• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

জোনাকির আলো – কাসেম বিন আবুবাকার

লাইব্রেরি » কাসেম বিন আবুবাকার » জোনাকির আলো – কাসেম বিন আবুবাকার
জোনাকির আলো - কাসেম বিন আবুবাকার

সূচিপত্র

  1. ০১.
  2. ০২.
  3. ০৩.
  4. ০৪.
  5. ০৫.
  6. ০৬.
  7. ০৭.
  8. ০৮.
  9. ০৯.
  10. ১০.
  11. ১১.

জোনাকির আলো – ইসলামিক প্রেমের উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার

০১.

আযীয মাস্টার প্রতিদিন ফজরের নামায পড়ে প্রায় আধঘণ্টা কুরআন তেলাওয়াত করেন, তারপর এশাকের নামায পড়ে ঘরে এসে বিস্কুট বা মুড়ি খেয়ে চা খান। আজ মসজিদ থেকে ঘরে এসে নাতনিকে দেখতে না পেয়ে একটু উঁচু গলায় বললেন, কোথায় গেলিরে দাদু, চা দিবি না?

রিজিয়া রান্নাঘর থেকে বলল, একটু বসুন, এক্ষুনি দিচ্ছি। দু’তিন মিনিট পর রিজিয়া চা-মুড়ি নিয়ে এসে বলল, বিস্কুট নেই, টিনে এই ক’টা মুড়ি ছিল।

আযীয মাস্টার বললেন, তোর চা কই?

রিজিয়া কিছু না বলে চুপ করে রইল।

আযীয মাস্টার জানেন, যেদিন চা বা চিনি কম থাকে সেদিন তার জন্য শুধু রিজিয়া এক কাপ চা করে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, যা কাপ নিয়ে আয়, একেই দুজনে ভাগ করে খাব।

রিজিয়া বলল, আপনি খেয়ে নিন নানা, আমি আজ চা খাব না।

ওসব নেই কাল বললি না কেন? কিনে নিয়ে আসতাম।

আপনার কাছে তো টাকা নেই, কিনে আনতেন কি করে? কথাটা রিজিয়া বলতে গিয়েও বলল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বস। মুড়ি খা।

না নানা আপনি খান। আমি মুড়ি খাব না। পান্তা আছে খাব। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে রিজিয়া বলল, যা চাল আছে এ বেলা হবে, ওবেলার চাল নেই।

তোর সামসু মামার দোকান থেকে দু’কেজি নিয়ে আসিস। বলবি নানা টাকাটা পরে দেবে।

চিনি কম আছে দেখে আপনার কথা বলে একশো গ্রাম আনতে গিয়েছিলাম, দিল না। বলল, তোর নানার কাছে অনেক টাকা পাব, এখন আর বাকি দিতে পারব না।

ততক্ষণে আযীয মাস্টারের চা-খাওয়া হয়ে গেছে। বললেন, মাতব্বরের কাছে যাই, কিছু টাকা হাওলাত নিয়ে আসি।

তার কাছ থেকে তো অনেক টাকা হাওলাত নিয়েছেন, এখন আর দেবেন বলে মনে হয় না।

দেবে দেবে, না দিলে আমরা যে উপোস করে দিন কাটাব তা মাতব্বর জানে।

কিন্তু আর কত দেবেন? তিনি তো অনেক দিয়েছেন।

অনেক দিলেও আরো দেবে।

কিন্তু কেন তিনি আপনাকে টাকা দিচ্ছেন? আপনি কি তা হলে বাস্তুভিটেও তাকে লিখে দিয়েছেন?

এখনো দিই নি, তবে এবার হয়তো দিতে হবে।

আপনাকে কতবার মাতব্বরের কাছ থেকে টাকা হাওলাত নিতে নিষেধ করেছি,তবু নেন কেন?

কি করব রে দাদু, সে ছাড়া অন্য কেউ তো একটা পয়সাও দিতে চায়। মাতব্বর দেয় বলে তবু খেতে পাচ্ছি, না দিলে কি হত আল্লাহ জানে।

মাতব্বর তো এমনিই দেন না, বাস্তুভিটের লোভে দেন।

তোর কথা হয় তো ঠিক; কিন্তু অন্য কেউ সেই লোভেও দিতে রাজি হয় নি।

এই ভিটে নিতে অন্য কেউ কেন রাজি হয় নি রিজিয়া জানে। নানার কাছে শুনেছে, তাদের বাস্তুভিটেটা অনেক আগে হিন্দুদের মড়াচির ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় ইংরেজরা যখন চলে যায় তখন হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নামে ভারতকে দুটো অংশে ভাগ করে দেয়। সেই সময় পাশের গ্রামে যে কয়েক ঘর হিন্দু ছিল, তারা সব কিছু বিক্রি করে হিন্দুস্তানে চলে যায়। সেই থেকে এই মড়াচির এমনি পড়ে ছিল। এখানে নাকি গভীর রাতে নানা রঙের আলো দেখা যেত, মেয়েদের কান্নাও শুনতে পেত। তাই ভয়ে এদিকে কেউ বড় একটা আসত না। একদিন সকালে গ্রামের লোকজন দেখল, মড়াচিরে একটা নতুন বেড়ার ঘর। তারা অবাক হলেও কে এই ঘর বানাল জানার জন্য কেউ সাহস করে সেখানে যেতে পারল না। কয়েকদিন পর জোহরের নামায পড়ার সময় মসজিদে একজন অচেনা দাড়িওয়ালা লম্বা চওড়া লোককে দেখে মুরুব্বিদের একজন তার পরিচয় জানতে চাইলেন। লোকটি বললেন, আমার নাম কুতুবউদ্দিন। আমাদের ঘর-বাড়ি, জমি জায়গা…নদীতে বিলীন হয়ে গেছে, তাই আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে আপনাদের পাশের গ্রামে আসি। সেখানে অনেকের কাছে থাকার জন্য একটু জমি চাইতে তাদের একজন এই জায়গাটার কথা বলে বললেন, ওটা হিন্দুদের জায়গা। তারা দেশ ভাগ হওয়ার সময় ভারতে চলে গেছে। বর্তমানে ওটার কেউ ওয়ারিস নেই। আপনি ওখানে ঘর করে থাকতে পারেন। তাই ওখানে একটা ঘর তৈরি করে এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকছি।

মুরুব্বি লোকটি বললেন, কিন্তু জায়গাটায় যে হিন্দুরা মড়া পুড়াত। সে কথা বলে নি?

কুতুবউদ্দিন বললেন, না বলে নি।

এই কয়েকদিনে কিছু অসুবিধে হয় নি?

কই না তো? তবে পানির জন্য একটু অসুবিধে হচ্ছে। পাশের গ্রামের যে বড় পুকুর রয়েছে, ওখান থেকে পানি নিয়ে আসতে হয়। ভাবছি, এখানে একটা পুকুর কাটাব।

মুরুব্বিরা তার কথা শুনে ভাবলেন, লোকটার বেশ টাকা-পয়সা আছে। ওখানে থাকলে তাদের তো কোনো অসুবিধে নেই। তা ছাড়া যে লোক স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে মাড়াচিরে থাকতে পারে, সে লোক নিশ্চয় সাধারণ লোক নয়। তাই তারা আর কিছু বললেন না।

জায়গাটা পাশাপাশি দু’টো গ্রামের মাঝখানে ও শেষ প্রান্তে জনবসতি থেকে একটু দূরে। তাই কুতুবউদ্দিন সেখানে বাস করলেও দুটো গ্রামেরই লোকজন তার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখে নি। তবে কুতুবউদ্দিন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি পুকুর কাটিয়েছিলেন। পুকুরের চারদিকের পাড়ে আম, জাম, নারিকেল, পেয়ারা ও অন্যান্য ফলের গাছ লাগিয়েছিলেন। সে সব গাছে এখন ফল হচ্ছে। কিছু জমি-জায়গাও কিনেছিলেন। তারই ছেলে আযীয মাস্টার। আযীয মাস্টার এস.এস.সি. পাস করে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করতেন, আর বাবার সঙ্গে চাষবাসের কাজ করতেন। সবাই তাকে আযীয মাস্টার বলে ডাকে। কুতুবউদ্দিন ছেলের বিয়ে দেয়ার তিন বছর পর মারা যান। আযীয মাস্টারের একমাত্র মেয়ে সাবেরা অত্যন্ত সুন্দরী ছিল। সে ক্লাস ফাঁইভ থেকে বোরখা পরে এস.এস.সি. পর্যন্ত লেখাপড়া করে। কলেজ অনেক দূর বলে মেয়েকে আর পড়ান নি। তবে প্রচুর ধর্মীয় বই কিনে দিয়েছেন। সাবেরা সে সব পড়ে ধর্মের সব কিছু নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত। পাশের গ্রামের ধনী আকরাম চৌধুরীর ছেলে শিহাব ঢাকায় ভার্সিটিতে পড়ত। ক্লাসমেট রাকিবের সঙ্গে শিহাবের গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। রাকিব একবার শিহাবের সঙ্গে তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। একদিন বেড়াতে বেরিয়ে আযীয মাস্টারের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সাবেরাকে দেখে এত মুগ্ধ হল যে, তাকে বিয়ে করার সংকল্প করে। এক সময় বন্ধু শিহাবকে কথাটা জানাতে সে হেসে উঠে বলল, কি যা তা বলছিস? তুই এখন ছাত্র। তা ছাড়া তোর বাবা ধনী ব্যবসায়ী। তিনি ও তোর মা কিছুতেই রাজি হবেন না।

রাকিব বলল, তাদের ব্যাপারটা আমি বুঝব। তুই মেয়ের বাবার সঙ্গে কথা বল।

শিহাব বলল, শুধু মেয়ের রূপ দেখে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া তোর উচিত নয়। মেয়ের মা-বাবা ও তাদের পারিবারিক এবং সামাজিক পরিবেশ জানা উচিত। ওরা এখানকার আদিবাসী নয়। ঐ জায়গাটা ছিল হিন্দুদের মড়াচির। তারপর কুতুবউদ্দিন কিভাবে এখানে এসে বাস শুরু করেছিলেন সেসব বলে বলল, সাবেরা মানে যাকে তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিস, তার দাদা হলেন কুতুবউদ্দিন। আর তারই ছেলে আযীয মাস্টার হল সাবেরার বাবা। সাবেরা জন্মাবার আগেই কুতুবউদ্দিন মারা যান। তার চার-পাঁচ বছর পর সাবেরার দাদিও মারা যান। ওরা হিন্দুদের মড়াচিরে থাকে বলে কেউ ওদের সঙ্গে মেলামেশা করে না। আযীয মাস্টার মেয়েকে এস.এস.সি. পর্যন্ত পড়িয়ে আর পড়ান নি। এ রকম একটা পরিবারের মেয়েকে তুই বিয়ে করতে চাইলেও আমি কিছুতেই মেনে নেব না। ভার্সিটিতে পড়ছিস, এসব কথা তোর বিবেচনা করা উচিত।

রাকিব বলল, তুই অবশ্য ঠিক কথা বলেছিস, কিন্তু কি জানিস, সাবেরাকে দেখে আমি শুধু মুগ্ধ হয় নি, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে রকম মেয়েকে জীবনসঙ্গী করার স্বপ্ন দেখে এসেছি, সাবেরা ঠিক তার মতো। এস.এস.সি. পাস হলেও আমি তাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করে নেব। আর পরিবেশের কথা যে বললি, তার উত্তরে বলব, মানুষ যখন যে পরিবেশে থাকে তখন সেই পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়।

শিহাব বলল, তোর কথা কতটা সত্য জানি না। আমি তো জানি মানুষের অনেক স্বপ্ন থাকে। বাস্তবে তার ক’টা সফল হয়? তা ছাড়া মা-বাবা ও সোসাইটির কথা চিন্তা করবি না?

নিশ্চয় করব। তারা যে রাজি হবে না তা জানি। তাই তো তাদের না জানিয়ে বিয়ে করব। পড়াশোনা শেষ করে যখন বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করব এবং মা-বাবা যখন বিয়ে করার কথা বলবে তখন সব কিছু তাদেরকে জানিয়ে সাবেরাকে ঘরে নিয়ে আসতে বলব।

সাবেরার রূপ দেখে সত্যিই তুই পাগল হয়ে গেছিস। নচেৎ এরকম কথা বলতে পারতিস না। আরে বাবা, ঢাকায় কি সুন্দরী মেয়ের অভাব আছে? উঁচু সোসাইটির ধনী ঘরের এমন অনেক মেয়ে আছে, যারা সাবেরার থেকে হাজার গুণ ভালো। আর তুই যে পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসায় নেমে সাবেরাকে তোলার কথা বললি, ভেবে দেখেছিস, পড়াশোনা শেষ করতে কত বছর লাগবে? এত বছর ওকে এখানে ফেলে রাখবি নাকি?

ফেলে রাখব কেন? বললাম না, ওকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে হোস্টেলে রেখে পড়াশোনা করাব।

একটা মেয়েকে হোস্টেলে রেখে পাঁচ-ছ’বছর পড়াতে কত খরচ জানিস?

না জানি না। তবে খরচের চিন্তা আমি করি না। যেমন করে তোক ম্যানেজ করব।

কিন্তু কথাটা তো বেশি দিন গোপন থাকবে না। সবাই জেনে গেলে কি করবি?

যতদিন সম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করব। তারপরও যদি জানাজানি হয়ে যায়, মা-বাবাকে সব কিছু জানাব।

শিহাব হেসে ফেলে বলল, তোর কথাগুলো একদম ছেলেমানুষের মতো। ক্লাস এইট পর্যন্ত আযীয মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেতাম। তখন থেকে ওকে ভালবাসতাম। অবশ্য সাবেরা সে কথা জানত না। কলেজে পড়ার সময় ওকে দেখার জন্য বিভিন্ন অসিলায় আযীয স্যারের কাছে যেতাম। আমাকে দেখলেই সাবেরা গায়ের ওড়না নাক পর্যন্ত ঢাকা দিয়ে ঘরে ঢুকে যেত। ছোটবেলা থেকে ও খুব সুন্দরী। বড় হয়ে আরো বেশি সুন্দরী হয়েছে। স্কুলে অনেকবার ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি; কিন্তু শুধু আমাকেই নয়, কোনো ছেলেকেই কাছে ঘেঁষতে দিত না। শেষে তোর মতো চিন্তাভাবনা আমিও করেছিলাম এবং কথাটা আমার ছোট মামাকে জানিয়েছিলাম। ছোট মামা আমার চেয়ে তিন বছরের বড় হলেও আমাদের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। তোকে যেসব কথা বলে আমি বোঝালাম, ছোট মামা শুনে আমাকে সেইসব কথা বলে বুঝিয়েছিল। আমি বুঝতে পেরে সাবেরার চিন্তা বাদ দিয়েছি। তোকেও বলছি তুইও সাবেরার চিন্তা বাদ দিয়ে বেড়াতে এসেছিস বেড়িয়ে যা। ঢাকায় ফিরে গেলে ওর কথা আর মনে থাকবে না।

রাকিব বলল, সব মানুষ যেমন সমান হয় না, তেমনি সব মানুষের মনও সমান হয় না। তোর ছোট মামার কথায় তোর মন বুঝ মানলেও আমার মন মানে নি। তুই ও তোর মামা কেন, পৃথিবীশুদ্ধ লোক আমাকে বোঝালেও আমার মন বুঝবে না। আমি ওকে বিয়ে করবই। তুই শুধু আমাকে সাহায্য করবি কি না বল?

শিহাব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, তোকে সাহায্য করব কি করব না সে কথা পরে বলছি। তার আগে আমার অসুবিধের কথা বলি। প্রথমত, তুই সাবেরাকে বিয়ে করলে তোর ও আমার গার্জেনরা আমাকে দায়ী করবেন। দ্বিতীয়ত, কোনো কারণে তুই যদি ওকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে পড়াশোনা করাতে না পারিস অথবা তোর মা-বাবা জেনে যাবার পর ডিভোর্স করায় তখন আযীয মাস্টারও আমাকে দায়ী করবেন এবং বাবার কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করবেন। তখন আমার পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে দেখ।

রাকিব বলল, অত ভূমিকার কি দরকার ছিল? সোজাসুজি বললেই পারিস সাহায্য করবি না।

তুই আমাকে ভুল বুঝছিস কেন? তোকে সাহায্য না করার জন্য কথাগুলো বলি নি। বন্ধুকে অসুবিধের কথা বলাটা কী অন্যায় হল? এবার আমার মতামত শোন। কালকেই আমি আযীয মাস্টারের সঙ্গে আলাপ করে তোকে জানাব।

না, তুই আগে কিছু ওনাকে বলবি না। যা বলার আমিই প্রথমে বলব। তারপর উনি যদি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেন, তখন আমার সম্পর্কে যা জানিস সেটাই বলবি। তুই শুধু আমাকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিবি।

ঠিক আছে, তাই হবে।

কুতুবউদ্দিন প্রথমে একটা বেড়ার ঘরে স্ত্রী ও চার বছরের ছেলে আব্দুল আযীযকে নিয়ে থাকতেন। ছেলে দশ বছরের হতে আরো একটা বেড়ার ঘর করেন। ছেলের বিয়ে দেয়ার আগে বেড়ার ঘর ভেঙ্গে পাকা ওয়াল ও উপরে টিনের চাল দিয়ে তিন কামরা ঘর করেন। একটা কামরায় তিনি স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। অন্য কামরায় আব্দুল আযীয ও তার স্ত্রী থাকতেন। বাকি কামরাটা বৈঠকখানা।

একদিন স্কুল ছুটির পর আযীয মাস্টার ঘরে আসার পথে মসজিদ থেকে আসরের নামায পড়ে এসে বৈঠকখানায় বসে চা খাচ্ছিলেন। এমন সময় শিহাব রাকিবকে নিয়ে এসে বাইরে থেকে বলল, স্যার বাড়িতে আছেন?

সাবেরা আব্বাকে চা দিতে এসে কাপ নিয়ে যাবে বলে সেখানে দাঁড়িয়েছিল। কেউ আব্বার কাছে এসেছে বুঝতে পেরে বলল, আমি যাই, পরে এসে কাপ নিয়ে যাব। কথা শেষ করে ওড়না দিয়ে নাক পর্যন্ত মুখ ঢেকে বেরিয়ে এসে শিহাবকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, শিহাব ভাই কেমন আছেন?

সালামের উত্তর দিয়ে শিহাব বলল, ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, স্যার আছেন?

হ্যাঁ আছেন। ভেতরে যান বলে এক পলক রাকিবের দিকে তাকিয়ে সাবেরা চলে গেল।

আযীয মাস্টার তাদের কথা শুনতে পেয়ে বললেন, কে? শিহাব না কি? এস ভেতরে এস।

শিহাব রাকিবকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে সালাম দিল।

সালামের উত্তর দিয়ে আযীয মাস্টার তাদেরকে বসতে বলে বললেন, কি খবর শিহাব?

শিহাব বলল, খবর ভালো, আপনি ভালো আছেন?

হ্যাঁ বাবা, আল্লাহ ভালই রেখেছেন। তা হঠাৎ কি মনে করে এসেছ? তারপর রাকিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে তো চিনতে পারছি না।

রাকিব কিছু বলার আগে শিহাব বলল, ও রাকিব, আমার বন্ধু। ভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়ি। বেড়াতে এসেছে। আমার মুখে আপনার কথা শুনে দেখা করতে এসেছে। তারপর রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই স্যারের সঙ্গে আলাপ কর, আব্বা এই গ্রামের একটা লোকের সঙ্গে দেখা করতে বলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি বলে শিহাব বেরিয়ে গেল।

আযীয মাস্টার রাকিবকে বললেন, শিহাব আমার ছাত্র, তুমি ওর বন্ধু। তোমাকে আমি তুমিই করে বলব, কিছু মনে করবে না তো?

রাকিব বিগলিত কণ্ঠে বলল, এতে মনে করার কি আছে? নিশ্চয়ই তুমি করে বলবেন।

তোমাদের বাড়ি মনে হয় ঢাকাতেই?

জি।

তোমার বাবা কি করেন?

উনি ব্যবসায়ী।

তোমরা কয় ভাইবোন?

 শুধু দুই ভাই, বোন নেই। আমি ছোট।

বস, চায়ের কথা বলে আসি বলে আযীয মাস্টার উঠে দাঁড়ালেন।

রাকিব বলল, শিহাবের সঙ্গে চা খেয়ে এসেছি। এখন আর খাব না, আপনি বসুন। একটা কথা বলব বেআদবি নেবেন না স্যার। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।

ঠিক এই সময় সাবেরা একটা বড় থালায় দু’কাপ চা ও কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে আসার সময় রাকিবের কথা শুনে খুব অবাক হয় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর জানালার পাশে এসে ভেতরে তাকিয়ে দেখল, শিহাব ভাই নেই। তার সঙ্গের ছেলেটা রয়েছে। ভাবল, ছেলেটা কে? শিহাব ভাইয়ের সঙ্গে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিল, অথচ শিহাব ভাই নেই। আব্বা কি বলে শোনার জন্য রাকিবের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

হোয়াট বলে আযীয মাস্টার কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার মেয়েকে চেনো?

কথাটা বলে রাকিব লজ্জায় মুখ নিচু করে নিয়েছিল। এবার মুখ তুলে বলল, জি না। তবে শিহাবের সঙ্গে কাল বেড়াতে বেরিয়ে এখান থেকে যাওয়ার সময় এক নজর দেখেছি।

আযীয মাস্টার অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার বয়স কম। তাই যে কথা বললে তার গুরুত্ব বোঝ না। শিহাবের বন্ধু, তাই কিছু বললাম না। অন্য কোনো ছেলে এ রকম কথা বললে চাবকে পিঠের ছাল তুলে বের করে দিতাম।

রাকিব রাগল না। মোলায়েম স্বরে বলল, আমার বয়স কম হলেও খুব একটা কম নয়। ভার্সিটিতে পড়ছি, জ্ঞানও যে একদম হয় নি তা নয়। জীবনসঙ্গী পছন্দ করার মতো বয়স ও জ্ঞান হয়েছে। আর কথাটার গুরুত্ব বোঝার মতো জ্ঞানও আমার হয়েছে। আপনি বাবার বয়সী ও একজন শিক্ষক। চাবকে আমার পিঠের ছাল তুলে বের করে দিলেও কিছু মনে করতাম না। ফিরে এসে ঐ কথা আবার বলতাম।

আযীয মাস্টার চিন্তা করলেন, অন্য কোনো ছেলে হলে তার কথা শুনে রেগে যেত ও অপমান বোধ করে চলে যেত। কিন্তু তা না করে যা বলল, তাতে মনে হল ছেলেটার চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম?

জি, রাকিব হাসান।

 বাবার নাম?

জাহিদ হাসান।

আযীয মাস্টার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি এখন যাও। শিহাবের ফিরতে বোধ হয় দেরি হবে। ওকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।

রাকিব চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে সালাম দিতে যাবে, এমন সময় সাবেরা ঘরে ঢুকে আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলল, শিহাব ভাই কোথায়?

আযীয মাস্টার মেয়েকে চা-বিস্কুট নিয়ে আসতে দেখে তার কথার উত্তর দিয়ে রাকিবকে বললেন, বস, চা খেয়ে যাবে।

সাবেরা থালাটা টেবিলের উপর রেখে চলে গেল।

চা খেয়ে রাকিব সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে বেরিয়ে কিছু দূর আসার পর শিহাবকে একটা গাছতলায় বসে থাকতে দেখে বলল, কি রে, এখানে বসে রয়েছিস যে? কার সঙ্গে দেখা করতে যাবি বললি, গিয়েছিলি?

শিহাব হেসে উঠে বলল, তোকে স্যারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য ঐ কথা বলে চলে এসেছি। চল এবার ঘরে যাই। তারপর যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, স্যারকে কথাটা বলেছিস?

হ্যাঁ বলেছি।

সত্যি বলেছিস!

এতে আবার সত্যি-মিথ্যের কি হল? কথাটা বলার জন্যই তো গিয়েছিলাম।

শুনে স্যার কি বললেন?

আযীয মাস্টার যা কিছু বলেছেন রাকিব সে সব বলল।

তোর সাহসের বলিহারী। স্যার যা কড়া, মরে গেলেও তাকে ঐ কথা বলতে পারতাম না। প্রাইমারিতে পড়ার সময় অনেকবার স্যারের হাতে মার খেয়েছি। তা স্যারের কথা শুনে তুই কি বললি?

রাকিব যা বলেছিল বলল।

তুই শুধু সাহসী নয়, বুদ্ধিমানও। আমি হলে তো ছুট দিতাম। তা শেষমেশ স্যার কি বললেন?

কি আর বলবেন? বললেন, তুমি এখন যাও, শিহাবকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলল।

আমার কিন্তু খুব ভয় করছে। আমাকে না একচোট নেন।

আরে তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? এখনও কি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র নাকি যে, তোকে সত্যি সত্যি চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেবেন?

আমি ঐ ভয়ের কথা বলি নি; বাবাকে না কথাটা জানিয়ে দেন, সেই ভয়ের কথা বলছি।

জানালে জানাবেন। তুই তো আর ছোট না যে, তোর বাবা তোকে পেটাবে?

তা পেটাবে না, তবু অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। তা হ্যাঁ রে, স্যার যদি রাজি হন, তা হলে এখনই বিয়ে করবি, না পরে এসে করবি?

এখনই করব।

ঝোঁকের মাথায় তাড়াতাড়ি কোনো কাজ করা কারোরই উচিত নয়। সব কিছু চিন্তা-ভাবনা করে ধীরে-সুস্থে করতে হয়।

দেখ, বড়দের মতো উপদেশ দিবি না। আমি যা করার ইচ্ছা করি তা তাড়াতাড়ি করেই থাকি। আজ পর্যন্ত কোনো ব্যাপারেই ফেল যেমন করি নি, তেমনি ফলাফলও খারাপ কিছু হয়নি।

তবু বলব, আজ সারাদিন ও রাত চিন্তা করে কাল সকালে জানাবি।

আমার চিন্তা করার কিছু নেই। তুই কাল সকালে স্যারের কাছে যাবি।

পরের দিন সকালে শিহাব আযীয মাস্টারের বাড়িতে গিয়ে সালাম বিনিময় করার পর বলল, আমাকে আসতে বলছিলেন স্যার?

আযীয মাস্টার বললেন, হ্যাঁ, বস। বসার পর বললেন, তোমার বন্ধুর প্রস্তাবের কথা তোমাকে নিশ্চয়ই আগেই জানিয়েছিল?

জি, জানিয়েছিল?

তার হয়ে তোমারই প্রস্তাব দেয়া উচিত ছিল।

আমি সে কথা ওকে বলেছিলাম; কিন্তু ও বলল, নিজেই দেবে।

ওদের ফ্যামিলির সব কিছু তুমি জান?

জি জানি। ওদের সব কিছু ভালো।

হ্যাঁ, ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে তাই মনে হল। তবে কি জান বাবা, সাবেরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের শুক্রবার মানে আর চারদিন পর ওর বিয়ে। কাল বললে ছেলেটা বেশি মনে কষ্ট পেত, তাই বলি নি। তুমি ওকে কথাটা জানিয়ে দিও।

রাকিবের কথা শুনে শিহাব কাল থেকে খুব টেনশানে ছিল। স্যারের কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে স্যার, জানাব।

তুমি তো জান, আমরা অন্য জায়গা থেকে এসে হিন্দুদের মড়াচিরে বাস করছি বলে এই গ্রামের ও তোমাদের গ্রামের সমাজ আমাদেরকে মেনে নিলেও তারা আমাদের বিয়ে-শাদিতে দাওয়াত দেয় না। আমার বিয়ের সময় আব্বা দুই গ্রামের লোকজনকে দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু গরিবরা দু’দশজন ছাড়া কেউ আসে নি। তবু এবারে সাবেরার বিয়েতে আমিও দাওয়াত দিয়েছি, জানি না সবাই আসবে কি না। কেউ আসুক আর না আসুক তোমার বন্ধুকে নিয়ে তুমি আসবে। অবশ্য তোমার বন্ধু যদি আরো কয়েকদিন থাকে। তুমি না এলে আজ তোমার কাছে যেতাম সাবেরার বিয়ের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য। তুমি বাবা যদি কাল থেকে আমাকে একটু সাহায্য করতে, তা হলে বড় উপকার হত।

কি যে বলেন স্যার, নিশ্চয় আসব। বলেন তো আজ থেকেই আপনাকে সাহায্য করব। আর রাকিব যদি আরো কয়েকদিন থাকে, তা হলে তাকেও নিয়ে আসব।

শুনে বড় খুশি হলাম বাবা। আমার আর এমন কেউ নেই যে আমাকে সাহায্য করবে।

আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। প্রয়োজনে আজ থেকে আপনাকে সাহায্য করব।

আজ আর আসতে হবে না, কাল থেকে এসো।

 তাই আসব বলে শিহাব দাঁড়িয়ে উঠে বলল, এবার আসি স্যার।

এমন সময় সাবেরা চা নিয়ে এসে শিহাবের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, বসুন, চা খেয়ে তারপর যাবেন। কাল এসেই চলে গিয়েছিলেন।

শিহাব চা খেয়ে ঘরে ফিরে আসতে রাকিব জিজ্ঞেস করল, স্যার তোকে কি বললেন?

তোর না শোনাই ভালো। শুনলে মন খারাপ হয়ে যাবে।

ইয়ার্কি না করে বলে ফেল তো।

বললাম না, শুনলে তোর মন খারাপ হয়ে যাবে।

হোক মন খারাপ, তুই বল।

 সাবেরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের শুক্রবারে বিয়ে।

রাকিব একদৃষ্টে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, ইয়ার্কি করছিস না তো? সত্যি করে বল না? স্যার কি বললেন?

বিশ্বাস কর, সত্যি কথাই বললাম।

বিশ্বাস হচ্ছে না।

কেন?

সত্যি হলে কালকেই স্যার আমাকে বলতেন।

উনি বলতে চেয়েছিলেন, তখনই বললে তুই মনে কষ্ট পাবি, তাই বলেন নি। আরো বললেন, তুই যদি কয়েকদিন থাকিস তা হলে কাল থেকে যেন আমার সঙ্গে সাবেরার বিয়ের ব্যাপারে সাহায্য করিস। স্যারের তো কেউ নেই। তাই আমাদেরকে কাল থেকে সব কিছু করার জন্য বললেন।

রাকিব অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

কি রে, চুপ করে আছিস কেন? কাল থেকে আমার সঙ্গে স্যারকে সাহায্য করবি না? না সাবেরাকে বিয়ে করতে পারলি না বলে বিয়ের আগেই ঢাকা চলে যাবি? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন রাকিব কিছু বলল না তখন আবার বলল, তোর মনের ব্যথা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কি করব বল, ভাগ্যের ওপর তো কারুর হাত নেই। এ কথা নিশ্চয় জানিস মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি?

রাকিব একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, তোর কথাই ঠিক, মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। শুধু সাবেরার বিয়ের দিন পর্যন্ত নয়, যতদিন থাকার কথা বলে এসেছি, ততদিনই থাকব।

.

০২.

আজ শুক্রবার সাবেরার বিয়ের দিন। এই ক’দিন আযীয মাস্টারের কথামতো শিহাব রাকিবকে সঙ্গে নিয়ে সব কিছু ব্যবস্থা করেছে। বর ও বরযাত্রীদের বেলা দশটার সময় আসার কথা। আসার পর নাস্তা খাইয়ে বিয়ে পড়ানো হবে। তারপর জুমার নামায পড়ে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে মেয়ে বিদায় করা হবে। কিন্তু দশটার সময় তো এলই না, এমনকি জুমার নামাযের পরেও যখন বর ও বরযাত্রীরা এসে পৌঁছল না তখন আযীয মাস্টার খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। এবারে দু’পাশের গ্রামের অনেক লোকজন ও মাতব্বররাও এসেছেন। আযীয মাস্টার মাতব্বরদের জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি করা যায় বলুন তো?

তারা বললেন, হয়তো পথে কোনো বিপদ হয়েছে, তাই দেরি হচ্ছে। আপনি একজনকে পাঠিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতে বলুন।

এমন সময় একজন লোককে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা এসে জানাল, নদী পার হওয়ার সময় বোটের ধাক্কা লেগে আমাদের নৌকা মাঝনদীতে ডুবে গেছে। অনেকে সাঁতরে পাড়ে উঠলেও বর ও বরযাত্রীদের বেশ কয়েকজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই খোঁজাখুঁজি করছে। বরের বাবা আমাকে পাঠালেন খবরটা দেয়ার জন্য। আরো বললেন, এই মেয়ে অপয়া, আমার ছেলে বেঁচে গেলেও এখানে আর বিয়ে করাবেন না।

কথাটা শুনে সবাই যতটা না অবাক হল, তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখ পেল। আযীয মাস্টার খুব মুষড়ে পড়লেন। খবরটা শুনে বাড়ির মেয়েরাও খুব দুঃখ পেল। আর সাবেরা শোনার পর অজ্ঞান হয়ে গেল। মেয়েরা তার মাথায় পানি ঢেলে ও চোখে-মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরালেও কিছুক্ষণ পরপর অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগল। কথাটা বাইরের লোকজন জানতে পেরে দুঃখ প্রকাশ ছাড়া তাদের আর কিছু করার রইল না।

দুই গ্রামের মাতব্বররা পরামর্শ করে আযীয মাস্টারকে বললেন, এখন আর কি করবেন? গ্রামের লোকজনদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করুন। নচেৎ তারা চলে গেলে এত লোকের খাবার নষ্ট হবে।

আযীয মাস্টার চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমার একমাত্র মেয়ে সাবেরার কি হবে আপনারা বলে দিন।

আমরা কি বলতে পারি বলুন। আপনার মেয়ের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। পরে আপনার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করব। এখন যা বললাম সেটা করলে ভালো হত না?

সেখানে শিহাব ও রাকিব ছিল। মাতব্বরদের কথা শুনে রাকিব বলল, আমি মাস্টার সাহেবের মেয়েকে এই মজলিসেই বিয়ে করব।

শিহাব ও তার বাবা আকরাম চৌধুরী এবং আযীয মাস্টার ছাড়া আর কেউ রাকিবকে চেনে না। তাই তারা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন।

আকরাম চৌধুরী ছেলের বন্ধু হিসাবে রাকিবের সব কিছু জানেন। বললেন, এ রকম হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয়া কি তোমার ঠিক হল?

রাকিব বলল, হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিই নি। আমি চিন্তা-ভাবনা করেই নিয়েছি।

আকরাম চৌধুরী ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি মত?

শিহাব বলল, রাকিব এখানে আসার দু’দিন পর সাবেরাকে দেখে স্যারকে নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিল। তার আগেই সাবেরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনে আমার সঙ্গে বিয়ের এ্যারেঞ্জমেন্ট করেছে। বিয়ে ভেঙ্গে গেছে জেনে আবার প্রস্তাব দিচ্ছে। স্যার রাকিবের কাছ থেকে তার সম্পর্কে সব কিছু জেনেছেন। এখন তিনি যদি ওকে পছন্দ করেন, তা হলে বিয়েটা হয়ে যাওয়াই আমি ভালো মনে করি।

আকরাম চৌধুরী আযীয মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মতামত বলুন।

আযীয মাস্টার বললেন, আমার মাথার এখন ঠিক নেই, আপনারা যদি ভালো মনে করেন, আমার কিছু বলার নেই।

আমরা ভালো মনে করলে তো হবে না, আপনার মতামত কি তাই বলুন।

আযীয মাস্টার বললেন, সাবালিকা মেয়ের বিয়ের মতামত মেয়ে নিজেই দেবে, এটাই শরীয়তের হুকুম। যে বিয়েটা ভেঙ্গে গেল, সেটাতেও আমি ছেলের সব কিছু বলে সাবেরার মতামত নিয়েছিলাম। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমি তার মতামত জেনে আসি। এই কথা বলে তিনি ভেতরে গিয়ে দেখলেন, সাবেরা তার মাকে জড়িয়ে ধরে ফেঁপাচ্ছে। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কান্না থামিয়ে মন দিয়ে আমার কথা শোন, বিয়ে-শাদি আল্লাহ যার সঙ্গে জোড়া করেছেন তার সঙ্গে হবেই। তাই হয়তো এই বিয়ে ভেঙ্গে গেল। তুমি তো শিহাবকে চেনো। তারপর রাকিবের পরিচয় দিয়ে বললেন, সে কয়েকদিন আগে তোমাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে জেনে শিহাবের সঙ্গে আজ দু’তিন দিন আমার কথামতো সব কিছু করেছে। বিয়ে ভেঙ্গে গেছে শুনে এখন আবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। দুই গ্রামের মাতব্বর ও লোকজন প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। তুমি যদি রাজি হও, তা হলে এক্ষুনি বিয়ে পড়ানো হবে।

সাবেরা কান্না থামিয়ে আব্বার কথা শুনছিল। থেমে যেতে ভিজে গলায় বলল, আপনি ভালো মনে করে যেখানে যার সঙ্গে বিয়ে দেবেন, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।

আলহামদুল্লিাহ বলে আযীয মাস্টার মজলিসে এসে বললেন, সাবেরা রাজি আছে। আপনারা বিয়ে পড়াবার ব্যবস্থা করুন।

বিয়ে হয়ে যাওয়ার দিন থেকে আরো পনের দিন রাকিব শ্বশুরবাড়িতে, মানে আযীয মাস্টারের বাড়িতে থাকল। তারপর শিহাবের সঙ্গে ঢাকায় ফিরে এল। বিয়ের পর সাবেরার সম্পর্কে যে প্ল্যান-প্রোগ্রামের কথা শিহাবকে বলেছিল, ঢাকায় ফেরার সময় সেসব সাবেরাকে বলে বলেছিল, তুমি শিহাবের ঢাকার ঠিকানায় চিঠি দিও। আমি শিহাবকে বলে রাখব, সে তোমার চিঠি আমাকে দেবে। আমিও তোমাকে চিঠি দেব। সামনে আমার ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার পর তোমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে হোস্টেলে রেখে কলেজে ভর্তি করে দেব। পরীক্ষার আগে আসতে পারব কি না সঠিক বলতে পারব না। তবে তোমাকে না দেখে বেশি দিন থাকতেও পারব না। আসার জন্য খুব চেষ্টা করব।

সাবেরা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, তোমার কথার ওপর আমি কখনো কিছু বলব না। শুধু আমার এতটুকু অনুরোধ, আমাকে যদি তোমার মা-বাবা কোনো দিন মেনে না নেন অথবা ওঁনারা আমাকে ত্যাগ করার কথা বলে ওঁনাদের পছন্দমতো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান, তা হলে বিয়ে করে ওঁনাদের সুখী করো; কিন্তু আমাকে ত্যাগ করো না। ছ’মাসে হোক, বছরে হোক বা দু’বছর পরে হোক অন্তত একদিনের জন্যে হলেও আমাকে দেখা দিতে এসো।

রাকিব তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলেছিল, আমি তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি, জীবন গেলেও তোমাকে ত্যাগ করতে পারব না। প্রয়োজনে মা-বাবাকে ত্যাগ করে তোমার কাছে চলে আসব। তারপর আদর করে বিদায় নিয়ে চলে আসে।

ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত মা-বাবাকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তিন চারবার সাবেরার কাছে এসে দু’একদিন করে থেকে গেছে। পরীক্ষার পর বেশ কয়েকদিন থাকার জন্য বন্ধুর দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা মা-বাবাকে জানাবে যখন ভাবছিল তখন একদিন কানাডা থেকে ফোন এল তার খালা মৃত্যুশয্যায়। বাবার অফিসের জরুরি কাজ থাকায় মাকে নিয়ে কানাডা যেতে হল রাকিবকে। যাওয়ার আগে সাবেরার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে, সময় করে উঠতে পারে নি। তাই একটা চিঠিতে সব কিছু লিখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা জানিয়ে পোস্ট করে গেল। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তার খালা মৃত্যুশয্যা থেকে বেঁচে গেলেও ঢাকা ফেরার আগের দিন রোড এ্যাকসিডেন্টে রাকিব মারা গেল।

পরীক্ষার তিন মাস আগে রাকিব যখন সাবেরার কাছে এসেছিল তখন থেকে সাবেরার প্র্যাগনেন্সি শুরু। তিন মাস পর সিওর হয়ে সাবেরা সে কথা চিঠি দিয়ে রাকিবকে জানিয়েছিল। রাকিব চিঠি পড়ে খুব আনন্দিত হলেও তখন পরীক্ষার পড়ার চাপে চিঠির উত্তর দিতে পারে নি। ভেবেছিল পরীক্ষার পর যাবে, তাই উত্তর না দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মাকে নিয়ে কানাডা যেতে হল। তাই যাওয়ার আগে যে চিঠি দিয়েছিল, তাতে বাবা হতে যাচ্ছে জেনে আনন্দিত হওয়ার কথা জানিয়েছিল।

সেই চিঠি পড়ে স্বামী আনন্দিত হয়েছে জেনে সাবেরা যতটা না খুশি হল, তার সঙ্গে দেখা না করে কানাডা চলে গেছে জেনে অনেক বেশি দুঃখ পেল। তারপর এক মাস দু’মাস করে যখন ছ’মাস পার হয়ে গেল অথচ রাকিব এল না, এমনকি একটা চিঠিও দিল না তখন সাবেরা অস্থির হয়ে উঠল। শহরের বড়লোকের ছেলেদের স্বভাব চরিত্রের কথা যতটুকু শুনেছিল, সেসব চিন্তা করে খুব আতঙ্কিত হল। ভাবল, রাকিবকে যতটুকু জেনেছে, সে তো অন্য পাঁচটা ছেলের মতো নয়। তবু কেন এতদিন তার খোঁজ-খবর নেই? তা হলে কি কানাডাতে তার কোনো বিপদ হল? না অন্য ছেলেদের মতো সেখানকার কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সুখের সংসার করছে? এইসব চিন্তা করতে করতে সাবেরার শরীর বেশ ভেঙ্গে পড়ল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর স্বামীর মঙ্গল কামনা করে ও তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগল।

জামাই এতদিন হয়ে গেল আসছে না দেখে আযীয মাস্টারও খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। দিন দিন মেয়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এতদিন হয়ে গেল জামাই আসছে না কেন বলতে পারিস?

সাবেরা ম্লান মুখে বলল, তা আমি কি করে বলব?

তোকে চিঠিপত্র দেয় নি?

না।

 জামাইয়ের পরীক্ষা প্রায় ছ’মাস আগে শেষ হয়েছে, তবু আসছে না কেন? তোর সঙ্গে মনোমালিন্য হয় নি তো?

না আব্বা, ওসব কিছু হয় নি। পরীক্ষার পর আসবার কথা আমাকে চিঠিতে জানিয়েছিল। তারপর কানাডা যাওয়ার কথা বলল।

আযীয মাস্টার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, এতদিন তো আর সেখানে নেই? নিশ্চয় ফিরে এসেছে। তবু কেন আসছে না বুঝতে পারছি না।

সাবেরা বলল, তুমি একবার শিহাব ভাইয়ের কাছে যাও। মনে হয় সে এখন ঘরেই থাকে। তাকে জিজ্ঞেস করলে তোমার জামাইয়ের খবর পাওয়া যাবে।

আযীয মাস্টার মেয়ের কথা শুনে একটু স্বস্তি পেলেন। বললেন, তুই খুব ভালো কথা বলেছিস। আগেই কথাটা আমার মাথায় আসা উচিত ছিল। এক্ষুনি শিহাবের কাছে যাচ্ছি।

শিহাব ঘরেই ছিল। আযীয মাস্টারকে আসতে দেখেই বুঝতে পারল কেন এসেছেন। রাকিবের মৃত্যুর খবর অনেক আগে জেনেছে। জানার পর তার জন্য যতটা না দুঃখ পেয়েছে, সাবেরা ও তার বাবা জানলে আরো অনেক বেশি দুঃখ পাবে এমনকি সাবেরা হয়তো পাগল হয়ে যেতে পারে ভেবে খবরটা তাদেরকে জানায় নি। কাছে এলে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন স্যার?

আযীয মাস্টার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল্লাহ একরকম রেখেছেন বাবা। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, রাকিবের খবর জান?

রাকিবের মৃত্যুর কথা কিভাবে বলবে শিহাব চিন্তা করতে লাগল।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আযীয মাস্টার আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কিছুদিনের মধ্যে ঢাকা গিয়েছিলে? ছ’মাসের বেশি হয়ে গেল রাকিব আসে নি। কোনো চিঠিপত্রও দেয় নি। সে নাকি কানাডা গিয়েছিল, সেখানেই আছে না দেশে ফিরেছে সে কথা কি জান?

শিহাব চিন্তা করল, একদিন না একদিন তো স্যার কথাটা জানবেনই। মানুষের মৃত্যুর খবর কতদিন আর চাপা থাকে। তা ছাড়া স্যারকে তো মিথ্যে কিছু বলা যাবে না। শিহাব কিছু বলছে না দেখে আযীয মাস্টার অধৈর্য গলায় বললেন, হ্যাঁ না কিছু একটা তো বলবে?

স্যার, কথাটা বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। রাকিব কানাডায় দিন পনের ছিল। যেদিন ফিরবে তার আগের দিন রোড একসিডেন্টে মারা গেছে। খবরটা আমি অনেক আগেই জেনেছি। আপনারা খুব দুঃখ পাবেন ভেবে এতদিন বলি নি।

রাকিব ছ’মাস আগে মারা গেছে শুনে আযীয মাস্টারের মনে হল কেউ যেন তাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে চোখের পানি ফেললেন। তারপর একসময় চোখ-মুখে কান্না জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান, সাবেরার পেটে রাকিবের সন্তান এসেছে?

জি, জানি। রাকিব কানাডা থেকে একটি চিঠিতে ফিরে আসার ও সাবেরার পেটে বাচ্চা আসার কথা লিখে জানিয়েছিল।

খবরটা শুনে সাবেরার কি অবস্থা হবে আল্লাহ মালুম। তারপর ফিরে আসার সময় আযীয মাস্টার ভাবতে লাগলেন, সাবেরার শরীরের যে অবস্থা, রাকিবের মৃত্যুর খবর শুনে না হার্টফেল করে। তবু তাকে জানানো উচিত ভেবে ঘরে এসে স্ত্রী ও মেয়েকে রাকিব মারা যাওয়ার খবরটা জানালেন।

শুনে মাসুদা বিবি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আল্লাহগো, আমার মেয়ের তকদিরে এই লিখেছিলে? ও কি করে বাকি জীবন কাটাবে?

আর সাবেরা খবরটা শুনে পাথরের মতো জমে গেল। কোনো কান্নাকাটি বা হা-হুঁতাশ করল না। তারপর যথাসময়ে সে মেয়ের জন্ম দিল, সেই মেয়ে রিজিয়া। রিজিয়ার বয়স যখন এক বছর তখন সাবেরা রোগে ভুগে মারা গেল। দাদি মাসুদা বিবি নাতনিকে মায়ের স্নেহ দিয়ে মানুষ করতে লাগলেন। বছর দুয়েক পর একদিন স্বামীকে বললেন, রিজিয়াকে ওর দাদা-দাদির কাছে দিয়ে এস। তারা ওকে লেখাপড়া করিয়ে বড় ঘরে বিয়ে দেবে।

আযীয মাস্টার বললেন, তুমি তো জান, রাকিব মা-বাবাকে না জানিয়ে সাবেরাকে বিয়ে করেছিল, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয়ও নেই। তারা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। বরং ঠকবাজ লোক ভেবে অপমান করে তাড়িয়ে দেবে।

কিন্তু রিজিয়া বড় হয়ে যখন তার বাবার কথা জানতে চাইবে তখন কী বলবে?

তখন তাকে সত্য ঘটনা বলব।

আর সে যখন বলবে ছোটবেলায় আমাকে দাদা-দাদির কাছে দিয়ে এলে কেন, তখন কী বলবে?

আযীয মাস্টার স্ত্রীর কথার উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইলেন।

মাসুদা বিবি বললেন, আমার কথা শোন, শিহাব তো সব কিছু জানে। তার কথা রিজিয়ার দাদা-দাদি অবিশ্বাস করতে পারবে না। যাওয়ার সময় তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। যা বলার শিহাবকেই বলতে বলবে।

আযীয মাস্টার বললেন, ঠিক আছে, শিহাবকে বলে দেখি সে কি বলে?

একদিন শিহাবের সঙ্গে দেখা করে আযীয মাস্টার স্ত্রীর কথাগুলো বলে জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যাপারে তুমি কি বল?

শিহাব বলল, চাচি আম্মা অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। আমার মনে হয় তাই করা উচিত। কিন্তু রাকিবের মা-বাবা আমার কথা বিশ্বাস করলেও তা প্রকাশ করবেন না আর রিজিয়াকেও গ্রহণ করবেন না। বরং আমাকে ও আপনাকে যা তা বলে অপমান করে তাড়িয়ে দেবেন।

আযীয মাস্টার বললেন, আমারও তাই ধারণা। কিন্তু তোমার চাচি আম্মা তোমাকে সঙ্গে নিয়ে রিজিয়াকে দিয়ে আসতে বারবার তাগিদ দিচ্ছে। এখন তুমি যা বলবে তাই হবে।

শিহাব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, যদিও মনে হচ্ছে গিয়ে কোন কাজ হবে, তবু চাচি আম্মার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য যাব। কবে যেতে চান?

শুক্রবার স্কুল বন্ধ। ঐ দিন গেলে ভালো হয়।

বেশ, তাই যাওয়া যাবে। আপনি সকালে রিজিয়াকে নিয়ে তৈরি থাকবেন, আমি এসে নিয়ে যাব।

শুক্রবার দিন শিহাব ওদেরকে নিয়ে ঢাকায় এসে প্রথমে একটা হোটেলে উঠল। তারপর বিকেলে রাকিবদের বাসায় গেল।

রাকিবের বাবা জাহিদ হাসান স্ত্রী, বড় ছেলে ও ছেলের বৌ এবং আট বছরের বড় নাতি হিমুকে নিয়ে বারান্দায় বসে চা-নাস্তা করছিলেন। এমন সময় দারোয়ান এসে বলল, ছোট ভাইয়ের বন্ধু শিহাব ভাই এসেছেন। তার সঙ্গে একজন বুড়ো লোক ও দু’বছরের একটা মেয়েও আছে।

শিহাব ভার্সিটিতে পড়ার সময় রাকিবদের বাসায় অনেক বার এসেছে। তাই দারোয়ান থেকে বাসার সবাই তাকে চেনে। রাকিব কানাডা যাওয়ার মাস খানেক পরে শিহাব একদিন বাসায় এসেছিল। সে সময় রাকিবের মৃত্যু সংবাদ শুনেছিল। তারপর আর আসে নি।

প্রায় আড়াই বছর পর শিহাব এসেছে জেনে তারা একটু অবাক হলেও খুশি হলেন। কেউ কিছু বলার আগে জাহিদ হাসান বললেন, ওদেরকে ড্রইংরুমে বসাও, আমরা আসছি।

একটু পরে সবাই ড্রইংরুমে এলেন।

শিহাব দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল।

জাহিদ হাসান তাদেরকে বসতে বললেন। বসার পর আযীয মাস্টারকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে?

শিহাব বলল, আমাদের গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। মেয়েটা ওনার নাতনি, আর রাকিবের মেয়ে।

তার কথা শুনে ঘরের সবাই খুব অবাক হয়ে একবার রিজিয়ার দিকে আর একবার আযীয মাস্টারের দিকে তাকাতে লাগলেন। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না।

জাহিদ হাসান অবাক হলেও শিহাবের ওপর খুব রেগে গেলেন। রাগটা সামলে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি রাকিবের বন্ধু না হলে এতক্ষণে তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতাম। যা বলার বলেছ, আর একটা কথা নয়। এক্ষুনি ওদেরকে নিয়ে চলে যাও।

শিহাব বলল, আপনারা বিশ্বাস না করলেও কথাটা সত্য। আর সত্য প্রকাশ করতে কোনো মানুষেরই ভয় পাওয়া উচিত নয়। মেয়েটা যে রাকিবের এবং তিন বছর আগে আমার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে রাকিব যে এই আযীয স্যারের মেয়েকে বিয়ে করেছিল, সে কথা আমাদের গ্রামের ও পাশের গ্রামের শত শত লোক জানে। তারপর রাকিব কিভাবে বিয়ে করল, সে সব বলে বলল, আপনারা আমাদের গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিলেই সত্য-মিথ্যা প্রমাণ পেয়ে যাবেন।

রাকিবের বড় ভাই রাগিব হাসান রাগের সঙ্গে বলল, আমাদের প্রমাণ নেয়ার দরকার নেই। তুমি ওদেরকে নিয়ে চলে যাও।

শিহাব বলল, জানতাম আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। তবু এসেছি, রাকিবের বন্ধু হিসেবে তার মেয়ের ভালোমন্দ চিন্তা করে। আপনারা যখন নিজের বংশধরকে মেনে নিতে পারলেন না তখন আমার আর কিছু করার নেই। তারপর সালাম দিয়ে আযীয মাস্টারকে আসতে বলে বেরিয়ে এল।

আযীয় মাস্টার চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতে জাহিদ হাসান বললেন, দাঁড়ান। তারপর ভেতরে গিয়ে ফিরে এসে একটা খাম আযীয মাস্টারের হাতে দেয়ার সময় বললেন, এতে হাজার দশেক টাকা আছে। এখন এটা রাখুন, পরে মাঝে মাঝে আসবেন তখন আবার দেব।

আযীয মাস্টার টাকার খামটা না নিয়ে বললেন, একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে একজন শিক্ষককে অপমান করতে পারলেন? আমি টাকার জন্য আসি নি? এসেছিলাম আপনার বংশের সন্তানকে দিতে। তারপর নাতনিকে বুকে তুলে নিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেলেন।

শিহাব বেরিয়ে এসে একটা স্কুটার ভাড়া করে অপেক্ষা করছিল। আযীয মাস্টার আসার পর স্কুটারে উঠতে বলে নিজেও উঠে বসল। স্কুটার চলতে শুরু করলে জিজ্ঞেস করল, বেরোতে দেরি হল কেন?

আযীয মাস্টার টাকা দেয়ার ঘটনাটা বলে বললেন, তোমার কথাই ঠিক হল, আমার জন্য ওনাদের কাছে তোমাকেও অপমানিত হতে হল।

শিহাব বলল, ও কিছু না স্যার। আমার কর্তব্য আমি করেছি, এটাই যথেষ্ট। তাতে কে কি বলল তা নিয়ে আমার কোনো যায় আসে না। তারপর বলল, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করব করব করেও মনে থাকে না, আচ্ছা, এবারে যখন সেটেলমেন্টের মাপ হল তখন আপনাকে একদিন বলেছিলাম, ঐ জায়গাটা আপনার নামে করে নিতে, নিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, করে নিয়েছি।

খুব ভালো করেছেন। ভবিষ্যতে কেউ আর ঐ জায়গাটা দখল করার চেষ্টা করতে পারবে না।

পরের দিন ঘরে ফিরে আযীয মাস্টার স্ত্রীকে রিজিয়ার বড় চাচা ও দাদাজী যা কিছু বলেছেন ও করেছেন জানালেন।

মাসুদা বিবি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের কর্তব্য আমরা করেছি। এখন আল্লাহ রিজিয়ার তকদিরে যা লিখেছেন তাই হবে।

রিজিয়া যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন হঠাৎ একদিন মাসুদা বিবি মারা গেলেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আযীয মাস্টার কেমন যেন হয়ে গেলেন। মাস্টারিতে ইস্তফা দিয়ে দিনরাত ঘরে থাকেন। সব সময় বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলেন। জমি-জায়গা বিক্রি করে সংসার চালালেন আর রিজিয়াকে এস.এস.সি. পর্যন্ত পড়ালেন। তারপর তার বিয়ে দেয়ার অনেক চেষ্টা করলেন।

রিজিয়া রাজি না হয়ে বলল, আমার বিয়ে হয়ে গেলে আপনার কি হবে? কে আপনাকে দেখাশোনা করবে?

তার কথা শুনে আযীয মাস্টার বললেন, আমি মরে গেলে তোর কি হবে? তোকে কে দেখাশোনা করবে? তোর ভরণ-পোষণ চলবে কি করে?

রিজিয়া বলল, যে ছেলে ঘরজামাই হয়ে থাকবে তাকে বিয়ে করব।

রিজিয়া দেখতে খুব সুন্দরী। স্বাস্থ্যও খুব ভালো। পাত্রপক্ষরা দেখতে এসেই পছন্দ করে ফেলে, কিন্তু যখনই শুনে ছেলেকে ঘরজামাই হয়ে থাকতে হবে তখনই তারা রাজি না হয়ে চলে যায়।

অনেকগুলো সম্বন্ধ ফিরে যাওয়ার পর আযীয মাস্টার ভেবে রাখলেন, শিহাব গ্রামে এসে দেখা করতে এলে নাতনির বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করবেন।

.

০৩.

শিহাব ঢাকায় ব্যবসা করে গাড়ি-বাড়ি করেছে। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে সেখানে থাকে। বছরে দু’তিনবার যখন গ্রামে আসে তখন আযীয মাস্টারের বাড়িতে এসে ভালোমন্দ খোঁজ নেয়। বন্ধুর মেয়ে হিসাবে রিজিয়ারও ভালোমন্দ খোঁজ নেয়। শিক্ষকের সম্মানস্বরূপ কিছু টাকা-পয়সা আযীয মাস্টারকে দেয়।

এবারে গ্রামে এসে শিহাব দেখা করতে এলে আযীয মাস্টার বললেন, তোমার বন্ধুর মেয়ে রিজিয়ার বিয়ে দিতে চাই; কিন্তু সে তো কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। তারপর রাজি না হওয়ার কারণ বললেন।

গত বছর রিজিয়া এস.এস.সি. পাস করার পর শিহাব তাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে কলেজে পড়াতে চেয়েছিল। আযীয মাস্টার রাজি হলেও রিজিয়া রাজি না হয়ে ঐ একই কথা তাকে বলেছিল। আযীয মাস্টার থেমে যেতে জিজ্ঞেস করল, রিজিয়া কি তার বাবার পরিচয় জানে?

হ্যাঁ, জানে। বড় হওয়ার পর আমি তাকে তার বাবার সব কিছু জানিয়েছি।

শিহাব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ওকে ডাকুন, আমি এ ব্যাপারে ওর সঙ্গে কথা বলব।

আযীয মাস্টার একটু উঁচু গলায় নাতনির নাম ধরে ডেকে বললেন, তোর শিহাব মামা এসেছে, চা করে নিয়ে আয়।

কিছুক্ষণের মধ্যে রিজিয়া দুকাপ চা নিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, মামা, কেমন আছেন? তারপর চায়ের কাপ দু’টো দু’জনকে দিল।

শিহাবকে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি মা। তুমি কেমন আছ।

আমি আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। নানাজীর মাঝে মাঝে শরীর খারাপ হয়। আর হবে নাইবা কেন, সারাদিন গ্রামে ঘুরে বেড়ান, সময়মতো গোসল ও খাওয়া-দাওয়া করেন না। আমি কতবার নিষেধ করি, আমার কথা কানেই নেন নি। আপনি একটু বুঝিয়ে বলবেন তো।

ঠিক আছে মা বলব। এখন তোমাকে দু’একটা কথা বলছি, স্যার তোমার বিয়ে দিতে চাচ্ছেন, তুমি নাকি রাজি হচ্ছ না?

বিয়ের কথা শুনে রিজিয়া লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি স্বামীর ঘরে চলে গেলে নানাজীকে কে দেখাশোনা করবে? তাই বলেছি, যে ছেলে ঘরজামাই হয়ে থাকবে তাকে….বলে লজ্জায় কথাটা শেষ করতে না পেরে ছুটে পালিয়ে গেল।

শিহাব মৃদু হেসে আযীয মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, রিজিয়া অন্যায় কিছু বলে নি। আমি ঐ রকম ছেলের খোঁজ করব। এখন আসি স্যার বলে সালাম বিনিময় করে চলে এল।

.

রিজিয়া ছোটবেলায় নানিকে জিজ্ঞেস করেছিল, তার আব্বা নেই কেন?

মাসুদা বিবি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে নাতনিকে আদর করে বলেছিলেন, তুই যখন মায়ের পেটে তখন তোর আব্বাকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নিয়েছে। যাকে আল্লাহ দুনিয়া থেকে তুলে নেয়, সে আর ফিরে আসে না।

বড় হয়ে রিজিয়া নানাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আব্বার গ্রামের বাড়ি কোথায়?

 আযীয মাস্টার বলেছিলেন, ঢাকায়।

রিজিয়া আবার জিজ্ঞেস করেছিল, আব্বার মা-বাবা ভাইবোন নিশ্চয়ই আছেন?

তা তো আছেই।

জানেন নানাজী, তাদেরকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছা করে। আচ্ছা তারা কি আমার কথা জানেন?

নাতনির কথা শুনে আযীয মাস্টার একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, তুই যখন দু’বছরের তখন আমি আর তোর শিহাব মামা তোকে তাদের কাছে দিয়ে আসার জন্য গিয়েছিলাম। তারা আমাদের কথা বিশ্বাস করলো না, অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন।

আব্বা কি ওনাদের অমতে মাকে বিয়ে করেছিলেন?

তোর আব্বা শিহাবের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল। তারপর বিয়ের ঘটনা বলার পর কিভাবে মারা গেল বললেন।

চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে রিজিয়া বলল, আল্লাহ আব্বাকে জান্নাত নসিব করুন। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি আব্বাদের বাসার ঠিকানা জানেন? দু’মণ ধান নেন। এইসব করে ধনী হয়েছেন। এখন এসব কথা বললে কেউ বিশ্বাস করবে?

আযীয মাস্টার বললেন, আল্লাহ কখন কাকে কি উসিলায় হেদায়েত করেন তা কেউ বলতে পারে না। আমার মনে হয় এ বছর হজ্ব করতে গিয়ে মাতব্বরের মন বদলে গেছে। ওপাড়ার হাশেম মিয়া একদিন বলল, মাস্টার সাহেব, আমাদের মাতব্বর হজ্ব করে এসে হুজুর হয়ে গেছেন। আমার যে জমিটা আধামূল্যে নিয়েছিলেন, গতকাল ডেকে পাঠিয়ে বাকি অর্ধেক টাকা দিয়ে বললেন, জমি নেয়ার সময় ন্যায্য দাম না দিয়ে যে ভুল করেছিলাম হজ্ব করতে গিয়ে সেই ভুল আল্লাহ ভেঙ্গে দিয়েছেন। তাই শুধু তোমাকে নয়, আরো যাদেরকে ঠকিয়ে জমি কিনেছি, তাদের সবাইকে ন্যায্য মূল্য দেব। আর যারা টাকা দিয়ে জমি ফেরৎ নিতে চাইবে, তাদের জমি ফেরৎ দিয়ে দেব।

মাতব্বরের ছোট ছেলে আশরাফও খুব ভালো। ঢাকায় ডাক্তারি পড়লেও নামায-রোযা করে। এখনও ডাক্তারি পাস করে নি। তবু গ্রামে এলেই গরিবদের কারো অসুখ-বিসুখের কথা শুনলে চিকিৎসা করে। এত কথা বলে আযীয মাস্টার হাঁপাতে লাগলেন।

রিজিয়া বলল, মাতব্বরের কথা পরে বলবেন। এখন চুপ করে ঘুমাবার চেষ্টা করুন।

.

প্রায় ঘণ্টা খানেক পর আশরাফ বন্ধুকে সঙ্গে করে ফিরে এসে ঘরের বাইরে থেকে বলল, আসতে পারি?

রিজিয়া গায়ে-মাথায় ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে বলল, আসুন।

আশরাফ ওষুধের প্যাকেট ও এক বোতল হরলিক্স নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল, স্যার এখন কেমন আছেন?

আযীয মাস্টার বললেন, এখন ভালো আছি।

আশরাফ হরলিক্সের বোতলটা টেবিলের উপর রেখে প্যাকেট থেকে ওষুধ বের করে খাওয়ার নিয়ম বলে দিল।

আশরাফ থেমে যেতে হিমু বলল, প্রেসক্রিপশনে কখন কোন ওষুধ খাবে লিখে দে।

আশরাফ লিখে দিয়ে রিজিয়াকে বলল, গ্লাসে পানি আন, আমি এক্ষুণি একটা ওষুধ খাইয়ে দিই। রিজিয়া পানি নিয়ে এলে আশরাফ স্যারকে ওষুধ খাইয়ে বলল, যে কয়েকদিন আছি প্রতিদিন একবার এসে আপনাকে দেখে যাব। এবার আসি বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আযীয মাস্টার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই রিজিয়া বলল, ওষুধ ও হরলিক্সের দাম কত।

আশরাফ বলল, ছাত্র হিসেবে স্যারকে আমি দিলাম। দামের কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? তারপর আযীয মাস্টারকে উদ্দেশ্য করে বলল, কয়েক মাস পরে আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা। দোয়া করবেন যেন আমরা ভালো রেজাল্ট করতে পারি।

আযীয মাস্টার বললেন, নিশ্চয় দোয়া করব ভাই।

রিজিয়াকে দেখে হিমু মুগ্ধ হয়েছে। হিমুকে দেখে রিজিয়াও মুগ্ধ হয়েছে। তাই একে অপরের দিকে মাঝে মাঝে তাকাতে গিয়ে বারবার চোখাচোখি হয়েছে এবং দুজনই লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে।

নানার কথা শেষ হতে লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে রিজিয়া আশরাফকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনার বন্ধু আমাদের বাড়িতে প্রথম এলেন, আমরা গরিব, ভাল কিছু আপ্যায়ন করাতে না পারলেও অন্তত এক কাপ চা না খাইয়ে যেতে দেয়া কি উচিত হবে? আপনারা বৈঠকখানায় বসুন আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।

আশরাফ কিছু বলার আগে হিমু বলল, ওসব ফরমালিটি আমি পছন্দ করি না। আপনি ওনার মাথায় বাতাস দিতে থাকুন। আমরা আসার সময় চা খেয়ে এসেছি। আল্লাহ রাজি থাকলে আবার যখন আসব তখন খাব।

হিমু থেমে যেতে আশরাফ বলল, এবার তা হলে আসি। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেল।

তারা চলে যাওয়ার পর আযীয মাস্টার বললেন, দেখলি তো আরাফ কত ভালো ছেলে?

রিজিয়া নানার কথার উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেল। একটু পরে এক গ্লাস গরম পানি নিয়ে এসে হরলিক্স তৈরি করার সময় বলল, আশরাফ ভাই যে ভালো তা আমি অনেক আগে থেকে জানি। স্কুলে পড়ার সময় যেসব ছেলেমেয়ে বেতন ও পরীক্ষার ফি দিতে পারত না তাদের বেতন ও পরীক্ষার ফি আশরাফ ভাইকে দিতে দেখেছি। এখন আর কথা না বলে এটা খেয়ে ঘুমান। আমি সামসু মামার দোকান থেকে চাল-ডাল এনে রান্না চাপাব। নানাকে হরলিক্স খাইয়ে রিজিয়া গ্লাস নিয়ে বেরিয়ে গেল।

আযীয মাস্টার চিন্তা করতে লাগলেন, আশরাফের মতো ছেলের সঙ্গে যদি রিজিয়ার বিয়ে হত, তা হলে শান্তিতে মরতে পারতাম।

ফেরার পথে হিমু বলল, তোর স্যারের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ, তাই?

আশরাফ বলল, হ্যাঁ, তবে আগে অবস্থা খুব ভালো ছিল। তারপর স্যারের বাবা অন্য জেলার লোক হয়েও কিভাবে এখানে এসে বসবাস করলেন এবং স্যারের অবস্থা কেন খারাপ হল বলল।

মেয়েটা স্যারকে নানাজী বলছিল, ওনার কোনো ছেলে নেই?

না। সাবেরা নামে একটাই মেয়ে ছিল। তারই একমাত্র সন্তান রিজিয়া। রিজিয়া যখন দু’বছরের তখন তার মা মারা যায়। তার কয়েক বছর পর রিজিয়ার নানিও মারা যান। তারপরের ঘটনা তো একটু আগে বললাম।

রিজিয়ার বাবার কথা তো কিছু বললি না?

আশরাফ হেসে উঠে বলল, ওদের ব্যাপারে তুই এত কথা জানতে চাচ্ছিস কেন?

হিমু বলল, বারে, একজন শিক্ষকের সম্পর্কে জানতে চাওয়া কি অন্যায়? এমনি মানবতার খাতিরে জানতে চাচ্ছি।

আশরাফ আবার হেসে উঠে বলল, আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।

হিমুও হেসে উঠে বলল, কি মনে হচ্ছে বল তো শুনি।

তুই রিজিয়ার দিকে বারবার যেভাবে তাকাচ্ছিলি যেন কখনো মেয়েছেলে দেখিস নি।

হিমু এবার একটু গম্ভীর হয়ে বলল, তোর কথা অস্বীকার করব না। রিজিয়াকে দেখে সত্যিই আমার মনে হয়েছে যেন এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখলাম।

এইতো ধরা পড়ে গেলি বন্ধু। আসলে রিজিয়াকে দেখে তুই মুগ্ধ হয়েছিস। তাই তাদের সব কিছু জানতে চাচ্ছিস। কিন্তু একটা কথা ভুলে যাচ্ছিস কেন, যে কোনো সুন্দর জিনিস দেখলে মানুষ মুগ্ধ হবেই। তাই বলে তাকে নিয়ে বেশি কচলাকচলি করা বোকামি।

হিমু রাকিবের বড় ভাই রাগিবের ছেলে। শিহাবের সঙ্গে আযীয মাস্টার যখন নাতনিকে তার দাদা-দাদিকে দিতে গিয়েছিলেন তখন হিমুর বয়স আট বছর হলেও ঘটনাটা তার মনে ছবির মতো গেঁথে আছে। বাবা ও দাদাজী যা কিছু বলেছিল তাও মনে আছে। এমনকি আযীয মাস্টারের করুণ মুখের ছবিও মনে আছে। বন্ধু আশরাফের বাড়িতে বেড়াতে এসে আযীয মাস্টারকে দেখে মনে হয়েছে, ইনিই নাতনিকে নিয়ে তাদের বাসায় গিয়েছিলেন। তাই রিজিয়ার সব কিছু জেনে নিশ্চিত হতে চায়। বলল, আমি তো কচলাকচলি করি নি, শুধু তার সব কিছু জানতে চাচ্ছি। তা ছাড়া সব কিছু জানার পেছনে এমন একটা কারণ আছে, যা এখন তোকে বলতে পারব না। তুই রিজিয়ার বাবার কথা বল।

আশরাফ রিজিয়ার বাবা কি ভাবে তার মাকে বিয়ে করল ও কিভাবে মারা গেল বলে বলল, স্যার দু’বছরের রিজিয়াকে নিয়ে ঢাকায় তার দাদা-দাদির কাছে দিতে গিয়েছিলেন। তারা স্যারকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন।

হিমু জিজ্ঞেস করল, তুই এত কিছু জানলি কি করে? তখন তো ছোট ছিলি?

আশরাফ বলল, বড় হয়ে বাবার মুখে শুনেছি।

হিমু প্রায় নিশ্চিত হয়েও জিজ্ঞেস করল, রিজিয়ার বাবার নাম জানিস?

জানতাম ভুলে গেছি, বাবাকে জিজ্ঞেস করে তোকে বলব।

তোকে আর জিজ্ঞেস করতে হবে না, আমিই জেনে নেব।

 ততক্ষণে তারা বাড়ি পৌঁছে গেল।

আশরাফের বাবা মাতব্বর করিম সেখ বৈঠকখানায় বসে গড়গড়ার পাইপ মুখে দিয়ে তামাক খাচ্ছিলেন। তাদের দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আযীয মাস্টার এখন কেমন আছেন?

আশরাফ বলল, ভালো আছেন। আমি ওষুধ ও হরলিক্স কিনে দিয়ে এসেছি।

করিম সেখ বললেন, ভালই করেছ। মনে হয় বেশি দিন বাঁচবেন না। তারপর আবার বললেন, বেলা হয়েছে, এক্ষুণি জোহরের আজান হবে। তোমরা গোসল করে নাও।

আশরাফ জি যাচ্ছি বলে বলল, হিমু রিজিয়ার বাবার সম্পর্কে কিছু জানতে চায়।

করিম সেখ হিমুর দিকে তাকিয়ে বললেন, কি জানতে চাও বল।

হিমু বলল, রিজিয়ার বাবার নাম ও তাদের বাসার ঠিকানা জানতে চাই।

করিম সেখ হিমুর মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন চিন্তা করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি রিজিয়ার মা-বাপের বিয়ের ঘটনা জান?

জি আশরাফ বলেছে। তবু আপনার মুখে শুনতে চাই।

রিজিয়ার বাপের নাম রাকিব হাসান। বাড়ি ঢাকায়, তবে তার বাবার নাম ও ঠিকানা জানি না। তারপর সাবেরা ও রাকিবের বিয়ের ঘটনা বলে বললেন, পাশের গ্রামের শিহাব তাদের সব কিছু জানে।

রিজিয়ার বাবার নাম শুনে মনের ভেতর চমক খেল হিমু। নিশ্চিত হল, রিজিয়া তার ছোট চাচার মেয়ে।

এমন সময় আশরাফ এসে হিমুকে বলল, আয়, পুকুরে গোসল করতে যাব। তারপর যেতে যেতে বলল, আব্বার কাছে সব কিছু জেনেছিস?

হিমু বলল, হ্যাঁ। রিজিয়ার বাবার নাম রাকিব হাসান। তবে রাকিবের বাবার নাম ও ঢাকার ঠিকানা বলতে পারলেন না। বললেন, পাশের গ্রামের শিহাব সব কিছু জানে। তুই শিহাবকে চিনিস?

পাশের গ্রামে বাড়ি, চিনব না কেন?

 বিকেলে নিয়ে যাবি, আমি ওনার সঙ্গে দেখা করব।

তিনি তো গ্রামে থাকেন না, ঢাকায় থাকেন। সেখানে ব্যবসা করে গাড়ি বাড়ি করেছেন। খুব ভালো লোক। গ্রামে এলেই স্যারের বাড়িতে এসে খোঁজখবর নেন।

ওনার ঢাকার ঠিকানা জানিস?

না বলে আশরাফ জিজ্ঞেস করল, সত্যি করে বল তো, তুই রিজিয়ার বাবার সব কিছু জানতে চাচ্ছিস কেন?

একটু আগে বললাম না, এখন বলতে পারব না? তবু জিজ্ঞেস করছিস কেন?

তা হলে বল, কখন বলতে পারবি?

মনে কিছু নিস না, কখন বলতে পারব তাও এই মুহূর্তে বলতে পারছি, তবে একদিন না একদিন তোকে বলবই। এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবি না।

পুকুর থেকে গোসল করে এসে খাওয়ার পর বিশ্রাম নেয়ার সময় হিমু বলল, আমার একটা উপকার করবি?

আশরাফ বলল, বন্ধু বন্ধুর উপকার করবে না তো শত্রুর করবে? বল কি করতে হবে।

আমি রিজিয়াকে বিয়ে করব, তোকে সব কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।

তোর কি মাথা খারাপ হল? এরকম বাজে চিন্তা করবি না।

মাথা আমার খারাপ হয় নি, আর বাজে চিন্তাও করছি না। তোকে কাল বললাম না, রিজিয়াকে দেখে আমার মনে হয়েছে এই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখছি।

তা বলেছিস, তাই বলে চাল-চুলোহীন, পাড়াগাঁয়ের অল্প শিক্ষিত এরকম একটা মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলতে মুখে বাধল না? তোর কি রুচি বলতে কিছু নেই। না-না, এ কখনই সম্ভব নয়। তুই রিজিয়ার রূপ দেখে মাতাল হয়ে গেছিস। কোনো সুস্থ মানুষ মাতালের কথামতো কাজ করতে পারে না।

তা হলে তুই আমার উপকার করবি না?

এটা তো উপকার করা নয়, বরং সর্বনাশ করা। এটা ফাইনাল ইয়ার। এক বছর পর তুই ডাক্তার হবি। আমার চেয়ে তুই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। তুই ই বল না, এ সময় তোর কি বিয়ে করা উচিত? জেনেশুনে আমি তোর সর্বনাশ করতে পারব না।

আমার ভালোমন্দ তোকে চিন্তা করতে হবে না। সাফ সাফ বল, উপকার করবি কি না।

আশরাফ কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বলল, মাফ কর, আমার দ্বারা একাজ করা সম্ভব নয়।

ঠিক আছে, তোকে আর কিছু বলব না, যা করার আমি নিজেই করব।

তুই রাগ করছিস কেন? একটু ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখলেই বুঝতে পারবি কত বড় সর্বনাশের পথে পা বাড়াতে যাচ্ছিস?

এক কথা বারবার বলবি না তো, তোকে কথাটা বলাই ভুল হয়েছে।

আশরাফ চিন্তা করল, এখন ওকে যত ভালো কথাই বলি না কেন, ওর মগজে ঢুকবে না। তাই আর কিছু না বলে চুপ করে রইল। পরের দিন সকালে আশরাফ ও হিমু আযীয মাস্টারকে দেখতে গেল।

রিজিয়া তখন বৈঠকখানা আঁট দিচ্ছিল। তাদেরকে দেখে আঁটা রেখে ওড়নাটা ভালো করে গায়ে-মাথায় দিয়ে সালাম দিল।

আশরাফ সালামের উত্তর দিয়ে বলল, স্যার আজ কেমন আছেন?

 রিজিয়া বলল, কালকের থেকে ভালো।

চল, তবু স্যারকে একটু পরীক্ষা করে দেখব।

আযীয মাস্টার চা-বিস্কুট খেয়ে ঘরের বারান্দায় বসেছিলেন। রিজিয়া কারো সঙ্গে কথা বলছে শুনে একটু উঁচু গলায় নাতনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কার সঙ্গে কথা বলছিস?

রিজিয়া তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আসার সময় বলল, আশরাফ ভাই ও তার বন্ধু আপনাকে দেখতে এসেছেন।

কাছে এসে আশরাফ সালাম বিনিময় করে বলল, রিজিয়ার কাছে শুনলাম আজ আপনি ভালো আছেন। তবু একটু পরীক্ষা করব।

আযীয মাস্টার রিজিয়াকে বললেন, আশরাফের বন্ধুকে একটা টুল এনে দে বসুক।

রিজিয়া ঘরের ভেতর থেকে টুল এনে হিমুকে বলল, আপনি বসুন। তারপর রান্না ঘরের দিকে চলে গেল।

হিমু আশরাফকে বলল, তুই টুলে বস, আজ আমি স্যারকে পরীক্ষা করব। এই কথা বলে পরীক্ষা করে বলল, ভীষণ দুর্বল। রোদে একদম হাঁটাহাঁটি করবেন না। কয়েকদিন সম্পূর্ণ বিশ্রাম নেবেন। তারপর বলল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলতে চাই।

আযীয মাস্টার বললেন, তোমরা আমারা নাতির বয়সী। তার ওপর শিক্ষিত। আজ বাদে কাল ডাক্তার হবে। তোমাদের কথায় মনে কিছু করব কেন? বল কি বলতে চাও।

রিজিয়া একটা থালায় দুকাপ চা ও কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে আসার সময় হিমুর ও নানাজীর কথা শুনেছে। তাই থালাটা বিছানার পাশে রেখে রান্না ঘরে গিয়ে হিমু কি বলে শোনার জন্য কান খাড়া করে রইল।

আশরাফ বুঝতে পেরেছে হিমু কি কথা বলবে। সে কিছু বলার আগে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আগে চা খেয়ে নে তারপর যা বলার বলবি।

হিমু চা খেয়ে কাপটা নামিয়ে রেখে আযীয মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আপনার নাতনিকে বিয়ে করতে চাই।

মেয়ের মতো নাতনির জীবনেও একই ট্র্যাজেডি ঘটতে দেখে আযীয মাস্টার চমকে উঠে এতো রেগে গেলেন যে, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না।

আর রিজিয়া কথাটা শুনে তার তনুমনুতে অজানা শিহরণ বইতে শুরু করলেও লজ্জায় তার মুখটা লাল হয়ে গেল।

কথাটা বলে হিমু মুখ নিচু করে নিয়েছিল। স্যারকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে মুখ তুলে দেখল, তিনি খুব রাগের সঙ্গে একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। ভয়ে ভয়ে বলল, জীবনসঙ্গী পছন্দ করার অধিকার ইসলাম নর-নারীকে দিয়েছে। তাই…।

আযীয মাস্টার হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, তা আমি জানি। তুমি বড়লোকের ছেলে হও আর গরিব লোকের ছেলে হও, যাই হও না কেন তোমার প্রস্তাব মেনে নিতে পারছি না। তুমি আর কখনও এখানে এসো না। তারপর আশরাফের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি একে সঙ্গে নিয়ে আর আসবে না। এখন তোমরা যাও।

হিমুর কথা শুনে স্যার যে খুব রেগে গেছেন ও তার প্রতিও খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন আশরাফ বুঝতে পারল। তাই কিছু না বলে হিমুকে নিয়ে বেরিয়ে এল। ঘরে ফেরার পথে হিমু বলল, বিয়ে করার কথা শুনে স্যার অত রেগে গেলেন কেন বলতে পারিস?

আশরাফ বলল, তা আমি কি করে বলব। তবে মনে হয় শহরের ছেলেদের ওপর ওনার খুব রাগ। রিজিয়ার বাবাও শহরের ছেলে ছিল কি না।

তাতে কি হয়েছে। তিনি তো স্ত্রীর সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেন নি। তাকে ত্যাগও করেন নি। এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। এতে তো ওনার কোনো হাত ছিল না।

তা অবশ্য ঠিক। শুনেছি অনেক ভালো ভালো সম্বন্ধ এসেছিল। রিজিয়া রাজি হয় নি। তারপর রাজি না হওয়ার কারণ বলল।

হিমু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুই রিজিয়াকে ও স্যারকে বলিস, ডাক্তারি পাস করার পর আমি রিজিয়াকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে থাকব। স্যার আমাকে যেতে নিষেধ করেছেন, নচেৎ নিজেই গিয়ে বলতাম।

আশরাফ বলল, এটা খুব বাড়াবাড়ি করছিস। তুই তোর মা-বাবার একমাত্র সন্তান। রিজিয়ার জন্য তাদেরকে ছেড়ে চলে আসতে পারবি? তা ছাড়া তারা তোর এই হঠকারিতা কিছুতেই মেনে নেবেন না।

আমার মা-বাবাকে আমি চিনি। তারা একমাত্র ছেলের মতের বিরুদ্ধে কিছু করবেন না।

সে বিশ্বাস আমার আছে। তবু আমি তোর কথা কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। আর রিজিয়া ও স্যারকে ঘরজামাই হয়ে থাকার কথা যে বলতে বললি, তা বলতেও পারব না।

হিমু খুব রেগে গিয়ে বলল, এটাই বুঝি বন্ধুর পরিচয়?

হ্যাঁ, এটাই প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়। কারণ তোর সর্বনাশ হতে আমি কিছুতেই দেব না। তুই যাতে রিজিয়াকে বিয়ে করতে না পারিস সেই চেষ্টাই করব।

তুই যাকে সর্বনাশ বলছিস, সেটাই আমার জীবনের পরম পাওয়া। যতই বাধা দিস, আমি রিজিয়াকে যেমন করে তোক বিয়ে করবই।

আমিও দেখব তুই কেমন করে রিজিয়াকে বিয়ে করিস।

ততক্ষণে তারা বাড়িতে চলে এসেছে। হিমু নিজের কাপড়-চোপড় ব্রিফকেসে ভরে নিয়ে বলল, আজ থেকে আমাদের বন্ধুত্ব শেষ। জানিস তো আমি যা বলি তা করেই থাকি। কথা শেষ করে ব্রিফকেস নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

আশরাফ তাকে বাধা দিতে গিয়েও দিল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভাবল, হিমু, তুই এখন রিজিয়ার রূপে পাগল হয়ে আছিস, তাই আমাকে ভুল বুঝে চলে গেলি। একদিন না একদিন তোর ভুল ভাঙবেই। একসময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।

হিমু আশরাফদের ঘর থেকে বেরিয়ে আযীয মাস্টারের বাড়িতে এল।

আযীয মাস্টার উঠোনের একপাশে তোলা পানিতে গোসল করছিলেন। তাকে দেখে খুব রাগের সঙ্গে বললেন, তোমাকে আসতে নিষেধ করেছি না?

হিমু বলল, আমি ঢাকা চলে যাচ্ছি। তাই একটা কথা বলার জন্য এসেছি।

আযীয মাস্টার জোর গলায় রাগের সঙ্গেই বললেন, আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।

আপনি শুনতে না চাইলেও আমি বলব। ডাক্তারি পাস করার পর আমি এসে আপনার নাতনিকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়েই থাকব। এর মধ্যে অন্য কোথাও তার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন না। কথা শেষ করে হিমু হনহন করে হাঁটতে শুরু করল।

রিজিয়া রান্নাঘরে রান্না করছিল। নানার বড় গলা পেয়ে উঁকি মেরে হিমুকে দেখে ও তার কথা শুনে যতটা না অবাক হল, তার থেকে হাজার গুণ বেশি আনন্দিত হল। বিড়বিড় করে বলল, আল্লাহগো, তুমি মানুষের মনের গোপন কথা জান, তুমি আমার মনের নেক বাসনা পূরণ করো।

এরপর থেকে আযীয মাস্টার দিনের পর দিন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন। চলাফেরা মোটেই করতে পারেন না। মাতব্বরের কাছ থেকে আনা টাকা ফুরিয়ে যেতে- যেদিন উপোষ গেল, সেদিন রাতে নাতনিকে বললেন, তুই কাল মাতব্বরের কাছে গিয়ে কিছু টাকা চেয়ে নিয়ে আসবি।

রিজিয়া বলল, না খেয়ে মরে গেলেও আমি টাকা চাইতে মাতব্বরের কাছে যেতে পারব না। কথাটা বলল বটে, কিন্তু সারারাত চিন্তা করল, মাতব্বরের কাছ থেকে টাকা না নিয়ে এলে নানাজী না খেতে পেয়ে মারা যাবেন। আর সেইবা কতদিন না খেয়ে থাকতে পারবে? সারারাত নফল নামায ও কুরআন পড়ে আল্লাহর কাছে কেঁদে সাহায্য চাইল। রাত জাগার ফলে ফজরের নামায পড়ার পর তার চোখে ঘুম ভেঙে এল। ফলে নামাযের পাটিতেই ঘুমিয়ে পড়ল।

.

০৪.

শিহাব একদিন স্বপ্ন দেখল, আযীয মাস্টার মারা গেছেন। আর রিজিয়া পাগল হয়ে গেছে। স্বপ্নটা দেখার পর শিহাবের ঘুম ভেঙ্গে গেল। চিন্তা করল, স্যারের কিছু হয় নি তো? তারপর আর ঘুমোতে পারল না।

সকালে স্বামীর মন খারাপ দেখে স্ত্রী আরিফা জিজ্ঞেস করল, আজ তোমাকে যেন কেমন দেখাচ্ছে, রাতে কি ভালো ঘুম হয় নি?

শিহাব বাবার বন্ধু আরমান চৌধুরীর একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করেছে। আরমান চৌধুরী শিহাবদের গ্রামের লোক হলেও ঢাকায় ব্যবসা করে বাড়ি গাড়ি করেছেন। শিহাব লেখাপড়া শেষ করার পর তিনি তাকে ঢাকায় ব্যবসায় নামিয়েছেন এবং পরে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য বিয়ের ব্যাপারটা শিহাবের বাবা ও আরমানের মধ্যে অনেক আগে থেকে পাকা কথা হয়ে ছিল।

আরিফার মা রেহানা ও বাবা আরমান চৌধুরী খুব ধার্মিক। মেয়ে আরিফা ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে অনুসরণ করেছে। তাই বড়লোকের একমাত্র মেয়ে কলেজ-ভার্সিটিতে পড়লেও যেমন ধর্মীয় জ্ঞান পেয়েছে তেমনি সেসব মেনেও চলে।

শিহাব এক সময় স্ত্রীকে বন্ধু রাকিবের বিয়ের কথা, কিভাবে সে মারা গেল ও রিজিয়াকে তার দাদা-দাদির অস্বীকার করার কথা যখন বলে তখন আরিফা দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিল, রিজিয়াকে নিয়ে এস, আমি তাকে মায়ের স্নেহ দিয়ে মানুষ করব।

শিহাব বলেছিল, তুমি আমার মনের কথাটা বলেছ। কিন্তু আযীয স্যার ওকে ছাড়া বাঁচবেন না।

আজ স্ত্রীর কথা শুনে বলল, ঘুম হয়েছে। তারপর স্বপ্নের কথা বলে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, ভাবছি স্যারের কিছু হয়ে গেল রিজিয়াকে এখানে নিয়ে আসব।

আরিফা বলল, আমি তো অনেক আগেই তোমাকে বলেছি ওকে এখানে নিয়ে চলে এসো। অনেক স্বপ্ন সত্য হয়। তুমি আজই একবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে স্যারের খোঁজ নাও।

শিহাব বলল, হ্যাঁ, আমিও তাই ভেবেছি। আজ রাতের গাড়িতেই যাব।

.

কারো ডাকে রিজিয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে নামায পাটি তুলে রেখে বাইরে এসে শিহাবকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, মামা কেমন আছেন?

শিহাব সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। তারপর জিজ্ঞেস করল, স্যার কেমন আছেন? তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলি?

রিজিয়া লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বলল, নানাজীর শরীর ভালো নয়। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না।

সে কি রে, চল তো দেখি বলে শিহাব ঘরের ভেতরে ঢুকল।

রিজিয়া নানাজী-নানাজী বলে দুতিনবার ডেকে সাড়া না পেয়ে গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠে বলল, মামা দেখুন না, নানাজীর গা বরফের মতো ঠাণ্ডা।

 তার কথা শুনে শিহাবও চমকে উঠে গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারল, অনেক আগে মারা গেছেন। ইন্নালিল্লাহে…রাজেউন পড়ে বলল, স্যার চার পাঁচ ঘণ্টা আগে মারা গেছেন।

রিজিয়া না… বলে নানাজীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

শিহাব দুই গ্রামের লোকজনদের স্যারের মৃত্যুর খবর জানিয়ে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করল। তারপর তাদেরকে রিজিয়ার সব দায়িত্ব নেয়ার কথা জানিয়ে তাকে বাড়িতে নিয়ে এলো। কয়েকদিন বাড়িতে থেকে রিজিয়াকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে এসে স্ত্রীকে সব কিছু জানাল।

আরিফা রিজিয়াকে মেয়ের মতো গ্রহণ করল। তার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করবে ছেলেমেয়েদেরকে বুঝিয়ে বলে দিল।

শিহাবের দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মেয়ে দুটো বড়। নাম ফারিহা ও সাজিদা। আর ছেলের নাম রায়হান। ফারিহা এ বছর কলেজে ভর্তি হয়েছে। সাজিদা এইটে ও রায়হান সিক্সে পড়ে।

আরিফা একদিন স্বামীকে বলল, রিজিয়া বাসায় সব সময় মন খারাপ করে থাকে। ও তো এস.এস.সি. পাস করেছে। ওকে ফারিহাদের কলেজে ভর্তি করে দাও। দুজনে একসঙ্গে কলেজে যাবে, একসঙ্গে পড়াশোনা করবে। তা হলে মন খারাপ করার সময় পাবে না।

শিহাব বলল, তুমি ঠিক কথা বলেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি সেই ব্যবস্থা করব।

প্রথম দিকে রিজিয়া মন খারাপ করে থাকলেও কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে এলো। ফারিহা শহরের বড় লোকের মেয়ে হয়েও তার কোনো অহঙ্কার নেই জেনে এবং তাকে খুব ধার্মিক দেখে রিজিয়া অবাক হলেও খুব খুশি হল। কিছুদিনের মধ্যে তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠল। একসঙ্গে শুধু কলেজে যাতায়াত ও পড়াশোনা নয়, খাওয়া-দাওয়া, বেড়ান ও ঘুমান পর্যন্ত একসঙ্গে করে।

এখন তারা বি.এ. পড়ছে। এটা তাদের ফাইনাল ইয়ার। একদিন দু’জনে মালিবাগে আড়ং-এর দোতলা থেকে দু’জনের থ্রিপিস কিনে নিচতলায় হ্যাঁন্ডিক্রাফটের সো-পিস দেখছিল। বোরখা পরে মুখে নেকাব দিয়ে এলেও তখন দু’জনের মুখ খোলা ছিল। হঠাৎ ফারিয়া লক্ষ্য করল, একটা হ্যাঁন্ডসাম ছেলে রিজিয়াকে দেখিয়ে সঙ্গের বয়স্ক মহিলার কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু বলছে। রিজিয়াকে কনুয়ের গুঁতো মেরে ব্যাপারটা বলে বলল, মুখে নেকাব দিয়ে কেটে পড়ি চল।

আশরাফের সঙ্গে রাগারাগি করে তাদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর হিমু তার সঙ্গে আর মেলামেশা করে নি। এমনকি কথাবার্তাও বলে নি। একসঙ্গে ক্লাস করার সময় দেখা হলে না দেখার ভান করে সরে গেছে। তারপর ডাক্তারি পাস করে একবছর ইন্টারনিশিপ করার পর মা-বাবাকে বন্ধুর বাসায় বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে একদিন আযীয মাস্টারের বাড়িতে এসে অবাক। সেখানে বিরাট হাসপাতাল হয়েছে। লোকজনদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, প্রায় দু’তিন বছর আগে আযীয মাস্টার মারা গেছেন। ওনার নাতনি রিজিয়ার কথা কেউ বলতে পারল না। হিমু একবার ভেবেছিল আশরাফের বাবাকে জিজ্ঞেস করলে হয়তো রিজিয়ার খবর তিনি দিতে পারেন। আবার ভাবল, আশরাফ ইন্টারনিশিপ করে বাড়িতে আছে। তার বাবার কাছে রিজিয়ার খবর জানতে গেলে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তাই চিন্তাটা বাদ দিয়ে গ্রামের লোকের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, পাশের গ্রামের শিহাব রিজিয়ার বাবার বন্ধু। সে রিজিয়াকে ঢাকায় নিয়ে চলে গেছে। শিহাবের ঢাকার ঠিকানা যেমন করে হোক জানার চেষ্টা করবে ভেবে ফিরে আসে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও শিহাবের ঠিকানা পেল না। এখন সে ঢাকাতেই চেম্বার খুলে প্র্যাকটিস করার চিন্তা-ভাবনা করছে। এর মধ্যে তার মা-বাবা বিয়ে দেয়ার কথা অনেক করে বলেছেন। হিমু রিজিয়ার কথা ভুলতে পারে নি। তার ধারণা, রিজিয়াকে একদিন না একদিন খুঁজে পাবেই। তাই মা বাবাকে বলেছে, এখন আমি বিয়ে করব না। তোমরা এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? চেম্বার খুলে প্র্যাকটিস করে রোজগার-টোজগার করি, তারপর না বিয়ের ব্যাপার।

আজ তার মা সাবিহা বেগম তাকে নিয়ে আড়ং-এ কাপড় কেনার জন্য এসেছেন।

দোতলায় উঠতে গিয়ে হিমু একটা মেয়ের সঙ্গে রিজিয়াকে দেখে চিনতে পেরে মাকে বলল, পরে দোতলায় যাব। তার আগে নিচতলায় হ্যাঁন্ডিক্র্যাফটের সো-পিস কিনব। তারপর সো-পিস দেখতে দেখতে মাকে বলল, ঐ যে দুটো বোরখা পরা মেয়ে দেখছ, বাম দিকের মেয়েটাকে ভালো করে দেখ, তোমার পছন্দ কিনা। যদি হয়, তা হলে তাদের কাছ থেকে বাসার ঠিকানা জেনে নাও।

একমাত্র ছেলের বিয়ে দেয়ার জন্য সাবিহা বেগম ও স্বামী রাগিব হাসান অনেক সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে দেখিয়েছেন। তা ছাড়া অনেক মেয়ের ফটোও দেখিয়েছেন। তাদের কাউকেই হিমুর পছন্দ হয় নি। আজ হঠাৎ তার মুখে এরকম কথা শুনে সাবিহা খুব অবাক হলেও রিজিয়ার মুখের দিকে তাকালেন।

ফারিহার কথা শুনে রিজিয়া তাদের দিকে একপলক তাকিয়ে মুখে নেকাব দিয়ে বলল, হ্যাঁ চল। তারপর দু’জনে ত্রস্তপদে বেরিয়ে এসে পার্ক করা গাড়িতে উঠে ফারিহা ড্রাইভারকে যেতে বলল।

হিমু মাকে অপেক্ষা করতে বলে বেরিয়ে তাদেরকে একটা প্রাইভেট কারে উঠতে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। গাড়িটা চলতে শুরু করলে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নাম্বারটা দেখে নিয়ে মায়ের কাছে ফিরে এসে বলল, দোতলায় চল।

রাস্তার দিকে কাচের দেয়াল থাকায় সাবিহা বেগম মেয়ে দু’টিকে গাড়িতে উঠে চলে যেতে দেখেছেন। ছেলের কথা শুনে হাসি চেপে রেখে বললেন, তুই সো-পিস কিনবি না?

আজ আর কিনব না, অন্য দিন কিনব। তুমি চল তো।

তুই ওদেরকে চিনিস?

হিমু বলল, যাকে দেখালাম, তাকে একটু একটু চিনি। অন্য মেয়েটাকে চিনি না।

সাবিহা বেগম মৃদু হেসে বললেন, বাসায় ফিরে এ ব্যাপারে তোর সঙ্গে কথা বলব, এখন উপরে চল কাপড় কিনব।

ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর ফারিহা পেছনে ফিরে হিমুকে তাদের গাড়ির দিকে চেয়ে থাকতে দেখে রিজিয়াকে বলল, দেখ দেখ, ছেলেটা রাস্তায় এসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে চিনিস না কি?

রিজিয়া হিমুকে এক নজর দেখেই চিনতে পেরেছে। যেদিন সে আশরাফের সঙ্গে তাদের বাসায় গিয়েছিল, সেদিন তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল ঠিক; কিন্তু কল্পনাও করে নি তাকে স্বামী হিসেবে পাওয়ার। তারপর যেদিন হিমু তাদের বাড়িতে এসে নানাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তখন তার তনুমনুতে আনন্দের শিহরণ বইতে শুরু করে। তারপর নানার কথা শুনে সেই শিহরণ থমকে বন্ধ হয়ে যায়। ঐ দিনই পর ঢাকা ফেরার পথে হিমু নানাকে যে কথা বলেছিল, তা শুনে থমকে বন্ধ হয়ে যাওয়া শিহরণ আবার সমস্ত শরীরে বইতে শুরু করে। তারপর থেকে আজ তিন বছর হিমুকে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে আসছে। ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আল্লাহকে জানায়, হিমুর সঙ্গে যেন অন্তত একবার কোথাও না কোথাও দেখা হয়ে যায়। আজ আড়ং-এ হিমুকে দেখে চমক খেলেও তা বাইরে প্রকাশ হতে দেয় নি। কয়েক সেকেন্ড মনের পিপাসা মিটিয়ে মুখের নেকাব দিয়ে ফারিহার কথা শুনে যন্ত্রচালিতের মতো এসে যখন গাড়িতে উঠেছে তখন তার মনের অবস্থা বেসামাল। আল্লাহ তার একটা আশা পূরণ করেছেন ভেবে মনে মনে তাঁর শুকরিয়া আদায় করছিল আর ভাবছিল, আল্লাহ একবার যখন তার মনের মানুষকে দেখিয়েছেন তখন আবার নিশ্চয় দেখাবেন। এইসব কথা ভাবছিল বলে ফারিহার কথা তার কানে গেল না।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে ফারিহা আবার বলল, কি ভাবছিস? ছেলেটাকে চিনিস কি না বললি না যে?

ফারিহাকে তার মনের কথা বলা ঠিক হবে কিনা রিজিয়া চিন্তা করতে লাগল। এক সময় তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল।

ফারিহা অধৈর্য হয়ে তার মুখের নেকাব সরিয়ে রাগের সঙ্গে কিছু বলতে গিয়ে চোখে পানি দেখে অবাক হয়ে বলল, কিরে কাঁদছিস কেন?

রিজিয়া চোখ মুছে সামলে নিয়ে ড্রাইভারকে দেখিয়ে বলল, বাসায় গিয়ে বলব।

দু’জনে এক রুমে থাকে। দুটো আলাদা খাটে ঘুমায়। আলাদা চেয়ার টেবিলে পড়াশোনা করে। রিজিয়া দু’বছরের বড় হলেও ফারিহা তুই-তোকারি করে। বাসায় ফিরে বোরখা খুলে রিজিয়াকে বলল, এবার বল।

রিজিয়া বলল, ওয়াদা কর কাউকে বলবি না।

আমাকে বিশ্বাস করিস না?

 করি।

তা হলে ওয়াদা করতে বলছিস কেন?

ঘটনাটা শোনার পর বুঝতে পারবি কেন ওয়াদা করতে বলছি।

করলাম, কাউকে বলব না।

রিজিয়া বলল, ছেলেটা আমাদের গ্রামের মাতব্বরের ছেলে আশরাফ ভাইয়ের বন্ধু। প্রায় তিন সাড়ে তিন বছর আগে আশরাফ ভাইয়ের সঙ্গে একবার বেড়াতে গিয়েছিল। তারপর যা কিছু ঘটেছিল বলল।

তা এতে তোর কাঁদবার কি হল?

সে তুই বুঝবি না।

বললে বুঝব কি করে? মনে হচ্ছে ছেলেটাকে দেখে ও তোর নানাকে ছেলেটা যে কথা বলেছিল, তা শুনে তুই তাকে নিয়ে যে স্বপ্ন বুনেছিলি; তা আজও মনে পুষে রেখেছিস?

হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। ওর সঙ্গে কোনো আলাপ না হলেও এত বেশি ভালবেসে ফেলেছি যে, আজও ভুলতে পারি নি। তাই ওকে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে তখন থেকে প্রত্যেক নামাযের পর ফরিয়াদ করি।

কেউ কাউকে একবার মাত্র দেখে যে এত ভালবাসতে পারে তা ফারিহা জানত না। তাই অবাক হয়ে বলল, তুই কি সে সময় ছেলেটার পরিচয় জানতিস?

না। শুধু জানতাম আশরাফ ভাই ও সে একসঙ্গে ডাক্তারি পড়ে। ঢাকায় বাড়ি। আরো জানি, তারা তখন ফাইনাল ইয়ারে পড়ত।

ছেলেটার নাম ও জানিস না?

হা জানি, হিমু।

হিমু তো তোর নানাকে বলেছিলেন ডাক্তারি পাস করে তোকে বিয়ে করে ঘরজামাই হয়ে থাকবেন, গিয়েছিলেন কি না জানিস?

কি করে জানব? নানাজী মারা যাওয়ার পরপরই তো মামা, মানে তোর আব্বা আমাকে এখানে নিয়ে চলে এলেন।

ফারিহা মুখে চুক চুক শব্দ করে বলল, দারুণ ভুল করে ফেলেছি। অবশ্য ব্যাপারটা যদি আগে বলতিস, তা হলে ভুলটা করতাম না। মনে হচ্ছে হিমু তোদের গ্রামে গিয়ে তোকে না পেয়ে আজও বিয়ে করেন নি। সঙ্গের মহিলা নিশ্চয় ওনার মা। তাই তোকে দেখিয়ে উনি মাকে কিছু বলছিলেন। তুইও ভুল করেছিস। আমি যখন চলে আসতে বললাম, তখন আমাকে অপেক্ষা করতে বলে তার সঙ্গে আলাপ করা তোর উচিত ছিল। যাকগে, যা হওয়ার হয়েছে। ভবিষ্যতে এ রকম ভুল আর করবি না।

.

বাসায় ফিরে ছেলেকে গাড়ি নিয়ে বেরুতে দেখে সাবিহা বেগম বললেন, এখন আবার কোথায় যাবি?

একটু কাজ আছে বলে হিমু গাড়ি ছেড়ে দিল।

অফিস থেকে স্বামী ফেরার পর চা-নাস্তা দিয়ে সাবিহা বেগম বললেন, আজ হিমুকে নিয়ে আড়ং-এ কাপড় কিনতে গিয়েছিলাম। তারপর মেয়ে দেখার ব্যাপারে যা কিছু ঘটেছে বললেন।

রাগিব হাসান হেসে উঠে বললেন, তাই নাকি?

তবে আর বলছি কি? মেয়েটা বোরখা পরে থাকলেও মুখ খোলা ছিল। এত সুন্দর মুখ কখনো দেখি নি। ঠিক যেন পটে আঁকা ছবি।

তা তোমার যখন পছন্দ তখন দেরি না করে বিয়ের ব্যবস্থা কর।

বিয়ের ব্যবস্থা তো তুমি করবে। তার আগে মেয়ে দেখ, তার মা-বাবার সঙ্গে আলাপ কর।

ঠিক আছে, মেয়ের বাসার ঠিকানা দাও।

ঠিকানা আমি পাব কোথায়? আর হিমুও বোধ হয় জানে না। তাই ঠিকানা জেনে নিতে বলেছিল; কিন্তু সে সুযোগ আর পেলাম কই? তার আগেই তো চলে গেল।

হিমু নিশ্চয় জানে, তার কাছ থেকে ঠিকানা জেনে আমাকে বলবে।

তুমি যে কি, এক্ষুনি বললাম না, সেই তো মেয়েটার সঙ্গে আলাপ করে ঠিকানা জেনে নিতে বলেছিল।

ঠিকানা না জানলে মেয়ের মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করব কি করে? আচ্ছা, হিমু মেয়েটাকে কিভাবে চেনে? কতটা চেনে, সে সব কিছু বলেছে?

কতটা চেনে বলে নি। জিজ্ঞেস করতে বলল, একটু একটু চিনি।

তা হলে তাকেই ঠিকানা জোগাড় করতে বল।

হ্যাঁ, তা ছাড়া আর কোনো উপায় কি? বাসায় ফিরলে ওর সঙ্গে আলাপ করব।

রাতে এক সময় সাবিহা বেগম ছেলেকে বললেন, আড়ং-এ যে মেয়েটাকে দেখালি তাকে একটু একটু চিনিস বললি। কতটা চিনিস বা কিভাবে চিনিস বল তো?

হিমু বলল, প্রায় তিন সাড়ে তিন বছর আগে আশরাফ নামে এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানেই মেয়েটিকে দেখি। মেয়েটা ছোটবেলাতেই মা-বাবাকে হারায়। নানা-নানি ওকে মানুষ করেন। নানা স্কুলের মাস্টার ছিলেন। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন উনি অসুস্থ ছিলেন। একদিন বন্ধুর সঙ্গে ওনাকে দেখতে গিয়েছিলাম। সেদিন বন্ধুই মেয়েটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।

গ্রামের গরিব ঘরের এতিম মেয়ে জেনে সাবিহা বেগমের মন খারাপ হয়ে গেল। বললেন, মেয়েটি দেখতে খুব ভালো ঠিক কথা; তাই বলে এরকম একটা মেয়েকে পছন্দ করা তোর উচিত হয় নি। গ্রামের অল্প শিক্ষিত আনকালচার্ড মেয়ে আমাদের মতো হাই সোসাইটিতে মানায় না। তা ছাড়া সেও আমাদের সোসাইটিতে এ্যাডজাস্ট করতে পারবে না। তোর বাবা শুনলে রেগে যাবে। ঐ মেয়ের কথা ভুলে যা। আমাদের হাই সোসাইটিতে কি সুন্দরী মেয়ের অভাব আছে? তাদের মধ্যে দেখেশুনে তোর বিয়ে দেব। একই সোসাইটির মেয়ে না হলে আমরা যেমন সুখ-শান্তি পাব না, তেমনি তুইও পাবি না।

মা, তোমার কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু মেয়েটি শুধু সুন্দরই নয়, গুণবতীও। তার গুণের কথা গ্রামের লোকের মুখে মুখে। সে অল্প শিক্ষিতও নয়। এস.এস.সি.তে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে। কলেজ অনেক দূরে বলে ওর নানা আর পড়ান নি। ওকে দেখে আমি এত মুগ্ধ হয়েছি যে, তখনই সিদ্ধান্ত নিই ওকে বিয়ে করব। তাই তোমরা এতদিন অনেক মেয়ে দেখালেও কাউকেই পছন্দ করি নি।

মেয়েটির কথা তোর বাবাকে বলেছি। শুনে বলল, মেয়েটির বাসার ঠিকানা দাও যোগাযোগ করব। এখন পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের এতিম মেয়ে শুনলে তোর ওপর খুব রেগে যাবে। আমিও চাই না এরকম একটা মেয়ে আমাদের বাড়ির বৌ হয়ে আসুক। আচ্ছা, তুই তো বললি, ওর কেউ নেই, ঢাকাতে কার কাছে থাকে? এমনও তো হতে পারে এ সে মেয়ে নয়। এতদিনে তার হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে। এই মেয়েটা সেই মেয়ের মতো দেখতে। আমার তো মনে হচ্ছে তোর চোখের ভুল। নচেৎ পরিচিত মেয়ে হলে আলাপ না করে তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন?

তোমার কথা হয়তো ঠিক, তবু বলব রিজিয়াকে চিনতে আমার ভুল হয় নি। একশ বছর পরে দেখলেও ওকে আমি ঠিক চিনতে পারব।

তাই যদি হয়, তা হলে তোর সঙ্গে আলাপ না করে চলে গেল কেন?

হয়তো আমাকে চিনতে পারে নি অথবা অন্য কোনো কারণ আছে। শোন মা, বিয়ে করলে রিজিয়াকেই করব, নচেৎ সারাজীবন বিয়েই করব না।

সাবিহা বেগম বুঝতে পারলেন মেয়েটির নাম রিজিয়া। একটু রাগের সঙ্গে বললেন, আমরা যদি রিজিয়াকে বৌ করতে না চাই?

তোমরা চাইবে না কেন? গরিবরা কি মানুষ না?

আমি তো সে কথা বলি নি। বলেছি, প্রত্যেক মানুষের উপযুক্ত স্থান নিজ নিজ সমাজে। এক সমাজের মানুষ অন্য সমাজে বেমানান।

আমি তোমার সঙ্গে এ ব্যাপারে তর্ক করতে চাই না। আমার সিদ্ধান্ত আমি জানালাম, এবার তোমরা কি করবে না করবে, সেটা তোমাদের ব্যাপার।

একটা কথা ভাবছিস না কেন, যে মেয়ে বোরখা পরে সে কি করে আমাদের হাই সোসাইটিতে মিশবে? তুই-ই বল না, কোনো ফাংশানে বা পার্টিতে বোরখা পরা বৌ নিয়ে কি যেতে পারব? আর পারলেও বৌকে দেখে সবাই যখন হাসাহাসি করবে তখন সেই অপমান তুই বা আমরা সহ্য করতে পারব?

বোরখা পরা ওদের সমাজের নিয়ম, তাই পরে। আমাদের সমাজে এলে আমাদের নিয়মনীতি মেনে চলবে। তবে তুমি যাই বল মা, বোরখা কিন্তু মেয়েদের সম্রম বজায় রাখার একটা শ্রেষ্ঠ উপাদান। আমার মতে বর্তমান যুগে সমাজের অবক্ষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য মেয়েদের বোরখা পরেই ঘরের বাইরে যাতায়াত করা উচিত। আজকাল মেয়েরা এমন অশালীন জামা-কাপড় পরে চলা-ফেরা করে, তাদের দিকে তাকানই যায় না।

সাবিহা বেগম খুব অবাক হয়ে বললেন, একজন ডাক্তার ছেলের মুখে এ রকম কথা শুনব আশা করি নি। মনে হচ্ছে রিজিয়ার রূপের মোহে তুই অন্ধ হয়ে গেছিস। তাই আমাদের সমাজের উন্নত কালচার ভুলে গিয়ে গরিবদের কালচারকে ভালো বলছিস।

তোমার ধারণা ভুল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমাদের সমাজের কালচারকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারি নি। কেবলই মনে হয় এসব কালচার আমাদের নয়, পাশ্চাত্যের। যাই হোক, এ ব্যাপারে আমি আর কোনো কথা বলতে চাই না। তারপর হিমু মায়ের কাছ থেকে নিজের রুমে এসে চিন্তা করতে লাগল, মনে হয় রিজিয়া আমাকে চিনতে পারে নি। তাই সঙ্গের মেয়েটা কিছু বলতে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। তাই বা কি করে হয়? আমি একা না থাকলে না হয় সন্ত্রাসী ভেবে চলে যেত; কিন্তু মা আমার সঙ্গে ছিল। তবে কি চিনতে পেরেও না চেনার ভান করল। আবার চিন্তা করল, বিয়ে হয়ে যাই নি তো? তাই আমাকে চিনতে পেরে দ্রুত চলে গেল। তা হলে কি আমাকে চিরকুমার হয়ে থাকতে হবে? যেমন করে হোক ওর বাসার ঠিকানা জানতে হবে। হঠাৎ গাড়ির নাম্বারের কথা মনে পড়তে নিজেকে বোকা ভেবে হেসে ফেলল।

.

ঘুমাবার সময় সাবিহা বেগম স্বামীকে বললেন, বিকেলে তোমাকে হিমুর পছন্দ করা মেয়েটার কথা যে বলেছিলাম, সে ব্যাপারে হিমুর সঙ্গে আলাপ করেছি। তারপর মেয়েটার নাম ও তার পরিচয় বলে বললেন, এখন কি করবে?

রিজিয়ার পরিচয় জেনে রাগিব হাসান ছেলের ওপর খুব রেগে গিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।

সাবিহা বেগম অধৈর্য গলায় বললেন, কি হল, কিছু বলছ না যে?

রাগিব হাসান রাগের সঙ্গে বললেন, হিমু এরকম একটা মেয়েকে পছন্দ করবে ভাবতেই পারছি না? আমাদের মান-সম্মানের কথা একটু ভাবল না? আমরা সোসাইটিতে মুখ দেখাব কি করে? শুনে তুমি তাকে কিছু বল নি?

বলি নি আবার। তারপর মা ছেলের সঙ্গে যে সব কথাবার্তা হয়েছে বললেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগিব হাসান বললেন, যত শীগ্রী সম্ভব ওর বিয়ে দিতে হবে। নচেৎ যে ভূত ওর ঘাড়ে চেপেছে, তাকে নামান যাবে না।

সাবিহা বেগম বললেন, তোমার কথাটা ঠিক হলেও যুক্তিসঙ্গত নয়।

মানে?

মানে তুমি কি মনে করেছ আমরা বিয়ে ঠিক করব আর হিমু কোনো প্রতিবাদ না করে বিয়ে করে ফেলবে? ওর সিদ্ধান্তের কথা তোমাকে তো বললাম।

ও এখন ছেলেমানুষ। ওর সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিতে পারি না।

তা তো নিশ্চয়। আমি যা বলছি শোেন, কথাটা বাবাকে জানাও, উনি কি বলেন দেখ।

না, বাবাকে জানান যাবে না। বাবা হিমুকে ভীষণ ভালবাসেন। হিমু যদি একটা রাস্তার মেয়েকে পছন্দ করে, তাকেই নাতবৌ করতে চাইবেন। আমি কাল সকালে হিমুর সঙ্গে কথা বলব।

তা বল। কিন্তু মনে রেখ, হিমু আমাদের একমাত্র সন্তান। এই বংশের একমাত্র প্রদীপ। এমন কিছু বলল না, যেন সে রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে না যায়।

সে কথা তোমাকে বলে দিতে হবে না। ভাবছি, উচ্চ ডিগ্রি নেয়ার জন্য ওকে ফরেনে পাঠিয়ে দেব।

হ্যাঁ, খুব ভালো কথা বলেছ। যত তাড়াতাড়ি পার সেই ব্যবস্থা কর।

.

পরের দিন সকালে হিমু দাদাজীকে জিজ্ঞেস করল, কোনো গাড়ির নাম্বার জানা থাকলে কিভাবে গাড়ির মালিকের ঠিকানা জানা যায় আপনি জানেন?

জাহিদ হাসান বললেন, তা জানব না কেন?

হিমু উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি বলুন।

জাহিদ হাসান নাতির উৎফুল্ল কণ্ঠ ও ব্যাগ্রতা দেখে বললেন, কী ব্যাপার, হঠাৎ গাড়ির মালিকের ঠিকানা জানার কি দরকার পড়ল?

সে কথা পরে বলব, যা জিজ্ঞেস করলাম বলুন।

আগে বল, ব্যাপারটা প্রতিশোধমূলক না প্রেম ঘটিত।

দাদু যে কি? ওসব কিছুই না। একজন পরিচিতকে অনেকদিন থেকে খুঁজছি, পাচ্ছি না। কাল তাকে একটা প্রাইভেট কারে যেতে দেখলাম। তখন গাড়িটার নাম্বার দেখে নিই। হল তো, এবার বলুন।

তা পরিচিতটা কে? মেয়ে না ছেলে?

হিমু কখনো মিথ্যা বলে না। তাই বলল, মেয়ে।

জাহিদ হাসান মৃদু হেসে বললেন, তা হলে এতদিনে কোনো মেয়ে তোমার মনে দাগ কেটেছে?

হিমু দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আপনার অনুমান ঠিক। প্লিজ দাদু, বলুন কিভাবে গাড়ির মালিকের ঠিকানা জানা যাবে?

ওয়াদা কর মেয়েটাকে দেখাবে?

হিমু অধৈর্য গলায় বলল, আপনাকেই তো আগে দেখাব।

তা হলে শোন, বি.আর.টি.এ. অফিস থেকে গাড়ির নাম্বার ও লাইসেন্স দেয়া হয়। সেখানে গিয়ে নাম্বারটা দিলে গাড়ির মালিকের ঠিকানা দিয়ে দেবে। তবে তাদেরকে মালপানি দিতে হবে। জান তো আজকাল বিনা মালপানিতে কোনো কাজই হয় না।

অসংখ্য ধন্যবাদ বলে হিমু দাদুর কাছ থেকে এসে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

বি.আর.টি.এ. অফিস থেকে ঠিকানা জেনে যখন বাসায় ফিরল তখন বেলা দশটা।

সাবিহা বেগম ছেলেকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, নাস্তা না খেয়ে কোথায় গিয়েছিলি? তোর বাবা খুঁজছিল।

হিমু বলল, একটা জরুরি কাজে গিয়েছিলাম। বুয়াকে নাস্তা রেডি করতে বল, আমি গোসল সেরে আসছি।

নাস্তা খেয়ে রুমে এসে চিন্তা করতে লাগল। এক্ষুনি ওদের বাসায় যাওয়া ঠিক হবে কি না। গেলেও রিজিয়া কি তার সঙ্গে দেখা করবে? যদি সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে থাকে, তা হলেও দেখা করা তো দূরের কথা, শুনে ঐ নামে কাউকে চেনে না বলে কাজের বুয়াকে দিয়ে জানিয়ে দেবে। হঠাৎ তার মনে হল, ফোনে আলাপ করলে কেমন হয়? কথাটা মনে হতে বাবার রুম থেকে টেলিফোন গাইড এনে খুঁজে নাম্বার বের করল। তারপর টেলিফোন করার সময় ভাবল, যদি বাসার অন্য কেউ ধরে, তা হলে কি বলবে? রিজিয়াকে চাইলে যদি আমার পরিচয় জানতে চায়, তা হলেইবা কি বলবে? এইসব ভাবলেও ডায়াল করল।

আজ ফারিহার শরীর খারাপ, তাই কলেজে যায় নি। শুয়ে ছিল। বারান্দায় রিং বাজতে শুনে উঠে এসে ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, কে বলছেন?

মেয়েলী কণ্ঠস্বর শুনে হিমু কিছুটা স্বস্তিবোধ করে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এটা কি শিহাব সাহেবের বাসা?

ফারিহা বলল, জি। আপনি কাকে চান?

শিহাব সাহেব কি বাসায় আছেন?

না, অফিসে আছেন। নাম্বার জানেন? না জানলে লিখে নিন, বলছি।

আমি ওনাকে চাচ্ছি না।

তা হলে কাকে চাচ্ছেন?

আপনি কে?

ফারিহা ক্ষেপে গেল। বলল, আমি কে জানার দরকার কি? কাকে চাচ্ছেন বলবেন তো?

আপনার পরিচয় পেলে বলতাম।

ফারিহার সন্দেহ হল, কোনো বখাটে ছেলে তাকে বা রিজিয়াকে ফোনে পেতে চায়। তাই আরো ক্ষেপে গিয়ে লাইন কেটে দিয়ে রুমে এসে শুয়ে পড়ল।

লাইন কেটে দিতে হিমু মনে করল, এমনি হয়তো লাইন কেটে গেছে। তাই আবার ডায়াল করল।

ফারিহা ফোনের রিং বাজার শব্দ শুনেও না শোনার ভান করে শুয়ে রইল।

ফারিহার মা আরিফা বেগম রান্নাঘরে ছিলেন। কেউ ফোন ধরছে না দেখে একটু উঁচু গলায় মেয়েকে উদ্দেশ করে বললেন, ফারিহা, ফোনটা ধর না। কখন থেকে রিং হচ্ছে।

ফারিহা বলল, তুমি ধর, আমি ধরতে পারব না।

আরিফা বেগম কাজের বুয়াকে বললেন, ফোনটা ধরে জিজ্ঞেস কর কে ফোন করেছে।

কাজের বুয়া হানুফা ফোন ধরে বলল, কে বলছেন?

হিমু বলল, আপনি কে বলছেন?

আমি বাসার কাজের বুয়া, আপনি কাকে চান?

একটু আগে কে ফোন ধরেছিলেন?

 ছোট আপা, তাকে ডেকে দেব?

ছোট আপার নাম কি?

ফারিহা।

হিমু বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, তা হলে বড় আপার নাম রিজিয়া তাই না?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে বলছেন না কেন?

আমাকে তুমি চিনবে না। বড় আপা রিজিয়াকে ডেকে দাও। বলবে ডা. হিমু ফোন করেছেন।

বড় আপা বাসায় নেই, কলেজে গেছে।

ঠিক আছে, কলেজ থেকে ফিরলে বলবে, আমি ফোন করেছিলাম, বিকেল পাঁচটায় আবার করব।

জি বলব, বলে বুয়া ফোন ছেড়ে দিল।

মা বুয়াকে ফোন ধরতে বলেছে ফারিহা শুনেছে। বখাটে ছেলেটা হয়তা বুয়ার কাছে তাদের সব খবর জানতে চাইবে ভেবে চুপে চুপে বুয়ার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বুয়া ফোন ছেড়ে দিতে জিজ্ঞেস করল, কে ফোন করেছিল?

ওনাকে চিনি না। বড় আপাকে চাইছিল। কলেজে গেছে শুনে বলল, বাসায় ফিরলে বলতে বলল ডা. হিমু ফোন করেছিল। বিকেল পাঁচটায় আবার করবে।

ঠিক আছে, তোকে কিছু বলতে হবে না, যা বলার আমি বলব। তারপর রুমে এসে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করল, তা হলে একটু আগে ডা. হিমুই ফোন করেছিল। ক্ষেপে গিয়ে ফোন ছেড়ে দেয়াটা ঠিক হয় নি। ডাক্তার সাহেব কি ভাবলেন কি জানি। বিকেলে ফোন করলে ক্ষমা চেয়ে নেবে ভেবে রাখল।

রিজিয়া কলেজ থেকে ফিরে ফারিহাকে শুয়ে জেগে রয়েছে দেখে বলল, কিরে? কেমন আছিস?

আগে শরীর খারাপ ছিল, সাড়ে এগারটার দিকে একজন ফোন করেছিল। তারপর থেকে মনটাও খারাপ হয়ে গেছে।

কে ফোন করেছিল? আর তার ফোন পেয়েইবা মন খারাপ হল কেন?

সে অনেক কথা। তুই আগে কাপড় পাল্টে খেয়ে আয় তার পর শুনিস।

রিজিয়া কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে বলল, তোর সব কিছু তো আমি জানি, অনেক কথা থাকার মতো ব্যাপার আবার কি?

আগে না থাকলেও কখনো কি থাকতে নেই? তুই শুনতে চাইলে বলব, চাইলে বলব না।

ততক্ষণে রিজিয়ার কাপড় পাল্টানো শেষ হয়েছে। রুম থেকে বেরুবার সময় বলল, শুনব রে শুনব। তোর কথা শুনব না তো কার কথা শুনব?

খেয়ে এসে ফারিহাকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে দেখে রিজিয়া বলল, কিরে ঘুমিয়ে পড়লি নাকি।

ফারিহা না বলে উঠে বসে বলল, ডা. হিমু ফোন করে তোকে চাচ্ছিলেন।

 রিজিয়া চমকে উঠে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

কিরে, অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না?

আমার তো মনে হচ্ছে তুই পুরিয়া ছাড়ছিস।

যদি বলি পুরিয়া ছাড়ছি না, সত্যি বলছি!

রিজিয়া একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, অত সৌভাগ্য কি আমার হবে?

হবে কি, হয়ে বসে আছে! আল্লাহর কসম করে বলছি, ডা. হিমু ফোন করে তোকে চেয়েছিলেন।

আল্লাহর নামে মিথ্যে কসম খেতে নেই, সে কথা ফারিহা একদিন রিজিয়াকে বলেছিল। তাই ফারিহা কসম খেয়ে বলতে বিশ্বাস না করে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে তার হার্টবিট বেড়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে সামলে নিয়ে বলল, তুই কি বললি?

প্রথমে ব্যাপারটা একটু উলট-পালট হয়ে গিয়েছিল।

 রিজিয়া হেসে ফেলে বলল, উলট-পালট মানে?

তবে আর বলছি কি? প্রথম যখন রিং করেন তখন আমি পরিচয় জিজ্ঞেস করি। পরিচয় না বলে আমার পরিচয় জানতে চায়। বখাটে ছেলে ভেবে রেগে গিয়ে লাইন কেটে দিই। কিছুক্ষণ পর আবার রিং বাজতে থাকলে ভাবলাম সেই ছেলেটাই করেছে। তাই মা ধরতে বললেও ধরি নি। শেষে মা বুয়াকে ধরতে বলে। জানিস তো বুয়া সাদাসিধে মেয়ে। তার কাছ থেকে মনে হয়। আমার ও তোর পরিচয় জেনে নিয়ে তোকে ফোন দিতে বলেন। বুয়া বলে তুই কলেজে। তখন বুয়াকে বলেছেন, কলেজ থেকে ফিরলে তাকে বলবে ডা. হিমু ফোন করেছিলেন, বিকেল পাঁচটায় আবার করবে।

তার কথা শুনে রিজিয়ার মনে আবার আনন্দের ঝড় বইতে শুরু করল। সেই ঝড়ের তাণ্ডব সহ্য করতে না পেরে ফারিহাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভাবল, এসব সত্য, না স্বপ্ন দেখছে?

রিজিয়ার চোখের পানিতে যখন ফারিহার কাঁধের গায়ের জামা ভিজে গেল তখন ফারিহা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল, এতদিন পর আজ মনের মানুষের সঙ্গে কথা বলবি, এটা তো আনন্দের খবর, কাঁদছিস কেন?

রিজিয়া চোখ মুছে বলল, তুই বোধ হয় জানিস না, মানুষ শুধু দুঃখ পেলে কাঁদে না, বেশি আনন্দ পেলেও কাঁদে।

কথাটা জানি, মনে ছিল না।

পাঁচটার সময় তো বাসার সবাই একসঙ্গে চা-নাস্তা খাব, ফোন এলে মামা যদি ধরেন?

তুই চিন্তা করিস না, আমি ম্যানেজ করব। তবে তুই কথা বলার আগে আমি আলাপ করব। রাজি আছিস তো?

রাজি।

আর একটা কথা, ফোনে উনি যা কিছু বলবেন আমাকে বলতে হবে।

রিজিয়া হেসে উঠে বলল, বলব, তবে আমি যখন কথা বলব তখন তুই কাছে থাকবি না বল।

ফারিহা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, তাই হবে।

.

বিকেল পাঁচটায় সবার সঙ্গে চা-নাস্তা খাওয়ার সময় রিজিয়া ও ফারিহা ফোন আসার অপেক্ষায় কান খাড়া করে রইল; কিন্তু সাড়ে পাঁচটা বেজে যাওয়ার পরও যখন ফোন এল না তখন রিজিয়া ফারিহাকে বলল, কিরে তুই যে বললি পাঁচটায় ফোন করবেন!

ফারিহা বলল, আমাকে তো বলেন নি, বলেছেন বুয়াকে। সে যা মেয়ে কি বলতে কি বলেছে আল্লাহ মালুম। তবে আমার মনে হয় কোনো কারণে হয়তো ঠিক সময়ে ফোন করতে পারেন নি। যে কোনো সময়ে করতে পারেন। এমন সময় ফোন বেজে উঠতে আবার বলল, মনে হয় ডা. হিমু করেছেন।

চা-নাস্তা খেয়ে দু’জনে রুমে বসে কথা বলছিল। ফারিহা ফোন ধরে রুমে নিয়ে আসার সময় ওপাশ থেকে পুরুষের গলায় সালাম শুনতে পেয়ে উত্তর দিয়ে বলল, কে বলছেন?

আমি ডা. হিমু, দয়া করে রিজিয়াকে একটু দেবেন?

কিন্তু উনি তো পাঁচটার সময় ফোন করবেন বলেছিলেন, এখন প্রায় পৌনে ছ’টা বাজে।

বিশেষ কারণে ঐ সময়ে করতে পারি নি। প্লিজ, দিন না রিজিয়াকে।

 রিজিয়া বলছি।

আপনি রিজিয়া নন, ফারিহা।

কি করে বুঝলেন?

ও-বেলা আপনি ফোন ধরেছিলেন। আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে একবার কারো সঙ্গে কথা বললে, পরবর্তীতে ঠিক বুঝতে পারি।

তা হলে আপনার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর?

 খুব প্রখর না হলেও মোটামুটি। নচেৎ ডাক্তারি পাস করতে পারতাম না।

ও-বেলা আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, সে জন্য ক্ষমা চাইছি।

রিজিয়াকে ফোনটা দিলে ক্ষমা করতে পারি।

আজ তিন থেকে সাড়ে তিন বছর রিজিয়ার খোঁজ করেন নি কেন?

তার কথা শুনে হিমু চিন্তা করল, তা হলে রিজিয়া কি তার সম্পর্কে সব কিছু ফারিহাকে বলেছে?

কি হল, চুপ করে আছেন কেন?

 খোঁজ করেছি কি না আল্লাহ ভালো জানেন।

আমাদের ফোন নাম্বার পেলেন কি করে?

মানুষ চেষ্টা করলে কি না পারে।

বাসার ঠিকানা জানার চেষ্টা করেন নি?

প্রথমে চেষ্টা করে বাসার ঠিকানা জেনেছি, তারপর ফোন নাম্বার। রিজিয়াকে দিচ্ছেন না কেন? বাসায় নেই না কি?

কেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে বিরক্ত লাগছে বুঝি?

না-না বিরক্ত লাগবে কেন? বরং ভালোই লাগছে।

তা হলে রিজিয়াকে বারবার চাচ্ছেন কেন?

এই কথার উত্তরে কি বলবে ভেবে না পেয়ে হিমু চুপ করে রইল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফারিহা বলল, কিছু বললেন না যে?

আপনার প্রশ্নের উত্তর পরে এক সময় দেব। এখন রিজিয়াকে ফোনটা দিলে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।

থাক, আপনাকে আমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে না, ধরুন ওকে দিচ্ছি। তারপর রিজিয়ার হাতে রিসিভার ধরিয়ে দিয়ে বলল, ডাক্তার সাহেব তোর সঙ্গে কথা বলবে বলে অস্থির হয়ে পড়েছেন। কথা শেষ করে ফারিহা রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

হিমু ফোন করেছে জানার পর থেকে রিজিয়ার সারা শরীরে আনন্দের শিহরণ বইছে। লজ্জায় তার গলা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই রিসিভার কানের কাছে ধরে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

ফারিহা রিসিভার রিজিয়াকে দিয়ে যে কথা বলেছে, হিমু শুনতে পেয়েছে। তাই রিজিয়াকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে বলল, চুপ করে আছেন কেন? আজ তিন সাড়ে তিন বছর আপনাকে দেখার ও আপনার গলার সুমিষ্ট কথা শোনার জন্য অধীর হয়ে আছি। আপনি হয়তো ভেবেছিলেন শহরের ছেলেরা প্রতারক। তারা কথা দিয়ে কথা রাখে না। এরকম ভাবাটা ঠিক হয় নি আপনার। কারণ সবাই একরকম হয় না। প্লিজ, কিছু অন্তত বলুন।

রিজিয়া আর চুপ করে থাকতে পারল না। সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?

হিমু সালামের উত্তর দিয়ে বলল, শারীরিক সুস্থ থাকলেও আপনার কারণে এতদিন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছিলাম। কাল আড়ং-এ আপনাকে দেখার পর থেকেই সেই যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেছে। আপনি কেমন আছেন?

সে কথা আল্লাহ ভালো জানেন।

আল্লাহ তো সব কিছু জানেন। আমি আপনার শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করছি।

আল্লাহর রহমতে ভালো।

ফোনে কথা বলে শান্তি পাচ্ছি না, সামনা-সামনি বলতে চাই। কখন কোথায় দেখা হবে বলুন। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে এবং আজও আমার কথা মনে থেকে থাকে যদি।

আপনি আশরাফ ভাইয়ের বন্ধু এতটুকু ছাড়া আপনার সম্পর্কে আর কিছুই জানি না। তবু কেন আপনার ছবি আমার হৃদয়ের আয়নায় সব সময় জোনাকির আলোর মতো একবার জ্বলছে ও একবার নিভছে আজও বুঝতে পারি না। যখন জ্বলে উঠে তখন স্বপ্নরাজ্যে বিচরণ করি। আর যখন নিভে যায় তখন অমানিশার অন্ধকারে হারিয়ে যাই। এই আলো আর অন্ধকারের কি যে অসহ্য যন্ত্রণা, তা আমি ও আমার একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। আপনি শুধু মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। আর আমি আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বের যন্ত্রণার সাথে সাথে অপেক্ষার প্রহরে অহরহ জ্বলছি।

তার কথা শুনে হিমুর অন্তর জুড়িয়ে গেল। সেই সাথে সারা শরীরে আনন্দের স্রোত বইতে শুরু করল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সেই স্রোত অনুভব করতে লাগল আর ভাবতে লাগল, রিজিয়া তা হলে আমাকে ভীষণ ভালবাসে। তাই আজও আমাকে ভুলতে পারে নি।

কি হল? আমার কথা শুনে চুপ করে আছেন কেন?

আমি সেই যন্ত্রণা ও অপেক্ষার জ্বালা নেভাতে চাই। তাই তো দেখা করতে চাচ্ছি।

স্থান ও সময় আপনিই বলুন।

হিমু অল্পক্ষণ চিন্তা করে বলল, নিশ্চয় পড়াশোনা করছেন?

জি, ইডেনে বি.এ. সেকেন্ড ইয়ারে।

কাল কলেজ আছে?

জি।

ছুটি হয় ক’টায়?

দেড়টায়।

ঐ সময়ে আমি গেটের কাছে থাকব।

ঠিক আছে। তবে ফারিহা যদি কাল কলেজ যায়, তা হলে সকালে ফোন করে কখন ও কোথায় দেখা হবে জানাব। ফোন নাম্বারটা বলুন।

হিমু ফোন নাম্বার বলে বলল, আমি সাতটার সময় ফোনের কাছে থাকব।

এমন সময় ফারিহা এসে বলল, অনেক হয়েছে এবার রাখ। মা খালার বাসায় ফোন করার কথা বলল। এক্ষুনি হয়তো এসে পড়বে।

কেউ রিজিয়ার সাথে কথা বলছে বুঝতে পেরে হিমু বলল, সকালে তোমার ফোন না পেলে দেড়টার সময় কলেজের গেটের কাছে থাকব।

ঠিক আছে, এবার রাখি। শামিমা ফোন করার জন্য আসছেন বলে রিজিয়া সালাম বিনিময় করে রিসিভার ক্র্যাডেলে রেখে দিল।

দেখা করার কথা ছাড়া হিমুর সঙ্গে যা কিছু কথা হয়েছে রিজিয়া বলল।

ফারিহা জিজ্ঞেস করল, তোর সঙ্গে দেখা করার কথা বলেন নি?

 রিজিয়া মিথ্যে করে বলল, বলেছিলেন, আমি পরে জানাব বলেছি।

ওনার পরিচয় জেনেছিস?

না।

তুই একদম বুদ্ধ। যাকে জীবন সাথী করতে চাস তার পরিচয় জানবি না?

কি জানি বুদ্ধু বলে হয়তো সে কথা মনে আসে নি।

আবার যখন ফোনে কথা বলবি অথবা দেখা হবে তখন সব কিছু জেনে নিবি। তা না হলে মা-বাবার কাছে তোদের জন্য ওকালতি করব কি করে?

রিজিয়া অবাক হয় চোখ বড় বড় করে বলল, তুই আমাদের হয়ে মামা মামির কাছে ওকালতি করবি?

হা করব। এতে অবাক হওয়ার কি আছে? আমি ছাড়া তোর আর কে আছে যে ওকালতি করবে?

আমার যে খুব ভয় করছে, মামা-মামি আমাকে কি মনে করবেন?

শুনেছি, প্রেম-ভালবাসা যারা করে তারা কোনো কিছুকেই ভয় পায় না। তুই পাচ্ছিস কেন?

জানি না। তোকে একটা অনুরোধ করব, রাখবি বল।

বলেই দেখ না রাখি কি না!

আগে ওয়াদা কর।

 করলাম।

আমার ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে পড়াশোনার ক্ষতি করবি না। আর আমাকে জিজ্ঞেস না করে মামা-মামিকে আমাদের ব্যাপারটা জানাবি না।

আরে দূর, তোর ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে পড়াশোনার ক্ষতি করব আমি? আর মা-বাবার কাছে ওকালতি করতে আমার বয়েই গেছে। তোকে একটু ভয় পাইয়ে দিলাম আর কি।

রিজিয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, কাল কলেজে যাচ্ছিস তো?

ফারিহা বলল, কালকের কথা কালকে, আজ বলব কি করে?

.

পরের দিন সকালে ফারিহাকে কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে দেখে রিজিয়া শুয়ে রইল।

ফারিহা বলল, কিরে শুয়ে রয়েছিস যে, কলেজ যাবি না?

রিজিয়া বলল, শরীরটা খারাপ লাগছে, যাব না।

সারারাত জেগে হিমু সাহেবের কথা ভেবেছিস নিশ্চয়?

না রে, ওসব কিছু নয়, এমনি মানুষের শরীর খারাপ হয় না? তোরও তো শরীর খারাপ হয়েছিল।

আমার যে শরীর খারাপের সময় দুতিন দিন খুব পেটে ব্যথা হয়, তা তো জানিস। তোর কখনো হতে দেখি নি, তাই বললাম।

রিজিয়া কিছু না বলে চুপ করে রইল।

 কিছু বললি না যে?

কখনো হয় নি বলে এখন হবে না ভাবাটা কি ঠিক?

তা অবশ্য ঠিক নয়। তারপর চলি তা হলে বলে ফারিহা কলেজ চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সাবিহা বেগম এসে বললেন, ফারিহার মুখে শুনলাম তোর শরীর নাকি খারাপ?

রিজিয়া কখনো মিথ্যে বলে নি। আজ ফারিহার কাছে বলে অপরাধবোধ করছিল। তাই মামিমার কাছে সত্য-মিথ্যা কোনোটাই বলতে না পেরে চুপ করে রইল।

সাবিহা বেগম বললেন, শরীর বেশি খারাপ লাগলে ডাক্তারের কাছে যা।

রিজিয়া জানে, একটু শরীর খারাপ হলে মামিমা তাকে ডাক্তারের কাছে পাঠাবেনই। তাই মিথ্যে না বলে পারল না। বলল, তেমন কিছু হয় নি, আজ নানাজীর কথা বারবার মনে পড়ছে। তাই কলেজে যেতে ইচ্ছা করল না। ফারিহাকে দুষ্টুমি করে শরীর খারাপের কথা বলেছি।

শুয়ে থাকলে তো নানার কথা আরো বেশি মনে পড়বে। কলেজে গেলেই ভালো করতিস।

হ্যাঁ, এখন তাই মনে হচ্ছে।

এমন সময় ফোন বেজে উঠতে সাবিহা বেগম বললেন, ফোনটা ধরত মা, চুলোয় তরকারি চাপিয়ে এসেছি, কি হল দেখি বলে চলে গেলেন।

রিজিয়া ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, কে বলছেন?

হিমু সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি কলেজ যান নি?

ফারিহা গেছে। তাই শরীর খারাপের অজুহাত দেখিয়ে আমি যাই নি। এক্ষুণি ফোন করব ভাবছিলাম। তার আগেই আপনি করলেন। আচ্ছা, আপনি কি আমাদের বাসা চেনেন?

চিনি, আসব?

না না। এক কাজ করুন, আমাদের বাসার গলির মোড়ে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। ওখানে আসুন, আমিও আসব। এবার রাখি তা হলে?

শুনুন, এখন নয়, দশটার সময় আসব।

ঠিক আছে, এবার রাখছি বলে রিজিয়া লাইন কেটে দিল। হিমুর সঙ্গে দেখা করার জন্য সে আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে। তাই একের পর এক মিথ্যে বলে চলেছে। ফোনের কাছ থেকে মামিমার কাছে এসে বলল, আমার এক বান্ধবী বেশ কিছুদিন আগে একটা নোট নিয়েছিল। অসুখ করেছে বলে কয়েকদিন কলেজে আসে নি। সে ফোন করে তাদের বাসায় যেতে বলল।

সাবিহা বেগম বললেন, নাস্তা খেয়ে যা। বান্ধবীর সঙ্গে গল্প করলে মন। ভালো হয়ে যাবে।

দশটার সময় রিজিয়া মামিমাকে বলে বাসা থেকে বেরিয়ে এল। গলির মোড়ে এসে রেস্টুরেন্টের কাছে একটা প্রাইভেট কারের পাশে হিমুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, কতক্ষণ আগে এসেছেন?

এই পাঁচ মিনিট বলে হিমু ড্রাইভিং সিটে বসে পাশের দরজা খুলে দিল। রিজিয়া উঠে বসার পর হিমু গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, প্লিজ, মুখের নেকাব সরিয়ে দিন।

রিজিয়া বলল, এদিকের অনেকে আমাকে চেনে, পরে দেখা যাবে।

কোথায় বসে নিরিবিলি আলাপ করা যায় বলুন তো?

আমি পাড়াগাঁয়ের মেয়ে, মাত্র তিন সাড়ে তিন বছর হল ঢাকায় এসেছি। আপনার জন্ম এখানে, সে কথা আপনিই তো ভালো জানবেন।

গুলশানে আমার এক বন্ধুর বাসা। তার মা ও একজন কাজের বুয়া ছাড়া কেউ নেই। যাবেন সেখানে?

না, কারো বাসায় যাওয়া ঠিক নয়। তা ছাড়া বন্ধুর মাকে আমার কি পরিচয় দেবেন? তার চেয়ে কোনো পার্কে চলুন।

এতক্ষণে কপোত-কপোতিরা পার্কের নিরিবিলি জায়গা দখল করে ফেলেছে।

তবুও পার্কেই চলুন কোথাও না কোথাও পেয়ে যাব।

আমার মনে হয় পার্কের চেয়ে কোনো চায়নিজ রেস্টুরেন্টে বসলে ভালো হয়। আলাপও হবে, খাওয়া-দাওয়াও হবে। পার্কে পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পরে। সঙ্গে বোরখা পরা মেয়ে দেখলে বিয়ে করেছি ভেবে অনেক কিছু বলবে।

তা হলে রেস্টুরেন্টেই চলুন।

হিমু গুলশানের একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি পার্ক করল। তারপর ভেতরে ঢুকে এক কোনের টেবিলে বসে বলল, এবার মুখের নেকাবটা সরান, আপনার মুখ দেখে মনের পিপাসা মেটাই।

রিজিয়া বলল, আপনি কি জানেন, যে চৌদ্দজনকে বিয়ে করা হারাম, তাদের ছাড়া অন্য মেয়েদের দিকে তাকানো ইসলামে নিষেধ?

না, জানি না।

মনে হচ্ছে ইসলাম সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না?

আপনার ধারণা ঠিক। কি করে জানব বলুন, ছোটবেলায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছি, তারপর হাই স্কুল ও কলেজে পড়ে মেডিকেলে পড়াশোনা করেছি। ভালো রেজাল্ট করার জন্য সে সময় পাঠ্য বই নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করার সময় কোথায়? তা ছাড়া গার্জেনরাও কেউ ইসলাম সম্পর্কে কোনো শিক্ষা দেয় নি।

এখন তো সময়ের অভাব নেই, ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করুন। মুসলমানদের ধর্ম হল ইসলাম। একজন মুসলমান হয়ে সেই ইসলামকে জানবেন না, এটা কি ঠিক?

এতদিন পর রিজিয়াকে প্রাণভরে দেখার জন্য হিমু কত চেষ্টা করে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আর সে কিনা ধর্ম নিয়ে আলাপ করছে? খুব বিরক্ত বোধ করলেও তা প্রকাশ না করে বলল, না ঠিক নয়। আজ থেকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করব।

এমন সময় বেয়ারা এসে দাঁড়াতে হিমু রিজিয়াকে জিজ্ঞেস করল, এখন কি খাবেন?

রিজিয়া বলল, এখন কিছু খেতে পারব না, পানীয় কিছু চলতে পারে। পরে না হয় কিছু খাওয়া যাবে।

হিমু বেয়ারাকে বলল, ম্যাডাম কি বললেন শুনলেন তো? এখন শুধু দু’টো ম্যাংগো জুস দিয়ে যান।

বেয়ারা ম্যাংগো জুস দিয়ে যাওয়ার পর হিমু বলল, দেখার ব্যাপারে ইসলামের যে নিষেধের কথা বললেন, তা কি শুধু পুরুষদের বেলায়?

না, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য।

তা হলে আপনি কেন মুখ ঢেকে রেখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন?

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে রিজিয়া বলল, ইসলামের আইন না মেনে অন্যায় করছি।

আপনি যদি অন্যায় করতে পারেন, তা হলে আমিও করব। প্লিজ, নেকাবটা সরান।

রিজিয়া নেকাব সরিয়ে বলল, এভাবে বেশি দিন আমরা মেলামেশা করতে পারি না। এটাও ইসলামে নিষেধ।

আমিও চাই না এভাবে মেলামেশা করতে। তাই তো একে অপরের মনের কথা জেনে ইসলামিক বিধি মোতাবেক যাতে মেলামেশা করতে পারি, সেই সম্পর্কে আলাপ করার জন্য এখানে আসা। আপনি জানেন কিনা জানি না, ডাক্তারি পাস করার পর আমি আপনাদের গ্রামে গিয়েছিলাম। লোকজনের কাছে জানতে পারলাম, আপনার নানা মারা যাওয়ার ও আপনার ঢাকা আসার কথা। ফিরে এসে আপনাকে অনেক খুঁজেছি। কাল আড়ং-এ মাকে নিয়ে কাপড় কিনতে গিয়ে আপনাকে দেখতে পেয়ে মাকেও দেখাই এবং তোমার সঙ্গে আলাপ করে ঠিকানা জেনে নিতে বলি। তারপর কিভাবে বাসার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার জোগাড় করেছে বলে বলল, তোমার মতামত জানতে পারলে শুভস্য শীঘ্রম করে ফেলব।

তার কথা শুনে রিজিয়া খুব লজ্জা পেলেও মনে আনন্দের ফোয়ারা ছুটল। অল্পক্ষণের মধ্যে চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। হিমু যাতে চোখের পানি দেখতে না পায়, সে জন্যে মুখ নিচু করে নিল।

রিজিয়া মুখ নিচু করার আগেই হিমু তার চোখের পানি দেখে ফেলেছে। ভয়ে ভয়ে বলল, কি ব্যাপার? মতামত জানতে চাইতে তোমার চোখে পানি? তা হলে কি বিয়েতে তোমার…কথাটা শেষ করতে না পেরে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। তখন তারও চোখে পানি আসার উপক্রম হল।

রিজিয়া চোখ মুছে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ফোনে সব কিছু শোনার পরও একথা ভাবলে কি করে? আমিতো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব।

হিমু দৃষ্টি তুলে তার হাসি মুখ দেখেও কথা শুনে ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল। বলল, আমিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তোমাকে না পেলে চিরকুমার থাকব। তোমার চোখে পানি দেখে যা ভয় পেয়েছিলাম না।

ওটা আনন্দ অশ্রু। আপনি কিন্তু ঘরজামাই হয়ে থাকবেন বলেছিলেন!

ডাক্তারি পাস করার পর সেইজন্যই তোমাদের গ্রামে গিয়েছিলাম। আর এখনো রাজি আছি।

কেন ঐ কথা বলেছিলাম, তা তো আপনি জানেন। নানাজী মারা গেছেন। এখন আর সে প্রশ্নই আসে না। কথাটা এমনিই বললাম। আপনি কিছু মনে করবেন না।

কথাটা যে এমনিই বলেছ, তা আমি জানি। কিছু মনে করার প্রশ্নই আসে। কথা শেষ করে মৃদু হাসল। তারপর বলল, এবার একটা কথা বলি?

বলুন।

প্রথম দিকে আমরা আপনি করে কথা বললেও পরে তুমি করে বলেছি। এখন পর্যন্ত আমি তোমাকে তুমি করেই বলছি; কিন্তু শেষের দিকে তুমি আমাকে আপনি করে বলতে শুরু করেছ। এটা ঠিক হচ্ছে না, তুমি করেই বল।

রিজিয়া অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদু হেসে বলল, তাই হবে। তারপর বলল, আর দেরি করতে পারব না। তোমার সঙ্গে একাকী দেখা করব বলে ফারিহাকে শরীর খারাপের মিথ্যে অজুহাত দেখিয়েছি। মামিমাকেও মিথ্যে করে এক বান্ধবীর কাছে নোট নেয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেরিয়েছি। ফারিহা বাসায় ফেরার আগে আমাকে ফিরতে হবে।

খুব ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। আমাকেও তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। আমি ফেরার পর ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অফিস থেকে বাবাকে আনতে যাবে। তারপর বেয়ারাকে ডেকে মেনু দেখে অর্ডার দিল।

খাওয়ার পর রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে হিমু বলল, চল তোমাকে গলির মুখে নামিয়ে দিই।

রিজিয়া বলল, তোমার দেরি হয়ে যাবে না? আমি একটা স্কুটার নিয়ে চলে যেতে পারব।

পাগল হয়েছ? যতই দেরি হোক তবু তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাব।

ফেরার পথে হিমু জিজ্ঞেস করল, আবার কবে আমাদের দেখা হবে?

এখন বলতে পারছি না, ফোন করে জানাব।

আমি তোমার শিহাব মামার সঙ্গে দেখা করতে চাই, তোমার আপত্তি আছে?

ভয়ার্তস্বরে রিজিয়া বলল, আজই দেখা করতে চাও নাকি?

কি ব্যাপার? তোমার মামার সঙ্গে দেখা করার কথা বলতে ভয় পেলে কেন?

না, মানে, আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে মামা-মামি কি মনে করবেন? আর আমিই-বা কি করে তাদেরকে মুখ দেখাব?

হিমু হেসে ফেলে বলল, তুমি আমাকে এত বোকা মনে করেছ? আমি তো আজই তোমাদের বাসায় যাওয়ার কথা বলি নি। আপত্তি আছে কি না জিজ্ঞেস করেছি। যেদিন যাব, তার আগের দিন তোমার সঙ্গে পরামর্শ করেই যাব। তোমার শিহাব মামার ছেলেমেয়ে কয়জন?

দুই মেয়ে এক ছেলে। সবার বড় ফারিহা। তারপর সাজিদা ও রায়হান। তুমি ফারিহার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছ।

মনে হয় ফারিহা তোমার আমার ব্যাপারটা জানে, তাই না?

হ্যাঁ, জানে। আড়ং-এ তোমাকে দেখে আমি বেসামাল হয়ে পড়ি। তাই দেখে ওর ধারণা হয় আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে। বাসায় ফিরে জানার জন্য খুব চাপ দেয়। ওর সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক থাকায় বলতে বাধ্য হই।

শোনার পর আমার ওপর খুব রেগে যায় নি?

না বরং খুব খুশি হয়েছে।

তা হলে তাকে গোপন করে আসাটা তোমার উচিত হয় নি।

হ্যাঁ, এখন আমারও তাই মনে হচ্ছে। শুনলে খুব দুঃখ পাবে। ভাবছি, বাসায় ফিরে সব কিছু বলে ক্ষমা চেয়ে নেব।

হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে।

ততক্ষণে রিজিয়াদের বাসার গলির মুখে তারা এসে গেল। গাড়ি একপাশে থামিয়ে হিমু দরজা খুলে দিয়ে বলল, ফোন করতে ভুলো না যেন?

রিজিয়া গাড়ি থেকে নেমে হাসিমুখে সালাম বিনিময় করে বলল, ইনশাল্লাহ ভুলব না।

.

শিহাব অফিস থেকে দুপুরে বাসায় খেতে আসার সময় গলির মুখে রিজিয়াকে একটা প্রাইভেট কার থেকে নামতে দেখে ভীষণ অবাক হলেন। ভাবলেন ভুল দেখলাম না তো? তাই ঘাড় ঘুরিয়ে আবার দেখলেন, রিজিয়া বোরখা পরে থাকলেও মুখে নেকাব নেই। ড্রাইভিং সিটে বসা একটা হ্যাঁন্ডসাম ছেলের সাথে হাসি মুখে কথা বলছে। ঘটনাটা দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলেন। যাকে ছোটবেলা থেকে খুব ধার্মিক বলে জেনে এসেছেন, তাকে এভাবে

দেখবেন কল্পনাও করেন নি। ভেবে রাখলেন, ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে, ছেলেটাইবা কে? আর রিজিয়ার সঙ্গেইবা তার কি সম্পর্ক?

স্বামীকে চিন্তিত মুখে বাসায় ফিরতে দেখে আরিফা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি শরীর খারাপ?

শিহাব বললেন, শরীর ভালো আছে।

তা হলে তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

ব্যবসা ও সংসার ধর্ম করতে হলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, চিন্তা তো থাকবেই। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসে জিজ্ঞেস করলো, মেয়েরা কলেজ থেকে ফিরেছে?

ফারিহা একা কলেজ গেছে। এখনও ফেরে নি। রিজিয়ার আজ নানার কথা মনে পড়তে মন খারাপ করে ঘরেই ছিল। দশটার দিকে এক বান্ধবীর কাছে নোট আনতে গিয়েছিল। তুমি আসার পর ফিরেছে।

শিহাব আর কিছু না বলে খেয়ে উঠে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার অফিসে চলে গেলেন।

রিজিয়া ও ফারিহা কেউ কাউকে ছাড়া এক ওয়াক্তও খায় না। আজ ফারিহা কলেজ থেকে ফিরে রিজিয়াকে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন আছিস?

ভালো।

তা হলে শুয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি উঠে হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে ভাত রেডি করতে বল, আমি আসছি। ক্ষিধেয় পেট চো চো করছে।

রিজিয়া হিমুর সঙ্গে চায়নিজ খেয়ে এসেছে। কি বলবে ভাবতে লাগল।

ফারিহার ততক্ষণ কাপড় পাল্টানো হয়ে গেছে। তাকে শুয়ে থাকতে দেখে পাশে বসে বলল, এখন ভালো আছিস বললি, তবু শুয়ে রয়েছিস কেন?

শরীর ভালো আছে, তবু আমি খাব না। তুই খেয়ে আয়। কেন খাব না। খেয়ে আসার পর বলব।

মা কিছু বকেছে?

মামিমা তোকে মাঝে মধ্যে বকলেও আমাকে কখনও কিছু বলেন নি। বললাম না, তুই খেয়ে আসার পর বলব।

তোকে ছাড়া আমি কোনো দিন খেয়েছি? কেন খাবি না আগে বল তারপর আমি খেতে যাব।

বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। ক্ষিধেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে বললি না? তাই বলছি খেয়ে আসার পর বলব।

ফারিহা আন্দাজে ঢিল ছুড়ল। বলল, বাইরে কোথাও খেয়েছিস, তাই না?

রিজিয়া হেসে ফেলে বলল, হ্যাঁ, খেয়েছি। কোথায় খেয়েছি, কি খেয়েছি, কে খাওয়াল সব বলব, আগে খেয়ে আয়।

ফারিহা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে খেতে চলে গেল।

প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট পর ফিরে এসে বলল, যা বলবি সত্যি বলবি, মিথ্যে বললে তোর বারটা বাজিয়ে দেব।

এখন তুই আর কি বাজাবি, তার আগেই একজন চৌদ্দটা বাজিয়ে দিয়েছে।

 ফারিহা রেগে উঠে বলল, হেঁয়ালি করবি না, সত্য ঘটনা বল।

তুই আগে বল, আমি কোনো ভুল বা অন্যায় তোর কাছে করলে মাফ করে দিবি!

তার কথা শুনে রাগের পরিবর্তে ফারিহা হেসে ফেলে বলল, কি ভুল করেছিস আগে বল। শোনার পর অন্যায়ের গুরুত্ব বুঝে মাফ করা যায় কি না চিন্তা করে বলব।

ফাজলামি করিস না, বল না মাফ করে দিবি?

 আচ্ছা বাবা আচ্ছা, যে কোনো অন্যায় করিস না কেন মাফ করে দেব।

রিজিয়া কলেজ না যাওয়ার কারণ, হিমুর সঙ্গে চাইনিজ খাওয়া ও তার সঙ্গে যেসব কথা হয়েছে বলল।

ফারিহা আহত স্বরে বলল, তা হলে আমাকে তুই বিশ্বাস করিস না?

একশ পার্সেন্টের চেয়ে বেশি করি।

 তা হলে আমার কাছে এসব গোপন করলি কেন?

গোপন করে মস্ত বড় ভুল করেছি। ওয়াদা করছি, আর কখনও এরকম ভুল করব না। বল মাফ করে দিয়েছিস। বলে ফারিহাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল।

ফারিহা তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলল, কাঁদছিস কেন? কম বেশি ভুল বা অন্যায় সবাই করে। যারা তা বুঝতে পেরে সংশোধন হওয়ার চেষ্টা করে তারা মহৎ। তারপর তার চোখ মুছে দিয়ে বলল, হিমু সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিবি না?

রিজিয়া বলল, সে নিজেই তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার জন্য তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।

কবে নিয়ে যাবি তা হলে?

এবারে যখন তার সঙ্গে দেখা করতে যাব, তোকেও নিয়ে যাব।

.

০৫.

রাগিব হাসান একদিন ছেলেকে বললেন, আমি তোকে উচ্চশিক্ষা নেয়ার জন্য ফরেনে পাঠাতে চাই। কোথায় যেতে চাস বল।

বাবা এমন কথা বলবে হিমু চিন্তাই করতে পারে নি। তাই খুব অবাক হয়ে বলল, রেজাল্ট বেরোবার পর আমি যখন ফরেনে যেতে চাইলাম তখন তোমরা একমাত্র সন্তানের অসিলা দিয়ে রাজি না হয়ে বললে, এখানে চেম্বার করে দেব প্র্যাকটিস কর। এখন আবার এ কথা বলছ কেন?

রাগিব হাসান বললেন, তখন চিন্তাভাবনা না করে বলেছিলাম। এখন আমি ও তোর মা চাই কোনো এক বিষয়ে ফরেন থেকে স্পেশালিস্ট হয়ে আয়। তা না হলে আজকাল শুধু এম.বি.বি.এস. ডাক্তারকে কেউ মূল্যায়ন করে না। তা ছাড়া হাই সোসাইটিতে আমাদের সম্মানও থাকবে না।

আমি তোমাদের হাই সোসাইটির পরওয়া করি না। আর শুনে রাখ, টাকা উপার্জনের জন্য আমি প্র্যাকটিস করব না, গরিব ও সাধারণ মানুষদের অল্প খরচে চিকিৎসা করব।

রাগিব হাসান রেগে গিয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন, তুই তা হলে আমাদের মনের আশা পূরণ করবি না?

দেখ বাবা, আমি তোমাদের ছেলে। তোমরা আমার স্বভাব-চরিত্র জান। আর এটাও জান, একবার কোনো ব্যাপারে না করলে, তা কিছুতেই হা করি না। তাই বলছি, এ ব্যাপারে আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করো না। যদি কর, যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।

রাগিব হাসান রাগ সামলাতে পারলেন না। চিৎকার করে বললেন, তাই যা, যে ছেলে মা-বাবার অবাধ্য তেমন ছেলের মুখ দেখতে চাই না।

সেখানে সাবিহা বেগমও ছিলেন। একমাত্র সন্তানের কথা শুনে আগেই ভয় পেয়েছিলেন। স্বামীর কথা শুনে আরো বেশি ভয় পেয়ে ভাবলেন, হিমু যদি সত্যি সত্যি বাবার ওপর রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে যায়, তা হলে বাঁচবেন কি করে? তাই স্বামীকে রাগের সঙ্গে বললেন, বাবা হয়ে একমাত্র ছেলেকে এরকম কথা বলতে পারলে? তারপর ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর বাবার কথায় কিছু মনে করিস না। তুই ফরেনে যেতে না চাইলে আমরা জোর করব না। এখানে যা করতে চাচ্ছিস তাই করে দেব।

রাগিব হাসান রাগের সঙ্গে স্ত্রীকে বললেন, তোমার আশকারা পেয়েই তো ও আমার মুখের ওপর কথা বলতে শিখেছে। ছেলেমেয়েকে স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে মানুষ করলেও আশকারা দিতে নেই। দিলে তারা মা-বাবার অবাধ্য হয়। তারপর গজর গজর করতে করতে উঠে চলে গেলেন।

পরে এক সময় সাবিহা বেগম স্বামীকে বললেন, হিমু যখন ফরেনে যেতে চাচ্ছে না তখন জোর করা ঠিক হবে না। তার চেয়ে চেম্বার করে দিয়ে তাড়াতাড়ি একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও। তা হলে ঐ মেয়েটার কথা ভুলে যাবে।

রাগিব হাসান বললেন, তোমার কথা যুক্তিসঙ্গত হলেও হিমু বিয়ে করতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। তখন হয়তো বলবে, জোর করে বিয়ে দিলে বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও থাকবে।

তবু যা বললাম কর। বেকার থাকলে মেয়েটাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। আর বিয়ের ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। যেমন করে হোক আমি ওকে রাজি করাব।

তা হলে শোন, আমার এক বন্ধুর মেয়ে আছে। ইংলিশে অনার্স করে মাস্টার্স করছে। দেখতে শুনতে খুব ভালো। মেয়েটা তাদের একমাত্র সন্তান। তোমাকে একদিন তাদের বাসায় নিয়ে যাব। দেখলে তোমারও পছন্দ হবে।

ঠিক আছে, যাব। হিমুকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। মেয়ের সঙ্গে পরিচয় থাকলে রাজি করাতে সুবিধা হবে।

বেশ, তাই হবে।

তোমার বন্ধু বা তার বৌ হিমুকে যদি পছন্দ না করে?

পছন্দ করবে না মানে? সেই তো একদিন কথায় কথায় হিমুকে জামাই করার কথা বলে ফেলল। আমি বলেছি হিমু বেকার অবস্থায় বিয়ে করতে রাজি হবে না। বন্ধু বলল, সেজন্যে চিন্তার কিছু নেই। বিয়ের পর আমি হিমুকে ফরেনে পাঠিয়ে দেব। সেখান থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে এলে আমিই চেম্বার করে দেব।

তাই নাকি? তা এতদিন কথাটা আমাকে জানাও নি কেন?

রোজই বলব বলব মনে করি, কিন্তু ভুলে যাই।

ঠিক আছে, দেরি না করে দু’একদিনের মধ্যে যাই চল।

.

রাগিব হাসানের বন্ধু মফিজ সাহেবও একজন বড় ব্যবসায়ী। তার একমাত্র মেয়ে উঁই। জুঁই যখন তের-চৌদ্দ বছরের তখন তার মা মারা যান। মফিজ সাহেব আর বিয়ে করেন নি। মেয়েকে মা-বাবার স্নেহ দিয়ে মানুষ করেছেন। বকাবকি তো দূরের কথা, এতটুকু চোখও রাঙান নি। যা আবদার করেছে তৎক্ষণাৎ পূরণ করেছেন। ফলে জুঁই খুব মেজাজি, একগুঁয়ে ও বেশ একটু উদ্ধৃঙ্খল ধরনের। সুন্দরী ও ধনীর একমাত্র দুলালী বলে অহঙ্কারীও। আর খুব অল্টা মডার্ন। লজ্জা-শরম নেই বললেই চলে। সব সময় অশালীন পোশাক পরে।

রাগিব হাসান এক ছুটির দিন স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে বন্ধুর বাসায় বেড়াতে এলেন। অবশ্য সে কথা বন্ধুকে আগেই বলে রেখেছিলেন। জুঁইকে দেখে সাবিহা বেগমের খুব পছন্দ হল। ভাবলেন, এ রকম মেয়েই তাদের বাড়ির বৌ হওয়ার উপযুক্ত।

জুঁইকে হিমুর একদম পছন্দ হল না। তার পোশাক দেখে হিমুর যেমন লজ্জা পেল তেমনি রাগ হলেও তা প্রকাশ করল না। উঁইয়ের বাবা যখন তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তখন হিমু মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে আলাপ করল। পরে যখন উঁই একাকী তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে মিশতে চাইল হিমু অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে উঁইয়ের অহঙ্কার ক্ষুণ্ণ হল। ভাবল, ভার্সিটির কত বড় বড় ধনী ঘরের ও হাই সোসাইটির ছেলেরা তার সঙ্গে একটা কথা বলতে পারলে ধন্য হয়ে যায়, যে কেউ তার দিকে তাকালে চোখ ফেরাতে পারে না, আর হিমু কিনা তার দিকে ভালো করে তাকাচ্ছে না? তাই এক ফাঁকে তাকে বলল, আপনি ডাক্তারি পড়ার সময় মেয়েদের লাশ কাটাছেঁড়া করেছেন, মেয়েদের সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন, হৈ-হুঁল্লোড় করেছেন, তবু আমাকে এড়িয়ে চলছেন কেন?

হিমু বলল, আমার স্বভাবই এরকম। সব সময় আমি মেয়েদের এড়িয়ে চলি।

কেন?

কেনর উত্তর এই মুহূর্তে দিতে পারছি না, সেজন্য ক্ষমা চাইছি।

আপনি ডাক্তার হলেও মনটা সেকেলে রয়ে গেছে। মনটাকে মডার্ন যুগের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করুন। নচেৎ হাই সোসাইটিতে মিশবেন কি করে?

হাই সোসাইটিতে মিশতেও আমার মন চায় না।

আমার সঙ্গে কিছুদিন মেলামেশা করুন, দেখবেন সব কিছু ভালো লাগছে।

আপনাকেও আমার ভালো লাগছে না। মেলামেশা করব কি করে?

এই কথা শুনে জুঁই খুব রেগে গেল। রাগের সঙ্গে বলল, আমাকে ভালো লাগছে না কেন বলুন তো?

মাফ করবেন, তাও এখন বলতে পারছি না।

আপনি একটা পুরুষত্বহীন কাপুরুষ বলে উঁই তার কাছ থেকে চলে গেল।

হিমু তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল।

বাসায় ফিরে সাবিহা বেগম ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, জুঁইকে কেমন মনে হল?

বাবার বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে হিমু মা-বাবার মতলব বুঝতে পেরে রেগে গিয়েছিল। তাই উঁইয়ের কাছে পুরুষত্বহীন ও কাপুরুষের মতো ব্যবহার করেছে। এখন মায়ের কথা শুনে বলল, যদি জানতাম বাবার বন্ধুর ঐ রকম যাচ্ছেতাই একটা মেয়ে আছে, তা হলে কিছুতেই যেতাম না। তোমাদের আবার বলছি, আমার বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করো না। আমার সিদ্ধান্তের কথা জানাবার পরও কেন যে তোমরা মেয়ে দেখাতে নিয়ে গেলে বুঝতে পারছি না।

সাবিহা বেগম খুব রেগে গিয়ে বললেন, আমিও বলে রাখছি, পাড়াগাঁয়ের আনকালচার্ড গরিব ঘরের এতিম মেয়েকে কিছুতেই এ বাড়ির বৌ করব না।

ঠিক আছে, তোমরা যদি তোমাদের ছেলেকে চিরকুমার করে রাখতে চাও তাই থাকব। এই কথা বলে হিমু বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

.

রাগিব হাসানকে ব্যবসার কাজে দু’মাসের জন্য কানাডা যেতে হল। যাওয়ার সময় স্ত্রীকে বলে গেলেন, কানাডা থেকে ফিরে হিমুর ব্যাপারে যা করার করব।

হিমু একদিন দাদুকে বলল, আমি একটা গল্প লিখেছি। কিন্তু কিভাবে নায়ক-নায়িকার মিল দেব ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি যদি একটু হেল্প করতেন, তা হলে গল্পটা শেষ করতে পারতাম।

জাহিদ হাসান বললেন, বেশ তো, গল্পটা যতদূর লিখেছ শোনাও। শোনার পর বলব কিভাবে নায়ক নায়িকার মিল দেয়া যায়।

হিমু প্রথমে আযীয মাস্টারের পরিচয় ও তার মেয়ে সাবেরার বিয়ের ঘটনা এবং সাবেরার পেটে সন্তান থাকা অবস্থায় স্বামীর মৃত্যুর ঘটনা, রিজিয়ার জন্ম ও সাবেরার মৃত্যু এবং আযীয মাস্টার দু’বছরের রিজিয়াকে দাদা-দাদির কাছে ফেরত দিতে যাওয়ার ঘটনা বলার পর জিজ্ঞেস করল, রিজিয়াকে তার দাদার ফিরিয়ে দেয়া কি উচিত হয়েছে?

গল্পটা শুনে জাহিদ হাসান মনে চমক খেলেও তা প্রকাশ না করে ভাবলেন, এই গল্পের সঙ্গে ছোট ছেলে রাকিব হাসানের অনেক কিছু হুবহু মিল রয়েছে।

দাদুকে চুপ করে থাকতে দেখে হিমু বলল, উচিত হয়েছে কি না বললেন যে?

নাতির কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে জাহিদ হাসান হেসে উঠে বললেন, এটা খুব সস্তা ধরনের গল্প। আজকাল আমাদের দেশের সিনেমাগুলোতে এইধরনের ছবি দেখাচ্ছে।

আমি কখনো সিনেমা দেখি নি, সস্তা না দামি জানব কী করে? ওসব কথা বলে যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দিন।

সে কথা পরে বলছি, গল্পটা আগে শেষ কর।

এবার হিমু নিজেকে নায়ক ও রিজিয়াকে নায়িকা করে তাদের সম্পর্কের কথা ও নায়কের বাবা-মার অমতের কারণ এবং নায়কের সিদ্ধান্তের কথা বলে বলল, গল্পের আর একটা অংশ বাদ পড়ে গেছে। বলছি শুনুন, দু’বছরের নায়িকাকে দাদা-দাদির কাছে দেয়ার ঘটনার সময় তার বড় চাচার আট বছরের ছেলেও সেখানে ছিল। ছেলেটার মনে তখন রিজিয়ার প্রতি সহানুভূতি জাগে এবং ঘটনাটা গভীরভাবে মনে দাগ কাটে। বড় হওয়ার পরও সেই দাগ মুছে যায় নি। বরং আরো বাড়ে। ঘটনাচক্রে নায়ক তার এক বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে যে মেয়েটিকে দেখে মুগ্ধ হয় এবং বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, সেই মেয়েই হল এই গল্পের নায়িকা। আর নায়ক হল নায়িকার বড় চাচার ছেলে। এবার বলুন কিভাবে তাদের মিল দেব?

গল্পের প্রথম অংশ শুনে জাহিদ হাসানের যে ধারণা হয়েছিল, শেষের অংশ শুনে সেই ধারণা আরো দৃঢ় হল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি গল্পের প্রথম অংশ বলার পর যে প্রশ্ন করেছিলে তার উত্তরে বলব, নায়িকার দাদা ও বড় চাচার উচিত ছিল সত্য-মিথ্যা যাচাই করা এবং ঘটনা সত্য হলে নায়িকাকে গ্রহণ করা। আর গল্পের নায়ক-নায়িকার মিল দিতে হলে প্রথমে নায়ককে জানতে হবে নায়িকা তাকে বিয়ে করতে রাজি আছে কি না। যদি রাজি থাকে, তা হলে নায়ক মা-বাবার অমতের কথা ও তার কারণ জানিয়ে গোপনে বিয়ে করার কথা বলবে। সব কিছু জানার পরও নায়িকা রাজি থাকলে কাজি অফিসে বিয়ে দিয়ে গল্পটা শেষ করবে।

হিমু বলল, বিয়ে দিয়ে শেষ করলে গল্পটা সম্পূর্ণ হবে না। কারণ ছেলের বৌকে নায়কের মা-বাবা গ্রহণ করবে কি না, না করলে নতুন বৌকে নিয়ে নায়ক কি করবে? কোথায় তুলবে? এসব প্রশ্ন পাঠকদের মনে জাগবেই। তখন তারা লেখককে যা তা বলবে।

জাহিদ হোসেন মৃদু হেসে বললেন, আরে ভাই, আমি তো আর লেখক নই, এসব বলব কি করে? তুমি যখন গল্পটার লেখক তখন তোমাকেই গল্পের শেষটা লিখতে হবে। আমার তো মনে হচ্ছে, গল্পটা কারো কাছে শুনে লিখেছ। তার কাছেও জিজ্ঞেস করতে পার। আমার অনুমান সত্য কি না বল?

আপনি জানেন কি না জানি না, লেখকরা কিন্তু কোনো বাস্তব ঘটনা দেখে-পড়ে অথবা শুনে গল্প বা উপন্যাস লেখেন। অবশ্য সেটাকে পাঠকদের কাছে আকর্ষণীয় ও সুখপাঠ্য করার জন্য কল্পনার আশ্রয় নেন।

একজন ডাক্তার হয়ে তুমি লেখকদের এসব কথা জানলে কি করে?

আমার একজন বন্ধু আছেন, তিনি গল্প উপন্যাস লেখেন, তার কাছে। শুনেছিলাম। ইদানীং কিছু গল্প উপন্যাস পড়ে বন্ধুর কথাই ঠিক মনে হয়েছে।

নাতির শেষের দিকের কথা জাহিদ হাসানের কানে গেল না। তখন তিনি চিন্তা করছেন, বিশ বছর আগের ঘটনা। শিহাবের কথা বিশ্বাস করলেও আভিজাত্যের অহঙ্কারে অস্বীকার করে তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও বেশ কিছু টাকা আযীয মাস্টারকে দিতে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য নাতনিকে গ্রহণ না করে যে অন্যায় করেছিলেন, সে জন্য অনুশোচনা হয়েছিল। এখন নাতির পুরো গল্প শুনে নিশ্চিত হলেন, সেই নাতনিই নায়িকা এবং নায়ক নাতি হিমু।

নিশ্চিত হয়ে জাহিদ হাসান এত আনন্দিত হলেন যে, অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে সেই আনন্দের জোস সামলাবার চেষ্টা করলেন। তবু একসময় বন্ধ চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

দাদুর অবস্থা দেখে হিমু বুঝতে পারল, সে সময় আভিজাত্যের অহঙ্কারে যে অন্যায় করেছিলেন, এখন অনুশোচনার আগুন নেভাবার চেষ্টা করছেন চোখের পানি ফেলে। তবু জিজ্ঞেস করল, গল্পটা শুনে, আপনার চোখে পানি কেন?

জাহিদ হাসান নাতিকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বললেন, সত্যি করে বল, এই গল্পের নায়ক তুই আর নায়িকা তোর ছোট চাচার মেয়ে?

হিমু বলল, হ্যাঁ দাদু, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন।

জানিস দাদু, সেদিন তোর ছোট চাচার মেয়েকে ও শ্বশুরকে ফিরিয়ে দিয়ে যে অন্যায় করেছিলাম, তার মাশুল আজও দিতে হচ্ছে। তুই কোনো চিন্তা করবি না। তোর মা-বাবা যতই অমত করুক না কেন নায়িকাকে নাতবৌ করে আনবই আনব। নায়িকার নামটা কি বলত ভাই।

রিজিয়া।

ওটা নিশ্চয় ডাক নাম, পুরো নাম জানিস না?

না।

শোন, ডাক নামটাই যদি পুরো নাম হয়, তা হলে বিয়ের সময় নাম দেব সুলতানা রিজিয়া। ইতিহাসে একজন বিখ্যাত মহীয়সীর নাম ছিল সুলতানা রিজিয়া। বলত তিনি কে?

আমি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছি ইতিহাসের কথা জানব কি করে?

উনিই প্রথম নারী, যিনি দিল্লির সিংহাসনে বসে দেশ শাসন করতেন। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে সৈনিকের পোষাক পরে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যও পরিচালনা করতেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, কবে তার সঙ্গে দেখা করাবি বল। দেখার জন্য খুব অস্থিরতা অনুভব করছি।

বাসায় আনা যাবে না। মা চিনে ফেলবে। তাই ওর সঙ্গে আলাপ করে আপনাকে জানাব।

তোর ছোট চাচার বন্ধু শিহাব নিজের বাসায় রেখে রিজিয়াকে পড়াচ্ছে, তাই না?

জি।

শিহাবের বাসা চিনিস তা হলে?

 জি, চিনি।

জাহিদ হাসান চিন্তিত মুখে বললেন, রিজিয়াকে দেখতে শিহাবের বাসায়ও যেতে পারব না, অন্য জায়গায় ব্যবস্থা করবি।

দাদু কেন শিহাব চাচার বাসায় যেতে চান না, তা বুঝতে পেরে হিমু বলল, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি অন্য জায়গায় ব্যবস্থা করব।

এমন সময় সাবিহা বেগম সেখানে এসে শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, নাতির সঙ্গে সেই কখন থেকে কি এত গল্প করছেন? এদিকে ক’টা বাজে খেয়াল করেছেন? দেড়টা বাজে, গোসল করবেন কখন আর খাবেনই বা কখন? কতবার বলেছি, এই বয়সে সময়মতো সব কিছু না করলে অসুখ করবে। তারপর ছেলেকে বললেন, তুই ডাক্তার হয়েছিস, না গাধা হয়েছিস? দাদুর সব কিছুর দিকে লক্ষ্য রাখবি না?

জাহিদ হাসান বললেন, ওকে শুধু শুধু বকছ কেন বৌমা? ঐ তো আমার সব কিছুর দিকে লক্ষ্য রাখে। এখন ওর সঙ্গে একটা জরুরি ব্যাপারে আলাপ করছিলাম। তাই একটু দেরি হয়ে গেছে। তুমি যাও, আমরা এক্ষুনি গোসল করে খেতে আসছি।

রিজিয়ার কাছ থেকে হিমু জেনেছে, শিহাব চাচা দুপুরে খেতে এলেও তিনটের আগে আবার অফিসে যান। আর তার মামি স্বামী অফিসে চলে যাওয়ার পর বিশ্রাম নেন। ফারিহার ছোট বোন ও ভাই পাঁচটা পর্যন্ত স্কুলে থাকে। ফারিহা ও রিজিয়া সেই সময় পড়াশোনা করে। তবে ফারিহা বেশিরভাগ দিন ঘুমায়। সোয়া তিনটে থেকে সাড়ে চারটের মধ্যে রিজিয়া তাকে ফোন করার কথা বলেছে। কয়েকদিন আগে রিজিয়া তাকে নিয়ে বায়তুল মোকাররমে গিয়েছিল। তখন মিলাদুননবী উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদের দক্ষিণ দিকের গেটের বাইরের চাতালে এক মাসব্যাপী ধর্মীয় বই-এর মেলার ব্যবস্থা করেছে। রিজিয়া তাকে নিয়ে বিভিন্ন স্টল ঘুরে কয়েকটা ইসলামিক বই কিনে দিয়েছিল।

আজ খেয়ে উঠে ভাবল, সাড়ে তিনটেয় রিজিয়াকে ফোন করবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আড়াইটা বেজেছে দেখে ঘুমাল না। রিজিয়ার কিনে দেয়া বইগুলো থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ইমাম বুখারী (রঃ) এর ‘আল আদাবুল মুফরাদ’ বইটির বঙ্গানুবাদ ‘অন্যন্য শিষ্টাচার’ বইটি নিয়ে পড়তে লাগল। যতই পড়তে লাগল ততই ইসলামের দেয়া বিধানসমূহ জেনে হতবাক হতে লাগল। ভাবল, ইসলাম পিতা-মাতা, স্ত্রী-পরিজন, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধবী, এতিম-মিসকিন, দাস-দাসি, এমন কি মুশরিক আত্মীয় ও সৎ-অসৎ নির্বিশেষে সকলের প্রতি সদয় ব্যবহার করার যে নির্দেশ দিয়েছে, তা কয়জন মুসলমান জানে আর কয়জন মুসলমান মেনে চলে? পড়তে পড়তে কখন ঘড়ির কাঁটা সাড়ে তিনটে পার হয়ে গেছে খেয়াল ছিল না। হঠাৎ খেয়াল হতে ঘড়ি দেখল, প্রায় চারটে বাজে। বইটা রেখে রিজিয়াকে ফোন করল।

ফারিহা ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, কে বলছেন?

সালামের উত্তর দিয়ে হিমু বলল, আমি হিমু। আপনি কে?

আমি ফারিহা। কেমন আছেন?

ভালো। আপনি কেমন আছেন?

আমি ভালো, তবে রিজিয়া ভালো নেই।

সিরিয়াস কিছু?

না, তেমন কিছু নয়। তবে…

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে হিমু বলল, ও বুঝেছি। দু’দিন ফোন করিনি, তাই মনে হয় খুব রেগে আছে।

তা আমি বলব কি করে? কেন ভালো নেই তাকেই জিজ্ঞেস করুন।

ওকে দিন তো।

দেব কি করে, ওতো নেই।

নেই মানে?

নেই মানে নেই?

 প্লিজ, দুষ্টুমি না করে কোথায় গেছে বলুন।

প্রায় এক ঘণ্টা আপনার ফোনের অপেক্ষায় থেকে একটু আগে বাথরুমে গেছে। কথা শেষ করে ফারিহা হেসে উঠল। তারপর বলল, জানেন ও খুব সেলফিস। অভিসারে যাওয়ার সময় কতবার বলি, আমাকেও নিয়ে চল না তোর হিমু সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিবি। প্রতিবারেই বলে, পরেরবারে নিয়ে যাব, কিন্তু একবারও নিয়ে যায় না। আচ্ছা আপনিই বলুন তো, আমি কি ওর কাছ থেকে আপনাকে কেড়ে নেব?

এটা রিজিয়ার উচিত হয় নি। ঠিক আছে, আমি ওকে এক্ষুনি বলে দিচ্ছি, কালই যেন আপনাকে নিয়ে আসে।

দেখা যাক ও আপনার কথা রাখে কি না।

এমন সময় রিজিয়া বাথরুম থেকে এসে ফারিহাকে জিজ্ঞেস করল, কার সঙ্গে কথা বলছিস?

তোর হিমু সাহেবের সঙ্গে বলে ফারিহা তার হাতে রিসিভার ধরিয়ে দিল।

রিজিয়া সালাম বিনিময় করে অভিমানভরা কণ্ঠে বলল, দু’দিন ফোন কর নি কেন?

হিমু বলল, ফোন না করে দেখলাম, তুমি কতটা অভিমান করতে পার।

তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে প্রতিদিন ফোন করবে?

কথাটা মনে ছিল না। এবার থেকে মনে রাখার চেষ্টা করব। এই একটা সুখবর আছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, তাই।

তা হলে তাড়াতাড়ি বল।

 এখন আর অভিমান নেই তো?

 একটু একটু আছে, সুখবরটা শোনার পর একেবারেই থাকবে না।

কিন্তু সুখবরটা ফোনে বলা যাবে না যে!

কেন?

সুখবরের আগে দুঃখের খবর আছে। সেটা না শুনলে সুখবরের গুরুত্ব বুঝতে পারবে না। তাই সামনা-সামনি বলতে চাই।

এখন না হয় আগে দুঃখের খবরটা বলে তারপর সুখবরটা বলবে।

সেসব অনেক কথা। অত কথা ফোনে বলা যাবে না। তাই তো সামনা সামনি বলার কথা বললাম। এক কাজ কর, এক্ষুনি ফারিহাকে নিয়ে গুলশানের ঐ চায়নিজ রেস্টুরেন্টে চলে এস, আমি অপেক্ষা করব। আর একটা কথা, ফারিহা তোমার সঙ্গে আসতে চাইলে তুমি নাকি প্রতিবারেই বল, পরেরবারে নিয়ে আসার কথা?

রিজিয়া হেসে উঠে বলল, ফারিহা বুঝি তোমাকে তাই বলেছে?

হ্যাঁ, একটু আগে তাই তো বলল।

রিজিয়া হাসতে হাসতে বলল, ও না ভীষণ ফাজিল। আমিই বরং ওকে প্রতিবারে যাওয়ার জন্য বলি। ও তখন বলে, আমি সঙ্গে থাকলে তোদের ডিস্টার্ব হবে। তাই কোনো অভিসারিণীর সঙ্গী হতে চাই না। হিমু সাহেব যখন তোর বর হবে তখন চুটিয়ে আলাপ করব।

ফারিহা ঝট করে রিজিয়ার হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে বলল, হিমু সাহেব, ওর কথা বিশ্বাস করবেন না, ও মিথ্যে বলতে ওস্তাদ।

ওরে আমার সত্যবাদী রে বলে রিজিয়া তার হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নেয়ার সময় বলল, তুই দিন দিন খুব বেশি ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস। তারপর হিমুকে বলল, আমরা আসছি, এবার রাখি তা হলে?

রাখ বলে হিমু সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

রিজিয়া রিসিভার ক্র্যাডেলে রেখে ফারিহাকে বলল, তৈরি হয়ে নে, এক্ষুনি যেতে বলল।

ফারিহা বলল, তুইতো জানিস কেন আমি তোদের অভিসারের সঙ্গী হতে চাই নি, তবু বলছিস কেন?

রিজিয়া বলল, আজ তোর কোনো কথাই শুনব না। ফাজলামি না করে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।

ফারিহা ও রিজিয়া রেস্টুরেন্টে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে হিমুকে একা একটা টেবিলে বসে থাকতে দেখে রিজিয়া বলল, ঐ যে তোর হিমু সাহেব আমাদের আগেই এসে গেছেন।

ফারিহা মৃদু হেসে বলল, হিমু সাহেব আমার না, তোর?

রিজিয়া বলল, আমার শুধু হিমু, আর তোর হিমু সাহেব। চল, বেশি ফাজলামি করবি না বলছি।

কাছে এসে দু’জনেই সালাম দিল।

হিমু সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বলল। বসার পর ফারিহার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি হিমু, আপনি নিশ্চয় ফারিহা?

মৃদু হেসে ফারিহা বলল, জি।

রিজিয়া হিমুকে বলল, ভালোমন্দ কি সব খবর শোনাবার জন্য আসতে বললে বল।

হিমু কিছু বলার আগে ফারিহা বলল, তার আগে আমি একটা কথা বলতে চাই।

রিজিয়া মনে করল, ফারিহা একটু দুষ্টুমি করতে চাচ্ছে। তাই বলল, তুই আবার কি বলবি? চুপচাপ বসে থাক।

ফারিহা বলল, তোর হিমুর সাথে যদি একটা কথাও বলতে না দিবি, তা হলে নিয়ে এলি কেন?

রিজিয়া কিছু বলতে যাচ্ছে দেখে হিমু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বলুক না উনি কি বলতে চান। তারপর ফারিহাকে বলল, রিজিয়া শুনতে না চাইলে কানে আঙ্গুল দিয়ে থাকুক, আমি শুনব, আপনি বলুন।

ফারিহা এক পলক রিজিয়ার দিকে চেয়ে নিয়ে বলল, আমি ওর থেকে দু’বছরের ছোট। ওকে যখন তুমি করে বলেন, আমাকেও তুমি করে বলবেন। এটা হল প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা হল, ওর সম্পর্কে ফোনে যা কিছু বলেছি, দুষ্টুমি করে বলেছি। ও আমার কাছে মাঝে মধ্যে এক আধটা মিথ্যে বললেও আপনার কাছে কোনোদিন বলে নি, ভবিষ্যতেও কোনো দিন বলবে না। কারণ ও খুব ধার্মিক। তাই দুজনের কাছে ক্ষমা চাইছি। আমার আর কিছু বলার নেই।

ফারিহা থেমে যেতে হিমু রিজিয়ার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

রিজিয়া বলল, এতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি দেখছ? যা বলার তাড়াতাড়ি বল।

হিমু যেন এতক্ষণ অন্য জগতে ছিল। রিজিয়ার কথায় বাস্তবে ফিরে এসে বলল, কি যেন বললে?

রিজিয়ার আগে ফারিহা বলে উঠল, বিয়ের আগে যদি রিজিয়ার মুখ দেখে বাস্তবজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। বিয়ের পর কি করবেন আল্লাহ মালুম।

রিজিয়া মিষ্টি ধমক দিয়ে বলল, তোকে নিয়ে এসে ভুল করেছি, না আনাই উচিত ছিল।

ফারিহা বলল, বকছিস কেন? আমি তো আসতেই চাই নি, তুই তো জোর করে নিয়ে এলি।

হিমু হাসতে হাসতে বলল, প্লিজ তোমরা চুপ কর। তারপর রিজিয়াকে বলল, কি বললে বলবে তো?

রিজিয়া আগের কথাটা রিপিট করে বলল সুখ-দুঃখের খবরগুলো বল।

হিমু বলল, প্রথমে দুঃখের খবরটা বলছি। মাকে তোমার পরিচয় দিয়ে আমার সিদ্ধান্তের কথা বলি। আড়ং-এ তোমাকে দেখে মা পছন্দ করলেও তোমার পরিচয় জানার পর আমাকে খুব রাগারাগি করে বলল, পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের এতিম মেয়ে এ বাড়ির বৌ হওয়ার উপযুক্ত নয়। তারপর মা যা কিছু বলেছিল সব বলার পর বলল, আমিও আর একবার আমার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছি। মা নিশ্চয় বাবাকে সব কিছু জানিয়েছে। তাই বাবা আমার ওপর খুব অসন্তুষ্ট। যদিও বাবা আমাকে বকাঝকা করে নি, তবু আমার ধারণা তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার জন্য আমাকে ফরেনে উচ্চ ডিগ্রি নিতে পাঠাবার কথা বলেছেন। আমি রাজি না হয়ে বলেছি, চেম্বার করে দাও, এখানেই প্র্যাকটিস করব। শুনে বাবা ভীষণ রাগারাগি করেছেন। আমিও বলেছি প্রয়োজনে যেদিক দু’চোখ যায় চলে যাব, তবু ফরেনে যাব না। আমার কথা শুনে বাবা আরো রেগে উঠে বলল, তাই যা। যে ছেলে মা-বাবার অবাধ্য, তার মুখ দেখতে চাই না। মা তখন বাবার ওপর রেগে গিয়ে বলল, আমাদের একমাত্র সন্তানকে এসব কথা বলতে পারলে? ও চলে গেলে আমরা কাকে নিয়ে বাঁচব? কে আমাদের এই সম্পত্তি ভোগ করবে? তারপর আমাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, তোর বাবার কথায় রাগ করিস না। তোকে এখানে চেম্বার করে দেব। তারপর থেকে তারা আমার বিয়ে দেয়ার জন্য পাত্রী দেখে বেড়াচ্ছে। এই হল দুঃসংবাদ বলে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, ভয় পেয়ে দু’জনেরই মুখ শুকিয়ে গেছে।

রিজিয়া কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারল না।

ফারিহা ভেবেছিল রিজিয়া কিছু বলবে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, তা হলে তো খুব চিন্তার কথা। মা-বাবার মনে কষ্ট দিতে আল্লাহ কুরআন পাকে নিষেধ করেছেন। আপনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাদের মনে কষ্ট দেয়া মোটেই উচিত হবে না। তাদের অমতে গোপনে বিয়ে করলে ইহকালে যেমন সুখ-শান্তি পাবেন না, তেমনি পরকালেও দোযখের আগুনে জ্বলতে হবে।

হিমু বলল, ওসব কথা আমিও জানি। তাই মা-বাবার মনে কষ্ট না হয় সেই রকম একটা পথ আল্লাহ আমাকে করে দিয়েছেন।

রিজিয়া ভয়ে এতক্ষণ কোনো কথা বলে নি। হিমুর শেষের কথা শুনে বলল, সেই পথটার কথা বল।

হিমু বলল, এত ভয় পাচ্ছ কেন? সুখবরটা শুনলেই পথটার কথা জানতে পারবে। সুখবরটা পরে বলছি, তার আগে যে কথা বলব শুনে চমকে উঠবে। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার বাবার নাম রাকিব হাসান, তাই না?

রিজিয়া খুব অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ, কিন্তু তুমি জানলে কি করে? তোমাকেতো বাবার নাম বলি নি।

এমন সময় বেয়ারা নাস্তা নিয়ে এলে হিমু বলল, আগে নাস্তা খেয়ে নিই এসো তারপর বলব।

নাস্তার আইটেম দেখে ফারিহা বলল, আমরা তো কেউ অর্ডার দিই নি, তবু এসব দিল কেন?

হিমু বলল, আমি প্রায় সময় এখানে নাস্তা খাই। এখানকার সবাই আমাকে চেনে এবং কি কি খেতে পছন্দ করি তাও জানে। তা ছাড়া রিজিয়াকে নিয়ে কয়েকবার এখানে নাস্তা খেতে এসেছি। তাই এখানে এলে অর্ডার দিতে হয় না। এসব আইটেম কি তোমার পছন্দ নয়?

ফারিহা বলল, না-না, তা নয়। বরং এগুলো আমিও পছন্দ করি।

তা হলে শুরু করা যাক বলে হিমু খেতে শুরু করল।

খাওয়ার পর রিজিয়া হিমুকে বলল, বাবার নাম জানলে কি করে বল।

হিমু বলল, শুধু নামই নয়, বাড়ি ঢাকায়, বড় বিজনেস ম্যানের ছেলে। তোমার মায়ের নাম সাবেরা তাও জানি। আরো জানি, রাকিব হাসান বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে তোমার মাকে দেখে মুগ্ধ হন এবং মা-বাবাকে না জানিয়ে বিয়ে করেন। বিয়ের ছ’মাসের মধ্যে কানাডায় রোড এ্যাকসিডেন্টে মারা যান। তোমার বয়স যখন দু’বছর তখন তোমার মাও মারা যান। আরো অনেক কিছু জানি। সেসব শোনার দরকার আছে বলে মনে করি না।

হিমুর কথা শুনে রিজিয়া এত অবাক হল যে, বেশ কিছুক্ষণ স্ট্যাচুর মত বসে রইল।

ফারিহা এসব কথা বাবার কাছে কিছু কিছু শুনলেও রিজিয়ার কাছে সব কিছু শুনেছে। কিন্তু উনি কি করে এসব কথা জানলেন ভেবে সেও খুব অবাক হল।

তাদের অবস্থা দেখে হিমু মৃদু হেসে বলল, আমার কথা শুনে তোমরা যতটা অবাক হয়েছ, এবার যা বলব, শুনে আরো বেশি অবাক হবে। তারপর রিজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার বাবা রাকিব হাসান আমার আপন ছোট চাচা। আর তুমি হলে আপন চাচাত বোন।

ফারিহা শুনে চমকে উঠে মূক ও বধির হয়ে গেল।

আর রিজিয়া চমকে উঠলেও আনন্দ ও বেদনায় তার চোখ দিয়ে পানি গড়ে পড়তে লাগল।

এক সময় ফারিহা বলে উঠল, তা হলে আপনি সব কিছু জেনেই রিজিয়াকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?

হিমু বলল, কথাটা ঠিক না হলেও একেবারে অস্বীকার করতে পারব না। দু’বছরের রিজিয়াকে যখন তার নানা দাদা-দাদির কাছে দিতে এসেছিলেন তখন আমার বয়স আট-নয় বছর হবে। তাদেরকে অপমান করে তাড়িয়ে দিতে আমি খুব দুঃখ অনুভব করি। পুরো ঘটনাটা শুনে আমার মনে দাগ কাটে এবং আজও ছবির মতো মনে আছে। বড় হওয়ার পর একদিন দাদাজীকে জিজ্ঞেস করে সব কিছু জেনে নিই। তারপর চাচার মতো আমিও এক বন্ধুর সঙ্গে তাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে রিজিয়াকে দেখে মুগ্ধ হই এবং বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। তাই বন্ধুর কাছে রিজিয়ার সব কিছু জানার চেষ্টা করি। সে অনেক কিছু বলতে পারলেও সবটা পারল না। তখন তার বাবার কাছ থেকে জেনে নিই এবং সিদ্ধান্তটা দৃঢ় করি। তারপর বন্ধুর সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণ, ডাক্তারি পাস করার পর রিজিয়াদের গ্রামে যাওয়ার কথা ও ঢাকায় ফিরে রিজিয়াকে খোঁজাখুঁজির কথা বলল।

রিজিয়া সামলে নিয়ে চোখ মুছে হিমুর কথা শুনছিল। সে থেমে যেতে বলল, এবার সুখবরটা বল।

হিমু আবার বলতে শুরু করল, আড়ং-এ তোমাকে দেখার পর দাদাজীকে তোমাকে পছন্দ করার কথা জানাই। তিনি আমাকে ভীষণ ভালবাসেন। তাই তোমাকে দেখতে চাইলেন। আমি বললাম, নিশ্চয় দেখাব। তারপর গতকাল যখন তোমার পরিচয়, মা-বাবার অমতের কথা ও আমার সিদ্ধান্তের কথা বললাম তখন অভয় দিয়ে বললেন, তুই কোনো চিন্তা করিস না, আমি যেমন করে তোক রিজিয়াকে নাতবৌ করে ঘরে আনবই। তারপর ছলছল চোখে বললেন, দু’বছরের রিজিয়াকে সেদিন আভিজাত্যের অহঙ্কারে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম বটে, কিন্তু সেই থেকে বিবেকের কষাঘাতে আজও আমি জর্জরিত। আরো বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা কর। তাই বলছি, দাদাজী যখন আমাদের পক্ষে তখন আর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। এখন বল, কোথায় তোমার ও দাদাজীর সাক্ষাৎ হতে পারে?

রিজিয়া বলার আগে ফারিহা বলল কেন? আমাদের বাসায় দাদাজীকে নিয়ে আসুন অথবা রিজিয়াকে আপনাদের বাসায় নিয়ে যান।

হিমু বলল, মা রিজিয়াকে দেখেছে, চিনে ফেলবে।

তা হলে আমাদের বাসায় নিয়ে আসুন। রিজিয়াকে দেখাও হবে আর সেই সাথে বাবার কাছে প্রস্তাবও দেবেন।

কথাটা মন্দ বল নি। দাদুর সঙ্গে আলাপ করে দেখি উনি কি বলেন।

এবার রিজিয়া বলল, মনে হয় দাদু আমাদের বাসায় যাবেন না। কারণ শিহাব মামা আব্দুর বন্ধু ছিলেন। তাকে দাদু চেনে। ছোটবেলায় যখন নানাজী আমাকে দিতে এসেছিলেন তখন শিহাব মামাও সঙ্গে ছিলেন এবং তিনিই আব্বার বিয়ের ঘটনা বলে আমাকে গ্রহণ করতে বলেছিলেন। সেদিন তাকেও দাদু যা তা বলে অপমান করেছিলেন।

হিমু বলল, তোমার ধারণা ঠিক। ছেলের বন্ধু জেনেও যাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার বাসায় যাবেনইবা কি করে? আর বিয়ের প্রস্তাবই বা দেবেন কি করে?

ফারিহা বলল, শুধু দেখতে চাইলে একদিন দাদুকে এখানে নিয়ে আসুন, রিজিয়াকেও সেই সময় আসতে বলবেন।

হিমু বলল, ঠিক আছে, একটু আগে বললাম না, দাদুর সঙ্গে আলাপ করে দেখি, তিনি যা বলবেন তাই করব?

তা হলে এখন ওঠা যাক বলে রিজিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে স্কুটারে ওঠার সময় ফারিহা হিমুকে বলল, একদিন আমাদের বাসায় আসুন না।

হিমু বলল, গেলে মা-বাবাকে কি পরিচয় দেবে?

রিজিয়ার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে ফারিহা বলল, কি আবার বলব? যা সত্য তাই বলব।

হিমু কিছু বলার আগে রিজিয়া মিষ্টি ধমকের স্বরে বলল, এতক্ষণ তো বেশ ছিলি, এখন আবার ফাজলামি শুরু করলি?

ফারিহা হাসিমুখে হিমুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনিই বলুন তো, আমি কি ফাজলামি করলাম?

রিজিয়া বলল, থাক, সাফাইয়ের জন্য আর সাক্ষী মানতে হবে না। তারপর হিমুর সঙ্গে সালাম বিনিময় করে ড্রাইভারকে স্কুটার ছেড়ে দিতে বলল।

.

বাসায় ফিরে হিমু দাদুকে বলল, আপনি যে রিজিয়াকে দেখতে চান, কোথায় কিভাবে দেখবেন? কারণ বাসায় নিয়ে এলে মা চিনে ফেলবে। আর শিহাব চাচাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাদের বাসায় যাওয়াও কি ঠিক হবে? তিনি যদি অপমানের বদলা নেয়ার জন্য আপনাকে অপমান করেন?

জাহিদ হাসান ম্লান হেসে বললেন, জ্ঞান অনুপাতে তোমার কথা ঠিক। তবে আমার যতদূর মনে হয় শিহাব তা করবে না, বরং খুশিই হবে। আর যদি সত্যি সত্যি অপমান করে, তবু আমি যাব এবং বিয়ের প্রস্তাবও দেব। তোমাকে ও রিজিয়াকে সুখী করার জন্য সব অপমান হজম করতে পারব। তুমি এখন যাও, চিন্তাভাবনা করে তোমাকে জানাব।

.

০৬.

আজ শিহাব একটা সুদর্শন ছেলেকে নিয়ে অফিস থেকে বেশ দেরিতে বাসায় ফিরলেন। তাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে ভেতরে গেলেন।

স্বামীকে দেখে আরিফা বেগম বললেন, ফিরতে দেরি হল যে?

শিহাব স্ত্রীর কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, কিছুদিন আগে আমাদের অফিসের ফাহিম নামে একটা ছেলের কথা বলেছিলাম মনে আছে?

আরিফা বেগম কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, কই, মনে পড়ছে না তো।

তোমার যদি কিছু মনে থাকে। মাস ছয়েক আগে মাস্টার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া একটা গরিব ঘরের ছেলেকে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের পোস্টে চাকরি দেয়ার কথা বলেছিলাম না?

ও হা হা মনে পড়েছে। চাকরি দেয়ার কিছুদিন পর বলেছিলে ছেলেটা খুব ধার্মিক ও কর্মঠ। তা সে কি অফিসে কিছু অঘটন ঘটিয়েছে?

আরে না, অঘটন ঘটাইনি বরং বর্তমান যুগে এক বিরল ঘটনা ঘটিয়েছে। বলছি শোন, আমাদের অফিসের ম্যানেজার বেশ কয়েক বছর ধরে কারসাজি করে অফিসের প্যাডে সরকারের বিভিন্ন অফিসে টেন্ডার দিয়ে মাল সাপ্লাই দিচ্ছিলেন। এ বছর ফাহিম তার কারসাজি ধরে ফেলে এবং ম্যানেজারকে সেকথা জানায়। ম্যানেজার ওকে একলক্ষ টাকা দিয়ে ঘটনাটা আমাকে জানাতে নিষেধ করে বলেন, পরবর্তীতে সাহেবের অগোচরে যা কিছু করব, তার ফিফটি পার্সেন্ট আপনাকে দেব। আর এসব কথা যদি সাহেবের কানে তোলেন, তা হলে আপনাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলা হবে। ফাহিম ম্যানেজারকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে আমাকে সব কিছু জানায় এবং টাকাটা আমার টেবিলের উপর রাখে। আমি ম্যানেজারকে ডেকে ঘটনাটা সত্য কিনা জিজ্ঞেস করি। ম্যানেজার ধারণাই করতে পারেন নি, ফাহিম এতবড় টোপ না গিলে আমাকে জানাবে। তাই আমার কথা শুনে ঘাবড়ে গিয়ে মুখ নিচু করে চুপ করে রইলেন। তখন টাকাটা টেবিলের উপর ছিল আর ফাহিমও সামনে দাঁড়িয়েছিল। ঘটনা সত্য বুঝতে পেরে ম্যানেজারকে বললাম, আপনাকে ডিসচার্জ করা হল টাকা নিয়ে সিটে গিয়ে বসুন, ডিসচার্জ লেটার একটু পরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ম্যানেজার টাকা নিয়ে চলে যাওয়ার পর ডিসচার্জ লেটারের একটা ড্রাফট লিখে ফাহিমের হাতে দিয়ে বললাম, এটা টাইপিস্টের কাছ থেকে টাইপ করিয়ে আন। ফাহিম টাইপ করিয়ে আনার পর পিয়নকে দিয়ে ম্যানেজারের কাছে পাঠিয়ে দিলাম। আর ফাহিমকে বললাম, তোমাকে ম্যানেজারের পোস্ট দেয়া হল। কাল থেকে তুমি ম্যানেজারের সিটে বসবে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি থাক কোথায়? বলল, খিলগাঁয়ে ম্যানেজারের বাড়ির পাশের বাড়িতে মাকে নিয়ে থাকি। বললাম ম্যানেজার তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। তা ছাড়া খিলগাঁও মতিঝিল থেকে অনেকটা দূর। মুগদাপাড়া অথবা গোপীবাগ খুব কাছে। ওদিকে বাসাভাড়া নাও। আমার কথা শুনে ফাহিম মৃদু হেসে বলল, আমি আল্লাহকে ছাড়া কাউকে ভয় করি না। তবু আপনি যখন বলছেন, তাই করার চেষ্টা করব। আজ ওকে ম্যানেজারের কাজ কর্ম বোঝাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। তা ছাড়া ওকে নিয়ে একটু গুলশানে গিয়েছিলাম। বাসা চেনাবার জন্য সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আমি ড্রইংরুমে যাচ্ছি, আমাদের চা-নাস্তা পাঠিয়ে দাও।

ফাহিম যখন নাস্তা খাচ্ছিল তখন আরিফা বেগম পর্দার আড়াল থেকে তাকে দেখেছেন। সে চলে যাওয়ার পর ভেতরে এলেন।

শিহাব জিজ্ঞেস করলেন, ফাহিমকে দেখেছ?

আরিফা বেগম বলেন, হ্যাঁ দেখেছি। খুব সুন্দর ছেলে। একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছা করে।

ঠিকই বলেছ। ছেলেটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি মনও খুব সুন্দর। এত ভালো ছেলে এ যুগে দেখাই যায় না। ভাবছি ওর সঙ্গে রিজিয়ার বিয়ে দেব। এ ব্যাপারে তোমার মতামত বল।

ছেলেটাকে দেখে আমারও তাই মনে হয়েছে।

 কিন্তু রিজিয়া আমাকে বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

আরিফা বেগম অবাক হয়ে বললেন, রিজিয়া তোমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে মানে?

বললেই বুঝতে পারবে। কিছুদিন আগে বাসায় ফেরার সময় ওকে আমাদের গলির মোড়ে একটা প্রাইভেট কার থেকে নামতে ও ড্রাইভারের সিটে বসা একটা হ্যাঁন্ডসাম ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে দেখেছিলাম। আজ গুলশান হয়ে ফেরার সময় একটা রেস্টুরেন্টের সামনে রিজিয়া, ফারিহা ও সেই ড্রাইভারকে আলাপ করতে দেখলাম। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

কি বললে, ফারিহাও ওদের সঙ্গে ছিল?

হ্যাঁ ছিল এবং ফারিহাকেই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি।

তাই যদি হয়, তা হলে ফারিহাকে জিজ্ঞেস করলে সব কিছু জানা যাবে।

জানার পর আমাকে বলবে। এখন আমি একটু বেরোব বলে শিহাব উঠে দাঁড়ালেন।

পরের দিন একসময় আরিফা বেগম মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, কাল বিকেলে তোরা কোথায় গিয়েছিলি?

মা কখনও কোনো কিছুর কৈফিয়ৎ চায় নি। তাই আজ চাইতে ফারিহা খুব অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করছ কেন? এর আগে তো কোনো দিন করো নি?

আগে প্রয়োজন হয় নি, তাই করি নি। কাল বিকেলে তোর বাবা তোদেরকে গুলশানে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে একটা ছেলের সঙ্গে আলাপ করতে দেখেছে। সেই ছেলেটা কে? আর তোদের সঙ্গেই বা ছিল কেন?

মায়ের কথা শুনে ফারিহা ঘাবড়ে গিয়ে মুখ নিচু করে চুপ করে রইল।

 কিরে, চুপ করে আছিস কেন? বলবি তো ছেলেটা কে?

ফারিহা চিন্তা করল, মিথ্যে বলে লাভ নেই, একদিন না একদিন তো ছেলেটার কথা বলতেই হবে। সাহস সঞ্চয় করে বলল, ছেলেটার নাম হিমু। ডাক্তারি পাস করেছে। রিজিয়াকে ভালবাসে। রিজিয়াও ছেলেটাকে ভালবাসে।

মেয়ের কথা শুনে আরিফা বেগম যেমন রেগে গেলেন তেমনি অবাকও হলেন। বললেন, ইসলামে ছেলে মেয়েদের মধ্যে প্রেম-ভালবাসা নিষেধ জেনেও রিজিয়া এ পথে পা বাড়াল? আর তুইও জেনেশুনে তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস? এদিকে তোর বাবা রিজিয়ার জন্য আমাদের অফিসের ম্যানেজারকে পছন্দ করেছে। ছেলেটা খুব সুন্দর ও ধার্মিক। এসব কথা তোর বাবা জানলে কি হবে ভেবে দেখ। আর তুই তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস শুনলে তোকে আস্ত রাখবে?

মা তুমি সব কথা না শুনে রাগ করছ। ওদের সম্পর্কে সব কিছু শোন, তারপর যা বলার বলো। তারপর হিমুর পরিচয়, কিভাবে হিমু রিজিয়াকে দেখে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় ও ঢাকায় কিভাবে রিজিয়াকে দেখে, সব কিছু খুলে বলল।

আরিফা বেগম আর একবার অবাক হয়ে বললেন, এসব তুই কি বলছিস?

হ্যাঁ মা, হিমু ভাই আজ সব কিছু জানাবার জন্য আমাদেরকে গুলশানের ঐ রেস্টুরেন্টে যেতে বলেছিলেন।

আরিফা বেগম চিন্তা করলেন, তা হলে কিছুদিন আগে আমাদের গলির মুখে রিজিয়াকে ঐ ছেলেটাই গাড়ি করে পৌঁছে দিতে এসেছিল?

মাকে চিন্তা করতে দেখে ফারিহা বলল, বাবাকে ওদের সম্পর্কে সব কিছু জানাব ভেবেছিলাম, তার আগেই তোমাকে জানালাম। তুমি বাবাকে সব কিছু বলে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে বলবে।

তোর বাবা আর হিমুর চাচা যে বন্ধু ছিল, তা কি হিমু বলেছে?

হ্যাঁ বলেছে। আরো বলেছে, ছোট বেলায় রিজিয়াকে তার দাদা-দাদির কাছে দিতে তার নানার সঙ্গে বাবা এসেছিলেন। ওঁনারা তাদেরকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আরিফা বেগম অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোর বাবা শুনলে মনে হয় খুব রেগে যাবে।

কিন্তু মা, বাবার রেগে যাওয়া কি উচিত হবে? যদি হিমু ভাইকে ছাড়া রিজিয়া অন্য কোনো ছেলেকে বিয়ে করতে না চায়? কাল ওদের দু’জনের কথা শুনে মনে হয়েছে, ওরা একে অপরের জন্য জীবন পর্যন্ত দেবে, তবু একে অপরকে ছাড়া বিয়েই করবে না। বাবাকে তুমি বুঝিয়ে বলবে।

কিন্তু তোর বাবা যে ম্যানেজারের সঙ্গে ওর বিয়ে দেয়ার কথা বলল, তার কি হবে? কাল বিকেলে তোর বাবা ম্যানেজারকে বাসায় নিয়ে এসেছিল। আমি ছেলেটাকে দেখেছি। অত সুন্দর ছেলে কখনো দেখি নি। তোদের ফেরার পাঁচ মিনিট আগে চলে গেছে। একটু আগে এলে তোরাও দেখতে পেতিস।

যত সুন্দর ও ভালো ছেলে হোক, এক্ষুনি বললাম না, রিজিয়া হিমু ভাইকে ছাড়া বিয়ে করবে না। এমনকি মরে গেলেও না।

তুই এতকিছু জানলি কি করে?

 রিজিয়াই বলেছে।

 ঠিক আছে, তোর বাবাকে বলে দেখি, সে কি করে।

.

ফারিহা মায়ের কাছ থেকে এসে রিজিয়াকে সব কিছু জানিয়ে বলল, শেষ পর্যন্ত তোর বিয়ের ওকালতি করতে হল। মনে হচ্ছে, মা রাজি আছে, বাবাও রাজি হয়ে যাবে।

রিজিয়া ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, মামা যদি রাজি না হন?

তুই ভয় পাচ্ছিস কেন? মাকে বলেছি বাবাকে বুঝিয়ে বলতে। তবু যদি বাবা রাজি না হয়, আমি বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করব।

মামা রেগে গেলে তুই কিছু বলতে পারবি?

পারব না মানে, নিশ্চয় পারব। তোকে সুখী করার জন্য আমি সব কিছু করতে পারব। এমনকি জীবনও দিতে পারব।

রিজিয়া ছলছল চোখে বলল, তুই আমাকে এত ভালবাসিস কেন? তোর ঋণ শোধ করব কি করে?

কে তোকে ঋণ শোধ করতে বলেছে? আমি তোকে কর্জে হাসানা দিচ্ছি। তুই শোধ করতে না পারলে আমি কোনদিন তাগিদ দেব না। আমাকে আল্লাহ উত্তম জাজা (প্রতিদান) দেবেন।

দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোকে তোর মনের মতো বর দেন।

এই রিজিয়া কি হচ্ছে? ছোট বোনের সঙ্গে ফাজলামি করছিস?

আরে আমার ছোট রে, আমাকে বড় বলে মানিস? ছোট হয়ে তুই যখন বড়র সঙ্গে ফাজলামি করতে পারিস, আমি বড় হয়ে পারব না কেন? তা ছাড়া আমি তো দোয়া করলাম। দোয়া করাকে কেউ ফাজলামি বলে না।

যাই বল না কেন, এবার হিমু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে দুলাভাই বলে ডাকব।

তবে রে তোর ফাজলামি বের করছি বলে রিজিয়া ওকে মারার জন্য ধরতে গেল।

ফারিহা দৌড়ে পালাবার সময় বলল, দেখিস যা বললাম তাই করব।

.

সময় সুযোগমতো আরিফা বেগম স্বামীকে বললেন, তুমি যে তোমার অফিসের ম্যানেজারের সঙ্গে রিজিয়ার বিয়ে দিতে চাচ্ছ, এদিকে তো রিজিয়া তার চাচাত ভাইকে ভালবাসে। তাকে ছাড়া অন্য কোনো ছেলেকে বিয়ে করবে না।

শিহাব খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

কি? খুব অবাক হয়েছ তাই না?

অবাক হওয়ার কথা নয় কি?

হ্যাঁ,অবাক হওয়ারই কথা। শুনে আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম।

কার কাছে শুনেছ?

ফারিহার কাছে।

শিহাব আরো বেশি অবাক হয়ে বললেন, কি বললে?

 বললাম তো ফারিহার কাছে। রিজিয়া ওকে বলেছে।

চাচাত ভাইটা কে? বুঝতে পারছি না।

না বোঝার কি আছে? তোমার বন্ধুর বড় ভাইয়ের ছেলে হিমু।

আশ্চর্য, ছেলেটার নামও জান দেখছি?

বললাম না, ফারিহা বলেছে? তারপর ফারিহা তাদের দু’জনের সম্পর্কে যা কিছু বলেছে আরিফা বেগম বললেন।

সব কিছু শুনে শিহাব অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

কি হল? মনে হচ্ছে কিছু যেন চিন্তা করছ?

হ্যাঁ, চিন্তা করছি। এইজন্য লোকে বলে, আল্লাহ যার সঙ্গে যার জোড়া করে থাকেন, যেমন করে হোক তাদের বিয়ে হবেই।

আরিফা বেগম ভেবেছিলেন, রিজিয়ার ঘটনা শুনে স্বামী তার ওপর খুব রেগে যাবে। তা হল না দেখে মনে মনে খুশি হয়ে বললেন, তুমি তা হলে রিজিয়াকে তার চাচাত ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে রাজি?

হা রাজি। তবে সহজে হিমুর দাদা ও বাবার কাছে নতি স্বীকার করব না। আমি তাদের আভিজাত্যের অহঙ্কার ভেঙ্গে দিতে চাই। দেখি, আল্লাহ কোন পথে রাজি।

আর ম্যানেজার ফাহিমের ব্যাপারে কিছু ভাববে না?

ওর ব্যাপারে আবার কি ভাবব? তাকে তো বলি নি, রিজিয়ার সঙ্গে বিয়ে দেব। ভালো জেনে রিজিয়ার জন্য পছন্দ করেছিলাম।

যদি কিছু মনে না কর তা হলে একটা কথা বলি?

স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছে ইসলামের পরিপন্থী ছাড়া সব কিছু বলতে পারে। এতে কারো কিছু মনে করা উচিত নয়। নিশ্চিন্তে বল, কি বলতে চাচ্ছ।

ফাহিমকে ফারিহার জন্য সিলেক্ট করলে হয় না?

তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দেব, ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমি প্রথমে ফারিহার জন্যই ওকে পছন্দ করি। পরে চিন্তা করে দেখলাম, নিজেদের অফিসের কর্মচারীকে তুমি হয়তো পছন্দ করতে নাও পার। তাই রিজিয়ার কথা বলি। ফারিহাকে হয়তো আল্লাহ ফাহিমের জোড়া করেছেন তাই এরকম হল। তারপর বললেন, ফারিহা যেন রিজিয়াকে বলে, হিমুকে একদিন বাসায় নিয়ে আসতে। আর শোন, এখন অফিসে কাজের চাপ। চাপ কমলে একদিন ফাহিমকে নিয়ে আসব। সেদিন ফারিহা যেন কোথাও না যায়। ওদের পরিচয় করিয়ে দেব। একে অপরকে দেখুক, আলাপ করুক। ওদেরও তো নিজস্ব মতামত আছে।

তাতো বটেই। যেদিন ফাহিমকে নিয়ে আসবে, সেদিন টাইমটা ফোন করে জানাবে। ফারিহা যদি কোথাও যেতে চায়, নিষেধ করব। আচ্ছা, আগের ম্যানেজার ফাহিমের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে কিনা খোঁজ নিয়েছ?

তা আবার নিই নি। সে রকম কিছু ঘটনা ঘটে নি।

ওকি আগের বাসা ছেড়ে দিয়েছে?

না, বাসা খুঁজছে। পেলে ছেড়ে দেবে।

ততদিন যদি ফাহিমের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়? তার চেয়ে আমাদের বাড়ির একটা ফ্লাট খালি করে সেখানে ফাহিমকে থাকতে দিলে হয় না?

তুমি খুব ভালো কথা বলেছ। এটা আমার মাথায় আসে নি। ওকে যখন আমরা জামাই করতে চাচ্ছি তখন ওর ভালোমন্দ আমাদেরই চিন্তা করা উচিত। সামনের মাসে যাতে একটা ফ্লাট খালি হয় সেই ব্যবস্থা করতে কেয়ারটেকারকে আজই বলে দেব।

হ্যাঁ, তাই কর। আমাদের বাড়িটা এখান থেকে কাছে। মাঝে মধ্যে গিয়ে ওর মায়ের সঙ্গে আলাপ করে আসব।

শিহাব হেসে উঠে বললেন, আলাপ করতে যাবে, না মেয়ের হবু শাশুড়ির আচার ব্যবহার কেমন দেখতে যাবে?

মেয়ের শাশুড়ি কেমন, মেয়েকে জ্বালাবে কি না মা হয়ে দেখব না? সামনের মাসেই যেন ফ্লাট খালি হয়, সেই ব্যবস্থা করবে।

বললাম তো করব।

.

০৭.

রাত এগারটা, ফারিহা ও রিজিয়া খেয়ে এসে আবার পড়তে বসেছে। ছোট বোন সাজিদা এসে ফারিহাকে বলল, তোমাকে মা ডাকছে।

মা ডাকছে শুনে ভয়ে ফারিহার বুক ঢিব ঢিব করতে লাগল। ভাবল, বাবা এখন ঘরে, তার সামনে যদি হিমু ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করে, তা হলে কি করবে? সাজিদাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা কোথায় রে?

সাজিদা বলল, বাবা টি.ভি. রুমে খবর শুনছে।

ফারিহা স্বস্তি পেয়ে মায়ের কাছে এসে বলল, কেন ডেকেছ তাড়াতাড়ি বল। এখনো এক সাবজেক্টের পড়া তৈরি করতে বাকি আছে।

আরিফা বেগম বললেন, রিজিয়ার ব্যাপারটা তোর বাবাকে বলেছি। শুনে খুব অবাক হলেও রাগারাগি করে নি। শোন, রিজিয়াকে বলিস, হিমুকে যেন একদিন বাসায় নিয়ে আসে।

ফারিহা মাকে জড়িয়ে ধরে উফুল্ল কণ্ঠে বলল, সত্যি বলছ মা, হিমু ভাইকে বাসায় নিয়ে আসার কথা বলব?

হ্যাঁ রে সত্যি। তোর বাবাই কথাটা বলেছে।

আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ফারিহা বলল, আমার এত খুশি লাগছে না মা, যা তোমাকে বোঝাতে পারব না।

আরিফা মেয়েকে পাশে বসিয়ে বললেন, তোর এত খুশি লাগছে কেন? খুশি তো লাগবে রিজিয়ার।

ফারিহা বলল, রিজিয়া কত দুঃখী, তা তো তুমি জান। দুঃখী মেয়ের সুখের কথা শুনে কে না খুশি হয়! তোমার খুশি লাগছে না?

পাগলী মেয়ের কথা শোন, তোর চেয়ে আমার বেশি খুশি লাগছে। এবার পড়তে যা।

যখন সাজিদা এসে ফারিহাকে বলল ডাকছে তখন রিজিয়াও ভয় পেয়েছে। ভেবেছে, আমার ও হিমুর সম্পর্কের কথা শুনে মামা হয়তো খুব রেগে গেছেন। তাই সাবধান করার জন্য মামিমা ফারিহাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এইসব ভেবে মন খারাপ হয়ে যেতে পড়া বন্ধ করে এতক্ষণ ফারিহার ফেরার অপেক্ষা করছিল। তাকে হাসি হাসি মুখে ফিরে আসতে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেয়ে জিজ্ঞেস করল, মামিমা কেন ডেকেছিল রে?

ফারিহা দুষ্টুমি করে বলল, বলব না।

 কেন বলবি না?

সেটা আমার ইচ্ছা।

প্লিজ বল না, মামিমা কেন ডেকেছিলেন?

বললাম তো বলব না, তবু জিজ্ঞেস করছিস কেন?

বলবি না, দাঁড়া মজা দেখাচ্ছি বলে রিজিয়া ড্রয়ার খুলে একটা তেলাপোকা ধরে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।

ফারিহা তার হাতে তেলাপোকা দেখে কাতরে উঠে বলল, বস বস বলছি। দয়া করে ওটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আয়। সে তেলাপোকাকে ভীষণ ভয় পায়। ঘরে যদি একটা তেলাপোকা উড়তে দেখে, তা হলে বিছানার চাদর তুলে পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাপা দিয়ে রিজিয়াকে বলবে, প্লিজ ওটাকে মেরে বাইরে ফেলে দিয়ে আয়। রিজিয়ার ড্রয়ারে তেলাপোকা থাকে বলে তার টেবিলের কাছে যায় না।

রিজিয়া তেলাপোকটা বাইরে ফেলে দিয়ে এসে বলল, এবার বল।

মা যা কিছু বলেছিল সেসব বলে ফারিহা জিজ্ঞেস করল, কবে তা হলে হিমু ভাইকে আসতে বলবি?

রিজিয়াও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, তুই বল না, কবে আসতে বলব?

এখনই ফোন করে হিমু ভাইকে জিজ্ঞেস কর, তিনি কবে আসতে পারবেন।

ঠিক বলেছিস। যা ফোনের সেটটা নিয়ে আয়।

তুই নিয়ে আসতে পারিস না, আমাকে বলছিস কেন? কথাটা ফারিহা বললেও বারান্দা থেকে সেটটা এনে বলল, নাম্বার বল।

দু’বার রিং হওয়ার পর একটা বয়স্ক মহিলার ভারি গলা শুনতে পেল, হ্যালো, কে বলছেন?

ফারিহা মাউথ পিসে হাত চাপা দিয়ে রিজিয়াকে বলল, এক মহিলা ফোন ধরেছেন। মনে হয় হিমু ভাইয়ের মা। কি বলব বল দেখি?

রিজিয়াও বলল, যা হোক কিছু বলে হিমুকে ফোনটা দিতে বল।

ফারিহা মাউথপিস থেকে হাত সরিয়ে বলল, ডা. হিমু আছেন? আমি ওনার বন্ধুর বোন। উনি আমার চিকিৎসা করছেন।

হিমুর মা সাবিহা বেগম ফোন ধরেছিলেন। বললেন, ধরুন হিমুকে দিচ্ছি।

ফোন রাগিব হাসানের রুমে থাকলেও হিমু নিজের রুমে প্যারালাল করে নিয়েছে। হিমু একটা হাদিসের বই পড়ছিল। রিং হতে ঘড়ি দেখে ভাবল, কে তাকে এত রাতে ফোন করবে? নিশ্চয় বাবার ফোন। সাথে সাথে রিং বন্ধ হয়ে যেতে বুঝতে পারল, মা বা বাবা ধরেছে। তাই আবার পড়ায় মন দিল। একটু পরে সেটে টিক টিক শব্দ শুনে বুঝতে পারল, তার ফোন। রিসিভার তুলতে মায়ের গলা পেল, তোর পেসেন্ট ফোন করেছে, কথা বল। তারপর মায়ের রিসিভার রাখার শব্দ পেয়ে বলল, হ্যালো, কে বলছেন?

ফারিহা বলল, জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনার মা তো কে ফোন করেছে বললেন?

ফারিহার গলা বুঝতে পেরে হিমু বলল, দুষ্টুমি না করে এত রাতে কেন ফোন করেছ বল।

ফারিহা বলল, দুষ্টুমি না করলে আপনার মায়ের হাত থেকে উদ্ধার পেতাম না। কি করছিলেন বলুন?

একটা হাদিসের বই পড়ছিলাম। রিজিয়াকে দাও।

কেন? আমার সঙ্গে কথা বলতে বুঝি ভালো লাগছে না?

ভালো লাগবে না কেন? বেশিক্ষণ কথা বললে মা বুঝতে পারবে, প্যারালাল ফোন তো। তাই ওকে দিতে বললাম।

ধরুন দিচ্ছি, বলে ফারিহা রিসিভার রিজিয়াকে দিয়ে বলল, নে কথা বল।

রিজিয়া সালাম বিনিময় করে বলল, মামা-মামি আমাদের ব্যাপারটা জেনে গেছেন। তারা তোমাকে বাসায় আসতে বলেছেন। কবে আসবে বল?

তুমি বললে এক্ষুনি এসে পড়তে পারি।

দুষ্টুমি না করে কবে আসবে বল।

মামা-মামি জানলেন কেমন করে?

সে অনেক কথা, ফোনে বলা যাবে না। শুধু এতটুকু বলতে পারি ফারিহা জানিয়েছে।

ও তো খুব ডেঞ্জারস মেয়ে।

ফারিহা ডেঞ্জারস মোটেই নয়। বরং সাহসী মেয়ে বলতে পার। ওর কথা বাদ দিয়ে কবে আসবে বলবে তো?

তুমি যেদিন বলবে। তবে তার আগে তোমার মামা-মামি কি করে জানলেন বিস্তারিত জানতে হবে। নচেৎ তেমন কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেব কি করে?

তা হলে কাল দেড়টার সময় কলেজের গেটের কাছে থাকবে।

 নিশ্চয় থাকব।

নিশ্চয় থাকব নয়, বলো ইনশাআল্লাহ থাকব। কারণ আল্লাহ রাজি না থাকলে মানুষ কিছুই করতে পারে না।

ইনশাআল্লাহ থাকব বলে হিমু বলল, এবার হয়েছে তো?

হ্যাঁ, হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?

 না তোমার কথামতো হাদিস পড়ছিলাম।

 ক’টার সময় ঘুমাও?

ছাত্রজীবনে কোনো নির্দিষ্ট টাইম ছিল না। বারটা-একটা-দুটা পর্যন্ত পড়তাম। এখন বারটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি।

রিজিয়ার হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে ফারিহা বলল, কতক্ষণ কথা বলছেন খেয়াল আছে? এখন বুঝি মা জানতে পারবেন না? তারপর রিসিভার ক্র্যাডেলে রেখে রিজিয়াকে বলল, আমাকে বললেন কিনা ‘বেশিক্ষণ কথা বললে মা জানতে পারবে, তাড়াতাড়ি রিজিয়াকে দাও। অনেকক্ষণ তোর সঙ্গে কথা বলছিল, তাই লাইন কেটে দিলাম। রাগ করলি?

রিজিয়া হেসে ফেলে বলল, দিন দিন তুই খুব বেশি ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস। তবে তোর উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না। আমি ফোন করলে হিমুর মাকে অত সুন্দরভাবে মিথ্যে বলে ম্যানেজ করতে পারতাম না।

তা হলে স্বীকার করছিস, আমি তোর থেকে চালাক?

চালাক কি না জানি না, তবে তোর ব্রেন যে খুব সার্ফ তা স্বীকার করছি।  

তুইও কম না। সোজাসুজি নাক না দেখিয়ে মাথার পেছন থেকে ঘুরিয়ে দেখালি।

হয়েছে হয়েছে, অত আর লেকচার দিতে হবে না। পড়লে পড়, তা না হলে ঘুমিয়ে পড়।

.

পরের দিন হিমু সোয়া একটা থেকে কলেজের গেটের উল্টো দিকের ফুটপাতে অপেক্ষা করছিল। দেড়টার সময় অনেক ছাত্রীদের বেরোতে দেখলেও তাদের মধ্যে রিজিয়া বা ফারিহাকে দেখতে পেল না। ভাবল, তা হলে কোনো কারণে ওরা কি আজ আসে নি? তাই বা কি করে হয়? না এলে নিশ্চয়ই ফোন করে জানাত। যখন দুটো বেজে গেল তখন আর ধৈর্য ধরতে পারল না। গেটের ভেতর ঢুকে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, ডিগ্রি আর্টস বিভাগের ছুটি হয়ে গেছে কি না জানেন?

দারোয়ান বলল, না, টিউটোরিয়াল ক্লাস চলছে। আড়াইটায় ছুটি হবে।

হিমু ফিরে এসে আগের জায়গায় অপেক্ষা করতে লাগল।

আড়াইটায় ক্লাস শেষ হওয়ার পর রিজিয়া ও ফারিহা গেটের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে হিমুকে দেখতে পেল না।

ফারিহা বলল, তোর কথাই ঠিক, দেড়টা দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করে হিমু ভাই ফিরে গেছে।

আজ টিউটোরিয়াল ক্লাস আছে গতরাতে ফোন করার সময় দু’জনের কারো মনে ছিল না। আজ টিউটোরিয়াল ক্লাস করার সময় মনে পড়ে এবং ফারিহাকে সে কথা বলে বলেছিল, আড়াইটায় টিউটোরিয়াল ক্লাস শেষ হবে। অতক্ষণ কি আর হিমু অপেক্ষা করবে? বড়জোর দুটো পর্যন্ত অপেক্ষা করে ফিরে যাবে।

ওদেরকে গেট থেকে বেরোতে দেখে হিমু ফুটপাতের একটা মোটা আশুথ গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে লক্ষ্য রাখল। তারপর ওরা যখন একটা স্কুটারের দিকে এগোল তখন আড়াল থেকে বেরিয়ে দ্রুত হেঁটে কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, আমি সেই সোয়া একটা থেকে অপেক্ষা করছি, আর তোমরা আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছ?

রিজিয়ার আগে ফারিহা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কোথায় ছিলেন দেখলাম না তো? আমরা চারদিকে তাকিয়ে কত খুঁজলাম।

হিমু বলল, একটু ভালো করে খুঁজলে ঠিকই দেখতে পেতে। ঐ গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, আমাকে না পেয়ে তোমরা কি কর।

রিজিয়া বলল, আজ যে টিউটোরিয়াল ক্লাস আছে, তা আমাদের কারো মনে ছিল না। ক্লাস শুরু হওয়ার পর মনে পড়ে। মনে থাকলে আড়াইটায় আসতে বলতাম। প্লিজ ক্ষমা করে দাও।

হিমু বলল, দেড়টায় অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে তোমাদের বেরোতে না দেখে দু’টো পর্যন্ত অপেক্ষা করি। তারপর দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম তোমাদের টিউটোরিয়াল ক্লাস হচ্ছে। তারপর বলল, ভুল কম বেশি সবারই হয়। মাফ চাওয়ার কি আছে? তবে ভালো করে না খুঁজে চলে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছিল না।

রিজিয়া বলল, ফারিহার মতো তোমার মাথায়ও যে দুষ্টুমিতে ভরা, তা জানব কি করে?

ফারিহা বলল, দেখছেন হিমু ভাই, আপনার সঙ্গে আমাকেও জড়াচ্ছে। এটা কি ওর উচিত হল?

হিমু হাসতে হাসতে বলল, মনে হয় ওর মাথায় কিছু নেই, তা না হলে এমন অনুচিত কথা বলতে পারত না।

রিজিয়া বলল, অনেক হয়েছে এবার চল তো।

 চলতে শুরু করে ফারিহা বলল, চলতো বললি, কোথায় যাবি বলবি না?

রিজিয়া বলার আগে হিমু বলল, আলাপ করার জন্য দুটো জায়গা। একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্ট আর অন্যটা পার্ক। কোথায় যাবে বল।

ফারিহা রিজিয়াকে বলল, তুই বল।

রিজিয়া বলল, তোর তো উপস্থিত বুদ্ধি বেশি। তুই বল।

ফারিহা বলল, পার্কের চেয়ে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট উত্তম। একঢ়িলে দু’পাখি স্বীকার হবে। আলাপও হবে, ডান হাতের কাজও হবে। পেটে ক্ষিধে নিয়ে তো আর আলাপ জমবে না? তারপর হিমুকে উদ্দেশ্য করে বলল, পকেট ভারি আছে তো? এসব ব্যাপারে লজ্জা করা উচিত হবে না, নচেৎ খাওয়ার পর তিনজনকেই অপদস্থ হতে হবে।

রিজিয়া তাকে ধমকের স্বরে বলল, তোর লজ্জা সরম বলতে কিছু নেই। ঘণ্টা খানেক আর ক্ষিধে সহ্য করতে পারবি না? বাসায় গিয়েই তো খাবি।

ফারিহা বলল, তোর যদি এতই লজ্জা, তা হলে তুই খাবি না, আমি আর হিমু ভাই খাব, তুই চেয়ে চেয়ে দেখবি। অবশ্য তাতেও তোর লাভ হবে। ঐ যে লোকে বলে, খাওয়ার চেয়ে দেখা ভালো।

ততক্ষণে তারা নীলক্ষেতের মোড়ে এসে গেছে। রিজিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, হিমু তাকে থামিয়ে দিয়ে একটা দাঁড়ানো স্কুটার ড্রাইভারকে বলল, যাবেন ভাই?

ড্রাইভার রাজি হতে হিমু তাদেরকে পেছনের সিটে উঠতে বলে ড্রাইভারের পাশে বসে বলল, পাঁচ নাম্বার ধানমন্ডির রাস্তার সামনের চায়নিজ রেস্টুরেন্টে চলুন।

ড্রাইভার এত কাছে যেতে রাজি হল না। বলল, আপনারা রিকশায় যান।

হিমু ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, কাছে যেতে চাচ্ছেন না তো, দূরের ভাড়া দেব, নিন স্টার্ট দিন।

রেস্টুরেন্টে ঢুকে হিমু বলল, তোমাদের সঙ্গে খাব বলে বাসা থেকে না খেয়ে বেরিয়েছি। তারপর মেনুর বোর্ডটা এগিয়ে দিয়ে বলল, অর্ডার দাও।

খাওয়ার পর ফারিহা বলল, হিমু ভাই, বেশি দেরি করলে মা চিন্তা করবেন।

হিমু বলল, দেরি করা না করা তোমাদের ওপর নির্ভর করছে।

রিজিয়া ফারিহাকে বলল, যা বলার তুই বল।

ফারিহা বলতে শুরু করল, বাবা তার অফিসের ম্যানেজারকে রিজিয়ার জন্য পছন্দ করেন এবং সে কথা মাকে জানান। মা আবার আমাকে জানান। শুনে আমার তো আক্কেল গুড়ুম। সঙ্গে সঙ্গে আপনার পরিচয়, রিজিয়ার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ও আপনারা যে একে অপরকে ভালবাসেন সব কিছু বললাম। মা শুনে প্রথমে আমার ওপর রেগে গেলেও পরে বললেন, তোর বাবাকে বলে দেখি, সে কি করে? বাবা শুনে মাকে বলেছেন, রিজিয়া যেন একদিন ছেলেটাকে বাসায় আসতে বলে।

হিমু বলল, তোমার বাবা আমাদের ভালবাসার কথা শুনে রেগে যান নি?

তা বলতে পারব না। তবে মনে হয় রাগেন নি। রাগলে আপনাকে বাসায় নিয়ে আসার কথা বলতেন না।

এটাও তো হতে পারে, অপমান করে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য বাসায় ডেকেছেন।

সম্ভাবনা যে একদম নেই, তা নয়। তবে আমার যতদূর ধারণা, আপনি যা ভাবছেন তা নাও হতে পারে।

তোমার কথা মেনে নিতাম যদি তিনি রিজিয়ার জন্য ছেলে পছন্দ না করতেন।

তা হলে বাসায় আসতে চাচ্ছেন না?

আসব না মানে, ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় আসব। তুমি জান না ফারিহা, রিজিয়া যে আমার হৃদয়ে কিভাবে জড়িয়ে আছে, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। ওকে পাওয়ার জন্য এমন কোনো কাজ নেই, যা আমি করতে পারব না।

শুনে খুব খুশি হলাম। দোয়া করি আল্লাহ আপনার মনের ইচ্ছা পূরণ করুন।

হিমুর কথা শুনে রিজিয়ার দু’চোখ পানিতে ভরে উঠেছিল। ফারিহা যাতে দেখতে না পায় সেজন্য তাড়াতাড়ি ওড়নায় চোখ মুছে ফেলল।

তার আগেই ফারিহা তার চোখের পানি দেখে ফেলে বলল, তুই বড় ছিচকাঁদুনে মেয়ে। এখন কাঁদার কি হল? নে, এবার চল আর দেরি করা ঠিক হবে না বলে কেউ কিছু বলার আগে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল।

রিজিয়া ভেজা চোখে হিমুর মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার ভালবাসার মূল্য আমি কি দিতে পারব? কেবলই মনে হয়, আল্লাহ যদি আমাদের মিলন তকদিরে না লিখে রাখেন, তা হলে তোমার অবস্থা কি হবে? কথাটা শেষ করে আবার চোখ মুছল।

হিমু বলল, সে কথা তকদির যিনি লিখেছেন তিনি জানেন। প্লিজ রিজিয়া, সবুর কর। তুমি তো আমার থেকে হাদিস-কালাম বেশি জান। তবু এত অধৈর্য হচ্ছে কেন? গত রাতে হাদিসে পড়লাম আমাদের নবী করিম (সঃ) বলেছেন, ধৈর্য ঈমানের অর্ধেক। এ কথা জেনেও সবুর করতে পারছ না কেন?

রিজিয়া সামলে নিয়ে চোখ-মুখ মুছে বলল, হাদিসটা জানলেও সব সময় মনে থাকে না। এবার থেকে ইনশাআল্লাহ মনে রাখার চেষ্টা করব। তারপর বলল, ফারিহা বাইরে অপেক্ষা করছে চল যাই। বেরুবার সময় জিজ্ঞেস করল, বাসায় কবে আসছ তা হলে?

পরশু শুক্রবার সকাল আটটার দিকে আসব।

বাইরে এসে দেখল, ফারিহা একটা স্কুটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওদেরকে দেখে বলল, বিয়ের আগে এতক্ষণ ধরে আলাপ করা উচিত নয়। অবশ্য বিয়ের পর যতক্ষণ ইচ্ছা বলে রিজিয়াকে বড় বড় চোখ বের করে রাগের সাথে তার দিকে তাকাতে দেখে থেমে গেল। তারপর সরি বলে স্কুটারে উঠে হিমুকে জিজ্ঞেস করল, কবে আসছেন ওকে বলেছেন?

হিমু বলল, হ্যাঁ, পরশু সকাল আটটায়।

রিজিয়া হিমুর সঙ্গে সালাম বিনিময় করে স্কুটারে উঠে বলল, আল্লাহ হাফেজ।

হিমুও বলল, আল্লাহ হাফেজ।

.

বাসায় ফিরে হিমু দাদুকে বলল, শিহাব চাচা আমাকে যেতে বলেছেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, দাদু তাই।

তা তোমাকে খবরটা দিল কে?

রিজিয়া।

নাতনির নাম শুনে জাহিদ হাসানের চোখে পানি আসার উপক্রম হল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামলে নিয়ে বললেন, ওকে দেখার জন্য মন ক্রমশ: উতলা হয়ে উঠছে।

আমি তো দেখাতে চেয়েছিলাম, আপনি আজ নয় অন্যদিন বলে এড়িয়ে গেছেন।

জাহিদ হাসান একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, কেন যে এড়িয়ে যাই জানিস?

না বললে জানব কি করে?

ওর সামনে যাওয়ার মুখ আমার নেই।

আমার যত দূর ধারণা, আপনার প্রতি ওর কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই।

কি করে বুঝলি?

আপনি ওকে নাতবৌ করতে রাজি আছেন শুনে খুব খুশি হয়েছে। রাগ বা ক্ষোভ থাকলে কি খুশি হত? পরশুদিন ওদের বাসায় যাব বলেছি, আপনিও চলুন।

শিহাবের কাছেও আমি অপরাধী। সে আমাকে কিভাবে গ্রহণ করবে না জানা পর্যন্ত ওদের বাসায় যাব না। পরশুদিন তুই একা যা, কি কথা হয় না হয় জানার পর ভালো বুঝলে যাব।

.

আজ শুক্রবার। কয়েকদিন খুব গুমোট ছিল। ভোর থেকে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঝাঁপটা খোলা জানালা দিয়ে হিমুর গায়ে পড়তে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে জানালা বন্ধ করে ঘড়ি দেখল। পাঁচটা বাজে। এতদিন নামায পড়ার জন্য নামায শিক্ষা দেখে বাংলায় কয়েকটা সূরা, নামাযের অন্যান্য সব কিছু মুখস্থ করেছে এবং নামায পড়ার নিয়মকানুন শিখে নিয়ত করেছে, শুক্রবার ফজর থেকে শুরু করবে। সে প্রতিদিন সাতটা পর্যন্ত ঘুমায়। আজ পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে যেতে নামায শুরু করার কথা মনে পড়ল। তাই বাথরুমের কাজ সেরে অযু করে এসে নামায পড়ল। তারপর গতকালের কিনে আনা কুরআনের বঙ্গানুবাদ পড়তে লাগল। সাতটা বাজতে গোসল করে দাদুর কাছে গিয়ে বলল, তুমি কি এ বেলা কোথাও যাবে?

জাহিদ হাসান বললেন, কেন, গাড়ি নিয়ে কোথাও যাবি বুঝি?

হ্যাঁ দাদু।

নিয়ে যা, তবে দুপুরের মধ্যে ফিরবি, আমি বিকেলে একটু বেরুব।

বেরুবার সময় হিমু মায়ের সামনে পড়ে গেল। সাবিহা বেগম বললেন, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এত সকালে কোথায় যাচ্ছিস? নাস্তা খাবি না?

না মা খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। খুব জরুরি একটা কাজে যাচ্ছি। বাইরে নাস্তা খেয়ে নেব।

.

০৮.

শিহাবের শ্বশুর আরমান চৌধুরী দশ কাঠা জমির পূর্ব পার্শ্বে দু’তলা বাড়ি করেছেন। তিনি খুব শৌখিন মানুষ। প্রতি তলায় তিনটি ফ্লাট। ভাড়া দেয়ার জন্য বাড়ি করেন নি, করেছেন নিজেরা থাকার জন্য। নিজে শৌখিন, তার বাড়িটাও শৌখিন। চারপাশে বারান্দা, দোতলায় ওঠার তিনটে সিঁড়ি। একটা নিচতলার ফ্লাটের ড্রইংরুম থেকে। অন্য দুটো দু’পাশের বারান্দা থেকে। গেটের পূর্ব দিকে ড্রাইভার, দারোয়ান ও কাজের লোকদের জন্য পাকা টিনশেডের তিনটে রুম। গাড়ি রাখার গ্যারেজ নেই। বারান্দার কড়িডোর বেশ বড়। তারই একপাশে গাড়ি থাকে। পুরো বাড়িটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। পশ্চিম পাশে ফুলের বাগান। বাকি জায়গাটা ফাঁকা রেখেছেন ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করার জন্য। যদিও আরিফা বেগম তাঁদের একমাত্র সন্তান। ভবিষ্যতে নাতি-নাতনি খেলাধুলা করবে চিন্তা করে এই ব্যবস্থা।

শিহাব আরিফা বেগমকে বিয়ে করার পর যখন শান্তিনগরে বাড়ি করে স্ত্রীকে নিয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন তখন আরমান চৌধুরী জামাইকে বলেছিলেন, আরিফা আমাদের একমাত্র নয়নের মণি। তাই এই বাড়ি ও অন্যান্য সব কিছু ওর নামে লিখে দিয়েছি। তবু যদি তুমি আরিফাঁকে নিয়ে তোমার বাড়িতে যেতে চাও বাধা দেব না। শুধু এতটুকু বলব, ওকে ছেড়ে থাকতে আমাদের খুব কষ্ট হবে।

সেখানে শিহাবের শাশুড়িও ছিলেন। স্বামী থেমে যেতে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, তোমার শ্বশুরের সঙ্গে আমি একমত। তা ছাড়া আমাদের বহুদিনের আশা, নাতি-নাতনিদের মানুষ করব, তাদের খেলাধুলার সঙ্গী হব, তাদেরকে নিয়ে বেড়াব, আনন্দ করব। আমাদের সেই আশা ও আনন্দকে বঞ্চিত করে চলে যেও না বাবা। তোমরা চলে গেলে আমরা যে অন্ধ হয়ে যাব। কথা শেষ করে চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠলেন।

শ্বশুর-শাশুড়ির কাতরোক্তি শুনে ও তাদের চোখে পানি দেখে শিহাব স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থেকে যান। আর নিজের বাড়িটা ভাড়া দিয়ে দেন।

হিমু গাড়ি নিয়ে যখন শিহাবদের বাসার গেটে পৌঁছাল তখন আটটা বেজে পাঁচ মিনিট। ঝড় কমলেও তখনও অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। গেট বন্ধ দেখে হর্ন বাজাল।

দারোয়ান ছোট গেট খুলে ছাতা খাটিয়ে বেরিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, মাফ করবেন, অপরিচিত কাউকে ভেতরে যেতে দেয়ার অনুমতি আমার নেই। আপনার পরিচয় বলুন।

হিমু সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি ভেতরে গিয়ে বলুন হিমু এসেছেন।

দারোয়ান ছোট গেট বন্ধ করে ভেতরে চলে গেল। একটু পরে ফিরে এসে বড় গেট খুলে দিল।

হিমু গাড়ি ভেতরে নিয়ে এসে করিডোরে পার্ক করল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে একজন দাড়ি-টুপিওয়ালা পৌঢ়কে দেখে সালাম দিল।

রিজিয়া ও হিমুর সব কিছু জানার পর শিহাব শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে আলাপ করার সময় অফিসের ম্যানেজার ফাহিমকে রিজিয়ার জন্য পছন্দ করার কথাও আলাপ করলেন।

আরমান চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ফাহিমকে দেখেছি ও তার সঙ্গে আলাপও করে বুঝেছি, রিজিয়ার উপযুক্ত। কিন্তু হিমু ও রিজিয়ার সম্পর্ক জেনে মনে হচ্ছে, হিমুর সঙ্গে রিজিয়ার বিয়ে দেয়া আমাদের কর্তব্য। তবে তার আগে হিমু কেমন ছেলে তাও আমাদের জানা উচিত।

শিহাব বললেন, আমরাও হিমুকে দেখি নি, তার সঙ্গে আলাপও করি নি। তাই তাকে আসতে বলা হয়েছে।

আরমান চৌধুরী বললেন, আগে আসুক, পরিচয় হোক, তারপর আমার মতামত জানাব।

আরমান চৌধুরী প্রতিদিন এক ঘণ্টা মর্নিংওয়াক করে বাসায় এসে পৌনে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নেন। সেই সময় পেপার পড়ার কাজ সেরে ফেলেন। তারপর পনের মিনিটের মধ্যে গোসল করে কাঁটায় কাঁটায় আটটায় নাস্তা করেন। আজ বৃষ্টির জন্য মর্নিংওয়াক করতে যান নি। কুরআনের তাফসির ও পেপার পড়ে সময় কাটিয়েছেন। তারপর গোসল করে হিমুর জন্য অপেক্ষা করছেন। সে সকাল আটটায় আসবে তাই মেয়ে আরিফা বেগম নির্দিষ্ট সময়ে নাস্তা খেতে ডাকলেও খান নি। বলেছেন, হিমু আসার পর একসঙ্গে খাবেন। তিনি বারান্দায় পায়চারি করছিলেন আর ভাবছিলেন, এই বৃষ্টির মধ্যে হিমু কি আসবে? না বৃষ্টি কমলে বা ছাড়ার পর আসবে? এমন সময় গাড়ির হর্ন শুনে গেটের দিকে তাকিয়ে দারোয়ানের কার্যকলাপ দেখলেন। তারপর তাকে ছাতা মাথায় আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কে এসেছে?

দারোয়ান বলল, হিমু নামে এক যুবক ছেলে।

যাও, তাড়াতাড়ি গেট খুলে দাও।

হিমু গাড়ি থেকে নেমে সালাম দিতে আরমান চৌধুরী উত্তর দিয়ে বললেন, আমি আরমান চৌধুরী, শিহাবের শ্বশুর। তারপরে বললেন ভেতরে চলুন।

হিমু ভেতরে আসার সময় বলল, আপনি আমার দাদুর বয়সী, আমাকে আপনি করে বলে লজ্জা দেবেন না।

আরমান চৌধুরী মৃদু হেসে বললেন, ঠিক আছে। তারপর ড্রইংরুমে এসে বসতে বলে নিজেও বসে বললেন, এত বৃষ্টির মধ্যে তুমি আসবে ভাবতে পারি নি। পাঁচ মিনিট লেট হলেও তোমার পাংচুয়েলিটি জ্ঞান আছে জেনে খুশি হয়েছি। প্রতিদিন আটটার সময় আমি নাস্তা খেলেও আজ তোমার সঙ্গে খাব বলে খাই নি। আশা করি, তুমিও নাস্তা না খেয়ে এসেছ?

আরমান চৌধুরীকে দেখেই হিমুর মনে শ্রদ্ধাবোধ জেগেছিল। তারপর তার কথা শুনে আরো বেড়েছে। মৃদু হেসে বলল, এখানে নাস্তা খাব বলে আমিও না খেয়ে এসেছি।

গুড, ভেরি গুড বলে আরমান চৌধুরী হাঁক দিয়ে বললেন, কে কোথায় আছ, মেহমান এসে গেছে নাস্তা নিয়ে এস।

রিজিয়া ও ফারিহা শুধু চোখ দুটো ছাড়া মাথা ও সারা শরীর ঢেকে দুপ্লেট নাস্তা, পানির জগ ও গ্লাস নিয়ে এসে সালাম দিল।

হিমু তাদের দিকে তাকিয়ে সালামের উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই আরমান চৌধুরী উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাদেরকে কি কাজের বুয়া হিসেবে নতুন এপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে?

কথাটা শুনে হিমু লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে নিল।

রিজিয়াও দাদুর কথা শুনে তাই করল।

কিন্তু ফারিহা তা না করে বলল, কেউ আমাদেরকে এপয়েন্টমেন্ট দেয় নি, নিজেরাই নিয়েছি। মেহমানকে কাজের বুয়াকে দিয়ে মেহমানদারি করালে তাকে অপমান করা হয়। আমাদের নবী করিম (সঃ) নিজের হাতে মেহমানের খেদমত করেছেন।

আরমান চৌধুরী আফসোসের স্বরে বললেন, তা হলে তো আমারই করানো উচিত ছিল।

ফারিহা বলল, আপনি মুরুব্বি মানুষ, আমরা থাকতে আপনি করাবেন কেন? আর আমরাইবা আপনাকে করতে দেব কেন? তা ছাড়া উনি আমাদের মেহমান, আমাদেরই তো করান উচিত।

তোমরা হলে ভাই মডার্ন যুগের শিক্ষিত মহিলা, আর আমি হলাম সেকেলে অল্পশিক্ষিত বুড়ো, তোমাদের সঙ্গে যুক্তিতে কি আর পারব?

হার যখন স্বীকার করলেন তখন আর কোনো কথা না বলে খেতে শুরু করুন। এমনিতেই তো আপনার নাস্তার টাইম দশ মিনিট লেট হয়ে গেছে।

নাস্তা খাওয়ার পর আরমান চৌধুরী হিমুর সঙ্গে তাদের পারিবারিক ও তার এম অফ লাইফ সম্পর্কে আলাপ করে খুশি হয়ে বললেন, তুমি বসো, ফারিহার মা-বাবা তোমাকে আসতে বলেছে। তারা হয়তো এবার আসবে। আমি এখন যাই বলে চলে গেলেন।

মিনিট পাঁচেক পর শিহাব ড্রইংরুমে ঢুকেই সালাম দিলেন।

হিমু জানত ছোটরাই বড়দের সালাম দেয়। তাই শিহাব চাচা আগে সালাম দিতে লজ্জা পেয়ে দাঁড়িয়ে সেও সালাম দিল।

শিহাব তাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর বললেন, ছোট বড় যে কেউ আগে সালাম দিলে শুধু সালামের উত্তর দিতে হয়। পাল্টা তাকে সালাম দেয়া বেদাত। অর্থাৎ যা ইসলামের বিধানে নেই অথচ নিজের ইচ্ছায় কোনো নতুন নিয়মের প্রচলন করা। এসব কথা থাক, যে কারণে তোমাকে আসতে বলেছি সে ব্যাপারে আলাপ করা যাক। তুমি আমার বন্ধুর বড় ভাইয়ের ছেলে আর রিজিয়া আমার বন্ধুর মেয়ে ও আমাদের গ্রামের মেয়ে। তোমাদের দুজনের ভালোমন্দ চিন্তা করা আমার কর্তব্য। আমার বড় মেয়ে ফারিহার কাছে তোমার ও রিজিয়ার সম্পর্কে সব কিছু শুনেছি। কিন্তু তুমি কি জান, শিশু রিজিয়াকে যখন তার নানা ও আমি তোমার দাদার কাছে দিতে এসেছিলাম, তখন শুধু রিজিয়ার নানাকে নয়, আমি তোমার চাচার অন্তরঙ্গ বন্ধু জানা সত্ত্বেও তিনি ও তোমার বাবা আমাকে অবিশ্বাস করে দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

হিমু বলল, জি জানি।

শিহাব আবার বলল, যে রিজিয়াকে তার নানা শত অভাবের মাঝে না খেয়ে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করিয়েছিলেন, যাকে তোমার দাদাজী ও বাবা স্বীকৃতি দেন নি, তাকে কি তারা মেনে নেবেন? না ঘরে তুলবেন? আমার তো মনে হয়, তা তারা করবেন না। আর আমারও কি উচিত হবে, তাদের বাড়ির ছেলের সঙ্গে রিজিয়ার বিয়ে দেয়া? কখনই উচিত হবে না। আমার একটা কথার উত্তর দাও তো, শুনেছি তুমি বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে রিজিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ, কিন্তু তার ও তার মা বাবার পুরো ইতিহাস জান কি?

হিমু বলল, জি জানি।

রিজিয়ার পরিচয় তোমার মা-বাবা, দাদা-দাদি জানেন?

দাদা-দাদি জানেন, মা বাবা জানেন না। তবে তারা শুধু এতটুকু জানেন, রিজিয়া পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের এতিম মেয়ে।

তারা কি রিজিয়াকে বৌ করতে রাজি আছেন?

মা-বাবা রাজি নন, দাদা-দাদি রাজি আছেন। ওঁনারা শিশু রিজিয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু পরে দাদাজী অনুতপ্ত হয়েছিলেন। এখন আমার কাছে রিজিয়ার সব কিছু শুনে আরো বেশি অনুতপ্ত হয়েছেন এবং তাকে দেখার জন্য খুব অস্থির হয়ে আছেন। আজ ওনাকে আসতে বলেছিলাম। বললেন, রাকিবের বন্ধুকে সেদিন অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম, এখন তার কাছে ও রিজিয়ার কাছে কোন মুখ নিয়ে দাঁড়াব।

তাই যদি হয়, তা হলে তো উনি ছেলে বৌকে রিজিয়ার আসল পরিচয় জানিয়ে রাজি করাতে পারেন! আর তুমিও রিজিয়ার আসল পরিচয় মা-বাবাকে জানাতে পারতে। জানার পর তারা হয়তো রাজি হতেন।

দাদাজী কেন জানান নি, তা আমি জানি না। আর আমি জানায় নি, কারণ আমার মা-বাবাকে আমি ভালোভাবেই জানি, তারা ধনের ও আভিজাত্যের অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে গেছেন। গরিবদের তারা মানুষ বলে মনেই করেন না। তারা কি রিজিয়ার আসল পরিচয় জেনে রাজি হবেন? কিছুতেই হবেন না। তাই আমি রিজিয়াকে বিয়ে করে তাদের সেই ধনের ও আভিজাত্যের অহঙ্কার চূর্ণ করে দিতে চাই।

তোমার উদ্দেশ্য ভালো হলেও এটা করা তোমার উচিত হবে না। কারণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) মা-বাবা যতই খারাপ হন না কেন, তবু তাদের মনে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন।

তা হলে আপনিই বলুন, আমার কি করা উচিত।

তুমি কি ইসলামের ওপর পড়াশোনা করেছ?

এতদিন করি নি। কিছুদিন আগে রিজিয়া আমাকে ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করতে বলে। তখন থেকে ইসলামের ওপর বিভিন্ন বই-পুস্তক পড়তে শুরু করেছি।

তোমার চাচার সঙ্গে যখন আমার বন্ধুত্ব হয় এবং তোমাদের বাসায় যাতায়াত করতাম তখন কেউ নামায রোযা করতেন না। আমি তোমার চাচাকে ইসলামী বই পড়িয়ে ইসলামের প্রতি অনুরক্ত করি এবং কিছুদিনের মধ্যে ইসলামের বিধান মেনে চলতে শুরু করে। এখন তোমাদের বাসার কেউ কি নামায-রোযা করে না?

জি, না?

তুমিও কর না?

চাচাকে যেমন আপনি ইসলামী বই-পুস্তক পড়িয়ে ইসলামে অনুরক্ত করে নামায-রোযা ধরিয়েছিলেন, তেমনি রিজিয়াও আমাকে তাই করেছে। আজ ফজর থেকে নামায পড়তে শুরু করেছি। ইনশাআল্লাহ আগামী রমযান মাসে রোযাও রাখব।

আল্লাহ সবাইকে ইসলাম বোঝার ও ইসলামের বিধান মেনে চলার তওফিক দান করুন। তোমাকে নামায-রোযার কথা জিজ্ঞেস করলাম বলে মনে কিছু করো না। কেন জিজ্ঞেস করলাম জান, যারা এগুলো করে না, তাদের বাড়িতে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেয়া কোনো মা-বাবার উচিত নয়। জেনে রেখো, ইসলামকে যে জানে না এবং ইসলামের বিধি-বিধান যে মেনে চলে না, মুসলমানের ঘরে জন্মালেও সে প্রকৃত মুসলমান নয়।

হা চাচা, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। এই কয়েকদিন ইসলামী বই পুস্তক পড়ে আমারও তাই মনে হয়েছে।

শুধু নিজে ইসলামকে জানলে ও মানলে হবে না, আস্তে ধীরে খুব হিকমতের সাথে প্রথমে বাসার সবাইকে এবং পরে অন্যান্য মুসলমানদের জানাবার ও মানাবার চেষ্টা করতে হবে। কারণ এটা করাও ইসলামের বিধান।

আমিও সেকথা বুঝতে পেরেছি। ইনশাআল্লাহ সেই চেষ্টাও করব। কিন্তু আমি এখন কি করব বললেন না তো?

তুমি জান কি না জানি না, আমি কিন্তু রিজিয়ার জন্য আমার অফিসের ম্যানেজারকে পছন্দ করেছিলাম। তোমাদের ব্যাপারটা জানার পর মত পাল্টেছি। এখন তোমাকে কিছু করতে হবে না, যা করার আমি করব। তুমি শুধু তোমার দাদাজীকে একদিন এখানে নিয়ে আসবে।

তা নিয়ে আসব, কিন্তু বাবা তো তার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। আমি প্রতিবাদ করেও কাজ হয় নি। মাও বাবার সঙ্গে একমত। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলতে মা বললেন, বিয়ে করতে যদি না চাস, তা হলে ফরেনে উচ্চ ডিগ্রি নিতে যা। তাতেও আমি রাজি না। আমি বলেছি, দেশের গরিব ও সাধারণ মানুষ যাতে অল্প খরচে চিকিৎসা পায়, সেজন্যে চেম্বার করে প্র্যাকটিস করব।

এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া তোমার ঠিক হয় নি। মা-বাবা যখন তোমাকে উচ্চ ডিগ্রি নিতে ফরেনে পাঠাতে চাচ্ছেন তখন তা করাই তোমার উচিত। ফরেনের ডিগ্রি থাকলে গরিব ও সাধারণ মানুষের আরো বেশি উপকার করতে পারবে।

কিন্তু রিজিয়াকে ভুলে যাওয়ার জন্য এটা যে তাদের একটা প্ল্যান, তা আমি জানি। তাই মাকে বলেছি, রিজিয়াকে বিয়ে করে বাসায় রেখে তারপর ফরেনে পড়তে যাব। মাও বাবার মতো রিজিয়াকে বৌ করতে কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। বলেছেন, তোর বাবার বন্ধু বিজনেস ম্যাগনেট। তার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করলে তিনিই তোকে ফরেনে পাঠাবেন এবং ভবিষ্যতে তার সব কিছু তুই ও তার মেয়ে পাবি। বাবা দু’মাসের জন্য কানাডা গেছেন। ফিরে এসে আমার বিয়ে দেয়ার কথা বলে গেছেন। খুব দুশ্চিন্তায় আমার দিন কাটছে।

এই পরিস্থিতি তুমি নিজেই সৃষ্টি করেছ। রিজিয়া পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের এতিম মেয়ে, এসব কথা তোমার মাকে বলে ভীষণ ভুল করেছ। ওসব না বলে যদি রিজিয়ার শুধু বর্তমান ঠিকানা জানিয়ে বলতে, ঐ বাসায় দুটি বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে আছে, তাদের মধ্যে রিজিয়া নামের মেয়েটিকে তুমি পছন্দ কর এবং আমাদেরকে তোমার পরিচয় দিয়ে সব কিছু জানাতে, তা হলে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হত না। যাই হোক, যা হওয়ার হয়েছে। এ নিয়ে তুমি দুশ্চিন্তা করবে না। একটু আগে বললাম না, যা করার আমি করব। তোমার বাবা কানাডা গেছেন। এই ফাঁকে আমি তোমাদের বাসায় গিয়ে তোমার দাদুর সঙ্গে আলাপ করতে পারতাম; কিন্তু তোমার মা আমাকে চিনে ফেলবে। তাই ওনাকে আমার বাসায় নিয়ে আসতে তোমাকে বললাম। এবার আমাকে উঠতে হচ্ছে বলে শিহাব দাঁড়িয়ে পড়লেন।

হিমুও দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

শিহাব সালামের উত্তর দিয়ে চলে যাওয়ার সময় বললেন, তুমি বস, চা খেয়ে যাবে।

স্বামীর পেছন পেছন এসে আরিফা বেগম দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিলেন। স্বামী বেরিয়ে এলে তার সঙ্গে যেতে যেতে বললেন, হিমু খুব সুন্দর ছেলে, কথাবার্তাও খুব ভালো।

শিহাব মৃদু হেসে বললেন, ফাহিমের থেকে ভালো?

আরিফা বেগম এরকম প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। থতমত খেয়ে বললেন, দু’জনেই খুব ভালো।

এবার শিহাব একটু জোরে হেসে উঠে বললেন, তোমাকে হারাতে গিয়ে নিজেই হেরে গেলাম।

ওমা, এতে আবার হার জিতের কি হল?

বাদ দাও ও কথা, ফারিহা ও রিজিয়া কোথায়? ওদের হাতে হিমুর জন্য চা পাঠিয়ে দাও।

আমাকে পাঠাতে হবে না। এতক্ষণে হয়তো ওরা চা নিয়ে চলে গেছে।

বাবা ড্রইংরুমে যাওয়ার পর ফারিহা রিজিয়াকে বলল, চল, আমরা দরজার আড়াল থেকে কি কথাবার্তা হয় শুনব। তারপর দরজার কাছে মাকে দেখে ওরা বারান্দায় এসে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সব কিছু শুনছিল। বাবা চলে যাওয়ার পর রিজিয়া বলল, কিচেনে চা তৈরি আছে তুই গিয়ে নিয়ে আয়, আমি হিমুর কাছে যাচ্ছি।

হুকুম করার স্বভাবটা এবার পাল্টা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে কাকে হুকুম করবি? আমাকে আনতে না বলে নিজে নিয়ে আসতে পারিস না? বলে ফারিহা কিচেনের দিকে চলে গেল।

রিজিয়া তার কথা গায়ে মাখল না। মৃদু হেসে ড্রইংরুমে ঢুকে সালাম দিল।

হিমু সালামের উত্তর দিয়ে বলল, এখানে আসার পর বেশ নার্ভাস ফিল করেছিলাম। তোমার দাদুর সঙ্গে আলাপ করার পর কিছুটা কমে। তারপর তোমার মামার সঙ্গে আলাপ করার সময় সম্পূর্ণ কেটে যায়। সত্যি ওনারা খুব মহৎ।

হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক। মামা ও দাদু মহৎ জানতাম; কিন্তু তোমার সঙ্গে ওনাদের আলাপ শুনে মনে হল শুধু মহৎ নন, খুব উদার মনের মানুষও। তারপর বলল, মামা অফিসের ম্যানেজারকে আমার জন্য পছন্দ করেছেন শোনার পর থকে খুব দুশ্চিন্তায় দিন কাটছিল। তার ওপর তোমাকে বাসায় ডেকে আনার কথা শুনে ভেবেছিলাম, খুব অপমান করে তাড়িয়ে দেবেন। তাই তুমি আসার পর থেকে ভয়ে কাঠ হয়েছিলাম। তারপর দাদুর ও মামার কথা শুনে আনন্দে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছি।

এমন সময় ফারিহা তিনকাপ চা নিয়ে এসে রিজিয়ার শেষের কথা শুনতে পেয়ে বলল, আর আমি যে তোর জন্য এত কিছু করলাম সেটা বুঝি কিছু না? আমি বুঝি কারো কাছ থেকে কিছু পেতে পারি না?

রিজিয়া বলার আগে হিমু বলল, নিশ্চয় পাবে। তোমাকে এমন একটা। জিনিস দেব, যা পেয়ে তুমি ধন্য হয়ে যাবে।

কি এমন জিনিস বলুন তো শুনি।

এখন বলা যাবে না। বললে জিনিসটার কদর তোমার কাছে কমে যাবে। তাই যখন দেব তখন জানতে পারবে কি অমূল্য রত্ন পেয়েছ। এবার তা হলে আসি বলে হিমু উঠে দাঁড়াল।

আরে করেন কি? অত কষ্ট করে আপনার জন্য চা নিয়ে এলাম, না খেয়েই চলে যাবেন?

হিমু বসে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, কথাটা ঠিক বললে কী? আমি খাব এক কাপ আর এনেছ তিন কাপ।

তিন কাপ আনি আর দশ কাপ আনি, উদ্দেশ্যতো আপনার জন্য।

তোমার সঙ্গে তর্কে পারব না বলে হিমু চায়ের খালি কাপ নামিয়ে টেবিলের ওপর রাখল। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে যেতে উদ্যত হলে রিজিয়া বলল, রাতে ফোনের অপেক্ষায় থাকব।

ঠিক আছে বলে হিমু চলে গেল।

ফারিহা বলল, রাতে আবার ফোন করতে বললি কেন? এতক্ষণ কথা বলে সাধ মেটে নি?

তুই তো কারো প্রেমে পড়িস নি, পড়লে এ কথা বলতিস না।

আমার বয়েই গেছে কারো প্রেমে পড়তে। একটা বই-এ পড়েছি, বিয়ের পর যে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের প্রেমে পড়ে, সেই প্রেমই খাঁটি প্রেম। সেই প্রেমে বেহেস্তের সুখ অনুভব হয়। আর যারা আগে প্রেম করে পরে বিয়ে করে, তাদের প্রেম কাচের মতো ঠুনকো। কাচ যেমন সামান্য আঘাতে ফাটল ধরে এবং বড় আঘাতে ভেঙ্গে চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়, তেমনি প্রেম করে যারা বিয়ে করে, তাদের মধ্যে সামান্য কোনো ব্যাপারে মনোমালিন্য হলে সেই প্রেমে ফাটল ধরে এবং বড় কোনো বিষয়ে মনোমালিন্য হলে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।

রিজিয়া হেসে উঠে বলল, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে তুই যেন আগে প্রেম করেও বিয়ে করেছিস, আবার বিয়ে করেও স্বামীর সঙ্গে প্রেম করেছিস।

ফারিহাও হেসে উঠে বলল, তোর মাথায় গোবর আছে। কি করে যে সব পরীক্ষায় আমার থেকে ভালো রেজাল্ট করিস বুঝতে পারছি না। আরে গাধা, সরি, আরে গাধী, কোনো কিছু জানতে হলে শুধু যে বাস্তব অভিজ্ঞতা দরকার তা ঠিক নয়। বিভিন্ন বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা পড়লেও জানা যায়। তুই তো ওসব পড়িস না জানবি কি করে?

রিজিয়া বলল, আমার জানার দরকার নেই। আমি বিয়ের আগে প্রেম করলেও বিয়ের পর সেই প্রেম আরো কত গম্ভীর হয় সবাইকে দেখিয়ে দেব। আর বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে কত গভীর প্রেম করিস তাও দেখব।

ফারিহা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কাজের বুয়াকে আসতে দেখে থেমে গেল।

কাজের বুয়া এসে বলল, এবার আপনারা যান, আমি ঘর গোছাব।

যেতে যেত ফারিহা বলল, আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে দেখব বিয়ের পর তোর কথা ঠিক, না আমার কথা ঠিক।

রিজিয়া বলল, তাই দেখিস।

হিমু বাসায় ফিরে এলে জাহিদ হাসান বললেন, রেজাল্ট শোনাও।

রিজিয়ার দাদু ও মামার সঙ্গে যা কিছু কথাবার্তা হয়েছে হিমু সব কিছু বলল। এমন কি ইসলাম সম্পর্কে শিহাব চাচা যা বলেছিল তাও বলল।

জাহিদ হাসান বললেন, শুনে খুব আনন্দিত হলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, রিজিয়ার সঙ্গে আমার দেখা করার ব্যাপারে আলাপ করিস নি?

জি, করেছি। বললেন, সে ব্যবস্থাও তিনি করবেন।

 শিহাবের অফিসের ফোন নাম্বার জানিস?

জানি, ইনডেক্সে লিখা আছে এক্ষুনি এনে দিচ্ছি বলে হিমু রুমে গিয়ে একটা কাগজে লিখে এনে দাদুর হাতে দিয়ে বলল, বাসার নাম্বারটাও দিলাম।

ঠিক আছে, তুই এবার যা।

.

০৯.

কয়েকদিন অপেক্ষা করেও যখন শিহাব যোগাযোগ করল না তখন জাহিদ হাসান একদিন তার অফিসে ফোন করলেন।

শিহাবের পি.এ. সাওকাত ফোন ধরে বললেন, কে বলছেন?

আমি জাহিদ হাসান, শিহাবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

একটু অপেক্ষা করুন বলে সাওকাত ইন্টারকমে সাহেবকে বললেন, জাহিদ হাসান আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন।

শিহাব বললেন, ঠিক আছে, লাইন দিন। লাইন দেয়ার পর শিহাব সালাম দিয়ে বললেন, চাচা কেমন আছেন?

ভালো, তুমি কেমন আছ?

আল্লাহ ভালোই রেখেছেন। হিমুর কাছে মনে হয় সব কিছু শুনেছেন। আমি যোগাযোগ করব করব করেও কাজের চাপে সম্ভব হয় নি। গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি, এলে খুব খুশি হব।

কাজে খুব ব্যস্ত বললে, অফিসে আলাপ করা যাবে কি? তার চেয়ে বিকেলে আমি তোমার বাসায় আসছি। ক’টায় বাসায় ফিরবে?

পাঁচটায়। আপনি ঐ সময়ে আসুন। গাড়ি পাঠিয়ে দেব।

গাড়ি পাঠাতে হবে না। আমি নিজেই আসব।

তাই আসুন। তারপর সালাম বিনিময় করে শিহাব রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।

.

শিহাব সাড়ে চারটের সময় বাসায় ফিরে স্ত্রী ও শ্বশুরকে জাহিদ হাসানের আসার কথা জানিয়ে কিভাবে হিমুর সঙ্গে রিজিয়ার বিয়ে দেয়া যায় আলাপ করলেন।

জাহিদ হাসান নিজের গাড়িতে করে ঠিক পাঁচটার সময় শিহাবদের বাসায় এলেন।

শিহাব জাহিদ হাসানের আসার কথা দারোয়ানকে বলে বারান্দায় অপেক্ষা করছিলেন। জাহিদ হাসান গাড়ি থেকে নামার পর সালাম বিনিময় করে ড্রইংরুমে এনে বসালেন।

বসার পর জাহিদ হাসান বললেন, প্রায় বিশ বছর আগে তোমার ও রিজিয়ার সঙ্গে এবং তার নানার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছি, সেজন্য আমি খুবই অনুতপ্ত। হিমুর কাছে তোমার ও রিজিয়ার আমার ওপর কোনো ক্ষোভ বা রাগ নেই শুনে বুঝতে পারি তোমরা কত মহৎ, তোমাদের মন কত উদার। তাই তোমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এসেছি। আর রিজিয়াকে নাতবৌ করে ঘরে তোলার জন্য তোমার সঙ্গে আলাপ করতেও এসেছি। রিজিয়ার নানা বেঁচে থাকলে তার কাছেও ক্ষমা চাওয়ার জন্য গ্রামের বাড়িতে যেতাম।

শিহাব বললেন, এ আপনি কি বলছেন চাচা? রিজিয়ার নানা সম্পর্কে যা বললেন, সে ব্যাপারে কিছু বলার নেই। কিন্তু আপনি আমার ও রিজিয়ার কাছে ক্ষমা চাইবেন কেন? রিজিয়া হল আপনার নাতনি। আপনার ওপর তার ক্ষোভ বা রাগ আগে ছিল কি না জানি না, কিন্তু এখন যে কিছুই নেই, তা আমি জানি। সে আপনার পায়ের সেবা করার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। আর আমি হলাম আপনার ছোট ছেলের বন্ধু। বন্ধুর বাবাকে নিজের বাবার মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে হয়, নিজের বাবার মতো সম্মান করতে হয়। পারতপক্ষে আমি আপনার ছেলের মতো। মায়ের কাছে জেনেছি, মা-বাবা অথবা মুরুব্বিদের দোষ-ক্রটি মনে রাখতে নেই। তাই সেদিন মনে খুব ব্যথা পেলেও মনে রাখি নি। তা ছাড়া আমাদের নবী করিম (সঃ) বলেছেন, অপরাধী নিজের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হলে ক্ষমার যোগ্য হয়ে যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন।

জাহিদ হাসান তার কথায় খুব খুশি হয়ে বললেন, রিজিয়াকে ডাক, ওকে দেখার জন্য খুব অস্থিরতা বোধ করছি।

অফিস থেকে এসে শিহাব যখন স্ত্রীকে জাহিদ হাসানের আসার কথা বলছিলেন তখন ফারিহা শুনেছে। তাড়াতাড়ি রিজিয়াকে কথাটা জানিয়ে তারা এতক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়েছিল। তাকে ডাকার কথা শুনে রিজিয়া আর স্থির থাকতে পারল না। একরকম ছুটে এসে এই তো আপনার হতভাগী নাতনি রিজিয়া বলে দাদাজীর দু’পা জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

জাহিদ হাসান হতবাক হয়ে নাতনির মুখের দিকে তাকিয়ে রাকিবের প্রতিচ্ছবি দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না।

কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে রিজিয়া বলল, জ্ঞান হওয়ার পর নানাজীর কাছে ঘটনা শুনে আপনাদের ওপর খুব ক্ষোভ ও রাগ হয়েছিল। এস.এস.সি. পাস করার পর নানাজী যখন কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যাসহ অন্যান্য ইসলামিক বই কিনে দিয়ে পড়তে বললেন তখন সেইসব পড়ে যে শিক্ষা পাই, সেই শিক্ষা মনের সব রকমের ক্ষোভ, রাগ ও দুঃখের কথা ভুলিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকে প্রত্যেক নামাযের পর আল্লাহর কাছে জানাতাম, তিনি যেন আপনাদের ক্ষমা করে দিয়ে আমাকে আপনাদের পায়ের সেবা করার সুযোগ দেন।

জাহিদ হাসান নাতনির মাথায় চুমো খেয়ে পাশে বসিয়ে বললেন, তুমি আল্লাহর খাস বান্দি। তাই তিনি তোমার দোয়া কবুল করে তোমাকে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তারপর শিহাবকে বললেন, আমার আর এক নাতনি কোথায়?

বাবা কিছু বলার আগে ফারিহা ভেতরে ঢুকে এই তো আপনার আর এক নাতনি বলে কদমবুসি করল।

জাহিদ হাসান তার মাথায়ও চুমো খেয়ে বললেন, থাক ভাই থাক। আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক। তোমার কথা হিমুর কাছে অনেক শুনেছি।

এমন সময় আরমান চৌধুরী সেখানে এসে সালাম দিয়ে বললেন, আমি শিহাবের শ্বশুর।

জাহিদ হাসান সালামের উত্তর দিয়ে দাঁড়িয়ে হ্যাঁন্ডসেক করার জন্য ডান হাত বাড়ালেন।

আরমান চৌধুরী দুই হাতে ওনার হাতটা ধরে বললেন, আপনিও দুই হাত দিয়ে আমার হাত ধরুন। ধরার পর বললেন, আমার চোখে চোখ রেখে বলুন আল্লাহুমাগ ফেরলি। অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন। এটাকে মুসাফাহা বলে। মুসাফাহা হল ইসলামী প্রথা। আর হ্যাঁন্ডসেক হল বিধর্মীদের প্রথা। আমরা মুসলমান, আমাদের ইসলামী প্রথাই তো মেনে চলা উচিত, তাই না?

জাহিদ হাসান এসব জানতেন না। তাই লজ্জিত স্বরে বললেন, হ্যাঁ উচিত।

আরমান চৌধুরী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জাহিদ হাসানকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। তারপর দুই নাতনিকে উদ্দেশ করে বললেন, দাদুকে পেয়ে খুশিতে নাস্তা খাওয়াবার কথা ভুলে গেছিস নাকি? যা, তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা কর।

নাস্তা খাওয়ার পর আরমান চৌধুরী নাতনিদের বললেন, তোমরা গিয়ে আরিফাঁকে পাঠিয়ে দাও।

কিছুক্ষণের মধ্যে আরিফা বেগম এসে জাহিদ হাসানের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বাবার পাশে বসলেন।

জাহিদ হাসানকে উদ্দেশ করে আরমান চৌধুরী বললেন, এ হল আমার মেয়ে। তারপর বললেন, আমি শিহাবের কাছে সব কিছু শুনেছি। আপনি তো ইচ্ছা করলে রিজিয়ার আসল পরিচয় ছেলে-বৌমাকে জানিয়ে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।

জাহিদ হাসান বললেন, হ্যাঁ, পারি। কিন্তু আমি তা করব না। কারণ আমার ছেলে-বৌমাকে আমি চিনি। তারা আভিজাত্যের অহঙ্কারে অন্ধ হয়ে আছে এবং ধনী হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুর সমস্ত সম্পত্তির লোভে তার একমাত্র মেয়েকে বৌ করতে চায়। আমি রিজিয়াকে নাতবৌ করে তাদেরকে শিক্ষা দিতে চাই। আর সেইজন্য হিমুর সঙ্গে আলাপ করে একটা প্ল্যানও ঠিক করেছি।

আরমান চৌধুরী বললেন, প্ল্যানটা বলুন।

শিহাবকে আমার ছেলে ও বৌমা চেনে; কিন্তু তারা বাসার ঠিকানা জানে। আমি তাদের কাছে এই ঠিকানা জানিয়ে সুলতানার জন্য প্রস্তাব দেব। রিজিয়ার নতুন নাম হবে সুলতানা। হিমুর মা-বাবাকে এনে রিজিয়াকে দেখাব। হিমুর মা একবার মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য দেখেছে। দেখে যদি রিজিয়াকে চিনে ফেলে তখন বলব, এ রিজিয়া নয়, সুলতানা। অনেক ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়ে দেখতে প্রায় একই রকম হয়। তারপর তারা যাতে রিজিয়াকে বৌ করতে রাজি হয়, সেরকম ব্যবস্থা আমি করব। তবে বিয়ে পড়াবার আগে পর্যন্ত শিহাব তাদের সামনে আসবে না। আর রিজিয়াকে শিখিয়ে দিতে হবে দেখতে এসে তারা যদি নাম জিজ্ঞেস করে তখন যেন নতুন নাম সুলতানা বলে। তারপর বললেন, আমি একজন মুফতির কাছে জেনেছি, বাবা বেঁচে থাকতে ছেলে মারা গেলে ছেলের ঘরের নাতি-নাতনিরা দাদার সম্পত্তি থেকে মাহরুম হয়ে যায়। তবে দাদা ইচ্ছা করলে কিছু সম্পত্তি নাতি-নাতনিকে দিতে পারেন। এটাও ইসলামে জায়েজ আছে। তাই বিয়ের আগে আমি আমার বাড়িটার অর্ধেক অংশ রিজিয়ার নামে লিখে দেব। তা হলে ওদের বিয়ের পর রাগিব রিজিয়ার আসল পরিচয় জেনে যদি ছেলে-বৌকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়, তখন আর তা পারবে না।

আরমান চৌধুরী বললেন, প্ল্যানটা আপনার ভালো। তবে একটু ফাঁক রয়ে গেছে। আমি সেই ফাঁকটা পূরণ করে দিতে চাই।

কি ফাঁক আছে বলুন।

সবার কাছে আমাকে আপনার বন্ধু বলে পরিচয় দেবেন। আর আপনার ছেলে-বৌ যখন লোভী তখন তাদেরকে বলবেন, মেয়ের নানা মা-বাবা হারা নাতনিকে বিয়ের সময় অনেক সোনা তো দেবেনই, নাতজামাইকেও প্রচুর টাকা-পয়সা দেবেন এবং বিয়ের পর তাকে ফরেনে পড়তে পাঠাবেন এবং ফরেন থেকে ফিরে আসার পর একটা ক্লিনিক করে দেবেন।

ফাঁকটা আপনি ঠিকই ধরেছেন, কিন্তু পূরণ করার জন্য যা বললেন, তা হয় না। হিমু আমার বড় ছেলের ঘরের নাতি, আর রিজিয়া ছোট ছেলের ঘরের নাতনি। সোনা-দানা যাই দেন না কেন, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য ব্যাপারে যেসব কথা বললেন, তা মেনে নিতে পারি না। ওটা আমিই করব। রিজিয়ার প্রতি আপনারা যা কিছু এতদিন করেছেন, সেটা আমারই করা কর্তব্য ছিল। তাই আপনাদের কাছে আমি চিরঋণী। এখন যদি এতটুকু না করি, তা হলে সেই ঋণের বোঝা আরো ভারি হয়ে যাবে।

আরমান চৌধুরী বললেন, বেশ, আপনার কথা মেনে নিলাম। আপনার ছেলে কানাডা থেকে ফিরে আসুক, তারপর প্ল্যান মতো কাজ করবেন।

.

১০.

শিহাব আজ দু’দিন হল অসুস্থতার জন্য অফিসে যান নি। দশটার সময় ফাহিম অফিস থেকে ফোন করল।

ফোনের কাছ থেকে ফারিহা রুমে যাচ্ছিল। রিং বাজতে শুনে ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, কে বলছেন?

ফাহিম সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমি অফিসের ম্যানেজার। আপনি কে বলছেন?

ফারিহা ভাবল, বাবা যখন এই ম্যানেজারকে রিজিয়ার জন্য পছন্দ করেছিল তখন নিশ্চয় ছেলেটা ভালো। কতটা ভালো জানার জন্য তার সঙ্গে দুষ্টুমি করার খেয়াল চাপল। বলল, আমি কে জানতে চাচ্ছেন কেন? সাহেবকে চাইলেই তো ল্যাটা চুকে যেত।

তার কথা শুনে ফাহিমের মনে হল মেয়েটা ফাজিল। বলল, আপনি তো আচ্ছা মেয়ে, কে ফোন রিসিভ করল জানতে চাওয়া বুঝি অন্যায়?

আপনিও তো আচ্ছা ছেলে, মেয়েদের সঙ্গে কিভাবে কথা বলতে হয়, সেই ভদ্রজ্ঞানটাও নেই আপনার!

ফাহিম খুব বিরক্ত হল। বলল, আপনার পরিচয় জানতে চেয়ে ভুল করেছি, মাফ করে দিন।

হাতের কাছে গজ ফিতে নেই, মাপ করব কি করে?

ফাহিম চিন্তা করল, মেয়েটার মাথার স্কু ঢিলে নাকি? মোলায়েম স্বরে বলল, প্লিজ, সাহেবকে একটু দিন না, জরুরি কথা আছে।

হ্যাঁ, এতক্ষণে ভদ্রলোকের মতো সরি, ভদ্রলোকের ছেলের মতো কথা বললেন। একটু অপেক্ষা করুন দিচ্ছি।

ফাহিম বুঝতে পারল মেয়েটি সাহেবের।

ফারিহা সেটটা নিয়ে বাবার ঘরে গিয়ে বলল, তোমার অফিসের ম্যানেজার ফোন করেছেন।

শিহাব ফোন ধরে বলল, কি খবর ফাহিম?

ফাহিম সালাম বিনিময় করে বলল, আপনি কেমন আছেন? আজও কি অফিসে আসবেন না?

না, অফিসে যেতে পারব না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এনি প্রবলেম?

না মানে, স্টাফদের আজ বেতনের দিন। তাই একাউন্টেন্ট বলছিলেন

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে শিহাব বললেন, তাই তো, আমার সে কথা একদম মনে নেই। তুমি একটা স্কুটার নিয়ে চলে এস। আমি চেক সই করে দেব। তারপর লাইন কেটে দিয়ে মেয়েকে বললেন, এটা নিয়ে যা। আর শোন, কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যানেজার আসবে। তুই দারোয়ানকে ম্যানেজারের আসার কথা বলে গেটের দিকে লক্ষ্য রাখবি। ম্যানেজার এলে আমার কাছে নিয়ে আসবি।

ফারিহা অবাক হয়ে বলল, তোমার বেডরুমে কেন? ড্রইংরুমে বসালেই তো হয়?

শিহাব মৃদু হেসে বললেন, আগের ম্যানেজার হলে ড্রইংরুমেই বসাতে বলতাম। কিন্তু ফাহিমকে বসানো যাবে না।

তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না। কত সম্মানীয় মেহমানকে ড্রইংরুমে বসান গেলে ওঁনাকে বসানো যাবে না কেন?

শিহাব মেয়ের কথায় বিরক্ত হলেন। কিন্তু তা প্রকাশ না করে বললেন, তুই তো খুব বাকপটু হয়ে উঠেছিস?

কোনো কিছু জানতে চাওয়া কি বাকপটুতা?

না তা নয়। তবে কি জানিস মা, বাবা অথবা মুরুব্বিদের কেউ কোনো হুকুম করলে তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করতে নেই। করলে বেয়াদবি করা হয়। আর বেয়াদবকে যেমন কেউ দেখতে পারে না, তেমনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) বেয়াদবকে পছন্দ করেন না। ফাহিমের ব্যাপারে এতটুকু জেনে রাখ, সে আমার শুধু প্রিয় নয়, ডান হাতও। এবার যা, যা বললাম কর।

ফারিহা সেটটা আগের জায়গায় রেখে দারোয়ানকে ম্যানেজারের আসার কথা জানাল। তারপর গেটের দিকের বারান্দায় একটা চেয়ারে বসে চিন্তা করল, বাবার একজন প্রিয় ছেলের সঙ্গে দুষ্টুমি করা উচিত হয় নি। এলে মাফ চেয়ে নিতে হবে। আরো চিন্তা করল, ওঁর মধ্যে নিশ্চয় এমন কোনো গুণ আছে, যে জন্যে বাবার শুধু প্রিয় নয়, ডান হাতও। রিজিয়ার সঙ্গে বিয়ে হলে বাবা বোধহয় খুব খুশি হত। মা বলল, ছেলেটা দেখতে খুব সুন্দর। ছেলেটার মা-বাবা ভাইবোন আছে কি না কে জানে। হঠাৎ তার মন বলে উঠল, রিজিয়ার সঙ্গে বিয়ে হলে যদি তোর বাবা খুশি হতেন, তোর সঙ্গে বিয়ে হলে তোর বাবা আরো বেশি খুশি হবে। মনের কথা শুনে ফারিহা এত গভীরভাবে চিন্তা করছিল যে, বাস্তবজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। পুরুষ কণ্ঠের সালাম শুনে চমকে উঠে বাস্তবে ফিরে দেখল, একটা সুদর্শন যুবক তার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবল, ইনি ম্যানেজার নয়তো? কথাটা মনে হতে লজ্জায় তার মুখটা লাল হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি গায়ে-মাথায় ওড়নাটা ভালো করে জড়িয়ে বলল, আপনি?

আমি ফাহিম। সাহেব আমাকে আসতে বলেছেন। তারপর বলল, আমি কিন্তু আপনাকে সালাম দিয়েছি।

আরো লজ্জা পেয়ে ফারিহা মুখ নিচু করে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, সরি, একটু অন্যমনস্ক ছিলাম, তাই শুনতে পাই নি।

আপনার পরিচয় দিলেন না তো?

সাহেবের মেয়ে বলতে গিয়ে সামলে নিয়ে বলল, আমি ফারিহা। আসুন আমার সঙ্গে। তারপর তাকে বাবার রুমে নিয়ে এসে বলল, বাবা, ম্যানেজার সাহেব এসেছেন।

ফাহিম ভেতরে ঢুকে সালাম দিল।

শিহাব সালামের উত্তর দিয়ে সোফায় বসতে বলে বললেন, ডাক্তার কয়েকদিন অফিসে যেতে নিষেধ করেছেন। তবে তোমার কোনো চিন্তা নেই। যখনই প্রয়োজন মনে করবে চলে আসবে।

ফারিহা চেকবই বের করে দাঁড়িয়েছিল। শিহাব তার হাত থেকে নেয়ার সময় ফাহিমকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার বড় মেয়ে ফারিহা, পরিচয় হয়েছে?

ফাহিম বলল, জি হয়েছে।

শিহাব চেক কেটে ফাহিমের হাতে দিয়ে বইটা ফারিহাকে দিয়ে ব্রিফকেসে রাখতে বললেন।

ফারিহা চেকবই ব্রিফকেসে রেখে বেরিয়ে এসে ফাহিমের কাছে ক্ষমা চাইবে বলে বারান্দায় অপেক্ষা করতে লাগল।

ফাহিম চেকটা পকেটে রেখে বলল, এবার তা হলে আসি স্যার?

শিহাব বললেন, যাবে তো নিশ্চয়, আর একটু বস। একটা কথা বলব। তোমাকে আর ভাড়া বাসা খুঁজতে হবে না। শান্তিনগরে আমার একটা বাড়ি আছে। সামনের মাসে দোতলার ভাড়াটিয়া চলে যাবেন। তুমি মাকে নিয়ে ঐ ফ্লাটে থাকবে। কোম্পানি তোমার বাসা ভাড়া বহন করবে।

ফাহিম মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, জি আচ্ছা। এবার অনুমতি দেন।

ঠিক আছে এস, বলে শিহাব মেয়ের নাম ধরে ডেকে বললেন, কোথায় গেলি রে মা, ফাহিমকে এক কাপ চাও দিলি না?

ফাহিম বলল, আমি খুব কম চা খাই। অফিস থেকে বেরোবার আগে খেয়েছি। এখন আর খাব না।

বারান্দা থেকে ফারিহা তাদের কথা শুনতে পাচ্ছিল। বাবা ডাকতে ততক্ষণে দরজার কাছে চলে এসেছে।

তাকে দেখে শিহাব বললেন, ফাহিম চা খাবে না বলছে। ফ্রিজ থেকে কোক দে। তারপর ফাহিমকে বললেন, তুমি ওর সঙ্গে যাও, কোক খেয়ে তারপর যাবে।

ফারিহা তাকে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে বসতে বলে ভেতরে চলে গেল। একটু পরে এক গ্লাস কোক এনে তার হাতে দেয়ার সময় বলল, আপনি ফোন করেছিলেন জানতাম না। ফোনে আপনার সঙ্গে অবাঞ্ছিত ব্যবহার করে ফেলেছি। সেজন্য অত্যন্ত দুঃখিত। দয়া করে মাফ করে দিন।

ফাহিম বিসমিল্লাহ বলে গ্লাসে দু’তিনটে চুমুক দিয়ে মৃদু হেসে বলল, আমি আপনার বাবার অফিসের একজন কর্মচারী। সাহেবের ছেলে-মেয়েদের অনেক কিছু যে সহ্য করতে হয় তা জানি, তাই কিছু মনে করি নি।

আমি ওসব কথা শুনব না, বলুন মাফ করে দিয়েছেন?

ফাহিম আবার মৃদু হেসে বলল, তা হলে তো আপনার কথাটাই বলতে হয়, কাছাকাছি গজ ফিতে নেই, মাপ করব কি করে?

ফারিহা না হেসে পারল না। হাসতে হাসতে বলল, আপনি তো দারুণ ছেলে?

ফাহিম বলল, আমার তো মনে হচ্ছে, আপনি আমার থেকে আরো দারুণ।

প্রমাণ করুন।

পর্দানশীন হয়েও প্রথম আলাপের সময় যে মেয়ে এত ফ্রি, তিনি দারুণ নয় তো কি?

ফারিহা হাসি মুখেই বলল, তা হলে মাফ করছেন না কেন?

আপনার পুরো নাম অথবা আসল নাম বললে মাফ করতে পারি।

আমি দারুণ মেয়ে হলে আপনি দারুণ চালাক ছেলে।

কি জানি, হয়তো আপনার কথা ঠিক বলে ফাহিম খালি গ্লাস টেবিলের উপর রেখে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, অনেক দেরি হয়ে গেল, এবার আসি।

ফারিহাও দাঁড়িয়ে উঠে বলল, মাফ করেছেন কি না বলবেন না?

বললাম না, পুরো অথবা আসল নাম…

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ফারিহা বলল, পুরো অথবা আসল নাম ফারিহা শাহানা।

নামের অর্থ জানেন?

জি, সুখী শাহজাদী। আপনার পুরো নাম অথবা আসল নাম বলুন।

ফাহিম মৃদু হেসে বলল, আমার পুরো অথবা আসল নাম ফাহিম শাহরিয়ার। অর্থ হল বুদ্ধিমান বাদশাহ।

ফারিহা শুধু হেসে উঠল, কোনো কথা বলল না।

হাসলেন কেন?

আমার পুরো নাম ও অর্থ শুনে আপনি যে কারণে হেসেছিলেন, ঐ একই কারণে আপনার পুরো নাম ও অর্থ শুনে হাসলাম। এবার আসুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে বললেন না!

ফাহিম সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

ফাহিমের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর শিহাব স্ত্রীকে তার আসার কথা জানিয়ে বলেছিলেন, ফারিহার সঙ্গে পরিচয় করবার জন্য ওকে নিয়ে আসব আসব করেও মনে থাকে না বলে আনা হয় নি। আজ যখন আসছে তখন পরিচয় করিয়ে দিতে হবে এবং ওরা যাতে নিরিবিলি আলাপ করতে পারে সে ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে। কারণটা তো তুমি জান।

আরিফা বেগম বললেন, বেশ তো কি করতে হবে বল?

যা করার আমি করব। তুমি শুধু রিজিয়াকে কাজের অজুহাতে নিজের কাছে রাখবে।

ঠিক আছে, তাই হবে।

ফাহিম যখন ফোন করে রিজিয়া তখন বাথরুমে গোসল করছিল। তাই তার আসার কথা জানতে পারে নি।

গোসল করার পর স্বামীর কথামতো আরিফা বেগম তাকে রান্নাঘরে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, আমার হাত দুটো ব্যথা করছে। ওষুধ খেয়েও কমে নি। তুই আজ রান্না কর, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

রান্নার কাজ শেষ করতে অনেক সময় লাগল। তাই রিজিয়া ফাহিমের আসার কথা যেমন জানতে পারে নি, তেমনি ফাহিমও ফারিহার আলাপের কথাও জানতে পারল না। তবে তখনও ওদের আলাপ চলছিল।

রান্নার কাজ শেষ করে রুমে এসে ফারিহাকে দেখতে না পেয়ে মামিকে জিজ্ঞেস করল, ফারিহা কোথাও গেছে নাকি?

আরিফা বেগম বললেন, না যাই নি। অফিসের ম্যানেজার তোর মামার কাছে এসেছিল। তার সঙ্গে ড্রইংরুমে কথা বলছে। তুই যেন আবার ওখানে যাস না।

রিজিয়া মামির চোখে-মুখে খুশির আমেজ দেখতে পেল। সেই সাথে ড্রইংরুমে যাওয়ার নিষেধের মধ্যে কিছু যেন ইঙ্গিত রয়েছে বুঝতে পারল। হঠাৎ তার মনে হল, তা হলে কি ম্যানেজারকে ফারিহার জন্য সিলেক্ট করেছেন। ম্যানেজারকে দেখার ইচ্ছা দমন করতে পারল না। দরজার আড়াল থেকে দেখলে মামিমা দেখে ফেলতে পারেন ভেবে বারান্দার জানালার কাছে গিয়ে পর্দা অল্প একটু ফাঁক করে ফাহিমকে দেখে ভাবল, মামা এই ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেয়ার জন্য পছন্দ করেছিলেন। তারপর এতক্ষণ তাদের আলাপ শুনছিল। ফাহিম চলে যাওয়ার পর ভেতরে ঢুকে না জানার ভান করে জিজ্ঞেস করল, কে রে ছেলেটা? দেখতে শাহজাদার মতো।

তার কথা শুনে ফারিহা অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে বলল, বাবার অফিসের ম্যানেজার। বাবা ইনাকেই তোর জন্য পছন্দ করেছিল। সত্যি, ছেলেটা খুব সুন্দর।

রিজিয়া হেসে উঠে বলল, শুধু কি সুন্দর? দারুণ হ্যাঁন্ডসাম ও দারুণ বুদ্ধিমান।

ফারিহা এবার অবাক হয়ে বলল, তুই এসব জানলি কি করে?

কারো চোখ-মুখ দেখলেই বোঝা যায় বোকা না বুদ্ধিমান। আর কথাবার্তা শুনলে জানা যায়, শুধু বুদ্ধিমান না দারুণ বুদ্ধিমান। তোর সঙ্গে মিলবে ভালো। তুই সুন্দরী, উনিও সুন্দর, তুই যেমন বুদ্ধিমতী, উনিও তেমনি বুদ্ধিমান, তুই সুখী শাহজাদী, উনি বুদ্ধিমান বাদশাহ। ওনাকে যদি তোর পছন্দ হয় বল, মামা-মামিকে শুভস্য শীঘ্রম করতে বলব।

তুই তা হলে আড়াল থেকে সব কিছু শুনেছিস।

শুধু শুনেছি নয়, তোদের কথা বলার এ্যাকটিংও দেখেছি।

তারপর রিজিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি বলছি, তোদের দু’জনকে যা মানাবে না…

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তার পিঠে কয়েকটা আদরের কিল মেরে বলল, এসব আজেবাজে কথা বলছিস কেন?

এটা আজেবাজে কথা হল বুঝি? কিল মারিস আর যাই করিস তোর চোখ-মুখ দেখে ও কথা শুনেই বুঝতে পারছি ম্যানেজারকে তোর পছন্দ হয়েছে। তুই আমার জন্য তোর মা-বাবার কাছে ওকালতি করেছিস। এবার আমি তোর জন্য মামা-মামির কাছে ওকালতি করব। দেখিস, যেমন করে হোক ওনাদের রাজি করাবই ইনশাআল্লাহ।

তুই জড়িয়ে রয়েছিস কেন? ছেড়ে দে, গোসল করব। তুই তো আগেই গোসল করে ফেলেছিস।

রিজিয়া ছেড়ে দিয়ে বলল, পছন্দ হয়েছে কি না বললি না যে?

ফারিহা বলল, আজই প্রথম দেখলাম ও আলাপ করলাম, এখনই কিছু বলা যাবে না বলে সেখান থেকে চলে গেল।

অনুমানটা ঠিক কিনা জানার জন্য রিজিয়া মামিমার কাছে গিয়ে বলল, একটা কথা বলব কিছু মনে করবেন না বলুন?

আরিফা বেগম বললেন, ওমা, মেয়ের কথা শোন, তোর কথায় কিছু মনে করতে যাব কেন? বল কি বলবি?

আপনি ড্রইংরুমে যেতে নিষেধ করেছিলেন বলে আড়াল থেকে ম্যানেজারকে দেখেছি। খুব সুন্দর ছেলে, বলে লজ্জায় মুখ নিচু করে নিল।

আরিফা বেগম মৃদু হেসে বললেন, হ্যাঁ, খুব সুন্দর ছেলে। তোর মামা ছেলেটার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাই তোর জন্য পছন্দ করেছিল। আর কিছু বলবি?

রিজিয়া সাহস করে বলে ফেলল, এখন ফারিহার জন্য পছন্দ করলে হয় না মামিমা?

আরিফা বেগম তার কথা শুনে অবাক হলেও খুশি হলেন। পছন্দ করলে তুই খুশি হবি?

রিজিয়া মামিমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, এত খুশি হব, যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।

আরিফা বেগম তার দু’গালে চুমো খেয়ে বললেন, তোর ও হিমুর ব্যাপারটা জানার পর আমি ও তোর মামা ম্যানেজারকে ফারিহার জন্য সিলেক্ট করেছি। তাদের বিয়ের পরপরই ওদের বিয়ে দেব।

আনন্দে টগবগিয়ে উঠে রিজিয়া আবার মামিমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, সত্যি বলছেন মামিমা?

আরিফা বেগম হাসতে হাসতে বললেন, হ্যাঁরে সত্যি।তারপর বললেন, মেয়ের কাণ্ড দেখ, ছাড় ছাড়, তোর মামাকে খেতে দেব।

রিজিয়া মামিমাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে রুমে এসে দেখল, ফারিহা নেই। বুঝতে পারল, গোসল করতে গেছে। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বারান্দা থেকে ফোনের সেটটা নিয়ে এসে হিমুকে ফোন করল।

হিমু রুমেই ছিল। ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, কে বলছেন?

রিজিয়া সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করল, চিনতে পারছ, না নাম বলতে হবে?

কি ব্যাপার? এ সময়ে ফোন করলে যে?

একটা দারুণ খবর আছে।

দারুণ খবরের পালা তো শেষ। আর তো থাকার কথা না?

আমাদের শেষ হলেও ফারিহার বাকি আছে না?

ও হ্যাঁ, তাই তো। ফারিহা কি কারো প্রেমে পড়েছে?

রিজিয়া হেসে উঠে বলল, ঠিক প্রেমে পড়ে নি, পছন্দ করেছে। শুধু তাই নয়, মামা-মামি ঐ ছেলেটাকে সিলেক্ট করে ফেলেছেন এবং আমাদের বিয়ের পরপরই ওদেরও বিয়ে দেবেন।

খবরটা তুমি কার কাছে শুনেছ?

মামিমার কাছে।

তা ছেলেটাকে চেন নাকি?

হ্যাঁ, মামার অফিসের ম্যানেজার। আমার জন্য যাকে মামা পছন্দ করেছিলেন।

তাই নাকি? তা হলে তো খবরটা সত্যিই দারুণ। আচ্ছা সিলেক্টের ব্যাপারটা কি ফারিহা জানে?

না। এমনকি আমি যে জানি, তাও ফারিহা জানে না। তাই তো জানার পরপরই তোমাকে ফোন করলাম। শোন, তুমি তো ফারিহাকে খুব মূল্যবান কিছু দেবে বলেছিলে, এই দারুণ খবরটা তাকে দিলে কেমন হয়?

খুব ভালো কথা বলেছ। কি বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দেব?

থাক, ধন্যবাদ দিতে হবে না, তোমার সাক্ষাৎ পেলেই ধন্য হয়ে যাব।

সাক্ষাৎ তো প্রায় রোজই হচ্ছে।

 যাতে ভুলে না যাও, তাই রিমাইন্ড দিলাম।

ঠিক আছে, ভুলব না, এবার রাখি, সাক্ষাতে কথা হবে বলে হিমু সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।

.

১১.

রাগিব হাসান কানাডা থেকে ফিরে আসার পর জাহিদ হাসান একদিন ছেলে ও বৌমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হিমুর ব্যাপারে কি চিন্তা-ভাবনা করলে?

রাগিব হাসান বললেন, ওকে ফরেনে পাঠাতে চাই। কিন্তু ও তো রাজি হচ্ছে না। বলছে চেম্বার করে দাও প্র্যাকটিস করব।

ফরেনের ডিগ্রি না থাকলে আজকাল সাধারণ মানুষরাও শুধু। এম.বি.বি.এস. ডাক্তারের কোনো দাম দেয় না। ওকে সে কথা বল নি?

বলেছি। শুনে বলল, আমি টাকা রোজগার করার জন্য ডাক্তার হই নি। সাধারণ ও গরিব মানুষেরা যাতে সহজে ও অল্প খরচে চিকিৎসা করতে পারে, সেজন্য ডাক্তার হয়েছি।

ওর উদ্দেশ্য মহৎ। তাই বলে উচ্চ ডিগ্রি নিতে ফরেনে যাবে না এটা ঠিক বলে নি। ঠিক আছে, আমি ওকে বোঝাব। আর শোন, আমি ওর জন্য ধনী ও সম্ভ্রান্ত ঘরের খুব ভালো একটা মেয়েকে অনেক দিন থেকে পছন্দ করে রেখেছি। মেয়েটি এ বছর ডিগ্রি পরীক্ষা দেবে। মা-বাবা নেই। নানা-নানি মানুষ করেছে। মেয়ের নানা, আমার বন্ধু। মেয়ে দেখতে খুব সুন্দরী বলে অনেক সম্বন্ধ আসছে। সে কথা জানিয়ে আমাকে খবর দিয়েছিল। আমি একদিন গিয়ে বলেছি, হিমু ফরেন থেকে উচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আসুক, আর আপনার নাতনি ততদিন মাস্টার্স কমপ্লিট করুক। উনি রাজি হলেন না। বললেন, আজকাল সমাজের অবস্থা ভালো না। বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে ছেলে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মেয়ের মুখে এসিড মারে। মেয়েকে হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে। তাই এ বছরই আমি নাতনির বিয়ে দিতে চাই। আরো বললেন, বিয়ের পর নাতজামাইকে ফরেনে পাঠাবেন। বিয়ের সময় প্রচুর সোনা-দানা দেবেন এবং ফরেন থেকে ফিরে আসার পর চেম্বার নয়, একটা ক্লিনিকও করে দেবেন। এখন তোমরা কি বল?

রাগিব হাসান ও সাবিহা বেগম তাদের ইচ্ছার কথা বলতে না পেরে চুপ করে রইলেন।

জাহিদ হাসান ছেলে ও বৌমার ইচ্ছার কথা হিমুর কাছে শুনেছেন। তবু বললেন, তোমরা কিছু বলছ না কেন?

স্বামী বলার আগে সাবিহা বেগম বললেন, আপনার ছেলে বন্ধুকে কথা দিয়েছেন, তার একমাত্র মেয়েকে এ বাড়ির বৌ করে আনবেন।

হিমু কি সেই মেয়েকে দেখেছে?

জি।

সে কি রাজি আছে?

হা-না কিছু বলতে না পেরে সাবিহা বেগম চুপ করে রইলেন।

কি হল? রাজি আছে কি না বলছ না কেন?

ধনী লোকের একমাত্র সন্তান বলে মেয়েটি একটু আধুনিকা ও আদুরে। তাই হিমু একটু অমত করেছে। আমি বলেছি, মেয়েরা বাবার বাড়িতে যাই থাকুক না কেন, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে বদলে যায়। এ কথা শুনে হিমু কি বলল?

ঠিক রাজি হয় নি। তবে আমি তাকে বুঝিয়ে রাজি করাব। আপনিও একটু বোঝাবেন।

স্ত্রী থেমে যেতে রাগিব হাসান বললেন, হ্যাঁ বাবা, আপনি বোঝালে হিমু করতে পারবে না।

জাহিদ হাসান বললেন, যেদিন তোমরা ওকে মেয়ে দেখাবার জন্য বন্ধুর বাসায় নিয়ে গিয়েছিলে তার পরের দিন কথাটা আমাকে জানিয়ে বলেছে, মেয়েটি দেখতে ভালো হলে কি হবে, ভীষণ আল্টা মডার্ন। অশ্লীল পোশাক পরে। তার অনেক বয়ফ্রেন্ড। তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে। লজ্জা-শরমের বালাই নেই। মা-বাবা যতই বলুক, আমি ঐ মেয়েকে কিছুতেই বিয়ে করব না।

রাগিব হাসান ছেলের ওপর খুব রেগে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে রাগ সামলে নিয়ে বললেন, আজকাল হাই সোসাইটির ছেলেমেয়েদের অনেক গার্লফ্রেন্ড ও বয়ফ্রেন্ড থাকে। আর আজকাল কটা ছেলেমেয়ে শালীনতা বজায় রেখে পোশাক পরে? তারা এটাকে সভ্য যুগের ফ্যাশন মনে করে। আসলে ওতো কোনো এক পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের এতিম মেয়েকে পছন্দ করে। সেইজন্যে অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছে না।

সে কথা আমাকেও বলেছে। তবে সে মেয়ের খোঁজ আজও পাই নি। কিছুদিন আগে নাকি আড়ং-এ সেই মেয়েকে দেখেছিল, কিন্তু আলাপ করার আগেই সঙ্গের মেয়েটির সঙ্গে গাড়িতে উঠে চলে যায়। হিমু গাড়ির নাম্বার মনে রাখে। তারপর বাসায় এসে আমাকে মেয়েটির সব কথা বলে গাড়ির নাম্বার একটা কাগজে লিখে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিভাবে এই নাম্বারের গাড়ির মালিকের ঠিাকানা পাব। আমি নাম্বার দেখে বললাম, এটা তো আমার বন্ধুর গাড়ির নাম্বার। তার তো দু’টো নাতনি। একটা মেয়ের ঘরের অন্যটা ছেলের ঘরের। হিমু বিশ্বাস করল না। একদিন তাকে নিয়ে বন্ধুর বাসায় গিয়ে দু’জনকেই দেখালাম। হিমু যে মেয়েটির কথা বলল, সে হল বন্ধুর মেয়ের ঘরের নাতনি। তার নাম সুলতানা। ফেরার পথে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়ে বললাম, পাড়াগাঁয়ের যে মেয়েকে তুমি পছন্দ কর, এতদিনে তার হয়তো বিয়ে-শাদি হয়ে ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। সুলতানা যখন তার মতো দেখতে ওকেই বিয়ে কর। তারপর বাসায় এসে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। এখন তোমাদের মতামত পেলে তাড়াতাড়ি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। দেরি করলে হিমুর মত পাল্টে যেতে পারে। তারপর সাবিহা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বৌমা, তুমিও তো সেদিন আড়ং-এ মেয়েটাকে দেখেছ?

সাবিহা বেগম মেয়ের নানার লেনদেনের কথা শুনে সুলতানাকেই বৌ করতে রাজি হয়ে গেলেন। আনন্দিত স্বরে বললেন, জি বাবা দেখেছি। আমিও সেদিন হিমুকে বলেছিলাম, অনেক সময় একই রকমের ছেলে বা মেয়ে দেখতে পাওয়া যায়। এখন হিমু যদি আপনার বন্ধুর নাতনিকে বিয়ে করতে রাজি হয়, তা হলে আমাদের আপত্তি করার কিছু নেই। তারপর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি বল?

রাগিব হাসান স্ত্রীর কথা শুনে রেগে গেলেন। রাগের সঙ্গে বললেন, ওর বিয়ের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। বাবা ও তুমি যা করার কর। আমাকে একটু বেরোতে হবে বলে সেখান থেকে চলে গেলেন।

.

আজ হিমুর বিয়ে। মেয়ে দেখা ও বিয়ের কথাবার্তার মধ্যে কোনো গোলমাল হল না। কিন্তু বিয়ের সময় কাজী সাহেব মেয়ের ও মেয়ের বাবার নাম-ঠিকানা জানতে চাইলে আরমান চৌধুরী যখন মেয়ের নাম সুলতানা রিজিয়া, বাবার নাম মরহুম রাকিব হাসান ও জাহিদ হাসানের বাসার ঠিকানা বলে জাহিদ হাসানকে বললেন, দেনমোহর বাবদ আপনার বাড়ির অর্ধেক অংশ আমার নাতনির নামে করে দেয়ার দলিলটা দেন এবং জাহিদ হাসান দলিলটা দিলেন তখন রাগিব হাসান যতটা না অবাক হলেন তার চেয়ে অনেক বেশি রেগে গেলেন। রাগের সঙ্গে জাহিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, এসব কি শুনছি ও দেখছি বাবা?

জাহিদ হাসান বললেন, যা শুনছ ও দেখছ সব সত্য। এই সুলতানা রিজিয়াই তোমার ছোট ভাই রাকিব হাসানের সন্তান। দৈবচক্রে বন্ধুর গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে একেই দেখে হিমু পছন্দ করে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য তখন সে জানত না রিজিয়া তার ছোট চাচার মেয়ে। পরে তার বংশ পরিচয় খোঁজ করতে গিয়ে জানতে পারে। যখন দু’বছরের রিজিয়াকে তার নানা ও রাকিব হাসানের বন্ধু শিহাব আমাদের কাছে দিতে এসেছিল তখন আমরা আভিজাত্যের অহঙ্কারে এতই অন্ধ ছিলাম যে, তাদের কথা সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আল্লাহ আমাদের অহঙ্কার চূর্ণ করে সেই রিজিয়াকে সুলতানা করে অর্থাৎ সম্রাজ্ঞী করে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থার করেছেন। তারপর শিহাবকে ডেকে আনার জন্য একজনকে বললেন। শিহাব আসার পর আবার ছেলেকে বললেন, দেখো তো একে চিনতে পার কি না?

শিহাব বন্ধু হিসাবে অনেকবার রাকিবদের বাসায় গেছেন। সেই সময় তাকে রাগিব হাসান দেখেছেন। তাই দাড়ি ও টুপিওয়ালা শিহাবকে চিনতে পারলেন। বললেন, হ্যাঁ চিনতে পারছি।

জাহিদ হাসান বললেন, আমরা আমাদের বংশের সন্তানকে ফিরিয়ে দিলেও এই শিহাবই বন্ধুর সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছে। আবার এত টাকা-পয়সা খরচ করে বিয়েও দিচ্ছে। আর তুমি অর্থের লোভে বন্ধুর গোল্লায় যাওয়া মেয়েকে ঘরের বৌ করতে চেয়েছিলে?

রাগিব হাসান নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় ও অপমানে মুখ নিচু করে নিলেন।

তাই দেখে শিহাব বললেন, চাচাজান, সবার সামনে ভাইয়াকে এসব কথা বলা ঠিক হয় নি আপনার। বাসায় গিয়ে বলতে পারতেন।

জাহিদ হাসান চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, তা আমিও জানি। তবু কেন বললাম, তা যাদের বোঝার ক্ষমতা আছে তারা বুঝতে পেরেছেন। আর যারা বুঝতে পারেন নি, তাদেরকে শুধু এতটুকু বলছি, আমারও তখন আভিজাত্যের অহঙ্কার ছিল। আর অহঙ্কার খুব শক্ত গুনাহ। যার অহঙ্কার থাকবে, একদিন না একদিন আল্লাহ তার অহঙ্কার চূর্ণ করে দেবেন। যেমন আজ আমাদের চূর্ণ করে দিলেন। তারপর রাগিব হাসানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি আগেই শিহাবের কাছে মাফ চেয়ে নিয়েছি। রিজিয়ার নানা বেঁচে থাকলে তার কাছেও মাফ চেয়ে নিতাম। তুমিও শিহাবের কাছে মাফ চেয়ে নাও।

রাগিব হাসান অনুতপ্ত হয়ে এতক্ষণ মুখ নিচু করে চোখের পানি ফেলছিলেন। বাবার কথা শুনে শিহাবকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমাকে মাফ করে দে ভাই।

শিহাব বললেন, আপনি আমার বড় ভাই। ছোট ভাইয়ের কাছে মাফ চেয়ে নিজেকে ছোট করবেন না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুন। তিনি আজ আমাদের সবাইকে যে এই শুভ মজলিশে মিলিত করিয়েছেন এবং আমাদের ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়েছেন, সেজন্য তার পাক দরবারে জানাচ্ছি শতকোটি শুকরিয়া। আর তার পেয়ারা হাবিব (সঃ)-এর ওপর হাজার হাজার দরুদ ও সালাম পেশ করছি।

জাহিদ হাসান কাজি সাহেবকে বললেন, এবার বিয়ে পড়িয়ে দিন।

লেখক: কাসেম বিন আবুবাকারবইয়ের ধরন: উপন্যাস
কালোমেয়ে - কাসেম বিন আবুবাকার

কালোমেয়ে – কাসেম বিন আবুবাকার

কিশোর কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের বিশ্বনবী (সা.) - কাসেম বিন আবুবাকার

কিশোর কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের বিশ্বনবী (সা.) – কাসেম বিন আবুবাকার

অমর প্রেম - কাসেম বিন আবুবাকার

অমর প্রেম – কাসেম বিন আবুবাকার

আমিও মানুষ - কাসেম বিন আবুবাকার

আমিও মানুষ – কাসেম বিন আবুবাকার

Reader Interactions

Comments

  1. Bangla Pdf Book

    April 13, 2020 at 2:19 pm

    Very Socialistic.

    Reply

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.