পুরাণী – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
সম্পাদনা – সুচেতা বন্দ্যোপাধ্যায়
দীপ প্রকাশক
প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০২১
প্রচ্ছদ সুব্রত চৌধুরী
প্রকাশক শংকর মণ্ডল
.
উৎসর্গ
তৎ সৃষ্ট্বা তদেবানুপ্রাবিশৎ
তিনি এই সমুদয় সৃষ্টি করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশ করিলেন
তৈত্তিরীয় উপনিষৎ, ২.৬.১
আমার প্রয়াত সাহিত্য-গুরু
রমাপদ চৌধুরীর
উদ্দেশে
বালকোচিত নিবেদন
.
কথামুখ
আমার এইসব লেখার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ‘বয়ঃ কৈশোরগন্ধি’। জড়িয়ে আছে যৌবন সন্ধির যত অপচেষ্টা এবং চেষ্টা; জড়িয়ে আছে ‘হয়ে ওঠা’র যন্ত্রণা এবং সুখ, আর সবার ওপরে জড়িয়ে আছেন এক দিগন্তে দাঁড়ানো পুরুষ—আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ সাহিত্যগুরু রমাপদ চৌধুরী। বস্তুত এই বইটির মধ্যে যেসব প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে, সেগুলির বিষয় প্রকীর্ণ এবং বিচিত্র। প্রাচীন ভারতীয় সমাজের জীবন এবং সংস্কৃতির নানান খণ্ডাংশ নিয়ে বিচিত্র প্রবন্ধ এখানে স্থান পেয়েছে, কিন্তু সেগুলির বৈশিষ্ট্য এটাই যে, আমার লেখক-জীবনের আরম্ভ এই প্রবন্ধগুলি দিয়েই। আমার জীবনের প্রথম লেখাটাও এখানেই প্রথম বইয়ের মধ্যে এল, যদিও গ্রন্থের গ্রন্থিতে সেই প্রথম লেখাটা—সংকেত স্থান, যা আমার এই লেখক-জীবনের সংকেত তৈরি করেছে, সেটা এই গ্রন্থের শেষের দিকে এসেছে।
এই গ্রন্থের ভূমিকায় আমার লেখাগুলি নিয়ে বলার কিছু নেই, কিন্তু যেহেতু এই লেখাগুলিই আমার লেখক-জীবনের ভূমিকা তৈরি করেছে, তাই সেই জীবনের ভূমিকাটাই এখানে বড়ো হয়ে ওঠে। ফলে যিনি না থাকলে আজকের এই পরিচিত নৃসিংহপ্রসাদের পরিচয়ই ঘটত না, তিনিই থাকুন এই গ্রন্থের ভূমিকায়। তিনি প্রয়াত সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী।
আমার জীবনে এমন গুণী, অথচ এমন বৈপরীত্যে ভরা মানুষ আমি দ্বিতীয় দেখিনি। তাঁর কথা বলতে গেলে যেহেতু আমার নিজের জীবন-কথা কিছু বলতেই হবে, অতএব সেই ক্ষুদ্রতাটুকু মার্জনা করুন আজ। বিশেষত আমার সেই ক্ষুদ্রতার বিপ্রতীপেই রমাপদবাবু সঠিক প্রকট হয়ে উঠতে পারেন, সেই জন্যই আমার ক্ষুদ্র জীবনের দুটো কথা নিরুপায় হয়ে শুনতে হবে আপনাদের।
আমার ক্ষেত্রে সেই দিনটা ভাল ছিল না। আমি তখন সদ্য কলেজে ঢুকে বড় বড় জার্নালে তথাকথিত বড় বড় লেখা লিখছি। মাঝেমাঝে সেসব গবেষণাপত্রে বেরচ্ছে। আপন কৃতকর্মে আপনি পুলকিত হয়ে দু-চারজন বিদ্বান মানুষের সঙ্গে সেই সব গবেষণার বিষয় নিয়ে আলোচনা বসছি। পুনরায় নতুন গবেষণায় মন দিচ্ছি এবং বড় বড় কাজ করছি বলে বেশ বিজ্ঞ-বিজ্ঞ আভাসে ঘুরে বেড়াই। আমার স্ত্রী এই ব্যাপারকলাপ অনেক দিন সহ্য করার পর একদিন রাগে ফেটে পড়লেন—তাঁর কাছে সময়ের ঋণ তৈরি হয়ে গেছে বড় বেশি। প্রতিবেশীর সমস্ত কৌতূহল জাগানো সেই ঝগড়ার অন্তিম পর্বে তিনি বলে ফেললেন, এই সব যে বড় বড় গবেষণাপত্র লিখছ, লোকে সেগুলো বারো বছরে একবার পড়বে এবং তাও প্রায় সমতুল এবং সম বিষয়ের হলে। নইলে কে পড়ে এসব লেখা? তোমার ক্ষমতা হবে আনন্দবাজারে লেখার—একটা রবিবাসরীয়তে একটা লেখা লেখার?
আমি সাময়িকভাবে যতই প্রতিবাদ করি না কেন, গিন্নির মুখের ওপর যতই প্রতিযুক্তি দিই না কেন, ‘পুষ্পে কীট সম’ একটা তৃষ্ণা তৈরি হল মনে। স্ত্রীকে কিছুই জানালাম না, কোনো চ্যালেঞ্জও জানালাম না, কিন্তু কীট দংশনের অধীর আমি দিন পনেরো খেটেখুটে লেখা ছিঁড়ে, লেখা কেটে, একটা লেখা তৈরি করে আনন্দবাজার অফিস ছুটলাম কলেজ সেরে। আগে কোনো দিন এই অফিসে যাইনি, যদিও দোতলা, তিনতলায় ওঠার কড়াকড়ি সেকালে ছিল না। তবুও শুধু রবিবাসরীয়ের জায়গাটা খুঁজে বের করাটাও নতুন একজনের পক্ষে সহজ ছিল না। পরে বুঝতে পেরেছি, আমি নিউজ রুমের এধার-ওধার ঘুরেছি এবং সেটা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন সেকালের দিনের আর-এক দিকপাল প্রয়াত শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
শক্তিদাকে আমি অনেক কাল আগে থেকেই চিনতাম; তবে যে-শক্তির সঙ্গে আমার দেখা হল, সেই সযত্ন সংযত, সর্বতোভদ্র শক্তিকে দেখে আমার অবাকই লাগল একটু। সেই উদভ্রান্ত পথিকের মতো কিংবা নিয়ন্ত্রহীন উচ্ছ্বাসের মতো শক্তি ইনি নন, বরং বেশ সযৌক্তিকভাবে শক্তিদা বললেন, তোকে এক যুগ পরে দেখলাম। তো কেন এসেছিস এখানে, লেখা-টেখার ব্যাপার নাকি? এত তাড়াতাড়ি আমার উদ্দেশ্য ধরে ফেলায় আমার বেশ সুবিধেই হল এবং প্রায় সুবিধাবাদীর মতোই বললাম, হ্যাঁ একটা লেখা। শক্তিদা বললেন, কোথায়? ‘দেশ’ পত্রিকায়? আমি বললাম, না। রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে। শক্তিদা অন্য একজনকে একটু হাত নাড়তে নাড়তে বললেন, একটু ‘টাফ’ হয়ে গেল। ঠিক আছে। চ। আমি বুঝলাম, সেই অন্তর্গূঢ় চেতনায় শক্তি শক্তির মধ্যেই আছে।
শক্তিদাই আমাকে রমাপদ চৌধুরীর ঘরে নিয়ে গেলেন, রবিবাসরীয়র সম্পাদক। তার আগে আমি কোনোদিন রমাপদ চৌধুরীকে দেখিনি এবং তিনি যে রবিবাসরীয় আনন্দবাজারের সম্পাদ, তাও আমি জানতাম না। দেখলাম রমাপদবাবু খবরের কাগজ পড়ছেন। সম্ভবত সেটা ছিল তিন তলায় এবং সে ঘরে রমাপদবাবু একাই বসতেন, তাঁর ডান পাশে লম্বা ডেস্কে পরপর তিনজন বসে আছেন। সবচেয়ে কাছে ডানদিকে রাধানাথ মণ্ডল—এ নামটাও পরে জানলাম। আমি যে ঢুকলাম শক্তিদার সঙ্গে কেউ আমার দিকে তাকালেন না ফিরে, শুধু শক্তিদার মুখে ‘রমা-দা’ ডাক শুনে তিনি মুখের ওপর থেকে খবরের কাগজটি নামালেন এবং স্বয়মাসনে বসা শক্তিদার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। আমাকে কেউ বসতে বললেন, না, রমাপদবাবুতো ননই, অন্যরাও না।
আমি বেশ বিব্রত বোধ করতে আরম্ভ করেছি। হাজার হলেও কলেজের মাস্টার, বড় বড় গবেষণাপত্র লিখছি, মনে মনে একটা গুমোর তো আছেই এবং মনে মনে এটাও বলছি—শক্তিদার সঙ্গে দেখা হয়েই ভুল হয়েছে, তিনি তো আমাকে ঘরটা দেখিয়ে দিয়েই চলে যেতে পারতেন। আমি তো আর লেখার জন্য তদবির করতে বলিনি শক্তিদাকে। আমি ঠিক শক্তিদার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছি বলে ওঁদের কথা শুনতেও পাচ্ছিলাম, সে একেবারেই অন্য কথা, আনন্দবাজারের ঘরোয়া। আমি কিন্তু পিছনে দাঁড়িয়েই আছি, মৌন, মূক এবং পলায়নেচ্ছ্ব। হঠাৎ শক্তিদা বললেন রমাদা! এ হল নৃসিংহ। একটা লেখা নিয়ে এসেছে। আমি বিদ্যুৎ-তাড়িতের মতো ক্ষিপ্রতায় লেখাটি রমাপদবাবুর হাতে দিলাম। তিনি একবার লেখাটির দিকে তাকালেন এবং আমার চেয়ে বেশি ক্ষিপ্রতায় বললেন, রাধানাথ!
রাধানাথ তাঁর স্বকর্মোচিত অভ্যস্ততায় লেখাটি নিয়ে একটি ড্রয়ারে পুরে দিলেন আরও অনেক লেখার সঙ্গে। আমি পুনরায় শক্তির দু’-হাত পিছনে গিয়ে অভিমুখে দাঁড়ালাম। আমাকে রমাপদবাবু বসতে বললেন না। শক্তিদা হঠাৎই ‘ঠিক আছে’ বলে বেরিয়ে গেলেন। রমাপদবাবু আবারও খবরের কাগজ খুলে পড়তে লাগলেন। ঘরের মধ্যে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে টের পাওয়া যায়, উন্মুখ, অভিমুখ থাকলে আরও বেশি টের পাওয়া যায়। ফলত একটু পরেই রমাপদবাবু খবরের কাগজটা মুখ থেকে একটু নামিয়ে বললেন, কী হল আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? লেখার কপি রেখেছেন তো? আমি বললাম, না। রমাপদবাবু বললেন, সব সময় কপি রেখে দেবেন। লেখা ছাপা না-হলে এসে বললেন, লেখাটা ফেরত দিন, তখন খুঁজে পাওয়া যাবে না এ লেখা। বেশ! আপনি আসুন, যদি লেখা ছাপা হয় তো ভাল, আর যদি তিন মাসের মধ্যে লেখা ছাপা না-হয়, তা হলে বুঝবেন—অ-ন-নু-মো-দি-ত। আসুন।
আমি ফিরে এলাম। কিন্তু আমার ফেরার পথটা ছিল চরম মানসিক যন্ত্রণার। লেখা কী ছাপা হবে না হবে, সেটা নিয়ে কোনো আলোড়ন আমার ছিল না। সারাটা রাস্তা আমার মন জুড়ে রইলেন রমাপদ চৌধুরী। এই সেই রমাপদ চৌধুরী! যাঁর ‘লালবাঈ’ থেকে ‘বনপলাশীর পদাবলী’ আমাদের ছাত্রজীবনে তারাশঙ্করকে ভুলিয়ে দিয়েচিল। এই সেই রমাপদ চৌধুরী, যাঁর ‘এখনই’ পড়ার পর জীবনের মধ্যে তাঁর উপন্যাসের অনুকরণ ঘটাতে চাইতাম। এই উপন্যাস সিনেমা হওয়ার পর কত যে পুরুষ স্বরূপ দত্তের মতো বদান্য হতে সিংহাসনের রাজা থেকে এক কঠিন শত্রুপিণ্ডে পরিণত হলেন।
সারা রাস্তা যন্ত্রণা সইতে বাড়ি ফিরলাম এবং স্ত্রীকে কিছুই জানাতে পারলাম না বলে যন্ত্রণা আরও বাড়ল। যন্ত্রণার মধ্যেই তুলনা আর প্রতিতুলনার ঝড় বইল আমার মনের মধ্যে। এই নাকি সেই রমাপদ চৌধুরী, যিনি নিজের সাহিত্য-পথ ভেঙে নিজেই বারবার নতুন পথ তৈরি করেছেন। নইলে দেখুন, তাঁর আগের সাহিত্যকৃতির মঞ্চ ভেঙে যে-বয়সে তিনি ‘এখনই’-র মতো উপন্যাসের মালঞ্চ তৈরি করছেন, সে বয়সে লেখার মধ্যে অনেক ঔপন্যাসিকের পৃথিবী বারাণসী হয়ে ওঠে। এর পর যখন ‘খারিজ’, ‘লজ্জা’, ‘হৃদয়ের মতো’ উপন্যাস তাঁর হাত দিয়ে বেরল, সেদিন কামু-কাফকার অতিপৃথক এক বঙ্গায়ন ঘটে গেল। প্রতি বছর যাঁর নতুন একখানি উপন্যাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতাম, অপমানে দিগ্ধ একটা রাত কাটালাম—নৈর্ব্যক্তিক এক গার্হস্থ অভিনয়ে।
তবু অবাক হওয়ার ছিল। আমি আমার প্রথম লেখাটি দিয়ে এসেছিলাম কোনও একটা সোমবারে অথবা মঙ্গলবারে। ঠিক তার অব্যবহিত রবিবাসরীয়তে আমার প্রবন্ধটি আনন্দবাজারের সহোদর হিসেবে বেরল। আমার বাড়িতে তখন ফোন ছিল না, কাজেই সকালবেলায় কোনো আত্মীয় কিংবা স্বজন আমাকে কোনো সাভিনন্দন সংবাদ দেননি। কিন্তু সেদিনকার কাগজটি শুধু খুব ঠান্ডা মাথায় নিরাসক্ত ভঙ্গিতে আমার স্ত্রীর সামনে খুলে ধরেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের ‘কবি জায়া’র মতো আমার স্ত্রীও সেদিন মাথার ওপর পড়ো পড়ো বাড়ির কথা খেয়াল করেননি, বরং সেই সাহিত্য-সরস্বতীর সঙ্গে একাসনে বসতে চেয়েছেনলক্ষ্মী মেয়ের মতো লক্ষ্মীদেবীর সংকোচে।
সেদিনই মনে হল, রমাপদ চৌধুরী অদ্ভুত এক বৈপরীত্যের আধার। আমার স্ত্রীকে সেদিনের অপমান-বোধের কথা সবিস্তারে জানালাম সেদিন। তিনি বললেন, কবিরে দেখো না তার জীবনচরিতে। এটা খুব সত্যি যে, তিনি বাইরে থেকে বেশ কঠিন এক মানুষ ছিলেন, আনন্দবাজারের অফিসে কাজ করা অনেক মানুষই তাঁকে বেশ ভয়ের চোখে দেখতেন, এটাও আমি দেখেছি। যাই হোক, পরের মঙ্গলবার যখন সকৃতজ্ঞচিত্তে আমি রমাপদ চৌধুরীর ঘরে ঢুকলাম, সেদিন তিনি অন্তত পূর্ণ চোখে একবার তাকালেন আমার দিকে। তবে সে তাকানোটাও আমার কাছে ভ্রুকুটির মতো ছিল, সেদিনও কোনো বিকার ছিল না তাঁর মুখে। সেদিনও তিনি বসতে বললেন না, আমি নিজে থেকেই ‘সগদগদং ভীত ভীতঃ’ ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, এইরকম লেখা কি আমি লিখতে পারি আরও দু-একটা? এবার বললেন সেই আগের মতোই কেটে কেটে, হ্যাঁ, মাঝেমাঝেই লিখবেন। আবারও চলে এলাম এবং মাঝেমাঝে আমার লেখা বেরতে লাগল। আনন্দবাজারে, কিন্তু একটি লেখা নিয়েও তিনি ভাল না মন্দ, তেমন সবিশেষ উচ্চারণ তখনও করেননি।
চার-পাঁচটা এইরকম লেখা বেরনোর পর, অবধারিতভাবে সেটা দশ-এগারো মাসের ‘গ্যাপ’ হবে—রমাপদবাবুর ঘর পালটে গেল এবং সেখানে আরও দুজন দিকপাল মানুষ একত্রে বসতে আরম্ভ করলেন—একজন গৌরকিশোর ঘোষ, অন্যজন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। খুঁজে-খুঁজে সেই চারতলার ঘরে গিয়ে যখন উপস্থিত হলাম, দেখলাম রমাপদবাবু ঘরে নেই। সেদিন কথা বললেন গৌরকিশোর ঘোষ তিনি হঠাৎ আমার নাম-পরিচয় জেনে বসতে বললেন আমাকে এবং লেখার প্রশংসা করলেন। এরই মধ্যে রমাপদবাবু ঘরে এলেন এবং আমার দিকে তাকানো-মাত্রেই শশব্যস্তে জিজ্ঞাসা করলেন, লেখা এনেচেন? বললাম, হ্যাঁ। যেন বেজায় সব অন্যরকম হয়ে গেছে। অতএব সেই শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাঁর কাছে জমা-দেওয়া লেখাটি একবার দেখেই বললেন, নীচে রাধানাথের কাছে দিয়ে যাবেন।
সেই আমার প্রথম বসা, অথচ এমনভাবেই রমাপদবাবু কথা বলতে লাগলেন, সেগুলো পাঁচ কথা ছিল। কিন্তু তার মধ্যে আমি অংশ নিচ্ছিলাম এবং রমাপদবাবুও এমনভাবেই কথা বলতে লাগলেন, যেন আমিও অনেকদিনই এইভাবে বসে তাঁর সঙ্গে গল্প করেছি। এইভাবেই রমাপদবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ জমে গেল এবং তারপর এমনও হত যে, এক সপ্তাহ দেরি করে গেলে—তিনি প্রশ্ন করতেন, কোথায় ছিলেন এত দিন। কী যে করেন আপনারা এই অধ্যাপকেরা।
নানা কথাতেই এই জিনিসটা ধরা পড়ত তাঁর কথায়, রমাপদবাবু অধ্যাপক-কুলকে খানিকটা আড়চোখে দেখতেন। বলতেন, কী যে লেখে এরা। বিষয় পেলে এমন জ্ঞান দেওয়া শুরু করে। আমি বললাম, আমিও অধ্যাপনাই করি। তিনি বললেন, আপনি কোনো অধ্যাপকই নন। আমি আর কথা বাড়াইনি। এরই মধ্যে আমি রমাপদবাবুকে একটা লেখা দিলাম, ‘উত্তর ভারতের চোখে সেকালের বাঙালি’। তখন জ্যোতি বসুর রাজত্ব চলছে—মাঝেমাঝেই তিনি কেন্দ্রের বিমাতৃসুলভ আচরণ নিয়ে সোচ্চার হচ্ছেন। ফলে সময় বুঝেই লেখা দিলাম। লেখাটি বেরনোর পর অদ্ভুত একটা তলব এল রমাপদবাবুর তরফ থেকে। সেই রবিবাসরীয়র পরের সোমবার এক পিওনের হাতে এক টুকরো চিঠি—’কাল দেখা করবেন। জরুরী।’
রমাপদবাবুর লেখাও এইরকম ছিল। কোনো বাড়তি মেদ থাকত না লেখার মধ্যে। ছোট ছোট বাক্য এবং যেখানে যে-শব্দ ব্যবহার করতেন, সেটা যেন আর নড়ানো যেত না। যদিও আমার কাছে আদেশের মতো ওই চিঠিটা নতুন একটা সংকট বলে মনে হল। পরের দিন দুরু দুরু বক্ষে রমাপদবাবুর ঘরে উপস্থিত হতেই তিনি প্রায় খেঁকিয়ে উঠে বললেন, কী করেছেন কী আপনি? কী লিখেছেন? গৌর বলছে, নীরেন বলছে, সিদ্ধার্থ বলে গেল। আমার মনে হল, যেটা ঘটেছে, তাতে আজকেই আমার লেখক-জীবনের ইতি টেনে বাড়ি ফেরা। মনে হল, শেষের দিনে সেজন বিনে/বলি, পর কি আপন হয় রে! রমাপদবাবু আবার বললেন, কী করেছেন আপনি! শুনুন, আপনাকে চারদিন সময় দিচ্ছি। আজ সোমবার, আগামী বৃহস্পতিবার বিকেল চারটের সময়, এই যেমন সময়ে আপনি আসেন, এই সময়ের মধ্যে আরও একটি লেখা দেবেন একই বিষয়ে। লেখাটা তো পুরো লিখতে পারেননি, পুরো লিখুন।
আমার ‘হাসব না কাঁদব’ অবস্থা তখন। তার মধ্যে গৌরদা লেখাটা নিয়ে খুব উচ্ছ্বসিত হলেন দেখে আমি রমাপদবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার কেমন লেগেছে? বললেন, আমার কথা ছাড়ুন। আমি পাঠকের দিকে তাকিয়ে থাকি। তারা যদি ভাল বলে, তবে ভাল। নইলে অযথা আমি কোনও লেখককে ‘গ্যাস’ খাওয়াই না। তবে জানবেন, একটা গৌর, একটা নীরেন যদি আপনার লেখা ভাল বলে, তা হলে বুঝবে পাঁচশো লোক আপনার লেখা ভাল বলছে। আর লেখা খারাপ হলে আপনি পণ্ডিচেরি থেকেও চিঠি পাবেন, এটা আনন্দবাজার।
আজকেই রমাপদবাবু খানিক কথা বলছেন। অন্য দিনগুলোতে অন্য অনেক কিছু নিয়ে কথার মধ্যে কথা বলেছি আমি, কিন্তু আমার লেখা নিয়ে তিনি এ পর্যন্ত একটি মন্তব্যও করেননি, অথচ একটি লেখা তিনি ফেরতও দেননি। আজকে তিনি কথা বলছেন ভাববাচ্যে, কর্মকর্তৃবাচ্যে। গৌরদা বললেন, আপনার লেখার মধ্যে যদি তেমন কিছু না-থাকত, তাহলে রবিবাসরীয়র সম্পাদক আপনাকে চার দিনের মধ্যে আরও একটা লেখা দিতে বলতেন না। রমাপদবাবু এই সময় স্মৃতিসূচক বিনোদনে মৃদু মৃদু হাসছেন দেখে আমি বললাম, কিন্তু রমাপদবাবু! ওই লেখাটা তৈরি করার জন্য আমার সতেরো-আঠেরো দিন লেগেছে, আমি এই একই বিষয়ে চার দিনের মধ্যে আর একটা লেখা দেব কী করে?
রমাপদবাবু আবরও সেই খটখটে আওয়াজ তুললেন, এটা কিন্তু আনন্দবাজার। এখানে রাত বারোটায় একটা লেখা আরম্ভ করে একটার মধ্যে লে-আউটে পাঠাতে হতে পারে এটা সংবাদপত্রের অফিস। আর কে বলল আপনাকে চার দিন সময় দিচ্ছি! আজকে সোম, মঙ্গল এবং বুধবারের রাতগুলোও আপনি পাচ্ছেন, আপনি রাত-দিন এক করে লেখা নামিয়ে দিন। আমি বললাম, আর কলেজ! বললেন, গুলি মারুন, আপনার কলেজের। পড়িয়ে তো সব উলটে দিচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের। তা ছাড়া কলেজ যাবেন না কেন, যাবেন। সে সব করেই তো লিখতে হবে আপনাকে। আপনি দায় করে আর এক মিনিটও এখানে নষ্ট না করে বাড়ি যান, একখুনি।
আমি উঠলাম, বাড়ি ফিরেই পড়তে-লিখতে বসে গেলাম এবং নির্দিষ্ট সময়ে লেখা দেওয়ার পর রমাপদবাবু বললেন, সময় আরও বেশি পাচ্ছেন, আজ বৃহস্পতিবার, বিকেল চারটে। তৃতীয় লেখাটা চাই এই সিরিজের, ‘বাঙালীর চোখে উত্তর ভারতীয়রা।’ সে লেখাও দিলাম পরের বৃহস্পতিবার। বস্তুত অনেকদিন রবিবাসরীয় লেখার পর এবার রমাপদবাবু আমাকে সাবজেক্ট দিতে আরম্ভ করলেন। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, যে-বিষয় নিয়ে আমি কোনোদিন ভাবিনি, সে বিষয়টা আমার জন্য রমাপদবাবু ভেবেছিলেন বলেই আজকে আমার যতটুকু সাহিত্যকর্ম। মহাকাব্যের জগতে আমি তখনও প্রবেশই করিনি, সেইরকম একটা দিনে হঠাৎই রমাপদবাবু আমাকে বললেন—মশায়! পুজোসংখ্যায় লিখতে হবে।
তখনকার দিনে একজন লেখককে পুজোসংখ্যায় লেখার জন্য দেশ, আনন্দবাজারের ডাক পাঠানো মানে যে লেখকের কাছে কী ছিল, সেটা এখনকার সাহিত্যের এই হন্তারক সময়ে বলে বোঝাতে পারব না। যাই হোক, প্রাক পূজাপর্বে একটি আনন্দবাজারী বার্ষিকীতে আমাকে পরীক্ষা করে নিলে রমাপদ চৌধুরী। তখনও এখানকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বিজেপি-র শব্দ শোনা যাচ্ছিল, সেটা বোধ হয় ১৯৮৮ সাল হবে। রমাপদবাবু আমাকে বাল্মীকির রামচন্দ্রকে নিয়ে লিখতে বললেন। বললেন, মশাই! আপনার কাছে রামচন্দ্রের গপ্পো শুনতে চাই না। সারাজীবন তাঁর কত দুঃখ গেছে, তাঁর পিতৃসত্য, তাঁর সীতাহরমের দুঃখের কথা কিচ্ছু শুনতে চাই না। আপনি বিংশ শতকে বসে আবার রামচন্দ্রকে নিয়ে লিখছেন। অতএব একটা মানুষ রামচন্দ্রকে নিয়ে আপনি লিখবেন, যে-মানুষটাকে বাল্মীকি দেখেছিলেন।
রমাপদবাবু কিন্তু লেখাটা বের করে নিলেন আমার মধ্যে থেকে। আমি যে-লেখা কোনোদিন লিখতে পারব বলে ভাবিনি, সেই লেখাটি তিনি বের করে নিলেন আমার কাছ থেকে। আমার নিজের মনে হল, কাঠের পুত্তলি যৈছে কুহকে নাচায়। অনুরূপ ঘটনা ঘটল পুজোসংখ্যায়। লিখলাম, মহাভারতের ভারতযুদ্ধ। সেই কিন্তু আমি খুব শক্ত পায়ে প্রবেশ করলাম রামায়ণ মহাভারেতর মতো মহাকাব্যের জগতে। তার আগে শুধুই ওপর ওপর পড়াশোনা আর আনাগোনা মাত্র চলত ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো। সারা দিন বাজাইলি বাঁশি।
আমার মহাকাব্য চর্চার জগতে রমাপদ চৌধুরী বিংশ শতকের আধুনিকতার মন্ত্র দিয়েছিলেন, যে-আধুনিকতা তিনি আপন সাহিত্যের ক্ষেত্রে বারবার ভেঙে এবং গড়ে সর্বদা সমসাময়িক হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আমার এই সাহিত্যগুরুর সঙ্গে আমি অনেক গভীরভাবে মিশেছি, তাঁর বাড়িতেও যাতায়াত করেছি অনেকবার। মনে আছে, পুজোসংখায় আমার প্রথম লেখা বেরনোর পর তিনি বলেছিলেন, আপনি সামনের পাঁচ বছর কোনো সভা-সমিতিতে যাবেন না। আপনার নামটা ভারী, সেটা আমার কাজে লাগে। রামায়ণ-মহাভারতের মতো ভারী, সেটা আমার কাজে লাগে। রামায়ণ-মহাভারতের মতো ভারী বিষয়, সেটাও আমার কাজে লাগে। কিন্তু আপনি যেভাবে জামা-প্যান্ট পরেন, যেভাবে গটমট করে চলেন, এসব লোকে দেখলে পণ্ডিতের ইমেজটা পুরো নষ্ট হয়ে যাবে। অতএব কোথাও সামনের পাঁচ বছর দেখা দেবেন না।
তখন বুঝিনি, এটাও তাঁর একটা দীক্ষামন্ত্র ছিল। রমাপদ চৌধুরী কোনও সভা-সমিতিতে গেছেন, এটা আমি দেখিনি। যশ-খ্যাতি কিংবা মানুষের মুখে—আপনি কী ভাল লেখেন—এই সব কথায় এতটাই নিঃস্পৃহ ছিলেন রমাপদবাবু যে, খ্যাতির চূড়ায় উঠেও তিনি ছিলেন অদ্ভুত নির্বিণ্ণ এক সাহিত্যের যোগীপুরুষ। সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে সাহিত্যের আসক্তি ভোগ করার মধ্যে যে-নির্মমতা তাছে, সেই নির্মমতাই তাঁকে বাইরে এমন বজ্রকঠিন, অথচ কুসুম-কোমল এক সাহিত্যিক হৃদয় দিয়েছিল, যাতে আমাদের মতো মানুষ এখনও অতি কঠিনভাবে লালিত বোধ করি। বিষয়ে আসক্ত থেকে এক অনাসক্ত যোগীর জীবন—এটাই রমাপদ চৌধুরী।
সাহিত্যের বিষয় নির্বাচনের বিষয়টা যেমন রমাপদবাবুর কাছ থেকে আমার শিক্ষণীয় ছিল, তেমনই শিক্ষণীয় বিষয় ছিল তাঁর জীবনচর্যা। বলতেন—সভা সমিতি-সমিতিতে আমি কক্ষনো যাই না, আপনিও এড়িয়ে চলবেন এই আকর্ষণটা। সামনাসামনি অনেক প্রশংসা শুনলে নিজেকে নিজের থেকে বড়ো ভাবা অভ্যেস হতে থাকে। কিন্তু আপনি সত্যি বড়ো কিনা, কিংবা সত্যিই আপনি ভাল লেখা লিখছেন কিনা, সেটা আত্মমগ্ন হলে নিজেই সবচেয়ে বেশি ভাল বোঝা যায়। রমাপদবাবুর এই কথাটা যে কত বড়ো কথা, সেটা আমি জীবন দিয়ে মানার চেষ্টা করেছি।
আরও একটা কথা রমাপদবাবু বলেছিলেন, সেটাও আমার শিরোভূষণ। রমাপদবাবু বলেছেন—আমি সারা জীবন উপন্যাস লিখে গেলাম বটে, কিন্তু আমার পড়ার বিষয়, এবং পছন্দের পড়ার বিষয় কিন্তু প্রবন্ধ। আমবার প্রবন্ধের মধ্যেও সেইসব প্রবন্ধ আমার ভাল লাগে যেগুলি অনর্থক জ্ঞান বিতরণ করে না। গবেষক-পণ্ডিতদের সমস্যা হল—অর্ধেক বিষয়েই তাঁদের জ্ঞান নেই, কিন্তু জ্ঞান বিতরণের গবেষকোচিত চেষ্টাটাই এমন, যেখানে অন্যের জ্ঞানের কথা বলতে-বলতেই নিজেকে জ্ঞানী বলে প্রকট করতে হয়। সেখানে তার নিজের কথা কিছুই থাকে না। কঠিন কথা, কঠিন বিষয়কে যতক্ষণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে না পারছেন, ততক্ষণ আপনি লেখক নন—এটা মনে রাখবেন। মনে রাখবেন—একজন লেখককে রসিকও হতে হয় পণ্ডিতও হতে হয়—আপনি মডেল হিসেবে নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস বইটার কথা মনে রাখবেন—আপনি চেষ্টা করবেন সেইভাবে লেখার, যেখানে আপনি পাণ্ডিত্যের কুশলী পরিবেশন করে যাবেন, কিন্তু পাণ্ডিত্য যেন চেপে না বসে আপনার ওপর। আর পাণ্ডিত্যের ভানও যেন করতে না হয় আপনাকে।
আজকে এই পরিণত বয়সে এসেও আমি রমাপদবাবুর এই কথাগুলি ভুলিনি। একদিন তাঁর বাড়িতে বসে—যিনি প্রায় কখনোই বেশি কথা বলে সদুপদেশ দিতেনই না, তিনি আমার তিন খানা বই বেরোনোর পর এই কথাগুলি বলে শেষ কথা বলেছিলেন—যেভাবে লিখছেন, এইভাবে লিখে যান। পণ্ডিতি কখনও ফলাবেন না মশাই।
আমি তাই শুধু চেষ্টা করে চলেছি এবং এ বইখানা আমার প্রথম চেষ্টার নমুনা। আমার সহৃদয় পাঠককুল আমার যত অজ্ঞাত এবং অভিজ্ঞতার ইতিহাসটাও জেনে রাখুন, তাতে আমাকে ক্ষমা করতে সুবিধে হবে।
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
Leave a Reply