মায়া মন্দির ২

২৬.

জায়গাটা নেভাডার পশ্চিম মরুভূমি। গুড়গুড় আওয়াজ তুলে পুরনো রাস্তা ধরে চলেছে ভেহিকেলের কনভয়। মাঝে রাখা হয়েছে কেমোফ্লেজ রঙ করা আঠারো হুইলের এক ট্রাক। সামনে ও পেছনে মেশিনগানবাহী হামভি। আকাশে এক শ ফুট ওপরে উড়ছে দুটো মিসাইল সজ্জিত ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার।

আরও পঞ্চাশ মাইল এগোবার পর কনভয় পৌঁছল ইয়াকা পর্বতে।

ঠিক হয়েছিল এ এলাকায় ফেলা হবে দেশের সব নিউক্লিয়ার বর্জ্য, কিন্তু হামলে পড়ল হাজারে হাজারে পরিবেশবাদীরা। কেস হলো আদালতে। বেশ কয়েক বছর চলল সেই মামলা। এদিকে পাল্টে গেল রাজনৈতিক পট। ফলে নির্জন পড়ে রইল ইয়াকা মাউন্টেন। পলিটিশিয়ানরা ভুলে যেতে চাইলেন, দেশের বেশিরভাগ রেডিও অ্যাকটিভ মেটারিয়াল রয়ে গেছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। হালকাভাবে পাহারা দেয়া হচ্ছে এক শ সাতটি রিঅ্যাক্টর সাইটের বিপুল বর্জ। কারও খেয়াল নেই দেশের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা থেকে বড়জোর কয়েক মাইল দূরে ওসব সাইট। যারা আপত্তি তুলেছিল ইয়াকা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে, তারা খেয়ালও করল না অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ছিল নির্জন পাহাড়ে বর্জ্য জমিয়ে রাখা।

সেই থেকে ফাঁকা পড়ে আছে ইয়াকা মাউন্টেন। কাজেই সিআইএ থেকে বলে দেয়া হয়েছে, ইচ্ছে করলে এই এলাকা ব্যবহার করতে পারবে এনআরআই। এ কারণেই এনআরআই ভল্ট থেকে বের করে ব্রাযিল স্টোন তুলে দেয়া হয়েছে এক মিলিটারি সি-১৭-এ। চারঘণ্টা আকাশপথে চলার পর এনআরআই চিফ নেমেছেন নেভাডার এয়ারফিল্ডে। ওখান থেকে রওনা হয়ে মায়ান স্ফটিক পৌঁছে গেছে ইয়াকা মাউন্টেনে।

যাত্রার প্রতিটি পদে সতর্ক ছিল সবাই। কখন কম বৈদ্যুতিক ফেয চলবে, সেটা হিসাব কষে সরানো হয়েছে স্ফটিক। আবার ম্যাগনেটিক ফিল্ড বাড়লে ওটাকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে নিরাপদ জায়গায়। বিপদের সম্ভাবনা সবসময়ই ছিল, তবে পরেরবার বা হওয়ার সাত ঘণ্টা আগেই চলে এসেছে স্ফটিক পাহাড়ি বাঙ্কারের কাছে।

সেমিট্রাকের ক্যাবে বসে মাথার ওপর দিয়ে ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার যেতে দেখলেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান। তীরের মত চলেছে মিলিটারি কপ্টার। মৃদু হাসলেন ব্রায়ান। তার মনে হয়নি এত সতর্কতার দরকার ছিল।

কনভয় চলেছে মিলিটারি নিয়ন্ত্রিত এলাকার মাঝ দিয়ে অচেনা সড়কে। তাদের ওপর হামলা করতে চাইলে পাড়ি দিতে হবে কমপক্ষে এক শ মাইল মরুভূমি। এ দেশের সবচেয়ে নিরাপদ বেস এটা। চারপাশে নেলিস বমিং রেঞ্জ। আকাশ পাহারা দিচ্ছে মিসাইল সজ্জিত হেলিকপ্টার ও এফ-টোয়েন্টি-টু র‍্যাপ্টর যুদ্ধবিমান। ব্রায়ানরা এখানে আসার আগেই ক্যামেরা ও ইনফ্রারেড সেন্সর ব্যবহার করে প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করেছে আর্মি। এমপিদের জানানো হয়েছে, অনুপ্রবেশকারী দেখলেই দেরি না করে গুলি করতে হবে। এত সতর্কতার মূল কারণ, মরুভূমির এদিকটায় রয়েছে গ্রুম লেক। এখানেই পরীক্ষা হয় স্টেল্থ বারের টপ সিক্রেট ফ্লাইট। এই এলাকার নিরাপত্তায় কোনও খুঁত রাখা হয়নি, তার আরেকটা কারণ এদিকেই রয়েছে কুখ্যাত এরিয়া ফিফটি-ওয়ান।

ব্রায়ানরা পৌঁছে গেছেন গন্তব্যের খুব কাছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। রুক্ষ, পরিত্যক্ত বালুমাটিতে হাজার হাজার বোমার গর্ত। পাথুরে পাহাড়ও খুব কুৎসিত। হাজার ধরনের বোমার পরীক্ষা করতে গিয়ে এই দশা হয়েছে এই এলাকার। বোমাগুলোর ভেতর রয়েছে ডেইযি কাটার থেকে শুরু করে নিউক্লিয়ার ওঅরহেড।

শুকনো মরুভূমির বুকে কোথাও নেই প্রাণের কোনও চিহ্ন। জন্মায়নি একটা ঘাসও। এলাকা ছেড়ে উধাও হয়েছে ক্যাকটাস। এই এলাকা যেন ভিন্ কোনও গ্রহ, অথবা চাঁদের বুক। এ কারণেই ইউএফও জাঙ্কিরা ভাবে, এখানে রাখা হয়েছে এলিয়েনদেরকে, যাতে সহজেই জীবন কাটাতে পারে তারা।

ট্রেইলারের দরজা খুলে মাথা বের করলেন এক সায়েন্টিস্ট। স্যর, একটা সমস্যার ভেতর পড়েছি।

বুক ধক্ করে উঠল ব্রায়ানের। কী হয়েছে?

অপ্রত্যাশিত এনার্জি ওয়েভ, বললেন বিজ্ঞানী, বাড়ছে খুব দ্রুত!

.

মেক্সিকো উপসাগর। সামনে থেকে দুটো বোট ছুটে আসতে দেখছে মাসুদ রানা।

আমাদেরকে বন্দি করবে, বেসুরো কণ্ঠে বললেন হ্যারিসন।

রানার হাতের ইশারায় ড্রাইভিং সিট ছেড়ে সরে গেলেন আর্কিওলজিস্ট। সিটে বসে ইঞ্জিনের শক্তি একটু কমিয়ে দিল রানা, যেন থামবে। পরমুহূর্তে প্রফেসরকে চমকে দিয়ে সোজা ছুটল বোটদুটোর দিকে। খুলে দিয়েছে পুরো থ্রটল।

ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়ছে ইঞ্জিন। দমকা হাওয়া ও পানির কণা এড়াতে নিচু হয়ে বসেছে রানা, তুমুল বেগে চলেছে দুই বোটের দিকে যেন চাইছে মুখোমুখি সংঘর্ষ হোক। অপেক্ষাকৃত বড় ওয়্যাহু বোটের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে দুপাশে সরে গেল সোর্ডফিশ শিকারি বোট দুটো।

গোঁয়ার গোবিন্দ ভঙ্গি নিয়ে রানাকে এগোতে দেখে মিতাকে বললেন প্রফেসর হ্যারিসন, মেঝেতে শুয়ে পড়ো, মিতা। আমিও তাই করছি।

পাবলোকে পাশে নিয়ে ডেকে শুয়ে পড়ল মিতা।

একটু দূরে হ্যারিসন।

এদিকে ড্রাইভিং সিটে আরও ঝুঁকে বসল রানা।

সামনের সোর্ডফিশ শিকারিরা সরে জায়গা দেয়ার পরও নাক ঘুরিয়ে ডানদিকেরটাকে ধাওয়া করল ওয়্যাহুশিকারি রানা। গতি কমপক্ষে সত্তর থেকে আশি নট। শক্ত হাতে হুইল ধরে রেখেছে ও।

ওকে উন্মাদ ধরে নিয়ে আরও সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ডানের বোটটা। সামান্য একটু বাঁয়ে কেটে সোর্ডফিশ শিকারির একেবারে গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল রানা। পেছনে পড়ল দুই বোট। অন্তত দশটা গুলি গেল রানার মাথার ওপর দিয়ে। যদিও ওগুলোর লক্ষ্য ছিল আউটবোর্ড ইঞ্জিন।

কিন্তু চলন্ত ও দুলন্ত ডেক থেকে লক্ষ্যস্থির প্রায় অসম্ভব।

ইঞ্জিনের আওয়াজ বদলে গেল কি না তা বুঝতে কান। পাতল রানা।

না, সবই ঠিক আছে।

অনেক পেছনে পড়েছে দুই শত্ৰুবোট।

কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রানা। পথ ছাড়তে গিয়ে বাধ্য হয়ে উত্তরদিকে গেছে একটা বোট। অন্যটা কোর্স ঠিক করে নতুন উদ্যমে আবার শুরু করেছে ধাওয়া।

আর কিছু করার নেই রানার।

 শুরু হয়েছে তীরে পৌঁছুবার রেস।

নেভাডার রুক্ষ মরুভূমি চিরে চলেছে কনভয়। বিজ্ঞানীর আতঙ্ক ভরা চোখে তাকালেন ব্রায়ান। এসব কী বলছেন আপনি? এনার্জি বাড়ছে কী করে?

জানি না, বললেন বিজ্ঞানী।

সিট ছেড়ে উঠতে চাইলেন ব্রায়ান, কিন্তু বাধা দিল সিটবেল্ট। কিন্তু এ তো অসম্ভব! বাঁধন খুলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কী করবেন বুঝছেন না। প্রায় কিছুই জানতে পারেননি তাঁরা ব্রাযিল স্টোনের ব্যাপারে!

ট্রাকের পেছনে গিয়ে ঢুকলেন ব্রায়ান। ভার্জিনিয়া ল্যাবের ক্ষুদ্র সংস্করণ তৈরি করা হয়েছে ট্রাকের ভেতর। তাঁর স্টাফরা মনিটর করছে জ্বলজ্বলে স্ফটিক। কমপিউটারের স্ক্রিনে রিডআউট দেখলেন তিনি। অন্তত চারগুণ বেড়ে গেছে এনার্জি।

কখন থেকে শুরু হয়েছে? জানতে চাইলেন।

পাঁচ মিনিট আগে থেকে, বললেন বিজ্ঞানী, প্রথমে খেয়াল করলাম, নতুন এনার্জি ডিসট্রিবিউশন প্যাটার্ন। বাড়তে লাগল এনার্জি। অনেক কমল ব্যাকগ্রাউণ্ড রিডিং। বদলে গেল কাউন্টডাউন সিগনাল। অনেক জটিল আর অনিশ্চিত হয়ে উঠল।

কী হয়েছে জানি না, তবে কিছু পাল্টে দিয়েছে একটু আগের সিগনাল, বলল ব্রায়ানের স্টাফ। হয়তো আপনাআপনি আগের মতই শান্ত হবে।

ধূসর চুলে হাত বোলালেন ব্রায়ান। লক্ষ করলেন স্ক্রিনে পাওয়ার কার্ভ। আরও বাড়ছে এনার্জি। ডিসচার্জের সময় এমনই করে স্ফটিক। কিন্তু এ মুহূর্তে চার্টের বেঞ্চমার্ক লেভেল খুব কম।

স্ফটিকের সঙ্গে সংযুক্ত কমপিউটার ফ্ল্যাশ করছে লাল বাতি, সেইসঙ্গে আছে জোরালো বিপবিপ সতর্কসঙ্কেত। বাড়ছে স্ফটিকের এনার্জি লেভেল। ধূসর হলো স্ক্রিন। রেডিওজুড়ে শুরু হয়েছে স্ট্যাটিক।

ড্রাইভারের উদ্দেশে চিৎকার করে বললেন ব্রায়ান, আশপাশে কোনও বাঙ্কার আছে?

কথা শুনে হতভম্ব হয়েছে এয়ারফোর্সের সার্জেন্ট। মিস্টার ব্রায়ান? কী বললেন?

এই জিনিস লুকাবার মত কোনও জায়গা আছে?

না, স্যর, বলল ড্রাইভার। এটা খোলা রাস্তা।

.

শক্ত করে পাবলোকে জড়িয়ে ধরে ডেকে শুয়ে আছে মিতা। ঝড়ের গতি তুলে তীর লক্ষ্য করে বোট ছুটিয়েছে মাসুদ রানা। প্রথমে সরে গেল ডানে, তারপর বামে। সহজ টার্গেট দেবে না। পিছন থেকে ধাওয়া করছে দুই শত্রুবোট।

তুমুল বেগ তিন বোটের, কিন্তু বারবার বাঁক নিতে গিয়ে পিছিয়ে পড়ছে রানারা।

এখন মাত্র পঞ্চাশ গজ পেছনে দুই বোট। দুপাশে সরে গিয়ে গুলি করছে ইঞ্জিন লক্ষ্য করে।

পাঁচ মিনিটের ভেতর বন্দরে পৌঁছবে ওরা। রানা আশা করছে, ব্যস্ত জায়গায় যা খুশি করতে পারবে না পেছনের লোকগুলো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ওরা ওই পর্যন্ত পৌঁছুতে পারবে কি না, তার ঠিক নেই। মাত্র একটা বুলেট খতম করে দিতে পারে আউটবোর্ড মোটর।

রানার দুফুট পেছনের ডেকে বিঁধল রাইফেলের গুলি। কানের পাশ দিয়ে গেল আরেকটা। আরও ঝুঁকে বসল রানা। পেছনে শুনল পাবলোর চিৎকার। মিতার হাত থেকে ছুটে গেছে বাচ্চা ছেলেটা। আঙুল তাক করল লকারের দিকে। বিস্ফারিত দুই চোখ, যেন আবিষ্কার করেছে নতুন কিছু। হঠাৎ চিকন কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল: টু! আবার দেখল মিতাকে। টু!

প্রফেসরের দিকে তাকাল মিতা।

ভদ্রলোক হামাগুড়ি দিয়ে পাশে চলে এসেছেন। ছেলেটা পাগল হয়ে গেল না তো?

জানি না, বিড়বিড় করল মিতা। ওকে শক্ত করে ধরে বসুন।

মিতা, হুইল ধরো, নির্দেশ দিল রানা।

মেয়েটা ড্রাইভিং সিটে বসতেই বোটের পেছনে এল রানা। সিটের পেছন থেকে নিল নোঙর। তীরের কাছে পৌঁছে গেছে ওরা। আর বড়জোর কয়েক মিনিট। সোজা এগিয়ে যাও, মিতা! ছোরা বের করে নোঙরের দড়ি কেটে দিল রানা।

সোজা ছুটছে বোট।

দড়ি ঘুরিয়ে হ্যামার থ্রোর মত করে নোঙর ছুঁড়ল রানা। ধাওয়াকারীদের দিকে উড়ে গেল ওটা। কিন্তু টার্গেট থেকে একটু আগেই ঝপাস করে পড়ল সাগরে।

আরও দূরে ফেলতে হলে গায়ে হাতির জোর লাগবে, চেঁচিয়ে বলল মিতা।

মাথা দোলাল রানা। এবার নিল বৈঠা, ওটা ঠিকই পড়ল শত্রুবোটের সামনে। কিলের নিচে চাপা পড়ে দুটুকরো হলো জিনিসটা।

জবাবে দুই বোট থেকে এল একরাশ গুলি। বাঁক নিয়ে ডানে চলেছে মিতা। সাগরে নাক ঔজল কয়েকটা বুলেট। বসে পড়েছে রানা। ওর চোখ পড়ল ফ্লেয়ার গানের ওপর। কয়েক সেকেণ্ড কী যেন ভাবল, তারপর একটা বয়ার সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিল স্পেয়ার ডাইভিং ট্যাঙ্ক।

এবারের মিসাইল লক্ষ্যভেদ করবে? জানতে চাইল মিতা।

দেখা যাক! সরল রেখার মত সাদা ঢেউ তৈরি হয়েছে পেছনে। ভালভ খুলে ট্যাঙ্ক সাগরে ফেলল রানা। তলিয়ে গেছে ভারী জিনিসটা। কিন্তু পরিষ্কার চোখে পড়ল বুদ্বুদ ও বয়া।

অপেক্ষা করল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর ফায়ার করল ফ্লেয়ার।

বুদ্বুদের দিকে গেল আগুনের কমলা হলকা। ট্যাঙ্কের বাতাসে আছে চল্লিশ পার্সেন্ট অক্সিজেন। এক সেকেণ্ড পর বোমার মত বিস্ফোরিত হলো স্পেয়ার দুই এয়ার ট্যাঙ্ক।

সরে যেতে অনেক দেরি করে ফেলেছে সামনের বোট, পেটের নিচে ট্যাঙ্ক বিস্ফোরিত হতেই সাগর থেকে পুরো দেড় ফুট ওপরে উঠল গোটা জলযান। বেকায়দাভাবে কাত হয়ে সাগরে পড়ল বোট। চাকা-ফাটা দ্রুতগামী গাড়ির মত কয়েক ডিগবাজি খেল ওটা। চারপাশে ছিটিয়ে গেল হাজারো ভাঙা টুকরো। শেষ গড়ান দিয়ে আবারও ভেসে উঠল। পেট ভরা পানি। দেখা গেল না কাউকে।

গুড শট! হৈ-হৈ করে উঠলেন হ্যারিসন।

ইচ্ছেপূরণ হলো না রানার। সঙ্গীদের তুলে নিতে থামল না দ্বিতীয় বোট। বিধ্বস্ত বোটকে পাশ কাটিয়ে ছুটে আসছে ফুল স্পিডে।

মাথার ওপর দিয়ে গুলি যাচ্ছে দেখে এঁকেবেঁকে চলেছে মিতা। এ সুযোগে আবারও কাছে এল দ্বিতীয় বোট। গুলি করছে লোকগুলো। বুলেট ও ট্রেসার বিধছে রানাদের বোটে।

মিতা ব্রেকওঅটার পেরিয়ে বন্দরে ঢুকতেই ডেকে শুয়ে পড়ল রানা। নোঙর করা একগাদা সেইল বোটের মাঝ দিয়ে চলল ওদের বোট। পেছনে চিকন গলায় চিৎকার করে উঠল পাবলো। গা মুচড়ে নিজেকে ছুটিয়ে নিল প্রফেসরের হাত থেকে। লাফিয়ে পড়ল লকারের ওপর। চিৎকার ছাড়ল: টু! টু! টু! টু! টু! লকারের ডালায় কিল বসাল ছোট্ট দুই হাতে।

.

রেডিয়ো থেকে কর্কশ আওয়াজ বেরোতেই গলা ফাটিয়ে নির্দেশ দিলেন জেমস ব্রায়ান: নামতে বলো হেলিকপ্টার দুটোকে!

কেন? জানতে চাইল ড্রাইভার।

নামতে বলো! জলদি!

রেডিয়োর রিসিভার তুলে ব্রায়ানের নির্দেশ রিলে করতে চাইল মাস্টার সার্জেন্ট, কিন্তু সেট থেকে এল শুধু ফিডব্যাক ও স্ট্যাটিক।

ওভারলোড হলো ট্রাকের পেছনের কমপিউটার। নানান ভেন্ট দিয়ে ছিটকে বেরোল কমলা ফুলকি। বিস্ফোরিত হলো সেটআপ-এর সঙ্গের একটা অসিলোস্কোপ।

বন্ধ করো সব! দলের লোকদের উদ্দেশে চিৎকার করলেন ব্রায়ান। স্ফটিক রাখা ভারী সীসার বাক্সের দিকে বাড়িয়ে দিলেন হাত। বন্ধ করো ওটা! বন্ধ করো!

করুণ আর্তনাদ ছাড়ল রেডিয়ো। একের পর এক বিস্ফোরিত হচ্ছে! শর্ট হয়ে গেল কমপিউটার। ব্রায়ান আর বিজ্ঞানী মিলে বন্ধ করতে চাইলেন ভারী সীসার বাক্স, কিন্তু তখনই স্ফটিক থেকে বেরোল অত্যুজ্জ্বল সাদা আলো। শক ওয়েভ ছড়িয়ে গেল ট্রাক থেকে চারপাশের মরুভূমিতে।

.

টু! টু! টু! পাগলের মত চিৎকার করছে পাবলো। বড় বড় হয়ে উঠেছে দুই চোখ। ওয়ান!

বোটের ভেতর বিস্ফোরিত হলো কী যেন!

আরেকটু হলে বোট থেকে পানিতে গিয়ে পড়ত রানা। ড্রাইভার্স প্যানেলে আছড়ে পড়েছে মিতা। কাত হয়ে পড়ে গেল ডেকে। বিস্ফোরিত হলো ইঞ্জিন। আগুনের হলকা বেরোল ডেথ ফাইণ্ডার আর রেডিয়ো ট্রান্সমিটার থেকে।

রানার মনে হলো, পুরু কাঁচের কোনও কিছু দিয়ে বাড়ি মেরে নাক-মুখ সমান করে দেয়া হয়েছে ওর। বুক থেকে বেরিয়ে গেছে বাতাস। ঝনঝন করছে কান। আবছা দেখল, পাবলোর ওপর ঝুঁকে পড়েছেন প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন। একটু সামলে নিয়ে হুইলের পেছনে বসতে চাইছে মিতা।

ঘুরে তাকাল রানা। ওদের আউটবোর্ড মোটর থেকে ভলকে ভলকে উঠছে কালো ধোঁয়া। কোর্স পাল্টে আরেক দিকে চলেছে পেছনের শত্রুবোট। ওটার ইঞ্জিন কমপার্টমেন্ট চাটছে আগুন। একই সমস্যায় পড়েছে বন্দরে বাঁধা কয়েকটা ভেসেল।

হুইল ধরে ঠিক দিকে বোট নিতে চাইল মিতা। এখনও যে গতি আছে, উঠে পড়তে পারবে সৈকতে।

কয়েক সেকেণ্ড পর ঘ্যাঁস্ শব্দে বালির বুকে উঠল বোট।

 রানার দিকে তাকাল বিস্মিত মিতা। কী হলো বলো তো?

জানি না, বলল রানা। ঘুরে দেখল, পাবলোকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন প্রফেসর। রক্তে ভিজে গেছে ছেলেটার কান।

হায়, ভগবান! বিড়বিড় করল মিতা।

চলো, সরে যেতে হবে, বলল রানা, আমি নিচ্ছি ওকে। হাত বাড়িয়ে প্রফেসরের কাছ থেকে অচেতন পাবলোকে নিল ও। লকার থেকে ইকুইপমেন্ট ব্যাগ নিয়ে নেমে পড়ল সৈকতে। ব্যাগের ভেতর রয়ে গেছে ওই স্ফটিক।

সৈকতে নামতে প্রফেসরকে সাহায্য করল মিতা, তারপর নেমে পড়ল নিজেও।

পাবলোকে কাঁধে রেখে পা বাড়িয়ে রানা ভাবল, ওরা পেয়ে গেছে দ্বিতীয় স্ফটিক। কিন্তু কে জানে, সেজন্যে দিতে হবে কত বড় মূল্য!

.

২৭.

একহাতে দরজা ঠেলে ইমার্জেন্সি রুমে ঢুকল রানা, কাঁধে পাবলো। পেছনেই মিতা। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, আমাদের ডাক্তার দরকার! একই কথা স্প্যানিশ ভাষায় জানাল: নেসেসিতামোস উন মেদিকো!

চারপাশে চোখ বোলাল রানা। এই ঘর প্রায় অন্ধকার। টিন্টেড জানালা দিয়ে আসছে রোদের আবছা আলো। এ ছাড়া, দুপ্রান্তে জ্বলছে দুটো করে ইমার্জেন্সি বাতি।

বিদ্যুৎ নেই, নিচু স্বরে বলল মিতা।

ঝোড়ো গতি তুলে ড্রাইভ করে এই হাসপাতালে পৌঁছেছে ওরা। কয়েকবার বেঁচে গেছে মারাত্মক দুর্ঘটনার কবল থেকে। রাস্তায় কাজ করছে না কোনও ট্রাফিক বাতি। জটলা পাকিয়ে গেছে অনেকগুলো গাড়ি। বাধ্য হয়ে ফুটপাথে জিপ তুলে অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়েছে রানা।

এখানে এসেও বিদ্যুৎ নেই। হৈ-চৈ করছে রোগীরা। রেগে ওঠারই কথা। ইমার্জেন্সি রুম, কিন্তু নেই যথেষ্ট নার্স বা ডাক্তার। ওয়েটিং রুমে গাদাগাদি করে অপেক্ষা করছে নতুন রোগীরা। আগে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে চরম অসুস্থদেরকে। মৃদু ট্রমা হয়েছে এমন রোগীদের অপেক্ষা করতে হবে ঘণ্টার পর ঘন্টা।

মিতার ধারণা, এত সময় পাবে না পাবলো। কাজেই এক নার্স চাইতেই ইশারা করে শিথিল, অচেতন ছেলেটাকে দেখাল ও। প্রায় দৌড়ে এল নার্স, হাতে স্টেথোস্কোপ।

আপনি ইংরেজি বলতে পারেন? জানতে চাইল মিতা।

মাথা দোলাল নার্স। স্টেথোস্কোপ রাখল পাবলোর বুকে। কী হয়েছে ওর?

জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছে, বলল মিতা।

পাবলোর রক্তাক্ত কান পরীক্ষা করল নার্স, তারপর চোখের পাতা তুলে ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেলল। গম্ভীর হয়ে গেল মহিলা। সাড়া নেই। শাস ফেলছে না বললেই চলে। রানাকে ইশারা করল সে। আমার সঙ্গে আসুন।

প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এক করিডোরে ওদেরকে নিয়ে এল সে, সামনেই পর্দা ঢাকা দরজা। ওদিকে জ্বলছে ইমার্জেন্সি বাতি। ঘরের ভেতরে পুরনো কিন্তু পরিষ্কার সব ইকুইপমেন্ট। দরকারি সব কিছু পাবলো এখানে পাবে কি না, জানা নেই। অসহায় চোখে রানার দিকে তাকাল মিতা। স্টেটস্-এ নিতে পারলে হতো।

আমাদের ভাল ডাক্তার আছে, চিন্তা করবেন না, বলল নার্স।

চুপ করে থাকল মিতা।

এগযামিনেশন টেবিলে পাবলোকে শুইয়ে দিল রানা। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল নার্স। ফিরল কয়েক মিনিট পর। এখন সঙ্গে এক মহিলা ডাক্তার। উনি বললেন, আমি ডাক্তার ফার্নেন্দেজ। রানা বা মিতার দিকে না চেয়েই টেবিলের পাশে থামলেন। জ্ঞান হারিয়ে গেছে এই ছেলের?

জী, বলল মিতা।

টেবিলের আরেক পাশে সরে পালস্ ও ব্লাড প্রেশার পরীক্ষা করছেন ডাক্তার। কখন এটা ঘটে?

বিশ মিনিট আগে।

মুখ তুলে তাকালেন মহিলা ডাক্তার। যখন বিদ্যুৎ চলে গেল? ওই সময়ে কী করছিল ও?

চুপ করে কী বলবে, ভাবছে মিতা।

টিভি দেখছিল? তখন কি অস্বাভাবিক আলো ছিল ঘরে?

টিপটিপ করা আলোয় অনেক সময় অচেতন হয়ে পড়ে রোগী। বেশি হয় টিভি বা কমপিউটার স্ক্রিনের সামনে থাকলে। মাথা নাড়ল মিতা। না। আমরা ছিলাম সাগরে ভোলা জায়গায়।

অবাক চোখে ওকে দেখলেন ডাক্তার। আপনারা ছিলেন  পুয়ের্তো আয়ুলের দিকে?

মৃদু মাথা দোলাল রানা। বুঝে গেছে, এই ছোট শহরে পৌঁছে গেছে অদ্ভুত ওই দুর্ঘটনার খবর। ঘুমন্ত গ্রামের কাছে বিস্ফোরিত হয়েছে বোট, আর তখনই গেছে বিদ্যুৎ। সৈকতে উঠে এসেছে একটা বোট। ওটা থেকে নেমে গেছে কয়েকজন। তাদের সঙ্গে ছিল ছোট এক আহত ছেলে। চোখ এড়াবার কথা নয় কারও।

এ ছেলের জ্ঞান নেই, বলল রানা। কান থেকে রক্ত পড়ছে। তাই দেরি না করে নিয়ে এসেছি হাসপাতালে।

হয়তো মগজে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, বলল মিতা, দেখুন এমআরআই বা সিটি স্ক্যান করতে পারেন কি না।

অস্বস্তির ভেতর পড়ে গেলেন ডাক্তার ফার্নেন্দেজ। চাপা স্বরে বললেন, আপনারা ছেলেটার বাবা-মা নন।

ঘরে ঢুকল লম্বু এক চওড়া কাঁধের আর্দালি। টের পেয়েছে ঘরের উত্তেজনা। ডাক্তার ফার্নেন্দেজের দিকে তাকাল।

রিকো… বলতে শুরু করে অ্যালার্ম বাটনের দিকে হাত বাড়ালেন ডাক্তার।

কী করবে ভাবতে শুরু করেছে মিতা, কিন্তু ওর দিকে এগোল আর্দালি। তার চেয়ে ঢের দ্রুত রানা, কাঁধের গুঁতো মেরে তাকে দেয়ালে ফেলল ও। হাতে উঠে এসেছে ওয়ালথার। নল তাক করল লোকটার কপালে।

ভীষণ ভয় নিয়ে রানার দিকে তাকালেন ডাক্তার।

মন দিয়ে শুনুন, নরম সুরে বলল রানা, চোখ ডাক্তারের চোখে। দয়া করে ভয় পাবেন না। আমরা আপনাদের ক্ষতি করতে আসিনি। কোনও ক্ষতিও করিনি ছেলেটার।

ওর চোখে চোখ রেখে বড় করে দম নিলেন ডাক্তার ফার্নেন্দেজ। পিস্তলের নল সরিয়ে নিল রানা। তবে দরকার পড়লে ওটা ব্যবহার করতে দ্বিধা করবে না।

মিতার দিকে তাকালেন মহিলা ডাক্তার।

না, আমি ওর মা নই, বলল মিতা, এমন কেউ নই যে ওকে কিডন্যাপ করেছি। ওকে সরিয়ে নিয়েছি একদল ভয়ঙ্কর লোকের কাছ থেকে। তারা কিডন্যাপ করেছিল ওকে। ড্রাগ দিয়েছিল। আমরা চাই না আবারও ছেলেটাকে ধরে নিয়ে যাক তারা।

রানা খেয়াল করল, নরম হলো ডাক্তারের চোখের ভাষা। পাবলোর দিকে তাকালেন তিনি। যদি চিৎকার করে, তাই মুখে হাত চাপা দিতে তৈরি থাকল রানা।

আপনারা কারা? জানতে চাইলেন মহিলা ডাক্তার।

সিকিউরিটি সার্ভিসের সঙ্গে আছি, বলল রানা।

আপনারা বেআইনিভাবে এ দেশে যা খুশি করতে পারেন না, বললেন মহিলা।

অবশ্যই পারি না, মাথা দোলাল রানা। ডাহা মিথ্যা বলল এবার, আমেরিকান কর্তৃপক্ষকে সব জানানো হয়েছে। তারা কথা বলছে এখন এ দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। আধঘণ্টার ভেতর সব ধরনের অনুমতি পাব। কাজেই, প্লিয, দয়া করে ছেলেটাকে সাহায্য করুন। চিকিৎসা শেষ হলে কোনও ঝামেলা না করেই বিদায় নেব আমরা।

দ্বিধায় পড়ে পাবলোকে দেখলেন ডাক্তার।

সাহায্য না করে উপায় কী তাঁর? ডাক্তার তো!

নরম সুরে বললেন ফার্নেন্দেজ, আমরা এমআরআই করব। তারপর বিদায় নেবেন আপনারা।

মৃদু মাথা দোলাল রানা। চাইছে, অন্তত মেডিকেল পরীক্ষা করে দেখা হোক পাবলোকে।

.

একদল মানুষের ভেতর পাবলিক প্লাযায় ঘুরঘুর করছেন প্রফেসর হ্যারিসন। দুপুরের দিকে কারেন্ট যেতেই বেরিয়ে এসেছে টুরিস্ট ও শহরবাসীরা। গাড়ির জ্যাম বেধে গেছে রাস্তায়।

চারদিকে চোখ রেখেছেন হ্যারিসন, গোলমাল দেখলেই পালাবেন। ভয় লাগছে তার। পিঠে ঝুলছে ব্যাকপ্যাক। ওটার ভেতরের মায়ান স্ফটিক থেকেই বিচ্ছুরিত হয়েছিল বিপুল ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এনার্জি। ওই জিনিসের জন্যেই তাদেরকে খুঁজছে দুই দল সশস্ত্র খুনি। যখন-তখন খুন হবেন। রানা বা মিতা চায়নি স্ফটিকটা হাসপাতালে নিতে, বাচ্চা ছেলেটার ওপর নানান পরীক্ষা হবে, তখন ওই জিনিস থেকে বিচ্ছুরণ হলে বাতিল হবে সব যন্ত্রপাতি, তাই বাধ্য হয়ে ওটা রাখতে হয়েছে তাকে।

হ্যারিসনের কাছ থেকে একটু দূরেই কংক্রিট দিয়ে তৈরি এক ফোয়ারা। ওখানে ঘুরছে শত শত মানুষ। বিদ্যুৎ নেই বলে ঘরের গরম থেকে বেরিয়ে এসেছে তারা। এক পাশে ফুটবল খেলছে একদল তরুণ। তাদের তৈরি মাঠের সীমানার বাইরে থেকে খেলা দেখছে ইউনিফর্ম পরা একদল ফেডারাল। তাদের কয়েকজন ঘুরছে টুরিস্টদের মাঝে। তাদেরকে হরিণের পালে নেকড়ে বলে মনে হলো হ্যারিসনের। তাঁর যৌক্তিক মন বলল, ভিড় সামলাতে এসেছে এরা। কিন্তু কু ডাকল মন। পুলিশগুলো আসলে খুঁজছে তাঁদেরকে! একবার ধরতে পারলেই পুরে দেবে কারাগারে। বাকি জীবনে আর বেরোতে পারবেন না ওই নরক থেকে!

.

ডক্টর ফার্নেন্দেজের পাশে দাঁড়িয়ে এমআরআই রিপোর্ট দেখছে রানা ও মিতা। হাইলাইট করা হয়েছে পাবলোর মগজের একটা অংশ। ওদিকে লাল-কমলা, কিন্তু আরেকটা দিক নীল ও ঝাপসা।

এটা কী? জানতে চাইল মিতা।

মেশিনের কন্ট্রোল অ্যাডজাস্ট করলেন ডাক্তার। নতুন করে স্ক্যান করছেন। বিশাল টিউবের মধ্যে নিথর পড়ে আছে পাবলো। জোরালো ক্লিক-ক্লিক আওয়াজ তুলল এমআরআই স্ক্যান। নতুন করে তুলল পাবলোর মগজের ছবি।

এবারের ছবি আগের চেয়ে স্পষ্ট। তবুও আবছাই রয়ে গেল নীল অংশের ছবি।

ইমেজের কোনও ভুল? জানতে চাইল মিতা।

মাথা নাড়লেন ডাক্তার ফার্নেন্দেজ। নিশ্চিত হতে আরেকটা অ্যাংগেল থেকে ছবি নিয়েছি। নীল অংশে আঙুল তাক করলেন তিনি। মেশিনের ত্রুটি থাকলে আবছা অংশ নড়ত। তা হয়নি। কয়েকবার দেখেছি, নীল অংশের ইমেজ রয়ে গেছে শুধু বাচ্চার মগজের নির্দিষ্ট জায়গায়।

জিনিসটা কী? জানতে চাইল মিতা।

আপনি না বলেছিলেন কারা যেন এক্সপেরিমেন্ট করেছে ওর ওপর?

তাই শুনেছি।

দুঃখিত চেহারায় মাথা নাড়লেন মহিলা ডাক্তার। তা হলে আপনারা বোধহয় দেখছেন তাদের এক্সপেরিমেন্টের পরিণাম। ওটা বৈদ্যুতিক কিছু, গেঁথে দেয়া হয়েছে সেরেব্রাল কর্টেক্স-এ।

বৈদ্যুতিক?

ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ তৈরি করছে, বললেন ডাক্তার, খুব সামান্য। কিন্তু সেজন্যেই নীল দেখাচ্ছে ছবি।

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে রানাকে দেখল মিতা। পরক্ষণে চমকে উঠল। টিউবের ভেতর জেগে উঠে চিৎকার শুরু করেছে পাবলো!

.

পার্কের বাইরে এসে দাঁড়ালেন প্রফেসর হ্যারিসন। পাশেই এক হকার। ছোট ছোট অসংখ্য জিনিস তার ডালায়।

আবার পুলিশদের দেখলেন আর্কিওলজিস্ট।

তাদের কয়েকজন রওনা হয়েছে তার দিকেই!

ওরা আসছে স্ফটিক কেড়ে নিতে!

 তা হলে কি তার মনের কথা বুঝে ফেলেছে তারা?

 পালাও, হ্যারিসন! বুকের ভেতর তাড়া দিল কেউ।

পালাও!

ঘুরেই রাস্তার দিকে ছুটলেন প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন।

.

জ্ঞান ফিরতেই গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করেছে পাবলো। তবে এমআরআই মেশিনের বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ করতেই শান্ত হয়ে গেল ও। টিউব থেকে বেরোবার পর আর ছাড়ল না মিতার বাহু। কয়েক ধরনের পরীক্ষা করলেন ডাক্তার ফার্নেন্দেজ।

ব্রেন ফুলে ওঠেনি, বললেন তিনি, নিউরোলজিকাল রেসপন্স যথেষ্ট ভাল।

চুপ করে আছে রানা।

মিতা জানতে চাইল, আর ওর কানের রক্ত?

কানের গর্তে ফুসকুড়ি হয়েছিল, অচেতন হয়ে যাওয়ার সময় ফেটে গেছে, বললেন ডাক্তার। কানে ঠিকই শুনছে। কোনও ক্ষতি হয়নি। মৃদু হাসলেন তিনি। ওর কপাল ভাল।

স্বস্তি নিয়ে পাবলোকে দেখল মিতা।

এবার ওকে কোথায় রাখবেন? জানতে চাইলেন ডাক্তার।

নিরাপদ কোথাও, যেখানে হামলা হবে না, বলল রানা।

আমাদের কাছে রেখে যেতে পারেন, বললেন মহিলা। ওর অযত্ন হবে না, সেটা দেখব।

দ্বিধা নিয়ে রানার দিকে তাকাল মিতা। কী যেন ভাবছে রানা।

ভাল হতো পাবলো হারিয়ে গেলে।

 ল্যাং বা রাশানরা খুঁজে পেত না!

আস্তে করে মাথা নাড়ল রানা। ওকে খুঁজে বের করবে।

প্রয়োজনে খুন করবে আশ্রয়দাতাদেরকে।

কেন খুন করবে? জানতে চাইলেন ফার্নেন্দেজ।

দীর্ঘ কাহিনি, বলল রানা, আপনার বা আমাদের হাতে এত সময় নেই যে বিস্তারিত বলব। এখান থেকে আমরা বেরিয়ে গেলেই যোগাযোগ করবেন পুলিশে। পাবলোর কিডন্যাপাররা এখানে চলে আসতে পারে। তার ফলাফল ভাল হবে না।

মৃদু মাথা দোলালেন ফার্নেন্দেজ, নার্ভাস। একবার দেখলেন, এখনও রানার হাতে পিস্তল। ঠিক আছে, তা হলে আপনারা বেরিয়ে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পর পুলিশে কল দেব। ভুলেও ফিরবেন না।

পাবলোর কাঁধে হাত রেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল মিতা। পিছু নিল রানা।

আমি কি সিকিউরিটির লোক ডাকব? জানতে চাইল রিকো।

না, মানা করে দিলেন মহিলা ডাক্তার।

চলে যেতে দেবেন ওদেরকে?

সেটাই ভাল, বললেন ফার্নেন্দেজ। এদেরকে স্পাই মনে হয়েছে, এসবের ভেতর না জড়ানোই ভাল আমাদের।

আর সত্যি যদি মিথ্যে বলে থাকে?

তা হলে এখান থেকে অনেক দূরে কোথাও গ্রেফতার হবে পুলিশের হাতে।

সামান্য আপত্তি নিয়ে মাথা দোলাল রিকো। দরজার পাশের ছোট এক ডিভাইসের ওপর চোখে পড়ল ওর। বারবার ঝলসে উঠছে সবুজ লেড বাতি।

বাচ্চাটার মগজে ওটা কি রেডিয়োঅ্যাকটিভ? জানতে চাইল রিকো।

না, বললেন ডাক্তার ফার্নেন্দেজ, হঠাৎ জিজ্ঞেস করছ কেন?

লেড বাতি দেখাল রিকো। ওই যে ওয়েস্ট অ্যালার্ম। ওই তিনজনের মধ্যে অন্তত একজন রেডিয়োঅ্যাকটিভ মেটারিয়ালের সংস্পর্শে এসেছে।

.

হনহন করে হেঁটে পালাচ্ছেন প্রফেসর হ্যারিসন। নিজেই বুঝতে পারছেন, আরও জোরে হাঁটলে বা দৌড় দিলে অস্বাভাবিক লাগবে লোকের চোখে। আহত পায়ে শুরু হয়েছে ব্যথা। প্রাণের ভয়ে অস্থির লাগছে বুকের ভেতরটা।

প্রাণপণে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেন, যেভাবে হোক সরে যেতে হবে পুলিশের লোক, রানা, মিতা আর শত্রুদের কাছ থেকে। প্রথম সুযোগে…

কয়েক সেকেণ্ড পর অন্য চিন্তা ঘাই দিল তার মনে। আরে, আগে এ কথা ভাবেননি কেন? রানা আর মিতা তো তাঁর দলের! ওরা নিরাপদে রাখতে চাইছে তাঁকে! তা হলে অবচেতন মন কী বোঝাতে চাইছে?

হাসপাতালের সামনের ব্যস্ত রাস্তায় একটা সিটি বাস থামতে দেখলেন প্রফেসর। প্রায় দৌড়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি। গতি কমতেই বিকট চুই আওয়াজ তুলল বাসের

প্রফেসর? ডাকল কে যেন!

ঘুরে হ্যারিসন দেখলেন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছে রানা ও মিতা। পাশেই হাঁটছে পাবলো। ছেলেটা সুস্থ দেখে খুশি হলেন তিনি।

কী করছিলেন? কাছে এসে সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল মিতা।

বেসুরো কণ্ঠে বললেন হ্যারিসন, আমি পালাচ্ছিলাম। যাতে কেউ দেখতে না পায়। হাতের ইশারা করে পার্ক ও রাস্তার কোণে পুলিশ দেখালেন তিনি।

পুলিশ আমাদেরকে খুঁজছে না, বলল মিতা।

বুঝবে কী করে? আপত্তির সুরে বললেন হ্যারিসন।

কী করা উচিত ভাবছ, রানা? গম্ভীর সঙ্গীর দিকে তাকাল মিতা।

ভুলে যেতে হবে পুরনো ওই জিপের কথা, বলল রানা।

অবাক হলেন প্রফেসর। তা হলে কি আমরা বাসে চাপব?

ঠিকই ধরেছেন, বলল রানা, চলুন, উঠে পড়ি বাসে।

.

২৮.

ইয়াকা পাহাড়ের সুড়ঙ্গের চিরকালীন প্রায়ান্ধকারে বসে আছেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান, কপালে ধরে রেখেছেন বরফঠাণ্ডা পট্টি। চারপাশে ব্যস্ত একদল টেকনিশিয়ান। নানান ইকুইপমেন্টের সঙ্গে যুক্ত করছে অজস্র কেবল। দ্বিগুণ চওড়া এক ট্রেইলারে নতুন করে সাজিয়ে নেয়া হচ্ছে গবেষণাগার।

উদাস হয়ে সবার কাজ দেখছেন ব্রায়ান। দুর্ঘটনার পর থেকেই প্রতি দশ বা পনেরো মিনিট পর পর ভীষণ বমি পাচ্ছে তার। এবার সুযোগ পেয়ে তাঁকে একহাত নিয়েছে সিআইএ চিফ ক্যালাগু। লোকটার মুখে বমি করতে পারলে তিনি খুশি হতেন।

নতুন ল্যাবোরেটরির ফ্ল্যাট-স্ক্রিন মনিটরে দেখা যাচ্ছে নতুন রিভিউ। স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে এনার্জি বিচ্ছুরণ। তবে ওটা দেখার জন্যে উদগ্রীব নন তিনি। বারবার প্যু করে দেখছেন দৃশ্যটা। আবারও চালু করছেন।

মরুভূমির মেঝে ভরা বোমার গর্ত। পাশেই পড়ে আছে আঠারো চাকার ট্রাক। ধোয়া উঠছে ওটা থেকে। একই অবস্থা হামভিগুলোর। একটু দূরে প্রায় বিধ্বস্ত হয়েছে দুই ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার। প্রথমটা মোটামুটিভাবে নেমে এলেও অন্যটা কাত হয়ে পড়েছে, বালির স্তূপে। পুরনো এলপি রেকর্ডের মত খান খান হয়েছে রোটর।

আবারও দৃশ্য পযূ করলেন ব্রায়ান। ওই জ্বলন্ত হেলিকপ্টার থেকে ঝাঁপিয়ে নেমে পড়ছে এক লোক!

ব্রায়ান রওনা হওয়ার আগেই ইয়াকা মাউন্টেনে হাজির হয়েছেন সিআইএ চিফ ক্যালাগু। পুরনো কথা আবারও বললেন, ভাল কোনও ভিডিয়ো নেই আমাদের হাতে। পুরো বেস ভরা হাজারো ক্যামেরা, সেগুলোর ভেতর রয়েছে নিউক্লিয়ার ব্লাস্টের দৃশ্য ধারণের বিশেষ ক্যামেরা, অথচ বিস্ফোরণের চার মিনিট উনিশ সেকেণ্ড আগে থেমে গেছে সব বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি। আবার চালু হয়েছে বিস্ফোরণের এক মিনিট ত্রিশ সেকেণ্ড পর।

কিন্তু আমাদের প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে, মরুভূমির ওপর দিয়ে গেছে শক ওয়েভ। ওটা ছিল নিউক্লিয়ার ব্লাস্টের মত। যদিও ব্যাঙের ছাতার মত মেঘ ছিল না।

আবারও ডিসপ্লে দেখলেন ব্রায়ান। বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট পর জ্ঞান ফিরেছে তাঁর।

ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত পনেরোটা কমার্শিয়াল এয়ারলাইন্স, বললেন ক্যালাগু। সেগুলোর নয়টা পুরোপুরি বৈদ্যুতিক পাওয়ার হারিয়ে বাধ্য হয়েছে ইমার্জেন্সি ল্যাণ্ড করতে। নেলিস রেইডার ও কমিউনিকেশন বন্ধ হয়েছে। সবচেয়ে বড় গ্রিড বিপর্যয় হয়েছে পশ্চিম উপকূলে। ভেগাস, হেণ্ডারসন এবং টাহোও হয়ে গেছে বিদ্যুত্তীন।

কথাগুলো পাত্তা দিতে চাইলেন না ব্রায়ান।

আরও খারাপ দিক, যোগ করলেন ক্যালাগু, রাশা এবং চিন মিলে একইসঙ্গে অভিযোগ করেছে, আমরা নাকি টেস্ট ব্যান ট্রিটি ভেঙে পরীক্ষা করেছি নতুন সুপারওয়েপন। আগামী পরশু সিকিউরিটি কাউন্সিলের মিটিং ডেকেছে ইউএন। তার মানে ছুটির দিনেও কাজ করতে হবে আমাদেরকে।

ব্যথা করছে বলে মাথা টিপলেন ব্রায়ান। নানান দেশের অন্যায্য সব দাবি আর কড়া ধমক জটিল করে তুলেছে পরিস্থিতি।

আপনি আসলে কী বলতে চান? বিরক্ত সুরে জানতে চাইলেন তিনি।

আমি বলতে চাই, আপনার ওই স্ফটিক খুবই বিপজ্জনক, তিক্ত সুরে বললেন ক্যালাগু।

এত ক্ষমতা যে জিনিসের, সেটা তো বিপজ্জনক হবেই, বললেন ব্রায়ান। গাড়ি, অস্ত্র, বোমা, এসব এমনই হয়। এমন কী আপনি নিজেও বিপজ্জনক। প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে এগুলো ব্যবহার করবেন বিপদ এড়িয়ে।

ঠিকই ধরেছেন, ব্রায়ান। আমরা জানি না, ওই স্ফটিক কীভাবে ব্যবহার করতে হবে। আসলে ওটা কী তা-ও জানি না। আমরা শুধু জানি, প্রায় একবছর ধরে গবেষণা করেও গুরুত্বপূর্ণ কিছুই আবিষ্কার করতে পারেননি আপনারা। আর সে কারণে আমাদের সবার প্যান্ট খারাব হওয়ার অবস্থা হয়েছে।

লোকটা নিশ্চয়ই এরই ভেতর সব ডেটা প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ভাবলেন ব্রায়ান। এমনিতেই নানা দেশের চাপ তাঁর ওপর। এখন মুখ রক্ষার মত জরুরি তথ্য না পেলে বিগড়ে বসবেন আমেরিকার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটা।

তার বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করবেন ডেটা সংগ্রহে, জানেন ব্রায়ান। বিস্ফোরণে সব নষ্ট হওয়ায় এরই ভেতর ইয়াকা মাউন্টেনে পাঠানো হয়েছে আরও আধুনিক ইকুইপমেন্ট। চালানো হবে আরও কিছু পরীক্ষা।

খুলে গেল ট্রেইলারের দরজা। ভেতরে ঢুকল এয়ার ফোর্সের এক মেজর। পেছনে সিভিলিয়ান পোশাকে কয়েকজন। এঁদের একজন ব্রায়ানের চিফ অ্যানালিস্ট। দুর্ভাগ্য, বিস্ফোরণের সময় তিনি ট্রাকে ছিলেন না। এ ছাড়া রয়েছেন সিআইএর বেছে নেয়া এক বিজ্ঞানী। কঠোর চেহারা তাঁর। বয়স পঁয়তাল্লিশ। মিলিটারির জন্যে অত্যাধুনিক সব অস্ত্র তৈরির সঙ্গে জড়িত। তৃতীয় লোকটির বয়স অন্তত সত্তর। রেড ইণ্ডিয়ান। ঝুলঝুল করছে গাল ও গলার চামড়া। পাতলা হয়েছে মাথার সাদা চুল। থুতনিতে সামান্য দাড়ি। পরনে কাউবয় শার্ট ও হাজার খানেক পকেটওয়ালা কর্ডের প্যান্ট। পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে নানান যন্ত্রপাতি।

তাকে চিনে ফেললেন ব্রায়ান।

ক্যাথিবা আলিহা। নামকরা থিয়োরিটিকাল ফিযিসিস্ট। আগে কাজ করতেন নিউ মেক্সিকোর অ্যাণ্ডিয়া ল্যাব-এ। এখন। আছেন ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অভ সায়েন্স-এ।

সুনাম আছে তার পরিবারের। তাঁর দাদা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ছিলেন ন্যাভাজো কোড টকার্সের একজন। কোরিয়া যুদ্ধে সাহসিকতার জন্যে মেডেল পান ক্যাথিবা আলিহার বাবা। বড় ভাই ছিলেন রেড ইণ্ডিয়ানদের ভেতর প্রথম গ্রিন ব্যারেট। বুক ভরা ছিল মেডেল। তিনবার যান ভিয়েতনামে যুদ্ধ করতে।

নিজে মিলিটারিতে যোগ না দিয়ে কলেজে গেলেন ক্যাথিবা আলিহা। কিন্তু আত্মীয়দের চেয়েও বেশি নাম করেন মিলিটারির জন্যে নিউক্লিয়ার ট্রিগার আবিষ্কার করে। এখন ট্রাইডেন্ট মিসাইল আরও আধুনিক করা এবং মিসাইল ডিফেন্সের কাজে ব্যস্ত। সত্যি কখনও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধলে, ক্যাথিবা আলিহার অস্ত্রের কারণে যেমন হাজার হাজার মানুষ খুন হবে, তেমনি হাজার হাজার মানুষ রক্ষা পাবে আমেরিকার।

সিআইএ চিফের কথা থেকে এরই ভেতর ব্রায়ান বুঝেছেন, লোকটা চাইছে ধ্বংস করে দেয়া হোক ব্রাযিল স্টোন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত মত অন্যরকম। ভয়ঙ্কর অনুচিত হবে ওই স্ফটিক বিনষ্ট করা। তবে আর কোনও উপায় না পেলে শেষে হয়তো তাই করতে হবে।

স্ফটিক ধ্বংস করা বা রেখে দেয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন ক্যাথিবা আলিহা। শেষ সিদ্ধান্ত হয়তো নির্ভর করবে তার ওপর।

উঠে বিজ্ঞানীর সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করলেন ব্রায়ান। ট্রেইলারের গবেষণাগারে ঢুকে পড়লেন ক্যাথিবা আলিহা। তাঁর সঙ্গে থাকলেন ব্রায়ান। খেয়াল করলেন, স্ফটিক দেখে কুঁচকে উঠেছে রেড ইণ্ডিয়ানের ভুরু। ঠোঁটে চেপে বসল ঠোঁট। কৌতূহলের কারণেও এমন হতে পারে। অথবা, ওটা তার অভ্যেস। তবে ব্রায়ানের মনে হলো, জ্বলজ্বলে স্ফটিক দেখে চরম বিরক্ত হয়েছেন বিজ্ঞানী।

.

২৯.

ভেবেচিন্তে ফাইভ স্টার হোটেলেই উঠেছে মাসুদ রানা। এখন বসে আছে ব্যালকনির চেয়ারে। জায়গাটা পুয়ের্তো আয়ুল থেকে পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে। উপকূলীয় অন্যসব এলাকার মতই বিদ্যুৎ নেই। তাতে খুশিই রানা, ওদের তথ্য ইলেকট্রনিকালি রেকর্ড করতে পারেনি ডেস্ক ম্যানেজার।

রানা ঘুষ দিয়েছে বলে বিদ্যুৎ ফিরলেও ওদের ব্যাপারে তথ্য তুলতে ভুলে যাবে লোকটা। আগাম টাকা দিয়েছে বলে পাশাপাশি দুটো ঘর পেয়েছে। বলে দেয়া হয়েছে, আগামী পাঁচ দিন ওদের উপস্থিতি গোপন রাখলে লোকটা পাবে আরও এক হাজার ডলার। তবে রানা জানে, আগেই এখান থেকে সরে যাবে ওরা।

বিদ্যুৎ তো নেই, তার ওপর চাঁদও নেই আকাশে। কুচকুচে কালো লাগছে সাগর। ওদিকে তৈরি হচ্ছে দুটো ভারী বজ্রবৃষ্টির ঝড়। থেকে থেকে ঝিলিক মেরে রাতকে ফরসা করে দিচ্ছে লালচে-কমলা বজ্রবিদ্যুৎ। জ্বলে উঠছে মেঘের বুকে হাজারখানেক আঁকাবাঁকা বর্শা। সেই আলোয় অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মিতাকে।

মোমবাতির আলোয় চুপচাপ বসে আছে ওরা।

সাগর থেকে এসে শহর ছেয়ে ফেলছে ঝড়ের মেঘ। থমথম করছে চারপাশ। রানা ভাবছে, অতীতের কথা। কিছুক্ষণ পর ফিরল বাস্তবে। মস্তবড় বিপদে আছে ওরা। একদিকে রাশান এফএসবি, অন্য দিকে হুয়াং লি ল্যাং-এর লোক। যে-কোনও সময়ে খুন হবে ওরা। তবু ভাল লাগছে, পাশেই আছে মিতা। বড় অদ্ভুত কোমল হৃদয়ের মেয়ে। মায়ের মত আগলে রেখেছে পাবলোকে। ছেলেটাও অন্তর থেকে ভালবেসে ফেলেছে ওকে।

রানা বুঝতে পারছে, ঠিকই হামলা হবে। তখন বৃদ্ধ আর্কিওলজিস্ট ও মিতার পাশে থাকবে ও, যে ভয়ানক বিপদই হোক না কেন। এখনও ওরা স্থির করতে পারেনি কোথায় লুকিয়ে রাখবে পাবলোকে।

ঘরে গিয়ে ঢুকল মিতা। চুপ করে বসে থাকল রানা। পাঁচ মিনিট পর আবার ফিরে এল মেয়েটা।

মোমবাতির আলোয় মুখ তুলে ওকে দেখল রানা। তোমার রোগীর কী অবস্থা?

রানার পাশের চেয়ারে বসল মিতা। প্রফেসরের ইনফেকশন কমে গেছে। বসে বসে কাজ করছেন। তোমার বিশ্বাস হবে না, সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছে পাবলো।

আমার মাথায় ওভাবে বিলি কেটে দিলে আমিও ঘুমাতাম, মৃদু হাসল রানা।

মানা তো করিনি! লজ্জায় লাল হলো মিতার গাল। ওকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। তোমার বোধহয় লাগবে না?

না। লাগবে না। দূরের অন্ধকারে তাকাল রানা।

জানলে, কীভাবে আমাদের খুঁজে নিয়েছিল লোকগুলো? জানতে চাইল মিতা।

সম্ভবত বোটের ডিলারের কাছ থেকে তথ্য সগ্রহ করেছে, কাঁধ ঝাঁকাল রানা। প্রশ্ন হচ্ছে: ওরা জানল কীভাবে, আমরা ওদিকে আছি।

পাহাড়ি দ্বীপের মূর্তি থেকে তথ্য পেয়েছে, বলল মিতা। ওটা দেখেই মায়ান মন্দির খুঁজে নিয়েছিলেন প্রফেসর।

তুমি বলেছিলে ভেঙে দিয়েছ হায়ারোগ্লিগুলো।

সাধ্যমত করেছি, বলল মিতা। তা যথেষ্ট ছিল না।

 মুখ ফিরিয়ে মিতাকে দেখল রানা।

 তুমি কি খুব চিন্তিত? জানতে চাইল মিতা।

 হ্যাঁ। যে-কোনও সময়ে বিপদ আসবে।

স্মিত হাসল মিতা। অত চিন্তা কেন? মায়ান স্কটিক এখন আমাদের কাছে, ধরতেও পারেনি শক্ররা। পাবলো ঠিক আছে। আমরাও সবাই সুস্থ। আর কী চাই?

অস্থির লাগছে রানার মন।

আকাশ চিরে এক পাশ থেকে আরেক পাশে গেল সাদা ঝিলিক। চোখে পড়ল দিগন্ত ও নিচের সাগর। কয়েক সেকেণ্ড পর এল আবছা আওয়াজ। ওই আলো দেখে আবারও মায়ান ফটিকের কথা মনে পড়েছে রানার। বোটে ওই শক ওয়েভ কীসের, বুঝতে পেরেছ, মিতা?

এনার্জি তৈরি করে এসব স্ফটিক, বলল মেয়েটা। বিচ্ছুরণ হয় ওগুলো থেকে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ।

মন্দির থেকে ওটাকে সরিয়ে নিয়েছি বলে এমন হয়েছে?

আমিও তাই ভাবছি। তবে সেসময়ে শক ওয়েভ না এলে খুন হতাম আমরা। সৈকতে নামলেই গুলি করত চিনারা।

কাকতালীয়, বলল রানা।

 দূরের ঝড়ের দিকে চেয়ে নরম সুরে বলল মিতা, তুমি তো না-ও আসতে পারতে আমার সঙ্গে?

টাকা পাব বলে হয়তো এসেছি? হাসল রানা।

কে দেবে টাকা?

এরই ভেতর ফাণ্ডে জমা নিজের সব টাকা আমার হাতে তুলে দিয়েছেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান। পায়ের ওপর পা তুলে কাটিয়ে দিতে পারি বাকি জীবন।

সত্যিই অত টাকা দিয়েছেন?

মাথা দোলাল রানা। তোমাকে মেয়ের মত ভালবাসেন। তাই ফিরে পাওয়ার জন্যে পথে নেমে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েছেন।

মায়ান স্ফটিক খোঁজার ব্যাপারে তাঁকে রাজি করিয়েছিলেন হ্যারিসন, তাই আমিও আসি এই অভিযানে, বলল মিতা। তারপর যখন কিডন্যাপ হলাম, সব দায় নিজের কাঁধে তুলে নিলেন আঙ্কেল ব্রায়ান। অদ্ভুত ভাল মানুষ।

উদ্ধার পেয়েও দেশে ফিরলে না, বলল রানা। তুমি নিজেও ভাল, তাই প্রফেসরকে খুঁজতে গিয়ে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছ। ভুলে যেতে পারতে তাঁর কথা, তা না করে চেয়েছ তাঁকে নিরাপদে রাখতে।

স্রেফ দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছি। রানার চোখে তাকাল মিতা। সব ফেলে আমার জন্যে ছুটে গেলে তুমি হংকঙে, এটাই আমাকে অবাক করেছে। বুঝে গেছি, যাদেরকে পছন্দ করো, তারা বিপদে পড়লে প্রাণ দিতেও দ্বিধা করো না তুমি।

চুপ করে থাকল রানা।

তুমি এমনই, তাই না? কখনও হেরে যেতে চাও না।

মোমবাতির আলোয় লোভনীয় লাগছে মিতার অধর।

অস্ফুট স্বরে কী যেন বলল মিতা। একটু ফাঁক হলো ঠোঁট।

হঠাৎ ওর দিকে ঝুঁকল রানা।

 পরস্পরের চোখে চোখ, বুকে অদ্ভুত এক তোলপাড়।

ছুঁয়ে গেল দুজনের ঠোঁট, কিন্তু তখনই বেরসিকের মত বেজে উঠল রানার স্যাটেলাইট ফোন। পকেট থেকে ওটা বের করে স্ক্রিন দেখল রানা। মিস্টার ব্রায়ান। চেয়ারে হেলান দিয়ে স্পিকার অন করে কল রিসিভ করল ও। বলুন?

বিস্মিত সুরে বললেন এনআরআই চিফ: পশ্চিম উপকূলে খুব কম মোবাইল ফোন এখনও কাজ করছে। কপাল ভাল যে আপনার ফোন এখনও চালু।

আমারটা বিসিআই থেকে পাওয়া সোলার পাওয়ার্ড ফোন, বলল রানা।

দুঃখিত, দেরি করেছি যোগাযোগ করতে, বললেন ব্রায়ান। খুব ব্যস্ত ছিলাম। এদিকে ঘটে গেছে দুর্ঘটনা।

ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলেন তিনি। শেষে বললেন, সুযোগ পেয়ে এনআরআই-এর ঘাড়ে চেপে বসতে চাইছে এখন সিআইএ। তাদের ধারণা, ধ্বংস করে দেয়া উচিত মায়ান স্ফটিক।

আপনি এখন কোথায় এবং কী করছেন? জানতে চাইল রানা।

ইয়াকা মাউন্টেনে, দেখছি আবারও এনার্জি বিচ্ছুরণ হবে কি না ওই পাথর থেকে। সময়ের আগেই হঠাৎ করে বসেছে।

পরস্পরকে দেখল রানা ও মিতা।

বোট আর ইয়াকা মাউন্টেনে একইসময়ে তৈরি হয়েছিল শক ওয়েভ। হয়তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

বোধহয় জানি কী হয়েছে, বলল রানা। বলুন তো?

আরেকটা মায়ান স্ফটিক পেয়েছি। ওটা ছিল উপকূল থেকে আট মাইল গভীর সাগরে এক ডুবো মন্দিরে।

দুর্দান্ত খবর, খুশি হলেন ব্রায়ান।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এনার্জি বিচ্ছুরণ হয়েছে আমাদের ফটিক থেকেও। সেজন্যে চলে গেছে ইউক্যাটানের অর্ধেক এলাকার বিদ্যুৎ।

আমাদেরটাও একই কাজ করেছে, বললেন ব্রায়ান।

আমার ভুল না হলে এসব স্ফটিক সর্বক্ষণ সিগনাল দেয় পরস্পরকে, বলল রানা।

একটা আরেকটাকে খুঁজে নেয়, যেমনটা করে কমপিউটারের নেটওঅর্ক?

এবার আলোচনায় যোগ দিল মিতা। আপনার স্ফটিক ছিল পাঁচ নম্বর দালানের নিচে, আর আমাদেরটা ছিল উপসাগরের পঞ্চাশ ফুট নিচে। চারপাশ থেকে ঘেরা ছিল হাজার হাজার টন পাথর ও প্রবালে। কিন্তু যখন সরিয়ে নিলেন আপনাদের স্ফটিক, ওই একইসময়ে সাগর থেকে আরেকটাকে তুলে এনেছি আমরা।

দুটোর শক ওয়েভ কাকতালীয় মনে হচ্ছে না, সায় দেয়ার সুরে বললেন এনআরআই চিফ। এনার্জি ওয়েভ কীভাবে বাড়ে, ওটা নিয়ে গবেষণা করছি আমরা। হঠাৎ বিকিরণ হলো। স্ফটিকের ভেতর ম্যালফাংশান হয়েছে, অথবা ওই দুই স্ফটিকের ওয়েভ মিলে যেতেই তৈরি হয়েছে শক ওয়েভ।

আমারও তাই ধারণা, বলল মিতা।

ফলে নতুন তথ্য পাব, ব্রায়ানের কণ্ঠে ফুটে উঠেছে। সামান্য স্বস্তি। এবার হয়তো বুঝব, কী কারণে বেড়ে গেল সিগনাল।

অস্বাভাবিক এসব স্ফটিক নিজেদের ভেতর সংযোগ রাখছে, ফিযিসিস্ট হিসেবে মতামত দিল মিতা, হয়তো কোনও নেটওর্ক আছে?

শক ওয়েভের সময় হয়তো ছিল, বললেন ব্রায়ান, এখন নেই। তা ছাড়া, কনটেন্টমেন্ট সাইটের মত ইয়াকা মাউন্টেনের টানেল। হয়তো সেজন্যে এখানে আনার পর খুব সাধারণ হয়ে গেছে ব্রাযিল স্টোন।

আপত্তি তুলল না মিতা।

তোমার নতুন এই থিয়োরি অনুযায়ী কাজে নামব আমরা, বললেন ব্রায়ান। আমার ধারণা, ঠিক পথেই ভাবছ।

এবার দেখবেন দুই স্ফটিক এক হলে কি ঘটে? জানতে চাইল মিতা। আমরা অবশ্য এ দেশের সিকিউরিটি এড়িয়ে আমেরিকায় জিনিসটা নিতে পারব না। তা ছাড়া, ওটা বিমানে তোলাও নিরাপদ নয়।

ঠিক, সায় দিলেন ব্রায়ান। আপাতত রাখো তোমাদের কাছে। চেষ্টা করো ওটাকে বদ্ধ কোথাও রাখতে। নইলে আবারও দেশ জুড়ে বৈদ্যুতিক বিপর্যয় হতে পারে।

চেষ্টা করব আগলে রাখতে, কথা দিল মিতা।

আপনি দেখুন পাবলোকে সরাবার জন্যে কাগজপত্র পাঠাতে পারেন কি না, বলল রানা।

আপনাদের সঙ্গে ও থাকলে অসুবিধা কী?

ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালসের জন্যে ক্ষতি হচ্ছে ওর, বলল রানা। আপাতত সুস্থ, কিন্তু ওকে নিরাপদ কোথাও সরিয়ে দেয়া উচিত। রাশানরা যে এক্সপেরিমেন্ট করেছে, সে কারণে বিচ্ছুরণ হলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ও।

আসলে কী করেছিল রাশানরা? জানতে চাইলেন ব্রায়ান। ব্রেনে কিছু ইমপ্ল্যান্ট করেছিল, বলল মিতা, শক ওয়েভের পর আধঘণ্টা অজ্ঞান ছিল। হাসপাতালে নিয়ে এমআরআই করিয়েছি। বড় করে দম নিল ও। বড় কথা, ওর দরকার ভাল একটা পরিবার। আমাদের সঙ্গে রয়ে গেলে যে কোনও সময়ে বিপদে পড়বে।

চুপ করে আছেন ব্রায়ান।

গোপনে নিতে পারবেন ওকে আমেরিকায়? জানতে চাইল রানা।

আগেও বলেছি, একবার ওকে পেলে গাপ করে দেবে সিআইএ, তিক্ত স্বরে বললেন ব্রায়ান। ওটা আরও খারাপ হবে। তার চেয়ে দিমিতভের হাতে ওকে তুলে দেয়াও ভাল।

রেগে গেছে মিতা। কাটা কাটা স্বরে বলল, আমরা চাইলেই তো ওর মত ছোট্ট বাচ্চাকে বিপদের ভেতর রাখতে পারি না!

বুঝতে পারছি কী বলছ, কিন্তু আপাতত আমি নাচার, বললেন এনআরআই চিফ।

আমরাও প্রায় নাচার, বলল মিতা, বিপদের ভেতর আছি।

রানার কাছে বেশি নিরাপদ থাকবে ছেলেটা, অপরাধী সুরে বললেন ব্রায়ান। কয়েক সেকেণ্ড পর জিজ্ঞেস করলেন, আসলে ওখানে কী ঘটছে?

পিছনে লেগে গেছে চিনা বিলিয়নেয়ার আর রাশানরা।

ওই দুটো দেশই খেপে গেছে আমাদের ওপর, বললেন এনআরআই চিফ। বলছে, আমরা নাকি গোপনে নিষিদ্ধ কোনও শক্তিশালী অস্ত্র পরীক্ষা করছি। ওটার ওপর আমাদের নিজেদেরই নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের সঙ্গে একমত সিআইএ চিফ ক্যালাগু। এখন সেটাই বোঝাতে চাইছে প্রেসিডেন্টকে। তিনি হয়তো বুঝবেন না যে এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মনোভাব পাল্টে ফেলতে পারেন। তা হলে সমস্ত দায় পড়বে এনআরআই বা আমার ওপর।

এসব থেকে কী বুঝব? জানতে চাইল রানা।

চিনা বিলিয়নেয়ারের কিডন্যাপ করা এক রাশান ছেলেকে আমরা কিডন্যাপ করে সরিয়ে নিলে, সমস্ত দোষ পড়বে আমেরিকার ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোর ওপর।

তা হলে ব্যবস্থা করুন কোনও সেফহাউসের, বলল রানা।

মেক্সিকোতে? এনআরআই-এর? তেমন কিছু আমাদের নেই!

আরও গম্ভীর হয়ে গেল রানা। খেয়াল করল, দরজা দিয়ে ঘরে চোখ রেখেছে মিতা। বিছানায় ঘুমিয়ে আছে পাবলো।

রানার মনে হলো, ফালতু এবং নিষ্ঠুর একটা দেশের জন্যে নিরীহ বাচ্চাটার জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে ও। ওই একই বিপদ ঘাড়ে নিয়েছে মিতা ও প্রফেসর হ্যারিসন। অথচ, এদের তিনজনকে আগলে রাখা প্রায় অসম্ভব ওর পক্ষে!

মেঘের মত গুড়গুড় করে উঠল ওর কণ্ঠ, বলতে চাইছেন, আমাদের সঙ্গে পাবলোর রয়ে যাওয়াই নিরাপদ?

তা নয়, নরম সুরে বললেন ব্রায়ান, বলছি, ছেলেটাকে এ দেশে আনলে ক্ষতি হবে ওর। ওকে কেড়ে নেবে সিআইএ বা মিলিটারি। তাতে লাভ হবে না আমাদের কারও।

ঝিরঝির করে একরাশ হাওয়া বইল ব্যালকনিতে। চুপ করে আছে রানা। ওকে দেখছে মিতা, চোখে দ্বিধা ও ভয়। এই রানাকে চেনে না ও।

সবমিলে পাবেন বিরানব্বই ঘণ্টা, বললেন ব্রায়ান, তারপর একসঙ্গে বাড়বে দুই স্ফটিকের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বিচ্ছুরণ।

একটু পর বলল রানা, কী করব, সেটা ফোনে আপনাকে পরে জানিয়ে দেব। বিরক্ত হয়ে কল কেটে দিল ও।

বাড়ছে বাতাসের জোর। শীতল হয়ে উঠছে চারপাশ। কাত হয়ে ব্যালকনির মেঝেতে পড়ল বৃষ্টির বড় কয়েকটা ফোঁটা। তারপরই শুরু হলো ঝমাঝম বর্ষণ। বিজলি জ্বলে উঠল সাগরের বুকে। সেই আলোয় দেখা গেল অস্থির সব বড় ঢেউ।

চুপ করে দূরের ঝড় দেখছে মিতা।

রানার মনে হলো, মেয়েটার বুকেও ভীষণ তুফান। কীসের, বোঝা কঠিন। ওর মগজে ঘুরছে ব্রায়ানের গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা: সবমিলে পাবেন বিরানব্বই ঘণ্টা, তারপর বাড়বে দুই

স্ফটিকের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বিচ্ছুরণ।

কী ঘটতে চলেছে আসলে? মিতার কাঁধে টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকল রানা।

বিপদের জন্যে প্রস্তুত হতে হবে ওদেরকে।

.

৩০.

ক্যামপেচে শহরতলীতে বিশাল ওয়্যারহাউসটি হুয়াং লি ল্যাং ইণ্ডাস্ট্রিয়ালের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান। আপাতত এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে সাধারণ সব ব্যবসার মালপত্র। ওয়্যারহাউস ব্যবহার হচ্ছে ল্যাং-এর ব্যক্তিগত কাজে। আশা করা হচ্ছে, যে-কোনও দিন বিলিয়নেয়ার পাবে তার সাধের মায়ান স্ফটিক।

হুইলচেয়ারে বসে সবার ব্যস্ততা দেখছে ল্যাং। পেছনের দেয়ালের কাছে স্কাইক্রেন হেলিকপ্টার। ওটা দিয়েই আইলা কিউবার্তো দ্বীপ থেকে আনা হয়েছিল রাজার মূর্তি। নতুন মিশনের জন্যে পাশেই আরও দুটো হেলিকপ্টার। দেয়াল ঘেঁষে অসংখ্য ইকুইপমেন্ট। একপাশে আর্মার্ড ভেহিকেল, ইনফ্লেটেবল রাফট, দুজন আরোহীর উপযোগী সাবমেরিন ও কয়েকটি ড্রোন। শেষের চাইনিজ জিনিসটা ইউ.এস. আর্মির প্রিডেটর ড্রোনের মতই।

চারপাশে চেয়ে গর্বে বুক ভরে গেল ল্যাং-এর। পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসী। বছরের পর বছর ধরে বাড়ছে তার হাই-টেক সব ইকুইপমেন্ট। সে-কারণেই যুদ্ধে জয় পাবে সে।

ক্রমেই বেড়েছে শারীরিক অসুস্থতা, তাই বাধ্য হয়ে এসব আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে চোখ রেখেছে সাম্রাজ্যের ওপর। অসুখ বাড়তেই সে সুযোগ নিয়ে তাকে শেষ করতে চেয়েছে। অন্য বিলিয়নেয়াররা। তা সম্ভব হয়নি শুধু টেকনোলজির কারণে। অসুস্থতার শুরুর দিকেই সে বুঝে গিয়েছিল, চারপাশে নজর রাখার ক্ষমতা মানুষের বড় কম। তাই নানান দিক থেকে হামলা করবে বাইরের শত্রুরা।

তার ওপর ছিল ঘরের শত্রু। অনেকেই চেয়েছে, শেষ হোক ল্যাং ইণ্ডাস্ট্রি। চরম অসুস্থতার ভেতর বাধ্য হয়ে ব্যবহার করল সে আট্রামডার্ন সার্ভেইলেন্স সিস্টেম।

আশপাশের প্রতি ইঞ্চি জায়গায় চোখ রাখল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সফ্টওয়্যার। শত শত অ্যানালিস্টকে চাকরি থেকে বিদায় করে ওই কাজ নিল আধুনিক সব প্রোগ্রাম। নজরদারীর ভেতর পড়ল দক্ষ ও অদক্ষ সবাই। প্রোগ্রাম স্থির করল, কাকে চাকরিতে রাখবে, আর কাকে নয়। আজকাল কোনও মিটিং হয় না। কাজ করে না আবেগ বা বন্ধুত্ব, শুধু ডেটা ও অ্যালগোরিদম বলে দিচ্ছে কী করতে হবে আর কী করতে হবে না। বাড়তি মানুষ বিদায় নেয়ায় মুনাফা বেড়েছে ল্যাং-এর প্রতিষ্ঠানের।

এবার স্ফটিক খুঁজতে অত্যাধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করছে ল্যাং। ক্যাং লাউ এবং তার দলের লোক যতই চেষ্টা করুক, সে বুঝে গেছে, শেষপর্যন্ত জিতবে আধুনিক যন্ত্রপাতি। ওসব চালাতে মানুষের প্রয়োজন আছে, কিন্তু তারা ভুল করলেও কখনও ব্যর্থ হয় না মেশিন।

ল্যাং-এর ধারণা, ক্যাং লাউ বা তার দল বড়জোর স্পেয়ার পার্ট। নষ্ট হলে বদলে নেবে। মূল কথা: চালু রাখতে হবে দরকারী মেশিন।

ল্যাং-এর সামনে এসে থামল এক ডাক্তার। নতুন চিকিৎসার জন্যে তৈরি।

হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিল ল্যাং, চলল টেস্টের টেবিলের দিকে। বরাবরের মতই পাশেই থাকল বিশ্বস্ত ক্যাং লাউ।

ধাতব টেবিলে নানান চেনা ইকুইপমেন্টের সামনে পৌঁছুল ল্যাং। সেগুলোর ভেতর রয়েছে ইলেকট্রিকাল স্টিমুলেটর, মনিটর বা পাওয়ার প্যাক।

আপনি কি তৈরি? জানতে চাইল ডাক্তার।

টেস্ট শেষ? জানতে চাইল ল্যাং।

মাথা দোলাল ডাক্তার। আগের পরীক্ষা থেকে ফিডব্যাক ও ডায়াগনস্টিক দেখে স্থির করা হয়েছে, কীভাবে চলবে চিকিৎসা।

এবার বোঝা যাবে সুস্থ হবে কি না ল্যাং। মৃদু মাথা দোলাল সে। বাড়িয়ে দিল মুচড়ে থাকা হাত। বেশ। কাজ শুরু করুন।

ব্যস্ত হয়ে উঠল ডাক্তার। টেনে নিল বিলিয়নেয়ারের বাহু। ওটার সঙ্গে যুক্ত করল কাঁধে রাখার মত অদ্ভুত এক হার্নের্স। প্রায় বেঁধে ফেলল ল্যাংকে। হার্নেসের নির্দিষ্ট জায়গায় একের পর এক কেবল লাগাল কয়েকজন ডাক্তার।

আপনি চিকিৎসা নিন, আমি যাই, বলল লাউ।

না, এখানেই থাকবে, নির্দেশ দিল ল্যাং।

অস্বস্তি নিয়ে পাশের চেয়ারে বসল বিশ্বস্ত স্যাঙাত।

কাজে নেমে পড়ল ডাক্তাররা।

ওদিকেই এল হলদে এক ফোর্কলিফ্ট। বয়ে আনছে বড় সব বাক্স। টেবিলের পাশে নামিয়ে দিয়ে গেল। দৌড়ে এসে বাক্স খুলল কয়েকজন মজুর। সবচেয়ে বড় বাক্স থেকে বেরোল বিশাল এক যন্ত্র, দেখতে চতুষ্পদী খচ্চরের মত। মাঝে শক্তিশালী ইঞ্জিনটাকে নিয়ন্ত্রণ করবে কমপিউটার, নিখুঁত ভারসাম্য রাখবে যন্ত্র, চলবে যে-কোনও উঁচু-নিচু জমিতে। ওটার সঙ্গে আছে কয়েক শ পাউণ্ড ওজনের নানান ইকুইপমেন্ট।

ব্যস্ত হয়ে মেশিন অ্যাসেম্বল করছে ল্যাং-এর টেকনিশিয়ানরা। বিরক্তি নিয়ে ওদিকে চেয়ে রইল ক্যাং লাউ।

তোমার বোধহয় ভাল লাগছে না? জানতে চাইল ল্যাং।

দ্বিধা করল লাউ।

তোমার মনে হচ্ছে খামোকা এসব করছি? রাগ চেপে বলল ল্যাং।

আপনার এত ইকুইপমেন্ট আমাদেরকে দেরি করিয়ে দেবে, বলল লাউ।

না, তার উল্টো হবে, বলল বিলিয়নেয়ার।

তার ও কেবল ঠিক জায়গায় আটকে দিয়েছে ডাক্তাররা। ল্যাং-এর বাহুর ওপর বেঁধে দেয়া হলো হার্নেসের পাওয়ার প্যাক। প্রশংসার চোখে টাইটানিয়ামের ব্রেস, হাইড্রোলিক, অ্যাকচুয়েটর, নকল কনুই ও কাঁধের জয়েন্ট দেখল ল্যাং। কবজিতে ভবিষ্যতের বডি আর্মারের মত জিনিস। বাস্তবে ওটা আরও বেশি কিছু।

সব পরীক্ষা করল ডাক্তাররা। অ্যাডজাস্ট করল কিছু জিনিস। নতুন করে টাইট দিল কয়েকটা স্ট্র্যাপ। এবার নানান ছোট মেশিন আটকে দেয়া হলো ল্যাং-এর আঙুলে।

ওই ছেলে বা মেয়েটার ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার, বলল ল্যাং, বারবার তোমাকে ফাঁকি দিয়ে গেছে তারা।

আপাতত। কিন্তু ঠিকই ওদেরকে হাতের মুঠোয় পাব, বলল ক্যাং লাউ।

গতকাল প্রায় পেয়ে গিয়েছিলে, বলল ল্যাং, কিন্তু তোমাকে বোকা বানিয়ে উধাও হয়েছে।

ক্যাং ও ল্যাং-এর মাঝে টেবিলের পাশে থামল এক ডাক্তার। ল্যাং-এর আঙুলের তারের সঙ্গে আটকে দিল অ্যাকচুয়েটর।

প্রথম সুযোগে পালিয়ে গেছে, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল লাউ। পারত না, কিন্তু তখনই এল ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বাস্ট। তবে তার আগে সরাসরি আমরা যেতে পেরেছি সাগরের ওই মন্দিরের কাছে। এখন আমাদের লোক ডাইভ দিচ্ছে ওখানে। মন্দিরের হায়ারোগ্লিফের ছবি তুলছে। দুএক দিনের ভেতর অনুবাদ হবে সব। নতুন তথ্য পেলেই সরাসরি যাব পরের গন্তব্যে।

কথা শুনে খুশি হলো না ল্যাং। তুমি দেরি না করলে অনেক আগেই ওই মন্দির থেকে স্ফটিক পেয়ে যেতাম।

তা ঠিক, স্বীকার করল লাউ, কিন্তু বড় সমস্যা হয়নি, জেনে গেছি ওদের থিয়োরি। সবমিলে আছে মোট চারটে ফটিক। তার মানে রয়ে গেছে আরও দুটো।

না, নিশ্চিত সুরে বলল ল্যাং। ওই জিনিস আছে আর মাত্র একটা।

অবাক চোখে তাকে দেখল লাউ।

 প্রিয় কুকুরের সঙ্গে কথা বলার সময় যেমন নরম হয় মানুষের কণ্ঠ, সেই সুরে বলল ল্যাং, জানি, এসব ভালভাবে বোঝার যোগ্যতা বা দূরদৃষ্টি তোমার নেই। তুমি আসলে যন্ত্রের সামান্য একটা পার্টস্, যেটাকে দরকারে ব্যবহার করা হয়।

টেকনিশিয়ানদের দিকে দেখাল সে। তারা টুইযার দিয়ে সরু সব তার আটকে দিচ্ছে হাতের নানান নার্ভ জংশনে। প্রতিবারে সামান্য নড়ে উঠছে ল্যাং-এর বাহু।

সূক্ষ্ম কাজে ধারালো তলোয়ারের ফলার বদলে হাতুড়ি ব্যবহার করলে যা হয়, বলল ল্যাং, হাতুড়ির দোষ দিতে পারে না মজুর। আসলে নিজের কাজ না বুঝে সময় নষ্ট করেছ। আমি কাজ বুঝিয়ে দিয়েছি বলে দোষটা আমার হতে পারে না। চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছ তুমি।

এখন আমাদের কাছে যে ধরনের তথ্য আছে, এবার ওদের আগেই পরের সাইটে পৌঁছব, বলল লাউ। ওরা যখন ওখানে পৌঁছুবে, দেখবে অপেক্ষা করছি আমরা। তখন ফাঁদ পেতে ধরব ওদেরকে। পালাতে পারবে না চাইলেও।

আমরা এবার পাওয়ার দেব, বলল টেকনিশিয়ানদের নেতা।

বিরক্ত চোখে তাকে দেখল ক্যাং লাউ।

কাজ শুরু করো, বলল ল্যাং। মেশিন চালু হতেই সামান্য নড়ল তার বাহু।

টেকনিশিয়ানদের সামনে গোপন কথা বলতে হচ্ছে বলে অপমানিত সুরে বলল লাউ, আমি চিন্তিত।

কী বিষয়ে? বাহু নাড়াবার ডিভাইসটা দেখছে ল্যাং।

সাবধানে মুখ খুলল লাউ, বুঝতে পারছি আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন স্ফটিকের জন্যে, কিন্তু ওটার যে ভয়ঙ্কর শক্তি…

লাউ মুখে মুখে কথা বলছে, তাই রাগী স্বরে বলল ল্যাং, রাশানরা ওটা ব্যবহার করেছে ছোট ছেলেটাকে সুস্থ করতে।

তা ঠিক। কিন্তু ওই স্ফটিকের টুকরো কী করেছে, তা নিজেই বুঝতে পারছেন। ওটা কিন্তু নিরাপদ নয় আমাদের জন্যে।

সামান্য বিস্ফারিত হলো ল্যাং-এর চোখ। কড়া সুরে বলল, আমি যা চাই, সেটা সবসময় পেয়ে অভ্যস্ত।

তাই হবে, আপনার জন্যে ওটা কেড়ে এনে দেব, বলল লাউ। কিন্তু খুব সতর্ক হতে হবে আমাদেরকে।

বাড়াবাড়ি করছে ক্যাং লাউ, রাগে অস্থির লাগল ল্যাং-এর। অন্য কিছুও খেয়াল করেছে। ধনদৌলতের লোভ পেয়ে বসেছে লাউয়ের। এ কারণেই বেঈমানি করছে, নির্দেশ অমান্য করছে। এখন পরিষ্কার সব বুঝতে পারছে সে। ইচ্ছে করেই ব্যর্থ হয়েছে লোকটা। তার চাই ল্যাং ইণ্ডাস্ট্রিয়ালের মালিকানা।

তুমি চাও যেন না পাই ওই স্ফটিক, গনগনে রাগ নিয়ে বলল ল্যাং।

না, তা ঠিক নয়, বলল লাউ।

সবই বুঝেছি, আমি মরলেই পথ খুলবে তোমার, ভাবল ল্যাং। তুমিও আর সবার মতই বিশ্বাসঘাতক, লাউ!

সুযোগ পেলে ওটা সরিয়ে ফেলবে, বলল ল্যাং। তুমি চাও আমি মারা যাই!

না, ভুল ভাবছেন। আমি চাই আপনি যেন ওটা পান। তবে এটাও চাই, ওটার কারণে আপনি যেন বিপদে না পড়েন। সেজন্যে…

কথা শেষ করতে পারল না ক্যাং লাউ। চোখ পড়েছে ল্যাং এর কবজির কাছে। ওখানে অদ্ভুত এক ডিভাইস। ওটার ওপর ফণা তোলা সাপের মত নড়ছে ল্যাং-এর আঙুল। তালু মেলল ল্যাং।

ক্যাং লাউ ও হুয়াং লি ল্যাং-এর কাছেই কফিনের মত বড় এক ক্রেট খুলেছে টেকনিশিয়ান। ধুম শব্দে মেঝেতে পড়ল ডালা। বাক্সের ভেতরে ল্যাং-এর কাঁধ ও হাতের অদ্ভুতদর্শন মেশিনের মতই জিনিস। আরও আছে যান্ত্রিক দুই পা। বুক ও মাথার জন্যে বর্ম ও শিরস্ত্রাণের মত জিনিস। হাইড্রোলিক অ্যাকচুয়েটরের সঙ্গে এক বাণ্ডিল ওয়্যায়ার ও র‍্যাক ভরা জি ফোর লিথিয়াম ব্যাটারি।

ওদিকে চেয়ে খুশি হয়ে উঠল হুয়াং লি ল্যাং।

দ্বিধা ও ভয় ফুটল ক্যাং লাউয়ের মুখে।

কয়েক বছর ধরে তোমার ওপর আমি নির্ভরশীল, লাউকে বলল ল্যাং, সহ্য করেছি তোমার ব্যর্থতা। চুরি থেকে শুরু করে বেয়াদবি কম করোনি। তবে এখন থেকে তোমাকে আর দরকার পড়বে না আমার।

তার বাহু ঝুলছে বড় একটা ক্রু-ড্রাইভারের ওপর। হাইড্রোলিক আঙুলগুলো চোখের পলকে খপ করে ধরল ওটা। পেছনে নিল স্ক্রু-ড্রাইভার, পরক্ষণে সামনে বাড়ল বাহু।

বুলেটের মত গতি চমকে দিল ক্যাং লাউকে। বোঝার আগেই বুকে গাঁথল ধ্রু-ড্রাইভার। কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল সে। দুহাতে বের করতে চাইল স্টিলের দণ্ড। কিন্তু হাড়ে লেগেছে, খুলল না ওটা। ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে তাজা রক্ত।

বার কয়েক হাঁফিয়ে উঠে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করল লাউ। চোখ গেল মনিবের চোখে। বিড়বিড় করল, আমি… বেঈমান নই… ওদেরকে ধরে আনব… আপনার জন্যে…।

মৃতপ্রায় লাউকে মৃদু হেসে জানাল হুয়াং লি ল্যাং, তোমাকে আর লাগবে না, লাউ। যখন পাব ওদেরকে, আমি নিজেই শাস্তি দেব!

.

৩১.

দিনটা ভাল, ভাবছে পাবলো। জোরালো কোনও আওয়াজ নেই। ফিরে এসেছে বিদ্যুৎ। ধীরে ধীরে ঘুরছে সিলিং ফ্যান।

ঘাড় কাত করে ঘরের আরেক দিকে তাকাল পাবলো।

ওই যে টেবিলে বসে কী যেন করছে কালো, বুড়ো লোকটা। বহু কিছু জানে সে। এমন কিছু দেখে বা শোনে, যেটা রানা, মিতা বা ও নিজে বুঝতে পারে না। খুব জানোয়ার লোক, জানে অনেক। কীসব ভাবতে থাকে আর বিড়বিড় করে কার সঙ্গে যেন কথা বলে। কিন্তু কাউকে দেখা যায় না।

বুড়োকে পছন্দ করে পাবলো। দয়ালু লোক। মিষ্টি করে কথা বলে। যদিও তার অচেনা ভাষা বোঝা যায় না। কাগজ পেন্সিল পেলেই খসখস করে কীসব লেখে। আপন মনে কী যেন গাল দেয়। কমপিউটারের চাবি টেপে।

গরম হয়ে উঠছে কমপিউটার, টের পেল পাবলো। কে জানে, হয়তো একদিন পুড়েই যাবে মেশিনটা। ওটার জ্বলজ্বলে আলো পড়লেই জ্বলতে থাকে ওর চোখ।

না, ওই জিনিসটা ভাল না, ভাবল পাবলো।

বুড়োও ওটাকে বেশি পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে চাপড় মারে ওটার পিঠে।

আচ্ছা, ওটা নিয়ে গিয়ে ব্যালকনি থেকে ফেলে দেয় না কেন?

চিন্তায় পড়ে গেল পাবলো। ও নিজেই কি ফেলে দেবে ওটা?

না, উচিত হবে না বোধহয়।

গাল দিলেও ওটাকে আগলে রাখে বুড়ো।

দরজা খুলে যেতেই ভেতরে ঢুকল সুন্দরী মেয়েটা। ওকে। খুব ভালবাসে পাবলো। কী আদর করে খাইয়ে দেয়!

বুড়ো লোকটাকে কী যেন বলছে। কিছু বোঝা যায় না!

কপাল খুলল, প্রফেসর? জানতে চাইল মিতা।

হাল ছাড়িনি। অনেক কিছু জেনেও গেছি।

পাবলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মিতা।

খুব ভাল মেয়ে, ভাবল পাবলো। এমন একটা আম্মু থাকলে ভাল হতো। কিন্তু আমার তো তেমন কেউ কখনও ছিল না।

কিন্তু মেয়েটা আম্মু হবে কী করে? বুড়োর সঙ্গে বসে কী যেন খোঁজে। রানার সঙ্গেও কথা বলে। কিন্তু মনে হয় না ওরা বিয়ে করেছে। ওরা কী যেন চায়। হয়তো একই জিনিস খুঁজছে না।

কাঁচের দরজার দিকে তাকাল পাবলো। ওদিকে আছে মাসুদ রানা। সে খুব গম্ভীর মানুষ। কিন্তু মনে হয় ওকে ভালইবাসে। কখনও কড়া সুরে কথা বলে না। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় না। আগে যে লোকগুলো বা মেয়েগুলো আসত, তারা কখনও কখনও খুব বকত ওকে। রানা এমন নয়। রানা ওর বাবা হলে ভাল হতো। তা হলে কেউ বকতে পারত না ওকে।

ভুলও হতে পারে, তবে বোধহয় মিতা আর বুড়ো খুঁজছে কিছু। ওদেরকে পাহারা দিচ্ছে রানা। কিন্তু পাহারা দিচ্ছে কেন?

আবারও বুড়োর দিকে ফিরে কথা বলে উঠল মিতা। আমরা যদি এম্ব্যাসির মাধ্যমে ওকে সরিয়ে নিতে পারি, তা হলে…

সম্ভব নয়, বললেন প্রফেসর। মিস্টার ব্রায়ান তো আগেই বলেছেন, সিআইএ বা আর্মি কেড়ে নেবে পাবলোকে। এদিকে যে-কোনও সময়ে হামলা হবে মনে করছে রানা।

প্লাস্টিকের ব্যাগ খুলল মিতা। ওটা থেকে নিল বেশ কয়েকটা বোতল।

ওষুধ, বুঝে গেল পাবলো। কখনও কখনও এমন বোতল থেকে ওকে ওষুধ খাওয়াত রাগী সব মহিলা। মিতা কখনও রাগারাগি করে না ওর সঙ্গে। ভাল মেয়ে। কিন্তু ওর আম্মু নয়। ওষুধগুলো কোনওটা কালো রঙের, কোনও হালকা রঙের। ওসব না খাওয়াই ভাল। ওষুধ খেলে মাঝে মাঝে শরীর খারাপ লাগে। মাথা ঘোরে, পেট ব্যথা হয়। মিতা কখনও ওকে ওষুধ দেয় না।

একটা বোতল থেকে দুটো ট্যাবলেট নিয়ে প্রফেসরের পাশে থামল মিতা। এ-দুটো খেয়ে নিন।

কীসের ওষুধ? জানতে চাইলেন হ্যারিসন।

নতুন অ্যান্টিবায়োটিক। জ্বরটা প্রায় গেছে, ইনফেকশনও চলে যাচ্ছে। আগামী কয়েক দিনের ভেতর পুরো সুস্থ হয়ে উঠবেন।

হাত পেতে ট্যাবলেট দুটো নিলেন প্রফেসর। ধন্যবাদ। ঘুরে ব্যালকনির দিকে চলল মিতা।

কালো বুড়ো গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়েও থেমে গেল। চোর-চোর চেহারা করে পকেটে পুরে ফেলল ট্যাবলেট দুটো।

সুন্দরী মেয়েটা কিছুই দেখতে পায়নি। জানবেও না ওষুধ খায়নি লোকটা। নতুন করে গরম মেশিনের দিকে ফিরেছে।

ওষুধ খেলে মন থেকে কিছু হারিয়ে যায়, তাই কালো লোকটা ওসব খাবে না, ভাবল পাবলো। অনেক কিছু দেখতে চায় সে, শুনতে চায় অনেক কিছু।

আনমনে ভাবল পাবলো, ভাল, বড় হলে কখনও ওষুধ খারে না ও।

.

৩২.

 প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে গ্রুম লেক বেস হাসপাতাল থেকে ঘুরে আসতে হয়েছে এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানকে। হামভিতে চেপে শটগানধারী সৈনিকরা আবারও ফিরিয়ে এনেছে তাঁকে ইয়াকা মাউন্টেনে। এইমাত্র চাকার গুড়গুড় আওয়াজ তুলে বিশাল সুড়ঙ্গে ঢুকছেন তারা।

ডানদিকে কাত হয়ে পড়ে আছে দানবীয় এক মেশিন, দেখলে মনে হবে স্যাটার্ন ভি বুস্টার। এক শ টনের চেয়েও বেশি ওজন। ওই জিনিস দিয়েই খুঁড়ে নেয়া হয়েছে ইয়াকা মাউন্টেনের সুগভীর সুড়ঙ্গ। কাজ শেষ হলে ওটাকে আর সরানো হয়নি। তাতে একটা একটা করে খুলতে হতো নানান অংশ। রেখে দেয়া হয়েছে, দরকার পড়লে তৈরি করা হবে আরও সুড়ঙ্গ।

পিচের পথে চড়-চড় শব্দে প্রকাণ্ড ব্লাস্টডোর পেরোল হামভি, সামনেই টানা সুড়ঙ্গ। প্রায় জ্বলন্ত নেভাডার পরিবেশ থেকে ঢুকে পড়ল হামভি ঘুটঘুটে আঁধারে। তবে সিলিঙে দূরে দূরে জ্বলছে একটা করে বাতি। ওই আলোয় চলা কঠিন। জ্বেলে নেয়া হয়েছে জিপের হাই বিম।

তোমরা এ পরিবেশে মানিয়ে নিলে কী করে? জানতে চাইলেন ব্রায়ান।

সময় লেগেছে, স্যর, বলল ড্রাইভার, দিনে তিনবার পাহাড় সার্চ করি। বিজ্ঞানীরা এলে খুশি হই। তবে আপনার মত এত বড় বিজ্ঞানী আগে কখনও আসেননি। মুখের কথা না, আপনাকে পাহারা দিয়ে এসেছে অন্তত বিশজন সৈনিক!

আবারও সুড়ঙ্গের দূরে চোখ রাখলেন ব্রায়ান। শুরুর দিকে সুড়ঙ্গ তিনগুণ চওড়া। দু শ গজ যাওয়ার পর সরু হয়েছে। টানেল। দুই লেনের রাস্তার মত। পাথর ও সিমেন্ট দিয়ে তৈরি। সরু, দীর্ঘ টানেলের ভেতর ব্রায়ানের মনে হলো আটকে আসছে দম। অথচ তিনি ক্লসট্রোফোবিক নন।

দেয়াল বা ছাত ধসে পড়লে? জানতে চাইলেন।

চিন্তা নেই, স্যর, বলল ড্রাইভার, একটু পর পর এস্কেপ ভেন্ট। উঠে গেছে একেবারে পাহাড়ের মাথায়। কয়েক শ ফুট মই বেয়ে উঠতে হবে। তবে পাগল হয়ে যাবেন পায়ের ব্যথায়।

দেয়াল ত্বণ ক্লসট্রোফোবিনের মনে হলো অদয়ে তৈরি।

ও, খুশি হতে পারলেন না ব্রায়ান। ভাবছেন, চাপা পড়ে মরা ভাল, না শত শত ফুট মই বেয়ে পাহাড়ে ওঠা। আবার ওখান থেকে নামা। কোনও এলিভেটর নেই?

মাথা নাড়ল ড্রাইভার। না, স্যর।

একমাইল যাওয়ার পর হেডলাইটের আলোয় দূরে দেখা গেল চওড়া ল্যাব ট্রাক। ওটাকে পাশ কাটিয়ে আরও চার মাইল গেছে সুড়ঙ্গ। এরই ভেতর বিজ্ঞানীরা প্রশ্ন তুলেছেন, এই গভীরতা স্ফটিকের জন্যে যথেষ্ট কি না। আগেও নানান এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে টেস্ট টানেলে। সেগুলো ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। এসবের জন্যে মাইলের পর মাইল টেনে নেয়া হয়েছে পাওয়ার কেবল। এ কারণে এনআরআই ও সিআইএর টিম সহজেই ব্যবহার করতে পারছে আধুনিক সব মেশিনারি।

ট্রেইলারের পাশে রকেট স্লেড তৈরি রাখা হয়েছে। সাইড ওয়াইণ্ডার মিসাইল থেকে খুলে ওখানে সেট করা হয়েছে মোটর, ক্রিটিকাল হলে দেরি না করে ব্রাযিল স্টোনটাকে ফেলা হবে পাহাড়ের প্রত্যন্ত গভীরে। তিন সেকেণ্ডে ধুলোয় মিশে যাবে ওটা।

ট্রেইলারের পাশে হামভি থামতেই নেমে পড়লেন ব্রায়ান, দুই ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠলেন অস্থায়ী গবেষণাগারে। শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়তে তৈরি তিনি, কিন্তু এখন অন্যদিকে মন সবার।

উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ইউএন মিটিং।

হাই-ডেফিনেশন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টিভি দেখছে ট্রেইলারের উপস্থিত সবাই। একের পর এক দেশের প্রতিনিধিরা উঠে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন। 

সবার তর্জনী ইউনাইটেড স্টেটসের দিকে।

এমন কী বন্ধু সব রাষ্ট্রও কঠোর সুরে জানতে চাইছে, কী হয়েছিল আমেরিকার মরুভূমির ভেতর। সত্যিই কি আমেরিকা পরীক্ষা করেছে অচেনা কোনও বিপজ্জনক অস্ত্র?

চুপ করে আছেন ইউ.এস. অ্যাম্বাসেডার। নিজ বক্তব্য কখন দেয়ার সুযোগ পাবেন, এখনও জানেন না। পাথুরে চেহারা করে বসে নোট নিচ্ছেন। বামহাত হেডফোনের ওপর।

সার্কাস চলছে, ভাবলেন ব্রায়ান। সবচেয়ে খারাপ দিক, ওভাল অফিসে বসে এসব দেখছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টও। চলছে টেলিকনফারেন্স। স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে চুপচাপ ইউএন তর্ক শুনছেন তিনি। কপাল ভাল, আপাতত ল্যাংলিতে ফিরেছে ক্যালাগু। আজ জ্বালাবে না লোকটা।

অবস্থা কতটা খারাপ? জানতে চাইলেন ব্রায়ান।

নানান ডেটা থেকে চোখ তুললেন বিজ্ঞানী ক্যাথিবা আলিহা। কেউ জুয়া খেলতে চাইলে তার উচিত হবে না বাজির অঙ্ক বাড়িয়ে দেয়া।

টিভির স্ক্রিনে মন দিলেন ব্রায়ান। চাইনিজ ডেলিগেট বলছেন, বিশেষ কোনও সুপারওয়েপন তৈরি করেছে আমেরিকা। ওটার কারণে নষ্ট হয়েছে চিনের কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক হামলা। কাজটি অগ্রাহ্য করার মত নয় এবং বেআইনী। এর ফলে চিন ধরে নিতে পারে, যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ডেলিগেট বললেন না, কী কারণে ইউ.এস. এলাকায় মরতে গেল চিনের কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট। দেশগুলোর ডেলিগেটরা ভাল করেই জানেন, আসলে গুপ্তচরের মত তথ্য সংগ্রহ করে এসব স্যাটেলাইট। তবে সেজন্যে ওগুলো ধ্বংস করে দিলে সত্যিই বেধে যেতে পারে অন্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধ।

সত্যিই কি পড়ে গেছে চিনা স্যাটেলাইট? জানতে চাইলেন ব্রায়ান।

জবাব দিলেন প্রেসিডেন্ট, আমাদের কাছে তথ্য আছে, আজ সকাল থেকে ব্যস্ত হয়ে একটা ইনফরমেশন গ্যাদারিং স্যাটেলাইট খুঁজতে শুরু করেছে ওটাকে।

কপাল, বিড়বিড় করলেন ব্রায়ান।

পরিস্থিতি আরও খারাপ, বললেন প্রেসিডেন্ট, রাশানরা বলছে, তারাও হারিয়ে ফেলেছে একটা স্যাটেলাইট।

বিড়বিড় করে কী যেন বললেন ব্রায়ান।

অন্য এক সুপারপাওয়ারের আকাশে নষ্ট হয়েছে স্যাটেলাইট। এবং চোখ রাখবেই না কেন রাশা বা চিন, ইউ.এস. রিয়াল এস্টেটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাহারা দেয়া হয় নেলিস এয়ার ফোর্স বেস, গ্রুম লেকের এয়ারফিল্ড ও এরিয়া ৫১। ব্রায়ান যথেষ্ট অবাক হয়েছেন, ওই সময়ে আমেরিকার আকাশে ছিল মাত্র দুটো স্যাটেলাইট।

কোনও মিলিটারি, মুভমেন্ট, স্যর?

রাশা ও চিন নানা দিকে নিয়েছে নিজেদের আর্মির ডিভিশন, বললেন প্রেসিডেন্ট, ব্যস্ত হয়ে উঠেছে নেভি ও এয়ার ফোর্স। যে-কোনও সময়ে হামলা করতে তারা তৈরি।

সবই বুঝছেন ব্রায়ান। যুদ্ধের আগে যে-কোনও দেশ ঘাড়ের কাছ থেকে সরাতে চাইবে শত্রু স্পাই স্যাটেলাইট। এ কারণেই সতর্ক ও ভীত হয়ে উঠেছে ওই দুদেশ। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নিরাপদে রাখতে আর্মি, এয়ার ফোর্স ও নেভির ইউনিট নানান দিকে সরিয়ে দিয়েছে তারা। যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে ওই একই কাজ করত ইউনাইটেড স্টেটস্।

কপাল টিপলেন ব্রায়ান। অতিরিক্ত চাপের কারণে মাথা জুড়ে শুরু হয়েছে মাইগ্রেনের ব্যথা। আবারও হাসপাতালে গিয়ে আশ্রয় নেবেন কি না ভাবলেন এনআরআই চিফ।

তাদের মুভের কারণে পাল্টা কী করেছি আমরা?

উপায় ছিল না, বাধ্য হয়ে অ্যালার্ট স্ট্যাটাস বাড়াতে হয়েছে, বললেন প্রেসিডেন্ট। ডিফেন্স কণ্ডিশন ফোর ঘোষণা করেছি। জয়েন্ট চিফরা বলছেন রাশা বা চিন নিজেদের মিলিটারি তৈরি রাখলে আমাদেরও উচিত হবে ডেফকন থ্রি ঘোষণা করা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ব্রায়ান। ওরা ভয় পেয়েছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

অবাক হওয়ার কিছু নেই, না? ভুরু কুঁচকে তাঁকে দেখলেন প্রেসিডেন্ট।

আমাদের উচিত ওদের সঙ্গে কথা বলা, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বললেন ব্রায়ান, লঞ্চ পযিশনে ট্যাঙ্ক বা এয়ারক্রাফট নেয়া ভুল হবে। একটা বাড়াবাড়ি তৈরি করে অন্যের বাড়াবাড়ি। ফলাফল সবসময় খারাপই হয়।

রেগে গিয়ে ভুরু কুঁচকে এনআরআই চিফকে দেখলেন প্রেসিডেন্ট। তুমি কিছুই বুঝছ না, জেমস। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবো। এসব ঝামেলা তৈরির জন্যে অর্ধেক দায় তোমার। এখন পর্যন্ত তোমার পাশে থেকেছি, কিন্তু আমারও ধৈর্যের একটা সীমা আছে। নতুন কোনও জরুরি তথ্য দিতে পারছ না। তোমাকে দেয়া তিন দিনও প্রায় ফুরিয়ে এল। এরপর…

মিস্টার প্রেসিডেন্ট…।

জেমস ব্রায়ানকে থামিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট, তুমি বলেছিলে কোনওভাবে আমাদেরকে নিরাপদ রাখছে ওসব স্ফটিক। কোথায় কী, এখন তো দেখছি মস্তবড় বিপদে ফেলে দিয়েছে ওগুলো আমাদেরকে! এবার স্থির করতে হবে ওগুলোর কী করব। ভেবে বের করো এই গাড়া থেকে কীভাবে আমাকে বের করবে, নইলে বাধ্য হয়েই ব্যবস্থা নিতে হবে আমাকে।

চুপ করে থাকলেন ব্রায়ান। হুমকির সুরে কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট। বন্ধুত্বের খাতিরে এমনিতেই সীমানার বাইরে চলে গেছেন তিনি। এখন যা ঘটছে, সবই সাধারণ যুক্তির বাইরে। এবার প্রেসিডেন্ট এবং কমাণ্ডার ইন চিফ হিসেবে নিজ দায়িত্ব পালন করবেন তিনি।

ব্রায়ান ভাবলেন, যখন-তখন প্রেসিডেন্টের নির্দেশে ধ্বংস করে দেয়া হবে ব্রাযিল স্টোন।

আমি দুঃখিত, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বললেন ব্রায়ান। আমি খুব ক্লান্ত। ভুল কথা বলে থাকতে পারি। দয়া করে কি বলবেন, আমরা আপাতত কী বলছি ওদেরকে?

ব্রায়ানের দিকে চেয়ে কাঁধ ঝাঁকালেন প্রেসিডেন্ট। বরং তুমিই বলো কী বলা উচিত? কী বলব আমরা ওদেরকে?

কাজে আসবে এমন যৌক্তিক কিছুই মনে এল না ব্রায়ানের। মাথা নিচু করে নিলেন। স্ট্যাটিক ঠেকিয়ে সূক্ষ্ম সব ইন্সট্রুমেন্ট রক্ষা করতে ট্রেইলারের মেঝেতে রাখা হয়নি কার্পেট। এতই ক্লান্তি, ব্রায়ানের মনে হলো কেমন হতো এখন লোহার শীতল মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে? প্রেসিডেন্ট নির্ঘাৎ ভাববেন, তিনি চিরকালের জন্যে পাগল হয়ে গেছেন!

গবেষণাগারের যেদিকে সায়েন্স সেকশন, সেদিকে তাকালেন ব্রায়ান। প্রথমবার স্ফটিকটা দেখার পর তার মনে হয়েছিল, ওটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজের জিনিস। ওই চিন্তা এসেছিল বলেই ওটাকে অনেক বেশি মূল্যবান ভেবেছেন? অবশ্য ভাবার যথেষ্ট কারণও ছিল। আজও আছে। বিবেক ও যুক্তির বাইরে একটা পা-ও ফেলেননি তিনি।

প্রায় একবছর ধরে ওটার ওপর গবেষণা করেও পুরো বুঝতে পারেননি তারা। প্রচণ্ড শক্তি ওটার ভেতর। দ্বিতীয় স্ফটিক পাওয়ার পর অন্তত দশ গুণ শক্তির বিচ্ছুরণ হয়েছে ওটা থেকে। এমনও হতে পারে, তৃতীয় স্ফটিক পেলে ওগুলো থেকে বেরোবে এক শ গুণ শক্তি। আর চার নম্বর স্ফটিক হয়তো দেবে হাজার গুণ ক্ষমতা। দুই স্ফটিকের কারণে এরই ভেতর যে শক্তি দেখা গেছে, তা কয়েক শ নিউক্লিয়ার ওয়ারহেডের এনার্জি বিচ্ছুরণের চেয়েও বেশি।

অথচ, এখন পর্যন্ত স্ফটিকে দেখা যায়নি কোনও রেডিয়েশন, নেই কোনও এক্সপ্লোসিভ কমপোনেন্ট। আছে শুধু প্রচণ্ড শক্তির ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। কিন্তু এর বাইরে আর কিছু নেই, তা-ই বা বলবেন কী করে? এরই ভেতর তাদেরকে বিস্মিত করে দিয়েছে ওই জিনিস। তিনিই হয়তো ভুল করেছেন, সব হাতের নাগালের বাইরে যাওয়ার আগেই উচিত ছিল ওই স্ফটিক ধ্বংস করে দেয়া।

ওই দুই দেশের কর্তাকে সত্য বলুন, স্যর, বললেন ব্রায়ান।

চুপচাপ চেয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট।

কিছুই গোপন না করে দুনিয়ার প্রতিটি দেশের সঙ্গে ডেটা শেয়ার করুন। জরুরি তথ্য এবং ভয়ের কারণে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে তারা। সেটা হয়তো পৃথিবীর জন্যে ভাল হবে না।

স্ক্রিনে বিস্মিত দেখাল প্রেসিডেন্টকে, চট করে তাকালেন এক পাশে। নিচু গলায় কার সঙ্গে যেন কথা বললেন। ব্রায়ান আঁচ করলেন, তাঁরা চিফ অভ স্টাফ।

তোমার পরামর্শ মাথায় রাখলাম, প্রেসিডেন্ট জানালেন।

আশা করি এসব ঠিকই বুঝবেন রাশা ও চিনের নেতারা, বললেন ব্রায়ান। মাথায় কথাগুলো খেলে গিয়েছিল বলে বুকে টের পেলেন গর্ব। তারা হয়তো নতুন কোনও পথও দেখিয়ে দিতে পারে। যেটা আমরা এখনও ভেবে বের করতে পারিনি।

প্রেসিডেন্টের পাশে থামলেন এক এইড। টেবিলের ওপর রাখলেন একটা ফোল্ডার। ফিসফিস করে কী যেন বললেন। কথাগুলো শোনার পর আড়ষ্ট হয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট, ঘুরে তাকালেন স্ক্রিনে ব্রায়ানের দিকে। চাপা স্বরে বললেন, আরেকটা সমস্যা। এইমাত্র মিসাইল মেরে চিনের দুটো গুপ্তচর বিমান ফেলে দিয়েছে রাশানরা।

নতুন করে ইউএন স্ক্রিনে তাকালেন ব্রায়ান। শিরশির করছে তার মেরুদণ্ড।

ওই যে, নতুন তথ্যটা পেয়েছেন চিনা অ্যাম্বাসেডার। লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে দৌড়ে গেলেন রাশান ডেলিগেশনের দিকে। আরও খারাপ দিক, চিৎকার করে যুদ্ধের জন্যে তৈরি হতে বলছেন রাশানদেরকে!

ব্রায়ান ভাবলেন, কেমন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে সব!

.

৩৩.

গতরাত ও আজ সকাল জুড়ে নিমজ্জিতথেকে মিতার তুলে আনা ছবি দেখেছেন প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন। ছবি কোনও কোনওটা খুব পরিষ্কার, অন্যগুলোর রেযযালুশন খারাপ। আলো ছিল না বললেই চলে। কিন্তু হায়ারোগ্লিফ থেকে এখন পর্যন্ত তিনি যা জানতে পেরেছেন, তা কম নয়।

নিজের থিয়োরি বলতে শুরু করলেন তিনি। কিন্তু হাত তুলে মানা করল মিতা। স্যর, আমার মনে হয় রানারও জানা উচিত।

মাথা দোলালেন আর্কিওলজিস্ট।

সত্যিই, এরপর তাঁরা কী করবেন, এখনই তা স্থির করতে হবে। সেজন্যে রানার মতামত প্রয়োজন। ওকে ছাড়া কোনও কাজেই নামতে পারবেন না।

ঘরের মাঝ থেকে ডাকল মিতা, নতুন তথ্য পেয়েছেন প্রফেসর। তোমার জানা থাকা দরকার, রানা।

ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে এসে ঢুকল রানা। মিতার পাশের চেয়ারে বসল।

রানা, তোমার মনে আছে ব্রাযিলের ওই অভিযানের কথা? বললেন হ্যারিসন।

মৃদু হাসল রানা। খেপে গিয়েছিল আদিবাসী। হামলা করেছিল কুমিরের মত দেখতে খুব দ্রুত চলতে পারে এমন অদ্ভুত জন্তু। খুন করতে চেয়েছে এক উন্মাদ বিলিয়নেয়ার। দারুণ মজা! চলুন, আবারও বেরিয়ে পড়ি ওরকম কোনও অভিযানে!

না, ঠাট্টা নয়, হেসে ফেললেন প্রফেসর। বিপজ্জনক সব জায়গায় যেতে হয়েছে, তাই না?

তাই তো মনে হচ্ছে, বলল রানা।

এখন কথা হলো, ওসব এলাকার হায়ারোগ্লিফ থেকে জানতে পেরেছি, মায়ানরা কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে দেবতা বয়ে নিয়ে গিয়েছিল অন্য এলাকায়। সঙ্গে ছিল জ্বলজ্বলে স্ফটিক।

তার দুটো আমরা পেয়েছি, বলল মিতা।

অন্যগুলোর জন্যে দরকার জরুরি তথ্য, বললেন প্রফেসর। তবে তথ্য পাইয়ে দেয়ার জন্যে সূত্র রেখে গেছে মায়ানরা। ম্যাপে আঙুল ঠুকলেন। এই ম্যাপ ধরে গেলে পাব পাহাড়ি জাগুয়ার রাজার আয়নার এক মন্দির। ওটা আগুন দেবতার। ওখানেই আছে তৃতীয় স্ফটিক। নিজের নোট দেখলেন হ্যারিসন। ওই মন্দিরের কাছেই ছিল বা আছে ব্রাদারহুডের অবশিষ্ট সৈনিকরা। হাজার হাজার বছর ধরে পাহারা দিচ্ছে ওই স্ফটিক। নৌকা ব্যবহার করে যেতে হবে ওই মন্দিরে। তারপর ডুব দিতে হবে পাতকুয়ায়। এরপর বেঁচে ফিরলে গ্রামের মোড়ল বুঝবেন এই লোকের অন্তর পবিত্র। তখন ইচ্ছে হলে স্ফটিক সরিয়ে নিতে পারবে সে।

এবার হয়তো অদ্ভুত মিউটেট জন্তু বা হাঙরের বদলে থাকবে আরও অনেক ভয়ঙ্কর কিছু, বলল রানা।

মাথা দোলালেন প্রফেসর। স্ফটিকের কারণে ধ্যানের মত ঘোর তৈরি হবে। ওই পাথর বা স্ফটিকের নাম এমনিতে দেয়া হয়নি পাহাড়ি জাগুয়ার রাজার আত্মত্যাগের আয়না। ওই স্ফটিকের জন্যে অবাক করা মায়া তৈরি হবে মনে। নইলে প্রাণের ভয় মন থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এ দেশে পড়ে থাকতাম না। ভাল করেই জানি, সুযোগ পেলে আমাদেরকে মেরে ফেলবে দিমিতভ বা ল্যাং।

এসব স্ফটিক সমস্যা তৈরি করে, বলল মিতা, তোমার হয়নি, কিন্তু আমাদের হয়েছে মাসের পর মাস ঘুমাতে পারিনি আমরা। বারবার মনে হয়েছে স্ফটিকের কথা: আরও তো আছে ওই জিনিস। দেরি না করে খুঁজে বের করতে হবে। সবগুলোকে রাখতে হবে নির্দিষ্ট সব জায়গায়।

বলতে চাইছ, তোমরা প্রভাবিত হয়েছ স্ফটিকের কারণে? জানতে চাইল রানা।

ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়, বলল মিতা, মন পাল্টে দেয় অনেক কিছুই। যেমন শিশুর কান্না অস্থির করে মেয়েদেরকে। মনের ভেতর প্রভাব পড়েছে বলে ওই স্ফটিকের জন্যে প্রাণ দিতেও রাজি হয়ে গেছি প্রফেসর আর আমি।

গম্ভীর হয়ে গেল রানা। কিন্তু ওটার জন্যে আবেগ আসছে কেন? কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারবে?

মায়ান চিলাম বালাম থেকে যা পড়েছি, এসব স্ফটিক ঠেকিয়ে দেবে পৃথিবীর ধ্বংর্স। নিজের নোট দেখলেন প্রফেসর। এখানে লিখেছে, বারো সালের পর থেকে বাবার পাপের জন্যে দায় নেবে তাদের সন্তানরা। অন্ধ হবে আকাশের চোখ। সভ্যতা হবে অসহায়। তা ঠেকাতে হলে লাগবে ওসব স্ফটিক।

স্যাটেলাইটের কথা লিখেছে নাকি? বলল রানা।

তাই তো মনে হয়, জানালেন প্রফেসর। সভ্যতা রক্ষা করতে হলে চাই ওই জ্বলজ্বলে স্ফটিক।

কিন্তু সভ্যতার ধ্বংস ঠেকাবে কী ভাবে? নরম সুরে জানতে চাইল রানা।

তা এখনও জানি না, আরও চাই তথ্য। প্রফেসরের দিকে তাকাল মিতা। আপনার নতুন তথ্যগুলো বলুন।

নিমজ্জিত মন্দির থেকে পাওয়া গ্লিফ দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় পাব পরের স্ফটিক, বললেন হ্যারিসন।

জায়গাটা কোথায়? জানতে চাইল রানা।

পাহাড়ি জায়গা। এই যে।

মানচিত্রের দিকে তাকাল ওরা।

নিমজ্জিত মন্দির থেকে সরল রেখা তৈরি করে প্রফেসরের হাত থামল দক্ষিণ মেক্সিকোয়। কয়েকটা সংখ্যা লেখা মানচিত্রে। ওখান থেকে আর্কিওলজিস্টের তর্জনী গেল গুয়াতেমালার উঁচু জমিতে।

এই অ্যাংগেল থেকে রওনা দিতে হবে, একটা রেখা দেখালেন হ্যারিসন, এটাই নেবে পরের স্ফটিকের কাছে। ওটাই পাহাড়ি জাগুয়ার রাজার আত্মত্যাগের আয়না।

এই রেখা ধরে কোথায় যাব? মিতার চোখ অনুসরণ করছে রেখাটা।

মানচিত্র দেখলেন প্রফেসর। তার তৈরি পথ গেছে নিচু ম্যানগ্রোভ জঙ্গল ও জলাভূমির মাঝ দিয়ে নিচু টিলাসারিতে। ওদিকটা সিয়েরা মাদরে ওক্সিডেন্টাল। পাঁচ থেকে ছয় হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ার ওপাশে প্রশান্ত মহাসাগর। পৌঁছুতে লাগবে অন্তত এক থেকে দেড় মাস।

একবার মাথা চুলকে নিলেন প্রফেসর, তারপর বললেন, ঠিক বুঝছি না। জটিল করে লিখেছে মায়ানরা: দেবতার পথে হাঁটবে ব্রাদারহুডের সবাই। ওখানেই আছে পাহাড়ি জাগুয়ার রাজার মন্দির। ওই জ্বলজ্বলে পথে পৌঁছতে হবে দেবতার কাছে।

আসলে কী বলতে চায়? আনমনে বলল মিতা।

জানি না, বললেন হ্যারিসন।

জ্বলজ্বলে পথ? রানার দিকে তাকাল মিতা। মিল্কি ওয়ের কথা বলছে নাকি? জ্যোতির্বিদ্যায় খুব দক্ষ ছিল মায়ানরা।

একই কথা ভেবেছি, বললেন প্রফেসর, কিন্তু গ্লিফের মধ্যে সময় বা ঋতু বলতে কিছুই নেই। একেক মৌসুমে ওপরের দিকে থাকে মিল্কি ওয়ে, আবার অন্য সময়ে নেমে আসে। বছরের নির্দিষ্ট মাস না পেলে কিছুই বুঝব না।

তা হলে এখন কী করবেন? জানতে চাইল মিতা।

রানার দিকে চেয়ে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। কোনও পথই তো পাচ্ছি না!

মৃদু হাসল রানা। আমি হয়তো জানি কোথায় ওই জ্বলজ্বলে পথ। এবার আমাদের লাগবে…

হাউস ফোন বেজে উঠতেই চুপ হয়ে গেল ও। খপ করে তুলে রিসিভার ঠেকাল কানে।

প্রফেসর ও মিতা আবছা শুনল ফ্রন্ট ডেস্কের ক্লার্কের বেসুরো, কর্কশ চিৎকার: পালিয়ে যান, সেনোর! পালান! ওরা আসছে আপনাদেরকে ধরতে!

ঠাস্ করে ফোন রাখল রানা। পাবলোকে নিয়ে তৈরি হও, ফটিক নাও! ওরা আসছে! চেয়ার ছেড়ে ক্লসিট থেকে শটগান বের করল ও।

পাবলোকে কোলে তুলে নিলেন হ্যারিসন, ওদিকে সুইটের কিচেন কেবিনেট থেকে ব্যাকপ্যাক নিল মিতা।

দরজা সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিয়েছে রানা। করিডোর ধরে হেঁটে আসছে কয়েকজন লোক, পরনে টুরিস্টদের পোশাক। গম্ভীর চেহারা। ছুটি কাটাবার মুডে নেই। দুজন থেমে গেছে সিঁড়ির মুখে। রানাদের সুইটের দরজা লক্ষ্য করে আসছে বাকি তিনজন।

কপাল ভাল, হোটেলের ডেস্কের ছোকরা চালু, ভাবল রানা। প্রাণে বাঁচলে পরে ওকে মোটা অঙ্কের বকশিশ দেবে।

পাশের ঘরে ঢুকল দুই ককেশিয়ান। তৃতীয়জনের চোখ ওদের দরজার ওপর।

নিঃশব্দে দরজা আটকে পরক্ষণে দূরের মেঝেতে ডাইভ দিল রানা। উড়ন্ত অবস্থায় গলা ছাড়ল, সবাই শুয়ে পড়ো!

দুসেকেণ্ড পর একরাশ গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হলো পাশের ঘরে যাওয়ার দরজা।

মেঝেতে গড়ান দিয়ে উঠেই পাল্টা জবাব দিল রানা। কান ফাটানো আওয়াজে দরজা ও পাতলা প্লাস্টিকের দেয়াল ভেদ করে পাশের ঘরে ঢুকল বন্দুকের চারটে বুলেট। হাউমাউ করে উঠেছে এক লোক। দুই সেকেণ্ড পর ধুপ করে মেঝেতে পড়ল কেউ। ওই ঘরে রয়ে গেছে আরও কেউ।

কাউন্টারের আড়াল থেকে উঁকি দিল মিতা। কোন্ দিকে যাব?

ঝাঁঝরা দরজার ওপর আছড়ে পড়ল কারও ভারী কাঁধ। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল এক লোক। কী করতে হবে বুঝে গেল মিতা। প্রফেসর ও পাবলোকে নিয়ে দৌড়ে গেল ব্যালকনিতে। বিশ ফুট নিচে বালিময় জমিন। এদিকে দরজার সামনের লোকটাকে এক গুলিতে গেঁথে ফেলেছে রানা।

পাশের ঘরের দেয়াল ভেদ করে এল একঝাক গুলি। চুরচুর হলো একগাদা বাসন-গ্লাস। ঝনঝন করে খসে পড়েছে ব্যালকনিতে যাওয়ার কাঁচের দরজা। পাশের ঘরে পাল্টা গুলি পাঠাল রানা, পরক্ষণে লাফিয়ে সরে গেল নতুন পযিশনে। একবার দেখল ব্যালকনি। এইমাত্র পাবলোকে বুকে নিয়ে রেলিং টপকে খসে পড়েছে মিতা। কমব্যাট ট্রেনিং ভালই শিখেছে, ভাবল রানা। রেলিঙের পাশে থেমে বরফমূর্তি হয়েছেন প্রফে হ্যারিসন।

ভদ্রলোক অন্য পথ খুঁজছেন, বুঝে গেল রানা। ধমকের সুরে বলল, কী হলো, লাফ দিন!

ওর কথা শেষ হতে না হতেই বুলেটের কারণে ঘরে তৈরি হলো ঝড়। নানান দিকে ছিটকে গেল প্লাস্টিক ও কাঠের টুকরো। আগেই মেঝেতে শুয়ে পড়েছে রানা, ক্রল করে চলল ব্যালকনির দিকে। আবারও বলল, লাফ দিন!

রেলিঙের ওদিকে একটা পা নিলেন প্রফেসর হ্যারিসন, করুণভাবে ফিরে চাইলেন রানার চোখে। হেডলাইটের তীব্র আলো চোখে পড়ায় থমকে দাঁড়ানো হরিণ যেন।

পাশের ব্যালকনিতে রাশানরা চলে এলেই মরবেন! ভাবল রানা। নিজে মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে বলে এক লাথিতে সুইটের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল এফএসবির এক এজেন্ট।

রানার চারপাশে বিঁধল অন্তত দশটা গুলি। একটা ছিলে দিয়ে গেল ওর কনুই। ঘুরেই পাল্টা গুলি পাঠাল রানা।

বুলেট গায়ে না বিঁধলেও লাফিয়ে ডানদিকে সরে গেল কালো চুলের মোষ। খালি হয়ে গেছে রানার বন্দুক। ওটা ব্যবহার করল ক্রিকেটের ব্যাটের মত। উড়াল দিল লোকটার হাতের অ্যাসল্ট রাইফেল, মেঝেতে পড়ে খটাং-খট আওয়াজে পিছলে গেল দূরে। ওটা পাওয়ার জন্যে ঝাঁপ দিল রানা। কিন্তু এক পাশ থেকে ওকে জাপ্টে ধরল মোষ। ধড়াস করে পড়ল দুজন মেঝেতে।

রানার বুকের ওপরে পড়েছে লোকটা। গড়ান দিয়ে তাকে মেঝেতে ফেলল রানা। কিন্তু উঠে বসেই শোল্ডার হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করছে সে!

মেঝেতে ছোরার মত চোখা এক কাঁচের টুকরোর ওপর হাত পড়ল রানার। ওটা তুলেই গেঁথে দিল এফএসবি এজেন্টের গলায়। ছেঁড়া গলা থেকে ফিনকি দিয়ে বেরোল রক্ত। কাত হয়ে মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে লাগল মৃতপ্রায় এজেন্ট।

উঠেই ব্যালকনি লক্ষ্য করে ঝেড়ে দৌড় দিল রানা। রেলিং টপকে পড়ার সময় সঙ্গে নিল হতভম্ব প্রফেসরকে। সাঁই করে নেমে এল ওরা বালি-জমিতে। হ্যারিসনের ওপর পড়েছে রানা। প্রফেসরের ওপর থেকে সরে গেল। আপনি ঠিক আছেন তো?

থাকি কী করে? নাকমুখ কুঁচকে উঠে বসলেন প্রফেসর।

সাবধান! একটু দূর থেকে চিৎকার করল মিতা।

ঝট করে ওপরে তাকাল রানা। একইসময়ে হোলস্টার থেকে ওয়ালথার বের করে তাক করেছে ব্যালকনির দিকে। রেলিঙে থেমেছে এক লোক, হাতে রাইফেল। বাঁটে লাগল রানার গুলি। ছিটকে গেল রাশানের অস্ত্র। রানার পরের গুলি বিঁধল লোকটার কপালে। ধড়াস্ করে ব্যালকনির মেঝেতে পড়ল লাশ।

ঘুরে তাকাল রানা। রক্তে ভেসে গেছে প্রফেসরের পোশাক।

 রক্ত তোমার হাতের, বললেন হ্যারিসন।

দেখব পরে, টান দিয়ে তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিল রানা। চলুন, ভাগতে হবে!

সৈকত ধরে দৌড়ে চলেছে ওরা। কাঁচে লেগে কেটে গেছে রানার বাহু। খুব গভীর নয় ক্ষত।

পঞ্চাশ গজ গেলেই সামনে পড়বে হোটেলের কাছের সড়ক। তার আগে এক পাশে ছোট কয়েকটা মেইনটেনেন্স ঘর। একটার ভেতর ঢুকল ওরা। পেছনে দরজা আছে। পিস্তলের বাড়ি পড়তেই খুলে গেল তালা। ঘরের র‍্যাকে তোয়ালে পেয়ে রানার বাহুতে জড়িয়ে দিল মিতা।

পাঁচ মিনিট পর ওরা বেরোল কর্মীদের ওভারঅল পরে। হোটেলের সামনের ঘাসজমি পেরিয়ে চলেছে রাস্তার দিকে। মিতার বাহু শক্ত করে ধরে রেখেছে পাবলো।

দূর থেকে আসছে পুলিশের সাইরেন। যে যার কামরা ছেড়ে বেরিয়ে আসছে হোটেলের গেস্টরা।

পিস্তল দেখিয়ে ভীত ভ্যালের কাছ থেকে চাবি নিল রানা। দু মিনিট পর হোটেলের আঙিনা ছেড়ে তুমুল বেগে ছুটল চোরাই রেন্টালকার।

সবাই ঠিক আছ তো? জানতে চাইল রানা।

আমি ছাড়া সবাই সুস্থ, বললেন হ্যারিসন।

পাবলোর কী অবস্থা?

রিয়ার ভিউ মিররে রানা দেখল ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মিতা। কোমল স্বরে বলল, মনে হচ্ছে ও ঠিকই আছে।

ছেলেটার চোখে এখন উন্মাদনা নেই, খেয়াল করল রানা।

ওরা ল্যাং-এর লোক নয়, বলল মিতা।

রাশান, বলল রানা, জানতাম, আগে হোক পরে ওদের সঙ্গে দেখা হবেই।

আমাদেরকে খুঁজে পেল কী করে? জানতে চাইল মিতা।

ল্যাং-এর লোকও খুঁজে নিয়েছে ওদেরকে।

 এই দুই প্রশ্নের জবাব খুঁজছে রানা।

ওরা অদ্ভুত এক দল। কৃষ্ণ বর্ণের এক বয়স্ক লোক, রূপসী এক যুবতী, বাচ্চা এক ছেলে, আর এশিয়ার বাদামি এক যুবক। সহজেই ওদেরকে আলাদা করা যাবে ভিড় থেকে।

প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছেন হ্যারিসন। তাঁর দিকে তাকাল রানা। প্রফেসর, আপনি ওপর থেকে নামতে ভয় পান?

গত বছর তোমার হেলিকপ্টারে উঠেছিলাম, নাকের কাছে ছিল গাছের সারি, তখনই কেঁপে গেল আত্মা। তারপর থেকে ভয় লাগে।

তা হলে ভয়টাকে এবার সামলে রাখতে হবে, বলল রানা।

 ঠিক করেছে, ওরা আবারও উঠবে আকাশে।

তছনছ হয়ে যাওয়া হোটেলের কামরায় ঢুকল ইগোর দিমিতভ। সোজা গেল ব্যালকনিতে। একটু আগে ওই পথে পালিয়ে গেছে তার শিকার। পায়ের নিচে কুড়মুড় করে ভাঙল কাঁচ। দূর থেকে আসছে পুলিশের গাড়ির সাইরেন।

রেলিঙের পাশে পড়ে আছে দিমিতভের দলের এক লোক, মৃত। ঘরের ভেতরেও লাশ। একজনের গলা চিরে গিয়েছিল কাঁচের ফালি লেগে। আরও দুজন খারাপভাবে আহত। বন্দুকের বাকশট লেগে ঝাঁঝরা হয়েছে একজনের পাছা। অন্যজনের ছিঁড়ে গেছে যৌনাঙ্গের ডগা। অন্যরা সরিয়ে নিচ্ছে তাদেরকে। আকাশে চোখ রেখে কড়া সুরে বলল দিমিতভ, ওদেরকে ভ্যানে তুলে দাও।

লাশগুলোর কী হবে? জানতে চাইল একজন।

মাথা নাড়ল দিমিতভ। পড়ে থাকুক। ট্রেস করতে পারবে পুলিশ।

পা ছেঁচড়ে ঘর ছাড়ল লোকটা। নিজেও ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে ফিরল দিমিতভ। বিড়বিড় করল, বাঙালি গুপ্তচর, এবার নিয়ে দুবার কপাল সাহায্য করল তোমাকে, কিন্তু তৃতীয়বার কপালই রাখব না! 

দরজার দিকে পা বাড়িয়ে চোখের কোণে মেঝেতে খোলা মানচিত্র দেখল সে। ঝুঁকে তুলে নিল ওটা। জায়গায় জায়গায় বৃত্তাকার চিহ্ন। কালো সরল রেখা গেছে বহু দূরে। বিস্মিত হয়ে বৃত্তাকার চিহ্ন ও সরল রেখা মন দিয়ে দেখল সে।

হাসি ফুটে উঠল নিষ্ঠুর ঠোঁটে।

নাহ্, ওদের নয়, আসলে ভাগ্যদেবী ওর সঙ্গেই আছে!

.

৩৪.

 নাসার মিশন কন্ট্রোল-এর মতই হয়ে উঠেছে ক্যামপেচে শহরে ল্যাং-এর ওয়্যারহাউস। এক পাশের টেবিলে সাগরের মন্দির থেকে পাওয়া হায়ারোগ্লিফ অনুবাদ করছেন স্কলাররা। আরেক দিকে সারি সারি কমপিউটার স্ক্রিনের সামনে এক ডজন ট্রেইণ্ড টেকনিশিয়ান নিয়ন্ত্রণ করছে নানান ইকুইপমেন্ট। ওদের জায়গাটা হয়ে উঠেছে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের ঘরের মত।

আরেক দিকে মানুষের ছবি বিশ্লেষণ করছে একুশ শতাব্দীর কমপিউটার। নানা শহর, গ্রাম ও আর্কিওলজিকাল সাইটে ছড়িয়ে পড়েছে ল্যাং-এর একদল কর্মী।

দলবল নিয়ে ওসব জায়গায় যেতে পারে মাসুদ রানা। চোখ রাখা হয়েছে মেক্সিকো সিটির অ্যানথ্রোপলজির মিউযিয়ামে।

সবমিলে দুশ লোকের হাতে ভিডিয়ো ক্যামেরা ও সেন্সিং ইকুইপমেন্ট। ঘুরছে তারা নানান এলাকায়। স্ক্যান করছে হাজারো মানুষের ছবি। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ প্লযা, এয়ারপোর্ট, রেস্টুরেন্ট, হোটেল, অ্যাভিন, কিছুই বাদ পড়ছে না। ল্যাং-এর লোকদের জানা নেই কাকে খুঁজতে হবে, তাই ইন্টারনেটের মাধ্যমে মনিবের টেকনিশিয়ানদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ছবি। বাকি কাজ করছে কমপিউটার।

ল্যাং-এর পেছনে গুনগুন আওয়াজ তুলছে র‍্যাক ভরা হাই পাওয়ার্ড সার্ভার। পেলেই প্রসেস করছে ডেটা। বিদ্যুদ্বেগে দেখা হচ্ছে হাজার মানুষের মুখের ছবি। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দুই মিনিটের ভেতর পাঁচ শ মানুষের ছবি স্ক্যান করছে কর্মীরা।

ঝড়ের গতি তুলে কাজ করছে স্পটারদের দল।

রিডআউট দেখল ল্যাং। তার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম জানিয়ে দিয়েছিল, রানারা এসব এলাকায় থাকবে, সে সম্ভাবনা মাত্র একত্রিশ পার্সেন্ট।

তবে কাজের গতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন আপডেট অনুযায়ী কাজ করছে প্রোগ্রাম। তাতে একটু হতাশ ল্যাং। ওই কালো লোক, বাচ্চা ছেলে, সুন্দরী মেয়েটা আর মাসুদ রানা বোধহয় পরিচিত কোনও মায়ান সাইটে যাবে না।

কমপিউটারের বর্তমান অ্যানালাইসিস অনুযায়ী ওদেরকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা দেখানো হচ্ছে:

* মাসুদ রানার দলের ধরা পড়ার সম্ভাবনাঃ ৩.২৫%,

* মাসুদ রানার দল এরই ভেতর মেক্সিকো ত্যাগ করে চলে গেছে আমেরিকায়। সম্ভাবনাঃ ৯.৩৬%..

* মাসুদ রানার দল আবারও প্রফেসর হ্যারিসনের নিউ ইয়র্কের ইউনিভার্সিটির মেইনফ্রেম ব্যবহার করবে। সম্ভাবনাঃ ১১.৭৮%,

* মাসুদ রানার দল রওনা হয়েছে পরের সাইটের উদ্দেশে। সম্ভাবনাঃ ১৪.৫৯%,

* মাসুদ রানার দল স্থানীয় কোনও ইউনিভার্সিটি বা জাদুঘরে যাবে। সম্ভাবনাঃ ২৮.৯৯%,

* মাসুদ রানার দল যথেষ্ট তথ্য পেয়ে পৌঁছে যাবে পরের সাইটে। সম্ভাবনাঃ ৩১.৫০%,

* অন্যান্য সম্ভাবনাঃ .৫৩%. এই ডেটা আবারও দেখল হুয়াং লি ল্যাং।

সম্ভাবনা সবচে বেশি, যথেষ্ট তথ্য পেয়ে স্ফটিক খুঁজতে বেরোবে রানা।

কখন তা করবে, তার হিসেব দেয়নি কমপিউটারের প্রোগ্রাম। ওই তথ্য লাগবে না। মাসুদ রানা একবার শহর ছেড়ে গেলেই ঢুকে পড়বে ল্যাং-এর মুঠোয়। ওদেরকে খুঁজে নেয়ার জন্যে অন্য ট্র্যাকিং সিস্টেম আছে তার। এরপর যখন পাবে, আশপাশে কেউ না থাকলে হাসতে হাসতে ওদেরকে খুন করবে সে। সাক্ষী বলতে কেউ থাকবে না তখন।

প্রজেক্ট লিডারের দিকে তাকাল হুয়াং লি ল্যাং।

আকাশে তোলার জন্যে তৈরি করো ড্রোন।

.

৩৫.

 হোটেল থেকে চোরাই গাড়ি নিয়ে বেরোবার আধঘণ্টা পর নকল আইনী কাগজ দেখিয়ে এক রেন্টালকার নিয়েছে রানা। আপাতত ওরা চলেছে উত্তরদিকে। আবারও ফিরছে ক্যানকুনের উপকূলীয় ব্যস্ত এলাকায়। ওদিকেই আছে এয়ারপোর্ট।

পেছনে বসে পাবলোর সঙ্গে রাশান ভাষায় টুকটাক কথা বলতে চাইছে মিতা। স্ফটিক এত কাছে বলে প্রায় খেপে আছে পিচ্চি ছেলেটা। বারবার দেখছে ব্যাকপ্যাক।

পাবলো, আমরা নতুন বাড়িতে যাচ্ছি, বলল মিতা। ওখানে কেউ আমাদেরকে ধরতে আসবে না।

স্ফটিক রাখা ব্যাকপ্যাক থেকে চোখ না সরিয়ে বলল পাবলো, অনেক বেশি আলো! অনেক! দুহাতে ঢেকে ফেলল চোখ।

রানা, প্রফেসর এবং মিতার ধারণা, ব্রাযিলের ওই স্ফটিকের মতই এই স্ফটিক। কিন্তু ভাবতে শুরু করেছে মিতা, যদি এক না হয় দুটো? বিচ্ছুরণের খুব কাছে পৌঁছে গিয়ে থাকলে? ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ মেপে দেখার যন্ত্রপাতি ওদের কাছে নেই।

কী দেখছ, পাবলো? জানতে চাইল মিতা।

হাত তুলে আঁকাবাঁকা রেখা তৈরি করল ছেলেটা। চাপা স্বরে বলল, হলদে।

চোখে কষ্ট লাগছে? জানতে চাইল মিতা।

জবাব দিল না পাবলো।

 চোখে ব্যথা? জিজ্ঞেস করল মিতা। মাথাব্যথা করছে না তো? পারলোর মাথা স্পর্শ করল ও।

নিচু স্বরে বলল পাবলো, হলদে মানেই ভাল। নীল খারাপ। যত কালচে, তত খারাপ। ব্যথা লাগে।

মিতা খেয়াল করছে, আগের চেয়ে বেশি সহ্য করছে। পাবলো এই স্ফটিক। তবে আবারও এনার্জি বাড়লে সমস্যা হবে।

ওর আন্দাজ অনুযায়ী, আবারও এনার্জি বাড়বে পাঁচ ঘণ্টা পর। তবে সেটা সাধারণ বিচ্ছুরণ, না বোটে যা হয়েছিল, তেমন ভয়ঙ্কর কিছু বোঝার উপায় নেই। পাবলোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল মিতা। ওর কোলে শুয়ে পড়ল পিচ্চি ছেলেটা।

সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে আছেন প্রফেসর হ্যারিসন। মিতার মনে হলো, বেড়ে গেছে মানুষটার পায়ের ব্যথা। সাবধানে ক্ষতের জায়গায় আঙুল বোলালেন তিনি।

আপনি ঠিক আছেন তো, স্যর? জানতে চাইল মিতা।

 হয় পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি, অথবা বাড়ছে ইনফেকশন।

আরেক দফা অ্যান্টিবায়োটিক দেব, বলল মিতা।

এখন না, বললেন প্রফেসর, কেমন মাথা ঘুরছে। কোথাও পৌঁছে তারপর খাব।

রানার দিকে তাকাল মিতা।

স্থানীয় এয়ারপোর্টের দিকে চলেছে ওরা। সরু দুই লেনের রাস্তায় গিজগিজ করছে গাড়ি। একটু পর পর থামতে হচ্ছে।

এই ছোট শহরে এত ভিড় হয় কী করে? বলল মিতা।

খেয়াল করোনি, সৈকতের কাছের সব হোটেল ভরে গেছে টুরিস্টে? বলল রানা। মেক্সিকোর বড় অনুষ্ঠান ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ার।

চুপ করে থাকল মিতা।

রেডিও ছাড়ল রানা।

স্প্যানিশ ভাষায় ব্রডকাস্ট করছে বিবিসি ওঅর্ল্ড। প্রথমেই জানাল সংবাদদাতা: অত্যন্ত ঘোলাটে হয়ে উঠছে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে আমেরিকা, চিন ও রাশা। অবশ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি, যুদ্ধঘোষণা আগে করবে কোন্ দেশ। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, বরাবরের মতই আমেরিকার পাশে থাকবে ব্রিটেন… ইত্যাদি ইত্যাদি।

একটু পর শুরু হলো জটিল এ বিষয়ে কজন বিশিষ্টজনের গালভরা আলোচনা।

ওই অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত হালকা সংবাদ প্রচারের এক স্টেশন ধরল রানা।

সংবাদ পাঠিকা বলল: চমকার পরিবেশের লোভে হাজারো টুরিস্ট এ দেশে এসেছেন ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ার পালন করতে। খুশি ছিল সবাই। কিন্তু গতকাল দুপুরে অদ্ভুত এক শক ওয়েভ বন্ধ করে দেয় এ দেশের বেশিরভাগ এলাকার বিদ্যুৎপ্রবাহ। মেক্সিকান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, ইউ.এস.-এর টপ সিক্রেট গ্রুম লেক এয়ার ফোর্স বেস-এ দুর্ঘটনার ফলে ওভারলোড হয়েছে তাঁদের গ্রিড। অনেকেই বলছেন, ওই শক ওয়েভ এতই শক্তিশালী ছিল, তা অনুভব করা গেছে এ দেশ থেকেও। ধারণা করা হচ্ছে, ওটা কোনও টেরোরিস্ট হামলা। …এদিকে আজ এক হোটেলে হঠাৎ হামলা করেছে একদল সশস্ত্র লোক। এ খবর জানার পর বাড়ি ফিরতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে বেশিরভাগ টুরিস্ট। আমরা এখন কথা বলব মেক্সিকান ফরেন মিনিস্টার মিস্টার গুডু হাচ্চির সঙ্গে…।

রেডিও বন্ধ করল রানা। দূরে চোখ ওর। একমাইল দূরে এয়ারপোর্টের প্রবেশপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে মেক্সিকান আর্মি ও রায় পুলিশ। একে একে গাড়ি পরীক্ষা শেষ করে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে তারা।

হয়তো ওদের কাছে আমাদের ছবি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ, বলল রানা, চাই না ওই সিকিউরিটির ভেতর পড়তে।

কী করবে? জানতে চাইল মিতা।

খুশি মনে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে হেলিকপ্টার ধার নিতাম, কিন্তু আপাতত তা সম্ভব নয়, বলল রানা। লোক বেশি।

সরল স্বীকারোক্তি শুনে হেসে ফেলল মিতা। চুরি করতে?

একে আপন করে নেয়া বলতে পারো।

খুশি হয়ে বললেন প্রফেসর, আমার ভাল লাগছে যে রানার হেলিকপ্টারে আমার উঠতে হচ্ছে না।

দয়া করে অত খুশি হবেন না, স্যর, বিনয়ের সঙ্গে বলল রানা। এবার কাজে লাগাতে হবে বি প্ল্যান।

কথা শুনে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেল হ্যারিসনের। পরিষ্কার মনে আছে রানার ঝরঝরে, প্রাচীন হেলিকপ্টারের কথা।

সামনের পেট্রল স্টেশনে ঢুকল রানা। অপেক্ষা করল কয়েক মিনিট, তারপর আবারও বেরোল রাস্তায়। এবার চলেছে ফিরতি পথে। মৃদু হাসি ফুটে উঠল রানার ঠোঁটে।

রিয়ার ভিউ মিররে ওকে দেখে জিজ্ঞেস করল মিতা, অত মিটমিট করে হাসছ কেন?

কারণ মহা-হারামি এক আমেরিকান বিলিয়নেয়ারের কথা মনে পড়েছে, বলল রানা, তার কাছ থেকে কিছু নেয়া সত্যিকারের পুণ্যের কাজ। ভাবছি, ওর পাপ কিছুটা মোচন করি।

.

লেক রেনেগেড এলএ-২৫০ সিঙ্গল ইঞ্জিন উভচর বিমানে পন্টুনের বদলে পেটের নিচে থাকে নৌকার খোল। টেক্সান ট্রাভেলস্ কোম্পানির জিনিস। চাইলে দু শ ডলার খরচ করে ওটাতে চেপে চল্লিশ মিনিটের জন্যে সাগর ও উপকূলের ওপর দিয়ে ঘুরে আসতে পারে টুরিস্ট। আরও কিছু ডলার খরচা করলে দুঘণ্টার জন্যে ঘুরিয়ে আনবে দূরের উপসাগর থেকে। নামা যাবে নির্জন সৈকতে, বাধা নেই পিকনিক করতে। তবে এত সময় নেই যে ওসব করবে রানা, মিতা, হ্যারিসন ও পাবলো।

রানা এজেন্সিকে দিয়ে জরুরি কিছু গোয়েন্দাগিরির কাজ করিয়ে নিয়েছিল টেক্সান ট্রাভেলস্ কোম্পানির বিলিয়নেয়ার মালিক। কাজ শেষে টাকা চাইলে ঘোরাতে লাগল: কাল দেব, পরশু দেব। কাটিয়ে দিল এভাবে কয়েক মাস। এরপর টাকা তো দিলই না, আইনের আশ্রয় নিতে চাইলে তার তরফ থেকে এল কড়া ধমক।

শাখা প্রধানের কাছ থেকে সব শোনার পর রানা বলল, বাজে লোক, টাকা তো দেবেই না, বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লেলিয়ে দেবে, যাতে সমস্যা তৈরি করে। আইনী ঝামেলায় যাব না আমরা। তবে মনে রাখব, ওর কাছে টাকা পাই। সুযোগ পেলেই আদায় করে নেব পাওনা।

আজ রাতে এসেছে সেই লোভনীয় সুযোগ।

প্রায় দুপুর থেকে ঘন জঙ্গলে গাড়ি রেখে অপেক্ষা করেছে। ওরা। বিচ্ছুরণ হওয়ার আগেই গভীর গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রেখেছে। স্ফটিক। পরে তুলে নিয়েছে আবার। তারপর মাঝরাতে হাজির হয়েছে জনমানবহীন সাগর-সৈকতে।

অন্যান্য বিমান ভাড়ার এজেন্সিতে না ঢুকে টেক্সান ট্রাভেলস্ কোম্পানির সামনে থেমেছে রানা। স্কেলিটন কি ব্যবহার করে ঢুকেছে ওই অফিসে। মাত্র পাঁচ মিনিট পর বেরিয়ে এসেছে পছন্দের বিমানের চাবি হাতে।

ডকে অপেক্ষা করছিল মিতা, হ্যারিসন ও পাবলো।

রানা যেতেই জিজ্ঞেস করেছেন হ্যারিসন, কোনও গোলমাল হয়নি তো?

মাথা নেড়েছে রানা। না। লবির সোফায় আরাম করে ঘুমিয়ে ছিল পাহারাদার। মাথায় টোকা দিয়ে অজ্ঞান করে হাত পা-চোখ-মুখ সব বেঁধে রেখে এসেছি।

মুচকি হেসে বলেছে মিতা, পাকা চোর বলব, না ডাকাত!

চোর-ডাকাত? এসব আবার কী কথা? ভুরু কুঁচকে ফেলেছে রানা। সুদে-আসলে নিয়েছি প্রাপ্য। এই কোম্পানির মালিকের কাছে অনেক টাকা পাই। একটু দূরের উভচর বিমানের ককপিটে চেপেছে। উঠে পড়ো।

সবাই সিটবেল্ট বেঁধে নেয়ার পর ঝিনুকের মত দরজা বন্ধ করেছে রানা। ইঞ্জিন চালু করে ডক থেকে সরিয়ে নিয়েছে বিমান। গভীর পানিতে যেতেই ঠেলে দিয়েছে থ্রটল।

বিলিয়নেয়ার ব্র্যাড হাডসনের দামি বিমান আকাশে উঠতে সময় নিয়েছে মাত্র ত্রিশ সেকেণ্ড।

সেটা পুরো আড়াই ঘণ্টা আগের কথা।

প্রফেসর হ্যারিসনের মানচিত্রে আঁকা রেখা অনুসরণ করছে। রানা। ভরসা দিয়েছে মিতাকে, ভাল করেই জানে, কোথায় যেতে হবে। তবে এটা বলেনি, যতটা দূরে যেতে হবে, তাতে প্রায় ফুরিয়ে যাবে বিমানের ট্যাঙ্কের তেল। ঠিক সময়ে উপযুক্ত জায়গায় নামতে না পারলে করুণ পরিণতি অপেক্ষা করছে। ওদের জন্যে!

চমৎকার বিমান বেছে নিয়েছে ও। বিশাল জানালা দিয়ে দেখা যায় চারপাশ। ছাতেও ওই একই জিনিস, পরিষ্কার চোখে পড়ে বহু দূরের মিটমিট করা নক্ষত্র।

অন্ধকারে বিকট আওয়াজ তুলছে বিমান। আপাতত দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। খুলে রেখেছে ককপিট দরজা, ঘুরে যাত্রীদের দেখল রানা। ঘুমিয়ে কাদা প্রফেসর হ্যারিসন ও পিচ্চি পাবলো। বিমানের ইঞ্জিনের গর্জনকে দাবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে আর্কিওলজিস্টের থ্যাবড়া নাক।

পাশের কো-পাইলটের সিটে বসে বলল মিতা, আকাশে উড়তে খুব পছন্দ করো, তাই না?  

পাখির মত ডানা নেই, তাই সাহায্য নিচ্ছি যন্ত্রের, বলল রানা। এই রেনেগেড বিমানের আড়াই শ হর্সপাওয়ারের ইঞ্জিন কেবিনের ওপরে পাইলনে বসানো, প্রচণ্ড শব্দ করে। তবে এত আওয়াজ না থাকলে খুশি হতাম।

গতরাতে ফোন দিলেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান, লজ্জায় লাল হলো মিতা। তার আগে কী যেন দিতে চেয়েছিলে?

তাই? একদম ভুলে গেছি। হাসল রানা। জোরালো আকর্ষণে টানছে ওকে মিতা। কিন্তু ওর জীবনে মেয়েটা কোনওভাবে জড়িয়ে যাক, তা চাইছে না রানা। মনে পড়লে তোমাকে জানাব।

কখনও ভেবেছ, এত ঝুঁকির জীবন থেকে অবসর নেয়ার কথা? বলল মিতা। হয়তো সংসার করলে?

নদীর বিপজ্জনক বাঁকে পৌঁছে গেছে মিতা। চুপ করে থাকল রানা।

কী ভাবছ? জানতে চাইল মেয়েটা।

ভাবছি, সামনে বিপদ হবে।

 ও, হতাশ হলো মিতা। নিজেকে মনে করিয়ে দিল, সত্যি, কখনও বাঁধতে পারবে না মানুষটাকে মায়ার জালে। মনে পড়ল আশা ভোঁশলের প্রিয় একটা গানের কথা: তারে ভোলানো গেল না কিছুতেই! এদের ভোলানো যায় না কোনওদিন।

বাইরে দেখো। 

জানালা দিয়ে দূরে তাকাল মিতা। অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই। মাইলের পর মাইল প্রায়-অভেদ্য ঘন জঙ্গল। তারপর হঠাৎ দেখল রুপালি ঝিলিক। যেন প্রতিফলিত হয়েছে দানবীয় কোনও আয়নায়। হারিয়ে গেল আলো।

ওটা কী, বুঝল না মিতা। আগে কখনও এমন কিছু দেখেনি। ঝলসে উঠেছিল জঙ্গলের মাঝে।

অন্ধকারে চেয়ে রইল ও। কানফাটা শব্দে এগিয়ে চলেছে বিমান। কিছুক্ষণ পর আবারও দেখল রুপালি ঝলক। এবার চারপাশের অন্ধকারের সঙ্গে মিতালি করে রয়ে গেল ওই আলো। সাপের মত চলেছে ঘাসের মাঝে। হারিয়ে গিয়ে আবারও ফিরল সাদা রশ্মি। বিমানের সঙ্গে যেন পাল্লা দিতে হবে তার।

কয়েক সেকেণ্ড পর মিতা বুঝল, আকাশের চাঁদ প্রতিফলিত হচ্ছে অনেক নিচের সরু নদীর জলে।

আগেও দেখেছ এই দৃশ্য? বলল মিতা।

 হ্যাঁ। দারুণ না?

 মাথা দোলাল মিতা।

এবার ঘুমন্ত সুন্দরকে জাগিয়ে তোল, কুচকুচে কালো প্রফেসরকে দেখাল রানা। কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছে যাব।

গিয়ে কাঁধে টোকা দিয়ে হ্যারিসনকে তুলল মিতা।

চোখ কচলে নিয়ে চমকে গেলেন প্রফেসর। নিচে জঙ্গলের মাঝে নদী, নানাদিক্লে তৈরি করেছে ছোট কিছু খাল। সেগুলোরই কোনওটায় নামতে হবে। পিছিয়ে গেল বামে কয়েকটা লেক।

জলে চাঁদের প্রতিফলন। সবমিলে ডজনেরও বেশি লেক।

মিতার মনে হলো, পায়ের ছাপ রেখে গেছে স্বর্গের কোনও দেবতা।

অকল্পনীয় দৃশ্য, বললেন প্রফেসর।

ফুরিয়ে এসেছে তেল, এবার নামব সবচেয়ে বড় লেকে, নইলে বিধ্বস্ত হবে বিমান জঙ্গলে, দুঃসংবাদ দিল রানা।

অবাক চোখে ওকে দেখল মিতা ও কম্পমান প্রফেসর।

অন্য উপায় ছিল না, নইলে রাশানরা, ল্যাঙের লোক, আর্মি বা পুলিশের লোকের হাতে ধরা পড়তাম, ব্যাখ্যা দিল রানা।

মাথা দোলাল মিতা। ও!

শেষে খুন হলাম বেপরোয়া, নচ্ছার, দুর্ধর্ষ রানার হাতে! করুণ সুরে বললেন প্রফেসর।

সরু, আঁকাবাঁকা নদী গেছে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে, দুপাশে ছোট পুকুর ও লেক, যেন আলোর দেবতার রুপালি পদচিহ্ন।

প্রফেসরের কাছ থেকে পাওয়া মানচিত্র দেখল রানা। এ দেশের উঁচু জমিতে পৌঁছে গেছে ওরা। নানান দিক থেকে নদী বা লেকে পড়েছে ঝর্না। কিন্তু সবই শীর্ণ। এ বছর অস্বাভাবিক বৃষ্টি হ্রাসের ফলে লেকের গভীরতা কম। হেলিকপ্টার পেলে বিপদ ছিল না, কিন্তু এত ছোটসব লেকে উভচর বিমান নামানো খুব কঠিন কাজ!

.

৩৬.

আগে কখনও হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে এত লোক দেখেননি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। জয়েন্ট চিফ, সিআইএ ডিরেক্টর ক্যালাগু, স্টেটসের ডিফেন্স সেক্রেটারিরা এবং তাদের এইডরা গিজগিজ করছে ঘরে। প্রধান টেবিল ঘিরে অন্যান্য কেবিনেট সদস্যরা।

গত কয়েক ঘণ্টায় আরও জটিল হয়েছে পরিস্থিতি। রাশানরা গুপ্তচর ফাইটার বিমান ফেলে দিয়েছে বলে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে চিন নেভি। বিতর্কিত সাগরে দুটো গুপ্তচর রাশান বোট দখল করে নিয়েছে তারা। সীমান্তে জড় হচ্ছে দুদেশের সেনাবাহিনী।

বিপজ্জনক সাগরের দিকে যাচ্ছিল আমেরিকার এক নেভির জাহাজ, কিন্তু বিপদ বুঝে পিছিয়ে গেছেন ক্যাপ্টেন। নইলে বেদখল হতো ওই রণতরী। এখন প্রতারক দেশ হিসেবে আমেরিকার দিকে আঙুল তুলছে রাশানরা। একই কথা বলছে চিন সম্পর্কে।

এদিকে চিনা কর্তৃপক্ষ জানতে চেয়েছে, কী কারণে তাদের সাগরে ঘুরঘুর করছে রাশান ও আমেরিকান গুপ্তচর রণতরী। সেক্ষেত্রে তারা কেন ধরে নেবে না, ওই দুই দেশ মিলে হামলা করতে চাইছে চিনের ওপর?

আমেরিকার দিকে আঙুল তাক করছে চিন ও রাশা।

নিজেরাও সন্দেহ করছে পরস্পরকে।

নিজের চেয়ারে চুপ করে বসে সিচুয়েশন রিপোর্ট শুনছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট।

বড় ফ্ল্যাট-স্ক্রিন দেখিয়ে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করছেন জয়েন্ট চিফ।

…এদিকে তাদের মোকাবিলা করতে রাশান সীমান্তে পাঠানো হয়েছে চাইনিজ আর্মির চল্লিশটা ডিভিশন। শুধু তাই নয়, কৌশলগত সব জায়গায় মোতায়েন হয়েছে আধুনিক যুদ্ধবিমান। সবই রাখা হয়েছে সীমান্তের এক শ মাইলের ভেতর।

ক্লিক করে নতুন ছবি আনলেন জয়েন্ট চিফ।

ওটা স্যাটেলাইট ইমেজ। দেখা গেল রাশান আইসিবিএম সাইলো। বিদঘুটে মস্ত এক ট্যাঙ্কার ট্রাক থেকে নানান হোস গেছে মিসাইলের পেটে। যুদ্ধের জন্যে তৈরি হচ্ছে রাশানরা। তৎপরতা দেখে বোঝা যাচ্ছে, তারা হামলা করতে পারে দুদিকে। সেনাবাহিনী সদস্যরা দুভাগে ভাগ হয়েছে, একদল হামলা করবে এশিয়ায় চিনের ওপর, অন্য দল ইউরোপে।

নতুন ছবি এল স্ক্রিনে।

সীমান্তের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে মোবাইল এসএস-২০ লঞ্চার।

বিশেষ একটি ছবি দেখা গেল। বছরের এ সময়ে বরফে ঢাকা থাকে মারম্যানস্ক বন্দর, কিন্তু যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে প্রকাণ্ড আইসব্রেকার দিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়েছে সমস্ত বরফ।

আমাদের দৃষ্টিতে এটা সবচেয়ে বড় সমস্যা, বললেন জয়েন্ট চিফ, আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সাগরে ছড়িয়ে পড়বে তাদের ব্যালিস্টিক মিসাইল বহর। কিউবার মিসাইল ক্রাইসিসের সময় আমরা ধরে নিয়েছিলাম, যুদ্ধে নামতে হলে সময় নেবে রাশানরা। কিন্তু এখন অন্য কিছু দেখছি আমরা।

প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন তিনি। এটা মস্ত বিপদ সঙ্কেত, স্যর। রাশানরা খুবই সিরিয়াস। আমাদেরও উচিত যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুতি নেয়া।

কী করবেন ভাবছেন প্রেসিডেন্ট।

আপাতত বিপদ ঘটাবে না ব্রাযিল স্টোন। রাখা হয়েছে ইয়াকা মাউন্টেনের গভীর অংশে। চারপাশের সেন্সর থেকে জানা গেছে, ওই স্ফটিক থেকে বেরোচ্ছে না ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এনার্জি। তবে এনআরআই স্টাফ, সিআইএর এক্সপার্ট বা ক্যাথিবা আলিহাও বলতে পারবেন না, আবার কখন মারাত্মক বিচ্ছুরণ হবে ওটা থেকে।

শুরু হয়েছে তিন দেশের স্নায়ু যুদ্ধ, এখন ব্রাযিল স্টোন থেকে আবারও বিচ্ছুরণ হলে মহাবিপদে পড়বে আমেরিকা।

যুদ্ধাবস্থায় পড়েছেন, ভাবছেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু হঠাৎ বুঝলেন, অন্যদিক থেকে কপাল ভাল।

এনআরআই হেডকোয়ার্টারে বা অ্যাড্রিউ এয়ার ফোর্স বেস থেকে রওনা হওয়ার আগেই ওই স্ফটিক বিচ্ছুরণ ঘটালে বিদ্যুত্তীন হতো পুব উপকূল। কানা হতে পেন্টাগন, হোয়াইট হাউস, কংগ্রেস, ল্যাংলির সিআইএ সবই।

ওই বিচ্ছুরণের ফলে বিনষ্ট হয়েছে গ্রুম লেকের প্রায় প্রতিটি সার্কিট ও ব্যাকআপ সিস্টেম। এমন কী আশি মাইল দূরের নেলিস এয়ার ফোর্স বেসও হয়ে পড়েছে অকার্যকর।

ওদিকে নেয়ার আগেই ব্রাযিল স্টোন থেকে বিচ্ছুরণ হলে অসহায় অবস্থায় পড়ত পুরো দেশ। এমন কী কাজ করত না ল্যাণ্ড ফোন। টিভি নেই, রেডিয়ো নেই, ইন্টারনেট নেই। পুবের কোনও এয়ারপোর্টে নামতে পারত না একটাও বিমান। হঠাৎ করেই যেন পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যেত নিউ ইয়র্ক থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন। যে-কেউ ভাবত, আমেরিকার ওপর নিউক্লিয়ার হামলা করেছে কোনও সুপারপাওয়ার।

সন্দেহের বশে অন্য দেশের ওপর নিউক্লিয়ার বোমা হামলা করত ওয়েস্টার্ন কমাণ্ড।

হ্যাঁ, কপাল ভাল, ওই বিচ্ছুরণ হয়েছে সভ্যতা থেকে বহু দূরে। তবে ওটার কারণে মনোভাব পাল্টে গেছে প্রেসিডেন্টের। বারবার সিআইএ চিফ ক্যালার কথা শুনে এখন তাঁরও মনে হচ্ছে, ভয়ঙ্কর স্ফটিক সত্যিই তাদের জন্যে অত্যন্ত বিপজ্জনক। যারা এসব নিয়ে গবেষণা করছে, তারাও জানে না এরপর কী ঘটাবে ওটা। কাজেই এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাওয়া বোকার কাজ।

গত কিছু দিন হলো পুরনো বন্ধু জেমস ব্রায়ানের দিকে ঝুঁকে তাকে সহায়তা করেছেন, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে: কী ধরনের বিপদ আসছে, তা বুঝতে পারছে না সে।

মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বললেন জয়েন্ট চিফ, দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে অনুরোধ করছি, আমরা যেন তৈরি রাখি আমাদের মিলিটারিকে। তাই বলব, আপনার বোধহয় ঘোষণা করা উচিত ডিফেন্স কণ্ডিশন টু।

টু? থমকে গেলেন প্রেসিডেন্ট।

জী, মিস্টার প্রেসিডেন্ট। রাশা ও চিনের যুদ্ধাবস্থার কারণে এটা ঘোষণা করা এখন জরুরি।  

প্রেসিডেন্টের মনে পড়ল জেমস ব্রায়ানের কথা: একটা বাড়াবাড়ি তৈরি করে অন্যের বাড়াবাড়ি। ঠিকই বলেছে এনআরআই চিফ। তবে নিজে ভুলে গেছে, তার কারণেই আজ এই বিপদ।

ব্রিফিং ফোল্ডারের ছবি দেখলেন প্রেসিডেন্ট।

ফিউয়েল ভরা হচ্ছে রাশান আইসিবিএম-এর বুকে। এটা করা হচ্ছে পুরো দশ বছর পর।

হাতের তালু ঘামছে প্রেসিডেন্টের। একটু আগেও ভেবেছেন, সামলে নেবেন সব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, হাতের বাইরে চলে গেছে পরিস্থিতি। আরও একটা চিন্তা এল তাঁর মনে: পুরনো বন্ধু জেমস ব্রায়ান আর আমেরিকার জনগণকে একইসময়ে নিরাপদে রাখতে পারবেন না।

মিস্টার প্রেসিডেন্ট… জরুরি হয়ে উঠেছে আপনার নির্দেশ।

ফোল্ডার বন্ধ করে মুখ তুললেন প্রেসিডেন্ট। না। ডেফকন থ্রি ঘোষণা করুন। নিরাপত্তার জন্যে সবই করুন, কিন্তু আগেই যেন সাগরে না যায় আমাদের রণতরী। সতর্ক থাকুক বোমারু বিমানের পাইলট ও ক্রুরা। তৈরি রাখা হোক আইসিবিএম। কিন্তু রাশা বা চিনকে কোনওভাবেই ভয় দেখাবেন না। নইলে চাকরি থাকবে না আপনাদের। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন?

এতই গম্ভীর কণ্ঠে বলেছেন প্রেসিডেন্ট, একেবারে থমকে গেছে ঘরের সবাই। এরপর উত্তেজিত হয়ে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করবে না কেউ প্রেসিডেন্টকে।

জী, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বললেন জেসিএস।

চেয়ার ছাড়লেন প্রেসিডেন্ট।

 সবার মনোযোগ চলে এল তার ওপর।

প্রতি দুঘণ্টা পর পর আপডেট চাই। সিআইএ চিফ ক্যালাগুর দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

দৃঢ় পায়ে সিচুয়েশন রুম থেকে করিডোরে বেরিয়ে এলেন। তিনি। রাগে থমথম করছে চেহারা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যারা অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্যে, সবাই সরে গেল দেয়ালের কাছে। এখন সময় নয় আবদার করার।

প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে পিছু নিয়েছেন সিআইএ চিফ ক্যালাগু। হোয়াইট হাউসের এলিভেটরের দিকে চলেছেন প্রেসিডেন্ট। তাঁকে মাঝ করিডোরে ধরলেন তিনি।

ব্রায়ানের ব্যাপারে কী বুঝলেন? ধমকের সুরে জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।

থমকে গিয়ে দ্বিধা করলেন ক্যালাগু। কয়েক সেকেণ্ড পর কথা গুছিয়ে নিয়ে বললেন, যা খুশি তা-ই করতে চান তিনি। শেষ কথা: বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার।

ব্রায়ান অমন লোক নন, ভাল করেই জানেন প্রেসিডেন্ট। যুক্তি না থাকলে এত ঝুঁকি নিতেন না তিনি। আরও কিছু আছে এসবের ভেতর।

করিডোরে বাঁক নিয়ে পরের প্রশ্ন ছুঁড়লেন প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান কী ধরনের তথ্য গোপন করছেন?

দূরে চোখ রাখলেন সিআইএ চিফ। ভঙ্গি নিয়েছেন, তিনি ভাবছেন। কয়েক সেকেণ্ড পর বললেন, প্রথম দিন থেকেই এনআরআই-এর বিপক্ষে ছিলাম। ব্রায়ান চিফ হওয়ার পর বিরক্তি বেড়েছে আরও। তিনি মনে করেন, মাঝখান থেকে এসে নাক গলাতে চাইছি। কিন্তু…

কিন্তু কী?

কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে, যা করছি, সবই দেশের জন্যে। এনআরআই থেকে সমস্ত ডেটা নিয়েছি আমরা। সেসবের ভেতর কোনও ত্রুটি থাকলে অবশ্যই তা চোখে পড়বে আমাদের। ব্রায়ান গোপন কিছু করে থাকলে, তা হয়তো রাখেননি ডেটার মাঝে।

একমত হলেন না প্রেসিডেন্ট। তবে অযৌক্তিক কিছু কাজ করেছেন ব্রায়ান। ছোট একটি দল পাঠিয়ে দিয়েছেন মেক্সিকোয়। পরে সাহায্য চেয়েছেন বাংলাদেশের এক লোকের কাছে। এসব দায়িত্ববান, দেশপ্রেমিক ব্রায়ানের চরিত্রের সঙ্গে ঠিক মেলে না।

এলিভেটর থেকে ত্রিশ ফুট আগে থামলেন প্রেসিডেন্ট। অপেক্ষা করছে সিক্রেট সার্ভিসের গার্ড।

আপনার কি মনে হয় ব্রায়ানের কাজ যৌক্তিক? জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।

সবুজ সিগনাল পেয়ে গেছেন সিআইএ চিফ। অবশ্য নালিশ না করে নরম সুরে বললেন, আপনি যদি জানতেই চান, মিস্টার প্রেসিডেন্ট… চুপ হয়ে গেলেন তিনি।

পেটের সব নোংরা প্যাঁচ মারবে এবার ক্যালাগু।

বন্ধু ব্রায়ানের ওপর রেগে গেলেন প্রেসিডেন্ট। তার কারণেই আজ এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছে!

আমি চাই আপনি আবারও ফিরবেন ইয়াকায়, বললেন তিনি, ব্যক্তিগতভাবে চোখ রাখবেন ব্রায়ানের ওপর।

মিস্টার প্রেসিডেন্ট…

অনেক জড়িয়ে গেছে ব্রায়ান, চাইলেও তাকে সরিয়ে দেয়া কঠিন। অন্যদের চেয়ে বেশি জানে ব্রাযিল স্টোন সম্পর্কে। আমার মনে হচ্ছে, শেষপর্যন্ত ওই জিনিস ধ্বংস করে দেয়াই ভাল। তবে তাতে আপত্তি থাকতে পারে ব্রায়ানের, সরিয়ে ফেলতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে ঠেকাবেন আপনি। কয়েক সেকেণ্ড ভেবে আবারও বললেন তিনি, প্রয়োজনে চরম সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধা করবেন না।

.

৩৭.

 আকাশ থেকে নিচের জঙ্গলের মাঝে নদী ও লেক দেখছে রানা। একটু পর পর বাঁক নিয়েছে সরু নদী, ওখানে প্লেন নামানো অসম্ভব। এদিকে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়নি বলে অগভীর ছোট সব লেকে নামা আরও বিপজ্জনক। কিন্তু ফুরিয়ে এসেছে তেল, ঝুঁকি না নিয়ে কোন উপায়ও নেই।

পুরো সাত মিনিট নদী অনুসরণ করল রানা। না, আশপাশে বড় কোনও লেক নেই। মাত্র পাঁচ মিনিট পর শেষ হবে তেল। বিমান ঘুরিয়ে আগে-দেখা বৃত্তাকার এক লেকের দিকে চলল রানা।

কিছুক্ষণ পর বিমান নিয়ে নেমে এল অনেক নিচে।

একটু গেলেই সামনে সরু কিন্তু অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ এক লেক। কিন্তু পাশ থেকে আসবে জোরালো হাওয়া। বিপদ হতে পারে।

ওটা বাদ দিয়ে বৃত্তাকার লেকের দিকেই চলল রানা। জ্বেলে নিল ল্যাণ্ডিং বাতি। গাছের সারি প্রায় ছুঁয়ে পৌঁছল লেকের কাছে। অগভীর জলে পচা গাছের কাণ্ড ভাসছে দেখে গলা শুকিয়ে গেল ওর। ভাল দিক হচ্ছে, পেছন থেকে আসছে। হাওয়া।

লেক পেরিয়ে আবারও ঘুরল রানা। ইন্টারকমে জানাল, সিটবেল্ট বেঁধে নাও। আবারও কো-পাইলটের সিটে এসে বসেছে মিতা। ওর সিটবেল্ট পরীক্ষা করল রানা। ওদিকে পাবলোকে পাশে নিয়ে চোখ বুজে আছেন প্রফেসর, গলা থেকে বেরোচ্ছে জ্বরাক্রান্ত রোগীর মত কো-কে আওয়াজ।

ইঞ্জিনের গতি কমিয়ে ফ্ল্যাপ আরও খুলল রানা। বিমানের নাক উঁচু রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

আরেকবার ঘুরে দেখলে ভাল হতো না? জানতে চাইল মিতা। তেল আছে?

মাত্র দুমিনিটের, বলল রানা।

 কিন্তু লেকে গাছ থাকলে? আমরা তো খুন হব!

একই কথা ভেবেছে রানা। কিন্তু এ-ও জানে, মেক্সিকোর দুর্ভেদ্য নরকের মত কারাগারে বাকি জীবন কাটিয়ে দেয়ার চেয়ে জঙ্গলের মাঝের লেকে লাশ হওয়া ঢের আনন্দের ব্যাপার।

পাইলটদের পুরনো একটা বাণী শুনবে? বলল রানা। রাতে ইমার্জেন্সি ল্যাণ্ডিঙের সময় এক শ ফুট ওপরে জ্বেলে নেবে ল্যাণ্ডিং বাতি। যা দেখবে, ওটা অপছন্দনীয় হলে নিভিয়ে দেবে সেটা। তারপর স্রষ্টা বা শয়তানের কাছে প্রার্থনা করবে। তাই, মিতা, তুমি এখন ভগবানের কথা ভাবতে পারো।

বিড়বিড় করে প্রার্থনা শুরু করেছে মিতা। রাগী চোখে একবার দেখল রানাকে।

নির্বিকার চেহারায় কী সব সুইচ দেখছে বাঙালী গুপ্তচর।

ঝাঁকি খেয়ে নামছে বিমান। দুলছে এদিক-ওদিক।

সামনে থ্রটল ঠেলে দিল রানা। গাছের সারির ওপর পড়ল বিমানের ল্যাণ্ডিং বাতি। 

মিতার মনে হলো হাজারটা ডাল ছুটে আসছে ওর দিকে! ভীষণ ভয়ে চিৎকার করে উঠল ও, রানা!

একটা গাছের মগডাল ভেঙে এগোল বিমান। পরক্ষণে বিশাল এক ঝপাস্ শব্দে নামল লেকের জলে। দ্রুত কমছে বেগ। সামনে ছিটকে যেতে চাইল ওদের দেহ, কিন্তু টানটান হয়ে বাধা দিল সিটবেল্ট।

লেকের জল ছেড়ে ওপরে উঠল বিমান। ধুপ করে আবারও নামল নিচে। কালো কাঁচের মত জল ছলকে চলেছে দূরে।

শক্ত হয়ে বোসো, বলল রানা।

 কেন? আমরা তো নেমে গেছি! কাঁপা গলায় বলল মিতা।

একবার ওকে দেখল রানা, তারপর কথাটা পাড়ল, সমস্যা হচ্ছে, আমাদের কোনও ব্রেক নেই।

নেই? উইণ্ডশিল্ড দিয়ে সামনে তাকাল মিতা।

একই কাজ করছে রানা। ঝড়ের বেগে আসছে লেকের তীর!

বেগ কমছে বটে, কিন্তু তীরে গিয়ে তো দেবে বিমান!

কয়েক সেকেণ্ড পর ধুম্ শব্দে তীরে ধাক্কা মারল বিমান। হুড়মুড় করে উঠে এল জঙ্গলের ভেতর। থামল সরু কয়েকটা গাছ ভেঙে।

সোজা হয়ে বসে রানাকে দেখল মিতা। ব্রেক নেই? এটা জেনেও এমন বিমান নেয় কোনও পাগল?

নিয়েছি, যাতে নামতে পারি লেকে, বলল রানা, তুমি জানতে না, এসব বিমানে ব্রেক থাকে না?

ও! বড় করে দম ফেলল মিতা। না, জানতাম না। এবার এই খাঁচা থেকে বেরোতে চাই!

ওর হাতে ফ্ল্যাশলাইট ধরিয়ে দিল রানা। সিটবেল্ট খুলে ককপিটে চলে এল পাবলো। দরজা খুলে নেমে পড়ল রানা। ঢালু জমিতে ওর পিছু নিল অন্যরা।

পাশে পৌঁছে রানার কাঁধ চাপড়ে দিলেন হ্যারিসন। ভীষণ ভয় পেয়েছি। তবে একেবারে মেরে ফেলোনি, এজন্যে থ্যাঙ্ক ইউ। আর কখনও তোমার বিমানে বা হেলিকপ্টারে জীবনেও উঠব না!

রানা ভাবছে, বিমান তো গেল, কিন্তু ওটার ব্যাটারি আর রেডিও পরে কাজে আসবে।

জঙ্গলে ফ্যাকাসে সাদা আলো ফেলেছে নক্ষত্র ও চাঁদ। রানা টের পেল, যা ভেবেছিল, তার চেয়েও ছোট ছিল বৃত্তাকার লেক। চওড়ায় ও দৈর্ঘ্যে বড়জোর সাত শ ফুট। তীরে পঞ্চাশ ফুটি গাছের সারি। খারাপ ল্যাণ্ডিং হয়নি। কিন্তু তাতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। দূরে কাঁপা কাঁপা আলো। তারপর এল ফ্ল্যাশলাইটের উজ্জ্বল রশ্মি। বেশ কয়েকটা কমলা আগুনও জ্বলছে মশালের আগায়।

জঙ্গলের মাঝ দিয়ে আসছে একদল লোক। জেনে গেছে, লেকে নেমেছে বিমান। তারা শত্রু না বন্ধু বোঝা যাবে একটু পর।

থেমে দাঁড়াল রানা। অপেক্ষা করো, ওরা আসুক।

ওরা কারা? জানতে চাইল মিতা।

মায়ানদের উত্তরসূরী, বলল রানা, তবে আমাদেরকে সাহায্য করবে না ক্ষতি করবে, সেটাই দেখার বিষয়।

জঙ্গলের মাঝে ওরা পেল পোড়া কাঠের ধোঁয়ার গন্ধ।

কাছে চলে এসেছে লোকগুলো।

পাবলোর কাঁধে হাত রাখল মিতা। আমাদের উচিত নয় পালিয়ে যাওয়া? জানতে চাইল রানার কাছে।

সম্ভব নয়, বলল রানা। আমরা এই এলাকা চিনি না। ফ্ল্যাশলাইট জ্বালল ও। আলো নেড়ে দেখাল ওরা কোথায় আছে।

দিক বদল করে এদিকে এল মশাল ও ফ্ল্যাশলাইটের আলো।

কাছেই বোধহয় ছোট শহর আছে, বললেন প্রফেসর, কপাল ভাল হলে এখানকার লোক বলতে পারবে, জঙ্গলের ভেতর কোথায় আছে প্রাচীন মায়ান স্থাপত্য।

একই কথা ভেবেছে রানা।

খুব কাছে পৌঁছে গেল আলো। নেমে আসছে টিলার গা বেয়ে। একটু পর ঝোপঝাড় ছেড়ে বেরিয়ে এল অন্তত বিশজন লোক। কয়েকজনের হাতে শক্তিশালী ফ্ল্যাশলাইট।

আলো ফেলতেই চোখ ঢাকল মিতা।

স্প্যানিশ ভাষায় জানতে চাইল রানা, আপনারা কি সাহায্য করতে পারবেন? আমরা বিপদে পড়েছি।

জবাব দিল কর্কশ স্বরের এক লোক, পংগো লস ম্যানোস!

নির্দেশমত মাথার ওপর হাত তুলল রানা। ওর দেখাদেখি অন্যরা। কিছু বলতে হয়নি, কড়াৎ-কড়াৎ কয়েকটা শব্দে বুঝে গেছে, কককরা হয়েছে কয়েকটা পাম্প শটগান।

ঘিরে ফেলা হলো রানা, হ্যারিসন, মিতা ও পাবলোকে। সবার ওপর তাক করা হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র।

বয়স্ক এক লোককে দলের নেতা মনে হলো রানার।

দৈর্ঘ্যে খাটো সে। বুক ভরা দাড়ি। গোঁফটা কাঠবিড়ালির লেজের মত বড় ও ফোলা। একহাতে ফ্ল্যাশলাইট, অন্যহাতে পিস্তল।

সার্চ করতে রানাদের বিমানে উঠল এক লোক। আরেকজন কেড়ে নিল মিতা ও হ্যারিসনের ব্যাকপ্যাক। ভালভাবে ওদের দেহ তল্লাশী করল তৃতীয় লোকটা। রানার কাছে ওয়ালথার পেয়ে সরিয়ে ফেলল।

রানাদের ঘিরে পায়চারি শুরু করেছে দাড়িওয়ালা। তবে দূরত্ব রেখেছে। হামলা করে তাকে জিম্মি করবে রানা, সে উপায় নেই। সবার পর পাবলোর ওপর মনোযোগ দিল সে। কিছুক্ষণ পর কোমরে গুঁজে রাখল পিস্তল।

সেনোর, সেনোরা, আপনারা এখানে কী চান?

বিমান ক্র্যাশ করেছে, রানা কিছু বলার আগেই তৈরি জবাব দিল মিতা। আমার স্বামী যাচ্ছিলেন পুয়ের্তো ভ্যালার্তায়, কিন্তু বেসামাল করে দিল দমকা বাতাস। তার ওপর ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে পড়ে গেল সব তেল।

কাছে সরে মিতাকে দেখল বয়স্ক লোকটা। তার চোখ পড়ল ওর হাতে। এই যুবক যদি স্বামীই হবে, তো কোথায় আপনার আঙটি? মিতা কিছু বলার আগেই জানাল, অনেকক্ষণ চক্কর কেটেছেন আকাশে। উপকূলে চলে যেতে পারতেন। কাজেই বুঝতে পারছি, আপনার পেটে অন্য গল্প আছে। তো সেটা কী?

ধরা পড়ে লজ্জায় লাল হলো মিতা।

রানার দিকে ফিরল গোঁফওয়ালা। কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই বিমানের পেট থেকে জানাল একজন, ভেতরে কেউ নেই। মালপত্রও নেই।

ব্যাকপ্যাক খুলে ফেলেছে আরেকজন। দাড়িওয়ালার হাতে দিল কাঁচের মত স্ফটিক ও স্যাটেলাইট ফোন।

কাছে স্ফটিক দেখে ছুটে যেতে চাইল পাবলো। শক্ত হাতে ওকে ধরে রাখল মিতা।

পাবলোর প্রতিক্রিয়া খেয়াল করেছে বয়স্ক লোকটা। আপনার ছেলে? জানতে চাইল।

পালক, বলল মিতা। ওর শারীরিক সমস্যা আছে। এখানে জঙ্গলের ভেতর আমাদেরকে আটকে রাখবেন না।

এক তরুণের হাতে স্ফটিক দিল লোকটা। পুরো সময়ে ড্যাবড্যাব করে ওটাকে দেখল পাবলো। সীসা দিয়ে মজবুত করা বাক্সে রেখে দেয়া হলো স্ফটিক।

নানান মিথ্যা বলছেন, বলল গোঁফওয়ালা, যাজকের কাছে আপনাদের স্বীকারোক্তি করা উচিত। তাতে পাপ মোচন হবে। ঘুরে টিলার দিকে পা বাড়াল সে, এদেরকে নিয়ে এসো!

.

৩৮.

 প্রায়ান্ধকার বার-এ বসে আছে ইগোর দিমিতভ। টেবিলে তিনটে গ্লাসে কম পয়সার তিন পেগ ভোদকা। পাশের চেয়ারে বসেছে স্থানীয় এফএসবি ইউনিটের নেতা।

বেয়াড়া যুবককে পছন্দ হয়নি ইগোর দিমিতভের। নেতা হওয়ার যোগ্যতা নেই এর। ইগোর বুঝে গেছে, এদেরকে রাখা হয়েছে ওকে পাহারা দেয়ার জন্যে। প্রশ্ন করলে বা নির্দেশ দিলে জবাব দেবে বা আদেশ পালন করবে, কিন্তু চোখে-মুখে অন্যকিছু। তাদের সত্যিকারের প্রভু রয়ে গেছে মস্কোয় এফএসবি অফিসে।

ভোদকা নেব তোমার জন্যে? বলল ইগোর দিমিতভ।

আমি ড্রিঙ্ক করি না, বলল যুবক।

কাঁধ, ঝাঁকাল ইগোর। করলেই ভাল করতে, খুব বিরক্ত দেখাচ্ছে তোমাকে।

লাশ ফেলে চলে আসা ঠিক হয়নি, বলল এফএসবি ইউনিট দলনেতা।

এ ছাড়া উপায় ছিল না, বলল ইগোর।

পিছু নেয়া উচিত ছিল, জোর দিয়ে বলল যুবক।

এক পেগ ভোদকা শেষ করে আরেকটা গ্লাস নিল ইগোর। কুঁচকে উঠেছে ভুরু। টুরিস্ট ভরা ব্যস্ত সৈকতে অস্ত্র হাতে ধাওয়া করতে? তোমার ধারণা আছে, কয়েক মিনিট পরেই পৌঁছত মেক্সিকান পুলিশ? মাত্র পাঁচ থেকে সাত মিনিটে হাজির হতো হেলিকপ্টার আর অন্তত দশটা পুলিশের গাড়ি। পালাতে কীভাবে? কাজ এগোত তাতে? আমাদের প্রথম দায়িত্ব পাবলোকে দেশে ফিরিয়ে নেয়া।

যুবক রেগে গেলেও সামলে রাখল নিজেকে। কিছুক্ষণ পর বলল, আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে: আপনি আসলে ওকে ধরতে চান কি না।

বিরক্তি চেপে হাসল ইগোর দিমিতভ। অনেক কিছুই ভাবতে পারো।

উঠে দাঁড়াল এফএসবি ইউনিট দলনেতা। আগামীকাল রওনা হব। পরেরবার আপনার কথামত সময় নষ্ট করব না, সেটা মাথায় রাখবেন।

বার ছেড়ে বেরিয়ে গেল যুবক।

এর বয়স কম, ভাবল দিমিতভ। ওজন ওর চেয়ে ত্রিশ পাউণ্ড বেশি। শক্তিশালী। পুরনো এজেন্টের প্রতি সম্মান নেই মনে।

দিমিতভের মনে পড়ল, কীভাবে বদলে গেছে সব। একসময় ও-ই ছিল সত্যিকারের হিরো, এজেন্টদের মাঝে সবচেয়ে প্রতিভাবান। এফএসবি ছেড়ে দেয়ার পরেও নানান কাজে ডাকা হতো। আর আজ পাঠানো হয়েছে বাচ্চা এক ছেলেকে কিডন্যাপ বা খুন করতে!

এই অপমান রাখবে কোথায়?

এফএসবির কাজ না করলে খুন হবে ও। বাদ পড়বে না আত্মীয়স্বজন। এখন আর সম্মান বলতে কিছুই নেই ওর। কোনও দাম নেই।

আরেক পেগ ভোদকা গলায় ঢালল দিমিতভ। জমে উঠছে নেশা। হ্যাঁ, কিছু করতে হবে, নইলে খুন হবে অর্ধেক বয়সের সব এজেন্টের হাতে!

.

৩৯.

 রানা, মিতা, হ্যারিসন ও পাবলোকে বন্দি করে ঘন ঝোপঝাড় ও জঙ্গলের মাঝ দিয়ে চলেছে সশস্ত্র লোকগুলো।

অনেকক্ষণ পর হালকা হলো অরণ্য। পাহাড়ি উঁচু এলাকা ছেড়ে নেমে এসেছে ওরা।

পুবাকাশ ফর্সা হয়ে একটু পর উঁকি দিল লাল সূর্য।

দুমাইল হাঁটার পর সামনে পড়ল খেলার মাঠ, অগভীর কাঁটা ঝোপঝাড়, সবুজ ফসলের জমি ও ঘাসে ঢাকা চারণভূমি।

একটু পর ওরা পৌঁছুল ছোট এক শহরে।

সাদা সব স্টাকো করা দালান। জেগে গেছে শহরবাসীরা। কাঁচা রাস্তায় খেলছে বাচ্চারা। গেট আটকে রাখা উঠানে গরু ছাগল। মুক্তি পেয়ে গেছে মোরগ-মুরগি। ছোট সব পোকা খুঁজে নিয়ে সাবড়ে চলেছে খুশি মনে।

হিসাবে ভুল হয়নি, ভাবছে রানা। এটা সন্ত্রাসী দলের আস্তানা নয়। অবশ্য অস্ত্রের মুখে ওদেরকে নেয়া হচ্ছে প্রধান সড়ক ধরে। বন্দিদের দেখে সব ফেলে থমকে গেছে শহরবাসীরা। কয়েক সেকেণ্ড পর এগিয়ে এল অনেকেই।

দলের সামনে হাঁটছে দাড়িওয়ালা বয়স্ক লোকটা। সাধারণ পোশাকের সুন্দরী এক যুবতী আসতেই হাতের ইশারায় সবাইকে থামতে বলল সে। মহিলা শুভ সকাল বলার পর নিচু স্বরে আলাপ শুরু হলো দুজনের।

আড় চোখে মিতা ও পাবলোকে দেখল মেয়েটা।

এরা নিচু স্বরে কী বলছে, কিছুই জানা নেই, আরও শক্ত হাতে পাবলোর হাত ধরল মিতা। প্রাণ থাকতে ছেলেটাকে কেড়ে নিতে দেবে না।

ভাববেন না, আশ্বাসের সুরে বলল দাড়িওয়ালা। আপাতত ওর দায়িত্ব নেবে লিনিয়া। এদিকে আলাপ করব আমরা।

মিতার মনে হলো নরম মনের মানুষ মহিলা। হাত তুলে একটু দূরের ছোট্ট এক বাড়ি দেখাল সে। কয়েক সেকেণ্ড দ্বিধা করে পাবলোকে ছাড়ল মিতা।

আবারও এগোতে ইশারা করল বয়স্ক লোকটা।

দুতিনটা বাড়ি পেরোবার পর সাদা এক বাড়ির উঠানে ঢুকল ওরা। রানা, মিতা ও হ্যারিসন বুঝল, এই দালান আসলে গির্জা। দরজায় লেখা, এই চার্চ স্যান ইগন্যাসিয়োর নামে উৎসর্গকৃত। উনি ছিলেন ক্যাথোলিক যোদ্ধাদের জেসুইট সন্ত।

দালানে ঢোকার পর পেছনে বন্ধ করে দেয়া হলো দরজা।

বেদির সামনে থেমে নতজানু হয়ে ক্রুশ আঁকলেন বয়স্ক লোকটা, নিজের গায়ে ছিটিয়ে দিলেন শ্লোক পড়া পবিত্র জল। এবার খুলে দেয়ালের পেরেকে ঝুলিয়ে রাখলেন পঞ্চো, তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন।

পরনের কালো আলখেল্লা ও সাদা গলাবন্ধ বলে দিল, তিনি একজন ক্যাথোলিক যাজক। ভারী গলায় বললেন, শুভ আগমন স্যান ইগন্যাসিয়োয়। আমি ফাদার ভাসকুয়েজ।

আপনি ফাদার… বিড়বিড় করল মিতা। মন দমে গেছে।

মৃদু হাসলেন ফাদার ভাসকুয়েজ। একগাদা মিথ্যা বলে এখন বুঝি মন খারাপ লাগছে?

রেগে গেছে মিতা। জানতে চাইল, বলুন তো, ফাদার, ঠিক কবে থেকে অস্ত্রের মুখে মানুষকে কিডন্যাপ করছে এই চার্চ?

ওর পাশেই টলে পড়ে যেতে গেলেন প্রফেসর হ্যারিসন, তবে চট করে তাকে ধরে ফেলল রানা। পাশের সরু এক বেঞ্চিতে শুইয়ে দিল। সতর্ক চোখে ওকে দেখলেন ফাদার ভাসকুয়েজ। আবার চোখ ফেরালেন মিতার চোখে। আমি যা করেছি, সেটা এই শহরের মানুষের নিরাপত্তার জন্যে।

কড়া কথা বলার জন্যে মুখ হাঁ করল মিতা, কিন্তু আগেই বলে উঠল রানা, ফাদার, যদি আপনার কাছে সাহায্য চাই, তা কি পাব?

নির্ভর করবে কী চাইবেন, তার ওপর। আমরা নিজেরা কোনও বিপদের ভেতর পড়তে চাই না।

আপনাদের বিপদটা কোথা থেকে আসবে? জানতে চাইল রানা।

ড্রাগ স্মাগলারদের তরফ থেকে।

আমরা তাদের দলের লোক নই, বলল রানা।

এখন তাই মনে হচ্ছে, বললেন ফাদার, কিন্তু আগে বোঝার উপায় ছিল না। কয়েক বছর আগে একদল লোক এসে টাকা সাধল আমাদেরকে। শুনল না কোনও কথা। গাছ কেটে তৈরি করল মাটির রানওয়ে। কেড়ে নিল আমাদের জমি। চাষ করতে লাগল ড্রাগসের গাছ।

যারা তাদের টাকা নিয়েছিল, তারাও ফেরত দিতে চাইল। কিন্তু তত দিনে দানব হয়ে উঠেছে ড্রাগ লর্ড। মেরে ফেলল কয়েকজন সাধারণ নাগরিককে। কিন্তু এই শহরের মানুষের মন। মরে যায়নি। যুদ্ধ ঘোষণা করলাম আমরা। কাজটা খুব কঠিন ছিল। লড়তে গিয়ে মারাও গেল বেশ কয়েকজন। তবে শেষপর্যন্ত তাড়িয়ে দিতে পারলাম দলবলসহ ড্রাগ লর্ডকে। আসলে একবার ঘরে বাঘ ঢুকতে দিলে ওটাকে বিদায় করা খুব কঠিন। শপথ নিলাম আমরা, আর কখনও এ এলাকায় ঢুকতে দেব না ড্রাগ লর্ডের লোকদেরকে।

জানালা দিয়ে নীল আকাশ দেখালেন ফাদার ভাসকুয়েজ। গভীর রাতে শহরের ওপর ঘুরছিল বিমান। তারপর নেমে পড়ল দূরের লেকে। ওদিকেই ছিল আমাদের কয়েকজন কাঠুরে। তাদের ফোন পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ করলাম আমরা। নিশ্চিত ছিলাম না আপনারা কারা। হয়তো জানেন না, মহান সন্ত ইগন্যাসিয়েও যাজক হওয়ার আগে সৈনিক ছিলেন। আমাদের উচিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা। আমরা তাই করেছি।

চুপ করে আছে রানা। আগেও দেখেছে দুর্গম এলাকায় মানুষের ওপর কত অত্যাচার করে ড্রাগ লর্ডরা।

লজ্জা পেয়েছে মিতা, ভেবেছিল একদল ডাকাতের হাতে ধরা পড়েছে। আপনার কথা বুঝতে পেরেছি, বলল ও।

তোমার দিকটাও বুঝেছি, বললেন ফাদার, মিথ্যা না বলে উপায় ছিল না। কিন্তু বুঝলাম না, এসেছ কী জন্যে। একটু খুলে বলবে? আমরা হয়তো সাহায্য করতে পারব তোমাদেরকে।

আপনি কি বিশ্বাস করবেন আমাদের কথা? বলল মিতা।

বলেই দেখো না। বিশ্বাস নিয়েই তো আমার কারবার।

আমরা খুঁজছি প্রাচীন এক মায়ান ধ্বংসাবশেষ। নাম ছিল পাহাড়ি জাগুয়ার রাজার মন্দির। আমাদের ধারণা, ওটা আছে এই শহরের কাছেই কোথাও।

হয়তো নেই, বললেন ফাদার ভাসকুয়েজ, এসব না খুঁজে নিজেদের দেশে ফিরলেই ভাল করবে।

পথ ছিল না ফেরার, বলল রানা, অন্যান্য কিছু কারণে শেষপর্যন্ত বাধ্য হয়েই নেমেছি সবচেয়ে উপযুক্ত লেকে।

বুঝলাম, মাথা দোলালেন ফাদার, ওই মন্দিরের ব্যাপারে গোপন রাখতে চান সব।

তার উপযুক্ত কারণ আছে, ফাদার, বলল রানা।

হয়তো তাই, বললেন ভাসকুয়েজ, এমন জিনিস এনেছেন, যেটা বোঝেন না। খুঁজছেন অমন আরও একই জিনিস। ভাবছেন, খারাপ কারও হাতে ওগুলো পড়লে সর্বনাশ হবে পৃথিবীর। আমি কি ঠিক বলেছি?

কয়েক সেকেণ্ড নিষ্পলক চোখে তাকাল রানা। তারপর মাথা দোলাল। ঠিকই বলেছেন।

জানলেন কীভাবে কী খুঁজছি? জানতে চাইল মিতা।

বোসো, ওকে বেঞ্চি দেখালেন ফাদার, সব বুঝতে হলে ফিরতে হবে কয়েক শ বছর আগের ইতিহাসের পাতায়।

.

৪০.

 দুর্গম ইয়াকা পাহাড়ের গভীর সুড়ঙ্গে চলছে তুমুল বিতর্ক। আসলে এনআরআই চিফ, সিআইএ চিফ বা বিজ্ঞানীরা কেউই জানেন না কীভাবে আসছে বিদ্যুৎ ওই মায়ান স্ফটিকের ভেতর। জিনিসটা যে অত্যন্ত বিপজ্জনক, তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।

এ কারণেই টেলিকনফারেন্স হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত। একের পর এক প্রশ্ন ছোঁড়া হচ্ছে এনআরআই চিফ ব্রায়ানের উদ্দেশে।

সমস্ত দায় চাপাতে চাইছেন সিআইএ চিফ ক্যালা তার ওপর।

ব্রায়ান বুঝে গেছেন, ওই স্ফটিক যে সত্যিই কাজের, তা বোঝতে না পারলে ধ্বংস করে দেয়া হবে ওটাকে।

সিআইএ চিফ হাঁফিয়ে যেতেই জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট, কোথা থেকে আসছে ওটার শক্তি? ওটা কি নিউক্লিয়ার? বা ওই ধরনের কোনও কিছুর ফিউশন হচ্ছে?

রেডিয়োঅ্যাকটিভ নয়, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বললেন ব্রায়ান, হচ্ছে না কোনও কোল্ড বা হট ফিউশন। আমরা এখনও বুঝিনি, কীভাবে তৈরি করছে শক্তি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এনার্জি সগ্রহ করছে কোথাও থেকে। জিনিসটা কটে (conduit)-এর মত।

ব্যাখ্যা করে বলল, বললেন প্রেসিডেন্ট।

ধরুন বাড়ির বৈদ্যুতিক তারের সকেটে গুঁজে দিলেন। আঙুল, সেক্ষেত্রে শক দেবে ওটা, বললেন ব্রায়ান, কিন্তু বৈদ্যুতিক তার বা সকেট সৃষ্টি করেনি ওই শক্তি। ওগুলো বড়জোর কণ্ডেট। ওই বিদ্যুৎ এসেছে আপনার বাড়ি থেকে বহু মাইল দূরের পাওয়ার স্টেশন থেকে। আমরা ভাবতে শুরু করেছি, স্ফটিকের ওই এনার্জি আসছে অচেনা কোনওখান থেকে।

সেই জায়গাটা কোথায়?

কথা বলতে হাঁ করেছিলেন এনআরআই চিফ, কিন্তু আগেই বলে উঠলেন সিআইএ চিফ ক্যালাগু, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, কখনও শুনেছেন জিওম্যাগনেটিক রিভার্সালের কথা?

সরে যাচ্ছে উত্তর মেরু?

মাথা দোলালেন ক্যালাগু। ফিরলেন তার বিজ্ঞানীর দিকে। প্রেসিডেন্টকে খুলে বলুন, হ্যাঁগার্ড।

চেয়ার ছেড়ে ল্যাব কোট ঝেড়ে নিয়ে দুবার কাশলেন নার্ভাস বিজ্ঞানী। আগে এত ক্ষমতাশালী কারও সামনে পড়েননি। গত এক শ মিলিয়ন বছর ধরে অন্তত বারোবার জায়গা ছেড়ে সরে গেছে দক্ষিণ ও উত্তর মেরু। শেষবার বড় পরিবর্তন এসেছে, সাত শ আশি হাজার বছর আগে। ওটাকে আমরা বলি ব্রানহেস-মাটুয়ামা রিভার্সাল। তবে এর আগে এমনই হয়েছে বিলিয়ন বছর ধরে। কখনও চল্লিশ বা পঞ্চাশ হাজার বছরের ভেতরেও সরে গেছে দুই মেরু। এরপর হয়তো স্থির থেকেছে পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর। ওটাকে বলি আমরা সুপারক্রন। অবশ্য কোনও বিজ্ঞানী হিসেব কষে বলতে পারবেন না কখন সরবে মেরু।

সিআইএর বিজ্ঞানী কী বলতে চাইছেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই এনআরআই চিফের। অপেক্ষা করলেন তিনি।

চশমা ঠিক করে নিলেন বিজ্ঞানী, দরদর করে ঘামছেন। গত কয়েক বছর ধরে ম্যাগনেটিক ফিল্ড বুঝতে গবেষণা করছেন এনওএএ ও অন্যান্য সংস্থার রিসার্চ স্পেশালিস্টরা…

বাধা দিলেন প্রেসিডেন্ট। আগ্রহী হওয়ার মত বিষয়। কিন্তু এসবের সঙ্গে কীসের সম্পর্ক ওই ব্রাযিল স্টোনের?

মস্ত ঢোক গিললেন সিআইএর বিজ্ঞানী। আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। কমপিউটারের কি বোর্ডে টোকা দিলেন। ল্যাবের ফ্ল্যাট স্ক্রিনে দেখা গেল গ্রাফ।

হোয়াইট হাউসের আরেকটি স্ক্রিনে ওই একই দৃশ্য দেখলেন প্রেসিডেন্ট।

গ্রাফের নিচে লেখা: আঠারো শ সত্তর সাল।

সিআইএর বিজ্ঞানী ব্যাখ্যা দেবেন, চিন্তায় পড়ে গেলেন ব্রায়ান। কী বলতে চাইছে এই লোক?

আঠারো শতাব্দী থেকেই মেপে বের করা হচ্ছে উত্তর মেরুর ফিল্ড স্ট্রেংথ ও পযিশন, বললেন বিজ্ঞানী, এই গ্রাফে দেখানো হয়েছে মেরু সরে যাওয়ার বিস্তার।

চার্টের নির্দিষ্ট অংশে লাল রেখা দেখালেন। এখান থেকেই শুরু হয়েছে দ্রুত সরে যাওয়া। শুরু হয়ে গিয়েছিল আঠারো শ সত্তর সালের আগেই। তা চরম কোনও কারণে বেড়ে ওঠে উনিশ শ আট সালে।

পয়েন্টার দিয়ে লাল রেখা দেখালেন। এরপর ধীর হয়েছে সরে যাওয়া। গত এক শতাব্দী ধরেই প্রতি বছর সাত থেকে আট মাইল দক্ষিণে সরছে উত্তর মেরু। কিন্তু গত কয়েক বছর হলো গতি বেড়ে হয়েছে বছরে বিশ মাইল।

কমপিউটারের মনিটরে ক্লিক দিতেই এল অন্য গ্রাফ। দেখা গেল গত তিন হাজার বছরের তৈরি ফিল্ড স্ট্রেংথ।

দেখছেন কীভাবে হাই-পয়েন্ট থেকে দুহাজার বছর আগে কমে গেছে ফিল্ড স্ট্রেংথ? কিন্তু গত বছর চূড়া থেকে নেমে পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড কমে গেছে পঁয়ত্রিশ পার্সেন্ট। উনিশ শ আট সালের পর থেকে অর্ধেক হয়েছে ম্যাগনেটিক ফিল্ড।

উনিশ শ আট সাল ঘুরছে ব্রায়ানের মগজে। কিন্তু যথেষ্ট তথ্য নেই যে কিছু বলবেন।

এবার স্ক্রিনে দেখা দিল আঁকাবাঁকা রেখা।

টাইম ফ্রেম বর্তমানের।

দেখুন গত তিন বছরের ফিল্ড স্ট্রেংথ।

চেয়ে রইলেন ব্রায়ান। দুবার পতন হয়েছে গ্রাফে। ওপরে উঠেছে দুবার। চট করে এনআরআই চিফ বুঝলেন, কী বোঝাতে চাইছে সিআইএর বিজ্ঞানী।

ব্রাযিল স্টোন এ দেশে আনার সময় গ্রাফে উঠেছে রেখা দুবার। আবার পতন হয়েছে দুবার। শেষের আগেরটা গত নভেম্বরের আর্কটিক সাগরের বিচ্ছুরণ। এরপর চার্টের শেষাংশে আরেকটা। তখন মেক্সিকো সাগরের মন্দির থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল দ্বিতীয় স্ফটিক। তাতে হঠাৎ করে কমে গেছে পঞ্চাশভাগ ম্যাগনেটিক ফিল্ড। গত পঞ্চাশ হাজার বছরের ভেতর ঘটেনি এমন কাণ্ড।

ডেটায় ভুল না থাকলে ম্যাগনেটিক ফিল্ডের দুর্বলতার সঙ্গে সম্পর্ক আছে এসব স্ফটিকের, ভাবলেন ব্রায়ান।

প্রেসিডেন্ট খেয়াল করেছেন তা নিশ্চিত হতে বললেন। সিআইএর বিজ্ঞানী হ্যাঁগার্ড, দেখেছেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, কীভাবে কমে গেছে ফিল্ড স্ট্রেংথ? আমরা ধারণা করছিঃ এনআরআই ব্রাযিল ও মেক্সিকো থেকে স্ফটিক সরিয়ে নেয়ায় এমনটি হয়েছে। গত পাঁচ মাসে এক শ চল্লিশ মাইল দক্ষিণে সরে গেছে ম্যাগনেটিক নর্থ। বাইশ নভেম্বরের পর গেছে কমপক্ষে নব্বই মাইল দূরে।

চুপ করে আছেন এনআরআই চিফ ব্রায়ান।

লাইম লাইটে আসতে চাইলেন সিআইএ চিফ ক্যালাগু। অর্থাৎ, এককথায় বললে: ঠিকই ধরেছে এনআরআই। অজানা এক উপায়ে কণ্ডেটের মত ম্যাগনেটিক ফিল্ড খেয়ে ফেলছে এসব স্ফটিক। চোখের সামনে সর্বনাশ হতে দেখছি আমরা। একটা করে স্ফটিক আবিষ্কার করছে মিস্টার ব্রায়ানের টিম, আর দশ কদম করে নরকের দিকে হাঁটছি আমরা মানবজাতি।

থমথম করছে প্রেসিডেন্টের মুখ। তিনি কিছু বলার আগেই আবারও শুরু করলেন ক্যালাগু, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, ধারণা করছি সমস্ত এনার্জি শুষে নিচ্ছে এসব স্ফটিক। এবং যখন মারাত্মক বিচ্ছুরণ হবে, হয়তো ধ্বংস হবে মানব সভ্যতা। ইলেকট্রনিক কোনও কিছুই কাজ করবে না। ফিরতে হবে আদিম যুগে।

মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ব্রায়ানের। সিআইএ এমন সব তথ্য দিয়েছে, যেগুলো পাননি তিনি। এককথায়, তাকে অপদার্থ প্রমাণ করছেন ক্যালাগু।

বুঝলাম, বললেন প্রেসিডেন্ট, কিন্তু ম্যাগনেটিক ফিল্ড স্বাভাবিক রাখতে কী করতে হবে? আগেও তো এমন হয়েছে। নিশ্চয়ই ডাইনোসরের মত নিশ্চিহ্ন হব না আমরা? এনআরআই চিফের দিকে তাকালেন তিনি। ব্রায়ান?

স্যর, ডাইনোসরের আমল আর আমাদের বর্তমান সময়কে মেলালে চলবে না, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন এনআরআই চিফ। আমাদের সভ্যতা নির্ভর করছে ইলেকট্রনিক শক্তির ওপর। তা ছাড়া, ম্যাগনেটিক ফিল্ড উবে গেলেই বইবে সোলার উইণ্ড।

তার ফলে কী হবে?

ছুটে আসবে বিলিয়ন বিলিয়ন চার্জড় পার্টিকল। ভয়ঙ্কর ক্ষতি হবে মানুষের টির। নষ্ট হবে ইলেকট্রিকাল গ্রিড, কমপিউটার, প্রোসেসর বা আধুনিক প্রতিটি সার্কিট। হলিউডের সিনেমার দৃশ্যের মত পৃথিবী গলে না গেলেও ঘটবে মারাত্মক সোলার ফ্লেয়ার, বা করোনাল ম্যাস ইজেকশন। মিস্টার ক্যালার কথা ঠিক, সেক্ষেত্রে আমরা আবারও ফিরব আঠারো শতকের জীবনে।

চুপ করে মনের ভেতর কথাগুলো নেড়েচেড়ে দেখছেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু হঠাৎ ডুবতে থাকা লোকের মত তীরের খোঁজ পেলেন। ব্রায়ান, তুমি বলেছ, প্রাচীন কোনও সভ্যতার তৈরি এসব স্ফটিক। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড বিনষ্ট হওয়া ঠেকিয়ে দেবে।

ইয়েস, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বললেন ব্রায়ান, ডেটা অনুযায়ী ওগুলোর কাজ পৃথিবী রক্ষা করা।

ভুরু কুঁচকে ফেললেন ক্যালাগু। এত কিছু হওয়ার পর পাগলের মত এসব কী বলছেন! পৃথিবী রক্ষা করবে? এখন তো দেখছি ধ্বংস করতে চাইছে!

ছাপা কাগজ দেখালেন তিনি। আমার সিআইএর লোকের অনুবাদ অনুযায়ী: যারা শিক্ষা নেবে না, তাদেরকে শাস্তি দেয়াই উচিত। লড়াই হবে এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতির মানুষের। ফসল ফলবে না। সাগরের মত বইবে মানুষের রক্ত। ছেকে ধরবে ভয়ঙ্কর সব অসুখ। পাইকারি হারে মরবে মানুষ। চলবে লড়াই শত বছর ধরে। আর এসব ঠেকাতে হলে দিতে হবে মানুষের জীবন উৎসর্গ করতে হবে তার সব।

কাগজটা টেবিলে রাখলেন ক্যালাগু। যুদ্ধে মরবে লক্ষ লক্ষ মানুষ। অসুখে বিলিয়ন বিলিয়ন। না খেয়ে মরবে বেশিরভাগ মানুষ। ব্রায়ান, এসব স্ফটিক আসলে প্রচণ্ড শক্তিশালী অস্ত্র, আমাদের চেনা পৃথিবী ধ্বংস করতে রেখে গেছে অচেনা মায়ান জাতি।

আপনার কথার কোনও যুক্তি নেই, ফুঁসে উঠলেন ব্রায়ান। পেয়েছেন কোনও প্রমাণ?

তপ্ত তেলে পড়া বেগুনের মত ফোঁস করে উঠলেন সিআইএ চিফ, এত কাজেরই যদি হবে, তো লুকিয়ে রেখেছিল কেন? আপনি কি ফার্স্ট-এইড কিট লুকিয়ে রাখবেন? বা ফায়ার এক্সটিংগুইশার? তা করবেন না। আপনি গোপন করবেন লুকানো মাইন, বুবি ট্র্যাপ বা বোমা। উপকারই যদি করবে, তো তুলে দিত আমাদের হাতে! সেসব না করে কেন হাজার হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রেখেছে দুর্গম সব মন্দিরের ভেতর?

এ কথায় নতুন করে শুরু হলো বিতর্ক।

 প্রায় ঝগড়ায় নামলেন এনআরআই চিফ ও সিআইএ চিফ।

নানান যুক্তি দেখাতে লাগলেন দুই দলের বিজ্ঞানীরা।

ব্যস্ত আদালতের বিচারকের ভূমিকা নিয়ে সবাইকে শান্ত হতে আহ্বান জানালেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু চেঁচালেন ব্রায়ান, ক্যালাগু পাগল হয়ে গেছেন! অতীতের মানুষ কেন ধ্বংস করতে চাইবে আমাদেরকে? আমরা তাদের উত্তরসূরি!

নিজেকে চোখ ঠেরে লাভ হবে না, ব্রায়ান, ধমকে উঠলেন ক্যালাগু। মানুষের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি দেশে দেশে যুদ্ধ দূর করে শান্তি বজায় রাখা! এ কাজেই ব্যস্ত সত্যিকারের ভাল মানুষ। আর প্রাচীন আমলে আপনার মায়ানরা চেয়েছে, যেন পরবর্তী সময়ে বেধে যায় দেশে দেশে যুদ্ধ!

তর্কে হারছেন বুঝে চুপ হয়ে গেলেন ব্রায়ান। তাঁর ইচ্ছে হলো চড়িয়ে বত্রিশ দাঁত ফেলে দেবেন ক্যালাগুর। কয়েক সেকেণ্ড পর প্রেসিডেন্টের দিকে তাকালেন। মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমরা আর্নল্ড শোয়ার্যনেগার, এইচ. জি. ওয়েলস্ বা স্টার ট্রেকের গল্প বলতে বসিনি। হাজারো বছর আগে সভ্য একটি জাতি চেয়েছে ভবিষ্যতের মানুষকে রক্ষা করতে। সেজন্যে শত শত মাইল পথ অতিক্রম করে নানান দিকে পৌঁছে দিয়েছে এসব স্ফটিক। এমনি এমনি এত কষ্ট করেনি তারা।

ওটা ছিল ওদের সুইসাইডিং মিশন, টিটকারির সুরে বললেন ক্যালাগু, চেয়েছিল পরবর্তী সময়ে দেশে দেশে যুদ্ধ বাধুক।

এটা যৌক্তিক হতে পারে না, প্রতিবাদ করলেন ব্রায়ান।

অত্যন্ত যৌক্তিক, জোর দিয়ে বললেন ক্যালাগু, অত্যন্ত বিপজ্জনক এসব স্ফটিক ভয়ঙ্কর বোমার মত। অথচ আপনি বা আপনার লোক জানেন না কীভাবে ডিফিউজ করবেন ওগুলোকে। এদিকে নাচতে লেগেছেন: আমরা দারুণ জিনিস পেয়েছি! আরে, আপনারা তো এটাও ভেবেও দেখেননি কোটি কোটি মানুষ যে-কোনও সময়ে খুন হতে পারে!

প্রেসিডেন্টের দিকে চেয়ে ব্রায়ান বুঝে গেলেন, উনি ভাবছেন, যুক্তিতে হেরে গেছেন এনআরআই চিফ।

ভীষণ রাগ হলো ব্রায়ানের। কিছুই করতে পারছেন না!

সবাই ভাবছেন না জেনেবুঝে মস্ত এক প্রজেক্টে হাত দিয়ে সব গুবলেট করে দিয়েছেন তিনি।

এনআরআই-এর বিজ্ঞানীদের দিকে চাইলেন তিনি, অসহায়। আরেকবার দেখলেন প্রেসিডেন্টকে। তারপর তাঁর চোখ পড়ল বিজ্ঞানী ক্যাথিবা আলিহার ওপর।

একটা কথাও না বলে এতক্ষণ দর্শকের মত চুপ থেকেছেন রেড় ইণ্ডিয়ান বিজ্ঞানী।

আপনি কিছু বলুন? মরিয়া হয়ে বললেন ব্রায়ান। মিস্টার প্রেসিডেন্ট আপনাকে পাঠিয়েছেন মতামত দিতে। আপনারই তো জানার কথা, কোন পক্ষ ঠিক বলছে আর কোন পক্ষ অন্যায্য। মুখটা অন্তত খুলুন!

বলে ফেলে ব্রায়ান বুঝলেন, এতক্ষণের খেলার রেফারিকে আক্রমণ করে বসেছেন তিনি। কিন্তু এ ছাড়া কীই বা করতেন? ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর, জ্বলছে খুলির মধ্যে মগজ। যখন তখন পাগল হয়ে যেতে পারেন!

কৌতূহল নিয়ে ব্রায়ানকে দেখলেন বিজ্ঞানী ক্যাথিবা আলিহা। নীরব হয়ে গেছে ঘরের সবাই। হোয়াইট হাউসে স্ট্যাটিকের আওয়াজ। অপেক্ষা করছেন প্রেসিডেন্ট। আলিহা বুঝে গেলেন, তিনি আছেন স্পট লাইটে। আরেক চুমুক আঙুরের রস দিয়ে গলা ভিজিয়ে নিয়ে বললেন, আপনারা চান আমি কিছু বলি। কণ্ঠ তাঁর দূর থেকে আসা মেঘের গম্ভীর ডাকের মত। আপনারা বাচ্চাদের মত চেঁচামেচি না করলে, বেশ, বলব আমার মতামত।

কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। আমার মনে হয়েছে, মিস্টার ব্রায়ান ভুল ভাবছেন।

ব্রায়ান ভাবলেন, তিনি গলা উঁচিয়ে কথা বলেছিলেন বলে খেপে গিয়ে বিপক্ষে চলে গেছেন আলিহা। কণ্ঠ সংযত করে বললেন, তাই? এর বাইরে আর কিছুই বলার নেই আপনার?

না, আরও কথা আছে, বললেন রেড ইণ্ডিয়ান বিজ্ঞানী, মিস্টার ক্যালাগুও ভুল ভাবছেন। আপনারা দুজন নেমেছেন সার্কাসে। কিন্তু চেঁচিয়ে কোনও কিছুই সমাধান করা যায় না। এত হৈ-চৈ করলে মগজ চলে না। আপনারা সময় নষ্ট করছেন। অন্য দিকে মনোযোগ দিয়ে।

ক্যাথিবা আলিহার দিকে চেয়ে আছেন ব্রায়ান।

কঠোর চোখে বিজ্ঞানীকে দেখছেন ক্যালাগু।

কাউকে পাত্তা দিলেন না রেড ইণ্ডিয়ান। আমার ধারণা: বুঝতে পেরেছি ঠিক কোথায় ভুল করেছেন আপনারা।

কোথায় ভুল করেছি? তেড়া সুরে বললেন ক্যালাগু।

আপনারা ভুলে গেছেন অতীতের মানুষ কী লিখে গেছেন।

চুপ করে আছে সবাই।

কাঁধ ঝাঁকালেন বিজ্ঞানী আলিহা। কারণ এবং তার প্রভাব গুলিয়ে ফেলেছেন আপনারা। হাজার বছর আগে যখন অতীতের মানুষ সিদ্ধান্ত নিলেন, কী কারণে কী করতে হবে, সব ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরা এমনি এমনি নির্দিষ্ট সব জায়গায় ফটিক রাখেননি। আপনারা বাচ্চাদের মত ওগুলো নিয়ে খেলতে চাইবেন, সেটা তাদের ইচ্ছে ছিল না।

সবার ওপর চোখ বোলালেন আলিহা। মানুষই তৈরি করে খারাপ দৃষ্টান্ত, এবং তা-ই করবে ধরে নিয়েই কাজে নেমেছেন প্রাচীন মায়ারা। যুদ্ধে জড়িয়ে নিজেদের সর্বনাশ করলে, সে দায় আমাদের। সেজন্যে দোষ পড়বে কেন এসব স্ফটিকের ওপর? আবার পৃথিবীকে স্বর্গ করে নিলে, সে-কৃতিত্বও আমাদের।

তার মানে, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ঠিক রাখার বিষয়ে তেমন কিছুই করার নেই? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট।

তা বলছি না, বললেন বিজ্ঞানী, বহু কিছুই করার আছে। এ পরিস্থিতি হবে ভেবেই অতীতে তৈরি করেছেন মায়ারা ওসব স্ফটিক। অদ্ভুত মেশিনও বলতে পারেন। এখন মানবজাতিকে ধ্বংস করবে, না রক্ষা করবে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।

বড় করে দম নিলেন এনআরআই চিফ ব্রায়ান।

বিজ্ঞানীর কথা শুনে থমকে গেছেন সিআইএ চিফ ক্যালাগু।

কিন্তু আপনার কথা থেকে তো কিছুই স্পষ্ট হলো না, বললেন ব্রায়ান। আপনি তৈরি করেছেন মস্ত এক বৃত্ত।

জানি, মাথা দুলিয়ে আঙুরের রসে চুমুক দিলেন আলিহা। এ কারণেই নিজের চিন্তা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলাম।

.

৪১.

 চার্চের বেঞ্চির হাতল ডানহাতে ধরে নিজেকে সামলে নিতে চাইলেন প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন। বনবন করে ঘুরছে মাথা। ভেবে পেলেন না অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন, না দুলছে মাটি।

কী যেন বলছিলেন? ফাদার ভাসকুয়েজকে বললেন তিনি।

সামনে বেড়ে বয়স্ক আর্কিওলজিস্টের কাঁধে হাত রাখলেন ফাদার। আপনি তো জানেন, মায়ান চিলাম বালামে কী লেখা। সেই অনুযায়ী: এ মাসের বাইশ তারিখে হয়তো ধ্বংস হতে শুরু করবে পৃথিবীর মানবজাতি।

আগেও নানান ধর্মের লোক ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। এবার শেষ হবে পৃথিবী, কিন্তু কিছুই হয়নি, বলল মিতা।

এবারের ব্যাপারটা আলাদা, বললেন ফাদার।

কোন্ দিক থেকে? জানতে চাইল রানা।

কারণ আপনারা এনেছেন অস্ত্র, বললেন ভাসকুয়েজ।

আমরা মাত্র কয়েকটা অস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করে দেব মানব সভ্যতা? মৃদু হাসল রানা।

গম্ভীর চোখে ওকে দেখলেন ফাদার ভাসকুয়েজ। না। অন্য কিছু এনেছেন। হারিয়ে যাওয়া পাহাড়ি জাগুয়ার রাজার মন্দিরে ওই স্ফটিক রাখতে চান আপনারা। উচিত ছিল না আগের জায়গা থেকে ওটা সরিয়ে ফেলা।

স্ফটিক সরিয়ে নিয়েছি গবেষণার জন্যে, বলল মিতা।

সেটা না করলেই ভাল হতো, বললেন ফাদার ভাসকুয়েজ। আপনাদের একটা জিনিস দেখাব। ওটা থেকে অনেক কিছুই বুঝবেন। ঘুরে ছোট একটা দরজার দিকে চললেন তিনি। আসুন আমার সঙ্গে।

বেদি পাশ কাটিয়ে ফাদারের পিছু নিয়ে সরু এক দরজা পেরোল ওরা। করিডোরের সামনেই পড়ল আরেকটা দরজা। এটা মজবুত। ঝুলছে আধুনিক প্যাডলক। তালা খুলে কড়ায় ওটা ঝুলিয়ে রাখলেন ফাদার। কাঁচকোঁচ আওয়াজে খুললেন দরজা। পাঁচ ফুট যেতেই সামনে পড়ল নিচে যাওয়ার কাঠের সিঁড়ি।

ফাদার ইশারা করতে প্রফেসরকে দুপাশ থেকে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল রানা ও মিতা। পিছু নিয়েছেন ফাদার। নিচে নেমে রানা দেখল, এটা বড়সড় ওয়াইন সেলার। ইট ও কাদার চার দেয়ালের পাশে বিশাল সব ওক কাঠের পিপে।

আগে মিশনের দুর্গ ছিল এটা, বললেন ফাদার ভাসকুয়েজ। পরে গোটা মেক্সিকো জয়ের পর এটাকে ব্যবহার করা হলো মঠ হিসেবে। উর্বর জমিতে ফলানো হলো আঙুর। ওই জিনিস দিয়ে ওয়াইন তৈরি করলেন সাধুরা। আজ রাতে যে অনুষ্ঠান হবে, তার জন্যে সমস্ত ওয়াইন সরবরাহ করা হবে এই সেলার থেকেই।

এক পাশের মস্ত এক পিপের কাছে থামলেন ফাদার। তাক থেকে স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে চাড় দিয়ে খুললেন পিপের ঢাকনি। এই পিপের ওয়াইন সেরা।

ঢাকনি সরিয়ে ওটার ভেতরের দিক থেকে চ্যাপ্টা এক বাক্স নিলেন ভাসকুয়েজ। পাশে থেকে পড়লেন প্রফেসর: ষোলো শ আটানব্বই সাল।

কোটি ডলারের ভিন্টেজ, বলল রানা।

খুব রেয়ার, মাথা দোলালেন ফাদার ভাসকুয়েজ। এর মত দামি ও দুর্লভ ওয়াইন আর নেই। রোযউড বাক্স থেকে নিলেন ছোট এক তোয়ালে। ওটার ভাঁজ খুলতেই বেরোল প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা পাতলা ফায়ারফ নোমেক্স: ফ্যাব্রিক। সেটা খুলে সিল্কের বর্ডার দেয়া শুকনো, প্রাচীন পার্চমেন্ট নিলেন ভাসকুয়েজ। পাশের ছোট্ট টেবিলে সাবধানে রাখলেন গাছের পাতলা বাকল দিয়ে তৈরি জিনিসটা। প্রথম পাতার ওপরের অর্ধেকাংশ হলদেটে কাগজের মত। নীল কালিতে লেখা প্রাচীন স্প্যানিশ বক্তব্য। নিচে একের পর এক মায়ান হায়ারোগ্লিফ সিম্বল।

জিনিসটা কী? জানতে চাইলেন প্রফেসর হ্যারিসন।

মৃদু হাসলেন ফাদার ভাসকুয়েজ। সে আমলে খুবই নিষ্ঠুর ছিল চার্চের ভূমিকা। এই দেশ বিজয়ী স্প্যানিশ কনকুইস্টেডোরা এ এলাকায় এলে তাদের পিছু নিল চার্চ। কর্টে এবং তার লোক যা ডাকাতি করেনি, বা পুড়িয়ে দেয়নি, সেসবই ধ্বংস করল যাজকরা। তাদের নির্দেশে খুন হয়ে গেল প্রভাবশালী ইণ্ডিয়ানরা। নিষিদ্ধ করে দেয়া হলো তাদের সংস্কৃতি। প্রায় মূর্খ সব যাজকের আদেশে প্রকাণ্ড সব আগুন জ্বেলে হাজারো বছরের মায়ানদের অর্জিত জ্ঞানের লাখো বই ছাই করে দিল সৈনিকরা। যদি পারত, ভারী পাথরের মনুমেন্টও সাগরে ফেলত স্প্যানিশ দখলদাররা।

আফসোস নিয়ে মাথা দোলালেন প্রফেসর হ্যারিসন। শেষে থাকল মাত্র কয়েকটা মায়ান বই। এখন যেগুলোকে আমরা বলি কোডেক্স।

সে আমলের যাজকরা যে মহাপাপ করেছে, সেজন্যে স্রষ্টার কাছে চরম শাস্তি পেতে হবে তাদেরকে, দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ফাদার ভাসকুয়েজ।

পার্চমেন্ট কয়েক পাতার, তা দেখে জানতে চাইলেন হ্যারিসন, কিন্তু এই কোডেক্স রয়ে গেল কী করে?

বেশিরভাগ যাজকের লজ্জাজনক আচরণ ভাল লাগেনি এক হৃদয়বান মিশনারি যাজকের। তাঁর নাম ছিল ফারেন ডি সিলভা। সবার আগে এসেছিলেন এই এলাকায়। দেখলেন খ্রিস্টান ধর্মের যাজকদের ছাড়াই ভাল আছে এদিকের মানুষ। তাদেরকে মস্ত বিপদে ফেলতে মন চাইল না সিলভার। মিথ্যা রিপোর্ট পাঠালেন বিশপের কাছে। হাজারো কোটি মশা ভরা জলাভূমি ও অনুর্বর জমি এতই জঘন্য, এই নরকে এলে বেশুমার মরবে স্প্যানিশ যোদ্ধা ও যাজকরা।

এই কোডেক্স কোথায় পান ফারেন ডি সিলভা? জানতে চাইলেন প্রফেসর হ্যারিসন।

উনি পাননি, মাথা নাড়লেন ফাদার। গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটা মৃত্যুর আগে ডেকে নিলেন সিলভাকে। বললেন, আগে কয়েকটি গ্রামে ছিলেন তিনি, কিন্তু অন্য সবার সঙ্গে পালাতে হয়েছিল পাহাড়ে। খুন হয়েছে তাদের ব্রাদারহুডের প্রায় সবাই, রয়ে গেছেন শুধু তিনি। চলে এলেন এ গ্রামে। তারপর যখন এখানে হাজির হলেন সিলভা, নতুন শাসকদের মধ্যে শুধু তাঁকে ভাল মানুষ বলে মনে হয়েছে তার। কথা দিলেন, গ্রামের সবাইকে বলে দেবেন, তারা যেন গ্রহণ করে যিশুর ধর্ম। তবে আছে একটা শর্ত। সিলভা রক্ষা করবেন তাদের শেষ লিখিত মায়ান ইতিহাসের বইটি।

আর এই কোডেক্সেই আছে সেসব হায়ারোগ্লিফ, বললেন হ্যারিসন।

মাথা দোলালেন ফাদার ভাসকুয়েজ। ধর্ম বদল বলতে কী জানেন, জিজ্ঞেস করেছিলেন সিলভা। ইণ্ডিয়ান বৃদ্ধ বলেছিলেন, আমরা জানি, বলি দেয়া বা রক্তক্ষরণের কারণে এক সময়ে এতই পাপ হবে, পচে দুর্গন্ধ বেরোবে আমাদের ধর্ম থেকে। তাই উচিত যিশুর পবিত্র পথে হাঁটতে শুরু করা। একটু চুপ থেকে আবার বললেন ফাদার, আসলে নির্মম সব রাজা বা লোভী পুরোহিতদের বলি বা রক্তক্ষরণের জন্যে চরম বিরক্তি ছিল সাধারণ মানুষের মনে। কাজেই তারা যখন দেখল চার্চ এসব করছে না, অনেকেই আগ্রহ নিয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছিল।

তা হলে ধর্মান্তরিত হয়েছিল মায়ান ব্রাদারহুডের ওই ইণ্ডিয়ান বৃদ্ধ, সঙ্গে গ্রামের সবাই, আন্দাজ করল মিতা। ফাদার সিলভার হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল শেষ পার্চমেন্ট।

সিলভা কথা দিয়েছিলেন, প্রাণ থাকতে নষ্ট হতে দেবেন না ওটা, বললেন ভাসকুয়েজ, ওটার লেখা স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদ করতে শুরু করেন। এবার গড়গড় করে বলে গেলেন। তিনিঃ তারা হবে দলে চারজন। আসবে এক বয়স্ক কালো লোক, এক রূপসী যুবতী, এক ছোট্ট বাচ্চা আর পবিত্র হৃদয়ের বাদামি রঙের এক নিষ্ঠুর চেহারার লোক। বাদামি লোকটাই সিদ্ধান্ত নেবে রক্ষা পাবে কি না এই গোটা পৃথিবী।

ফাদার ভাসকুয়েজের কথা শুনে অবাক চোখে রানার দিকে তাকালেন প্রফেসর হ্যারিসন।

যথেষ্ট ভাল স্প্যানিশ জানে মিতা, কাজেই বিস্মিত।

রানার বাহুতে হাত রাখলেন ফাদার ভাসকুয়েজ। কাজেই, রানা, আশা করি বুঝতে পারছেন, আপনার ওপর বর্তে গেছে খুব কঠিন কাজ। হয়তো সফল হবেন, অথবা অসফল। তবে মনে রাখবেন, আপনার একার ওপর নির্ভর করবে মানবজাতির গোটা ভবিষ্যৎ। সুতরাং, যা করার করবেন খুব ভেবেচিন্তে।

গম্ভীর চোখে যাজককে দেখছে নীরব রানা।

অবিশ্বাস্যভাবে বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মিলে গেছে প্রাচীন পার্চমেন্টের লেখা।

এটা কাকতালীয় হতে পারে না? বলল মিতা।

কাকতালীয় মনে হয় না। মৃদু হাসলেন ফাদার ভাসকুয়েজ। আগেও পড়েছি কোডেক্সের অনুবাদ করা অংশ। ধারণা করেছি, ওটাতে মিথ্যা লিখেছে মায়ানরা। কিন্তু সে ভুল ভেঙেছে আমার। ভুললে চলবে না, কোডেক্স লেখা হয়েছে হাজারো বছর আগে। যে নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছে চারজনের, তা আঁৎকে ওঠার মতই।

পার্চমেন্ট থেকে অনূদিত স্প্যানিশ ভাষার অংশ পড়ে নিয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল রানা।

প্রায় অন্ধকার সেলারে মায়ান হায়ারোগ্লিফ পড়তে লাগলেন প্রফেসর হ্যারিসন। চকচক করছে চোখ। বিড়বিড় করলেন, তা হলে সত্যি? নিয়তি এনেছে আমাদেরকে এখানে শেষ স্ফটিকের কাছে?

বাস্তবে নিয়তি বলে কিছু আছে? ভাবছে রানা। নিজ চোখে দেখেছে ধর্ম বা স্রষ্টার নামে অবলীলায় কত ভয়ঙ্কর পৈশাচিক কাজ করে আপাতনিরীহ মানুষ। অনেকেই তারা শিক্ষিত ও সভ্য সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষ। নানান স্বার্থের জন্যে দেরি হয় তাদের পাগলা কুকুরের মত অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে।

নীরবে ওকে দেখছে মিতা, চোখে অনুরোধ।

একবার ওকে দেখে নিয়ে ফাদারের দিকে ফিরল রানা। আপনি পুরো কোডেক্সের স্প্যানিশ অনুবাদ পেয়েছেন? জানেন কীভাবে রক্ষা করতে হবে মানবসভ্যতা?

না, জানি না, তবে ধৈর্য ধরুন, বললেন ফাদার ভাসকুয়েজ। স্রষ্টা ভালবাসেন ধৈর্যশীলদের।

.

৪২.

 স্যাটেলাইট ফোনের কল রিসিভ করতেই এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানের দুশ্চিন্তা ভরা আংশিক বিকৃত কণ্ঠ শুনল রানা। ওর পাশেই আছে মিতা। যাতে শুনতে পায়, তাই স্পিকার চালু করল রানা।

মিস্টার রানা, একটু আগে সিআইএ চিফ মিস্টার ক্যালাগু আর আমার এক লোকের মাধ্যমে পেলাম পাবলো সম্বন্ধে নতুন তথ্য। যে এসব জানাল, সে রাশান সায়েন্স ডিরেক্টোরেটের উঁচু পদে আছে। এসব ইনফর্মেশন মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

বলুন, বলল রানা। কু ডাকছে ওর মন।

ফোনের ডেটা স্ক্রিনে পাঠিয়ে দেব সব ইনফর্মেশন। তবে সংক্ষেপে বলছিঃ চের্নোবিলের রেডিয়েশন আক্রান্ত এলাকায় জন্ম নিয়েছিল পাবলো। জেনারেটিভ নার্ভ ডিযিয আছে বলে দুচার দিনের ভেতর ওর বাবা-মা বুঝে যান, অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারবেন না ছেলের। পাবলো মরে যাবে বুঝে যোগাযোগ করলেন তাঁরা সায়েন্স ডিরেক্টোরেট-এ। বিজ্ঞানীরা নিয়ে গেল ওকে। এরপর কী ধরনের গবেষণা করা হয়েছে, তা অজানা। সাধারণত এ ধরনের রোগে প্রথমে শুরু হয় দেহ জুড়ে কম্পন। দ্বিতীয় স্টেজে মানুষ হারিয়ে ফেলে চেতনা। তৃতীয় স্টেজে নষ্ট হয় রোগীর মোটর কন্ট্রোল। চতুর্থ স্টেজে খিচ ধরে বন্ধ হয় হৃৎপিণ্ডের পেশি। ফলাফল আকস্মিক মৃত্যু।

পাবলো কোন্ স্টেজে আছে? জানতে চাইল রানা।

ওর বয়স পাঁচ বছর। পেরিয়ে যাওয়ার কথা স্টেজ থ্রি। বাঁচবে বড়জোর আর পাঁচ বছর।

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মিতা। বেসুরো কণ্ঠে জানতে চাইল, ভুল হচ্ছে না তো? আমি তো ওর ভেতর কোনও সিম্পটম দেখছি না। হয়তো ভুল হয়েছে ডাক্তারদের?

কোনও ভুল হয়নি, আমি দুঃখিত, মিতা, নরম সুরে বললেন এনআরআই চিফ। পাবলো বেঁচে আছে কারণ, অস্বাভাবিক চিকিৎসা করেছে রাশান বিজ্ঞানীরা। তাতে দেখা গেছে ইলেকট্রো-স্টিমুলেশন দিয়ে নার্ভের তg, মেরুদণ্ড বা সেরেব্রাল কর্টেক্সের রোগের আক্রমণ অনেক ধীর করে দেয়া যায়।

পাবলোর কর্টেক্সে একটা জিনিস আছে, বলল মিতা। ওটা রাশানদের প্ল্যান্ট করা।

এক্সপেরিমেন্ট, বললেন ব্রায়ান, ওটার কারণেই পাবলো টের পায় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ডিস্টার্বেন্স।

বাচ্চা ছেলেটার ওপর রাশানরা নিষ্ঠুর গবেষণা করেছে ভেবে আগে রাগ ছিল মিতার মনে, এখন বুঝে গেল, এ ছাড়া উপায় ছিল না ওকে বাঁচানোর। পরীক্ষা সফল, অন্তত দৈহিকভাবে সুস্থ আছে পাবলো।

তাতে তেমন খুশি হওয়ার কিছু নেই।

 কেন?

কারণ, আধুনিক কোনও ডিভাইস নয় ওর মগজের জিনিস। ওটা রাশানদের খুঁজে পাওয়া স্ফটিকের অংশ। পঞ্চাশ দশকে পেয়েছিল রাশান সায়েন্স ডিরেক্টোরেট।

বিস্মিত হয়ে রানার দিকে তাকাল মিতা। কী জিনিস?

 চুপ করে শুনছে রানা।

ব্রাযিল স্টোনের মতই আরেকটা ছিল রাশায়, তিক্ত স্বরে বললেন ব্রায়ান, আগের মিটিঙে বেকুব করেছে আমাকে সিআইএ চিফ ক্যালাগু। তাদের বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করেছে, এসব স্ফটিকের কারণে অনেক হ্রাস পেয়েছে পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড। আমরা প্রতিবার একটা করে ওই স্ফটিক পেয়ে সরিয়ে নিলেই সরে যাচ্ছে উত্তর মেরুর ম্যাগনেটিক পোল।

হঠাৎ রানার মনে পড়ল হংকং-এ মিতাকে কারাগার থেকে উদ্ধারের পর ওর কাছে শুনেছিল, কী হয়েছিল দিমিতভের ট্রলারে। পথ হারিয়ে ফেলে লোকটা। আগে থেকেই নষ্ট হয়েছিল জিপিএস, তাই চৌম্বক কমপাস দেখে পথ চলছিল। কিন্তু দক্ষিণের বদলে চলে গেল উত্তর মেরুর দিকে। কিছুই টের পায়নি। অনুসরণ করছিল হাঙর ও কিলার ওয়েইল। এখন রানা বুঝতে পারছে এর কারণ। পাবলোর মগজের স্ফটিক থেকেই ছোট বিচ্ছুরণ ঘটেছিল বেয়ারিং সাগরে নভেম্বর মাসের বাইশ তারিখে।

একইভাবে উনিশ শ আট সালে হ্রাস পায় ম্যাগনেটিক ফিল্ড, বললেন ব্রায়ান, এটা বুঝতে সময় লেগেছে আমার।

অত আগে স্ফটিক পেয়ে গিয়েছিল রাশানরা? জানতে চাইল মিতা।

না, পায়নি, বললেন এনআরআই চিফ, যে কারণেই হোক, রাশায় ওই বছরের জুন মাসে বিস্ফোরিত হয়েছিল ওই স্ফটিক।

জুন মাস, উনিশ শ আট সাল, ভাবছে রানা। নিচু স্বরে বলল, দ্য তুঙগুসকা ব্লাস্ট।

জানেন আপনি ওই ঘটনা সম্বন্ধে?

সামান্য, বলল রানা। উনিশ শ আট সালের জুনের গোটা রাশার তুন্দ্রা এলাকা কেঁপে গিয়েছিল ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণে। তিন শ মাইল দূর থেকেও দেখা গিয়েছিল আকাশে আগুন। ওই শক ওয়েভে বিশ মাইল বৃত্তের ভেতর পুড়ে যায় সব গাছ। অনেকে ভেবেছে, ছোট কোনও গ্রহানুর জন্যে হয়েছিল ওই বিস্ফোরণ। ওটার অবশিষ্ট অংশ খুঁজতে গিয়েছিল অভিযাত্রীরা। পাওয়া যায়নি কিছুই। বইয়ে পড়েছি, ওই বিস্ফোরণ ছিল ত্রিশ মেগাটন আণবিক বোমা ফাটার মতই প্রচণ্ড।

রাশানদের হিসেব অনুযায়ী ওই বিস্ফোরণ ছিল পঞ্চাশ মেগাটন আণবিক বোমার সমান, বললেন ব্রায়ান, হিরোশিমার ওই বোমার চেয়ে দুহাজার গুণ বেশি শক্তিশালী।

আপনি বলছেন ওটা ছিল এসব স্ফটিকের একটা? অবাক হয়ে গেছে মিতা।

এ ছাড়া আর কোনও ব্যাখ্যা তো পাওয়া যায় না, বললেন ব্রায়ান। ওই একইসময়ে কমে যায় ম্যাগনেটিক ফিল্ড। পরে ওই এলাকায় পাওয়া যায়নি গভীর কোনও গর্ত। কোথাও ছিল না রেডিয়েশন। তবে একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছিল রাশানরা।

ওই স্ফটিকের একটা টুকরো, প্রায় ফিসফিস করল মিতা।

আমাদের কাছে তথ্য আছে, উনিশ শ সাতান্ন সালে কোল্ড ওঅরের সময় এক্সপিডিশন করে রাশানরা, বললেন ব্রায়ান। তবে কখনও স্বীকার করেনি। সে সময়ের আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে পেয়ে গিয়েছিল ওই জিনিস। হাইলি ডিসটর্টেড ম্যাগনেটিক রিডিং থেকে ধরে নিয়েছিল, তুন্দ্রার ওখানে পড়েছিল উল্কা। কিন্তু সে সময়ে হঠাৎ করেই ম্যাগনেটিক শক্তির কারণে নষ্ট হলো তাদের প্রধান ড্রেজিঙের বোটের সব ইলেকট্রনিক সিস্টেম। নতুন করে মেশিন চালু করার আগেই একটা ম্যাগনেটোমিটার দেখিয়ে দিল ছোট্ট এক টুকরো স্ফটিক।

তখন থেকে রাশানরা লুকিয়ে রেখেছে ওই জিনিস, বলল মিতা।

সায়েন্স ডিরেক্টোরেটের সেরা জিনিস।

ব্যবহার করেছে পাবলোর মগজে, বলল রানা। স্বাভাবিক কারণেই ওকে দেশে ফিরিয়ে নিতে চাইছে এফএসবি।

পাবলোকে চায় না, ওদের দরকার ওই স্ফটিকের টুকরো, বললেন ব্রায়ান, গোটা দুনিয়া থেকে গোপন করতে চায় ওই এক্সপেরিমেন্ট।

আর এক্সপেরিমেন্ট শেষ হলে? জানতে চাইল মিতা।

 পাবলোর মগজ থেকে সরিয়ে নেবে স্ফটিকের টুকরো, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ব্রায়ান, ফলে মারা পড়বে ছেলেটা।

শিউরে উঠল মিতা।

ওর কাঁধে আলতো করে হাত রাখল রানা, চোখে সহানুভূতি।

ল্যাং কী করে ওর খোঁজ পেল? চাপা স্বরে বলল মিতা।

রাশান সায়েন্স ডিরেক্টোরেটের নরম মনের কয়েকজন ভেবেছিলেন, স্ফটিকের টুকরো পাবলোর মগজ থেকে সরিয়ে নেয়া হবে অমানবিক কাজ। তাঁরাই কিডন্যাপ করে তুলে দেন এক কন্ট্যাক্টের হাতে। বিক্রি হয়ে গেল পাবলো। কিন্তু তার আগে ল্যাংকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন তাঁরা, যাতে পাবলোর ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করে চাইনিজ বিলিয়নেয়ার। আমার ধারণা, পাবলো হারিয়ে যাওয়ায় এফএসবির হাতে খুন হয়েছেন সেই মানুষগুলো।

পাবলোকে কেন চাইল ল্যাং? জানতে চাইল মিতা।

কয়েক বছর ধরেই চোখের আড়ালে আছে সে, পাবলোর মত একই রোগে ভুগছে, বললেন এনআরআই চিফ, গুজব ঠিক হলে আর দুএক বছরের ভেতর মারা পড়বে।

সেক্ষেত্রে ল্যাং তো নিজের ডাক্তার দিয়ে পাবলোর মগজের স্ফটিকের টুকরো সরিয়ে ফেলতে পারত, বলল মিতা।

ওটা চাই না তার, ভেবেছে পাবলোর মাধ্যমে খুঁজে পাবে আস্ত কোনও স্ফটিক, বললেন ব্রায়ান। তার ধারণা, ওই জিনিস পেলে পুরো আরোগ্য পাবে সে।

তার মানে এখন আর চতুর্থ স্ফটিক নেই, বলল মিতা।

রানা ভাবছে, তা হলে মায়ানদের ওই ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হবে কি না। আরেকটা বিষয়: এসব স্ফটিক রাখা হয়েছিল পৃথিবী রক্ষার জন্যে। সেক্ষেত্রে চারটের বদলে মাত্র তিনটে স্ফটিক কী পারবে ম্যাগনেটিক ফিল্ড টিকিয়ে রাখতে? কে জানে, সত্যিই হয়তো এসব স্ফটিক প্রচণ্ড শক্তিশালী অস্ত্র। তাদেরটা বিস্ফোরিত হওয়ায় বেঁচে গেছে আধুনিক রাশা। কিন্তু মধ্য আমেরিকা বা উত্তর আমেরিকার বুকে নেমে আসতে পারে সত্যিকারের প্রলয়।

একটা কথা, আঙ্কেল ব্রায়ান, এসব স্ফটিক মিশন শেষ করলে তারপর কী হবে ওগুলোর? জানতে চাইল মিতা।

জানি না, সরল স্বীকারোক্তি দিলেন ব্রায়ান, মিতা, তুমি তো ফিযিসিস্ট, আমার চেয়ে এসব ভাল বুঝবে।

সব শেষে পাবুলোর কী হবে? জানতে চাইল উদ্বিগ্ন মিতা।

আমাদের ধারণা, এরপরের বিচ্ছুরণ আসছে অনেক বেশি শক্তি নিয়ে, বললেন ব্রায়ান। আগের চেয়ে এক শ গুণ। বা হাজার গুণ। হয়তো ওটার কারণে মারাত্মক ক্ষতি হবে পাবলোর। কাজেই…

তার বক্তব্য বুঝে গেছে মিতা। ধরা গলায় এনআরআই চিফের কথাটা শেষ করল ও, মরে যাবে ও!

রানা দেখল, ভিজে গেছে মিতার চোখের কোণ।

 চুপ করে থাকলেন এনআরআই চিফ।

পুত্র হারাতে হবে জেনে, স্নেহময়ী মা-র অভিমান উথলে উঠেছে আবেগপ্রবণ মিতার হৃদয়ে। ছলছলে চোখে তাকাল রানার চোখে। নীরবে যেন বলছে: রানা, তুমি না আছ আমাদের পাশে? পারবে না পাবলোকে বাঁচাতে? মরে যেতে হবে কেন অসহায় বাচ্চাটাকে?

মন শক্ত করো, মিতা, কয়েক সেকেণ্ড পর বললেন ব্রায়ান। এসব স্ফটিক নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কোনও ভুল হলে মরবে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ। তাদের ভেতর রয়েছে পাবলোর মত শত কোটি শিশু।

দূরের সবুজ টিলা থেকে চোখ সরিয়ে কালচে মেঝে দেখল মিতা।

মিস্টার রানা, প্লিয, ঘড়িতে ঠিক করে নিন কাউন্টডাউন, বললেন ব্রায়ান, ট্রিপল যিরোর আগেই আমি যোগাযোগ করলে, দেরি না করে ধ্বংস করে দেবেন ওই দুই স্ফটিক। গভীর কোনও গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেবেন ওসব গুঁড়ো।

বুঝলাম, জানাল রানা। এর পরের কাজ কী?

জানি না, দুর্বল স্বরে বললেন ব্রায়ান, সিআইএ মন্দ দৃষ্টিতে দেখছে এসব স্ফটিক। অথচ আমার ধারণা, ওগুলো রক্ষা করবে এই পৃথিবী। তবুও যদি ধ্বংস করে দেয়ার জন্যে ফোন করি; প্লিয, কোথাও রাখবেন না ওগুলোর কোনও চিহ্ন।

ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনুরোধ করতে গিয়ে বুকে পাষাণ বেঁধেছেন ভদ্রলোক, বুঝতে পারছে রানা।

দয়া করে নিজের বিবেক বুঝে কাজ করবেন, মিস্টার রানা, চাপা কণ্ঠে বললেন এনআরআই চিফ। আর, প্রিয, ক্ষতি হতে দেবেন না মিতার। ওর বাবা হিসেবে এটা আপনার কাছে আমার কাতর অনুরোধ।

রানা দেখল, জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে মিতা।

ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যা।

সামনেই ক্রিসমাস, তাই ছুটি চলছে শহরে।

স্যান ইগন্যাসিয়োর বাসিন্দারা বেরোচ্ছে পার্টির জন্যে।

প্রাণভরে ছুটোছুটি করছে দামাল শিশুরা।

রানা বুঝে গেল, পাবলোর কাছে যাওয়ার জন্যে মন কাঁদছে। মিতার।

আমার সাধ্যমত করব, অন্তর থেকে ব্রায়ানকে বলল রানা।

কথাটা বলেছেন, সেজন্যে অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার রানা, বললেন ব্রায়ান। ভাল থাকুন।

আপনিও ভাল থাকুন।

ফোন কল কেটে দিলেন এনআরআই চিফ।

অসহায় পিচ্চি পাবলোর করুণ পরিণতির কথা ভেবে নীরবে কাঁদছে উদ্ভ্রান্ত মিতা। ভরসা পেতে আকুল হয়ে তাকাল রানার চোখে।

কিন্তু আশ্বাস দেয়ার মত কিছুই খুঁজে পেল না রানা।

.

৪৩.

 স্যান ইগন্যাসিয়ো থেকে তিন শ মাইল দূরে ল্যাং-এর কমাণ্ড সেন্টার। ওয়্যারহাউসে বসে ডেটা প্রসেস করছে বিলিয়নেয়ারের টেকনিশিয়ান। পথে পথে ক্যামেরা হাতে মানুষের ছবি তুলছে ল্যাং-এর কর্মীরা। এরই ভেতর স্ক্যান হয়েছে দুলাখ মানুষের চেহারা। এখনও পাওয়া যায়নি রানার দলের কাউকে। আকাশে ঘুরছে ল্যাং-এর এরিয়াল ড্রোন। ইনফ্রারেড ক্যামেরা ব্যবহার করে তন্নতন্ন করে খুঁজছে জঙ্গল ও পাহাড়। ব্যবহার করা হচ্ছে। ম্যাগনেটোমিটার। আছে বিশেষ একটা রিসেপ্টর, অনায়াসেই ধরবে মেডিকেল গ্রেড রেডিয়োঅ্যাকটিভ মেটারিয়াল।

এর ভেতর জঙ্গলে পাওয়া গেছে কয়েক দল ট্র্যাকারকে। ছিল মিলিটারির ভাঙাচোরা ট্রেনিং বিমান। বহু আগে বিধ্বস্ত হয়েছিল জঙ্গলে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই এলাকায় রয়ে গেছে। কয়েকটা মায়ান সাইট। কিন্তু দেখা নেই মাসুদ রানা, মিতা দত্ত, পাবলো বা বুড়ো প্রফেসরের।

কমাণ্ড সেন্টারে চুপচাপ যে যার কাজ করছে টেকনিশিয়ানরা।

ওদিকে ক্যামপেচে শহরে বসে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করছে এক পাইলট। টয়লেটে যাবে বলে সিট ছাড়বে, এমনসময় অ্যালার্ম বাজিয়ে সতর্ক করল তার দুই কমপিউটার। সেন্সর ধরেছে ড্রোনের টেলিমেট্রি। হালকা ওই বিমান পৌঁছে গেছে নিজের রেঞ্জের শেষপ্রান্তে।

কয়েক সেকেণ্ড পর মিলিয়ে গেল টেলিমেট্রি।

বেদম বেগ চেপে ওদিকের পাহাড়-জঙ্গল আরেকবার ঘুরে আসতে চাইল পাইলট। ভাল করেই জানে, মিলিয়ন ডলারের মেশিন বিধ্বস্ত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে তার বিরুদ্ধে।

একটু পর এল জোরালো সিগনাল।

দেরি না করে নাক-মুখ কুঁচকে ল্যাং-এর অফিসে ফোন করল পাইলট টেকনিশিয়ান কল রিসিভ করতেই বলল, পাঁচ নম্বর ড্রোন থেকে কন্ট্যাক্ট রিপোর্ট পেয়েছি। এখন দেখব ওদিকের এলাকা।

ফোন রেখে ব্যস্ত হয়ে উঠল সে।

এদিকে ল্যাং-এর ওয়্যারহাউসে টেকনিশিয়ান কোঅর্ডিনেট স্ক্রিনে তুলে দিতেই সেন্সর অ্যানালাই করল কমপিউটার। তিন সেকেণ্ড পর কনফার্ম করল সিগনাল।

হুয়াং লি ল্যাং-এর দিকে ফিরল টেকনিশিয়ান। স্যর, স্যান ইগন্যাসিয়ো। ওরা লুকিয়ে আছে ওই শহরে।

.

গেস্ট হাউসের সামনের সিঁড়িতে বসে আছে মাসুদ রানা, দেখছে শহরের প্রধান রাস্তায় ফুর্তি করছে শহরবাসীরা।

বাচ্চাদের জন্যে নাটক লিখে দিয়েছেন ফাদার ভাসকুয়েজ।

একজোড়া কিশোরী ও কিশোর সেজেছে মাতা মেরি ও তার স্বামী জোসেফ। ছেলেটির পরনে নীল আলখেল্লা। পাশেই গাধার পিঠে সাদা-হলদে পোশাকে স্ত্রী মেরি। পিছু পিছু হাঁটছে ছোট বাচ্চারা। তাদের ভেতর পাবলোকেও দেখল রানা।

স্ত্রীকে নিয়ে দোরে দোরে ঘুরছে কিশোর জোসেফ, ভদ্রতা বজায় রেখে বলছে: বলতে পারেন, খালি আছে এই সরাইখানায় কোনও কামরা?

এরই ভেতর সব কামরা ভাড়া হয়ে গেছে বলে, মনে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মাথা নাড়ছে সরাইখানার মালিকরা। অবশ্য, কয়েকটা সরাইখানায় ব্যর্থ হয়ে চার্চের একটু দূরের এক দরজায় টোকা দিল জোসেফ।

দরজা খুলে কিশোরী মেরি ও কিশোর জোসেফকে দেখলেন এক মহিলা। ঠোঁটে ফুটে উঠল মিষ্টি হাসি। হ্যাঁ, কামরা আছে।

এই ঘটনায় খুশিতে হৈ-হৈ করে উঠল বাচ্চারা।

নাটক শেষ হতেই শুরু হলো মূল অনুষ্ঠান। নানান বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে সবাইকে মাতিয়ে তুলল শিল্পীরা। পিনাটা নিয়ে হৈ-চৈ শুরু করল বাচ্চারা। সবার জন্যেই আছে খেলনা ও চকলেট। মস্ত কয়েক টেবিল থেকে হাতে হাতে সরবরাহ করা হবে খাবার ও ওয়াইন। ক্রিসমাসের কয়েক দিন আগে থেকেই মেক্সিকোর প্রতিটি শহর ও গ্রামে চলে এসব অনুষ্ঠান।

এই কদিন মনে দুঃখ রাখবে না কেউ। দূর থেকে রানাকে দেখে হাসল পাবলো। জবাবে হাত নাড়ল রানা। একটু পর অন্য সাধারণ শিশুর মতই খেলায় মেতে উঠল পাবলো।

এ ধরনের ছোট শহরে আগেও থেকেছে রানা। ওর জানা আছে, এসব জায়গা বাচ্চাদের জন্যে স্বর্গ। বিদ্যুৎ সংযোগ আছে শহরে, পথে পথে জ্বলছে স্বল্প ওয়াটের বাতি। বেশিরভাগ বাড়িতে রেডিয়ো, টিভি বা ফোন নেই, তবে তাতে বয়েই গেছে। দরিদ্র কিন্তু সুখী মানুষগুলোর!

ঘনিয়ে আসা বিপদ থেকে অন্যদিকে মন সরিয়ে নিল রানা। সব ঠিক থাকলে, হয়তো এই শহরে কোনও পরিবারে পাবলোকে রেখে যেতে পারবে ওরা। তাতে হয়তো স্বাভাবিক জীবন পাবে ছেলেটা।

রাস্তা পেরিয়ে চার্চে ঢুকে একটু অবাক হলো ও। বেদির সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিতা। দেখাচ্ছে পবিত্র কোনও অপরূপা দেবীর মত। এইমাত্র উৎসর্গ করেছে মাতা মেরির কাছে জ্বলন্ত মোমবাতি। সাদা-লাল-কালো ফুল তোলা সুতির গাউন পরনে। কাঁধে লুটিয়ে পড়েছে দীর্ঘ, কালো এলো কেশ।

মিতা সুন্দরী, কিন্তু আগে কখনও এভাবে খেয়াল করেনি রানা। টের পেল, রূপের ওই ঝলক শুকিয়ে দিয়েছে ওর গলা। কী করে এত সুন্দরী হয় কোনও মেয়ে?

খুকখুক করে কেশে নিয়ে ডাকল রানা, মিতা?

ঘুরে তাকাল মেয়েটা। অদ্ভুত মিষ্টি হাসল। মা চলে যাওয়ার পর কখনও কোনও চার্চে ঢুকিনি। আর বাবার মৃত্যুর পর যাওয়া হয়নি কোনও মন্দিরেও।

বিশেষ কোনও ধর্মে আস্থা নেই তোমার, বলল রানা।

মাথা নাড়ল মিতা। ভগবান; গড বা আল্লা যা-ই বলো, তার নানান ভেদ তৈরি করেছে স্বার্থপর একদল মানুষ। আমার মনে হয় না এসবে কিছুই যায় আসে সত্যিকারের স্রষ্টার।

অর্থাৎ ডারউইনের থিয়োরি থেকে একতিল সরবে না।

ধর্মান্ধ তো নই।

 অদ্ভুত রূপসী লাগছে তোমাকে, বলল রানা।

হঠাৎ লাল গোলাপের মত লজ্জায় রক্তিম হলো মিতা। বাইরে পটকা ফাটতেই একটু চমকে গিয়ে তাকাল রানার চোখে। দৃষ্টি নামিয়ে নিল। এই পোশাক তোমার পছন্দ হয়েছে?

হ্যাঁ। আগে কখনও তোমাকে এভাবে দেখিনি। মৃদু হাসল রানা। চমকে গেছি।

পাবলোকে রেখেছে যে মহিলা, তার কাছ থেকে ধার নিয়েছি।

একটু আগে দেখলাম পাবলোকে, বলল রানা। মজায় আছে।

বিষাদের ছাপ পড়ল মিতার চোখে। নিচু স্বরে বলল, আপাতত। ওর হয়তো শেষে মরতে হলো না?

হয়তো, কেন যেন নিজের ওপর রাগ হলো রানার। মনে পড়ল, আমাযন জঙ্গল বা সাগরের মন্দিরে বহু নিচে ছিল স্ফটিক। নিচের সেলারে রাখব ওকে, আশা করি তাতে কমবে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ।

ওর মনে হলো, যে-কোনও সময়ে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হু-হু করে কাঁদতে শুরু করবে মেয়েটা।

কোনও আশা নেই ওর, বিড়বিড় করল মিতা, মেনে নিয়েছি নিয়তি। নির্দ্বিধায় স্বীকার করল, তবে তুমি পাশে থাকলে ভয় থাকে না।

প্রসঙ্গ পাল্টে নিল রানাঃ চলো, দেখে আসি সেলারে কী করছেন প্রফেসর।

একটু আগে গিয়েছিলাম, বলল মিতা, হায়ারোগ্লিফ থেকে নতুন কিছু পাননি। ফাদার ভাসকুয়েজ বলেছিলেন, আমাদের কথা লিখে গেছেন মায়ান কোনও জ্ঞানী। কিন্তু তাতে তৃতীয় স্ফটিক পাব না আমরা।

আশা করতে দোষ নেই, বলল রানা, তবে এসব স্ফটিকের কারণে তোমার, পাবলো বা অন্য কারও ক্ষতি হবে বুঝলে দেরি করব না হাতুড়ি দিয়ে গুঁড়ো করে দিতে। তারপর যা খুশি হোক।

নীরবে রানার চোখে চেয়ে রইল মিতা।

চার্চের প্রকাণ্ড ঘরের চারপাশে ঘুরল রানার চোখ। এবার বাইরে গিয়ে দেখব ওদের অনুষ্ঠান।

আমিও যাব তোমার সঙ্গে, বলল মিতা।

বাইরের শীতল হাওয়ায় বেরিয়ে এল ওরা।

এক সেকেণ্ডের জন্যে ছোট কোনও বিমানের ইঞ্জিনের শব্দ পেয়েছে বলে মনে হলো রানার। সতর্ক হয়ে কান পাতল। কিন্তু কোথাও যান্ত্রিক আওয়াজ নেই। তিন সেকেণ্ড পর রাস্তার মঞ্চে শুরু হলো গান-বাজনা।

মিতার ডানহাত মুঠোয় নিয়ে নাচের মঞ্চ লক্ষ্য করে পা বাড়াল রানা।

.

৪৪.

গভীর রাত। ইয়াকা মাউন্টেনের গভীর সুড়ঙ্গে রয়ে গেছেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান। বিশেষ একটি প্রোগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত তার টেকনিশিয়ানরা। মার্ল ক্যালাগুর সংগৃহীত থিয়োরিই ঠিক। ম্যাগনেটিক ফিল্ড হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে জড়িত রহস্যময় স্ফটিক। তবে ভেরিয়েবলের সব সংখ্যা মিলছে না। রয়ে গেছে কোথায় যেন ক্রটি।

এনআরআই বিশেষজ্ঞদের ইনপুট বেশ কয়েকবার বদল করেছেন ব্রায়ান। সংখ্যা একটু বেশি দেখাচ্ছে।

আবারও সংখ্যা পাল্টে নিলেন তিনি।

ম্যাগনেটিক ফিল্ড কমে যাওয়ার অঙ্কের সঙ্গে এখনও মিলল না এবারের সব সংখ্যা।

বিরক্ত হয়ে সিমুলেশনের জন্যে রিভার্স অ্যানালাইয করতে নির্দেশ দিলেন ব্রায়ান। সত্যিকারের ডেটা কী হওয়া উচিত, আর কী আছে, তার তফাৎ জানতে চান।

অপেক্ষা করলেন। কিছুক্ষণ পর স্ক্রিনে এল: Operational parameter invalid.

কী যেন বাধা দিচ্ছে সমীকরণ করতে।

ব্রায়ান টাইপ করলেন: Suggested parameter adjustment?

কয়েক ধরনের হিসাব কষল কমপিউটার, তারপর সবচেয়ে ভাল আন্দাজ জানিয়ে দিল: 

Parameter with highest likelihood of successful adjustment: Number of Magnetic Fields.

কার্সারের দিকে চেয়ে রইলেন জেমস ব্রায়ান।

 বলে কী কমপিউটার?

তা হলে কি আরও আছে ম্যাগনেটিক ফিল্ড?

 এর মানেটা কী?

 ঠিকভাবে নাকের ওপর চশমা বসিয়ে নিলেন। ক্লিক করলেন ইনপুট পেজ-এ। স্ক্রল করে দেখলেন প্রতিটি বর্তমান প্যারামিটার। সেসবের ভেতরেই পেলেন ম্যাগনেটিক ফিল্ডের ইনপুট সংখ্যা। কমপিউটারে সেট করা: One.

নিজেকে বোকা মনে হলো ব্রায়ানের। একটার বেশি ম্যাগনেটিক ফিল্ড থাকতে পারে?

এই প্রোগ্রাম এসেছে নর্থ পোল সার্ভে গ্রুপের তরফ থেকে। ওটার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মেরুর গতি ও ভবিষ্যৎ পরিবর্তন। এসব হিসেবে রেখে এনআরআই বিশেষজ্ঞরা বিবেচনা করেছে স্ফটিকের প্রভাব।

চিন্তা আরও বাড়ল ব্রায়ানের।

নিজেরা ম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করছে ওইসব স্ফটিক?

চশমার ওপর দিয়ে স্ক্রিন দেখে নিয়ে সংখ্যা বদল করলেন। এবার কি বোর্ডে লিখলেন: Two। দ্বিতীয় ফিল্ডের আউটপুট চান তিনি। মিলিয়ে দেখবেন স্ফটিকের পাওয়ার লেভেল। টিপে দিলেন এন্টার।

লেখা উঠল স্ক্রিনে: Operational parameter invalid.

বুঝলাম, বিড়বিড় করলেন ব্রায়ান।

এবার পাল্টে নিলেন সংখ্যা। নতুন ফিল্ডের শক্তির জন্যে সংখ্যা চাইল কমপিউটার। কিন্তু তেমন কোনও তথ্য তার কাছে নেই। টাইপ করলেন X. এবার টিপলেন এন্টার।

এনআরআই-এর তৈরি অত্যাধুনিক সিস্টেম ব্যবহার করে ভাবতে শুরু করেছে কমপিউটার। প্রয়োজনে সাহায্য নেবে সংযুক্ত অন্তত এক শটা মেইনফ্রেম কমপিউটারের। সবাই মিলে কাজ করবে সুপার কমপিউটারের মত করে।

ব্রায়ানের দেয়া জটিল X হিসাব কষতে কমপিউটারের লাগবে প্রচণ্ড ক্যালকুলেটিং ক্ষমতা।

থম মেরে গেছে কমপিউটারের স্ক্রিন।

ওটার দিকে চুপ করে চেয়ে রইলেন ব্রায়ান। ভয় পাচ্ছেন, যে-কোনও সময়ে ক্র্যাশ করবে সিস্টেম।

কয়েক মিনিট পর ফেস করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আগের নির্দেশ বাতিল করে দেবেন, এমনসময় স্ক্রিনে এল মেরুর শক্তি বিষয়ে একের পর এক সংখ্যা। সবই ম্যাগনেটিক ফিল্ড সংশ্লিষ্ট।

সংখ্যাগুলো দেখলেন ব্রায়ান।

পেয়ে গেছেন নিখুঁত সব সংখ্যা।

সঠিক তথ্য দিয়েছে কমপিউটার: পৃথিবীতে একটি নয়, সব মিলে রয়েছে পুরো তিনটে ম্যাগনেটিক ফিল্ড!

.

৪৫.

 ছাত থেকে ঝুলন্ত ন্যাংটো বাল ছড়াচ্ছে হলদে আলো। চার্চের ভূগর্ভস্থ সেলারে বসে আছেন প্রফেসর হ্যারিসন। আবারও ঘুরছে তার মাথা। চোখের সামনে ঝাপসা লাগছে পার্চমেন্ট।

মায়াদের হায়ারোগ্লিফ ব্যবহার করেছে স্ক্রলের লেখক।

নিজের করা নোট দেখতে চাইলেন তিনি।

আমি ব্রাদারহুডের মৃতপ্রায় এক জাগুয়ার। এসব লিখছি এমন এক ভাষায়, যেটা আজ আর ব্যবহার করে না কেউ।

নোট করা লেখার পরের লাইনে চোখ রাখলেন হ্যারিসন। কেঁপে গেছে হাত, তাই আঁকাবাঁকা হয়েছে ইংরেজি অক্ষর।

ডানহাতের দিকে তাকালেন প্রফেসর।

ও, আগে থেকেই তিরতির করে কাঁপছে বাহু!

আবার পড়লেন: প্রথমে ছিল চারটি স্ফটিক। সেগুলোকে ঠিক জায়গায় সরিয়ে দিয়েছে ব্রাদারহুডের সদস্যরা। তাদের কাছেই রয়ে গেছে ওই রহস্য।

এসব লেখা মায়াদের সৃষ্টির বিষয়ে, ভাবলেন প্রফেসর। দেবতারা প্রথমে চেষ্টা করেছিলেন মায়াদের তৈরি করতে। কিন্তু তাঁরা পারলেন না বলেই সৃষ্টি হলো কাঠের মানুষ। দেখতে তারা অনেকটা মানুষের মতই। তাদের চেহারা ছিল বিকৃত।

স্কলাররা বলেন, এসব লেখা হয়েছে বাঁদরের বিষয়ে। তারা ছিল গাছে গাছে।

কিন্তু এ থিয়োরি মানেন না প্রফেসর হ্যারিসন।

কাঠের মানুষের রোম ছিল না। কোথাও পাওয়া যায় না তাদের লেজের কথা। দৌড়ঝাঁপ সম্পর্কে কিছুই নেই। হায়ারোগ্লিফে। লেখা আছে, তারা ছিল আড়ষ্ট ও দুর্বল।

প্রচণ্ড এক ঝড় ও বন্যায় মরে সাফ হলো কাঠের মানুষ। বদলে পৃথিবীতে এল সত্যিকারের মানুষ। তবে প্রাণের ভয়ে আমাযন ছেড়ে উত্তরদিকে গেল তারা। সবাই নয়, ব্রাদারহুডের একদল যাজক জানতেন কী করতে হবে। দেবতাদের নির্দেশ অনুযায়ী স্ফটিক নিয়ে দীর্ঘ এক অভিযানে বেরিয়ে পড়লেন তাঁরা। কিন্তু আগের মন্দিরে রয়ে গেল ব্রাযিলের ওই স্ফটিক।

হ্যারিসনের মনে পড়ল, এক বছর আগে ওটাই আবিষ্কার করেছিল রানা ও মিতা।

এবারের অভিযানে মিতা আর তিনি খুঁজতে বেরোন পরের তিনটে স্ফটিক। ওগুলো: মন উৎসর্গের আয়না, দূর সাগরের আত্ম উৎসর্গের আয়না, আর শেষেরটা দেহ উৎসর্গের আয়না।

মেক্সিকো উপসাগরের মন্দিরে পেয়েছেন তারা মন উৎসর্গের স্ফটিক।

দূর সাগরের আত্মা উৎসর্গের আয়না বা স্ফটিক বোধহয় রয়ে গেছে রাশায়। ওটা খুঁজে বের করতে হবে।

আর শেষের স্ফটিকটা দেহ উৎসর্গের আয়না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রয়ে গেছে পাহাড়ি জাগুয়ার রাজার কোনও মন্দিরে।

মানবজাতি দুর্বল হলে তাদেরকে নতুন করে উৎসাহিত করত এসব স্ফটিক।

ওগুলোর ব্যবহার জানত মায়ান ব্রাদারহুডের সদস্যরা।

আবারও নিজের নোটে ডুব দিলেন প্রফেসর। কিছুক্ষণ পর বুঝলেন, প্রায় অসম্ভব ওই স্ফটিক খুঁজে বের করা।

বড্ড ঘুরছে প্রফেসরের মাথা। তবুও হায়ারোগ্লিফের বইয়ের ওপর ঝুঁকলেন অনুবাদ করতে। হঠাৎ তাঁর কপাল থেকে একফোঁটা ঘাম পড়ল পার্চমেন্টের ওপর। চট করে তোয়ালে দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখ মুছলেন। আবারও মন দিলেন পরের হায়ারোগ্লিফের ওপর।

একটু পর চেনা কয়েকটা মায়ান অক্ষর দেখে ভাবলেন, ভুল না হলে, এসব স্কটিক রক্ষা করবে এই পৃথিবী। কিন্তু রক্ষা করবে কী থেকে?

আরও কিছুক্ষণ অনুবাদের পর পেয়ে গেলেন উপযুক্ত মায়ান বাক্য।

হ্যাঁ, মানবজাতি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করবে এসব স্ফটিক। যদি না পারে, মানবজাতিকে ধ্বংস করবে স্বয়ং প্রকৃতি।

জ্বরের ঘোরে মাথা ঘুরছে বলে নিজের ওপর রেগে গেলেন প্রফেসর। কাজ করছে না মগজ। এখন ডেটা বেস পেলে কাজে আসত। ঘাটতে হতো না পুরনো স্মৃতি। তার আগের নোট বুকটা পেলেও চলত।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন হ্যারিসন। গরম সেলারে লাগছে শীত। আজকাল এমনই হচ্ছে। একবার গরম লাগে, আবার মনে হয় বরফের মত জমে যাবেন।

তোয়ালে দিয়ে আবারও মুখ মুছলেন তিনি। বমি এলেও পেট থেকে বেরোতে চাইল না কিছুই। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন। তারপর স্পর্শ করলেন পায়ে বুলেটের ক্ষত। গর্তের চারপাশে শক্ত হয়ে উঠেছে মাংস। গরম লাগছে।

নতুন করে শুরু হয়েছে ইনফেকশন। বাড়ছে ব্যথা।

 আনমনে স্ত্রীর কথা ভাবলেন প্রফেসর হ্যারিসন।

কই, শুনছেন না হান্নার কথা!

কোথায় গেল মেয়েটা?

ওর কথা শুনবেন আর গল্প করবেন বলেই বন্ধ করেছিলেন অ্যান্টিবায়োটিক।

এখন দেখা যাচ্ছে, ভাল করেননি কাজটা!

.

রাত বারোটার দিকে থিতিয়ে এল স্যান ইগন্যাসিয়ো শহরের অনুষ্ঠান। বাড়ি ফিরতে লাগল যে যার মত।

বিশ মিনিট পর ফাঁকা হয়ে গেল প্রধান সড়ক।

সবার কাছ থেকে আগেই বিদায় নিয়েছে রানা ও মিতা। সরু গলির মুখে গেস্টহাউসের সামনে, বেঞ্চিতে মুখোমুখি বসল ওরা।

চুপ করে আছে।

একটু পর জিজ্ঞেস করল মিতা, কী ভাবছ?

সরল স্বীকারোক্তি দিল রানা, নিয়তি বিশ্বাস করি না।

আমি বিশ্বাস করি, বলল মিতা, নইলে আমার জীবনে আসতে না তুমি। এতক্ষণে খুন হতাম ল্যাং-এর জেলখানায়।

ওকে দেখল রানা, গম্ভীর।

মিতার চোখে পড়েছে কয়েকটা চুল। হাত বাড়িয়ে ওগুলো ওর কানের পেছনে গুঁজে দিল রানা।

বলতে পারো এটা কেন, রানা? হঠাৎ করেই জানতে চাইল মিতা।

বেঞ্চিতে পিঠ ঠেকিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করল রানা, কেনটা কীসের?

অনেক ভেবেও বুঝিনি, কেন এত আগলে রেখেছ। না আমি আত্মীয়, না বাংলাদেশের কেউ। তবু আমার জন্যে বারবার এত ঝুঁকি কেন নিলে?

মৃদু হাসল রানা। জানতেই হবে?

হ্যাঁ। মাথা দোলাল মিতা।

বেশ, শোনো, আমার সাধ্যমত করছি কারণ ভুলে যাইনি, তুমি বাংলাদেশি এক প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর মেয়ে। তুমি মুসলিম, হিন্দু বা খ্রিস্টান তা কখনও বিবেচনার বিষয় ছিল না। আর… হ্যাঁ, তোমাকে সাহায্য করার আরও একটা জরুরি কারণও আছে।

সেটা কী? ধনুক ভুরু ওপরে তুলল মিতা।

মুচকি হাসল রানা। এত দুর্দান্ত সুন্দরীর পাশে নিজেকে মস্ত কিছু মনে হয়।

কিল তুলল মিতা, ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। রানার হাতটা আলতো করে নিয়ে গালের পাশে চেপে ধরল ও। চোখ স্থির হলো সঙ্গীর চোখে। নীরবে কী যেন বলছে ওর দৃষ্টি।

ওই অলঙ্ঘ্য আহ্বান এড়াতে পারবে না কোনও পুরুষ।

মিতার কমলালেবুর কোয়ার মত ঠোঁট স্পর্শ করল রানার নিষ্ঠুর ঠোঁট। পরক্ষণে টের পেল রানা, সাড়া দিচ্ছে মিতা।

এক হয়ে গেল দুজনের তপ্ত শ্বাস।

একটু থেমে পরস্পরের চোখে তাকাল ওরা।

চলে গেছে অদ্ভুত এক ঘোরের মাঝে। জড়িয়ে ধরল ওরা দুজন দুজনকে।

রানার অবাধ্য হাত চলে গেল মিতার পিঠ পেরিয়ে কোমরের বাঁকে।

ওর কানের কাছে ফিসফিস করল মিতা, রানা! আমার ঘরে?

গাউনের ভেতর থেকে হাত বের করে নিয়ে একটু পিছিয়ে বসল রানা।

কী হলো? সব হারিয়ে বসার সুর মিতার কণ্ঠে। চোখে অবহেলিত যুবতীর দৃষ্টি।

এবার ওর ব্রা-র স্ট্র্যাপ খুলল রানা।

কিন্তু ওর হাত প্রেমিকের নয়। কী যেন খুঁজছে আঙুল।

বিস্মিত হয়েছে মিতা। কী হয়েছে, রানা? এমন করছ কেন?

গত কিছু দিনের ভেতর সার্জারি হয়েছে তোমার? জানতে চাইল রানা।

না তো! অবাক কণ্ঠে বলল মিতা। কেন?

কারণ তোমার দুই শোল্ডার ব্লেড ও মেরুদণ্ডের মাঝে তাজা ক্ষতের দাগ। ত্বকের নিচে শক্ত কিছু।

চমকে গেল মিতা। চলো তো, বেডরুমে গিয়ে দেখব ওটা কী।

কয়েক মুহূর্ত পর মিতার বেডরুমে চলে এল ওরা।

এবার দেখি তোমার ক্ষতটা? বলল রানা।

লজ্জায় লাল হলো মিতা। তবে খুলে ফেলল সুতির গাউন।

বেয়াড়া চোখকে ফর্সা, সুডৌল কোমরের দিকে যেতে দিল না রানা, দৃষ্টি স্থির হলো ক্ষতের ওপর।

ওদিকে মিতার মনে পড়ল, জ্ঞান ফেরার পর হংকঙে ব্যথা ছিল পিঠে। খুব উজ্জ্বল সাদা বাতির একটা ঘরে নেয়া হয়েছিল ওকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে।

তা হলে ওটা কি অপারেশন থিয়েটার ছিল?

ওর পিঠে অস্ত্রোপচার করেছে ল্যাং-এর লোক?

জিনিসটা কী, রানা? শুকনো গলায় জানতে চাইল মিতা।

আমার ধারণা, কোনও ট্র্যাকিং ডিভাইস, বলল রানা। সম্ভবত শর্ট রেঞ্জের। তবে দূর থেকে জানবে রিমোট সেন্সর। লোজ্যাকের মত।

মিতার মনে পড়ল, ফেরত দিয়েছিল ওর জুতো। যাতে পালাতে পারে! ল্যাং ভাল করেই জানত, কী খুঁজছে ও। এ-ও বুঝেছে, অন্য কারও চেয়ে অনেক আগেই ও পৌঁছুবে স্ফটিকের কাছে। জেনেবুঝেই মুক্তি দিয়েছিল। হয়তো চেয়েছিল ওর সঙ্গে থাকুক পাবলো। তাতে সুবিধা হবে মিতার।

কী ঘটেছে, সংক্ষেপে রানাকে জানাল মিতা। তারপর বলল, এখন জানি, কীভাবে সাগরে খুঁজে নিয়েছিল ল্যাং-এর লোক!

মৃদু মাথা দোলাল রানা।

তুমি না সন্ধ্যার দিকে বিমানের ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়েছ? বলল মিতা।

শুনতে ভুল হয়েছে হয়তো, মিতার শঙ্কা দূর করতে চাইল রানা।

কিন্তু অন্তরে জানো, কেউ না কেউ আসছে, বলল মিতা। উঠে গাউন দিয়ে বুক ঢাকল। ঘুরে আয়নায় দেখল পিঠের ক্ষত। ওটা এমন এক জায়গায়, দেখা প্রায় অসম্ভব। হাত যেতে চায় না ওখানে। বুঝে শুনেই ওখানে রাখা হয়েছে ট্র্যাকিং ডিভাইস। রানা পিঠে হাত না দিলে কিছুই জানত না কেউ।

কতটা গভীরে? কাঁপা কণ্ঠে জানতে চাইল মিতা। ভয় পেয়েছে, ওটা আছে পেশির নিচে।

ডিভাইসের কিনারা স্পর্শ করল রানা। ত্বকের ঠিক নিচেই।

চেহারা মড়ার মত ফ্যাকাসে হলেও বিড়বিড় করল মিতা, চামড়া কেটে ওটা বের করো।

অপারেশনটা ছোট হলেও এটা উপযুক্ত জায়গা নয়, বলল রানা। আপাতত থাক, পরে ভাল কোনও হাসপাতালে…

বারকয়েক মাথা নাড়ল মিতা। আমার ভয় কী, আমাদের কাছে আছে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক।

একটু দ্বিধা নিয়ে বলল রানা, বেশ। তা হলে উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ো।

আমার পেছনের দিকে তাকাবে না তো?

নাহ্, তোমার তো পেছন বলতে কিছুই নেই, সবই সামনের দিক! জানিয়ে দিল গম্ভীর রানা।

শুয়ে পড়ে ঘাড় কাত করে করুণ হাসল অসহায় মিতা। রানার মনে হলো, জবাই হবে বলে তৈরি হয়ে গেছে বেচারি।

একটু ব্যথা, ওটা কিছুই নয়, নিষ্ঠুর দাঁতের ডাক্তারদের মত বলবে কি না ভাবল রানা। পরক্ষণে সিদ্ধান্ত নিল: না, অত পাষণ্ড হতে পারবে না। ফার্স্ট এইড কিট থেকে রাবিং অ্যালকোহল নিয়ে ভালমত ঢালল ক্ষতের ওপর। একহাতে ডলছে। অন্য হাতে মিতার হাতে দিল দুটো যিথ্রোম্যাক্স বড়ি।

গ্লাস ভরা পানি দিয়ে ওগুলো গিলে জানতে চাইল মিতা, খুব ব্যথা লাগবে?

জবাবে নীরবে অ্যালকোহল দিয়ে স্ক্যালপেল ধুয়ে নিল রানা।

ভয়ঙ্কর নীরব জবাব পেয়ে গেছে মিতা। মুখ চেপে ধরল বালিশে। কোমরে চাপল অনেক ভারী কিছু। পরক্ষণে স্পর্শ পেল রানার তপ্ত আঙুলের।

আচ্ছা, রানা, তোমার কি উঠতেই হবে আমার… ওহ্! রানা! …মরে গেলাম!

ভীষণ ব্যথা পেয়ে দম আটকে ফেলেছে মিতা।

ওর পিঠের ত্বক থেকে সরে গেল শীতল কী যেন। পাজর বেয়ে নামল উষ্ণ রক্ত।

একটু আগে মিতা ভাবছিল: রানা খুব কাছে, ঘুরে ওকে বুকে টানলে কেমন হয়? খুশি মনে দেবে কুমারীত্ব! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, মরেই যাবে ব্যথায়! আর এই নচ্ছার, আনাড়ি ব্যাটার কারণেই ওর এত কষ্ট!

কোমর থেকে নেমে জানিয়ে দিল রানা, তোমার অপারেশন শেষ, এবার ব্যাণ্ডেজ করে দেব।

তুমি ভাল মানুষ হতে পার, কিন্তু পচা ডাক্তার! ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল মিতা। খবরদার! আমার দিকে তাকাবে না! কাত হয়ে তোয়ালে দিয়ে ঢাকল শরীর। জানা নেই, প্যান্টি নেই বলে সবই দেখা শেষ নিশ্চুপ মাসুদ রানার!

.

৪৬.

একটু আগে ঢাকায় বিসিআই-এর অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্রিগেডিয়ার (অব.) সোহেল আহমেদের সঙ্গে জরুরি আলাপ সেরেছে রানা।

এই সুযোগে নতুন পোশাক পরে নিয়েছে মিতা। এখন রানার পাশে হেঁটে চলেছে চার্চের দিকে। নতুন ক্ষত থেকে একটু একটু করে রক্ত পড়ে ভিজে গেছে ব্যাণ্ডেজ।

দ্বিতীয় পাথর সঙ্গে নিয়েছে রানা। বামহাতে ফাস্ট-এইড কিটে প্রফেসর জর্জ হ্যারিসনের জন্যে অ্যান্টিবায়োটিক।

মিতার পিঠের ওই রেডিয়োঅ্যাকটিভ পেলেট ছিল দূর থেকে অনুসরণ করার আইসোটোপ ইকুইপমেন্ট, কাজেই আগের চেয়েও সতর্ক রানা। ল্যাং ভেবেচিন্তেই মাইক্রোট্রান্সমিটার রাখেনি। দূরে সিগনাল দিত না ওটা। সহজ উপায় ব্যবহার করেছে সে। এখন জিনিসটা লো-গ্রেড আইসোটোপ হলেই ভাল, তা হলে কম ক্ষতি হবে মেয়েটার।

স্ফটিক রাখার সীসার পাত দিয়ে মোড়া কেসে পেলেট রেখেছে রানা। ওই টোপ ফেলে এই শহর থেকে সরাতে হবে ল্যাং-এর লোককে। রানা যত দূরে যাবে, ততই সম্ভাবনা কমবে শহরে হামলা হবার।

চার্চে ঢুকে সরাসরি ওয়াইন সেলারে নামল রানা ও মিতা। সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে ডাকল রানা, প্রফেসর?

তখনই ভারী কিছু পড়ল ধুপ-খটাং শব্দে!

ঘরের কোনায় চেয়ারসহ কাত হয়ে পড়ে আছেন প্রফেসর হ্যারিসন। প্রায় ছুটে গিয়ে তাকে টেনে তুলল রানা। ওকে সাহায্য করল মিতা।

ঘামে জবজব করছে আর্কিওলজিস্টের মুখ-গাল-বুক।

কী হয়েছে, প্রফেসর? একটা চেয়ারে হ্যারিসনকে বসিয়ে দিল রানা।

বুঝতে… বুঝলাম না… বিড়বিড় করলেন হ্যারিসন।

তাঁর কপালে হাত রেখে বলল মিতা, জর অন্তত এক শ পাঁচ ডিগ্রি! পুড়ে যাচ্ছে গা!

রানা কিছু বলার আগেই প্যান্টের পকেট থেকে গত পাঁচ দিনের অ্যান্টিবায়োটিক বড়ি বের করলেন হ্যারিসন। এত দিন ভঙ্গি করেছেন, ওগুলো নিয়মিত খেয়েছেন।

দু-দু-দু… দুঃখিত, বললেন লজ্জিত স্বরে। হান্নাকে দেখতে চেয়েছি। মনে হয়েছিল ওকে এনে দেবে ওই স্ফটিক। এখন বুঝছি… চুপ হয়ে গেলেন।

আপনাকে ওপরে নিয়ে যেতে হবে, বলল মিতা।

ভারবাহী গাধা তো আছেই, বলল বিরক্ত রানা। প্রফেসরের দুবগলে হাত ভরে টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেলল তাঁকে, পরক্ষণে ডান কাঁধে তুলল। রওনা হয়ে গেল সিঁড়ির দিকে।

হায়ারোগ্লিফ বুঝতে চাইছিলাম, কিন্তু মাথা চলছিল না, দুর্বল স্বরে বললেন হ্যারিসন।

তারপর চলল আপনার মাথা নরকে? জানতে চাইল রানা।

হ্যাঁ। তবে এসব স্ফটিক রক্ষা করে পৃথিবীকে।

 তাই? সিঁড়ি বেয়ে উঠছে রানা। পেছনে মিতা।

মাটি রক্ষা করে, অপরাধী কণ্ঠে বললেন হ্যারিসন, দুঃখিত, আমি হান্নাকে আবার পাশে চেয়েছি।

চিকিৎসা না পেলে বাঁদরের মত মস্ত এক লাফে পৌঁছে যাবেন তার পাশে, বলল রানা। হাঁফ লেগে গেছে সেলার থেকে সোয়া দুই শ পাউরে লাশ চার্চে তুলে এনে।

নিচু স্বরে বলল মিতা, বাইরের ঠাণ্ডা পরিবেশে তাপ কমবে ওঁর।  

দরজা পেরিয়ে মাটির ওপর প্রফেসর হ্যারিসনকে শুইয়ে দিল রানা। টনটনে ব্যথাভরা কোমর সোজা করে মিতাকে বলল, দাও ওঁকে অ্যান্টিবায়োটিক। যদি ঝামেলা করতে চান, চোয়ালে কষে এক ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে নেব।

না-না, ঘুষি লাগবে না, চিচি করে বললেন হ্যারিসন।

লাগবে কি না, সেটা আমি বুঝব, ধমকের সুরে বলল রানা।

তা হলে আপনার ক্ষত পরিষ্কার করতে দেবেন তো? সুযোগ পেয়ে দাবি জানাল মিতা। নাকি রানা আরেক ঘুষিতে…

না-না, দেব-দেব! দেব!

ঠিক আছে, তো চুপ করে শুয়ে থাকুন। বেচারা প্রফেসরের প্যান্টের বোতাম খুলতে লাগল মিতা।

অপমান গিলে বললেন প্রফেসর, আরে, জরুরি কথা তো বলিইনি!

তার চোখে ফ্ল্যাশলাইটের কড়া আলো ফেলল রানা। কী সেই জরুরি কথা? জ্বর আরও বাড়ল যে প্রলাপ বকছেন?

উজ্জ্বল আলোয় চোখ পিটপিট করলেন হ্যারিসন। হাত দিয়ে ঢেকে ফেললেন দুচোখ। তারই ভেতর হঠাৎ তার মনে এল গভীর এক সন্দেহ: দুর্দান্ত হ্যাণ্ডসাম ছোেকরা ওই অপ্সরার মত সুন্দরী মিতাকে পটিয়ে রাত-বিরাতে…

কী হলো, বলে ফেলুন, বলল রানা।

মিনমিন করে বললেন প্রফেসর, ইয়ে… হায়ারোগ্লিফ থেকে সবই জেনে গেছি কোথায় আছে পরের স্ফটিক।

তাই? একটু ঝুঁকল রানা প্রফেসরের দিকে। জ্বরের ঘোরে যা খুশি বকছেন না তো?

মাথা নাড়লেন হ্যারিসন। হাওয়ায় এসে ভাল লাগছে এখন। দুর্বল স্বরে বললেন, হ্যাঁ। পাহাড় পাড়ি দিয়ে ফিরতে হবে ওই লেকে।

তারপর?

দক্ষিণে পড়বে কয়েক সারি টিলা। তৃতীয় ও চার নম্বর টিলার মাঝে ওই সিঙ্কহোল। অনেকটা নিচু জমির সেনোটের মত। বর্ষার এ সময়ে জেগে ওঠে ছোট কামরার সমান ওই দ্বীপ। পানি থাকে কূপের ভেতর।

ওটা মন্দির? অবাক হয়েছে রানা।

ওই দ্বীপ সত্যিই মন্দির, পাহাড়ি জাগুয়ার রাজার মন্দির। আর তার আয়না হচ্ছে ওই সেনোট।

আয়না নাম হলো কেন?

কূপ বা চারপাশের পানি কাঁচের মত পরিষ্কার, নিজের চেহারা দেখা যায়, বললেন আর্কিওলজিস্ট।

কোথায় আছে ওই স্ফটিক? জানতে চাইল রানা।

চুপ করে থাকলেন প্রফেসর। অপেক্ষা করছে রানা। কিছুক্ষণ পর মুখ খুললেন হ্যারিসন, দ্বীপে উঠলে পাবে সাধারণ কূপের মত ওই সেনোট। কিন্তু অন্যদিক থেকে ওটা আলাদা। নিচে ফেলতে হবে না বালতি, টেনেও তুলতে হবে না দড়ি। ব্যবস্থা করে রেখেছে প্রাচীন মায়ারা। একটা লিভার খুলে দিলেই নেমে যাবে পাথরের স্তূপ, বদলে শেকলের টানে উঠে আসবে ওই স্ফটিক।

তার মানে, কয়েক শ বছর আগেও ছিল মায়ান ব্রাদারহুডের লোক, বলল মিতা।

শেষজন কোডেক্স ফাদার সিলভার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, নইলে হারিয়ে যেত ওই দ্বীপ ও স্ফটিক। রানার চোখে চোখ রাখলেন হ্যারিসন। বিশ্বাস করো, স্ফটিক আছে ওখানে।

ঘুরে এসে হয়তো ধন্যবাদ দেব; একটু পর রওনা হব, বলল রানা। ঠিক করেছে, স্যান ইগন্যাসিয়ো ত্যাগ করে বহু দূরে চলে যাবে। এমন ব্যবস্থা নেবে, যাতে প্রথম সুযোগে ওর পিছু নেয় শত্রুরা।

মায়ারা ভাবতে ভালবাসত, আগামীকালের ওই বিশেষ ভোরে ধ্বংসের দিকে যাত্রা করবে না বিশ্ব, বললেন হ্যারিসন, আরও আসবে লক্ষ লক্ষ স্বাভাবিক ভোর।

খুঁজতে যাব পাহাড়ি জাগুয়ার রাজার মন্দির, বলল রানা, আপনারা থাকছেন এ শহরে।

আর্কিওলজিস্ট নিচু স্বরে বললেন, বাছা, প্রার্থনা করি, যাতে তোমার মঙ্গল হয়। ভায়া কন ডিয়োস।

শুশ্রূষা দরকার প্রফেসরের। তাঁকে ফেলে কোথাও যাবে না মিতা। ভেজা কণ্ঠে রানাকে বলল, সাবধান থেকো।

পাঁচ মিনিট পর স্যান ইগন্যাসিয়ো ছেড়ে বেরিয়ে এল রানা। ভোর হতে এখনও দুঘণ্টা। ওঁর পিঠে ব্যাকপ্যাকে সাগরের মন্দির থেকে পাওয়া স্ফটিক এবং ল্যাং-এর সেই আইসোটোপ।

.

শহরের ছোট একটি বাড়িতে আঁধারে ঘুম ভাঙল পাবলোর। শুনল কী এক আওয়াজ। চিৎকার করল কেউ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল ও। এল না আর কোনও আওয়াজ। বাতি নেই কোথাও। ঘুমিয়ে পড়েছে অন্য বাচ্চারা। নড়ছে না কেউ।

অথচ, বুকের মাঝে পাবলো বুঝল, কী একটা দূরে চলে যাওয়ার অনুভূতি।

বিছানায় উঠে বসে চারপাশ দেখল ও।

মগজের ভেতর কেউ বলল, সত্যিই দূরে চলে যাচ্ছে ওটা!

শুনল কিট-কিট আওয়াজ।

বিছানা ছেড়ে নেমে নিঃশব্দে জানালার পাশে গেল পাবলো। কোথাও আলো নেই। কিন্তু রঙিন আলো দেখছে চারপাশে। ওই যে শহরের বাইরের টিলা, ওখানে নড়ছে সাইরেন।

হাতড়ে পোশাক পেয়ে পরে নিল পাবলো। পায়ে জুতো গলিয়ে নিয়ে নীরবে বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল।

ওই সাইরেনের পিছু নিতে হবে ওকে!

.

৪৭.

ক্যামপেচের নির্জন এক হেলিপ্যাডে প্রকাণ্ড স্কাইক্রেন হেলিকপ্টারে উঠছে একদল সশস্ত্র চাইনিজ লোক। তিন মিনিটের মধ্যেই অস্ত্র রেখে সিটে বসে পড়ল তারা। সব মিলে বিশজন। সবার পর র‍্যাম্প বেয়ে উঠল তাদের নেতা। যে-কেউ ভাববে তার দেহ জুড়ে রয়েছে নতুন ধরনের কোনও কেভলার আর্মার।

বিশেষ সিটে বসে দলের লোকদের দেখল হুয়াং লি ল্যাং। নিজে বেছে নিয়েছে এই যোদ্ধাদেরকে। বুকে ভয় বলতে এদের কিছুই নেই। আড়চোখে দেখছে আর ভাবছে, নেতা পুরোপুরি মানুষ নন, মেশিনের অংশ। অথবা নেতার অংশ ওই ভয়ঙ্কর মেশিন।

নার্ভের ইনপুট অনুযায়ী নির্দিষ্ট গতি তুলে ককপিটের দিকে তাকাল হুয়াং লি ল্যাং। প্রথমে তার মনে হচ্ছিল, বড় বেশি দ্রুত নড়ছে সে। কিন্তু এখন মানিয়ে নিয়েছে মেশিনের সঙ্গে। নিজেকে মনে হচ্ছে টিভির সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যানের মত শক্তিশালী। ভালুকের চেয়েও বেশি শক্তি, গতি চিতার সমান। ঠিক করে ফেলেছে ল্যাং, স্ফটিক ব্যবহার করে পুরো সুস্থ হলেও, আরও আধুনিক করে তুলবে এই সুট। আসলে সব সময়ই ঠিক ভেবেছে সে: মেশিনই তাকে করে তুলবে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি।

ওই ছেলে আর ওসব পাথর খুঁজে বের করব আমরা, দলের উদ্দেশে বলল ল্যাং। কাজেই দয়া দেখাবে না কাউকে। কোনও বাধা এলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করবে। কাজ শেষ হলে প্রত্যেকে পাবে বড় অঙ্কের বোনাস।

খুশিতে হৈ-হৈ করে উঠল চাইনিজ মার্সেনারিরা। দরকার হলে যোগ্য নেতার সঙ্গে নরকে যেতেও আপত্তি নেই।

পাইলটের দিকে ইশারা করল হুয়াং লি ল্যাং।

দুসেকেণ্ড পর গর্জে উঠল স্কাইক্রেন হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন।

.

সারারাত অক্লান্ত সেবা করেছে মিতা।

প্রফেসর জর্জ হ্যারিসনকে খাটে শুইয়ে আইভি দেয়ার পর পরিষ্কার করেছে ক্ষত, তারপর খাইয়ে দিয়েছে ওষুধ। রানা চলে যাওয়ার একটু পর এসেছেন ফাদার ভাসকুয়েজ। তিনি সাহায্য করেছেন রোগী শুশ্রূষায়। ভোরের দিকে ছেড়ে গেছে হ্যারিসনের জ্বর।

হাঁফ ছেড়েছে মিতা, এবারের মত প্রাণে বেঁচে গেছেন পাগলা প্রফেসর।

চলে গেছেন ফাদার। পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে মিতা।

তবে ওর ঘুম ভাঙল দুঘণ্টা পর চার্চের ঘণ্টির ঢং-ঢং আওয়াজে।

আনমনে ভাবল মিতা, আজ কী রবিবার?

কী জানি!

পাশের ঘরে গিয়ে রোগীকে দেখল, জেগে গেছেন প্রফেসর। চেতনা আছে পুরো।

ঘুম ভেঙে গেল? জানতে চাইল মিতা।

এত আওয়াজ হলে ঘুমানো যায়? দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হ্যারিসন।

কথা ঠিক। বেজেই চলেছে চার্চের ঘণ্টি। মোটেও থামছে না।

হঠাৎ চমকে গেল, মিতা। মস্ত কোনও বিপদ না হলে এভাবে বাজানো হয় না ঘন্টি!

পাশের ঘরে এসে ব্যাকপ্যাক থেকে পিস্তল নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এল মিতা। ওখানেই থামতে হলো ওকে। অস্ত্র হাতে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে দুই শ্বেতাঙ্গ লোক। শহরের কয়েকজনকে জিম্মি করেছে ওই দলের আরও দুজন।

এই চারজনের নেতার বয়স চল্লিশ হবে। দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। কঠোর সুরে বলল সে, পিস্তলটা মাটিতে ফেলে দাও, মেয়ে!

নির্দেশ পালন করল মিতা।

ওর দিকে এগিয়ে এল লোকটা। গম্ভীর চেহারায় বলল, আমার নাম ইগোর দিমিতভ। তোমার কাছে রয়ে গেছে আমাদের খুবই জরুরি কিছু।

.

বিশ মাইল দূরে চতুর্থ টিলা বেয়ে উঠছে মাসুদ রানা।

রাতে পেছনে রেখে এসেছে ঘন জঙ্গল ও কয়েকটা টিলা। ছোট, সরু এক ক্যানিয়ন পেরোবার সময় ওটার ভেতর ফেলেছে রেডিওঅ্যাকটিভ পেলেট। কপাল ভাল হলে ওখানে খুঁজতে গিয়ে সময় নষ্ট করবে ল্যাং-এর লোক। গর্ত ও ফাটলের শেষ নেই, ভাবতে পারে, ওরা আছে ওখানেই।

এরপর নানান বাধা পার করে পুরো পাঁচ মাইল সরে এসেছে রানা, ক্লান্ত। এ মুহূর্তে হাঁটছে স্বাভাবিক গতিতে। কাঁটাগাছের অত্যাচারে ছড়ে গেছে শরীর। চটচট করছে ঘাম মেশা ধুলো। পুরো মনোযোগ সামনের দিকে। আর সে কারণেই শুনতে পেল না ঘনিয়ে আসছে মহাবিপদ।

একটু পর কানে এল আওয়াজটা। বাতাসে গুনগুন গুঞ্জন তুলছে কিছু। বিমান বা হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না, আওয়াজটা অনেকটা লন মোয়ারের মত।

চট করে ঘন এক ঝোপে ঢুকল রানা। চোখ পেছনে ফেলে আসা আকাশে। কয়েক সেকেণ্ড পর দেখল, একমাইল দূরে ওটা। উড়ে আসছে এদিকে। রিমোটলি অপারেটেড ড্রোন।

তার মানে, ওকে খুঁজে পেয়ে গেছে ল্যাং!

ঝোপ ছেড়ে বেরিয়েই ঝেড়ে দৌড় দিল রানা। ওপর থেকে ওকে দেখবে ড্রোন। কাজেই চাই ভাল কোনও কাভার। হয়তো টিলার ওপরের দিকে আছে তেমন জায়গা।

ঝোপঝাড় ভেঙে দৌড়ে চলেছে রানা। কিন্তু মাত্র একমিনিট পর মাথার ওপর দিয়ে গুঞ্জন তুলে গেল ড্রোন। আরেকটু হলে ছিলে দিয়ে যেত চাঁদি।

ছুটতে ছুটতে ওপরে তাকাল রানা।

ভাগ্য ভাল, ওই ড্রোন নিরস্ত্র।

অবশ্য, তখনই শুনল আরেকটা গুঞ্জন।

ওটাও ড্রোন!

পরক্ষণে শুনল আনগাইডেড রকেটের তীক্ষ্ণ হুইস!

ডানদিকের ঢালু জমিতে ঝাঁপ দিল রানা। মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে এক শ ফুট দূরের জমিতে পড়ে বিস্ফোরিত হলো রকেট। দুসেকেণ্ড পর এল কংকাশন ওয়েভ ও আগুনের তাপ।

রানার দশ ফুট ওপর দিয়ে গেল দ্বিতীয় ড্রোন। ঘুরে এসে খতম করবে শিকারকে। লাফ দিয়ে উঠে হরিণের গতি তুলল রানা, পাই-পাঁই করে উঠে যাচ্ছে টিলা বেয়ে। কয়েক সেকেণ্ড পর চূড়ার কাছে পৌঁছে লুকিয়ে পড়ল বেশ কিছু বোল্ডারের মাঝে।

আপাতত নিরাপদ।

ড্রোনের খোঁজে আকাশে তাকাল রানা।

পাইলটহীন দুই বিমান অলস শকুনের মত ঘুরছে ওপরে। আটকে রাখবে ওকে, ওদিকে দূর থেকে এসে হাজির হবে সত্যিকারের শিকারীরা!

.

উদ্যত অস্ত্রের মুখে আবারও গেস্টহাউসে ঢুকতে হয়েছে। মিতাকে। ওর পিছু নিয়ে ঢুকেছে ইগোর দিমিতভ। এ ছাড়া, এ বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছে ফাদার ভাসকুয়েজ এবং শহরের কয়েকজনকে। তাদের ভেতর লিনিয়াকে চিনল মিতা। ওই মহিলা রেখেছিল পাবলোকে। অনুষ্ঠানের জন্যে ওকে ধার দিয়েছিল গাউন। এখন হাঁটু গেড়ে সবাইকে বসিয়ে রেখেছে নিষ্ঠুর চেহারার রাশানরা।

দয়া করে ওদের ক্ষতি করবেন না, কাতর সুরে বলল মিতা। আমার সঙ্গে ওদের কোনও সম্পর্ক নেই।

ঠোঁটে ভোদকার বোতল তুলল ইগোর দিমিতভ। এক ঢোক জ্বলন্ত তরল গিলে নিয়ে বলল, আমাদেরকে ফাঁকি দিয়েছ, মেয়ে। তোমার কারণেই ওরা এখানে। লুকিয়ে রেখেছো ছেলেটাকে। কাজেই প্রাণে বাঁচবে না কেউ।

দিমিতভের লোকদেরকে দেখল মিতা। এ ধরনের লোকই গিয়েছিল সেই ফাইভ স্টার হোটেলে। এবার সঙ্গীদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে। চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে রাগ ও ঘৃণা।

দিমিতভের দিকে তাকাল মিতা। লোকটার দৃষ্টি বলে দিল, আগেও মানুষ খুন করেছে সে।

জ্যৈষ্ঠের কাঠের মত শুকিয়ে গেল মিতার গলা। বাঁচবে না ওরা কেউ!

ফাদার ভাসকুয়েজের পাশে বসানো হয়েছে ওকে। সামনে এসে দাঁড়াল ইগোর দিমিতভ। ছেলেটা কোথায়?

এই পাষণ্ডের হাতে বাচ্চা ছেলেটাকে তুলে দিতে হবে ভাবতে গিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো মিতার। কিন্তু উপায়ই বা কী? নইলে এই শহরের সবাইকে মেরে ফেলবে রাশানরা।

আমি জানি না ও কোথায়, সত্য বলল মিতা।

মিথ্যা বলছ! রাগে গর্জে উঠল দিমিতভ। ঠেকিয়ে দিল মিতার মাথার পাশে ম্যাকারভ পিস্তল।

ওটার জোর গুঁতো খেয়ে মেঝেতে কাত হয়ে পড়ল মিতা। তাক করেই গুলি ছুঁড়ল লোকটা। প্রচণ্ড আওয়াজে কেঁপে উঠল ঘর। চমকে গেছে সবাই। ফুটো হয়ে গেছে মিতার নাকের তিন ইঞ্চি দূরের মেঝে।

সাবধানে উঠে বসল মিতা। হাত মাথার ওপর।

এক পা পিছিয়ে বোতল ঠোঁটে তুলে আরেক ঢোক ভোদকা খেল ইগোর দিমিতভ। পরিষ্কার বোঝা গেল, কঠিন কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। এমন কিছু, যেটা পছন্দ নয় তার।

চার্চ আর ওই মেয়েলোকের বাড়ি সার্চ করেছি, এই রাস্তার অন্য বাড়িও বাদ পড়েনি, কিন্তু আশপাশে নেই ওই ছেলে, কঠোর সুরে বলল প্রাক্তন এফএসবি এজেন্ট।

পালিয়ে গেছে, কাঁপা গলায় বলল লিনিয়া, জানি না কোথায়।

মহিলার পেছনে গিয়ে প্রফেসর হ্যারিসনের দিকে তাকাল দিমিতভ। আঙুল তাক করল আইভি লাইনের দিকে।

আমি আপনাকে ভয় পাই না, আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন বৃদ্ধ আর্কিওলজিস্ট।

অসুস্থ? বলল দিমিতভ, তো সবার আগে কষ্ট দূর করব আপনার।

শ্বাস আটকে ফেলল মিতা। বুঝে গেছে, লোকটাকে আরও রাগিয়ে দিলে খুন হবেন প্রফেসর। খুনিটার পায়ের আওয়াজ সরে আসছে শুনে একটু স্বস্তি পেল।

আবারও বন্দিদের সামনে এসে দাঁড়াল ইগোর দিমিতভ। আঙুল নাচিয়ে বলল, তোমরা একই কথা বলছ। তার কণ্ঠ শুনে মিতার মনে হলো, ওদের কথা বিশ্বাস করেছে সে। কিন্তু পরক্ষণে বলল লোকটা, কিন্তু ঝালাই করা মিথ্যা সবসময় জোরালো হয় সত্যির চেয়েও।

সবাইকে নিয়ে কীভাবে মুক্তি পাবে, তাই মগজ খেলাতে শুরু করেছে মিতা। কয়েক সেকেণ্ডে বুঝল, কাজটা অসম্ভব। দরজার সামনেই নীরব চার রাশান, কিন্তু ওরা কেউ উঠে দাঁড়ালেই অস্ত্র তাক করবে ওদের দিকে। খাঁচায় বন্দি বাঘের মত পায়চারি করছে ইগোর দিমিতভ। মিতা দেখল, ধুপ ধুপ শব্দে কাঠের মেঝেতে পা ফেলছে সে। তার মানেই, ফুরিয়ে আসছে ধৈর্য।

মিতার সামনে থামল ইগোর দিমিতভ। ভাল করেই জানো, কীভাবে শেষ হবে খেলা। খুন করব সবাইকে। তবে অন্যদের মরতে দেখবে তুমি। ওদেরকে বাঁচাতে চাইলে, দেরি না করে বলো ছেলেটা কোথায়।

মেঝের দিকে তাকাল মিতা। চোখে চোখ রাখার সাহস হারিয়ে ফেলেছে। চোখের কোণে জমে গেল জল, তারপর টপটপ করে অশ্রু বিন্দু পড়ল শুকনো কাঠের মেঝের ওপর।

চোখ বুজে ফেলল মিতা। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড পর দুহাতে মুছে ফেলল অশ্রু। রাগ হলো ওর রাশানদের ওপর। শহরের সব মানুষকে জিম্মি করেছে এরা। খুন করবে বলছে। অথচ ওদের কোনও দোষ নেই। ইগোর দিমিতভের চোখে চোখ রাখল মিতা।

আমি ভাল করেই জানি তুমি কে, ইগোর দিমিতভ।

অবসর নেয়ার আগে পেশাদার ছিলাম, বলল দিমিতভ, তখন সম্মান ছিল। এখন আমি আবর্জনাখেকো, ঘেয়ো কুকুর।

হয়তো আমাদেরকে খুন করবে, কিন্তু মনে রেখো, নিজেদের কবর খুঁড়ছ তোমরা, বলল মিতা।

ইগোর দিমিতভের কঠোর চেহারায় কীসের এক রহস্যময় অনুভূতি খেলে যেতে দেখল মিতা। কয়েক সেকেণ্ড পর লোকটার পেটের গভীর থেকে উঠে এল অসুস্থকর হাসি। আরেক চুমুক দিয়ে মিতার দিকে বাড়িয়ে দিল ভোদকার বোতল। নিচু স্বরে বলল, অনেক আগেই খোঁড়া হয়ে গেছে আমার কবর।

মুহূর্তের জন্যে তাকে দুঃখী মনে হলো মিতার। আর তখনই মনে পড়ল সেই গোল মুখ। চ্যাপ্টা নাক। চোখের দৃষ্টি ধারালো ছোরার মত।

আমি চিনতাম তোমার ভাইকে, বলল মিতা। তোমার তুলনায় হাজারগুণ ভাল ছিল সে। ছেলেটার প্রতি মমতা ছিল।

খুব ধীরে ম্যাকারভ পিস্তল ওপরে তুলল ইগোর দিমিতভ। মিতার মনে হলো, মাতাল হয়ে গেছে লোকটা। ভারী লাগছে তার কাছে অস্ত্রটা।

তুমি আমার ভাইয়ের কথা বলছ? বলল সে। ও কিডন্যাপ করেছিল পাবলোকে।

বাঁচাতে চেয়েছিল ছেলেটাকে, বলল মিতা।

 তাই? ঘৃণার সঙ্গে বলল ইগোর। এবং ব্যর্থ হয়েছে।

 হয়নি! নিজের প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছে বাচ্চাটাকে!

 ঘুরে ফাদার ভাসকুয়েজের মাথার পেছনে পিস্তল ঠেকাল সে।

এ কাজ কোরো না, অনুরোধ করল মিতা।

সময় হয়ে এল, থমথমে কণ্ঠে বলল ইগোর।

স্রষ্টা মাফ করুন তোমাদের, সরল কণ্ঠে বললেন ফাদার ভাসকুয়েজ।

আশা ছাড়া আর কিছুই নেই মানুষের, বলল ইগোর দিমিতভ। পিস্তল তুলেই ঘুরে ডানদিকের দুই রাশানের বুকে গুলি করল সে। লাশদুটো মেঝেতে পড়ার আগেই পরের দুই গুলি বুকে নিয়ে ছিটকে পড়ল বামদিকের দুই রাশান।

বদ্ধ ঘরে কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছে চারটে গুলির আওয়াজ: গুড়ুম! গুড়ম! গুড়ুম! গুড়ম!

এখনও ছটফট করছে এক এফএসবি জুনিয়র এজেন্ট।

আবারও গুড়ম করে উঠল ইগোর দিমিতভের পিস্তল।

খুন করতে এসে পৃথিবী ছেড়ে গেল মাথায় গুলি খেয়ে চার যুবক।

নানান দিকে ছিটকে পড়েছে ঘরের সবাই। উঠে দাঁড়িয়ে দৌড় দিয়েছে লিনিয়া দরজার লক্ষ্য করে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেখছে অবাক মিতা। বরফের মূর্তি হয়েছেন প্রফেসর হ্যারিসন। বিস্ফারিত চোখে দেখলেন মিতার ওপর স্থির হলো দিমিতরে পিস্তলের নল।

ক-কী হলো? জানতে চাইল মিতা। বোঝা সহজ, বলল দিমিতভ। আমার আপত্তি আছে। আজ মরতে।

আমিও তো চাই না মরতে, জানাল মিতা।

মরতে হবে না তোমাকে, পিস্তল নামিয়ে ফেলল ইগোর। অন্তত আমার হাতে মরবে না। আজ সবাইকে খুন করত এরা। মৃত রাশানদের দেখাল সে।

মিতা মুখ খোলার আগেই ফাদার ভাসকুয়েজের দিকে ফিরল প্রাক্তন এফএসবি এজেন্ট। ফাদার, আপনি কী জানেন পাবলো কোথায়?

মাথা নাড়লেন ভাসকুয়েজ।

জানি না মিথ্যা বলছেন কি না, তবে আশা করি, ওকে ভাল কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন আপনারা, বলল দিমিতভ। ভয় পাবেন না, ওকে রাশায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই।

আমরা জানিই না ও কোথায়, মাথা নাড়লেন ফাদার।

তা হলে ওকে খুঁজে বের করুন, বলল দিমিতভ। সরিয়ে ফেলবেন এই শহর থেকে। এমন কোথাও, যেখানে ওকে খুঁজে পাবে না এফএসবি। যারা আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাদেরকে বলব, গোলাগুলির সময় মারা গেছে পাবলো। লাশ নিয়ে পালিয়ে গেছে একদল লোক।

চুপ করে আছে মিতা। দেখছে ইগোর দিমিতভকে। ভাবছে, একটু আগে কত খারাপ লোক ভেবেছিল একে!

আসলে কী হলো, সত্যিই বুঝলাম না, বলল মিতা।

দিনের পর দিন ভেবেছি, আমার ভাই অসম্মান করেছে আমাদের বংশের, বলল ইগোর দিমিতভ। কিন্তু বাস্তব কথা হচ্ছে, না বুঝে ওকে অসম্মান করে ফেলেছি আমি। যা উচিত, তাই করতে চেয়েছিল ও।

এখন কী করবেন ভাবছেন? জানতে চাইল মিতা।

কী করব? বলল এফএসবির প্রাক্তন তুখোড় এজেন্ট, এখন একদল চিনা সশস্ত্র লোক এবং প্রায় মেশিনের মত একদল দানব যাচ্ছে তোমার বন্ধু মাসুদ রানাকে খুন করতে। এমন এক যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে বাঙালী যুবক, কেউ পাশে না লড়লে নির্ঘাত মরবে।

মিতার দিকে ডানহাত বাড়িয়ে দিল রাশান। আমরা সাহায্য করতে পারব ওকে।

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মিতার মুখ। বেসুরো কণ্ঠে বলল, কিন্তু… রানা তো… চলে গেছে অনেক দূরে!

জানি, বলল ইগোর দিমিতভ, কমরেড হুয়াং লি ল্যাং-এর সঙ্গে আছে হেলিকপ্টার। কিন্তু ঘাবড়ে যেয়ো না। আমাদের সঙ্গে যা থাকবে, ওটার কথা ভাবতেও পারেনি ওই নরকের পশু।

এত কিছু ঘটে গেছে, কেমন মাথা ঘুরছে মিতার। কিন্তু হঠাৎ করে ভয়ে বুক আঁকড়ে এল ওর। একা রানাকে বাগে পেয়ে খুন করবে ল্যাং!

ইগোর দিমিতভের হাত ধরে উঠে দাঁড়াল মিতা। তা হলে চলুন! ওর সাহায্য দরকার!

.

৪৮.

 ইয়াকা মাউন্টেনের সুড়ঙ্গে ড্রাইভার হামভি পুরো থামাবার আগেই লাফিয়ে নেমে পড়লেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান। প্রায় দৌড়ে গিয়ে উঠলেন ট্রেইলার ল্যাবোরেটরির ভেতর।

কার এত তাড়াহুড়ো, তা দেখতে মুখ তুলে তাকালেন বিজ্ঞানী ক্যাথিবা আলিহা, সিআইএ চিফ মার্ণ ক্যালাগু এবং দুই দলের বিজ্ঞানীরা। মাত্র আধঘণ্টা পর প্রচণ্ড বিচ্ছুরণ হবে ব্রাযিল স্টোন থেকে, তাই কীভাবে ওটাকে সবচেয়ে নিরাপদে ধ্বংস করা যায়, তা নিয়ে চলছিল আলোচনা।

ফ্ল্যাট-স্ক্রিন মনিটরের স্পিকার থেকে এল প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ: সব ফেলে কোথায় ছিলে, জেমস?

সরি, নতুন একটা থিয়োরি নিয়ে কাজ করছিলাম, বললেন ব্রায়ান।

আর সময় পেলেন না! ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে বললেন ক্যালাগু।

ফালতু কথা বাদ দিন! পাল্টা ধমক দিলেন ব্রায়ান। ঘুরে তাকালেন মনিটরে প্রেসিডেন্টের দিকে।

অনেক দেরি হয়ে গেছে, জেমস, বললেন প্রেসিডেন্ট।

আগে শুনুন আমার কথা, তারপর যা ভাল মনে হবে করবেন, বললেন ব্রায়ান, চাইলে এরপর গুলি করেও মারতে পারেন আমাকে, আপত্তি তুলব না। মাত্র দুটো মিনিট দিন। প্রেসিডেন্ট কিছু বলার আগেই দম না নিয়েই বললেন, মিস্টার ক্যালাগুর তথ্য ঠিক। কিন্তু সংখ্যা ঠিক ছিল না। ওগুলো আমরা বের করেছি। আর তাই জেনে গেছি বাস্তবতা কী।

মিস্টার ক্যালাগু? বললেন প্রেসিডেন্ট।

মাথা নাড়লেন সিআইএ চিফ। আমার জানা নেই ব্রায়ান কী বলতে চাইছেন।

উদ্বিগ্ন হয়ে ঘড়ি দেখলেন প্রেসিডেন্ট। যা বলবে চট করে বলো, জেমস।

বড় করে দম নিলেন ব্রায়ান। দরদর করে ঘামছেন। ঘুরছে মাথা। টিটকারির হাসি হাসছেন ক্যালাগু। বস আবারও অপমানিত হবেন, সেই কথা ভেবে মেঝের দিকে চেয়ে আছে এনআরআই স্টাফরা। মন খারাপ করে অন্যদিকে তাকালেন ক্যাথিবা আলিহা।

এই ল্যাবে কেউ তার সঙ্গে সায় দেবে না, বুঝে গেলেন ব্রায়ান। আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন, মিস্টার প্রেসিডেন্ট, জিয়োলজি অনুযায়ী, পৃথিবীর মাঝের অংশ প্রকাণ্ড এক তপ্ত, ঘুরন্ত তরল। বেশিরভাগ নিকেল আর আয়ার্ন। আর এ কারণেই ওই ঘুরন্ত গোলক তৈরি করছে ম্যাগনেটিক ফিল্ড। ওটা রক্ষা করছে আমাদেরকে।

সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছেন, বুঝে গেলেন ব্রায়ান।

তবে সমস্যা হচ্ছে, কেউ নিশ্চিত নন অত গভীরে কী আছে এবং কী হচ্ছে। কারও সাধ্য নেই যে থিয়োরি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। আর এ কারণেই কেউ জানাতে পারেননি, কী কারণে পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবীর ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড। হয়তো এক বিলিয়ন বছর পর পরিবর্তিত হলো ওটা। আবার মাত্র পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর পরেই এল পরিবর্তন। ঘর্মাক্ত চুলে হাত বোলালেন ব্রায়ান। টের পেলেন, ফেটে যেতে চাইছে কপালের পাশের রগ। এর কারণ, স্যর, মাত্র একটা ম্যাগনেটিক ফিল্ড কাজ করছে না পৃথিবী জুড়ে। তিন স্তরের ফিল্ড নিয়ন্ত্রণ করছে এই গ্রহ। তাদের ভেতর ঘটছে অনেক কিছুই।

পাগল হয়েছেন? খেঁকিয়ে উঠলেন ক্যালাণ্ড।

তাকে পাত্তা দিলেন না ব্রায়ান। ওই একই ঘটনা ঘটছে সূর্যের বুকে। তৈরি করছে আমাদের গ্রহের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের চেয়ে লক্ষ গুণ শক্তিশালী ফিল্ড। তবে প্রতি এগারো বছরে পাল্টে যাচ্ছে সেসব ম্যাগনেটিক ফিল্ড। সহজ নয় বিষয়টি। সূর্যের মেরুর দিকে নিরক্ষরেখা ঘুরছে অনেক জোরে। ফলে সূর্যের বুকে আঁচড়ের মত তৈরি হচ্ছে ম্যাগনেটিক লাইন। ব্যাপারটা পেতে রাখা চাদরের মাঝ থেকে টান দেয়ার মত। ওপরে উঠছে মাঝখান, কিন্তু রয়ে যাচ্ছে আগের জায়গায় চাদরের কিনারা। এলোমেলো হয়ে উঠছে। টেনে রাখা রাবার ব্যাণ্ডের মত ছিটকে যাচ্ছে সূর্যের লাইন। আমরা ওটাকেই বলি সোলার ফ্লেয়ার। বা বলতে পারেন করোনাল ম্যাস ইজেকশন। ওটার কারণে মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে অকল্পনীয় পরিমাণের এনার্জি।

কী পরিমাণের কথা বলছ? জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।

এতই, একেক মুহূর্তে মহাশূন্যে ছুঁড়ছে শত শত বিলিয়ন টন তপ্ত মেটারিয়াল।

এরসঙ্গে পৃথিবীর কী সম্পর্ক? জিজ্ঞেস করলেন প্রেসিডেন্ট।

আমরা ধারণা করেছি, পৃথিবীর মাঝের অংশ গোল বলের মত, ঘুরছে। কিন্তু বাস্তবে ভেতরে ঘুরছে তপ্ত তরল। সিমুলেশনের সময় গ্রাফ দেখে বুঝলাম, কখন হবে ফিল্ডের স্ট্রেংথ আর রিভার্সাল। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর বাইরের অংশে নিরক্ষরেখা আর মেরু কিন্তু আলাদা গতি তুলে ঘুরছে। ওটাই হচ্ছে দ্বিতীয় ম্যাগনেটিক ফিল্ড।

তুমি বলেছিলে তিনটে ম্যাগনেটিক ফিল্ড আছে?

হ্যাঁ, মাথা দোলালেন ব্রায়ান। তৃতীয় ফিল্ডটা তৈরি করেছে বিপুল পরিমাণের পাথর মিলে। মাত্র তিন হাজার বছর হলো ওটা তৈরি হয়েছে। ভেতরের গরম তরল যেন ছিটকে বেরিয়ে না আসে, সে চেষ্টা করছে ওটা।

এর ফলে কী হচ্ছে?

 সূর্যের মতই পৃথিবীর বুকেও তৈরি হচ্ছে ভাজ।

গলা পরিষ্কার করলেন প্রেসিডেন্ট। আর এরপর যখন ওই রাবার ব্যাণ্ড ছিঁড়ে যাবে?

মাথা নাড়লেন ব্রায়ান। আণবিক বোমা বিস্ফোরণের মত হবে না সাদা ব্যাঙের ছাতার মেঘ। কিন্তু আমরা টের পাব অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে। হয়তো তা হবে মৃদু ভূমিকম্প, বা থরথর করে কাঁপবে পৃথিবী। তবে সবচেয়ে বেশি বুঝব আমরা

অন্য কারণে। বিচ্ছুরণ হবে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক প্রচণ্ড শক্তি। পুরো সংখ্যা দেখিনি, কিন্তু ধরে নিন, ওই বিচ্ছুরণ হবে কদিন আগের ওই মারাত্মক বিচ্ছুরণের চেয়ে দশ হাজার গুণ বেশি।

দশ হাজার গুণ? চমকে গেলেন প্রেসিডেন্ট।

প্রচণ্ড এক সুনামির আঘাতের মত ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ ধ্বংস করবে পশ্চিম হেমিস্কেয়ারের প্রতিটি ইলেকট্রিকাল সার্কিট। নষ্ট হবে পৃথিবীর গৃহপথের কাছের সব স্যাটেলাইট। সামান্য দুর্বল ওয়েভ যাবে এশিয়া, রাশা ও উত্তর-পুব ইউরোপের ওপর দিয়ে। এর মানে, আধুনিক সব ইলেকট্রনিকের সর্বনাশ হলেও তাদের রয়ে যাবে মিলিটারি অনেক ইকুইপমেন্ট। বিশেষ করে সাইলোর ভেতর মিসাইল। থাকবে তাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা। কিন্তু আমাদের থাকবে না সে শক্তি। যে-কোনও সময়ে আসবে চিন বা রাশার তরফ থেকে হামলা।

আর এসব স্ফটিকের কী ভূমিকা এসবের ভেতর?

ওগুলো রয়েছে সঠিক সময়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ মহাশূন্যে পাচার করে দেয়ার জন্যে, যাতে ছিঁড়ে না যায় পৃথিবীর ওপরের রাবার ব্যাণ্ড, বললেন ব্রায়ান। কিন্তু গণ্ডগোল দেখা দিল রাশার ওই স্ফটিক বিস্ফোরিত হওয়ায়।

অবশ্য, এমন হবে ভেবেছিলেন অতীতের মায়ান বিজ্ঞানীরা। তাই আমরা স্ফটিক সরিয়ে নিলেও নিজেদের ভেতর ছিল ওগুলোর তথ্য আদান-প্রদান। লাইটনিং রডের মত যে যার ভাগের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ নিরাপদে পাঠিয়ে দিয়েছে মহাশূন্যে। কিন্তু এসব স্ফটিক কাজ করবে শুধু মাটির ওপরে তুললে। একটা আছে মেক্সিকোতে। আমাদের কাছে একটা।

চুপ করে আছেন প্রেসিডেন্ট।

থমথম করছে ঘর।

এমন কী নিশ্চুপ ব্রায়ান। জানেন না, ঠিকভাবে বোঝাতে পেরেছেন কি না কমাণ্ডার ইন চিফকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, সাধ্যমত তো করলাম!

আপনারা সবাই আপাতত ল্যাব থেকে বাইরে যান, কিছুক্ষণ পর বললেন প্রেসিডেন্ট, আমি ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে চাই এনআরআই চিফের সঙ্গে।

ব্রায়ানের পাশেই বসেছেন ক্যাথিবা আলিহা। আঙুরের রসের বোতল নিয়ে উঠে পড়লেন। নরম সুরে বললেন, ভালই শোচালালেন।

ওই কথা শুনে ব্রায়ানের মনে হলো, বিজ্ঞানী বুঝে গেছেন, ভাল লড়েও হেরে গেছেন তিনি।

একে একে ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেলেন অন্যরা। সবার শেষে সিআইএ চিফ ক্যালাগু। দরজা বন্ধ করার আগে বিষ চোখে দেখলেন ব্রায়ানকে। যদি পারতেন, গুলি করে পাগলা কুকুরের মত করে খুন করতেন জন্মের শত্রুকে।

.

৪৯.

 আকাশের দুই ড্রোন মিলে কয়েকটা বোল্ডারের মাঝে গেঁথে ফেলেছে রানাকে। কী করবে ভাবছে ও, এমনসময়, দেখল পৌঁছে গেছে তিনটে ভারী হেলিকপ্টার। নেমে পড়ল ওগুলো দুই টিলার মাঝে সমতল জমিতে।

সামনের হেলিকপ্টার থেকে নামল সশস্ত্র একদল লোক। সংখ্যায় হবে কমপক্ষে বিশজন! দ্বিতীয় হেলিকপ্টার থেকে নামল খচ্চরের মত দেখতে বেশ কয়েকটা জন্তু।

ওগুলো আবার কেন?

 চোখে বিনকিউলার তুলল রানা।

খচ্চর নয় ওগুলো!

অদ্ভুত কোনও মেশিন! চার পা খচ্চরের মতই, কিন্তু মাথার জায়গায় মেশিনগানসহ টারেট!

পিছিয়ে পড়ল সশস্ত্র আর্মি, তাদের আগে আগে হাইড্রলিক পায়ে হেঁটে আসতে লাগল যন্ত্রমানবরা! টারেটের মাথা দুলছে এদিক-ওদিক!

ছয়জন, গুনল রানা। গলা শুকিয়ে গেল ওর। যন্ত্রমানব কাছে আসার আগেই ভাগতে হবে এখান থেকে!

দুই বোল্ডারের মাঝে অ্যাসল্ট রাইফেল রেখে সাইট স্থির করল সামনের যন্ত্রমানবের ওপর। ট্রিগার টিপতেই দুই সেকেণ্ড পর বুলেট লাগল বুকে, ছিটকে উঠল লালচে ফুলকি, হোঁচট খেল যন্ত্রমানব। পড়তে গিয়েও সামলে নিল তাল। লম্বা লম্বা পায়ে উঠে আসছে ঢালু জমি বেয়ে।

আবারও গুলি করল রানা। ফলাফল একই। এবার সুইচ টিপে ফুল অটোমেটিকে নিয়ে কয়েক পশলা গুলি করল ও।

মাটিতে পড়ল এক যন্ত্রমানব। ক্ষতি হয়েছে সামনের পায়ের। পেছনের দুই পা এখনও ঠেলছে এগোবার জন্যে। রানার দিকে ঘুরল অন্য পাঁচ যন্ত্রমানব, পরক্ষণে এল একরাশ বুলেট। ছিটকে উঠল রানার সামনের বোল্ডারে লেগে।

ডাইভ দিয়ে একটু দূরের জমিতে পড়ল রানা। ক্রল করে সরে গেল পনেরো ফুট। কয়েকটা বোল্ডারের মাঝ দিয়ে দেখতে চাইল অগ্রসরমাণ দানবগুলোকে। কিন্তু ওর জন্যেই যেন তৈরি ছিল তারা। উঁকি দিতেই আরেক পশলা গুলি এসে লাগল সামনের বোল্ডারে।

রানার জানা নেই, কেমন সেন্সর ব্যবহার করছে। যন্ত্রমানবরা। হয়তো হিট সেন্সর, মোশন ডিটেক্টর, শেপ রেকগনিশন সফ্টওয়্যার ঘটনা যাই হোক, খুব ভালভাবেই জানে ওর বর্তমান অবস্থান।

শিলাবৃষ্টির মত চারপাশে লাগছে অজস্র বুলেট। আবারও সরে কাভার নিল রানা। সবচেয়ে বড় বোল্ডারে ঠেকিয়ে নিল পিঠ। বুঝে গেছে, এবার আর রক্ষা নেই ওর!

বিদঘুটে ঠক-ঠক-ক্যাঁচ শব্দে উঠে আসছে পাঁচ যন্ত্রমানব!

.

ঝড়ের গতি তুলে আকাশ চিরে চলেছে রাশান প্রকাণ্ড মিলিটারি গানশিপ হিন্দ-ডি। গানারের সিটে মিতা। একহাত গান কন্ট্রোল জয়স্টিক-এর ওপর, চাইলেই ব্যবহার করতে পারবে ৩০ এমএম কামান। আরও আছে এক র‍্যাক ভরা এয়ার-টু-গ্রাউণ্ড মিসাইল।

পুরো আড়াই শ নট গতি তুলেছে হিন্দ। টপ স্পিড।

মৃদু কম্পন এয়ারফ্রেম জুড়ে। হেলিকপ্টারের তুমুল বেগ ও প্রচণ্ড শক্তির জন্যে নিজেকে ক্ষমতাশালিনী মনে হচ্ছে মিতার। যেন প্রাচীন এক জেনারেল, বিশাল স্ট্যালিয়নে চেপে চলেছে মহাযুদ্ধে!

হিন্দ-ডি আকাশে তোলার আগে মিতাকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে ইগোর দিমিতভ, কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সব অস্ত্র। এখন টার্গেট যোন-এর কাছে পৌঁছে গেছে ওরা।

শত্রু ঘায়েল করতে তৈরি মিতা। এই জিনিস এ দেশে আনলেন কী করে? জানতে চাইল ইন্টারকমে।

বড় বাজেটের রাশান সিনেমা করছি, তাই এই জিনিস না আনলে চলবে? কাভার হিসেবে মন্দ নয়, বলল ইগোর দিমিতভ।

ঘাবড়ে গিয়ে জানতে চাইল মিতা, কামানের গোলা আর মিসাইল নকল না তো?

পেট কাঁপিয়ে হাসল দিমিতভ। উষ্ণ সুরে বলল, ভয় নেই, নিশ্চিন্তে থাকুন।

রকেটের গতি তুলে তৃতীয় টিলা পেরোল ওরা। সামনের দৃশ্য দেখা গেল হেলিকপ্টারের রেইডার স্কোপে।

আকাশে উড়ছে একটা স্কাইক্রেন। ওটার দিকে বাঁক নিল দিমিতভ।

টার্গেটিং ডিসপ্লের হলদের বদলে জ্বলে উঠল সবুজ বাতি। ফায়ার বাটনে চাপ দিল মিতা। থরথর করে কাঁপল গানশিপ। মস্ত ভ্রমরের ভারী গুঞ্জন তুলে ঘুরছে কামান, কয়েক সেকেণ্ডে ওটা থেকে ছিটকে গেল অন্তত এক শ গোলা।

আকাশে বাঁকা পথে গিয়ে স্কাইক্রেনের গায়ে বিঁধল একঝাঁক ট্রেসার। প্রতিটি জ্বলন্ত মার্কারের পর গেছে দশটি বিস্ফোরক গোলা। উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে ভুস্ করে বেরোল কুচকুচে কালো ধোঁয়া, পরক্ষণে প্রচণ্ড আওয়াজে বিস্ফোরিত হয়ে ঝরঝর করে মাটিতে পড়ল হাজারো টুকরো।

পরের টার্গেট খুঁজল উত্তেজিত মিতা।

.

খচ্চরের মত দেখতে অত্যাধুনিক সমরযন্ত্রে চেপে আসছে ল্যাং এর পাঁচ মার্সেনারি। চারপাশে শত শত গুলি লাগছে বলে মাটিতে শুয়ে আছে অসহায় রানা। কিছুই করার নেই। ভাবছে কীভাবে বেরোবে এই গাড়া থেকে। এমনসময় টিলা বেয়ে উঠে এল বজ্রপাতের মত বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ।

কানে ঝিঁঝি ধরে গেল রানার। চোখের কোণে দেখল, পুবে কমলা আগুনের মস্ত এক ফুটবল। কয়েক সেকেণ্ড আগেও ওটা ছিল স্কাইক্রেন হেলিকপ্টার।

হঠাৎ কেন বিধ্বস্ত হলো ওটা?

তখনই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিচের ক্যানিয়নের দেয়ালে খসে পড়ল দুই ড্রোন।

আর কিছু জানতে চাইল না রানা, মাটি ছেড়ে তীরের বেগে ছুটল টিলার চূড়ার দিকে।

কয়েক ঘণ্টা আগে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক প্রচণ্ড ঢেউয়ের সঠিক সময় জানিয়ে দিয়েছেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান।

ফুরিয়ে আসছে রানার রোলেক্স ঘড়ির কাউন্ট ডাউন।

হাতে আছে মাত্র দশ মিনিট!

.

চলে গেছে সিআইএ চিফ মার্ল ক্যালাগু এবং অন্যরা। দরজা বন্ধ হওয়ার আগে এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান দেখলেন রকেট স্লেড। ধ্বংসের ওই যানে শুয়ে আছে মিসাইল। টেকনিশিয়ানরা তৈরি নির্দেশের জন্যে। একটু পর স্ফটিক নিয়ে পাহাড়ের নির্জন এক এলাকায় বিস্ফোরিত হবে রকেট।

তুমি বুঝতে পারছ, কীসের ভেতর আমাদেরকে ফেলেছ, জেমস? ধমকের সুরে বললেন প্রেসিডেন্ট।

আমি? আমি কী করলাম?

স্ফটিক ধ্বংস করতে যে মিটিং ডাকা হয়েছে, সেখানে ছিলে না। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সারারাত কোনও বার-এ বসে মদ গিলেছ। এখন হাজির হয়েছ পৃথিবীর কোর-এর ফালতু থিয়োরি নিয়ে।

নিজের এলোমলো পোশাক ও চেহারা সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান আছে মিস্টার ব্রায়ানের। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। চোখের নিচে কালির মত দাগ। পুরো দেড় দিন পাল্টাননি বাসি, নোংরা কাপড়চোপড়।

না ঘুমিয়ে সারারাত কাজ করেছি, যেন…

তাকে থামিয়ে দিলেন প্রেসিডেন্ট, সমস্যার শেষ নেই তোমার! ক্যালাগুর কাছে শুনলাম, মোটেও ঘুমাও না?

চুপ করে থাকলেন ব্রায়ান।

যখন মিটিঙে ঠিক সময়ে এলে না, তোমার স্টাফদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি সুস্থ আছ কি না, বললেন প্রেসিডেন্ট। মিথ্যা বলেনি ওরা। মাসের পর মাস ধরে মিথ্যা আশায় সময় নষ্ট করেছ। উচিত ছিল না দেশকে এত বড় বিপদে ঠেলে দেয়া।

মিস্টার প্রেসিডেন্ট, জেনে বুঝে…।

নরকের ওই স্ফটিক এ দেশে এনেছ, তাতেই শখ মেটেনি, লোক পাঠিয়ে দিয়েছ আরও ওই জিনিস খুঁজতে, ধমকের সুরে বললেন প্রেসিডেন্ট। মানা করেছিলাম, যাতে মিতা দত্তকে উদ্ধার করতে গিয়ে বিপদে না পড়ো। বারবার ঝুঁকি নিয়েছি তোমার জন্যে। অথচ একবারের জন্যে বোঝোনি, তোমার উচিত নয় আমার কাছে মিথ্যা বলা।

আপনাকে বোঝাতে চেয়েছি…

মিথ্যা বন্ধ করো, জেমস! সবাইকে মস্ত ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছ! এতে হয়তো ক্ষতি হবে গোটা দুনিয়ার! আমি জানতে চাই, কেন এসব করলে তুমি!

মিস্টার প্রেসিডেন্ট…

কেন! ধমকে উঠলেন সিনিয়র বন্ধু। কিছু গোপন করছ!

কিছুই…

প্রেসিডেন্টের চেহারায় ফুটে উঠেছে প্রচণ্ড ক্রোধ। আড়ষ্ট কণ্ঠে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে, এবার অবসর নেবে এনআরআই চিফের পদ থেকে। কয়েক সেকেণ্ড বিরতির পর অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় জানালেন, ক্যালাগুকে আমার সামনে আসতে বলো।

 .

৫০.

 রাশান গানশিপের কামান লাল আগুন উগরে দিতেই মিতা দেখল, গোলার প্রচণ্ড আঘাতে ছিঁড়ল দ্বিতীয় স্কাইক্রেনের পাতলা দেহ। ফিউজেলাজ ভেদ করে টেইল রোটর উপড়ে নিয়েছে, ফলে কয়েক টুকরো হয়ে টিলার ঢালে পড়ে বিস্ফোরিত হলো কপ্টার।

তৃতীয়টা পালিয়ে যাচ্ছে, বলল ইগোর দিমিতভ। ঘুরে গেছে শেষ উড়ন্ত শত্রুর দিকে।

বাদ দিন, বলল মিতা। টিলায় উঠছে ল্যাং-এর লোক।

হিন্দ-ডির ক্যামেরায় রয়েছে টেলিস্কোপিক লেন্স, ওটা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যায় চারপাশ। ফলে বন্ধু বা শত্রু চেনা সহজ। টেলিস্কোপিক লেন্স ব্যবহার করে জমিতে শুধু ল্যাং-এর লোক এবং যান্ত্রিক কয়েকটা খচ্চর দেখল মিতা।

সর্বনাশ! বলল ফিসফিস করে।

ইন্টারকমে শুনতে পেয়ে জানতে চাইল ইগোর, এদের আশপাশে নেই তো মাসুদ রানা?

কেউ বা কিছুর পেছনে ছুটছে ল্যাং-এর মার্সেনারি আর্মি। একটু পর উঠে পড়বে টিলার চূড়ায়।

না, নেই, তবে জিজ্ঞেস করছেন কেন? পাল্টা জানতে চাইল মিতা।

কারণ, আমরা সামনের জমি পেছনে ফেললে, তখন আর জীবিত কিছুই থাকবে না।

বুঝলাম। প্রতিশোধ নেবেন ভাইয়ের মৃত্যুর।

পঞ্চাশ ডিগ্রি বাঁক নিল ইগোর দিমিতভ। সরাসরি সামনে পড়বে একদল মার্সেনারি ও যন্ত্রমানব। নাক নিচু করে তাদের দিকে তেড়ে গেল হিন্দ-ডি। কামান তৈরি রাখল মিতা।

পেছনে বাজ পড়া আওয়াজে চমকে ঘুরে তাকাল ল্যাং-এর আর্মি। দেরি হলো না গানশিপের দিকে গুলি পাঠাতে।

ওদিকে কামানের ট্রিগার টিপে ধরেছে মিতা। একইসময়ে আকাশে ছাড়ল এয়ার-টু-গ্রাউণ্ড একরাশ মিসাইল।

ঘুরন্ত কামান থেকে প্রতি পাঁচ সেকেণ্ডে বেরোচ্ছে এক শ গোলা। এদিকে ডান ও বামে টার্গেট করা জমিতে আঘাত হানল মিসাইল। প্রচণ্ড সব বিস্ফোরণে কাঁপতে লাগল চারপাশ। নানা দিকে লাফ দিল কমলা আগুন। জ্বলন্ত পাথর ও মাটির সঙ্গে মিশে ছিটকে উঠল ছিন্নভিন্ন মানুষের পোড়া মাংস।

ওই এলাকা পেরিয়ে ধোয়া ও আগুন থিতিয়ে আসবে বলে থেমে অপেক্ষা করল হিন্দ-ডি।

তখনই মিতা দেখল, রয়ে গেছে আরেকদল লোক। বামদিকে! বলে উঠল ও। টেন ও ক্লক! সাবধান!

হিন্দ-ডি সরিয়ে নেয়ার আগেই এল প্রতিপক্ষদের গুলি। কিন্তু জমির খুব কাছে নেমে যুদ্ধের জন্যে তৈরি করা হয়েছে হিন্দ-ডি গানশিপ। শক্তিশালী রাইফেলের গুলি অনায়াসে ছিটকে দিল ওটার আর্মার। তবে অন্য জিনিস রকেট-প্রপেল্ড গ্রেনেড। ফাটল মিতাদের মাথার ওপরের রোটরে।

উইণ্ডশিল্ড ভরে গেল তপ্ত তেল ও লেলিহান আগুনে। ভক্ করে ককপিটে ঢুকল একরাশ কালো ধোঁয়া। চাকা হারিয়ে বসা ছুটন্ত গাড়ির মত হোঁচট খেল গানশিপ।

ওটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইল দিমিতভ। কিন্তু ভালভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রোটর।

চিৎকার করল প্রাক্তন এজেন্ট, শক্ত হাতে কিছু ধরুন!

পানি থেকে ওঠা বিরক্ত কুকুরের মত বারকয়েক ঝটকা দিল গানশিপ, তারপর এক পাশে কাত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলল মাটি লক্ষ্য করে।

.

ব্যক্তিগত স্কাইক্রেনে বসে রাশান গানশিপ পড়তে দেখল হুয়াং লি ল্যাং। ভাল লড়াই করেছে তার লোক। ঘুরে এগিয়ে যাও, পাইলটকে নির্দেশ দিল সে।

লোক তুলে নেব?

না, পেরিয়ে যাও টিলার চূড়া।

মেসার ওপর এক লোককে দেখেছে ল্যাং।

 লম্বা লম্বা পায়ে ছুটছে ওইবদমাশ।

ওই লোককে চাই! গর্জে উঠল ল্যাং, ধাওয়া করে ধরো ওকে!

লক্ষ্যবস্তু পেয়ে হেলিকপ্টারের গতি বাড়াল পাইলট। ভীত কণ্ঠে বলল, কিন্তু আমাদের কাছে তো কোনও অস্ত্র নেই!

ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়ে চেঁচাল ল্যাং, ওর কাছে নিয়ে যাও, নিজের হাতে খুন করব ওকে!

.

অন্ধকারাচ্ছন্ন ইয়াকা মাউন্টেনের গভীর সুড়ঙ্গে দাঁড়িয়ে ট্রেইলার থেকে এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ানকে নামতে দেখলেন সিআইএ চিফ মার্ল ক্যালাগু। তার শত্রুর কাঁধে বেকায়দাভাবে ঝুলছে কোঁচকানো সুট জ্যাকেট। স্লথ গতি হাঁটার। যাক, ভাল, শেষপর্যন্ত ব্যাটা হেরে গেছে, ভাবলেন ক্যালাগু।

প্রেসিডেন্ট কী বললেন? জানতে চাইলেন। ভাল করেই জানেন, যিরো আওয়ার আসতে বাকি মাত্র পাঁচ মিনিট।

আপনিই জিতলেন, রকেট স্লেডের দিকে মাথা কাত করে ক্লান্ত স্বরে বললেন ব্রায়ান, তৈরি রাখুন ওটা।

মস্ত রেকার টো ট্রাকের দিকে চলেছেন। ওই জিনিসই টেনে এনেছিল ট্রেইলার।

 ব্রায়ানের দিকে চেয়ে আছেন ক্যালাগু, মুখে মুচকি হাসি। বিশাল জয় পেয়েছেন আজ! স্টাফদের দিকে ফিরলেন তিনি। বাকি চার মিনিট। স্লেড রেডি রাখো। কাজ শেষ করতে হবে দেরি না করে।

ট্রেইলারে গিয়ে উঠলেন ক্যালাগু। চোখ পড়ল মনিটরের ওপর।

চেহারায় গনগনে রাগ নিয়ে তাঁকে দেখলেন প্রেসিডেন্ট। এত সময় নিলেন কেন!

ব্রায়ান এইমাত্র জানালেন, বললেন ক্যালাগু, এবার আগামী দুমিনিটের ভেতর ধ্বংস হবে ওই স্ফটিক।

গুড। কাজটা শেষ হলে আমাকে জানাবেন।

ক্যামেরার সামনে থেকে সরে গেলেন প্রেসিডেন্ট। অফ হয়ে গেল স্ক্রিন। ল্যাব সেকশনের দরজা খুলে ভেতরে পা রেখে চমকে উঠলেন ক্যালাগু। ভেতরে জ্বলছে না বাতি। আলো আসছে শুধু কমপিউটারের স্ক্রিন থেকে।

ফটিক দেখার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে গিয়ে আরেকটু হলে হোঁচট খেয়ে পড়তেন ক্যালাগু।

আরে, কী ব্যাপার?

নিচে চেয়ে দেখলেন আঙুরের রসের ভেতর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছেন বিজ্ঞানী ক্যাথিবা আলিহা। প্রায় অচেতন। কপালে কালশিটে।

কী হয়েছে? চমকে গিয়ে জানতে চাইলেন ক্যালাগু।

গুঙিয়ে উঠে চোখ মেললেন বিজ্ঞানী। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই বুঝে গেলেন ক্যালাগু। লাফ দিয়ে উঠলেন প্ল্যাটফর্মে। ভল্টে এখন আর নেই ব্রাযিল স্টোন!

আহত বিজ্ঞানীকে সাহায্য না করেই এক দৌড়ে ট্রেইলের সামনের অংশে ফিরলেন ক্যালাগু, পরক্ষণে দরজা খুলে ছিটকে বেরিয়ে এলেন দীর্ঘ সুড়ঙ্গে।

গুড়গুড় আওয়াজ তুলে দূরে ছুটছে বক্স ট্রাক। ওটাতে আছে। এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান!

ঠেকাও ওই ট্রাক! চিলচিৎকার ছাড়লেন ক্যালাগু, ব্রায়ানের কাছে ব্রাযিল স্টোন!

.

৫১.

পেছনে কারা যুদ্ধে মেতেছে, দেখার সময় নেই রানার। টিলার চূড়ায় উঠেই থমকে গেল। সামনেই মস্ত হাঁ মেলেছে বিশাল এক বৃত্তাকার গহ্বর। ঢালু দেয়াল নেমেছে অন্তত তিন শ ফুট। এত ওপর থেকে মনে হলো, ওটা উন্মুক্ত খনির প্রকাণ্ড মুখ। নিচে গিয়ে ঢালু দেয়াল মিশেছে নিথর জলের সুনীল এক লেকে।

নামতে হবে, বিড়বিড় করল রানা।

লেকের মাঝে বিশ ফুট বৃত্তাকার, পাথুরে, সমতল ছোট্ট দ্বীপ। আর্কিওলজিস্ট প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন গতরাতে বলেছিলেন ওটার কথা। লেক ছুঁড়ে উঠেছে। এক পাশের সিঁড়ি নেমেছে লেকের জলে। সাঁতরে গিয়ে উঠতে হবে ওই দ্বীপে।

চারপাশে চোখ বোলাতেই একটু দূরে সরু একটা পথ দেখল রানা। কিন্তু ওই পথে যাওয়ার সময় ওর হাতে নেই। ঢালু দেয়াল বেয়ে পিছলে নামল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর থামল প্রায় খাড়া এক জায়গায়। তখনই বজ্রপাতের আওয়াজ তুলে মাথার ওপর স্থির হলো কী যেন!

মুখ তুলে তাকাল রানা, টিলা টপকে হাজির হয়েছে ল্যাং এর স্কাইক্রেন হেলিকপ্টার। খুলে গেছে দরজা। এবার ওকে গেঁথে ফেলবে ইপার। কিন্তু বিস্মিত হলো রানা। দরজায় থেমেছে রুপালি চকচকে আমার পরা এক লোক!

কিছু ভাবার আগেই তিরিশ ফুট ওপর থেকে লাফিয়ে ভারী পাথরের মত নেমে এল সে। রানা সরার আগেই দুজনের বুকে লাগল বেকায়দা ধাক্কা। ভারসাম্য হারিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল ওরা!

.

গানশিপ নিয়ন্ত্রণে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ইগোর দিমিতভ, কিন্তু সর্বনাশ হয়েছে ইঞ্জিনের। বিকট জোরালো ধুপ শব্দে মেসার ঘাসে পড়ে পঞ্চাশ ফুট পিছলে থামল হিন্দ-ডি।

সিটবেল্ট বাঁধা বলে ছিটকে উইণ্ডশিন্ডে পড়েনি মিতা। হার্নেস থেকে নিজে মুক্ত হয়ে খুলে দিল ইগোর দিমিতভের সিটবেল্ট। বিধ্বস্ত হেলিকপ্টার থেকে নেমে পড়ল দুজন। এদিকে চড়-চড় শব্দে পুড়তে শুরু করেছে হিন্দ-ডি।

বিশ ফুট যেতেই খেয়াল করল মিতা, খুঁড়িয়ে হাঁটছে ইগোর দিমিতভ। জানতে চাইল ও, আপনার কী হয়েছে?

মৃদু মাথা নাড়ল রাশান। ভেঙে গেছে ডান গোড়ালি। আমার লড়াই শেষ।

উপত্যকার যেদিকে দেখেছে ল্যাং-এর লোক, ওদিকে তাকাল মিতা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, আপনার পিস্তলটা দিন।

বিনা-বাক্যে কোমরে গোঁজা ম্যাকারভ মিতার হাতে দিল ইগোর দিমিতভ।

ক্রল করে পৌঁছে বোল্ডারের মাঝ দিয়ে উঁকি দিল মিতা। বুকে টের পেল স্বস্তির ঝিরঝিরে ঢেউ। ফিরতি পথে চলেছে ল্যাং-এর লোক। যুদ্ধ শেষ তাদেরও।

আবারও ইগোর দিমিতভের কাছে ফিরল মিতা। এদিকটা নিরাপদ। অপেক্ষা করুন। কাজ শেষ হলে রানাকে নিয়ে ফিরব। তারপর দেখব ভাঙা গোড়ালির কী করা যায়।

আপনার যেতে হবে টিলার পশ্চিমে।

ওদিকে তাকাল মিতা। এক হাজার গজ দূরে টিলার চূড়ায় ভাসছে তৃতীয় স্কাইক্রেন হেলিকপ্টার। আকাশে ঘুরছে শামুকের গতি তুলে। ওদিকে কোথাও নেই রানা। তবে ওর আর ভাসমান হেলিকপ্টারের মাঝে মেসা ধরে ছুটছে খুব ছোট কেউ! উচ্চতা তার তিন ফুট!

পিচ্চি পাবলো!

.

পুরো এক শফুট পিছলে ও গড়িয়ে এবড়োখেবড়ো কিছু পাথরের সরু এক কার্নিশে থামল রানা। পাশেই হুয়াং লি ল্যাং!

সামনে বেড়ে আছে কার্নিস। সরাসরি দু শফুট নিচে নীল লেক।

একইসময়ে পাথুরে জমি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা ও ল্যাং।  

লাফ দিয়ে এগোল রানা। হামলাকারীর বুকে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসাল। কিন্তু ওটা অনায়াসে ঠেকাল শত্রুর আমার পরা কবজি। পরক্ষণে ঘুষি মারল লোকটা।

ওটা ভীষণ মারাত্মক!

ভুস করে বেরোল রানার বুকের সমস্ত বাতাস। টলতে টলতে পা পিছলে চিত হয়ে পড়ল ও। জীবনে অনেক লড়াই করেছে, কিন্তু আগে জানত না কেউ এত ব্যথা দিতে পারে!

ল্যাং-এর শক্তি ভবিষ্যতের দানবীয় কোনও রোবটের মত!

ধড়মড় করে উঠে সরতে চাইল রানা। কিন্তু সামনে বেড়ে খপ করে ওর কলার চেপে ধরল লোকটা। পরক্ষণে তুলে ফেলল শূন্যে।

ভেজা বেড়ালের মত করুণভাবে ঝুলছে রানা। বিস্মিত চোখে দেখল, ভঙ্গুর দেহের লোক হুয়াং লি ল্যাং। কিন্তু নানাদিকের হাইড্রলিক অ্যাকচুয়েটর, প্যাডিং ও আর্মার তাকে করে তুলেছে খেপা মোষের মতই শক্তিশালী।

তুমি আসলে খুব সামান্য মানুষ, কর্কশ স্বরে বলল লোকটা।

সত্যি কথা, হাড়ে হাড়ে বুঝেছে রানা। ঝুলতে ঝুলতে ঘুষি মারল শত্রুর ঘাড়ের পাশে। কিন্তু আরেক হাতে মুহূর্তে ঘুষি ঠেকিয়ে দিল ল্যাং। নির্বিকার সুরে বলল, যা চাই, ওটা দিয়ে দাও। তা হলে সহজে মরতে পারবে।

মরতে চাই কে বলল তোমাকে? দাঁতে দাঁত চেপে লোকটার অণ্ডকোষ লক্ষ্য করে কষে লাথি ছুঁড়ল রানা।

খটাং শব্দে লাগল জায়গা মত!

কিন্তু রানার মনে হলো পায়ের টনটনে ব্যথায় দুভাজ হবে ও সংবেদনশীল অঙ্গ স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে বাঁধিয়ে এসেছে হারামজাদা আধা রোবট ব্যাটা!

দাও ওই স্ফটিক! কড়া ধমক দিল হুয়াং লি ল্যাং।

লজ্জাজনকভাবে হেরে গেছে অসহায় রানা। নরম সুরে বলল, আগে পিঠ থেকে নামাতে হবে ব্যাকপ্যাক।

ধপ করে ওকে সামনে নামাল ল্যাং। কই?

পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাক খুলল রানা, পরক্ষণে ল্যাং-এর কানের তিন ইঞ্চি দূর দিয়ে ওটা ছুঁড়ল সংকীর্ণ কার্নিশে। বদমাশটাকে পাশ কাটিয়েই ঝেড়ে দৌড় দিল। এবার ব্যাকপ্যাক তুলে নিয়েই একটু দূরের ঢালু দেয়াল বেয়ে সরসর করে নামবে। তুলল ওটা…।

কিন্তু ঝড়ের গতি শক্রর। ঘুরেই ল্যাং মারল হুয়াং লি ল্যাং!

কিছু বোঝার আগেই হোঁচট খেল রানা। তাল হারিয়ে খসে পড়ল কার্নিশের কিনারা থেকে!

আঁকড়ে ধরেছিল বলে সঙ্গে চলেছে স্ফটিক রাখা ব্যাকপ্যাক।

দুই শ ফুট নিচে লেকের সুনীল জল!

সাঁই-সাঁই করে নামছে রানা। কানের পাশে শোঁ-শোঁ শব্দ!

এদিকে প্রচণ্ড রাগে কর্কশ একটা গর্জন ছাড়ল হুয়াং লি ল্যাং।

সামান্য লোক মাসুদ রানা ঠকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার স্কটিক!

 বিশাল লাফে কিনারা পেরিয়ে গেল সে, চলেছে সোজা লেক লক্ষ্য করে!

কসেকেণ্ড পর বুঝল, দুশ ফুট উঁচু কার্নিশ থেকে পড়েই তীরের মত লেকের জলে তলিয়ে গেছে রানা!

স্বচ্ছ কাঁচের মত জলে এখন অসংখ্য বৃত্তাকার ঢেউ!

 তিন সেকেণ্ড পর একই আলোড়ন তৈরি করল ল্যাং।

ওদিকে লেকের পঞ্চাশ ফুট নিচে তলিয়ে গেছে রানা। ওপরে শুনেছে জোরালো, ভোতা ঝপাৎ শব্দ। হাল ছাড়েনি চাইনিজ দানব! রানা বুঝে গেছে, বাঁচতে হলে সরে যেতে হবে। তবে নড়ার আগেই দেখল, হাজির হয়েছে ল্যাং!

তার আর্মার সুট ওঅটারপ্রুফ!

ওপরে উঠতে প্রাণপণে দুপা ছুঁড়ল রানা।

কিন্তু হাত বাড়িয়ে ওর গোড়ালি ধরে ফেলেছে চাইনিজ বিলিয়নেয়ার।

বাম পায়ে তার ঘাড়ে দুর্বল লাথি মারল রানা। দম ফুরাবার আগেই উঠতে হবে ওপরে!

একই কাজ করত হুয়াং লি ল্যাং, কিন্তু আর্মার, হাইড্রলিক ও ব্যাটারি প্যাক-এর ভারী ওজন কমপক্ষে এক শ পাউণ্ড!

গোড়ালি খামচে ধরে রানাকে টেনে নিয়ে ভারী পাথরের মত চলল সে লেকের তলদেশে!

.

হামভিতে চেপে জেমস ব্রায়ানের পিছু নিয়েছে সিআইএ চিফ মার্ল ক্যালাগু। পেছনের এয়ার ফোর্সের এসপির উদ্দেশে ঘেউ করে উঠল, গুলি কর! খুন কর, শালা, হারামজাদাকে!

হামভির পাশ দিয়ে রাইফেলের নল বের করে গুলি করল সৈনিক। কিন্তু ট্রাকের ক্যাবের পেছনে ব্রাযিল স্টোন রাখার ভারী ভল্ট। রাইফেলের গুলির সাধ্য নেই লক্ষ্যভেদ করবে, স্টিলের দেয়ালে লেগে নানান দিকে ছিটকে পড়ছে ঠুং-ঠাং শব্দে।

তুমুল বেগে ছুটছে দ্বিতীয় হামভির ড্রাইভার। গুলির জন্যে খুঁজছে ভাল অ্যাংগেল। কিন্তু বারবার ট্রাক এদিক-ওদিক সরিয়ে নিচ্ছেন ব্রায়ান। মস্ত ট্রাকের লেজ দিয়ে টানেলের দেয়ালে পিষে দিতে চাইলেন হামভিটাকে।

অন্ধকার সুড়ঙ্গে ছিটকে উঠল কমলা ফুলকি।

নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল হামভি, তিন গড়ান দিয়ে লাগল গিয়ে ওদিকের দেয়ালে। তার আগে ধাক্কা দিয়েছে ক্যালার হামভির নাকে।

কাত হতে শুরু করেও শেষ মুহূর্তে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে সামলে নিল ক্যালাপুর ড্রাইভার। পেছনে ফেলে এল বিধ্বস্ত হামভি। এই ধাওয়ায় অংশ নিয়েছে তৃতীয় হামভি। কিন্তু ঝড়ের গতি তুলে ছুটে চলেছেন ব্রায়ান। গতি আরও বাড়ছে ট্রাকের।

চাকা লক্ষ্য করে গুলি! গলা ফাটাল ক্যালাণ্ড। থামাতে হবে হারামজাদাকে, নইলে আমরা সবাই শেষ!

তার কথা শেষ হতে না হতেই গোটা কমপ্লেক্স জুড়ে শুরু হলো কর্কশ অ্যালার্ম। ওটা ছাপিয়ে এল কমপিউটারাইড় এক নারীর মিষ্টি কণ্ঠ: One minute to EM Burst Event. Shut down all electrical systems. Repeat, shut down all electrical systems.

হামভির ক্যাবে আছে ডিজিটাল রিডআউট। চট করে ওটা দেখল ক্যালাগু। মরা কাঠের মত শুকিয়ে গেল গলা।

সুড়ঙ্গের মাঝে রিনরিনে নারীকণ্ঠ অনুত্তেজিত স্বরে বলল, Fifty-five… fifty-four… fifty-three.

ক্যালাগু দূরে দেখল সুড়ঙ্গের মুখে ঝকঝকে সাদা আলো।

 ওখানে কোনওভাবেই পৌঁছুতে দেয়া যাবে না ব্রায়ানকে!

বন্ধ করো দরজা! রেডিয়োতে চিৎকার ছাড়ল ক্যালাপ্ত, বন্ধ করো নরকের দরজা!।

.

টাইটানিক জাহাজের গতি তুলে তলিয়ে চলেছে রানা। টের পাচ্ছে চাপ বাড়ছে কানের ওপর। খামচে ধরতে চাইল একটু দূরের খাড়া দেয়াল। কিন্তু মসৃণ এ্যানেট পাথরে নেই ফাটল বা ভাঁজ!

রানার গোড়ালি শক্ত করে ধরেছে ল্যাং-এর যান্ত্রিক হাত। নেমে চলেছে ওরা নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে!

মুক্ত পায়ে ল্যাং-এর বুকে লাথি মারল রানা। কিন্তু তাতে ওই পা-ও ধরতে চাইল দানবটা। সফল হলো না দুজনের কেউই। পাথরের মত নেমে এল ওরা লেকের পাথুরে তলদেশে। জোর ঝাঁকি লেগে ল্যাং-এর হাত থেকে ছুটে গেল রানার গোড়ালি। কিন্তু তখনই সামনে বেড়ে ওর গলা আঁকড়ে ধরল সে। এবার খুশিমনে ছিঁড়বে কণ্ঠনালী!

খুন হবে, বুঝে গেছে রানা। তবুও ব্যস্ত হয়ে ডানহাতে ধরল ল্যাং-এর ঘাড়ের পাশের হাইড্রলিক পাইপ, পরক্ষণে দিল হ্যাঁচকা টান।

সরু সব তার মোড়া পাইপ, ছিঁড়ল না।

রানার কণ্ঠনালীতে বাড়ল ল্যাঙের আঙুলের চাপ। সময় নিয়ে কষ্ট দিয়ে ওকে খুন করতে চায় লোকটা!

দুহাতের সমস্ত জোর খাঁটিয়ে মোড়ানো তার বিশ্রীভাবে মুচড়ে দিল রানা।

ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাইড্রলিক অ্যাকচুয়েটর সিস্টেম। খুলে গেল হুয়াং লি ল্যাঙের মুঠি। ওর পেটে একটা লাথি মেরে সরে গেল রানা। প্রাণপণে হাত-পা নেড়ে উঠে যেতে লাগল ওপরে। একটু পরেই ফুরাবে ফুসফুঁসের সব বাতাস। উঠতে উঠতে একবার তাকাল নিচে।

পাথুরে মেঝে ছেড়ে উঠে আসতে চাইছে হুয়াং লি ল্যাং। কসেকেণ্ড পর বুঝল, এত ওজন নিয়ে ভেসে ওঠা অসম্ভব। পাগল হয়ে উঠল সে। তাকাল মসৃণ দেয়ালের দিকে! ভয় পেয়েছে ভীষণ। তাড়াহুড়ো করে খুঁজতে চাইল অন্য উপায়। কিন্তু তার জন্যে খোলা নেই কোনও পথ। অসহায় চোখে তাকাল ওপরে।

ওই যে উঠে যাচ্ছে বদমাশ মাসুদ রানা!

এদিকে বুক আঁকড়ে আসছে রানার। অক্সিজেনের অভাবে যে-কোনও সময়ে জ্ঞান হারাবে। উঠছে পূর্ণ গতি তুলে।

পাঁচ সেকেণ্ড পর ভুস করে ভেসে উঠল গভীর লেকের খাড়া কিনারায়। বিষাক্ত কার্বন-ডাইঅক্সাইড ছেড়ে বুক ভরে নিল তাজা অক্সিজেনে। বিশ্রাম নেয়ার সময় নেই। রওনা হলো সেনোটের মাঝের দ্বীপ লক্ষ্য করে।

স্ট্যাটিকের চড়-চড়ে অনুভূতি, খুব শিরশির করছে শরীর। দুই মায়ান স্ফটিক শুরু করছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বিচ্ছুরণ। অস্থির হয়ে নাচছে লেকের জল। গভীর থেকে এল গুরুগম্ভীর আওয়াজ।

দ্বীপের পাশে সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গেল রানা। টলতে টলতে উঠে গেল ওপরে। পৌঁছুল মাঝের কূপের পাশে।

সামনেই প্রফেসরের সেই দেহ উৎসর্গের আয়না।

কূপের ভেতর চোখ বোলাল রানা। তলা থেকে আসছে ভীষণ কোনও কম্পন, ফলে ওর দেহ জুড়ে শুরু হয়েছে টনটনে ব্যথা। মাথার ভেতর ভয়ঙ্কর গুঞ্জন। ওর মনে হলো, সব ছাপিয়ে আসছে মস্ত, বিরাট এক ঢেউ।

চোখের কোণে কিছু নড়তে দেখল রানা। ঘুরে তাকাল তীরের দিকে। ঢালু পাথুরে দেয়াল বেয়ে নেমে আসছে পাবলো!

আরে! ছেলেটা এখানে এল কী করে?–ভাবল রানা।

পাবলো এসে থামল লেকের তীরে। হাত বাড়িয়ে পানি থেকে তুলে নিল রানার ভাসমান ব্যাকপ্যাক।

টান দিয়ে খুলছে ওটার চেন।

না, পাবলো! তীব্র ব্যথা সহ্য করে প্রাণপণে চেঁচাল রানা। সরে যাও!

কিছুই শুনল না পিচ্চি পাবলো। ব্যাগে ভরে দিয়েছে হাত। বের করে নিল সীসা দিয়ে বাঁধানো বাক্স। ওটা থেকে নিয়ে অবাক চোখে দেখল চকচকে স্ফটিক, যেন পেয়েছে স্বর্গীয় কিছু।

পরবর্তী আওয়াজের ঢেউ এল প্রচণ্ড বেগে। থরথর করে কাপল চারপাশ। প্রচণ্ড ব্যথার মধ্যেও পাবলোর দিকে চেয়ে আছে রানা। ছেলেটার অল্প দূরে দেখতে পেল মিতাকে। প্রায় দৌড়ে নেমে আসছে ও। চোখ পাবলোর ওপর।

আবারও এল ইলেকট্রোম্যাগনেটিক আরেকটি ঢেউ। এবার আরও ভয়ঙ্কর। জোরালো ভূমিকম্পে থরথর করে কাঁপল  দুনিয়া। ছোট্ট দ্বীপ ভাসিয়ে নিতে উঠে আসছে লেকের জলরাশি।

যেন চুরমার হচ্ছে গোটা পৃথিবী। প্রবল ভূকম্পনে ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে গেল রানা। ক্রল করে পৌঁছুল কূপের কপিকলের সামনে।

ওটা ব্যবহার করতে বলেছেন প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন।

.

তুমুল বেগে চলেছে প্রকাণ্ড ট্রাক, মেঝের সঙ্গে অ্যাক্সেলারেটর চেপে রেখেছেন ব্রায়ান। অবাক হলেন, বুজে আসছে সামনের আলো!

বন্ধ হচ্ছে ইয়াকা মাউন্টেনের সুড়ঙ্গের প্রকাণ্ড দুই কবাট!

Twenty-nine… twenty-eight… twenty-seven.

সুড়ঙ্গ মুখে এক পাশে রাখা খোঁড়ার মেশিনটা পেরিয়ে গেলেন ব্রায়ান। অনেকটা চওড়া হলো সুড়ঙ্গ। একইসময়ে বাম থেকে ক্যাবের পাশে পৌঁছুল দ্বিতীয় হামভি। বিশাল ট্রাক নিয়ে ওটার দিকে চেপে এলেন ব্রায়ান।

একরাশ গুলি ঢুকল ক্যাবে। গাল কুঁচকে ফেললেন ব্রায়ান। এইমাত্র উড়ে গেছে রিয়ার ভিউ মিরর। তার ডান বাহুতে লাগল একটা বুলেট। হাত থেকে ছুটে গেল স্টিয়ারিং হুইল।

তখনই হঠাৎ করে বিস্ফোরিত হলো ট্রাকের সামনের একটা চাকা। বাঁক নিল যন্ত্রদানব, তাল হারিয়ে কাত হয়ে পড়ল রাস্তার ওপর। কর্কশ ধাতব আওয়াজ তুলে হেঁচড়ে চলেছে প্রবেশ পথের দিকে। কিন্তু থেমে গেল এক্সিট ডোের থেকে বিশ ফুট আগে।

মিষ্টি সুরে জানাল কমপিউটারাইযড় নারীকণ্ঠ: Twenty three… twenty-two… twenty-one.

ভাঙা উইণ্ডশিল্ডের প্লাস্টিক মেশানো কাঁচ লেগে কেটে গেছে ব্রায়ানের মুখ, দরদর করে পড়ছে রক্ত। বুজে গেছে ডান চোখ। বাম চোখে বাইরে তাকালেন। ভাবলেন, এখনও একটা সুযোগ আছে!

মেঝে থেকে কোট তুলে ক্রল করে বেরোলেন বিধ্বস্ত ট্রাক থেকে। উঠে দাঁড়িয়ে চললেন একটু দূরের আলোর দিকে।

অ্যালার্মের তীব্র আওয়াজের ওপর দিয়ে শুনলেন: Nineteen… cighteen…

হঠাৎ এক পা-ও আর এগোতে পারলেন না ব্রায়ান। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন প্রায় বুজে আসা চোখে।

পেছন থেকে টাই টেনে ধরেছে সিআইএ চিফ ক্যালাগু। ভাব দেখে মনে হলো, এইমাত্র খুঁজে পেয়েছে অবাধ্য কুকুরকে।

দেরি করে ফেলেছ, কর্কশ স্বরে বলল ক্যালাগু। কেড়ে নিল ব্রায়ানের হাতের কোট! একইসময়ে ধুম করে ধাতব আওয়াজ তুলে বন্ধ হলো সুড়ঙ্গ-মুখের ভারী দুই স্টিলের কপাট।

দ্রুত হাতে ব্রায়ানের কোট সার্চ করল ক্যালাগু।

কিছুই নেই ভেতরে!

Fifteen… fourteen..

এখানেও কিছুই নেই! বিধ্বস্ত ক্যাব থেকে উঁকি দিল এক গার্ড।

কোথায় ওটা? চিৎকার করে জানতে চাইল ক্যালাগু।

করুণ চেহারায় তাকে দেখলেন পরাজিত ব্রায়ান। তবে শান্ত স্বরে বললেন, ওটা আমার কাছে নেই।

দ্বিধা-ভয় ক্যালাগুর চোখে-মুখে। তারপর হঠাৎ করেই বুঝে গেল সব। ঝট করে ঘুরে তাকাল গভীর সুড়ঙ্গের দিকে।

ক্যাথিবা আলিহা!

.

ইয়াকা মাউণ্টেনের সুড়ঙ্গে বহু দূরে স্টিলের মই বেয়ে প্রায় চূড়ার কাছে পৌঁছেছেন রেড ইণ্ডিয়ান বিজ্ঞানী ক্যাথিবা আলিহা। কয়েক শ ফুট নিচে সুড়ঙ্গের মেঝে, পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু, তবুও তার বুকে কোনও ভয় নেই। শুনলেন আরও জোরালো হয়ে বাজছে অ্যালার্ম। বেশ কয়েক ধাপ উঠে হ্যাঁচ খুলবেন, এমনসময় শুনলেন: Three…

অন্ধকার সুড়ঙ্গ ছেড়ে সূর্যের আলোয় বেরোতে হবে!

 শুনলেন মিষ্টি নারীকণ্ঠ: Two…

ন্যাভেজো গালি বকে ঝট করে খুললেন হ্যাঁচের দরজা। চোখে পড়ল ন্যাভেজো সূর্যের কড়া সোনালি রশ্মি। ছিটকে বেরিয়ে এসে পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলেন ক্যাথিবা আলিহা, হাতে সেই স্বচ্ছ ব্রাযিল স্টোন। পেছনে শুনলেন মিষ্টি কণ্ঠ: One…

.

যা আছে কপালে! বিড়বিড় করে কূপের লিভার টানল রানা।

খুলে গেছে লিভারের কাউন্টারওয়েইট। প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে কপিকল। তুমুল বেগে নেমে গেল ভারী পাথরের স্তূপ, একই বেগে উঠে এল কূপের পাশে ধাতব একটা বাটি।

পলকের জন্যে ওটার ভেতর স্ফটিক দেখল রানা।

যেন স্থির হয়ে গেছে গোটা পৃথিবী।

 অবাক হয়ে রানা দেখল, কিছুই ঘটছে না।

 পরক্ষণে জীবনের বড় একটা শখ পূরণ হলো ওর।

নিচ দিয়ে যাওয়া কবুতরের মত সই-সাঁই করে উড়ে চলল রানা। মাত্র কয়েক ফুট নিচেই বিক্ষুব্ধ নীল লেক। তীব্র যন্ত্রণা মিলিয়ে গেলে ভাবত, ও আছে স্বর্গে!

বুঝবার আগেই এক পলকে তীরের কাছে পৌঁছে গেল রানা। ঝপাস্ করে পড়ল পানির ভেতর। কান-মাথার যন্ত্রণায় মনে হলো মারা পড়বে ও।

শুরু হয়েছে আরও ভয়ঙ্কর কী যেন!

বিকট আওয়াজে থরথর করে কাঁপছে দুনিয়া।

প্রচণ্ড ব্যথায় রানার শরীর থেকে হারিয়ে গেল সমস্ত শক্তি।

চারপাশ থেকে আসছে জোরালো গুমগুম আওয়াজ!

তলিয়ে যেতে লাগল রানা। চেতনা হারাতে হারাতে ভাবল, তা হলে এই পাহাড়ি লেকেই ছিল মৃত্যু?

পানির নিচেও একই গর্জন!

তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল সব আওয়াজ।

রানা টের পেল, লেকের তীরের কাছে অগভীর জলে ঠেকে গেছে ওর পা! নাক ডুবে আছে, কিন্তু চোখদুটো দেখছে একটু দূরের ঢালু দেয়ালের পার।

রানা! ডাকল কে যেন।

চেনা মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনে সামান্য ঘুরে তাকাল ও।

তীরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে মিতা!

হঠাৎ কোত্থেকে যেন জোর পেল রানা, কয়েক পা হেঁটে উঠল অগভীর একটি ধাপে। পরক্ষণে পা রাখল ওপরের পাথুরে জমিতে। উড়তে শুরু করলে কী হয়েছিল? জানতে চাইল।

তার আগে সঠিক জায়গায় তুলেছিলে স্ফটিক, বলল মিতা। ভীষণ অগোছালো। কালো আকাশের মতই কালিমাখা।

তবুও ওকে দারুণ সুন্দর লাগল রানার।

তারপর পুরো এক শ ফুট উড়ে এলে। জলের ভেতর নাক ডুবিয়ে বকের মত কী যেন ভাবছিলে। ওই মেয়ে দারুণ সুন্দরী, তাই না?

তুমি উড়ে যাওনি কেন? জানতে চাইল রানা।

তুমি ছিলে খোলা জায়গায়। আমার কপাল ভাল, খোড়লের মত জায়গায় বড় এক পাথর জাপ্টে শুয়ে ছিলাম। তবে আরেকটু হলে উড়ে যেতাম। ফ্যাকাসে হয়ে গেল মিতার মুখ। চোখ থেকে পড়ে গাল বেয়ে নামল দুই ফোঁটা অশ্রু। চুপ করে চাইল রানার চোখে।

কী হয়েছে, মিতা?

জবাব দিল না মেয়েটা।

নীরবতাই কখনও হয় উত্তর। মিতার জবাব পেয়ে গেছে রানা। একটু দূরে অগভীর এক গর্তের পাশে নিথর পড়ে আছে পিচ্চি পাবলো। ওকে নিয়ে ওই গর্তে আশ্রয় নিয়েছিল মিতা।

মগজে রাখা স্ফটিকের টুকরোর কারণে দুই কান দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়েছে পাবলোর।

বাচ্চাটার পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল রানা। পালস্ দেখল।

নেই!

অসহায় পিচ্চি পাবলোর করুণ মৃত্যু খারাপ করে দিয়েছে রানার মন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ তুলে তাকাল। আকাশ প্রায় ছাইয়ের মত। তার বুকে বারবার ঝিলিক দিচ্ছে সাদা-নীল রশ্মি। খুব দ্রুত কমে আসছে ওসব আলো।

তুমি তো ফিযিসিস্ট, জানো এসব আলো কীসের? জানতে চাইল রানা।

অ্যাটমসফেয়ারের চার্জড় পার্টি। ম্যাগনেটিক লাইনের সঙ্গে মিলে বেরিয়ে যাচ্ছে মহাশূন্যে।

পাহাড়ি জাগুয়ার রাজার মন্দিরের স্ফটিক রক্ষা করল আধুনিক বিশ্বের মানুষকে, বলল রানা, কিন্তু মেরে ফেলল পাবলোকে। হঠাৎ নিজেকে খুব দুর্বল লাগল ওর, চুপ করে বসে থাকল পাথুরে জমিতে।

পাশে বসল মিতা। মাথা রাখল রানার কাঁধে। নীরবে কাঁদছে পাবলোর জন্যে।

.

৫২.

ইউ.এস.এ-র মেরিল্যাণ্ড, বেথেসড়া নেভাল হসপিটাল।

আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে রানা, মিতা, জর্জ হ্যারিসন ও ইগোর দিমিতভকে ভর্তি করা হয়েছে এই হাসপাতালে। কান-চোখ ভালভাবে পরীক্ষা করে আপাতত রানাকে বিশ্রাম নিতে বলেছেন ডাক্তার। লো-লেভেল রেডিয়েশন পয়জনিং-এর জন্যে চলছে মিতার চিকিৎসা। অপারেশন হয়েছে আর্কিওলজিস্টের পায়ের ক্ষতে। ড্রেস করা হয়েছে নতুন করে। ভাঙা গোড়ালি ঠিক করা হয়েছে ইগোর দিমিতভের।

আলাদা আলাদা কামরায় ওদেরকে রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

কাজ বলতে কিছুই নেই, তাই এরই ভেতর ভীষণ বিরক্ত হয়ে উঠেছে রানা। বিকেলে যখন ওর ঘরে উঁকি দিলেন এনআরআই চিফ জেমস ব্রায়ান, খুশিই হলো ও। দেখল, এইমাত্র দুর্দান্ত কোনও পুরস্কার পেয়ে খুশিতে গদগদ হয়েছেন, এমনভাবে হাসছেন ভদ্রলোক। তবে বেধড়ক মারধর খাওয়ার চিহ্ন নাকে-মুখে।

রানার বেডের পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন। নিচু স্বরে খুলে বললেন ইয়াকা মাউন্টেনে কী ঘটেছে। শেষ করলেন এই বলে: ওই তিন স্ফটিক মিলে মহাশূন্যে পাচার করেছে প্রচণ্ড ম্যাগনেটিক ওয়েভ। তবে কিছুক্ষণের জন্যে বিদ্যুহীন ছিল গোটা পৃথিবী। আপনারা অসফল হলে ভেঙে পড়ত সব যোগাযোগ ব্যবস্থা। এখন অন্যসব দেশের কর্তা-কত্রীদের সঙ্গে আলাপ করছেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে বুঝিয়ে বলছেন, আসলে কী ঘটেছে। আপত্তি তোলার উপায় নেই কারও। ন্যাচারাল অকারেন্স।

এবার আমাকে ছেড়ে দিন, বাড়ির ছেলে বাড়ি ফিরি, বলল রানা।

নিশ্চয়ই যাবেন, মিস্টার রানা, বললেন ব্রায়ান, তবে আপনার সঙ্গে দেখা করতে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন এক ভদ্রলোক। চলে আসবেন একটু পর।

উনি কে? জানতে চাইল রানা।

ইউনাইটেড স্টেটস্-এর প্রেসিডেন্ট। পাশে রাখা ব্রিফকেস তুলে নিলেন ব্রায়ান। ওটা খুলে বের করলেন রানার জন্যে এক সেট নিখুঁত পোশাক। আমি অন্যদের জড় করতে গেলাম। দয়া করে পোশাক পরে নিন। একটু পর পৌঁছে যাবেন তিনি।

এনআরআই চিফ বেরিয়ে যেতেই কাপড়গুলো দেখল রানা। কসেকেণ্ড পর স্বীকার করল, রুচি অত্যন্ত ভাল জেমস ব্রায়ানের।

বেড থেকে নেমে পড়বে ভাবছে, এমনসময় আজকে পনেরো বারের মত কামরায় ঢুকল সুন্দরী নার্স। বেয়াড়া রোগীকে দেখলেই কুঁচকে ফেলে ডান দিকের ভুরু।

আবার কী দোষ করলাম? জানতে চাইল রানা।

অনেক! এক বোতল পানি বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। ওর অন্য হাতে ক্লিপবোর্ড। আপনাকে ডিসচার্জ করা হয়েছে। পোশাক পরে মিস্টার ব্রায়ানের সঙ্গে দেখা করতে সোজা চলে যাবেন কনফারেন্স রুমে।

পাঁচ মিনিট পর কামরা থেকে বেরিয়ে সোজা মিতার ঘরে ঢুকল রানা। ব্রায়ানের সঙ্গে চলে গেছে মেয়েটা। একমিনিট পর করিডোরে এসে ও দেখল, একটু দূরের একটা কামরার সামনে হাজির হয়েছে সিক্রেট সার্ভিসের একদল এজেন্ট।

তারা কেউ বাধা দিল না। কনফারেন্স রুমে ঢুকে রানা দেখল, হাজির আছেন প্রফেসর জর্জ হ্যারিসন, এনআরআই চিফ ব্রায়ান ও মিতা।

গত দুদিন দেখা করার সুযোগ হয়নি ওদের।

রানাকে দেখে পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে মিতার মুখ। জানো, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আসছেন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে!

রানা জবাব দেয়ার আগেই ঘরে ঢুকল দুজন সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট, পেছন পেছন ঢুকলেন প্রেসিডেন্ট। লেজের মত পিছু নিয়ে সিআইএ চিফ মার্ল ক্যালাগু।

বদমাশ ব্যাটা কালো গু, বিড়বিড় করল রানা।

কয়েক সেকেণ্ড পর খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকলেন রেড ইণ্ডিয়ান বিজ্ঞানী ক্যাথিবা আলিহা। হাতে বরাবরের মতই আঙুরের রসের বোতল। কাউকে পাত্তা না দিয়ে বসে পড়লেন চেয়ারে। চেহারা দেখে রানার মনে হলো, এই লোক কথা বলবেন না, এসেছেন প্রেসিডেন্টের সম্মানে।

প্লিয, দয়া করে বসুন আপনারা, খুশিমনে আহ্বান জানালেন প্রেসিডেন্ট।

সবাই বসতেই প্রথমে রানা, মিতা ও আর্কিওলজিস্ট জর্জ হ্যারিসনকে ধন্যবাদ দিলেন প্রেসিডেন্ট। জানালেন, ওদের কাছে চিরকালের জন্যে কৃতজ্ঞ রইল আমেরিকা। এরপর বললেন, আমরা প্রচার করছিঃ ইউনাইটেড স্টেটস, রাশা, মেক্সিকো, বাংলাদেশ আর চিন মিলে ঠেকিয়ে দিয়েছে ভয়ঙ্কর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বিবৃতি শুনে এসব দেশের প্রধানরা খুশি হয়েছেন।

মিতার মনে পড়ল, স্যান ইগন্যাসিয়ো শহরের গোরস্তানে কবর দেয়া হয়েছে পাবলোকে। প্রেসিডেন্টের কাছে জানতে চাইল ও, স্যর, ইগোর দিমিতভের খোঁজ জানি না, তার কী হলো?

চিকিৎসার পর তুলে দেয়া হয়েছে বিমানে, বললেন প্রেসিডেন্ট, পৌঁছে যাবে নিজের দেশে।

ওই লোকই স্যান ইগন্যাসিয়ো শহরে খুন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছিল হ্যারিসন ও মিতাকে। পরে তার সাহায্য নিয়েই রানার কাছে পৌঁছেছিল মিতা। হাতে পেলে মেরে ফেলবে না এফএসবি? চিন্তিত কণ্ঠে বলল ও।

ভাববেন না, বললেন প্রেসিডেন্ট, ইগোর দিমিতভ এখন রাশার সত্যিকারের হিরো। আপনাদের মতই। রক্ষা করেছে বর্তমান আধুনিক বিশ্ব। তা ছাড়া, রাশান কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে, বিলিয়নেয়ার হুয়াং লি ল্যাং-এর লোকদের সঙ্গে যুদ্ধে মারা গেছে দিমিতভেদ্র সঙ্গীরা। বাকি জীবন অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে থাকবে এফএসবির ওই প্রাক্তন এজেন্ট।

এবার আমাদের কী হবে, কোনও রোগবালাই নেই, কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়ছে না! নালিশ করলেন জর্জ হ্যারিসন।

এবার মুখ খুলল সিআইএ চিফ মার্ল ক্যালাগু, আপনাদের কথা দিতে হবে, সত্যিকারের ঘটনা কাউকে বলবেন না। সেজন্যে প্রথমেই উনিশ শ ঊনপঞ্চাশের অ্যান্টি এসপিয়োনাজ অ্যাক্ট অনুযায়ী শপথ করতে হবে; তারপর…।

বাদ দিন তো আপনার প্যাচাল, প্রায় ধমক দিলেন ব্রায়ান।

ক্যালাগু, এঁদের বিষয়ে আপনাকে আর নতুন করে ভাবতে হবে না, বলে দিলেন প্রেসিডেন্ট। পৃথিবীর এত বড় বিপদ যারা ঠেকিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের বিব্রত করা কোনওভাবেই উচিত হচ্ছে বলে মনে করি না।

কথাগুলো শুনে কেঁচোর মত গুটিয়ে গেল মার্ল ক্যালাগু।

চেয়ার ছাড়লেন প্রেসিডেন্ট। আবারও বলছি, অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদেরকে। তার চোখ সরাসরি রানার ওপর। মিতার কাছ থেকে সবই শুনেছে ব্রায়ান। ওর কাছ থেকে আমি। বিশেষ করে আবারও ধন্যবাদ দিচ্ছি আপনাকে, মিস্টার রানা।

বিড়বিড় করে ধন্যবাদ জানিয়ে চুপ করে থাকল রানা।

রানা ওর প্রাপ্য সম্মান পেয়েছে দেখে আরেকবার পূর্ণিমার চাঁদের মত ঝলমল করে উঠল মিতার মুখ।

প্রেসিডেন্ট উঠে পড়তে চেয়ার ছাড়ল অন্যরা।

বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট। তার পর বিজ্ঞানী ক্যাথিবা আলিহা। পিছু নিয়ে গেল দুই সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট ও সিআইএ চিফ মার্ল ক্যালাগু।

এবার সোজা ইউনিভার্সিটির কাজে ফিরব, বললেন জর্জ হ্যারিসন।

তাই বোধহয় ভাল, বলল মিতা। রানার দিকে তাকাল। ওই যে দুই তরুণ বিসিআই এজেন্ট এল স্যান ইগন্যাসিয়ে শহরে, তাদের কাজ কি শেষ হয়েছে?

মাথা দোলাল রানা। মাত্র কয়েকজন জানেন, কোথায় রাখা হয়েছে ওই দুই স্ফটিক। আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে জানানো হয়েছে। তাতে আপত্তি তোলেননি তিনি।

রানা থেমে যেতেই জিজ্ঞেস করলেন ব্রায়ান, আচ্ছা, একটা কথা, মিস্টার রানা, বলুন তো, আমার সমস্ত টাকা আমি দিয়েছিলাম আপনাকে! তা হলে…

আপনি সত্যিই খুব মারকুটে লোক, মৃদু হেসে বলল রানা। সিআইএ-র ক্যালাগুর সঙ্গে মারপিট করতে গিয়ে খেয়ালই ছিল না, সব টাকা ফেরত গেছে আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।

কিন্তু কেন? অবাক চোখে রানাকে দেখছেন ব্রায়ান।

তাড়াতাড়ি ফেরত দিয়েছি, কারণ যে বিপদে পাঠিয়েছিলেন, যে-কোনও সময়ে মারা যেতে পারতাম।

জেমস ব্রায়ান মাথা নাড়লেন। কিন্তু কেন বলুন তো? আমি তো সব তুলে দিয়েছিলাম আপনার হাতে, যাতে…

যাতে ফেরত পান আপনার মেয়েকে। এই তো?

 হ্যাঁ।

কিন্তু একটা কথা জানতেন না যে, কারও কলজের টুকরোকে বিপদ থেকে উদ্ধার করে আনতে টাকা নিই না আমি। এবার বুঝেছেন?

হাঁ হয়ে গেছে ব্রায়ানের মুখ। অবাক হয়ে রানাকে দেখছে মিতাও। খুশিতে চকচক করছে দুই চোখ। অন্তরে নতুন করে উপলব্ধি করেছে: শুধু ওরই জন্যে কী ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে ঝাঁপ দিয়েছিল মাসুদ রানা।

হাসল রানা।

আপনার মেয়ে তো ফিরে পেয়েছেন; ব্যস, আর কী চাই?

খুকখুক করে কাশলেন ব্রায়ান। তারপর বললেন, ধন্যবাদ!

এবার ঘরে গিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে যে যার মত চলে যেতে পারি তো? বলল রানা।

হ্যাঁ, আর ঝামেলা করতে পারবে না কেউ, বললেন। ব্রায়ান। মিতার দিকে তাকালেন। তোমার জন্যে অপেক্ষা করব লবিতে। রানার কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তিনি।

করিডোরে বেরিয়ে এল রানা, মিতা ও হ্যারিসন।

টুকটাক জিনিস নিতে নিজ কামরায় গেলেন প্রফেসর।

এবার কী? রানার চোখে তাকাল মিতা।

দেশে ফিরব, বলল রানা। বেকার লোক, তবে বিসিআই চিফ হয়তো দয়া করে জুটিয়ে দেবেন কোনও কাজ।

ওর কথা শুনে হাসল মিতা। নিচু স্বরে বলল, আমিও যেতে চাই। একবার ঘুরিয়ে দেখাবে তোমার দেশ? শুনেছি অদ্ভুত সুন্দর নাকি আমার পিতৃভূমি। তবে ভিন দেশের পর্যটকদের জন্যে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা নেই বলে অবহেলায় পড়ে আছে সব।

কথা মিথ্যে নয়, বলল রানা, চলে এসো, ঘুরিয়ে দেখাব কত সুন্দর দেশটা। তবে তোমার তো জুটে যাবে অনেক কাজ। সময় কি আর পাবে?

চোখ নিচু করে নিল মিতা। মনে মনে বলল, পাব, অনেক সময় পাব। এটাও জানি, চিরকালের জন্যে পাব না তোমাকে।

ঘরে চললাম, মালপত্র গুছিয়ে নেব, বলল রানা, তুমি যখনই জানাবে বাংলাদেশে আসছ, রিসিভ করব তোমাকে এয়ারপোর্টে।

ঘুরে রওনা হলো রানা।

পেছন থেকে চেয়ে রইল মিতা, ওর চোখে চলে এল অবুঝ অশ্রু। বেপরোয়া মানুষটা বিদায় নিতেই প্রায় দৌড়ে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল মিতা। আছড়ে পড়ল বেডের ওপর। আকুল হয়ে কাঁদছে। কিন্তু একটু পরেই গালে খোঁচা দিল শক্ত খাম। অবাক হয়ে ওটা তুলে নিল ও।

খামের ওপর লেখা: বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহৃত।

ফড়াৎ করে খাম ছিঁড়ে ভেতরের কাগজটা নিল মিতা।

 হতবাক হয়ে গেল লিখিত বক্তব্য পড়ে।

বাংলাদেশ সরকারের নির্মাণাধীন সবচেয়ে আধুনিক ও বড় আণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রধান ফিযিসিস্ট হিসেবে কাজে যোগ দেয়ার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ওকে!

অশ্রু এখনও শুকিয়ে যায়নি, ফিক করে হেসে ফেলল মিতা।

রানা সত্যিই কী যে অদ্ভুত সব কাণ্ড করে!

বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওকে এনে দিয়েছে মস্তবড় সম্মান!

লাফ দিয়ে বেড ছাড়ল মিতা, ছুটে গিয়ে ঢুকল রানার ঘরে।

 কিন্তু চলে গেছে নিষ্ঠুর মানুষটা।

ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল মিতা, এলিভেটরের জন্যে অপেক্ষা না করে সিঁড়ি বেয়ে উড়ে নেমে এল রিসেপশনে। দেখল, দূরে মেইন গেটের কাছে রানা। হরিণীর মত ছুটল মিতা। কিন্তু থমকে গেল মাঝপথে। এইমাত্র রানার পাশে থেমেছে এক ট্যাক্সি। পেছনের দরজা খুলে সিটে উঠে পড়ল মানুষটা।

এখন ছুটেও লাভ হবে না।

তবুও আনমনে ক’পা এগিয়ে গেল মিতা। চোখের সামনে ট্যাক্সি রওনা হতেই বিড়বিড় করল, ঠিক আছে, চাকরি নেব। তখন নিশ্চয়ই দেখা পাব, তাই না, রানা? অন্তরের গভীরে শুনল জীবনের প্রথম প্রেম মাসুদ রানার দরাজ কণ্ঠ: চলে এসো, মিতা!

মিতা জানল না, ট্যাক্সিতে আনমনে ভাবছে রানাঃ সত্যি কি আসবে মিষ্টি মেয়েটা? আমি অপেক্ষা করব ওর জন্যে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *