দৃষ্টিপাত – যাযাবর (বিনয় কুমার মুখোপাধ্যায়)
দৃষ্টিপাত – যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়)
.
সংকলয়িতার নিবেদন
এই রচনাটির একটু ভূমিকা আবশ্যক।
১৯৩৬ সালে একটি বাঙালী যুবক লণ্ডনে ব্যারিস্টারি পড়িতে যায়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে গাওয়ার স্ট্রীটের ভারতীয় আবাসটি জার্মান বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হইলে আত্মীয়বর্গের নির্বন্ধ্যাতিশয্যে যুবকটি ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসে। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপসের আলোচনার প্রাক্কালে বিলেতের একটি প্রাদেশিক পত্রিকা তাহাকে তাঁহাদের নিজস্ব সংবাদদাতা নিযুক্ত করিয়া দিল্লীতে পাঠান। লণ্ডনে অবস্থানকালে ঐ পত্রিকায় সে মাঝে-মাঝে প্রবন্ধ লিখিত। দিল্লীতে যাইয়া যুবকটি তাহার এক বান্ধবিকে কতগুলি পত্র লেখে। বর্তমান রচনাটি সেই পত্রগুলি হইতে সংকলিত। পত্রলেখক ও পত্রাধিকারিনীর একমাত্র একান্ত ব্যাক্তিগত ও পারিবারিক প্রসঙ্গ ব্যতীত পত্রগুলির আর কিছুই বাদ দেওয়া হয় নাই, যদিও পত্রে বর্ণিত পাত্র-পাত্রীদের যথার্থ পরিচয় গোপনের উদ্দেশ্যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাম-ধামের পরিবর্তন অপরিহার্য হইয়াছে। এই স্বল্পপরিসর পত্ররচনার মধ্যে লেখকের যে সাহিত্যিক প্রতিভার আভাস আছে, হয়তো উত্তরকালে বিস্তৃততর সাহিত্যচর্চার মধ্যে একদা তাহা যথার্থ পরিণতি লাভ করিতে পারিত। গভীর পরিতাপের বিষয়, কিছুকাল পূর্বে এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় তাহার অকালমৃত্যু সেই সম্ভাবনার ওপরে নিশ্চিত যবনিকা টানিয়া দিয়াছে।
রাতারাতি দিগ্বিজয় করে ফেলার মতো বই সাহিত্যের ক্ষেত্রে হামেশা দেখা যায় না; ক্বচিৎ-কদাচিৎ এরকম ঘটনা ঘটে। এমনই একটি বই ‘দৃষ্টিপাত’। লেখকের মধ্যে স্বাভাবিক কাব্যশক্তি পরিচ্ছন্নতাবোধ, চিন্তাশীলতা রয়েছে; আর আছে গভীরতর বেদনা বোধের একটি সুর যা নিশীথ রাত্রির অন্ধকারের মতন আপনার ধ্যানে নিঃশ্বব্দ। যে নেত্র দিয়ে লেখক দৃষ্টিপাত করেছেন তার সাধনা আছে; যা সাধারণ দৃষ্টি এড়িয়ে যায় তা দেখবার ক্ষমতা আছে; মানুষের অন্তর্লোকে প্রবেশ করবার অন্তর্দৃষ্টি আছে। এ নেত্র কখনও ঘৃণা ও রোধের বহ্নিজ্বালায় দীপ্ত, কখনও দয়া-স্নিগ্ধ সমবেদনায় অশ্রুসজল। ভাষার এমন সাবলীল গতি, এত স্বচ্ছলতা, এত ঔজ্জ্বল্য এবং এমন সৌন্দর্য রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীর লেখায় ছাড়া আর বেশি দেখা যায় না। ক্রীপস্-দৌত্যের ইতিবৃত্ত ইতিহাসে পড়েছেন সকলেই, কিন্তু মানবীয় অভিজ্ঞতার অভিঘাতে সেই শুষ্ক বৃত্তান্তও যে রসঘন কমনীয় হয়ে উঠতে পারে, উঠতে পারে স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ অধ্যায়ের মর্মস্পর্শী ইতিহাস হয়ে, তা ‘দৃষ্টিপাত’ না পড়লে বোঝার উপায় ছিল না। তাই পৃষ্ঠা ফুরিয়ে গেলেও কাহিনী ফুরোয় না কানে বাজতে থাকে “প্রেম জীবনকে দেয় ঐশ্বর্য, মৃত্যুকে দেয় মহিমা। কিন্তু প্রবঞ্চিতকে দেয় কী? তাকে দেয় দাহ। যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্ময় দাহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।”
Leave a Reply