• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

আমার কথা – বিনোদিনী দাসী

লাইব্রেরি » আমার কথা – বিনোদিনী দাসী
আমার কথা বিনোদিনী দাসী

বিনোদিনীর কথা বা (আমার কথা) – প্রথম খণ্ড – বিনোদিনী দাসী

[সোর্স – উইকিসংকলন]

বেঙ্গল, গ্রেট ন্যাশন্যাল, ন্যাশন্যাল ও স্টার থিয়েটারের ভূতপূর্ব্বা অভিনেত্রী শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী কর্ত্তৃক প্রণীত।

নব সংস্করণ।
প্রকাশক—শ্রীগুরুদাস চট্টোপাধ্যায়।

বেঙ্গল মেডিক্যাল লাইব্রেরী,
২০১ নং কর্ণওয়ালিস্ স্ট্রীট,—কলিকাতা।
সন ১৩২০ সাল।
মূল্য৷৷৵৹ দশ আনা।

প্রিণ্টার—শ্রীযোগেশচন্দ্র অধিকারী,
মেট্‌কাফ্ প্রেস্,
৭৬ নং বলরাম দে ষ্ট্রীট্—কলিকাতা।

.

ভূমিকা।

 মর্ম্ম-বেদনার আবার ভূমিকা কি? ইহা শুধু অভাগিনীর হৃদয় জ্বালার ছায়া! এ পৃথিবীতে আমার কিছুই নাই, অনন্ত নিরাশাময়, কাতরতা জানাইবারও লোক নাই; কেননা, আমি সংসার মাঝে পতিতা বারনারী! আত্মীয়বন্ধুহীনা কলঙ্কিনী! কিন্তু যে দয়াময় সর্বশক্তিমান্ ঈশ্বর ক্ষুদ্র মহৎ সকল হৃদয়েই সুখ দুঃখ অনুভব করিবার ক্ষমতা দিয়াছেন, তিনিই আবার এ ভাগ্যহীনা কলঙ্কিনীর হৃদয়ে যন্ত্রণাজ্বালায় সান্ত্বনার আকাঙ্ক্ষা দিয়াছেন। কিন্তু এ হতভাগিনী কোথায় সান্ত্বনা পাইবে! দুঃখিনীকে কে সহানুভূতি দিবে!

 হৃদয়ে হৃদয়ে পিষিয়া যে যাতনার অগ্নি প্রাণের ভিতর ছুটিয়া বেড়ায়, মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতগণও তাহা ব্যক্ত করিতে পারেন কি না, জানি না। কিন্তু এ অধমা জ্ঞানহীনা অভাগিনীর শক্তিতে তাহা অব্যক্তই রহিল; তবে আর ভূমিকা কি লিখিব!

.

উপহার।

 উপহার কি? প্রীতির কুসুমদামে প্রিয়জনের পূজা। একদিন যাঁহার স্নেহমমতায় এ তাপিত হৃদয় সান্ত্বনার সুধা-ধারায় পরিতৃপ্ত হইয়াছিল, এ ক্ষুদ্র কাহিনী তাহাকেই সমর্পণ করিলাম। কিন্তু যাঁহাকে দিলাম, আমার সে প্রিয়তম কোথায়? তিনি স্বর্গে; স্বর্গেও তিনি আমার! প্রীতির বন্ধন মরণেও বিচ্ছিন্ন হয় না। ভালবাসা মৃত্যুকে জয় করে। প্রীতির আকর্ষণে পিক্মিলয়নের ‘গ্যালেটিয়া’ প্রস্তরমূর্ত্তি হইতে প্রাণ পাইয়া তাহার নিকট উপস্থিত হইয়াছিল; আমিও কাতর-প্রাণে আমার স্বর্গীয় দেবতার চরণে আমার এ ক্ষুদ্র কাহিনী উপহার দিতেছি। যদি হিন্দুধর্ম্ম সত্য হয়, আমাদের দেবদেবী সত্য হন, তবে সেই প্রাণময় দেবতার চরণে, আমার কৃতজ্ঞ হৃদয়ের উপহার পৌঁছিবে।

 এ জীবনে একদিন সংসারে আমার কামনার সকল বস্তুই ছিল; সে দিন ফুরাইয়াছে; আর কিছুই নাই! যাঁহার অভাবে আজ আমি সংসারে ভাগ্যহীনা দুঃখিনী, কোথায় সেই স্নেহপূর্ণ দেবহৃদয়! হায়, সংসার কি পরিবর্তনশীল!

“যদুপতেঃ ক গত মথুরাপুরী,
রঘুপততঃ ক গতোত্তরকোশলা।
ইতি বিচিন্ত্য কুরুষ মন স্থিরং
ন সদিদং জগদিত্যবধারয়॥”

.

অধীনার নিবেদন।

 আমার শিক্ষাগুরু ৺গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের অনুরােধে এই আত্মকাহিনী লিখিয়া যখন তাহাকে দেখিতে দিই; তিনি দেখিয়া শুনিয়া যেখানে যেরূপ ভাবভঙ্গীতে গড়িতে হইবে উপদেশ দিয়া বলেন যে, তােমার সরলভাবে লিখিত সাদা ভাষায় যে সৌন্দর্য্য আছে, কাটাকুটি করিয়া পরিবর্তন করিলে তাহা নষ্ট হইবে। তুমি যেমন লিখিয়াছ, তেমনি ছাপাইয়া দাও। আমি তােমার পুস্তকের একটি ভূমিকা লিখিয়া দিব। একটি ভূমিকা লিখিয়াও দিয়াছিলেন; কিন্তু তাহা আমার মনের মতন হয় নাই। লেখা অবশ্য খুব ভালই হইয়াছিল; আমার মনের মতন না হইবার কারণ, তাহাতে অনেক সত্য ঘটনার উল্লেখ ছিল না। আমি সেকথা বলাতে তিনি বলিয়াছিলেন যে,—সত্য যদি অপ্রিয় ও কটু হয়, তাহা সকল সময়ে প্রকাশ করা উচিত নয়। সংসারে আমাদের ন্যায় রমণীগণের মান অভিমান করিবার স্থল অতি বিরল। এইজন্য যাঁহারা স্বভাবের উদারতা গুণে আমাদিগকে স্নেহের প্রশ্রয় দেন, তাহাদের উপর আমরাও বিস্তর অত্যাচার করিয়া থাকি। একে রমণী অদূরদর্শিনী, তাহাতে সে সময় অভিমানে আমার হৃদয় পূর্ণ; গিরিশ বাবু মহাশয়ের রুগ্ন-শয্যা ভুলিয়া, তাঁহার রােগ-যন্ত্রণা ভুলিয়া, সত্য ঘটনা সকল উল্লেখ করিয়া আর একটি ভূমিকা লিখিয়া দিবার জন্য আমি তাহাকে ধরিয়া বসিলাম। তিনিও তাহা লিখিয়া দিতে স্বীকার করিয়া ছিলেন। আমি ভাবিয়াছিলাম যে, আমার শিক্ষাগুরু ও সম-সামযিক শ্রেষ্ঠ অভিনেতা যদি সকল ঘটনা ভূমিকায় উল্লেখ না করেন, তাহা হইলে, আমার আত্মকাহিনী লেখা অসম্পূর্ণ হইবে। শীঘ্র ভূমিকা লিখিয়া দিবার জন্য আমি তাঁহাকে ত্বরা দিতে লাগিলাম। স্নেহময় গুরুদেব আমায় বলিলেন,—তােমার ভূমিকা লিখিয়া না দিয়া আমি মরিব না। রঙ্গালয়ে আমি ৺গিরিশবাবু মহাশয়ের দক্ষিণহস্তস্বরূপ ছিলাম। তাঁহার প্রথম ও প্রধান ছাত্রী বলিয়া একসময়ে নাট্যজগতে আমার গৌরব ছিল। আমার অতি তুচ্ছ আবদার রাখিবার জন্য তিনি ব্যস্ত হইতেন। কিন্তু এখন সে রামও নাই, সে অযোধ্যাও নাই! আমার মান অভিমান রাখিবার দুইজন ব্যক্তি ছিলেন, একজন বিদ্যায়, প্রতিভায় উচ্চ সম্মানে পরিপূর্ণ, অন্যজন ধনে মানে যশে গৌরবে সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী। এক্ষণে তাঁহারা কেহই আর এ সংসারে নাই। আমার তুচ্ছ আব্দার রক্ষা করিবার জন্য বঙ্গের গ্যারিক্ গিরিশ বাবু আর ফিরিয়া আসিবেন না। ‘ভূমিকা লিখিয়া না দিয়া মরিব না’ বলিয়া তিনি আমাকে যে আশ্বাস দিয়াছিলেন, আমার অদৃষ্টে তাহা ঘটিল না। মনে করিয়াছিলাম, তাঁহার পুনৰ্বার-লিখিত ভূমিকা সম্পূর্ণ হইলে, আমার আত্মকাহিনীর নব সংস্করণ করিব। কিন্তু আমার শিক্ষাগুরু ভূমিকা লেখা অসম্পূর্ণ রাখিয়া আমায় শিখাইয়া গেলেন যে, সংসারের সকল সাধ সম্পূর্ণ হইবার নয়।

 সম্পূর্ণ ত হইবার নহে, তবে যাহা আছে, তাহা লােপ পায় কেন? আমি গিরিশ বাবু মহাশয়ের পূর্ব্বলিখিত ভূমিকাটি অন্বেষণ করিতে গিয়া শুনিলাম যে, গিরিশ বাবুর শেষ বয়সের নিত্যসঙ্গী পূজনীয় শ্রীযুক্ত অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় তাহা যত্ন করিয়া তুলিয়া রাখিয়াছেন। সেটি তাঁহার নিকট হইতে ফিরাইয়া লইয়া আমার ক্ষুদ্র কাহিনীর সহিত গাঁথিয়া দিলাম। আমার শিক্ষাগুরু মাননীয় ৺গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের উৎসাহে ও বিশেষ অনুরোধে লিপিবদ্ধ হইয়া আমার আত্মকাহিনী প্রকাশিত হইল। কিন্তু তিনি আজ কোথায়? হায়—সংসার! সত্যই তুমি কিছুই পূর্ণ কর না! এ ক্ষুদ্র কাহিনী যে স্বহস্তে তাঁহার চরণে উপহার দিব, সে সাধটুকুও পূর্ণ হইল না।

বিনীতা 
শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী।

.

বঙ্গ-রঙ্গালয়ে শ্রীমতী বিনোদিনী।

(নাট্যসম্রাট্ স্বর্গীয় গিরিশচন্দ্র ঘোষ

কর্ত্তৃক লিখিত।)

 বঙ্গ-রঙ্গভূমির কয়েকজন উজ্জ্বল অভিনেতা অকালে কালগ্রাসে পতিত হওয়ায়, কখনও শোকসভায়, কখনও বা সংবাদপত্রে, কখনও বা রঙ্গমঞ্চ হইতে আমার আন্তরিক শোক প্রকাশের সহিত তাঁহাদের কার্যদক্ষতা সংক্ষেপে উল্লেখ করি। যখন সুপ্রসিদ্ধ অভিনেতা স্বর্গীয় অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফীর শোকসভা সমাবেশিত হয়, তখন আমি একটি প্রবন্ধ পাঠ করি ষ্টার থিয়েটারের সুযোগ্য ম্যানেজার শ্রীযুক্ত অমৃতলাল বসু, তিনিও তাহার হৃদয়ের শোকোচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন এবং সেই শোকসভার অব্যবহিত পরেই তিনি আমায় একখানি পুস্তক লিখিতে অনুরোধ করেন, যাহাতে বঙ্গ-রঙ্গালয়ের প্রত্যেক অভিনেতা ও অভিনেত্রীর কার্যকলাপ বর্ণিত থাকে। অমৃত বাবু মনে করেন, আমার দ্বারা অভিনেতা ও অভিনেত্রীর কার্যকলাপ বর্ণিত হইলে এবং কোন্ সময় কি অবস্থায় তাহারা কার্য্য করিয়াছে, তাহা বিবৃত থাকিলে, এক প্রকার বঙ্গ-রঙ্গালয়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ থাকিবে। এ পুস্তকে জীবিত ও মৃত অভিনেতা ও অভিনেত্রীর বিষয় যাহাতে বিস্তৃতরূপে বর্ণিত হয়, ইহাই অমৃত বাবুর অনুরোধ। কিন্তু সে কার্যে হস্তক্ষেপ করিতে আমি সাহস করি নাই। আমার যাহারা ছাত্র এবং যাহাদের সহিত একত্র কার্য্য করিয়াছি, তাহাদের বিষয়ও লিখিতে গেলে হয়তো একজনের প্রশংসায় অপরের মনে আঘাত লাগিতে পারে, হয়তো বহুদিনের কথা স্মৃতির ভ্রমে, স্বরূপ বর্ণিত হইবে না। তার পর অভিনেতা ও অভিনেত্রীর বর্তমান অবস্থা সমাজের চক্ষে এরূপ উন্নত নয় যে, এক নাট্যামোদী পাঠক ব্যতীত অপর সাধারণের নিকট তাহার মূল্য থাকিবে। আর এক বাধা এই যে, তাহাদের নাট্যজীবনের সহিত আমার নাট্যজীবন এরূপ বিজড়িত যে, অনেক স্থলে আমার আপনার কথাই বলিতে বাধ্য হইব। এ বাধা বড় সাধারণ। বাধা নহে। পৃথিবীতে যত প্রকার কঠিন কার্য্য আছে, তন্মধ্যে আপনার কথা আপনি বলিতে যাওয়া একটি কঠিন কার্য্য। অনেক সময়ে প্রকৃত দীনতাও ভাণ বলিয়া পরিগৃহীত হয়; স্বরূপ বর্ণনায় অতিরঞ্জিত জ্ঞান হয়; আর সমস্তটাই আত্মম্ভরিতার পরিচয়—এইরূপ পাঠকের মনে ধারণা জন্মিবার সম্ভাবনা। এরূপ হইবার কারণ বিস্তর। অনেক সময় আপনি আপনার দোষ দেখা যায় না এবং আত্মদোষ বর্ণনাও অনেক সময়ে উকীলের বিচারপতির সম্মুখে নিজ মক্কেলের দোষ স্বীকারের ন্যায় ওকালতী ভাবেই হইয়া থাকে। তাহার পর ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্র আন্দোলনে ফল কি? এই সকল চিন্তায় এ পর্য্যন্ত বিরত আছি; কিন্তু অমৃত বাবুও সময়ে সময়ে আসিয়া অনুরোধ করিতে ক্রটি করেন না।

 এক্ষণে ভূতপূর্ব্ব-প্রসিদ্ধ-অভিনেত্রী শ্রীমতী বিনোদিনী দাসী তাহার নিজ জীবনী লিপিবদ্ধ করিয়া আমাকে দেখাইয়া একটি ভূমিকা লিখিতে অনুরোধ করে। যাঁহারা থিয়েটারে “চৈতন্য লীলা”র নাম শুনিয়াছেন, তিনিই বিনোদিনীর নাম জানেন। “চৈতন্যলীলা” যে কেবলমাত্র নাট্যামোদীরা জানেন, এরূপ নয়; একটি বিশেষ কারণে “চৈতন্যলীলা” অনেক সাধু শান্তের নিকটও পরিচিত। পতিতপাবন ভগবান্ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব রঙ্গালয়ের পতিতগণকে তাঁহার মুক্তিপ্রদ পদধূলি প্রদানার্থ “চৈতন্যলীলা” দর্শনচ্ছলে পদার্পণে রঙ্গালয়কে পবিত্র করিয়াছিলেন। এই চৈতন্যলীলায় বিনোদিনী ‘চৈতন্যের’ ভূমিকা গ্রহণ করে।

 বহুপূর্ব্বে আমি বিনোদিনীকে বলিয়াছিলাম যে, যদি তোমার জীবনের ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করো, এবং সেই সকল ঘটনা আন্দোলন করিয়া ভবিষ্যৎ জীবনের পথ মার্জ্জিত করিতে পারো, তাহা তোমার পক্ষে অতিশয় ফলপ্রদ হইবে। এই কথার উল্লেখ করিয়া এক রকম আমার উপর দাবী রাখিয়া বিনোদিনী তাহার জীবনআখ্যায়িকার একটি ভূমিকা লিখিতে বলে। আমি নানা কারণে ইতস্ততঃ করিলাম; আমি বিনোদিনীকে বুঝাইয়া বলিলাম যে,অবশ্য তুমি ইহা তোমার পুস্তকে মুদ্রাঙ্কিত করিবার জন্য ভূমিকা লিখিতে বলিতেছ, কিন্তু তাহাতে কি ফল হইবে? তুমি লিখিয়াছ যে, তোমার হৃদয়ব্যথা প্রকাশ করা—তোমার মন্তব্য। কিন্তু তুমি সংসারে ব্যথার ব্যথী কাহাকে পাইলে, যে, হৃদয়ব্যথা জানাইতে ব্যাকুল হইয়াছ? আত্মজীবনী লেখা যেরূপ কঠিন আমার ধারণা, তাহাও বুঝাইলাম,—আত্মজীবনী লিখিতে অনেককে অনেক কৌশল করিতে হইয়াছে, তাহাও বুঝাইলাম। জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস-লেখক ডিকেন্স গল্পচ্ছলে আপনার নাম প্রচ্ছন্ন রাখিয়া; তাহার আত্মজীবনী লিখিয়াছেন। অনেকে বন্ধুর সহিত কথোপকথনচ্ছলে। কেহ বা পুত্রের প্রতি লিপির ছলে আত্মজীবন প্রকাশ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। কারণ, অতি উচ্চ ব্যক্তি প্রভৃতিও নিজ জীবনী লিখিতে ব্যঙ্গের ভয় করিয়াছেন। বিনোদিনীর জীবনীতে আমি যে ভূমিকা লিখিব, তৎসম্বন্ধে সাধারণকে কি কৈফিয়ৎ দিব? আমিও কৈফিয়তের ভয়ে লিখিতে চাহি না, বিনোদিনীও ছাড়িবে না। কিন্তু সহসা আমার মনে উদয় হইল যে, এই সামান্য বনিতার ক্ষুদ্র জীবনে যে মহান্ শিক্ষাপ্রদ উপাদান রহিয়াছে! লোকে পরস্পর বলাবলি করে,—এ হীন—ও ঘৃণিত; কিন্তু পতিতপাবন ঘৃণা না করিয়া পতিতকে শ্রীচরণে স্থান দেন। বিনোদিনীর জীবন ইহার প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত। অনেকে আজীবন তপস্যা করিয়া যে মহাফল লাভে অসমর্থ হন, সেই চতুর্ব্বর্গ ফলস্বরূপ শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের পাদপদ্ম বিনোদিনী লাভ করিয়াছে। সেই চরণ-মাহাত্ম্য যাহার হৃদয়ে আংশিক স্পর্শ করিয়াছে, তিনিই বিভোল হইয়া ভাবিবেন যে, ভগবান্ অতি হীন অবস্থাগত ব্যক্তিরও সঙ্গে থাকিয়া সুযোগপ্রাপ্তি মাত্রেই তাঁহাকে আশ্রয় দেন। এরূপ পাপী তাপী সংসারে কেহই নাই, যাহাকে দয়াময় পরিত্যাগ করিয়াছেন। বিনোদিনীর জীবনী যদি সমাজকে এ শিক্ষা প্রদান করে, তাহা হইলে বিনোদিনীর জীবন বিফল নয়। এ জীবনী পাঠে ধর্ম্মাভিমানীর দম্ভ খর্ব্ব হইবে, চরিত্রাভিমানী দীনভাব গ্রহণ করিবে এবং পাপী তাপী আশ্বাসিত হইবে।

 যাহারা বিনোদিনীর ন্যায় অভাগিনী, কুৎসিত পন্থা ভিন্ন যাহাদের জীবনোপায় নাই, মধুর বাক্যে যাহাদিগকে ব্যভিচারীরা প্রলোভিত করিতেছে, তাহারাও মনে মনে আশ্বাসিত হইবে যে, যদি বিনোদিনীর মত কায়মনে রঙ্গালয়কে আশ্রয় করি, তাহা হইলে, এই ঘৃণিত জন্ম জনসমাজের কার্য্যে অতিবাহিত করিতে পারিব। যাহারা অভিনেত্রী, তাহারা বুঝিবে—কিরূপ মনোনিবেশের সহিত নিজ ভূমিকার প্রতি যত্ন করিলে জনসমাজে প্রশংসাভাজন হইতে পারে। এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি ভূমিকা লিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। যদি দোষ হইয়া থাকে, অনেক দোষেই মার্জনাপ্রাপ্ত হইয়াছি, ইহাতেও মার্জনা পাইব—ভরসা করি।

 বিনোদিনীর এই ক্ষুদ্র জীবনী একস্রোতে লিপিবদ্ধ হইলে, উত্তম হইত; কিন্তু তাহা না হইয়া অবস্থাভেদে সময়ভেদে লেখা হইয়াছে, তাহা পড়িবামাত্র বোঝা যায়। বিনোদিনী মনের কথা বলিবার প্রয়াস পাইয়া সহানুভূতি চাহিয়াছে; কিন্তু দেখা যায়, কোথাও কোথাও সমাজের প্রতি তীব্র কটাক্ষ আছে। যে যে ভূমিকা বিনোদিনী অভিনয় করিয়াছিল, প্রতি অভিনয়ই সুন্দর, কিরূপে তাহা অভ্যাস করিয়াছে, তাহাও বর্ণিত আছে,—কিন্তু সে। বর্ণনা অনেকটা কবিতা। কিরূপ চেষ্টায় কিরূপ কার্য্য হইয়াছে, কিরূপ কঠোর অভ্যাসের প্রয়োজন, কিরূপ কণ্ঠস্বর ও হাব-ভাবের প্রতি আধিপত্য আবশ্যক—এ সকল শিক্ষোপযোগীরূপে বর্ণিত না হইয়া আপনার কথাই বলা হইয়াছে। যে অবস্থা গোপন রাখা আত্মজীবনী লেখার কৌশল, সে কৌশল ক্ষুন্ন হইয়াছে। আমি তাহার প্রধান প্রধান ভূমিকাভিনয়ে, যতদূর স্মরণ আছে, সে চিত্র পাঠককে দিবার চেষ্টা করিতেছি।

 বিনোদিনী যথার্থ বলিয়াছে যে, তাহার ভূমিকা উপযোগী পরিচ্ছদে সুসজ্জিত হইবার বিশেষ কৌশল ছিল। একটি দৃষ্টান্তে তাহার কতক প্রকাশ পাইবে। বুদ্ধদেবের অভিনয়ে বিনোদিনী গোপার ভূমিকা গ্রহণ করে। একদিন, ভক্তচূড়ামণি স্বর্গীয় বলরাম বসু “বুদ্ধদেব” দেখিতে যান। তিনি এক অঙ্ক দর্শনের পর সহসা সজ্জাগৃহে যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। কেন যে তাঁহার এরূপ ইচ্ছা হইল, তাহা আমি জিজ্ঞাসা না করিয়া, কন‍্সার্টের সময়, তাহাকে ভিতরে লইয়া যাইলাম। তিনি এদিক্ ওদিক্‌ দেখিয়া কন‍্সার্ট বাজিতে বাজিতেই ফিরিয়া আসিলেন। তাহার পর তিনি গল্প করিয়াছিলেন যে, তিনি রঙ্গমঞ্চের উপর গোপাকে প্রথমে দেখিয়া ভাবিয়াছিলেন যে, এরূপ আশ্চর্য সুন্দরী থিয়েটারওয়ালারা কোথায় পাইল? তিনি সেই সুন্দরীকে দেখিতে গিয়াছিলেন। সাজঘরে দেখিয়া তাহার মনে হইয়াছিল যে, রঙ্গমঞ্চে যেরূপ দেখিয়াছিলেন, সেরূপ সুন্দরী নয় সত্য, কিন্তু সুন্দরী বটে। তৎপরে একদিন অসজ্জিত অবস্থায় দেখিয়া, সেই স্ত্রীলোক যে ‘গোপা’ সাজিয়াছিল, তাহা প্রথমে বিশ্বাস করেন নাই। তিনি সাজসজ্জার ভূয়োভূয়ঃ প্রশংসা করিতেন। সজ্জিত হইতে শেখা আভনয়কার্যের প্রধান অঙ্গ, এ শিক্ষায় বিনোদিনী বিশেষ নিপুণা ছিল। বিনোদিনী ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায়, সজ্জা দ্বারা আপনাকে এরূপ পরবর্ত্তিত করিতে পারিত যে, তাহাকে এক ভূমিকায় দেখিয়া অপর ভূমিকায় যে সেই আসিয়াছে, তাহা দর্শক বুঝিতে পারিতেন না। সাজসজ্জার প্রতি অভিনেতা ও অভিনেত্রীর বিশেষ লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। সজ্জিত হইয়া দর্পণে নিজের প্রতিবিম্ব দর্শনে অনেক পময়ে অভিনেতার হৃদয়ে নিজ ভূমিকার ভাব প্রস্ফুটিত হয়। দর্পণ অভিনেতার সামান্য শিক্ষক নয়। সজ্জিত হইয়া দর্পণের সম্মুখে হাবভাব প্রকাশ করিয়া যিনি ভূমিকা (part) অভ্যাস করেন, তিনি সাধারণের নিকট বিশেষ প্রশংসাভাজন হন। কিন্তু এরূপ অভ্যাস করা কষ্টসাধ্য। শিক্ষাজনিত অঙ্গভঙ্গী স্বাভাবিক অঙ্গভঙ্গীর ন্যায় অভ্যস্ত করা এবং স্বেচ্ছায় তৎক্ষণাৎ সেই অঙ্গভঙ্গী প্রকাশ— শ্রম ও চিন্তা-সাধ্য। এ শ্রম ও চিন্তা-ব্যয়ে বিনোদিনী কখন কুষ্ঠিত ছিল না। বিনোদিনীর স্মরণ নাই, মেঘনাদের সাতটি ভূমিকা বিনোদিনীকে ন্যাসান্যাল থিয়েটারে অভিনয় করিতে হয়, বেঙ্গল থিয়েটারে নয়। যাহা হউক, সাতটি ভূমিকাই অতি সুন্দর হইয়াছিল। সাতটি ভূমিকা একজনের দ্বারা অভিনীত হওয়া কঠিন; দুইটি বৈষম্যপূর্ণ ভূমিকা এক নাটকে অভিনয় করা সাধারণ নাট্যশক্তির বিকাশ নয়। কিন্তু এ সকল অপেক্ষা এক ভূমিকায় চরমোৎকর্ষ লাভ করা বিশেষ নাট্যশক্তির কার্য্য। চরমোৎকর্ষ লাভ সহজে হয় না। প্রথমে নিজ ভূমিকা তন্ন তন্ন করিয়া পাঠের পর সেই ভূমিকার কিরূপ অবয়ব হওয়া কর্ত্তব্য, তাহা কল্পনা করিতে হয়। অঙ্গে কি কি পারিচ্ছদিক পরিবর্ত্তনে সেই ভূমিকা-কল্পিত আকার গঠিত হইবে, তাহা মনঃক্ষেত্রে চিত্রকরের ন্যায় সেই আভাস আনা প্রয়োজন। অভিনয়কালীন ঘাতপ্রতিঘাতে কিরূপ অঙ্গভঙ্গী হইবে এবং সেই সকল ভঙ্গী সুসঙ্গত হইয়া শেষ পর্যন্ত চলিবে, তাহার প্রতি সতর্ক লক্ষ্য রাখিতে হয়। অভনয়কালে যে স্থানে মনশ্চাঞ্চল্য ঘটিবে, কি আপনার কথা কহিতে, কি সহযোগী অভিনেতার কথা শুনিতে, সেইক্ষণেই অভিনয়ের রস ভঙ্গ হইবে। এ সমস্ত লক্ষ্য করিতে পারেন, এরূপ দর্শক বিনোদিনীর সময় বিস্তর আসিতেন; এবং সে সময়ে অভিনয় সম্বন্ধে অতি তীব্র সমালোচনা হইত। যথা—পলাশীর যুদ্ধ দেখিয়া সাধারণীতে সমালোচনা,— “ন্যাশন্যাল থিয়েটারের অভিনেতারা সকলে সুপাঠক; যিনি ক্লাইভের অংশ গ্রহণ করিয়াছিলেন, তিনি অঙ্গভঙ্গীও জানেন।” এইটুকু একপ্রকার সুখ্যাতি ভাবিয়া লওয়া যাইতে পারে। তাহার পর সিরাজদ্দৌলার উপর এরূপ কঠোর লেখনী সঞ্চালন যে, প্রকৃত সিরাজদ্দৌলা যেরূপ পলাশী ক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, সেইরূপ অভিনেতা সিরাজদ্দৌলা সমালোচনার তাড়নায় নিজ ভূমিকা ত্যাগ করিতে ব্যগ্র হইয়াছিলেন। ব্যথিতচিত্তে বলিয়াছিলেন, “আর আমার নবাব সাজায় কাজ নাই।” কিন্তু তৎকালিক সমালোচক যেরূপ কঠোরতার সহিত নিন্দা করিতেন, অতি উচ্চ প্রশংসা দানেও কুণ্ঠিত হইতেন। এই সকল সমালোচকশ্রেণী তৎকালিক বঙ্গীয় সাহিত্যজগতের চালক ছিলেন। বহু ভূমিকায় বিনোদিনী ঐ সকল সমালোচকের নিকট উচ্চ প্রশংসা লাভ করিয়াছে। দক্ষযজ্ঞে সতীর ভূমিকা আদ্যোপান্ত বিনোদিনীর দক্ষতার পরিচয়। সতীর মুখে একটি কথা আছে, “বিয়ে কি মা?”—এই কথাটি অভিনয় করিতে অতি কৌশলের প্রয়োজন। যে অভিনেত্রী পর অঙ্কে মহাদেবের সহিত যোগ-কথা কহিবে, এইরূপ-বয়স্কা স্ত্রীলোকের মুখে “বিয়ে কি মা?” শুনিলে ন্যাকাম মনে হয়। সাজসজ্জায় হাবভাবে বালিকার ছবি দর্শককে না দিতে পারিলে, অভিনেত্রীকে হাস্যাস্পদ হইতে হয়। কিন্তু বিনোদিনীর অভিনয়ে বোধ হইত, যেন দিগম্বর-ধ্যান-মগ্ন বালিকা সংসার-জ্ঞানশূন্য অবস্থায় মাতাকে “বিয়ে কি মা?” প্রশ্ন করিয়াছে। পর অঙ্কে দয়াময়ী জগজ্জননী জীবের নিমিত্ত অতি ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করিতেছেন,—

“কহ, নাথ!
কি হেতু কহিলে—
“ধন্য, ধন্য কলিযুগ”?
ক্ষুদ্র নর অন্নগত প্রাণ,
রিপুর অধীন সবে;

রোগশোক সন্তাপিত ধরা,
পন্থাহারা মানবমণ্ডল
ভীম ভবার্ণব মাঝে;—
কেন কহ বিশ্বনাথ,—“ধন্য কলিযুগ?”

যোগিনীবেশে যোগীশ্বরের পার্শ্বে জগজ্জননী এইরূপ প্রশ্ন করিতেছেন,—ইহা বিনোদিনীর অভিনয়ে প্রতিফলিত হইত। তেজস্বিনীর মহাদেবের নিকট বিদায় গ্রহণ, মাতাকে প্রবোধ দান,—

“শুনেছি যজ্ঞের ফল প্রজার রক্ষণ।
প্রজাপতি পিতা মোর;
প্রজারক্ষা কেমনে গো হবে?
নারী যদি পতিনিন্দা সবে,
কার তরে গৃহী হবে নর?
প্রজাপতি-দুহিতা গো আমি,
ওমা, পতিনিন্দা কেন সব?”

 এ কথায় যেন সতীত্বের দীপ্তি প্রত্যক্ষীভূত হইত। যজ্ঞস্থলে পিতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন; অথচ দৃঢ়বাক্যে পূজ্য স্বামীর পক্ষ সমর্থন, পতিনিন্দায় প্রাণের ব্যাকুলতা, তৎপরে প্রাণত্যাগ স্তরে স্তরে অতি দক্ষতার সহিত প্রদর্শিত হইত।

 “বুদ্ধদেব” নাটকে পতিবিরহ-ব্যাকুলা গোপার ছন্দকের নিকট

‘দাও, দাও ছন্দক আমায়,
পতির বসনভূষা মম অধিকার!
স্থাপি সিংহাসনে,
নিত্য আমি পূজিব বিরলে

 বলিয়া পতির পরিচ্ছদ যাচ্ঞা একপ্রকার অতুলনীয় হইত। সে অর্দ্ধোন্মাদিনী বেশ—আগ্রহের সহিত স্বামীর পরিচ্ছদ হৃদয়ে স্থাপন এখনও আমার চক্ষে জাগরিত। যাহাকে পূর্ব্বাঙ্কে অপ্সরীনিন্দিত সুন্দরী দেখা যাইত, পরিচ্ছদ-যাচ্ঞার সময় তাপশুষ্ক পদ্মের ন্যায় মলিনা বোধ হইত। “Light of Asia”-রচয়িতা Edwin Arnold সাহেব এই গোপার অভিনয়ের প্রশংসা করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার “Travels in the East” নামক গ্রন্থে বঙ্গনাট্যশালা অতি প্রশংসার সহিত বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি রঙ্গালয় দর্শনে বুঝিয়াছিলেন যে, হিন্দু আধ্যাত্মিক অবস্থায় উন্নত, নচেৎ বুদ্ধদেবচরিত্রের ন্যায় দার্শনিক অভিনয় স্থিরভাবে হিন্দুদর্শকমণ্ডলী দেখিতেন না। বিদেশীর চক্ষে এইরূপ হিন্দুর হৃদয়ের অবস্থার পরিচয় দেওয়া। রঙ্গালয়ের পক্ষে সামান্য গৌরবের বিষয় নহে। রঙ্গালয়ের পরমবিদ্বেষী ব্যক্তিকেও ইহা স্বীকার করিতে হইবে।

 বলা হইয়াছে যে, সকল ভূমিকাতেই বিনোদিনী সাধারণের প্রশংসাভাজন হইয়াছিল, কিন্তু “চৈতন্যলীলায়” চৈতন্য সাজিয়া তাহার জীবন সার্থক করে। এই ভূমিকায় বিনোদিনীর অভিনয় আদ্যোপান্তই ভাবুক-চিত্ত-বিনোদন। প্রথমে বাল-গৌরাঙ্গ দেখিয়া ভাবুকের বাৎসল্যের উদয় হইত। চঞ্চলতায় ভগবানের বাল্যলীলার আভাস পাইতেন। উপনয়নের সময় রাধাপ্রেমমাতোয়ারা বিভোর দণ্ডী দর্শনে দর্শক স্তম্ভিত হইত। গৌরাঙ্গমূর্ত্তির ব্যাখ্যা “অন্তঃকৃষ্ণ বহিঃ রাধা—পুরুষ প্রকৃতি এক অঙ্গে জড়িত।” এই পুরুষপ্রকৃতির ভাব বিনোদিনীর অঙ্গে প্রতিফলিত হইত। বিনোদিনী যখন “কৃষ্ণ কই—কৃষ্ণ কই?” বলিয়া সংজ্ঞাহীনা হইত, তখন বিরহবিধুরা রমণীর আভাস পাওয়া যাইত। আবার চৈতন্যদেব যখন ভক্তগণকে কৃতার্থ করিতেছেন, তখন পুরুষোত্তমভাবের আভাস বিনোদিনী আনিতে পারিত। অভিনয় দর্শনে অনেক ভাবুক এরূপ বিভোর হইয়াছিলেন যে, বিনোদিনীর পদধূলি গ্রহণে উৎসুক হন। এই অভিনয় পরমহংসদেব দেখিতে যান। হরিনাম হইলে হরি স্বয়ং তাহা শুনিতে আসেন, পরমহংসদেব স্বয়ং তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রদর্শন করিলেন; পদধূলিলাভে কেহই বঞ্চিত হইল না। সকলেই পতিত, কিন্তু পতিতপাবন যে পতিতকে কৃপা করেন, একথা সে পতিতমণ্ডলীর বিশ্বাস জন্মিল। তাহাদের মনে তর্ক উঠে নাই, সেইজন্য তাহাদের পতিত জন্ম ধন্য। বিনোদিনী অতি ধন্যা, পরমহংসদেব করকমল দ্বারা তাহাকে স্পর্শ করিয়া শ্রীমুখে বলিয়াছিলেন,—“চৈতন্য হোক।” অনেক পর্ব্বত-গহবরবাসী এ আশীর্ব্বদের প্রার্থী। যে সাধনায় বিনোদিনীর ভাগ্য এরূপ প্রসন্ন হইল, সেই সাধনাই, অভিনয়ের নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে হইলে, অভিনেতাকে অবলম্বন করিতে হয়। বিনোদিনীর সাধন —যথাজ্ঞান কায়মনোবাক্যে মহাপ্রভুর ধ্যানে নিযুক্ত থাকিতে হইয়াছিল। যে ব্যক্তি যে অবস্থায়ই হোক, এই মহা ছবি ধ্যান করিবে, সেই ব্যক্তি এই ধ্যানপ্রভাবে ধীরে ধীরে মোক্ষের পথে অগ্রসর হইয়া মোক্ষলাভ করিবে। অষ্টপ্রহর গৌরাঙ্গমূর্ত্তি ধ্যানের ফল বিনোদিনীর ফলিয়াছিল।

 গুরুগম্ভীর ভূমিকায় (serious part) বিনোদিনীর যেরূপ দক্ষতা, “বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ” প্রহসনে ফতীর ভূমিকায়, এবং “বিবাহ-বিভ্রাটে” বিলাসিনী কারফর্ম্মার ভূমিকায়, “চোরের উপর বাটপাড়ি”তে গিন্নী, “সধবার একাদশী”তে কাঞ্চন প্রভৃতি হাল‍্কা ভূমিকায়ও বিনোদিনীর অভিনয় অতি সুন্দর হইত। মিলনান্ত ও বিয়োগান্ত নাটক, প্রহসন, পঞ্চরং, নক‍্সা প্রভৃতিতে সে সময় বিনোদিনীই নায়িকা ছিল। প্রত্যেক নায়িকাই অন্য নায়িকা হইতে স্বতন্ত্র এবং প্রশংসনীয় হইত। এক্ষণে যাঁহারা কপালকুণ্ডলার অভিনয় দেখিতে যান, তাঁহাদের ধারণা যে, মতিবিবির অংশই নায়িকার অংশ। কিন্তু যাঁহারা বিনোদিনীর অভিনয় দেখিয়াছেন, তাঁহাদের নিশ্চয় ধারণা যে, কপালকুণ্ডলার নায়িকা কপালকুণ্ডলা, মতিবিবি নয়। কপালকুণ্ডলার চরিত্র এই যে, বাল্যাবধি স্নেহপালিত না হওয়ায়, নবকুমারের বহু যত্নেও হৃদয়ে প্রেম প্রস্ফুটিত হয় নাই। অবশ্য অন্য স্ত্রীলোকের ন্যায় গৃহকার্য্য করত, কিন্তু যখন তাহার ননদিনীর স্বামী বশ করিবার ঔষধের নিমিত্ত বনে প্রবেশ করিল, তখন পিঞ্জরাবদ্ধা বিহঙ্গিনী যেরূপ পিঞ্জরমুক্ত হইয়া বনে প্রবেশ মাত্র বন্যবিহঙ্গিনী হইয়া যায়, সেইরূপ গৃহবদ্ধা কপালকুণ্ডলা-অংশ-অভিনয়কারিণী বিনোদিনী বনপ্রবেশ মাত্রেই পূর্ব্বস্মৃতি জাগরিত হইয়া বন্য কপালকুণ্ডলা হইয়া যাইল— এই পরিবর্ত্তন বিনোদিনীর অভিনয়ে অতি সুন্দররূপ প্রস্ফুটিত হইত। তখন কপালকুণ্ডলার অভিনয়ে কপালকুণ্ডলাই নায়িকা ছিল। এখন হীরার ফুলের অভিনয়েও সেইরূপ পরিবর্ত্তন হইয়াছে। এক্ষণে অভিনয় দর্শনে দর্শকের ধারণা হয় যে, রতি হীরার ফুল: গীতিনাট্যের নায়িকা; কিন্তু যিনি ‘হীরার ফুলে’ বিনোদিনীকে দেখিয়াছেন, তাঁহার ধারণা যে ‘হীরার ফুলে’ গ্রন্থকার-রচিত নায়িকাই নায়িকা, রতি নায়িকা নয়। অনেক সময়েই আমি বিনোদিনীর সহযোগী অভিনেতা ছিলাম। “মৃণালিনীতে” আমি পশুপতি সাজিতাম, বিনোদ “মনোরমা” সাজিত। অন্যান্য অনেক নাটকেই আমরা নায়ক-নায়িকার অংশ গ্রহণ করিয়াছি; সমস্ত বলিতে গেলে অনেক কথা, প্রবন্ধ দীর্ঘ হয়, কেবল ‘মনোরমর’ কথাই বলিব। মনোরমার কথা বলিতেছি, তাহার কারণ, আমি প্রতি অভিনয়েই সাহিত্যসম্রাট্ বঙ্কিমবাবু-বণিত সেই বালিকা ও গম্ভীরা মূর্ত্তি প্রত্যক্ষ দেখিয়াছি। এই শিক্ষাদাত্রী তেজস্বিনী সহধম্মিণী আবার পরক্ষণেই “পশুপতি, তুমি কাঁদ‍্ছ কেন?” বলিয়াই প্রেম-বিহ্বলা বালিকা। হেমচন্দ্রের সহিত কথোপকথন করিতে করিতে এই স্নেহশীলা ভগ্নী, ভ্রাতার মনোবেদনায় সহানুভূতি করিতেছে, আর পরক্ষণেই “পুকুরে হাঁস দেখিতে যাওয়া” অসাধারণ অভিনয়চাতুর্য্যে প্রদর্শিত হইত। বেঙ্গল থিয়েটারে আসিয়া বঙ্কিম বাবু কি বলিয়াছিলেন, তাহা আমি জানি না, কিন্তু যিনি মনোরমার অভিনয় দেখিতেন, তাঁহাকেই বলিতে হইয়াছে যে, এ প্রকৃত “মৃণালিনীর” মনোরমা। বালিকাভাব দেখিয়া এক ব্যক্তির মনে উদয় হইয়া ছিল, বুঝি কোন বালিকা অভিনয় করিতেছে। অভিনয়-কৌশলে বিনোদিনীর এই উভয় ভাবের পরিবর্ত্তন, উচ্চশ্রেণীর অভিনেত্রীরও উচ্চ প্রশংসা। বিনোদিনী একবাক্যে দর্শকের নিকট সেই উচ্চ প্রশংসা লাভ করিয়াছিল। বিননাদিনীর গঠনও অভিনেত্রীর সকল ভূমিকা গ্রহণেরই উপযুক্ত—যুবক যুবতী, বালক বালিকা, রাজরাণী হইতে ফতী পর্য্যন্ত সকল ভূমিকার উপযুক্ত। বঙ্গরঙ্গভূমির যদি সমাজের চক্ষে অন্যরূপ অবস্থা হইত, তাহা হইলে বিনোদিনীর অভিনয়-জীবনের আত্মবর্ণনা অনাদৃত হইবার সম্ভাবনা থাকিত না। কিন্তু এ কথা বলিতে সাহস করা যায়, যদি বঙ্গবঙ্গালয় স্থায়ী হয়, বিনোদিনীর এই ক্ষুদ্র জীবনী আগ্রহের সহিত অন্বেষিত ও পঠিত হইবে।

 বিনোদিনী আপনার শৈশব-অবস্থা বর্ণনা করিয়াছে। সে সমস্ত আমি অবগত নই। শ্রীযুক্ত ভুবনমোহন নিয়োগী মহাশয়ের গঙ্গাতীরস্থ চাঁদনীর উপর আমার সহিত তাহার প্রথম দেখা। তখন বিনোদিনী বালিকা। বিনোদিনী সত্য বলিয়াছে, সে সময় তাহাকে নায়িকা সাজাইতে সজ্জাকরকে যাত্রার দলের ছোক‍রা সাজাইবার প্রথা অবলম্বন করিতে হইত। কিন্তু সে সময়ে তাহার শিক্ষাগ্রহণের ঔৎসুক্য ও তীব্র মেধা দেখিয়া, ভবিষ্যতে যে বিনোদ রঙ্গমঞ্চে প্রধান অভিনেত্রী হইবে, তাহা আমার উপলব্ধি হইয়াছিল। কিন্তু তাহার পর আমিও কিছুদিন থিয়েটার ছাড়িয়াছিলাম, বিনোদিনীও সেই সময়ে বেঙ্গল থিয়েটারে যোগদান করিয়াছিল। বেঙ্গল থিয়েটারের দৃষ্টান্তে বাধ্য হইয়া যখন গ্রেট ন্যাসান্যাল থিয়েটার নারী অভিনেত্রী লইয়া, ৺মদনমোহন বর্মণের কৃতিত্বে জাঁকজমকের সহিত “সতী কি কলঙ্কিনী?” অভিনয় করিয়া যশস্বী হয়, তখন আমার সহিত থিয়েটারের কোনও সম্বন্ধ ছিল না। থিয়েটারের নানাদেশভ্রমণবৃত্তান্ত যাহা বিনোদিনী বর্ণনা করিয়াছে, তাহা আমি নিজে কিছু জানি না। পরে যখন ৺কেদারনাথ চৌধুরীর সহিত একত্র হইয়া থিয়েটার আরম্ভ করি, সেই অবধি বিনোদিনীর থিয়েটারে অবসর লওয়া পর্যন্ত আমি সাক্ষাৎ সম্বন্ধে বিনোদিনীর অনেক কথাই অবগত আছি। বিনোদিনী হয়তো কেদারবাবু বা অন্য কাহারও নিকট শুনিয়া থাকিবে যে, আমি শরৎবাবুর নিকট হইতে বিনোদিনীকে যাচ‍্ঞা করিয়া লইয়াছি। বিনোদিনীর প্রশংসার জন্য এ কথার সৃষ্টি হইয়া থাকিবে, কিন্তু বিনোদিনী আমাদের থিয়েটারে আসার পর এক মাসের বেতন যাহা বেঙ্গল থিয়েটারে বাকী ছিল, তাহা বহুবার তাগাদা করিয়াও বিনোদিনীর মাতা প্রাপ্ত হয় নাই। বস্তুতঃ বিনোদিনী বেঙ্গল থিয়েটার হইতে চলিয়া আসায় তথাকার কর্তৃপক্ষীয়েরা বিনোদিনীর উপর ক্র‍ুদ্ধই হইয়াছিল। ইহার পর আমাদের থিয়েটার একস্রোতে চলে নাই, মাঝে মাঝে হইয়াছে ও আবার বন্ধ হইয়াছে। ৺প্রতাপচাদ জহুরীর থিয়েটারের কর্ত্তৃত্বভার গ্রহণের পর হইতে আমি থিয়েটারে প্রথম বেতনভোগী হইয়া যোগদান করি এবং সেই সময় হইতে বিনোদিনী আমার নিকট বিশেষরূপ শিক্ষিত হয়। বিনোদিনী তাহার জীবনীতে স্বর্গীয় শরচ্চন্দ্র ঘোষের প্রতি তাহার শিক্ষক বলিয়া গাঢ় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়াছে, আমারও শিক্ষাদানের কথা অতি সম্মানের সহিত আছে; কিন্তু আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতেছি যে, রঙ্গালয়ে বিনোদিনীর উৎকর্ষ আমার শিক্ষা অপেক্ষা তাহার নিজগুণে অধিক।

 উল্লেখ করিয়াছি, সমাজের প্রতি বিনোদিনীর তীব্র কটাক্ষ আছে। বিনোদিনীর নিকট শুনিয়াছি, তাহার একটি কন্যা সন্তান হয়, সেই কন্যাটিকে শিক্ষাদান করিবে, বিনোদিনীর বড়ই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সে কন্যা নীচকুলোদ্ভবা—এই আপত্তিতে কোন বিদ্যালয়ে গৃহীত হয় নাই। যাহাদিগকে বিনোদিনী বন্ধু বলিয়া জানিত, কন্যার শিক্ষাপ্রার্থী হইয়া তাহাদের অনুনয় বিনয় করে, কিন্তু তাহারা সাহায্য না করিয়া বরং সে কন্যার বিদ্যালয়-প্রবেশের বাধা প্রদান করিয়াছিল—শুনিতে পাই। এই বিনোদিনীর তীব্র কটাক্ষের কারণ। কিন্তু নিজ জীবনীতে উক্তরূপ কঠোর লেখনীচালন না হইলেই ভাল ছিল। যে পাঠক এই জীবনী পাঠ করিবেন, শেষোক্ত লেখনীর কঠোরতায়, প্রারম্ভে যে সহানুভূতি প্রার্থনা আছে, তাহা ভুলিয়া যাইবে।

 এই ক্ষুদ্র জীবনীতে অনেক স্থলে রচনাচাতুর্য্য ও ভাব-মাধুর্য্যের পরিচয় আছে। সাধারণের নিকট কিরূপ গৃহীত হইবে— জানি না, কিন্তু আমার স্মৃতিপথে অনেক ঘটনাবলী হর্ষশোকবিজড়িত হইয়া বিস্মৃত স্বপ্নের ন্যায় উদয় হইয়াছিল।

 উপসংহারে আমার সাধারণের নিকট নিবেদন যে, যিনি বঙ্গরঙ্গালয়ের আভ্যন্তরিক অবস্থা কিরূপ, জানিতে চাহেন, তিনি সে সম্বন্ধে অনেক কথা জানিতে পারিবেন ও ইচ্ছা করিলে বুঝিতে পারিবেন যে, অভিনেতা ও অভিনেত্রীর জীবনপ্রবাহ সুখদুঃখে জড়িত হইয়া সাধারণের কৃপাপ্রার্থনায় অতিবাহিত হয় এবং সাধারণের আনন্দের নিমিত্ত জীবন উৎসর্গ করিয়াছে, এই সর্ত্তে সাধারণকে তাহাদের ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্র দুই একটি কথা শুনাইবার দাবি রাখে। যে সহৃদয় ব্যক্তি এ দাবি স্বীকার করিবেন, তিনি এ ক্ষুদ্র কাহিনী পাঠে কৃপা প্রার্থিনী অভিনেত্রীর নাট্যজীবন বর্ণনার প্রথম উদ্যম কৃপাচক্ষে দৃষ্টি করিবেন।

শ্রীগিরিশচন্দ্র ঘোষ।

Book Content

অঙ্কুর
রঙ্গালয়ে প্রবেশের সূচনা
রঙ্গালয়ে
বেঙ্গল থিয়েটারে
ন্যাশন্যাল থিয়েটারে
স্টার থিয়েটার সম্বন্ধে নানা কথা
শেষ সীমা
প্রথম খণ্ডের শেষের দুটী কথা
বইয়ের ধরন: আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা

সত্যজিৎ রচনাবলী – ৮ / সত্যজিৎ রায়

কবিতাসমগ্র ২ - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতাসমগ্র ২ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

সত্যজিৎ রচনাবলী – ৬ / সত্যজিৎ রায়

পিপুল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.