• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

এবাদতনামা – ফরহাদ মজহার

লাইব্রেরি » ফরহাদ মজহার » এবাদতনামা – ফরহাদ মজহার
এবাদতনামা ফরহাদ মজহার

সূচিপত্র

  1. এবাদতনামা: ১ – বলি ও টগরফুল
  2. এবাদতনামা: ২ – বৃক্ষতলে চোর কিংবা বাদামভিখারি
  3. এবাদতনামা: ৩ – ‘সকল প্রশংসা তাঁর’
  4. এবাদতনামা: ৪ – নয়া অভ্যুদয়
  5. এবাদতনামা: ৫ – রূহ ও নফসের দ্বন্দ্ব
  6. এবাদতনামা: ৬ – দুনিয়া রেজিস্ট্রি কর
  7. এবাদতনামা: ৭ – কলিজার ছায়া
  8. এবাদতনামা: ৮ – সিধা কানেকশান
  9. এবাদতনামা: ৯ – কাদা দিয়ে দাগা দেবো
  10. এবাদতনামা: ১০ – সহিসালামতে আছে সবার ভণ্ডামি
  11. এবাদতনামা: ১১ – মজেছি নিজের মোহে
  12. এবাদতনামা: ১২ – বাংলা তোমার নয়
  13. এবাদতনামা : ১৩ – সব ধর্মে এক কথা
  14. এবাদতনামা: ১৪ – কাঁধে করে ঘুরিফিরি
  15. এবাদতনামা: ১৫ – স্বেচ্ছায় সিজদা চাও
  16. এবাদতনামা: ১৬ – ইমান বা রেনে দেকার্তের জ্যামিতি
  17. এবাদতনামা: ১৭ – ফুরসত কোথায়?
  18. এবাদতনামা: ১৮ – আল্লার কালাম
  19. এবাদতনামা: ১৯ – একাকী থেকেছি
  20. এবাদতনামা: ২০ – ‘আম্রমুকুল মারহাবা’
  21. এবাদতনামা: ২১ – নগদ
  22. এবাদতনামা: ২২ – বেকায়দা সওয়াল
  23. এবাদতনামা: ২৩ – শতখণ্ডে বিকায় তৌহিদ
  24. এবাদতনামা: ২৪ – বেগম শালিখ
  25. এবাদতনামা: ২৫ – হেরা গুহা গহ্বরে
  26. এবাদতনামা: ২৬ – জিম্মাদার বিদ্রোহের লাশে
  27. এবাদতনামা: ২৭ – ওয়াদা
  28. এবাদতনামা: ২৮ – মানুষের মহব্বত
  29. এবাদতনামা: ২৯ – আমিও মিশিবো কালস্রোতে
  30. এবাদতনামা: ৩০ – শ্রীরাম পরমহংস
  31. এবাদতনামা: ৩১ – ঠাকুরের বেটা
  32. এবাদতনামা: ৩২ – কচি হাঁটু কচি পায়ে
  33. এবাদতনামা: ৩৩ – কবিদের বাদশাহ তিনি
  34. এবাদতনামা: ৩8 – বেয়াদপি
  35. এবাদতনামা: ৩৫ – বোরখা
  36. এবাদতনামা: ৩৬ – বিবি খদিজা
  37. এবাদতনামা : ৩৭ – সোনার মদিনা চল্‌
  38. এবাদতনামা: ৩৮ নবীর রুমাল
  39. এবাদতনামা: ৩৯ – ফটোগ্রাফার
  40. এবাদতনামা: ৪০ – পদশব্দ
  41. এবাদতনামা: ৪১ – আষাঢ়
  42. এবাদতনামা: ৪২ – নবীজির ওয়াস্তে
  43. এবাদতনামা: ৪৩ – আমার জানিতে সাধ
  44. এবাদতনামা: ৪৪ – বিসমিল্লাহ
  45. এবাদতনামা: ৪৫ – ‘যতনে’ ‘সতত’ হৃদয়ে রেখো আদরিনী শ্যামা মাকে
  46. এবাদতনামা: ৪৬ – ত্রিভুবনের প্রিয় মুহম্মদ
  47. এবাদতনামা: ৪৭ – সুবেহসাদেকে বৃষ্টি
  48. এবাদতনামা: ৪৮ – ‘তিন পাগলে হোল মেলা নদে এসে…’
  49. এবাদতনামা: ৪৯ – আমি ঘোর পৌত্তলিক
  50. এবাদতনামা: ৫০ – ‘আমি’
  51. এবাদতনামা: ৫১ – শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সঙ্গে নামাজ আদায়
  52. এবাদতনামা:৫২ – ঘুম
  53. এবাদতনামা: ৫৩ – অনন্তের বৈকুণ্ঠধাম
  54. এবাদতনামা: ৫8 – নিদানের কালে
  55. এবাদতনামা:৫৫ – বিনয়ের দুই বাংলা
  56. এবাদতনামা:৫৬ – কাদা, জল, নীলাকাশ
  57. এবাদতনামা: ৫৭ – এশেকের ভেদ
  58. এবাদতনামা:৫৮ – ছেঁউড়িয়া
  59. এবাদতনামা: ৫৯ – আজান
  60. এবাদতনামা: ৬০ – সহস্রার পদ্মচক্র
  61. এবাদতনামা: ৬১ – মৃত্যু
  62. এবাদতনামা: ৬২ – শ্রীরাধিকা
  63. এবাদতনামা: ৬৩ – নিত্যানন্দ
  64. এবাদতনামা: ৬8 – তিন পাগলে হোল মেলা নদে এসে
  65. এবাদতনামা: ৬৫ – জালালুদ্দিন রুমি
  66. এবাদতনামা: ৬৬ – কোরান শরিফ
  67. এবাদতনামা: ৬৭ – প্রেমধর্ম
  68. এবাদতনামা: ৬৮ – অনন্ত গল্প
  69. এবাদতনামা: ৬৯ – গুরু
  70. এবাদতনামা: ৭० – বিপ্লবী গোরা
  71. এবাদতনামা: ৭১ – বাংলায় মোনাজাত
  72. এবাদতনামা: ৭২ – তওবা
  73. এবাদতনামা: ৭৩ – দাসী শুধু জানে
  74. এবাদতনামা: ৭৪ – আশেকির দিব্য কারখানা
  75. এবাদতনামা: ৭৫ – বৃক্ষধর্ম
  76. এবাদতনামা: ৭৬ – সরলতা
  77. এবাদতনামা: ৭৭ – মানুষ
  78. এবাদতনামা: ৭৮ – ইবলিসের দিন
  79. এবাদতনামা: ৭৯ – দেখা
  80. এবাদতনামা: ৮o – যে জানে সে জানে
  81. এবাদতনামা: ৮১ – কবিতার জন্য
  82. এবাদতনামা: – ৮২ নিহেতু প্ৰেম
  83. এবাদতনামা: ৮৩ – কে বা বাংলাদেশ!
  84. এবাদতনামা: ৮৪ – পূজায় বসেছি
  85. এবাদতনামা: ৮৫ – যদি দেখি ফেলি মুখ
  86. এবাদতনামা: ৮৬ – বিজ্ঞানী হয়েছি
  87. এবাদতনামা: ৮৭ – সঙ্গ দোষে নষ্ট আমি
  88. এবাদতনামা: ৮৮ – প্রতিবিম্ব হবো না
  89. এবাদতনামা: ৮৯ – গোনাহ
  90. এবাদতনামা: ১০ আমিও উদিত হবো পুবে
  91. এবাদতনামা: ৯১ – বিশুদ্ধ ভিক্ষুকের বৃত্তি
  92. এবাদতনামা: ৯২ – নিহেতু প্রেমের গল্প
  93. এবাদতনামা: ৯৩ – নদী
  94. এবাদতনামা: ৯৪ – মওতের মুখচ্ছবি
  95. এবাদতনামা: ৯৫ – জন্মেই হাজতি আমি
  96. এবাদতনামা: ৯৬ – কমিউনিস্ট
  97. এবাদতনামা: ৯৭ – বৰ্তমান
  98. এবাদতনামা: ৯৮ – নামাতীত
  99. এবাদতনামা: ৯৯ – বিরহ

এবাদতনামা – ফরহাদ মজহার

আগামী প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ—ফাল্গুন ১৪১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১১
প্রকাশক—ওসমান গনি আগামী প্রকাশনী ৩৬ বাংলাবাজার ঢাকা ১১০০
প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা : সব্যসাচী হাজরা

.

ফ্ল্যাপের লেখা

বাংলা কবিতার ইতিহাসে ‘এবাদতনামা’ একটি অনন্য ঘটনা। কাব্যের ভিতরে একটি জনগোষ্ঠীর বহুমুখী ও বিচিত্র অভিজ্ঞতার অনাগত ভূগোল আবিষ্কার ও ধারণ করবার সাহস নিয়ে পংক্তিগুলো নিবেদিত।

এবাদতনামায় তাই কবি ফরহাদ মজহার বাংলার ভাব ও ভাষাকে নতুন ভাবে মোকাবিলার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির পুনর্গঠনের নতুন নতুন রূপকল্প অনুসন্ধান করেন, নান্দনিক দ্যোতনায় হাজির হন নতুন অর্থের বিচ্ছুরণ ঘটাতে। ফলে ফুল ও পাপড়ির ধর্মে মৃদঙ্গও ইবাদতের অনুসঙ্গ হয়ে যায় অনায়াসে। আদরনী শ্যামা মেয়ের ব্যাকুল আহবান আর রামকৃষ্ণ সমীপে রক্তিম জবা ফুল নিবেদনের যৌথতায় ক্রমে পরিস্ফুট হতে থাকে ভাব ও ভক্তিরসে উদীয়মান সম্প্রদায় অতিক্রান্ত এক যূথবদ্ধতা। বাংলা কবিতায় এ এক অভূতপূর্ব বাঙলা, যেখানে বিপুল বৈচিত্র্যের সংশেষ আত্মস্থ করে দৃশ্যমান হয় বিদ্যতার স্বাদ।

আর কবি মিলনের অপেক্ষায় অভিসারের প্রস্তুতিতে আরো বেশি মগ্ন…।

.

এবাদতনামা প্রথম সংস্করণের প্রস্তাবনা

এবাদতনামা প্রথমে ৪৪টি নিয়ে কবিতাপুস্তিকা হিশাবে প্রকাশিত হয় ৯ ফাল্গুন ১৩৯৬ বা ইংরেজি ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ তারিখে। পরে আরো কিছু অগ্রন্থিত এবাদতনামা ‘কবিতাসংগ্রহ’ বইটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ফাল্গুন ১৪১১ বাংলা সালে (ইংরেজি ২০০৫) প্রকাশিত হয়। এখন সব এবাদতনামাই এই বইটিতে পেশ করছি। এবার ৯৯টি এবাদতনামায় এসে থেমেছি। নিরানব্বই কেন সেটা যারা আশেকান তাঁরা নিজ গুণে বুঝে নেবেন। এবাদত নিশ্চয়ই অন্যভাবে—নানারূপে কাব্যে সতত জারি থাকবে, তবে এইভাবে আর ফিরে আসা হবে কি না কে জানে!

.

এবাদতনামা প্রথম সংস্করণের প্রস্তাবনা

‘এবাদতনামা’ প্রথম সংস্করণে প্রকাশকের পক্ষ থেকে মলাটে যে প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছিল কবিতাগুলির পাঠে তা সহায়ক হতে পারে ভেবে এখানে সংযোজন করা হলো:

‘ফরহাদ মজহার কবি, এ পরিচয়ে থাকতে পারলে সম্ভবত তিনি সবচেয়ে বেশি সুখী হতেন। তাঁর রক্তে-মাংসে মিশে আছে কবিতা। কিন্তু কেবল কবি হওয়া তাঁর ধাতে নেই। দর্শন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁর নানাবিধ সক্রিয়তার জন্যও তিনি সমান লোকপ্রিয়। কবিতা তাঁর প্রাণ কিন্তু দর্শন এবং তার সক্রিয় রূপ রাজনীতির মধ্যেই ব্যক্তির অভিপ্রকাশ অধিক তৃপ্তির বলে তিনি মনে করেন।’

‘বাংলা কাব্যে লিপ্ত কবিতার ধারার তিনি প্রধান প্রবক্তা এবং এই ধারারই অন্যতম কবি, তরুণ কবিরা সোৎসাহে যে ধারাকে গত কয় বছরে একটি আন্দোলনে পরিণত করেছেন। অসামান্য আধুনিক এই কবি মননে ও নিরীক্ষায় তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থে বাংলা কবিতাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে এসেছেন, এক্ষেত্রে তাঁর শক্তি ও অবদান আজ আর অবিদিত নেই।’

‘খ্রিস্টীয় মনোগাঠনিক ভিত্তি ও মানসিক পরিমণ্ডলের ওপর ইয়োরোপীয় আধুনিকতার যে ধারা আমাদের সাহিত্যে এখনো প্রগতির লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত সে ধারা আদতে সাম্প্রদায়িক কম্যুনাল। এর ঐতিহাসিক অবদান অবশ্যই আছে। প্রগতির এই ধারা, এই যোগসাজস সম্পর্কে আদৌ সতর্ক নয়। এই অসতর্কতা মারাত্মক।’

‘মারাত্মক এ কারণে যে সাম্রাজ্যবাদের সর্বব্যাপী আগ্রাসনের ফলে পৃথিবীর অন্যান্য জাতি ও তাদের ধর্মবোধের মানসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আধুনিক ও প্রগতিশীল দিক আজ প্রায় বিলুপ্ত। আপরদিকে খ্রিস্টীয় ধারা অন্যান্য জাতি ও সংস্কৃতির ওপর বর্বর হামলা চালাবার জন্যে পুঁজিবাদের যে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ হাতে পেয়েছিল অন্যেরা ঐতিহাসিক কারণে তা পায়নি। এর মোকাবেলা করতে গিয়ে নিপীড়িত জাতি ও ধর্মবোধ উল্টা নিপতিত হয়েছে পাড় রক্ষণশীলতায়, নিজেদের ধর্ম ও জাতিবোধের পরিণতি ঘটেছে চরম অসহিষ্ণুতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতায়। এই প্রকাশে ভয় পেয়ে তথাকথিত প্রগতিশীলরা এর রূপকে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে মর্যকেও ছুড়ে ফেলেছেন।’

‘ফলে সাম্রাজ্যবাদী খ্রিস্টীয় ধারার আধুনিকতা ও প্রগতি প্রকারান্তরে তাদের সমর্থনে পুষ্ট হয়েছে। এবং এখনও হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তথাকথিত আধুনিকতাবাদীরা এক কাঠি ওপরে। তাদের ধারণা ক্রুশবিদ্ধ যীশুর যন্ত্রণাকাতর যে রূপ সেই রূপের ওপর আশ্রয় করে প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ব্যক্তিমানসের যুগযন্ত্রণা ও কষ্টই বুঝি আধুনিকতার একমাত্র মাপকাঠি: সাহিত্যের পরম ও একমাত্র উপাস্য বুঝিবা কেবল দস্তয়ভস্কি বা শার্ল বোদলেয়ার, ইত্যাদি।’

‘ফলে হয়েছে এই, আল্লার সঙ্গে তার দোস্ত নবী মুহম্মদের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক ও অতি আধুনিক টানাপোড়েন বা টেনশন, বা শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের দশাপ্রাপ্তি বা শ্রী চৈতন্যের রাধা ভাবে উপাসনার নারীবাদী ভাববৈশিষ্ট্য—এ সবের অসামান্য আধুনিকতা চোখে পড়ে না। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়ে আমরা যদি জিততে চাই তাহলে যা আমাদের নিজস্ব সম্পদ—আমাদের মর্মের যা ভাব স্বভাব তাকে উদ্ধার করা চাই। ‘এবাদতনামা’ এই আলোকে পাঠ করলে পাঠক উপকৃত হবেন। এই কাব্যগ্রন্থটি একদিকে সাম্রাজ্যবাদ অপরদিকে প্রতিক্রিয়াশীলতার কবল থেকে নিজেদের ভাবসম্পদ পুনরুদ্ধারের একটি প্রচেষ্টা।’

.

উৎসর্গ পদ্য

তুমি কি আল্লা মানো? তুমি বেটা পাড় কমিউনিস্ট
তুমি কেন লিখিতেছ অকস্মাৎ এবাদতনামা?
কহি শুন: বহু আছে বুর্জোয়া—সর্বস্ব নাস্তিক
অথচ খাতায় আছে একমাত্র আমার ঠিকানা।
কাহারে দুষ্কের কথা কই আজ শুনিও সকলে
মোমিন ও বুর্জোয়া জোড়ে চলে বগলে বগলে।

মাওলা গো, তুমি নাই বুঝি যদি তবু কোনো দিন
স্পুটনিকে খুঁজি খোদা পাই নাই করিনি প্রমাণ।
কারণ মানুষ আমি ভালোবাসি, তারা দিলে দাগা
যদি পায় সেই ভয়ে মোমিনেরে করেছি সম্মান;
মুয়াজ্জিনের ডাকে মুসল্লিরা গেছেন মসজিদে
প্রেম ও প্রজ্ঞার ডাকে আমি রত নিজ এবাদতে।

ভণ্ডামি করি নাই; জনগণ নিজের নৌকায়
তুলিবার ভাঁওতায় মসজিদে নামাজ পড়ি না।
ভবিষ্যতে পড়িব না। বিশ্বাসের সঙ্গে বুদ্ধির
সংঘাতের সার কথা ঘুণাক্ষরে কখনো ভুলি না।
কিন্তু জ্ঞান প্রেমশূন্য, বিশ্বাস এশেক বর্জিত
যদি হয় উভয়েরে জানপ্রাণ করি প্রতিহত।

ফলে আমি লিখিয়াছি এই পদ্য প্রেমে ও এশেকে
লিখিয়াছি বুদ্ধিকে বানিয়ে প্রাণের ক্রীতদাস:
দেখি ফুল ফোটে কি না, দেখি ফল ধরে কি মুকুলে
মনুষ্যের ইঞ্জিনে দেখি সাফ হয় কি নিশ্বাস।
প্রজ্ঞার মহরতে এই পদ্য পড়িবেন যিনি
আমারে পরাণ ভরে দোয়া ঠিক করিবেন তিনি।

এই চতুর্দশপদী তুলে দিনু মোমিনের হাতে
আমার কর্জ শোধ আল্লার মাশুকের সাথে।।

.

এবাদতনামা: ১ – বলি ও টগরফুল

বলি, ও টগরফুল ফুটিলি কি বঙ্গে গুলিস্তাঁয়
জিব্রাইল ফেরেশতার সফেদ পায়ের ভাষা লয়ে
পাপড়ির শুভ্রতায়; আমি তোকে পেয়ে এবাদতে
বসেছি পুষ্পোদ্যানে ফুলে ফুলে নতজানু হয়ে।

শর্করা দানার মতো ফুটিলি কি ফুল প্রাণেশ্বরী
আলো হয়ে এই বঙ্গে? রোশনিতে ভরে অন্তর।
অতো ফর্শা কোথা পেলি? দুনিয়ার নানা বাগিচায়
আছে নানা ফুল, কিন্তু কেউ নয় বঙ্গীয় টগর।

জায়নামাজের স্থান আজ আমি বিছাবো পুষ্পের
অন্তঃস্থল লক্ষ করি; পাপড়িগুলো তসবির মতো
গুনবো যেন নিরানব্বই নামে ফের পৃথিবীতে
ফুল ও পাপড়ির ধর্ম পুনর্বার হয় প্রচারিত—

রোজ হাশরের দিন তুই তবে সাক্ষ্য দিস ফুল
সুন্দরের এবাদতে কেটে যায় কবির জিন্দেগি।

এবাদতনামা: ২ – বৃক্ষতলে চোর কিংবা বাদামভিখারি

কাঠবিড়ালিকে আমি মাঝেমধ্যে এহতেকাফে দেখি
মহাবোধিবৃক্ষ তলে। আর সেই মাসুম বিড়ালি
পশমের খানদানি ফাঁপাফোলা লেজের ঝাণ্ডায়
উড়িয়ে বুদ্ধের মতো এসে বসে শেকড়ের মূলে।

তারপর চলে ধ্যান, মাঝে মধ্যে উঁচু ডাল থেকে
নিজের মর্মের ভারে ঝরে যায় সুন্দরী বাদাম
ভেতরে সফেদ শাঁস; ঊর্ধ্বলোকে কোথাও জান্নাতে
এইসব স্বাদু ফল ফেরেশতার মাখনে প্রস্তুত।

তবু কাঠবিড়ালির হুঁশ নেই বাদামের প্রতি
কণামাত্র কোনো লোভ তার তথাগত তবিয়তে
লক্ষণীয় নয়। ঘাস আর বৃক্ষে বৃক্ষে তার
আধ্যাত্মিকতা; ব্যাপ্ত এই দৃশ্যে কে আমি, কোথায়?

না, আমি কামেল নই, নই এহতেকাফের বিড়াল
আমি কবি: বৃক্ষতলে চোর কিংবা বাদামভিখারি।

এবাদতনামা: ৩ – ‘সকল প্রশংসা তাঁর’

‘সকল প্রশংসা তাঁরা কিন্তু সব নিন্দার ভার
যদি মনুষ্যের হয় ওর মধ্যে প্রভু ইনসাফ
নাই, আমি সে কারণে সর্বদা তোমাকে অন্ধভাবে
প্রশংসা করি না; তবু, গোস্বা তুমি কোরো না মা’বুদ।

আমি যেন সিধা চলি তাই দাও বেহেশতের লোভ
যদি চলি উল্টা-পাল্টা নিমেষেই কুখ্যাত দোজখ
দেখায় আমাকে ভয়: উভয়ের মধ্যবর্তী পথে
নিরীহ ষাঁড়ের মতো দড়ি নাকে সদর রাস্তায়
চলেছি ইমানদার—এতে কিবা কৃতিত্ব তোমার?

শির খাড়া চোখ লাল মাঝেমধ্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে ষাঁড়
ছোটে ঊর্ধ্বলোকে যেথা তোমার নক্ষত্র ফুটে থাকে
সুবেহসাদেকের শুকতারা হয়ে; প্রেমে ও প্রজ্ঞানে
সে ধায় আপন বেগে হুঁশ নাই তিলেক নিজের—

কিছুটা প্রশংসা তাই ধার্য থাক বিদ্রোহী ষাঁড়ের।

এবাদতনামা: ৪ – নয়া অভ্যুদয়

মাঝেমধ্যে দুই চোখে নেমে আসে রাজ্যের আঁধার
তৈমুরের কালো ঘোড়া মনে হয় কাঞ্চনজঙ্ঘার
নুর ও বরফ ঢেকে দাঁড়িয়েছে—আলো নাই হায়
আলো নাই – অপার ভারতবর্ষে আমি নিঃসহায়।

না, আমি মোঙ্গল নই, নই তুর্কি, মুঘলকি বীর
অহংকারী আর্য নই, নই খাস প্রাচীন দ্রাবিড়,
ভূমিষ্ঠ হইনি আমি ব্রাহ্মণ বা মৌলবির ঘরে
আমি নয়া অভ্যুদয় ভূমণ্ডলে মাটির অন্তরে।

আমার রূহের মধ্যে আমলকি সৃষ্টির সুবাদে
রুয়ে দিয়েছিলে; আমি উদ্ভিদের গর্ভের সংবাদে
সতী যেন মরিয়ম; প্রভু, তবে দাও অভিজ্ঞান
দাও বাক্য, বলো ‘হও’, আমি জন্মদান করি প্রাণ
বঙ্গোপসাগরে—করি বালি-নুন-শঙ্খ-কাদা-তীরে
আজানুলম্বিত সিজদা, বঙ্গদেশে, এহেন তিমিরে….

এবাদতনামা: ৫ – রূহ ও নফসের দ্বন্দ্ব

এ জিহ্বা তোমার তুমি কেন তবু নিজের জিহ্বায়
নিজের প্রশংসা ছাড়া আর কিছু চাও না মা’বুদ
এ দিল কি সারাখন সহবতে থাকে? এ মেজাজ
হামেশাই বিগড়ায়, তখন কী করি রহমান?

বানাতে পারতে তুমি মনুষ্যকে জিহ্বার আদলে
ছহি গ্রামোফোন যথা আলজিভে দিতে কণ্ঠস্বর,
পাম্পে নিশ্বাস ভরে ছেড়ে দিতে গানের মেশিন
ঘুরে ঘুরে বেজে যেতো আরবিতে খোদার রেকর্ড।

তা না করে তাকে তুমি একদিকে বানালে নশ্বর
রক্তমাংসের প্রাণ, অন্যদিকে নিজের রূহের
নিশ্বাস দিয়ে তার হৃদয়ে দিয়েছো নিজ রূহ
রূহ ও নফসের দ্বন্দ্বে সে এখন কোন দিকে যাবে?

তদুপরি কবিদের বানিয়েছ আস্ত বেয়াদপ
তারা বেয়াদপি করলে খেপো কেন আল্লা হুজুর?

এবাদতনামা: ৬ – দুনিয়া রেজিস্ট্রি কর

তিলেক হিম্মত নাই, আধা ছটাকের নাই তেজ
সাত আসমানে প্রভু খোদাতা’লা হয়ে বসে আছ
মুখে খালি কহ শুনি দুনিয়ার তুমিই মালিক
অথচ মালিক অন্যে, অন্যে কহিতেছে তারা খোদা।

ধরো আমাদের গ্রামে আলহাজ ছামাদ মৌলবি
তিনি খোদ নিজ নামে বাহাত্তর বিঘা হালটের
জমির মালিক, তেতাল্লিশ চেয়ারম্যান, ষাট বিঘা
রশিদ কন্ট্রাক্টর, ইটের ভাটার ছরু মিয়া
চৌদ্দ বিঘা বিশ ডেসিমেল, বাকি থাকে ছমিরুদ্দি
চন্দনের বাপ, হারাধন—প্রত্যেকেই কমবেশি প্রভু
মালিক এ জমিনের—প্রত্যেকেই তোমার শরিক
তোমার শরিক নাই এই কথা তবে কি বোগাস?

এদের দলিল যদি মিথ্যা হয় যাও আদালতে
উকিল ধরিয়া করো দুনিয়া রেজিস্ট্রি নিজ নামে।

এবাদতনামা: ৭ – কলিজার ছায়া

দুনিয়ায় দুঃখ আছে তবু তুমি সুখের সন্ধানে
কলিজা তালুতে রাখি ঘুরিতেছ খ্যাপা মুসাফির
শহরে বন্দরে গ্রামে ইস্টিশানে মন্দিরে মসজিদে
বাজারে ও নিরজনে। নির্বিকার নির্দয় কণ্টক
চরণে ও প্রাণে বাজে। তুমি তবু নিজের তৌহিদ
পর্বতশৃঙ্গের মতো খাড়া রাখি মাংসের বেদনা
হামেশাই সহ্য কর। গোড়ালি বিদীর্ণ করি খুন
ঝরিতেছে। তবুও আখির নুরে দৃষ্টির হায়াত
মহাকাল হয়ে জ্বলে – বেদিশায় ঘুরিছ ফকির।

কোথায় রহিছে সুখ? কোথাও সুখধাম নাই
শুধু আছে অন্বেষণ—শুধু আছে অন্ধ অন্বেষণ
যাহা নাই তার পিছে – যাহা আছে তাহাকে পেছনে
পদাঘাতে দূরে ফেলি মায়ামরীচিকা জ্ঞান করি।

যাকে চাও সে কি আছে? সে তোমার কলিজার ছায়া
অন্বেষণে মিলিবে না, মিলিবে না হাজার সিজদায়।

এবাদতনামা: ৮ – সিধা কানেকশান

হাদিস ও ফিকাহ্‌শাস্ত্র নিয়ে কভু করিনি বাহাস
অক্ষর খুঁটে খাক পেশাদার মৌলবি মৌলানা
আমি মস্তিষ্কের মধ্যে খাড়া করে রেখেছি এন্টেনা
সেহেতু তোমার বার্তা পেয়ে যাই সিধা কানেকশানে।

বুদ্ধি তুমি দিয়েছিলে, সেই বুদ্ধি চোখ ঠার মেরে
নিদ্রিত রাখার জাদু আজো আমি শিখিনি মা’বুদ
বুদ্ধি দিয়ে বুঝি তুমি কবে কাকে কোন দরকারে
কী কথা বলেছ – বুঝি, ধর্ম মানে ধর্মগ্রন্থ নয়—
ধর্ম মানে সম্ভাবনা, ধর্ম মানে নিহিত প্রতিভা
ধর্ম মানে প্রেম, জ্ঞান, মেধা ও নির্মাণ
তদুপরি ইতিহাস: মানুষের ক্রমে ক্রমান্বয়ে
মাংসের চেতনা থেকে বয়স্ক বুদ্ধিতে বেড়ে ওঠা।

প্রাপ্তবয়স্ক ধর্ম ব্যক্ত হয় বিদ্যা ও বিজ্ঞানে
তবুও ধর্মের পেশা স্থায়ী রাখে অক্ষরের কীট।

এবাদতনামা: ৯ – কাদা দিয়ে দাগা দেবো

সাফ কবলায় লিখে দিয়া দেব নিজের যকৃত
বর্গা দেব ফুসফুস হৃৎপিণ্ড পাম্পের মেশিন,
মগজের সারবস্তু দিয়া দেব ছটাকে মাপিয়া
আমাকে চষিয়া যাও, শস্য হই দিলে ভারি সাধ।

তারে দেখি—কামলারে, সে অনতিপ্রাতে লাঙলের
হাতা ধরে মাঠে আসে বলদের লেজে হুট হুট
টুশকি মারে, জিহ্বায় ঈষের মাফিক ধরি ফণা
ধাক্কা দেয় মূর্ধায়, দিলখোশ চলে চাষাবাদ।

তোমাকে চিনেছি নাথ: হাতে ধরি, পায়ে পড়ি, বলি,
আমাকে হালট করো, এই অঙ্গে করো হালচাষ;
এশেকে মজেছি-তুমি চাষির স্বরূপে যদি আছো
আমি স্রেফ কাদা হবো পদযুগে হবে। স্বর্ণরেণু—

মসজিদে মুসল্লিরা যখন সিজদা দেবে ভূঁইয়ে
আঠালো চাষের কাদা তাদের কপালে দেবে দাগা।

এবাদতনামা: ১০ – সহিসালামতে আছে সবার ভণ্ডামি

সব ইমামের পিছে সততই হয়েছে আদায়
তোমার নামাজ। বেঁধে এহতেরাম আকিদা মাফিক
ফাতেহা মুখস্থ পাঠ, নিয়তে সবাই পয়বন্দ
সহিসালামতে আছে মনুষ্যের নামাজি তৌফিক।

তবুও মা’বুদ দেখো কেউ কিন্তু কিচ্ছু বোঝে নাই
কে কার হিশাব নেবে? মসজিদে বিশুষ্ক খিলানে
তোমার আয়াতগুলো ভিনদেশি স্বরে প্রতিধ্বনি
তুলে স্রেফ ঝরে যায়—বালি জমে শূন্য আসমানে।

একি শুধু ভাষা প্রভু? একি শুধু জবানের দোষ?
যে ভাষা সবার নয় সে ভাষায় কেন তুমি নিজে
প্রকাশিত হয়েছিলে? তুমি প্রভু আসলে ভাষায়
কখনো কি ছিলে? ছিলে নিঃশব্দে কামে ও এশেকে
বোধে আর অনুভবে—রূহের ভেতরে পিপাসায়।

সে পিপাসা আজ কই? শুধু আছে ভান ও ভণিতা
শোকরগুজার করো সহিসালামতে থাক সবার ভণ্ডামি।

এবাদতনামা: ১১ – মজেছি নিজের মোহে

বিশ্বাসে ইমান নাই, তদুপরি তুমিও মালিক
বুদ্ধি দিয়েছো ঠিকই, অথচ খাটালে বুদ্ধি ভাবো
মস্তিষ্কে আসর করে বেতমিজ দুষ্ট ইবলিস
ফাপরে পড়েছি মওলা কী বা করি কোন রাহে যাই।

মনুষ্যের বুদ্ধিকে কেন এতো ডরাও মা’বুদ
ছহি কি আদতে তবে প্রজ্ঞা তোমারই প্রতিচ্ছবি?
তোমারই ফটোগ্রাফ, তোমারই ক্যামেরাবাক্স, ক্লিক
ফটো তোলা? কার ফটো? তোমার না ক্যামেরা বেটার?

কী নাটবল্টু মাওলা মজাদার মনুষ্যের কলে
কতো না বিজ্ঞান কতো কারখানা—নবীজি ভেতরে
ডিউটিতে ফোরম্যান ভেঁপু হেঁকে ডাকেন শ্রমিক
সকাল বিকাল নাই ওভারটাইম নাই ছুটিফুটি নাই।

ইমান যে বোঝে বুঝবে বুদ্ধি থাক কূটতর্ক লয়ে
মজেছি নিজের মোহে প্রজ্ঞার প্রতিচ্ছবি হয়ে।

এবাদতনামা: ১২ – বাংলা তোমার নয়

গড়েছে। বাংলাভাষা দিয়ে মোর মূর্ধা আর তালু
আলজিহ্বা খেলা করে আ-কারে ও দীর্ঘ ঈ-কারে
দমে দমে টের পাই ওঁ-কার ও বক্ষস্পন্দন
হৃৎতন্ত্র বেজে ওঠে ব্যঞ্জনের বিমুগ্ধ বিস্তারে—

এত্তো ভালো লাগে, প্রভু, এত্তো ভালো লাগে বাংলাভাষা
লোভে চেটেপুটে খাই যেন জান্নাতের আতাফল।
তোমার কি ঈর্ষা হয়? তুমি তো করোনি এ জবানে
নিজেকে জাহির! তবু, হামেশাই আমি আদাজল
খেয়ে লেগে আছি যেন বাংলা রানি নিজেই নিজের
নুরে ও হিম্মতে প্রভু আগুয়ান থাকে প্রত্যেকের।

দশে আজ বলে, বাংলা, তুমিও কি তার ঐশ্বরিক?
তুমিও অশ্রুতপূর্ব? তুমিও কি আল্লার হরফ।

খুশি আমি, বাংলা তোমার নয়, যদি হোত তবে—
বেহুদা তোমার ডাঁট বেড়ে যেত বাংলার গৌরবে।

এবাদতনামা : ১৩ – সব ধর্মে এক কথা

সব ধর্মে এক কথা সব ধর্ম মা’বুদ তোমার
সব ধর্মে আছ, তবু, আমাদের আহাম্মক পেয়ে
একবার খালে ফেলো, একবার বিলে নাও, একবার বনে
বাঘের সামনে থুয়ে কী খেলা গো খেলিছ চতুর!

শিষ্য হয়ে পরমহংসের আমি কালীর মন্দিরে
সিজদা দিয়ে পড়ে রবো দেখি তুমি চিনো কি না মোরে;
দূরদেশে চলে যাবো—শ্যামদেশে অথবা জাপানে—
বুদ্ধের মন্দিরে গিয়ে চেরি গাছে ফুটির কুসুম
দেখি তুমি চিনো কি না; যে কোনো গির্জায় গিয়ে যিশু
যেভাবে ক্রুশের কাঠে অঙ্গে নিয়ে প্রত্যেকের গোনাহ্
নির্মম পেরেকে বিদ্ধ আমি তাঁর রূহের ছায়ায়
প্রজাপতি হয়ে রবে।—চিনে নিয়ো, চিনে নিয়ো মোরে।

চিনিবে না? অবিলম্বে খেলা তবে থামাও নিষ্ঠুর
খেলোয়াড় না রহিলে দুনিয়া নিজেই ঠিক র’বে।

এবাদতনামা: ১৪ – কাঁধে করে ঘুরিফিরি

কাঁধে করে ঘুরিফিরি এ ওজন পাথরের বাড়া
প্রভু দুই ফেরেশতাকে কাঁধে নেয়া যথেষ্ট জুলুম
নিতান্ত তোমার ভয়ে চুপ থাকি। নইলে কবেই
নামিয়ে রাস্তায় বলি, ‘ও ফেরেশতা হাঁটা শিক্ষা করো’

আমার আমলনামা লিখা হয় ফেরেশতার হাতে
মানুষের চেয়ে তারা কেরানি হিশাবে খুব ভালো!
কিন্তু রোজ হাশরের দিন যদি বলি প্রভু তুমি
যাদের দলিল দেখে দুনিয়ায় আমার কাজের
হিশাব মেলাচ্ছ তারা কতটুকু বুঝেছে আমার
কাজের মর্মার্থ? যদি মখলুকাতে ইনসান
সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয় তবে ফেরেশতাকে কোন বলে
মানুষের কর্মনামা লিখতে তুমি দিয়েছ মা’বুদ?

তবে কি আমাকে তুমি দোজখে পাঠাবে? তাই হোক
কবিকে শাস্তি দিয়ে এ সওয়াল মীমাংসা হবে না।

এবাদতনামা: ১৫ – স্বেচ্ছায় সিজদা চাও

পশ্চিমে কাবার দিকে মুখ রেখে বুঝেছি মা’বুদ
স্রেফ দেহচর্চা ছাড়া আখেরাতে তোমার খাতির
পাবার ভরসা নাই; লাব্বায়েক লাব্বায়েক ডেকে
ডাকা শুধু সারা হয় আমি নিজে থাকি না হাজির
নিজের নফসের সঙ্গে; চাঁদসূর্য অভ্যাসবশত
মক্কা প্রদক্ষিণ করে, আমি আছি উপাসনারত
একাকী বা মসজিদে সবি প্রভু সর্বস্ব অভ্যাস
বান্দার দাসত্বরীতি বান্দাকে বানিয়েছে দাস।

মোমিনের প্রাণ মৃত দৈনন্দিন বিশ্বস্ত ব্যায়ামে
সেকি তার দোষ প্রভু? তুমি চাও তোমার নামাজ
তাই সে যন্ত্রের মতো গায়ে খেটে রেখেছে ইমান
সত্যি যদি স্বেচ্ছায় সিজদা চাও তবে ইচ্ছা কাজ
অভ্যাসবিমুক্ত করো। সৃষ্টি হোক সম্পূর্ণ স্বাধীন
এ কারণে হতে দাও হলে কেউ মা’বুদবিহীন।

এবাদতনামা: ১৬ – ইমান বা রেনে দেকার্তের জ্যামিতি

হ্যাঁ, আমি কবুল করি, বলি আমি দুনিয়ার কোনো
আল্লা নাই খোদা নাই, ভণ্ডেরা চটেছে বিস্তর
মসজিদে মসজিদে কড়াকণ্ঠে কর্কশ ইমাম
আমাকে কাফের বলে জারি করে দিয়েছে ফতোয়া।

তুমি প্রভু হেসেছিলে, তুমি জানো আমি দেকার্তের
জ্যামিতি ও যুক্তিতর্ক ভালোভাবে আয়ত্ত করেছি
দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বস্তু থাকে সেরকম বস্তুর লাহান
তুমি অবস্থিত নও, তুমি স্থিত কেবল ইমানে।

তবু দেখো রে-আক্কেল বস্তুর সহিত তোমার
অস্তিত্ব তুলনা করে হরদম করছে শেরেক
শেরেকির গুনা ভারি মারাত্মক; তবুও গজব
নাজিল করোনি তাকে। শেরেকির দিয়েছো প্রশ্রয়।

এ দুনিয়া রন্ধ্রে রন্ধ্রে শেরেকিতে ভরেছে মা’বুদ
আমি একা পদ্য লিখে কতো আর করে যাব সাফ!

এবাদতনামা: ১৭ – ফুরসত কোথায়?

দুনিয়ায় পাঠিয়েছো, আমি তাই কাজ করে খাই—
আমি চষি হাল গড়ি কারখানা চালাই ইঞ্জিন।
কামে কাজে এতো ব্যস্ত ফুরসত পাইনা মা’বুদ
তোমাকে যথেষ্ট ডাকি সেরকম সময় কোথায়?

অথচ ফেরেশতারা তোমার সান্নিধ্যে কী আরামে
হেসে খেলে মহানন্দে থাকে দিলখোশ সারাখন
এমন অলস বান্দা বানিয়েছ প্রভু তুমি যেন
নিজের প্রশংসা শুনে হতে পার নিজে ডগমগ—
সিজ্‌দা পাও নিরন্তর। মানুষের জিহ্বায় তোমার
নামের যে অর্থ আছে তুমি তাতে কেন না-শোকর
বুঝতে পারি না। তবে, কেন দাও পদ্যের আয়াত
কবিকে, যে বেতমিজ, যে তোমাকে ভুলে গিয়ে ভাবে
সকল কালাম বুঝি তার লিখা: সে নিজেই তুমি।

দুনিয়া চালাক দেখি ফেরেশতারা, সভ্যতা গড়ুক
তখন দেখবে মজা আল্লার প্রশংসা কাকে বলে!

এবাদতনামা: ১৮ – আল্লার কালাম

একটি হরিণছানা নহরের জলে মুখ রেখে
স্রোত নাড়াচাড়া করে। তারপর জননীর কাছে স্ত
নের সন্ধান পেয়ে চলে যায়। অভিমানী জল
পাহাড়ের সিনা ভেঙে ধায় বেগে প্রবল আক্রোশে।

আমিও তোমার ঢেউ নেড়েচেড়ে দেখেছি মা’বুদ
নিরাকার জলস্রোতে নিরঞ্জন তোমার তৌহিদ
আয়নার মতো স্বচ্ছ। আমার সর্বস্ব হয় লীন
তোমার ভেতর, ভারি ভয় পাই নিজেকে হারিয়ে।

হরিণশাবক তাই ফিরে যাই দুনিয়াদারির
আরাম ও আয়েশের খোশহাল জননী কন্দরে
তুমি ফলে রুষ্ট হও, বে-রহম হয়ে অকস্মাৎ
আমার কপালে হানো অকারণে তোমার গজব।

কিন্তু যদি লীন হয়ে বলি আমি আল্লার কালাম
তোমার মোল্লারা খায় ছিড়েখুঁড়ে আমার কলিজা।

এবাদতনামা: ১৯ – একাকী থেকেছি

একাকী থেকেছি, আর যাকে ঠিক একাকীত্ব বলে
তাকেও বুঝেছি মর্মে জীবনে অনেক একা থেকে।
কিন্তু সেটা সাময়িক, প্রভু তুমি অপার দয়ালু
স্বভাবে হলেও একা মনুষ্যেরে একা কর নাই।

আছে আম্মা আব্বা বোন আছে ভাই চাচা ও মাতুল
আছে দোস্ত রসিক স্বজন আছে প্রীতিময়ী প্রেমিক বঁধুয়া
কার্যব্যপদেশে আছে নানাবিধ ব্যক্তি ও সজ্জন
একা নই একা নই মনুষ্য মোটেও একা নয়।

কিন্তু এই নিখিলের নিরালম্ব বিশাল গহ্বরে
তোমার আরশখানি এত্তো একা নিঃসঙ্গ মা’বুদ
ভেবে খালি ভয় লাগে; মনে হয় নৈঃসঙ্গের ভারে
তুমিও হয়েছো হিম, দীর্ঘশ্বাসে হয়েছো পাথর

পড়ে আছো কোন গ্রহে? নিজ মখলুকাতে নিজে একা!
আল্লাহ তোমার লাগি কেবলি বেদনা জাগে মনে।

এবাদতনামা: ২০ – ‘আম্রমুকুল মারহাবা’

খোরমা আমি ভালোবাসি আলুবোখারাও খুব স্বাদ
পেশতাবাদাম প্রভু খেয়ে আমি দেখেছি প্রত্যেকে
অতি উপাদেয় আর পুষ্টিকর; নাশপাতিগণ
যখনি তুলেছি হাতে টসটস সঙ্গে সঙ্গে রসে।

মরু ও বালুর দেশে রকমারি ফলের বাহার
আমি অভিভূত হই তোমার গহিন কুদরতে
এই রহমত থেকে বঙ্গদেশ কেন, ইয়া রব,
দারুণ বঞ্চিত—আমি ভাবি, কিন্তু উত্তর জানি না।

তবে ফাল্গুনে প্রভু আমি খোদ লক্ষ করেছি
আমের মুকুলগুলো বৃক্ষদের হৃৎপিণ্ড থেকে
নিজের গরিমা নিয়ে একান্তই নিজের কুদরতে
প্রস্ফুটিত হয়, বলি, ‘আম্রমুকুল মারহাবা’।

আরো আছে জামরুল, জামফল, বৈঁচির জাদু
লিস্টি দেবো না, তুমি খামোখাই ঈর্ষান্বিত হবে।

এবাদতনামা: ২১ – নগদ

দাও যদি দেবে, আর না দেবে তো প্রভু সাফ সাফ
বলে দাও আমি বৃথা তোমার পেছনে আমরণ
ঢুঁড়িব না। মানুষের আছে আরো বহু অন্বেষণ
আছে নানা কাজ, আছে নানাবিধ সাধ্য, সাধনা।

আমি সাদামাটা প্রাণ, মাথা মোটা বহরে বাঙালি
লুঙ্গি যদি পরি তবে মালকোঁচা মেরে নামি কাজে;
টুপিটাপা বুঝি কম। মারফতি? তাও ধাতে নাই
বীজ ফেলি ধান হয়—নগদে নগদে সারি কাম।

তুমি কি ফুটিবে নাকি ফুটিবে না? সর্ষের মৌসুম
কার্তিকের মাসে শুরু শীতে শীতে পৌষে পেকে যায়।
এরকম স্রেফ সাড়ে তিন মাসে ফুটিবে কি নাথ?
ধরিবে কি ফল? আমি এশেকের পাবো ফজিলত?

তা না হলে এসে যাবে তড়িঘড়ি ইরির মৌসুম
তোমাকে ভুলিতে হবে ফাদে পড়ে হাজার ধান্দায়।

এবাদতনামা: ২২ – বেকায়দা সওয়াল

সাধ হয় একবার শুধাই তোমাকে বরাবর
তুমি কি বানাতে পারো মশহুর এলেমি পাথর
যা নিজেই মাটি থেকে ওঠাতে পারো না—এতো ভারী!
পারো কি মা’বুদ, বলো, আসো তবে ফয়সলা সারি।

যদি ব্যর্থ তার মানে আল্লা নয় সর্বশক্তিমান
এলেমি পাথর তিনি পারেন না নিজ হিম্মতে
মাটির ওপরে তুলতে—খুব শরমের কথা—মান যায়!
‘হ্যাঁ’ বললে পড়বে মওলা মহা সমস্যায়!

তাহলে কি সত্যি তুমি ও পাথর বানাতে পারো না?
অক্ষম? অসম্ভব- অবিশ্বাস্য মোমিনের কাছে!
কিন্তু বুদ্ধি, প্রভু, না-বাচক তোমার উত্তরে
চোখ ঠারাঠারি করে—মজা পায় হেঁয়ালির ধাঁচে

তোমাকে কব্জা করে। ঘাঁটিও না আমাকে মা’বুদ
ঝুড়িতে সদাই রেডি বেকায়দা সওয়াল-সা’বুদ।

এবাদতনামা: ২৩ – শতখণ্ডে বিকায় তৌহিদ

সকলি এশেক মওলা? আর নাই, আর কিছু নাই?
বিজ্ঞান যেভাবে জানে সেভাবে জানার মতো কোনো
আলাহিদা সত্তা নাই? তুমি নাই? শূন্য পুষ্করিণী—
বড়শি ফেলে বসে থাকা, চুপচাপ, জলে মাছ নাই!

আমি তবু বসে আছি যেভাবে কাছিম বসে থাকে
শক্ত চামড়ার খোলে গা-গতর সমস্ত সেঁধিয়ে
যেন মস্তো উজবুক; দুনিয়ার হাল হকিকতে
তার তিল হুঁশ নাই—এ কাছিম নিতান্ত এতিম!

মাঝেমধ্যে জলে তার ছায়া পড়ে ঢেউয়ের আঘাত
বিম্ব শতচ্ছিন্ন করে, জলে জলে প্রতিবিম্বে যিনি
রাজিছেন ছায়া হয়ে—মৎস্যের পুচ্ছ হয়ে দ্রুত
খেলিছেন লুকোচুরি—সে তাকে বড়শির ক্ষিপ্র টানে
তুলে আনে স্থল ভাগে, তুমি প্রভু হাসো অট্টহাসি।

মাছের বাজারে তাই শতখণ্ডে বিকায় তৌহিদ!

এবাদতনামা: ২৪ – বেগম শালিখ

বেহেশতের বাগিচায় গা-খয়েরি একটি শালিখ
ডাকিতেছে। ওরে প্রাণ, শুনিলি কি বেহেশতের ডালে
জানপ্রাণ ডাকিতেছে দয়াময়ী মোদের শালিখ
আল্লার দরবারে, ডাকিতেছে নিজের জবানে।

তুমি কি শুনিতে পাও, তুমি কি দেখিতে পাও, প্রভু,
হলুদ ঠ্যাঙের হাঁটু টান করি গন্দমের ডালে
গলায় খাঁকারি দিয়া দীনহীন চঞ্চু দ্বয়ে ক্ষীণ
কাতর বিনীত স্বরে ডাকিতেছে বেগম শালিখ?

কী আর চেয়েছি, প্রভু, অতি অল্প মোদের প্রত্যাশা
বেহেশতে থাকিতে দাও আমাদের প্রাণের পক্ষীরে
হোক সে শ্যামলা মেয়ে, সোঁটা নাক, ঠ্যাং দুটো বাঁকা
খাটাখাটুনির ফলে চোখ বসা, তবু সে বঙ্গের
আদুরিনী মেয়ে, তাকে না পেলে তো বৃথা ফেরদৌস—

জানপ্রাণ ডাকো পাখি, আল্লারও দিল গলে, ডাকো জানপ্রাণ।

এবাদতনামা: ২৫ – হেরা গুহা গহ্বরে

হেরা গুহা গহ্বরে কাঁপিছেন নবীজি আমার
জিব্রাইল আসিতেছে, ক্রমে ক্রমে আসিছেন তিনি।
কাঁপিছেন থরথরি, কাঁপিছেন সর্ব অঙ্গে ভীতি:
বাঘের থাবার মুখে পড়ি যথা কাঁপিছে হরিণী।

জিব্রাইল কহিলেন, ‘মুহম্মদ, কহো দেখি শুনি
তোমার প্রভুর নামে, সাফ সাফ করো উচ্চারণ…।’
কাপিল নবীর জিহ্বা, তৎসঙ্গে কাপিল কলব
আল্লার নিশ্বাসে রূহের সঙ্গে হোল রূহের মিলন।

আমাকে এখন প্রভু বোঝাও গুহার মানে, কেন
তোমাকে জাহির হতে হয়েছিল গিরির কন্দরে?
কেন এই একাকীত্ব? কেন এই নিঃসঙ্গ প্রস্তুতি
হেরার গুহায় বসি প্রিয়তম আমার নবীর?

যে পায় সে একা পায় যে নিজের হৃৎপিণ্ড চেনে না
তার নফসের দোষ কাটিবে না নামাজে রোজায়।

এবাদতনামা: ২৬ – জিম্মাদার বিদ্রোহের লাশে

প্রভু, ঢাকা শহরের মসজিদ সারা দুনিয়ায়
মশহুর; থাম্বা ও খিলানে আছে রকমারি কাজ।
ব্রিটিশের জমানায় সাহেবেরা ঠিক বা বেঠিক
সোসাইটি এশিয়াটিক বানিয়ে বিস্তর গবেষণা
করে গিয়েছিল শুনি। সাহেবের মতো সাদা চোখে
নব্য বাঙালি আজো ঘাঁটাঘাঁটি অনুসন্ধান
করেন দেখতে পাই, দোয়া করি তারা ডক্টরেট
পেয়ে যেন সাহেবের চেয়ে হন দ্বিগুণ সরেস।

আমি ডাহা মূর্খ প্রভু, বুঝি না স্থাপত্য চিত্রকলা
বুড়িগঙ্গার পাশে গেলে শুধু হু হু করে প্রাণ
মনে হয় সিপাহিরা আজো ঝোলা ফাঁসির রজ্জুতে
দাফনের অপেক্ষায়—দড়ি কেটে নামাই জমিনে।

জানাজায় লোক নাই, জিম্মাদার বিদ্রোহের লাশে
গম্বুজ ও খিলানের মশকরা আমাকে কোরো না।

এবাদতনামা: ২৭ – ওয়াদা

কদম আগাই যদি তুমি নাকি কদম দশেক
আগুয়ান হয়ে আরো কাছাকাছি আসিবে আমার,
তাহলে দিলাম দেখো প্রথম কদম, মৃত্তিকায়
গোড়ালি আঘাত করি রওয়ানা দিলাম লিল্লাহে।

কী করে জানিব মওলা তুমি অতঃপর বিপরীতে
ক’ কদম এলে, নাকি ভুলে গিয়ে আদৌ এলে না।
পথপার্শ্বে বটবৃক্ষ তবে হোক সাক্ষী উভয়ের
আমি বৃক্ষ তক এসে দাঁড়ালাম জানাও হদিস।

ক্রমে বেলা পড়ে আসে পক্ষীগণ ফেরে নিজ নীড়ে
সবুজ বৃক্ষের বুকে অন্তরীক্ষ বুঝি করে ভিড়।
আমি ঠায় জেগে থাকি সারারাত নক্ষত্রের তলে
নীহারিকামণ্ডলে তোমার পায়ের চিহ্ন খুঁজে।

ভোর হয়, বদলে যায় একদিন ঋতু ও ভূগোল
ওয়াদা বেকার হয় কোনো দিন জবাব মেলে না।

এবাদতনামা: ২৮ – মানুষের মহব্বত

গোস্বা হয়ে চলে গেছো, ত্যাগ করে আমাকে কৈশোরে
গেছো বয়ঃসন্ধিকালে। যে বয়সে বালকেরা ভাবে
আল্লা মানে পোস্টম্যান: অজপাড়াগাঁয়ে খাকি জামা
গায়ে দিয়ে খুঁজিতেছে বাল্যের বেগানা সাকিন।

ডাকটিকিটের তলে চাপা পড়া আমার ঠিকানা
তুমিও খুঁজিতেছিলে। পথে দেখা পেয়ে গেলে তার
চঞ্চল কিশোরী—যার রশি বাঁধা ছিল শিশু ছাগ
জানপ্রাণ খুঁটিখানা বক্ষে চাপি ছিল মহব্বতে।

শুধালে আমার কথা, সে তখনি প্রতিদ্বন্দ্বী জেনে
তর্জনী চিবুকে রাখি পলকে আঁটিল কৌশল
কহিল, ‘কবিকে চাও? তবে যাও সদর রাস্তায়’
নিজে ধানক্ষেত ভেঙে আগেভাগে বাধিল আমায়।

মানুষের মহব্বত ঠকিয়েছে তোমাকে মা’বুদ—
রেগেমেগে চলে গেছো, আমি নই সে কারণে দায়ী।

এবাদতনামা: ২৯ – আমিও মিশিবো কালস্রোতে

প্রভু মওতের ডর আমাকে খামাখা দেখিয়ো না
আজরাইল এলে পর দুই হাতে হ্যান্ডকাফ পরে
যেভাবে পুলিশ ভ্যানে রাজবন্দি ওঠে দৃঢ় পায়ে—
মৃত্যুর মোটরে চাপি আমিও সেভাবে যাবো চলি।

বন্দি আর কতদিন! সব রাজবন্দি শেষমেশ
মুক্তি পায়। রাজার বদল হলে রাজার আসামি
কখনো কি পারে কেউ কারাগারে রাখিতে আটক?
আমাকেও পারিবে না, আমিও মিশিবো কালস্রোতে।

কোথাও মিছিলে ফের আমি হবো আকাঙ্ক্ষার ভাষা
কিম্বা পাঠ্য গ্রন্থে হবো প্রতিপাদ্য পিথাগোরাসের
পদার্থবিজ্ঞান হবো; আল জুবায়ের নই, তবু
এলজেব্রা হবো, হয়ে জেব্রা হবো বিজ্ঞানখানায়।

না পারি তো পদ্য কাফি, পদ্যে আমি বিলকুল খাঁটি
শোনাবো আজরাইলকে গান সে আমার পরান নেবে না।

এবাদতনামা: ৩০ – শ্রীরাম পরমহংস

লাল জবা দেখিয়াছ? তুমি অই ফুল বঙ্গদেশে
ফুটিতে কহিয়াছিলে তাই সে লটকে ফুটে থাকে;
লোহুর মতোন লাল—শোণিতের হিমোগ্লোবিন
বুঝি পাপড়িবৎ হয়ে শোভা পায় বনে ও বাগানে।

আমি একটি জবা ফুল আজ প্রভু তোমার সম্মানে
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের হাতে দেবো
তিনি মুচকি হাসিবেন, ফোকলা দাঁত উঠিবে বিহসি
কহিবেন, ‘এলি নাকি ও আমার শেখের ছাওয়াল?’

আমি কি কোথাও গেনু? আমি তো কোথাও যাই নাই
আমি যদি যাই তবে সর্বত্রই সমভাবে যাই।
ভাবাবেশে নাচিতেছে দশাপ্রাপ্ত প্রেমের ঠাকুর
শেখের ছাওয়াল নাচে সমভাবে ঠাকুরের প্রেমে।

শ্রীরাম পরমহংস মা কালীর মারফতে প্রভু
ও জবা পাঠালে তুমি মহব্বতে করিও গ্রহণ।

এবাদতনামা: ৩১ – ঠাকুরের বেটা

আমাদের রবিবাবু মস্তবড়ো কবি, সাহেবেরা
নোবেল প্রাইজ দিয়ে হক তার সাহিত্য কীর্তির
করেছে কদর। ইংরেজের ঘেঁটু হয়ে তার বাপ দাদা
মালপানি কামিয়েছে, ব’নেছে স্বঘোষে জমিদার
কিন্তু বংশের দোষে জল পড়া পাতা নড়া প্রভু
কভু বন্ধ হয় নাই—সে হয়েছে বিশ্বের শায়ের।

তাহারে সালাম করি তাঁহারে মারহাবা কহি প্রাণে
পরওয়ারদিগার তবু দিল মোর বহুত নাখোশ
তাঁর প্রতি। ছিল দোষ রবীন্দ্রের। তেনার কলমে
বহু পয় পয়গম্বর সাধক ও মনীষীর নাম
হয়েছে স্মরণ কিন্তু ঘুণাক্ষরে নবী মুহম্মদ
আকারে ইঙ্গিতে ভাবে দিলে কিম্বা নিবের ডগায়
একবারও আসে নাই, তাঁকে তাই মাফ করি নাই।

ঠাকুরের বেটাটারে তুমি কিন্তু রহমান করে দিয়ো মাফ।

এবাদতনামা: ৩২ – কচি হাঁটু কচি পায়ে

আজ আছি কাল নাই, কাল যদি না থাকি তো র’বে
একটি পদ্যের খাতা—একটি জায়নামাজের স্মৃতি—
তোমার সহিত শত খুনসুটি। নদীয়ার চাঁদ
শচিমাতা সনে যথা খেলিয়াছে বালখিল্য খেলা
এই রাঢ়ে এই বঙ্গে—তার কচি হাঁটু ও পায়ের
চিহ্ন যদি খুঁজে পাও আমাকেও পাবে তার সাথে।

গোরাচাঁদ নেচে যায় হাসিয়া কাঁদিয়া নাচে প্রেমে
সঙ্গে অদ্বৈতাচার্য ঊর্ধ্বে তুলি বেহুঁশ দু’হাত
প্রভু দেখ নাচিতেছে; নাচিতেছে কাহার এশেকে
একবার দেখে যাও, এসে শুধু দেখো গো চাহিয়া!

আজ আছি কাল নাই, কাল যদি না থাকি তো প্রভু
আমার এ জায়নামাজ লোকে যেন রাখে হেফাজতে,
হাঁটু ও পায়ের নানা আলামতে ছেঁড়াখোড়া; লোকে
এবাদত যেন বোঝে—তৎসঙ্গে বোঝে ইতিহাস।

এবাদতনামা: ৩৩ – কবিদের বাদশাহ তিনি

আমার নবীজি প্রভু নিরক্ষর, অক্ষরের দোষ
তাঁর কলবের গায়ে বিলকুল ছাপ ফেলে নাই।
আসমান জমিন চাঁদ সুরুজ ও নক্ষত্রমণ্ডল
সিধা এসে তাঁর প্রাণে সৃষ্টির গূঢ় হিকমত
দান করে দিয়েছিল। অক্ষরের আগে হৃদয়ের
সঙ্গে ছিল বস্তুর আদি ও বিশুদ্ধ জানাশোনা।
যা প্রকৃতি তাই প্রাণ—প্রাণ প্রভু বস্তুর জবান
সে জবান দিয়েছিলে তুমি মোর প্রিয় নবীজিরে।

তাই তিনি কবি, তিনি কবিদের চেয়েও অধিক
প্রতিটি আয়াতে তাঁর মখলুকাত কথা কয়ে ওঠে;
পরিচিত শব্দ ভাষা অক্ষরের ভারমুক্ত হয়ে
দুনিয়া নতুন নামে নামাঙ্কিত বলে মনে হয়।

কবিদের বাদশাহ তিনি তাঁকে দিয়ো আমার সালাম
এই উম্মতের পদ্য যেন তাঁর পায় সুপারিশ।

এবাদতনামা: ৩8 – বেয়াদপি

আমি বেতমিজ জানি, আমি হাড়ে হাড়ে বেয়াদপ
রোখ চেপে যায় প্রভু লুকোচুরি খেলি তোমা সনে
অন্যেরা কী বুঝিবে? তারা কি এশেকে দরবেশ?
তারা কি দেখেছে আমি রাখি কই লোটা ও কম্বল?

বাজারে রটায়ে দেবো তুমি প্রভু মৃত, কফিনের
বাক্স লয়ে নগরে নগরে আমি দেবো প্রদর্শনী
নাস্তিকেরা খুশি হবে। ভক্তেরা কেঁদে কেঁদে ক’বে
‘হায় হায় শেষমেশ মনুষ্যেরা হয়েছে এতিম।’

ফের বেয়াদপি? গোস্বা কোরো না, থাক ও পরিকল্পনা-
কিন্তু ভেবে দেখো এতে ভালো হোত। তুমি মানুষেরে
দিয়েছ আক্কেল বুদ্ধি অথচ সে নিজের আক্কেলে
চলে না, সে ভাবে সব তুমি তার করে দেবে ঠিক;
কী কথা বলেছ সেই দু’হাজার সাল আগে, তার
পেছনে ছুটেছে আজো এক পাল ভেড়ার দঙ্গল!

এবাদতনামা: ৩৫ – বোরখা

আমার বান্ধবী প্রভু বোরখা পরে না, মোরে কয়
যারা পরহেজগার তারা কক্ষনো নারীর শরীর
কু-নজরে নয়, দেখে আল্লার শরিফ নয়নে;
লুচ্চা ও লম্পট যারা তারাই কেবলি বোরখার
অজুহাত তোলে। আল্লা দিক কালো কাপড়ের
পট্টি বেঁধে এইসব পুরুষের নাপাক নজরে।

তোমার কী মত? দেখো, বসে আছে দর্জি আর তাঁতি
তারাও সমান ভাবে তোমার মতের উদগ্রীব
তাদের ব্যবসা ধান্দা, তারা আছে কাঁচি ও কাপড়ে
সেলাই মেশিনগুলো ফোঁড় দেবে তোমার নির্দেশে।

প্রভু, মন্দ নয় দেখো: পোশাকে দুরস্ত, আছে ভান
টুপিও রয়েছে, কিন্তু চোখে পট্টি কালো কাপড়ের
হাটিতেছে বেয়াকুফ। রাস্তায় বোরখা নাই, আর
লোকে চিনিতেছে ঠিক কে যে লম্পট কে যে পরহেজগার।

এবাদতনামা: ৩৬ – বিবি খদিজা

বিবি খদিজার নামে আমি এই পদ্যটি লিখি:
বিসমিল্লাহ কহিব না, শুধু খদিজার নাম নেবো।
প্রভু, অনুমতি দাও। গোস্বা করিও না, একবার
শুধু তাঁর নামে এই পদ্যখানি লিখিব মা’বুদ।

নবীজির নাম? উহুঁ, তাঁর নামও নেবো না মালিক
শুধু খদিজার নামে—অপরূপ খদিজার নামে
একবার দুনিয়ায় আমি সব নাম ভুলে যাবো
তোমাকেও ভুলে যাবো ভুলে যাবে। নবীকে আমার।

একমাত্র তিনি, প্রভু, একমাত্র তাঁর চাকুরিতে
উট ও ব্যবসা লয়ে ছিল মোর নবীজি বহাল।
তুমি ডাঁট মারিও না—নবী ছিল তোমার হাবিব
কিন্তু খদিজার ছিল বেতনের বাঁধা কমচারী—

সব নারী জানে তুমি খাটো হয়ে আছে। এইখানে
তোমার খাতিরে তবু প্রকাশ্যে তা জাহির করে না।

এবাদতনামা : ৩৭ – সোনার মদিনা চল্‌

সোনার মদিনা চল ওরে মন পাখি হয়ে উড়ি
সোনার মদিনা চল, নবীজিরে পা ধরে সালাম
করে আয়। এলুমিনিঅমে তৈরি মস্ত বড় পাখা—
সউদি এয়ারলাইন্স—তারা তোরে নেবে না আরবে?
তোর কি ডলার আছে? রিয়েল, ইয়েন আছে? নাই
দিনের মজুরি দিয়া কোনো শালা দেবে না টিকেট।

অতএব পাখি হও, ওরে মন আল্লার দরবারে
কহ এ মনুষ্যজন্ম তেয়াগিয়া পাখি হতে চাও;
কিম্বা হও আরবের শেখ; কিম্বা কন্ট্রাকটরি ধরি
জহুরুল ইসলাম হয়ে নবীর মোকামে বিজিনেস
শুরু কর্‌। ওরে মন কষে ধর্ আদম ব্যবসা
তড়িঘড়ি মালকড়ি কামা। টাকা ছাড়া ছেঁড়া ত্যানা
কী করে ঢাকিবে তোর অনাহারে ক্লিষ্ট লজ্জাস্থান?

উড়ে যা নবীর কাছে নিয়ে যা রে পাখি ফরিয়াদ!

এবাদতনামা: ৩৮ নবীর রুমাল

যদি দাও নেবো আর না দেবে তো তথাপিও নেবো
এ দুনিয়া সর্বভাবে—এ জাহান সর্বস্ব আমার।
তোমাকেও নেবো, তুমি যদি জানো বলে কয়ে নেবো
না জানো তো চুরি করে নিয়ে যাবো সর্বস্ব তোমার।

নবীর রুমাল নেবো, পরিশ্রমে ঘামে ভেজা মুখ
যে রুমালে মুছে তিনি ব্যস্ত ফের দৈনন্দিন কাজে
 সে রুমাল চেয়ে নেবো, না দিলে পকেটমার হবো
কাঁচি দিয়ে কেটে নেবো। দো জাহানে চোরের সমাজে
হবো আমি ধুরন্ধর ক্ষিপ্রহাত চোরের সম্রাট
সাবধান সাবধান যদি ঘটে বিষম বিভ্রাট!

আমি কি হারাতে চাই? আমি কিচ্ছু হারাতে দেবো না
না ধর্ম না নাস্তিকতা—কবি, প্রভু, উভয়স্বভাব:
চুরি তার খাসিলত—নবীর রুমালে তার লোভ
অথচ কালকেই ফের ধরিবে সে নাস্তিক্যভাব।

এবাদতনামা: ৩৯ – ফটোগ্রাফার

আমারে বুঝায়ে কও কোনো আহাম্মক যদি বলে
আমি আল্লা বিশ্বাস করি না, তাতে তুমি কি মা’বুদ
থোড়াই কেয়ার করো? বেশুমার কীট ও জীবাণু
পয়দা করেছো, ফলে কতো কীট পুচ্ছে ফরফর
সুড়সুড়ি টের পেলে হয়ে যায় বেদিশা ফড়িং
তারা লম্বা লাফ দেয়—ঘাসের ডগায় বসে ভাবে:
উঠে বসিয়াছে বুঝি আসমানে আল্লার আরশে!

ওগো প্রভু, তুমি বসে হাসো দেখে তোমার শিশুর
ইঁচড়ে পাকামি। হেসে দক্ষিণের বাতাসকে আরো
মৃদুভাবে বয়ে যেতে বলো যেন ঘাসের ফড়িং
আরামে দুলতে পারে, পা ফসকে যেন আহাম্মক
নিচে না আবার পড়ে সেই ভয়ে থাকো উদগ্রীব।

আমি কবি—ফটোগ্রাফার—আমি নিরপেক্ষভাবে
এই মহব্বত, প্রভু, এঁকেছি পদ্যে দেখো প্রকাশ্য খাতায়।

এবাদতনামা: ৪০ – পদশব্দ

পদশব্দ শুনিতেছি পদশব্দে জাগিছে নিশীথ
পক্ষ ঝাপটি জাগে পদশব্দে প্যাঁচা ও হুতোম।
মধ্যরাতে পদশব্দে শ্যাওড়া গাছে কাঁপে হি হি
ভূত অমাবস্যা জাগিতেছে, কার পদশব্দে জাগে রাত?

কবি জাগে। অকস্মাৎ বাসুকির মতো ধরি ফণা
অন্ধকার ধেয়ে আসে গোগ্রাসে খাবে সে দুনিয়া।
খাক, খেয়ে এ দুনিয়া হয়ে যাক হাড়ে মাংসে খাক
কংকাল ঝুলিয়া থাক রাত্রিকালে তারার পেরেকে।

প্রভু, তুমি শুনিতেছ? পদশব্দ? আমি আসিতেছি—
আমি আসিতেছি তাই কাঁপিতেছে জাহেলিয়াতের
শেষ সেকেন্ডের কাঁটা—ঘড়ি আজ ভাঙিব মিনিটে
সাফা মারওয়ার মধ্যে গোড়ালিতে বহাবো নহর।

পদশব্দ বাজিতেছে, পদশব্দে সুবেহসাদিকের
দিগ্বিজয় জাগিতেছে, প্রভু, করি হাজার শোকর।

এবাদতনামা: ৪১ – আষাঢ়

এ জগতে বৃষ্টি হয় যে জানে সে জানে ভালোভাবে
বিরহের কান্দনে কীভাবে আসমান ফালা হয়
শহরের মধ্যিখানে। কদম্বের ডালে বসি ডাকে
আষাঢ়ের মুয়াজ্জিন, গলায় খাঁকারি দিয়া ধায়
বেতমিজ ট্রাক টেম্পো রংবাজ তেকোনো স্কুটার
দুনিয়ায় বৃষ্টি হয় ছটফট লাগে কলিজায়।

কোথাও গলির মধ্যে তবুও হঠাৎ জানালার
আধখানা খুলে যায়—আধা দেখি গূঢ় তসবির;
চেহারা ঠাহর করে বুঝি তুমি ষোলো আনা নাই—
তবু দিলে শান্তি লাগে পলকের বিদ্যুৎ ঝিলিকে।

ষোলো আনা দেখা দাও। এ আষাঢ়ে সজল শহরে
আধেক নগদে শোধ বাকি হাফ কেন প্রভু বাকি!
এশেকের মূল্য দাও: দরদামে কবির জিন্দেগি
তামাম হয়েছে শোধ—দাও প্রভু এবার দিদার।…

এবাদতনামা: ৪২ – নবীজির ওয়াস্তে

আমার মওত হলে কেউ যেন না পড়ে জানাজা
অপরের সুপারিশে প্রভু আমি যাবো না জান্নাতে।
তুমি যদি নিতে চাও তাও ভেবে দেখিব মা’বুদ
কবির কী আসে যায় ফেরদৌস বা হাবিয়া নরকে?

ফেলে দাও পরিত্যক্ত—খাক মুর্দা কাকে ও শকুনে
অথবা মাটির তলে সোৎসাহী কৃমি আর কীট।
আগুনে পোড়াও আর জলেতে ভাসাও—সবই প্রেম
রাধা হয়ে গোরস্থানে ঝুলে রবো তমালের ডালে।

কবির কী আসে যায়? আছে দায় নবী মুস্তফার তাঁ
র কাছে হেফাজতে আছে সব কবি ও কবিতা
উম্মতি উম্মতি বলে কাঁদিবেন। নবীজি জানেন
সব কাব্য নবীজির ওয়াস্তে লেখে স্বয়ং ঈশ্বর।

পরলোক? পরলোকে এক ফোঁটা করি না বিশ্বাস
স্রেফ নবীজীর ওয়াস্তে ফেলিতেছি জীবের নিঃশ্বাস।

এবাদতনামা: ৪৩ – আমার জানিতে সাধ

আমার জানিতে সাধ এক আদমেরে কেন একা
পয়দা করিয়া ছিলে? ফের তার পাঁজরের হাড়
ধার লয়ে কেন তুমি পয়দা করেছ শ্রীজননী?
দোষ কার? প্রভু, বলো, তোমার না বিবি হাওয়ার?

জননীর গর্ভে দেখি ফের সেই পাঁজরের হাড়
সৃষ্টির আদি থেকে পয়দা করে চলেছো মা’বুদ
এক আদমের কেচ্ছা—সেই কেচ্ছা ওয়াজে কেরাতে
নিত্যদিন গাহিতেছে বে আক্কেল সমস্ত পুরুষ।
বিপরীতে কোটি কোটি আদমের স্রষ্টা নারী, দেখো,
তোমার ইজ্জতে প্রভু নীরবে নিঃশব্দে এবাদতে
সংগোপন রাখে জ্ঞান। লুকায় সে আদ্যসৃষ্টির
ভুল। মওলা গো সর্বজ্ঞ তুমি জানো অবশ্যই
আদম পয়দা হয়, কিন্তু প্রভু স্রষ্টার হিম্মত
শ্রীজননীর জন্য ধার্য। তিনিই কি তবে প্রভু তুমি?

এবাদতনামা: ৪৪ – বিসমিল্লাহ

কহিও সকল লোকে এই এবাদতনামা প্রভু
যদি কেহ পড়ে তবে তোমার সুনামে যেন পড়ে।
বিসমিল্লাহ কহিতব্য। যে না নেবে আল্লার নাম
সেই মূর্খ কী বুঝিবে বঙ্গের এ নয়া মসনবি!

তারপর নবীজিরে যেন তারা পাঠায় সালাম—
শুধু তাঁর মহব্বতে শুধু তাঁর এশেকের লাগি
এই পদ্য ফুটিয়াছে—এই পদ্ম ফুটেছে হরফে;
ফেরেশতার দস্তখতে প্রতি বর্ণ হয়েছে কাতিব।

যারা খোদাবন্দ, প্রভু, তাঁরা স্রেফ অভ্যাসবশত
তোমার নামের গুণে বিসমিল্লাহ জানি পড়িবেন।
যাহারা স্বাধীন তাঁরা সব কাজ নিজের রূহের
সম্মানে করেন—তাঁরা অতএব নিজের খাতিরে
কহিবেন বিসমিল্লাহ। যে জানে সে জানে
হৃদয়ের নাম তুমি, এশকের নাম মুহম্মদ।

এবাদতনামা: ৪৫ – ‘যতনে’ ‘সতত’ হৃদয়ে রেখো আদরিনী শ্যামা মাকে

আদরিনী শ্যামাঙ্গিনী দারুণ রূপসী মেয়ে ওকে
যতনে হৃদয়ে রাখি। তসবিতে জননীর নাম
সতত জিকির করি। প্রভু তাঁকে পাবো বলে আমি
প্রথমে ‘যতনে’ লিখি, লিখে ফের সবুজ কালিতে
তাকে কাটি। ভেবে দেখো কালো কালি দিয়ে কি কালিকে
কাটা যায়? অতঃপর সবুজাভ অক্ষরের পাশে
‘সতত’ শব্দটি লিখি। কাটাকুটিসহ সবকিছু
ঠিকঠাক রেখে দেই, মোটেও মুছি না। সব থাকে।

আমি কি রামপ্রসাদ? অন্ধ ভক্ত? আমি কালো রূপে
মজেছি আদ্যার্থসহ। অনাদি জননী যন্ত্রে নিজে
নিজেকেই পয়দা করি। প্রভু শুধু কর্মজ্ঞানে নয়
কালজ্ঞান দৃঢ় রেখে পূজা করি। শ্যামার পূজায়
দুটোই একসঙ্গে লাগে জেনে ম্লেচ্ছ আমি দিশেহারা—
হিন্দু কবে ভুলে গেছে যবন এশেকে বলে ‘তারা’।

এবাদতনামা: ৪৬ – ত্রিভুবনের প্রিয় মুহম্মদ

অনেকে দোজখে যাবে আমি যাবো দোজখের পাশে
বেহেশতের উল্টো দিকে। রোজ হাশরের ময়দানে
শূন্যে ঝুলে রবো। তুমি কিছুতেই আমাকে মা’বুদ
না ডানে না বামে মানে পাপে পুণ্যে নিতে পারবে না।

গুনা কাকে বলে প্রভু? কাকে বলে সওয়াব হাসিল?
কাকে শাস্তি কাকে স্বস্তি আমি প্রভু জানি তো থোড়াই।
উম্মতের জামিন যিনি আমি আন্ধা তাঁর আশেকান
আমি শুধু তাঁকে চিনি আমি ছার ইসলাম চিনি না।

যে জেনেছে তাঁর রূপ তার মধ্যে ধর্মাধর্ম ভেদ
লুপ্ত হয়। মুহম্মদ ছাড়া আর অন্য কোনো নাম
মিথ্যা। না দোজখ না বেহেশতের মাঝখানে যিনি
উম্মতি উম্মতি বলে শোকাকুল তিনিই আমার

ধর্ম। প্রেম। ভক্তি। জ্ঞান। বঙ্গে তাঁর পূজার প্রচার
করে প্রভু ধন্য হবো, উম্মতের তিনিই ঈশ্বর।

এবাদতনামা: ৪৭ – সুবেহসাদেকে বৃষ্টি

মা’বুদ, প্রভাতকালে কেন হেন হানিছ বারিষ?
মসজিদ ভিজে যায় শ্রাবণের মাসুম ক্রন্দনে
বেহাল হয়েছি প্রভু, আজ আমি নামাজ ভুলেছি—
আজ মেঘ মুয়াজ্জিন, আজ শুধু বৃক্ষের জামাত।

দাড়াও অশোকবৃক্ষ এই বৃষ্টি আল্লার আদর
রুকু বাঁধো দেখো আজ তিনি নিজে সম্মুখে ইমাম
দাঁড়াও তমাল, বিল্ব, দেবদারু, বট ও অর্জুন
দাঁড়াও কোমর জলে ডুবে থাকা বঙ্গীয় হিজল।

সূর্য দেবে না দেখা এই সুবেহসাদেকে বর্ষায়
আমি শ্রীরাধিকা হয়ে তোমাকে ঢুঁড়িব ঘনশ্যাম;
কার জল ঝরিতেছে? কার প্রেম কাকে ডাকে, প্রভু?
কেন নেমে আসিতেছ বঙ্গের শ্রাবণ বর্ষণে?

ভেজাও, তোমার সঙ্গে গলে যাই, প্রভু নিরবধি
সৃষ্টি ও স্রষ্টার স্রোত মিশে হয় বঙ্গে পদ্মা নদী।

এবাদতনামা: ৪৮ – ‘তিন পাগলে হোল মেলা নদে এসে…’

প্রভু, আমি গৌরাঙ্গ—এশেকে দেওয়ানা নদীয়ায়
মৃদঙ্গের জিহ্বা দিয়ে প্রভু দেখো শিখেছি জিকির
বোল আল্লা আল্লা কয়, বোলে বোলে লা-ইলাহা বাজে
মা’বুদ নাচিতে আছে হরি বলে তোমার বালক।

কে তিন পাগল এসে নদীয়ায় বসায়েছে মেলা
ঠাকুর অদ্বৈতাচার্য ওর নাম আদিতে আহাদ
আদম সুরত ধরে নৃত্য করে নিমাই পণ্ডিত
চৈতন্য তোমার নুরে রোশনি হয়ে এশেকে বেহুঁশ।

কে আর আরবে যাবে এই পলিমাটিতে সকলি
নিরন্তর পয়দা হয়, আমি এই মৃত্তিকার কাদা
পুড়িয়ে মৃদঙ্গ করি, বাজাই বঙ্গীয় দশঘুচি
তোমার কীর্তনে প্রভু জিকিরে বয়স্ক হয়ে উঠি।

নদীয়ায় তোমার আয়াত যদি তুমি নিজ কানে
শোনো তবে তুমিও পাগল হবে প্রেম সংকীর্তনে।

এবাদতনামা: ৪৯ – আমি ঘোর পৌত্তলিক

প্রভু আমি সৃষ্টি থেকে স্রষ্টাকে আলাহিদা করতে পারি না
সেটা কি আমার দোষ? তুমি কি মনুষ্যেরে সেই তৌফিক
কোনো কালে দিয়েছিলে? দাও নাই। কলকব্জা খুলে
নিজে ফের দেখে নাও কী মেশিন বানালে মা’বুদ!!

আমার জায়নামাজ সে কারণে কাবামুখী প্রভু
আমি ঘোর পৌত্তলিক আমি কালো পাথর পূজারি।
জগৎ তোমার, কিম্বা তুমি নিজে হয়েছো দুনিয়া
সে কারণে সিজদা করি অগ্নি, বৃক্ষ, পশু ও মুর্শিদ।

প্রভু, বঙ্গে মূর্তি পূজা আইয়ামে জাহেলিয়া নয়
যে মূর্তি গড়ি তুমি সেই মূর্তি নিজেই গড়েছো
নিজ হাতে। অজ্ঞানতাবশে লোকে ভাবে তারা নিজে
সৃষ্টিকর্তা। এই কুফরি কেটে গেলে বঙ্গে ইসলাম
একদা কায়েম হবে। জৈবে ও অজৈবে একদিন
ভেদাভেদ লোপ পাবে, শান্তি হবে লোকে ও অলোকে….

এবাদতনামা: ৫০ – ‘আমি’

জাতি ধর্ম বর্ণ শ্রেণী লিঙ্গ কিম্বা দেশকাল ভেদ
মানি না, তবুও কেন মুছতে পারি না সেই দাগ
যাকে ‘আমি’ বলে ডাকি। যদি মোছা যেত তবে প্রভু
লুপ্ত হোত চরাচরে আদম ও আল্লার ফারাক।

মানুষের মধ্যে বসে যে নিজেকে কর্তা গণ্য করে
তাকে আমি আজো কেন চিনতে পারি না। শুধু জানি
তরঙ্গ সে, আছে, কিন্তু পাবো বলে যদি স্পর্শ করি
হাত জলে ভিজে যায় তরঙ্গকে ধরতে পারি না

শরীরের মধ্যে থাকে বৃথা অপারেশন টেবিলে
চিৎপাত থুয়ে আমি কেটে ছিঁড়ে দেখেছি, মা’বুদ
রক্ত নাড়ি মাংস অস্থি শিরা উপশিরা সব থাকে
কিন্তু খোদ মনুষ্যের কভু কোনো সন্ধান মেলে না।

দাগ তবু থেকে যায়, নামের চিহ্নটুকু তবু রয়ে যায়
ভুলে যেতে পারি নাম কিন্তু মুছে ফেলতে পারি না।

এবাদতনামা: ৫১ – শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সঙ্গে নামাজ আদায়

প্রভু হে এশেকে আছি দিন কাটে তবু অবিদ্যায়
বলি প্রেম ভক্তি তোরা ফিরে আয় সোনার বাংলায়।
মোর আছে ভিন্ন ধারা, মোর আছে প্রাণ ও প্রতিমা
মোর বঙ্গে সমার্থক ভাব আর বস্তুর গরিমা।

হরি বলে গান গাই সামনে দেখি তুমি খোদ খাড়া
ফলে প্রেমে নত হই সিজদা দিয়ে কেঁদে পড়ে থাকি
মাটিতে সাষ্টাঙ্গ হয়ে দেখি তুমি কেউ নও, মাটি
হরি নামে মর্খদের বরাবর দিয়ে গেলে ফাঁকি।

আল্লাহু আকবর বলে চরাচরে যতোবার আমি
মুয়াজ্জিন হয়ে প্রভু মুসল্লিকে দিয়েছি আওয়াজ
দেখি শুধু সাড়া দেয় আমার গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু
দুজনে আদায় হয় এই বঙ্গে তোমারি নামাজ।

গোস্বামীরা বোঝে নাই। নীলাচলে প্রভু নিরঞ্জন
স্বয়ং মর্ত্যে এসে প্রেমভাবে করেছিলা বঙ্গদর্শন।

এবাদতনামা:৫২ – ঘুম

ডাকিতেছি নিশাকালে, মা’বুদ, দাসীরে সাড়া দাও
বাঁশবনে পাতাগুলি কেন হেন বৃথা ঝরিতেছে
পাতাকুড়ানিয়া মেয়ে শেষ ঝরাপাতাটি কুড়ায়ে
ফিরিয়া গিয়াছে গৃহে। প্রভু, ওকি আর আসিবে না?

ছাগীটিকে বাঁধিতেছে চাষি বউ। পায়রাগুলো বকম বকম
থামিয়ে পরস্পর ফিসফাস ঘুমাবার করে আয়োজন।
গৃহস্থের মতো মুখ ভারি করে জোয়ান বলদ
আন্ধারের তাড়া খেয়ে বাধ্য হয়ে ঢুকিছে গোয়ালে।

পুকুরে ঝাপট মারে কই মাছ, কাদার বালিশে ধুমধাম
মাথা খালি ঘষিতেছে শিং শোল টেংরা মাগুর
কারো চোখে ঘুম নাই, বোকা টোড়া সাপটিও চোখ
মেলে রাখে, ব্যাঙটিকে অন্ধকারে যদি দেখা পায়।

মানুষের শুধু ঘুম, ঘুমে চোখ টলিতেছে দেখো
কার ইচ্ছা চিরকাল জিকিরে জিকিরে জেগে থাকে?

এবাদতনামা: ৫৩ – অনন্তের বৈকুণ্ঠধাম

কতো জল উড়িতেছে, কতো বর্ষা ঋতু বহির্ভূত
ঝরিতেছে বঙ্গে, প্রভু, তবু মোর মেটে না তিয়াসা—
আমি সদা চাতকিনী, সর্ব মেঘে রেখেছি নজর
তবু কই সিক্ত হয় মাশুকের প্রেমের পিয়াসা?

এশেকের কিবা জানি? জানিতেন শ্রীমতি রাধিকা
মূর্খের জিন্দেগি মোর কাটে বৃথা তত্ত্বে তালাশে
প্রভু যদি প্রেম দিলে তবে কেন ভক্তি দিলে না
সোনার যৌবন যায় তর্কে তর্কে বেহুদা বাহাসে।

শহরে আসিল মেঘ নগরে নামিল বর্ষারানি
তোমার নামের শব্দে জলে জলে উঠিল জিকির
সিজদায় পড়ে আছি, কিন্তু শ্রুতি সমূহ সন্ধানী
চাই তার সর্বদাই বাশিটুকু শোনার ফিকির।

কে বাজায়, কে যে শোনে!! মা’বুদ, দাসীরে প্রেমে কামে
পাগলিনী নিয়ে চলো অনন্তের বৈকুণ্ঠধামে।

এবাদতনামা: ৫8 – নিদানের কালে

সহসা মেশিনখানি শহরের সদর রাস্তায়
কাচের মতোন ফশ। দিনেমানে প্রকাশ্য বাজারে
ভেঙে ছত্রখান হয়। নাটবল্টু খসে চতুর্দিকে,
চাকাগুলি মুর্দা হয়ে পড়ে থাকে রাস্তার ধারে।

বর্জ্যের ব্যবস্থা আছে, মাঝেমধ্যে ফিরতি ব্যবহারে
পুরনো চাকাটি কাঁধে তুলে নেয় নতুন মোটর।
কিছু যন্ত্রে জং ধরে, কিছু স্রেফ স্তূপ হয়, তবু
কয়েকটি গলিয়ে নিয়ে কাজ করে দক্ষ কারিগর।

প্রভু, ভেঙে পড়ে আছি শহরের এক প্রান্তে একা—
এই জন্ম শেষ হয়, আমার কি অন্য ব্যবহার
নাই আর? কীট, পাখি, পতঙ্গের খাদ্য হয়ে আমি
ফের কি দেখিব, প্রভু, চতুর্দিকে সৃষ্টির বিস্তার?

হেলায় ফেলায় গেল অমূল্য মনুষ্য জন্ম, তবু
নিদানে কিঞ্চিত যেন ব্যবহৃত হয় দেহ, প্রভু।

এবাদতনামা:৫৫ – বিনয়ের দুই বাংলা

‘প্রকৃত চুলের মধ্যে অমেয় জলের উৎস আছে’
—বিনয় মজুমদার

জলের মা’বুদ তুমি প্রভু তুমি পানির ঈশ্বর
তবুও বৃহৎ বঙ্গে জল আর পানি মিশিল না
পানি কথাটিকে কেটে বারবার লিখি আমি জল
তবুও পদ্মার জলে গঙ্গার পানি মজিল না।

মানুষ ও ভূগোলের স্রষ্টা তুমি, বুঝেছি, তবুও
মন আর মানচিত্র প্রভু কারো মানে না নির্দেশ।
তোমারই দ্রব্য হয় পাত্র ভেদে জল আর পানি
তোমারই ভূগোল হয় ইতিহাস ভেদে ভিন্ন দেশ।

‘প্রকৃত চুলের মধ্যে অমেয় জলের উৎস আছে’
আমার ভাইদের মধ্যে বিনয় তা জেনেছে বিশদ
চুলে জটা বেঁধে গেছে মহাদেব এখনো বেহুঁশ
উমা জটা ছাড়াচ্ছেন ভেবে সন্তানদের ভবিষ্যৎ।

এবাদতনামা:৫৬ – কাদা, জল, নীলাকাশ

মা’বুদ, তোমার নামে কমলিনী ফুটিল সলিলে
শেকড় কাদায় বিদ্ধ, দেহখানি ভিজিতেছে জলে
কিন্তু ফুল অন্তরীক্ষে সূর্যের সুসঙ্গ সাথে মিহি
কাঁপিতেছে অহর্নিশি কামে আর রতি শিহরণে।

আলো ঝরে গ্রহ থেকে, দিব্য নুরে বিশ্ব দিলখোশ
কিরণসম্পাতে খোদ তুমিই স্থলিত হও পুষ্প-গর্ভাশয়ে
কার সাধে? কার প্রেমে? কোন অভিলাষ আজো হায়
অপূর্ণ তোমার প্রভু? ইয়া খোদা, পরওয়ারদিগার?

কাদা, জল, নীলাকাশ—এই তিন জগতেরে তুমি
মূলে, কাণ্ডে আর পুষ্পে একাধারে আলিঙ্গন করি
কী খেলা খেলিতে আছো জলে পুষ্প কিন্তু আসমানে
সূর্য হয়ে। কে বুঝেছে? কেউ নয়। তবু কলমা-চোর

আছে মসজিদে মসজিদে, কলিযুগে। আছে টুপিটাপ্পি
আছে মওলানা। অহো, সক্কলেই আল্লার মৌলবি!!

এবাদতনামা: ৫৭ – এশেকের ভেদ

কী দশা মহব্বত প্রভু, কী দশারে কহিব এশেক?
কী দশায় পাগল পাগলই হয়, কী বিচারে প্রভু
সেহি লক্ষণই হয় আউলিয়া? কী ভেদে কহিব
এহি ফানাফিল্লাহ হাল আর ঐ বিলকুল শেরেকি।

মনসুর চড়িল শূলে। কী বুঝিবে কাজি ও মওলানা?
কাফনের দোকানদার জানে শুধু দাফন ও দোয়া
নশ্বরের জানাজা বেকার। দেখো রক্তাক্ত হাল্লাজ
হাঁকে আমিই আল্লাহ; একমাত্র সত্য শুধু আমি!!

কে মরিল? কে হাঁকিল? কার মৃত্যুদণ্ড শেষাবধি
কামিয়াব করে ছিলে? কার অবিনশ্বর দেহ শূলে
চড়িয়ে পরওয়ারদিগার হতে চাও অদ্বিতীয়, একা?
কাকে ভয়? আশেকি ও শেরেকির ভেদ কি মনসুর
মুছে নাই?

মুছে ছিল। সকলের হয় না খবর
এশেকের দুই সত্তা, দুদিকেই আল্লাহু আকবর!!

এবাদতনামা:৫৮ – ছেঁউড়িয়া

কী কামে হে কামাতুর আপনারে করো আস্বাদন
এই নবদ্বীপে, বঙ্গে, কুমারখালিতে ছেঁউড়িয়ায়?
পরওয়ারদিগার, বুঝি ব্রজধামে মেটে নাই সাধ
কেন বঙ্গে মনুষ্যজনম লভি ধরেছিলে ফের
গৌরাঙ্গ মুরতি। ওগো প্রেমের মা’বুদ কেন সাধ
একই গতরে হবে বংশীধারী আর রাধারানি?

আদমের রঙ্গভূমি, আদমেরই লীলা ও কল্পনা
আদমেরই কাণ্ডকীর্তি আদমেরই ক্রীড়া ও কৌতুক
আদমেরই কাব্য, ধর্ম, ভাব, কর্ম, প্রতিভা, বিস্ময়
আদমেরই ভক্তি, ভয়, আকুলতা, সৃষ্টির সঙ্গম
সাধ, সাধ্য, প্রতিজ্ঞা ও বিহ্বলতা। আদমেরই লোভে
আদম সুরত নিয়ে শচির উদরে এলে গৌরাঙ্গ ঠাকুর।

কিন্তু ফকির তুমি ছেঁউড়িয়ায়। কালিগঙ্গা জলে
জন্ম নিয়ে কার লোভে লীলারঙ্গে মাতিলে মা’বুদ?

এবাদতনামা: ৫৯ – আজান

তুমি কি বধির প্রভু? নাকি কানে তুলা দিয়ে থাক?
এভাবে হুংকার দিয়ে পাঁচবার মাইক্রোফোনে কেন
মোয়াজ্জিন হাঁকিতেছে? প্রেমকথা কে কয় চিৎকারে?
দুনিয়া কাপিয়ে দিয়ে তোমাকে ধর্মের নামে ডাকা
কোথা থেকে এল প্রভু? তবে কি ধূর্ত শয়তানে
মনুষ্যেরে ডাকিতেছে অধর্মের সাজানো ময়দানে?

মোমিন পেয়েছে টের এ আজান নয় কৃষ্ণবান
বেলালের। চতুর্দিকে অমাবস্যা—প্রেমহীন কাল
আইয়ামে জাহেলিয়া। চতুর্দিকে মওলানা মৌলবি
মাশায়েখ, পিরবিদ। কোথা প্রভু প্রেমের নদীয়া?

আমার প্রভুর নেই শব্দ আর নৈঃশব্দ্যের ভেদ
মেঘ তার মোয়াজ্জিন—ক্রন্দনে সেজদা ভিজে যায়।

বেলাল আজান হাঁকো সততই মোমিন জাগ্রত
কাজা হয়ে যাচ্ছে হায় বিরহিনী দাসীর জিন্দেগি।

এবাদতনামা: ৬০ – সহস্রার পদ্মচক্র

একাকী নির্জনে চাই, একা একা হাড়েমাংসে একা
যদি প্রেম জানো তবে একা এসে জুড়াও পরাণ
কামে প্রেমে দেহে মনে সর্বাংশে দিয়ে শিহরণ
আসো ওহে নিরাকার সাকারে প্রেমাস্পদ হও।

যদি ইচ্ছা করো তবে সকলি সম্ভব। রূপ ধরে
আসো ওগো নির্বস্তু নির্গুণ। আসো ফর্শা শশীমুখী
প্রজ্ঞার সারবস্তু হয়ে। আসো তুমি কোরান শরিফ
বয়ঃসন্ধিক্ষণ কালে বালিকার প্রেমপত্র হয়ে—
যদি আল্লা হও তবে অবশ্যই হতে পারো ক্ষীর
হতে পারো চন্দ্রকান্ত নিষ্কাম প্রেমের শরীর।

একাকী আস্বাদ চাই যেভাবে গৌরাঙ্গ কলিকালে
শ্রীমতি রাধিকা হয়ে মূর্ছা গিয়েছিলেন শরীরে
কৃষ্ণস্পর্শে। দাও তীব্র দহনের সুধা ও সুস্বাদ
সহস্রার পদ্মচক্রে ফিরে যাক প্রেমের সংবাদ।

এবাদতনামা: ৬১ – মৃত্যু

এটা তো সহজ বলা তুমি সর্বভূতে আছো। স্থিত
সর্বরূপে। প্রভু হে সচ্চিদানন্দ, আছো সর্বভাবে
যে শর্তে ‘আছে’ কিম্বা ‘আছি’ বলি। কিম্বা যদি বলি
‘নাই’—তবে রয়েছি বলেই প্রভু ‘নাই’ বলা যায়।

এইসব বোঝা সোজা। আমি প্রেম সহজে করিনি
তুমি নিরাকার কিন্তু দেশকালপাত্রে আছি আমি
কী সাধনে আল্লা মিলে? কী সাধনে দেশে কালে পাত্রে
সহজ স্বরূপ নিয়ে ধরা দেবে আমার সুন্দর?

কেতাবে কেতাবি হয়ে বিদ্যানেরা বুঝিতেছে খোদা
মোল্লা তোতাপাখি হয়ে পড়িতেছে কোরান শরিফ
দাসী নিরক্ষর প্রভু তার পড়া বোঝা সাধ্যে নাই
অনন্ত অপেক্ষা তার একাকিনী তোমার সংসারে।

যদি আকদ হয়ে তাকে তবে জানি আসিবে সুন্দর
মৃত্যুই বিবাহ জানি পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতির।

এবাদতনামা: ৬২ – শ্রীরাধিকা

জোয়ার দেখেছি আমি ঢেউ উঠিতেছে ত্রিবেণীতে
গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতী। হে প্রভু যোগেশ্বর
তিনটি মেয়ের লীলা দেখে আমি বেহুঁশ হয়েছি
এক কৃষ্ণা, দুই যুঁই আর তৃতীয়টি লালমতি।

তিন মেয়ে তিন গুণে গুণবতী কিঞ্চিত মহেশ্বর
তাহাদের গুণাবলি শুনেছেন পার্বতীর কাছে
কেউ তাঁর মস্তকে কেউ বুকে, কেউ সংগোপনে
আছে প্রেমকথা হয়ে—ভাসে শুধু মাসান্তে জোয়ারে

যাঁকে সংগোপনে রাখি সতর্ক সতীর মতো ঘরে
তাঁকে বলি আল্লা বলো দেখি তুমি সত্যি তাঁর কি না
দেখি কতো শক্ত মেয়ে— বেঁধে রাখি ঘরের ভেতর
ঘরের শক্তি প্রভু ঘরে রাখি, সমভাবে তুমিও রয়েছো।

পরজন্মে মেয়ে হবো, মেয়ে হয়ে স্বয়ং তোমাকে
আস্বাদন করে আমি নাম নেবো শ্রীমতি রাধিকা।

এবাদতনামা: ৬৩ – নিত্যানন্দ

নিত্য আনন্দ যিনি তাঁকে প্রভু প্রণতি জানাই
তাঁকে লয়ে হাসি গাই তাঁকে লয়ে কীর্তন—জিকির
তাকে লয়ে যোগক্রিয়া তাঁকে লয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা
অনাদি বঙ্গের তিনি আদি প্রেমী—অনাদি ফকির।

তিনিই শরিয়া প্রভু, তিনিই তো বিধি ও করণ
তাহার ইশারা পেয়ে শ্রী গৌরাঙ্গ বঙ্গে প্রকাশিয়া
কতো না বিচিত্র লীলা দেখাইল তোমারই হুকুমে—
তুরীয় আনন্দে প্রভু আজও বঙ্গ যায় যে ভাসিয়া।

আমিও ভাসিতে আছি। অদ্বৈতের চৈতন্যের নেশা
অত্যধিক ধরিয়াছে। আল্লাহু আল্লাহু বলে খোল
বাজিতেছে ঘরে ঘরে। তোমাকে এখন অতি কাছে
পেয়ে আমি দিশাহারা, শিশুভাবে হতবিহ্বল।

জয় নিত্যানন্দ, প্রভু, আমি তাঁর দাস তস্য দাস
তারই দয়া ভিক্ষা চাই আর নাই অন্য অভিলাষ।

এবাদতনামা: ৬8 – তিন পাগলে হোল মেলা নদে এসে

পাগলেরে কেবা চেনে? নদীয়ায় ছিল তিনজন
তুমি প্রত্যেককে চেনো প্রত্যেকেই খোদ আরবের;
তোমার এশেকে তারা বঙ্গে দেওয়ানা। তুমি প্রভু
নিত্য লীলাময় তাই এতো ঘোর নশ্বর জীবের!!

আহাদ অদ্বৈত—মীমে আহমদ চৈতন্য অবশ্যই
নিত্যানন্দ রক্তেমাংসে বস্তুভাবে আদম নির্ঘাত
একজন মন্ত্র হন, একজন যন্ত্র আর অন্যজন
তন্ত্রের তন্ত্র হয়ে বঙ্গে প্রভু প্রেমের প্রপাত
ঘটিয়ে এখন স্বর্গে তোমার সহিত কৌতুকে
আমাদের দেখিতেছে। বঙ্গ লীলাময়। অকস্মাৎ
যদি গুরু কৃপা বলে কেউ ফের জীব-পরমের
ভেদ জ্ঞান মুক্ত গিয়ে আরেকবার বিশ্ব-নিখিলের
তৌহিদ টের পায়। হায়, যদি তিন পাগলের
মেলা ফের বসে বঙ্গে। অহো যদি রহমান রহিম
আবার ফিরিয়ে দেন জীবে জীবে দৃষ্টির রৌশন
আহা যদি ঘটে বঙ্গে আরেকবার জিকির-কীৰ্তন …

এবাদতনামা: ৬৫ – জালালুদ্দিন রুমি

প্রভু, আমি একা নই। আমার সহিত আছো তুমি
চিনিলেও আছো, যদি চিনি নাই তথাপিও আছো।
ছায়া পড়ে, ছায়া নড়ে, ছায়া দেখে ভাবি তুমি মায়া
অথচ আমিই ছায়া, তুমি সত্য তুমিই তৌহিদ।

একটি বাঁশি বাজিতেছে দূরে নাকি অত্যন্ত নিকটে
তাহার কান্নার শব্দে কাঁদিতেছে সমস্ত মোমিন
চোখে জল লয়ে বলি কী বিরহে কাঁদিছে সকলে?
লোকে বলে এই বাঁশিটির নাম দরবেশ জালালুদ্দিন।

রুমি কাঁদিতেছে প্রভু। তোমার বাগান কেটে বাঁশি
তুমিই বানাও যেন তোমারই বিরহে জীব কাঁদে—
দারুণ প্রেমের খেলা: নিজ নুরে বানাও পুতুল
বানিয়ে নিজেই কাঁদো নিজেকে নিজেই ধরো ফাঁদে।

আমিও কাঁদিতে আছি রাধারানি রাধারানি বলে
বিরহযাতনা বঙ্গ নিত্য দিন করে আস্বাদন।

এবাদতনামা: ৬৬ – কোরান শরিফ

তোমার কালাম আমি পড়িতেছি যথা রাধারানি
স্বামীর সংসারে থেকে গুপ্তভাবে পড়েছেন চিঠি
স্বয়ং শ্যামের। কোনোই গোস্বামী সেই পত্রের হদিস
জানে না অথচ সত্য জানে বঙ্গে প্রেমের মোমিন।

প্রভু হে সংসারে থাকি, সংসারে তুমিই পাঠালে
সংসারের সঙ্গে তুমি শাদিসাঙ্গা স্বয়ং ঘটালে
তবু কেন চিঠি দাও? আসে ডাক, আসে জিব্রাইল
বাজে বাঁশি। আমি হই কলংকিনী একুলে ওকূলে।

যদি জীব জ্ঞান করো তবে কেন প্রেমের তৃষ্ণায়
আমাকে উলঙ্গ করো। জীব কি শরীর ছাড়া আর
অন্য কোনো ভাবে প্রেম আস্বাদন জানে? যদি জীব
পরমের ভাষ্য হয় তবে কেন কামের বিস্তার
ঘটে নিত্য জীবদেহে? কেন শ্রীরাধিকারানী ঘরে
স্বামীকে লুকিয়ে পড়ে গোপনীয় কোরান শরিফ?

এবাদতনামা: ৬৭ – প্রেমধর্ম

যে আছে দ্বীনের পথে সেই শুধু প্রেমধর্ম বোঝে
যে শুধু কলমাচোর তার আছে বাহানা নানান
তার আছে তসবি, টুপি, চোখে সুর্মা।—কথায় কথায়
তোমার কসম কাড়া—ফেরকাগিরি—বিবিধ ব্যাখ্যান।

যার আছে এবাদত সেই জানে নামাজের মানে
যে শুধু ব্যায়ামবীর তার শুধু আছে জায়নামাজ
যে জেনেছে ধর্ম শুধু সেই বোঝে সিজদা প্রাপ্য কার
ভুলেও কি সে কখনো পূজা করে ইটের মসজিদ?

অদ্বৈতে নিরিখ রেখে প্রভু আছি এশেকে দেওয়ানা
মাছের মতোন আমি ডুবে আছি তোমার তৌহিদে
ডোবাও ডুবিয়া যাই শামুকের মতো মুখ বুজে
প্রেমে মুক্তা হই, হই কামরাঙা। কালের নিশীথে

চতুর্দিক অন্ধকার। শুধু জাগে রাধা বিরহিনী
কবি তাঁরই অশ্রু হয়ে রাষ্ট্র করি প্রেমের কাহিনী।

এবাদতনামা: ৬৮ – অনন্ত গল্প

দিনে দিনে দিন যায় কাজে কাজে কর্মফল বাড়ে
মা’বুদ, দাসীরে তুমি দেখা দিয়ো নিদানের কালে
যে প্রেমে মওত হয়ে আসো আমি সে প্রেমভিখারি
জন্মযোগে যে-বিরহ-কাটে যেন অমোঘ বিকালে।

মৃত্যু মেহেরবান, জানি, তাই, তারই দিকে যাই
প্রভু, যেতে যেতে দেখি চতুর্দিকে বকুলের ফুল
ঝরিতেছে যেন বৃষ্টি। সুগন্ধে নিখিলে মৌজ। দূরে
বাঁশি বাজিতেছে। কতো সুহাসিনী প্রেমের হিল্লোল
ভাসিতেছে। তুমি বুঝি ডাক দাও তাই কি সকলি
দৃশ্যের অতীত হয়? এশেকের নানা দৃশ্যাবলি
দেখিতেছি কতোকাল। প্রভু, যদি দৃশ্য শেষ হয়
দ্রষ্টার কি সমাপ্তি ঘটে? নাকি প্রেম সকল সময়

শ্রীরাধিকা হয়ে হয় অনন্ত গল্পের সুধা! নাকি
গল্পের শেষ নাই। কিছু গল্প সদা থাকে বাকি….

এবাদতনামা: ৬৯ – গুরু

গুরুকে ভজনা করি। এই বঙ্গে গুরুই ঈশ্বর
জীবে যদি ব্যক্ত হও তবে গুরু তোমারই প্রতিমা।
জ্ঞানে বা প্রজ্ঞায়, কিম্বা কর্মে বা করণে নশ্বর
মনুষ্যই নিজ গুণে রাষ্ট্র করে আল্লার মহিমা।

তোমার তৌহিদ ব্যক্ত নানাভাবে। গুরু রূপে তুমি
সাকার ও নিরাকার—একসঙ্গে সামান্য বিশেষ।
গুরুকে মনুষ্যজ্ঞান যে করেছে তার গতি জানি
অধঃপতনের দিকে—তার আজো বস্তুনির্দেশ
ঘটে নাই। সেই মূর্খকে এই জাহেলিয়া যুগে
লা ইলাহা কলমা পড়াবে কারো সাধ্য নাই। তুমি
ডাক নামে জ্ঞান-শব্দ— আল্লা নামে মানুষের মুখে
নানাবিধ সম্ভাবনা—অনন্ত অসীম অন্তর্যামী।

কিন্তু গুরু একজন—অঙ্গে আছে প্রকৃতি তোমার
প্রক্রিয়া-স্বরূপে গুরু অতএব পরওয়ারদিগার।

এবাদতনামা: ৭० – বিপ্লবী গোরা

জ্ঞান রূপে চিন্তামণি—জ্ঞানেরে ঈশ্বর জ্ঞান করি
জ্ঞানেরে গৌরাঙ্গ বলি, গৌর রূপে যিনি দিব্যযুগ
দেখালেন নদীয়ায় তাঁর নামে বিসমিল্লাহ বলি
তাঁর নামে হাসি কাঁদি তাঁরই নামে ঘটে মহা সুখ
এই বঙ্গে। জাতপাত শ্রেণী লিঙ্গ ভেদ যার নাই
তিনি ক্ষণে শ্রীরাধিকা পরক্ষণে ব্রজের কানাই।

তাঁর নাই বিষয়-আশয় কিম্বা সঞ্চয় বাসনা—
নিমাই ফকিরকে, প্রভু, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যাখ্যা
সাধ্য কী কে দিতে পারে? ‘আমি দোষ অথবা কামনা
মুক্ত যিনি তাঁকে, প্রভু, বঙ্গে কেন এতো আগে দেখা
গিয়েছিল? চার যুগ চলে যায় দিব্যযুগ তাঁর
আসিবে কি বঙ্গে? জ্ঞানচিন্তামণি নামে নবভাবে
তিনিই কি ফকির লালন?

সম্মুখে আছে শুভদিন
এই সত্য জানিতেন সম্ভবত মার্কস ও লেনিন।

এবাদতনামা: ৭১ – বাংলায় মোনাজাত

মোনাজাত মেনে নাও। সেই ডাক ডাকিতে জানি না
যে ডাকে আকাশ থেকে নেমে আসে বিপুল বর্ষার
জলধারা। দাবদাহে শীর্ণ শুষ্ক মাঠ অচিরেই
যে আহ্বানে ভিজে যায় আমি সেই নামের হরফ
বাংলা বর্ণে বাংলাতেই পাঠ করি। জিহ্বার মহিমা
সেই শুদ্ধ ধ্বনি বোঝে, কিন্তু শুদ্ধ উচ্চারণ ভঙ্গিমা
শিখি নাই। বাঙালেরে নিজগুণে মাফ করে দিয়ো—
আরবি তার ভাষা নয়, বাংলায় দাসত্ব মেনে নিয়ো।

আরব আমার ভাই, আরব আমার বোন, আমি
আরবের সঙ্গে লড়ি। যুদ্ধবাজ তেলের কোম্পানির
বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে লক্ষবার হয়েছি শহিদ
কিন্তু ফিরেছি ফের বাংলাদেশে। নামের মহিমা
বঙ্গে যেন জারি থাকে, জাত পাত বর্ণ ভেদ ভুলে

রাজা বা প্রভুর নয় একমাত্র দাসত্ব তোমার
করি আমি। আমি দাসী। এ প্রার্থনা মধুর বাংলার।

এবাদতনামা: ৭২ – তওবা

গল্প জানি, গল্প শুনি। বুঝি কি না তুমিই বুঝিও
দাসীর অস্ফুট বাক্য, তথাপি তওবাটি মেনে নিয়ো।

দেখিতেছি আদ্যচিত্র। দেখাও দেখিতে আছি, দেখি
জীবের আকাঙ্ক্ষা নিয়া হাওয়া বিবি আদ্য প্রকৃতি
কামাতুর। প্রাগৈতিহাসিক এই শ্রুতি ও পুরাণ
নির্বিশেষ গল্প হয়ে পবিত্র কেতাবে হয় স্মৃতি।

স্মৃতি নাকি ইতিহাস? পৌরাণিক গল্পে বটে তুমি
মানুষের ইতিহাস কীভাবে সম্ভব হয় তার তত্ত্ব কথা
বুঝিয়েছ মূর্খদের। যুগপৎ প্রকৃতি পুরুষে
কাম বিদ্যমান। উভয়েই জীব। তবু সে বারতা

কে বুঝেছে? ধর্ম কই? আমি শুধু কেচ্ছাটুকু জেনে
শরমিন্দা হয়ে আজো তওবা পড়ি গন্দম বাগানে।

এবাদতনামা: ৭৩ – দাসী শুধু জানে

প্রেম করিতেছি প্রভু আহা প্রেম কতো সুমধুর
ভ্রমর উড়িয়া যায় ফুলে ফুলে। কুসুম-কিশোরী
হাস্যরসে নূরজাহান। পাপড়িগণ আলিঙ্গন করে
কাকে হে মা’বুদ? আজ কে ঈশ্বর কে আর ঈশ্বরী?

বকুল বিছায় বঙ্গে জায়নামাজ ফের আশেকির
তসবির নিঃশব্দ ভাষ্যে সপ্তর্ষিমণ্ডল মধ্যাকাশে
সাত দরবেশ হয়ে হাত ধরে একে অপরের—
ভারী হয়ে যায় বায়ু জিকিরে ও সকাম নিশ্বাসে।

দেখিতেছি কতো দৃশ্য! দেখিতেছি কতো মেহেরবান
চিত্রাবলি। কতো না বিচিত্র ছবি আঁকো খেলাচ্ছলে—
রাজারে বানাও ভৃত্য দাসীরে বানাও রাজরানি
জীবেরে পরম আর পরমেরে কতো কৌতূহলে

প্রদর্শন করিতে আছো এই বঙ্গে। দাসী শুধু জানে
তুমি সাড়া দাও প্রভু কার ডাকে কোন আহ্বানে।

এবাদতনামা: ৭৪ – আশেকির দিব্য কারখানা

শব্দ শুনিতে আছি, নৈঃশব্দ্যের মধ্যে শুনি ডাক—
বাঁশি বাজে। যমুনায় নীরে ক্ষীরে প্রকৃতি বহতা
শোণিতে সুষুম্না বয় চক্রে চক্রে সহস্রার জ্যোতি
ইড়া আর পিঙ্গলায় জমা রাখি প্রেমের বারতা।

প্রভু প্রেম কে করিল? কে কাকে হে সাকারে আকারে
আস্বাদন করে নিত্য। নিরাকার অখণ্ড পুরুষ
তাকে চিনি কী প্রকারে? চিনি প্রভু শুধু আলিঙ্গনে।
চিনি কামে রক্তে বীজে স্বেদে নুনে বীজে বর্জ্যে হুঁশ
রাখি বলে। বস্তুর ভেতর থেকে আমি অবস্তুর
বন্দনায় রত থাকি। কেন থাকি? তোমার মধুর
রূপে মূর্ছা যাবো বলে? নিজ অঙ্গে বিছাই বিছানা
মনুষ্যের মধ্যে গড়ি আশেকির দিব্য কারখানা।

চাঁদ, সূর্য, গ্রহ তারা বৃক্ষ লতা প্রাণ আহ্লাদিনী
প্রত্যেকেই প্রেম করে, আমি একা হই কলংকিনী।

এবাদতনামা: ৭৫ – বৃক্ষধর্ম

বৃক্ষদের ভাষা নাই। আছে কিন্তু ফটোসিনথেসিস
আসমানে অঙ্গ মেলি উহাদের গুপ্ত প্রেমারতি
প্রভুর পূজায় সিদ্ধ। নভোমণ্ডলের যতো আলো
ক্রমে ক্রমে বৃক্ষ হয়। বৃক্ষে ঘটে সর্ব পরিণতি
জীব আর অজীবের। সবুজ তৈরি হয় নুরে—
বৃক্ষরূপে আছো তাই বৃক্ষে শুধু জানাই প্রণতি।

বঙ্গের জায়নামাজ আমি তাই বিছায়ে দিয়েছি
সবুজ বন্দেগির পথে, হে মা’বুদ, গাছের ছায়ায়।
অশ্বত্থেরে মানি আমি আমার ইমাম; আমি বলি
ও হাবসি কোকিল, তুই বেলালের রূপ ধরি আয়
বঙ্গে আজান দিবি বাংলাভাষায়। নিজেকে জাহির
না হয় করেছো মরুভূমির ভেতরে, তবু জানি
এই বঙ্গে বৃক্ষই সিদ্ধার্থ। আছে চতুর্দিকে জারি
বৃক্ষধর্ম—মশহুর আলো-সংশ্লেষণের কাহিনী।

এবাদতনামা: ৭৬ – সরলতা

সহজে তোমাকে চাই। সোজা ভাবে সরলে সরলে
যেভাবে শিশুর মুখে জননীর দুগ্ধ ঝরে পড়ে
সেই ভাবে ধর্ম দাও। শিশু—ভাবে তোমার সালাত
আদায় করবো বলে বঙ্গে আমি হয়েছি ইমাম।

বেহেশতের লোভ নাই দোজখের ভয়ে ভীত ন‍ই
ইহকাল-পরকালে ভেদ আমি করি না মা’বুদ
যদি ধর্ম সত্য হয় তবে সত্য গর্ভের খবর
রাষ্ট্র করবেই জানি। চতুর্দিক জন্মের সংবাদে
নিশ্চিত আকুল হবে। ইচ্ছা হলে পরলোকে বসে
হাসিও সৃষ্টির প্রেমে। আমি যেন ইহলোকে সেই
দিব্যরূপ দেখি। সর্বলোকে হে পরওয়ারদিগার—

সৃষ্টিকর্মের মতো স্পষ্ট হও। যেন অবিকল
গর্ভিণী মায়ের মতো পাই ধর্ম সহজ সরল।

এবাদতনামা: ৭৭ – মানুষ

মানুষ দেখিতে আছি, মানুষেরা দেখিতে সুন্দর
শৃগালিনী সরিসৃপ মানুষের বিচিত্র বাজার
দেখিতেছি চতুর্দিকে। তবু প্রভু ইমানে মেনেছি
মানুষেরি মধ্যে আছো দীনবন্ধু পরওয়ারদিগার।

কেউ সিংহ কেউ বাঘ কেউ কীট কেঁচো চুনোপুঁটি
কেউ ডাঁশ লালপিপড়া কাটে মাংস বিষাক্ত কুটুস
কেউ শিং দিয়ে মারে, কেউ মারে কামড়, ছোবল
রাক্ষস খোক্কস ভূত পেত্নী কতো বিচিত্র মানুষ!!

ইবলিস ফুসলায়: মনুষ্যেরে ফেরেশতা নূরের
কেন সেজদা করে নাই আছে তার যথার্থ কারণ
মানুষই ইবলিস হয়। মানুষের মধ্যে আছে বিষ—
মাটির তৈয়ারি জীব ধরে বহু চরিত্র ধারণ।

আশরাফুল মখলুকাত? কে করিবে সন্দেহ ভঞ্জন?
মনুষ্যে প্রকাশ হও লা-ইলাহা প্রভু নিরঞ্জন।

এবাদতনামা: ৭৮ – ইবলিসের দিন

আমার ধর্মের কথা না জানুক মোল্লা মৌলবি
মোমিন জেনেও যেন না রটায় ইবলিসের দিনে
অগ্রহায়ণের মাসে মাঠ থেকে হাটুরিয়া ধান
ফড়িয়া ও দালালের হাত হয়ে উচ্চ দামে কিনে
ঠকুক শহর। আমি চুপ রয়ে যাবো বাংলার গ্রামে
হালের পেছনে হাল বীজের ভেতরে হয়ে প্রাণ।—
শেকড়ের বিছানায় বসে বসে দেখিব প্রকৃতি
সতত জাগ্রত। আমি জাগরণে তোমার সন্ধান
পাবো বলে জেগে আছি। দীনহীন যেন দেখা পায়
সর্বলোকে—এমনকি তুচ্ছাতিতুচ্ছের বিদ্যায়—

ইবলিসের দিন বড়ো, মোমিনের মুহূর্তই কাফি—
যদি ধরে ফেলতে পারি পলকেই তোমার গরিমা
রাষ্ট্র হবে। চাষির নজর পাকা বীজে ও জমিনে
আল্লাই একমাত্র জানে আল্লার অপার মহিমা।

এবাদতনামা: ৭৯ – দেখা

সকলেই ধর্ম করে আমি একা হয়েছি বে-দ্বীন
যদি প্রেম না পাই তো শরিয়তে কী ফল জীবের?
সকলেই আল্লাওয়ালা, আমি একা এশেকে দেওয়ানা
যদি রাজি না-ই থাকো, কী দাম এ কাবিননামার?

স্বামীর সংসার করি, স্বামী নাই এ কেমন ঘর?
যাকে পতি বলে জানি হয় নাই তাঁর দরশন
এ ধর্ম কিসের ধর্ম? পরকীয়া প্রেমে অবিশ্বাস
যদি নাস্তিকতা হয় হোক তাই দাসীর ভূষণ।

আওয়াজে জেগে থাকি জানি শরীরেরও তুমি কাছে
ঘাড়ের নিকটে শিরা তারও কাছে আছো দীননাথ
আছো প্রাণে প্রাণ হয়ে—নফসে আছো রূহের মহিমা
সুবেহসাদেকের মধ্যে থাকে যথা অনন্ত প্রভাত।

ঘুমে কি সম্পর্ক হয়? দাসী তাই চিরকাল জাগে
জেগে থাকি কামে প্রেমে হর্ষে দুঃখে ধর্মে অনুরাগে।

এবাদতনামা: ৮o – যে জানে সে জানে

যে জানে সে জানে আর যে জানে না সে কিন্তু জানে না
জানল না যারা তারা কলিকালে মৌলবি, ঠাকুর—
যে শেখে সে বোবা আর যে শিখে না তার বকোয়াজি
ভেঙে তছনছ করে প্রেম আর প্রজ্ঞার মুকুর।

যতো জানি ততো হই শিশুর মতোন অসহায়
হামাগুড়ি দিয়ে দাসী যাচ্ছে দেখে কোলে তুলে নিয়ো
নিদানের কালে যেন কাছে পাই। স্নেহে ও দয়ায় আপন
মুখের দিকে পলকের দৃষ্টি রাখিও।

ভাঙা কাচ পড়ে আছে টুকরাগুলি কুড়িয়ে নেবার
কেউ নাই। ছেঁড়া পাতা চতুর্দিকে উড়িছে বাতাসে
কোথাও দপ্তরি নাই। সেলাইয়ের নিবিষ্ট সাধনা
কই আর? নিষ্ঠা কই বাতেনি বা জাহেরি নিশ্বাসে?

যে জানে সে জানে আর যে জানে না সেও ভাঙা কাচে
দেখে নিজ মুখচ্ছবি কিন্তু রূপ চিনতে পারে না।

এবাদতনামা: ৮১ – কবিতার জন্য

একটি বাক্যের জন্য সারারাত এবাদত চলে
একটি অক্ষরের জন্য ফেরেশতার হাতে পায়ে ধরি
একটি বর্ণের জন্য ইবলিসের সঙ্গে লেনদেনে
গরমিল হয়ে যায়—ঘটে যায় মস্ত গুনাগারি।

তোমার নামের জন্য দিকে দিকে আজান রটানো।
তিলার্ধ কোথাও নাই কেউ জায়নামাজ ছাড়ে না।
একটি পদ্যের জন্য অসময়ে গোপন মসজিদে
ঢুকে গিয়ে দেখি আগে কোটি কবি রুকুতে দাঁড়ানো।—

প্রত্যেকেই প্রেম করে, আমি শুধু পাই নাই টের
বেলা গেল গঞ্জে হাটে বাজারের থলি নিয়ে হাতে
কামাই হোল না কিছু। প্রত্যেকেই পেয়ে যায় কথা
কিছু কি বরাদ্দ নাই দীনহীন অধম বরাতে?

দয়া করো। যদি তুমি দিতে চাও যথার্থই পারো
তোমার ইচ্ছায় লিখি, কে জানে তা কালাম না কবিতা।

এবাদতনামা: – ৮২ নিহেতু প্ৰেম

একদা প্রতিটি কেচ্ছা শেষ হবে। হোক মনুষ্যের
মসনবি কিম্বা বৌদ্ধ পূর্ণিমায় চন্দ্রাক্ষরে লেখা
মহর্ষি ফেরেশতাদের স্বহস্তে লিখিত জ্যোৎস্না
নিশা শেষে সকলি তামাম হবে। দিনের নিয়তি
রাত্রি; রাত্রির মৃত্যু পরোয়ানা হয়ে ফর্শা পৃষ্ঠায়
ভোর হয়! তুমি শুধু আলো দেখো, রজনী দেখো না?

এপারে ওপারে আমি নজর রেখেছি, কিছু নাই
এ-পিঠ ওপিঠ আমি ভাজা মাছ উল্টিয়ে খেয়েছি,
সকলি সমান ভোজ্য। আখেরে সকলি হবে ফানা
দুনিয়া বা আখেরাতে কী ফায়দা আমার তবে, প্রভু?

কেবলি এশেকে বাঁচি। নিহেতু এ প্রেমের তুলনা
কোথা পাবে? যদি পারো দাসীরে পোড়াও প্রেমাগুনে।

এবাদতনামা: ৮৩ – কে বা বাংলাদেশ!

অজ্ঞান শৈশবে আমি শঙ্খে ঘুমন্ত ভ্রূণ। তারো আগে
রক্তে কামে বিন্দু, কিম্বা তারো আগে বহু বর্ষ আগে
ধরো আমি মইনুদ্দিন চিশতির দরবারে ভক্তদের
পদধূলি। অটল গোরক্ষনাথ গুরুর সন্ধানে
যবে বঙ্গে বেকারার, আমি সেই অববাহিকায়
মহেশখালির তীরে বঙ্গোপসাগরে ভিজেছি।

কেহ মোরে দেখে নাই, কেহ মোরে জানে নাই, আমি
উপকূলবর্তী বীজ ক্রমে ক্রমে উদ্ভিদ হয়েছি
গ্রামের কৃষককুল শস্য কেটে ভরেছে ভাড়ার
ধরো আমি তাদেরি হাঁড়ির শত্রু বিখ্যাত ইঁদুর
ধান খাই, খুদ খাই, এই ভাবে ফাঁকে ও ফোকরে
হয়েছি বাংলাদেশ কবে আমি নিজেও জানি না।

মা’বুদ, তুমি তো জানো, ধূলি, ধান, খুদ বা ইঁদুর
কীট বা পতঙ্গ হই, আমি ছাড়া কে বা বাংলাদেশ?

এবাদতনামা: ৮৪ – পূজায় বসেছি

আশ্বিনে মহৎ বৃষ্টি, আশ্বিনে জলে জলে বেলা
বয়ে যায়। যদি তুমি শরতের নিষ্ঠা হয়ে ফুল
আবির্ভূত হতে চাও, আমি ডাক দিয়ে বলি, ‘বেলি,
এবার ফুটো তো দেখি আমি জায়নামাজে বসেছি।’
ফর্শা কুসুমের দিকে রুকু করে বেঁধে এহতেরাম
বলি, প্রেম বৃষ্টি হও, আশ্বিনে ফের দাঁড়ালাম
কার্তিকের কিছু আগে। বলি, তুমি মেঘ কিম্বা জল
যা খুশি যা ইচ্ছা হও, সর্ব রূপে ভজনা শিখেছি।

কী পার্থক্য মোমিনের? হিন্দু কিম্বা হোক মুসলমান
যে তোমার প্রেমে পড়ে সাকারে কি নিরাকারে তার
কী ছাতুটি এসে যায়! সর্বত্রই তুমি। ফুলে ফুলে
মেঘে জলে হিন্দু হও। আমি হিন্দু ঘোর পৌত্তলিক!

যদি তুমি প্রেম হও তবে ঠিক আমার বাগানে
জানি তুমি ফুটে আছো। আমি দেখো পূজায় বসেছি।

এবাদতনামা: ৮৫ – যদি দেখি ফেলি মুখ

কি জানি কী খসিতেছে, পাতা উড়িতেছে পালকের
উড়াল নকল করে। ন্যূনতম শব্দও শুনি না
পতনের। জীবিতের দোয়া ও দরুদ ছাড়া যারা
ভূমি লক্ষ করি নামে, সেই সব প্রতিটি বস্তুর
গতিবিধি নজরদারিতে রেখে অপলক থাকি
অপেক্ষায়। পতন ও শয়নের মধ্যবর্তী স্থানে
যদি দেখে ফেলি মুখ, যদি দেখি সেই মুখচ্ছবি
যদি দেখি জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যে দিব্য আলো!

কোনো আহাজারি নাই, জানাজা কাফন নাই, শুধু
হেমন্তে ধানের ক্ষেত শুষ্ক ধড় নিয়ে পড়ে আছে
আদিগন্ত মাঠের বিরানে। কোনো হল্লা কোলাহল নাই,
কার্তিকের জ্যোৎস্নায়। কুয়াশার মধ্যে সারারাত

দাঁড়িয়ে রয়েছি ঠায়, দাঁড়িয়ে রয়েছি যদি দেখি
যে আমাকে এনেছিল সে স্বয়ং নিতে আসে নাকি!

এবাদতনামা: ৮৬ – বিজ্ঞানী হয়েছি

আমি ভালোবাসি আম, করমচার ফুল, ভালোবাসি
কাঁঠালের তরকারি, ভালোবাসি ভর্তা, শাক, লাল
আউশ ধানের ভাত, ভালোবাসি খই, চিড়া, ভালোবাসি
দই, যদি যদি মুগের ডালের মধ্যে সজনে থাকে, আমি
সজনে খেতে ভালোবাসি, ডাল ছাড়া। যদি কেউ
ঘি দিয়ে রান্না করে সনকার তিতা গিমা আমি অবশ্যই খাবো। স্নেহ মিশ্রিত তিতা অবশ্যই খাই। টক ঝাল মিষ্টি তিতা সকল কিছুতে আছে রুচি।

খুব কাছে যেতে চাই। সবুজ ও শব্জির মধ্যবর্তী
পথ ধরে। গাছে গাছে ফুল ধরে ফল হয়,
আমি ফুলকেও ভালোবাসি, ফলকেও, এমনকি বীজটিও
নিয়ে ঘরে সংরক্ষণ করি, আবার লাগাই মাঠে, যেন
জীবের খাদ্যব্যবস্থার মধ্যে তোমার অশেষ কুদরতি
বুঝি। পরওয়ারদিগার, আমি ভালো বিজ্ঞানী হয়েছি!

এবাদতনামা: ৮৭ – সঙ্গ দোষে নষ্ট আমি

সঙ্গ দোষে নষ্ট আমি, মাফ চাই, মা’বুদ, কবিদের
সমুদয় কাব্য তবু পাঠ করি—গুপ্ত আতিশয্যে,
উৎসাহে। তারা তুচ্ছ শিশিরের কেচ্ছা কয়, তারা
চুল ও চিবুক নিয়ে পদাগিরি করে, প্রেমিকাকে
প্রকাশ্যে বাক্যের মধ্যে যত্রতত্র চুম্বনাদি করে,
বাক্যে বাক্যে ‘আমি’ ছাড়া কবিগণ ‘অপর’ জানে না।

কবির ঘরের পাশে খাদ্য মাছ শক্তির আড়ৎ
পানিতে যে মাছ ভাসে সেই মাছ অক্ষরের জলে
সাঁতার কাটে না। কবিতায় ধান বোনা অসম্ভব
শক্তিতেও ফল ধরে, কবি জানে, সেই ফুল
তবুও ফোটে না কাব্যে। প্রকাশ্যে কবুল করি, প্রভু
এ পারলৌকিকতার এক বিন্দু ফায়দা নাই, তবু
কবির এ গুনাহগারি, মাফ করো প্রভু, তুমি জানো

তোমার প্রশস্তি গায় কবি ছাড়া হেন বান্দা নাই।

এবাদতনামা: ৮৮ – প্রতিবিম্ব হবো না

সর্বত্রই ক্লিক পড়ে, সর্বত্র শাটারের শব্দ শুনি
কোথাও কে জানি কার ফটো তুলিতেছে ক্রমাগত।
আমি সে ক্যামেরাম্যান খুঁজি, কিন্তু নিকটে দেখি না
প্রত্যেকে অদৃশ্য সেই ক্যামেরার হাতে দৃশ্যবস্তু
হয়ে যায়। জানি আমরা অন্যের অপর হয়ে থাকি—
নিজ ছবি চাই বটে কিন্তু পাই অপরের চোখে
অন্যদের তসবির, নিজ চোখে নিজেকে দেখি না—
ফটো বাক্সে পরাধীন আমাদের জিন্দেগি ফুরায়।

নিজের তসবির আমি নিজ চোখে শুধু একবার
প্রাণভরে দেখি যেন প্রভু। আয়নায় যাকে দেখি
সেকি আমি? পারদের বিপরীতে নয়, নিজ চোখে
নিজেকে দেখাও, আমি কিন্তু প্রতিবিম্ব হবো না।

আয়না ছাড়া মানুষের চেহারা মানুষ নিজ চোখে
দেখতে অক্ষম, প্রভু, এ এক আশ্চর্য কুদরতি!

এবাদতনামা: ৮৯ – গোনাহ

আজ আমি আরেকবার রপ্তানিমুখী পোশাকের
কারখানায় ব্যস্ত কিশোরীদের অনুপম মাধুর্য দেখেছি।
একদা তারাই ছিল কাব্যে, রসে। আমিও কাব্যের
কারখানায় নিয়োগপত্র ছাড়া উহাদের অনেকের
নিয়োগ দিয়েছি। মসৃণ আঙুল দিয়ে তারাও আমার
অক্ষর বুনেছে; সেই পদ্য কিশোরীমঙ্গল আমি
নিজ নামে ছাপিয়েছি, কৈশোরিক কারখানার ধন
কাব্যের বাজারে আমি বেচাবিক্রি করেই তো কবি!

কবিতার কারবারে শ্রমিকের সমিতি ছিল না
যখন যে নামে খুশি ডেকেছি আফোটা মেয়ে, তারা
সেলাই করেছে বাক্য, সুতা দিয়ে বুনেছে অক্ষর।
আজ কাব্য স্বপ্নচ্যুত হয়ে বাস্তবে দলে দলে তারা
পোশাক তৈরি কারখানায় সস্তা শ্রমিক হয়ে কাব্যের
মশকরা করে যাচ্ছে, এই গোনাহ মাফ করো, প্রভু।

এবাদতনামা: ১০ আমিও উদিত হবো পুবে

আজ আমি ভোরবেলা সূর্যকে প্রণাম করেছি,
বলেছি ধন্য তুই, পরওয়ারদিগারের আদেশে
প্রতিদিন পুবে উঠলি, যথারীতি পশ্চিমে মক্কায়
অস্ত গেলি, রুকু সিধা রেখে তুই প্রিয় রসুলের
রওয়াজা মোবারকে নিজের হাজিরা দিয়ে ফের
যথারীতি ফিরে এলি সেই পুবে, বঙ্গদেশে, যেন
শস্যেরা সবুজ হয়, বৃক্ষ বাড়ে, যেন জ্যৈষ্ঠ মাসে
আম পাকে, কাঁঠাল বৃহৎ হয়, যেন জাম গাছে
পাখি বসে, লাল, নীল, খয়েরি রঙের পাখি, যারা
বাংলা ফল ছাড়া আর অন্য ফল আহার করে না।

আমি গোনাহগার প্রভু, এক অক্ষর নামাজ জানি না
আদেশ নির্দেশ জানি কিন্তু কই আমল করি কি?
তবু প্রকৃতির মধ্যে আমি একা প্রকৃতি সাধনা
করে যাচ্ছি, একদিন আমিও উদিত হবো পুবে।

এবাদতনামা: ৯১ – বিশুদ্ধ ভিক্ষুকের বৃত্তি

দাও যাদ দিতে পারো, আমি দুই বাহু মেলে নেবো
বেশরম নেবো ঠিক ভিখারি যেভাবে ভিক্ষা নেয়
নিজের মর্যাদা ভুলে, দীনহীন নিজেকে অন্যের
পদানত জ্ঞান করে, ভিখারি যেভাবে দয়ালুর
দিকে অসহায় দেখে, সেই নিঃসহায় চোখ মেলে
আমিও তাকাবো, প্রভু, সাধ যদি দেখে ফেলি মুখ।
নিষ্ঠুর বনীর গাড়ি তারও নামে কাচের জানালা
ভিক্ষা দিতে, তুমি আর কী নিষ্ঠুর ওহে দয়াময়!

দাসী আমি, নিতে জানি, কিন্তু কিছু তোমাকে দেবার
ধন নাই, কিচ্ছু নাই। ভাঙা কলসি তবু ঠনঠন
বাজে। চতুর্দিকে মানুষের বিশাল বাজার। আমি
সে বাজারে বসে আছি সওদা ছাড়া বিশুদ্ধ ভিক্ষুক
জীর্ণ জোব্বা গায়ে, শুধু নেবো বলে সাধুর বাজারে
বসে থাকি ভিক্ষা ছাড়া মোমিনের বৃত্তি কিছু নাই।

এবাদতনামা: ৯২ – নিহেতু প্রেমের গল্প

যে প্রেমের হেতু নাই, নাই কোনো কার্যকারণ
যে প্রেমে বেহেশত নাই, কিম্বা নাই নরক দোজখ
যে প্রেমে শরিয়া নাই, কিম্বা নাই গুপ্ত মারেফত
সেই প্রেম খুঁজিতেছি। সে এশেকে উন্মাদ হয়েছি।

রোজ হাশরের গল্প শুনিতেছি, শুনি কেয়ামত
আসিতেছে। সৃষ্টি আদ্যপান্ত নাকি ফানা হয়ে যাবে
যে প্রেমে ধ্বংস নাই, সৃষ্টি ও স্রষ্টা কিছু নাই
সে প্রেম সন্ধান করে আমি আজ পাগল হয়েছি।

যে আছে সে আছে তার জন্মমৃত্যু সৃষ্টি লয় নাই
সব শূন্য হয়ে গেলে তবু এই ‘আছে’ টুকু আছে।
হেন শূন্যতার সঙ্গে প্রেম, হেন বৈবাহিকতায়
নিত্য বিরহের সঙ্গে ঘর করে উদভ্রান্ত হয়েছি।

মা’বুদ, তুমি তো জানো যে আগুনে নিত্য ভস্ম হওয়া
সে অগ্নির হেতু নাই। শুধু নিরন্তর পুড়ে যাওয়া।

এবাদতনামা: ৯৩ – নদী

এই নদী চলিয়াছে অন্য এক সাগরের প্রতি
হয়তো সাগর নয়, তার নাম ধারা নিরবধি
কোনো উৎসমুখ নাই, এই নদী ঠিকানা রহিত
যে বাকে সে দৃশ্যমান সেই তীরে ইচ্ছা করি যদি
বসতের—সে জীবন অনিত্যের, তিলেকের স্থিতি;

এ বড়ো অদ্ভুত কাণ্ড এ স্রোতের বিচিত্র প্রকৃতি।

আমি জেলে। তবুও সাহস করে ছিপ ফেলে জলে
বসে আছি। যদি সাধনার গুণে ধরা পড়ে পুচ্ছবান
রুপার ইলিশ। যে সকল মৎস্যকুল উজানে চলেছে
তাদের গুরুর গুরু হয়তো বা নদীর গহিনে
জীবচিহ্ন গুপ্ত রেখে পরমের প্রবাহে সাঁতার
দিতে আসে জ্যোৎস্নায়। পরমেরে যদি পেয়ে যাই
তাহলে চিনবো কি? মা’বুদ সে সিদ্ধাচার্য কই?
যার দেখা পাবো বলে বঙ্গে আজও উচাটন রই!

এবাদতনামা: ৯৪ – মওতের মুখচ্ছবি

মওতের মুখচ্ছবি নজরদারিতে রাখি। জীব
জন্ম আর মৃত্যুর ফারাক জানে না, তাই তার
নিরন্তর ঘাস খাওয়া। কিম্বা মাংসখেকো হয়ে
পশুই ঘটায় দেখো পশু খেয়ে পশুর বিস্তার।

মওতের নামখানি সর্বদা সস্মরণে রাখি, যেন
তোমার শরণে থেকে তোমার ভজনা জীবলোকে
অনিবার্য হয়ে ওঠে। ও আমার পরওয়ারদিগার
যেন তুমিই কর্তব্য হও মনুষ্যের। যে রূপের সাধনা
ফেরেশতার জানা নাই, যেন সেই আনন্দস্বরূপ
এ দাসীর ধার্য হয়, অবলার আর কী কামনা!

অনাথের নাথ তুমি। পতিতের তুমিই উদ্ধার
মোমিনের রুকু তুমি, শ্রমিকের রক্ত আর ঘাম
কৃষকের এবাদত—তুমি কর্তা তুমিই প্রক্রিয়া
মৃত্যুকে ব্যঙ্গ করে বঙ্গে তাই তোমার জিকির।

এবাদতনামা: ৯৫ – জন্মেই হাজতি আমি

দয়াল নামটি ছাড়া অন্য নাম শিখি নাই। শুনি
তুমিই প্রভুর প্রভু। রোজ হাশরের ময়দানে
তুমিই সুপ্রিম কোর্ট। হতে পারে তুমি নিজে বাদি
নিজেই তো খেলাচ্ছলে বিবাদি সেজেছ পরক্ষণে?

তোমরা মামলা দেখি নিজের বিরুদ্ধে নিজে, তুমি
নিজেই নালিশ করো, সালিশেও তুমি। রে নিষ্ঠুর
হও ফরিয়াদি কিন্তু বেশরম নিজেরই এজলাসে
কেন নিজে চিফ জাস্টিস হও ওগো আল্লা-হুজুর?

তোমার ইত্যাদি লীলা নয়া বঙ্গে নিরীক্ষণ করি
কাকে দোষ দেব বলো? মানুষেরে কেন দোষী করো?
নিজের আনন্দে তুমি নিজে প্রভু খেলিতেছ খেলা
বেলা গেল তথাপিও আদালতে ছুটি তো হোল না!

জন্মেই হাজতি আমি। আসামির কেমন বিচার?
‘দয়াল’ নামটি ছাড়া অন্য নামে পাবে না নিস্তার।

এবাদতনামা: ৯৬ – কমিউনিস্ট

আমি প্রভু কমিউনিস্ট। ঠিক, আমি আস্তিক নই
কসম বিপ্লবের, কক্ষনো তাই বলে নাস্তিকও না;
কাকে প্রভু ‘আছে’ বলে, কাকে বলে ‘নাই’ অদ্যাবধি
এই ভেদবিদ্যা আজও কমিউনিস্ট, মৌলবি মওলানা
ভিক্ষু পুরোহিত যাজক মণ্ডলী আচার্য বা শ্রমণ
আমল করেনি বলে কুতর্কের বাজারে জরিমানা
দিচ্ছে প্রত্যেকেই। ঘটে দাঙ্গাহাঙ্গামা। জাহেলিয়া যুগে
তর্ক কুতর্ক হয়। কোনো ভেদবিদ্যার সুরাহা ঘটে না।

প্রত্যেকেই সবজান্তা। কীভাবে কে ‘আছে’ কিম্বা ‘নাই’
উভয়ে আগাম জানে! দেশকালে যা ‘আছে’ কিম্বা ‘নাই’
তুমিও কি তেমনি বস্তু? তুচ্ছ এক বস্তুর তুলনা?
শেরেকির অন্ধকার—জিজ্ঞাসিলে আসমান দেখায়!

দ্বীনের তরিকা বৈপ্লবিক—শেষ শেরেকির দিন
ইমানে কবুল করো কমিউনিস্ট তোমারই মোমিন।

এবাদতনামা: ৯৭ – বৰ্তমান

দেনা শোধ হয় নাই। ভয়ে পদ্যে করি মোনাজাত
নিহেতু প্রেমের রজনীতিটুকু ছাড়া অন্য বিজ্ঞান
জানি নাই, শিখি নাই, অন্য কুদরতি বেলায়েতি
কে শেখাবে? কেউ নাই—নবীদের যুগ আর কই?

কম্পাস ও ধ্রুবতারা আছে কিন্তু নামেই আশ্রয়
জাহাজ আমার প্রভু কোথায় চলেছে ঠিক নাই
নাবিক তো নই। বর্তমান জানি—আমি ‘বর্তমান’
যা নাই বা দেখি নাই তার কেচ্ছা কখনও বলি না।
আমি প্রভু সত্যবাদী—নবীজির সত্য নিয়ে আজ
অকূল পাথারে পাড়ি দিয়ে যাচ্ছি। তুমিই ভরসা।

বড় সাধ ছিল কবিদের যুগে নিত্য বর্তমান
আরো বর্তমান হবে। কিন্তু প্রকাশ/প্রকাশিতব্যের
ভেদ কেউ বোঝে নাই। কাব্য শেষাবধি শুয়রের
খোঁয়াড়ের চিৎকার। ভয়ে লিখি এবাদতনামা।

এবাদতনামা: ৯৮ – নামাতীত

‘অনামক অচিনায় বচন বাগেন্দ্রিয় না সম্ভবে’
–ফকির লালন সাঁই

ভালো লাগে, ভালোবাসি। শিশিরের শব্দে জেগে উঠি
ঘাসের ওপর দিয়ে ঘাস হয়ে ঘাসেরই ফড়িং
হেঁটে যাচ্ছি দৌড়ে যাচ্ছি সচ্চিদানন্দ দিচ্ছি ঝাঁপ
কিন্তু পড়ি তোমারই কোলের মধ্যে—সর্বত্রই তুমি।

প্রত্যেকে ফরহাদ বলে ডাকে, কিন্তু কসম তোমার
কাকে তারা ডাকে আর কেই বা উত্তর দেয় আমি
হদিস জানি না। কার নাম নিত্যদিন বহন করেছি
একমাত্র তুমি জানো। যে নামের আশ্রয়ে আশ্রিত আমি
সেই নামটুকু ভিন্ন অন্য নাম হে জগৎস্বামী
আমি কি শিখেছি কভু? তবু প্রভু ভুল হয়ে যায়
লোকে ডাকে, সাড়া দেই। এ আমিত্ব সহজে গেল না।
যে তুমি আমিত্বহীন তাকেই বা ডাকি কোন নামে?

আল্লা খোদা কৃষ্ণ দুর্গা তারা শিব যে নামেই ডাকি
ওগো নিরঞ্জন তুমি সর্বদাই থাকো নামাতীত।

এবাদতনামা: ৯৯ – বিরহ

আমার দেখাতে সাধ কীভাবে নেকাব খসে। বাঞ্ছা
একাকী দেখাবে দাসী আপন বোরখা খুলে শুদ্ধ
দিগম্বরী নিবেদন। কী মধুর সর্বাঙ্গ দেওয়া!
যে ফুলে ভ্রমর মধু খায় সে কুসুমে ওগো পতিধন
তোমার নামাজ বঙ্গে আদায় হবে না। যে অন্ন অন্যের
হস্তক্ষেপে এঁটো হয় সেই বাড়া ভাত বঙ্গ জেয়াফতে
কবুল করে না। শুদ্ধ প্রেমে পাক ও পবিত্র হয়ে আমি
কাফনের রঙে নিজে সেজেগুজে আতরে সুরমায়
অভিসারে যাব। আমাকে তোমার বুকে গ্রহণ করিও।
দাসীর বাসনা এই—পতিধন, এই বাঞ্ছা হবে কি কবুল?

রোজা বা নামাজ আমি জানি নাই শিখি নাই। আমি
শরিয়ত তরিকত হাকিকত মারফত ইত্যাদির ভেদ
বুঝি নাই। কে বুঝাবে শুদ্ধ রসিক ছাড়া? আহা
কতোকাল এ অপেক্ষা? এ বিরহ আর তো সহে না।

Book Content

আত্মা ও সম্পত্তি
কর্তৃত্ব গ্রহণ কর, নারী
লেখক: ফরহাদ মজহারবইয়ের ধরন: Editor's Choice, কাব্যগ্রন্থ / কবিতা

বৃক্ষ – ফরহাদ মজহার

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.