• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

একশ বছরের সেরা ভৌতিক – সম্পাদনা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও বারিদবরণ ঘোষ

লাইব্রেরি » বারিদবরণ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায় » একশ বছরের সেরা ভৌতিক – সম্পাদনা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও বারিদবরণ ঘোষ
একশ বছরের সেরা ভৌতিক

একশ বছরের সেরা ভৌতিক – সম্পাদনা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও বারিদবরণ ঘোষ

মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:

প্রথম প্রকাশ, কলকাতা পুস্তকমেলা, মাঘ ১৪০২

প্রচ্ছদপট – অঙ্কন : সুধীর মৈত্র

.

নিবেদন

ভূত প্রসঙ্গটাই আবহাওয়া বদলে দেয়, রহস্য ঘনীভূত করে তোলে, মানুষ নড়েচড়ে বসে৷ ভূত আছে কি নেই এই প্রশ্ন তো অবান্তর, কারণ কেউই জানে না তা৷ তবে ভূত আমাদের প্রিয় বিষয়৷ ভূত এবং ভৌত পরিমণ্ডল আমাদের জীবনের ধরাবাঁধা সীমানাকে প্রসারিত করে দেয়৷ ভূত মানে শুধু ভয় নয়, মজা, কল্পনার চিন্তার এবং অবশ্যই এক প্রয়োজনীয় অসঙ্গতি৷ রূপকথা, কল্পবিজ্ঞান বা নননেন্স ভার্সে যেমন লোকে যুক্তি-বিজ্ঞান খুঁজতে যায় না, তেমনি ভূতের গল্পেরও কিছু অধিকার আছে৷ এই সংকলনটি অনেকগুলো মাথা এক হয়ে তবেই করেছে৷ ওই মাথাগুলির একটি আমার৷ সম্পাদকের অনেক দোষ, তবু বলি দোষগুলো ধরতে পারলে সংশোধন করা যাবে৷

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
১২.০১.৯৬

.

ভূমিকা

সব দেশেই ভূত একটা সমস্যা বিশেষ৷ কারণ জীবনে কোনো সময়ে ভূতের ভয় পাননি—এমন মানুষ সম্ভবত পৃথিবীতে নেই৷ আবার ভূতকে ভয় পান—এমন কথা স্বীকার করতে প্রস্তুত আছেন—এমন বয়স্ক লোকের সংখ্যাও পৃথিবীতে খুবই কম আছে৷ অনেকে দিনের আলোয় বুক ফুলিয়ে বলেন ‘ভূতে বিশ্বাস করি না,’ সন্ধে হলে তাঁদেরই বুকের স্পন্দন একশো আশিতে পৌঁছে যায়৷ ভূত-প্রেত নিয়ে জগতে গবেষণাও কম হয়নি৷ এককালে থিওজফিক্যাল সোসাইটি এদেশে এই নিয়ে দারুণ আলোড়ন তৈরি করেছিলেন৷ প্ল্যানচেটে আত্মাকে নামানো তো একসময়ে একটা দারুণ বিলাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ স্বামী অভেদানন্দের ‘লাইফ বিয়ন্ড ডেথ’ বইয়ে আত্মার ছবি পর্যন্ত মুদ্রিত আছে৷ রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা একটা গ্রন্থের উপকরণ জুগিয়েছে৷ কাজেই ভূতকে কোনোক্রমেই অবহেলা করা উচিত হবে না৷ ভূত একটা ভালো ‘ইন্ডাস্ট্রি’তে এখন পরিণত হয়েছে, বাংলা সাহিত্যের পাঠকেরা তা স্বীকার করে নেবেন৷ সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত ভূতের নাচ ছবিতে দেখিয়ে বাজার মাত করেছিলেন৷

সব দেশেই ভূতের এক একটা নাম আছে স্ত্রী, পুরুষ এবং জাতি বা বৃত্তি ভেদে৷ সেই বেদের আমল থেকে ভূতেদের অগ্রগতি ও প্রগতি শুরু হয়েছে৷ তার আগেও নিশ্চয়ই ছিল, ‘ভূত’ শব্দটির মুখ্য অর্থই তার প্রমাণ—যদিও তার লিখিত-পড়িত কোনো নিদর্শন আমরা দিতে পারছি না৷ এজন্যে যদি কোনো ত্রুটি হয়ে থাকে, সেজন্যে আগেভাগেই ভূতনাথের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি৷

অর্থাৎ ভূতেদেরও একজন নাথ ছিলেন এবং এখনও নিশ্চয়ই আছেন৷ একজন প্রমথনাথ শিব৷ শ্মশানচারিণী মহাকালীও আদি দেবীদের মধ্যে অগ্রগণ্য৷ দুজনেরই প্রচুর স্ত্রী-পুরুষ ভূত-পেত্নী শিষ্য-শিষ্যা৷ আগে তাঁরা প্রকাশ্যেই ঘোরাফেরা করতেন—এখন মনুষ্যভূতের অত্যাচারে একটু অন্তরালে গেছেন৷ তবে যেরকম লোডশেডিং চলছে তাতে তাঁদের ফিরে আসার প্রচুর সম্ভাবনা৷ কারণ ভূত-ভূতিনীরা অন্ধকারটাকেই বেশি পছন্দ করে৷ দুর্যোগপূর্ণ অমাবস্যার রাত্রিতে তাঁরা একটু বেশি সচল হন৷

বেদে ‘ভূত’ কথাটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘প্রেত’ এবং ‘পিশাচ’ শব্দ দিয়েই বোঝানো হয়েছে৷ অথর্ববেদের চতুর্থ কাণ্ড অষ্টম অনুবাক অথবা অষ্টাদশ কাণ্ডের ২-৪ অনুবাকে এদের বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনা আছে৷ সত্যি কথা বলতে, অথর্ববেদেই প্রেত-পিশাচ তাড়ানোর মন্ত্রেরও সৃষ্টি৷ তবে তারা সে সময়ে আমাদের ব্রহ্মদত্যি বা মামদোর চরিত্রের ভূত হয়ে ওঠেনি৷ তারা মাংস খেতে ভালোবাসত৷ পিশাচ কথাটার অর্থই অবশ্য তাই—যারা পিশিত বা মাংস আশ বা ভক্ষণ করে৷ এদের আবার ‘বিবাহিত’ বউও ছিল—তারা পিশাচী নামে পরিচিত৷ পরবর্তীকালে এরা শিবের অনুচর হয়—‘ধিয়া তা ধিয়া, তা ধিয়া ভূত নাচে৷ উলঙ্গী উলঙ্গ পিশাচী পিশাচে৷’ এদের মধ্যে যারা ব্রাহ্মণ থেকে জন্মগ্রহণ করত তারা হত ব্রহ্মপিশাচ—‘বিল্ব বিটপে ব্রহ্মপিশাচ, হাসিছে বাজায় গালে৷’ (ছায়াময়ী—হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়)৷

আর প্রেত জন্ম নিত তখনই যখন নিয়মানুসারে ঔর্ধ্বদেহিক ক্রিয়া সম্পন্ন না হত৷ এই মৃত ব্যক্তির আত্মার নাম প্রেত—যা সূক্ষ্মদেহে বিরাজ করে৷ এদের খাওয়ানোর জন্যে গয়ায় পিণ্ডদানের ব্যবস্থা দেখে মনে হয় এরা নিরামিশাষী৷ মহানির্বাণ তন্ত্রেও এইসব প্রেত ইত্যাদির সবিশেষ উল্লেখ আছে৷ এই সংকলনের অন্যতম সম্পাদক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন যে ভূতের দলে পৃথিবী পূর্ণ হয়ে গেলে তা জগতের পক্ষে মঙ্গলদায়ক হবে একারণে একজাতের ভূতেদের জন্যে গয়ায় পিণ্ডদান তিনি নিষেধ করেছেন—কারণ এই ভূতেরা মঙ্গলজনক৷

শুধু আমাদের দেশেই নয়, সব দেশেই ভূতেদের যথেষ্ট প্রতিপত্তি আছে৷ স্পুক, স্পিকি, গবলিন প্রভৃতি বিলিতি ভূতেরা গোস্ট, স্পিরিটদের পাশে নিশ্চয়ই বর্তমান আছেন৷ জিন, জান, আফিদ, মারিদ প্রভৃতি আরবি-কাবুলি ভূতেদের দাপাদাপি নিশ্চয়ই অব্যাহত৷ সুকুমার সেন আরও নানান ভূতের তালিকা দিয়েছেন—হাঙ্গেরির ভ্যামপি, আয়র্ল্যyন্ডের বনশি, জার্মানির পলটারজাইস্ট, উত্তর ইউরোপের ওয়ারউলফ প্রভৃতি৷ এদেশে সাহেব ভূতদের নিয়ে নানা গল্প আছে৷ ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘বীরবালা’ গল্পে বীরবালার দীর্ঘনিশ্বাসে এমন এক সাহেব ভূতের শরীরের সব জোড় খুলে গিয়েছিল৷ তাঁর বইয়েই দুটি ভূতের নাম ছিল স্কাল এবং স্কেলিটন৷ কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী লিখে গেছেন—‘আকাশে কুমুদা আছিলা মামুদা ভাঙ্গিলা মাথার খুলি৷’ বাংলা প্রবাদে আছে—‘সাত গেঁয়ের কাছে মামুদাবাজি’৷ গল্পে আছে হিন্দুপ্রধান সপ্তগ্রামের বেশি-চালাক হিন্দু ভূতের কাছে কম-চালাক মুসলমান ভূতের নিষ্ক্রিয়তার কথা৷ ভরসা করি এটি কোনো হিন্দু ভূতের তৈরি গল্প৷ ভূতের সমাজেও যে সাম্প্রদায়িকতা আছে—এই গল্প তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷

আবার বাঙালি ভূত ছাড়া, হিন্দুস্তানী ভূতের সন্ধানও আমরা পেয়েছি রাজশেখর বসুর ‘ভূশণ্ডীর মাঠে’ গল্পে৷ এর সুপরিচিত ‘কারিয়া পিরেত’—মাথায় পাগড়ি কালো লিকলিকে চেহারা, কাঁকলাসের মতো সেই জীবাত্মার বিখ্যাত গানটি জানে না—এমন রসিক ভূ-বাংলায় আছেন কিনা জানি না—‘কা রা রা রা রা রা৷ আরে ভজুয়াকে বহিনিয়া ভগলুকে বিটিয়া কেকরাসে সাজিয়া হো কেকরাসে হো-ও-ও-ও—৷’ ইত্যাদি৷ হিন্দুস্তানী গুটিয়া দেও—বেঁটে ভূতের সন্ধানও পেয়েছি আমরা৷

এখন আমাদের বাঙালি ভূত, তাদের বাসস্থান, আবির্ভাব, খাদ্যাভাব, চেহারা, পোশাক-আশাক, অত্যাচার এবং বিচিত্র নামকরণের আগে তাদের সৃষ্টির ইতিহাস এক শাব্দিক অনামা কবির কাছ থেকে আগে ঋণ করে পাঠকদের নিবেদন করি :

আসমান থাক্যা পড়িল বালি
তাতে উঠিল গাছাগাছালি
এক গাছের তিন পাতা
শুন ভূতের জন্মকথা
কালিকা কালিকা বর
খালের পাড়ে দিগম্বর
দিগম্বর নাচে লেংটা হইয়া
জটার পানি পড়ে পর্বতে মাথা বাইয়া
পর্বত কাঁপে থরথর সায়রে কাঁপে পানি
তাতে জনমিল ভূতযোনী
পার ভাঙ্গে বিরক্ষ ভাঙ্গে সাগর শুকায়
ভূতের ভয়ে দেবী দুর্গা নিদ্রা নাহি যায়…

কাজেই আমাদের ভূত স্বয়ং শিবসৃষ্ট—অন্নদা নিজেই বলেছেন ‘ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে’ (অন্নদামঙ্গল—ভারতচন্দ্র)৷ মনে হয় সেই সুযোগেই কিছু ভূত পৃথিবীতে থেকে গেছিল—কৈলাসে ফিরে যায়নি৷ এবং অনুমান করি সেটা ছিল কার্তিক মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী৷ কারণ এই তিথিকেই ভূত চতুর্দশী বলা হয়৷

এবার ভূতেদের বংশপরিচয় দিই৷ প্রথমে স্ত্রী ভূতের কথা—লেডিস ফার্স্ট৷ ভূতের স্ত্রী হিসেবে পেত্নীর (‘পত্নী’-জাত?) খ্যাতিই সমধিক৷ আসলে কথাটা প্রেত-এর স্ত্রীলিঙ্গ প্রেতিনী-জাত৷ তার থেকে লৌকিক উচ্চচারণে পেত্নী৷ শিবায়ন কাব্যে আছে—‘ভাগ্য বলে সন্ধ্যাকালে পেতি জ্বালে বাতি৷’ কাব্যনির্ণয়ে আছে—‘ও যায় পেতিনী দানা, খাইছে সখের খানা, একখানা পচা ঠ্যাং নিয়া৷’ বাংলা গ্রাম্যকথায় ‘পেত্তা’ জ্বলছে বলে একটা কথা রয়ে আছে৷ মরাহাজা পুকুরে যে ‘আলেয়া’ জ্বলে তাকেই ‘পেত্তা’ বলা হয়ে থাকে—শিবায়ন কাব্যের ‘পেতি’ তাই ‘জ্বালে বাতি’৷

এছাড়া ডাকিনী-নাগিনী চেড়িরা আছে৷ ডাকিনীরা শিব-দুর্গার অনুচরীবিশেষ৷ অন্নদামঙ্গলে আছে—‘ডাকিনী-যোগিনীগণ ভূত প্রেত অগণন সঙ্গে রঙ্গে নাচিয়া বেড়ায়৷’ ডাকিনী কথা থেকেই ডাইনি এসেছে—একেবারে দেহধারিণী নারী, সূক্ষ্ম আত্মা নয়৷ যোগিনীরা হল দুর্গার সখী—চৌষট্টি সংখ্যক দেবী৷ কবিকঙ্কণে আছে—‘রণে অলক্ষিত হয়ে, চৌষট্টি যোগিনী লয়ে ঊরিলেন শ্রীসর্বমঙ্গলা৷’ পেত্নীর পরেই ভূতসমাজে শাঁকচুন্নির স্থানই বর্তমান৷ শব্দটি এসেছে—শঙ্খচূর্ণি শব্দটি থেকে৷ মরবার সময় যে স্ত্রীলোক সধবা ছিলেন এবং হাতে শাঁখা নিয়ে মরেছেন—তাঁরই প্রেতাত্মা হল শাঁকচুন্নি৷ এরাও দুর্গা-অনুচরী, এদের অপর নাম ‘শাঁখিনী’৷ অন্নদামঙ্গলে আছে—‘চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে৷ চলে শাঁখিনী পেতিনী মুক্তকেশে৷’ রাজশেখর বসুর গল্পে (আহা, যতীন সেন মহাশয়ের সেই অনবদ্য ছবি!) বিদেহী শিবুর সঙ্গে একটা শাঁকচুন্নির দেখা হয়েছিল— সে একটা গামছা পরিয়া আর একটা গামছা মাথায় দিয়া এলোচুলে বকের মতো লম্বা পা ফেলিয়া হাতের হাঁড়ি হইতে গোবর-গোলা জল ছড়াইতে ছড়াইতে চলে যাচ্ছিল’! মাঝে মাঝে আমাদের সমাজেও আমরা শাঁকচুন্নির গান শুনে পরিতৃপ্তি পেয়ে থাকি৷ জানি না এদের দেখেই আমরা ছড়া কাটি কিনা—

ভূত আমার পুত পেত্নি আমার ঝি,
রাম লক্ষ্মণ বুকে আছে করবে আমার কি!

এবার পুরুষ ভূতেদের কথা বলি৷ প্রথমেই ব্রাহ্মণ ভূত—ব্রহ্মদৈত্য বা বেম্মদত্যির কথা৷ হয়তো সন্ধ্যা বা রাত্রিকালে কেউ কেউ খড়ম পায়ে একে ঘুরে বেড়াতে ‘শুনে’ থাকবেন! হয়তো বা বাড়ির কাছে ন্যাড়া বেলতলাটায় দেখেও থাকতে পারেন কেউ কেউ৷ এঁরাই ভূতের বংশে নৈকষ্য কুলীন৷ হয়তো শিবের খাসমহলের লোক, নইলে বেলগাছে বসতি কেন? শিবানুচর হয়ে তাল-বেতালও ভারতীয় সাহিত্যে দুই উল্লেখযোগ্য ‘ভূত’৷ ‘দানো’ ঠিক ভূত নয়—দানব বা দৈত্য বিশেষ, আরবি সাহিত্যের জিনের জিগরি দোস্ত!

একানড়ে হল এক পা-ওয়ালা ভূত৷ এরই মতো আর এক প্রতিবন্ধী ভূত কন্ধকাটা৷ আসলে এটা হল কবন্ধ ভূত৷ এর মাথা নেই, কেবল ধড়৷ সাহেবদের ভূতেরও অনেক সময় মুণ্ডু থাকে না৷ প্রায়ই দেখা যায়—গলাকাটা এই ভূতের মাথাটা অনেক সময় ভূতের হাতেই ধরা থাকে এবং কাটা মুণ্ডটিই অনর্গল কথা বলতে পারে৷ তবে নাকিসুরে কিনা—তা আমি হলফ করে বলতে পারব না৷ তবে এরা নিশ্চয়ই হাসে৷ ভূতের হাসি সে বড় সাংঘাতিক ব্যাপার—গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে, চোয়ালে চোয়াল লেগে যায়৷

ছোট ছেলেরা এক ধরনের ভূতের দ্বারা সহজে আক্রান্ত হয়৷ কেন জানি না, এ ধরনের ভূতেদের পছন্দ কেবল খুব ছোটরাই—একেবারে আঁতুড়ে শিশুরা৷ এরা হল পেঁচো ভূত৷ পেঁচো কথাটা পিশাচ (না পঞ্চাননের চর?) থেকে এলেও এদের ঘোরা-ফেরা ছোটদের ঘিরেই৷ যক ভূতকে বিশ্বাস করেন এমন লোকের অভাব এখনও নেই৷ যক হল যক্ষ৷ যক্ষ হলেন ধনরক্ষক৷ আগে ধনী কৃপণেরা ধন যক দিত৷ তাদের টাকাকড়ি সুরক্ষিত রাখার জন্যে মাটির নীচে ঘর তৈরি করে সেখানে সব ধনরত্ন রেখে একটি বালককে ধরে পুজো করে সেই আবদ্ধ ঘরে রেখে দিত৷ পরে সেই বালকের মৃত্যু হলে সে যক্ষযোনি পেয়ে সেই ধন রক্ষা করত৷ এই ভূতের কাজ ছিল ধন রক্ষা করা, ভোগ করা নয়৷ উপযুক্ত উত্তরাধিকারীকে এই ধন ফেরত দিতে পারলেই তার মুক্তি ঘটত৷ রবীন্দ্রনাথের ‘সম্পত্তি-সমর্পণ’ গল্পের পাঠক নিশ্চয়ই এদের সম্বন্ধে সম্যক অবহিত আছেন৷ হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘যখের ধন’-এর যাঁরা পাঠক, তাঁরাও এদের জানেন৷

পুকুরে থাকে যে ভূত নাম হাঁড়া-ভূত৷ মানুষ পুকুরে নাইতে নামলে এরা নাকি মাঝে মাঝে পা ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে ডুবিয়ে মেরে রক্তপান করে৷ কালবৈশাখীর ঝড়ে বর্তুল আকারে যে ঝড় ঘুরতে থাকে—তাকে বলে বাঁড়ুল ভূত৷ ইনি এলে মাঝউঠোনে একটা পিঁড়ে উল্টো করে দিয়ে বলতে হয়— ‘বাঁড়ুল বাঁড়ুল—মাছ-পোড়া দিয়ে ভাত খেয়েছি—ছুঁয়ো না’৷ এই মন্ত্রটা আমরা ভুলে গেছি বলেই ফি-বছর ঘূর্ণিঝড় এসে আমাদেরকে নাজেহাল করে যায়৷ অবনীন্দ্রনাথ একে বলেছেন ‘বীর-বাতাস’৷ ‘ভূত-পতরীর দেশে’ তিনি লিখেছেন—‘সর্বনাশ! এ যে দেখছি বীর-বাতাস৷ এ বাতাসের মুখে পড়লে তো আর রক্ষে থাকবে না৷ —পালকি-সুদ্ধ আমি, আমার লাঠি, আমার ছাতা, ধুতি-চাদর, পোঁটলা-পুঁটলি, বিছানা-বালিশ কাগজের টুকরোর মতো কোথায় উড়ে যাবে তার ঠিকানা নেই৷’ বাঁশ-ঝাড়ে বাস করে ঝেরু-ভূত, এদের জন্যেই নাকি এক একটা বাঁশ রাতের বেলায় একদম শুয়ে পড়ে!

তবে দিশা-ভূত নিশা-ভূতের কথা এখনও অনেকে বিশ্বাস করেন বেশি মাত্রায়৷ নিশিভূত ঘুমন্ত লোককে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়ে সারারাত ঘুরিয়ে মারে৷ মাঝে মাঝে ঘাড় মটকেও দেয়৷ এরা নাকি একবারের বেশি ডাকে না৷ তাই রাতে নিরাপদে থাকতে হলে—কেউ অন্তত তিনবার না ডাকলে সাড়া দেওয়া উচিত নয়! তবে এটা যে Somnambulism নামে একটা রোগ—তা সাধারণ মানুষকে বোঝানো কঠিন৷ কেউ কেউ একে দিশা-ভূতও বলে৷ মানুষ ভূতের পাশে ঘোড়া-ভূত গোভূতেরাও (গো-দানো) আছে৷ অবনীন্দ্রনাথ নাকি ঘোড়া-ভূত দেখেছিলেন৷ বাস্তুসাপের মতো বাস্তুভূতও নাকি আছে— যারা এমনিতে কোনো ক্ষতি করে না৷ এদের মাঝে মাঝে মাছের বাসি অম্বল খাওয়াতে হয়৷ বিভূতিভূষণ পূর্ব এশিয়াতে ‘বিষ্মমণি’ ভূতের উল্লেখ করেছেন তাঁর ‘হীরামানিক জ্বলে’ কিশোর উপন্যাসে৷

ভূতেদের বাসস্থান বিচিত্র প্রকার৷ জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে এদের অবাধ অবস্থিতি৷ ব্রহ্মদত্যির পছন্দ বেলগাছ, তাল-বেতালের শিমুল গাছ৷ শাঁকচুন্নি ভালোবাসে ঘন শ্যাওড়া ঝোপের মধ্যে থাকতে৷ অন্য ভূতেরাও এই গাছ বেশ পছন্দ করে৷ একানড়ে জাতীয় ভূতেদের পছন্দ তালগাছ৷ নির্জন বিস্তীর্ণ প্রান্তরে—যেমন ভূশণ্ডীর মাঠে—এদের অনেকে থাকে৷ আর ভূতুড়ে বাড়ি পেলে তো এদের আনন্দের অবধি থাকে না৷ পুকুরেও কোনো কোনো ভূত থাকে৷ তবে সব মিলিয়ে গাছে থাকাটাই এদেরকে ফ্ল্যাটে থাকার মতো আনন্দ দেয়৷

ভূতেরা দেখতে নানা ধরনের৷ কেউ দু তাল গাছ সমান উঁচু৷ এদের হাত-পা খুব লম্বা এবং ইচ্ছে করলেই ক্রেনের মতো হাত এগিয়ে দিয়ে শিকার ধরতে পারে৷ কারো সব শরীরটাই হাড় দিয়ে গড়া, চক্ষু কেবল কোটরগত, কিন্তু অনেক সময় দাঁত থাকে— ফোকলা দাঁতে শিরশিরিয়ে হাসে৷ গায়ের রং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অন্ধকারের মতো কালো—সাহেব ভূতেদের কথা অবিশ্যি আলাদা৷ কালো-কুচ্ছিত খ্যাঁদা-নাকী কেউ কেউ থাকলেও মেয়ে ভূতেরা মোটের উপর সুন্দরী৷ অনেক সময় এদের একটা পা, কারো পায়ের পাতা পিছনের দিকে৷ বেঁড়ে ভূত যখন আছে, তখন কারো কারো লেজ আছে নিশ্চয়ই৷ সূক্ষ্ম মসলিন জাতীয় কাপড় কেউ কেউ পরলেও বেশির ভাগই সাদা থান এবং শাঁকচুন্নি হলে লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরে থাকে৷ রাজশেখরবাবু গামছা পরে থাকতেও দেখেছেন৷ কোনো কোনো ভূত একেবারে ছায়াসর্বস্ব৷

ভূত-সম্প্রদায়ের যিনি মাথা—তিনি হলেন কর্তা-ভূত৷ এদের খাওয়া-দাওয়ার রেসিপিও মন্দ নয়৷ মেনুতে সব চেয়ে পছন্দ পোড়া মাছ৷ ভাতের হাঁড়ি ভেঙে রান্না মাছ খেতে এদের দারুণ প্রীতি৷ মেছো ভূতেরা তো মাছ না দিলে পিছনই ছাড়ে না৷ মাঝে মাঝে ঘাড়-মটকানো এদের খুব সহজ এক্সারসাইজ৷ রক্তপানও নিশ্চয়ই করে৷ এদের চলাফেরা খুব সহজ হয়ে পড়ে কার্তিক মাসের চতুর্দশীতে, অমাবস্যা তিথিতে অথবা শনিবারের বারবেলা হলে৷ এসব দিনে ওঝার মন্ত্র, ভূতপতরীর লাঠিও অকেজো হয়ে পড়ে৷ পাঠক কি পরীক্ষা করে দেখতে চান? তবে তাদেরকে ভূত বশীকরণের একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিই চুপি চুপি :

কুর কুর কুয়াশা ভরা আসমানে নাই চান্দ তারা
মানুষ গরু দিলাশা গাঙ্গের পাড় সরিষা
আন্ধারে আন্ধার গান্ধারে গান্ধার
নাই মানুষ নাই পউখ পাখালি
হেনকালে সরিষা তুলি
মন্ত্র ঝাড়রা মাইলাম ভূতের গায়
আন্ধাইল সুন্ধাইল ভূত শয়ন লইল আস্যা পায়৷
রামকুণ্ডলী লক্ষ্মণ দ্বারী
ওরে ভূত ছাইড়া যাও আমার বাড়ি
যদি ছাড়্যা না যাও ঈশ্বর মহাদেবের মাথা খাও৷
দেখবেন আর ভূত হালছে না বলছে না—
জ্বলে কপাল ধঃ ধঃ ধঃ
এটা কার মাথা হি হি হঃ
ধাকিটি ধাকিটি ধিমিয়া৷

এতেও ভূতের প্রতি যদি অবিশ্বাস জেগে থাকে তবে ত্রৈলোক্যনাথের কথা তুলে বলি : ‘এই হতভাগা দেশের লোকগুলো এমনই ইংরেজি-ভাবাপন্ন হইয়াছে যে, কাহাকেও ভূতে পাইলে কি ডাইনে খাইলে বলে কিনা হিস্টিরিয়া হইয়াছে৷ এ কথায় রক্তমাংসের শরীরেই রাগ হয়, ভূত দেহে তো রাগ হইবেই৷’ পাঠক, তখন একটু সামলে চলাই ভালো৷

২

পৃথিবীর তাবৎ উচ্চচশ্রেণীর সাহিত্যের মতো বাংলা সাহিত্যেও ভূতের রমরমা কম নয়৷ এঁরা বিচিত্র নামে, বিচিত্র ধামে বঙ্গসাহিত্যের বৃক্ষে, আনাচে-কানাচে, পোড়ো-বাড়িতে, ডোবাপুকুরে বসবাস করলেন৷ ত্রৈলোক্যনাথের ঘ্যাঁঘো ভূত এবং নাকেশ্বরীকে কেই বা না চেনে! লুল্লু গল্পে ঘ্যাঁঘো লুকিয়েছিল কুয়োর মধ্যে৷ এর সঙ্গে ‘গত পৌষ মাসে নাকেশ্বরীর শুভবিবাহ’ হয়েছিল৷ দীর্ঘ নাকের জন্য তার স্ত্রী ‘নাকেশ্বরী’ নামে পরিচিত ছিল৷ তিনি আরও দেখেছিলেন গোঁগোঁ, চুড়েল এবং সবুজ ভূত৷ সুকুমার রায় জ্যোৎস্না আলোতে স্বচক্ষে দেখেছিলেন ‘পান্তাভূত’—‘পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে, পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে৷’ আজকাল আবার আধুনিক ভূতের জমানায় বিচিত্র নামের ভূতেরা এসে গেছে৷ অচিরাৎ এদের নিয়ে একটি অভিধান রচনা করার বাসনা মনে মনে পোষণ করছি৷ এজন্যে একটা ছাপাখানার ভূত-এর সন্ধানে আছি৷ জানি না এই সংকলনে কোথাও কোথাও তাঁরা আবির্ভূত হয়েছেন কিনা!

এই শতবর্ষের ভৌতিক সংকলনের সূত্রপাত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে সেরা ভূতের জন্মদাতা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের গল্প দিয়ে৷ ‘কঙ্কাবতী’ উপন্যাসে ‘স্কল স্কেলিটন এন্ড কোং’ খুলে ভূতেদের ইন্ডাস্ট্রির শুভসূচনা হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে৷ সেদিক থেকে বাংলা সাহিত্যে ভূতের রীতিমতো আবির্ভাবের শতবর্ষপূর্তি উদযাপন সবেমাত্র শেষ হয়েছে৷ তিনিই প্রথম সাহস করে ভূতের জন্মরহস্য উদঘাটন করে লিখেছিলেন— ‘যেমন জল জমিয়া বরফ হয়, অন্ধকার জমিয়া তেমন ভূত হয়৷…অন্ধকার জমাইয়া ভূত করিবার কল কি সাহেবেরা করিতে পারেন না?’ তারপর সার কথাটি বলে দিয়েছেন— ‘অন্ধকারের অভাব নাই৷ নিশাকালে বাহিরে তো অল্প অল্প অন্ধকার থাকেই৷ তারপর মানুষের মনের ভিতর যে কত অন্ধকার আছে, তাহার সীমা নাই, অন্ত নাই৷ কোদাল দিয়া কাটিয়া কাটিয়া ঝুড়ি পুরিয়া এই অন্ধকার কলে ফেলিলেই প্রচুর পরিমাণে ভূত প্রস্তুত হইতে পারিবে৷ তাহা হইলে ভূত খুব সস্তা হয়৷ এক পয়সা, দুই পয়সা, বড় জোর চারি পয়সা করিয়া ভূতের সের হয়৷ সস্তা হইলে গরিব-দুঃখী সকলেরই যার যেমন ক্ষমতা ভূত কিনিতে পারে৷’ জনদরদী ত্রৈলোক্যনাথের এই মনোভাব লক্ষ করে হিমানীশ গোস্বামী ‘ন্যায্য মূল্যের দোকান মারফৎ’ সস্তায় ভূত সরবরাহের সাধু প্রস্তাব করেছেন!

এই সংকলনে বাংলা সাহিত্যের প্রায় অর্ধশত প্রতিনিধিস্থানীয় ভূতকে এনে পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে৷ এই মাগগিগণ্ডার বাজারে সংখ্যাটি অবহেলার নয়৷ এছাড়া একটি ভূত-বিষয়ক চর্চাও রয়েছে৷ এতে ভূতেরা কতখানি স্বস্তিতে রয়েছেন তা পাঠকেরা বিচার করবেন—আমরা কোনো মন্তব্য করছি না৷ এইসব গল্পের সবগুলিকে নিয়ে আলোচনা করার অবকাশও নিইনি৷ যাঁদের নিয়ে আলোচনা করছি না, তাঁদের গল্পের ভূতেরা যে সদাশয়—তা নিশ্চয়ই জানি৷ এই অপরাধে তাঁরা আমাদের ঘাড় মটকাবেন না—এই বিশ্বাস আমাদের রয়েছে৷

ত্রৈলোক্যনাথ পূজার সময় একজাতীয় ভূতের গল্প লিখে নাম দিয়েছিলেন ‘পূজার ভূত’৷ গল্পটি হানাবাড়ি গোছের একটা পরিবেশে একটি ছোট মেয়ে সীতাকে মাধ্যম করে অতীত ইতিহাসের যবনিকা উদঘাটন করেছেন৷ এক ঝড়জলের রাত্রিতে এই কাহিনী যেভাবে শামীমাসির জবানিতে কথিত হয়েছে তা খুবই লোমহর্ষক৷ সীতাকে একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে যেভাবে ডেকে নিয়ে যায় সে মহাষ্টমীর রাতে, তার পিছনে বাড়ির একদা কর্তা জগমোহন চৌধুরির জীবনের ঘটনার সাক্ষ্য রেখে জীর্ণ দালানবাড়িতে লেখক যে ভৌতিক পরিবেশ গড়ে তুলেছেন তা রবীন্দ্রনাথের আগে এটিকেই সার্থক গল্প বলে ঘোষণা করতে আমাদের দ্বিধা নেই৷

রবীন্দ্রনাথ কি সত্যিকারের কোনো ভূতের গল্প লিখেছিলেন? ভূত থাকলে এবং গল্প থাকলেই ভূতের গল্প হয় না৷ রবীন্দ্রনাথের মণিহারা, না কঙ্কাল, না ক্ষুধিত পাষাণ— কোনটা ভূতের গল্প—তা নিয়ে দ্বিধার শেষ নেই৷ আমরা কোনো বিতর্কে না গিয়ে ‘মণিহারা’ গল্পটি নিয়েছি ভাঙা পোড়োপাড়ি, কঙ্কালের খটখট শব্দের পটভূমি লক্ষ করে৷ মৃত পত্নী মণিমালিকা ফিরে পেতে চেয়ে ফণিভূষণ সালাঙ্কারা মণিমালিকার যে কঙ্কালময় রূপ দেখে, তা যদি ভূত না হয়ে শুধু ‘ভ্রম’ বলে ভ্রম হয়, তবে আমরা নাচার৷ তৃতীয় রাত্রিতে যে কঙ্কালকে সে দেখতে পায়, তার ঢিলা অলঙ্কারগুলো যে গা থেকে খুলে পড়ছে না—এটাই তো যথেষ্ট ভৌতিক৷

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘একটি ভৌতিক কাহিনী’ গল্পে অশরীরী সত্তার অস্তিত্বকে সন্দেহাতীতভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এবং সেজন্যে এর ভৌতিক রস অক্ষুণ্ণ রয়ে গেছে৷ পাঁচকড়ি দে-র ‘সর্বনাশিনী’ গল্পের পাহাড়ি পরিবেশ নতুন মেজাজ সৃষ্টি করে৷ দুটি নারীকে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়েছে৷ মন্মথদের বিবাহিত জীবনে যে মর্মান্তিক পরিণতি ঘনিয়ে আসে, ভুটিয়া কবি সোহোর জীবনের নিষ্ঠুর কাহিনী শোনা তার অন্যতম কারণ৷ সোহোর প্রণয়িনীর প্রেতসত্তা যেভাবে মন্মথর দরজায় করাঘাত করত তাতে ভৌতিক পরিবেশ ঘনীভূত হয়ে উঠেছে৷

দীনেন্দ্রকুমার রায়ের ‘উৎপীড়িতের প্রতিহিংসা’ গল্পটি পড়তে পড়তে বহুপাঠী পাঠকের শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পিছু পিছু চলে’ বা বনফুলের ‘পালানো যায় না’ গল্প দুটির কথা মনে পড়ে যেতে পারে৷ গল্পটি ইংরেজি থেকেও নেওয়া হতে পারে৷ ইতিহাসের পটভূমিকাটি যথেষ্ট মনোরম৷ পরশুরামের ‘মহেশের মহাযাত্রা’ গল্পটির উপসংহারে পৌঁছে পাঠকের শরীর ও মনে যে রোমাঞ্চ জাগে তা আমি প্রত্যক্ষ করে আনন্দ পাই৷ এর হাস্যরস, শ্লেষ এবং বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গী গল্পটিকে দারুণ উপভোগ্য করে তুলেছে এক অভাবিত ভৌতিক পরিবেশের মধ্যে৷ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মায়া’ একটি ভিন্নস্বাদী ভূতের গল্প৷ একটি ভূতুড়ে বাড়ির বন্ধঘর থেকে জল পড়া, অট্টহাসির ধ্বনি, রাত্রিবেলা ঝিঙে খেত থেকে ঝিঙে তোলা, জ্যোৎস্নারাতে সুবাস ছড়ানো—সবই এক ব্যাখ্যাতীত লোকে পাঠককে পৌঁছে দেয়৷ সবচেয়ে ধাঁধা লাগে সেই পরিবেশে এক বিদেশি মানুষের নিরুপদ্রবে থাকাটা৷ এই যে অপ্রাকৃত পরিবেশ—এর স্বাদটাই যেন আলাদা৷ বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের গল্পে নদীর তীর, সাঁকো জলজ পরিবেশে যে ভৌতিক রসের সৃষ্টি করেছে—তার মধ্যে একটা অদ্ভুত হাতছানি বর্তমান৷

তারাশঙ্করের ‘অক্ষয়বটোপাখ্যানম’ গল্পটি একটু অভিনব৷ প্রথমদিকে ভূতের কুলপঞ্জিকা নির্মাণের উদ্যোগ এবং পরে একটা লোমহর্ষক গল্প৷ লেখক যেভাবে আমদপুর-সাঁইথিয়া-বোলপুর স্টেশন এবং দার্জিলিং মেল-এর সহাবস্থান ঘটিয়েছেন তাতে গল্পটা যেন গল্প না হয়ে সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তবে বুনি ও কুনি ভূতের সানুনাসিক কান্না যদি সত্যি হয় তবে তো সন্ধেবেলায় গা ছমছম করারই কথা৷ বিশেষ করে পাঁচশো বছরের পুরনো বটগাছটার আত্মা যদি এমনতর কথা বলে তবে তো পাঠকের ‘বল মা তারা দাঁড়াই কোথা’ গোছের অবস্থা হবে৷ সুকুমার সেনের গল্পটি তো গল্প না হয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ হয়ে উঠেছে৷ তবে এটাই তাঁর কারসাজি কিনা জানিনে৷ মণীন্দ্রলাল বসুর ‘ভেরনল’ গল্পের বক্তা ডা. সরকার রিচার্ড রোজেনবেয়ার্গ নামধারী এক রোগীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়সূত্রে জানতে পারেনা যে রোগীর বিশ্বাস মাথার ক্যান্সারে তার মৃত্যু হবে? সেজন্য তার সম্পত্তির অর্ধেক সে কোনো ক্যান্সার হাসপাতালে দিয়ে যেতে চায়৷ মরার আগে জীবনকে উপভোগ করতে লাগল৷ তারপর দেখল রোজেনবেয়ার্গ মরে গেছে, পাশে ভেরনলের শূন্য শিশি এবং উপভোগের পাত্রী গণিকা মাদেলিন উধাও৷ এমনতর এক ডিটেকটিভ গল্পের পরিবেশে গল্পটিতে এক ভৌতিক আবহাওয়া রচনা করেছেন লেখক অতি মুন্সিয়ানার সঙ্গে৷ হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘কে?’ গল্পটিকে সুকুমার সেন মশায় Iycanthropy জাতীয় রচনা বলেছেন এবং অনুমান করেছেন এটির মূল কোনো ইংরেজি গল্প৷ তা হতে পারে, কিন্তু এর দেশীয় পরিবেশে ভৌতিক ছমছমানি বেশ উপভোগ্য৷

ভূতের গল্পের আধুনিক যুগের রীতিমতো সূত্রপাত ঘটিয়েছেন সম্ভবত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়৷ স্মৃতি গল্প আর হ্যালুসিনেশন-জাতীয় অতিপ্রাকৃতিকতা মিশিয়ে এই যুগের সূচনা করেছেন তিনি৷ এই গল্পটি ‘ক্ষুধিত পাষাণে’র আত্মীয়৷ প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘কলকাতার গলি’তে যেভাবে মৃত বন্ধু জীবিত বন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছে তাতে আমাদের প্রয়াত কোনো বন্ধু থাকলে তাঁর কথা স্মরণ করে আমাদেরও মনে হতে পারে—‘জামার নিচে যে কিছুই নেই—একেবারে ফাঁকা শূন্য’৷ বনফুল মানবমনের চেতন-অবচেতন মনের দুর্জ্ঞেয়তাকে তুলে ধরতে গিয়ে কাহিনীর ভিতরে কাহিনী—তার ভিতরে কাহিনী বয়ন করে ডাকবাংলোয় জনৈক ভদ্রলোকের মুখে তাঁর শিকারী জীবনের কাহিনী শোনাতে শোনাতে একটা লোকহর্ষক পরিবেশ রচনা করেছেন৷

অন্যদিকে প্রেতাত্মা, ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র দিয়ে, ‘হলুদপোড়া’ গল্পের অতিপ্রাকৃত পরিবেশ রচনা করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ এমনকী গল্পে একটা ডিটেকটিভ-সুলভ সাসপেন্সও এনে দিয়েছেন৷ এর সঙ্গে রোমান্স রস এনে দিয়ে একটি নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন মনোজ বসু ‘লাল চুল’ গল্পে৷ গল্পটি পড়তে পড়তে ‘নিশীথে’ গল্পটির কথা মনে পড়ে যায়৷

ধীরে ধীরে ভূতের গল্প নব্য আধুনিক যুগে এসে পড়ল৷ যন্ত্র এসে গল্পে স্থান নিল৷ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূত ‘টাইপরাইটার’-এর ছদ্মবেশে খটখট করে টাইপ করে ভূতের জবানবন্দী লিখেছে৷ টেলিফোন-এ ভূত আমদানি করেছিলেন কানাডার রসিক লেখক স্টিফেন লিকক৷ তাঁরই দৃষ্টান্তে একদা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ‘টেলিফোন’-এ ভূত এনে হাজির করেছিলেন৷ পরশুরামের গল্পের গামছা ছেড়ে সৈয়দ মুজতবা আলির গল্পে ‘কোট’ একটা মুখ্য ভূমিকা যে নিয়ে বসেছে—সেও আধুনিক যুগের ইঙ্গ প্রভাবে৷ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের গল্পে একটা নব্যবাবুযুগীয় যানবাহনের ব্যাপার৷ তবে আধুনিকতম ব্যাপারটি ঘটিয়েছেন তারাপদ রায় ‘ভূত রিপোর্টার’-এ৷ অবশ্য ঘড়েল পাঠক এদের অস্তিত্ব সংবাদপত্রে দীর্ঘকাল ধরেই লক্ষ করে আসছেন৷

আসলে পাঠক লক্ষ করেছেন গল্পকারেরা যত একালীন হয়ে এসেছেন—তাঁদের সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করার ব্যাপারে ভূমিকা লেখক বেশ কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন৷ আসলে তিনি এখনো হালআমলের ভূতেদের টেকনিক সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল হয়ে ওঠেননি৷ ফলে লেসার রশ্মি কি রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে তাঁরা যদি কোনোপ্রকারে তাঁর উপর ‘দৃষ্টি’ দেন—তাহলেই তো তাঁর ‘গেছি রে বাবা’ অবস্থা৷ ভূতগ্রস্ত অবস্থায় ভূমিকা লিখতে শুরু করেছিলাম৷ লেখকেরা তাঁদের ঝুলিতে নানারকমের ভূত থাকা সত্ত্বেও সেই ‘ভর’প্রাপ্ত অবস্থায় যে ‘ভূত’গুলিকে পাঠিয়েছিলেন, সেগুলিই মাত্র গ্রহণ করেছিলাম৷ কেন তাঁদের অন্য ভূতের গল্পগুলি নিইনি—এটাই সবচেয়ে বড় কারণ৷ কাজেই এই সংকলনের মেরিট-ডিমেরিট নিয়ে কেউ অভিযোগ করবেন না৷ তাতে বক্ষ্যমান ভূতেরা বক্ষ বিদীর্ণ করে দিতে পারে! যতক্ষণ ভূতগ্রস্থ ছিলাম, ততক্ষণ এলোমেলো বকেছি৷ ভূত একটু ছেড়ে যেতেই বুঝেছি তাঁদের নিয়ে আর বুকনি না দিয়ে পাঠকের গায়ে ভূত ছেড়ে দেওয়াই উচিত৷ তবে যাঁদের লেখার আলোচনা করতে পারলাম না নিজের অক্ষমতাবশত, তাঁদের কাছে একটামাত্র প্রার্থনা—আপনারা প্রতিশোধ নেবার জন্য নিজ নিজ ভূত আমার দিকে লেলিয়ে দেবেন না৷ মাননীয় প্রকাশকের পোষা ভূত কল্যাণময়—তিনি আপনাদের আশীর্বাদ করবেন৷

জানি না এই ভূতের বেগার খাটা কতখানি গ্রহণীয় হবে৷ ভূতের রাজা আমাকে বর দিন—এইমাত্র প্রার্থনা৷

বারিদবরণ ঘোষ
রোজভিলা, বর্ধমান
কলিকাতা পুস্তকমেলা ১৯৯৬

Book Content

পূজার ভূত – ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়
মণিহারা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একটি ভৌতিক কাহিনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
সর্বনাশিনী – পাঁচকড়ি দে
উৎপীড়িতের প্রতিহিংসা – দীনেন্দ্রকুমার রায়
মহেশের মহাযাত্রা – পরশুরাম
নরক এক্সপ্রেস – সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়
মায়া – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘‘ক্লাইম্যাক্স’’ – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়
অক্ষয়বটোপাখ্যানম – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
ভেরনল – মণীন্দ্রলাল বসু
কে? – হেমেন্দ্রকুমার রায়
অশরীরিণী – শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
‘‘—সাথে সাথে ঘুরবে’’ – প্রমথনাথ বিশী
নমস্কার – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
চাচা কাহিনী – সৈয়দ মুজতবা আলী
কলকাতার গলিতে – প্রেমেন্দ্র মিত্র
অবর্তমান – বনফুল
দুই বন্ধু – বুদ্ধদেব বসু
রক্তের ফোঁটা – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
ডাক্তারের সাহস – প্রবোধকুমার সান্যাল
হলুদপোড়া – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
লাল চুল – মনোজ বসু
চেতলার কাছে – লীলা মজুমদার
একরাত্রির অতিথি – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
নিজে বুঝে নিন – আশাপূর্ণা দেবী
রাত তখন এগারোটা – বিমল মিত্র
কুয়াশা – নীহাররঞ্জন গুপ্ত
মরণের পরে – সুমথনাথ ঘোষ
টাইপরাইটার – নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
ভুতুড়ে কাণ্ড – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
সত্যি ভূতের গল্প – বিমল কর
ভুলো ভূত – মহাশ্বেতা দেবী
একদিন রাত্রে – শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
ছক্কা মিয়ার টমটম – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
বৃত্তের বাইরে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বড়পিসিমা – সমরেশ মজুমদার
স্বপ্নের মতো – নবনীতা দেবসেন
গগনের মাছ – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
তেত্রিশ নম্বর ঘর – দিব্যেন্দু পালিত
বামরার রহস্য – বুদ্ধদেব গুহ
ভূত ও রিপোর্টার – তারাপদ রায়
সপ্তর্ষি আর হারানো বিকেল – তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
ভূতের কথা – যমদত্ত
সংসর্গ – সর্বাণী মুখোপাধ্যায়
লেখক: বারিদবরণ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়বইয়ের ধরন: ভৌতিক, হরর, ভূতের বই

ধূসর সময় – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শূন্যের উদ্যান – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

ভৌতিক গল্পসমগ্র - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

ভৌতিক গল্পসমগ্র – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

ক্ষয় – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.