রমণী

রমণী

এযুগে আপনার চিন্তার দরবারে, স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম্ দেবা ন জানন্তি, ইত্যাদি জাতীয় বচন কী রকম বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচনা করেন, জানি না। আমার অবিশ্যি এমন সাহস নেই যে বলি, উপরোক্ত বচনগুলোর উৎপত্তি একেবারেই ভিত্তিহীন, তবে ভিত্তিগুলোতে যে পরিমাণ রহস্যের জারক রস মেশানো হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে বলতে গেলে, কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলতে পারি, ওই সব বচনের মধ্যে সম্ভবত পুরুষের অনভিজ্ঞতার বিড়ম্বনাটাই বেশি রয়েছে। কথাটা বলতে আমাকে এত কিন্তু কিন্তু করতে হচ্ছে, তার কারণ আর কিছু নয়, পাছে স্ত্রী চরিত্ররা আমার দিকে কটাক্ষ করে ভেবে বসেন, এ পুরুষের বড় সাহস দেখছি! তাঁর কটাক্ষের কারণ আর কিছু নয়, সম্ভবত তিনি নিজেকে চিরদিনই সেই রহস্যের আড়ালে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর এবম্বিধ কটাক্ষের হাত থেকে আমি বেচারি আসলে রেহাই চাই, যে কারণে, পুরুষের উক্তির হেতুটাই বলতে চেয়েছি, এবং পুরুষের অনভিজ্ঞতা জনিত বিড়ম্বনায় যে সব প্রবচনের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে তাঁর, অর্থাৎ নারীর দুঃখ পাবার কিছু নেই।

এ কথাগুলো আমাকে বলতে হল, ইদানীং আমার ধারণা হয়েছে, যে মানুষকে আমরা সর্বাপেক্ষা বেশি অনাবিষ্কৃত অজ্ঞেয় বলে এসেছি, সম্ভবত সেই অনাবিষ্কৃত মানুষকে, এ যুগের আমরা কিছু কিছু চিনতে আরম্ভ করেছি। এ আবিষ্কারের চেষ্টা শিল্পের একটা বড় কাজ, কিংবা তাই বা কেন, একটা বড় আশ্রয় বলাই ভাল। শিল্পের ওটাই একটা পরম পবিত্র ও মহৎ দীনতা, মানুষকে সে চিনে ফেলেছে, এ কথাটা আর দশজনের মতো দুম দাম বলতে পারে না, চেনাটাকে সে একটু একটু করে ব্যাখ্যা করে। তার অনেক ব্যর্থতা যেমন দেখেছি, কিন্তু কিছু সার্থকতা নিশ্চয়ই দেখেছি। কিন্তু যে কারণে, আপনাকে ইদানীং কালের ধারণার কথাটা বলতে চেয়েছিলাম সেটা হল, এতাবতকাল যা জেনে এসেছি, তাতে কোথায় যেন একটা একপেশেমি রয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিককালে তার বিস্তার দেখে, একপেশেমি থেকে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা দেখে, হঠাৎ যেন কেমন ভয় পাচ্ছি, সভ্যতার ট্র্যাজেডি না আবার এর ভিতর দিয়ে প্রকাশ হয়ে পড়ে। তবে দেশ বিদেশের কিছু কিছু লেখা পড়ে, ভয়টা আমার ভিতরে শিকড়-গাড়তে পারে না, কারণ দেখছি, ভয়টা আর কিছু নয়, মানুষ যত আবিষ্কৃত হচ্ছে, ততই সভ্যতার ফাঁকিটাই ধরা পড়ে যাচ্ছে। আসলে, সেই ফাঁকির মধ্যে আমরা সবাই জড়ানো বলেই, আমরা চেঁচামেচি লাগিয়ে দিই, আর নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে নোটিস দিতে আরম্ভ করি, না না এ সব বলা চলবে না, এ সব শুধুই অন্ধকারের কথা। আচ্ছা দেখুন তো, সাধ করে কেউ অন্ধকারের কথা বলে। আলোর জন্যে ব্যাকুলতাই তো, অন্ধকারের কথা বলাতে চায়, বলতে চায়, দ্যাখো, আমার অন্ধকারের মধ্যে কী বীভৎস ভয়ংকরতা রয়েছে।

দেখুন, যোগাযোগের কুমুদিনীর কোনও মুক্তি হয়েছিল কিনা, আমি জানি না, কিন্তু চতুরঙ্গের দামিনীর বুকেতে, এক অন্ধকার রাত্রের গুহায়, পদাঘাতের তীব্র ব্যথা আর দুঃসহ যন্ত্রণায় চোখের জলের মধ্যে, আমি প্রায় আমারই চোখের জল মিশিয়ে ফেলি, আমি অনুভব করি, আঘাত আর অন্ধকার আর ব্যথা আর যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে, কোথায় যেন আলোয় স্নান করা একটি প্রাণের মুক্তি ঘটছে। এবং এই সব কারণেই, ইদানীং বলতে ইচ্ছা করছে, একজন বুদ্ধ বা একজন খ্রিস্টের বাণীই মাত্র মানবসমাজকে মুক্তি দিতে পারে না, প্রতিটি মানুষকেই তার মুক্তির মূল্য দিতে হবে। বাণী কপচানো নয়, একেবারে ব্যক্তির রক্তমাংসেই, নিজেকেই তার নিজের বাণীর জন্ম দিতে হবে। হাল আমলের মানুষকে দেখে কি আপনারও তা বলতে ইচ্ছে করে না।..

কিন্তু, এ কী প্রলাপ দেখুন, কথা ছিল গল্প বলার, আরম্ভ করেছি শিবের গীত। আসলে, আমার নিজের লেখার মতো গল্প কিছু হাতড়ে পাচ্ছি না। আপনাকে দেব দুটো চিঠি, একটি আমার এক বন্ধুর, সেটা নিতান্তই লিংক। দ্বিতীয় চিঠিটি, বন্ধুকে লেখা আর একজনের একজন রমণীর, অনুগ্রহ করে আপনার পত্রিকায় পত্রস্থ করবেন।

সব মিলিয়ে একটা গল্প হয়ে উঠবে কি না জানি না, যদি না হয়, তার জন্যে আগেই মার্জনা চেয়ে রাখছি, এবং যদি হয়, তা হলে দেখবেন, আমার উপরোক্ত প্রলাপের কোনও মূল্যই নেই, শেষ পর্যন্ত সেই একটি কনভেনশনাল গল্পই দাঁড়িয়েছে, বা একটি চরিত্র। অতএব, প্রলাপাদির জন্যেও ক্ষমা করবেন। ইতি।

বন্ধুর চিঠি

বন্ধুবরেষু:
আমার জবানিতে তোমাকে সব কথা জানাতে পারলে ভাল হত, কিন্তু এখন আমার সে প্রবৃত্তি নেই। নেই তার কারণ, আমার স্বচ্ছন্দ উড়ে চলা তেজি ডানায় কোথায় যেন একটা আঘাত লেগেছে। আঘাতের স্বরূপ বা স্থানটা ঠিক চিনতে পারছি না বলেই গোলমালটা আরও বেশি লাগছে। তুমি আমাকে মোটামুটি চেনো, আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে; অপরের একটি চিঠিও তোমাকে এই সঙ্গেই পাঠালাম। সঙ্গের চিঠিটি পড়ে, কী বুঝলে, যদি একটু জানাও, তা হলে বাধিত হই। আমি ঘটনার মধ্যে কিছুই বুঝতে পারিনি, তবে, ওই যে বললাম, অনুভূতির মধ্যে কোথায় একটা গোলমাল হয়েছে, যার কোনও ব্যাখ্যা করতে পারছি না। তুমি সাহিত্যিক মানুষ, মানুষের মনের খবর না কি তোমরাই জান। অতএব, তোমার বিচারটা জানলে পরে, নিজের ভিতরের খোঁজটা করতে পারি।

তুমি তো জানোই, আমার কোনও কোনও বিষয়ে কতগুলো অহংকার জমে আছে, এবং যে অহংকারগুলো প্রায় আমার মজ্জাতেই মিশে গিয়েছে। এটা বুঝতে পারছি, আঘাতের একটা ঘা সেই অহংকারের কোথাও লেগেছে, কিন্তু আমার ধারণাটা ব্যাপারটা তার থেকে কিছু কিঞ্চিৎ বেশি। কিন্তু এত কথা আমি আর তোমাকে লিখব না, সঙ্গের চিঠিটাই তোমাকে সব কথা জানিয়ে দেবে আশা করি। হয়তো অবাকই হবে, চিঠিটাতে আমার যে বর্ণনা দেওয়া আছে, সেটা কেমন অদ্ভুত সত্যি, অথচ, নিজে দূরের কথা, তোমরাও কেউ কোনওদিন আমার কথা বলতে গিয়ে ঠিক ওভাবে বলনি।

তোমার উত্তরের আশায় রইলাম। ভালবাসা।
ইতি —

বন্ধুর লেখা চিঠি

মান্যবরেষু,
একমাত্র ঈশ্বরই জানেন, এইভাবে আপনাকে চিঠি লিখিয়া পাঠাইব কোনওদিন ভাবি নাই। আন্না, হারাণী, বিলুদিদি, ইত্যাদি–সব্বাইকে বলিয়াছি, আপনাকে আমি একখানি চিঠি লিখিব। দেখুন, তাহারা আমাকে বিশ্বাস করে নাই যে, আপনাকে আমি লিখিতে পারি। কিন্তু আপনি দেখিতেছেন, পারি। বিলুদিদিদের এ কথা বলি নাই, কবে চিঠি দিব, কেবল বলেছি, দিব। তাহারা তো বিশ্বাস করে নাই, তাই আর জিজ্ঞাসাও করে নাই। আন্নার মাথায় কীরকম পোকা আছে, সে-ই একমাত্র ডাকিয়া বলে, দিয়েছিস? আমি চুপ করিয়া থাকি, আর হাসি। আমাকে হাসিতে দেখিয়া সে ভাবে, আমি তাহাদের ঠাট্টা করিয়াছি। ওরা সবাই যদি আপনাকে লিখিতে পারে, তবে আমি লিখিব না কেন। ওরা ভাবে, ওদের সঙ্গে আপনার খুব ভাব, আমার সঙ্গে ভাব নাই বলিয়া আমি লিখিতে পারিব না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি কলকল করিয়া কথা বলিতে পারি না, খিলখিল করিয়া হাসিতে পারি না, বা আপনার পায়ের কাছে গিয়া ওদের মতো বসিতে পারি না, তা বলিয়া সত্যি কি আপনার সঙ্গে আমার ভাব নাই।

আপনি আমাদের গ্রাম হইতে গিয়াছেন গত ১৯শে অঘ্রাণ, বুধবার, আর আজ মাঘ মাসের পায়ের কাছে গিয়া ওদের মতো বসিতে পারি না, তা বলিয়া সত্যি কি আপনার সঙ্গে আমার ভাব নাই।

আপনি আমাদের গ্রাম হইতে গিয়াছেন গত ১৯শে অঘ্রাণ, বুধবার, আর আজ মাঘ মাসের ৯ তারিখ। ইহার মধ্যে প্রায় হিসাব করিলে, পঞ্চাশ দিন হয়। এতদিন ধরিয়া রোজই ভাবি, আপনাকে চিঠি লিখিব অথচ লিখিতে পারি নাই। প্রথম প্রথম কয়েকদিন তো খালি এই কথা ভাবিয়াছি আমি কি পাগল না কি যে আপনাকে চিঠি লিখিব। একলা একলাই লজ্জায় মরিয়া যাইতাম। আমি যেন দেখিতে পাইতাম, আমার চিঠিটা হাতে লইয়া আপনি কী রকম হাসিতেছেন। এমনকী, দেখিতাম আপনি আপনার বন্ধু বান্ধবদের ডাকিয়া আমার লেখা দেখাইয়া সবাই মিলিয়া খুব হাসাহাসি করিতেন। কিন্তু আবার মনে হইত, কেন হাসিবেন কেন, আমি তো খারাপ কথা কিছু লিখিতে চাই না। এইসব সাত-পাঁচ ভাবিতে ভাবিতে এমন হইল, মন আর কিছুতেই স্থির করিতে পারি না। শেষে ভগবানকে ডাকিয়া বলিলাম, হে ভগবান আমাকে একটা চিঠি লিখিয়ে দাও, আমার মনে একটু সাহস দাও আমাকে এত লজ্জা দিয়ো না, আমি যেন ওঁকে একটা চিঠি লিখিতে পারি। জানেন, এতদিন লিখিতে পারি নাই বলিয়া, রাত্রে শুইয়া কাঁদিয়া ফেলিয়াছি, ঘুম আসিত না। মা বলে, কী হয়েছে, তোর, শরীর খারাপ না কি। বন্ধুরা বলে, কী লো শুকোচ্ছিস কেন। বরের চিন্তায় না কি।

আপনি তো জানেন, আমার কপাল খারাপ, বর আমাকে নেয় না। সবাই বলে, আমার গত জন্মের অনেক পাপ আছে, তাই বর নেয় না। কী জানি, গত জন্মে কী পাপ করিয়াছিলাম, তা তো কিছুই জানি না, সবাই বলে, আমি শুনি। তবে আপনাকে বলিতে পারি, আমি ও সব কিছু বিশ্বাস করি না। আবার এ কথাও সত্যি, বরের উপর আমার একটুও রাগ হয় না। কত ভাবি, রাগ করিব, অথচ রাগ করিতে পারি না। মাঝে মাঝে মা বলে, কথায় কথায় তুই আমার পরে এত রাগ করিস, কই তোর বরের উপর তো কখনও রাগ করতে দেখি না।

দেখুন তো, মাকে যে কী বুঝাইব, ভাবিয়া পাই না। বরের উপর রাগ না আসিলে আমি কী করিব। গাঁয়ের বাউরি বউ খাদনবালা কথামত চুনা মাছ বা আচার না দিয়ে গেলে, তাহার সঙ্গে দুদিন কথা বলি না, তাহার উপরেও আমার রাগ হয়, তবু বরের উপরে হয় না, ইহাতে আমি কী করিব। মা যে কখন কী বলে আর করে, তাহা আমি সবই বুঝিতে পারি, তাই কোনও কিছু হইলে মায়ের উপর রাগ না করিয়া থাকিতে পারি না। বাউরি বউ কী কী কারণে আমার কাজ করিয়া দিতে পারে না, সব জানি। হয়তো সে তার বরের কথায় সারাদিন ঘরে বসিয়া মদ চোলাই করিয়াছে, সন্ধ্যাবেলা দুটিতে তাই খাইয়া গড়াগড়ি গিয়াছে। যাহাদের বুঝিতে পারি, তাহাদের উপর রাগ। যাহাদের সঙ্গে একটা কিছু গিয়া আনা নেওয়া করি, তাহাদের উপর রাগ করি। কিন্তু বরের উপর রাগ করিব কেন। তার সঙ্গে আমার কিছুই আনা নেওয়া নাই। অনেক ভাবিয়া দেখিয়াছি, কোনও কারণে তার উপরে রাগ করিতে পারি কিনা। একমাত্র দেখি, সে যখন কথা নাই বার্তা নাই, উপশাস্ত্র শ্বশুরবাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হয়, আর রাত্রে থাকিতে চায়, তখন আমার মাথার মধ্যে আগুন জ্বলিতে থাকে। মুখ ফুটিয়া আপনাকে আর কতটা বলিতে পারি, সে আসিয়া রাত্রিবাস করিতে চাহিলেই, হারাণী আন্নারা সব ঠাট্টা করিতে থাকে, ভাবে সেই রাত্রিটা আমার খুব সুখের। মাও আমাকে রাত্রে বরের কাছে যাইতে বলে। তখন আমার যে এত বয়স হইয়াছে, সবাই বলে পঁচিশ বছরের ধুমসো মেয়েমানুষ, সে কথা বলিয়া যাই। মনে হয় আমি মরিয়া যাইব। মনে হয় ঘৃণায় শরীরটা রি রি করিতেছে। তখন মনে হয় শ্রীনাথপুরের মেলায় রাত্রে যে আমাকে একটা লোক একবার জাপটাইয়া ধরিয়াছিল, যাহাকে ধরিয়া লোজনেরা মারধোর করিয়াছিল, তাহাও অনেক ভাল ছিল। তবু বরের এই রাত্রিবাস সহ্য করিতে পারি না। পনেরো বছর বয়সে বিবাহ হইয়াছিল, আজ পঁচিশ বছর। তখন হইতেই জানি যাহার সঙ্গে আমার বিবাহ হইয়াছে, তাহা সে চায় নাই, কারণ তাহার না কি মেয়েমানুষের অভাব নাই। তাহার অবস্থা ভাল, অনেক জমিজমা বাড়ি পুকুর, মায় কলকাতায় চাকরি, সবই। তবে তাহার কেন মেয়েমানুষের অভাব হইবে। এই সব ভাবিয়া, আমি বেশ ছিলাম। তারপরে বর বলে, তুই কাঁদিস না, রাগও করিস না। তোর এত অহংকার কীসের। এই বলিয়া পিটাইয়া বাপের বাড়িতে পাঠাইয়া দিল। কিন্তু কাঁদিব কেন, রাগিব কেন, কিছুই জানিতাম না, জানেন, আমি এমনিতে খুব ভাল থাকি, জেদ চাপিলে রক্ষা নাই। তাই বরের সঙ্গে রাত্রিবাস আমার কোনওকালেই হয় না। কিন্তু এ সব কথা থাক। আপনি না জানি কী ভাবিতেছেন। অথচ আজ যে এমন বেহায়া হইয়াছি, তাহা কিন্তু অনেক সাধনা করিয়া, ভগবানকে ডাকিয়া, ডাকিয়া হইয়াছি। প্রথমে চিঠি লেখার লজ্জা কাটাইয়া, তারপর এই কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং হাতের লেখার লজ্জা কাটাইয়াছি তারপর যে সব কথা কোনওদিন লিখিতে পারিব না ভাবিয়াছিলাম, সেই লজ্জাও কাটাইয়াছি। সেই যে বলে না, লজ্জা ঘৃণা ভয়, তিন থাকিতে নয়, আমার সেই রকম হইয়াছে। লজ্জা ত্যাগ করিয়াছি। যদি ঘৃণা করেন, তাহাতেও আর ভাবি না। আর সমাজের বা আপনার ভয়, তাও মন হইতে দূর করিয়াছি।

এইবার চিঠি লেখার কারণ বলি। দোহাই আমার উপর রাগ করিবেন না। অবিশ্যি যদি করেন, তা হইলে আর কী করিব। তবে, আপনাকে আমি এত ভালভাবে চিনিতে পারিয়াছি, তাহা না জানাইয়া থাকিতে পারিতেছি না। ইহাতে আপনার হয়তো কিছুই যায় আসে না, কিন্তু আমার মনে হইতেছে, যেন আমার বুকের মধ্যে রক্ত ঝরিতেছে, তাই আমি লিখিতেছি।

এবার আপনি যখন আমাদের গ্রামে আসিলেন, কয়েকদিন আগে হইতেই তাই লইয়া হারাণী, আন্না, বিলুদি সবাই আলোচনা করিতেছিল। আপনাকে সকলে এতই ভালবাসে, সকলেই ভুলিয়া গিয়াছে, আপনি পাঁচ বছর আগে, এখানে সরকারি জরিপের কাজ করিতে আসিয়া, হঠাৎ ফণীকাকার মেয়েকে বিবাহ করিয়া বসিলেন। গ্রামে তাহা লইয়া ঘোঁট পাঁচালি হইলেও, দুদিনেই থামিয়া গিয়াছিল, কারণ জাতের কোনও বাধা ছিল না, এমনকী গোত্রেরও কোনও অসুবিধা হয় নাই। আর আপনিও ছেলেমানুষ, সুন্দর, সুপুরুষ। আপনার মতো বর, আপনার মতো জামাই পরম ভাগ্যের কথা। কলকাতায় আপনাদের বাড়ির অবস্থা ভাল, সংসারে তেমন কোনও ঝামেলা নাই। ইহা হইতে আর কী ভাল হইতে পারে। আপনি যখন বিবাহ করিতে আসিয়াছিলেন, আমাদের সকলেরই মনে হইয়াছিল, স্বর্গের থেকে ইন্দ্র কিংবা কার্তিক ঠাকুর নামিয়া আসিয়াছে। কিন্তু রমলার কপাল খারাপ, সে আপনার বউ হইয়া, বেশিদিন আপনার সঙ্গে সুখে ঘর করিতে পারিল না, কাল রোগ তাকে লইয়া গেল।

জানেন, আমার মুখ খুব খারাপ, এমনি দেখিলে বুঝিতে পারিবেন না। মনে মনে আমার মুখ খারাপ। এখন মনে হয়, রমলাটা মরিয়া বাঁচিয়াছে, সে কি আপনাকে লইয়া সুখে ঘর করিতে পারিত। আমার তো একেবারেই মনে হয় না। কারণ সংসারে কোনও কোনও পুরুষ বা মেয়ে জন্মায়, যাহারা কখনও একজনকে লইয়া সুখে থাকিতে পারে না, তাহাদের কেহ থাকিতে দেয় না। আমি আপনাকে দিয়াই সেটা ভাল বুঝিয়াছি।

যাই হোক, রমলা মরিয়াছে বটে, কিন্তু এই গ্রামের দক্ষিণপাড়ার মেয়েরা তো মরে নাই। তাহারা আপনার জন্যেই মরিয়াছে। আজকাল আপনি আবার একজন গায়ক হইয়াছেন। কলকাতায় আপনার অনেক নাম। আপনার রূপ, আপনার গুণ, খ্যাতি, গাড়ি, টাকা, সবই যেন আগুনের মতো জ্বলিতেছে, আর পতঙ্গেরা আপনাকে ঘিরিয়া ঘিরিয়া নাচিতেছে, মরিতেছে। তবে হ্যাঁ, সে মরণেও বোধহয় সুখ আছে। আমার তো ধারণা কলকাতা শহরটাই আগুন, যেন শ্মশান, সেখানে আপনাকে ঘিরিয়া কী ঘটিতেছে জানি না, তবে যখন হারাণী আন্না বিলুদিদের মুখে শুনি, একশো টাকা দামের এক বোতল বিলাতি মদ আপনি ব্যাগে লুকিয়ে এনেছেন, তখনই কলকাতার আগুনের আঁচ বুঝিতে পারি।

আপনি আসেন শ্বশুরবাড়িতে, ফণীকাকার বাড়িতে, কিন্তু আপনার নিমন্ত্রণ দক্ষিণপাড়ার ঘরে ঘরে। আপনার নিজের দূর সম্পর্কের যুবতী শালিই আছে জনা তিনেক, তার সঙ্গে পাড়ার অন্যান্য মেয়ে বউ, সবাই আপনাকে লইয়া কী মাতামাতি করে। তা আপনি আমার থেকে ভালই জানেন। দেখিয়া শুনিয়া আমার তো কেষ্টঠাকুর আর গোপিনীদের কথাই বারে বারে মনে হয়। অন্তত দুই-তিনটি পাশাপাশি বাড়ির মেয়েরা আপনার সেবার জন্যে সকাল থেকেই ছুটোছুটি আরম্ভ করে। আপনার জন্যে ফোঁটানো গরমজল ঠাণ্ডা করিয়া দেওয়া, আপনি স্নান করিবেন, আপনার খাবার জল, আপনার জলখাবার। এমনকী মেয়েরাই আপনার গায়ে তেল মাখাইয়া দেয়। গায়ে একটি ঘামাচি দেখিলে, সকলের হাত সুড়সুড়াইয়া ওঠে। অতএব, আপনি আসিতেছেন জানিলে, দক্ষিণপাড়ার মেয়েমহলে উৎসব লাগিয়া যায়।

এবারও যখন আপনার গাড়ি আসিয়া ফণীকাকার বাঁশঝাড়ের ছায়ায় দাঁড়াইল, সেই রকমই উৎসব। মেয়েরাই আগে আপনাকে দখল করিয়া বসিল। গুরুজনদের কাছে গিয়া প্রণাম করিবার সময়ও আপনার হইয়া ওঠে না। আপনার দোষ কী। গুরুজনেরা এই ভাবিয়া নিশ্চিন্ত, আহা এমন গুণবান বিপত্নীক জামাই, তাহাকে লইয়া সবাই যদি একটু মাতিয়া ও মাতাইয়া রাখিতে পারে, রাখুক না কেন। কিন্তু আপনি ভালই জানেন, আপনি আসিয়াছেন একটু মুখ বদলাইতে। খারাপ অর্থে লইবেন না যেন। আমি তো নিজের চোখেই দেখিয়াছি, আন্না আপনার হাত লইয়া তাহার নিজের বুকে চাপিয়া কী রকম নিশ্বাস ফেলিতে থাকে। হারাণীর মতো রূপসী মেয়ে, অন্ধকারে আপনার বাহুবন্ধনে কী রকম পাগল হইয়া যায়, আমি সাক্ষী আছি। বিলুদির মতো মেয়ে, যাহাকে পাড়ার গুরুজনেরাও বয়সের তুলনায় বেশি মান্য করিয়া থাকে, যাহার ব্যক্তিত্ব গাম্ভীর্যকে সকলেই ভয় করে, সেই বিলুদি পর্যন্ত গভীর রাত্রে, আপনার টলোমলো শরীরটাকে বুকে জড়াইয়া শোয়ার ঘরে লইয়া যায়। অন্যান্য মেয়েদের কথা বাদই দিলাম। গ্রামের মাতালদের উপর সকলেরই রাগ ও ঘৃণা। বিলুদির সামনে কোনও মাতাল কথা বলিতে সাহস করে না। কিন্তু আপনাকে সকলে ক্ষমা করিয়াছে।

কিন্তু এ সব পুরানো কথা। এবার আমাকে দেখিয়া আপনার কী হইল, বলুন তো। আপনি অবিশ্যি আমাকে কখনও আগে দেখেন নাই, আমিও আপনার কাছে আসি নাই, যদিও আমি দক্ষিণপাড়ারই মেয়ে। কেন আসি নাই, তাহা যদি বলিতে হয় তবে বলিতে হয়, মনে মনে ভাবিতাম, কেন যাইব। ফণীকাকার জামাই হতে পারে সুন্দর, নাম করা গায়ক, ধনী, তাতে আমার কী। আমার রাগ হইত, কিছুতেই যাইতাম না। তবে যাইতে ইচ্ছা করিত। আপনি আসিলেই যাইতে ইচ্ছা করিত, মনকে শাসন করিতাম। এইবার আর পারিলাম না। আমি জানি, আপনার সহচরীদের তুলনায়, রূপে আমি নিরেশ। তবু আপনি আমাকে দেখিয়া প্রথমে বলিলেন, বাঃ দুর্গা প্রতিমার মতো। তারপরে বলিলেন, ঠিক লক্ষ্মীঠাকরুন।

কিন্তু ভাবিয়া দেখুন, আপনি বারেবারেই চোখ নামাইয়া লইয়া ছিলেন। আপনি যে চোখে চাহিতে অভ্যস্ত, সেই চোখে আমার দিকে তাকাইয়া বারেবারেই চোখ সরাইয়া লইয়াছেন। অথচ বিশ্বাস করুন, আপনি আমার লাল পাড় শাড়ি, পায়ের আলতা, সিথের সিঁদুর, যাহা কিছু দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন, এবং একবার যদি হাত বাড়াইয়া কাছে টানিতেন, আমি নিজেকে ফিরাইতে পারিতাম না। অথচ আপনি একবারও টানিলেন না, চুইলেন না, যেন জীবনে নতুন কিছু দেখিয়াছেন, এইভাবে বারে বারে চোখ তুলিয়া দেখিলেন আর কী একভাবে যেন মাথা নিচু করিয়া রহিলেন। আপনার সহচরী রূপসিরা আমার উপর চটিল, বিরক্ত হইল, নানান কথা ঠেস মারিয়া বলিল, আপনাকেও বলিল, তবু আপনি নিজেকে ঠিক করিতে পারিলেন না। আপনাকে আমি যখন হাসিয়া বলিলাম, কী হল, চুপ করে রইলেন যে। আপনি কেবল বলিলেন, মনটা কেমন ভার হয়ে যাচ্ছে। অথচ আপনার তো মন ভার হইবার কথা নয়। বেশ তো পরিবৃতই ছিলেন।

তিন দিন আপনি আমাকে কেবল দেখিলেন, এবং যাইবার সময় আপনার মুখের মেঘ কাটিল না, আমি রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া কেবল মুখ বুজিয়া চোখের জল মুছিলাম। একটা কথাও বলিতে পারিলাম না। তবে মনে মনে কেবল বলিলাম, ভগবান ওঁকে একটু শান্তি দাও, একটু শান্তি দাও, তোমার দেওয়া এত আগুনে কেন ওঁকে পুড়িয়ে মারছ।

আমি এইটুকুই জানি, আপনার চোখে যত হাসি ছিল, আগুন ছিল, তার মধ্যে একজন দুঃখী অসহায় এমনকী উঞ্ছ মানুষকেই দেখেছি। যাহার কিছুই নাই, বুকের মধ্যে শ্মশানের হাহাকার। যাহা চাহিয়া আপনি সারা জীবনেও পান নাই, আপনি তাহার খোঁজেই আগুনে পুড়িয়া ছুটাছুটি করিতেছেন। কেন এমন মনে হইল, জানি না। দেখিবা মাত্রই এ কথা মনে হইল, আর সেই জন্যেই যেন আপনি আমার দিকে চোখ রাখিতে পারিলেন না। তাই সত্যি না কি। মনে হইল, দ্যাখো, লোকটির এত আছে, তবু নাই। কিন্তু সে কথা তো বলিতে পারি না, তাই কেবল চোখে জল আসিল, কথা বলিতে পারিলাম না। আপনার গাড়ি যখন সাঁকো পার বাঁক ফিরিল, তখন বিলুদিকে বলিতে শুনিলাম, আপনার চোখে না কি জল দেখা দিয়াছিল। ইহার পরেও চিঠি না লিখিয়া কেমন করিয়া থাকি। এবার হইতে আমি কেবল এই প্রার্থনা করিব, ওঁকে একটু শান্তি দাও, ওঁকে একটু মিলাইয়া দাও।

আমি নিজের জন্যেও সেই প্রার্থনাই করি যে, তাই অপরের জন্যেই করি। প্রণাম নেবেন, আর এই চিঠির জন্যে ক্ষমা করবেন। ইতি— ফুলফুল

 [ডাকনামটাই লিখিলাম, চিনিতে সুবিধা হইবে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *