সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ : সাহিত্যের সেরা গল্প
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ : সাহিত্যের সেরা গল্প
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ২০০৭
প্রচ্ছদ : অনুপ রায়
বীরেন্দ্র দত্ত
বন্ধুবরেষু—
.
এই মুহূর্তে সিরাজ
”এখন একটা কষ্ট হয়, কত কথা বাকি রয়ে গেল—এখন মনে হচ্ছে আরো কত কী লিখতে পারতাম—কিছুই যে বলা হল না। ইদানীং প্রচণ্ড একটা কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ করে কেন জানিনা আমার সমস্ত অতীত আমার সামনে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ছে। মনে হচ্ছে যা লেখা হয়নি, যা লেখা হল না, তা ঝটপট লিখে ফেলি। কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর। তার ওপর আমার এ জীর্ণশীর্ণ শরীর—মনের ক্ষমতা থাকলেও শরীরের ক্ষমতায় আমি ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে পড়ছি। মনের মধ্যে কে যেন আমায় বারবার বলছে, ‘ক্ষমতা নেই’—অথচ একটা দুর্নিবার প্রেরণা বা শক্তি আমার শরীরেই উৎসারিত হচ্ছে। আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে চাইছে।”
এই ভাবেই সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ সেদিন সকালে তাঁর কথোপকথন শুরু করেছিলেন। যিনি নিজেকে ‘বক্তব্যজীবী’ লেখক বলে বরাবরের একটা ঘোষণা করে দিয়েছেন, আর যার ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সমস্ত সাহিত্য সাধনার ভিত্তি—জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে সেই মানুষটি পুনরায় নব উদ্যোগে শুরু করতে চাইছেন তাঁর লেখনী—কোন এক অজানা অতৃপ্তিতে তাঁর মনে হচ্ছে ”কিছুই তো হল না বলা।’ এর কিছুদিন আগেই সিরাজ গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন। রোগ শয্যায় জীবনমরণের লড়াই-এ তিনি জিতলেও ফিরে এসেছেন চুড়ান্ত দুর্বল এক শরীর নিয়ে। ক্ষমতা এমনই যে দুই আঙুলের চাপে কলমটিকেও পূর্বের মতো আর সামলে উঠতে পারছেন না। জীর্ণ ফুসফুস দুটিও উগড়ে দিয়েছে রক্ত—শিউরে উঠেছেন সবাই। তবে শেষ রক্ষা হয়েছে। গভীর রক্তপাতের মধ্যেই সিরাজ আবার তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা পেয়েছেন। সেদিন বললেন, গল্পের যে বোধ ও সৃষ্টির যে প্রেরণা নিয়ে তিনি তার সাহিত্য জীবন শুরু করেছিলেন তা থেকে আজ পর্যন্ত তিনি সরে আসেন নি। রাস্তাটা একই রয়েছে—অনেকটা দীর্ঘ, কিছুটা বা দুর্গম কিন্তু এঁকে বেঁকে এগোলেও তিনি একই জায়গায় রয়ে গিয়েছেন। ‘আমার লাইন অব অ্যাকশান চেঞ্জ হয় নি।’ হয়ত সে কারণেই বিদগ্ধজনে ও সুধী পাঠক সিরাজকে গভীর উপলব্ধির বক্তব্যজীবী লেখক বলেই স্বীকার করেন।
সেদিন বললেন, শারদীয়া আজকালে সন্দীপনের (চট্টোপাধ্যায়) ডাইরি পড়ছিলাম। ওর মৃত্যুর পর বেরিয়েছে, ও ঠিকই বলেছে তৃতীয় ছবি এমনই উঠে আসে। তবেই মৌলিক কাজের সৃষ্টি হয়। গ্রামীণ জীবন, মানুষ, সময়, স্থিতি ও কাল আমার গল্পের বিষয়। নগর জীবনও আমি একই চোখে দেখেছি। গ্রাম ও নগর জীবনের যে দ্বন্দ্ব, যে বৈপরীত্য আর যে সংঘাত তা আমার চোখের বাইরে কখনই যায়নি। কিন্তু এই দুটি ছবির পাশাপাশি আমরা কি পারলাম নিজস্ব কোন এক তৃতীয় ছবি তৈরী করে নিতে সন্দীপন এই চেষ্টার কথাই বলেছে।
গ্রামীণ জীবন নিয়ে সিরাজ কম লেখেননি। কিন্তু তবুও এই মুহূর্তে তাঁর মনে হচ্ছে তৃতীয় একটা ছবির প্রয়োজন ছিল। হয়তো ইতিহাসের গর্ভে থেকে যায় এই তৃতীয় ছবি। লেখকরা শুধুমাত্র তাকে তুলে আনেন পাঠকের চোখের সামনে। সেদিন সিরাজ নিজেই স্বীকার করেছেন যে সিঙ্গুরের ঘটনা কখনোই কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। তা জীবনেরই একটা ভিন্ন আঙ্গিক এবং কঠোর সত্য।
‘দীর্ঘকাল আমি গ্রামে কাটিয়েছি। চাষীদের আমি চিনি, জানি। জমি তাদের কাছে মায়ের মতো। সিঙ্গুরের চাষীদের জমি নিয়ে যে যন্ত্রণা তা কারোর ব্যক্তিগত যন্ত্রণা নয়, তা সমাজের, যার আধার সাহিত্য। একদিন যারা উদ্বৃত্ত জমি পেল ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে আজ তাদেরই জমি ছেড়ে দিতে হল। যে জমি ছিল বাঁচার জন্য তা হয়ে গেল আজ লড়াইয়ের ময়দান।’
সিঙ্গুরের ঘটনা যে সিরাজের মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে তা আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। তিনি অবশ্য এজন্য সরকার বা বিরোধী কোন পক্ষকেই দায়ী করতে চান না। তাঁর মতে সিঙ্গুরের ঘটনাই ইতিহাসের এক জঘন্যতম আত্মপ্রকাশ।
‘আমার একটা গল্প আছে। সেখানে নায়ক এক খোঁড়া চাষী। সে জমি পেয়েছিল, ঘটনাক্রমে তার জমি গেল, তার বউ ছিল, একটা বাচ্চা ছিল। ভূমিহীন হলে তার বউ তাকে ছেড়ে গেল, বাচ্চাটিও রইল না। এমন যন্ত্রণার গল্প আমি লিখেছি। আমি ভাগ্যবাদী নই। তবে জীবনে যা ঘটছে তা কোনটাই হয়তো আমাদের হাতের মধ্যে নয়। এখানেই হয়তো আমাদের সেই তৃতীয় ছবি তৈরী হয়। যখন ভাবি সিঙ্গুরের মতো ঘটনা ঘটে কেন? তখন আমায় অনেক প্রশ্ন হন্ট করে। হয়তো কোনো ঐতিহাসিক মুহূর্তে সেইসব প্রশ্নের উত্তর পাব। আমরা সকলেই দুটো ছবি দেখেছি পাশাপাশি। ‘উড়ো চিঠি’ বলে আমার একটা গল্প আছে, যার মধ্যে গ্রাম জীবনের অতীত সামাজিক ঐক্যের কথা বলতে চেয়েছি। কার্ল মার্কস ভারতীয় সেই জীবনকে উদ্ভিদের জীবন বলেছেন। এই গল্পে উদ্ভিদের লক্ষ্মণ সবই আছে কিন্তু তা সত্বেও মানবতার যে উচ্ছ্বাস আছে তা দূরে বসে মার্কস টের পান নি।
এখানে, সাহিত্যের সেরা গল্পের ভূমিকায় সৈয়দ মুজতবা সিরাজ নামের মহতী কথা সাহিত্যিকের জীবনী লেখার সুযোগ বড়ো কম। করলে তা পুনরাবৃত্তির দোষে দুষ্ট হত। বরেণ্য এই লেখকের জনপ্রিয়তা এমনই যে তার জীবন, কাল, সাহিত্য, রচনার খুটিনাটি তথ্য প্রায় সকলেরই জানা। আমরা স্বল্প পরিসরে তার ভাবনার একটা মুহূর্তকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।
সিরাজ বক্তব্যজীবী লেখক হলেও তিনি যে গভীর উপলব্ধির লেখক তা তাঁর গল্প পাঠ করলেই বিদগ্ধজন তো বটেই, এমনকি সাধারণ পাঠক ও বুঝতে পারেন। তাঁদের কৌতূহলও তাই সীমাহীন। সিরাজের উপলব্ধির গভীরতা এমনই যে তাঁকে নিয়ে জানার শেষ হয় না—তাঁকে ছুঁয়ে ছোঁয়া দুরূহ। সিরাজের লেখার বিষয়ও কোনো লক্ষ্মণরেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—
তার সাহিত্য রচনা বৈচিত্র্যময়তায় পূর্ণ। এই সংকলনে সিরাজের বেশ কয়েকটি বক্তব্যমূলক গল্প রয়েছে।
সঙ্গতকারণেই তাত্বিক ও সাহিত্য সমালোচকরা সিরাজকে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং পরবর্তী তিন বাঁড়ুজ্যের উত্তরাধিকারী বলেন। নিজেকে বক্তব্যজীবী লেখক বলতে চেয়ে সিরাজ উপলব্ধির কথাই হয়তো বুঝিয়েছেন কেন না বক্তব্যের উত্তরাধিকার তার সাহিত্যে থাকলেও তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে পেরেছেন। তাই মানব জীবনের কথার সঙ্গে সঙ্গে মানব জমিনের গাঢ় উপলব্ধি তার সাহিত্যে প্রকট ও রহস্যময়। তবুও এখনও সহজেই সিরাজ বলতে পারেন যে তাঁর দিক পরিবর্তন হয় নি। বহুপথ পরিক্রমা করেও সঠিক জায়গাতেই রয়ে গিয়েছেন। সময়ে, কালে শুধু পরিবর্তিত হয়েছে অভিজ্ঞতার ভাষা। কখনো তা রঙিন কখনো সাদা কালো। যে কারণেই আশ্চর্য মানুষগুলি তার গল্পের চরিত্র হয়। এখানে তিনি একান্ত নিজস্বের। কোনো ক্ষেত্রে তারাশঙ্করের প্রায় পাশাপাশি হেঁটেও তিনি আকর্ষণীয় এক ‘অলীক মানুষ’ এর জনক শুধু দশবারোটি গল্প দিয়ে সিরাজকে চেনানো যায় না— যে চেষ্টাও এখানে করা হয়নি। কেবলমাত্র ‘লালীর জন্য’ গল্পটি পড়লেই বোঝা যায় বিশ্বসাহিত্যে বরেণ্য লেখকদের সারিতে সহজেই সিরাজ তাঁর স্থান করে নিতে পারেন। সিরাজের যে কোনো গল্পেই পাঠক তাঁর গভীর উপলব্ধির সঙ্গী হয়ে ওঠেন।
আমাদের আশা সিরাজ তাঁর সেই ‘তৃতীয় ছবি’ এখনো না আঁকতে পারার আক্ষেপ থেকে খুব শীঘ্রই নিজেকে মুক্ত করবেন।
কল্যাণ মৈত্র
Leave a Reply