• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

৩১. অশান্তির ছায়া

লাইব্রেরি » কাজী আনোয়ার হোসেন » ৩১. অশান্তির ছায়া
Current Status
Not Enrolled
Price
Free
Get Started
Log In to Enroll

৩১. অশান্তির ছায়া [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]

কুয়াশা ৩১

প্রথম প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১

এক

–

চৌধুরী পরিবারে বাহ্যত কোন অশান্তি ছিল না।

. চৌধুরী সাহেবের বয়স হয়েছে। দুই ছেলের পিতা তিনি, এবং তিন মেয়ে তার বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। তিন মেয়ের মধ্যে দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে । ছোট ছেলে এবং ছোট মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে, কিন্তু এদের দুজনের বিয়ে। তাড়াতাড়ি হবে বলে মনে হয় না। তা না হোক, সে ব্যাপারে চৌধুরী সাহেবের বিশেষ কোন মাথা ব্যথা নেই আপাতত। ছোট ছেলের ব্যাপারটা হল এই যে সে

এখনও চঞ্চল। আর ছোট মেয়েটি এখনও পড়াশোনা করছে। ‘

খারাপ অবস্থা থেকে জীবন শুরু করেছিলেন চৌধুরী সাহেব। খারাপ অবস্থা থেকে ভাল অবস্থায় পৌঁছেছেন তিনি। জীবনে কষ্ট করলে প্রতিদান পাওয়া যায়ই। চৌধুরী সাহেব জীবনে কোনদিন চাকরি করেননি। খাওয়া আর কষ্ট গেছে দিনের পর দিন, তবু চাকরি করার মনোবৃত্তি শিকড় গাড়েনি কোনদিন তার মধ্যে। ব্যবসার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের শুরু। হোক স্বল্প পুঁজি, তবু তো নিজের ব্যবসা। ‘ ধীরে ধীরে, অধ্যবসায় এবং পরিশ্রমের ফলশ্রুতি হিসেবে চৌধুরী সাহেব বড় হয়েছেন। প্রচুর টাকা রোজগার করেছেন তিনি। ব্যাঙ্কে নগদ টাকা রয়েছে লাখখানেক। ছোটখাট একটা ইণ্ডাস্ট্রি দাঁড় করিয়েছেন তিনি। আজ বয়স হয়েছে। নিজে আর কারখানা দেখাশোনা করতে পারেন না। ছেলে উপযুক্ত হয়েছে। সে-ই দেখাশোনা করে। বড় ছেলের প্রতি তার অগাধ আস্থা। এমন ছেলে বড় একটা দেখা যায় না। সংসারী, মিতব্যয়ী, শান্ত প্রকৃতির। চৌধুরী সাহেবের বড় ছেলের বিয়েও দিয়েছেন তেমনি দেখে। গরীবের মেয়েকে ছেলের বউ করে এনেছেন তিনি। সুন্দরী বউ। সংসারী বউ। | মেয়ে দুটোর বিয়ের ব্যাপারেও একটু বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন চৌধুরী সাহেব। দুই মেয়েরই বিয়ে দিয়েছেন ভাল এবং আত্মীয়স্বজনহীন দুই ছেলে লেখে। মেয়েদের দূরে পাঠিয়ে দিতে হবে বিয়ে দিয়ে, এ চিন্তা দুর্বল করে ফেলত চৌধুরী সাহেবকে। তাই নিজের বাড়ির দুই পাশে দুই জামাইকে চমঙ্কার দুটো বা বানিয়ে দিয়েছেন। দুই জামাই সেই বাড়ি দুটোতেই বসবাস করে সানন্দে । ছোট মেয়ের জন্যেও জমি রাখা আছে।

কুয়াশা-৩১

জামাইদের মধ্যে বড় জামাইটার অবস্থা একটু খারাপ। খারাপ আগে ছিল না। কারবারে ফেল মেরে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। চাকরি করে এখন। মেজ জামাই একটা হোটেল অ্যান্ড বারের অংশীদার এবং ম্যানেজা। ভাল আয় তার। দুই জামাইয়ের চরিত্র দেখেই বিয়ে দিয়েছেন চৌধুরী সাহেব। বড় জামাই আজকাল কেমন যেন বিরস মুখ করে থাকে বটে, কিন্তু আগে সে এমনটি ছিল না। ছোট জামাই আগের মতই আছে। দিলদরিয়া, উদার, হাসি খুশিতে ভরপুর।

বড় ছেলের খোকা হয়েছে একটা। নাতিকে নিয়েই আজকাল চৌধুরী সাহেবের সারাদিন কাটে। রাতে পড়াশোনা করেন। আনন্দময়, স্বস্তিময় জীবন। সুখী মানুষ তিনি। কোথাও কোন সমস্যা নেই। কোথাও কোন অশান্তি নেই।

কিন্তু চৌধুরী সাহেবের ‘হ্যাপি কটেজ’-এ সমস্যার এবং ভীতিকর মারাত্মক অশান্তির আগুন তলে তলে বিস্তার লাভ করছিল। প্রথমে যে ঘটনাটি সূচনা হিসেবে লক্ষ করা যায় সেটি হল বড় জামাইয়ের টাকা প্রার্থনা। শ্বশুরের কাছ থেকে কিছুদিন ধরে দশ হাজার টাকা চেয়ে আসছে বড় জামাই রুহুল আমিনু। নতুন করে ব্যবসা আরম্ভ করতে চায় সে। চৌধুরী সাহেব এখনও কোন কথা দেননি। শাশুড়ি কিন্তু টাকা দেবার পক্ষে। কিন্তু রুগ্ন স্ত্রীর চেয়ে চৌধুরী সাহেব, বড় ছেলে সালাম চৌধুরী এবং ছোট ছেলে জামাল চৌধুরীর মতামতের দাম বেশি দেন। ছেলেরা তার বড় হয়েছে । সংসারের ভালমন্দ নির্ধারণ করবে এখন তারাই। তাদের কথা ফেলে রুগ্ন স্ত্রীর কথায় বড় জামাই রুহুল আমিনকে এককথায় দশ হাজার টাকা দিয়ে, দিতে পারেন না চৌধুরী সাহেব। দুই ছেলেই টাকা দেবার ব্যাপারে ঘোর বিরোধী। মেজ জামাই আবদুর রশিদকে নিয়ে কোন সমস্যাই নেই। যদিও বড় জামাইকে টাকা দিলে সে-ও দাবি করবে না এমন নয়।

এই পরিবারটির অভ্যন্তরে গোপনীয় আরও কয়েকটি কারণ সৃষ্টি হয়েছে, যে কারণগুলো মারাত্মক আগুন জ্বালবে. অচিরেই। বড় জামাই তার জীবনের একমাত্র মূল্যবান একটি জিনিস হারাতে যাচ্ছে। মেজ জামাই হোটেল অ্যাণ্ড বারে চাকরি করে, সুতরাং মদ্যপান করে এবং বেআইনী উপায়ে তার রোজগার প্রচুর। ছোট ছেলেও মদ পান করে, জুয়া খেলে। ছোট মেয়ে ফিরোজা করে প্রেম। পাড়ারই একটি গরীব অথচ স্বাস্থ্যবান, বেপরোয়া, উদ্যমী, সপ্রতিভ এবং প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর এক যুবকের সঙ্গে। যার অনেক বদনাম এবং যার সম্পর্কে পাড়ার বয়স্ক লোকেরা কঠোর ভূমিকা পালন করে থাকেন। এছাড়া বড় ছেলে তার শ্বশুর এবং শাশুড়িকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য করে আসছে মা-বাবার অজান্তে। এসব কারণ এবং এসব ঘটনার কথা প্রকাশিত নয় চৌধুরী সাহেবের কাছে। শুধু চৌধুরী সাহেবের বেলায় একথা খাটে না, খাটে অনেকের বেলাতেই। কেউ একটা কথা জানে, বাকিগুলো জানে না। বেশির ভাগই জানে না কেউ। পরস্পরের চরিত্র এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে পরস্পর প্রায় অজ্ঞই বলা চলে।

ভলিউম-১১

সেদিন ছোট ভাই জামাল কলেজ থেকে ছোট বোন ফিরোজাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। গাড়ি করেই ফিরছিল ওরা। জামাল গিয়েছিল ফ্যাক্টরিতে। বড়দার কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে বাড়ি আসার পথে কলেজ থেকে তুলে নিয়েছিল ফিরোজাকে।

দুই ভাই বোন অনর্গল গল্প এবং হাসিতে মশগুল হয়ে ফিরছিল। দু’জনের কেউই ভাবেনি একটু পর কি থেকে কি ঘটবে । পাড়ার ভিতরে ঢুকে পড়েছিল গাড়ি। পাড়ার ক্লাবের পাশ ঘেঁষে ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল গাড়িটা। ক্লাবের দরজায় এসে দাঁড়াল লম্বা, ফর্সা, স্বাস্থ্যবান শফিক। উজ্জ্বল, সপ্রতিভ দুটি চোখ শফিকের।.পাড়ার স্কুল-কলেজের ছাত্ররা শফিকদা বলতে অজ্ঞান। পাড়ার ক্লাব তথা লাইব্রেরির স্রষ্টা। পাড়ার প্রাণ এই শফিক। অন্যায়, অবিচারের যম। দরকার হলে গুরুজনদেরকেও শাসিয়ে দেয়। মারামারিতেও ওস্তাদ। বয়স্ক ডানপিটেই বলা যায়। এই শফিকই চৌধুরী বাড়ির ছোট মেয়ে ফিরোজার প্রেমিক।

ক্লাবের দরজায় দাঁড়িয়ে ফিরোজার দিকে তাকিয়ে রইল শফিক। ফিরোজা তাড়াতাড়ি মুখ নামিয়ে নিল লজ্জায়। ছোটদা দেখে ফেললে সব জানাজানি হয়ে যাবে এই ভয়ে। শফিক ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দুষ্টুমি করে একটু শব্দ করেই হেসে ফেলল। সেই হাসির শব্দে গাড়ি চালাতে চালাতে জামাল তাকাল শফিকের দিকে। শফিক তখনও হাসছে ঘাড় ফিরিয়ে ফিরোজার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ কি

যে হল, পা থেকে মাথা অবধি আগুন জ্বলে উঠল জামালের। রাগে লাল হয়ে উঠল তার মুখের চেহারা। এই ছোকরা যে পাড়ার হিরো তা সে জানে। ছোকরার হাবভাব তার কোনদিনই ভাল ঠেকেনি। আজ তার ছোট বোনের দিকে বেহায়ার মতো তাকিয়ে হাসছে দেখে আগুন জ্বলে উঠল তার সর্বশরীরে। কি করবে ভেবে

পেয়ে ব্রেক কষে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ফেলল ‘জামাল। ফিরোজা কিছু একটা সন্দেহ করে প্রায় আঁতকে উঠে জানতে চাইল, কি হল, ছোটদা!

পঁড়া, হারামজাদাটাকে শিক্ষা দিয়ে দিই! মেয়েছেলের দিকে তাকিয়ে হাসা ওর আমি বের করছি!’

জামাল ঝট করে খুলে ফেলল গাড়ির দরজা। ফিরোজা চমকে উঠে ধরে ফেলল জামালের হাত। বলে উঠল, ‘এই ছোটদা, তোমার দুটো পায়ে ধরি দাঁড়াও!’

জামাল ফিরোজার হাতটা ছাড়িয়ে নিল ঝাঁকানি দিয়ে। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে সে। হন হন করে এগিয়ে যাচ্ছে সে ক্লাবটার দিকে।

ক্লাবের দরজায় শফিক তখনও দাঁড়িয়ে আছে। বিমূঢ় আকার নিয়েছে [এমধ্যে তার মুখ। ফিরোজার দিকে তাকিয়ে সে হেসেছে এবং ওর ছোটদা তা 1.পথে ফেলে রেগে গেছে, এটুকু বুঝতে না পারার কথা নয়। কিন্তু শফিক

নক কিছু একটা আশঙ্কা করেনি। বড় জোর দুকথা রাগের মাথায় শুনিয়ে

ক

-৩১

চলে যাবে জামাল চৌধুরী, এই ভেবেছিল সে। কিন্তু জামাল সরাসরি তার সামনে দাঁড়িয়েই শার্টের কলার চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল, ‘তোকে কেউ কিছু বলে না বলে মাথায় চড়ে গেছিস, নারে বাঁদর! মেরে হাড়-গোঁড় গুড়ো করে দিতে পারি, তা জানিস!

| শফিক প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল । জামাল চৌধুরী যে তাকে এভাবে সম্বোধন করে তার শার্টের কলার চেপে ধরে ঝাঁকানি দেবে তা সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ক্লাবের দরজার উপর থেকে টেনে রাস্তায় নামিয়ে আনল জামাল তাকে। ক্লাবের ভিতর থেকে চার পাঁচজন যুবক ছুটে এল। তাদের শফিকদাকে কেউ মারধর করছে, এ যে অবিশ্বাস্য!

শফিক বিমূঢ়তা কাটিয়ে উঠল। অপমানে গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে তার । থমথমে গলায় ও শুধু বলে উঠল, ‘শার্ট ছাড়ুন আমার । যা বলতে চান, ভালভাবে বলুন।’

| মেয়েদের দিকে তাকিয়ে হারামীপনা করা হয়, তোর সাথে আবার ভালভাবে কি কথা বলব রে, হারামজাদা!’ | চিৎকার করে উঠল জামাল। সঙ্গে সঙ্গে বসিয়ে দিল প্রচণ্ড এক ঘুসি শফিকের মুখে । গাড়ির দরজা খুলে ফিরোজা সেই সময়ই বের হয়ে এল। আর্তকণ্ঠে ককিয়ে উঠল, ‘ছোটদা, তুমি…!’

শফিক এবং জামালকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে কয়েকজন যুবক। শফিক অনড় দাঁড়িয়ে আছে। জামাল অনর্গল গালাগালি দিয়ে চলেছে। হঠাৎ এলোপাতাড়িভাবে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিল শফিকের গালে। দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করছে শফিক। মাঝে মাঝে সে শুধু তাকাচ্ছে ফিরোজার দিকে। যা ঘটেছে তার এক হাজার ভাগের এক ভাগও সহ্য করার ছেলে নয় শফিক। তবু আজ তাকে সয়ে যেতে হচ্ছে এত ‘মারাত্মক এবং দুঃসাহসিক অপমান। সে কেবল ফিরোজার খাতিরে। ফিরোজার ভাই না হলে এতক্ষণ জামাল চৌধুরীকে পাওয়া যেত না, তার লাশ পড়ে থাকত রাস্তার ওপর। | ফিরোজা ভিড় ঠেলে এগোতে চাইছে। রীতিমত কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে সে। কিন্তু যুবকদল তাকে পথ করে দিচ্ছে না। জামাল চৌধুরীকে পালাবার সুযোগ করে দিতে রাজী নয় । শফিকের একটা ইঙ্গিতের জন্য শুধু অপেক্ষা করছে ওরা। ইঙ্গিত পেলেই খতম করে ফেলবে জামাল চৌধুরীকে। .।

| শফিক আবার মৃদু স্বরে শার্ট ছেড়ে দিতে বলল জামালকে। নাক থেকে রক্ত গড়িয়ে শার্ট ভিজে গেছে শফিকের। জামাল বারবার দাবি জানাচ্ছে, মাফ চা মামার কাছে, তা না হলে খুন করে ফেলব বলছি!’

এমন সময় জামালের দুই ভগ্নিপতি বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ল। ভিড় ঠেলে ওদের দুজনের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। প্রথমেই দু’জনে মিলে ওদেরকে ছাড়িয়ে

ভলিউম-১১

নিল। তারপর কারণ জিজ্ঞেস করবার পালা। একতরফা কথা বলে গেল জামাল। শফিক একটি কথাও উচ্চারণ করল না। জামালের দিকে শুধু তাকিয়ে রইল সে। তার বিস্ময় এখনও কাটেনি যেন। যুবকদের মধ্যে সকলেই জামালের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশ করল। বড় ভগ্নিপতি রুহুল আমিন বলল, এ কাজ করা উচিত হয়নি মোটেই। মারামারি না করাটাই উচিত ছিল। এক পাড়ায় বাস করি আমরা সবাই, কেউ কোন অন্যায় আচরণ করলে তার বিচার করা উচিত।’ “ মেজ জামাই কিন্তু উল্টো কথা বলল। ফোঁস করে উঠে বলে উঠল সে, বিচার আবার কিসের, শুনি? মেয়েদের দেখে শয়তানি করার মজা বুঝিয়ে না দিলে এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করবে না? ঠিক করেছে জামাল, কয়েকটা দাঁত ভেঙে দিতে পারলে আরও ভাল হত।’

পাড়ার বয়স্ক লোকেরা ইতিমধ্যে ঘটনাস্থলে জমায়েত হয়েছেন। তাঁরা মেজ জামাইকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। প্রকৃতপক্ষে মেজ জামাইকে সমর্থন করলেন তারা। শফিক এবারও মুখ খুলল না। যাই হোক, দুই ভগ্নিপতি জামাল এবং ফিরোজাকে নিয়ে ফিরে এলেন বাড়িতে। মেজ জামাই ফেরার পথে বারবার বলতে

লাগল, “ঠিক করেছ তুমি জামাল, হারামজাদাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছ।’

বড় জামাই শুধু বলল, “মোটেই ভাল কাজ হয়নি এটা। বড় সাঙ্ঘাতিক প্রকৃতির, ছেলে সে। জামাল, তুমি রাত করে বাড়ি ফেরো,বলা যায় না কি সর্বনাশ ও করে বসে তোমার । সাবধানে চলাফেরা করো তুমি ক’দিন।’

জামাল বড় ভগ্নিপতি রুহুল আমিনের কথাটা হেসেই উড়িয়ে দিল।

এ ব্যাপারটা বাড়িতে বিশেষ আর আলোচিত হল না। প্রতিক্রিয়া যা হল তা কেবল ফিরোজার। খেল না ও দুপুরবেলা। ভাবী জিজ্ঞেস করাতে দরজা খুলল বটে, কিন্তু শরীর ভাল নয় বলে এড়িয়ে গেল। মেজ জামাই আবদুর রশিদ একবার ঢুকল ফিরে জার ঘরে । ছোট শালীর সঙ্গে রসিকতা করে বলল, “বাপরে বাপ, রাস্তার একটা বখাটে ছেলের জন্যে ছোট রানীর এমন কান্না! আমি তো ভাবলাম কিনা কি। তা ফিরোজা, কোন মেন্টাল উইকনেস ফিল করছ নাকি ছোকরা সম্পর্কে? সাবধান কিন্তু, ওসব দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়ো না। মেয়েরা ঝটপট প্রেমে পড়ে যায় এরকম পরিস্থিতিতে।’

| ফিরোজা কথা না বলে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ল। হাঃ হাঃ করে বাড়ি মাত করা, হাসি হেসে আবদুর রশিদ ফিরে গেল পাশের বাড়িতে। পাশের বাড়ি বলা চলে। বটে, কিন্তু তিনটে বাড়ির সদর দরজা একটিই। আসলে বাড়ি একটাই। তিনভাগে ভাগ করা। কোন দেয়ালও নেই, যা আলাদা করে রাখতে পারে বাড়িটাকে।

বিকেল বেলা দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটা ঘটল। | বড় জামাই রুহুল আমিন আজ এক সপ্তাহ পর আবার শ্বশুর সাহেবের ঘরে পদার্পণ করল। উদ্দেশ্য সেই দশ হাজার টাকা প্রার্থনা। বিকে-র চা পান কুয়াশা-৩১

করছিলেন চৌধুরী সাহেব। রুহুল আমিন ঘরে ঢুকে মৃদু কণ্ঠে বলল, আমার টাকার কি হবে, আব্বা?’ | চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন চৌধুরী সাহেব । হঠাৎ মুখের ভিতরটা তেতো স্বাদে ভরে গেল। মহা মুশকিলে পড়েছেন তিনি। ছেলেরা বড় জামাইকে টাকা দেবার বিপক্ষে। অথচ কথাটা তিনি জামাইয়ের মুখের উপর বলতে পারেন না। চৌধুরী সাহেব চুপ করে রইলেন। বড় জামাই এবার একটু অভিমানী কণ্ঠে বলে উঠল, আমাকে আপনাদের দেবার কথা ছিল তো অনেক কিছুই। কি দিয়েছেন বলুন? দরকারের সময় যদি না পাই, তাহলে আমার ভাগ্য খারাপ বলতে হবে । আমাকে কিন্তু গাড়ি দেবার কথা আপনাদের ছিল, আমিই নিতে চাইনি। তখন গাড়ি আমারই ছিল। গাড়ির বদলে টাকাটা দিচ্ছেন মনে করুন।’

চৌধুরী সাহেব মুখ খোলার আগেই ছোট ছেলে জামাল ঢুকল ঘরে। সে শুনেছে বড় ভগ্নিপতির কথাগুলো। সকালবেলা অযাচিতভাবে উপদেশ দিয়েছিল। বলে মেজাজ তার এমনিতেই তিক্ত হয়ে আছে। তার উপর আবার আব্বার কাছ থেকে টাকা চাইতে এসেছে বুঝতে পেরে ঘৃণা জাগল মনে লোকটা সম্পর্কে। তাছাড়া আজ তার নিজেরই শ’দুয়েক টাকা দরকার। বড়দার কাছে চেয়ে পায়নি। আব্বার কাছ থেকে আদায় করার ইচ্ছা তার। সেজন্যেই এমন সময় আব্বার ঘরে প্রবেশ তার। এদিকে ঘৃণিত লোকটা আগেই নিজের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টায় পায়তারা কষতে শুরু করে দিয়েছে।

ঘরে পা দিয়ে জামাল আব্বার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, আমিনদাকে তুমি কথাটা পরিষ্কার করে বলে দাওনি কেন, আব্বা! বড়দা তোমাকে সেদিন বলল না যে কারবারের অবস্থা বিশেষ ভাল নয়, এখন টাকা-পয়সা দেয়া যাবে না।’

আজ নতুন শুনলাম কারবারের অবস্থা খারাপ। কই, এতদিন তো শুনিনি একথা । আমাকে টাকা দেবার বেলাতেই…।’

রুহুল আমিন গম্ভীর কণ্ঠে অভিযোগ করে যাচ্ছিল। চৌধুরী সাহেব কথা বলে উঠলেন, “তোমার কি ধারণা বলো তো আমিন, সালাম কি তাহলে মিথ্যে কথা বলেছে?’

জামাল বলে উঠল, কারবারের অবস্থা সত্যি খারাপ। একথা কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক।’

রুহুল আমিন বলে উঠল, তাতেই বা কি হয়েছে! আজ খারাপ কাল ভাল হবে, কারবারের যা নিয়ম। আমাকে টাকা না দেবার কারণটা তো দেখছি না।’

জামাল মন্তব্য কর, দশ হাজার টাকাও তো মুখের কথা নয়। চাইলেই দেয়া

যায়?

| ‘অন্যায়ভাবে কি চাইছি আমি? গাড়ি দেবার কথা ছিল কিনা মনে করে দেখো

ভলিউম-১১

১০

একবার।’

চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘গাড়ি দেবার কথাটা বারবার তুলে কি লাভ বলো। গাড়ি আমি দেব বলেছিলাম শখ করে। দেনা পাওনার বাইরে ছিল ও কথাটা। তা দিলেও কি নতুন গাড়ি দিতে পারতাম? চার পাঁচ হাজারের পুরানো একটা গাড়ি কিনে দিতাম । তা সে সময় তুমি রাজী হলে না হয় দিতামও। এখন সে কথা তুলে কি হবে।’

জামাল বলল, তাছাড়া বাড়ি দেবার কথাও ছিল না। দেয়া হয়েছে। এরপর পাওনা আছে মনে করে টাকা চাওয়াটা কেমন কথা বুঝি না।’

বড় জামাই ছোট শালার শত্রুতামূলক কথাবার্তা সহ্য করতে না পেরে বলে উঠল, তুমি কেন আমাদের মাঝখানে ফুট কাটতে এসেছ, জামাল? তুমি চুপ করে থাকো।

চৌধুরী সাহেব ছোট্ট মন্তব্য করলেন একটা, আহা, রাগারাগি কেন আবার । কথা তো মিটেই গেল। কারবারের অবস্থা ভাল হলে তোমার কথা না হয় ভেবে দেখা যাবে। এত তাড়াতাড়ি কি কোন কাজ হয়!’

রুহুল আমিন শ্বশুর সাহেবের চালাকী ধরতে পেরে মরিয়া হয়ে বলল, “টাকা তো আজকে থেকে চাইছি না। এতদিন আমায় আশায় রেখে আজ হঠাৎ “না” বলে দেয়াটা কি উচিত হল আপনাদের?

‘কে আশা দিয়েছিল আপনাকে! আর উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন তুলতে খারাপ লাগল না আপনার, আমিনদা?’ জামাল চটে উঠে বলল।

রুহুল আমিন এবার চিৎকার করে উঠল প্রায়, আবার তুমি কথা বলছ আমাদের মাঝখানে?’ | জামালও চেঁচিয়ে উঠে বলল, একশোবার বলব। টাকা পয়সা সবই তো আমাদের, আমরা মতামত দেব না তো কে দেবে শুনি? শেষ কথা জেনে রাখুন, টাকা আমরা আপনাকে দেব না ঠিক করেছি। বুঝলেন?’

“বেশ! দেখে নেব আমি!’

চরম উত্তেজনায়, অপমানে, লজ্জায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে ঝড়োবেগে বের হয়ে গেল বড় জামাই রুহুল আমিন কথাগুলো বলে।

বড় জামাই ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতেই মেজ জামাই আবদুর রশিদ চিন্তিত মুখে ঘরে ঢুকল। আবদুর রশিদ পারিবারিক অশান্তির ঘোর বিরোধী। সব সমস্যা পারস্পরিক সহনশীলতার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলারই পক্ষপাতি সে। এই ত্রিকোণাকৃতি পরিবারে এমন গুণ তারই শুধু আছে। ফলে সকলের আস্থা তার, উপর। ছোট শালার মুখে সব কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনল সে। বিচলিত দেখাল তাকে। জামাল যে বড় ভগ্নিপতিকে রীতিমত অপমান করে ফেলেছে তা বুঝতে বাকি রইল না তার। কথাটা সে জামালকে বলতেও কসুর করল না, আমাদের

কুয়াশা-৩১

১১

সম্মানী লোক উনি। ওঁর সাথে সম্মান বজায় রেখে কথা বলা উচিত আমাদের

সকলের! তাই না, জামাল?’ | জামাল অভিযোগ করল, কিন্তু সব জিনিসের একটা সীমা আছে, রশিদদা । কই, আপনি তো কোনদিন একটা পয়সা চাননি। কই, আপনার সাথে তো কারও মন কষাকষি হয় না।

আবদুর রশিদ বলে উঠল, সব মানুষকে সমান চোখে দেখো না, জামাল। উনি খারাপ মানুষ একথা বলা অপরাধ, কথাটা সত্যি নয়। বিপদে পড়লে ভাল মানুষও খারাপ হয়ে যেতে বাধ্য হয়। চলো, ঝগড়া করে বসে থাকা উচিত নয়, | তোমাদের মিল করিয়ে দিই।’

আব্দুর রশিদের কথা, আগ্রাহ্য করা জামালের পক্ষে অসম্ভব। শুধু জামালের কাছেই নয়, এ বাড়ির সকলের কাছেই মেজ জামাই আবদুর রশিদ শ্রদ্ধা, ভালবাসার পাত্র। এর কথা ফেলা অসম্ভব।

কিন্তু বড় জামাই রুহুল আমিনের ঘরে গিয়ে দেখা গেল সে বের হয়ে গেছে। বাইরে । ব্যাপারটা স্থগিত রইল আপাতত । প্রকৃতপক্ষে চিরতরে।

সন্ধ্যার পর, রোজকার মতন হোটেল অ্যাণ্ড বারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল মেজ জামাই আবদুর রশিদ। গভীর রাতে ফিরবে সে। জামালও বের হল ঘন্টা দেড়েক পর । আব্বার কাছ থেকে টাকা চেয়েছিল, সে একশো পায়নি। মেজাজ গরম নিয়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে সে। ফিরোজা দুপুর থেকে দরজা বন্ধ। করে ছিল। মাঝে একবার বের হয়েছিল বুঝি । তারপর দরজা-জানালা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে শুধু বাড়ির বড় মেয়ে সালমাও আজ কান্নাকাটি করেছে। স্বামীকে আব্বা এবং ছোট ভাই মিলে, অপমান করেছে এ লজ্জা ঢাকবার আর উপায়ই বা কি, সে তো মেয়েছেলে মাত্র। মেজ মেয়ে ফাহমিদা বড় বোনের ঘরে এসে বোঝাবার চেষ্টা করেছে। তাতে কাজ হয়নি কোন । ভাবী রাহেলাও বড় ননদের ঘরে গিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছে। শাশুড়িও খবর নিয়েছে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বড় মেয়ের। চৌধুরী সাহেব অসুস্থ স্ত্রীকে বিছানা থেকে উঠতে দেননি। তা

হলে মেয়েকে গিয়ে স্বয়ং বুঝিয়ে-পড়িয়ে কান্নাকাটি করে মানসিক কষ্ট বাড়াতে মানা করে আসতেন।

মেজ জামাইয়ের ফেরবার কথা গভীর রাতে। কিন্তু রাত আটটার সময়ই সে আজ ফিরে এল। ফিরেই বাড়ি মাত করে তুলল সে স্বভাবসিদ্ধ হাস্য-কৌতুকে। বাড়ির সুবগুলো মেয়েছেলেকে ডেকে জড়ো করল সে ছোট শালীর ঘরে। মেজ জামাইয়ের ডাক শুনে আসবে না কেউ এমন হতেই পারে না। খোলামেলা মানুষকে সবাই ভালবাসে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেজ জামাই আবদুর রশিদ ঘোষণা করল, সিনেমায় যাব আমরা সবাই। এই যে, টিকিট পর্যন্ত কিনে এনেছি।’ | সত্যি তাই। পাঁচটা ডি.সি’র অ্যাডভান্স টিকিট করে নিয়ে এসেছে সে।

. ভলিউম-১১

টিকিটগুলো রক্সি সিনেমা হলের। ন’টা-বারোটা শো। ইংরেজি ছবি। একটা সামাজিক কাহিনী অবলম্বনে তৈরি।

মেজ জামাইয়ের এত পরিশ্রম কিন্তু ব্যর্থ হল। এমনিতেই নানারকম অশান্ত সকলের মনে। তার উপর সিনেমায় গিয়ে আনন্দ করার প্রস্তাবটা গ্রহণযোগ্য হল

কারও কাছেই। মেজ মেয়ের রাজি রাজি ভাব দেখা গেল। কিন্তু একে নাইট শশা, তার উপর ইংরেজি ছবি। তাছাড়া কেউ যখন যেতে রাজি নয় তখন তারও যাবার সাধ রইল না। মেজ জামাই বহু চেষ্টা করল । কিন্তু রাজি করাতে পারল না কাউকে। রীতিমত নিরাশ হয়ে পড়ল বলে মনে হল। মনক্ষুণ্ণতার কারণ অবশ্যই আছে। বাড়িতে অশান্তি দেখেই সকলকে একটু আনন্দ দিয়ে স্বাভাবিক করতে চেয়েছিল সে পরিবেশটা। কিন্তু কোন কাজ হল না। অগত্যা একটু রেগে উঠেই সে বলে উঠল, “ঠিক আছে, কেউ না যাক, আমি একাই যাব।’

চলে গেল সে পৌনে ন’টার সময়। | বাড়ির বড় ছেলে সালাম চৌধুরী ফিরে এল রাত সাড়ে দশটায়। সন্ধ্যার পর কোথায় যেন বেরিয়েছিল সে। বড় জামাই ফিরল এগারোটায়। মেজ জামাই সিনেমা দেখে ফিরল সোয়া বারোটায়। রাত শেষ হতে চলেছে অথচ ছোট ছেলে

জামালের বাড়ি ফেরার নাম নেই।

রাতটা কেটে গেল। সকালে সকলে জানতে পারল জামাল গতরাতে বাড়ি | ফেরেনি। খুব একটা চিন্তিত অবশ্য কাউকেই মনে হল না। জামাল আজকাল

প্রায়ই বাইরে রাত কাটায়।

কিন্তু কোন কোন রাত বাইরে কাটালেও পরদিন সকাল বেলাতেই বাড়ি ফিরে জামাল। আজ কিন্তু সকাল পেরিয়ে দুপুর হল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল এবং বিকেল উতরে সন্ধ্যা হয়ে গেল–তবু বাড়ি ফিরল না জামাল। দুশ্চিন্তার কথা । সকলেই বলাবলি করতে লাগল ওর আচরণ সম্পর্কে। শয্যাশায়িতা মায়ের দুশ্চিন্তাই সবার চেয়ে বেশি। মেজ জামাই বারবার করে শাশুড়ির পাশে গিয়ে বসছে। দুশ্চিন্তা করতে মানা করছে। কিন্তু মায়ের মন, বিপদের কথা অনুভব করতে পারে। রীতিমত কান্নাকাটি শুরু করছেন তিনি জামাইয়ের হাত ধরে। বললেন, না বাবা, তোমরা বুঝতে পারছ না। আমার মন বলছে জামালের কোন বিপদ হয়েছে।

মেজ জামাই চিন্তিত ভাবে বড় জামাই রুহুল আমিনের ঘরে এল। বলল, কি করা যায় বলুন দেখি। জামাল তো কখনও এমন করে সকলকে দুশ্চিন্তায় ফেলে।

–

–

–

–

–

–

| বড় জামাইয়ের রাগ আজও মেটেনি। সে বিরক্ত হয়ে এবং প্রায় বেঁকিয়ে উঠেই বলে বসল, দুশ্চিন্তায় ফেলেছে তো আমি কি করব? ওর কোন ব্যাপারে আমি আর নেই।’

মেজ জামাই একাই গেল ছোট শালা জামালের খোঁজ করার জন্যে। বড় ছেলে সালামকে ফোন করলেন চৌধুরী সাহেব। সালাম অফিস থেকেই জামালের বন্ধু বান্ধবের কাছে খবর জানার জন্যে গেল। কেউ কোন খবরই দিতে পারল না। জামালের। গতকাল থেকে কোন বন্ধুই জামালকে দেখেনি। সালাম ঘাবড়ে গেল। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এল সে। রাত তখন আটটা। মেজ জামাই ব্যর্থ হয়ে ফিরল রাত দশটায় । জামালকে তো পাওয়া যায়নি-ই, তার খবরও দতে পারেনি কেউ। | চৌধুরী সাহেব শুকনো মুখে মের্জ জামাই এবং বড় ছেলেকে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন। বড় জামাই এল না। বড় মেয়ে একবার এল অবশ্য। তবে সে

কোন কথা বলল না কারও সঙ্গে।

| রাত এগারোটায় সালাম এবং আবদুর রশিদ এক সঙ্গে আবার বের হল। হাসপাতালগুলোতে খবর নেয়া দরকার। বলা যায় না, কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে হয়ত জামাল।

বড় মেয়ে এল আর একবার। সে ফিরে গিয়ে স্বামীকে কি বলল কে জানে। তবে শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করল সে একবার। তারপর বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। বলে গেল, থানায় খবর দেয়া দরকার, খবরটা দিয়ে আসি আমি।

| রাত সাড়ে এগারোটা। ফোনটা চৌধুরী সাহেবের ঘরেই। সেটা অশুভ সঙ্কেত জানিয়ে অকস্মাৎ বেজে উঠল । ত্রস্ত হাতে রিসিভার তুলে নিয়ে চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘হ্যালো!’

অপরপ্রান্ত থেকে উত্তর এল, ‘আপনাদের বাড়ির ছোট মেয়ে ফিরোজাকে ডেকে দিন একবার। | চৌধুরী সাহেব হতবাক হয়ে বলে উঠলেন, কিন্তু আপনার পরিচয় কি বলুন দেখি । ফিরোজার সাথে কি কথা আপনার?’

অপরপ্রান্ত থেকে অজ্ঞাত পরিচিত পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠল বিরক্তভরা গলায়, আপনি আমাকে চিনবেন না। ফিরোজা চিনবে। যা বলছি, ডেকে দিন ফিরোজাকে। ওকেই বলতে হবে কথাটা।’

রীতিমত খেপে যাবার কথা চৌধুরী সাহেবের । খেপেই গেলেন । কিন্তু কি মনে করে রিসিভারের মাউথপিসটা হাত দিয়ে চেপে জোর গলায় মেয়ের নাম ধরে ডাকলেন দু’বার। ফোলা ফোলা মুখ নিয়ে ফিরোজা আব্বার ঘরে ঢুকল। চৌধুরী সাহেব মেয়ের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলে উঠলেন, “তোকে এত রাতে ফোন করে কে রে! বলে আপনাদের বাড়ির ফিরোজা আমাকে চিনবে, আপনি চিনবেন না?’

ফিরোজা রীতিমত আশ্চর্য হয়ে যায়। কে ফোন করবে তাকে? তেমন কারও কথা তো মনে পড়ছে না!

“দেখো কে। দাঁড়িয়ে থেকো না।’

ভলিউম-১১

১৪

ধমক দিয়েই কথাটা বললেন চৌধুরী সাহেব। রিসিভারটা নিয়ে ফিরোজা বলল, হ্যালো!’ | তারপর কান পেতে অপরপ্রান্তের লোকটার কথাগুলো শুনতে লাগল ফিরোজা । মুহূর্তের মধ্যে বিকৃত হয়ে উঠল তার মুখের চেহারা। ফ্যাকাসে মুখটা আব্বার দিকে ফেরাল সে। হঠাৎ হাত থেকে খসে পড়ে গেল রিসিভারটা সশব্দে। বিকৃত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল সে, অবিশ্বাসে বিস্ফারিত হয়ে গেল তার চোখ জোড়া। বলে উঠল, “ছোটদাকে মেরে ফেলেছে! আব্বা, ছোটদাকে মেরে

ফেলেছে!’

তীক্ষ কণ্ঠে কথাটা বলেই অবরুদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়ল ফিরোজা । কাঁদতে কাঁদতে ছুটল সে নিজের ঘরের দিকে। ঘরে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আকুলভাবে লুটিয়ে পড়ল সে মেঝের উপর।

রুগ্না মা থেকে শুরু করে ভাবী, দুই বোন এবং চৌধুরী সাহেব স্বয়ং ফিরোজার দরজার সামনে এসে অনুরোধ, আদেশ-নির্দেশ জানাতে লাগল, ‘ফিরোজা দরজা খোল । কি হয়েছে সব বল আমাদেরকে।

কিন্তু ফিরোজার কান্না উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। দরজা সে খুলল না কোনমতে। কারও কথার উত্তরও দিল না।

| বারোটার সময় ফিরে এল মেজ জামাই। বড় ছেলের সঙ্গে বের হয়ে দুজনে। আলাদা আলাদা ভাবে হাসপাতালগুলোতে খবর নিতে গিয়েছিল। বড়ছেলে সালাম ফিরল পাঁচ মিনিট পরই। বড় জামাই রুহুল আমিন থানায় ডায়েরী করে দু’এক । জায়গায় খোঁজ করতে গিয়েছিল। সে ফিরল সোয়া বারোটায়।

বাড়ির মেয়েরা অদম্য কান্নায় ভেঙে পড়ল এবার। মেজ. জামাইয়ের চোখেও জল। বড় ছেলে, বড় জামাইয়ের চোখেও জল। মেজ জামাই ফিরোজার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল এবার। দরজা খুলল ফিরোজা। খুলেই মেজ ভগ্নিপতিকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। মেজ জামাই বারবার বলতে লাগল, ফিরোজা শোনো, কেঁদো না, শোনো আমার কথা-বলো তো কে ফোন করেছিল তোমাকে?’

ফিরোজা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, জানি না, মেজদা, আমি চিনি না কেটাকে।’

কি নাম বলেছিল, বলো তো। আমরা হয়ত চিনতে পারব।’ | ফিরোজা এক মুহূর্তের জন্যে কান্না থামিয়ে বলে উঠল, ‘নামও বলেনি আমাকে।’

ঠিক কি কি কথা বলেছিল, বলো দেখি। ঠি: যা শুনেছ তাই বলো।’

ফিরোজা কান্না থামিয়ে কি যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, বলল–তোমার নাম ফিরোজা আমি জানি। তোমার ছোট ভাইয়ের নাম জামাল, তাই না? কুয়াশা-৩১

জামালকে আমি খুন করেছি। তোমার আব্বা বুড়ো বলে খবরটা এঁকে দিইনি। এটুকু শুনেছি আমি। তারপর আর কিছুই শুনতে পাইনি।’

| মেজ জামাই ফিরোজার একখানা হাত ধরে শান্ত এবং স্নেহপূর্ণ স্বরে বলল, ‘কোন কথা আমাদের কাছে লুকিয়ে রেখো না, ফিরোজা। সত্যি তুমি বুঝতে পারনি কে ফোন করেছিল?’

‘পারিনি। বিশ্বাস করুন, মেজদা। লোকটাকে আমি চিনি না। কোনদিন ওর গলার স্বর শুনিনি আমি।’ ::

তাহলে সে তোমার নাম জানল কিভাবে?’ জানি না। আমি কিছু জানি না!’ ফিরোজা আবার নিজের ঘরের ভিতর ঢুকে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল।

থানায় ডায়েরী করে এসেছিল রুহুল আমিন। মেজ জামাই আবার ফোন করল রমনা থানায়। ও. সি.-কে নতুন ব্যাপারটা জানানো হল। পনেরো মিনিটের মধ্যে ও. সি. দুজন কনস্টেবল নিয়ে হ্যাপি কটেজ’-এ উপস্থিত হলেন। সব কথা : মনোযোগ দিয়ে শুনলেন তিনি। তারপর বললেন, আপনাদের ছোট মেয়েকে। ডাকুন। তাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই আমি।’

ফিরোজাকে ও. সি. সেই একই প্রশ্ন নানা ভাবে নানা কায়দায়, নানা ভঙ্গিতে । জিজ্ঞেস করলেন। ফিরোজার সেই একই উত্তর। সে জানে না কে ফোন করেছিল, চেনে না লোকটাকে। ও. সি. একে একে প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করলেন জামাল চৌধুরীর কোন শক্তি আছে কিনা। সকলেই উত্তর দিল-না। ও. সি. এবার ওদেরকে বুঝিয়ে বললেন, দেখুন, আমরা কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে অনুসন্ধান কাজ শুরু করতে পারি। আপনারা যদি কাউকে সন্দেহ না করেন তাহলে আমরা। অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ি। ব্যাপারটা আসলে সত্য কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। যে জামাল চৌধুরীর মৃত্যু-সংবাদ দিয়েছে সে হয়ত ঠাট্টাও করে থাকতে পারে। জামাল চৌধুরীর কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না এটা অবশ্যই দুশ্চিন্তার কারণ। এক্ষেত্রে আমরা তার জন্যে চারদিকে লোক পাঠিয়ে দিতে পারি আপাতত । প্রকৃতপক্ষে সে কোথায় কেমন অবস্থায় আছে তা না জানা পর্যন্ত তদন্ত কার্য সীমিত

রাখা ছাড়া পথ নেই। নতুন কোন খবর বা দুঃসংবাদ পেলে সাথে সাথে জানাবেন আমাদেরকে। প্রাণপণ চেষ্টা করব আমরা আপনাদের বিপদে সাহায্য করতে।’ | ও, সি, সহানুভূতি প্রকাশ করে এবং তদন্ত কাজ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিল। হ্যাপি কটেজ’-এর সকলের রাত কাটল মাথায় হাত দিয়ে বসে বনে।

| সকালবেলা বড় এবং মেজ জামাই থানা থেকে খবর আনতে গেল। থানা থেকে জানা গেল জামালের চেহারার বর্ণনা দিয়ে চারদিকের থানায় খবর পাঠানো

ভলিউম-১১

হয়েছে। এখনও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। ফিরে এল ওরা মুখ কালো করে। বাড়ির মেয়েরা আবার কান্না জুড়ল। বিকেল অবধি হাঁড়ি চড়ল না চুলোয় । মেজ জামাই দোকানের খাবার কিনে এনে দিল। নিজে অবশ্য মুখে দিল না কিছুই। সকলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সামান্য খেতে বাধ্য করল।

বিকেল বেলা চরম সর্বনাশের খবর পাওয়া গেল। থানার ও. সি. ফোন করলেন। একটা লাশ পাওয়া গেছে ডেমরা রোডের পাশ্ববর্তী একটা পানাভর্তি পুকুরে। লাশটা হয়ত জামালের। সনাক্ত করার জন্য লোক দরকার । মেজ জামাই বড় ছেলে সালামকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল মর্গের উদ্দেশে। লাশটা সেখানেই নিয়ে এসে রাখা হয়েছে ডাক্তারী পরীক্ষার জন্যে।

লাশ দেখে চেনবার কোন উপায় ছিল না। বুকে ছোরা মারা হয়েছে জামালের। মুখেও ছোরার দাগ। বেশ কয়েক ঘন্টা পানিতে পড়েছিল বলে পচে ফুলে উঠেছে মরদেহটা। জামালকে চেনা গেল তার পরনের পরিচিত শার্ট আর প্যান্ট দেখে। কপালের কাটা দাগটা দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল পুরোপুরি।

রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরে এল সালাম এবং আবদুর রশিদ।

বিকেল পাঁচটা। মি. সিম্পসনের অফিসরুম। শহীদ, কামাল ও মি. সিম্পসন গভীর এক আলোচনা সবেমাত্র শেষ করেছেন। ইদানীং শহীদ সিরিয়াসলি একটা শুদ্ধি ক্যাম্প তৈরি করার কথা চিন্তা করছে। যে শুদ্ধি ক্যাম্পে বিভিন্ন প্রকৃতির অপরাধীরা শাস্তি ভোগ করার পর সাময়িকভাবে আশ্রয় গ্রহণ করবে। কোন কোন ক্ষেত্রে। তাদেরকে বাধ্য করা হবে শুদ্ধি, ক্যাম্পে ভর্তি হতে। বিদেশে এ ধরনের বহু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান আছে। এতে করে অপরাধীরা অপরাধ করা ভবিষ্যতের জন্যে, ছেড়ে দেয়। রীতিমত সুনাগরিক, আদর্শবান মানুষ হবার জন্যে উত্তম শিক্ষা দেয়া হবে এই শুদ্ধি ক্যাম্পে। আইনগত জটিলতা এবং পারিপার্শ্বিক অসুবিধে সম্পর্কে আলাপ চলছে কিছুদিন থেকে । আজকের মত আলাপ শেষ হয়েছে। মোট তিন? লাখ টাকা নগদ খরচ হবে প্রাথমিক অবস্থায়। সব খরচ শহীদের।’

চা পান করছিল ওরা। এমন সময় বেজে উঠল টেবিলের ফোনটা। মি. সিম্পসন বেশ খানিকক্ষণ ধরে কথা বললেন ফোনে। তারপর রিসিভার নামিয়ে

রেখে শহীদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, জ্বালা আর কাকে বলে!

কি হল আবার?

শহীদের প্রশ্নের উত্তরে মি. সিম্পসন বললেন, ‘গতকাল জামাল নামে এক যুবক নিরুদ্দেশ হয়েছে বলে ডায়েরী করা হয়েছিল, তারপরই থানায় খবর আসে কে যেন জামালের বাড়িতে ফোন করে বলেছে-আমি জামালকে হত্যা করেছি।

২ কুয়াশ-৩১

১৭

ঘন্টাখানেক আগে সেই জামালের লাশ পাওয়া গেছে। কি সব আশ্চর্য।

শহীদ মি. সিম্পসনকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠল, বাহ! ইন্টারেস্টিং তো! কে ফোন করেছিল জামালের বাড়িতে?’

মি. সিম্পসন বললেন, “সে এক জটিল ব্যাপার। রমনা থানার ও, সি.-র ধারণা, যে ফোন করেছিল তাকে নাকি জামালের ছোট বোন চেনে। কিন্তু চেনে বলে স্বীকার করছে না সে। ফোন করনেওয়ালা নাকি জামালের বাবাকে বলেছে আপনি আমাকে চিনবেন না, আপনার ছোট মেয়ে চিনরে।’

শহীদ দ্বিতীয়বার বলল, ইন্টারেস্টিং।

মি. সিম্পসন শহীদের কৌতূহল দেখে বলে চললেন, আমাকে একবার যেতে হচ্ছে জামালের বাড়িতে। চলো না, তোমরাও চলো।’

শহীদ বলে উঠল, সুযোগ পেয়ে আমাদেরকে জড়াতে চাইছেন, কেমন? কিন্তু আমরা খুব ব্যস্ত ক’দিন ধরে। কেসের ভার নিতে পারছি না।’

‘ মি. সিম্পসন হেসে ফেলে বললেন, ঠিক ধরে ফেলেছ আমার মনের ইচ্ছা, তাই না! ঠিক আছে চলো, কেসের ভার নিতে বলব না।’

• মিনিট সাতেক পর ওদের তিনজনকে হ্যাপি কটেজ’-এর বৈঠকখানায় উপস্থিত দেখা গেল। মি: সিম্পসন সকলের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং তারপর শহীদ, ও কামালের পরিচয় সকলকে দিলেন।-চৌধুরী সাহেবকে প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন মি. সিম্পসন, ‘ঠিক কখন ফোনটা এসেছিল এবং কি বলা হয়েছিল ফোনে?’ | চৌধুরী সাহেব হুবহু বলে গেলেন ঘটনাটা। ঘটনাটা লিখে নিলেন মি. সিম্পস। চৌধুরী সাহেব মি. সিম্পসনের অনুরোধে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে পাঠিয়ে দিলেন ছোট মেয়ে ফিরোজাকে। থমথমে, অপ্রতিভ মুখে ফিরোজা একা এসে বৈঠকখানায় বসল। মি. সিম্পসন ছোট্ট একটা ভূমিকা করে প্রশ্ন করলেন, ‘কে ফোন করেছিল তা তুমি জানোবলেই সকলের বিশ্বাস। মনে রেখো তোমার নিজের ভাইকে খুন করেছে লোকটা । তোমার সাথে তার কোন সম্পর্ক থাক বা না থাক, তাকে শাস্তি পেতেই হবে। তুমি শুধু নামটা বলো। তারপর যা রার আমরা করব।

ফিরোজা অস্বীকার করল। মি. সিম্পসন নানাভাবে বোঝালেন। কিন্তু ফিরোজার সেই একই উত্তর-আমি লোকটাকে চিনি না।

মি. সিম্পসন এবার অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করার প্রয়াস পেলেন, আচ্ছা, জামালের হাবভাবে কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছিলে কি দু’একদিন থেকে?

না।’

সংক্ষিপ্ত উত্তর ফিরোজার । মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, বাড়ির লোকজনের সাথে জামালের সম্পর্ক কেমন ছিল? তাছাড়া কোন উল্লেখযোগ্য ঝগড়াঝাটি ছিল ১৮

ভলিউম-১১

বাড়ির কারও সাথে ওর? তোমার বড় ভাই সালাম চৌধুরী ব্যবসা দেখাশোনা করেন। এ ব্যাপারে কোন ক্ষোভ ছিল না জামালের?, ফিরোজা একটু চিন্তা করে প্রথমেই বলল, আমাদের পরিবারে তেমন গুরুতর

ধরনের কোন সমস্যা কোনদিনই ছিল না। প্রতিটি পরিবারে খুঁটিনাটি বিষয়ে যেমন, মতবিরোধ সাধারণত থাকে তেমনি কিছু ব্যাপার আমাদের পরিবারেও আছে। তবে সেসব তেমন কিছু নয়।’

মি. সিম্পসন বললেন, ‘আমার প্রশ্নটা উদ্দেশ্যমূলক নয়, আমি বলতে চাই না যে জামালের সাথে এ বাড়িরই কারও সাথে শত্রুতামূলক সম্পর্ক ছিল বলে সে নিহত হয়েছে। প্রশ্নট। আমি করেছি এই জন্যে যে সব জানা দরকার আমাদের। সামান্য এতটুকু একটা কথাও যেন অজানা না থাকে। তবেই প্রকৃত খুনীকে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।

ফিরোজা এবার বলল, আমার বড়দা কারবার দেখাশোনা করেন বলে। ছোটদার কোন রাগ ছিল না। তবে ছোটদা মাঝে মাঝেই দু’চারশো করে টাকা চাইত। বড়দা স্বভাবতই সহজে দিতে রাজি হতেন না। শেষে অবশ্য দিতে হত। এই কারণে ছোটদার সাথে বড়দার কথা কাটাকাটিও হয়েছে, দু’একবার। কিন্তু বড়দা মনে কোন রাগ পুষে রাখবার মত মানুষ নন। ছোটদাকে বড়দা খুব বেশি ভালবাসতেন।’

“ইদানীং বড়দার সাথে বা অন্য কারও সাথে ঝগড়াঝাটি হয়েছিল কি জামালের?’।

হ্যাঁ, হয়েছিল। যেদিন শেষবার বাড়ি থেকে বের হয় ছোটদা সেদিন বিকেলে ঝগড়া হয়েছিল আমার বড় ভগ্নিপতির সাথে। বড় ভগ্নিপতি কিছুদিন থেকে টাকা চাইছিলেন আব্বার কাছ থেকে। সেদিনও চাইতে গিয়েছিলেন আব্বার ঘরে। ছোট সেখানে ছিল বোধহয়, ও বলে টাকা দেয়া হবে না। এই নিয়ে ওদের দু’জনের মধ্যে তর্ক হয়। সেদিনই দুপুরের আগে কারখানায় গিয়েছিল ছোটদা বড়দার কাছে কিছু টাকা চাইতে, বড়দা দেয়নি। এ ব্যাপারে আমার কাছে অনুযোগ করেছিল ও।’

‘তোমার বড় ভগ্নিপতি রুহুল আমিন কত টাকা চেয়েছিলেন?’ ফিরোজা বলল, “অত কথা আমি জানি না। আব্বা জানেন। মি. সিম্পসন বললেন, তোমার আব্বাকে আর একবার ডেকে দাও এখানে।

ফিরোজা চলে যেতে চৌধুরী সাহেব আবার বৈঠকখানায় এলেন। মি. সিম্পসনের অনুরোধে তিনি বড় জামাই এবং ছোট ছেলের মধ্যে ঝগড়ার বিশদ বিবরণ দিলেন। মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, আপনার বড় জামাই ঘর থেকে বের হয়ে যান শেষ পর্যন্ত রেগে গিয়ে। যাবার সময় তেমন কিছু বলেছিলেন কি?

চৌধুরী সাহেব চুপ করে রইলেন। মি: সিম্পসন সন্দিহান চোখে তাকিয়ে। কুয়াশা-৩১

১৯

থেকে বললেন, “কোন কথা লুকোবেন না, চৌধুরী সাহেব, যদি প্রকৃত খুনীকে শাস্তি দেবার কোন ইচ্ছা আপনাদের সত্যিই থাকে।’

চৌধুরী সাহেব বলে উঠলেন, কিন্তু আমার বড় জামাই জামালকে খুন করেছে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে না, মি. সিম্পসন।’

মি. সিম্পসন বললেন, হয়ত উঠতে পারে না। কিন্তু কোন্ কথার মধ্যে কি তাৎপর্যের সৃষ্টি হতে পারে তা কথাটা না জেনে বলা যায় না। আপনার বড় জামাই কি বলেছেন তা আমরা জানি না। যদি উনি বলতেন–জামালকে খুন করব, তাহলেও তদন্ত করে নিশ্চিত না হয়ে আমরা বলতাম না যে আপনার বড় জামাই খুনী। আমরা প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিই। তারপরও কোর্ট আছে। সেখানে প্রমাণিত হয় অভিযুক্ত ব্যক্তি সত্যি অপরাধী কিনা। সুতরাং আমাদেরকে সব কথা অকপটে জানানো দরকার।’’

চৌধুরী সাহেব নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হলেন। বললেন, বুঝেছি আমি । হ্যাঁ, বড় জামাই রাগ করে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সময় বলেছিল “বেশ! দেখে নেব আমিও।”

মি. সিম্পসন বললেন, আপনাকে আর একটি প্রশ্ন করব, আপনার বড় ছেলের কাছ থেকে সেদিনই জামাল কিছু টাকা চেয়েছিল। আপনার বড় ছেলে এ সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন আপনাকে?’

মাফ করবেন, আর একটি প্রশ্ন। জামালের কোন শত্রু থাকা সম্ভব বলে মনে করেন? কিংবা শত্রুতা সৃষ্টি হতে পারে কারও সাথে এমন কোন ঘটনার কথা আপনার জানা আছে?’

চৌধুরী সাহেব বললেন, ‘পাড়ার এক ভদ্রলোক, তিনি আমার বন্ধুও বলতে পারেন, জামালের নিহত হবার সংবাদ পেয়ে এসেছিলেন। তিনি বলে গেলেন জামাল, যেদিন শেষবার বাড়ি থেকে বের হয় সেদিন নাকি পাড়ার এক বখাটে ছেলের সাথে কি একটা গোলমাল হয়েছিল। ব্যাপারটা বিশদ জানি না আমি। আমার জামাইরা নাকি জানে ব্যাপারটা। আনি ওদেরকে এখনও কিছু জিজ্ঞেস করিনি।’ | মি. সিম্পসন বললেন, ‘ধন্যবাদ। আপনি আপনার বড় ছেলেকে পাঠিয়ে দিন।’

খানিক পরই সালাম চৌধুরী সালাম জানিয়ে ঘরে ঢুকে বসল একটা চেয়ারে। মি. সিম্পসন জেরা শুরু করলেন, “আচ্ছা, আপনার ছোট ভাই শেষ কবে টাকা চেয়েছিল আপনার কাছ থেকে? কেন চেয়েছিল? আপনি কি টাকা দিয়েছিলেন?

| ‘যেদিন শেষবার বের হয় ও বাড়ি থেকে সেদিনই টাকা চায় ও দুপুরে। কেন তা জানি না। প্রায়ই কারণে-অকারণে টাকা নিত ও। বয়সের ব্যাপার, আজে বাজে খরচ করে ফেলত। আমি ওকে টাকা দিইনি। ও একটু রেগেও ছিল।’

ভলিউম-১১

মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, রাগের মাথায় কিছু বলেছিল কি ও?’

না। জামাল আমাকে অপমানকর কিছু কোনদিনই বলেনি। আমি ওকে ভালবাসতাম, ও আমাকে শ্রদ্ধা করত। তবে এই টাকা-পয়সা চাওয়া এবং দেয়া। নিয়ে মাঝে-মধ্যে গোলযোগ হয়ত হয়েছে, কিন্তু সে কেবল অভিমানের ব্যাপার ।

ও খুব অভিমানী ছিল।’

মি. সিম্পসন বললেন, ‘জানা গেছে যেদিন জামাল নিখোঁজ হয় সেদিনই রাত এগারোটার সময় নিহত হয় সে। প্রথমে বিষ প্রয়োগে অজ্ঞান করা হয় ওকে। তারপর মাথায় লোহার ডাণ্ডা বা ওই জাতীয় কোন অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে ওকে। রাত এগারোটার সময় সেদিন কোথায় ছিলেন আপনি?

. সালাম চৌধুরী চুপ করে রইল! মি. সিম্পসন তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করে উঠলেন, কি ভাবছেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। কোথায় ছিলেন সেদিন আপনি রাত এগারোটার সময়? | সালাম চৌধুরী অস্বস্তি বোধ করছে উত্তর দিতে। মি. সিম্পসন তৃতীয়বার প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই সে বলল, ঠিক কোথায় ছিলাম মনে নেই আমার। সেদিন আমি পার্কে গিয়েছিলাম, নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম, নৌকোয় চড়েছিলাম, কখন কি করেছি তা আমার স্মরণ নেই।

‘আপনি একা ছিলেন? যেখানে-যেখানে গিয়েছিলেন সেখানে পরিচিত কারও সাথে দেখা হয়েছিল কি?’

। | ‘ঘড়ি সম্পর্কে এমন অস্বাভাবিক উদাসীন হওয়াটা কি অদ্ভুত ব্যাপার বলে মনে হয় না আপনার?’

সালাম চৌধুরী মাথা নিচু করে কি যেন ভাবতে ভাবতে বলল, ‘সেদিন মনটা কেমন যেন করছিল, ঘড়ির দিকে তাকাইনি।’

মি. সিম্পসন বললেন, “আশ্চর্য! আচ্ছা, জামালের নিহত হবার সংবাদ যখন ফোন করে জানানো হয় তখন আপনি কোথায় ছিলেন?’

| ‘হাসপাতালে জামালের কোন সন্ধান পাওয়া যায় কিনা খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। মেডিকেলে গিয়েছিলাম আমি। আবদুর রশিদ, এ বাড়ির মেজ।

মাই, আমার সাথেই বের হয়েছিল। সে মিটফোর্ডে গিয়েছিল আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে। আমি ফিরে এসেছিলাম বারোটা পাঁচে। এসে শুনি কে যেন ফোন করে জানিয়েছে খবরটা।

আপনার বাবার মুখে শুনলাম ফোন করা হয়েছিল ঠিক রাত সাড়ে গোটায়। সেই নির্দিষ্ট সময়টিতে কোথায় ছিলেন আপনি?

সালাম চৌধুরী ইতস্তত করে বলল, “ঠিক উত্তর দেয়া কঠিন, বুঝতেই ছন। কেননা, ঘড়ির কাঁটা দেখে চলার মত মানসিক অবস্থা তখন নয়।

**-৩১

সম্ভবত হসপিটালেই ছিলাম তখন।’

হাসপাতাল থেকে কোথাও ফোন করেছিলেন আপনি?’

সালাম চৌধুরী মি. সিম্পসনের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর মৃদু স্বরে উত্তর দিল, করেছিলাম। শেরে বাঙলা হসপিটালে ফোন করে জামালের খোঁজ নিয়েছিলাম।’

‘ক’টা ফোন করেছিলেন আপনি সত্যিসত্যি? কতক্ষণ সময় লেগেছিল?’

‘একটা ফোন করেছিলাম। খবর পেতে সময় লেগেছিল মিনিট পাঁচেক বা তার কিছু বেশি।’–

মি. সিম্পসন কি যেন ভাবলেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘জামালের নিহত। হবার সময় আপনি কোথায় ছিলেন এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর না দিতে পেরে আপনি সন্দেহভাজন হচ্ছেন। আপনি বরং চিন্তা করে দেখুন খানিক।’

সালাম চৌধুরী অপ্রতিভ গলায় বলে উঠল, চিন্তা করে দেখলেও মনে পড়বে না আমার।’

., ‘শেষ একটা প্রশ্ন। আপনি যা যা বললেন তার মধ্যে সত্যতা কতটুকু?

মানে? সব সত্যি কথা বলেছি আমি।’

মি. সিম্পসন গম্ভীর হয়ে উঠে বললেন, ‘ধন্যবাদ। আপাতত আপনি আসতে পারেন। আপনাদের বড় ভগ্নিপতিকে পাঠিয়ে দিন এবার।

রুহুল আমি; পাণ্ডুর মুখে ঘরে ঢুকল। চেয়ারটায় বসল মিনিট দুয়েক পর । মি. সিম্পসনের প্রথম প্রশ্ন, ‘আপনি বর্তমানে কি কাজ করেন, মি. আমিন?’

বর্তমানে কিছু করছি না। ব্যবসাটা নতুন করে দাঁড় করাবার কথা ভাবছি কিছুদিন থেকে জানালার গ্রিল তৈরি করার কারখানা ছিল আমার। টাকার অভাবে পারছি না।’

. মি. সিম্পসন, ‘সেজন্যেই সম্ভবত আপনি চৌধুরী সাহেবের কাছে টাকা। চাইছেন। তা, কত টাকা?

দশ হাজার।’

টাকার ব্যাপারে জামালের সাথে আপনার কথা কাটাকাটি হয়েছিল সেদিন, তাই না? জামালকে কি বলেছিলেন আপনি?’

জামালকে বলেছিলাম আমার এবং শ্বশুর সাহেবের কথার মাঝখানে ও যেন কথা না বলে। সম্পর্কে, ও আমার ছোট, সুতরাং ওর মাতব্বরি পছন্দ হয়নি

আমার।’ | মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, মাতব্বরি শব্দটা দিয়ে আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন? ও কি আপনাকে অপমান করেছিল?

তা এক রকম অপমান করেছিল বৈকি। কিন্তু জামাল আমার ছোট শালা, ভালবাসতাম নিঃসন্দেহে। ওর কোন কথা মনে রাখিনি আমি।’

ভলিউম-১১

২২

মি. সিম্পসন সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু ঘর থেকে রাগ করে বের হয়ে যেতে যেতে কি বলেছিলেন আপনি?’

চুপ করে রইল রুহুল আমিন। মি. সিম্পসন প্রশ্নটা আবার করলেন। একটু পর রুহুল আমিন বলল, “সে আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছিলাম।’ কথাটা বলার মধ্যে আপনার কোন উদ্দেশ্য ছিল না?

। বিশ্বাস করতে পারেন আমাকে।’

মি. সিম্পসন বললেন, “যেদিন রাত এগারোটায় নিহত হয় জামাল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?’

রুহুল আমিন ইতস্তত করতে লাগল । দ্বিতীয়বার মি. সিম্পসন প্রশ্ন করতে বলে উঠল, “আমি একটা হোটেলে ছিলাম। হোটেলটার নাম সালমাবাদ হোটেল অ্যাণ্ড রেস্টুরেন্ট। রেকর্ড বাজানো হয় ওখানে। গান শুনতে শুনতে ভবিষ্যতের কথা ভাবছিলাম আমি।’

মি. সিম্পসন কঠিন কণ্ঠে বলে উঠলেন, কিন্তু আপনি যে হোটেলের কথা বলছেন সেটা তো এখান থেকে কয়েক মাইল দূরে। ওখানে আপনি গিয়েছিলেন কেন? তাছাড়া হোটেলটা তো খুব লো-স্ট্যাণ্ডার্ড!’ | ‘ওদিকে গিয়েছিলাম হাঁটতে হাঁটতে, কোন কারণবশত নয়। তাছাড়া আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব চিন্তিত আমি, তাই হোটেলটা ভাল কি খারাপ লক্ষ করিনি। জামালের সাথে ঝগড়া হবার ফলে মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই অন্যমনস্কভাবে গান শুনছিলাম।’

‘হোটেলের বেয়ারারা নিশ্চয় চিনতে পারবে আপনাকে আবার দেখলে?’ |

হঠাৎ ঘাবড়ে গেছে বলে মনে হল রুহুল আমিনকে।রলে উঠল বিচলিতভাবে, তা কি করে সম্ভব। শ’য়ে শ’য়ে লোকের মাঝখানে আমিও ছিলাম। আমাকে আলাদাভাবে চিনতে পারা কিভাবে সম্ভব?’

| মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, ‘বেয়ারারা ঠিক চিনতে পারে। যা হোক, সেখানে আপনি যে সেদিন রাত এগারোটার সময় ছিলেন তা কি প্রমাণ করতে পারেন?

বাহ্, তা আমি কিভাবে প্রমাণ করব?’ ‘প্রমাণ করতে না পারাটা খুব খারাপ।

মি, সিম্পসন গম্ভীর স্বরে যোগ করলেন, আচ্ছা, জামালের নিহত হবার খবর দিয়ে যখন ফোন করা হয় তখন কোথায় ছিলেন আপনি?

‘আমি থানায় ডায়েরী করতে গিয়েছিলাম।’

কখন বের হয়েছিলেন আপনি? কখন থানায় পৌঁছান? কখন ফিরে এসেছিলেন?

রুহুল আমিন খানিক চিন্তা করে বলল, কখন ডায়েরী লিখিয়েছি তা আপনি থানায় খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। কিন্তু কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম এবং কুয়াশা-৩১

কখন ফিরেছিলাম তা মনে নেই।’

বাইরে থেকে কোথাও ফোন করেছিলেন কি?’

।’ মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, কোন প্রশ্নের উত্তর দিয়েই আপনি আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেননি।

| রুহুল আমিন ইশমে গলায় মন্তব্য করল, আমি যা জানি বা যা মনে করতে পারছি বা যা সত্য তাই বলেছি।’

মি. সিম্পসন বললেন, এবার আসতে পারেন আজকের মত। এ বাড়ির মেজ জামাই আবদুর রশিদ সাহেবকে পাঠিয়ে দিন।’ | রুহুল আমিন ঘর থেকে বের হয়ে যেতে মি. সিম্পসন শহীদ ও কামালকে সিগারেট দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কেমন বুঝছ শহীদ?’

শহীদ এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল। মুখ খুলল ও এই প্রথম, “ইন্টারেস্টিং। বড় ছেলে সালাম চৌধুরী, এবং বড় জামাই রুহুল আমিন দু’জনেই মিথ্যে কথা বলে গেলেন, আমার দৃঢ় সন্দেহ। মিথ্যে কথা বলার সময় বেশিরভাগ লোকই ধরা পড়ে যায়। জামাল যখন নিহত হয় ঠিক সেই সময়টা কোথায় ছিলেন ওঁরা খোদা মালুম। ওঁরা যা বলে গেলেন তা সত্য হতে পারে না বলেই আমার বিশ্বাস।’

‘তোমার কাকে সন্দেহ হয়?’

শহীদ হেসে বলল, সন্দেহ দুনিয়ার সব লোককে করা যায়। প্রমাণ খুঁজতে হবে। উদ্দেশ্য কি আছে দেখতে হবে। সময় এবং সুযোগের কথা ভাবতে হবে। সব জানা থাকলেই কেবল সন্দেহ করা চলে।

| শহীদের কথা শেষ হতেই মেজ জামাই আবদুর রশিদ ঘরে ঢুকল। সুন্দর, সুঠাম চেহারা। ফর্সা। চোখ দুটো রাত্রি জাগরণের ফলে লাল। মৃদু হেসে চেয়ারটায় বসল সে।

মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, কি করেন আপনি?

‘হোটেল মহল অ্যাণ্ড বারের ম্যানেজার এবং অংশীদার আমি, আবদুর রশিদ ম্রিয়মাণ স্বরে উত্তর দিলেন।

মি. সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, আমরা জানতে পেরেছি জামাল প্রায়ই রাতে বাইরে থাকত এবং মদটদও পান করত। কথাটা কতটুকু সত্যি?

আমিও শুনেছিলাম। ওর বোন দু’একবার বলেছে বটে আমাকে। আমি একবার কথাটা জিজ্ঞেসও করেছিলাম ওকে। আমার কাছে কোন কথা লুকোবে এমন ছেলে ছিল না জামাল। আমাকে ও বলেছিল যে মদদ ও জীবনে ছুঁয়েও দেখেনি। আমার বিশ্বাস শখে পড়ে দু’একবার খেলেও খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু ঠিক নেশা করা বলতে যা বোঝায় তা করত না।’

আপনাদের বারে যাওয়া-আসা ছিল ওর?’

ভলিউম ১১

আবদুর রশিদ বলল, না। দু’বার কি একবার কোন খবর-টবর দিতে গিয়েছিল হয়ত, ঠিক মনে নেই, গিয়ে থাকলেও ছ’মাসের মধ্যে আর যায়নি।

মি. সিম্পসন বেশি সময় নষ্ট না করে জানতে চাইলেন, জামাল নিহত হয়েছে যে-সময় সে-সময় কোথায় ছিলেন আপনি?’

আবদুর রশিদ বলল, “সেদিন সিনেমা দেখাবার জন্যে রাত আটটায় বাড়ির সব মেয়েদের জন্যে রক্সি সিনেমার টিকিট কিনে নিয়ে এসেছিলাম আমি। কিন্তু ওরা কেউ যেতে রাজি হল না। অগত্যা টিকিটগুলো নষ্ট হয় দেখে আমাকে যেতে হয়েছিল একাই। একটা টিকিট নিজের জন্যে রেখে বাকিগুলো বিক্রি করে দিই। সিনেমা দেখে ফিরেছিলাম আমি সাড়ে বারোটায়।’

| মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, ‘সিনেমার টিকিটের অর্ধেকটা কি দেখাতে, পারবেন আমাদেরকে?’ | আবদুর রশিদ মি. সিম্পসনের দিকে তাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। তারপর বলে উঠল, আপনি কি প্রমাণ দেখাতে বলছেন?’ | মি. সিম্পসন বললেন, ‘টিকিটটা থাকলে দেখাতে আপত্তি করবেন না নিশ্চয়।

থাকলে অবশ্য আলাদা কথা। প্রতিটি জিনিসের পিছনে প্রমাণ থাকাটা কি সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং নির্ভরযোগ্য নয়?’

আবদুর রশিদের মুখ অপমানে লাল হয়ে উঠল। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি ঠিক বলতে পারছি না টিকিটের অর্ধেকটা ফেলে দিয়েছি কিনা। মানিব্যাগে খোঁজ নিয়ে দেখছি।’

ঘর থেকে বের হয়ে গেল আবদুর রশিদ। ফিরে এল পাঁচ মিনিট পরে । হাতে একটা কাগজ। সেটা মি. সিম্পসন পরীক্ষা করে দেখলেন। বললেন, ঠিক আছে। আর কয়েকটা প্রশ্ন করব আপনাকে। দুঃসংবাদটা জানিয়ে যখন ফোন করা হয়েছিল তখন আপনি কোথায় ছিলেন?’.

হসপিটালে খবর নিতে গিয়েছিলাম। ঠিক ক’টার সময়?’

আবদুর রশিদ একটু অসহায়ভাবে হেসে ফেলল। বলল, “দেখুন, ঘড়ি দেখার মত এবং মনে রাখার মত অবস্থা তখন ছিল না।’

মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, ‘জামালকে হত্যা করতে পারে এমন কোন শত্রু তার ছিল কিনা জানেন?’

না। জামাল তেমন ছেলে ছিল না। ওর কোন শত্রু আছে বলে বিশ্বাস হয় আমার। | কামালের সাথে ওর বড় ভগ্নিপতির ঝগড়া হয়েছিল। হুমকি দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন মি. রুহুল আমিন। এ সম্পর্কে আপনার মতামত কি?’

‘ছিঃ ছিঃ। জামালকে আমিন ভালবাসত, মি. সিম্পসন । এরকম ন্দেহ ভুলেও কাশ-৩১

করবেন না।

মি, সিম্পসন জানতে চাইলেন, এমন কোন ঘটনার কথা আপনার জানা আছে যাতে করে জামালের শত্রু সৃষ্টি হতে পারে?’

পাড়ার শফিককে জামাল মেরেছিল একথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল আবদুর রশিদের । সে ঘটনাটা উল্লেখ করল। মি. সিম্পসন শফিকদের বাড়ির ঠিকানা লিখে নিলেন। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার।. ‘ এরপর মি. সিম্পসন শহীদ ও কামালকে সঙ্গে নিয়ে বিদায় নিলেন হ্যাপি কটেজ’ থেকে। । শফিকদের বাড়িতে একবার ঢু মেরে নিলেন মি. সিম্পসন। শফিককে পাওয়া

গেল না। কোথায় গেছে বলতে পারল না শফিকের বুড়ো বাপ। | গাড়িতে চড়ে মি. সিম্পসন বললেন, ‘শফিক সম্ভবত পালিয়ে গেছে বলে

সন্দেহ হয়। ছোকরাকে সত্যি সন্দেহ করা যেতে পারে।’

শহীদ কোন মন্তব্য করল না। মি. সিম্পসন আবার বললেন, ‘অফিসে গিয়েই দু’জন কনস্টেবলকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাড়িতে ফিরলেই পাকড়াও করে নিয়ে যাবে থানায়। জেরা করলে ফল পাওয়া যেতেও পারে। অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্যে জামালকে খুন করা কিছুমাত্র বিচিত্র নয়।’

কামাল বলল, আমারও তাই মনে হয়। চৌধুরী সাহেবের মেয়েকে হয়ত এই শফিকই ফোন করেছিল।’

শীহদ বলল, কিন্তু একটা কথা বেশ ইন্টারেস্টিং। জামাল যখন নিহত হয়েছে এবং যখন তার নিহত হবার খবর ফোন করে জানানো হয়েছে–দুটো ক্ষেত্রেই বাড়ির তিনজন পুরুষের কেউই বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন না।’ * মি. সিম্পসন শহীদের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে না পেরে প্রশ্নবোধক, চোখে তাকিয়ে রইলেন। শহীদ বলে উঠল, ‘এবার নিশ্চয়ই মি. সিম্পসন আমাকে কেসটার ভার নিতে অনুরোধ জানাবেন। | শহীদের কথা শেষ হতে কামাল এবং মি. সিম্পসন দু’জনেই হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন। শহীদও যোগ দিল সে হাসিতে।

তিন, মি. সিম্পসন, শহীদ, কামাল বিদায় নিতে ‘হ্যাপি কটেজ’ ঝিমিয়ে পড়ল। জেরা করার ফলে প্রত্যেকের মনে অস্বস্তি দানা বেঁধেছে। প্রত্যেকে নিজের নিজের কথা ভাবছে। একে এতবড় একটা শোকাবহ ঘটনা ঘটে গেল, তার উপর পুলিসী সন্দেহের পাল্লায় পড়ে নাকানিচোবানি খেতে হবে। যে যার ঘরের দরজা বন্ধ করে, শুয়েছিল। কিন্তু কারও চোখেই ঘুমের লেশমাত্র নেই।

ভলিউম-১১

মিসেস চৌধুরী রোগিনী। তাঁর দরজা দুটো মেলা। মি. চৌধুরী আলাদা ঘরে থাকেন। ডাক্তারের নির্দেশ মিসেস চৌধুরীকে নিরিবিলিতে রাখতে হবে। ঘুম হয়

, সেজন্যই তাঁর অসুখ এবং ভয়। শব্দটব্দ হলে ঘুম হবার কথা নয়। তাই তার ঘরে কেউ ঢোকে না।

বাড়ির চাকরাণী ফিরোজার ঘরে এবং মিসেস চৌধুরীর ঘরে দুধের গ্লাস রেখে রান্নাঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ল।

‘ মিসেস চৌধুরী চোখ বন্ধ করে কাঁদছিলেন। ধীরে ধীরে সময় বয়ে যাচ্ছে। * হঠাৎ হঠাৎ কান্না বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তার। চমকে উঠে একটা স্বচক্ষে দেখা ঘটনার । কথা ভাবছিলেন। যেদিন জামাল নিহত হয়েছে সেদিনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করেছেন তিনি। বাথরূমে একজনকে রাত দুপুরে একটা কাপড় ধুতে দেখেছেন। এর অর্থ কি? হাজার রকম করে ভেবেও কোন কূল-কিনারা পাননি তিনি। কথাটা কাউকে বলবেন না ভেবেছিলেন। কিন্তু না বলেও পারেননি। কিন্তু এ বাড়ির প্রতিটি লোকই তাঁর আপনার। তাঁরই ছেলে, তাঁরই মেয়ে, তারই জামাই, তাঁরই স্বামী, তাঁরই ছেলের বউ। কার কথা কাকে বলবেন তিনি? তবু না বলেও পারেননি। যাকে বিশ্বাস করতে পারেন, যার প্রতি সবচেয়ে বেশি আস্থা তাকেই

একটু আভাস দিয়েছেন ব্যাপারটা সম্পর্কে।

হঠাৎ কান পাতেন মিসেস চৌধুরী । কিসের যেন শব্দ হল একটা নাকি কানের ভুল? ওই যে, আবার। কেউ কি হাঁটছে ঘরের ভিতর? খুট করে আরও একটা শব্দ হল যেন। চোখ মেলে তাকালেন মিসেস চৌধুরী। জিরো পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে ঘরে। মশারি খাটানো। দরজা এখনও খোলাই রয়েছে। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন মিসেস চৌধুরী । কেউ কি পালিয়ে গেল ঘর থেকে? যেন একটা ছায়ামূর্তি সরে গেল দরজার কাছ থেকে। ভাল ভাবে দেখতে পাননি তিনি। কিন্তু শব্দ তিনি শুনেছেন। ও কিসের শব্দ হতে পারে? কে এসেছিল তার ঘরে। সাড়া না দিয়ে? বিড়াল টিড়াল নয়ত? মিসেস চৌধুরী খাট থেকে নেমে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। হাঁটতে কষ্ট হয় তাঁর। দাঁড়ালে থরথর করে কাঁপতে থাকেন। দরজা পেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন তিনি। কেউ নেই বাইরে। বড় ছেলের ঘরে, ছোট মেয়ের ঘরে, স্বামীর ঘরে এবং দু’জামাইয়ের ঘরেও আলো জ্বলছে। সবাই জেগে আছে। মিসেস চৌধুরী ছোট ছেলে জামালের ঘরের দিকে তাকালেন। ঘরটা বন্ধ এবং অন্ধকার। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এল আবার। দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে,। ধীর পায়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে ঢুকলেন তিনি। চৌধুরী সাহেব একটা বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে আকাশ-পাতাল কি যেন ভাবছিলেন। স্ত্রীকে দেখে চমকে উঠলেন তিনি। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মিসেস চৌধুরী বললেন, “ঘুম আসছে না, গো। একা থাকতেও ভাল লাগছে না।’

ভবে বসো। আমার কাছে একটু বসো।’ কুয়াশা-৩১

২৭।

চৌধুরী সাহেব স্ত্রীকে ধরে বসালেন।

এদিকে ফিরোজা তার ঘরে চরম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে সর্বনাশের পথে এগিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছোটদাকে কে হত্যা করেছে তা সে জানে। ফোনে যে খবরটা দিয়েছিল, তাকে না চেনবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। শফিক নিজের নাম প্রকাশ করেই বলেছিল,তোমার ছোট ভাই জামালকে খুন করেছি আমি। আমাকে অপমান করার প্রতিশোধ নিয়েছি।’ ফিরোজা নিজেকেই অপরাধী ভাবছে। যথেষ্ট কারণ আছে তার নিজেকে অপরাধী ভাবার। এমন নিষ্ঠুর ছেলের সঙ্গে সে প্রেম করতে গিয়েছিল কেন? ফিরোজার সঙ্গে কোন সম্পর্ক না থাকলে অকারণে তার । দিকে তাকিয়ে হাসত না শফিক। ছোটদাও রেগে গিয়ে মারধর করত না, এবং নিহত হতেও হত না ওকে। ছোটদার নিহত হবার জন্যে তো সেই দায়ী।

| একটু আগে ফিরোজা মায়ের ঘরে ঢুকেছিল। মা টের পাননি। মায়ের টেবিলে ওষুধের শিশিগুলোর মধ্যে থেকে স্লিপিং ট্যাবলেটের শিশিটা চুরি করে নিয়ে এসেছে। আটটা ট্যাবলেট ছিল। আটটাই গুড়ো করে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছে ফিরোজা। হ্যাঁ, আত্মহত্যাই করবে সে। এই অপরাধ বোধে জর্জরিত হয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে।

দুধে ওভালটিন মেশানো আছে বলে খয়েরী রঙের ঘুমের ট্যাবলেট গুঁড়ো করে মেশাবার পরও রঙ বদলায়নি। গ্লাসটা মুখের কাছে নিয়ে গিয়েও গলায় ঢালতে পারল না ফিরোজা। মরতে ভয় নেই তার। কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে মরার আগে তার একটা কাজ করা দরকার। কি কাজ সেটা? কাজটা হল শফিকের মুখের সামনে গিয়ে একবার দাঁড়ানো। শফিককে সে প্রাণমন দিয়েই ভালবেসেছিল। সেই ভালবাসার প্রতিদানে কেন সে তাদের পরিবারের এমন চরম সর্বনাশ করল? অপমানটাই বড় হল তার কাছে, ভালবাসাটা কিছু না? ফিরোজা যাবে। ফিরোজা শফিককে বলবে তোমাকে আমি ভালবেসেছিলাম, শফিকদা। কিন্তু তুমি আমার ভালবাসার যে প্রতিদান দিয়েছ তার ফলে আত্মহত্যা না করে আমার আর কোন উপায় নেই।

* সকলের অজান্তে দরজা খুলল ফিরোজা। বের হয়ে গেল ও বাড়ি থেকে। শফিকদের বাড়ি বস্তির যেখানে শুরু ঠিক সেখানটাতেই। দু’তিন মিনিটের রাস্তা। যাবে আর আসবে ও। তারপর ফিরে এসে দুধটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে চিরতরে।

পরদিন ফিরোজার ঘুম ভাঙল রোজকার মতই সকাল সাতটায়। কিন্তু হ্যাপি কটেজ’-এরই অন্য একজন চিরদিনের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ল।

মিসেস চৌধুরীর দরজা ভাঙা হল বেলা দশটায় । ডেকে ডেকে কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না তাঁর। দরজা ভাঙার পর দেখা গেল মিসেস চৌধুরীর সর্বশরীর ঠাণ্ডা হিম । ডাক্তার আনানো হল। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলল, মিসেস চৌধুরী মারা গেছেন। মৃত্যুর কারণ ধরতে হলে আরও পরীক্ষা করা দরকার। তবে

ভলিউম-১১

সম্ভবত, ঘুমের মধ্যে হার্টের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবার ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে।’

চার

সেদিন সকালেও মি. সিম্পসনের অফিসে বৈঠক বসেছে শহীদ ও কামালের। আলোচনা তখন শুরু হয়নি। গল্পগুজব করছিল ওরা। এমন সময় বেজে উঠল টেবিলের উপর রাখা ফোনটা রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকালেন মি. সিম্পসন । দেখতে দেখতে ভারি হয়ে উঠল তাঁর মুখাকৃতি। খানিক পর রিভািরটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখে মি. সিম্পসন ত্যক্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘বড় মুশকিল দেখা যাচ্ছে! শহীদ, চৌধুরী সাহেবের “হ্যাপি কটেজ”-এ আবার যেতে হচ্ছে আমাকে একবার। এবার বাড়িতেই আর একজন নিহত হয়েছেন। মিসেস চৌধুরীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে তাঁর ঘরে। ছোট মেয়েটা, ফিরোজা ফোন করেছিল। তার বিশ্বাস তার মায়ের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। হত্যা করা হয়েছে। অনেক অপ্রকাশিত কথা নাকি আমাদেরকে শোনাবে সে। এখুনি একবার যেতে বলল।’

কামাল বলল, রহস্যটা দেখছি ক্রমশই জটিলতর হয়ে উঠছে। তা আমরা এখন এখানে করবটা কি বসে বসে?

মি. সিম্পসন বললেন, চলো না তোমরাও। কি বলে শোনা যাবে।’ শহীদ বলে উঠল, “সেই ভাল। চলুন, ঘুরেই আশা যাক।’

মি. সিম্পসন, শহীদ ও কামালকে দেখে হ্যাপি কটেজ’-এর প্রায় সকলেই বিস্মিত হল। মি. সিম্পসন বললেন ফিরোজা ফোন করেছিল।

| বোঝা গেল ফিরোজা ফোন করেছিল একথা কেউ জানে না। মি. সিম্পসন বৈঠকখানা থেকে সকলকে চলে যাবার অনুরোধ জানিয়ে ফিরোজাকে একা পাঠিয়ে দিতে বললেন। সকলে ধীরে ধীরে বের হয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢুকল ফিরোজা। দরজাটা সে নিজের হাতে বন্ধ করে দিয়ে ওদের তিনজনের মুখোমুখি বসল। উত্তেজনায় মিনিট তিনেক কোন কথাই বলতে পারল না ফিরোজা। তারপর নিচু স্বরে কথা বলতে শুরু করল । প্রয়োজনীয় কথাগুলো লিখে নিতে লাগলেন মি. সিম্পসন। ফিরোজা প্রথমেই স্বীকার করল যে ছোটদার নিহত হবার সংবাদ যে দিয়েছিল সে নিজের নাম বলেছিল। শফিককে সে ভাল করেই চিনত। ফিরোজা ওদের প্রেমমূলক সম্পর্কের কথাও লুকোল না। সেজন্যেই প্রথমে নাম বলতে রাজি হয়নি সে। কিন্তু কাল রাতে মায়ের ঘর থেকে ঘুমের ট্যাবলেট চুরি করার পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে শফিকের খোঁজে গিয়ে যখন সে দেখল শফিকের বাড়িতে পুলিস মোতায়েন এবং তারা বলাবলি করছে শফিক যে জামাল চৌধুরীকে হত্যা করে পালিয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই তখন তার মনেও কোন সন্দেহ রইল না আর।

কুয়াশা-৩১

ঘুমের ট্যাবলেট মেশানো দুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে সে। ঘুম আর ভাঙবে না, এই ভেবেছিল ও। কিন্তু ঘুম তার যথারীতি ভেঙেছে। ঘুম ভাঙতে যখন দেখল যে সে মরেনি তখন কিছুক্ষণের জন্যে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। একটু আনন্দবোধও করেছিল। কিন্তু বেলা দশটায় যখন মায়ের দরজা ভেঙে দেখা গেল মা মৃতা তখন কেমন যেন রহস্যময় মনে হয় ওর কাছে ব্যাপারটা। সকলের অজ্ঞাতে মায়ের দুধের গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে সে। শিউরে ওঠে ও। গ্লাসের নিচে দু’তিন ফোঁটা দুধের সঙ্গে ঘুমের গুঁড়ানো ট্যাবলেট পরিষ্কার দেখতে পায় ও।

মি. সিম্পসন চমকে উঠে জানতে চাইলেন, তার মানে তুমি যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও তখন কেউ তোমার দুধের গ্লাসের সঙ্গে তোমার আম্মার দুধের গ্লাস বদলাবদলি করে রেখে গিয়েছিল?

ফিরোজা আঁতকে উঠে বলে উঠল, কিন্তু কে এমন কাজ করবে? কে এমন শত্রু আছে আমাদের? তাছাড়া সে জানলই বা কিভাবে আমি ঘুমের ট্যাবলেট চুরি করেছি, তারপর দুধের গ্লাসে গুঁড়ো করে মিশিয়ে দিয়েছি?’

তুমি যখন গ্লাসে ট্যাবলেট মেশাচ্ছিলে তখন তোমার ঘরের দরজা জানালা বন্ধ ছিল?’

না। দরজা বন্ধ ছিল শুধু।’

মি. সিম্পসন বললেন, জানালা দিয়ে কেউ তোমাকে দেখে থাকতে পারে। তুমি বাড়ি থেকে বাইরে বের হয়ে যেতেই ষড়যন্ত্রটা মাথায় ঢোকে তার। বাড়িতে তখন কে কোথায় ছিল বলো তো?” | ‘আম্মা ছিলেন আব্বার ঘরে। আম্মার ঘরে কেউ ছিল না। বড়দার ঘরে বাতি জ্বলছিল, মেজ দুলাভাইয়ের ঘরেও বাতি জ্বলছিল, বড় দুলাভাইয়ের ঘরেও জ্বলছিল। সম্ভবত। সকলেই জেগেছিল, কিন্তু দরজা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে-বসে ছিল বোধহয়। * এ বাড়ির চাকরাণী?

ফিরোজা বলল, সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় নাক ডাকার শব্দ শুনেছিলাম আমি।’

মি. সিম্পসন বললেন, ‘গ্লাস দুটো কি সরিয়ে ফেলা হয়েছে?’

না। আপনাদের কাজে লাগবে মনে করে দুটো গ্লাসই, আমারটা এবং আম্মারটাও লুকিয়ে রেখে দিয়েছি আমি। সকালবেলা আম্মার গ্লাসটা ধরার সময় রুমাল ব্যবহার করেছিলাম আমি।

“খুব ভাল করেছ? খুব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছ তুমি। গ্লাসে হয়ত হাতের ছাপ পাওয়া যেতে পারে। গ্লাস দুটো এনে দাও দেখি এখুনি।

ফিরোজা উঠে চলে গেল গ্লাস দুটো আনতে। কামাল মন্তব্য করল, বড় রহস্যময় ব্যাপার, তুই যা-ই বলিস শহীদ। শফিকই যদি হত্যা করে থাকে জামালকে তাহলে কেন সে স্বীকার করতে যাবে যেচে পড়ে? হত্যা করে কেউ

ভলিউম-১১

ফোন করে এভাবে?’

মি. সিম্পসন বললেন, উত্তেজনার মূহূর্তে কি করছে মানুষ তা ভাবে না। কথাটা সত্যি নয়?

কামাল প্রশ্ন করল, জামালকে হত্যা করার কারণ না হয় বোঝা গেল। কিন্তু মিসেস চৌধুরীকে কে হত্যা করল? এক্ষেত্রে শফিকের স্বার্থ কি? তার পক্ষে সম্ভবই বা কেমন করে দুধের গ্লাস বদলানো?

মি. সিম্পসন চিন্তা করে বললেন, এর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপারও থাকতে পারে। হয়ত মিসেস চৌধুরী স্বয়ং মেয়ের দুধের গ্লাস বদলে নিয়ে গিয়েছিলেন। হয়ত তার গ্লাসে বেশি দুধ ছিল। বেশি দুধটুকু মেয়েকে খাওয়াবার সাধ জাগাটা মায়েদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক।’. ..

কামাল হেসে উঠল। বলল, সেক্ষেত্রে ফিরোজাকে ঘরে না দেখে তিনি কিছু ভাবেননি কেন? ভাবলে কেন জিজ্ঞেস করেননি কাউকে ফিরোজার কথা?’’

মি. সিম্পসন চুপ করে রইলেন। এমন সময় দুটো গ্লাস একটা রুমালে জড়িয়ে নিয়ে বৈঠকখানায় ঢুকল ফিরোজা। গ্লাস দুটো টেবিলে রাখতে শহীদ জোরে একবার নিঃশ্বাস নিল। মুহূর্তের জন্যে তাকিয়ে রইল ও গ্লাস দুটোর দিকে । তারপর অন্যমনস্কভাবে দুটো গ্লাসই হাতে তুলে নিল ও। রেখে দিল একটু পরই।

গ্লাস দুটো হস্তগত করে মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, আচ্ছা ফিরোজ’, শফিকই যে তোমাকে ফোন করেছিল সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত?’

ফিরোজা সন্ধানী চোখে মি. সিম্পসনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, শফিকদা নিজের নাম বলেছিল।’

‘গলার স্বর ঠিক শফিকের বলে চিনতে পেরেছিলে তুমি?’

ফিরোজা বলল, তখন গলার স্বরের দিকে মনোযোগ ছিল না আমার। ওর নাম শুনে বুঝতে পেরেছিলাম যে কে কথা বলছে।’

কিন্তু, ধরো, নাম যদি না বলত-তাহলেও বুঝতে পারতে কি কে ফোন করেছিল?’

. ফিরোজা একটু চিন্তা করে বলল, “ঠিক বলতে পারছি না। হয়ত শফিককে সন্দেহ করতাম না। কেননা ও এমন কাজ করতে পারে তা বিশ্বাস করা আমার পক্ষে অসম্ভব মনে হত।

মি. সিম্পসন বললেন, আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে আসলে.শফিক ফোন করেনি, শফিকের নাম ব্যবহার করে ফোন করেছিল অন্য কেউ, শফিকের ঘাড়ে সব দোষ চাপাবার জন্যে।

ফিরোজা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল মি. সিম্পসনের দিকে। বলল, “তা হত হতে পারে। কিন্তু শফিকদা যদি ছোটদাকে খুন না করে থাকে তাহলে সে পায়ে গবে কেন?’

বুয়াশা-৩১

মি. সিম্পসন বললেন, সে কথা সত্য বটে।’

শহীদ এই প্রথম একটা মন্তব্য করল, ‘পালিয়ে যাবার অসংখ্য কারণ থাকতে পারে। খুন করেছে। সুতরাং পালিয়ে গেছে এমন না-ও হতে পারে।

ফিরোজা জিজ্ঞেস করল, শফিকদাই সত্যি সত্যি খুন করেছে বলে আপনাদের ধারণা?’

‘এখনও ঠিক বলা যাচ্ছে না। পালিয়ে যাবার অনেক কারণ থাকতে পারে বটে, কিন্তু পালিয়ে যাওয়াটা প্রকৃত পক্ষে রহস্যময়। ওর সন্ধানে প্রতিটি শহরে লোক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ না করা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।’

ফিরোজা বলল, কিন্তু আমার আম্মার ব্যাপারটা কি? শফিকদা কেন আম্মাকে হত্যা করবে? বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার সময় আমি দরজা খুলে গিয়েছিলাম, তখন অবশ্য বাড়িতে ঢুকলেও ঢুকতে পারে সে। কিন্তু আমার দুধের গ্লাসে যে ঘুমের ট্যাবলেট মেশানো আছে তা সে জানবে কেমন করে?’

মি. সিম্পসন বললেন, এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর এখন দেয়া সম্ভব নয় কোনমতেই। তবে অনুমানের উপর নির্ভর করে এ কথা বলা চলে যে, শফিক তো আগে থেকেও বাড়ির ভিতর লুকিয়ে থাকতে পারে। সে হয়ত লুকিয়ে লুকিয়ে সব লক্ষ করেছে।’

| ফিরোজা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠল, কিন্তু আম্মার ব্যাপারটা ঘটার পর আমি আর শফিককে সন্দেহ করতে পারছি না। আমার যেন মনে হচ্ছে দুটো হত্যার পিছনেই অন্য কোন রহস্য আছে।’

‘বিশেষ ভাবে তুমি কাউকে সন্দেহ করো এ ব্যাপারে?’

ফিরোজা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। একটু পর কি বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু বলল, না। কাউকে সন্দেহ করি না আমি।’

| ফিরোজা এরপর চলে গেল। জেরা শুরু করার আগে শহীদ কানে কানে মি. সিম্পসনকে কি যেন বলল। মি. সিম্পসন চৌধুরী সাহেবকে ডেকে বললেন যে বৈঠকখানায় আর কাউকে আসতে হবে না। ওরাই প্রত্যেকের ঘরে যাবে। তারপর একে একে বাড়ির সকলকে জেরা করা হল। কিন্তু সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়ল।

মি, সিম্পসনের । মিসেস চৌধুরী ঘর থেকে বের হয়ে কখন স্বামীর কাছে। গিয়েছিলেন এবং কখন, আবার নিজের ঘরে এসে দুধ খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন তা কেউই বলতে পারল না। শুধু চৌধুরী সাহেব বললেন, আমার স্ত্রীকে আমিই বারবার বলেকয়ে দুধ খাইয়ে বিছানায় উঠিয়ে দিয়েছিলাম। কে জানত•••!’

প্রত্যেকের নিজস্ব শোবার ঘরে গেল ওরা তিনজন। সকলের জবানবন্দী লিখে নেয়া হল। শহীদ আলাদা আলাদা ভাবে সকলকে একই প্রশ্ন করল-ফিরোজার ধরে কাল রাত থেকে এখন অবধি কেউ ঢুকেছিল কিনা । চাকরাণীটা ছাড়া আর •

ভলিউম-১১

সকলেই বলল ঢোকেনি। ফিরোজার ঘরের টেবিলের নিচ থেকে একটা সিগারেটের টুকরো কুড়িয়ে পেল শহীদ। কাউকে কিছু না জানিয়ে সেটা পকেটে চালান করে দিল ও।

| এরপর বিদায় নিয়ে চলে এল ওরা তিনজন।

বিকেলবেলা গ্লাসের পরীক্ষা শেষে রিপোর্ট এল মি. সিম্পসনের অফিসে। দুটো গাসেই ফিরোজার হাতের ছাপ পাওয়া গেছে। দুটোর একটিতে পাওয়া গেছে মিসেস চৌধুরীরও। অন্য কেউ গ্লাস দুটো বদলাবদলি করার সময় ধরে থাকলেও রুমাল ব্যবহার করছিল নিশ্চয়। তাই ছাপ ওঠেনি।

বেলা সাড়ে চারটার সময় হঠাৎ অফিসে এসে হাজির হলেন মিসেস সালাম। কথাবার্তা শুরু হল। মিসেস সালাম বললেন, মি. সিম্পসন, জামাল যখন নিহত হয় তখন আমার স্বামী কোথায় ছিলেন এ প্রশ্নের উত্তর আমার স্বামী সঠিক দিতে পারেননি। একথা আমার স্বামীই আমাকে বলেছেন। জামাল যখন নিহত হয় তখন তিনি ছিলেন আমার মায়ের বাড়ি। আমার মা-বাবা বড় গরী এবং তাঁদের সাথে আমার শ্বশুর বাড়ির সম্পর্ক ভাল নয়। আমার স্বামী কিছু কিছু অর্থ সাহায্য করেন ওঁদেরকে। সেদিনও গিয়েছিলেন আমার মায়ের হাতে কিছু টাকা দেবার জন্যে। কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়লে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি অসন্তুষ্ট হবেন মনে করে আপনার কাছে প্রকাশ করেননি। কিন্তু আমি ভেবে দেখুঁলাম কাজটা উচিত হচ্ছে না। আপনারা আমার স্বামীকে সন্দেহ করবেন, এদিকে আসল খুনী নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকবে হয়ত। তাই কথাটা বলতে এলাম। কিন্তু আমার শ্বশুর-শাশুড়ি যেন। একথাটা না জানেন, আমার অনুরোধ।’

মি, সিম্পসন আশ্বাস দিয়ে বলর্লেন, ‘কেউ জানবে না। আচ্ছা, দুটো খুনের ব্যাপারে আপনার সন্দেহ হয় কাউকে?’

মিসেস সালাম বললেন, আপনাকে এ প্রশ্নের উত্তর আগেও দিয়েছি। কাউকে সন্দেহ করবার মত দেখছি না আমি। তবে একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার কাল থেকে লক্ষ করছি আমি। গতকাল আমার শাশুড়ি আমার স্বামীকে একা ডেকে কি যেন বলেছিলেন। শাশুড়ির ঘর থেকে আসার পর ওকে কেমন যেন গম্ভীর, চিন্তিত দেখাচ্ছিল। কারণ জিজ্ঞেস করাতে বলেছে, “ও কিছু না। সব কথা তোমার শোনার দরকার নেই।”

ব্যাপারটা কি হতে পারে বলে আপনার ধারণা?’ ‘ কিছুই বুঝতে পারছি না আমি, মি. সিম্পসন।’ এরপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মিসেস সালাম। মি, সিম্পসন রিপোর্ট লিখতে বসলেন।

৩ কুয়াশা–৩১ ..

পাঁচ একদিন পরের ঘটনা ।

রাত একটা। ডেমরা বোড়। বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল কংক্রিটের নির্জন রাস্তা। নারায়ণগঞ্জের দিক থেকে দ্রুত বেগে ছুটে আসছে একটা ভাড়াটে মোটর গাড়ি। গাড়িতে কোন প্যাসেঞ্জার নেই। ড্রাইভার কাসেম আলী প্যাসেঞ্জার নামিয়ে ফিরে আসছে গ্যারেজের উদ্দেশে ঢাকায়। •

| গাড়ি চালাতে চালাতে কাসেম আলীর চোখ জোড়া তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল হঠাৎ। এতক্ষণ রাস্তায় কোন জনমানবের চিহ্ন দেখেনি সে। গাড়ি-ঘোড়াও বড় একটা নজরে পড়েনি। বৃষ্টির রাত। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হয় না কেউ। ঢাকার প্যাসেঞ্জার পাবে এই আশায় নারায়ণগঞ্জ ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল সে। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে খালি গাড়ি নিয়েই ফিরতি পথে রওনা দিয়েছে সে। কিন্তু রাস্তার মাঝখানে, ওই দূরে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন মানুষ। কি ব্যাপার? কে ও?

| আরও সামনে এসে একজন মানুষকে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পরিষ্কার দেখতে পেল ড্রাইভার কাসেম। সাবধান হয়ে গেল সে। ডেমরা রোডে প্রায়ই ডাকাতি হয় আজকাল। গাড়ির স্পীড বাড়িয়ে দিল ও। গাড়িটা আরও সামনে বাড়তে কাসেম আলী অবাক হয়ে দেখল রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানে, লোকটার বেশবাস ভদ্রলোকের মত । এবং তার পায়ের কাছে একজন মানুষ পড়ে রয়েছে। রক্তের দাগ দেখা যাচ্ছে নিঃসাড় লোকটার শার্টে। দাঁড়ানো লোকটা গাড়ি থামাবার জন্যে কাসেম আলীর উদ্দেশে হাত নাড়ছে উত্তেজিত ভাবে।

দ্রুত চিন্তা করতে লাগল কাসেম আলী। দাঁড়ানো লোকটাকে জরিপ করার চেষ্টা করল সে। সন্দেহজনক মনে হল না ভদ্রলোককে। হয়ত কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। কি মনে করে গাড়ির স্পীড কমিয়ে দিল কাসেম আলী। একটু পরই গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তার পাশে। | পাদানি থেকে সাবধানতার জন্যে একটা ছোট হাতুড়ি তুলে নিল কাসেম আলী। বলা যায় না কার মনে কি আছে। সাবধান থাকা ভাল। হাতুড়িটা পকেটে চালান করে দিয়ে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ না করেই নেমে পড়ল সে। ধীরে ধীরে পা বাড়িয়ে সুবেশী লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। সুবেশী লোকটা উত্তেজিতভাবে বলল, তুমি গাড়ি নিয়ে কোন দিকে যাবে, ভাই?’

কাসেম আলী লোকটার গলার স্বরে ব্যাকুলতার রেশ দেখে খানিকটা আশ্বস্ত হল। নিশ্চয় কোন বিপদ হয়েছে বুঝতে পারল সে। বলল, নবাবগঞ্জের দিকে যাব।’

ভলিউম-১১

৩৪

সুবেশী বলল, ভয়ানক একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে গেছে, ড্রাইভার! এই লোকটা আমার বন্ধু। এর বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলাম আমি। হঠাৎ ওর দাদীর শরীর খারাপ হয়ে যায় বলে ডাক্তার ডাকার জন্যে বেরিয়েছিলাম আমরা। রাস্তা পেরোবার সময় হঠাৎ একটা ট্রাক ওকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেছে মিনিট পাঁচেক আগে। একে এখন হাসপাতালে না পাঠাতে পারলে হয়ত বাঁচানই যাবে না! অজ্ঞান হয়ে গেছে, ভীষণ জোরে ধাক্কা খেয়েছে তো!’

| ড্রাইভার ইতস্তত করতে লাগল। সুবেশী লোকটা বলল, একটু কষ্ট হলেও ভাই, মেডিকেল কলেজে পৌঁছে দিতে হবে একে। একটু উপকার তোমাকে করতেই হবে।

ড্রাইভারের সহানুভূতি জাগল। বলল, “ঠিক আছে, গাড়িতে তুলুন আপনার বন্ধুকে।

সুবেশী লোকটা তার বন্ধুর জ্ঞানহীন দেহটা গাড়িতে তুলে দিল। অবশ্য লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেছে না একেবারে মরে গেছে তা ড্রাইভার কাসেম আলী সঠিক বুঝতে পারল না। সুবেশী লোকটা বলল, তুমি আমার ঠিকানা নিয়ে রাখে। আমি আমার বন্ধুর বাড়িতে খবরটা জানিয়ে আসি আগে। তারপর মেডিকেলে যাব। মেডিকেলে হয়ত তোমাকে জিজ্ঞেস করবে কার কাছ থেকে তুমি দুর্ঘটনার কথা জেনেছ। ঠিকানাটা লিখে দিচ্ছি তোমাকে।’

| একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিল সুবেশী লোকটা। ড্রাইভার সেটা পকেটে রেখে গাড়ি ছেড়ে দিল। সুবেশী লোকটা রাস্তার পাশে সরু মেঠো পথ দিয়ে নেমে গেল গ্রামের দিকে।

• ছুটে চলল কাসেম আলীর গাড়ি মেডিকেল হাসপাতালের দিকে। | রাত একটা কুড়ি মিনিটে মেডিকেলে ভর্তি করা হল ড্রাইভার কাসেম আলী কর্তৃক আনীত লোকটাকে। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের ডাক্তার লোকটাকে দেখেই চমকে উঠলেন। একটা হাত তুলে নিয়ে পালস দেখেই দারোয়ানকে ডেকে পাঠালেন তিনি। বললেন, “কে এনেছে লাশ?’

দারোয়ান উত্তর দিল, ‘একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার, স্যার।’ ডাক্তার বললেন, কি বলেছে সে?’

ট্রাক নাকি ধাক্কা মেরে পালিয়েছে। একটা লোক ওর গাড়ি করে পাঠিয়েছে হাসপাতালে ভর্তি করার জন্যে।’

ডাক্তার বললেন, ইনভেস্টিগেশন অফিসার আবদুল হককে পুলিসে ফোন করতে বলে দাও এখুনি। ড্রাইভারটাকে আটকাও। মিথ্যে কথা বলছে সে অথবা কেউ তাকে বোকা বানিয়েছে। লোকটা ট্রাক দুর্ঘটনায় মারা যায়নি। মারা গেছে। মাথায় ডাণ্ডা জাতীয় কোন অস্ত্রের আঘাতে। কমপক্ষে তিনঘন্টা আগে মারা গেছে লোকটা।’

কুয়াশা-৩১

পনেরো মিনিটের মধ্যে পুলিস এলো হাসপাতালে। ড্রাইভার কাসেম আলীকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করল বড় দারোগা। কাসেম আলী সত্য ঘটনা বিবৃত করল। ঠিকানাটা নিল ড্রাইভারের কাছ থেকে। ড্রাইভারকে নিয়ে গেল জেল হাজতে।

সকাল না হওয়া অবধি বিবেচনা করা যাবে না তার মুক্তির ব্যাপারটা।

| রাত তিনটেয় থানা থেকে ফোন এল চৌধুরী সাহেবের ‘হ্যাপি কটেজ’-এ। চৌধুরী সাহেবের বড় এবং মেজ জামাই রাত দুটোর সময় থানায় ডায়েরী করে গেছে সালাম চৌধুরীর কোন সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। থানা থেকে ফোন করল বড় দারোগা। ফোন ধরল বড় জামাই। বাড়ির সকলে আতঙ্কিত মনে অপেক্ষা করছিল। বড় জামাই বড় দারোগার বক্তব্য শুনল ফোনে। রিসিভারটা পড়ে গেল তার হাত থেকে। •

| কি হয়েছে!’ ‘

কান্না মিশ্রিত আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন করে উঠল সকলে। বড় জামাই ঢোক গিলে অশুভ সংবাদটা উচ্চারণ করল অতি কষ্টে, ‘সালামের লাশ পাওয়া গেছে। মেডিকেলে আছে লাশ।

| শোকের উপর শোক। পাথরের মত বড় জামাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সকলে। কেঁদে ওঠার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে ওদের।

. মি. সিম্পসন সকাল নটায় একা উপস্থিত হলেন হ্যাপি কটেজ’-এ। তাকে দেখে কোনরকম প্রতিক্রিয়া হল না চৌধুরী বাড়ির কারোর মধ্যে। পুলিস শুধু জেরা, আর যাতায়াতই করতে পারে। খুনীকে খুঁজে বের করতে পারে না। এই বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছে সকলের মনে। একে একে খুন হল বাড়ির ছোট ছেলে, বাড়ির কর্তী এবং বাড়ির বড় ছেলে। অথচ পুলিস এখনও পরিষ্কার ভাবে সন্দেহও করতে পারল না কাউকে তিন-তিনটে খুনের দায়ী হিসেবে। মি. সিম্পসন মেজ জামাইকে জেরা করলেন সর্বপ্রথম। মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, কোথায় ছিলেন আপনি গতকাল মতে, মি. রশিদ?’

আবদুর রশিদ বিষণস্বরে উত্তর দিল, সন্ধে সাড়ে সাতটায় বাড়ি থেকে বের এই আমি। আমার হোটেল মহল অ্যাও বারে পৌঁছুই সাতটা পঁয়ত্রিশে।’

‘পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গেলেন মতিঝিল কমার্শিয়াল এরিয়ায়?’ |

মেজ জামাই বলল, ‘পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবার কথা নয়। ওঃ, আপনি বুঝি জানেন না আমার গাড়ি আছে?’ | ..

‘গাড়ি করে অবশ্য পাঁচ মিনিটই লাগার কথা। বলে যান।’

রাত বারোটায় বের হই আমি আমার হোটেল অ্যাও রেস্টুরেন্ট থেকে। রাত বারোটার আগে আপনি আর বের হননি? প্রমাণ করতে পারবেন?”

মে জামাই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। মি. সিম্পসন অবশ্য বুঝতে পারছিলেন কারণটা । একটা বাড়িতে পরপর তিনটে

ভলিউম-১১

খুন হয়ে গেলে মানুষ তো দিশেহারা হয়ে পড়বেই। আবদুর রশিদ উত্তরে বলল, ‘প্রমাণ’ আর কেমন করে করব? হোটেলের সব কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। যারা দেখেছে আমাকে তারাই বলতে পারবে বারোটার আগে বের হয়েছিলাম কিনা।’

দয়া করে আপনার ফোন নম্বরটা দেবেন?

ফোন নম্বরটা দিল আবদুর রশিদ। মি. সিম্পসন তখুনি ফোন করলেন হোটেল মহল অ্যাণ্ড বারে। কথাটা জিজ্ঞেস করে অপেক্ষা করতে হল না মি. সিম্পসনকে। ক্লার্ক উত্তর দিল, জি, স্যার, মি. রশিদ গতকাল রাত বারোটায় গেছেন হোটেল থেকে। না, তার আগে কেউ দেখেনি তাঁকে বের হতে। | ফোন রেখে দিয়ে মি. সিম্পসন বললেন, কর্তব্যের খাতিরে অপ্রীতিকর কাজ করতে হয়। কিছু মনে করবেন না।’

আবদুর রশিদ বিষণ্ণভাবে তাকিয়ে রইল মি. সিম্পসনের দিকে। কথা বলল । মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, বারোটার পর?

বারোটা পাঁচে বাড়ি ফিরি আমি। এসে শুনি সালাম বাড়ি ফেরেনি। আমার বাড়ি থেকে বের হবার পরই বেরিয়েছে, অথচ তখনও দেখা নেই। আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করার পর গাড়ি নিয়ে বের হলাম। ওর শ্বশুর বাড়ি গেলাম, সেখানেও নেই। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম আমি। রাত তখন হবে একটা দশ।’

মি. সিম্পসন ভেবে দেখলেন ব্যাপারটা। পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট অনুযায়ী সালাম চৌধুরীকে হত্যা করা হয়েছে গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে। তারপর মাথায় লোহার রড বা ওই জাতীয় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। ট্রাক অ্যাক্সিডেন্টের গল্পটা তৈরি করার জন্যেই মাথায় ঘা মারা হয়েছে বলে মি. সিম্পসনের বিশ্বাস । মৃত্যুর সঠিক সময় সম্পর্কে পোস্টমর্টেমের রিপোর্টে নির্দিষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। মৃত্যু সন্ধ্যা সাতটা থেকে দশটার মধ্যে যে-কোন সময় হতে পারে। এদিক দিয়ে আবদুর রশিদকে সন্দেহ করা চলে না। কিন্তু রাত একটার সময় ট্যাক্সি ড্রাইভার কাসেম আলীকে যে সুবেশী লোক লাশটা মেডিকেল হাসপাতালে পৌঁছে দেবার ভার দেয় সে যদি হ্যাপি কটেজ’-এর কেউ হয় তাহলে রাত একটার সময় এরা

কে কোথায় ছিল তা জানা দরকার।

| রাত ঠিক একটার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?’

| মি. সিম্পসনের প্রশ্নের উত্তরে আবদুর রশিদ বলল, রাত একটার সময় আমি সালামের ছোট মামার বাড়ি থেকে ওর বড় মামার বাড়ি যাচ্ছিলাম। যাবার পথে ঘড়ি দেখেছিলাম। তখন একটা বাজে। ওর বড় মামাকে সালামের কথা জিজ্ঞেস করে বাড়ি ফিরে আসি আমি। রাত তখন একটা দশ।’

সালাম চৌধুরীর দুই মামার বাড়িতেই ফোন আছে। ফোন করে জেনে নিলেন ব্যাপারটা মি. সিম্পসন। দুই মামাই বললেন তাঁরা ঘড়ি দেখেননি বটে, কিন্তু মি, কুয়াশা-৩১

৩৭

সিম্পসন যে সময়ের কথা জিজ্ঞেস করছেন সামান্য কমবেশি.সেই সময়েই আবদুর

রশিদ তাঁদের বাড়ি গিয়েছিল ।

আবদুর রশিদকে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। মি. সিম্পসন বড় জামাই রুহুল আমিনকে ডেকে দিতে বললেন। রুহুল আমিনকে বেশি প্রশ্ন করার দরকার পড়ল না। কেননা কাল সন্ধ্যার পর থেকে বাইরেই বের হয়নি রুহুল আমিন।

সুতরাং আবার দোষী সন্দেহ করতে হয় সেই ফিরোজার প্রেমিক শফিককে। মি. সিম্পসন এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছেন তিনটে হত্যার জন্যে শফিকই দায়ী। যে সুবেশী লোকটা ড্রাইভার কাসেম আলীকে সালামের লাশটা মেডিকেলে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দিয়ে কেটে পড়ে সে নিজের ঠিকানা লিখে দিয়েছিল কাসেম আলীকে। পুলিস ভোর রাতে সেই ঠিকানায় পৌঁছে দেখে ঠিকানাটা শফিকের ছাড়া আর কারও নয়। বেচারা ড্রাইভার কাসেম আলীকে কয়েদ করে রাখার কোন মানে খুঁজে পাননি মি. সিম্পসন। তাকে ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিয়ে এসেছেন তিনি।

মি. সিম্পসন আর কাউকে জেরা করবেন কিনা ভাবছিলেন। এমন সময় বৈঠকখানায় প্রবেশ করলেন সালাম চৌধুরীর স্ত্রী মিসেস সালাম।

আসন গ্রহণ করে মিসেস সালাম বলল, “মি. সিম্পসন আপনার নিশ্চয় মনে আছে যে সেদিন আপনার অফিসে গিয়ে আমি বলেছিলাম আমার শাশুড়ি আমার স্বামীকে কিছু বলেছিলেন এবং তারপর থেকে আমার স্বামী অস্বাভাবিক গম্ভীর এবং চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। আমার এখন সন্দেহ ব্যাপারটা একটা শার্ট সম্পর্কে। আমার শাশুড়ি সম্ভবত একটা শার্ট সম্পর্কে কোন কথা আমার স্বামীকে বলেছিলেন।’

আপনার সন্দেহের কারণ কি?

গতকাল আমার স্বামী আমাকে লুকিয়ে একটা লরি প্যাকেট ঘরে নিয়ে এসে রাখেন। তোশকের তলায় সেটা রেখেছিলেন তিনি। রাখার সময় আমি ঘরে ছিলাম মা, কিন্তু জানালা দিয়ে ব্যাপারটা আমি দেখে ফেলি। আমার স্বামী বাথরুমে গেলে তোশক উল্ট আমি দেখি প্যাকেটটায় একটা ইস্ত্রি করা শার্ট রয়েছে। শার্টটা লণ্ডি থেকে সদ্য আনানো হয়েছে তা আমি বুঝতে পারি। এবং বুঝতে পারি শার্টটা আমার স্বামীই এনেছেন। বাইরে থেকে এসেই তোশকের নিচে ওটা রাখেন তিনি। শার্টটা যে কার তা আমি চিনতে পারিনি। বাড়িতে কার ক’টা, কি রকম শার্ট আছে তা সঠিক ভাবে জানি না। বাড়ির যে কারও হতে পারে ওটা। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, শার্টটা লঞ্জি থেকে ধোলাই হয়ে আসেনি। ঘরে ধুয়ে লন্ড্রি থেকে ইস্ত্রি করে, আনানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের বাড়ির পুরুষদের কোন শার্ট-প্যান্টই বাড়িতে বোয়া হয় না। লখ্রিতে কাপড় ধোয়া হলে লণ্ডি থেকে মোটা এবং ছোট্ট এক ইঞ্চি একটা কাপড়ের টুকরোয় নম্বর লাগানো থাকে। সুতো দিয়ে সেলাই করা থাকে। সেটা। কিন্তু এটাতে সেরকম কিছু ছিল না। খবরের কাগজ দিয়ে শার্টটা জড়ানো

৩৮

ভলিউম-১১

*.–

।–

—–

–

–

–

–

—

—

–

———–

–

ছিল। এবং নম্বর লাগানো ছিল সাদা এক টুকরো কাগজে। নম্বরটা আমি দেখতে পাই এবং লুকিয়ে ফেলি। তারপর রান্নাঘরে যাই আমি। আমার স্বামী বাথরূম থেকে বের হয়ে চায়ের জন্যে রান্না ঘরে আমার কাছে যান। তারপর ঘরে ফিরে আসি আমরা দুজন। এর ঘন্টা দুয়েক পর আমি আমার শ্বশুরের ঘরে যাই। পনেরো মিনিট পর আমার স্বামী আমাকে ডেকে পাঠান। আমি নিজের ঘরে ফিরে আসতে দেখি তোশকটা মেঝেতে পড়ে আছে। জিজ্ঞেস করি আমি-এমন করল কে? আমার স্বামী উত্তেজিত ভাবে বলে উঠেন, “তোশক সরিয়েছি আমি। একটা জিনিস রেখেছিলাম, সেটা পাচ্ছি না। তুমি দেখেছ নাকি?’

আমি বলি–দেখিনি। কিন্তু মনে মনে অবাক হয়ে ভাবি শার্টটা গেল কোথায়? যাই হোক, আমার স্বামীকে এরপর বারবার জিজ্ঞেস করি জিনিসটা আসলে কি? কিন্তু কোন উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যান উনি। নম্বর লেখা কাগজটা আমি ওঁকে দিইনি। আপনাকে দেখাবার সুযোগ গতকাল পাইনি। তারপর রাতে খবর পেলাম আমার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি এসেছেন বলে, তা না হলে নম্বরটা দেখাবার জন্যে আপনার কাছে যেতাম। বড় ভয়ানক ভুল করেছি আমি। আমার ধারণা এই শার্টের পিছনে কোন না কোন রহস্য আছে। এবং সেই জন্যেই আমার। স্বামী খুন হয়েছেন। গতকাল দিনে যদি এটা আপনাকে দিতে পারতাম তাহলে

হয়ত এতবড় সর্বনাশ আমার ঘটত না।

মিসেস সালামের কাছ থেকে নম্বর লেখা কাগজটা নিয়ে পকেটে ফেললেন মি. সিম্পসন।

এরপর দু’একটা প্রশ্ন করে বিদায় নিলেন মি. সিম্পসন। | অফিসে ফিরে লরি নম্বরটা লিখে দিয়ে দু’জন কনস্টেবলকে চৌধুরীদের পাড়ায় এবং পাড়ার আশেপাশে সবক’টা লণ্ডিতে খোঁজ নেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলেন মি. সিম্পসন । ঘন্টা দুয়েক পর কনস্টেবল দু’জন ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল। প্রায় পনেরোটা লখ্রিতে গিয়ে খোঁজ করেছে ওরা। নম্বরটা গত মাসখানেকের মধ্যে কোন লখ্রি থেকেই ব্যবহার করা হয়নি।

সারাদিন “হ্যাপি কটেজ’-এর হত্যা রহস্য নিয়ে মাথা ঘামিয়েও কোন কূল কিনারা করতে পারলেন না মি. সিম্পসন।

তারপর সন্ধ্যার সময় হঠাৎ বেজে উঠল ফোনটা।

খবর এসেছে, শফিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘোড়াশাল রেল স্টেশনে পুলিস ওকে গ্রেফতার করে। এই মুহূর্তে সে রমনা থানার জেল-হাজতে বন্দী। খবরটা পেয়ে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ছুটলেন মি. সিম্পসন।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে রমনা থানায় পৌঁছে গেলেন মি. সিম্পসন। পৌঁছেই সাব ইন্সপেক্টরকে হুকুম করলেন, শফিককে অফিস রূমে আনাও।’

শফিককে দুজন কনস্টেবল পাহারা দিয়ে নিয়ে এল। ধীর পায়ে অফিস রূমে

কুয়াশা-৩১

এসে দাঁড়াল শফিক। হাত দুটোয় হ্যান্ডকাফ। দারুণ স্বাস্থ্য দেখে কনস্টেবল দুজন দড়ি বেঁধে নিয়ে এসেছে শফিককে, যাতে পালাবার চেষ্টা করতে না পারে। অফিস রূমে ঢুকে যথাক্রমে সাব ইন্সপেক্টর এবং মি. সিম্পসনের দিকে তাকাল শফিক। শুকিয়ে গেছে মুখটা। রাতে সম্ভবত. ঘুম হয়নি ভাল চোখের নিচে কালির দাগ। কাপড় জামা ময়লা। মি. সিম্পসন শফিকের আপাদমস্তক দেখতে লাগলেন তীব্র দৃষ্টিতে। হঠাৎ ভারি গলায় শফিক বলে উঠল, আমাকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সত্যি কোন ফল পাবেন না আপনারা । আমার কথা আমি যা বলব তা যদি বিশ্বাস করেন। সময় অপচয় হবে না আপনাদের।’

মি. সিম্পসন কঠোর কণ্ঠে বলে উঠলেন, উপদেশ দেবার মত উপযুক্ত এখনও হওনি তুমি, ছোকরা! বেশি কথা বলার চেষ্টা করো না। আমি যা প্রশ্ন করব তার উত্তর দিয়ে যাবে একের পর এক। তোমাকে বিশ্বাস করব কি করব না, সেটা আমাদের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দাও।’

শফিক নিরুত্তর হয়ে গেল। মি. সিম্পসন প্রশ্ন করলেন, তোমার বাবার নাম মোহাম্মদ শফিক? তুমি নয়াপল্টনের বস্তি এলাকার একটা একতলা পাকা বাড়িতে, থাকো?’

– জ্বি, হ্যাঁ।’

‘তোমার সাথে “্যাপি কটেজ”-এর ছোট মেয়ে ফিরোজার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং জামাল যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিন তার সাথে মারামারি করেছিলে তুমি?’

‘ফিরোজার সাথে সম্পর্কের কথা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু জামালের সাথে মারামারি করিনি আমি, জামাল একতরফাভাবে আমাকে মেরেছিল।’’ ।

মি. সিম্পসন সঙ্গে সঙ্গে কঠোর কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘একতরফাভাবে মার খেয়ে তোমার মধ্যে প্রতিহিংসাবোধ জন্মেছিল এবং তার ফলে তুমি জামালকে খুন করে। তাই না?’

। জামালকে আমি খুন করিনি।’ ‘কিন্তু তুমি নিজেই ফোন করে কথাটা ফিরোজাকে জানিয়েছ। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।’

শফিক চমকে উঠল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে মি. সিম্পসনের দিকে। তারপর বলে উঠল, এ কথাও অস্বীকার করছি আমি। ফিরোজাকে কেন, গত মাসখানেকের মধ্যে কাউকেই ফোন করিনি আমি। ‘

কিন্তু তোমার প্রেমিকা নিজে যে কথাটা প্রকাশ করে দিয়েছে!’, শফিক বলল, “সে ভুল করেছে। এর বেশি কিছু বলার নেই আমার।

মি, সিম্পসন একটার পর একটা প্রশ্ন করে গেলেন। শফিক প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর দিল । কিন্তু তার কোন উত্তরই বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হল না মি, সিম্পসনের। তিনটে খুনের অভিযোগই অস্বীকার করল সে। তবে সে পালিয়েছিল

ভলিউম-১১

৪০

কেন? উত্তরে বলল, ওর বন্ধুরা জানতে পারে পুলিস ওকে গ্রেফতার করার জন্যে ওর বাড়িতে অপেক্ষা করছে। তারা ওকে খবর দেয় এবং পালিয়ে যেতে বলে। মাথা ঠিক রাখতে না পেরে সে পালিয়ে যায় ঘোড়াশালে। ঘোড়াশালে কারও বাড়ি যায়নি সে। হোটেলে খেয়েছে এবং যেখানে সেখানে রাত কাটিয়েছে। সুতরাং সে যে ঘোড়াশালে ছিল তা প্রমাণ করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। ওর দাবি হল মিসেস চৌধুরী এবং সালাম চৌধুরীর হত্যার সময় সে ঢাকাতে ছিল না। মোট কথা সব ক’টা অভিযোগই অস্বীকার করল শফিক। পুরো তিন ঘন্টা ধরে জেরা করেও তাকে দিয়ে কোন কথা স্বীকার করাতে পারলেন না মি. সিম্পসন । হুমকি দিলেন, ভয়

দেখালেন, আশ্বাস দিলেন-কিন্তু শফিক অটল রইল তার বক্তব্যে।

ছয়।

কয়েকদিন পরে এক সন্ধ্যাবেলার কথা।

| নয়া পল্টন। বস্তি এলাকা। সবেমাত্র সন্ধ্যার কালো ছায়া পৃথিবীর গায়ে কালো রঙ মাখিয়ে দিয়েছে।

বস্তি এলাকায় মুটে-মজুর, কুলি-কামিনরাই বাস করে। সূন্ধে হতে না হতে এক মুঠো খেয়ে বা একেবারে না খেয়েই ছেঁড়া কাঁথা বিছিয়ে বস্তিবাসীরা শুয়ে সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর জোরে জোরে হাঁপ ছাড়ছে। শুয়েছে বটে, কিন্তু কেউ ঘুমিয়ে পড়েনি। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে সহজে ঘুম আসার কথা নয়। তার উপর আগামীকাল কিভাবে কি কাজ করলে সারাদিন পর দু’মুঠো খাবার জুটবে সে দুশ্চিন্তায় চোখের পাতা এক হতে চায় না।

| বস্তিবাসীরা কেউ ঘুমায়নি। তাদের সকলের কানেই ঢুকছিল বুড়ো রফিক। মিয়ার কান্নার করুণ সুর। রফিক মিয়ার কপাল মন। একশো তিন বছরের বুড়ো রফিক মিয়া। দুনিয়ায় এক যুবক ছেলে ভিন্ন আর কেউ নেই তার। বস্তিবাসীরা। জানে রফিক মিয়ার ছেলের মত ছেলে হয় না। হীরের টুকরো ছেলে শফিক। বস্তির একধারে একটা একতলায় বাপ-বেটাতে বাস করে ওরা। কিন্তু বস্তির ভাল-মন্দতে শফিক সকলের আগে সামনে এসে দাঁড়াত। বস্তির বাসিন্দাদেরকে শফিক বয়স অনুযায়ী ভাই, বোম, মা, বাপ বলে মনে করত। বস্তিবাসীরা প্রায় সকলেই শফিকের কাছে ঋণী। কত লোকের কত রকম উপকার যে শফিক করেছে তার কোন হিসেব দেয়া সম্ভব নয়। সেই হীরের টুকরো ছেলেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে চৌধুরী সাহেবের দুই ছেলে এবং স্ত্রীকে হত্যা করার অভিযোগে । ‘বস্তিবাসীরা মনে মনে জানে শফিক এ কাজ করেনি। কিন্তু বস্তিবাসীদের মনে ভয়ও আছে, এবং তারা সবাই অশিক্ষিত। তাই কেউ কেউ ভাবে শফিক হয়ত সত্যিই খুন করেছে। তা না হলে কেন শফিককে পুলিশ গ্রেফতার করবে? শফিক পালিয়ে

কুয়াশা-৩১

ছিলই বা কেন? । বুড়ো রফিক মিয়া ক’দিন থেকেই কান্নাকাটি করছে। একমাত্র ছেলে তার শফিক। বয়স হয়েছে নিজের। খেটে খাবার বয়স পার হয়ে গেছে সে বহুকাল আগে। শফিক একটা কারখানার কুলীর সর্দার হিসেবে কাজ করত। একশো কুলি খাটত তার অধীনে। বেশি মাইনে নয়। তবে যা পেত তাতেই বাপ-বেটার চলে যেত। শফিককে পুলিস ধরে নিয়ে যাবার পর বুড়োর হয়েছে মরণদশা। রোজ পয়সা আনত শফিক। শফিক নেই, পয়সাও নেই, বস্তিবাসীরা নিজেরাই গরীব। তারা কতদিন বুড়োকে খেতে দেবে?

নোংরা বস্তির সরু রাস্তা দিয়ে দীর্ঘাকৃতি, স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ ধীর পায়ে হাঁটছিল। তার কানেও প্রবেশ করেছে বুড়োর করুণ কান্নার সুর। ধীর পায়ে বস্তির করুণ দৃশ্য দেখতে দেখতে এগোচ্ছে অস্বাভাবিক লম্বা-চওড়া মানুষটা। পরনে তার কালো রঙের প্যান্ট এবং হালকা নীলচে রঙের শার্ট। মানুষটার বিশাল বুক মাঝে মাঝে ফুলে ফুলে উঠছে। দীর্ঘশ্বাস নেবার ফলে এমনটি হচ্ছে। মানুষ পৃথিবীতে কত কষ্ট করে বেঁচে থাকে সে দৃশ্য স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করতে করতে দুঃখে এবং দুশ্চিন্তায় চোখ দুটো চকচক করছে তার। এগিয়ে চলেছে সে রফিক মিয়ার কান্নার সুর লক্ষ করে।

* বস্তিবাসীরা হঠাৎ আর শুনতে পেল না বুড়ো রফিক মিয়ার কান্নার শব্দ। কেন

বিশাল বুকওয়ালা সেই দীর্ঘাকৃতি ব্যক্তি বুড়ো রফিক মিয়ার বাড়ির ভিতর ঢুকে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি বাবা; আপনি কাঁদছেন কেন? আপনার কি দুঃখ?’

| অকস্মাৎ ভারি অপরিচিত কণ্ঠে ‘বাবা’ সম্বোধন শুনে চমকে উঠে জল ভরা চোখ দুটো ফিরিয়ে তাকাল রফিক মিয়া। রফিক মিয়ার শরীরের প্রতিটি বিন্দুতে বয়সের ছাপ পরিস্ফুট। বিঙ্খিত চোখে একরাশ অভিযোগ নিয়ে দীর্ঘাকৃতি অস্বাভাবিক স্বাস্থ্যবান মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল সে। দীর্ঘাকৃতি ব্যক্তি মোলায়েম কণ্ঠে আবার বলল, আপনি আপনার দুঃখের কথা সব আমাকে শোনান, বাবা । আমি চেষ্টা করব আপনার দুঃখ দূর করার।’ | তুমি..তুমি কে, বাবা! এত মায়াদয়া তোমার মনে? এমন ভাল মানুষ দুনিয়ায় এখনও আছে, একথা যে বিশ্বাস করতে পারিনি এতদিন, বাবা!’

* দীর্ঘাকৃতি ব্যক্তি হাসিমুখে বলল, আমি ভাল মানুষ নই, বাবা। আমার পরিচয় জেনে কোন উপকার হবে না আপনার। আমি মানুষ, এটাই আমার সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র পরিচয়। মানুষই মানুষের দুঃখ দূর করতে চায় এবং পারে। আপনি আমাকে বলুন বাবা সব কথা।’

বুড়ো রফিক মিয়া দম নিতে নিতে তার দুর্ভাগ্যের কথা ব্যক্ত করল। সব শুনল। দীর্ঘাকৃতি ব্যক্তি। তারপর সেই মহান আশ্বাসের হাসি হেসে বলল, আপনার

ভলিউম-১১

৪২

উপকার বিশেষ কিছু করতে পারব না আমি, বাবা। তবে আমার দ্বারা যতটা করা সম্ভব আমি তার সবই করব। আপনি বললেন, আপনার ছেলেকে এক নজর দেখতে চান আপনি। আমি কথা দিচ্ছি আগামী কাল সকাল দশটায় আপনার ছেলে এখানে এসে আপনার সাথে দেখা করে যাবে। তা সে দোষীই হোক বা নির্দোষই হোক। কথা দিলাম আমি।’ ২ ‘কিন্তু তা কি করে সম্ভব?’ রফিক মিয়া আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

কথাটা বলে দীর্ঘাকৃতি ব্যক্তি পকেট থেকে কয়েকটা দশ টাকার নোট বুড়ো রফিক মিয়ার সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়াল।

• তুমি কে, বাবা!’ ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করে উঠল রফিক মিয়া।

কোন উত্তর মিলল না। অদৃশ্য হয়েছে সেই দয়ামায়ার বিশাল শরীর।

পরদিন সকাল বেলার ঘটনা। বেলা ন’টা। রমনা থানার সামনে একটা প্রিজন ভ্যান এসে দাঁড়াতেই গার্ডবক্স থেকে দুজন কনস্টেবল লাফিয়ে নেমে পড়ল থানা কম্পাউন্ডের ভিতর। দ্রুত পায়ে সিধে অফিস রূমে গিয়ে ঢুকল ওরা। একজন পকেট থেকে একটা বড় কাগজ বের করে বড় দারোগার সামনের টেবিলে রাখল। তার আগে নিখুঁত ভঙ্গিতে দুজনেই স্যালুট ঠুকে সম্মান প্রদর্শন করে নিয়েছে। | বড় দারোগা গম্ভীরভাবে ওদের দুজনকে দেখে নিয়ে টেবিল থেকে টাইপ করা। কাগজটা তুলে পড়তে শুরু করল। চিঠিটা পড়ে আবার ওদের দুজনের দিকে তাকাল সে। তারপর মি, সিম্পসনের সইটা দেখল টাইপ করা চিঠিটার নিম্নাংশে দৃষ্টি রেখে। পরক্ষণেই চোখ তুলে বেল টিপল। একজন কনস্টেবল ঢুকল অফিসে। বড় দারোগা গম্ভীর স্বরে হুকুম করল, কয়েদী শফিককে হাজির করো।’

শফিককে নিয়ে আসা হল দু’মিনিটের মধ্যেই। বড় দারোগা আগন্তুক দুই কনস্টেবলকে একটা খাতা দেখিয়ে বলল, সই করো এখানে।’

কনস্টেবলদ্বয় একে একে সই করল। বড় দারোগা সই দুটো পরীক্ষা করে। বলল, নিয়ে যাও। দেখো, সাবধানে যেয়ো। তিনটে খুনের দায় ওর ঘাড়ে। পালালে রক্ষা নেই।’

স্যালুট করল আবার কনস্টেবলদ্বয়। দুজনের একজন এক গাল হেসে বলে ফেলল, ‘পালাবে, কি বলেন, স্যার! পালানো কি অতই সহজ!

যাও।’

গম্ভীর ভাবটা আরও বেশি ফুটিয়ে বড় দারোগা নিজের কাজে মনোনিবেশ করল । কনস্টেবলদ্বয় শফিকের দু’দিক থেকে দুই হাত ধরে বের হয়ে এল থানা থেকে।

থানা থেকে বের হতেই এক দীর্ঘাকৃতি, স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি ওদের তিনজনের সামনে আবির্ভূত হল। শফিকের চোখের উপর চোখ স্থাপন করে সে ব্যক্তি বলে কুয়াশা-৩১

যশোক

অন্য

স্থা

উঠল, তুমি দোষী, না নির্দোষ?

কিন্তু আপনি কে…?” ‘দোষী, না, নির্দোষ।’ |

রহস্যময় ব্যক্তিটি দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করল নিচু অথচ মোটা কণ্ঠে। শফিক বিশাল একটা শরীর এবং ব্যক্তিত্বের সামনে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র এবং অপ্রতিভ

অনুভব করল। কে এই বিশালদেহী?’

নিজের অজান্তেই শফিকের গলা থেকে বের হল, আমি নির্দোষ। | ‘বেশ। বেলা দশটায় দেখা করবে তুমি তোমার বুড়ো বাপের সাথে। যদি সত্যি তুমি নির্দোষ হও তাহলে পুলিস কেন, কেউ তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু যদি তুমি, দোষী হও, তাহলে পৃথিবীর এমন কোন ক্ষমতা নেই যে তোমাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারে বা রক্ষা করতে পারে। আমি তোমাকে খুঁজে পাবই। তখন মিথ্যে কথা বলার শাস্তি পেতে হবে তোমাকে।’

শফিকের কি যে হল কে জানে। তার ইচ্ছা হতে লাগল বিশালদেহী মানুষটার, পায়ের উপর আছড়ে পড়তে পারলে তার জীবন সার্থক হয়ে যাবে। অস্ফুটে আবার বলে উঠল সে, আমি নির্দোষ।

শফিকের কথা শেষ হতেই কনস্টেবল দু’জন হাত দুটো ধরে মৃদু টান দিল । এগিয়ে চলল শফিক। প্রিজন ভ্যানে চড়বার আগে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সে রহস্যময় মহান ব্যক্তিটিকে আর একবার চোখের দেখা দেখবার জন্যে। কিন্তু শফিক তাকে আর দেখতে পেল না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে বিশালদেহী মানুষটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।’ | গাড়িতে চড়ল শফিক। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল। শফিক ভাবছিল বেলা দশটায় বাবার সঙ্গে দেখা করতে বলে গেল,আশ্চর্য মানুষটা। কিন্তু কি করে দেখা করবে সে? পুলিসরা তাকে ছাড়বে কেন?

শফিক বিমূঢ় হয়ে গেল কথাটা ভাবতে ভাবতে। এমন সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল প্রিজন ভ্যানটা। গাড়ির দরজা খুলে দেয়া হল। কনস্টেবল দু’জন কোন কথা

বলে গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাথে উঠে পড়ল। ফুটপাথ ধরে সিধে হেঁটে চলল। তারা। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। শফিক বিশ্বাস করতে পারল না নিজের চোখ দুটোকে। তাকে পাহারা দেবার কথা ভুলে গিয়ে ওরা দু’জন এমন আশ্চর্যভাবে চলে গেল কেন!

শফিকের বিস্ময়ের ভার আরও বাড়িয়ে দিল এবার স্বয়ং ড্রাইভার। প্রিজন ভ্যানের ড্রাইভিং সীট থেকে নেমে শফিকের কাছে গার্ড বক্সের ভিতর চলে এল সে। শফিক বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইল ড্রাইভারের দিকে। ড্রাইভার পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হঠাৎ নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল সে, একটা বিড়ি-টিড়ি হোবে নাকি, মিস্টার?’

৪৪

ভলিউম-১১

‘বিড়ি! হাঁ হয়ে গেল শফিকের মুখ। লোকটা বলে কি?

জুশ্চিন্টা কোরো না, ডোস্টো। টোমার হাট দুটো বস্তু আছে টো কি হয়েছে, আমি টোমার পকেট থেকে নিকাল লেগা। আছে বিড়ি-টিড়ি?

‘নেই।

ঢোক গিলে উত্তর দিল শফিক। ড্রাইভারের মুখটা বাঙলার পাঁচ সংখ্যার মত বেঁকে গেল নিরাশায়। পকেট থেকে একটা চাবি বের করে শফিকের হাতের হাতকড়া খুলতে খুলতে বলে উঠল, টাটে কিছু এসে যায় না, নেই টো কি হল ডোন্ট মাইণ্ড! টা, পার্সোনাল কোশ্চেন টোমাকে করটে পারি কি?’

শফিক কিছু বলার আগেই ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে বসল, বউ-টউ আছে বাড়িটে? হামার সাটে পরিচয় করিয়ে ডেবে টুমি টোমার ওয়াইফের সাটে! আজ

এ ফ্রেণ্ড?’।

‘আমি বিয়ে করিনি এখনও।’ | ড্রাইভার দ্বিতীয় শকটাও হজম করল বাংলার পাঁচ সংখ্যার মত মুখ করে। শফিকের হাতকড়া খুলে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। ড্রাইভার চলে যাচ্ছে দেখে শফিক বিস্ময় চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করে উঠল, “তোমরা সব চলে যাচ্ছ যে একে

একে? আর আমি?”

ড্রাইভার বাঁকা মুখ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘আমি কি?” ‘আমি কি করব এখন?” ড্রাইভার বলল, ‘টুমি যাও।’ কিন্তু কোথায় যাব? তোমরা আমাকে এখানে…।’

ড্রাইভার শফিককে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠল, কার কাছে এখন টুমি যাবে টা আমি বলে ডিটে পারি, কিন্তু টার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে ডিটে হোবে। টবে বলব।

‘দেব। বলো।

ড্রাইভার শফিকের কানের কাছে মুখ এনে বলল, “সিডে টুমি টোমার লাভারের কাছে চলে যাও।

শফিকের মুখ হাঁ হয়ে গেল। বলল, অমন কেউ নেই যে আমার।

তৃতীয় আঘাতটাও হজম করল ড্রাইভার আগের মতই। তারপর বলল, | ‘টাহলে টোমার বুড়ো ফাদারের কাছেই যাও আগে।

• শফিক জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি সেই মহান ব্যক্তিটির তরফের লোক বুঝি?”

ড্রাইভার বলে উঠল, ‘কার কঠা বলছ টুমি? কুয়াশা? সে আমার ফ্রেণ্ড-বন্দু। কথাটা বলে ড্রাইভার রূপী ডি-কস্টা আর দাঁড়াল না। হন হন করে হাঁটতে

কা

–

১

শুরু করল সে ফুটপাথের উপর উঠে গিয়ে।

সাত

সেদিন বেলা সাড়ে দশটার ঘটনা। মি. সিম্পসন নিজের অফিস রূমের বিরাট সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে একমনে কি যেন লিখে চলেছেন। এমন সময় হৈ-হৈ করে চিৎকার করে উঠল দরজার দারোয়ান। ভুরু কুঁচকে চোখ তুললেন মি. সিম্পসন। অবাক হয়ে তিনি দেখলেন একজন গাট্টাগোট্টা লোক দুটো কাপড়ের পুটুলি দু’হাতে টানতে টানতে তার অফিসে ঢুকে পড়ল। তার দিকে এবং দারোয়ানের দিকে একবারও না তাকিয়ে বের হয়ে গেল অফিস রুম থেকে। দারোয়ান কি করবে ভেবে না পেয়ে ছুটল লোকটার পিছন পিছন । মিনিট দুয়েক কেটে গেল। দেখা গেল অপরিচিত লুঙ্গি পরা লোকটা একহাতে দারোয়ানের ঘাড়টা বজ কঠিনভাবে ধরে অন্য হাতে আর একটা কাপড়ের বোঝা নিয়ে অফিস রূমে ঢুকল। দারোয়ানকে জোর করে মেঝেতে বসিয়ে দিয়ে বোঝাটাও মেঝেতে রাখল সে। তারপর আবার বের হয়ে গেল। এভাবে লোকটা একটার পর একটা মোট অফিসে এনে রাখতে শুরু করল। দেখতে দেখতে অফিস রুমের ভিতর জায়গা অবশিষ্ট রইল না আর। বিভিন্ন সাইজের বস্তা, গাঁটরি ইত্যাদিতে গুদোম ঘর হয়ে উঠল অফিস রূমটা। মি. সিম্পসন নিঃশব্দে দেখে যাচ্ছিলেন লোকটার সব, কাণ্ড। লোকটা আবার চলে গেল শেষ বস্তাটি নামিয়ে রেখে। দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন মি. সিম্পসন আরও কিছু দেখার জন্যে। বস্তাগুলোর মাঝখানে দেখা যাচ্ছে দারোয়ানের মাথাটা। ঘাড়ে হাত বুলোচ্ছে সে।

দরজার সামনে একটু পরই দীর্ঘাকৃতি, স্বাস্থ্যবান এক ব্যক্তির মূর্তি দেখা গেল। তার হাতে একটা অ্যাটাচিকেস শোভা পাচ্ছে। চমকে উঠলেন মি. সিম্পসন । মুহূর্তের জন্যেদম বন্ধ হয়ে গিয়ে আব্বার স্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করল। বিশালদেহী ব্যক্তি হাসিমুখে রূমের ভিতর ঢুকে আসন গ্রহণ করতে করতে বলে উঠল, অনেকদিন পর দেখা হল, খবর ভাল তো, মি. সিম্পসন?’

ভাল, ভাল বৈকি। তা এসবের মানে কি বুঝলাম না তো, কুয়াশা!’

মি. সিম্পসন নিজের উত্তেজিত ভাবটা গোপন রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করলেন। কুয়াশা বলল, জানেনই তো কাজ ছাড়া কুয়াশার আগমন ঘটে না। নয়াপল্টনের পিছনে একটা বস্তি আছে। বস্তিবাসীরা বড় গরীব। বস্তাগুলোয় শাড়ি, লুঙ্গি, গেঞ্জি, জুতো আছে। আপনার অফিসের বাইরে একটা ট্রাকে আছে কিছু যন্ত্রপাতি। যন্ত্রপাতিগুলো আমার আবিষ্কার। অল্প সামান্য কয়েক টাকার কাঁচা মাল কিনে নানা রকম জিনিস উৎপাদন করা যাবে মেশিনগুলো দিয়ে। ব্যবহার বিধি আর কাঁচা মাল কেনার জন্যে পঞ্চাশ হাজার

৪৬

ভলিউম-১১

টাকা দিয়ে যাচ্ছি আমি আপনাকে। আপনি বিবেচনা মত বস্তিবাসীদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেবেন। কাজটা দয়া করে আমার হয়ে করবেন আপনি, আমার অনুরোধ। আমাকে তো স্বহস্তে করতে দেবেন না আপনারা, পিছনে লেগে থাকবেন।

মি. সিম্পসন টেবিলের উপর একটা ইলেকট্রিক বোতামের মাথায় আঙুল বসিয়ে গোপনে সেটা টেপার উপক্রম করতে করতে প্রশ্ন করলেন, তা এত টাকা যে খরচ করছ, টাকাগুলো এসেছে কোথা থেকে তা জানতে পারি কি?’

কুয়াশা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, “ও কি করছেন, মি. সিম্পসন! ছিঃ ছিঃ, শেষে নিজেই লজ্জায় পড়ে যাবেন যে! বোতাম টিপে পুলিস ফোর্স ডাকছেন কেন? আমাকে গ্রেফতার করবেন? কিন্তু তারপর? আমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ দাখিল করতে পারবেন কি? পারবেন না। কুয়াশা যা করে, যা করেছে এবং যা করবে সে সবের কোন প্রমাণ থাকে না, নেই, থাকবে না। গ্রেফতার করে স্রেফ প্রমাণের অভাবে মুক্তি দিতে হবে আমাকে। মানহানির কেস করব আমি তখন। আপনার মত নামী অফিসারের এমন কাঁচা কাজ দেখে লোকে কি বলবে ভাবুন একবার।’ | লজ্জায় লাল হয়ে উঠল মি. সিম্পসনের মুখ। বোতামের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিলেন তিনি। কুয়াশা বলে উঠল, ‘আমার আর একটা কাজ আছে। আমি “হ্যাপি কটেজ” হত্যা রহস্য সম্পর্কে কৌতূহলী। এ পর্যন্ত তৈরি করা রিপোর্টগুলো দয়া করে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে দিন আমাকে। ওঃ, একটা কথা । আপনারা নিরপরাধী শফিককে গ্রেফতার করে রেখেছিলেন কেন বলুন তো! আমার বিশ্বাস ও

একটা খুনও করেনি। অই জেল-হাজত থেকে বের করে নিয়েছি ওকে।’ | ছানাবড়া হয়ে গেল মি. সিম্পসনের চোখ জোড়া। দ্রুত হাতে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে ডায়াল করলেন তিনি রমনা থানায়। খবর জিজ্ঞেস করলেন এবং সত্য খবরও পেলেন। রিসিভারটা ক্রেড়লে সশব্দে রেখে দিয়ে মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, তুমি যে একটা ভয়ানক অপরাধ করেছ তা এখুনি স্বীকার করলে। এই অপরাধের জন্যে তো গ্রেফতার করতে পারি তোমাকে, পারি না?’

না, পারবেন না। প্রমাণ কই? আমি অস্বীকার করলে কিভাবে প্রমাণ করবেন আপনি আমার অপরাধ? যাক, রিপোর্টগুলো কি দেখতে পারি?’

মি. সিম্পসন কোন কথা না বলে হ্যাপি কটেজ’ কেসের ফাইলটা শেলফ থেকে পেড়ে কুয়াশার দিকে বাড়িয়ে দিলেন । কুয়াশা ফাইলটা উল্টে মনোনিবেশ করল তাতে।

পনেরো মিনিট পর একজন কনস্টেবল অফিসরূমে ঢুকে মি, সিম্পসনকে স্যালুট ঠুকে সসম্মানে নিচু গলায় বলল, লালবাগ থানা থেকে “হ্যারি কটেজ” মার্ডার কেস সম্পর্কে একটা নতুন রিপোর্ট স্যার। দারোগা সাহেব পাঠিয়ে দিলেন।

দ্রুত একবার কুয়াশার দিকে তাকালেন মি. সিম্পসন । কুয়াশা নিবিষ্ট মনে কুয়াশা-৩১

৪৭

ফাইলের দিকে মাথা নিচু করে পড়ে যাচ্ছে রিপোর্টগুলো। কনস্টেবলের হাত থেকে নতুন রিপোের্টটা হস্তগত করে কাগজের নিচে চাপা দিয়ে রাখলেন মি. সিম্পসন। কুয়াশাকে নতুন রিপোর্টটা দেখার ইচ্ছা নেই তার।

কনস্টেবলটা চলে যাবার পাঁচ মিনিট পর মাথা তুলল কুয়াশা। মি. সিম্পসন জিজ্ঞেস করলেন সঙ্গে সঙ্গে, চা না কফি?’

কফি। ধন্যবাদ।’

বয়কে বলতে বয় কফি দিয়ে গেল দুকাপ। কফি পান করতে করতে আলাপ চলল। এক সময় কুয়াশা বলল, তিনটে হত্যা পর পর হয়ে গেল অথচ কোন কিনারা করতে পারলেন না যে? জামালের হত্যার সময় “হ্যাপি কটেজ”-এর পুরুষ মানুষরা কে কোথায় ছিল এ কথার উত্তরে ওঁদের মধ্যে একজন বড় ভয়ানক একটা মিথ্যে কথা বলেছে। ওই লোকটাই সম্ভবত খুনী।

‘কে? কে খুনী? কে মিথ্যে কথা বলেছে?’

কুয়াশা হাসল মি, সিম্পসনের ব্যগ্রতা দেখে। বলল, উত্তেজিত হবেন না। আমাকে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। নিশ্চিতভাবে যখন জানব সেই হত্যাকারী, তখন-নামটা জানাব আপনাকে। প্রস্তুত হয়ে থাকবেন, আজকেই কোন সময় হয়ত জানিয়ে দেব কে হত্যাকারী। আচ্ছা, এবার আমাকে উঠতে হচ্ছে।’’

অ্যাটাচী কেস থেকে কয়েকটা একশো টাকার নোটের বাণ্ডিল এবং ছাপা। কতকগুলো কাগজ টেবিলের উপর রেখে উঠে দাঁড়াল কুয়াশা।

মি. সিম্পসন তাকিয়ে রইলেন। অফিসরূম থেকে ধীর ভাবে বের হয়ে গেল কুয়াশার বিশাল দেহটা।

| কুয়াশা বিদায় নেবার একটু পরই মি. সিম্পসন পরাজয়ে রাগে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। হ্যাপি কটেজ’ মার্ডার কেস সম্পর্কে লালবাগ থানা থেকে খানিক আগে যে রিপোর্টটা এসেছিল সেটা লুকিয়ে রেখেছিলেন মি. সিম্পসন । কুয়াশ্বা, চলে যাবার পর সেটা তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। রিপোর্টে কি ছিল সেকথা এথনও জানা হয়নি তাঁর। অথচ তার মনোভাব বুঝতে পেরে কুয়াশা সেটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে পড়ে ফেলতে শুরু করে দিয়েছে এতক্ষণে, একথা বুঝতে পেরে রাগে দিশেহারা না হয়ে উপায় ছিল না মি. সিম্পসনের।

• আধঘন্টা গুম মেরে বসে রইলেন তিনি। তারপর লালবাগ থানায় ফোন করলেন। সেখান থেকে জানানো হল শর্ট হ্যাঁণ্ড রাইটিং থেকে রিপোর্টটা আবার নতুন করে তৈরি করতে কম পক্ষে দু’ঘন্টা সময় লাগবে। স্টেনোটাইপিস্ট হঠাৎ চলে গেছে ছুটি নিয়ে। রিসিভার রেখে দিতেই ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার আবার * কানে লাগালেন মি: সিম্পসন, হ্যালো।’

অপর প্রান্ত থেকে শহীদের কণ্ঠ শোনা গেল, শহীদ স্পিকিং। ব্যস্ত ছিলাম বলে আপনার খবর নিতে পারিনি, মি. সিম্পসন। আপনার সেই “হ্যাপি কটেজ”

৪৮

ভলিউম-১১

মার্ডারের কতদূর?

মি. সিম্পসন উত্তেজিত স্বরে বলে উঠলেন, ‘আরে, কেসটার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। ওকথা বাদ দাও, কুয়াশার কীর্তি শোনো।

মি. সিম্পসন কুয়াশার আজকের প্রতিটি অপকর্মের বিশদ বর্ণনা দশ মিনিট ধরে শহীদকে শোনালেন। শহীদ অপর প্রান্ত থেকে বলল, কুয়াশার চরিত্রের সঙ্গে সব মিলে যাচ্ছে। নতুন কিছু বলে তো মনে হচ্ছে না। নিজের কাজ সে এভাবেই সেরে কেটে পড়ে।

‘আমি এখন কি করব?

উত্তেজনায় প্রশ্ন করে উঠলেন মি. সিম্পসন। শহীদ বলল, কুয়াশা যখন বলেছে খুনী কে তা সে জানাবে আপনাকে, তখন সে জানাবে। ধৈর্য ধরে দেখুন আজকের দিনটা। অবশ্য খুনী কে তা না জানলেও আমি অন্তত প্রমাণ করে দিতে পারি যে “হ্যাপি কটেজ”-এর অন্তত দুটো খুন ‘হ্যাপি কটেজ”-এরই একজনের পক্ষে করা সম্ভব।’

‘কিভাবে?’ হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলেন মি. সিম্পসন।

শহীদ বলল, আমার প্রমাণগুলো এখন প্রকাশ করব না। কুয়াশার সঙ্গে আমারগুলো মিলে যায় কিনা দেখতে চাই আমি। কুয়াশা অবশ্য তার নিজস্ব পদ্ধতিতে খুনীর পরিচয় জানার চেষ্টা করবে। আমি দেখতে চাই, আমি যাকে খুনী বলে বিশ্বাস করি কুয়াশাও তাকে খুনী বলে চিহ্নিত করে কিনা।’

‘তোমার বিশ্বাস কুয়াশা খুনীকে চিনতে পারবে? শহীদ বলল, “নিশ্চয় পারবে।’

তাহলে কুয়াশার খবরের জন্যে অপেক্ষা করব বলতে চাও?

শহীদ বলল, নিশ্চয়। কুয়াশা খবর দিলেই আমাকে জানাবেন। আমিও সঙ্গী হতে চাই আপনার।’

‘বেশ। দেখা যাক খবর আসে কিনা। শহীদ বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে ফোন ছেড়ে দিল।

মি. সিম্পসন যখন শহীদের সঙ্গে আলাপে মশগুল তখন ডি-কস্টা ড্রাইভার কাসেম আলীর ঠিকানায় হাজির হয়ে তাকে বিশেষ এক ব্যাপারে রাজি করাবার চেষ্টা করছে। কাসেম আলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে দশ মিনিটের বেশি সময় লাগল না

র। কাসেম আলী স্যানন ডি-কস্টার ধোপদুরস্ত পোশাক এবং ইংরেজি-বাংলা 4 বোলচাল শুনে একেবারে গলে গেল। ডি-কস্টা কাসেম আলীকে নিয়ে হ্যাপি শটিজ’-এ এল একটা প্রাইভেট গাড়িতে। দরজায় কড়া নাড়তেই চাকরাণী দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ডি-কস্টা তাকে বলল, এ বাড়ির বড় জামাই মি. রুহুল মনের সাথে বিশেষ আলাপ আছে আমার। আমরা বসতে চাই।’ ডি-কস্টাকে

যাশা-৩১

৪৯

বৈঠকখানায় বসানো হল। ড্রাইভার কাসেম আলী ঢুকল না বাড়িতে। সে দাঁড়িয়ে রইল দরজার বাইরে। একটু পরই বড় জামাই রুহুল আমিন বৈঠকখানায় ঢুকল। ডি-কস্টাকে তার চেনবার কথা নয়। ডি-কস্টা নিজেই পরিচয় দিল নিজের। বলল, ‘মি. রুহুল, হাপনি হামাকে চিনটে পারবেন না। হামি একজন বিজনেস ম্যান আছে। নানারকম জিনিস-পট্রর কেনা হামার বিজনেস। সারণটু ডুপ্রাপ্য জিনিস পট্টর কিনে ঠাকি হামি।’ | রুহুল আমিন আশ্চর্য হয়ে বলে উঠল, ‘কিন্তু আমার কাছে আসার কারণটা ঠিক…’।

বলটেছি। হামি বিস্বস্ট সূট্রে খবর পেয়েছি যে আপনার কাছে বহুট পুরাতন ডিনের একটা গুণ্ঠনের নকসা আছে। নকচাটা আফ্রিকার কোন এক ডেশের। সেটা আমি কিনতে চাই, মি. রুহুল। আশা করি আপনি হামাকে নিরাশ করবেন না।’ | রুহুল আমিন বলল, তা একটা নকশা আছে বটে। আমার বাবা আজ থেকে কুড়ি বছর আগে ওটা এনেছিলেন। কিন্তু নকশার খবর আপনি পেলেন কোথা

থেকে?’

| ডি-কস্টা বলল, অটোকঠা জানটে চাইবেন না। কটো ডামে বেচবেন ওটা, টাই বলুন।’ ।

রুহুল আমিন একটু চিন্তা করে বলল, কিন্তু সেটা তো এখন আমার কাছে নেই। দশ হাজার টাকায় একজনের কাছে বন্ধক দিয়েছি। ওটা বেচে দেবারই ইচ্ছা। কিন্তু…।’

ডি-কস্টা বলল, ‘মোট কটো টাকা হলে আপনি বেচটে পারবেন বলে ঢারণা?’ ‘এক লাখ টাকার কমে নিশ্চয় নয়। ওর দাম আরও•••।’ ডি-কস্টা জিজ্ঞেস করল, নকসাটা কোঠায় আছে? কাহার কাছে? “সে কথা বলা যাবে না।’

ডি-কস্টা ড্রাইভারকে ইঙ্গিত করল। কাসেম আলী বের হয়ে গেল । ডি-কস্টা বলল, আমি আপনাকে এক লাখ টাকাই ডেব। ডশ হাজার অ্যাডভান্স করে যাচ্ছি। ওটা ছাড়াইয়া আনবেন। বাকি টাকা পাইবেন নকসা ডেবার সময়। কখন ডিবেন ওটা?’

রুহুল আমিন দ্রুত ভাবছিল। ডি-কস্টা যে বড়লোক তাতে সন্দেহ নেই। এত বড় একটা সুযোগ সে ছাড়বে কিনা ভাবছিল । আফ্রিকায় গিয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করা তার ভাগ্যে নেই। নগদ যা আসে তাই লাভ। ডি-কস্টাকে’ সে বলল, রাত দশটার সময় আমি নকশাটা বাড়িতে আনব। আপনি সাড়ে দশটায় আসুন।’

‘টাই কঠা রহিল।’ | ডি-কস্টা কথা শেষ করেই অ্যাটাচী কেস থেকে দশ হাজার টাকা বের করে

ভলিউম-১১ ।

রুহুল আমিনকে দিয়ে বলল, রসিদ নেবে না এখন হামি। সব টাকা ডিয়ে নেবে।’

রুহুল আমিন বলল, তাই হবে। চা না কফি?’

ডি-কস্টা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মেনি থ্যাঙ্কস। এখন কিছু পান করটেছি না। কাজ হলে সব হোবে। আচ্ছা বিড়ায়।’

ডি-কস্টা বের হয়ে এল বাড়ি থেকে। সদর দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিল ড্রাইভার কাসেম আলী। কাসেম আলী উত্তেজিতভাবে বাড়ির ভিতরে ইঙ্গিত করে বলল, ‘ওই যে, ওই লোকটাই ডেমরা রোডে লাশের ভার চাপিয়ে দিয়েছিল আমার ঘাড়ে। খোদার কসম বলছি সাহেব।’

ডি-কস্টা ঘাড় ফিরিয়ে বাড়ির ভিতর তাকাল। তারপর বলল, “ঠিক হ্যায়। চলো।’

গাড়িতে উঠে বসল ওরা। ডি-কস্টা পেন্সিল আর কাগজ বের করে একজন মানুষের মুখ এঁকে ফেলল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। কাসেম আলীকে সেটা দেখাতে সে বিস্মিতভাবে বলে উঠল, “ঠিক ওই লোকটার মতো হয়েছে। ওই লোকটাই সাহেব। খোদার কসম! এখুনি পুলিসে খবর…।’

ডি-কস্টা হেসে ফেলে বলল, “গাড়ি ছাড়ো, ডোস্টো। হামার বসকে রিপোর্ট ডিটে হবে। পুলিসকে মারো গুলি।’

বকশিশ দিয়ে কাসেম আলীকে নামিয়ে দিল ডি-কস্টা অন্য এক রাস্তায়। তার বস লরি এক বিশেষ নম্বর দিয়ে এক ডজন লোককে চারিদিকে পাঠিয়েছে। নম্বরটা যে লরি সেই লণ্ডিটা খুঁজে বের করতে হবে। যে খুঁজে পাবে তাকে নগদ একশো টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। নম্বরটা সেও লিখে নিয়েছে।

ডি-কস্টা শহরের লগুিলোয় খোঁজ নিতে শুরু করল। কপাল ভাল ওর। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই পরিশ্রম সার্থক হল। লণ্ডিটা পাওয়া গেল। লরি মালিক জানাল ওই বিশেষ নম্বরে একটা শার্ট ছিল। শার্টটা যে দিয়ে গিয়েছিল সে নিয়ে যায়নি। দু’জনেরই নাম লেখা আছে। নিয়ে গিয়েছিল অন্য একজন। নাম দুটো লিখে নিল ডি-কস্টা। শার্টটা যে দিয়ে গিয়েছিল তার নাম লিখতে ইংরেজির এগারোটা অক্ষর লাগে।

এদিকে মি. সিম্পসন লালবাগ থানা থেকে দুপুরবেলা নতুন রিপোর্টটা নতুন করে আবার পেলেন। পাবার সঙ্গে সঙ্গে সেটা পড়ে ফেললেন তিনি। রিপোর্টের সার অংশ নিম্নরূপ।

হ্যাপি কটেজ’-এর ছোট ছেলে জামাল চৌধুরীর বন্ধু স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে থানায় বিশেষ একটি তথ্য জানাবার জন্যে আসে। তথ্যটার যথেষ্ট মূল্য আছে বলে ধারণা

তার। তার নাম ইয়াকুব আহমেদ। ইয়াকুব জানায় যে যেদিন জামাল নিহত হয় তার পরদিন ওদের দুই বন্ধুর আফ্রিকায় অভিযান উপলক্ষে রওনা হবার কথা ছিল। কুয়াশা-৩১

. আফ্রিকায় যাবার কথা সে এবং জামাল ছাড়া তৃতীয় কেউ জানত না। পাসপোর্ট ইত্যাদি সব ঠিকঠাক করে রেখেছিল ওরা। টাকা পয়সাও তৈরি ছিল। সব খরচ জামালেরই দেবার কথা। টাকাগুলো জামাল ইয়াকুবের কাছে জমা রাখে। সেই টাকা থানায় জমা দিয়েছে সে। ওদের আফ্রিকায় যাবার একটা বিরাট উদ্দেশ্য ছিল। আফ্রিকার কোন এক দেশের গুপ্তধন উদ্ধারই ছিল ওদের লক্ষ্য। গুপ্তধনের নকশা নাকি জামালের বড় দুলাভাই রুহুল আমিনের কাছে ছিল। জামাল তাই জানায় ইয়াকুবকে। নকশাটা সে কোনদিন দেখেনি। জামালের বিশ্বাস ছিল ওর বড় দুলাভাইয়ের কাছ থেকে যাবার একদিন আগে নকশাটা আদায় করে নিতে পারবে ও। কিন্তু যাবার আগের দিনই নিহত হয় সে। ইয়াকুব এতদিন এই তথ্য কেন জানায়নি এই প্রশ্নের উত্তরে সে বলেছে আমাদের আফ্রিকায় যাবার ব্যাপারটা বাধা পাবে বলে কাউকে বলিনি। সেই কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে লোকে সন্দেহ করবে জামালকে বোধহয় আমিই খুন করেছি। তাই এতদিন চুপ করে ছিলাম। কিন্তু জামালের পর একই বাড়ি থেকে আরও দু’জন নিহত হবার পর

আমার যুক্তিহীন চিন্তাধারার বদল ঘটে। তাই সব কথা প্রকাশ করতে চাই। | রিপোর্ট পড়ে মি. সিম্পসনের মাথাটা যেন খুলে গেল। কেসটা সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে বসলেন তিনি। জামাল রুহুল আমিনের কাছ থেকে গুপ্তধনের নকশাটা চেয়েছিল এবং রুহুল আমিন সেটা দিতে চায়নি। জামাল হয়ত ভয় দেখায়। ফলে রুহল আমিন জামালকে খুন করে। এটুকু কল্পনা করে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন মি. সিম্পসন। শহীদকে ফোন করে জানালেন তিনি। শহীদ রহস্যময় হাসি হেসে জানাল, অপেক্ষা করুন। কুয়াশা খবর দিক আগে।’

আট

সাভারের রোডের পাশে একটা মাঠ। মাঠের মাঝখানে একটা পুরানো বাড়ি। বাড়িটার সামনে সাত-আটটা প্রাইভেট কার দাঁড় করানো। বাড়িটার সামনে বিরাট একটা সিমেন্ট করা চত্বর। গেটে কোন দারোয়ান নেই। চত্বরটা পেরিয়ে গেলে বাড়ির অভ্যন্তরে ঢোকার রাস্তা। সরু একটা গলি চলে গেছে ভিতরে। গলির শেষ মাথায় দেখা যাচ্ছে একটা দরজা। দরজার কাছে গুণ্ডা প্রকৃতির দু’জন লোক প্যান্ট শার্ট পরে সিগারেট টানছে।

রাত ন’টা বেজে দশ।

সাত-আটটা গাড়ির মধ্যে একটি গাড়িতে কলিম বসে আছে। ঘড়ি দেখল সে। পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল, তারপর স্টার্ট দিল গাড়িটায়। চারতলা বিরাট বাড়িটার চত্বর থেকে ছুটে বের হয়ে গেল কালো মরিসটা। | গাড়ি মাইল খানেক চালাবার পর একটা ডাক্তারখানা দেখতে পেল কলিম।

ভলিউম-১১

গাড়ি থেকে নেমে জরুরী ফোন করতে চাইল সে। পয়সা দিয়ে রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে শুরু করল। কানেকশন হতেই অপর প্রান্ত থেকে মি. সিম্পসনের অধীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, হ্যালো। কুয়াশা বলছ নাকি?’

কলিম বলল, “আমি কুয়াশার সহচর কলিম বলছি। আপনি আপনাদের দলবল নিয়ে সাভার রোডের ‘সুন্দর নীড়ে” চলে আসুন। বাড়িটা হাকিম দাওয়াখানার মাইলখানেক আগে। “হ্যাপি কটেজ”-এর প্রকৃত খুনীকে ধরার ইচ্ছে থাকলে আপনি আসবেনই। দাদা আমাকে তাই বলে দিয়েছে। সাদা পোশাক পরিয়ে লোকজন আনবেন।’

| কলিম মি. সিম্পসনের জবাবের অপেক্ষা না করেই রিসিভার নামিয়ে রাখল। ডাক্তারখানা থেকে দ্রুত বের হয়ে গাড়িতে চেপে বসল সে। তারপর গাড়ির মুখ

ঘুরিয়ে ফুটিয়ে দিল সেটাকে যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকেই-সুন্দর নীড়’-এর। উদ্দেশে।

বিরাট এবং পুরানো বাড়ি সুন্দর নীড়’-এর চত্বরে অপেক্ষারত গাড়িগুলোর পাশে আবার ফিরে এল কলিমের কালো মরিসটা। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে বসে রইল সে একইভাবে। পনেরো মিনিটও কাটল না। দেখা গেল একটা ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেন এবং দুটো জীপ এসে দাঁড়াল অপেক্ষারত গাড়িগুলোর সামনে। ফোক্সওয়াগনটা শহীদের। শহীদ, মি. সিম্পসন ও কামাল রয়েছে তাতে। বাকি দুটো জীপে মোট বারোজন সাদা পোশাক পরা সশস্ত্র পুলিস।

অস্ত্রগুলো ওরা লুকিয়ে রেখেছে।

গাড়ি থেকে কেউ নামল না। মি. সিম্পসন বললেন, এবার আমাদের কর্তব্য কি হবে? এখানে আসার পর কি করতে হবে, কাকে গ্রেফতার করতে হবে তা তো কুয়াশার লোক কলিম জানায়নি।’

শহীদ কি যেন চিন্তা করছিল। ও বলে উঠল, অপেক্ষা করুন। কুয়াশা বাকিটুকুও বলবে।’

তাই ঠিক হল। অপেক্ষা করতে লাগল ওরা নিঃশব্দে। দেখতে দেখতে কেটে গেল পনেরোটা মিনিট। এমন সময় একটা বেবিট্যাক্সির শব্দ পাওয়া গেল। ট্যাক্সিটা এগিয়ে আসছে এদিকেই। অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইল ওরা তিনজন। ট্যাক্সিটা ওদের গাড়ির কাছ থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে এসে থামল। ট্যাক্সি থেকে যে নামল তাকে দেখে চমকে উঠলেন মি. সিম্পসন। ফিসফিস করে শহীদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘এ যে দেখছি “হ্যাপি কটেজ”-এর মি. রুহুল আমিন। তাহলে এই আসল খুনী, কি বলল! |

শহীদকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। ও কোন উত্তর দিল না।

রুহুল আমিন ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সরু গলি পথটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মি. সিম্পসন উত্তেজনায় ছটফট করছেন। এমন সময় আর একটা গাড়ির কুয়াশা-৩১

শব্দ শোনা গেল। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল ওরা। গাড়িটা একটা টয়োটা করোনা। এসে থামল অপেক্ষারত গাড়ির অপর প্রান্তে। ঝটপট গাড়ি থেকে নামল দুজন লোক। মি. সিম্পসন ডি-কস্টা এবং ভাড়াটে ট্যাক্সির ড্রাইভার কাসেম আলীকে চিনতে পারলেন।

| কাসেম আলী গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত এগিয়ে চলল সরু গলি পথটা দিয়ে, যে পথে মাত্র কয়েক সেকেণ্ড আগে রুহুল আমিন গেছে। ডি-কস্টা আবার উঠে | বসল গাড়ির ভিতর। চুপচাপ বসে রইল সে ড্রাইভিং সীটে।

সরু গলি পথটার শেষ মাথায় একটা দরজা। এবং দরজাটার কাছে দু’জন পাহারাদার। রুহুল আমিন সেখানে গিয়ে পৌঁছুতেই সসম্মানে লোক দুজন পথ করে দিয়ে সালাম জানাল। রুহুল আমিন ভিতরে ঢুকতেই দারোয়ান দুটোর সামনে এসে দাঁড়াল কাসেম আলী। সন্দিহান চোখে তাকাল লোক দু’জন কাসেম আলীর দিকে। কাসেম আলী বলল, ভিতরে যেতে চাই।’

| ‘পাস আছে?’

ব্যঙ্গাত্মক স্বরে প্রশ্ন করল দারোয়ানদ্বয়ের একজন। কাসেম বলল, “নেই। তবু যেতে হবে। ভালয় ভালয় যেতে না দিলে তোমাদের দু’জনের কপালেই খারাবি আছে।’

আজব চিড়িয়া দেখছি হে!

দু’জন দারোয়ানই তেড়ে এল কাসেম আলীকে মারতে। কাসেম আলী হঠাৎ বিদ্যুৎবেগে ঝাড়া দিয়ে নিল নিজের শরীরটা। তারপর একজন দারোয়ানের উদ্যত হাতটা খপ করে ধরে ফেলে মোচড় দিতে দিতেই অন্যজনের পেটে একটা লাথি বসিয়ে দিল কায়দা মত। লাথির চোটে হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকটা। তার আর • উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা রইল না। এদিকে দ্বিতীয় লোকটাও মা-বাপ’ বলে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে হাতের ব্যথায়। কাসেম আলী তার ঘাড়ে একটা ঘুসি বসিয়ে দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিল। কাবু হয়ে গেল সে। এমন সময় দেখা গেল রুহুল আমিন হিংস্রভাবে ঘুসি বাগিয়ে ছুটে আসছে দরজার ওদিক থেকে কাসেম আলীর দিকে। সব লক্ষ্য করেছে সে আড়াল থেকে।

কাসেম আলী রুহুল আমিনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল।

এদিকে সরু গলিপথটার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে শহীদ, কামাল এবং মি. “সিম্পসন । ওরা দেখল কাসেম আলী রুহুল আমিনের দিকে এক পা এগিয়ে গেল । কয়েক মুহূর্ত নিঃসাড় দাঁড়িয়ে রইল কাসেম আলী এবং রুহুল আমিন। ওদের দু’জনের কথাও শোনা যাচ্ছে না, মুখও দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ কাসেম আলী রুহুল আমিনকে কাঁধে তুলে নিল। পরমুহূর্তে অদৃশ্য হল সে দরজার ওপারে ।

মি, সিম্পসন বলে উঠলেন, “আর দেরি করা যায় না। রহস্যময় ব্যাপারটা জানতেই হচ্ছে এবার। চলো, শহীদ।

৫৪

ভলিউম-১১

ওরা তিনজন ছুটল সরু গলিপথটা দিয়ে। আহত দারোয়ানের একজন মাথা তুলে ওদের তিনজনকে ছুটে আসতে দেখেই তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। তারস্বরে চিৎকার করতে করতে অদৃশ্য হয়ে গেল সে দরজা অতিক্রম করে।

ওরা তিনজন দরজাটা অতিক্রম করতেই বাধার সম্মুখীন হল। আহত দারোয়ানটা চিৎকার করে দলের লোকজন জড়ো করে ফেলেছে। চারজন পেশীবহুল লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের উপর। মি, সিম্পসন একমুহূর্তের সময়। পেলেন, সেই অল্প সময়েই সজোরে বাঁশি বাজিয়ে দিলেন।

শহীদ আক্রান্ত হল সবচেয়ে আগে। অতর্কিতে একটা ঘুসি এসে লাগল ওর চোয়ালে। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল ওর। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল ব্যথায় । কিন্তু আন্দাজের উপর নির্ভর করেই প্রচণ্ড একটা ঘূসি চালিয়ে দিল ও। আক্রমণকারীর নাকে গিয়ে লাগল ঘুসিটা। ধরাশায়ী হল একজন। কামালের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দু’জন। শহীদ চোখ মেলে দেখে কামাল একা পারছে না দু’জনের সঙ্গে। এগিয়ে গেল ও লাফ মেরে।

মি, সিম্পসন হাত মুচড়ে ধরে কাবু করে ফেলেছেন বাকি একজনকে। শহীদ পিছন থেকে দুজন আক্রমণকারীর গর্দানে দুটো কারাতের কোপ বসিয়ে দিল। বিনা বাক্য ব্যয়ে ভূপাতিত হল দু’জনই। কামাল মুক্ত হল। এমন সময় এসে পড়ল। সাদা পোশাক পরিহিত বারোজন কনস্টেবল। মি. সিম্পসন, শহীদ, কামাল যে-যার রিভলভার বের করে ফেলেছে। মি. সিম্পসন হাঁপাতে হাঁপাতে আদেশ দিলেন, ‘এদের সবাইকে শক্ত করে বেঁধে ফেলো।’

বেঁধে ফেলার কাজ শুরু হয়ে গেল। ওরা তিনজন এগিয়ে চলল অভ্যন্তরে। সঙ্গে চলল দু’জন কনস্টেবল। * তিনটে পাশাপাশি ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ দেখা গেল । মি. সিম্পসন নক করলেন সজোরে। একটা দরজা খুলল। চারজন সুবেশী ভদ্রলোক কাচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের ভিতর। দেখা গেল শুকিয়ে গেছে প্রত্যেকের মুখ । ঘরের এক ধারে একটা টেবিল। টেবিলের উপর টাকার তোড়া এবং তাস। ওদের হাতে রিভলভার দেখে চারজন ভদ্রলোকই একপা করে পিছিয়ে গেলেন। মি. সিম্পসন ধমক দিয়ে জানতে চাইলেন, কারা আপনারা? জুয়া খেলার আড্ডা নাকি বাড়িটা?

| চারজনই চুপচাপ রইলেন। আবার ধমক লাগালেন মি. সিম্পসন । এবার এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “দেখুন, আমরা অন্যায় করেছি এখানে জুয়া খেলতে এসে। কিন্তু এই বাড়িতে যে আ বসায় তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।’

মি. সিম্পসন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনাদের সবাইকে থানায় যেতে হবে। পরে বিবেচনা করা যাবে আপনাদের ব্যাপারে।’ কনস্টেবল দুজন রজনকে পাহারা দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল। বাকি দুটো ঘর থেকেও যাশা-৩১

মোট ছয়জন দ্ৰ জুয়াড়া আবিষ্কৃত হল। কয়েকজন কনস্টেবল সবাইকে একটা জীপে করে খানার উদ্দেশে নিয়ে চলল।

আরও কয়েকটা ঘর দেখা হল। কিন্তু ড্রাইভার কাসেম আলী এবং রুহুল আমিনের হদিস পাওয়া গেল না কোথাও। দোতলায় উঠে এল ওরা এবার । সবকটা ঘর দেখা হল। দোতলায় আটজন জুয়াড়ী পাওয়া গেল আরও। তাদেরকে একটা ঘরে অপেক্ষা করতে বললেন মি. সিম্পসন। তিনতলায়ও জুয়াড়ী পাওয়া গেল বারোজন। কিন্তু কাসেম আলী এবং রুহুল আমিনের কোন সন্ধানই পাওয়া গেল না। ওরা তিনজন উঠে গেল চারতলায়।

চারতলায় একটি মাত্র ঘর। করাঘাত করলেন মি. সিন। তাতেই খুলে গেল দরজা। বন্ধ ছিল না, ভেজানো ছিল। ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল তিনজন উদ্যত রিভলভার হাতে। ঘরের ভিতর মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে রুহুল আমিন। তার সামনে একশত টাকার নোটের কয়েকটা তোড়া। ঘরের মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে রয়েছে আর একজন লোক। লোকটা মারা গেছে কিনা কে জানে। চেনা যাচ্ছে

তাকে। ড্রাইভার কাসেম আলীকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও।

রুহুল আমিন ওদের দিকে ভাবলেশহীন চোখ তুলে তাকাল। এমন সময় গোলমালের শব্দ শোনা গেল। কে যেন চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসছে। কামাল বের হয়ে গেল ঘর থেকে। একটু পরই দু’জন কনস্টেবলের হাত থেকে ছাড়িয়ে কলিমকে সঙ্গে নিয়ে ঘরের ভিতর ফিরে এল কামাল। মি. সিম্পসন রুহুল আমিনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে উঠলেন এমন সময়, আপনিই তাহলে তিন তিনটে খুন করেছেন?’ | ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল রুহুল আমিন। কোন কথা ফুটল না তার মুখে! কলিম কামালের পাশ থেকে বলে উঠল, ‘না, মি. রুহুল আমিন খুনী নন। যে লোকটা উপুড় হয়ে মেঝেতে পড়ে রয়েছে সেই-ই আসল খুনী। “হ্যাপি কটেজ’

এর তিনজনকেই নিজের হাতে খুন করেছে ও।’

মি. সিম্পসন কঠিন কণ্ঠে কলিমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি তা কি করে জানলে?’

কলিম বলল, আমাকে কুয়াশাদা সব বলেছেন।’ ‘খুনের মোটিভ কি তা জানো?’

কলিম বলল, জানি। ওই অজ্ঞান লোকটা এই বাড়িতে অনেকদিন ধরে জুয়ার আচ্ছা বসিয়ে ভাল কামাই করে আসছে। কথাটা জানত জামাল চৌধুরী। জামাল চৌধুরীও ওকে ব্ল্যাকমেল করে আসছিল গত দু’বছর ধরে। ওই জ্ঞানহীন লোকটা জামালকে প্রতি সপ্তায় একশো টাকা করে দিতে বাধ্য হত। এই জুয়া খেলার কথা জানতেন মি. রুহুল আমিনও। তিনিও খেলা ধরেন। সব টাকা হেরে গিয়ে কারবার নষ্ট করে ফেলেন তিনি। কিন্তু জুয়া খেলার নেশা ত্যাগ করতে পারেন না। তাই

ভলিউম-১১

তার কাছে গুপ্তধনের যে নকশাটি ছিল সেটা বন্ধক রাখেন ওই জ্ঞানহীন লোকটার কাছে দশহাজার টাকায়। জামাল এই কথাটাও জানত। জামালের ইচ্ছা ছিল গুপ্তধন উদ্ধার করবে সে আফ্রিকায় গিয়ে। ওই অজ্ঞান লোকটার কাছে জামাল নকশাটা বিনা পয়সায় দাবি করে। ফলে ওই লোকটা জামালকে খুন করে।

* কলিম দম নিয়ে বলতে থাকে, মিসেস চৌধুরীকেও খুন করে এই অচেতন লোকটা। তবে এই খুনের মোটিভটা ভিন্ন। মিসেস চৌধুরী ওকে সন্দেহ করেছিলেন। তাই খুন হতে হয় তাকে। কিন্তু তিনি নিহত হবার আগেই তার বড় ছেলে সালাম চৌধুরীকে সন্দেহের কথাটা বলে যান। মিসেস চৌধুরী ওই অচেতন লোকটাকে একটা রক্ত মাখা শার্ট নিজের হাতে ধুতে দেখেছিলেন যেদিন জামাল নিখোঁজ হয়েছিল সেদিন গভীর রাতে। বড় ছেলে সালাম মায়ের মৃত্যুর পর ওই লোকটার ঘর থেকে একটা লরি রশিদ চুরি করে সেই ধোয়া শার্টটা বাসায় নিয়ে আসে। খুনী তা টের পায়। শার্টটা সে চুরি করে সরিয়ে ফেলে বাড়ি থেকে। সালাম কিন্তু খুনীকে অনুসরণ করতে করতে একদিন এখানে চলে আসে। সেই সুযোগে ওই অচেতন খুনী লোকটা সালাম চৌধুরীকেও হত্যা করে। খুনের সময় সে কোথায় ছিল এ প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যে কথা বলেছে সে। যে ড্রাইভারকে সালাম চৌধুরীর লাশ হাসপাতালে পৌঁছে দেবার ভার দেয় ও, সেই ড্রাইভার ওকে আজ সকালে চিনতে পারে।’

‘কিন্তু খুনীর পরিচয় কি? কে ও?’:

মি. সিম্পসনের প্রশ্নের উত্তরে শহীদ মুখ খোলে এবার। ও বলে, “যে লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে সেই খুনী, মি. সিম্পসন। ও হচ্ছে “হ্যাথি কটেজ”-এর মেজ জামাই। আবদুর রশিদ।

| চমকে উঠলেন মি. সিম্পসন। বললেন, ‘কিন্তু জামালের নিহত হবার সময় ও তো সিনেমায় ছিল। টিকিট পর্যন্ত দেখেছি আমরা।’

শহীদ বলল, এর রহস্য আছে। সিনেমার টিকিট ঠিকই অ্যাডভান্স কিনেছিল ও। কিন্তু সিনেমা দেখতে যায়নি। তাই ও জানে না সেদিন সেই হলে শশা শুরু হয়েও শেষ হতে পারেনি। আধঘন্টার মতো শো দেখাবার পর প্রোজেকশন মেশিন। ‘খারাপ হয়ে যায়। অথচ শশা দেখে ও বাড়ি ফিরেছিল রাত সাড়ে বারোটায়, এই কথা বলেছিল। ব্যাপারটা আমিও জানতাম না। আজ সকালে খবরের কাগজে সেই সিনেমা হলের তরফ থেকে একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। সেদিনের টিকিট

• কিনেও যারা শশা দেখতে পারেননি তাদেরকে অনুরোধ করা হয়েছে পয়সা ফেরত নিয়ে যাবার জন্যে। কয়েকদিন শো দেখানো সম্ভব হবে না ওদের পক্ষে।’

শহীদ দম নিয়ে আবার শুরু করল, ফিরোজার ঘর থেকে ঘুমের ট্যাবলেট মেশানো দুধের গ্লাস মিসেস চৌধুরীর ঘরে কিভাবে গেল তা আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম। আবদুর রশিদ শ্যানেল ফাইভ সেন্ট ব্যবহার করত, একথা বুঝতে

কুয়াশা-৩১

বাকি ছিল না। দুটো দুধের গ্লাসেই শ্যানেল ফাইভের গন্ধ পাই আমি। আবদুর রশিদ দুধের গ্লাস বদলাবার সময় রুমাল ব্যবহার করেছিল। রুমালের সেন্ট গ্লাসেও লাগে। দ্বিতীয়ত একটা সিগারেটের টুকরো খুঁজে পাই আমি ফিরোজার ঘর থেকে। সেটা ক্যাপস্টানের টুকরো । ও বাড়িতে ওই সিগারেট একমাত্র আবদুর রশিদই ব্যবহার করত। গ্লাস বদলাবার সময় ফিরোজার ঘরে ভুল করে ফেলে দিয়েছিল সে পোড়া টুকরোটা।

শহীদ ওর বক্তব্য শেষ করল। মি. সিম্পসন রুহুল আমিনকে প্রশ্ন করলেন, ‘আবদুর রশিদ জ্ঞান হারাল কিভাবে? | রুহুল আমিন বলল, আমাকে যে লোকটা এখানে নিয়ে আসে সেই লোকই ঘুসি মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছে ওকে।’

‘আপনাকে কাসেম আলী এখানে কাঁধে করে নিয়ে আসে কেন?”

রুহুল আমিন বলল, আমি ওর সামনে দাঁড়াতেই ও বলল, “হ্যাপি কটেজ” এর সব কটা খুনের খুনীকে ধরে দিতে পারব আমি। তুমি আমার কাঁধে চড়ো।’ আমি কিছু বলার আগেই লোকটা কাঁধে তুলে ফেলল আমাকে। কাঁধে করে । রশিদের ঘরে নিয়ে আসে আমাকে। রশিদ লোকটাকে দেখে কেন জানি না ভীষণ ভাবে ভয় পেয়ে যায়। লোকটা রশিদকে বলে, আমি তোমার সব কথা পুলিসকে জানিয়ে দেব, তবে তোমার সব টাকা আর রুহুল আমিনের গুপ্তধনের নকশাটা আমাকে দিয়ে দিলে কিছু বলব না। রুহুল আমিনকে ধরে এনেছি আমি। নকশাটা ওর, ওর কাছ থেকেই সেটা আদায় করব আমি।’

রশিদ ভয়ে ভয়ে সব টাকা আর নকশাটা দিয়ে দেয় লোকটাকে। লোকটা তখন বলে, তোমার অপরাধের কথা সব লিখে দাও আমাকে। আমি মাসে মাসে তোমার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে আসব। যতদিন টাকা দেবে ততদিন পুলিস কিছু জানবে না। রশিদ ভয়ে ভয়ে একটা কাগজে সব লেখে। লেখাটা নিয়েই লোকটা হঠাৎ ঘুসি মারে রশিদকে। রশিদ অজ্ঞান হয়ে যায়। লোকটা তখন আমাকে নব্বই হাজার টাকা দিয়ে নকশাটা নিয়ে জানালা দিয়ে পানির পাইপ বেয়ে, নিচে নেমে যায়। তার পনেরো মিনিট পর আপনারা আসেন।’

রুহুল আমিন তার বক্তব্য শেষ করতেই কলিম বলে, এই যে সেই কাগজটা, আবদুর রশিদের স্বীকারোক্তি। লেখাটা লিখিয়ে নেবার জন্যেই কাসেম আলী ব্ল্যাকমেইলিং করার কথা বলেছিল ওকে। | একটা কাগজ বের করে দিল কলিম। মি. সিম্পসন পড়ে দেখলেন আবদুর রশিদের নাম সই করা চিরকুটটায়। তাতে লেখা, ‘আমি জামাল চৌধুরী, মিসেস চৌধুরী এবং সালাম চৌধুরীকে খুন করেছি।’

মি. সিম্পসন কলিমের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে রিভলভার উঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘এ কাগজ তুমি পেলে কোথায়?

৫৮

ভলিউম-১১

ড্রাইভার কাসেম আলী আপনাকে পৌঁছে দিতে বলেছিল আমাকে এটা। এটা নিয়েই তো আসছিলাম আমি, পুলিস আমাকে ধরে ফেলে।

মাথার উপর হাত তোলো, কুয়াশা! ছদ্মবেশ দারুণ হয়েছে স্বীকার করি, কিন্তু তুমিই তো কুয়াশা তাতে কোন ভুল নেই।’

ভয়ে ভয়ে কলিম মাথার উপর হাত তুলল। তারপর বলল, ড্রাইভার কাসেম আরও একটা কাগজ আপনাকে দেবার জন্যে দিয়েছে আমাকে। সেটা আমার বুক পকেটে। কিন্তু আপনি ভুল করছেন, আমি কুয়াশাদার অনুচর কলিম।

মি. সিম্পসন কিছু বলার আগে শহীদ বলে উঠল, আপনার ভুল হচ্ছে, মি. সিম্পসন। কুয়াশা নয়, ও কলিম। কুয়াশা পালিয়েছে। যাকে আমরা ড্রাইভার কাসেম আলী বলে মনে করেছিলাম সে আসলে কাসেম আলীর ছদ্মবেশে কুয়াশা স্বয়ং। আবদুর রশিদকে ভয় দেখাবার জন্যে কাসেমের ছদ্মবেশে এসে নিজের কাজ গুছিয়ে পালিয়ে গেছে কুয়াশা।

কলিমের পকেট থেকে দ্বিতীয় চিরকুটটা বের করা হল। তাতে লেখা, আপনি আমার হয়ে বস্তি এলাকায় সামান্য জিনিস-পত্র বিলি করার ভার নিয়েছেন, সেজন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। এবং সে কাজের বদলে আমিও আপনার কাজ করে দিয়ে গেলাম। আবদুর রশিদকে গ্রেফতার করুন। তিনটে খুনের জন্যে ও-ই দায়ী। বিদায়। আবার দেখা হবে অচিরেই। ইতি। কুয়াশা।

পালিয়েছে আপনার ভুল

গুছিয়ে বছর রশিদকে করেছিলাম সে।

লেখক: কাজী আনোয়ার হোসেনসিরিজ: সেবা কুয়াশা সিরিজবইয়ের ধরন: সেবা প্রকাশনী

৫৯. অপরাধী ১ (কুয়াশা – ভলিউম ২০)

মাসুদ রানা - ২১৭ ও ২১৮ - অন্ধ শিকারী

মাসুদ রানা – ২১৭ ও ২১৮ – অন্ধ শিকারী (দুইখণ্ড একত্রে)

৫৮. দানব ২ (কুয়াশা – ভলিউম ২০)

থিসিস ১ (কুয়াশা ৭)

০৭. থিসিস ১ (কুয়াশা ৭)

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.