• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

কিরীটী অমনিবাস ১৫ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

লাইব্রেরি » নীহাররঞ্জন গুপ্ত » কিরীটী অমনিবাস ১৫ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

কিরীটি অমনিবাস ১৫ (পঞ্চদশ খণ্ড) – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
মিত্র ও ঘোষ পাবলিসার্স প্রাঃ লিঃ
প্রথম প্রকাশ : ফাল্গুন ১৩৯২
প্রথম ‘মিত্র ও ঘোষ’ সংস্করণ : ভাদ্র ১৩৯৯
তৃতীয় মূদ্রণ : শ্রাবণ ১৪০৮
প্রচ্ছদ : আশু বন্দ্যোপাধ্যায়

.

সূচীপত্র :
যুগলবন্দী
সামনে সমুদ্র নীল
মানসী তুমি
অবগুণ্ঠিতা

.

ভূমিকা

আমার কবুল করতে দ্বিধা নেই যে ধরনের লেখা নিয়ে নিজেকে আমি নিয়োজিত করে রেখেছি তাতে উত্তেজনাপূর্ণ রহস্য-রোমাঞ্চের আতঙ্ক ভয় উৎকণ্ঠা বিস্ময় কৌতূহল আমাকে তেমন টানে না, বর্তমানে ইলেকট্রনিক সমাজ-সভ্যতায় মানুষের রক্তকণিকায় এমনিতেই টেক্স ও উত্তেজনা হৃৎপিণ্ডে রক্তবাহী শিরা আটকে ধরেছে, তার ওপর এই কাল্পনিক আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা তাকে মৃত্যুর সীমায় নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সাহিত্যের একটা বৈশিষ্ট্য, কল্পনাই এর জন্য দায়ী, কোলরিজ যে অর্থে কল্পনাকে ব্যাখ্যা করেছেন, বীভৎস উৎকণ্ঠা আতঙ্ক মৃত্যুভয়ের মধ্যেও একটা আনন্দ আসে। এই কারণেই মানুষ যে-কোনও সাহিত্য পড়ে, কিছু না কিছু আনন্দ পায়। ‘ক্রিস্টাবেল’ কবিতায় নিশীথ রাত্রির রহস্যময় বিভীষিকায় মনের জটিল অনুভূতি প্রকাশের মধ্যেও মানসিক সত্যের কথা সুন্দরভাবে বলেছেন তিনিঃ Perhaps it’s pretty to force together thoughts to all unlike each other; to mutter and mock a broken charm, to dally with wrong that does no harm. ক্ষতি না করবার জন্যে আনন্দ হয় ঠিকই, কিন্তু রক্তের মধ্যে বায়ুর গতি ঢুকে আমাদের সত্তাকে নতুন কিছু দেয়। এই নতুন কিছু আস্বাদের জন্যে লোভ মানুষের চিরকালের।

না, আমি সূক্ষ্ম বুদ্ধির বড়াই করি না, সরলতাকে বোকামি বলে উড়িয়ে দিয়ে আমার গর্ববোধ হয় না;বাংলা দেশে মার্কস্ না পড়ে বিকৃত মার্ক্সিস্টদের সমাজসচেতনতার ভণ্ডামি আমার নেই, বরং জটিল অপমনস্তত্ত্বের মধ্যে, অপরাধমূলক সাহিত্যে যৌনবাসনার বিকৃত অস্বাভাবিকতার মধ্যে আমাদের যুগের ভেতরে কদর্য গ্লানিই দেখতে পাই, এর মূলে আছে, সামাজিক অর্থনৈতিক বৃত্তিগত অসাম্য বিরোধ ও বিশৃঙ্খলা, এই বিশৃঙ্খলার গভীরে কোথাও হয়তো আদিম মানুষের রক্তপিপাসু প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি ইনস্টিংক্টের মধ্যে লুকিয়ে আছে; এ ঠিক পুরাণে বর্ণিত নর-পশুর মিলনে গঠিত শরীরের মতো, ওপরটা মানুষের, নীচের অংশ পশুর। রবীন্দ্রনাথ যেমন কল্পনা করেছিলেন প্রকৃতি-প্রীতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, সেই ব্যাখ্যা ডারউইনের অনুসারে ক্রাইম রচনার ক্ষেত্রেও উল্লেখ করা যায়, বহু বছর আগে মানুষের সঙ্গে পশুর ভেদ ছিল না, পশু থেকেই মানুষের উদ্ভব, কিন্তু সেই পশু-সত্তা তার ভেতরে আছে। আছে বলেই পশুর মতো স্বার্থপরতায় নিজের লোভে যুক্তিবিন্যস্ত সমাজ-নিয়মকে সে ভেঙে ফেলতে চায়। আরিস্টটলের ভাষায় মানুষ যুক্তি-সমন্বিত জানোয়ার। এই জাতীয় সাহিত্যে যে অপরাধ করে তার মধ্যে জানোয়ারই প্রধান, জানোয়ারকে খুঁজে যে বার করে তার মধ্যে মানুষের যুক্তি, যে যুক্তি স্বচ্ছ অপাপবিদ্ধ, ঐশিতার সঙ্গে তুলিত, সমাজকে দেখায় কোন রোগে সে আক্রান্ত। অপরাধকারী পশুর মধ্যেও দুর্বলতা থাকে, এই দুর্বলতা মানবিক, এই মানবিক দুর্বলতাই মানুষের যুক্তির সঙ্গে একাত্ম হয়; তাই গোয়েন্দা তাদের খুঁজে বের করতে পারে। অপরাধ গ্রীক নাটক থেকে শুরু করে একালের মার্ডার ইন্ দ্য ক্যাথেড্রালের মধ্যেও আছে। রাস্তার মোড়ে রথের ওপর নিজের পিতাকে হত্যা করেছিল ওয়েদিপাউস এবং সেই রহস্য উদ্ঘাটিত করতে গিয়েই তার নিজের জীবনে ট্র্যাজেডি নিয়ে এসেছে। এখানেও ক্রাইম-সাহিত্যের মতো হত্যা, হত্যাজনিত রহস্য, পাপে লিপ্ত হওয়া, রহস্য-উন্মোচনের কথা আছে : আগামেননকে হত্যা করায় অপরাধ ও পাপ, সেই সঙ্গে ষড়যন্ত্রের রহস্য জড়িত; লেডি ম্যাকবেথের হত্যায়ও অপরাধ ও পাপ সংশ্লিষ্ট; তবু এগুলি অপরাধমূলক সাহিত্য নয়। ক্রাইম-লিটারেচারের অপরাধী তার অপরাধকে লুকিয়ে রাখে, অপরাধের বোধকে লুকিয়ে রাখবার শক্তির মধ্যেই তার চরিত্রের দৃঢ়তা; পাপ ও তার জন্যে কোনও অনুতাপ নেই; কিন্তু গ্রীক সাহিত্য বা শ্রেষ্ঠ সাহিত্য অপরাধের সঙ্গে পাপবোধের দ্বন্দ্ব ও বিরোধজনিত জটিলতাকে তুলে ধরে বুদ্ধি ও হৃদয়ের উত্তর্ষে নিয়ে গিয়ে বিশ্বসত্যের সঙ্গে যুক্ত করে দেয়-ক্রাইম-সাহিত্য এই পর্যায়ে ওঠে না বলেই নিম্নস্তরের, উপভোগের, আমাদের, যেমন উত্তেজনামূলক ইন্দ্রিয় আমাদের সুখ দেয়! দ্বিতীয়ত, এই সাহিত্য যুক্তির শবব্যবচ্ছেদ করে জীবন্ত ঘটনা ও চরিত্রের ক্রিয়া অতীত হয়ে যাবার পর। সাহিত্যে আমরা জীবন্ত মানুষকে দেখতে চাই, শবকে নয়, তার ব্যবচ্ছেদের মধ্যে বরং একটা জুগুপ্সা আছে, অনেকে শবব্যবচ্ছেদের বীভৎসতা সহ্য করতে পারে না। কিন্তু শব ব্যবচ্ছেদ তো করে ডাক্তার হবার জন্যে ছাত্রেরা, বোগ পরীক্ষা ও ভেতরের প্রকৃত রহস্য উদ্ভাবনের জন্যে, জানবার জন্যে;জানলে রোগ সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়, কারণ সম্বন্ধে নিশ্চিত অবহিত হলে ওষুধ দিয়ে রোগ সারানো ডাক্তারের পক্ষে সহজ হয়। তাই হোমিওপ্যাথিতেও এখন শবব্যবচ্ছেদ রীতি গৃহীত। কোনান ডয়েল যেমন পরিচ্ছন্ন পোশাকের অন্তরালে ভিক্টোরীয় মানুষের অন্তরের গ্লানি পাপ অপরাধকে ফুটিয়ে তুলেছেন স্বচ্ছ বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দিয়ে, যে মানুষের অপরাধ ও পাপ উপনিবেশের শাসনের অত্যাচারে ভারতবর্ষে প্রকট হয়েছিল, তেমনিভাবে সমাজে মানুষের রোগ ও অপরাধকে খুঁটিয়ে দেখানো ক্রাইম-সাহিত্যের মূল উদ্দেশ্য বলে আমি মনে করি। তৃতীয়ত, সন্দেহকে মূলধন করেই এই সাহিত্য এগোয় উৎকণ্ঠা ও কৌতূহলে; কিন্তু সন্দেহ তো জীবনের মূল নয়।

২.

ক্রাইম-সাহিত্যের ক্রাইম সম্বন্ধে সচেতন করে তোলাও আরেকটা দিক। ক্রাইম-প্রবণতা জাগতেই পারে, কিন্তু তাকে নিবৃত্তি করবার উপায়ই এই সাহিত্যের সামাজিক উদ্দেশ্য। সুতরাং ক্রাইম-সাহিত্যে নৈতিকতা, সমাজতত্ত্ব, অর্থনীতি, সমাজ-প্রশাসন, নৃতত্ত্ব, লিগ্যাল মেডিসিন, মানসবিকৃতির লক্ষণ ও কারণ, আইনগত শিক্ষা, দণ্ডবিধান আরও সব উপাদান এমনভাবে জড়িয়ে থাকে, তাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কিন্তু এসবের মূলে থাকে মানবিকতা ও সহানুভূতি। ডয়েলের শার্লস্ হোম উৎকেন্দ্রিক কোকেনসেবী রূঢ়ভাষী হওয়া সত্ত্বেও তার সহানুভূতি ও মানবিকতা জীবনবোধকে উন্নত করেছে; ব্যোমকেশের ক্ষেত্রে করেছে প্রেম, কিরীটীর ক্ষেত্রে করেছে সর্বজনীন জীবনবোধ। হয়তো দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য থাকতে পারে, কেউ মনে করে নিষ্ঠুরতা মানুষের স্বভাবে ও খেয়ালখুশিতে; কারও মনে অপরাধের দায়িত্ব সমাজের পরিবেশেদারিদ্র্য, বাপ-মায়ের ভাঙা জীবন, কু-পরিবেশ এর জন্যে দায়ী। কিন্তু অপরাধ সাহিত্যের একটা বড় দিক হল এই যে, অপরাধীদের অধিকারের সঙ্গে সমাজের অধিকারের বিরোধের জটিলতার সামঞ্জস্য-যে লেখক এই সামঞ্জস্য দেখাতে পারেন তিনি বড়, তিনি শুধু হত্যা ও অপরাধের গোয়েন্দা নয়, জীবনের অনুসন্ধানী, মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা শিশির ঋতুতে নবোদম কচি পাতার মতো।

৩.

শবব্যবচ্ছেদে যেমন অনুসন্ধান চলে দেহের অস্থিমজ্জায় শিরায় স্নায়ুতে, কোষে কোষে, তেমনি ঘটে-যাওয়া কাহিনীর অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে মানুষের চিন্তা ও ভাবনার রহস্য উদঘাটনই এর উপায়। কার্যকারণ শৃঙ্খলার প্রতি গভীর বিশ্বাসই এর পরমা ভক্তি। দেশ ও কালের ঐক্য সূত্রের সঙ্গে জড়িত গতি; যখন কারণ থেকে কার্য বা কার্য থেকে কারণ অনুসন্ধানের প্রশ্ন ওঠে, তখন দেশ ও কালের মধ্যে বস্তু থেকে শক্তির উদ্ভবে গতির ধারা লক্ষ্য করা যায়; এই গতিময়তা যেমন জগৎ ও জীবনের লক্ষণ, অপরাধ-সাহিত্যেরও মূল কথা; তাই প্লটের অ্যাকশনের মধ্যে। দিয়ে এই নিরন্তর গতিময়তা বিপর্যয় ও আবিষ্কারে উৎকণ্ঠা আতঙ্ক ভয়কে জাগিয়ে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। কার্যকারণের মধ্যে সময়ের কোনও বিরাম নেই, কেননা সময়ই গতিকে পূর্ণ করে তুলেছে। কার্যকারণে বিশ্বাসী মানুষ মাত্রই জানে কারণের সঙ্গে কার্যের পরিমাণ এক, কমও নয় বেশিও নয়, আপেক্ষিকতা বর্জিত, গুণের দিক থেকে অব্যবহিত, নিঃশর্ত পরিণামী কার্যে অনিবার্য। কারণের মধ্যে যেখানে বহুধা উপাদান এসে জোটে, সেখানে অনিবার্যত অদৃশ্য। তবে একথাও স্বীকার্য, যেখানে কার্যকারণের ব্যাপারটা যান্ত্রিক, সেখানে কার্যের সঙ্গে কারণের পরিমাণ এক; কিন্তু যেখানে জৈবিক ও রাসায়নিক সেখানে পরিমাণ প্রায়ই আলাদা হয়ে যায়। দুই উপাদান যখন একত্র মিলিত হয়, তখন দুই উপাদানের অনেক ধর্ম উধাও। অনেক সময় চাপা থাকে, তাকে খুঁজে বার করা যায় না, এই পারস্পরিক মিশ্রণে উপাদানের ধর্মের ভিন্নতায় ও বিভিন্নতায় কৌতূহল ও রহস্য জাগে। অপরাধ-সাহিত্যিকেরা এই সুযোগই নেয়, কারণ মানুষ যন্ত্র নয়, জৈব ঐক্যের রাসায়নিকতা তার সমগ্রতায়। এরই ফলে কম শক্তিশালী লেখক এই শাখায় কারণের বহুধা এনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন, উত্তেজনা আতঙ্ক ভয় কৌতূহল কারণের সঙ্গে যুক্ত হয় না বলে বিশ্বাসযোগ্য হয় না; আবার মানুষকে রাসায়নিক জৈব ঐক্যের বিস্ময় মনে করে অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিকতাকে প্রাধান্য দেয়। রসায়নে জৈব ঐক্যের মধ্যে উপাদানের ধর্ম লুকিয়ে থাকলেও বিজ্ঞানী তাকে খুঁজে বার করতে চেষ্টা করে এবং প্রায়শ সমর্থ হয়। ভুললে চলবে না, অপরাধ-সাহিত্য বিজ্ঞানেরই শাখা। বিজ্ঞানী যেমন অণু ভাঙতে ভাঙতে মূলে পৌঁছুবার সময় রহস্য ও বিস্ময়ে মুগ্ধ হন, তেমনি বিপদের ঝুঁকি নিতেও তার আতঙ্কের উৎকণ্ঠার শেষ নেই।

রহস্য উপন্যাস এবং ক্রাইম উপন্যাস এক নয়; যদিও ক্রাইমের মধ্যে রহস্য নিহিত। সত্যজিৎ রায়ের উপন্যাসে কিছু হত্যার কাহিনী থাকলেও শিশু-ভোলানো রহস্য ও অ্যাডভেঞ্চারই মুখ্য স্থান অধিকার করে আছে; তবে ভাষার দৃঢ়তা ও ঋজুতা, কথ্য শব্দকে মুচড়ে ও নিঙড়ে তার থেকে নতুন তাৎপর্য বার করবার চেষ্টা ও সার্থকতা, প্লট বয়নের রহস্যময় বিস্ময়কারিতার মধ্যে উৎকণ্ঠা ও আতঙ্কের সৃষ্টি, মনস্তত্ত্বের নিগূঢ়তায় পৌঁছাবার চেষ্টা–তার গল্পগুলিকে স্বাদিষ্ট করে তুলেছে। ইংরেজিতে তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হয় : ক্রাইম, দেলি (delit) এবং কন্ট্রাভেশ। এর মধ্যে ক্রাইমই হচ্ছে মারাত্মক অপরাধ, মৃত্যুই এর শাস্তি; দেলি হচ্ছে জেল-খাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিন্তু মৃত্যু নয়;সমষ্টি বা ব্যক্তির অধিকার ও নীতির লঙ্ঘন করা হয় যেখানে, সেখানেই এই দেলি অপরাধযোগ্য বলে স্বীকৃত। অপরাধ-স্পৃহা নয়, কিন্তু আইনে নিষিদ্ধ কার্যের প্রতি যদি কোন ব্যক্তির প্রবণতা দেখা যায়, তবে তাকে বলা যায় যে আইন লঙ্ন করছে।

কিন্তু গোয়েন্দা গল্পে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সত্যান্বেষণে ক্রাইমই হচ্ছে তার বড় রাস্তা। মৃত্যুর কারণ ঘটাবার ইচ্ছায় কোনও কার্যের দ্বারা কেউ যদি মৃত্যু ঘটায় কারও অথবা শরীরের আঘাত ঘটাবার কারণের ইচ্ছা থেকে কেউ কোনও কাজ করে, শরীরের যে আঘাত মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে, তাহলে সেই ব্যক্তি শাস্তিযোগ্য মনুষ্য-হত্যার অপরাধ করে। এই হচ্ছে পেনাল কোডের আইন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কারণই বড় কথা, সেই কারণের সঙ্গে ইচ্ছা ৰা। সচেতনতা এবং ইচ্ছা বা সচেনতার সঙ্গে বাস্তবের কার্য জড়িত। এই কারণেই ডিটেকটিভ বা গোয়েন্দা কার্যকারণ বাদে বিশ্বাসী। ঐ তার উপায়। হত্যাকারী হত্যার শিকার খোঁজে নিজের। বা দলের স্বার্থে; গোয়েন্দা নিহত শিকারের সূত্র ধরে কারণের মূলে পৌঁছোয় শিকারীর দুর্বলতার চিহ্নকে অনুসরণ করে। সুতরাং গোয়েন্দা বা ডিটেকটিভ হত্যাকারীর শনি, শনি যেমন মানুষের নৈতিক দুর্বলতার রন্ধ্রপথে ঢুকে তার জীবনকে বিপর্যস্ত ও মৃত্যুমুখে নিয়ে যায়, গোয়েন্দার কাজও তাই। যে-সব গোয়েন্দা কাহিনীতে গোয়েন্দাকাহিনীর মধ্যে হত্যাকারী ও গোয়েন্দার জীবনমরণ যুদ্ধের পরিস্থিতির বর্ণনা ও ঘটনা এড়িয়ে যায়, তা বিশেষ আস্থা আনতে পারে না; গোয়েন্দা যেন দেবতা, তাকে ছোঁয়া যায় না, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, এরকম মনোভাব গোয়েন্দা কাহিনীর পক্ষে অস্বাস্থ্যকর। হত্যাকারী নায়ক বটে, নায়কের শত্রুর সঙ্গে গোয়েন্দা জড়িত বলে দুই শত্রুর মুখোমুখি লড়াই না ঘটলে জীবনযুদ্ধের সংগ্রামের দিকটা লেখক এড়িয়ে যান। আর গোয়েন্দার বিচার ও সিদ্ধান্তের ওপরই লেখকের জীবনদর্শন ব্যাখ্যাত হয়ে থাকে।

গোয়েন্দা কাহিনীতে প্রায়শ দেখা যায় সরকারী গোয়েন্দা বা পুলিস কর্মচারী ভাড়ামির পর্যায়ে চিত্রিত তাদের স্কুলবুদ্ধির সঙ্গে ভুল দেহের সংযোগে;তারা যাকে ধরে, হাতকড়া পরায়, জেলে পাঠায়, অধিকাংশ স্থলে নির্দোষ। এর একটা কারণ হতে পারে, হত্যাকারীর সঙ্গে পুলিস কর্মচারীদের হিস্যার যোগ; অন্য কারণটি গূঢ়তর, পুলিশী শাসন-ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য সমাজের শান্তিরক্ষা;তাই ক্রাইমের মধ্যে অ্যাকশনের ওপর জোর দেয়, আইনের চোখে এটাই বড় কথা; এই কারণে পুলিসের রিপোর্ট ও কোর্টের সওয়াল পদ্ধতির রেকর্ড অ্যাকশনের মূলে পৌঁছুতে পারে না। কিন্তু গোয়েন্দারা অপরাধের মধ্যে ব্যক্তির মনের রহস্যের মধ্যে কৌতূহলী হয়ে প্রবেশ করতে চায় বিজ্ঞানীর মতো;কারণ এই মানুষ সমাজবদ্ধ মানুষ;সমাজবদ্ধ মানুষ বলেই সমাজের সঙ্গে অঙ্গীভূত রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি নৃতত্ত্ব শিক্ষা সমাজ আচারবিধি সব কিছু মিলিয়ে হত্যাকারী মানুষকে স্থাপিত করে, তার মনের মূল রহস্যে পৌঁছুতে চেষ্টা করে; কোনান ডয়েলের গল্প যে এখনও লোকে পড়ে তা শুধু চমকপ্রদ ঘটনা, কৌতূহল আতঙ্ক, উৎকাল্পনিক পরিবেশের অস্বাভাবিকতার কৌতূহলের জন্যে নয়, এগুলি ফ্যাসির পর্যায়ে পড়ে, অপরিণত মন শিশুদের ভোলায়, তার গল্পের সার্থকতা মানুষকে তিনি সম্পূর্ণ করে দেখেছেন সমাজের মধ্যে স্থাপিত করে; তার হারানো রেলগাড়ি গল্পটি এরই উদাহরণ। কিন্তু পুলিসের কার্যবিধি পুরনো প্রথা ও রীতিনীতিকে অবলম্বন করে অ্যাশনে জোর দেয় বলে ভুল করবার জন্যে হাস্যকর হয়ে ওঠে।

৪.

অনেকে মনে করেন এডগার অ্যালেন পো রচিত ১৮৪১ সালের ‘দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ গল্পটি পৃথিবীর আদি গোয়েন্দা কাহিনী; যদিও পো গল্পটি পেয়েছিলেন ফ্রাঁসোয়া-ইউজেনে ভিদো-এর ১৮২৮-১৮২৯ সালে লেখা ‘মেমোয়ার্স’ থেকে। অর্থাৎ গোয়েন্দা কাহিনীর উৎপত্তি ফরাসী সাহিত্য থেকে। প্রকৃত ঘটনা এই সত্যই প্রমাণিত করে; ভলতেয়ারের লেখা ১৭৪৭ সালে Zadig উপন্যাসটিই পৃথিবীর প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস। বিজ্ঞানী অনুসন্ধিৎসু মন ও কার্যকারণ তত্ত্বে বিশ্বাসী ভতেয়ারের পক্ষেই রহস্য-উন্মোচনের উপায় সম্ভব, এই যুক্তিসিদ্ধ মন বিশ্বজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত বলেই মানবজীবনের রহস্য এমন গভীরভাবে উদঘাটিত করতে পেরেছেন। গোয়েন্দা গল্প পড়লে জীবন সম্বন্ধে এক রকম বোধ জেগে ওঠে; মানুষের মধ্যে অপরাধসত্তা রক্তের মধ্যে নিহিত থেকে মানুষকে ও তার পরিবেশকে ‘অজ্ঞাত আতঙ্কে’ ভরিয়ে রেখেছে, আতঙ্কের বিস্ময় ও বিস্ময়ের আতঙ্ক মানুষকে অহরহ জাগিয়ে সন্দিগ্ধ করে তুলছে, যেন সে স্থির বিশ্বাসে নিশ্চিত নয়; এক সাঙ্কেতিক বোধ জেগে ওঠে;মানুষের জীবনের পথ জটিল, দুর্নিরীক্ষ ঈশ্বরের খেয়ালখুশীর জন্যেই মানুষকে রহস্যময় আতঙ্কে পড়তে হয়; পরিণতিতে জীবনে হয়তো বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু জীবন আমাদের ধসে পড়ে, এক অন্তর্গঢ়, নৈরাশ্যের আতঙ্ক ও ভয় আমাদের জড়িয়ে ধরে। ভতেয়ার জাদি উপন্যাসে এই সত্যই প্রকাশ করতে চেয়েছেন। পো’র গোয়েন্দা গল্পে রহস্যের সঙ্গে কবি-কল্পনা ও নিসর্গ সৌন্দর্য মিশে এক নতুন চিত্রকল্প তৈরী হয়েছে যার প্রভাব রবীন্দ্রনাথের রহস্যগল্পে কিছুটা প্রতিফলিত, যদিও মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা একে ফ্যাসি থেকে রক্ষা করেছে।

গোয়েন্দা গল্পের জনপ্রিয়তার মূলে আছে তীব্র উত্তেজনাপূর্ণ রোমাঞ্চ প্লট নির্ভর দ্রুত ক্ষিপ্ত গতিসম্পন্ন অ্যাকশন, রহস্যময় উৎকণ্ঠা; কিন্তু এগুলির প্রশান্তি ঘটে যুক্তির দ্বারা রহস্যোন্মোচনে। যেখানে রহস্য উন্মোচন ও সমস্যার সমাধান হয় না, হলেও দৈব আবির্ভাবের আকস্মিকতায় (deux ex machina) ঘটে থাকে, সেখানে গোয়েন্দা কাহিনী থ্রিলার ও গুপ্তচর কাহিনীর সঙ্গে একাত্ম হয় এবং উপভোগ বিনোদনই এর একমাত্র উদ্দেশ্য;তাই একালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে রাজনীতি ও মিলিটারি থ্রিলারের এত বাড়াবাড়ি। গোয়েন্দা কাহিনীর সঙ্গে গুপ্তচর কাহিনীর যোগও নিবিড়, কারণ এখানেও প্লট কার্য কারণে আদ্যন্ত বিন্যস্ত; উত্তেজনা, টেনশন ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে কাহিনীর রহস্যময়তা জীবনবোধের গভীরে নিয়ে যায়। যুক্তির শৃঙ্খলায় যুক্তিপূর্ণ ও প্রামাণিক তথ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু ও পরিণতিও এর মধ্যে। বাইবেল কেন, ভারতবর্ষে তার অনেক কাল আগে থেকে গুপ্তচর কাহিনীর রহস্যময়তা সাহিত্যে স্থান পেয়েছে।

প্রেম ও অর্থের সঙ্গে মানুষের রক্তে পাপ অপরাধ হত্যা যৌনতা জড়িয়ে আছে, প্রেমের ক্ষেত্রে শারীরিক হত্যা হয় না অনেক জায়গায়, কিন্তু মানসিক হত্যা তো নিয়ত ঘটে থাকে নর ও নারীর জীবনে; ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসে রোহিণীর হত্যা প্রেম ও যৌনতার সঙ্গে সামন্ততান্ত্রিক অধিকারের সমস্যা জড়িত হয়ে রহস্যকে ঘন করে তুলেছে, তবু গোবিন্দলাল হত্যাকারী হয়েও গোয়েন্দা কাহিনীর নিষ্ঠুর নরঘাতক নৃশংস নায়ক নয়;কারণ সে এখানে তার চিত্তকে হৃদয়কে বিবেককে খুলে ধরেছে;অনুতাপ দুঃখভোগ যন্ত্রণায় সে শুদ্ধ হয়ে রূপান্তরিত হয়েছে পরিণতিতে, কিন্তু গোয়েন্দা কাহিনীতে হত্যাকারীর এই যন্ত্রণা ও রূপান্তর নেই। তাই গোয়েন্দাকে ব্যক্তির সমস্যার মধ্যে ঢুকে অন্যায়, অপরাধ, অপরাধের জায়গা, অপরাধের সঙ্গে সংযোগ, স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক মানসিকতা, বৃত্তিগত ও স্বভাবগত অপরাধকে বিশ্লেষণ ও তুলনা করতে হয় সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। সেজন্যই গোয়েন্দাকে সত্য অন্বেষণ করবার জন্যে সংখ্যাতাত্তিক উপায়ে চিন্তা ও স্বজ্ঞাগতভাবে ভবিষৎ ঘটনার কল্পনীয় রূপ ভেবে নিতে হয়। বড় কবির কল্পনায় সগোত্রীয় না হলে যেমন শ্রেষ্ঠ কাব্যের সমালোচনা ব্যর্থ হয়, তেমনি হত্যাকারীর চিন্তার ওপরে ও তার সঙ্গে যুক্ত না হলে গোয়েন্দা হত্যার ও জীবনের রহস্য ধরতে পারে না; চিন্তার দিক থেকে দুজনের মানসিক সমধর্মিতা আছে, হত্যারূপ কার্য ধরে হত্যার কারণে বা উৎসে পৌঁছয় গোয়েন্দা; সেখানে গোয়েন্দা হত্যাকারীর সঙ্গে একাত্ম। প্রভেদ হচ্ছে, হত্যাকারী অসামাজিক নায়ক, সামাজিক হচ্ছে গোয়েন্দা, তাই প্রতিপক্ষ জয়ী হয়। কিন্তু এখন নতুন ধরনের গোয়েন্দা গল্প লেখার সুযোগ এসেছে, একটি হত্যার জন্য ব্যক্তিকে খুঁজে বের করবার উপায় হিসেবে সমাজ চিন্তার সমস্ত শক্তিকে নিয়োজিত করা হয়; কিন্তু রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির সমষ্টিগত হত্যার পেছনে যে অপরাধস্পৃহা ও পাপচেতনা কাজ করছে তার জন্যে বিশ্ব ইতিহাস-গোয়েন্দার প্রয়োজন; ইতিহাসের বিশ্লেষণে এর সামান্যই ধরা পড়ে, রাজনৈতিক ‘থ্রিলার’ রচনা করে কৌতূহল সৃষ্টি নয়, বিশ্বজাগতিক সমস্যা সমাধানের উপায় বার করা চাই।

৫.

উপস্থিত খণ্ডে নীহাররঞ্জন গুপ্তের তিনটি কাহিনী স্থান পেয়েছে : ‘যুগলবন্দী’, ‘সামনে সমুদ্র নীল’, ‘মানসী তুমি’। তিনটি কাহিনীই প্রেম ও যৌন সমস্যার জটিলতায় আবর্তিত। গোয়েন্দা কাহিনীর অন্তরালে নরনারীর আদিম রিপুকে সমস্যার কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত করেছেন। এই তিনটি কাহিনীর হত্যাকাণ্ড প্রেমের বিচিত্র রূপের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে; প্রেমের দ্বন্দ্ব, প্রেমের পূর্বস্মৃতি, যৌনবাসনা, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যজীবনে যৌনতার ব্যর্থতা, সম্মান, অহংকার–এগুলি থেকেই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এই তিনটি উপন্যাসে। পূর্বস্মৃতি কখনও সতেজতা নিয়ে আসে, কখনও বীভৎস ভীষণতা; কিন্তু দুটোই ভয়ংকর হয়ে ওঠে; প্রেমিক বা প্রেমিকাকে নিহত হতে হয়; বিতৃষ্ণ স্ত্রী স্বামীকে হত্যা করায় বা হত্যা করতে সাহায্য করে পরোক্ষে, তবে হত্যায় কারও মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটে; কখনও ঘটে না; তবে যন্ত্রণা-জর্জরিত হয়। কিন্তু নীহাররঞ্জন গুপ্তের অপরাধী ও হত্যাকারীরা হৃদয়ে একটু দুর্বল; এখানেই বাংলা গোয়েন্দা গল্পে নীহাররঞ্জনের স্বাতন্ত্র।

শরদিন্দু যেমন ১৯২৪-২৫ সালের বাঙালী জীবন ও পরিবেশে চরিত্রের রূপ বর্ণনা করেছেন, নীহাররঞ্জন করেছেন স্বাধীনতা-উত্তর বাঙালী, বিশেষ করে কলকাতার মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত উচ্চবিত্ত ও গরিবের জীবনকাহিনী। সমাজের বিভিন্ন স্তরে পাপ ও অপরাধ লুকিয়ে আছে, সলিল দত্ত মজুমদারের জীবনকাহিনীতে সেই রূপ সুস্পষ্ট। একটা কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার সে, শাসনযন্ত্রের সকলের সঙ্গে তার পরিচয়, পুলিসের আই. জি., হয়তো মন্ত্রীটন্ত্রীর সঙ্গেও, যদিও এদিকটায় নজর দেন নি, দিলে ভাল হত। এই পরিচয়ের ফলেই চোরাকারবারে টাকা লুটে নিতে তার অসুবিধে হয় না। চাকরি দেবার নাম করে যুবতাঁকে চাকরি দিয়ে তাকে রক্ষিতা হিসেবে রাখে এবং রোজ রাত্রে দেহ ভোগ করে। এবং তার বিরুদ্ধে গেলে পথ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়। টাকার জন্য স্মাগলারদের হাতে স্ত্রীকে তুলে দিতেও তার বাধে না;তারপর ছেঁড়া জুতোর মত তাকে ফেলে দেয়; ‘সামনে সমুদ্র নীল’ উপন্যাসে এরই রূপ; প্রেমিক ও পশুর মাঝখানে অনুরাধা প্রেমকে সমুদ্রের ঢেউয়ের শীর্ষে আনন্দের রূপ জাগিয়ে নিজে নিহত হয়েছে পশুশক্তির কাছে।

উচ্চ মধ্যবিত্তদের সঙ্গেই নীহাররঞ্জনের যোগ বেশি, তাদের কাহিনীই এখানে ব্যক্ত; কিন্তু যোগ ঘটেছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে; বিশ্লেষণের অভাবে নিচুতলার রূপ স্পষ্ট হয় নি, অনুরাধা অর্থের জন্যে কেন দেহ বেচে চাকরি নিয়েছে; মানসীর বাবার দিকটা আরও স্পষ্ট করলে সুকুমার ও মানসীর রূপ উপন্যাসের স্তরে আসত। আর একথা অস্বীকার করে লাভ নেই, অপরাধ-স্পৃহা ও পাপচেতনা বিত্তবান লোকদের মধ্যেই সক্রিয়। অর্থই পাপ বাইবেলের এই উক্তি এখানে স্মরণীয়।

নীহাররঞ্জনের লেখা আমাকে আশ্চর্য করেছে এই কারণে যে, প্রাইভেট গোয়েন্দা কিরীটী নিজেকে সত্যসন্ধানী মনে করে না; সে দরদী, মানবপ্রেমিক, সহানুভূতিশীল এবং মনস্তত্ত্বকুশলী; দাম্পত্যজীবনে যৌনতা ও নরনারীর জীবনের প্রেমকে সে দেখে, প্রেমের নিহিত সত্যকে জেনে নারী বা পুরুষের সামান্য ত্রুটিকে ক্ষমার চোখে দেখে সে। ক্ষমা সত্যকে নির্মম হতে দেয় না হিব্রু দেবতার মতো; ‘যুগলবন্দী’ উপন্যাসে রজতশুভ্র আর্মি অফিসার হবার আগে বিপাশাকে ভোগ করেছে; বিপাশা ভালোবেসেছে রজতশুভ্রকে গভীরভাবে। কিন্তু রজতশুভ্রের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যেই উন্মাদ পিতার পুত্র অনন্য বক্সীকে সে বিয়ে করে রজতশুভ্রের প্রেমকে পাথরচাপা দিতে চেয়েছে জীবনে। প্রেমের পরিবর্তে কর্তব্যনিষ্ঠা, যত্ন ও দায়িত্ববোধ দিয়ে সে অনন্যকে ঘিরে রাখে। এগুলিকেও অনেকে প্রেম বলে মনে করে। কিন্তু বিপাশার গভীরে ও গোপন অন্তস্তলে তার পূর্ব-প্রেম ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের ভাষায় অবদমিত হয়ে লুকিয়ে ছিল–তাই রজতশুভ্র যখন আর্মি অফিসার হয়ে ফিরে এসে অনন্য বক্সীর স্ত্রী বিপাশাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে আম্বালায়, তখন প্রেমের বিরুদ্ধে ও বীভৎস রূপ দেখে আতঙ্কিত হয়েছে। রজতশুভ্রের পিস্তলের সামনে নিজেকে ও স্বামীকে রক্ষা করবার জন্যে রজতশুভ্রের অ্যাপার্টমেন্টে রাত্রে যেতে রাজি হয়েছে। সেখানেই রজতশুভ্রের আরেক প্রণয়ী বকুলকে দেখতে পাওয়া যায়। বকুলকেও রজতশুভ্র ভোগ করেছে বিবাহ করবে বলে;বকুলকে একা পেয়ে যখন। ধর্ষণ করতে যায় তখন প্রাণপণে বাধা দেয় সে। বকুলের প্রচণ্ড ধাক্কায় রজতশুভ্র ছিটকে পড়ে; সোফার কোণে আঘাত লেগে অজ্ঞান হয়ে যায় রজতশুভ্র। আর তখনই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধে বকুল রজতশুভ্রের গলায় মাদুলির কার-সুতোর গলায় ফাঁস লাগিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে। বকুল মনে করেছিল রজতশুভ্র মারা গেছে, তাই সে হতচকিত। এই সময়ই বিপাশা পূর্ব কথামতো স্বামীকে না জানিয়ে ঘরে ঢোকে, রজতকে দেখে মৃত;বকুলের ঈর্ষা ঘৃণা ও প্রতিহিংসা তখন তীব্র; বিপাশাকে দেখেই লুকিয়েছিল বকুল; কিছুক্ষণ বাদে বকুল বেরিয়ে আসে গোপন স্থান থেকে। দুই প্রণয়িনী একজন প্রতিহিংসাপরায়ণবকুল যে পাটনা থেকে এসেছে, অন্যজন মুক্তিপ্রয়াসী বিপাশা, পরামর্শ করে রজতশুভ্রের লাশ টেনে নিয়ে ব্যালকনি থেকে নীচে ফেলে দেয়। তাতেই অচেন রজতশুভ্র মারা যায় এবং দুজনেই হত্যাকারী ও অপরাধী। প্রেমের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশোধে হত্যার অপরাধে যুগলবন্দী দুই নারী একসঙ্গে দায়ী। হত্যার চেষ্টা করে সচেতনভাবে বকুল, অচেন দেহ ফেলে দেবার চেষ্টায় হত্যা করে বিপাশা, যদিও রজতশুভ্র মৃত এ সম্বন্ধে সে সচেতন নয়। এরা হত্যা করে এক পশু ও জানোয়ারকে। তাই দুই নারীকে সত্যানুসন্ধানে হত্যাকারী জেনেও কিরীটী রিপোর্ট দেয় রজতশুভ্র আত্মহত্যা করেছে লাফিয়ে পড়ে। কিরীটীর মুখ দিয়ে দুই নারীর অন্তরের রহস্য ও মোটিভ যেমন ব্যক্ত হয়েছে, তেমনি কিরীটীর কথায় তার জীবনদর্শনের সঙ্গে লেখকের জীবনদর্শন ব্যক্ত হয়েছে; কিরীটীর ধর্মবোধ লেখকেরও, বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে যার মিল প্রচণ্ড; কেননা : ’প্রৌঢ় বয়সে পৌঁছে বুঝতে পারছি– সব কিছুর ওপরে একজন আছেন। তিনি যেমন পাপীকে শাস্তি দেন, তেমনি ক্ষমাও করেন পাপীকে। তার এক চোখে অনুশাসনের প্রতিজ্ঞা, অন্য চোখে ক্ষমার অশ্রু। ভুলে যাও। ভুলে যাও সব ব্যাপারটা।‘ এ যেমন বাইবেলকে স্মরণ করায়, তেমনি সহানুভূতি সমবেদনা ক্ষমাসিগ্ধতার সঙ্গে ডাক্তারের জীবনবোধের সামাজিক সুস্থতাকেও ইঙ্গিতবহ করে তোলে। আমাদের ভারতবর্ষে পুরাণাশ্রিত ধর্মীয়বোধে এই ক্ষমামিগ্ধতাই ক্রিয়াশীল। মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের শাশ্বত সত্য, ঋগ্বেদের ঋত, গ্রীকদের ‘ইন্টারন্যাল ট্রুথ’ রবীন্দ্রনাথের সত্যবুদ্ধি নয়। এই ক্ষমা-স্নিগ্ধ উদার-মানবতার বোধ নীহাররঞ্জনের গল্পে প্রথম থেকে ধরা পড়েছে। ‘রহস্যভেদী’ গল্পে বন্ধুর পিসিমা যখন তার বখা ছেলের ত্রাণের জন্য দাদার জমির দলিল চুরি করে পুত্র শম্ভুকে রাত্রে হাতে তুলে দিতে গিয়ে কিরীটীর কাছে ধরা পড়েছে;তখন পিসিমার মাতৃহৃদয়ের কান্নার কাছে তার সত্যানুসন্ধানকে সে প্রকাশ করতে পারে নি, দলিল ফিরিয়ে দিয়েছে বটে বন্ধুর পিতাকে, কিন্তু কি ভাবে কার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, তা সে এম. এ. ছাত্র থাকাকালীন যুবক বয়সেও হৃদয়ের কাছে হার মেনে প্রকাশ করতে পারে নি; সে বলেছে : কাকাবাবু, পৃথিবীতে সব অপরাধেরই কি শাস্তি হয়? আপনার দলিলের প্রয়োজন, দলিল পেয়েছেন, আর একটা অনুরোধ আপনার কাছে–এ বিষয় নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করতে পারবেন না আপনি।

‘রহস্যভেদী’ তার প্রথম গল্প। এখানেই কিরীটীর ধর্মীয়বোধ ও সহানুভূতি, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, এই গুণেই অন্য সব দুর্বলতাকে ঢেকে রেখে কিরীটীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ভক্তি ভালোবাসা উজাড় করে দিতে ইচ্ছে হয়। এই গুণের জন্যেই অন্য গোয়েন্দা থেকে নীহাররঞ্জন ও তার কিরীটী পৃথক ও উজ্জ্বল।

নীহাররঞ্জন ডাক্তার বলেই অধিকাংশ চরিত্রে কিছু কিছু নিহিত রোগের পরিচয় দিয়েছেন; অনন্য বক্সীর চরিত্রে বংশানুক্রমিক হত্যা ও আত্মহত্যার প্রবণতা, অ্যাটাভিজম; তা থেকে ভ্রান্তি ও ভয় চমৎকার প্রকাশ পেয়েছে কুয়াশার জীবন্ত ছবির মধ্যে। গোয়েন্দা কাহিনীতে কাব্য বা স্পন্দিত গদ্য, নতুবা প্রতীক ব্যবহারের সুযোগ অতি স্বল্প;তবু অজ্ঞাতে আচমকা কিছু জায়গায় স্থিতবর্ণনা প্রতীকময় হয়ে উঠেছে;পুরীর সমুদ্রের সঙ্গে অনুরাধার হৃদয়ের দোলা; নীল আকাশ চক্রবালে নীল সমুদ্রের উপর ঝুঁকে যেন নিজেকে নিজে দেখাচ্ছে আর দেখছে। দেখার বুঝি শেষ নেই। অজস্র সূর্যালোক। অনুরাধা তার পূর্বপ্রেমিক সরিৎশেখরকে এবং সরিশেখরও তার প্রণয়িনী অনুরাধাকে এমনি অজস্র সূর্যালোকে আকাশের মতো ঝুঁকে পড়ে যেন সমুদ্রকে দেখছে এবং পেতে চাইছে। হত্যার আগে বীভৎসতার ভয়ংকর রূপের মতো প্রাকৃতিক। ঝড় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে আত্মিক শক্তিতে।

কোনও কোনও গল্পে যদিও পাপের বিশ্লেষণ ও প্রেমের ঘূর্ণি ও আবর্ত আছে;তবে রহস্য উন্মোচনে সেই সংকেত অনেকটা ঢাকা পড়ে যায়। হয়তো কিছু কিছু জায়গায় বাঙালী চরিত্রের স্বাভাবিক দুর্বলতার জন্যেই সেন্টিমেন্টালিটি প্রকাশ পেয়েছে, সম্ভবত অপরাধী নিজেকে ঢেকে রাখবার জন্যেও এই কৌশল নিতে পারে, যেমন ‘মানসী তুমি’ কাহিনীর পূর্ব-প্রণয়ী সুকুমার আপিস থেকে ফিরে এসে রাত এগারটায় তীব্র করুণ সুরে বেহালা বাজাচ্ছে। হৃদয়ের সঙ্কেত ধর্মিতা একেবারে বাদ দেওয়া যায় না, কারণ একই বাড়িতে দাদার স্ত্রী হিসেবে পূর্ব-প্রণয়িনীকে দেখে পুরনো স্মৃতির গানের হাওয়ার সুর জাগছে।

আরেকটা জিনিস বিশেষভাবে লক্ষণীয়, নীহাররঞ্জনের প্রেমিক চরিত্রগুলি ভীরু, দুর্বল, কিছুটা কাপুরুষও। ভীরুতার পেছনে আর্থিক দারিদ্র কিছু আছে যেমন সুকুমারের ক্ষেত্রে। সে পিসতুতো দাদা শরদিন্দুর আশ্রয়ে মানুষ, তার ওষুধের কারখানায় চাকরি করে অন্ন যোগায়। তবু অধ্যাপক সরিৎশেখর যেভাবে অনুরাধাকে এড়িয়ে গেছে, পুরীর সমুদ্রে এসে ভীরুতার মধ্যেও পূর্ব প্রণয়ে উদ্বেল হয়ে উঠেছে, তাতে সরিতের দুর্বলচিত্ততারই প্রকাশ। শুধু ভীরুতার ও দুর্বলতার ক্ষেত্রে নয়, নারীর প্রেম সম্পর্কে ধারণায়ও একটি বিশিষ্ট অনুভব আছে বলে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ এই জটিল রহস্যে তেমন অবতীর্ণ হন নিঃ ‘মেয়েমানুষ জীবনে একবারই ভালোবাসতে পারে সুকুমার।’ (মানসী তুমি) নীহাররঞ্জনের হাতে গৌণ চরিত্রগুলি দুর্বলতা ভীরুতা ও উৎকেন্দ্রিকতায় চমৎকার খোলে; অথচ তাদের অন্তরে এক সৎ বিবেকী মানুষ যেন জেগে উঠতে চায়। মানসী তুমি’ কাহিনীতে হোটেলের মালিক মহিলা সুষমা ভট্টাচার্যের স্বামীর চরিত্রটি একটি সার্থক ও জীবন্ত চরিত্র, সাহিত্যে চিরকাল স্থান পাবার যোগ্য, তার মাতলামি হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে জীবনের একাকিত্ব ও কান্নাকেই বয়ে নিয়ে চলেছে : ‘জানেন মিঃ রায়, আমি নিঃসঙ্গ একাকী সত্যিই, কিন্তু সুষমা আমার চাইতেও নিঃসঙ্গ একাকী। অনেক টাকা আজ ওর, কিন্তু মনের তৃপ্তি ওর নেই। সামনে সমুদ্র নীল’ কাহিনীতে ক্ষিতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এমনি একটি সার্থক টাইপ চরিত্র। সে অতিরিক্ত ভীতু, দুর্বল, তাই কথায় চালিয়াতি তার অসামান্য, খেতে ভালোবাসে, জীবনে কোন শৃঙ্খলা নেই, কিছু নির্বোধ, নির্বুদ্ধিতার জন্যে অন্যের কাছে হাস্যাস্পদ হয়েছে, আর তার স্ত্রী তার মধ্যে বিরাটত্ব আরোপ করে স্বামীর ব্যর্থতাকে প্রকট করে তুলেছে সে, এই ব্যর্থতার জন্যেই সে ঘর ছাড়া, বিবাগী, কারণ স্ত্রী তাকে চায় না, ক্ষিতীন্দ্রের সৎভাই জীমূতবাহনের মৃতদেহকে নিজের স্বামীর মৃতদেহ বলে সনাক্ত করে বিবাহিত জীবনে, স্বামীর সম্পর্ক থেকে মুক্তি চেয়েছিল সে, সেই স্বামীই যখন চন্দ্রকান্ত ঘাই নামে দেখা দিয়ে মিথ্যা হত্যার দায়ে ধরা পড়ে পালিয়ে গিয়ে নিহত হয়, তখন মৃতদেহের দিকে মালতীকে উদ্দেশ্য করে কিরীটীর উক্তি : ‘ভদ্রলোক সত্যিই হতভাগ্য, ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন, বাপের স্নেহ কোনদিন পান নি, আপনিও সারাটা জীবন বিমুখ হয়েছিলেন, অন্তত শেষ কাজটুকু করুন। পরলোক বলে যদি কিছু থাকে তো, হয়তো একটু শান্তি পাবেন–হয়তো সেন্টিমেন্টাল বাঙালীর চিরন্তনত্ব এখানেই।

এই তিনটি কাহিনীতেই গল্পের তিন রকম টেকনিক ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছেন নীহাররঞ্জন : যুগলবন্দী’ কাহিনীতে প্রথমেই সাইকাইয়েট্রির ভ্রান্তি, বিভ্রান্তি, আতঙ্ক, ভয়, কুয়াশায় জীবন্ত ও প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে, কুয়াশার মধ্যেই দেখতে পাচ্ছে একটা পাকান দড়ির ফাঁস, সেই ফঁসটা অনন্য বক্সীর গলায় চেপে বসেছে; এই আতঙ্কময় কুয়াশার জীবন্ত ছবির মধ্যে দিয়েই কাহিনীর কুয়াশাময় রহস্যের অবতারণা। সামনে সমুদ্র নীল’ কাহিনীতে জীমূতবাহনের বৈমাত্র ভাই ক্ষিতীন্দ্রের পত্রের মধ্য দিয়েই ক্ষিতীন্দ্রের সঙ্গে মালতীর, সলিল দত্তের সঙ্গে জীমূতবাহনের ভগিনী মুকুলের অবিবাহিত জীবনের কাহিনী ও তাকে হত্যা করবার উদ্দেশ্য, জীমূতবাহনকে হত্যা করবার কারণ এবং মৃত্যুর ভেতর থেকে পুনরায় তার জেগে উঠবার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে সংক্ষেপে। ‘মানসী তুমি’ কাহিনীতে মৃত্যুর পূর্বে পিতৃগৃহে রাখা ডায়েরিই কাহিনীতে নতুন রূপ ও রহস্য এনে দিয়েছে। ডায়েরিতে মানসী নিজের বিশ্লেষণ– করেছে প্রেমের সূত্রে। এমনিভাবে বিভিন্ন টেকনিক অনুসরণের চেষ্টা আছে।

এই তিন কাহিনীর তিনটি নারীচরিত্রই স্বতন্ত্র, তাদের মানসিক যন্ত্রণা বিভিন্ন;কিন্তু তিনজনের মধ্যেই পূর্ব প্রণয়ের স্মৃতি তাদের ব্যাকুল ও চঞ্চল করেছে। মেয়েরা যে গোপনতা ও ছলনায় পরম দক্ষ পুরুষের চেয়ে, তার কারণ শুধু সন্তানধারণের জন্যে সঙ্কোচনের বৃত্তিই নয়, তাদের অর্গানিজমের মধ্যে আকর্ষণকে সংহত করবার চেষ্টা সৃষ্টির আদিকাল থেকে রয়েছে। তাই নারী গোপনতাকে ছলনার, ছলনাকে গোপনতার পোশাক পরাতে পারে। এই তিনটি নারী, বিপাশা অনুরাধা ও মানসীসকলেই একই কর্মে দক্ষ। তবু বিপাশার সঙ্গে অনুরাধা পৃথক, অনুরাধা শরীরের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে প্রেমকে জিইয়ে রাখতে পারে নি, তাই সরিৎকে দেখে উদ্বেলিত হয়েছে পুরীর সমুদ্রের মত, বিপাশা তার গোপন প্রেমকে কর্তব্যে নিষ্ঠায় চাপা দিয়ে শেষে প্রতিশোধ নিয়েছে রজতশুভ্রের কাছ থেকে মুক্তি পাবার জন্যে;আর মানসী একই বাড়িতে পূর্ব প্রণয়ীকে দেখে, কথা বলে, সঙ্গসুখ পেয়ে, স্বামীর শয্যায় কণ্টকিত হয়েছে। এই কাঁটায় কণ্টকিত হয়ে বেঁচে থাকবার চেয়ে মৃত্যু সেখানে অনেক শান্তির।

৬.

সিচুয়েশন তৈরি করে ডিটেকটিভ কাহিনীর উদ্বেগ আতঙ্ক উৎকণ্ঠা। অশরীরী ভয়ংকরতা যেমন নীহাররঞ্জন তৈরি করতে চেয়েছেন, সেই সঙ্গে অবচেতন মনের দুঃস্বপ্ন, মৃত্যুভয়, আত্মহত্যা প্রবণতা প্রভৃতির উপস্থাপনে মনস্তাত্ত্বিক রূপ প্রকাশ করতে চেয়েছেন তিনি। প্লটের অ্যাকশন নির্ভর করে সিচুয়েশনের আকস্মিকতায় ও অপ্রত্যাশিত চমকে, বিপর্যয় ও আবিষ্কারে। কৌতূহল উৎকণ্ঠা দিয়ে যুগলবন্দী’ শুরু, মনে হয় অনন্য বক্সী ও তার ভৃত্য পরেশ রজতশুভ্রের হত্যার জন্য দায়ী। কিন্তু যখন দুই প্রণয়িনী, ব্যর্থ ও প্রতিশোধপরায়ণ বকুল ও বিপাশা প্রেমের ব্যর্থতায় ও হতাশায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে একই প্রণয়ীর লাশ চারতলার ব্যালকনি থেকে ধরাধরি করে টেনে নিয়ে ফেলে দিচ্ছে; সেই সিচুয়েশনের অভাবিত রহস্য ও মানবজীবনের ট্র্যাজেডির নিয়তি আমাদের বিমূঢ় করে। এই প্রশ্ন বকুল সম্বন্ধে ততটা জাগে না, যতটা জাগে বিপাশা সম্বন্ধে। যে হত্যায় বিপাশা তার হাত রক্তাক্ত করেছে, সেই রক্তাক্ত হাতে স্বামীর কণ্ঠ জড়িয়ে যখন কর্তব্য ও নিষ্ঠা, যত্ন ও সেবাকে উপস্থাপিত করবে, তখন কি এই হত্যা তার বিবেককে জাগিয়ে দেবে, না ছলনাময় গোপনীয়তায় পাথর হয়ে থাকবে–এই প্রশ্নই সাহিত্যের প্রশ্ন, সিচুয়েশন থেকে উৎপন্ন।

‘সামনে সমুদ্র নীল’ কাহিনীতেও কিরীটী যেন হত্যাকারী ও প্রেমিকের মাঝখানে জীবনের আতঙ্কময় রহস্য দেখছে, সে সরিশেখর ও অনুরাধার মাঝখানের ঘরে। অনুরাধা বাস করেছে তার হত্যাকারীকে নিয়ে। প্রেমিক সরিৎশেখরের হৃদয় হত্যাময় প্রেমের উজ্জ্বলতায় ধাবিত কিরীটীর ঘর পেরিয়ে, আর হত্যাকে বুকে নিয়ে সরিতের কাছে মুক্তি চায় তার প্রেমের পাত্রী কিরীটীর ঘর পেরিয়ে। এই সিচুয়েশনই আরও রহস্যময় ও জটিল হয়েছে কিরীটীর ঘরে পূর্বে নিহত জীমূতবাহনের ভয়ংকর অনুষঙ্গ, এর আবহাওয়ার মধ্যে হত্যা ও পাপ, তাকে প্রত্যক্ষ করে তুলেছে ছদ্মবেশী চন্দ্রকান্ত ঘাই, ক্ষিতীন্দ্র রূপে যার মৃতদেহ তারই স্ত্রী সনাক্ত করেছিল। ক্ষিতীন্দ্রের এ জগতে বেঁচে থাকাটাই যেন অপরাধ, এই অপরাধ থেকে মুক্তির জন্যেই তার মৃত্যু অনিবার্য এবং অপরিহার্য নিয়তি। কাহিনীর শেষে সলিল দত্ত মজুমদারের–যে তিনটি হত্যার জন্যে দায়ী–হো হো করে হাসি কি সাম্প্রতিক যুগের ও জীবনের প্রতি তুচ্ছতার প্রতীক, না তার নিজের জীবনই হাসির মত তুচ্ছ?

‘মানসী তুমি’ কাহিনীর সিচুয়েশন আরও গাঢ়তর;নাটকীয় অপ্রত্যাশিত কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। মানসীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের অপূর্ব মহীয়সী রূপ প্রথমে শরদিন্দুর কাছে ধরা দিয়েছে; সেই মানসীরই যখন বিবাহ হয়েছে শরদিন্দুর সঙ্গে, সুকুমারের সঙ্গে একই বাড়িতে বাস করছে, স্বামীর সন্দেহের ও ঈর্ষার জ্বালায় নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে, তখন তার চেহারা অন্য রকম। সামাজিক সংস্কার ও প্রেম; দুই ভাই, একজন স্বামী, অন্যজন প্রেমিক; স্বামী ঐশ্বর্যশালী ও বিত্তবান, প্রেমিক পরাশ্রয়ী প্রেমভীরু দুর্বল; এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে মানসী জর্জরিত। এই নাটকীয় সিচুয়েশান থেকেই সুকুমারের প্রেম প্রতিহিংসায় রূপান্তরিত হয়েছে; চোখের সামনে সে দেখতে পারে না তারই প্রেমিকার দেহ ভোগ করছে অন্য পুরুষ;তাই প্রেমিকাকে হত্যা করবার সংকল্প নেয়। এবং কাহিনীর শেষে মৃত্যু থেকে ফিরে এসে মানসী যখন সুকুমারের হাতে আবার মারা পড়তে গিয়েও কিরীটীর জন্য বেঁচে শেষ পর্যন্ত নিরুদ্দেশ হয়ে যায় স্বামীর কাছে ফিরে না এসে–তখন পাঠকের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে-সে কি সুকুমারকে হত্যার মামলা থেকে বাঁচাবে, না প্রেমকে বড় করে দেখেছে বলে সুকুমারের এই দৃশ্য সইতে না পেরে নিরুদ্দেশ হয়েছে ব্যর্থ হতাশায়, নতুবা সে নিজেই নিজেকে মারবে? এই বিভিন্ন প্রশ্নাকুলতাই এই কাহিনীর সার্থকতা।

বার্ণিক রায়
৭.২.৮৬

লেখক: নীহাররঞ্জন গুপ্তসিরিজ: কিরীটী অমনিবাসবইয়ের ধরন: গোয়েন্দা (ডিটেকটিভ), রচনাসমগ্র / রচনাবলী / রচনা সংকলন
কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

কিরীটী অমনিবাস ২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

কিরীটী অমনিবাস ১৩

কিরীটী অমনিবাস ১৩ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

কিরীটী অমনিবাস ১২ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

কিরীটী অমনিবাস ৪ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.