সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় : সাহিত্যের সেরা গল্প
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ২০০৬
প্রচ্ছদ : অনুপ রায়
.
ভূমিকা
কোনারক থেকে করতালের শব্দ
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প একটাই। আর সেটা নিয়েই তিনি সব গল্প লেখেন, যদিও সেই মূল গল্পটি নেহাতই শিশুপাঠ্য। কথাটি সন্দীপনের নিজের, তাঁর পঞ্চাশটি গল্পের শেষ গল্প। যদিও সন্দীপনের সব কথা বিশ্বাসযোগ্য নয়, চমক দেওয়ার জন্য সেক্স-বিষয়ে কথাগুলো বিশেষ করে। তবে এই কথাটি বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। শুধু এজন্য নয় যে গল্পটি শিশুপাঠ্য; শিশুদের কাছে লোকে সাধারণত মিথ্যা কথা বলে না, আর শিশুদের কাছে জটিল বিষয়ের মূল কথাটি সরলভাবে বলা হয়— সন্দীপনের কাছে আমরা সেই সেন্টিমেন্ট আশা করি না। কথাটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, কারণ, ১৯৬০ সালে লেখা ‘বিজনের রক্তমাংস’ থেকে ১৯৯২ সালে লেখা ‘সেইসব আত্মহত্যা’ পর্যন্ত বেশিরভাগ গল্পের মূল কথাটি একই।
গল্পটি এই : বেড়ালকে ইঁদুর বলছে, আমাকে খাও। বেড়াল খাবে না, আপাতত তার খিদে নেই। কিন্তু ইঁদুরকে খাওয়া বেড়ালের কর্তব্য। ইঁদুরের পীড়াপীড়িতে বিরক্ত বেড়াল ইঁদুরের মুণ্ডু মুখে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। অধৈর্য ইঁদুর জিজ্ঞাসা করল, বেড়াল কখন তাকে খাবে। বেড়াল রাস্তায় লেজ বিছিয়ে শুয়ে আছে। রাস্তার লোকেরা সেটা এড়িয়ে হাঁটছে। তবে কাছে অন্ধস্কুলের বাড়ি, স্কুল ছুটি হলে কোনো অন্ধ ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ই লেজে পা দেবে, মাড়ালেই বেড়াল খ্যাঁক করে কামড়াবে। ততক্ষণ ইঁদুরের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
সন্দীপনের গল্পে চরিত্র অনির্দিষ্ট, ঘটনা দানা বাঁধে না, পরিস্থিতি গড়ে ওঠে না, এসব মনে হয় না তাঁর উদ্দিষ্ট। কোনো দর্শন গড়ে তোলা হয়ত তাঁর ইচ্ছা, তবে কোনো দর্শন গড়ে তোলার ধৈর্য, পরিশ্রম বা ধারণক্ষমতা দেখা যায় না। ন্যারেটিভ পরিহার করেছেন, গল্প বলাটা তিনি চলতি গল্পলেখকদের (তাঁর ভাষায়, বা-লে : বাঙালি লেখক) হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। যাঁদের বন্ধ্যা স্ত্রীরা টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, সাউন্ড সিস্টেম, টেলিফোন, মারুতি ভ্যান, সুরেন টেগোর রোডে দুই হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট আদি প্রসব করেন। সন্দীপনের উদ্দিষ্ট মহৎ সাহিত্য। সেই সাহিত্যের অবশ্য কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, জীবনানন্দ, কামুর কথা তিনি বলেন প্রবন্ধে গল্পে। সুস্থ স্বাভাবিক বাঙালি জীবন নিয়ে তিনি লেখেন না। মৃত্যু যখন নিশ্চিত, অথচ মৃত্যুর সময়টা অনিশ্চিত (ইঁদুর আর বিড়ালের গল্পটা কথার কথা নয়), মৃত্যু যখন আসে অসুখ, নিরাপত্তাহীনতা, আশ্রয়হীনতা, উদ্দেশ্যহীনতার মধ্যে দিয়ে, তখন সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন আশা করাটাই অপ্রাপ্তমনস্কতা। ফলে, রমণে উদ্যত পুরুষের চোখে নারীর অঙ্গে কুষ্ঠের সংকেত, মানুষে-মানুষে সম্পর্কের আত্মহত্যা, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিচের উপত্যকার লোকটাকে নিদারুণ একা মনে হওয়া, রামবাগানের শেফালির ক্ষয়ে-যাওয়া সাবান দেখে ঘেন্নায় ‘একি প্রবৃত্তি!’ বলে চিৎকার করা—এগুলো সন্দীপনের লেখার ট্রেডমার্ক। যেমন তাঁর গদ্যের ট্রেডমার্ক : ”অসুখ হয়; সেরে উঠে অনেকে ভাবে, ‘বাঁচলুম’। হেসে তাকে বলার, ‘এটা ভুল’। মৃত্যু থেকে কেউ কখনও বেঁচে ওঠে না।” ”বইটাতে খালি ফুলস্টপ দেখলুম— কমা, সেমিকোলন, লীডার (…), ড্যাস এসব নেই বললেই চলে। সম্ভবত তার বদলে রয়েছে তথ্যাশ্রয়ী, তত্বাশ্রয়ী, চৈতন্য, সত্তা, নিরঞ্জন, সূর্য, অভিব্যঞ্জনা, উচ্চকোটি—এইসব। …ইনি ‘রূপনারায়ণের কূলে জেগে উঠিলাম’-কে কবিতা বলে মনে করেন না। (‘পিওর প্রোজ!’) রবীন্দ্রনাথের ছবি তাঁর অন্ধকার দিককে তুলে ধরে মনে করেন, পঁচিশে বৈশাখ জোড়াসাঁকোয় যান। ভোরে ভৈরবী, সন্ধ্যের ঝোঁকে পূরবী শোনেন।”
ইংরাজিতে ড্রাই হিউমার বলে একটা কথা আছে। বাঙালির ধাতে শুকনো পরিহাস বেশি আসে না, তারা উচ্চহাস্য করে, মৃদুহাস্য করে, ঠা ঠা করে হাসে, মিচকি মিচকি হাসে। সন্দীপন বিরল ব্যতিক্রম, যাঁকে শুকনো ঠাট্টা করলে মানায়। কেননা, তাঁর ঠাট্টা আত্মঘাতী, অন্যকে যত আহত করে, নিজেকে তার বেশি। তাঁর পরিচারিকার নাম আশা। আশা তাঁকে বেশিদূর নিতে পারে না। কারণ সেই একই। ”মীরা লিখেছে ‘তুমি আমার জীবনে আগে এলে না কেন?’ এলুম একটা ধরেই নিয়েছে। ভালো। আমি তার ভুল ভাঙব না। আমি তার চিঠি পেয়ে হো হো করে হেসে উঠেছিলুম। এই হাসি ভয়াবহ একথা মনে করিয়েও হাসি থামাতে পারিনি বলে সুনীল রায় এখন লুম্বিনীতে।”
সন্দীপনের পাখিরা ওড়ে না, ওড়াউড়ি করে। তাঁর চরিত্রেরা, যদি আদৌ কোনো চরিত্র থাকে, কেননা তাঁর চরিত্ররা মরালিটি প্লে’র মতো আইডিয়ার বাহক, স্বচ্ছন্দে ওড়ে না, নিঃস্পৃহভাবে ওড়াউড়ি করে। তাঁর বিড়ালরা বেড়াল, বিড়াল নয়। সাধুলোকের ভাষায় তিনি জীবন খুঁজে পান না। মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে মায়ের আশীর্বাদের মতো তাঁর দশ-দিন-বন্ধ স্যানিটারি পায়খানার প্যান পরিষ্কার হয়ে যায়। অ্যাডাল্টদের জন্য এ সব গল্প শৌখিন লোকেদের কাছে দুঃসহ, দুর্গন্ধ মনে হবে—আর যাঁদের জগতে ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই/নিভে যায় বারে বারে’, যাঁদের জগতে গভীর অন্ধকারে কারও আসনই পাতা থাকে না, যাকে সাহিত্যের ইতিহাসে পোস্ট-মডার্নিস্ট আখ্যা দেওয়া হয়েছে, তাঁরা অবশ্যই সন্দীপনের লেখা খুঁজে পড়বেন। খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অকস্মাৎ বিস্ফোরণ তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য, যে জন্য গড়গড় করে পড়ে ফেলার জন্য তাঁর লেখা না, পঁচিশ বছরের পুরানো লেখা, আগে-পড়া লেখাও, আবার পড়লে নতুন লাগে, সত্য মনে হয় খণ্ড খণ্ড ছবি, অখণ্ড ছবি গড়ে তোলার কোনো চেষ্টা নেই, যে জন্য তাঁর লেখা প্রথম থেকে, মাঝ থেকে, শেষ থেকে পড়া যায়, ক্লান্তি আসে না। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে লিখে সন্দীপন অন্তত এটা বলতেই পারেন, তিনি অনন্য—এই ধরনের লেখা বাংলায় বেশি লেখা হয়নি। কোনারক থেকে যে করতাল-শব্দ ভেসে আসে, সেটা জীবনের নয়, মৃত্যুর। ”সে শব্দ সবার কাছে পৌঁছায় না, কেননা, সন্দীপনেরই ভাষায়, কানের বদলে আমাদের মাথায় দু-পাশে খণ্ড-ত”।
এই ক্ষীণকায় আলোচনায় সন্দীপন থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিতে হল, শুধু একটু বোঝানোর জন্য, তাঁর রচনায় কোটেবল, কোটের সমারোহ। গানের কলির মতো। তবে, এ গান আনন্দের নয়, দুঃখেরও নয়, যন্ত্রণায় দমবন্ধ করা হাসির মতো।
নিত্যপ্রিয় ঘোষ
Leave a Reply