চারুশীলা যে কেন তাকে এয়ারপোর্টে ধরে এনেছে তা চয়ন জানে না। চারুশীলার কোনও সিদ্ধান্ত বা কাজেরই যুক্তি সঙ্গত ব্যাখ্যা করা মুশকিল। তবে তাতে চয়নের একটা লাভ হয়েছে। কস্মিনকালেও সে এয়ারপোর্ট দেখেনি। দেখা হয়ে গেল আজ।
চারুশীলা হুকুম করতে ভালবাসে এবং সেটা তামিল না হলে যে চারুশীলা মানসিক দিক দিয়ে ভেঙে পড়ে এই সূহ্ম ব্যাপারটা চয়ন বোঝ। তাই সে পারতপক্ষে চারুশীলার মতের বিরুদ্ধে কিছু করে না, সামান্য গৃহশিক্ষক হলেও—কে জানে কেন—তাকে ভদ্রমহিলা নানাভাবে নানা বিষয়ে জড়িয়ে দেন। হয়তো ভাবেন, এরকম নানা ব্যাপারে জড়িয়ে থাকলে চয়নের উপকার হবে। উপকার কিছু হয় না, বরং চয়নের অস্বস্তি বাড়ে।
আজকের ঘটনাটাই যেমন পড়াতে গিয়েছিল চয়ন। চারুশীলা তাকে দেখেই ঘোষণা করল, আজ আর পড়াতে হবে না। রশ্মি আজ লন্ডন চলে যাচ্ছে। সি-অফ করতে আমরা সবাই যাচ্ছি। আপনাকেও যেতে হবে।
বিস্মিত চয়ন বলে, আমি।
হ্যাঁ, আপনিও। ফিরতে অনেক রাত হবে। ডিনার এখানেই করে নিন, আর আমাদের সঙ্গেই ফিরে আসবেন। এখানেই রাতে থাকবেন।
এগুলো কোনও প্রস্তাব বা অনুবোধ নয়, সিদ্ধান্ত এবং ঘঘাষণা।
চয়ন ভেবেচিন্তে কিছু বলতে পারল না। কেবল চারুশীলার কথারই শেষাংশ পুনরাবৃত্তি করল মাত্র, রাত্রে থাকব।
কেন, আপনার জন্য কেউ চিন্তা করবে নাকি?
চয়ন লাজুক মুখে বলে, না, তা কেউ করবে না।
বলেই চয়নের মনে হল, কথাটার মধ্যে একটু মিথ্যে রয়ে গেল। তার জন্য চিন্তা করার লোক এতদিন কেউ ছিল না। আজকাল হয়েছে। অনিন্দিতা আর তার মা। যদিও ওদের উৎকণ্ঠা বা উদ্বেগ চয়ন এখনও পছন্দ করে উঠতে পারেনি। রাতে না ফিরলে ওরা অবশ্যই টের পাবে। দাদা-বউদিকেও বলতে পারে।
চারুশীলা বলল, তা হলে আর কী?
চয়ন মৃদু একটু হাসল। ব্যক্তিত্বহীন হওয়ার অসুবিধে অনেক আছে, আবার সুবিধেও কি আর কিছু নেই। ব্যক্তিত্বহীন মানুষদের সঙ্গ বেশিরভাগ মানুষই পছন্দ করে। কেনো, তারা সব কথাতেই সায় দেয়, অকারণে অন্যায্য প্রশংসা করে এবং হাবিজাবি কথাও মন দিয়ে শোনে। মানুষ নিজের ইচ্ছেমতো চালানোর জন্য এসব লোককে সবসময়েই সঙ্গী হিসেবে চায়। মানুষের ইচ্ছাপূরণে সাহায্য করে বলেই কিছু দয়া ও দাক্ষিণ্য তারা পেয়ে থাকে।
লোক বড় কম জোটায়নি চারুশীলা। সন্ধের পর একে একে এল রিয়া আর মোহিনী, এল ঝুমকি, এল দাড়িওলা এবং বিষণ্ণ হেমাঙ্গ। আরও জনা তিনেককে চেনে না চয়ন। দেখা গেল, সকলেরই ডিনারের নেমন্তন্ন। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও বেশ বিরাট।
সেদ্ধ ভাত খেয়ে খেয়ে চয়নের পেট মরে গেছে। আজকাল সে একদম বেশি খেতে পারে না। বিশেষ করে ঝালমশলার খাবার খেলেই তার পেটের গোলমাল হয়। কিন্তু বোধ হয় তার স্বাহারে চারুশীলা খুশি নয়। তাই ডিনার টেবিলে তাকে নিয়েই পড়ল চারুশীলা, ও কী চয়নবাবু, ওটুকু মাছ নিলেন যে! ভাতটা আরও নিন তো! …আর একটা মুরগির টুকরো নিতে হবে। …হাত গুটিয়ে রয়েছেন যে, পুডিংটা নিন।
হেমাঙ্গ বিরক্ত হয়ে বলল, মানুষকে খাইয়ে মারতে চাস নাকি? এটা বেশি ফুড ইনটেকের যুগ নয়। মানুষ যত কম খাবে তত বেশিদিন বাঁচবে।
চারুশীলা ঈষৎ ব্লগের গলায় বলে, আহা, বন থেকে বেরোলো টিয়ে, সোনার টোপর মাথায় দিয়ে। এসব ফিলজফি কি সুন্দরবন থেকে শিখে এলি নাকি? নিজের চেহারাটা তো চিমসে তালপাতার সেপাই বানিয়েছিল।
সুন্দরবনে শিখবো কেন? তুই মডার্ন ওয়ার্ল্ডের খবরই রাখিস না। বরং সুব্রতদাকে জিজ্ঞেস কর ঠিক বলছি কি না।
সুব্রত শান্ত মানুষ, বেশি কথা বলে না। তর্কবিতর্ক একেবারেই করে না। শাস্ত হেসে বলল, তোমার লাইফ স্টাইলটা খুবই স্পার্টান হয়ে গেছে।
সেটাই কি ভাল নয়?
সুব্রত মাথা নেড়ে বলে, ভালই।
আমাকে ও চিমসে বলছে ব্রতদা, শুনলেন?
শুনেছি। আমার তো মনে হয় তুমি অনেক লিন হয়েছে, আর চটপটে। রংটাও বেশ ট্যান হয়েছে।
চারুশীলা একটু অবাক হয়ে বলে, তুমি এর প্রশংসা করছো? ধন্যি তোমাকে। ওকে চাষা ছাড়া আর কিছু মনে হয় এখন? কী কালো হয়েছে, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে, মুখে জঙ্গল।
সুব্রত মৃদু মৃদু হাসতে লাগল। হেমাঙ্গ একটু মাথা তুলে বলল, টুকটুকে ফর্সা নাদুসনুদুস ন্যাদসমার্কা চেহারা বুঝি ভাল?
হাসতে গিয়ে ঝুমকি বিষম খেল। একটু জল চলকে গেল মোহিনীর হাতের গেলাস থেকে।
কিন্তু এইসব হাসিঠাট্টার মধ্যেও চয়ন লক্ষ করছিল, হেমাঙ্গর চোখ আসছে না। একটা গভীর ক্লান্তি, হতাশা এবং হয়তোবা একটা অপরাধবোধে ছেয়ে আছে তার চোখ। হেমাঙ্গ আর রশ্মির ব্যাপারটা চয়ন জানে বলেই আরও ভাল বোঝা গেল।
দুখানা গাড়ি হলেই হয়ে যেত। কিন্তু বন্দোবস্ত হয়েছে তিনখানা গাড়ির। চারুশীলার দুটো, হেমাঙ্গর একটা। চয়ন পড়ল হেমাঙ্গর ভাগে। সামনের সিটে পাশাপাশি বসে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হেমাঙ্গ বলে, চয়নবাবু গান জানেন?
আজ্ঞে না।
জানলে আপনাকে আজ একটা গান শোনাতে বলতাম।
কী গান?
যখন ভাঙল মিলনমেলা ভাঙল। কাল রাতেও স্টিরিওতে শুনলাম।
আপনার মনটা খুব খারাপ, না?
একটা হাত স্টিয়ারিং থেকে তুলে দাড়ি আঁচড়াল হেমাঙ্গ। তারপর বলল, আমি বোধ হয় একটা ইমবেসাইল। কিন্তু কিছু করার ছিল না।
চয়ন চুপ করে থাকে। এ ব্যাপারে সে কথা বলার অধিকারী নয়।
হেমাঙ্গ বাইপাসের দিকে গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে আয়নায় একবার পিছনের গাড়িগুলো ঠিকঠাক আসছে কি না দেখে নিল। তারপর বলল, অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? উই আর বোথ ইন লাভ উইথ ইচ আদার। কিন্তু কতগুলো মেটেরিয়াল কারণে, মাইনর পয়েন্টে আটকে রইলাম। দিস ইজ দা জোক অফ এ লাইফটাইম!
চয়ন মৃদু অস্বস্তি বোধ করছে। এই কথার মধ্যে সে একটা ভুল ধরতে পারছে। স্পষ্ট নয়, কিন্তু আবছা হলেও সত্যি। সে মৃদু স্বরে বলল, দুঃখের ব্যাপার।
আপনিও তাই মনে করেন?
চয়ন সোজা সামনের দিকে চেয়ে থেকে বলে, তাই তো।
দোষটা কার বলুন তো? আমারই, না?
চয়ন মাথা নেড়ে বলল, না।
তবে কার?
বোধ হয় ঘটনাচক্রের। আপনি তো রাজি ছিলেন।
আমার যে কেবলই মনে হয় আমি ওকে অপমান করেছি।
চয়ন খুব ভয়ে ভয়ে বলে, অপমান! কই, মনে হয় না তো!
কিন্তু প্রত্যাখ্যান মানেই তো অপমান।
চয়ন সংকোচের সঙ্গে বলে, প্রত্যাখ্যান! এটা কি তাই?
নয় তো?
হেমাঙ্গ কী শুনতে চাইছে তা চয়ন বুঝতে পারল। বলল, না, প্রত্যাখ্যান কেন হবে?
অন্তত লোকে তো তাই ভাববে?
চয়ন একটু ভাববার ভান করল। তারপর একটু সরল গলায় বলে, আমার তা মনে হয় না।
হেমাঙ্গ সামনের হেডলাইটে উজ্জ্বল রাস্তার দিকে চেয়ে বলে, কি জানি, আমার তো সন্দেহ ছিল সবাই আমাকেই দায়ী করবে। ডি ছি করবে, খানিকটা সেই ভয়েই তো গায়ে পালিয়ে ছিলাম।
চয়ন মৃদু হেসে বলে, আপনার গাঁয়ের বাড়িটা খুব সুন্দর।
আপনার ভাল লেগেছে? যাদের চোখ আর রুচি আছে তাদের ভালই লাগবে। বসবাস করার পক্ষে শহর একদম বাজে জায়গা। বুক ভরে দমটা অবধি নেওয়ার উপায় নেই। কৃষ্ণজীবনবাবু কি আর সাধে পরিবেশ-পরিবেশ করে এত অস্থির হন! আমার তো ইচ্ছে করছে কালকেই আবার গায়ে চলে যাই। যাবেন আমার সঙ্গে?
চয়ন একটু শঙ্কিত হয়ে বলে, আমার তো উপায় নেই।
টিউশনি?
আজ্ঞে।
আমারও তো কত কাজ কলকাতায়। কিন্তু জীবনের আনন্দটাই যদি না থাকে তা হলে পয়সা দিয়ে কী হবে?
তা তো বটেই।
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ গাড়ি চালাল হেমাঙ্গ। তারপর বলল, তা হলে আপনি বলছেন রশির সঙ্গে আমি বিট্রে করিনি।
না তো!
একটা যেন স্বস্তির শ্বাস মোচন করে হেমাঙ্গ বলে, রশি খুব ভাল স্বভাবের মেয়ে। কাল নিজে গিয়ে আমাকে কলকাতায় টেনে আনল। একটুও রাগ করল না আমার ওপর।
চয়ন মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, ওঁর মতো মেয়ে কমই দেখা যায়। যেমন ব্রিলিয়ান্ট, তেমনি বিনয়ী।
রশির প্রশংসা শুনে খুশি হল হেমাঙ্গ। বলল, বিয়ে করলে ওরকম মেয়েকেই করতে হয়। আমার কপালটাই হয়তো খারাপ।
চয়ন সতর্কভাবে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, আপনিও তো কম যান না!
আমি! হাসালেন মশাই। রশ্মির তুলনায় আমি নিতান্তই এলেবেলে।
চয়ন মাথা নেড়ে বলে, না না, তা কি হয়? আপনারা দুজনেই সমান ভাল।
বলছেন?
হ্যাঁ। আর তাই আমার মনে হয়, বিয়েটা না হয়ে আপনার কোন ক্ষতি হয়নি।
অ্যাঁ। ক্ষতি হয়নি মানে?
চয়ন ব্যস্ত হয়ে বলল, সমান ভাল দুজনের জোড় হয়তো মিলত না।
কথাটা শুনে এত অবাক হয়ে গেল হেমাঙ্গ যে, আর একটু হলে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলত। সামলে নিয়ে বলে, কী বলছেন চয়ন?
চয়ন ভীষণ সংকুচিত হয়ে বলল, বিজ্ঞানের নিয়মেই সগোত্র হওয়া ভাল নয়।
হেমাঙ্গ গাড়ির গতি কমিয়ে চয়নের দিকে অবাক একটি চাউনি হেনে বলল, আপনি তো ডেঞ্জারাস লোক মশাই!
চয়ন একটু ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, আপনি রাগ করলেন।
হেমাঙ্গ আরও কিছুক্ষণ ধীর গতিতে গাড়ি চালাল। ততক্ষণে ডান পাশ দিয়ে সাদা মারুতিটা বেরিয়ে গেল। জানালা দিয়ে চারুশীলা মুখ বাড়িয়ে বলল, এই হাঁদারাম, গাড়ি খারাপ হয়েছে নাকি?
না। সব ঠিক আছে।
গাড়িটা বেরিয়ে গেলে হেমাঙ্গ বলল, রাগ করাই বোধ হয় উচিত। কিন্তু রাগ হচ্ছে না। সগোত্র কথাটা খুব ইন্টেলিজেন্টলি পুট করেছেন তো! একজ্যাক্টলি যেন এই শব্দটাই আমি খুঁজছিলাম।
আমি কিন্তু ভেবেচিন্তে বলিনি।
তা না বললেও এ কথাটা যে আপনার মাথায় এসেছে এটা কম কথা নয়। আমার কখনও কখনও মনে হয়েছে আমাদের মধ্যে স্বভাবের একটা বড় মিল আছে। আবার নেইও। কিন্তু মিলটাই বোধ হয় বেশি।
চয়ন করুণ একটু হাসল। সে জানে হেমাঙ্গ এখন যা বলছে সেটাও সত্যি নয়। কারণ বাস্তবিক পক্ষে হেমাঙ্গর সঙ্গে রশ্মির মিলের চেয়ে অমিলই ঢের বেশি। চয়ন সগোত্র শব্দটা ব্যবহার করেছে অনিচ্ছে সত্ত্বেও স্রেফ আত্মরক্ষার জন্য।
হেমাঙ্গ একটু সময়ের ফাঁক দিয়ে বলল, আমি ওকে খুব ভালবাসি বটে, কিন্তু মনে হল আমাদের বিয়েটা যেন একটা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করার মতো হয়ে যাবে। এরকম হওয়া উচিত নয়। কী বলেন? বিয়ে করলে ইংল্যান্ডে যেতে হবে, আমার শিকড় উপড়ে নিতে হবে। আমার পক্ষে এতটা কি সম্ভব?
চয়ন মাথা নেড়ে বলে, ঠিকই তো।
ঠিক নয়?
চয়ন একটু চুপ করে থেকে বলে, লোকে ভালবাসার জন্য কত কী করে? কোনও মানে হয় না। প্র্যাক্টিক্যাল হওয়াই ভাল।
গাড়িটা আর একবার যেন টাল খেল। হেমাঙ্গ অস্ফুট স্বরে বলল, আপনি খুব ডেঞ্জারাস লোক মশাই।
আজ্ঞে তা নয়।
একটু বিচ্ছু টাইপের কি আপনি! বাইরে থেকে মনে হয়, ভাজা মাছ উলটে খেতে জানেন না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে গভীর জলের মাছ।
চয়ন সভয়ে বলে, না না, আমি আসলে—
হেমাঙ্গ খোলা গলায় হাসল, আপনি কি বলতে চান যে, রশ্মি আর আমার মধ্যে সত্যিকারের ভালবাসা হয়নি?
তা তো বলিনি!
না, তা বলেননি। বিরা অত খোলাখুলি বলেও না।
আপনি ভুল বুঝেছেন।
ঠিক বুঝেছি। কিন্তু তা বলে রাগ করিনি। ভয় পাবেন না। আপনার আই. কিউ. কত?
জানি না তো!
একবার মেপে দেখবেন!
কেন বলুন তো?
মনে হচ্ছে আপনার আই. কিউ. রেটিং বেশ হাই।
চয়ন লজ্জা পেয়ে বলে, আপনি রাগ করেছেন।
হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলে, করিনি। রশ্মি আর আমার ব্যাপারটার মধ্যে রোমান্টিক জিনিসটা ছিল না। আমরা দুজনেই পাক্কা প্রফেশনাল। কী জীবনে, কী কেরিয়ারে। বাট শী ইজ সাচ এ সফটু বিউটিফুল উওম্যান।
চয়ন চুপ করে থাকে।
হেমাঙ্গ নিজেই আবার হঠাৎ বলল, কেন বলুন তো আমি ওর জন্য ঠিক পাগল হতে পারলাম না? পাগল হতে পারলে ও যা চাইছে তা করা শক্ত ছিল না। কেন পারলাম না? কোথায় একটা ক্যালকুলেশন ঢুকে পড়ল আমাদের রিলেশনে?
চয়ন একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ক্যালকুলেশন কেন ঢুকবে?
হেমাঙ্গ গম্ভীর হয়ে বলে, ক্যালকুলেশনই। আমি নানাভাবে নিজেকে পরীক্ষা করেছি, প্রশ্ন করেছি। গাঁয়ে বসে রাতের পর রাত জেগে বসে ভেবে দেখেছি। দেয়ার ইজ এ ফ্লাই ইন দি অয়েন্টমেন্ট। মনে হচ্ছে, এই মাছিটা হল আমার ভিতরকার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টটা।
চয়ন ব্যস্ত হয়ে বলে, না না। তা নয়।
তা হলে?
আমার মনে হয় আপনি ঠিক ততটা আগ্রহী ছিলেন না।
অত ভদ্রতা করে বলছেন কেন? বী এ ফ্রেন্ড অ্যান্ড বী ফ্র্যাংক। চয়ন লজ্জা পেয়ে বলে, আমি তো অত বুঝি না।
খুব অবুঝও আপনি নন। ঠিক আছে। এ নিয়ে পরে কথা হবে। দুটো গাড়িই আমাদের পেরিয়ে গেছে। ওদের ধরা যাক।
গাড়িটা আচমকা দারুণ জোরে চলতে শুরু করল। আর সিটে সিঁটিয়ে বসে রইল চয়ন।
এয়ারপোর্ট দেখে চয়ন মুগ্ধ। এত বড়, এত সাজানো, এত ঝকঝকে ব্যাপার সে আগে বড় বিশেষ দেখেনি। লাউঞ্জে রশ্মিকে ঘিরে তার মেলা আত্মীয়স্বজন।
দুটো গাড়িকে পিছনে ফেলে হেমাঙ্গই পৌঁছেছে আগে। লাউঞ্জে ঢাকার মুখে সামান্য প্রোটোকল ছিল। সেটা ডিঙিয়ে চয়নকে নিয়ে ভিতরে ঢুকেই সে বেশ নাটকীয়ভাবে ডাকল, রশ্মি!
রশ্মি হাসিমুখে একটু এগিয়ে এল, এসেছে?
দুজনেরই হাসিমুখ। দুটো মুখই মেঘমুক্ত। কোনও টেনশন নেই। একটু দূর থেকে দুটো মুখকে এরকমই মনে হল চয়নের। এরা কি পরস্পরের খপ্পর থেকে বেঁচে গেল? এরা কি পরস্পরের গ্রাস হতে হতেও হল না?
চয়নের অবশ্যম্ভাবী অনিন্দিতার কথা মনে হল। অনিন্দিতা একটা কিছু ঘটিয়ে তুলতে চাইছে কি? গতকালও থিয়েটারের টিকিট এনেছিল এবং তাকে অনিন্দিতার সঙ্গে যেতেও হয়েছিল থিয়েটারে। নাটকটা কেমন তা ভাল বঝেনি চয়ন। তবে তার ভাল লাগছিল না। কিন্তু অনিন্দিতা মন্ত্ৰমুগ্ধ হয়ে দেখছিল। ফেরার সময় একসঙ্গে কিছুক্ষণ। না, বিশেষ ইঙ্গিতবহ কোনও কথা হয়নি। শুধু অনিন্দিতা একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ভাল লাগল?
ভালই তো!
কোনটা ভাল?
কেন, নাটকটা!
আর আমি! বলে খুব হেসে ফেলেছিল অনিন্দিতা।
চয়ন একটু দূর থেকে দেখছে, রশ্মি কথা বলছে হেমাঙ্গর সঙ্গে। একটা ডোরাকাটা জামা আর জিনসের প্যান্ট পরে আছে হেমাঙ্গ। দাড়িতে তার মুখে একটা আলাদা সৌন্দর্য এসেছে। আর রশ্মি তো দারুণ সুন্দরীই। তার পরনে সবুজ আর সাদায় মেশানো চুড়িদার। দুজনকে মুখোমুখি বেশ মানিয়েছে। যেন মেড ফর ইচ আদার। কিন্তু ব্যাপারটা যেমন দেখাচ্ছে। তেমন নয়। পৃথিবীতে এরকম কত ভুল দৃশ্য আছে।
লাউঞ্জে ঢুকল এসে চারুশীলা অ্যান্ড পার্টি। হইহই ব্যাপার। এই ডামাডোলে কেউ লক্ষই করল না চয়নকে। এরকমই ভাল। সে কারও লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকলে অস্বস্তি বোধ করে। ভয় একটাই, ফেরার সময় তাকে আবার ভুলে ফেলে না চলে যায়।
দল থেকে কিছুক্ষণ পর একটি মেয়ে শুটপুট করে এসে তার পাশে দাঁড়াল।
একা দাঁড়িয়ে যে!
চয়ন লাজুক গলায় বলে, এমনি।
আপনি ভীষণ মুখচোরা, না?
চয়ন মৃদু হেসে বলে, না, তা নয়। রশ্মি আর হেমাঙ্গবাবু কথা বলছিলেন তো, তাই একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঝুমকি হেসে বলল, বিদায়-দৃশ্যটা কেমন হল? খুব ট্র্যাজিক?
চয়ন মাথা নেড়ে বলে, কি জানি ঠিক বুঝতে পারিনি।
ঝুমকি দলটার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বললচারুমাসি আমাকে ভীষণ ভালবাসে। সব জায়গায় নিয়ে যায় জোর করে। নইলে আমার কিন্তু একদম আসার ইচ্ছে ছিল না।
চয়ন হঠাৎ প্রশ্ন করল, কেন?
এরা সবাই বড়লোক। অনেক টাকা। আমার যেন বড়লোকদের সঙ্গে বেশী মেলামেশা করতে অস্বস্তি হয়। আপনার হয় না।
চয়ন একটু অবাক হয়ে বলে, আমার! আমি তো সামান্য পড়ার মাস্টার।
আপনি এলেন কেন?
উনি জোর করে নিয়ে এলেন।
দূর থেকে চারুশীলা হাতছানি দিয়ে ডাকল ঝুমকিকে।
চয়ন বলল, আপনি যান। ডাকছে।
ঝুমকি চলে গেল। চয়ন একদৃষ্টে চেয়ে রইল। সে এই মেয়েটিকে নিয়ে ভাবছে। ভাবতে হচ্ছে। এই মেয়েটারও একটা চাপা বক্তব্য আছে। সেটা ঠিক বোঝা যায় না।
বিদায় পর্ব শেষ হয়ে গেল। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এনক্লোজারে ঢুকে গেল রশ্মি। সে ফিরে যাচ্ছে নিজের ক্ষেত্রে। নিজের জায়গায়। মুখে হাসি। কোনও বিষণ্ণতা নেই। বিন্দুমাত্র নেই।
চারুশীলা সবাইকে কফি খাওয়াল। তারপর তারা উঠল ওপরে। যেখান থেকে প্লেনটা দেখা যায়। নানা আলো বিকীরণ করে প্লেনটা দাঁড়িয়ে গো গো করছে। আকাশজোড়া অন্ধকার। ওই অন্ধকারে একটু পরেই আকাশে উধাও হবে বিমান। তার ছোট্টো খোলর মধ্যে কয়েকটি মানুষ। হাজার হাজার মাইল পেরোবে। কী সাঘাতিক।
চয়নের পাশেই দাঁড়ালো হেমাঙ্গ। বলল, কুইটস্।
চয়ন চমকে উঠে বলে, কিছু বলছেন?
দাড়ি-গোঁফের ভিতর দিয়ে একটু হাসল হেমাঙ্গ। বলল, বললাম।
আজ্ঞে আমি বুঝতে পারিনি।
বললাম হিয়ার এন্ড দি ড্রামা। ড্ৰপসিন।
ওঃ।
আমি আবার মুক্ত, ভারহীন, স্বাধীন।
চয়ন মৃদু একটু হাসল।
হাসলেন যে!
ভালই তো।
কাল গাঁয়ে ফিরে যাচ্ছি।
কালকেই?
নয় কেন? দিন সাতেক বিরহের জ্বালাটা জুড়িয়ে আসি।
ও।
বিশ্বাস করলেন না।
কেন করব না?
মুখ দেখে মনে হচ্ছে আপনি বিরহে বিশ্বাসী নন।
ছয়ন বিব্রত হয়ে বলে, তা নয়। আমি সব ঠিকমতো বোঝাতে পারি না।
আপনার কাছে অনেক কিছু শেখার আছে মশাই।
কী যে বলেন।
হেমাঙ্গ অন্যমনস্কভাবে প্লেনটার দিকে চেয়ে রইল।
চয়ন হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, প্লেনে চড়তে ভয় করে না?
হেমাঙ্গ তার দিকে ফিরে চেয়ে বলে, করে। আমার তো খুব করে। কেন যে এসব বিপজ্জনক জিনিস বানায় মানুষ। এ সবের চেয়ে নৌকো ভাল, পালকি ভাল, পায়ে হাঁটা ভাল বা ঘোড়ায় চড়া। বুঝলেন, পৃথিবী আবার একদিন সেই সব যুগে ফিরে যাবে।
চয়ন মৃদু হাসল।
প্লেনটা উড়ল আরও আধঘণ্টা বাদে। জীবনে প্রথম প্লেন উড়তে দেখল চয়ন। অনেকটা গড়িয়ে গিয়ে রানওয়েতে ঘুরল। তারপর একটা প্রচণ্ড গতি। একটা ঢেউ। তারপর জানালার পিদিমের সারি নিয়ে অন্ধকার আকাশে কী সুন্দর একটা ক্ষণিকের দৃশ্য হয়ে মিলিয়ে গেল।
চারুশীলার গাড়িতে ফিরে এল চয়ন। অনভ্যস্ত রাত্রিবাস।
সে অবাক হয়ে দেখল, তার জন্য চমত্তার বিছানা তো হয়েছেই, বিছানার পাশে একটা টুলের ওপর নতুন পায়জামা, গেঞ্জি আর ভোয়ালে। সঙ্গে নতুন টুথব্রাশ আর টুথপেস্ট।
শুয়ে পড়ুন। আমি বাতি নিবিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। বাথরুটা চিনে রেখেছেন তো? পায়ের দিকে। ঘরে ডিমলাইট জ্বলবে। বালিশের পাশে টর্চও আছে।আর কিছু চাই?
চারুশীলার দিকে অবাক চোখে চেয়ে চয়ন বলে, আরও?
চারুশীলা হাসল না। বলল, দরকার হলে বাঁ দিকের বেড সুইটা টিপবেন। ওটা কলিং বেল। বাজালে চাকরদের মধ্যে কেউ চলে আসবে।
চয়ন মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।