ধর্ষিতা

ধর্ষিতা

০১.

বাংলাদেশের ব্যাপারে, ভাবাবেগ থেকে আমিও রেহাই পাইনি। কিন্তু তা ছিল খুবই সীমিত। প্রকাশ্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার মতো উদ্বেলতা, কখনওই তেমন বোধ করিনি। গত একাত্তরের পঁচিশ মার্চের পর কয়েক দিন বিশেষ উদ্বেগ বোধ করেছি, পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের সংবাদে ক্রুদ্ধ হয়েছি। পরে ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে, জয়ে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে, খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। এমনকী রেডিয়োতে গলা কাঁপানো নাটকীয় সংবাদ-পাঠ। শুনতে আমার অরুচি হয়নি। তখন আবেগ এবং গর্ব, দুই-ই বোধ করেছি। মনে মনে একটা বিশেষ ব্যাকুলতা বোধ করেছি, বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষদের দেখবার জন্য, কাছে যাবার জন্য। অবিশ্যি অন্য একটা আকর্ষণও ছিল, জেলা ঢাকা আমার জন্মস্থান।

ভাবাবেগ আর আবেগ এক না। ভাবাবেগ অনেকটাই যুক্তি-অমানিত এবং আজ যখন বাংলাদেশের মাটিতে পা দিলাম, তখন আমার চোখ আপনা থেকেই ঝাপসা হয়ে উঠল। বিমানের সহযাত্রীদের দিকে না তাকিয়ে, মাটিতে হাত ঠেকিয়ে, কপালে স্পর্শ করলাম। এবং স্পষ্টই অনুভব করলাম, একটা আবেগের কলকলানি আমার মধ্যে ছলছল করছে।

.

যাই হোক, আপাতত এ সব বক্তব্যগুলো থাক। এখন আমি বিশেষ একজনের কথা বলতে চাই। যাঁর কথা আমি বলতে চাইছি, তাঁর কথাই বলি। আমি একজন মহিলার কথা বলতে চাইছি। ঢাকায় আসার সপ্তাহখানেক পরে ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। একজন বিশিষ্ট সংস্কৃতিবিদ ভদ্রলোকের বাড়িতে রাত্রের খাবারের জন্য আমাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। তাঁর গৃহেই। ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, তিনিও নিমন্ত্রিত ছিলেন। গৃহকর্তা মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেবার সময় জানালেন, তিনি আমার একজন অনুরাগিণী পাঠিকা। আমি কৃতজ্ঞ বোধ করলাম এবং মহিলার শিক্ষা এবং বিদ্যাবত্তার পরিচয় পেয়ে তাঁকে আমার শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারলাম না। তিনি শুধু বিদুষী নন, প্রকৃতপক্ষে রসিক বলতে যা বোঝায় তিনি তা-ই। সাহিত্য, সংগীত, শিল্প সমস্ত বিষয়েই তাঁর দখলের সীমা দিগন্তবিসারী। মহিলাদের বয়স সম্পর্কে স্থির করে কিছু বলা যায় না, তবু আমার মনে হয় তাঁর বয়স চল্লিশের নীচে, সম্ভবত ত্রিশের সামান্য ঊর্ধ্বে। বিদুষী বলার পরেই মহিলাদের রূপের প্রসঙ্গটা এসে যায়। এ মহিলাকে ঠিক রূপসি বলা যায় না, কেননা, তাঁর রূপ ঠিক সেরকম হালকা না, তার অধিক কিছু। যে রূপকে ঝলকানো বলে, এ রূপ সেরকম না। এ রূপ যেন স্নিগ্ধ দীপশিখা এবং তাকে ঘিরে আছে একটি সম্ভ্রমপূর্ণ গাম্ভীর্য। তাঁর শরীর অনুদ্ধত, অথচ সেই গানটির মতোই–টলমল যৌবন সরসী নীরে। কালো চোখের তারা সকরুণ বিষণ্ণ, তথাপি মনে হয় বিদ্যুৎ চমকের মতো হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠতে পারে। অথবা আরও কিছু, বিদ্রূপ বা ঘৃণা। কেশবতী, টিকোলো নাক, বিষোষ্ঠা। কণ্ঠস্বরটি প্রায় বালিকার মতো মিষ্টি আর সুর-ঝংকৃত, তথাপি একটি বিষাদের স্পর্শ যেন রয়েছে। হালকা নীলের ওপরে সাদা ফুল ফোঁটানো শিফনের শাড়ি আর জামা তাঁর গায়ে। কানে অলংকার নেই, হাতের কবজিতে ঘড়ি। এই বাঙালি মহিলার নাম আনোয়ারা খান।

খাবার আগে, খেতে বসে এবং পরেও আনোয়ারা খানের সঙ্গে বাংলাদেশের বিষয়ে অনেক কথা হল। পশ্চিম বাংলার সাহিত্য শিল্প বিষয়ে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন, বললেন এবং আমার লেখার বিষয়েও কিছু কিছু কথা বললেন। তাতে বুঝলাম, তিনি আমার অনুরাগিণী পাঠিকা বটে, কিন্তু তাঁর কাছে আমি সমালোচনার ঊর্ধ্বে না। আমি ওঁর কথাবার্তা আচরণে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

কথায় কথায় তিনি জানতে চাইলেন, বাংলাদেশে আমার আগমনের হেতু কী। নিশ্চয়ই লেখার রসদ সংগ্রহের জন্য? সেটা আমি স্পষ্টভাবে বলতে পারলাম না, কারণ সত্যি আমি লিখব বলেই বাংলাদেশে আসিনি। তবে আমি লেখক, সেরকম যদি কোনও বিষয় আমাকে উদ্বুদ্ধ করে আমি নিশ্চয়ই লিখব। কিন্তু আপাতত বাংলাদেশ নিয়ে ভাবাবেগে চিৎকৃত যা সব লেখা হচ্ছে, সেরকম কিছু লেখবার ইচ্ছা আমার নেই।

আনোয়ারা খানের কালো ডাগর চোখে একটু হাসি দেখা দিল। বললেন, ভাল লাগল আপনার কথা শুনে। কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই গত ন মাসে কী ঘটেছে তার কিছু চিহ্ন দেখতে চাইবেন?

বললাম, নিশ্চয়ই। ইতিমধ্যেই কিছু কিছু দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আমার কথা বলার খুব ইচ্ছা, আর যাঁরা নানাভাবে পাক শিবিরে বন্দি ছিলেন এবং সেই সঙ্গেই নিপীড়িত মেয়েদের বিষয়েও জানতে চাই, সম্ভব হলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

এবার গৃহকর্তা বলে উঠলেন, তা হলে আপনাকে মিসেস খান সাহায্য করতে পারবেন। উনি একজন সমাজসেবিকাও বটে। নিপীড়িত মেয়েদের নিয়ে উনি কাজ করছেন, কয়েকটি চিন্তাশীল প্রবন্ধও ঢাকার কাগজে লিখেছেন।

আনোয়ারা খান একটু বিব্রত হলেন, হাসলেন এবং কয়েক মুহূর্ত কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে রইলেন। তারপরে বললেন, নিপীড়িত মেয়েদের আপনি দেখতে পাবেন। কিন্তু আমার মনে হয়, ওরা আপনার কথার জবাব দিতে পারবে না, কিংবা মুখ ফুটে কিছু বলতেই চাইবে না। অবিশ্যি সেরকম মেয়েও আছে, যে আপনার কথা বুঝতে পারবে, তবু হয়তো জবাব দিতে পারবে না।

কথাটা একদিক থেকে ঠিকই। প্রথম বাধা, আমি পুরুষ। দ্বিতীয়ত, পাক শিবিরের সেই সব নারকীয় অত্যাচারের কথা মুখ ফুটে বলাটা সহজ না। বিশেষত একজন অপরিচিত পুরুষকে। সবথেকে ভয় যেটা, তা হল, যদি সেই সব মেয়েরা তাদের অত্যাচারিত, বিড়ম্বিত জীবনের প্রতি আমার কৌতূহল ও উৎসাহকে কোনওরকম সন্দেহ বা বিদ্বেষের চোখে দেখে! তাদের দিক থেকে সেটা খুব অসম্ভব নাও হতে পারে।

তথাপি আনোয়ারা খান বললেন, আমি কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে আপনাকে দেখা করিয়ে দেবার চেষ্টা করব। অবিশ্যি, অধিকাংশই শারীরিক বা মানসিকভাবে এখনও অসুস্থ।

আহারের পর মিসেস খান তাঁর গাড়িতে আমাকে আমার হোটেলে পৌঁছে দিলেন। যাবার সময় পরের দিন তাঁর গৃহে আমাকে দাওয়াত দিলেন। জানালেন, তিনি সন্ধেবেলা গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। আমি সানন্দেই সম্মত হলাম।

.

পরের দিন, সন্ধে সাতটায় আনোয়ারা খানের টেলিফোন পেলাম। বললেন, তৈরি থাকুন, গাড়ি যাচ্ছে।

বললাম, তৈরি আছি।

আনোয়ারা খান একটু হাসলেন। বললেন, ধন্যবাদ, খুশি হলাম।

পনেরো মিনিট পরেই গাড়ি এল। ধানমণ্ডির বেশ অভিজাত নিরিবিলি পাড়াতে ওঁর বাড়ি। বাগান লন, সবই আছে এবং এক সময় নিশ্চয় যথেষ্ট সাজানো-গোছানো সুন্দর ছিল। এখন যেন একটু শ্রীহীন দেখাচ্ছে। বসবার ঘরটি সুন্দর সাজানো। পিয়ানো রেডিয়োগ্রাম দু পাশে। মেঝেতে মোটা কার্পেট পাতা। ডাইনিং রুমের কিছু অংশ, কাঠের পার্টিশনের পাশ থেকে দেখা যায়। দেখলাম, আমি ছাড়াও একটি দম্পতি এবং একজন মহিলা নিমন্ত্রিত। আনোয়ারা খান পরিচয় করিয়ে দিলেন–বেগম ও সাহেব মজিদ। আর একজন নীলা ইদ্রিস। জানালেন, সকলেই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং আমার লেখার অনুরাগী, যে কারণে বিশেষ করে আজ সন্ধ্যায় এঁদেরও নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অনুরাগী পাঠক-পাঠিকা শুনলেই, কেমন একটা সংকোচ বোধ করি, যদিও একটা খুশির কৃতজ্ঞতাও নিশ্চয়ই থাকে। কথা প্রসঙ্গেই জানা গেল, মজিদ সাহেব মূলত ব্যবসায়ী। ন মাসের যুদ্ধে ব্যবসার অধিকাংশই প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির ওপরে ওঁর কয়েকটি বই আছে। বেগম মজিদ একটি কলেজের অধ্যাপিকা। আর নীলা ইদ্রিসের পরিচয় একমাত্র–আমার সহেলি নীলা ইদ্রিস।

বুঝতে পারলাম না, শ্রীমতী ইদ্রিস বিবাহিতা কি না। বাঙালি হিন্দু বিবাহিতাদের অধিকাংশের মতো ওঁরা সিঁদুর ব্যবহার করেন না। অধিকাংশ বললাম, কারণ সব হিন্দু বিবাহিতারাই আজকাল বোধহয় সিঁদুর স্পর্শ করেন না। যাই হোক, বেগম মজিদ আর নীলা ইদ্রিস, দুজনেই সামান্য কম-বেশি আনোয়ারা খানেরই বয়সি হবেন, তাঁরা নিজেদের তুমি সম্বোধন করছিলেন। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, সবদিক থেকেই আনোয়ারা খান অনেক বেশি উজ্জ্বল। আজ ওঁকে আরও সুন্দর লাগছে, অথচ কোনও অলংকারেই সাজেননি, কেবল বিনুনিহীন জড়িয়ে বাঁধা খোঁপাটি বেশ বড়।

পরস্পরের পরিচয় ইত্যাদির পরে স্বভাবতই সাহিত্যের কথা উঠল। এক এক করে নানা প্রসঙ্গ। উঠছিল, অথচ আনোয়ারা খানের নিজের কথা কিছুই বিশেষ শোনা হল না। আমার মনে নানা কৌতূহল এবং জিজ্ঞাসা, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারছি না। বয়স অনুযায়ী, তিনি বিবাহিতা বলেই বিবেচনা করা উচিত। অথচ তাঁর স্বামীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি, বা তাঁর কথাও কেউ তোলেনি। নতুন পরিচিত একজন মহিলাকে জিজ্ঞেস করতেও বাধে, তাঁর আর কে আছে, কারওকেই দেখতে পাচ্ছি না কেন। কিংবা এমনও হতে পারে, তিনি কুমারী। যাই হোক, নিজের থেকে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব না। যা দেখছি এবং শুনছি তাতেই আমার জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি হোক।

বাংলাদেশের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মর্মন্তুদ ঘটনা আমাদের আলোচনাভুক্ত হল।

 কথায় কথায় গতকালের সেই কথা উঠল, নিপীড়িতা মেয়েদের বিষয়ে আমার কৌতূহল এবং ঔৎসুক্য। আনোয়ারা খানের মতো মোটামুটি সকলের একই মন্তব্য, মেয়েরা কেউই মুখ খুলবে না। বিশেষ করে একজন সাহিত্যিকের সব প্রশ্নের সুবিচার করাও হয়তো তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। প্রসঙ্গক্রমে এঁরা নিজেরাই কোনও কোনও মেয়ের নাম করে, তাদের বিষয় আলোচনা করতে লাগলেন, যাদের আমি চিনি না, দেখিনি। তার মধ্যে কিছু কিছু বীভৎস ঘটনার উল্লেখ ছিল এবং মেয়েদের শারীরিক ক্ষতির ভয়ংকর বিবরণ। মানসিক ক্ষতির চিহ্নও বাইরে থেকে স্পষ্ট। কারোর কারোর আচরণ উন্মাদসদৃশ, প্রলাপ বকে, কেউ একেবারেই মৌন। কেউ কেউ এমনকী স্বৈরিণীর মতো কথা বলে। তার থেকেই বোঝা যায়, কেবল শারীরিক অত্যাচারের আঘাতই না, কেবল মানসিক আঘাত না, ভবিষ্যতে সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠার অনিশ্চয়তা ও ভয়ও অত্যন্ত তীব্র।

আনোয়ারা খান তথাপি বললেন, তিনি আমাকে নিপীড়িত মেয়েদের বিষয়ে জানতে সাহায্য করবেন। কারণ, ওঁর ভাষায়, আপনার জানা দরকার। ওঁর এই বিশ্বাসের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ক্ষমতার বিষয়ে, আমার মন সংশয়াবৃত।

তারপরেই কী কথায়, গানের কথা উঠল। আনোয়ারা নীলা ইদ্রিসকে দেখিয়ে বললেন, আমার এই বন্ধু ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত করতে পারেন।

নীলা ইদ্রিসের ফরসা মুখে একটু লালের ছটা লেগে গেল। চকিত লজ্জিত দৃষ্টিপাতে, একবার আমাকে দেখে নিয়ে বললেন, ছি ছি রুণি, (আনোয়ারার ডাকনাম) কার সামনে কী বলছ?

আনোয়ারাও যেন ওঁর বন্ধুর কথায় একটু অপ্রস্তুত বোধ করলেন। আমার দিকে চেয়ে বললেন, আমি সেরকম কিছু ভেবে বলিনি। নীলার গান আমাদের খুব ভাল লাগে, তাই বলেছি। তাতে কী হয়েছে?

বলতে বলতে উনি আবার নীলা ইদ্রিসের দিকে তাকালেন, এবং তারপরে মজিদ দম্পতির দিকে। আমি অবাক হয়ে বললাম, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। মনে হচ্ছে আমি কোনও অপরাধ করেছি। যেন আপনাদের যা ভাল লাগে আমার তা লাগতে নেই।

সকলেই হেসে উঠলেন। নীলা বললেন, না না, তা না, কলকাতায় আপনারা কত ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন, সেই তুলনায় বলতে গেলে আমি তো কিছুই জানি না!

আমি বললাম, সেই কিছু না জানাটাই কিছু দিন না, দেখি স্বাদ নিতে পারি কিনা।

বেগম মজিদ বললেন, ঠিক ঠিক। নীলা, তুমি গাও।

নীলা ইদ্রিসের সংকোচ ও লজ্জা তথাপি যেন কাটতে চায় না। একবার আনোয়ারার দিকে তাকিয়ে ঈষৎ কুটি করে বললেন, কী যে করো!

আনোয়ারা আমার দিকে একবার দেখে ঠোঁট টিপে হেসে বললেন, ঠিকই করেছি।

অগত্যা, নীলা ইদ্রিস কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সামনের দিকে তাকিয়ে গান ধরলেন: সুখে আমায় রাখবে কেন, রাখো তোমার কোলে–যাক না গো সুখ জ্বলে!…

গান শুরু হতেই মনে হল ঘরের পরিবেশ বদলে গেল এবং সেই সঙ্গে সকলের মুখের চেহারাও। কেউ কারও দিকে তাকিয়ে নেই, সকলেই যেন নিজেদের মধ্যে ডুবে গিয়েছেন। আনোয়ারার নত মুখ দেখতে পাচ্ছি না, মজিদ দম্পতি ভিন্ন ভিন্ন দিকে তাকিয়ে আছেন, আর নীলা ইদ্রিস আমাকে যে কেবল অবাক করলেন তা নয়, তাঁর গভীর সুর ঝংকৃত গানে আমার বুক টনটনিয়ে দিলেন। এখন তিনি চোখ বুজে আছেন এবং জাকুটিযুত ব্যথার অভিব্যক্তি ফুটেছে অন্তরাতে, যাক না পায়ের তলার মাটি, তুমি তখন ধরবে আঁটি…

গান শেষ হবার আগেই আনোয়ারা হঠাৎ উঠলেন। তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে চলে যাবার আগে, অস্ফুটে হয়তো কিছু বললেন। আমি ছাড়া, মজিদ সাহেব সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন। আবার একভাবেই চুপ করে রইলেন। আমি ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারলাম না, মনে হল, কী একটা যেন ঘটে গেল!

.

গান শেষ হল। নীলা ইদ্রিস চোখ মেললেন। স্পষ্টতই তাঁর চোখে একটি সকরুণ বিষাদের ছায়া। আনোয়ারা ফিরে এলেন। মনে হল, ওঁর চোখ আরক্ত ভেজা ভেজা, মুখেও রক্তোচ্ছাসের আভা। অনুভব করলাম, এখানে শুধু গান গাওয়া হয়নি, তার চেয়ে বেশি কিছু হয়েছে যা কথার ব্যাখ্যা থেকে দূরে–অনির্বচনীয়। কেউ যখন কিছু বলছেন না, তখন আমিই মুখ খুললাম, নীলা ইদ্রিসের দিকে চেয়ে বললাম, কিছু না জানাতেই যদি এমন বুক ভরে ওঠে, তা হলে কিছু জানার দরকার নেই। আর একটা শোনাবেন?

নীলা ইদ্রিসের বিষাদ-আচ্ছন্ন মুখে একটু সলজ্জ হাসি দেখা দিল। আনোয়ারা যেন কৃতজ্ঞ চোখে আমার দিকে তাকালেন। মজিদ দম্পতির দৃষ্টি নীলার দিকে, আমারই প্রার্থনা তাঁদের চোখে। নীলা আনোয়ারার দিকে একবার দেখে, টপ্পা আঙ্গিকে গাইলেন, আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায় কেমনে, নয়নের জল বহিয়া নয়নে।.

সকলের অভিব্যক্তি সেই একই এবং এবারও গান, গানের থেকে কিছু বেশি। আনোয়ারা এবার উঠে গেলেন না, কিন্তু মুখ তোলেননি একবারও। নীলা গান করে যেন নিজের কথাই বলছেন। গান শেষে আনোয়ারার মুখে সেই রক্তোচ্ছ্বাসেরই আভা দেখলাম। চোখ ভেজা না, সজল মেঘের মতো ছায়াভরা।

নীলা ইদ্রিসের দিকে চেয়ে বললাম, বাংলাদেশে এসে এটা একটা বড় পাওয়ানা পেলাম।

 নীলা লজ্জা পেয়ে হেসে বললেন, কী যে বলেন!

আনোয়ারা মুখের ছায়ায় হাসি ফুটিয়ে বললেন, কিন্তু ধন্যবাদটা আমারই পাওয়ানা।

বললাম, হাজার বার।

 সকলের হাসির মধ্যেই আনোয়ারা বললেন, এবার খেতে যাওয়া যাক।

রাত্রিও হয়েছে প্রায় দশটা। অতএব খাবার টেবিলে গেলাম সবাই। আয়োজন প্রচুর সুপ্রচুর বলা উচিত। মাছের আয়োজনই বেশি। একটি বয়স্ক লোক এবং অল্পবয়সি একটি মেয়ে খাবারদাবার এগিয়ে দিল, জল ঢেলে দিল। আর কারওকেই দেখতে পেলাম না। বাড়িটা ছোটখাটো না, দোতলা বড় বাড়ি। মনে হয় সবই খালি আর নিঝুম। খেতে খেতে নানা কথা উঠল এবং আনন্দের বিষয়, মজিদ দম্পতি এবং নীলা ইদ্রিস তাঁদের গৃহে আমাকে নিমন্ত্রণ জানালেন।

পরিশেষে মজিদ দম্পতির সঙ্গে নীলা ইদ্রিসও বিদায় নিলেন। নীলাকে তাঁরাই পৌঁছে দেবেন। আমার বিদায়ের প্রাক মুহূর্তে, আনোয়ারা বললেন, এক মিনিট বসুন, আসছি।

বলে বাড়ির ভিতরে অদৃশ্য হলেন। প্রায় তিন-চার মিনিট পরে ফিরে এলেন। বললেন, আমি আপনাকে নিপীড়িতা মেয়েদের সঙ্গে দেখা করাব। তবু আপনার অনেক কৌতূহল, তাই জন্য এটা আপনাকে দিচ্ছি, পড়ে দেখবেন। একরকম ডায়েরি বলতে পারেন, একটি নিপীড়িত মেয়েরই।

আমার দিকে মলাটবিহীন একটি নোটবুক বাড়িয়ে দিলেন। দেখে মনে হল, শিথিলবন্ধন নোটবুকটি নতুন না। সামনে পিছনে অনেকগুলো পাতাই নেই। পাতা উলটে মনে হল, ভিতরের কিছু পাতায় বাংলায় কিছু লেখা রয়েছে। আনোয়ারা আবার বললেন, এটা ঠিক রোজনামচা না। যে লিখেছে, যেদিন যখন যা মনে এসেছে তা-ই লিখেছে। এটা এখন আমার সংগ্রহে আছে। আপনাকে পড়তে দিলাম, পড়ে ফেরত দেবেন। কেবল একটা আরজি, কারওকে দেখাবেন না, বলবেন না।

আমি কৃতজ্ঞতা এবং উৎসাহের সঙ্গে বললাম, নিশ্চয়ই আপনার কথা থাকবে, আমাকে বিশ্বাস করবেন।

আনোয়ারা বললেন, করছি বলেই তো দিলাম।

আমি ওঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ওঁর কালো চোখের গভীরে বহু দুরে যেন কিছু চিকচিক করছে। যেন আমাকে কিছু বলছেন বা প্রশ্ন করছেন, কিন্তু তা অনুচ্চারিত। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আগামীকালই এটা আপনাকে আমি ফেরত দেব।

আনোয়ারা বললেন, আপনার পড়া হয়ে গেলে দেবেন।

আমার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত এলেন। গাড়ি প্রস্তুত ছিল, ড্রাইভার সামনেই দাঁড়িয়ে। আনোয়ারা আবার বললেন, আমি কি যাব আপনার সঙ্গে?

আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, না না, এত রাত্রে আপনি আর আসবেন না। আজ চলি, আদাব।

আনোয়ারা বললেন, খোদা হাফেজ।

গাড়িতে উঠে আর একবার ওঁর গভীর চিকচিক চোখের সঙ্গে চোখাচোখি হল। হাসলেন, চিবুকের কাছে হাত তুললেন। গাড়ি এগিয়ে গেল।

আমি হোটেলে ফিরে বাইরের পোশাক বদলে একটু ঝাড়া হাত পা হয়ে নিলাম। কিন্তু আমার মন এবং চোখ টেনে রেখেছে নোটবুকটি। যে নিপীড়িতা মেয়ে লিখতে জানে, সে নিশ্চয়ই অনেক কিছু ব্যক্ত ও ব্যাখ্যা করতে পারে। তীব্র একটা কৌতূহল আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। বেড সুইচ জ্বালিয়ে আমি নোটবুকের পাতা উলটালাম।

সামনের দিকে কয়েকটি পাতায় কিছুই লেখা নেই। পাতায় পাতায় মাস এবং দিনাঙ্ক ইংরেজিতে ছাপা। প্রথম লেখা পাতাটিতে রবীন্দ্রনাথের ইতস্তত কয়েকটি কবিতার লাইন লেখা, নজরুলের দু-একটি গানের কলি। এক পাশে ছোট একটি গোলাপ আঁকা, যেন রুমালের কোণে ফুল তোলা। যদিও কলমের কালিতে আঁকা। হাতের লেখা গোটা গোটা, স্পষ্ট, পরিচ্ছন্ন।

.

 পরের পাতা ওলটালাম। বিশেষ কিছু লেখা নেই। মাঝখানে লেখা রয়েছে, আশায় রইলাম। তার নীচেই ছোট একটি পালতোলা নৌকা আঁকা। তার নীচে কিছু লিখে আবার ভাল করে কেটে দেওয়া হয়েছে। পড়া যায় না। বাঁ পাশের নীচের দিকে লেখা রয়েছে, পেট্রল-১৯ গ্যালন। রমজন–৪ টাকা। একেবারে নীচে, কলম বুলিয়ে বুলিয়ে মোটা করে লেখা আছে, মুশতাক। গোটা পাতায় আর কিছুই নেই। তারপরে দু পাতায় কিছুই লেখা নেই। আবার পরের পাতায় লেখা রয়েছে-খোদা। আমার মন বড় খারাপ লাগছে। কী ঘটবে কিছুই বুঝতে পারছি না। বাইরে অশান্তি, ঘরেও অশান্তি। হাসিনা আর মজিদ ভাইও আজ ইন্ডিয়াতে চলে গেল। রোজিকে আগেই আগরতলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সে নাকি এখন কলকাতায় আছে। মুশতাক এত গম্ভীর হয়ে গেল কেন। দুদিন ধরে সে আমার সঙ্গে প্রায় একটা কথাও বলেনি। তার আব্বাজানের সঙ্গে কথাবার্তা তো অনেক দিন ধরেই বন্ধ। দেখেশুনে আমার মনের অবস্থা এমন হয়েছে যে, নামাজে বসলেও আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। শহরটা যেন কবরখানার মতো নিঝুম আর নিশ্চুপ। মোরশেদ বাড়িতে না থাকলে, একটা সামান্য আওয়াজেও ভীষণ চমকে উঠি। বুকের মধ্যে ধ ধ করতে থাকে। বিশেষ করে দূর থেকে যখন কোনও ভারী ট্রাক বা জিপের আওয়াজ আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে, আর বাড়িতে আমি, আবদুল আর কুলসম এবং আম্মা ছাড়া কেউ থাকে না, তখন মনে হয় সেই ভয়ংকর আওয়াজ যেন আমার বুকে চেপে আসছে। আবদুল নিরীহ ভিতু প্রকৃতির চাকর। কুলসম ছেলেমানুষ, গ্রাম্য মেয়ে। আম্মা বুড়ি মানুষ। তাদের উপর আমার কোনও ভরসা নেই। রাস্তায় একটি লোক নেই। জানালার পরদা ফাঁক করে যেদিকেই তাকাই একটা মানুষও দেখতে পাই না।

খোদার শুকুর, আজ পর্যন্ত কোনও মিলিটারি গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়নি। কিন্তু মন মানে না। কিছু কিছু খবর যা পাই, ভরসা বলে কিছু করার নেই। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলেই হল। তবে আমাদের কি ওরা কিছু করবে? পাশের বাড়ির হাফেজ সাহেব সাইকেল রিকশায় চেপে অফিসে যান, ভয়ে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করেন না। মোরশেদ তো রোজই গাড়ি নিয়ে বেরোয়, গাড়িতেই ফিরে আসে৷ সেটাও কেমন খারাপ লাগে। তার যেন কোনও দুশ্চিন্তা নেই, ভয় ভাবনা নেই। দেশে এখন যা। চলছে সে বিষয়ে তার মতামত একেবারে অন্যরকম। আমার ভাল লাগে না। মুশতাকের সঙ্গে তা নিয়ে। তো প্রায়ই কথা কাটাকাটি হত। এখন মুশতাক মুখ বন্ধ করেছে। সেটা আরও খারাপ। যখন কথা কাটাকাটি করত, তখন তবু তাকে বোঝা যেত। এখন কিছুই বলে না। সে তার আব্বাজানের সামনে পর্যন্ত আসে না। মোরশেদ জিজ্ঞাসাবাদ করে, ছেলেটা কোথায় কী করছে। কিন্তু সে যতই জিজ্ঞাসাবাদ করুক, আমি জানি, সেও মুশতাক সম্পর্কে মনে মনে শক্ত হয়ে থাকে। বুঝি, কিছু বলি না। আমি মনে মনে মুশতাকেরই পক্ষে। ও আমার ছেলে বলে নয়। মোরশেদকে ছাড়া আমি দ্বিতীয় পুরুষকে জানি না। তার মতো স্বামী কজনের হয়? তাকে নিয়ে আমি সুখী, গর্বিত। কিন্তু একমাত্র মোসলমান বলেই, পাঞ্জাবিদের অন্যায় অত্যাচার মেনে নিতে পারি না। তাদের সঙ্গে বোঝাঁপড়ার আর কিছু নেই। তাদের বুঝতে আর বাকি কিছু নেই। তারা বিশ্বাসঘাতক, তাদের প্রত্যেকটি কাজ তাই প্রমাণ করেছে। অথচ মোরশেদ এখনও আশা রাখে, পশ্চিমের সঙ্গে একটা মিটমাট করে নেওয়া যায়, করে নিতে হবে। এটাই মোরশেদের বক্তব্য, তবু ইন্ডিয়ার সঙ্গে কিছুতেই হাত মেলানো চলবে না। আমি জানি, মোরশেদ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি। কিন্তু দিনের পর দিন যা ঘটছে, তারপরে আমি আর তার মতামতের উপর আস্থা রাখতে পারছি না। এটাও জানি, তার সঙ্গে তর্ক করেও লাভ নেই। সেও মোটামুটি আমার মনোভাব বোঝে, তর্ক করতে চায় না। আমিও চাই না। আমার ভয় অন্যখানে। এখন মোটামুটি যা পরিস্থিতি, মোরশেদকে লোকে হয়তো দেশের শক্ত ভাবছে। পাশের বাড়ির হাফেজ সাহেব আর তেমন। আসেন না। তাঁর সেই সরল হাসি আর নেই। বুঝতে পারি, আমাদের যেন কেমন এড়িয়ে চলেন। বেগম। হাফেজও তাই। আমাদের এদিকে জানালা খোলা থাকে না। অথচ মুশতাকের সঙ্গে তাদের খুব ভাব। হাফেজ সাহেবের ছেলের সঙ্গে মুশতাক বেশি সময় কাটায়। এখন ইস্কুল কলেজ বলে কিছু নেই, লেখাপড়ারও কথা নেই। কিন্তু মুশতাক, হাফেজ সাহেবের ছেলে আতাউর আর নুরুল, আরও কয়েকটি ছেলে, যারা আমাকে চাচি বা খালু বলে ডাকে, তাদের হাবভাব চলাফেরাও যেন কেমন। ছেলেগুলি যেন কী একটা করছে! সামনাসামনি কিছু দেখতে বা শুনতে পাই না। মনে মনে ভয় পাই। পল্টনের সৈয়দ আলি সাহেবের ছেলে তো নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের দলে যোগ দিয়েছে। আরও অনেকেই চলে গেছে। জোয়ান ছেলেদের পাঞ্জবিরা বিশ্বাস করে না। নিয়মিত খোঁজখবর রাখে। প্রত্যেককে নিয়মিত থানায় হাজিরা দিতে হয়। মুশতাককেও দিতে হয়। মোরশেদকে হয় না। মোরশেদের সঙ্গে তাদের এখনও বন্ধুত্ব আছে। সে যে পাঞ্জাবিদের সঙ্গে মেলামেশা করে, তার কথা থেকে বুঝতে পারি। মোরশেদ যথেষ্ট বুদ্ধিমান, তাকে আমার বলার কিছু নেই। তবু এক-আধবার না বলে পারি না। সে গায়ে মাখে না। বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস হয় না। আমার মনে হয়…

লেখা এখানে শেষ হয়েছে। দেখেই বোঝা যায়, হঠাৎ শেষ হয়েছে। হয়তো কেউ এসে পড়েছিল অথবা যে কোনও কারণেই হোক, লেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এবং লক্ষণীয়, ন মাসের কোন সময়ে কবে এ কথাগুলো লেখা হয়েছে তার কোনও তারিখ নেই। কিন্তু পড়লেই বোঝা যায়, সেই অভিশপ্ত ন মাসের কোনও একদিন লেখিকা এ সব কথা লিখেছিল। এ লেখা থেকে মোটামুটি তার পরিবারের একটা ছবি এবং মনোভাব সম্পর্কে কিছু জানা যায়। অবস্থাটা জটিল, ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।

তারপরের লেখায়, তারিখ দিনক্ষণ স্পষ্ট করে লেখা।

১৪ই জুন–সোমবার।

গত শুক্রবার দিন আম্মা ইন্তেকাল করলেন। অসুখ-বিসুখ কিছু করেনি। মোটা মানুষ, চলাফেরা বিশেষ করতে পারতেন না। দোতলার সিঁড়িতে উঠতে গিয়ে হঠাৎ হার্টফেল করেছে। কোনও শব্দই পাওয়া যায়নি। কুলসম দেখতে পেয়ে চিৎকার করেছিল। আমি টেলিফোন করে মোরশেদকে অফিসে খবর দিয়েছিলাম। মোরশেদকে আমি কখনও কাঁদতে দেখিনি, শুক্রবার দিন দেখেছি। তার চোখে জল। ছিল। মুশতাক আম্মার চোখের মণি ছিল। সে তার দাদির বুকের ওপর পড়ে শিশুর মতো কেঁদেছিল। আমি তাঁর আদর করে ডাকা দুলহীন বিবি ডাক বারে বারে শুনতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, তিনি যেন জায়নামাজে বসে মোটা কাঁচের চশমা চোখে তসবিহ পড়ছেন।

আম্মার বয়স হলেও তিনি সংসারে এতদিন বর্তমান থাকায় আমি যেন অনেক নিশ্চিন্ত ছিলাম। তাঁর অভাব আমি কোনওদিন মেটাতে পারব না। দেশের এখন দুঃসময়। আত্মীয়স্বজনরা অনেকেই শহরে নেই। যারা আছে, তারাও কেউ প্রায় আসতে পারেনি। নিতান্ত বাধ্য না হলে কেউ বাড়ির বাইরে বেরোয় না। লোকের কথা শোনা যায় না। পাঞ্জাবি আর পাঠানদের হাতে শহর মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ। করে। মুশতাক আর তার বন্ধুদের কাছে খবর পাই, দেশের ভিতরে ও ইন্ডিয়ার সীমান্তে রীতিমতো যুদ্ধ হচ্ছে। যে সময়ে আরও বেশি মানুষ কাছে থাকলে ভরসা পাওয়া যায়, সেই সময়েই আম্মা আমাদের ছেড়ে গেলেন। আমাদের বড় বসি।

৩রা জুলাই–শনিবার।

গতকাল অভাবিত ব্যাপার হয়ে গেল। আমাদের সন্ধেবেলাগুলো, বলতে গেলে অন্ধকার ঘরে, চুপচাপ কাটে। জানালার মোটা পরদা টেনে, আমি আর মোরশেদ বসে থাকি। গাড়ির শব্দ পেলে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে দম বন্ধ করে থাকি। মোরশেদ অবশ্য অনেক কথা বলে। সত্যি বলতে কী, আমি সবসময়ে তার সব কথা শুনি না। মুশতাক তার আব্বার সামনে এসে বসে না। সে দোতলায় দরজা-জানালা বন্ধ করে রেডিয়োতে ইন্ডিয়া আর স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ শোনে। মোরশেদ সেটা পছন্দ করে না। বরং সে স্পষ্ট জানিয়েই দিয়েছে, ও সব মিথ্যা আর ভিত্তিহীন সংবাদ শোনা চলবে না। এ হুকুম আমিও মানতে পারি না। আমিও সুযোগ পেলে লুকিয়ে শুনি। এমনিতেই তো লুকিয়ে শুনতে হয়। মোরশেদের জন্যও লুকোতে হয়।

যাই হোক, গতকাল মোরশেদ অফিস থেকে ফিরতে দেরি করেছিল। সন্ধ্যার পরে সে ফিরেছিল। তার সঙ্গে ছিল তিনজন পাঞ্জাবি সশস্ত্র মিলিটারি। আমি তো প্রথমে ভীষণ ভয় পেয়ে গেছলাম। একটা চরম দুর্ঘটনার আশঙ্কা করেছিলাম। কিন্তু গাড়ি বারান্দায়, মোরশেদের এবং সকলের হাসি শুনে, অবাক। হয়ে গেলাম। আমি বসবার ঘর থেকে উঠে পাশের ঘরের পরদার পাশ থেকে সব দেখছিলাম। দেখলাম, দুজন বন্দুক বাগিয়ে ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। আর একজন কোমরে ঝোলানো রিভলবার, মোরশেদের পাশে পাশে ঘরে এসে ঢুকল। মোরশেদ তাকে উর্দুতে খাতির করে বসতে বলল। দুজনেই মদ্য পান করেছে, বুঝতে পারলাম। দুজনেরই মেজাজ বেশ হাসিখুশি। পাঞ্জাবিকে অফিসার বলে মনে হল। মোরশেদ তাকে বসতে বলে, ডাইনিং রুমের দিকে গেল। অফিসার কোমর থেকে রিভলবারটা বের করে সামনের টেবিলের উপর রাখল। আমার পিছনে আবদুল আর কুলসম দাঁড়িয়েছিল। তাদের চোখে ভয়। আমি পা টিপে টিপে, অন্য দিক দিয়ে, ডাইনিং রুমের দরজায় গিয়ে দেখলাম, মোরশেদ। রেফ্রিজারেটর খুলে হুইস্কির বোতল বের করছে। বোতল নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, সে আমাকে দেখতে পেল। একটু অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বলল, বুলবুলি (সে আমাকে আদর করে এই নামে ডাকে) এসো। আমি তাকে হাতের ইশারা করে, ভিতরের ঘরে চলে গেলাম। মোরশেদ আমার পিছনে পিছনে এল। গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কাকে নিয়ে এসেছেন? মোরশেদ বলল, এ একজন লেফটানেন্ট কর্নেল, ইয়াকুব। লোকটা ভাল, আমার সঙ্গে পুরনো আলাপ। সিক্সটিসেভেনে রাওলপিণ্ডিতে আমাকে খুব খাতির করেছিল। এখানেও মাঝে মাঝে দেখা হয়। আজ হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় বলল, আমার মোকামে আসবে। আমিই বরং ভয় পাচ্ছিলাম, ওর কোনও বিপদ হলে, আমার আর রক্ষা থাকবে না। আমি অবাক হয়ে বললাম, তবু নিয়ে এলেন? মোরশেদ গায়ে না মেখে হেসে বলল, কী করব বুলবুলি, ছোকরা কিছুতেই ছাড়ল না। কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাবে। ঘরে কি একটু খাবার-টাবারের জোগাড় আছে? আমি বললাম, আছে। কিন্তু কাজটা কি আপনি ভাল করলেন? পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে। মেলামেশা কি ঠিক হচ্ছে! মোরশেদের ভুরু কুঁচকে উঠল। কিন্তু হেসে বলল, ভুলে যেও না, আমিও পাকিস্তানি, তবে হ্যাঁ, বাঙালি আমি। সেটা আমাদের নিজেদের বোঝাঁপড়ার ব্যাপার। থাক, ও সব কথা পরে হবে, কাবাব নিয়ে তুমি নিজেই এসো৷ আমার মনটা বিরূপ হয়ে উঠল। আমি পর্দানশিন নই। সকলের সঙ্গে বসে কথা বলতে পারি। মোরশেদ আর তার বন্ধুদের মদ্যপানের আসরে আমিও কথা বলি, গল্প করি। বন্ধুদের বিবিরাও থাকে। কিন্তু পাঞ্জাবি মিলিটারি অফিসারের সামনে যেতে আমার মন চাইল না। বললাম, আমাকে যেতে বলবেন না, আমি আবদুলকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। মোরশেদ মানতে চাইল না, সে সকাতর আদরের গলায় বলল, আমার বুলবুলি, তোমার বেইজ্জত হবে বুঝলে, আমি তোমাকে আসতে বলতাম না। লেঃ কর্নেল ইয়াকুবের সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবে, সে কী রকম খাঁটি ইমানদার মোসলমান। বাঙালিদের সে কত পেয়ার করে। কাবাব নিয়ে তুমি পাঁচ মিনিটের জন্য এসো।

মোরশেদ এভাবে বললে, আমি তার কথা ঠেলতে পারি না। আমি চুপ করে রইলাম। মোরশেদ আবদুলকে গেলাস আর পানি দিতে বলে, ড্রয়িং রুমে চলে গেল। আমি কুলসমকে ডেকে নিয়ে রেফ্রিজারেটার থেকে কাঁচা গোস্ত বের করে দিলাম। রসুই ঘরের দিকে যেতে গিয়ে, দরজার পাশে মুশতাককে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মুশতাকের এরকম চোখের নজর, মুখের ভাব কখনও দেখিনি। তার চোখ বিস্ময়ে ভরা, কিন্তু ঘৃণায় জ্বলজ্বল করছে। আমি নিজেই যেন লজ্জায় গুটিয়ে গেলাম। নিজের ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। নজর ফিরিয়ে রসুই ঘরে চলে গেলাম। সেখান থেকে মোরশেদ আর পাঞ্জাবি লেঃ কর্নেলের হাসি আর কথা শুনতে পাচ্ছিলাম, অস্পষ্টভাবে। কুলসম ছুরি দিয়ে কাবাবের সাইজে গোস্ত কাটছে। আমি জানালার কাছে গিয়ে, হাফেজ সাহেবের বাড়ির দিকে তাকালাম। অন্ধকার চুপচাপ, কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। তবু আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, দোতলার একটা জানালায়, অস্পষ্ট ছায়া ছায়া দুটি মুখ। বোধ হয় হাফেজ সাহেব আর তাঁর বিবি। আমি আস্তে আস্তে জানালার কাছ থেকে সরে এলাম। কাবাব বানাতে গেলাম। কিন্তু আমার মন অশান্তিতে, অস্বস্তিতে, ভয়ে ভরে উঠছে। কেবলই মন বলছে, মোরশেদ এটা ঠিক করেনি। শহরের সব জায়গা থেকেই পাঞ্জাবিদের নানান অত্যাচারের সংবাদ পাই। বিভিন্ন জায়গায় তারা বধ্যভূমি তৈরি করেছে, সেখানে রোজ অনেক বাঙালিকে নিয়ে গিয়ে খুন করছে। মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের ওপর বীভৎস অত্যাচার করছে। যত দিন যাচ্ছে, পাঞ্জাবিদের খুন আর অত্যাচারের মাত্রা বাড়ছে। আর এদিকে আমি এক পাঞ্জাবির জন্য কাবাব বানাচ্ছি! মুশতাকের ঘৃণা ঝলকানো চোখ দুটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মোরশেদের এখনও কীসের আশা? এ তো অন্ধ ইন্ডিয়া-বিরোধিতা ছাড়া আর কিছুই না। উঃ খোদা, মোরশেদকে তুমি সুমতি দাও। সে দুর্বুদ্ধিপরায়ণ নয়, তাকে বিবেচনার শক্তি দাও।

কাবাব বানিয়ে, বসবার ঘরে যাবার আগে একবার থমকালাম। বাইরের লোকের সামনে এভাবে যাব? কখনও যাইনি। কিন্তু প্রসাধন তো ক মাস ধরেই ভুলেছি। এখন আর আমার প্রবৃত্তি হল না, শাড়ি বদলাই, মুখ ধুই, সুর্মা মাখি, পাউডার বুলাই। আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে, আবদুলের হাতে কাবাবের প্লেট দিয়ে তাকে আমার পিছনে পিছনে আসতে বললাম। মুশতাক কোথায় কে জানে। আমি ডাইনিং রুমের ভিতর দিয়ে বসবার ঘরে গেলাম। আমাকে দেখেই মোরশেদ বলে উঠল, এসো। এসো লেঃ কর্নেল ইয়াকুব দাঁড়িয়ে উঠল। মোরশেদ আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। আমি একটু হেসে, লেঃ কর্নেলকে বসতে বলে, আবদুলের হাত থেকে প্লেট নিয়ে টেবিলে রাখলাম, চামচ ন্যাপকিন এগিয়ে দিলাম। মোরশেদ আমাকে বসতে বলল। আমি একটা সোফায় বসলাম। সেই সময়েই গাড়িবারান্দার দিকে আমার চোখ পড়ল। লাইট মেশিনগান বাগিয়ে ধরে দুজন পাঞ্জাবি বাইরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার রমজান গাড়িবারান্দার সিঁড়ির কাছে বসে আছে।

লেঃ কর্নেল ইয়াকুব আমাকে উর্দুতে বলল, শামসের (মোরশেদ) সাহেবের কাছে শুনলাম, আপনি বাংলাতে এম এ পাশ করেছেন।আমি একটু লজ্জিত হয়ে বললাম, সে কিছু না। ইয়াকুব কাবাব মুখে দিল। মোরশেদ জিজ্ঞেস করল, কাবাব কেমন হয়েছে?ইয়াকুব বলল, ডিলিসিয়াস। মোরশেদ বলল, যাই হোক, আমরা যে বিষয়ে কথা বলছিলাম তাই হোক। আপনি আমার বিবিকে বলুন, মুক্তিযুদ্ধ-টুদ্ধ ব্যাপারটা আসলে কী। আমরা কী রকম মিথ্যা প্রচারের শিকার হয়ে পড়েছি।

মোরশেদ কেন এ সব প্রসঙ্গ তুলছে? আমি মনে মনে খুব অস্বস্তি বোধ করলাম। মুশতাক নিশ্চয়ই কোথাও থেকে এ সব কথা শুনছে। আমি লেঃ কর্নেল ইয়াকুবকে দেখছিলাম। টকটকে ফরসা, হুইস্কির। নেশায় মুখচোখ লাল, কালো কুচকুচে চুল। মোরশাদের থেকে সে বয়সে কিছু কমই হবে। হাসতে হাসতে বলল, এ আর বলবার কথা কী আছে। ইন্ডিয়ান আর্মির কুত্তারা উনিফর্ম ছেড়ে বাঙালি। মুক্তিযোদ্ধা সেজে আমাদের বিরুদ্ধে লড়ছে। প্রচার করছে, মুক্তিযোদ্ধারা লড়ছে। হয়তো আওয়ামী লীগের কিছু বিপথগামী ছোকরা পালিয়ে গিয়ে তাদের সাহায্য করছে। কেউ বলতে পারবে না, ইস্ট পাকিস্তানের ভিতরে কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে। ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে লড়াই হচ্ছে বলেই, যা হচ্ছে সবই সীমান্তে। এটাকে পাকিস্তানের সঙ্গে ইন্ডিয়ার একটা অঘোষিত যুদ্ধ বলতে হবে। ইন্ডিয়া পাকিস্তানকে টুকরা করতে চাইছে, আফসোসের কথা, কিছু বাঙালি সেই ফাঁদে পা দিচ্ছে। তারা জানে না, ইন্ডিয়া আগুন নিয়ে খেলা করছে। ইয়াকুব হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিল, কাবাব চিবোতে চিবোতে আমার দিকে তাকাল। তার আরক্ত চোখের নজর আমার শরীরে ঘুরে বেড়াল। আমি মোরশেদের দিকে তাকালাম। আমার গায়ের মধ্যে ঘিন ঘিন করে উঠল। ঘৃণায় মনটা জ্বলে গেল। কিন্তু মোরশেদও হুইস্কির গেলাস নিয়ে ব্যস্ত, সে আমার দিকে তাকাল না। মোরশেদের উপর আমার বিরক্ত লাগছে। ইয়াকুবের এতগুলো কথার অনেক জবাব আমার দিতে ইচ্ছা করছিল। প্রবৃত্তি হচ্ছিল না। মোরশেদের মতো আমি তার মিথ্যাগুলো বিশ্বাস করিনি। ইয়াকুব নিজেকে খুব চালাক মনে করছিল, তাই ইন্ডিয়াকে গালিগালাজ করছিল। কিন্তু তারা যে বাঙালিদের রোজ খুন করছে, মেয়েদের লুট করছে, বেইজ্জত করছে, সে কথা একবারও উচ্চারণ করল না। জানি, আমি সে কথা বলতে গেলে, পাঞ্জাবি লেঃ কর্নেলের মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। হয়তো মোরশেদেরও। কারণ মোরশেদ এখনও কেমন অন্ধ।

ইয়াকুব হেসে আমাকে বলল, মিসেস শামসের, আশা করি আপনি সেরকম বেকুফ বাঙালি মহিলা না, যারা ইন্ডিয়ার কথায় বিশ্বাস করছে। কোনও খাঁটি মোসলমান তা করতে পারে না। আমার হয়ে মোরশেদ জবাব দিল, লেঃ কর্নেল সাহেব, আমরা খাঁটি মোসলমান। পাকিস্তান আমরা আদায় করেছি, তাকে ছাড়তে পারি না। কিন্তু বাঙালিকে তার মর্যাদা দিতে হবে, আর সেটা আমরা, পুব আর পশ্চিম, নিজেদের মধ্যেই মিটমাট করে নিতে চাই। তার মধ্যে আমরা কাউকে নাক গলাতে দেব না। মোরশেদ এখনও এ সব কথা বলে। সে কি গত মার্চ মাসের সেই সব দিনগুলোর কথা ভুলে গেছে। সে আওয়ামী লীগের সমর্থক না হতে পারে, কিন্তু বাস্তব ঘটনাকে অস্বীকার করে কেমন করে। আমার আর এ সব শুনতে ইচ্ছা করছিল না। মোরশেদ যখন কথা বলছিল, ইয়াকুব তখন তার চোখের দিকে অপলক তাকিয়েছিল। তার চোয়াল শক্ত দেখাচ্ছিল। মোরশেদের কথা শুনে, সে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জরুর জরুর, নিজেদের মধ্যে একটা মিটমাট তো করতেই হবে। তার আগে আমরা ইন্ডিয়ার লড়াইয়ের খোয়াবটা মিটিয়ে নিই। বাঙালি বেয়াদপদের শায়েস্তা করতে হবে। আপনাদের সামনে। বলতে আমার বাধা নেই, রেগুলার ফোর্স, ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স আর মুজাহিদ মিলিয়ে সামান্য কম এক লাখ ফোর্স আমাদের এখানে আছে। আর আর্মসের তো কথাই নেই।..

আমার আর এ সব শুনতে ভাল লাগছিল না। মনে হচ্ছিল, ইয়াকুব যেন আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে। আমি ইংরেজিতে বললাম, কিছু মনে করবেন না, আমি একটু কাজে যাচ্ছি। ইয়াকুব আবার উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করল। তার চোখের দিকে তাকাবার আমার আর দরকার ছিল না। তার চোখ। কী খুঁজছে জানি। কিন্তু মে মাস থেকে এই জুলাইয়ে পড়েছে, পাঞ্জাবিরা যে এর মধ্যে রাজাকার। আর আলবদর বাহিনী তৈরি করছে, মুশতাকের কাছে সে খবরও আমি পেয়েছি। ডাইনিং রুম দিয়ে পাশের ঘরে যেতে মুশতাককে আমি দেখতে পেলাম। বসবার ঘরের দিকে, বন্ধ দরজার কাছে সে চুপ। করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতে পেয়ে কাছে এগিয়ে এল। তার মুখ শক্ত, চোখে সেই জ্বলন্ত ঘৃণা। সে কিছু বলতে গেল, আমি তার মুখে হাত চাপা দিলাম। ফিসফিস করে বললাম, এখন না, লোকটা চলে যাক, তারপর।মুশতাক তার মুখের ওপর থেকে আমার হাত সরিয়ে নিচু গলায় বলল, আব্বাকে আমি কিছুই বলব না, ওনার সঙ্গে আমার আর কোনও কথা নেই। উনি নিজের বিপদ নিজেই ডেকে এনেছেন। দেখবেন, এর কী রেজাল্ট হয়। আমি কিছু বলবার আগেই ইয়াকুবের গলা শুনতে পেলাম, আপনার ছেলে আছে, তা তো বলেননি। তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিন। আমরা মা ও ছেলে চোখাচোখি করলাম। মোরশেদ কী বলল, শুনতে পেলাম না, গেটের কাছে একটা ভারী গাড়ির গর্জন শোনা গেল। তারপরেই কিছু বুটের আওয়াজ আমাদের বসবার ঘরের দরজার কাছে এগিয়ে এল। ইয়াকুবের গলা শোনা গেল, কী খবর শাহজাদা, তোমাদের কাজ হয়ে গেছে? জবাব শোনা গেল, জি। আপনাকে নিতে এলাম। ইয়াকুবের গলা শোনা গেল, চলো। গুডনাইট মিঃ শামসের, আবার দেখা হবে। সকলের বেরিয়ে যাবার পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। গাড়ির গর্জন দূরে চলে গেল। শুনতে পেলাম, মোরশেদ ড্রাইভারকে বলছে, রমজান, তুমি গাড়িটা গ্যারাজে তুলে দাও। আবদুল, দরজা বন্ধ করে দে। মুশতাক তাড়াতাড়ি আমার কাছ থেকে সরে গেল। আমি ভয় পেলাম, সে হয়তো মোরশেদের সঙ্গে ঝগড়া করতে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি তার পিছনে পিছনে গেলাম। কিন্তু মুশতাক সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় চলে গেল। আমি বাইরের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই মোরশেদ এগিয়ে এল। আমি পরিষ্কার বললাম, আপনি আর কোনওদিন পাঞ্জাবি মিলিটারিকে নিয়ে বাড়িতে আসবেন না। এর পরিণতি মোটেই ভাল হবে না। খোদার কাছে হাজার শুকুর, যেন এ কথা রাষ্ট্র না হয়। আমি বেশ উত্তেজিত ছিলাম। মোরশেদ একটু অবাক হল, বলল, এ সব কে বলল, মুশতাক বুঝি? আমি বললাম, না, মুশতাক বলবে কেন, আমিই বলছি। আপনার চিন্তা আপনি মনে মনে রাখুন। মোরশেদ যেন কেমন চিন্তিত হয়ে পড়ল। অথচ আমি ভাবছিলাম, সে হয়তো রেগে উঠবে। বিশেষ করে, তার পেটে তখন যথেষ্ট হুইস্কি ছিল। বলল, কিন্তু বুলবুলি, লোকটা আমাদের বিশ্বাস করে, তা না হলে সামরিক শক্তির কথা এভাবে বলত না। আমি বললাম, আমার মনে হয়, সে আমাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেবার জন্য ও সব বলছিল। তা ছাড়া লোকটাকে আমার একটুও ভাল লাগেনি, নজর খুব নোংরা। আমি বুঝতে পারি, আপনি এখনও কী করে এদের বিশ্বাস করেন। আপনি কি কোনও খবরই জানেন না, ওরা কী করছে? মোরশেদ বলল, শত হলেও এরা মিলিটারি, পাকিস্তান ভাঙবার চক্রান্ত যদি হয়। আমি মোরশেদকে বাধা দিয়ে বললাম, আপনি কি চান, বাঙালির কবরের ওপরে ইস্ট পাকিস্তান থাকবে? মোরশেদ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে বলল, খোদা জানেন কী ঘটছে।বলে সে গোসল করতে চলে গেল। মোরশেদকে চিন্তিত দেখে আমি যেন একটু শান্তি পেলাম।..

.

০২.

 এরপরে যে ঘটনা লেখা হয়েছে, তার কোনও তারিখ নেই, কিন্তু দিনের একটা হিসাব থেকে বোঝ যায়, ঘটনা জুলাই মাসের মধ্যেই ঘটেছিল। হাতের লেখা অত্যন্ত দ্রুত, ফলে অক্ষর অসমান, লাইন আঁকাবাঁকা।

হায় আল্লা, কদিন ধরে আমার মনে এ ভয়টাই হচ্ছিল। মুশতাক চলে গেছে। আজ দশ দিনও হয়নি, সেই লেঃ কর্নেল এসেছিল। সেই থেকেই, এ কথাটা আমার মনে হচ্ছিল। কারণ, পরের দিন, মুশতাক আমাকে বলেছিল, সে আর এভাবে দিন কাটাতে পারছে না। কীভাবে দিন কাটালে ঠিক হয়, তাও সে বলেনি। পরশু রাত্রে মুশতাক চলে গেছে।

একলা মুশতাক না। ড্রাইভার রমজানও চলে গেছে। কাল সকালে তাকেও আর দেখা যায়নি। মুশতাক আমার জন্য একটা চিরকুট রেখে গেছে, সকালবেলা আমি যেখানে নামাজ পড়তে বসি, তার কাছেই। লিখে গেছে, আম্মা, চললাম। একজন খান সেনাও যতদিন বাংলাদেশে থাকবে, ততদিন ফিরব না।–তোমার মুশতাক। আর কিছুই সে লেখেনি। কিন্তু সে কী করতে গেছে, তা বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি। নামাজে বসব কী, আমার প্রাণটা হাহাকার করে উঠল। মুশতাককে আর কোনওদিন দেখতে পাব কি না, জানি না। তাড়াতাড়ি মোরশেদকে ঘুম থেকে তুলে, তাকে চিরকুটটা দেখালাম। সে সেটা দেখে হতভম্ব হয়ে বসে রইল। একটু পরেই, কুলসম এসে আমাকে বলল, পাশের বাড়ি থেকে হাফেজ বেগম এসেছেন। আমি নীচে নেমে গেলাম। তাঁর মুখ থেকে শুনলাম, তাঁদের দুই ছেলে আতা আর নুর চলে গেছে। বলতে বলতে তাঁর চোখে জল এসে পড়ল। বললেন, আমার দুধের বাচ্চারা কোথায় লড়াই করতে গেল?

কিন্তু খোদার শুকুর, বেলা দশটার সময় পাঞ্জাবি মিলিটারি এসে আমাদের কয়েকটা বাড়ি ঘিরে ফেলল, আর নাম বলে বলে, গালিগালাজ করে ছেলেদের খোঁজখবর করল। একদল বন্দুক বাগিয়ে বাইরে পাহারা। আর একদল বন্দুক উঁচিয়ে বাড়ির মধ্যে। মোরশেদ তখনও বাড়ি থেকে বেরোয়নি। সেই লেঃ কর্নেল ইয়াকুব এল। তার চোখা গোঁফে হাসি, কিন্তু চোখ দুটো যেন জ্বলছে। তার পাশে একটা লোক, মনে হল বাঙালি, লোকটার নজর দেখলে মনটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। ইয়াকুব বলল, আসলামওয়ালাইকোম্ শামসের সাব, আপনার ছেলের সঙ্গে আলাপ করতে এলাম, তাকে ডাকুন। মোরশেদ বলল, সে তো ঘরে নেই। কোথায় গেছে? বোধহয় কাছেই কোথাও গেছে। কখন? মোরশেদ বলল, ঘণ্টাখানেক আগে। ইয়াকুব সঙ্গে সঙ্গে বলল, কী করে সে তা গেল? বাইরে তো কারফিউ রয়েছে। তার কি পাশ আছে? মোরশেদ কোনও জবাব দিতে পারল না। ইয়াকুব সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক বাগানো দুজন খানের দিকে ফিরে বলল, বাড়ির অন্দরে যাও, খুঁজে দেখো৷ আমি ডাইনিংরুমে ছিলাম। তাড়াতাড়ি রসুইখানায় চলে গেলাম। পাঞ্জাবিরা বাড়ির মধ্যে ঢুকল, সঙ্গে সেই বাঙালিটা। তারা একতলা দোতলা, বাগান, গ্যারাজ সব ঘুরে দেখল। মুশতাক কি জানত ওদের খুঁজতে আসবে? অথবা। পাঞ্জাবিরাই কিছু জানতে পেরেছিল? তারা রসুইখানা থেকে বাথরুম, কিছুই বাদ দিল না। আবদুল আর কুলসম আমার কাছেই দাঁড়িয়েছিল। আমি পাঞ্জাবিদের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম না। কুলসমের চৌদ্দ বছর বয়স। তার দিকে পাঞ্জাবি দুটো তাকাল, যেরকম লোভী কুকুরের মতন তাকাল, দেখে আমার গায়ের মধ্যে শিউরে উঠল।

তারা মুশতাককে পেল না। ইয়াকুব চিৎকার করে আমাকে বাইরের ঘরে তলব করল। জিজ্ঞেস করল, আপনি কি জানেন, আপনার ছেলে কোথায়? এই সেই লেঃ কর্নেল ইয়াকুব, মোরশেদ যাকে খাঁটি ভদ্রলোক মনে করেছিল। আমি বললাম, না। ইয়াকুব যেন খুবই দুঃখিত; বলল, কিছু মনে। করবেন না মিসেস শামসের, আমাকে কর্তব্য করতে হচ্ছে। আমাদের কাছে খবর আছে, আপনার ছেলে। মুক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। আপনি কিছু জানেন? আমি একই জবাব দিলাম, না।ইয়াকুবের তীক্ষ্ণ সন্দিগ্ধ চোখের সঙ্গে আমার নজর মিলল। ইয়াকুব হঠাৎ হেসে উঠল। হাসিটার কী অর্থ বুঝলাম না। সে মোরশেদের দিকে ফিরে বলল, খোদার কী মর্জি জানি না। এখন চললাম। তখন হাফেজ সাহেবের বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল, তার সঙ্গে অন্যান্য পাঞ্জাবি গালিগালাজ। আমাদের মোকাম থেকে সবাই বেরিয়ে গেল। পরে জানলাম, ওরা হাফেজ সাহেবকে মারধোর করেছে। আমাদের পিছনের বাড়ির, সামাদ সাহেবের বারো বছরের ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেছে। এই প্রথম দেখলাম, মোরশেদ চোখ বুজে চুপ করে সোফায় বসে আছে।

কিন্তু অবাক হবার মতো আরও ঘটনা ঘটল। গতকালের ঘটনার পরে, আজ সকাল বেলা দেখছি, হাফেজ সাহেবের বাড়ি একেবারে চুপচাপ, দরজা-জানালা সব বন্ধ। কেমন যেন সন্দেহ হল। আবদুলকে দেখতে পাঠালাম। সে এসে বলল, সব বন্ধ, তালা ঝুলছে। কখন সবাই চলে গেল? নিশ্চয়ই রাত্রের অন্ধকারে, চুপিসাড়ে। কিন্তু আমাদের একটু জানাল না? আশেপাশের বাড়িগুলোতে লোক আছে কি না বুঝতে পারলাম না। সামাদ সাহেবের বাড়িতে টেলিফোন আছে। সেখানে টেলিফোন করলাম। বেশ খানিকক্ষণ বাজবার পরে জবাব পাওয়া গেল। যেন ভয় পাওয়া সন্দিগ্ধ মোটা ভাঙা গলা। জিজ্ঞেস করলাম, কে কথা বলেন? উত্তর এল, আপনি কে? আমি আমার পরিচয় দিলাম। তখন সামাদ সাহেব নিজের নাম বললেন। আমি হাফেজ পরিবারের অন্তর্ধানের কথা বললাম। জানতে চাইলাম, তাঁরাও সেরকম ভাবছেন নাকি। সামাদ সাহেব বললেন, না, এখনও সেরকম কিছু ভাবিনি। ছেলেটার কথাই কেবল ভাবছি। মনে হল সামাদ সাহেব কাঁদছেন। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মোরশেদকে গিয়ে সব কথা বললাম। মনে হল মোরশেদের চোখও ছলছল করছে। সে বলল, বুলবুলি, মুশতাকের সঙ্গে আমার কতদিন একটা কথাও হয়নি। শুনে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। হা খোদা! আজ মোরশেদের সে কথা মনে পড়ল। কিন্তু আমার মুশতাক শুনতে পেল না। আমি নিজেকে স্থির রেখে, মোরশেদের বুকে হাত চেপে বললাম, হবে, মুশতাক ফিরে এসে আবার আপনার সঙ্গে কথা বলবে। মোরশেদ অন্য দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইল।

এখন বিকাল পাঁচটা। আসমান মেঘে ঢাকা। ঘর অন্ধকারময় লাগছে। যাই দেখি মোরশেদ কী করছে। দূর থেকে কি ট্রাকের গর্জন ভেসে আসছে?.

আমি খুব দ্রুত পরের পাতা ওলটালাম। সাদা, কিছু লেখা নেই। অথচ প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে এমনভাবে এখানে শেষ হয়েছে, মনে হয়, তারপরেই কিছু ঘটেছে। পর পর বেশ কয়েকটি পাতা উলটে গেলাম, পাছে কোনও ঘটনা ছেড়ে যাই। কিন্তু হাজার হাজার মেয়ের ভাগ্যে যা ঘটেছে, এই লেখিকা মিসেস শামসেরের জীবনে এ পর্যন্ত তার কিছুই ঘটেনি দেখছি। আরও কয়েকটি সাদা পাতা উলটে, আমি যখন হতাশ হতে চলেছি, তখনই দেখতে পেলাম, একই হাতের লেখা, ভিন্ন তার রূপ। হস্তাক্ষর অনেক বড়, বড়, অথচ যেন কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা, জড়ানো। এবং প্রথম শুরুটা দেখেই বোঝা যায়, লেখিকা মোটেই কিছু লিখবে কিনা, তা স্থির করে উঠতে পারেনি। কারণ প্রথম একটু লিখে, অনেকখানি ফাঁক দিয়ে আবার লিখেছে, আর সেখানেই একটা তারিখ বসানো আছে।

এই তো আমার সেই নোটবুক। কিন্তু আর আমার কী লেখার আছে? কী ভেবে আজ আবার আমি হাতে কলম তুলে নিলাম? খোদা, আমাকে দিয়ে তোমার এই সংসারে আর কী দরকার আছে? বেঁচে থাকবার সব প্রয়োজন কি আমার ফুরিয়ে যায়নি? মোরশেদ বা মুশতাকের কোনও অসুখবিসুখ করলে আমার মন যখন খারাপ হয়ে যেত, তখন আম্মা আমাকে কাছে নিয়ে বলতেন, আমার তাবত এবাদতের বদলে, আমি ওদের হায়াত মেগে নিচ্ছি। আমি জীবনে কখনও অন্যায় করিনি। কিন্তু সারা জীবনে আমিও তো কোনও অন্যায় করিনি। আমিও তো আমার এবাদতের বদলে স্বামী-পুত্রের হায়াত চেয়েছিলাম!…

তারপরে অনেক নীচে, লেখিকা মোটামুটি মনস্থির করে তার জীবনের এক মর্মন্তুদ ঘটনা লিখেছে:

.

২১-১-৭২, শুক্রবার।

জুলাই মাসের সেই সর্বনাশা বিকাল, এই নোটবুকে লিখতে লিখতেই সেই যে মোরশেদের কাছে যাচ্ছিলাম, আর দূর থেকে যেন ট্রাকের আওয়াজ কানে এসেছিল, সেই আওয়াজ যেন হাজারটা বাঘের মতন গর্জন করে আমাদের গোটা পাড়াটা ঢেকে ফেলেছিল। মোরশেদ তখন তার ঘরে নামাজ পড়া শেষ করে বসে ছিল। কুলসম চা দিয়ে গেছে, পেয়ালায় ধোঁয়া উঠছে। তখনও চুমুক দেওয়া হয়নি। আমাকে দেখে সে ডাক দিল, আসো মুশতাকের আম্মা। সেই প্রথম আমাকে সে মুশতাকের আম্মা বলে ডাকল। এরকমভাবে সে কখনও ডাকেনি। দু দিন সে তার কাজে বার হয়নি। আগের দিনের ঘটনার পর থেকে তার যেন আমূল পরিবর্তন হয়েছিল। আমি তার কাছে এগিয়ে যাচ্ছি, ট্রাক আর জিপের গর্জনও যেন আমাদের ঘিরে ফেলল। তারপরেই দুমদাম আওয়াজ কানে এল। চিৎকার আর গালিগালাজের সঙ্গে হুকুম শোনা গেল, গোলি চালাও। কোথায় কী ঘটছে বোঝবার আগেই আবদুল ওপরে ছুটে এল। সে তখন কাঁপছিল। সে বলল, হাফেজ সাহেবের বাড়ির দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে ওরা তছনছ করছে। আমাদের আর আশপাশের বাড়ির দরজায় দরজায় সব বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক মিলিটারি একসঙ্গে এসেছে।

মোরশেদ তখন ঘরোয়া লেবাজ পরেছিল। সেটাকে কোমরের ওপরে একটু টেনে দিয়ে, জানালা সামান্য একটু ফাঁক করে দেখল। তার পাশেই আমি দাঁড়িয়েছিলাম। চুপিচুপি বললাম, কী দেখছেন? মোরশেদ আস্তে আস্তে জানালাটা বন্ধ করে, নিচু স্বরে বলল, ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের লোকেরা এসেছে। যমে ছাড়লেও এরা নাকি ছাড়ে না। কথাটা শুনে, আমার বুকের মধ্যেও কেঁপে উঠল। আমিও শুনেছি, এই এফ. আই. ইউ. চক্র বড় ভয়ংকর। সামরিক গুপ্তচর বাহিনী। এরা যাদের পিছনে লাগে, তাদের ছাড়ে না। কাউকে বিশ্বাস করে না, নিজেরা যে সংবাদ পায়, তা ছাড়া আর কিছু বিশ্বাস করে না। সমস্ত ঢাকা শহর নাকি এদের হাতে।

আশপাশের গোলমাল আর চিৎকারের মধ্যে, আমাদের নীচের দরজায় দুমদাম আওয়াজ হল। মোরশেদ ঘরের বাইরের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আমি তার হাত ধরে বললাম, আপনি কোথায় যান? নীচে। না, আপনি যাবেন না, এদের আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। মোরশেদ বলল, আমাকে অনেকে চেনে, আমাকে ওরা মারবে না।বলে সে নীচে নেমে গেল। আমি পিছন পিছন এসে ডাইনিং রুমের পরদার পাশে উঁকি দিলাম। মোরশেদ দরজা খুলে দিতেই কয়েকজন তার ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল। বন্দুকের নল তাগ করা। একজন, মনে হল সে একজন পাঞ্জাবি ক্যাপটেন, মোরশেদের বুকের ওপর রিভলবারের নল ঠেকিয়ে, নিজের ভাষায় বলল, কুত্তার বাচ্চা বাঙালি, তোর ছেলে কোথায় আছে বল, আর পাশের কুত্তারা কোথায় গেছে, তাও কবুল কর। আমার বুকের মধ্যে এমন করছিল, যেন ফেটে যাবে। কিন্তু মোরশেদ ক্যাপটেনের জবাবের ধারকাছ দিয়ে গেল না। আমি দেখলাম, তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে। তবু সে শান্ত আর গম্ভীর স্বরে বলল, মোসলমান হয়ে তুমি মোসলমানের সঙ্গে কথা বলতে শেখনি? বলামাত্রই সেই শয়তান মোরশেদের গালে প্রচণ্ড জোরে একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল। আমি পরদার আড়াল থেকে আর্তনাদ করে উঠলাম। মোরশেদ তবু টাল সামলে দাঁড়াল। শয়তানটা বলল, বাঙালি যদি মোসলমান হয়, তবে বেইমান কে? আমি ও সব বাজে কথা শুনতে চাই না। যা পুছ করছি, তার জবাব দাও। মোরশেদ বলল, আমি জানি না। মিলিটারি ক্যাপটেন মোরশেদের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বলল, এখনও বলছি, কবুল কর। মোরশেদের ঠোঁটের কোণে রক্ত। সে আবার বলল, আমি জানি না। সঙ্গে সঙ্গে একটা মাত্র বাড়ি কাঁপানো আওয়াজ। মোরশেদ ঘরের মেঝেয় লুটিয়ে পড়ল, একটা আওয়াজও করল না। আমি চিৎকার করে, মোরশেদের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে গেলাম। কিন্তু এখন আর মনে করতে পারি না, আমি কী বলে কেঁদেছিলাম, মোরশেদকে আমি স্পর্শ করতে পেরেছিলাম কি না! আমার জ্ঞান ছিল না।

এর পরে, প্রথম আমার জ্ঞান হয়, ঠোঁটের ওপর আগ্রাসী দংশনে। জ্ঞান হওয়া মাত্র মুখ ছাড়াতে গেলাম। পারলাম না। আমার শরীরের ওপরে মানুষ। সম্ভবত সেই মাত্রই আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম। আমার শরীর যে প্রায় বিবস্ত্র, তাও টের পেয়েছিলাম। আমি যে কোথায়, তাও বুঝতে পারছিলাম না। চিৎকার করতে পারছিলাম না। নিজের গোঙানি নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম। এমন কী চোখ চেয়েও, লোকটার মুখ আমি ভাল করে দেখতে পাইনি। যতই হাত-পা ছুড়ি সেই আসুরিক শক্তির সঙ্গে আমি পেরে উঠছিলাম না। আমাকে জোর করতে দেখে, সে আমাকে পাগলা কুত্তার মতো দংশন করেছিল। আমার সারা গায়ে আঘাত, প্রচণ্ড আঘাত করেছিল। কী ভাবে পশুটা তার কামনা চরিতার্থ করেছিল, আমি জানি না। আবার জ্ঞান হারিয়েছিলাম….

তারপরে যখন আমার জ্ঞান হয়েছিল, প্রথম চোখ খুলে দেখছিলাম, মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। প্রথমে কিছুই মনে করতে পারলাম না। আবার চোখ বুজলাম। আবার চোখ খুললাম। মাথার উপরে ফ্যান ঘুরছে। আবার চোখ বুজে গেল, আর তখনই মোরশেদের কথা মনে পড়ে গেল।–মোরশেদ রিভলবারের গুলি খেয়ে পড়ে গেল। তারপরেই সেই ভয়ংকর যন্ত্রণা আমার ঠোঁটে, শরীরে, আর সেই জানোয়ারের অত্যাচার। আমি তাড়াতাড়ি উঠতে গেলাম। পারলাম না। আমার সারা গায়ে, কোমরে অসম্ভব ব্যথা। চোখ চেয়েই ভাবলাম, কোথায় রয়েছি? শোবার ঘরেই খাটে শুয়ে আছি নাকি? পাশ ফিরে তাকালাম। প্রায় আমার শিয়রের কাছেই একটা সোফা। মেঝেতে বেগুনি রঙের কার্পেট পাতা। আস্তে আস্তে অন্যদিকে পাশ ফিরলাম। একটা আলো জ্বলছে, বাতাসে ঝোলানো আলো দুলছে। দেয়াল ঘেঁষে টেবিল। তার ওপরে দু-তিনটে গেলাস, পানির জাগ, হুইস্কির বোতল, ছাইদানি, সিগারেটের প্যাকেট, টেবিলের ধারে দুটো চেয়ার। টেবিলের এক পাশে একটা আলমারি। সবই আমার অচেনা। এ তো আমার ঘর না! এত ঘটনার পরেও, আমি যেন নতুন করে আতঙ্কে কেঁপে উঠলাম। তবে আমি কোথায় আছি? পশুরা আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছে? এবার শরীরের সমস্ত যন্ত্রণাকে অবজ্ঞা করে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। বসতেই, সামনাসামনি একটা আয়নায় নিজেকে দেখতে পেলাম, আর তৎক্ষণাৎ আমার গা থেকে কিছু কোলের কাছে ঝরে পড়ল। ইয়া আল্লা! আমার জামা আর অন্তর্বাস। সবই আমার বুকের ওপর জড়ো করা ছিল। তাড়াতাড়ি সেগুলো তুলে বুকের কাছে চেপে ধরলাম। আয়নার দিকে তাকালাম। আয়নাটা একটা ড্রেসিং টেবিলের সঙ্গে জোড়া, খাট থেকে দূরে, দেয়াল ঘেঁষে। ঘরের আলো তেমন জোর না। ভাল করে কিছু দেখা যায় না। দূর থেকে আয়নায় যে মুখ দেখতে পাচ্ছি সেটা আমার নিজের মুখ বলে যেন চিনতে পারছি না। ঠোঁটের চার পাশে যেন কিছু লেগে আছে। সেখানে টনটনে ব্যথা। নিচু হয়ে নিজেকে দেখলাম। শাড়ি নেই, শুধু সায়াটা রয়েছে। নিজের এই অবস্থা দেখে, আর কিছু হল না, কেবল কান্না পেল। হা মোরশেদ, তুমি কোথায়! এই তোমার বুলবুলির হাল। মুশতাক, তুই কোথায়! এই তোর আম্মার নসিব। আর মনে পড়ল, ফরিদপুরের কোন পরিবারের মেয়ে আমি! যে পরিবারকে সারা বাংলাদেশের লোক এক ডাকে চিনত।

কিন্তু কী হবে এ সব ভেবে? এ ভাবে কেঁদে? কান্না থামল। আমার এই ছিঁড়ে খাওয়া শরীরের দিকে তাকিয়েই বা নতুন কী দেখব? জামাটা ছিঁড়ে ফেলেছে খানিকটা। অন্তর্বাসটা আস্ত। বিছানায় বসে বসেই, সেগুলো যথারীতি পরে নিলাম। তারপরে আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালাম। দাঁড়াতে কষ্ট, পা দুটো কাঁপছে। একটুখানি দাঁড়িয়ে থেকে, আয়নার সামনে গেলাম। ঠোঁটের চারপাশেই রক্তের দাগ। গালে নীল দাগ। জানি, জানোয়ারের আগ্রাসী শোষণের আর দংশনের চিহ্ন।

বড় পিপাসা। ইচ্ছা না থাকলেও, জানোয়ারদের পানীয় জাগ তুলে গলায় পানি ঢালোম। মনে হয়েছিল, ভিতরে যেন একটা জ্বলন্ত চুলায় কলকল করে পানি পড়ল। আগুন নিভল, ঠাণ্ডা হল না। তখন ঘরের চারদিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম। এতক্ষণ কোনও আওয়াজ কানে আসছিল না। এখন মনে হল, কোথাও যেন, অনেক দূরে মানুষের গলা এক-আধবার শোনা যাচ্ছে। আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু কোথায় আছি আমি? দুটো দরজা দেখতে পাচ্ছিলাম। দুটো জানালা, পরদা ঢাকা। জানালা দুটোর কাছে গিয়ে পরদা সরিয়ে দেখলাম কাগজ লাগানো কাঁচের পাল্লা। তার ফাঁক দিয়ে কিছুই দেখা যায় না, ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। মনে পড়ে গেল, বাইরে ব্ল্যাক আউট। দরজার কাছে গিয়ে, হাতল ঘুরিয়ে ঠেলতেই। দরজা খুলে গেল। অন্ধকার ঘর, বোধহয় গোসলখানা। ডান দিকে সুইচ দেখে টিপলাম। দেখলাম, তা-ই। ভিতরে গিয়ে দেখি, অপরিষ্কার, দুর্গন্ধ। একটা স্ট্যান্ডে দুটো ব্যবহৃত টাওয়েল ঝুলছে, তার পাশেই ওটা কী ঝুলছে? তাজ্জব হয়ে দেখলাম, মেয়েদের একটি অন্তর্বাস। তারপরেই চোখে পড়ল, এক কোণে লেডিজ স্লিপার। এ কার ঘর? কোথায় আছি জানি? এ সব কি আমারই মতো কোনও হতভাগির অন্তর্বাস আর স্লিপার? একদিকের দেয়ালে, উঁচুতে স্কাইলাইট, সেখানেও অন্ধকার। বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে, অন্য দরজাটার হাতল ধরে টানতে গেলাম। বাইরে থেকে বন্ধ, হাতল ঘুরল না।

তখন কত রাত্রি, জানি না। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল। মোরশেদের সেই গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়া ছবি আবার আমার চোখে ভেসে উঠল। মোরশেদ কি তখন বেঁচে ছিল? বেঁচে আছে? খোদা, তাই যেন হয়। কিন্তু আমার এই মুখ যেন তাকে আর দেখতে না হয়। মুশতাককেই বা এ মুখ আর দেখাব কেমন করে? এখন খোদার কাছে একমাত্র আরজি, মুশতাক যেন তার জবান রাখতে পারে। একজন খান সেনাও যেন এ দেশের মাটিতে না থাকতে পারে।

.

হঠাৎ মনে হল, কোথায় যেন কারা চিৎকার করে কথা বলছে। আমি দরজায় কান পাতলাম। মনে হল, দূরে বুটের আওয়াজ, কারা যেন চলাফেরা করছে। তার মধ্যেই আচমকা স্ত্রীলোকের আর্তনাদ শুনতে পেলাম। সেই আর্তনাদে আমার হাত-পা যখন হিম হয়ে যাচ্ছে, সেই সময়েই মনে হল, ভারী বুটের আওয়াজ এদিকে এগিয়ে আসছে। আমি দরজার কাছ থেকে ছিটকে সরে এলাম। আওয়াজ আরও এগিয়ে এল, দরজায় চাবি ঘোরাবার আওয়াজ হল। আমি দৌড়ে গোসলখানায় ঢুকে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই পাঞ্জাবি ভাষার গর্জন শুনতে পেলাম, কই, ও কোথায়? কয়েক পলক পড়তে না পড়তেই, জবাব শোনা গেল, জরুর গোসলখানার মধ্যে ঢুকেছে। বলতে বলতেই, দরজায় দমাদম ধাক্কা আর বুটের লাথি পড়তে লাগল, তার সঙ্গে চিৎকার, খোল,দরজা খোল, তা না হলে গুলি করে দরজা ভেঙে ফেলব। বন্ধ দরজার ওপারে হুকুমের স্বর শুনতে পেলাম, থামো গুলি কোরো না, আমি দেখছি। গলার স্বরটা কি চেনা ঠেকল? দরজায় খট খট করে আওয়াজ হল, শুনতে পেলাম, মিসেস শামসের, আপনি কি ভিতরে আছেন? আমি লেঃ কর্নেল ইয়াকুব বলছি। সেই জন্যই গলার স্বর আমার চেনা ঠেকছিল। তা হলে লেঃ কর্নেল ইয়াকুব এখানেই আছে। আমি কোনও জবাব না দিয়ে চুপ করে রইলাম।

ইয়াকুবের শান্ত গলা আবার শোনা গেল, মিসেস শামসের, আমি জানতাম না, ওরা আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এই মাত্র জানতে পেরেই ছুটে এসেছি। আপনার কোনও ভয় নেই, দরজা খুলুন।

ইয়াকুবের গলার স্বরে যথেষ্ট বিশ্বাস ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা আছে। কিন্তু পাঞ্জাবিকে বিশ্বাস? এর পরেও কি সে বিশ্বাস আমি করতে পারি? ইয়াকুবের সেই নজর আর হাসি কি আমি ভুলে গেছি? দরজায় করাঘাত, ইয়াকুবের গলা আবার শোনা গেল, দরজা খুলুন, আমাকে বিশ্বাস করুন। আমি প্রায় চিৎকার করেই জবাব দিলাম, আমি বিশ্বাস করি না। ইয়াকুবের গলা শোনা গেল, আমাকে বিশ্বাস করুন। তা না হলে এরা গুলি করে দরজা ভেঙে ফেলবে। আমি আপনাকে বাঁচাতে চাই৷বাঁচা? এখন। আর আমার বাঁচা-মরার কী আছে? কিন্তু কই, তবু তো মরবার কথা যেন ভাবতে পারছি না। ইয়াকুবের কথার স্বর যেন ব্যস্ত আর উদ্বিগ্ন। একেই কি বলে, পানিতে ডুবে যাওয়া মানুষের তৃণকুটা ধরে বাঁচবার আশা?

আবার দরজায় শব্দ হতেই, আমি বললাম, কারুর সামনে বাইরে যাবার মতো আবুও আমার নেই। হঠাৎ সব চুপ, তারপরেই দু-একটা অস্পষ্ট কথা শুনতে পেলাম। ঘরের ভিতরে কী ঘটছে বুঝতে পারছি না। স্কাইলাইটের দিকে তাকালাম। অতখানি উঁচুতে উঠবার কোনও উপায় নেই। মিনিটখানেক পরেই, বাইরে থেকে সুইচ টিপে গোসলখানার আলো জ্বেলে দিল। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজের সঙ্গে। ইয়াকুবের গলা শোনা গেল, দরজা খুলুন, এই কাপড় নিন, তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসুন।কী করব? স্থির করে ওঠবার মুহূর্তেই আবার মনে হল, ইয়াকুব চলে গেলে দরজা গুলি করে ভেঙে ফেলবে। আশা করা ছাড়া, আমার আর কী করার আছে? আমি সাহস করে দরজা খুলে একটুখানি ফাঁক করে, বাইরে হাত বাড়ালাম। একটা কিছু আমার হাতে এসে পড়ল। আমি হাত ভিতরে নিয়ে এসে, দরজা বন্ধ করে দিলাম। কেউ বাধা দিল না। দেখলাম আনকোরা একটা নতুন সিল্কের শাড়ি। এক মিনিটের মধ্যেই কেমন করে এইরকম একটা শাড়ি এদের হাতে এল?

সে সব কথা ভাববার সময় পরেও পাব। এখন বাঁচার আশা আমার মনে।

আমি তাড়াতাড়ি কাপড়টা গুছিয়ে নিয়ে পরলাম। অভ্যাসবশতই বোধহয় আয়নার দিকে তাকালাম। ঘেঁড়া জামা সায়া ঢেকে সেই উজ্জ্বল সিল্কের শাড়ি পরে একটু অপেক্ষা করলাম। তারপর খোদার নাম নিয়ে দরজা খুলে বাইরে এলাম। ইয়াকুব কয়েক হাত দূরেই দাঁড়িয়ে। সেই একই বেশ, কোমরে রিভলবার। চোখ রক্তবর্ণ। বাইরে যাবার দরজার কাছে, অটোমেটিক বন্দুক হাতে একজন সেনা দাঁড়িয়েছিল। ইয়াকুব সেদিকে ফিরে হুকুম করল, তুমি বাইরে যাও। বলে সে এগিয়ে গিয়ে ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। ফিরে এসে টেবিলের কাছে দাঁড়াল। আমি তার দিকে না তাকিয়েও, ঠিক তার দিকেই নজর রেখে ছিলাম। সে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, আমি সারাদিন শহরের বাইরে ছিলাম। কিছুক্ষণ আগে এসেই শুনলাম, আপনাকে ওরা ধরে নিয়ে এসেছে। সবথেকে যেটা বড় গলতি হয়ে গেছে, মিঃ শামসেরকে মেরে ফেলা। এর জন্য আমি নিশ্চয়ই কৈফিয়ত তলব করব। আমি দুঃখিত। জিজ্ঞেস করলাম, আমি এখন কোথায়? ইয়াকুব বলল, আপনি রমনার একটা বাড়িতে আছেন? আমি এখন তার সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বলছিলাম, আমার স্বামী তা হলে সত্যি মারা গেছেন? ইয়াকুব ঘাড় নেড়ে জবাব দিল, দুঃখের কথা, হ্যাঁ। তাঁর মৃতদেহ এখন কোথায় আপনি জানেন? না, মনে হয় ওরা কোথাও নিয়ে গিয়ে গোর দিয়েছে। আমার বুকের কাছে কিছু ঠেলে এল। আমি কথা বলতে পারলাম না। আমার মন বলছে, মোরশেদকে আর কোনওদিন দেখতে পাব না। আর মুশতাক–আমার মুশতাক, সে-ই বা এখন কোথায়? তাকেও কি আর কখনও দেখতে পাব?

.

গেলাসে হুইস্কি ঢালার শব্দে আমি টেবিলের দিকে ফিরে তাকালাম। ইয়াকুব গেলাসে হুইস্কি ঢালছে, কিন্তু তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। ওই চোখের নজর আমার প্রথম দিন থেকেই চেনা। ভয়? হ্যাঁ এখনও আছে। কিছুই হয়তো আর বাকি নেই, তবু বেঁচে আছি। বেঁচে থেকে পীড়ন সহ্য করা বড় যন্ত্রণা। ইয়াকুবকে কি আমি বিশ্বাস করব? হা বিশ্বাস! মোরশেদ বিশ্বাস করেই মরল। ইয়াকুব হুইস্কির গেলাসে পানি ঢেলে চুমুক দিল। জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে নিয়ে আপনারা এখন কী করতে চান? ইয়াকুব বলল, যা আপনার মর্জি। চান তো, আপনার ধানমণ্ডির মোকামে আপনাকে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। তবে এই রাত্রে সম্ভব হবে না। ভোর না হলে, আমাদের শহরে ঘোরা নিষেধ। আমি তা জানি। দিনের বেলা কারফিউ দিয়ে, এলাকা ঘিরে ঘিরে, গ্রেপ্তার লুঠ খুন আর ধর্ষণ। রাত্রি হলেই মুক্তিদের ভয়ে বন্দুক বাগিয়ে অন্ধকারে আত্মরক্ষা। জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মোকাম কি আস্ত আছে? ইয়াকুব জবাব দিল, কোনও মোকাম উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে কিছু খবর নেই। তবে কিছু লুঠপাট হয়ে থাকতে পারে। বেশ সহজভাবেই ইয়াকুব কথাগুলি বলল। মনের মধ্যে কোনও অহংকার বা জেদ না থাকলে এরকম সাফ কথা ভাল। কিন্তু সত্যি কি আমি আমার ধানমণ্ডির মোকামে ফিরে যেতে পারব? পারলেও, আমি কি সেখানে আর থাকতে পারব? অসম্ভব। তা আমি বুঝে নিয়েছি। আবদুল ও কুলসমের কথা মনে পড়তেই, জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি আমার ঝি-চাকরের সংবাদ কিছু জানেন?ইয়াকুব হঠাৎ কোনও জবাব দিল না। আমারই, শরীরের নীচের দিকে তাকিয়ে, গেলাসে চুমুক দিল। মুখ নিচু করেই, একটু যেন শক্ত গলায় বলল, ঝি-চাকরের সংবাদ আমাকে কেউ জানায়নি। বলে সে আমার দিকে তাকাল। রক্তবর্ণ চোখ। ইয়াকুবের মুখটা যেন কেমন বড় আর মোটা মোটা দেখাচ্ছে। রোদলাগা আয়নায় যেমন চোখ রাখা যায় না, আমিও তেমনি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। নজর ফিরিয়ে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, তা হলে এ রাত্রিটা আমি কোথায় থাকব? কেননা, মনে মনে স্থির করেই নিচ্ছি, একবার এখান থেকে ছাড়া পেলে, কিছু একটা গতি হতে পারে। সামাদ সাহেবরা বা পাড়ায় কি অন্য কেউ নেই? আবদুল আর কুলসমকে পেলেও শহরের বাইরে পালিয়ে যাবার একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু তার আগেই ইয়াকুব বলল, আপনার ছেলেই আপনাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী। কথাটা শোনা মাত্র ঘৃণায় আর রাগে আমার ভিতরটা জ্বলে গেল। বোধহয় তার ছাপ আমার মুখেও ফুটে থাকবে। কিন্তু আমি এ কথার কোনও জবাব তাকে দিলাম না। কথাটা কি আপনি বিশ্বাস করেন না? ইয়াকুব সোজাসুজি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাটা জিজ্ঞাসা করল। দেখলাম তার মুখ কঠিন, রক্তচোখ যেন জ্বলছে। বললাম, এখন আর এ সব কথায় কিছু যায় আসে না। ইয়াকুব মুহূর্তেই পাঞ্জাবি লেঃ কর্নেল হয়ে উঠল। মেঝেতে বুট ঠুকে গর্জন করল, যায় আসে। তোমাকে মুখ খুলে বলতেই হবে। এই প্রথম সে আমাকে তুমি বলল। মুশতাকের মুখ আমার মনে পড়ল। ভয়? আর আমার কীসের আশা? ইয়াকুবকে আর চিনতে ভুল হওয়া উচিত না। সে সেই একই পাঞ্জাবি, নতুনত্ব কিছুই নেই। নরম করে কথা বা মিথ্যা কথা কেন বলব? সামাদ সাহেবের বারো বছরের ছেলেটাকে তারা নিয়ে গেছে। মুশতাক ঘরে থাকলে, ছেড়ে দিত? এখন মুশতাককে দায়ী করছে। বাঘ সেই জল ঘোলা করার ছলনা করছে। চোখ দেখে আমি চিনতে পারছি। ইয়াকুবের এইটুকুই বৈশিষ্ট্য।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে আবার গর্জন করে উঠল, মুখ খোলো৷আমি ইয়াকুবের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললাম, বিশ্বাস করি না। ছলাৎ করে আমার দুই ঘোলা চোখে হুইস্কি ছিটকে পড়ল। ইয়াকুব গেলাসটা ছোড়নি। আমি চোখে হাত চাপা দিলাম। চোখ জ্বলে যাচ্ছিল। আমি ইয়াকুবের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম, বাঙালি কুত্তাকুত্তিরা সবাই সমান। তারা সত্যি কথা বলতে শেখেনি। ইচ্ছা করল, চিৎকার করে বলি–পাঞ্জাবি কুত্তা, তোরা বুঝি শিখেছিস? চোখ থেকে হুইস্কি মুছে ফেলার আগেই, ইয়াকুবের গায়ের স্পর্শ আমার গায়ে লাগল। ঘাম আর হুইস্কির গন্ধ। ছিটকে সরে যাব? কোথায়? শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে, দম বন্ধ করে, পরের অ্যাকশনের অপেক্ষা করতে লাগলাম। বুঝতে পারছি সে আমাকে এখুনি ছোঁ মেরে তুলে নেবে।

কিন্তু আমার আশঙ্কা মিথ্যা হল। আমি কানের কাছে তার শান্ত মোটা গলা শুনতে পেলাম, মিঃ শামসের একজন খাঁটি লোক ছিল। তাকে মেরে ফেলাটা গলতি হয়েছে। কিন্তু তোমার ছেলে মুক্তি না হলে, এ সব দুর্ঘটনা কিছুই ঘটত না। এ কথা তুমি কী করে অস্বীকার করছ! এ সব কথার কোনও জবাব নেই। আমি চোখ মুছতে লাগলাম। ইয়াকুব আমার গায়ের কাছে আরও ঘন হয়ে এল। আমার কাঁধে তার হাত রাখল। আঃ খোদা, আমি তো হাতেমতাইয়ের জাদু জানি না। গুটিয়ে যেতে পারি না, অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি না। কেবল দাঁতে দাঁত চেপে, শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। ইয়াকুব আমাকে আর এক হাত দিয়ে ধরে, তার দিকে ফেরাল। আমার চোখ তখনও জ্বলছে, চোখ মুছছি। ইয়াকুবের হাত আমার শরীরে ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে যেখানে এসে ঠেকল, আমি হাত দিয়ে বাধা না দিয়ে পারলাম না। ইয়াকুব জোর করল না, কিন্তু তার চেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার হল, আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। সে মাতাল মিঠা গলায় ডাকল, বুলবুলি। চোখের জ্বালা ভুলে, আমি তার দিকে তাকালাম। নিজের নামটা আমি নিজেই মনে মনে একবার উচ্চারণ করলাম। তারপরে তার সেই কামার্ত লুব্ধ মুখের উপর থুথু ছিটিয়ে দিলাম। এক ঝটকায় কয়েক হাত সরে গেলাম। রাগে আর ঘৃণায় আমি কথা বলতে পারছিলাম না।

ইয়াকুব রিভলবারে হাত রেখে, অন্য হাতে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছল। মুছতে মুছতেই বলল, দেখো বুলবুলি, আমি অনেক বাঙালি অওরতকে দেখলাম, তোমার মতো কাউকে পাইনি। অন্য কোনও অওরত হলে তাকে আমি একটি গুলিতেই খতম করতাম। এফ আই ইউর ক্যাপটেনের ওপরেও আমার মেজাজ বিগড়ে গেছিল, কেন সে তোমার ওপর জুলুম করেছে। তুমি। আমাকে থু দিয়েছ? বলে সে আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল। আমি কিছু বললাম না। সে আবার বলল, তোমাকে বুলবুলি বলে ডেকেছি বলে? আমি তোমাকে বুলবুলি বলেই ডাকব। দরকার। হলে, তোমাকে আমি পাঞ্জাবে পাঠিয়ে দেব।বলতে বলতে সে আমার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। আমি বললাম, আবার আমি থুথু দেব। সে আমার গায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, তবু আমি তোমাকে। খুন করব না।বসে এক পলক সময় না দিয়েই, সে আমার বুকের শাড়ি আর জামা একসঙ্গে চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। আমি তার গায়ের ওপরে গিয়ে পড়লাম। বাধা দেবার আগেই, তার নিজের দেওয়া সিল্ক শাড়ির আঁচল টেনে নামিয়ে দিল। আমি বুকের কাছে হাত জড়ো করে ধরতেই, সে নিচু হয়ে, ভাল্লুকের মতো দুহাত দিয়ে আমার সায়াটা ছিঁড়ে দিল। আমি উপুড় হয়ে বসে পড়লাম। সে পিছন থেকে এক টানে জামা আর অন্তর্বাস টেনে ছিঁড়ে দিল। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা লাগল। তবু আমি মুখ না তুলে, হাঁটুতে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে রইলাম। সে পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে টেনে তুলল। আমি হাত-পা ছোঁড়া সত্ত্বেও সে আমাকে মারল না। গায়ের জোরে এক এক করে আমাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে দিল। খাটের বিছানায় তুলে দিল। নিজেকেও সে আবৃত রাখল না। আমাকে শরীর দিয়ে চেপে ধরে নিজেকে সে অনাবৃত করল, আর আঃ খোদা, আমি অজ্ঞান হলাম না, জীবন্ত দোজখের যন্ত্রণা ভোগ করলাম, আর মনে হল, আমার মাথাটা একেবারে শূন্য।

কতক্ষণ পরে জানি না, দরজায় খটখট আওয়াজ শোনা গেল। ইয়াকুব চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, কে? দরজার বাইরের জবাব আমি ভাল শুনতে পেলাম না। ইয়াকুব চিৎকার করে বলল, যাচ্ছি।তারপরে লোকটার মায়ের উদ্দেশে একটা খারাপ গালি দিল। সে আমার ওপর থেকে উঠতেই, আমি বিছানার চাদরটা গায়ের ওপর টেনে নিলাম। দরজা খোলার শব্দ পেলাম। কথাবার্তা কিছুই স্পষ্ট শুনতে পেলাম না, পাবার মতো আমার অবস্থাও ছিল না। একটু পরেই আবার ভিতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বাইরে পায়ের আওয়াজ দূরে চলে গেল। ইয়াকুবের হুকুম শোনা গেল, ওঠো, জামা কাপড় পরে নাও।তারপরেই চাদরে ঢাকা আমার গায়ের ওপরে ঝুপ করে কী সব পড়ল। বুঝতে পারলাম, আমারই ছেঁড়া জামা-কাপড়। গোসলখানার দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হল। তৎক্ষণাৎ যেন আমার মাথায় বিজলি। হেনে গেল। আমি চাদর সরিয়ে উঠে পড়লাম। সায়া বা জামার দিকে হাত না বাড়িয়ে, কোনওরকমে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। ছুটে গিয়ে সাবধানে, আওয়াজ না করে ছিটকিনি খুললাম। অন্ধকার, কিন্তু। যা আশা করেছিলাম, তাই হল। দরজায় কেউ দাঁড়িয়ে নেই। ডান দিকে রেলিংয়ের আভাস দেখে। সেখানে এগিয়ে গেলাম।

অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে, রেলিং টপকালেই গাছপালা আর ঘাস। মনে হল বাগান। আমি একতলাতেই ছিলাম। আর একটুও না ভেবে, রেলিং টপকালাম। টপকে সামনে তাকিয়ে মনে হল। গাড়ি বারান্দা, সেখানে লোজন রয়েছে মনে হয়। আমি পিছন ফিরে দেয়ালের গা ঘেঁষে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে এগোলাম। তখনই একটা চিৎকার আমার কানে এল, আর্দালি! সঙ্গে সঙ্গে বুটের দ্রুত ছুটে যাওয়া। কিন্তু ঠিক আমার উলটো দিকে। আমি কোমর ভাঙা গোসাপের মতো চলতে চলতে, হঠাৎ নর্দমার মধ্যে পড়ে গেলাম। খুব বড় না, ছোটও না। আর মনে হল, নর্দমায় ময়লার চেয়ে পানি বেশি। ওদিকে তখন হাঁক-ডাক চলছে। টর্চের আলো ঘুরছে। আমার মাথার ঠিক নেই। আমি নর্দমা বেয়েই চলতে লাগলাম। একটা গাড়ির ইঞ্জিন গর্জে উঠল, আর মনে হল, সেই গর্জনটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে খ্যাপা বাঘের মতো পাক দিয়ে বেড়াচ্ছে, আর টর্চের আলো ঝলকে উঠছে। আমি থামছি না। নর্দমা কামড়ে চলছি আর মনে হচ্ছে নর্দমাটা যেন আরও বেশি পিছল হয়ে যাচ্ছে। তারপরে হঠাৎ আমার মাথাটা জোরে ঠুকে গেল, আর মনে হল, আমি যেন একটা অন্ধকার কুয়ার মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। মাথা ঠোকার যন্ত্রণা আমার নেই। কিন্তু কোথায় পড়ে যাচ্ছি, সেটা বোঝবার জন্য সামনে উঁচুতে হাত বাড়াতেই, দেয়াল পেলাম। হাত দিয়ে নিজেকে ঠেলে রাখলাম। নীচের দিকে তাকিয়ে মনে হল, আরও বড় গভীর নর্দমা সামনে। ঠিক এ সময়েই একটা আলোর ঝলক দেখলাম। মুখ তুলেই দেখলাম, টর্চের আলো পড়েছে রেলিংয়ের উপর। মনে হল, আমি যে বাড়িতে আছি, এই রেলিং তার সীমা। বাইরে বোধহয় রাস্তা। টর্চের আলো একবার বাঁয়ে আর একবার ডাইনে ঘোরাফেরা করল। নর্দমায় নেমে এল না, খোদার শুকুর। কিন্তু এ রেলিং বেশ উঁচু, মনে হয় আমার বুকের সমান। ছোট ফাঁক, শরীর ঢুকবে না। জায়গাটা যে কোথায়, কিছুই বুঝতে পারছি না। রমনাই কি সত্যি? ক্যান্টনমেন্ট না, তা বুঝতে পারছি। তার চেহারা আলাদা। এখানে কী ধরনের কাজ হয়, বুঝতে পারি না। কেবল কি মেয়েদের ধরে আনে এখানে?

হঠাৎ একসঙ্গে কয়েকটা গাড়ি যেন বেরিয়ে গেল। তারপরে সব চুপচাপ। কোনও সাড়াশব্দ নেই। টর্চের আলোও পড়ছে না। তবু উঠে দাঁড়াবার আগে, আর একবার ভাবলাম। তারপরে নর্দমার ধারে হাত রেখে মাথা তুললাম। চারদিকেই অন্ধকার। কিন্তু রেলিংয়ের বাইরে যে একটা রাস্তা, তাতে সন্দেহ নেই। এবার খোদা যা করেন। পিছল নর্দমার উপর থেকে সাবধানে উঠলাম। কাছেই একটা বড় গাছ দেখে হামাগুড়ি দিয়ে তার নীচে গেলাম। হঠাৎ টর্চের আলো ফেললেও লুকোনো যেতে পারে। রেলিংয়ে ওঠারও সুবিধা আছে। দেরি করলাম না, রেলিংয়ের লোহায় হাত দিয়ে আর এক পা গাছে। ঠেকিয়ে উঠতে গিয়েই ধপ করে পড়ে গেলাম। কিন্তু এখন আমার শরীরে যন্ত্রণা বোধ নেই। পায়ের তলা দূর্বায় ঘষে, আবার চেষ্টা করলাম। শেষ চেষ্টায় ওপারে গিয়ে পড়লাম, কিন্তু শাড়ি ছিঁড়ে গেল। বাঁ হাতের বগলের নীচে রেলিংয়ের খোঁচায় অনেকখানি আঁচড়ে গেল। সেদিকে দেখবার সময় আমার ছিল না। কোমরের কাছে কাপড় চেপে ধরে উলটো দিকে ছুটতে লাগলাম। আবার বাঘের ঘরেই যাচ্ছি কি না, না জেনেই ছুটতে লাগলাম। সবসময়েই কোনও না কোনও মোকামের দেওয়াল কিংবা রেলিং বা বাগান ঘেঁষে। অন্ধকারে আমি যেন তখন সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। গোটা শহরটা যেন কবরখানার মতো নির্জন নিঝুম। খোদাকে বললাম তোমার জগৎকে এখন এমনি কবরখানা করেই রাখো।….

কতক্ষণ ছুটেছি জানি না। এক সময়ে আমার মনে হল, আমি ছোট রাস্তায় ঢুকেছি। আশেপাশে ঘিঞ্জি বাড়িঘর। সবই চুপচাপ, অন্ধকার। মনে হল কোনও বাড়ি-ঘরে লোকজন নেই। কিন্তু আমি আর পারছিলাম না। অথচ বুঝতে পারছিলাম না, কোন এলাকা? বিহারি এলাকা না তো? মনে হয় না। একটা বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাঁচিলের মধ্যে দোতলা বাড়ি, গাছপালা আছে। পাঁচিলের পাশে পাশে এগিয়ে দেখলাম কাঠের গেট। হাত দিয়ে দেখলাম, আলগা খিল। তারপর খুলে ভিতরে ঢুকলাম। খোলা জায়গা পেরিয়ে বাড়ির বারান্দায় উঠলাম। তারপর? না, ভাববার সময় নেই, দরজায় আস্তে টুক টুক করে আওয়াজ করলাম। কোনও জবাব নেই। একটু থেমে আবার দরজা ঠুকলাম। থেমে থেমে ছ-সাতবার ঠুকবার পরেও যখন খুলল না, বুঝলাম খালি বাড়ি ফিরতে যাব, ক্যাঁচ করে একটি আওয়াজ হল। মনে হল, দরজা একটু ফাঁক হল। ভিতরে অন্ধকার। বোধ হয় আমাকে একলা দেখেই ভিতরের মানুষের একটু ভরসা হল। চাপা গলা শোনা গেল, কে? বাঙালি! আমি দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, আমাকে একটু ঢুকতে দিন, বাঁচান, ভয় পাবেন না, আমি একটা মেয়ে! মনে হল, ভিতরে কয়েকজন লোক আছে। স্ত্রীলোকের চাপা গলাও যেন শুনতে পেলাম। মনে। হল তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। তারপরে শুনতে পেলাম, আসেন। নসিবে কী আছে জানি না, ভিতরে ঢুকে পড়লাম। দরজা সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। একমাত্র ভরসা, এখানা বাঙালির মোকাম মনে হচ্ছে।…

.

কিন্তু যাক, আর এ সব কথা লিখে কী হবে? আমি ঠিক আশ্রয়েই উঠেছিলাম। আমার আশ্রয়দাতারা জানে, আমি আক্রান্ত হয়েছিলাম, পালিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছি। আজ যারা নিপীড়িতা বলে পরিচিতা, তার কোনও পরিচয় আমার নেই। আমি একদিন আমাদের ধানমণ্ডির বাড়িতে টেলিফোনও করেছিলাম। কোনও জবাব পাইনি। বুঝতে পেরেছিলাম, বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে। পরে ফিরে এসে দেখেছি, আলমারি ও সিন্দুক ছাড়া আর কিছুই ভাঙা হয়নি। টাকা গহনা ছাড়া, বিশেষ কিছু খোয়া যায়নি। পিয়ানোটার উপরে আঘাতের দাগ দেখেছি। টেলিভিশন সেট বিকল। রেডিয়োগ্রামটা ঠিকই ছিল।

তিন দিন আগে হাফেজ সাহেবের ছেলে আতাউর এসেছিল। ওর মুখেই শুনেছি, আমার মুশতাক নেই। বলতে গেলে আতার চোখের সামনেই নাকি মুশতাক মারা যায়। মুশতাক নাকি কেবল দুঃসাহসী ছিল না, সে কারুর কথা মানত না। অনেক সময় কিছু হিসাব-বিবেচনা না করেই সে খান মিলিটারিদের। উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, আর তা করতে গিয়েই মারা যায়। মুশতাককে খানেরা গুলিতে ঝাঁজরা করে দিয়েছিল। কিন্তু নুরও ফেরেনি, আতার ছোট ভাই, হাফেজ সাহেবের ছোট ছেলে। সে মারা গেছে। সামাদ সাহেবের বারো বছরের ছেলেটি ফিরে এসেছে। মাথার ঠিক নেই। আবোলতাবোল কথা বলে। সবসময়েই যেন ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। ওর কাছ থেকে এফ আই ইউ-এর লোকেরা পাড়ার ছেলেদের। খবর জানতে চেয়েছিল, ভীষণ মারধোর করেছে। আর যা করেছে, তা লেখা যায় না।

মোরশেদ আমার চোখের সামনেই গেছে। যখনই আতাকে কাছে পাই, ডেকে ডেকে মুশতাকের কথা জিজ্ঞাসা করি। খান সেনারা আর এ দেশে নেই। কিন্তু আমার মুশতাক আর ফিরে এল না। আম্মার কাছে তার সেই শেষ কদমবুসি।…

.

লেখা এখানেই শেষ, এবং মনে হয়, যেন আকস্মিকভাবেই লেখিকা লেখা থামিয়ে দিয়েছে। পাতা উলটে দেখলাম, আর কিছুই লেখা নেই। কোনও রকমে কয়েকটা ভয়ংকর দিনের স্মৃতিচারণ মাত্র। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধের অবস্থায়, কী ভেবেছে, কী প্রতিক্রিয়া তাঁর মনে ঘটেছে, সে বিষয়ে একটি কথাও নেই। জয়ের উল্লাস বা বিজয়ের গর্ব বা মুক্তির আনন্দ, অথবা ঘরে ফিরে আসতে পারার শান্তি, কোনও কথাই নেই। সেই ভৃত্য আবদুল বা বালিকা দাসী কুলসমেরও কোনও কথা নেই।

নোটবইটা বন্ধ করে, আমি যেন একটা বিস্মিত তীব্র কৌতূহলে নোটবইটাকে তাকিয়ে দেখলাম। চোখ বুজলাম। কেন যেন একটিমাত্র মুখই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। কিন্তু আমি মনে মনে বললাম, না।তবু সে মুখ চোখের সামনে জেগে রইল। নোটবইটা আবার রেখে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। সেই মুখই আমার চোখের সামনে ভাসছে।

.

পরের দিন স্নানের পরে, ব্রেকফাস্ট শেষ করতেই এক সাংবাদিক বন্ধু ঘরে এলেন। এলেন আসলে তাঁর বাড়িতে দাওয়াত জানাতে। এমন সময়েই টেলিফোন বাজল। গলার স্বর শুনেই চিনতে পারলাম, আনোয়ারা খান কথা বলছেন। বললেন, সালামওয়ালাইকুম। শুভ সকাল।

হেসে বললাম, শুভ সকাল।

ওপার থেকেও হাসির সঙ্গে প্রশ্ন এল, রাত্রে ভাল ঘুমিয়েছিলেন?

বললাম, তা ঠিক বলা যায় না। আমি আপনার দেওয়া সেই লাঞ্ছিতার ডায়রিটা রাত্রেই শেষ করেছি।

ওপার থেকে হঠাৎ কোনও কথা শোনা গেল না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হ্যালো।

জবাব এল, হ্যাঁ। তা হলে তো আপনার রাত্রিটা এক রকম দুঃস্বপ্নে কেটেছে।

বললাম, এক রকম তাই বলতে পারেন।

আনোয়ারা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যস্ত আছেন? বললাম, এই মুহূর্তে না।

তবে আসুন না একবার, একটু গল্প করি।

বেলা প্রায় দশটা। এখন যাওয়া কি ঠিক হবে? ওপার থেকে আবার প্রশ্ন এল, অসুবিধা আছে?

বললাম, ঠিক তা না, তবে বেলা তো হল।

আনোয়ারা বললেন, আসুন না ভাই। গাড়িটা পাঠিয়ে দিচ্ছি। একবার একটু ঘুরে যান। অসুবিধা না হলে আমার এখানেই দুপুরে খেয়ে যাবেন।

তাড়াতাড়ি বললাম, তার দরকার নেই। গাড়ি পাঠান, আমি যাচ্ছি।

 কৃতজ্ঞ খুশির স্বর শোনা গেল, লক্ষ্মী ভাই আমার।

লাইন কেটে দিলেন। সাংবাদিক বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে কথা হচ্ছিল? আমি নাম বললাম। বন্ধুটির মুখ সশ্রদ্ধ গাম্ভীর্য ও ব্যথায় ভরে উঠল। বললেন, ভদ্রমহিলা কোনও রকমে বেঁচে গেছলেন। কিন্তু আর সবাইকে হারালেন।

বলে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, উঠে বললেন, চলি, সন্ধ্যা সাতটায় আপনাকে নিতে আসব।

তিনি বিদায় নিলেন। মিনিট পনেরো পরেই রিসেপশন থেকে টেলিফোনে খবর দিল, গাড়ি এসেছে। নোটবইটা নিয়ে আমি দরজা বন্ধ করে নীচে নেমে গেলাম। ড্রাইভার আমার চেনা। সে আমাকে সেলাম দিল। প্রায় পনেরো মিনিটের মধ্যেই মিসেস আনোয়ারা খানের গৃহে পৌঁছলাম। তিনি বাইরের ঘরেই বসে ছিলেন। একলা, আর কেউ ছিল না। এগিয়ে এসে ডাকলেন, আসুন।

দুজনেই কপালে হাত ছোঁয়ালাম। বসবার আগে তাঁকে আমি নোটবইটি এগিয়ে দিলাম। তিমি হাত বাড়ালেন, তাঁর দৃষ্টি আমার চোখের প্রতি। তারপরে নোটবইটার দিকে তাকালাম, আবার আমার চোখের দিকে, তাঁর কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা, এবং একটু কি অনুসন্ধিৎসাও রয়েছে? নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, পড়লেন?

আমি তাঁর চোখের দিকে চেয়ে বললাম, নিশ্চয়।

তিনিও চোখ না সরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন? কী মনে হল?

এক কথায় বললাম, নৃশংস।

আনোয়ারা খানের মুখ বিমর্ষ হয়ে উঠল। কিন্তু তিনি আবার আমার চোখের দিকে তাকালেন। বোধহয় একটা দীর্ঘশ্বাসে তাঁর বুক ফুলে উঠছিল। তিনি সামলে নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু মনে হল না?

এবার আমি ওঁর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বললাম, মিসেস শামসেরের নিঃসঙ্গ জীবনের কথা ভাবতে আমি সাহস পাই না।

আনোয়ারা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, একটু অস্ফুট স্বরে বললেন, আসছি।

মুখটা ফিরিয়ে চলে গেলেন। নীলা ইদ্রিসের গানের কথা আমার মনে পড়ে গেল। সুখে আমায় রাখবে কেন…।

ঘরের এক পাশে পিয়ানোটার দিকে ফিরে তাকালাম। নীল কাপড়ের কভার দিয়ে ঢাকা। আর এক পাশে রেডিয়োগ্রাম। বাঁ দিকে ডাইনিং হলের পার্টিশনের দেওয়ালের দিকে আমার চোখ গেল। পার্টিশনের ওপারে, ডাইনিং রুমের পিছনের দেওয়াল ঘেঁষে, ওপরে যাবার সিঁড়ির রেলিং দেখতে পাচ্ছি। ডায়রিতে লেখা মোরশেদ সাহেবের বাড়ির বর্ণনা মনে করবার চেষ্টা করলাম। বাড়িটা কী নিঝুম! নীলা ইদ্রিসের গান আবার আমার মনে পড়ল, আজি যে রজনী যায় ফিরাইব তায়…আর মনে পড়ল।

আনোয়ারা ফিরে এলেন। রক্তের ছটা মুখে। দুচোখেও। নিজেই বললেন, এখন একটু চা খান।

বললাম, দিন।

 তিনি সেখান থেকেই গলা একটু তুলে বললেন, বশীর, একটু চায়ের জল বসাও।

ভিতর থেকে জবাব এল, জি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই ডায়রির লেখিকার সেই ঝি-চাকরদের আর কোনও সংবাদ পাওয়া যায়নি?

আনোয়ারা আমার চোখের দিকে তাঁর দুচোখের কালো তারা পূর্ণ করে মেলে ধরে বললেন, গেছে।

কী হয়েছে তাদের?

আবদুল বেঁচে আছে। কুলসম একটা নিপীড়িতা মেয়েদের ক্যাম্পে আছে। সে এখন গর্ভবতী।

আমি কোনও কথা বলতে পারলাম না। আনোয়ারার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। আনোয়ারা চোখ সরিয়ে, শুন্যে তাকিয়ে রইলেন। বাইরে মার্চের বাতাস, বাংলাদেশের বসন্ত আসন্ন, এই দুপুরের মুখে কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠছে।

Leave a Reply to Chandrima Gupta Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *