প্রবাসে দৈবের বশে – নবনীতা দেবসেন
‘প্রবাসে দৈবের বশে’ উপন্যাসের কেন্দ্রে রয়েছে লেখক—কবি এবং অবিবাহিত নারী বিপাশা। লন্ডনে বসে ইংরাজিতে লেখালেখি করে সে। পূর্ব ইউরোপের চেকোস্লাভিয়ায় লেখক—শিল্পীদের এক সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে বিপাশার মনে হয় সবাই তাকে অবহেলা করছে কারণ, তার দেশ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের শিকার এবং মাতৃভাষা না জেনে অত্যাচারীর ভাষায় সে নকল শিল্পসৃষ্টি করছে! লেখক—কবিদের এই সম্মেলনেই শোনা যায় সেই ঘোষণা, ‘শিল্পীদের খেয়ালিপনাটা সম্পূর্ণ বানিয়ে তোলা বুর্জোয়া ভণ্ডামি মাত্র। একটা সামাজিক লাইসেন্স নিয়ে নেওয়া আর কি, যা খুশি তাই করবার জন্য।’ বিপাশা প্রায়ই দেশের জন্য নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়। সেখানে বিনা বিচারে জেলে আটক সমীর, কবিতা আর রাজনীতি ছাড়া বিপাশাই ছিল যার জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। বাবার জোরজুলুমের কাছে নতিস্বীকার করে বিপাশাকে লন্ডনে পালিয়ে যেতে হয়, পেটি বুর্জোয়া পরিবারের কন্যা হয়েও কম্যুনিস্ট সমীরের জন্যই সে বিপ্লবী হতে চেয়েছিল বিপ্লবকে না বুঝেই, আজ রাজবন্দী সমীর আর বিপ্লব, দুই—ই তার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
একদিকে প্রবাসের অ—পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সমাজতন্ত্রী সাম্রাজ্যবাদে সে লক্ষ্য করে স্তালিনরাজের সময়কার ষড়যন্ত্রী আবহাওয়ার চাপ, অন্যদিকে দেশে প্রেম—পরিবারের স্মৃতি বিপাশাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। বিপাশার বর্তমানে একাকার হয়ে যায় যৌনতা ও রাজনীতি, তাকে শারীরিকভাবে পেতে চায় পার্টির প্রধান সেক্রেটারি ও সাহিত্য—সমালোচক যোহান, রাজনীতি যার পরিবারে ভাঙন ধরিয়ে দিয়েছে, মা থেকে গেছে সোশালিস্ট বিশ্বাস নিয়ে, স্ত্রী সরে গেছে আস্থা রাখতে না পেরে। সমীর প্রেমের ব্যাপারে, যোহান স্মৃতির ব্যাপারে পুঁজিবাদী। যোহান স্বীকার করে, ‘সোশ্যালিজম এখনও পাকা হয়নি আমাদের মধ্যে, এখনও বহু দ্বন্দ্ব, বহু বিচ্যুতি, বহু ত্রুটি কনট্রাডিকশনের সীমা নেই, আর সেই কনট্রাডিকশন জগতের কাছ থেকে লুকোনোর জন্য আমাদের সাবধানতারও সীমা নেই।’ বুর্জোয়া বিপাশা হারিয়েছে বিপ্লবী ও কম্যুনিস্ট সমীরকে, বিপ্লবী ও কম্যুনিস্ট যোহানের জীবন থেকেও সরে গেছে তার বুর্জোয়া স্ত্রী কাত্রিনা। দুই নিঃসঙ্গ নরনারী উপন্যাসের শেষে যৌনতার মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনের শূন্যতার ক্ষতিপূরণ খোঁজে, দমচাপা স্মৃতির হাত থেকে মুক্তি খোঁজে, অতিক্রম করে যেতে চায় রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও বাস্তবতার সীমাবদ্ধতাকে এবং রেখে যেতে চায় মানবিক সম্পর্কের শাশ্বত স্মৃতিকে।
Leave a Reply