• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৮. থিসিস ২ (কুয়াশা ৮)

লাইব্রেরি » কাজী আনোয়ার হোসেন » ০৮. থিসিস ২ (কুয়াশা ৮)
Current Status
Not Enrolled
Price
Free
Get Started
Log In to Enroll

সূচিপত্র

  1. কুয়াশা ৮ – থিসিস ২
  2. এক
  3. দুই
  4. তিন
  5. চার
  6. পাঁচ
  7. ছয়
  8. সাত
  9. আট
  10. নয়
  11. দশ
  12. এগারো
  13. বারো
  14. তেরো
  15. চোদ্দ

কুয়াশা ৮ – থিসিস ২

এক

কুয়াশা ডায়েরী লিখছিল একমনে।

চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান তার মনকে আকণ্ঠ বেদনায় আপ্লুত করেছিল, তার কলমের আচড়ে তাই-ই মূর্ত হয়ে উঠছিল।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো কুয়াশা। নিঃশ্বাসের শব্দে নিজেই চমকে উঠলো। ঠোঁটে ফুটে উঠলো বিচিত্র ম্লান হাসি। অমরত্বের আর আল্টা-সোনিক্সের দুঃসাধ্য গবেষণায় বারবার পর্বতপ্রমাণ প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেছে সে; কিন্তু সিদ্ধিলাভের . মুহূর্তে তা বানচাল হয়ে গেছে। সাধনা আর সিদ্ধির এই অলংঘ্য ব্যবধান কেন? নিজেকে প্রশ্ন করলো কুয়াশা। ভাগ্যের পরিহাস! ভাগ্যকে মানে না সে। ভাগ্যকেই সে পরিহাস করে তুড়ি মেরে।

উড়িয়ে দিয়ে এসেছে সারাটা জীবন। অট্টহাস্যে পরিহাস করেছে ললাটের লিখনকে।

উইস্কির গেলাসটা ঠোঁটে তুললো কুয়াশা। এক নিঃশ্বাসে ঢক ঢক করে অর্ধেকটা শেষ করে ফেললো। সিগারেট কেস থেকে বেরোলো দামী ফিলটারটিপ সিগারেট।

ঠোঁটে লাগিয়ে রনসন গ্যাসলাইটারটা জ্বাললো।

কলমটা রেখে দিয়ে চেয়ারের পিঠে গা এলিয়ে দিলো কুয়াশা। ফিরে তাকালো কর্মমুখর অতীতের পানে। পনেরো বছর জার্মেনীতে বিজ্ঞানের কঠোর সাধনা। অসংখ্য মানুষের উপর এক্সপেরিমেন্ট | হেকমত আলীর উন্মত্ত চিৎকার ‘আমায় মেরে ফেলো’, ‘আমায় মেরে ফেলল। শহীদ। শহীদ খান। আনিস চৌধুরী। অসংখ্য ছবি। টুকরো টুকরো মনের ক্যানভাসটাকে কে যেন ছুরি দিয়ে কাটছে। কি নিদারুণ বেদনা। কি অসহ্য ব্যর্থতা।

আরও কতকগুলো ছবি। লিপোপো নদীর সেই ভয়াবহ অভিযান। জেবা ফারাহ। দীবা ফারাহর আত্মদান। দস্যু নেসার আহমেদের মুখটা দু’ভাগ হয়ে গেল গুংরির হাতের টানে। মহুয়া। আমার মিষ্টি বোন মহুয়া। তোর জন্যে কিছুই করতে পারিনি।

আমি। আব্বা, তুমি ক্ষমা করো তোমার অবাধ্য সন্তানকে!

সেই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণটা কানে আসছে তার। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে যে বিশাল ল্যাবরেটরি সে গড়ে তুলেছিল ভূগর্ভে, চোখের সামনে তা নিমেষে ভস্মীভূত হয়ে গেল আসাদুজ্জামানের আক্রোশে।

আসাদুজ্জামান। তোমাকে তবু আমি ক্ষমা করলাম। কোটি টাকা আর আমার জীবনভর সাধনাকে ব্যর্থ করে দিয়েছো তুমি। তবুও তোমার মাতৃভক্তি মনুষ্যত্বের গৌরবদীপ্ত।

রাত এখন ক’ টা বেজেছে? রেডিয়াম-ডায়াল ঘড়িটা দেখলো কুয়াশা। প্রায় তিনটে। কৃষ্ণপক্ষের শেষ রাতের জ্যোৎস্না কুহকিনী মায়া ছড়িয়ে আছে শহরতলীর আকাশে। আকাশের কালো জাজিমে তারাগুলো যেন হলুদ আলোর ফুলকি। চারদিকে অটল নৈঃশব্দ্য।

সিগারেটটা ফেলে দিলো কুয়াশা। এতক্ষণের উল্টোপাল্টা চিন্তাটাকে সহজ খাতে বইয়ে দিতে চাইলো সে। স্নায়ুর এই সাময়িক দুর্বলতাগুলোকে উড়িয়ে দিলো। হাসি পেলো তার। কেন যে এই চিন্তাগুলো মাঝে মাঝে তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কর্মমুখর জীবন থেকে দূরে নিয়ে এসে একান্ত আপন চিত্তবিলাসে বিভ্রান্ত করে তোলে বুঝতে পারে না কুয়াশা।

কিন্তু এই দুর্বলতকে প্রশ্রয় দিলে তো তার চলবে না। ব্যর্থতাকে বরণ করে নেবে কুয়াশা। যে অবিশ্বাস্য অসম্ভাব্যতাকে সম্ভব করে তোলবার সাধনায় সে সাধারণ সুখের বাসনাকে ত্যাগ করে বেছে নিয়েছে হলাহল আকীর্ণ পথ-তাকে সে-পথ ধরে চলতেই হবে। অমরত্বের সাধনায় তাকে সাফল্য অর্জন করতেই হবে। আবার নতুন করে–সম্পূর্ণ নতুন করে বসাতে হবে দুবার ছক। আমৃত্যু সে সাধনা করব। বাসবের অমৃত আসবে মানুষের অধিকার সে প্রতিষ্ঠা করবে। মিথলিজীর অসুরকুল দেবতাদের কবল থেকে যা কেড়ে আনতে বাধ্য হয়েছে।

নীলকণ্ঠের মতো সে সেই সুধাভাণ্ড তুলে দেবে মানবের হাতে। স্থির-সংকল্পে ধীরে ধীরে কুয়াশার মনের ভার কেটে গেল। দুর্বলতার গ্রন্থিগুলো নিস্তেজ হয়ে পড়লো।

মনে মনে গুছিয়ে নিলো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। হুইস্কির ভুক্তাবশিষ্ট আর এক ঢোকে পান করে সিগারেট ধরালো আর একটা।

প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে নুরক্সকে। সে তার গবেষণার থিসিসের একটা অংশ নিয়ে পালিয়েছে মাস্ক স্টোর থেকে, জামান আর সিম্পসনের সেখানে হানা দেবার পর। সাথে নিয়ে গেছে সে কুয়াশার এতদিনকার কঠোর সাধনায় পাওয়া অমরত্বের চাবিকাঠি। তাকে খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বাসঘাতককে দিতে হবে উপযুক্ত শাস্তি।

কিন্তু কুয়াশার আর বিশ্রামের সময় নেই। জীবন থেকে মূল্যবান আটটা মাস অপচয় হয়ে গেছে। ফেন্ট হ্যাটটা মাথায় পরে নিলো কুয়াশা। ওয়ারভোব খুলে কালো আলখাল্লা বের করে বিশাল দেহটা ঢেকে নিলো। রাত শেষের আলোয় শহরতলীর একটা অতি সাধারণ বাড়ির পেছন দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লো সে। যেন একটা বিশাল সচল মহীরুহ রাতের ম্নান জ্যোৎস্না পাড়ি দিতে দিতে চললো।

কুয়াশাকে বেরোতে দেখে একটা ছায়ামূর্তি সাঁ করে মিলিয়ে গেল ঝোঁপঝাড়ের অন্ধকারে। কুয়াশার বিশাল দেহ ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে গেল আবছা অন্ধকারে। বেরিয়ে এলো ছায়ামূর্তি। গেটটা ধরে ধাক্কা দিতে গিয়েই মনে কিসের একটা সন্দেহ হলো যেন তার। লোহার গেট। নিশ্চয়ই তাতে চলাচল করছে বিদ্যুৎ তরঙ্গ। এক মুহূর্ত টর্চের আলোয় পরীক্ষা করলো আগন্তুক। যা ভেবেছিল তাই। একটা তার এসে নিচের দিকে একটা শিকের সাথে আটকে আছে।

চারদিকে তাকিয়ে দেখলো ছায়ামূর্তি। পকেট থেকে বের করলো প্লয়ার্স। রবারের গ্লাভস পরা হাতে প্লয়ার্স ধরে এক টানে ছিঁড়ে ফেললো তারটা। গ্লাভসটা খুলে ফেললো। আঙুলের ডগা দিয়ে সাবধানে স্পর্শ করলে লোহার গেটটা। না, বিদ্যুৎপ্রবাহ নেই। গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকলো সে। ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ছায়ামূর্তি। সরু আলো টর্চ থেকে বেরিয়ে চক্রাকারে বিচ্ছুরিত হলো।

সড় সড় শব্দ ভেসে এলো কোত্থেকে। একলাফে ছায়ামূর্তি সরে গেল বারান্দার অন্ধকার কোণে। অজান্তেই বাঁ হাতটা ঢুকে গেল পকেটে। সেখানে আছে পয়েন্ট থ্রি-টু ক্যালিবারের ছোট্ট একটা পিস্তল।

না কিছু নয়। শেষরাতের হাওয়ায় গাছের পাতার শব্দ। আশ্বস্ত হলো ছায়ামূর্তি। আবার এগিয়ে এলো দরজার কাছে। একটা ছোটো ইস্পাতের নলের মতো বের করলো পকেট থেকে! তালাবদ্ধ কড়ার ভিতরে ঢুকিয়ে বাঁকিয়ে চাপ দিলো। কড়াটা খুলে এলো দরজা থেকে। ঘরে ঢুকলো ছায়ামূর্তি।

*

নিমিষে জরিপ করলো সমস্ত ঘরটা। তার চোখ দুটো ঘরের নিস্তব্ধ অন্ধকারে বিড়ালের মতো জ্বলে উঠলো। সন্তর্পণে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সে এগিয়ে গেল, ওয়ার ড্রোবের দিকে। কে জানে কাঙ্ক্ষিত দ্রব্য মিলবে হয়তো সেখানেই? সমস্ত ওয়ার, ডোবটা তছনছ করে ফেললো। কিন্তু কোথায়? কোথায় সেই থিসিসের অবশিষ্টাংশ। বইয়ের র‍্যাক, আলমারী, বিছানা তন্ন তন্ন করে খুজতে লাগলো। কোথায় সেই লাল মলাটের বইটা। যার একটা অংশ আছে তার নিজের কাছে। কোথায়? কোথায়?

হন্যে হয়ে উঠলো ছায়ামূর্তি। উদ্বেগে, ক্রোধে সে দিশে হারিয়ে ফেললো। সেটা তাকে পেতেই হবে। নিশ্চিত অমরত্ব লাভ থেকে সে নিজেকে বঞ্চিত হতে দেবে না। দিতে পারে না।

নিজেকে সংযত কালো ছায়ামূর্তি। শেষ রাত। আর দেরি করলে ধরা পড়ে যাবে সে কুয়াশার হাতে। আর তার অর্থ হলো মৃত্যু। নিশ্চিত মৃত্যু। অমরত্বের আস্বাদ আর পেতে হবে না। খাটের তলায় গিয়ে উপরের দিকে চাইতেই তার চোখ দুটো আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অসহ্য উল্লাসে তার মনে আগুন ধরে গেল যেন। খাটের গদির নিচে নাতিবৃহৎ স্টিলের চ্যাপ্টা বাক্স চোখে পড়লো তার। বাক্সটা তার চেনা। তার স্বপ্নের ধন। কুয়াশী খাটের গদির তলায় যে এই অমূল্য সামগ্রী লুকিয়ে রাখতে পারে তা তার কখনোই সন্দেহ হয়নি। এর চাইতেও গোপন স্থানে ওটাকে লুকিয়ে রাখবে-সেটাই স্বাভাবিক।

খাটের নিচে থেকে বেরিয়ে এলো ছায়ামূর্তি। আর দেরি নয়। গদীর তলায় হাত ঢুকিয়ে দিয়ে টেনে বের করলো স্টিলের পাতলা বাক্সটা। তার এক কোণে একটা ঈষৎ উঁচু জায়গায় চাপ দিতেই খুলে গেল। ভিতর থেকে উঁকি দিলো লাল রঙের একটা বই। তবুও সন্দেহ গেল না ছায়ামূর্তির। খুলে দেখে নিলো বইটা। না ঠিকই আছে, মনে মনে বললো সে। বাক্সটা বন্ধ করলো। পেছন দিয়ে দরজার দিকে এগোলো। খুট করে শব্দ হলো একটা। ঘরটা আলোয় প্লাবিত হয়ে গেল মুহূর্তে।

‘হ্যাণ্ডস আপ। মাথার উপর দু’হাত তুলে দাঁড়াও, নুরবক্স।’ ঘরের মধ্যে কিসের যেন বিস্ফোরণ হলো। ছায়ামূর্তি হকচকিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ালো। একটা রিভলভারের নল ঠিক তার মাথার দিকে লক্ষ্য করে স্থির হয়ে আছে। লোকটা মান্নান। কুয়াশার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর। তার জন্য মান্নান হাসতে হাসতে প্রাণ দিতে পারে।

‘হাত তুলে দাঁড়াও, নুরবক্স। না হলে এই মুহূর্তেই তোমার খুলি ফুটো হয়ে যাবে।’

হকচকিয়ে গেল ছায়ামূর্তি। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যে, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলো সে। মান্নান কিছু বলার আগেই ছায়ামূর্তি হাতের চ্যাপ্টা বাক্সটা জোরে ছুঁড়ে মারলো মান্নানের রিভলভার ধরা ডান হাত লক্ষ্য করে। বাক্সটা এসে আঘাত করলো মান্নানের কব্জিতে। রিভলভারটা পড়ে গিয়ে ছিটকে চলে গেল ওয়ারড্রোবের নিচে। একলাফে এগিয়ে এসে মান্নানের তলপেট বরাবর লাথি হাঁকলো নরবক্স। মান্নান বিদ্যুৎবেগে পাশ কাটিয়ে সরে যেতেই নিজেকে সামলাতে না পেরে সামনের দিকে বুকে পড়লো ছায়ামূর্তি। এই অবসরে মান্নান তার চোয়ালের উপর ঘুসি চালালো। তীব্র যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেল ছায়ামূর্তির মুখ। কুদ্ধ সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে ডানদিকের পকেট থেকে বের করে আনলো পিস্তল। মান্নানের দিকে তাক করার আগেই সে ছুটে এগিয়ে এসে ছায়ামূর্তির ডানহাতটা ধরে উপরের দিকে ঠেলে দিলৌ। সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল থেকে শব্দ বেরোলো দুপ। মান্নান ছায়ামূর্তির পাঁজর লক্ষ্য, করে প্রচও ঘুসি হাঁকালো। কোঁক করে একটা শব্দ করে ভূতলশায়ী হলো ছায়ামূর্তি। পিস্তলটা ছিটকে পড়লো কয়েকহাত দূরে। মান্নান ছায়ামূর্তির উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই তীব্র যন্ত্রণা সত্ত্বেও দাঁতে দাঁত চেপে সে ঘুসি মারলো মান্নানের ডান চোখের উপর। ভু থেকে উষ্ণ তরল রক্ত বেরিয়ে এলো। ডান চোখটা বন্ধ হয়ে গেল মান্নানের। ডানহাতটা যন্ত্রচালিতের মতো চোখের উপর উঠে এলো। এই সুযোগে আবার ঘুসি চালালো ছায়ামূর্তি। এবারে নাক বরাবর। জ্ঞান হারিয়ে টলতে টলতে পড়ে গেল মান্নান। ছায়ামূর্তির পাশেই। একটা অশ্লীল গালাগাল বেরিয়ে এলো ছায়ামূর্তির মুখ থেকে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো ছায়ামূর্তি। বাক্স আর পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল সে।

দুই

সিম্পসন টেলিফোন রেখে দ্রুত তার কামরা থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, কামাল তখন ঢুকলো। কামালের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে সিম্পসন বললেন, ‘আরে কামাল সাহেব যে, এসো এসো। এদিকে আর এক কাণ্ড ঘটে গেছে। জামান অর্থাৎ আসাদুজ্জামানের বোন লিলিকে কে বা কারা চুরি করে নিয়ে গেছে কাল রাতে, জামানের বাড়ির লোকের ধারণা এ কাজ কুয়াশার।’

কামাল বিস্ময়ের সুরে বললো, ‘আবার কুয়াশা? আমি তো ভেবেছিলাম কুয়াশা মারাই গেছে। কয়েক মাস ধরে তো তার কোনও পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছিলো না।’

সিম্পসন বললেন, ‘তা ঠিক। আমরাও একটু বিস্মিতই হয়েছিলাম। কিন্তু লিলিকে যে কুয়াশাই চুরি করেছে এটাও তো অনুমান মাত্র। যা হোক। আমি এক্ষুণি বেরোচ্ছি। তুমি কি যাবে আমার সাথে?’

‘সানন্দে। অনেকদিন ধরে শুয়ে বসে থেকে হাতে পায়ে খিল ধরে গেছে। এখন কিছু একটা করতে পারলে বেঁচে যাই। শহীদ তো বিজনেসের মধ্যে ডুবে গেছে। গোয়েন্দাগিরিতে, বিশেষ করে কুয়াশা ঠেঙানোতে ওর কোনও উৎসাহ নেই আর। অতএব, এবারে শহীদকে ছেড়ে আপনার, চাই কি জামানের উপগ্রহে পরিণত হতে আমি প্রস্তুত।’

সিম্পসন হাসলেন। সিগারেটের কৌটোটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘চল, যাওয়া যকি।’

ড্রইংরুমের ভিতর অস্থিরভাবে পায়চারী করছিল জামান। অসহ্য ক্রোধে তার দু’চোখে যেন আগুন জ্বলছিল। কামরুজ্জামান সাহেবের চোখ বেয়ে পানি ঝরছে। ছোট চাচার মুখটা বেদনায় আর আতঙ্কে নীল। তার ঠোঁট কাঁপছে। হায়দার দরজার পাশে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। কামরুজ্জামান সাহেব বেরিয়ে গেলেন। মিনিটখানেক পর তার পিছন পিছন ঢুকলেন সিম্পসন আর কামাল।

সিম্পসন কামালের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওদের। সবাই বসলো। সিম্পসন বললেন, ‘ঘটনাটা কিভাবে ঘটলো, জামান, বলতে পারো কিছু?’

‘বলবার মতো কিছু নেই মি. সিম্পসন। লিলি এই পাশের ঘরটায় থাকতো। আমি থাকি তার পরের কামরায়। সকালে হায়দার অর্থাৎ আমাদের চাকরটার চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। সে হাউমাউ করে যা বললো তার অর্থ এই যে, লিলিকে সকাল থেকে পাওয়া, যাচ্ছে না। ছুটে লিলির ঘরে গিয়ে দেখি ওর শিয়রের জানালার মোটা শিকগুলো উধাও হয়ে গেছে। নিচে গলানো মোমের মতো লোহা পড়ে আছে। লিলির বিছানা শূন্য। অথচ রাতে যে সে বিছানায় শুয়েছিল, তাও স্পষ্ট বোঝা যায়।’ জামান থামলো।

‘আমার মনে হচ্ছে এটা কুয়াশার কাজ,’ কামরুজ্জামান সাহেব বললেন। ছোট চাচা সায় দিলেন। ‘আমাদেরও তাই ধারণা, কামাল সাহেব।’ ‘তোমার কি মনে হয় জামান?’ সিম্পসন প্রশ্ন করলেন।

জামান ক্লিষ্ট হাসি হেসে বললো, ‘এ সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে কি মি. সিম্পসন? এই কুয়াশাই আমার মাকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। কে জানে কুয়াশা। লিলিকে এখন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে কিনা।’ গলা আর্দ্র হয়ে গেল জামানের। মাথা নিচু করলো বোধহয় উদ্যত অশ্রু গোপন করার জন্যে।

সিম্পসন চুপ করে রইলেন। জামান নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘তাছাড়া কুয়াশা যেমন করে শিক গলিয়ে ঘরে ঢোকে সেইভাবেই লিলির ঘরের শিক গলিয়ে ফেলা হয়েছে।’

ছোটো চাচা বললেন, ‘আশ্চর্য। লোকটা কয়েকটা বছর ধরে একের পর এক নরহত্যা করে চলেছে অথচ…’ সিম্পসনের মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করলেন তিনি।

জামান বললো, ‘এবার আর কুয়াশার রক্ষা নেই। কুয়াশা যতবড় দুরন্ধরই হোক আর যতবড় প্রতিভাই হোক তাকে আমি খুঁজে বের করবই। আসামীর কাঠগড়ায় তাকে এবার দাঁড়াতেই হবে।’ জামানের কণ্ঠস্বরে প্রতিজ্ঞা আর জেদ।

কামরুজ্জামান বললেন, ‘তাই যেন হয়, আল্লাহ।’

সিম্পসন উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘চলো। লিলির ঘরটা দেখা দরকার একবার।’

জামান সিম্পসন আর কামালকে নিয়ে লিলির কামরায় ঢুকলো। সুসজ্জিত ছিমছাম ঘর। খাটের উপর শয্যায় শয়নের চিহ্ন সুস্পষ্ট। শিয়রের জানালাটা খোলা। তাতে একটিও শিক নেই। কাছে গিয়ে দেখলেন মোটা শিকগুলো গলানো মোমের মতো মাটিতে পড়ে রয়েছে।

কামাল জিজ্ঞেস করলো, ‘শফি সাহেব কোথায়, মি. জামান?’

জামান চিন্তিত গলায় বললো, ‘বুঝতে পারছিনে। আজ তিনদিন ধরে শফি আসেনি আমাদের এখানে। আমিও খোঁজ নিতে পারিনি। লিলি বোধহয় কাল গিয়েছিল একবার। কিন্তু কিছু বলেনি।’

‘শফি ইদানীং থাকতো কোথায়?’ কামাল জিজ্ঞেস করলো।

‘ঢাকেশ্বরীতে ওর আগের বাসায়।’ সমস্ত ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখে এসে সিম্পসন দাঁড়ালেন। ‘কিছু খোয়া গেছে কিনা বলতে পারো জামান?’

‘তেমন তো মনে হচ্ছে না।’

জানালা গলে নিচে লনে নেমে গেলেন সিম্পসন। কাল রাতে বৃষ্টি হয়ে গেছে। মাটি ভেজা। আর সেই ভেজা মাটির উপর দু’জোড়া জুতোর ছাপ চোখে পড়লো সিম্পসনের। জুতোর ছাপ ধরে এগোলেন তিনি। সামনের দিকে গেটের কাছে জুতোর ছাপ গিয়ে মিলিয়ে গেছে। আবার ঐ পথ দিয়েই ফিরে এলেন সিম্পসন।

সবাই ড্রইংরুমে ফিরে এলেন।

একটা স্কুটার থামবার শব্দ শোনা গেল। গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে শফি এসে ঢুকলো ড্রইংরুমে। একগাদা লোক দেখে একটু হকচকিয়ে গেল শফি। সিম্পসনের দিকে নজর পড়তেই ভ্রু দুটো জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে বেঁকে গেল। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ‘কি ব্যাপার, আপনি এখানে?’ ছোটো চাচা কি যেন বলতে গেলেন। তার আগেই গলা শোনা গেল জামানের। তিক্ততা মেশানো কণ্ঠে জামান বললো, ‘কি আর করবেন মি. সিম্পসন। তোমার কুয়াশা ভাইয়া যে আবার আমাদের উপর দয়া করেছেন।’

‘তার মানে?’

‘মানে অতি সরল। আমার মাকে হত্যা করে শখ- মেটেনি কুয়াশার। এবারে লিলিকে চুরি করে নিয়ে গেছে।’

‘লিলিকে চুরি করে নিয়ে গেছে?’ যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করলো শফি। যেন ব্যাপারটা তার চেতনায় গিয়ে পৌঁছলো না। পাথরের ‘ তা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।

*

আস্তে আস্তে চোখ মেলে চাইলো লিলি–চারদিকে হাল্কা অন্ধকার। এখনও সকাল হয়নি বুঝি? মাথাটা ঝিমঝিম করছে। জ্বর এলো না তো? অস্পষ্ট চেতনায় নিজেকে প্রশ্ন করলো সে। শরীরটা অবসন্ন লাগছে কেন? ঘরটা ধীরে ধীরে দুলছে, ভূমিকম্প হচ্ছে! ধড়মড় করে উঠে বসলো সে। একি! এ আমি কোথায়? ঘরটা দুলছেই বা কেন? স্বপ্ন দেখছি নাতো! না স্বপ্ন নয়–নিজের গায়ে চিমটি কাটলো লিলি।

…তাহলে? তাহলে আমি কি বন্দী? আমাকে এখানে কি কেউ ধরে এনেছে? একটা অজ্ঞাত আশঙ্কায় বুকের মধ্যে ধড়াশ করে উঠলো লিলির। দেহটা কেঁপে উঠলো একবার। জিভটা শুকিয়ে গেল।

ছোট্ট একটা ঘর। বারবার দুলে উঠছে। মাথার উপর একটা শূন্য পাওয়ারের বাল্ব মিটমিট জ্বলছে। এতক্ষণে লক্ষ্য করলো লিলি, সে মাটির উপর শুয়ে ছিলো। ঘরটার ভিতর চাপা গুমোট। শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো ওর।…কে তাকে ধরে এনেছে? কেন ধরে এনেছে? নিজেকে প্রশ্ন করলো লিলি। মায়ের কথা মনে হতেই বুকের ভিতরটা কাঁপুনি ধরে গেল। ঘরের দেয়ালে ভর দিয়ে অসহায়ের মতো বসে রইলো সে।

তেষ্টা পেয়েছে। গলাটা শুকিয়ে গেছে।

উঠে দাঁড়ালো। ঘরটায় দরজা বলতে কিছু দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে শুধু দেয়াল। ঘুরে ঘুরে ধাক্কা দিয়ে দেখলো দেয়ালটা। বাইরে পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো। ঘরটা আবার দুলে উঠলো।

আবার বসে পড়লো লিলি। ডুকরে কেঁদে উঠলো। ঝরঝর করে দু’চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে এলো।

খুট করে শব্দ হলো একটা। সামনের দেয়ালটা ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। একটা লোক এসে দাঁড়ালো ফাঁকটার মধ্যে। একহাতে তার টর্চ অন্য হাতে একটা চাকু অস্পষ্ট আলোকে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। ঘরটা দুলে উঠলো আবার।

বেটে গাঁট্টাগোট্টা লোকটা। দু’চোখ দিয়ে লেহন করছে লিলিকে। ওকে দেখে কান্না, ভুলে গেল লিলি। শঙ্কায় দুরুদুরু করে উঠলো বুকের ভিতরটা। যদি ধরতে আসে?

বাধা দেবে লিলি। আত্মসমর্পণ করা চলবে না। কিছুতেই না। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো লিলি।

লোকটা দু’পাটি দাঁত বের করে হাসলো বলে মনে হলো লিলির। কি কুৎসিত হাসিটা! লিলি মুখ ফেরালো।

কর্কশ গলা শোনা গেল। বাঃ, দিব্যি জ্ঞান ফিরা আইছে। হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ, যাই হুজুররে খবর দেই গ্যা। বেরিয়ে গেল লোকটা। দেয়ালের ফাঁকটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।

শফির কথা, দাদাদের কথা, মৃত মায়ের মুখ মনে পড়লো লিলির স্মৃতিপটে। চোখ বেয়ে আবার অশ্রু ঝরতে লাগলো নীরবে।

তিন

কয়েকদিন পরের কথা। আষাঢ় মাস। বৃষ্টিভেজা পড়ন্ত বিকেল। সারাদিন একঘেয়ে। বর্ষণের পর মেঘগুলো বিশ্রাম নিচ্ছে। আবার এখুনি হয়তো বর্ষণ শুরু করবে।

কাকরাইলে শহীদ খানের বাড়িটায় একা হাঁপিয়ে উঠেছিল কামাল। শহীদ, মহুয়া ভাবী, লীনা কেউই বাড়ি নেই। কোথায় কোন এক মরহুম শিল্পপতির একমাত্র দুহিতার বিয়ে খেতে গেছে ইস্কাটন ক্লাবে।

জামানের অপেক্ষায় বসে ছিলো কামাল। সময় কাটতে চাইছিল না। শহীদের স্টাডিতে ক্রিমিনোলজির বই ঘাঁটছিল। প্রার্থিত বইটা খুঁজতে খুঁজতে ওর মনে হলো বইগুলোর উপর যেন হাল্কা ধুলোর আস্তরণ জমেছে। আপনমনে হাসলো কামাল। ক্রিমিনোলজিতে শহীদের সব ইন্টারেস্ট চৈত্রের মেঘের মতো উবে গেছে। কুয়াশার প্রতি শহীদের জাতক্রোধ আর একই সাথে অসীম শ্রদ্ধার টানাপোড়েনে ক্লান্ত হয়ে শহীদ শুধু সৌখিন গোয়েন্দাগিরি থেকেই দূরে সরে আসেনি, ক্রিমিনোলজিতেও তার আগ্রহের অবসান ঘটেছে।

সিম্পসন দুঃখ করছিলেন, ‘এতো সম্ভাবনাময় গোয়েন্দা শহীদ খান কলরবমুখর খ্যাতির প্রাঙ্গণ থেকে নীরবে সরে দাঁড়ালো। ওর জন্যে আমার বড় দুঃখ হয়।

কামাল হেসে মনে মনে বলেছিল, ‘অসুবিধেও হয়। কঠিন কেসগুলো শহীদ যেমন স্বচ্ছন্দে সমাধান করে দিতো তাতে পুলিশের অপরাধ নির্ণয় শাখা অনেকটা তার উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। গোয়েন্দাগিরির প্রতি শহীদের অনীহায় সিম্পসনের দুঃখ হওয়া স্বাভাবিক।

সিম্পসন আরও বলেছিলেন, ‘কুয়াশার ব্যাপারে ব্যর্থতায় শহীদ খান সেই যে শামুকের খোলের মধ্যে গুটিয়ে বসলো, আজও আর তাকে তার বাইরে আনা গেল না। আর শহীদ খানের মতো সত্যনিষ্ঠ নীতিবাগীশ পোক কুয়াশার মতো দুর্ধর্ষ ডাকাত নরহন্তাকে কেন যে শ্রদ্ধা করে তা-ও আমি বুঝতে পারিনে।’

কামাল বলেছিল, ‘কুয়াশার মধ্যে আছে যেমন প্রলয়ের মত্ততা তেমনি আছে… সৃজনশীল প্রতিভা। সেই প্রতিভার প্রতিই শহীদ ভক্তিপ্রণত।’

সিম্পসন বলেছিলেন, ‘আমিও ভেবে অবাক হই কামাল-কুয়াশা যদি তার সত্তার অর্ধাংশ নেমেসিসের কাছে সমর্পণ না করে মানুষের কল্যাণে তার প্রতিভাকে নিয়োজিত করতো তাহলে নিউটন আর আইনস্টাইনের সাথে এক সারিতেই তার নাম লেখা হতো বিজ্ঞানের পরিমণ্ডলে। এক মহতী আবিষ্কারের জন্যে সমগ্র মানবজাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতো তার নাম। ‘

এই সময় জামান এসে পড়েছিল সিম্পসনের চেম্বারে। মি. সিম্পসন তাকে সমাদরে বসিয়ে আবার ফিরে গেলেন আপন বক্তব্যে।

‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আণ্ডার গ্রাউণ্ডের সেই বিরাট ল্যাবরেটরিতে অমরত্বের সাধনায় অসামান্য প্রতিভার পণ্ডশ্রম হচ্ছিলো না কি?’

জামান ভ্রু কোঁচকাল, ‘সেই পাষণ্ড কুয়াশার কথা হচ্ছে বুঝি? আমি ভেবে পাইনে আপনারাও, অর্থাৎ পুলিস বিভাগের লোকরাও একটা নরপশুকে এমন করে শ্রদ্ধার সিংহাসনে বসিয়ে কি করে তাকে পূজা করছেন। কুয়াশা একটা খুনী, জঘন্য অপরাধী। মৃত্যুই তার একমাত্র শাস্তি। আর তাকে পাওনা শাস্তি কড়ায়-গণ্ডায় পাইয়ে দেবার জন্যে পুলিসকে সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করে যেতে হবে।’

ঘৃণায় মুখ কুঞ্চিত করলো জামান।

তার কথার কোনও জবাব দিতে পারনি কামাল। মাতৃহন্তা কুয়াশাকে জামান কেন, কেউই কোনও দিন ক্ষমা করতে পারে না। ওর জীবনের চরম বেদনা কুয়াশাকে ঘিরে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে।

সিম্পসন স্বভাবসুলভ মৃদুস্বরে বললেন, ‘জামান, কুয়াশার প্রতিভার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ কখনো কর্তব্যবোধকে আচ্ছন্ন করতে পারবে না। কি জানো-কুয়াশার আণ্ডার গ্রাউণ্ড ল্যাবরেটরিতে আমাদের হানা দেবার পর গত আট মাস তার কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।’

জামান ভ্রূকুটি করে বললো, ‘কে জানে কোন শ্মশানে সে তান্ত্রিকের মতো শব-সাধনা করছে। পিশাচসিদ্ধ হবার বাসনায় নরমুণ্ডের মালা নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলছে।’

বর্তমানে ফিরে এলো কামাল।

শহীদের ধুলোর আস্তরণ পড়া ক্রিমিনোলজির বইয়ের গাদার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই হাসলো।

সন্ধ্যা নেমেছে বাইরে। গফুর দ্বিতীয় দফা চা নিয়ে এলো। তার সাথে গরম সমুচা। এটা গফুরের স্পেশাল।

গরম সমুচা মুখে পুরতেই ইলেকট্রিক বেলের বিদঘুঁটে আওয়াজটা কানে এলো। একটু পরে গফুর ফিরে এলো। বললো, ‘একজন সাহেব দেখা করতে এসেছেন।’ চায়ে চামচ নাড়তে নাড়তে কামাল জিজ্ঞেস করলো, ‘কাকে চান তিনি?’

‘প্রথমে দাদামণিকে চাইছিলেন। নেই শুনে আপনার নাম বলছেন। বাইরের ঘরে বসিয়ে এসেছি।’

‘ঠিক আছে। বাইরে চা দাও এক কাপ। আমি যাচ্ছি।’

চা শেষ করে ড্রইংরুমে এলো কামাল। আর ঢুকেই চক্ষুস্থির। কুয়াশা। হ্যাঁ, কুয়াশা বসে আছে তার সামনে। স্বপ্ন দেখছে নাতো কামাল? বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার মাঝখানে।

প্রথমে কথা বললো কুয়াশাই। মৃদু হেসে বললো, ‘অবাক হয়ে গেছে, না? তা অবাক হবার কথাই বটে। কিন্তু আর যাই করো ভয় পেয়ো না। ভয় দেখাতে আসিনি। শহীদ নেই–তাই তোমাকেই বলছি। আরে, দাঁড়িয়ে কেন? বসো। আমি নিরস্ত্র।’

কামালের বিস্ময় অনেকটা কেটে গেছে তখন। কিন্তু কুয়াশার এই দুঃসাহসিকতায় চমৎকৃত না হয়ে পারছিল না সে। যাকে তারা খুঁজে বেড়াচ্ছে আট মাস ধরে, সে নিজেই এসেছে তাদেরই একজনের কাছে। অথচ তাকে আইন অনুযায়ী যথোচিত সংবর্ধনা জানানোর আয়োজন করা হয়নি।

কুশনে দেহটা এলিয়ে দিলো কামাল। না এই মুহূর্তে তাকে ভয় পাবার কিছু নেই। নিশ্চিন্তে তার সাথে ড্রইংরুমী ভদ্রতা করা যেতে পারে। কুয়াশাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো কামাল। সেই শালপ্রাংশু দেহ। প্রশস্ত ললাট। যামিনী রায়ের আঁকা অর্জুনের চোখের মতো বিশাল দুটি বুদ্ধি প্রদীপ্ত চোখ। সবই আগের মতো। তবুও ওর চোখে পড়লো প্রশস্ত ললাটে বলিরেখা। চিন্তার লাঙ্গল কপালটা চিরে দিয়েছে–না মহাকালের নির্ভূল নিয়ম? কে জানে? আর মুখেই বা ক্লান্তির ছাপ কেন?

সিগারেট কেস খুলে দামী সিগারেট বের করলো কুয়াশা। গ্যাসলাইটারটা জ্বেলে সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে এক গাল ধোয়া ছাড়লো নিশ্চিন্ত মনে। মুখ তুলে বললো, ‘আমার সময় কম। কাজের কথায় আসা যাক।’

গফুর চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঢুকলো। টিপয়টা এগিয়ে এনে ট্রে রেখে বেরিয়ে গেল। কুয়াশা কামালের চোখের দিকে লক্ষ্য রাখলো।

তারপর হেসে বললো, ‘চা খাবার সময় নেই আমার। মেনি থ্যাঙ্কস।’

একটু থেমে কুয়াশা বললো, ‘আজ ইস্কাটন ক্লাবে পরলোকগত শিল্পপতি হাফিজুর রহমানের একমাত্র সন্তান মিস্ রুবিনা রহমানের বিয়ে হামিদ জালাল নামে এক কন্ট্রাকটরের সাথে। আশঙ্কা করছি, বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যেই রুবিনা রহমানকে খুন করবার চেষ্টা করা হবে। এই খুনটাকে যে করেই হোক রোধ করতে হবে। পারবে?’

কামাল চমকে উঠলো। বিয়ের দিন কনে খুন হবে। খুন হবে রুবিনা রহমান। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালো কামাল। 

‘উত্তেজিত হয়ো না কামাল। যে কোনো ভাবে এই খুনটাকে ঠেকাবার ব্যবস্থা করো। আমি নিজেই যেতাম কিন্তু আমি আজ রাতে ব্যস্ত থাকবে এক ডাকাত দলের লুণ্ঠনদ্রব্য লুণ্ঠনে। অর্থাৎ ডাকাত দলের উপর পাল্টা ডাকাতি করবো। তাই এদিকে সময় দিতে পারছিনা।’ কুয়াশা হাসলো।

আবার বিস্ময়াভিভূত হলো কামাল। কি দুঃসাহস কুয়াশার। আজ রাতে সে ডাকাতি করবে স্পষ্ট ভাষায় শুনিয়ে গেল কামালকে–যে নাকি কুয়াশাকে ধরবার জন্যে বলতে গেলে শপথই নিয়েছে। কামালের সব চিন্তা-ভাবনাগুলো জট পাকিয়ে আসছে। আবার সে ভাবলো, স্বপ্ন দেখছি নাতো?

কুয়াশা যেন তার মনের কথা পড়তে পারলো। হেসে বললো, ‘না স্বপ্ন দেখছো না। শহীদের ড্রইংরুমে বসে বাস্তব জগতে কুয়াশার সঙ্গ–সুখ উপভোগ করছো কামাল। হ্যাঁ শোনো, যে খুন করতে চাচ্ছে তাকে আমি জানি। তার শাস্তিও তাকে আমি নিজের হাতেই দেবো, দেবো কঠোরতম দণ্ড। আচ্ছা চলি। গুড নাইট।’

‘একটু দাঁড়ান’, কামাল বললো।

‘বলো।’

‘একটা কথা বুঝতে পারছিনা, কুয়াশা। একটা সামান্য মেয়ের জন্যে যদি আপনার এতোই মায়া, তাহলে নির্মম হাতে ঠাণ্ডা মাথায় একের পর এক নরহত্যা করেন কি করে? তখন আপনার এই মমতা কোথায় থাকে?’ কামালের কণ্ঠে উত্তেজনা।

কুয়াশা কিছুক্ষণ কামালের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘নরহত্যাকে আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি কামাল। কিন্তু মানুষের কল্যাণের জন্য, রোগ জ্বর থেকে চির মুক্তিদানের জন্যে আর মানুষের অমরত্বের সাধনায় যারা মরে তাদের মৃত্যু মহান। যাক, সময় নেই আমার। আচ্ছা, গুড নাইট।’

কুয়াশা উঠে দাঁড়ালো। মাথাটা একটু নুইয়ে বেরিয়ে গেল। কামালের মনে হলো কুয়াশা যেন ব্যঙ্গ করলো তাকে। বাইরে গাড়ি স্টার্ট নেবার শব্দ কানে এলো। সোফা ছেড়ে এক লাফে বাইরে এসে দাঁড়ালো কামাল। গাড়িটা তখন ধোঁয়া ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে।

নিঃশ্বাস ফেলে আবৃত্তি করলো কামাল, ‘দুঃসাহস, তোমার নাম কুয়াশা।’

কামাল দ্রুত ফিরে গেল ড্রইংরুমে। সময় নেই তারও। রুবিনা রহমানকে যদি সত্যি খুন করবার চেষ্টা করা হয় তাহলে বাঁচাতে হবে তাকে।

জামানকে টেলিফোন করতে যেতেই খেয়াল হলো সে নিশ্চয়ই এখন লিলির কিডন্যাপারের সন্ধানে বেরিয়েছে। সিম্পসনও বেরিয়েছেন। ন’ টার আগে পাওয়া যাবে। ইস্কাটন ক্লারে ডায়াল করতে থাকলো কামাল। এনগেজড সাউণ্ড ভেসে আসছে।

এখন উপায়? অসহায় উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠলো সে।

লালবাগ থানায় টেলিফোন করে মোজাম্মেল হককে চাইলো, কামাল। দ্রুত ব্যাপারটা তাকে বুঝিয়ে বলে সিম্পসনকে খবর দিতে বললো। বিস্মিত হক সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা, অহনই খবর দিতাছি।’

রিসিভার রেখে বেরিয়ে এলো কামাল ঘর থেকে। গাড়িতে চেপে বসে স্টার্ট দিলো। ইঞ্জিন নিঃশব্দে ব্যঙ্গ করলো তাকে। ব্যাটারী ডাউন।

সর্বনাশ। তাহলে উপায়? ইঞ্জিনের কি হলো? ঘড়ি দেখলো কামাল। সোয়া আটটা বাজে। ইশ! পঁয়তাল্লিশ মিনিট নষ্ট হয়ে গেছে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলো সে।

চার

রাত দুটো বেজে গেছে। কৃষ্ণ কুটিল অন্ধকারে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের পথের দু’ ধার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু দূরে এখানে-সেখানে দেখা যাচ্ছে দু-চারটে আলো মিটমিট করে অন্ধকারের সাথে যুঝে চলেছে। ঝিঁঝি পোকার একটানা আর্তনাদ আর গাছের পাতায় আটকে থাকা পানি পথের উপর গড়িয়ে পড়ার টুপটাপ শব্দ রাতের নিঃশব্দকে ভারি করে তুলছে।

আকাশটা কালো মেঘে আচ্ছন্ন। বৃষ্টি বোধহয় আবার নামবে। ফতুল্লা স্টেশন পেরিয়ে আষাঢ়ের ভরা বুড়িগঙ্গা যেখানে সড়কের পাশে এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে– সেখানটায় ছোটো ছইওয়ালা ডিঙি এসে থামলো তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ নদীর তীরে একটা ছোটো ব্রিজের পাশে। নৌকার তিনজন আরোহীর মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘আমাদের দেরি হয়নি তো, ভাইয়া?

ছই-এর ভিতর থেকে ভারি গলায় আওয়াজ ভেসে এলো, ‘নারে, পাগলা। দেরি হবে কেন? সময়ের হিসেবে কুয়াশাকে কখনও ভুল করতে দেখেছিস?’

লোকটা কোনও উত্তর দিলো না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পথের দিকে চেয়ে রইলো। ভিতর থেকে মৃদু ঢক ঢক শব্দ কানে এলো। হুইস্কির বোতলটা শেষ হয়ে গেল বোধহয়।

ভারি গলাটা কানে এলো, ‘তবে সময় বেশি নেই। সোয়া দু’টো থেকে আড়াইটার মধ্যে নুরবক্সের দলটাকে আশা করছি।’

‘ওদের মোটর বোটটা কোথায় আছে?’

‘মোটর বোট আছে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জে। নুরবক্সের দল এসে সঙ্কেত করলেই ওপার থেকে মোটর বোট চলে আসবে। কিন্তু তার আগেই, আমাদের কাজ সারতে হবে।’

মেঘগুলো ক্রমে সরে গিয়ে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ উঁকি দিলো। বুড়িগঙ্গার বুক ঝিকমিক করে উঠলো মুহূর্তে।

ভারী কণ্ঠস্বরের মালিক বেরিয়ে এলো ছই-এর ভেতর থেকে-মুখে তার মুখোশ। ডিঙি থেকে নেমে ব্রিজের পাশে ঢালু জমিতে এসে দাঁড়ালো। সামনে ছোটবড় আগাছার ঝোঁপ। রেডিয়াম ডায়াল ঘড়িটা দেখলো একবার। সোয়া দুটো বেজে গেছে। ডিঙিটাকে ওরা ধাক্কা দিয়ে ঢোকালো ব্রিজের তলায়। ছোটো একটা আংটার সাথে বাঁধলো নৌকার দড়ি।

কয়েক মিনিট নিঃশব্দে কেটে যাবার পর ভারি গলাটা আবার শোনা গেল, ‘যা মান্নান। সময় হয়ে গেছে। কলিম, তোর রিভলভার ঠিক আছে তো?”

অন্ধকারে জবাব শোনা গেল, ‘জ্বি, ঠিক আছে।’

দু’জন এগিয়ে গেল নিঃশব্দে। একটা অপেক্ষাকৃত অন্ধকার জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়ালো। অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগলো দু’জন।

কুয়াশা একটু দূরে একটা বটগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালো।

দূরে, বহুদূরে নারায়ণগঞ্জের দিকে একটা ক্ষীণ আলো ওদের চোখে পড়লো।

গতিশীল আলোটা দেখেই বুঝলো, ওরা আসছে। আলোটা ক্রমশঃ এগিয়ে আসছিল ওদের দিকে। নিস্তব্ধতাকে দূর করে গাড়ির শব্দ এসে পৌঁছলো ওদের কানে। ওরা দু’জনই শুয়ে পড়লো। শব্দটা নিকটবর্তী হলো। কয়েক সেকেণ্ড পরে একটা গাড়ি এসে থামলো ওদের খুব কাছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে রইলো ওরা। মান্নান আস্তে আস্তে মাথাটা তুললো। গাড়ির আলোটা নিভে গেছে। কে একজন একটা টর্চ জ্বালালো। চারদিকে আলোটা ফেলে দেখলো একবার। মান্নান মাথা নামালো। উঃ, আর একটু হলেই ধরা পড়েছিল আর কি! টর্চের আলোটা নদীর উপর নিক্ষিপ্ত হলো। কয়েক সেকেণ্ড পরে টর্চটা নিতে গিয়ে তৎক্ষণাৎ আবার জ্বলে উঠলো। আবার নিভলো, আবার জ্বলে উঠলো। নদীর ওপার থেকেও তেমনি জ্বলে উঠলো আলো তিনবার।

মোটর গাড়ির আরোহীদের মধ্যে একজন দেশলাই জ্বালালো। সিগারেট ধরালো। সেই আলোয় দেখা গেল গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে চারজন। হয়তো ভিতরেও দু’ একজন আছে।

না আর দেরি করা ঠিক হবে না। মান্নান আর কলিম এগোলো হামাগুড়ি দিয়ে। ঝোঁপঝাড় দুলে উঠলো। কেউ কিছু বোঝবার আগেই পথের উপর যেন বজপাত হলো। নিঃশব্দে দু’জন গিয়ে পিছন থেকে আক্রমণ চালালো। মান্নান প্রথমেই রিভলভারের বাঁট দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করে একজনকে মাটিতে ফেলে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা মুহূর্তের জন্যে বিহ্বল হলেও সামলে উঠতে এক সেকেণ্ড ও দেরি হল না। সঙ্গে সঙ্গে ওরা উল্টো আক্রমণ করলো। গাড়ির ভিতর থেকে কে যেন বললো, ‘সর্বনাশ!’

মান্নান এক দৌড়ে গাড়ির পিছন দিয়ে ঘুরে তার দিকে এগোতেই পিছন থেকে তার উপর একজন ঝাঁপিয়ে পড়লো। মান্নান মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মাটির উপর। সেই, অবসরে লোকটা তার উপর চেপে বসে চুলের মুঠো ধরে মাটির উপর মাথাটা বারবার আঘাত করতে লাগলো। নাকটা থেতলে রক্ত বেরিয়ে গেল মান্নানের। পকেট থেকে ছোরা বের করে মারবার উপক্রম করতেই লোকটা কলিমের এক লাথিতে কয়েক হাত দুরে গিয়ে ছিটকে পড়ল। বাকি দুজন কলিমের দিকে এগিয়ে এলো।

কলিম ডান হাতের এক প্রচণ্ড ঘুসি চালালো আক্রমণকারীদের একজনের উপর। উঃ! ক্ষীণ আর্তনাদ ভেসে এলো। লোকটা গিয়ে ছিটকে পড়লো পথের ধারে। গাড়ির ভিতর থেকে ততক্ষণে আর একজন এসে দাঁড়িয়েছে। হিংস্রতায় তার চোখ দুটো জ্বলছিল। কলিম চিনতে পারলো নুরবক্সকে। তার বাঁ হাতে ছোরা ডান হাতে রিভলভার। কলিম ক্ষিপ্রগতিতে তার দিকে এগোতেই ডান দিক থেকে তার উপর আর একজন আক্রমণ চালালো ছোরা হাতে। সাঁ করে সরে এলো কলিম। নুরবক্সের হাতের রিভলভার গর্জে উঠলো নিস্তব্ধতার বুক চিরে। আক্রমণকারী পড়ে গেল মাটিতে।

কলিমের চোখে-মুখে উষ্ণভেজা কি যেন ছিটকে এসে লাগলো। কয়েক সেকেণ্ড যন্ত্রণায়। ছটফট করলো লোকটা। নুরবক্স বোধহয় হতবাক হয়ে গিয়েছিল। কলিম সেই সুযোগ ছাড়লো না। চট করে নুরবক্সের তলপেট বরাবর ঘুসি চালালো। নুরবক্স পাশ কাটিয়ে সরে গিয়ে দ্বিতীয়বার পিস্তল তুললো। কলিম এক লাফে গিয়ে তার হাতটা উপরের দিকে ঠেলে দিলো। গুলিটা আকাশের দিকে চলে গেল। পরক্ষণেই প্রচণ্ড এক ঘুসি মারলো নুরবক্সের চোয়াল বরাবর। গাড়ির উপর গিয়ে সে চিৎ হয়ে পড়লো। মার্ডগার্ডের উপর ডান হাত। কলিম পা দিয়ে ডান হাতের উপর চাপ দিয়ে নিচু হয়ে এক ঝটকায় রিভলভারটা টেনে নিয়ে ছুঁড়ে দিলো পানির মধ্যে। ইতিমধ্যে মান্নান আবার উঠে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে লড়ছিল। প্রচণ্ড যুসোঘুসি করছিল দু’জন। সেই ফাঁকে আর একজন ছুটে গেল মান্নানের দিকে ছোরা হাতে। কলিম নুরবক্সকে ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে পিছন থেকে পাঁজাকোলা করে শূন্যে তুলে আছাড় মারলো। কোক করে শব্দ হলো একটা। মান্নানের সাথে যে লড়াই করছিল সে দৌড়ে ছুটে গেল নদীর দিকে। মান্নান ছুটলো তার পিছনে পিছনে। ঝপাৎ করে শব্দ হলো।

নুরবক্স আবার উঠে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে ছোরা। বুনো শুয়োরের মতো ছুটে। এলো কলিমের দিকে। শব্দ শুনে পিছনে তাকালো কলিম। অকস্মাৎ শুয়ে পড়ে ঘুরে নুরবক্সের দু পায়ের ফাঁকে পা চালিয়ে দিলো কলিম। কাত হয়ে পড়ে গেল নুরবক্স। উঠে দাঁড়াবার আগেই তলপেটে প্রচণ্ড লাথি চালালো কলিম। তবুও শেষ চেষ্টা করতে ছাড়লো নুরবক্স। যন্ত্রণায় অস্থির হয়েও ছোরাটা ছুঁড়ে মারলো কলিমের পাঁজর লক্ষ্য করে।

সেটা এসে বিধলো কলিমের বাঁ হাতে। যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করলো কলিম। ডানহাত দিয়ে ছোরাটা টেনে বের করলো। চেপে ধরলো ক্ষতস্থানটা।

ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলো কুয়াশা। নুরবক্স তখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কুয়াশা তার পাশে এসে দাঁড়ালো।

অস্পষ্ট জ্যোৎস্নালোকে নুরবক্সের চোখ পড়লো কুয়াশার মুখোশ পরা মুখটার উপর। সমস্ত শরীর মুহূর্তে শিউরে উঠলো তার।

কলিম বললো, ‘শেষ করে দেই বদমাশটাকে।’

কুয়াশা বললো, ‘না। ওকে চরম শাস্তি দেবার সময় এখনও আসেনি। আরও যন্ত্রণাভোগ করুক।’

পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো নুরবক্স কুয়াশার দিকে। পরমুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লো মাথার পিছনে কলিমের এক লাথি খেয়ে।

মান্নান গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো। টর্চ জ্বেলে দেখলো পিছনের সিটে তিনটে পেটমোটা ব্যাগ রয়েছে। দ্রুত হাতে একটা খুলে দেখলো সোনা আর জড়োয়া গয়নায় ভর্তি। বন্ধ করে ব্যাগ তিনটে নিয়ে এলো।

মোটর বোটের শব্দ কানে এলো ওদের।

কুয়াশা বললো, ‘আরও ব্যাগ আছে বোধহয় গাড়ির পেছনে’। মান্নান আবার ছুটে গেল। গায়ের জোরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বুটের বনেটুটা খুলে ফেললো। টর্চ জ্বেলে দেখলো সেখানেও আছে তেমনি পেটমোটা চারটে ব্যাগ। দ্রুতহাতে নামিয়ে আনলো সেগুলো মান্নান।

কুয়াশা ধীরে ধীরে ব্রিজের উপর গিয়ে দাঁড়ালো।

মোটর বোটটা পাড়ে ভিড়লো। কলিম আর মান্নান চট করে এসে দাঁড়ালো গাড়ির আড়ালে। মোটর বোটের এঞ্জিনের শব্দ থেমে গেছে। কে একজন মৃদুস্বরে বললো, ‘শালারা এখনও পালায়নি বোধহয়।’

মান্নান ফিসফিস করে বললো, ‘এই লোকটাই বোধহয় নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল। ফিরে এসেছে আবার।’

ওরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাতে তাকাতে রাস্তার দিকে উঠে এলো। সংখ্যায় ওরা তিনজন। টর্চের আলো ফেলে এগোলো সাবধানে। গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো একজন।

মান্নান দৌড়ে এসে পিছন থেকে জাপটে ধরলো তাকে। এক ঝাঁকুনিতে সে মান্নানকে ছাড়িয়ে প্রচণ্ড ঘুসি মারলো একটা। মান্নান চিৎ হয়ে পড়ে যেতেই লোকটা চেপে বসলো মান্নানের বুকের উপর। গলাটা টিপে ধরলো সমস্ত শক্তি দিয়ে। মান্নান, ওর হাত দুটো সরিয়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। শরীরটা শিথিল হয়ে আসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কলিম আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না। পিছন থেকে এসে আক্রমণকারীর পাঁজরের উপর লাথি চালালো। আর্তনাদ করে পড়ে গেল লোকটা। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই চোয়াল লক্ষ্য করে লাথি হাঁকালো আর একটা। পাক খেয়ে পড়ে গেল। কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো।

ডানদিক থেকে আর একজন ছুটে এলো। হাতে তার লোহার ডাণ্ডা। সেটা ব্যবহারের আগেই মান্নানের পিস্তল গর্জন করে উঠলো।

পায়ে গুলি লেগে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল লোকটা।

তৃতীয় লোকটা হতভম্ব হয়ে দেখছিল। সে আর না এগিয়ে মোটর বোট খুলে দিলো। কলিম দৌড়ে গিয়ে বোটে চাপলো। লোকটা আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নেবার আগেই কলিম তাকে জাপটে ধরে ছুঁড়ে দিলো পানিতে। মোটর বোটটা দুলে উঠলো। ঝপাৎ করে শব্দ হলো একটা। বৈঠা হাতে নিয়ে দাঁড়ালো কলিম। কয়েক সেকেণ্ড পরেই লোকটাকে দেখা গেল একটু দূরে। তারপর আবার ডুব দিলো।

মান্নান ততক্ষণে উঠে এসেছে। ওর দেহে তখন অসহ্য বেদনা। তবু তা উপেক্ষা করে সে উঠে দাঁড়িয়েছে। অবশিষ্ট ব্যাগগুলো এনে তুললো মোটর বোটে। কুয়াশাও এসে চাপলো বোটে।

ঢাকার দিক থেকে কয়েকটা উজ্জ্বল আলোর রেখা দেখা দিলো পথের উপর। একটু পরেই শোনা গেল মোটর গাড়ির আওয়াজ।

এতক্ষণ পরে ওরা আবার কথা বললো।

কুয়াশা বললো, ‘পুলিস আসছে বোধহয়। স্টার্ট দে মান্নান।’

মান্নান স্টার্ট দিলো। গতি সঞ্চারিত হলো বোটে। স্টিয়ারিং ধরলো কুয়াশা। মুহূর্তে ওরা নদীর মাঝামাঝি চলে এলো। মোটর গাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে ক্রমেই ব্রিজটার কাছে এসে পড়ছে। হঠাৎ তার চোখে পড়লো একটা মানুষের মূর্তি নদীর দিকে নেমে আসছে।

পাঁচ

গাড়িগুলো ব্রিজটার কাছে আসতেই এই গভীর রাতে ব্রিজের কাছে নতুন মডেলের আঁনকোরা টয়োটা করোনা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল জামানের। ব্যাপারটা কি খোঁজ নেবার জন্য গাড়ি থামালো সে। সিম্পসন চোখ বুজে গাড়ির অন্ধকারে হেলান দিয়ে বলেছিলেন।

জামান গাড়ি থামাতেই তিনি বললেন, ‘কি হলো?

ওরা সবাই যাচ্ছিলো নারায়ণগঞ্জ। রুস্তম বাহনীর জুয়েলারীতে ডাকাতি হয়ে গেছে রাত একটার দিকে। নারায়ণগঞ্জ পুলিস ওদের সাহায্য চেয়েছে।

ইস্কাটন ক্লাবে তদন্ত সেরে ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল জামান। সন্ধ্যায়ই কামালের মুখে শুনেছিল কুয়াশার আজ রাতের অভিসারের দম্ভ ভরা উক্তি। রাত দুটোয় টেলিফোন করে যখন ঘুম ভাঙালেন সিম্পসন, ব্যাপারটা তখনই আন্দাজ করতে কষ্ট হয়নি ওর।

হাই তুলে ঘুমজড়িত গলায় রিসিভার তুলেছিল জামান। হ্যাল্লো, ‘জামান স্পিকিং ..মি. সিম্পসন?’‘কোথায় হলো ডাকাতি ওঃ  নারায়ণগঞ্জ। না, কুয়াশা নয় বোধহয়…সে তো কামালকে বলেছিল ডাকাতদের ওপর ডাকাতি করা কুয়াশার বৈশিষ্ট্য? …এখুনি যাবেন…আমি? দেখি যদি কুয়াশার সাথেও সাক্ষাৎ হয়ে যায়।’ হ্যাঁ .. আসছি পনেরো মিনিটের মধ্যে।’

জামান দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে কাপড় পরে গাড়ি নিয়ে বেরোলো। পিস্তলটা নিতে ভুললো না। সিম্পসন ওর জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। কয়েকজন কনস্টেবল সাথে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ রওনা দিলো দু’জন। রাত তখন তিনটে।

শেষরাতের ক্লান্ত জ্যোৎস্না মায়া ছড়িয়েছে নারায়ণগঞ্জের পথের পাশে। আকাশে আর মেঘ নেই। অসংখ্য তারা জ্বলছে মিটমিট করে। মাঝে মাঝে দু’চারটে বাড়ি, কারখানা, দোকান, খেত। তার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে আষাঢ়ের পানি ফুলে ফেঁপে উঠেছে বুড়িগঙ্গায়।

সিগারেট জ্বাললো জামান। সামনের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রেখে এগিয়ে চললো। তার পাশেই সিম্পসন। কেউ কোনো কথা বলছে না।

ইস্কাটন ক্লাবের নাতিবৃহৎ কামরাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো জামানের। লাল রঙের উপর জরীর কাজ করা বহুমূল্য শাড়ি পরা অপূর্ব সুন্দরী তরুণীর নিস্পন্দ দেহ, রক্তে ভেজা ব্লাউজ আর শ্বেতশুভ্র গালিচ; মৃত যন্ত্রণাকাতর চন্দনচর্চিত মুখশ্রী; বিকার হীন-মুখ, খাকি পোশাক পরা পুলিস; আতরের সুবাস, ফিসফাস কথা; সন্ত্রস্ত চেহারার কয়েকজন নারী-পুরুষ খণ্ড খণ্ড চিত্রের মতো উঁকি দিলো ওর মনের কোণে।

যে কামরায় রুবিনা নিহত হয় তার পিছনের সরু বৃষ্টি ভেজা গলিতে পায়ের ছাপ। একটা ওষুধের কৌটা। আরও কয়েকটি খণ্ড খণ্ড ছবি।

নিমন্ত্রিতদের কিছু কিছু ততক্ষণে চলে গেছেন। উৎসবমুখর বিয়ে বাড়ির আনন্দ, উল্লাস নিভে গেছে এক ফুয়ে। আলোকমালার লাল নীল সবুজ বাতিগুলো নির্ধারিত বিরতিতে আর জ্বলে উঠছে না।

শেরোয়ানী পরা শোকমলিন এক যুবক নিস্পন্দ রুবিনা রহমানের শিয়রে বসে আছে। একটা পাগড়ি গড়াগড়ি খাচ্ছে তার পায়ের কাছে।

প্রাঙ্গণে এখানে সেখানে বেয়ারারা মৃদুস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। এখনও লোক রয়েছে বিস্তর কিন্তু কোনো এক জাদুমন্ত্রের স্পর্শে যেন সবাই নির্বাক চলচ্চিত্রের চরিত্রে পরিণত হয়েছে।

শহীদ আর মহুয়া হল ঘরটার সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল আরও কয়েকজনের সাথে। জামানের সাথে শহীদের চোখাচোখি হলো। জামান দাঁড়ালো এক সেকেণ্ড র জন্যে। কি একটা ইঙ্গিত বিনিময় হলো দু’জনের মধ্যে। পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল জামান।

খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো কামালকে। তার পাশে বিশাল বপু দারোগা। মোজাম্মেল হক। তার পাশের চেয়ারে সিম্পসন। সামনে ড. রহমান। রুবিনার চাচা। জামানের পরিচিত। বিধ্বস্ত চেহারা। উদভ্রান্ত দৃষ্টি।

মোজাম্মেল হকের টাকটা আরও প্রশস্ত হয়েছে। বিদ্যুতের আলো ঠিকরে পড়ে চকচক করছে।

জামানের পায়ের আওয়াজে মুখ তুললো সবাই। সিম্পসন বললেন। ‘এই যে এসে গেছে দেখছি।’

জামান জবাব না দিয়ে ড. রহমানের দিকে মাথাটা একটু নুইয়ে এগিয়ে গেল চাদর দিয়ে ঢাকা লাশটার দিকে। চাদরটা তুলে কয়েক সেকেণ্ড নিষ্পলক দৃষ্টিতে দেখলো রুবিনা রহমানের লাশটা। আবার ঢেকে দিলো চাদর দিয়ে।

‘ঘটনাটা কখন ঘটেছে মি, সিম্পসন?’ প্রশ্ন করলো জামান।

‘রাত সাড়ে আটটার দিকে।‘

‘কিভাবে ঘটলো?’

‘হঠাৎ করে ক্লাবের সব বাতি নিভে যায় ঠিক সাড়ে আটটায়। আর সেই অন্ধকারে আততায়ী তার জিঘাংসা চরিতার্থ করছে।’

জামান একটু বিস্মিত হলো। বিয়ের কনের ঘরে স্বাভাবিকভাবে অসংখ্য মহিলা থাকবার কথা। তাদের মধ্যে আলোতেই কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির দিকে গুলি ছোঁড়া কঠিন। অন্ধকার তো কথাই নেই। হত্যাকারার হাতের টিপ যে নির্ভুল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ড. রহমান জামান আর সিম্পসনের কথা শুনছিলেন।

পাজামা-পাঞ্জাবী পরা শুকনো মুখ এক তরুণ এগিয়ে এলো। জামান দেখালো তার চোখের কোণ চিকচিক করছে।

সিম্পসন পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাইদুল হক। রুবিনার ফুফাতো ভাই।

কান্নাভরা গলায় সাইদুল হক বললো, ‘মি. সিম্পসন, গেস্টরা বাকি যারা আছেন সবাই চলে যাবার জন্যে উসখুস করছেন। আপনি যদি বলেন।’

সিম্পসন মৃদুস্বরে বললেন, ‘তা তাঁরা যেতে পারেন। শুধু মিসেস ফকরুন্নেসা কবীর, মিসেস জাহেদা করিম আর মিস সাদিয়া খোরসানীকে আগামীকাল সকাল ন’টায় ড. রহমানের বাসায় আসতে বলবেন দয়া করে। মি, জালাল, আপনিও আসবেন অনুগ্রহ করে।’

সাইদুল হক নিষ্ক্রান্ত হলো। বরের পোশাক পরা হামিদ জালাল চোখ তুলে তাকালো সিম্পসনের দিকে। কিছু বললো না।

জামান জিজ্ঞেস করলো, ‘শুধু এই তিনজনকেই কেন? হত্যাকাণ্ডের সময় এই তিনজনই বুঝি এই ঘরে ছিলেন?’

জবাব দিলেন ড. রহমান। তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘সবই ভাগ্যের খেলা মি. জামান। হত্যার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ঘরটায় তিল ধারণের জায়গা ছিলো না। অথচ এখন শুনতে পাচ্ছি ঘটনার সময় মাত্র তিনজন নাকি ছিলো সেখানে।’ তিনি একটু হাসবার চেষ্টা করলেন। সে হাসি কান্নার মতো মনে হলো।

সিম্পসন ব্যাখ্যা করলেন ঘটনাটা। ‘হত্যাকাণ্ডটা যখন ঘটে তখন যতদূর মনে হয় মাত্র তিন-চারজনই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলো। কারণ ঠিক সেই সময়ই বর এসে পৌঁছায়। যারা রুবিনার কাছে ছিলো তারা সবাই বর দেখতে ছুটেছিল। ঘরটা তাই নিতান্তই ফাঁকা ছিলো তখন। খুব সম্ভব হত্যাকারী আগে থেকেই এই ধরনের পরিকল্পনা করে রেখেছিল।’

ঘরের চারদিকে বড় বড় জানালা। ভারি বাসন্তী রঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা। জামান উঠে পিছনের জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আবছা আলোয় দেখলো হাত দুয়েক দূরে উঁচু পাঁচিল।

সিম্পসন ওদিকে দারোগা মোজাম্মেল হককে ডেকে লাশটা মর্গে পাঠাবার নির্দেশ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কামাল আর জামানকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন তিনি। বারান্দায় এসে দাঁড়ালো তিনজন। সিম্পসন বললেন, ‘কুয়াশার সতর্কবাণী সত্ত্বেও মেয়েটাকে বাঁচানো গেল না।’

জামান ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তার মানে?’ সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করলো কামাল।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সিম্পসন বললেন, ‘আমরা প্রস্তুত হয়ে আসবার আগেই আততায়ী তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে ফেলেছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এখানে এসে যখন পৌঁছলাম তার মাত্র পাঁচ মিনিট আগে সব শেষ হয়ে গেছে।’

সিম্পসন আশা করছিলেন কুয়াশার নাম শুনে জামানের মুখটা ক্রোধে বিকৃত হয় উঠবে। তিনি তাকিয়ে ছিলেন জামানের মুখের দিকে। কিন্তু জামানের মুখের ভাব পাল্টালো না। সিম্পসন মনে মনে হাসলেন।

জামান ভাবছিল, কুয়াশা তাহলে সত্যি আবার লাইম লাইটে এলো। ওদের অনুমান সত্য হলো।

হত্যকারী তাহলে কুয়াশার অতি পরিচিত। তার সামান্যতম অভিলাষও জানা আছে কুয়াশার। তার অর্থ হচ্ছে দু’জনের মধ্যে রয়েছে শত্রুতা। কিন্তু কুয়াশা নিজে মেয়েটার প্রাণ বাঁচাতে না এসে শহীদ খানের উপর দায়িত্বটা কেন চাপাতে গিয়েছিল বুঝতে পারলো না জামান।

‘চলুন, মি. সিম্পসন, আমরা চারদিকটা ঘুরে আসি,’ জামান বললো।

‘তুমি যাও, জামান। আমি ঘরে আছি।’

জামান নেমে গেল টর্চ হাতে। লনটা ঘুরে ঘুরে দেখলো ডাইনে-বাঁয়ে। যে ঘরটায় রুবিনাকে হত্যা করা হয়েছে তার পিছনে এসে দাঁড়ালো। ঘরটার পেছনে উঁচু দেয়াল। মাঝখান দিয়ে সরু পথ। একজন চলতে পারে কোনও ক্রম। নিচের দিকে টর্চের আলো ফেললো। ভেজা মাটি। মাঝে মাঝে বৃষ্টির পানি জমে আছে। তার উপর একজোড়া জুতোর ছাপ অত্যন্ত গভীর। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল জামান। কাদার উপর ছোটো একটা কৌটা আলো পড়ে চিকচিক করে উঠলো। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সেটা দিয়ে কৌটাটা জড়িয়ে পকেটে পুরলো। জানালা পর্যন্ত গিয়েই পায়ের ছাপটা বেঁকে গেছে, তারপর আবার সামনের দিকে চলে গেছে।

ফিরে এলো জানান।

ইস্কাটন ক্লাবের ঘটনাগুলোর মধ্যে মালা গাঁথবার চেষ্টা করছিল জামান। ফুলস্পীডে গাড়ি চলছে নারায়ণগঞ্জের পথে। জায়গাটার নাম বোধহয় পাগলা। বুড়িগঙ্গা নদীটা এঁকেবেকে সড়কটার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। নদীর পানিতে জ্যোৎস্নার ঝিলিমিলি।

হঠাৎ বর্তমান বাস্তবতার রূপ নিয়ে দাঁড়ালো সামনে। এই গভীর রাতে নির্জন নদী তীরে পথের মাঝখানে সর্বশেষ মডেলের টয়োটা করোনা দাঁড়িয়ে থাকবার অর্থ কি? ইন্দ্রিয়গুলো মুহূর্ত সজাগ হলো জামানের। গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লো সে। সিম্পসনও নেমে পড়লেন। পিছনের পুলিশের গাড়িটাও থামলো, কোত্থেকে একটা মোটরবোটের ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে। স্পষ্ট জ্যোৎস্নায় দেখা গেল নদীর মাঝামাঝি একটা মোটরবোট, দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমেই।

ওরা টয়োটার দিকে এগিয়ে গেল। গাড়িটার পাশেই মুখ থুবড়ে একটা লোক পড়ে আছে। টর্চ জ্বাললেন সিম্পসন। মরে গেছে। কালা গাট্টাগোট্টা চেহারা। পরনে হাফ প্যান্ট, গায় গেঞ্জি। কপালটায় ক্ষত। রক্ত তখন পর্যন্ত তরল। পুরোপুরি জমাট বাঁধেনি। খুব বেশি হলে হয়তো মিনিট বিশেক আগে আঘাত করা হয়েছিল লোকটাকে।

সিম্পসন পরীক্ষা করে বললেন, ‘গুলির আঘাতে মারা গেছে লোকটা। বোধহয় পিস্তল হবে।’

টর্চ জ্বেলে চারদিক দেখলো জামান, আশেপাশে অনেকটা জায়গা। না, আর কিছু নেই। ব্রিজটার দিকে এগোলো জামান। উঁচু হয়ে টর্চের উজ্জ্বল আলোয় দেখলো ব্রিজের পাশে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে কয়েকটা ছোটো গাছের মাথা দোমড়ান- মোচড়ান। কিছু কিছু পাতা ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে গেছে।

সিম্পসন এদিকে গাড়িটা খুলে ভিতরটা দেখছিলন। দরজা খোলাই ছিলো। বাইরে দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বেলে সাবধানে পরীক্ষা করলেন। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন আবার। একজন পুলিসকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘দেখো, কেউ যেন ভিতরে না ঢোকে বা কিছু স্পর্শ না করে। এখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকো একজন।’

দারোগা মোজাম্মেল হক মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর হাই তুলছিলেন বারবার। সিম্পসন তাকে ডেকে লাশটার বিহিত করবার নির্দেশ দিলেন।

ঢাকার দিক থেকে একটা গাড়ির আলো এসে ঠিকরে পড়লো জামানের গায়ে। মুহূর্তেই সচকিত হলো সকলে। সিম্পসন পিস্তল বের করলেন। সেপাইরা রাইফেল তুলে দাঁড়ালো। পথের মাঝখানটায় এসে দাঁড়ালেন মোজাম্মেল হক দু’জন রাইফেল ধারী পুলিশ সাথে নিয়ে।

গাড়িটা এসে দাঁড়িয়ে গেল ওদের কাছে। সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে অভাবনীয় কিছু একটা ঘটবার আশঙ্কা করছিল। | গাড়ি থেকে ভেসে এলো, ‘মি. সিম্পসন।

‘কে? কামাল?’ জবাব দিলেন সিম্পসন। পিস্তল নামিয়ে এগিয়ে তোলেন গাড়িটার দিকে।

‘সর্বনাশ করেছিলেন একেবারে। সবাই দেখি যুদ্ধংদেহী ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভয় নেই, আমি কামাল। কুয়াশা নই।’

সবাই হেসে ফেললো ওর কথায়। সিম্পন্সন বললেন, ‘এতো দেরিতে যে? তুমি না বললে আজ রাতে বেরোবে না?’

‘তাই তো ভেবেছিলাম। কিন্তু ভেঙে যাওয়া ঘুমটা আর এলো না। যাকগে, এখানে কি বাপার?’

জামান বললো, ‘এখানে কিন্তু একটা প্রচণ্ড সংঘর্ষ ঘটে গেছে। একজন মারাও গেছে। ঐ দেখুন লাশ।’

‘কুয়াশার কীর্তি নাকি?

‘হতে পারে। চলুন চারদিকটা ভালো করে খোঁজ করে দেখা যাক।’ জামান এগিয়ে গেল ব্রিজের দিকে, নিচ থেকে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আসছিল। টর্চের আলো ফেললো জামান নিচের দিকে। ব্রিজের একটা আংটার সাথে বাঁধা একটা দড়ি চোখে পড়লো। তার। দড়ি ধরে আস্তে আস্তে টান দিতেই ছইওয়ালা ছোটো একটা দেশী নৌকা বেরিয়ে এলো ব্রিজের তলা থেকে। দড়িটা খুলে ব্রিজের পাশে ঝোঁপঝাড় ভেঙে নৌকাটা টেনে নিয়ে এলো নদীর উল্টো দিকে রাস্তার অপর পাশে।

সিম্পসন এগিয়ে গেলেন ডিঙির কাছে। কামাল এলো পিছন পিছন।

ডিঙিতে উঠে পড়লো সে। পকেট থেকে রিভলভার বের করে নিয়ে ছইয়ের তলায় উঁকি দিলো কামাল। ডিঙি শূন্য। পাটাতনের কাঠগুলো খুললো কামাল। টুং টুং কর শব্দ ভেসে এলো। একি? এ যে দেখছি সরোদ। আলগোছে সরোদটা বের করলো কামাল পাটাতনের তলা থেকে।

সিম্পসন বললেন, ‘আরে, এটা একটা সরোদ না?’

কামাল বললো, ‘হ্যাঁ, মি. সিম্পসন। কুয়াশা মিথ্যে বড়াই করে না। এখানেই সে ডাকাতির মাল লুট করেছে। আর মৃত লোকটা সেই লুণ্ঠন কার্যের শিকার। সম্ভবতঃ দুর্বৃত্ত দলটিরই লোক, আর সরোদটাই কুয়াশার উপস্থিতির প্রমাণ।’

রাতের আধার ফিকে হয়ে আসছে। ঘড়ির কাঁটা পাঁচের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। নদী থেকে ভেসে আসছে শেষ রাতের হাওয়া। আরও ভেজা আরও ঠাণ্ডা। আকাশটা আবার ঘনকালো মেঘে ঢেকে গেছে। এখুনি বৃষ্টি নামবে বোধহয়।

ছয়

সকাল প্রায় সাড়ে সাতটা। প্রাতরাশ করছিল শহীদ। চায়ে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজ টার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। মিস রহমানের হত্যাকাণ্ড টা মন দিয়ে পড়ছিল সে।

পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার লিখেছেনঃ গতকাল রোববার ইস্কাটন ক্লাবে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে অজ্ঞাত আততায়ীর গুলিতে বিয়ের কনে মুত্যুবরণ করেন।

পাত্রী মিস রুবিনা রহমান পরলোকগত শিল্পপতি হাফিজুর রহমানের একমাত্র কন্যা। প্রখ্যাত কন্ট্রাক্টর হামিদ জালালের সাথে তার বিয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিলো।

রাত সাড়ে আটটায় হঠাৎ বিয়ে বাড়িতে বাতি নিভে যায়। সেই অন্ধকারে গুলির আওয়াজ আর মেয়েলী কণ্ঠের মর্মবিদারী আর্তনাদ শোনা যায়। ঠিক দু’মিনিট পরেই বাতি জ্বলে ওঠে। তখন গুলিবিদ্ধ ও রক্তস্নাত অবস্থায় মিস রুবিনা রহমানকে ছটফট করতে দেখা যায়। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই তার মৃত্যু হয়।

প্রকাশ, ঘটনার সময় শুধুমাত্র ইস্কাটন ক্লাবেই বাতি নিভছিল।

আশেপাশে সব বাড়িতেই বিদ্যুৎ প্রবাহ ছিল অবিচ্ছিন্ন। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সরকারী গোয়েন্দা মি. সিম্পসন ও শখের গোয়েন্দা জনাব কামাল আহমেদ এই হত্যা রহস্যের তদন্তভার গ্রহণ করেছেন। বিশিষ্ট গোয়েন্দা জনাব শহীদ খান বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তিনি এই কেস হাতে নিতে অস্বীকার করেছেন। তবে মি. সিম্পসন ও জনাব কামাল আহমেদ দ্রুত আততায়ীদের আইনের হাতে তুলে দেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

শহীদ হাসছিল খবরটা পড়া শেষ করে। মহুয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘হাসছো কেন?’

সকালেই বোধহয় গোসল করেছে মহুয়া। ফিরোজা রঙের একটা শাড়ি পরেছে। সকালের শিশিরভেজা তাজা ফুলের মতো লাগছে তাকে। কোঁকড়া চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে। দু-একটা অলকগুচ্ছ এসে পড়েছে কপালের উপর। ফ্যানের বাতাসে নড়ছে একটু একটু। রজনীগন্ধা সেন্টের মৃদু সৌরভ ভেসে আসছে।

মহুয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শহীদ। প্রশ্নের জবাব দিতে ভুলে গেল।

‘আঃ, কি দেখছো অমন করে।’ লজ্জা পেলো মহুয়া। ‘কথার জবাব দাও। হাসছে। কেন?’

আবার মুচকি হাসলো শহীদ। সিগারেট ধরালো একটা। বললো, ‘কামাল দেখছি শিগগির আমার জায়গাটা দখল করবে। ইতিমধ্যেই কাগজে নাম উঠতে শুরু করেছে।’

বাইরে একটা গাড়ির শব্দ পাওয়া গেল। ইঞ্জিন অফ করা হলো। উৎকর্ণ হলো মহুয়া। কামাল এসে গেছে। ইঞ্জিনের শব্দটা ওর চেনা।

জুতোর মচ মচ শব্দ করে কামাল এসে ঢুকলো। ‘সুপ্রভাত, ভাবী। শিগগির নাস্তা দাও। এক সেকেণ্ড ও দেরি নয়।’

‘তা হয় না, কামাল। বলতে গেলে সারাটা রাত জেগেছিস। চট করে গোসলটা সেরে আয়,’ শহীদ বললো।

‘তোকে নিয়ে আর পারা গেল না। বেশ, গোসল করে আসছি।’ নিষ্ক্রান্ত হলো কামাল।

আধঘন্টা পরের কথা। কামাল নাস্তা শেষ করে আয়েস করে সিগারেট ধরালো একটা। এক গাল ধোঁয়া ছাড়লো। মহুয়া টেবিল গোছাচ্ছিল। ওকে একটু উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে।

‘কুয়াশা তার চ্যালেঞ্জ রেখেছে নিশ্চয়ই?’ শহীদ প্রশ্ন করলো।

‘তোর বোধহয় সন্দেহ ছিলো?’ শহীদ হাসলো। অসহায়ের হাসি।

‘কুয়াশার কাছে আমরা কতো অসহায়।’ মহুয়া চুপচাপ শুনছিল আর টেবিল ক্লথের উপর নখ দিয়ে দাগ কাটছিল।

কামাল নারায়ণগঞ্জ রোডের ঘটনা বর্ণনা করলো। মহুয়া জিজ্ঞেস করলো, ‘সরোদটা কোথায়?’

‘গাড়ির ভিতরে। থানায়ই জমা দিতাম। শুধু তোমার ভাইয়ের স্মৃতি হিসেবে নিয়ে এসেছি।’

‘না, আমার দরকার নেই।’ আশ্চর্য কঠিন শোনালো মহুয়ার কণ্ঠস্বর। শহীদ চমকে তার দিকে তাকালো। কিছু বললো না। মহুয়া অকস্মাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘কুয়াশা আমার ভাই নয়। কেউ নয়। কেউ নয়। আমার ভাইয়ের নাম মনসুর আলী। অনেক বছর আগে তার মৃত্যু হয়েছে।’

ঘর ছেড়ে চলে গেল মহুয়া।

শহীদ পিছন পিছন গেল। যাবার সময় বললো, ‘সরোদটা আমাদের শোবার ঘরে পাঠিয়ে দিস কামাল।’

*

ধানমণ্ডিতে বিরাট দোতলা বাড়ি ড. রহমানের। বাড়িটা সম্ভবতঃ তার তাই শিল্পপতি মরহুম হাফিজুর রহমানের। প্রশস্ত গেটটা খোলা। গেটের পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবল কামালকে চেনে। সে খটাশ করে সালাম ঠুকলো একটা। গাড়িটা বাইরেই রাস্তার পাশে পার্ক করে ভিতরে ঢুকলো কামাল।

সাইদুল হক অপেক্ষা করছিল বারান্দায়। কামালকে দেখে ছুটে এলো। বললো, ‘আসুন মি, কামাল। মি. সিম্পসন আর মি. জামান আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। মামার ঘরে।’

সাইদুল হকের পিছন পিছন এগিয়ে গেল কামাল। ড্রইংরুমের পর আরও দুটো কামরা পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলো ওরা। জামান আর সিম্পসন দুটো চেয়ারে গুম মেরে বসে আছেন।

বিছানায় শায়িত ড. রহমানের কপালটা জুড়ে বিরাট এক ব্যাণ্ডেজ। চোখ দুটো বন্ধ। ডান হাতের সামনের অর্ধেকটা ব্যাণ্ডেজে আবৃত। ডান হাতের তালুতে তখন ডাক্তার আরও একটা ব্যাণ্ডেজ করছিলেন মাথা নিচু করে। দশাশই জোয়ান ডাক্তার। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ডাক্তারের সহকারীর মাথায় একটা বিদঘুঁটে টুপি।

কামালের জুতোর শব্দে ডাক্তার মুখ তুলে তাকালেন, আবার নিচু হয়ে ব্যাণ্ডেজ করতে বসলেন। ঘরে ডেটলের গন্ধ।

কামাল ড. রহমানকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল।

লম্বাটে যন্ত্রণাকাতর মুখ। পরনে সিল্কের স্লিপিং গাউন। পেশীবহুল মজবুত চেহারা। একটা টিপয়ের উপর রাখা রক্ত আর ময়লা মুছে ফেলা তুলোর বিরাট ভূপ।

উঃ! আর্তনাদ করে পাশ ফিরে শুলেন ড. রহমান।

‘ঘটনাটা কি ঘটেছিল, মি, সিম্পসন?’ প্রশ্ন করলো কামাল ফিসফিস করে।

‘রাতে কে বা কারা ড. রহমানের ঘরে ঢুকে মিস রুবিনার বিয়ের অলঙ্কার চুরি করেছে। ড. রহমান টের পেয়ে বাধা দিতে যেতেই তাঁকে মারপিট করেছে প্রচণ্ড ভাবে।’

জামান ঘরটা খুটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিল।

সুসজ্জিত কক্ষ। দরজা বরাবর একটা আয়রন সেফ খোলা দেখা যাচ্ছে। মেঝেতে দামী কার্পেট।

দেয়ালে একটা বিরাট আকারের ফটো। স্পষ্টই বোঝা যায় ড. রহমানের যৌবন কালের ছবি। বুদ্ধিদীপ্ত। মুখে মৃদু হাসি! চোখ দুটো উজ্জ্বল। আকর্ষণীয় চেহারা। অনেকক্ষণ ফটোর দিকে চেয়ে রইলো জামান। ডাক্তারের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তার সহকারী যন্ত্রপাতি গুটিয়ে ব্যাগে ভরলেন।

মাথা তুলে কাকে যেন খুজছিলেন ডাক্তার। ‘কিছু খুজছেন?’ সাইদুল জিজ্ঞেস করলো।

‘হাত ধুতে হবে। বাথরুমটা?’ ভারি গলায় আওয়াজ ভেসে এলো।

‘ওঃ, এই যে, এইদিকে যান।’ ডাক্তার বাথরুমে ঢুকলেন। জামান বললো, ‘ড, রহমানকে এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না।’

‘হ্যাঁ, চলুন ড্রইংরুমে বসা যাক। ন’টা বাজলো বলে। কাল রাতে যারা হত্যাকাণ্ডের সময় মিস রহমানের কাছে ছিলেন তাদের জবানবন্দী নিতে হবে।’

‘ওঁরা বোধহয় এসে গেছেন,’ কামাল বললো। ‘চলুন।’ ওরা বেরিয়ে এলো। সাইদুল হকও ওদের সাথে সাথে বেরিয়ে এলো। ড্রইংরুমে এসে বসলো সবাই। সিম্পসন কামালকে বললেন, ‘সকালে ড. রহমানের চাকর সুজাউল্লাহ এসে ড. রহমানকে কার্পেটের উপর পড়ে থাকতে দেখতে পেয়ে আমাকে আর জামানকে খবর দেয়। তোমাকে এখানে এসে টেলিফোন করেছি। ইতিমধ্যে জামান প্রয়োজনীয় তদন্ত সেরে ফেলেছে। শুধু ড. রহমানের কাছ থেকে দু-একটা খবর জানবার জন্যে অপেক্ষা করছি।’

ভিতরে করিডর থেকে ভারি জুতোর আওয়াজ ভেসে এলো। পর্দা তুলে ভিতরে ঢুকলেন ডাক্তার। পিছনে তাঁর সহকারীর দু’হাতে দুটো ব্যাগ। মাথায় সেই বিদঘুঁটে টুপি।

ডাক্তারের বপুটা বিরাট। মুখটা গম্ভীর। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে হাঁটেন।

সিম্পসন সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন দেখলেন ডাক্তার সাহেব?’

সেই ভারি কণ্ঠটা আবার কানে এলো।

‘ভয়ের কিছু নেই। সামান্য আঘাত। দু-চারদিনের মধ্যেই সেরে যাবে।’ বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার সাহেব। মিনিট দুয়েক পরেই গাড়ির গর্জন শোনা গেল।

একজন পুলিস এসে সালাম দিয়ে দাঁড়ালো। ‘জামান সাবকা চিটঠি হ্যায়।’

‘আমার চিঠি?’ হাত বাড়িয়ে দিলো জামান। পুলিস চিঠিটা জামানের হাতে দিয়ে সিম্পসন সাহেবকে বললো, ‘মেমসাহেব লোগ আগায়া সব।’

চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলো জামান।

প্রিয় জামান,

যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলাম তা আংশিকভাবে পূরণ হয়েছে। আবার আসবো এখানে। দেখা হবে।

কুয়াশা। 

জামানের বিস্ফারিত চোখের দিকে চেয়ে সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ব্যাপার জামান?’ চিঠিটা বাড়িয়ে দিলো জামান। সিম্পসন পড়লেন।

আমাদের আবার বোকা বানিয়ে দিয়ে গোল কুয়াশা। এই প্রকাশ্য দিবালোকে। কি উদ্দেশ্যে কুয়াশা এখানে এসেছিল তাই ভাবছিল জামান। কুয়াশা নিশ্চয়ই গতরাতের আগন্তুক নয়। কারণ রাতে কুয়াশা এসে থাকলে অবশ্যই তার উদ্দেশ্য পূরণ করে যেতো।

সিম্পসনও বোধহয় তাই ভাবছিলেন। তিনি হঠাৎ মুখ খুললেন, ‘সমস্ত ব্যাপারটাই খুব ঝাপসা লাগছে।’

কামাল হাসলো। বললো, ‘বলুন কুয়াশাচ্ছন্ন লাগছে।’ সিম্পসনও হেসে উঠে ড্রইংরুমের বাইরে চলে গেলেন। মিনিট খানেক পরে ফিরে এসে বললেন, ‘সময় নষ্ট করে লাভ নেই, জামান। জবানবন্দী সেরে ফেলা যাক এই বেলা। আমি ওদের আসতে বলেছি একে একে।’

সাত

খুট খুট করে পায়ের শব্দ হলো বাইরে থেকে। পর্দা তুলে এক মহিলা প্রবেশ করলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়েস হব। গোল ভাটার মতো চোখ দুটোতে একগাদা কাজল লেপ্টানো। খর্বকায়। স্ফীত দেহ দরজার প্রায় সবটা জুড়ে প্রবেশ করলেন তিনি। হাঁড়ির মতো মুখে কর্তৃত্বের চিহ্ন সুস্পষ্ট। রাজ্যের বিরক্তি মুখে নিয়ে এসে দাঁড়ালেন। এইটুকু হেঁটে এসেই হাঁপাচ্ছিলেন মহিলা।

জামান, কামাল ও সিম্পসন উঠে দাঁড়ালো। ওদের দিকে দৃষ্টিপাত না করে বসে পড়লেন মহিলা। বাজখাই গলায় বললেন, ‘বিয়ে খাওয়ার নিকুচি করি। আগে জানলে এ বিয়েতে যেতামই না। কি হেনস্তা এখন!’

সিম্পসন বললেন, ‘তা আর বলতে। কিন্তু বিপদ হলো খুনের কথা কেউ আগে থাকতে জানিয়ে দেয় না। কিছু মনে করবেন না মিসেস। আই মিন…। যদি দয়া করে…’

‘মিসেস ফকরুন্নেসা কবীর। আমার স্বামী মি. এরফান কবীর ন্যাশনাল এসেম্বলীর মেম্বার। বাসা এই ধানমণ্ডিতেই। রুবিনাকে চিনি বছর পাঁচেক হলো। সে লেখাপড়া শিখে বিলেত থেকে আসার পরেই। আমার মেয়ের বান্ধবী। ড. রহমানকে চিনি তা মাস ছয়েক হবে। এর আগে উনি কন্টিনেন্টে ছিলেন বছর পনেরো। এখন উনিই রুবিনার বাবার ইণ্ডাস্ট্রির ম্যানেজিং ডিরেক্টর।’

ঘন্টায় একশো মাইল বেগে ঝড়টা থেমে গেল। দম নিলেন মিসেস কবীর।

‘আরও শুনবেন?’ গলায় স্পষ্ট ঝাঁজ। ‘রুবিনার বয়েস হবে পঁচিশ। প্রেম করে বিয়ে করতে যাচ্ছিলো। কাল বিয়ের আসরে হঠাৎ বাতি নিভে গেল। তারপর গুলির আওয়াজ হলো। প্রথমে ভেবেছিলাম বাজির শব্দ। কিন্তু তীক্ষ্ণ চিৎকার করে রুবি পড়ে গেল। আমি ওর পাশেই ছিলাম কিনা। ওকে ধরতে গিয়ে গরম ভেজা কি আমার হাতে লাগলো। ভয় পেয়ে গেলাম, বাতির জন্যে চিৎকার শুরু করলাম। তারপর বাতি জ্বলে উঠতেই দেখি রুবির মাথা থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে। কিছুক্ষণ ছটফট করে মারা গেল।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করলেন মিসেস কবীর। শেষের দিকে তার গলার ঝাঁজটা। কমে এসেছিল। হাঁপাতে লাগলেন তিনি।

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলেন। আবার শোনা গেল তার বাজখাঁই কণ্ঠ, ‘আরও কিছু জানবার আছে?’

সিম্পসন মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন।

দ্রুত কামাল বললো, ‘মোটেও না। আপনি আসতে পারেন অনায়াসে। আচ্ছা আদাব। অসংখ্য ধন্যবাদ, ম্যাডাম কবীর।’

বিরাট বপুটা সোফা থেকে কোনও ক্রমে টেনে তুলে বিরক্তি ভরা মুখটা ঘুরিয়ে, বেরিয়ে গেলেন মহিলা।

‘বাপ। বাঁচা গেল। আরেকটু হলে আমি হার্টফেল করতাম। এখনও বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে।’

সিম্পসন আর জামান হাসলো।

সাদিয়া খোরাসানী এলেন। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়েস। হালকা দীঘল দেহ। অস্বাভাবিক ফর্সা রঙ। অনেকটা সাবানের ফেনার মতো। গাঢ় লাল রঙ-এর লিপস্টিক। চর্চিত অধর। বব করা লালচে চুলে অভিজাত সোসাইটির সর্বশেষ হেয়ার-ডু। নেটের মতো কাপড়ের বগলকাটা এক ধরনের কামিজ যুবতীর দেহের সাথে সাঁটা। হালকা নীল রঙ। তার ওপর ওড়না ইংরেজি ভি অক্ষরের মতো করে রাখা। অস্বাভাবিক ফর্সা রঙ এর গালে আবছা লালের আভাস। গলায় সরু চেন। মুখটা শুকনো, বোধহয় একটু আতঙ্ক মাখাও।

ছোট্ট আদাব করে বললো, ‘বলুন কি বলতে হবে? আমি কিন্তু ভালো বাংলা বলতে পারি না।’ মিষ্টি গলার আওয়াজ রিমঝিম করে উঠলো।

সিম্পসন বললেন, ‘তাতে কিছু অসুবিধে নেই। বসুন আপনি।’

জামান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিস খোরাসানীকে লক্ষ্য করছিল। সে দৃষ্টির কাছে মহিলা একটু সঙ্কুচিত হলেন বোধহয়। জামান চোখ সরিয়ে নিলো।

সিম্পসন বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, মিল খারাসানী। নিতান্ত বাধ্য হয়েই আপনাকে বিরক্ত করছি। আমরা…!’

সাদিয়া তর্ক থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মি. সিম্পসন, I understand this is your duty, and this is also my duty to help you find the murderers of my friend. রুবী ছিলো আমার সবচে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। কি ব্যথা যে পেয়েছি তার মৃত্যুতে বিশেষ করে এমন অস্বাভাবিক আর করুণ মৃত্যুতে।’

সাদিয়ার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। মাথা নিচু করে বোধহয় চোখের কোণ মুছলো আলগোছে।

সিম্পসন বললেন, ‘মোটামুটি তথ্য আমরা পেয়েছি। শুধু দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করবো।’

‘বলুন।’

‘মিস রুবীকে যে ঘরে সাজানো হচ্ছিলো খুনের সময় সে ঘরে আপনারা ক’জন ছিলেন?”

‘তিন-চারজন।’

‘কোনও পুরুষ! ছিলো কি?’

‘না। কোনও পুরুষ ছিলো না।’

‘কিন্তু অনেক মহিলাই তো বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তাঁদের অনেকেরই তো থাকবার কথা মিস কবীর সাথে?’

‘তা ঠিক। ছিলও অনেকে। কম করেও জনা পঁচিশেক। কিন্তু বাতি নেভবার মিনিট খানেক আগে বর এসে পৌঁছেছিল। সবাই বর দেখতে ছুটেছিল। ফলে সেখানে তখন ছিলাম মাত্র আমরা ক’জন।’

‘গুলির শব্দ শুনে আপনার কি ধারণা হয়েছিল?’

‘প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। কারণ আশেপাশে অসংখ্য বাজি ফুটছিল। কিন্তু ঘরের মধ্যে হঠাৎ আর্তনাদ শুনলাম আমার পাশেই। রুবীর আর্তনাদ। তখন আমি ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু কিছু বুঝিনি। আলো জ্বলে ওঠবার সাথে সাথে দেখলাম।’

এবারে প্রশ্ন করলো জামান। ‘আচ্ছা, মিস রুবীকে আপনি কতদিন যাবত জানেন, মিস খোরাসানী?’

‘ছোটবেলা থেকেই। রুবীর মতো আমিও শৈশবে মাতৃহারা। তখন থেকেই বিতে দু’জন এক সাথে পড়াশোনা করেছি।’

‘তার সম্পর্কে আর কিছু জানেন? মানে–তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে? অবশ্যি যদি আপত্তি না থাকে।’

কিছুক্ষণ নীরব রইলো সাদিয়া। নখ খুটলো চুপ করে।

‘দেখুন মি. ‘জামান। আসাদুজ্জামান।’ একটু ইতস্ততঃ করলো সাদিয়া, তারপর বললো, ‘এটা হচ্ছিলো রুবীর সেকেণ্ড ম্যারেজ। এর আগে রুবী বিয়ে করেছিল বিলেতে। স্বামীর বাড়ি ঢাকাতেই। বিয়ের পর ভদ্রলোক আমেরিকা যান কয়েকমাসের জন্যে। আর রুবী দেশে ফিরে আসে। ওর স্বামী আমেরিকা থেকে সোজা চলে আসেন ঢাকায়। কিছুদিন পরে দু’জনের মধ্যে মনো মালিন্য দেখা দেয়।’

‘কারণটা বলতে পারেন কিছু?’

‘রুবী বলেছিল ভদ্রলোক নাকি কি এক রকম নেশা করেন।’

‘নামটা হচ্ছে, মারিজুয়ানা,’ জামান বললো।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মারিজুয়ানা।’

সিম্পসন আর কামাল অবাক হয়ে জামানের মুখের দিকে তাকালো। জামানের মুখটা নির্বিকার।

‘তারপর?’ জামান প্রশ্ন করলো।

‘রুবী ব্যাপারটা খুব অপছন্দ করতো। দু’জনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি হতো। শেষটায় রুবী তালাক দিলো ভদ্রলোককে বছর খানেক আগে।’

‘ভদ্রলোকের নামটা জানা আছে আপনার?’

‘ওর নাম হচ্ছে আজিজুল করিম। নিজের ব্যবসা আছে এক্সপোর্ট ইমপোর্টের। মতিঝিলে অফিস।’’

‘তালাকের পর ভদ্রলোকের কি রি-অ্যাকশন হয়েছিল বলতে পারেন?’

‘উনি খুব শাসিয়েছিলেন রুবীকে। আর প্রায়ই টেলিফোনে হুমকি দিতেন। কিন্তু আশ্চর্য কি জানেন, রুবীর সামনাসামনি হলে লোকটা যেন কেঁচো হয়ে যেতেন। কাকুতি-মিনতি করতেন। মাঝে মাঝে ক্লাবে রুবীর কাছেপিঠে ঘুরঘুর করতেন নির্লজ্জের মতো। রুবী বিরক্ত হতো। এইতো কালও…’

‘আরও একটা প্রশ্ন করবো, মিস খোরাসানী?’

‘বলুন।’

‘মিস রহমানকে বিয়ের জন্যে আর কোনও ক্যাণ্ডিডেট ছিলো কি?’

সাদিয়া একটু লজ্জিত হলো যেন। মাথা নিচু করে বললো, ‘অনেক।’

জামান সিম্পসনকে বললো, ‘আমার আর কিছু জিজ্ঞেস করবার নেই। ইচ্ছে করলে আপনি প্রশ্ন করতে পারেন।’

সিম্পসন বললেন, ‘আচ্ছা মিস খোরাসানী, ড. রহমানকে আপনার কেমন মনে হয়?’

‘গম্ভীর রাশভারি লোক। তবে…’

‘তবে কি বলুন…’

‘মেয়েদের সাথে আচরণে যথেষ্ট ভব্য নন।’ লাল হয়ে গেল সাদিয়ার মুখমণ্ডল।

সিম্পসন বললেন, ‘শুনেছি ভদ্রলোক নামকরা বৈজ্ঞানিক। সম্প্রতি বিদেশ থেকে এসেছেন।’

‘জ্বি। আংকল রহমান অর্থাৎ রুবীর বাবার ইন্তেকালের মাসখানেক আগে উনি কন্টিনেন্ট থেকে ফিরে আসেন।’

‘উনি কি বিবাহিত নন?’

‘জ্বি না। এখনও বিয়ে করেননি উনি।’

‘আচ্ছা, মিস খোরাসানী, রুবীর হত্যার ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?’

সাদিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘না। কাউকেই তো সন্দেহ করতে পারছিনে আমি।’

‘আচ্ছা, মিস খোরাসানী, অসংখ্য ধন্যবাদ। অনেক কষ্ট দিলাম আপনাকে। তবে যে তথ্য আপনি দিলেন তাতে আমাদের তদন্তের অনেক সুবিধে হবে।’

এরপর মিসেস জাহেদা করিম আর হামিদ জালালকে জেরা করা হলো। কিন্তু তারা বিশেষ কিছু নতুন তথ্য দিতে পারলেন না। কিন্তু সাইদুল হক যোগ করলো এক বিস্ময়কর তথ্য। সে বললো, ‘কাল সন্ধ্যায় সে ইস্কাটন ক্লাবের সামনের রাস্তার উল্টোদিক দিয়ে পায়চারি করতে দেখেছে আজিজুল করিমকে। ওর দৃষ্টি ছিলো ক্লাবের দিকে।’

‘ঠিক ক’টার সময় বলতে পারেন?’ জামান জিজ্ঞেস করলো দেশলাইয়ের উপর সিগারেট ঠুকতে ঠুকতে।

‘সাড়ে সাতটার দিকে।’

‘আচ্ছা। মিস রুবীর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কাউকে সন্দেহ হয়?’ সাইদের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকালো জামান।

সাইদ বললো, ‘না। তেমন একটা সন্দেহ কাউকে হয় না।’

‘কোনও কারণ অনুমান করতে পারেন?’

সাইদ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো, ‘না, তাও না।’

‘আচ্ছা মি. সাইদ। কাল রাতে ড. রহমানের ঘর থেকে কোনও অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন কি?’

‘জ্বি না। কোনও শব্দই কানে আসেনি আমার।’

‘রাত দুটো পর্যন্ত কি আপনি জেগে ছিলেন?’

‘প্রায় সারারাতই জেগে ছিলাম। কিন্তু তেমন অস্বাভাবিক কোনও শব্দ কানে, আসেনি আমার।’

আট

সাইদকে বিদায় দিয়ে জামান বললো, ‘চলুন মি. সিম্পসন, বাড়ির চারদিকটা একটু ভালো করে দেখে আসি।’

কামাল এতক্ষণ চুপচাপ ছিলো। বললো, ‘উত্তম প্রস্তাব।’ তিনজন ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির পিছন দিকে চললো। দেয়ালের পাশ দিয়ে হাঁটছিল, ওরা। হঠাৎ জামানের চোখে পড়লো ভেজা মাটির উপর একজোড়া জুতোর ছাপ। জামান ইঙ্গিতে ওদের ছাপগুলো দেখালো। জুতোর ছাপ অনুসরণ করে এগোলো জামান।

দালানের পিছন দিকে একটা দরজা পর্যন্ত এসে ছাপটা মিলিয়ে গেছে। দরজাটা ধাক্কা দিলো জামান। ভিতর থেকে বন্ধ। মাটির দিকে লক্ষ্য রেখেই আবার ফিরে এলো জামান। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেয়ালটা পরীক্ষা করে গম্ভীর হয়ে গেল। আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে কি যেন খুজলো সে।

একটা চাকর এসে দাঁড়ালো। সিম্পসন মুখ ফেরাতেই চাকরটা বললো, ‘বড় সাহেব আপনাদের সালাম দিয়েছেন।’

সিম্পসন বললেন, ‘চলো, জামান। ড. রহমান ডেকে পাঠিয়েছেন।’ ওরা এসে তাঁর কামরায় বসলো। ক্লান্ত ভাঙা গলায় ড. রহমান বললেন, ‘আপনাদের কষ্ট দিচ্ছি, মি. সিম্পসন। মেয়েটার খুনের কিনারা করতে পারলেন কিছু?’ কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো ড. রহমানের। দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালেন ড. রহমান।

সিম্পসন জরাব দিলেন, ‘জ্বি না, তদন্তের এই তো সবে শুরু। তবে পারবো। অবশ্যই।’

‘অবশ্যই। আশা করি পারবেন। আর পারতে আমাদের হবেও। আমাদের বংশের একমাত্র দুলালীর্কে যারা হত্যা করেছে তাদের শাস্তি দিতেই হবে।’

উঠে দাঁড়ালো জামান। বললো, ‘যদি কিছু মনে না করেন, ড. রহমান। আপনার ঘরটা একটু ভালো করে দেখতে চাই।’

‘আর দেখে কি হবে বলুন?’ শুকনো গলায় বললেন ড. রহমান।

‘তবুও দেখা ভালো,’ সিম্পসন বলেন।

‘তা দেখুন প্রয়োজন বোধ করলে।’

কামাল আর সিম্পসন খাটের তলা, ওয়ারড্রোব, আয়রন সেফের পিছনটা উঁকি, মেরে দেখলো।

জামান বললো আমি বাথরুমটা দেখে আসি। জামান বাথরুমের ভিতর ঢুকলো। ফিরে এসে বললো, ‘না, কিছু পাওয়া গেল না।’

সিম্পসন আবার বসলেন। বললেন, ‘ড, রহমান ইয়ে মানে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবার ছিলো।’

‘বলুন।’

‘কাল যখন মিস রুবিনা খুন হলেন তার আগে বা পরে তার সাবেক স্বামী আজিজুল করিমকে ইস্কাটন ক্লাব বা তার কাছেপিঠে দেখা গিয়েছিল কি?’

ড. রহমান একটু চিন্তা করে বললেন, ‘সন্ধ্যার দিকে আমি একবার তাকে দেখেছিলাম বটে ক্লাবের সামনে। তাছাড়া…’ চুপ করলেন ড. রহমান।

‘তাছাড়া কি বলুন, ড. রহমান?’

‘রুবী খুন হবার অল্প কিছু আগে একটা লোকের পিছনের দিকটা আর চলার ভঙ্গি দেখে মনে হয়েছিল লোকটা করিম হতে পারে। তবে ব্যস্ততার মধ্যে ঠিক খেয়াল করতে পারিনি। আর করিমের বিয়েতে উপস্থিত হবার কথাও কল্পনাতীত ছিলো, তাই না?’

‘আচ্ছা ঠিক কোন জায়গায় দেখেছিলেন বলতে পারেন?’

‘ভিতরের করিডরে।’

‘হত্যাকাণ্ডের মুহূর্তে আপনি কোথায় ছিলেন?’

ড. রহমান বললেন, ‘আমি তখন গেটের দিকে যাচ্ছিলাম। বর এসে পৌঁছেছিল। তাদের রিসিভ করতে এগোচ্ছিলাম।’

‘কাল রাতে আপনাকে ওরা অ্যাটাক করেছিল ক’টার সময় কিছু বলতে পারেন?’

‘রাত দুটোর দিকে হবে। রাত একটার দিকে শুয়ে পড়েছিলাম। ঘুম হচ্ছিলো। রুবীর কথা মনে হচ্ছিলো বারবার। কখন যেন তন্দ্রা মতে এসেছিল। হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা অস্পষ্ট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেই কে যেন পিছন থেকে জাপটে ধরলো। লোকটার গায়ে অসুরের মতো শক্তি। আমার এই যে ব্যায়াম করে গড়ে তোলা স্বাস্থ্য, তবুও তার কাছে হিমসিম খেয়ে গেলাম। আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘুসি মারবার চেষ্টা করতেই লোহার ডাণ্ডা দিয়ে ডানহাতে প্রচণ্ড আঘাত করলো।’ ব্যাণ্ডেজটা দেখালেন তিনি। ‘তারপর আঘাত করলো মাথায়। পরের কথা আমার আর কিছু মনে নেই।’

‘ক’জন এসেছিল বলে মনে হয়?’

দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালেন ড. রহমান। তার ঠোঁট দুটো নড়ে উঠলো, ‘আমি একজনকেই দেখেছি। কালো মুখোশের ভিতর চোখ দুটো ভাটার মতো জ্বলছিল।’

অনেকগুলো কথা একসঙ্গে বলে হাঁপাতে শুরু করলেন ড. রহমান! চাখ দু’টো বুজে এলো ড. রহমানের। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সিম্পসন ইশারা করলেন কামালকে। সবাই বেরিয়ে এলো।

এক সপ্তাহ পর ইস্কাটন ক্লাবে সন্ধ্যা নেমেছে।

ফ্লোরোসেন্ট টিউবের আলো বিরাট সনের যে কোণটির অন্ধকার ঘোচাতে পারেনি সেখানটায় একটা চেয়ারে বস ছিলো সাইদুল হক। সামনে একটা ফান্টার শূন্য বোতল। অদূরে আরও অনেক মেয়ে পুরুষ বিভিন্ন দল ভাগ হয় আড্ডা মারছে। কেউ তাস খেলছে। সিগারেট জ্বলছে জোনাকার মতা। টুকরো টুকরা করে হাসির খিল খিল শব্দ সাইদুল হকের কানে আসছিল। রাত তখন দশটা। চারদিকে অসহ্য গরম। শ্রাবণের আকাশে জমাটবাঁধা মেঘের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সে। মাত্র সাতদিনেই রুবীকে সবাই ভুলে গেছে। অথচ ক’দিন আগেও সে ছিলো এই ক্লাবের প্রাণ। কিন্তু সাইদুল হক তাকে ভুলতে পারছে কই। রুবীকে যেন এখন স্মারও অনেক বেশি করে মনে পড়ছে তার।

কে যেন পাশে এসে দাঁড়ালো। সাইদ টের পেলো না। ‘সাইদ।’ মমতাভরা একটা গলা কানে এলো। ‘কে?’ মাথা নামালো সাইদ। সাদিয়া খোরাসানী ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘সাদিয়া? বোস।’ চেয়ার দেখিয়ে দিলো সাইদ। মিস খোরাসানী বসলো।

অনেকক্ষণ চুপচাপ রইলো দু’জন। কেউ কোনও কথা বলছে না। অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলো দুজনে।

‘বড় কষ্ট হচ্ছে, সাইদ?’

মলিন হাসি হাসলো সাইদ। অন্ধকারে সে হাসি দেখা গেল না। কিন্তু গলা শোনা গেল, ‘সব কষ্টই একদিন দূর হয়ে যায়, সাদিয়া। তবে সময় লাগে এই যা।’ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো সাইদ।

আবার বললো, ‘তুমিতো জানো। বোন বলতে ভাই বলতে এমন কি মা বলতে একমাত্র রুবীই ছিলো আমার। পৃথিবীতে বলতে গেলে রুবীই ছিলো আমার একমাত্র আত্মীয়া। অথচ তার জীবনের কি ভয়ংকর পরিসমাপ্তি। কিন্তু কারো কোনও ক্ষতি করেনি রুবী। করতে চায়নি। তবুও কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল।’

সাদিয়া হাত বাড়িয়ে সাইদের একটা হাত টেনে নিলো। গভীর মমতায় চাপ দিয়ে বললো, ‘মি. জামানের উপর বিশ্বাস রেখো। অসাধারণ প্রতিভা ভদ্রলোকের। আততায়ীকে ঠিক ধরে ফেলবেন তিনি।’

ক্লিষ্ট হাসি শোনা গেল সাইদের কণ্ঠে।

‘কে জানে? লিলিরই কোনও খোঁজ করতে পারলেন না অ্যাদ্দিনে! কে জানে ওকেও হয়তো রুবীর মতো খুন করেছে।’

শিউরে উঠলো সাদিয়া। আস্তে আস্তে বললো সাইদ আবার, ‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনে রুবিনার উপর এই দুর্বত্তের এতো আক্রোশ কেন? রুবী তো টাকা পয়সা নিয়ে নাড়াচাড়া করে না। টাকা পয়সা তো মামার কাছে।’

‘ওসব কথা ভুলে যাও, সাইদ।’

বাঁ হাতের উপর সাইদের-হাতটা রেখে ডান হাত দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছিলো সাদিয়া। অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বললো না। আলোর দিকে মুখ করে বলেছিল সাদিয়া।

সাইদ হাত টেনে নিতে যাচ্ছিলো। সাদিয়া হাতটা আরও জোরে চেপে ধরলো। ওর হাতটা তখন থর থর করে কাঁপছে। সাইদ অবাক চোখে দেখলো, সাদিয়ার আয়ত চোখের দৃষ্টি সাইদের চোখে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। চোখে চোখ পড়তেই দৃষ্টি নত করলো সাদিয়া। বিহ্বল হলো সাইদ। সাদিয়া সাইদের হাতটা তখন আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরেছে।

সামনে প্রাচীরের উপর থেকে একটি মূর্তি সরে গেল নিঃশব্দে। প্রেমবিহ্বল দুই যুবক-যুবতীর দৃষ্টি তখন পরস্পরকে নতুন করে আবিষ্কারের নেশায় মগ্ন। নিয়নের আবছা আলোয় সাদিয়ার লজ্জারক্তিম মুখটা স্পষ্ট না হলেও তারা হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব করছিল ক্লাবের অস্পষ্ট অন্ধকারে।

বেশ কিছুক্ষণ পর। সাইদ সিগারেট কেসটা খুলে সাদিয়ার সামনে ধরলো। ‘নাও। সিগাকেট কেস দেখে মাথা নোয়ালো সাদিয়া। ‘নাও, লজ্জার কি আছে?’

‘তুমি ধরিয়ে দাও।’

নয়

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।

শফি একটা চিঠি পড়ছিল। ক্ষুদ্র চিঠিটা যেন সারা গায়ে ওর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পড়া শেষ করে ক্রোধে ওর চোখ মুখ লাল হয়ে গেল।

বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ পাওয়া গেল। চিঠিটা পকেটে পুরে নিয়ে দরজা খুললো। বাইরে দাড়িয়ে জামান।

‘আয়, ভিতরে আয়,’ সংবর্ধনা জানালো শফি। জামান ঢুকলো। ক্লান্ত ভঙ্গি। চোখমুখ শুকনো। একটা চেয়ার টেনে বসলো। সিগারেট ধরিয়ে গা এলিয়ে দিলো চেয়ারে। চোখ বুজে কি যেন চিন্তা করতে লাগলো।

শফিও একটা চেয়ার টেনে বসলো। নিঃশব্দে কয়েক মিনিট পার হয়ে গেল। কেউই কোনো কথা বলছে না। অস্বস্তিকর নীরবতায় হাঁপিয়ে উঠলো শফি। কিই বা বলবে? আলোচনার বিষয় তো মাত্র একটাই হতে পারে। কিন্তু সেতো উভয়ের পক্ষই নাজুক। জামান তো ধরেই নিয়েছে যে কুয়াশাই লিলিকে চুরি করে নিয়ে গেছে। এ যে কতবড় মিথ্যে আর কেউ তা না জানলেও শফি তা জানে। কিন্তু, জামান তো বিশ্বাস করতে চাইবে না। কুয়াশা লিলির মাকে চুরি করেছিল, আর কুয়াশার পদ্ধতিতেই লিলিকে চুরি করা হয়েছে। কাকতালীয় এই যুক্তির কাছে জামান আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। জামান মুর্খ নয়। তবুও আবেগের প্রাবল্যে তার স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত শফিই মুখ খুললো। জিজ্ঞেস করলো, ‘লিলির কোনো খোঁজ পেলি, জামান?’

এখন পর্যন্ত না। তবে একটা ভুল শুধরেছি এতদিনে। কুয়াশা কিডন্যাপ করেনি লিলিকে।

শফির মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে বললো, ‘কি করে বুঝলি তুই?’

‘কয়েকটা কারণ। প্রথমতঃ, তোর সাথে লিলির বিয়ের সম্ভাবনার কথা মনে রি। তোকে কুয়াশা যতটা ভালবাসে সে অবস্থায় কুয়াশা আর যাই করুক তোর বাগদত্তাকে চুরি করবে না। দ্বিতীয়তঃ, কুয়াশা শুধুমাত্র একজনকে চুরি করে ক্ষান্ত হবে না। করলে লিলির বয়সের অনেক চুরি করবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত লিলির সমবয়েসী আর কেউ কিডন্যাপ হয়নি। তারপর মিস রুবিনা রহমানের হত্যাকাণ্ডের কথাই ধর। কুয়াশা যদি সত্যি লিলিকে হত্যা করতো তাহলে তার অপরাধবোধই তাকে শহীদ খানের বাসায় যাওয়া থেকে নিবৃত্ত করতো। অন্ততঃ অপরাধতত্ত্বে এই কথাই বলা হয়েছে। মাল্টা-সানিক্সের ব্যাপারটা বুঝতে পারছিনে। ঐখানেই কনফিউশন রয়েছে।’

‘কিন্তু এতো নেগেটিভ সাইড। কে কিডন্যাপ করলো তার হদিস পেলি কিছু?’ শফি প্রশ্ন করলো।

জামান ঘাড় নেড়ে বললো, ‘বেশ কিছুটা।’

শফি একটু ইতস্ততঃ করে পকেট থেকে একটা চিঠি বের করলো। জামানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘পড়।’

জামান চিঠিটা নিয়ে পড়লো।

শফি,

এখনও তোমার শিক্ষা হলো না। যদি লিলির প্রাণ বাঁচাতে চাও তাহলে কুয়াশার থিসিসের যে অংশটা তোমার কাছে আছে সেটা এবার দিয়ে দাও। আমার লোক আজকে তোমার বাড়িতে যাবে রাত ঠিক একটায়। এই শেষ। সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে। যদি অন্যথা হয় আর যদি কুশাক দিয়ে গোলযোগ পাকাবার ব্যবস্থা করো তাহলে লিলিকে খুন করে ফেলা হবে। এরপরে আর কোনও সুযোগ দেয়া হবে না।

নুরবক্স।

এক নিঃশ্বাসে চিঠিটা পড়ে ফেললো জামান। কি যেন ভাবলো অনেকক্ষণ ধরে। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘বলতে পারিস কে নুররক্স?’

শফি বললো, ‘এই নুরক্স এক সময় ছিলো কুয়াশার ঘনিষ্ঠ সহচর। তোরা যখন মাস্কস্টোরে হানা দিল তার কিছুক্ষণ পরই লোকটা কুয়াশার থিসিসের একটা অংশ চুরি করে গায়েব হয়ে যায়। সে আগে থেকেই একটা পাকা ক্রিমিন্যাল ছিলো। পুলিস রেকর্ডে ওর নাম আছে। কিভাবে কুয়াশার সুনজরে পড়েছিল জানি না। আল্টা-সোনিক্সের যন্ত্রটা সে কুয়াশার সান্নিধ্যে এসেই আয়ত্তে এনেছে।’

‘কিন্তু একটা সামান্য ডাকাত কুয়াশার থিসিস নিয়ে কি করবে?’ জামান জিজ্ঞেস করলো।

‘দুনিয়ার সব দেশের অপরাধীদের মধ্যে আছে নিষ্ট আদান-প্রদান। অনেক সময় ওরা একটা দেশের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার চুরি করে অন্য দেশে বিক্রি করে দেয়। হয়তো তেমনি কোনও মতলব আছে ওর। তবে অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে।’

জামান কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো, ‘এই কি তোর কাছে লেখা নুরবক্সের প্রথম চিঠি?’

‘না। আরও চঠি আছে। প্রথমদিন থেকেই আমি জানতাম কে লিলিকে কিডন্যাপ করেছে, আর কেন করেছে। কারণ নুরবক্স বহুদিন ধরেই আমাকে শাসাচ্ছিল। বুঝতেই পারছিস আমাকে জব্দ করার জন্যে লিলিকে চুরি করা হয়েছে।’

‘কিন্তু সে কথা আমাকে এতদিন কেন বলিসনি?’ বিরক্ত হয়ে বললো জামান।

‘বলিনি, কারণ তোদর কুয়াশা-ম্যানিয়ায় পেয়ে বসেছিল। কিন্তু তাই বলে তো আমি বসে নেই। নুরবক্সকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি।«

‘তা তুই কি করলি চিঠির ব্যাপারে?’ অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলো জামান।

‘তার মানে?’

‘নুরবক্সের এজেন্ট আজ রাতে আসবে তোর কাছে। তুই কি থিসিসটা দিয়ে দিবি?

‘তুই কি বলিস?’

‘দিয়ে দে থিসিসটা।’

শফি অবাক হয়ে জামানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। শফির চোখের দিকে চেয়ে কি একটা ইঙ্গিত করলো জামান। তারপর বেশ উঁচু গলায় বললো, ‘দিয়ে দে নুরবক্সকে কুয়াশার থিসিসটা। ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমার কথাটা রাখ। তোকে মিনতি করছি।’ জামান উঠে গিয়ে শফির হাতটা ধরে চাপ দিলো। ‘লিলিকে বাঁচা তুই।’

‘ওসব উদ্ভট জিনিস দিয়ে তোর, আমার দরকারই বা কি?’ ওর গলায় আকুতি ঝরে পড়লো।

শফি ইঙ্গিতটা বুঝে নিয়ে সায় দিলো, ‘ঠিক আছে, তুই যখন অতো করে বলছিল, তখন তাই হবে।’ কেমন ঠাণ্ডা শোনালো ওর গলা।

বিদায় নিয়ে জামান চলে গেল। একটা লোক অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ওর সামনে দিয়ে। সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠলো জামানের ঠোঁটের কোণে।

হাঁটতে হাঁটতে আজিমপুর কলোনীর বাস স্ট্যাণ্ডের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো জামান। সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিকে চেয়ে দেখলো। না, কেউ ওকে অনুসরণ করছে না। নিউ মার্কেটগামী একটা বাসে চেপে বসলো জামান। পরের স্টপেজেই নেমে পড়লো। চলন্ত একটা স্কুটার থামিয়ে উঠে পড়লো তাতে।

রাত সাড়ে বারোটা বাজে। কৃষ্ণপক্ষের ঘন অন্ধকার রাত। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। মোড়ে লাইটপোস্টের নিচে একটা রিক্সা দাঁড়িয়ে। হডলোলা রিক্সাটার মধ্যে পরম নিশ্চিন্তে সিগারেট টানছে রিক্সাওয়ালা। পথ নির্জন। মাঝে মাঝে দু’একটা মোটর গাড়ি বা স্কুটার নির্জনতা ভঙ্গ করে চলে যাচ্ছে। রিক্সাওয়ালা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে গাড়িগুলো। লুঙ্গি আর ময়লা শার্ট গায়ে একজন সামনের দিক থেকে দ্রুত পায়ে হেঁটে আসছিল।

রিক্সাওয়ালা তার দিকে চেয়েছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। লোকটা এসে দাঁড়ালো রিক্সার পাশে। 

‘ওরা এসে গেছে?’ প্রশ্ন করলে রিক্সাওয়ালা। তার গলায় উত্তেজনার আভাস।

‘হ্যাঁ, মি. জামান।’ লোকটা অর্থাৎ কামাল চাপাস্বরে বললো। ‘এসে গেছে ওরা ওই দিক দিয়ে। এই দিকে বেরোবে বলে মনে হচ্ছে। আপনি মোটর সাইকেলের কাছে চলে যান। আর কাপড়টা পাল্টে ফেলুন।’

জামান কোনও কথা বললো না। অন্ধকারে মিলিয়ে গেল দ্রুত। কামাল গিয়ে রিক্সায় বসলো। ‘বাহ বেশ লাগছে’ –মনে মনে বললো। ‘এখন একটা সওয়ারী পেলেই খেলাটা জমবে ভালো।’

একটা সিগারেট ধরালো কামাল। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। একটু পরে একটা কালো অস্তিন চলে গেল রিক্সার পাশ দিয়ে। পিছনে দূরত্ব বজায় রেখে হেডলাইট নেভানো একটা মোটর সাইকেল বেরিয়ে গেল।

আর কয়েক সেকেণ্ড পর কামালকে বিস্মিত করে দিয়ে আরও একটা মোটর সাইকেল চলে গেল ওর পাশ দিয়ে।

লাইটপোস্ট থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় দেখা গেল মোটর সাইকেল আরোহী হাত নাড়লো কামালের দিকে। সিগারেটে টান দিতে ভুলে গেল কামাল। কুয়াশা!

দশ

সাইদ যখন সাদিয়াকে নিয়ে ক্লাব ত্যাগ করলো বৃষ্টি তখন চেপে এসেছে। সারাপথ নির্বাক রইলো দু’জন। কি যেন এক বিচিত্র অনুভূতির স্পর্শে দু’জনের কথা হারিয়ে গেছে। তবুও ওদের মনে হচ্ছিলো যেন নীরবে তারা অনেক কথার জাল বুনে চলেছে।

পিছনে একটা গাড়ি অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে ওদের অনুসরণ করতে লাগলো।

সাইদ ভাবছিল রুবিনা বেঁচে থাকলে কতো খুশি হতো। আর ঠাট্টার ছলে পাগল করে তুলতে দু’জনকেই। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো সে।

সাদিয়া মুখ ফিরিয়ে বললো, ‘রুবিনার কথা ভাবছো?’

‘হ্যাঁ। রুবিনা বড্ড খুশি হতো। তাই না?’

সাদিয়া কোনো জবাব দিলো না। দীর্ঘনিঃশ্বাস চেপে গেল। গাড়ি এগিয়ে চললো নিঃশব্দে। সাইদের চিন্তা-স্রোত মোড় পরিবর্তন করলো। চারদিকের বৃষ্টি, অন্ধকার আর নৈঃশব্দ ছায়া ফেলেছে ওর মনে। সাইদের মনে হলো সমগ্র পৃথিবীটা যেন তার চারদিক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আছে এই পথটা, চলমান এই গাড়িটা! আর ওরা দু’জন। জনহীন এই পথটা যদি হয় সমগ্র পৃথিবী, এই গাড়িটা তাহলে ইডেন উদ্যান। আর ওরা দু’জন আদিম মানব-মানবী। নিয়ন-গ্যাস শোভিত বৃষ্টি-ক্লান্ত এই পথের পৃথিবীটা যেন শেষ না হয়–মনে মনে আর্তি জানালো সাইদ। কিন্তু পৃথিবীটা সত্যি বড় ছোটো। ভাবতে বাধ্য হলো সে। চলমান ইডেন উদ্যানটা মোড় ঘুরে সরু পথ বেয়ে এসে থামলো সাইদের সাময়িক পৃথিবীর শেষ প্রান্তে। সাদিয়াদের বাগানের বড় বড় গাছের পাতাগুলো মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো প্রেমিক দম্পতিকে। গাড়ির ভিতরে বাতিটা জ্বলে উঠলো।

পিছনের গাড়িটা মোড়ের কাছে এসে নিঃশব্দে থামলো। ‘ভিজে যাবে যে সাদিয়া। ঠাণ্ডা লাগবে।’ সাইদের গলায় স্পষ্ট উদ্বেগ। খিল খিল করে হেসে উঠলো সাদিয়া। ‘হাসলে যে?’ অবাক হলো সাইদ।

‘ওমা, একটু সময়ের মধ্যে এতো। আর আমি তোমাকে কতো শক্ত, কাঠখোট্টা পুরুষ ভেবে বসেছিলাম।’ অবাক হবার ভান করলো সাদিয়া চোখ দুটো বড় বড় করে।

‘দুষ্ট মেয়ে।’ গালে টোকা দিলো একটা সাইদ।

গাড়ির দরজা খুললো সাদিয়া। বৃষ্টির ছাঁট আসছে।

‘কাল কখন আসছো?’ জিজ্ঞেস করলো সাদিয়া। তারপর নিজেই বললো, ‘সকালে এসো। নানীর সাথে আলাপ করিয়ে দেবো। উনি খুবই খুশি হবেন। এসো কিন্তু।’ গাড়ি থেকে নামলো সাদিয়া।

‘আমার তো এখুনি যেতে ইচ্ছে করছে।’’

‘আহা! তা আর করবে না? তোমরা সবাই এক রকম। ঢুতেই নুয়ে পড়ো। যাও, বাড়ি গিয়ে সুশীল বালকের মতো ঘুমিয়ে পড়গে। টা টা।’

মিষ্টি হেসে অপসৃয়মান সাদিয়ার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো সাইদ।

সরু পথ। সামনে একটা অস্টিন আড়াআড়িভাবে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। এগিয়ে গিয়ে হর্ন দিলো সাইদ কয়েকবার। বিরক্ত হয়ে গাড়ি থামালো। হঠাৎ ওর মনে হলো গাড়ির দু’পাশে জানালার ধারে কারা যেন এসে দাঁড়ালো। অজ্ঞাত আশংকায় বুকের মধ্যে দুরুদুরু করে উঠলো সাইদের। ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টির ফোঁটা জমা জানালার কাঁচের ওপাশে দুটো অস্পষ্ট মানুষের মুখ। ডাইনের দিকের জানালায় টোকা দেয়ার শব্দ কানে এলো। একটা হাতও দেখা গেল আবছা।

সাইদ কম্পিত হাতে কাঁচ নামাবার হাতল ঘোরালো। বাইরে দাঁড়ি, একজন মুখোশ পরা লোক। তার গায়ে রেনকোট, হাতে একটা রিভলভার ওর বুকের দিকে উদ্যত।

চাপা গলায় লোকটা বললো, ‘একটু শব্দও করবে না, বাছাধন। করলে জানটা এখানেই শেষ করে দেবো। দু’হাত তোলো উপরে।’ সাইদ যন্ত্রচালিতের মতো দু’হাত উপরে তুললল। লোকটা ইঙ্গিত করতেই আরও দু’জন লোক এগিয়ে এলো।

চারদিকে আবার তাকিয়ে দেখলো সাইদ। অদূরে সাদিয়াদের বাড়ি। সে হয়তো কল্পনাও করেনি যে তাদের বাড়ির এতো কাছে তারই পরম প্রিয় লোকটা দুবৃত্তদের হাতে ধরা পড়েছে।

‘চুপচাপ বেরিয়ে এসো।’ ধমকে উঠলো মুখোশধারী। ‘নইলে খুলি উড়ে যাবে এক সেকেণ্ডের মধ্যে। বেরিয়ে এসো জলদি।’

সাইদ ভয়ে কাঁপছিল। ওর দুটি চোখ তখন বিস্ফারিত। ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নামলো সে হাত মাথার উপর তুলে।

আধ মিনিটের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে গেল সাইদ। মুখোশধারীর পাশের লোকটা গাড়িতে উঠে বাম দিকের আর পিছনের দরজা খুলে দিলো।

‘নাও। লক্ষ্মীছেলের মতো গিয়ে বসো।’ পিছনের দিকে ইঙ্গিত করলো লোকটা।

পিছনের সিটে গিয়ে বসলো সাইদ। তার দু’পাশে দু’জন লোক এসে বসলো। তাদের হাতে ছোরা। লোক দুটোর গায়ে গেঞ্জী। পরনে হাফ প্যান্ট। মুখে উৎকট গন্ধ। আর একজন এসে বসলো ড্রাইভিং সিটে।

মুখোশধারী বললো, ‘খুব সাবধান, রজব।’ ওরা কেউ কোনও জবাব দিলো না। পথের পাশে বিদ্যুতের আলোয় দেখা গেল মুখোশধারী চারদিক একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখে নিয়ে অস্টিনের দিকে এগিয়ে গেল দ্রুত। সাইদের মনে হলো মুখোশধারীর কণ্ঠস্বরটা যেন তার অতি পরিচিত।

ওর ডান পাশের লোকটা হঠাৎ অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠলো, ‘কি যে ঝকমারী। কর্তার কাণ্ডটাই এমনি। এখানে শেষ করে দিলেই হতো। তা না বয়ে নিয়ে চলো।’

ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটা গর্জন করে উঠলো, ‘বেয়াদবের মতো কথা বলবি না, জুম্মন। নিজের জানটাই শেষ হয়ে যাবে।’

লোকটা আর উচ্চবাচ্য করলো না।

আতংকে অর্ধবিলুপ্ত চেতনায় সাইদের মনে হলো ওকেও নিয়ে যাচ্ছে খুন করার জন্যে। মেরুদণ্ডের ভিতরটা শির শির করে উঠলো। অমৃতের মতো আচ্ছন্ন হয়ে বসে রইলো সে।

ইঞ্জিন স্টার্ট নেবার শব্দ শোনা গেল। কিন্তু সামনের গাড়িটা তখনও ঠায় আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ সামনের দিক থেকে একটা চাপা গর্জন ভেসে এলো। আর পরমুহূর্তেই সাইদের চোখে পড়লো মুখোশধারী অস্টিন থেকে মুখ থুবড়ে পথের উপর পড়ে গেল।

সাইদের গাড়ির লোকগুলো চঞ্চল হয়ে উঠলো। মুখোশধারী উঠে দাঁড়িয়ে ওদের পাশ দিয়ে দৌড় দিলো। তার পিছনে ছুটে আসছে আরও দু’জন লোক। তাদের হাতের পিস্তল ঝিকমিক করে উঠলো নিয়ন বাতির আলোয়। সাইদের পাশের লোকটা গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললো, ‘সর্বনাশ! কুয়াশার দল।’ তিনজনেই গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড় দিলো এক পলকের মধ্যে।

পিস্তল হাতে যারা দৌড়ে আসছিল তাদের একজন এসে সাইদের গাড়িতে উঁকি দিলো। অন্ধকারে কিছু বোধহয় দেখতে পেলো না। হতভম্ব সাইদের মুখের উপর টর্চের আলো এসে পড়লো। তার হাতটা উঠে এলো চোখের ওপর। কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে অন্ধকার দেখলো সাইদ। কিন্তু কণ্ঠস্বর কানে এলো।

‘এই যে ভাইয়া, গাড়িতেই আছেন উনি।’ দরজাটা খুলে ফেললো লোকটা। সাইদ আবার শঙ্কিত হলো।

দীর্ঘ বিশাল একটা মূর্তি সাইদের চোখে পড়লো জানালার ভিতর দিয়ে রাস্তার দীপালোকে। দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। গায়ে রেনকোট। মাথায় হ্যাট।

পিস্তলধারী আর তার সঙ্গীরা ফিরে এসে দাঁড়ালো, নিচু গলায় বললো, ‘পালিয়ে গেছে ওরা।’ সেই বিশালদেহী মূর্তিটা দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে বললো, ‘কিছু ভয় নেই, সাইদ। ওরা পালিয়েছে।’ ভরাট গলা কানে এলো তার।

সাইদ হাঁ করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। কথা বলবার শক্তিটাও সে হারিয়ে ফেলেছে একের পর এক দুঃস্বপ্নময় ঘটনার আবর্তে।

লোকটা বোধহয় তা বুঝতে পারলো। হাত বাড়িয়ে আস্তে করে ঝাঁকুনি দিলো সাইদের কাঁধে। একটু মিষ্টি হাসি হাসলো। সে হাসিতে অভয়ের আশ্বাস।

‘ভয় পাচ্ছো, সাইদ। আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি তোমাকে বাঁচাতেই এসেছি। চলো তোমাকে নিরাপদ কোথাও পৌঁছে দিই। আর দেরি করা যায় না এভাবে পথের মাঝখানে। কে জানে হঠাৎ হয়তো পুলিসের লোকগুলো মাটি ফুঁড়ে উদয় হতে পারে। তবে তোমাকে তো তোমাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া নিরাপদ নয়। সেখানে তোমার উপর তাহলে আবার হামলা হবে। আপাততঃ আমার সাথে যেতে হবে তোমাকে।’

‘কোথায় যেতে হবে?’ সাইদ জিজ্ঞেস করলো। ওর অকস্মাৎ মনে হলো যদি তার একটিমাত্র হিতার্থ থাকে তাহলে সে তার সামনে দাঁড়ানো এই বিশালদেহী মূর্তিটা। বোধহয় শুধু মাত্র তার উপরই নির্ভর করা চলে সমগ্র পৃথিবীতে। সাইদ প্রশ্ন করলো, ‘আপনি কে?’

জবাব এলো, ‘আমি কুয়াশা।’

স্বপ্ন দেখছিল সাইদ। সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে কাটতে অবশ হয়ে গেছে ওর দেহটা। পাড়ে এসে পৌঁছতে পারছে না। রুবিনা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো। গুণ্ডারা ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সাইদের দিকে নজর পড়ায় গুণ্ডারা রুবীকে এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দিয়ে ওর দিকে এগিয়ে এলো। ডুব দিলো সাইদ। বিরাট একটা তিমি মাছ হাঁ করে ওকে ধরতে গেল। চিৎকার করতে গিয়ে দেখে মাছটা কামাল হয়ে গিয়ে হাসতে শুরু করেছে। দৃশ্য পালটে গেল। কে যেন বললো, ‘জানিস জর্জিয়া থেকে কালচারাল মিশন এসেছে, ঠাটারী বাজারের রাস্তা বন্ধ করে কাওয়ালী গাইব।’ হেসে, উঠলো লোকটা। রাস্তা দিয়ে চার আনা দামের বেহালা বাজাতে বাজাতে একটা লোক যাচ্ছে। তার পিছনে ভিড়।

ঘুম ভেঙে গেল সাইদের। কে যেন সরোদ বাজাচ্ছে। খুব কাছে। মনে হয় পাশের ঘরে। চমৎকার বাজাচ্ছে তো! কে বাজায়? কুয়াশা? হতে পারে। হাতটা কি মিষ্টি! অপূর্ব সুরেলা বাজনা। সুরের পরিচয় জানে না সাইদ। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত সম্পর্কে ওদের সমাজের উৎসাহ কম। সাইদেরও নেই। কিন্তু এই নিশুতি রাতে সরোদের সুরের মায়াজালে যেন অমৃতময় অতীন্দ্রিয়া জগতের দ্বার খুলে দিলো তার সম্মুখে।

এমন সুরেলা সরোদ বাজানো শোনেনি কখনো সাইদ। শিল্পী যেন সুরের ঐশ্বর্য মুঠোয় মুঠোয় ছড়িয়ে দিচ্ছে। একান্ত হয়ে গেছে সঙ্গীতের মূৰ্ছনার মধ্যে। কুয়াশা বাজাচ্ছে? কুয়াশা এতো বড় শিল্পী। অথচ আইনের চোখে সে ঘৃণিত অপরাধী। হিসেব মেলাতে পারছে না সাইদ। ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লো সে।

সরোদ থেমে গেল। গভীর স্নেহে প্রিয় বাদ্যযন্ত্রটাকে পাশে রেখে দিলো কুয়াশা। তার গুলোর উপর আস্তে আস্তে টোকা দিলো। শব্দ হলো টুংটুং। হুইস্কির গ্লাসটা তুলে নিলো কুয়াশা। রাত শেষ হয়ে আসছে। পাশের ঘরের নিদ্রিত সাইদের ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে সাইদ।

অনেক-অনেক কথা ভিড় জমালো কুয়াশার মনে। কামালের প্রশ্ন মনে পড়লো। ‘মানুষের প্রতি যখন এমন গভীর মমতা আপনার, তাহলে নিজে কেন বিজ্ঞানের নামে প্রাণ সংহারে মেতেছেন?’ এ প্রশ্ন শুধু কামালের নয়। সারা দেশ, সমগ্র পৃথিবী যেন কামালের মুখ দিয়ে ঐ প্রশ্নটা করিয়ে নিয়েছে। কুয়াশা ভাবছিল এইখানেই তার জীবনের শোচনীয় ট্রাজেডী। কেউ তাকে বুঝলো না। মানুষের কল্যাণই যে তার উদ্দেশ্য, এই কথাটা কেউই সহানুভূতির সাথে ভেবে দেখলো না। সবাই জানলো সে খুনী। আইনের চোখে অপরাধী। তাকে অপরাধী মনে করে নিয়েই তার পশ্চাদ্ধাবন করছে সিম্পসন, জামান, কামাল, এমনকি শহীদ খানও। এই জন্যেই সাধনায় সার্থকতা লাভের মুহূর্তে আইন নিষ্ঠুর আঘাত করেছে তাকে। কিন্তু কেন? সত্যি কি সে অন্যায় করেছে? হ্যাঁ, মানুষের তৈরি আইনের চোখে সে অন্যায় করেছে বৈকি! কিন্তু বিবেকের কাছে কোনও অন্যায় নে করেনি। তবুও তার সিদ্ধি লাভ বানচাল হয়েছে আইনকে লংঘন করতে গিয়েই। অনন্তকাল ধরে মানুষ যে আইন তৈরি করছে তার সাথে বিজ্ঞানের এই সংঘর্মর জন্য কে দায়ী? তার নিজের অবারতা? বোধহয় তাই।

সে তাড়াতাড়ি সিদ্ধিলাভ করতে চেয়েছিল। ধৈর্যের বাঁধ মানছিল না তার দ্রুত জয়লাভের অসীম আগ্রহ। তাই প্রচলিত পথ ছেড়ে অন্য প্রাণীর উপর পরীক্ষায় সময় অপচয় না করে প্রথমেই পরীক্ষা চালিয়েছে মানুষের উপর। তার জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে অনেককে-কিন্তু তাদের মৃত্যু কুয়াশা চায়নি। কুয়াশা চেয়েছিল তাদের কল্যাণ, জ্বরা থেকে তাদের মুক্তি। তবু সংঘাত বেধেছে আইনের সাথে। এর চেয়ে যদি সে প্রচলিত প্রথায় গবেষণা চালাতো তাহলে আজ তাকে অপরাধ বলে ঘৃণা পেতে হতো পালিয়ে ফিরতে হতো না অপরাধ জগতের পশুদের মতো।

কোথায় যেন বিরাট ভুল হয়ে গেছে শুধুমাত্র অধরতার কাছে আত্মসমর্পণ করে। এবার থেকে শুধরে নিতে হবে।

‘এবার থেকে শুধরে নেবো।’ আপন মনে আবৃত্তি করলো কুয়াশা।

এগারো

আজিজুল করিমের অফিস থেকে বেরিয়ে জামান সোজা চলে গেল সিম্পসনের অফিসের দিকে। সিম্পসন ওর জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।

জামান ঘরে ঢুকতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি, কিছু পাওয়া গেল?’

জামান বললো, ‘হ্যাঁ, অনেক কিছু। কিন্তু অনেক কষ্টে। ব্যাটাচ্ছেলে কিছুতেই ধরা দিতে চায় না। কাক খেয়ে সে স্বীকার করলো যে, মিস রুবিনার বিয়ের মজলিসে সে গিয়েছিল ঠিকই, তবে খুনের কথা কিছুই জানে না। কিন্তু সেখানে কেন গিয়েছিল তা কিছুতেই বললো না। অবশ্যি কিছু এসে যায় না। লোকটা আসলে একটা গর্দভ।’

সিম্পসন বললেন, ‘ এদিকের খবর কিন্তু খুবই খারাপ।’

‘কী?’ সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলো জামান।

‘সাইদ আর মিস খোরাসানী নিখোঁজ হয়েছে।’

জানান চমকে উঠলো। বললো, ‘দু’জনই নিখোঁজ?’

‘হ্যাঁ দুজনই। মিস খারাসানীকে কিডন্যাপ করা হয়েছে জানালার শিক গলিয়ে।’

‘আর সাইদকে?’ সিগারেটে টান দিলো জামান।

‘সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে সাইদ রাতে বাড়ি ফেরেনি। ওদের শেষ দেখা গেছে ইস্কাটন ক্লাব থেকে গত রাত এগারোটার দিকে বেরোনোর সময়।’

সিগারেটে টান দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাবলে জানান। তারপর বললো, ‘ঠিক আছে, মি. সিম্পসন। আমাদের স্ট্র্যাটেজীটা পাল্টাতে হবে।’

এবার দু’জন মিলে অনেকক্ষণ পরামর্শ করলো। কয়কটা জায়গায় টেলিফোন করলেন সিম্পসন।

জামান চলে এলো বাসায়। সেখানেও তার জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল।

জামান বাসায় পৌঁছুতেই ছোটচাচা হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলেন, ‘শফির খবর কিছু জানিস?’

জামান থমকে দাঁড়ালো, ‘তার মানে?’

‘মানে আর কি? আমি সকালে গিয়েছিলাম শফির বাসায়। শফি নেই। ওর সমস্ত ঘর কারা তছনছ করে রেখে গেছে। বই-পত্র মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দুয়ার খোলা।’

জামান বললো, ‘এমনটিই আশংকা করছিলাম।’

‘আশংকা করেছিলি মানে? তাহলে এমনটি যাতে না হয় তার চেষ্টা করিসনি কেন?’

‘চেষ্টার ত্রুটি করিনি, চাচাজান।’ নিজের ঘরে ঢুকলো জামান। চাচাজান পিছন পিছন ঢুকলেন, ‘লিলির খবর কিছু পেলি?’ হতভাগী বেঁচে আছে, না-’ গলাটা আর্দ্র হয়ে গেল তাঁর।

জামান কোনও জবাব দিলো না।

বাইরে একটা গাড়ি থামবার শব্দ পাওয়া গেল। জামান নিজেই বেরিয়ে এলো। বারান্দার সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে আজিজুল করিম। মুখটা শুকনো।

জামান এগিয়ে এলো। ঠোঁটের কোণে বিচিত্র হাসি। বললো, ‘আসুন আসুন করিম সাহেব। আমি জানতাম আপনি আসবেনই। চলুন ড্রইংরুমে।’

কামাল ফুলছিল আর শহীদ মুখ টিপে হাসছিল। তার হাসি দেখে জ্বলে উঠলো কামাল। বললো, ‘দ্যাখ, শহীদ। আমার নতুন গুরুদেব যে এতো শিগগির কুয়াশার সন্ধান পাবে, লিলিকে খুঁজে বের করবে, আর রুবিনার হত্যা রহস্যের সমাধান করবে এমন মনে করার কি কারণ আছে বল? একা কুয়াশাই তো তোকে কম ঘোলা পানি খাওয়ায়নি। পেরেছিস তাকে ধরতে? কলা দেখিয়ে বিদায় দিয়েছে না?’

শহীদ বললো, ‘না পারিনি। কিন্তু তোকে তো আমার চাইতে অনেক বেশি ট্যালেন্টেড লোক মনে করি কিনা। তাই তোর ব্যর্থতায় অবাক না হয়ে পারছিনে।’

‘ফাজলামো হচ্ছে?’

‘যাক, এখন মোদ্দা ব্যাপার দাঁড়ালো তুই তাহলে লিলিরও খবর সংগ্রহ করতে পারিসনি আর রুবী হত্যারও কোনও কিনারা করতে পারিসনি।’

‘আহা। যেন আমি একাই মহাপুরুষদের পশ্চাদ্ধাবন করছি।’

শহীদ সিগারেট ধরালো। দেশলাই-এর কাঠিটা নিভিয়ে আসাটতে ফেলে দিয়ে বললো, ‘কিন্তু জামান আর সিম্পসন তো পৌঁছে গেছে তদন্তের শেষ প্রান্তে। এতদিন জামান তো শুধু শুধুই ঢাকা শহর ঘুরপাক খায়নি রাতদিন।’

‘কই আমাকে তো কিছু বলেনি?’

‘বলবে কিরে, হতভাগা। তোর চোখ কান নেই? আমার ধারণা জামান চলছে ঠিক পথ ধরে। দু’একটা ভুল না করছে এমন নয়। মনে হচ্ছে, ওর মনের সন্দেহটা এখন সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে গেছে।’

‘এসব কি উদ্ভট কথা বকছিস তুই?’

‘উদ্ভট নয়রে, উদ্ভট নয়। কুয়াশা-নাটকের বর্তমান দৃশ্যে একই ব্যক্তি দ্বৈতচরিত্রে অভিনয় করছে। সেই মহাধূর্ত ব্যক্তিটি এমন একটা জটিল অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে আসল অপরাধীকে হাতের মুঠোয় আনতে রীতিমত বেগ পেতে হচ্ছে জামানকে। তাছাড়া মূল নায়ক কুয়াশাও ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে বেড়াচ্ছে। আর জামান দু’দিক দিয়ে তাল সামলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে।’

‘মানে তুই বলতে চাচ্ছিস…’

‘আমি বলতে চাচ্ছি যে, তোর মাথায় আচ্ছা করে ঝাঁকুনি দে। ঘিলুর সেলগুলো থেকে মরচে খসে পড়ুক।’

‘ঠাট্টা রাখ, শহীদ।’

‘ঠাট্টা নয়। ঘটনাগুলোকে আনুপূর্বিক সাজিয়ে ফেল। আর তার মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা কর। রুবিনাকে খুন করা হবে কুয়াশা তা জানতো। তার মানে হত্যাকারী তার অতি পরিচিত। এমন কি তার ইচ্ছার সাথেও কুয়াশার পরিচয় আছে। রাতের বেলাই ড. রহমানের ঘরে ডাকাতি হলো। কুয়াশা নিশ্চয়ই ডাকাতি করেনি। সামান্য পণ্যের জন্যে কুয়াশা ডাকাতি করবে না। আবার সকাল বেলাতেই ডাক্তার বেশে কুয়াশা ড. রহমানের বাড়ি গেল। কেন গেল? কি তার উদ্দেশ্য? রুবিনাকে হত্যাই বা করা হলো কেন? ঘটনাস্থলে তার ভূতপূর্ব স্বামীকেই বা দেখা গেল কেন?’

‘তুই-ই বল।’

শহীদ হো হো করে হেসে উঠলো, ‘আমি বলবো কেন? বলবি তুই। এই ঘটনা গুলোর মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করলেই নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবি। ’

সিগারেটে লম্বা টান দিলো শহীদ। কামাল শহীদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ধোঁয়া ছেড়ে শহীদ বললো, ‘তবু জামান শেষরক্ষা করতে পারলে হয়।’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ পাখি পালাচ্ছে। তার ডানা ঝটপটানির শব্দ আসছে স্পষ্ট।’

বারো

রাত প্রায় এগারোটা। শ্রাবণের বুড়িগঙ্গা পূর্ণযৌবনা। দু’কূল প্লাবিত করে বাকল্যাণ্ড বাঁধ ছাপিয়ে উঠবার চেষ্টায় ব্যাপৃত।

অসংখ্য ছোটবড় নৌকা, লঞ্চ চলছে। বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘাটে মানুষের ভিড় আর কোলাহল। চোঙা হাতে যাত্রীদের প্রতি সাদর আমন্ত্রণ। আলো আর অন্ধকার পাশাপাশি যুদ্ধে প্রমত্ত।

একটা রিক্সা ওয়াইজঘাটে এসে থামলো। কামাল আর শহীদ নামলো রিক্সা থেকে। সামান্য ছদ্মবেশ নেয়ায় ওদের চেনা যাচ্ছিলো না। দু’জনের হাত দুটো ব্যাগ। ইনশিওরেন্সর এজেন্টের মতো দেখাচ্ছিল দু’জনকেই। কামাল একটা সিগারেট ধরিয়ে এদিক-ওদিক চাইলো। সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়লো না।

রিক্সার ভাড়া চুকিয়ে নদীর তীরে গিয়ে পৌঁছলো ওরা চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে। একটা লোক, এগিয়ে এলো, ‘এই যে স্যার, কই যাইবেন? মাদারীপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা।’ জোরে জোরে বললো লোকটা।

‘নবীপুরের লঞ্চটা কোথায় বলতে পারো?’

‘পুবে, স্যার। মাঝ দরিয়ায়। নৌকা লইয়া যাইতে অইবো। নাইলে চলেন স্যার আমার সঙ্গে এই কেয়ায়। দুই সিকি দিবেন স্যার। আয়েন।’

‘দুই সিকি বেশি চাচ্ছো, মিঞা। এক সিকি পাবে।’

‘আইচ্ছা, স্যার। তত্বরি লন। নাইলে লঞ্চ ছাইড়া দিবার পারে। আয়েন, ব্যাগ দুইডা সাবধানে ধইরা আনবেন স্যার, পইরা না যায়।’

ওরা গিয়ে উঠলো নৌকায়। কামাল জিজ্ঞেস করলো, ‘সবাই এসে গেছে?’ .

‘জ্বি, স্যার। একেবারে চারদিকে সাদা পোশাকে পুলিস ছেয়ে গেছে। ভয়, স্যার, এপারে ওরা যদি পালিয়ে সাঁতার কেটে এপারে কোনও লঞ্চের মধ্যে উঠে যাত্রীদের মধ্যে মিশে যায় তাহলে আর পাওয়া যাবে না।’

নৌকো ছেড়ে দিলো লোকটা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে মাঝ দরিয়ায় এসে পড়লো।

লোকটা দূরে একটা বিরাট লঞ্চ দেখিয়ে বললো, ‘এইটেই এম. ভি. নবীপুর।’

‘মি. সিম্পসন ঠিক বারোটায় লঞ্চে উঠতে বলেছেন। ততক্ষণ আমাদের দূরে থাকাই ভালো। ওদের লোকও চারদিকে নৌকো আর মোটরবোট নিয়ে ঘোরাফেরা করছে।’ শহীদ বিরক্ত হলো। এমন তো কথা ছিলো না। রাত এগারোটায় হানা দেবার কথা ঠিক হয়েছিল। দেরি করলে সর্বনাশ হতে পারে।

কামাল বললো, ‘মি, সিম্পসন আবার প্ল্যানটা কখন পাল্টালেন বুঝতেই পারছিনা।’

শহীদ এম. ভি, নবীপুরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। দূরত্ব খুব বেশি হলে তিরিশ গজ হবে। শহীদের মনে হলো একটা লোক লঞ্চ থেকে ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়লো। সচকিত হলো শহীদ। সঙ্গে সঙ্গে গুড়ুম গুডুম পিস্তলের আওয়াজ শোনা গেল দু’বার। প্রতিধ্বনিও শোনা গেল।

‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে কামাল। শিগগির পানিতে নেমে পড়। ডুব সাঁতার দিয়ে আসবি। পিছন দিক দিয়ে উঠবার চেষ্টা করবি লঞ্চে।’

‘হাসান আলী, সিগন্যাল দাও আলো দেখিয়ে।’ দুজন নেমে পড়লো নদীতে।

অন্ধকারে দুজন মুহূর্তে হারিয়ে গেল। কয়েক মিনিট পর আবার পিস্তলের গুলির আওয়াজ ভেসে এলো। শহীদ তখন এম. ভি. নবীপুরের কাছে এসে পড়েছে। মাথাটা তুলে এক ঝাঁকুনিতে চোখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। গুলির আওয়াজের প্রতিধ্বনির সাথে সাথে ভেসে এলো চিৎকার। ঝপ করে শব্দ হলো একটা কাছেই। কাকে যেন পানিতে ফেলে দেয়া হলো। তলিয়ে গেল একটা মানুষের দেহ।

লঞ্চটা থেকে ধুপধাপ শব্দ আসছে। যেন সেখানে লোক দৌড়াদৌড়ি করছে। শহীদের পাশেই আর একটা মুখ ভেসে উঠলো। ডুব দিলো শহীদ সাথে সাথে। পরক্ষণেই খেয়াল হল মাথাটা কামালের, আবার মুখ তুলেই দেখে মাথাটা অদৃশ্য হয়েছে। হাসি পেল শহীদের।

লঞ্চটার পাশে এসে পৌঁছালো শহীদ। একটা মোটা দড়ি নেমে এসেছে। হাঁপাচ্ছিল শহীদ। দড়ি ধরে অবলীলাক্রমে সে উপরে উঠে এলো। কামালের মাথাটা দেখা গেল আবার। ইশারা করলো শহীদ। এদিকে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একটা লোক উপুড় হয়ে পড়ে আছে। তার পিঠে একটা ছোরা আমূল ঢোকানো। পিস্তলটা বের করে হাতে নি লঞ্চের ধার বেয়ে এগোল শহীদ। একটা লোক ছুটে আসছে শহীদের দিকে। হাতে ছোরা। শহীদ লঞ্চের প্রান্তে দাঁড়িয়ে পড়লো। লোকটা ছুটে আসতেই শহীদ সাঁ করে এক পাশে সরে গেল। নিজেকে থামাতে না পেরে লোকটা পড়ে গেলি নদীতে।

কামাল ততক্ষণে উঠে এসেছে দড়ি ধরে। অন্ধকার কাঁপিয়ে আবার গর্জন শোনা গেল পিস্তলের। পুলিসের মোটর বোট এসে পড়েছে দুটো। তাদের হাতে উদ্যত রাইফেল। মি. সিম্পসন এসে পৌঁছেছেন।

নদীর দু’দিক থেকে দুটো সার্চ লাইটের তীব্র আলো এম. ভি. নবীপুরকে আলো কিত করে ফেললো। আর সেই আলোয় দেখা গেল ডেকের একপাশে রেলিং এর উপর একটা লোককে চেপে ধরছে দারোগা মোজাম্মেল হক। লোকটা হঠাৎ কেমন করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেলিং টপকাতে যেতেই পাশ থেকে একটা পুলিস রাইফেল তুলে মাথায় আঘাত হানলা। লোকটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। হক সাহেব মোটা ভারি দেহটা টেনে থপথপ করে এগিয়ে এলেন। তাঁর ইউনিফর্মটা ঘামে ভেজা। শহীদ দ্রুত তার কাছে আসতেই হক সাহেব বললেন, ‘বড় লেট কইরা ফালাইছেন, শহীদ সাব। আয়েন সামনের সেলুনে পালের গোদা নুরবক্স ঢুইকা পড়ছে। চারদিকে পুলিস বসাইয়া রাখছি। তবে সাবধানে আউগাইতে অইব।’ হাঁপাতে লাগলেন তিনি।

‘দেখা যাক। দরজাটা ভেঙে ফেলন,’ সিম্পসন বললেন। তিন চারজন পুলিস এগিয়ে গিয়ে একনাগারে প্রচণ্ড লাথি মারতে লাগল। কিন্তু দরজাটা এতটুকু হেললো না।

মোজাম্মেল হক বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তরা ভাত খাছ না ঘাস খাছ। সর দেহি।’

সবাইকে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে গেলেন দরজার দিকে। ঝনঝন করে শব্দ হলো। খসে পড়লো দরজাটা চৌকাঠ থেকে।

চমৎকৃত হলো সবাই। হোঁৎকা আয়সী দারোগা মোজাম্মেল হকের দেহ যে এমন অসুরের শক্তি ছিলো তা কে জানতো?

কামাল মুগ্ধ হয়ে বললো, ‘দারোগা সাহেবের প্রমোশন এবার ঠেকায় কে?’

হক সাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখে মুখে ক্লেশের ছাপ। রেলিং ধরে বললেন, ‘হেই আর জীবনে অইলো না। সিম্পসন সার দি একটু কইয়া দেন।’

শহীদ আর সিম্পসন কেবিনের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। কেবিন শূন্য। সেখানে কেউ নেই। বিছানার তলা, বাথরুম কোথাও নেই কেউ। নিশ্চয় কোনও গোপন দরজা দিয়ে সরে গেছে নুরবক্স। বেরিয়ে এলো ওরা। হক সাহেব বললেন, ‘আপনারা দোতলায় উডেন গিয়া। আমি নিচে নামি গিয়া ইঞ্জিন ঘরের দিকে। আইয়েন, আসাদ সায়েব। দেরি কইরেন না। এই মিঞারা, তোমরাও কয়েকজন আইয়া পড়ো সাথে। কামাল সাব আপনে কয়েকজন সিপাই লইয়া এহানেই থাইকেন।’ ডান পা টা ঈষৎ খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেলেন হক সাহেব লঞ্চটার পিছন দিকে। কামাল সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো। এই লোকটাকে সে এতদিন অপদার্থ বলেই মনে করে এসেছে।

হক সাহেব সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন। পুলিসদের হাতের টর্চলাইটগুলো জ্বল উঠলো। সিঁড়ির উপরে নিচে একজন করে পুলিস দাঁড় করিয়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। দুপাশ থেকে দুজন লোক ওদের উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়লো। জামানের বাঁ হাত থেকে টর্চটা ছিটকে পড়ে গেল। হক সাহেব বোধহয় প্রস্তুত ছিলেন। আর্তনাদ করে উঠলো লোকটা। মাটিতে ফেলে অন্ধকারেই আন্দাজে পাঁজরের উপর লাথি চালালেন।

তেরো

জামান আর একজন পুলিস তখন আর একজন আক্রমণকারীকে পিটিয়ে আধমরা করে লেছে। ওদের এক নজর দেখে এগিয়ে গেলেন হক সাহেব।

সামনে কোথা থেকে ক্ষীণ আর্তনাদ ভেসে আসছে। এগোলেন সেদিকে।

‘ঐ যে আর এক শয়তান আসছে।’ ছোরা হাতে এগিয়ে এলো একটা লোক। চোখ দুটো জ্বলছে তার। হক সাহেবের পিছনে জামানের হাতে সাইলেন্সর পাইপ লাগানো পিস্তলটা আধা অন্ধকারেও চকচক করে উঠলো। মখ থুবড়ে পড়ে গেল লোকটা।

হক সাহেব সামনের দেয়ালে কান পাতলেন। জামনি আর পুলিস পিছনে এসে দাঁড়ালো। তিনি ইঙ্গিতে শব্দ করতে নিষেধ করলেন।

‘সবগুলোকে মেরে ফেলে, দাও।’ জিঘাংসা ভরা চাপা কণ্ঠ কানে এলো। ‘হারামজাদী দুটোকে আগে। হাত চালা। সময় নেই। পাশের ঘরে তিনটে টিকটিকি আটকা পড়েছে। ওদেরও শেষ করতে হবে। কুইক।’

কণ্ঠটা থেমে গেল।

একটু পরে আবার শোনা গেল, ‘শফি, এখনও বল কোথায় রেখেছিল কুয়াশার থিসিস। আমার সাথে জালিয়াতি? এখনও বল কোথায় আছে। না হলে পরিণাম কি হবে দেখতেই পাচ্ছিস চোখের সামনে। কুয়াশার সাধ্য নেই তোক বাঁচাবে।’ কোনও জবাব শোনা গেল না।

সপাং করে একটা শব্দ হলো। আর সাথে সাথে ভেসে এলো মর্মস্পর্শী আর্তনাদ। জামান দাঁতে দাঁত চেপে উত্তেজনা দমন করলো। ক্রোধে তার হাত দুটো নিশিপিশ করছিল।

আবার সেই গলাটা শোনা গেল।

‘তোদের কপাল ভালো। আমার হাতে সময় নেই। খুন করা ছাড়া উপায় নেই আর। রজব, দেরি না। আগে হারামজাদীদের চোখগুলো গরম শিক দিয়ে ঝলসে দে।’

জামান শিউরে উঠে বোধহয় চিৎকার করতে যাচ্ছিলো। হক সাহেব বুঝতে পেরে তার হাতের উপর চাপ দিলেন। তারপর তাকে সরিয়ে দিয়ে কয়েক পা পিছনে সরে গিয়ে ফিরে দাঁড়ালেন। দৌড়ে এসে দেহের সমগ্র শক্তি দিয়ে লাথি মারলেন দেয়ালটার উপর। দড়াম করে ভেঙে পড়লো দেয়াল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন হক সাহেব ভিতরে। ভিতরের উজ্জ্বল আলোয় জামান দেখতে পেল জ্বলন্ত চুল্লীত একজন লোহার শিক গরম করছে। ধোয়ার উৎকট গন্ধ। পাশে একজন লোক দাঁড়িয়ে। তার হাতে চাকুক। আর চয়ারে বসে মুখোশ পরা একজন। নিশ্চয়ই ঐটেই নুরবক্স।

ঘটনার আকস্মিকতায় বোধহয় সবাই চমকে গিয়েছিল। কিন্তু মুহূর্তের মবাই দাঁড়ানো লোকটা চাবুক ফেল ঝাঁপিয়ে পড়লে হক সাহেবের উপর। তারপর একটা আর্তনাদ করে পড়ে গেল। হক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। পিস্তলটা নড়ে উঠলো জামানের হাতে। সাইলেন্সর লাগানো পিস্তল থেকে মৃত্যু ঝরে পড়লো নিয়ে। যে লোক শিক গরম করছিল চাকু নিয়ে রুখে এলো সে। হক সাহেব লোকটার তলপেটে জোর লাথি মারলেন। লোকটা পড়ে গেল নুরবক্সের উপর।

হক সাহেব মুখোশধারীর দিকে পিস্তল উঁচিয়ে ধরলেন, ‘তারপর, নুরবক্স, ওরফে ড. রহমান?’ কঠিন শোনাল হক সাহেবের কণ্ঠ। জবাবে সে একটা ছোরা ছুঁড়ে মারলো বিদ্যুৎ গতিতে হক সাহেবের দিকে। দ্রুত সরে গেলেন তিনি।

মুখোশের অন্তরাল থেকেও চোখ দু’টো থেকে যেন আগুন বেরিয়ে আসছে। সে একটা ডাইভ দিলে হক সাহেবের দিকে। হক সাহেবের হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেল। প্রচণ্ড লাথি চালাল নুরবক্স হক সাহেবের পেটের দিকে। হক সাহেব সরে গেলেন। নুরবক্স টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল।

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় লিলি, শফি আর সাদিয়া খোরাসানী দেখছিল সমস্ত ঘটনা। ওদের চোখে-মুখে আশার আলো।

জামান আর দেরি করলো না। পুলিসের সহযোগিতায় দ্রুত তাদের বাঁধন কেটে দিলো। অজ্ঞান হয়ে লিলি জামানের গায়ের উপর ঢলে পড়লো। বোনকে কোলে করে, নিয়ে বেরিয়ে এলো জামান। নুরবক্সের সাথে যুদ্ধরত হক সাহেব বোধহয় ওদের দিকেও লক্ষ্য রাখছিলেন। তিনি নরবক্সের চোয়ালে প্রচণ্ড এক ঘুসি লাগাবার ফাঁকে বললেন, ‘শফি, জামানের সাথে চলে যাও। মিস খোরাসানীকে তুমি নিয়ে যাও ইয়ার মাহমুদ।’

শফি চলে গেল। ইয়ার মাহমুদ অর্থাৎ পুলিসটা হক সাহেবের কথা না শুনে সঙ্গীন উঁচু করে তেড়ে এলো তাঁকে সাহায্য করার জন্য।

‘থামো। চিৎকার করে উঠলেন হক সাহেব। আমিই ওকে সামলাচ্ছি। তুমি মিস খোরাসানীকে নিয়ে যাও।’ পুলিসটা হকচকিয়ে গেল। দ্রুত মিস খোরাসানীকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

তাদের কথাবার্তার সুযোগে নুরবক্স হঠাৎ পিছিয়ে গেল।

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাসি ভেসে এলো। হক সাহেব মুখ তুলে দেখলেন সামনে শূন্য। নুরবক্স নেই। দেয়ালের একাংশ ফাঁক। সে ফাঁকটা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। হাসিটা ক্রমেই দূর বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয়েছিলেন বোধহয় হক সাহেব। সে ভাবটা কেটে যেতেই সারা ঘরময় কি যেন খুঁজতে লাগলেন। অবশেষে এক কোণে একটা বোতাম দেখত পেলেন।

বোতামটা টিপতেই হাতের ডাইনে ক্রমশঃ ফাঁক হয়ে গেল। ওদিকের ঘরটা বোধহয় অন্ধকার ছিলো। এই কক্ষের আলোতে সেই অন্ধকার কেটে গেল। দেখা গেল কামাল, আর সিম্পসনের হাতে পিস্তল। এখুনি হয়তো গর্জে উবে।

হক সাহেব হাঁ হাঁ করে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘করেন কি, স্যার। ‘আমি মোজাম্মেল হক, স্যার। আমার মাইরেন না, সার।’

পিস্তল তিনটা নেমে এলো।

সিম্পসন বোধহয় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। হক সাহেব দেয়ালে কি যেন খোঁজ করছেন দেখে চুপ করে গেলেন। জিজ্ঞাসায় তাঁর দু’টো কুঁচকে গেল।

দেয়াল পরীক্ষা শেষ করে ফিরে দাঁড়ালেন হক সাহেব। সিম্পসনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যার, নুরবক্স পালাইয়া গেছে। আপনারা আর দেরি কইরেন না। এই লঞ্চ ঠিক বারোটায় এক্সপ্লোশান হইবো, মাত্র দশ মিনিট সময় আছে। আপনারা রাইয়া যান। সামনেই সিঁড়ি। আপনাদের লঞ্চে আসল ড. রহমানরে পাঠাইয়া দেওয়া হইছে পুলিশ পাহারায়। পিছন কয়েকজন পুলিস রইছ তাগো আমি লইয়া আসতাছি। যান, স্যার, আর দেরি কইরেন না।

সিম্পসন আর কামাল প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে এগিয়ে গেল।

শহীদ হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। বললো, ‘আর আপনি, হক সাহেব?’

ইঞ্জিন ঘরটা দেখ আসি। নুরবক্স এখানে থাকতে পারে।

‘এতোটা রিস্ক নেয়া কি ঠিক হচ্ছে, কুয়াশা?’

‘ভেবো না, শহীদ। আত্মরক্ষার ব্যবস্থা আছে আমার। তাছাড়া তোমাদের সকলের চাখেই ধরা পড়ে গেছি আমি। হ্যাঁ শোনো, সাদিয়া খোরাসানীকে নিয়ে যাচ্ছি আমার সাথে সাইদের কাছে, আর আসল দারোগা মোজাম্মেল হক জাবেদ বোর্ডিং-এ ঘুমাচ্ছে। আর দেরি নয়। গুড বাই।’ 

প্রশস্ত হাতটা বাড়িয়ে দিলা কুয়াশা। শহীদ নিবিড় আন্তরিকতায় কুয়াশার হাতে চাপ দিয়ে বললো, ‘আবার তুমি আমাদের প্রাণ বাঁচালে কুয়াশা।’

হাতটা ছেড়ে দিলো দারোগাবেশী কুয়াশা। কোনও জবাব দিলো না। অন্ধকারে, হারিয়ে গেল।

মোটর লঞ্চটা এম. ভি. নবীপুর থেকে অনেক দূর সর এসেছে। সার্চলাইট দু’টো এখনো লঞ্চটার দিকে স্থির হয়ে আলো ছড়াচ্ছে।

‘শেষ পর্যন্ত কুয়াশাই আমাদের প্রাণরক্ষা করলো,’ জামান বললো। তার গলায় কৃতজ্ঞতার রেশ।

কামাল কি একটা জবাব দিলো। কিন্তু একটা গগনবিদারী বিস্ফোরণের শব্দে তার কথা মিলিয়ে গেল। ওরা সবাই তাকিয়েছিল এম. ভি. নবীপুরের দিকে। সার্চলাইটের আলোয় দেখা গেল এম. বি. নবীপুরের বিশাল কাঠামোটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে।

চোদ্দ

জামান একে একে রইস্যর জটিল গ্রন্থি উন্মোচন করছিল আর চারদিকে সব নির্বাক শ্রোতারা রুদ্ধনিঃশ্বাসে তার কথা শুনছিল।

ড. রহমানের ড্রইংরুমে জুটছিল প্রায় সবাই। আমন্ত্রণকর্তা ড. রহমান স্বয়ং। নুরবক্স অর্থাৎ নকল ড. রহমানের বন্দীশালা থেকে অবিশ্বাস্যভাবে অপ্রত্যাশিত মুক্তি পেয়ে সভ্যজগতের মানুষ আর একমাত্র আত্মীয় সাইদকে পেয়ে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন। কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্যে তিনি ডিনারে আমন্ত্রণ করেছিলেন সবাইকে।

ডিনার সবেমাত্র শেষ হয়েছে। দুইংরুমে বসে কফি খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। প্রধান বক্তা জানান। সাইদ আর সাদিয়া পাশাপাশি বসে জামানের কথা শুনছে। তাদের এক পাশে মি.. সিম্পসন, ড. রহমান আর কামাল। অদূরে বড় সোফাটায় লিলি, মহুয়া, লীনা আর শফিক। আর একটা সোফায় শহীদ আর দারোগা মোজাম্মেল হক। তাদের একদিকে। আজিজুল করিম অন্যদিকে হামিদ জালাল।

শহীদ একটা সিগারেট ধরিয়ে প্যাকেট এগিয়ে দিলো মোজাম্মেল হকের দিকে। বললো, ‘নিন, মি, কুয়াশা!’ নিচু গলায় বললেও শহীদের কথা কানে গেল সবার।

হাসির হুল্লোড় উঠলো সঙ্গে সঙ্গ। মোজাম্মেল হক লজ্জা পেয়ে আড়চোখে সিম্পসনের দিকে তাকালেন। সিম্পসন হাসি থামালেন।

মোজাম্মেল হক সিগারেট বের করতে করতে বললেন, ‘কি যে ঠাট্টা করেন, মি. খান।’

শহীদ জামানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মি, জামান, সবাই আপনার কথা শোনবার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছেন। আপনি শুরু করে দিন।’

জামান কফির কাপটা ঠেলে দিয়ে বললো, ‘আমি ইনভেস্টিগেশন শুরু করেছিলাম লিলিকে উদ্ধার করার জন্য। মিস রুবিনা রহমান হত্যা আসল কাহিনীর দ্বিতীয় পর্ব। কিন্তু আপনাদের বোঝার সুবিধার জন্যে সেখান থেকেই শুরু করা উচিত।’ সিগারেট ধরালা জামান। ধোঁয়া ছেড়ে বললো, ‘প্রথম থেকেই রুবিনার হত্যাকারী চেয়েছিল হত্যাকাণ্ডের সমস্ত সন্দেহ তার পূর্ব স্বামী মি. আজিজুল করিমের উপর চাপিয়ে দিতে। কারণ সেইটেই ছিলো সহজ। আর তার জন্যে দীর্ঘদিন ধরে আততায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।

আততায়ী অসম্ভব রকমের ধূর্ত আর বুদ্ধিমান এবং নিজের বুদ্ধির উপর তার অসামান্য বিশ্বাস। যদিও সেই বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত তার সঠিক পরিচয় জানতে আমাদের সাহায্য করছিল।’

সাফিয়া বললো, ‘আচ্ছা নকল ড. রহমানই যে নুররক্স তা আপনি কি করে বুঝতে পারলেন?’

জামান কিছুক্ষণ চুপ কর কি যেন চিন্তা করলো, তারপর বললো, ‘নুরবক্স আর নকল ড. রহমান যে একই লোক তা বুঝতে আমার সময় লেগেছে অনেক। তবে তার আচরণ সম্পর্কে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল প্রথম দিকেই।’

‘কবে?’ প্রশ্ন করলো আজিজুল করিম।

‘রুবিনার খুনের পরের দিন যখন আহত ড. রহমানের সাথে দেখা করতে যাই তখন আমার মনে সন্দেহ দোলা দেয় কয়েকটি কারণে। ড. রহমান বললেন যে, রাতে ডাকাত তার ঘরে এসে তাকে মারপিট করে মারাত্মকভাবে আহত করেছে এবং রুবিনার বিয়ের অলংকার নিয়ে পালিয়ে গেছে। কিন্তু লক্ষ্য করে দেখলাম যে তার স্লিপ গাউনে রক্তের কোনও দাগ নেই। মনের মধ্যে সন্দেহ খচ খচ করে উঠলো। দ্বিতীয়তঃ ড. রহমানের ক্ষতস্থান থেকে ময়লা বের করার জন্যে যে পরিমাণ তুলো ব্যবহার করা হয়েছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘরের মধ্যে মারপিট হলে ময়লা সাফ করার জন্য অতো তুলো দরকার হতে পারে না। তাছাড়া ড. রহমানের ঘরে তাঁর যৌবনের যে ফটো আছে তাতে নাকের বাঁ দিকে ছোটো একটা তিল ছিলো। নকল ড. রহমানের নাকের বাঁ দিকে সেই তিলটা ছিলো না। আসল ড. রহমানের মুখের দিকে তাকালেই তা বুঝতে পারবেন। কিন্তু নকল ড. রহমান আহত হয়েছিলেন একথা তো সত্য। তাহলে মারপিট নিশ্চয়ই তার এই ঘরে হয়নি, হয়েছে বাইর কোথাও। কিন্তু কেন? আর বাইরে মারপিট হলে ড. রহমান মিথ্যার আশ্রয় কেন নিলেন? স্বভাবতই এই প্রশ্নগুলো আমার মনে এলো। এই সন্দেহের বশে ড. রহমানের কিছু মনে করবেন না ড. রহমান, আমার বর্ণনার সুবিধের জন্য নুবক্সক ড. রহমান হিসেবেই উপস্থাপন করতে হচ্ছে।’

ড. রহমান বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনি বলুন।’

সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে জামানের কথা শুনছিল। কামাল অধৈর্য হয়ে বললো, ‘চালিয়ে যান, জামান সাহেব।’

‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ড. রহমানের রুম ভালো করে পরীক্ষা করার নাম করে আমি বাথরুমটাও দেখে এলাম। আশা করছিলাম সেখানে রক্তমাখা কাপড় পাবো। পাইনি। পেলাম একটা ছোট্ট টেপ রেকর্ডারের স্পল।’

জামান পকেটে হাত গলিয়ে একটা টেপ রেকর্ডারের স্পল বের করলো। বললো, ‘এটার ব্যাখ্যা পর দিচ্ছি। আগে অন্য কথা বলি। রুম সার্চ করার আগেই আমি বাড়ির আঙিনা দেখতে গিয়ে একটা জিনিস আবিষ্কার করি। আমি দেখতে পেলাম বাড়ির পেছনের দেয়ালের বিশেষ স্থান থেকে ভেতর বাড়ির দরজা পর্যন্ত ঘাসের উপর এক জোড়া পায়ে দাগ। খুব সূক্ষ্মভাবে পরখ করে দেখলাম ঘাসের ওপর এমনভাবে আবছা একটা দাগ পড়ে আছে যা শুধু একদিন নয়, নিয়মিত চলাচলের ফলেই অমন হতে পারে। অর্থাৎ এখান দিয়ে কেউ অনেক দিন ধরে হাঁটছে। ড. রহমান যে মিথ্যে কথা বলেছিলেন তাতো আগেই আমার কাছে ধরা পড়েছে। ফলে আমার ধারণা হলো হয়তো তিনিই ঐ পথ দিয়ে নিয়মিত চলাচল করেন। কিন্তু কেন? তার জবাব পরে দিচ্ছি।’

জামান থামলো। সিগারেট ধরালো আর একটা। ধোঁয়া ছেড়ে আবার শুরু করলো, ‘মিস খোরাসানী একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিলেন। কথাটা হচ্ছে মি, আজিজুল করিম টেলিফোনে রুবিনাকে শাসানি দিতেন, কিন্তু সামনে এলে একেবারে কেচো হয় যেতেন। মিস খোরাসানীর কথায় আমার খটকা লেগেছিল। কারণ, একই লোক সামনে একরকম আর টেলিফোনে অন্যরকম কথা বলবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে কোথাও কিছু একটা কারচুপি আছে। ড. রহমানের বাথরুমে পাওয়া, টেপরেকর্ডারের স্পল সে সমস্যার সমাধান করে দিলো। স্পলটা বাজিয়ে দেখলাম তাতে নানাভাবে মিস রুবিনাকে শাসানি দিয়ে অনেক কথা রেকর্ড করা আছে আর সে গলার স্বর ড. রহমানেরই। আর কারো নয়। ফলে ড. রহমানের উপর সন্দেহ আমার বেড়ে গেল। ‘এদিকে ড. রহমান আগেই অন্য চাল দিয়ে বসে আছেন। তিনি জানতেন মি. করিমের মারিজুয়ানার নেশা আছে। বস্তুতঃ এই নেশার ব্যাপার নিয়েই তাদের বিবাহিত জীবনে ছেদ নেমে আসে। মিস রুবিনা রহমানকে ইস্কাটন ক্লাবের যে কামরায় খুন করা হয় তার পিছনে সরু পথের উপর জানালার ঠিক নিচে মারিজুয়ানার একটা কৌটা পেয়েছিলাম আমি। আমি সেই সরু প্যাসেজে খোঁজ করার আগে মি. সিম্পসনও ওদিকটা ঘুরে এসেছেন চুপি চুপি। যদিও তিনি প্যাসেজের ভিতরে ঢোকেননি, কিন্তু যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বেলে দেখেছেন সেখান থেকে কৌটোটা নজরে না পড়ে পারে না। তার অর্থ হচ্ছে মি. সিম্পসনের তল্লাশির পর আর আমার তল্লাশির আগে অর্থাৎ হত্যাকাণ্ডের অনেকক্ষণ পর সেখানে মারিজুয়ানার কৌটা ফেলে দেয়া হয়েছে। মি. করিমকে খুনী প্রতিপন্ন করার জন্য তিনি এছাড়াও আরও এক চাল চেলেছিলেন। মি. করিম মিস রুবিনাকে সত্যিই ভালবাসতেন। তিনি আবার তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। ড. রহমান এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। তিনি কুয়াশার নাম ভাঙিয়ে মি. করিমের কাছে এক চিঠি লিখলেন। তার মূল বক্তব্য হচ্ছে মি. করিম যদি ইচ্ছে করেন তাহলে বিয়ের আসরে হামিদ জালালের সাথে বিয়ে ভেঙে দিয়ে তখন তখনই তাঁর সাথে মিস রহমানের বিয়ে হতে পারে। মি. করিম কুয়াশার অসাধারণ ক্ষমতা সম্পর্কে বিলক্ষণ অবগত ছিলেন, তাই আশায় আশায় বিয়ের দিন সন্ধ্যা থেকে ইস্কাটন ক্লাবের সামনে, I must say, বোকার মতো ঘোরাঘুরি শুরু করলেন তিনি। সাইদ মি. করিমকে দেখে ফেলে। ড. রহমানের চাল তখনকার মতো সফল হয়। মি. করিম প্রথমে আমার কাছে কোনও কিছু স্বীকার করতে না চাইলেও পরে সব কিছুই স্বীকার করতে বাধ্য হন। চিঠিটাও আমাকে দেন। অবশ্য সেই চিঠি আমাকে নুরবক্সেরও সন্ধান পেতে সাহায্য করে। হাতের লেখা দেখেই বুঝেছিলাম ঐ চিঠি কুয়াশার লেখা নয়। তার লেখা আমার চেনা। মি. সিম্পসনও আমার অভিমত সমর্থন করেন। তাছাড়া টেপ রেকর্ডারের স্পল, মারিজুয়ানার কৌটা আর আজিজুল করিমকে লেখা চিঠিতে ঠিক একই রকম আঙুলের ছাপ পাওয়া গেল। অবশ্য চিঠিতে স্বভাবতই মি. করিমের আঙুলের ছাপও পাওয়া গিয়েছিল, আর তাতে আরও ভালো করে বোঝা গেল যে মারিজুয়ানার শিশিতে বা স্পলে যে আঙুলের ছাপ ছিল তা মি. করিমের নয়। ফলে তাকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝোলাবার যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল তা থেকে তিনি নিষ্কৃতি পেলেন। ড. রহমানই যে রুবিনাকে হত্যা করেছে সে সম্পর্কে আমি তখন নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছি।’ জামান একটু থেমে আবার বললো, ‘আমি আগেই বলেছি ড. রহমান আহত হয়েছিলেন তার বাড়ির বাইরে কোথাও। কিন্তু কেন? তার বাড়ির পেছন দিকে ঘাসের উপর আবছা সরু দাগ কেন? আর কুয়াশাই বা সকালে কেন ডাক্তার সেজে তার ঘর হানা দিয়েছিল? মিস রহমানকে হত্যা করা হবে তা কুয়াশাই বা জানলে কি করে? এসবের অর্থ হচ্ছে ড. রহমানের কার্যকলাপের দিকে কুয়াশার দৃষ্টি গভীরভাবে নিবদ্ধ রয়েছে। নইলে মিস রহমানকে যে ড. রহমান হত্যা করবেন তা তার জানবার কথা নয়। কিন্তু এই ইন্টারেষ্ট কেন কুয়াশার? প্রথম দিকে তার জবাব পাইনি। পেলাম পরে। লিলির অন্তর্ধানের রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে। কুয়াশা যে লিলিকে চুরি করেনি তা বুঝতে পেরেছিলাম সহজেই, কিন্তু এটাও অনুমান করেছিলাম যে কুয়াশা এই কিডন্যাপারকে চেনে। কারণ, কুয়াশার আবিষ্কৃত আলট্রা-সোনিক্স পদ্ধতিতে জানালার শিক গলিয়েই লিলিকে চুরি করা হয়েছে। সাধারণ চোর-বাটপারদের ঐ পদ্ধতি জানবার কথা নয়। কিন্তু কিডন্যাপারের মোটিভটা বুঝতে পারলাম না। ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করত গোলাম শফির সাথে। শফির কাছেই শুনলাম লিলিকে চুরি করবার কারণ। ওর কাছেই প্রথম শুনলাম নুরবক্সের নাম। নুরবক্স শফিকে হুমকি দিয়ে যে চিঠি লিখেছে তাতে বলা হয়েছে যে, সে-ই লিলিকে চুরি করছে। শফি যদি কুয়াশার থিসিসের যে অংশ তার কাছে আছে সেটা নুরবক্সকে দিয়ে দেয় তাহলে লিলিকে ফেরত দেয়া হবে অন্যথায় লিলিকে খুন করা হবে বলে হুমকি দেয়া হয়েছে। আমি যেদিন সন্ধ্যায় শফির কাছে গেছিলাম সেই রাতেই থিসিসটা নুরবক্সকে দেবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমি আর শফি যখন এই নিয়ে আলাপ করছিলাম, তখন একটা ছায়ামূর্তিকে আবছা অন্ধকারে শফির ঘরের জানালার কাছে থেকে সরে যেতে দেখলাম। সেই মুহূর্তেই আমি স্ট্র্যাটেজী ঠিক করে ফেললাম। বেশ জোরে জোরে শফিককে বললাম, ‘থিসিসটা নুরবক্সকে দিয়ে দাও।’ শফি আমার ইঙ্গিত বুঝলো।

সেই রাতেই সে নুরবক্সের লোকের কাছে যাহোক একটা কিছু গছিয়ে দিলো। গাড়ি করে চলে গেল ওরা। আমি মোটর সাইকেলে ওদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম। ওদের গাড়ি চললো ওয়াইজ ঘাটের দিকে। নুরবক্সের আস্তানাটা চেনা গেল।’

কামাল বললো, ‘কিন্তু আপনার মোটর সাইকেলের পেছনে আরও একটা মোটর সাইকেল ছিলো জানেন?’

জামান বিস্মিত হয়ে বললো, ‘নাতো! কে ছিলো সেই সাইকেলে?’

কামাল বললো, ‘কুয়াশা স্বয়ং।’

জামান বললো, ‘আশ্চর্য তো!’

ড. রহমান জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারপর?’

‘তারপর আর তেমন কিছু নেই। শফির কাছে লেখা নুরবক্সের চিঠি আর মি. করিমের কাছে লেখা তথাকথিত কুয়াশার চিঠির হস্তলিপি, দেখা গেল, এক ও অভিন্ন। সুতরাং আমার কনকুশন কি হতে পারে বুঝতেই পারছেন। আর এতেই বোঝা গেল কুয়াশা কেন ড. রহমানের চারদিকে অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছে।’

ড. রহমান বললেন, ‘নুরবক্স আগেই কুয়াশার থিসিসের একটা অংশ চুরি করে রেখেছিল। অবশিষ্ট অংশের জন্য হন্যে হয়ে উঠেছিল। তার ইচ্ছে ছিলো হয় সে নিজেই অমরত্বের গবেষণা করবে, নয়তা অনেক দামে থিসিসটা বেচে দেবে বিদেশের কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছে।’

আজিজুল করিম বললেন, ‘আশ্চর্য। নুরবক্স নির্বিঘ্নে কয়েকটা মাস আমাদের নাকের ডগায় ড. রহমান বলে নিজেকে চালিয়ে দিলো, আমরা বুঝতেই পারলাম না?’

জামান বললো, ‘সেটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ কুয়াশার কাছ থেকে নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণের বিদ্যা নুরবক্স ভালোই আয়ত্তে এনেছিল। আর ড. রহমানকে অনেকেই চিনতো না। কারণ তিনি পনেরো বছর আগে বিদেশে গিয়েছিলেন। সাইদ আর রুবিনা তখন ছোট। বৃদ্ধ শিল্পপতি হাফিজুর রহমানও তাকে চিনতে পারেননি।

তাঁর নিরুদ্দিষ্ট ভাই ফিরে এসেছে এই আনন্দে কিছু সন্দেহ করার অবকাশও তাঁর হয়নি। অথচ তিনিই হয়েছিলেন নকল ড. রহমানের প্রথম শিকার।’

সাইদ আতকে উঠলো। ড. রহমানও চমকে উঠলেন। সাইদ বললো, ‘বলেন কি মি. জামান?’

জামান বললো, ‘হ্যাঁ, he was the first victim. যদিও নিহত হবার আগেই তিনি তাঁর ভাইকে তাঁর ফার্মের ম্যানেজিং ডিরেক্টর করে দিয়েছিলেন। কিন্তু, রুবিনা আর সাইদকে তার ভাগ দিতে হবে এটা নুরবক্স সইতে পারেনি। তাছাড়া ধরা পড়বার আশংকা তাৈ ছিলোই। তাই পথের কাঁটা দূর করবার জন্যে নুরবক্স নৃশংসভাবে হত্যা করলো রুবিনাকে। পরবর্তী শিকার ছিলো সাইদ। কুয়াশা তাকে রক্ষা করলো। কিন্তু নুরবক্স শেষরক্ষা করতে পারলো না। সে বুঝতে পেরেছিল যে তার পরিচয় আর জানতে কারো বাকি নেই। তাই সে ড. রহমানের খোলস ত্যাগ করে পালিয়ে গেল। আর সাইদের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে চুরি করলো সাদিয়াকে। আল্টা-সোনিক্স দিয়ে জানালার শিক গলিয়ে শফি থিসিসের বদলে কতকগুলো আজেবাজে কাগজপত্র দিয়েছিল বলে রাগে উন্মত্ত হয়ে তাকেও ধরে নিয়ে গেল। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবে আমার দুঃখ রইলো যে নুরবক্সকে এযাত্রা ধরতে পারলাম না হাতেনাতে। প্রাপ্য শাস্তি পাওনাই রয়ে গেল ওর।’

-সমাপ্ত-

লেখক: কাজী আনোয়ার হোসেনসিরিজ: সেবা কুয়াশা সিরিজবইয়ের ধরন: সেবা প্রকাশনী

৫৬. মরণ ছোবল ২

মাসুদ রানা ৪৩৫ - মৃত্যুদ্বীপ - কাজী আনোয়ার হোসেন

মাসুদ রানা ৪৩৫ – মৃত্যুদ্বীপ

৪২. স্বর্ণ চালান ১

০১. কুয়াশা ১

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.