• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৪৯. বড় মেয়ের বয়স

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ০৪৯. বড় মেয়ের বয়স

তোমার বড় মেয়ের কত বয়স হল তা জানো?

কেন জানব না? উনিশ।

মোটই নয়, কুড়ি পেরিয়ে একুশ।

বাড়াচ্ছে। কুড়ি পেরোলেও একুশ হয় না, একুশ পূর্ণ হলে একুশ হয়।

বাপদের একটা দোষ কি জানো? ছেলেমেয়েদের বয়স হলেও সেটা স্বীকার করতে চায় না। তুমি হলে সেইসব বাপদের মধ্যে আরও এক কাঠি। আচ্ছা না হয় কুড়িই হল, কুড়িও কি কম?

এসব হিসেব নিকেশ উঠছে কেন অপু। বিয়ের কথা ভাবছে নাকি?

ভাববো না? তুমি ভাবো না বলেই আমাকে ভাবতে হয়। আমার তো আর তোমার মতো চোখ বুজে থাকার অভ্যাস নয়।

কী সর্বনাশ! তুমি ঝুমকির বিয়ের কথা ভাবছে! আজকাল কি মেয়েদের কুড়িটা কোনও বয়স? তুমি যে গৌরীদানের যুগে ব্যাক করে যাচ্ছো!

পাত্র বাছতে বাছতে কুড়িই বাইশ তেইশে গিয়ে দাঁড়াবে। মেয়ের বিয়ে বলে কথা, আগে থেকে চেষ্টাটা অন্তত শুরু করতে হয়।

মণীশ কিছুক্ষণ অপলক চোখে তার বউয়ের দিকে চেয়ে থেকে বলল, তোমার কথাবার্তা এত প্রবীণা গৃহিণীর মতো হয়ে যাচ্ছে কেন বলো তো! বুড়িয়ে যাচ্ছে নাকি?

অপর্ণা হেসে ফেলল। তারপর মুখটা একটু গম্ভীর করার চেষ্টা করে বলল, অস্বীকার করে লাভ নেই যে, আমাদের বয়স হল।

ওভাবে বোলোনা অপু। কানে লাগে। এই তো সেদিনও তুমি যুবতীটি ছিলে, আজও আছে। অন্তত আমার চোখে তো অন্যরকম লাগছে না। তবে প্রবীণটি হলে কবে?

প্ৰবীণা না হলেও মধ্যবয়স্কা।

তার মানে কি বিগতযৌবনা?

যৌবনের খবর কি আমার রাখার কথা। আমি শুধু জানি আমার ছেলেমেয়ের বয়স হচ্ছে, সংসারের দায়িত্ব বাড়ছে।

একটা কথা বলো অপু। সাজগোজ করে যদি বেরোও তাহলে কি আজকাল পুরুষের অ্যাডমিরেশন পাও না? দু-চার জোড়া মুখ চোখ কি তোমার দিকে চেয়ে থাকে না।

অপর্ণা রাগ করতে চেষ্টা করল। কুটি করেও হেসে ফেলে বলে, আমি আজকাল সাজি নাকি? পুরুষদের লক্ষ করতেও আমার বয়ে গেছে।

একটু লক্ষ কোনো অপু। যদি দেখ যে, পুরুষের চোখ এখনও তোমাকে লক্ষ করছে তাহলে নিশ্চিতভাবে জেনো, তোমার যৌবন যায়নি।

যে-পুরুষটিকে নিয়ে আছি সে লক্ষ করলেই হল। আর আমার কাউকে চাই না।

আমার চোখ তো ভুল চোখ। সেই যে ট্রামগাড়িতে চয়ে আধমরা যুবতীটিকে দেখেছিলাম, চারদিকে টিয়ার গ্যাস, গুলি আর ট্রামের মধ্যে পড়ে থাকা লাশের ভয়ংকর অবস্থায়, দেখেই আমার ভিতরে যে একটা উথাল-পাথাল হয়েছিল, আজও তোমাকে দেখলে ঠিক সেরকমটি হয়। কই, পাল্টাওনি তো তুমি! আমার চোখে তোমার বয়স বাড়ে না, যৌন যায় না। তাই বলছি আমার চোখ হল ভুল চোখ।

ভুল চোখই তো। তোমার চোখে আমার বয়স বাড়ে না, ছেলেমেয়ের বয়স বাড়ে না।

মেয়ের বিয়ের কথা উঠছে কেন বলো তো!

দেখতে থাকা ভাল। বয়স হয়ে গেলে আর ভাল পাত্র পাবে না।

না, অপু, তুমি সেজন্য বলছে না।

তবে কেন বলছি।

রাত্রে শোওয়ার আগে বিছানায় দুজন পাশাপাশি আধশোয়া। গায়ে পাতলা কম্বল। একটু বাদেই বেড সুইচ টিপে আলো নিবিয়ে দেবে অপর্ণা। তার আগে দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে আছে নিৰ্ণিমেষ।

মণীষ হঠাৎ বলল, তুমি আমার হার্ট অ্যাটাকের কথা ভেবে বলছে না তো? হয়তো ভাবছো, আমার অনিশ্চিত আয়ু, তাই তাড়াতাড়ি ঝুমকির বিয়েটা দিয়ে দেওয়া ভাল। তাই ভাবছে অপু?

ভারি বিব্রত বোধ করে অপর্ণা। বলে, যাঃ! ওকথা কেন ভাববো? কী যে যা-তা বলো না।

কিন্তু অপর্ণা নিজের অপ্রস্তুত মুখটাকে লুকোতেও পারে না। মণীশের অনিশ্চিত হৃদযন্ত্রের কথা ভেবে ভেবেই যে আজকাল বেশীর ভাগ সিদ্ধান্ত নেয়। এটাও নিয়েছিল।

বাড়ি করার কথা বলবে না অপু?

বাড়ি! হঠাৎ বাড়ি কেন?

তোমার যে চার কাঠা জমি কেনা আছে। আমি বেঁচে থাকতে থাকতে সেখানে একটা বাড়ি করে ফেল। এখনই শুরু করলে আমি হয়তো বাড়িটা দেখেও যেতে পারি।

বেড সুইচ টিপল না অপৰ্ণা। মণীশের দিকে খানিকক্ষণ অপলক চেয়ে থেকে বলল, আমাকে কাঁদাতে চাও? বউয়ের চোখের জল বুঝি খুব ভাল লাগে?

বলতে বলতেই অপর্ণার চোখ ভরে উঠল জলে। মণীশ সেদিকে চেয়ে রইল, কিন্তু একটুও উদ্বেল হল না। তার মুখখানা ক্লান্ত, বিমৰ্ষ, আনমনা। একটু ধরা গাঢ় স্বরে বলল, তুমি বাস্তববাদী অপু। ঠিকই ভাবো। কিন্তু তোমাকে আজ বলি, আমি কিন্তু তোমার চেয়েও বেশি ভাবি। আমার বউ আর তিনটে অপোগও বাচ্চাকে আমি কার জিন্মায় দিয়ে যাবো।

অপর্ণার ফোঁপানির শব্দ শুনতে পাচ্ছিল মণীশ। অন্য সময়ে হলে সে অস্থির হত। সে কারও কান্না সহ্য করতে পারে না। আজ বাধা দিল না। চিত হয়ে শুয়ে সিলিঙের দিকে চেয়ে বলল, আমি প্রভিডেন্ট ফান্ডের লোনের জন্য একটা দরখাস্ত দিয়েছি। বাড়ির প্ল্যান করার জন্য একজন আর্কিটেক্টের সঙ্গে একটু কথাও হয়েছে।

অপৰ্ণা কান্নার মধ্যেই বলল, চুপ করো।

কেঁদো না অপু। তোমার কথাটা আমি অন্যভাবে ধরিনি। নিজের মৃত্যুর কথা আমি তো সবসময়ে ভাবি।

অপর্ণা হঠাৎ তার গলা জড়িয়ে ধরে হেঁচকির মতো শব্দ করে বলে, কেন ভাববে? কত লোক তো হার্ট অ্যাটাকের পরও অনেকদিন বেঁচে থাকে। তুমি কেন থাকবে না।

বেঁচে থাকতে তো আমার আপত্তি নেই অপু। বাঁচলে তো ভালই। কিন্তু হার্ট যখন বিগড়ে বসেছে তখন তাকে বিশ্বাস করা কি ঠিক হবে? আমি বাড়িটাই আগে করে ফেলতে চাই। ঝুমকির বিয়ে নিয়ে তত মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তোমাদের নিরাশ্রয় করে যাওয়াটা অপরাধ হবে।

আবার ওসব বলছো?

তোমার জমিটা আমার পছন্দ ছিল না। কিন্তু মনে হয় তুমি খুব বুদ্ধিমতীর কাজই করেছো।

আর বোলো না। চুপ করো, পায়ে পড়ি।

মণীশ নিজেই বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে বলে, ভাবাবেগ নিয়ে বসে থাকা তো ঠিক নয় অপু। তুমি কাঁদছো কেন? তুমি তো জানো আমি কিরকম ফুর্তিবাজ হুল্লোড়বাজ মানুষ। যতক্ষণ বেঁচে আছি হাসি-খুশি-মজা নিয়েই তো বাঁচতে চাই। কিন্তু সেটা ইদানীং হচ্ছে না। ভবিষ্যতের চিন্তা এসে পড়ছে। কেবল ভাবছি তোমাদের কী হবে। প্রিয়জন মারা গেলে প্রথমটায় শুধু তার অভাবের জন্য হাহাকার হতে থাকে। কিন্তু সেই কষ্টটা বেশীক্ষণ থাকে না। তারপরে আসে অবশ্যম্ভাবী হিসেব নিকেশ। আমাদের জন্য লোকটা কতখানি রেখে গেল, আমাদের কতটা নিয়ে গেল। তখন শুরু হয় লোকটার বিচার।

তোমার মুখের কি কোনও আগল নেই? তুমি কি জানো তোমার প্রত্যেকটা কথা আমার বুকে এসে লাগছে।

কেন জানব না? তবু তোমাকে শক্ত হতে বলি। আমি আগে পয়সা ওড়াতে ভালবাসতাম। একটু বড়লোকী করতে ভাল লাগত। আজকাল দেখ না কত হিসেবী হয়েছি। আমার অপব্যয় তুমি চিরকাল অপছন্দ করতে। আমি আজকাল ভাবি, তুমিই ঠিক।

অপৰ্ণা মণীশের বুকের মধ্যে নিজেকে এগিয়ে দিয়ে বলল, প্লীজ! ঘুমোও।

মণীশের শিথিল একখানা হাত আলতো জড়িয়ে রাখল অপর্ণাকে। আলিঙ্গন করল না। মণীশ চাপা স্বরে বলল, হার্টের একটা ধাক্কা আমার জীবন-দর্শনটাই পাল্টে দিয়ে গেল। মৃত্যুটা কী জিনিস বলো তো অপু! তোমাদের ছেড়ে আমি কোথায় যাবো? তোমাদের ছাড়া আমি যে কিছু ভাবতে পারি না।

অপৰ্ণা মণীশকে প্রগাঢ়ভাবে চুমু খেল। চেষ্টা করল তাকে যৌন আবেগে অন্যমনস্ক করার। কিন্তু পারল না। মণীশ আজ বিষণ্ণ, আনমনা। মণীশকে আজ ভূতে পেয়েছে।

মণীশ অপর্ণাকে কোমলভাবে নিরস্ত করে বলে, আমার মৃত্যুর ঠিক পরের অবস্থাটা নিয়ে আমি খুব চিন্তা করি অপু। আমি মরে গেলে তোমরা খুব কাঁদবে, পাগলের মতো হয়ে যাবে শোকে। আমার মৃতদেহ নিয়ে যেতে দেবে না, খাট ধরে পড়ে থাকবে তুমি …

অপর্ণার হাত এসে মুখটা চাপা দিল মণীশের। অপর্ণা ফের নতুন করে কেঁদে উঠল, ও কথা কি করে বলছে তুমি? এমন করে কেউ বলে?

শোনোই না। এ শুধু কথার কথা তো নয়। জীবনে সত্যগুলোর মুখোমুখি হবে না অপু? শুধু ভয় পেলে, শুধু কাঁদলেই কি হবে?

চুপ করো! চুপ করো। আর বোলো না।

শোনো, অপু, নিষ্ঠুর সত্যটার কথা শোনো। তোমাদের মোক খুব সত্য। আমার জন্য তুমি কাঁদবে, ঝুমকি-বুবকা-অনু কাঁদবে! বাড়িটা ভীষণ ফাঁকা হয়ে যাবে। সব সত্য। কিন্তু শোকের পাথর বুকে চাপা দিয়ে কতদিন থাকবে তোমরা? একদিন চোখের জল মুছে উঠতে হবে তোমাদের। ঘর-গেরস্থালিতে চোখ ফেরাতে হবে। দিনের পর দিন কাটতে থাকবে। শোক কমতে থাকবে। ধীরে ধীরে বাড়িটা আর তত ফাঁকা লাগবে না। সব সময়ে আমার কথা আর মনে পড়বে না। শোক তো পুকুরে ঢিল। ধীরে ধীরে ঢেউ মরে যায়। আবার নিথর হয়ে যায় জল। এ বাড়িতে, এ সংসারেও তেমনি ধীরে ধীরে আমার অভাবটাও তোমাদের অভ্যাস হয়ে যাবে। ছেলেমেয়েরা বড় হবে, ওদের সংসার-টংসার হবে, ছেলেমেয়ে হবে, তোমার হবে নাতি-নাতনী। আমি তখন নেই হয়ে যাবো। শুধু স্মৃতি। তাই না অপু?

অপর্ণা উঠে বসে খোঁপা ঠিক করতে করতে বলল, আমি ঝুমকির কাছে শুতে যাচ্ছি। তুমি একা থাকে। এরকম অসভ্য লোকের সঙ্গে আমি থাকতে চাই না।

দুহাতে অপর্ণাকে ধরে ফেলে মণীশ নিজের বুকে টেনে নেয় তাকে। বলে, শোনো, আমার কথা শেষ হয়নি এখনও।

তুমি ভীষণ খারাপ লোক। আগে জানলে তোমাকে আমি বিয়েই করতাম না।

মণীশ হেসে ফেলে। তারপর অপর্ণাকে একটু আদর করে বলে, মরার কথা বলছি বলে রাগ করছে কেন? মৃত্যুচিন্তা তো খুবই স্বাভাবিক। এই চিন্তাই তো মানুষকে জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ধরো আমাদের যদি মৃত্যু না থাকত, যদি আমরা কেউ বুড়ো অথর্ব না হতাম, হাজার হাজার বছর যদি এরকমই থাকতাম তাহলে কি সেটা ভাল হত। বড় একঘেয়ে হয়ে যেত না কি? এই যে আমাদের বাইশ বছরের বিবাহিত জীবনের সুখ, এটা কি বাইশ হাজার বছর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হত অপু? আমরা দুজনে কি দুজনকে বাইশ হাজার বছর সহ্য করতে পারতাম।

ঘন হয়ে মণীশের বুকে লেপটে থেকে অপর্ণা বলল, পারতাম। আমি পারতাম।

মণীশ একটু হেসে বলল, নিষ্ঠুর সত্য হল, পারতাম না। কেউ পারতাম না। জীবনটা ক্ষণস্থায়ী বলেই কিছুটা সুন্দর। মৃত্যুটা কী তা আজ অবধি কেউ জানে না অপু। মৃত্যুর পরও কি আমি একটুখানি থাকব। আত্মা হয়ে? ভূত হয়ে? যেমন ভাবেই হোক আমি একটু থাকতে চাই। যদি ভূত হই তাহলে এ বাড়িতে তোমাদের কাছাকাছিই এসে থাকব। নিশুত রাতে

এ-ঘর ও-ঘর ঘুরে ঘুরে তোমাদের দেখব, আদর করব।

উঃ মা গো! তুমি বোধহয় মানুষ খুন করতেও পারো। আমার বুকের ভিতরটা কেমন করছে ওসব শুনো ছাড়ো তো আমাকে, ছাড়ো! আমি কিছুতেই তোমার কাছে থাকব না।

তোমাকে ছাড়া কাকে এসব কথা বলব বলো তো! আর কে আমার এসব আবোল-তাবোল শোনার জন্য বসে আছে? এক বুক কথা জমে থাকে, একজন কাউকে তো বলতে হবে! তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার?

এসব বুঝি ভাল কথা।

ভাল নয়, কিন্তু আমার যে এখন এইসব কথাই মনে হয়। মরতে আমার একটুও ভয় নেই, কিন্তু কষ্ট আছে। মনের কষ্ট।

অপর্ণা দুহাতে বেষ্টন করে মণীশকে। সোহগে ভরা গলায় বলে,তুমি মরবে কেন? এসব ডেবো না। তোমাকে আমি ঠিক বাঁচিয়ে রাখব। আমার ইচ্ছের জোর আছে। আমার ভালবাসারও জোর আছে।

কী হয় জানো! আজকাল পৃথিবীকে বড় সুন্দর লাগে। তোমাদেরও যেন বেশী করে ভাল লাগে। এতকাল হেলাফেলা করে যখন বেঁচে থাকতাম তখন পৃথিবীর এত রূপ চোখেই পড়ত না।

প্লীজ। আর নয়। একদিনে অনেক বলেছে। রাত বাড়ছে। তোমার যে ঘুম দরকার।

ঘুমের কথাই তো হচ্ছে। টানা লম্বা চিরদ্রিা। আমার ঘুমোতে ইচ্ছেই করে না আজকাল। ইচ্ছে করে যতক্ষণ পারি জেগে থেকে পৃথিবীটা ভাল করে দেখে নিই।

তোমার সঙ্গে আজ কথাই তো বলতে পারছি না। ঝুমকির বিয়ের কথা তুলেই মস্ত ভুল করে ফেলেছি।

না, ভুল করেনি। বিয়ে দেওয়া যে দরকার তা আমি জানি। কিন্তু কোনটা আগে, কোনটা পরে তা স্থির করাটাই এখন জরুরী।

কী বলছে?

বলছি, আমার হাতে কতটা সময় আছে তা যখন জানি না তখন দেখতে হবে কোন কাজটা আগে করা দরকার, কোনটা পরে হলেও চলবে। আমি প্রথমেই বাড়িটা করে ফেলতে চাই। বুঝলে।

আজ অনেক খারাপ খারাপ কথা বলেছে। তবু তার মধ্যে এই একটা কথা যা শুনতে ভাল লাগছে। আমাদের একটা বাড়ি দরকার। ভাড়ার বাড়িতে থাকতে আমার একটুও ভাল লাগে না। পার্মানেন্ট কিছু না হলে একটা টেনশন থাকেই।

মণীশ একটু হেসে বলে, শুনলে তুমি রাগ করবে। কিন্তু জমির দলিল কখনও মন দিয়ে পড়েছো?

কেন বলো তো!

দলিলে পরিষ্কার লেখা থাকে জমিটা তোমার নয়। সরকারের। তোমাকে কেবল ভোগ দখলের স্বত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর এক ছটাক জমিও তোমার নিজের নয়। আবার দেখ, জমিটা কি সরকারেরই! তাও নয়। কারণ, একদিন, অনেক অনেক বছর পরে পৃথিবীর সব সৃষ্টি যখন ধ্বংস হয়ে যাবে, পৃথিবী যখন একটা ঠাণ্ডা অন্ধকার গ্রহে পরিণত হবে তখন কোথায় সরকার, কোথায়ই বা তার অধিকার? পার্মানেন্ট কথাটাকে বিশ্বাস কোবরা না অপু। আমরা কেউ কোথাও কখনোই পার্মানেন্ট নেই।

তুমি আজ বড্ড জ্বালাচ্ছে তো!

তোমার মনটা খুব খারাপ করে দিলাম তো!

তা তো দিয়েছেই। আমার কান্না দেখতে তুমি বরাবর ভালবাসো।

আচ্ছা, ক্ষমা করে দাও।

ক্ষমা কি এত সহজ? আমার মনটা এমন ভেঙে দিয়েছে যে আর কিছুতেই ভাল হবে না। শুধু যদি অনেক আদর করো আর অনেক ভাল ভাল কথা বলো তাহলে হয়তো একটু ভাল লাগবে।

মণীশ শুধু আর একটু জড়িয়ে নিল অপৰ্ণাকে। তার বেশী কিছু করল না। তেমনি বিষাদ মাখানো গলায় বলে, শুধু এইটুকুর জন্যই কি জীবন?

আবার মাথা গরম হল বুঝি?

না। আমার মাথা খুব ঠাণ্ডা। কিন্তু ভেবে দেখ তো, মানুষ জন্মায় কেন? এই জন্মের উদ্দেশ্যটা কী?

কিছু একটা তো আছেই।

একটা মানুষ জন্মায়, বড় হয়, লেখাপড়া শেখে, রোজগার করে, বিয়ে হয়, সন্তান হয়, টাকা জমায়, বাড়ি করে, তারপর বুড়ো হয় মরে যায় ব্যাপারটা অদ্ভুত না।

কেন, অদ্ভুত কিসের?

শুধু এসবের জন্য তার জন্মানোর দরকারটা কি? তার চৈতন্য, বুদ্ধি, বিচারবোধ, এক্সপ্রেশন এসব তো কাজেই লাগে না। তার অস্তিতুটা একদম একটা ফালতু ব্যাপার বলে মনে হয় না তোমার।

আমি কি তোমার মতো ভাববার সময় পাই।

ভাবো না কেন অপু? ভাল করে ভেবে দেখো তো, এই সামান্য অর্থহীন ক্রিয়াকর্মের জন্য আমাদের জন্মানোর সত্যিই কি জরুরী প্রয়োজন ছিল। জন্মটাকেই আমার আজকাল কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ইচ্ছে করে। জন্মলাম কেন অপু। এই জীবনটা যে বড় অর্থহীন। সম্পূর্ণ মিনিংলেস। ভেবে দেখ তো, সত্যিই এর কোনও অর্থ আছে!

আমার কিন্তু আবার কান্না পাচ্ছে।

কান্নাটা কোনও সলিউশন নয়। আমি তোমার কাছে একটা সলিউশন চাইছি।

আমার কাছে সলিউশন চাইছো! আমি কি একটা সাঙ্ঘাতিক জ্ঞানী লোক।

মণীশ একটু হেসে বলে, জ্ঞানীরাই কি পারে? তারাও তো হাতড়ে মরছে। প্রাণের রহস্য ভেদ করা কি অত সোজা?

তারাই যদি না পারে তাহলে আমি পারব কি ভাবে?

কে যে জানে তাই তো জানি না। কার কাছে যাবো অপু? কে বুঝিয়ে দেবে এই অর্থহীন জীবনের প্রকৃত মানে?

আচ্ছা, আরও লক্ষ লক্ষ লোক তো আমাদেরই মতো বেঁচে আছে। আছে তো! তারা কি এত মাথা ঘামায় এ নিয়ে?

তাই কি আমাকেও মাথা না ঘামাতে বলছো?

বলছি। ওসব ভাবলে তোমার শরীর খারাপ হবে।

মানুষ যদি মাথা না ঘামাত তাহলে পৃথিবীর কোনও সত্যই আবিষ্কার হত না অপু। প্রশ্ন, কেবল প্রশ্ন করে করেই না মানুষ এত জেনেছে। কিন্তু জানা আরও কত বাকি। সবচেয়ে ভাইটান প্রশ্নই হল, এই জন্ম কেন? কেন এই বেঁচে থাকা?

তোমাকে কি আজ রাতেই সব জানতে হবে?

প্রশ্নটা কত সিম্পল দেখ, কত প্রাসঙ্গিক। কিন্তু জবাবটা নিয়েই যত মুশকিল।

এবার ঘুমোও। পায়ে পড়ি।

আজ কি আমার ঘুম আসবে?

ও মা গো! ঘুম না হলে যে ভীষণ খারাপ হবে। তুমি তো ট্রাংকুইলাইজার খেয়েছো! ঘুমের ওষুধ খেয়ে না-ঘুমোনো ভীষণ খারাপ।

তাহলে আর একটা খাই। কিন্তু ঘুমটা চটে গেছে।

ইস্! আমার যে ভয় করছে।

ধুস! ভয়ের কিছু নেই। শরীরটা প্রকৃতির দান। তাতে সবরকম রক্ষাকবচ দেওয়া আছে। অত ভয় পেও না।

আমারই ভুল। আমার মাথা কুটতে ইচ্ছে করছে। কেন যে মেয়ের বয়সের কথা তুলতে গেলাম!

কথাটা তুমি না তুললেও কি আমি ভাবি না ভেবেছে? সবসময়ে ভাবি, আমার কত কী করার আছে, কত দায়িত্ব আমার মাথার ওপর। তার মধ্যে ঝুমকির বিয়ের কথাও যে মনে না হয় তা তো নয়। তুমি কথাটা তুলে কিছু ভুল করেনি অপু।

তোমাকে আর ঝুমকির বিয়ের কথা ভাবতে হবে না। ও মেয়ের বিয়ে দিলে তুমি থাকতে পারবে না। ছেলেমেয়ে তোমার চোখের মণি তা আমি জানি।

তবে কথাটা তুললে কেন?

ঝুমকির কি বিয়ের ইচ্ছে হতে নেই? আমাকে যখন বিয়ে করে এনেছিলে তখন তো শ্বশুরমশাইয়ের মনের খবর নাওনি।

তোমার আমার কথা আলাদা। এখন বলো তো, ঝুমকির কি বিয়ের ইচ্ছে হয়েছে?

তা আমি কি জানি?

তবে যে বলছে ঝুমকির ইচ্ছে হয়েছে!

মেয়েটা তো একটা আস্ত পাগল। বাবাকে সাহায্য করবে বলে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে।

বিয়ের পর প্রথম প্রথম তাদের সারা রাত কেটে যেত গল্প আর ভালবাসার নানা প্রকাশে। আজ বহু দিন বাদে তারা। প্রায় ভোর রাত অবধি জেগে রইল। তারপর ঘুমোলো। দুজনের বাহপাশে বাঁধা হয়ে দুজনে। বহুদিন বাদে। মৃত্যুর ছায়া সাপের মতো দুলতে লাগল শিয়রে। অনিশ্চিত ওই আক্রমণকারী না থাকলে কি এত ভালবাসা হয়।

তিন দিন বাদে বাড়ির প্ল্যান নিয়ে এল মণীশ।

অপু! শীগগির এস। বুকা, ঝুমকি, অনুকে ডাকো। বাড়ির প্ল্যান এনেছি।

সে এত হাঁকডাক করতে লাগলেন যেন প্ল্যান নয়, বাড়িটাই বয়ে নিয়ে এসেছে। দ্যাখো, দ্যাখো বলে সে সবাইকে ডেকে বাড়ির প্ল্যান বোঝাতে লাগল। প্ল্যানটা বেশ বড়লোকী। প্রত্যেক ছেলেমেয়ের জন্য আলাদা ঘর এবং আলাদা স্টাডি। মণীশ আর অপর্ণার শাওয়ার ঘর যদিও একটাই, তবু তাদের আলাদা ড্রয়িং রুম আছে। মোট ছখানা বাথরুমের ব্যবস্থা করেছে মণীশ, তার একটা ঝি-চাকরদের জন্য। ইনডোর গেম এবং জিমন্যাসিয়াম, মিউজিক রুম ইত্যাদিও রয়েছে।

প্ল্যান দেখে অপর্ণা চোখ কপালে তুলে বলে, তুমি ভেবেছেটা কী? আমরা কি কোটিপতি?

আহা, নিজের বাড়ি বলে কথা। এটুকু না হলে আরামে থাকা যায় নাকি?

এটুকু? এটাকে এটুকু বলে? যা প্ল্যান করেছে তাতে আমার চার কাঠাই খেয়ে নেবে। লংকা গাছ, লাউ গাছ লাগাবো কোথায়?

মণীশ খুব দমে গেল; বলল, তাহলে! পছন্দ হয়নি তোমার?

আহা, কেমন বাচ্চাদের মতো অভিমান করছে দেখা পছন্দ হবে না কেন? কিন্তু আমরা তো আর রাজাগজা শেঠিয়া নই। আমাদের এত বড় বাড়ির দরকার নেই তো! বড় বাড়ি মেনটেন করার খুব কষ্ট। ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করবে কে বল তো? ঝি তো পাঁচশো টাকা চাইবে।

কেন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার কিনব।

উঃ, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। আমরা হচ্ছি বাঙালী মধ্যবিত্ত পরিবার। অত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে আমাদের ভাল লাগবে না। যে যার নিজের ঘরে একা একা থাকলে কি ভাল লাগে? আমরা আর একটু ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকব।

ঝুমকি, বুবকা, অনু তিনজনেই সমস্বরে বলে উঠল, তাদের আলাদা আলাদা ঘরই চাই। প্রাইভেসি চাই।

অপর্ণা রাগ করে বলে, এত বড় বাড়ি করতে কত টাকা লাগবে জানিস তোরা? বাপটাকে কি মারতে চাস।

Category: পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০৪৮. দুনিয়াটা চারদিকে হাঁ-হাঁ করা খোলা
পরবর্তী:
০৫০. ভাঙনে নদীর ধারে বাড়িঘর »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑