• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

কিছু স্মৃতি কিছু কথা

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » স্মৃতিচারণ » কিছু স্মৃতি কিছু কথা

১৯৫০ সালে আমার নিজ গ্রাম নাওঘাটের সন্নিকটবর্তী তালশহর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে আমি ঢাকা কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হই। ঢাকা কলেজ ছিল সে সময়ে ঢাকা মহানগরীর পুরোনো অঞ্চলে ফুলবাড়িয়া এলাকায়। কলেজের উত্তর পাশেই ছিল রেলওয়ে স্টেশন। পুরোনো ঢাকা কলেজ, রেলওয়ে স্টেশন এবং ফুলবাড়িয়া এলাকার সেকালের বহু কিছুরই চিহ্ন এখন আর অবশিষ্ট নেই। গত অর্ধশতাব্দীরও অধিককালের পরিসরে এবং সাবেক পাকিস্তান আমলে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর উন্নয়নের স্পর্শে ফুলবাড়িয়া এলাকা প্রায় আমূল বদলে গেছে। গড়ে উঠেছে সুপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, বড় বড় দালানকোঠা, দোকানপাঠ, বিপণিকেন্দ্র ও সোধমাল্য। কিন্তু আমাদের স্মৃতিতে জেগে আছে সেই পুরনো ঢাকা কলেজ, ফুলবাড়িয়া এলাকা।

ঢাকা কলেজের সঙ্গে শুধু আমার শিক্ষা জীবনই নয়, সাহিত্য-জীবনও অবিচ্ছিন্ন সূত্রে গ্রথিত। একালের শক্তিমান ও প্রখ্যাত কথাশিল্পী মরহুম মাহমুদুল হকের স্মৃতিচারণ করতে গেলেও অনিবার্যভাবেই পুরনো ঢাকা কলেজের কথা এসে যায়। কেন না, আজিমপুর কলোনীতে কিশোর মাহমুদুল হকের সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয়, সে সময়েও আমি ছিলাম ঢাকা কলেজে আইএ দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমার লেখা অসংখ্য কবিতা এবং কিছু গদ্যরচনা প্রকাশের ফলে সে সময়েই আমার কিছুটা সাহিত্যিক পরিচিতি হয়ে গেছে। কিশোর মাহমুদুল হকের লেখকসত্তার এবং তার প্রতিভার পরিচয় তখনো পাইনি কিন্তু আমার কবিতার একজন অনুরাগী পাঠককে সে সময়েই আবিষ্কার করলাম।

১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত আজিমপুর কলোনীতে আমরা ছিলাম একই ভবনের পাশাপাশি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। আমার ফুফাতো ভাই ও ফুফাতো বোন জাহানারা বেগমের স্বামী মরহুম আব্দুল হাকিম ছিলেন সচিবালয়ে ফুড ডিপার্টমেন্টের অন্যতম কর্মকর্তা। চাকরি জীবনে ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে অবসর পান। তিনি সপরিবারে বসবাস করতেন ১৪/ই ফ্ল্যাটে। মাহমুদুল হকের পিতা মরহুম সিরাজুল হক ছিলেন সচিবালয়ের অন্যতম পদস্থ কর্মকর্তাণ্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার। তিনি পাশের ফ্ল্যাটেই সপরিবারে বসবাস করতেন। পাশাপাশি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা দুই পরিবারের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও হৃদ্যতাপূর্ণ। মনে হতো যেন আমরা একই পরিবারের মানুষ।

১৯৫১ সালে আজিমপুর কলোনীতে বসবাসের জন্য ফুফাতো ভাই ও বোনের ফ্ল্যাট ১৪/ই-তে আসার আগে আমি ছিলাম ঢাকা কলেজের হোস্টেলণ্ড বেগম বাজারে নূরপুর ভিলার বাসিন্দা। আমার পাশের রুমেই থাকতেন সহপাঠি বন্ধুণ্ড একালের খ্যাতনামা লেখক ও শিক্ষাবিদ বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। সৌভাগ্যক্রমে, একালের খ্যাতনামা লেখক ও সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী, লেখক সাংবাদিক শফিক রেহমান, লেখক ও শিক্ষাবিদ ডক্টর কবিরউদ্দিন আহমদ, সাংবাদিক দাউদ খান মজলিস, লেখক ও শিক্ষাবিদ ডক্টর আহাসনুল হক, লেখক সাংবাদিক আবেদ হোসেন, রবীন্দ্র সঙ্গীতবিশারদ ওয়াহিদুল হক, লেখক ও শিক্ষাবিদ ডক্টর মোজাফফর আহমদকে ঢাকা কলেজে সহপাঠি বন্ধুরূপে পেয়েছিলাম।

কিশোর মাহমুদুল হকের প্রথম লেখা প্রকাশ এবং তার সাহিত্য প্রতিভার বিকাশে সেকালে আজিমপুর কলোনীর বাসিন্দা এবং ঢাকা কলেজের ছাত্রণ্ড আমার সহপাঠি বন্ধু একালের (অধ্যাপক) ডক্টর মোজাফফর আহমদের কিছুটা ভূমিকা ছিল। সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল আজিমপুর কলোনীর সেকালের বাসিন্দা এবং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুণ্ড একালের খ্যাতনামা লেখক ও শিক্ষাবিদ ডক্টর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর। তিনি সেকালে ভাষা আন্দোলনের অগ্রণী সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের মুখপাত্র সাপ্তাহিক সৈনিক-এর শিশু বিভাগ ‘কিশোর মজলিস’-এর সম্পাদক ছিলেন। ‘জঙ্গী ভাই’ ছদ্মনামে তিনি বিভাগটি পরিচালনা ও সম্পাদনা করতেন। তমদ্দুন মজলিসের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোজাফফর ও আমি ‘কিশোর মজলিস’-এ লিখতাম।

মাহমুদুল হকের প্রথম কিশোর উপযোগী গল্প লেখার এবং তা প্রকাশের একটি ইতিহাস আছে। আজিমপুর কলোনীতে বসবাসের আগে থেকেই আমি ১৪/ই-তে আমার ফুফাতো ভাইয়ের বাসায় আসা-যাওয়া করতাম। সেই সুবাদে পাশের ফ্ল্যাটের অর্থাৎ মাহমুদুল হকদের বাসার এবং পরিবারের সদস্যদের সবার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাহমুদুল হকের ডাকনাম যে বটুণ্ড তা আজিমপুর কলোনীতে বসবাসের জন্য আসার আগে থেকেই জানা হয়ে যায়। তার পিতা শ্রদ্ধেয় সিরাজুল হক, তার মাতাণ্ড আমাদের শ্রদ্ধেয়া খালাম্মা এবং তাদের ছোট-বড় সন্তানদের অমায়িক ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। মাহমুদুল হক বটুর কাছ থেকেই জানতে পারি যে সে আমার কবিতারণ্ড অনুরাগী পাঠক। আরও বহু লেখকের রচনা সে মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে থাকে। পঞ্চাশের দশকে আজিমপুর কলোনীতে নবীন-প্রবীণ অনেক কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী বসবাস করতেনণ্ড কবি আব্দুল কাদির, নাট্যকার নূরুল মোমেন, কথাশিল্পী শামসুদ্দীন আবুল কালাম, নাট্যকার অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এবং আরো অনেকে।

১৯৫১ সালে আজিমপুর কলোনীতে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আসার পর প্রীতিভাজন কিশোর বটুর সঙ্গে আমার মানস-আত্মীয়তা ও হৃদ্যতা আরো বেড়ে যায়।

আমাদের মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে আলোচনার পরিধিও বাড়তে থাকে। বটু ছিল কিশোরকাল থেকেই বিনম্র প্রকৃতির এবং মৃদুভাষী। কিশোরকালে তো নয়ই, কথাশিল্পী হিসেবে খ্যাতিমান হওয়ার পরও তাকে কখনো উচ্চকণ্ঠ হতে দেখিনি। তার কৈশোরকালেণ্ড আমাদের আজিমপুর কলোনীতে বসবাসের সময়েই আমি একদিন বটুকে বললাম: ‘তুমি সাহিত্যের একজন অকৃত্রিম অনুরাগী, বাংলা সাহিত্যের অনেক খ্যাতিমান লেখকের রচনার সঙ্গেই তোমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে। তুমি নিজে লিখতে চেষ্টা করো না কেন?’ বটু বলল, ‘আমি তো কবিতার ছন্দ জানি না, আপনার মতো কবিতা লিখব কীভাবে?’ আমি বললাম, ‘কবিতা লেখার দরকার নেই, তুমি গল্প লেখার চেষ্টা করো।’

এর কিছুদিন পর মাহমুদুল হক বটু তার লেখা একটি কিশোর উপযোগী ছোটগল্পের পান্ডুলিপি আমার হাতে তুলে দিল। অতি বিনয়ের সঙ্গে এবং লজ্জাজড়িত কণ্ঠে বলল: ‘আমার হাতের লেখা ভালো না, বাংলা বানানও শুদ্ধভাবে লিখতে পারি না। আপনি আমাকে বানান শেখাবেন, আমার লেখাটিতে কোনোরূপ ভুলত্রুটি থাকলে শুদ্ধ করে দেবেন।’ আমি বললাম, ‘সেজন্য তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি আরো গল্প লিখবে, সেটাই আমি চাই।’ অনেকেই হয়তো জানেন না, মাহমুদুল হক বটুদের পৈতৃক নিবাস পশ্চিমবঙ্গে। তারা সবাই পশ্চিমবঙ্গের ‘বিশুদ্ধ’ বাংলায় কথা বলতে অভ্যস্ত। ঢাকায় এসে এবং আমাদের মতো ‘বাঙ্গাল’দের সঙ্গে মিশে তাদের পরিবারের সদস্যদেরও ‘বিশুদ্ধ’ ভাষা কিছুটা ‘দো-আঁশলা’ হয়ে যায়। বটুর বাংলা বানান বিভ্রাটের হয়তো এটাও ছিল একটা কারণ।

আমি বটুর লেখা কিশোর উপযোগী গল্পটি পাঠ করলাম, কিছু কিছু বানান এবং বাক্য গঠনরীতির ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধন করলাম। গল্পটি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সৌজন্যে সাপ্তাহিক সৈনিক-এর ‘কিশোর মজলিস’-এ প্রকাশিত হলো। লেখকের নাম ‘মোহাম্মদ মাহমুদুল হক’। একই নামে তার দ্বিতীয় গল্পও ছাপা হয় সৈনিক-এর ‘কিশোর মজলিস’-এ। সে সময়ে কিশোরদের লেখায় অনুপ্রাণিত করার এবং লেখার কায়দা-কানুন ও রীতিনীতি শেখানোর উদ্দেশ্যে সৈনিক-এর কিশোর মজলিস নামে একটি বিভাগ খোলা হয়: ‘কেমন করে লিখবে’। তাতে (অধ্যাপক) মোজাফফর আহমদ লেখেন ‘কেমন করে লিখবে: প্রবন্ধ’, (অধ্যাপক) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লেখেন ‘কেমন করে লিখবে: গল্প’ এবং আমি লিখি ‘কেমন করে লিখবে: কবিতা’। উল্লেখ্য, সে সময়ে আমরা তিনজনই ছিলাম কলেজের ছাত্র, আর মাহমুদুল হক বটু পড়ত আজিমপুরের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে। একই স্কুলের ছাত্র ছিল একালের খ্যাতনামা কথাশিল্পী ও আমেরিকা প্রবাসী (ডক্টর) আবদুন নূর। পরবর্তীকালে নূরের লেখাও আমি মাহে নও পত্রিকায় ছাপি।

মাহমুদুল হক সাপ্তাহিক সৈনিক-এ প্রকাশিত আমাদের তিনজনের উপরোক্ত তিনটি লেখাই অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একালে প্রাবন্ধিক ও মননশীল লেখক হলেও, তার ছাত্রজীবনে লিখতেন প্রধানত ছোটগল্প। আমি লিখতাম কেবলই কবিতা। আমার আরেক বন্ধু প্রখ্যাত কবি, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক পরলোকগত ডক্টর আবু হেনা মোস্তফা কামালও ছাত্রাবস্থায়ই কবিতা লিখতেন। আজিমপুর কলোনীর বাসিন্দা আবু হেনাও সে সময়ে সৈনিক ও দ্যুতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

সৈনিক-এ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা ‘ছোটগল্প’ সম্পর্কিত রচনাটি পাঠ করে হয়তো মাহমুদুল হক বটু গল্প লেখায় অনুপ্রাণিতবোধ করে থাকবে। তার আরেক অনুপ্রেরণার উৎস ছিল তারই স্কুল-শিক্ষক শক্তিমান কথাশিল্পী শহীদ সাবের। তিনিও আজিমপুর কলোনীতে আমাদেরই পাশের বিল্ডিং ১০ নম্বরের বাসিন্দা ছিলেন। আমারই সমবয়সী শহীদ সাবের সেকালেই প্রগতিশীল লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন, তিনি কারাবন্দীও হন। সেকালে কলকাতার নতুন সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত তার ছদ্মনামী লেখা ‘আরেক দুনিয়া থেকে’ শীর্ষক রচনা আলোড়ন সৃষ্টি করে। মাহে নও পত্রিকার চাকরিকালে আমি শহীদ সাবেরের কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশ করি। এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ‘এক টুকরো মেঘ’। এ নামেই তার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। শহীদ সাবের পরবর্তীকালে সাংবাদিক হিসেবেও খ্যাতিমান হন। কিন্তু তার জীবনের করুণ পরিণতি ও মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের জন্য বেদনাবহ স্মৃতি। মানসিকভাবে অসুস্থ ও ভারসাম্যহীন শহীদ সাবের ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে তার পুরনো কর্মস্থল সংবাদ অফিসে ঘুমন্ত অবস্থায় বর্বর পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে আগুনে পুড়ে মারা যান। শহীদ সাবের শহীদ হন।

শহীদ সাবের সম্পর্কে এত কথা বললাম এ কারণে যে, কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের মনোগঠনে এবং তার প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনধর্মিতার বিকাশে যারা প্রেরণা জোগান তাদের মধ্যে শহীদ সাবের, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ এবং বিশেষভাবে কবি আহসান হাবীবের নাম স্মরণযোগ্য। একালে বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া আরেকজন কবি ও কথাশিল্পী চৌধুরী লুৎফুর রহমান ও মাহমুদুল হকের মনে কথাশিল্পী রচনার প্রেরণা সঞ্চার করেন। তিনি ছিলেন আজিমপুর কলেজের সন্নিকটবর্তী শেখ সাহেব বাজারের বাসিন্দা এবং মাসিক দ্যুতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। শহীদ সাবের ছিলেন ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলে মাহমুদুল হকের শিক্ষক এবং কথাসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে তার এক ধরনের দীক্ষাগুরু। সেকালেই খ্যাতিমান কবি ও কথাশিল্পী এবং বুধবার রাতে শীর্ষক গল্পগ্রন্থের স্রষ্টা সাইয়িদ আতিকুল্লাহ মাঝেমধ্যেই শহীদ সাবেরের বাসায় এবং আমাদের বাসায়ও আসতেন, আমাদের মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে অনেক কথাবার্তাও হতো। প্রীতিভাজন মাহমুদুল হকও আমার আমন্ত্রণে এই ঘরোয়া আসরে শরিক হতো এবং কোনো কথাবার্তা না বলে নীরবে আমাদের আলোচনা শুনত। এই সূত্রেই সাইয়িদ আতিকুল্লাহর সঙ্গে তার পরিচয় এবং পরবর্তীকালে ঘনিষ্ঠতা জন্মে। চৌধুরী লুৎফর রহমান একজন শক্তিমান কবি ও কথাশিল্পী এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেকালে দ্যুতি, মাহে নও, সওগাত, মোহাম্মদী এবং আরো অনেক পত্রিকায় প্রকাশিত তার গল্প কবিতা সুধী পাঠকমহলে সাড়া জাগায়। বন্ধুবর চৌধুরী লুৎফর রহমানের ছোট গল্পের অনুরাগী পাঠক ছিল কিশোর মাহমুদুল হক বটু। বন্ধু চৌধুরী লুৎফর

রহমান মাঝেমধ্যেই আমাদের বাসায় আসতেন, ঘণ্টার পর ঘন্টা উভয় বাংলার সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। সাহিত্যের প্রগতিশীল ধারা, প্রতিক্রিয়াশীল ধারার আধুনিকতা ও পশ্চাৎমুখিতা, প্রাচীনতা ও নবীনতা ইত্যাদি হতো আলোচনার বিষয়বস্তু। মাহমুদুল হক বটু বিমুগ্ধ বিস্ময়ে এসব আলোচনা শুনত।

কবি আহসান হাবীব ছিলেন সেকালে দৈনিক আজাদ-এর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক এবং মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকারও সম্পাদক। সেকালেই দুটি পত্রিকায় আমার অনেক কবিতা প্রকাশিত হয়। আমি প্রায়ই লেখা নিয়ে শ্রদ্ধেয় আহসান হাবীবের কাছে যেতাম। একদিন সঙ্গে নিয়ে গেলাম মাহমুদুল হক বটুকে। হাবীব ভাইকে জানালাম, কিশোর বটুও গল্প লেখে এবং সাহিত্যের বিশেষ অনুরাগী। লাজনম্র বটু হাবীব ভাইয়ের সামনে কোনো কথাই বলল না, বিনম্র দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। হাবীব ভাই বললেন: ‘বটু, তুমি আজাদ ও মোহাম্মদীর জন্য গল্প দেবে। বটু কোনো গল্প দিয়েছিল কিনা, মনে পড়ে না। পরবর্তীকালে কবি আহসান হাবীব দৈনিক ইত্তেহাদ-এর সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক হন। যতদূর মনে পড়ে, ইত্তেহাদ-এর সাহিত্য বিভাগে মাহমুদুল হকের কয়েকটি সাড়া জাগানো ছোটগল্প প্রকাশিত হয় এবং সেই সূত্রে হাবীব ভাইয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাও বাড়ে। একদিন হাবীব ভাই আমাকে বললেন: ‘তোমাদের বটু তো একজন জীবনধর্মী, অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কথাশিল্পী, ভাষার ওপরও তার দখল চমৎকার।’ হাবীব ভাইয়ের মন্তব্য শুনে আমিও অবাক এবং অভিভূত হলাম।

আমি আজিমপুর কলোনী ছেড়ে ১৯৫৮ সালে আগামসিহ লেনে আমার শ্বশুর প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় আবুল কালাম শামসুদ্দীনের বাসায় চলে যাওয়ার আগেই মাহমুদুল হকদের পরিবার কলোনী ছেড়ে সূত্রাপুরে তাদের নিজেদের কেনা বিশাল বাসায় চলে যায়। তাদের এই বিদায় এবং দুই পরিবারের বিচ্ছেদণ্ড উভয় পরিবারের সদস্যদের মনে করুণ হয়ে বাজে। আমাদের স্মৃতিতে জেগে ওঠে ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কের অনেক কাহিনী। মনে পড়ে মাহমুদুল হকের পিতা শ্রদ্ধেয় সিরাজুল হক ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও মৃদুভাষী অথচ স্নেহপ্রবণ। অন্যপক্ষে, তার মা তথা আমাদের প্রিয় খালাম্মা ছিলেন স্নেহশীল, অনর্গল কথা বলায় পটু এবং ভারিক্কি চালের মানুষ। তিনি প্রায় প্রতিদিনই তার অবসরের সময় আমাদের ফ্ল্যাটে আসতেন এবং নানা বিষয়ে আমাদের সঙ্গে অকপটে কথা বলতেন। সূত্রাপুরে নিজের বাসায় চলে যাওয়ার পরও, সেখানে যখনই গিয়েছি, খালাম্মা আগের মতোই স্নেহাদরে সিক্ত করেছেন, অকপটে অনর্গল কথা বলেছেন আগের মতোই। মাহমুদুল হকদের বাড়িতে কোনো উৎসব অনুষ্ঠান হলে আমাদের দাওয়াত দিতে ভুলতেন না। তার বড় বোনের বিয়েতে যে বিরাট আয়োজন হয়েছিল তাতে আমরাও অংশ নিয়েছিলাম।

আমারও বয়স বাড়ার সাথে সাথে মাহমুদুল হক এবং তার ভাইবোনদের বড় হতে দেখেছি। খালু এবং খালাম্মা অধিকতর প্রবীণতার দিকে পা বাড়িয়েছেন। কিশোর মাহমুদুল হক বটু শুধু বয়সেই বেড়ে ওঠেনি, শিশু-কিশোর উপযোগী ছোট গল্পের লেখক থেকে পরিণত হয়েছে একজন দক্ষ ও শক্তিমান কথাশিল্পীতে। আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরবের কথা যে, মাহমুদুল হক বটুকে একদিন তার কিশোরকালে ছোটগল্প রচনায় সামান্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলাম, সেই অনুজপ্রতীম ও প্রীতিভাজন মাহমুদুল হকই ১৯৭৭ সালে আমার সঙ্গে একই বছরে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হলো। মাহমুদুল হক কথাসাহিত্যে বিশিষ্ট অবদানের জন্য আর আমি কাব্যসাহিত্যে। পুরস্কারের মানপত্র হাতে নিয়ে তোলা আমাদের গ্রুপ ফটোর দিকে যখন তাকাই, তখন এই প্রবীণ বয়সেও আমাদের আজিমপুর কলোনীর জীবনের কথা মনে পড়ে, স্মৃতিতে ভেসে ওঠে কিশোর বটুর মুখ। শুধু মাহমুদুল হকই নয়, সে বছর বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত অনেক কবি-সাহিত্যিকই পরলোকে। তাদের এবং মাহমুদুল হকের অকাল মৃত্যুর কথা স্মরণে এলে মন আপনিতেই শোকাতুর হয়ে ওঠে।

মাহমুদুল হক বটু ছিল বরাবরই স্বল্পভাষী এবং বিনম্র স্বভাবের। কথাশিল্পী হিসেবে খ্যাতিমান হওয়ার পরও তার এই স্বভাবের পরিবর্তন তেমন লক্ষ্য করিনি। বায়তুল মোকাররম মার্কেটে তাদের পারিবারিক দোকান ‘তাসমেন’-এ (অধুনালুপ্ত স্বর্ণালংকারের দোকান) গেলে মাঝেমধ্যে মাহমুদুল হকের সঙ্গে দেখা হতো কিন্তু সাহিত্য নিয়ে তেমন কোনো কথা হতো না। আমি তাকে লেখার ব্যাপারে তাগাদা দিলে সে প্রায়ই নিরুত্তর থাকত। তার কোনো ছোটগল্প গ্রন্থ কিংবা উপন্যাসের আলোচনার জন্য সে আমাকে কখনো কিছু বলেনি। আমিই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তার উপন্যাস যেখানে খঞ্জনা পাখির আলোচনা লিখি সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এবং জীবন আমার বোন শীর্ষক উপন্যাসের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করি বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। এসব বিষয়েও মাহমুদুল হকের কোনো প্রতিক্রিয়া জানতে পারিনি।

বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদক বন্ধুবর মীজানুর রহমান একদিন আমাকে বললেন, মাহফুজউল্লাহ সাহেব, বটু সব সময় আপনার কথা বলে। আজিমপুর কলোনীতে থাকতে আপনি তাকে হাতে ধরে লেখা শিখিয়েছেন, তার লেখা ভুল বানান শুদ্ধ করে দিয়েছেন, তার প্রথম গল্প আপনার হাত দিয়েই ছাপা হয়, মাহে নও পত্রিকায় তার গল্প ছেপে আপনি চাকরি হারাতে যাচ্ছিলেনণ্ড এসব কথা সে প্রায়ই বলে। পরলোকগত মীজানুর রহমানের সঙ্গে তখন বটুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সে সময়ে তার বন্ধুমহল এবং সাহিত্যিক পরিমন্ডলও বদলে গেছে। তবুও সে যে অতীতের কথা বিস্মৃত হয়নি, শ্রদ্ধার সাথে মনে রেখেছে, সেটা আমার জন্য আনন্দের।

আরও আনন্দের কথা, প্রীতিভাজন বটু আমার নামে তার গল্পগ্রন্থ প্রতিদিন একটি রুমাল উৎসর্গ করে শ্রদ্ধার নিদর্শন রেখে গেছে। ছাপান্ন কি আটান্ন সালের কথা। একালের খ্যাতিমান কথাশিল্পী মাহমুদুল হকের একটি ছোটগল্প সরকারি মাহে নও পত্রিকায় ছাপার কারণে আমার প্রায় চাকরি যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। মাহমুদুল হক পুরোনো ঢাকার পটভূমিকায় এবং সেখানকার বাসিন্দাদের নিয়ে একটি বাস্তবধর্মী আকর্ষণীয় গল্প লিখেছেন। বাস্তবতা ও জীবনধর্মিতার প্রয়োজনেই সে গল্পটিতে বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপে ব্যবহার করেছিল ঢাকাইয়া ভাষা, কিছু খিস্তি-খেউর। বয়সে তরুণ হলেও মাহমুদুল হকের গল্পটিতে ছিল জীবনালেখ্য ফুটিয়ে তোলার এবং চিত্রণের দক্ষতা, ভাষা ব্যবহারের কিছুটা নৈপুণ্য। মাহে নও-এর সহ-সম্পাদক হিসেবে আমি গল্পটি মনোনীত করি এবং সেটি যথাসময়ে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গল্পটি প্রকাশের পর এটি আপত্তিকর ও অশ্লীল বলে অনেকে নাকি লিখিতভাবে অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গল্পটি প্রকাশের জন্য আমার মৌখিক কৈফিয়ত তলব করা হয় এবং লেখক মাহমুদুল হকের নাম ব্ল্যাকলিস্টেড হয়ে যায়। তার লেখা মাহে নও পত্রিকায় প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়। [বিস্তারিত বিবরণের জন্য দ্রষ্টব্য: ‘পূবালী’র দিনগুলো ও সমকালীন সাহিত্য সংস্কৃতি। মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, পৃ. ২১-২২]

এই ঘটনায় আমি মনে মনে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম, মনে দুঃখও পেয়েছিলাম। পরে উপলব্ধি করেছিলাম, মাহমুদুল হক জীবনধর্মী এবং চক্ষুষ্মান ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কথাশিল্পী বলেই পাঠকের মনে তার গল্পটি গভীরভাবে দাগ কেটেছে। এমন জীবনবাদী ও শক্তিমান কথাশিল্পী মাহমুদুল হক কেন যে মধ্যবয়সে ব্যাপক খ্যাতি অর্জনের প্রাক মুহূর্তে সাহিত্যচর্চা এবং জীবন-যাপনের প্রতি অনীহ ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেল তা আজও আমি ভেবে পাই না। যখন শুনতাম আমাদের প্রিয় বটু বাস্তবজীবনের এবং জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হওয়ার বদলে এক ধরনের রহস্যময় জীবনের দিকে, সাধু সন্ন্যাসীদের জীবনযাত্রা ও আখড়ার প্রতি আকৃষ্ট ও ধাবিত হচ্ছে, তখন অবাক না হয়ে পারিনি। যে বটু কিশোরকাল থেকেই জীবন-যাপনে ও চালচলনে আধুনিকতামনস্ক সে কেন পরিণত বয়সে অনাবিষ্কৃত ও অদেখা রহস্যময় জীবনের দিকে যাত্রা করবে। নাকি তথাকথিত কোনো কোনো আধুনিক কবি-সাহিত্যিক ও সঙ্গী-সাথীরা জীবনের রহস্য আবিষ্কারের নামে তাকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল।

মৃত্যুর আগেণ্ড অনেক বছর ধরে বটুর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। ১৯৯৯ সালে আমার স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ কৈশোরকালের কথা ও সাহিত্য জীবনের সূচনাপর্ব প্রকাশের পর তা পাঠ করে বটু আমাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানায়, আমার স্মৃতিশক্তির ভূয়সী প্রশংসা করে। বটু আমাকে কথা দিয়েছিল যে, একদিন সে আমার বাসায় আসবে এবং তখন অনেক কথা হবে। কিন্তু তার আর আসা হয়নি, আমিও শারীরিক অসুস্থতার কারণে যেতে পারিনি তার তখনকার এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়। মৃত্যুর অমোঘ হাত সেই পথ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। হয়তো অচিরকালের মধ্যেই আমিও অন্যলোকে তার সহযাত্রী হবো। সেখানে দেখা হবে কিনা কে জানে! একটি কবিতায় আমি লিখেছিলাম ‘কে গেল আগে কে পরে সেটা কোনো বড় কথা নয়। অন্তিমে সকলি হবে প্রলয়ে বিলয়।’

মোহাম্মদ মাহ্‌ফুজউল্লাহ্‌
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, জুলাই ২৪, ২০০৯

Category: স্মৃতিচারণ
Previous Post:গানের রাজা রজনীকান্ত সেন
Next Post:ধক ধক

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑