2 of 3

০৫৯. বাড়ির প্ল্যান পাল্টাতে হল

বাড়ির প্ল্যান পাল্টাতে হল মণীশকে, অপর্ণা পরিষ্কার বলল, তুমি যাকে দিয়ে প্ল্যান করিয়েছে সে বড়লোকদের প্ল্যানার। আমাদের মত মধ্যবিত্তের জন্য নয়। নিশ্চয়ই একগাদা টাকা নিয়েছে।

মণীশ খুব অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে বলল, না, তেমন কিছু নয়।

অপর্ণা ম্লান একটু হেসে বলল, শুনতে চাই না। শুনলে আমার মন খারাপ হবে। শোনো, তোমার রক্ত জল-করা টাকা ওভাবে ওড়াতে নেই। টাকা আমাদের কাছে সস্তা নয়। আমি অন্য প্ল্যানারকে দিয়ে প্ল্যান করিয়ে নিচ্ছি। তুমি আর বাড়ি নিয়ে মাথা ঘামাবে না।

মণীশ লজ্জার সঙ্গে বলল, লেকটা আমার বন্ধু। ও আবার প্ল্যান করে দেবে। আর ফি দিতে হবে না। কথা হয়ে আছে, প্ল্যান অলটার করলে আর বাড়তি কিছু লাগবে না।

তাহলে শোনো, আমি অনেকদিন আগে থেকেই বাড়ির একটা রাফ স্কেচ করে রেখেছি। খুব ভেবেচিন্তে, আমাদের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখেই করেছি। সেটা ওই ভদ্ৰলোককে দিও। উনি ওটা দেখে প্ল্যান করে দেবেন।

অপর্ণা বাস্তবিকই তার কাঁচা হাতে সাদা কাগজে প্ল্যান করেছে। একটা নয়, একাধিক। দুপুরে বা বিন্দ্রি রাতে সে ভেবে ভেবে ঘর বারান্দা সিঁড়ি এঁকেছে। এ তার স্বপ্নের বাড়ি। খুব বড় নয়। ছোট মিষ্টি একখানা, দোতলা, বাগানঘেরা, চটকদার নয়, কিন্তু ছিমছাম। কী রঙ হবে তাও ভেবে রেখেছে। সেই আঁকা কাগজ সে মণীশের হাতে দিয়ে বলল, ঠিক এরকম হবে। মনে রেখো। ঘর আর বারান্দার মাপও দিয়ে দিয়েছি।

মণীশ একটু কাচুমাচু হয়ে বলে, দত্ত একটা কথা বলছিল। আধুনিক কনসেপশন হচ্ছে ছাদে সোলার প্যানেল লাগিয়ে নেওয়া।

সোলার প্যানেল! বলে চোখ কপালে তোলে অপর্ণা, কী হবে সোলার প্যানেল দিয়ে?

ঘরদোর শীতকালে গরম করা যাবে, গরম জলের অভাব হবে না।

অপৰ্ণা আকুল হয়ে বলে, কী মানুষ বলে তো তুমি! বাচ্চা ছেলে নাকি? এটা কি সাহেবদের দেশ যে ঘর গরম করতে হবে। এ শহরে বছরের মধ্যে নয় মাসই তো গরম। আর গরম জল আমাদের কোন কাজে লাগবে? তোমাকে নিয়ে যে আর পারি না।

মণীশ একটু গম্ভীরভাবে কাগজগুলো দেখে নিয়ে তার অ্যাটাচি কেসে ভরে যখন রওনা হচ্ছিল তখন অপর্ণার বড় কষ্ট হল মণীশের জন্য। বাচ্চা ছেলের হাত থেকে খেলনা কেড়ে নিলে তার যেমন অভিমানী মুখ হয় মণীশের মুখের অবস্থা ঠিক তেমনি। অপর্ণা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। দুহাতে মণীশকে জড়িয়ে ধরে বলল, রাগ করোনি তো!

মণীশ হাসল, বলল, না। তুমি এ্যাকটিক্যাল আর আমি ড্রিমার। তুমিই ঠিক কথা বলছো। আমি শুধু ভাবি, ড্রিমারদের দিয়ে দুনিয়ার কিছুই বোধ হয় হয় না।

ওভাবে বলো না। স্বপ্ন কি আমিও দেখি না! তোমার মতোই দেখি। কিন্তু মাটিতে পা রেখে। তুমি যে পাখনা মেলে উড়ে যাও কল্পনার রাজ্যে! দুঃখ পাওনি তো!

না। তোমার কথায় দুঃখ পাবো কেন অপু? তুমি তো বরাবর আমাকে তোমার সবটুকু দিয়ে আড়াল করে রাখতে চেয়েছে।

আজকাল তোমাকে বড় ভয় পাই। একটুতেই অভিমান করে যে!

মণীশ পুব ফ্যাকাসে একটু হেসে বলে, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কি তাহলে ফর্মাল হয়ে যাচ্ছে অপু যদি বেশী মন বুঝে চলতে শুরু করে তাহলে যে আমি আর আমার আগের পাগলি, সোহাগী, ডমিনেটিং অপুকে খুঁজে পাবো না।

অপর্ণা দুহাতে মণীশের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, আমি বুঝি বদলেছি? তুমিই তো বড্ড গোমড়া মুখ করে থাকো।

আমার মুখ গোমড়া করে দাও কেন? আমি তো হাসিখুশিই থাকতে চাই।

অপর্ণা অবাক হয়ে বলে, আমি মুখ গোমড়া করে দিই? ওমা! বলে কী রে?

মণীশ তার অ্যাটাচি খুলে অপর্ণার আঁকা স্কেচগুলো বের করে বলল, দেখ অপু, একতলার ডিজাইনে তুমি একা হলঘর এঁকেছে। এক কোণে ছোট্ট করে লিখেছে ব্যাঙ্ক অর অফিস। কেন লিখেছে অপুএকতলাটা ভাড়া দিতে চাও?

অপর্ণার দুটি হাতই মণীশের গলা জড়িয়ে ধরে ছিল। হাত দুটি এ কথায় হঠাৎ শিথিল হয়ে গেল। একটু বিবর্ণ হয়ে সে বলল, ওঃ, ওটা এমনিই লিখেছিলাম। ভাবছিলাম একটু বড়ই তো হচ্ছে বাড়িটা। আমরা কজনই বা লোক বলে! মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাবে, বা কোথায় চাকরি করতে চলে যাবে হয়তো। তখন বুড়োবুড়ি কি করে থাকব। বরং একতলায় একটা ব্যাংক বা অপিস থাকলে ততটা ফাঁকা লাগবে না।

মণীশ হাসল না। মৃদু স্বরে বলল, তাই বুঝি অপু?

হ্যাঁ গো, বিশ্বাস করো।

তুমি কিন্তু বরাবর বলে এসেছে, বাড়ি করলে কখনও সে বাড়িতে ভাড়াটে রাখবে না।

আহা, এ তো আর ফ্যামিলি ভাড়াটে নয়। অফিস বা ব্যাংক তো দশটা-পাঁচটা। তারপর তো আর ঝামেলা থাকবে না। কন্ট্রাক্ট থাকবে। দুচার বছর পর তুলে দিতে পারা যাবে।

জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে মণীশ খুব মৃদুস্বরে বলল, আমি ভাবলাম বুঝি তুমি ভবিষ্যতে একটা আয়ের পথ খোলা রাখলে। হয়তো ধরেই নিয়েছে, আমি আর বেশি দিন নয়। তাই কি এইসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, অপু?

অপর্ণা এত কঠোর ও নগ্ন সত্যকে স্বীকার করে কি করে? সে কৃতকৰ্মকে চাপা দেওয়ার জন্যই যেন আরও আবেগে জড়িয়ে ধরে মণীশকে। মণীশের ইস্ত্ৰি-করা শার্টের কলার দুমড়ে যায়। অপর্ণা বলে, কি করে এমন কথা ভাবতে পারো তুমি? কি করে ভাবো?

আমি তোমার দূরদৃষ্টির প্রশংসাই তো করছি অপু!

না, তুমি সন্দেহ-বাতিকে ভুগছে। সবসময়ে সন্দেহ করছে যে, আমরা তোমাকে খরচের খাতায় ধরে নিয়েছি।

মণীশ একটু হাঁফিয়ে পড়ছিল। ধীরে সে অপর্ণার বাহুপাশ আলগা করে চেয়ারে বসল অবসনের মতো। বলল, একটু জল দাও। ঠাণ্ডা জল।

উদ্বিগ্ন অপর্ণা দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজের জল নিয়ে এল, তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?

মণীশ মাথা নেড়ে বলে, না। মাঝে মাঝে একটু হাফ ধরে যায়। হাৰ্ট একটা ভীষণ জরুরি জিনিস। তাকে বেশী উত্তেজিত করতে নেই।

দাও, প্ল্যানটা আমি এখনই ছিঁড়ে ফেলছি।

না অপু, থাক। আমার মনে হচ্ছে, তুমি ঠিকই করেছে। ও বাড়িতে আমাদের ফাঁকাই লাগবে।

আচ্ছা, আর এত রাগ করতে হবে না। নিচের তলাটা আমরা একটা হলঘরই রাখব। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে, পাড়ার ওয়ার্কিং মায়েদের বাচ্চাদের জন্য একটা ক্রেশ করি। কলকাতায় ভাল ক্ৰেশ নেই। আমি একটা কিছু নিয়ে থাকতে চাই। দেবে করতে?

মণীশ একটা গভীর শ্বাস ছেড়ে বলে, কোনো অপু।

হ্যাঁ গো, সত্যিই শরীর খারাপ লাগছে না তো! আজ তাহলে অফিস গিয়ে কাজ নেই।

মণীশ বলল, আজ জরুরি কাজ আছে অফিসে। যেতে হবে। শরীর ঠিক আছে অপু। তবে মনে হয়, আমার একটু চেঞ্জ দরকার ছিল।

তাহলে চলো না, পুরী থেকে কয়েকদিন ঘুরে আসবে।

মণীশ ম্লান হেসে মাথা নেড়ে বলে, অনেক কামাই হয়েছে অপু। আর ছুটি নেওয়া যায় না। কাজও অনেক জমে গেছে।

এই বলে মুখের বিবৰ্ণতাটুকু নিয়েই বেরিয়ে গেল মণীশ। পিছনে একা ঘরে কেমন বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল অপর্ণা। চোখ ভরে আসছে জলে। এ কান্নাকে থামানো যাবে না কিছুতেই। তার এখন কান্নাই দরকার। মণীশ কেন সব বুঝতে পারে। তার মনের কথা, তার ভবিষ্যতের গোপন চিন্তা, সবই যে ধরা পড়ে যাচ্ছে মণীশের কাছে! অথচ সে তো চায় মণীশ আরও একশো বা হাজার বছর বেঁচে থাকুক। সে কি তা চায় না। অবশ্যই চায়। আবার এও সত্য, সে বাস্তববাদী, সে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্না। ভাবাবেগে ভেসে যেতে নেই, বেশী বিস্তার করা উচিত নয় কল্পনার পাখা। সে তাই একতলাটা ভাড়া দেওয়ার কথা ভেবে রেখেছিল। কোনও দোষ হয়নি তাতে। অথচ মণীশ কত কী ভেবে নিল হয়তো।

এক একটা দিন যেন পাষাণভার নিয়ে আসে। সারাটা দিন যেন দমচাপা, পাগল-পাগল, বিচ্ছিরি। আজকের দিনটা কিরকম যে যাবে, কে জানে! এরকম সব বিচ্ছিরি দিনে মাঝে মাঝে অপর্ণার ইচ্ছে করে কেরোসিনে স্নান করে একটা দেশলাই কাঠি ঘষে দেয় শরীরে।

এক বুক ভালবাসা আছে বলেই না এত জ্বালা! যাদের সে ভালবাসে না, তাদের জন্য তো জ্বালা-যন্ত্রণা নেই, উদ্বেগ নেই, অশান্তি নেই। কিন্তু যাদের ভালবাসে তাদের জন্যই সবসময়ে বুক দুরু-দুরু, তাদের মুখ একটুখানি হাস্যহীন দেখলেই বুক ফাঁকা লাগে। তাহলে ভালবাসার এত গুণগান করে কেন লোকে? ওই যে ফ্যাকাসে মুখখানা নিয়ে বেরিয়ে গেল মণীশ, এখন সেই মুখখানা সারাদিন চোখের সামনে আসবে, আর জ্বালাতন হবে সে। তার পাগল স্বামী তাকে একদিন বলেছে, পঁচিশ হাজার বছর বেঁচে থাকলে তারা নাকি আর পরস্পরকে ভালবাসতে পারত না। মণীশ পারত কিনা কে জানে। কিন্তু অপর্ণা পারত। খুব পারত। ভাগ্যিস পঁচিশ হাজার বছর তাদের বাঁচতে হবে না। হলে পঁচিশ হাজার বছর ধরে সহ্য করতে হত এই উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা। এই কয়েক বছরেই পঁচিশ হাজার বছরের অভিজ্ঞতা হয়ে গেল বোধ হয় তার।

বিকেলে শুকনো মুখে মেয়েটা ফিরল।

অপর্ণা বলল, কি রে, মুখ শুকনো কেন?

ঝুমকি বড় শান্ত বিবেচক মেয়ে। একটু চুপচাপ আপনমনে থাকতে ভালবাসে। বলল, দেখ না মা, ওরা মোটে তিন শশা টাকা মাইনে দেবে বলছে।

অপর্ণা উত্তষ্ঠ হয়ে বলল, ওরা কারা? অমন অর্ধেক করে কথা বলিস কেন?

একটা কম্পিউটার ফার্ম।

তিনশো টাকা মাত্ৰ!

তিনশো টাকাতেই লোক পেয়ে যাবে।

অপর্ণা মেয়ের দিকে চেয়ে থেকে বলল, তুই ও চাকরি করবি?

ভাবছিলাম চাকরিটা ভাল না হলেও এক্সপেরিয়েন্স তো হবে।

চারুশীলার ভাই যে তোকে চাকরি দেবে বলেছিল, তার কী হল।

ঝুমকি মায়ের দিকে চেয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ওসব কথার কোনও দাম নেই। লোকটার বোধ হয় আমার কথা মনেই নেই। তাছাড়া হেমাঙ্গবাবুর এখন রোমান্টিক পিরিয়ড চলছে। এসব ছোটখাটো প্রবলেম নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।

অপর্ণা সামান্য স্ক্যান্ডালের আভাস পেয়ে বলল, রোমান্টিক পিরিয়ড? কার সঙ্গে?

বিলেত-ফেরত দারুণ সুন্দরী একটা মেয়ের সঙ্গে। রশ্মি রায় শুনতে পাচ্ছি বিয়ের পর দুজনেই বিলেতে চলে যাবে।

শোনো ঝুমকি, তোমাকে আর চাকরি চাকরি করে হন্যে হতে হবে না। চেহারাটা দিন-দিন যা হচ্ছে। কষ্ঠার হার বেরিয়ে গেছে, মুখ শুকিয়ে এতটুকু। এখন কয়েকদিন বাড়িতে বসে বিশ্রাম নাও। তোমার রেস্ট দরকার। যদি ভাল কোনও চাকরি পাও তখন দেখা যাবে।

ঝুমকি মায়ের দিকে একটা আনমনা দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ বলল, আচ্ছা, মা পৃথিবীতে কিছু মানুষ খুব অন্যায় রকমের সুখে আছে, না?

কী বলছিস।

দেখ না, কিছু মানুষ এমন ভাগ্য করে এসেছে যে, তাদের কিছুই করতে হয় না। তাদের অনেক টাকা, গাড়ি বাড়ি, ব্যবসা বা চাকরি, যখন তখন বিদেশে চলে যাচ্ছে, আসছে। ভাবলে কেমন লাগে বলো তো? আমার তো ভীষণ রাগ হয়।

অপর্ণা একটু হাসল, ওভাবে বিচার করলে রাগ হওয়ারই কথা। আবার আমাদের চেয়েও কত দুঃখে কষ্টে মানুষ আছে।

সেটা ভাবলে তো আরও রাগ হয় না। মানুষে মানুষে এত তফাত যে, সেটাকে লজিক্যাল বলেই মনে হয় না। কেন পৃথিবীটা এরকম বলো তো!

অপর্ণা মায়ের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে। ঝুমকি তার চেয়ে এক ইঞ্চি লম্বা। একটু হেসে বলে, বড়লোকদের হিংসে করে কী করবি? যার যেমন কপাল।

কপালে আমার বিশ্বাস ছিল না। ভাবতাম, সবাই সবকিছু হতে পারে। যদি চেষ্টা করে। কিন্তু এখন দেখছি, চেষ্টাতে কিছু হয় না। একটা সামান্য ভদ্র মাইনের চাকরি পাওয়াই কঠিন!

ইদানীং ঝুমকির মুখে যে প্রগাঢ় ক্লান্তির ছাপ দেখতে পায় অপর্ণা, তা তার একটুও ভাল লাগে না। শুধু একটা চাকরির জন্যই কি এত আকাতা আর এত হতাশা? চাকরির ওর এমন কি দরকার? মেয়েদের একটু অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকা যে ভাল, তা অপর্ণাও বিশ্বাস করে। কিন্তু তার জন্য এত তাড়াহুড়োর কি আছে? ঝুমকির বাবা তার সন্তানদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মুক্তহস্ত। দশ টাকা চাইলে বিশ টাকা দিয়ে দেয়। কিন্তু বুবকা বা অপু যেমন টাকা-পয়সা খরচ করতে ভালবাসে, ঝুমকি সেরকম নয়। সে বাবার কাছ থেকে ততটুকুই নেয়, যতটুকু না হলেই নয়। সেই হিসেবে ঝুমকি অনেকটা অপর্ণার মতো টাকা-পয়সা ওড়াতে পছন্দ করে না। একটু হিসেবী। ইদানীং বাই চেপেছে বাবাকে সাহায্য করতে হবে। কিন্তু সেটা এখনই না হলেও হয়। অপর্ণার সন্দেহ হয়, চাকরি নয়, অন্য কোনও গুঢ় কারণে মেয়েটা শুকিয়ে যাচ্ছে। এমনিতেই এই বয়সের মেয়েদের ভিতরের কথা টেনে বার করা কঠিন। তার ওপর ঝুমকি ভীষণ চাপা। অন্য সব কথা দূরে থাক, ঝুমকি কী খেতে ভালবাসে বা কোন রং পছন্দ করে সেটা অবধি অপর্ণা ধরতে পারে না। তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ঝুমকিই সবচেয়ে বেশী আবছা তার কাছে।

অপর্ণা মেয়ের দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থেকে ওর মনের কথা বুঝবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। বলল, তোর বুঝি চাকরি ছাড়া আর কিছুতে মন নেই? হ্যাঁ রে, তোর কি একটাও ছেলে-বন্ধু নেই।

ঝুমকি যেন সামান্য অবাক হল। তারপর দ্রু কুঁচকে বলল, খুব পাকা হয়েছে তো মা! মেয়ের বয়ফ্রেন্ডের খবর নেওয়া হচ্ছে?

আহা, আছে কি নেই, বল না!

আমার আবার বয়ফ্রেন্ড! কী যে বলো না! এই তো তুমিই বললে আমার চেহারাটা হাড়গিলের মতো।

মিথ্যুক! আমি কনো তোকে হাড়গিলে বলিনি।

হাড়গিলে কথাটা হয়তো উচ্চারণ করেনি, কিন্তু যা বিবরণ দিয়েছে, তাতে তাই দাঁড়ায়।

মোটই না। চেহারা খারাপ হয়েছে তাই বলছিলাম। গায়ে মাংস লাগলে তোর পাশে কেউ দাঁড়াতে পারে।

খুব পারে। নিজের মেয়েকে অত বাখনাতে হবে না। আমার চেহারা কেমন, তা আমি জানি।

খুব জানিস। কটা দিন রেস্ট নে, আর ভাল করে খা। তারপর দেখিস আয়না অন্য কথা বলবে।

ঝুমকি একটু হাসল।

অপর্ণা বলল, তোর একটা কিছু হয়েছে। কী হয়েছে বলবি আমাকে?

কী হয়েছে বলে ঝুমকি অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।

তুই বলছি না। কিন্তু আমি যেন টের পাচ্ছি।

ঝুমকি শান্ত গলায় বলে, তুমি সব সময়ে এত টেনশনে থাকো কেন মা। আমার আর কী হবে? চাকরি পাচ্ছি না, তাই মনটা ভাল লাগে না।

চাকরি তো তোর তত দরকার নেই। এমন নয় যে, তুই চাকরি না করলে আমরা খেতে পাবো না।

চাকরি পাওয়াটা শুধু খাওয়ার জন্য দরকার নয় মা। একটা প্রেস্টিজেরও ব্যাপার। চাকরি না-পাওয়া মানে আমাকে কেউ যোগ্য মনে করছে না। কম্পিটিশনে আমি হেরে যাচ্ছি।

আহা, ওসব ভাববার কি আছে? সবাই কি একবারেই পায়? সকলকেই চেষ্টা করতে হয়।

ঝুমকি একটু মাথা নেড়ে বলে, আমার কিছু হবে না মা। কিছুই হবে না।

অপর্ণার সন্দেহটা গেল না। তার ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় হয়তো নেই, কিন্তু মায়ের মন বলে কথা! তার মনের মধ্যে একটু চিমটি থেকে গেল। মেয়েটা তাকে বন্ধু বলে ভাবে না, হয়তো বিশ্বাসও করে না, হয়তো ভাবে মা বুঝবে না। কিন্তু বললে অপৰ্ণা হাঁফ ছেড়ে বাঁচত।

অনু ফিরল বিকেলের মুখে। এ মেয়েটা ঝুমকির মতো নয়। খুব হাসিখুশি আর ইয়ারবাজ হচ্ছে দিনকে দিন। চেহারাটা ভর। এখনই যৌবন ডাক দিয়েছে যেন। অনুর খুবই সুন্দরী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা।

বই-খাতা ফেলে এসেই অপর্ণাকে জড়িয়ে ধরল, হাই মাৰ্ম্মি, হোয়াটস দি নিউজ?

অপর্ণা তার মাথায় হাত দিয়ে বলে, রোজ কি আর নিউজ থাকে? আমাদের আবার নিউজ কিসের?

হোয়ট অ্যাবাউট দি হাউস?

হবে, তোমার বাবা আবার নতুন করে প্ল্যান করতে দিয়েছে।

তুমি এক নম্বরের মাইজার। আগের প্ল্যানটা কত বেটার ছিল। কত বড় আর কী সুন্দর ব্যাপারটা হত বলো তো!

আর টাকাটা আসত কোত্থেকে? তোর শ্বশুর দিত।

ইউ আর ইমপসিবল। আমার বাবা কি বেকার। বাবা ঠিক পারত।

তোদের বুদ্ধি নিয়ে চললে সংসার একদিন ভেসে যাবে। আমরা যেমন, আমাদের বাড়িও ঠিক তেমনি হবে।

মজা থাকবে না মা।

খুব থাকবে। মজা তো জিনিসে থাকে না, থাকে মনে।

আমাকে সেপারেট রুম দেবে তো? দেখব।

প্ল্যান হয়ে গেলে আর কি করে দেখবে?

দেখব নয়, দেখেছি। তোমাদের আলাদা আলাদা ঘরই হবে।

দ্যাটস্ মাই মাগ্নি। বলে অনু তাকে একটু আদর করল।

এই মেয়েকে নিয়ে চিন্তা আছে অপর্ণার। বড় ইংরিজিয়ানা শিখছে। ট্যাশ স্কুলে পড়ে বলে নয়। সে তো বুকাও পড়ে। ওর মধ্যে একটু বিলিতি নকলের ঝোক আছে। একটু ছেলে-ঘেষা। ওর অনেক বয়ফ্রেন্ড। মেয়েটার একটু ডোন্ট কেয়ার ভাবও আছে। তবে পড়াশুনোয় অনু বেশ ভাল।

স্কুলের পোশাক না ছেড়েই অনু টেলিফোনের সামনে বসে গেল। রোজ গাদা গাদা ফোন করে। কাজের কথা হয় কিনা কে জানে, বন্ধুদের সঙ্গে বিস্তর হা-হা হি-হি হয়।

এই, না খেয়েই যে বড় টেলিফোন করতে বসলি?

খিদে নেই মা। আজ ফেট ছিল। স্কুলে খাইয়েছে।

টেলিফোনের বিল কত আসছে জানিস।

উঃ, তুমি না দারুণ মাইজার।

মোটই মাইজার নই। ফ্রি কল-এর ওপরে আগের বারে অন্তত একশো কল হয়েছে, তা জানিস?

তিনটে ফোর করব মা। মাত্র তিনটে।

কাকে করব?

ফ্রেন্ডদের।

তাদের কাছ থেকেই তো এলি এইমাত্র।

একটু দাও না মা। কত কথা থাকে জানো না তো। এণাক্ষী একটা দারুণ স্টোরি বলছিল। কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই ওর স্টপ এসে গেল যে।

অপর্ণা চোখ কপালে তুলে বলে, এখন ফোনে স্টোরি শুনবি?

একটা করি না মা, মাত্র একটা।

না। এখন নয়। ও মেয়েটাও বাড়িতে গিয়ে এখন একটু হাফ ছাড়ছে। ওকে একটু সময় দাও। সন্ধের পর করিস।

উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না।

এক একদিন অপর্ণা টের পায়, মাঝরাতেও অনু কাকে যেন টেলিফোন করে। বন্ধুদেরই করে কি? নাকি? সেসব কথা এখনই ভাবতে চায় না অপৰ্ণা। অনু এখনও ছেলেমানুষ। তবে আজকালকার মেয়ে, তাদের সম্পর্কে কিছু ধারণা করে রেখে লাভ নেই। তার কাছে ছেলেমানুষ, লোভী যুবকদের কাছে তো তা নয়। তাদের কাছে লোভনীয় সামগ্রী।

বুকা আসে সবার পরে। স্কুলে আজকাল টিউটোরিয়াল ক্লাস হচ্ছে। তর পরেও ক্রিকেট প্র্যাকটিস থাকে প্রায়ই।

বুবকা এলে বুকটা ভরে যায় অপর্ণার। ভিতরে ভিতরে একটু পক্ষপাত তার হয়তো আছে। এ জন্মে সেটা কাটবে না। ছেলের জন্য একটা বাড়তি তেষ্টা তার থাকেই। একটু চিন্তাও। বুবকা বড় ভাল ছেলে। তার মধ্যে কোনও কমপ্লেক্স নেই। একটু বেশী সাদা আর সরল। উনিশে পা দিয়েছে, কিন্তু এখনও শিশুর মতো। কিন্তু এ সমাজে শিশুদেরই বিপদ বেশী। কে কোথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে ভুল পথে নিয়ে যাবে।

বুবকা সম্পর্কে একটু দুঃখের বোধও আছে অপর্ণার। বুবকা মাকে ভালবাসে খুব, কিন্তু বাপকে একটু বেশী। খুব শিশুকাল থেকেই ছেলেটা বাপ-ঝোকা, কি করে যে হল কে জানে। বুবকা তার বাবাকে যত ভালবাসে, যত বিশ্বাস করে, বাপের ওপর যত নির্ভর করে, তত আর কাউকে নয়, কারও ওপর নয়।

মা! বলে এক গাল হাসল বুবকা।

ইস ঘেমেছিস কেন? শীতে কেউ ঘামে?

আমার যে ফ্যাট আছে।

ফ্যাট! কে আবার ওকথা বলল?

তুমি খাইয়ে খাইয়ে বোজ আমার ফ্যাট বাড়িয়ে দিচ্ছো।

বলিস কি রে? কোথায় আবার ফ্যাট?

আছে মা। রোজ এত এত খাচ্ছি, সেগুলো যাচ্ছে কোথায়?

মোটেই তোর ফ্যাট নেই।

স্কুলে আমাকে আজকাল কেউ কেউ ফ্যাটসো বলে ডাকে।

তারা অন্ধ।

বুবকা নিঃশব্দে হাসল, তারপর বলল, কী টিফিন খাওয়াবে বলে তো! আই অ্যাম হাংরি।

হাত-মুখ ধুয়ে আয়। নুডলস্ করে রেখেছি, চিংড়ি দিয়ে।

দ্যাটস্ ফাইন।

সন্ধে অনেকটা গড়িয়ে মণীশ ফেরে। মুখখানা গম্ভীর। ছেলেমেয়েরা যে যার ঘরে পড়ছে। একা অপৰ্ণাই রিসিভ করে তাকে।

গম্ভীর কেন গো?

গম্ভীর! না তো!

অপর্ণার আবার চোখে জল আসতে চায়। সে তো মণীশকে দুহাতে আগলে রেখেছে। তবু কোথায় যে ব্যবধান রচিত হয়ে যায়। সে কিছু করতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *