৩. রান্নাঘরের টেবিল

অধ্যায় ১১

২৯ শে জুন
সূর্যোদয়-৩:২০
ইয়োকু নদীর তীর

রান্নাঘরের টেবিলটাতেই ঘুম ভাঙল আমার। উঠে দেখি আশেপাশে ল্যাসি আর ওপিক নেই। ম্যাপটা আগের জায়গাতেই আছে।

ম্যাপের ওপর ঝুঁকে আবার দূরত্বটা পরিমাপ করলাম, আশা করছিলাম, এবার হয়ত কমে আসবে ওটা। এক ইঞ্চি মানে হয়ত দু-মাইল হবে, বিশ মাইল না। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। ম্যাপ অনুযায়ি নদীপথে ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে ছয় ইঞ্চির দূরত্বে আমরা। তারমানে পাক্কা একশ বিশ মাইল। মাঝখানে অনেক পাহাড়, যেগুলোকে ঘিরে এঁকেবেঁকে চলেছে নদীগুলো। ফিরতি পথে যেকোন সময় হারিয়ে যেতে পারি আমরা। যার কারণে কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত দেরি হয়ে যেতে পারে।

আমাদের নদীপথ ধরে এগোতে হবে। যার মানে :

১. ইয়োকু নদীর উত্তর তীর থেকে দক্ষিণ তীরে যাওয়া।

২. এরপরে উল্টোদিকে পনের মাইল উজানে যেতে হবে, যেখানে তানানা আর ইয়াকু মিলেছে।

৩. তানানা নদী ধরে নব্বই মাইল দক্ষিণপূর্ব দিকে সেইনা নদী বরাবর যাত্রা।

৪. সেইনা নদী ধরে উত্তর-পূর্বে আরো পনের মাইল গেলে পড়বে ফেয়ারব্যাঙ্কস।

আজকে রওনা দিলেও একমাস লাগবে। জুলাইয়ের শেষদিকে পৌঁছুতে পারলেও নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব।

একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে গেল মুখ থেকে অজান্তেই। এতটা পরাজিত মনে হয়নি কখনো নিজেকে। এখন ইনগ্রিডের সাহচর্য খুব দরকার আমার। ওকে বুকে চেপে ধরে এই ট মিনিট যদি কাটাতে পারতাম!

ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা চার বাজে।

টেবিলটার ওপরে উঠে ফের শুয়ে পড়লাম চোখ বুজে। প্রার্থনা করতে লাগলাম যাতে খুব তাড়াতাড়ি চারটা বেজে যায়।

.

বাজল না।

আমার ঘাড়ে কে যেন হাত দিয়ে ধাক্কাচ্ছে।

চোখ খুললাম আমি। ওপিক আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিল। ওর হাতে বাদাম বা বেরি জাতীয় কিছু একটা, যেটা এখন পর্যন্ত দেখিনি আমি। ওটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলে মাথা নেড়ে না করে দিলাম। খেতে ইচ্ছে করছে না।

খাবারটা আমার পাশে রেখে টেবিলের ওপর উঠে গেল ও। এরপর দুই হাত দিয়ে আমাকে ঠেলতে লাগল।

“থামো।”

আমার নিচ থেকে ম্যাপটা নিয়ে নেমে গেল ও।

এক মিনিট পর।

“অন-রে! অন-রে!”

চোখ খুললাম আমি।

হাত দিয়ে ম্যাপে টোকা দিল ও।

উঠে বসলাম। “কি?”

হাত নেড়ে আমাকে টেবিল থেকে নেমে আসার জন্যে ইশারা করল।

আমি নেমে আসার পর ম্যাপটা আরো ঠিকমত বিছালো ও। এরপর একটা কাঠের চেয়ারে উঠে হাটুতে ভর দিয়ে বসল। যে কালো বিন্দু কেবিনটাকে নির্দেশ করছে ওটার দিকে দেখাল প্রথমে। এরপর ইয়োক নদীর ওপর দিয়ে আট ইঞ্চি দূরে আরেকটা কালো বিন্দুর দিকে দেখাতে লাগল।

আমি মাথা ঝাঁকালাম।

নদীর ওপর জায়গাটা দেখিয়ে এস্কিমোতে কিছু বলা শুরু করল।

“কি বলছ বাবু? বুঝতে পারছি না তো।”

জবাবে মাথা নাড়তে লাগল। এরপরে হঠাৎ ভ্রু দুটো উপরে উঠে গেল। নিজের পরনের শার্টের ওপর নির্দেশ করে ইন্ডিয়ান শব্দটা দেখাতে লাগল।

“এখানে ইন্ডিয়ানরা থাকে?”

মাথা নাড়ল ও। ইন্ডিয়ান শব্দটা বুঝতে পেরেছে।

কিছুক্ষণের জন্যে আশার আলো দেখতে পেলাম, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল আট ইঞ্চি মানে তো আগের চেয়েও বেশি দূরে।

“বেশি দূর,” এই বলে আঙুল দিয়ে আগের রাস্তাটা দেখালাম ওকে, “এদিক দিয়ে গেল ভালো হবে।”

জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো ও। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমার দেখানো রাস্তাটার ওপর দিয়ে আস্তে আস্তে হাত বোলাল একবার। এরপরে ইয়োকু নদীর ওপরে ওর রাস্তাটা দিয়ে হাত বোলাল। এবার অনেক তাড়াতাড়ি।

আরো এক মিনিট কিছুই বুঝলাম না আমি।

যতক্ষণ না পর্যন্ত ও আমার হাত ধরে কেবিন থেকে বের হয়ে নদীর তীরে নিয়ে গেল।

ল্যাসিকে দেখলাম ওখানে।

একটা নৌকার ওপর বসে আছে।

.

মিয়াও।

“পাহারা দিচ্ছিস নৌকাটা?”

মিয়াও।

নৌকাটার দিকে দেখিয়ে বললাম, “এটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কয়েক বছর ধরে এখানে পড়ে আছে। তোর কি মনে হয় এখন কেউ চুরি করতে আসবে এটাকে? ওপিক আমাকে ডাকতে যাওয়ার মাঝখানে?”

মিয়াও।

“ভাল্লুক? চাপা মারিস না!”

মিয়াও।

“তুই মোটেও দুইবার ভাগিয়ে দিসনি ওটাকে।”

আমার কব্জিতে কে যেন টোকা মারল।

ওপিক। আমার ঘড়িতে টোকা দিচ্ছে।

এখন তিনটা আঠার বাজছে।

ও জানে, আমার হাতে সময় বেশি নেই। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরিয়ে পড়তে চায়।

মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

ওপিকের উপস্থিতি সবকিছু বদলে দিয়েছে। নৌকা চালানোর ব্যাপারে যদি ওর খাবার সংগ্রহ আর মাছ ধরার মত জ্ঞান থেকে থাকে তাহলে ওর ওপর ভরসা করা যায় নির্দ্বিধায়। হালে ওকে বসিয়ে রেখে দু-দিনে ঐ ইন্ডিয়ান গ্রামটায় পৌঁছে যাব আমরা। পত্রিকার শিরোনামটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি : সাইত্রিশ বছরের এক লোক আর তার বেড়ালকে উদ্ধার করল পাঁচ বছরের এক এস্কিমো বালক।

ওপিক আর আমি কেবিনে দৌড়ে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সব কিছু নিয়ে ফেরত আসলাম।

আমরা যখন সবকিছু নৌকায় সাজিয়ে রাখছি তখন আকাশে গোলাপি আভা দেখা দিয়েছে। একে একে ম্যাপ, মধুর বোতল, লণ্ঠন, জ্যাকেটটা তুলে ফেললাম। এরপরে নৌকাটা পরীক্ষা করে দেখতে লাগলাম। সবকিছু ঠিকঠাকই মনে হল। উপরি পাওনা হিসেবে একটা বৈঠা দেখতে পেলাম পাটাতনে ওপর।

আমি আর ওপিক দু-জনেই নৌকার একপাশে গিয়ে ওটার গায়ে হাত রেখে দাঁড়ালাম। ধাক্কা মারতে হবে।

“এক…দুই-”

এমন সময় বিকট একটা গর্জন শুনে আমরা দুজনই চমকে ফিরে তাকালাম। ঠিক যেমনটা ছবিতে দেখেছিলাম। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ হা করা। তীক্ষ্ণ নখযুক্ত থাবা দিয়ে বাতাসে খামচাচ্ছে।

মিয়াও।

হ্যাঁ, আগেই বলেছিলি।

“কি করব আমরা এখন?” কাতর স্বরে জিজ্ঞেস করলাম।

ওপিক একটা পাথর নিয়ে বাদামি গ্রিজলি ভাল্লুকটার দিকে ছুঁড়ে মারল। এতে মনে হয় আরো বেশি রেগে গেল ওটা। বাতাসে আগের চেয়ে জোরে জোরে খামচাতে লাগল। থাবার আঘাতে একটা গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল।

পানি থেকে আমাদের দূরত্ব মাপলাম। কমসেকম পাঁচবার ধাক্কা দিতে হবে। নদীতে নৌকাটা পড়লেই চলতে শুরু করবে স্রোতের টানে। কিন্তু তখন ওটার ভেতরে তখন তিনজনকেই থাকতে হবে আমাদের।

ভাল্লুকটা পনের ফিট দূরে। যদি আসলেই নৌকাটা চায় ও, তাহলে ঠেলতে দেখলে সাথে সাথে তেড়ে আসবে।

বাবার বলা একটা কৌতুকের কথা মনে পড়ে গেল এসময়।

দুই বন্ধু বনের ভেতরে ঘুরছিলো। এমন সময় একটা ভালুক তাড়া করা হশুরু করে ওদের। প্রথম বন্ধু প্রাণপণে দৌড়ানো শুরু করাতে অন্য বন্ধুটা বলে, “একটা ভালুকের সাথে পাল্লা দিতে পারবি না তুই।” উত্তরে অন্যজন বলে, “ভালুকের সাথে কে পাল্লা দেয়, আমি তোর আগে থাকতে পারলেই হল।”

“উঠে পড়,” আমি ওপিককে বললাম।

কথা শুনল ও।

নৌকার অন্য পাশে চলে গেলাম, আমার ইচ্ছে বৈঠাটা দিয়ে একটা বাড়ি মেরে ভয় দেখাব ওটাকে। কিন্তু তার চেয়েও একটা ভালো বুদ্ধি মাথায় আসল এ সময়। নৌকার ভেতর ওটার খোঁজে হাতড়াতে লাগলাম। এরপর ওটা নিয়ে আবার ফিরে এলাম আগের জায়গায়।

ল্যাসি গুঙিয়ে উঠল। প্রথমে ভাবলাম হয়ত আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে ওরকম করছে। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম, ওর যাবতিয় চিন্তা আমার হাতের মধুর বোতলটাকে নিয়ে।

যতটা সম্ভব মধু বের করে বোতলটার আশেপাশে মাখলাম। এরপর ওটা ছুঁড়ে মারলাম ভালুকটার উদ্দেশ্যে।

বোতলটা ধরতে পারল নাকি সেটা দেখার পেছনে সময় নষ্ট করলাম না। পেছনে ঘুরে সর্বশক্তি দিয়ে নৌকাটা ঠেলতে লাগলাম। এক চুলও নড়ল না।

ঘুরে তাকালাম। ভালুকটা মধুর বোতলের ওপর ঝুঁকে আছে, বিশ ফিট দূরে। আবার ধাক্কা দিলাম। এবার দুই ইঞ্চি নড়ল বলে মনে হল। ওপিকের হাবভাব দেখে মনে হল নেমে সাহায্য করতে চাচ্ছে।

হাত দিয়ে থামার নির্দেশ দিলাম, “ভেতরেই থাক।”

পেছনে তাকালাম আবার।

ভালুকটা দুই পায়ে খাড়া হয়েই তাড়া করা শুরু করল।

চিৎকার করে উঠলাম।

ধাক্কা দিতে লাগলাম প্রাণপণে। এবার নৌকাটা সামনে এগোতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বালুর ওপর দিয়ে মসৃণ ভঙ্গিতে গড়াতে লাগল। শেষ পাঁচ ফিট যাওয়ার সময় পেছনে গাছের ডাল ভাঙার আওয়াজ কানে আসলো। এরপর লাফ দিয়ে নৌকায় উঠে গেলাম।

.

ল্যাসি আমার হাত চেটে স্বান্ত্বনা দিচ্ছে।

“ধন্যবাদ।”

জবাবে ও আমার চেহারার দিকে তাকালে আবারো বুঝতে পারলাম, আমার ভালো থাকা না থাকা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় সে। বরং আমার হাতে লেগে থাকা মধুর দিকেই যাবতিয় মনোযোগ।

হারামি কোথাকার।

ওপিক নৌকার পেছন দিকে দাঁড়িয়ে আছে। “অন-রে,” আমাকে ওর দিকে যাওয়ার ইশারা করে বলল। জিনিসপত্র সরিয়ে ওর কাছে পৌঁছুলাম। নৌকার একটা অংশ দেখাল ও যেখানে অনেকটা চলটে উঠে গেছে।

“আকলার্ক,” বলল ও।

কিছুটা সময় লাগল বুঝতে। নৌকার গায়ে সমন্তরাল চারটা দাগ।

ওপিক ওর আঙুলগুলো গুটিয়ে থাবা দেয়ার ভঙ্গি করতে লাগল।

আকলার্ক।

মানে ভালুক।

ভাল্লুকটা নিশ্চয়ই শেষ মুহূর্তে আমার উদ্দেশ্যে থাবা চালিয়েছিল। কিন্তু একটুর জন্যে ফসকে গেছি।

বুকটা ধকধক করতে লাগল।

আরেকটু হলে গেছিলাম আজকে। আর প্রথম যে চিন্তাটা মাথায় আসল : এই কাহিনী ইনগ্রিডকে বলতেই হবে।

.

তিনটা তেপ্পান্নর সময় খাবারগুলো ভাগ করে খেলাম।

তিনটা পঞ্চান্নর সময় পশমি কোটটা মাথার নিচে রেখে শুয়ে পড়লাম।

তিনটা ছাপ্পান্নয় আমার বুকের ওপর উঠে আসল ল্যাসি।

তিনটা সাতান্নয় নৌকাটা ডোবা শুরু করল।

“এত পানি কোথা থেকে আসছে?”

প্রথমে আস্তে আস্তে পানি উঠছিল, এখন অনেক জোরে উঠছে। ওপিক আর আমি ফুটোর খোঁজে নৌকার মেঝে পরীক্ষা করতে লাগলাম।

মিয়াও।

“নাহ, পানিতে লাফ মারব না আমরা,” আমি বললাম। “ফুটোটা খুঁজে বের করে বন্ধ করতে হবে।”

তিরিশ সেকেন্ড পরে একটা ছোট গর্ত খুঁজে পেলাম দুটো কাঠের বোর্ডের মাঝে। “এখানে!” এক পা দিয়ে ফুটোটা জোরে ঢাকতে ঢাকতে বললাম। জোরে একটা আওয়াজ হয়ে আমার পা নৌকার তলা ভেদ করে চলে গেল। একটা বিরাট গর্ত সৃষ্টি হল ঐ জায়গায়।

পানি আগের চেয়ে আরো বেশি বেগে ঢুকতে লাগল ভেতরে। পাটা গর্ত থেকে তুলে বৈঠা নিয়ে নিলাম ওপিকের কাছ থেকে। নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিলাম তীরের দিকে। আমরা তীর থেকে পঞ্চাশ ফিট দূরে আছি এখন। আর আমার হাতে এক মিনিটেরও কম সময় আছে। এরপর কাটা কলাগাছের মত পড়ে যাব।

বৈঠা জোরে জোরে চালাতে লাগলাম। “ল্যাসিকে ধর,” ওপিকের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললাম।

বিভ্রান্তের মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকল ছেলেটা।

“পুসি!”

এবার ল্যাসিকে তুলে নিল ওপিক।

আর অল্প দূরত্ব বাকি আছে। নদীর স্রোত আমাদের সাহায্য করছে কিন্তু আর তিনবার বৈঠা মারার পরেই নৌকার সামনের দিকের নাকটা ডুবে যেতে লাগল।

“যাও!”

অর্ধেক ডুবে গেছে নৌকা। যেকোন সময় পুরোটা ডুবে যাবে।

ওপিক ল্যাসিকে নিয়ে তীরের ঝোপঝাড়ের ওপর লাফিয়ে নেমে গেল। আমি ওর হাতে বৈঠা আর পশমি কোটটা তুলে দিলাম। আরেকবার পকেটে হাত দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম, ম্যাপটা নিরাপদ আছে। এরপর লম্বা ঘাসের উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দিলাম।

পেছনে তাকিয়ে দেখলাম নৌকার শেষ ইঞ্চিটাও ডুবে গেল পানিতে।

*

অধ্যায় ১২

সূর্যোদয়-৩:২৩

কারো ফোঁপানোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।

চোখ খুলে আশেপাশে নজর বোলাতে লাগলাম। বিশ ফিট দূরে একটা গাছের পাশে ল্যাসি আর ওপিক বসে আছে।

এরকম আওয়াজ আগেও শুনেছি। ল্যাসি দুঃস্বপ্ন দেখার সময় এরকম শব্দ করে সাধারণত। প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার বুকের ওপর থেকে এরকম আওয়াজ আসছে। ল্যাসি চোখ বন্ধ করে ফোঁপাচ্ছে।

ওদের দুজনের কাছে গিয়ে বসে পড়লাম। কিন্তু ল্যাসিকে দেখলাম আরামসে ঘুমাচ্ছে।

ওপিক হাটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। থেকে থেকে পুরো শরীর কেঁপে উঠছে।

আমি একটা গর্দভ। একবারও মাথায় এটা এলো না যে, ফোঁপানোর আওয়াজটা ওপিকও করতে পারে। আসলে এতদিনে সব প্রতিকূলতার মাঝেও ওর অমন সাহস দেখে ধরে নিয়েছিলাম কোন কিছুতেই বিচলিত হয়

ছেলেটা। এটা আমার মাথাতেই আসেনি, ওপিকও ওর মা-বাবা আর ভাইবোনদের শূন্যতা অনুভব করতে পারে।

আস্তে করে একটা হাত ওর কাঁধে রাখলাম।

“কি হয়েছে বাবু?”

জবাবে নাক টানার আওয়াজ ভেসে আসল কেবল।

“আমার দিকে তাকাও তো একটু,” ওর মাথাটা তোলার চেষ্টা করে বললাম।

কিন্তু ও আগের অবস্থাতেই রইল।

“সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমরা ফিরে যেতে পারব এক সময়।”

আমি জানি ও আমার একটা কথাও বুঝবে না। আর বুঝতে পারলেও কতটা বিশ্বাস করত তাতে আমার কথা সন্দেহ আছে। কিভাবে বিশ্বাস করবে একজন মানুষের কথা যে কিনা দিনে মাত্র ষাট মিনিট সময় দেয় ওকে আর ওর কষ্ট করে জোগাড় করা খাবার দিয়েই গত এক সপ্তাহ পার করেছে। তবুও বলতেই হত কথাগুলো, কারণ কেন জানি না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে আমার।

হাত দিয়ে ওর মাথাটা তুললাম।

বাধা দিল আমাকে, ঘাড়ের পেশি শক্ত হয়ে আছে বেচারার।

ওর কান্নারত চেহারা আমাকে দেখাতে চায় না। এস্কিমো সংস্কৃতি সম্পর্কে খুব একটা জানা নেই আমার, কিন্তু এটা নিশ্চিত, পৌরুষত্বকে অনেক বড় করে দেখা হয় সেখানে। এরকম দুর্গম পরিবেশে দিনাতিপাত করা একটা জাতির জন্যে সেটাই স্বাভাবিক।

বেশ খানিকক্ষণ ওর পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলাম। কয়েক মিনিট পর মাথা তুলল ও। চোখের চারপাশ ফুলে আছে। সুন্দর বাদামি চোখজোড়া রূপালি বর্ণের দেখাচ্ছে এই আলোছায়ার খেলায়।

“কান্নার মধ্যে কাপুরুষতার কিছু নেই,” ওকে বললাম। “আমি তো সবসময়ই কাঁদি।”

আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকল ও।

দু-হাত চোখের কাছে নিয়ে নাক টেনে টেনে কান্নার অভিনয় করে দেখালাম।

ছোট্ট একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল ছেলেটার মুখে।

ল্যাসি জেগে উঠে ওপিকের কোলে চড়ে বসল। গাল থেকে চোখের পানিগুলো চেটে চেটে পরিস্কার করে দিতে লাগল।

কিছুক্ষণ পরে একটু স্বাভাবিক হল ওপিক। যদিও চোখের দিকে তাকালে অসহায় একটা ভাব নজরে পড়বে। ল্যাসির চোখেও একই প্রতিফলন দেখলাম। যেন আমাদের সব আশা ভরসা নৌকাটার সাথে ডুবে গেছে। আমারটুকু ডুবে গেছে এটা জানি।

কিন্তু একটা কথা মনে পড়ল এ সময়।

ক্যানোটার কথা তো ভুলেই গেছিলাম!

.

ইনগ্রিড আর আমি একবার পিকশনারি খেলেছিলাম। এই খেলায় আপনাকে একটা সূত্র দেয়া হলে ওটা একে অন্যজনকে বোঝাতে হবে। কিন্তু আমার আঁকার হাত একেবারেই জঘন্য, কারণ কোন স্কুলের আর্ট ক্লাসে যাওয়া হয়নি আমার। একটা জিনিসই ঠিকমত আঁকতে পেরেছিলাম, স্টক মার্কেটের গ্রাফের ছবি।

তাই একবার যখন আমার চিরকুটটায় লেখা দেখলাম ‘হাঁচি’ তখন কল্পনাও করতে পারছিলাম না, কী করব, কীভাবে আঁকব। রাগের মাথায় ইনগ্রিড ওর সব কাপড়…থাক সে অন্য কথা।

তো, এবার যখন বালিতে একটা ক্যানো আঁকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম, অন্তত হাঁচি থেকে সোজা হবে এটা আঁকা। কিন্তু অবস্থা বিশেষ সুবিধার মনে হচ্ছে না।

ওপিক বেশ খানিকক্ষণ আমার আঁকা ক্যানোটার দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। বুঝতে পারছে না।

“এটা একটা ক্যানো,” পঞ্চমবারের মত ওকে বললাম, “ক্যা-নো।”

মিয়াও।

“না, এটা কলা না।”

হাত দিয়ে মুছে আবার শুরু থেকে আঁকলাম।

আমার মাথায় পরিস্কার ক্যানোটা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আঁকতে গেলেই সমস্যা হয়ে যাচ্ছে।

মিয়াও।

“মারডকেরটার মতন মানে?”

মিয়াও।

“বদ কোথাকার!”

ওপিক আমার হাত থেকে লাঠিটা নিয়ে নিল। আমি দেখতে লাগলাম ও দক্ষ হাতে একটা ক্যানোর ছবি আঁকল বালুতে। বৈঠা হাতে দু-জন আরোহিসহ।

“ক্যা-নেউ,” ও বলল।

আমি মাথা নেড়ে সায় জানালাম।

.

আমরা যখন পঁচিশ মাইল দূরে ক্যানোটার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম তখনও আবছা অন্ধকার চারপাশে। বিশ মিনিট পরে ফের বালুতটের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম আমরা। বাকিটা সময় প্রায় দৌড়ে এগোলাম, এরপর ক্যাম্প করার জন্যে থামলাম। যে পাউডারগুলো মশাদের দূরে রাখে ওগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় মশারা ইচ্ছেমত কামড় বসাতে লাগল আমাকে।

কিছুক্ষণ পর মশাদের ভিড় একটু কমলে ওপিকের কাছে অনুনয় করতে লাগলাম আবার ঐ পাউডারের ব্যবস্থা করার জন্যে।

কিন্তু মাথা নেড়ে না করে দিল ও।

একবারের বেশি ওটা লাগাবে না, কোন ধরণের কুসংস্কার হবে হয়ত। জানতেও পারলাম না কোন গাছের পাউডার।

ঘুমিয়ে পড়ার কিছুক্ষণ আগে ওপিককে মাছ ধরতে দেখার সৌভাগ্য হল আমার। প্রথমে লাঠি দিয়ে কয়েক জায়গায় ছোঁয়া দিল, এরপর গায়ের জোরে বাড়ি বসাল। আমার ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত অবশ্য কোন মাছ ধরা পড়ল না। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখব, আমার জন্যে দুটো মাছ ঠিকই অপেক্ষা করছে।

আমার ধারণা ঠিক প্রমাণিত হল।

আমার হাতের ওপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা। আর এক হাত দিয়ে ল্যাসির লেজ ধরে রেখেছে। উঠে বসতে চাইলাম, কিন্তু ওকে তখনই জাগাতে ইচ্ছে করল না। চুপচাপ দেখতে লাগলাম ওর ছোট বুকটা ঘুমের তালে ওঠা নাম করছে। আরো পাঁচ মিনিট পরে দু’জনকে ডেকে তুললাম ঘুম থেকে।

আমার হিসেব অনুযায়ি ইয়াকু আর তানানা নদীর মিলনস্থলে পৌঁছুতে আর দশ মাইল পাড়ি দিতে হবে আমাদের। এরপর ওখান থেকে ক্যানোর কাছে পৌঁছুতে আরো আট নয় মাইল।

খেতে খেতেই দৌড়োতে লাগলাম আমরা।

এর পরের দিনটাও একই রকম গেল। একটাই পার্থক্য-আগের দিনের চেয়ে তিন মিনিট কম সূর্যালোক।

তৃতীয় দিনে বৃষ্টি পড়তে লাগল।

ল্যাসির ভাষ্যমতে আমি ঘুমিয়ে পড়ার বারো ঘন্টার পর থেকে ঝড় শুরু হয়। এর এক ঘন্টা পর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে থাকে।

ভাগ্যিস বালুতটে উঁচু জায়গায় ঘুমিয়েছিলাম আমি। না-হলে নদীর বাড়তি পানি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারত আমাকে। পানির উচ্চতা আগের দিনের চেয়ে তিন ফিট বেড়ে গেছে দেখলাম, আর আগের দ্বিগুণ বেগে প্রবাহিত হচ্ছে স্রোত।

এই বৃষ্টির থেকে মাথা বাঁচানোর মত কোন আশ্রয়ই নেই আশেপাশে। মাছ ধরা আর ফল সংগ্রহ করাও অসম্ভব। পুরো দিন না খেয়ে থাকতে হল।

.

৩ জুলাই
সূর্যোদয় ৩:৩২

ভারি বর্ষণের কারণে ঝোপঝাড়গুলোর অবস্থা একদম করুণ। ওপিক যে কয়টা ফল খুঁজে পেল সবগুলোই নষ্ট হয়ে গেছে, আর না-হলে চেনা যাচ্ছে না। নদীর পানি এত ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যে, মাছ ধরার সুযোগও পাচ্ছে না ছেলেটা।

আমিষের স্বল্পতার প্রভাব টের পাচ্ছি। বুকের প্রতিটা পাঁজর হাত দিয়ে গুণতে পারি আমি। ওগুলোর ওপর দিয়ে মসৃণভাবে আঙুল বোলানো যায় না, আটকে যায়। আমার ট্রাউজার ঢিলে হয়ে যাওয়াতে শক্ত করে বেধে রেখেছি। তা-ও মাঝে মাঝে কোমর থেকে নেমে যাওয়ার অবস্থার সৃষ্টি হয়। আলাস্কার বুনো অঞ্চলে এগার দিন কাটানোর পরে আমার ওজন প্রায় পনের পাউন্ড কমে গেছে।

গত দিন বৃষ্টির মাঝে হাঁটার মধ্যেই তানানা আর ইয়োকু নদীর মিলনস্থল পেছনে ফেলে এসেছি। এবার বুঝেছি গতবার কেন চোখে পড়েনি। ওখান দিয়ে ঘন হয়ে জন্মেছে ঘাস। ভালো মত না তাকালে বোঝাই যায় না অন্যপাশে কি আছে।

বৃষ্টি তুলনামূলক কম হওয়াতে ইয়োকু নদীর পানিও কমে গেছে। ফলে আবার বালুতটের ওপর দিয়ে দ্রুতবেগে হাঁটতে পারছি আমরা।

ল্যাসি আমার হাতে থাকে আর ওপিক পেছন পেছন পেছন দৌড়ায়। মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্যে ল্যাসিকে ওপিকের কোলেও দেই। সবসময় এই আশায় থাকি যে কখন ঐ তিনটা পাথর আর উল্টিয়ে রাখা ক্যানোটা চোখে পড়বে।

তিনটা চল্লিশের সময় পাহাড়ের ওপাশ থেকে সূর্য বেরিয়ে এল।

এক মাইল পর থামলাম আমি।

“ওখানে,” এই বলে হাতের বৈঠাটা দিয়ে বাঁকের অন্যপাশের তিনটা পাথরের দিকে দেখালাম।

কিন্তু কী যেন একটা অন্যরকম লাগছে।

ক্যানোটা।

চিহ্নও নেই ওটার।

.

“নদীতে ভেসে গেছে,” বলতে লাগলাম, “ভেসে গেছে।”

এখন পাথরগুলোর প্রায় পনের ফিট নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে নদী। কিন্তু ভারি বর্ষণের ফলে নিশ্চয়ই উচচতা বেড়ে গেছিল বহুগুণে। এটা আগেই মাথায় আসা উচিত ছিল আমার। কিন্তু আসেনি, অতিরিক্ত আশাবাদি আমি!

ওপিক একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। ওখানেই ক্যানোটা রেখেছিলাম আমি দু’সপ্তাহ আগে। বেচারার মাথায় কি ঘুরছে কে জানে? হয়ত আমার মাথায় যা ঘুরছে সেটাই, আবার আগের অবস্থাতেই ফেরত গেছি আমরা। নাকি একশ চল্লিশ মাইল দূরের ইন্ডিয়ান গ্রামটার কথা ভাবছে?

ম্যাপটা খুলে সামনে বিছালাম।

এর এক মিনিট পরে একটা কাঠি নিয়ে বালিতে লেখা শুরু করলাম।

.

হারিয়ে গেছি। আজ ৩ জুলাই। এখন নদীর পার ধরে ফেয়ারব্যাঙ্কসের দিকে রওনা হচ্ছি। হেনরি বিনস, ল্যাসি আর ওপিক।

লেখা শেষ করে বললাম, “চল, আবার শুরু করা যাক।”

*

অধ্যায় ১৩

৪ জুলাই
সূর্যোদয়-৩:৩৫

ঘুম থেকে উঠে শুনি ল্যাসি তারস্বরে চেঁচাচ্ছে আর ওপিকের মুখ আমার থেকে এক ইঞ্চি দূরে। এর আগের দিন বিশ মিনিটের মত দৌড়ানোর পর বালুতটে ঘুমোনোর জন্যে ভালো একটা জায়গা বের করে ক্যাম্প করি আমরা।

“কি হয়েছে?” লাফিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করলাম। “বয়া হরিণ? নাকি ভাল্লুক?”

মিয়াও।

“তোরা খুঁজে পেয়েছিস ওটাকে?”

মিয়াও।

“ক্যানোটার সন্ধান পেয়েছিস তোরা?” ল্যাসির উদ্দেশ্যে এটা বলে ওপিককে কোলে তুলে নাচতে লাগলাম। গতদিন একারণেই ইয়োকু নদী ধরে এদিকটায় রওনা হয়েছিলাম। স্রোতের টানে নৌকাটা ভেসে এদিকে আসার সম্ভাবনাই বেশি। কিনারার ভাসমান গাছের গুঁড়িগুলোর সাথে আটকে থাকতে পারে ওটা।

অন্তত একবারের জন্যে হলেও তো ভাগ্য আমাদের সহায় হল!

দ্রুত ক্যাম্প গুটিয়ে ইয়োকু নদী ধরে দৌড়াতে লাগলাম আমরা। এখনও অন্ধকার পুরোপুরি কাটেনি চারপাশে। সূর্য উঠতে আরো প্রায় তিরিশ মিনিট। তবে এই হালকা আলোতেও নদীর অপর তীরে ক্যানোটা দৃষ্টি এড়াল না।

বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ না করে কাপড়চোপড় খুলে, শুধুমাত্র আন্ডারওয়্যারটা পরে পানিতে ঝাঁপ দিলাম, হাতে বৈঠাটা। পানি একদম ঠান্ডা। হাড্ডি পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে অপর পাড়ে পৌঁছানোর জন্যে সাঁতার কাটতে লাগলাম।

প্রায় আধমাইল সাঁতরে অন্যপাশে পৌঁছে ক্যানোটা যেখানে আটকে আছে সেখানে দৌড়ে গেলাম। পাঁচ মিনিট লাগল ঝোপঝাড় থেকে ওটাকে মুক্ত করতে, আরো পাঁচ মিনিট লাগল বৈঠা মেরে ওটাকে এপাশে নিয়ে আসতে। ল্যাসি আর ওপিক আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

ঘড়িতে এখন তিনটা আটাশ।

ঠান্ডায় আমার হাত পা কাঁপছে। ওপিক দ্রুত আমার গায়ে কেবিন থেকে সংগ্রহ করা পশমি কোটটা চাপিয়ে দিল।

দশ মিনিটের জন্যে উধাও হয়ে গেল ছেলেটা। যখন ফিরে আসল তখন হাত ভর্তি বাদাম। মাথা নেড়ে বোঝাল এটুকুই জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে ওর পক্ষে।

আমাদের মধ্যকার ভাব প্রকাশের ধরণটা আসলেও অদ্ভুত। আমি মাত্র দশদিন ধরে আছি ছেলেটার আশেপাশে, তবুও ও যখন হাত পা নেড়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করে বোঝাল, তুমি এখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নাও, আমি দেখি কিছু খাবার জোগাড় করতে পারি কিন, এরপরে আলো ফুটলে ক্যানোতে চড়ে রওনা হব আমরা-বুঝতে অসুবিধা হয়নি।

তিনটা বিয়াল্লিশের সময় সূর্যের সোনালি আভায় যাত্রা শুরু করলাম আমরা।

.

৫ জুলাই
সূর্যোদয় ৩:৩৯

পরের দিন যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখনও আমরা ইয়োকু নদীতে। ওপিকে ক্যানোর পেছনের সিটটাতে বসে আছে, হাতে বৈঠা। ওর কাছে গিয়ে বৈঠাটা আমাকে দেয়ার জন্যে ইশারা করলাম।

“একটু বিশ্রাম নাও তুমি।”

মাথা নেড়ে সায় জানালো ও।

আশেপাশে তাকিয়ে একটু অবাক হলাম। নদীর প্রস্থ বেড়ে গেছে আগের তুলনায় প্রায় তিনগুণ। ঠিক মাঝখান দিয়ে চলছে ক্যানোটা। কিন্তু। অন্য কোন মানুষের চিহ্ন চোখে পড়ল না। না কোন আগুন, না কোন মাছ ধরার নৌকা।

একদম একা আমরা। ভাবতে লাগলাম ওপিক আর ল্যাসি কোন এক পর্যায়ে ক্যানোটা তীরে ভিড়িয়েছিল কিনা। একটু পরেই উত্তর পেয়ে গেলাম যখন ওপিক আমার দিকে অনেকগুলো বাদাম আর ফলমূল বাড়িয়ে দিল। দ্রুত খেয়ে নিয়ে ওকে বললাম, “এবার ঘুমোও একটু।”

মাথা নাড়ল ও জবাবে। আমার কোলে এসে বসল ল্যাসি।

“তোদের চোখে উদ্ধার পাবার মত কিছু পড়েনি তাহলে গতকাল।”

মিয়াও।

“আচ্ছা। তুই ঠিক আছিস?”

মিয়াও।

“ওহ্, ডায়রিয়া।”

লম্বা একটা শ্বাস নিলাম। আসলে আমি অবাকই হয়েছি, পেটের অসুখ হতে এত সময় লাগল। প্রথম দু-দিন সরাসরি নদীর পানি খাওয়ার পর ভেবেছিলাম তখনই অসুবিধা হবে কিন্তু কিছুই হয়নি। এরপরে তো ওপিকের পদ্ধতিতে পানি খেয়েছি আমরা, যা মোটামুটি নিরাপদই বলা চলে। আমার মনে পানি থেকে না, অন্য কোন খাবার থেকে এরকমটা হয়েছে। হয়ত আমি ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ডাঙায় নেমে কিছুতে মুখ দিয়েছিল ও কিংবা আসলেই কিছু একটা হয়েছে।

আমার কথা প্রমাণ করতেই যেন বমি করা শুরু করল ল্যাসি। বমি করে কিছুক্ষন আমার দিকে বিলের মত তাকিয়ে থাকল।

আলেক্সান্দ্রিয়ায় থাকলে এতক্ষণে ওকে নিয়ে স্কুটারে করে পশু ডাক্তারের উদ্দেশ্যে রওনা হতাম।

ওকে সাহায্য করতে পারব না আমি এ মুহূর্তে, কিন্তু ইন্ডিয়ান গ্রামটায় পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত সাহস জোগাতে পারব। ওকে কোলে তুলে নিলাম।

আস্তে আস্তে গোঙাতে লাগল বেচারা।

“কালকেই সাহায্য খুঁজে পাব আমরা, দেখিস।”

মিয়াও।

“সুযোগ হল না? কিসের সুযোগ?”

মিয়াও।

“মেরু শিয়ালের সাথে কি?”

মিয়াও।

“তুই আর ঠিক হলি না,” একমাত্র ল্যাসির পক্ষেই এমন পরিস্থিতিতে এই কথা ভাবা সম্ভব।

ওপিকের দিকে তাকালাম। শান্ত ভঙ্গিতে ঘুমুচ্ছে ছেলেটা।

নিচু হয়ে ঝুঁকে মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে আস্তে করে বললাম, “আমার আর ইনগ্রিডের ছেলেটা যেন একদম তোমার মত হয়।”

ভূমিকম্পের পরে ঠিক আছে তো ইনগ্রিড আর আমাদের বাচ্চাটা?

.

এরপরের আধা ঘন্টা বৈঠা বাইলাম দ্রুতগতিতে, আর আশেপাশে তীক্ষ্ণ নজর বোলাতে লাগলাম।

পৌনে চারটার সময় নদীর দক্ষিণ তীরে নৌকা ভিড়ালাম এই আশায় যে, বালুতটের দেখা পাব, কিন্তু গিয়ে দেখি কেবল বুনো ঝোপঝাড়।

তিনটা পঞ্চান্নর সময় ওপিককে ডেকে তুললাম।

“এবার তোমার পালা।”

হেসে আমার হাত থেকে বৈঠাটা নিয়ে নিল ও।

আমি তীরের দিকে দেখলে মাথা নাড়ল।

সামনে বালুতট চোখে পড়লে নৌকা ভিড়িয়ে বিশ্রাম করবে।

হাত দিয়ে পানিতে বাড়ি মারার ভঙ্গি করে দেখালাম।

“ফিশি!” হেসে বলল ও।

নিচু হয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।

*

অধ্যায় ১৪

৬ জুলাই
সূর্যদোয়-৩:৪৩

ঘুম থেকে জেগে দেখি পুরোপুরি ভিজে গেছি আমি।

ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলাম। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে উঠে বসলাম আমি।

একটা বিশাল ঢেউয়ের ওপর উঠে গেল নৌকাটা। পরমুহূর্তেই পড়ে গেল নিচে। আবার পানির ঝাঁপটা এসে ভিজিয়ে দিল পুরো শরীর। নৌকার ভেতরেই তাল হারালাম।

ভয়ানক দুলছে ক্যানোটা, মনে হচ্ছে উল্টেই যাবে।

আবার উঠে বসলাম।

ওপিক ভয়ে গুটিয়ে আছে, আতঙ্কে চোখজোড়া বড় বড় হয়ে গেছে। ওর পাশে বসে থাকা ল্যাসিরও একই অবস্থা।

“কি হচ্ছে—”

ঠিক এই মুহূর্তে আরেকটা ঢেউ আছড়ে পড়ল আমাদের ওপর। কোনমতে সোজা হয়ে ভেসে থাকল নৌকাটা।

শক্ত করে ক্যানোর পাটাতন ধরে বসে থাকলাম। নদীর একটা সরু অংশ দিয়ে যাচ্ছে নৌকাটা। আমরা এখন পুরোপুরি ঢেউ আর পাথরের মর্জিতে আছি। একজন দক্ষ গাইডকেও এই দুর্গম অংশ দিয়ে নৌকা চালানোর সময় কয়েকবার ভাবতে হত।

কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে। ওপিকের দিকে ফিরে তাকালাম।

“বৈঠাটা কোথায়?”

জবাবে মাথা ঝাঁকাল ও।

নেই।

বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে ঘুরে বসলাম। আরেকদফা বিরাট ঢেউ এসে ভিজিয়ে দিয়ে গেল।

পাঁচ সেকেন্ড পরে হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল নদীটা।

পরের সোয়া মাইলের মত শান্তই থাকবে মনে হয়। কিন্তু তবুও ঝুঁকি নিতে চাই না আমি।

“ল্যাসি তুই ঠিক আছিস,” আমার দুই সহযাত্রির দিকে নজর দিতে দিতে বললাম।

পুরোপুরি ভিজে গেছে ও। কাঁপছে। দেখে মনে হচ্ছে, ওজন দুই পাউন্ডও হবে কিনা সন্দেহ।

“তোর কি এখনও শরীর খারাপ লাগছে?”

কোন উত্তর এল না।

মোটেও ভালো লক্ষণ নয় এটা।

ওপিক কাঁদছে। আমি জানি না বৈঠাটা কিভাবে হারিয়ে গেছে, কিন্তু সেটার জন্যে অপরাধবোধে ভুগছে ছেলেটা।

“ঠিক আছে, কোন ব্যাপার না। ওটুকু পার হয়ে এসেছি আমরা।”

আমি বৈঠার মত করে হাত দিয়ে পানিতে ধাক্কা দিতে লাগলাম। নদীর প্রস্থ এখানে কম। আমরা যদি তীরের পনের ফিটের মধ্যেও যেতে পারি, তাহলে একটা গাছের ডাল ধরে তীরে ভিড়তে পারব। ওখান থেকে একটা গাছের ডাল ভেঙে না-হয় বৈঠা বানিয়ে নিব।

“শিট!”

সামনে এই অন্ধকারের মধ্যেও ফেনা দেখা যাচ্ছে পানির ওপর।

তীরে ভেড়ার মত সময় নেই আমাদের হাতে।

“সামনের দিকে যাও,” হাত নেড়ে জোরে নির্দেশ দিলাম ওপিককে।

সামনের বসার জায়গাটাতে চলে গেল ও।

আমি পেছনের দিকে থাকলে একটা ভারসাম্য থাকবে এই ভেবে পেছনে গিয়ে বসলাম দ্রুত। একহাতে ল্যাসির কলার ধরে রেখেছি। বললাম, “শক্ত করে ধরে বস।”

ঠিক এই সময়ে দুটো পাথরের ভেতরে ঢুকে গেল নৌকাটা। জোরে বাড়ি খেয়ে তীব্র স্রোতের প্রভাবে সামনেই যেতে লাগল। বড় একট ঢেউ এসে ধাক্কা দিল নৌকাটাকে। ডানদিকে ঘুরে গেল সেটা, একটা পাথরের গায়ে বাড়ি খেল।

ওপিক তাল সামলাতে না পেরে উধাও হয়ে গেল নৌকা থেকে।

“ওপিক!”

ক্যানোটা লাফিয়ে সামনে এগিয়ে গেল এ সময়। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ফিরে তাকালাম। ওপিকের ছোট মাথাটা ভাসতে দেখলাম একবার। এরপর আবার ডুবে গেল।

হায় ঈশ্বর!

ক্যানোটা সামনে এগোতে লাগল। আমি ওপিকের খোঁজে পানিতে চোখ বোলাতে লাগলাম।

“কই গেল!”

অবশেষে আবার দেখতে পেলাম ওকে। আমাদের থেকে চল্লিশ ফিট বামে, অসহায়ের মত হাত ছুঁড়ছে। ভেসে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। এই বুনো অঞ্চলে টিকে থাকার সব পদ্ধতি জানলেও

সাঁতার জানে না ছেলেটা।

একবার ল্যাসির দিকে তাকালাম, তারপর ওপিকের দিকে।

মিয়াও।

“অসম্ভব!”

মিয়াও।

“কিভাবে—”

মিয়াও।

লাফ দিলাম ক্যানো থেকে।

দুই সেকেন্ড পরে ওপিকের শরীর আমার সাথে ধাক্কা খেলে ধরে ফেললাম ওকে।

ল্যাসিকে শেষবারের মত দেখলাম ক্যানোর ওপর থেকে অসহায়ের মত আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

.

যখন আমার বয়স চৌদ্দ বছর তখন একদিন বাবার সাথে লড়েছিলাম আমি। বাবা এখন যে বাসাটাতে থাকেন সেটারই ড্রয়িং রুমে। নাস্তা শেষ করে সেদিন কেবলই অংক করতে বসেছি, বাবা এটা ভালো মতনই জানেন যে প্রতিদিনকার জন্যে বরাদ্দ ষাট মিনিট থেকে বিশ মিনিট অঙ্ক করতে কতটা বিরক্ত লাগে আমার। তাই তিনি বলতেন আমি যদি কুস্তির লড়াইয়ে তাকে হারাতে পারি তাহলে আগামি দিনের ‘স্কুল থেকে আমার মুক্তি।

বেশ কয়েকবারই লড়েছি আমরা। কিন্তু প্রতিবারই ঐ ছোটখাটো মানুষটা মেঝেতে ধরে চেপে ধরতেন আমাকে আর গুনতেন, “এক হাজার এক…এক হাজার দুই…এক হাজার তিন!” এরপর বিজয় নৃত্য জুড়ে দিতেন।

এটা আমি জানতাম, আমাকে অল্পের ওপর দিয়েই পার পেয়ে যেতেন তিনি। কিন্তু সেদিনকার লড়াইয়ে তিনি এটা জানতেন না, গত ছয়মাস ধরে আমি ওনাকে অল্পের ওপর দিয়ে পার হয়ে যেতে দিচ্ছি। ঐ ছমাস আমি আমার ব্যক্তিগত দশ মিনিট বুক ডন করে কাটিয়েছি। যদিও আমাকে দেখে কেউ বুঝবে না, কিন্তু স্বাস্থ্যের একটু হলেও উন্নতি হয়েছে। শক্তিও বেড়েছে।

আর সেদিনই সব অনুশীলন কাজে লাগিয়েছিলাম।

চুলোয় যাক বীজগণিত।

“এতদিন লুকিয়ে কি খাচ্ছিলে তুমি?” বাবা দুই মিনিট পরে জিজ্ঞেস করলেন।

আমি হেসে তার প্যাঁচ থেকে বের হয়ে গেলাম।

এরপরের বাবার দুবারের চেষ্টা ব্যর্থ করে দিলাম অনায়াসেই। বুঝতে পারলাম, ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন তিনি।

তার ওপরে উঠে গেলাম, এরপর দুই পা দিয়ে তার মাথা চেপে ধরে আটকে ফেললাম প্যাঁচে। নড়তেও পারছে না।

“তুমি কি আমাকে আটকে ফেললে নাকি?” বাবা মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলেন।

“ইয়েস স্যার, আরো শক্ত করে আটকে ধরে বললাম।

“এক হাজার এক…এক হাজার দুই…এক হাজার তি–”

শেষ মুহূর্তে এক ঝটকায় ছুটে গিয়ে আমাকে নিচে চেপে ধরলেন বাবা। এরপর ওপর থেকে বললেন, “তুমি কি আসলেও ভেবেছিলে আমাকে হারিয়ে দেবে?”।

“ধুর,” হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম।

আমার ওপর থেকে সরে যেতে লাগলেন তিনি। কিন্তু সরার সময় তার পুরো ভর গিয়ে পড়ল আমার ডান পায়ের পাতার ওপর। মট করে শব্দ করে ভেঙে গেল ওটা।

দশ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পৌঁছে যাই আমরা। ডাক্তাররা হাড়ি ঠিকমত বসিয়ে প্লাস্টার করে দেয়।

ততক্ষণে চারটা বেজে যায় আর পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি বিছানায়।

পায়ের সাদা প্লাস্টারের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠেছিলাম। আগেরদিন ভেবেছিলাম ওখানে সাইন করে দেয়ার মত কেউ নেই। কিন্তু বাবা সারা হাসপাতালে হুইল চেয়ারে করে ঘুরিয়েছিলেন আমাকে আর সবাইকে দিয়ে সাইন করিয়েছিলেন ওখানে।

কিন্তু ওপিকের কোন প্রাস্টার নেই সাইন করার মত।

পানিতে পড়ে যাবার পরে কোন এক সময় ওর পা নিশ্চয়ই শক্ত কোন পাথরের সাথে বাড়ি খেয়েছিল অনেক জোরে। বাম পাটা গোড়ালি থেকে বিশ ডিগ্রি বিশ্রিভাবে ঘুরে আছে। কিন্তু ওটুকুই সব নয়, পেটের কাছটাতে বিরাট একটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। হা হয়ে আছে জায়গাটা, গলগল করে রক্ত পড়ছে।

আমি আমার টি-শার্ট ছিঁড়ে ওটা দিয়ে কেটে যাওয়া জায়গাটা চেপে ধরলাম।

ওপিক চিৎকার করে উঠল।

ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে তিনটা এগার।

উনপঞ্চাশ মিনিট।

আরো পাঁচ মিনিট ওর ক্ষতস্থানে টিশার্টটা চেপে ধরে রাখলাম। এরপরে সরিয়ে নিয়ে দেখি রক্তে ভিজে গেছে ওটা। এখনও সূর্যের আলো ফোটেনি। তবে এই অন্ধকারেও বেশ বুঝতে পারছি যে ক্ষতটা মারাত্মক। চামড়া ফেড়ে আছে, ভেতরে হাড্ডি পর্যন্ত ফুটে উঠেছে।

ওপিক চিৎকার করে উঠল ব্যথায়।

পায়ের ব্যথায় নাকি কাটা স্থানের জ্বালাপোড়ায় তা বুঝলাম না।

অসহায়ের মত লাগছে। কি করব কিছুই বুঝছি না।

ওকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া দরকার এখনই। পনেরটার মত সেলাই লাগবে আর পা-টাও ঠিকমত ঘুরিয়ে দিতে হবে। আর সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে লাগবে ব্যথার ওষুধ।

কি কি করতে হবে মনে মনে ঠিক করে নিলাম।

ওপিকের হাতটা নিয়ে টিশার্টের ওপর রেখে বললাম, “চাপ দিয়ে রাখো!”

এরপর ওর পায়ের কাছে চলে গেলাম।

“ব্যথা করবে ভীষণ,” বললাম ওর উদ্দেশ্যে।

এরপর জুতো ধরে ওর পা-টা ঘুরিয়ে দিলাম।

ওপিকের এবারের চিৎকারের কাছে আগের চিৎকারটা কিছুই না।

ওর পায়ের নিচে বালি দিয়ে দিলাম, যাতে উঁচু হয়ে থাকে ওটা।

“আমি জানি খুব ব্যথা করছে বাবু,” ওর হাতে চাপ দিয়ে বললাম। “কিছু জিনিস জোগাড় করতে হবে আমাকে। এখনই আসছি!”

দাঁত চেপে কোনমতে মাথা নাড়ল ছেলেটা।

তিনটা বাইশ বাজছে।

দিনের আলো ফুটতে এখনও বিশ মিনিট। কিন্তু চলাফেরা করার মত যথেষ্ট আলো আছে। দশ মিনিট লাগল ঝোপটা খুঁজে বের করতে যেটার পাতা থেকে জেল বানিয়ে ল্যাসিকে লাগিয়ে দিয়েছিল ওপিক।

পাতাসহ দুটো ডাল তাড়াতাড়ি ভেঙে নিলাম। এরপর আরো শক্ত দেখে গাছের ডাল খুঁজতে লাগলাম যেটা থেকে লাঠি বানানো যাবে।

ওপিকের কাছে বালুতটে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে সময় তিনটা তেতাল্লিশ।

বাচ্চাটা এখনও কাঁদছে।

এখনও চিৎকার করছে।

দুটো লাঠি ওর ভাঙা পা’টার দুপাশে রেখে জুতোর ফিতে দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলাম। তাহলে নড়াচড়া কম হবে। পাগলের মত কাতরাচ্ছে ছেলেটা।

এরপর পাতাগুলো ছিঁড়ে পানিতে ভিজিয়ে হাত দিয়ে পিষতে লাগলাম যতক্ষণ না জেলের মত পদার্থ না বের হয়।

ওপিকের ক্ষতস্থানটা থেকে টি-শার্টটা সরিয়ে পানি দিয়ে পরিস্কার করে দিলাম। সূর্যের আলোয় এখন ওটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। চার ইঞ্চির মত হা হয়ে আছে জায়গাটা। হাতের জেলগুলো আস্তে করে ওখানে লাগিয়ে দিতে থাকলাম। প্রতিবার হাত ছোঁয়ানোর সাথে চিৎকার করে উঠছে ছেলেটা। কিন্তু এখন একটু নেতিয়ে পড়েছে।

তিনটা পঞ্চান্নর সময় ওর মাথাটা আমার কোলের ওপর নিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।

“ঠিক হয়ে যাবে, বাবু।”

দুই মিনিট পরে কান্না বন্ধ হয়ে গেল ওর।

*

অধ্যায় ১৫

৭ জুলাই সূর্যোদয়-৩:৪৭

সূর্য আর মশা দুটোই ঝাল মিটিয়েছে আমার খোলা পা-টার ওপর। বালিতে উঠে বসতে বসতে চুলকে নিলাম জায়গাটা। ওপিক যেখানে শুয়ে আছে সেদিকে গেলাম। ওর বাম পা ফুলে আছে বেঢপভাবে। কালচে নীল হয়ে আছে ওপরের আকাশের মত।

ওর পাশ থেকে বালিতে গভীর একটা দাগ শুরু হয়ে ঝোপের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। ওটা দেখে বুঝলাম এক পর্যায়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ওখানে গেছিল ছেলেটা। কতটা কষ্ট সহ্য করে কাজটা করতে হয়েছে। ভাবতেই খারাপ লাগল। অথচ পাশেই কাজ সারতে পারত ও।

এরপরে কিছুক্ষণ খাবারের খোঁজে হন্য হয়ে ঘুরলাম। কিন্তু অল্পসংখ্যক বেরি ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। ওখান থেকে দুটো নিজের জন্যে রেখে বাকিটুকু ওপিককে খাওয়াতে লাগলাম। চোখ বন্ধ করে গিলতে লাগল ও। বালিতে গর্ত করে ওখান থেকে একটু একটু করে পানি নিয়ে খাওয়ালাম ওকে। তারপর কোলে করে লম্বা একটা পাথরের পাশে নিয়ে গেলাম ওকে। ওর ওজন মাত্র চল্লিশ পাউন্ড। কিন্তু আমার এই দূর্বল অবস্থায় ওটাকেই একশ কেজি বলে মনে হচ্ছে।

একটা লাঠি নিয়ে নদীতে নেমে পড়লাম। ওপিক যেভাবে মাছ ধরে সেভাবে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু কিছুই পেলাম না।

.
৮ জুলাই
সূর্যোদয়-৩:৫১

ইনগ্রিডের সাথে বসে কেবিনের বারান্দা থেকে প্রথমবারের মত সূর্য দেখার দিনটাকে এখন মনে হচ্ছে কয়েক যুগ আগের ঘটনা। সূর্যের মাহাত্ম তখনও ঠিকমতো বুঝিনি আম। হ্যাঁ, আমার সাদাকালো জীবনকে সেদিন কিছুটা রঙ্গিন করেছিলো ঠিকই, কিন্তু এই কয়দিনে আলাস্কার এই বুনো অঞ্চলে দিনাতিপাত করে ওটার গুরুত্ব আরো ভালোমত বুঝতে পেরেছি আমি। এই সূর্যালোকের কারণেই বেড়ে উঠেছে গাছগুলো, যার ফল খেয়ে বেঁচে আছি আমি।

আমার দেখা সূর্যের শেষ আলোটুকু প্রাণ ভরে উপভোগ করতে ইচ্ছে করছে। কারণ কাল থেকে আমার জাগ্রত থাকা অবস্থায় আর সূর্যের দেখা পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমি পারছি না উপভোগ করতে। কারন এই সূর্যের আলোতেই ওপিকের ক্ষতস্থানটা দেখা যাচ্ছে। ইনফেকশন হয়ে গেছে ওখানে। আস্তে করে হাত রাখলাম ওর কাঁধে। ওর চিৎকারের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

৮ জুলাই
সূর্যোদয়, ৩:৫৮

পাথরদুটো সজোরে বাড়ি লাগালাম। একবার স্পার্ক করল কিন্তু ঘাসে আগুন জুলল না। আবার চেষ্টা করলাম। আবার। আবার। হাত থেকে রক্ত বের হতে লাগল।

আবার ঘষা দিলাম জোরে।
“জ্বল, জ্বল!”

এবার একটা ঘাসে আগুন ধরল। ওর ওপর আরো কিছু শুকনো ঘাস ছড়িয়ে দিলাম। ওগুলোও জ্বলতে লাগল। এর কিছুক্ষণ পরে গাছের ডালটা সাবধানে রাখলাম আগুনের ওপর। ফুঁ দিতে লাগলাম। ওটাতেও ধরল আগুন। এরপর আশেপাশে থেকে জোগাড় করা সবগুলো ডালপালা একে একে ছড়িয়ে দিলাম আগুনের ওপর।

দুই মিনিট পরে দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো ওগুলো। দিনের আলো ফোঁটা পর্যন্ত টিকতে হবে এই আগুনকে।

ওপিকের পাশে যখন ঘুমিয়ে পড়লাম তখনও জ্বলছে আগুন।

১০ জুলাই
সূর্যোদয়, ৪:০০

ওপিকের কপাল থেকে কালকের ঐ আগুনের মতই উত্তাপ ছড়াচ্ছে। ঐ আগুন দেখে কেউ উদ্ধার করতে আসেনি আমাদের। গত দু-দিনে আমরা কেউই কিছু খাইনি। ওর গোল গালদুটো শুকিয়ে হাড্ডি বেরিয়ে এসেছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিও কমে গেছে।

হাত দিয়ে পানি খাওয়ালাম ওকে।

“সব ঠিক হয়ে যাবে,” মিথ্যে বললাম। “আমাদের কেউ না কেউ উদ্ধার করবেই। আমাকে আর তোমাকে।”

প্রতিটা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট করতে হচ্ছে আমাকেও। আবারো সবকিছু ঘোলা ঘোলা দেখছি। কোনমতে হামাগুড়ি দিয়ে নদীর তীরে গেলাম।

দুই চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।

“কেউ আছেন? সাহায্য করুন আমাদের! খাবার দরকার আমাদের! আর অ্যান্টিবায়োটিক! কেউ শুনতে পাচ্ছেন?” চিৎকার করতে লাগলাম।

ঘড়ির দিকে তাকালাম। সংখ্যাগুলো নাচতে লাগল আমার চোখের সামনে।

তিনটা আটত্রিশ। তিরিশ মিনিট ধরে চিল্লাচ্ছি আমি।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এরপর আরো সোয়া মাইল গেলাম তীর ধরে। হাতদুটো গোল করে শুকনো ঠোঁটের কাছে নিয়ে এলাম।

“কেউ আছেন?”

১১ জুলাই
সূর্যোদয়, ৪:০৫

“ওপিক, ওপিক,” ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম। উঠে বসতে চাই আমি। ওর ওপর নজর রাখতে চাই, যদিও জানি এতক্ষণে মারা গেছে ও। তবুও না দেখলে তো নিশ্চিত হতে পারব না।

নিশ্চিত হতে পারব না এ ব্যাপারে যে, ওকে বাঁচাতে পারিনি আমি।

শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলা শুরু করলাম, “আমার বাসায় লাল রঙের বড় একটা খাম আছে।”

এটুকু বলে লম্বা একটা শ্বাস নিলাম।

“আমার মা’র ফাইল আছে ওটার ভেতরে। খুব খারাপ খারাপ কাজ

মাত্র একঘন্টার জন্যে জেগে উঠি আমি। স্লিপ অ্যামপ্লিফিকেশন না কী যেন করেছেন তিনি। নিজের ছেলের সাথে কেউ করে এমনটা? কিন্তু ওটা নিয়ে ভাবিও না আমি। ওপিক? তুমি কি শুনছ ওপিক? আমি মার সম্পর্কে সত্যটা জানতে চাই না। আমি যদি খামটা না খুলি তাহলে একটা সম্ভাবনা থেকে যায়, তিনি হয়ত আসলে অতটা খারাপ নন, যতটা ওরা বলেছে। তিনি শুধু আমাদের ফেলে চলে গেছেন।”

“এখান থেকে ফিরতে পারলে তিনটা কাজ করব আমি। ইনগ্রিডকে খুব করে আদর করব। এরপরে বলব, ছেলে হোক আর মেয়ে হোক, আমি খুশি, আমরা বাবা-মা হতে যাচ্ছি। তারপর দোকানে গিয়ে একটা বিড়াল কিনব। একটা পুসি! ল্যাসিকে পাওয়ার আগে আমি জানতামও না, একটা বিড়ালকে এতটা ভালোবাসা যায়। ওর মত আর কেউ নেই! যদিও একটু বদ টাইপের। তা-ও। তোমার কি মনে হয় ওপিক? এসব করার পর কি করব জানো? ঐ খামটা খুলব।

“আমাকে জানতেই হবে, বুঝেছ। জানতে হবে, তিনি আসলেও খারাপ কিনা। আর শুধু ওটাই না। বাবার সম্পর্কেও জানবো। আমার ওপর যখন এক্সপেরিমেন্ট করছিল মা, তখন কোথায় ছিলেন তিনি? বেজমেন্টে? ঐ ফালতু বেজমেন্টটাতে? যেখানে ওনার একেকটা অদ্ভুত রকম শখের জিনিসগুলোর কবর দেয়া হয়! ওখানে কি লুকানো আছে জানো? সারি সারি বাক্স। হয়ত আমার মার জিনিসপত্র। একবারে ক্রিসমাসে আমরা, মানে আমি, ল্যাসি আর ইনগ্রিড গেছিলাম ওগুলোর ভেতরে কি আছে দেখতে। ও হ্যাঁ, মারডক ও ছিল। শুনতে পাচ্ছ? ওপিক? কি দেখলাম জানো? বাক্সগুলো গায়েব!

“ওপিক! ব্যাপারটা অদ্ভুত, তাই না? এর পরের দিন প্রায় খুলেই ফেলেছিলাম খামটা। কিন্তু খুলতে পারিনি শেষ পর্যন্ত। যদি আজ পর্যন্ত আমার বাবা সম্পর্কে যা যা জানি ওগুলোও মিথ্যে হয়?”

ওপিকের উত্তর শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু মারা গেছে ও।

ইনগ্রিড।

ল্যাসি।

ওপিক।

সবাই মৃত।

“ওখানে। দেখতে পাচ্ছি!”

“পেয়েছি মনে হয় ওদের। নদীর তীরে, দেখে মনে হচ্ছে দুজন।”

চোখ খুলে উঠে বসার চেষ্টা করলাম।

একটা আলো এসে পড়ল আমার চোখে।

“হেনরি? কেউ জিজ্ঞেস করল। পরিত্রাণ!

*

অধ্যায় ১৬

২০শে জুন

“হেনরি?”

চট করে চোখ খুলে গেল আমার। ঘরটা পুরোপুরি সাদা। আমার ডান হাতের সাথে একটা আইভি নল লাগানো।

“কোথায় আমি?” জিজ্ঞেস করলাম। “এটা কি ফেয়ারব্যাঙ্কসের হাসপাতাল? ওপিক কোথায়? ও কি বেঁচে আছে?”

একজন ডাক্তার ঝুঁকে আছেন আমার ওপর। তার পরণে নীল রঙের অ্যাপ্রন, আর মুখে সাদা মাস্ক।

“ঘুম ভালো হয়েছে আপনার?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলাম। আমার মাথা ঠিকমত কাজ করছে না, কিন্তু ওটাই স্বাভাবিক। “হ্যাঁ, ভালোই ঘুমিয়েছি। আমাকে উদ্ধার করার জন্যে ধন্যবাদ।”

তিনি ঘাড় বাঁকা করে আয়নার ওপাশে কার দিকে যেন তাকালেন। তার মাস্ক আর মাথার ক্যাপের মধ্যে দিয়ে শুধু কুঁচকানো ড্র জোড়া দেখা যাচ্ছে।

“ওপিক আছে এখানে? ইনগ্রিড?”

আমার কথা কানেও তুললেন না তিনি।

এসময় দরজা খুলে কেউ একজন ভেতরে ঢুকল।

কালো স্যুট পরা একজন লোক আমার ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বললেন, “হ্যালো, মি. বিনস।”

“আপনিই কি আমাদের খুঁজে পেয়েছেন নদীতীর থেকে?”

তার প্রতিক্রিয়াও ডাক্তারের মতনই হল। ঘাড় কাত করে ভুজোড়া কুঁচকিয়ে রাখলেন।

“আপনি কি জানেন আজ কত তারিখ, মি. বিনস?”

কিছুক্ষণ ভাবলাম, “জুলাইয়ের বারো তারিখ।”

আবারো একই প্রতিক্রিয়ার পুণরাবৃত্তি।

“ইনগ্রিড কোথায়? ও কি ঠিক আছে?”

ঘুরে চলে গেলেন তিনি।

দীর্ঘ দুই মিনিট পার হল। খেয়াল করে দেখলাম আমার কেবিনটাতে কোন চেয়ার কিংবা টেলিভিশন নেই।

ইন্টারকমে একটা আওয়াজ ভেসে আসল এই সময়, “ইনগ্রিড নিরাপদে আছে।”

“ভূমিকম্পের হাত থেকে বেঁচে গেছে ও?”

একটা দীর্ঘ বিরতি।

“কোন ভূমিকম্প হয়নি,” জোরে ইন্টারকম থেকে উত্তর এলো।

“হয়েছে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারব! নিজের চোখে বিল্ডিংগুলো ভেঙে পড়তে দেখেছি আমি।”

একটা দরজা খুলে গেল। পায়ের আওয়াজ শুনলাম। এবার একজন। মহিলা। তার পরনে একটা লম্বা জ্যাকেট। ধূসরাভ চুলগুলো পনিটেইল করে বাঁধা। মুখের ওপর সার্জিক্যাল মাস্ক।

“ফেয়ারব্যাঙ্কসে পৌঁছুনো সম্ভব হয়নি তোমার পক্ষে।”

“হ্যাঁ, আমি পৌঁছেছিলাম।”

“পাইলটরা তোমাকে আমাদের ফ্যাসিলিটিতে নিয়ে এসেছিল, মনে নেই?”

“আপনি পাগল নাকি? আমি ফেয়ারব্যাঙ্কসে গেছিলাম। এরপরে একটা মারাত্মক ভূমিকম্প হয়েছিল। আমি যে ব্রিজের ওপর ছিলাম সেটা ভেঙে নদীতে পড়ে যাই ল্যাসিসহ। এরপরে ওখান থেকে প্রায় একশ মাইল ভেসে আলাস্কার বুনো অঞ্চলে চলে আসি। সেখানেই ছিলাম গত একুশ দিন। বেঁচে থাকার জন্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়েছে।”

“তোমাকে দেখে কেউ বলবে না, আলাস্কার বুনো অঞ্চলে তিন সপ্তাহ কাটিয়েছ।”

আমার হাতের দিকে তাকালাম, ওগুলো দেখে মনে হচ্ছে না, একটা মশাও ছুঁয়েছে আমাকে গত একুশদিনে। পরনের গাউনটা বুক পর্যন্ত খুলে ভিতরে তাকালাম। আশা করছিলাম হাড্ডিসার পাঁজর চোখে পড়বে। কিন্তু ওরকম কিছু দেখলাম না। সব স্বাভাবিক। গালে হাত দিলাম। লম্বা দাড়ি নেই! তার বদলে দু-দিনের না কামানো চাপদাড়ি অনুভব করলাম।

“কি হচ্ছে এসব?”

“কতদিন আলাস্কায় ছিলে তুমি?”

এত কিছুর মাঝে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা কঠিন। বুনো অঞ্চলে ছিলাম একুশ দিন, তার সাথে ভূমিকম্পের আগের দু-দিন। “তেইশ দিন।”

“এর মাঝে কত ঘন্টা জেগে ছিলে তুমি?”

“তেইশ ঘন্টা,” ঢোক গিলে বললাম।

মহিলাটা মাথা নেড়ে বলল, “তেইশ ঘন্টা আগে প্লেনে চড়ে ফেয়ারব্যাঙ্কসের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলে তুমি। কিন্তু প্লেনটা তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।”

মেরুদণ্ড বরাবর ঠাণ্ডা একটা স্রোত প্রবাহিত হল।

“মানে? কেন? ইনগ্রিড কোথায়? আর এখানে মানে, কোন্ জায়গা?”

“ইনগ্রিড নিরাপদে আছে। বিড়ালটাও। তাদের মৃদু চেতনানাশক দিয়ে প্লেন ছাড়ার আগে গাড়িতে তুলে দেয়া হয়েছিল।”

মৃদু চেতনানাশক? গাড়িতে তুলে দেয়া হয়েছিল?

“আচ্ছা! কিন্তু আমি এখানে কি করছি?” জিজ্ঞেস করলাম। কোথায় এটা?”

গাঢ় সবুজ চোখের মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। জ্বলজ্বল করছে চোখদুটো।

“এটা হচ্ছে সর্বাধুনিক জিজ্ঞাসাবাদের কেন্দ্রস্থল!”

সবকিছু পরিস্কার হয়ে গেল।

গত তেইশ ঘন্টা ঘুমিয়েছি আমি।

আর আমাকে নির্যাতন করা হচ্ছিল।

আমার নিজের মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে নির্যাতন।

আগের কথা ভাবলাম। একটা সাদা ঘর।

নীল অ্যাপ্রন পরিহিত একজন ডাক্তার।

আমার বাহুতে একটা আইভি লাগানো।

কোথায় ওটা?

আমি জানি না।

কোথায় ওটা?

কি কোথায়?

ফ্ল্যাশড্রাইভভটা।

কিসের ফ্ল্যাশড্রাইভভ?

গোলাপি রঙের তরলে ভরা একটা সিরিঞ্জ ।

আমি বাধা দেয়ার চেষ্টা করলাম।

আইভি নলের মধ্যে সিরিঞ্জটা ঢুকিয়ে চাপ দিল লোকটা।

আমি চিৎকার করে উঠলাম।

ওটা স্বপ্ন ছিল না মোটেও, বাস্তবে ঘটেছে। বাকি সবকিছু, কেবিন, সূর্যোদয়, প্রেগন্যান্সি, ভূমিকম্প, নদী, ক্যানো, বন্ধু হরিণ, এপিক, ভালুক, রাগ, ক্ষুধা, যন্ত্রনা, মৃত্যু ওসবই…কল্পনা।

“কি ইনজেক্ট করা হয়েছিল আমাকে?”

“আমাদের গত চল্লিশ বছরের গবেষণার ফসল।”

“দুঃস্বপ্ন দেখতে বাধ্য করে ওটা?”

“অনেকটা ওরকমই।”

দীর্ঘক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল সে। জানে, আমার মাথায় কি চলছে। “দুঃস্বপ্নটা আমরা তৈরি করি না। আমাদের কাজ শুধু ঘুমের মধ্যে কিছু ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করা। বাকিটা কাজ সাবজেক্টের মস্তিষ্কই করে।”

ভূমিকম্পের পরিসংখ্যান, এস্কিমো-ইন্ডিয়ান অলিম্পিক, বল্লা হরিণ, ভালুক, এসবই ইন্টারনেটে দেখেছিলাম আমি। ইনগ্রিডের প্রেগন্যান্ট হওয়া, ল্যাসির অসুস্থ হয়ে পড়া, ওপিকের মৃত্যু, বাবার সম্পর্কে ভুল জানা-এসব হচ্ছে আমার সবচেয়ে বড় ভয়গুলো।

আমি নিজেই ঐ পৃথিবীটা তৈরি করেছিলাম।

মুখের সার্জিক্যাল মাস্কটা নামিয়ে ফেলল মহিলা।

ডানদিকে রাখা আমার হার্ট-রেট মনিটরটা তীক্ষ্ণ শব্দ করে উঠল। শব্দ করে ঢোক গিলোম।

“সিআইএ’র স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামে স্বাগতম,” আমার মা বললেন। “অনেক দিন পরে এখানে আগমন ঘটল তোমার।”

.

নীল অ্যাপ্রন পরিহিত ডাক্তারটা ফেরত এলো এ সময়।

“আমি আবার জিজ্ঞেস করছি,” মা বললেন। “ফ্ল্যাশড্রাইভভটা

“কিসের ফ্ল্যাশড্রাইভভ? আমি জানি না কিসের কথা বলছেন আপনারা।”

“ফ্ল্যাশড্রাইভভটার কথা,” এই বলে থামলেন তিনি।

ডাক্তার একটা সিরিঞ্জ তুলে ধরল।

“প্রেসিডেন্ট যেটা দিয়েছে তোমাকে।”

.

শেষ

লেখকের কথা :

আমি জানি আপনাদের অনেকেই হয়ত এতক্ষণে বইটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন কিংবা কুটি কুটি করে ছেঁড়ার কথা ভাবছেন। আশা করি ঐ ভাবনা পর্যন্তই, পরের কাজটা আর করেননি। একটা জিনিস জেনে অবাক হবেন, এই বইয়ের বেশিরভাগ ঘটনাই বাস্তবসম্মত। আলাস্কার সূর্যোদয়ের সময়গুলো আসল, আর সত্যিই আমেরিকার ৫০% ভূমিকম্প আলাস্কাতেই হয়।

আলাস্কাতে বল্গা হরিণ, বাদামি ভাল্লুক আর মেরু শিয়াল (আর্কটিক ফক্স)-এর বসবাস।

সব বেরি ফল আর বাদামের কথাগুলোও সত্যি।

২১ দিন অল্প খাবার খেয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব। ন্যাকেড অ্যান্ড আফ্রেইড দেখতে পারেন প্রমাণস্বরূপ।

আর এস্কিমোদের সম্পর্কে বেশিরভাগ কথাবার্তাই সত্যি। বেশিরভাগ।

নদীগুলোর বর্ণণাও সঠিক আশা করি।

ইন্ডিয়ান-এস্কিমো অলিম্পিক প্রতি বছর ফেয়ারব্যাঙ্কসে সংঘটিত হয়। আর অদ্ভুত অদ্ভুত খেলাগুলো আসলেও খেলে লোকজন।

সিআইএর স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের অংশটুক নেয়া হয়েছে একসময়কার সিআইএ’র টপ সিক্রেট প্রজেক্ট MKUltra থেকে। উইকিপিডিয়ায় খোঁজ নিতে পারেন।

হেনরির মা আর সিআইএ’র স্লিপ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের বড় একটা ভূমিকা থাকছে আগামি বইতে। এখন দ্রুত সেই বইটা পড়ে ফেলুন। ওটা পড়লেই এটার উদ্দেশ্য বুঝতে পারবেন।

ধন্যবাদ সবাইকে।

নিক পিরোগ
ডিসেম্বর ১, ২০১৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *