রহস্য সমগ্র – অজেয় রায়
সংগ্রহ ও সম্পাদনা – অরিন্দম দীঘাল ও সমুদ্র বসু
দে’জ পাবলিশিং
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১৭, মাঘ ১৪২৩
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : রঞ্জন দত্ত
ওসিআর ক্রেডিট – অরাজকতা
(এই বইটি আমরা আর দ্বিতীয়বার প্রুফরীড করিনি।)
.
যে সমস্ত শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাহায্য ও উৎসাহে
নিরন্তর অনুপ্রেরণা পাই তাদের কয়েকজন—
অর্ণব দাস, সৌগত সেনগুপ্ত, সোমনাথ মান্না, রাজর্ষি সরকার, প্রদীপ্ত ভক্ত, দেবাঞ্জন দেব, অরিন্দম চক্রবর্তী, ইন্দ্রাশিস গোস্বামী এবং অভিষেক চ্যাটার্জী কে
—সমুদ্র বসু
আমার বাবা (শ্রীঅনিলচন্দ্র দীঘাল) ও আমার মা (শ্রীমতী ছন্দা দীঘাল) কে
—অরিন্দম দীঘাল
.
ভূমিকা
সত্তরের দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশক এর শেষ পর্যন্ত বাংলা কিশোর সাহিত্যের জগৎ ঠিক যেন ছিল স্বপ্নের মতো। সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সহ বহু নামীদামি লেখক-লেখিকারা তাঁদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যগুলো সেই সময়ই লিখেছিলেন। সেই সময়কার কিশোর সাহিত্যিকদের মধ্যে যাঁরা বহু অসাধারণ গল্প, উপন্যাস লিখেও যথার্থ স্বীকৃতি বা প্রাপ্য সম্মান পাননি তাঁদের মধ্যে প্রথমেই অজেয় রায়-এর নাম উঠে আসা উচিত। অথচ রহস্য-রোমাঞ্চ, অ্যাডভেঞ্চার ভৌতিক, মজার, ঐতিহাসিক প্রতি বিষয়েই অসাধারণ সব গল্প-উপন্যাস উনি সেইসময় লিখে গিয়েছেন। সমসাময়িক প্রতিটি প্রথম সারির কিশোর পত্রিকায় ওঁর লেখাগুলো অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তৎকালীন সন্দেশ-এর সম্পাদক সত্যজিৎ রায়ের অত্যন্ত প্রিয় লেখক ছিলেন উনি। সন্দেশ সহ শুকতারা, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, ঝলমল ইত্যাদি পত্রিকায় অসংখ্য লেখা লিখেছিলেন উনি।
অজেয় রায়-এর অধিকাংশ লেখাগুলোই পরবর্তীকালে বই-এর আকার পায়নি। যেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। দু’-তিনটি প্রকাশনা ছিল অত্যন্ত দায়সারা গোছের। পরবর্তীকালে কিছু গল্প সংকলন প্রকাশ পেলেও উপন্যাসগুলি বেশিরভাগই অগ্রন্থিত ছিল। কিংবা কোনো এক সময় প্রকাশিত হলেও বহুযুগ আর ছাপাই হয় না। শেষ পর্যন্ত ২০০৯ সালে দে’জ পাবলিশিং প্রথম একটা উপন্যাস-এর সংকলন প্রকাশ করে যেটায় যথেষ্ট পরিকল্পনার ছাপ ছিল। সেটিতে মূলত অজেয় রায়-এর অ্যাডভেঞ্চার-এর কাহিনিগুলি গ্রন্থিত হয়। সেগুলি ছাড়াও ওঁনার রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনিগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য পুরো ধন্যবাদটাই প্রাপ্য দে’জ পাবলিশিং-এর শুভঙ্কর দে-র। আরও বিশদে বললে আমাদের ভীষণ প্রিয় অপুদার।
এই সংকলনটা প্রকাশ করার ইচ্ছে যখন থেকে আমার মাথায় এসেছিল ঠিক তখনই আমার আলাপ হয় শিশু ও কিশোর সাহিত্যের এনসাইক্লোপিডিয়া সমুদ্র বসুর সঙ্গে। ভ্রাতৃসম সমুদ্রকে অজেয় রায়-এর সংকলনটির প্রকাশের ব্যাপারে জানাই। সমুদ্ররও চরম উৎসাহে আর অপুদার সম্মতি নিয়ে এই রহস্য রোমাঞ্চ অমনিবাসের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই সময় বেশ কিছু লেখা দিয়ে বিশেষ উপকার করেন ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সময়ের কিশোর সাহিত্য অনুরাগীসহ অজেয় রায়-এর অসংখ্য অনুরাগীদের এই বইটি ভালো লাগলে শ্রম সার্থক হবে বলে মনে করি।
অরিন্দম দীঘাল
যাদবপুর, কলকাতা
.
এক মিনিট, আপনাকে বলছি
সমুদ্র বসু
বাংলা সাহিত্যে আদ্যোপান্ত শিশু-কিশোর সাহিত্যিক বোধ হয় হাতে গোনা কয়েকজন। যে পবিত্র কর্মকাণ্ডকে সফল করে তুলতে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের মতো আদ্যোপান্ত শিশু সাহিত্যিকরা সেই ধারাটিকে বজায় রাখতে সামান্য যে কয়েকজন সফল হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অবশ্যই অজেয় রায় অন্যতম। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের সাহিত্য জীবনে পুরোটাই ছোটদের কথা ভেবে লিখে গিয়েছেন এই মানুষটি। নামীদামি পুরস্কারের হাতছানিতেও কখনো বড়দের জন্য লেখার কথা ভাবেননি তিনি। ১৯৩৫ সালের ২৭ আগস্ট শান্তিনিকেতনে জন্ম তাঁর। তাঁর মা লতিকা রায় শান্তিনিকেতনের ছাত্রী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নাট্য অভিনয়ে লতিকা রায় একাধিকবার নৃত্য পরিবেশন করেছেন। অজেয় রায়ের নামটিও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের দেওয়া। তাঁর পিতা পূর্ণেন্দু রায়। তাঁরা ছিলেন ছয় ভাইবোন। তিনি বিশ্বভারতী ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বিশ্বভারতীর কৃষি-অর্থনীতি গবেষণা কেন্দ্রে গবেষক কর্মী হিসাবে যুক্ত ছিলেন। শিশু সাহিত্যিক অজেয় রায় অজস্র সাহিত্য সম্মান লাভ করেছেন যার মধ্যে অন্যতম জগত্তারিণী স্মৃতি পুরস্কার, বিশ্বভারতী প্রদত্ত আশালতা সেন স্মৃতি পুরস্কার, সন্দেশ পত্রিকা প্রদত্ত সুবিনয় স্মৃতি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার প্রভৃতি। ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর স্বল্পকাল রোগ ভোগ করার পর হায়দরাবাদে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ছোটবেলায় একদিকে খেলাধুলো করতে যেমন ভালোবাসতেন তিনি, তেমন অন্যদিকে ঝোঁক ছিল গল্পের বই পড়তে। ছেলেবেলায় জন্মদিনে তাঁর বাবা অজেয় রায় ও তাঁর অন্য ভাইবোনদের এক গোছা বই উপহার দিতেন যা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে পড়ার ধুম পড়ে যেত। অ্যাডভেঞ্চার ও রহস্য-রোমাঞ্চ বইয়ের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আকর্ষণ। হেমেন্দ্রকুমার ও নীহাররঞ্জন ছিলেন তাঁর সব থেকে প্রিয় দুই লেখক। বিশেষত হেমেন্দ্রকুমারের বিমল-কুমার ও জয়ন্ত-মানিক ছিল তাঁর সব থেকে কাছের। লেখক অজেয় রায়ের আবির্ভাবের অনেক আগেই গল্পকার অজেয় রায়ের আবির্ভাব হয়েছিল। উনি ছোটবেলা থেকেই স্বরচিত রহস্য রোমাঞ্চ অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি খাওয়ার টেবিলে বসে ভাইবোনদের শোনাতেন রাত্রিবেলায়। মায়ের চোখরাঙানি ভুলে সেই সব গল্প গোগ্রাসে গিলতেন তাঁর ভাইবোনেরা। ১৯৬৪ সালের মার্চ মাসের শুকতারা পত্রিকায় অজেয় রায়ের প্রথম গল্প “যেমন ইচ্ছা সাজো” প্রকাশিত হয়। তখন তিনি অজেয় রায় নামে লিখতেন না। সেই লেখাগুলো বেরোত তাঁর ছদ্মনাম অন্তু রায় নামে। একটা স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে মেদিনীপুরের পঁচেটগড়ে কোনো এক খররৌদ্রে অজেয় রায় কয়েকজনের সঙ্গে এক পুকুর ঘাটে বসে আছেন। সাঁতার কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় পোস্টম্যান এসে রেজিস্ট্রি বুকপোস্টে সই করিয়ে তাঁকে একটা পত্রিকা দিয়ে যায়। সেটাই হল সেই শুকতারা পত্রিকা যেখানে অন্তু রায় নামে তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। অন্যেরা হই হই করে উঠলেও ছাপার অক্ষরে প্রথমবার নিজের নাম দেখে একটুও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেননি তিনি। শুধু একটু মুচকি হেসেছিলেন। হয়তো তিনি সেদিন বোঝেননি যে একদিন বাংলা শিশু সাহিত্যে তাঁর নাম স্থায়ীভাবে মতো থেকে যাবে। নক্ষত্রের
লেখা পাঠাতে থাকলেন। এরপর তিনি অন্তু রায় নামে শুকতারা ও সন্দেশে পরপর বেশ সেগুলো সবই ছাপাও হতে থাকল। প্রবল উৎসাহ পেলেন তিনি। এবারে একটা মজার ঘটনা বলা যাক যা জানা গিয়েছে অজেয় রায়েরই একটা লেখা থেকে। তিনি একসময় একটা স্কুলে শিক্ষকতার কাজ করতেন। সেখানে ছেলেপুলেরা ছিল ভয়ঙ্কর অবাধ্য। নরম মনের মানুষ অজেয় রায় তাদের মারধর করা তো দূরের কথা, খুব বেশি বকাঝকাও করতে পারতেন না। যার ফলে অনেক সময় ক্লাসের মধ্যে গোলমাল বা চিৎকার শুরু হয়ে যেত। একদিন হেড মাস্টারমশাই অজেয় রায়কে ডেকে আরও কড়া হতে বললেন যাতে ক্লাসে ডিসিপ্লিন বজায় থাকে। বেশ বিপাকে পড়া অজেয় রায় এরপর একদিন যখন ক্লাসের মধ্যে প্রবল গোলমাল হচ্ছে সেদিন ছাত্রদের চুপ করানোর এক নতুন পন্থা নিলেন। তিনি সবাইকে একটি গল্প বলতে লাগলেন। রবিনহুডের গল্প। টনিকের মতো কাজ হল তাতে। সবাই গোগ্রাসে গিলল সেই গল্প। এরপর সবাই যেন গল্প শোনার নেশায় মেতে উঠল। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তাই নতুন নতুন গল্প বলতে হত তাঁকে। তিনি এইভাবেই একদিন আফ্রিকা অভিযানের একটা গল্প তাদের বলতে লাগলেন যা কিনা তাঁর নিজের মনগড়া এক কাহিনি। গল্পের নায়ক এক বাঙালি বৈজ্ঞানিক এবং তার দুই যুবক সঙ্গী। এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সূত্র ধরে তারা বেরিয়ে পড়ল এক রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চারে। আফ্রিকা সম্বন্ধে যথেষ্ট পড়াশোনা ছিল অজেয় রায়ের। তাই থেকে বর্ণনা দিতে লাগলেন অভিযানের পথের, সেখানকার গাছপালা, জীবজন্তু, আদিবাসীদের। বলতে বলতে চরিত্রগুলো দিব্বি জীবন্ত হয়ে উঠল। জমে গেল গল্প। আসলে রহস্য রোমাঞ্চ গল্প বানাতে তাঁকে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। কল্পনায় অ্যাডভেঞ্চারের জাল বুনতেন তিনি। কত ঝোঁপ জঙ্গল ভরা মাঠঘাটে, নদীর তীরে, নির্জন প্রান্তরে দু-এক জন বন্ধুকে সঙ্গী করে তিনি ঘুরেছেন। পুরনো বাড়ি পেলেই আঁতিপাতি করে খুঁজতেন গুপ্তধন। আর তাই কল্পনার জাল বুনে তৈরি করা ওই মস্ত অ্যাডভেঞ্চার যখন তিনি বলা শেষ করলেন তখন ক্লাসের সব ছাত্ররা এক কথায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। একজন ছাত্র তো গোঁ ধরে বসল যে ওই বইটা সে কিনবেই। এদিকে অজেয় রায় তো তাকে “পরের দিন বলব”, “দেখে বলব”, “ইংরেজি নামটা ঠিক মনে পড়ছে না” ইত্যাদি বলে সেই ছাত্রকে এড়িয়ে গেলেন। আর সেই থেকেই তিনি ভাবতে শুরু করলেন যে এই সুদীর্ঘ কাহিনিটিকে উপন্যাসের আকারে লিখে ফেললে কেমন হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একটা জাবদা খাতায় প্রবল উৎসাহের সঙ্গে লিখে ফেললেন তাঁর জীবনের প্রথম উপন্যাস।
কয়েক মাস পরেই সেই স্কুল ছাড়লেন তিনি। চাকরি বদলালেন। এলেন শান্তিনিকেতনে। হঠাৎ একদিন খবর পেলেন যে সন্দেশ পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদিকা লীলা মজুমদার শান্তিনিকেতনে এসেছেন বেড়াতে। তখন তাঁর খুব ইচ্ছা হল যদি কোনোভাবে সম্পাদিকার সঙ্গে দেখা করে আলাপ করা যায়। দূর থেকে তাঁকে দেখে বেশ ভয় পেলেন তিনি। চশমা পরা রাশভারী চেহারা। তবু একদিন বুক ঠুকে ঢুকে পড়লেন আলাপ করতে। ভয় ভেঙে গেল সেদিনই। খুব সহজ সরল মানুষ সেই সম্পাদিকা। একবারেই তিনি মনে করতে পারলেন অজেয় রায়ের লেখা গল্প দুটির কথা। উৎসাহ পেয়ে লিখে ফেললেন আরও বেশ কিছু গল্প। এরপর লীলা মজুমদার শান্তিনিকেতনে বছরে দু-তিনবার আসতে থাকলেন এবং প্রতিবারই অজেয় রায় তাঁর সঙ্গে দেখা করে গল্পগুলো সংশোধন করিয়ে নিতেন। প্রায় বছর দুই-তিন পর এরকমই একদিন শান্তিনিকেতনে লীলা মজুমদারের সঙ্গে খুব সাহস করে তিনি নিয়ে গেলেন তাঁর সেই জাবদা বড় খাতাটা যাতে তিনি কয়েক বছর আগে সেই বড় উপন্যাসটা লিখে রেখেছিলেন। মনে মনে অনেক দ্বিধা সত্ত্বেও তিনি সেই উপন্যাসের খাতাটা জমা দিয়ে এলেন লীলা মজুমদারকে। তারপর দিন সাতেক সম্পাদিকার ধারে কাছেও যাননি তিনি। আবার সাহস করে একদিন হাজির হলেন সম্পাদিকার কাছে। প্রথম প্রতিক্রিয়াটা বেশ ভয়ঙ্কর ছিল সম্পাদিকার – “বড্ড বানান ভুল।” সম্পাদিকা জানালেন বেশ কিছু অংশ কাটছাঁট করার জন্য দাগ দিয়ে দিয়েছেন। ভালোমন্দ কিছুই বলেননি সম্পাদিকা। আর তাই অজেয় রায় বেশ সংকোচের সঙ্গে সেই খাতাটা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। সেটা ছিল ১৯৭০ সাল। এর কয়েক মাস পরেই অযাচিত ভাবেই সন্দেশ দফতর থেকে লীলা মজুমদারের লেখা এক চিঠি আসে তাঁর কাছে।
সেখানে অজেয় রায়কে সেই উপন্যাসটা পরিষ্কার হাতের লেখায় বানান ঠিক করে এবং অন্যান্য দাগ দেওয়া জায়গায় সংশোধন করে সন্দেশ শারদীয়াতে পাঠাতে বলেন। এই “মেঘ না চাইছে জল” খবরে নতুন উদ্যমে উপন্যাসটা আবার লিখে সন্দেশে তিনি পাঠিয়ে দিলেন কোনো নাম ছাড়াই। অবশেষে ১৯৭০ এর সন্দেশ শারদীয়াতে প্রকাশ পেল এক কালজয়ী উপন্যাস “মুঙ্গু”। পাতা জোড়া সুবিশাল নামাঙ্কন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের করা। জানা গেল নামটাও তাঁরই দেওয়া। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি অজয় রায়কে। তাঁর কলমে একের পর এক অসাধারণ কিছু অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস প্রকাশ পেতে থাকে –“আমাজনের গৃহনে”, “ফেরোমন”, “মিস্টার বাসুর ফরমুলা”, “মানুক দেওতার রহস্য সন্ধানে”, “বাতেন দ্বীপে অভিযান”, “কেল্লাপাহাড়ের গুপ্তধন” ইত্যাদি।
সন্দেশ ও শুকতারার পাশাপাশি সে সময়ের অন্যান্য সমস্ত শিশু কিশোর পত্রিকা যেমন আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, ঝলমল, কিশোর মন ইত্যাদিতে লিখেছেন অজেয় রায়। ভৌগোলিক তথ্য, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এবং অ্যাডভেঞ্চার এই টিনের অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটেছে তাঁর সৃষ্ট চরিত্র মামাবাবু-সুনন্দের কাহিনিগুলিতে। বীরভূম জেলার ময়ূরাক্ষী নদীর পাড়ে ছোট্টগ্রাম চন্দনার দুই কিশোর শিব ও দেবুর নানা কীর্তিকলাপ নিয়ে বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস লিখেছেন তিনি। তবে অজেয় রায়ের শ্রেষ্ঠ মূল্যায়ন করা যায় তাঁর লেখা রহস্য রোমাঞ্চ, ভৌতিক এবং হাস্যরসপূর্ণ ছোটগল্পগুলি থেকে।
অ্যাডভেঞ্চারধর্মী গল্পের বাইরেও আজীবন তিনি লিখেছেন নানা ধরনের রহস্য রোমাঞ্চ গল্প। দেজ পাবলিশিং ও শ্রী অপু দে-কে সাধুবাদ জানাই এরকম এক অনবদ্য পরিকল্পনার জন্য যেখানে খণ্ডে খণ্ডে অজেয় রায়ের এক একটা “থিম” এর গল্পগুলিকে দুই মলাটে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। এই উদ্যোগ আগে কোনো প্রকাশক করেননি। একমাত্র দেজ পাবলিশিং থেকেই এর আগে অজেয় রায়ের অ্যাডভেঞ্চারধর্মী গল্পগুলিকে দুই মলাটে সাজিয়ে “অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র” নাম নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছিল। এই বইয়ে অজয় রায়ের বেশ কিছু নির্বাচিত রহস্য রোমাঞ্চ শ্রেণির গল্পগুলিকে পাঠকের কাছে তুলে দেওয়া হল। এর বেশির ভাগ গল্পই বর্তমানে অগ্রন্থিত যা পাওয়া গিয়েছে অনেক পুরনো সন্দেশ, শুকতারা, কিশোর ভারতী বা আনন্দমেলাতে। এই সংকলনকে সম্পাদনা করা সম্ভব হয়েছে অপুদার প্রবল উৎসাহ ও অনবরত লেগে থাকার জন্য। সুযোগ্য সঙ্গী অরিন্দমকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাই গল্পগুলিকে নির্বাচন ও জোগাড় করতে সাহায্য করার জন্য। আমি আমার বাবা ও মার কাছে ঋণী থাকব কারণ বই নিয়ে আমার উন্মাদনাকে সবসময় প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য ও আমার ছোটবেলার কিনে দেওয়া পত্রিকাগুলি আজ আমার কাছে অমূল্য সম্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা না থাকলে এই ধরনের কাজ সম্ভব ছিল না। আমি ঋণী আমার অত্যন্ত প্রিয় দীপঙ্কর দত্তর কাছে যে আমাকে অনেক পত্রিকা জোগাড় করে দিয়েছে। সর্বোপরি এই প্রজেক্টে অনবরত উৎসাহ দিয়ে ও গল্প বাছাইয়ে যাঁরা সাহায্য করেছেন এবং যাঁদেরকে পাশে না পেলে এই সংকলন সম্ভবপর হত না তাঁরা হলেন—অর্ণব দাস, সোমনাথ মান্না, রাজর্ষি সরকার, অনন্যা দাশ, সৌরভ দত্ত, প্রদীপ্ত ভক্ত, ইন্দ্রাশিস গোস্বামী এবং সৌগত সেনগুপ্ত। সবশেষে, এই সংকলন আপনাদের সকলের ভালো লাগা বা না লাগার বিচার আপনাদের হাতেই তুলে দেওয়া হল।
Onek dhonyobad Apnader.
Apnara kub valo kaj korchen.
I want to read bengali Book