মহাশ্বেতা দেবী : সাহিত্যের সেরা গল্প
সম্পাদনা – রঞ্জন মিত্র
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১৯
প্রচ্ছদ : অনুপ রায়
.
১৯৭০ থেকে ১৯৮৮—দীর্ঘ দু—দশকের কিছু কম সময়কালে রচিত মহাশ্বেতা দেবীর অজস্র গল্পের মধ্য থেকে অনুপম দশটি গল্প নির্বাচন করে—বর্তমান সংকলন মহাশ্বেতা দেবীর সেরা গল্প গ্রন্থটি নির্মাণ করা হল। নির্বাচনের সময় গল্পগুলির বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সম্পাদকের নিজস্ব পক্ষপাত, পচ্ছন্দ ব্যতীত—শ্রী তুষারকান্তি তালুকদার ও অধ্যাপিকা সোমা মুখোপাধ্যায়ের সুযোগ্য পরামর্শ ও নির্দেশ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এঁদের দু—জনের সহৃদয় সহায়তা ভিন্ন এ গ্রন্থ নির্মাণের প্রয়াস অভাবনীয় থাকত।
‘সাহিত্য শুধু ভাষা, শৈলী, আঙ্গিক নিরিখে বিচার করার মানদণ্ডটি ভুল। সাহিত্য বিচার ইতিহাস প্রেক্ষিত হওয়া দরকার। লেখকের সময় ও ইতিহাসের প্রেক্ষিত মাথায় না রাখলে কোনো লেখকের মূল্যায়ন করা যায় না। পুরাকথাকে, পৌরাণিক চরিত্র ও ঘটনাকে আমি বর্তমানের প্রেক্ষিতে ফিরিয়ে এনে ব্যবহার করি অতীত ও বর্তমানে যে লোকবৃত্তে আসলে অবিচ্ছিন্ন ধারায় গ্রথিত তাই বলবার জন্য।’— বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের অন্যতম বলিষ্ঠ গদ্যকার শ্রীমতী মহাশ্বেতা দেবী অন্যত্র লিখেছেন একথা।
বস্তুত নানান সময়ে রচিত মহাশ্বেতা দেবীর গল্পে, উপন্যাসে এমন সব প্রান্তিক মানুষ, আদিবাসী চরিত্র উঠে এসেছে—বাংলা সাহিত্যের মূল ভূ—খণ্ডে যাদের প্রবেশাধিকার ইতিপূর্বে ব্যাপকভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়নি।
এই গ্রন্থের ভূমিকা লেখার জন্য অন্য কাউকে অনুরোধ না জানিয়ে মহাশ্বেতা দেবীর একটি পৃথক রচনাকেই ভূমিকার পরিবর্তে বলে দেওয়া হল।
১৯৯৬ সালে সোমা মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রতিক্ষণ থেকে প্রকাশিত হয় এক খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংকলন—মহাশ্বেতা দেবীর পঞ্চাশটি গল্প।
ভূমিকা লিখেছিলেন লেখিকা স্বয়ং। একটি অংশে মহাশ্বেতা দেবীর আক্ষেপ ছিল—’আমার গল্পগ্রন্থের ভূমিকা আমার চেয়ে তরুণতর লেখকবন্ধুদের কেউ লিখলে, সমীচীন হত বলে মনে করি। অবশ্য তাঁদেরও সময়াভাব।’
মহাশ্বেতা দেবীর রচনা ভারতের বহু ভাষায়, এমনকী বিদেশেও নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষার পাঠকদের যে মনোযোগ ও গুরুত্বের দাবিদার ছিল মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য সৃষ্টির সমগ্রতা—কোনো অজ্ঞাত কারণে সেইরূপ আগ্রহ ও জনপ্রিয়তার ভাগীদার হননি মহাশ্বেতা। দেশ—বিদেশের বহু পুরস্কার। খেতাব, সম্মান প্রাপ্তি—নিরহঙ্কার, নিবিষ্ট লেখিকা ও সমাজকর্মী—মহাশ্বেতা দেবীর নামটিকে নির্ভার থাকতে দেয়নি। সক্রিয় নানান সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে—বিশেষত সমাজের একেবারে নীচুতলার মানুষ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নিম্নবর্গীয় মানুষজনকে নিয়ে তাঁর নিরন্তর প্রায় একক লড়াই প্রসঙ্গে—যে সঙ্গত আলোচনা প্রত্যক্ষ করা যায়—একজন লেখিকা হিসেবে ও সক্রিয় সমাজকর্মীরূপে তাঁর ভূমিকা যে বিশিষ্টতায় উপনীত হয় প্রতি—তুলনায় তাঁর অসামান্য সব সাহিত্যসৃষ্টি, অন্যতর অন্বেষণ প্রায় অবহেলার ধুলায় থাকা পড়ে থাকে—হয়তো এ—ও ইতিহাসের অমোঘ ট্র্যাজেডি। সমকাল যতই অবহেলা করুক সযত্ন সচেতন দূরত্ব বজায় রাখুক মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্য সংস্রব থেকে—উত্তরকালের নতুন সমাজের, নতুন সময়ের মানুষ হয়তো খুঁজে নিয়ে পড়বে তাঁর অসামান্য স্বতন্ত্র সাহিত্য নির্মাণ অন্য অন্বেষণের আগ্রহ নিয়ে—আর তখনই শুরু হবে মহাশ্বেতা দেবীর সৃষ্টিকর্মের প্রকৃত মূল্যায়নের কাজ, তার আগে নয়।
দশটি গল্পের এই সংকলন প্রকাশ করার অনুমতি দিয়েছেন মহাশ্বেতা দেবীর পৌত্র তথাগত ভট্টাচার্য। তাঁর কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার—ঋণ লাঘব করার প্রয়াসমাত্র।
রঞ্জন মিত্র
.
”বায়স্কোপের বাক্স”। তমস্বিনী আমার দিদিমা নন। কিন্তু তমস্বিনীর ঘর, লাইব্রেরি, ওই বাড়ি, ঢাকার ১৫ কিন্দা বাজার লেনে আমার দাদামশাইয়ের বাড়ি, ঘরটি দাদু দিদিমার। আলোমাসির কিছুটা নেওয়া মায়ের মণিমাসির কাছ থেকে। দেওঘরের বাড়ি আমার মায়ের মাতামহ, কবি অমিয় চক্রবর্তীর মাতামহ যাদবচন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়ি। ইনি রাজনারায়ণ বসুর বন্ধু ছিলেন। শেলিমাসি, বেলিমাসির ছোটবেলা আমার আর আমার পরের বোন মিতুলের ছোটবেলা। ভিতরের গল্পটি খুব নিষ্ঠুর। ছত্রিশ বছরের শেলিমাসি, বারো বছরের নেলিকে ছেড়ে চলে যান। তারপর দীর্ঘকাল ধরে অনুশোচনায় দগ্ধ এক শূন্য জীবন, প্রৌঢ়া এক রমণীর নিরন্তর অপরাধবোধের কাহিনী। এ গল্পের প্রসঙ্গে একজন ভালো পাঠক বলেছিলেন, কি মেয়েলি গল্প, আমার ভালো লাগেনি। এই পাঠক এক বিরল বন্ধু, সমালোচক, তাঁর বুদ্ধি ও নানা বিষয়ে জানার ব্যাপারটা খুবই স্বীকৃত এ রাজ্যে, অন্যত্রও। তিনিও এ কাহিনীর ভিতরের অকথিত অব্যাখ্যাত কাহিনী ধরতে পারেননি। হয়তো চাননি। আমাকে তিনি অন্যরকম লেখক মনে করেন। কিন্তু ”বায়স্কোপের বাক্স” আমি ছাড়া কেউই লিখতে পারত না, আমিও পরে হলে পারতাম না। মিত্র ও ঘোষ দ্বারা একদা প্রকাশিত এ বইটি এখনও পাওয়া যায় কিনা জানি না। তার আগের লেখা ‘সন্ধ্যার কুয়াশা’র কাহিনীতে, চরিত্র চিনে আমাদের বৃহৎ পরিবারের অনেক কিছু এসে পড়েছে। পরিবার তো রেখে যায় অবদান। আর আমরা মাতৃকুল, পিতৃকুল মিলিয়ে শতখানেক মানুষের পারিবারিক বৃত্তে বড় হয়েছি।
এর লাভের দিকটা অসামান্য। কতরকম মানুষ দেখা, কতরকম জীবন জানা। যখন দেখেছি, থেকেছি, জানাজানিটা ভালো লাগত। আর ভালো লাগত বই পড়ার অপার সুযোগ। পিতামহ, মাতামহ ও মাতামহী, আমার পিতা, এঁদের লাইব্রেরিও দেখেছি। সে লাইব্রেরি হারিয়ে যাওয়াও দেখেছি। যেহেতু এসব লাইব্রেরিতে গল্প উপন্যাস কমই থাকত, ইতিহাস, দেশের কথা, জীবনী, স্মৃতিকথা, এসবে নিমজ্জিত থাকতে বাধা ছিল না কোনো।
আবার ‘বায়স্কোপের বাক্স’—র কথা বলি। ওই বই, বাঁয়েন গল্প, এসবে মাতৃহৃদয়ের শূন্যতার চিত্র খুব পরিষ্কার। জননীর ব্যাপারটি আমাকে খুব আকর্ষণ করেছে। কত মায়ের কথা না লিখলাম। ‘সাঁঝসকালের মা’ আমার কাছে যথেষ্ট প্রয়োজনীয় এক লেখা। লেখার বিষয়বস্তুও অদ্ভুতভাবে আসে। পরিবারে এক মৃত্যু ঘটে। মৃতের বিশ্বাসানুযায়ী আনুষ্ঠানিক শ্রাদ্ধ হচ্ছে। এক অগ্রদানী ব্রাহ্মণ বোঝাচ্ছেন, সামান্য মূল্য ধরে দিলে আপনি সসাগরা ধরিত্রী দান করতে পারেন। ”সাঁঝসকালের মা” গল্পের সূত্র ওখানেই। মন তো কিছু বর্জন করে না। লেখাটি লোকবৃত্ত জীবনের। বস্তুত ”হাজার চুরাশির মা” লেখার আগে আমি সত্তরের আন্দোলন নিয়ে গ্রামীণ প্রেক্ষিতে কয়েকটি গল্প লিখি, ”ধীবর”, ”জল—অপারেশন বাকুলি”, ”কানাই বৈরাগীর মা” মনে পড়ছে। গ্রামীণ প্রেক্ষিতে এবং সমাজের দুর্বলতম শ্রেণীর প্রেক্ষিতে কম লিখিনি। ”বান”, ”যশোমতী”, ”ভীষ্মের পিপাসা”, এমন কত। এসব গল্প কোনোদিন সংকলিত হলে পাঠক হয়তো প্রথম পদক্ষেপ থেকে এখনও জেদের বশে পথ চলার মধ্যে একটা নিয়ম, ক্রম পরিণতি দেখবেন, ”হাজার চুরাশির মা” থেকে আমাকে সহসা আবিষ্কার করবেন না। লেখালেখির কাজে হঠাৎ সহসা, এসব আমি জানি না। আমি জানি লিখে যেতে হয়, পরিশ্রম করে চলতে হয় যার যেমন সাধ্য। লেখাটা আমার কাছে নিজের সঙ্গেই সংগ্রাম, কেননা আমার বিষয়ে আমি ক্ষমাহীন, নির্মোহ, হয়তো ভালো বিচারকও। সেই কোন যুগে লিখেছিলাম। ”পথ চলি আনন্দে”, আলাদীনের প্রদীপের দায়িত্ব নিয়ে অত্যন্ত ক্লান্ত এক পথিক। (ভালো লোকের হাতে পড়লে এ প্রদীপ ঘটাবে কল্যাণ, মন্দ লোকের হাতে পড়লে ডাকবে ধ্বংস, আমার গল্পের পথিক তার যাত্রা শেষ করে মহাচীনে। তখন চীন বিষয়ে কিছু জানি না। আজ বা কী জানি। ১৯৫০ সালে চীনা দূতাবাসে আমি ও বিজন আমন্ত্রিত হয়েছিলাম একবার। আর চাইনিজ লিটারেচার পড়েছিলাম কিছু। বইটি বের করেন ”পুস্তক”, বিনয় ঘোষের ”পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির” প্রকাশক। নির্মল সরকারের ছিল দিলখুসা কেবিন, তাঁরই বন্ধু রজনী। তা রজনীর পায়ে কি চোট লেগেছিল উরুতে। হঠাৎ আমার কি মনে হল, বললাম, দেখিয়ে নিন ক্র্যাক হয়েছে কি না। ক্র্যাক থেকে গেলে জল জমে। —দুর্বাক্যটি খেটে গেল। রজনীর ক্র্যাকই হয়েছিল। লিখতে বসে হঠাৎ মনে পড়ল। ”পথ চলি আনন্দে” ছাপা নেই। ওই বই লেখার জন্যে কি কম খেটেছি। কেন এত খেটেছি লেখার জন্যে, এখনও কেন খাটি, পরিশ্রম করেছি হাড়ভাঙা। ঘরে বাইরে, খুব বেশি খরচ করে ফেলেছি নিজেকে, এখনও করি। ডাক্তার বলে, সবাই বলে, সাবধান হও। কিন্তু স্বভাব কি পালটানো যায়?
কোনো কোনো লেখা কেমন করে এসেছে তাই বলি। প্রথমেই বলে নিই, কেউ বলেননি, নিজে থেকে লিখেছি এ জীবনে মাত্র তিন—চারটি লেখা। প্রথম বই ”ঝাঁসীর রানী”, দীর্ঘকাল বাদে ”অপারেশন বসাই টুডু” ”চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর” (আমার মতে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস আমার) এবং কবিকঙ্কণের সম্পূর্ণ গদ্যানুবাদ। বাকি সব লেখাই সম্পাদক ও প্রকাশকের কথায় লেখা। লিখছি, অথচ ছাপা হচ্ছে না এমন অভিজ্ঞতাও খুব কম। তা শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়রা তখন কাছাকাছি থাকেন। রিকশা বা ট্যাকসিতে যাবার সময়ে আমার অভ্যাস, হাত নেড়ে ডান—বাঁ বোঝানো। নিজের অজান্তেই করি এমনটা। এমনভাবে রিকশাওয়ালাকে বোঝাচ্ছি, নিজের হাত দুটো দেখছি, মনে দানা বাঁধছে কিছু। ওদের বাড়ি পৌঁছেই শমীককে বলেছিলাম, একটা লোক দুই হাতে বাতাসের গলা মুচড়ে দিচ্ছে বারবার তাই মনে হল।
এরকম একটা ব্যাপার থেকে ”অগ্নিগর্ভ” বইয়ের প্রথম কাহিনী ”অপারেশন”?
—”বসাই টুডু”র সৃষ্টি নয়। তখন মনের মধ্যে ওই কাহিনী ঘুরপাক খাচ্ছিল কিন্তু বসাই টুডুই কেমন একটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে আমাকে দিয়ে ওর কথা লিখিয়ে নিল। বসাই বাতাসের গলা দুই হাতে মুচড়ে দিত। এরকম বেশ কিছু লেখার বেলা হয়েছে, হয়। লেখাটা মনের দরজায় ঘা মেরে চলে, যেন দরজা ভেঙে ঢুকে যাবে। বসাই টুডুর কাহিনীতে কালী সাঁতরা ও বসাই টুডু দুজনেই খুব প্রয়োজনীয় থাকে বলেই ”অক্লান্ত কৌরব” কাহিনীতে তারা ফিরে আসে। কালী সাঁতরাকে পাঠকরা মেনে নেন। কিন্তু বসাই টুডুর বারংবার মৃত্যু ও বেঁচে ওঠার ব্যাপারটা এখনও অনেকের কাছে প্রতীকী হয়ে আছে। বসাই টুডু অবশ্যই প্রতীকী চরিত্র। কিন্তু তার বারবার মৃত্যু ও বেঁচে ওঠা সবটাই বাস্তবতা বর্জিত ছিল না। ধানবাদের এক কুলি বস্তি টোলার এক সামান্য ঘরে বসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিলাম এক প্রখ্যাত ট্রেডইউনিয়ন নেতার কথা তাঁরই মুখে। ৩/৪ বার তিনি মনে করে ধানবাদ মাফিয়ারা মেরে ফেলে অন্য লোকদের, এবং প্রতিবারই তিনি বেঁচে আছেন—এই সত্যই তাঁর কর্মীদের মনে শক্তি জোগায়। ঝাঁসীর রানীর সময়েও তো ”আমি ঝাঁসীর রানী” বলে একাধিক মহিলা মৃত্যু বরণ করতে এগিয়ে যান। এ ঘটনা পরে আরও ঘটেছে। ”অগ্নিগর্ভ” আবারও পড়লে পাঠক বুঝবেন রামেশ্বরের সঙ্গে সংঘর্ষেই বসাই মারা যায় হাসপাতালে, কিন্তু বসাইদের ক্ষেত্রে দেহের মৃত্যু মৃত্যু নয়। কালী সাঁতরারা আজও আছেন, তবে তাঁরা বিরল হয়ে আসছেন। যে রাজনীতিক আদর্শের জন্যে তাঁরা সর্বস্ব ত্যাগ করেন, সেই রাজনীতিই আজ তাঁদের চাইছে না এবং জীবনের প্রান্তে পৌঁছে এ উপলব্ধি বড় মর্মান্তিক হতে পারে। মানুষ, সৎ ও বিবেকী মানুষ তো চায় বিশ্বাসের অবলম্বন। বসাই টুডু ও কালী সাঁতরার পথ এক নয়, কিন্তু কালী সাঁতরা বসাইয়ের বিশ্বাস ও কর্মকে শ্রদ্ধা করে বলেই তাকে বারবার যেতে হয় বসাইয়ের কাছে। তার পক্ষে এটাও দুঃসাহসিক কাজ। অপারেশন (?) ”বসাই টুডু” যখন লিখি, সেটা কোনো পুজোর লেখালেখির সময় নয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ”কৃত্তিবাস” কাগজে সেটি বেরোয়।
”চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর” ভূতগ্রস্তের মতো ৬/৭ দিনে রাতদিন লিখেছিলাম। এটিও হিসেব ছাড়া লেখা। পূজা সংখ্যার পক্ষে বড়ই বড়ো। ধারাবাহিক লেখার কথা মনে আসেনি। অবশেষে করুণা এটি পুস্তকাকারেই ছাপলেন। বাংলার চেয়ে হিন্দি অনুবাদে ”অগ্নিগর্ভ” ও ”চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর” আগে প্রথম সংস্করণ ফুরিয়েছে। হিন্দির বাজার বড়ো। আমার হিন্দি প্রকাশক একই সঙ্গে বোর্ড বাঁধাই ও পেপার ব্যাক সংস্করণ করেন। হিন্দি অনুবাদ থেকেই ক্রমে অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করার আগ্রহ দেখা দেয়। এই সূত্রে ভারতীয় যেসব লেখকদের সঙ্গে আলাপ ও বন্ধুত্ব হয়েছে, সেটি আমার কাছে এক মূল্যবান অভিজ্ঞতা।
কেউ—না—বলতে লেখা কবিকঙ্কণের গদ্যানুবাদ আমার অনেক লেখার মতোই অপ্রকাশিত পুস্তকাকারে। মৃত্যুকালে এমন কিছু পাণ্ডুলিপি রেখে যাওয়া যাবে। ”অরণ্যের অধিকার” লিখিয়ে নিয়েছিলেন শান্তিপ্রসাদ চৌধুরী। প্রয়াত এই চিত্র পরিচালকের মতো তীক্ষ্ন বুদ্ধি, ধারালো মগজি এবং মূলত মস্তিষ্ক বিচারী মানুষ আমি কম দেখেছি। একেবারে অন্য মেরুর মানুষ সমর সেন ও অনেকটা হীরক—কঠিন—বুদ্ধিদীপ্ত যৌক্তিক মানুষ। কিন্তু দু—জনের নাম একসঙ্গে আসে না, এঁরা এমনই অন্যরকম। বুদ্ধিপ্রধান যুক্তিপ্রধান মানুষের সঙ্গে কথা বলতে আমার চিরকাল ভালো লাগে। আর এটা বোঝাতে পেরেছি কি না জানি না, নিজে বাঁচবার, নিজেকে বাঁচাবার জন্যই দীর্ঘকাল ধরেই আমার ভিতরের আমি—কে বাঁচাবার জন্যে ভিতরে একটা অদৃশ্য আড়াল তুলে নিজেকে কোথাও একলা রেখেছি, আজও রাখি। নইলে লিখতাম কি করে। হাতে করে মানুষ করা তিনটে ভাই চলে গেল, একজন সেবার সুযোগ দেয় নি। অন্য দুজন দিয়েছিল। তাদের মৃত্যু—দাহ শ্রাদ্ধ শান্তি সবই করেছি। বাবা দেড় বছর, মা প্রায় তেরো বছর অচল হয়ে পড়েন। মা তো ডায়াবেটিক গ্লুকোমায় অন্ধ এবং আর্থ্রাইটিসে শয্যাশায়ী হয়ে যান। এ ছাড়াও কত আত্মীয়, অনাত্মীয় কত জনের দায় নিজেই তুলে নিয়েছি মাথায়। কত রেঁধেছি, কত গৃহকর্ম করেছি, এখন ভাবলে বুঝি নিজেকে বড় বেশি খরচ করেছি। বামা অনেকটা জানবে, যদি ওর মনে থাকে। [আর আদিবাসী দুর্গত অঞ্চলে যে যাই, সে ভূমিকাও স্বনির্বাচিত। আসলে, মানুষ হিসেবে, পরিবার ও সমাজবাসী মানুষ হিসেবে ন্যূনতম কর্তব্য পালন করায় আমার গভীর বিশ্বাস। আর নিজের জীবনকে বারবার বদলে ফেলা সেও তো আমিই করেছি। তার জন্য মনে যে আঘাত নিজেই দিয়েছি। তার ভারও তো আমারই বইবার কথা। এখন শরীর তার দাম তুলছে। নেহাত ছোটবেলা থেকে স্বাস্থ্য—শক্তি—কর্মদক্ষতা—উদ্যম, সবই বড় অধিক মাত্রায়। জন্মে ভাবিনি ডায়াবেটিস ধরবে আর তেষট্টিতে পড়তেই মনের উদ্যম না ফুরাক, দেহের শক্তি কমবে। এখনো ঘুরি, মনই চালায় দেহকে। বাইরে ৮/১০ মাইল হাঁটি শুনে ডাক্তার বললেন, অস্বাভাবিক জীবন।]
স্বাভাবিক জীবন কী? আমি কিসে অস্বাভাবিক? আসলে নিজের সম্বন্ধে কখনো ভাবিনি। শুধু কাজ করে গিয়েছি। সত্তরের দশক নিয়ে যখন লিখছি, তখন লিখছি ”আনন্দপাঠ” পাঠমালা ও অনুশীলনী। আসলে সেদিন অবধি ১৪/১৬ ঘণ্টা লিখতে পারতাম। ”বিছন” ও ”স্তনদায়িনী” সকালে বসে রাত দুটো অবধি এক এক দিনে লেখা। আজ ভাবতে পারি না। [”হাজার চুরাশির মা” শারদীয়া ”প্রসাদে” বেরোয়, আড়াই দিনে লেখা।] বই হয়ে বেরোল, নন্দিনীর অধ্যায় নতুন করে লিখলাম তিন চার দিনে। এটা পারতাম, লেখার বিষয়বস্তুটাকে একটা শক্ত নিউক্লিয়াসে ধরতাম। কলম ধরার আগে মনের মধ্যে গ্রহণ ও বর্জন চলত। শুরুর বাক্যটি অবধি ভেবে নিতাম। তারপর ধরতাম কলম। এখন লক্ষ রকম কাজে খরচ হয়ে যাই। তবু এবার ”টেরোড্যাকটিল” লিখে আনন্দ পেয়েছি। [আমার অনেক লেখাই ”কঠিন” এমন শুনেছি। কিন্তু লেখক যদি পরিশ্রম করে লেখে, পাঠকও পড়ার জন্য পরিশ্রম করুন। সব লেখা কি মেড ইজি করা যায়?]
”অরণ্যের অধিকার”—এর কথা। শান্তিবাবু কুমার সুরেশ সিংয়ের ”ডাস্ট স্টর্ম অ্যান্ড হ্যাংগিং মিস্ট” বইটি দিয়ে বলেন, একটা লেখা তৈরি করুন। ছবি করব। —তা ”অরণ্যের অধিকার” নাম দিয়েই ছোট্ট করে লিখলাম ”উল্টোরথ” কাগজে। ”উল্টোরথ” কাগজে প্রসাদ সিংহ, গিরীন সিংহকে আজকের লেখকরা কমই চেনেন। ওঁরা বুঝেছিলেন মানুষ চটজলদি পড়ার জিনিস চায়। সময় বদলাচ্ছে। ওঁরা সম্পূর্ণ ছোট উপন্যাস ছাপতেন, ভালো টাকা দিতেন। পঞ্চাশের শেষে না ষাটের দশকে আড়াইশো থেকে পাঁচশো টাকার দাম ছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু থেকে কে লেখেননি। প্রসাদ নেই। গিরীন নেই। মালিকানাও বদলে গেছে। কিন্তু ”উল্টোরথ” ও ”প্রসাদ” কাগজ লিখতে বললে তার একটা দাম পুরোনো লেখকদের কাছে থাকা উচিত। আছেও।
ওই কাগজে ওই লেখার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। শান্তি বাবু ছবি করার চিন্তা ও তাকে তুলে রাখলেন। কত পরে রাজা দাশগুপ্ত করল ”সং ফর বিরসা”, [”বেতার জগৎ” কাগজে সুভাষ বসু (এখন কোথায় জানি না) ধারাবাহিক লিখতে বলেন। বিরসার জায়গা, মানুষজন চেনা ছিল। এবারে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সুরেশের বই; শরৎচন্দ্র রায়ের ”দি মুণ্ডাস অ্যাম্যা দেয়ার কানট্রি”; হফস্টানের ”এনসাইক্লোপিডিয়া মুণ্ডারিকা”; প্রিয়নাথ জেমস পূর্তির হিন্দি বই ”শহীদ বীরসা মুণ্ডা”; মুচিরাই তিরু মণ্ডার হিন্দি বই ”শ্রী বীরসা ভগোয়ান”; রীডের ”দি ছোটনাগপুর টেনানসি অ্যা অফ ৭০৪” এবং রাঁচি ও সিংভূম গেজেটিয়ার সব পড়ে, বহু বিনিদ্র রাতের পর ধারাবাহিক লিখলাম ”অরণ্যের অধিকার”।] ”অরণ্যের অধিকার” না বেরোতেই দিল্লির রাধাকৃষ্ণ প্রকাশনের ওমপ্রকাশ ওটি হিন্দি করতে চাইলেন। হিন্দি করলেন জগৎ শঙ্খধর। আর ১৯৭৯—তে ওমপ্রকাশ মারা গেলেন। ওর ছেলে অরবিন্দ কুমারের অনুরোধেই নভেম্বরে গেলাম দিল্লি। বাবা খুব অসুস্থ। ক—দিন চলে এলাম। আকাদেমি পাওয়ার কথা মনে থাকবে। ঠিকে ঝি সম্বল, একা থাকি। সাত সকালে (রবিবার ছিল), টেলিফোনে ডাকল নীচে। ঠিক জানি বাবার খবর এসেছে। ফোন তুললাম। শ্যামল গাঙ্গুলী বলল, মহাশ্বেতা, কাগজ দেখেছ? তুমি আকাদেমি পেয়েছ। —যাক, বাবার খবর নয়। আমি বোধ হয় বললাম, ও। তারপর বাড়িতে কতজন। ডায়াবেটিক লোকের বাড়ি নতুন গুড়ের সন্দেশের পাহাড়। এবং আমার জীবনে কি কম গন্ডগোল? আগে থেকে কথা হয়ে আছে, বিপ্লবী লেখক সম্মেলনের প্রথম দিনে আমরা গেলাম বারুইপুর কোনো মতে রেঁধে খেয়ে।
এর ক—দিন বাদেই বাবার মৃত্যু হয়। সাহিত্য আকাদেমি কলকাতায় এসে এক অনুষ্ঠান করে আমাকে পুরস্কার দেন।
তারপরে অত্যুৎসাহীরা কি কম সমালোচনা করেছেন? এই তো বিপ্লবী লেখিকা নিলেন আকাদেমি, নিলেন আদিবাসী উন্নয়নে পদ্মশ্রী। এঁদের বিচারে ডবল স্ট্যান্ডার্ড ফিল্ম করিয়ে মানুষরা কত অ্যাওয়ার্ড, কত টাকা পান সরকারের কাছে, সরকার তাঁদের বিদেশেও পাঠান। সে তো ভালোই। কিন্তু অত্যুৎসাহীরা তাঁদের প্রগতই মনে করেন, আর লেখকদের সম্পর্কে ভাবেন, পাঁচ হাজারি পুরস্কার (তখন তাই ছিল) নিলেই লেখক কেনাবেচা হয়ে গেলেন। [যে—কোনো লোকের বেলাই, তাঁর কাজ দিয়ে তাঁর বিচার হওয়া উচিত বলেই তো মনে করি।] কে জানে কেন এমন হয়।
ওই বই পুরস্কার পাবার পর আদিবাসী সমাজের আপনজন হওয়ার সব আড়াল যেন ভেসে গেল। এ যে কত বড় পুরস্কার, তা কাকে বলি। কেমন করে বোঝাই। এরপর যে ছোট ”বীরসা মুণ্ডা” লিখি, তা হো—আদিবাসী ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে।
আমার বেশ কিছু গল্প বেরিয়েছে অনীক—এ (বিছন, শূন্যস্থান পূর্ণ করো, ২৯ নং ধারার আসামী—শেষেরটি উপন্যাস); অনীকের সম্পাদকদের একজন দীপংকর চক্রবর্তী বোধ হয় ১০৮৪ বা বসাই টুডু পড়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। লিখেছি এক্ষণে (ঋত্বিকের বইয়ের উপর প্রবন্ধ; স্তনদায়িনী; গুরু; পাপপুণ্যের ইতিহাস); অনুষ্টুপে লিখেছি (নিশাত মাঝির ভোটান যাত্রা, লাইফার, গতিগঙ্গা নাইয়া, কালিদাসের হেঁয়ালি); প্রমাতে লিখেছি (বেহুলা, একাহার, মাষ্টারসাব, রাজাবাসার রূপকথা, বিশ—একুশ)। এ সব কাগজে আরোহী লিখে থাকব। সব নাম তো মনে পড়ে না। প্রমা অবশ্য টাকা দেন। পরিচয়ে লিখেছি ”দ্রৌপদী”।
কিন্তু এখন মনে পড়ল, ”কবি বণ্ডঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু” লেখার পর একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী লেখা শুরু করি মাসিক বসুমতীতে ”বিবেক বিদায় পালা”। এর প্রথমার্ধ সুনীল মণ্ডল বের করেছেন। দ্বিতীয়ার্ধ তখনি শুরু করি, আজও অসমাপ্ত। সে সময়ে বসুমতী বন্ধ হয়ে যায়। কাগজটি চললে লেখাটিও হয়ে যেত। লেখাটি আমার কাছে প্রয়োজনীয়ই মনে হয়। শ্রীচৈতন্য যে জন্মলগ্নে জন্মগ্রহণ করেন, ঠিক সেই জন্মলগ্নে জন্মায় এক গরিব ব্রাহ্মণের ঘরে একটি বামন ছেলে, নাম তার বিবেক, ডাক নাম বটু। সমগ্র কাহিনীতে নিমাইকে একবারই দেখা যায় দূর থেকে। যখন তিনি বালক। নিমাই ক্রমে হন শ্রীচৈতন্য। বটু দূর থেকে তাঁর কথা শোনে, তাঁর সুন্দর কান্তি, বিদ্যাবত্তা, ক্রমে সন্ন্যাস গ্রহণ সব কিছুর মধ্যে সে তার অপূর্ণ দেহ ও তুচ্ছ জীবনের কোনো ক্ষতিপূরণ দেখে। বটু সেই শতকের যে সমাজ দেখে, তার মধ্যে অনাচার ও ব্যভিচারটাই ধরা পড়ে। মানুষ হিসেবে চৈতন্য বড়ো, এটা তার দীর্ণ মনে যেন প্রলেপ। ক্রমে সে গৃহত্যাগী হয়, নবদ্বীপ থেকে উৎকল সেও ঘোরে। ঝারিখণ্ডে সে যখন যায়, তখন বর্ষা নামে। সেখানকার আদিবাসীরা তাকে সুলক্ষণ মনে করে ও আশ্রয় দেয়। একটি মেয়ে তাকে ভালোবাসে। কিন্তু পরের বছর হয় খরা, শস্য জ্বলে যায়, বটুকে গ্রামবাসীরা তাড়িয়ে দেয়। বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বটু যেদিন জানে, যে চৈতন্য জীবিতাবস্থাতেই দেবতা বলে পূজা পাচ্ছেন, সে ফিরে আসে ঝারিখণ্ডে। শস্য কাটার পর আদিবাসীরা অপদেবতার যে মূর্তি মঞ্চে তোলে, তাকে সংহার করার আগে তীর ধনুক ও বর্শা নিয়ে নাচছে, বটু সে মূর্তি ফেলে দিয়ে মঞ্চে দাঁড়ায়। বলে, আমার নাম বিবেক। নিজেকে আমি বাঁচাতে পারি না, তোমরা আমাকে বাঁচাতে পারতে। এখন তোমরা আমাকে মেরে ফেলবে জানি, কিন্তু তাতে আমি মরব না। তোমরা আমার দেহ শস্যক্ষেত্রে পুঁতে দেবে। শস্য হয়ে আমি ফিরে আসতে থাকব। যতদিন না মানুষ আমাকে প্রাপ্য স্থান দেয়, সেদিন আমি বিশাল হয়ে যাব।
আদিবাসীরা সুরাপ্রমত্ত, ধর্মীয় আচার পালনের উন্মাদনায় প্রমত্ত, তারা প্রথা অনুযায়ী তীর ও বর্শা ছোঁড়ে। মরতে মরতে বটু সবিস্ময়ে দেখে পৃথিবীর সকল মানুষের মতোই তার রক্তও লাল।
বটুর গৃহত্যাগ অবধি ”বিবেক বিদায় পালা” বইয়ে বেরিয়েছে। এবার যেমন করে হোক শেষের (দুই অধ্যায় লেখা আছে) অধ্যায় লিখে ফেলব। এ কাহিনী বটু বা বিবেকের শ্রী চৈতন্যের নয়। এখন কয়েক শতক ফিরে গিয়ে পরিবেশ পুনঃসৃজন করা, ওই ভাষায় ফিরে যাওয়া সহজ হবে না। অবশ্য সহজ আর কোনটা। মধ্যযুগের বাংলার কবিকঙ্কণের লেখার মধ্যে সব চেয়ে বেশি পাই লোকবৃত্তের কথ্য বাংলার আভাস। ততদিনে যে বাংলা গদ্য বেশ স্ট্যান্ডার্ডাইজ হয়ে গেছে তা বোঝা যায়। এ উপন্যাস কত আগে লেখা। তবু তখনি মনে হয়েছিল, আজও মনে করি, মানুষকে মানুষ যে কত বড়ো হতে পারে, তা আমরা ভাবতে চাই না বলেই দেবতা বানিয়ে মূর্তি পূজা করে বিবেকী ও সন্ধিৎসু জিজ্ঞাসু হবার দায় এড়িয়ে যাই। রাজনীতিতেও ছবি বা বাণীকে দেবতা বানাই। নিজেদের সক্রিয় হবার দায়িত্ব এড়াই, ধর্মের ব্যাপারেও তাই। যাঁরা ধর্মবিশ্বাসী তাঁদের কথা এখানে আসে না। কিন্তু যাঁরা ধর্মে বিশ্বাস অধর্ম মনে করেন, তাঁরাও (সকল শিবিরেই) নেতাদের দেবতা বানিয়েও স্বস্তি পান না, গুরু—জ্যোতিষী—গ্রহরত্ন—মাদুলি—কবচেও বিশ্বাস করে অনেকেই। এই কপটতায় দেশ ভরে গেছে। পূজাটা আমরা বুঝি, সত্যি বলতে বারোয়ারি পূজা বুঝি। যাঁর স্মরণে উৎসবকে পূজা বানাই, তাঁর জীবন বা বাণী বুঝবার জন্যে প্রয়াস করি না।
বটু প্রতিবাদ করেছিল, তার সময় ও সাধ্যমতো। এই না—লেখা কাহিনীর কথা দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলাম, মহা খুশি। দীপেন তো ”দ্রৌপদী” পড়েও লিখেছিল ”শা—বাশ!” দীপেন নেই। দীপেন নেই, নেই দীপ্তেন্দ্র কুমার সান্ন্যাল, যে আমাদের বহু নিরানন্দ সময়কে আনন্দে কৌতুকে ভরে দিয়েছে। ওদের দু—জনের মতো মেরুদণ্ডী, ঋজু মানুষ কমই দেখেছি সে সময়ে। সদালাপী, মধুর ব্যবহার ছিল প্রাণতোষ ঘটকের, তিনিও নেই। অসময়ে অকাল প্রস্থান যে কতই দেখলাম।
লিখছি বলে পিছনের অনেক কথাই মনে পড়ছে। ১৯৫৬ সালে প্রথম বই বেরোয়। বত্রিশ বছর। যেন ভূশণ্ডীর কাক হয়ে গেছি। এক জীবনে কত সাহিত্যিককে দেখলাম। আজ দেখছি তরুণদের। কতজনের কথা মনে পড়ছে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন। সেটা মানতে পারি। অকাল প্রস্থান নয়। কিন্তু তাঁর বড় ছেলে সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায় চলে যাবেন তা কখনো ভাবিনি। সম্ভবত ”চন্দন যাত্রা” লিখেই উনি ক্রমে লেখা ছেড়ে দেন। কি সহিষ্ণু, স্নেহশীল মানুষ ছিলেন। মনে পড়ছে, ”স্তনদায়িনী”, ”দ্রৌপদী”, ”বিছন” পড়ে সন্তাোষ কুমার ঘোষ টেলিফোনে বলেছিলেন, শেষ হয়ে যাবার আগে আপনি শেষবারের মতো জ্বলে উঠছেন। —তিনিই বা কোথায়? আমি তো লম্ফোর আলোর মতো মিটমিটে হয়ে থেকেই গেছি।
হঠাৎ মনে হল ”তারার আঁধার” বইটির কথা। বাজারে নেই, উধাও, প্রকাশনাও মৃত। বহুকাল আগে হলেও সম্ভবত সত্যি কথাই বলেছিলাম।
নিজের কিছু প্রতিভা আছে (আমি নিজের ক্ষেত্রে প্রতিভা নয়। পরিশ্রমে বিশ্বাসী) জানা, তার জন্য অহংকার, পথ খুঁজে না পাওয়া, হতাশা, এই ছিল মূল বিষয়। ব্যাপারটি আমার এত জানা, এত দেখা, আজও এত দেখতে হয়। এ ট্র্যাজিডি চিরকালীন।
মহাশ্বেতা দেবী
এপ্রিল ১৯৮৮
.
সাঁঝসকালের মা
প্রথম প্রকাশ—উল্টোরথ জুন/জুলাই ১৯৭০
দ্রৌপদী
প্রথম প্রকাশ— পরিচয় শারদীয় ১৯৭৭
স্তনদায়িনী মা
প্রথম প্রকাশ—এক্ষণ বর্ষ ১২, সংখ্যা ১—২ শারদীয় ১৩৮৪/১৯৭৭
বিছন
প্রকাশ প্রকাশ— অনীক, সেপ্টেম্বর ১৯৭৮
বেহুলা
প্রথম প্রকাশ— প্রমা ১ম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৭৮
জগমোহনের মৃত্যু
প্রথম প্রকাশ—অমৃত ১৩৮৫ (ইংরেজি ১৯৭৮)
মৌল অধিকার ও ভিখারি দুসাদ
প্রথম প্রকাশ— শারদীয় দৈনিক বসুমতী ১৩৮৬ (ইংরেজি ১৯৭৯)
ভাত
প্রথম প্রকাশ—ম্যানিফেস্টো, বর্ষ ৪, সংখ্যা ১, মার্চ—এপ্রিল ১৯৮১
লাইফার
প্রথম প্রকাশ—শারদীয় অনুষ্টুপ ১৩৯০ (ইংরেজি ১৯৮৩)
ডবল
প্রথম প্রকাশ—প্রমা, সেপ্টেম্বর ১৯৮৮
Leave a Reply