০৪. সন্ধির শর্তভঙ্গ ॥ অ্যাগামেমনন কর্তৃক সৈন্যবাহিনী পর্যবেক্ষণ

চতুর্থ পর্ব
সন্ধির শর্তভঙ্গ ॥ অ্যাগামেমনন কর্তৃক সৈন্যবাহিনী পর্যবেক্ষণ

অলিম্পাসের দেবলোকে সুবর্ণনির্মিত এক বিশাল কক্ষে দেবতারা এক মহতী সভায় মিলিত হয়েছেন দেবরাজ জিয়াসের সঙ্গে। দেব-পরিচারিকা হেবী সুবর্ণপাত্রে সুরা পরিবেশন করছেন দেবতাদের মাঝে। সুরাপানের সঙ্গে সঙ্গে সুদূর মর্ত্যলোকে অবস্থিত ট্রয়নগরীর দিকে মাঝে মাঝে ঘৃণাভরে তাকাচ্ছিলেন দেবতাবৃন্দ।

ক্রোনাসপুত্র জিয়াস হেরার মধ্যে ক্রোধসঞ্চারের জন্য বললেন, স্বর্গলোকের দুই দেবী হেরা ও এথেন মেনেলাসের পক্ষে থাকা সত্ত্বেও তাঁদের কাছ থেকে কোন সাহায্যই পাচ্ছে না মেনেলাস। তারা নীরবে নিষ্ক্রিয়ভাবে বসে আছেন আর ওদিকে অ্যাফ্রোদিতে আলেকজান্দ্রাসকে রক্ষা করে চলেছেন সমস্ত বিপদ থেকে। প্রকৃতপক্ষে মেনেলাস দ্বৈতযুদ্ধে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও তার কবল থেকে আলেকজান্দ্রাসকে রক্ষা করে নিয়ে আসেন অ্যাফ্রোদিতে। এখন আমাদের স্থির করতে হবে আমরা এ ব্যাপারে কি করব। তারা কি এখনো পূর্বের মত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে অথবা শাস্তি স্থাপিত হবে তাদের মধ্যে। যদি তোমরা শান্তি স্থাপনে আগ্রহী হও তাহলে মেনেলাস হেলেনকে ফিরে পাবে এবং প্রিয়ামের জনবহুল ট্রয়নগরী রক্ষা পাবে।

অস্ফুট ভাষায় তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করলেন দেবী হেরা আর এথেন। তারা তখন ট্রয়জাতিরই অমঙ্গল কামনা করছিলেন এবং সেবিষয়ে কোন অশুভ চক্রান্তের পরিকল্পনা করছিলেন।

এথেন শুধু এক অব্যক্ত বিক্ষোভে গর্জন করতে লাগল মনে মনে। সে তার পিতার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু হেরা আর নীরব থাকতে পারলেন না। তিনি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, হে ভীষণস্বভাব ক্রোনাসপুত্র, এসব কথার অর্থ কি? যে বিপুল শ্রম সহকারে আমি রাজা প্রিয়াম ও তার পুত্রদের বিরুদ্ধে এই অসংখ্য সৈন্য সমবেত করেছি সে শ্রম কি পণ্ড হবে? দিনের পর দিন এই উদ্দেশ্যে আমার দেহ নিঃসৃত যে ঘর্মপাত করেছি তা কি ব্যর্থ হবে? ঠিক আছে, তুমি অন্যান্য দেবতাদের সহযোগে যা খুশি করতে পার।

কুদ্ধ জিয়াস তখন এর উত্তরে বললেন, বল প্রিয়তমা, প্রিয়াম আর তার পুত্ররা কী এমন ক্ষতি করেছে যার ফলে তার ইলিয়াম নগরীকে বিধ্বস্ত করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছ তুমি? তুমি কি নিজে ট্রয়নগরীর প্রাচীর অতিক্রম করে তার অভ্যন্তরে গিয়ে রাজা প্রিয়াম ও তার পুত্রদের ভক্ষণ না করে তৃপ্ত হবে না? ঠিক আছে তোমার যা ইচ্ছা তাই করো। আমি আর এই ব্যাপার নিয়ে বিবাদ করব না তোমার সঙ্গে। তবে একটা কথা বলে রাখছি তোমায়, যদি আমি কোনদিন তোমার দ্বারা অনুগৃহীত কোন ব্যক্তির কোন নগরীকে বিধ্বস্ত করি তাহলে তোমাকে আমার ইচ্ছামত সেই ধ্বংসকার্য সাধন করতে দিতে হবে। কারণ আমি তোমাকে আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করার সুযোগ দিয়ে চলেছি। সারা পৃথিবীর মধ্যে রাজা প্রিয়াম ও তার প্রজাকুল-অধ্যুষিত ইলিয়াম নগরীকে অন্যান্য সমস্ত নগরীর থেকে ভালবাসি আমি। তাদের কাছ থেকে উপযুক্ত ভোগ আরতি বা অগ্নিদগ্ধ সুগন্ধি চর্বির অভাব ঘটে নি কখনো।

হেরা বললেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় তিনটি নগরীর নাম হলো আর্গস, স্পার্টা আর মাইসেন। যদি তুমি এই সব নগরীর প্রতি অসন্তুষ্ট বা ক্রুদ্ধ হও তাহলে ইচ্ছামত তাদের বিধ্বস্ত করতে পার। আমি তাদের রক্ষা করার কোন চেষ্টাই করব না। আর আমি তোমাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও সফল হব না। কারণ আমার পক্ষ থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী তুমি, সুতরাং পণ্ডশ্রম আমি করব না। তবে জেনে রেখো, আমিও তোমার সমজাতীয় এবং সমগোত্রীয় দেবতা এবং তোমার ধর্মপত্নী, তাছাড়া তুমি দেবতাদের রাজা। সুতরাং এখন বৃথা বিবাদ বিসম্বাদ না করে আমাদের নিজেদের মধ্যে এক শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করা উচিত। তাহলে অন্যান্য দেবতারা আমাদের নির্দেশমত কাজ করে যাবেন। এই মুহূর্তে তুমি এথেনকে মর্ত্যভূমিতে পাঠিয়ে দাও। সে সেখানে গিয়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি করবে যাতে ট্রয়ের রাজন্যবর্গই প্রথম শপথ ভঙ্গ করে গ্রীকদের আক্রমণ করতে বাধ্য হবে।

দেবী হেরার একথা মেনে নিলেন স্বর্গ ও মর্ত্যলোকের পরমপিতা দেবরাজ জিয়াস। তৎক্ষণাৎ তিনি এথেনকে ডেকে বললেন, তুমি মর্ত্যভূমিতে গিয়ে এমন কিছু ব্যবস্থা করো যাতে ট্রয়বাসীরাই প্রথম শপথ ভঙ্গ করে এবং গ্রীকদের আক্রমণ করে।

এথেনও মনে মনে এই ব্যবস্থাই চাইছিলেন। সুতরাং জিয়াসের বাক্য স্ফুরণের সঙ্গে সঙ্গে অলিম্পাসের সেই সর্বোচ্চ স্বর্ণশিখর হতে তীরবেগে উড়ে গেলেন সুদূর মর্ত্যলোকের পানে যেন দেবরাজ জিয়াস দ্বারা বিচ্ছুরিত কোন আলোক সংকেতস্বরূপ এক অগ্নিপুচ্ছ সমন্বিত জ্বলন্ত উল্কা কক্ষ হতে কক্ষান্তরে উড়ে চলেছে শূন্য আকাশপথে। উল্কাসদৃশ সেই উডডীয়মান আলোকস্তম্ভ দেখে ট্রয়বাসী ও গ্রীকরা সকলেই অবাক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে উঠল। পরস্পরে বলাবলি করতে লাগল, হয় আবার আমরা যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে পড়ব অথবা যুদ্ধের দেবতা জিয়াস শান্তি স্থাপনের জন্য দেবদূত প্রেরণ করেছেন।

এইভাবে যখন আলোচনা করছিল, এথেন ঠিক তখনই অ্যান্টিনরপুত্র ল্যাভাকাসের ছদ্মবেশে লাইকাওনপুত্র প্যারাসের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ট্রয়বাসীদের মধ্যে। অবশেষে এথেন দেখলেন অন্যান্য ট্রয়বীরদের সঙ্গে প্যান্ডারাস তখন সবেমাত্র ঈসিপাস নদীর তীর থেকে ফিরেছে। তিনি প্যান্ডারাসের কাছে গিয়ে বললেন, হে বীর লাইকাওনপুত্র, আমি যা বলব তা করতে পারবে কি তুমি? যদি তুমি সাহস করে একটি তীর এখান থেকে গ্রীকবীর মেনেলাসকে লক্ষ্য করে ছুঁড়তে পার তাহলে ট্রয়বাসী বিশেষত রাজকুমার আলেকজান্দ্রাসের কাছ থেকে পাবে প্রভূত সম্মান আর ধন্যবাদ। তোমার এই তীরে নিহত হয়ে মেনেলাস যদি চিতাগ্নিতে আরূঢ় হতে বাধ্য হয় তাহলে যথাযোগ্যভাবে পুরস্কৃত হবে প্যারিসের দ্বারা। অতএব ধনুকে তীর সংযোজন করো সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতীরন্দাজ অ্যাপোলোকে স্মরণ করে। প্রার্থনা করে তাঁকে বল, তুমি অতঃপর তোমার জেনিয়া নগরীতে প্রত্যাবর্তন করে পশুবলির দ্বারা প্রীত করবে তাকে।

একথা শুনে গর্বে স্ফীত হয়ে উঠল নির্বোধ প্যান্ডারাসের অন্তর। তূণ থেকে তীর নিয়ে ধনুকে সংযোজন করল। এই ধনুক তারই দ্বারা নিহত এক পশুর বিরাটকায় শৃঙ্গ হতে প্রস্তুত। অ্যাপোলোকে স্মরণ করে ধনুকটিকে অর্ধবৃত্তাকারে বাঁকিয়ে লক্ষ্যবস্তুর উদ্দেশ্যে তীর নিক্ষেপ করল প্যান্ডারাস।

কিন্তু দেবতারা ভুলে যান নি মেনেলাসকে। তাই দেখা গেল সহসা যে জিয়াসকন্যার প্ররোচনায় এ তীর নিক্ষিপ্ত হয় সেই জিয়াসকন্যাই নিজে মেনেলাসের সামনে দাঁড়িয়ে তীরটি তার বক্ষ ভেদ করার আগেই তা তিনি সরিয়ে দিলেন অনায়াসে, ঠিক যেমন কোন ঘুমন্ত শিশুর মুখ থেকে মাছি তাড়িয়ে দেয় তার মা।

তথাপি তীরটি মেনেলাসের উরুর উপর চামড়ার বন্ধনী ভেদ করে কিছুটা আঘাত করল আর সঙ্গে সঙ্গে রক্ত ঝরতে লাগল। সাদা হাতীর দাঁতকে লাল রঙ দিয়ে রাঙিয়ে দিলে যেমন হয় তেমনি মেনেলাসের সাদা উরু হতে রক্ত ঝরতে থাকায় তাই মনে হলো।

সে রক্ত দেখে ভীত হয়ে উঠলেন রাজা অ্যাগামেমনন। বীর মেনেলাসও ভয়ে ভয়ে দেখলেন একটি তীর তখনও লেগে রয়েছে তার উরুর উপর।

প্রথমে কিছুটা মেনেলাস অপ্রতিভ হয়ে পড়লেও পরে সাহস সঞ্চয় করলেন। কিন্তু অ্যাগামেমনন একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ক্ষুণ্ণমনে বললেন, হে আমার প্রিয়তম ভাই, আমিই ওদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ওদের শপথবাক্যে বিশ্বাস করে তোমার মৃত্যুর কারণ হতে বসেছিলাম। ট্রয়বাসীরা তাদের শপথের শর্ত পদদলিত করে তোমাকে আঘাত করেছে। তথাপি জেনে রেখো, দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে মেষমাংস ও মদ্য উৎসর্গ করেছি, আমাদের দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে যে শপথবাক্য উচ্চারণ করেছি পরস্পরে তা ব্যর্থ হবার নয়। অলিম্পাস পর্বতস্থিত দেবরাজ যদি এই মুহূর্তে তাদের এই হীন কার্যের জন্য শাস্তি প্রদান না করেন তাহলে এরপরে একদিন নিশ্চয়ই সে শাস্তি প্রদান করবেন। এর জন্য ওদের একদিন পুত্রপরিবারসহ জীবন ও যথাসর্বস্ব হারাতে হবে। ওদের এই বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তিস্বরূপ জিয়াস যখন তাঁর স্বর্গের সিংহাসন হতে ভয়াবহ রাজদণ্ড সঞ্চালন করবেন তখন বিপদের এক বিশাল ছায়া নেমে আসবে ওদের উপর, তখন দেখবে মুহূর্তে রাজা প্রিয়াম ও তাঁর প্রজাকুলসহ ধূলিসাৎ হয়ে যাবে গর্বোদ্ধত ইলিয়াম নগরীর মাথা। সে যাই হোক হবে। কিন্তু মেনেলাস, এখন কি তোমার মৃত্যুর জন্য বিলাপ করতে হবে আমাদের? তাহলে গ্রীকরা এখনি প্রত্যাবর্তন করবে আর আমাকেও তাদের সঙ্গে ফিরে যেতে হবে ব্যর্থ হয়ে। রাজা প্রিয়াম আর ট্রয়বাসীরা সগর্বে হেলেনকে রেখে দেবে তাদের ট্রয়রাজ্যে, যে রাজ্যের মাটিতে সমাহিত হবে তোমার মৃতদেহ। হয়ত কোন গর্বিত ট্রয়বাসী তোমার সেই সমাধির উপর দাঁড়িয়ে আস্ফালন করে বলবে, বৃথাই আমাদের উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য এত সৈন্যবাহিনী এনেছিল রাজা অ্যাগামেমনন। ব্যর্থ হলো তার অভিযান। শূন্য রণতরী নিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল সে। আর তার যাবার বেলায় এদেশের মাটিতে চিরতরে রেখে গেল মেনেলাসের মৃতদেহ। আর সেই অপবাদ মাথায় করেই হয়ত আমাকেও একদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ঢাল পড়তে হবে ধরিত্রীমাতার কোলে।

তখন তাঁকে আশস্ত করে মেনেলাস বললেন, ধৈর্য ধরো, আমাদের সেনাদলকে সন্ত্রস্ত করে তুলো না। তীরটি আমাকে মারাত্মকভাবে আঘাত করতে পারে নি। প্রথমে যে তীর আমার ধাতব পদাচ্ছাদনের উপর প্রতিহত হয়, পরে আমার উরুদেশের গাত্রত্বককে কিঞ্চিৎ পরিমাণে বিদ্ধ করে।

অ্যাগামেমনন বললেন, তা হলেও আমাদের শল্য চিকিৎসক তোমাকে পরীক্ষা করে তোমার যন্ত্রণা উপশমের জন্য ওষুধ দান করবেন।

এই বলে ট্যানথাইবিয়াসকে তৎক্ষণাৎ ডেকে শল্য চিকিৎসক অ্যাসিলিপিয়াসের পুত্র ম্যাকাওনের কাছে পাঠালেন। বললেন, শরাহত মেনেলাসের চিকিৎসার জন্য তিনি যেন এই মুহূর্তে আসেন।

রণক্ষেত্রে বীর যোদ্ধাদের মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান ম্যাকাওনকে তৎক্ষণাৎ সব কথা বলে ডেকে আনল ট্যানথাইবিয়াস। ম্যাকাওন এসে মেনেলাসের ক্ষতস্থান ভালভাবে পরীক্ষা করে শিরণপ্রদত্ত এক আশ্চর্য ওষধি প্রয়োগ করলেন।

মেনেলাসের চিকিৎসার ব্যাপারে গ্রীকবীরদের যখন এইভাবে ব্যস্ত ছিলেন তখন তাদের সহসা অতর্কিত আক্রমণ করল ট্রয়সৈন্যরা। তবু কিন্তু যুদ্ধবিমুখ অবস্থায় কাপুরুষের মত ঘুমিয়ে রইলেন না অ্যাগামেমনন। তিনি তখন তাঁর অশ্বসংযুক্ত অস্ত্রসজ্জিত রথের ভার টলেমিয়াসপুত্র ইউরিমীডনের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজে পদব্রজে চলে গেলেন সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে। পুনরায় যুদ্ধারম্ভের আদেশ দিতে হবে তাদের।

অ্যাগামেমনন গিয়ে দেখলেন, প্রতি-আক্রমণের জন্য মুহূর্তে প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। তাঁর সেনাবাহিনী। তিনি তাদের উৎসাহ দিয়ে বললেন, হে গ্ৰীক সৈন্যগণ, তোমাদের • মধ্যে উপযুক্ত সময়োদ্যমের যেন বিন্দুমাত্র অভাব না ঘটে। মনে রেখো, দেবরাজ জিয়াস কখনই মিথ্যাবাদীদের সাহায্য করবেন না কোনভাবে। ট্রয়বাসীরাই প্রথম শপথ। ভঙ্গ করে আক্রমণ করেছে আমাদের। সুতরাং তারা অবশ্যই একদিন শকুনির খাদ্যে পরিণত হবে। আমরা তাদের নগর অধিকার করবই এবং তাদের স্ত্রীপুত্রদের আমাদের জাহাজে চাপিয়ে বন্দী হিসেবে নিয়ে যাব আমাদের রাজ্যে।

কিন্তু গ্রীকসৈন্যদের মধ্যে যারা সন্ত্রস্ত অবস্থায় ইতস্তত ঘুরছিল তাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে অ্যাগামেমনন বললেন, হায় কাপুরুষ ঘৃণ্য জীবের দল। ভীত সন্ত্রস্ত হরিণ-শিশুর মত একস্থানে ঘনসন্নিবিষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে লজ্জা করছে না তোমাদের? ব্যাঘ্ৰভীত হরিণীর মতই হতোদ্যম হয়ে আছ তোমরা। কখন ট্রয়বাসীরা এসে তোমাদের উপকূলবর্তী রণতরীগুলোকে অধিকার করবে অথবা ক্রোনাসপুত্র জিয়াস এসে স্বয়ং তোমাদের শত্রুকবলমুক্ত করবেন, তোমরা কি তারই প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে আছ?

অতঃপর তিনি আইডোমেনেউসের নেতৃত্বে সুসংবদ্ধ ক্রীটসৈন্যদের মাঝখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর আদেশে যখন মেরিওন সম্মুখ সারিতে সৈন্যসজ্জা করছিলেন তখন শিকারাবিমুখী বন্য শূকরের মত ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল আইডোমেনেউসকে। অ্যাগামেমনন তখন তাকে বললেন অন্যান্য রাজন্যবর্গের থেকে সব সময় তোমাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখি কারণ তোমার পানপাত্র কখনো শূন্য হয় না, তোমার অমিত প্রাণশক্তির জোয়ারে কখনো ভাটা পড়ে না। অতএব হে বীর, তোমার অপরাজেয় পৌরুষের অহঙ্কারকে নতুন করে সার্থক ও সম্প্রমাণিত করে তোল।

আইডোমেনেউস উত্তর করলেন, আমি আমার প্রতিশ্রুতিমত চিরদিন আপনার বিশ্বস্ত সহকর্মী রয়ে যাব। অন্যান্য গ্রীকসৈন্যদের আপনি এই মুহূর্তে যুদ্ধ শুরু করতে আদেশ দিন, কারণ ট্রয়বাসীরাই প্রথম শপথ ভঙ্গ করেছে এবং এই শপথ ভঙ্গের শাস্তিস্বরূপ তাদের উপর নেমে আসবে মৃত্যু আর ধ্বংস।

অনন্তর আত্রেউসপুত্র অ্যাগামেমনন গেলেন অ্যাজাক্স ভ্রাতৃদ্বয়ের সমীপে। তাদের অধীনস্থ পদাতিক সৈন্যদের মাঝে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে উঠলেন অ্যাজাক্স ভ্রাতৃদ্বয়। পশ্চিমাবায়ুতাড়িত প্রচণ্ড ঘূর্ণিবাত্যার প্রভাবে উৎক্ষিপ্ত সমুদ্রতরঙ্গ কোন সুউচ্চ উপত্যকাভূমি থেকে যেমন ভীত হয়ে উঠে ছাগ ও মেষের পাল তেমনি বিক্ষুব্ধ শত্রু সৈন্যদের দেখে এক সন্ত্রাসবিহ্বল প্রতীক্ষা ও প্রস্তুতিতে নিবিড় হয়ে উঠছিল অ্যাজাক্স পরিচালিত পদাতিক সৈন্যের দল। তাঁদের দেখে রাজা অ্যাগামেমনন বললেন, তোমাদের মত যুদ্ধবিশারদ বীরদের আদেশ দেবার কিছু নেই। তোমাদের বিবেচনামত সৈন্য পরিচালনা করবে। গ্রীকসেনানীদের অন্যান্য সকলে যদি তোমাদের মত হত তাহলে অবশ্যই একদিন রাজা প্রিয়ামের ট্রয়নগরী করতলগত হত আমাদের।

পেলাগল, ক্রোমিয়াস, অ্যানাস্টার, হীমন প্রমুখ অন্যান্য বীরের সমভিব্যাহারে বাগীশ্রেষ্ঠ নেস্টর যখন তার অধীনস্থ সৈন্যদের পরিচালনা করছিলেন তখন সেখানে গিয়ে উপনীত হলেন রাজা অ্যাগামেমনন। প্রথম সারিতে রথারূঢ় বীরর্ষভ নাইট উপাধিধারীদের স্থাপন করে অন্যান্য বীর ও পদাতিক সৈন্যদের পিছনের সারিতে দাঁড়াবার আদেশ দিলেন নেস্টর। মধ্যস্থলে রইল কাপুরুষ যুদ্ধপরাজুখের দল যারা যুদ্ধে তেমন পারঙ্গম না হলেও কোন ক্ষতি হবে না। তারপর তিনি উপদেশ দিলেন, শত্রুদের সম্মুখে কেউ যেন বিচ্ছিন্নভাবে একা একা যুদ্ধ করতে যেও না। অস্ত্র দ্বারা সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুদের সাক্ষাৎ পাওয়ার সাথে সাথে। আমাদের প্রাচীন রণবিশারদ বীরেরা এইভাবে পররাজ্য ও কত সব দুর্ভেদ্য দুর্গ জয় করতেন।

নেস্টর প্রদত্ত এই উপদেশ শুনে খুশি হলেন অ্যাগামেমনন। তিনি তাঁকে বললেন, আপনার মনের শক্তি মত দেহেও যদি শক্তি থাকত, সর্বসংহারকারী কাল যদি আপনার যৌবনশক্তি হরণ না করত তাহলে আমাদের পক্ষে তা হত অতীব মঙ্গলজনক।

নেস্টর তখন বললেন, হে আত্রেউসপুত্র, যৌবনের যে শক্তির দ্বারা আমি অজেয় শত্রু বীর এবেনথ্যানিনকে হত্যা করছিলাম যে শক্তি আজ আমার দেহে বিদ্যমান থাকলে আমিও গৌরববোধ করতাম। কিন্তু দেবতারা তা একই সময়ে একই সঙ্গে সব কিছু মানুষকে দান করেন না। আজ আমি বৃদ্ধ। আজ তাই অস্ত্রচালনার কাজ যুবকদের হাতে ন্যস্ত করে বয়োপ্রবীণ হিসেবে তাদের উপযুক্ত উপদেশ দানে উৎসাহিত করছি আমি।

পিটিয়সপুত্র এথেন্সরাজ মেনেসথিউসের কাছে আনন্দোৎফুল্ল অন্তরে গিয়ে অ্যাগামেমনন দেখলেন আদেশের প্রতীক্ষায় তিনি তার অধীনস্থ সৈন্যদলসহ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সিফিলিনিয়ার বলিষ্ঠ সেনাদলসহ ওডিসিয়াসও তার অদূরে অনুরূপভাবে ছিলেন দণ্ডায়মান। তারা তখনো যুদ্ধ শুরু হতে দেখেন নি। ট্রয় ও গ্রীকসৈন্যরা তখন সবেমাত্র রণক্ষেত্রাভিমুখে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। তাঁদের দেখে ভৎর্সনার সুরে অ্যাগামেমনন বললেন, তোমার মত দুজন বীর কেন যে এখনো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছ অপরের অপেক্ষায় তা বুঝতে পারছি না আমি। আমার ভোজসভা বা মন্ত্রণাসভায় তোমাদের সর্বাগ্রে আমন্ত্রণ জানাই আমি। তোমরাও উপযুক্ত মদ্য ও মাংসের সদ্ব্যবহার করো। সুতরাং এই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে অসংখ্য গ্রীকসৈন্য যুদ্ধবিরত থাকলেও তোমাদের মত বীরদের কখনই নিষ্ক্রিয় থাকা উচিত না।

ওডিসিয়াস তখন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর পানে তাকিয়ে উত্তর করলেন, কী বলছেন আপনি আত্রেউসপুত্র? আমরা অলস বা নিষ্ক্রিয়–একথা আপনি বললেন কোন যুক্তির ভিত্তিতে? যুদ্ধ বাধলে দেখবেন টেলিমেকাসের পিতা সর্বাগ্রে অগ্রসর হবে। সুতরাং আপনার ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক।

ওডিসিয়াসকে ক্রুদ্ধ দেখে অলক্ষ্যে মুদু হাসলেন অ্যাগামেমনন। তারপর হাসিমুখে বললেন, হে মহান লার্তেসপুত্র ওডিসিয়াস, তুমি চিরদিন সুমন্ত্রণা দানে সিদ্ধ। তোমাকে পরামর্শ দান অথবা তোমার কোন ছিদ্র অন্বেষণ করতে আমি আসি নি। আমি জানি তোমার অন্তঃকরণ ন্যায়পরায়ণ। কোন অন্যায় বা অপ্রিয় কথা বলে যদি কোন ক্ষতি করে থাকি তোমার তাহলে সে ক্ষতি একদিন পূরণ করে দেব সেজন্য কিছু মনে করো না।

সেখান থেকে বেগে অন্যত্র চলে গেলেন অ্যাগামেমনন। যেতে যেতে এক স্থানে দেখলেন টাইডেউসপুত্র মহান ডায়োমেডিস অশ্বসংযোজিত রথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীরবে। আর তার পাশে রয়েছে কাপেনিউসপুত্র স্থেনেলাস। তাদের দেখে তিরস্কার করতে লাগলেন অ্যাগামেমনন, টাইডেউসপুত্র, কেন তুমি রণক্ষেত্রের প্রান্তভাবে নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছ? তোমার পিতা টাইডেউস শত্রুদের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনাকালে সব সময় সম্মুখে এগিয়ে গেছেন, কোনদিন পিছিয়ে যান নি। যারা তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে স্বচক্ষে দেখেছে তারা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে একথা। তারা বলে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। একবার তিনি পলিনিসেস-এর সঙ্গে থীসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য সংগ্রহ করার মানসে মাইসেনিস নগরীতে আসেন। মাইসেনিসরা তাঁকে এ কাজে সাহায্য দান করতে চাইলেও বিভিন্ন অশুভ লক্ষণ পরিদর্শন করে তাদের প্রতিনিবৃত্ত করেন দেবরাজ জিয়াস। তখন ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে যান টাইডেউস। একবার তাঁরা রাজা ইটিওকলস-এর রাজভবনে অনুষ্ঠিত এক ভোজসভায় গ্রীকদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানো হয়। অ্যাসোপাস নদীর তীরসংলগ্ন জনহীন প্রান্তর ও অরণ্যসঙ্কুল পথ অতিক্রম করে একাকী যেতে হয় তাঁকে। ভোজসভায় যোগদান করে টাইডেউস দেখেন সেখানে তাঁর শত্রুপক্ষীয় ক্যাডমিন জাতির বহু লোক উপস্থিত। তিনি একা এবং সেখানে বিদেশী অতিথি হিসেবে উপস্থিত হলেও শত্রুদের সকলকে একক যুদ্ধে আহ্বান জানালেন নির্ভীকভাবে এবং তাদের সকলকেই পরাজিত করলেন একে একে। পরে ক্যাডমিনরা তার উপর এ ব্যাপারে প্রচণ্ডভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে নিধন করার জন্য তাঁর পথে পঞ্চাশজন যুবকের একটি দল পাঠায়। তাদের নেতা হিসেবে পাঠানো হয় হীমনপুত্র মেওন ও অ্যান্টিফোলাসপুত্র পলিফোনটেসকে। টাইডেউস তখন সেই বিপদসঙ্কুল অরণ্যপথে একাকী প্রত্যাবর্তন করছিলেন তাঁর স্বদেশে। তবু তাদের দেখে কিছুমাত্র ভীত বা বুদ্ধিভ্রংশ হলেন না টাইডেউস। বীরবিক্রমে তাদের সঙ্গে লড়াই করে একমাত্র মেওন ছাড়া তাদের সকলকেই নিহত করলেন। ইটোলিয়ার অধিপতী টাইডেউস ছিলেন এমনই এক কীর্তিমান পুরুষ। তাঁর পুত্র অসার আস্ফালনে, মিথ্যা বাগাড়ম্বরে ফেটে পড়তে পারে। কিন্তু সম্মুখ সমরে তাঁর পিতার মত বিক্রম প্রদর্শন করতে পারবে না।

লজ্জায় হতবাক হয়ে রইলেন ডায়োমেডিস। কিন্তু স্থেনেলাস অ্যাগামেমননের ভর্ৎসনা বাক্যের উত্তরে বলল, সত্যের অপলাপ করবেন না আত্রেউসপুত্র। আমরা সর্বসমক্ষে দাবি করছি আমরা কার্যক্ষেত্রে পিতৃপুরুষদের থেকে অধিকতর বিক্রম প্রদর্শন করেছি। তার একটি দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে পারি থবস নগরীর দুর্গপ্রকার দুর্ভেদ্য ও অনতিক্রম হলেও তার সাতটি সুরক্ষিত দ্বারপথ অতিক্রম করে সে নগরী অধিকার করি এবং থীবসরা তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। সুতরাং আমাদের পিতৃপুরুষদের সর্বক্ষেত্রে আমাদের সমতুল ভাববেন না।

কিন্তু স্থেনেলাসের মুখপানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডায়োমিডস বলল, তুমি চুপ করো বন্ধু। কোন অন্যায় কথা বলেন নি রাজা অ্যাগামেমনন। গ্রীকদের তিনি এ যুদ্ধে উৎসাহিত অবশ্যই করবেন, কারণ আমরা ট্রয়নগরী অধিকার করলে তিনি বিজয়গৌরব লাভ করবেন এবং আমরা পরাজিত হলে লজ্জাহত চিত্তে ম্রিয়মান হয়ে উঠবেন। সুতরাং চল আমরা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাই।

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রথ হতে অবতরণ করল ডায়োমডিস। তার ধাতুনির্মিত বর্ম ও অস্ত্রের ঝনঝন শব্দে সহসা বিদীর্ণ হলো শান্ত ও নিস্তরঙ্গ বায়ুর স্তর।

সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাবায়ুতাড়িত বিশাল সমুদ্রতরঙ্গগুলো যেমন ফেনিল মুকুট পরে পাহাড়ের মত মাথা উঁচু করে বিভিন্ন দিক থেকে উপকূলভূমির দিকে ছুটে যায়, গ্রীকসৈন্যগণও তেমনি ইতস্তত ছোটাছুটি করতে লাগল রণক্ষেত্রে। সেনাপতিরা আপন আপন সেনাদলকে আদেশদান করলেন আর সৈন্যরা নীরবে সে আদেশ মেনে চলতে লাগল। গ্রীকসৈন্যদের মত ট্রয়সৈন্যরাও কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল না। দোহনকালে শাবকসহ চিৎকাররত মেষ-মাতাদের মত বিভিন্ন ভাষাভাষী ট্রয়সৈনরা শৃঙ্খলাহীনভাবে চিৎকার করছিল। গ্রীকসেনাদের অনুপ্রাণিত করেছিল এথেন আর ট্রয়সৈন্যরা অনুপ্রাণিত হচ্ছিল জিয়াসপুত্র ও কামদেবী অ্যাফ্রোদিতের প্রণয়ী অ্যারেসের দ্বারা।

আক্রমণাত্মক যুদ্ধের দেবতা অ্যারেসের পদতল পৃথিবীর মাটিতে স্থিত এবং সে আকারে ক্ষুদ্র হলেও বিশৃঙ্খলাজনিত চিৎকারের প্রতিমূর্তি তার মাথাটা ছিল আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। বিবাদ বিশৃঙ্খলা আর শঙ্কা ছিল তার প্রিয় সহচর। সে যেখানেই যেত মানুষের মধ্যে বাধিয়ে তুলত ঝগড়া আর বিবাদ। মানুষের দুঃখ কষ্টের সীমা থাকত না।

উভয় পক্ষ সমবেত হলে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। উভয় পক্ষের মধ্যে অবিরাম গতিতে চলতে লাগল ঘাত-প্রতিঘাত। ঢালের সঙ্গে ঢাল, বর্শার সঙ্গে বর্শার ঠোকাঠুকি হতে লাগল। আহত ও নিহতদের রক্তে পৃথিবীর মাটি হয়ে উঠল লাল। মৃত্যুযন্ত্রণার মর্মস্পর্শী চিৎকারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল চারদিকের বাতাস। বৃষ্টিপুষ্ট জলস্রোত যেমন বেগে নিম্ন দিকে ধাবিত হয়ে নদী খাল প্লাবিত করে বিরাট বন্যার তাণ্ডবে পরিণত হয় এবং দূর হতে তার গর্জন শুনে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে মাঠের রাখালেরা, তেমনি গ্রীকসেনাদের সমরায়োজনের ঘোর রব শুনে ভীত হয়ে উঠল ট্রয়সেনারা।

প্রথমে অ্যান্টিওকাস সম্মুখ সারিতে যুদ্ধ করতে থাকা থ্যালাইসিয়াসপুত্র অ্যাকিপোলাস নামে এক ট্রয়বীরকে হত্যা করল। সে তার শিরস্ত্রাণ এড়িয়ে জমধ্যে তার বর্শার ফলাটি আমূল বসিয়ে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎ হয়ে পড়ে গেল অ্যাকিপোলাসের দেহটা। তখন রাজা এলিফিনর অ্যাকিপোলাসের আহত দেহটা সরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে অ্যাজিনর নামে এক গ্রীকবীর তার অরক্ষিত দেহটাকে আঘাত করল এবং সেই আঘাতেই তার মৃত্যু ঘটল। এইভাবে আহত অ্যাকিপোলাসের সংজ্ঞাহীন দেহটাকে কেন্দ্র করে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল গ্রীক ও ট্রয়সেনাদের মধ্যে যুদ্ধ এবং একে অন্যকে হিংস্র নেকড়ের মত আক্রমণ করতে লাগল।

অতঃপর সুদর্শন যুবক সাইময়সিয়াসকে হত্যা করলেন বীর অ্যাজাক্স। তার মা আইডা পর্বত থেকে আসার পথে সাইময় নদীর ধারে তাকে প্রসব করে বলে তার নাম হয় সাইময়সিয়াস। কিন্তু মায়ের সে ঋণ আর পরিশোধ করতে পারল না সাইময়সিয়াস, কারণ অকালে প্রাণবিয়োগ হলো তার। বীর অ্যাজাক্সের একটি সুতীক্ষ । বর্শা তার স্কন্ধদেশ বিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল পপলার গাছের মত ভূতলে পতিত হলো সাইময়সিয়াস। রথ নির্মাতা যেমন কোন গাছকে ভূপাতিত করে তা দিয়ে রথের চাকা তৈরির জন্য কুঠার দিয়ে কাটতে থাকে তেমনি করে সাইময়সিয়াসকে ভূপাতিত করে তাকে আঘাত করতে লাগল অ্যাজাক্স। অতঃপর প্রিয়ামপুত্র অ্যান্টিফাস অ্যাজাক্সকে লক্ষ্য করে একটি বর্শা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু সে বর্শা হলো লক্ষ্যভ্রষ্ট। কিন্তু ওডিসিয়াসের জনৈক বীর সহকর্মী মিউকাস যখন সাইময়সিয়াসের আহত দেহটি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন অ্যান্টিফাস নিক্ষিপ্ত সেই বর্শাটি আঘাত করল মিউকাসকে। মিউকাসকে নিহত দেখে প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়লেন ওডিসিয়াস। বীর বিক্রয়ে এগিয়ে গিয়ে হাতের বর্শাটি ট্রয়সৈন্যদের লক্ষ্য করে সজোরে নিক্ষেপ করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে তা প্রিয়ামের অবৈধ পুত্র ডেমকুনকে আঘাত করল। অ্যামাইডাস নামক এক জায়গায় প্রিয়মের আস্তাবলে ঘোড়াদের দেখাশোনা করতে ডেমকুন। সহকর্মীর মৃত্যুতে ভয়ঙ্করভাবে ক্রোধাবিষ্ট ওডিসিয়াসের দ্বারা নিক্ষিপ্ত বর্শাফলাটি এমন জোরে ডেমকুনের ললাটদেশকে বিদ্ধ করল যে চক্ষুসমেত তার মস্তক বিদীর্ণ হয়ে গেল। মুহূর্তে সব অন্ধকার হয়ে গেল ডেমকুনের। দুঃসহ যন্ত্রণাসহ ঢলে পড়ে গেল ডেমকুন। ফলে সম্মুখ সারিতে কর্তব্যনিরত ট্রয়সৈন্যরা বিব্রত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ল সহসা এবং সেই সুযোগে সপক্ষীয় মৃত ও আহতদের সরিয়ে নিয়ে যাবার অজুহাতে বেশকিছুটা এগিয়ে গেল গ্রীকসৈন্যগণ। এই ঘটনায় অসন্তুষ্ট ও বিশেষভাবে ক্রোধাবিষ্ট হয়ে অ্যাপোলো ট্রয়সৈন্যদের সম্বোধন করে পার্গামুস থেকে বললেন, হে ট্রয়বাসীগণ, শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়, তাদের দ্বারা কখনই এভাবে নির্জিতভাব হতে দিও না নিজেদের। গ্রীকদের গাত্রগর্ম লৌহ বা প্রস্তরবৎ দুর্ভেদ্য নয় যে তোমরা অস্ত্র দ্বারা তা ভেদ করতে পারবে না। তাছাড়া থেটিসপুত্র বীর অ্যাকেলিস যুদ্ধ হতে বিরত হওয়ায় রণতরী মধ্যে তাঁর নিষ্ফল ক্রোধকে লালন করে চলেছেন নীরবে।

এইভাবে অ্যাপোলো যখন দৈববাণীর দ্বারা ট্রয়বাসীদের উত্তেজিত করে চলেছিলেন, জিয়াসকন্যা এথেন তখন প্রতিটি গ্রীকসৈন্যকে অগ্রসর হবার জন্য অনুপ্রাণিত করতে লাগলেন।

এরপর ভাগ্যদেবী অপ্রসন্ন হলেন এ্যামরাইসিউসপুত্র ডাওরেসের উপর। সহসা ঈনাস থেকে আগত গ্রসীয়সর্দার ইমব্রেসাসপুত্র পীরুষ দ্বারা নির্মিত একটি প্রস্তরখণ্ডে ডান পাটা ভেঙে গেল তার। পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় চিৎ হয়ে পড়ে গিয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর হয়ে দু হাত বাড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল সে। কিন্তু তাকে সাহায্য করার জন্য তার কোন সহকর্মী এগিয়ে আসার আগেই পীরুষ তার বর্শাটা তার পেটে আমূল বসিয়ে দিল এবং তার ফলে সব নাড়িভূঁড়ি বেরিয়ে গেল পেট থেকে। মৃত্যু ঘনিয়ে এল তার চোখে। কিন্তু পীরুষ যখন শেষ আঘাত হানার পর চলে যাচ্ছিল তার কাছে থেকে তখন থোয়াস তার বর্শা দিয়ে পীরুষের বক্ষস্থল ভেদ করল। তারপর সেই বর্শাটা উঠিয়ে তরবারি দিয়ে তার পেটটাকে বিদ্ধ করে হত্যা করল তাকে। যে ফ্রেসীয় যোদ্ধাগণ মাথায় চূড়ার আকারে চুল বাঁধে তারা সবাই তাদের মৃতদেহগুলোকে ঘিরে দাঁড়াল।

ক্রমে সেই রণক্ষেত্রের অবস্থা হয়ে উঠল ভয়াবহ। উভয়পক্ষ হতে অবিরাম এমনভাবে বর্শা ও তীরবৃষ্টি হতে লাগল যে একমাত্র দেবী এথেনের সাহায্য ছাড়া সে রণক্ষেত্রে প্রবেশ করার সাধ্য ছিল না কারো পক্ষে। বহু ট্রয় ও গ্রীকসৈন্যর মৃতদেহ অধোমুখে শায়িত ছিল সারা রণক্ষেত্রে ব্যাপ্ত করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *