মানুষ রতন

মানুষ রতন – গল্প – সমরেশ বসু

০১.

কথা চোখে চোখে। ত্যাবড়া চোখের তারা উলটে খানিকটা শিবনেত্র ভঙ্গি করল। মনা ওর দিকে চেয়ে, নীচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে, পক পক করে হর্ন বাজিয়ে দিল। যেন একটা জন্তুর খুশির ডাক। পুনিয়া তখন ওর সামনে দাঁড়িয়ে, তলপেটের নীচে রং ওঠা ময়লা চাপা প্যান্ট, পা দুটো অনেকখানি ফাঁক করা। হাত দুটোও ওপর দিকে তুলে দুদিকে ছড়ানো। সরু গলার ওপরে রুক্ষু ঝাঁকড়াচুলো মাথাটা না থাকলে, রোগা শরীরটা পুরো ইংরেজি এক্স অক্ষর। শরীরটাকে দুলিয়ে, মনাকে চোখ টিপল। সোতে, ওদের তিন জনের দিকেই তাকিয়ে, চোখের কোণে বাঁ দিকে ইশারা করল। তারপরে লাফ দিয়ে রিকশার সিটের ওপর উঠে, উলটো দিকে প্যাডেল ঘুরিয়ে দিল বনবনিয়ে। পথ চলতি এক মহিলাকে ডেকে, চেঁচিয়ে বলল, রিকশা নিয়ে আসব দিদিমণি?

দিদিমণি ওর দিকে চেয়ে, হেসে বললেন, এখন না।

সোতে মুখের ভাব করল, যেন হতাশ হয়েছে। মাথাটা নিচু করে হাত ঝুলিয়ে দিল। তারপরেই আবার চারজনে, চারজনের দিকে তাকাল। আবার কথা চোখে চোখে। ত্যাবড়া এমন ভাবে ঘাড় কাত করে, জিভটা এক পাশে বের করে ঝুলিয়ে দিলে, মরা মানুষের মুখের কথা মনে হয়। সেই সঙ্গে আবার চোখ ওলটানো, আর ঘাড়ের একটা ইশারা। মনা মাথা নেড়ে কয়েকবার খাবি খাওয়ার ভঙ্গি করল। পুনিয়া ঠোঁট টিপে, ভুরু কুঁচকে, ঘাড় নেড়ে মনাকে সায় দিল। সোতে এমন মুখ-চোখ করল, আর শক্ত হাতে হর্ন টিপল, যেন কারোর গলা টিপছে। ত্যাবড়া ঠোঁটের কোণে হেসে বলল, ভাগ শালা।

সোতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আমার শালা আর দেরি সইছে না।

এই সময় গণেশ এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। পরনে লুঙ্গির মতো করে ময়লা কাপড় দুভাঁজ দিয়ে পরা। গায়ে একটা সাবানের কোম্পানির ছাপ মারা, বিনা পয়সায় পাওয়া ধবধবে সাদা গেঞ্জি। মফস্বলের রিকশাওয়ালাদের গেঞ্জি দান করে কোম্পানিগুলো এভাবে বিজ্ঞাপন করে। ওর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, সন্দেহে ভরা। চারজনের দিকে তাকিয়ে, রাস্তার আশেপাশে একবার দেখে নিল। ইস্টিশনের দিকেও একবার দেখল। তারপরে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার রে তোদের?

ত্যাবড়া সমস্ত দাঁতগুলো বের করে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ক্যানারে গণিশ?

বলে, চারজনে আবার চারজনের দিকে তাকাল। চারজনেই হাসল। মনা আর সোতে জোরে জোরে হর্ন বাজাতে লাগল। সেপাই লাঠি তুলে ছুটে এসে বলল, এই শালারা, শুধু শুধু হল্লা করছিস কেন?

ঠিক এ সময়েই, কুড়ি হাত দূরে স্ট্রিটকর্নার মিটিং শুরু হয়ে গেল, বন্ধুগণ, মহকুমার আসন্ন ছাত্র ও যুবকদের যে সম্মেলন হতে যাচ্ছে, সেখানে বিপ্লবী মোর্চায় দীক্ষিত…

ওরা চারজন বা গণেশ সেদিকে ফিরে তাকাল না। কানও নেই। গণেশের সন্দিগ্ধ চোখ দুটো যেন দপ দপ করে জ্বলে উঠল। নাকের পাটা ফুলে উঠল। সে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ফিটকে, অ্যাই ফটকে।

যার নাম ফটকে সে একটা হুডতোলা রিকশার মধ্যে ঠ্যাঙ ছড়িয়ে আয়েস করে বসেছিল। গণেশের ডাক শুনে লাফ দিয়ে নেমে এসে বলল, কী বলছ গুরু।

গণেশ আবার ওদের চারজনের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল। বলল, এরা একটা মতলবে আছে মনে হচ্ছে। আমি যেন কীরকম একটা গন্ধ পাচ্ছি। দ্যাখ তো, ইস্টিশনে একটা পাক মেরে আয়। সব ভাল করে দেখে আসবি।

ফটকেও গণেশের মতোই সন্দিগ্ধ চোখে চারজনের দিকে একবার দেখে দৌড় দিল। বলে গেল, এখুনি দেখে আসছি গুরু।

মনা ঘাড় কাত করে গণেশের দিকে তাকাল। চোখ আধবোজা করে জিজ্ঞেস করল, কী হল রে গণিশ?

গণেশ একটা বিড়ি কামড়ে ধরে চোয়াল শক্ত করে বলল, তোদের পোল খুলব।

ওরা চারজনেই আবার হেসে উঠল। কেউ খ্যালখেলিয়ে, কেউ কিতকিতিয়ে। আর ঢলে ঢলে পড়তে লাগল। পুনিয়া বলল, খালি পোল্ কেন রে, বল, আমাদের সব খুলে নিবি।

ত্যাবড়া ওর কোমরের প্যান্টটা টেনে দেখিয়ে বলল, ইস্তক এটা।

সোতে তাড়াতাড়ি ওর পাছায় দু হাত চেপে ভয়ে ভয়ে বলল, উ রে শালা, ফাদরাফাই করে দেবে, গণিশ মরদ বলে কথা!

বলেই, আবার একটি সাজগোজ করা, কালো ঠুলি পরা যুবতাঁকে ডেকে চেঁচিয়ে উঠল, রিকশা নিয়ে আসব দিদিমণি?

মেয়েটি ফিরে তাকাল না। মনা বলল, শালার খালি দিদিমণি দেখলেই ডাকাডাকি। মা-ঠাকরুন বাবুদের ডাকতে পারিস না?

সোতে হাত নেড়ে বলল, ও সব তুই বুঝবি না। প্যাসেঞ্জার হালকা হবে, দানাদ্দান চালাব, পয়সাও বেশি, ওদিকে নজরেও মেজাজ।

সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের মুখোশ আমরা টেনে ছিঁড়ে ফেলব…।

মাইকে গলা শোনা যাচ্ছে। এ সময়েই একটা ট্রেন এল। রাস্তার ওপরে জলের স্রোতের মতো প্যাসেঞ্জার নেমে এল। একসঙ্গে বোধহয় পঞ্চাশটা রিকশাওয়ালা হর্ন বাজিয়ে প্যাসেঞ্জার ডাকতে লাগল। মাইকের শব্দ একটু সময়ের জন্য চাপা পড়ল। ফাঁকা হতেও সময় লাগল না।

ওরা চারজন তেমনি দাঁড়িয়ে। গণেশ প্যাসেঞ্জার ধরবার জন্য যেতে গিয়েও থমকে গেল। ওর চোখের পাতা কুঁচকে উঠল। নাকের পাটা আবার ফুলল, সন্দেহের সঙ্গে উত্তেজনায় চোখ ঝকঝকিয়ে উঠল। বলল, উ রে শালা, প্যাসেঞ্জার ধরার তাল নেই তোদের?

মনা বললে, শালা এমন লক্ষ্মী গাড়ি না, দেখবি প্যাসেঞ্জার নিজেই এসে গেছে।

 গণেশের উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তা বেড়ে উঠল। বলল, নির্ঘাত তোরা কিছু পেয়েছিস, না হলে!

ফটকে ফিরে এসে বলল, না গুরু, ইস্টিশনে প্যালেটফর্মে কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না।

ঝাড়ুদারনিটাকে জিজ্ঞেস করেছিলি?

হ্যাঁ, বললে কিছু দেখতে পায়নি।

এই সময়েই পুনিয়ার রিকশায় গাদাখানেক কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে একটি গরিব বউ উঠে পড়ল।

পুনিয়া খেঁকিয়ে উঠল, আরে আরে কোথায় যাবে?

 বউটি ব্যস্ত। কোলে একটি, কোলের নীচে একটি, কোল ধরে, পাশে দুটি। বলল, জোড়া তালাও।  

পুনিয়ার মুখ বিকৃত। বলল, বারো আনা লাগবে।

বউটি প্রতিবাদ করে বলল, কেন? ছ আনা ভাড়া তো।

পুনিয়া ঘাড় নেড়ে বলল, হবে না, অন্য রিকশা দেখ।

গণেশ ইতিমধ্যে ওদের আরও কয়েকবার দেখে সরে গেল। যাবার আগে বলে গেল, আচ্ছা, আমিও দেখছি।

ত্যাবড়া বলল, দ্যাখ দ্যাখ, দেখে লে গণিশ।

 ওরা চারজনেই আবার হেসে উঠল। হাসির মধ্যেই মনা পুনিয়ার রিকশার যাত্রী বউটিকে জিজ্ঞেস করল, দশ আনা দেবেন দিদি?

বউটি বলল, না ভাই, আট আনা দিতে পারি।

পাঁচজন যাবেন তো।

সব তো ছেলেমানুষ বাপু।

 মনা রাজি হয়ে গেল, আসুন, দিনের বেলাটা চালাতে হবে তো।

বউটি বাচ্চাদের নিয়ে হুড়মুড় করে পুনিয়ার রিকশা থেকে নেমে মনার রিকশায় এসে উঠল।

পুনিয়া বলল, বা রে শালা!

মনা বলল, তোমার শালা এখন গরম বেশি। সক্কালেই লম্বা টিরিপ মেরেছ, দেড় টাকা করকর করছে।

ওরা চারজনে আবার চোখাচোখি করল। আবার ইশারা, চোখে চোখে কথা। বোঝা যায় তার সঙ্গে ভাড়ার কোনও ব্যাপার নেই। ত্যাবড়া বলল মনাকে, যাচ্ছিস, একটা টাকা ছেড়ে যা, জিনিস কিনতে হবে না?

ঘুরে আসি।

ত্যাবড়া ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, না না, ঘুরে এলে হবে না। রেডি করতে হবে।

মনা মুখ বিকৃত করে প্যান্টের পকেট হাতড়াল। একটা আধুলি বের করে দিয়ে বলল, এখন এটা রাখ, ফিরে এসে বাকিটা দিচ্ছি।

ত্যাবড়া আধুলিটা নিয়ে বলল, থাকলেও দিবি না, খচ্চর! আচ্ছা শোন–

ও রিকশাসারির সকলের মুখের দিকে একবার দেখে নিল। গণেশ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। মনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওদিকে যাচ্ছিস, একবার দেখে আসিস।

মনা জিজ্ঞেস করল, পটল তোলা হয়ে গেলে নিয়ে আসব?

ত্যাবড়া নেতার মতো মুখ করে বলল, না, একলা আনিস না। আমাদের কাউকে ডেকে নিয়ে যাস। আমার শালা খুব ভয় লাগছে।

কেন?

 গণেশ ফটকেরা না টের পেয়ে যায়?

মনা একবার গণেশের দিকে দেখল, বলল, শালা খট্টাসের মতন চেয়ে রয়েছে। তবে কিছু আনজাদ করতে পারছে না। আচ্ছা আমি ঘুরে আসি।

ওরা চারজনেই মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। মনা যাত্রী নিয়ে চলে গেল। আর দুটি কলেজের মেয়ে সোতের রিকশার কাছে এসে বলল, ভাড়া যাবে?

সোতে তড়াক করে রিকশার কাছ ঘেঁষে বলল, কোথায় যাবেন?

লক্ষ্মীপুর।

 বসুন।

ভাড়া কত?

আপনাদের আবার ভাড়া বলব কী, উনি না। যা ভাড়া তা-ই দেবেন।

মেয়ে দুটি ওঠবার সময়েই ত্যাবড়া ডেকে উঠল, সোতে।

সোতে হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল। প্যান্টের হিপ পকেট থেকে একটা টাকা বের করে ত্যাবড়ার হাতে দিয়ে বলল, সসতীশ দাস্ ওসসব ভোলে না।

বলেই রিকশাটাকে নিয়ে দৌড়ে ছুটে গেল রাস্তার ওপর। লাফ দিয়ে সিটের ওপর উঠতে উঠতে কপালে পড়া চুলে একটা ঝাপটা মারল, হর্ন বাজাল।

পুনিয়া বলল, শালার কপাল দেখলি। ঠিক দিদিমণি মিলে গেল।

ত্যাবড়াও সেই দিকে চেয়ে কবুল করল, হ্যাঁ, ওর কপালে দিদিমণি আছে।

কথা বলতে বলতেই ত্যাবড়া আর পুনিয়া আবার চোখে চোখে তাকায়।

..আজকের যুবক আর ছাত্রেরা সংগ্রামী জনতার এক বিরাট অংশ, তারা অতন্দ্র প্রহরীর মতো…

ওই দ্যাখ, গণশা শালা ফটকের কানে কানে কী বলছে। পুনিয়া বলল।

ত্যাবড়া বলল, দেখছি। শালারা খেকতুরে শকুন হয়ে আছে। এর আগেরটাও ওদের হাত ফসকেছিল। এটাও–

ভাড়া যাবে?

ত্যাবড়ার বদলে পুনিয়া যাত্রীর দিকে দেখল। ভোঁদকা মোটা, পাতলুন কোট পরা, হাতে ব্যাগ। জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবেন?

রেজিষ্ট্রি আপিস।

আট আনা।

 চার আনা।

পুনিয়া গণেশকে দেখিয়ে বলল, ওই রিকশায় যান।

লোকটা একটু অবাক হয়ে গণেশের দিকে এগিয়ে গেল। কী দু-একটা কথা হল। গণেশ চেঁচিয়ে খিস্তি করে উঠল, শালা, ইয়ে মজাকি হচ্ছে আমার সঙ্গে, অ্যাঁ? প্যাসেঞ্জার লিয়ে ইয়ারকি। খপরি খুলে নেব।

পুনিয়া ত্যাবড়ার দিকে চেয়ে ওর পাকানো শরীর কাঁপিয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগল। ত্যাবড়া বলল, পেছুতে লাগিস না, বুড়ো এমনিতেই ব্যমকে আছে।

গণেশের সঙ্গে লোকটার ভাড়ার রফা হয়ে গিয়েছে। যাত্রী তুলে নিয়ে যাবার আগেও সে দপদপে চোখে পুনিয়ার দিকে চেয়ে খেউড় করে গেল। ত্যাবড়া বলল, দে, তোর টাকাটা ছাড়।

পুনিয়া বলল, এখনই?

হ্যাঁ, দে, মালপত্তর রেডি রাখি।

পুনিয়া টাকাটা বের করে দিতে একটু দেরি করল। তার আগে বলল, আগে যেয়ে একবার দেখে আসব, মাল মজুদ আছে, না হাপিস হয়ে গেল।

ত্যাবড়া ধমকে উঠল, ধ্যাত শালা, বলছি টাকাটা দে। হাপিস হবে কেন?

পুনিয়া একটা টাকা দিল ত্যাবড়াকে। ত্যাবড়া বলল, তুই থাক আমি আসছি।

পুনিয়া তবু বলল, আমি একবার দেখে আসি না।

ফটকেরা টের পেয়ে যাবে।

বাজারের পেছুনকার গলি দিয়ে ঘুরে যাব। বুঝতে পারবে না।

ত্যাবড়া একটু ভেবে বলল, যা তবে।

.

পুনিয়া চলে গেল। ত্যাবড়া দাঁড়িয়ে রইল। আড়চোখে ফটকেকে দেখল। তারপরেই হঠাৎ মেয়ে গলার খলখলে হাসি শুনে পিছন ফিরে তাকাল। রিকশা-সারির পিছনে দেখল দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে জগা ঠ্যাঙ ছড়িয়ে বসে আছে। পান-খাওয়া লাল দাঁত বের করে মেয়েটার দিকে চেয়ে হাসছে। ত্যাবড়ার মুখ শক্ত হয়ে উঠল। মেয়েটাকে দেখলে ওর গা জ্বালা করে। বছর দুই তিন আগে কোথা থেকে ছুঁড়ি এল। তখন গায়ে গতরে একফোঁটা মাংস নেই। গায়ে একটা বুকখোলা ফ্রক, তলায় একটা ইজের। আর এখন দেখো একটা ধুমসি মাগি হয়ে উঠেছে। ভিক্ষের বহর বজায় রেখেছে, কিন্তু জগাদের একটা গুরুপের সঙ্গে মেয়েটার কারবারের কথা জানতে কারোর বাকি নেই। রাত্রের অন্ধকারে আনাচে কানাচে আরও উটকো প্যাসেঞ্জার কি না আছে। ইস্টিশনের সেপাইরাও নিশ্চয় ছেড়ে কথা কয় । মেয়েটার নাম, কে জানে সত্যি না মিথ্যে, যমুনা। দুই ঠ্যাঙের ফাঁকের মাঝখানে কাপড় উঁচু করে তুলে ধরে যেভাবে খলখলিয়ে হাসছে মনে হয় যেন এখনই একটা কাণ্ড করবে। অনেকেই এখন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। পথ চলতি ভদ্দরলোকেরাও ছেড়ে দিচ্ছে না। মেয়েমানুষ এর নাম!

খচড়ি। ত্যাবড়া মনে মনে বলল। কিন্তু যাই হোক গিয়ে, ওর কিছু যায় আসে না। জগা এখন বসে বসে মজা মারছে কেন। বলেছিল, শরীর খারাপ, জ্বর হয়েছে, আজ এ বেলা গাড়ি চালাতে পারবে না। ও দলের লোক, এক টাকা ওর দেবার কথা। খাটতে না পারলে কথা ছিল না। যমুনার আঁচে বসে গা গরম করবে, আর দু-চারটে টিরিপ মারতে পারে না। ও জগার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। যমুনা বলল, এই যে ত্যাওড়া দাদা।

ত্যাবড়া খিস্তি করে, তাকে অন্য ভাবে উচ্চারণ করল, তারপর বলল, ত্যাওড়া তোর বাপের নাম।

যমুনা খলখলিয়ে আগের মতোই হাসতে লাগল। জগা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ত্যাওড়া আমার শ্বশুরের নাম। খবর কী ওস্তাদ, ফট না খাবি?

ত্যাবড়া বলল, সে যাই হোক গে, একটা টাকা ছাড়, মজাকি করলে হবে না।

জগা নরম স্বরে বলল, নেই মাইরি, বিশ্বাস কর।

তবে খাটতে যাও না। কাল রাত্রে তো শালা বেসি মাল খেয়ে, সকালে পড়ে আছ। জ্বর না হাতি।

 জগা বলল, যাব যাব, বেলা দুটো থেকে গাড়ি চালাব।

যমুনা জিজ্ঞেস করল, কীসের টাকা?

জগা বলল, সে খোঁজে তোর দরকার কী। টাকা আছে? দিবি?

যমুনা নাচবে কি না কে জানে, একটু একটু কোমর দুলিয়ে, ভুরু কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে চোখ ঘুরিয়ে বলল, দিতে পারি, সুদ কত দেবে?

জগা যমুনার সারা গায়ের দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, যত চাস।

যমুনা ঠোঁট উলটে বলল, মুরোদ! দেখবখনি। টাকা একটা দিচ্ছি। কিন্তু তোমাদের মতলব কী বলো তো?

বলতে বলতে যমুনা, কোমরের কষি ঢিলে করে, ভিতরে হাত ঢোকাল। ত্যাবড়া আর জগা চোখাচোখি করল। ত্যাবড়ার চোখে সাবধানের ইশারা। বলল, খুব হুশিয়ার। গণেশ শালা একটা কিছু আজ্জাদ করেছে। ফকেকে ইস্টিশনে পাঁতি পাঁতি করে খুঁজতে পাঠিয়েছিল। আমাদের ওপর ওদের নজর আছে।

যমুনা ছোট একটা গেঁজে থেকে, ছোট করে পাকানো এক টাকার নোট জগার কোলের ওপর ছুঁড়ে দিল। বলল, তোমাদের মতলব তো? পরে ঠিক জানতে পারব।

জগা বলল, সে টাইম হলে দেখা যাবে।

ত্যাবড়া জগার কোল থেকে টাকাটা কুড়িয়ে নিতে নিতে খ্যাঁক করে উঠল, না, মেয়েমানুষের ও সবে দরকার নেই। এ সব তোদের রাত্রের কারবার না।

যমুনা শরীর দুলিয়ে হি হি করে হাসল, বলল, কারবার করলে আর এ সব বলতে না ত্যাওড়া দাদা।

 ত্যাবড়া হাত তুলে খেঁকিয়ে উঠল, ভাগ বলছি।

যমুনা হাসতে হাসতে দৌড় দিল। যাবার আগে বলে গেল, জগা, আমার টাকা যেন ফাঁকি না যায়। তা হলে তোমাকে চিবিয়ে খাব।

.

যমুনার দৌড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, সারে সারে রিকশাগুলো থেকে আওয়াজ উঠল, উই উই উই।..ধর ধর ধর।..খা খা খা। এবং অনেক গলার হাসি।

…অতএব বন্ধুগণ, স্থানীয় জনসাধারণের কাছে আমাদের আবেদন, এই সম্মেলনকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলার জন্য…।

ত্যাবড়া চারদিকে একবার দেখে নিয়ে জগাকে বলল, শোন, আমি জিনিসপত্তর সব নিয়ে আসি। পুনিয়া কাট পুলের ওখানে গেছে। ফিরে এসে যেন চেঁচামেচি না করে, শালাকে বিসবাস নেই। গাড়ি রইল।

জগা বলল, যা ওস্তাদ যা, আমি সব দেখছি।

দেওয়ালের ধারে নর্দমা, নর্দমার ধারে পাতা চটের থলের ওপর, জগা এলিয়ে পড়ল দেওয়ালে হেলে। ওর ঢুলু ঢুলু চোখে খুশির চকচকানি। বলল, যাক, অনেকদিন বাদে।

ত্যাবড়া সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে, চোখের কোণে এদিক ওদিক দেখে বাজারের রাস্তায় চলে গেল। ঠোঁট নেড়ে, বিড়বিড় করে, আঙুলের কড় গুনে কী হিসাব করল। তারপরে রাস্তার ধারেই একটা ছোট কাপড়ের দোকানে ঢুকে পড়ল। আবার কী ভাবল। ভেবে, মাথা নাড়ল। মিটারের হিসাবে, দু মিটার সাদা কাপড় চাইল।

দোকানদার জিজ্ঞেস করল, কোরা না ধোলাই?

কোরা। সব থেকে সস্তাটা দিন বাবু।

কাপড়ের প্যাকেট নিয়ে, মুদি দোকানে গেল। সব থেকে সস্তা ধূপকাঠি কিনল এক বাক্সসা। তারপরে গেল ফুলের দোকানে। গাঁদা ফুলের দিন চলে গিয়েছে, মালার বাহার নেই। যে সব মালা দেখে চোখ টানে, সে সব পড়তায় আসবে না। এমনি বাজে ফুলের দাম শুনে, ত্যাবড়ার মনে হল, ফুল না, সব আগুনের ফুলকি। দাম শুনলে ছ্যাঁকা লাগে। তবু পাঁচ পাপড়ি টগরের একটা মালা কিনতে হল পনেরো পয়সা দিয়ে। পাঁচ পয়সা দিয়ে একটা জবাও তার সঙ্গে গেঁথে নিল। মনে মনে বলল, যাক গে শালা, আফসোস রেখে লাভ কী।

ফুলওয়ালা মালাগাছি কাগজে মুড়তে মুড়তে, এতক্ষণে যেন ত্যাবড়াকে চিনতে পারল। জিজ্ঞেস করল, মালা দিয়ে কী হবে?

ত্যাবড়া বলল, হবে।

 দোকানদার হেসে জিজ্ঞেস করল, বিয়ে করতে যাবি নাকি?

 ত্যাবড়া পয়সা দিয়ে, মালা নিয়ে বলল, জমমো দিতে যাব!

 সব জোগাড় করে ত্যাবড়া যখন ইস্টিশনের কাছে এসে দাঁড়াল, দেখল পুনিয়া হাত পা নেড়ে জগাকে যেন কী বলছে। জগার সঙ্গে ত্যাবড়ার চোখাচোখি হতেই, জগা একটা ইশারা করল। পুনিয়া দৌড়ে এল ত্যাবড়ার কাছে। ওর চোখে মুখে উত্তেজনা। ত্যাবড়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ফিনিস।

ত্যাবড়া সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাপতির মতো খাড়া হয়ে উঠল। যেন একটা কী ঘটে গেল। দৌড়ে জগার কাছে গিয়ে প্যাকেটগুলো সব দিয়ে দিল। ফিরে, দৌড়ে ওর রিকশার সিটে লাফ দিয়ে উঠে বসল। চিৎকার করে হুকুম করল, পুনিয়া, গাড়িতে ওঠ।

গণেশও এবার চিৎকার করে উঠল, ফটকে, জলদি। আমার গাড়িতে উঠে বস।ত্যাবড়া ততক্ষণে রিকশা চালাতে আরম্ভ করেছে। পুনিয়া লাফ দিয়ে উঠে বসল। বলল, মনা জোড়া তালাওয়ের প্যাসেঞ্জার ছেড়ে আসছিল। ওকে পুলের ওখানে যেতে বলেছি।

ত্যাবড়া বলে উঠল, ফাঁকেলাস্! শালা এ না হলে বুদ্ধি। দ্যাখ তো গণেশ শালা আসছে নাকি?

পুনিয়া পিছন ফিরে দেখল, গণেশ ফটকেকে রিকশায় চাপিয়ে নিয়ে চালিয়ে আসছে। বলল, আসছে।

ত্যাবড়া বলল, শালাকে এবার একদিন অ্যায়সা ঝাড়ব, বাপের নাম ভুলিয়ে নেব মাইরি। ও কী ভেবেছে, বেওয়ারিশ মাল, ছিনিয়ে নেবে?

পুনিয়া বলল, আসতে দে না, চেয়ে চেয়ে দেখুক আর জ্বলে মরুক।

কাট পুলের সিঁড়ির কাছে, রাস্তার ধারে, মনার গাড়িটা দেখা গেল। তার পিছনে ত্যাবড়া ব্রেক কষল। পুনিয়া লাফিয়ে নেমে সিঁড়ির পাশ দিয়ে রেল লাইনের দিকে গেল। ত্যাবড়াও গেল। রেল লাইনের কাছাকাছি এক রাশ বুনো ঝাড়ে বুনো কুল। কয়েকটা খাড়া বাঁকা বুড়ো কাঁটামনসা। তার পাশে খানিকটা খোলা জায়গা। সেই জায়গায়, একটা লোক শোয়া। কাছে পাশে মনা দাঁড়িয়ে।

ত্যাবড়া আসতেই মনা প্রায় চমকে উঠে বলল, এসেছিস? ওই দ্যাখ মাইরি, আর উইদিকেও দ্যাখ। আমি ভয় পাচ্ছিলাম।

দেখা গেল, রেল লাইনের ওধারে দুটো শকুন এসে বসেছে। মাথার ওপরে, বেশ নীচের দিকেই, মাটিতে ছায়া ফেলে কয়েকটা উড়ে বেড়াচ্ছে। লক্ষ্য, শোয়া শরীরটার ওপরে। মরা শরীর। ৫৮০

এই সময়ে, ওদের পিছনে, গণেশের গলা শোনা গেল, দ্যাখ ফটকে, বলেছিলাম কি না, জরুর কোনও মতলব আছে ওদের।

ত্যাবড়া মনা আর পুনিয়ার দিকে একবার তাকাল। তারপরে মনার দিকে ফিরে বলল, আরে তুই আমাকে ও সব কী দেখাচ্ছিস। আসল শকুন দুটো তো আমাদের পেছনে।

পুনিয়া খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠল। পিছন ফিরে তাকাল। মনাও দেখল। গণেশ আর ফটুকে, মরা শরীরটার দিকে চেয়ে রয়েছে, গণেশের চোখ দুটো দপদপ করছে। মার খেয়ে, রাগ হলে যেমন হয়, সেইরকম ওর মুখের ভাব। বাঁশচেরা গলায় বলল, শকুন কারা দেখাই যাচ্ছে। আমরা মড়া খুঁজে ফিরি না। আয় ফটকে।

মনা আর পুনিয়া হ্যাঁ হ্যাঁ করে হেসে উঠল। মনা বলে উঠল, শালা, ইমলি ইমলি, থুঃ।

আচ্ছা রে শালা, এর পরে আমরাও দেখে লেব, কোথা থেকে।

গণেশের কথা শেষ হবার আগেই মনা বলে উঠল, হাসপাতাল থেকে মড়া লিয়ে আসবি।

এবার ত্যাবড়া সুদ্ধ হেসে ফেলল। গণেশরা রাস্তার দিকে চলে গেল। ওরা তিনজনেই মরা মানুষটার আরও কাছে ঘেঁষে দাঁড়াল। কালো, রোগা একটি বুড়ো। মুখে কোনও বিকার নেই। বয়স হয়ে গেলে, মানুষ যেমন ঘুমোয়, চোখ বুজে, মুখটা একটু হাঁ করে, তেমনি দেখাচ্ছে। মুখের ভিতর জিভটা দেখা যাচ্ছে। মুখে কিছু পাঁশুটে গোঁফ দাড়ি। মাথার পাতলা চুলও সেই রকম। এই বয়সে আর এ অবস্থায়, লোকের চুল দাড়ি আর তেমন গজায় না। তবে মরবার পরে যেন লোকটার মুখ বেশি চকচক করছে। নাকটা তো বটেই। গায়ে দু-তিনটে ছেঁড়াখোঁড়া জামা। হাঁটুর ওপর অবধি ময়লা ন্যাকড়া জড়ানো! চিত হয়ে, প্রায় সোজা শুয়ে আছে। বাঁ পা-টা একটু বেঁকে রয়েছে, পাতাটা কাত করা। মাথার কাছে একটা পুঁটুলি।

কাছেপিঠে লোকালয় তেমন নেই। রেল লাইনের ওপারে, খোলা মাঠের ওপারে কয়েকটা খোলার ঘর। এপারে, বড় রাস্তার দিকে মুখ করা বাড়িগুলোর পিছন দিক। রেল লাইনের দিকে কেউ আসে না।

ত্যাবড়া বলল, লোকটা মনে হয় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মরে গেছে। এর আগেরটা যে রকম ছিল সে রকম না, চোখের পাতা খোলা, মুখটা রাক্ষসের মতো হাঁ করা, যেন গিলতে আসছিল।

পুনিয়া বলে উঠল, মাইরি।

ওরা তিনজনে আবার মরা মানুষটাকে দেখতে লাগল। ত্যাবড়া ঝোঁপের নীচে, কাঁটামনসার গোড়ার কাছে পরিষ্কার জায়গাটার দিকে তাকাল। বলল, লোকটা ওখানে থাকত। আমি পয়লা একদিন মারক করেছিলাম, পুলের ওপর থেকে। তখনই ঠিক করে রেখেছিলাম।

মনা বলল, তবে একটাই বাঁচোয়া, লোকটার গায়ে ঘা পাঁচড়া পুঁজ রক্ত কিছু নেই।

পুনিয়া বলল, আর হেগে মুতে মাখামাখিও করে রাখেনি।

ত্যাবড়া বলল, লোকটা বোধহয় কিছু পুণ্যি করেছিল।

মনা বলল, আমাদেরও পুণ্যি বল।

ত্যাবড় ঘাড় ঝাঁকাল। মরা মুখের দিকে চোখ রেখে বলল, লোকটা ভাল মানুষ ছিল মনে হয়, না?

পুনিয়া বলে উঠল, হ্যাঁ, আমার তাই মনে হচ্ছিল। কোথা থেকে এসেছিল লোকটা?

ত্যাবড়া বলল, মানুষ আবার কোথা থেকে আসে। সবাই যেখান থেকে আসে, সেখান থেকেই এসেছে।

পুনিয়া অবাক হয়ে মনার দিকে তাকাল। মনা বলল, বাঃ, তা বলে একটা জায়গা, ঘরবাড়ি।

 ত্যাবড়া ভুরু তুলে, ঠোঁট বেঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই কোথায় থাকিস, তোর বাড়ি-ঘর কোথায়?

মনা বোকার মতো শব্দ করল, অ্যাঁ?

 বল না।

 মনা বলল, আমি তো ইস্টিশনের এক দিকে।

ত্যাবড়া বলে উঠল, অই রকম, সব অই রকম। এক জায়গা থেকে এলেই হল। তুই মরে যাবার পরে যখন কেউ খোঁজ নেবে–।

মনা খেঁকিয়ে উঠল, খচ্চর, শালা, তোর খোঁজ নেবে লোকে।

ত্যাবড়া শ্লেষ্ম জড়ানো গলায় হেসে উঠল। বলল, নে, বুড়োর হাঁ মুখটা বুজিয়ে দে তো।

 কিন্তু মনার কানে কথাটা সেই মুহূর্তেই গেল বলে মনে হল না। মরা মুখটার দিকে চেয়ে, ও কেমন যেন আনমনা। এ সময়ে শেষ মাঘের দক্ষিণা বাতাস বইছিল। হঠাৎ একটা ছোট ঝাপটা মতো এল, ধুলো আর পাতা উড়ে, একটা ঘূর্ণির মতো হল। দুটো ছায়া, মরা শরীরের ওপর দিয়ে সাঁ করে চলে গেল। তিনজনেই দেখল, কয়েকটা শকুন, উড়তে উড়তে আরও নীচে নেমে এসেছে। ওপারে লাইনের ধারে, আরও দুটো নেমে বসেছে।

ত্যাবড়া নিচু হয়ে, মরা মানুষটির হাঁ মুখ বন্ধ করে দিল। কিন্তু পুরো বন্ধ হল না। আস্তে আস্তে খুলে, অল্প একটু ফাঁক হয়ে রইল। ওইটুকু আর বন্ধ করার চেষ্টা না করে ত্যাবড়া পুঁটলিটা খুলল। একটু আধটু ছেঁড়া থাকলেও, প্রায় ফরসা একটা জামা। একটা চশমা, একদিকে কাঁচ নেই। একটা চিরুনি। কয়েক মুঠো শুকনো মুড়ি একটা ঠোঙায় দলা পাকানো। কিছু শুকিয়ে যাওয়া ফুল বেলপাতা। ছোট রুদ্রাক্ষের মালা। পুঁটলিতে আর কিছু নেই।

তিনজনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ত্যাবড়া মরা মানুষটির কোমরের কাছে থেকে জামা তুলে, হাত দিয়ে টিপে টিপে দেখল। ছেঁড়া-খোঁড়া জামার বুকের কাছে, পিঠের নীচে, সব জায়গায় হাতড়াল। ঠোঁট উলটে বলল, শালা, একটা ঘষা লোহাও নেই।

মনা বলল, এরকম হয় না। ইস্টিশনের কাছে সেই যে পাগলিটা পচে গলে মরেছিল, তার পুঁটলিতেও কিছু পয়সা ছিল।

পুনিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, এ সময়ে পিছন থেকে মোটা আর আর ভরাট গলা শোনা গেল, কে রে তোরা, কী করছিস?

ওরা তিনজনেই ফিরে দেখল। চিনতে পারল, বড় রাস্তার ধারে বাবুর বাড়ি। ত্যাবড়া বলল, দেখুন না বাবু, বুড়ো মরে গেছে, ভাবছি পুড়িয়ে দেব।

ভদ্রলোক মৃতদেহ দেখলেন। নাকে কাপড় চাপা দিলেন। চোখে খুশির ভাব ফুটে উঠল। ঘাড় নেড়ে বললেন, খুব ভাল, খুব ভাল। তোদের চেনাশোনা ছিল বুঝি?

ত্যাবড়া বলল, না না, কে কার চেনাশোনা। দেখলাম মরে পড়ে আছে, আপনাদের ঘর-দোরের সামনে, ভাবলাম দিই গে পুড়িয়ে।

ভদ্রলোক ঘাড় নেড়ে বললেন, বাহবা বাহ্বা, এই তো চাই, এই তো।

ত্যাবড়া ফিসফিসিয়ে বলল, শালা দায়ে পড়ে বলছে। গলা তুলে বলল, কিছু সাহায্য করুন বাবু। খরচ-টরচ আছে তো।

ভদ্রলোক ভাবতে পারেননি, কথা কত দিকে গড়াতে পারে। বললেন, অ্যাঁ? তারপরে ঘাড় নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা বটে, তা বটে।

পকেট থেকে গোটা একটি টাকার নোট তুলে ধরলেন। মনা এগিয়ে হাত বাড়িয়ে নিল। ভদ্রলোক যেন পালক ঝাড়া দিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন, তা হলে, নিয়ে যাস বাবা।

ত্যাবড়া শ্লেষ্ম জড়ানো গলায় হাসল। বলল, শালা বাঁশ কেন ঝাড়ে..খবরদারি করতে এসে একটা টাকা দণ্ড, বউনিটা ভাল, কী বলিস?

পুনিয়া বলল, মাইরি মাইরি।

লে ধর, তুলে নিয়ে যাই। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, আর দেরি করব না।

ত্যাবড়া ধরল দুটো হাত। মনা ধরল দুটো পা। চ্যাংদোলা করে তুলে ধরতে, মাথাটা পড়ল ঝুলে। ত্যাবড়া পুনিয়াকে হুকুম করল, পুঁটলিটা নে, আর এক হাতে মাথাটা তুলে ধর।

পুনিয়া হুকুম পালন করল। তিনজনে মিলে, মরা শরীর নিয়ে রাস্তায় এসে উঠল। ত্যাবড়া মনার রিকশার ওপরে তুলতে যেতে মনা খেঁকিয়ে বলল, না, তোর গাড়িতে নে।

ত্যাবড়া মড়াটাকে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, আরে ধ্যাৎ, তোল না।

ও মনার রিকশায় অর্ধেকটা শরীর তুলে দিল। দিয়ে, আরও খানিকটা টেনে সিটের গায়ে ঠেকনো দিল। মনার চোখ দপদপিয়ে উঠল। শালা, নিজের বেলায় আঁটিসুটি।

ত্যাবড়া বলল, লে, লে, হাঁটু দুটো একটু ভেঙে তুলে দে। আরে বাবা, একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিলেই হবে।

সে তো তোর গাড়িতেও দেওয়া যেত।

ত্যাবড়া সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে, মড়ার পা দুটোকে একটু ভেঙে, যতটা সম্ভব, রিকশার পা রাখবার জায়গায় তুলে দিল। আবার ছায়া উড়ে গেল মরা শরীরের ওপর দিয়ে। তিনজনেই আকাশের দিকে তাকাল। শকুনগুলো এখনও উড়ছে; পুনিয়া কাঁচকলা দেখিয়ে বলল, এই পাচ্ছ।

ত্যাবড়া মরা লোকটির দিকে তাকিয়েছিল। ও যেন হঠাৎ খুব অবাক হয়েছে, চোখের পলক পড়ছে না। মনা বিরক্ত হয়ে বলল, কী হল কী। যেন বাপের মুখ দেখছিস শালা।

ত্যাবড়া ঘাড় নেড়ে বলল, আমার বাপ? এরকম ভাল মানুষ হতে হলে আমার বাপকে আবার জমাতে হবে। সে শালার কথা ছেড়ে দে, কিন্তু মাইরি আমি এই লোকটার কথা ভাবছি। এ নিগঘাত খুব পুণ্যি করেছে, চেহারা দেখেছিস। তাই তো বলি।

বলে ঘাড় নাড়তে লাগল। মনা পুনিয়া চোখাচোখি করল। ত্যাবড়া ওদের দিকে চেয়ে বলল, ভেবে দ্যাখ, মাসের এখন পয়লা হপ্তা যাচ্ছে, অ্যাঁ? কাল চটকলে হপ্তা হয়ে গেছে, কেমন? আর আজ শনিবার–শনিবারের দুপুরে লোকটা মরল। উ রে শালা, কপাল কাকে বলে। এ নিশ্চয় কোনও সাধক টাধক হবে। এর আগের দুটোর একটাও এ রকম হয়নি।

মনা পুনিয়াও এবার অবাক হয়। মনা বলল, ঠিক বলেছিস তো।

ত্যাবড়া আদরের ভঙ্গিতে, চুমকুড়ির শব্দ করে, মৃতের মরা চিবুকে হাত বুলিয়ে দিল। বলল, বাবা, বরাবর যেন তোমার মতো পাই।

বলে ত্যাবড়া সিটের ওপর উঠে বসতে বসতে পুনিয়াকে বলল, তুই আমার গাড়িটা চালিয়ে চল। পুঁটলিটা বুড়োর কোলে রেখে দে।

এ সময়ে মনা গাড়িতে উঠতে গিয়ে টের পেল, তিনটে চাকায় হাওয়া নেই। ও চিৎকার করে উঠল, এ শালা নিগঘাত গণশা আর ফটকের কাণ্ড।

ত্যাবড়া বলল, তা ছাড়া? কিন্তু আগে চল, গাড়ি হাঁটিয়ে নিয়ে চলে যাই, দু মিনিট লাগবে। ওরা স্বীকার যাবে না, তুই সবাইকে শুনিয়ে, আচ্ছা করে খিস্তি দিবি।

দেবে না, দেওয়া শুরু হয়ে গেল।

.

০২.

ওরা যখন মড়া নিয়ে ইস্টিশনে এল, সোতে আর জগা বাকি ব্যবস্থা করে রেখেছে। বাকি ব্যবস্থা আর কী, নতুন কোরা কাপড়টা দু-ফালি করে কেটে রেখেছে। ওরা আসতেই, সোতে ইস্টিশনের রোয়াকে ওঠবার সিঁড়ির এক ধারে এক টুকরো কাপড় পেতে দিল। ত্যাবড়া আগে পুঁটলিটা খুলে রুদ্রাক্ষের মালাটা বুড়োর গলায় পরিয়ে দিল। পুঁটুলিটা রাখল শিয়রের দিকে, বালিশের মতো করে। তারপরে সবাই মিলে যখন মরা মানুষটাকে শুইয়ে দিল, চারপাশে তখন লোকের ভিড়।

সোতে বলে উঠল, ভিড় হঠাও ভাই, ভিড় হঠাও, মড়া কথা বলে না।

জগা ওর জায়গায় বসেই, ধূপ কাঠি জ্বালিয়ে দিল। ত্যাবড়া আর এক টুকরো নতুন কাপড় দিয়ে বুড়োর শরীর বুক অবধি ঢেকে দিল। পাঁচ-পাপড়ির টগরের মালাটা বুকের ওপর ছড়িয়ে দিল। শুকনো জবা ফুলটা একদলা বাসি রক্তের মতো দেখাচ্ছে। মনা ততক্ষণে চিৎকার করে খিস্তি শুরু করে দিয়েছে। যে ওর চাকার হাওয়া খুলেছে, তার মা বোন কারোর বিষয়েই, ওর কোনও বাছ বিচার নেই, এই কথাটাই, রাগে আর অনেক কথায় বলে চলেছে। আশেপাশের দোকানদারেরা ব্যাপার দেখে হাসাহাসি রাগারাগি করছে। শালারা যমের অরুচি। এদের কি মশাই ধমমোজ্ঞান নেই? দেশটা রসাতলে গেল। কীরকম মজার ব্যবসা দেখেছেন। আজ শালাদের ফলার হবে। কিন্তু পথচারীরা বা রেলের যাত্রীরা, রাস্তার ধারের দোকানদার না। তাদের কাছে, সব মিলিয়ে এটা একটা নিখুঁত দৃশ্য। একটি মৃতদেহ, নতুন কাপড়ে চাকা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, বুকে ফুল, ধূপকাঠি জ্বলছে।

পুনিয়া বলে উঠল, মড়া পোড়ানোর জন্য কিছু দিয়ে যাবেন দাদারা।

সোতে ধমক দিয়ে উঠল, চুপ কর শালা। মরদা কী বলে দিয়েছিল মনে নেই? সককারের জন্য কিছু সাহায্য করুন দাদা এ কথা বলতে হবে।

ত্যাবড়া পুনিয়াকে খিঁচিয়ে বলল, তা না শালা, মড়া পোড়াবার জন্য বলছে।

 মনা তখনও চাকার হাওয়া খুলে দেওয়ার রাগ সামলাতে পারেনি। নাগাড়ে খিস্তি করে যাচ্ছিল। গণেশ ফটকেরা প্রথম প্রথম হাসছিল। খিস্তিগুলো শুনতে শুনতে ক্রমে ওদের মুখ শক্ত হয়ে উঠছিল। মনা তা-ই চাইছিল। এই সময়ে ত্যাবড়া ধমকে বলল, এই মনা, এবার থাম, কুত্তাদের কামড়াতে যাসনে। শালারা কী জ্বালায় জ্বলছে, জানিস না? যা, চাকার হাওয়া দিয়ে নিয়ে আয়।

ইতিমধ্যে জগাও চটের থলি ছেড়ে উঠে এল। ত্যাবড়া একটা টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা মড়ার বুকের ওপরে রাখল। তা ছাড়া পাঁচ দশ কুড়ির মুদ্রা দু-চারটে পড়তে আরম্ভ করেছে। এই সময়ে সেপাই এসে দাঁড়াল। মড়ার দিকে তাকাল না, ত্যাবড়াদের দিকে তার নজর। বলল, কী হচ্ছে এ সব?

জগা বলল, ওই হচ্ছে, মড়ার ওপরে তো কথা নেই।

সেপাই ভুরু কোঁচকাল, চোখ ছোট করল। বলল, খুব বেড়েছিস। যা খুশি তাই? মড়া পোড়াবার নামে টাকা তুলে মদ মাগিবাজি আর মাংস–?

সোতে ওর কালো ঠোঁটের ফাঁকে সমস্ত সাদা দাঁতগুলো দেখিয়ে বলল, ওটি বলবেন না সেপাই দাদা। নাম করে না, যা করি পুড়িয়ে করি।

গণেশ কখন এসে দাঁড়িয়েছিল কারোর খেয়াল হয়নি। সে বলে উঠল, মিছে কথা বাবু, শালারা মিছে কথা বলছে।

ওরা শক্ত মুখে ঝটিতি ফিরতে সেপাই নিজেই হাতের ডাণ্ডা তুলে খেঁকিয়ে উঠল, শালা, তোকে মোড়লি মারতে কে বলেছে। তুই যখন এর আগে

পিঠে এক ঘা পড়ার আগেই, গণেশ হাত তুলে চাটুকারের মতো হাসল। হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে গেল।

ত্যাবড়া সেপাইকে বলল, যান না, যান না, নিজের কাজ করুনগে দাদা, দেবতার পুজো হবে।

 সেপাইটা এক গাল হাসল। জগার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, একটা সিগারেট দে।

সোতে একটা সিগারেট দিল। সেপাই অন্যদিকে গেল। তিনজনেই মুখ বিকৃত করে বলল, শালা মড়া দেখলেই সব্বার নোলায় জল।

ঠিক এ সময়েই শোনা গেল, হু হু হু, হেঁ হেঁ হেঁ, কীরে ত্যাবরা, র‍্যালের জায়গায় হালায় মড়া শোয়াইছস?

দেখা গেল, মড়ার মাথার কাছে, রোয়াকের ওপরে জি আর পি-র সেপাই দাঁড়িয়ে। মুখের হাসিতে রেখাপাক নেই বরং বেশ অমায়িক। সোতে বলে উঠল, আবার আর এক শালা।

ত্যাবড়া বলল, আমরা নিমিত্ত দাদা, সব পাবলিকের ব্যাপার। ফেলে দিন, পাবলিককে বলুন।

সেপাই হ্যা হ্যা করে হেসে বলল, আইচ্ছা আইচ্ছা, আজকাল পাবলিক দেখাইতে শিখছ হালা তোমরা, অ্যাঁ।

জগা যেন বিরক্ত অথচ মেজাজের মাথায় জঘন্য একরকম হাসি হেসে চোখ মারল, বলল, কেন দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছেন, অন্যদিকে যান না।

সেপাই এবার হি হি করে হাসল। আশ্বস্ত হয়ে চলে যেতে যেতে অনেকটা আদরের স্বরে বলল, খুব পাজি হইছস তোরা।

পুনিয়া রেগে উঠে বলল, শালা মড়াখেকো সব।

ভর দুপুরে রাস্তাটা একটু ফাঁকা হয়ে আসে। এ সময়ে ট্রেন কম, যাত্রীর আনাগোনা তেমন নেই। রিকশাচালকেরা কেউ কেউ খেতে গিয়েছে, যাচ্ছেও। মাঘের শেষের দুপুরটা অকালের উত্তাপে ঝাঁঝালো। রোদে বেশ তেজ। থেকে থেকে দক্ষিণা বাতাস দিচ্ছে। এ সময়েই মাছি ওড়ে, ভ্যান ভ্যান করে, আর দুর্গন্ধ ছড়ায় সবখান থেকে। খোলা নর্দমাগুলো থেকে, আর প্রস্রাবের গন্ধ যেখানে সেখানে। বাতাসে গন্ধ ছড়ায়, ধুলো ওড়ে, আর কুকুরগুলো হঠাৎ হঠাৎ বাতাসে নাক তুলে শুঁকতে শুঁকতে যেন কোনও মড়ার খবর পায়। শোকে মড়াকান্না জুড়ে দেয়।  

ত্যাবড়া সোতে জগা আর পুনিয়া, মরা শরীরটার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। মনা গিয়েছে চাকার হাওয়া ভরতে। খাওয়ার কথা ওদের মনে নেই। ভাড়া খাটবার চিন্তাও মাথায় নেই। একটা মরা মানুষের শরীর ওদের চোখে মুখে নতুন ঝলক এনে দিয়েছে। থেকে থেকে ওদের চোখ পড়ছে মরা শরীরটার দিকে। আর চারজনেই কী করবে এখন ঠিক করতে পারছে না। অথচ কেউ কারোর দিকে তাকাচ্ছে না। কেউ দু পা হেঁটে চলে যাচ্ছে। রিকশা হাতড়াচ্ছে, না হয় তো হর্নটাই টিপে দিচ্ছে। পুনিয়া একবার বলেই উঠল, আজ শালা!

কথা শেষ হল না। বাকি তিনজনে ওর দিকে ফিরে তাকাল। পুনিয়া ঝোল টানার শব্দ করল। সোতের আবার ডান হাতে ঘড়ি। সেই হাতটা তুলে ও বলল, অনেক দিন শরীরের জাম ছাড়েনি। আজ একটু জাম ছাড়াতে হবে।

জগা জিজ্ঞেস করল, ক বোতল টানবি?

তা জানি না। যতক্ষণ হুঁশ থাকবে।

ত্যাবড়া বলল, খাওয়াব শালা। তারপরে, তিন দিন গাড়ি চালাতে পারবে না, তখন আমার কাছে। খালি টাকার হিসাব চাইবে।

সে তো আগেই ভাগাভাগি হয়ে যাবে ওস্তাদ।

হলেও, শালা তোমাদের চিনি না? পরে বলবে, ত্যাবড়া শালা বেশি মেরে দিয়েছে।

এই সময়ে মনা চাকায় হাওয়া দিয়ে ফিরে এল। আর সোতের নজর খাড়া হয়ে উঠল। ইস্টিশনের রোয়াক থেকে নেমে এল সাজগোজ করা তিন যুবতী। সোতে এগিয়ে গিয়ে বলল, গাড়ি নিয়ে আসব। দিদিমণি?

পুনিয়া চিৎকার করে বলল, আমি আনছি দিদিমণি।

দিদিমণিদের একজন সোতেকে বলল, তিনজনকে নিতে পারবে?

সোতে বলল, চারজন হলেও পারব দিদিমণি। কোথায় যাবেন?

রুবি সিনেমা।

কোনও জবাব না দিয়ে, সোতে রিকশাটা তিনজনের সামনে নিয়ে এল। ইতিমধ্যে এক দিদিমণি প্রায় আঁতকে উঠে বলল, ওমা, এটা কী?

ত্যাবড়া বলল, মিতদেহ দিদিমণি।

সোতে বলল, সসৎকারের জন্য কিছু সাহায্য করে যান দিদিমণি।

তিনজনেই খানিকটা সরে গেল। দুই দিদিমণি ব্যাগ খুলে পয়সা ফেলল। একজন বলল, মড়া দেখলে যাত্রা শুভ। তারপরে রিকশায় কে কার কোলে বসবে, তাই নিয়ে কথা আর হাসির মধ্যে, কোলে বসতে হল সব থেকে ছোটদিদিমণিকে, যার পরনে আঁট পায়জামা আর পাঞ্জাবি। রিকশা চালাবার আগে, সোতে একবার সঙ্গীদের দিকে আড়চোখে তাকাল। হাত তুলে নমস্কার করল মরা মানুষের দিকে চেয়ে। দৌড় দিল রিকশা নিয়ে। পিছন থেকে ত্যাবড়া বলল, দুপুরের খাওয়া মিটিয়ে আসিস।

এই মুহূর্তে সবাই সোতের চলে যাওয়া রিকশার দিকেই তাকিয়েছিল। মনা বলল, শালার কপালটা সত্যি দিদিমণি ছাপা।

পুনিয়া বলল, তাও এই ভর দুপুরে। এখনও ম্যাটিনি শোর কত দেরি।

 ত্যাবড়া বলল, কেন বলো তো? কেন?

সবাই ওর দিকে তাকাল।

ত্যাবড়া মরা মানুষটাকে দেখিয়ে বলল, এর জন্য। মুখখানা দেখেছিস। সেই যাদের ফটো দেখে লোকে পুজো করে, সেইরকম দেখাচ্ছে, তাই না?

সবাই মরা মুখের দিকে তাকাল। সকলেই যেন অবাক, আবিষ্ট হয়ে কয়েক মুহূর্ত সেই মুখের দিকে চেয়ে রইল। কালো চোখ বোজা শান্ত লম্বাটে একটা মুখ। অল্প অল্প ধূসর গোঁফ দাড়ি। হাঁ মুখটা সামান্য একটু ফাঁক। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা।

জগা বলে উঠল, সত্যি। লোকটার কী নাম ছিল কে জানে?

ত্যাবড়া বলল, নাম ছিল জগার বাপ।

 জগা ত্যাবড়ার দিকে তাকাল। মনা আর পুনিয়া হেসে উঠল। মনা বলল, ত্যাবড়ার বাপ।

 ত্যাবড়া বলল, মনার বাপ।

জগা বলল, পুনিয়ার বাপটা আর বাদ যায় কেন?

 পুনিয়া বলল, তা হলে সোতের বাপও নাম হতে পারে।

ত্যাবড়া বলল, হ্যাঁ, আমাদের সকলের বাপ, বাপ চোদ্দপুরুষ। এখন সর তো এখান থেকে, একটু ফারাকে থাক। লোকজন যাবে, দেখবে, তবে তো পয়সা দেবে।

পয়সা ইতিমধ্যেই কিছু পড়েছে। পড়ছেও। ওরা সবাই একটু সরে গেল। জগা বলল, তোর চোখ বটে ত্যাবড়া। পুলের ওপর থেকে দেখতে পেয়েছিলি।

ত্যাবড়া বলল, দেখেই আমার কেমন খটকা লাগল। তখখুনি নেমে কাছে গেলাম। যা ভেবেছি, সনসারে মায়া কাটাবার তালে আছে। তবে এমন জায়গা, যদি রাত্তিরে পটল তুলত তা হলে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। শেয়ালকুকুরে খেয়ে ফেলত।

মনা বলল, আর ভাব, কাল থেকে খাবি খেতে খেতে মরল আজ দুপুরে। শালা টাইম জ্ঞান দেখেছিস, রেলগাড়ির মতন।

রেলগাড়ি? বিটকেল মুখ করে জগা বলল, রেলগাড়ির মতন টাইমে মরলে আর দেখতে হত না। কোন গাড়িটা শালা টাইমে চলে রে?

ত্যাবড়া বলল, যা বলেছিস। আমাদের বাবার টাইম অন্য জিনিস। মুখ দেখছিস না?

আবার সবাই মরা মুখটার দিকে ফিরে তাকাল। খানিকক্ষণ পরে সেই দিকে চোখ রেখেই জগা বলল, এর আগেরটা প্রায় চার মাস হয়ে গেল, না?

ত্যাবড়া বলল, তা হবে।

চার মাস পরে, আবার আজ!

পুনিয়া গান গেয়ে উঠল, কঁহা গয়ে হো–।

ত্যাবড়া খেঁকিয়ে উঠল, চুপ কর, গিলে আয় না। মনাও খেয়ে আয়। তোরা এলে আমি আর জগা খেতে যাব।

পুনিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলল, চল দোস্ত।

ও আর মনা চলে গেল। জগা তখনও মরা মুখের দিকে চেয়ে। ডাকল, ত্যাবড়া শোন।

কী।

আট আনা পয়সা দে তো, এ মুখটার ওপরে একবার ঝেঁকে আসি।

 ত্যাবড়া একটা খিস্তি করে বলল, এই দেব। খাবার নাম নেই, তুমি এখন জুয়া মারতে যাবে।

জগা বলল, দে না, দে না। ওবেলা খাটব। এ মুখ আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি, তুই আট আনা দে, আধঘণ্টা বাদে তোকে ফেরত দেব।

মুখের কথায় ত্যাবড়া একটু দুর্বল হল। তবু বলল, কেন, তোর সেই ছুঁড়ি কোথায় গেল।

সে এখন কোথায় জোড় হয়ে বসে আছে কে জানে। তুই দে না।

ত্যাবড়া প্যান্টের পাছার পকেট থেকে একটা আধুলি বের করে দিয়ে বলল, আধ ঘণ্টা বাদে ফেরত দিলে কিন্তু দোস্তি থাকবে না বলে দিলাম।

জগা কথা না বলে আধুলিটা নিয়ে ইস্টিশানের রোয়াকের ওপর উঠে গেল। রোয়াকের শেষ প্রান্তে পান বিড়ি সিগারেটের গুমটি ঘরের পিছনে গেল। সেখান তখন জমজমাটি আসর। সামনের দিক থেকে কিছুই দেখা যায় না। পুলিশের সঙ্গে ব্যবস্থা আছে। রিকশাচালকদের খেলার জায়গা এটা। এখন দুটো দলে খেলা হচ্ছে। একদল খেলা দেখছে। জগা দেখল, যমুনা এক পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। হীরা তার ঘাড়ের ওপর একটা পা তুলে দিয়ে খেলা দেখছে।

জগা মনে মনে বলল, তা-ই। না হলে এতক্ষণ যমুনার দেখা পাওয়া যেত।ও দিয়ে হীরার পাশে বসল।

.

এক পাত্র, দু পাত্র, তিন পাত্র। তারপরে মাতাল যেমন তার নিজস্ব মূর্তি পায়, ছোট মফস্বল শহরটা তেমনি পেতে আরম্ভ করে। বিশেষ করে ইস্টিশনের সামনে, শহরের এই সদর অংশে। যতই বেলা গড়িয়ে যায়, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, ভিড় ততই বাড়তে আরম্ভ করে। ট্রেন মোটরবাসের যাত্রী ছাড়াও কলকারখানার ছুটির ভিড়। সন্ধ্যার ঝোঁকে পতাকা ফেস্টুন সহ মিছিলটা চলে যাবার পরে ভিড়টা যেন নতুন করে বেড়ে উঠল। বাতিগুলো জ্বলতে আরম্ভ করল।

সোতে ইতিমধ্যে দুটো দিদিমণি ট্রিপ দিয়েছে। পুনিয়া একটা ট্রিপ দিয়েছে। মনা যাত্রী পায়নি।

জগা ত্যাবড়াকে আট আনা পয়সা ফেরত দিয়ে আবার সেখানেই ফিরে গিয়েছে। ত্যাবড়ার নড়াচড়া নেই। ওর লক্ষ্য, মরা মানুষ। মরা মানুষ শোয়ানো, নতুন কাপড়ের আর মরা শরীরের দিকে। অজস্র পয়সা পড়েছে। ত্যাবড়া কয়েকবার কাপড় তুলে তুলে পয়সাগুলো এক জায়গায় জড়ো করে দিয়েছে। কিছু কিছু তুলে টাকার নোট করে নিয়েছে। চোখে দেখা গুনতিতে যদি ঠিক থেকে থাকে, তবে প্রায় সত্তর টাকার মতো উঠেছে। রাত্রি দশটার আগে মড়া গোটানো হবে না। শনিবারের বাজার, মাসের প্রথম সপ্তাহ। ত্যাবড়া মরা মুখের দিকে চেয়ে মনে মনে বলল, বাবা, আজ তোমার দিন, আমাদেরও দিন।

এ সময়েই ঘটনাটা ঘটল। গণেশের দল অনেকক্ষণ থেকেই অনেক রকম টীকাটিপ্পনী কাটছিল। এরা বিশেষ কিছু জবাব দেয়নি। এ বেলার দিকে প্রথম মনার গাড়িতে প্যাসেঞ্জার জুটল, স্বামী-স্ত্রী। দুজনে উঠতে যাবে, গণেশ চেঁচিয়ে বলল, ও গাড়িতে উঠবেন না বাবু, ওই মড়াটা ওতে বই করেছে।

স্বামী-স্ত্রী একবার মড়ার দিকে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ পেছিয়ে গেল। মনার গলায় একটা গর্জন শোনা গেল, তবে রে শুয়োরের বাচ্চা।

তারপরেই ও একটা উড়ন তুবড়ির মতো ঝাঁপ দিয়ে পড়ল গণেশের ওপর। গণেশকে নিয়ে একবারে মাটির ওপরে আছাড়, আর একটা বিরাশি সিল্কা ওজনের ঘুষি চোয়ালে, শালা, সেই থেকে পেছুতে লেগে আছ, এখন প্যাসেঞ্জার ভাগাচ্ছ?

গণেশও সমানে খিস্তি চালাচ্ছে ওঠবার চেষ্টা করছে। একটা দল হাত দিয়ে সবাইকে আগলে রাখছে আর চেঁচাচ্ছে, চালাও হারকিলিস এসপার কি উসপার।

হাততালি আর কানফাটানো শিস বাজল। গণেশ কায়দা করে মনাকে কাত করে পেটে একটা ঘুষি কষাল। মনা গণেশের চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ঠুকে চেপে ধরল।

ত্যাবড়া মরা মুখের দিকে চেয়ে বলল, মনাকে অসুরের শক্তি দাও বাবা।

ঠিক এ সময়েই ফটকে আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ও ঝাঁপিয়ে পড়ল গিয়ে মনার ঘাড়ের ওপর। দেখেই পুনিয়া গিয়ে পড়ল ফটকের ওপর। জগারা গুমটির পেছন থেকে খেলা ছেড়ে এসে পড়ল। চারটে মানুষ দলা পাকিয়ে আছাড়িপিছাড়ি মারামারি করছে। হার জিত বোঝার উপায় নেই, আর ওদের ঘিরে এক দলের চিৎকার শিস হাসি।

জগা বলল, ত্যাবড়া, হুশিয়ার, তাল বুঝে সব এখানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

জানি, সে মতলবও কয়েকজনের আছে। এদিকে দঙ্গল এলেই গুটিয়ে ফেলব।

 তারপরেই রিকশার ওপরে ঝপাঝপ লাঠি পেটাবার শব্দ শোনা গেল। চিৎকার শোনা গেল, হঠাও শালা, ভাগো হিয়াসে।

সেপাই ছুটে এসে চারজনের ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। লাঠি চালাল অন্ধের মতে, বাছবিচার না করে। নিজেদের মারামারি একরকম, রাগে আর জেদে সেটা চালিয়ে যাওয়া যায়। বাইরের থেকে লাঠি পড়লেই মুশকিল। প্রথমে দু দিকে ছিটকে গেল পুনিয়া আর ফটুকে। তারপরে মুখোমুখি দাঁড়াল গণেশ আর মনা। দুজনেরই গাল কপাল ফোলা, ঠোঁটের কষে রক্ত। দুজনে দুটো মোষের মতো রক্ত চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে হাঁপাচ্ছে।

ত্যাবড়ার পাশে জগা বলল, গণেশটা খুব বাড়িয়ে তুলেছে।

ত্যাবড়া বলল, জ্বালায়। এখন কিছু বলিস না। দেখিস, সোতেটা না খেপে যায়। তুই পুনিয়ার গাড়িতে প্যাসেঞ্জার দুটোকে নিয়ে এই তালে কেটে পড়।

জগা তা-ই করল। পুনিয়ার গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে এসে দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন বাবু, আপনাদের আমি পৌঁছে দিচ্ছি। ও শালারা ছোটলোক।

ভদ্রলোক খুশি হয়ে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ চলো, সব ডাকাত আর গুণ্ডা।

 স্ত্রীকে নিয়ে ভদ্রলোক উঠে পড়লেন।

 সেপাই প্রথমেই গণেশকে ধাক্কা মারল, যা শালা ভাগ, এই তল্লাটে থাকবি না।

গণেশ বলল, আমি কি মিছে বলেছি, ওর গাড়িতে।

 সেপাই ওকে জোরে ধাক্কা মারল, চুপ, বাত নেই মাংতা, তুই যা এখান থেকে।

বলেই পাশে ফটুকেকে দেখে ওকেও ধাক্কা মারল। দুজনকেই ধাক্কাতে ধাক্কাতে দূরে নিয়ে গেল। ফিরে এসে মনাকেও ধাক্কা মারল, যা, সরে যা এখান থেকে।

মনা ঠোঁটের কষ থেকে রক্ত মুছতে মুছতে বলল, আপনি জানেন না, সেপাইদা!

আমি জানতে চাই না। বড়বাবু দেখতে পেলে সব কটাকে হাজতে পুরে দেবে।

পুনিয়া আগেই সরে গিয়েছে, মনা ওর রিকশার গদিতে উঠে বসল। সোতে এসে ওর মুখের দিকে দেখল। বলল, মুখটা জল দিয়ে ধুয়ে আয়। কপালটায় লাগল কী করে।

মনা কপালে হাত দিয়ে বলল, কী জানি, সেপাইটার লাঠি হবে বোধ হয়। একটু মাল টানতে হবে।

 সোতে বলল, হবে। আজ আর আমরা কেউ গাড়ি চালাব না। যা, মুখ ধুয়ে আয়।

মনা ইস্টিশনের দিকে চলে গেল। সোতে ত্যাবড়ার কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, কাল আমি গণশা শালাকে একবার দেখব।

ত্যাবড়া বলল, ওর প্যাসেঞ্জার জগাকে দিয়ে পুনিয়ার গাড়িতে তুলে দিয়েছি।

সোতে হেসে বলল, ফাসকিলাস। তবে গণেশ শালাই বেশি প্যাঁদানি খেয়েছে। ঠোঁট কপাল দু জায়গায় ফেটে রক্ত বেরিয়ে গেছে। মাথার সামনের দিকে সব চুল তুলে নিয়েছে।

শালা।

দুজনেই হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে মরা মুখের দিকে তাকাল। মুখ থেকে, কাপড়ে আর সারা শরীরে ছড়ানো পয়সাগুলোর দিকে। ত্যাবড়া বলল, সব এর জন্য। মড়া হলেই হয় না, এ শালা মড়া দেখেছিস। এখনও মনে হচ্ছে বেঁচে থেকে ঘুমোচ্ছে। আমার মনে হয়, লোকটা বোধ হয় সব জানত।

কী?

 ওকে দিয়ে আমাদের একদিন হবে।

কী করে বুঝলি?

 মুখের দিকে চেয়ে দ্যাখ না।

সোতে মরা মুখের দিকে আবার তাকাল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকার পরে ও হঠাৎ সরে গেল। বলল, দুর, ওসব কথা আমার ভাল লাগছে না। টাকা দে, একটা পাঁট নিয়ে আসি, মনা খাবে।

ত্যাবড়া ঘাড় নেড়ে বলল, এখন যে যার পকেট থেকে নিয়ে আয়, পরে শোধ হবে।

সোতে চলে যাচ্ছিল। ত্যাবড়া ডাকল, শোন, কমলা কেবিনের ব্যাচাদাকে বলবি আড়াই কেজি মাংস রান্না করে দিতে হবে, আর ভাত।

আগাম টাকা দিতে হবে না?

তুই আমার নাম করে বলবি। আর বলবি নাড়িভুড়ি যেন না দেয়।

আর মিষ্টি?

রাজভোগ কেনা হবে।

আর মাল?

 সে হবে এখন।

সোতে মুখ শক্ত করে বলল, অই শালা তোর দোষ, সব তাতে কত্তামো করবি।

ত্যাবড়া ওর লাল দাঁত বের করে হাসল, বলল, শালা, যত খুশি টেনো, টেনে পড়ে থেকে, চিতেয় তুলে দিয়ে আসব। আগে সব টাকাটার হিসাব হোক না।

সোতে আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। ত্যাবড়া মরা মুখের দিকে ফিরে তাকাল। পয়সা না গুনেও আধুলি, সিকি, কুড়ি, দশ, পাঁচ, তিন, দুই-এর ঘিঞ্জি, পায়ের ওপরে, গায়ে ছড়ানো চেহারা দেখেই ও অনুমান করতে পারে, আশির ওপরে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে হিসাবে তিনটে দশ আর একটা পাঁচ টাকার নোট, ওর নিজের পকেটেই আছে। এখন প্রায় সাতটা বাজে। আরও ঘণ্টা তিনেক কম করে সময় হাতে আছে। এখনও বাইরের প্যাসেঞ্জার বিস্তর। দুটো সিনেমা হলে দুটো শো ভাঙবে, আবার শুরু হবে। শনিবার মাসের প্রথম…আর এ যা মুখ, এমন নিপাট ভাল অঘোর ঘুমে নিরীহ মানুষের মতো, এ আর দেখতে হবে না। একশো ছাড়িয়ে কুড়ি পঁচিশে নির্ঘাৎ দাঁড়াবে। ত্যাবড়ার বিশ্বাস, লোকটা ওকে ডেকেছিল। না হলে পোলের ওপর দিয়ে যেতে যেতে নীচে পিছনের দিকে ঝোঁপের পাশে লাইনের ধারে হঠাৎ কারোর নজর টানে। অনেক দিন তো আধপেটা ছাড়া ভাল-মন্দ খাসনি, প্রাণভরে মাল টানিসনি। আমাকে দিয়ে খাস, জানিয়ে দিয়ে গেলাম। প্রথম দেখে এ কথাই ওর মনে হয়েছিল। গোটা শীতকাল ধরে প্রতিটা ছুটির দিনে গাড়িতে লরিতে কত ভদ্রলোকের ছেলেমেয়েরা ফিসটি করতে যায়। গান করতে করতে, টুইস্ট নাচতে নাচতে যায়, মাইকে গান বাজাতে বাজাতে যায়, রাস্তায় মেয়ে দেখলে শিস দেয়, ইশারা করে। এই শহরের ছেলেমেয়েরাই কতরকম করে। কী ফুর্তি!

ত্যাবড়া ভাবে, তা এও একরকমের ফিসটি। এও এক রকমের চাঁদা। সব জাতের মানুষদের তো আর একরকমের হয় না। খাওয়া ফুর্তি হলেই হল, ওটা সবাই বোঝে।

এই সময়ে পুনিয়া এল একদিক থেকে। আর এক দিক থেকে যমুনা। পুনিয়ার মুখটা একদিকে খামচানো। ত্যাবড়া ওর মুখের দিকে চেয়ে বলল, ওখানে কী হয়েছে?

পুনিয়ার মুখে এখনও খামচানোর আর রাগের জ্বালা। বলল, ফটুকে শালা, খামচে দিয়েছে। শুয়োরের বাচ্চাকে কাল আমি দেখাব।

যমুনা মরা মানুষের ধার ঘেঁষে ত্যাবড়ার প্রায় গায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ত্যাবড়া রুক্ষু মুখে ভুরু কুঁচকে তাকাল। যমুনা দেখছে মরা মুখ আর একটু একটু কোমর দুলিয়ে মিটিমিটি হাসছে। কোমর নাচানো মেয়েটার একটা অভ্যাস। মরা মুখের দিকে চোখ রেখেই বলল, আগেই বলেছিলাম তোমাদের মতলব ঠিক জানতে পারব। রতন আমাকে দুকুরেই বলেছে।

ত্যাবড়া মুখ খিঁচিয়ে বলল, বেশ করেছে। কোথা থেকে তেতে এলি?

 তেতে আবার আসব কোত্থেকে? আমি তো গুমটির পেছনে সারা দিন শুয়ে কাটালাম গো।

কেন, পেট বাঁধিয়েছিস নাকি?

যমুনা সারা গায়ে ঢেউ দিয়ে খিলখিল করে হাসল। অন্যান্য রিকশাচালকদের শিস্ আর গলার রকমারি আওয়াজ শোনা গেল। কে যেন ডাকল, এই যমুনা, ইদিকে আয়।

যমুনা সেদিকে তাকাল না। হাসতে হাসতে প্রায় ত্যাবড়ার গায়ে ঢলে পড়ার জোগাড় করল। মরা মানুষের আরও কাছে সরে গেল। ত্যাবড়া খেঁকিয়ে উঠল, আরে, আরে, তুই ও মড়া ছুঁসনি, কাট এখান থেকে।

যমুনা হাসি থামিয়ে ঘাড় কাত করে ত্যাবড়ার দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কেন, আমি এ-মড়া ছুঁলে মড়ার জাত যাবে?

তা যাবে না? কোত্থেকে কী করে এসেছিস, যা এখান থেকে।

এবার পুনিয়া হেসে উঠল। ও সরে এসে যমুনার কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে। যমুনাও হাসল। বলল, ত্যাওড়াদাদার যে কথা। মাইরি বলছি, কিছু করে আসিনি, পেটও বাঁধেনি। আমার শালা বাঁজা পেট, দেখলে না, ইস্টিশনের খুঁড়িটা, পেট বাঁধিয়ে মরে গেল অ্যাদ্দিনে। বেঁচেছি বাবা। রতনটা কোথা গেল?

ত্যাবড়া বলল, সেই খোঁজেই এসেছিস। সেজন্যই তো বলেছিলাম, কোথা থেকে তেতে এলি।

এই সময়ে যমুনা পুনিয়ার দিকে ফিরল। পুনিয়ার খামচানো মুখে হাসি। নজর যমুনার জামার বোতামছাড়া অনেকখানি খোলা বুকের দিকে। অন্যদিকে যমুনার দিকে কথা ছোঁড়াছুড়ি শিস চলছিল। যমুনা পুনিয়াকে বলল, কী রে মড়া, তুই কী দেখছিস?

পুনিয়া হেসে বলল, মড়া।

 যমুনা বলল, শালা, শকুন কমনেকার।

ও ত্যাবড়ার দিকে ফিরে বলল, একটা টাকা দিয়েছি

কথা শেষ করবার আগেই, ত্যাবড়া বলে উঠল, রতনের কাছ থেকে রাত্রেই নিয়ে নিস।

 যমুনা মাথা নেড়ে বলল, টাকা আমি নেব না, তোমাদের দলে থাকব।

ভাগ, মেয়েমানুষটানুস আমাদের দলে নিই না।

 আমি ঠিক থাকব।

বলেই যমুনা মরা মানুষের মাথার কাছে বসে পড়ল। বলল, ই কী গো, ধূপকাঠি নিবে গেছে কখন, দ্যাখ নি। দাও, শালাইটা দাও।

বলে, ধূপকাঠির বাকসোটা হাতে তুলে নিল। ত্যাবড়া হুমকে উঠল, অ্যাই, অ্যাই, মড়া ছুঁসনি বলছি।

যমুনা বলল, মড়া ছুঁচছিনা বাবা, শালাইটা দাও না, ধূপকাঠি জ্বেলে দিচ্ছি।

 ত্যাবড়া দেশলাইটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, শালা, আচ্ছা আপদ জুটেছে তো।

 যমুনা হাসতে হাসতে দেশলাই জ্বালিয়ে জোড়া কাঠি ধরাল। কাদা মাটির ড্যালায় পুঁতে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ত্যাবড়াকে দেশলাই ফিরিয়ে দিয়ে আশপাশে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, যে কথা বলতে এয়েছিলাম, শোনো। তোমরা যখন মড়া নিয়ে বেরোবে তখন রাস্তায় তোমাদের আটকাবে।

কারা?

গণশা ফটকেরা তো থাকবেই, শিবে লাটুরাও ওদের সঙ্গে থাকবে, ছিনতাই করবে টাকা।

ত্যাবড়ার মুখ শক্ত হয়ে উঠল। পুনিয়ার সঙ্গে ওর চোখাচোখি হল। পুনিয়ার চোখ ছোট হল, রাগ ফুটে উঠল। ত্যাবড়া মরা মুখের দিকে তাকাল, তারপরে হিপ পকেট থেকে টেনে বের করল একটা ছুরি। ছুরির ফলাটা খুলে বোতাম টিপে আটকে যেন মরা মানুষটাকে দেখাল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তোমার জন্য আজ জ্যান্ত খাব, কিন্তু তোমার দিন, আমাদের দিন পাক্কা, পাই পয়সা কাউকে ভাগ দেব না।

পুনিয়া বলল, শালাদের ঘাড়ে কটা মাথা আছে দেখব!

 যমুনা বলল, আমি বলেছি ওদের, তোরা যখন মড়ার পয়সায় খেয়েছিলি রতনদের ভাগ দিয়েছিলি। আমাকে গণশা শালা বললে, চোপড়া ভেঙে দেব। আমি বলেছি, তোর ইয়ে মুচড়ে দেব।

এই সময়ে মনা আর সোতে একসঙ্গে এল। সোতের প্যান্টের পকেট দেখেই বোঝা যায়, একটা পাঁট নিয়ে এসেছে। দুজনেই ওদের পাশ ঘেঁষে যাবার সময় সোতে যমুনার পাছায় একটা চাঁটি মারল। যমুনা প্রতিবাদে কোমরটা দুলিয়ে দিল। ওরা দুজনে রিকশা সারির পিছনে নর্দমার ধারে দেওয়াল ঘেঁষে চটের ওপর গিয়ে বসল।

যমুনা আবার ত্যাবড়াকে বলল, আমি কিন্তু দলে রইলাম।

 ত্যাবড়া ধমক দিল, ভাগ।

 যমুনা হাসতে হাসতে ইস্টিশনের দিকে চলে গেল। সোতে মনার দিকে একবার তাকিয়ে পুনিয়াকে বলল, শোন পুনিয়া, একবার গুয়ের ডিপোর কাছে যাস। একটু এগিয়ে গেলে দেখবি, রেললাইনের ঢোকবার গলির মধ্যে একটা বাঁশ পড়ে আছে। ওটা নিয়ে চলে আয়।

পুনিয়ার চোখেমুখে অনিচ্ছা। বলল, হ্যাঁ, শালা কার বাঁশ, দেখবে তারপরে তাড়া করবে।

আরে কেউ দেখবে না, তুই যা না।

আমার সঙ্গে কেউ চলুক।

সঙ্গে আবার যাবে কী, তুই দ্যাখ না যেয়ে।

পুনিয়া যাবার আগে বলল, তুমি শালা আমাকে দিয়ে বেশি খাটাচ্ছ।

 ত্যাবড়া হেসে বলল, দু টুকরো মাংস বেশি খাস।

পুনিয়া হাসল না, চলে গেল।

রাত যত বাড়তে লাগল, ইস্টিশনের সামনেটা একটা ফাঁকা হতে লাগল। তবে শনিবারের রাত। অন্যান্য দিনের তুলনায় এখনও ভিড় কম না। আইন আছে, রাত আটটার পরে দোকান বন্ধ। এ শহরে আইন নেই। দশটা বাজছে, দোকান সবই হাট করে খোলা, আলোয় ফটফট করছে। পকেট যাদের ভরবার তাদের ভরছে।

মাঘের শেষ, কিন্তু দিনের বেলার মতনই এখনও দক্ষিণা বাতাস ছাড়ছে। শীত তেমন নেই, বসন্তকালের মতো আবহাওয়া। পুনিয়া বাঁশটা ঠিক আনতে পেরেছে। সেটাকে দু টুকরো করে কেটে মোটামুটি একটা চালি বানানো হয়েছে। সোতে মনা আর জগাই করেছে। তবে ইতিমধ্যে পাঁচজনে দু পাঁট খেয়েছে। কিন্তু যে কারণে ওরা খায়, খেয়ে বলে, শরীরের জাম ছাড়াচ্ছি, এখন সে অবস্থা নয়। যমুনার সংবাদের পরে ভিতরে ভিতরে ওদের এখন লড়াইয়ের প্রস্তুতি। সকলেরই শক্ত মুখ, চোখে চোখে নজর হানা। গণশাদের দলটাকে কাছেপিঠে দেখা যাচ্ছে না। তবে মদ খাওয়ার পরে সবাই একবার মরা মানুষের গায়ে হাত বুলিয়েছে। ত্যাবড়া মরার ঠাণ্ডা কনকনে চিবুকে হাত দিয়ে চুমকুড়ি শব্দ করে বলেছে, আসিরবাদ কর, নিজের বাপকে যেন তোমার মতন এখানে এনে শোয়াতে পারি।

জগা বলেছে, নিজের বাপকে শোয়াবি?

শোয়াব না? ওটাই তো একমাত্তর হকের ধন। বাপ পুড়িয়ে আবার একদিন আশ পুরে খাব।

 সোতে বলেছে, আর সেইসব ছেরাদ্দটেরাদ্দ কী সব বলে, সেসব করবি না?

 ধূশালা, ছেরাদ্দ আবার কী। চিতেয় গঙ্গাজল ঢেলে দেব, ওতেই ছেরাদ্দ হয়ে যাবে।

 বাকি চারজন চুপ করে ছিল খানিকক্ষণ। তারপরে জগা বলেছে, আমার তো বাপই মরে গেছে।

মনা সোতেও তাই বলেছে, ওদের বাপও মরে গেছে। পুনিয়া বলেছে, আমাকে সেই বাচ্চা বয়সে ছেড়ে দিয়ে বাপটা যে কোথায় ভেগে গেল, কোনওদিন জানতে পারলাম না।

ত্যাবড়া বলেছে, কোথায় যেয়ে মরে গেছে, কারা হয়তো পুড়িয়ে আমাদের মতন খেয়েছে।

পুনিয়া সামনের মরা মানুষের মুখের দিকে ফিরে তাকিয়েছে। ওর আনমনা চোখে বাবার ঝাঁপসা মুখটা ভেসে উঠছিল। গালের খামচানো ক্ষতের জায়গাটা কেমন যেন কুঁচকে উঠছিল।

দু পাঁট মদ খাবার পরে এইসব কথা ওরা বলাবলি করেছে। তারপরে কারখানায় রাত্রি দশটার ভোঁ বেজে যাবার পরে ত্যাবড়া মরা মানুষের শরীর আর কাপড় থেকে সব পয়সা তুলে নিয়ে গুনল। যা ভেবেছিল তা-ই, প্রায় একশো পনের টাকা উঠেছে। সোতে আর মনাকে ডেকে বলল, ভাত আর মাংসের আগাম টাকা দিয়ে আয়। রাজভোগের হাঁড়িটা ওখানেই জমা করে দিস। মালের বোতলের কথা বলে রেখেছিস?

সোতে বলল, পাঁচ বোতল পুরো।

ত্যাবড়া বলল, খেয়ে যদি পড়ে থাকিস কোনও শালাকে টেনে তোলা হবে না।

 মনা বলল, তোকেও শালা তুলব না।

 ত্যাবড়া টাকা দিয়ে বলল, যা, মিটিয়ে আয়, এবার বেরুব। আমরা মড়াটা বেঁধে ফেলছি।

জগা বলল,সাড়ে দশটার মধ্যে। আরও দুটো গাড়ি দেখে নে।

 ত্যাবড়া বলল, জোগাড় যন্তর করতে করতে হয়ে যাবে।

 সোতে মনা চলে গেল। ত্যাবড়া মড়ার কাছে উপুড় হয়ে খাঁজে ভাঁজে অগলে বগলে হাটকে দেখল, পয়সা আরও পড়ে আছে কি না। তিনটে দশ পয়সা পাওয়া গেল আরও। এ সময়েই একটা হাসির রোল আর মার মার শব্দ শোনা গেল। কোথায় কী ঘটছে বোঝবার আগেই নর্দমায় বড় বড় ইট পড়তে লাগল। সেই সঙ্গে একটা জন্তুর গলা ফাটানো চিৎকার। তারপরেই নর্দমার থেকে শব্দ দিয়ে উঠল নোংরা মাখা একটা শুয়োর। মরা মানুষটার ওপর দিয়ে মাড়িয়ে চলে গেল। ত্যাবড়া ছিটকে সরে যাবার আগেই ওর গায়েও নর্দমার দুর্গন্ধ ময়লা লেগে গেল।

কয়েকজনের একটা দল খ্যাল খ্যাল করে হাসতে লাগল।

ত্যাবড়া চিৎকার করে উঠল, জগা, মড়াটা আগলে দাঁড়া তো। একটা কুত্তার বাচ্চা এদিকে এলে মাথা দু ফাঁক করে দিবি।

হাসিটা তাতে আরও জোর হল। জগা চেঁচিয়ে বলল, কুত্তার বাচ্চা দেখছিস কোথায়, সব তো শোরের বাচ্চা। শালাদের জমমের ঠিক থাকলে সামনে আসুক।

পুনিয়া ততক্ষণে ওর রিকশায় যাত্রী বসবার সিট তুলে ভিতর থেকে একটা সাইকেলের চেন বের করে নিয়েছে। চাবুকের মতো ধরে চিৎকার করল, সব বেজম্মার চামড়া খুলে নেব।

এ সময়ে যমুনা এসে দাঁড়াল। আবার হাততালি, হাসির রোল, শিস বেজে উঠল। সেই সঙ্গে খিস্তি। যমুনাও কোমর দুলিয়ে শরীর কাঁপিয়ে হাততালি দিয়ে উঠল। চেঁচিয়ে বলল, কীরে মড়ারা, হল কী তোদের, চালিতে উঠবি নাকি।

ফটকের গলা শোনা গেল, না, তোর ওপরে।

যমুনা বলল, মুরোদ জানা আছে রে। রিকশা চালিয়ে চালিয়ে তো শালা তোদের মাজা ভেঙে গেছে।

সেপাইটা আবার এগিয়ে এল। এতক্ষণ ছিল না। ডিউটি শেষ করে চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে এসেছে। এসেই হাঁক দিল, অ্যাই, গোলমাল কীসের, ঝামেলা হটাও।

বলতে বলতে সে মারমুখী হয়ে লাঠি উঁচিয়ে গণেশদের দিকে এগিয়ে গেল। ওরা সব এদিক ওদিক দৌড় দিল। ত্যাবড়া নিজের গায়ের ময়লা মোছার আগে, ন্যাকড়া দিয়ে মড়ার শরীর পরিষ্কার করতে লাগল। মরা মানুষটার মুখের ওপর ময়লার ধ্যাবড়া, শুয়োরের পায়ের আঁচড়ে গালের খানিকটা চামড়া খসে গিয়েছে।

সেপাইটা ওদের দিকে এগিয়ে এসে সিঁড়ির ধারে যমুনাকে দেখল। দেখলেই বোঝা যায়, নজরের ঠেক কোথায়। দাঁতচাপা স্বরে বলল, তুই এখন এখানে কেন, তোর জায়গায় যা।

যমুনা হেসে বলল, আমার আবার জায়গা কোথায় গো সেপাইদা?

সেপাই আবার লাঠি তুলে এগোল, তোমার জায়গা চেন না হারামজাদি।

যমুনা বাবা গো বলে ঢঙ করে হেসে দৌড় দিল। আর তখুনি ওর ডানা মুচড়ে ধরল রেলের সেই সেপাই, গায়ের উপরে পড়স ক্যান ডেকরি, গতরে পোকা পড়ছে নাকি?

যমুনা ব্যথার শব্দ করল, উঃ উঃ লাগে।

রিকশাচালক, ভিখিরি আর একশ্রেণীর যাত্রীরা হেসে উঠল। ত্যাবড়ার সামনে শহর থানার সেপাই নিচু হয়ে বলল, অনেক রাত হল রে ত্যাবড়া, এবার বাড়ি যাব।

ত্যাবড়া তখন মড়ার গালের উঠে যাওয়া চামড়াটা লেপটে দেবার চেষ্টায় ছিল। পকেট থেকে তিনটে টাকা বের করে, সেপাইয়ের হাতে গুঁজে দিল। সেপাই খেঁকিয়ে বলল, ভাগ হারামজাদা, আর দুটো টাকা দে। দেড়শো টাকা তো তুলেছিস।

মাইরি না সেপাইদা, একশোও পুরো হয়নি।

ভাগ, পাঁচটা টাকা ছাড়।

 ত্যাবড়া মনে মনে বলল, শুয়োরের বাচ্চা।

আরও দুটো টাকা দিয়ে দিল। জগা বলল, আর এক শালা তাকিয়ে আছে রে।

ত্যাবড়া বলল, হ্যাঁ, জলের কুমিরটা গেল, এখন ডাঙার বাঘ। রেল সেপাই দেখতে পেয়েছে কত দিলাম?

শালা যমুনার গায়ে খুমচে ধরে খপিসের মতো এদিকে নজর রেখেছিল। ওকে যা দিয়েছিস, ওকেও তাই দিতে হবে। বুড়ো মানুষটার দেনা মিটছে।

ত্যাবড়া মাথা ঝাঁকিয়ে পকেটে হাত দিল। বলল, আমাদের দেনা বল। মানুষটাকে দিয়ে নিজেদের দেনা মেটাচ্ছি।

ভুরু আর ঠোঁট ফোলা মনা বলল, হ্যাঁ, রিকশাওয়ালা হলেই পুলিশের কাছে চোদ্দ পুরুষের দেনা থাকে। আর ইস্টিশনের ধারে হলে রেল পুলিশের কাছেও। মিটিয়ে দে শালা।

ত্যাবড়া রতনের হাতে পাঁচটা টাকা দিয়ে দিল। রতন ইস্টিশনের রোয়াকে উঠে রেল সেপাইয়ের হাতে গুঁজে দিল। সেপাই প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে তৃপ্ত হেসে বলল, এইবার মরা লইয়া যা গিয়া, গন্ধ ছাড়ব।

সোতে ফিসফিসিয়ে বলল, এখন যা, পাঁচ টাকা নিয়ে বুড়ি মাগের কাছে যা শালা।

যমুনা ছাড়া পেয়ে একদিকে পালিয়েছে। বাতাসটা কমের দিকে না, রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। যেন। কয়েকটা কুকুর দৌড়োদৌড়ি কামড়াকামড়ি খেলা জুড়ে দিয়েছে, আর এখন ফ্যাঁস ফ্যাঁস শব্দ করছে, যেন চুপিচুপি কিছু কথা বলছে। পুনিয়া ইট নিয়ে তৈরি, মড়ার ঘাড়ের ওপর এসে পড়তে পারে। বলল, শালারা হঠাৎ খেলা জুড়ে দিল কেন বল তো?

সোতে বলল,কুত্তার মর্জি, কে বুঝবে।

যে দুটো গাড়ির অপেক্ষা ছিল, তাও এসে গেল। মড়ার চাদরে আরও কিছু পয়সা পড়ল। দোকানপাটও কয়েকটা বন্ধ হতে আরম্ভ করল। দু-একটা আপ ডাউন গাড়ি আছে। তার অনেক দেরি। ত্যাবড়া বলল, নে, এবার চালিটা আন, বেঁধে ফেলা যাক।

সোতে মনা পিছনের দেওয়ালের কাছ থেকে চালিটা নিয়ে এল। সবাই মিলে মরা মানুষটাকে চালিতে তুলল। মুখটা বের করে রেখে, জড়িয়ে বাঁধবার সময় গণেশরা চিৎকার করে হরিবোল দিল, তারপরে লাটুর গলা শোনা গেল, পাঁচ ব্যাটার বাপ মরেছে।

ওরা কেউ সে সবে কান দিল না। ত্যাবড়া বলল, পুনিয়া, তোর গাড়িটা নিয়ে চল। সিটের নীচে, মালের বোতলগুলোন নে। আড়াই শো চানাচুর নিয়ে, খালি মুখে চলবে না।

সোতে বলল, তোকে বলতে হবে না, নেওয়া হয়েছে।

পুনিয়া বলল, গাড়ি চালাবে কে?

 তুই।

না, আমি মড়া বইব।

আচ্ছা চল, গাড়ি আমি চালিয়ে যাব।

গলা শুনে সবাই ফিরে তাকাল। যমুনা কোমর দুলিয়ে হাসছে। ত্যাবড়া জগার মুখের দিকে তাকাল। শক্ত মুখে খেঁকিয়ে উঠল, না, মেয়েমানুষ-টানুষ যাবে না।

জগা সোতে আর মনার দিকে তাকাল। সোতে বলে উঠল, যেতে চায়, চলুক না।

মনা বলল, চলুক। একটা টাকা দিয়েছিস তো?

ও যমুনার দিকে তাকাল। ত্যাবড়া খিঁচিয়ে উঠল, অ শালা, তোমরা মাল খেয়ে মেয়ে নিয়ে ব্যালা করতে যাচ্ছ? আমি ওসবের মধ্যে নেই।

জগা বলল, আরে, র‍্যালা করার কী আছে! আমরা থাকব আমাদের মনে, ও থাকবে ওর মনে।

ত্যাবড়া মুখ বিকৃত করে বলল, যা খুশি করগে শালা। একটা ভাল মানুষের মড়া, আর সঙ্গে দিন ভর কী না কী করছে ছুঁড়ি।

যমুনা ঘাড় দুলিয়ে বলল, মাইরি আজ সারাদিন কিছু

 চোপ, আমার সামনে থেকে যা।

যমুনা যেন ভয় পেয়েই একটু সরে গেল। আর পুনিয়া যমুনার দিকে চেয়ে, হেসে বলে উঠল, তা হলে আমিই গাড়ি চালাব।

কথাটা শেষ হবার আগেই ত্যাবড়া ওর কোমরে একটা লাথি কষিয়ে দিল, শালা।

পুনিয়া হেসে, লাফ দিয়ে সরে গেল। নান্টা এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। নান্টাকে দেখেই, ওরা পাঁচজনে নান্টার দিকে ফিরে তাকাল। নান্টা একবার চালির দিকে দেখল, আর একবার ওদের দিকে।

সোতে জিজ্ঞেস করল, কী হল রে নান্টা, তুই আবার কেন এখানে?

 নান্টা বলল, তখন থেকে দেখছি, কেউ কিছু বলছিস না। এখন কেটে পড়বার তালে আছিস। একি সেপাইয়ের পাওয়ানা? যেচে দিতে পারিস না?

ওরা পাঁচজনে চোখাচোখি করল। মনা বলল, ইউনিয়নের চাঁদা চাইছিস?

নান্টা বলল, তবে কি মাল খাব বলে?

নান্টা ইউনিয়নের লিডার। ত্যাবড়া বলল, এর আগে তো মড়ার টাকা থেকে চাঁদা নেওয়া হয়নি।

 নান্টা বলল, সে হয় নি, হয়নি। ফোকটে পেয়েছ, ইউনিয়নকেও দিতে হবে।

ত্যাবড়া বলল, ফোকটে বলিস না। চাঁদা দিতে বলছিস দিচ্ছি। কিন্তু কার নামে বিল লিখবি? পাঁচজনের নামে?

নান্টা ভুরু কুঁচকে বলল, তোদের নামে লিখব কেন? মড়ার চাঁদা বলে লিখব।

ত্যাবড়া বলল, সেই ভাল।

ও পাঁচটা টাকা এগিয়ে দিল। নান্টা খেঁকিয়ে উঠল, ভাগ শালা, সেপাইদের পাঁচ টাকা করে ঘুষ দিতে পারো, ইউনিয়নকে দশটা টাকা দিতে পারো না? নিজেরা তো শালা ভেঁড়েমুষে মাল আর মাংস মারবে।

মনা হাত তুলে বলল, একটা তো দিন, ওসব খোঁটা দিস না নান্টা। ত্যাবড়া কথা বাড়াসনি, মিটিয়ে দে।

ত্যাবড়া দশটা টাকা নান্টার হাতে তুলে দিল। আর তখনই দক্ষিণ দিকে, একটু দূরে রাস্তার ওপরে দুম করে একটা শব্দ হল। আগুন ঝলকে উঠল। তারপরেই একসঙ্গে কতগুলো গলার চিৎকার। নান্টা ছুটে গেল। ওরা পাঁচজন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। জগা বলে উঠল, বেজাদের ছিনতাই পার্টির মধ্যে লাগল বোধহয়।

ওর কথা শেষ হবার আগেই, আবার দুটো পর পর বোমা ফাটল। একদল ভয় পাওয়া লোক ইস্টিশনের দিকে ছুটে এল! দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হতে লাগল। দক্ষিণদিকের রাস্তাটা হঠাৎ একেবারে অন্ধকারে ডুবে গেল। রাস্তার আলোগুলো নিবে গেল। জগা বলে উঠল, যা বলেছিলাম, তা-ই।

একটু দূরেই অন্ধকারের মধ্যে, কিছু লোকের ছোটাছুটি মারামারি দাঙ্গা হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে। ব্যাপারটা এদিকে এগিয়ে আসবে কি না, বোঝা যাচ্ছে না। দোকানঘরগুলো দু মিনিটের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল। ফলে, ইস্টিশনের সামনেটাও অন্ধকার হয়ে এল। ইস্টিশনের রোয়াকের ওপর লোকের ভিড় বাড়তে লাগল। বাজার রাস্তা আর সমস্ত পটি থেকে লোকজন এখানেই জড়ো হল। এখন ইস্টিশনই তাদের কাছে একমাত্র নিরাপদ জায়গা।

ত্যাবড়া ভয়ে আর উত্তেজনায় বলে উঠল, আমাদের এখুনি কেটে পড়া দরকার।

সোতে বলল, কিন্তু যাবি কোন রাস্তা দিয়ে। আমাদের যাবার রাস্তার ওপর তো লেগেছে। টাকা আর মড়া সব ছিনতাই হয়ে যাবে।

পুনিয়া বলে উঠল, চল মড়া নিয়ে রেল লাইন দিয়ে কেটে পড়ি।

জগা ভেংচি কেটে বলল, হ্যাঁ, আর পোটেকশন পুলিশে সব কেড়ে নিক।

ওর কথা শেষ হবার আগেই, আবার কয়েকটা বোম ফাটল। একটা বোম ইস্টিশনের কাছাকাছি? তৎক্ষণাৎ একদল খালি রিকশা নিয়ে উলটো দিকে ছুটল।

ইস্টিশনের রোয়াকের ভিড় ওভারব্রিজের দিকে ছুটল। ত্যাবড়া চিৎকার করে বলল, ওরা মারামারি করতে করতে এগিয়ে আসছে, শিগগির চালি ঘাড়ে কর।

মনা বলে উঠল, ওস্তাদ এক কাজ করো। চলো, মড়া নিয়ে বাজারের পেছু দিয়ে গঙ্গার ধারে চলে যাই। গঙ্গার ধার দিয়ে শ্মশানে যাব।

জগা বলল, কিন্তু বড় নর্দমার খালটা পেরোবি কী করে? গঙ্গায় জোয়ার থাকলে বুক সমান জল হবে।

ত্যাবড়া বলে উঠল, সে তখন দেখা যাবে। তোল তাড়াতাড়ি।

এ সময়েই দক্ষিণের অন্ধকার থেকে একটা প্রচণ্ড চিৎকার শোনা গেল। তারপরেই একজনের গলা শোনা গেল, ওরা হেবোকে পেট ফাঁসিয়ে দিয়েছে।

তারপরেই অনেকগুলো গলার চিৎকার। পরপর কয়েকটা বোম ফাটাতে ফাটাতে ইস্টিশনের দিকে একটা দল আর একটা দলকে হটিয়ে নিয়ে এল। ইস্টিশনের সামনে রাস্তা রোয়াক সব ফাঁকা।

ত্যাবড়া চিৎকার করে বলল, শালারা, তোল না মড়াটা।

সোতে মনা জগা ত্যাবড়া মড়া তুলে ঘাড়ে ফেলে উলটোদিকে দৌড় দিল। যমুনা পুনিয়ার রিকশায় লাফ দিয়ে উঠল। পুনিয়া রিকশা চালিয়ে দিল। এ সময়ে একটা পুলিশের জিপ আর ভ্যান আলো জ্বালিয়ে, উত্তর দিক থেকে ছুটে এল। পুনিয়া বলল, যাক, এসে গেছে।

.

০৩.

মড়া নিয়ে, প্রায় দশ মিনিটের মধ্যেই, ওরা গঙ্গার ধারে এসে পড়ল। পেছনে পেছনে, যমুনাকে নিয়ে পুনিয়া, রিকশা চালিয়ে। কিন্তু গঙ্গার ধারে এসেও ওরা থমকে দাঁড়াল। রাস্তায় আলো নেই, অন্ধকার। এমন থাকবার কথা নয়। গঙ্গার বুকে, স্রোতের বাঁকা ঘূর্ণিতে কয়েকটা লম্বা ঝিলিক মাত্র। ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায়, হঠাৎ যেন এক-আধটা জোনাকির জ্বলে ওঠা। আর সবই অন্ধকার, উঁচু রাস্তা, নীচের পাড়, নদী। দক্ষিণের দূর বাঁক পর্যন্ত অন্ধকার। ওপারের আলো কিছু দেখা যায়। সব যেন কেমন থমথম করছে।

ত্যাবড়া নিচু স্বরে বলল, রাস্তায় একটাও বাতি নেই কেন?

মনা বলল, কেমন যেন লাগছে। কিছু হয়েছে নাকি?

খানিকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। ইস্টিশনের ওদিক থেকে আর একবার একটা বোমা ফাটার শব্দ শোনা গেল। দু-একটা গাড়ির গর্জন একটা ট্রেন আসার শব্দ। তা ছাড়া শহরটা নিঝুম, যেন নিশ্বাস বন্ধ, চুপ করে এক কোণে লুকিয়ে আছে।

সোতে বলল, আমরা তো মড়া নিয়ে বেরিয়েছি। চল না, হরিবোল দিতে দিতে চলে যাই।

ত্যাবড়া বলল, হ্যাঁ, তারপরে যখন চিনতে পারবে মড়াসুদ্ধ সব ছিনিয়ে নেবে।

জগা বলে উঠল, তালে এক কাজ কর।

কী?

 ঝামেলায় যেয়ে দরকার কী, চল গঙ্গায় ভাসিয়ে দিই।

ত্যাবড়া নিচু স্বরে গর্জে উঠল, শালা বেইমান! তারপরে তুমি মদ মাংস খেয়ে, ঘুড়িটাকে নিয়ে কোথাও পড়ে থাকবে।

মনাও অনেকটা গর্জনের স্বরে বলল, শালা। খালি আমাদের ফিসটি গেলাবার জন্য লোকটা মরেছে, না?

সোতে বলল, হ্যাঁ, না পোড়ৗলে মাইরি শাপ লাগবে।

জগা বলল, যা বাবা, আমি ভালর জন্য বললাম, আর–।

যমুনা রিকশা থেকে বলে উঠল, সব ভাল ভাল না জগা। তোমার মনে অধমমো আছে। লোকটা চিতেয় পড়বে বলেই না ত্যাওড়াদাদার নজর টেনেছিল।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনও কথা বলল না। মনে হল মরা মানুষটার মুখটা ওদের সকলের চোখের সামনে জেগে উঠল। পুনিয়া পিছন ফিরে যমুনাকে একবার দেখতে চেষ্টা করল। সোতের গলা শোনা গেল, হ্যাঁ, পুড়িয়ে যাব, ভাসিয়ে যাব না। পুনিয়া, একটা কাজ কর তো। একটা বোতল বের কর, এক ঢোক করে মাল টেনে নিই।

মনার গলা, মাইরি।

পুনিয়া রিকশা থেকে নামল। যমুনার গায়ে হাত দিয়ে বলল, নাম।

যমুনা ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল, তুই যা, আমি দিচ্ছি।

যমুনা নিজেই, সিটের তলা থেকে একটা দেশি মদের বোতল বের করল। গালার সিল ভেঙে ছিপি খুলে, আগে ত্যাবড়ার হাতে দিল। ত্যাবড়া প্রথমটা একটু থমকে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে মরা মুখটা একবার দেখবার চেষ্টা করল। তাপরে বোতল উপুড় করে গলায় ঢালল। দমবন্ধ গলায় বলল, তাড়াতাড়ি কর, বেরিয়ে যাই।

যমুনা তারপরে সোতেকে বোতল দিল। যমুনার গলা শোনা গেল, আঃ, ছাড়।

গলায় মদ ঢালার শব্দ হল। মনা বলল, সোতেটা শালা মড়া কাঁধেও খচড়ামি করছে।

 সোতে মদ গিলে নিয়ে বলল, একটা কথা হঠাৎ মনে হল মাইরি। আমরা পাঁচ জন পাণ্ডব, আর যমুনা দুরুপদী।

পুনিয়ার হাসি শোনা গেল! যমুনা বলল, ঠাকুর দেবতা নিয়ে ইয়ার্কি ভাল না।

ত্যাবড়া হঠাৎ অনেকটা চিন্তিত সুরে বলল, হ্যাঁ, এবার বুঝেছি, গঙ্গার ধারটা কেন অন্ধকার করে রেখেছে। শালারা লড়াইয়ের ময়দান সাজিয়ে রেখে গেছে, বুঝলি? বড় রাস্তায় ফয়শালা না হলে, এখানে আসবে।

সোতে বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি চল।

জগা বলল, দাঁড়া বাবা, ঢোঁকটা মেরে নিই।

 বাহকদের পরে, যমুনা পুনিয়াকে বলল, হাঁ কর, তোর গলায় ঢেলে দিচ্ছি।

পুনিয়া বলল, তুই খাবি না?

না।

কেন, খাস না নাকি?

তা বলে, তোদের মতন। মড়া নিয়ে যেতে যেতে খাব? নে নে, হাঁ কর।

পুনিয়া হাঁ করল। যমুনা মদ ঢেলে দিল। আর পুনিয়ার হাতটা উঠে এল যমুনার কাঁধে। যমুনা বলল, নে হয়েছে, চালা।

ওরা চারজন আগে আগে মড়া নিয়ে, নিঃশব্দে চলেছে। হরিধ্বনি উচ্চারণ করতে পারছে না। পেছনে পেছনে, রিকশার ঝনঝন্ শব্দটা সকলেরই খারাপ লাগছে, ভয় পাচ্ছে। গাঢ় অন্ধকার, একটা লোক নেই। গাছের ঘন ঝোঁপ থেকে ভয় পাওয়া পাখি, হঠাৎ এক-আধবার ডেকে উঠছে। থমথমে অন্ধকারের মধ্যে, প্রতি মুহূর্তেই যেন একটা কিছু ঘটবার আশঙ্কা। একটা বোম ঝটিতি এসে ফাটা, বা একটা দল এসে ঝাঁপিয়ে পড়া।

হলও তাই। দূর থেকে, ওদের ওপরে একটা চড়া আলো এসে পড়ল। আলোটা ছুটে ওদের দিকে আসতে লাগল।

ত্যাবড়া উত্তেজিত হয়ে, হিপ পকেট থেকে ছোরাটা বের করে খুলে ফেলল, যা থাকে বরাতে, লড়ে যাব।

মনাও ছোরা বের করে বলল, আমারও আছে।

পুনিয়া বলল, যমুনা, শিগগির সিটের নীচে থেকে সাইকেলের চেনটা দে।

আলোর পিছনে কী আছে, কে আছে, প্রথমে বোঝা গেল না। আরও খানিকটা কাছে আসতেই বোঝা গেল, প্রাণপণে কেউ সাইকেল চালিয়ে আসছে। সামনে ডায়নামোর আলো। কাছাকাছি আসতেও যখন সাইকেলের গতি কমল না, তখন ওরা একটু নিশ্চিন্ত হল। কাছাকাছি হতে, ওরা দেখল, সামনের রডের ওপর আর একজন ঝুঁকে বসে আছে। তার মাথা মুখ বেয়ে রক্ত পড়ছে। ওদের গা ঘেঁষে, সাইকেলটা সাঁ করে বেরিয়ে গেল।

ত্যাবড়া বলে উঠল, যা বলেছিলাম, এবার সব এদিকে আসবে। দৌড়ো।

ওরা মড়া কাঁধে দৌড়তে লাগল। সোতে বলল, কোনও রকমে একবার খাল নদ্দমার ধারে পৌঁছুতে পারলে হয়, তারপরে সব ঠাণ্ডা।

পৌঁছল তা-ই, ধুক ধুক প্রাণে, কিন্তু নিরাপদেই। কেবল অন্ধকারটা আরও ঘন হয়ে উঠল। খাল নর্দমা মানে, শহরের একমাত্র আউট-লেট! গঙ্গায় এসে মিশেছে। আসশ্যাওড়া আর কালকাসুন্দের জঙ্গল পায়ের নীচে। খালের দিকে ঢালু জমি নেমে গিয়েছে।

পুনিয়া বলল, রিকশা পার করব কী করে?

ত্যাবড়া বলল, রিকশা পার করা যাবে না। মালপত্তর সব বের করে ঝোলায় নে, গাড়ি জঙ্গলের মধ্যে ঢুকিয়ে দে, কেউ দেখতে পাবে না।

পুনিয়া বলল, হ্যাঁ, কেউ দেখতে পাবে না। যদি কেউ দেখতে পায়, আর মেরে নিয়ে যায়, গাড়ির মালিক শালা আমাকে ফাটকে পাঠিয়ে দেবে।

মনা বলল, তুই আমার ওপর ছেড়ে দে। এমন জায়গায় ঢোকাব, কাকপক্ষীও দেখতে পাবে না।

মড়াটা ওরা আর একবার নামাল। যমুনা সিটের তলা থেকে মদের বোতলগুলো, চানাচুরের ঠোঙা নামিয়ে নিল। মনা ঢালু জমির ঘন জঙ্গলের একদিকে তিন চাকার গাড়িটা নামিয়ে নিয়ে গেল। মড়মড় করে কয়েকটা আসশ্যাওড়া গাছ ভেঙে গাড়িটাকে ঢেকে দিল। ত্যাবড়া নর্দমার ধার থেকে উঠে এসে বলল, জোয়ারটা নেমে গেছে, কিন্তু হাঁটু ভোবা পাঁক জমেছে। সাবধানে যেতে হবে। চল বেরিয়ে যাই।

চারজনেই আবার মড়া কাঁধে তুলে নিল। পুনিয়া বোতলের ঝোলা কাঁধে নিল। যমুনা ওর পাশে পাশে। নর্দমার ময়লার ওপরে, পলিমাটির আস্তরণের ওপর দিয়ে সবাই সাবধানে পা টিপে টিপে নামতে লাগল। ময়লায় পা পড়তেই, এমন দুর্গন্ধ বেরোল নাড়িভুড়ি উঠে আসবার জোগাড়। যমুনাই প্রথম শব্দ করে নাকে আঁচল চাপা দিল। নর্দমার মাঝামাঝি আসতে, হাঁটুর বেশি ডুবে গেল।

ত্যাবড়ার গলা শোনা গেল, হুঁশিয়ার।

 যমুনা পুনিয়ার ঘাড়ে হাত রাখল। পুনিয়ার এখন মজা নেই। পাঁকের মধ্যে ডুবে যাবার ভয় করছে। তথাপি যমুনার ছোঁয়া পেয়ে, একটু যেন ভরসাও পেল। কিন্তু ওর গায়ে হাত দেবার সাহস পেল না। একটা ঝুঁকে পড়া গাছের ডালের সঙ্গে, মড়ার ধাক্কা লাগল। ওরা খুব আস্তে আস্তে পার হল। নর্দমার পাঁক ওদের উরত ছাড়িয়ে উঠতে লাগল। যমুনার গলা শোনা গেল, আমার কোমর ধরেছে।

সোতে শব্দ করল, সসস, উম্।

সকলেই প্রায় কোমর অবধি ময়লা আর দুর্গন্ধ মাখামাখি করে পার হয়ে এল। ওপরে উঠে বাঁ দিকে ফিরে খানিকটা যাবার পরে গঙ্গার ধারের রাস্তা পেল। আলোও পাওয়া গেল। নিজেদের দিকে সবাই তাকিয়ে দেখল। কোমর অবধি রং বদলে গিয়েছে।

জগা এতক্ষণে কথা বলল, একেবারে পুড়িয়ে চান করব।

এক দিকে গঙ্গা, আর এক দিকে চটকলের লম্বা পাঁচিল। তারপরে একটা গরিবদের পাড়া। সেই পাড়াটা পেরিয়ে গেলেই শ্মশান। মনা বলল, হরিবোল দেব?

ত্যাবড়া বলল, থাক শালা, যা দিন আজ, বলা যায় না। চুপচাপ চলে যাই।

 সোতে বলল, লোকটা বোধহয় চুপচাপ থাকতে ভালবাসত।

অর্থাৎ মরা মানুষটি। পুনিয়া বলল, আস্তে আস্তে একটা গান গাইব?

কেউ জবাব দিল না। পুনিয়া সকলের সম্মতি আছে ভেবে নিচু গলায় গান ধরল, আমরা রিকশা চালাই, আমরা রিকশা…।

সোতে বলল, ভাগ শালা, আর গান খুঁজে পেলে না। শুনলে শালা আমার চিত্তির জ্বলে যায়।

 মনা বলল, আমারও মাইরি। গাড়ি চালাই আমরা, আর শালা ওরা গান করে, তাল মারে।

সোতে বলল, শালা মাক্ষীচুষ জাত। সবখানে চুষে খায়।

পুনিয়ার আর গান গাওয়া হল না। ও মুখ ফিরিয়ে যমুনার দিকে তাকাল। যমুনা এসব কথা শুনছিল না। ও গঙ্গার দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। বাতাসে ওর চুল উড়ছে। পা থেকে কোমর পর্যন্ত মাটি দিয়ে গড়া প্রতিমার মতো দেখাচ্ছে। কালো ময়লা আর পলিমাটির জন্য ওদের সবাইকেই এরকম দেখাচ্ছে। যমুনা মেয়ে বলে অন্য রকম।

ত্যাবড়া হঠাৎ মোটা গলায়, নিচু সুরে গেয়ে উঠল, মরিব মরিব সখি, নিশ্চয় মরিব…।

সোতে হেসে উঠল, তারপরে সবাই হেসে উঠল। সোতে বলল, শালা আর গান খুঁজে পেল না। মড়া বইছে কিনা!

যমুনা বলল, তোমার আবার সখি কে গো ত্যাওড়া দাদা।

 ত্যাবড়া ধমক দিয়ে বলল, তুই চুপ কর।

বোঝা গেল, ত্যাবড়ার মনটা এখন বেশ খুশি আর নিশ্চিন্ত, এবং সকলেরই।

গরিবপাড়ার পরে, ছোট একটা মাঠ। তারপরে শ্মশান। শ্মশানে ঢোকার আগে, ওরা এবার গলা ফাটিয়ে হরিধ্বনি দিল। যমুনার গলাটা ওদের সঙ্গে মিশে হরিবোল ধ্বনিটা কেমন একটা নতুন সুরে বাজল।

শ্মশানটা ফাঁকা, একটাও চিতা জ্বলছে না। মনা বলল, সত্যি, লোকটা ঝামেলা পছন্দ করত না। আজ মড়ার ভিড় নেই।

কাঠের চালাটার পাশে টিমটিমে বিজলি আলোর নীচে চণ্ডী এসে খালি গায়ে দাঁড়াল। পাশেই তার নিজের থাকবার ঘর। সেখানে তার বউ ছেলেমেয়েরা আছে। চণ্ডী শ্মশানের ডোম। সে এসে দাঁড়াতে, গঙ্গার ধারের ছাইগাদা থেকে তিনটে কুকুরও তার পাশে এসে দাঁড়াল। কান খাড়া, ল্যাজ ঝোলা, লাল ঢুলুঢুলু চোখ কুকুরগুলো যেন বিশেষভাবে লক্ষ করে কাঁধের মড়াটা দেখল। ওরা চারজন শ্মশানের কাঁচা উঠোনে মড়া নামাল।

উঠোনের একপাশে কয়েকটা দরজাবিহীন চালা ঘর। একটাতে টিমটিম করে কুপি জ্বলছে। গায়ে গেরুয়া জামা পরে, চুল দাঁড়িওয়ালা এক বুড়ো গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছে। আর একটা ঘরে অস্পষ্টভাবে দেখা যায়, দু-তিনজন ঢাকাটুকি দিয়ে শুয়ে আছে।

চণ্ডী এসে মড়ার সামনে দাঁড়াল, দেখল, তারপরে সকলের দিকে ফিরে তাকাল। রোগা লম্বা কালো চণ্ডী কলসিতে জল ভরার মতো বগ বগ করে হাসে। বলল, কার মড়া? নিজেদের কারোর? নাকি জুটল?

ত্যাবড়া বলল, জুটল।

চণ্ডী বলল, বাহু, তোমাদের কপালটা বেশ ভাল। তা কেমন পেলে?

 মন্দ না, মাখো মাখো করে ভালই।

 মাখো মাখো? গড়িয়ে পড়বে না?

চণ্ডী বগ বগ করে হাসল। যমুনার দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, আর ইটি?

 সোতে বলল, জুটে গেল।

 চণ্ডী আবার হাসল। ত্যাবড়া বলল, নাও দাদা, সাজিয়ে ফেল, জিনিস তৈরি। বলে পকেট থেকে টাকা বের করে গুনে দিল। চণ্ডী বলল, চার মাস আগের হিসাবে দিলে। আরও দেড় টাকা দাও, লকড়ির দাম বেড়েছে।

ত্যাবড়া মুখটা বিকৃত করল। মনা বলল, কমছেটা কী, তা তো বুঝি না।

চণ্ডী বলল, মড়া। মাইরি, বড্ড কমে গেছে।

ত্যাবড়া আরও দেড় টাকা দিল। চণ্ডী এবার পুনিয়ার হাতের ঝোলার দিকে তাকাল। বলল, চিতের কাছে নিয়ে যেয়ে মড়ার ধরাচূড়া খোলো। আমি সাজিয়ে ফেলছি।

চারটি চিতা, পাঁচিল ঘেরা। চিতার ঘেরাও থেকে জমি ঢালুতে নেমে গঙ্গায় গিয়েছে। ওরা একটা চিতার সামনে মড়াটা নামাল। ত্যাবড়া বলল, এখন ধরাচূড়া খোলার দরকার নেই। আগে কাঠ ফেলুক।

জগা বলল, তা হলে গলাটা একটু ভিজিয়ে নিই। ট্যাড লাগছে।

সোতে মনাও সায় দিল। জগা বলল, যমুনা, তুই মড়ার কাছে থাক, আমরা ঢালুতে নেমে যাচ্ছি।

 যমুনা বলে উঠল, না না, আমি একলা মড়া আগলাতে পারব না।

জগা হঠাৎ ধমকে উঠল, পারবি। আমরা তো পাঁচ হাত দূরেই থাকছি। ন্যাকামো হচ্ছে।

যমুনার ভুরু কুঁচকে উঠল। হঠাৎ ওর শরীরটা বেঁকে যেন ধারালো হয়ে উঠল। বলল, বড় যে মেজাজ দেখাচ্ছ?

জগা হাত তুলে, খেঁকিয়ে উঠল, এক থাপ্পড় মারব বেশি কথা বললে, খালি কচর কচর।

জগার ব্যবহারে সবাই অবাক হল। যমুনাও। কিন্তু যমুনার চোখ ধ্বক ধ্বক করে উঠল। কিছু বলবার আগেই ত্যাবড়া বলে উঠল, শালা মাগ-ভাতারি ঝগড়া।

জগা তেমনি গর্জে বলল, মুখ সামলে কথা বলবি ত্যাবড়া।

ত্যাবড়াও একইভাবে বলল, এক ঝাপ্পড়ে দাঁত তুলে নেব।

 দুজনেই মারমুখী হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। বাকিরা ওদের ঘিরে। মনা বলল, আ রে, আপসে লড়ছে দেখ। কী হল রে জগা?

জগা চেঁচিয়ে বলল, ত্যাবড়া কেন সব সময়ে লিডারি মারবে? তখন দেখতাম, গঙ্গার ধারে বোমবাজি হলে, মড়া গঙ্গায় না ফেলে কী উপায় ছিল? তা শালা আমাকে শোনালে, আমি মদ খেয়ে মাগিবাজি করতে যাব। আর এই মাগি।

যমুনার দিকে তাকাল ও, বলে কি না, আমার মনে অধমো। শালী, আমার ধমমের বকনা গাই।

বলেই ও গঙ্গার ধারে নেমে গেল। বাকিরা সব মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, যমুনা ছাড়া। যমুনা ঠোঁট বাঁকিয়ে জ্বলন্ত চোখে জগাকে দেখছিল। সোতে হেসে বলল, সেই থেকে শালা মনে মনে ফুঁসছে। ত্যাবড়া তুইও খচ্চর আছিস। খালি খোঁটা দিয়ে কথা বলিস কেন?

যমুনা বলল, না না, তোমাদের ওপর চটেনি, আমার ওপর গরম হয়েছে। অই যে, ত্যাওড়াদাদাকে সাপোট দিয়ে, অধমমো বলেছি।

বলেই, ও গঙ্গার ধারের দিকে চেয়ে, কোমরে একটা হ্যাঁচকা দোলা দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ইস্টিশনে ভিক্ষে করে খাই, যমুনা কারোর তোয়াক্কা করে না।

সোতে বলল, লে লে, তুই আর শুরু করিস না।

এই সময়ে চণ্ডী কাঠের বোঝা এনে চিতার পাশে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, কী হল?

ত্যাবড়া বলল, কিছু না। চণ্ডী তো এখন কাঠ সাজাবে, যমুনাকে একলা থাকতে হবে না।

চণ্ডী বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি আছি, তোমরা চালাও গে।

ওরা সবাই নেমে গেল। গঙ্গার ধারে ছাইয়ে ভরতি। ছাইগাদার পরে, পলি পড়া ভিজে পাড়। ছাইয়ের ওপরেই ওরা চেপে বসল। বাতাসে ছাই উড়ল। চুপচাপ সবাই, ভোলা বোতলটা হাতে হাতে নিয়ে শেষ করে দিল। তারপরে চানাচুর চিবোতে লাগল।

পুনিয়া হঠাৎ বলল, আমি চিতা সাজানো দেখিগে।

মনা বলল, হ্যাঁ, পোড়া গে শালা।

পুনিয়া চলে গেল। সোতে বলল, যমুনার কাছ থেকে নড়তে চাইছে না।

ত্যাবড়া হাসল। আর একটা নতুন বোতল বের করে ছিপি খুলে গলায় ঢালল। একে একে সবাই ঢালল। ত্যাবড়ার গোঙানো স্বর শোনা গেল, লোকটার মুখটা আমার মনে পড়ছে।

মনা বলল, আমার মাংস দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।

সোতে বলল, ধূ। দে, মাল খাই। আমার বাবা এই ভাল।

 জগা হেসে বলল, হ্যাঁ, দিদিমণি তো আর কোনও দিন জুটবে না, খালি বয়েই বেড়াতে হবে।

সোতে বলল, দিদিমণি জুটে আমার দরকার নেই। মেয়েমানুষ সব এক, কোনও সুখ নেই।

জগা বলল, সুখ নেই?

না। আমার শালা কোনও কিছুতে সুখ নেই, আমি বুঝতে পারি না মাইরি।

কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। কেবল মনার চানাচুর চিবানোর মচ মচ্ শব্দ শোনা গেল।

জগা বলল, মাল খেলে আমার এরকম মনে হয়।

সোতে বলল, তুই তো যমুনাকে নিয়ে বেশ আছিস।

যমুনা কি আমার একলার?

 একলার হলে খুশি হতিস?

জগা জবাব দিল না। মনা বলল, রিকশাওয়ালার আবার খুশি। খেটে খেয়ে মরে যাব, ফিনিস।

 ত্যাবড়ার গোঙানো স্বর আবার শোনা গেল, এই দ্যাখ, আমি মরলে তোরা ফিসটি করবি তো?

 সবাই ওর দিকে তাকাল। ত্যাবড়া আবার বলল, আমি নিশ্চয়ই ইস্টিশনেই মরব।

জগা বলল, আমরা সবাই ইস্টিশনে মরব। আমাদের কার ঘর আছে?

ত্যাবড়া বলল, কিন্তু দেখিস, আমাদের মড়া নিয়ে যেন গণেশ ফটকেরা না যায়।

মনা বলে উঠল, তাহলে শালাদের কাঁচা খেয়ে ফেলব।

এই সময়ে চণ্ডীর গলা শোনা গেল, কই গো, এসো সব, চাপাতে হবে।

বোতলের ঝোলা রেখেই ওরা সবাই উঠে গেল। ত্যাবড়া নিজের হাতে মড়ার গায়ের কাপড় খুলতে গিয়ে দেখল নতুন কাপড়ের টুকরো নেই। জিজ্ঞেস করল, নতুন কাপড় কোথায় গেল?

চণ্ডী বগবগ করে হাসল। যমুনা বলল, এক টুকরো এ নিয়েছে। আর এক টুকরো ওই সাধু নিয়েছে।

সবাই তাকিয়ে দেখল, গেরুয়া জামা গায়ে, চুল দাড়িয়াওয়ালা সাধু একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ঘাড় নেড়ে হেসে বলল, এমন একটা লোক মরল, সবায়েরই তো কিছু পাওয়া চাই।

চণ্ডী সায় দিয়ে বলল, সত্যি কথা। নাও, বাকি জামাকাপড়গুলো খুলে দাও। ঘি এনেছ?

ত্যাবড়া বলল, কী হবে?

 মড়ার গায়ে মাখতে হয়।

ওসব ছাড়।

নিদেন একটু দালদা আনলেও পারতে। যাক গে, আননি যখন…।

ত্যাবড়া মরা মানুষটির গা থেকে জামা কাপড় খুলতে খুলতে বলল, সব খুলে নেব?

না, কোমরের কানিটুক রাখো, বাকি খুলে দাও।

 তা-ই করা হল। তারপর চারজন ধরে চিতায় কাঠের ওপরে মড়া শুইয়ে দিল। হাত দুটো গুটিয়ে দিতে গিয়ে দেখা গেল, ভীষণ শক্ত হয়ে গিয়েছে। শরীরের একটা জায়গাও বাঁকাবার উপায় নেই। চণ্ডী বলল, ছেড়ে দাও, এমনি থাকুক।

সে মড়ার ওপরে কাঠ সাজিয়ে দিতে লাগল। ওরা সবাই ঘিরে দাঁড়িয়ে রইল। ত্যাবড়া মড়ার মুখের দিকে চেয়ে বলল, দেখো বাবা, কোনও দোষ নিও না। এই চেয়েছিলে তো?

বুড়ো সাধুটা ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল, আর আবার কী চাইবে। মরার পরে চিতায় উঠে পুড়তে যাচ্ছে, মানুষের আর কী চাইবার আছে।

কথাটা সবাই শুনল, কেউ ফিরে তাকাল না। কাঠ সাজাবার পরে চণ্ডী নিজের হাতে কয়েকটা প্যাঁকাটি জ্বালিয়ে বলল, নাও, কে মুখে দেবে, দাও।

ত্যাবড়া বলল, আমিই দেব।

 জগা বলল, তোর না বাপ বেঁচে আছে, তুই মুখে আগুন দিবি কি?

 ত্যাবড়া বলল, এ বাপ বাপের থেকে বেশি।

 জগা বলল, তবে আমিও দেব।

 সোতে মনা পুনিয়া সবাই বলল দেবে। সবাই একসঙ্গে বুড়ো মানুষটার মুখে আগুন ঠেকিয়ে দিল। যমুনা পলকহীন চোখে দেখছিল। চণ্ডী হেসে বলল, মন্দ না, নতুন এক রকম হল।

সে চিতায় আগুন ধরিয়ে দিল। বাতাস থাকায়, একটু পরেই ভালভাবে আগুন জ্বলে উঠল। সোতে বলল, যাই, ছাইগাদায় বসি গে।

জগা যমুনার দিকে ফিরে ডাকল, আয়, ওখানে যেয়ে বসি।

 যমুনা আগুনের দিকে চোখ রেখে বলল, যাও, যাচ্ছি।

ওরা সবাই গিয়ে আবার ছাইগাদায় বসল। যমুনাও আস্তে আস্তে এসে বসল। চণ্ডীও এল। বগ করে হেসে ত্যাবড়ার পাশ ঘেঁষে বসল। বোতল হাতে হাতে ঘুরতে লাগল, গলায় ঢালা চলল।

চণ্ডীও হাতে বোতল তুলে নিয়ে বলল, মাগিটা ঘুমোচ্ছ।

অর্থাৎ তার বউ। না ঘুমোলে, মদ খেতে পারত। সোতে বলল, যমুনা একটু খা না।

 যমুনা বলল, না, ভাল লাগছে না।

যমুনার একদিকে জগা আর একদিকে পুনিয়া। হাঁটুর কাছে সোতে, একটা পা ঢুকিয়ে দিয়েছে। যমুনার ঠ্যাঙের তলায়। পুনিয়া বলল, তোর কোলে একটু মাথা রাখতে দিবি যমুনা?

যমুনা বলল, রাখো, তোমার মরণ ধরেছে জানি।

চণ্ডী বগবগ করে হাসল, বলল, সেই কথা, মরণ না ধরলে চলবে কেন।

পুনিয়া যমুনার কোলে মাথা রাখল। যমুনা পুনিয়ার মাথার চুলে হাত দিল। সোতে একবার যমুনার ঘাড়ে আস্তে টিপে দিয়ে, পুনিয়াকে চোখের ইশারায় দেখাল। মনা এগিয়ে এসে যমুনার পিঠে আস্তে হেলান দিয়ে বসল।

নতুন বোতল খোলা হল। এমন সময়, সেই দাড়িওয়ালা বুড়ো এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, কী, কারণ পান হচ্ছে? এ তো বড় ভাল জিনিস।

ত্যাবড়া বলল, চলবে?

বুড়ো বলল, তা আর না চলবে কেন। অমন মানুষের মড়া। লোকটা পুণ্যিমন্ত ছিল।

সে কাছে এসে বসল। ত্যাবড়া বলল, কিন্তু খাবে কীসে বাবা? আমাদের পাত্তর টাত্তর নেই, বোতল থেকে চুমুক মারতে হবে।

বুড়ো হে হে করে হেসে বলল, এখানে আবার এঁটোকাটা কী আছে। বোতল ধরেই খাব।

বুড়ো গাঁজার কলকেটিও এনেছে। সেটা বাঁ হাতে নিয়ে, ডান হাতে বোতল ধরে চুমুক দিল। দাড়ি বেয়ে কয়েক ফোঁটা পড়ল। তারপরে কলকের ভিতরে আঙুল টিপতে লাগল। এখন সকলেই চুপচাপ। কেউ কারোর দিকে তাকিয়ে নেই। সকলেরই চেহারাগুলো যেন কেমন বদলে গিয়েছে। সেই দুপুরের মানুষগুলোকে আর চেনা যায় না। পুনিয়ার একটা হাত মায়ের কোলে শিশুর মতো যমুনার বুকের কাছে নড়ছে। যমুনা নির্বিকার, গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আছে। বাতাস বইছে। কয়েকটা কুকুর ওদের আশেপাশে এলিয়ে শুয়ে আছে।

ত্যাবড়া হঠাৎ বলে উঠল, মানুষ যে কী, তা বুঝলাম না।

কেন কথাটা বলল, বোঝা গেল না। কেবল সোতে সায় দিতে গিয়ে, শুধু উচ্চারণ করল, হ্যাঁ, শালা মানুষ।

দাড়িওয়ালা সাধু বুড়ো, গাঁজায় কলকে টিপতে টিপতে, ঘাড় নেড়ে হাসল। তারপরে কেশো ঘড়ঘড়ে গলায় সুর করে গাইল,

মানুষ মানুষ করলি মানুষ
রতন চিনলি না।

 তারপরে বলল, মান চাই, হুঁশ চাই, মানে হুঁশে মানুষ।

তার এ সব কথার কেউ কোনও জবাব দিল না।

আবার নতুন বোতল খোলা হল। তার থেকে দু ঢোক খেয়ে চণ্ডী উঠে বলল, যাই, একটু খুঁচিয়ে আসি।

ত্যাবড়া বলল, চলো, আমিও যাই।

সবাই উঠল। সবাই গেল। মড়া পুড়ছে, মুখটা পুড়ছে, আর ঠোঁট পুড়ে গিয়ে, দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ছে। মাথার চুল পুড়ে, চামড়া উঠে, সাদা খুলি দেখা যাচ্ছে।

ত্যাবড়া বলল, আমার মনে হচ্ছে, হাসছে।

চণ্ডী বলল, হ্যাঁ, এখনই তো যত রঙ্গ।

বলে বগবগ করে হাসল। মনা বলল, ধূছাইগাদাতে যেয়ে বসি।

সোতেও সায় দিল। সবাই সায় দিল। আবার সবাই ছাইগাদায় গেল। বুড়ো সাধুও গেল। গিয়ে কলকেয় আগুন দিল।

জগা বলল, সব হল, কিন্তু মানুষটার জন্য কাঁদা হল না।

সোতে হেসে বলল, ঠিক বলেছিস। এর আগেরবার বেগা শালা কী রকম কেঁদেছিল, মড়াটার জন্য?

মনা বলল, যমুনা, তুই মেয়েমানুষ, তুই কাঁদ।

যমুনা ঝংকার দিল, আমার বয়ে গেছে।

সোতেও বলল, কাঁদ না যমুনা, তুই একটু কাঁদ।

 যমুনা গায়ে মোচড় দিয়ে বলল, ভাগ, কাঁদবে না হাতি।

সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, কাঁদ না যমুনা, কাঁদ কাঁদ, তুই কাঁদ।

ওরা যেন যমুনাকে সবাই পাগল পেল। যমুনা হাসতে লাগল। কিন্তু ওরা যেন কেমন খেপে উঠতে লাগল, জেদ করতে লাগল, কাঁদ না, কাঁদ যমুনা, তুই কাঁদ।

ওরা যমুনাকে ধাক্কা মারতে লাগল, আর ওদের খ্যাপা খ্যাপা দেখাতে লাগল। যমুনা ছিটকে উঠে দাঁড়াল, চেঁচিয়ে উঠল, না না না।

বলে ও গঙ্গাধারের দিকে চলে গেল। খানিকটা গিয়ে হঠাৎ দাঁড়াল, তারপরেই হঠাৎ সবাই শুনতে পেল, যমুনা হা হা করে কাঁদছে, আর বলছে, অ গো বাবা গো, বাবা গো..বাবা, আমার বাবা, সেই রাস্তার ধারে তুমি মরে পড়ে রইলে গো, বাবা গো! তোমার টেপিকে দেখলে না–আঁ আঁ আঁ…।

ওরা সবাই শুনল, আর সকলেরই যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ওরা নিজেদের দিকে কেউ তাকাল না। তারপরেই হঠাৎ ত্যাবড়া ফুঁপিয়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ ওরা এ ওর দিকে একবার তাকাল, এবং সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিল। যেন ওরা কেউ কারোকে আর চিনতে পারছে না। তারপরে পুনিয়াও তেমনি হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো কেঁদে উঠল।

মনা বলল, ধ্যাত, ভাল লাগে না। খাটব খাব…।

ওর কথা শেষ হল না, গলার কাছে শব্দটা আটকে গেল, যেন স্বরটা ভেঙে গেল। সোতে দাঁতে দাঁত টিপে, চোখের জল মুছতে লাগল। ওর নিচু চাপা স্বর শোনা গেল, সুখ নেই শালা।

যেন পাথর সরে গেল, বানের জল ভাসল কলকলিয়ে।

 চণ্ডী বোতল তুলে চুমুক দিল। যমুনা তখনও কাঁদছে। চণ্ডী বলল, কাঁদ, সবাই কাঁদ। কাঁদলে জ্বালা জুড়োয়। যাই, আবার একটু খুঁচিয়ে দিয়ে আসি।

চণ্ডী চিতার দিকে এগিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *