• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

পল্লীবালা – কাসেম বিন আবুবাকার

লাইব্রেরি » কাসেম বিন আবুবাকার » পল্লীবালা – কাসেম বিন আবুবাকার
পল্লীবালা - কাসেম বিন আবুবাকার

সূচিপত্র

  1. ০১.
  2. ০২.
  3. ০৩.
  4. ০৪.
  5. ০৫.
  6. ০৬.
  7. ০৭.
  8. ০৮.
  9. ০৯.
  10. ১০.

পল্লীবালা – কাসেম বিন আবুবাকার

০১.

জয়নগর গ্রামের এমন কোনো ছোট বড় মেয়ে পুরুষ নেই, যে নাকি আসমাকে চেনে। আসমা খুব ডাকসেটে মেয়ে। ভয়-ডর বলতে কিছু নেই। সুন্দরী হলে কী হবে, দুষ্টমীতে ওস্তাদ। কোনো মেয়েকে তাদের পুকুর থেকে মাটির কলসিতে করে পানি নিয়ে যেতে দেখলে, সে বৌড়ী, ঝিউড়ী বা শাশুড়ী যেই হোক না কেন, ইটের টুকরো ছুঁড়ে তার কলসি ফুটো করে দেবেই। সেই জন্যে তাকে মায়ের কাছে অনেক বকুনী খেতে হয়। তবু তা। করবেই। মা মাহমুদা বিবি গরিব মেয়েদের অনেককে কলসি কেনার টাকা দেন। বাবা মোসারেফ হোসেন মেয়েকে রাগারাগি না করলেও দুষ্টুমী করতে নিষেধ করেন। তার কথাও শোনে না। বড় ভাই ইলিয়াস তার চেয়ে তিন বছরের বড়। সে মাঝে মধ্যে চড়-চাপটা দিলে তার সাথে হাতাহাতি করে। ছোটরা তাকে ভয় পায়, দেখলেই ছুটে পালায়। সমবয়সি ছেলে-মেয়েরাও ভয় করে। বড়রা তাকে এড়িয়ে চলে। কেউ যদি তার দিকে তাকায়, তা হলে তার সামনে গিয়ে গর্জে উঠবে, কী দেখছেন? ঘরে মা বোন নেই? আবার কোনোদিন তাকালে চোখ উপড়ে নেব।

তার চেয়ে দু’তিন বছরের বড় দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই মতি তাকে ভালবাসে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারেনি। একদিন সুযোগ পেয়ে বলল, আসমা তুই দেখতে খুব সুন্দরী, কিন্তু তোর স্বভাবটা এত খারাপ কেন?

ব্যাস, আর যায় কোথায়? কর্কশ কন্ঠে বলল, কেন? তোদের পাকা ধানে মই দিয়েছি নাকি? আমার স্বভাব কী খারাপ দেখেছিস তোকে বলতেই হবে। নচেৎ তোর একদিন কী আমার একদিন।

মতি বলল, এখন যা করছিস, সেটাই তার প্রমাণ।

আসমা তার মুখে খুব জোরে একটা ঘুঁসি মেরে বলল, তাতে তোর কী? তোর খাই না পরি?

ঘুঁসি খেয়ে মতির একটা দাঁত ভেঙ্গে গিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল।

আসমা দেখেও গ্রাহ্য করল না। বলল, আবার যদি কোনোদিন আমার সাথে লাগিস, তা হলে বাকি দাঁতগুলোও ভেঙ্গে দেব।

মতি বলিষ্ঠ তরুণ। ইচ্ছা করলে প্রতিশোধ নিতে পারত। তা না করে খুব রাগের সাথে বলল, মেয়ে বলে পার পেয়ে গেলি, নচেৎ………….. কথাটা শেষ না করে চলে গেল।

ঘরের সবাই যখন জিজ্ঞেস করল, তোর দাঁত ভাঙ্গল কি করে, তখন লজ্জায় সত্য ঘটনা বলতে না পেরে বলল, হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, ওর সঙ্গে ভালবাসা করে বিয়ে করে প্রতিশোধ নেবে। তখন আসমা ক্লাস নাইনে পড়ে। তারপর থেকে মতি আসমার ধারে কাছে যায় না। তবে দূর থেকে লক্ষ্য করে।

মতির বাবার অবস্থা তেমন ভালো না হলেও চাষের ধানে সারা বছর একরকম টেনে টুনে চলে যায়। ওরা দু’ভাই তিন বোন। মতি সবার বড়। গত বছর এস.এস.সি. পাশ করে আর্থিক কারণে কলেজে পড়েনি। বাবার সঙ্গে চাষ-বাসের কাজ করে।

বছর দুই পরে যে বছর আসমা এস.এস.সি. পরীক্ষা দিল সেই বছর তার ভাই ইলিয়াস কুয়েতে চাকরি করতে গিয়ে তিন মাসের মধ্যে মারা গেল। লাশ ফেরৎ এলে তার বাবা মোসারেফ হোসেন দেখে স্ট্রোক করে পঙ্গু হয়ে গেলেন।

মতি সেদিন ইলিয়াসের দাফন-কাফনে সহযোগীতা করল। কয়েকদিন পর আমাদের বাড়িতে আসার সময় পুকুর পাড়ে তার সঙ্গে দেখা।

মতি কিছু বলার আগে আসমা বলে উঠল, কিরে মতি, দাঁত ভাঙ্গার প্রতিশোধ নিতে এসেছিস না কি?

মতি মৃদু হেসে বলল, তখন অবশ্য ভেবেছিলাম, সুযোগ পেলে নেব। পরে চিন্তা করে

দেখলাম, তুই আমার চেয়ে দু’তিন বছরের ছোট, তা ছাড়া দূর সম্পর্কের হলেও চাচাতো বোন। ছোট বোন অন্যায় করলে বড় ভাই হিসাবে মাফ করে দেওয়া উচিত। তাই সে কথা মনে না রেখে মাফ করে দিয়েছি।

আসমা বলল, সেদিন ঘরে এসে আমিও ভেবেছিলাম তোকে মারাটা অন্যায় হয়েছে, মাফ চেয়ে নেব। যাক, তুই মাফ করে দিয়েছিস শুনে খুশি হলাম।

একটা কথা বলব রাবি না বল?

না, কি বলবি বল।

আমি তোর চেয়ে বড়, তুমি করে বলতে পারিস না?

আসমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আর কিছু বলবি?

তুই বড় হয়েছিস, এস.এস.সি. পরীক্ষাও দিয়েছিস। আমি খারাপ কিছু বললাম কিনা ভেবে দেখ। ইলিয়াস মারা যেতে চাচা পঙ্গু হয়ে গেছেন। এবার তুই সংযত হ’! বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করতে শেখ। এখন আর পাড়ায় পাড়ায় ডগাং ডগাং করে ঘুরে বেড়ানোও তোর উচিত নয়।

আসমা ভিজে গলায় বলল, মতি ভাই তুমি ঠিক কথা বলেছ। পাড়ায় ঘোরা আমি বন্ধ করে দিয়েছি। তুমিও কিন্তু আমাকে তুমি করে বলবে।

মতি খুশি হয়ে বলল, ঠিক আছে, চলো চাচাকে দেখে আসি।

এরপর থেকে মতি প্রায় চাচাকে দেখতে এসে আসমার সঙ্গে গল্প করে। তাদের সংসারের বাইরের যাবতীয় কাজ করে দেয়। তাদের পুকুরে মাছ চাষের ও বিক্রি করার ব্যবস্থা করে। তাদের দুরাবস্থা দেখে দুঃখ পায়। যতটুকু পারে মাঝে মধ্যে মা-বাবার অগোচরে চাচার হাতে বিশ-পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সাহায্য করে।

আসমা জানতে পেরে একদিন বলল, মতি ভাই, আব্বাকে যে টাকা তুমি দাও, সেটা কোথায় পাও?

আমি মায়ের কাছ থেকে মাঝে মাঝে হাত খরচের জন্য কিছু কিছু চেয়ে নিই। খরচ না করে জমিয়ে চাচাকে দিয়ে যাই।

কেন দাও বলতো?

বারে, চাচার দুর্দিনে সাহায্য করাই তো উচিত।

তা উচিত, তবে আমার মনে হয় তোমার আরো কোনো মতলব আছে।

এরকম মনে হওয়ার কী কোনো কারণ ঘটেছে?

না, তা ঘটেনি। নিকট আত্মীয় তো কত রয়েছে। তারা কখনো দু’চার টাকা দিয়ে। সাহায্য করেনি। তুমি দূর সম্পর্কের হয়ে করছ, তাই বললাম আরকি।

মতি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, তুমি কি অনুমান করেছ জানি না, তবে যদি রেগে যাবে না বলে কথা দাও, তা হলে বলতে পারি।

তার হাবভাব দেখে আসমা অনেক আগেই বুঝেছে, সে তাকে ভালবাসে। ভাবল, সেই কথাই হয়তো বলবে। অনুমানটা যাচাই করার জন্য বলল, রাগব না, কি বলবে বল।

তুমি যখন ঘুঁসি মেরে দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছিলে, তার অনেক আগে থেকেই তোমাকে ভালবাসি। তাই তো সেদিন ভালো হতে বলেছিলাম।

আসমার অনুমানই ঠিক হল। তবু ভালবাসার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। কারণ সেও মতিকে ভালবেসে ফেলেছে।

মতি বলল, খুব রেগে গেছ মনে হচ্ছে। এক্ষুণি কিন্তু রাগবে না বলেছ।

আসমা মাথা নিচু করেই বলল, না, রাগিনি মতি ভাই। তবে…. বলে থেমে গেল।

তবে কী বলবে তো?

আসমা কিছু বলল না।

তবে কী আমাকে তুমি পছন্দ কর না?

না তাও না। পরে একদিন বলব।

ঠিক আছে, আজ আসি বলে মতি চলে গেল।

.

মতির এক মামা ঢাকা জজ কোর্টে মুহুরীর কাজ করেন। তার তদবীর এক উকিলের চেম্বারে মতি পিয়নের চাকরি পেল। উকিলের বাসায় থাকা-খাওয়া, বেতন এক হাজার টাকা;

মতি ঢাকায় চাকরি করতে যাওয়ার আগের দিন মোসারেফ চাচাদের বাড়িতে সে কথা জানিয়ে ফেরার সময় আসমাকে ইশারা করে বাইরে আসতে বলল।

আসমা তার সাথে পুকুর পাড়ে এসে বলল, ঢাকায় গেলে মানুষ গ্রামের সবকিছু ভুলে যায়।

মতি বলল, সবাই একরকম হয় না। ওসব কথা থাক, তোমাকে আজ আমার দু’আড়াই বছর আগের সেই একটি প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। নচেৎ ভাববো, সত্যি সত্যি তুমি আমাকে পছন্দ কর না।

আসমা বলল, এতদিনেও কী তুমি বুঝতে পারনি? শুধু মুখে বললেই কী হয়? ছেলেরা মুখ ফুটে যা বলতে পারে মেয়েরা তা পারে না। তুমি চাকরি করতে ঢাকায় চলে যাবে শোনার পর থেকে খুব খারাপ লাগছে। আমার মুখ দেখেও তুমি বুঝতে পারছ না?

মতির মন আনন্দে নেচে উঠল। এদিক ওদিক তাকিয়ে খপ করে তার দুটো হাত ধরে চুমো খেয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, আজ এতদিন পরে আল্লাহ তোমার মনের কথা জানালেন, সেই জন্যে তাঁর পাক দরবারে শত কোটি শুকরিয়া জানাই। তারপর বলল, নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে।

আসলেও তুমি তাই। তা না হলে এক নিঃস্ব বাবার মেয়েকে ভালবাসতে না।

এ আবার কি কথা বলছ, আমি তো বুঝতে পারছি না?

বোকা না হলে ঠিকই বুঝতে পারতে। তোমার বাবা কী তার ছেলের বিয়ে যৌতুক ছাড়া দেবেন? তার উপর তুমি আবার চাকরি পেয়েছ।

তা হয়তো দেবেন না, তবে আমার অমতেও কিছু করতে পারবেন না। যা জানার আমার জানা হয়ে গেছে। যৌতুকের ব্যাপারটা আমি বুঝব। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।

মতি ভাই, একটা কথা বলব কিছু মনে করবে না বল?

তোমার কোনো কথাতেই আমি কিছু মনে করব না। তুমি নিশ্চিন্তে বল।

তুমি আমাকে ভুলে যাও। কারণ যৌতুকের কথা বাদ দিলেও আব্বাকে এই অবস্থায় ফেলে বিয়ে করা কিছুতেই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি চলে গেলে সংসারের অবস্থা কি হবে ভেবে দেখ।

মতি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কি হবে আল্লাহকে মালুম। তবে এটা শুনে রাখ, তোমার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করব। অনেকক্ষণ এসেছি, এবার আসি। ছুটিতে যখন আসব তখন এ ব্যাপারে আলাপ করব।

.

০২.

মোসারেফ হোসেন আজ তিন বছরের বেশি পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। আড়াই বিঘা জমি বেচে বড় ছেলে ইলিয়াসকে কুয়েত পাঠিয়েছিলেন। আরো আড়াই বিঘা বেচে নিজের চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু বাক শক্তি ফিরে পাওয়া ছাড়া আর কোনো উন্নতি হয়নি।

ভাইয়া ও আব্বার দুর্ঘটনার পর আসমার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার আসমা যেন আগের আসমা নয়। প্রথম কয়েকদিন তো চুপচাপ পুকুর পাড়ে নির্জন কোনো গাছতলায় বসে বসে কাঁদত। ছোট বোন সালেহা তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়াত। মোসারেফ হোসেন মেয়েকে অনেক বুঝান। একদিন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, মা, আল্লাহ তোর ভাইকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলেন। আমাকেও পঙ্গু করে দিলেন। তুইও যদি ভেঙ্গে পড়িস, তা হলে সালেহাকে, জাহিদকে কে দেখবে? তুই বড় হয়েছিস, লেখাপড়াও করেছিস, এত ভেঙ্গে পড়লে চলবে? তোর মাকে তো জানিস, সে মাটির মানুষ। তোকেই তো এখন সংসারের সব দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।

তারপর থেকে আসমার পরিবর্তন এল। নিয়মিত নামায ও কোরআন পড়তে লাগল। এখন আর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় না। কোনো কারণে কোথাও গেলে গায়ে মাথায় চাদর জড়িয়ে যায়। মুরুব্বিদের সঙ্গে দেখা হলে রাস্তা ছেড়ে একপাশে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। যেসব ছেলে-মেয়েরা তাকে দেখলে ছুটে পালাত, এখন তাদেরকে আদর করে বুকে টেনে নেয়। এসব দেখে গ্রামের লোকজন বলাবলি করে, ভাই মারা যাওয়ার পর ও বাপ পঙ্গু হয়ে যেতে মোসারেফ হোসেনের মেয়েটা খুব ভালো হয়ে গেছে। গ্রামের বৌড়ী-ঝিউড়ীরা স্বস্তি পেয়ে নির্ভয়ে তাদের পুকুর থেকে কলসি করে পানি নিয়ে যায়।

ছোট মেয়ে সালেহার ক্লাস নাইনে উঠার পর পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। টাকার জন্য মোসারেফ হোসেনের চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে গেছে। স্ত্রী হামিদা বিবি খুব পর্দানশীন ও ধার্মীক মহিলা। তিনি সব ছেলে মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে সেই মতো মানুষ করলেও বড় মেয়ে আসমা ছোট বেলা থেকে বড় দুষ্টু। তাকে বাগে আনতে পারেননি। এখন তার পরিবর্তন দেখে খুব খুশি হয়ে আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করেন। আসমা আব্বার যে সমস্ত ধর্মীয় বই পুস্তক ছিল, সেই সব পড়ে নিজে যেমন মেনে চলে, তেমনি ছোট দুটো ভাই-বোনকেও শিক্ষা দেয়। এখন সে বিশ বছরের যুবতী। সংসারের দায়-দ্বায়িত্ব তার উপর। সকালে ও বিকালে স্কুলের কয়েকটা ছেলে মেয়েকে পড়ায়। ছোট ভাই জাহিদ পড়া শোনায় খুব ভালো। তাই শত অভাবের মধ্যেও তার পড়া বন্ধ করেনি। সে এখন ক্লাশ সিক্সে পড়ে।

আজ সকালে জাহিদের ছেঁড়া জামাটা সেলাই করার সময় মতির কথা ভাবছিল। প্রায় ছ’মাস হতে চলল ঢাকায় চাকরি করতে গেছে। নতুন চাকরি বলে ছুটি পায়নি। তাই আসতে পারেনি। সে কথা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। এপর্যন্ত আসমা তার পাঁচটা চিঠি পেয়েছে। এমাসে এখনো পায়নি। রান্না ঘর থেকে মায়ের ডাক শুনে তার চিন্তায় ছেদ পড়ল।

আসমা…. ও আসমা, কোথায় গেলিরে মা?

আসমা জামাটা সেলাই করতে করতেই মায়ের কাছে এসে বলল, কেন ডাকছ বল।

মাহমুদা বিবি গলার স্বর নামিয়ে বললেন, তোর আব্বার হাত-পায়ের যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কিছু কিছু ওষুধ না কিনলেই নয়। ঘরে এক মুঠো চালও নেই।

তারপর দু’গাছা সোনার বালা তার দিকে বাড়িয়ে বললেন, তুই এক্ষুণি বালিয়াকান্দি যা। তোর বড় মামাকে এ দুটো বিক্রি করে টাকা দিতে বলবি।

ততক্ষণে জামাটা সেলাই হয়ে গেছে। দাঁত দিয়ে সুতো কেটে বালা দুটো নিয়ে বলল, বিয়ের চিহ্ন সবকিছুই তো বিক্রি করে দিলে, এ দু’টেও করবে? আব্বা এ দুটো বিক্রি করতে নিষেধ করেছিলেন না?

আস্তে বল, তোর আব্বা শুনতে পাবে। তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই তো জানিস, এছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই।

তা তো জানি; কিন্তু এই টাকায় কত দিন আর চলবে? তারপর কি করবে ভেবে দেখেছ?

মাহমুদা বিবি আবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভেবে আর কী করব মা, আল্লাহর যা মর্জি তাই হবে। তুই আর দেরি করিস না। এতটা পথ যেতে আসতে অনেক সময় লাগবে।

জাহিদের আজ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে এসে মাকে সালাম করে আসমাকে করার সময় বলল, বড় বুবু জামা সেলাই হয়েছে? পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে তো।

হাঁ হয়েছে, বলে আসমা জিজ্ঞেস করল, আব্বাকে সালাম করেছিস?

হ্যাঁ করেছি।

আসমা জামাটা পরিয়ে দিয়ে বলল, পরীক্ষা শুরু হতে দেরি আছে, একটু দাঁড়া আমিও তোর সঙ্গে যাব। কথা শেষ করে রুমে এসে শাড়িটা ঠিক করে পরার সময় বালা দুটো পেট কাপড়ে জড়িয়ে নিল। তারপর মুখে হাতে একটু নারকেল তেল মেখে মাথায় দু’একবার চিরুনী বুলিয়ে বেরিয়ে এসে জাহিদকে বলল, চল।

আসার সময় বারান্দার তার থেকে চাদরটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিল।

যেতে যেতে জাহিদ বলল, তুমি স্কুলে যাবে কেন বড় বুবু?

আসমা বলল, স্কুলে যাব না, মামাদের ওখানে যাব।

অত দূরের রাস্তা তুমি একা যাবে? কাল আমার পরীক্ষা নেই, কাল গেলে হত না? আমিও তোমার সঙ্গে যেতাম।

না, পরীক্ষার সময় তোর কোথাও যাওয়া চলবে না। বিশেষ দরকারে আব্বা পাঠালেন। বড় মামার সঙ্গে দেখা করেই চলে আসব।

এ বছর ক্লাসে ওঠার পর আমাকে নতুন প্যান্ট-জামা কিনে দিতে হবে কিন্তু।

দেব রে দেব, তোকে কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে।

ফার্স্ট হব কি করে? আমার তো প্রাইভেট মাস্টার নেই। জান বড় বুবু, মিয়া বাড়ির রসিদ দু’টো মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, ওর সঙ্গে কি পাল্লা দিতে পারব?

কেন পারবি না, আমি তো তোকে সব সাবজেক্ট পড়াই। আমার মন বলছে, ইনশাআল্লাহ তুই ফার্স্ট হবি।

স্কুলের কাছে এসে আসমা বলল, ধীর স্থিরভাবে পরীক্ষা দিবি। তাড়াহুড়ো করবি না। প্রথমে প্রশ্নপত্র পুরোটা পড়বি। তারপর যে গুলো সহজ মনে হবে সেগুলোর উওর আগে লিখবি। ঘন্টা পড়ার আগে যদি সব উত্তর লেখা হয়ে যায়, তা হলে বসে বসে রিভাইজ দিবি। তারপর তাকে স্কুলের গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে আসমা হাঁটতে শুরু করল।

তার মামাদের বাড়ি বালিয়াকান্দী, জয়নগর থেকে প্রায় চার মাইল। তার মামারা তিন ভাই। সবাই ভিন্ন। নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক। ছোট দু’জনের পাঁচ-ছটা ছেলে মেয়ে। চাষবাস করে কোনোরকমে সংসার চালায়। বড় জনের নাম আনোয়ার হোসেন। তার এক ছেলে এক মেয়ে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের ঘরে চার বছরের এক নাতি। তার নাম রহিম। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় জনের অবস্থা একটু স্বচ্ছল। তিনি মাঝে মধ্যে একমাত্র বোনের বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নেন। যতটুকু পারেন টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন।

আসমা যখন মামা বাড়ি এসে পৌঁছাল তখন বেলা এগারটা।

আনোয়ার হোসেন বাড়িতে ছিলেন। ভাগনিকে দেখে বললেন, কিরে খবর সব ভালো তো?

আসমা সালাম বিনিময় করে মামা মামিকে কদমবুসি করল। তারপর বলল, জ্বি ভালো বলে পেট কাপড় থেকে বালা দুটো বের করে মামার হাতে দিয়ে বলল, এগুলো মা বিক্রি করে টাকা দিতে বলেছে। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে।

আনোয়ার হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বললেন, মারে, আমি এমনই হতভাগা, তোদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। তোর মা এক এক করে সব গহনা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। আল্লাহ যে তোদের তকদিরে কি রেখেছেন তা তিনিই জানেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন, ওকে কিছু খেতে দাও, আমি এগুলো বিক্রি করে আসি। কথা শেষ করে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।

বড় মামি হুসনে আরা আসমাকে বললেন, এখন মুড়ি টুড়ি কিছু খাবি, না একেবারে ভাত খাবি?

আসমা বলল, না বড় মামি এখন কিছু খাব না। একেবারে ভাত খাব। ভাবি কোথায়?

সে রান্না ঘরে।

আসমা রান্না ঘরে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, ভাবী কেমন আছ?

জুলেখা তরকারী কুটছিল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আরে আসমা যে, কেমন আছ? ফুফা ফুপি ভালো আছেন? তারপর একটা পিঁড়ে এগিয়ে দিয়ে বলল, বস।

আসমা বসে বলল, হ্যাঁ, সবাই ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?

ভালো, অনেক দিন আসনি কেন? আগে তো প্রায় আসতে।

কি করে আসব? কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দু’বেলা প্রাইভেট পড়াই। তারপর জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া বুঝি মাঠে গেছে?

হ্যাঁ, হাল চাষ করতে গেছে।

রহিমকে দেখছিনা কেন?

তাকে এবারে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। স্কুলে গেছে।

যাই, মেজ মামা ও ছোট মামাদের সঙ্গে দেখা করে আসি।

 ঠিক আছে এস।

খাওয়া দাওয়া করে টাকা নিয়ে আসমা বেলা দেড়টায় রওয়ানা দিল। মামা-মামি এত রোদে যেতে নিষেধ করে বিকেলে যেতে বলেছিলেন; আসমা শোনেনি। মাইল দুয়েক আসার পর দূর থেকে ইহসানকে দুটো ছেলের সঙ্গে তাদের বাগানের কাছে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে তার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। সে যখন ক্লাস টেনে পড়ত তখন থেকে এস.এস.সি. পাশ করা পর্যন্ত ইহসান তার পেছনে লেগেছিল। প্রতিদিন স্কুলের চারপাশে ঘোরাঘুরি করত। ছুটির সময় পথে অনেকবার দেখা করে প্রেম নিবেদন করে চিঠিও দিয়েছে। আসমা উত্তর দেয়নি। শেষে চিঠি দিয়ে বিয়ে করার কথা বলেছিল। আসমা তারও উত্তর দেয়নি। একদিন একা পেয়ে কুৎসিৎ প্রস্তাব দিয়ে ভয়ও দেখিয়েছিল। আসমা রেগে গিয়ে বলেছিল, আমি স্যারকে বলে আপনার বাবার কাছে নালিশ করব। তারপর থেকে আর কাছে আসেনি, কথাও বলেনি। কিন্তু যাওয়া আসার পথে তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। সে সব চার বছর আগের কথা। এর মধ্যে ইহসানের সঙ্গে আসমার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। আজ তাকে দেখে ভয় পেলেও ভাবল, এতদিনে হয়তো ইহসান তাকে ভুলে গেছে। বিয়ে শাদি করেছে। এখন ভয় পাওয়ার কি আছে ভেবে দ্রুত হাঁটতে লাগল। কাছাকাছি এসে না দেখার ভান করে যখন মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ইহসানের গলা শুনতে পেল, আসমা দাঁড়াও।

আসমা দাঁড়াল না, আরো দ্রুত হাঁটতে লাগল।

ইহসান প্রায় ছুটে এসে তার পথ রোধ করে বলল, তোমাকে ডাকলাম আর তুমি না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছ যে।

আসমা বাধ্য হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সঙ্গি দু’জন নেই। তবে অনেকটা দূরে একটা লোক এদিকে আসছে। চিন্তা করল, লোকটা কাছে আসা পর্যন্ত ইহসানকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে।

মিথ্যে করে বলল, আমি খুব অন্যমনষ্ক ছিলাম। আপনার কথা শুনতে পাইনি। কি বলবেন বলুন। আমার খুব তাড়া আছে।

ইহসান বলল, চার বছর আগে তোমাকে আমার মনের কথা জানিয়েছিলাম। তখন রেগে গেলেও ভেবেছিলাম, তুমি ম্যাচিওর হওনি। আজও তোমার ভালবাসা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। এখন তুমি পূর্ণ ম্যাচিওর। আশা করি, আজ আর আমার ভালবাসাকে ফিরিয়ে দেবে না।

এটা সম্ভব নয় ইহসান ভাই। আপনি বড় লোকের ছেলে। আপনার জন্য কত বড় বড় ঘরের মেয়েরা হাঁ করে বসে আছে। আমার বাবা শুধু গরিব নয়, একেবারে সহায় সম্বলহীন। তা ছাড়া….।

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ইহসান বলে উঠল, প্রেম ভালবাসার কাছে ধনী গরিবের প্রশ্ন অবান্তর। তোমার কোনো কথাই শুনব না। আজ তোমাকে বলতেই হবে, তুমি আমাকে ভালবাসবে কিনা?

আপনি কি জানেন মুখে বললেই যেমন ভালবাসা হয় না, তেমনি জোর করেও তা পাওয়া যায় না।

ইহসান এতক্ষণ নরম ভাবে কথা বললেও এবার গরম মেজাজে বলল, তার মানে তুমি আমার ভালবাসাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ?

আসমা এতক্ষণ রেখে ঢেকে কথা বলছিল। আগন্তুক পথিক কাছে এসে গেছে দেখে সেও দৃঢ় কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ ফিরিয়ে দিচ্ছি। কারণ আপনার দুশ্চরিত্রের কথা জানতে আমার বাকি নেই। চেয়ারম্যানের ছেলে বলে কেউ কিছু বলতে সাহস করেনি, নচেৎ টের পেতেন।

ইহসান আসমাকে আসতে দেখে বন্ধু দু’জনকে বাগানের ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে বলেছিল, আসমা যদি আমার কথায় রাজি না হয়, তা হলে বাগানের ভিতরে নিয়ে গিয়ে যা করার করে ওর অহঙ্কার ভাঙবো। এখন আসমার কথা শুনে খুব রেগে গিয়ে তার একটা হাত ধরে বাগানের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।

আসমার স্বাস্থ্য ভালো। গায়ে শক্তিও আছে। ঝটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল।

ইহসান আসমাকে জাপটে ধরে বন্ধুদের বেরিয়ে আসতে বলল।

ইহসানের বন্ধু দু’জনের একজনের নাম বসির, অন্যজনের নাম সাগির। তারাও স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। তিনজনেই কয়েক বছর আগে এস.এস.সি. ফেল করার পর আর পড়েনি।

ইহসানের কথা শুনে বসির ও সাগির এসে তিনজনে মিলে আসমাকে বাগানের ভিতরে নিয়ে যেতে লাগল।

আসমা প্রাণপনে বাধা দিতে দিতে চিৎকার করতে লাগল, কে কোথায় আছ বাঁচাও।

আসমা যে লোকটাকে দূর থেকে আসতে দেখেছে তার নাম রিয়াজুল। ততক্ষণে সে তাদের কাছে এসে পৌঁছে গেছে। আসমার চিৎকার শুনে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি তাদের পথ রোধ করে গম্ভীর স্বরে বলল, মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।

এতক্ষণ তারা কেউ রিয়াজুলকে লক্ষ্য করেনি। তার কথা শুনে ইহসান বন্ধুদের বলল, শালাকে ভাগাবার চেষ্টা কর।

বসির ও সাগির রিয়াজুলের ষণ্ডা মার্কা চেহারা দেখে কিছু করার সাহস পেল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

রিয়াজুল ইহসানের জামার পিছনের কলার ধরে কঠিন কণ্ঠে বলল, ভালো চাও তো ছেড়ে দাও।

ইহসান রিয়াজুলের গলার স্বর শুনে ও বন্ধুদের চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেল। আসমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে করে নিল।

রিয়াজুল তার জামার কলার ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের ছেলে। ছিঃ ছিঃ এরকম কাজ করা তোমাদের ঠিক হয়নি। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমরা কোন গ্রামের ছেলে?

ইহসান রাগে কিছু বলতে পারল না। কিন্তু বসির ও সাগির খুব লজ্জা পেয়েছে। তারা আপন চাচাতো ভাই। তাদের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। বন্ধুকে শুধু সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বসির বলল, আমরা এই গ্রামেরই ছেলে।

তোমার নাম কি?

বসির।

তামার বাবার নাম?

জাফর আলি।

 রিয়াজুল সাগিরকে জিজ্ঞেস করল তোমার নাম?

সাগিব।

বাবার নাম?

সানোয়ার আলি।

রিয়াজুল এবার ইহসানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম?

ইহসান উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।

বসির বলল, ও চেয়ারম্যান আলি আসগরের ছেলে ইহসান।

তোমরা কি পড়াশোনা কর?

এস.এস.সি. পরীক্ষায় ফেল করে আর পড়িনি।

এটা তোমরা খুব ভুল করেছ। আমি তোমাদের বড় ভাইয়ের মতো। তাই কয়েকটা কথা বলছি শোন, তোমাদের কারো বোনকে যদি কেউ এরকম করত, তা হলে তোমরা কি করতে? নিশ্চয় তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে শালীসি ডাকতে। এখন ভেবে দেখ, তোমরা যে কাজ করতে যাচ্ছিলে, তা ক্ষমার অযোগ্য। তোমাদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। বড় ভাই হিসাবে আজ তোমাদের ক্ষমা করে দেব, যদি তোমরা ভবিষ্যতে এরকম আর করবে না বলে প্রতিজ্ঞা কর। নচেৎ তোমাদের গার্জেনদের জানিয়ে এর বিহীত করব।

এই কথায় বসির ও সাগির খুব ভয় পেল। কারণ তাদের বাবা খুব কড়া লোক। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, এরকম কাজ আর জীবনে করব না।

ইহসানকে চুপ করে থাকতে দেখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রিয়াজুল বলল, কী ভাই তুমি কিছু বলছ না কেন? মনে হচ্ছে আমার উপর খুব রেগে আছ?

এমন সময় চেয়ারম্যান আলি আসগরকে দু’জন লোকের সঙ্গে আসতে দেখে বসির বলে উঠল, ইহসান তোর আব্বা আসছে।

সেদিকে তাকিয়ে ইহসানের মুখে রাগের পরবর্তে ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। ভাবল, আব্বাকে যদি লোকটা বলে দেয় তা হলে আস্ত রাখবে না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে বলল, আমিও প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনে আর কোনোদিন এমন কাজ করব না।

রিয়াজুল বলল, পাশের গ্রামে আমার বাড়ি। মনে রেখ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে, আমি জানতে পারব। তখন কিন্তু ছেড়ে কথা বলব না। তারপর আসমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?

আসমা।

বাড়ি?

আসমা সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ গ্রামের পাশের গ্রাম জয়নগরে।

আরে আমারও তো ঐ গ্রামেই বাড়ি। তোমার বাবার নাম কি?

মোসারেফ হোসেন।

ততক্ষণে আলি আসগর দু’জন সঙ্গিসহ সেখানে এসে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কী ব্যাপার এখানে কি করছ?

ইহসান কিছু বলার আগে রিয়াজুল সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন চেয়ারম্যান চাচা?

 আলি আসগর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে তো চিনতে পারছি না।

আমি জয়নগর গ্রামের মরহুম সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে। ছোট বেলা থেকে ঢাকায় থেকে লেখাপড়া করি। গ্রামে তো থাকি না, চিনবেন কি করে?

আলি আসগর বেশ অবাক হয়ে বললেন, তুমি সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে?

 জ্বি।

আল্লাহ তোমার আব্বাকে জান্নাতবাসী করুন। খুব ভালো লোক ছিলেন। শুনেছি, তুমি যখন তোমার মায়ের পেটে তখন তিনি মারা যান। তা হঠাৎ কি মনে করে এলে? এবার দেশে থাকবে নাকি? তোমার ছোট চাচার সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা হয়েছিল। তার কাছে। শুনলাম, তোমার বাবার সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল চলছে।

জ্বি সেই জন্যেই তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন।

আলি আসগর আসমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে যেন চেনা চেনা লাগছে, কার মেয়ে তুমি?

আসমা বলল, জয়নগর গ্রামের মোসারেফ হোসেনের মেয়ে।

আহা রে! তোমার বাবাও খুব ভালো লোক। ছেলের কারণে পঙ্গু হয়ে গেল। তা তোমার বাবা কেমন আছে?

জ্বি ঐ একই রকম।

ইহসান, বসির ও সাগির এক ফাঁকে সেখান থেকে কেটে পড়ছে। রিয়াজুল বলল, চাচা, আমরা এবার যাই?

হ্যাঁ যাও, বলে আলি আসগর সঙ্গিদেরকে বললেন, চল।

কিছুটা আসার পর রিয়াজুল আসমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে কেন এসেছিলে?

আসিনি, বালিয়াকান্দি মামাদের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম।

লেখাপড়া কতদূর করেছ?

তিন বছর আগে এস.এস.সি. পাশ করেছি।

তাই নাকি? তা হলে তো তুমি করে বলে ভুল করেছি। যাক কিছু মনে করবেন না। না জেনে…………।

কথাটা তাকে শেষ করতে না দিয়ে আসমা পথ রোধ করে কদমবুসি করে ছলছল চোখে ভিজে গলায় বলল, আমি আপনার পায়ের ধূলোর যোগ্যও নই। আমাকে তুমি করেই বলবেন। আপনি আমার ইজ্জত বাঁচিয়ে নবজন্ম দিয়েছেন। ঠিক সময় মতো এসে না পড়লে কি যে হতো আল্লাহকেই মালুম। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

রিয়াজুল তাকে কিছুক্ষণ কাদার সময় দিয়ে বলল, হ্যাঁ এটাই আল্লাহ পাকের ইশারা ছিল। এবার চল যেতে যেতে কথা বলি। তারপর যেতে জিজ্ঞেস করল, তোমার কে কে আছে?

আম্মা- আব্বা ও এক ভাই এক বোন। ওরা সবাই আমার ছোট।

তোমার আব্বার নাম যেন তখন কি বললে?

মোসারেফ হোসেন।

চেয়ারম্যান চাচা তোমার আব্বার পঙ্গু হওয়ার কথা যেন কি বলছিলেন?

আমার একটা বড় ভাই ছিল, এইচ.এস.সি পাশ করে কুয়েতে গিয়েছিল। কয়েক মাস পরে সেখানে মারা যায়। লাশ ফিরে এলে আব্বা দেখে স্ট্রোক করে পঙ্গু হয়ে গেছেন।

ইন্নালিল্লাহে………….রাজেউন পড়ে রিয়াজুল বলল, খুব দুঃখের ব্যাপার। আল্লাহ তোমার আব্বাকে সুস্থ করে দিন। তুমি সেয়ানা মেয়ে। বোরখা পরনি কেন? বোরখা পরলে এরকম বিপদে পড়তে না।

আমার বোরখা নেই। আম্মারটা পরার অযোগ্য। তাই চাদর গায়ে দিয়ে এসেছিলাম। ওরা বাগানের ভিতর ফেলে দিয়েছে।

ওদেরকে তুমি চেন?

চেয়ারম্যানের ছেলে ইহসানকে চিনি। বাকি দু’জনকে চিনি না।

রিয়াজুলের মনে সন্দেহ হল, জিজ্ঞেস করল, ওতো এই গ্রামের ছেলে, চিনলে কেমন করে?

আসমা এই কথার উত্তর না দিয়ে হাঁটতে লাগল।

আমার কথার উত্তর দিলে না যে?

আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমার পিছনে লেগেছিল। সে আজ চার বছর আগের ঘটনা। এতদিন পরে আজ হঠাৎ যে এরকম করবে ভাবতে পারিনি।

তুমি একা একা গিয়েছিলে কেন? ছোট ভাইকে সঙ্গে নিতে পারতে।

ওর আজ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। খুব জরুরী কাজে আম্মা পাঠিয়েছিলেন। তারপর অনেক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কতদিন এখানে থাকবেন?

সে কথা আল্লাহ জানেন। তবে আপাতত বেশ কিছুদিন থাকব।

তারপর আর কেউ কোনো কথা বলল না। গ্রামে ঢুকে রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে গেছে। সেখানে এসে আসমা বলল, আপনি তো মিয়াবাড়ি যাবেন?

হাঁ মিয়া বাড়ি কোন দিকে বল তো?

আসমা একটা রাস্তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, চলুন আমি দেখিয়ে দিয়ে আসি।

না না তোমাকে যেতে হবে না, আমি লোকজনকে জিজ্ঞেস করে যেতে পারব। তার চেয়ে আমাদের বাড়িতে চলুন। খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নেবেন। আব্বার সঙ্গে পরিচয়ও হবে। বিকেলে আমার ভাই আপনাকে পৌঁছে দেবে।

কথাটা মন্দ বলোনি, তবে তা সম্ভব নয়। আচ্ছা চলি একদিন এসে তোমার আব্বার সঙ্গে পরিচয় করব। কথা শেষ করে রিয়াজুল হাঁটতে শুরু করল।

আসমা যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বাড়ির দিকে। হাঁটতে লাগল।

.

০৩.

জয়নগর গ্রামের মিয়াবাড়ির খুব নাম ডাক। খান্দানী বংশ। বিষয় সম্পত্তি প্রচুর। তিন ভাইয়ের বড় নূরুদ্দিন মিয়া ও ছোট সামসুদ্দিন মিয়া বেঁচে আছেন। মেজ সালাউদ্দিন মিয়া অনেক আগে মারা গেছেন। রিয়াজুল তারই ছেলে।

রিয়াজুল যখন তার মায়ের পেটে ছয় মাসের তখন সালাউদ্দিন মিয়া মারা যান। আর রিয়াজুলের বয়স যখন দুই বছর তখন তার মায়ের খুব কঠিন অসুখ হয়েছিল। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করে অনেক দিন চিকিৎসা করান হয়। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। সেখানেই মারা যান। মারা যাওয়ার আগে বোন জাহেদার হাতে রিয়াজুলকে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, বুবু একে তোমাকে দিয়ে গেলাম। আজ থেকে তুমি ওর মা। তারপর দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, আপনারা একে নিজেদের ছেলের মতো করে মানুষ করবেন। সেই থেকে রিয়াজুল খালা-খালুর কাছে মানুষ হয়েছে। তার বড় চাচা নুরুদ্দিন মিয়া গ্রামের। মাতবর। খুব কৃপণ ও লোভী। গরিবদের বিপদে আপদে সাহায্য করার সুযোগে তাদের। জমি-জায়গা হাতিয়ে নেন। নিয়মিত নামায রোযা করেন, হজ্বও করেছেন। কিন্তু আখলাকের পরিবর্তন তার হয়নি। সালাউদ্দিন ও ছোট সামসুদ্দিন বড় ভাইয়ের সম্পূর্ণ বিপরিত। যেমন পরহেজগার তেমনি দিলদার। সামসুদ্দিনও হজ্ব করেছেন। সালাউদ্দিন কম বয়সে মারা গেছেন। তাই হজ্ব করতে পারেন নি। তিনি গরিবদের প্রতি খুব সদয় ছিলেন।

কেউ যে কোনো বিষয়ে সাহায্যপ্রার্থী হলে বিমুখ করতেন না। সামসুদ্দিন বড় ভাইকে ভক্তি শ্রদ্ধা করলেও তার কার্যকলাপে সন্তুষ্ট নন। মাঝে মাঝে বড় ভাইয়ের ন্যায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন। ভিননা হওয়ার সময় মৃত মেজ ভাইয়ের সম্পত্তি নিয়ে দুজনের মধ্যে বেশ গোলমাল হয়। সামসুদ্দিন মিয়া চেয়েছিলেন, মেজ ভাইয়ের সম্পত্তি বর্গা দিয়ে তার ফসল বিক্রি করে ভাইপো রিয়াজুলের খালা খালুকে দিতে; কিন্তু নুরুদ্দিন তাতে রাজি না হয়ে দু’ভাইয়ে ভাগ করে নেন। বছরের শেষে সামসুদ্দিন মেজ ভাইয়ের অংশের জমির ফসল ও ফল-মূল বিক্রি করে বড় ভাইকে বললেন, টাকাটা আমি রিয়াজুলের খালা-খালুকে দিতে যাব। আপনিও কি দেবেন?

নুরুদ্দিন রেগে উঠে বললেন, এ টাকা তাদেরকে দিতে হবে কেন? তারা তো খেয়ে পরে শেষ করে দেবে।

তা হলে টাকাটা কি করব?

 সেটা তুমি জান? তবে তাদেরকে দিও না।

সামসুদ্দিন ফিরে এসে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, প্রতিবছর টাকাটা ব্যাংকে রাখবেন। রিয়াজুল উপযুক্ত হলে তাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন।

রিয়াজুলের বড় খালা জাহেদার বিয়ে ঢাকায় বেশ বড় ঘরেই হয়েছিল। তার খালু মুনসুর আলি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। চাচাদের সম্পত্তি নিয়ে মামলা করে সর্বসান্ত হয়েছেন। শুধু দাদার আমলের দোতলা চার কামরা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। গুলিস্তানে একটা ষ্টেশনারী দোকানের আয়ে সংসার চালান। তাদের কোনো সন্তানাদি হয়নি। রিয়াজুলকে পেয়ে আল্লাহর দান মনে করে মানুষ করেছেন। রিয়াজুল তাদেরকেই আপন মা-বাবা জানে। পড়াশোনার অবসরে বাবার দোকানে এসে বসে।

রিয়াজুলের ছোট চাচা সামসুদ্দিন বছরে দু’তিনবার ঢাকায় এসে ভাইপোকে দেখে। যেতেন। সেই সময় জাহেদ তাকে বলে দিয়েছিলেন, রিয়াজুলকে যেন তার আসল পরিচয় জানায়। উপযুক্ত বয়স হলে তিনি নিজেই জানাবেন। তাই আজ পর্যন্ত জানাননি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে রিয়াজুল জেনে এসেছে সামসুদ্দিন বাবার দূর সম্পর্কের ভাই।

এতদিন বড় ভাই মেজ ভাইয়ের সম্পত্তি ভোগ দখল করে এলেও সামসুদ্দিন কোনো প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু এবারে সেটেলমেন্টের মাপ শুরু হতে যখন মেজ ভাইয়ের সম্পত্তি নিজের নামে লেখাতে শুরু করলেন তখন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। একদিন তাকে বললেন, বড় ভাই, এটা কি ঠিক হচ্ছে? মেজ ভাই মারা গেলেও তার একটা ছেলে রয়েছে। সে এখন বড় হয়েছে। এবার তার বাবার সম্পত্তি তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। মেজ ভাইয়ের অংশের সম্পত্তি রিয়াজুলের নামেই রেকর্ড করান উচিত। তা না করে আপনি নিজের নামে করে নিচ্ছেন। লোকজন জানতে পারলে আপনার মান সম্মান থাকবে? তা ছাড়া কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে কী জওয়াব দেবেন?

নূরুদ্দিন ছোট ভাইয়ের কথা শুনে খুব রেগে গেলেন। বললেন, আমাদের পারিবারিক ব্যাপার লোকে জানবে কেন? আর জানলেও কারো ঘাড়ে দু’টো মাথা নেই যে, আমার বিরুদ্ধে কিছু বলবে। কেয়ামতের সময় আল্লাহকে যা বলার আমি বলব। তোমাকে ভাবতে হবে না। তোমার কাছে যে অংশ আছে ইচ্ছা করলে তার ছেলের নামে রেকর্ড করাতে পার। তুমি আর এব্যাপারে আমার সঙ্গে কথা বলতে এস না।

সামসুদ্দিন ফিরে এসে একটা চিঠিতে বিস্তারিত লিখে জাহেদাকে জানাল, আপনি বলেছিলেন, রিয়াজুলের উপযুক্ত বয়স হলে তাকে তার আসল পরিচয় জানাবেন। সে এখন সাতাশ বছরের যুবক। আমার মনে হয় এখন জানাবার উপযুক্ত সময় হয়েছে। এবার তাকে সব কিছু জানিয়ে পাঠিয়ে দিন। আমি তাকে সবদিক থেকে সাহায্য করব।

চিঠি পেয়ে জাহেদা স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে একদিন রিয়াজুলকে তার আসল পরিচয় ও তার বাবার সম্পত্তির কথা জানিয়ে সামসুদ্দিনের সাহায্য করার কথাও জানালেন।

রিয়াজুল এম.এ. পাশ করে চাকরীর চেষ্টা করছে। অনেক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বলল, আমি তোমাদেরকে মা-বাবা বলে জানি। বাবা জন্মের আগে মারা গেছেন। মাও দু’বছরের রেখে মারা গেছেন। বড় চাচা বাবার সম্পত্তি মেরে খাচ্ছেন। ছোট চাচার যদি আমার প্রতি এত দয়া, তা হলে এতদিন প্রতিবাদ করেননি কেন? আমার কাছেই বা কেন পরিচয় গোপন করেছেন?

জাহেদা বললেন, তিনি গোপন করতে চাননি, আমিই তাকে বাধ্য করিয়েছি।

তাই যদি হয়, তা হলে এখন আমাকে এসব জানাবার দরকার কী ছিল? বাবার সম্পত্তি আমার দরকার নেই। আমি আপনাদের ছেলে। আমাকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন। আমার এখন কর্তব্য উপার্জন করে আপনাদের খেদমত করা।

মনসুর আলি বললেন, তুমি খুব ভালো কথা বলেছ। আমাদেরও তোমার বাবার সম্পত্তির উপর কোনো লোভ নেই। আর এসব কথা তোমাকে কখনও জানাতামও না। তোমার মা তোমার ছোট চাচাকে কথা দিয়েছিল, উপযুক্ত বয়সে তোমাকে জানাবেন। তোমার ছোট চাচা চিঠিতে সেই ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে সম্পত্তির কথা জানিয়ে তোমাকে জানাতে বলেছেন এবং তোমাকে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। আমরা আমাদের ওয়াদা পূরণ করার জন্য। সবকিছু তোমাকে জানালাম। এখন তোমার সবকিছু বোঝার মতো বয়স ও জ্ঞান হয়েছে। যা ভালো বুঝ করবে। তাতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

রিয়াজুল বলল, ঠিক আছে, কয়েকদিন চিন্তা ভাবনা করে দেখি।

ঐদিন নামায পড়ে মোনাজাত করার সময় যখন বলল, রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানী সাগীরা (হে প্রভূ আমার মাতা-পিতাকে রহম করুন, যেমন করে তাঁরা আমাকে শিশুকালে লালন-পালন করেছেন) [আল কোরআন, সূরা-বনি ইসরাইল, ২৪ আয়াত, পারা ১৫]। তখন রিয়াজুলের মনে মা-বাবার কথা মনে পড়ল এবং চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল। সেই অবস্থায় তাদের রুহের মাগফেরাতের জন্য আরো অনেক দোয়া করল। তারপর থেকে প্রায় হঠাৎ হঠাৎ তাদের কথা মনে পড়তে লাগল। কয়েকদিন ভেবে ঠিক করল, বাবাকে তো দেখিনি, মাকেও না দেখার মতো। একবার অন্ততঃ দেশে গিয়ে মা-বাবার কবর জিয়ারত করে আসবে।

চিঠি দিয়েও যখন রিয়াজুল এল না এবং কোনো উত্তরও পেল না তখন সামসুদ্দিন মিয়া একদিন ঢাকায় এলেন।

তখন রিয়াজুল বাসায় ছিল না দোকানে ছিল। জাহেদা ও মুনসুর আলি সালাম ও কুশল বিনিময় করে আপ্যায়ন করালেন।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, আমার চিঠি নিশ্চয় আপনারা পেয়েছেন?

মুনসুর বললেন, হ্যাঁ পেয়েছি। পাওয়ার পর রিয়াজুলকে সবকিছু জানিয়েছি। সে কয়েকদিন ভাববার সময় নিয়েছে। তাই আপনাকে কিছু জানাতে পারিনি। বাসায় এলে আপনি তার সঙ্গে আলাপ করবেন।

মুনসুর আলি দোকানে গিয়ে রিয়াজুলকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। বাসায় এস সামসুদ্দিন মিয়াকে দেখে সালাম বিনিময় করে কদমবুসি করল। তারপর জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, কয়েকদিন আগে মায়ের কাছে আমার আসল পরিচয় পেয়েছি। কিন্তু আপনি যে উদ্দেশ্যে ডেকে পাঠিয়েছেন, তা সম্ভব নয়। সম্পত্তির জন্য বড় চাচার সঙ্গে মনোমালিন্য করতে পারব না। তবে আব্বা আম্মার কবর জিয়ারত করার জন্য মাঝে মাঝে যাব।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, তাতো যাবেই। কিন্তু সম্পত্তির দাবি তুমি ছাড়বে কেন? এটা তোমার আল্লাহ প্রদত্ত হক। একজন অন্যায়ভাবে হককে না-হক করবে, তা তোমার মত শিক্ষিত ছেলের মেনে নেওয়া উচিত নয়। ঠিক আছে, দুলা ভাই আসুক, তার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর সামসুদ্দিন মিয়া সবাইকে নিয়ে আলোচনা করার জন্য বসলেন, প্রথমে তিনিই মুনসুর আলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, রিয়াজুল তো সম্পত্তির ব্যাপারে যেতে চাচ্ছে না। বড় চাচার সঙ্গে বিরোধ করতে পারবে না বলছে। তবে মাঝে মাঝে মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে যাবে।

মুনসুর আলি বললেন, ও বড় হয়েছে, লেখাপড়া করেছে, নিজের ভালো মন্দ বোঝার জ্ঞানও হয়েছে। এটা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমরা ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করব না! আর ওর বাবার সম্পত্তির উপর আমাদের কোনো লোভ নেই। ও যদি বাবার সম্পত্তি পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে তাতে যেমন বাধা দেব না, তেমনি চেষ্টা করতেও বলব না। তবে সে ব্যাপারে সাহায্য চাইলে পিছ-পা হব না। কারণ হককে যারা অন্যায় ভাবে না-হক করে, তারা জালেম। আর জালেমকে আল্লাহ ভাবাসেন না। এটা কোরআন পাকের কথা। আল্লাহর রাসুল (দঃ) মজলুমদের সাহায্য করতে বলেছেন।

সামসুদ্দিন বললেন, আমিও তা জানি। তাই তো রিয়াজুলকে সব রকমের সাহায্য করতে চাই। তারপর রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো শিক্ষিত ছেলে, এতবড় জুলুম মেনে নেবে কেন?

রিয়াজুল মায়ের দিকে চেয়ে বলল, তুমি কিছু বলছ না কেন?

জাহেদা সামসুদ্দিন মিয়ার যে কোন ছেলে মেয়ে নেই তা জানেন। ওঁর ধারণা সামসুদ্দিন মিয়া রিয়াজুলকে বাবার সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে নিজের কাছে রেখে দেবেন। তাই বললেন, তোর আব্বার ও চাচার সঙ্গে আমি একমত হলেও সম্পত্তি আদায় করতে গিয়ে তোর কোনো বিপদ হোক, তা আমি চাই না। জান্নাতবাসিনী মায়ের মুখে শুনেছিলাম, বিষয় সম্পত্তি বিষের মতো। সেই বিষের মোহ যেন তোকে পেয়ে না বসে। আর সে জন্যে তুই যদি সেখানে থেকে যাস এবং বিপদে পড়িস, তা হলে আমি বাঁচব না। তারপর চোখ মুছলেন।

রিয়াজুলকে দু’বছরের রেখে যখন তার মা মারা যান তখন সামসুদ্দিন মিয়ার ইচ্ছা ছিল, ভাইপোকে মানুষ করার। কিন্তু মেজ ভাবি রিয়াজুলকে তার বড় বোনের হাতে দিয়ে দেওয়ায় সে আশা পূরণ হয়নি। তবে একেবারে নিরাশ হননি। ভেবে রেখেছিলেন, উপযুক্ত বয়স হলে তার বাবার সম্পত্তি বুঝিয়ে দিয়ে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবেন। তাই এখন জাহেদার কথা শুনে মনে মনে চমকে উঠলেন। সামলে নিয়ে বললেন, আপা কি যে বলেন, আমি থাকতে আল্লাহর রহমতে রিয়াজুলের কোনো বিপদ হতে দেব না। আর থেকে যাওয়ার কথা। যে বললেন, তা কী রিয়াজুলের মতো ছেলে পারবে? ওকে আপনারা শিশুকাল থেকে মানুষ করেছেন। আপনারাই ওর মা-বাবা। মা-বাবাকে ছেড়ে কোনো ছেলে কী চাচার কাছে থাকতে পারে? সম্পত্তির ব্যাপারে ও যা চাইবে তাই হবে। মা-বাবার কবর জিয়ারত করার কথা বলছিল, তাই এবারে না হয় আমার সঙ্গে গিয়ে দেশ দেখে এল। সেই সাথে মা-বাবার কবর জিয়ারতও করে এল।

রিয়াজুল চাচাকে বলল, আপনার সঙ্গে আমি যাব না। কিভাবে যেতে হবে বলুন, কয়েকদিন পরে যাব।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, ঠিক আছে বাবা তাই যেও। তবে আমার সঙ্গে গেলে তোমার কোনো অসুবিধা হত না। তুমি তো কখনো গ্রামদেশে যাওনি, তাই সঙ্গে যেতে বলছিলাম।

রিয়াজুল বলল, মানুষ কত অজানা দেশে যাচ্ছে, এটা তো নিজের দেশ। অসুবিধা তেমন হবে কেন?

পরের দিন বাড়ি ফেরার সময় সামসুদ্দিন মিয়া কি ভাবে যেতে হবে রিয়াজুলকে বুঝিয়ে বলে এসেছিলেন।

রিয়াজুল এক সপ্তাহ পরে আজ রওয়ানা হয়েছিল। আসমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। যখন ছোট চাচার বাড়িতে পৌঁছাল তখন তিনি সদরে বসে গরুর জন্য পাটের দড়ি পাকাচ্ছিলেন।

রিয়াজুলকে দেখে দড়িটা রেখে এগিয়ে এলেন।

রিয়াজুল সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।

সামসুদ্দিন মিয়া সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, আসতে কোনো অসুবিধা। হয়নি তো বাবা?

না চাচা কোনো অসুবিধা হয়নি। আপনারা কেমন আছেন?

আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তোমার আব্বা-আম্মা ভালো আছেন?

 জ্বি, আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন।

চল বাবা ঘরে চল। তারপর তাকে নিয়ে উঠোনে এসে স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কই গো, কোথায় গেলে? দেখবে এস কে এসেছে।

খায়রুন্নেসা স্বামীর কথা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রিয়াজুলকে দেখে ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

সামসুদ্দিন মিয়া হেসে উঠে বললেন, তুমি কাকে দেখে ঘোমটা দিচ্ছ? এতো আমাদের রিয়াজুল, মেজ ভাইয়ের ছেলে। যাকে নিয়ে আসার জন্য তুমি বারবার আমাকে বল।

রিয়াজুল বুঝতে পারল, ইনি ছোট চাচি। এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে কদম বুসি করল।

খায়রুন্নেসা সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে বললেন, থাক বাবা থাক, আল্লাহ তোমাকে সুখি করুন। এস বাবা ঘরে এসে বস। তারপর ঘরে এনে বসিয়ে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

কিছুক্ষণ পর আসরের আযান শুনে রিয়াজুল বলল, চলুন ছোট চাচা, মসজিদে নামায পড়তে যাই।

মসজিদে নামায পড়ার পর সামসুদ্দিন মিয়া মুসুল্লীদের সঙ্গে রিয়াজুলের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

রিয়াজুল জিজ্ঞেস করল, বড় চাচা নামায পড়তে আসেননি?

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, সব সময় আসেন। আজ হয়তো কোনো কারণে আসতে পারেননি। চল গ্রামের অন্যান্য সবাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। সেই সাথে গ্রামটাও দেখা হয়ে যাবে।

মাগরিব ও এশার নামাযের সময়েও বড় ভাই মসজিদে এলেন না দেখে সামসুদ্দিন মিয়া রিয়াজুলকে বললেন, কাল সকালে তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব।

সামসুদ্দিন মিয়া বাপ-দাদার আমলের চার কামরা বাড়িতে আছেন। ভিন্ন হওয়ার পর নূরুদ্দিন মিয়া বাস্তুর অর্ধেক পাঁচিল দিয়ে ঘিরে নতুন আট কামরা বাড়ি করেছেন। পাঁচিলের বাইরে সদর বাড়ি। মাতবর মানুষ, সারাদিন লোকজন যাতায়াত করে। তিনি সদর বাড়িতে তাদের সঙ্গে দেখা করেন।

সামসুদ্দিন মিয়ার চার কামরা বাড়ির এক কামরায় স্বামী স্ত্রী থাকেন। একটা মেহমান এলে ব্যবহার হয়, এটা ভাড়ার ঘর আর একটায় বর্ষাকালের রান্নার জন্য জ্বালানী রাখেন। এবারে ঢাকা থেকে ফিরে এসে মেহমানদের কামরাটা রিয়াজুলের থাকার জন্য ঠিক-ঠাক করে রেখেছিলেন। সেখানেই তাকে থাকতে দেওয়া হল। খাওয়া-দাওয়ার পর সামসুদ্দিন মিয়া স্ত্রীকে নিয়ে ভাইপোর রুমে এসে তার মা-বাবার কথা ও তাদের মারা যাওয়ার পর কিভাবে খালা খালুর ছেলে হল, সবকিছু বলতে লাগলেন :

রিয়াজুল বলল, কাল আম্মা-আব্বার কবর জিয়ারত করব।

সামসুদ্দিন মিয়া বলেন, ঠিক আছে যোহরের নামায পড়ে তোমাকে কবরস্থানে নিয়ে যাব। তারপর সম্পত্তি ভাগের কথা ও তার অংশের ফসল বিক্রির টাকা যে এত বছর ব্যাংকে জমা রেখেছেন সে কথা বলে বললেন, কালকেই তোমাকে ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে একাউন্ট খুলে সব টাকা তোমার নামে ট্রান্সফার করে দেব। আর একটা কথা, মোশারেফ হোসেনের পাঁচ বিঘে জমি ঐ টাকা থেকে তোমার নামে কিনেছি, কিন্তু তুমি না থাকাতে রেজিষ্ট্রি হয়নি। এবার করে নিতে হবে।

মোসারেফ হোসেনের নাম শুনে রিয়াজুলের আসমার কথা মনে পড়ল। তার বাবার নামও মোসারেফ হোসেন। বলল, তিনি এক সঙ্গে পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করলেন কেন?

সামসুদ্দিন মিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, সে অনেক কথা বাবা। সংক্ষেপে বলছি শোন, মোসারেফ হোসেন লোক হিসাবে খুব ভালো। তোমার আব্বার খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। জমি জায়গা যা ছিল তার ফসলে বেশ ভালোভাবেই দিন চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বিধির বিধান কে খন্ডাবে। বড় ছেলেটা আই.এ. পাশ করে আদম ব্যাপারীর পাল্লায় পড়ে আর পড়ল না। কুয়েত যাওয়ার জন্য মা বাবাকে অস্থির করে তুলল। শেষে আড়াই বিঘা জমি বেচে তাকে কুয়েত পাঠালেন মোসারেফ হোসেন। আল্লাহর কি ইচ্ছা, সেখানকার আবহাওয়া সহ্য হল না ছেলেটার। যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে সর্দি গরমে মারা গেল। এক সপ্তাহ পর লাশ ফিরে এল। ছেলের লাশ দেখে মোসারেফ হোসেন স্ট্রোক করে পঙ্গু হয়ে গেলেন। চিকিৎসা করানোর জন্য আরো আড়াই বিঘা জমি বেচেছেন। এখন অল্প-সল্প কথা বলতে পারলেও হাঁটতে পারেন না। বড় মেয়েটা লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল। বছর তিনেক আগে এস.এস.সি. পাশ করেছে। মোসারেফ হোসেন ভালো থাকলে এতদিনে বিয়ে দিয়ে দিতেন।

আসমার বাবার কথা শুনে রিয়াজুলের মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল। বলল, আল্লাহর মহিমা বোঝা মানুষের অসাধ্য। তিনি মুহূর্তের মধ্যে মৃতকে জীবিত, জীবিতকে মৃত, ধনীকে গরিব ও গরিবকে ধনী করতে পারেন।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, হ্যাঁ বাবা, তিনি সর্বশক্তিমান। যখন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন।

বড়চাচার ছেলে মেয়ে কয়জন তো বললেন না।

তিন ছেলে চার মেয়ে, সবার বিয়ে শাদি হয়ে গেছে।

 ছেলেরা মসজিদে নামায পড়তে আসে না?

সব সময় না এলেও জুম্মার দিন আসে।

আচ্ছা ছোট চাচা, আমার কোনো ফুফু নেই?

হা একজন আছে। সে সবার ছোট নাম তানজিলা। প্রায় সাত মাইল দূরে তার বিয়ে হয়েছে। তার দুই ছেলে, দুই মেয়ে। ছেলে দুটো বড়। তোমার ফুফু, ফুপা ও তাদের ছেলে মেয়ের মাঝে মধ্যে এলে আমার কাছেই উঠে। বড় ভাইয়ের কাছেও থাকে, তবে আমার কাছেই বেশি থাকে।

আমি ফুফুদের বাড়ি বেড়াতে যাব।

নিশ্চয় যাবে বাবা, নিশ্চয় যাবে। তোমাকে দেখলে তানজিলা খুব খুশি হবে। এখানে যতবার আসে ততবারই আগে তোমার কথা জিজ্ঞেস করে।

ফুফা কি করেন?

গৃহস্থালী কাজ করেন। জমি-জায়গা অনেক।

আর ছেলে মেয়েরা।

সবাই পড়াশোনা করছে। জান বাবা, তোমার বড় চাচা তানজিলার নামও, রেকর্ড করাচ্ছেন না। আমি সে কথা জিজ্ঞেস করতে বললেন, তাকে এক জায়গা থেকে কিছু জমি দিয়ে দিলেই হবে। সব জায়গায় নাম লেখাবার দরকার নেই। পরে ঝামেলা হবে। আমি তোমার ফুফা আকবর হোসেনকে সেটেলমেন্ট অফিসের হাকিমের কাছে যেতে বলেছিলাম। সে বলল, গেলে মিয়া ভাই অপমানিত হবেন। তা ছাড়া আপনাদের বোনের সম্পত্তিতে আমার কোনো লোভ নেই। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন। তানজিলা শুনে বলল, এখানে লোভের কথা আসবে কেন? এই সম্পত্তি আমার আল্লাহ প্রদত্ত হক। যে কেউ না-হক করতে চাইলে তার প্রতিবাদ করা উচিত। বড় ভাই যদি আমাদের সঙ্গে বেঈমানী করতে পারেন, তা হলে আমরা প্রতিবাদ করতে পারব না কেন? আকবর হোসেন বললেন, তোমার কথা ঠিক, কিন্তু হাকিমের সামনে প্রতিবাদ করলে, ওঁর মান সম্মান ধূলোয় মিশে যাবে। এটা আমি পারব না। তখন তোমার ফুফু আমাকে বলল, তুমি রিয়াজুলকে নিয়ে এস, তাকেও বড় ভাই ফাঁকি দিচ্ছে। রিয়াজুল আর আমাদের রফিক দু’জনে মিলে হাকিমের কাছে প্রতিবাদ করবে। তাই চিঠি দেওয়ার পরও তুমি যখন এলে না তখন আনতে গিয়েছিলাম।

রিয়াজুল হাই তুলে বলল, ফুফুআম্মা ঠিক কথা বলেছেন।

তাকে হাই তুলতে দেখে খায়রুন্নেসা স্বামীকে বললেন, এবার তোমাদের আলাপ বন্ধ কর। ছেলেটা কতদূর থেকে হয়রান হয়ে এসেছে। এবার ঘুমাতে দাও। তারপর রিয়াজুলকে বললেন, তোমার চাচা তোমাকে পেয়ে সব কিছু ভুলে গেছে।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, হ্যাঁ বাবা, তোমার চাচি ঠিক কথা বলেছে। এবার ঘুমিয়ে পড়। তারপর পাশের রুম থেকে একটা চার্জ লাইট এনে বললেন, এটা মাথার কাছে রাখ। রাত এগারটার পর প্রতিদিন কারেন্ট চলে যায়। বাইরে যাওয়ার দরকার হলে এটা জ্বেলে যেও।

রিয়াজুল বলল, ওটা আপনি নিয়ে যান। গ্রামে আসব বলে আম্মা তিন ব্যাটারীর একটা টর্চ লাইট কিনে দিয়েছেন। দাঁড়ান ব্যাগে আছে বার করছি।

খায়রুন্নেসা বিছানা ঝেড়ে মশারী খাটিয়ে স্বামীকে নিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, কোনো অসুবিধা হলে তোমার চাচাকে ডেক।

পরের দিন সালে নাস্তা খেয়ে সামসুদ্দিন মিয়া রিয়াজুলকে সাথে করে বড় ভাইয়ের কাছে গেলেন।

নূরুদ্দিন মিয়া তখন একাকী সদরে বসে ছিলেন। সামসুদ্দিন সালাম দিয়ে বললেন, কাল মসজিদে দেখলাম না, শরীর কি ভালো নেই?

নূরুদ্দিন মিয়া সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, বাতের ব্যাথাটা বেড়েছে। তাই যেতে পারিনি। তারপর রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে ছেলেটা? চিনতে পারছি না তো।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, ও মেজ ভাইয়ের ছেলে রিয়াজুল। ঢাকা থেকে গতকাল বিকেলের দিকে এসেছে।

রিয়াজুল বুঝতে পারল, ইনিই বড় চাচা। সালাম দিয়ে কদমবুসি করে বলল, কয়েকদিন আগে পর্যন্ত আমার পরিচয় জানতাম না। জানার পর আপনাদের দোয়া নিতে এসেছি।

নূরুদ্দিন মিয়া সালামের উত্তর দিয়ে অবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, রিয়াজুল মেজ ভাইয়ের মতো দেখতে হয়েছে, তাই না বড় ভাই?

নূরুদ্দিন মিয়া বললেন, হ্যাঁ তাই তো দেখছি। তারপর বসতে বলে একজন কাজের মেয়েকে ডেকে চা-নাস্তা দিতে বললেন।

রিয়াজুল বলল, এক্ষুণি নাস্তা খেয়ে আসছি। শুধু চা দিতে বলুন।

নূরুদ্দিন মিয়া কাজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তিন কাপ চা নিয়ে আয়। তারপর রিয়াজুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, লেখাপড়া কতদূর করেছ?

আপনাদের দোয়ায় এম.এ. পাশ করেছি।

 চাকরি বাকরি কিছু করছ?

চেষ্টা করছি বাকি আল্লাহর মর্জি।

তা বেড়াতে এসেছ বুঝি?

 জ্বি।

কতদিন থাকবে?

 আল্লাহ যতদিন এখানে রেযেক রেখেছেন।

 ভালো, আমার এখানেও কয়েকদিন থেক।

 জ্বি থাকব।

এমন সময় কাজের মেয়ে চা নিয়ে এলে, খেয়ে সামসুদ্দিন মিয়া ও রিয়াজুল সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

রাস্তায় এসে রিয়াজুল বলল, আপনি যান, আমি গ্রামটা একটু ঘুরে দেখি।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, রোদে বেশি ঘুরো না, তাড়াতাড়ি ফিরো।

জ্বি আচ্ছা বলে রিয়াজুল হাঁটতে হাঁটতে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে এক সময় আসমাদের ঘরের কাছে এসে পুকুর-ঘাটে কর্মরত একটা লাবণ্যময়ী তরুনীকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। আধ-ময়লা আটপৌরে শাড়ির আঁচলে ঘোমটা থাকা সত্বেও তরুণীর মুখের লাবণ্য রিয়াজুলের মন কেড়ে নিল। দুধে-আলতা মেশান আপেলের মতো নিটোল গাল, পিঠের উগর মেঘবরণ চুলের বৃহৎ খোঁপা, সর্বোপরি নিখুঁত দেহ সৌষ্ঠব তার মনকে এত মুগ্ধ কল যে, দীলে দীলে আল্লাহে জানাতে বাধ্য হল, বেহেস্তের হুর-সম তোমার এই বান্দিকে আমার জীবন সাথি করো। হঠাৎ তার মনে হল, আসমার মুখের সঙ্গে যেন এই তরুণীর মিল রয়েছে। গলা খাকারী দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী আসমার বোন?

সালেহা একমনে ছাই দিয়ে থালা-বাসন মাজতেছিল। হঠাৎ ঘাটের উপর থেকে কেউ বুবুর নাম ধরে তার কথা জিজ্ঞেস করতে চমকে উঠল। তারপর সেদিকে চেয়ে একটা অচেনা সুন্দর যুবককে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিল।

রিয়াজুল বলল, কি হল? কিছু বলছ না কেন?

 সালেহা মুখ নিচু করেই বলল, কে আপনি?

আমাকে তুমি চিনবে না, যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দাও।

 জ্বি, আপনার অনুমান ঠিক।

তোমার নাম কি?

সালেহা আরো লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল।

 রিয়াজুল বুঝতে পেরে বলল, নাম বলতে লজ্জা পাওয়া উচিত নয়।

 সালেহা।

বাহ, খুব সুন্দর নাম তো? নামের অর্থ জান?

সালেহা মাথা নাড়াল।

সালেহা অর্থ ধার্মিকা। তুমি নিশ্চয় ধর্মের আইন মেনে চল?

যতটুকু জানি ততটুকু মেনে চলি।

গুড, কোন ক্লাশে পড়?

সালেহা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থালা-বাসন মাজতে লাগল।

রিয়াজুল ভাবল, হয়তো পড়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, তোমার আপা ঘরে আছে?

জ্বি আছে।

তুমি হাতের কাজ সেরে নাও, আমি অপেক্ষা করছি। কাল আসমার মুখে তোমার আব্বার কথা শুনেছি। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

আপনি কোথা থেকে এসেছেন?

 আমি মিয়া বাড়ির ছেলে। ঢাকায় থাকি। কাল এসেছি।

বুবুকে চিনলেন কি করে? কা

ল আসার সময় পরিচয় হয়েছে।

ঠিক আছে একটু অপেক্ষা করুন। তারপর থালা-বাসন ধুয়ে উপরে এসে আপাকে ডেকে দিচ্ছি বলে চলে গেল।

সালেহা ঘরে এসে আসমাকে বলল, মিয়া বাড়ির একটা লোক তুমি ঘরে আছ কিনা জিজ্ঞেস করে বললেন, আব্বার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

আসমা গতকাল ঘরে এসে যখন আব্বাকে চেয়ারম্যানের ছেলের কথা বলল, তখন মোসারেফ হোসেন প্রমে রেগে গিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারেননি। পরে মিয়া বাড়ির ছেলে তাকে উদ্ধার করেছে জেনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে ভিজে গলায় বললেন, আমার এই অবস্থা না হলে চেয়ারম্যানের ছেলে বিচার করে ছাড়তাম। আল্লাহ মিয়া বাড়ির ছেলেটার ভালো করুন। তার নাম জানিস?

আসমা বলল, না। তবে চেয়ারম্যান তার বাবার নাম জিজ্ঞেস করতে বললেন, সালাউদ্দিন মিয়া।

মোসারেফ হোসেন অবাক হয়ে বললেন, কি নাম বললি মা?

আব্বাকে অবাক হতে দেখে আসমা বলল, তুমি ওঁকে চেন নাকি? আমি তো মিয়া বাড়ির সবাইকে চিনি। ওঁরা তো দু’ভাই।

তুই চিনবি কি করে? তোর জন্মের অনেক আগে সালাউদ্দিন মিয়া মারা গেছেন। তখন তার স্ত্রীর পেটে বাচ্চা ছিল। দু’বছরের ছেলেকে বড় বোনের হাতে দিয়ে তিনি মারা গেছেন। বড় ভালো ছিলেন সালাউদ্দিন মিয়া। আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল। প্রায় আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমাকেও অনেকবার তাদের বাড়িতে নিয়ে গেছেন। আল্লাহর কি কুদরত, তারই ছেলের দ্বারা আজ তোকে বিপদ থেকে উদ্ধার করালেন। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলি না কেন?

আসমা বলল, আসতে বলেছিলাম, উনি বললেন পরে এক সময় আসবেন।

তারপর থেকে সবসময় ছেলেটার কথা আসমার মনে পড়েছে। এখন সালেহার কথা শুনে বলল, উনি কোথায়?

সালেহা বলল, উনি পুকুর পাড়ে ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।

আসমা গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে উঠোন পার হয়ে রিয়াজুলকে দেখতে পেল। এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

রিয়াজুল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর বলল, গ্রাম দেখতে। বেরিয়েছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম।

আসুন বলে আসমা এগোল।

তার পিছু নিল।

আসমা তাকে ঘরে নিয়ে এসে আব্বাকে বলল, গতকাল ইনি আমাকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন।

মোসারেফ হোসেন শুয়েছিলেন। নিজে উঠে বসতে পারেন না। রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন, বাপের মতো হয়েছে।

রিয়াজুল সালাম দিল।

মোসারেফ হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমাকে ধরে একটু বসা তো মা।

আসমার আগে রিয়াজুল এগিয়ে এসে তাকে ধরে বসাল।

আসমা দু’টো বালিশ পিঠের দিকে ঠেস দিয়ে রিয়াজুলকে বলল, আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন।

রিয়াজুল বসার পর মোসারেফ হোসেন তার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার নাম কি বাবা?

রিয়াজুল।

 তোমাকে তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করনি তো?

না-না, মনে করব কেন? আমি তো আপনার ছেলের বয়সি।

হাঁ বাবা, আমার ইলিয়াস তোমার বয়সিই হবে। তিন বছর হল আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছেন। কথা শেষ করে চোখ মুছলেন।

রিয়াজুল বলল, কাঁদবেন না চাচা, হায়াৎ মউত আল্লাহর হাতে। সবর করুন। আল্লাহ যা কিছু করেন বান্দাদের ভালর জন্য করেন।

চোখ মুছে মোসারেফ হোসেন বললেন, হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক কথা বলেছ। সবর করেই আছি। তোমাকে দেখে ও তোমার কথা শুনে ইলিয়াসের কথা মনে পড়ে গেল। জান বাবা, তোমার আব্বার সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। তার মতো ভালো লোক পাঁচ সাতটা গ্রামে ছিল না। আসমা যে ওর মামাদের বাড়ি গিয়েছিল আমি জানতাম না। ফিরে এসে বিপদের কথা জানিয়ে যখন বলল, তুমি তাকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছ তখন তোমার জন্য অনেক দোয়া করেছি। আল্লাহ তোমার হায়াৎ দারাজ করুন। তোমাকে সুখি করুন।

রিয়াজুল বলল, আপনার অসুখের কথা কাল আসমার কাছে কিছু শুনেছিলাম। রাত্রে ছোট চাচার কাছে সব শুনেছি। আপনি নাকি আগে কথাও বলতে পারতেন না। আল্লাহর রহমতে এখন তো পারছেন। আমার মনে হয় শহরে নিয়ে ভালো ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করালে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। এখানে চিকিৎসা করাচ্ছেন না?

হ্যাঁ বাবা করাচ্ছি। তবে….. বলে থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আসমাকে বললেন, রিয়াজুলকে চা করে দে। শহরের ছেলে চা খাওয়া অভ্যাস। তারপর রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আমার বন্ধুর ছেলে। তুমি এসেছ, আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু তোমার জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না। আল্লাহ আমাকে…..। কথাটা শেষ করতে পারলেন না। কান্নায় গলা বুজে এল। ঠোঁট চেপে সামলাবার চেষ্টা করলেন।

রিয়াজুল বলল, হাদিসে পড়েছি, পিতার বন্ধু পিতার সমান। পিতার মতো তাকে। সম্মান করবে। হাদিস মোতাবেক আমি আপনার ছেলের মতো। আপনার অপারগতার কথা আমি জানি। ছেলে হিসাবে বলছি, আপনি বিচলিত হবেন না। আল্লাহ যেমন দিনের পর রাত্রি রেখেছেন, তেমনি সুখের পর দুঃখ ও দুঃখের পর সুখও রেখেছেন। রাত্রের অন্ধকার যেমন এক সময় দূর হয়ে দিনের আলো ফুটে উঠে তেমনি দুঃখের রজনী একসময় দূর হয়ে সুখের আলো ফুটে উঠবে। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের নানা রকম দুঃখ কষ্ট ও বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন। কোরআন পাকে আছে, আর আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করিব কিঞ্চিৎ ভয় দ্বারা। আর উপবাস দ্বারা এবং ধনের ও প্রাণের ও ফল-শষ্যের স্বল্পতা দ্বারা। আর সুসংবাদ শুনাইয়া দিল এমন ধৈর্যশীলদিগকে যখন তাহাদের উপর মুসিবত আসে তখন বলে, আমরা তো আল্লাহরই আয়ত্তে আর আমরা সকলে আল্লাহরই সমীপে প্রত্যাবর্তনকারী। আপনি সবর করুন। যে বান্দা দুঃখ কষ্টে ও বিপদে পড়ে সবর করেন, আল্লাহ তাকে খুব ভালবাসেন। তার দুঃখ কষ্ট ও বিপদ দূর করে দেন।

তুমি খুব দামি কথা বলেছ বাবা। তোমার আব্বার কাছে আমি কোরআন হাদিসের অনেক জ্ঞান পেয়েছি। তার কাছ থেকে ঐসবের বাংলা তরজমা নিয়ে অনেক পড়েছি। তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর করে আছি। শুধু মেয়ে দুটোর জন্য খুব চিন্তা হয়। আসমার বিয়ের বয়স হয়েছে। কতদিন তাকে আর ঘরে রাখব। সালেহাও ডাগর হয়ে উঠেছে। অভাবের কারণে তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছি। আসমা দু’বেলা কয়েকটা ছেলে-মেয়েকে প্রাইভেট পড়িয়ে ছোট ভাইকে এখনো পড়াচ্ছে। সব দিন চুলোও জ্বলে না। বাপ হয়ে শুয়ে শুয়ে এইসব দেখতে হচ্ছে। আড়াই বিঘা জমি বেচে বড় ছেলেকে কুয়েত পাঠিয়েছিলাম। তারপর আরো আড়াই বিঘা জমি বেচে নিজের চিকিৎসা করিয়েছি। বাস্তু আর পুকুরটা ছাড়া কিছু নেই। পুকুরটা বেচেই দিতাম, যদি পুকুর ব্যবহার করতে না দেয়, তা হলে আমরা যাব কোথায় ভেবে বেচিনি। এমন সময় আসমাকে চা হাতে আসতে দেখে চুপ করে গেলেন।

আসমা এক কাপ চা ও একটা পিরিচে খান চারেক বিস্কুট এনে রিয়াজুলকে বলল, নিন চা খান। তারপর আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমিই তো বলেছ হাদিসে আছে, সংসারের অভাব অনটনের কথা কাউকে জানাতে নেই।

মোসারেফ হোসেন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, হাদিসটা মনে ছিল না মা। তা ছাড়া রিয়াজুলকে ঘরের ছেলে মনে করে বলে ফেলেছি।

আসমা রিয়াজুলের দিকে চেয়ে বলল, দীর্ঘ দিন অসুখে ভুগে আব্বার মাথা ঠিক নেই। আপনি কিছু মনে করবেন না।

মোসারেফ হোসেনের কথা শুনতে শুনতে রিয়াজুলের চোখে পানি এসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল, না কিছু মনে করিনি। বন্ধুর ছেলে নিজের ছেলের মতো। সেই কথা ভেবে বলেছেন। ওঁর দোষ ধরা তোমার উচিত হয়নি। তারপর চা খেয়ে বলল, এখন আসি চাচা। অনেক বেলা হয়ে গেছে। ছোট চাচা তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছেন।

মোসারেফ হোসেন বললেন, আবার এস।

 জ্বি আসব। তারপর সালাম বিনিময় করে রিয়াজুল সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

আসমাও যে তার পিছন পিছন পুকুর পাড় পর্যন্ত এল, তা রিয়াজুল জানতে পারল না। যতক্ষণ তাকে দেখা গেল ততক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঘরে ফিরে এল।

.

০৪.

ফেরার পথে হঠাৎ রিয়াজুলের মনে হল, আসমার মায়ের সঙ্গেও পরিচয় করা উচিত ছিল। ভেবে রাখল, আবার যখন যাবে তখন করবে।

ঘরে এলে সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, এত দেরি করলে কেন? তোমাকে নিয়ে ব্যাংকে যাব বলে অপেক্ষা করছি।

রিয়াজুল বলল, এত তাড়া কিসের? কাল যাওয়া যাবে।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, কাল ব্যাংকের কাজ সেরে তোমার ফুফুর বাড়ি যাব। সেটেলমেন্ট অফিসে খোঁজ নিয়ে জেনেছি দু’চার দিনের মধ্যে আমাদের এলাকার জমি রেকর্ড করা হবে। এর মধ্যে তোমার ফুফুর সঙ্গে পরামর্শ করে তার বড় ছেলে রফিককে নিয়ে তোমরা ঐদিন অফিসে থাকবে।

রিয়াজুল বলল, তার আগে আপনাকে নিয়ে আমি বড় চাচার সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাই। আপোষে মিমাংসা হলে শুধু শুধু বিবাদ করা কি উচিত হবে? তা ছাড়া মানি লোকের মান নষ্ট করতে আমাদের নবী (দঃ) নিষেধ করেছেন। আর একটা কথা চিন্তা করেছেন? আমি যদি সবার সামনে বড় চাচাকে অপমান করি, তা হলে উনি ভাববেন, এর পিছনে আপনি আছেন। তখন আপনার সঙ্গেও বিবাদ হবে। আমি আপনাদের মধ্যেও বিবাদ বাধাতে চাই না।

আমি বড় ভাইকে বলেছিলাম; কিন্তু তিনি আমার কথা নেননি। তবু তোমার প্রস্তাবে আমি রাজি।

আমার মনে হয় ফুফা-ফুফু সঙ্গে থাকলে আরো ভালো হবে।

রিয়াজুলের ধর্মীয় জ্ঞান ও বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে সামসুদ্দিন মিয়া খুশি হলেন। বললেন, তুমি খুব ভালো কথা বলেছ। কালই আমরা তোমার ফুফুদের ওখানে যাব।

একসময় খায়রুন্নেসা স্বামীকে বললেন, আমিও বড় ভাসুরের সঙ্গে মনোমালিন্য চাই না। রিয়াজুলের সব কথা আমার খুব পছন্দ, তুমি ওর কথামতো কাজ করো।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, তাতো করবই। ও মেজ ভাইয়ের মতো খুব বুদ্ধিমান হয়েছে।

পরের দিন সামসুদ্দিন মিয়া রিয়াজুলকে নিয়ে ব্যাংকে গেলেন। পঁচিশ বছরের ফসল বিক্রির টাকা অনেক জমে ছিল। তার নামে একাউন্ট খুলে সেখানে পুরো টাকাটা ট্রান্সফার করে দিলেন।

ব্যাংকের কাজ সারার সময় রিয়াজুল বেশ কিছু টাকা তুলল। ঘরে এসে বলল, আচ্ছা ছোট চাচা, আপনি বললেন, মোসারেফ হোসেন পঙ্গু হয়ে কয়েক বছর বিছানায় পড়ে আছেন, ফসলি জমি বিক্রি করে দিয়েছেন, তা হলে সংসার চলে কি করে?

সামসুদ্দিন মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সংসার তো আর থেমে থাকে না বাবা! যেভাবেই হোক চলে যায়। তবে খুব কষ্টের সঙ্গে চলছে। ওঁর স্ত্রী খুব পর্দানশীন। কারও সামনে বার হন না। বড় মেয়েটা খুব চৌকোষ। পুকুরের মাছ বিক্রি করে, পুকুর পাড়ে গাছপালার ফল-পাকাড়ি বিক্রি করে, ওঁর বড় মামাও কিছু কিছু সাহায্য করেন। এছাড়া দু’বেলা কয়েকটা ছেলে-মেয়েকে প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু আয় করে। এইভাবেই কোনোরকমে ঐ মেয়েটাই চালাচ্ছে।

আব্বার সঙ্গে উনার খুব ভাব ছিল, তাই না?

হ্যাঁ বাবা, তা ছিল। দু’জনের গলায় গলায় ভাব ছিল। যা কিছু করতেন একসঙ্গে করতেন! যেখানে যেতেন একসঙ্গে যেতেন। মেজ ভাই মারা যাওয়ার সময় মোসারেফ হোসেনের কান্না দেখে গ্রামের লোকজন তো অবাক। আমার মনে হয়েছে আপন ভাই হয়ে আমরা যতটা না দুঃখ পেয়েছি, তার থেকে বেশি উনি পেয়েছেন। তাই মেজ ভাইয়ের কথা স্মরণ করে আমি মাঝে মাঝে তার সঙ্গে দেখা করি। তিনিও আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেন। পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পর অমিও তাকে কিছু কিছু সাহায্য করি।

হাদিসে পড়েছি, পিতার বন্ধু পিতার মতো সম্মানীয়। পিতার বন্ধুকে সম্মান করা মানে পিতাকে সম্মান করা। তাই তার এই দুর্দিনে আমি তাকে সাহায্য করতে চাই।

এটা তো খুব ভালো কথা। এমনি তো যে কোনো অসহায় মানুষকে সাহায্য করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) খুশি হন। আর উনি তোমার আব্বার বন্ধু।

আমি কাল মোসারেফ হোসেন চাচার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সবকিছু দেখে শুনে আমার খুব দুঃখ লাগল। তারপর এক হাজার টাকা ছোট চাচার হাতে দিয়ে বলল, এটা আপনি আজই তাঁকে দেবেন।

তুমি নিজের হাতে দিলে ভালো হত না? উনি খুশি হতেন।

তা হতেন, তবু এই টাকাটা আপনি দেবেন। এই টাকায় তো ওঁদের অভাব দূর হবে। তাই আমি চিন্তা ভাবনা করে এমন কিছু করতে চাই, যাতে এক বেলা এক সন্ধ্যে খেয়ে পরে ওঁদের চলে যায়। ছোট ছেলেটাও লেখাপড়া করে মানুষ হয়।

তোমার কথা শুনে খুশি হলাম। কিন্তু বাবা, তুমি যা করতে চাচ্ছ তা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমন প্রচুর টাকা পয়সারও দরকার।

তা আমি জানি। তবু আব্বার বন্ধু হিসাবে আমি কিছু করবই ইনশাআল্লাহ। আর ভালো কাজে ঝুঁকি তো থাকবেই। আল্লাহ ও রাসুল (দঃ) কে খুশি করার জন্য বিপদকে আমি ভয় করি না। হাদিসে পড়েছি এরকম কাজে বিপদে পড়লে আল্লাহ সাহায্য করেন। আপনার কাছ থেকে শুধু সহযোগিতা পেতে চাই।

ইনশাআল্লাহ আমি তোমাকে নিশ্চয় সহযোগিতা করব। একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞেস করে পারছি না, আমি তো জানি তুমি মাদ্রাসায় পড়নি স্কুল কলেজে পড়েছ কোরআন হাদিসের এত জ্ঞান তোমার হল কি করে?

রিয়াজুল মৃদু হেসে বলল, কলেজে পড়ার সময় একটা ছেলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। সে তাবলীগ করত। এখনো করে। কয়েকটা চিল্লাহ্ দিয়েছে। তার সঙ্গে মিশে আমি ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ি। লেখাপড়ার সাথে সাথে কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে শুরু করি। দু’তিনটে চিল্লাও দিয়েছি। চিল্লাতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা পড়লে শুধু ধর্মীয় জ্ঞান বাড়ে এবং তা মেনে চলার প্রেরণাও আসে, কিন্তু জামাতের সঙ্গে চিল্লাতে গেলে সেই প্রেরণা হাজার গুণ বেড়ে যায়। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, সময় সুযোগ করে চিল্লাতে যাওয়া। আপনি কি কখনও গিয়েছেন?

না বাবা যাইনি, তবে তাবলীগ জামাতের সঙ্গে ওঠা বসা করে বুঝতে পেরেছি, চিল্লাতে গেলে চরিত্রের সংশোধন হয়। ধর্মের পথে, সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার প্রেরণা পাওয়া যায়।

খায়রুন্নেসা বিবি এতক্ষণ রান্না করছিলেন। রান্নার কাজ শেষ করে তাদের কাছে এসে বললেন, তোমরা এখনও কথা বলছ? কত বেলা হয়েছে খেয়াল আছে? এক্ষুণি যোহরের আজান হবে। যাও গোসল করে এস।

মাগরিবের নামায পড়ে সামসুদ্দিন মিয়া মোসারেফ হোসেনের বাড়িতে গেলেন।

বছর দুই আগে গ্রামে বিদ্যুৎ এলেও মোসারেফ হোসেন নিতে পারেননি। হমুদা বিবি লম্ফ জ্বালিয়ে রান্নাঘরে রান্না করছেন। সালেহা মাকে সাহায্য করছে। আসমা বারান্দায় পাটি বিছিয়ে হারিকেনের আলোতে দুই ভাই বোনকে পড়াচ্ছে।

সামসুদ্দিন মিয়া উঠোনে এসে বললেন, কই গো আসমা, তোমরা কি করছ?

হারিকেনের আলোর কাছ থেকে দূরের কিছু দেখা যায় না। আসমা গলা শুনে বুঝতে পারল, সামসুদ্দিন চাচা এসেছেন। উঠোনের দিকে তাকিয়ে বলল, এদের পড়াচ্ছি, আপনি আসুন চাচা। তারপর এগিয়ে এলে সালাম দিল।

সামসুদ্দিন মিয়া সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কয়েক দিন আসতে পারিনি। তোমার আব্বা কেমন আছেন?

ঐ একই রকম, আসুন বলে আসমা তাকে সঙ্গে করে রুমে এসে বলল, আব্ব মিয়া বাড়ির ছোট চাচা এসেছেন। তারপর চেয়ারটা খাটের কাছে এগিয়ে দিয়ে সামসুদ্দিন মিয়াকে বলল, বসুন চাচা।

সামসুদ্দিন মিয়া মোসারেফ হোসেনের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বললেন, চিকিৎসা তো অনেক করালেন, আগের থেকে কিছু উন্নতি হচ্ছে বলে মনে হয়?

মোসারেফ হোসেন একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কই আর উন্নতি হল, এখনও নিজে উঠে বসতে পারি না। আমার কথা বাদ দিন, আপনারা কেমন আছেন বলুন?

আল্লাহর রহমতে আমরা ভালো আছি। তারপর টাকাটা পকেট থেকে বার করে বালিশের নিচে রেখে বললেন, এখানে এক হাজার টাকা আছে। মেজ ভাইয়ের ছেলে রিয়াজুল পরশু এসেছে। রাত্রে আমার কাছে আপনার ও মেজ ভাইয়ের বন্ধুত্বের কথা ও আপনার ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা শুনে সকালের দিকে আপনাকে দেখতে এসেছিল। এই টাকাটা আপনার চিকিৎসার জন্য সে-ই দিয়েছে। রিয়াজুল কলেজ ভার্সিটিতে পড়লেও ধর্মীয় জ্ঞানও অর্জন করেছে। টাকাটা দিয়ে আমাকে বলল, আব্বার বন্ধু আব্বার মতোই সম্মানের পাত্র। তার বিপদে সাহায্য করা আমার কর্তব্য। আমি বললাম, টাকাটা তুমি দিলে উনি খুশি হবেন। বলল, পরে না হয় আমি দেব। আজ আপনি দিয়ে আসুন।

মোসারেফ হোসেনের কান্নায় গলা বুজে এল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বললেন, এমনই ত্বকদিরের লিখন, আপনাদের দয়ার উপর বেঁচে থাকতে হচ্ছে। তার ভেদ তিনিই জানেন। কথা শেষ করে চোখ মুছলেন।

হ্যাঁ ভাই আল্লাহর ভেদ বোঝা মানুষের অসাধ্য। কার তকদিরে কি আছে তা তিনিই জানেন। আপনি ধৈর্য ধরুন, কাঁদবেন না। তাঁরই ইশারায় ইনশাআল্লাহ আপনার বিপদ একদিন দূর হবে। আপনি সুস্থ হয়ে উঠে আবার সংসারের হাল ধরবেন। আল্লাহর উপর ভরস করে তাঁর দরবারে ফরিয়াদ করুন। তিনি বিপদ দিয়েছেন আবার তিনিই উদ্ধার করবেন। আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের কঠিন বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। ধৈর্যহারা হলে পরীক্ষায় উত্তির্ণ হতে পারবেন না।

হা ভাই রিয়াজুলও কোরআন পাকের ঐ কথা বলে বুঝিয়ে গেছে। আমি আল্লাহর উপরই ভরসা করে সব সময় ফরিয়াদ করি। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, রিয়াজুল দেখতে ঠিক ওর আব্বার মতো হয়েছে তাই না ছোট মিয়া?

আপনার কথা ঠিক। শুধু দেখতেই নয়। মনটাও মেজ ভাইয়ের মতো। আল্লাহ ওকে কামিয়াব করুন। আপনিও ওকে দোয়া করবেন।

নিশ্চয় করব ভাই নিশ্চয় করব। মাঝে মাঝে আসতে বলবেন, ওকে দেখলে মনে হয়। আমার বন্ধুকে দেখছি।

ঠিক আছে বলব। তবে আমার মনে হয় আমি না বললেও আসবে। এবার আসি হলে?

আসমা তাকে বসতে দিয়ে রান্নাঘরে চা করতে গিয়েছিল। চা নিয়ে ফিরে এসে বলল, চা খেয়ে যাবেন চাচা।

তুমি আবার চা করতে গেলে কেন? ঠিক আছে দাও, এনেছ যখন খেয়েই যাই।

সামসুদ্দিন মিয়া চলে যাওয়ার পর মোসারেফ হোসেন মেয়েকে বললেন, তোর মাকে ডেকে নিয়ে আয় তো মা।

আসমা মাকে ডেকে নিয়ে এল।

মোসারেফ হোসেন তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, সকালের দিকে আমার বন্ধুর ছেলে রিয়াজুল যে এসেছিল, সে কথা তোমরা জান। ছেলেটা শুধু শিক্ষিত নয় ধার্মীকও। বাবার বন্ধুর দুরাবস্থার কথা জেনে ছোট চাচার হাতে এক হাজার টাকা চিকিৎসা করার জন্য পাঠিয়েছে। আর কি বলেছে জান? বাবার বন্ধু বাবার সমান। তাকে সম্মান করা মানে বাবাকে সম্মান করা। তুমি দেখো আসমার মা, রিয়াজুল জীবনে উন্নতি করবেই। তারপর বালিশের তলা থেকে টাকাটা বার করে আসমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, এটা তুলে। রাখ।

মাহমুদা বিবি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আল্লাহ ওকে সুখি করুন। তোমার মুখে শুনেছিলাম সে ঢাকায় খালার কাছে মানুষ হচ্ছে। ও কী এখন গ্রামেই থাকবে?

তা জিজ্ঞেস করিনি, আবার এলে করব।

আসমা টাকাটা আলমারীতে রেখে এসে বলল, সেদিন আমাকে বললেন, বেশ কিছুদিন থাকবেন। তারপর যাই ওদেরকে পড়াই বলে আসমা বেরিয়ে এসে ভাইবোনের কাছে বসল।

ঘরে ফিরে সামসুদ্দিন মিয়া রিয়াজুলকে বললেন, তুমি টাকা দিয়েছ শুনে মোসারেফ হোসেন খুব খুশি হয়েছেন। তোমাকে অনেক দোয়া করে বললেন, মাঝে মাঝে আসতে বলবেন! ওকে দেখলে মনে হয় যেন আমার বন্ধুকে দেখছি। ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?

না, দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে চলে এসেছি। এবারে গেলে পরিচয় করব।

উনি খুব পর্দানশীন। তোমার সামনে আসবে বলে মনে হয় না।

এটা তো খুব ভালো কথা। এরকম মেয়েদের কথা আজকাল তো শোনাই যায় না। আল্লাহ পাকের একমাত্র নেক বান্দিরাই পর্দানশীন হয়ে থাকেন।

.

০৫.

তানজিলার বিয়ে হয়েছে জয়নগর থেকে প্রায় সাত আট মাইল দূরে জামতলা গ্রামে। যাতায়াতের জন্য ভালো রাস্তা নেই। তাই কোনো যানবাহন চলাচল করে না। বর্ষাকালের চার মাস ছাড়া শীত ও গ্রীষ্মের সময় অল্প কিছু রিক্সা চলাচল করে। আর গরুর গাড়িতে করে উচ্চ পরিবারের লোকজন ও মেয়েরা যাতায়াত করে। তবে যাদের হাঁটার ক্ষমতা আছে, তারা হেঁটেই যাতায়াত করে। কারণ গ্রামের এবড়ো থেবড়ো মাটির রাস্তায় রিক্সা ও গরুর গাড়ির আঁকুনী খেয়ে মানুষের কোমর ব্যাথা হয়ে যায়। আবার অনেকের মাথা ধরে যায়। কেউ কেউ বমিও করে দেয়। তবে এসব এলাকায় বর্ষাকালে যাতায়াতের খুব সুবিধা। মাঠ ঘাট পানিতে ডুবে গেলে নৌকা করে একেবারে গন্তব্য স্থানে যাওয়া যায়। এখন গ্রীষ্মকাল। তাই ছোট চাচার মুখে যানবাহনের দুরাবস্থার কথা শুনে রিয়াজুল তার সঙ্গে হেঁটে জামতলা রওয়ানা দিল। প্রায় আড়াই ঘন্টা পর ফুফুর বাড়ি এসে পৌঁছাল। এত রাস্তা সে কোনোদিন হাঁটেনি। বেশ কষ্ট অনুভব করল।

আলাপ পরিচয়ের পর রিয়াজুল ফুফা-ফুফুকে কদমবুসি করল।

তানজিলা ভাইপোকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদলেন। তারপর চোখ মুখ মুছে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সামসুদ্দিন মিয়া সবাইকে নিয়ে জমি রেকর্ড করাবার কথা তুলে রিয়াজুলের মতামত বললেন।

স্ত্রী কিছু বলার আগে আকবর হোসেন বললেন, রিয়াজুল খুব ভালো কথা বলেছে। আমার মনে সেটা করাই সর্বোত্তম।

স্বামী থেমে যেতে তানজিলা বলল, আমিও তোমার সাথে একমত। কিন্তু বড় ভাই যদি রাজি না হন, তখন কি হবে?

কেউ কিছু বলার আগে রিয়াজুল বলে উঠল, আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আমার যতদূর ধারণা, ইনশাআল্লাহ কোরআন-হাদিসের কথা বলে বড় চাচাকে রাজি করাতে পারব।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, আল্লাহ তোমার চেষ্টা সফল করুন। তোমার ফুফু জানতে চাচ্ছেন, একান্তই যদি রাজি না হন তা হলে কি করবে?

রিয়াজুল দৃঢ় কণ্ঠে বলল, তা হলে আপনারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেই মতো আমি ও রফিক হাকিমের কাছে বড় চাচার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব।

সামসুদ্দিন মিয়া বললেন, বেশ তাই হবে।

ফুফুর বাড়ি দু’দিন থেকে পরের দিন দুপুর নাগাদ ফুফু ও রফিককে নিয়ে রিয়াজুল ৬ সামসুদ্দিন মিয়া জয়নগর ফিরে এল।

বিকেলে আসরের নামায পড়ে রিয়াজুল আসমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। পুকুর পাড়ের কাছে এসে আমাকে একটা ছেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

ছয় মাস পর পনের দিনের ছুটি পেয়ে মতি গতকাল রাত নটার সময় এসে আজ আসমাদের খোঁজ-খবর নিতে এসেছিল। চাচার হাতে দু’শো টাকাও দিয়েছে।

ফিরে আসার সময় আসমাও পুকুর পাড় এসে মতির কাছ থেকে ঢাকার গল্প শুনছিল। একসময় আসমা কয়েকদিন আগে বালিয়াকান্দি থেকে ফেরার সময় যে বিপদে পড়েছিল এবং কিভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার পেল, তা বলল।

মতি খুব রেগে গিয়ে বলল, চেয়ারম্যানের ছেলে বলে ইহসান বারবার অপকীর্তি করেও রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। তবে যিনি তোমাকে রক্ষা করেছেন, তার জায়গায় আমি হলে তাকে খুন করে ফেলতাম। আল্লাহ যদি সেদিন দেন, তা হলে আমি ওর হাত দুটো ভেঙ্গে দেব। তারপর বলল, যিনি তোমাকে উদ্ধার করেছিলেন তার পরিচয় বল, আমি তার সঙ্গে দেখা করব।

আসমা রিয়াজুলের পরিচয় বলল। তারপর আব্বার সঙ্গে তার যেসব কথাবার্তা হয়েছে, সেসব বলে বলল, চিকিৎসার জন্য আব্বাকে একহাজার টাকাও দিয়েছেন।

মতি খুব অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? তা হলে তো তিনি খুব ধার্মিক?

শুধু ধার্মিক নন, উচ্চ শিক্ষিতও।

উচ্চ শিক্ষিত ও ধার্মিক মানুষের মন খুব উদার হয়। আমি আজই তার সঙ্গে দেখা করব।

মতি ভাই, ভাবছি এ বছর পুকুরটা বিলি করব। তুমি খদ্দের দেখ।

 ঠিক আছে দেখব, এবার আসি। তারপর সালাম বিনিময় করে মতি চলে গেল।

রিয়াজুল এতক্ষন রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। মতি এগিয়ে এলে সালাম দিল।

সালামের উত্তর দিয়ে মতি বলল, আপনাকে তো চিনতে পারছি না?

আমি রিয়াজুল। মিয়া বাড়ির ছেলে। আমার বাবার নাম মরহুম সালাউদ্দিন মিয়া। ছোট বেলা থেকে ঢাকায় খালার কাছে মানুষ হয়েছি। কয়েকদিন হল এসেছি। আপনি?

মতি বুঝতে পারল, এর কথাই আসমা বলেছে। বলল, আমি এই গ্রামেরই ছেলে। ঢাকায় চাকরি করি। কাল এসেছি। মোসারেফ হোসেন আমার দূর সম্পর্কের চাচা হন। উনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। আপনার কথা কিছুক্ষণ আগে আসমার কাছে শুনলাম। আপনি তাকে পাষণ্ড চেয়ারম্যানের ছেলের হাত থেকে কয়েকদিন আগে রক্ষা করেছেন ও মোসারেফ চাচার চিকিৎসার জন্য সাহায্য করেছেন তা-ও শুনেছি। দেখা হয়ে ভালই হল। নচেৎ আমি নিজেই আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য যেতাম। এখন আসি, পরে আবার দেখা হবে। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

রিয়াজুল আসমাদের উঠোনে এসে আসমার নাম ধরে ডাকল।

আসমা ঘরে এসে আব্বা ও আম্মাকে এবছর পুকুর বিলি করার কথা বলছি। তার নাম ধরে কেউ ডাকছে শুনে মাকে বলল, তুমি এখান থেকে যাও, কে যেন আব্বার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তারপর বাইরে এসে রিয়াজুলকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, আপনি?

রিয়াজুল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?

বারে, বিশ্বাস হবে না কেন? কিছুক্ষণ আগে আব্বা আপনার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। বললেন, ছেলেটা তিন চারদিন এল না কেন বলতে পারিস?

তুমি কী বললে?

 বললাম, হয়তো কোনো কাজে ব্যস্ত আছেন।

মাহমুদা বিবি মেয়ে বলা সত্ত্বেও রিয়াজুলকে দেখার জন্য কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিলেন। প্রথম দিন তার মুখ দেখেননি। রিয়াজুলের গুণগান আসমা ও স্বামীর মুখে শুনে আজ না দেখে থাকতে পারলেন না।

আসমা মাকে আব্বার রুম থেকে বেরোতে দেখেনি। মাকে বেরোবার সময় দিয়ে রিয়াজুলের সঙ্গে বাইরেই কথা বলছিল। তবু যখন মাকে রুম থেকে বেরোতে দেখল না তখন রিয়াজুলকে বলল, একটু অপেক্ষা করুন, আসছি। তারপর আব্বার রুমে গিয়ে মাকে বলল, তুমি এখনো রয়েছ?

মাহমুদা বিবি ঘোমটা টেনে পাশের রুমে চলে গেলেন।

আসমা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রিয়াজুলকে আসতে বলল।

 রিয়াজুল রুমে ঢুকে সালাম দিয়ে বলল, চাচা কেমন আছেন?

মোসারেফ হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল্লাহর রহমতে একরকম আছি। তা তুমি কয়েকদিন আসনি কেন বাবা?

ছোট চাচার সঙ্গে ফুফুর বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আজ দুপুরের দিকে ফিরেছি।

তাই বল, আমি মনে করেছিলাম তোমার কোনো কিছু হল কিনা। তারপর বললেন, তোমার ফুফু খুব ভালো। তার স্বামী আকবর হোসেনও খুব ভালো। এখানে এলেই আমাকে দেখতে আসেন। জান বাবা, তোমার ফুফুর ঘটকালি আমিই করেছিলাম। তা ওরা সবাই ভালো আছে তো?

জ্বি ভালো আছেন। ফুফু ও ওঁর বড় ছেলে রফিক আমাদের সঙ্গে এসেছেন।

তাই নাকি! তানজিলাকে বলো আমাকে যেন একবার দেখা দিয়ে যায়।

জ্বি বলব। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আমি একটা আবদার করব, বলুন রাখবেন?

মোসারেফ হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার আবদার রাখার মতো ক্ষমতা আমার কী আছে বাবা? তবু তুমি বল, রাখার মতো হলে নিশ্চয় রাখব।

রিয়াজুল আসমাকে বলল, চাচি আম্মাকে এখানে নিয়ে এস।

আসমা জানে আম্মা রিয়াজুলের সামনে আসবে না। তাই ইতস্ততঃ করতে লাগল।

রিয়াজুল বলল, কই নিয়ে এস।

মোসারেফ হোসেন মেয়ের ইতস্তত করার কারণ বুঝতে পেরে বললেন, কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর মাকে নিয়ে আয়।

আসমা বাইরে এসে দেখল, মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল, আব্বা যেতে বললেন। তুমি ঘোমটা দিয়ে চল। তা হলে কোনো গোনাহ হবে না।

মাহমুদা বিবি লম্বা ঘোমটা দিয়ে ভিতরে এসে স্বামীর পায়ের দিকে দাঁড়ালেন।

রিয়াজুল সালাম দিয়ে প্রথমে মোসারেফ হোসেনকে ও পরে মাহমুদা বিবিকে কদমবুসি করে ভিজে গলায় বলল, আমি মা-বাবা কি জিনিস জানি না। ছোট বেলা থেকে খালা খালুকে মা-বাবা জেনে এসেছি। এমন কি এখানে আসার কিছুদিন আগে পর্যন্ত নিজের মা-বাবার কথা জানতাম না। এখানে এসে ছোট চাচার কাছে আপনাদের পরিচয় পেয়ে মনে হয়েছে আল্লাহ মা-বাবাকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলেও আপনাদেরকে আমার মা-বাবা করে রেখেছেন। আমাকে কী আপনারা ছেলে হিসাবে গ্রহণ করবেন না?

রিয়াজুলের কথা শুনে মোসারেফ হোসেন ও মাহমুদফা বিবি অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। আর আসমা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। সালেহা পাশের রুমে ছিল। বুবু যখন রিয়াজুলের সঙ্গে কথা বলছিল তখন জানালা দিয়ে তাকে দেখছিল। রিয়াজুল ঘরে ঢুকে যেতে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। মা রুমে ঢুকলেও সে ঢুকেনি। সেও রিয়াজুলের কথা শুনে ভীষণ অবাক হল।

রিয়াজুল চোখ মুছে বলল, আপনারা কিছু বলছেন না কেন?

মোসারেফ হোসেন কান্না সামলাতে পারলেন না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, কি আর বলব বাবা, আমাদের বড় ছেলেকে আল্লাহ তুলে নিয়ে তোমাকে পাঠিয়েছেন। শুধু ছেলে হিসাবে নয় আল্লাহর দান হিসাবেও গ্রহণ করব। এযে আমাদের কতবড় ভাগ্য তা আল্লাহপাকই জানেন। তারপর আসমাকে বললেন, সালেহা ও জাহিদকে ডেকে নিয়ে আয়।

আসমা রুমের বাইরে এসে সালেহাকে দেখে বলল, জাহিদ কোথায়?

সালেহা বলল, বোধ হয় খেলতে গেছে।

তুই আমার সঙ্গে আয় বলে আসমা তাকে নিয়ে রুমে ঢুকে আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, জাহিদ খেলতে গেছে।

মোসারেফ হোসেন বললেন, রিয়াজুল তোদের বড় ভাইয়ের মতো, সালাম কর।

আসমা ও সালেহা একে একে সালাম করল।

রিয়াজুল মাথায় হাত ছুঁয়ে চুমো খেয়ে বলল, তোমাদের বড় ভাইয়ের হক আদায় করার তওফিক আল্লাহ আমাকে যেন দেন। তারপর আসমাকে জিজ্ঞেস করল, সালেহা কী আর স্কুলে যায় না?

না।

সামনেই জানুয়ারী মাস। সেই সময় ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিও। টাকার জন্য চিন্তা করে না। আবার জিজ্ঞেস করল, চাচাকে কোন্ ডাক্তার চিকিৎসা করছেন?

ডাক্তারের নাম বলে আসমা বলল, টাকার অভাবে প্রায় একবছর চিকিৎসা বন্ধ। টাকা হাতে এলে মাঝে মাঝে আগের প্রেসক্রিপসানের ঔষধ নিয়ে আসি।

ঠিক আছে, আমি ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করে যা করার করব। প্রয়োজন হলে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাব। তারপর মাহমুদা বিবির দিকে তাকিয়ে বলল, চাচি আম্মা আপনারা দোওয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমার মনের বাসনা পূরণ করেন।

মাহমুদা বিবি সবকিছু শুনে ঘোমটার ভিতর চোখের পানি ফেলছিলেন। চোখ মুছে বললেন, আল্লাহ তোমাকে আমাদের উপর রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছেন। তার দরবারে জানাই হাজার হাজার শুকরিয়া। তিনি তোমাকে হায়াতে তৈয়েবা দান করুন। তোমার মনের নেক মকসুদ পূরণ করুন। তোমাকে সুখি করুন।

রিয়াজুল বলল, এখন আসি মাগরিবের সময় হয়ে আসছে।

 মোসারেফ হোসেন বললেন, একটু চা খেয়ে গেলে হত না বাবা?

না চাচা, নামাযের দেরি হয়ে যাবে। তারপর সালাম বিনিময় করে আসমাকে বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস।

পুকুর পাড়ে এসে বলল, আমি যখন আসি তখন যে ছেলেটার সঙ্গে তুমি কথা বলছিলে তার সঙ্গে পরিচয় হল। কে হয় তোমাদের?

আসমা থতমত খেয়ে কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না। সামলে নিয়ে বলল, দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই, মতি। আত্মীয়দের মধ্যে ও-ই আমাদের খোঁজ-খবর নেয়। মাস ছয়েক আগে চাকরী পেয়ে ঢাকায় চলে গিয়েছিল। কাল এসে আমাদের খবর নিতে আজ এসেছিল।

মতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা জানার জন্য জিজ্ঞেস করল, অতক্ষণ ধরে কি কথা বলছিলে?

এই পুকুরটা এ বছর বিলি করব। তাই গ্রাহক দেখার কথা বলছিলাম।

তা আর করো না। যা করার আমিই করব ইনশাআল্লাহ। তারপর বলল, চাচা-চাচি যখন ছেলে বলে গ্রহণ করেছেন তখন তোমরাও নিশ্চয় বড় ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে?

আমি তো সেই প্রথম দিনেই করেছি।

তা হলে ভাইয়া বলে ডাকনি কেন?

লজ্জায়, তবে আব্বা আজ ভাঙ্গিয়ে দিয়েছেন।

এমন সময় জাহিদকে পাশ কেটে চলে যেতে দেখে আসমা বলল, এই জাহিদ শোন।

মাহমুদা বিবি ছেলেমেয়েদের আদব কায়দা শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছেন। বড়দের সঙ্গে দেখা হলে সালাম দিতে শিখিয়েছেন। বড়রা যখন কথা বলবে তখন ছোটদের সেখানে থাকা নিষেধ করেছেন। তাই বড় বুবুকে একজনের সঙ্গে কথা বলতে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। বড় বুবুর কথা শুনে দাঁড়িয়ে রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে সালাম দিল।

রিয়াজুল সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তুমিই তা হলে জাহিদ? খেলতে গিয়েছিলে বুঝি?

জ্বি।

ঠিক আছে যাও।

জাহিদ যেতে উদ্যত হলে আসমা বলল, ইনি আমাদের বড় ভাই, কদমবুসি কর।

জাহিদ অবাক হয়ে একবার রিয়াজুলের দিকে আর একবার আসমার দিকে তাকাতে লাগল।

কিরে কদমবুসি করতে বললাম না?

জাহিদ কদমবুসি করতে এগিয়ে এলে রিয়াজুল বসে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বলল, থাক তোমাকে আর কদমবুসি করতে হবে না। কোন ক্লাশে পড়?

সিক্সে।

রোল নাম্বার কত?

দুই।

আরো ভালো করে পড়াশোনা করবে, তা হলে এক নাম্বারে এসে পড়বে।

 জ্বি করব।

এমন সময় আজান শুনে জিজ্ঞেস করল, তুমি নামায পড়তে জান?

জ্বি জানি। কোরআনও পড়তে জানি। আম্মা শিখিয়েছেন।

তা হলে যাও কাপড় পাল্টে এস, মসজিদে যাবে।

 আপনি যান, আমি ঘরে পড়ব।

কেন?

আমার একটা লুঙ্গি, তার অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। তাই বড় বুবু ঘরে পড়তে বলেছে।

ঠিক আছে তুমি যাও, আমি তোমার বড় বুবুকে লুঙ্গি কিনে দিতে বলব।

জাহিদ আর কিছু না বলে চলে গেল।

জাহিদের কথায় আসমা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ছিল। রিয়াজুল বুঝতে পেরে বলল, আল্লাহর কী কুদরত দেখ আসমা, কারো আট দশটা জামা কাপড়, আবার কারো পরার উপযুক্ত একটাও নেই। কেউ উদ্বৃত্ত খাবার ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে, আবার কেউ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে।

আসমা বলল, আযান হয়ে গেছে, নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে না?

ও হ্যাঁ যাচ্ছি। তারপর আসি বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

আসমা ঘাট থেকে অযু করে ঘরে এস নামাযে দাঁড়াল।

মোসারেফ হোসেনের বারান্দাসহ টিনসেড দুই রুমের ঘর। একটায় স্বামী স্ত্রী থাকেন। অন্যটায় আসমা দুই ভাই-বোনকে নিয়ে ঘুমায়। বারান্দায় অর্ধেকটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে আসমা একটা রুম করেছে। সেখানে সে সকালে ও দুপুরের পর স্কুলের কয়েকটা ছেলে মেয়েকে প্রাইভেট পড়ায়।

রাত্রে ঘুমাবার সময় জাহিদ বলল, বড় বুবু, তখন যাকে বড় ভাই বলে কদমবুসি করতে বললে, সে কে? কই তাকে তো আগে কখনও দেখিনি?

আসমা বলল, মিয়া বাড়ির যে ছেলেটা তোর সঙ্গে পড়ে উনি তার বাবার মেজ চাচার ছেলে। ওঁর মা-বাবা ওঁকে খুব ছোট রেখে মারা গেছেন। সেই থেকে ঢাকায় খালার কাছে ছিলেন। কয়েকদিন হল এসেছেন। ওঁর বাবার সঙ্গে আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। এখানে এসে সে কথা জানতে পেরে আমাদেরকে আপন করে নিয়েছেন। ওঁর সঙ্গে দেখা হলে সালাম দিবি। কোনো রকম বেয়াদবি করবি না : তারপর সালেহার উদ্দেশ্য করে বলল, তুইও তাই করবি। তোকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দিতে বলেছেন।

জাহিদ বলল, আমরা ওঁকে কি বলে ডাকব?

 ভাইয়া বলে ডাকব।

উনি তোমাকে আমার লুঙ্গি কিনে দিতে বলেছেন?

হ্যাঁ বলেছেন। কাল মনোয়ার চাচাকে টাকা দেব, লুঙ্গি এনে দেবে।

.

০৬.

পরের দিন সকালে রিয়াজুল ফুফুকে নিয়ে বড় চাচাদের বাড়িতে গেল। সালাম ও কুশল বিনিময়ের পর নূরুদ্দিন মিয়া তানজিলার সঙ্গে তার স্বামীর বাড়ির খোঁজ নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতে লাগলেন।

একসময় রিয়াজুল বলল, বড় চাচা আমি কিছু আলাপ করতে চাই।

রিয়াজুল আসার পর থেকে নুরুদ্দিন মিয়া এরকমই আশা করেছিলেন। বললেন, বেশ তো কি আলাপ করতে চাও বল।

আমি আমার মরহুম আব্বার অংশের সম্পত্তি পেতে চাই।

বাবার সম্পত্তি নেবে, ভালো কথা। আমি সামসুদ্দিনের সঙ্গে আলাপ করে ব্যবস্থা করে দেব।

ছোট চাচার কাছে জানলাম, আব্বার সম্পত্তি আপনারা দু’ভাই নাকি ভাগ করে নিয়ে ভোগ দখল করছেন?

হ্যাঁ ঠিকই জেনেছ।

এত বছরের ফসলি জমির ফসল আপনারা নিশ্চয় বিক্রি করেছেন? সেই সব টাকা দেবেন না?

জমিতে ফসল তো আপনা-আপনি হয় না, প্রচুর খরচ করতে হয়।

তাতো হবেই। আপনারা খরচ করে চাষ করেছেন সেজন্যে ফসলের অর্ধেক পাবেন। বাকি অর্ধেক তো আমার পাওনা।

ঠিক আছে, এ ব্যাপারেও সামসুদ্দিনের সঙ্গে আলাপ করব।

এবার তানজিলা বলল, বড় ভাই, আমিও আমার অংশের সম্পত্তি পেতে চাই।

নূরুদ্দিন মিয়া রেগে উঠে বললেন, কেন? তোর আবার কিসের অভাব? আকবর হোসেন তোকে কি খোর-পোষ দিচ্ছে না?

হাজার দিলেও আমি আমার হক সম্পত্তি পেতে চাই।

এখন সম্পত্তি নিয়ে নিলে ভবিষ্যতে যদি তেমন কোনো বিপদে পড়িস, তখন কোথায় যাবি?

ভবিষ্যতের কথা আল্লাহ জানেন। আর সত্যিই যদি আমার ভাগ্যে তেমন কিছু ঘটে, তা হলে মনে রাখবেন, না খেতে পেয়ে মরে গেলেও আপনার কাছে এসে হাত পাতব না।

নূরুদ্দিন মিয়া রাগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, তুই যে সম্পত্তির দাবি করছিস, আকবর হোসেন জানে?

হা জানে।

জানতাম আকবর হোসেনের দীল ও দৌলত দু’টোই আছে। এখন জানলাম, দৌলত থাকলেও দীল নেই। তার দীল এত ছোট, কখনো ভাবিনি।

আল্লাহ তাকে দল-দৌলত দু’টোই দিয়েছেন। সে এই সম্পত্তি আশা করেনি। কিন্তু আমি আমার হক সম্পত্তি ছাড়ব কেন? আর আপনারাই বা দিতে চাচ্ছেন না কেন?

নূরুদ্দিন আরো রেগে গিয়ে বললেন, আমি কী বলেছি দেব না?

বড় চাচাকে রেগে যেতে দেখে রিয়াজুল বলল, বেয়াদবি নেবেন না, আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই।

নূরুদ্দিন মিয়া গম্ভীর স্বরে বললেন, বল কী বলবে।

রিয়াজুল বলল, আল্লাহ কোরআন পাকে বাবার সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়েদের অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এক ছেলে যা পাবে, এক মেয়ে পাবে তার অর্ধেক। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইয়েরা বোনদেরকে তাদের ন্যায্য সম্পত্তি থেকে নানান ছুতায় বঞ্চিত করে। এটা যে আল্লাহর আইনকে অমান্য করা হল, তা চিন্তা করে না। যারা একজনের হক সম্পত্তি না-হক করে ভোগ দখল করে, তাদেরকে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। এটাও কোরআন হাদিসের কথা। ইসলামের বিধান হল, বাবা মারা যাওয়ার পর ছেলেরা যখন সম্পত্তি ভাগ করে নেবে তখন মেয়েদের অংশও তাদের দিয়ে দিতে হবে। তবে কেউ যদি না নিয়ে স্বেচ্ছায় ভাইদের দিয়ে দেয়, তাতেও কোনো নিষেধ নেই। তবু তাদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দেওয়াই ভালো। কারণ ভবিষ্যতে বোনের ছেলে মেয়েরা মায়ের সম্পত্তি দাবি করতে পারে। তা ছাড়া আজকাল পুরুষরা মেয়েদেরকে মুল্যায়ন করছে না। তাদের প্রতি কর্তব্য আদায়ও করছে না। যার ফলে দিনের পর দিন সমাজে মেয়েদের মূল্য অনেক কমে যাচ্ছে। তারা পুরুষদের কাছ থেকে ন্যায্য অধিকার না পেয়ে তা আদায়ের জন্য রাস্তায় নেমে শ্লোগান দিচ্ছে, বিভিন্ন সভা সমিতি করছে। আবার অনেক এন.জি.ও.দের খপ্পরে পড়ে বেপর্দা হয়ে শালীনতা হারাচ্ছে। তাদেরকে অনুকরণ অনুসরণ করে ধর্মান্তরিতও হচ্ছে। একরকম পুরুষরাই তাদেরকে ঐ পথে যেতে বাধ্য করছে। মেয়েরা যদি তাদের ন্যায্য অধিকার তার স্বামীদের ও ভাইদের তথা পরিবারের সবার কাছ থেকে পেত, তা হলে তারা পথে নামত না। এবং ইসলামকে পরিত্যাগ করে এন.জি.ও.দের পাল্লায় পড়ত না। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর শালা-সম্বন্ধীরা বোনেদের হক দিচ্ছে না। তাই জামাই বা জামাই-এর বাবা-ভাইয়েরা বিয়ের সময় মোটা যৌতুক দাবি করছে। সব থেকে বড় অপরাধ পুরুষরা করছে, তারা মেয়েদেরকে তাদের অধিকার সম্বন্ধে অজ্ঞ করে রেখে বাদী-দাসীর মতো খাটাচ্ছে। তারা যে, পুরুষের অর্ধেক, তা স্বীকার না করে তাদের প্রতি ইতর প্রাণীর মতো ব্যবহার করছে। এর জন্য পুরুষদেরকে কাল কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহর কাছে জওয়াবদিহি করতে হবে। আমরা মুসলমান হয়েও ইসলামের তথা কোরআন-হাদিসের বিধান মতো ভাইয়েরা বোনেদের ন্যায্য সম্পত্তি না দিয়ে, স্বামীরা স্ত্রীদেরকে তাদের দেনমোহরের টাকা না দিয়ে জঘন্যতর অপরাধ করছি। যারা আল্লাহ, কবর ও হাসরকে বিশ্বাস করে ও ভয় করে, তারা কোনোদিন এইরূপ জঘন্য অপরাধ করতে পারে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, ডেথ ইজ ইমপেন্ডিং ওভার আওয়ার হেড। অর্থাৎ মৃত্যু আমাদের মাথার উপর ঝুলছে। যে কোনো সময়ে ফাঁসির রশির মতো গলায় চেপে ধরবে। তা সত্বেও আমরা মৃত্যু ভুলে, আল্লাহ ও তার রাসুল (দঃ) এর বাণী ভুলে দুনিয়াদারীর মোহে হাবুডুবু খাচ্ছি। দুনিয়াদারীর জন্য আমরা যে কোনো জঘন্যতর অপরাধ করাছ। অথচ শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হলে তার এক কানাকড়িও মূল্য থাকবে না। আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি, ফুফুর অংশ মতো সম্পত্তি তাকে দিয়ে দিন। আর একটা কথা, শুনলাম জমির রেকর্ড হচ্ছে। আপনারা দাদাজীর সম্পত্তি শুধু দু’ভাইয়ের নামে রেকর্ড করাচ্ছেন। আমার মরহুম আব্বার নাম ও ফুফুর নামে করাচ্ছেন না, এই কথাটা কী সত্য?

নূরুদ্দিন মিয়া খুব রেগে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কার কাছে শুনেছ?

মাফ করবেন, বলতে পারব না। কথাটা সত্য কিনা জানতে চাই।

নূরুদ্দিন মিয়া প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছেন, সামসুদ্দিন এদের পিছনে আছে। আরো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার বাবার সম্পত্তি তুমি পাবে, আর তানজিলাও তার সম্পত্তি পাবে। রেকর্ড নিয়ে তোমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে।

শুধু সম্পত্তি পেলে তো হবে না, রেকর্ড থাকতে হবে। নচেৎ ভবিষ্যতে বংশধরদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হবে।

তুমি ছেলে মানুষ। বিষয় সম্পত্তির জটিলতা বুঝবে না। ভবিষ্যতের যে বিবাদের কথা বললে, সব সম্পত্তিতে সবাইয়ের নাম লেখালে ভবিষ্যতে সেই বিবাদ আরো বেশি হবে। আমি আর এ ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বলতে পারি, তোমরা তোমাদের অংশ মতো সম্পত্তি পেয়ে যাবে।

বেয়াদবি নেবেন না, আমি ও ফুফু কিন্তু রেকর্ডে নাম লেখাতে চাই।

নূরুদ্দিন মিয়া রাগে ফেটে পড়লেন, ও…. তা হলে তোমরা ফুফু ভাতিজাতে যুক্তি করে এসেছ?

আপনি যা ইচ্ছা ভাবতে পারেন, আমরা কিন্তু নাম রেকর্ড করাবই।

 নূরুদ্দিন মিয়া তানজিলার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুইও কী তাই চাস?

 তুমি রেগে যাচ্ছ কেন বড় ভাই? রিয়াজুল তো উচিত কথা বলেছে।

ঠিক আছে পারলে লেখাস। তারপর সেখান থেকে চলে গেলেন।

রিয়াজুল ও তানজিলা সামসুদ্দিনের বাড়ি ফিরে এল।

এশার নামাযের পর নূরুদ্দিন মিয়া তিন ছেলেকে ডেকে সব কথা বলে বললেন, পঁচিশ বছর পর সালাউদ্দিনের ছেলে এসে যে ঝামেলা বাধাবে, তা কখনো ভাবিনি। এখন তোমরা কি সিদ্ধান্ত নেবে বল।

বড় ছেলে আলাউদ্দিন বাবার মতো হয়েছে। সে বলল, ঝামেলা বাধাবার আগে রিয়াজুলকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলেই তো সব ল্যাঠা চুকে যায়। আর ফুফুকে কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট করে দিলেই হবে।

নূরুদ্দিন মিয়া মেজ ও ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি বল?

মেজ কলিম উদ্দিন যেমন চালাক তেমনি কৃপণ। বলল, আমার মতে ফুফুর মতো রিয়াজুলকেও কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট করাই ভালো। খুন-খারাবি করার পক্ষে আমি নেই। এসব ব্যাপার চাপা থাকে না। থানা পুলিশ হলে কেলেঙ্কারীর শেষ থাকবে না। তা ছাড়া টাকা পয়সাও কম খরচ হবে না। তারপর রিয়াজউদ্দিনের দিকে চেয়ে বলল, তুই কি বলিস?

আলাউদ্দিন ও কলিমউদ্দিন ক্লাশ টেন পর্যন্ত পড়লেও পরীক্ষা দেয়নি। রিয়াজউদ্দিন বি.এ. পাশ করে হাইস্কুলে মাষ্টারী করে। বড় ভাইদের কথা শুনে সন্তুষ্ট হতে পারল না। বলল, আমার মনে হয়, ছোট চাচার সঙ্গে পরামর্শ করে যার যা অংশ তা দিয়ে দিলে কোনো ঝামেলাই থাকবে না।

নূরুদ্দিন মিয়া তিন ছেলেকে কিছু কিছু সম্পত্তি দিয়ে আলাদা করে দিয়েছেন। বড় ও মেজ গৃহস্থালী করে। আর ছোট স্কুলে শিক্ষকতা করে ও টিউশনী করে মোটা টাকা রোজগার করে। এর মধ্যে বেশ কিছু জমি জায়গাও কিনেছে। বড় ও মেজ তাকে হিংসা করে।

আলাউদ্দিন তার কথা শুনে জ্বলে উঠে বলল, তুই তো এই কথা বলবি। তোর তো কোনো অভাব নেই। অংশ মতো সব কিছু দিলে আমরা আর কতটুকু পাব। এখনই সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। সম্পত্তি দিয়ে দিলে উপোস করে মরতে হবে।

কলিমউদ্দিন বলল, হ্যাঁ বড় ভাই, তুমি ঠিক কথা বলেছ। রিয়াজউদ্দিন আছে নবাবী হালে। আমাদের কষ্ট বুঝবে কি করে?

রিয়াজউদ্দিন রেগে উঠে বলল, তোমরা উল্টো পাল্টা কথা বলছ কেন? আমার মতামত জানতে চেয়েছিলে বললাম। পছন্দ না হলে তোমরা তোমাদের মতলব মতো কাজ করবে তাতে আমার কী? তবে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমাকে জড়াবে না। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ, ছোট চাচার সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু সিদ্ধান্ত নেবেন না। কথা শেষ করে সেখান থেকে চলে গেল।

আলাউদ্দিন বলল, দেখলেন আব্বা, রিয়াজউদ্দিনের কত দেমাগ। আমাদেরকে বড় ভাই বলে গ্রাহ্য তো করলই না, এমন কি আপনাকেও করল না।

নূরুদ্দিন মিয়া রিয়াজউদ্দিনকে ছোট বেলা থেকেই স্বাধীনচেতা দেখে এসেছেন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে অনেক সময় তার অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেও দেখেছেন। তখন রেগে গেলেও প্রতিবাদ করেননি। আজও তার কথায় রেগে গিয়েও করলেন না। আলাউদ্দিনের কথা শুনে বললেন, রিয়াজউদ্দিনের স্বভাব তো তোমরা জান। তার কথা বাদ দাও। সামসুদ্দিনের সঙ্গে আমি আগে কথা বলে দেখি, তারপর যা করার তোমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে করব। এখন তোমরা যাও।

নূরুদ্দিনের স্ত্রী সায়মা বিবি এতক্ষণ আড়াল থেকে সবকিছু শুনছিলেন। ছেলেরা চলে যাওয়ার পর স্বামীর কাছে এসে বললেন, অনেক রাত হয়েছে খাওয়া দাওয়া করবে না? প্রতিদিন তো এশার নামাযের পর খাও। আজ খিধে পায়নি?

নূরুদ্দিন হাই তুলে বললেন, রিয়াজুল ঝামেলা বাধিয়ে খিধে মেরে দিয়েছে।

তার বাবার অংশ তাকে দিয়ে দিলেই তো ঝামেলা মিটে যায়।

তুমি মেয়ে মানুষ, সংসারের ঝামেলা শুধু বোঝ, সম্পত্তির ঝামেলায় নাক গলিও না। চল খেতে দেবে।

রিয়াজুল ও তানজিলা ফিরে এলে সামসুদ্দিন মিয়া তাদের কাছ থেকে সব কিছু শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগলেন।

রিয়াজুল বলল, চাচা কি এত ভাবছেন?

ভাবছি, বড় ভাই ডেকে পাঠালে কী বলব?

এতে ভাববার কি আছে? আপনি আপনার নিজস্ব মতামত বলবেন।

তাতো বলবই। আমি ভাবছি অন্য কথা।

 তানজিলা বলল, অন্য কী কথা ভাবছ বল না।

পরে বলব, এখন আমি একটু বেরোবো।

.

দু’দিন পর নূরুদ্দিন মিয়া চাকরের মারফত ছোট ভাইকে ডেকে পাঠালেন।

সামসুদ্দিন মিয়া গিয়ে সালাম দিল।

সালামের উত্তর দিয়ে নূরুদ্দিন মিয়া বসতে বলে বললেন, কাজটা তুমি ভালো করেনি। যাক, যা করেছ সে ব্যাপারে কিছু বললে তো আর কোনো লাভ হবে না। এখন বল, রিয়াজুল এসে তার বাবার সম্পত্তি চাচ্ছে, তার কি করবে?

ছেলে হিসাবে রিয়াজুল মেজ ভাইয়ের সব সম্পত্তির হকদার। তাকে তার বাবার সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়াই তো উচিত।

সে কিন্তু গত পঁচিশ বছরের তার বাবার সম্পত্তির ফসলের ভাগও চাচ্ছে।

চাইলে দিতে হবে।

এত বছরের ফসলের দাম কত হবে ভেবে দেখেছ? তা ছাড়া সব বছর তো সমান ফসল। হয়নি। কি হিসাবে দেব?

আমি প্রতি বছর মেজ ভাইয়ের জমির ফসল আলাদা হিসাব করে বিক্রি করে ব্যাংকে জমা রেখেছিলাম। রিয়াজুল আসার পর তাকে বুঝিয়ে দিয়েছি।

তোমার ছেলে মেয়ে নেই, ছোট সংসার, তাই পেরেছ। কিন্তু আমার তো বিরাট সংসার। সব খরচ করে ফেলেছি। কিভাবে অত টাকা এখন দেব?

সামসুদ্দিন জানে টাকা না দেওয়ার এটা একটা অসিলা। বললেন, সেটা আপনার ব্যাপার। যা ভালো বুঝবেন করবেন। তবে আমার মনে হয়, আপনি যতটা সম্ভব দিয়ে রিয়াজুলকে মানিয়ে নিতে পারেন। ও এলেমদার ছেলে। বড়দেরকে খুব সম্মান করে।

আমিও তাই ভেবেছি। আর একটা কথা, সে জমির রেকর্ডেও নাম লেখাতে চায়। আমি বলেছি তোমার বাবার সম্পত্তি তুমি পাবে। রেকর্ডে নাম লেখালে ভবিষ্যতে অসুবিধা হবে। কিন্তু সে আমার কথা মানতে রাজি নয়। তুমি ওকে বুঝিয়ে বললে হয়তো শুনবে।

রেকর্ডে ওর নাম লেখানোই তো উচিত। আপনি নিষেধ করছেন কেন? আর ভবিষ্যতে অসুবিধাই বা হবে কেন? বরং সুবিধাই হবে।

নূরুদ্দিন এবার রাগত স্বরে বললেন, তা হলে তুমিই রিয়াজুলকে আনিয়ে এই যুক্তি দিয়েছ? আর তানজিলাকেও আনিয়েছ?

যা কর্তব্য তাই করেছি। আমি চাই যে যা পায়, তাকে তা দিয়ে দিতে।

আমিও দেখে নেব কর্তব্য কতটা করতে পার। আর রিয়াজুল কী করে রেকর্ড করায় দেখব। এখন শোন, তানজিলাও সম্পত্তি চাচ্ছে। সে ব্যাপারে কি করবে?

তারটাও তাকে দিয়ে দিতে হবে।

ফসলি জমি না হয় দেওয়া যাবে, কিন্তু বাস্তু, পুকুর, ডোবা, আগান-বাগান ও গাছপালার অংশ কিভাবে দেবে?

সে সব ব্যাপারে তানজিলার সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাকে সন্তুষ্ট করে যা করার করতে হবে। আর সে যদি সব জায়গা থেকে দাবি করে, তা হলে তাই দিতে হবে।

ঠিক আছে তুমি এখন যাও। আর শোন, ওদেরকে নিয়ে বেশি নাচানাচি করো না।

নাচানাচি বলতে আপনি কি বোঝাতে চাচ্ছেন জানি না। তবে যার যা অংশ, তা দিয়ে দিতে চাই। কারণ আল্লাহর কাছে একদিন এজন্যে জবাবদিহি করতে হবে। তারপর সালাম বিনিময় করে সামসুদ্দিন সেখান থেকে চলে এলেন।

ঘরে এসে বড় ভাইয়ের সঙ্গে যা কিছু কথাবার্তা হয়েছে সবাইকে বললেন।

রিয়াজুল বলল, কিছুক্ষণ আগে আপনার কাছে মনোয়ার নামে একজন লোক এসেছিলেন। আপনাকে দেখা করতে বলে গেলেন। তারপর জিজ্ঞেস করল, লোকটা কে ছোট চাচা?

মনোয়ার তোমার মোসারেফ চাচার চাচাতো ভাই। গরিব হলে কি হবে, খুব ভালো লোক। তোমার আব্বার সঙ্গে খাতির ছিল। ওকেই সেটেলমেন্ট অফিসের খোঁজ খবর রাখতে বলেছি। হয়তো কিছু খবর দিতে এসেছিল। যাই দেখা করে আসি।

রিয়াজুল বলল, আমি গেলে কোনো অসুবিধা আছে?

অসুবিধা আবার কিসের, চল যাই। বলে রওয়ানা দিলেন।

মনোয়ার হোসেনের ঘরের কাছে গিয়ে সামসুদ্দিন মিয়া তার নাম ধরে ডেকে বললেন, ঘরে আছ নাকি?

মনোয়ার হোসেন ঘরে ছিল। বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, একে তো চিনতে পারছি না?

 সাসমুদ্দিন মিয়া বললেন, ভালো করে দেখো দেখি, চিনতে পার কিনা।

মনোয়ার হোসেন কয়েক সেকেন্ড রিয়াজুলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন, মেজ মিয়া ভাইয়ের সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে।

হ্যাঁ তুমি ঠিকই ধরেছ। ও মেজ ভাইয়ের ছেলে রিয়াজুল। ওর কথাই তো তোমাকে কয়েকদিন আগে বলেছি।

মনোয়ার হোসেন বললেন, আসুন ঘরে এসে বসুন কথা আছে। তারপর তাদের নিয়ে ঘরের বারান্দায় খেজুর পাটি পেতে বসতে দিয়ে নিজেও বসলেন।

সামসুদ্দিন মিয়া বসে বললেন, এবার বল, কি বলবে।

মনোয়ার হোসেন বললেন, আজ সেটেলমেন্ট অফিসে গিয়েছিলাম, কাল আপনাদের জমি রেকর্ড হবে। তারপর কিভাবে কি করতে হবে সামসুদ্দিন মিয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে রিয়াজুলকে বুঝিয়ে দিল।

.

সেটেলমেন্ট অফিস পাশের গ্রাম সোনাপুরে বসেছে। এই গ্রামেই চেয়ারম্যান আলি আসগরের বাড়ি। পরের দিন বেলা দশটার দিকে রিয়াজুল কি করতে হবে রফিককে বুঝিয়ে বলে সেটেলমেন্ট অফিসে গেল।

অফিস রুমটা বেশ বড়। লোক গিজগিজ করছে। রিয়াজুল রফিককে নিয়ে পিছনের দিকে দাঁড়াল। হাকিম সাহেব যখন দাগ ও খতিয়ান নাম্বার বলে অংশীদারের নাম জানতে চাইলেন তখন নূরুদ্দিন মিয়া নিজের নাম ও ছোট ভাই সামসুদ্দিন মিয়ার নাম বললেন।

হাকিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনার আর কোনো ভাই বা বোন নেই?

নূরুদ্দিন মিয়া বললেন, না।

ঠিক তখনই রিয়াজুল বলল, জ্বি হুজুর আছে।

রিয়াজুলের কথা শুনে লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন উঠল।

হাকিম সাহেব সবাইকে থামতে বলে রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি?

রিয়াজুল বলল, আমি নূরুদ্দিন ও সামসুদ্দিন মিয়ার মেজ ভাই মরহুম সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে। আমি আমার মায়ের পেটে থাকতে উনি মারা গেছেন। তারপর রফিককে দেখিয়ে বলল, এ আমার ফুফাতো ভাই। আমার ফুফু বেঁচে আছেন। তিনিও অংশীদার। তার নাম তানজিলা বেগম।

হাকিম সাহেব নাম লিখে নিয়ে নূরুদ্দিন মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কী বড় মিয়া, আপনি জ্ঞানী-গুনী, তার উপর মাতবর মানুষ হয়ে এরকম কাজ করতে পারলেন?

রিয়াজুল যে তাকে এতবড় অপমান করবে নূরুদ্দিন মিয়া কল্পনাও করেননি। রাগে ও লজ্জায় মাথা নিচু করে ঘরে ফিরে এসে ছেলেদের ডেকে ঘটনাটা বলে বললেন, ওকে আমি বন্দুক দিয়ে গুলি করে শেষ করে দেব। ও আমার মান ইজ্জত ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ব্যাটা ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি। ফাঁদে ফেলে ব্যাটাকে কি করি বুঝবে।

রিয়াজুল ছোট চাচার কাছ থেকে সমস্ত সম্পত্তির দাগ ও খতিয়ান নাম্বার নিয়ে সবগুলোতে তার মরহুম বাবার ও ফুফুর নাম রেকর্ড করাবার জন্য একটা দরখাস্ত লিখে এনেছিল। সেটা হাকিম সাহেবের কাছে জমা দিল।

সেখানে চেয়ারম্যান আলি আসগর ছিলেন। রিয়াজুলকে বাইরে ডেকে নিয়ে এসে বললেন, তোমার বড় চাচা তোক ভালো নয়, এটা গ্রামের সবাই জানে। তবু এভাবে অপমান করা তোমার ঠিক হয়নি।

রিয়াজুল বলল, চেয়ারম্যান চাচা, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমিও এটা করতে চাইনি। তাই ওঁকে অনেক বুঝিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই রাজি হননি। একরকম বাধ্য হয়েই এই কাজ করতে হল।

কিন্তু বাবাজি ওঁর সঙ্গে বিবাদ করে তুমি গ্রামে থাকতে পারবে?

থাকতে পারব কিনা সে কথা আল্লাহপাক জানেন। আমি আল্লাহপাককে ছাড়া কাউকে ভয় করি না। হায়াত মউত আল্লাহপাকের হাতে। সত্যের জন্যে যদি প্রাণ দিতে হয়, তাতেও আমার কোনো দুঃখ নেই। আমার মা-বাবা নেই যে, আমি মারা গেলে দুঃখ পাবেন। আপনি দোয়া করবেন চাচা, আমি যেন সত্যের জন্য সংগ্রাম করতে পারি। তারপর সালাম বিনিময় করে রফিককে নিয়ে সেখান থেকে চলে এল।

নূরুদ্দিন মিয়া লজ্জায় প্রায় এক সপ্তাহ ঘরের বাইরে বের হলেন না। তিন ছেলেকে নিয়ে পরামর্শ করলেন, রিয়াজুলকে এমনভাবে খুন করবেন, যেন কেউ তাদেরকে সন্দেহ করতে না পারে। মেজ ও ছোট কিছু না বলে চুপ করে থাকল। বড় আলাউদ্দিন বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, যা করার আমি করব।

নূরুদ্দিন মিয়া অন্য দুজন ছেলেকে বললেন, তোমরা কিছু বলছ না কেন?

মেজ ছেলে কলিমউদ্দিন বলল, আমার মতে খুন করলে পুলিশরা যেমন করে থোক খুনিকে বার করে ফেলবে। তার চেয়ে সে যাতে এখানে থাকতে না পেরে ঢাকা ফিরে যায় সেই ব্যবস্থা করাই ভালো।

মেজ ভাই থেমে যেতে ছোট রিয়াজ উদ্দিন বলল, আপনি এতদিন অনেক অন্যায় করেছেন। বাবা হিসাবে সম্মান করে কিছু বলিনি। কিন্তু আর না বলে পারছি না। আপনি যা করতে চাচ্ছেন, তা অন্যায় ও পাপ। এসব পথ আপনার পরিত্যাগ করা উচিত।

নূরদ্দিন মিয়া রেগে উঠে বললেন, তুমি আমাকে উপদেশ দিচ্ছ? আমার অন্যায়টা দেখেতে পেলে, আর রিয়াজুল যে আমাকে সাত গ্রামের মানুষের কাছে অপমান করল, সেটা বুঝি কিছু নয়?

আপনি নিজের ভুলের কারণে অপমানিত হয়েছেন। সম্পত্তিতে তার বাবার নাম রেকর্ড করিয়ে আপনি কী ভুল করেননি? সে তো আপনার কাছে পরামর্শ করতে এসেছিল। আপনি তাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন। তাই হাকিমের কাছে প্রতিবাদ করেছে।

চুপ কর বেয়াদব কোথাকার। শত্রুর হয়ে কথা বলতে তোর লজ্জা করছে না। লেখাপড়া করে তুমি জানোয়ার হয়েছ। যে ছেলে বাবার মান সম্মানের চেয়ে শত্রুর পক্ষে কথা বলে, তার মুখ আমি দেখতে চাই না। দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে।

রিয়াজউদ্দিন আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গেল।

একটু পরে কলিমউদ্দিন ছোট ভাইকে অনুসরণ করল।

 আলাউদ্দিন বলল, দেখলেন আব্বা, ওরা কেমন পাশ কেটে চলে গেল।

নূরুদ্দিন মিয়া বললেন, ওদের কথা বাদ দাও। তুমি তোমার মতো করে কাজ কর।

.

০৭.

মতি যেদিন ঢাকা যাবে তার আগের দিন রাত্রে হঠাৎ বুকে ব্যাথা উঠে তার বাবা মারা গেলেন। ব্যাথা উঠতে মতি ডাক্তার এনেছিল। উনি বললেন, হার্ট এটাক করেছে। হাসপাতালে নিতে হবে। অত রাত্রে হাসপাতালে কিভাবে নিয়ে যাবে কোনো উপায় না পেয়ে গরুর গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর মারা যান। পরের দিন সকালে দাফন কাফনের ব্যবস্থা হল। খবর পেয়ে গ্রামের লোকজন এসেছিল। মতির কান্না দেখে রিয়াজুল তাকে অনেক সান্তনা দিল।

বিকেলে মতি আসমাদের ঘরে এসে মোসারেফ হোসেনের কাছে অনেক কান্নাকাটি করল।

মোসারেফ হোসেন তাকে খুব স্নেহ করেন। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, সবর কর বাবা সবর কর। কার কখন হায়াত শেষ হবে, তা কেউ জানে না। তুমি তোমার বাবার বড় ছেলে। তুমি ভেঙ্গে পড়লে ছোটদের সান্তনা দেবে কে? তাদেরকে তুমিই তো এখন মানুষ করবে। এই আমাকেই দেখ না, বেঁচে থেকেও না থাকার মতো। বড় ছেলেটাকে আল্লাহ তুলে নিল। আমি বুকে পাথর বেঁধে সবর করে আছি। নিজেরও এই অবস্থা, ঘরে দু’টো সেয়ানা মেয়ে। কি যে হবে আল্লাহকেই মালুম। তারপর নানারকম কথা বলে প্রবোধ দিয়ে বিদায় দিলেন।

মতি আর ঢাকায় চাকরি করতে গেল না। সংসারের সব দায়-দায়িত্ব এখন তার ঘাড়ে।

একদিন মতি আমাদের পুকুরের খদ্দের ঠিক করে মোসারেফ হোসেনের সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় আসমাকে কথাটা জানাল।

আসমা বলল, পুকুর বিলি করব না। রিয়াজুল ভাই নিষেধ করেছেন।

জমি রেকর্ড করার ব্যাপারে রিয়াজুলের নাম গ্রামময় ছড়িয়ে পড়েছে। সে যে উচ্চ শিক্ষিত ও ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত, তা গ্রামের সবাই জেনে গেছে। সে জন্যে তারা তাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে। তার সঙ্গে মতির বেশ জানাশোনা হলেও এদের সংসারের কর্তৃত্ব করছে তা জানে না। তাই বেশ অবাক হয়ে বলল, রিয়াজুল ভাই নিষেধ করেছেন, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

আসমা বলল, সেদিন বললাম না, আব্বার সঙ্গে ওঁর আব্বার বন্ধুত্ব ছিল। সে কথা জেনে উনি আব্বাকে খুব সম্মান করেন। প্রায় আব্বাকে দেখতে আসেন। আব্বার চিকিৎসাও করাচ্ছেন। যেদিন পুকুর বিলির কথা তোমার সাথে আলাপ করলাম, সেদিন তুমি চলে যাওয়ার পর আমার কাছে থেকে পুকুর বিলির কথা শুনে নিষেধ করে বললেন, উনি পুকুরে মাঝের চাষ করার ব্যবস্থা করে দেবেন। আমাদের সংসারের সব দায়িত্ব এখন ওঁর উপর। জান মতি ভাই, উনি খুব ভালো ছেলে। আজকালের যুগে নিজের ছেলেই মা-বাবাকে দেখে না। বন্ধুর ছেলে হয়ে আব্বার জন্য যা করছেন, তা কেউ বিশ্বাস করবে না।

মতির মনে সন্দেহ হল, ভাবল, এতকিছু করার পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। আসমাকেও দেখছি তার কথা খুব আনন্দের সঙ্গে বলছে। তা হলে কী আসমার মন জয় করার জন্য এতকিছু করছে? আসমাকে কী আমি পাব না? সেও কী রিয়াজুলের টাকা দেখে তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে?

তাকে চুপ করে ভাবতে দেখে আসমা বলল, কী হল মতি ভাই, রিয়াজুল ভাইয়ের কথা শুনে কী এত ভাবছ?

আমার কথা শুনে মতির মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। ম্লান মুখে বলল, টাকাওয়ালা রিয়াজুল ভাইকে যখন পেয়েছ, তখন আর আমাকে তোমাদের দরকার নেই, কি বল?

আসমা বুঝতে পারল, মতি ভাই রিয়াজুল ভাইকে হিংসা করছে। বলল, মতি ভাই, তুমি ব্যাপারটা অন্যভাবে নিচ্ছ কেন? রিয়াজুল ভাই আব্বাকে নিজের বাবার মতো মনে করে। আব্বা তাকে পেয়ে ভাইয়ার কথা ভুলে গেছে। আমরাও তাকে বড় ভাইয়ের মতো মনে করি। এতে তুমি মনে কিছু করছ কেন? তিনি খুব উদার মনের ছেলে। তার সঙ্গে পরিচয় করো, তা হলে আমার কথা সত্য না মিথ্যা জানতে পারবে।

তাই জানব বলে মতি ভারাক্রান্ত মনে ফিরে আসার সময় রিয়াজুলকে আসতে দেখে অন্য পথ ধরল।

রিয়াজুল তাকে দেখতে পেয়ে ডাকল, মতি শোন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

মতি তার প্রতি অসন্তুষ্ট হলেও ডাক শুনে একরকম বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

রিয়াজুল কাছে এসে সালাম দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার? তোমার মনটা খারাপ দেখছি?

মতি সালামের উত্তর দিয়ে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কই না তো।

আমি তোমাদের বাড়ি গিয়ে না পেয়ে ফিরে এলাম। কোথাও যাচ্ছ নাকি?

 হ্যাঁ, তা আমার কাছে গিয়েছিলেন কেন?

তোমার সঙ্গে একটু আলাপ আছে। চল মোসারেফ চাচাদের ঘরে। আলাপটা ওঁর কাছেই করব। কয়েকদিন কাজের চাপে দেখতে যেতে পারিনি।

আমি একটু আগে গিয়েছিলাম। আপনি যান, পরে না হয় আলাপ করবেন।

 গেছ তো কি হয়েছে? আলাপটা চাচার ব্যাপারেই তাই তো বললাম, ওঁর কাছেই করব।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও মতি বলল, চলুন তা হলে।

যেতে যেতে রিয়াজুল বলল, চাকরি করতে তা হলে আর ঢাকায় যাবে না?

চাকরি করতে গেলে সংসার দেখবে কে?

হাঁ, তোমার কথাই ঠিক। সংসার ও ভাই-বোনদের লেখাপড়া করানোর দায়িত্ব তো তোমাকেই বইতে হবে। তুমি মন খারাপ করো না। মানুষের চিরকাল দুঃখ থাকে না। আল্লাহর উপর ভরসা করে কর্তব্য করে যাও। তিনি বড়ই মেহেরবান। একদিন না একদিন তোমাদের দুঃখের অবসান ঘটাবেন।

মতি চলে যাওয়ার পর আসমা পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে তার কথা চিন্তা করছিল, মতি ভাই তা হলে রিয়াজুল ভাইকে ভুল বুঝেছে। ভুলটা তার ভাঙ্গতে হবে। কি করে ভাঙ্গাবে সেই কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ দেখতে পেল, রিয়াজুল ভাইয়ের সঙ্গে মতি ভাইও আসছে। কাছে এলে সেই আগে সালাম দিল।

রিয়াজুল সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করল, চাচা কেমন আছেন?

আসমা বলল, আগের থেকে একটু ভালো। নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার ফলে কাল থেকে নিজেই উঠে বসতে পারছেন।

শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে রিয়াজুল বলল, চল ওঁর কাছে যাই।

মাহমুদা বিবি মুরগী হাঁসকে কুড়ো খাওয়াচ্ছিলেন। তাদেরকে দেখে ঘোমটা টেনে আড়াল হয়ে গেলেন!

ঘরে ঢুকে রিয়াজুল সালাম দিল।

মোসারেফ হোসেন খাটে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। সালামের উত্তর দিয়ে তাদেরকে বসতে বললেন।

বসার পর রিয়াজুল বলল, জমির রেকর্ড ও ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কয়েকদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। তাই আসতে পারিনি। কিছু মনে করেননি তো?

ছেলের কথা শোন, মনে করব কেন? মনোয়ারের মুখে শুনলাম, তুমি যা করেছ, তা কেউ কখনো করেনি। তোমার সাহস দেখে গ্রামের লোকজন যেমন অবাক হয়েছে তেমনি। বাহবাও দিয়েছে।

ওসব কথা থাক চাচা, যে জন্য এসেছি তা বলছি শুনুন। আমি মহিম ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করেছি। উনি বললেন, আপনাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে একজন বড় ডাক্তারকে দেখাতে। তাই কয়েকদিনের মধ্যে আপনাকে ঢাকা নিয়ে যাব।

সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। মহিম ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে আল্লাহ চাহে তো আগের থেকে ভালো আছি। কাল থেকে নিজে উঠে বসতে পারছি।

উনি বললেন, ঢাকায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করালে আরো তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবেন। আল্লাহ রাজি থাকলে কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। আর টাকা পয়সার কথা যে বললেন, সে চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আল্লাহকে জানান, তিনিই ব্যবস্থা করে দেবেন।

কিন্তু বাবা বাড়িতে কোনো পুরুষ লোক থাকবে না, তোমার চাচি দুটো সেয়ানা মেয়ে নিয়ে একা থাকবে কি করে?

আপনার সেবা যত্নের জন্য আসমাও যাবে। মনোয়ার হোসেন চাচাকে রাত্রে এবাড়িতে থাকতে বলে যাবো। আর দিনের বেলা মতিকে বললে, সেও নিশ্চয় লক্ষ্য রাখবে। তারপর মতির দিকে তাকিয়ে বলল, কী মতি রাখবে না?

কিছুক্ষণ আগে আসমার মুখে রিয়াজুলের সাহায্য করার কথা শুনে মতির মনে যে সন্দেহের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল, এখন আসমার ঢাকা যাওয়ার কথা শুনে সেই আগুন আরো বেশি জ্বলে উঠল। কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে রইল।

আসার সময় মতিকে দেখে রিয়াজুল বুঝতে পেরেছিল তার মন খারাপ। এখন তার মুখ দেখে ও তাকে মাথা নিচু করে চুপ করে থাকতে দেখে বুঝতে পারল, নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। নচেৎ যে মতির মুখে সব সময় হাসি লেগে থাকে, তার এই অবস্থা কেন? বলল, মতি আমার মনে হচ্ছে কোনো কারণে তোমার মন খারাপ। তা পরে শুনব, এখন বল, চাচাকে ঢাকা নিয়ে গেলে তুমি কী এ বাড়ির দিকে লক্ষ্য রাখবে না? জেনেছি আত্মীয়দের মধ্যে একমাত্র তুমিই চাচাকে সবসময় সাহায্য কর।

মতি মাথা নিচু করেই বলল, হ্যাঁ করব।

আমি জানতাম, তুমি না করবে না। তারপর মোসারেফ হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল, সম্পত্তি মাফ জোক হয়ে ভাগ বাটোয়ারা হয়ে গেছে। আমি দু’একদিনের মধ্যে মিউট্রেসান করার জন্য দরখাস্ত করব। সামনের সপ্তাহে আমরা ঢাকা রওয়ানা দেব। তারপর বেশ কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বলল, এর মধ্যে একমাসের মতো সংসারের প্রয়োজনীয় হাট-বাজার করার মতো টাকা আছে। মতি বা মনোয়ার হোসেন চাচাকে দিয়ে করিয়ে নেবেন। মহিম ডাক্তারের কথা মতো ইনশাআল্লাহ আমরা এক মাসের আগেই ফিরব।

আসমা বলল, আপনি বলেছিলেন, পুকুরে মাছ চাষ করবেন। এখনই কিন্তু ডিম ছাড়ার সময়।

জেলে পাড়ায় গিয়ে সে ব্যবস্থা করেই এখানে এলাম। মদন জেলেকে পরশু ভোরে আসতে বলেছি। পুকুরে জাল দিয়ে মাছ ধরে সব বিক্রি করে দেব। তারপর সার দেব। আর মদনকে বলেছি তিন চার দিনের মধ্যে মাছের ডিম ছাড়ার ব্যবস্থা করতে, তাতে যদি ঢাকা যেতে দু’একদিন দেরি হয় হবে।

মোসারেফ হোসেন চোখের পানি রোধ করতে পারলেন না। গাল বেয়ে টপ টপ করে পড়তে লাগল।

তাই দেখে রিয়াজুল এগিয়ে এসে তার একটা হাত ধরে বলল, চাচা আপনি কাঁদছেন কেন? অসুস্থ বোধ করছেন?

চোখ মুছে মোসারেফ হোসেন ভিজে গলায় বললেন, না বাবা, তা নয়। আল্লাহর মহিমা চিন্তা করে সামলাতে পারছি না। এত সুখ, এত আনন্দ জীবনে কোনোদিন পাইনি। তারপর ফুঁপিয়ে উঠে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, এই গোনাহগার বান্দার দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন কিনা জানি না, তবু করছি, আল্লাহ তোমার ইহজীবন ও পরজীবন সুখের করুন, শান্তির করুন, তোমাকে হায়াতে তৈয়েবা দান করুন, তোমার হায়াত দারাজ করুন।

রিয়াজুল তার পায়ে হাত ছুঁয়ে চুমো খেয়ে বলল, আপনি আমার বাবার মতো। আর আল্লাহ সন্তানের প্রতি মা-বাবার দোয়া কবুল করেন। এটা হাদিসের কথা। আপনার কাছ থেকে শুধু আমি দোয়াই কামনা করি। তারপর সালাম বিনিময় করে মতিকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল।

রাস্তায় এসে মতি বলল, রিয়াজুল ভাই, আপনি যান, আমি একটু শেখ পাড়ায় যাব।

রিয়াজুল বলল, ঠিক আছে যাও। আমি পরে তোমার সঙ্গে দেখা করব। তারপর পোষ্ট অফিসে গিয়ে মা-বাবাকে সব কিছু জানিয়ে একটা চিঠি লিখে পোষ্ট করে দিয়ে ফিরে এল।

মতি যেতে যেতে চিন্তা করল, রিয়াজুল ভাইয়ের কাছে আমি কিছুই না। সে যেভাবে আসমাদের সাহায্য করছে, আমার দ্বারা তা সম্ভব নয়। আসমা এখন কি আর আমাকে বিয়ে করতে চাইবে? তারপর আবার চিন্তা করল, রিয়াজুল কী বাবার বন্ধুকে শুধু শুধু সাহায্য করছে, নাকি আসমাকে পাওয়ার জন্য করছে? যদি আসমাকে পাওয়ার জন্য করে, তা হলে আমিও দেখব, কি করে পায়। আর আসমা যদি বেঈমানি করে, তা হলে তাকেও দেখে নেব।

জালাল শেখ মতির বন্ধু। একসঙ্গে এস.এস.সি. পাশ করেছে। জালাল এস.এস.সি. পাশ করে ঢাকায় চাকরির চেষ্টায় গিয়ে সন্ত্রাসীদের পাল্লায় পড়ে চাঁদাবাজি ও হাইজ্যাক করে বেড়াত। কয়েকবার ধরা পড়ে জেলও খেটেছে। বছরখানেক হল বিয়ে করে গ্রামেই আছে। শ্বশুরের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে আড়তের ব্যবসার করছে। গ্রাম থেকে বিভিন্ন তরিতরকারী ও ধান-চাল কিনে ঢাকার আড়তদারদের সাপ্লাই দেয়। সে যে ঢাকায় সন্ত্রাসী করত, তা গ্রামের কেউ না জানলেও মতি জানত। তাই জালাল যখন মাঝে মাঝে বাড়ি আসত তখন মতি তাকে ভালো হওয়ার পরামর্শ দিত। ব্যবসা শুরু করার পর মতির সঙ্গে আগের বন্ধুত্ব আরো গম্ভীর হয়েছে! মতি যে আসমাকে ভালোবাসে ও তাকে বিয়ে করতে চায়, সে কথা জালালকে বলেছিল। আজ যখন মতি বুঝতে পারল, রিয়াজুলের জন্য আসমাকে পাওয়া যাবে না তখন জালালের কাছে পরামর্শ করার জন্য গেল।

সালাম ও কুশল বিনিময় করে জালাল বলল, আয় বস। তারপর তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার, তোর মন খারাপ মনে হচ্ছে?

মতি বলল, হ্যাঁ তুই ঠিকই ধরেছিস। তারপর রিয়াজুলের পরিচয় ও আসমাদেরকে সাহায্য করার কথা বলে বলল, রিয়াজুল নিশ্চয় আসমাকে পাওয়ার জন্য এতকিছু করছে।

জালাল বলল, আমার কানেও রিয়াজুলের ব্যাপারটা এসেছে। যাই বলিস, ছেলেটার বুকের পাটা আছে। অমন জাদরেল মাতবর চাচার বিরুদ্ধে লড়ে বাবার সম্পত্তি আদায় করল। মাতবরকে আর বড় একটা বাজারে আসতে দেখা যায় না। রিয়াজুল উচ্চ শিক্ষিত ও ধার্মীক।

মতি বিরক্ত স্বরে বলল, আমি এলাম তোর কাছে রিয়াজুলের বিরুদ্ধে নালিশ করতে, আর তুই কিনা তার প্রশংসা করতে শুরু করে দিলি।

জালাল বলল, দেখ মতি, এক সময় আমি ঢাকায় সন্ত্রাসী করতাম ঠিক। তাই বলে ভালোকে ভালো বলব না, একথা ভাবলি কি করে? রিয়াজুলের কথা কিছু কিছু শুনেছিলাম। হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে পরিচয় হয়। আলাপ করে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়, সে তার অসহায় বাবার বন্ধুকে সাহায্য করছে, আসমার জন্য নয়। আসমা ও তোর সম্পর্কে কথা জানতে পারলে সে হয়তো নিজেই উদ্যোক্তা হয়ে তোদের বিয়ে দিয়ে দেবে। তুই শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছিস। তবে আসমা যদি তোর সঙ্গে বেঈমানী করে রিয়াজুলের দিকে ঝুঁকে পড়ে, সেটা আলাদা কথা। সে ব্যাপারে তুই কি করবি চিন্তা করে দেখ।

তুই তো জানিস, আমরা এক অপরকে অনেকদিন থেকে ভালবাসি এবং একদিন বিয়েও করব। হঠাৎ কোথাকার কে রিয়াজুল উড়ে এসে জুড়ে বসে আমার কাছ থেকে আসমাকে ছিনিয়ে নেবে, তা সহ্য করব না।

কী করবি শুনি?

হয় ওকে এখান থেকে তাড়াব, না হয় দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেব।

 তুই কোনোটাই পারবি না।

 কেন?

এসব করতে হলে জনবল ও অর্থবল দু’টোই থাকতে হবে। তোর কোনোটাই নেই।

তুই আমাকে সাহায্য করবি না?

করব; তবে তুই যেভাবে চাচ্ছিস, সেভাবে নয়। এসব কাজে ধৈৰ্য্য হারাতে নেই। ধৈৰ্য্য ধরে খুব ভেবে-চিন্তে করতে হয়। যা বলছি শোন, আসমাকে জিজ্ঞেস করে দেখ, সে তোকে এখনো ভালবাসে কিনা এবং বিয়ে করতে রাজি আছে কিনা। যদি রাজি থাকে, তা হলে রিয়াজুল কোনো সমস্যা নয়।

আর যদি রাজি না হয়?

এ্যাডভান্স বলছিস কেন? মেয়েরা প্রথম যাকে ভালবাসে, জীবন গেলেও তাকে ভুলতে পারে না। তোকে যা বললাম কর। আমিও তো আসমাকে চিনি, আমার বিশ্বাস সে বেঈমানী করবে না।

আমারও সেই বিশ্বাস আছে; কিন্তু রিয়াজুল যেভাবে তাদের সবার জন্য করছে, আসমা বেঈমানী করতে না চাইলেও বাবার অসহায়ত্বের কথা ভেবে যদি বাধ্য হয়ে রিয়াজুলকে বিয়ে করতে রাজি হয়?

বললাম না, আসমা তোকে চাইলে রিয়াজুল কোনো সমস্যা নয়। সে ধরনের মেয়ে সে নয়।

ঠিক আছে চলি বলে মতি সালাম বিনিময় করে চলে এল।

.

রিয়াজুল ভাইয়ের কথা শুনে মতি যে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছে ও তাকে ভুল বুঝেছে, তা বুঝতে পেরে তার ভুল ভাঙ্গাবার জন্য আসমা ঐদিন বিকেলে জাহিদকে বলল, তুই মতি ভাইকে ডেকে নিয়ে আয়। বলবি আমি ডেকেছি।

জাহিদ মতিদের ঘরে গিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে তার মাকে জিজ্ঞেস করল, মতি ভাই কোথায়?

মতির মা বললেন, সে তো ঘরে নেই। তাকে কী দরকার আমাকে বল।

 বড় বুবু মতিভাইকে যেতে বলেছে।

ঠিক আছে তুমি যাও, মতি ঘরে এলে যেতে বলব।

জাহিদ ফিরে এলে আসমা জিজ্ঞেস করল, কিরে, মতি ভাই এল না?

জাহিদ বলল, মতি ভাই ঘরে নেই। তার মা বলল, ঘরে এলে আসতে বলবে।

মতি মাগরিবের নামায পড়ে ঘরে এলে তার মা বললেন, আসমা তোকে ডাকতে জাহিদকে পাঠিয়েছিল।

মতি বলল, আজ আর যাব না, কাল সকালে যাব।

পরের দিন মাঠে কাজ করতে যাওয়ার আগে মতি আসমাদের বাড়ি গেল।

আসমা মনে করেছিল, মতি সন্ধ্যের পর নিশ্চয় আসবে। যখন এল না তখন ভাবল, হয়তো কোনো কারণে আসতে পারেনি। কাল সকালে আসবে। তাই পরের দিন সকালে পুকুর ঘাটে হাঁড়ি-পাতিল মাজার সময় বারে বারে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখছিল। মতিকে আসতে দেখে হাত ধুয়ে ঘাটের উপরে উঠে এল।

কাছে এসে মতি সালাম বিনিময় করে মুখ ভার করে বলল, কেন ডেকেছ বল।

আসমা বলল, তার আগে বল, তোমার মন খারাপ কেন?

কেন খারাপ তা কী বুঝতে পারনি?

পেরেছি বলেই তো ডেকে পাঠিয়েছি। শোন মতি ভাই, তোমার আমার সম্পর্ক অনেক দিনের। তুমি আমাকে অবিশ্বাস করবে, তা ভাবতেই পারছি না। জান, যখন আমাকে ভুল বুঝে মন খারাপ করে চলে গেলে তখন থেকে মনে এতটুকু শান্তি নেই। সারারাত ঘুমাতে পারিনি। তোমাকে যে কি করে বোঝাব, তুমি আমার কাছে কতখানি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না মতি ভাই। তারপর আঁচলে চোখ মুছল।

রিয়াজুল ভাই তোমাদের জন্য এতকিছু করছেন, তিনি যদি তোমাকে বিয়ে করতে চান, তা হলে কী করবে?

আমি নিশ্চিত, তিনি তা চাইবেন না।

 যদি চান, তুমি না করতে পারবে?

আসমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, পারব মতি ভাই পারব। তোমার জন্য আমি বিষও খেতে পারব।

ছিঃ আসমা, একথা উচ্চারণ করাও গোনাহ। আর কখনো বলবে না। আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। তোমার কথা শুনে সেই ভুল ভেঙ্গেছে। সেজন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছি। এবার আসি, মাঠে যেতে হবে।

এস বলে আসমা সালাম বিনিময় করে তাকে যতক্ষণ দেখা গেল তার দিকে তাকিয়ে রইল। আড়াল হয়ে যেতে ঘাটে নামল।

.

দিন দশেকের মধ্যে রিয়াজুল সব কাজ সেরে মোসারেফ হোসেন ও আসমাকে নিয়ে ঢাকা রওয়ানা হল। রওয়ানা হওয়ার আগের দিন মতি আসমাকে ও রিয়াজুলকে চিঠি দিতে বলে দিল।

.

০৮.

মুনসুর আলি ও জাহেদা রিয়াজুলের চিঠি পেয়ে খুব অবাক হলেও মোসারেফ হোসেনের থাকার জন্য একটা রুম রেডি করে রেখেছিলেন।

ঢাকায় পৌঁছে রিয়াজুল সবার সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিল।

আসমা জাহেদা ও মুনসুর আলিকে কদমবুসি করে আব্বাকেও করল।

জাহেদা আসমাকে দেখে মুগ্ধ হলেন। জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, বেঁচে থাক মা, সুখি হও। তারপর রিয়াজুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, এর কথা তো তুই চিঠিতে লিখিসনি?

রিয়াজুল বলল, তোমাদেরকে একটু অবাক করে দেব বলে লিখিনি।

পরের দিন রিয়াজুল মোসারেফ হোসেনকে পঙ্গু হাসপাতালের একজন বড় ডাক্তারের চেম্বারে দেখাল। উনি পরীক্ষা করে বললেন, অনেক দিন ঠিকমতো চিকিৎসা না করার ফলে ও মানসিক দুশ্চিন্তায় শিরা-উপশিরাগুলো খুব দুর্বল হয়ে গেছে। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ঠিক মতো চিকিৎসা ও সেই সঙ্গে কিছু ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ এবং পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করলে ভালো হয়ে যাবেন।

রিয়াজুল বলল, ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ উনি করবেন কি করে?

উনি করবেন না, আমরা উনাকে করাব।

 ঠিক আছে, আপনি ব্যবস্থা করুন।

কোনো ক্লিনিকে রেখে চিকিৎসা করাতে পারবেন?

জ্বি পারব।

ডাক্তার প্যাডে ক্লিনিকের নাম ঠিকানা ও ভর্তি করার এ্যাডভাইস লিখে রিয়াজুলের হাতে দিয়ে বললেন, আজ কালের মধ্যে ভর্তি করে দিন। ওখানে আমিই চিকিৎসা করব।

কাল সকালে ভর্তি করার কথা বলে রিয়াজুল মোসারেফ হোসেনকে নিয়ে বাসায় ফিরে মা-বাবাকে ডাক্তারের কথা বলল।

একসময় মুনসুর আলি ও জাহেদা রিয়াজুলকে বললেন, ক্লিনিকে রেখে চিকিৎসা করালে অনেক টাকা লাগবে। তুই তো আমাদের অবস্থা জানিস, এত টাকা পাব কোথায়?

টাকার চিন্তা তোমরা করো না। তারপর ছোট চাচা ও বড় চাচার কাছ থেকে পঁচিশ বছরের ফসল বিক্রির টাকা পাওয়ার কথা বলল।

জাহেদা বলল, আল্লাহ অনেক বড় দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচালেন। সে জন্যে তাঁর পাক দরবারে জানাই হাজার হাজার শুকরিয়া।

মোসারেফ হোসেনের ঠিকমতো চিকিৎসা না হওয়ার কারণে যতটা না পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন, সংসারের দুরাবস্থা ও দু’টো সেয়ানা মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তায় আরো বেশি পঙ্গু হয়ে পড়েছিলেন। রিয়াজুলকে পেয়ে সেই দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পান। তারপর ঢাকায় এসে ক্লিনিকে ঠিকমতো চিকিৎসা ও ভালোমন্দ খাওয়ার ফলে পনের বিশ দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে চলাফেরা করতে পারছেন।

একদিন রিয়াজুলকে বললেন, বাবা, এবার গ্রামে যেতে চাই। এখানে আর মন টিকছে না।

রিয়াজুলকে বলল, আরো কিছুদিন থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তারপর যাবেন।

মোসারেফ হোসেন জানতে পেরেছেন, ক্লিনিক থেকে চিকিৎসা করাতে এ পর্যন্ত পঁচিশ ত্রিশ হাজার টাকা বিল হয়েছে। তাই নিজেই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে বাড়ি যাওয়ার কথা রিয়াজুলকে বার বার বলতে লাগলেন।

রিয়াজুল বলল, ঠিক আছে, আমি, ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখি, উনি যা বলবেন তাই করব। তারপর ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে রুগীর বাড়ি যাওয়ার কথা বললেন।

ডাক্তার বললেন, এবার নিয়ে যেতে পারেন। তবে ওষুধ অনেক দিন খেতে হবে। আর গ্রামে তো ফিজিক্যাল এক্সারসাইজের যন্ত্রপাতি নেই, আমরা ফ্রি হ্যাঁন্ড কিছু পদ্ধতি দেখিয়ে দেব। সেগুলো প্রতিদিন অনুশীলন করলে আশা করি দু’এক মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। তবে কোনো পরিশ্রমের কাজ আর কখনো যেন না করেন। আর মানসিক টেনশন ও দুশ্চিন্তা করতে একদম নিষেধ করে দেবেন। তা নাহলে আবার সারাজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে যাবেন অথবা হার্টফেল করে মারা যাবেন।

রিয়াজুল বলল, অনুগ্রহ করে আপনি নিজে ওঁকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবেন।

ছাব্বিশ দিন ক্লিনিকে থেকে মোসারেফ হোসেনকে রিয়াজুল বাসায় নিয়ে এল।

জাহেদা ও মনসুর আলি মাঝে মাঝে ক্লিনিকে গিয়ে ওঁকে দেখে এসেছেন। মোসারেফ হোসেন গ্রামে ফিরে যাওয়ার কথা বললে মনসুর আলি বললেন, ঢাকায় এসে ক্লিনিকে প্রায় একমাস রইলেন। এবার আমাদের বাসায় কয়েকদিন বেড়ান, তারপর যাবেন।

মোসারেফ হোসেন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আপনারা আমার জন্য যা কিছু করলেন, তার ঋণ আমি কোনো কিছুর বিনিময়ে শোধ করতে পারব না। আল্লাহ তার জাজাহ আপনাদেরকে নিশ্চয় দেবেন।

আসমাকে দেখে ও তার আচার ব্যবহারে জাহেদা ও মনসুর আলি খুব সন্তুষ্ট। একদিন রাতে ঘুমাবার আগে আসমাকে নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আলাপ হওয়ার সময় জাহেদা বললেন, আসমাকে বৌ করলে কেমন হয়?

মুনসুর আলি বললেন, আমার মনের কথা বলেছ, রিয়াজুলের মতামত জানার জন্য তোমাকে বলব ভাবছিলাম। ওর মতামতটা জানতে পারলে ভাল হত।

আমার ধারণা রিয়াজুল না করবে না।

ধারণাটা ভুলও হতে পারে?

না, হতে পারে না, তুমি কী মনে কর, রিয়াজুল শুধু শুধুই তার বাবার বন্ধুকে সাহায্য করছে?

ওর মত ছেলের এটা করাই স্বাভাবিক।

তোমার সঙ্গে আমিও একমত। তবে এর মধ্যে আসমার মতো মেয়েকে পাওয়ার আশা করাটা কী অস্বাভাবিক কিছু?

 না তা নয়, তবু তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো। তবে আমার মনে হয়, সবার আগে মোসারেফ ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করা উচিত।

বেশ তো, তাই করা যাবে।

মোসারেফ হোসেন ক্লিনিক থেকে ফিরে আসার পরের দিন মাগরিবের নামাযের পর জাহেদা স্বামীকে বললেন, চলো আসমার বাবার সঙ্গে কথাটা আলাপ করা যাক। মুনসুর আলী বললেন, বেশ তাই চলো।

মোসারেফ হোসেন নামায শেষ করে বসে বসে তসবিহ পড়ছিলেন। ওদের দেখে তসবিহ পকেটে রেখে বললেন, আসুন, বসুন।

বসার পর বললেন, আর কতদিন আপনাদের বিরক্ত করব? এবার দু’একদিনের মধ্যে যাওয়ার অনুমতি দিন।

মুনসুর আলি বললেন, বিরক্ত হব কেন? বরং আমরা ভাবছি এখানে আপনাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা।

কি যে বলেন ভাই সাহেব, যে সেবা-যত্ন আপনাদের কাছে পেয়েছি তা কোনোদিন কল্পনাও করিনি।

ওসব কথা থাক ভাই, যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে আমরা একটা কথা আলাপ করতে চাই।

একটা কেন? হাজারটা করুন, মনে কিছু করব না। আপনারা নিশ্চিন্তে বলুন।

আমরা আসমাকে বৌ করতে চাই। আপনি রাজি থাকলে কথাবার্তা বলে বিয়ের দিন ধার্য করব।

মোসারেফ হোসেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। আনন্দে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললেন। বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। একসময় তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল।

মুনসুর আলি বললেন, কী হল ভাই সাহেব, কথাটা শুনে কী খুব দুঃখ পেলেন? যদি তাই হয়, তা হলে মাফ…….।

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মোসারেফ হোসেন ভিজে গলায় বললেন, না ভাই সাহেব না, এতটুকু দুঃখ পাইনি। বরং এত বড় সুসংবাদ শুনে আনন্দ ধরে রাখতে পারছি না। এই কান্না দুঃখের নয়, আনন্দের। আসমার কী এত বড় ভাগ্য হবে যে, আপনাদের বৌ হবে? আমি যে ভাবতেই পারছি না। তারপর চোখ মুছে বললেন, আপনারা কথাটা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, রিয়াজুলের আব্বা ও আমি ওয়াদা করেছিলাম, আমাদের যারই ছেলে অথবা মেয়ে হোক না কেন, তাকে বৌ অথবা জামাই করব। কথাটা এতদিন ভুলে গিয়েছিলাম, আপনারা প্রস্তাব দিতে মনে পড়ে গেল। সে সময় হয়তো আল্লাহ আমাদের ওয়াদা কবুল করেছিলেন। তাই তিনি আপনাদের দ্বারা প্রস্তাব দেওয়ালেন।

মুনসুর আলি শোকর আল-হামদুলিল্লাহ বলে বললেন, সৌভাগ্যের কথা কি বলছেন ভাই, সবকিছু আল্লাহর ইশারা।

এতক্ষণ জাহেদা চুপ করেছিলেন। এবার বললেন, তা হলে শুভ কাজে দেরি করে কি লাভ। এখনই দিন ধার্য হয়ে যাক।

মোসারেফ হোসেন বললেন, তার আগে রিয়াজুলের মতামত জানা দরকার নয় কি?

 আমাদের মতামতই তার মতামত। আমাদের কথা সে কখনো এতটুকু অমান্য করেনি।

আল-হামদুলিল্লাহ বলে মোসারেফ হোসেন বললেন, তবু ওর মতামত নিয়েই দিন ধার্য। করা উচিত।

জাহেদা বলল, ঠিক আছে আমি এক্ষুণী ওকে জিজ্ঞেস করে আসছি। তারপর স্বামীকে বললেন, তুমি গল্প কর, আমি যাই। কথা শেষ করে চলে গেলেন।

জাহেদা নিজের রুমে যাওয়ার সময় কাজের মেয়েকে ডেকে বললেন, রিয়াজুলকে আসতে বল।

কাজের মেয়ে রিয়াজুলের কাছে গিয়ে বলল, আম্মা আপনাকে ডাকছেন।

রিয়াজুল আসমার সঙ্গে মুফতী মাওলানা মুনসুরুল হক রচিত নারীর মান বইটা তার হাতে দিয়ে সংসারে নারীর ভূমিকা ও অধিকার সম্বন্ধে আলোচনা করছিল। কাজের মেয়ের কথা শুনে আসমাকে বলল, তুমি এটা পড়। আমি আসছি। তারপর মায়ের কাছে এসে বলল, তুমি নাকি ডেকেছ?

জাহেদা বললেন, হ্যাঁ ডেকেছি। বস।

রিয়াজুল মায়ের পাশে বসল।

জাহেদা বললেন, আমরা তোর বিয়ে দিতে চাই। মেয়েও পছন্দ করেছি। তোর মত পেলে মেয়ের বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলব।

বিয়ের কথা শুনে রিয়াজুলের সালেহার কথা মনে পড়ল। বলল, এত তাড়াহুড়া করছ কেন? আগে স্বাবলম্বী হয়ে নিই। তারপর যা করার করো।

দেশে তোর বাবার যে সম্পত্তি পেয়েছিস তার এক বছরের ফসলে দু’তিন বছর নবাবী হালে চলতে পারবি। সাবলম্বী হওয়ার কথা বলছিস কেন?

বাবার সম্পত্তির উপর ভরসা করে আমি বিয়ে করব না। তা ছাড়া শুধু নিজেদের কথা ভাবলে চলবে? ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা চিন্তা করতে হবে না?

বিয়ের পরেও তা করতে পারবি।

তা হয়তো পারব। তবু আমি কিছু করে সাবলম্বী হতে চাই।

তোর আব্বা আর কতদিন ব্যবসা চালাবে। তুই তাকে সাহায্য করবি না?

ভেবেছি, গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে ঐ ব্যবসাটাই বড় করব।

তা হলে বিয়েতে অমত করছিস কেন? সারাদিন আমি একা বাসায় যোবার মত থাকি। কাজের বুয়ার সাথে কি আর কথা বলব। বৌ হলে তার সঙ্গে গল্প করতাম। তুই অমত করিস না বাবা, যে মেয়ে আমি ও তোর আব্বা পছন্দ করেছি, তাকে তোরও পছন্দ হবে।

রিয়াজুল ভেবে রেখেছে, মোসারেফ চাচা সুস্থ হওয়ার পর একটা ভালো ছেলে দেখে আসমার বিয়ে দেবে। তারপর সালেহা এস.এস.সি. পাশ করার পর তাকে বিয়ে করবে। তাই মা-বাবার পছন্দ করা মেয়ের কথা শুনে কিভাবে সালেহার কথা বলবে চুপ করে ভাবতে লাগল।

জাহেদা বললেন, কি রে, চুপ করে কি ভাবছিস? তুই কী কোন মেয়েকে পছন্দ করিস?

 রিয়াজুল লজ্জায় কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।

 বল না লজ্জা করছিস কেন? আমি তোর মা না? আমাকে বলতে লজ্জা কিসের।

তোমরা যে মেয়েকে পছন্দ করেছ, তার পরিচয় আগে বল।

 আসমাকে আমরা পছন্দ করেছি।

রিয়াজুল চমকে উঠে একবার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিল।

জাহেদা বললেন, আসমার মতো মেয়ে আজকাল হয় না। তোর আব্বা বলছিল, ওর মতো মেয়েই এ বাড়ির বৌ হওয়ার উপযুক্ত। আমারও তাই মনে হয়। তুই যদি না করিস, আমার চেয়ে তোর আব্বা বেশি মনে ব্যথা পাবে।

রিয়াজুল খুব চিন্তায় পড়ে গেল। বড় বোন থাকতে ছোট বোনের কথা কি করে বলবে? আবার না করলে মা-বাবা মনে ব্যথা পাবে। মনে মনে আল্লাহকে বলল, তোমার কালাম পাকে ও নবী (দঃ) হাদিসে পড়েছি মা-বাবার মনে কষ্ট দেওয়া কবিরা গোনাহ। তা হলে কী সালেহাকে তুমি আমার জোড়া করনি?

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে জাহেদা ভাবলেন, রাজি থাকলেও লজ্জায় বলতে পারছে না। বললেন, আসমাকে বৌ করার জন্য আমরা মোসারেফ ভাইকে প্রস্তাব দিয়েছি। উনি খুব আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করে বললেন, তোর আব্বা ও তার সঙ্গে নাকি কথা হয়েছিল, ছেলে মেয়ে যার যাই হোক না কেন তাদের বিয়ে দেবেন। আমরা দিন ধার্য করতে চাই। তোর কিছু বলার থাকলে বল।

রিয়াজুলের মনের অবস্থা খুব খারাপ। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও একরকম বাধ্য হয়ে বলল, এ ব্যাপারে আপনারা যা করবেন তাতে আমার আপত্তি নেই। তবে বিয়েটা গ্রামের বাড়িতে হবে। আমি গিয়ে ছোট চাচাকে আপনাদের মতামত জানাব। তারপর চিঠি দিয়ে আপনাদেরকে যেতে বলব। আপনারা গিয়ে ছোট চাচার বাড়িতে উঠবেন। তারপর তাকে নিয়ে সবকিছু করবেন। নচেৎ তিনি মনে খুব কষ্ট পাবেন। তারপর সেখান থেকে চলে গেল।

জাহিদা ফিরে এসে বললেন, রিয়াজুল বিয়েতে রাজি আছে। তারপর বিয়ে কোথায় ও কিভাবে হবে সে কথাও বললেন।

মুনসুর আলি বললেন, সে খুব ভালো কথা বলেছে। তারপর মোসারেফ হোসেনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তা হলে এটাই পাকা কথা?

মোসারেফ হোসেন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, আপনাদের মতামতই আমার মত।

.

০৯.

প্রায় একমাস পর রিয়াজুল মোসারেফ হোসেন ও আসমাকে নিয়ে জয়নগরে ফিরে এল। মোসারেফ হোসেন ঢাকায় চিকিৎসা করিয়ে ভালো হয়ে ফিরে এসেছে জেনে গ্রামের লোকজন। এসে দেখা করে যেতে লাগল। মোসারেফ হোসেন তাদের কাছে রিয়াজুলের গুণাগুণের কথা বললেন। ফলে রিয়াজুলের সুনাম আরো বেশি ছড়িয়ে পড়র। আসমার মামা-মামীরাও এসে দেখা করে যাওয়ার সময় রিয়াজুলকে অনেক দোয়া করে গেলেন।

ভাইপো রিয়াজুল যে মোসারেফ হোসেনকে সাহায্য করছে তা জেনে নূরুদ্দিন মিয়া বড় ছেলে আলাউদ্দিনের সঙ্গে পরামর্শ করে বললেন, খুন-খারাবি করলে ঝামেলা হওয়াই স্বাভাবিক। তাই ভাবছি রিয়াজুল তো পঙ্গু মোসারেফ হোসেনের ঘরে ঘন ঘন যাওয়া আসা করছে। তার বড় মেয়ে আসমার সঙ্গে দুর্নাম রটিয়ে বিচারের ব্যবস্থা কর। আর প্রমাণের জন্য তাদেরকে কুকীর্তি করতে দেখেছে এমন দু’জন সাক্ষী জোগাড় করার ব্যবস্থাও কর। বিচারে রিয়াজুলকে এমন অপমানজনক শাস্তির ব্যবস্থা করব যাতে ঢাকা ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

কিন্তু পরামর্শ মত কাজ করার আগেই রিয়াজুল মোসারেফ হোসেন ও আসমাকে নিয়ে ঢাকা চলে যায়। ফিরে আসার খবর পেয়ে আলাউদ্দিনকে বললেন, এবার আর দেরি না করে কাজে লেগে পড়।

আলাউদ্দিন বলল, আপনি বলার আগে সোরাব ও খলিলকে রিয়াজুলের গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে বলেছি।

.

মোসারেফ হোসেনের বিশ্বাস রিয়াজুলের মতো ছেলের সঙ্গে বিয়েতে আসমা অরাজি হবে না বরং নিজেকে সৌভাগ্যবতী মনে করবে। তাই ঢাকাতে মেয়েকে কথাটা জানান নি। বাড়িতে এসে ঐদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর প্রথমে স্ত্রীকে জানালেন।

মাহমুদা বিবি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, এত বড় ভাগ্য আসমার হবে?

মোসারেফ হোসেন বললেন, আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে কি না হয়। মা আমার রাজকপাল নিয়ে জন্মেছে। তারপর রিয়াজুলের বাপের সঙ্গে ওয়াদার কথা বলে বললেন, তোমাকেও তো কথাটা বলেছিলাম, মনে আছে?

ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি বলতে মনে পড়ল।

আসমাকে ডেকে আন, শুনলে সেও নিশ্চয় খুশি হবে।

মাহমুদা বিবি মেয়ের নাম ধরে ডেকে আসতে বললেন।

আসমা পাশের রুমে ছোট দু’ভাই বোনকে নিয়ে একটা বড় খাটে ঘুমায়। তাদের ঘুমাতে বলে মতির কথা চিন্তা করছিল। আজ একমাস তাকে দেখেনি। এমন সময় মায়ের। ডাক শুনে তাদের কাছে এল।

মোসারেফ হোসেন মেয়েকে পাশে বসতে বললেন। বসার পর তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, রিয়াজুলের মা-বাবা তোকে দেখে খুব পছন্দ করেছেন। তারা তোকে বৌ করতে চান। শুনে আমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি। মনে হয়েছিল স্বপ্ন দেখছি। পরে তাদের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বুঝতে পারলাম স্বপ্ন নয়, বাস্তব। রিয়াজুলের মতামত নেওয়া হয়েছে, সে রাজি আছে। কিছুদিনের মধ্যে তারা এসে রিয়াজুলের ছোট চাচাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে বিয়ের ব্যবস্থা করবেন।

আব্বার কথা শুনে আসমার মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রাঘাত পড়ল। মাথা বনবন করে ঘুরতে লাগল। বাড়ি-ঘর দুলতে লাগল। মুখ নিচু করে ও চোখ বন্ধ করে সামলাবার চেষ্টা করল। তার মনে হল, রিয়াজুল ভাই তা হলে এইজন্যই আমাদেরকে সাহায্য করছে। তখন রিয়াজুলের প্রতি তার প্রচণ্ড রাগ হল।

মোসারেফ হোসেন মনে করলেন, মেয়ে লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে আছে। বললেন, রিয়াজুল খুবই চরিত্রবান ও সৎ ছেলে। তুই সুখি হবি মা। ওর মা-বাবাও যে খুব ভালো মানুষ, তা তো তুই নিজেই দেখেছিস।

আসমা খুব স্পষ্টবাদী ও একরোখা মেয়ে। তবু এ বিয়েতে মত নেই বলতে গিয়ে সামলে নিল। কারণ তখন তার ডাক্তারের কথা মনে পড়ল। কোনো কারণেই উত্তেজিত হতে দেবেন না। নচেৎ আবার পঙ্গু হয়ে যাবেন অথবা হার্টফেল করে মারা যাবেন, কোনো রকমে বলল, আমার বড় মাথা ধরেছে, আমি এখন যাই।

মোসারেফ হোসেন বললেন, হ্যাঁ মা যাও, শুয়ে পড়। গরুর গাড়ির ঝাঁকুনিতে মাথা তো ধরবেই।

আসমা অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারলো না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চিন্তা করতে লাগল, একদিকে আমার প্রেম ও স্বপ্ন এবং অন্যদিকে আব্বার জীবন ও পুরো সংসারের ধংসলীলা। কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করল, আল্লাহ গো, আমি এখন কী করব, মতিকে কী বলব, তুমিই বলে দাও।

.

সালেহার বয়স পনের মোলর মতো। স্বাস্থ্য ভালো। দেখতে আসমার থেকে সুন্দরী। তরুণী বয়সেই যুবতী বলে মনে হয়। বুবুর সঙ্গে মতি ভাইয়ের যে ভালোবাসা হয়েছে তা জানে। সেও চায়, মতি ভাইয়ের সঙ্গে বুবুর বিয়ে হোক। ইদানিং রিয়াজুল ভাই এসে তাদের সব দায়-দায়িত্ব নিতে তাকে বড় ভাইয়ের মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। আজ ঘুমাবার সময় বুবুকে ডেকে আব্বা কি বলেছে তা জানতে পারল না। কারণ বুবু যখন আব্বার কাছ থেকে ফিরে আসে তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যেতে বুবুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে ভয় পেল। তাকে নাড়া দিয়ে বলল, বুবু তুমি কাঁদছ কেন? কোননা। খারাপ স্বপ্ন দেখছ না কি?

আসমা সামলে নিয়ে চোখ মুছে বলল, না, ওসব কিছু নয়, তুই শুয়ে পড়।

সালেহা অবাক হয়ে বলল, তুমি তা হলে জেগে জেগে কাঁদছ? কি হয়েছে বুবু বল না, আমার খুব ভয় করছে।

আসমা তার গায়ে হাত রেখে বলল, কিসের ভয়? আমি তোর পাশে রয়েছি না। নে এবার শুয়ে পড়।

সালেহা চিন্তা করতে লাগল, বুবু কাঁদছে কেন? রাতে আব্বা কি বকেছে? কিন্তু আব্বাতো বুবুকে আগেও কতবার বকেছে, কই কোনো সময়েই তো কাঁদেনি। তা হলে এখন কেন কাঁদছে। কারণ খুঁজে না পেয়ে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারল না। বলল, বুবু তুমি ঘুমিয়েছ?

না, তুই ঘুমাসনি এখনো?

 তুমি কেন কাঁদছিলে না বললে ঘুম আসবে না।

তুই আমাকে খুব ভালবাসিস তাই না?

সালেহা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাকে আমি সবার চেয়ে বেশি ভালবাসি। কেন, সে কথা কী তুমি জান না?

আসমা তার দু’গালে চুমো খেয়ে বলল, জানি রে জানি, তবু জিজ্ঞেস করলাম আরকি। আচ্ছা, আমি যদি মরে যাই তখন কী করবি?

বুবু এমন কথা আর বলবে না। তুমি মরে গেলে আমিও মরে যাব।

তুই আমাকে এত ভালবাসিস? ঠিক আছে ঐ কথা আর বলব না। এবার বল, বিয়ে হয়ে গেলে আমি তো স্বামীর ঘরে চলে যাব, তখন কী করবি?

বারে, রোজ পাঁচ-ছ’বার তোমাকে দেখতে যাব। মতি ভাইয়ের বাড়ি তো কাছেই।

এই কথা শুনে আসমার চোখে পানি চলে এল। ভিজে গলায় বলল, আর মতি ভাইয়ের সঙ্গে যদি বিয়ে না হয়?

কেন হবে না? তোমরা দু’জন যে অনেকদিন থেকে দু’জনকে ভালবাস তা আমি জানি।

আসমার ভীষণ কান্না পেতে লাগল। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সামলাবার চেষ্টা করল। কিন্তু তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

সালেহা ভয়ার্ত স্বরে বলল, বুবু তুমি আবার কাঁদছ? তোমার কি হয়েছে?

আসমা ফুঁপিয়ে উঠে বলল, তুই কখনো কোনো ছেলেকে ভালবাসবি না। ভালবাসা শুধু কাঁদায়।

কেন বুবু? মতি ভাই কী তোমাকে বিয়ে করবে না বলেছে।

না রে, তা বলেনি। তারপর বলল, সে করতে চাইলে কী হবে, আমার ভাগ্যে মতি ভাই নেই।

সালেহার মনে হল, রাতে আব্বা নিশ্চয় কিছু বলেছে। বলল, মতি ভাই যখন চায় তখন তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে না কেন? তোমাকে আল্লাহর কসম লাগে বল।

কাউকে বলবি না বল?

না বুবু কাউকে বলব না।

রিয়াজুল ভাইয়ের মা-বাবা আমাকে বৌ করতে চান। তারা আব্বাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। আব্বা রাজি আছেন এবং সে কথা তাদেরকে জানিয়েও এসেছেন। তারা। কিছুদিনের মধ্যে এসে বৌ করে আমাকে ঢাকা নিয়ে যাবেন। আব্বা আমাকে ঢাকায় কিছু বলেননি। আজ রাতে ঘুমোবার সময় বলেছেন। এখন বুঝতে পারলি কেন কাঁদছি? কথা শেষ করে আসমা চোখ মুছল।

সালেহা জিজ্ঞেস করল, রিয়াজুল ভাই একথা জানেন?

হাঁ, তার মতামত নিয়েই তারা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।

তা হলে মতি ভাইয়ের কী হবে? সে তো রিয়াজুল ভাইয়ের উপর খুব রেগে যাবে। আর তুমিও কী পারবে মতি ভাইকে বাদ দিয়ে রিয়াজুল ভাইকে বিয়ে করতে?

আমি কী করব কিছুই ভাবতে পারছি না। তাই তো শুধু কান্না পাচ্ছে। মতি ভাইকে যেমন বাদ দিতে পারব না, তেমনি রিয়াজুল ভাইকেও না। রিয়াজুল ভাই আমাদের সংসারের দায়-দায়িত্ব নিয়েছেন, অনেক টাকা খরচ করে আব্বার চিকিৎসা করিয়ে ভালো করেছেন। তাকে যদি বিয়ে না করি, তা হলে সংসারের অবস্থা কী হবে? তা ছাড়া ডাক্তার বলেছেন, আব্বা যদি কোনো কারণে রেগে যান অথবা টেনশন ফিল করেন, তা হলে আবার স্ট্রোক করে চিরকালের মতো পঙ্গু হয়ে যাবেন অথবা হার্টফেল করে মারা যেতে পারেন। তুই বল, আমি এখন কী করব? আত্মহত্যা করা যদি মহাপাপ না হত, তা হলে সেই পথ বেছে নিতাম। কথা শেষ করে আবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

সালেহা কী বলবে ভেবে না পেয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

আসমা কান্না থামিয়ে বলল, কি রে, ঘুমালি নাকি?

না, বুবু ঘুম আসছে না। তোমার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।

আসমা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কষ্ট আমারও কি কম হচ্ছে? শোন, ঘুমাবার চেষ্টা কর। আল্লাহ যা তকদিরে রেখেছেন হবে। আমি এখন তাহাজ্জুদের ও এস্তেখারার নামায পড়ব।

বুবু তুমি তো আমাকে কবে থেকে তাহাজ্জুদ নামাষের ফযিলত বলে পড়তে বলেছ, পড়িনি। আজ থেকে আমিও পড়ব।

তা হলে উঠ, দু’জনে অজু করে আসি।

সালেহা তাহাজ্জুদের নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আর আসমা তাহাজ্জুদ নামাযের পর এস্তেখারার নামায পড়ে আল্লাহর কাছে কী করবে না করবে জানার জন্য কেঁদে কেঁদে দোয়া। করে ঘুমাল।

সালেহা এস্তেখারার নামাযের সম্বন্ধে জানে। তাই সকালে ফযরের নামায পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করার সময় বুবুকে জিজ্ঞেস করল, স্বপ্ন দেখেছিলে?

আসমা বলল, না। তারপর বলল, পর পর সাত রাত পড়ার নিয়ম। এর মধ্যে আল্লাহ স্বপ্নে জানিয়ে দেবেন।

তিন রাত পড়ার পর আসমা স্বপ্নে দেখল, রিয়াজুলের মা-বাবা ও ছোট চাচা তাদের বাড়িতে এসে যখন বিয়ের দিন ঠিক করার কথাবার্তা বলছেন তখন রিয়াজুল ছিল না। হঠাৎ সেই সময় মনোয়ার হোসেন চাচা এসে বললেন, তোমরা বিয়ের দিন ঠিক করছ, আর ওদিকে রিয়াজুলকে কারা খুন করেছে। এই কথা শুনে আসমা চমকে উঠল। সেই সাথে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তারপর বাকি রাতটা ভয়ে সে ঘুমাতে পারল না। কেঁদে কেঁদে ফজর করল। ফজরের নামায পড়ে আল্লাহকে জানাল, হে রহমানুর রহিম, স্বপ্নের দ্বারা এ কেমন ইশারা করলে? রিয়াজুল ভাইয়ের তুমি হায়াৎ দারাজ কর। তার হায়াৎ না থাকলে আমার হায়াৎ তাকে দাও। তার বদলে আমাকে তুমি দুনিয়া থেকে তুলে নাও।

আসমারা যেদিন বাড়ি ফিরে আসে সেদিন সকালে মতি নানার অসুখের কথা শুনে তাকে দেখার জন্য সোনাহাটা গিয়েছিল। তিনদিন পরে আজ ফিরে এসে তাদের আসার কথা জানতে পেরে দেখা করতে গেল।

মোসারেফ হোসেন বারান্দায় বসেছিলেন। মতিকে দেখে বললেন, এস বাবা এস। আমরা তো তিন দিন হল ফিরেছি। তুমি আসনি কেন?

মতি সালাম দিয়ে বলল, নানার অসুখ, দেখতে গিয়েছিলাম। আজই ফিরেছি। তারপর বলল, আসমার চিঠিতে জানতে পেরেছিলাম, আপনি হাঁটা চলা করতে পারছেন; এখন কেমন আছেন?

আল্লাহর রহমতে ভালো। তোমরা সবাই ভালো আছ?

জ্বি ভালো। তারপর বলল, আসমাকে দেখছি না কেন?

মতি এই কদিন আসেনি কেন জানার জন্য আসমা আজ সকালে জাহিদকে তাদের বাড়ি পাঠিয়েছিল। জাহিদ ফিরে এসে জানিয়েছে, সে নানার বাড়ি গেছে। দুপুরে রান্নার কাজে মাকে সাহায্য করছিল। মতির গলার শব্দ পেয়ে তার বুক ধক ধক করতে লাগল। রান্না ঘর থেকে আব্বার ও মতির কথা শুনতে পাচ্ছে।

মোসারেফ হোসেন অনেক আগে থেকে ভেবে রেখেছিলেন, আসমাকে মতির হাতেই দেবেন। মতির বাবা যে দাবি-দাওয়া করবেন, তা দিতে পারবেন না ভেবে সে কথা কাউকে বলেননি। মতির বাবা মারা যাওয়ার পর মতিকে বলবেন বলবেন করেও বলেন নি। তারপর ঢাকায় গিয়ে রিয়াজুলের মতামত ও তার খালা-খালুর প্রস্তাব পাওয়ার পর ভেবেছেন, এই জন্য বোধহয়, আল্লাহ কথাটা মতিকে এতদিন বলতে দেননি। ভাবলেন, মতিকে এখনই রিয়াজুল ও আসমার বিয়ের কথা জানান দরকার। তিনি আসমাকে রান্নাঘরে যেতে দেখেছেন। মতি তার কথা জিজ্ঞেস করতে বললেন, আসমা রান্না ঘরে। তারপর তার নাম ধরে ডেকে বললেন, মতি এসেছে এক কাপ চা করে নিয়ে।

মতি বলল, না চাচা, এখন চা খাব না।

তা হলে সরবত খাও। তারপর মেয়েকে এক গ্লাস সরবত করে আনতে বলে বললেন, জান বাবা, রিয়াজুলের মতো ছেলে সারা দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। তুমি বোধহয় জান, ওর খালা-খালু ওকে নিজের ছেলের মতো লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছেন। তারাও খুব ভালো মানুষ। আমার জন্য যা করেছেন, তা কেউ আপনজনের জন্যও করে না। তাদের কোনো সন্তানাদি নেই। রিয়াজুলই তাদের সব। তারা আসমাকে পছন্দ করে বৌ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তুমিই বল না বাবা, যারা আমার জন্য এত কিছু করলেন, তাদের প্রস্তাব কী ফিরিয়ে দিতে পারি? তারা কিছুদিনের মধ্যে এসে রিয়াজুলের ছোট চাচার বাড়িতে উঠবেন। তারপর বিয়ের ব্যবস্থা করবেন।

কথাটা শুনে মতির নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। তার সন্দেহ সত্যে পরিণত হতে যাচ্ছে জেনে রিয়াজুলের উপর প্রচণ্ড আক্রোশ হল। সেই সাথে আসমার উপরও কম হল না। মাথা নিচু করে গম্ভীর হয়ে বসে রইল। তখন তার মনের মধ্যে প্রতিহিংসার ঝড় বইছে।

আসমা সরবত করার সময় আব্বার সব কথা শুনেছে। দুরু দুরু বুকে সরবতের গ্লাস। নিয়ে মতির সামনে এসে বলল, মতি ভাই সরবত নাও।

আসমার হাতের কোনো কিছু খেতে মতির ইচ্ছা হল না। যে আসমাকে দেখার জন্য আজ একমাস অধীর আগ্রহ নিয়ে দিন গুনেছে, যার আসার খবর পেয়ে ছুটে এসেছে, সেই আসমার দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করল না। মাথা নিচু করে বসেই রইল।

অনুরোধ করার শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও আসমা করতে পারল না।

মতি এলে সবসময় আসমাকে আগে বেড়ে তার সঙ্গে কথা বলতে মোসারেফ হোসেন দেখেছেন। আসমার উপর সংসারের দায়-দায়িত্ব। তাই সে মতিকে দিয়ে অনেক কাজ করায়। সে জন্যে তারা অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলে। মেয়েকে মতির হাতে দেবেন ভেবে তাদের মেলামেশায় বাধা দেননি। বিয়ের কথা শোনার পর থেকে মেয়ের মুখ গম্ভীর দেখেছেন। আজ আবার আসমার বিয়ের কথা শুনে মতির অবস্থা দেখে মোসারেফ হোসেন। মনে মনে চমকে উঠলেন। ভাবলেন, তা হলে কী এদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সামলে নিয়ে বললেন, কী হল বাবা মতি, সরবতটা খেয়ে নাও।

না খেলে চাচা মনে কষ্ট পাবে ভেবে আসমার দিকে না তাকিয়ে সরবতের গ্লাস নিয়ে। খেল। তারপর গ্লাসটা পাশে রেখে এখন আসি চাচা বলে সালাম দিয়ে হন হন করে চলে গেল।

আসমা তার পিছন পিছন এসেও ধরতে পারল না। পুকুর পাড়ে এসে বলল, মতি ভাই। দাঁড়াও, কথা আছে।

 মতি শুনেও না শোনার ভান করে চলে গেল।

আসমা এতক্ষণ সামলাতে পারলেও এখন আর পারল না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল জানতে পারল না। সালেহা এসে যখন বলল, বুবু তোমাকে আব্বা ডাকছে তখন হুঁস হল। চোখ মুখ মুছে বলল, হ্যাঁ চল।

যেতে যেতে সালেহা বলল, মতি ভাই রিয়াজুল ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ের কথা শুনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছে।

শুধু কষ্ট পায়নি, খুব রেগেও গেছে। দেখলি না, আমার দিকে তাকায়নি পর্যন্ত।

 হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হচ্ছে।

ততক্ষণে তারা উঠোনে এসে গেছে। মোসারেফ হোসেন আসমার নাম ধরে ডেকে বললেন, আমার কাছে আয়।

আসমা সালেহাকে মায়ের কাছে যেতে বলে আব্বার কাছে এল।

মোসারেফ হোসেন নরম সুরে বললেন, তুই আর মতির সঙ্গে মেলামেশা করবি না। সে। এলে যতটুকু কথা না বললে নয়, ততটুকু বলবি। আল্লাহ এখন আমাকে সুস্থ করেছেন। দরকারী কথা আমিই মতির সঙ্গে বলব। এ বাড়ি-ও বাড়ি ঘুরে বেড়াবি না। কিছুদিনের মধ্যে তুই মিয়া বাড়ির বৌ হবি। সেই বুঝে চলাফেরা করবি। তোর মা বলছিল, এই ক’দিন তুই নাকি একদম খাওয়া-দাওয়া করিসনি? কোনো অসুখ-বিসুখ করেনি তো?

না আব্বা, আমার কিছু হয়নি। তুমি চিন্তা করো না।

তোকে যতদিন না রিয়াজুলের হাতে দিতে পারছি ততদিন নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। আল্লাহ যেন ভালই ভালই কাজটা মিটিয়ে দেন। এবার যা আমার গোসলের পানি দে, যোহরের আযানের সময় হয়ে এল।

কিসের জন্য যেন স্কুল কয়েকদিন বন্ধ। দুপুরে খেয়ে উঠে জাহিদ ঘুমাল। আর সালেহা আসমাকে বলল, অনেক অংক পারিনি, সেগুলো বুঝিয়ে দাও।

আসমা বলল, বই খাতা বের কর।

সালেহা ঘরের মেঝেতে পাটি মেলে বই খাতা নিয়ে বসল।

আসমা তার পাশে বসে বলল, বই খুলে দেখা কোন অংকগুলো পারিস নি।

সালেহা অংকের বই খুলে দেখিয়ে দিয়ে বলল, বুবু তিন রাত পার হয়ে গেল, স্বপ্ন। দেখনি?

আসমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, দেখেছি। তোর শোনার দরকার নেই।

বল না বুবু, আল্লাহর কসম কাউকে বলব না।

কথায় কথায় আল্লাহর কসম কাটিস কেন? আমি কী তোকে কসম কাটতে বলেছি?

ঠিক আছে, আর কাটব না। কি স্বপ্ন দেখেছ তুমি বল।

শোন, স্বপ্নের কথা বড় আলেমের কাছে ছাড়া কারো কাছে বলতে নেই। তা ছাড়া তিন দিনের আগে বলাও নিষেধ। তিন দিন পর মসজিদের ইমাম হুজুরের কাছে তোকে সাথে করে নিয়ে যাব স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানার জন্য, তখন শুনিস। এখন অংক বুঝে নে।

আসরের আযান হতে আসমা বলল, বাকিগুলো কাল বুঝিয়ে দেব। তারপর জাহিদকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বলল, উঠ আযান হয়ে গেছে। অজু করে আমার সঙ্গে দেখা করে নামায পড়তে যাবি।

জাহিদ অজু করে এলে আসমা বলল, মতি ভাই মসজিদে নামায পড়তে এলে তাকে বলবি, আজ রাত নটার সময় অতি অবশ্যই যেন আমার সঙ্গে দেখা করে। আমি পুকুর পাড়ের জাম গাছের তলায় থাকব। আর যদি সে মসজিদে না আসে তবে তাদের ঘরে গিয়ে তাকে বলে আসবি।

ঠিক আছে বলব বলে জাহিদ নামায পড়তে মসজিদে গেল। নামায পড়ে বেরোবার সময় মতি ভাইকে দেখে বুবুর কথা বলল।

মতি শুনে রেগে গিয়ে কিছু না বলে চলে গেল।

 জাহিদ ফিরে এলে আসমা জিজ্ঞেস করল, কিরে, মতি ভাই নামায পড়তে এসেছিল?

হা। যা বলতে বলেছিলে বলেছি।

শুনে কিছু বলেনি?

না। বলে জাহিদ খেলতে চলে গেল।

 এশার নামায পড়ে আসমা সালেহাকে বলল, আমি পুকুর পাড়ের জাম গাছতলায় যাচ্ছি। জাহিদকে দিয়ে মতি ভাইকে এই সময়ে আসতে বলেছি। আব্বা ডাকলে আমি নামায পড়ছি বলে আমাকে খবর দিবি। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জাম গাছের নিচে অপেক্ষা করতে লাগল।

জাহিদের মুখে আসমা ডেকেছে শুনে মতি প্রথমে খুব রেগে গিয়ে যাবে না ভেবেছিল। পরে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিল, গিয়েই দেখা যাক, আসমা কী বলে।

এশার নামায পড়ে মতি জাম গাছ তলায় এসে দেখল, আসমা দাঁড়িয়ে আছে। বলল, কেন ডেকেছ বল?

আসমা বসে পড়ে তার দু’পায়ে দু’টো হাত রেখে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, বিশ্বাস কর মতি ভাই, ঢাকায় থাকাকালীন আমি এ সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। ঘরে এসে আব্বা আমাকে বলেছে। শোনার পর থেকে আমি যে কী যন্ত্রণায় ভুগছি তা আল্লাহকে মালুম। একদিকে তুমি, আর অন্যদিকে আব্বার জীবন। তারপর ডাক্তার যা বলেছিলেন বলে বলল, তুমি আমাকে বিষ এনে দাও, খেয়ে এই যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাই।

আসমার কথা শুনে তার প্রতি মতির যে রাগ ছিল, তা পড়ে গেল। হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে তার চোখ-মুখ মুছিয়ে দেওয়ার সময় বলল, তুমি বিষ এনে দেওয়ার কথা আমাকে বলতে পারলে? যন্ত্রণা তুমি একা ভোগ করছ? আমি করিনি? বিষ খেলে দুজনে একসঙ্গে খাব।

আসমা চমকে উঠে ভিজে গলায় বলল, না মতি ভাই, না। তা হলে আব্বা আবার পঙ্গু হয়ে যাবে, অথবা হার্টফেল করে মারা যাবে। যদি ডাক্তার ঐ কথা না বলতেন, তা হলে আব্বার মুখে রিয়াজুল ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের কথা শোনার রাত্রেই এই জীবন শেষ করে দিতাম। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

রিয়াজুল ঢাকা থেকে ফিরে এসে ছোট চাচা-চাচিকে আসমার সম্বন্ধে মা-বাবার ইচ্ছার কথা জানাতে তারা শুনে খুশি হয়ে বললেন, এতে খুব ভালো কথা। তুমি তাদেরকে চিঠি লিখে তাড়াতাড়ি আসতে বলে দাও। এসব কাজে দেরি করতে নেই।

রিয়াজুল বলল, ছোট চাচা, মোসারেফ চাচার জমির দলিল তো রেজেন্ত্রী হয়নি। সেটা আমাকে দেবেন। ওটা ফেরৎ দেব ভেবেছি।

সামসুদ্দিন বললেন, তোমার জিনিস তুমি ফেরৎ দেবে, তাতে আমি বাধা দেব না। বরং এখন ফেরৎ দেওয়াই ভালো মনে করি। যখন দিতে যাবে তখন চেয়ে নিও।

রিয়াজুল বাবার সম্পত্তি মিউট্রেশনের জন্য দরখাস্ত করে ঢাকা গিয়েছিল। সে ব্যাপারে এই দু’তিন দিন অফিসে ছুটাছুটি করেছে। তাই আসমাদের ওখানে যেতে পারেনি। আজ মসজিদে এশার নামায পড়ে রওয়ানা দিল। আকাশে সপ্তমীর চাঁদ। তাই টর্চ লাইট নিয়ে বেরোয়নি। চাঁদের আলোয় হেঁটে আসছিল।

আসমাদের পুকুরটা উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। তার পূর্ব পাড় দিয়ে ওরা যাতায়াত করে। উত্তর পাড়ে ঘাট ও বাস্তু ভিটা। ঘাট থেকে বাস্তুটা বিশ-পঁচিশ হাত দূরে। পুকুরের চারপাশের পাড়ে নানারকম ফলের গাছ। জাম গাছটা ঘাটের কাছে পশ্চিম পাড়ে।

রিয়াজুল ঘাটের কাছাকাছি এসে আমাকে পশ্চিম পাড়ের দিকে যেতে দেখে একটা নারকেল গাছেল আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভাবল, ওদের বাড়ির পিছনে ছোট বড় বাথরুমের ব্যবস্থা, এত রাতে ঐদিকে যাচ্ছে কেন? একটু পরে পুরুষ ছেলের গলা পেয়ে সন্দেহ হল। ভাবল, ছেলেটা মতি নয় তো?

অল্প একটু এগিয়ে নিশ্চিত হল। তারপর একটা আমগাছের আড়াল থেকে তাদের কথাবার্তা শুনতে লাগল।

তখন তার মনে পড়ল, বেশ কিছুদিন আগে তাদের দু’জনের অনেকক্ষণ আলাপ করার ঘটনা। সেদিন মনে একটু যে সন্দেহ হয়েছিল, আজকের ঘটনায় তা দৃঢ় হল। সঙ্গে সঙ্গে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। যে আসমাকে ফুলের মতো পবিত্র মনে করেছিল, সে কিনা। বাসি ফুল? ছি-ছি-ছি। যে রাতের অন্ধকারে প্রেমিকের সঙ্গে অভিসার করে, তাকে পবিত্র ভেবে বিয়ে করতে যাচ্ছি? না-না, এ কখনই সম্ভব নয়। চিন্তা করতে লাগল, তার এখন কী করা উচিত।

মোসারেফ হোসেন মেয়েকে কিছু বলার জন্য স্ত্রীকে বললেন, আসমাকে ডাক তো।

মাহমুদা বিবি পাশের রুমে গিয়ে সালেহা ও জাহিদকে পড়তে দেখে সালেহাকে জিজ্ঞেস করলেন, আসমা কোথায়?

সালেহা মাকে দেখে বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, বুবু এক্ষুণি বাথরুমে গেল।

বাথরুম থেকে এলে বলিস, তোর আব্বা ডেকেছে। কথা শেষ করে মাহমুদা বিবি চলে গেলেন।

সালেহা তাড়াতাড়ি বুবুকে ডাকতে গেল।

কারো আসার শব্দ পেয়ে রিয়াজুল ঘাটের দিকে আসার সময় সালেহাকে দেখে বলল, এত রাতে এদিকে কোথায় যাবে?

সালেহা তাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কোনো উত্তর দিতে না পেরে মাথা নিচু করে নিল।

রিয়াজুল বুঝতে পারল, সালেহা ওদের অভিসারের কথা জানে। দেরি হচ্ছে বলে হয়তো বুবুকে ডাকতে এসেছে।

সালেহা আমতা আমতা করে বলল, আমি ঘাটে এসেছি। আপনি এদিকে কি করছিলেন।

আমি তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। এদিকে কারা যেন কথা বলছে শুনে দেখতে যাচ্ছিলাম। যাক গে চলি, আজ আর যাব না। কাল সকালে আসব বলে রিয়াজুল চলে গেল।

রিয়াজুল চলে যাওয়র পর সালেহা জামগাছের কাছাকাছি এসে বলল, বুবু তোমাকে আব্বা ডাকছে।

আসমা মতিকে বলল, কাল এই সময়ে এস। তারপর এগিয়ে এসে সালেহাকে বলল, চল।

আমগাছের কাছে এসে সালেহা বলল, রিয়াজুল ভাইকে এখানে দেখলাম। আমাকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এত রাতে এদিকে কোথায় যাবে?

আসমা চমকে উঠে ভয়ার্ত স্বরে বলল, কী বলছিস তুই?

হা বুবু।

তার কথার উত্তরে তুই কী বললি?

বললাম, আমি ঘাটে এসেছি। তারপর বললাম, আপনি এখানে কী করছিলেন? জবাবে উনি বললেন, তোমাদের বাড়ি যাচ্ছিলাম। বুবু, আমার মনে হয় উনি তোমাদের কথাবার্তা শুনেছেন।

রিয়াজুল ভাই আমাদের ঘরে গেছেন?

না। বললেন, কাল সকালে আসবেন।

 ততক্ষনে তারা উঠোনে চলে এল। আসমা তাকে যেতে বলে আব্বার কাছে এল। তার বুক ভয়ে তখনওঁ ধক ধক করছে। ঘরে ঢুকে যথাসাধ্য সংযত করে বলল, আমাকে ডেকেছ আব্বা?

মোসারেফ হোসেন বললেন, এই ক’দিন রিয়াজুল এল না কেন বলতে পারিস?

 হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত আছেন। কাল আসবেন বলতে গিয়েও সামলে নিল।

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়! কাল সকালে না হয় জাহিদকে ডাকতে পাঠাস।

ঠিক আছে, পাঠাব।

আজ তিন-চারদিন হয়ে গেল ছেলেটা এল না। কোনো অসুখ-বিসুখ করল কিনা কে জানে।

কাল জাহিদকে পাঠালে খবর পাওয়া যাবে।

তা অবশ্য যাবে। কি জানিস মা, এই ক’দিন ছেলেটাকে না দেখে বড় খারাপ লাগছে। ঠিক আছে, যা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।

আসমা খেয়ে রুমে এসে দেখল, জাহিদ ঘুমিয়ে পড়েছে। আর সালেহা মশারী খাটাচ্ছে।

 বুবুকে দেখে সালেহা জিজ্ঞেস করল, আব্বা ডেকেছিল কেন?

রিয়াজুল ভাই ক’দিন আসেনি কেন জিজ্ঞেস করে বলল, কাল সকালে ডেকে আনার জন্য জাহিদকে পাঠাস।

ছোট বাথরুমের কাজ সেরে এসে দু’বোনে শুয়ে পড়ল। কিন্তু কারো চোখে ঘুম এল না। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে সালেহা বলল, বুবু তুমি ঘুমিয়েছ?

আসমা বলল, নারে, ঘুম আসছে না। তুই ঘুমাসনি কেন?

আমারও ঘুম আসছে না। রিয়াজুল ভাই যদি সত্যি সত্যি তোমাদের কথাবার্তা শুনে থাকে, তা হলে কি হবে ভেবে ভয় ভয় করছে।

তোর ভয় করবে কেন? করলে আমার করবে। শোন, তোকে যদি রিয়াজুল ভাই। আজকের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে, বলবি, তুই কিছু জানিস না।

আর তোমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তুমি কী বলবে?

 সে তখন দেখা যাবে। তোকে ভাবতে হবে না।

তুমি মতি ভাইয়ের রাগ মানাতে পেরেছ?

আসমা রেগে উঠে বলল, হ্যাঁ পেরেছি। তারপর বলল, এত উঁকিলি জেরা করছিস কেন? নে এবার শুয়ে পড়।

আরো কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে সালেহা ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু আসমার চোখে ঘুম এল না। রিয়াজুল ভাই কিছু জিজ্ঞেস করলে কী বলবে না বলবে ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

.

সামসুদ্দিন মিয়া নামায পড়ে মমজিদ থেকে ফিরে ভাত না খেয়ে ভাইপোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাকে দেখে বললেন, ভাত না খেয়ে কোথায় গিয়েছিলে?

রিয়াজুল বলল, একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

খাওয়ার পর সামসুদ্দিন মিয়া জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মা-বাবাকে আসার জন্য চিঠি দিয়েছ?

রিয়াজুল মনে মনে বলল, তার আর দরকার নেই ছোট চাচা। মুখে বলল, কাজের ব্যস্ততায় দিতে পারিনি। কাল দেব। তারপর ঘুমাতে গিয়ে অনেক রাত ঘুমাতে পারল না। চোখ বন্ধ করতেই আসমা ও মতির কথপোকথন মনে পড়তে লাগল। হঠাৎ তার বিবেক বলে উঠল, তুমি শিক্ষিত ও ধার্মীক ছেলে হয়ে এই সামান্য ব্যাপারে বিচলিত হচ্ছ কেন? তুমি তো তোমার আব্বার বন্ধুকে আব্বার মতো মনে করে ও আল্লাহর নবী (দঃ) এর বানী স্মরণ করে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য মোসারেফ হোসেনকে সাহায্য করছ। নিশ্চয় তার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য নয়? তার মেয়ের জন্য করলে তো তুমি আল্লাহ ও তাঁর নবী (দঃ) এর সন্তুষ্টি পাবে না। তা ছাড়া তুমি তো আসমাকে ভালবাসনি। মা-বাবা মনে কষ্ট পাবে ভেবে বিয়েতে মত দিয়েছ। আর আসমা ও মতি অনেক বছর আগে থেকে একে অপরকে ভালবাসে। সেই ভালবাসার মাঝখানে বাধা সৃষ্টি করা কী তোমার উচিত? তুমি কী ভুলে গেছ, সুখ-শান্তি ভোগে নয়, ত্যাগে। মনে রেখ, যারা প্রকৃত মুসলমান, তারা নিজের সুখ শান্তির চেয়ে অন্যের সুখ-শান্তির চিন্তা বেশি করে। তা ছাড়া আসমাকে বিয়ে করলে সবাই ভাববে, এই জন্যই তাদেরকে সাহায্য করছ। আল্লাহ রাজি থাকলে তোমার তকৃদিরে আসমার থেকে আরো ভালো মেয়েকে বউ হিসেবে পাবে। শুধু শুধু নিষ্পাপ ফুলের মতো দুটো ছেলে-মেয়েকে দুঃখের সাগরে ভাসিওনা। আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে যে মহৎ কাজে হাত দিয়েছে, তা যদি সম্পন্ন করতে পার, তা হলে আসমাকে বিয়ে করে যতটা না সুখ-শান্তি পেতে তার থেকে অনেক বেশি পাবে।

বিবেকের যুক্তির কাছে রিয়াজুল হেরে গেল। সিদ্ধান্ত নিল, সে নিজে মতির সঙ্গে আসমার বিয়ের ব্যবস্থা করবে। তারপর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত দু’টো।

বিছানা থেকে নেমে অজু করে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে মোনাজাত করল, হে গাফুরুর রহিম, আমি তোমার একজন নাদান গোনাহগার বান্দা। ভুল-ত্রুটি হওয়া স্বাভাবিক। তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাস। আমি আমার ভুল ত্রুটির জন্য ক্ষমা চাইছি, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। তোমাকে ও তোমার হাবিব (দঃ) কে সন্তুষ্ট করার জন্য যে পথে অগ্রসর হয়েছি তা সফল করার তওফিক আমাকে দাও। শয়তানের চক্রে পড়ে আমি যেন পথভ্রষ্ট না হই। বিতাড়িত শয়তানের হাত থেকে তুমি আমাকে রক্ষা কর। আমার সকল নেক মনস্কামনা পূরণ কর। তোমার পেয়ারা হাবিব (দঃ) এর উপর শতকোটি দরূদ ও সালাম। তাঁরই অসিলায় আমার এই দেওয়া কবুল কর। আমিন। মোনাজাত শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে রিয়াজুল ছোট চাচার কাছ থেকে মোসারেফ হোসেন চাচার জমির দলিল নিয়ে ফেরৎ দেওয়ার জন্য রওয়ানা দিল। পথে মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা হতে সালাম বিনিময় কলে বলল, চাচা, আপনার সঙ্গে আমার খুব দরকারী কথা আছে।

মনোয়ার হোসেন বললেন, এখন তো সময় নেই বাবা, কাজে যাচ্ছি। ফিরতে সন্ধ্যে পার হয়ে যাবে। এশার নামাযের পর না হয় এস।

তাই আসব বলে রিয়াজুল আসমাদের পুকুর পাড়ে এসে দেখল, মোসারেফ হোসেন চাচা, হাঁটাহাঁটি করছেন। কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

মোসারেফ হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো। তুমি এই কদিন আসনি কেন? তোমার খবর নেওয়ার জন্য জাহিদকে পাঠাবার কথা আসমাকে কাল রাতে বলে রেখেছিলাম।ও স্কুলে গেছে। ফিরে এলে পাঠাতাম।

রিয়াজুল বলল, আব্বার অংশের জমিগুলো মিউট্রেশান করার জন্য অফিসে ছুটাছুটি করতে হচ্ছে। তাই আসতে পারিনি।

 চল বাবা ঘরে গিয়ে বসি।

না চাচা, এখন সময় হবে না। পরে আবার আসব। তারপর দলিলটা পকেট থেকে বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, আপনার যে জমি ছোট চাচা আমার নামে কিনেছিলেন, এটা সেই দলিল। রেজিষ্ট্রী তো হয়নি। এখন আর রেজিষ্ট্রী করারও দরকার নেই। ছেলে কি তার বাবার জমি কিনতে পারে? আপনার জমি আপনারই থাক। এ বছর থেকে আপনিই ভোগ দখল করবেন।

মোসারেফ হোসেনের মনে হল, পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দিবা স্বপ্ন দেখছেন। কোনো কথা বলতে পারলেন না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। একসময় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।

রিয়াজুল বলল, কাঁদছেন কেন? আপনি কী মনে করছেন এই জমি আপনাকে দান করলাম? তা কখনো মনে করবেন না। ছেলে কী বাবাকে দান করতে পারে? চোখ মুছুন, নচেৎ ভাবব, আমাকে ছেলে হিসাবে গ্রহণ করতে পারেননি।

না বাবা না, আমি তা ভাবিনি। তোমাকে নিজের ছেলের থেকে বেশি মনে করি। তোমার মতো ছেলে যে মা-বাবা জন্ম দিয়েছেন তারা ধন্য। তাদেরকে আল্লাহ জান্নাতবাসি করুন। তোমার মনের উদারতা দেখে চোখের পানি রোধ করতে পারিনি। আল্লাহ তোমাকে চিরসুখী করুন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, দলিল ফেরৎ দেওয়ার ব্যাপারটা তোমার ছোট চাচা জানেন?

জ্বি জানেন। এবার আসি। সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে রিয়াজুল আসার সময় চিন্তা করতে লাগল, কী ভাবে মতির সঙ্গে আসমার বিয়ের ব্যবস্থা করবে? সব থেকে বেশি যে কথাটা ভাবিয়ে তুলল, সেটা হল মোসারেফ চাচাকে কী করে ম্যানেজ করবে। আসমাকে বিয়ে করব না শুনে যদি মনে আঘাত পেয়ে স্ট্রোক করে আবার পঙ্গু হয়ে যান। সারাদিন চিন্তা করেও কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারল না। শেষে ভেবে রাখল, মনোয়ার হোসেন চাচাকে সব কথা জানিয়ে পরামর্শ চাইবে।

মোসারেফ হোসেন ঘরে এসে স্ত্রীকে, আসমাকে ও সালেহাকে ডেকে দলিলটা দেখিয়ে বললেন, এটা আমাদের পাঁচ বিঘা জমির দলিল। যে জমি আমি সামসুদ্দিন মিয়ার কাছে বিক্রি করেছিলাম। উনি ভাইপোর নামে দলিল করিয়েছিলেন। কথা ছিল, রিয়াজুল এলে রেজিষ্ট্রী হবে। রিয়াজুল একটু আগে এসেছিল। দলিল ফেরৎ দিয়ে বলল, ছেলে কী বাবার সম্পত্তি কিনতে পারে? এ বছর থেকে আপনার জমি আপনি চাষ করবেন। কত বড় উদার মনের ছেলে তোমরা দেখেছ? কথা বলতে বলতে কান্নায় তার গলা বুজে এল। সামলে নিয়ে আসমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দু’দিন পর তুই বুঝতে পারবি, ওর মন কত উদার। তারপর আসমানের দিকে দু’হাত তুলে বললেন, আল্লাগো, তুমি তাড়াতাড়ি সে দিন আমাকে দেখাও, যে দিন আসমাকে রিয়াজুলের হাতে তুলে দেব।

.

মনোয়ার হোসেন মোসারেফ হোসেনের চাচাতো ভাই। বয়সে পাঁচ-সাত বছরের বড়। জমি জায়গা যা ছিল ভালো ভাবেই চলে যেত। তার কোনো পুত্র সন্তান নেই। তিন মেয়ে। জমি বিক্রি করে তাদের বড় ঘরে বিয়ে দিতে গিয়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। বিঘে খানেকের মতো জমি এখনো আছে। তার ফসলে ও অন্যের খেত খামারে কাজ করে স্বামী স্ত্রীর একরকম চলে যায়। অসুখ-বিসুখে মেয়ে জামাইরা কিছু কিছু সাহায্য করে। মোসারেফ হোসেনের পূর্বদিকে পুকুর পাড়ের অল্প দূরে তার দোচালা বেড়ার ঘর। আজ কাজ থেকে ফিরে এশার নামায পড়ে খাওয়া দাওয়ার পর দাওয়ায় বসে বিড়ি টানছিলো।

এমন সময় রিয়াজুল উঠোনে এসে চাচা বলে ডাকল।

 মনোয়ার হোসেন বিড়ি নিভিয়ে ফেলে দিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, তুমি এসেছ?

রিয়াজুল সালাম বিনিময় করে বলল, বাইরে বসে কথা বলি চলুন।

মনোয়ার হোসেন বললেন, তাই চল, তারপর উঠোনের বাইরে লিচু গাছের তলায় এসে বললেন, এখানেই বসা যাক।

বসার পর রিয়াজুল বলল, চাচা, আমি একটা সমস্যায় পড়েছি। আপনি ছাড়া আর কেউ সমাধান করতে পারবে না।

 কি যে বল বাবা। শুনেছি তুমি শিক্ষিত ছেলে। আর আমি হলাম পাড়া-গাঁয়ের মূর্খ মানুষ। আমি কী করে সমস্যার সমাধান করব?

আমি শিক্ষিত হলে কী হবে? বয়সে আপনার ছেলে মত। হাজার হোক আপনি মুরুব্বি। কথায় আছে, কোনো সমস্যায় পড়লে মুরুব্বি লোকের কাছে পরামর্শ নেবে। তা ছাড়া যে ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি, তা আপনার সাহায্য ছাড়া সমাধান হবে না।

তাই যদি মনে কর, তা হলে সমস্যাটা বল, যদি সম্ভব হয়, যেকোন সাহায্য করার চেষ্টা করব।

শুধু চেষ্টা করার কথা বললে চলবে না। আপনাকে কথা দিতে হবে আমাকে সাহায্য করবেন। আমার দৃঢ় ধারণা, আপনি সাহায্য করলে সমস্যার সমাধান হবেই।

তোমার বাপকে আল্লাহ বেহেস্ত নসীব করুক। আমার সঙ্গে তার খাতির ছিল। আমার দ্বারা যদি তোমার কোনো উপকার হয়, তা হলে কথা দিলাম, সাহায্য করব। এবার তোমার সমস্যাটা বল।

আপনি কী শুনেছেন, আসমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে?

হা বাবা শুনেছি। আসমার বাপ ও তোমার ছোট চাচার কাছে শুনেছি। তা ছাড়া তুমি তোমার বাপের বন্ধুর জন্য যা কিছু করছ তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

আচ্ছা চাচা, মতি কেমন ছেলে বলতে পারেন?

হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?

সে কথা পরে বলছি। মতির কথা আগে বলুন।

মতি খুব ভালো ছেলে। ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকায় চাকরি করত। হঠাৎ করে বাপটা মারা গেল। চাকরি ছেড়ে সংসারের হাল ধরেছে।

আমি মতির সঙ্গে আসমার বিয়ে দিতে চাই।

মনোয়ার হোসেন খুব অবাক হয়ে বললেন, সে কি বাবা, তুমি আসমাকে বিয়ে করবে?।

করার তো কথা ছিল, কিন্তু কালকে জানতে পারলাম, ওরা দুজন একে অপরকে অনেক আগে থেকে পছন্দ করে। এখন আপনিই বলুন, আমাকে বিয়ে করে আসমা কী সুখী হবে? না আমি সুখী হব? আর মতিও খুব দুঃখ পাবে। আমরা তিনজনের কেউই সুখি হতে পারব। না। তাই মতির সঙ্গেই আসমার বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

মনোয়ার হোসেন মতি ও আসমার সম্পর্ক জানে। বহুবার দু’জনকে নির্জন দুপুরে পুকুরের পশ্চিম পাড়ে বসে গল্প করতে দেখেছেন। বেশ কয়েকবার মোসারেফ হোসেনের কানেও কথাটা তুলেছেন। তাই রিয়াজুল তাদের পছন্দের কথা বলতে কোনো প্রতিবাদ করতে পারলেন না। বরং রিয়াজুলের মনের উদারতার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হলেন। তার প্রতি স্নেহ আরো বেড়ে গেল।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে রিয়াজুল বলল, কি হল চাচা, কি এত ভাবছেন?

কী আর ভাবব বাবা, তোমার মতো ছেলে এখনো দুনিয়ায় আছে, তোমাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না।

আমার কথা বাদ দিন। ওদের ব্যাপারে কী করবেন বলুন। আমি নিজেই কথাটা মোসারেফ চাচাকে বলতে পারতাম। কিন্তু উনি যদি কথাটা শুনে উত্তেজিত হন, তা হলে আবার পঙ্গু হয়ে যাবেন অথবা হার্টফেল করে মারা যাবেন। তাই উনি যাতে উত্তেজিত না হন, সেই রকম পরামর্শ দিয়ে আপনি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করবেন।

মনোয়ার অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, খুব কঠিন সমস্যা বাবা, আমি মূর্খ মানুষ। এর সমাধান কী করতে পারব?

আপনি আসমার আব্বাকে বলবেন, ইদানিং আমার একটা খুব কঠিন রোগ ধরা। পড়েছে। ডাক্তার বিয়ে করতে নিষেধ করেছেন। আমার নিজের পক্ষে জানানো সম্ভব নয় বলে আপনাকে জানাতে বলেছি। আরো বলবেন, রিয়াজুল মতিকে খুব ভাল ছেলে বলে জানে। তার সঙ্গে আসমার বিয়ে দিতে চায়। সব খরচ-পত্র রিয়াজুল বহন করবে।

মনোয়ার হোসেন রিয়াজুলের মহানুভবতায় ক্রমশ আরো বেশি মুগ্ধ হলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আল্লাহ তোমাকে দু’জাহানে খুশি করুন। তোমার হায়াৎ বাড়িয়ে দিন। জেনেছি তুমি খুব ধার্মিক ছেলে। তোমার কাজ কর্ম দেখেও তাই মনে হচ্ছে। মৌলবীদের মুখে শুনেছি, ছেলে-মেয়ে ধার্মিক হলে আল্লাহ তাদের মা-বাবাকে নাজাত দেন। তোমার মা বাবাকে আল্লাহ নিশ্চয় নাজাত দেবেন। তোমার কথা শুনে খুশি হয়েছি। আমি গরীব ও মূর্খ। হলেও জীবনে কোনোদিন মিথ্যা বলিনি। মিথ্যা বলা যে হারাম, তা আমার চেয়ে তুমি বেশি। জান। তাই বলছি, মিথ্যা করে তোমার কঠিন অসুখের কথা বলার দরকার নেই। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। বলছি শোন, তুমি আসমাকে বিয়ে করবে না শুনলে মোসারেফ যে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন তা আমিও জানি। সেই সাথে তাকে যদি বলা হয়, তুমি সালেহাকে বিয়ে করবে, তা হলে তার কোন বিপদ হবে বলে মনে হয় না।

রিয়াজুল শুনে মনে মনে মনোয়ার চাচার বুদ্ধির তারিফ না করে পারল না। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, আল্লাহ সালেহাকে তোমার জোড়া করেছেন, তাই এরকম ঘটনা ঘটল।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে মনোয়ার বললেন, আমার বুদ্ধিটা তোমাকে যে নিতেই হবে তা ভেব না। পরামর্শ চেয়েছ দিলাম। নেওয়া না নেওয়া তোমার ইচ্ছা।

না চাচা, আপনি খুব ভালো পরামর্শ দিয়েছেন। আমি ভাবছি সালেহার বয়স কম, সে যদি আমাকে পছন্দ না করে?

তোমার কথা ঠিক, তবে আমার মনে হয়, সালেহা সে রকম মেয়ে নয়। আর বয়সের কথা যে বললে, সেটা কিছু না। ছেলেদের পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে ও মেয়েদের পনের থেকে বিশের মধ্যে বিয়ে হওয়া উচিত। সালেহার বয়স পনের ষোেলর মতো। আর তোমার নিশ্চয় ত্রিশের নিচে?

রিয়াজুল বলল, সাতাশ।

তা হলে তো বয়সের কথাই উঠে না। তুমি বললে, আমি কালই মোসারেফের সঙ্গে কথা বলব।

রিয়াজুল বলল, আমি ছোট চাচা-চাচির সঙ্গে আলাপ করে আপনাকে জানাব। এবার আসি চাচা। অনেক রাত হয়েছে বলে রিয়াজুল সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

মনোয়ার হোসেন পকেট থেকে বিড়ি ও দিয়াশলাই বের করে বিড়ি ধরিয়ে টানতে টানতে ঘরে এলেন। তার স্ত্রী করিমন স্বামীর অপেক্ষায় জেগে ছিলেন। তাকে ফিরে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, মিয়া বাড়ির ছেলের সঙ্গে এতক্ষণ কি কথা বলছিলে?

মনোয়ার হোসেন বললেন, সে অনেক কথা পরে শুনো। এখন রাত হয়েছে শুয়ে পড়।

.

১০.

মতি যে রাতে আসমার সঙ্গে জাম তলায় দেখা করে,তার পরের দিন সকালে বন্ধু জালালকে আসমার পরিস্থিতির কথা বলে বলল, এখন বল আমি কি করব?

জালাল বলল, তা হলে তো তোর জন্য কিছু করা দরকার। কিন্তু রিয়াজুলের মত ভালো। ছেলের বিরুদ্ধে কিছু করতে বিবেকে বাধছে।

তাই বলে আমার জন্য তুই কিছু করবি না?

জালাল কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, এক কাজ কর, তুই বা আসমা তোদের সম্পর্কের কথা তাকে জানিয়ে দে! তোকে তো সেদিন বলেছিলাম, তোদের সম্পর্কের কথা জানলে রিয়াজুল নিজেই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করবে।

তোর কথাটা কতদূর সফল হবে জানি না, তবে আসমাকে দিয়ে জানাব। যদি তোর কথা না ফলে, তা হলে কিন্তু তোকে বিহিত করে দিতে হবে।

ঠিক আছে, তাই হবে।

মতি ফিরে আসার সময় চিন্তা করল, আসমা তো আজ রাতে যেতে বলেছে, সেই সময় তাকে বলবে, সে যেন তাদের সম্পর্কের কথা রিয়াজুলকে জানায়।

রিয়াজুল মনোয়ার হোসনের সঙ্গে দেখা করতে আসার কিছুক্ষণ আগে মতি জামতলায় এসে অপেক্ষা করছিল। আসমা আসার পর বলল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। সেটা করতে পারলে রিয়াজুল ভাই তোমাকে বিয়ে তো করতে চাইবেন না, বরং আমার সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। আর সেই কাজটা তোমাকেই করতে হবে।

অকুল সমুদ্রে জাহাজ ডুবে গেলে মানুষ সাঁতার কাটতে কাটতে হয়রান হয়ে ডুবে যাওয়ার সময় সামান্য একটা ভাসমান কিছু পেলে তাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার জন্য যেমন তার মনের অবস্থা হয়, মতির কথা শুনে আসমার মনের অবস্থাও তেমনি হল। বলল, তাড়াতাড়ি বল, কী করতে হবে?

আমাদের সম্পর্কের কথা তুমি তাকে জানাবে।

 আসমা হতাশ গলায় বলল, ও এই কথা? আমি মনে করেছিলাম, কি না কী।

মতি বলল, তুমি হতাশ হচ্ছ কেন? আমার দৃঢ় বিশ্বাস রিয়াজুল ভাই আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে, আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবেনই।

তোমার ধারণা আল্লাহ কবুল করুক। তারপর গত রাতের ঘটনা খুলে বলল, আমার মনে হয়, রিয়াজুল ভাই আমাদের কথা সব শুনেছেন, আর বলা লাগবে না। তবু দু’একদিন অপেক্ষা করে দেখি, রিয়াজুল ভাই কী করেন। তারপর না হয় বলব।

হাঁ, তাই কর।

আজ সকালে একটা ঘটনা হয়েছে।

কী ঘটনা বল।

তুমি তো জান, সামসুদ্দিন চাচার কাছে আব্বা পাঁচ বিঘা জমি বিক্রি করেছিল। তারপর রিয়াজুল দলিল ফেরৎ দিয়ে যেসব কথা বলেছে বলল।

তাই নাকি? সত্যি রিয়াজুল ভাই খুব উঁচু মনের ছেলে। আমার এখন আরো দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে আমাদের ব্যাপারটা যদি জেনে থাকেন, তা হলে যা বললাম তা করবেনই।

আসমা বলল, আল্লাহ যেন তাই করেন। তুমি এবার যাও, আর রাত্রে এস না। দিনে সময় করে এস।

ঠিক আছে, তাই আসব বলে মতি বিদায় নিয়ে চলে গেল।

.

সালেহাকে পছন্দ হলেও রিয়াজুল মনোয়ার হোসেন চাচার প্রস্তাবটা এবং আসমা ও মতির সম্পর্কের কথা তিন চার দিন পার হয়ে গেলেও ছোট চাচাকে বলতে পারল না। শেষে মা-বাবাকে চিঠি লিখে সমস্যা ও তার সমাধানের উপায় বিস্তারিত জানাল। আরো জানাল, তারা যেন অতি শিঘ্র এসে ছোট চাচাকে নিয়ে সমস্যা মিটিয়ে দেন।

দু’বছর আগে সালেহা নাইনে উঠে পড়া বন্ধ করে দিয়েছিল। রিয়াজুল তাকে এ বছর ঐ ক্লাসেই ভর্তি করে দিয়েছে। একদিন ছুটির সময় স্কুল থেকে ফেরার পথে সালেহার সঙ্গে দেখা করে বলল, তোমাকে কয়েকটা কথা বলব। কথাগুলো ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন, কাউকে বলবে না, তবে তোমার বুবুর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বলতে পার।

সালেহা বলল, আপনার যে কোনো কথা আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। তা ছাড়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি কোনো মন্দ কথা বলতে পারেন না।

আমাকে এত বড় মনে করার কারণটা বল তো?

সূর্য কিরণ না দিলে পৃথিবী যেমন অন্ধকার হয়ে থাকত, চাঁদের আলো যদি না থাকত, তা হলে পৃথিবীর মানুষ যেমন সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হত, তেমনি যেসব মানুষ মানুষের উপকারের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে, তারা চন্দ্র সূর্যের মত। আপনি তাদেরই একজন।

আমাকে অত বড় করে বলো না সালেহা। তুমি যাদের কথা বললে, তারা আল্লাহর খাস বান্দা। তাদের পায়ের ধূলোর যোগ্যও আমি নই।

আল্লাহর খাস বান্দারা নিজেদেরকে তাই মনে করেন। যাই হোক, কি বলবেন বলছিলেন বলুন।

তুমি কী তোমার বুবুর ও মতির সম্পর্কের কথা জান?

জ্বি জানি।

আমার সঙ্গে তোমার বুবুর বিয়ের কথা হয়েছে, তাও নিশ্চয় জান?

জ্বি জানি।

তোমার বুবু প্রতিবাদ করেনি কেন, বলতে পার?

জ্বি পারি। ডাক্তার বলেছেন, আব্বা কোনো কারণে উত্তেজিত হলে আবার পঙ্গু হয়ে যাবেন, তাই করেনি।

তুমি তো বেশ বুদ্ধিমতী ও স্পষ্টবাদিনী। বল তো দেখি। আমার এখন কী করা উচিত?

আমি সত্য জিনিস চেপে রাখতে পারি না। সে জন্য অনেকে আমাকে ঠোঁটকাটি বলে। কিন্তু বুদ্ধিমতী কেউ বলেনি। আপনার মুখে এই প্রথম শুনলাম।

সালেহার সঙ্গে রিয়াজুল যত কথা বলছে, তত তার সুপ্ত প্রতিভা জানতে পেরে মুগ্ধ হচ্ছে। ততক্ষণে তারা পুকুর পাড়ে চলে এসেছে। বলল, তোমার সঙ্গে আরো কিছু কথা আছে, ঐ জামরুল গাছের গোড়ায় বসি চল।

কেন, ঘরে চলুন না।

ঘরে পরে যাব, তার আগে কথাগুলো এখানে সেরে নিতে চাই।

সালেহা কিছু না না বলে জামরুল গাছের তলায় এসে ঘাসের উপর বসে বলল, এবার বলুন।

রিয়াজুল দূরত্ব বজায় রেখে বসে বলল, আমি যদি আগে তোমার বুবু ও মতির সম্পর্কের কথা জানতাম, তা হলে মা-বাবা ঢাকায় যখন আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন তখন। অমত করতাম। ঢাকা থেকে ফিরে মাত্র চার পাঁচ দিন আগে জেনে খুব মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি। আর ওরাও যে ভুগছে, তাও বুঝতে পারছি তোমার বাবার কথা চিন্তা করে এখন আমিও এ বিয়েতে অমত করতে পারছি না। এক এক সময় মনে হয় ঢাকার ছেলে ঢাকায় চলে যাই। কিন্তু ঐ একই কারণে যেতেও পারছি না। এই কঠিন সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় তোমার হাতে।

আমার হাতে? কী বলছেন আপনি, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না বলে সালেহা তার মুখের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

রিয়াজুলও কয়েক সেকেন্ড একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ সালেহা, তুমিই পার তোমার বাবার জীবন রক্ষা করতে এবং তোমার বুবুকে, মতিকে ও আমাকে যন্ত্রণার হাত থেকে রক্ষা করতে।

সালেহা আরো বেশি অবাক হয়ে বলল, বেশ যদি তাই হয়, তা হলে ইনশাআল্লাহ আমার জীবনের বিনিময়েও তা করব। বলুন আমাকে কী করতে হবে?

তোমাকে কিছুই করতে হবে না। শুধু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তবে সেই উত্তরটা যেন তোমার মনের কথা হয়।

ভনিতা করে কিছু বলা যে হারাম, তা আমি জানি, আল্লাহর কোনো ঈমানদার বান্দা বান্দি জীবন গেলেও ভনিতার আশ্রয় নেয় না।

রিয়াজুল সুবহান আল্লাহ বলে বলল, তোমার কথা শুনে খুব খুশি হলাম। তারপর বলল, প্রথম যেদিন তোমাদের বাড়িতে আসি, সেদিন পুকুর ঘাটে তোমাকে দেখে ও তোমার সঙ্গে কথা বলে এত মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, মনে মনে স্ত্রী হিসাবে পাওয়ার জন্য আল্লাহকে জানিয়ে ছিলাম। তাই তোমাকে আবার স্কুলে ভর্তি করি। ঢাকাতে আসমাকে দেখে মা-বাবা যখন মতামত জানতে চাইল তখন তারা মনে কষ্ট পাবে ভেবে অমত করিনি। ভেবেছিলাম, আল্লাহ সালেহাকে আমার জোড়া করেননি, করেছেন আসমাকে। এখন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, আল্লাহ পাক সেই প্রথম দিন যে দোয়া করেছিলাম, তা কবুল করেছেন। কিন্তু কিভাবে কি করব ভেবে ঠিক করতে না পেরে মনোয়ার হোসেন চাচাকে তোমার বুবুর ও মতির সম্পর্কের কথা বলে আমার সমস্যার কথা বলি। তিনি বললেন, তুমি যদি সালেহাকে বিয়ে কর, আর আসমার বিয়ে মতির সঙ্গে দেওয়ার ব্যবস্থা কর, তা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তারপর নিশ্চিত হওয়ার জন্য কাল রাতে আমি এস্তেখারার নামায পড়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিলাম, আল্লাহ আমি যে সমস্যায় পড়েছি, তা থেকে তুমি আমাকে মুক্তির পথ দেখিয়ে দাও। তারপর ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলাম, আমি তোমাদের পুকুরে গোসল করার সময় সাঁতার কাটতে কাটতে যখন মাঝখানে গেছি তখন কে যেন পানির ভেতর থেকে আমার একটা পা ধরে টেনে আমাকে পানির নিচে নিয়ে যেতে লাগল। আমি অনেক চেষ্টা করেও ভেসে থাকতে পারলাম না, ডুবে গেলাম। নিঃশ্বাস নিতে না পেরে যন্ত্রণায় ছটফট করছি, হঠাৎ মনে হল, কে একজন আমার একটা হাত ধরে পানির উপরে নিয়ে এসে সাঁতরিয়ে পুকুরের কিনারে নিয়ে এল। আমি তখন খুব ক্লান্ত। একটু পরে স্বস্তি বোধ করে উদ্ধার কর্তার দিকে তাকিয়ে দেখি, তুমি। আর তখনি ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্বপ্নটা দেখার পর ভেবে রাখলাম, তোমাকে আমার ইচ্ছার কথা জানাব, এখন আমি তোমার মতামত জানতে চাই।

সালেহা বোবা দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মাথা নিচু করে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। রিয়াজুলের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে এবং পরে তার কাজ-কর্ম দেখে বিশ্বাসই করতে পারেনি, এ যুগে এতো ভাল ছেলে থাকতে পারে। সে যখন আব্বার সঙ্গে দেখা করতে আসত এবং বুবুর সঙ্গে সংসারের ব্যাপারে আলাপ করত তখন লজ্জায় কাছে আসত না। তবে আড়াল থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকত; কিন্তু তাকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার কথা চিন্তা করেনি কোনোদিন। আজ তার কথা শুনে এত আনন্দিত হল যে, তার মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হল না। থর থর করে কাঁপতে লাগল। একসময় আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে বুকের উপর টপটপ করে পড়তে লাগল।

রিয়াজুল দেখতে পেয়ে তার চিবুক ধরে মুখটা তুলে বলল, আমার কথা শুনে তুমি এত কষ্ট পাবে জানলে বলতাম না। তারপর চিবুক ছেড়ে দিয়ে বলল, কথাটা বলে খুব বড় অন্যায় করেছি। পারলে মাফ করে দিও। এবার আসি বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সালেহা চমকে উঠে দাঁড়িয়ে ভিজে গলায় বলল, প্রশ্নের উত্তর না শুনেই চলে যাচ্ছেন যে? তারপর বলল, না চাইতেই আল্লাহপাক আমাকে যা দিতে চাচ্ছেন, তা দুনিয়ার সবশ্রেষ্ট নেয়ামত বলে আমি মনে করি। কথা শেষ করে টলতে টলতে ঘরের দিকে চলে গেল।

রিয়াজুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তার দিকে তাকিয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তারপর সেখান থেকে চলে এল।

.

সালেহার স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে আসমা পুকুর ঘাটে এসে রাস্তার দিকে তাকাতে তাকে ও রিয়াজুলকে জামরুল গাছের তলায় বসে কথা বলতে দেখে বেশ অবাক হয়ে ঘরে এসে অপেক্ষা করছিল। অনেকক্ষণ পর সালেহা ঘরে এলে জিজ্ঞেস করল, এতক্ষণ ধরে রিয়াজুল ভাইয়ের সঙ্গে কী কথা বলছিলি?

সালেহা বই-খাতা রেখে বুবুকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বুকের ধকধকানি সামলাবার চেষ্টা করল।

আসমা তা অনুভব করে বলল, কিরে রিয়াজুল ভাই কী এমন কথা বলেছেন যে, তোর বুক ধক ধক কছে।

সালেহা ঐ অবস্থাতেই বলল, শুনলে তোমার বুকও ধক ধক করবে।

দেখ ফাজলামী করবি না। তারপর বলল, এবার ছাড়। কাপড় পাল্টে খাবি চল। খিদেয় পেট চো-চো করছে।

কথাটা শুনলে শুধু পেটের চোঁ-চোঁয়ানি নয়, দমও বন্ধ হয়ে যাবে।

আসমা জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, খুব বেড়ে গেছিস না? বড় বোনের সঙ্গে ফাজলামী করছিস। তারপর তার একটা হাত ধরে টান দিয়ে বলল, চল আগে খেয়ে নি, তারপর না হয় শুনব।

সালেহা অনঢ় থেকে বলল, রিয়াজুল ভাই তোমার ও মতি ভাইয়ের সম্পর্ক জেনে গিয়ে তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করছেন। আর আব্বার বিপদের কথা চিন্তা করে তিনি….। বলে কথাটা আর শেষ করতে পারল না। লজ্জায় লাল হয়ে কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার জড়িয়ে ধরল।

আসমা তার প্রথম দিকের কথা শুনে চমকে উঠেছিল। তারপর পরের কথাটা শেষ না করে লজ্জা রাঙা হয়ে জড়িয়ে ধরতে খুব অবাক হল। বলল, আব্বার বিপদের কথা চিন্তা করে রিয়াজুল ভাই কী বললেন, বলবি তো।

সালেহা ফিস ফিস করে বলল, সে কথা তাকেই জিজ্ঞেস করো, আমি বলতে পারব না।

 কেন পারবি না শুনি?

 খুব লজ্জা পাচ্ছি।

ওমা, কি এমন কথা যে, বলতে লজ্জা পাচ্ছিস? রিয়াজুল ভাই বলতে লজ্জা পেলেন না, আর তুই তার বলা কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিস কেন?

ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের লজ্জা যে বেশি, সে কথা তুমি মেয়ে হয়েও ভুলে গেছ?

আসমা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে ঢিল ছুঁড়ল। তা হলে কথাটা আমি বলি?

পারবে বলে মনে হয় না, তবু বল তো দেখি?

 রিয়াজুল ভাই তোকে বিয়ে করবেন, তাই না?

ওহ্ বুবু, তুমি না, তুমি না….। বলে থেমে গেল।

আসমা বুঝতে পারল, ঢিলটা ঠিক জায়গা মতো লেগেছে। বলল, আমি কী বলবি তো।

সালেহা তাকে ছেড়ে দিয়ে কদমবুসি করে বলল, তুমি আল্লাহর খাস বান্দি। তোমার অনুমান মিথ্যা হতে পারে না। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, রিয়াজুল ভাইয়ের মুখে কথাটা শুনে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম।

শুকুর আল-হামদুলিল্লাহ্ বলে আসমা ছোট বোনের মুখ ধরে দু’গালে অনর্গল চুমো খেতে লাগল।

লেখক: কাসেম বিন আবুবাকারবইয়ের ধরন: উপন্যাস
ক্ষমা - কাসেম বিন আবুবাকার

ক্ষমা – কাসেম বিন আবুবাকার

কালোমেয়ে - কাসেম বিন আবুবাকার

কালোমেয়ে – কাসেম বিন আবুবাকার

জীবন বড় সুন্দর - কাসেম বিন আবুবাকার

জীবন বড় সুন্দর – কাসেম বিন আবুবাকার

যেতে নাহি দেব - কাসেম বিন আবুবাকার

যেতে নাহি দেব – কাসেম বিন আবুবাকার

Reader Interactions

Comments

  1. ইবনুল আরাবী

    April 29, 2023 at 1:38 pm

    আমি আপনাদের কী বলব ভাই! আপনারা পুরো গল্প টা কেন দেন না। এটাই বুঝি না। নাকি আমার কমেন্ট আপনাদের দৃষ্টিগোচর হয় না।

    Reply
    • admin_egb

      April 29, 2023 at 2:45 pm

      কিছু কিছু বই লেখক/প্রকাশকদের আপত্তির কারণে শুধু প্রথম অধ্যায় রেখে বাকিটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এসব নিয়ে আমাদের ফেসবুক পেজে অনেক কথা হয়েছে। আবার কিছু কিছু বই আমাদের সংগ্রহে নেই। নেট থেকে পিডিএফ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু কোয়ালিটি খারাপ বলে পুরোটা করতে পারিনি। তবে আপনি যদি সেগুলো মিন না করেন, তাহলে আপনার কাছে কোনগুলো অসমাপ্ত মনে হয়েছে, আমাদের জানাতে পারেন। আমরা আবার চেষ্টা করে দেখব সংগ্রহ করে বাকিটা দেয়া যায় কি না। ধন্যবাদ।

      Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.