আত্মজীবনী 

আত্মজীবনী 

প্রথম পরিচ্ছেদ

১৭৪৯ সালের ২৮শে আগস্ট দুপুরের ঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই আমি এসেছিলাম এই পৃথিবীতে। এসেছিলাম ফ্রাঙ্কফোর্ট শহরের একটা ঘরে। আমার জন্মলগ্নে গ্রহনক্ষত্রের অবস্থিত এমন কিছু খারাপ ছিল না। সূর্য বা রবি ছিল কন্যা রাশিতে। বৃহস্পতি ও শুক্রের দৃষ্টি ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। বুধও বক্রী ছিল না। শনি ও মঙ্গল ছিল উদাসীন। আমার জন্মের উপর একমাত্র চন্দ্রের দৃষ্টি ছিল বক্রকুটিল, যে দৃষ্টির বক্রতা শোধরায়নি কখনও আমার সারা জীবনের মধ্যে। 

আমরা থাকতাম আমার বাবার মার বাড়িতে। আমার ঠাকুরমাকে আজও মনে পড়ে আমার। উনি থাকতেন একতলায় পিছনের দিকে একটা বড় ঘরে। সুন্দর রোগা রোগা চেহারার এক মহিলা। সব সময় সাদা ফিটফাট পোশাক পরে থাকতেন। আমি আর আমার ছোট বোন প্রায়ই তাঁর চেয়ারের কাছে খেলা করতাম। অসুস্থ অবস্থায় তিনি বিছানায় শুয়ে থাকলেও আমরা তার বিছানায় উঠে খেলতাম। কিন্তু তিনি বিরক্ত হতেন না কখনও। 

শৈশবের অনেক দুষ্টুমির মধ্যে একদিনের একটা দুষ্টুমির কথা মনে আছে। একবার একটা মাটির বাসনপত্রের এক মেলা বসে শহরের শেষপ্রান্তে। সেখান থেকে আমাদের রান্নাঘরের জন্য অনেক মাটির থালা ও নানারকমের পাত্র কেনা হয়। একদিন বিকালে বাড়িতে খেলার কিছু না পেয়ে একটা মাটির প্লেট রাস্তায় ছুঁড়ে দিই। মাটির পাত্রটা বাঁধানো রাস্তায় পড়ে খান খান হয়ে ভেঙে গেল। আমি আনন্দে হাততালি দিতে লাগলাম। আমার সে আনন্দে আমার এক প্রতিবেশীও আনন্দ পেলেন। আমি চিৎকার করে উঠলাম, আর একটা। সত্যি আর একটা মাটির পাত্র এনে এইভাবে ভাঙলাম। এইভাবে আমার প্রতিবেশী দর্শক ভন অকসেনস্টাইনকে খুশি করার জন্য একে একে সব মাটির পাত্রগুলো সেদিন ভেঙে ফেললাম আমি। সেদিন যেন শুধু ভাঙ্গার আনন্দে মত্ত ও আত্মহারা হয়ে উঠেছিলাম আমি। 

আমাদের বাড়ির সামনের দিকে ছিল বড় রাস্তা আর পিছনের দিকে ছিল প্রতিবেশীদের বড় বাগান। বাড়ির তিনতলার ঘরটাকে বলা হতো বাগানবাড়ি। কারণ সে ঘরের প্রতিটি জানালার ধারে ধারে অনেক রকম লতা ও চারা গাছ টবের উপর সাজিয়ে রাখা হতো। আমি ছেলেবেলায় সেখানে বসে আমার পড়া তৈরি করতাম। আরও বড় হয়ে আমার কোনও খুশির ভাব এলেই আমাদের তিনতলার সেই বাগান ঘরটাতে চলে যেতাম। কিন্তু মনে কোনও বিষাদ জমলে সে ঘরে কখনও যেতাম না। জানালার ভিতর দিয়ে প্রসারিত আমার দৃষ্টিটা মাঝে মাঝে চলে যেত শহরের সীমানা ছাড়িয়ে এক সবুজ প্রান্তরে। আজ বেশ বুঝতে পারছি এই ঘরটাই আমার শিশুমনে প্রথম এনে দেয় নিভৃত চিন্তার প্রেরণা। আর কিছু অস্পষ্ট অব্যক্ত কামনার বাধাবন্ধহীন ব্যাকুলতা। আমি স্বভাবতই গভীরতাপ্রিয় এবং ভাবুক প্রকৃতির। এই ঘরে এলেই আমি যেন আমার সে প্রকৃতিকে খুঁজে পেতাম। 

ছেলেবেলায় রাত্রিবেলাটা আমার ভারি খারাপ লাগত। ছায়া ছায়া বিষণ্ণতায় ভরা পুরনো আমলের বাড়িটা রাত্রির অন্ধকারে কেমন যেন ভয়ঙ্কর দেখাত। তার উপর তখনকার দিনে ছেলেদের ভয় জয় করতে শেখাবার জন্য রাত্রিবেলায় একা একা শোয়ার ব্যবস্থা ছিল। আমার বাবা-মাও সেই ব্যবস্থা করেছিলেন আমার জন্য। এক একদিন একা ঘরে ভয় লাগতেই উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম। বাবা বকতেন। তখন মা ফন্দি আঁটেন। তখন পীচফল পাকার সময়। আমার মা বলেন যে কোনও ভয় না করে একা ঘরে ঘুমোতে পারবে তাকে পীচফল বেশি করে দেওয়া হবে রোজ। এইভাবে ফলের লোভে পুরস্কারের লোভে ভয় জয় করতে শিখেছিলাম আমরা। 

কেন জানি না আমার বাবা ছিলেন রোমক সংস্কৃতির উপাসক। ইতালীয় ভাষা, ইতালীয় গান, ইতালীয় শিল্পকলা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল অগাধ। আমাদের। বাড়ির একটা ঘর ভর্তি ছিল ইতালীয় ছবিতে। জিওতিনাৎসী নামে একজন প্রবীণ ইতালীয় সঙ্গীত শিক্ষক আসতেন আমাদের বাড়িতে। আমরা গান শিখতাম। আমার মা ক্লেভিকর্ড বাজাতে শিখতেন। বিয়ের পর মাকেও গান শিখাতে হয় বাবার জেদে পড়ে। 

আমার ঠাকুরমা মারা যাবার পর বাড়িটা আমূল সংস্কার সাধন করলেন। পুরনো বাড়িটা ভেঙে তার জায়গায় গড়লেন নূতন ধাচের নূতন বাড়ি আর আমাদের পাঠালেন পাবলিক স্কুলে। আমি যেন নূতন এক জগতে এসে পড়লাম। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী থেকে আসা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে প্রথম মেলামেশা শুরু হলো আমার। আগের থেকে অনেক বেশি স্বাধীনতার সঙ্গে শহরের বিভিন্ন এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়াতে লাগলাম। কিন্তু আমার সবচেয়ে ভালো লাগত শ্যোন নদীর সেতুর উপর দাঁড়িয়ে নদীর স্রোত আর মালবোঝাই নৌকার আনাগোনা দেখতে। নীচেকার নদীর স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেতুর উপর দিয়ে অবিরাম চলে যেত জলস্রোত। কৌতূহলী হয়ে আমি দুদিকেই তাকাতাম। মাঝে মাঝে ঘিঞ্জি বাজারের নোংরা পথ পার হয়ে রঙিন জলছবি কিনে আনতাম। আবার মাঝে মাঝে চলে যেতাম রোমার হিলে। তবে আর একটা জিনিস ভালো লাগত আমার। তা হলো উঁচু উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা পুরনো কালের দুর্গ, বড় বড় বাড়ি আর বাগান দেখতে। অদেখা অচেনা কুহেলিঘেরা অতীতের প্রতি কেমন যেন এক সকরুণ মমতা গড়ে উঠেছিল আমার মনে। কিছু কিছু রূপকথা আর ইতিবৃত্ত শুনে সে মমতা বেড়ে উঠেছিল। আমরা শুনেছিলাম শার্লেমেদের রূপকথা, শুনেছিলাম যেমন করে হ্যাঁপস রুডলফ তার বীরত্ব আর সাহসিকতার দ্বারা শান্তি এনেছিল অশান্তির মাঝে। চতুর্থ চার্লস ও স্বর্ণবলদের কথাও শুনেছিলাম আমরা। 

আমার মন কিন্তু পুরোপুরি অতীতাশ্রয়ী ছিল না। মানবজীবনের বিচিত্র অবস্থা যথাযথভাবে দেখার একটা আগ্রহও ছোট থেকে গড়ে উঠেছিল আমার মনে। ধনীর প্রাসাদ থেকে শুরু করে গরিবের কুঁড়ে আর কলকারখানা সংলগ্ন শ্রমিকবস্তিগুলো ঘুরে মানবজীবনের যে সব ছবি আমি পেয়েছিলাম সে ছবির মধ্যে কোনো সৌন্দর্য ছিল না, কোনও গুরুত্বও ছিল না। তাছাড়া সে সৌন্দর্য বা গুরুত্ব আমি দেখতেও চাইনি। তবু বলব অকৃত্রিম অকপট স্বাভাবিকতায় ভরা সে ছবির একটা নিজস্ব গুরুত্ব, একটা অন্তর্নিহিত মূল্য ছিল আমার ক্রমোদভিন্ন ও ক্রমাত্মপ্রকাশমান শিশুমনের কাছে। 

একদিন ঘুরতে ঘুরতে রাজবাড়ির বাইরে এক অভিষেক উৎসবে চোখে পড়ে আমার। ছেলেমানুষ বলে দারোয়ানরা দয়া করে আমাদের ভিতরে কিছুদূর ঢুকে দেখতে দেয়। এত জাঁকজমক ও ঐশ্বর্যের ঘনঘটা জীবনে কখনও দেখিনি। তারপর বাড়িতে লোকের মুখে শুনেছিলাম আর একটি অভিষেক উৎসবের কথা। সে অভিষেক হলো সপ্তম চার্লসের অভিষেক, যে অভিষেক উৎসবে উপস্থিত ছিলেন পরমাসুন্দরী সম্রাজ্ঞী মেরিয়া থেরেসা। সে উৎসবে যেমন সব পুরুষদের দৃষ্টি দুর্বার বেগে গিয়ে পড়েছিল মেরিয়া থেরেসার উপর তেমনি সব নারীদের দৃষ্টিও কেড়ে নিয়েছিল সর্বাঙ্গসুন্দর চার্লস এর দুটি অপরূপ ভাষা ভাষা নীল চোখ। 

যে কোনও মেলা ও উৎসব দেখতে ভালো লাগত আমার। যেমন সেটি বার্থোলোমিউর মেলা আর পাইপার কোর্ট উৎসব। পাইপার কোর্ট উৎসব অনুষ্ঠিত হতো শহরের যত সব বড় বড় ব্যবসায়ীদের দ্বারা অতীতের একটি দিনের স্মৃতিরক্ষার্থে। এই দিনটিতে ব্যবসায়ীরা একযোগে এক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারি চাঁদা তোলার রীতির অবসান ঘটায়। সম্রাট তাদের দাবি মেনে নেন। এই উৎসব আমার খুব ভালো লাগত। কারণ আমাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি-কলাপগুলোকে আমাদের চোখের সামনে যেন অবিকল মূর্ত করে তুলত। এ উৎসবে নিষ্প্রাণ অতীত হয়ে উঠত যেন রঙে রসে জীবন্ত। 

আমাদের বাড়িটা নূতন হয়ে ওঠার পর যে জিনিসগুলো সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করত আমার তা হলো বাবার সংগৃহীত বই আর ছবি। বিভিন্ন ধরনের বই সংগ্রহ করার বাতিক ছিল বাবার। তার মধ্যে ছিল চিরায়ত লাতিন সাহিত্য, ইতালির কবিদের রচনা, ট্যানোর সমগ্র রচনা, আইনের বই, অভিধান আর বিজ্ঞান ও কলার বিশ্বকোষ। এছাড়া কিছু সমালোচনাগ্রন্থও ছিল। তবে প্রতি বছরই বাবা কিছু আইনের বই কিনতেন। 

আগে আমাদের পুরনো বাড়িটার দোতলার ছায়ান্ধকার যে ঘরখানায় দামী ছবিগুলো সাজানো থাকত সে ঘরে মোটেই মানাত না ছবিগুলোকে। নূতন বাড়ির একটা চকচকে ঝকঝকে ঘরে যখন নূতন করে সাজানো হলো ছবিগুলো তখন তাদের। সৌন্দর্য যেন অনেকগুণে বেড়ে গেল আগের থেকে। বড় বড় ছবিগুলো সব ছিল কালো ফ্রেমে আঁটা। তবে চিত্রশিল্প সম্বন্ধে বাবার একটা বিশেষ নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি বলতেন, বড় বড় শিল্পীর আঁকা পূরনো ছবি ভালো, কিন্তু বর্তমান কালের শিল্পীদের আঁকা ছবির উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বর্তমান কালের এই সব ছবিই একদিন কালোত্তীর্ণ মর্যাদা লাভ করে চলে যাবে অতীতের মধ্যে। বাবা বলতেন শিল্প-সাহিত্য বা যে কোনও বস্তুর ক্ষেত্রে অতীতের বলেই যে কোনও বস্তু ভালো হতে হবে তার কোনও মানে নেই। 

এই নীতির বশবর্তী হয়েই বাবা হার্ত, ট্রটমান, বো, স্কিৎস প্রভৃতি ফ্রাঙ্কফোর্টের নামকরা শিল্পীদের বাড়িতে এনে ছবি আঁকাতেন। তাই দিয়ে ঘর সাজাতেন। 

কিন্তু একবার একটি অসাধারণ ঘটনা আমার মনের ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেয়। আমার শান্তিকে ক্ষুণ্ণ করে। ১৭৫৫ সালের ১লা নভেম্বর তারিখে লিসবন শহরে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যে ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ড ঘটে যায় শহরে তা কল্পনাতীত আর তার খবর এক ব্যাপক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে সারা ইউরোপের মধ্যে। এই ঘটনায় ষাট হাজার লোক নিহত হয়। অসংখ্য বাড়িঘর, চার্চ, অফিস ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। চারদিকে ফেটে যাওয়া মাটির ভিতর থেকে ধোঁয়া ও আগুন বার হতে থাকে। অসংখ্য উত্তাল সমুদ্র-তরঙ্গ ফেনায়িত করাল মুখ মেলে এগিয়ে আসে সর্বগ্রাসী। ক্ষুধায় এবং রাজপ্রাসাদের একটি বড় অংশ গ্রাস করে ফেলে। এই ভূকম্পন আরও অনেক জায়গায় অনুভূত হয়। এই ভয়াবহ ঘটনার পূর্ণ বিবরণ শুনে ধার্মিক দার্শনিক বিজ্ঞানী প্রভৃতি সকল শ্রেণীর মানুষই ভয় পেয়ে যায়। পণ্ডিতরা এ ঘটনার কোনও ব্যাখ্যাই করতে পারে না। আমার বালকমনেও এক দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এ ঘটনা। আমি কিছুতেই বুঝতে পারতাম না। যে ঈশ্বরকে কেন ধর্মশাস্ত্রের প্রথমেই বিশ্বের পরম স্রষ্টা, সংরক্ষক ও পিতা হিসাবে দেখানো হয়েছে। যিনি মানুষের ভালোমন্দ কর্মের বিচার করে পুরস্কার বা শাস্তির বিধান করে থাকেন সেই ঈশ্বর ভালোমন্দ এতগুলো মানুষকে কেন নির্বিচারে এই ব্যাপক ধ্বংসের কবলে ঠেলে দিলেন। আমি তো দূরের কথা, ধর্মতত্ত্বে অভিজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিরাই এর কারণ খুঁজে পেলেন না অনেক চেষ্টা করেও। 

ওল্ড টেস্টামেন্টে যে ক্রুদ্ধ দেবতার কথা লেখা আছে, পরের বছর গ্রীষ্মকালে একদিন সেই ক্রুদ্ধ দেবতার সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম হঠাৎ। তিনি আমাদের দেখা দিলেন মত্ত ঝড়ের বেগে। আমাদের বাড়ির পিছন দিকের বাগান থেকে বজ্রবিদ্যুৎসহ এক প্রচণ্ড ঝড় ছুটে এল সহসা। লণ্ডভণ্ড করে দিল আমাদের বাড়ির সাজানো ঘরগুলোকে। অনেক জানালার কাঁচ ভেঙে দিল। সে ঝড়ের প্রচণ্ডতা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। ভয়ে। আমরা ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে রেখেছিলাম। কিন্তু বাবা সেগুলো জোর করে খুলে। দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির জলে ভেসে যেতে লাগল ঘরগুলো। সত্যিই আমার বাবার মনটা ছিল শক্ত, খুব মজবুত। কোনও ঘটনার আঘাতেই সে মন ভাঙতে চাইত না। বাবা চাইতেন আমাদের মনও বাল্যকাল থেকে অমনি শক্ত ও মজবুত হয়ে গড়ে উঠবে। অমনি করে সব ভয় জয় করতে পারবে। 

সেকালে শিক্ষাদীক্ষার আবহাওয়া ভালো ছিল না দেশে। শিক্ষাদানের নামে সর্বত্রই চলছিল আত্মম্ভরিতার প্রচার। আমার বাবা তাই আমার স্কুল জীবনেই বাড়িতেই নিজে আমাদের অনেক জিনিস পড়াতেন। তিনি বলতেন যিনি যে বিষয়ে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী তাঁর কাছ থেকে সেই বিষয় শিখতে হবে।

পড়াতে গিয়ে আমার সহজাত বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করতে লাগলেন বাবা। আবার বোনকে বাবা যখন ইতালীয় ভাষা ও সাহিত্য পড়াতেন তখন আমি ঘরের এক কোণে বসে তা শুনে অনেক কিছু শিখে নিতাম। বাবা স্পষ্ট একদিন আমাকে বললেন, আমি যদি তোর মতো বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি পেতাম তাহলে আরও বড় হতাম জীবনে।

বাবা লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইনবিদ্যা পাশ করেন। বাবা বলতেন, তিনি জীবনে যা কিছু শিখেছেন প্রচুর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে শিখেছেন। অপরিসীম একাগ্রতা আর নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশুনা করে শিখেছেন। তাঁর সহজাত গুণ আর প্রতিভা বলে নাকি কিছু ছিল না। 

আমার বাবা ও স্কুলের শিক্ষকরা যা পড়াতেন, অল্প সময়ের মধ্যেই তা আয়ত্ত করে ফেলতাম আমি। কিন্তু একটা বিষয় আমার পড়তে ভালো লাগত না। তা হলো ব্যাকরণ। আমার মতে ব্যাকরণের নিয়মকানুনগুলো মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়, কারণ সেগুলো ব্যতিক্রমে ভরা এবং সেগুলো ব্যাপক সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে শিখতে হয়। কোনও লেখার মধ্যে কিছু কিছু ব্যাকরণগত ত্রুটি থাকলেও ছন্দ, অলঙ্কার ও রচনালিখনে তাই তখনকার কোনও ছেলে পেরে উঠত না আমার সঙ্গে। 

বাবা একদিন আমার বললেন আমার স্কুলের পড়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি কলেজে যাব। তিনি আরও বললেন তাঁর মতো আমাকেও লিপজিগে গিয়ে শিখতে হবে আইনবিদ্যা। অন্যান্য পিতার মতো আমার পিতাও স্বভাবতই আশা করতেন তাঁর আরদ্ধ কাজকে আমি শেষ করব, তাঁর মনের কোণে জমে থাকা গোপন স্বপ্নকে সার্থক করে তুলব। তিনি বললেন, লিপজিগ ছাড়া আমাকে যেতে হবে ওয়েসলার, র‍্যাটিসবন এবং তারপর ইতালি। ইতালি থেকে আসার পথে যেতে হবে প্যারিসে। তার মতে ইতালি থেকে আসার পরে প্যারিস ছাড়া আর কোনো জায়গা ভালোই লাগবে না। কিন্তু কেন জানি বা বাবা আমাকে একটি জায়গায় যেতে নিষেধ করলেন। সে জায়গা হলো গর্টিনজেন। অথচ ঐ জায়গাটায় যাবার খুব ইচ্ছা ছিল, আশা ছিল।

ইতালি দেশটার প্রতি বাবার কেমন যেন একটা দুর্বলতা ছিল। সে দেশের নদী সমুদ্র, পাহাড়-প্রান্তর, বন-উপবন, ভাষা-সাহিত্য, শিল্প সব কিছুই যেন অনবদ্য, অতুলনীয় ছিল তাঁর কাছে। স্বভাবতই তিনি স্বল্পভাষী ও রাশভারি প্রকৃতির হলেও তিনি যখন আমার কাছে লেপনস শহরের বর্ণনা করতেন তখন কেমন যেন আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠত তাঁর নীরস অন্তর। তথাকথিত সেই ভূ-স্বর্গে সেই মুহূর্তে কল্পনার পাশা মেলে ছুটে যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠত আমার বালকমন। 

প্রতি রবিবার আমাদের এক সভা বসত। সভা মানে কবিতার আসর। আমরা কয়েকজন সহপাঠি মিলে একটি করে কবিতা লিখে আনতাম। আর তা একে একে পাঠ। করতাম। ছন্দ ও অলঙ্কারে আমার কিছু জ্ঞান হয়েছিল। তাই আমার কবিতায় ছন্দপতন বিশেষ ঘটত না। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, আমি যেমন আমার যে কোনও লেখায়। আনন্দ পাই তেমনি অন্য যেসব ছেলের ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কারে কোনও জ্ঞান নেই তারাও তেমনি আনন্দ পায় নিজেদের লেখায়। তারা প্রত্যেকেই মনে করে তাদের আপন আপন লেখা সবচেয়ে ভালো। কিন্তু একটা ঘটনায় আমি খুব ব্যথা পেলাম। আমাদের এক সহপাঠি বন্ধু তার শিক্ষকের কাছ থেকে কবিতা লিখে এনে বলত, সেটা তার লেখা। সে তার লেখার সঙ্গে আমার লেখার তুলনা করে অন্যায়ভাবে দাবি করত। আপন শ্রেষ্ঠত্বের। অবশেষে আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম হতাশ হয়ে। কিন্তু আর একটি ঘটনায় আমি আবার ফিরে পেলাম আমার হারিয়ে যাওয়া আশা আর উৎসাহ। একদিন আমাদের শিক্ষকরা আমাদের মতো যে সব ছেলেরা কবিতা লিখত তাদের নিয়ে এক কবিতা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলেন। সেখানে কিন্তু আমার কবিতাই সাধারণভাবে সকলের প্রশংসা অর্জন করল। 

সেকালে শিশুদের জন্য গ্রন্থাগার ছিল না। পাঠ্যপুস্তক আর বাইবেল ছাড়া অন্য কোনও বাইরের বই পড়তে পেতাম না আমরা। কিন্তু যে কোনও ভাবে হাতে একটা বই পেলাম আমি। বইটা খুব ভালো লেগে গেল আমার। বইটা হলো অভিদের ‘মেটামরফসিস’ বা রূপান্তর। এ বই-এর প্রতিটি ঘটনা ও চরিত্র ছবির মতো ভাসতে লাগল আমার মনে। আমি অবসর পেলেই সে বই-এর ছত্রগুলো আবৃত্তি করে ফেলতাম। 

এরপর আরও কয়েকটা বই পড়ার সৌভাগ্য হয় আমার। যেমন ফেনেলনের ‘টেলিমেকাস’, ড্যানিয়েল দিফোর ‘রবিনসন ক্রুসো। ক্রুসো পড়ে মনে হলো ফসলেনবার্গ দ্বীপ কল্পনার সৃষ্টি নয় তা বাস্তবে আছে। আর একখানা বই আমাদের কল্পনাকে উদ্দীপিত করে তুলল। তা হলো লর্ড অ্যানসরের ভয়েজ রাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড। বাস্তব ঘটনা ও পরিবেশের সঙ্গে দেশীয় রূপকথার এমন অপূর্ণ মিলন আমি আর কোথাও দেখিনি। 

ঐ সময় আমাদের শহরে ছেলেদের জন্য বেশ কিছু মধ্যযুগীয় রূপকথার বই বিক্রি হতে থাকে। তরুণ ছেলেমেয়েদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ঐ সব বই। এই সব বইয়ের মধ্যে ছিল ‘দি এমপারার অক্টেভিয়ান’, ‘দি ফেয়ার মেলুসিনা’, ‘দি ফোর সালয় অফ হাইম’, ‘দি ওয়ানডারিং জু’। সহজ ভাষায় লেখা এই সব বই পড়ে আমরা তার গল্পগুলো সহজেই বুঝতে পারতাম। অর্থাৎ এইভাবে দ্বিতীয়বার তাদের রস আস্বাদন করার সুযোগ পেলাম।

পড়াশুনোর আনন্দে বেশই বিভোর হয়ে ছিলাম আমি। কিন্তু বনভোজনের সময় হঠাৎ ঝড় এসে যেমন তার সব আনন্দ উপভোগ উড়িয়ে নিয়ে যায় মুহূর্তে তেমনি হঠাৎ অসুখ এসে ছিন্নভিন্ন করে দিল আমার সেই আনন্দকে। হঠাৎ একদিন জ্বর ও বসন্তরোগে আক্রান্ত হলাম আমি। বেশ কিছুদিন ভুগে যখন ভালো হলাম তখন দেখি। পড়াশুনার দিক দিয়ে পিছিয়ে গেছি আমি। কিন্তু সবচেয়ে সমস্যার সৃষ্টি করলেন আমার বাবা। অসুখের জন্য আমার পড়ার যে ক্ষতি হয়েছে সে ক্ষতি পূরণের জন্য তিনি আমায় রোজ দ্বিগুণ পড়ার কাজ দিতে লাগলেন। আমার শরীর খুব দুর্বল। আমার খুবই কষ্ট হচ্ছিল সে পড়ার কাজ করতে। কিন্তু কোনও উপায় ছিল না। 

দুঃখে যখনি অধৈর্য হয়ে পড়তাম আমি, অধৈর্যের পীড়নে যখন পীড়িত হতাম তখন নিজের মনকে নিজেই বোঝাতাম। তবে স্টইক সন্ন্যাসীদের কথা থেকে শেখা ও খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বে পড়া ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা নামক গুণটিকে সেই বয়সেই আয়ত্ত করে ফেলেছিলাম আমি। সেই গুণই আমাকে সান্ত্বনা দিত কোনও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে।

তবে বাবার এই শিক্ষাগত পীড়নের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য মাঝে মাঝে আমরা ভাইবোনে চলে যেতাম আমাদের দিদিমার বাড়ি। আমাদের দিদিমা-দাদামশাই দুজনে যখনও জীবিত ছিলেন। তাঁদের বাড়িটা ছিল আমাদের শহরেই ফ্রেডবার্গ স্ট্রীটে। পুরনো দুর্গের মতো বাড়িটা আমার মোটেই ভালো লাগত না। ভালো লাগত শুধু বাড়ির পিছনের দিকের বিরাট বাগানটা। সে বাগানের একদিকে ছিল ফুলের গাছ আর অন্য একদিকে ছিল শাকসজি আর ফলের গাছ। এর মধ্যে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল জাম আর জামরুল গাছ। গেলেই আশ মিটিয়ে ফল পেড়ে খেতাম গাছ থেকে। আমার দাদামশাই ছিলেন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। কিন্তু রোজ কোর্ট থেকে এসেই খোন্তা নিয়ে বাগানবাড়িতে চলে যেতেন। মালী থাকা সত্ত্বেও নিজের হাতে ফুলগাছগুলোর যত্ন। নিতেন। সারা বাগানটা তদারক করে বেড়াতেন। 

আর একটা কারণে আমরা গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতাম আমাদের দাদামশাইকে। সে কারণটি হলো এই যে তিনি ভবিষ্যতের সব কিছু বলে দিতে পারতেন। তিনি নাকি স্বপ্নে অনেক জিনিস আগে হতে জানতে পারতেন। একবার নিজের সম্বন্ধে এক ভবিষ্যদ্বাণী করেন দাদামশাই। তিনি দিদিমাকে বলেন, সরকারের আইনবিভাগের একটি পদ অল্পদিনের মধ্যেই শূন্য হবে আর সেই শূন্য পদে তিনিই অধিষ্ঠিত হবেন। কিছুদিন পর দেখা গেল সত্যিই এক ভদ্রলোক মারা গেলেন সেই বিভাগে আর তাঁকেই সরকার সেই পদে বসাল। দাদামশাই একমাত্র দিদিমার কাছে বলেন তিনি নাকি স্বপ্নে একথা জানতে পারেন। আর একটি মৃত্যুর কথাও আগেই বলে দেন তিনি।

আমি একবার দাদামশাই-এর বইখানা ওলটাতে ওলটাতে একটি খাতায় দেখি কি সব রহস্যময় কথা লেখা রয়েছে। আজ রাত্রিতে অমুকে আমার কাছে এসেছিল। অমুক ছাড়া সবাই চলে গেল। এইভাবে কারও নাম না করে তিনি অনেক কথা খাতায় লিখতেন। তার অর্থ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। 

আমার দুই মাসি ছিল। আমাদের শহরের মাঝেই দুজনের বিয়ে হয়েছিল দু জায়গায়। এক মাসির বাড়ি ছিল বাজারের কাছে ঘিঞ্জি জায়গায়। কিন্তু সে মাসি ছেলেবেলায় আমাদের বড় ভালোবাসত। শুধু আমাদের নয়, পাড়ার অনেক গরিব। ছেলেমেয়েদেরও সমানভাবে ভালোবাসত মাসি। তাদের গা পরিষ্কার করে দিত। চুল আঁচড়ে দিত। কোলে পিঠে করে খেলা করত তাদের সঙ্গে। 

আমার এক মাসির বাড়িতে একটা ছোটখাটো গ্রন্থাগার ছিল। আমি একদিন। সেখানে হোমারের এক গদ্যানুবাদ দেখতে পাই। কিন্তু তাতে ট্রয় জয়ের পূর্ণ বিবরণ। পেলাম না। পেলাম শুধু বিকৃত রুচির কতকগুলি ছবি। ছবিগুলো দেখে তখন আনন্দ পেলেও এখন বুঝছি সেগুলি খুবই খারাপ ছবি। আমার মেসোমশাইকে কথাটা বলতে তিনি আমাকে ভার্জিল পড়ার কথা বললেন। 

অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ধর্ম বিষয়েও আমাদের শিক্ষাদান করা হতো। কিন্তু তখনকার দিনের প্রোটেস্টান্ট ধর্ম আমাদের মনকে তৃপ্ত করতে পারেনি। সে ধর্মের কথা ছিল শুধু কতকগুলো নীরব নীতিশিক্ষার কথা যার সঙ্গে আমাদের হৃদয় ও উপলব্ধির কোনও সম্পর্ক ছিল না। এই জন্যই হয়ত ধর্মের ক্ষেত্রে গড়ে উঠেছিল অনেক সম্প্রদায়, অনেক মত, অনেক পথ। 

তবে আমি ধর্মের কথা বিভিন্নভাবে শুনেছিলাম তাতে আমার একটা কথা মনে হয়েছিল ঈশ্বর সম্বন্ধে। মনে হয়েছিল আমি ঈশ্বরকে খুঁজব প্রকৃতির মাঝে। আমি খুঁজব সেই ঈশ্বরকে যিনি একাধারে সারা বিশ্বের স্রষ্টা এবং পরিচালক, যে ঈশ্বরের মধ্যে নেই কোনও ক্রোধ বা রোষের প্রচণ্ডতা, আছে শুধু অফুরন্ত সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যের স্রোতই বিশ্বের সর্বত্র বিশেষ করে প্রকৃতির মাঝে খেলা করে চলেছে সর্বক্ষণ। 

আমার মনে হয়েছিল যে ঈশ্বর প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং তিনি প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে দিয়ে কাজ করে থাকেন সেই ঈশ্বর প্রকৃত ঈশ্বর। তবে এই ঈশ্বরকেই মানুষের সঙ্গেও সম্পর্কযুক্ত করে তুলতে হবে। এই ঈশ্বরই মহাশূন্যে গ্রহনক্ষত্রের গতিপ্রকৃতি পরিচালনা করে থাকেন। তবে আমার এ কথাও মনে হয়েছিল যে এ ঈশ্বরের কোনও আকার নেই। এ ঈশ্বর অরূপ নিরাকার।

একদিন এই ঈশ্বরের উপাসনা করার জন্য ওল্ড টেস্টামেন্টের কায়দায় এক বেদী তৈরি করলাম। তার উপরে আগুন জ্বালাতে হবে। সেই আগুনের শিখা ঈশ্বরের প্রতি মানুষের, ভগবানের প্রতি ভক্তের সুনিবিড় কামনার দ্যোতক হয়ে জ্বলতে থাকবে। 

একদিন ভোর হতেই উঠে পড়লাম আমি। তখনও সূর্য উঠতে দেরি আছে। সূর্য ওঠার আগেই বেদীতে আগুন জ্বালব আমি। কিন্তু সুগন্ধি কাঠ কোথায়? একমাত্র সুগন্ধি ধূম পরিবৃত্ত অগ্নিই হতে পারে আমার অন্তরের প্রতিনিধি। অনেক কষ্টে আমি অবশেষে কিছু সুগন্ধি চন্দনকাঠ যোগাড় করে বেদীর উপর রেখে তাতে অগ্নিসংযোগ করলাম। আমার ধারণা আমি এইভাবে ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পাব। তখন সূর্য উঠেছে, কিন্তু চারদিকের বাড়িগুলোর আড়ালে সে সূর্যের মুখ দেখতে পেলাম না। যাই হোক, বেদীতে আগুন জ্বলতে লাগল। সুগন্ধি ধোঁয়া উঠতে লাগল যজ্ঞবেদী হতে। আর আমি চোখ বন্ধ করে একমনে ধ্যান করতে লাগলাম ঈশ্বরের। 

চোখ বন্ধ করে একমনে ধ্যান করছিলাম। কিন্তু দেখতে পাইনি যজ্ঞবেদীর আগুন প্রবল হয়ে কখন বেদীর কাছে রাখা ফুল, পূজোর উপকরণ ও আরও কিছু জিনিসপত্র সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। আমার নিজের ঘরে এই পূজোর আয়োজন করেছিলাম আমি। হঠাৎ আমার ধ্যান ভেঙে গেল আমার। না ভাঙলে ঘরের সমস্ত জিনিস এবং এমনকি আমিও পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম। 

তারপর এ কাজ আর আমি কখনও করিনি। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

আমার সাতটা বছর শান্তিতেই কেটেছিল। সারা দেশে তখন বিরাজ করত নিরঙ্কুশ শান্তি। কিন্তু সহসা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল সেই অবিচ্ছিন্ন শান্তির ধারা। এল অশান্তি। এল যুদ্ধ। ১৭৫৬ সালের ২৮শে আগস্ট তারিখে বাধল অস্ট্রিয়ার সঙ্গে প্রুশিয়ার যুদ্ধ। প্রুশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক ষাট হাজার সৈন্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেদিন। অস্ট্রিয়ার পাক্সলি শহরের উপর। রাজনৈতিক মতবাদের দিক থেকে দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল আমাদের দেশের লোকেরা। একদল সমর্থন করতে লাগল প্রশিয়ার রাজা। ফ্রেডারিককে আর একদল সমর্থন করতে লাগল অস্ট্রিয়াকে। 

আমাদের পরিবারের মধ্যেও দেখা দিল এক ফাটল। আমার দাদামশাই অস্ট্রিয়ার পক্ষ অবলম্বন করলেন অথচ আমার বাবা সম্রাট সপ্তম চার্লস কর্তৃক মনোনীত ইম্পিরিয়াল কাউন্সিল-এর সদস্য হিসাবে অবলম্বন করলেন ফ্রেডারিকের পক্ষ। ফলে রবিবার আর আমাদের দাদামশাই-এর কাছে যাওয়া হতো না। এমনকি মা নিষেধ করে। দিয়েছিলেন তাঁর নাম যেন কখনও উচ্চারণ না করি। 

সুতরাং তখন আমার বালক মনেও পড়েছিল প্রুশিয়ার প্রভাব। প্রুশিয়ার হয়ে অনুভব করতাম জয়ের আনন্দ। কিন্তু আমার দাদামশাই-এর কথা মনে করে সেই আনন্দের মাঝেও অনুভব করতাম এক নিদারুণ বেদনা! সঙ্গে সঙ্গে লিসবনের সেই ভূমিকম্পের মতো এই যুদ্ধের ঘটনাটাও নতুন করে প্রচণ্ডভাবে কাঁপিয়ে দিল আমার ঈশ্বরবিশ্বাসের ভিত্তিভূমিটাকে। আমার কেবলি মনে হতো আমার দাদামশাই সব দিক দিয়ে একজন আদর্শ চরিত্রের মানুষ হয়েও কেন আজ রাজনৈতিক কারণে জনসাধারণের ও শহরের বহু বিশিষ্ট লোকের কাছ থেকে পাচ্ছেন দুঃসহ অবহেলা আর অপমান? এখানে কি ঈশ্বরের করার কিছু নেই? আর জনমতেরই বা সততা কোথায়? কোথায় তাদের ন্যায়বিচার? লোকে কি বলবে বলে ছোট থেকে আমাদের যে জনমতের জুজুর ভয় দেখানো হয় আসতে সে জনমত অর্থহীন।

যুদ্ধের সময় ছেলেদের বাইরে বার হতে দেওয়া হতো না। সারাদিনই আমাদের মতো ছেলেদের সবসময় থাকতে হতো বাড়ির ভিতর। তাই মাঝে মাঝে আমাদের আমোদ-প্রমোদের জন্য পুতুলনাচের অনুষ্ঠান হতো। আমাদের বাড়িতে একবার পুতুলনাচ হয়েছিল আর তাতে পাড়ার ছেলেমেয়েদের প্রচুর ভিড় হয়েছিল। 

মাঝে মাঝে রাত্রিবেলায় স্বপ্ন দেখতাম আমি আর সেই স্বপ্নের কথাগুলোকে গল্পের মতো করে বলতাম আমার খেলার সঙ্গী-সাথীদের কাছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কথা বিশ্বাস করত। কেউ আবার স্বপ্নের কথা অর্থাৎ বন, বাগানবাড়ি কোথায় আছে তা মিলিয়ে দেখবার চেষ্টা করত। 

একদিনকার এমনি এক স্বপ্নের কথা মনে আছে আমার। একদিন রাত্রিতে আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি আয়নার সামনে নূতন পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছি। তখনও আমার সাজসজ্জা শেষ হয়নি, এমন সময় এক সুদর্শন যুবক এসে হাসিমুখে দাঁড়াল আমার সামনে। আমি তাকে অভ্যর্থনা জানাতে সে বলল, তুমি জান আমি কে? আমি বললাম, তোমাকে দেখতে লাগছে ছবিতে দেখা বুধগ্রহের মতো। সে বলল, হ্যাঁ, আমি তাই। দেবতাদের এক বিশেষ অনুরোধে আমি এসেছি তোমার কাছে। তার হাতের উপর রাখা তিনটি আপেল দেখিয়ে সে তখন বলল, দেখতে পাচ্ছ এই আপেলগুলো? আমি ভালো করে দেখলাম তার হাতের তিনটি আপেল তিন রং-এর এবং সেগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। একটি আপেল লালচে, একটি সোনালী আর একটি সবুজাভ। আমি তখন হাত বাড়িয়ে আপেলগুলো নিতে গেলাম তার হাত থেকে। কিন্তু সে সরে গিয়ে বলল, এগুলো তোমার জন্যে নয়। তুমি এই আপেলগুলো শহরের তিনজন খুব সুন্দর যুবককে দেবে। তাহলে তারা তাদের পছন্দমতো সুন্দরী স্ত্রী খুঁজে পাবে। এই বলে আপেলগুলো আমার হাতে দিয়ে যুবকটি চলে গেল। আমি আপেলগুলো হাতে। নিয়ে দেখতে লাগলাম আশ্চর্য হয়ে। কিন্তু আপেলগুলো সহসা বড় হতে হতে মাঝারি আয়তনের তিনটি পুতুলের আকার ধারণ করে। তারা রূপান্তরিত হলো তিনটি নারী মূর্তিতে। তাদের শাড়ির রং ছিল ঠিক সেই আপেল তিনটির মতো। তাদের মধ্যে দুজন পালিয়ে গেল আমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে। আর একজন আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে নাচতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে তার নাচ দেখতে লাগলাম। আমি ভাবলাম সে আমায় ধরা দেবে। তাই যেমন তাকে ধরতে গেলাম অমনি আমার মাথায় কে যেন জোর আঘাত দিল আর আমি পড়ে গেলাম। 

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে বেলা হয়ে গিয়েছিল আমার। 

স্টইক সন্ন্যাসীদের অনেক আত্মনিগ্রহের কথা শুনে আমিও নিজের উপর তা প্রয়োগ করতাম। এর মধ্যে একটি আত্মনিগ্রহ আমাদের শিখতে হলো শিক্ষকদের কাছ থেকে। সেটা হলো দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করতে শেখা। এই সহনশক্তি শিক্ষা দেওয়াই হলো বেশির ভাগ খেলাধূলার লক্ষ্য। আমাদের শিক্ষক আমাদের মুখে গায়ে ঘুষি মেরে যেতেন আর তাই চুপ করে আমাদের সহ্য করে যেতে হতো। কোনও কথা বলতে পেতাম না। এর থেকে আমরা ক্রোধ দমন করতে ও দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা অর্জন করতাম। 

১৭৫৭ সালটা মোটের উপর শান্তিতে কেটে গেল। যে সব সংসারে রাজনৈতিক মতামতের জন্য ফাটল ধরেছিল সে সব সংসারেও অনেকটা শান্তি ফিরে এল। ফাটলের অনেকখানি পূরণ হলো। আমার বাবা তখন বাড়িতে ছিলেন না। দেশভ্রমণে বার হয়েছিলেন। 

অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে অবশেষে ঘরে ফিরলেন বাবা। ফিরে কি মনে হলো, আমাদের শহরের পৌর প্রতিষ্ঠানে এক অবৈতনিক প্রশাসকের পদ চাইলেন। কিন্তু তাঁর সে আবেদন প্রত্যাখ্যাত হতে বড় ব্যথা পেলেন। যাই হোক, ঠিক এই সময় উফেনব্যাক নামে একজন নামকরা গাইয়ে আসেন আমাদের শহরে। আমাদের সকলের দৃষ্টি তখন চলে যায় সেই দিকে। 

ব্যারন ভন বেকেন নামে একজন সামন্তের কথা আমার আজও মনে আছে তিনি বড় অদ্ভুত প্রকৃতির লোক ছিলেন। একবার শহরের বহু ভিখারীকে ডেকে তাদের প্রত্যেকের ছেঁড়া কাপড় আর কম্বল সব কেড়ে নিয়ে তাদের পোশাক বিতরণ করেন এবং এক ঘোষণা জারি করে বলে দেন, প্রতি সপ্তাহে তিনি তাঁর বাড়িতে ভিখারীদের কিছু দান করবেন। কিন্তু যারা এই দান নিতে চায় তাদের প্রত্যেকে ফর্সা জামাকাপড় পরে আসতে হবে। তিনি যেমন সমাজের অভিজাত শ্রেণীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন তেমনি নিঃস্ব গরিব ও ভিখারীদের খাওয়াতেও ভালোবাসতেন। 

এরপর মনে পড়ে আমার ডাক্তার ওর্থের কথা। তিনি ধনী ঘরের সন্তান হয়েও প্রচুর পড়াশুনা করেন। জ্ঞানের গভীরতা, পাণ্ডিত্য, প্রশাসনিক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনও সরকারি পদ গ্রহণ করেননি। তিনি রিফরমেশান অফ ফ্যাঙ্কফোর্ট’ নামে একখানি বই লেখেন এবং তা প্রকাশ করেন। আমি যৌবনে বইখানি পড়েছিলাম। বইখানির ঐতিহাসিক মূল্য অনস্বীকার্য। জন মাইকেল ভন লোরেন নামে আর একজন লেখকের কথা মনে আছে। তিনি কাউন্ট অর রিভেয়া’ ও ‘দি টু রিলিজিয়ন’ নামে দুখানি বই লিখে বেশ নাম করেন। প্রথম বইখানি শিক্ষামূলক রোমান্স। তাতে অভিজাত সমাজের জন্য বেশ কিছু নীতিশিক্ষার কথা ছিল। আর দ্বিতীয় বইখানি ধর্ম বিষয়ে বিতর্কে ভরা। এই বই পড়ে অনেক ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কে নেমে যান। এর ফলে রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিকের দৃষ্টি পড়ে তার উপর এবং তাঁকে লিনজেনের সভাপতির পদ দান করেন। 

আমাদের প্রতিবেশী ভন অকসেনস্টাইনের নাম আগেই করেছি। তার তিনটি ছেলে ছিল। এই পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র জীবদ্দশায় কোনও নাম-যশ লাভ করতে পারেননি। কিন্তু মৃত্যুর পর হঠাৎ খ্যাতি অর্জন করে প্রচুর। মৃত্যুকালে যাজকদের কাছে তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করে যান তার মৃতদেহ সমাধিক্ষেত্রে নিয়ে যাবে দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা। এতে সমাজের উচ্চশ্রেণীর অনেকে রেগে যান। কিন্তু পরে দেখা গেল অনেকে আবার এই রীতি গ্রহণ করছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা এই রীতির পক্ষপাতী হয়ে ওঠে কারণ এতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়র খরচ কম পড়ে। 

আমাদের শহরের আর এক অদ্ভুত পরিবারের কথা মনে আছে। সে পরিবারের নাম হলো সেনকেনবার্গ পরিবার। তাদের বাড়িতে একটি পোষ খরগোস ছিল বলে সেই জন্য স্থানীয় রাস্তার নাম হেয়ার স্ট্রিট হয় আর সেই পরিবারের তিনটি ছেলেকে তিনটি খরগোস বলত পাড়ার লোক। অথচ পরবর্তীকালে তিনটি ছেলেই আপন আপন ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জন করে। বড় ছেলে ছিল রাজপরিষদের নামকরা সদস্য। দ্বিতীয় ছেলে ছিল সুযোগ্য জেলাশাসক। আর তৃতীয় ছেলে ছিল ডাক্তার। 

ভন লোয়েন যেমন অভিজাত সমাজের উচ্ছখল লোকদের নৈতিক অনুশাসনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করতে চেয়েছিলেন, ভন মোসের নামে এক ব্যবসায়ী তেমনি কয়েকখানি বই লিখে ব্যবসায়ীদের অসাধুতা দূর করে তাদের সৎ জীবন যাপন করার শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ী মহল তাঁর কথা শুনেছিল বলে মনে হয় না। ফলে মনে কোনওদিন শান্তি পাননি মেসের। এমন একটা দুঃসহ দুরন্ত অনুভূতির সঙ্গে সারাজীবন তাঁকে যুদ্ধ করে যেতে হয়েছিল যে অনুভূতিকে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে। আমার সেই অনুভূতিকে একেবারে দূর করে দিতেও পারছিলেন না মন থেকে। 

আমার বাবা মনে করতেন ছন্দই হলো কবিতার প্রাণ। তাই বেছে বেছে সেই সব প্রবীণ ও নবীন কবিদের কাব্যগ্রন্থ কিনে ঘরে সাজিয়ে রেখেছিলেন যারা ছন্দে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন ক্যানিস, হেগেডন, ড্রোনিংগার, জগেলার্ত ও হলার। 

এমন সময় ক্লপস্টক নামে একজন আধুনিক কবি হঠাৎ নাম করে বসলেন, তাঁর ‘মেসিয়া’ নামে একখানি কাব্যগ্রন্থ আমাদের শহরের প্রায় ঘরে ঘরে স্থান পেল। অনেকে আবৃত্তি করল তাঁর কবিতা। বাবা সব নামকরা আধুনিক কবিদের কবিতার বই ঘর কিনে সাজিয়ে রাখতেন। নূতনদের বাবা পছন্দ করতেন, কিন্তু ক্লপস্টকের কবিতা ‘হেক্সামিটার বা ষষ্ঠপার্বিক ছন্দে লেখা বলে বাবা তাঁর কবিতার বই কেনেননি। বাবা বলতেন, ও ছন্দ ছন্দই নয়। 

যাই হোক আমাদের পরিবারর এক বন্ধু ‘মেসিয়া’ বইখানি আমার মার হাতে দিয়ে যান। ভদ্রলোক ব্যবসায়ী হলেও বইখানি পছন্দ করেছিলেন এবং এর অনেক কবিতা তিনি আবৃত্তি করে পড়তেন। আমরাও মার সহযোগিতায় বাবাকে লুকিয়ে বাড়িতে সে বই-এর অনেক কবিতা মুখস্থ করতাম। 

একদিন একটা মজার ঘটনা ঘটল। সন্ধের দিকে নাপিত এসে বাবার ঘরে তাঁর দাড়ি কামাবার জন্য মুখে সাবান মাখাচ্ছিল। ঠিক এই সময় তারা দুই ভাই-বোনে চাপা গলায় আগুনের কাছে এক কোণে বসে ‘মেসিয়া’ কাব্যগ্রন্থের একটা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে আমাদের ভাব এসে গিয়েছিল। হঠাৎ আবেগের মাথায় আমার ছোট বোন একটা ছত্র বলতে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে আর নাপিত চমকে যাওয়ায় তার হাত থেকে অনেকটা সাবানের ফেনা পড়ে যায় বাবার জামার উপর। বাবা রেগে গিয়ে এর। কারণ অনুসন্ধান করে অবশেষে বইটির কথা জানতে পারলেন। সেদিন থেকে ক্লপস্টকের ‘মেসিয়া কাব্যগ্রন্থখানি চিরদিনের জন্য নির্বাসিত হলো বাবার বিচারে। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১৭৫৯ সাল এসে গেল। কিন্তু নববর্ষের পারস্পরিক সাদর সম্ভাষণের মিস্টি আবহাওয়াটা কেটে যেতে না যেতেই আমাদের শহরের উপর নেমে এল দুর্দিনের করাল কালো ছায়া। ফরাসি সৈন্যরা দলে দলে আমাদের শহরের ভিতর দিয়ে মার্চ করে যেতে লাগল। শহরের কৌতূহলী জনতা রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে তাদের দেখল। কিন্তু তাদের বাধা দেবার কোনও ক্ষমতা ছিল না আমাদের। এমনি করে একদিন দেখা গেল শহরের সামান্য রক্ষীদের হারিয়ে দিয়ে শহরটা দখল করে নিল ফরাসিরা। 

শান্তিপ্রিয় শহরবাসীদের কাছে এক বিরাট দুঃখের কারণ হয়ে উঠল ব্যাপারটা। কিন্তু সবচেয়ে বেশি দুঃখ পেলেন আমার বাবা। কারণ তাঁর নতুন বাড়িটার এক বড় অংশ ছেড়ে দিতে হলো বিদেশী সৈন্যদের অফিসের জন্য। বাবা ছিলেন প্রুশিয়ার পক্ষে তাই কার্যত তিনি বন্দি হয়ে রইলেন তার ঘরে। 

কাউন্ট থোরেন নামে এক ফরাসি সামরিক অফিসার অফিস খুলল আমাদের একতলার বাইরের ঘরে। ফরাসি সৈনিকরা ঘিরে রইল বাড়িটাকে। নগরবাসী ও ফরাসি সৈন্যদের সঙ্গে কোথাও কোনও দ্বন্দ্ব বা বিবাদ বাধলে এবং কোন পক্ষ অভিযোগ জানালে থোরেন তার বিচার করবে এবং শাস্তি বিধান করবে। সারা দিন তাঁর কাজকর্মের অন্ত ছিল না। 

কিন্তু লোক হিসাবে খারাপ ছিল না থোরেন। আসার প্রথম দিকে একদিন আমাদের বাড়িটা বাবার সঙ্গে ঘুরে দেখার সময় আমাদের ছবির ঘরটা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। বলে, এই সব শিল্পীদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তাদের সঙ্গে আলাপ করবে। আমাদের বাড়ির সকলের সঙ্গে খুবই ভালো ব্যবহার করত থোরেন। রোগা ছিপছিপে চেহারার মানুষটা ছিল লোহার মতো শক্ত এবং অসাধারণ গাম্ভীর্যে ভরা মুখে ছিল বসন্তের দাগ। কিন্তু কড়া সামরিক অফিসার হলেও শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি থোরেনের অনুরাগ ছিল অপরিসীম। আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই তা দেখে।

তবু কিন্তু বাবার মন ভিজল না, গলা তো দূরের কথা। মা তো থোরেনের সঙ্গে কথা বলার জন্য সাধ করে ফরাসি শিখতে লাগল। আমাদের পরিবারের বন্ধুরা ও মা নিজে বাবাকে বোঝাতে লাগল, থোরেন ছাড়া অন্য লোক এসে অবস্থা আরও খারাপ হবে। কিন্তু থোরেন যত ভালো লোকই হোক বাবা এই চাপিয়ে দেওয়া অবাঞ্ছিত পরাধীন পরিবেশটা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না মনে মনে। আগে তিনি আমাদের যেভাবে পড়াতেন এখন তেমন করে মন দিতে পারলেন না পড়ানোয়। কোনও কাজেই তার উৎসাহ নেই। 

কাউন্ট থোরেনের সঙ্গে একজন দোভাষী ছিল। সে হচ্ছে আমাদের শহরের লোক। ফরাসি এবং জার্মান দুইই জানত বলে এই কাজ পায়। সে রোজ কাজ সেরে আমাদের বাড়ির ভিতরে এসে মজার মজার গল্প বলত। কোনো কোনো মামলায় থোরেন কি কি রায় দিত তার একটা করে ফিরিস্তি দিত। এই সব গল্প শুনে আমার মা ও আমরা মজা পেতাম। এই দোভাষী আবার অবসর সময়ে আমার মাকে ভাষা শেখাত। 

অদ্ভুত একটা রোগ ছিল থোরেনের। সে রোগের নাম হলো হাইপোকনড্রিয়া বা বিষাদময়তা। মাঝে মাঝে গম্ভীর ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ত থোরেন। কাজ ফেলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘরের মধ্যে চলে যেত। আর বার হতো না, কারও সঙ্গে দেখা করত না। একমাত্র খাস চাকর ছাড়া কেউ তার কাছে যেতে পারত না। এক-এক সময় দু-তিন দিন পর্যন্ত এইভাবে থাকত। আমরা বলতাম ওর ঘাড়ে ভূত চেপেছে। ভূতটা ছেড়ে গেলেই আবার স্বাভাবিক মানুষ হয়ে উঠত থোরেন। 

একবার থোরেন সত্যি সত্যি শহরের নামকরা আধুনিক শিল্পীদের ডেকে তাদের কাছ থেকে তার পছন্দমতো বেশি কিছু ছবি কিনে নেয়। সেই ছবিগুলো আমাদের এক ঘরে ভরে রাখে। ঘরখানা স্টুডিওর মতো দেখাত। তার মতো কড়া সামরিক অফিসারের সূক্ষ্ম শিল্পরুচি দেখে আশ্চর্য হলাম আমরা। একদিন ছবির ঘরে ঢুকে আমি একটা ফটোর বাক্সের তালা খুলে তার মধ্যে কোনও নিষিদ্ধ ছবি দেখার চেষ্টা করি। ঢাকনা বন্ধ করার আগেই কাউন্ট থোরেন ঘরে ঢুকে আমাকে এভাবে দেখে দারুণ। রেগে যায়। গম্ভীরভাবে আমাকে হুকুম দেয় আমি যেন আটদিন এ ঘরে আর না ঢুকি। আমার দোষের কথা বুঝতে পেরে আমি মাথা নত করে নীরবে বেরিয়ে যাই ঘর থেকে। সে হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করছিলাম আমি। 

এই সময় আমি ফরাসি ভাষা শিক্ষা করি। কিছু কিছু কথা বলতে পারতাম এবং বুঝতাম। এমন সময় একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম অপ্রত্যাশিতভাবে। আমাদের শহরের একটা থিয়েটারে তখন বেশ কয়েকদিন ঘরে ফরাসি নাটক দেখানো হচ্ছিল। আমার দাদামশাই আমাকে একখানা সিজন টিকিট দিয়েছিলেন যাতে আমি রোজ যে কোনও নাটক দেখতে পারি। আমার বাবা এটা না চাইলেও মার সহযোগিতায় আমি সেখানে যেতাম। কিন্তু মিলনান্তক নাটক আমার মোটেই ভালো লাগত না। সে নাটকের সংলাপ কোনও রেখাপাত করত না আমার মনে। ভালো লাগত বিয়োগান্ত নাটক। দীর্ঘ বিলম্বিত লয়ে বাঁধা ছায়িত সংলাপ, নায়ক-নায়িকার ধীর উদাত্ত কণ্ঠস্বর, সদা সতর্ক পদক্ষেপ ও অঙ্গসঞ্চালন, গুরুগম্ভীর পরিবেশ–সব মিলিয়ে আমার বড় ভালো লাগত। অনেক সংলাপ আমার মুখস্থ হয়ে গেল। 

দিরোনেস নামে একটি ছেলের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। সে একবার তার বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বোনটি বয়সে আমার থেকে কিছু বড় ছিল। দেখতে মেয়েটি ভালো ছিল–সবল সুগঠিত চেহারা, বাদামী রং কালো চুল। কিন্তু তার ভাসা ভাসা চোখ দুটো সব সময় বিষাদের ছায়ায় কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। মেয়েটিকে আমার ভালো লাগে এবং তার কাজে আমার প্রিয় করে তোলার জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করতে থাকি। যখনি তাদের বাড়ি যেতাম আমি কোনও ফুল বা ফল বা কোনও না কোনও একটা জিনিস উপহার দিতাম মেয়েটিকে। কিন্তু কোনও কিছুতেই তার মুখে হাসি ফোঁটাতে পারিনি আমি। অবশেষে একদিন মেয়েটির বিষাদের কারণ জানতে পারলাম। একদিন তার ঘরে বিছানার পাশে দেওয়ালে একটি ফটো দেখলাম। ছবিটি এক সুন্দর চেহারার ভদ্রলোকের। দিরোনেস আমাকে যা বলল তাতে বেশ বুঝতে পারলাম, ঐ ভদ্রলোক তাদের মার প্রথম পক্ষের স্বামী এবং তার দিদি হচ্ছে এ ভদ্রলোকের মেয়ে তারা দুই ভাই তার মার এক পক্ষের স্বামীর ছেলে। এবার বুঝলাম তার বাবাকে অকালে হারিয়ে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্যই মেয়েটি সতত বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকে।

কাউন্ট থোরেন ছিল ফরাসি রাজার লেফটন্যান্ট। সেই সূত্রে বহু গণ্যমান্য ফরাসি লোক ও উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার প্রায়ই দেখা করতে আসত তার সঙ্গে। এক সময় দেখা গেল রাজা নিজে এলেন কাউন্টের সঙ্গে গোপনে পরামর্শ করার জন্য। দেখলাম থোরেনের কাছে ঘন ঘন সেনাবাহিনীর অফিসারেরা দেখা করতে আসছে। এমন সময় একটা গুজব রটনা হয়ে গেল। শোনা গেল প্রুশিয়ার রাজা ফার্ডিন্যান্ড আবার আসছেন। তিনি শীঘ্রই ফরাসিদের তাড়িয়ে দেবেন ফ্রাঙ্কফোর্ট শহর থেকে। অনেকে ব্যগ্রভাবে সেই মুক্তির দিনের প্রতীক্ষা করতে লাগল। কথাটা শুনে আমার বাবা খুব আশান্বিত হলেন। খুশি হলেন মনে মনে। কিন্তু আমার মা কেমন যেন মুষড়ে পড়লেন। তাঁর কথা হলো এই যে ফরাসিদের শহর থেকে তাড়াতে পারলেই যুদ্ধ বাধবে। ফরাসিরা তাতে হেরে গেলেও পালিয়ে যাবার সময় যে ক্ষয়ক্ষতি করে যাবে তার ফল খুবই খারাপ হবে। তার থেকে যে অবস্থা বর্তমানে রয়েছে তাই থাক। 

শহরের মধ্যে প্রচুর সৈন্য আনাগোনা করতে লাগল। আমাদের বাড়িতে দিনরাত সমানে লেগে থাকত ভিড় আর গোলমাল। বাড়ি থেকে ছেলেদের বার হতে দেওয়া হতো না। আমার বাবা ছিলেন প্রুশিয়ার পক্ষে। যুদ্ধ শুরু হতেই তিনি এগিয়ে গেলেন বিজয়ী বীরদের শহরে বরণ করে আনার জন্য। কিন্তু বাবা বেশ কিছুটা শহরের বাইরে এগিয়ে দেখলেন উল্টো ফল ফলেছে। দলে দলে আহত বন্দি জার্মানরা ফিরে আসছে শহরে। শুনলেন ফরাসিদের অবস্থা বর্তমানে ভালো। আপন দেশবাসীদের বন্দিদশা দেখে বাবা কেমন যেন আত্মহারা হয়ে পড়লেন। তিনি হতাশ মনে বিষণ্ণ মুখে বাড়ি ফিরে একে দুঃখে জলস্পর্শ করলেন না। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আকাশ পাতাল কি সব ভাবতে লাগলেন। মা ও আমরা সকলে পীড়াপীড়ি করেও কিছু খাওয়াতে পারলাম না বাবাকে।

সেদিন থোরেনকে খুব খুশি দেখাচ্ছিল। সে অফিস থকে ঘোড়ায় চেপে কোথায় যাচ্ছিল। আমরা তার কাছে গিয়ে তার হাত চুম্বন করলাম। সে খুশি হয়ে আমাদের মিষ্টি দেবার হুকুম দিল তার লোকদের। কিন্তু ঘরে ফিরে আবার জন্য খারাপ লাগছিল আমাদের। বাবা তখনও কিছু খাননি। অনেক করে কোনওমতে মধ্যাহ্নভোজনে রাজি করালাম আমরা। নিচেকার খাবার ঘরে গিয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে খাবেন। 

কিন্তু তখন আমরা ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি আমরা তাঁকে এর দ্বারা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। বাবা উপর থেকে সিঁড়ি নিয়ে নিচে নামবার সময় দুর্ভাগ্যক্রমে থোরেনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মুখোমুখি হতেই থোরেন বাবাকে বলল, এই ভয়ঙ্কর বিপদটা যে এত সহজে কেটে গেল এর জন্য তুমি আশা করি নিজেকে ও আমাদের সম্বর্ধনা জানাবে। 

আমার বাবা কিন্তু গম্ভীর মুখে বললেন, কোনওক্রমেই না। তার থেকে তুমি আমি সব যদি নরকে যেতাম তাও ভালো ছিল। 

এতে কাউন্ট থোরেন রেগে গিয়ে বলল, এর জন্য দুঃখ পেতে হবে তোমায়। তুমি বুঝতে পারবে এভাবে অকারণে আমাকে অপমান করা তোমার উচিত হয়নি। 

সেকথায় কান না দিয়ে বাবা নিচে নেমে এসে খাবার টেবিলে বসলেন। সাধ্যমতো যা পারলেন খেলেন। কাউন্ট থোরেনকে কিছু শক্ত কথা বলে মনটা যেন কিছুট হাল্কা হয়েছে তার। 

কিন্তু সে রাতে আমরা যখন ঘুমিয়ে ছিলাম এক তুমুল ব্যাপার ঘটে যায়। জানতে পারলাম পরের দিন সকালে। দোভাষী সেই ফরাসি ভদ্রলোকের কাছ থেকে সব শুনলাম আমরা। শুনলাম গত রাতে আমরা বাড়ির ছেলেরা শুতে যাবার পর থোরেন বাবাকে গ্রেপ্তার করে গার্ড হাউসে নিয়ে যাবার হুকুম দেয়। বাবার পরিত্রাণের কোনও উপায় ছিল না। তার অধীনস্থ কর্মচারীরা সে হুকুম তামিল করতে কিছু দেরি করে আর সেই অবসরে দোভাষী সব নিয়মকানুন ভুলে গিয়ে কাউন্ট থোরেনের খাস কামরায় চলে যায়। মা ও আমাদের নামে আবেদন জানায় থোরেনে কাছ। বলে এ দণ্ডাদেশ মকুব করতেই হবে। থোরেন বলে, সে এ অপমান কিছুতেই সহ্য করবে না। তার হুকুম নড়চড় হবার নয়। কিন্তু দোভাষী অনেক করে বুঝিয়ে বলতে থাকে, আমার বাবা আসলে লোকটা খারাপ নয়, হঠাৎ কি মনে করে কথাটা বলে ফেলেছেন। তাছাড়া আমার মা ও আমরা ছেলেমেয়েরা তার আনুগত্য তো মেনেই নিয়েছি। সুতরাং থোরেনের মতো একজন সদাশয় অফিসার যদি সকলের সকল অভিযোগ ধৈর্য ধরে শুনে সকলের প্রতি সুবিচার করেন, তাঁর পক্ষে সামান্য একটা তুচ্ছ ব্যাপারে একজন নিরীহ লোককে এ শাস্তি দান করা শোভা পায় না। 

যাই হোক, অবশেষে দোভাষীর আবেদন মঞ্জুর হয়। শাস্তির আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় থোরেন। পরের দিন দোভাষী আমাদের বাড়িতে এসে এ ব্যাপারে থোরেনের সঙ্গে যা যা কথা হয় সব গর্বের সঙ্গে বলে যায়। কোনও খুঁটিনাটি বাদ দেয়নি। এর মধ্যে হয়ত কিছু অত্যুক্তিও থাকতে পারে। 

সেই দিন থেকে কেমন যেন বেশি গম্ভীর দেখাত থোরেনকে। বাবাও সাবধান হয়ে যান। হঠাৎ দেখা গেল অদ্ভুত খেয়াল চাপল থোরেনের মাথায়। সে শহরের নামকরা আধুনিক চিত্রশিল্পীদের ডেকে যে সব ছবি কিনেছিল তাতে তার মন ঠিকমতো তৃপ্ত হয়নি। সে লক্ষ্য করেছিল তাদের হাত ভালো হলেও প্রত্যেকের এক-একটি বিশেষ দিকে প্রতিভা আছে। কেউ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি ভালো ফুটিয়ে তুলতে পারে, কেউ মানুষের বিচিত্র জীবনধারা, কেউ মানুষের মন ও দেহ। থোরেন সবাইকে ডেকে বলল, তোমরা সবাই মিলে এমন একখানি বড় ছবি আঁকবে যাতে এই সব কিছু থাকবে, সার্থকভাবে ফুটে উঠবে। সকলের সব প্রতিভা একখানি ছবির মধ্যে ধরে রাখবে থোরেন, এই ছিল তার অভিপ্রায়। তার এই অভিপ্রায়ের অর্থ শিল্পীরা ঠিক বুঝতে না পারলেও মোটা টাকার লোভে রাজি হয়ে গেল সকলে। সে ছবির কাজ শেষ হতেই একদিন দেখা গেল থোরেন তার সব সংগৃহীত ছবি গাড়িতে করে পাঠিয়ে দিল তার ভাই-এর কাছে। আমাদের ঘরটা খালি হয়ে গেল।

তার অফিস সমেত থোরেনকে আমাদের বাড়ি থেকে যাবার জন্য অনেক আবেদন-নিবেদন যায় ফরাসী রাজার কাছে। অবশেষে সে আবেদন মঞ্জুর হয় এবং একদিন তার দলবল নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে চলে যায় থোরেন। তবু তার কথা আমি ভুলিনি কখনও। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

আমাদের নিজস্ব ঘরখানা আবার আমি ফিরে পেলাম। এই ঘরে থাকত থোরেনের ছবিগুলো। ঘরটা খালি হলেও বেশ কিছুদিন ধরে সেই সব ছবির ভূতগুলোকে আমি যেন আমার ঘরের দেওয়ালগুলোতে চলাফেরা করতে দেখতাম। 

কাউন্ট থোরেন ও তার দলবল চলে যাওয়ার পর ঘরগুলো পরিষ্কার ও ঝাড়ামোছা হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নূতন ভাড়াটে এল। এলেন প্রসিদ্ধ আইনজীবী, বাবার অন্যতম বন্ধু মরিৎস। মরিৎস নিজের আইনব্যবসা ছাড়াও বড় বড় সামন্তদের পরিবারের ও রাজপরিবারের মামলা-মোকদ্দমা দেখাশোনা করতেন। মরিৎস বাবার কাছে প্রায়ই এলেও তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা ঘর থেকে বেরোয় না। আমাদের বাড়িতে আসত না। তাই থোরেনরা চলে যাবার পর আমাদের বাড়িটাকে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগত।

মরিৎস শিল্পী না হলেও কিছু কিছু আঁকতে পারতেন। আমি ঘরবাড়ির স্কেচ করে তাঁকে দেখাতাম। তারপর ল্যান্ডস্কেপ পেস্টিং-এ মন দিলাম। আমার বাবা অসীম ধৈর্যের সঙ্গে নিজে শিখে আমাকে শেখাতেন। তারপর গান। অনেকদিন ধরেই আমাদের গান। শেখাবার কথা হচ্ছিল। অবশেষে ঠিক হলো আমরা ভাইবোনে হাপসিকউ শিখব। কিন্তু শিক্ষক পছন্দ হচ্ছিল না। এমন সময় একদিন আমার এক সহপাঠি বন্ধুর বাড়ি গিয়ে দেখি সে একজনের কাছে ঐ বাজনা শিখছে। শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতি আমার ভালো লাগল। তার ডান ও বাঁ হাতের আঙুলগুলো সমানে চলত এবং প্রত্যেকটা আঙুলের একটা করে নাম দিয়েছিলেন। কখন কোন আঙুলটা চালাতে হবে তা খুব সুন্দরভাবে দেখিয়ে দিতেন। 

আমি বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে বলে সেই শিক্ষককে নিযুক্ত করলাম। কিন্তু লোকটার নীরস গুরুগম্ভীর ভাব দেখে অল্পদিনের মধ্যেই মোহমুক্ত হলাম আমরা। আবার বোন তো আমায় গাল দিতে লাগল। আমার বাবা অবশ্য আমার গান-বাজনা শেখার উপর তেমন জোর দিতেন না। তিনি শুধু চাইতেন আমার বোনই কিছু গান বাজনা শিখুক। আর চাইতেন আমার পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও আমি কিছু ছবি আঁকতে শিখি। 

এই সময় গিফেন নামে এক ফরাসি যুবককে দিয়ে একটি বোর্ডিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ফরাসি ছাড়াও গ্রীক ও লাতিন ভাষা শেখানো হতো। পিফেন গান বাজনাও জানত। মস্ত বড় গাইয়ে ফেলতিনি নোরার সঙ্গে তার ভাব ছিল এবং নোরার কাছ থেকে একটা বড় পিয়নো কিনে আনে আমার বোনের জন্য। এই পিয়ানো বাজনা শিখতে আমার বোনের বড় কষ্ট হতো। এই সময় বাবা আবার ইংরেজি শিক্ষার জন্য একজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। 

ছোট থেকে আমার ইহুদি ভাষার শেখার শখ ছিল। আমারও আশা ছিল এই ভাষা শিখে আমি ওল্ড টেস্টামেন্ট গ্রন্থটি পড়তে পারব। আমার প্রায়ই মনে হতো ইহুদি জাতি সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ঈশ্বরের অনুগৃহীত এমনই এক জাতি যারা পৃথিবীর মধ্যে হাজার বছরের ইতিহাস রচনা করেছে। যুগ যুগ ধরে কত কথা ও কাহিনী গড়ে উঠেছে তাদের নিয়ে। কল্পনার পাখায় চড়ে আমার মন চলে যেত সেই সুদূর পৌরাণিক অতীতের অজানা রাজ্যে। একটি পরিবার কিভাবে বংশ বিস্তার করে এগিয়ে যায় আরবের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস বিধৌত ভূখণ্ড হতে প্যালেস্টাইন, জর্ডন ও পর ঈজিপ্টের পথে। কত সব মরুভূমি, পাহাড়, নদী ও সমুদ্রের দেশ ঘুরে একটি জাতি এগিয়ে চলেছে আত্মপ্রতিষ্ঠার পথে। আদ্রাবাথ, মোজেস জ্যাকব, র‍্যাশেল, জোশেফ প্রভৃতি কত সব পৌরাণিক চরিত্র ভিড় করে আসত আমার মনে। তাদের আশা, আকাক্ষা, আত্মদহন, দুঃখ-কষ্ট, প্রেম-ভালোবাসা সব নাড়া দিত আমার মনকে। হাজার বছরের একটা প্রকাণ্ড অতীতের ধূসর পটভূমিকা সহসা জীবন্ত হয়ে উঠত আমার মনে। 

বাইবেলের এইসব ঘটনা ও চরিত্র নিয়ে আমি এক বিরাট পদ্য রচনা শুরু করে দিলাম। লেখা শেষ হলে আমাদের বাড়িতে যে যুবকটি থাকত এবং যার হাতের লেখা খুব ভালো ছিল তাকে দিয়ে ভালো করে প্রথম থেকে লেখালাম। তারপর বই বাঁধাই কারখানা থেকে ভালো করে বাঁধাই করে বাবাকে দেখালাম। এই বই আমি লিখেছি আমার অবসর সময়ে আমার পড়ার কাজ বাঁচিয়ে। দেখে খুশি হলেন বাবা। 

আমার বাবা বলতেন কোনও কাজ শুরু করলে তা যেমন করেই হোক শেষ করতে হবে। কাজের পথে যত বাধা, বিপত্তি, দুঃখকষ্ট আসুক না কেন তা শেষ করতেই হবে। তার মতে মানুষের জীবনে একমাত্র লক্ষ্য হবে পূর্ণতা, আর তার একমাত্র গুণ হবে অধ্যবসায়। তাই দীর্ঘ দিনের শ্রম ও সাধনায় এ কাজ আমি সম্পন্ন করেছি তা দেখে প্রীত হলেন বাবা। 

কিন্তু আমি যাই করি বা যত ভাষাই শিখি, লেখা বা ছবি আঁকায় যত কৃতিত্বই দেখাই তার মূল লক্ষ্য হতে বিচ্যুত হননি বাবা। তিনি একবার যা বলেন তা ভোলেন না। একবার যা লক্ষ্য হিসাবে স্থির করেন তার থেকে সরেন না। তিনি চেয়েছিলেন আমাকে আইন পড়িয়ে তাঁর আরদ্ধ কাজ সম্পন্ন করবেন। তাই তিনি একদিন হঠাৎ আমাকে একটি হালের আইনের বই দিলেন পড়তে। যদিও আমার কাছে বইখানি খুবই কঠিন ঠেকছিল তবু বাবার হুকুম তা পড়ে শেষ করতেই হবে। 

একদিন আমাদের শহরে নেহাৎ কৌতূহলের বশে ইহুদিদের বস্তি দেখতে যাই। তারা যে ঘিঞ্জি নোংরা বস্তিতে থাকত তা দেখে দুঃখ হতো আমার। ঈশ্বরপ্রেরিত যে জাতির কথা বাইবেলে ফলাও করে পড়েছি সেই জাতির অবশিষ্টাংশ এরা। এদের এই শোচনীয় অবস্থা দেখে সত্যিই কষ্ট হয় আমার। আমি আমার অবসর সময়ে মাঝে মাঝে সেই বস্তিতে যেতাম। তাদের জীবনযাত্রা লক্ষ্য করতাম। অনেক উৎসবে যোগ দিতাম। খ্রিস্টান হয়েও তাদের সৌজন্যপূর্ণ ব্যবহারে মুগ্ধ হতাম আমি। 

আমার ইচ্ছা না থাকলেও যৌবনে পা দিয়ে আমাদের দেশের প্রথা অনুসারে ঘোড়ায় চাপা ও ফেন্সিং খেলা শিখতে হলে আমায়। আমাদের শহরে তখন দুজন ফেন্সিং খেলোয়াড় এ খেলা শেখাতেন। একজন জার্মান ও আর একজন ফরাসি ভদ্রলোক। আমি ফরাসি ভদ্রলোকের কাছেই এ খেলা শিখতে থাকি। তবে ঘোড়ায় চাপা বাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগত না। পরে অবশ্য আমি খুব ভালো ঘোড়সওয়ার হয়ে উঠি এবং একনাগাড়ে কয়েকদিন ঘোড়ার পিছে চেপে থাকতে পারি অক্লান্তভাবে। 

আমি বড় হয়েছি দেখে বাবা আমাকে এই সময় তার ব্যবসায় সাহায্য করতে বলেন। আমাদের যে কারখানায় অনেক লোক কাজ করত এবং বাবাকে যেখানে দেখাশোনা করতে হতো দীর্ঘ সময় ধরে, আমাকে সেখানে যেতে বললেন বাবা। কাজের তদারক করতে বললেন। কর্মীদের উপর নজর রাখতে বললেন। এইভাবে কর্মস্থলে গিয়ে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্কটিকে ভালোভাবে দেখতে পাই। আর তা থেকেই উদ্ভুত এক সাম্যবোধ জাগে আমার মনে। উচ্চ, অভিজাত ও নিম্ন সকলের মধ্যে কোথায় প্রকৃত পার্থক্য তা বুঝতে চাই আমি। সব মানুষ সমান হোক তা আমি হয়ত চাইনি। আমি চেয়েছিলাম মানবজীবনের বিভিন্ন অবস্থার মধ্যে অন্তত সমতা বিরাজ করুক, কারণ শ্রেণী নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যেই আছে অস্তিত্বের সংরক্ষণ প্রচেষ্টা, বাঁচার এক অপরিহার্য তাগিদ। 

এই সময় ভন ওলেনস্লেগার আমাদের পরিবারের খুব প্রিয় হয়ে ওঠেন। ওলেনম্নেগারের নাটকে বেশ জ্ঞান ছিল। তিনি যুবকদের নিয়ে বেশ আমোদ-প্রমাদ করতে পারতেন। তাঁর নাটক করার খুব শখ ছিল। তাঁর নির্দেশনায় আমরা স্লেগারের ক্যানিয়ুট মঞ্চস্থ করি। এতে আমি আমার বোন ও ছোট ভাই তিনজনেই তিনটি ভূমিকায় অভিনয় করি। এরপর রেসিনের লেখা ট্র্যাজেডি ব্রিটানিকাশও মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে নিরোর ভূমিকায় অভিনয় করি। আমার বোন নেয় এগ্রিপিয়ার ভূমিকা। এইভাবে ভন ওলেনম্নেগার এক রীতিমতো নাট্যপ্রীতি জাগিয়ে তোলেন আমার প্রথম যৌবনে। 

১৭৬৩ সালের প্রথম বসন্তে একদিন এক জাতীয় উৎসবে মেতে ওঠে আমাদের শহর। কারণ ঐ দিন হুবার্তসবার্গ সন্ধি সম্পাদিত হয়। কিন্তু চারদিকের আনন্দোৎসবের মাঝে আমার কেবলি মনে পড়তে থাকে ভন রেনেকের কথা। আপন কন্যার সঙ্গে মামলায় হেরে গিয়ে স্বেচ্ছাকৃত এক প্রায়ান্ধকার কারাজীবন যাপন করে চলেছেন তিনি। তাঁদের মুখে আমি কোনওদিন বিন্দুমাত্রও হাসি ফুটে উঠতে দেখিনি। একবার তার পরিবারের বন্ধুস্থানীয় একটি লোকের সঙ্গে তাঁর মেয়ে পালিয়ে যায়। এটা মনঃপুত না হওয়ায় তিনি তাদের সন্ধান করেন। সন্ধান পেয়ে মামলা করেন। কিন্তু তাঁর প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় মামলায় হেরে যান রেনেক। হেরে গিয়ে তার বাড়ির একতলায় এক অন্ধকার ঘরে আশ্রয় নেন। সে ঘর থেকে বিশেষ বার হতেন না। সে ঘরের দেওয়াল চুনকাম করা হয় না কখনও। কিন্তু রেনেক আমাকে বড় ভালোবাসতেন এবং তার ছোট ছেলেকে আমার সঙ্গে মিশতে বলতেন। 

আমি তাঁর কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর খিটখিটে মেজাজ অনেকটা শান্ত ও নরম হতো। তাঁর বাড়িতে গেলে খাওয়া-দওয়া ভালোই হতো। তিনি অতিথিবৎসল ছিলেন। কিন্তু তার একটা স্টোভ ছিল। সেই স্টোভটা জ্বালতে গেলেই ধোয়া হতো আর তাতে অতিথিদের কষ্ট হতো। একদিন এক অতিথি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রেনেক বলেন মানুষকে যে সব অশুভ শক্তি কষ্ট দেয় তারা যদি ঈশ্বরের কাছে যেত তাহলে ভালো হতো। একবার তার মেয়ে তাঁর প্রথম ছেলেকে নিয়ে দেখা করতে আসে। জামাই ভয়ে আসেনি। কিন্তু যে মেয়েকে নিয়ে এত কাণ্ড, এত মামলা-মোকদ্দমা, সে মেয়ের আর মুখদর্শন করবেন না তিনি। আমার প্রতি রেনেকের কিছুটা দুর্বলতা ছিল। তাঁর অনমনীয় মনকে নমনীয় করার জন্য আমাকে ডাকা হলো। অবশেষে অনেক করে মেয়ের সঙ্গে দেখা করে একবার নাতির মুখ দেখার জন্য রাজি করলাম রেনেককে। যে। রেনেক সেই অন্ধকার ঘরখানা ছেড়ে, তাঁর স্বেচ্ছানির্বাসনের সেই জগৎ ছেড়ে কোথাও বার হতেন না, সেই রেনেককে নিয়ে প্রতি রবিবার বিকালে বেড়াতে বেরোতাম। তিনি গোলাপী রং ভালো না বাসলেও তাঁকে গোলাপী ফুল ভালোবাসতে শিখিয়েছিলাম। 

ভন ম্যালাপার্ট নামে এক ধনীও রেনেকার মতো একা একা থাকতেন। কিন্তু পরে তাঁর সঙ্গে রেনেকার ভাব করিয়ে দিই। ম্যালাপার্টের ফুলবাগানে বসন্তের ফুলের ছাড়াছড়ি হতো। যেখানে-সেখানে রেনেককে পাঠিয়ে দিতাম কৌশলে। 

এরপর মনে পড়ে হাৎ হুয়েসজেনের কথা। ধর্মের দিক থেকে তিনি সংস্কারপন্থী ছিলেন না বলে কোনও সরকারি পদ পাননি। কিন্তু কৃত আইনজীবী হিসাবে নাম করেছিলেন। হুয়েসজেনের মাথায় টাক ছিল। সব সময় মুখে হাসি লেগেই থাকত। গণিতে তার জ্ঞান ভালো ছিল এবং তিনি নিজের বুদ্ধিতে সব এক ঘড়ি তৈরি করেন যা ঘণ্টা-মিনিট ছাড়া সূর্য-চন্দ্রের গতিবিধি বলে দিতে পারত। কিন্তু হুয়েসজেন আইনবিদ্যাকেই সবচেয়ে ভালোবাসতেন এবং মনে করতেন প্রত্যেক ছাত্রেরই আইন পড়া উচিত। কারণ এই আইনের দ্বারা নিপীড়িত উৎপীড়ত মানুষের উপকার করা যায় সবচেয়ে বেশি। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

আমার শিক্ষা, স্বভাব, গৃহ, পরিবেশ এমনই ছিল যে আমি সমাজের নিচুতলার লোকদের সঙ্গে মিশতে পারতাম না। কখনও কোনও ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠত না তাদের সঙ্গে। বিশেষ করে মিস্ত্রী বা কারিগরদের আমি দেখতে পারতাম না। কোনও অসাধারণ বা বিপজ্জনক কাজের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে যাবার সাহস ছিল আমার। কিন্তু সে কাজ সম্পন্ন করার মতো উপযুক্ত কৌশল ও কর্মশক্তি ছিল না। 

এই সময় অপত্যাশিতভাবে আমি একটা জটিল ঘটনাজালের মধ্যে জড়িয়ে পড়ি। আমি বলি পাইলেদস নামে আমার এক বন্ধু ছিল। একদিন ফোর্ট গ্যালাসের কাছে পাইলেদস-এর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আমার। তার সঙ্গে তার দু-একজন বন্ধুও ছিল। দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পরই সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠল, আমি তোমার কবিতা আমার সঙ্গীদের কাছে পড়ে শুনিয়েছিলাম। তারা কেউ বিশ্বাস করতেই চায় না যে এটা তোমার লেখা। 

আমি বললাম, কবিতা সম্বন্ধে যার যা খুশি বলতে পারে। এতে বলার কিছু নেই। ছেড়ে দাও। 

পাইলেদস কিন্তু অত সহজে ছাড়ল না। সে বলল, আমার বন্ধুদের বক্তব্য, এই ধরনের কবিতা লেখার জন্য যে ধরনের শিক্ষাদীক্ষা থাকা দরকার তা তোমার নেই। আমি কোনও উত্তরই দিলাম না। তখন পাইলেদস তার সঙ্গীদের বলল, ঠিক আছে, তোমরা ওকে কোনও বিষয়বস্তু দাও। ও সঙ্গে সঙ্গে এইখানে কবিতা লিখে দেবে। 

আমি তাতে রাজি হলাম। তখন ঠিক হলো আমাকে একটি প্রেমপত্র ছন্দোবদ্ধ কবিতায় লিখে দিতে হবে। ধরে নিতে হবে কোনও এক যুবতী তার প্রেমিককে তার মনের কথা জানাচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে একটা বেঞ্চের উপর বসে পড়লাম। ওরা আমাকে সাদা কাগজ দিল। ওরা কাছাকাছি থেকে আমার উপর নজর রাখতে লাগল। আমি লিখতে শুরু করলাম। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম যেন কোনও তরুণী যুবতী আমাকে ভালোবাসে এবং যে আমাকে তার মনের গভীর গোপন কথাগুলো জানাচ্ছে। 

কবিতাটি শেষ হলে পাইলেদস ও তার বন্ধুরা একবাক্যে প্রশংসা করল আমার। তারা আমাকে বিশেষ ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেল। বলে গেল শীঘ্রই আবার দেখা হবে। 

সত্যিই দেখা হলো। গ্রামাঞ্চলে এক প্রমোদভ্রমণের ব্যবস্থা হলো। পাইলেদস তার একদল বন্ধু নিয়ে হাজির হলো। তারা সবাই বলল, আমার চিঠিটা নিয়ে একটা বেশ মজার ব্যাপার করেছে তারা। তাদের এক বন্ধুর ধারণা মাত্র একদিনের পরিচয়েই এক যুবতী প্রেমে পড়েছে। ওরা তাই আমার সেই ছন্দোবদ্ধ প্রেমপত্রটি একটু সম্পাদনা করে। অন্য হাতে লিখিয়ে সেই বন্ধুর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। সে চিঠি পেয়ে বন্ধু ভাবছে তার প্রেমিকাই সে চিঠি লিখেছে। এবার সে চিঠির জবাব দিতে চায়। কিন্তু সে ক্ষমতা তার নেই। তাই আমার সাহায্য একান্ত দরকার। 

খেলাচ্ছলে ছলনা ও প্রতারণা করে ছেলেবেলায় আমরা অনেক আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু এখন দেখলাম সব বয়সের মানুষই এ ধরনের ছলনায় আনন্দ পায়। যাই হোক, আমি মত দিলাম। তার চিঠির উপাদান আমাকে দিয়ে দিল। আমি লিখে দিলাম। 

এরপর একদিন সন্ধ্যার সময় কোনও এক হোটেলের এক ভোজসভায় নিয়ন্ত্রণ পেলাম আমি। গিয়ে দেখলাম পাইলেদস-এর সেই প্রেমিক বন্ধুটি এই ভোজসভার ব্যয়ভার বহন করছে। আমি গিয়ে বসলাম। খেলাম। কিন্তু ওদের সঙ্গ আর আমার ভালো লাগছিল না। আমি প্রতিজ্ঞা করলাম এ ধরনের লেখা আর লিখব না। অকারণে একটি মানুষকে ছলনার দ্বারা প্রতারিত করে বিগত সন্ধ্যাটা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর হয়ে উঠল। কিন্তু হঠাৎ একটা মিষ্টি ঘটনা ঘটে আমার মনটাকে অন্যদিকে নিয়ে গেল। 

খাবার পর আমাদের কিছু মদের দরকার ছিল। আমাদের মধ্যে একজন হোটেলের পরিচারিকাকে ডাকল। কিন্তু পরিচারিকার বদলে এল পরমা সুন্দরী একটি মেয়ে। নাম তার গ্ৰেচেন। তার মুখ-চোখ অপরূপ লাবণ্য। সুন্দর সুগঠিত দেহ। আঁটসাঁট পোশাক। একবার তাকালে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। আমাদের অনুরোধে আমাদের কাছে। বসে একপাত্র মদ পান করল ঘেঁচেন। 

সেদিন সন্ধ্যায় সেইখানেই ব্যাপারটার ইতি ঘটলেও আমার মনের মধ্যে সব সময় সব জায়গায় গ্রেচেনের ছবিটা আনাগোনা করতে লাগল। যেহেতু তার বাড়িতে যাওয়ার কোনও অজুহাত ছিল না আমার সেই হেতু একটি চার্চে গেলাম তার দেখা পাবার আশায়। দেখা পেলাম। কিন্তু তার কাছে গিয়ে আলাপ করতে পারলাম না। 

সেদিন না পারলেও আবার একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। পাইলেদস আবার আমাকে ডাকল সেই হোটেলের এক সান্ধ্য ভোজসভায়। তার বন্ধুর যে প্রেমপত্র আমি লিখে দিয়েছিলাম সেটা তারা মিথ্যা করে বলেছে, নির্দিষ্ট ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার মেয়ের তরফ থেকে উত্তর দেবার পালা। সেই উত্তর আমায় লিখতে হবে। এসব লেখা আর লিখতাম না আমি। কিন্তু হোটেলে গেলে গেচেনকে দেখতে পাব বলে রাজি হয়ে গেলাম। 

হোটেলে গিয়ে আমি আমার লেখা পড়ে শোনালাম। আমি যেন গ্রেচেনকে লক্ষ্য করেই এ চিঠি লিখেছি। কিন্তু আসলে পাইলেদস-এর বন্ধু যে মেয়েটিকে ভালোবাসে সে ধনী ঘরের মেয়ে। সুতরাং কিছু অদল-বদল করতে হলো। গ্ৰেচেন কাছ থেকে সব শুনছিল। একসময় আমার বন্ধু উঠে যেতেই গ্ৰেচেন নিজে থেকে আমার কাছে মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বলল, এসব কি করছেন আপনি? এটা অপরকে প্রতারণা করা হচ্ছে। এতে লাভ কি? 

আমি বললাম, আসলে ব্যাপারটা মজার। নির্দোষ আমোদ।

গ্ৰেচেন বলল, এটা একটা মজার ব্যাপার নিশ্চয়, কিন্তু নির্দোষ নয় মোটেই। আমি দেখেছি এর মধ্য দিয়ে অনেক যুবক নিজেদের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। 

আমি বললাম, এখন কি করব! চিঠিটা লেখা হয়ে গেছে। এখন শুধু কিছু সংশোধন করা দরকার। 

গ্ৰেচেন বলল, থাক, সংশোধন করতে হবে না। পকেটে রেখে দাও। আমি একজন গরিব ঘরের মেয়ে। আমাকে ওরা প্রথমে চিঠিটা নকল করতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি। আর তুমি ধনী ঘরের পুরুষ ছেলে হয়ে জেনেশুনে এমন কাজ করছ যাতে কোনও ভালো হবে না, বরং তার থেকে অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। 

গেচেনের এই সব কথায় তাকে আরও ভালো লেগে গেল আমার। আবেগে আত্মহারা হয়ে পড়লাম আমি। আমি বললাম, কি হবে টাকা-পয়সা বা ধন-ঐশ্বর্যে যদি আমি আমার আকাক্ষিত বস্তুকে না পাই। 

এমন সময় আমার হাত থেকে লেখা চিঠিটা নিয়ে শান্তভাবে পড়তে লাগল। পড়ে আপনার মনে বলল গ্রেচেন, চমৎকার লাগছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এত ভালো লেখা কোনও ভালো বা সৎ উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হচ্ছে না।

গ্ৰেচেন চিঠিটা আমার হাতে দিলে আমি বললাম, কোনও প্রেমিকার কাছ থেকে এই ধরনের চিঠি পাওয়া কতই না ভাগ্যের কথা। আচ্ছা, যদি কেউ তোমাকে ভালোবেসে শ্রদ্ধার সঙ্গে এই ধরনের লেখা লেখে তাহলে তুমি কি করবে? 

আমি কাগজটা তার দিকে এগিয়ে দিতেই গ্রেচেন মৃদু হেসে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে কলম দিয়ে কাগজটাতে তার সই করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আমি আবেগে আত্মহারা হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম। কিন্তু গ্রেচেন বলল, না, আলিঙ্গন বা চুম্বন নয়, পারলে পরস্পরকে আমরা ভালোবেসে যাব। 

কাগজটা পকেটে ভরে রেখে বললাম, এ আর কেউ পাবে না। ব্যাপাটার এইখানেই ইতি। তুমি আমাকে মুক্ত করলে অবাঞ্ছিত এই ব্যাপারটা থেকে। 

গ্ৰেচেন বলল, তোমার বন্ধুরা না আসতেই চলে যাও। 

আমার যেতে মন সরছিল না। তবু যেতে হবে। গ্ৰেচেন আমার দুটো হাতের মধ্যে হাত দিয়ে মৃদু চাপ দিল। আমার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। জল এল চোখে। আমি তার হাত দুটো তুলে নিয়ে আমার মুখের উপর একবার চেপে ধরেই ছেড়ে দিয়ে চলে গেলাম। 

প্রথম প্রেমের আবেগের সঙ্গে যেন এক আধ্যাত্মিক ব্যাকুলতা জড়িয়ে থাকে। গ্ৰেচেনের কাছ থেকে আশ্বাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সৌন্দর্যের এক নূতন জগৎ খুলে গেল আমার সামনে। আমার জীবন-যৌবন যেন হঠাৎ অর্থময় হয়ে উঠল। আমি তার সই করা সেই কাগজটা বার করে পকেট থেকে বার করে সেটাকে চুম্বন করতে লাগলাম। বুকের উপর চেপে ধরলাম। 

পরের রবিবার আবার আমি নিজের থেকে পুরনো বন্ধুদের আড্ডায় গেলাম। চিঠিটা ঠিক করে দিইনি বলে তারা মোটেই রাগ করেনি আমার উপর। বরং তারা নিজেরা যেচেই বলল, তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। এই ধরনের কাজ আর করবে না। এর থেকে আমি যদি কিছু বিয়ের ও মৃত্যুর উপর কবিতা লিখে দিই, তাহলে তার থেকে তারা উপকৃত হবে এবং আমিও যা পাব তাতে হোটেলের বন্ধুদের খাওয়ার খরচটা হয়ে যাবে। 

তারা সবাই ছিল স্বল্পবিত্ত ঘরের ছেলে। সব দিন হোটেলে কিছু খাবার পয়সা থাকে না। তাদের অবস্থার কথা বিবেচনা করে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তারা পরদিন সন্ধ্যায় আমাকে হোটেলে নিমন্ত্রণ করল। গ্ৰেচেনও নাকি তাদের সঙ্গে খাবে। গ্ৰেচেনের কথা শুনে উল্লসিত হয়ে আমি পরের দিন সন্ধ্যার জন্য ব্যাকুলভাবে প্রতীক্ষা করতে লাগলাম। 

পরের দিন সন্ধ্যা হতেই হোটেলে হাজির হলাম। গ্ৰেচেনকে দেখে খুশি হলাম। বন্ধুরা সব হইহুল্লোড় করতে লাগল। গ্রেচেন একপাশে চুপ করে বসে রইল। আমার চোখ সব সময়েই প্রায় নিবদ্ধ ছিল গ্রেচেনের উপর। ঠিক হলো, তার বন্ধুরা একে একে তাদের জীবনের লক্ষ্য কি তা বলে যাবে। পাইলেদস-এর পর আমি বললাম। 

আমার প্রতি আচরণের ব্যাপারে গ্রেচেন একটা সঙ্গতি আর রীতি মেনে চলত। আমি যখন কিছু লিখতাম বা পড়তাম তখন সে আমার কাছে ঘন হয়ে বসে আমার পিঠের উপর হাত রেখে তা দেখত। কিন্তু আমি যদি কখনও তার পিঠে বা কাঁধের উপর হাত রাখার চেষ্টা করতাম তাহলে সে সরে যেত। গ্ৰেচেনের বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া শক্ত ছিল। সে কখনও চরকা কাটার কাজ করত, কখনও বা সেলাই-এর কাজ করত। কখন কোথায় কি কাজ করত বোঝাই যেত না। একদিন আমার লোকের জন্য একটা নামকরা বড় ফুলের দোকান থেকে ফুল আনতে গিয়ে দেখি ঘেঁচেন অন্য পোশাক পরে সেই ফুলের দোকানে অস্থায়ীভাবে কোনও এক কর্মচারীর পদ পূরণ করছে। আমাকে দেখতে পেয়ে গ্ৰেচেন ইশারা করে আমাদের পরিচয়ের কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করল।

পরে গ্ৰেচেনকে সে কথা জিজ্ঞেস করায় সে বলল, তোমরা সেদিন আমার জীবনের লক্ষ্যের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলে নারীদের উচিত ভদ্র কাজের মধ্য দিয়ে তাদের অবসর সময় কাটানো। আমি সেদিন দেখলাম একটি ফুলের দোকানে একদিনের জন্য একটি কাজ খালি আছে। তাই ঢুকে গেলাম। 

তবু আমার মনে হলো গ্ৰেচেনের মতো সুন্দরী মেয়ের পক্ষে ঐ দোকানের কর্মচারিণীরূপে মোটেই মানায় না। 

একদিন সন্ধ্যার সময় হোটেলে খাবার পর একটা মজার খেলা হলো। গ্ৰেচেন ও তার এক জ্ঞাতি ভাই কবিতা লেখা শিখতে লাগল আমার কাছে। মোটমুটিভাবে তাদের একে একে শিখিয়ে দিতে লাগলাম কিভাবে ছন্দ অলঙ্কার ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হয় কিন্তু শিখিয়ে দিলেও তারা তা পারল না। তবু গ্ৰেচেন কাছে থাকায় আমার খুব ভালো লাগছিল খেলাটাকে। 

একদিন সন্ধ্যায় সময় তারা ডেকে বলল জোশেফ রাজা নির্বাচিত হচ্ছে। অভিষেক উপলক্ষে দারুণ ধুমধাম হবে। সত্যিই অভিষেক উপলক্ষে সে উৎসব চলল, নানারকমের ঐশ্বর্যের যে বিপুল সমারোহ দেখলাম তার তুলনা হয় না। 

সেদিন সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে আমার ঘরে বসে আমি বিশ্রাম করছি এমন সময় মা এসে মুখ ভারী করে বললেন, শুনেছি আজকাল তুমি নাকি কুসঙ্গে মিশছ। আমাদের কানে সব কথা এসেছে। তুমি তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলো। 

কোনও এক তৃতীয় ব্যক্তির দ্বারা তিনি সমস্ত ব্যাপারটার তদন্ত করবেন। কাউন্সিলার স্লিদেলই তদন্ত করবেন। 

স্লিদেলের কথা মনে পড়ল আমার। একদিন উনিই ‘মেসিয়া’ নামক একটি কাব্যগ্রন্থ আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিয়েছিলেন আমাদের। 

স্লিদেল এসে আমার সামনে চোখে জল নিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, তোমার মতো এক নিরীহ যুবক সঙ্গদোষে ধাপে ধাপে নরকের পথে নেমে যাবে এটা খুবই পরিতাপের বিষয়। 

আমি বললাম, আমি জ্ঞানত কোনও অন্যায় বা অপরাধ করিনি এবং কোনও কুসঙ্গেও মিশিনি। 

স্লিদেল বললেন, দেখো, আমাদের বাধা না দিয়ে কথাটা স্বীকার করাই ভালো। 

আমি বললাম, কি জানতে চান আপনি? 

স্লিদেল বললেন, তুমি একটি লোকের চাকরির জন্য তোমার দাদামশাই-এর কাছে সুপারিশ করেছিলে? 

আমি বলল, হ্যাঁ করেছিলাম।

স্লিদেল আরও তিনজন ছেলের নাম করে বললেন, তুমি এদের সঙ্গে মেলামেশা করো? 

আমি বললাম, প্রথম ছেলেটি ছাড়া আমি ওদের কাউকেই চিনি না।

স্লিদেল তখন আমার উপর স্বীকারোক্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করতে লাগলেন। বললেন, তুমি কোথায় কোথায় যাও, কার কার সঙ্গে মেশো আমরা সব জেনেছি। আমার কাছে স্বীকার না করলে ম্যাজিস্ট্রেটের লোক আসবে। সেটা খুব খারাপ হবে। তুমি অপরের হয়ে চিঠি লিখে দিয়েছ। অনেক জাল চিঠি ধরা পড়েছে। 

আমি মনে মনে ভাবলাম, কার্যত আমি কোনও অন্যায় করিনি ঠিক তবে আমি নিম্নশ্রেণীর এমন সব ছেলেদের সঙ্গে মিশেছি যারা যে কোনও অপরাধ করতে পারে। অবশ্য তারা আমার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেনি। 

অবশেষে আমি স্লিদেলকে বললাম, যা যা হয়েছে আমি সব আপনাকে বিশ্বাস করে বলব। তবে যেন আমার কথা সত্য বলে ধরে নেয়া হয় এবং আমি যাদের সঙ্গে মিশতাম তাদের যেন অযথা কোনও শাস্তি দেওয়া না হয়। 

প্রথম থেকে অর্থাৎ পাইলেদস-এর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে যা যা হয়েছিল, যা যা আমি করেছিলাম, বা লিখেছিলাম সব বললাম স্লিদেলকে, গ্রেচেনের কথাও বললাম। বলে মনে ব্যথা পেলাম দারুণ। ভাবলাম এ সব না বললেই ভাল হতো। আমার কোন ক্ষতি না হলেও তাদের ক্ষতি হবে হয়ত। যাই হোক, আমার চোখে জল দেখে আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলেন স্লিদেল। 

স্লিদেল চলে গেলে আমি মেঝের উপর শুয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমার বোন এসে একসময় সান্ত্বনা দিল আমায়। বলল, কোনও ভয় নেই। বলল, নিচেতে বাবার কাছে। আর একজন দাঁড়িয়েছিল। স্লিদেল গিয়ে তারে সব বলতে তারা সন্তুষ্ট হলো। সবাই হাসাহাসি করতে লাগল। সবাই বলল, ব্যাপারটা এমন কিছু নয়। 

তবু আমি আমার বন্ধুদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে রইলাম। যারা একদিন আমায় বিভিন্নভাবে আনন্দ দান করেছে, সঙ্গ দান করেছ, তাদের জন্য দুঃখ হতে লাগল। আমার। আমি বাড়ির মধ্যে স্বেচ্ছানির্বাসন গ্রহণ করলাম। সারা দিনরাত বাড়ির মধ্যেই ভেবে ভেবে কাটাতে লাগলাম। 

পরদিন বাবা আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি গেলাম না। দিনকতকের মধ্যেই আমার অসুখ করে গেল। ডাক্তার ডাকতে হলো। অসুখের মধ্যেই আমার বন্ধুদের ভাগ্য সম্বন্ধে স্লিদেলের কাছে জানতে চাইলাম। অবশেষে আমাকে জানানো হলো আমার বন্ধুদের কারও কিছুই হয়নি। গ্ৰেচেন শহর থেকে গ্রামে চলে গেছে। তবে আমার মনে হলো, গ্রেচেন নিজে থেকে যায়নি। তাকে হয়ত আমার । জন্যই যেতে বাধ্য করা হয়েছে। আর একথা ভাবতে গিয়ে অসুস্থ শরীরেই দারুন কষ্ট পেলাম মনে। আমার মনে হলো পাইলেদস অথবা গ্ৰেচেন হয়ত চিঠি লিখেছিল আমায় । কিন্তু সে চিঠি আমাকে দেওয়া হয়নি। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

আমার দেখাশোনার জন্য একজন লোক নিযুক্ত করা হলো। ভদ্রলোক বেশ অমায়িক লোক। আর আগে আমার বাবার বন্ধুর এক ছেলেকে পড়াতেন। সেই ছেলেটি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছে। ঠিক হলো, ভদ্রলোক আমার পাশের ঘরে থাকবেন এবং আমার সঙ্গ ও সান্ত্বনা দান করে সাহায্য করবেন আমার আরোগ্য লাভে। মোটামুটি ভদ্রলোককে আমার ভালোই লাগল। 

কথা বলে জানলাম উনি আমার সবকিছুই শুনেছেন। আমি তাকে একদিন কথায় কথায় ঘোচেনের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। উনি বললেন, গ্রেনেচ খুব ভালো মেয়ে। তদন্তকারীদের সামনে গ্ৰেচেন খুব ভালো সাক্ষ্য দিয়েছে। আমি তখন জিজ্ঞাসা করলাম, আমার সম্বন্ধে কি বলেছে? উনি তখন উত্তর করলেন, আপত্তিকর কিছুই বলেনি; বরং খুব ভালো কথা বলেছে। তদন্তকারীরা তার আচরণে মুগ্ধ। গ্রেনে বলেছে, তুমি নাকি ছেলেমানুষ। তোমাকে ও ভাই-এর মতো স্নেহ করত। তুমি যাতে কুসঙ্গে না মেশো বা কারও প্ররোচনায় বিপথে না যাও তার জন্য ও সাবধান করে দিত তোমায়। এখন সে গ্রামে চলে গেছে। তোমাদের বন্ধুদের কোনও ক্ষতি হয়নি। 

কথাটা শুনে কিন্তু মনে দুঃখ পেলাম আমি। গ্ৰেচেনের উপর রাগও হলো। গ্ৰেচেন আমাকে ছেলেমানুষ ভেবে তুচ্ছজ্ঞান করেছে। যে একদিন আমার লেখা কবিতার প্রশংসা করেছিল নিজের মুখে সেই ঘেঁচেন আমাকে তুচ্ছ ভেবে আমার গুরুত্বকে উড়িয়ে দিয়েছে। ভাবলাম গ্রেচেনের নাম আর করব না। তার কথা কখনও ভাবব না। 

আমার দেখাশোনার জন্য যিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন তাকে আমি আমার ‘ওভারসিয়ার’ বলতাম। একটু সুস্থ হলে আমি আমার ওভারসিয়ারের সঙ্গে বেড়াতে বার হলাম একদিন। কিন্তু শহরের পথে বার হতেই আমার মনে হতে লাগল পাইলেদস আর তার বন্ধুদের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে। তাদের সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কথা ভেবে আমার কষ্ট হতে লাগল মনে। যেদিকেই তাকাই ভয় ভয় ঠেকে, যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তাহলে কি বলব তাদের? তাদের দেখা না পেলেও তাদের প্রেতগুলো যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরের পথ পথে-ঘাটে। আমি ওভারসিয়ারকে বললাম বন দিয়ে বেড়াতে চলুন। লোকালয় ভালো লাগছে না।

ফার, ওক প্রভৃতি বড় বড় গাছগুলোর শীতল ছায়ার মধ্যে বসে বসে ভাবতে বড় ভালো লাগছিল আমার। তবে কোনও কথা নয়, শুধু একা থাকতে মন চাইছিল আমার। আমি একটা গাছের তলায় একা একা বসেছিলাম। আমার ওভারসিয়ার ছিলেন একটু দূরে। নির্জন বনভূমির শান্তশীতল স্তব্দতায় আমার অন্তরের সব জ্বালা, দুঃসহ স্মৃতির সব উত্তাপ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। বনভূমিতে এ ফাঁকা মাঠে ঘুরে বেড়িয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য নিয়ে ছবি আঁকার শখ হলো আমার। আমার দু’একটা ছবি দেখে বাবাও খুশি হলেন। তিনি নিজে ছবি ভালোবাসতেন। আমার ওভারসিয়ার এইসময় বাবাকে বললেন আমি দেহ ও মনের দিক থেকে সেরে উঠেছি। আমি খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছি নিজেকে বর্তমানের পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে। 

আগের থেকে কিছুটা স্বাধীনতা পেলাম আমি। বাইরে বেড়াতে দেওয়া হলো আমাকে। পাহাড় অঞ্চলে চলে গেলাম বেড়াতে। হামবার্গ ক্রোনবার্গ থেকে শুরু করে রাইনের উপত্যকা পর্যন্ত বেড়ালাম। কিছু ছবিও আঁকলাম। কিন্তু ছবিগুলো তাড়াহুড়ো করে আঁকায় মোটেই ভালো হয়নি। ছবি নয় যেন কতকগুলো ছবির কাঁচা উপাদান। তবু বাবা ধৈর্য ধরে সেগুলো নিয়ে উৎসাহের সঙ্গে বসে গেলেন। সম্পূর্ণ বা আংশিক সংশোধনের চেষ্টা করতে লাগলেন। 

আমার বাবা ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতেন না। তিনি ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাওয়া-দাওয়ার উপর নজর রেখেছেন, পিতার কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন এতেই তিনি সন্তুষ্ট। মা ছিলেন শিশুর মতো সরল, আত্মভোলা। বাড়িতে আমার বোনই যেন একমাত্র কথা বলার লোক। আমার থেকে মাত্র এক বছরের ছোট আমার বোনই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু। 

এই সময়ে এক ইংরেজ যুবকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। তার কাছে আমি ইংরেজি ভাষা শিখতাম। আর সে আমার কাছে জার্মান ভাষা শিখত। সে প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসত। আমার বোনকে ভালোবাসত সে এবং ইংরজি ভাষাতে সে তার ভালোবাসার কথা জানাত। ছেলে হিসাবে সত্যিই সে ছিল যোগ্য সব দিক দিয়ে। লম্বা, ছিপছিপে চেহারা, মুখ-চোখ স্বাভাবিক। মুখে ছিল কিছু কিছু বসন্তের দাগ। আমার বোনের চেহারাটাও বেশ লম্বা আর সুগঠিত ছিল। মুখখানা তত সুশ্রী ছিল না। এ নিয়ে আমার বোনের দুঃখ ছিল মনে। কিন্তু গুণের দিক থেকে সে ছিল তুলনাহীন। 

মাঝে মাঝে আমরা প্রমোদভ্রমণে বার হতাম। বেশিরভাগই নৌকোয় করে জলপথে যাওয়া হতো। সবাই প্রায় জোড়ায় জোড়ায় অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রী অথবা প্রণয় প্রণয়ীতে মিলে যেত। আমার বোনও তার সেই ইংরেজি প্রণয়ীকে সঙ্গে নিয়ে যেত। একমাত্র আমারই কোনও সঙ্গী ছিল না। আমি শুধু একা একা তাদের সব আনন্দ লক্ষ করে যেতাম। তাই নিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতাগুলোকে আমার অনুভূতির রসে ভিজিয়ে আমার কবিতার মধ্যে নূতনভাবে রূপ দেবার চেষ্টা করতাম। 

এমনি করে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল। নূতন। পরিবেশে গিয়ে কেমন লাগবে, আমার জীবন কি রূপ নেবে, আমার শিক্ষাদীক্ষা কেমন হবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত রইল না আমার মনে। তবে একটা বিষয়ে আশ্বস্ত হলাম আমি। অর্থাৎ আমাদের শহরটা ফেলে দূরে থাকতে পারব। গ্ৰেচেনের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকেই শহরটাকে আর মোটেই ভালো লাগত না আমার। মনে হতো এ শহরটা থেকে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পেলে বেঁচে যাই। আমার জীবন থেকে গ্ৰেচেন চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার যৌবন-জীবন হতে প্রথম প্রেমের সবুজ সজীব চারাগাছটা মূল সমেত উৎপাটিত হয়ে যায় একবারে। তার জায়গায় কোনও নূতন চারাগাছ গজিয়ে উঠতে অনেক সময় লাগবে। আমি আর শহরের মধ্যে। গ্ৰেচেনদের পাড়া দিয়ে যেতাম না। গোটা শহরটা আমার বন্দিশালা বলে মনে হলো। 

আর কোনও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আগের মতো মিশতাম না আমি। বেশি কথা খুব একটা বলতাম না। কবিতাই ছিল আমার অবিরাম সহচর। সময় কাটাবার একমাত্র উপায়। 

অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার দিনটি এসে গেল। পুস্তক-বিক্রেতা ফ্লেসার সম্প্রতি আমার সঙ্গী ছিলেন। ফ্রেসারের স্ত্রী উইটেনবার্গে তাঁরা বাপের বাড়ি যাচ্ছে। আমরা যাব লিপজিগ। জীবনে প্রথম বাড়ি-ঘর, শহর, বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে দূরে যাচ্ছি আমি। প্রত্যেককেই একবার করে যেতে হয়। এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম। কারণ এইভাবেই মানুষ স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে তখনই সে বাড়ি-ঘর, বাবা-মা, ভাই-বোনের সাহচর্য ও সাহায্য ছেড়ে স্বাধীনভাবে কোথাও গিয়ে নিরাপদ জীবনযাপন করতে চায়।

লিপজিগ বিরাট শহর। কাজ-কারবারের প্রচুর ভিড়। অসংখ্য কর্মব্যস্ত মানুষের বিপুল আলোড়নে সব সময় স্পন্দিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে হাথ বমি নামে একজন অধ্যাপকের হাতে পরিচয় পত্র দিলাম। তিনি ইতিহাস আর আইনবিদ্যার অধ্যাপক। কিন্তু আমার আইন মোটেই ভালো লাগে না। আমার ঝোঁক হচ্ছে প্রাচীন বিষয়ের সাহিত্য পাঠের উপর। প্রথমেই কথাটা বললাম না। 

পরে অবশ্য আমার ইচ্ছার ব্যাপারটা শুনে আমাকে ভালো করে বোঝালেন হাথ। তিনি বললেন আইন পড়লে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক পরিষ্কার হয়। তাছাড়া আমার বাবার একান্ত ইচ্ছা আমি আইন পড়ি। মনে আমার যাই হোক, হাথের কথা ও যুক্তি আমার ভালো লাগল। অধ্যাপকদের মধ্যে হফ্রাথকেই আমার খুব ভালো। লেগেছিল। তাঁর স্ত্রীও আমাকে ছেলের মতো ভালোবাসতেন। তিনি রুগ্ন বলে বাড়ি থেকে সন্ধ্যার দিকে কোথাও বেরোতেন না। তাই আমাকে রোজ সন্ধ্যার সময় যেতে বলতেন তাঁদের বাড়ি। আমার কাছে অনেক বড় বড় পরিচয়পত্র ছিল। আমি অভিজাত বংশের ছেলে। তাই অল্প দিনের মধ্যেই শহরের অভিজাত সমাজের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠলাম। তাদের মনমতো পোশাক পরে ও তাদের মনমতো ভাষা বলে তাদের সঙ্গে অনেক মিশতাম। কিন্তু তাদের আদবকায়দা আমার ভালো লাগত না।

তর্কবিদ্যার জন্য দর্শনবিদ্যার ক্লাসে যেতে ভালো লাগত না আমার। তাছাড়া দর্শনের অধ্যাপক জগৎ, জীবন, আত্মা, ঈশ্বর সম্বন্ধে যা বা বলতেন তা আমার আগে থেকে জানা ছিল না। 

আইনবিদ্যর ক্লাসেও ঐ একই অভিজ্ঞতা। আমার কাছে আইনের যে সব বই ছিল এবং যেসব তত্ত্ব ও বিষয় পড়তাম, বুঝতাম, শিখতাম, অধ্যাপক তাই বোঝাতেন। কিন্তু নূতন কথা বলতেন না। এজন্য তার বক্তৃতার সব কিছু খাতায় লিখে নেবার কোনও উৎসাহ পেতাম না। অবশ্য আমি এটাও উপলব্ধি করলাম, আমি যে পরিমাণ পড়েছি সেই পরিমাণে পাঠ্য বিষয়গুলো হজম বা আত্মসাৎ করতে পারিনি। এজন্য আরও সময় দরকার। 

প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও অভিজাত সমাজের মেয়ে-পুরুষের প্রতি কিছুদিন পর বিতৃষ্ণা জেগে উঠল আমার মনে। আমার মনে হতে লাগল, ওরা যেন আমার সব স্বাতন্ত্রকে গ্রাস করে নিতে চাইছে। ওরা চাইছে আমি নিজেকে নিঃশেষে হারিয়ে ফেলি ওদের মাঝে। আমার এতদিনের ধ্যান-ধারণা, ভাবধারা, চিন্তা, কল্পনা সব কিছু নস্যাৎ করে দিয়ে তার জায়গায় ওদের চিন্তা, ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। 

তাই অভিজাত সমাজের সভা-সমিতির থেকে মাদাম বমির সাহচর্য আমার অনেক ভালো লাগত। উনি জার্মান কবিতার একজন বড় সমঝদার ছিলেন। উনি যখন দেশের আধুনিক কবিতার সমালোচনা করতেন তখন আমি তা মন দিয়ে শুনতাম। উনি বলতেন, যে সব দুর্বলমনা কবি বসন্তকালীন সুখপিয়াসী পাখির মতো শুধু বসন্তের গান গায় তাদের আমি দেখতে পারি না। আমি ভালোবাসি সেই সব কবিতা যার মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে উপস্থাপিত হয়েছে চিরকালের কোনও শাশ্বত কথা বা কাহিনী।

তাঁর স্বামী হাথ বমি সাধারণভাবে কবিতা মোটেই পছন্দ করতেন না। হাত দম্পতির বাড়িতে আর একজন সহৃদয় অধ্যাপকের সংস্পর্শে আমি আসি। তিনি হলেন অধ্যাপক মোরাস। উনিও মাদাম হফ্রাথকে সমর্থন করতেন কবিতার আলোচনায়। মোরাসের মিষ্টি ব্যবহার আমার এত ভালো লেগে গেল যে আমি তার বাড়ির যাওয়া আসা শুরু করেছিলাম। মাদাম বমির থেকে আরও যুক্তিপূর্ণ ও পরিণত ভাষায় চিরায়ত সাহিত্য সম্বন্ধে আমার বুঝিয়ে দিতেন মোেরাস। 

জেনেমিয়াদস নামে আরও একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার। তিনি কবিতা মোটেই ভালোবাসতেন না। তিনি শুধু প্রবন্ধ লিখতে বলতেন। আবার আমার কোনও গদ্য রচনাও ভালো লাগত না তার। তিনি বলতেন আমার গদ্য রচনায় রীতি বড় সেকেলে। তাছাড়া তার মধ্যে যে পরিমাণে রোমান্সের আবেগ আছে সে পরিমাণে জীবনবোধমূলক কোনও সারবস্তু নেই। আমিও তা স্বীকার করলাম। চিঠিতে মানুষ যেমন তার প্রিয়জনদের কাছে আবেগ প্রকাশ করে তেমনি আমারও সব লেখাতেই আবেগের আতিশয্য এসে যেত। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

আমি যে যুগে জন্মেছিলাম সে যুগ জার্মান সাহিত্যের ক্ষেত্রে সমগ্রভাবে ছিল সমৃদ্ধির যুগ। তার পূর্ববর্তী যুগের সাহিত্য ছিল বিদেশী ভাষা ও চিন্তাধারার দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত। রাজনৈতিক কারণে বিদেশী প্রভাব অনুপ্রবিষ্ট হয়ে যায় কাব্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে। সেই প্লাবন দ্বারা আনীত পলিমাটিতে যে সৃষ্টি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তার মধ্যে স্বদেশী ভাষা আর স্বদেশী চিন্তাধারাই ছিল প্রধান উপজীব্য। যে যুগের নামকরা লেখকদের মধ্যে লিসকাউ, রাবেনা ও গটশেভ, বেলির প্রভৃতির নাম অবশ্যই করতে হয়। সৃজনশীল সাহিত্যের সঙ্গে সমালোচনা সাহিত্যও উন্নত হয়ে উঠেছিল বিশেষভাবে। 

আমি যে সব সাহিত্যরসিক বন্ধুদের সঙ্গে খুব বেশি মিশতাম তারা হলেন ক্লোজার আর কেনেন। তাছাড়া বিভিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে লেখা আর সমালোচনা পড়ে আমার একটা ধারণা স্পষ্ট হলো। আমাদের যুগের সাহিত্যের সবচেয়ে বড় দোষ এই যে সে যুগে সব লেখাই অনাবশ্যকভাবে আবেগপ্রধান ও দীর্ঘায়িত হয়ে উঠত। তাতে আসল বক্তব্য খুব কম থাকত আর যাও বা থাকত বা অস্পষ্টভাবে কুয়াশায় ঢাকা। আমি বুঝলাম লেখার মধ্যে আরও স্পষ্টতা, পরিমার্জিত চিন্তাশীলতা ও সংক্ষিপ্ত হওয়া প্রয়োজন। আমার কিন্তু রেনির আর উইল্যান্ডের লেখা খুবই ভালো লাগত। উইল্যান্ডের লেখার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল আলোছায়ার এক অপূর্ণ খেলা। বাস্তব অভিজ্ঞতার এক প্রখর প্রতপ্ত আলোর ঝলকানির সঙ্গে অবান্তর এক আদর্শের ছায়াপথ। 

প্রাণমাতানো এক চঞ্চল খেলা মেতে উঠত তাঁর লেখার মধ্যে। এই আবহাওয়ার মধ্যে আমিও লেখা শুরু করে দিলাম। কবিতা লেখার উপর জোর দিলাম। আবার কিছু লেখা বাড়িতে বাবার কাছে ফেলে আসি। তারপর এখানে এসে বহু সুযোগ্য। সাহিত্যরসিক ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশার ফলে আগের থেকে অনেক পরিণত লেখাও কিছু লিখি। কয়েকটি প্রবন্ধও লিখেছিলাম। 

এই সময় গ্রেনেচের মতো আর একটি মেয়ের প্রেমে পড়ি। সেও হোস্টেলে কাজ করত। তার নাম ছিল অ্যালেত্তে। মেয়েটি গ্রেনেচের মতোই ছিল সুন্দরী। কিন্তু গ্ৰেচেনের থেকে অনেক শান্ত ও স্বভাবা। গ্ৰেচেনের তেজস্বিতা ও দৃঢ়তা তার ছিল না। সে আমাদের খাবার তৈরি করত, রাত্রে মদ এনে দিত। আমাদের ফরমাশ খাটত। তাকে খুব ভালো লেগে গেল আমার। এই ভালো লাগা যতই ভালোবাসায় পরিণত হয়ে উঠল ততই তার চরিত্র সম্বন্ধে সন্দেহ জাগত আমার মনে। আমি বেশ বুঝতে পারলাম এ সন্দেহ অকারণ, সত্যিই সে নিরীহ। তবু মন আমার বুঝত না। কেবলি মনে হতো সে হয়ত গোপনে আরও কাউকে ভালোবাসে, মনে হতো হয়ত হে বহুবল্লভা। অথচ আমি জানতাম অ্যালেত্তে আমায় মন-প্রাণ নিয়ে ভালোবাসে এবং আমাকে খুশি করার জন্য সে অনেক কিছু করে। তবু একদিন আমি আমার সন্দেহের কথা তাকে বলে কত মনোকষ্ট দিলাম তাকে। 

তবে অ্যালেত্তের প্রতি আমার আবেগের প্রবণতাটা কমতে আমি প্রেমিকাদের খামখেয়াল নামে একটি নাটিকা লিখে ফেললাম। গ্ৰেচেনের সঙ্গে গভীরভাবে মিশতে যে পরিণাম ভোগ করতে হয়েছিল আমার তাতে একটা শিক্ষা হয়েছিল। আমার তথাকথিত ভদ্র সমাজটাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনেছিলাম। যে অভিজাত সমাজ মুখে বড় বড় ন্যায়-নীতি, আইন-কানুন প্রভৃতির কথা বলে তারাই সুড়ঙ্গপথে পার করে বেশি। এই নৈতিক অনুশাসন সব বইয়ের ব্যাপার। মুখের কথা যা শুধু সমাজের উপরিপৃষ্ঠে ভেসে বেড়ায়। সমাজের গভীরে বা মানুষের বাস্তব আচরণে তার কোনও স্থান নেই। শহরের পিচঢালা মসৃণ রাজপথের দুধারে বড় বড় সুদৃশ্য বাড়িগুলোতে যারা বাস করে তারা লোকচক্ষে দ্র ও অভিজাত শ্রেণী। সবাই তাদের খাতির করে। কিন্তু সেই সব বাড়িতে ঘুরে ঘুরে আমি দেখেছি অবৈধভাবে টাকা রোজগার, অবৈধ সংস্পর্শ, স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া, বিবাহ-বিচ্ছেদ প্রভৃতি নানা অকর্ম-কুকর্ম ও অশান্তি লেগেই আছে। সেখানে। তার উপর তাদের বাড়িতে খুন, ডাকাতি, মেয়ে নিয়ে অশান্তি, বিষ খাওয়া প্রভৃতি কত অশান্তি। অনেক সময় অনেক পরিবারের বন্ধু হিসাবে আমি তাদের বিপদে সাহায্য করতাম। সেই সব বিপদের কথা বাইরে প্রকাশ করতাম না। এই সব পরিবারের কোনও নোংরামি বা দুর্ঘটনার কথা বাইরে বড় একটা প্রকাশ হতো না বলে কেউ জানতে পারত না। এই সব পারিবারিক ঘটনা বা দুর্ঘটনা নিয়ে আমি দু-একটা নাটকও লিখেছিলাম। কিন্তু যত কুকর্মের কথা স্কুলভাবে বলা ছিল বলে সে নাটক সার্থক শিল্পরসে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। 

এরপর কিছু হাসির নাটক লিখি আমি। এই সময় মাদাম বমি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে আমি আর বিশেষ যেতাম না তাদের বাড়িতে। তার স্বামীর বক্তৃতা আমার ভালো লাগত না। তিনি আমাকে প্রায়ই বকতেন। তাই আমি তাঁকে এড়িয়ে চলতাম। একদিন তার ক্লাসে আমি তার বক্তৃতার নোট না লিখে আমার খাতার পৃষ্ঠায় ছবি আঁকছিলাম। তাই দেখে আমার পাশের ছাত্ররা অমনোযোগী হয়ে পড়েছিল। 

আমার অমনোযোগী মনটাকে আরও গভীর ও আগ্রহশীল করে তোলার জন্য অধ্যাপক লোকটি আমাকে ধর্মের দিকে টানার চেষ্টা করলেন। নিয়মিত চার্চে যাওয়া, স্বীকারোক্তি করা, সমবেত প্রার্থনা ও যোগ প্রভৃতির প্রতি অভ্যাস গড়ে তুলতে বললেন। এসবও আমার ভালো লাগত না। তবু গেলার্তকে আমাদের ভালো লাগত। তাছাড়া প্রোটেস্ট্যান্টদের ধর্মীয় রীতিনীতি আমার মোটেই পছন্দ হতো না। অথচ গেলার্ত আমাদের বোঝাতে চাইত ক্যাথলিকদের থেকে প্রোটেস্ট্যান্টদের রীতিনীতি অনেক ভালো। এখানে স্বীকারোক্তির জন্য বাধ্য করা হয় না কোনও মানুষকে। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে স্বীকারোক্তির পক্ষে, কারণ মানুষ অনেক গোপন অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করে হালকা হয়ে ওঠে মনে মনে। আমার এই ধরনের একটা গোপন কথা ছিল। ধর্ম সম্বন্ধে এক বিরাট সংশয় ছিল আমার মনে। এই সংশয়ের কথা আমি স্বীকারোক্তির মাধ্যমে ব্যক্ত করতে চাই কোনো সহৃদয় মানুষের কাছে। কিন্তু তারও কোনো ব্যবস্থাই নেই আমাদের ধর্মীয় রীতিতে। 

হঠাৎ এক মহান ব্যক্তির সংস্পর্শে এলাম লিপজিগ শহরে। আমি যেন এই ধরনের একটা মানুষকেই খুঁজছিলাম। তিনি হলেন বেহরিস্ক। আগে তিনি কাউন্ড লিন্দেনাদের ছেলের গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাঁর বয়স ছিল তিরিশের কিছু বেশি। রোগা অথচ সুগঠিত চেহারা। লম্বা নাক। সাদাসিধের উপরেই বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরতেন।

বেহরিস্ক এক অদ্ভুত মানুষ। কবিতা তিনি ভালোবাসতেন। তবে আধুনিক কোনও কবির কবিতা ভালো লাগত না তাঁর। আমার সঙ্গে এ বিষয়ে কিছু অমিল ছিল তাঁর। তবু বেহরিস্ক তাঁর সেই ভালো না লাগার কথা এমন সুন্দরভাবে বুদ্ধির সঙ্গে পরিহাসরসিকতা মিশিয়ে বলতেন আর তার উপর আমি কিছু বলতে পারতাম না। তাছাড়া তাঁর জার্মান ভাষা ও সাহিত্যে পড়াশুনা ছিল প্রচুর। লিখতেও ভালো পারতেন। এক উন্নতমানের রুচিবোধ ছিল তাঁর আর তাই দিয়ে যে কোনও কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভালো-মন্দ দিকগুলো বলে দিতে পারতেন তিনি। 

বেহরিস্ক আমায় ভালোবাসতেন। তাঁর প্রেরণাতেই নূতন করে কবিতা লিখতে শুরু করি আমি। কিন্তু বেহরিস্ক এই শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিলেন। আমার কবিতা কখনও ছাপানো চলবে না। আমি আমার লেখা কবিতাগুলো তাঁর হাতে লিখে দেব আর তিনি সেগুলোর থেকে থেকে বেছে ভালো করে লিখে তার একটি সংকলন বাঁধিয়ে আমার হাতে তুলে দেবেন। 

এই ধরনের একটা সংকলন সত্যিই সুন্দরভাবে আত্মপ্রকাশ করল রেহরিস্কের চেষ্টায়। লেখাগুলো খুবই প্রশংসা পেল। সংকলন পড়ে বাড়ি থেকে বাবা একখানা চিঠি লিখে পাঠালেন আমায় প্রশংসা করে। অধ্যাপক ক্লোডিয়াস ও গেলার্ত গদ্য ও পদ্যের রীতি সম্বন্ধে কিছু গালভরা উপদেশ দিলেও মোটের উপর ভালো বললেন। 

কিন্তু হঠাৎ রেহরিস্কের মৃত্যু ঘটায় আমি দারুণ মুষড়ে পড়লাম। উনি ছিলেন একাধারে আমার বন্ধু, পরিচালক এবং প্রধান উপদেষ্টা। সেই রেহরিস্ককে বাদ দিয়ে জীবনে কিভাবে চলব তা খুঁজেই পেলাম না। এক অদম্য শোকাবেগের বিহ্বলতায় বেশ কিছুদিন কেটে গেল আমার। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

বেহরিস্কের পর যিনি আমার সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তিনি হলেন ওয়েজার। বেহরিস্কের সঙ্গে কতকগুলো বিষয়ে যেমন তার পার্থক্য ছিল তেমনি আবার কতকগুলো সাদৃশ্যও ছিল। এই কারণেই দুজনের মধ্যে আসে তুলনার কথা। সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের কথা, বেহরিস্কের মতো ওয়েজারও অন্তহীন কর্মব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিতে চাইতেন জীবনটাকে। 

ওয়েজার ছিলেন শিল্পরসিক। নিজেও আঁকতে পারতেন। তবে রেহরিস্ক যেমন কাব্যরসিক হয়েও আধুনিক কবিতা পছন্দ করতেন না তেমনি ওয়েজারও শিল্পরসিক হলেও আধুনিক শিল্প পছন্দ করতেন। তিনি প্লেজেনবার্গ প্রাসাদে অ্যাকাডেমি অফ ডিজাইন-এর অধিকর্তা ছিলেন। তবে অবসর সময়ের সমস্তটাই ছবি এঁকে কাটাতেন। প্রাচীন শিল্পরীতিতেই তিনি ছিলেন বিশ্বাসী। ওয়েজারের একটা গোঁড়ামি ছিল, একবার যদি তিনি কাউকে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা করতেন তাহলে সে বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা হতে কখনও টলতেন না তিনি। কোনও অবস্থাতেই তাঁর মতের পরিবর্তন হতো না। 

ওয়েজার যে ঘরে থাকতেন সে ঘরটা ছিল শিল্পরসের আবহাওয়ায় সিক্ত। বেহরিস্কের সংস্পর্শে এসে আমি যেমন নাটক ছেড়ে নূতন করে কবিতা লিখতে শুরু করি, তেমনি ওয়েজারের সংস্পর্শে এনে নূতন করে চিত্রশিল্প আঁকতে শুরু করি। তবে আধুনিক শিল্প বাজে হচ্ছে ওয়েজার-এর এ মত কিছুতেই মানতে পারলাম না আমি। 

আমি আমার ছবি আঁকার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলাম। শিল্প সম্বন্ধে ওয়েজারের শিক্ষাদীক্ষা আমাদের মনে যথেষ্ট উৎসাহ ও প্রেরণার সঞ্চার করত। কিন্তু ওয়েজারের নিজের আঁকা ছবিগুলো মোটেই ভালো লাগত না আমাদের। তাঁর হাতে কোনও বস্তুর আকৃতিটা মোটেই ফুটে উঠত না ভালো করে। 

ওয়েজারের আর একট বড় কাজ হলো থিয়েটারের জন্য একটা বড় বাড়ি নির্মাণ। সে বাড়ির সামনে প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার সোফোক্লিস ও অ্যারিস্টোফেনস-এর মূর্তি স্থাপন করা হলো আর সেই সব মূর্তি চারপাশে রইল আধুনিক জার্মানির নাট্যকারদের মূর্তি। আবার তার সঙ্গে ছিল কলাবিদ্যার বিভিন্ন অধিষ্ঠাতী দেবীর ছবি। 

ওয়েজার চিত্রশিল্প সৃষ্টির কাজে নিজে খুব সার্থক না হলেও আমাদের আঁকার কাজে শিক্ষা দিতেন ভালো। আঁকার কাজে শিক্ষার্থীদের কোথায় কি ত্রুটি তা ঠিক করতে পারতেন। তবে নিজের হাতে কোনও বিষয়ে দেখিয়ে না দিয়ে তিনি শুধু আমাদের দোষটা ধরিয়ে ভাবতে বলতেন যাতে আমরা নিজেরাই উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারি। 

এই সময় দার্জেনভিলের লেখা চিত্রকরদের জীবনী গ্রন্থটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হলো। সেই অনুবাদটির মধ্য দিয়ে চিত্রকলার এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠলাম আমরা। আবার আমার মনে এই সব বিভিন্ন যুগের বিভিন্ন শিল্পীর ছবি দেখে কবিতা লেখার প্রেরণা জাগত আপনা থেকে। 

ওয়েচারের আর একটা গুণ ছিল। মৃত ব্যক্তিদের ছবি আঁকতে ভালোবাসততা। মৃতদের স্মরণ করার একটা ঝোঁক ছিল। 

তখন লিপজিগ শহরে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির সমন্বয় ঘটেছিল। এঁদের মধ্যে তিনজন ছিলেন বেশ নামকরা। তাঁরা হলেন হুবার, কুশপ আর উইঙ্কলার হুবার জার্মান সাহিত্যের ইতিহাসটাকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেন। এটা সত্যিই বিরাট কাজ যার জন্য ফরাসিরা কৃতজ্ঞ থাকবে চিরদিনের জন্য। বাকি দুজন ছিলেন শিল্পরসিক। 

কিন্তু আমাদের চূড়ান্ত রসতৃপ্তি ঘটেনি। কিছুতেই মন ভরছিল না আমাদের। আমরা চাইছিলাম এর নূতন আলো। চাইছিলাম আমাদের পরিচিত কোনও শিল্পী সে আলো নিয়ে আসবে। 

মানুষের মন সাধারণত দুভাবে আনন্দ পায়। এক হচ্ছে প্রত্যক্ষীকরণ আর অন্যটি হলো ধ্যানধারণা। প্রত্যক্ষীকরণের মধ্য দিয়ে আনন্দ পেতে হলে হাতের কাছে পার্থিব বস্তু বা উপাদান ভালো থাকা চাই। কিন্তু ধ্যানধারণার একটা সুবিধা এই যে, এর মাধ্যমে বাস্তব প্রতিরূপ ছাড়াই কোনও ভালো বিষয়বস্তুকে মনের মতো উপভোগ করা যায়। 

এই সময় আমি আর্নল্ডের ‘মি হেস্ট্রি অফ দি চার্চ অ্যান্ড অফ হেরেটিকস’ নামে একখানি বই পাই হাতে। বইখানি পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আর্নল্ডের মধ্যে ধর্ম বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই আমার মতের মিল হয়। যুগে যুগে দেশে দেশে ঈশ্বর সম্বন্ধে মানুষের ধারণা যাই হোক, ধর্মের ইতিহাস ও দর্শন আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে মানবাত্মা নিরন্তর সংকোচন ও প্রসারণের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সাধন করে চলেছে। মানুষের সত্তাটি একাধারে আত্মগত ও বিশ্বগত। কখনও সে সত্তা বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ করে নিজের মধ্যে নিজেকে কেন্দ্রীভূত করে সংগঠিত করে চলেছে, আবার কখনও বা নিজেকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দিকে সম্প্রসারিত করতে চাইতে। নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চাইছে। 

নবম পরিচ্ছেদ

বসন্তকাল আসতেই আমি ভালোভাবে সেরে উঠলাম। আমি আমার হারানো স্বাস্থ্য আবার ফিরে পেলাম। আর আমার বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছিল না। তাছাড়া বাবার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও ভালো যাচ্ছিল না। তিনি এমনভাবে কথা বলতেন জীবনের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে যাতে মনে হতো সব কিছু মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে, মানুষ যেন ইচ্ছামতো জীবনের যে কোনও ঘটনাকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারে। কথায় কথায় আমিও কয়েকটি ক্ষেত্রে আঘাত দিয়ে ফেলেছি তাঁকে। 

এরপর আমি স্ট্রসবার্গ শহরে আইন পড়তে গেলাম। রাইন নদীর ধারে অবস্থিত ছবির মতো সাজানো শহরটাকে আমার ভালো লাগত। শহরটার চারদিকে বড় বড় গাছে ভরা প্রান্তর। নদীর ধারটা বড় চমৎকার। 

আমি সেখানে আমার আইনপড়া সম্পর্কে ডক্টর সালিকম্যান নামে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বললাম। আমাকে কতদিন থাকতে হবে, কতগুলো বক্তৃতায় যোগদান করতে হবে সেসব বিষয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন এখানে কাজ চালাবার মতো মোটামুটি ধরনের শিক্ষা দেওয়া হয়, আইনবিদ্যা গভীরভাবে পড়তে হবে জার্মানির কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি আমাকে বলতেন, এখন যা করে হোক একটা ডিগ্রি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে দাও। 

এতে কিন্তু আমার মন ভরছিল না। আমি সব কিছুর ইতিহাস জানতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম আমি যা পড়ব তার ক্ষেত্রটি হবে একই সঙ্গে বিরাট ব্যাপক এবং গভীর এবং আমি তাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করব। 

আমি যে বোর্ডিংয়ে থাকতাম সেখানে বেশিরভাগ সদস্য ডাক্তারি ছাত্র ছিল। তারা সব সময় চিকিৎসাবিদ্যার কথা বলত। ডাক্তারি পড়ার ছাত্রদের তাদের পাঠ্য বিষয়ের প্রতি অনুরাগের আতিশষ্যের কারণ প্রধানত দুটো। প্রথম কথা, মানুষের রোগ ও দেহতত্ত্বের ব্যাপারটার একটা নিজস্ব আকর্ষণ আছে। মানুষ হিসাবে সবাই তা জানতে চায়। আর একটা কারণ আর্থিক লোভ। ডাক্তারি পাশ করে চিকিৎসা ব্যবসায় শুরু করলেই আসবে টাকা আর প্রতিষ্ঠা। এজন্য দেখতাম ডাক্তারির ছাত্ররা সব সময় সর্বশক্তি দিয়ে পড়াশুনো করত অথবা গভীর আগ্রহের সঙ্গে পড়ার বিষয়ে আলোচনা করত। 

আমি আইনের ছাত্র হলেও তাদের আলোচনার স্রোত আমাকে অনেক সময় অনেক দূরে টেনে নিয়ে যেত। দেহতত্ত্বকে কেন্দ্র করে সাধারণভাবে বিজ্ঞানের প্রতি আমার আগ্রহকে বাড়িয়ে দিত। 

এমন সময় এমন একটা ঘটনা ঘটল যা আমাদের মনটাকে দিনকতকের জন্য পড়াশুনোর চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। হঠাৎ খবর এল অস্ট্রিয়ার ডিউককন্যা ও ফ্রান্সের রানি মেরি আঁতানোৎ স্ট্রসবার্গ হয়ে ফ্রান্সে তাঁর স্বামীর কাছে যাবেন। স্ট্রসবার্গে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হবে এবং শহরের বাইরে রাইন নদীর তীরে অবস্থিত এক সুসজ্জিত প্রাসাদে তিনি ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে মিলিত হবেন। এই উপলক্ষে এক বিরাট উৎসবে মেতে উঠল সারা শহর। পরে প্যারিসে বাজি পোড়ানো হলো। হুড়োহুড়ি ও পুলিশের বাড়াবাড়িতে কিছু লোক নিহত ও আহত হলো। 

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেক্রেটারি ও প্রভাবশালী কর্মচারী মাসম্যান-এর সঙ্গে হঠাৎ আমার পরিচয় হয়ে গেল। সে ছিল ভালো বাগ্মী এবং বিচক্ষণ। তার সঙ্গে অনেকে মিশতে চাইত। কিন্তু আমার কিছু কিছু বিষয়ে জ্ঞান ছিল আমার বিচারবুদ্ধি সংস্কারমুক্ত ছিল বলে সে আমাকেই বেশি পছন্দ করত তার সঙ্গী হিসাবে। সে আমার হিতাকাক্ষী হিসাবে পরামর্শ দিত বিভিন্ন বিষয়ে। 

আমি স্ট্রসবার্গে ফ্রান্সের রানির আগমন উপলক্ষে জীবনে এই প্রথম ফরাসি ভাষায়। একটি কবিতা লিখি। 

গ্ৰেচেনের সঙ্গে আমার প্রেম সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর থেকে আমি সাধারণত আনন্দোৎসবের ঘটনাকে এড়িয়ে চলতাম। আমি নিজেকে যেন আত্মনিগ্রহের পথে ঠেলে দিয়েছিলাম স্বেচ্ছায়। ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লিপজিগে থাকার সময় আমোদ-প্রমোদের সাধারণ উপকরণ বা উপাদান থেকে সরে থাকতাম আমি। 

কিন্তু স্ট্রসবার্গে আসার পর এ বিষয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে সুযোগ পেয়ে গেলাম। একে একে নাচের আসতে যেতে শুরু করলাম। শুধু শহরের মধ্যে নয়, মাঝে মাঝে গ্রামাঞ্চলেও যেতাম। পড়াশুনোর ফাঁকে ফাঁকে অবসয় পেলেই যেমন জার্মান শিক্ষা সংস্কৃতির সম্বন্ধে চর্চা করতাম তেমনি সন্ধের দিকে কোথাও কোনও নাচগাচের আসরে সুযোগ পেলেই যোগদান করতাম। 

এক সময় লার্সে নামে এক যুবকের সঙ্গে আলাপ হয় আমার। আলাপ-পরিচয় হতে অন্তরঙ্গ হয়ে উঠি আমরা। সে সব সময় নিজেকে নায়ক ভাবত। সে প্রায়ই বলত ঈশ্বর তাকে নায়ক করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। কি যুদ্ধ কি প্রেম সবেতেই সিদ্ধহস্ত সে। যুদ্ধের বীর ও প্রেমের নায়ক হিসাবে সে সব সময় তার মাথা উঁচু করে থাকবে। দ্বিতীয় কোনও ভূমিকা সে কখনও কোথাও গ্রহণ করবে না। আমি তার কথা মনে রেখেছিলাম, ‘আইরন হ্যান্ড’ নাটকে ফ্রৎস নামে একটি চরিত্রের মধ্যে তাকে মূর্ত করে তুলি আমি। সে সব সময় বড় বড় কথা বলত এবং সে কখনও কোনো অবস্থায় কারও কাছে মাথা নত করলেও আত্মমর্যাদা ত্যাগ করত না। 

শুধু নাচের আসরে গেলেই হবে না। ভালো নাচ শিখতে হবে। ওয়ালৎস নৃত্য আমার শিখতে ভালো লাগত। কিন্তু এ বিষয়ে আমার কোনও পারদর্শিতা ছিল না। তাই একজন নাচের শিক্ষকের কাছে নিয়মিত নাচ শিখতে লাগলাম। তার একটা ছোট বেহালা ছিল। আমি অল্পদিনের মধ্যেই ভালোভাবে নাচ শিখে তাঁকে সন্তুষ্ট করলাম। 

তার দুটি মেয়ে ছিল। তাদের বয়স তখনও কুড়ি পার হয়নি। তাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। তাদের মধ্যে ছোট এমিলিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম আমি। কিন্তু এমিলিয়ার ও আমার এই ঘনিষ্ঠতা বড়বোন লুসিন্ডা মোটেই ভালো চোখে দেখত না। উল্টে ঈর্ষাবোধ করত এমিলিয়ার উপর। 

একদিন এক বুড়ির কাছে তার ভবিষ্যৎ গণনা করতে যায় লুসিন্ডা। আমি তাকে ও তার বোনকে সঙ্গে করে নিয়ে যাই। বুড়ি লুসিন্ডার হাত দেখে বলে, তার প্রেমিক দূরে আছে। সে যাকে ভালোবাসে সে কিন্তু তাকে ভালোবাসে না; সুতরাং মিলনের আশা কম। তাদের প্রেমের মাঝখানে একজন অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার চিঠিপত্র লিখে বা কিছু টাকা দিয়ে দেখতে পার।

লুসিন্ডা বলল, আমার ভালোবাসা যদি সত্য হয় তাহলে আর কিছুই লাগবে না। সে আমার প্রেমের প্রতিদান দেবেই। 

বুড়িকে টাকা দিয়ে চলে এলাম আমরা। আমি প্রায়ই তাদের বাড়ি যেতাম। একদিন এমিলিয়া তার জীবনের সব কথা খুলে বলল আমায়। সে বলল, সে আগে একটি ছেলেকে ভালোবাসত। সে এখন দূরে। তবু আজও তাকে ভালোবেসে যায়। তবে তুমি আসার পর থেকে তোমার গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারছি না। এদিকে দিদি লুসিন্ডা আবার তোমাকে ভালোবাসে অথচ তুমি আমার প্রতি আসক্ত। হায়, তুমি আমাদের দুজনের কাউকেই সুখী করতে পারলে না। একজনকে ভালোবেসে শুধু দুঃখ দিলে আর একজনকে ভালোবাসা দিতে না পেরে দুঃখ দিলে। 

আমরা সোফায় বসে কথা বলছিলাম। এমিলিয়ার কথা শেষ হতে আমি তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে চুম্বন করলাম। সে বলল, এই হয়ত আমাদের শেষ দেখা। আমি উঠে পড়লাম। সে দরজার কাছ পর্যন্ত এগিয়ে এল। 

এমন সময় লুসিন্ডা ঝড়ের বেগে পাগলের মতো ঘরে ঢুকল। তার বোনকে বলল, একা তোর কাছেই ও শুধু বিদায় নেবে? আমি কেউ নই? আর আগেও তুই এইভাবে আমার প্রেমিককে ছিনিয়ে নিয়েছিস। 

এই বলে সে জোর করে আমাকে ধরে আমার গালে তার চোখ দুটো ঘষতে লাগল। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে সোফার উপর সটান শুয়ে পড়ল লুসিন্ডা। এমিলিয়া তার কাছে গেলে সে তাকে সরিয়ে দিল। 

আমি কোনওরকমে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে। মনে মনে সংকল্প করলাম এ বাড়িতে জীবনে আর কোনওদিন আসব না। 

দশম পরিচ্ছেদ

জুং স্টিলিং-এর মতো হার্ডারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব আমার জীবনে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আর একটা বিরাট আকর্ষণশক্তি ছিল যা আমাকে ক্রমাগত টানত তার দিকে। তার সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠভাবে মিশলেও তাকে কিন্তু আমি আমার কতকগুলো ব্যক্তিগত গোপন কথা বলিনি। যেমন গোয়েৎস ভর বার্লিসিঞ্জেন ও ফাউস্টকে নিয়ে আমি যে লেখার কথা ভাবতাম তাদের কথা বলিনি তাকে। 

যাই হোক, হার্ডারের একবার অসুখ করতে বাইরে কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য মন হাঁপিয়ে উঠল আমার। আমি সুযোগের অপেক্ষায় রইলাম। হার্ডার রোগমুক্ত হতেই আমরা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে হার্ডার আর একজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে আর দুজন পাবর্ত্য অঞ্চলের অধিবাসীকে নিয়ে আমি ঘোড়ায় চেপে জেবার্নের পথ রওনা হলাম। 

জেবার্নে একমাত্র দেখার জিনিস হলো বিশপের প্রাসাদ। এরপর আমরা পাহাড়ের উপর উঠে জেবার্ন স্টেয়ার্স নামে এক স্থাপত্যকীর্তির বিরাট নিদর্শন দেখলাম। তখন সবেমাত্র সূর্য উঠছিল পাহাড়ের মাথায়। সেদিন ছিল রবিবার। বেলা নটার সময় আমরা পাহাড় থেকে নিচে শহরে নেমে এলাম। 

এরপর আমরা বুখনওয়েলার নামে আর একটি শহরে গেলাম। সেখানে ওয়েল্যান্ড নামে আমাদের এক বন্ধু ছিল। সে আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানাল। আমরা আরও উপরে উঠার মনস্থ করলাম। পার্বত্য প্রদেশের আরও মনোরম দৃশ্য হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল আমাদের। পাহাড়ের উপর অবস্থিত লিচেনবার্গের প্রাসাদ দেখার পর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়েই সহসা সামনে দেখতে পেলাম আলসেসিরি বিশাল প্রান্তর যা দূরে-বহুদূরে পাহাড়ের ছবি আঁকা দিগন্তের কুয়াশায় মিলিয়ে গেছে। 

পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়, নদী, যা কিছুই দেখি তাই বিস্ময় সৃষ্টি করে আমার মনে। তাদের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন জাগায়। পথে কোনও নদী দেখলেই মনে হয় ছুটে যাই তার উৎসদেশে। কোনও পাহাড় দেখলেই মনে হয় তার মাথায় উঠে যাই। দেখি তার বুকের অরণ্যের মাঝে। 

এরপর আমরা উত্তর-পশ্চিমের পর্বতমালার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। এগিয়ে যেতে লাগলাম লোরেনের পথে। এরপর শুরু হলো অরণ্যপথ। এক-একটা পাহাড়কে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক-একটা গহন অরণ্য। পথে যেতে যেতে একটি মুখখোলা কয়লাখনি দেখলাম। তারপর দেখলাম একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। পাহাড়ের মাথায় পাথরগুলো আগুনে পুড়ে লাল হয়ে উঠেছে। অনবরত ধোঁয়া উঠছে। পাহাড়ের কাছে যেতেই আমাদের পায়ে গরম অনুভব করলাম। কেউ জানে না কখন কিভাবে আগুন এল এখানে। 

এরপর ফেরার পালা। এই সময় ইংরেজ লেখকও কবি গোল্ডস্মিথের ‘ভিকার অফ ওয়েকফিল্ড’ বইখানি আমাকে সঙ্গদান করত। বইখানির জার্মান অনুবাদ পড়তে লাগল আমার। আমার প্রিয় সেসেনহেমে ফিরে এলাম। 

ওয়েল্যান্ড আমাদের সঙ্গেই ছিল। আমরা যে গাঁয়ের পান্থশালায় ডেরা নিয়েছিলাম সেখানে এক পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হই আমি। সে পরিবার ওয়েল্যান্ডের পরিচিত। পরিবার মানে দুই বোন, এ ভাই আর বাবা-মা। আমার মনে হলো, ঠিক যেন সম্প্রতি পড়া গোল্ডস্মিথের ওয়েকফিল্ড। প্রতিটি চরিত্র হুবহু মিলে যাচ্ছে। আমার অবশ্য ছোট বোনও ফ্রেডারিকাকেই বেশি সুন্দরী ও আকর্ষণীয় বলে মনে হতো, তবে বড় বোনও কম সুন্দরী নয়। 

ওদের বাবার থেকে মার ব্যক্তিত্বই বেশি মনে হলো। শিক্ষিতা ও মার্জিত রুচিসম্পন্না ভদ্রমহিলাকে দেখলে একই সঙ্গে ভয় ও শ্রদ্ধা জাগে। বোন দুজনের মধ্যে দেখলাম গ্রাম্যতা ও নাগরিকতার দ্বৈত সমন্বয়ে গড়া একটা মিশ্র ভাব। 

বিশেষ করে ছোট বোন সুন্দরী ফ্রেডারিকার সঙ্গে আলাপ করে তার স্বভাবের অনাবিল মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি। একদিন তার কাছে বসে অনেকটা সময় কাটালাম। পরে ওয়েল্যান্ডকে প্রশ্ন করলাম, ফ্রেডারিকা কি কাউকে ভালোবেসেছিল বা এখনও বাসে? সে কি কারও বাগদত্তা? ওয়েল্যান্ড আমার সব প্রশ্নের উত্তরেই ‘না’ বলল। আমি বললাম, কোনও মানুষ ভালো না বাসলে এত প্রাণ খুলে হাসতে পারে না। আমার মনে হলো ফ্রেডারিক নিশ্চয় কাউকে ভালোবেসে হারিয়ে আবার তাকে খুঁজে পেয়েছে। জীবনের পরম ধনকে হারিয়ে পাওয়ার দ্বিগুণ আনন্দে তাই এত আত্মহারা। অথবা তার কোনও দীর্ঘায়িত প্রণয়সম্পর্ক আশা-নিরাশার চড়াই-উত্রাই পার হয়ে অবশেষে শুভ পরিণয়ে সার্থক হতে চলেছে। 

একাদশ পরিচ্ছেদ

আবার ফিরে এলাম আমার পড়ার জায়গায়। ফিরে এলাম আমার ছাত্রজীবনে। মনের মধ্যে সংকল্প গড়ে তুললাম, আইনবিদ্যায় আমায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করতে হবে। চিকিৎসাবিদ্যা আমাকে আকৃষ্ট করলেও আমার আরব্ধ কাজ ভালোভাবে সম্পন্ন করতে হবেই। 

তবু সেসেনহেম গাঁয়ের সেই সন্ধ্যাটা ভুলতে পারলাম না। ভুলতে পারলাম না ফ্রেডারিকের কথা। আমি সেখানে এক সন্ধ্যায় একটা গল্প লিখে ওদের শুনিয়েছিলাম। ওরা আগ্রহসহকারে শুনেছিল। গল্প শেষ হলে আমার আবার এই ধরনের গল্প লিখতে বলেছিল। 

ওদের কথা ভেবেই আমি একদিন ঘোড়ায় করে আবার গিয়ে উঠলা সেসেনহেম গাঁয়ে। 

আমি ফ্রেডারিকদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম ওরা দুই বোন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমাকে দেখেই সে তার দিদিকে বলল, সে যা বলেছিল তাই সত্য হলো। আমি আজ তাদের বাড়ি যাব একথা সে নাকি আগেই অনুমান করে তার দিদি অলিভিয়াকে বলেছিল। 

অলিভিয়া হাসতে লাগল। ওদের মা আমাকে আত্মীয়ের মতোই সহজভাবে অভ্যর্থনা করলেন। পরদিন সকালে ফ্রেডারিকা আমাকে সঙ্গে করে বেড়াতে নিয়ে গেল। ওর মা ও দিদি ব্যস্ত ছিল বাড়ির কাজে। আজ ওদের বাড়িতে কয়েকজন অতিথি আসবে। সেদিন ছিল রবিবার ফ্রেডারিকার পাশে ছুটির দিনের উজ্জ্বল সকালটাকে এমন এক সুন্দর গ্রাম্য পরিবেশে কাটাতে অদ্ভুত ভালো লাগছিল আমার। 

ওদের বাড়িতে ফিরে এসে দেখলাম ওদের অতিথিরা এসে গেছে, দেখলাম ওরা ফ্রেডারিকাকে খুব ভালোবাসে। আমি জীবনে যত মেয়ের সংস্পর্শে এসেছি তাদের সাধারণত দুই শ্রেণীতে ভাগ করে দেখি আমি। এক শ্রেণীর মেয়েদের ঘরের মধ্যে ভালো লাগে। ভালো লাগে তাদের পাকা গৃহিণীরূপে। আমার মন হয় ফ্রেডারিকা এমন শ্ৰেণীর মেয়ে যাকে ভালো লাগে ঘরের বাইরে। সে এখন মুক্ত আকাশের তলে বিস্তৃত পথের উপর দিয়ে চলে তখন তার দেহের অপূর্ব যৌবনসৌন্দর্য ফুল্লকুসুমিত উদার উন্মুক্ত প্রান্তরের সঙ্গে যেন মিশে এক হয়ে যায়। তার মুখের হাস্যোজ্জ্বল আনন্দ যেন নীল আকাশ থেকে টাটকা ঝরে পড়া এক আশ্চর্য বস্তু। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য সে যেন ঘরের মধ্যেও বয়ে আনে আর তাই বোধ হয় যে কোনও অপ্রীতিকর প্রতিকূল অবস্থাকে কত সহজে কাটিয়ে উঠতে পারে ফ্রেডারিকা। 

ওদের বাড়িতে থাকার সময় একদিন রাতে হঠাৎ লুসিন্ডাকে স্বপ্নে দেখলাম। সে স্বপ্ন উত্তেজনায় উত্তাল হয়ে উঠল আমার দেহের সমস্ত রক্ত। মনে হলো লুসিভা আমাকে আবেগের সঙ্গে ধরে আমার মুখে চুম্বন করে আমার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। তার মুখে ফুটে উঠেছে তীব্র ঘৃণার ভাব। সে তার বোনকে অভিশাপ দিচ্ছে। অভিশাপ আমার উপরেও বেশ কিছুটা পড়েছে। আর সেই অভিশাপ বর্ষণের মাঝে স্লানমুখে দাঁড়িয়ে আছে তার বোন। 

আমি আবার শহরে ফিরে এলাম। ফ্রেডারিকার বাবাকে একটা কথা দিয়েছিলাম। উনি একটা বাড়ি তৈরি করতে চান গাঁয়ে। কিন্তু ওঁর পরিকল্পিত নক্সাটা কারও পছন্দ হচ্ছে না। আমি তাই শহরে এসেই আমার এক পরিচিত স্থপতিকে দিয়ে একটা সর্বাঙ্গ সুন্দর বাড়ির নক্সা করালাম। এরপর ফ্রেডারিকাদের আসতে বললাম ঐসবার্গ শহরে। এ শহরে ওদের এক আত্মীয় পরিবার আছে। সেখানে এসে ওরা সহজেই উঠতে পারে। ওরা কিন্তু কেউ শহরে আসতে চায় না। অলিভিয়া তো একবারে গ্রাম্য আচারে-ব্যবহারে। কিন্তু ফ্রেডারিকারও কোনও মোহ বা আগ্রহ নেই শহরের প্রতি। কিন্তু আমি তো ওদের বাড়ি কতবার গেছি, কতদিন থেকেছি। আর ওরা আমার একটা অনুরোধ রাখবে না। 

অবশেষে ওরা এল। কিন্তু সত্যিই আমার ভালো লাগল না। আমার মনে হলো আমি সত্যিই ভুল করেছি। যদি আমি মনোরম গ্রাম্য পরিবেশে মুক্ত আকাশের তলে প্রবহমান নদীর ধারে নুয়েপড়া গাছের ছায়ায় দেখেছি, যাদের অঙ্গলাবণ্যকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখেছি, তাদের শহরের এই ইট কাঠ পাথরের কৃত্রিম পরিবেশে মোটেই ভালো লাগল না। 

অবশ্য অন্তরের ভালোবাসা কোনও পরিবেশ মানে না। প্রতিকূল পরিবেশকেও অনুকূল করে তোলে। তবু পরিবেশের আনুকূল্যে ভালোবাসা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বেশি। সার্থকতা লাভ করে সহজে। তাই ওরা যখন চলে গেল তখন আমার মনে হলো আমার বুক থেকে যেন একা ভারী বোঝা নেমে গেল। আমি আবার সহজভাবে পড়াশুনোয় মন দিতে পারলাম।

ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে পড়তে আসার সময় আমি আবার বাবাকে কথা দিয়ে এসেছিলাম আমি ভালোভাবে আইন পাশ করব। বিশ্ববিদ্যালয় লাতিন ভাষায় লেখা আমার গবেষণার কাজ সমর্থন করল। আমি আইনের ডিগ্রি পেলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমায় বলল, এখন এই মুহূর্তে সেটা যেন প্রকাশ না করি। পরে ভালো করে আরও বড় করে সেটা লিখে যেন প্রকাশ করি। বাবাকে একথা জানালে তিনি আমাকে সেটা এখনি প্রকাশ করতে বললেন। কিন্তু আমি ভবিষ্যতে সেটা আবার ভালো আকারে প্রকাশ করার জন্য তার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। 

আমি ডিগ্রি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অধ্যাপক স্কফলিন মারা গেলেন। আমার মনের উপর তার প্রভাব ছিল অপরিসীম। তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত তবু পড়াশুনার অন্ত ছিল না তার। সারা জীবন ধরে তিনি রয়ে গেছেন শিক্ষার্থী। অসাধারণ হয়েও সাধারণ এই নিরহঙ্কার মানুষটি সহজেই টেনে নেন আমার মনকে। তিনি আমাদের পড়াতেন রাজনীতি। 

এই সময় ফরাসি সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো করি। কিন্তু সে সাহিত্যের কাছে আমি যা আশা করেছিলাম তা পেলাম না। ভলতেয়ার যিনি দীর্ঘকাল ফরাসি সাহিত্যের ক্ষেত্রটিকে আচ্ছন্ন করেছিলেন তিনি সৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। দিদেরো, রুমা, হলবার্ক প্রভৃতি এঁদের কল্পনা এতই নিচু যে আমরা তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারিনি আমাদের চিন্তাভাবনাকে। 

সাহিত্যের মধ্যে আমি যা খুঁজছিলাম হঠাৎ তা পেয়ে গেলাম। এক অভাবিত সাফল্যের সঙ্গে পূর্ণতার সঙ্গে পেয়ে গেলাম শেকসপিয়ারের মধ্যে। শেকসপিয়ার নিয়ে তখন স্ট্রসবার্গ জ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছিল। তাঁর মূল রচনার সঙ্গে সঙ্গে জার্মান ভাষায় অনূদিত রচনাও বিভিন্ন জায়গায় পড়া ও অভিনীত হতো। শেকসপিয়ারের উপর আমার বন্ধু হার্ডার একটা প্রবন্ধ লিখেছিল। এইরকম অনেকেই লিখত তখন। আলোচনা করত চারদিকে। 

হঠাৎ কি খেয়াল হতে আমি একবার ওডিলেনবার্গে তীর্থযাত্রায় যাই। সেখানে গিয়ে অদ্ভুত এক কাহিনী শুনি। রোমান আমলের এক সুপ্রাচীন ধ্বংসাবশেষের মাঝে দেখতে পাই একটি ভূমিসাৎ প্রাসাদের একটি দেওয়াল আজও দাঁড়িয়ে আছে। লোকে বলত ঐখানে কোনও এক ধর্মপ্রাণা কাউন্টকন্যা একা এক পবিত্র ধর্মজীবন যাপন। করতেন। আমি সে কাহিনী শুনে সেই অদৃষ্টপূর্ণ কাউন্টকন্যার এক মূর্তি কল্পনায় খাড়া করি। 

কিন্তু যখন যেখানে যাই ফ্রেডারিককাকে ভুলতে পারি না কখনও। স্মৃতির মাঝে সমানে চলে তার স্বচ্ছন্দ আনাগোনা। 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দীর্ঘ অনুপস্থিতির আর দেশভ্রমণের পর ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম। এবার কিন্তু আগের থেকে দেহমন দুটোই আমার অনেক উজ্জ্বল। মাকে আবার তেমনি মমতাময়ী ও স্নেহময়ীরূপে ফিরে পেলাম আমি। আপোসহীন অনমনীয় বাবা তার কল্পনাপ্রবণ আবেগপ্রবণ আমার মাঝে মা-ই ছিলেন একমাত্র সেতুবন্ধন। তিনি আমাদের সব দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতেন। 

এই সময় আমরা শহরে এক সান্ধ্যসভায় যাতায়াত করতাম। শহরের উচ্চশিক্ষিত বিশিষ্ট লোকরা সেখানে আসতেন। তাঁরা আমাকে সাহিত্য সৃষ্টির কাজে দারুণভাবে উৎসাহ যোগাতেন। আমার সমাপ্ত, অসমাপ্ত বা আরদ্ধ অনেক লেখা আমি তাঁদের কাছে পড়ে শোনাতাম। তারা সব মন দিয়ে শুনতেন এবং উৎসাহ দিতেন। ফাউস্টের পরিকল্পনার কথাটা তাঁদের আমি প্রথম বলি। বলি যে মেফিস্টোফোলিসের মতো এক বন্ধু সত্যিই আমি আমার জীবনের পেয়েছিলাম। 

এই সময় বাইবেল নিয়েও নূতন করে পড়াশুনা করি। ওল্ড ও নিউ টেস্টামেন্টের সব ধর্মগত সত্যকে মেনে নিতে পারল না আমার মন। আমি সব কিছু চিরে চিরে বিচার করে দেখলাম। আমার যুক্তিবাদী প্রোটেস্ট্যান্ট ভাবাপন্ন মনে প্রথাগত ও ধর্মগত সত্য সম্পর্কে নানারকমের প্রশ্ন জাগতে লাগল। 

এত সব সত্ত্বেও ফ্রেডারিকার কথাটা ভুলতে পারলাম না কিছুতেই। আর তার জন্যই কাব্যচর্চা করতে লাগলাম আবার। এই কাব্যরসই আমাকে মুক্তি দিল সকল বেদনার হাত থেকে। অন্য সব জার্মান আধুনিক কবিদের মধ্যে ক্লপস্টকের লেখা আমার ভালো লাগত। আর প্রাচীনদের মধ্যে ভালো লাগত হোমার। 

ঘটনাক্রমে আমি দুজন ব্যক্তির সঙ্গে পরিচিত হই যাদের প্রকৃতি আমার ভালো লাগে এবং যাদের জীবনকে আমি গোয়েৎস ও ওয়ার্দার এই দুই রচনার নায়ক হিসাবে মূর্ত করে তুলি। অবশ্য ওয়ার্দারের মধ্যে আমার নিজের গভীর আন্তর্জীবনের ব্যথা-বেদনার অনেকখানি মিশে ছিল। ওয়ার্দার ছিল আমার বন্ধু এবং তার অপ্রাপণীয়া প্রেমিকা লোত্তে যেন ছিল আমারও প্রেমিকা। তবে ওয়ার্দারের মতো আমার প্রেমাবেগ অতখানি ভয়ঙ্কর এবং আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারেনি।

ক্লোসার বলে আমার এক বন্ধু আমার বোনের প্রতি তার প্রেমাসক্তির কথা প্রকাশ করে। আমার বোনকে বিয়ে করতে চায় সে। আমি কিছুটা আশ্চর্য হয়ে যাই তার কথা শুনে। অবশ্য এর কোনও প্রতিবাদও করিনি আমি। 

আমার বন্ধু বাগ্মী মার্ককে দেখেই আমি আমি গোয়েৎস ভন বার্লিশিঞ্জেনের কথা ভাবি। মার্ককে সঙ্গে করে আমি একবার ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে কবনেন্তস-এর পথে রওনা হই। পথে পাই রাইন নদীর উপত্যকায় অবস্থিত অনেক শান্ত সুন্দর সাজানো এক গ্রাম। 

জেরুজালেম নামে একটি ছেলে তার এক বন্ধুর স্ত্রীকে ভালোবাসত। এই ব্যর্থ প্রেমের বেদনাকে জয় করতে পারেনি সে কোনওমতে। তাই সে বাধ্য হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। জেরুজালেমের এই হৃদয়যন্ত্রণা আর মৃত্যুই আমার ওয়ার্দারের পটভূমি রচনা করে। আমি তখন ওয়ার্নারের মধ্য দিয়ে জেরুজালেম ও আমার নিজের ব্যর্থ প্রেমের অনতিক্রম্য বিষাদ ও বেদনাকে এক বাঅয় রূপ দান করি। এক ভ্রান্ত আবেগপ্রবণ যুবকের অপ্রকৃতিস্থ মনের বিচিত্র গতিপ্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলি আমি এই রচনার মধ্যে। ওয়ার্দারের আত্মহত্যার কথা লিখতে গিয়ে আমি নিজেও এই আত্মহত্যার কথা ভাবি এবং যুক্তি দিয়ে তা সমর্থন করি।

‘ওয়ার্দারের দুঃখ’ এই ছোট বইখানি প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তার আবেদন অপরিসীম। ওয়ার্দারের দুঃখ সকল শ্রেণীর নরনারীর মর্মকে স্পর্শ করে বিদীর্ণ করে। 

গোয়েৎস ভন বার্লিশিঞ্জেনকে নিয়ে লেখা নাটকখানিও সে যুগের সত্যকে অনেকখানি প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছিল। 

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

আমার বিভিন্ন রচনা যতই প্রকাশিত হতে লাগল ততই সাড়া পড়ে গেল আমার বন্ধুদের মধ্যে। আমার যেসব পুরনো বন্ধুদের কাছে আগে আমার কত কবিতা ও বিভিন্ন রচনা করে শোনাতাম, তাদের মতামত চাইতাম, তারা তখন ভাবতেই পারেনি সেই সব রচনা একদিন প্রকাশিত হবে ও জনপ্রিয়তা লাভ করবে। 

এই সব দেখে আমার এবং আমার প্রকাশিত সাড়া জাগানো অনেক রচনা পড়ে পুরানো বন্ধুরা যেমন দেখা করতে আসত আমার সঙ্গে তেমনি অনেক সাহিত্যানুরাগী নূতন বন্ধুও জুটল। 

এই সব বন্ধুদের মধ্যে লেস ছিল অন্যতম। সে বড় হাসতে পারত। তার এই পরিহাসরসিকতার জন্য আমার ভালো লাগত তাকে। এই লেৎস একবার তার লেখা একটি কাব্য-নাটক আমাকে দেখাবার জন্য নিয়ে আসে। কাব্য-নাটকটি তার প্রেমাস্পদকে নিয়ে লেখা। সে এক সুন্দরী মহিলাকে ভালোবাসত। কিন্তু মেয়েটির প্রতি আরও কয়েকজন আসক্ত ছিল এবং সে তার সঙ্গে ব্যবহার করে কিছুই বুঝতে পারত 

মহিলাটি তাকে ঠিক ভালোবাসে কিনা। মহিলাটি ছিল খুব খেয়ালী। এক সময় খুব ভালো থাকে, আবার এক সময় খুব রেগে যায়। যাই হোক, তার মিলনাত্মক কাব্য নাটকটি Disodatin বা সৈনিকগণ পড়ে আমার মোটেই ভালো লাগল না। আমি সরাসরি চিঠিতে জানালাম, এর মধ্যে কবিতাই নেই, তুমি এ লাইনের লোক নও। তার থেকে তুমি তোমার অভিজ্ঞতার কথা গদ্যে দিয়ে একটা প্রেমের গল্প খাড়া করার চেষ্টা করো। 

এরপর আমার ‘আয়রন হ্যান্ড’ নাটকটি প্রকাশিত হলে সে তার সমালোচনা করে একখানা চিঠি দিল। আমার প্রতিভার সঙ্গে তার তুলনা করল। যাই হোক, আমি তাকে উৎসাহ দিয়ে চিঠি দিলাম। আসল কথা পেঁৎস কবিতা লিখত, সে ছিল বড় খেয়ালী। কোনও একাগ্রতা ছিল না। তাই দেশের কাব্যাক্যাশে ধূমকেতুর মতো হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে পরক্ষণেই অদৃশ্য হয়ে যায়। 

অথচ আবার অন্য এক বন্ধু ক্লিঙ্গার ছিল কিন্তু লেস-এর ঠিক বিপরীত। সে দৃঢ়চেতা, অধ্যবসায়ী। সেও কবিতা লিখত এবং এখনও টিকে আছে কাব্যের জগতে। সে ছিল রুশোর ভক্ত। তার লম্বা ছিপছিপে চেহারার মধ্যে একটা ব্যক্তিত্ব ছিল। 

এই সময় ল্যাভেটার নামে এক খ্রিস্টান সাধক আমাদের দেশে বেড়াতে আসে। আমার সঙ্গে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়ে ওঠে। আমার বন্ধু ফ্রানিল কিটেনবার্গও একজন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান। এদের দুজনের মধ্যে প্রায় তর্ক-বিতর্ক হতো। আসলে ল্যাভেটার ছিল ভক্ত। তার দেহ-মন দুটোই ছিল খ্রিস্টের উপর সমর্পিত। কিন্তু ফ্রলিন ও আমার দেহ-মনের সমস্ত চেতনা ল্যাভেটারের মতো খ্রিস্টের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল না। খ্রিস্টধর্মের মহিমা আমরা মনে মনে স্বীকার করি। মোট কথা, ভক্তি ও জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য থাকবেই সকল ধর্মসাধনার ক্ষেত্রে। ভক্তির মধ্যে মানুষ চিরকাল তার আবেগ অনুভূতি কল্পনা সব ঢেলে এক সাকার ঈশ্বরকে জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু জ্ঞান সব সময় মানুষকে টেনে নিয়ে যায় নির্বিশেষে নিরাকার ঈশ্বরের দিকে। কারণ বিশুদ্ধ জ্ঞান কখনও কোনও সীমা মানতে চায় না।

ফ্রলিন ভন কিটেনবার্গ ছিল জ্ঞানযোগী। সে নিয়মিত যোগসাধনা করত বলে আমি তার কাছে প্রায়ই যেতাম। যতক্ষণ তার কাছে থাকতাম ততক্ষণ আমার চিত্তের সকল সংক্ষোভ, অন্তরের সমস্ত দ্বন্দ্ব ও আলোড়ন স্তব্ধ হয়ে থাকত তার প্রভাবে। আমি বেশ কিছুক্ষণের জন্য এক পরম আত্মিক প্রশান্তি লাভ করতাম। আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলাম তার শরীর ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে। তবু সে যখন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে জানালার ধারে একটি চেয়ারে বসে আমার কথা অথবা আমার কোনও লেখা শুনত তখন তার দেহগত অসুস্থতার কথা একটুও জানতে পারা যেত না। 

সূর্যাস্তের স্নান আলোয় ফ্রলিনের কাছে বসে থাকতে আমার খুব ভালো লাগত। মনে হতো গোটা পৃথিবীটার রূপ রং সব বদলে গেছে। মনে হতো গোধূলির ছায়াছায়া ধূসরতায় শুধু আমার নয়, পৃথিবীর সব মানুষের সব কামনা-বাসনার দূরন্ত রং মুছে গেছে চিরদিনের মতো। ফ্রলিন প্রায়ই বলত একমাত্র ঈশ্বরই মানুষের বেদনার্ত আত্মাকে চিরশান্তি দান করতে পারেন। এটা ছিল তার পরম বিশ্বাস। এ বিশ্বাসে আমি কখনও আঘাত দিতাম না কোনও ছলে। 

এই সময় মোরাভীয় ধর্মমতের সঙ্গে পরিচিত হই আমি এবং ফ্রলিনের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে আসি। মোরাভীয়রা বলত মানুষের ধর্মজীবন এবং বাস্তব জীবনের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। যে সমাজে শিক্ষকরা হবে শাসক এবং ধর্মযাজক বিচারক সেই সমাজই হবে আদর্শ সমাজ।

আমি একবার যুবরাজের আমন্ত্রণে মেয়ে বেড়াতে যাই। আমার বাবা একদিন অনেক রাজসভায় ঘুরে বেড়ালেও যুবরাজ বা রাজকুমারদের সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করতেন না। ফ্রলিনকে আমি মায়ের মতো জ্ঞান করতাম এবং তাকে আমার ব্যক্তিজীবনের সব কথা বলতাম। কিন্তু সে তখন শয্যাগত থাকায় তার পরামর্শ নেওয়া হলো না। যুবরাজের সঙ্গে আমার একটা বিষয়ে মতপার্থক্য হলো। উনি গ্রিক শিল্পরীতি পছন্দ করেন না। আমার মতে দেহগত শক্তি ও সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ বিকাশই গ্রিক শিল্পকলার লক্ষ্য। এই শিল্পরীতি তাই অসংখ্যক শিল্পীকে যুগ যুগ প্রেরণা যুগিয়ে আসছে। 

আমি বাড়ি ফিরে আসতেই আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে আমাদের সংসারী করার জন্য পরিকল্পনা করেন। আমি কিন্তু এ বিষয়ে তখনও মনস্থির করে উঠতে পারিনি। আমার দুই-একজন বন্ধু আমাকে আমাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে পাকাপাকিভাবে। বসবাস করার জন্য অনুরোধ করে বিশেষভাবে। 

আমাকে আমার কাকা নাগরিক পরিষদ থেকে কৌশলে সরিয়ে দিলেও তখন আমার কাজের অভাব ছিল না। অনেক অফিস এজেন্সিতে আমি চেষ্টা করলেই কাজ পেতাম। এই সময় একটি মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েটি সুন্দরী এবং গৃহনিপুণা। সবদিক দিয়ে আদর্শ স্ত্রী হবার যোগ্য। কিন্তু আমি খেলার ছলে উড়িয়ে দিলাম এ পরিকল্পনাটাকে। 

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

একদিন আমার এক বন্ধু সন্ধের সময় কোনও গানের আসরে যাবার জন্য অনুরোধ করল। মানুষ কোনওভাবে একবার নাম করলেই অনেক বন্ধু জুটে যায়। অনেক জায়গা থেকে অনেক নিমন্ত্রণ আসে। গানের এই আসরটি বসবে কোনও এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে। 

বেরোতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, নির্দিষ্ট সময়ের একটু পরেই বেরিয়ে পড়লাম তাড়াহুড়ো করে। 

কোনও একটি বাড়ির একতলার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম আমরা। ঘরটির আসবাবপত্র সাধারণ ধরনের হলেও ঘরখানি প্রশস্ত। ঘরের মধ্যে লোক ছিল অনেক। ঘরের মাঝখানে একটি পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইবে। 

আমি পিয়ানোর কাছেই বসলাম। মেয়েটি যখন গান শুরু করল আমি তার চেহারা এবং গতিভঙ্গি ভালো করে লক্ষ করলাম। তার চেহারা মোটামুটি সুন্দর। কিন্তু তার সবচেয়ে যেটা ভালো লাগল তা হলো তার প্রতিটি আচরণের মধ্যে শিশুসুলভ এক সরলতা। গান শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সে এগিয়ে এসে আলাপ করল আমার সঙ্গে। আমি বললাম, এটা আমার পক্ষে সৌভাগ্যের কথা যে আপনার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনেই আপনার প্রতিভার সঙ্গেও পরিচিত হলাম। 

আমরা পরস্পরের মুখপানে তাকালাম। কিন্তু আমরা কেউ কথাবার্তায় আবেগের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলাম না। আমাদের আপন আপন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের বাঁধ দিয়ে ঘেরা একটি ব্যবধানকে সাবধানে বজায় রেখে চললাম আমরা। আমার বিদায় নেবার সময় মেয়েটির মা ও সে নিজে আমাকে শীঘ্রই আর একবার তাদের বাড়ি যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। 

আমিও সুযোগ পেলেই মাঝে মাঝে তাদের বাড়ি যেতাম। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে আনন্দ পেতাম। তার মধ্যে আমার এক মনমতো সঙ্গিনীকে খুঁজে পেলাম। 

এই সময় বাবার সঙ্গে আমার অনেকদিন পর মতবিরোধ হলো। 

জীবন সম্বন্ধে আমার উন্মার্গগামী দৃষ্টিভঙ্গি মোটেই ভালো লাগত না আমার বাবার। আমি সব সময় মানুষের মধ্যে যে বৃহত্তর জীবনাদর্শনের সন্ধান করে যেতাম তা কখনও কার মধ্যে খুঁজে পেতাম না। ফলে সব মানুষেরই অপূর্ণ বলে মনে হতো আমার। যারা সৎ, তারা সাধারণত ধার্মিক হয়, তারা কাজের লোক হতে পারে না। আর যারা কর্মঠ, যারা কাজের লোক, তারা বিজ্ঞতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারে না। 

আমার অন্যতম পুরনো বন্ধু জং স্টিলিং ছিল চোখের ডাক্তার। আমাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের হের ভন লার্সেনার নামে এক ধনী বয়স্ক ভদ্রলোকের দুটি চোখই খারাপ হয়ে যায়। তিনি প্রায় অন্ধ হয়ে যান। এদিকে তখন স্টিলিং চোখের ছানি অপারেশনের দ্বারা নাম করেছিল। চোখ অপারেশনে তার হাত এত ভালো যে প্রায় সব ক্ষেত্রেই সফল হয়। লার্সেনারকে শহরের ডাক্তাররা পরামর্শ দেন স্টিলিং-এর কাছে অপারেশন করতে। 

সুতরাং স্টিলিংকে আসতে বলা হয় এবং ঠিক হয় সে এলে আমাদের বাড়িতে উঠবে। সে আসবে জেনে আমার বাবা-মাও খুশি হন। 

যথাসময়ে স্টিলিং এসে অপারেশন করল লার্সেনারের দুটি চোখ। কিন্তু অপারেশন শেষ করার পর স্টিলিং কিন্তু খুশি হতে পারল না। সে বলল, দুটি চোখ একসঙ্গে অপারেশন করা উচিত হয়নি তার, যদিও লার্সেনার ও তার লোকজনরা তাকে তাই করতে বলেছিল। এর আগে যে স্টিলিং প্রায় একশোটি ক্ষেত্রে সফল হয়েছে, এই স্টিলিং লার্সেনারের ক্ষেত্রে সাফল্যের আশ্বাস দিতে পারল না। অথচ সফল হলে লার্সেনারের কাছ থেকে পেত প্রচুর টাকা। সে অনেক কিছু আশা করেছিল। স্টিলিং আমার কাছে স্পষ্ট স্বীকার করল, অপারেশন ভালো হয়নি। সে নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি।

স্টিলিং স্বভাবত ছিল নীতিবাদী এবং ধর্ম প্রবণ। সে ভালোবাসা তার সহানুভূতিসূচক পরিবেশ ছাড়া টিকতে পারত না। সে কোথাও কোনো মানুষের কাছে। আন্তরিকতা না পেলে তাকেই মোইে সহ্য করতে পারত না। বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে একই সঙ্গে সমন্বয় করে চলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল স্টিলিং-এর। সে একই সঙ্গে ছিল বর্তমানে স্থির ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আর সে ছিল ভবিষ্যত্মখী ও আশাবাদী। 

তবে স্টিলিং-এর একটা জিনিস আমার পছন্দ হতো না। সে তার জীবনের সব ব্যর্থতা ও সফলতাকে ঈশ্বরের বিচার হিসাবে ব্যাখ্যা করত। কোনও কাজে সফল হলে বলত ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে সফল হয়েছে। আবার কোনও কাজে ব্যর্থ হলে বলত তার কোনও ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য ঈশ্বর তিরস্কার করেছেন। এই ব্যর্থতার মাধ্যমে। আমি তার একথা শুনতাম। কিন্তু কোনও মন্তব্য করতাম না। কোনও উৎসাহ দিতাম না। যাই হোক, এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে অতিশয় আঘাত পেয়েছিল সে মনে। সে হতাশায় ভেঙে পড়েছিল ভীষণভাবে। সে বলত টাকা এবং নাম-যশ দুটির থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হলো সে। এইভাবে ভগ্নহৃদয়ে বিদায় নিল সে আমাদের কাছ থেকে। 

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

সেদিনের সেই গানের আসরে যে মেয়েটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল সেই লিলি স্কোরেন নামে মেয়েটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ধীরে ধীরে আলাপ-পরিচয়ের সব স্তর অতিক্রম করে প্রণয়ে পরিণত হলো। প্রায়ই সন্ধ্যার সময় আমি তাদের বাড়িতে যেতাম। সে আমাকে একে একে তার নিজের ও পরিবারের অনেক কথা অনেক কাহিনী বলতে থাকে। সে বলে তার মধ্যে আমাকে আকর্ষণ করার একটা ক্ষমতা আছে। কিন্তু এবার সে হার মানতে বাধ্য হয়েছে। কারণ সে আমার দ্বারাও কম আকৃষ্ট হয়নি। এর আগে সে যেমন অপরকে আকর্ষণ করতে তেমনি কেউ তার কাছে এলে স্বচ্ছন্দে তাকে এড়িয়ে যেতেও পারত। কিন্তু এবার সে নাকি জল হয়ে পড়েছে আমার কাছে। 

লিলি সাধারণত আমার কাছে সাদাসিধে পোশাক পরে আসত। কিন্তু তাকে নিয়ে কোনও নাচগানের আসরে যেতাম তখন সে রীতিমতো জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরত। অনেক গহনা পরত। কিন্তু সেই সব জমকালো পোশাক ও মূল্যবান অলঙ্কারের উজ্জ্বলতার মধ্যে আমি যেন সেই একই লিলিকে দেখতাম। দেখতে দেখতে তার সেই পোশাক ও অলঙ্কারের উজ্জ্বলতা উবে যেত আর তার চেহারাটা অনাবৃত হয়ে উঠত আমার চোখের সামনে এক অকপট স্পষ্টতায়। তার সেই স্ফীত বুকের রহস্য কতবার অনাবৃত করে দিয়েছে আমার কাছে সেই বুক একই ভাবে আছে। যে অধরোষ্ঠ কতবার চুম্বন করেছি সেই অধরোষ্ঠের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই দৃষ্টি সেই হাসি সব ঠিক আছে। 

আমি আমার কাব্যচর্চা করে গেলেও লিলির সংস্পর্শে আসার পর কিছু গান লিখেছিলাম। এ গান কেউ শুনলে বা গাইলে বেশ বুঝতে পারতাম লিলির সঙ্গে কাটানো আমার সেই আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তগুলো কিভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে এই সব গানের মধ্যে। 

শীতের পর বসন্ত এল। কিন্তু এ বসন্তকে শহরে থেকে গ্রামাঞ্চলেই অনুভব ও উপভোগ করা যায় বেশি। কোনও নদীর ধারে ফাঁকা মাঠে কোনো নির্জন ফুলের বনে এ বসন্তের মায়াময় আবেগ সারা দেহমনে উপভোগ করা যায়। বিশেষ করে বসন্তের এই মনোরম গ্রাম্য পরিবেশ কোনও নূতন প্রেমসম্পর্কের পক্ষে খুবই অনুকূল। 

আমি সাধারণত সকালের দিকটা কাব্যচর্চা বা লেখালেখির কাজ করতাম। দুপুরের দিকটায় আমাদের বাড়ির কাজ অর্থাৎ বাসার কোনও কাজের কথা বললে করে দিতাম। বাবা সাধারণত বিষয়-সম্পত্তির বা আইনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে পরামর্শ করে উনি নিজেই সব কাজ করতেন। ওঁর নিজের আইনজ্ঞান ছিল। তাছাড়া বিভিন্ন লোককে আইনের পরামর্শ দেবার জন্য উনি ওঁর অধীনে কিছু উকিলকে রেখে দিয়েছিলেন। তাদের দিয়েই দরকার হলে কাগজপত্র সই করাতেন। আমি বেড়াতে যেতাম বিকালে এবং আমার আমোদ-প্রমোদের ব্যাপারগুলো সন্ধের দিকেই সারতাম। 

এই সময় জন আঁদ্রে নামে আর একজন সঙ্গীতসাধকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় যে গানকে ভালোবাসত এবং যাকে আমি গান লিখে দিতাম। সে আমার গান সুর সহযোগে গেয়ে শোনাত। একই সঙ্গে এইভাবে গান ও কবিতার রস উপভোগ করতাম। 

কুমারী ডেলফ নামে একটি মেয়ে লিলিদের বাড়ি যাতায়াত করত। লিলির মা তাকে ভালোবাসত। ডেলফ লিলির সঙ্গে আমার প্রেম সম্পর্কের কথা জানত। একদিন সে লিলির মার কাছ থেকে আমাদের বিয়ের অনুমতিসহ লিলিকে নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে বলে, নাও, পরস্পরে হাতে হাত দাও।

আমি অবাক হয়ে গেলাম। মনে হলো ডেলফ যেন এক অসাধ্য অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে তুলেছে। সে আমদের বাড়ির মতও নিয়েছে। 

যাই হোক, আমরা দুজনেই হাতে হাত রাখলাম। পরে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলাম। সঙ্গে সঙ্গে লিলির রূপটা আরও সম্পূর্ণ হয়ে উঠল আমার চোখে। সে এমনিতেই দেখতে সুন্দরী ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা সব ঠিক হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো হঠাৎ সে যেন আগের থেকে অনেক বেশি সুন্দরী হয়ে উঠেছে। তখন থেকে তার দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রতঙ্গ, তার মনের সব সুষমা আমার, শুধু একান্তভাবে আমার। 

লোকে বলে মানুষ নাকি তার আকাঙ্ক্ষিত সুখ বা উন্নতির সর্বোচ্চ চূড়ায় বেশিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না স্থিরভাবে। বিয়ের ব্যাপারে আমাদের ও লিলিদের বাড়ির সম্মতি পেয়ে আমরা দুজনেই যেন হাতে চাঁদ পেয়েছিলাম। কিন্তু আবেগের উন্মাদনার একটা দিক তলিয়ে দেখিনি। সেটা হলো আর্থিক দিক। 

আমি বেশ বুঝতে পারলাম বাবা এ বিয়েতে কোনওরকমে মত দিলেও তিনি মনেপ্রাণে এ প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ তিনি পুত্রবধূ হিসাবে চেয়েছিলেন আরও অভিজাত বাড়ির মেয়ে। সুতরাং তিনি আমাকে এ বিয়ের জন্য আর্থিক সাহায্য নাও করতে পারেন। আমি তখন স্বাধীনভাবে অর্থ উপার্জনের কথা ভাবলাম। চাকরির চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু ব্যাপারটা যত সহজ ভেবেছিলাম কার্যক্ষেত্রে ততটা সহজ বলে মনে হলো না। 

আমি অনেকটা দমে গেলাম। এদিকে আমার বোনের বিয়েটা সেই ক্লোজারের সঙ্গে হয়ে গেল। কিন্তু আমার বোন আমাকে বার বার লিলিকে বিয়ে করতে নিষেধ করল। কেন তা জানি না। 

কেন জানি না লিলির সঙ্গে আমার বিয়েতে কোনও পক্ষের অমত না থাকলে দুটি পরিবারের মধ্যে যাওয়া-আসা বা কোনওরকম ঘনিষ্ঠতা হলো না। 

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

লিলির ব্যাপারে আমার বোনের আপত্তির কারণ হলো দুটি পরিবারের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে বিরাট তারতম্য। আমার বোন স্পষ্ট করে আমায় বলল, তুমি কি ভেবেছ। তুমি লিলিকে বিয়ে করে এনে আমাদের পুরনো বাড়িটার একটা ঘরে ভরে রেখে দেবে? সে আধুনিক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত নয়। সে আমাদের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের ঠিকমতো অভ্যর্থনা জানাতে পারবে না। 

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম শুধু আমার বোনের কথাগুলো। কিন্তু কোনও কথা বললাম না। তাকে শুধু বললাম, এখন কিছু বলতে পারছি না। তবে তোমার কথা মনে থাকবে। 

আমি সুইজারল্যান্ডে বেড়াতে গেলাম কিছুদিনের জন্য। জুরিখে গিয়ে দেখা করলাম ল্যাভেটারের সঙ্গে। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সাদর অভ্যর্থনা জানাল ল্যাভেটার। দারুণ খুশি হলো। তার স্ত্রীকেও বেশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ মহিলা বলে মনে হলো। মনে হলো ভদ্রমহিলা সব বিষয়েই সমর্থন করে চলে তার স্বামীকে। দুজনের কী অদ্ভুত মিল। 

সমগ্র সুইজারল্যান্ডের মধ্যে আমার সবচেয়ে ভালো লাগল রাইনের জলপ্রপাত। এটি হচ্ছে শাকসেন পার্বত্য অঞ্চলে। তারপর যে জিনিসটি ভালো লাগল আমার তা হলো জুরিখের লেক। এই দুটি দৃশ্যই আমি জীবনে কখনও ভুলব না। 

আমি ল্যাভেটারকে তার দেহতত্ত্বের গবেষণার কাজ সম্বন্ধে খবর জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, কাজটা এখনও শেষ হয়নি। তবে তার প্রায় অর্ধেক লেখা ছাপা হয়ে গেছে। এতে যে সব তথ্য ও তত্ত্ব লেখা আছে তা সবই তার অভিজ্ঞতালব্ধ। 

রাইনের নিম্ন উপত্যকা ধরে আমি ল্যাভেটারদের সঙ্গে নূতন করে যাত্রা শুরু করলাম। আমার ভ্রমণ তখন শুরু হয়েছে সবেমাত্র। দেখলাম ল্যাভেটারের গবেষণার কাজের সত্যিই বেশ প্রচার হয়েছে। ও যেখানেই যাচ্ছিল বহু লোক ওকে দেখতে ও ওর সঙ্গে আলাপ করতে আসছিল। অনেক বিদেশী ভ্রমণকারীও ওর নাম শুনেছে। লোকের ভিড় দেখে ল্যাভেটার নিজেও বিবৃত হচ্ছিল। 

আমরা মানুষের ভিড় এড়িয়ে জনপথ থেকে দূরে চলে গেলাম খাঁটি পর্বতের রাজ্যে। গোলোকধাঁধার মতো কত প্রায়ান্ধকার গিরিপথ, কত সুদৃশ্য পর্বতশৃঙ্গ যার উপরে মেঘের উপর মেঘ জমেছে। তুষার আর কুয়াশা জমে আছে যাদের গায়ে। আবার এক এক জায়গায় পথের দুধারে দাঁড়িয়ে আছে খাড়াই পাহাড়। ঠিক যেন রঙ্গ মঞ্চের দৃশ্যপটে আঁকা। এ পাহাড় যুগ যুগ ধরে স্থাণুর মতো অচল অটলভাবে এই। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সুখদুঃখের যে তরঙ্গ মানুষের জীবনকে ক্রমাগত অসহায়ভাবে দোলাচ্ছে সে তরঙ্গ ওদের কাছে যেতে পারে না। ওদের স্পর্শ করতে পারে না। 

পাহাড়ের রাজ্যে অনেক ঘোরাফেরার পর আমরা সেই পার্বত্য প্রদেশে এক তীর্থস্থান দর্শন করলাম। সেটা হলো মেরিয়া আইনসীভাইন চার্চ। চার্চটি এক উঁচু পাহাড়ের উপর। সে পাহাড়ে উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে উঠলাম আমরা। তারপর অতিকষ্টে গিয়ে দেখলাম ডেভিল স্টোন বা শয়তানের পাথর। 

আমার আমরা সমতলে ফিরে এলাম। আবার সেই উদার উন্মুক্ত প্রান্তর আর কুয়াশাঢাকা হ্রদ। আমরা অনেক পথ পার হয় অনেক ওঠানামা করে অবশেষে নিশ্চিন্ত। ও পরিপূর্ণ বিশ্রামের আশায় সেন্ট গথার্ড হসপিনে এসে উঠলাম। এখানে এক ফাদার আমাদের ইতালি যাবার কথা বললেন। কিন্তু জার্মানি ফিরে যাবারই মনস্থ করলাম। 

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াবার সময় আমি একটি কবিতায় লিখেছিলাম, আমি তোমার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি লিলি, কিন্তু না, আমি তোমার বন্ধনে আজও আবদ্ধ আছি। আমি একের পর এক বন, পাহাড় আর উপত্যকা পার হয়ে চলেছি, কিন্তু যেখানেই যাচ্ছি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারছি না। তুমি দেখছি সব সময় আমার সঙ্গেই আছ। 

বাড়ি ফিরে তাই আমি লিলির সঙ্গে দেখা না করে পারলাম না। আমি কিন্তু বাড়ি গিয়ে শুনলাম লিলিকে আমার অনুপস্থিতিকালে বোঝানো হয়েছে আসল ব্যাপারটা। বোঝানো হয়েছে আমার আশা তাকে ত্যাগ করতেই হবে। এ বিচ্ছেদ অনিবার্য। তার উত্তরে লিলি নাকি তাদের বলেছ সে আমার জন্য আমার সঙ্গে তার সবকিছু ছেড়ে, বাড়িঘর দেশ আত্মীয়-স্বজন সব ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পার। 

লিলির জন্য আমিও তা পারি। কিন্তু আমি পরক্ষণেই অন্য কথা ভাবলাম। ভাবলাম, আমার বাবার এই সুন্দর সাজানো বাড়ি, এত সব বিষয়-সম্পত্তি, এই নিশ্চিন্ত আরামঘন জীবনযাত্রা, সবকিছু ত্যাগ করে অজানা দূরদেশে গিয়ে নিশ্চিত জীবনযাত্রার মধ্যে নিজেকে ঠেলে দেওয়ার কোনও অর্থই হতে পারে না। সুতরাং লিলির এ প্রস্তাবে আমি সাড়া দিতে পারলাম না। তার প্রতি আমার ভালোবাসার কোনও ফাঁকি না থাকলেও আমি তা পারলাম না। 

এই সময় এগমঁত নাটকটি লেখা শুরু করি। আয়রন হ্যান্ড’-এ যেমন নেদারল্যান্ডবাসীদের বিদ্রোহের ঘটনাকে রূপদান করেছি, তেমনি এ নাটকের বিষয়বস্তুও রাজনৈতিক। এতে দেখাতে চেয়েছি, কোনো স্বৈরাচারী দুর্ধর্ষ শাসকের কাছে গণতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা বা অধিকারের কোনও মূল্য নেই। এই নাটকে আমি আবার আমার প্রতিহত প্রেমাবেগকেও বাণীরূপ দান করলাম। 

এইভাবে লিলির কাছ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমি বাড়ির মধ্যে স্বেচ্ছানির্বাসন গ্রহণ করলাম। একমনে এগমঁত নাটক লিখে যেতে পারলাম। এই সময় ওয়েগনারের কাউন্টের কাছ থেকে নিমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে আবার মনস্থ করি। কিন্তু যথাসময়ে কাউন্টের দূত না আসায় আমি ইতালি চলে যাওয়াই স্থির করি। 

ইতালি যাবার পরে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে গেল ডেলফের সঙ্গে। দেখা হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল লিলির কথা। যাকে এড়িয়ে দূরে পালিয়ে যাচ্ছি সে যেন আমার সামনে অন্যের রূপ ধরে এসে দাঁড়াল। ডেলফ আমায় অনেক করে বুঝিয়ে বলল। আমার সংসারজীবন সম্পর্কে তার পরিকল্পনার কথা বলল। কিন্তু আমার মনে কোনওরূপ সাড়া জাগাতে পারল না সে কথা। কেমন যেন বৈরাগ্যে ধূসর হয়ে গেছে আমার সে মন। আমার প্রতিহত প্রেমাবেগ এক ভয়ঙ্কর শূন্যতায় আবর্তিত হতে লাগল যেন। গ্রেচেন, ফ্রেডারিক, লিলি–এদের সকলের মধ্যে সেই এক নারী, এক প্রেম ভিন্ন ভিন্ন মূর্তি ধরে এসেছে আমার কাছে, কিন্তু কোনও না কোনও কারণে তারা চলে যেতে বাধ্য হয়েছে আমার কাছ থেকে। আমি এবার সম্পূর্ণরূপ মুক্ত সব মোহ থেকে। আমি এখন তাদের আর কাউকেই চাই না।

হোটেল থেকে ইতালির পথে আবার যাত্রা শুরু করব এমন সময় ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে লোক এল। একটি চিঠি দিল। ওয়েগনারের কাউন্টের লোকের আসতে কেন দেরি হয়েছে তার কারণ তাতে সবিস্তারে লেখা আছে। কাউন্টের অনুরোধ ফিরে যেতে হবে। অগত্যা আবার জার্মানির পথ ধরলাম। 

পথ ভাবতে লাগলাম, আমি কোথায় চলেছি তা আমি জানি না। শৈশব থেকে বাল্যে, বাল্য থেকে যৌবনে আমার সারাজীবন ধরে আমি কী খুঁজে চলেছি। পাহাড়ে প্রান্তরে, জলে-স্থলে, সুন্দর-অসুন্দরে, রূপে-অরূপে, ইন্দ্রিয়ে ও অতীন্দ্রিয়ের মাঝে কী খুঁজেছি আমি? যা খুঁজেছি তা কি আমি পেয়েছি কোনওদিন? তা কি কেউ পায়? 

গাড়ি এড়িয়ে চলেছে। চালকের হাতে লাগাম ধরা। আমার মনে হলো, কোনও এক অদৃশ্য দেবতার দ্বারা প্রহৃত হতে হতে অবিরাম কালের অশ্ব ছুটে চলেছে সারা বিশ্বজীবনের বিপুলতায়তন বেগভার নিয়ে। সেই আশ্চর্য অশ্বের লাগাম ধরার শক্তি সবার নেই। হয়তো কোনও মানুষেরই নেই। তবু মানুষের মতো বাঁচতে হলে সে লাগামটা শক্ত মুঠিতে ধরে রাখতেই হবে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *