আশাপূর্ণা দেবী – সাহিত্যের সেরা গল্প
প্রথম প্রকাশ : কলকাতা বইমেলা ২০০৬
প্রচ্ছদ : অনুপ রায়
প্রকাশক : শংকর মণ্ডল, দীপ প্রকাশন
.
ছোটোগল্পে আশাপূর্ণা – ড. সুমিতা চক্রবর্তী
বাংলা সাহিত্যে মহিলা লেখকরা বরাবরই আমাকে অবাক করে দেন। বিশ শতকের প্রথম তিন দশক পর্যন্তও পারিবারিক অন্তঃপুর থেকে বেরিয়ে এসে একা রাস্তায় হাঁটারও উপায় ছিল না মেয়েদের। মেয়েদের স্কুলে, কলেজে পড়তে পাঠাতেন কেবল মুষ্টিমেয় প্রগতিশীল পরিবারের অভিভাবকরা। মেয়েদের বিয়ের বয়স পনেরো পার হওয়া ছিল প্রায় বিপ্লব। আর মেয়েদের চাকরি করতে যাওয়াকে মনে করা হত পরিবারের অপমান। অথচ এর মধ্যেও বাঙালি মেয়ে যখনই বর্ণমালা আয়ত্ত করবার সুযোগ পেয়েছেন, প্রায় তখন থেকেই সাদা কাগজে কালির লিখনে উদঘাটন করে দিয়েছেন নিজেদের হৃদয় আর আবেগই কেবল নয়, নিজেদের মেধা, মননশীলতা, সমাজ—ভাবনা এবং প্রতিবাদ। উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে বিদ্যাসাগর এবং আরও কারও কারও চেষ্টায় স্ত্রী—শিক্ষার বিস্তার ঘটতে শুরু করল। বিত্তবান পরিবারের আদরের মেয়ে আর ব্রাহ্মণ পরিবারের বালিকারা ছাড়াও মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালি পরিবারের মেয়েরা হাতে কাগজ—কলম ধরবার অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন। ঐ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেই সাময়িক পত্রের পাতায় দেখা যেতে লাগল স্বনামে ও বিনা নামে নারীর রচনা। অবশ্য গল্প—কবিতার সংখ্যা কমই; পত্রাকারে নিজেদের ক্ষোভ ব্যক্ত করা এবং নিবন্ধাকার রচনাই বেশি। তবু তারই মধ্যে স্বর্ণকুমারী দেবীর উজ্জ্বল উপস্থিতি ছাড়াও মেয়েদের লেখা কবিতা আর দুটি—চারটি উপন্যাস মুদ্রণের দুর্লভ সুযোগও পেতে লাগল। কিন্তু তাঁদের লেখার মধ্যে ছোটোগল্প প্রায় ছিলই না।
বিশ শতকের প্রথম তিন দশকের কথা বলছিলাম। অর্থাৎ প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। যার পর থেকে একদিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সংখ্যাবৃদ্ধি; অন্য দিকে মন্দা, বেকার—সমস্যা, গ্রামীণ অর্থনীতির বিপর্যয়ের চাপে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনদৃষ্টি একটু একটু করে পরিবর্তিত হতে লাগল। ঠিক এই সময়টিতেই কলম উঠে এল আশাপূর্ণা দেবীর হাতে।
জন্ম ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে। আত্মীয়—পরিবৃত মধ্যবিত্ত পরিবারে সাহিত্য—পাঠের চর্চা ছিল। বাড়িতে আসত বই আর পত্রিকা। কিন্তু স্কুলে যাওয়া হয়নি তাঁর। তবু বালিকা আশাপূর্ণা—র মনকে অন্তঃপুর—আবদ্ধ করে রাখা যায়নি। খাতার পাতায় কবিতা—চর্চা চলত। ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে একটি কবিতা তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা—নাম ছিল ‘বাইরের ডাক’। বয়স তেরো—ও পূর্ণ হয়নি। ঐ ‘শিশুসাথী’ পত্রিকা থেকেই তাঁর কাছে গল্প চেয়ে চিঠি গেল। কিশোরী আশাপূর্ণা একটি দুটি করে গল্পও লিখতে লাগলেন।
যে—সব গল্প ছোটোদের পত্রিকায়, ছোটোদের মতো করেই লেখা। লেখিকাও সাবালিকা নন। এর মধ্যেই বিবাহ। বাংলা সাহিত্যের সৌভাগ্যক্রমে স্বামী দাঁড়িয়েছিলেন পাশে। আশাপূর্ণা দেবীর সাহিত্য—চর্চা বন্ধ হল না। ছোটোদের লেখা থেকে বড়োদের লেখার পৃথিবীতেও প্রবেশ ঘটল তাঁর। সংসার সামাল দিয়েও লেখক হয়ে উঠলেন অচিরেই। পত্রিকায় তাঁর গল্পের চাহিদা বাড়ল। ক্রমে প্রকাশকেরাও আগ্রহী হলেন। আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রকাশিত বই—ছোটোদের জন্য লেখা গল্পের একটি সংকলন। নাম ‘ছোট ঠাকুর্দার কাশীযাত্রা’। তার পর প্রকাশিত হল প্রথম বড়োদের জন্য লেখা বই—আর একটি গল্প—সংকলন ‘জল আর আগুন’। সাল ১৯৪০, প্রকাশক ‘দাশগুপ্ত অ্যান্ড সন্স’।
পারিবারিক নানা দায়িত্বে মাঝে তেমন বেশি লিখতে পারেননি। কিন্তু ১৯৫৬ সাল থেকে আশাপূর্ণা দেবীর কলম সর্ব অর্থে সচল। পত্রিকায় লিখে চলেছেন। অতি নিয়মিত বই প্রকাশিত হয়ে চলেছে। পত্রিকা—সম্পাদকেরা আর প্রকাশকেরা নিত্য—প্রার্থী তাঁর কাছে। অত্যন্ত জনপ্রিয় তাঁর লেখা, সংস্করণ শেষ হয়ে যায় দ্রুত। তার প্রয়াণ ঘটেছে ১৯৯৫—এ। এখনও সে জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি। তাঁর কলম শেষ পর্যন্তও সক্রিয় ছিল। লিখেছেন অজস্র। কিন্তু তিনি সেই বিরল জনপ্রিয় লেখকদের একজন—যাঁরা খোলা বাজারের তৈরি চাহিদার কথা ভেবে লেখা ‘বানিয়ে’ দেন না। যাঁরা নিজের ক্ষমতায় নিজের বাজার তৈরি করে নিতে পেরেছেন—তাঁদেরই একজন তিনি। আমরা জানি তাঁর কাছে ঠিক কী পাবো। আমরা জানি, তিনি তাঁর নিজের স্থির করে নেওয়া স্ট্যান্ডার্ড থেকে নেমে আসবেন না। আশাপূর্ণা দেবী সাহিত্য—জগতের ব্র্যান্ড নেম।
উপন্যাস লিখেই বৃহত্তর পাঠক—সমাজে নিজেকে চেনাতে হয়েছিল তাঁকেও। আজও শুনতে পাই তরুণ গল্প—লেখকদের আক্ষেপ—প্রকাশকেরা উপন্যাস চান, গল্প—সংকলন নয়। চিরকালই ছিল এই ঝোঁক। বিশ শতকের পাঁচের দশকে ‘বলয় গ্রাস’ লিখে খ্যাতি অর্জন করলেন আশাপূর্ণা দেবী। তার কিছুকাল পরে ‘শশীবাবুর সংসার’ লিখেই জয় করে নিলেন একটি সিংহাসন। সাহিত্য—সাম্রাজ্য কোনোদিনই এক সিংহাসনের জায়গা নয়। নিজের সিংহাসনে আশাপূর্ণা দেবী আজও অধিষ্ঠিত পূর্ণ মর্যাদায়।
আশাপূর্ণা দেবীর নাম করলেই তাঁর অসাধারণ ত্রি—পর্ব উপন্যাস ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’—’সুবর্ণলতা’—’বকুল—কথা’—র নাম উঠে আসে। খুব স্বাভাবিক কারণ এই উপন্যাস—ত্রয়ী যেভাবে বাংলার নারী—জীবনকে পর্বে পর্বে চিত্রিত করেছে নিবিড় হৃৎস্পন্দনের ধ্বনি সহ তাতে এই সৃষ্টির কালোত্তীর্ণতা সম্পর্কে অ—সংশয় আমরা সকলেই।
এইভাবে কোনো একটি বা দুটি বা কয়েকটি ছোটোগল্পের নাম করা যাবে না। ছোটোগল্প তার কায়া—পরিমিতির কারণে বহুক্ষণ ধরে পঠিত হয় না বলে বিশিষ্ট একটি গল্পের নাম বা কথাবস্তু পাঠক—মনের পৃষ্ঠা থেকে একটু অস্পষ্ট হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বা রাজশেখর বসুর মতো গল্পকারেরা ব্যতিক্রম। ক্বচিৎ কোনো কোনো লেখকের এক—একটি ছোটোগল্প ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে বা চলচ্চিচত্রে রূপায়িত হবার কারণে পাঠকের স্মৃতিতে গৃহীত হয়ে যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘শুধু কেরানী’, সুবোধ ঘোষের ‘ফসিল’, সমরেশ বসুর ‘আদাব’, রমেশচন্দ্র সেনের ‘সাদা ঘোড়া’, মহাশ্বেতা দেবীর ‘অপারেশন বসাই টুডু’। কিংবা এসবের বেশ কিছুকাল আগে লেখা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘দেবী’। আশাপূর্ণা দেবীর গল্পের কথা ভাবলে তেমন কোনো একটি নাম হয়তো মনে পড়বে না হঠাৎ। কিন্তু আশাপূর্ণা দেবীর নাম করলেই তাঁর গল্পের পরিবেশ, পরিস্থিতি, মানুষ—জন, আখ্যানের বৈশিষ্ট্য, লেখকের দৃষ্টিকোণ সব একসঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠবে পাঠকের স্মৃতিতে ও ভাবনায়। পাঠক জানেন এই লেখকের কাছে তাঁর প্রত্যাশা কী; পাঠক বিশ্বাস করেন—আশাপূর্ণা দেবীর ছোটোগল্প হাতে নিলে তাঁর প্রত্যাশা পূরণে কোনো অতৃপ্তি থাকবে না।
আশাপূর্ণা দেবীর ছোটোগল্পের পরিসর হল বাঙালি মধ্যবিত্তের পরিবার—আরও নির্দিষ্ট করে বললে পরিবারের অন্তঃপুর। এটা কিন্তু একটু আশ্চর্যেরই ব্যাপার। নিজে না হয় তিনি বহির্জগতের কর্মক্ষেত্রে আসেননি। কিন্তু সুস্থ শরীরে ও সজাগ মনে জীবিত ছিলেন ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। দেখেছেন মেয়েদের জীবনের বহু বিবর্তন, বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের চলে আসার ফলে ঘরের জীবন ও বাইরের জীবন—উভয়ক্ষেত্রেই নারী এবং পুরুষ—উভয়েরই পরিস্থিতিগত যে—সব নতুন সংকট উদ্ভূত হয়েছে তার অনেকটাই তিনি দেখেছেন চারিদিকে। কিন্তু গল্প লেখার সময়ে তাঁর দৃষ্টি মূলত নিবদ্ধ গৃহকেন্দ্রের দিকে। অন্তঃপুর সেভাবে আজ আর একক পরিবারে থাকে না। তবু স্বামী—স্ত্রী, স্বামীর বাবা—মা এবং পুত্র—কন্যা এবং কাজের মেয়ে নিয়ে যে সংসার—তারই গড়ন ও গড়নের ফাটলগুলি তাঁর ছোটোগল্পের প্রধান অবলম্বন।
এখানে আশাপূর্ণা দেবীর প্রধান শক্তি হল তাঁর নিরপেক্ষ তীব্র দৃষ্টি—যা মানুষের মনের ত্রুটি—দুর্বলতা, নীচতা—দীনতা, লোভ—ঈর্ষা—ভয়কে একেবারে গোড়া পর্যন্ত দেখতে পায়। সেই দেখাকে একেবারে খোলা ভাষায়, কাউকে রেয়াৎ না করে তিনি ব্যক্ত করেন। ‘খোলা ভাষায়’ বলেছি বলে কেউ যেন মনে না করেন আশাপূর্ণা দেবীর ভাষায় চলতি অ—শালীন শব্দের প্রয়োগ ঘটে। একেবারেই তা ঘটে না। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে যে ভাষা ও আচরণের সাধারণ সংযম ও শালীনতা—বিশেষ করে মেয়েদের শেখাবার চেষ্টা করা হয় তা তিনিও শিখিয়েছিলেন এবং লেখার সময়েও সেই শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হননি। স্ল্যাং শব্দের প্রয়োগ প্রায় পাওয়াই যাবে না তাঁর লেখায়। কিন্তু মনের অলিগলিতে যে—সব জমাটবাঁধা নীচতা সব মানুষের মনের মধ্যেই চাপা থাকে এবং মাঝে মাঝে বাইরে বেরিয়ে আসে—সেগুলিকে তিনি দেখতেও পান পরিষ্কার, আর লিখেও দেন পরিষ্কার করে।
আশাপূর্ণা দেবীর চোখে মেয়েদের মনের অনুদারতা, কুটিলতা, ঈর্ষা, ক্ষুদ্রতা বার বার ধরা পড়ে, কারণ এই জীবনের মধ্যেই তাঁর দীর্ঘ কাল—যাপন। সামাজিক বঞ্চনার ব্যাখ্যা দিয়ে নারীর ছোটোমনের প্রকাশের কোনো সাফাই দেবার চেষ্টা তিনি করেননি। পুরুষের ক্ষেত্রেও করেননি। বহু লেখকই পুরুষ—শাসিত সমাজে, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের চাপে নারীর চরিত্রের বিকাশ ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করেন। সেই মনে করা এতটুকুও মিথ্যা নয়। তবু আশাপূর্ণার দৃষ্টিকোণ একটু আলাদা। তিনি সমাজ ও পরিস্থিতির চাপের কাছে নারী ও পুরুষ—উভয়েরই মন দুর্বল ও কম—বেশি পরিমাণে বিকৃত হয়ে যেতে দেখেছেন। নিরপেক্ষভাবেই তা প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছেন তিনি। সাহিত্যের জগতে কিছুটা পরিচিত হয়ে ওঠা লেখিকা যখন সাহিত্য সভায় যান তখন তাঁর সর্বাঙ্গ প্রসাধিত হয়ে যাবার প্রবণতাকে তীব্র বিদ্রূপে ঝলসে দিতে এতটুকুও বাধে না তাঁর। যেমন দেখি এই সংকলনের ‘বরফজল’ গল্পটিতে। আবার দাঙ্গা—বিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে উদ্ধার করে আনা মেয়েরা তাদের অপরিসর ত্রাণ—শিবিরে জাতের বিচার আর বড়াইকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে তা—ও তিনি বেশ কঠিনভাবেই ব্যক্ত করেছেন। যেমন ‘ধ্বংসের মুখে নারী’ গল্পে দেখি। তাঁর ভাষাটা ব্যঙ্গ—তির্যক। তাতে মজাও পেতে পারেন কেউ কেউ। আমার মনে হয় ঐ ভাষার বিদ্রূপ—বাচন থেকে ঝরে পড়ছে ঘৃণা।
সংসারের অভ্যন্তরেও কেবল নারীরই অস্তিত্ব থাকে না, থাকে পুরুষেরও। বিশেষভাবে আশাপূর্ণা দেবী সেই ধরনের সংসারের কথাই লেখেন যেখানে উপার্জন পুরুষের এবং গৃহ—পরিচালনা নারীর। মেয়েদের চরিত্রে বৈচিত্র্যের টানগুলিই তাঁর কলমে বেশি সজীব হয়ে ওঠে। সম্ভবত নিজের অভিজ্ঞতা আর নিজের বিশ্লেষণের সমন্বয়ে এই জায়গাটাই তিনি সবচেয়ে ভালোভাবে ধরতে পেরেছিলেন। অকৃত্রিম এবং সুগভীর সততা আশাপূর্ণার লেখক—চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
অনেক গল্পেই অবশ্য দেশ—কালের বৃহত্তর বাস্তবতার একটি বহির্বলয় রচিত হয়েছে। যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কলকাতায় বোমা পড়া, দাঙ্গাকালীন পরিস্থিতি, চীন যুদ্ধের ইঙ্গিত এবং নকশাল আন্দোলনের প্রসঙ্গ। এখান থেকেও বোঝা যায় কতখানি প্রসার ছিল তাঁর অভিজ্ঞতার। কিন্তু প্রায় সর্বত্রই তাঁর গল্পে মনঃসম্পাতের বিন্দু হয়ে উঠেছে সাংসারিক অভিঘাতে বিচলনের শিকার নারী ও পুরুষের মনশ্চরিত্র এবং আচরণ। তার যে কত বৈচিত্র্য; আপাতভাবে এক ধরনের ঘটনা—সংস্থান হলেও প্রায় একই পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন মানুষ কীভাবে ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করেন—তা আমাদের কাছে জীবন্ত হয়ে ওঠে আশাপূর্ণা দেবীর গল্প থেকে। তাঁর গল্প যেন আমাদের কাছে এক অভিনব আবিষ্কার। ছড়িয়ে ছিল আমাদের চারদিকে, কিন্তু আমরা যেন চোখ মেলে তা দেখিনি। তাঁর লেখা যেন আমাদের এক রকমের চেনা পৃথিবী পালটে দিয়ে আর একরকমভাবে চিনিয়ে দেয়।
বস্তুতই আবার অনেক সময় মনে হয়েছে আশাপূর্ণা দেবী এক নির্মম সাহিত্যিক। মাঝে মাঝে অবশ্য নারী ও পুরুষের প্রেমের উজ্জীবন ও অনুভবের গল্পে তাঁর কলমকে স্নিগ্ধ হয়ে উঠতে দেখি। কিন্তু এই ক্ষেত্রটি ছাড়া যেখানে সংসার তার দাবিসর্বস্ব হাত কেবলই পেতে রাখে; সেই হাত কখনও কখনও তীক্ষ্ন নখওয়ালা আঙুলে মানুষের মনকে চেপে ধরে নিষ্ঠুর মুঠিতে—সেই সত্যটাকেই আশাপূর্ণা দেবী তুলে ধরেন বার বার। পাঠকের মন সেখানে সাজানো কোনো সুখী গৃহকোণের আশ্রয় ও আশ্বাস পায় না। আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে এই নিরাসক্ত সত্য দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছেন বলেই আশাপূর্ণা দেবী মহৎ সাহিত্যিক। বিশেষ করে ছোটোগল্পে—যেখানে একক প্রতীতির উপলব্ধি—বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত হয় একটি বাহুল্যবর্জিত আখ্যান—সেখানে আশাপূর্ণার লেখক—চরিত্রের এই স্বচ্ছ কঠিনতা প্রতিভাত হয়।
Leave a Reply