• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

বিষহরির প্রসাদ – নবনীতা দেবসেন

লাইব্রেরি » নবনীতা দেবসেন » বিষহরির প্রসাদ – নবনীতা দেবসেন
বিষহরির প্রসাদ

সূচিপত্র

  1. এক : নতুন বন্ধু
  2. দুই : এক ঢিলে অনেক পাখি
  3. তিন : রাজাবাবু
  4. চার : মল্লভূম
  5. পাঁচ : রাজবাড়ি
  6. ছয় : বাস
  7. সাত : জীপ
  8. আট : শুশুনিয়া
  9. নয় : মেঠোপথ
  10. দশ : পিস্তল
  11. এগারো : বাউল
  12. বারো : সোঁতাপথ
  13. তেরো : ঢল
  14. চৌদ্দ : গুহা
  15. পনেরো : রোড-রাস্তা
  16. ষোলো : উধাও
  17. সতেরো : খবরের কাগজ
  18. আঠারো : ঝাঁপান
  19. জন্মদিন

বিষহরির প্রসাদ – নবনীতা দেবসেন

এক : নতুন বন্ধু

সারার একটি দারুণ বন্ধু জুটে গেছে। নেহরু চিলড্রেন্স মিউজিয়াম ইন্টারস্কুল কুইজ প্রতিযোগিতায় পরপর দু’বছর সারাদের স্কুল প্রথম হয়েছে। ছোটোমামুর কল্যাণে সারার সাধারণ জ্ঞানের ভাঁড়ারটি অসামান্য, আর সারার দৌলতে ওদের স্কুল প্রথম হচ্ছে বছর বছর।

কিন্তু এ—বছর সারারা দ্বিতীয় হয়ে গেছে। ফার্স্ট হয়েছে দূর বাঁকুড়ার একটা নাম—না—জানা ইস্কুল। সব্বাইকে চমকে দিয়েছে ওরা। আর যার জন্যে এই ফার্স্ট হওয়া, সেটা একটা বাচ্চা ছেলে, মাথায় সারার চেয়েও ছোটো। পড়ে অবশ্য সারার ক্লাসেই। বিরাট লম্বা—চওড়া ওজনদার একখানা নাম, কিন্তু চেহারাটা ঠিক পাখির মতো। ছটফটে দুরন্ত, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, মুখখানা যেন শিউলিফুল। নাক, চোখ, ভুরু, ঠোঁট ঠিক তুলির টানে আঁকা। আর চোখের মণিদুটো যেন সবসময় ঝিকমিক করছে, হাসিতে আর বুদ্ধিতে। কেবল মুখখানা দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। আর সে যখন অমন চটপট করে সব শক্ত শক্ত প্রশ্নগুলোর ঠিকঠিক জবাব সাপ্লাই করছিল, তখন তো আরোই। সেকেন্ড হয়ে সারার খুবই দুঃখ হয়েছে, ছেলেটার ওপরে রাগও হয়েছে কম নয়, তবু ওর ওপরে কেমন যেন রাগ করে ওঠা যায় না। শেষটায় ভাব জমিয়ে ফেলতেই হলো। কুইজের শেষে ছেলেটা নিজেই এসে বলল—’তুমিই বুঝি পরপর দুবার এখানে ইনডিভিজুয়াল চ্যাম্পিয়ন হয়েছ?’ সারা গম্ভীর হয়ে বললে—’হ্যাঁ। আর আমাদের স্কুল দু’বার টীম—চ্যাম্পিয়নশিপ পেয়েছে।’ ছেলেটা বলল—’বাঃ! তা, খুব ভালো টিম তোমাদের—ফার্স্ট হবে নাই বা কেন? আমার নাম লক্ষ্মীন্দ্রনারায়ণ, তোমার নাম কী?’ নামের বহর শুনে সারা হেসে ফেলল।—’ওঃ হো! তাই বুঝি ”এল. এন. এম. বর্মণ” বলে তোমার নামটি শর্টে অ্যানাউন্স করা হলো? অত লম্বা নামটা বলতে চায় না কেউ, তাই না?’

—’এমন কিছু লম্বা নয় আমার নাম। সবাই ডাকে লখিন্দর বলে। তোমার নাম তো কই বললে না?’

—’আমি? আমার নাম সারা।’

—’সারা না হয়ে তোমার নাম হওয়া উচিত ছিল সেরা। কেননা তুমিই হচ্ছ কুইজের সেরা মেয়ে। সবাই তাই বলছে।’

—’কোথায় আর সেরা রইলুম? এবার তো তোমার কাছে হেরে গেছি।’ মনে মনে খুশি হলেও সারা ঠোঁট ফোলায়। লক্ষ্মীন্দ্র বলে—’খেলা মানেই হারজিৎ। তুমি তো দু’বার জিতেছ, এবার আমিও দু’বার জিতি? তবে তো ন্যায্য হিসেব হবে?’

‘ঈশ! আব্দার! একবার জিতে হলো না, বলে কিনা দু’বার জিতবে। দু’বার তোমাকে জিততে দিলে তো? আমি তোমায় ছেড়ে দেব নাকি? আজ্ঞে না। দেখবে মজা সামনের বছর।’ কথায় কথায় দু’জনে কখন যেন ভাব হয়ে গেল, যদিও ঝগড়ারই ইচ্ছে ছিল সারার।

ছোটোমামুর জন্যে ভাবটা গড়ালো আরো বেশিদূর।

দুই : এক ঢিলে অনেক পাখি

এক্কেবারে বাঁকুড়া পর্যন্ত।

ছোটোমামুর তো কুইজ—অন্ত প্রাণ! রেডিও—কুইজ, টিভি—কুইজ, সবতাতে যোগ দেওয়া চাই—সবতাতে জেতা চাই। সারার সঙ্গে প্রতিবছর ইন্টারস্কুল কুইজ প্রতিযোগিতার দর্শক হয়ে আসে ছেটোমামু। এবারে সারার ছোটোভাই মহারাজকেও এনেছে সঙ্গে। দু’দিনের সেশনে দেখা হলো লখিন্দরের সঙ্গে, তাই সবচেয়ে বেশি ভাব হয়ে গেল ছোটোমামুরই। আর তারপরেই মহারাজের। এতই ভাব যে, লখিন্দর শেষটায় বললে,—’আজই তো আমি ফিরছি বাঁকুড়ায়, তোমরাও চলো না আমাদের সঙ্গে। দেখবে সেখানে কেমন সাপের ঝাঁপান—উৎসব হয়, মনসাপুজোর মেলা বসে। চলো, এক ঢিলে দুই পাখি মেরে আসবে। আমার জন্মদিনের নেমন্তন্নও খাওয়া হবে, মনসাবাঘের ঝাঁপানও দেখা হবে। পয়লা ভাদ্র আমার জন্মদিন। ঐ দিনে মনসাপুজোর মেলাও বসে বিরাট।’

—’ও, তাই বুঝি তোমার নাম লখিন্দর?’ ছোটোমামু বলে, ‘বেশ তো, বেশ তো, লখিন্দর—নিশ্চয়—নিশ্চয়, তোমার নেমন্তন্ন গ্লাডলি অ্যাকসেপ্ট করলুম আমরা। দুটো কেন, এক ঢিলে সাত—আটখানা পাখি সাবাড় করা যাবে। বিষ্ণুপুর—বাঁকুড়া কি সোজা জায়গা? বাংলার পুরাকীর্তির পীঠস্থান বিষ্ণুপুর। ওখানে কত কী দেখবার আছে। গানের চর্চায়, রেশম শিল্পের চর্চায়, পোড়ামাটির কাজে, বিষ্ণুপুরের দেশজোড়া নামডাক ছিল। সারা, মহারাজ, তোরা তো বই খুললেই কেবল বিলেতের গুণগান পড়িস, রোমে কী ছিল, গ্রীসে কী ছিল, লন্ডনে—প্যারিসে কী কী আছে, এইসব? আর স্বদেশের ঐতিহ্য বলতেই দিল্লি,আগ্রা, ভুবনেশ্বর—খাজুরাহো, অজন্তা—ইলোরা, ব্যাস! অথচ ঘর হতে শুধু দুই পা ফেললে বাঁকুড়া—বিষ্টুপুরে অসামান্য লোকাল বাঙালি কালচার! বাঙালির গর্ব, বাংলার গর্ব, বিষ্ণুপুরী সিল্ক, বুঝলি? রাজরানীদের স্বপ্ন ছিল বালুচরী শাড়ি। এখনো তা বোনা হচ্ছে, যদিও মাসে দু’খানা মাত্র কাপড় তৈরি হয়—সেই বুননের জটিল সূক্ষ্ম কারুকার্য কম্পিউটার প্রোগ্রামিং—এর মতন রীতিমতো কার্ড পাঞ্চ তৈরি করে হয়, জানিস? সেইসব দেখে আসা যাবে।’ মহারাজা বলল, ‘বাঁকুড়ার টেরাকোটার কথা আমরা জানব না কেন? সবাই জানে। বাঁকুড়ার কান—খাড়া ঘোড়া তো গড়িয়াহাটের পথেঘাটের দোকানে গড়াগড়ি যাচ্ছে। সে আমরা দেখলেই চিনতে পারি।’ সারা বলল—’ছোটোমামু, বিষ্ণুপুরেই না যদুভট্টের বাড়ি ছিল? সেই সে তুমি একবার ‘বাবুল মোরা’ গানের সময় বলেছিলে, ‘ঔরংজীব যখন গানবাজনার পাট তুলে দিয়েছিল তখন বিষ্ণুপুরের রাজা তাঁর হুকুম না মেনে তানসেনের বংশধরকে রাজসভায় এনে গানের চর্চা বজায় রেখেছিলেন? সেটা এই বিষ্ণুপুরই তো?

—’হ্যাঁ রে হ্যাঁ, সেই বিষ্টুপুর।’

হিসেব করে দেখা গেল পর পর জন্মাষ্টমী আর স্বাধীনতা দিবসের ছুটি পড়ছে, তার গায়ে—গায়ে জুড়ে গেছে শনি—রবির স্কুল ছুটি—আর কপাল গুণে মনসাপুজোটাও পড়ে গিয়েছে তারই মধ্যে। বাঃ! তাহলে তো কোনো অসুবিধেই নেই। স্কুলের ছুটিই আছে যখন! মহারাজ লাফিয়ে উঠল। —’হ্যাপি বার্থডে টু লক্ষ্মীন্দ্রনারায়ণ! নিয়ে চলো ছোটোমামু, নিয়ে চলো! প্লিজ, মাকে বলো’, মাকে রাজি করানোটা, ছোটমামু বললে, কোনো ব্যাপারই নয়। কথা হয়ে গেল লক্ষ্মীন্দ্রের সঙ্গে। ওদের স্কুল—টীম পরের দিন সকালের বাসে ফিরে যাচ্ছে। সারা, মহারাজ বেজায় ট্রেনে চড়তে ভালোবাসে। কু—ঝিকঝিক করে চলা। প্রতি স্টেশনে—’চা! চা!’ ‘পান—ব্রি সিগ্রেট!’—’চাই ঝালমুড়ি। মুড়ি খাবেন মুড়ি!’ ওঃ! সে কী মজা। তার সঙ্গে বাসে চড়ার তুলনা হয় না। ঠিক হলো পরদিন রাত্রের ট্রেনে ওরা বিষ্ণুপুর রওনা হবে। লখিন্দর গিয়ে বাড়িতে সব ঠিকঠাক করে রাখবে ওদের জন্যে। পরশু ভোরে বিষ্ণুপুর স্টেশনে আসবে লখিন্দর সারাদের রিসিভ করতে।

তিন : রাজাবাবু

ট্রেনে ভয়ানক দুষ্টুমি করেছে মহারাজ। দুটো বার্থ পাওয়া গিয়েছিল, একটাতে ছোটোমামু। আর একটাতে সারা আর মহরাজ। মাথার দিকে পা—পায়ের দিকে মাথা—এমনি উল্টোউল্টি করে শুয়েছিল। ঘুমোতে কোনো অসুবিধেই হতো না। কিন্তু মহারাজটা এত দুষ্টু, প্রত্যেক স্টেশনে—’ছোটোমামু, চা খাবে না?’ বলে ছোটোমামুকে টেনে তুলেছে। নিজে খুরি খুরি চা খেয়েছে। সারাকেও খাইয়েছে। এ—ট্রেনে আলো নেভে না, সব আলো সারারাত্রি জ্বলে। সারার চুলের রিবন সিটের কাঠের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে, চা খেতে উঠতে গিয়ে সারার প্রায় ঘাড়টাড় মটকে যায় আর কি? সামনের এক ভদ্রলোক জোর করে এদের জানালার ধারের সিটটা নিয়ে নিয়েছিলেন, সারা একবার অন্যমনস্ক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জল খাচ্ছিল জানালা থেকে সরে, এসে তখন। তিনি যেই ‘ঝাল—মুড়ি’ কিনতে উঠেছেন, অমনি মহারাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে জানালার ধারের সীটটা ফের দখল করে নিল আর কিছুতেই ছাড়ল না। ছোটোমামু তো মন দিয়ে ‘মন্দিরময় বিষ্ণুপুর’, ‘মল্লভূমের পুরাকীর্তি, ‘বাঁকুড়া জেলার সচিত্র ইতিহাস’ এইসব চটি চটি বই মুখে নিয়ে শুয়ে আছে। থেকে থেকেই বলছে—’শোন শোন সারা—মহারাজ, বিষ্ণুপুরের কাছাকাছি অজস্র দেখবার জায়গা’—খড়্গপুরে চায়ের ভাঁড় ত্রিশ পয়সা হয়ে গেল, তখন মহারাজের চা—চাঞ্চল্য একটু কমে এল, রাতও বেশ হয়েছে, ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ। তবুও, জোর—জবরদস্তি মেদিনীপুর অবধি জেগে থেকে, শেষটা ঘুমিয়ে পড়ল মহারাজ।

 ভোররাত্রে ঘুম ভাঙলো ছোটোমামুর তাড়ায়।

‘নেমে পড়। নেমে পড়। বিষ্টুপুর! তাড়াতাড়ি।’ তাড়াতাড়ি নামবে কি, এত বড় বড় ঝুড়ি নিয়ে সাঁওতাল মেয়েরা মেঝেভর্তি শুয়ে—বসে আছে। কোনোরকমে তো হারডল রেস দেবার মতন করে লাফিয়ে লাফিয়ে সেসব পেরিয়ে নেমে পড়ল সারা, মহারাজ। সোজা বৃষ্টির মধ্যে। কী আকাশভাঙা বৃষ্টি রে বাবা! স্টেশনে সব আলো জ্বলছে, যেন রাত্রিবেলা। এখন আসলে বেশ ভোর। বৃষ্টির জন্যে বোঝা যাচ্ছে না। কিছু লোক মাথায় সুদ্দু চাদর মুড়ি দিয়ে বেঞ্চে উঁচু হয়ে বসে আছে। সব স্টেশনেই এরকম কিছু চাদর মুড়ি দিয়ে বসে থাকা লোক থাকে। তারা কোনো ট্রেন থেকে নামে না, কোনো ট্রেনে ওঠেও না। মহারাজ আর সারা এদিক—ওদিক তাকাচ্ছে, হঠাৎ একজন চাদর মুড়ি দেওয়া লোক উঠে দাঁড়িয়ে চাদরটা ঝেড়েঝুড়ে গায়ে দিয়ে ওদের সামনে এসে খুব নিচু হয়ে জোড় হাতে নমস্কার করলো—’আপনারাই কি রাজাবাবুর বন্ধু?’ সারা আর মহারাজ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

—’রাজাবাবু? না তো। আমরা লখিন্দরের বন্ধু।’ লোকটা একগাল হেসে আবার নমস্কার করে বলল—’ওই নখীন্দরবাবুই তো ছোট রাজাবাবু। আমাদের হুজুর মহারাজর নাতি। ওনারাই তো আমাদের বিষ্টুপুরের রাজবংশ কিনা। মল্ল—রাজপরিবার।’ জোড়হাত মাথায় ঠেকালো লোকটা।

—’লখিন্দর আসেনি?’ মহারাজের মুখে প্রশ্নটা এসে গেলেও সে গপ করে গিলে ফেলল। কে জানত এসব রাজারাজড়ার ব্যাপার। আগে জানলে ওরা আসতই না। দূর! ছোটোমামুর কিন্তু উৎসাহ বেড়ে গেল।—’ওহো। তাই তো? আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। ওর নামের ”এম”টা হচ্ছে ”মল্ল”—এল. এন. এম. বর্মণ বলেছিল। লক্ষ্মীন্দ্রনারায়ণ বর্মণ হলে ”এম”টা কিসের?—মল্লবর্মণের। ও লজ্জায় মল্লবর্মণটা ইউজ করে না আর কি। শুধু বর্মণ লেখে!’ লোকটা বলে—’এজ্ঞে রাজাবাবুও তাই লেখেন। তিনিও মল্লবর্মণ লেখেন না। কেবল হুজুর মহারাজই যা পুরো নাম সই করেন—রাঘবেন্দরনারায়ণ মল্লবর্মণ।’ কথা কইতে কইতেই লোকটা ওদের হাত থেকে ঝোলা—ঝুলিগুলি কেড়ে নিয়েছে। ওভারব্রীজের নিচে নেমে দেখা গেল এটা ছোট্ট কালো অস্টিন এইট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভীষণ বৃষ্টিতে ভিজছে। লোকটা চাদরের তলা থেকে একটা ছাতা বের করে মেলে ধরলো—’এক এক করে চলে আসুন’, বলে মহারাজকে প্রায় কোলে করে নিয়ে ছুট লাগালো গাড়ির দিকে। গাড়ির দরজা খুলে সারা আর মহারাজকে প্রায় ঠেলে দিতেই ভেতরে লখিন্দর চেঁচিয়ে উঠলো—’এত বৃষ্টি বলে আমাকে কিছুতেই বেরুতে দিল না রে নাড়ুদাস!’ লখিন্দরকে দেখে ওদের বুক জুড়িয়ে গেল। যাক, নিজে এসেছে তাহলে। কথা রেখেছে! রাজারাজড়া বলে হেলা—চ্ছেদ্দা করেনি ওদের। মহারাজের এবার খুব লজ্জা করতে লাগলো, তার নামের জন্যে। সত্যিকারের রাজাদের নাম কখনো কেউ ‘মহারাজ’ রাখে না, তাদের অন্য নাম থাকে। সত্যি, ছয় বোনের পরে জন্মেছে বলে মা—বাবা যে কী বিশ্রী একখানা নাম দিয়ে রেখেছেন তাকে। আজকালের দিনে নামটা খুব লজ্জার। মহারাজদের কেউ সম্মান করে না। নকল মহারাজদের তো আরোই না।

গাড়ি থেকে নামা হলো একটা পাঁচিলের সামনে। গেটে ঢুকে, একের পর এক পোড়ো উঠোন আর ভাঙা ইঁদারা, ঘাসগজানো ভাঙাচোরা সিঁড়ি, আর লতাপাতা আগাছায় ছাওয়া দালান—পাকা ঘরের মধ্যে কোথাও গরুবাছুর শুয়ে আছে, কোথাও একটা ছুঁচো দৌড়ে চলে গেল। ছায়ামূর্তি কিছু কুকুর বৃষ্টির মধ্যে কোথা থেকে বেরিয়ে পড়ে বেদম ডাকাডাকি শুরু করে দিল। এই কি রাজবাড়ি? না একটা পোড়োবাড়ি? প্রাসাদ কৈ? এমন সময়ে একটা সুন্দর চকচকে মাটির ঘরে এসে পৌঁছুলো ওরা। ঘরের ভেতরে মস্ত পালঙ্কে ফর্সা বিছানা পাতা। মহারাজ আর ছোটোমামু এখানে থাকবে। সারার ব্যবস্থা আলাদা। ভেতর মহলে। লখিন্দরের মার কাছে থাকবে সে। সারাকে জামাকাপড় আলাদা করে নিয়ে চলে যেতে হবে, তার চান, খাওয়া, সব আলাদা।

—’কিন্তু বেড়ানো?’ সারার কান্না পেয়ে যায়।—’বেড়াব সব একসঙ্গে।’ লখিন্দর হাসে।—’এ—বাড়ির মেয়েরা বেড়াতেই যায় না। ইস্কুলেও যায় না। সব পর্দানশীন যে! এখনো সেই পদ্মিনীর যুগের মতো পর্দাপ্রথা রয়ে গেছে আমাদের বাড়িতে। এমনকী মন্দিরের পুরোহিতের পর্যন্ত মেয়েদের সামনে যাবার নিয়ম নেই।’

—’তাহলে?’ সারা কাঁদোকাঁদো।

‘তোমার কথা আলাদা। তুমি তো অতিথি। তুমি তো এ—বংশের কেউ নও।’

—’ভাগ্যিস নই। যাক বাবা। বেরুতে পারব তো তাহলে?’ সারা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে—’কখন তাহলে দেখা হবে আমাদের?

—’একটু পরে। খেয়ে দেয়ে, বিশ্রাম করে, বেরুবো মন্দির দেখতে। কেমন? ততক্ষণে বৃষ্টিও একটু ধরবে মনে হচ্ছে। মন্দিরে সূর্যোদয় দেখতে পেতেও পারি আমরা।’

চার : মল্লভূম

বরাতজোরে ধরেও গেল বৃষ্টি। বিষ্ণুপুরের মন্দির—তার অসামান্য কারুকার্য নিয়ে দাঁড়য়ে আছে একটির পরে একটি, মল্লভূমের ঐতিহ্য বহন করে।

‘—কী আশ্চর্য!’ ছোটোমামু বললে, ‘ভাবলে অবাক লাগে, নারে? এমনিতে এক—একটা পোড়ামাটির ইঁট চল্লিশ, পঞ্চাশ, খুব জোর শ’খানেক বছর থাকে। তারপরই নোনা লেগে ক্ষয়ে ধ্বংস হয়ে যায়, আর এইসব পোড়ামাটির কারুকার্য করা টালি বেঁচে আছে তিন—চারশো বছর ধরে। কী সব বিশেষ বৈজ্ঞানিক পন্থায় পোড়াতো এগুলো কে জানে? হায় হায়, সেসব আর কেউই জানতে পারবে না—মন্ত্রগুপ্তির নিয়ম ছিল তো।’ মদনমোহনের মন্দিরে কয়েকটা ড্রাগনের মুখ দেখে ছোটোমামু মহা উত্তেজিত। —’কী করে এই মোটিফ এখানে এল? ড্রাগনের মুখ তো কখনো বাঁকুড়ার স্থানীয় মোটিফ হতে পারে না?’—মহারাজের সবচেয়ে আনন্দ হলো জোড়বাংলা কেষ্টরায়ের মন্দির দেখে—সেখানে বন্য জীবজন্তুদের অনায়াস গতি আশ্চর্যভাবে ধরে ফেলেছে মাটির টালিতে। পরপর শিকারের ছবি, যুদ্ধের ছবি, স্থলযুদ্ধ, জলযুদ্ধ, কী নেই? লখিন্দর দেখিয়ে দেয় রামায়ণ—মহাভারতের গল্পও খোদাই করা আছে। খুব খুশি মহারাজ আর সারা! একেবারে হাঁ হয়ে গেছে শ্যামরায়ের মন্দিরের কারুকার্য দেখে। মাটি কুঁদে কুঁদে কি কাণ্ডই করেছে! কত ছবি। এই রাসমণ্ডল, এই ন’টি সখীর শরীর জুড়ে গড়া হয়েছে হাতির মূর্তি; আরো কত ছবি—দশমহাবিদ্যা, দশাবতার, আবার কোট—পরা ভুঁড়িওলা পাগড়ী বাঁধা বাবুদের তামাক খাওয়া, কত ধরনের ছবি! দেখে দেখে আর ফুরোতেই চায় না। কী সুন্দর সব ময়ূর! কী সুন্দর রথে চড়ে তীর—ছোঁড়ার দৃশ্য।

—’ঠিক কার্টুন ছবিতে যেমন পরপর ঘটনাগুলো ঘটে যায়—সব মিলিয়ে একটা সম্পূর্ণ অ্যাকশনের দৃশ্য ফুটে ওঠে, তেমনি। বুঝলি, ঠিক সিনেমারই মতন!’ ছোটোমামু বুঝিয়ে দিল ওদের। মন্দির দেখতে দিন কেটে গেল।—রাসমঞ্চে গিয়ে ভীষণ ছুটোছুটি করে ‘কু’ দিয়ে লুকোচুরি খেলা শুরু করে দিল মহারাজ। তিন সারিতে প্রায় শ’খানেক খিলানদরজা পেয়েছে, আর যাবে কোথায়। লখিন্দর, সারা, এমনকী ছোটোমামুকে খেলতেই হলো। নাড়ুদাস অবিশ্যি খেলল না। বিরক্ত—বিরক্ত হাসি—হাসি একটা অদ্ভুত মুখে দাঁড়িয়ে রইল। শহরের ছেলেমেয়েদের বোকামি দেখে তার যেন গা—জ্বালা করছে, এমন মনে হয়। মন্দির দেখা শেষ হ’তে লখিন্দর ওদের নিয়ে চলল দুর্গ দেখাতে।

দুর্গ কিছুই নেই। ভাঙাচোরা কিছু মাটির দুর্গ—প্রাকার—বিশাল পাথরের তোরণ, তার মধ্যে বন্দুক রেখে পাহারা দেবার জায়গা। যেখানে উঁকি মারতেই একটা মোটা ব্যাঙ থপাস করে লাফিয়ে পড়লো সারার গায়ে। ‘বাপরে মারে’ করে পালিয়ে এলো সে—আর হা হা হি হি করে হাততালি দিয়ে অসভ্যের মতো হেসে উঠলো মহারাজ। লখিন্দরও মনে হলো দুই চোখে হাসছে। এমনকী ছোটোমামুও।

খুব রাগ হলেও সারা সেটা চেপে গিয়ে, কথা ঘোরানোর জন্য বলে—’আচ্ছা লখিন্দর, তোমার আশ্চর্য লাগে না, ভাবতে, যে, এই পরিখা, প্রাকার, ওই দলমাদল কামান—এ সমস্তই তোমাদের জিনিস? কেমন লাগে তোমার, যখন ভাবো যে এইসব মন্দির তোমারই বাবার বাবার বাবাদের তৈরি? এই দুর্গ তোমাদেরই দুর্গ ছিল?’

লখিন্দর হাসলো। কিছু বললো না।

মহারাজ বলে—’আমার বাবার বাবার বাবার তৈরি হতো যদি, আমি তো গর্বে মাটিতে পা—ই দিতুম না। দিনরাত মনে হতো—’ঈশ! এইসব ভালো ভালো জিনিসগুলো সমস্ত আমারই পৈতৃক সম্পত্তি!’

—কিন্তু তা তো নয়।’ লখিন্দর হাসে—’এসব তো সরকারি সম্পত্তি। তোমারও যতখানি, আমারও তাই। জাতীয় সম্পদ। তবে মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয়, বীর হাম্বীর, বীর রঘুবীর সিংহ এরা আমারই পূর্বপুরুষ ছিলেন! আর আমি কিনা লালবাঁধের কেল্লায় যেতে ভয় পাই?’

—’ভয় পাও নাকি? কেন? লালবাঁধে কী আছে?’

—’কিছুই নেই। লোকে বলে রঘুবীর সিংহের সময়ে ওখানে রাজার প্রিয় বাঈজী লালবাঈকে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। লালবাঈয়ের ভূত সেই থেকে রোজ রাত্তিরে ওখানে ঠুংরি গায়—সে গান যে শুনতে পাবে সেই আপনা থেকে জলের মধ্যে নেমে যাবে। গানের টানে টানে। তার আর রক্ষে নেই। লালবাঈকে ডুবিয়ে মেরে রাজাও রক্ষে পাননি।’

 ছোটোমামু হঠাৎ বই থেকে মুখ তুলে বলল, ‘লখিন্দর, কবে তোমার জম্মদিন? কালকে?

—’তরশু। পরশু তো ঝাঁপান; মনসাপুজো শুরু, শ্রাবণ সংক্রান্তি। আমার জম্মদিন পয়লা ভাদ্র।’

—’তাহলে কালকের দিনটা তো ফ্রী? চলো শুশুনিয়া পাহাড় ঘুরে আসি। ওখানে দুটো পুরোনো শিলালিপি আছে, বাংলাভাষায় প্রাচীনতম শিলালিপিগুলোর মধ্যে অগ্রগণ্য—চট করে তো দেখার সুযোগ হয় না। তুমি দেখেছ নাকি?’

লজ্জা লজ্জা মুখ করে লখিন্দর জানালো সে দেখেনি। তবে হ্যাঁ, খবরটা জানে। বিষ্ণুপুর বিষয়ে সব বইতেই থাকে মল্লরাজ চন্দ্রবর্মণের তৈরি শিলালিপির কথাটা। খৃষ্টীয় চতুর্থ শতকে খোদিত। হৈ হৈ করে ছোটোমামু প্রোগ্রাম ঠিক করে ফেলল। এখন বেরুনো হবে লালবাঁধের দিকে। অনেক দেখবার জিনিস আছে ওখানে, সাহিত্য পরিষদের যাদুঘরে। কাল ভোরে রওনা বাঁকুড়া, বাই বাস। সেখান থেকে জীপ ভাড়া করে শুশুনিয়া পাহাড়।

পাঁচ : রাজবাড়ি

মহারাজ আর সারা বুঝতে পারছে, রাজবাড়ির অবস্থা ভালো নয়। ওই গাড়িটা রাজার নয়, রাজার এক বন্ধুর। তিনি রাজার উকিল। দরকারে—অদরকারে রাজাকে গাড়িটা ধার দিয়ে সাহায্য করেন। রাজাদের অবস্থা এখন অতি সামান্য। নিম্ন—মধ্যবিত্ত পরিবারের সামিল। লখিন্দরের বাবা ব্যাঙ্কে বড় চাকরি করেন বাঁকুড়া শহরে! লখিন্দরের ঠাকুর্দা এখনো ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছেন। বৌ, নাতি—নাতনীদের বুকে নিয়ে। রাজবাড়ি মানে প্রচুর ভাঙা—চোরা ইঁটের স্তূপ, পাঁচ একর জমির ওপরে ছড়ানো—ছিটানো কড়ি—বরগা, পাঁচিল, ইঁদারা, আধখানা দেয়াল, পাথরের টালি। কিছু অপূর্ব কারুকার্য করা কাঠের দরজা, খাটপালঙ্ক আর সিন্দুক। আর কিছু কাঁসা—পেতলের, শ্বেতপাথরের থালা—বাসন। মাত্র কয়েকখানাই আস্ত ঘর আছে, পাকা দালানকোঠা যাকে বলে। বাকি আস্ত ঘরগুলো সব মাটির। মাটিরই তৈরি সুন্দর একটা দোতলা খোড়োচালের বাড়িতে সারা আছে। মেয়েমহলে। আর বাড়ির গরুর দুধ, ঘরের পুকুরের মাছ, বাগানের কলাটা—আমটা, উঠোনের মূলোটা—শশাটা—এটুকু আছে। অতি উৎকৃষ্ট, বাদশাভোগ চালের ধবধবে সাদা সরু সরু দানার ধোঁয়াওঠা ভাত, তাতে সুগন্ধী গাওয়া ঘি, কুড়কুড়ে করে উচ্ছেভাজা, আলুভাজা, নারকোল দিয়ে মুগের ডাল, বড়ি দিয়ে শাকের ঘণ্ট, ঝিঙেপোস্ত, আর তাজা মাছের ঝোল—সব শেষে দই, কলা, সন্দেশ। খাওয়াটা হলো দারুণ। কাছে বসে খাওয়ালেন লখিন্দরের মা, নাক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে। পরনে ফর্সা কিন্তু মোটা সুতোর তাঁতের শাড়ি। হাতে কেবল শাঁখারুলি, কিন্তু ওঁর গায়ের রংটাই কাঁচা সোনার মতো। ছোটোমামু আর মহারাজ রাণীমায়ের মুখ দেখতে পায়নি। কিন্তু সারা দেখেছে ঠিক একেবারে লখিন্দরের মুখটাই, কেবল নথ আর সিঁদুর টিপটা অতিরিক্ত। এখনো এই ভাঙা খোড়োচালের দাপটে বিষ্ণুপুর—বাঁকুড়ার মানুষজন তটস্থ। এখনো ‘মল্লের রা’ কাড়া না হলে সারা মল্লভূম বাঁকুড়ায় মহাষ্টমীর পুজো শুরু হয় না। ‘মল্লের রা’ হলো রাজবাড়ির তোপ দাগা। মহাষ্টমীতে বলির সঙ্গে সঙ্গে রাজবাড়িতে তিনবার তোপ পড়ে। সারাটা মল্লভূম জুড়ে, মানুষজন গাছে চড়ে, ছাদে চড়ে সেই শব্দটি শুনবার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। রাজবাড়ির তোপের আওয়াজ কানে এলে, তারপর হয় তাদের অষ্টমীপুজোর উদ্বোধন। এ নাকি হাজার বছরের ঐতিহ্য।

নাড়ুদাস বললো—’গাড়ি যোগাড় করে দেব, বাবুরা বাসে যাবেন কেন?’ কিন্তু ছোটোমামু কিছুতেই চাইল না ওদের জন্যে রাজার বিন্দুমাত্রও অসুবিধা হয়। ওরা বাসেই যাওয়া ঠিক করল।

ছয় : বাস

বাসের ছাদে চড়ে বসতে হলো সবাইকে। বাসের ভেতরে ঢুকবে কার সাধ্যি। সেই দুর্গাপুর থেকে আসছে এক্সপ্রেস বাস, যাচ্ছে বাঁকুড়ায়। ভয়ানক ভিড় ভেতরে। ওরা তারই মধ্যে ঠেলেঠুলে ওঠার উপক্রম করছে, এমন সময় নাড়ুদাস বলল—’চলুন, চলুন, পিছনে চলুন, ঐ যে মই, উঠে পড়ুন—ঢের জায়গা আছে—’

 সারা মই বেয়ে তরতরিয়ে ওপরে উঠে পড়ল। তারপরে মহারাজ, লখিন্দর, ছোটোমামু।—’সাবধানে বসবেন’ বলে নাড়ুদাস নিচে থেকেই বিদায় নিল। ছাদের ওপরে কয়েকটা বিরাট বিরাট টায়ার রাখা আছে। তার ওপরে, এবং তার চারধারে যাত্রীদের বসতে হবে। ছাদটা যেন একটা সুন্দর বারান্দা, চারদিকে নিচু রেলিং দিয়ে ঘেরা। কিন্তু এখানেও ঝুড়ি ঝুড়ি সবজি। সেই ট্রেনের মতন। সারার মন্দ লাগছিল না, কিন্তু ভোরবেলাকার আবছা আলো কী ঠাণ্ডা! কাল রাত্রের বৃষ্টির জল লেগে আছে, যেমন আকাশের গায়ে, তেমনি লালমাটির বুকেও। চারিদিকে একটা তরতাজা, ভিজে ভিজে, পরিষ্কার—পরিষ্কার গন্ধ। বাসের মাথায় চড়ে ভ্রমণ সারাও করেনি, মহারাজও না। ছোটোমামু বললো নাকি ঢের চড়েছে। এমনি করেই সে আঁটপুরের মন্দির দেখতে গিয়েছিল হরিণাভি থেকে।

লখিন্দর বলল সেও ঢের চড়েছে এই বাঁকুড়া—বিষ্ণুপুর লাইনেই। যেই বাস ঝাঁকুনি মেরে স্টার্ট দিয়েছে অমনি সারা পড়ে যায় আর—কি। ছোটোমামু জোর করে তিনজনকেই ছাদের ঠিক মধ্যিখানে একখানা টায়ারের ওপরে গোল বেঞ্চিতে বসার মতো করে বসিয়ে দিল, পরস্পরের দিকে পিঠ করে। চলল বাস। উঃ, কী মজা! হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে, কত দূর দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে—রাস্তা, গ্রাম, ক্ষেত, পুকুর। কোথায় লাগে দোতলা বাসের সামনের সীট! এর কোনো তুলনাই হয় না। একসঙ্গে গান ধরল ওরা কয়েকবার, কিন্তু ঠিক জমল না। যা জোর হাওয়া, শনশন করে শব্দ হচ্ছে বাতাসের। মাঝে মাঝে গাছের ডালপালা এসে পড়লেই সব্বাই নমাজ পড়বার মতো করে নুয়ে পড়ছে ঝটপট মাথা নীচু করে। এমনই একসঙ্গে এই অ্যাকশন, যেন কত প্র্যাকটিস করা। একটা একটা গাছ এগিয়ে আসছে, ওরা আগে হৈ হৈ করে উঠছে, উৎকণ্ঠ হয়ে অপেক্ষা করছে, আর গাছ এসে পড়লেই মাথা নুইয়ে ফেলছে। যেন একটা খেলা।

ছোটোমামুর কী মনে হলো, একবার পা—টা ঝুলিয়ে বসেছিল। নিচে থেকে জানালা দিয়ে হাত বের করে কে একজন দিলে পায়ে একটা রামচিমটি কেটে। ‘উহু হুহু’ করে ছোটোমামু পা তুলে নিতে পথ পায় না, এমনি অবস্থা। সেই দেখে ছাদের অন্য লোকেরা হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগলো। সারার খুব রাগ হলো লোকগুলোর ওপরে। কিন্তু রাগ করা উচিত না, সত্যিই তো, কার না কার নাকের ডগায় ছোটোমামুর শ্রীচরণটি দুলে উঠেছিল কে জানে? সে কাটবে না কেন চিমটি? বাঁকুড়া এসে গেল ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই। অত সুন্দর জার্নিটা ফুরিয়ে গেল। দ্বারকেশ্বর নদী পার হবার আগে, ছোটোমামু দূরে একটা মন্দির দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলে একজনকে—’ওটি কিসের মন্দির গো?’ গ্রামের লোকটি বললে, ‘ওটি এক্তেশ্বর শিবের মন্দির গো! মহাপুণ্যি হয় ওখানে শিবের মাথায় জল ঢাললে!’ অনেক লোকে হলুদ রঙের ধুতি পরে রঙিন ফুল দিয়ে পালক দিয়ে সাজানো বাঁক কাঁধ নিয়ে ঐদিকে যাচ্ছে দেখা গেল।

সাত : জীপ

বাঁকুড়ায় নেমে জীপ ভাড়া করলো ছোটোমামু। কোনো মুশকিল হলো না। শুশুনিয়া পাহাড়ে নিয়ে যাবে। অপেক্ষা করবে। তিনঘণ্টা! ফেরৎ আসবে। পঞ্চাশ টাকা।

—’তিনঘণ্টায় যদি দেখা শেষ না হয়?’ সারা প্রশ্ন করে।

জীপ চালাতে চালাতে হেসে ফেলে ড্রাইভার :

—’আরে, হবে, হবে।’

‘দেখার কীই—বা আছে ভাই ওখানে? নরসিংহ, কালভৈরব, আর চুলকুনি ঝর্ণা। এই তো? তিন— ঘণ্টা কেউ থাকেই না। একঘণ্টার মতোও থাকতে পারবেন না যদি—না পাহাড়ে চড়েন। তা আজকাল বৃষ্টিতে যা পেছল, চড়বেন কি।’

 ছোটোমামু বলে,—’আর শিলালিপি? শিলালিপি দেখবার জন্য তো পাহাড়ে চড়তেই হবে। রাস্তাটা কেমন?’

—’শিলালিপি? দুর, দুর যত বাজে কথা।’ ড্রাইভার বলল—’কত লোকেই যে ঠকেছে এইভাবে। শিলালিপি—ঢিপি কিসসু নেই। কবে ছিল, কে দেখেছে, তা জানিনে বাবু, তবে আমরা দেখিনি। আমাদের জীপে অদ্যাবধি যারা বেড়াতে এসেছেন, তাঁরাও দেখতে পাননি। ওসব দুরাশা ছাড়ুন। এমনি কালভৈরব, নরসিংহের বেদী এগুলো দেখে নিন, ঝর্ণার জলে স্নানটা সেরে নিন যদি পারেন, সবরকম দাদ, চুলকুনি, চর্মরোগ সেরে যাবে—ওখানে হোটেলে বললে ভাতও রেঁধে দেবে’—লখিন্দর বলে ওঠে—’নেই মানে? নিশ্চয় আছে। আমার ঠাকুর্দাদা নিজে দেখেছেন। আমাকে বলেছেন।’

—’সে তখনো হয়তো ছিল। এখন নেই।’

—’নেই কী করে হয়? ওটা তো মূর্তি নয় যে তুলে নিয়ে যাবে? স্তম্ভও নয় যে ভেঙে যাবে। একটা গুহার মধ্যে পাথরের দেয়ালের গায়ে খোদাই করে কুঁদে কুঁদে লেখা একটা নোটিস—সেটা ”নেই” হয়ে যাবে কেমন করে?’ লখিন্দরের কথায় একবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকে দেখে নেয় ড্রাইভার। সেই চাউনিটা দেখে কেমন যেন ভয় ভয় করে সারার। কেমন যেন রাগী—রাগী চাউনি। এমন সময় ছোটোমামু ভাগ্যিস বিষয়টা বদলায়:

—’ছাতনা কতদূর?’ ছাতনাতে চণ্ডীদাসের ভিটেটা একটু দেখে যেতে চাই।’

—’চণ্ডীদাসের ভিটে বলতে কিছুই লাই’, ড্রাইভারের সাগরেদ মুখ খোলে এবার—’কয়েকটি ইঁট—পাটকেল, আর কড়িবরগা। বাশুলিদেবীর মন্দিরখানা লতুন বেশ সোন্দর। সেটি পথে পড়ে। ছাতনা বেশি দূর লয়।’

বাশুলিদেবীর মডার্ন মন্দিরে নামতে কারুরই ইচ্ছে হলো না—ওপাশে ভাঙা মন্দির, ভাঙা ভিটেটুকু দেখে নিয়ে জীপ চলল অন্য রাস্তা দিয়ে শুশুনিয়া পাহাড়ের দিকে। দুদিকে বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ—কিছু ধানজমি, কিছুটা খোয়াই। মাঝে মাঝে সাঁওতালদের গ্রাম।

এক জায়গায় এসে জীপ গড়গড় করে গড়িয়ে ঝর্ণার জলে নামতে শুরু করল। কি সুন্দর নদী! নদী, না কঁদর?

ঝর্ণা যখন সমতলে নেমে খানিকটা জমিতে বিছিয়ে যায় তখন তাকে নাকি ‘কঁদর’ বলে—শ্যামলমামা বলেছিল সারাকে একবার। শ্যামলমামা ছোটোমামুর বন্ধু, গল্প লেখে।

মহারাজ চেঁচিয়ে ওঠে—’থামাও, গাড়ি থামাও, নামবো! নামবো!’ লখিন্দর, সারা, আর ছোটোমামুও কোরাসে যোগ দেয়। ‘থামাও, থামাও! নামবো, নামবো!’ জীপ থামে। ঝপঝপ লাফিয়ে নেমে পড়ে তিনজনে চটিগুলো জীপে রেখে। সারার একটু সময় লাগে স্ট্র্যাপ খুলতে চটির। পরনে ভাগ্যিস ম্যাক্সিফ্যাক্সি নেই—ফ্রকটি আছে, তাই বাসের ছাদে চড়তেও অসুবিধে হয়নি, ঝর্ণার জলে নামতেও না।

আঃ! কি আরাম! কি ঠাণ্ডা জল! হাঁটতে কি আরাম! ভয় করে না পা ফেলতে। পায়ের নীচে বড় বড় শক্ত পাথর—গড়িয়ে গড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছে না নুড়ির মতন। জলের মধ্যে ঝাঁপাঝাঁপি শুরু করেছে মহারাজ আর লখিন্দর। মুহূর্তের মধ্যে সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে ফেলেছে দুজনে। সারাকেও ভেজানোর চেষ্টা করছে, ছোটোমামুকেও, কিন্তু ওরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ধরা দিচ্ছে না।

ফুল সাজানো বড় বড় বাঁকে কাপড় ঢাকা দেওয়া ডবল ডবল হাঁড়ি নিয়ে কয়েকজন লোক এসে জলে নামলো উল্টোদিক থেকে, ‘ভোলেবাবা পার করেগা’ বলতে বলতে। সারা তাদের জিজ্ঞেস করল—’তোমরা বুঝি শুশুনিয়া পাহাড় থেকে আসছ?’ ওরা যেন চমকে ওঠে। কোনো উত্তর দেয় না। সারা আবার বলে—’তোমরা বুঝি এক্তেশ্বরে পুজো দিতে যাচ্ছ?’ এবারে ওরা একটু সহজ বোধ করে, মাথা নেড়ে বলে ‘হ্যাঁ’। সারা বলে—’পুরো রাস্তা হেঁটে যাবে? এই ষোল কিলোমিটার পথ?’—’আরো বেশি।’ ওদের মধ্যে একজন বলে—’তোমাদের বাঁকে ওই হাঁড়িগুলো কাপড়—চাপা দেওয়া কেন?’ লোকগুলো মুখ চাওয়া—চাউয়ি করে। সারা বলে, ‘ওই হাঁড়িতে করে জল নিয়ে যাচ্ছ বুঝি, শিবের মাথায় দেবে বলে?’ লোকগুলো বলে—’হ্যাঁ হ্যাঁ, ঝর্ণা থেকে জল নিয়ে যাই, শিবঠাকুরের মাথায় ঢালি। কাল সংক্রান্তিতে ঢালব। আজ লয়’

—’এর জন্য তোমরা টাকা পাও?’ লোকগুলো যেন আবার চমকায়।

—’টাকা?’ একজন বলে। ‘না, না পুণ্যি হয়।’

—’আমাদের কলকাতা থেকে তারকেশ্বরে যায় যেসব লোকেরা, তারা কিনা ভাড়া খাটে, তাদের পুণ্যও হয়, টাকাও হয়। আমাদের বাড়ির পাশে থাকে ঝগড়ু, সে যায় প্রত্যেক বছর। অন্যদের মানতের জল ঢেলে আসে। নতুন কাপড়—গামছা পায়, টাকাও পায়। তাই ভাবছি তোমরাও হয়তো—’

হলদে ধুতি, হলদে পাগড়ি পরা লোকগুলো মাথা নেড়ে বলল—’না, না, আমরা অন্যের জন্যে যাচ্ছি না, পুণ্যির জন্যে—’, বলে তাড়াতাড়ি ‘ভোলে বাবা পার করেগা’ বলে চেঁচিয়ে উঠে জলের মধ্য দিয়ে ছপছপিয়ে পার হয়ে গেল।

জীপগাড়ি হর্ণ দিচ্ছে। ছোটোমামু তাড়া লাগালো। —’সবাই ওঠ গাড়িতে। —ঈশ! কী ভেজাটাই ভিজেছে দুজনে। মহারাজ আর ছোটরাজাবাবু!’ ছোটোমামু আদর করে লখিন্দরকে মাঝে মাঝে ছোটরাজাবাবু বলে ডাকছে নাড়ুদাসের মতো।—’শিগগির শার্ট খুলে ফ্যালো, বাতাসে ধরে থাকো, জীপ চলতে চলতে শুকিয়ে যাবে’—ওরা সত্যি সত্যি তাই করে। পতাকার মতো সারাটা পথ শার্ট ওড়াতে ওড়াতে চলে দুজনে—লাল আর সবুজ রঙের দুটো মস্ত মস্ত প্রজাপতি যেন লটপট লটপট করতে থাকে জীপের পেছনে। —’দেখিস, যেন হাত ফসকে উড়ে না বেরিয়ে যায়—’

—’না না, শক্ত করে ধরে আছি—’, শার্ট শুকুনোও একটা মজা হয়ে দাঁড়ায়।

সারা বলে—’ড্রাইভারদাদা, যেটা পেরুলেন ওইটে কি নদী, না ঝর্ণা, না কঁদর?’

—’নন্দেশ্বর। ও—নদীর নাম নন্দেশ্বর।’

—’ওটা কি শুশুনিয়ার ঝর্ণা থেকে তৈরি?’

—’না, এটা অন্য নদী থেকে বেরিয়েছে।’ এদের এত জলে ঝাঁপাঝাঁপি জীপওলাদের পছন্দ হয়েছে বলে মনে হলো না। নদী পেরিয়েই ডানহাতি শুশুনিয়া পাহাড় দেখা গেল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড় খুব কাছে চলে এল। এক সময়ে জীপ ডাইনে বাঁক নিল একটা কাঁচা রাস্তায়।

আট : শুশুনিয়া

—’ওই যে ঝর্ণা! ঐ ও—পাশে নরসিংহ। আর এ—পাশে কালভৈরব। তিনঘণ্টা পরে ঘুরে এখানেই আসবেন।’ টপটপ করে নেমে ঝর্ণার কাছে চলে যায় ড্রাইভার আর তার সাকরেদ। হাত—মুখ ধুতে থাকে। ঝর্ণা মানে একটা বাঁধানো দেয়ালের মাথায় খানিকটা বাঁধানো নর্দমার মতন জায়গা—সেখান থেকে কলের মতো অল্প তোড়ে জল পড়ছে। চওড়ায় ফুটখানেক হবে। তবে দেয়ালটা বেশ উঁচু। দশ—বারো ফুট মতো।

—এই নাকি ঝর্ণা?

—এইটে ঝর্ণা?

—এটাকে বলেছিল ঝর্ণা?

তিনজনের মুখ থেকে একসঙ্গেই দুঃখ—শব্দ বেরিয়ে আসে। ছোটোমামুর মুখ দেখে মনে হয় মনে মনে সেও ঐ কথাই বলছে, তবে বয়সে একটু বড় বলে, মুখে বলছে না। ঝর্ণায় স্নান করছিল কিছু সাঁওতাল। তারা হেসে বললো—’হাঁ বেটে। ইটোই তো ঝর্ণা বেটে।’

—’ছাই! ঝর্ণা বেটে!’ রেগে গিয়ে ভেংচি কেটে ফেলে মহারাজ। ছোটোমামুর শাসনের ভুরু লাফিয়ে ওঠে। মহারাজ বলে ফেলে—’স্যরি। আর বলব না।’

কালভৈরব মানে একটা ভাঙা পাথরে কিছুর অস্পষ্ট মূর্তি খোদাই করা, তার সামনে অনেক সিঁদুর—লেপা একটা হাড়িকাঠ। পথে ড্রাইভার বলেছে, এখানে নরবলি হতো।

—’এখানে নরবলি হতো বুঝি?’

—’নরবলি?’ স্নান করতে করতে সাঁওতালগুলো জিব কাটে, হাতজোড় করে—’নাই নাই, ঈঃ ম্যাগো, ছি! ছি! নরবলি হইত নাই, তবে পাঁঠা বলিটো হয় বেটে।’

—’দূর দূর, যত গুলগপ্পো।’

—’শিলালিপিও নিশ্চয় নেই।’

নরসিংহ মানে আরেকটা পাথরে আরো কিছু সিঁদুর, আর বুনোফুল। একটা শালপাতায় করে কিছু বাতাসা, ফুল ভোগও দেওয়া আছে। বিরাট একটা গাছের তলায়, এক একদিকে এক একজন দেবতার সহাবস্থান। সামনেই ঝর্ণা।

—’এদিকে কি মুণ্ডমালার মন্দির আছে?’

—’মুণ্ডমালার ঘাট? সিটি তো ইখেনে লয়! সে তো বিষ্টুপুরে বেটে!’ একজন বুড়ো উত্তর দেয়। ‘সিটি তো পরিখা পাহাড়ে বেটে, মুণ্ডমালাঘাট। মহাকালীর মন্দির।’

হঠাৎ ছোটোমামু বলে—’আচ্ছা, শিলালিপিটা কোথায়, কোন গুহাতে আছে, জানো?’

‘শিলালিপি? মহারাজ চন্দ্রবর্মার? সিটি ইখেনেই আছে। এই শুশুনিয়া পাহাড়েরই উপরে গুহাটির মধ্যে।’

—’তুমি জানো গুহাটা কোথায়? কী করে যেতে হয়?’

—’জানি বেটে। কোত্তো গেঁইছি।’

—’আমাদের নিয়ে যাবে?’ ছোটোমামুর গলায় চাপা উত্তেজনা।

—’যাব না কেনে। একটা ট্যাকা দিতে হবেক কিন্তুক।’

—’বেশ, দু’টাকা দেব, একটাকা কেন?’

—’গাড়িতে উইঠ্যে চলেন তবে।’ বুড়ো ভিজে গামছার ওপরে শুকনো ধুতিটা জড়িয়ে রেডি হয়ে নেয়। মুহূর্তেই ভিজে গামছা চলে আসে কাঁধে।

কিন্তু জীপ যেতে রাজি হয় না।

—’আমাদের কনট্রাক্ট এই পর্যন্তই’, তারা বলে।—’ওদিকে আমরা যাব না। কখনো কোনো যাত্রীকে নিয়ে যাইনি।’ অনুনয়—বিনয়, জোর—জবরদস্তি, কিছুই ফল দেয় না। জীপ কিছুতেই যাবে না। অথচ বুড়ো বলছে অনেকটা দূর— জীপে গেলে ঘণ্টাখানেক সময় ও পরিশ্রম বাঁচে। পাহাড়ের উল্টোদিকে গুহাটা। পাহাড়ের নিচে পর্যন্ত গাড়ির রাস্তা আছে। তারপর অবশ্য উপায় নেই হাঁটা ছাড়া।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। জীপটা গেলে ভালো হতো। কিন্তু জীপ কিছুতেই গেল না। লোকটা শেষকালে ইঞ্জিনের কীসব খুলে ফেললে, তারপর যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাঁটতে বসে গেল।

—’এখন গাড়ি যাবে না।’ বলে দিলে।

—’সারা, মহারাজ ছোটরাজাবাবু—’, ছোটোমামু প্রত্যেকের দিকে তাকালো, যেন মিলিটারির কম্যান্ডার—

—’তোমরা কি যেতে রাজি আছ? হাঁটতে পারবে?’

—’হ্যাঁ—অ্যাঁ—অ্যাঁ!’ সমস্বরে উত্তর এল।

—’ঠিক তো? পরে বলবে না কোলে নাও, বাড়ি চলো, বসে পড়ো, খিদে পেয়েছে?’

—’না—আ—আ!’

—’বেশ। চলো বুড়ো।’

—’যাচ্ছেন যান—কিছুই দেখতে পাবেন না। ঠিক তিনঘণ্টার মধ্যে ফিরবেন। নইলে আমরা চলে যাবো কিন্তু!’ জীপের ড্রাইভার মনে করিয়ে দেয়।

নয় : মেঠোপথ

বুড়ো হাঁটছে, যেন রণপায়ে ছুটছে। বাবাঃ, পারে কি করে? এত বুড়ো হয়েছে, যে মুখের চামড়ার ভাঁজে দুধের সরের মতো কুঁচি পড়েচে। বুড়োর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটছে চারজনে—কিন্তু ছোটোমামু যেমন বুড়োর পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে—এরা তিনজনে তা পারছে না।

পারবে কি করে?

পথে কত লোভ। কত সুন্দর সুন্দর জিনিস! শিলালিপি শিলালিপি করে ছুটলেই তো হলো না?

এমন সুন্দর খোয়াই দিয়ে ওরা জীবনে কখনো হেঁটেছে? বুড়ো তো রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে না। যাচ্ছে মাঠঘাট—ঝোপঝাড় দিয়ে, লাফিয়ে—ঝাঁপিয়ে।

একদিকে শুশুনিয়া পাহাড়, অন্যদিকে ঢালু ধানজমি। আর তালখেজুর গাছের সারি, আর গেরুয়াজলের পুকুর। কতরকম রঙের যে হলুদ আর সবুজ হয়—কে জানতো। হালকা হলুদ, সোনালি হলুদ, সবজে হলুদ থেকে গাঢ় সবুজ পর্যন্ত—লালমাটির আল দিয়ে ভাগ—ভাগ করা—ঠিক ড্রইং খাতাতে যেমন আঁকা হয় তেমনি। মাঝে মাঝে প্রহরীর মতো তাল গাছ খেজুরগাছেরা খাড়া, কিংবা সারি বেঁধে। হাঁটতে হাঁটতে চোখের যেন ফিস্টি হচ্ছে—সারার একটুও কষ্ট হচ্ছে না। লাল মাটি দিয়ে মাঝে মাঝেই উঁচুনীচু এ—মাঠ থেকে ও—মাঠে বেগে বৃষ্টির জল ছুটে যাচ্ছে, কখনো—বা ঝর্ণার মতো শব্দ করে ঝরছে—সব জলেই ওদের পা দেওয়া চাই। কখনো—বা অমনিই ভাঙাচোরা মাটির ফাঁক দিয়ে জলের ধারা বয়ে চলেছে। কী সুন্দর, কী সুন্দর! পথের দুদিকে কতরকম নাম—না—জানা ফুলের গাছ। সবচেয়ে বেশি একরকম লালচে পাতার গাছ। তাতে ছোট্ট ছোট্ট কামরাঙার মতো সবুজ ফল আর ছোট্ট ছোট্ট লাল টুকটুকে ফুলের গুচ্ছ একসঙ্গে ফুটে আছে। মাটির বুকে বুক দিয়ে শুয়ে আছে নীল, হলুদ, সাদা ক্ষুদে ক্ষুদে ঘাসফুলের দল। সরু সরু লতায়। আর তাদের মধুর লোভে লোভে মাটির কাছাকাছি উড়ে বেড়াচ্ছে ফুরফুরে ফুলের পাপড়ির মতো ডানা নেড়ে নেড়ে প্রজাপতিরা! কেউ হলুদ, কেউ সাদা, কেউ কালোয়—কমলায় আলপনা কাটা। মহারাজা কেবলই ছোটে প্রজাপতির পেছু পেছু, আর সারা বসে পড়ে ফুল তুলতে। সরু সরু ঘাসফুল ঘাসলতা তুলে তুলে হাতে একটা মিনি—তোড়া বানিয়েছে সে। লখিন্দর এর মধ্যে অনেকটা সহজ, সে ফুল পাখি প্রজাপতির মধ্যেই মানুষ। কুরর—কুট কুররর—কুট করে একটা পাখি ডাকছে। কোথায় ডাকছে? কোন ঝোপে? অমনি ছুটলো ভাইবোনে খুঁজতে।—’এমনি করলে হয়? জীবনেও যাওয়া হবে না শিলালিপি অবধি।’ লখিন্দর বকুনি দেয়।

—’ওমা? ওমা? আতাগাছ? ছোট্ট ছোট্ট আতা ফলে রয়েছে!’ চেঁচিয়ে ওঠে সারা। একটা নয়, আতা বন। কী মজা! মহারাজ দুটো ক্ষুদে আতা ছিঁড়ে পকেটে পোরে। এমন সময় কোমরে বাঁশী গোঁজা, হাতে গরুর পাঁচন, মাথায় সাদা পাগড়ি, কোমরে খাটো ধুতি এক সাঁওতাল বন থেকে বেরিয়ে এসে ওদের জিজ্ঞাসা করলো—

—’যাবি কুথাকে?’

—’শিলালিপির গুহায়।’

—’যাস নাই। উখানে কিছুটি নাই। যাবি কেনে?’

—’আছে আছে।’

—’আরে নাই নাই। মোরা জানি বেটে। কিছুটি নাই। সাঁপ আছে।’

—’দূর। ওর কথা শুনিস না তো’—লখিন্দর এক ধমক দেয়, ‘চল চল!’ ছোটো হলেও ওর কথা বলার মধ্যে কী একটা জোর আছে। সাঁওতালটা চুপ করে যায়।

দশ : পিস্তল

হঠাৎ পকেট থেকে একটা ছোটো পিস্তল বের করে লখিন্দর বলে—’সাপকে ভয় কী? পিস্তল আছে না?’—’ওকি!’ সারা আর মহারাজ চমকে ওঠে—’সত্যি সত্যি পিস্তল নাকি রে?’

—’সত্যি না তো কি? খেলনার?’

—’তুই চালাতে পারিস?’

—’পারি না? বাবার কাছে ক—বেই তো শিখেছি। আমি তো রাইফেলও চালাতে জানি।’

—মুগ্ধ সম্ভ্রমে চুপ করে থাকে সারা। এতটুকু ছেলে। রাইফেল চালায়? সারাক্ষণ পকেটে একটা পিস্তল ছিল ওর? এতক্ষণ কিছু বলেনি? মহারাজ হলে এর মধ্যে কতবার ওটা দেখানো হয়ে যেত।

মহারাজ বললে—’সত্যি না ছাই। কই? দেখি তো কেমন টিপ তোর?’ লখিন্দর বললে—’কী দেখাব? কী মারব?’—’পাখি!’—’এ দিয়ে তো পাখি মারে না। এটা আত্মবক্ষার অস্ত্র। শিকারের নয়। বনে—বাদাড়ে বেরুলে বাবা সবসময় এটা কাছে রাখতে বলেন। বনবেড়াল আছে, নেকড়ে আছে— তাছাড়া সাপ তো আছেই। অবশ্য যদি সামনে থেকে আসে!’ মহারাজ বলল—’কই, মার তো দেখি ওই গাছটার গুঁড়িতে?’

—’দূর, গাছের গুঁড়িতে কী মারব? এ তো সবাই পারে। তার চেয়ে বরং ঐ দ্যাখ ঐ যে আতাগাছটা—ঐ ছোট্ট আতাটা, ঐ যে সামনের ডালটায়—ঐটেতে মারব। পাতায় একটুও লাগবে না—দেখাব? ওয়ান, টু, থ্রি—’, ধুসুম করে শব্দ হলো, একটা আতা খসে পড়ল, আর—’কী হলো! কী হলো!’ বেদম চীৎকার করে উঠল ছোটোমামু। সামনেই আলের ওপর থেকে বুড়ো প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় আর কি!

দারুণ হাততালি দিয়ে উঠল সারা আর মহারাজ। ছোটোমামু ততক্ষণে এসে গেছে ওদের কাছে। ব্যাপার দেখে অবাক হলো, খুশিও হলো। বলল—’যাক, ভালোই হলো। আমার একটু উদ্বেগই হচ্ছে। বুড়োটা যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের! ধূ ধূ করে যেদিক পানে চাই, কোনো জনমানব নাই—’, এমন সময়ে বুড়োটা হেঁকে উঠল—’চলেন গো—।’ ওরা আবার চলল।

এগারো : বাউল

এমন সময়ে একজন লোক উদয় হলো যেন মাটি ফুঁড়ে, একটা বাঁক ঘুরে। পরনে বাউলের গেরুয়া পোশাক, হাতে একতারা, মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, মুখভর্তি গোঁফদাড়ি।—বলল—

—’কোথায় যাচ্ছেন বাবুরা?’

—’শিলালিপি দেখতে।’

—’শিলালিপি? সেসব কবেই উঠে গেছে। সেসব কিছু নাই বাবু।’

—’না থাক। গুহাটা তো আছে? সেটাই দেখব আমরা।’

—’গুহা দেখে কী হবে? সে বড় দুর্গম পথ। মজুরি পোষাবে না। তার চেয়ে আমি বলছি, সিধে চলে যান ওই বটবৃক্ষ পর্যন্ত, সেইখান থেকে ডাইনে তাকালেই দেখতে পাবেন পাহাড়ের গায়ে গুহার মুখটি, তার মাথায় টিনের শেড লাগানো আছে। উপরে আর যাবেন না।’

—’কেন? গুহার মাথার টিনের শেড কেন?’

—’ওই, শিলালিপি রক্ষের জন্য। যাতে রোদে—বর্ষায় নষ্ট না হয়ে যায়।’

—’তবে যে বললে নষ্ট হয়ে গেছে?’

—’তা তো গেছেই। টিনের শেডে কি কালচক্রের গতি রোধ করা যায় রে ভাই? আমি কি এই পাগড়ি বেঁধে যমকে ঠেকাতে পারবো?’

—’ওপরে যেতে মানা করছ কেন বলো তো?’

—’মানা করিনি তো? তবে আমরা যাই না ওপরে। বড় পথশ্রম। কোনো রাস্তা তো নেই। একটা নদীর সোঁতাপথ বেয়ে উঠতে হয়। একবার জল নামলে আর যাবার উপায় থাকে না।’ একটু হেসে বাউল বলে—

—’তাছাড়া জায়গাটা ভালো নয়। বড্ডই সাপের উৎপাত, বাবু। আমরা তাই যাইনে ওদিকপানে।’ বলতে বলতেই বাউলটা চলে যায়। এদের দল এগিয়ে চলে। বুড়োটা বলে—’সাঁপ? সাঁপকে আমরা ভয় পাই না বাবু, আমরা বেদ্যের জাত! মাটির বাসে—টাসে সাঁপ ঠাইরাতে পারি! হাঁ! হাঁ, এই পাহাড়ে অনেক সাঁপ আছেন বটে, মা বিষহরির ক্রেপায় চট করে মনিষ্যিকে কাটেন নাই।’

ওরা বটগাছের কাছে এসে পৌঁছয়। সত্যি সত্যি দেখা যায় গুহার মুখ। সত্যিই একটা টিনের শেড, ক্রিকেটারদের টুপির মতো উঁচিয়ে আছে গুহার মাথায়।

—’এমন কি আর দূর?’ সারা বলে।

—’চল, ওঠা যাক।’ বলে ছোটোমামু।

—’জয়, মল্লরাজ চন্দ্রবর্মণ কি—জয়!’—বলে চেঁচিয়ে উঠে দৌড় লাগায় মহারাজ। লখিন্দর হাসে, তার সেই পাগলকরা মিষ্টি হাসিটা। সারার বুক ধড়াস করে ওঠে, মনে পড়ে যায়—এই ছেলেটার গায়ে বইছে মল্লরাজ চন্দ্রবর্মণের ধমনীর রক্ত। নিজের পূর্বপুরুষের লেখা দেড় হাজার বছরের পুরনো চিঠি স্বচক্ষে পড়তে যাচ্ছে সে। হঠাৎ এইটে খেয়াল হতেই সবার গায়ে রোমাঞ্চ হয়। শিলালিপিটা দেখতে যাবার উৎসাহ শতগুণে বেড়ে যায় ছোটরাজাবাবুর সঙ্গে থাকাটা যে এতখানি মূল্য এনে দেবে এই যাওয়াটাকে, তা এতক্ষণ খেয়ালই হয়নি ওর।

বারো : সোঁতাপথ

বাউল বলেছিল—’উদিকে তো কোনো ”রোড রাস্তা” নেই এরকম—’, বলে, আর একদিকে আঙুল দেখিয়েছিল। সেদিকে চেয়ে অবাক চোখে ওরা দেখতে পেল—সুরকিঢালা দিব্যি পরিষ্কার ‘রোড—রাস্তা’। জীপ এতদূর আসতে পারত সহজেই। গাড়ি চলাচল করে এই পথে, চাকার দাগ বসে বসে গেছে। অথচ এতক্ষণের মধ্যে একটাও গাড়ি আসেনি। বুড়োটা কেন যে রাস্তা দিয়ে নিয়ে এল না ওদের? তাহলে এতবার সারা হোঁচট খেত না, মহারাজের পা গর্তে পড়ে যেত না, ছোটোমামুকে এতবার আল ডিঙোতে হতো না। কাঁটাগাছের ডালপালার ঝাপটা লেগে পা ছড়ে যেত না লখিন্দরের।

মহারাজ অনেক সুন্দর সুন্দর নুড়িপাথর কুড়িয়ে দুটো পকেটই ঝুলিয়ে ফেলেছে। একটা সুন্দর নুড়ি হঠাৎ হাত ছিটকে একটা গর্তে গিয়ে পড়ল। যেই মহারাজ নুড়িটা কুড়োতে গর্তে হাত দিতে যাবে—লখিন্দর হাতটা চেপে ধরল। —’পাগল নাকি? সাপের গর্ত নিশ্চয়।’

—’সাপ?’ মহারাজের চোখে ভয়।

—’নিশ্চয় সাপ। সবাই বলছে, শুনছ না ভীষণ সাপ? এ—গর্ত সাপের। আমরা চিনি না?’ বলতে বলতেই একটা ছোটো ছুঁচোর মতো ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়ে আসে গর্ত থেকে। নুড়িটা বোধহয় বেচারির গায়ে গিয়েই পড়েছে। —সারা হেসে ওঠে—

—’ও লখিন্দর! ওই যে তোমার সাপ!’ লখিন্দর লজ্জা পেয়ে যায়।

—’ওটা না হয় ইঁদুরের গত! কিন্তু ইঁদুরেও তো কামড়ে দেয়!’

‘কোনো গর্তেই হাত ঢোকাতে হয় না! বুঝলে মশাই?’ মহারাজ হেসে বলে—’বুঝলুম।’

রোড—রাস্তার বদলে সোঁতা—রাস্তা দিয়ে হাঁটতে খুব মজা। বেশ বালির রাস্তার মতন।

ওদিক থেকে আস্তে আস্তে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে একজন লোক আসছে। খাকিপ্যান্টটা গোটানো, বুশশার্ট ঝুলছে ওপরে। সাইকেল নিয়ে কেউ পাহাড়ে চড়ে না। লোকটা তার মানে পাহাড় থেকে নামছে না। কোথা থেকে আসছে? লোকটা ওদের কাছে এসে, প্রচণ্ড জরুরি গলায় বলল—’পালান বাবুরা, শিগগির পালিয়ে যান, ঢল নামছে, পাহাড়ি ঢল—গত তিনদিনের বৃষ্টির ফল—এ—নদীতে এক্ষুনি ঢল নামছে—পালান বাবুরা, বাঁচতে চাইলে পালান’—’একটা গাছে উঠে পড়ি?’ মহারাজ বলে।—’গাছ? গাছ যদি ভেঙে ভাসিয়ে না নেয়, তাহলে অবিশ্যি বেচে যাবেন। কিন্তু এখানে তেমন গাছই বা কোথায়? তার চেয়ে আমার সঙ্গে চলুন, সামনেই রোড—রাস্তা আছে। একেবারে বড় রোডে পৌঁছে দেবো আপনাদের’—

—’আমরা পাহাড়ে উঠছি।’ হঠাৎ ঠাণ্ডাগলায় এই কথাটা ব’লে ছোটোমামু এগুতে থাকে।

—’বাবু, পাহাড়ী ঢল নামলেক কিন্তুক আমার কুনো মন্ত্র নাই। বাবু, চলেন ফিরে� যাই। সাপটা আমি ভয় করি নাই,—কিন্তু ঢল নামলে গাঁওকে গাঁও ভাসায়্যাঁ দিবেক।’

—’ঢল নামছে না।’ ছোটোমামু বলে। ‘ঢল নামলে ও—লোকটা অত ধীরেসুস্থে সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে নদীর সোঁত বেয়ে আসতো না। ও বাজে কথা বলছে।’

সত্যি তো? সারারও খেয়াল হয়। সত্যি তো? কেন বলল মিছে কথা লোকটা?

—তিনজন লোকে বাধা দিয়ে গেল পরপর। রাখালটা, বাউলটা, আর এই লোক। পথে ধান ক্ষেতে এক হাঁটু জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে লাল—নীল শাড়িপরা কয়েকজন সাঁওতাল মেয়ে ধান গাছ তুলে তুলে ফের পুঁতছিল—সারা ওদের সঙ্গেও ভাব করেছিল। ওদের একটা বাচ্চা শোয়ানো ছিল মাঠের ওপরে, মস্ত একটা পেতলের হাঁড়ির পাশে। ‘হাঁড়িতে কী আছে গো?’

—’ভাত আছেক গ?’

—’আর কী আছে?’

—’আলু আছেঁ, ডাল আছেঁ, সবজি আছেঁ। কেনে? তুর ভুখ লাগছেঁ? খাবি বেটে টুকান ভাত?’ মেয়েটা হাসি মুখে সারাকে উত্তর দিয়েছিল।

—’না না, ভাত খাব কি? আমরা এখন পাহাড়ে যাচ্ছি। গুহা দেখতে।’

‘গুহাতে সাঁপ আছেক। যাইতে মানা আছেক। তুরা যাইস নাই।’ ওরাও বলেছিল। ব্যাপার কী?

তেরো : ঢল

ছোটোমামু আর বুড়োটা অনেক দূর উঠে গেছে। হঠাৎ একটা বাঁশির সুর মাঠ থেকে উঠে পাহাড়ের দেয়ালে—দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে বাতাসে প্রতিধ্বনি তোলে। সাঁওতালী সুর।

—’সেই রাখালটা নিশ্চয়। তার কোমরে ইয়া লম্বা বাঁশি গোঁজা ছিল।’ মহারাজ বলে। কিন্তু বাঁশিটা কেমন যেন শোনায়। মোটে একটা সুরই বারবার বাজে। যেন সাইরেনের শব্দ।

হঠাৎ লাফ দিয়ে ছোটোমামু বাঁদিকে সরে যায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই লখিন্দর একধাক্কা দিয়ে সারাকে ঠেলে দেয় মহারাজের গায়ের ওপর। হুড়মুড়িয়ে দুজনেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

কিছু বোঝবার আগেই, পাশ দিয়ে গড়িয়ে গেল বিশাল একটা কালো পাথর, তার পেছু পেছু আসে আরো কিছু ছোটোবড় পাথরের টুকরো।

ভয়ে থ হয়ে যায় সারা। তারপর চেঁচায়—’ঢল!! ছোটোমামু, ঢল!!’

—’না। ইটো ঢল লয় মা, ইটো কারো শয়তানি কম্মো বেটে! কেও গড়াঞে দিছেঁ পাথরগুলান, পাহাড় থিক্যেঁ।’ বুড়ো বলে। বলতে বলতে ওপর দিকে চেয়ে কী যেন খোঁজে। ওপরে তাকিয়ে দেখা গেল গুহাটা আর বেশি দূরে নেই।

—’চল। বাকিটুকুন আমরা ঝোপঝাড় ধরে ধরে উঠে পড়ি—এ সোঁতাটা ছেড়ে দি। পারবি না?’—’কেন পারব না? খুব পারব।’ ছোটোমামুর কথামতন ওরা সোঁতা ছেড়ে ঘাস—পাথরে পা দেয়। ঝোপঝাড় ধরে ধরে সাবধান উঠতে থাকে। —খুব সাবধানে। পাথর যদি পিছল হয়? আর একটুখানি। ‘লখিন্দর, মহারাজ, সারা—খুব সাবধানে।’

চৌদ্দ : গুহা

গুহার সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ নীচু হয়ে হয়ে মাটির গন্ধ শুঁকতে থাকে বুড়ো।

—’হ্যাঁ, এইখেনে সাঁপ আছেক—কিন্তুক ডর নাই। আমি মন্তর জানি।’ বুড়োর সান্ত্বনায় একটুও ভয় যায় না সারার। সারা বলে, ‘থাকগে ছোটোমামু, গুহাতে ঢুকে কাজ নেই, সাপ আছে যখন—

—’সে কি রে, এত কষ্ট করে এতদূর এলুম, আর শিলালিপি না দেখেই ফিরব? সাপ যে কেবল গুহার মধ্যেই থাকবে কে বললে? সাপ তো এইখানেই থাকতে পারে, এই মুহূর্তে।’

—’তা বটে।’ সারা ছোটোমামুর যুক্তিটা অমান্য করতে পারে না। বুড়ো সাঁওতালের যেমন সাহস, তেমনি উৎসাহ। গটগটিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে—’দাঁড়াঞে থাকেন, আমি পয়লা দেইখ্যেঁ আসি সাঁপটা কুথাকে—’, বুড়ো ফিরে এল। ‘চলেন, সাঁপ নাই।’

গুহাতে ঢুকে সামনেই স্পষ্ট স্পষ্ট কোণাচে অচেনা হরফে পাথর কুঁদে কুঁদে লেখা রয়েছে কিছু কথা। ওরা লেখাটা চোখে দেখেও পড়তে পারল না, কিন্তু কাঁধের ঝোলা থেকে বই বের করে, গুহার বাইরেই লিপিটা পড়ে শুনিয়েছে ছোটোমামু—’চক্রস্বামিন দাসাগ্রেণাতিসৃষ্ট পুষ্করণাধিপতে মহারাজ শ্রীসিংহবর্মণস্য পুত্র মহারাজ শ্রীচন্দ্রবর্মণঃ দৃতি।’ মাঝখানে একটি বিরাট সুদর্শন চক্র আঁকা, তারই তিনদিকে গুহালিপি লেখা। এই চক্রটি চক্রধারী দেবতা বিষ্ণুর প্রতিনিধি—এবং সেই দেবতার ‘সেবকদের অগ্রগণ্য, পুষ্করণের অধিপতি, মহারাজ শ্রীসিংহবর্মার পুত্র শ্রীচন্দ্রবর্মার দ্বারা উৎসর্গীকৃত।’

দ্বিতীয় লিপিটি বলে—’ চক্রস্বামিনো ধেসোগ্রামোত্রিসৃষ্টি।’ অর্থাৎ ধেসোগ্রাম চক্রস্বামীকে উৎসর্গ করা হলো। কে জানে কোথায় ছিল ধোসোগ্রাম! কোথায় তার অধিপতি দেব চক্রস্বামী!

ওরা যখন লেখাটা পড়ছে—অক্ষরগুলো অদ্ভুত অচেনা, কতকটা ওড়িয়ার মতো, কতকটা তেলগুর মতো, কতকটা আবার সেই ইজিপ্টে দেখা হিয়েরোগ্লিফিক লিপির মতো। একে নাকি বলে সংস্কৃত পূর্বাঞ্চলীয় লিপি। খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী—সারার মনে হলো—ইশ! এটা হচ্ছে এই লক্ষ্মীন্দ্রনাথ মল্লবর্মণেরই পূর্বপুরুষদের কীর্তি।—’চন্দ্রবর্মণ কি কখনো ভেবেছিলেন যে ষোলেশো বছর পরে তাঁরই উত্তরপুরুষদের একজন এত কষ্ট করে, পাহাড়ে চড়ে এই লেখাটি পড়বে?’

ছোটোমামুর কথাটা যেন গুহাসুদ্ধ সকলেরই মনের কথার প্রতিধ্বনি করল।

সারা দেখল বুড়ো দরজার কাছে গিয়ে ফের গন্ধ শুঁকছে। —’চল চল, দেখা তো হলো,এবার সাপের পাল্লায় পড়বার আগে পালাই চল—’, মহারাজ লখিন্দরের হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়—হঠাৎ সামনে ফোঁস শব্দ। চকিতে একটা ফণা ঝলসে ওঠে, এবং লখিন্দরের পিস্তল বেরুনোর আগেই বুড়োর মুঠোতে ধরা পড়েছে। —’ঝাঁপি সঙ্গে নাই, আহঃ, লিয়েঁ যেতে পারলাম নাই! কী সোন্দর সাঁপটো রে!’ বুড়ো খুব জোরে ঘুরিয়ে সাপটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল পাহাড়ের নিচে। মহারাজা হিসু করবে বলে একটু অন্যদিকে গিয়েছিল, হঠাৎ ওর মনে হলো একটা শ্যাওলাধরা মস্ত পাথর খানিকটা আলগাভাবে পাহাড়ের গায়ে বসানো রয়েছে। ঠেলা দিতেই পাথর একটু সরে গেল। বেরিয়ে পড়ল আরেকটা গুহার পথ। গুপ্ত গুহা!

—’সারা! লখিন্দর! ছোটোমামু!’ মহারাজের চীৎকারে সবাই ওখানে ছুটে যায়। —’আরেকটা গুহা!’ ছোটোমামু টর্চ ফেলে ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করে। বুড়ো গিয়ে গন্ধ শোঁকে। গন্ধ শুঁকে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় তার মাথার মধ্যে। চোখে—মুখেই সেই বিচলিত ভাবটা ফুটে ওঠে।

ছোটোমামু পাথরটা আরেকটু ঠেলবার চেষ্টা যেই করে, সঙ্গে সঙ্গে সেটা গড়িয়ে সরে যায়, একটা বড়সড় গুহাকে উন্মোচিত করে দিয়ে। আশ্চর্য! গুহার ভেতরে যেন পরপর বহু বস্তা সাজানো। অল্প আলোয় অন্তত তাই তো মনে হচ্ছে। বোধহয় পাথর হবে। ছোটোমামু টর্চটা মারতেই একটা অভূতপূর্ব দৃশ্যে সকলের গায়ে কাঁটা দেয়। গুহার মধ্যে সত্যি বস্তার রাশি একদিকে সাজানো—আর মেঝেভর্তি কেবল সাপ, আর সাপ। ‘ঈশ!’ নিশ্বাস টানার শব্দ হয় একসঙ্গে সবার। তারপর বোঝা যায় জ্যান্ত সাপ নয়, মরা সাপের চামড়া। কেউ যত্ন করে ছাড়িয়ে নিয়ে ওখানে শুকোতে দিয়েছে। বিশ্রী একটা দুর্গন্ধ গুহার বাতাসে।

এত সাপ কোথায় পেল?

এত সাপ কে মারল?

এত সাপের চামড়া দিয়ে কি হবে?

নানা প্রশ্নে এদের মাথা গুলিয়ে যায়, বুড়ো চমকে ওঠে। কেউ যেন তাকে এইমাত্র ছুরি মেরেছে—তার মুখের চেহারা এতই করুণ বেদনার্ত হয়ে যায়। হঠাৎ দুলে দুলে হাতজোড় করে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে। —’হায়! হায়! হায়! মাতা বিষহরি গ’! দোষ লিও নাই, দোষ লিও নাই, চরণ ধরি গ’! হায়! হায়! হায়! মাতা বিষহরি গ’! বুড়ো হাতজোড় করে কপালে ঠেকায় আর বলে—’কাইল ঝাঁপান, আইজ সংক্রান্তির আগের দিন। লিয়ম করার দিন। এ আমি কী পাপ—জিনিস দেখলাম গ! হে মাতা বিষহরি! পাপ দিও নাই গ মাতা, আমার ইথে কুনো দোষ নাই।’ গুহার মুখে হঠাৎ একটা ছায়া পড়ল। রোদটা গন্ধ করে। ওরা তাকিয়ে দ্যাখে কাপালিকের মতো চেহারার একজন লোক। কপালে সিঁদুর, লাল ধুতি পরা, কালো দাড়ি—গেঁফে—জটায় ভয়ংকর চেহারা। হাতে একটা মস্ত ছোরা ঝলসে উঠল—’ওঃহো বুড়ো গুণিন। খবরটি পেঞ্যা তুমিও আইছঁ, আই?’ তারপরেই ছোরাটা তোলে। কিছু বোঝবার আগেই আওয়াজ হয় ‘ধুসুম’ আর কাপালিকের হাত থেকে ছোরাটা খসে পড়ে। সারাটা শুশুনিয়া পাহাড়ে তার প্রতিধ্বনি বাজাতে থাকে—’ধুসুমম্…ধুসুমম্…ধুসুমম্’, কাপালিকের হাত থেকে ছোরাটা পড়বামাত্রই সেটা পা দিয়ে টিপে ধরে ছোটোমামু মুহূর্তেই কুড়িয়ে নেয়। বুড়ো ভয় পাবার চেয়ে যেন অবাক হয়। অবাক হয়ে বলে—’আরে? বুধানিয়া—তুই বেঁইচ্যে আছিস বেটে।’ সারার হঠাৎ কি হয়, শরীরের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে একটা ধাক্কা মারে সে লাল কাপড় পরা দুষ্টু লোকটাকে—সঙ্গে সঙ্গে ছোটোমামুও এক কুংফু—লাথি কষিয়ে দেয় বিদ্যুৎ চমকের মতো। মাটিতে গড়িয়ে পড়ে লোকটা।

ওর বুকের ওপর দিয়েই দৌড়ে বেরিয়ে আসে মহারাজ, লখিন্দর, সারা, আর ছোটোমামু,—বুড়ো তো আগেই বাইরে চলে গেছে। ছুটতে ছুটতে পাহাড়ী নদীর সোঁতায় এসে প্রায় ছেলেবেলায় পার্কে স্লিপ খেত যেভাবে, সেই কায়দায় বুড়ো বসে বসে আধা স্লিপ খেয়ে নামতে থাকে দ্রুত—সঙ্গে সঙ্গে ওরা সবাই। কিন্তু ওভাবে নামা মোটেই তত সহজ নয়, বুড়োকে দেখে যা মনে হয়েছিল। বেশ কঠিন। যথেষ্ট কায়দা—কসরৎ করতে হয়। পশ্চাৎ যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। নামতে নামতে ওরা আবার বাঁশির তীব্র সুর শুনতে পায়। ঠিক সংকেতের মতো।

পনেরো : রোড-রাস্তা

নিচে নেমে এসে সেই চেনা বটগাছটা দেখে ওদের খুব ভালো লাগল। এই গাছের পেছন দিয়েই গেছে সেই ‘রোড-রাস্তা’, যেখানে ওদের জীপওয়ালারা অনায়াসে আনতে পারত জীপটা, কেবল দুষ্টুবুদ্ধি করে আনেনি, তাই পৌঁছুতে অতটা সময় লেগেছে ওদের। বটগাছের ওপারেও বেশ ঝোপ—জঙ্গল। তার ওপারে পথ, আলপথ বেয়ে আর নয়, এবারে প্রপার রাস্তা দিয়ে পালাতে হবে। কে জানে পেছনে কারা? সারা—মহারাজ—লখিন্দর ছুটে গাছের ওপাশে গিয়েই একটা বিপুল হর্ষধ্বনি করে ওঠে। ছোটোমামু এবং বুড়োও সেখানে এসেই বুঝতে পারে জয়ধ্বনিটা কিসের। পিছনে ‘রোড-রাস্তা’র ওপরে দাঁড়িয়ে আছে আর কেউ নয়, ওদের সেই জীপ।—’সেই তো এলি, অথচ তখন এলি না।’ লখিন্দর চাপা গলায় বলে। ড্রাইভার বেশ ব্যস্ত—’কী কী মারলেন? বাঘ? হরিণ? না পাখি? বললেই হতো শিকারে এসেছেন। ওসব গুহালিপি—টিপি না বললেই হতো। আপনাদের গুলির শব্দ পেয়ে চলে এলুম। চাষী—মেয়েরা ক্ষেতে কাজ করছিল। বললে এই পথে এসেচেন। এইখেনে গাড়ি রাখতে বললে।’

‘আর শিকার! কিছু পেলে তো! কিছুই মারতে পারিনি। চলুন, চলুন—যেতে যেতে সব বলছি।’ ছোটোমামু বলে। ওরা জীপে উঠে বসেছে। বুড়ো সুদ্ধু। ড্রাইভার পেছু ফিরে বসে আছে হুইলে। ছোটোমামু চোখের ইশারায় জানিয়ে দিল ওদের কিছুই না বলতে। আপনমনে গুনগুনিয়ে বুড়ো তবু বলে ফেলে—’হায় হায় মা। হে বিষহরি মা! দোষ লিও নাই মা! দোষ লিও নাই মা! পাপ দিও নাই মা। ইথে মোদের কুনো দোষ লাই গ!’

—’কী হলো? কী ব্যাপার? হঠাৎ বিষহরির কথা?’

‘কিছু না। আমরা একটা সাপ মেরে ফেলেছি, তাই বুড়োর পাপের ভয় হয়েছে, বুড়ো জাতে তো বেদে। কাল ওদের মনসাপুজো কিনা।’

—’ওঃ তাই! ও বুড়ো একটো সাঁপ মারলে কিছু পাপ হবে নে—কোত্তো সাঁপ মারছে সবাই রোজ রোজ’—ড্রাইভারের সাগরেদ ছোকরা সান্ত্বনা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার তার দিকে শাসনের তীক্ষ্ন চোখ তুলে তাকায়। সাগরেদ তৎক্ষণাৎ চুপ করে যায়। সবটাই সারার চোখে ধরা পড়ে। মনে মনে যেটা ভীষণ ইচছা করছে, সেইটেই আলোচনা করতে পারছে না। ওরা কেউই শান্তি পাচ্ছে না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন ওদের মাথার মধ্যে গজগজ করছে।

অত সাপ কে মারল? কেন মারল?

ওই কাপালিকটা কে? ওখানে কী করছিল?

ওই বস্তাগুলোতে কী আছে? বস্তাগুলো ওখানে কে ভরল? কে সাজাল বস্তাগুলোকে অমন করে? কাপালিকটা কি সর্প—সাধনা—টাধনা করে? সাপের চামড়া ছাড়িয়ে মেঝেময় পেতে রেখেছে কেন? ঢল নামার কথা বলল কেন সাইকেল—ঠেলা লোকটি? রাখাল, বাউল ওরা কেন বলছিল, ‘গুহায় শিলালিপি নেই?’ শিলালিপি তো আছে! বেশ স্পষ্ট। কাপালিকটা ছোরা তুলল কেন? বাঁশি বাজিয়ে রাখালটা কাকে যেন কী একটা সংকেত করছিল! কাকে? কী সংকেত?

কিন্তু জীপের মধ্যে কোনো প্রশ্ন করা চলবে না। হঠাৎ দেখে ‘ভোলে বাবা পার করেগা’র বাঁক নিয়ে দুটো তিনটে লোক যাচ্ছে। প্রায় একইসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল সারা আর লখিন্দর—’ঐ যে সেই রাখালটা! কোমরে বাঁশি। ওরও কাঁধে বাঁক! জীপ থেকে মুখ বের করে ছোটোমামু হঠাৎ জিজ্ঞেস করে—’এই! তোমাদের হাঁড়িতে কী আছে?’ সারা জীপটা থামাতে বলে। ড্রাইভার থামে। কিন্তু লোকগুলো কেমন যেন চমকে যায়। ছুটতে শুরু করে দেয় বনের দিকে। হঠাৎ শব্দ হয় ‘ধুসুম’…লখিন্দরের গুলি লেগে কাপড় চাপা দেওয়া একটা হাঁড়ি ফেটে যায়। মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে কিছু ছোট্ট ছোট্ট প্লাস্টিকের থলি। মুখগুলো সীল করা। লোকগুলো দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে।

ষোলো : উধাও

—’ওগুলো কী পড়ল? দেখি দেখি’, বলতে বলতে লাফিয়ে নেমে পড়ে ছোটোমামু। পেছ পেছু লাফ দেয় সারা, মহারাজ, লখিন্দরও। ওরা সবে নীচু হয়েছে, হঠাৎ স্টার্ট দিয়ে স্পীডে চলতে শুরু করে দিল জীপগাড়ি—বুড়োটাকে সুদ্ধু ভেতরে নিয়ে। ‘এই! থামাও! থামাও’, বলতে—বলতেই রাঙাধুলোর মেঘ উড়িয়ে জীপটা উধাও হয়ে যায় পথের বাঁকে।—

জঙ্গলের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে ছোটোমামু, সারা, লখিন্দর আর মহারাজ। সামনে ছড়ানো কিছু ছোট্ট ছোট্ট প্লাস্টিকের সীলকরা থলে। প্রত্যেকটার ভেতরে আরো একটা করে ছোট থলে। ভেতরে কী জিনিস, বোঝা যাচ্ছে না। লখিন্দর পিস্তল উঁচিয়ে থাকে—মহারাজ তুলে নেয় ফেলে—যাওয়া বাঁকের বাঁশটা। ছোটোমামু উবু হয়ে বসে থলিগুলো নেড়ে—চেড়ে পরীক্ষা করে দ্যাখে।

—’কী করে এখন বাঁকুড়া ফিরব?’ —’ওরা অমন করে আমাদের ফেলে গেল কেন? এখনো তো কুড়িটাকা ওদের পাওনা বাকি।’ —’বুড়োটার কী হবে? ওকে যে ধরে নিয়ে গেল?’ এক—একজনের এক—এক প্রশ্ন। ছোটোমামুর সেদিকে মন নেই। সে কেবল বুঝতে চেষ্টা করছে এই প্যকেটগুলোতে কী আছে।

—’যাই থাকুক, আপাতত এগুলো কাঁধের ঝোলায় ভরে নেওয়া যাক।’ শেষটা এই ঠিক করে, ওরা হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে শালবন পেরিয়ে আবার ক্ষেতে এসে পড়ে। দুপাশে রাস্তায় জনমানব নেই। মাঠে গরু, টেলিগ্রাফের তারে ফিঙে। হঠাৎ দ্যাখে, রাস্তার ধারে কিছু সাঁওতাল মেয়েপুরুষ একটা গাছের নিচে কিছু ঝুড়ি—চুপড়ি নিয়ে বসে—দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে যেন ধড়ে প্রাণ এল সারার। তার মানেই গ্রাম কাছে। ওরা সব কী করছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে? মানুষ দেখে সারার খেয়াল হয়, খিদেয় প্রাণ যাচ্ছে প্রত্যেকেরই নিশ্চয়ই একই অবস্থা! ছোটোমামু সাঁওতালদের কাছে গিয়ে অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে—’বাস কটায়?’ ওরা বলে—’এই তো, টাইম হইঁছে, এইবার এইস্যেঁ যাবেক।’

—’বাস? এটা বাসস্টপ নাকি?’

—’তুমি কী করে বুঝলে ছোটোমামু?’

—’যাক বাবা! বাঁচা যাবে!’ একটু বাদে সত্যি সত্যি একটা ত্যাড়াব্যাঁকা কমলারঙের টিনের বাস উদিত হলো দূর দিগন্তে—শুশুনিয়ার দিক থেকেই আসছে।

—’কুথাকে যাইবেন? বাঙ্কুড়াকে?’

—’হ্যাঁ।’

—’ই—বাস বাঙ্কুড়ারই বাস বেটে।’

ভ্যাঁ এঁ এঁ এঁ ক…ভ্যাঁ এঁ এঁ ক…ভ্যাঁ এঁ এঁ এঁ ক…। বিকট শব্দে হর্ন বাজাতে বাজাতে বাসটা এসে ওদের সামনে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়ালো। জায়গার তেমন অভাব নেই। কোনোরকমে বসে পড়ল চারজনে। বাঁকুড়া স্টেশনে বাস থেকে নেমেই ওরা দেখল সামনেই বিষ্ণুপুর—দুর্গাপুরের এক্সপ্রেস বাস ‘জয়লক্ষ্মী’ দাঁড়িয়ে—চালু এঞ্জিন গরগর করছে। এখুনি ছাড়বে। মুহূর্তের মধ্যে ঠেলেঠুলে উঠে পড়ল তিনজনে। পেছনে ছোটোমামু বলল—’আমি ছাদে যাচ্ছি।’ বসবার জায়গা হলো না মহারাজ আর লখিন্দরের, কিন্তু সারাকে লেডিজ—সীট ছেড়ে দিল একজন। সারার তার দিকে চেয়ে মনে হলো যেন কবেকার বন্ধু। খিদেয়—তেষ্টায় সারার শরীর অস্থির, মহারাজের তো আরো বেশি খিদে পায়। কী করে যে সহ্য করে আছে কে জানে? রাজার ছেলে লখিন্দর—সেও নিশ্চয় এমন কষ্ট সইতে অভ্যস্ত নয়। খিদেয় সারার পেট মোচড়, ক্রমে মাথার যন্ত্রণা হতে লাগলো, হেঁটে হেঁটে পা—দুটোও ক্লান্ত, ব্যথা করছে। লখিন্দর আর মহারাজ তো এখনো দাঁড়িয়ে। সারা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। কে একজন ওকে ঠেলে তুলে দিল—’ঐ যে খুকি, তোমাকে ডাকছে। নামতে বলছে। বিষ্টুপুর এসে গেছে।’ বাইরে ছোটোমামু। লখিন্দর, মহারাজও নেমেছে। নেমেই দুটো রিকশায় চেপে বসলো চারজনে। —’চলো, রাজবাড়ি।’

সতেরো : খবরের কাগজ

সব শুনে লখিন্দরের দাদু, নাড়ুদাসের ‘হুজুর মহারাজ’ বললেন—’কী আশ্চর্য যোগাযোগ! আজকের স্টেটসম্যান খুলে দ্যাখো তোমরা, দেখলেই সব বুঝতে পারবে। তোমরা ভোরে উঠে বেরিয়েছো, কাগজ তো আসে বেলা তিনটের পরে। জানবে কি করে? এই দ্যাখো।’ কাগজ খুলে ছোটোমামু দেখল—তৃতীয় পাতায় মস্ত একটা ছবি—ঠিক যে দৃশ্যটি ওরা দেখে এসেছে শুশুনিয়ার গুপ্ত গুহায়। মাটিতে সারি সারি গোখরোর চামড়া বিছানো। তলায় খবর—১৫০,০০০টি সাপের চামড়া, প্রধানত গোখরো, কেউটে এবং ময়ালের—কাস্টমস অফিসারদের হাতে ধরা পড়েছে, দমদম এয়ারপোর্টে কিছু আর খিদিরপুর ডকে কিছু। দমদমে ঊনপঞ্চাশটা বস্তা আর খিদিরপুর ডকে আশিটা। অন্ততপক্ষে ১৫০,০০০ সাপের চামড়া আছে তাতে। এক—একটি ছ’ ফুটেরও বেশি লম্বা, অন্তত চল্লিশ টাকা করে এক—একটি চামড়ার দাম পড়ে। ধরা—পড়া চামড়াগুলোর মোট দাম ষাট লক্ষ টাকারও বেশি। ১৯৭৭ সালে চামড়া রপ্তানি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এদেশে, অথচ এগুলো সবই তাজা মাল। বিদেশে সাপের চামড়ার খুব কদর, তাই জোর স্মাগলিং ব্যবসা চলে। সরকারি বন্যপশু সংরক্ষণ বিভাগের পূর্বাঞ্চলের অধিকর্ত্রী শ্রীমতি অ্যান রাইট ও ২৪ পরগনার স্নেক—ফার্মের পরিচালক শ্রীদীপক মিত্রকে খবর দেওয়া হয়েছে—কীভাবে ওই বিপুল পরিমাণ সাপের চামড়ার সুসংরক্ষণ সম্ভব, সে বিষয়ে উপদেশ নিতে।’

‘পুলিশ।’ ছোটোমামু বলে—’এক্ষুনি পুলিশকে খবর দেওয়া হোক। সেই বুড়োটাই বা কী হলো? ওকে তো বলেছিলুম আমরা বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতে আছি—জানি না ওর কোনো ক্ষতি করলো কিনা জীপগাড়ির লোকেরা।’

এইবারে সব প্রশ্নের উত্তরই আপনা—আপনি মিলে গেল। সারা, মহারাজ আর লখিন্দরের কোনো অমীমাংসিত প্রশ্ন রইল না।

প্লাস্টিকের থলিগুলো পুলিশের জিম্মায় দিয়ে দেবে ছোটোমামু। হুজুর মহারাজ বললেন ওগুলোতে সম্ভবত সাপের বিষ আছে। সাপের বিষেরও খুব বিক্রি আছে। এখানকার বেদেরা কী এক নিয়মে মনসাপুজো করে, বিষদাঁত ভাঙলে ওরা বিষের থলি কক্ষনো বেচে না, মাটিতে পুঁতে ফেলে। তাই বিষ পাওয়া শক্ত। কবিরাজরা বিষ কেনে, ওষুধ কোম্পানিরাও।

ছোটোমামু বললে—ওই জিপওয়ালাদের সঙ্গে ষড় আছে নিশ্চয়ই স্মাগলারদের, ওরাই নিশ্চয় সাপের চামড়ার বস্তাগুলো বয়ে নিয়ে যায়। তা না হলে অত চাকার দাগ থাকে পাহাড়ের রাস্তায়! জীপওয়ালা এই কারণেই কাউকে গুহালিপি দেখতে দেয় না,—আর স্মাগলারদের চরেরা রাখাল সেজে, বাউল সেজে ঘোরে, লোকজনদের ভয় পাইয়ে দেয়, কিছুতেই গুহায় যেতে দেয় না। এমনই রটনা করে রেখেছে যে স্থানীয় সরল চাষীরা সবাই, সাঁওতাল মেয়েগুলো পর্যন্ত ওদের কথা বিশ্বাস করে গুহার দিকে যায় না। নিশ্চিন্ত হয়ে স্মাগলিং—চক্রটি চালাচ্ছে ডাকাতেরা।

আঠারো : ঝাঁপান

পরদিন ঝাঁপানে দল বেঁধে মাটির বাঘে চড়ে, সাপের গুণিনরা আসতে লাগল—পীর কোরবান আলি নাকি বাঘে চড়ে বেরুতেন—সেই থেকে এই কায়দা চালু হয়েছে বিষ্টুপুরে। গরুর গাড়ির ওপরে মাটির বাঘের ওপরে বসে থাকে—শিষ্যরা ৪/৫ জন মিলে জোয়াল ঠেলে গাড়ি টেনে নিয়ে যায়। গাড়িতে ভর্তি থাকে সাপের ঝাঁপি। প্রত্যেক দলের সঙ্গে ২—১টি বিষদাঁত না—ভাঙা সাপ থাকে। ঝাঁপি বদল করার সময়ে সেই সাপ এ—দল ওইদলের হাতে পাস করে দেয়! তেমন গুনিন হলে ওই সাপেই খেলা দেখিয়ে যাবে—কোনো ক্ষতি হবে না। এ—দল, ও—দল ছড়া কেটে গান বেঁধে বেঁধে তরজার মতন লড়াই করে—সাপের খেলা দেখাতে দেখাতে। রাজার সামনে গিয়ে প্রত্যেকে একবার করে ‘নাগদর্শন’ করিয়ে আনে সবশেষে। হঠাৎ সারা দ্যাখে—শুশুনিয়ার মাঠের সেই রাখাল বাঘে চড়ে আসছে। সাপ খেলাতে খেলাতে। আর একমিনিটও অপেক্ষা করে না লখিন্দর। সাইকেলে চড়ে দ্রুতবেগে থানার দিকে চলে যায়।

ঝাঁপানের দলের মধ্যেই সেই বাউলটাকে দেখতে পাবে এ ওরা কেউ ভাবতে পারেনি। পুলিশ এসে পড়লে ছত্রভঙ্গ হয়, তাই পুলিশ এসে নীরবে অপেক্ষা করে রাজদরবারে। বড় গুনিন যখন, তখন নাগদর্শন করাতে আসতে হবেই তাকে হুজুর মহারাজের সামনে। ঝাঁপি খুলে প্রায় ছ’ফুট দীর্ঘ শঙ্খচূড় সাপটাকে লেজের ওপরে দাঁড় করালো গুনিন। হুজুর মহারাজ তাকে একটা রুপোর টাকা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। ঝাঁপি বন্ধ করে ওঠবার সঙ্গেই সঙ্গেই পুলিশ ঘিরে ধরলো তাকে। হাতকড়া পরাতে যেতেই লোকটা হঠাৎ বুকের কাছে ঝাঁপিটা তুলে নিল আর বলল—’ঝাঁপিতে আমার বিষদাঁত না—ভাঙা সাপ—সাবধান’—মুহূর্তেই পুলিশরা পেছিয়ে যায়। লোকটা ঝাঁপি খুলে সাপ হাতে নিয়ে পেছু হটে হটে ভিড় ঠেলে এগুতে থাকে দরজার দিকে—বাইরে তখন গান হচ্ছে—

দেবী এসো গো মা এসো গো মা আমারও আসরে

ধূলায় পড়িয়া তোমায় ডাকি গো কাতরে—

দারোগা চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘হলট’—

গুনিন সাপটাকে কী যে করে, সাপটা গর্জে ওঠে—’ফোঁসস…’, ফণা ছড়িয়ে ভীষণভাবে ছোবল মারে বাতাসে। সবাই পেছিয়ে যায়।

গুনিন দ্রুত পায়ে পেছুতে পেছুতে দরজায় পৌঁছে যায়। ঠিক সেই সময়েই সেখানে আরেক পাড়ার ঝাঁপানদল এসে উপস্থিত। হাতের সাপ উঁচু করে তুলে ধরে গুনিন গর্জে ওঠে, ‘দোর ছেড়ে দে! আমার হাতে জীয়ন সাপ’—ভেতরে অতগুলো পুলিশ দেখেই দ্বিতীয় দলটা আন্দাজ করতে পেরেছে, ব্যাপারটা গোলমেলে। তাদের গুনিনও ফোঁস করে ওঠে—’জীয়ন সাপ তো কী রে?—দেখি! মার ছুঁড়ে তোর সাপ। দেখি কার কত শক্তি? এই ঝাঁপিতে আমার কালসাপ আছে রে—ধরবি, এই ধর—’ দ্বিতীয় গুনিন হঠাৎ ঝাঁপিটা খুলে ধরে বাউলের সামনে। ফোস করে লাঠির মতো খাড়া হয়ে ওঠে লিকলিকে কালকেউটে। বাউলটার চোখে বিস্ময়। সে তাড়াতাড়ি হাতের সাপ ঝাঁপিতে ভরে ফেলে কালকেউটেকে আটকাতে হাত বাড়ায়।—সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পেছন থেকে হ্যাঁচকা টান মেরে জাপটে ধরে পুলিশ। হাত থেকে সাপের ঝাঁপি পড়ে গিয়ে ঢাকনা খুলে এঁকেবেঁকে বেরুতে শুরু করে শঙ্খচূড়। লোকজন চীৎকার করে দৌড়োতে আরম্ভ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে কেউটের ঝাঁপি বন্ধ করে ফেলে, নীচু হয়ে শঙ্খচূড়কে ধরে ঝাঁপির মধ্যে ভরে দেয় দু’নম্বর গুনিন। কানফাটানো হাততালি পড়ে ভিড়ের মধ্যে। পুলিশ ততক্ষণে বাউল গুনিনকে হাতকড়া এঁটে বেঁধে ফেলেছে। এমন সময় একজন এসে লখিন্দরকে ডাকে পিছন থেকে : ‘দাদাবাবু? ও দাদাবাবু। একট্যাকা দিবেক বইলেছিলেঁ, দিবেক নাই?’ লখিন্দর পিছন ফিরে দেখে, শুশুনিয়ার বুড়ো। ‘আরে বুড়ো। কোথায় চলে গেলে কালকে?’ মহারাজ আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠে—’ছোটোমামু, বুড়ো ফিরে এসেছে।’ সারার ইচ্ছে করে বুড়োকে জড়িয়ে ধরতে। যাক, ওরা কোনো ক্ষতি করেনি তাহলে বুড়োর।—’নিশ্চয় নিশ্চয়, একটাকা কি, দু’টাকা দেবার কথা, কিন্তু তোমাকে দেব পাঁচ টাকা—এই নাও।’ ছোটোমামুর কথায় গদগদ হয়ে এক গাল হেসে—’জয় মা বিষহরি, তুমাদের মঙ্গল করিবেক।’ ‘ওঃ’, বুড়ো বলে ‘কাইল কি পাগলপারা গাড়িতে চড়্যেঁছিলাম গ’! শেষটোয় লদীখান পেরুইবার কালে আমি নেইমে পাইল্যে যেঁইছি। গাঁয়ে যেঁইয়ে শুনলাম, আপনারা বাসে উঠ্যে বাঙ্কুড়া যেইছেন’—

 ছোটোমামু সোজা বুড়োকে ধরে পুলিশের সামনে নিয়ে এল।—’শোনো বুড়ো, ওখানে যে লোকটাকে দেখেছিলে, তাকে তুমি চেনো?’

—’চিনি বেটে। ওটি বুধানিয়া। ছাতনার বড় গুনিনের—ছেইল্যা। ছাতনার দারোগা ওটিকে জেইল্যে পুর‍্যে দেইছিলে, আর ঘরে ফিরেঁ আসেক নাই। আমরা মনে লিই ফাঁসি হইঁছেক বুঝি বুধানিয়াটোর।’

—’ও ও কি গুনিন নাকি?’

—’বড় গুনিনের বিটা, সিটো—গুনিন হবেক নাই! সব মন্তর উয়ার জানা। কিন্তুক বড্ড বেইমানি কইরেছেঁ। মা বিষহরির কোপ পড়িবেক বেটে উয়ার উপরে। হাঁঃ’—ঝাঁপানের গান বাইরে তখনো হচ্ছে—

নম নম নম মাগো নম নারায়ণী।—

দেবী এসো গো মা এসো গো মা জয় বিষহরি

অনন্ত লাগ মা তোর মাথায় ছত্র ধরি।

চিরুনিয়া লাগ মা তোর কেশ বিনাইবার দড়ি

ঢোঁড় ঢ্যামনা, লাগ মা তোর দুয়ারে প্রহরী—

দেবী এসো গো মা এসো মা জয় বিষহরি

নম নম নম মাগো নম নারায়ণী।

জন্মদিন

পরদিন পয়লা ভাদ্র। লক্ষ্মীন্দ্রনারায়ণের জন্মদিন। পরিষ্কার করে নিকোনো মাটির দাওয়ায় আলাদা আলাদা কারুকার্য করা সুন্দর আসনে বসে এই বড় বড় সোনার মতো ঝকঝকে থালায় গরম ভাতে গাওয়া ঘি, আলু—ভাতে, মাছভাজা দিয়ে খেতে খেতে—সামনে বড় বড় কাঁসার বাটিতে শুক্তো, ছানার ডালনা, মাংস, গোবিন্দভোগ পায়েসের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ছোটোমামু আয়েস করে বলল—’তা ছোটরাজাবাবু, জন্মদিবস এ—যাত্রা বেশ ভালো করেই হলো। ঝাঁপানটাও যা দেখালে, এমন ঝাঁপান আগে এখানেও কেউ দেখেনি! কি বলো?’ এমন সময় দাদু হাতে খবরের কাগজ—এসে উপস্থিত। –‘Daring children expose snakeskin smugglers’ secret den’—বড় হরফে বেরিয়েছে শুশুনিয়ার গুপ্তগুহায় আবিষ্কৃত সাপের চামড়ার গুদামের খবর—আর সেইসঙ্গে তার ক্ষুদে আবিষ্কারকদের প্রত্যেকের নাম!—’ভেবে দ্যাখো, এমন একটা দারুণ প্রেজেন্ট আশা করেছিলে কি?’

বাঁকুড়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওদের চারজনকেই একটা করে সোনার পদক দেবেন বলেছেন আর ছোট বয়সে দুঃসাহসের, সৎকাজের পুরস্কারের জন্যে দিল্লিতে পশ্চিমবাংলা থেকে তিনটি নাম গেছে এ—বছরে, সারা, মহারাজ, আর এল. এন. এম. বর্মণ। গর্বে ছোটোমামুর মাটিতে পা পড়ছে না।

পক্ষীরাজ ১৩৯০

লেখক: নবনীতা দেবসেনবইয়ের ধরন: উপন্যাস
রামধন মিত্তির লেন

রামধন মিত্তির লেন – নবনীতা দেবসেন

মায়া রয়ে গেল

মায়া রয়ে গেল – নবনীতা দেবসেন

অন্যদ্বীপ – নবনীতা দেবসেন

হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে - নবনীতা দেব সেন

হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.