে!

আঁতকে উঠল কামাল, না! এই পদ্ধতিতে পালালে মহুয়াদি নির্ঘাত সন্দেহ করবে আমিই তোমাকে বুদ্ধিটা যুগিয়েছি। দা দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে আমাকে তাহলে।

তাহলে উপায়? ফিসফিস করে জানতে চাইল কুয়াশা।

নিরুপায় ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়তে নাড়তে কামাল বলল, উপায় নেই। বুঝিয়ে শুনিয়ে দেখো, যদিদয়া হয়।

গত পাঁচ ছয় দিন তো কম চেষ্টা করিনি। এখন শুধু কান্নাকাটি করাটাই বাকি আছে।

কামাল চিন্তিতভাবে বলল, শেষ অস্ত্র ওটা। করো কান্নাকাটি–দেখো লাভ হয় কিনা!

কোন লাভ হবে না। অকস্মাৎ বজ্রপাত ঘটল কামালের ঠিক পিছনে। মহুয়ার কণ্ঠস্বর। পর মুহূর্তে কামাল অনুভব করল তার কান দুটো দুই হাত দিয়ে মুচড়ে ধরে পিছন দিকে টানছে কে যেন। পিছিয়ে যেতে যেতে গলা ছেড়ে চিৎকার জুড়ে দিল কামাল। লাভ সত্যি হলো না। কানের টানে পিছু হটতে হটতে দরজা পেরিয়ে, ড্রয়িংরুমের ভিতর ঢুকে পড়ল কামাল।

হোঃ হোঃ করে হাসতে শুরু করেছে কুয়াশা। দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেও হাসতে থাকল সে।

খানিক পর কামালের চিৎকার থামল। মহুয়ার কণ্ঠস্বরও স্তিমিত হয়ে এল একসময়। ধীরে ধীরে কুয়াশা কোটের ভিতরের পকেট থেকে একটা সিগারেট কেস সদৃশ যন্ত্র বের করল। ক্ষুদ্রাকৃতি বেতার যন্ত্র ওটা। সেটটা অন করে একজন সহকারীর সাথে কথা বলতে শুরু করল নিচু গলায়।

কমিনিট পর সেটটা অফ করে পকেটে রাখল কুয়াশা। এমন সময় ড্রয়িংরূমে ঢোকার দরজাটা খুলে গেল আবার। সহাস্যে প্রবেশ করল কামাল। হাতে একটা টে। তাতে একগ্লাস পানি। এবং একটা পিরিচে একটা দুরুঙা ক্যাপসুল।

আবার কানমলা খাবে না তো?

কামাল সগর্বে বলল, না। অনুমতি দিয়েছে। খেয়ে নাও ক্যাপসুলটা। মহুয়াদি বলেছে তোমার সান্নিধ্য মাঝেমধ্যে আমি পেতে পারি, যদি তোমাকে সেবা করার উপযুক্ততা প্রমাণ করতে পারি আমি।

ক্যাপসুলটা খেয়ে পানির গ্লাসটা ট্রের উপ্র নামিয়ে রাখল কুয়াশা। চাপা গলায় বলল, ওই আসছে!

কামাল অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ল কুয়াশার দুই পায়ের উপর।

 কি হলো! ও কি! পা টিপছ কেন? ছাড়ো, ছাড়ো।

কামাল নিবেদিত প্রাণ সেবকের মত অত্যন্ত সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে কুয়াশার পা টিপে দিচ্ছে

আহ! সুড়সুড়ি লাগছে তো!

কুয়াশার কথায় কর্ণপাত করছে না কামাল, যেন শুনতেই পাচ্ছে না।  

কী হচ্ছে?

না থেমে, পা টিপতে টিপতে বলল কামাল, সেবা করছি।

মহুয়া ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। হাসি চেপে রাখা কঠিন হয়ে পড়ল তার পক্ষে। বলল, সেবা বুঝি একে বলে? দাদা কি বলছে শুনতে পাচ্ছ না?

কুয়াশা বলল, ছাড়ো! ছাড়ো! সুড়সুড়ি লাগছে আমার!

কামাল বলল, তুমি কি বলো, মহুয়াদি? সারা দিন রাত বসে থাকলে পায়ের শিরাগুলোয় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। টিপে দিলে উপকার হবে। সুড়সুড়ি একটু লাগলেই কি করা যাবে…! হাসাহাসি করা তো ভাল!

কুয়াশা বলল, কথাটা একেবারে বাজে বলেনি কামাল, বুঝলি মহুয়া। কিন্তু এই সুড়সুড়িও তো আমি সইতে পারছি না। এক কাজ করলে হয়, একটু হাঁটাহাঁটি করলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

মহুয়া বলল, রক্ত চলাচলের কথাটা সত্যি আমি ভাবিনি। ঠিক আছে, প্রতি ঘন্টায় পাঁচ মিনিট করে চেয়ার ছেড়ে হাঁটাহাঁটি করতে পারবে তুমি এখন থেকে।

শহীদের রসাত্মক কণ্ঠস্বর ভেসে এল দরজার কাছ থেকে, ভুল করলে, মহুয়া। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই কুয়াশা বাংলাদেশটা একবার চক্কর দিয়ে ফিরে আসতে পারবে। ওকে আটকে রাখতে হলে…।

আরে এসো, এসো! সহাস্যে, ভরাট গলায় বলল কুয়াশা।

কামাল গম্ভীর হয়ে ওঠে হঠাৎ। বলে, তোর জন্যেই অপেক্ষা করছি, শহীদ।

শহীদের ভুরু কুঁচকে ওঠে, কি ব্যাপার?

কামাল বলল, কাগজে জাস্টিস ইরাহিম খাঁ লোদীর নিহত হবার খবর পড়িসনি?

আজ, খানিক আগে, পড়েছি।

কামাল বলল, মি. সিম্পসন এবং আমার, তথা গোটা পুলিসবাহিনীর জীবনে সবচেয়ে রহস্যময় কেস এটা, শহীদ। যার মাথা মুণ্ডু কিছুই উদ্ধার করা যাচ্ছে না। মি. সিম্পসন তার পদত্যাগপত্র তৈরি করে রেখেছেন। তোর সাথে পরামর্শ করবেন শুধু একবার, তারপর চাকরিতে ইস্তফা দেবেন।

বলিস কি? মি. সিম্পসন পদত্যাগ করবেন? কেন?

কামাল বলল, আই. জি. সাহেবকে কেসটা সম্পর্কে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা দিতে পারছেন না বলে। রহস্যটা এমনই জটিল, যার মীমাংসা সম্ভব নয়।

কুয়াশা বলল, তোমার মুখে এরকম নেতিবাচক কথা মানায় না, কামাল। কোন কেসই মীমাংসার বা সমাধানের অযোগ্য নয়।

মহুয়া বাধা দিল এবার, দাদা!

 শহীদ বলল, ওহ্। কুয়াশার বাক স্বাধীনতাও হরণ করেছ তুমি?

 মহুয়া বলল, তোমরা দুজন ডুয়িংরূমে যাও। এখুনি।

 কামাল বলল, যাচ্ছি।

মহুয়া বলল, আর শোনো, মি. সিম্পসন পদত্যাগ করতে চাইছেন–করুন, তাকে দয়া করে বাধা দিয়ো না তোমরা। ভদ্রলোক পদত্যাগ করলে অনেক দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচব আমি। রাত দুপুরে টেলিফোনও আসবে না, দাদার পিছনেও ভদ্রলোক ফেউয়ের মত লেগে থাকবেন না।

কামাল বলল, তবু, তাঁর শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করার ব্যবস্থা করা দরকার। তিনি আমাকে অনুরোধ করেছেন, শহীদ বাড়ি ফিরলেই আমি যেন টেলিফোন করে খবরটা তাঁকে দিই।

শহীদ বলল, ফোন কর তুই।

কুয়াশা কি যেন বলতে যাচ্ছিল, মহুয়া ধমক দিয়ে বলল, না! কোন কথা নয় আর।

কামালকে অনুসরণ করে শহীদও বেরিয়ে এল লাইব্রেরী থেকে।

তেপয়ের সামনে সোফায় বসে ডায়াল করতে শুরু করল কামাল। মি. সিম্পসনকে অফিসে পাওয়া গেল না। ইন্সপেক্টর জাহিদ হোসেনকে মেসেজটা দিয়ে ফোন ছেড়ে দিল কামাল।

শহীদ পাইপ ধরাতে ধরাতে বলল, কুয়াশার ব্যাপারটা মি. সিম্পসন সন্দেহ করেননি তো?

কামাল হেসে উঠল, এক বিন্দু না! এই তো, পরশু দিন ঘণ্টা দুয়েক গল্প করে, গেলেন কুয়াশার সাথে। গাড়িতে ওঠার সময় আমাকে কি বললেন জানিস? বললেন, ভদ্রলোক আশ্চর্য বুদ্ধি রাখেন। যেমন শার্প ব্রেন, ব্রেনটাকে খাটানও তেমনি। দুনিয়ার এমন কোন সাবজেক্ট নেই যার সম্পর্কে খোঁজ খবর না রাখেন।

তুই কি বললি?

কামাল বলল, বললাম, শহীদের বন্ধু তো, উঁচু স্তরের ইনটেলেকচুয়াল তো হবেই। বারবার ঘাড় দুলিয়ে বললেন, ঠিক বলেছ, ঠিক বলেছ!

হেসে উঠল শহীদ ও কামাল।

গেটে লেবু যেন চেল্লাচ্ছে? দেখ তো?

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল কামাল। কি সে দেখল কে জানে, বিড় বিড় করে উচ্চারণ করল, ব্যাটা কেষ্টা? সর্বনাশ না করে ছাড়বে না দেখছি!

কথাগুলো বলে চরকির মত ঘুরে দাঁড়িয়ে ড্রয়িংরূম থেকে বেরিয়ে গেল সে।

অপর দরজা দিয়ে কফির ট্রে নিয়ে প্রবেশ করল মহুয়া। কামালকে ড্রয়িংরূমে দেখতে না পেয়ে থমকে দাঁড়াল সে। শহীদের দিকে ভুরু কুঁচকে:কিয়ে জানতে চাইল, ব্যাড এলিমেন্টটা কোথায় গেল?

মৃদু হেসে শহীদ বলল, ডি. কস্টাকে গেট থেকে তাড়াতে।

তিনি আবার এসেছেন বুঝি জ্বালাতে?

পাশের সোফায় বসল মহুয়া তেপয়ের উপর ট্রে নামিয়ে রেখে, কফি। বিয়ে কেমন খেলে?

শহীদ বলল, ভাল। সঞ্চিতার বরটা আমার পরিচয় পেয়ে বিতিকিচ্ছি একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিল, জানো!

মানে?

বরের আসন থেকে সোজা উঠে আসে সে আমার সামনে, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে…

সকৌতুকে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে মহুয়া, বলো কি। এত বড় ভক্ত সে তোমার?

শহীদ বলল, কারণ আছে। ওর বাবাকে এক লোক ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছিল কয়েক বছর আগে। ভদ্রলোক তখনঢাকায় ব্যবসা করতেন। আমার কাছে সাহায্যের আশায় আসেন তিনি। সাহায্য করেও ছিলাম। যে লোকটা ব্ল্যাকমেইল করছিল সে একটা খুনও করে। তাকে ধরে পুলিসের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এখনও সে জেলে পচছে। সে যাক, বাপের কাছে আমার নাম শুনেছিল হাসান।

সঞ্চিতার স্বামীর নাম?

শহীদ বলল, হ্যাঁ।

 সঞ্চিতার ভাই, তোমার বন্ধু রহমান সাহেব কি বললেন?

শহীদ বলল, কি আর বলবে, সে-ও তার সেই ভারি গলায় হোঃ হোঃ করে অট্টহাসি হাসতে লাগল আর আমার সম্পর্কে যা নয় তাই প্রশংসা গাইতে শুরু করল। সে এক লজ্জাকর অবস্থা।

মহুয়া বলল, বেশ স্ফুর্তিতেই সময় কেটেছে তাহলে তোমার। তা, কক্সবাজারে এবার শীত কেমন?

গত পঁচিশ বছরের মধ্যে এত শীত পড়েনি, ছত্রিশ ডিগ্রী পর্যন্ত নেমেছিল।

 ওদিকে গেটে তুমুল বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে গেছে।

গেটের বাইরে ডি কস্টা। গেটটা খোলাই। ডি. কস্টার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মত পথরোধ করে কামাল। ডি কস্টা তার সরু কোমরে দুহাত রেখে পল্টনী বাংলায় দ্রুত ভাষণ দিয়ে চলেছে।

হামার অটিকার হাপনি হরণ করিটে পারেন না! টিনি হামার ফ্রেণ্ড, হামি টাহার সহিট ডেখা করিব, ইহাটে হাপনি কেন প্রবলেম ক্রিয়েট করিটেছেন? ভালোয় ভালোয় যড়ি বাড়ির ভিটর ঢুকিটে না ডেন, পরিণাম বহুট খারাপ হইবে এবং টাহার জন্যে এই মি. ডি. কস্টা কোন প্রকারেই ডায়ী ঠাকিবে না।

কামাল শান্ত। দৃঢ়কণ্ঠে শুধু বলল, এখনও বলছি, ভাগেন। আপনার বস মি. কুয়াশার মঙ্গল যদি চান, আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না।

বাট হোয়াই। টাহার সহিট হামার জরুরী টক আছে!

কামাল বলল, জানেন তো, মি. সিম্পসন এমনিতেই সন্দেহ করেন কুয়াশা এ বাড়িতে আসা-যাওয়া করে। এ বাড়ির ওপর সর্বক্ষণ একজন লোক নজর রাখে, সে ব্যবস্থা মি. সিম্পসন অনেকদিন থেকে করে রেখেছেন। সেই লোক যদি আপনাকে এখানে ঘন ঘন দেখে, পরিষ্কার বুঝতে পারবে সে, কুয়াশা এ বাড়িতেই আছে। কুয়াশা গবেষণা করতে গিয়ে ল্যাবরেটরিতে অ্যাক্সিডেন্ট করে আহত হয়েছে, এ খবর মি. সিম্পসন জানেন। আপনাকে দেখলেই তিনি বাড়ি সার্চ করাবার জন্যে লোক পাঠাবেন

ডি. কস্টা বলল, সার্চ করুক আর মার্চ করুক, আমার ফ্রেন্ডকে ঢরার সাঢ্য মি. সিম্পসনের নাই। ওসব ফালটু কঠা বাড ডিন। হামি জানিটে চাই, ঢুকিটে ডিবেন কিনা।

না।

ঠিক আছে, একটা জরুরী মেসেজ আছে, নিয়া যাইবেন?

 কামাল বলল, তা নিয়ে যেতে পারি। বলুন, কি বলতে হবে কুয়াশাকে?

বলবেন, বিশটা টাকা ডরকার হামার।

কামাল মারমুখো হয়ে উঠল, ওহ্! এই বুঝি আপনার জরুরী মেসেজ? পারব না আমি কুয়াশাকে গিয়ে একথা বলতে।

প্লীজ! মি. কামাল! হাপনাকে এই ডয়াটুকু করিটেই হইবে! কাজ কর্ম না করিয়া করিয়া হাটে পায়ে খিল ঢারিয়া যাইটেছে, এক বোতল মড্যপান না করিলে শরীরটা চাঙ্গা হইবে না! বিশটা টাকা আমাকে যেভাবে হউক যোগার করিয়া ডিন…!

কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কামাল জিজ্ঞেস করল, বিশ টাকা দিলে আর আসবেন না তো?

 ডি. কস্টা চিন্তা করুল খানিক, একদিন পর পর আসিব, বিশটা করিয়া টাকা ডিলে চলিয়া যাইব।

কামাল বলল, একদিন পর পর এলেও পুলিস সন্দেহ করবে। আপনি মদের দোকানে ধার করুন, পরে কুয়াশার কাছ থেকে টাকা নিয়ে টাকা দিয়ে দেবেন।

ডি. কস্টা বলল, লোন ডিবে না হামাকে।

কামাল বলল, সেক্ষেত্রে মদ খাওয়া বন্ধ রাখুন।

 দ্যাটস ইমপসিবল! বড্য হামাকে পান করিটেই হইবে! ইংরেজের রক্ট…।

 কামাল চটে উঠে বলল, আপনি যাবেন কিনা তাই বলুন।

 ডি. কস্টা বলল, বিশ টাকা ডিয়া ডিন, ভ্যানিশ হইয়া যাইব।

আর কোন দিন আসবেন না তো?

 ডি. কস্টা বলল, কঠা ডিটেছি।

বিশটা টাকা দিল পকেট থেকে বের করে কামাল। ছোঁ মেরে দশ টাকার নোট দুটো কামালের হাত থেকে নিয়ে দুপা পিছিয়ে গেল ডি কস্টা, বলল, হাজার বার আসিব। প্রটেক ডিন আসিব হামারকস্ যট ডিন এ বাড়িটে ঠাকিবেন টট ডিন যখন ইচ্ছা টখন আসিব!

কামাল তাড়া করুল, তবে রে।

খিচে দৌড়তে শুরু করল ডি. কস্টা। দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল তার পাটখড়ির মত রোগা শরীরটা। কামাল কয়েক পা মাত্র এগিয়ে ছিল, ফিরে এল সে বাড়ির ভিতর। লেবু বেরিয়ে এল গেটের আড়াল থেকে।

কি রে, তুই লুকিয়ে ছিলি মনে হলো?

লেবু বলল, ভভভ ডয়ে।

ভয়ে লুকিয়েছিলি? ডি. কস্টাকে ভয় করিস নাকি? কেন?

লেবু বলল, ঠ-ঠ-ঠ-ঠকিয়ে দেদে-দেবে।

হাসি চেপে কামাল বলল, ঠকিয়ে টাকা পয়সা আদায় করে নিয়ে যাবে এই তোর ভয়?

লেবু মাথা কাত্ করে বলল, জ্বী-জ্বী। আ-আ-মার কু-বুদ্ধি ক-ক-কম কি কিনা।

বুদ্ধি যতই কম হোক, ওই ডি. কস্টাকে যেন বাড়ির ভিতর ঢুকতে দিসনে। শোন, জীপ নিয়ে খানিকক্ষণের মধ্যে মি. সিম্পসন আসবেন, গেট খুলে দিবি, বুঝলি? এখন গেট বন্ধ করে রাখ।

লেবু গেট বন্ধ করে দিতেই কামল বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

.

০২.

ড্রয়িংরূমে ফিরে এসে শহীদের পাশে বসে কামাল পট থেকে কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বলল, ডি. কস্টা বড্ড বিরক্ত করছে।

মদ খাবার টাকার জন্যে এসেছিল বুঝি?

চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠল কামালের, জানলি কিভাবে?

চট্টগ্রাম যাবার আগে পর পর সাতদিন বিশ টাকা করে দিয়েছি। কথা আদায় করে নিয়েছিল, রোজ দিতে হবে। গত দুদিন নিয়েছে তোর মহুয়াদির কাছ থেকে।

কামাল বলল, ব্ল্যাকমেইলিং করছে লোকটা। আমার কাছ থেকেও বিশ টাকা নিল এখন।

শহীদ বলল, উপায় কি, দিয়ে যেতে হবে। ভাল কথা, কেসটা সম্পর্কে বল শুনি।

কামাল মুখ খুলতে যাবে, নিচে থেকে ভেসে এল জীপের শব্দ। কামাল সোফা ত্যাগ করল হাতে কফির কাপ নিয়ে। জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে, ওই আসছেন মি. সিম্পসন। ওর মুখেই শোন্ সব। মোস্ট ইন্টারেস্টিং কেস, শহীদ।

সিঁড়িতে বুটজুতোর শব্দ পাওয়া গেল খানিক পর।

কামাল বসল শহীদের ডান পাশের সোফায়। মি. সিম্পসনকে দেখা গেল এক মুহূর্ত পর দোরগোড়ায়।

হ্যালো!

শব্দটা উচ্চারণ করে ড্রয়িংরূমে ঢুকলেন মি. সিম্পসন। পরনে সিভিল ড্রেস। সাদা শার্ট, লাল টকটকে টাই, ব্রাউন রঙের গরম কাপড়ের সুট পরনে। মাথায় নতুন কেনা একটা হ্যাট হাতে জ্বলন্ত পাইপ। বাঁ হাতে এরিনমোর টোবাকোর কৌটা।

শহীদ উঠে দাঁড়াল, আমি আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি।

নিঃশব্দে করমর্দন করলেন মি. সিম্পসন। প্রথমে শহীদ, পরে কামালের সাথে।

 শহীদ বলল, বসুন।

সকলে আসন গ্রহণ করল। কারও মুখে কথা নেই কয়েক মুহূর্ত। মি. সিম্পসন বাঁ দিকে কাত হয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। কপালের ঘাম মুছলেন।

টকটকে লাল হয়ে আছে মুখটা। উত্তেজিত এবং নার্ভাস দেখাচ্ছে তাঁকে। কিন্তু নিজেকে তিনি সামলে রেখেছেন এখন পর্যন্ত।

নিস্তব্ধতা ভাঙল শহীদই, সত্যিই কি…?

মি. সিম্পসন শহীদের প্রশ্নটা বুঝতে পেরে, ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, তাছাড়া উপায় কি, বলো? কেসটা সমাধানের সম্পূর্ণ বাইরে! আই. জি, সুহেবকে সম্ভাব্য সমাধান শোনাবার চেষ্টাও সফল হয়নি। অনুমান করে কিছু যে বলব, তারও উপায় নেই। কেসটা একটা বিকট ধাঁধা ছাড়া আর কিছুই নয়। নিশ্চয়ই শুনেছ কামালের মুখে…?

শহীদ বলল, অস্থির হবার কিছু নেই। না, এখনও আমি কিছুই শুনিনি। কামাল, মি. সিম্পসনকে এক কাপ কফি দে।

কামাল পট থেকে গরম কফি ঢালল কাপে। মি. সিম্পসন ধন্যবাদ বলে কাপটা ট্রে থেকে তুলে নিয়ে চুমুক দিলেন ঘন ঘন। বললেন, ঘটনাটা শোনার পর তুমিও আমাদের সাথে একমত হবে, কেসটা সত্যি সমাধানের বাইরে।

শহীদ পাইপে অগ্নিসংযোগ করে ধোয়া ছাড়ল এক মুখ। বলল, মনে হয় না। অপরাধ যখন একটা ঘটেছে, অপরাধীর অস্তিত্ব তখন থাকতে বাধ্য। সে যত বড় বুদ্ধিমানই হোক, কোথাও না কোথাও সে, সামান্যতম হলেও, ভুল না করে পারে না। সেই ভুলটা কি, ধরতে পারলেই অপরাধীকে চেনা যাবে।

এই রকম যত থিওরি আছে সব আমি জানি, শহীদ।

অফকোর্স!

মি. সিম্পসন বললেন, জেনেও স্বীকার করছি, এই কেসের মাথা মুণ্ডু কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।

শহীদ বলল, অনেক সময় হয় কি জানেন, ছোট্ট একটা জিনিস চোখে ধরা। পড়লেই রহস্যের সমাধান হয়ে যায়। জিনিসটা সবার চোখের সামনে থাকে, কিন্তু কারও চোখে ধরা পড়ে না। এমন সময় নতুন এক লোককে সেখানে পাঠালে, তার চোখে জিনিসটা প্রথমেই ধরা পড়ে যায়। আমার মনে হয়, আপনি কাহিনীটা বললে আমার চোখেও তেমন কিছু ধরা পড়তে পারে।

মি. সিম্পসন বললেন, পদত্যাগ আমি করব, এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আমি জানি, এ কেসের সমাধান আমার দ্বারা অসম্ভব। তবে পদত্যাগ পত্র পেশ করার আগে তোমার সাথে কেসটা সম্পর্কে একবার আলোচন করতে চাই আমি। তোমার ওপর আমার বিশ্বাস এবং আস্থা কতটুকু, বুঝিয়ে বলতে পারব না। যদিও এই কেসের ব্যাপারে তুমিও তেমন কিছু করতে পারবে বলে আমি মনে করি না, তবু সবটা তোমাকে শোনাতে চাই। শোনার পর তোমার মুখ থেকে কেসটা সম্পর্কে একটা মন্তব্য আশা করব আমি। তারপর অফিসে ফিরে গিয়ে পদত্যাগ পত্র পেশ করব।

শহীদ মৃদু হাসল, হয়তো কাহিনীটা শোনার পর, সমাধানের আশ্বাস দিতে পারব আমি। সেক্ষেত্রে তো আপনার পদত্যাগের দরকার পড়বে না, কেমন?

মি. সিম্পসন কথা বললেন না।

কামালও গম্ভীর।

 শহীদ বলল, আচ্ছা, সে দেখা যাবে। আপনি শুরু করুন। .

শহীদের কথা শেষ হতে মি. সিম্পসন ধীরে ধীরে পাইপটা নামিয়ে রাখলেন তেপয়ের উপর। তারপর উঠে দাঁড়ালেন সোফা ছেড়ে।

ও কি!

শহীদ অবাক হয়ে বলল।

কোটের দুই সাইড-পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিতে দিতে মি. সিম্পসন বললেন, সূত্রগুলোও সাথে করে নিয়ে এসেছি। এই দেখো।

 দুপকেট থেকে দুটো-আগ্নেয়াস্ত্র বের করলেন মি. সিম্পসন। বসলেন। একটা পিস্তল, অপরটি রিভলভার–রাখলেন মধ্যবর্তী তেপয়ের উপর পাশাপাশি।

শহীদ চোখ নামিয়ে দেখল আগ্নেয়াস্ত্র দুটির একটি আইভর-জনসন–৩৮। অপরটি ব্রাউনিং .৩২ অটোম্যাটিক।

হঠাৎ মৃদু ঝিরঝির শব্দ এল জানালা গলে।

কামাল নড়েচড়ে বসল, বলল, মাঘ মাসে বৃষ্টি। হাড় কাঁপানো শীত পড়বে এবার। মি. সিম্পসন, আর এক কাপ কফি চলবে নাকি?

চলবে।

কামাল উঠে দাঁড়িয়ে অন্দর মহলের দিকে যাবার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়ল, মহুয়াদি, চার কাপ!

কামাল ফিরে এসে বসল সোফায়।

মুচকি মুচকি হাসছিল শহীদ। মি. সিম্পসন ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সফল না হয়ে অগত্যা প্রশ্ন করলেন, চার কাপ, কামাল? এখানে তো আমরা তিনজন।

কামাল বলল, শহীদের বন্ধু এনাম আহমেদ লাইব্রেরী রূমে বিশ্রাম নিচ্ছে, তার জন্যেও…।

মি. সিম্পসন বললেন, ওহহহ! মাথার ঠিক নেই, ভদ্রলোকের কথা ভুলেই গেছি। তা, কেমন আছেন মি. আহমেদ? হাঁটাচলা করতে পারছেন? ..

কামাল বলল, না। আরও কিছু দিন সময় লাগবে বলে মনে হয়।

মি. সিম্পসন বললেন, ভদ্রলোককে ডাকলে হয়। কাহিনীটা তিনিও শুনতেন। অত্যন্ত বিচক্ষণ এবং ক্ষুরের মত ধারাল বুদ্ধি রাখেন তিনি কথা বলে বুঝেছি তাঁর সাথে।

কামাল বলল, কিন্তু ডাক্তারের কড়া নিষেধ, কথা বলা চলবে না। 

মি. সিম্পসন বললেন, তবে থাক।

শহীদ বলল, হ্যাঁ, এবার আপনি শুরু করুন, মি. সিম্পসন।

মি. সিম্পসন নড়েচড়ে বসলেন, সোফায়। নতুন করে পাইপে অগ্নিসংযোগ করে বললেন, প্রথম থেকেই শুরু করি। জজ ইব্রাহিম খাঁ লোদীকে তুমি চিনতে। তবু তাঁর সম্পর্কে দুএকটা কথা তোমাকে বলে নিই। জজ হিসেবে তিনি প্রচুর সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। জজ কোর্টের ক্রিমিন্যাল ডিভিশনের বিচারকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি সুদীর্ঘ ছাব্বিশ বছর। বেশ কবছর আগে তিনি রফিক চৌধুরী নামে এক যুবককে পনেরো ঘা বেত এবং আঠারো মাসের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান। করেন, ডাকাতি করার অপরাধের শাস্তিস্বরূপ বিচার চলাকালে, কোর্টরুমে, রফিক জজ লোদী সাহেবকে হুমকি দেয়। বলে, ছাড়া পেলে আপনাকে আমি দেখে নেব। এ ধরনের ঘটনা এর আগেও কোর্টরূমে ঘটেছে, নতুন কিছু নয়। অপরাধীরা প্রায়ই জজ সাহেবকে গালাগালি করে, হুমকি দেয়। কিন্তু সাধারণত ব্যাপারটা সীমিত থাকে কোর্টরুমেই। অপরাধীরা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জজ সাহেবকে খুঁজে বেড়ায় না খুন করার জন্যে বা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে। কিন্তু এ ঘটনাটা। অন্য রকম, সম্পূর্ণ বিপরীত। রফিক চৌধুরী হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে জজ লোদী সাহেবকে খুন করে। আপাতদৃষ্টিতে এই হলো সত্য ঘটনা।

শহীদ বলল, আপনি বলছেন আপাতদৃষ্টিতে–তার মানে প্রকৃত সত্য এটা নয়? প্রকৃত ঘটনা তাহলে কি?

মি. সিম্পসন বললেন, প্রকৃত ঘটনা কি তা আমি বা কামাল কেউই আমরা জানি না। ইব্রাহিম খা লোদী সাহেব গতকাল সন্ধ্যার অল্প আগে বুকে গুলি খেয়ে নিহত হন। সাড়ে পাঁচটার সময়। কামাল এবং আমি, প্রকৃত পক্ষে, হত্যাকাণ্ডটি প্রত্যক্ষ করি। আমাদের চোখের সামনেই অপরাধটা ঘটে। লোদী সাহেব একা ছিলেন–বাড়ির ভিতরই, কিন্তু বাড়ির মূল অংশ থেকে কিছুটা দূরে, বিশেষভাবে তৈরি তাঁর নিজস্ব রেস্ট হাউজে। তাঁর কাছাকাছি গিয়ে তাকে গুলি করা, এক কথায়, অসম্ভব। সূতরাং রফিক চৌধুরী যদি তাকে খুন করে না থাকে, ধরে নিতে হয় কোন অলৌকিক শক্তি গুলি করেছে জজ সাহেবকে। অপরদিকে, যদি ধরে নেয়া হয় যে রফিক চৌধুরীই খুন করেছে জজ সাহেবকে, তাহলে স্বীকার না করে। উপায় নেই রফিক চৌধুরী অলৌকিক শক্তির অধিকারী।

সাগ্রহে শুনছে শহীদ। কৌতূহল ফুটে উঠেছে ওর চোখমুখে। বলল, বলে যান।

লোদী সাহেব সম্পর্কে বলি। বাষট্টি বছর বয়সে তিনি অবসর নিয়েছিলেন, একজন জজের জন্যে সকাল সকালই বলতে হবে। শারীরিক দিক থেকে সক্ষম ছিলেন তিনি, মানসিক দিকটাও সতেজ ছিল। শাস্তি দেবার সময় তিনি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতেন অপরাধের চেয়ে শাস্তির ওজন যাতে বেশি না হয়। বেত্রাঘাত বা শারীরিক যন্ত্রণাদায়ক কোনরকম শান্তি দিতে ঘোর আপত্তি ছিল তার। বেত্রাঘাতের বিরুদ্ধে তিনি পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও করেছেন প্রচুর, ভাষণও দিয়েছেন সেমিনারে। অথচ রফিক চৌধুরীকে তিনি পনেরোটা বেত মারার নির্দেশ দেন। এটা একটা রহস্য। এর কারণ কেউ বুঝতে পারেনি।

শহীদ বলল, রফিক চৌধুরী সম্পর্কে কিছু বলুন এবার।

মি. সিম্পসন বললেন, যুবক। সিনেমার হিরোদের মত নিখুঁত চেহারা। পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে সজাগ দৃষ্টি। এর আগে কখনও কোন অপরাধ করেনি সে, ওই ডাকাতিই তার প্রথম অপরাধ। ব্যক্তিগত জীবনে একজন শিল্পী, ওয়েল এডুকেটেড। কিন্তু যতদূর জানা যায়, তার আসল নাম রফিক চৌধুরী নয়। নাম তার যাই হোক, পুলিসের খাতায় তার নাম নেই।

ডাকাতি করল কোথায়, কিভাবে?

মি. সিম্পসন পাইপে ঘন ঘন কয়েকবার টান দিলেন বটে কিন্তু ধোঁয়া বের হলো না দেখে ঠোঁট থেকে নামালেন সেটা। বললেন, বলছি।

পাইপে অগ্নিসংযোগ করে ধোয়া ছাড়লেন গলগল করে, ডাকাতির অভিযোগ আনা হয় রফিকের বিরুদ্ধে ঠিক, কিন্তু এখানেও সন্দেহের ছায়া আছে।

পাইপ তুলতে যাচ্ছিল শহীদ ঠোঁটে, হাতটা স্থির হয়ে গেল ওর, জিজ্ঞেস করল, কি রকম?

নিউ বেইলী রোডের একটা সুন্দর স্টেশনারি দোকানে ডাকাতিটা ঘটে। দুবছর আগের এই মাঘ মাস, সময়টা সন্ধ্যা। গাঢ় কুয়াশা ছিল সেদিন। দোকানে ছিল একা দোকানদার। দোকানদার বুড়ো চোখে কম দেখে। সিগারেট কেনার নাম করে এক লোক তার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। বুড়ো সিগারেট দিচ্ছিল, লোকটা এই সময় তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর লাফ মেরে দোকানে উঠে একটা কাঁচের বোতল দিয়ে বুড়োকে বেশ কবার আঘাত করে। বুড়ো জ্ঞান হারায়। দোকানের ক্যাশ-ড্রয়ার থেকে খোয়া যায় দশ এবং পঞ্চাশ টাকার নোটের একটা বাণ্ডিল। নোটের বাণ্ডিলটা কাগজে ভাল ভারে মোড়া ছিল। পরদিন সকালে দোকানদার ওই টাকা ব্যাঙ্কে জমা দেবে বলে কাগজ দিয়ে মুড়ে রেখেছিল। প্যাকেটে ছিল নয় হাজার টাকা।

রফিক চৌধুরীকে পুলিস নোটের বাণ্ডিল হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রায় অন্ধকার রাস্তায়। পুলিসকে দেখেই সে প্যাকেটটা ফেলে দিয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সফল হয় না, ধরা পড়ে সে পুলিসের হাতে। রফিক চৌধুরী দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল ওই এলাকা থেকে, এমন সময় ধরা পড়ে সে। তার বক্তব্য ছিল, একা রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল সে, এমন সময় দোকানটার দিক থেকে একটা বুড়ো লোকের চিৎকার ভেসে আসে। কি করা উচিত ঠিক করতে না পেরে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। খানিক পর ছুটন্তু পদশব্দ শুনতে পায়। একপাশে সরে দাঁড়াবার আগেই সে দেখে একজন লোক তার কাছে চলে এসেছে। লোকটাকে ভাল করে দেখার সুযোগ পায়নি ও। লোকটা ছুটে পালাবার সময় একটা প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দেয়। প্যাকেটটা তার পায়ের কাছে এসে পড়ে। প্যাকেটটা তুলে নেয় সে। এমন সময় পুলিসকে ছুটে আসতে দেখে প্যাকেটটা ফেলে দিয়ে ছুটতে শুরু করে সে এবং প্রায় সাথে সাথে ধরা পড়ে।

মি. সিম্পসন থামেন। ঘনঘন টান দেন পাইপে। নীলচে ধোয়া ছাড়েন এবং আবার মুখ খোলেন।

বিচার চলাকালে কয়েকটা ব্যাপার সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রফিক চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো তেমন শক্ত ছিল না। বুড়োর কথাই ধরো। ডাকাত রফিক চৌধুরীই কিনা সন্দেহাতীতভাবে সনাক্ত করতে পারেনি সে। জুরিরা। প্রমাণাদির ওপর যতটা না জোর দিয়েছিল তার চেয়ে বেশি জোর দিয়েছিল রফিক চৌধুরীর খিটখিটে মেজাজের ওপর। তাছাড়া, জজ সাহেবের দ্বারা তারা সবাই ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়। রফিক চৌধুরীর আচরণ জুরিদেরকে বিরক্ত ও অসন্তুষ্ট করে চরমভাবে। তাকে কেন শাস্তি দেয়া হবে না-এই প্রশ্নের উত্তরে সে লোদী। সাহেবকে বলে, আপনি শুধু বোকা আর সেকেলে নন, আপনি অযোগ্য এবং অনুপযুক্তও বটে। আপনাকে আমি দেখে নেব। শেষ কথাটা নিশ্চয়ই হুমকি, তাই না? তবে, লোদী সাহেব যখন বেত্রাঘাতের কথা ঘোষণা করেন, রফিক অসুস্থ হয়ে পড়ে, প্রায় জ্ঞান হারাবার মত অবস্থা দাঁড়ায় তার।

শহীদ বলল, কিন্তু মি. সিম্পসন, ব্যাপারটা যেন কেমন লাগছে আমার কাছে। রফিক চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রমাণাদি যা ছিল, তাতে শান্তি হয় না। আমি জানতে চাইছি, আপীল করেনি সে?

না, রফিক আপীল করেনি। শাস্তি ঘোষণা করার পর একটা কথাও উচ্চারণ করেনি সে। কি জানো, এই রফিক সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী অনেক কথা অনেকে বলে। কেউ বলে ছোকরা জাত হারামি, পেটে পেটে প্যাচানো বুদ্ধি, আবার কেউ বলে নির্দোষ, আদর্শবান সৎ ছেলেটাকে অকারণে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। ঢাকা জেলে ছিল সে। জেলের ডাক্তার এবং সুপারিনটেন্ডেন্টের ধারণা, রফিক অত্যন্ত নিরীহ, ভদ্র এবং বুদ্ধিমান যুবক। অপর দিকে ইন্সপেক্টর তৈয়ব আলির ধারণা, রফিক একনম্বরের। বজ্জাত, ইচড়ে পাকা শয়তান একটা। সে যাই হোক, আঠারো মাসের জায়গায় পনেরো মাস জেল খাটে সে। শুড়-কণ্ডাক্ট-এর জন্যে তিনমাস কমিয়ে দেয়া হয় শাস্তি।আজ থেকে ছয় সপ্তাহ আগে জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে সে।

ছাড়া পাবার পরও কি সে লোদী সাহেবকে হুমকি দেয়?

মি. সিম্পসন বললেন, না। ইন্সপেক্টর তৈয়ব তার বিরুদ্ধে অভিযোগ খাড়া করেছিল। রফিক জেল থেকে ছাড়া পাবার পর তৈয়ব একজন সিভিল ড্রেস পরা ওয়াচারকে তার ওপর নজর রাখার জন্যে নিযুক্ত করে। অল্প কিছুদিন চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখা হয় রফিকের ওপর। কিন্তু তার আচার-ব্যবহারে তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখা যায়নি বলে তার ওপর নজর রাখার দরকার নেই মনে করে ইন্সপেক্টর তৈয়ব উঠিয়ে নেয় ওয়াচ। এরপর আর কোন ঘটনা ঘটেনি। হঠাৎ করে, গতকাল বিকেলে, ইন্সপেক্টর তৈয়ব একটা ফোন কল পায়। ফোন করে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি। সে ফোনে জানায়, অবৈধ এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে রফিক চৌধুরী এই মাত্র একটা আগ্নেয়াস্ত্র কিনেছে। এই যে, এইটা!

তেপয়ের উপর রাখা দুটো আগ্নেয়াস্ত্রের মধ্যে আইভর-জনসন .৩৮ রিভলভারটা আঙুল দিয়ে দেখালেন মি. সিম্পসন।..

শহীদ হাত বাড়িয়ে তুলে নিল রিভলভারটা। পরীক্ষা করে দেখল, ম্যাগাজিন থেকে ছয়টার মধ্যে মাত্র একটি বুলেট খরচ করা হয়েছে।

ফোন কল পেয়ে ইন্সপেক্টর তৈয়ব লোকজন পাঠিয়ে দেয় চারদিকে, রফিক চৌধুরীকে ধরে আনার জন্যে। এদিকে, আমি আমার চেম্বারে বসে গল্প করছিলাম। কামালের সাথে। রফিক চৌধুরী আগ্নেয়াস্ত্র কিনেছে, তাকে ধরার জন্যে ইন্সপেক্টর লোক পাঠিয়েছে–এসব তখনও জানি না। এমন সময় ফোন এল।  

কার ফোন? শহীদের প্রশ্ন।

মি. সিম্পসন বললেন, জজ লোদী সাহেবের সাথে আমার বেশ ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। তাঁর বাড়িতেও বেশ কবার গেছি আমি। সেই সূত্রে তার মেয়েদের সাথেও পরিচয় হয়। ফোন করেছিল লোদী সাহেবের ছোট মেয়ে, শাহানারা। হিস্টিরিয়াগ্ৰস্তা রোগিণীর মত চিৎকার করছিল শাহানারা ফোনে। সে বলে, রফিক চৌধুরী বাবাকে খুন করার জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠেছে, আপনারা কিছু করুন এই মুহূর্তে।

কামাল কোন ফাঁকে ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, ওরা কেউ, লক্ষ করেনি। ট্রে হাতে মহুয়া ঢুকল ভিতরে, জিজ্ঞেস করল, সেই ব্যাড এলিমেন্টটা কোথায় গেল আবার?

শহীদ এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, আরে তাই তোত কোথায় গেল কামাল?

সকলের অগোচরে সবজান্তার মত মাথা নাড়ল মহুয়া, ট্রে নামিয়ে রেখে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল সে ড্রয়িংরূম থেকে। করিডর ধরে এগিয়ে গিয়ে বাক নিল সে, দাঁড়াল লাইব্রেরীর বন্ধ দরজার সামনে।

লাইব্রেরীর ভিতর থেকে অদ্ভুত সব শব্দ বেরিয়ে আসছে। অস্পষ্ট শব্দ। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল মহুয়া। চিন্তার রেখা ফুটে উঠল তার কপালে। কেউ যেন ফোঁস ফোঁস করে হাঁপাচ্ছে। দুপদাপ শব্দও হচ্ছে।

মাথা নিচু করে কী-হোলে চোখ রাখল মহুয়া। লাইব্রেরীর বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে। কামাল নেই কোথাও। তবে।

হাসি চেপে রাখা কঠিন হয়ে উঠল মহুয়ার পক্ষে। কী-হোল দিয়ে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে কুয়াশাকে। তার দাদা লাইব্রেরীর মেঝেতে বিছানো নরম কার্পেটে দুই হাঁটু আর দুই হাত দিয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে। কুয়াশার পিঠের উপর একটা স্কেলকে ছড়ির মত করে ধরে বসে আছে শহীদের একমাত্র পুত্র সন্তান রুবিন। মাত্র বছর দেড়েক বয়স রুবিনের। ইতিমধ্যেই মামার উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে সে।– কুয়াশার মাথার পিছনে স্কেল দিয়ে টুকটুক করে বাড়ি মারছে রুবিন। আর জিভ দিয়ে টট টট শব্দ তুলে ঘোড়ারূপী মামাকে আরও জোরে দৌডুবার হুকুম দিচ্ছে।

সিধে হয়ে দাঁড়াল মহুয়া। মামা-ভাগ্নের কাণ্ড দেখে হাসি চেপে রাখা কঠিন, তাড়াতাড়ি সরে পড়া দরকার। কিন্তু কামাল কোথায় গেল তাহলে? আবার ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়াল সে।

ড্রয়িংরূমে তখন মেলা শোরগোল।

.

০৩.

মহুয়া ট্রে রেখে ড্রয়িংরূম থেকে বেরিয়ে যেতেই করিডরে ছুটন্ত পদশব্দ এবং স্যানন ডি. কস্টার আর্তনাদ ভেসে এল।

মুহূর্তে থমথমে হয়ে উঠল মি: সিম্পসনের মুখের চেহারা। তিনি জানতে চাইলেন, মি. ডি. কস্টা না?

শহীদ উত্তর দেবার আগেই কামাল ডি. কস্টার একটা সরু হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ড্রয়িংরূমে প্রবেশ করল, আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনছিল। আমি বেরুতেই দৌড়ে পালাচ্ছিল, সিঁড়ি থেকে ধরে এনেছি।

মি. সিম্পসন নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, কামাল, ছেড়ে দাও ওকে। তবে দরজার কাছে পাহারায় থাকো। মি. ডি. কস্টা, আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব, আশা করি উত্তর দেবেন।

ডি. কস্টাকে ছেড়ে দিল কামাল। ডি কস্টা তার ডান হাতের কব্জি বা হাত দিয়ে মেসেজ করতে করতে বলল, উট্রর ডিব কি ডিব না টাহা ডিপেন্ড করে হাপনার কোশ্চেনের উপর।

মি. সিম্পসন কঠিনদৃষ্টিতে ডি. কস্টার আপাদমস্তক দেখে নিলেন একবার। তারপর বললেন, এদিকে ঘুরঘুর করছিলেন কি মনে করে?

উট্রর ডিব না। হোয়াট ইজ ইওর সেকেণ্ড কোশ্চেন?

মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, আমি কুয়াশার সন্ধান চাই। কোথায় সে?

ডি. কস্টা ঠোঁট বাঁকা করে একটু হাসল। বলল, আপনি কি কানা নাকি? হামার, ফ্রেও মি. কুয়াশা টো আপনার চোখের সামনেই রহিয়াছেন, ডেকিটে পাইটেছেন না?

এক পা এগুলেন মি. সিম্পসন ডি. কস্টার দিকে। সবিস্ময়ে বললেন, হোয়াট?– কি বললেন?

ডি. কস্টা হাসছে দাঁত বের করে।

কামাল ঢোক গিলল। শহীদের দিকে তাকাল একবার আড়চোখে। এমন সময় মহুয়া এসে ঢুকল ড্রয়িংরূমে।

কারও মুখে কোন কথা নেই।

বলিলাম, মি. কুয়াশা আপনার চোখের সামনেই রহিয়াছেন। আপনি কানা টাই টাহাকে ডেকিটে পাইটেছেন না।

মি. সিম্পসন ঝট করে তাকালেন শহীদের দিকে।

শহীদ মৃদু হাসল, বুঝতে পারছি না। আপনি ওকেই চেপে ধরুন, যদি বের করতে পারেন ধাঁধার উত্তর।

ডি. কস্টার দিকে আরও এক পা এগোলেন মি. সিম্পসন। ডান হাতটা কোটের পকেটে ঢুকে গেছে তার।

পরিষ্কার করে বলুন, কোথায় সে?

ডি. কস্টা বলল, টিনি ছদ্মবেশ নিয়া আছেন, টাই আপনি টাহাকে চিনিটে পারিটেছেন না।

গর্জে উঠলেন মি. সিম্পসন, কই! কোথায়? দেখিয়ে দিন আমাকে?

ডি. কস্টা বলল, ডেকাইয়া ডিব? কি ডেকাইয়া ডিলে আপনি যডি সাটে সাটে গুলি করেন?

একশোবার করব। আপনি শুধু বলুন কোথায় সে!

ডি. কস্টা বলল, কি হাপনি বিশ্বাস করিবেন না।

 বিশ্বাস করব না? নিশ্চয়ই বিশ্বাস করব!

ডি. কস্টা আঙুল তুলে বলল, ঠিক টো?

ঠিক।

ডি. কস্টা নিজের বুকের উপর আঙুল ঠুকতে ঠুকতে বলল, এই বাঙাই মি. কুয়াশা, ছড্ডবেশে আছি!

কী! আমার সাথে ঠাট্টা! বলেই লাফ দিয়ে পড়লেন মি. সিম্পসন। কিন্তু ডি. কস্টা তার আগেই ক্যাঙ্গারুর মত লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে গেছে রূমের বাইরে, সেখান থেকে সিঁড়ির দিকে ছুটতে ছুটতে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে সে, ফর গডস্ সেক, হামিমি, কুয়াশা নহি হামাকে গুলি করিবেন না…!

করিডর থেকে ড্রয়িংরূমে ঢুকে মি. সিম্পসন বিকট কণ্ঠে বললেন, দেখলে শহীদ! লোকটার স্পর্ধা দেখলে? আমার সাথে কেমন ঠাট্টা করে গেল?

শহীদ হাসি চেপে বলল, কিন্তু আপনিই বা হঠাৎ এমন অস্থির হয়ে উঠলেন কেন কুয়াশার খোঁজ পাবার জন্যে?

মি. সিম্পস সোফায় বসলেন। বললেন, কেসটার সাথে কুয়াশা জড়িত থাকতে পারে, শহীদ। অকারণে বলছি না কথাটা। আমি অনেক আগে থেকেই জানি, লোদী সাহেবের সাথে কুয়াশার পরিচয় ছিল। লোদী সাহেবই একদিন আমাকে বলেছিলেন, আইনসংক্রান্ত জটিল সমস্যা দেখা দিলে তিনি কুয়াশার সাথে দেখা করেন কুয়াশা তাঁর সমস্যার সমাধান করে দেয়।

শহীদ বলল, পরিচয় ছিল, সে আমিও জানি। কিন্তু সম্পর্কটা ছিল বন্ধুত্বের মত, তাই না? কুয়াশা বন্ধুকে খুন করবে, এ আপনি ভাবলেন কিভাবে? কুয়াশা বন্ধুত্বের মর্যাদা দেয়–এ তো আপনিও ভালভাবে জানেন।

জানি। কিন্তু বন্ধুত্ব শেষ পর্যন্ত ছিল কিনা তা জানি না।

শহীদ বলল, কুয়াশা একবার যাকে বন্ধু বলে গ্রহণ করে তাকে কখনও শত্রুর তালিকায় ফেলে না, মি. সিম্পসন। বন্ধু শত্রুতে পরিণত হলেও কুয়াশা তাকে ক্ষমা করে। এ সবই তো আপনার জানা।

কামাল মন্তব্য করল, আমরা কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক আলোচনায় সময় নষ্ট করছি।

মি. সিম্পসন বললেন, ঠিক, শহীদ, কুয়াশার ব্যাপারে পরে কথা বলব আমি। কাহিনীটা বলি আবার। হ্যাঁ, কোন পর্যন্ত যেন বলেছিলাম?

শহীদ বলল, লোদী সাহেবের ছোট মেয়ে শাহানারা ফোন করুল, ফোন পেয়ে আপনারা কি করলেন?

মি. সিম্পসন পাইপে টোবাকো ভরতে শুরু করলেন। কামাল পট থেকে উত্তপ্ত কফি ঢালার কাজে হাত লাগাল।

মহুয়া একসময় নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছে রূম থেকে।

মি. সিম্পসন বলতে শুরু করলেন ধীরেসুস্থে, আগেই বলেছি, কামাল আমার সাথে গল্প করছিল চেম্বারে বসে। রিসিভার রেখে দিয়ে ওকে বললাম, চলো, জজ লোদী সাহেবের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি একবার। রফিক চৌধুরী নাকি তাঁকে খুন করার জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। কামাল কথাটা শুনেই একলাফে উঠে দাঁড়াল। আমরা দুজন নিচে নেমে এসে একটা জীপে চড়লাম। স্টার্ট দিলাম আমি।.

 পাইপে অগ্নিসংযোগ করে ধোয়া ছাড়লেন তিনি। তুলে নিলেন কফির একটা কাপ, চুমুক দিলেন ছোট ছোট করে পর পর কবার, বললেন, শহীদ, বাড়িটার আকার আকৃতি সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। লোদী সাহেবের নতুন বাড়ি এটা, বোধহয় যাওনি কখনও ওখানে, নাকি গেছ?

যাইনি।

বাড়িটাকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে দশ ফিট উঁচু, মসৃণ একটা কংক্রিটের পাঁচিল। পাঁচিলের কোথাও কোন খাজ, গর্ত ইত্যাদি কিছুই নেই। পাঁচিলের মাথায় ভাঙা কাঁচের টুকরো ঢোকানো, চোর-টোর যাতে উঠতে না পারে। পাঁচিলের বাইরে দশ গজের মধ্যে কোন গাছপালা নেই। বাড়ির ভিতর ঢোকার পথ মাত্র। দুটো। সদর গেট-এবং, পিছনের খিড়কি। সদর গেটে রাতদিন চব্বিশ ঘন্টা একজন দারোয়ান থাকে। গেটের কাছেই একটা ছোট ঘরে থাকে সে। লোকটা প্রৌঢ়, নাম রমজান মিয়া। জীপ গেটের সামনে থামতে সে-ই গেট খুলে দেয়। তখন সাড়ে পাঁচটার মত বাজে। সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে, চারদিক প্রায় অন্ধকার। বাইরে এখন যেমন বৃষ্টি হচ্ছে, গতকাল তখনও এইরকম বৃষ্টি পড়ছিল ঝির ঝির করে।

শহীদ পা দুটো লম্বা করে দিয়ে নড়েচড়ে বসল। আড়চোখে তাকাল একবার লাইব্রেরী রূমে ঢোকার মধ্যবর্তী বন্ধ দরজাটার দিকে। ব্যাপারটা লক্ষ করল কামাল। কিন্তু শহীদের মুখের চেহারায় কোনরকম ভাবান্তর লক্ষ করল না সে।

মি. সিম্পসন বলে চলেছেন, দারোয়ান রমজান মিয়া আমাদের বলল, জজ সাহেব তার রেস্টহাউজে আছেন। মূল বিল্ডিং থেকে রেস্টহাউজটা দুশো গজ দূরে। রেস্টহাউজটা আকারে ছোট। মাত্র দুটো রূম। দুই রূমের মাঝখানে একটা লম্বা হলরুম। লোদী সাহেব একটি রূমকে লাইব্রেরী হিসেবে ব্যবহার করতেন। তিনি যে তার লাইব্রেরী রূমে আছেন, দারোয়ান সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিল। লোদী সাহেব নাকি তার এক পুরানো বন্ধুর জন্যে অপেক্ষা করছিলেন, দুজন বৈকালিক চা পান। করবেন বলে। সাড়ে তিনটের সময় গেটে ফোন করে তিনি কথাটা বলে রেখেছিলেন রমজান মিয়াকে, তার বন্ধু এলে, রজমান মিয়া যেন তাকে রেস্টহাউজে পাঠিয়ে দেয়।

মি. সিম্পসন বিরতি নেবার জন্যে থামলেন। মৃদু একটু হাসলেন তিনি শহীদের দিকে তাকিয়ে। বললেন, অ্যাকশন শুরু হতে যাচ্ছে! এখন থেকে যা বলব, খুব মন দিয়ে শুনতে হবে তোমাকে।

শহীদ পাইপ টানতে টানতে বলল, বলে যান।

বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরে আমরা এগোতে শুরু করি। জীপ রেখে, পায়ে হেঁটে। সোজা, আমাদের সামনে রেস্ট হাউজটা দেখতে পাচ্ছিলাম। রেস্টহাউজের প্রায় চারদিকেই ঝোঁপঝাড় আর গাছপালা আছে। তবে কোন ঝোঁপ বা কোন গাছই রেস্টহাউজের দশ-বারো ফিটের মধ্যে নেই। রেস্টহাউজের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা দরজা। দরজার মাথার উপর একটা বালর জ্বলছিল। দরজাটা খোলাই ছিল। খোলা দরজা পথে দেখা যাচ্ছিল স্বল্পালোকিত হলরুম। খোলা দরজার বাঁ দিকে লাইব্রেরী রূমের দেয়াল। দেয়ালের গায়ে দুটো জানালা। দুটো জানালার একটি বন্ধ, অপরটি খোলা। খোলা হলেও, ভারি পর্দা ঝুলছিল। তবে মৃদু আলোর আভাস পাচ্ছিলাম আমরা, পর্দার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছিল।

হলরুমে ঢোকার দরজাটা পুরোপুরি খোলা ছিল?

মি. সিম্পসন শহীদের প্রশ্নের উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। খোলা দরজা পথে আমরা হলরুমের ভিতর ভাস্কর্য মূর্তিগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। এমন সময়, হঠাৎ করে খেলাম লম্বা একটা লোক আমাদের কাছ থেকে দশ কি পনেরো গজ সামনের একটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে খোলা দরজার দিকে তীরবেগে ছুটতে শুরু করেছে। ঠিক এই সময় বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেল। চোখেমুখে বর্শার মত বৃষ্টির ফোঁটা বিঁধছিল। সেই সাথে মেঘের ডাক, বিদ্যুতের ঝলকানি। লোকটা দরজার কাছে। পৌঁছে গেছে, এমন সময় চারদিক দিনের মত আলোকিত হয়ে উঠল। বিদ্যুতের আলোয় দেখলাম লোকটা আমাদের দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চিনতে পারলাম তাকে, রফিক চৌধুরী।

থামলেন কেন, বলে যান!

আবার মি. সিম্পসন বলতে শুরু করলেন, আমাদেরকে দেখেই রফিক তার প্যান্টের পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে ফেলল। কিন্তু আমাদেরকে গুলি করার কোন চেষ্টাই সে করেনি। লাফ দিয়ে খোলা দরজা দিয়ে হলরূমে ঢুকল সে। ছুটল লাইব্রেরীতে ঢোকার দরজার দিকে।

কামাল বলল, এক মিনিট। একটা কথা বলতে ভুলে গেছেন আপনি, মি. সিম্পসন। রফিককে দেখেই আমি চিৎকার করে উঠি, দাঁড়াতে বলি তাকে, এবং তার দিকে দৌড়তে শুরু করি।

মি. সিম্পসন বললেন, ঠিক। ধন্যবাদ, কামাল। হলরূমের বাঁ দিকে লাইব্রেরী রূমে ঢোকার দরজা। রফিক সেদিকে ছুটছিল। কামাল ছুটছিল হলরুমের দরজার দিকে। আমিও ছুটছিলাম। কিন্তু কামাল আমার অনেক আগে ছিল। তখনও চিৎকার: করে ডাকছিল ও রফিককে। ওর চিৎকারেই জজ, লোদী সাহেব একমাত্র খোলা। জানালার পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে বাইরে তাকান। জানালাটা হলরুমে ঢোকার দরজার কাছ থেকে মাত্র হাত দশেক দূরে। শহীদ, তোমাকে বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছি এই জন্যে যে, গোটা ঘটনাটায় কোনরকম জটিলতা বা ব্যাখ্যাতীত রহস্য কিছু ছিল না সেটা বোঝাবার জন্যে। জানালা দিয়ে যিনি উঁকি দিলেন তিনি যে জজ লোদী সাহেব তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তাকে দেখেই আমি চিনতে পারি। সেই মুহূর্তে দিব্যি সুস্থ এবং জীবিত ছিলেন তিনি। তাঁর প্রকাণ্ড টাক পড়া মাখাটা চকচক করছিল বিদ্যুতের আলোয়। তিনি বিরক্তির সাথে হক ছেড়ে জানতে চাইলেন, কে ওখানে? পরমুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি রূমের দিকে, যেন কোন শব্দ শুনে শব্দের উৎস জানার জন্যে জানালার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালেন।

ঘুরে দাঁড়ালেন কেন?

ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে লক্ষ করলাম, রাগ রাগ ভাব ফুটে উঠল তার চেহারায়। ঘুরে দাঁড়ালেন কেন? রফিক লাইব্রেরী রূমের দরজা খুলে লাইব্রেরীতে ঢুকে পড়েছিল ঠিক সেই সময়। ঢুকে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয় সে। দরজা, বন্ধ করার শব্দ পেয়েই জজ সাহেব ঘাড় ফিরিয়ে দেখেন, তারপর ঘুরে দাঁড়ান।

মি. সিম্পসন থামতেই কামাল শুরু করল, আমি ধাওয়া করছিলাম রফিককে। লাইব্রেরীতে ঢোকার একটি মাত্র দরজা, সেটি হলরূমের দেয়ালে 1. রফিককে। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। লাইব্রেরীতে ঢোকার দরজাটা ভেজানো ছিল। রফিক সবেগে ছুটে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল সেটা। ভিতরে লাফিয়ে ঢুকল সে, সাথে সাথে ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল দরজা। কী-হোলে সম্ভবত চাবি ছিল, দরজা বন্ধ করেই চাবি ঘুরিয়ে তালা লাগিয়ে দেয় সে। মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড পর আমি দরজার সামনে পৌঁছুই। মি. সিম্পসন, এর পরের ঘটনা আপনি বলুন।

লাইব্রেরী রূমে সহজে পৌঁছুতে হলে জানালা গলে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করাই উত্তম, বুঝতে পারলাম আমি। তাই পাকা রাস্তা ছেড়ে আমি ঘাসের উপর নামলাম। তখনও ছুটছি। কোনাকুনিভাবে, জানালার দিকে। জানালার কাছ থেকে যখন আমি বিশ কি বাইশ কদম দূরে, ঠিক তখন গুলির শব্দ কানে ঢুকল। তারপর জানালার কাছ থেকে যখন আমি দশ কদম দূরে, তখন শুনলাম দ্বিতীয় গুলির শব্দ।

সোফায় সিধে হয়ে বসল শহীদ। জানতে চাইল, কি বললেন? দ্বিতীয় গুলির  শব্দ শুনলেন?

মি. সিম্পসন বললেন, হ্যাঁ, শহীদ। দ্বিতীয় গুলির শব্দ শুনলাম। কালো কাপড়ের ভারি পর্দা ঝুলছিল বনে লাইব্রেরী রুমের ভিতরটা দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি। কসেকেণ্ড পর জানালার সামনে পৌঁছুলাম আমি। হাত দিয়ে পর্দা সরালাম। দেখলাম, জানালার কাছ থেকে হাত তিনেক দূরে, বা দিকে, ডেস্কের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন লোদী সাহেব। কোমরের নিচের অংশটা ঝুলছে, পা দুটো মাটিতে ঠেকে আছে। বোঝা যায়, ডেস্কের সামনে পঁড়িয়ে ছিলেন, গুলি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন ডেস্কের ওপর। রূমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল রফিক, হাতে উদ্যত রিভলভার, আইভর-জনসন। হতভম্ব, বোকা বোকা দেখাচ্ছিল তাকে। হিংস্র বা উত্তেজিত নয়, অস্থির বা আতঙ্কিত নয়, এমন কি মুষড়ে পড়া। ভাবও তার মধ্যে দেখলাম না। অপরাধ ঘটিয়ে ফেলে অপরাধীরা আশ্চর্য সব কাণ্ড করে। কেউ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে, কেউ ভয়ে ছুটোছুটি শুরু করে দেয়, কেউ আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে–কিন্তু রফিকের মধ্যে এসবের কোনটাই দেখলাম না। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে আছে। জানালা গলে যখন ভিতরে ঢুকলাম, আমাকে যেন সে দেখতেই পেল না। এগিয়ে গিয়ে প্রথমেই আমি তার হাত থেকে আইভর-জনসনটা নিয়ে নিলাম। বাধা দিল না সে এতটুকু। এরপর আমি রূমের একমাত্র দরজার দিকে পা বাড়ালাম। কামাল তখনও দরজার গায়ে ঘুসি মারছিল। দরজা খুলে দিয়ে আমি লোদী সাহেবের লাশের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।

লোদী সাহেবের অর্ধেক দেহ ডেস্কের ওপর, বাকি অর্ধেক ঝুলছিল। ডেস্কের ওপর চাইনীজ ড্রাগনের মত দেখতে একটা টেবিল-ল্যাম্প, পঁচিশ ওয়াটের বাল জুলছিল সেটার ভিতর। শেড থাকায় বালবের আলো শুধুমাত্র ডেস্কের উপরই পড়ছিল। গোটা রূমে এই একটাই বালব জলছিল। লোদী সাহেবের বাঁ দিকে, ডেস্কের পাশেই রাখা ছিল একটা ডিষ্টাফোন। রাবারের কাভারটা ভোলা ছিল। লোদী সাহেব মারা গেছেন গুলি লাগার দুচার সেকেণ্ড পরই। বুকের বাম দিকে গুলি লাগে তার, গুলি করা হয় কাছাকাছি দূরত্ব থেকেই। গুলির শব্দ হয়েছিল দুটো। দুটো বুলেটেরই অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হলো। একটি বুলেট দিয়ে লোদী সাহেব নিহত হয়েছেন, সেটা তার শরীরের ভিতর। অপর বুলেটটি ডিক্টফোনের স্পীকিং টিউবের মুখটাকে ভেঙে দিয়ে ছুটে গিয়ে বিঁধেছে দেয়ালের ভিতর। পরে এই বুলেটটা আবিষ্কার করি আমি এবং দেয়াল থেকে বের করি।

শহীদ বলল, লাইব্রেরী রূমটা সম্পর্কে বিস্তারিত বলুন আমাকে।

বলছি। বেশ বড়, চারকোনা রূম। লেদার চেয়ার আর বুক-কেস দিয়ে সাজানো। উত্তর দিকে, বুক-কেসের আড়ালে উঁচু একটা ইলেকট্রিক ফায়ার মেশিন ছিল।

ইলেকট্রিক ফায়ার মেশিন?

মি. সিম্পসন বললেন, হ্যাঁ, বাংলাদেশে সাধারণত শীত তেমন পড়ে না, তাই ফায়ারপ্লেস বা ইলেকট্রিক ফায়ার মেশিনের দরকার হয় না। কিন্তু গত বছর লণ্ডন থেকে বেড়িয়ে ফেরার সময় মেশিনটা কিনে আনেন লোদী সাহেব। সে যাক, মেশিনটা অন্ করা ছিল। উত্তর দিকের দেয়ালে কোন জানালা বা দরজা নেই। পশ্চিম দিকের দেয়ালে দুটো জানালা, দরজা নেই। ভিতর থেকে দুটো জানালাই বন্ধ, ভারি কাঠের শাটার লাগানো, শাটারে আবার তালা মারা। দক্ষিণ দিকের দেয়ালে কোন দরজা নেই, আছে কেবল দুটো জানালা। দুটোর একটি বন্ধ, শাটার লাগানো, এবং শাটারে তালা মারা। অপরটি খোলা, কালো কাপড়ের ভারি পর্দা ঝোলানো। এই জানালাটা দিয়েই আমি ভিতরে প্রবেশ করি। এবং এই জানালাটা সর্বক্ষণ আমার দৃষ্টির মধ্যে ছিল। রূম থেকে বেরুবার আর একটি মাত্র পথ হলো, দরজা। একটিই দরজা। এবং সেই দরজার ওপর নজর ছিল সর্বক্ষণ কামালের, রফিক রূমে ঢুকে দরজায় তালা মারার পর থেকে।

বিরতি নিয়ে মি. সিম্পসন বললেন, দুয়ে দুয়ে চারের মতই সহজ কেস? রফিককে আমরা রূমের ভিতর পাই লাশসমেত। আর কেউ রূমে ছিল না। থাকলে তার পক্ষে কোনক্রমেই পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। রূমের ভিতর কেউ লুকিয়েও ছিল না, থাকলে সার্চ করার সময় ধরা পড়তই সে। আমি এবং কামাল তন্নতন্ন করে গোটা রূমটা সার্চ করি। কোন গোপন পথ, গর্ত বা অন্য কিছু নেই, ছিল না। কি দাঁড়াল তাহলে? রফিক চৌধুরী দুটো গুলিই করেছে, একটি ব্যর্থ হয়েছে, অপরটি লোদী সাহেবের বুকে বিঁধেছে। ব্যর্থ বুলেটটি বিঁধেছে দেয়ালে খুবই সহজ সরল ব্যাপার। কোন জটিলতা নেই, কোন রহস্য নেই। কিন্তু গণ্ডগোল হয়ে গেল সব যখন আমি রুটিন চেকের জন্যে রফিকের আইভর-জনসন রিভলভারটা চেক করতে, গেলাম। রিভলভার খুলে সিলিণ্ডার চেক করতে গিয়ে দেখি, মাত্র একটি, আই রিপিট, মাত্র একটি বুলেট খরচ হয়েছে আইভর-জনসন থেকে। ছয়টা বুলেটের মধ্যে পাঁচটাই রয়েছে রিভলভারের সিলিণ্ডারে। তারমানে, আইভর-জনসন থেকে দুটো নয়, মাত্র একটি বুলেট ছোঁড়া হয়েছে।

উপভোগ্য কাহিনী, সন্দেহ নেই।

মি. সিম্পসন বললেন, প্রথমে, শহীদ, আমরা নিজেদের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারলাম না। অবশ্যই, রফিক লাইব্রেরীতে ঢুকে গুলি করতে পারে প্রথমে একবার, তারপর সাবধানে এবং দ্রুততার সাথে সিলিণ্ডার খুলে ব্যবহৃত কাটিজ কেস ফেলে দিয়ে তার জায়গায় নতুন একটা বুলেট পুরে আবার গুলি করতে পারে, দ্বিতীয়বার। সেক্ষেত্রে পাঁচটি বুলেটই থাকার কথা আইভর-জনসনে।

রাবিশ!

 ঠিক বলেছ! পাগল ছাড়া কে অমন কাণ্ড করতে যাবে? সিলিণ্ডারে পাঁচ-পাঁচটা বুলেট থাকা সত্ত্বেও কেউ কি নতুন করে বুলেট ভরে রিভলভারে? ভরে না। তাছাড়া, যদিও ওরকম করে থাকে রফিক, প্রশ্ন ওঠে, এক্সট্রা খোলটা তাহলে কোথায়? রূম সার্চ করে পাইনি আমরা কোন এক্সট্রা খোল। রফিককেও আমরা সার্চ করি পাওয়া যায়নি।

রফিকের বক্তব্য কি?

মি. সিম্পসন পকেট থেকে একটা নোটবুক বের করলেন। বললেন, তাৎক্ষণিক প্রশ্নগুলোর উত্তর আমি লিখে রেখেছিলাম। পড়ছি, শোনো।

প্রশ্ন: গুলি করে খুন করলে তাহলে জজ সাহেবকে শেষ পর্যন্ত, কেমন?

উত্তর: জানি না।

 প্রশ্ন: জানি না মানে? গুলি করেছ, অস্বীকার করছ নাকি?

উত্তর: গুলি করেছি ওর দিকে। তারপর অদ্ভুত কিছু একটা ঘটনা ঘটে গেছে। কি ঘটেছে তা আমি বলতে পারব না, বুঝতে পারিনি আমি।

প্রশ্ন: পর পর দুবার গুলি করেছ তুমি, তাই না?

উত্তর: না, দুবার গুলি করিনি। আমি মাত্র একবারই গুলি করেছি। ঠিক জানি না আমার গুলিটা ওর লেগেছে কিনা, তবে আমার গুলিতে ও পড়েও যায়নি, বা টলেও ওঠেনি…।

প্রশ্ন: তুমি কি বলতে চাইছ, গুলি মাত্র একটাই করা হয়েছে?

উত্তর: তা বলছি না। গুলি দুটোই হয়েছে। শব্দ শুনেছি আমি। কিন্তু দুটো গুলি আমি করিনি। কে করেছে, কোত্থেকে করেছে, কিছু বুঝতে পারিনি!

প্রশ্ন: কোনটা ছেড়ো তুমি? দ্বিতীয়টা, না প্রথমটা?

উত্তর: প্রথমটা। রূমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াই আমি, সাথে সাথে গুলি করি। শয়তানের বাচ্চাটা জানালার দিক থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াচ্ছিল, ঠিক তখনই আমি গুলি করি।

প্রশ্ন: তুমি বলতে চাও এই রূমে তুমি ছাড়াও আর একজন ছিল, এবং সেই দ্বিতীয় গুলিটা করেছে?

উত্তর: আমি জানি না।  

প্রশ্ন: তুমি কাউকে দেখেছ রূমে ঢোকার পর?

উত্তর: না। ডেস্কে ছাড়া রূমের আর কোথাও আলো নেই, অন্ধকারে ভাল দেখতে পাচ্ছিলাম না।

প্রশ্ন: এই রূমে কেউ যদি থাকত, সে-ই যদি গুলি করত-তোমার চোখে কি সে ধরা পড়ত না? আলো রূমের সর্বত্র সমান হারে নেই ঠিক, কিন্তু একেবারে অন্ধকার তো নয় কোন অংশই।

উত্তর: জানি না আমি। যা জানি, আপনাকে আমি তাই জানাবার চেষ্টা করছি মাত্র। বুড়ো শয়তানটাকে গুলি করি আমি, কিন্তু সে আহত হয়নি। আমার দিকে এগিয়ে আসছিল, দুহাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে। এমন সময় দ্বিতীয় গুলির শব্দ পাই আমি। শয়তানটা দাঁড়িয়ে পড়ে সাথে সাথে দুহাতে বুক চেপে ধরে। তারপর আরও দুপা সামনে বাড়ে টলতে টলতে, তারপর মুখ থুবড়ে পড়ে যায় ডেস্কের উপর। 

প্রশ্ন : দ্বিতীয় গুলিটা কোন্ দিক থেকে ছুটে আসে?

 উত্তর: আমি জানি না।

.

০৪.

 মি. সিম্পসন নোটবুক বন্ধ করে পকেটে ভরলেন। পাইপে অগ্নিসংযোগ করে কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে ধুম্র উদ্‌গিরণ করলেন চুপচাপ, তারপর বললেন, এই সময়, কামাল একটা জিনিস আবিষ্কার করল। পশ্চিম দিকের দেয়ালের কাছে ঘুর ঘুর করছিল ও। উত্তর-পশ্চিম কোণে, চীনা মাটির একটা ফ্লাওয়ার ভাস দাঁড়িয়ে ছিল। সেটার পিছন দিকে তাকাতে দেখতে পায় ও খালি একটা কাট্রিজ কেস।

কামাল কথা বলে উঠল এবার, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আইভর-জনসন ৩৮ রিভলভার থেকে যে বুলেটটা ছোঁড়া হয়েছে এটি সেই বুলেটের কান্ট্রিজ কেস। কিন্তু মি. সিম্পসনকে দেখাতেই তিনি বললেন, না, এটা ৩৮ রিভলভারের কান্ট্রিজ কেস হতেই পারে না।

মি. সিম্পসন বললেন, দেখেই বুঝতে পারি আমি, ওটা ৩৮-এর না, ওটা .৩২ অটোমেটিক-এর কান্ট্রিজ কেস। এরপর আমরা দুজন ফ্লাওয়ার ভাসের ভিতরেকাই। এবং এটা পাই।

মি. সিম্পসন তেপয়ের উপর রাখা আইভর-জনসন রিভলভারের পাশের আগ্নেয়াস্ত্র ব্রাউনিং .৩২ অটোমেটিকটি আঙুল দিয়ে দেখালেন শহীদকে। …

ভাসের তলায় পড়েছিল অটোমেটিকটা। ফ্লাওয়ার ভাসটা হাত আড়াই লম্বা, : তার ভেতর কেউ ফেলে দিয়েছিল। হাত ঢুকিয়ে নাগাল পাওয়া গেল না। লোদী। সাহেবের ছাতার বাকানো হাতল দিয়ে তুলে ফেললাম আমি ব্রাউনিংকে। ব্যারেল নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে শ্বাস নিতেই বারুদের গন্ধ পেলাম। ক্লিপে একটি বুলেট নেই দেখলাম। সেই বুলেটেরই কার্টিজ কেস ভাসের আড়াল থেকে কুড়িয়ে পায় কামাল। কার্টিজ কেসটা তখনও একটু একটু উত্তপ্ত ছিল। অর্থাৎ, বুঝলে শহীদ, দ্বিতীয় গুলিটা যে ব্রাউনিং অটোমেটিক থেকে করা হয়েছে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ দেখলাম না। শুধু তাই নয়, প্রমাণ হয়ে গেল সেই সাথে, রূমের ভিতর দাঁড়িয়েই দ্বিতীয় গুলিটা করেছে কেউ ওই ৩২ ৰাউনিং দিয়ে গুলি করার পর সে ব্রাউনিংটা ফেলে দেয় ভাসের ভিতরে।

কোন্‌ বুলেটটা লোদী সাহেবকে আঘাত করে?

মি. সিম্পসন অদ্ভুতভাবে হাসলেন। বললেন, ওখানেই গণ্ডগোল, শহীদ। লোদী সাহেব কোন বুলেটের দ্বারা খুন হয়েছেন তা আমরা এখনও জানতে পারিনি।

শহীদ তীক্ষ্ণকণ্ঠে প্রশ্ন করল, জানেন না? কেন, খুব সহজেই তো তা জানা ভব! বুলেট ছোঁড়া হয় মাত্র দুটো। একটা ৩৮ অপরটি ৩২। একটি বুলেট লোদী সাহেবের বুকে বিদ্ধ হয়। অপরটি দেয়ালে। দেয়ালের বুলেটটা বের করেছেন আপনি, বলেছেন খানিক আগে আপনি। সেটা .৩৮, না, ৩২?

পকেট থেকে একটা সাদা এনভেলাপ বের করলেন মি.. সিম্পসন। এনভেলাপের মুখ খুলে সেটাকে উপুড় করে ধরলেন তেপয়ের উপর।

খট করে চ্যাপ্টা এক টুকরো সীসা পড়ল কাঠের তেপয়ের উপর।

দেয়ালের ভিতর থেকে এটা পাওয়া গেছে। শক্ত ইটের দেয়াল, বুলেটটা প্রেশার খেয়ে কেমন চ্যাপ্টা হয়ে গেছে দেখো। দেখে বলা মুশকিল এটা কোন রিভলভার থেকে বেরিয়েছে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এটা ৩৮ রিভলভারের বুলেট। অফিশিয়ালি এখন কিছুই বলব না, পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত। ডাক্তার ইদ্রিস আজ সকালে পোস্টমর্টেম সারবেন। রিপোর্ট পাব খানিকক্ষণের মধ্যেই, আশা করছি।

শহীদ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করল। তারপর প্রশ্ন করল মি. সিম্পসনের উদ্দেশে, বাউনিংয়ে হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি?

না। তবে রফিকের হাতে দস্তানা ছিল।

আপনি কি মনে করেন রফিকই দুটো হ্যাণ্ডগান থেকে দুবার গুলি করেছিল?

মি. সিম্পসন বললেন, একটা সম্ভাবনা বৈকি। সে হয়তো দুটো আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে লাইব্রেরীতে ঢুকেছিল। পুলিসকে ধোকা দেবার জন্যে সে হয়তো অভিনয় করছে, বলছে, দ্বিতীয় গুলি সম্পর্কে যেন কিছুই জানে না।

শহীদ বলল, কিন্তু আমার তা মনে হয় না। এই পদ্ধতিতে সে যদি ধোকা দিতে চাইত, তাহলে আগে থেকে সে কোন একটা পথ খোলা রাখার ব্যবস্থা করত, যে পথে কেউ পালাতে পারে। কারণ, পুলিসের মৃনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে, দ্বিতীয় গুলি যে ছুঁড়েছে,.সে পালাল কোন্ পথে? পুলিস এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না পেলে তাকে ছাড়বে না, সে এটুকু অন্তত জানে।

মি. সিম্পসন বললেন, ঠিক। তাছাড়া, অনেকে বলছে বটে রফিক অভিনয় করছে কিন্তু আমার তা মনে হয় না। তার চোখেমুখে যে বিস্ময়ের ভাব আমি দেখেছিলাম, তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম অভিনেতার পক্ষেও অভিনয়ের মাধ্যমে দেখানো সম্ভব নয়। কিন্তু, অপরদিকে, প্রকৃত ঘটনাই বা কি হতে পারে? কি বিশ্বাস করব, আমরা? রূমটা বাক্সের মত সীল করা। দুটো পথ ছাড়া বেরুবার কোন উপায় নেই। একটি পথের সামনে ছিল কামাল, অপরটির সামনে আমি। রূমের ভিতর ছিল একমাত্র রফিক। কি দাঁড়াচ্ছে? দুটো গুলিই ছুঁড়েছে রফিক-ধরে না নিয়ে আর কোন উপায় আছে কি? রফিক ছাড়া আর কে?

বিকল্প একটা ব্যাখ্যা আছে। দেখতে পাচ্ছেন না?

 পাচ্ছি, মি. সিম্পসন বললেন।

 শহীদ বলল, বিকল্প ব্যাখ্যা সম্পর্কে কি ধারণা আপনার?

বিকল্পটা হলো, রফিক হয়তো কাউকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এমন হতে পারে, ধরা যাক, রূমের ভিতর আর একজন কেউ ছিল, তার কাছেই ছিল ব্রাউনিং অটোমেটিকটা। রফিক রূমে ঢুকে গুলি করল কিন্তু তার গুলি ব্যর্থ হলো। এক্স, যাকে আমরা চিনি না, দ্বিতীয় গুলিটা করল এবং তার গুলি বিদ্ধ হলো লোদী সাহেবের বুকে। কামাল ছিল দরজায়, আমি ছিলাম দক্ষিণ দিকের জানালায়, সুতরাং এক্স পশ্চিম দিকের একটা জানালা খুলে রূম থেকে বেরিয়ে গেল। এবং রফিক সেই জানালার কবাট বন্ধ করল, শাটার বন্ধ করল এবং শাটারের তালা বন্ধ করল।

শহীদ বলল, সুতরাং ধরা যাক, রফিক লোদী সাহেবকে খুন করেনি। এখন দেখা যাক, কোথাও এমন কেউ আছে কিনা যে লোদী সাহেবকে খুন করতে চায়? বাড়ির লোকজন বা বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে কেউ কি…?

বাড়ির মধ্যে লোকজন কম। বিপত্নীক ছিলেন তিনি। স্ত্রী মারা গেছেন বছর পাঁচেক আগে। দুই মেয়ে। বড় মেয়ে, ছাব্বিশ, নাম ইলোরা। ছোট মেয়ে, চব্বিশ, শাহানারা। বাড়িতেই থাকে আরও একজন, মেয়েদের সিরু কাকা ওরফে সিরাজ সাহেব। বয়স ষাটের উপর। লোদী সাহেবের লিগ্যাল ক্লার্ক বা সেক্রেটারি। এছাড়া। আছে চাকর-বাকর, দারোয়ান।

বন্ধু-বান্ধব?

ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে একজনই। তিনি বিখ্যাত ব্যারিস্টার সুফী সরফরাজ খান সাহেব। গতকাল তারই রেস্টহাউজে চা পান করতে আসার কথা ছিল।

শহীদ বলল, সুফী সরফরাজ খান? তিনি দেশের সবচেয়ে বড় ক্রিমিন্যাল লইয়ার।

হ্যাঁ, পুলিস যতগুলো ওয়েল-প্রিপেয়ার্ড কেস দাঁড় করিয়েছে, মি. সরফরাজ তার প্রায় প্রত্যেকটি বানচাল করে দিয়ে, অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে নিয়ে গেছেন। অত্যন্ত উপযুক্ত এবং ধুরন্ধর আইনবিদ।

তিনি কি চা পান করতে এসেছিলেন?

না। দেরি হয়ে গিয়েছিল, তাই লোদী সাহেবের কাছে ক্ষমা চাইবার জন্যে ফোন করেছিলেন। কিন্তু তখন লোদী সাহেব বেঁচে নেই।

শহীদ জানতে চাইল, বাড়ির প্রত্যেকের জবানবন্দী নেয়া হয়েছে কি? আপনি বলেছেন, ছোট মেয়েটা অর্থাৎ শাহানারা আপনাকে ফোন করে জানায়, রফিক তার বাবাকে খুন করার জন্যে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। রফিককে সে ব্যক্তিগতভাবে চেনে?

চেনে। শাহানারার সাথে কথাও বলেছি আমি। গতকাল বাড়িতে একমাত্র ওর সাথেই কথা বলার সুযোগ পাই আমি। বড় মেয়েটি, ইলোরা, এবং বুড়ো কেরানী সিরু কাকা সে-সময় বাড়িতে ছিল না।

শাহানারাকে আপনি কি জিজ্ঞেস করেছিলেন, রফিককে কতটুকু চেনে সে? রফিকের সাথে তার সম্পর্কটা কি পর্যায়ের?

খুটিয়ে প্রশ্ন করা সম্ভব ছিল না। খুব মুষড়ে পড়েছিল সে বাবার মৃত্যুতে। আমার প্রশ্নের উত্তরে সে বলে, রফিককে মোটামুটি চিনি, তবে খুব একটা পছন্দ করি না তাকে, যদিও রফিক আমার সাথে সবসময় ভাল ব্যবহার করে এসেছে এ পর্যন্ত। শাহানারা আরও বলে, একটা ক্লাবে পরিচয় হয় তার সাথে রফিকের। লা লেজুয়ান ক্লাবে। উল্লেখ করা দরকার, এই ক্লাবে নিয়মিত যাতায়াত করে বড় মেয়েটি, ইলোরা। তবে, শহীদ, আমার ধারণা, ইলোরা বা শাহানারা, হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে এদের দুজনের কেউই কোনভাবে জড়িত নয়।

শহীদ বলল, কিন্তু একটু আগে আপনি স্বীকার করেছেন, কাউকে রক্ষা করবার জন্যে রফিক অভিনয় করছে, এটা একটা সম্ভাবনা।

স্বীকার করেছি নাকি? না, ব্যাপারটা তা নয়, শহীদ। আমি আলোচনার স্বার্থে কথাটা ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু আসলে, ওরকম কিছু ঘটা সম্ভব নয়।

কেন?

গুলির আগে বা পরে দক্ষিণ দিকের জানালা আমার দৃষ্টিসীমার মধ্যে ছিল। গুলির আগে বা পরে ওই জানালা দিয়ে কেউ ঢোকেনি বা বেরিয়ে আসেনি। রূমের একমাত্র দরজা, সেখানে ছিল কামাল। আর পথ কই? পশ্চিম দিকের জানালা দুটো অবশিষ্ট থাকে, তাই না? কিন্তু দারোয়ান রজমান মিয়ার কাছ থেকে আমরা পরে জানতে পারি, গত একবছরের মধ্যে পশ্চিম দিকের দুটো এবং দক্ষিণ দিকের অপর একটি জানালায় কেউ হাত দেয়নি। হাত যে সত্যি কেউ দেয়নি, তার প্রমাণ আমরাও পাই। মরিচা ধরে এমন আঁটা হয়ে গেছে শাটার এবং কবাটের কজা যে আমি এবং কামাল, দুজন গায়ের জোরে, ঝাড়া দশ মিনিট টানাটানি করার পর খুলতে সমর্থ হই একটি মাত্র জানালা। প্রত্যেকটি জানালা খুলতে রীতিমত গলদঘর্ম হতে হয় আমাদেরকে। সুতরাং কেউ জানালা খুলে পালিয়ে গেছে, রফিক তারপর জানালা বন্ধ করে দিয়েছে-এ অসম্ভব!

শহীদ পাইপে টোবাকো ভরার জন্যে তেপয় থেকে কৌটা তুলে নিতে নিতে বলল, তার মানে ঘুরে ফিরে আবার সেই একই জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছি আমরা।

ঠিক তাই, শহীদ। চারকোনা রূমটার একদিকে কোন জানালা নেই, একদিকে একটি মাত্র দরজা, আর একদিকে দুটো জানালা, সর্বশেষ দিকে আরও দুটো জানালা। মোট চারটে জানালার একটি মাত্র খোলা। সেটা আমার পাহারায় ছিল। একটি মাত্র দরজা, সেটির পাহারায় ছিল কামাল। বাকি থাকে তিনটে জানালা, যেগুলোর যে কোন একটি খুলতে দশ মিনিট করে সময় লাগে। সুতরাং, আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য যে রফিক চৌধুরীই দুটো গুলি ছুঁড়েছে–তা না হলে, অলৌকিক শক্তি এই ঘটনার সাথে জড়িত, ধরে নিতে হয়।

ক্রিং ক্রিং।

হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলল কামাল ক্রেডল থেকে। কয়েক সেকেণ্ড পর রিসিভারটা বাড়িয়ে দিল সে শহীদের দিকে, অপরিচিত এক মহিলা, তোর সাথে কথা বলতে চাইছেন।

রিসিভার নিয়ে শহীদ কানে ঠেকাল। হ্যাঁ, হুঁ, ঠিক আছে, এখুনি, বেশ-ছোট ছোট কিছু শব্দ উচ্চারণ করে রিসিভারটা যথাস্থানে নামিয়ে রাখল শহীদ।

প্রশ্ন করল মি সিম্পসনকে, রফিক এখন কোথায়? নিশ্চয়ই জেল হাজতে? 

হ্যাঁ।

শহীদ বলল, ছেলেটার সাথে আমি কথা বলতে চাই। একা ওকে কি এখানে কিছুক্ষণের জন্যে একবার আনানো যায় না?

মি. সিম্পসন বললেন, কাজটা ঠিক আইনসঙ্গত নয়। তবে একান্তই যদি প্রয়োজন বলে মনে করো তুমি

প্রয়োজন তো বটেই। তবে এখন নয়, পরে। কামাল, গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাক। মেহমান মেহমান না বলে মক্কেল বলাই ভাল, পাঁচ মিনিটের মধ্যে তসরিফ আনছেন!

মক্কেল আসছেন? কে? মি. সিম্পসন অবাক হয়ে জানতে চান।

শহীদ বলল, মিস শাহানারা। এবং তার সাথে প্রখ্যাত ব্যারিস্টার সুফী সরফরাজ খান সাহেবও আসছেন।

.

০৫.

ব্যারিস্টার সুফী সরফরাজ খানের বয়স পঞ্চাশ হলেও, দেখে মনে হয় পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ। প্রায় ছয়ফুট লম্বা তিনি। ইংরেজদের মত গায়ের রঙ। চঞ্চুনাসা। পরনে দামী ট্রপিক্যাল কাপড়ের কমপ্লিট স্যুট। শহীদের ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলেন গভীরভাবে, হাতে সুগন্ধী হ্যাঁভানা চুরুট থেকে নীলচে ধোয়া উঠছে।

ড্রয়িংরূমে ব্যারিস্টারের পিছু পিছু ঢুকল শাহানারা। প্রথম দর্শনেই মেয়েটাকে অপরূপ সুন্দরী বলে সার্টিফিকেট দেয়া চলে। সে যে চলনে বলনে আচারে ব্যবহারে আধুনিকা, তা বোঝা যায় মুখের সপ্রতিভ ভাব, হাতকাটা ব্লাউজ, পিন দিয়ে শরীরের সাথে আঁট করে জড়ানো দামী শিফন, সুরুচির নিদর্শন কারুকার্যময় ভ্যানিটি ব্যাগ এবং উঁচু হিলওয়ালা পায়ের জুতা দেখেই।

মি. সিম্পসনকে দেখে একটু যেন অবাক হলো শাহানারা, কিন্তু প্রায় সাথে সাথে সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল সে, মি. সিম্পসন, আপনাকে এখানে আশা করিনি। যাক, ভালই হলো। তামি যে কারণে এখানে এসেছি, তা আপনারও জানা দরকার।

সকলের সাথে করমর্দন সেরে ওরা আসন গ্রহণ করল।

ব্যারিস্টার সরফরাজ খান বললেন, মি. শহীদ, লোদী সাহেবের পারিবারিক বন্ধু হিসেবে আমি শাহানারার সাথে এখানে এসেছি। শাহানারা কিছু তথ্য পেতে আগ্রহী…

শাহানারা ব্যারিস্টারকে বাধা দিয়ে থামিয়ে দিল, বলল, না, ঠিক তা নয়। মি. শহীদ, খোলাখুলি বলছি আমি। আমি এসেছি আপনার সাহায্য চাইতে।

শহীদ বলল, বলুন, কিভাবে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি?

আমাকে নয়, সাহায্য দরকার রফিকের।

কামাল এবং মি. সিম্পসন চমকে উঠে দুজনে একযোগে উচ্চারণ করল, রফিকের সাহায্য দরকার?

শাহানারা দুজনের কারও দিকে না তাকিয়ে শহীদের চোখে চোখ রেখে বলল, রফিকের সাহায্য দরকার। কারণ, আমার বিশ্বাস, পুলিস তাকে অকারণ সন্দেহে গ্রেফতার করেছে। আমার বিশ্বাস, বাবাকে সে খুন করেনি।

ব্যারিস্টারকে অপ্রতিভ দেখাল একটু।

শহীদ তার উদ্দেশেই প্রশ্ন করল, ঘটনা সম্পর্কে বিশদ জানা আছে আপনার, মি. খান?

কাগজে যা পড়েছি, তার বেশি এখনও বিশেষ কিছু জানার সুযোগ ঘটেনি আমার। শাহানারা এখানে আসছে শুনে ওকে সঙ্গ দেবার জন্যে চলে এসেছি আমি। সে যাই হোক, মি. শহীদ, আমি শুধু জানতে চাই, রফিক চৌধুরীই যে হত্যাকারী এ ব্যাপারে কি তেমন কোন সন্দেহ আছে?

শহীদ প্রশ্নটা নিয়ে খানিক ভাবল। তারপর বলল, আছে বৈকি, তবে এ সন্দেহটাকে আনরীজনেব ডাউট বলতে চাই আমি। ভাল কথা, মিস শাহানারা, আপনাকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।

বেশ তো।

শহীদ বলল, কিছু মনে করবেন না, রফিক চৌধুরীর প্রতি আপনার কি বিশেষ কোন দুর্বলতা আছে?

না না! ভুল বুঝবেন না আমাকে, প্লীজ, মি. শহীদ। হৃদয়ঘটিত কোন সম্পর্ক ওর সাথে আমার নেই। ওকে সম্ভবত আমি একটু অপছন্দই করি। তবে আমার সাথে আশ্চর্য ভাল ব্যবহার করে এসেছে ও সবসময়। হয়তো সেজন্যেই ওর এই বিপদে আমি স্থির থাকতে পারছি না।

শহীদ বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, ডাকাতির দায়ে ওর শাস্তি হয়েছিল? ডাকাতি করতে গিয়ে এক অসহায় বৃদ্ধকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলে।

জানি! কিন্তু বিশ্বাস করি না। পুলিস আসল ডাকাতকে ধরতে না পেরে নিরীহ, রফিককে ধরে হাজতে ভরে। রফিককে আমি যতটা চিনি, তার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া, জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ও নিজে আমাকে বলেছিল, অকারণে ওকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। মি. শহীদ, আপনি জানেন না, কিন্তু আমি জানি, রফিক একটা আদর্শবান ছেলে। ওর মত ভাল মানুষ আমার জীবনে আমি আর দেখিনি। যুদ্ধকে ঘৃণা করে ও, মারামারি সমর্থন করে না, মহাত্মা গান্ধীর ভক্ত ও। একটা গোপন সংস্থার সক্রিয় সদস্য ও সংস্থার নীতি হলো, পৃথিবীতে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে, শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে, মানুষকে না খেয়ে মরতে দেয়া চলবে না, ধনী লোককে আরও ধনী হতে দেয়া চলবে না–ইত্যাদি। আপনিই বলুন, যে ছেলে এই সব মহৎ উদ্দেশ্যের জন্যে রাতদিন খাটাখাটনি করে, তার পক্ষে ডাকাতি করা কি সম্ভব?

হু। কতদিনের পরিচয় তার সাথে আপনার?

বছর তিন চার হবে।

কি করে সে?

সে একজন শিল্পী।

শহীদ বলল, আর মাত্র একটা প্রশ্ন। আপনি বলছেন, আপনার বিশ্বাস, রফিক আপনার বাবাকে খুন করেনি। অথচ আপনিই মি. সিম্পসনকে ফোন করে বলেছিলেন:..

হ্যাঁ, বলেছিলাম। তবে সত্যি সত্যি সে খুন করতে যাচ্ছে তা ভেবে ফোন করিনি আমি। ঘটনাটা ব্যাখ্যা করে বললে বুঝতে পারবেন। আসলে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম আমি। হয়েছিল কি, গতকাল সাড়ে তিনটে এবং চারটের মধ্যে রাস্তায় দেখা হয়েছিল আমার সাথে রফিকের। চারটে বা আরও কিছু আগে থেকে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছিল, তাই না? মতিঝিলের কাছাকাছি লাভলি রেস্টুরেন্টের কাছে ওকে আমি দেখতে পাই। মাথা নিচু করে হনহন করে হাঁটছিল ও। দেখে মনে হচ্ছিল রাগে ফায়ার হয়ে আছে। গাড়ি দাঁড় করিয়ে ডাকি ওকে। কাছে আসে, কিন্তু কথা বলতে অস্বীকার করে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেও কোন উত্তর দিতে রাজি হয় না। লাভলি রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছিল, ওকে বললাম, চা খাবে নাকি? অনেক করে বলতে রাজি হলো। রেস্টুরেন্টে ঢুকে বসতে না বসতে, ফেটে পড়ল ও, বাবাকে যা-তা বলে গালমন্দ করতে শুরু করল। এর আগে রফিককে আমি রাগতে দেখিনি। সুতরাং ভয় পেয়ে যাই আমি। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। শেষ পর্যন্ত বলি, তুমি যদি না থামো, বাধ্য হব আমি চলে যেতে। পাল্টা জবাব দিয়ে বলে ও, যাও! কিন্তু যাবার আগে শুনে যাও, তোমার বাবাকে আজ আমি খুন করবই। রেস্টুরেন্টে ওকে রেখে আমি গাড়িতে ফিরে আসি। ওখান থেকে পাবলিক লাইব্রেরীতে যাই, একটা বই নিয়ে সোজা ফিরে আসি বাড়িতে। গেটে দারোয়ান রমজান ছিল, তাকে আমি সাবধান করে দিয়ে বলি, কেউ যেন বাড়ির ভিতর ঢুকতে না পারে। রমজানকে কথাটা বলে নিজের রুমে চলে। আসি। কিন্তু রফিকের শেষ কথাটা কোনমতে মন থেকে সরাতে পারিনি। অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকি। তখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল, বৃষ্টির বেগ বেড়ে গিয়েছিল পরিবেশটা আমাকে আরও অস্থির এবং আতঙ্কিত করে তোলে। তারপর একসময়, কি করছি না করছি না ভেবেই ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে ডায়াল করি, মি. সিম্পসনকে বলি…

শহীদ বলল, বুঝেছি। আচ্ছা, আপনার বাবা কি রফিককে চিনতেন?

একটু ইতস্তত করল শাহানারা, চিনতেন বৈকি। জানতেনও আমি রফিকের সাথে মেলামেশা করি।

নিশ্চয়ই পছন্দ করতেন না?

না। কিন্তু কারণটা জানি না। তবে আমার উপস্থিতিতে রফিকের সাথে বাবার সাক্ষাৎ হয়নি কখনও।

শহীদ প্রশ্ন করল, তাহলে, আপনি কি মনে করেন রায় দেবার সময় আপনার বাবা ব্যক্তিগত অপছন্দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন? ঠিক আছে, এ প্রশ্নটার উত্তর না দিলেও চলবে। আপনাদের পারিবারিক বন্ধু, মি. খান, চান না আপনি এ প্রশ্নের উত্তর দেন। ভাল কথা, আপনি কি জানেন, রফিক স্বীকার করেছে যে দুটোর মধ্যে একটি গুলি সে-ই ছুঁড়েছে?

শাহানারার চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে উঠল, না তো! কী আশ্চর্য! সে যদি নিজেই স্বীকার করে থাকে!

না, আপনার বাবাকে সে খুন করেছে একথা স্বীকার করেনি। তার বক্তব্য, সে যে গুলিটা করে সেটা আপনার বাবাকে স্পর্শ করেনি। সমস্যা ওখানেই।

শহীদ সংক্ষেপে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করে শোনাল, তারপর বলল, সুতরাং বুঝতেই পারছেন, পুলিস রফিককেই অভিযুক্ত করবে, অন্য কাউকে খুনী বলে সন্দেহ করার মত পাওয়া না গেলে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তেমন কাউকে পাওয়া যাবে না। আপনার বাবাকে খুন করতে পারে, এমন কেউ আছে বলে মনে করেন আপনি?

বাবাকে খুন করতে পারে এমন কেউ? নাহ! পৃথিবীতে তেমন লোক আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। বাবা আদর্শ মানুষ ছিলেন, তাঁকে সবাই শ্রদ্ধা করত, ভালবাসত।

পারিবারিক জীবনে তিনি কি কারও বিরূপতার কারণ ছিলেন?

শাহানারা সবিস্ময়ে বলল, কি বলছেন আপনি, মি. শহীদ? বাবা অন্য ধরনের মানুষ ছিলেন। জীবনে তিনি আমাদের দুবোনকে কখনও ধমক মারেননি। বাবা সর্বক্ষণ আদর্শ, মহত্ত্ব, মানবতা-ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। স্বীকার করি, তিনি প্রায় প্রত্যেকদিনই আমাদেরকে একত্রিত করে বক্তৃতা মত দিতেন। ভবিষ্যৎ পৃথিবীটাকে কিভাবে স্বর্গতুল্য করে তোলা যায়, সে ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব মতবাদ ছিল। ধৈর্য ধরে তার বক্তব্য শুনতে হত আমাদের। বাড়িতে আমরা সবাই এতে করে একটু অস্বস্তি বোধ করতাম, কিন্তু সে এমন কিছু নয়।

শহীদ ব্যারিস্টারের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি, মি. খান?

নাহ, লোদীর কোন শত্রু ছিল না। থাকতে পারে না।

শহীদ বলল, আর কিছু বলবার নেই আপনার?

অকস্মাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল তাঁর কণ্ঠস্বর, তেপয়ের উপর রাখা ব্রাউনিং অটোমেটিকটার দিকে আঙুল দেখিয়ে তিনি বললেন, ও, তাহলে দ্বিতীয় পুলিটা করা হয়েছে এই বাউনিং দিয়ে? বাহ, গোটা ব্যাপারটা চমৎকার মোড় নিল দেখছি। মি. শহীদ, আমি জানি না রফিক চৌধুরী গিল্টি অর নট গিল্টি। কিন্তু এখন আমি জানি, তার পক্ষ সমর্থনের জন্যে আমি রাজি হব না কারণ, এই ৩২ রাউনিং অটোমেটিকটার মালিক আমি স্বয়ং!

.

০৬.

 সুন্দরী শাহানারা বিস্ময়ের আতিশয্যে দুর্বোধ্য একটা শব্দ উচ্চারণ করে ঝুঁকে পড়ল ব্যারিস্টার সরফরাজ খানের দিকে।

ব্যারিস্টার সাহেব বিনাবাক্যব্যয়ে সোফা ত্যাগ করলেন। কোটের বুক পকেট থেকে রেক্সিন দিয়ে বাঁধাই করা একটা নোটবুক বের করলেন। নোটবুকের মত দেখতে হলেও জিনিসটা তা নয়।

নির্বিকার পাইপ টানছে শহীদ। একটু যেন কৌতুক বোধ করছে ও।

কামাল এবং মি. সিম্পসন বিস্মিত হয়ে পড়েছেন। ব্যারিস্টারের দিকে অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

ব্যারিস্টার হাতের জিনিসটা বাড়িয়ে দিলেন শহীদের দিকে, বললেন, মি. শহীদ, এই হলো আমার ব্রাউনিং অটোমেটিকের লাইসেন্স। সিরিয়াল নাম্বুর মিলিয়ে দেখুন, হুবহু মিলে যাবে।

শহীদ ঠোঁট থেকে পাইপ নামিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রশ্ন করল, মি. খান, আপনি কি স্বীকার করতে যাচ্ছেন লোদী সাহেবের হত্যাকারী আপনি নিজে?

ব্যারিস্টার সাহেবের ক্লিনশেভ মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। তিনি শহীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, গড লাভ আস, আই ডিড নট কিল হিম, ইফ দ্যাটস হোয়াট ইউ থিঙ্ক। লোদীকে আমি ভালবাসতাম। জানি, অসাধারণ একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি আমি। এখানে ঢোকার পরপরই ব্রাউনিংটাকে দেখে সন্দেহ হয় আমার। কিন্তু এতক্ষণ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে করছিলাম, আমারটার মত দেখতে, নিশ্চয়ই আমারটা নয় এটা। কিন্তু সিরিয়াল নাম্বার দেখে সব সন্দেহ দূর হয়ে গেছে। অটোমেটিকটা আমারই। শেষ বার এটাকে আমি দেখেছি আমার নিজ চেম্বারের ডেস্কে, বা দিকের সবচেয়ে নিচের দেরাজে।

রফিকের পক্ষে কি সেখান থেকে এটাকে চুরি করা?

ব্যারিস্টার সাহেব খানিক চিন্তা করলেন, তারপর জবাবে বলেন, মনে হয় না। প্রায় অসম্ভবই বলতে পারেন। রফিককে আমি চিনি না। আমার চেম্বারে কখনও সে যায়নি। তবে, সি কেটে বা গোপন কোন পদ্ধতিতে চুরি করে থাকলে, বলতে পারি না।

শেষ কবে দেখেছেন এটাকে?

এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারব না। দুঃখিত। বছর খানেকের মধ্যে ডেস্কের নিচের দেরাজটা খুলিনি আমি। কে জানে, বছর খানেক আগেই হয়তো চুরি হয়েছে এটা। আবার, দুচারদিন আগেও চুরি হয়ে থাকতে পারে।

কে চুরি করতে পারে? কাউকে আপনার সন্দেহ হয় কি? লোদী সাহেবের বাড়ির মানুষ কেউ?

সন্দেহ কাকে করব বলুন? তবে, পরিচিত অনেকেই আমার চেম্বারে যাতায়াত করে। তাদের মধ্যে যে কেউ চুরি করতে পারে।

শহীদ বলল, কিছু মনে করবেন না, মি. খান, আমি জানতে চাই গতকাল বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন?

সাড়ে তিনটে পর্যন্ত ছিলাম কোর্টে। ওখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। সাড়ে চারটের সময় লোদীর সাথে চা খাবার কথা ছিল। কিন্তু, দুর্ভাগ্যক্রমে, বাড়ি ফিরে আমার মুহুরির মুখে শুনলাম আমার এক বন্ধু ব্যারিস্টার জাহিদ হোসেন হাই প্রেশারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, এবং লেকসার্কাস মার্ডার মিস্টরির। আসামীদের দায়িত্ব আমাকে নেবার অনুরোধ জানিয়ে গেছে সে। মার্ডার কেসটা। খুবই জটিল, আশা করি সংবাদপত্রে এ সম্পর্কে পড়েছেন। কেসের ট্রায়াল ছিল আজ। মুহুরির মুখে সব শুনে লোদীর সাথে চা খাবার পরিকল্পনা বাতিল করে দিলাম। কোর্টে আসামীদের হয়ে লড়তে হলে ৰীফ নিয়ে বসতে হবে। তাই বলাম। চারটে থেকে ছটা পর্যন্ত ব্রীষ নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম আমি। দুটার পর হঠাৎ আমার মনে পড়ে লোদীর কথা। চাখেতে যাবার কথা অথচ যাইনি, সময়ও চাওয়া হয়নি–ব্যস্তভাবে ফোন করি লোদীর বাড়িতে…কিন্তু কাকে ফোন করব! লোদী তখন বেঁচে থাকলে তো!

চারটে থেকে ছয়টা পর্যন্ত, সব সময়, চেম্বারেই ছিলেন আপনি? আপনার এই বক্তব্যের পক্ষে সাক্ষী দেবেকেউ?

আউটার রূমে আমার মুহুরি ছিল। প্রায় ছয়টা পর্যন্তই ছিল সে। আমি ছিলাম ভিতরের চেম্বারে। আমার চেম্বার থেকে বেরুবার ওই একটাই পথ, মুহুরির রূমের ভিতর দিয়ে।

দাঁত দিয়ে পাইপ চেপে ধরে শহীদ সোফা ত্যাগ করল অকস্মাৎ। সামনের, দিকে একটু ঝুঁকে ও যেন একটু সম্মান প্রদর্শন করুল ব্যারিস্টার এবং শাহানারাকে, তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল, আর একটি অনুরোধ রাখব আপনাদের কাছে আমি। আপনাদের মূল্যবান আধঘণ্টা সময় আমাকে দান করতে হবে। আশা করি.. 

শাহানারা বলল, বুঝলাম না।

আপনারা পাশের স্টাডিরুমে মাত্র আধঘন্টার জন্যে অপেক্ষা করুন, আমরা জরুরী একটা কাজ সেরে নিই এই ফাঁকে, তারপর আবার আপনাদের সঙ্গে কথা বলব আমি।

ব্যারিস্টার খান কিছু যেন বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু শহীদ তাকে প্রতিবাদের সুযোগ না দিয়ে কামালের উদ্দেশে বলে উঠল, কামাল, মিস শাহানারা এবং মি. খানকে লাইব্রেরী রূমে পৌঁছে দিয়ে আয়।

কামাল সোফা ছেড়ে পা বাড়াল, বলল, আমার সাথে আসুন আপনারা, প্লীজ!

 অগত্যা কাঁধ ঝাঁকিয়ে ব্যারিস্টার খান কামালকে অনুসরণ করলেন। শাহানারাও।

কামাল লাইব্রেরী রূমের দরজার কাছে পৌঁছুবার আগেই, বন্ধ দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল।

ইনভ্যালিড চেয়ারে বসে রয়েছে কুয়াশা। মুখে স্মিত হাসি। চলমান চেয়ার নিয়ে লাইব্রেরী থেকে ড্রয়িংরূমে ঢুকল সে। সহাস্যে সকলের উদ্দেশে বলল, ডমর্নিং, অল অফ ইউ!

মি. সিম্পসন সোফা ত্যাগ করে এগিয়ে গেলেন সহাস্যে, হ্যালো, মি. আহমেদ! কেমন আছেন? মাত্র দুদিনের আলাপে.মনের ওপর এমন একটা ছাপ মেরে দিয়েছেন, আপনাকে আমি ভুলতেই পারছি না।

করমর্দন করল ওরা।

ব্যারিস্টার খান লাইব্রেরীতে ঢুকে পিছন ফিরে তাকালেন একবার, নিচু গলায় শাহানারার উদ্দেশে বললেন, ভদ্রলোক কে বলো তো? একটু যেন চেনা চেনা লাগছে?

শাহানারা বলল, আশ্চর্য সুন্দর চেহারাখানা, তাই না? বাঙালী পুরুষ এমন দেখা যায় না।

ভদ্রতাসূচক হাসি হেসে কামাল মধ্যবর্তী দরজাটা বন্ধ করে দিল ধীরে ধীরে।

শহীদ মুচকি হেসে বলল, মি. সিম্পসন, এবার আপনার ক্ষমতা কাজে লাগান। থানা হাজত থেকে রফিককে আনাবার ব্যবস্থা করুন।

মি. সিম্পসন বললেন, করছি ব্যবস্থা। মি. আহমেদ, আমার অনুরোধ, এই রহস্যময় কেসটা সম্পর্কে আপনিও একটু মাথা ঘামান। আপনাকে আমি এক ফাঁকে সংক্ষেপে সব শুনিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু তার আগে, ফোন করে রফিককে আবার ব্যবস্থা করি।

কামাল বলল, আমি যাই, মহুয়াদিকে চা দিতে বলি।

কামাল পা বাড়াল অন্দর মহলের দিকে। মি. সিম্পসন রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে শুরু করলেন থানায়।

শহীদ পাইপে টোবাকো ভরছে মাথা নিচু করে। একসময় চোখ তুলে তাকাল ও কুয়াশার দিকে। ইনভ্যালিড চেয়ারে বসে আছে সে। কোলের উপর পাঁচ সের ওজনের একটা মোটা বই। বইটা খোলা। কুয়াশা পড়ায় মগ্ন। মুচকি একটু হাসল শহীদ।

দুজন কনস্টেবল পনেরো মিনিটের মধ্যে হাজির হলো রফিক চৌধুরীকে নিয়ে। ত্রিশ-একত্রিশ বছর বয়স রফিকের। হ্যাণ্ডসাম। মুখটা মান হলেও, দুচোখে বুদ্ধির দীপ্তি। নিঃশব্দে ড্রয়িংরূমে ঢুকল সে। হাতে হাতকড়া লাগানো থাকলেও, দাঁড়াবার ভঙ্গিতে পরাজয়ের কোন লক্ষণ নেই।

বসুন। শহীদের কণ্ঠস্বর শুনে তাকাল রফিক। বসল একটা চেয়ারে। কনস্টেবল দুজন পঁড়াল তার দুপাশে।

 কোনরকম ভূমিকা না করে শহীদ সরাসরি প্রশ্ন করল, রেস্টহাউজে, আই মীন, লোদী সাহেবের লাইব্রেরী রূমে আসলে যা ঘটেছে, আপনি পরিষ্কার করে সব বলছেন না কেন?

রফিক বলল, আসলে কি ঘটেছে তা জানলে তো বলব! শয়তানটাকে গুলি করেছিলাম, জানিগুলি লাগেনি…ব্যস! এর বেশি আমি কিছু দেখিনি। তবে আরও একটা গুলির শব্দ শুনেছিলাম আমি। সেই গুলিটাই লাগে ওর। চেয়েছিলাম নিজের হাতে খুন করব শয়তানটাকে–কিন্তু মিস করি আমি।

কে খুন করেছে সেটাই আবিষ্কার করতে চাই আমরা। ভাল কথা, আপনি একজন আর্টিস্ট, তাই না?

আমি একজন পেইন্টার। শিল্পী বলে নিজেকে দাবি করি না।

শহীদ প্রশ্ন করল, আপনার রাজনৈতিক বিশ্বাস কি?

রফিক গড় গড় করে বলতে শুরু করল, সংঘর্ষে বিশ্বাস করি না। যুদ্ধকে ঘৃণা করি। আমরা এমন একটা পৃথিবী কায়েম করতে চাই যে পৃথিবীতে যুদ্ধ, হিংসা, নির্যাতন এবং অভাব থাকবে না।

কিভাবে, কোন পদ্ধতিতে তা সম্ভব?

অত্যাচারী শোষকদের উৎখাত করার মাধ্যমে তা অব। আমলাদের পদচ্যুত করে, ক্ষমতাবান অন্ধদের বিতাড়িত করে, রক্ষণশীল অভিভাবকদের জ্যান্ত কবর, দিয়ে তা সম্ভব।

জজ লোদী সাহেব কি রক্ষণশীল ছিলেন?

 রক্ষণশীলদের চূড়ামণি ছিল শয়তানটা।

 তার প্রতি এত ক্রোধ কেন আপনার?

রফিক বলল, অবাধ মেলামেশায় বিশ্বাস ছিল না তার। রক্ষণশীল ছিল। সবচেয়ে বড় কারণ, আমাকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করত না বলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমাকে বেত্রাঘাত এবং আঠারো মাসের জেলের হুকুম দেয়। এতে করে সমাজের চোখে সে আমাকে নষ্ট বলে প্রমাণ করে।

মিস শাহানারার সাথে আপনার সম্পর্ক কি?

তাকে চিনি। এইটুকুই সম্পর্ক। এই কেসে তাকে টেনে আনার কোন মানে হয় না। সে এ ব্যাপারে কিছুই জানে না।

শহীদ বলল, হু। আচ্ছা, এবার বলুন, গতকাল বিকেলে লোদী সাহেবের বাড়িতে আপনি ঢুকেছিলেন কিভাবে।

আমার সাথে শাহানারার দেখা হয় রাস্তায়। ও আমাকে চা খেতে নিয়ে যায় লাভলীতে। মেজাজ খারাপ ছিল, ওকে দেখে কি যে হলো, বলেই ফেললাম, তোমার বাবাকে আজ আমি খুন করতে যাচ্ছি। দুঃখ পায় ও, আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আমাকে রেস্টুরেন্টে রেখে বেরিয়ে যায় ও, যাবার সময় বলে যায়, পাবলিক লাইব্রেরীতে যাচ্ছে ও। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যাবার পর ওকে আমি ফলো করি। ও পৌঁছুবার মিনিট সাতেক পর আমি পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে পৌঁছাই। ওর গাড়িটা তখনও দাঁড়িয়েছিল, আশপাশে কেউ নেই দেখে আমি ওর গাড়ির পিছন দিকের বনেট খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ি। খানিক পর গাড়িতে এসে ওঠে শাহানারা। সোজা বাড়ি ফেরে ওখান থেকে। গ্যারেজে গাড়ি রাখে ও, বেরিয়ে যায়। খানিক পর গাড়ির পিছন থেকে আমিও বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু আমি জানতাম না ওর বাবা ঠিক কোথায় আছে। আধ ঘণ্টা সময় নষ্ট করি আমি এদিক ওদিক উঁকি মেরে। একটা জানালা দিয়ে তারপর টুকি বাড়ির ভিতর। শাহানারাকে একটা রূমের ভিতর বসে থাকতে দেখি আমি। কি যেন চিন্তা করছিল। আমাকে ও দেখতে পায়নি। জানালা দিয়ে গোপনে দেখছিলাম ওকে আমি। এই সময় বাটলার লোকটা রূমে ঢোকে, জানতে চায় শাহানারা চা খাবে কিনা।

বলে যান, বলে যান।

শাহানারা বলে, হ্যাঁ, চা খাব। তারপর সে বাটলারকে বলে, বাবার চা তৈরি করতে হবে না, কারণ, বাবা রেস্টহাউজে আছেন। মোটকথা, ওদের কথাবার্তা শুনেই আমি বুঝতে পারি, শয়তানটা কোথায় আছে। এরপর জানালা গলে আবার আমি বেরিয়ে আসি বাড়ির বাইরে, পা বাড়াই রেস্টহাউজের দিকে।

তখন কটা বাজে?

জানি না। ওখান থেকে সোজা আমি রেস্টহাউজের দিকে চলে যাই। দরজা দিয়ে হলরুমে ঢোকার আগেই দেখতে পাই মি. সিম্পসন এবং তার এক সঙ্গীকে ওই ওখানে। কামালকে দেখিয়ে দিয়ে কথা শেষ করল রফিক।

শহীদ বলল, ওরা আপনাকে দেখেন সাড়ে পাঁচটার সময়। বেশ, বলে যান। সবটা শুনতে চাই আমি।

এর আগে হাজার বার বলেছি আমি। তবু, ফের বলছি। দরজা পেরিয়ে আমি হলরুমে ঢুকি। লাইব্রেরীতে ঢোকার দরজাটা ওই হলরুমেই। দরজাটা খোলা কিনা। জানতাম না। কিন্তু ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকে বন্ধ করতে গিয়ে দেখি কী-হোলে চাবি ঢোকানো রয়েছে। দেরি না করে চাবি ঘুরিয়ে তালা লাগিয়ে দিই দরজায় আমি। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি বুড়ো শয়তানটা জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে, শব্দ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে আমার দিকে। আমি কয়েক পা এগিয়ে যাই, দাঁড়াই কামরার মাঝখানে, তারপর গুলি করি। …

এর মধ্যে তিনি কিছুই বলেননি?

বলেছিল, কি চাও…বা ওই ধরনের কিছু। জানালার কাছ থেকে এগিয়ে আসছিল সে, ডেস্কের দিকে। হাত দুটো সামনে বাড়িয়ে রেখে ছিল, আমার হাতে রিভলভার দেখে ভয়ে সম্ভবত। গুলি করলাম, কিন্তু সে থামল না। যেমন এগিয়ে আসছিল তেমনি এগিয়ে আসতে লাগল। ডেস্কের একেবারে কাছাকাছি চলে আসতে, আমাকে চমকে দিয়ে আর একটা গুলির শব্দ হলো। শয়তানটা বুক ধরে টলতে লাগল। তারপর মুখ থুবড়ে পড়ল ডেস্কের ওপর।

আচ্ছা, আপনি পিস্তল-রিভলভার চালাতে অভ্যস্ত?

না। এর আগে শখের বশে দুএকবার রাইফেল চালিয়েছি।

রূমের ভিতর আর কাউকে আপনি দেখেননি?

না।

মি. সিম্পসনের দিকে তাকাল শহীদ, একটা প্রশ্ন, মি. সিম্পসন। রূমের ভিতর এমন কোন যান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে কি যেটার সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পিস্তলের গুলি ছোঁড়া সম্ভব, মানুষের সাহায্য ছাড়াই?

একেবারে অসম্ভব, শহীদ। আমি আর কামাল রূমটা তন্নতন্ন করে খুঁজে, দেখেছি। গোপন পথ বা ওই ধরনের কোন কিছুর কথাও তুমি বাদ দিতে পারো, রূমের ভিতরে একটা ইঁদুরের গর্ত পর্যন্ত নেই। তা ছাড়া, বাউনিংটা পাওয়া গেছে রূমেরই ভিতর একটা ফ্লাওয়ার ভাসে, রূমের ভিতর থেকেই ওটা ব্যবহার করা হয়েছে।

শহীদ খানিক চিন্তা করার পর বলল, ঠিক। আমরা ধরে নিতে পারি দ্বিতীয় গুলিটা যে-ই করে থাকুক করেছে সে রূমের ভিতর থেকেই। রফিক চৌধুরী, বলুন। তো, আপনি যখন গুলি করেন, লোদী সাহেব তখন আপনার কাছ থেকে ঠিক কতটা দূরে ছিলেন?

পনেরো ফিট হবে।

হু। ঠিক আছে। ধরে নেয়া যাক, কেউ গুলি করার পর ব্রাউনিংটা ফ্লাওয়ার ভাসের ভিতর ফেলে দেয়। শব্দ হবার কথা। আপনি তেমন কোন শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন কিনা মনে করে দেখুন তো?

রফিক বলল, কোন শব্দই পাইনি আমি। পেলে মনে থাকত।

শহীদ বলল, রফিক চৌধুরী, যা বলতে চাইছেন আপনি তা যে সম্পূর্ণভাবে অসম্ভব, বুঝতে পারছেন তো? আপনি বলতে চাইছেন ওই রূমের ভিতর আরও একজন লোক ছিল; যার গুলিতে লোদী সাহেব খুন হয়েছেন অথচ তাকে আপনি দেখেননি, তাকে আপনি পালাতেও দেখেননি। ব্যাপারটা অসম্ভব নয়?

এমন সময় বাধা দিল টেলিফোনটা।

কামাল রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল, বলল, মি. সিম্পসন, আপনার ফোন।

রিসিভার নিয়ে মি. সিম্পসন কথা বলতে শুরু করলেন। মিনিট খানেক কথা বলার পর রিসিভার নামিয়ে রাখলেন তিনি।

অস্বাভাবিক গভীর ও চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে।

শহীদই প্রশ্ন করল, কি খবর, মি. সিম্পসন? মি. সিম্পসনের কণ্ঠস্বরটাও থমথমে শোনাল। তিনি বললেন, পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট তৈরি করেছেন ডাক্তার ইদ্রিস।

কামাল ব্যগ্রকণ্ঠে জানতে চাইল, কি বলা হয়েছে রিপোর্টে? লাশের শরীরে কত ক্যালিবারের বুলেট পাওয়া গেছে?

রফিক হঠাৎ টলতে টলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। অস্থির উত্তেজনায় কাঁপছে সে। পোস্টমর্টেমের রিপোর্টের উপর জীবন-মরণ নির্ভর করছে তার। লাশের শরীরে যদি .৩৮ আইভর-জনসনের বুলেট পাওয়া যায়, নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে তাকে।

মি. সিম্পসন বললেন, রিপোটে কি বলা হয়েছে তা ডাক্তার ইদ্রিস আমাকে বললেন না। লাশ পরীক্ষা করে তিনি নাকি এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছেন, শুনে মূর্ছা যাবার মত অবস্থা হবে আমার। ডাক্তার ইদ্রিস অন্তত তাই বললেন। তিনি স্বয়ং আসছেন রিপোর্ট সঙ্গে নিয়ে। সামনাসামনি বলবেন।

লেখক: কাজী আনোয়ার হোসেনসিরিজ: সেবা কুয়াশা সিরিজবইয়ের ধরন: সেবা প্রকাশনী

৬০. অপরাধী ২ (কুয়াশা – ভলিউম ২০)

মাসুদ রানা ১৪১-১৪২ – মরণখেলা (দুই খণ্ড একত্রে)

২৩. মাস্টার প্ল্যান

৭৬. গুপ্তধন (কুয়াশা সিরিজ)

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.