রক্তফলক

রক্তফলক

প্রবল উত্তুরে হাওয়ার রাত ছিল সেটি, আর সে বছর মধ্য মাঘ মাসে নেমেছিল বৃষ্টি। প্রত্যাশিতভাবেই সমগ্র মহাবিহার ঘুমে আচ্ছন্ন, শুধু এক জনই জেগে আছেন এই দুর্যোগের রাতে। প্রধান চৈত্যটির পাশ দিয়ে লম্বা বারান্দা, আর তারপরেই শ্রমণদের থাকার সারিসারি ঘর। ভন্তে ভিক্ষুপা তাঁর অঙ্গবস্ত্রটি দিয়ে প্রদীপটি আড়াল করে সাবধানে বাঁচিয়ে শেষ ঘরটির মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। তারপর এদিক-ওদিক দেখে উত্তর-পূর্বের কোণের একটি পাথরের ওপর মৃদু চাপ দিতেই সেটি ভেতরে ঢুকে গেল। আর সঙ্গেসঙ্গে কালো দেওয়ালের একটি অংশ খুলে উন্মুক্ত হল একটি গুপ্তপথের মুখ। সন্তর্পণে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার ভেতরে ঢুকে দেয়ালের অংশটি ঠেলে গোপন রাস্তাটি বন্ধ করে দিলেন ভিক্ষুপা।

খানিকক্ষণ বাদে ঠিক সেই ঘরের বাইরে যেন ভোজবাজির মতোই আবির্ভূত হলেন তিন জন, তাদের মধ্যে এক জন দ্রুত এসে পাথর চেপে সরিয়ে সেই গুপ্তসুড়ঙ্গের পথ উন্মুক্ত করলেন, তারপর চাপা গলায় বললেন, ‘আসুন স্থবিরশ্রেষ্ঠ, আসুন পণ্ডিতাচার্য, দ্রুত গেলে হয়তো কন্যা তিনটিকে বাঁচালেও বাঁচাতে পারি।’

দ্রুত সেই গুপ্তপথে প্রবেশ করলেন পালসম্রাট কুমারপালের প্রধান অমাত্য সোমেশ্বর গর্গ, মহাপণ্ডিতাচার্য বোধিভদ্র এবং অঙ্গ থেকে হরিকেল তথা সমগ্র পৌণ্ড্রবর্ধনের অহংকার, সোমপুর মহাবিহারের মুখ্যস্থবির, পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের আধ্যাত্মিক গুরুদেব শ্রীরত্নাকরশান্তি।

* * *

রক্ত দেখতে খুব ভালোবাসে টেনিয়া, ছোটোবেলা থেকেই। ওর যখন পাঁচ বছর বয়েস, তখন থেকেই আরশোলা আর ইঁদুর ধরে ব্লেড দিয়ে কেটে দেখা ওর প্রিয় শখ ছিল। নেতাজিনগরের উদ্বাস্তু কলোনির ছেলেটির এহেন শখ দেখে আত্মীয়স্বজনরা হেসে কুটিপাটি হতেন, ‘অ মায়া, দেইখ্যা যাও, তুমার পোলা ডাক্তার অইব মনে লয়।’ হাসিটা অবশ্য মিলিয়ে গেছিল যেদিন সাত বছর বয়েসি টেনিয়া মায়ের কাপড় কাটার কাঁচি দিয়ে একটা দু-সপ্তাহ বয়েসি বিড়াল বাচ্চার মুণ্ডু কেটে ফেলে। মা বিড়ালের করুন মিউ মিউ কান্না শুনে সেদিন মায়ারানি হালদার মুখে ভাত তুলতে পারেননি। এরপর টেনিয়াকে শোধরাবার অনেক চেষ্টা করা হয়, ফল হয় উলটো। নিজের ছেলের মধ্যে শীতল নিষ্ঠুরতা আর শিয়ালের ধূর্ততা নজর এড়ায়নি তাঁর। ডাক্তার বদ্যি মানত জলপড়া, চেষ্টা সবই হয়, বলাবাহুল্য লাভ কিছুই হয়নি।

মায়ারানি জানতেন যে হবে না।

তাঁর শ্বশুরবংশে কারো কারো এরকম উন্মাদ ও হিংস্র হয়ে ওঠার ইতিহাস আছে। তাঁর শাশুড়ির ভাসুরের বড়ো ছেলের নাকি এরকম অভ্যেস ছিল। নিজের হাতে মুরগির মাথা ছিঁড়ে ফেলা, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কুকুরছানার চোখ তুলে ফেলা, খাঁচার মধ্যে কয়েকটা হিংস্র ক্ষুধার্ত সড়ালে কুত্তার মধ্যে বাচ্চা সমেত মা বিড়াল ছেড়ে দেওয়া, এসবের মধ্যে লোকটা পৈশাচিক উল্লাস খুঁজে পেত। আর উত্তর চর মজলিশপুরের জমিদার রতিকান্ত হালদারের বড়ো ছেলের সেইসব কাজে বাধা দেবে, এমন সাহস গোটা চট্টগ্রামে কারও ছিল না। শুধু তাই নয়, মায়ারানি জানেন, শুধু হিংস্রতাই নয়। সঙ্গে করে এরা নিয়ে আসে অতলস্পর্শী কামুকতা। লঘুগুরু জ্ঞান থাকে না, সময় অসময় বিচার থাকে না, পাত্র অপাত্র ভেদ থাকে না, এমনই রাক্ষুসে সর্বগ্রাসী সেই কামস্পৃহা! রতিকান্ত হালদারের বড়ো ছেলের হাতে তিনি নিজে কতবার নিগৃহীতা হয়েছেন, বলতে বলতে কেঁদে ফেলতেন মায়ারানির শাশুড়ি। শেষে নিজের বাবারই এক মুসলমান রক্ষিতাকে নিয়ে সে পালায়, তখন তার বয়েস ষোলো! যাবার আগে অবশ্য সে বাবার সঞ্চয়ের বেশ খানিকটা অংশ নিয়ে যেতে, আর বাবার বুকে একটা আধহাতি তলোয়ার গেঁথে দিয়ে যেতে ভোলেনি!

মায়ারানির তাই ভয় হয়। একে কলোনি এলাকা, উঠতি বয়সের মেয়ে বউদের ভিড়। আর তা ছাড়া বাঙালদের মধ্যে অন্তরালের আব্রু ব্যাপারটা কম। কবে কী কেলেঙ্কারি হয়ে যায়, ভেবে মায়ারানি কাঁটা হয়ে থাকেন।

* * *

অতসী গেছিল সাহাদের বাড়ির পেছনে কী একটা কাজে, ওর ঠিক মনেও নেই। আসার সময় হঠাৎ করেই চোরকাঁটার একটা ঝোপ ওর শাড়ি টেনে ধরে, আর সেটা ছাড়াতে গিয়েই ওর নজরে পড়ে লাল বলটা।

অতসীর ছেলের বয়েস তিন। লাল বল দেখলে চকাই খুশিই হবে, ভেবে বলটা তুলতে গিয়েই ফলকটা নজরে পড়ে ওর। নেহাত কৌতূহল বশেই ফলকটা তুলে নেয় ও, আর তখনই টের পায় যে ফলকটা বেশ ভারী। ওর ছেলের লেখার স্লেট যেরকম, প্রায় সেরকম সাইজেরই, চারিপাশে ভাঙা, কিন্তু তেলতেলে মসৃণ। মানে রীতিমতো ব্যবহার হত আর কী! সলিড পাথরের তৈরি বোঝাই যাচ্ছে, নইলে এত ভারী হয় না। কিন্তু অতসীকে যেটা আশ্চর্য করল, সেটা হচ্ছে ফলকের ওপরে খোদাই করা ছবিটা। পাথরে কুঁদে বানানো চারটে শরীর। একদম নীচে, বাঁ-দিকে এক জন মানুষ বসে আছে পদ্মাসনে, আর দুই হাত তুলে কার প্রশংসা করছে। প্রশংসা করছে অবশ্য দুই নর্তকীর, যারা ফলকের মাঝামাঝি, এবং স্পষ্টতই তারা নাচছে। যেটা বুঝতে পারল না অতসী, যে দু-জনেরই মাথা বাঁ-দিকে নাচের ভঙ্গিতে হেলানো, আর দু-জনারই ডান হাত তাদের ঘাড়ের কাছে। হাতে কি কিছু ধরা আছে? বুঝতে পারল না অতসী। যাগগে যাক। ফলকের ওপরে আবার এক জন মহিলা, আশীর্বাদ দেওয়ার ভঙ্গিতে।

ফলকটা ফেলেই দিত অতসী, কিন্তু খেয়াল করে দেখল যে সিঁদুর আর তেলের দাগ রয়েছে নীচের দিকে। মানে পুজোআচ্চা হত বা হয়। ফেলে দেবে অতসী? এমনিতেই দিন ভালো যাচ্ছে না ওর। ওর বরের সঙ্গে রোজ তার মালিকের খিটিমিটি লাগছে। অনেকদিন থেকেই ভোম্বল বলছে ওই মালিকের কাছে ও চাকরি করবে না, এবার একটা টোটো কিনবে।

মা, মা গো, দয়া করো মা, একটু দেখো।

ফলকটা প্রণাম করে নিয়েই নিল অতসী।

* * *

সুড়ঙ্গের মধ্যে আদিম অন্ধকার। হাতড়ে হাতড়ে বেশ খানিকক্ষণ গিয়েই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তিন জন। কারও কাছেই আলোর উৎস কিছু নেই। হঠাৎ করে রত্নাকরশান্তির হাতে জ্বলে উঠল একটি প্রদীপ। শান্ত, কিন্তু ভারি উজ্জ্বল। চকিতে আলোময় হয়ে উঠল অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ। প্রথমটা হকচকিয়ে গেছিলেন সোমেশ্বর আর বোধিভদ্র। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, ‘এই উজ্জ্বলতম আলোকরশ্মি কোথায় পেলেন গুরুদেব? আমরা তো শুধু…’ হাত ঠোঁটে তুলে শশশস করলেন রত্নাকরশান্তি। এক বার শুধু চাপা গলায় বললেন যে ‘দ্রুত যেতে হবে ভদ্র, অসহায় তিনটি বালিকার কান্না আমি স্বকর্ণে শুনেছি। আর এই আলো? এর উৎস কিছু চৈনিক অগ্নিমশালা, আমার প্রিয় শিষ্য অতীশ তিব্বতেই এর সন্ধান পেয়ে কিছুমাত্র মশালাচূর্ণ আমাকে পাঠায়। তারই কিছু সাবধানে, বিশেষ প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করলাম। চলুন সামনে এগোনো যাক। অতীশ বলে পাঠিয়েছে যে খুব সাবধানে এর নাড়াচাড়া করতে। এ দিয়ে নাকি প্রাচীন কালের ব্রহ্মাস্ত্র বা পাশুপতাস্ত্রের মতন মহাধ্বংসলীলা চালানো সম্ভব। অতীশের ধারণা মহাভারতীয় অস্ত্র, সবই নাকি স্বাভাবিক সাংখ্য যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা যায়। তাই হোক, হে ভদ্র, আসুন, আপাতত সোমপুর মহাবিহারের অদ্যাবধি অনাবিষ্কৃত গুপ্ততম প্রকোষ্ঠে সযতনে প্রবেশ করি, এইবার আপনাদের চোখের সামনে উন্মুক্ত হোক…’

চোখের সামনের দৃশ্যটির জন্যে অবশ্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না।

* * *

স্নান করছিলেন মায়ারানি। তাঁর বয়েস সাতচল্লিশ। বিধবা মায়ারানির যৌবন এখনও যায় যায় করেও যায়নি, তার ওপর তিনি সুন্দরী। রাস্তায় বেরোলে এখনও লুব্ধ পুরুষের নজর তাঁর সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে যায়। শিরশির করে ওঠে মায়ারানির গা। কুপ্রস্তাব কি কম পেয়েছেন নাকি এই এক জীবনে?

স্নান করে পুজোয় বসলেন মায়ারানি। আরাধ্যদেবতার পুজো করে ঠাকুরের আসনের নীচ থেকে একটা চওড়া, বাচ্চা ছেলেদের স্লেটের আকারের একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স বার করলেন।

মায়ারানির শ্বশুর-শাশুড়ি সাতচল্লিশে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসার সময় প্রায় কিছুই আনতে পারেননি, এই বাক্সটা ছাড়া। এ নাকি তাঁদের পরিবারের অনেক প্রাচীন বিগ্রহ। এ জিনিস হালদার পরিবারের বাইরে কারও দেখার অধিকার নেই। এবং পরিবারের বউ বা মেয়ে ছাড়া কোনো পুরুষের পূজা করবার অধিকার নেই।

শাশুড়ি যতদিন বেঁচে ছিলেন, তিনিই এর পূজা করতেন, প্রতি অমাবস্যা তিথিতে। মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে আর পাঁচটা জিনিসের সঙ্গে এইটাও সঁপে দিয়ে যান মায়ারানির হাতে, আর বলে যান কয়েকটি গুহ্য কথা,

‘একখান কথা কই মায়া, কারোরে কইবা না। আমাগো পরিবারের উফর একখান অভিশাপ আসে। আমাগো কোন এক পূর্বপুরুষ কী একখান নাকি খুব নীচ পাপকাজ কইরা রাজার আদেশে দ্যাশান্তরী হন। হেই থিক্যা আমাগো ফেমেলিতে থাইক্যা থাইক্যা একখান কইরা অপদ্যাবতা জন্ম নেয় আর তার মায়ে বাপেরে অ্যাক্কেরে শ্যাষ কইরা ফালায়, এই হইলো গিয়া আমাগো শাস্তি। এইখান সাবধানে রাখবা, তাহইলে আমাগো বংশধারা থাইক্যা যাইবো অ’নে, শাস্তি ভোগ কইরাও। সাবধানে রাখবা, কারোরে দ্যাহাইবা না। মাইয়ালোগ ছাড়া এয়ার পুজা করায় নিষেধ আসে। অমাবস্যাতিথিতে পুজা দিবা।’

‘পূজার বিধি কী মা?’ জানতে চেয়েছিলেন মায়ারানি।

পূজাবিধি বলে দেওয়ার পর খানিকক্ষণ চুপ করেছিলেন সেই বৃদ্ধা, তারপর ফিসফিস করে বলেন, ‘ দি কোনোদিন এইডা নিজে নিজে হারাইয়া যায়, খোঁজবা না। জানবা হালদার বংশের শ্যাষ সময় উপস্থিত, হেইদিনই আমাগো বংশলোপ অইবো, হালদার ফেমেলির কেউই আর বাঁইচ্যা থাকবা না। এক মহাপুরুষ আইস্যা এঁয়ারে উদ্ধার কইরা লয়্যা যাবেন। হেইডাই হইলো গিয়া আমাগো ফেমিলির মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত।’

সামান্য কেঁপেই উঠেছিলেন মায়ারানি, কার কেন কীসের অভিশাপ তা কেউই লিখে রাখেননি, কেউই জানেন না, তাঁর শাশুড়িও নয়। শুধু কে জানে কবে থেকে এই অভিশপ্ত পরিবার বসে আছে পুরুষে পুরুষে অপরাধ ভোগ করার জন্যে আর বংশধারা লোপ করে শাপমুক্তির জন্যে! কত নৃশংস সেই পাপ যে হাজার বছর তার জের টেনে যেতে হয়?

‘ইনি কে মা? কোন দেবতা?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মায়ারানি। শাশুড়ি বলেছিলেন দেবতা নয়, দেবী। তবে ‘ইনি কে কইতে পারুম না। অনেক পুরুত মশাইরে জিগাইসি বন্ননা কইরা, কেউই কইতে পায় নাই। রক্ষা কইরো এনারে। খুবই জাগ্রত দেবী, অবহেলা কইরো না।’

এর কয়েক দিন পরেই শাশুড়ি চোখ বোজেন। তখন মায়ারানির বয়েস সাঁইত্রিশ।

আর তার একমাসের মধ্যেই ঘটে যায় সেই দুর্ঘটনা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মায়ারানি। দশ বছর হয়ে গেল, এখন তার বয়েস হওয়ার কথা ছাব্বিশ। কে জানে কোথায় আছে, কেমন আছে।

চওড়া বাক্সটা বার করে ডালাটা খোলেন মায়ারানি, আর তারপর আতঙ্কে, ভয়ে আর বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যান। বাক্সটা খালি!

* * *

বালুরঘাটের বিবেকানন্দ পাড়ায় দত্তগুপ্ত গিন্নির সুনাম আছে ধর্মপ্রাণা মহিলা বলে। ভদ্রমহিলা ঝাড়া হাত পা, ছেলে-মেয়ে দু-জনেই বিবাহিত, বাইরে চাকরি করে। স্বামী ভদ্রলোকটি ভারি ভালোমানুষ, বহুদিন বালুরঘাট কলেজে দর্শন পড়িয়েছেন। ফলে কর্তা-গিন্নির ইহজীবনের জাগতিক দায়দায়িত্ব আপাতত শেষ। মাঝেমধ্যে ছেলের কাছে মুম্বাইতে বা মেয়ের কাছে ব্যাঙ্গালোরে ঘুরে আসা, গান শেখানো, গিন্নিদের দ্বিপ্রাহরিক আলাপ, কর্তার অবসরপ্রাপ্ত বন্ধুদের নিয়ে বৈকালিক আড্ডা দেওয়া, এই নিয়েই কেটে যাচ্ছে। তবে গিন্নিমার দিনের বেলার প্রায় পুরোটাই যায় ঠাকুরসেবায়। দত্তগুপ্ত গিন্নির বিশাল ঠাকুরঘরে খুঁজলে নাকি তেত্রিশ কোটি দেবতার কম করে হলেও অন্তত অর্ধেককে পাওয়া যাবেই, পাড়ায় প্রচলিত প্রবাদ। এ ছাড়াও ভদ্রমহিলা দরিদ্র প্রতিবেশীদের প্রয়োজনে দেখেন, পাড়ার কয়েকটি শিশুর পড়াশোনার ব্যয়ভার চালান, সব মিলিয়ে বেশ জনপ্রিয়ই বলা চলে।

অতসীর এ বাড়িতে যাতায়াত ছোটোবেলা থেকেই। বস্তি বাড়ি থেকে প্রায় কুড়িয়ে এনে একে মানুষ করেছিলেন গিন্নিমাই। নইলে নেশাখোর বাপ আর বহুগামিনী মায়ের সংসারে যে এতদিনে সে ভেসে যেত, সেটা অতসী ভালো করেই জানে। লেখাপড়া বেশি হয়নি অতসীর। আঠারো বছর বয়সে খানিকটা গিন্নিমার সঙ্গে জোরাজুরি করেই সে ভোম্বলকে বিয়ে করে। সে বিয়েও গিন্নিমাই দেন। আজ ফলকটা পেয়ে সে সোজা এসে গিন্নিমার দরবারে উপস্থিতি।

গিন্নিমা আজ বেজায় ব্যস্ত ছিলেন। গ্রাম থেকে তাঁর দেওরের বড়ো মেয়ে তিতলি এসেছে, প্রায় দু-বছর পর। এই দেওরকে তিনি পুত্রসম স্নেহে মানুষ করেছেন। সে এখন তাঁদের গ্রামের দিকের পৈতৃক সম্পত্তির দেখাশোনা করে, দাদা-বউদিকে সাক্ষাৎ দেবতাজ্ঞানে শ্রদ্ধা করে। ফলে তার মেয়ে যে ওঁদের চোখের মণি হবে সে তো বলাই বাহুল্য। আর কী দেখতে হয়েছে মেয়েকে! সবে ষোলো বছর বয়েস, আহা, সাক্ষাৎ দেবীপ্রতিমা যেন, রূপ যেন একেবারে ফেটে পরছে। উজ্জ্বল গম রঙের ত্বক, তাতে লালচে আভা, একঢাল কোঁকড়ানো চুল, পদ্মফুলের পাপড়ির মতন চোখ আর তেমন মিষ্টি ব্যবহার। গিন্নিমা তো ঘুরে ঘুরে দেখেন, আর আশ মেটে না। থেকে থেকেই থু থু করে যাচ্ছেন, আহা যদি নজর লাগে।

পাশের মুখুজ্জে বাড়ির যমজ মেয়ে সোনাই আর রূপাই তো তিতলির খুব ন্যাওটা। তারা তো দিদিকে দু-বছর বাদে পেয়ে কি করবে বুঝেই উঠতে পারছে না। সেই সক্কাল থেকে চিলেকোঠায় গল্প জুড়েছে তিন জনে। ছাদে কাপড় মেলতে গিয়ে হা হা হি হি শুনেছেন তিনি বার দুয়েক। এই বারো বছর ষোলো বছর বয়সে এত কী তোদের গোপন গল্প রে বাপু, অ্যাঁ?

অতসী যখন আসে, দত্তগুপ্ত গিন্নি তখন খেয়েদেয়ে শোবার উদ্যোগ করছিলেন, ফলকটা দেখে বললেন, ‘তোর হাতে ওটা কিরে অতসী?’ অতসী হাত পা নাড়িয়ে বেশ বর্ণনা সহকারে তার প্রাপ্তি কাহিনিটি জানালো, ‘মনে হচ্ছে খুব বড়ো তিন দেবী, বুইলে গিন্নিমা, আমি তো ভাবলুম তোমার কাছে দিলে সেবাযত্ন পাবে, তাই নিয়ে এলুম।’

এর বেশি কিছু বলার দরকারও ছিল না গিন্নিমাকে। ঠাকুরদেবতার মূর্তিগুলোকে উনি মানুষ জ্ঞান করেই সেবাযত্ন করেন। গরমের আলাদা জামা, শীতের আলাদা জামা, তার ওপর মরসুমের নতুন ফল কি সবজি, সবই আগে ঠাকুরসেবায় যায়। গরমকালে ঠাকুরঘরে এ সি চলে, কর্তার অনুযোগ উপেক্ষা করে। হৃষ্ট মনে গিন্নিমা ফলকটা নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে বললেন, ‘চল তাহলে, মায়ের যখন ইচ্ছে।’

অতসী ফিরে যাবার সময় দেখল ছাদে দাঁড়িয়ে চাপা লজ্জারুণ মুখে মোবাইলে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে তিতলি।

* * *

একটা দীর্ঘ গুপ্তপথ পেরিয়ে তিন জনে যখন সেই পথের শেষে এসে দাঁড়ালেন, তাঁদের সামনে একটা বিশাল গর্ভগৃহ। তার চারিপাশের দেওয়ালে মশাল গুঁজে রাখার ফলে স্থানটি ঈষৎ আলোকিত। প্রবেশপথের একদম উলটোদিকের দেওয়ালে লম্বমান একটি চিত্রিত বস্ত্রখণ্ড। তার সামনে, প্রবেশপথের দিকে পিঠ করে বসে একটি বিশাল শরীর, তার উর্ধ্বাংশ অনাবৃত, নিম্নাংশে পরিহিত গেরুয়া পট্টবস্ত্র। তাঁর পাশে বিনীতভাবে দাঁড়ানো একটি শরীর, এই সোমপুরা মহাবিহারের একজন শ্রমণ, ভিক্ষুপা।

চিত্রিত বস্ত্রখণ্ডটিতে যে চিত্রটি অঙ্কিত, চকিতে দেখলে অতিবড়ো সাহসীরও বুক কেঁপে উঠবে। চিত্রের মধ্যস্থলে এক ভয়ালদর্শন কালদংষ্ট্রাবিশিষ্ট নীলবর্ণ পুরুষের ছবি। ভয়াবহ আরক্ত চোখ দুটি যেন বাইরে বেরিয়ে এসেছে অসীম ক্ষুধায়। তাঁর মাথায় রত্নখচিত বহুমূল্য মুকুট অঙ্কিত। মুখমণ্ডল সামান্য উন্মুক্ত, তার মধ্যে দিয়ে তাঁর শ্বদন্ত দুটি প্রকট। গলায় মুণ্ডমালা, বদনমণ্ডল ক্রোধাবেশে উদ্ভাসিত এবং কেশরাজি অগ্নিশিখার ন্যায় উর্ধ্বগামী। ইনি আলীঢ় পদে, অর্থাৎ দক্ষিণ পদ অগ্রবর্তী করে, এবং বাম পদ পিছনে মুড়ে নীচে এক যুগনদ্ধ মূর্তিকে পদদলিত করছেন।

শ্রীরত্নাকরশান্তি এবং বোধিভদ্র জানেন ওই যুগনদ্ধ মূর্তি কার। ভৈরব ও কালরাত্রি!

এখানেই শেষ নয়, এক উলঙ্গিনী দেবী, যাঁর গাত্রবর্ণ রক্তের ন্যায় লাল, তিনি এই নীলবর্ণ পুরুষের বাম ঊরুর ওপর আসীনা, তাঁর মুখ সেই ভয়াল পুরুষটির মুখের কাছে, দেবীর শুধুমাত্র উন্মুক্ত পশ্চাৎদেশটি দৃশ্যমান এবং শুধুমাত্র বাম পার্শ্বের মুখমণ্ডলটি উদ্ভাসিত। আহা, কী ক্রোধোদ্দীপ্ত, কী ভয়ংকর সেই মুখমণ্ডল! তাঁরও বাম পদ সেই ভৈরব ও কালরাত্রির যুগনদ্ধ মূর্তির উপর স্থাপিত। নীলবর্ণ সেই ভয়াল পুরুষটির ঘাড় জড়িয়ে দেবীর দুটি হাত, এক হাতে উদ্যত কর্ত্রি, আরেক হাতে রক্তপূর্ণ করোটি। আর দেবীর মাথার পাশ থেকে একটি বরাহমুখ নির্গত হয়ে রয়েছে।

এর সামনে যে বিশালকায় পুরুষটি বসে ছিলেন, তিনি ‘হ্রীঃ হ হ হুঁ হুঁ ফট’ বলে সেই বিশাল চিত্রপটাঙ্কিত বস্ত্রখণ্ডের উপর কিছু রক্তচন্দনচর্চিত পদ্ম ছুঁড়ে দেওয়ার সঙ্গেসঙ্গে পিছন থেকে মহাস্থবির রত্নাকরশান্তি গম্ভীরস্বরে বলে উঠলেন ‘এই সময়ে এত গোপনে আপনি কীসের সাধনায় রত ভন্তে বজ্রকেতু, জানতে পারি?’

সেই বিশালদেহী পুরুষটি চমকে ঘাড় ঘোরালেন, চমকে উঠলেন ভিক্ষুপা। উঠে না দাঁড়িয়ে, না ঘুরেই গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলেন বিশাল পুরুষটি, ‘চক্রসম্বর হেরুকের আরাধনা তো আপনার অজানা নয় স্থবিরশ্রেষ্ঠ, আর চক্রসম্বর হেরুক ও দেবী বজ্রবারাহীর যুগনদ্ধ মূর্তি কি আপনার মতন পণ্ডিতের অদেখা? ইনি দেব সপ্তাক্ষর, দেবী বজ্রবারাহী…’

রূঢ় কণ্ঠে তাঁকে থামিয়ে দেন সোমেশ্বর গর্গ, ‘উঠে দাঁড়ান ভন্তে, ওইভাবে কারো সঙ্গে কথা বলা ভব্যতাবিরুদ্ধ, সে আপনি জানেন না?’

এইবার সম্পূর্ণ উঠে দাঁড়ালেন সেই দীর্ঘকায় বলশালী পুরুষটি। এদিকে ফিরে তাকাতে প্রকাশ পেল তাঁর পেশিবহুল চেহারা। মাথায় অবিন্যস্ত কেশরাশি জটাকারে চূড়া করে বাঁধা, শ্মশ্রুগুম্ফময় মুখ। তবে সবচেয়ে দর্শনীয় বুঝি চোখ দুটো।

মনে হয় যেন সহস্র বছরের আদিম ক্রূরতা সেই চোখের অতলে লুকিয়ে আছে, লুকিয়ে আছে আগ্নেয়গিরির মতন। বিষধর কালনাগিনী যেন ফনা তুলবে যেকোনো মুহূর্তে, কিন্তু আপাতত শীতল বিষের সঞ্চয় নিয়ে সে অপেক্ষমান।

সামান্য কৌতুক কি খেলে গেল বজ্রকেতুর মুখে? সাড়ম্বরে মাথা ঝুঁকিয়ে বললে, ‘প্রণত হই মহামাত্য গর্গ। কী সৌভাগ্য, আচার্য বোধিভদ্রও উপস্থিত দেখছি। অধীনের প্রতি কী আদেশ প্রভু?’

‘প্রশ্ন তো আগেই করেছি ভন্তে বজ্রকেতু। এই সময়ে এত গোপনে সপ্তাক্ষর বজ্রবারাহীর পুজোর কী প্রয়োজন? সোমপুর মহাবিহারের যেকোনো চৈত্যে বা প্রকোষ্ঠে আপনি এ পূজা করতে পারতেন ভন্তে’, শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন রত্নাকরশান্তি।

‘মন্ত্রযানে আসনসিদ্ধির উপায় ও প্রকরণ যে একান্ত গোপনীয়, হে মহাস্থবির।’

‘কীসের এত গোপনীয়তা বজ্রকেতু?’ সামান্য অস্থির গলায় প্রশ্ন করলেন বোধিভদ্র, ‘সোমপুর মহাবিহার সম্পূর্ণত সদ্ধর্মের মহাযানপন্থা অবলম্বন করে। যেখানে বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বরের পথানুসারে বহুজনসুখায় বহুজনহিতায় করুণাবিতরণ করে জগতের উদ্ধারই একমাত্র লক্ষ্য। যদি ব্যক্তিগত সম্বোধিই একমাত্র লক্ষ্য হয়, ধর্মকায়ে এবং তথতায় যদি একাই আগত হতে চান, তাহলে মহাযানপন্থা আপনার পথ নয় ভন্তে, আপনি থেরবাদী, স্বার্থপর হীনযানী। আপনি কীসের আকাঙ্ক্ষায় ব্যক্তিগত সিদ্ধির পথ বেছে নিলেন ভন্তে বজ্রকেতু? এত গোপনীয়তা কীসের? প্রভু শাক্যসিংহ তো আমাদের এই রাস্তা দেখাননি ভন্তে।’

‘আহ, তত্ত্বকথা রাখুন পণ্ডিতাচার্য, আমার প্রশ্নের উত্তর চাই। ভন্তে বজ্রকেতু, আমার চরেরা খবর দিয়েছে একটু আগে পাশের গ্রাম থেকে আপনি আর আপনার এই অনুগত শ্রমণ শিবাপা মিলে তিন জন শিশুকন্যা চুরি করে এনেছে। তারা কোথায়?’ সোজা প্রশ্ন সোজা ভাবে করাই মহামাত্য সোমেশ্বর গর্গের বৈশিষ্ট্য।

‘পালবংশের উন্নতি হোক। সামান্য তিনটি গ্রামীণ কন্যার জন্যে স্বয়ং মহামাত্য ছুটে এসেছেন…’

‘স্থানীয় মহাপ্রতিহারের সঙ্গে কয়েক জন দণ্ডপাশিকা বা দণ্ডশক্তি পাঠালেই হত। কিন্তু আশেপাশের গ্রাম থেকে এই কন্যা শিশু চুরি এবং সোমপুর মহাবিহারের ভিতর তাদের গোপনে নিয়ে আসার অভিযোগ বেশ কয়েক দিন ধরে স্থানীয় মহাসামন্তের দ্বারা আমাদের কর্ণগোচর হচ্ছিল। যেহেতু পালবংশের গৌরব সোমপুর মহাবিহারের সঙ্গে জড়িত, তাই আমাকে নিজে আসতে হয়েছে ভন্তে। এইবার জবাব দিন, কন্যা তিনটি কোথায়? আর এরকম আচরণের কারণ কী?’

মুহূর্তে মুখের ভাব বদলে যায় সেই বিশালদেহী পুরুষটির। সারা মুখে ছড়িয়ে পরে অদ্ভুত এক শান্তি, ‘কন্যা নয় মহামাত্য, তারা এখন মহান হেরুক ও বজ্রবারাহীর পদতলে অতি পবিত্র তিনটি অর্ঘ্য, তিনটি স্বয়ম্ভু কুসুম।’

চোয়াল দৃঢ় হল বোধিভদ্র এবং রত্নাকরশান্তির। রজঃস্বলা বা ঋতুমতী কন্যাকে এই নবোত্থিত মন্ত্রযানমতে বলা হয় স্বয়ম্ভু কুসুম। সোমেশ্বর অতশত বুঝলেন না, শুধু গলা চড়িয়ে বললেন, ‘অর্ঘ্য মানে? কী উন্মাদের প্রলাপ শুরু করেছেন ভন্তে?’

বিশাল পুরুষটি এইবার পূজার স্থল থেকে পুরোপুরিভাবে সরে দাঁড়ালেন। আর সেইক্ষণে তিন জনেই ক্রোধে, আতঙ্কে, বিবমিষায় স্থির হয়ে গেলেন।

সেই চিত্রাঙ্কিত বস্ত্রটির একদম নীচে একটি ফলক রাখা আছে। তাতে কয়েকটি শরীর উৎকীর্ণ। লাল রঙের সেই ফলকটি সিঁদুর ও চন্দনচর্চিত, সামনে কিছু ফুল পড়ে আছে। তার সামনে ভূমির ওপর জটিল একটি জ্যামিতিক ছবি আঁকা। যন্ত্র অঙ্কনে দুই পণ্ডিতপ্রবরেরই বিশেষ সিদ্ধি আছে, কিন্তু তাঁরাও বুঝতে পারলেন না, এতই জটিল সে যন্ত্র। অবশ্য তাঁরা বুঝবার মতন অবস্থাতেও ছিলেন না।

সেই যন্ত্রচিত্রটির মধ্যস্থানে একটি তাম্রপত্রের ওপর ত্রিভুজাকারে সাজিয়ে রাখা তিনটি সদ্যকর্তিত ছিন্ন শিশু বালিকামুণ্ড!!!

ক্রোধে ক্ষোভে দিশাহারা বোধিভদ্র কাঁপতে কাঁপতে দক্ষিণ হস্তের তর্জনী তুলে বললেন, ‘ওরে নরাধম পাষণ্ড, এ কী করেছিস? তিনটি অসহায় বালিকার বলি দিয়ে ভাবছিস অর্হৎ হবি? বোধি লাভ করবি? হায় শাক্যসিংহ, হায় অবলোকিতেশ্বর, দেখে যাও, তোমাদের প্রচলিত সদ্ধর্মের নামে কী মহাপাপ করেছে এই বর্বর। ওরে পাপিষ্ঠ, নিরীহ প্রাণীহত্যায় ভেবেছিস পুণ্য হবে তোর? নরকভোগ হবে তোর, অক্ষয় নরকভোগী হবি তুই’, মহাপণ্ডিতাচার্যের হাহাকার সারা গর্ভগৃহে ছড়িয়ে পড়ল।

অবাকই হলেন বজ্রকেতু, ‘সে কি পণ্ডিতপ্রবর? নরবলি তো মহাবলি, মন্ত্রযানে এর থেকে বেশি পুণ্যকর্মের রাস্তা আর কিই বা আছে? আপনারা কি সিদ্ধাচার্য কাহ্নপাকে নিয়ে সদ্যঘটিত কাহিনিটি শোনেননি? মেখলা আর কনখলা নামের দুটি মেয়ে…’

‘ওরে পাপমতি মূঢ়, ও কাহিনি সত্য নয়, রূপক মাত্র। জ্ঞানখড়্গে নিজের অহংকার বলি দেওয়ার রূপক’, আর্তনাদ করে উঠলেন রত্নাকরশান্তি, ‘আর তুই তাকে সত্যি ভেবে তিনটি নিরীহ শিশু বধ করলি? হায় প্রভু শাক্যসিংহ, হায় পঞ্চবিংশতি বোধিসত্ত্ব, হায় প্রভু অবোকিতেশ্বর, দেখো, তোমাদের সদ্ধর্মের কী নিদারুণ অধঃপতন।’

নিজের অসি কোষমুক্ত করলেন সোমেশ্বর গর্গ, ক্রোধে তাঁর সর্বাঙ্গ কাঁপছিল, দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, ‘এক বার শুধু অনুমতি দিন স্থবিরশ্রেষ্ঠ, এই নরপশুটির বোধিলাভের ইচ্ছেটা জন্মের মতন ঘুচিয়ে দিই।’

হাত তুলে মহামাত্যকে নিরস্ত করলেন মহাস্থবির, কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে অস্ফুটে কিছু উচ্চারণ করলেন, তারপর দক্ষিণহস্ত সামনে প্রসারিত করে, তর্জনী এবং কনিষ্ঠা দুটি উত্তোলিত অবস্থায় রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলিটি দিয়ে অন্যান্য অঙ্গুলিগুলি বদ্ধ করে করণমুদ্রা ধারণান্তে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘শোন রে পাপমতি ক্রূরাত্মা, এই পবিত্র মহাবিহারে আমি আর নরহত্যা হতে দেব না, তাই তোকে মহামাত্যের হাতে সমর্পণ করলাম না। এইদণ্ডে তুই দূর হয়ে যা, তোকে পাল সাম্রাজ্যের বাইরে নির্বাসিত করা হল। হরিকেল থেকে অঙ্গ, তাম্রলিপ্ত থেকে প্রাগজ্যোতিষপুর, সমগ্র সমতট বা পৌণ্ড্রবর্ধন, কোথাও কোনো ভূমিতে যেন তোর অপবিত্র ছায়া অবধি না পড়ে, হরিকেলের এদিকে যেন তোর ওই পাপিষ্ঠ মুখ কেউ না দেখে। আরও শুনে রাখ। আজ থেকে তোর বংশকে আমি দেবী একজটার নামে অভিশপ্ত ঘোষণা করলাম। তোর বংশে প্রতি পুরুষে একটি করে বদ্ধ উন্মাদ শিশু জন্মাবে যার জন্যে তোর বংশাবতংসদের অশেষ দুঃখ ও ক্লেশ স্বীকার করতে হবে। এইভাবে এক হাজার বছর ধরে এই জ্বালা ভোগ করার পর তোর পুনর্জন্ম হবে, আর সেই জন্মে দেবী বজ্রবারাহী নিজহস্তে তোর পাপ নাশ করবেন। যে পাপিষ্ঠ ফলকটির সামনে এই ঘৃণ্য পাপকর্মটি করেছিস, তাকেও অভিশাপ দিলাম। এক হাজার বছর ধরে এই অভিশপ্ত ফলক তোদের বংশে পূজিত হতে থাকবে আর তোদের এই অভিশাপের কথা মনে করিয়ে দিতে থাকবে। যেদিন এই ফলক স্ব-ইচ্ছায় আমার বংশের কারও কাছে ফিরে আসবে, সেদিন জানবি তোদের পাপভোগের শেষ। সেইদিন তোর বংশধারা লোপ পাবে, এবং তোর যাবতীয় পাপের বিনাশ হবে। ততদিন পর্যন্ত তোর মুক্তি নেই, নেই, নেই।’

* * *

মায়ারানি খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন ফাঁকা বাক্সটার দিকে। কেউ নিয়ে গেছে এই বাক্স তা হতেই পারে না, কারণ এই পরিবারের বাইরে কেউ এর অস্তিত্বই জানে না। আগেরবার নিজে পূজা করে নিজের হাতে তুলে রেখেছিলেন, স্পষ্ট মনে আছে। নীচু হয়ে এদিক-ওদিক দেখলেন। না নেই, কোথাও তার চিহ্ন নেই। হঠাৎ করে অজানা আশঙ্কায় বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল আর অমঙ্গল আশঙ্কায় স্তব্ধ হয়ে গেলেন মায়ারানি, শাশুড়ির বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল।

বংশলোপ।

জানেন না মায়ারানি সে কোথায়, কীরকম আছে। দশ বছর হয়ে গেল, তার মুখদর্শন করেননি তিনি।

দশ বছর আগেকার এক অভিশপ্ত দুপুর যেন উত্তপ্ত আগুনের ঝলকের মতন মায়ারানির স্মৃতিসত্তা নাড়িয়ে দিয়ে গেল। পুজো করছিলেন মায়ারানি, সেদিন নীলষষ্ঠীর ব্রত ছিল। যতই কুপুত্র হোক, মা সবসময়ই সন্তানের ভালো চান, তাই সেইদিনও করজোড়ে প্রার্থনা করছিলেন, এমন সময়ে উঠোনে বিপুল হট্টগোল, চিৎকার চেঁচামেচি আর কান্নার আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে আসেন। এসে দেখেন তাঁর উঠোনে প্রায় সারা পাড়া ভেঙে পড়েছে। তার সামনে রণরঙ্গিণী মূর্তিতে হরেন গোঁসাইয়ের বউ, তার হাতে ধরা হরেন গোঁসাইয়ের বড়ো মেয়ে, তেরো বছরের মাম্পি। মাম্পি বোধ হয় স্নান করছিল, ক্রুদ্ধা গোঁসাইগিন্নি সেই অবস্থাতেই ভিজে টেপজামার ওপর একটা গামছা জড়িয়ে টেনে এনেছেন মেয়েটাকে। ঘটনার অভিঘাতে, লজ্জায় আর ভয়ে থরহর করে কাঁপছে মেয়েটা। গোঁসাইগিন্নির অবশ্য তাতে হুঁশ নেই, তিনি চিল চিৎকারে পাড়া মাথায় তুলেছেন, ‘ছি ছি ছি, পাড়ার মধ্যে বাস করা দায় হয়ে উঠল দেখছি। বেআদব বদমাশ ছেলে, ছি ছি ছি। এত দিন মেয়েদের স্নান করার সময় উঁকিঝুঁকি দিতিস, সাহস বাড়তে বাড়তে কোথায় উঠে ঠেকেছে দ্যাখো… ঘরে ঢুকে সোমত্ত মেয়েকে… বলি এমন ছেলেকে আঁতুড়েই নুন খাইয়ে মেরে ফেলতে পারোনি মেজো বউ… ছি ছি…’

মায়ারানি প্রথমে হকচকিয়ে গেছিলেন, তারপর সামান্য সামলে নিয়ে বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হয়েছে দিদি?’

‘আর দিদি বলে ডেকো না ভাই। দেখো তোমার গুনধর সুপুত্তুরের কাণ্ড। মাম্পি চান করতে বাথরুমে ঢুকেছে, সেই সুযোগে তোমার ছেলে বাইরে থেকে কাঠি দিয়ে ছিটকিনি খুলে ভেতরে ঢুকে… ছি ছি ছি… তোকে দাদা দাদা বলে ডাকত, হ্যাঁ, সেদিনও মাসিমা মাসিমা করে ডেকে লুচি আর পায়েস খেয়ে গেলি… ছি ছি ছি… দুধ দিয়ে কী কালসাপই না পুষেছ ভাই… কী শিক্ষাই না দিয়েছ… এ পাড়ায় বাস করা কিন্তু ঘুচিয়ে দোবো, আমাকে চেনো না…’

পাথরের মতন স্থবির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মায়ারানি, আর তাঁর ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। আজ অবধি না তাঁর মা-বাবা, না শ্বশুর-শাশুড়ি, না স্বামী, কেউ তাঁকে একটা কটু কথা বলতে পারেননি, এমনই শান্ত অথচ দৃঢ় স্বভাব মায়ারানির। সত্য ব্যবহার ও স্পষ্ট উচ্চারণের জন্যে পাড়ায় লোকে তাঁকে ভয়ও করে ভালোও বাসে। আজ সারাজীবন ধরে তিল তিল করে জমানো মান-ইজ্জত সব যেন তাসের ঘরের মতন তাঁর চারিপাশে ভেঙে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল যেন গোঁসাইগিন্নি সর্বসমক্ষে তাঁর শাড়ি টেনে খুলে উলঙ্গ করে দিচ্ছে।

‘সে কোথায়?’

অবিশ্বাস্য শান্তস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন মায়ারানি। সারা উঠোন মুহূর্তে চুপ করে গেল। শুধু গোঁসাইগিন্নি থুতু ফেলে মুখ বাঁকিয়ে বললেন, ‘যাবে কোথায়, দ্যাখো গে, আবার কোথায় মুখ মারতে গেছে। কুকুরের লেজ কি আর…’

‘যদি তাকে দেখতে পাও কেউ, বলে দিও যদি বেঁচে থাকতে চায়, এ বাড়িতে যেন আর না ফেরে, এইদণ্ডে আমি ওকে ত্যাজ্য করলাম, আমি ওকে আমার ছেলে বলে আর মানি না, এই ফ্যামিলির সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই ওর। আর তুমি ঘরে যাও দিদি। মাম্পির কাছে আমি গিয়ে পা ধরে ক্ষমা চেয়ে আসব না হয়, এখন আর শাপমন্যি না করে বাড়ি যাও। কেউ যদি কখনো জানতে পার ও মরে গেছে, আমাকে জানাবে না, আর যদি আমি মরে যাই, ওকে খবর দেবে না, আজ থেকে ও হালদার বাড়ির কেউ নয়’, এই বলে ধীরপায়ে ঘরে ঢুকে খিল দিলেন মায়ারানি।

পাড়ার সবাই যে-যার নিজের ঘরে ফিরে গেল। এবং সেইদিন থেকে টেনিয়া আর বাড়ি ফেরেনি। আর কোনোদিনই তার মুখ দেখেননি মায়ারানি।

বংশলোপ।

মায়ারানি জানেন যে একমাত্র তিনি আর তাঁর ছেলে ছাড়া হালদার বাড়ির আর কেউ বেঁচে নেই। হালদার পরিবারের যারা চট্টগ্রামে থেকে গেছিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁদের আক্ষরিক অর্থেই কুচিকুচি করে কেটে সারা বাড়িতে ছড়িয়ে রেখে সারা গ্রামকে ডেকে দেখানো হয়েছিল যে নাপাক হিন্দুদের কী শাস্তি হওয়া উচিত, দেড় বছরের শিশুও রেহাই পায়নি। তারপর সারা বাড়িতে পেট্রোল লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মাঝেমধ্যে মনে হত মায়ারানির হয়তো একদিন সে ফিরবে, ভালো হয়ে ফিরবে। কোনো এক অলৌকিক মধ্যরাতে এসে চুপিচুপি মা-কে ডেকে বলবে, ‘মা, আমি ভালো হয়ে গেছি, চলো অন্য কোথাও গিয়ে থাকি’, সেরকম কখনো হলে মায়ারানি হয়তো একবস্ত্রেই চলে যেতেন। কতদিন স্তব্ধ দুপুরে খেতে বসে বাইরে কারো আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠতেন, সে এল নাকি ফিরে?

কী করতেন মায়ারানি সত্যি সে যদি ফিরে আসত? কী করতেন? কে জিতত? মাতৃহৃদয় নাকি ন্যায়বিচার?

আজ যখন জানলেন মায়ারানি হয়তো আজই তার শেষ দিন, তখন কেমন জানি মনে হচ্ছে মাতৃহৃদয় জিতলেও জিতে যেতে পারত। অন্তত মরে যাবার আগে একটি বার দেখতে পেতেন। বাপের বাড়ি বলে অনেকদিনই কিছু নেই তাঁর। শ্বশুর গেলেন, স্বামীও। তারপর শাশুড়িও। এখন ছেলেকে হারিয়ে কী নিয়ে বাঁচবেন মায়ারানি? কীসের আশায়?

অনেক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলেন মায়ারানি। দুপুর গড়িয়ে মায়ারানির উঠোনে মিঠে বিকেল নেমে এল। মায়ারানি তাও ঠায় বসে রইলেন। তারপর পাশের বাড়িতে সন্ধেবেলায় তীক্ষ্ণ শাঁখ বেজে উঠতে সংবিৎ ফিরে পেলেন তিনি। ধীরপায়ে উঠে আলমারি খুললেন, সবচেয়ে ওপরের কুঠুরির একদম পেছনে হাত চালিয়ে বার করে আনলেন একটা ছোটো চামড়ার ব্যাগ, মৃত সেলস অফিসার স্বামীর শেভিং কিট। তার মধ্যে হাত চালিয়ে তুলে আনলেন ভারী পুরোনো রেজরটা। তারপর টলতে টলতে গেলেন তাঁর ভাঁড়ার ঘরে। খুঁজেপেতে একটা নতুন ব্লেড বার করে আধাআধি ভাঙলেন। রেজরে ভরলেন। তারপর একটা বালতি টেনে এনে বিছানার বাঁ-দিকে রাখলেন। তারপর ঠাকুরঘরের সামনে নির্নিমেষ নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। সবশেষে বিছানায় শুয়ে এক বার সামান্য অভিমানভরেই হয়তো বললেন, ‘এ জন্মে বিনা দোষে বড়ো কষ্ট দিলে ঠাকুর। আমার কিন্তু কোনো অপরাধ ছিল না। দেখো ঠাকুর, পারলে পরের জন্মে ভালো মা বানিয়ে পাঠিও’, বলে বাঁ-হাতটা বালতির মধ্যে রেখে, কবজির উলটোদিকে রেজরটা প্রায় গেঁথে দিয়ে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে দিলেন মায়ারানি হালদার।

* * *

ঘোরের মধ্যে ছিল তিতলি। এমনও হয়? রূপকথা আজও ঘটে? এভাবেও প্রেমে পড়া যায়? গত বছরেই ভালো রেজাল্ট করে বাবাকে বলে একটা দামি স্মার্টফোন পেয়েছে তিতলি। আর ফোন পাওয়া মাত্রই সিম কার্ড, ডেটা প্ল্যান ইত্যাদি হাবিজাবি সেট করে ফেসবুক! আর মুহূর্তের মধ্যে তিতলির সামনে যেন পুরো দুনিয়াটা দরজা কপাট খুলে তার গ্রামের বাড়ির উঠোনে চলে এল। লখনউয়ের মনামাসি, বম্বের বুলুকাকা, কলকাতার রত্নাপিসিমা আরও অনেকে, তারপর ওর স্কুলের সিনিয়র শবনমদিদি, যে জয়েন্ট পেয়ে কলকাতায় যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেছে সে, সব্বাইকার সঙ্গে রোজ রোজ কথাবার্তা হা হা হি হি। কে বলে পৃথিবীটা এত বড়ো? এই তো সেদিন ব্যাঙ্গালোরের অনিদা প্যারিস গেল, তারপর কত্ত কত্ত ছবি আপলোড করল, দেখে দেখে তো তিতলির আর আশ মেটে না। শুধু কি আত্মীয় আর বন্ধুবান্ধব? তা ছাড়াও তাদের বন্ধু, কত গায়ক, নায়ক, লেখক, সব্বাই যেন কত হাতের কাছে চলে এসেছে জাদুকাঠির ছোঁয়ায়।

এই করতে করতে একদিন তিতলি দেখে অচেনা একটি ছেলের থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, নাম স্যাম। প্রোফাইল পিকচারটা দেখে থমকে গেল তিতলি, আইব্বাস, পুরুষ মানুষ এত সুন্দরও হয়? দারুণরকম দেখতে তো ছেলেটাকে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা অ্যাকসেপ্ট করেই ফেলল তিতলি।

* * *

সেইদিন বিকেলে লেকের আড্ডায় গিয়ে এক ছোটোখাটো টাকমাথা সৌম্যদর্শন প্রৌঢ়কে দেখে একটু আশ্চর্যই হলেন বালুরঘাট কলেজের দর্শনের প্রাক্তন অধ্যাপক তথাগত দত্তগুপ্ত। দেখা হতেই তাঁর বন্ধুরা হইহই করে ডেকে নিলেন, আলাপটা অবশ্য অবসরপ্রাপ্ত আমলা সমীরমোহনই করালেন, ‘আসুন গুপ্তদা, আলাপ করিয়ে দিই। ইনি মিস্টার মৈত্র, আর ইনি প্রফেসর দত্তগুপ্ত। প্রফেসর সাহেব কিন্তু বিখ্যাত লোক মিস্টার মৈত্র, অনেকদিন ফিলোজফি পড়িয়েছেন কলেজে। এঁর কাছে কিন্তু বিশেষ জারিজুরি খাটবে না আপনার, এই বলে দিলুম।’

মৃদু হেসে যুক্তকরে নমস্কার করলেন তথাগতবাবু। মাথা সামান্য নীচু করে প্রতিনমস্কার করলেন নবাগত প্রৌঢ়টি। সাদা ট্রাউজার্স, কমলা রঙের হাফ শার্ট আর সাধারণ একটি বাটার জুতো পরে আছেন ভদ্রলোক। সম্পূর্ণ ন্যাড়া মাথায় সামান্য একটি টিকির আভাস, যা আজকালকার বাঙালিদের মধ্যে দেখাই যায় না। তবে সমস্ত শরীরে যেটা নজর কাড়ে, খেয়াল করলেন তথাগত, সেটা হচ্ছে চোখ দুটি। আশ্চর্য শান্ত মায়াময় অথচ উজ্জ্বল চোখ দুটি, দেখেই মনে হয় বুদ্ধিমান ভালো লোক। ভদ্রলোককে মনে মনে বেশ পছন্দই হয়ে গেল তাঁর।

‘নতুন এলেন নাকি এখানে’, স্মিত হেসে প্রশ্ন করলেন প্রফেসর দত্তগুপ্ত।

‘আরে না না, গেসলাম বীরভূমের মল্লারপুর’, মাঝখানে প্রায় ঝাঁপিয়েই পড়লেন অকৃতদার, সম্পন্ন ব্যবসায়ী মাধব আচার্য, ‘ভাইয়ের ওখানে, বুইলেন। একটা তেলকল সস্তায় পাচ্ছিলাম কিনা, ভাবলাম কিনে রাখি। তা একদিন সকালে উঠে দাঁত মাজতে মাজতে রাস্তায় হাঁটছি, দেখি ইনি পাশের বাড়ির বাগানে একটা বেদিতে বসে ধ্যানট্যান করছেন। আমি তো মশাই, আপনারা জানেন, সারা জীবন টাকাপয়সা ছাড়া অন্য ব্যাপারে কিছু ভাবিনি। তা পাপীতাপী মানুষ, ভাবলুম দেখে নিই ধ্যানট্যান কী করে করতে হয়, রাত্তিরে হিসেবটিসেব করে খেয়েদেয়ে মশারি টশারি ফেলে প্র্যাকটিস করব না হয়। ওমা, খানিকক্ষণ পর ইনি হঠাৎ চোখটোখ খুলে বলেন, ‘‘তেলকলটা কিনবেন না, ওতে অভিশাপ আছে।’’ আমার তো মশাই ঠকাস করে হাত থেকে টুথব্রাশটা পড়ে নর্দমায় ভেসে চলে গেল। আমি তেলকল কিনব ইনি কী করে জানলেন? পাশের বাড়ির সঙ্গে আমার ভাইয়ের তো বাক্যালাপই নেই, ওদের জানার প্রশ্নই ওঠে না। তারপর ভাবলুম বাজারে তো কথা উড়ছেই, ইনি হয়তো সেখান থেকে জানবেন। যাই হোক, পনেরো টাকার টুথব্রাশটা গচ্চা দিয়ে বাড়িতে এসে চানটান করে খেতে বসিচি কি বসিনি, ওম্মা, খবর পেলুম সেই তেলকলে নাকি পুলিশ এসেছে। কী ব্যাপার? আমি তো মশাই ধাঁ! তারপর ছুটে গিয়ে দেখি তেলকলের মেঝে খুঁড়ে পুলিশ একটা মেয়ের লাশ তুলছে। সে কী ওয়াক তোলা গন্ধ মশাই! জানা গেল মালিক নাকি তার ছেলের বউকে মেরে পুঁতে দিয়ে তেলকলটা আমার ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টায় ছিল, বিয়ের দেনা-পাওনা নিয়ে কারবার… আমি তো মশাই ছুট্টে গিয়ে এঁয়াকে বল্লুম, আপনাকে ছাড়ছি না দাদা…’

এতটা একদমে বলে হাঁপাতে লাগলেন মাধব আচায্যি। এতক্ষণ তথাগত হাঁ হয়ে শুনছিলেন, এইবার সমীরবাবু বললেন, ‘তারপর আচায্যিবাবু শোনেন ইনি ভাইয়ের সেই প্রতিবেশীদের গুরুভাই, কী এক প্রাচীন তান্ত্রিক পুঁথির খোঁজে এসেছেন মল্লারপুর। আর আচায্যিমশাইকে তো আপনি চেনেনই, যেটা ধরেন, তার একেবারে শেষতক বুঝে থাকেন। ইনিও মৈত্রমশাইকে বগলদাবা করে বালুরঘাটে এনে হাজির।’

এতক্ষণে মৈত্রমশাই কথা বললেন, ‘আমারও অবশ্য ইচ্ছে কম ছিল না, এদিকে আসার ইচ্ছে আমার অনেকদিনের।’

তথাগতবাবু প্রশ্ন করেন, ‘কেন বলুন তো? এদিকেও কি তান্ত্রিক পুঁথি খুঁজছেন নাকি? সেসব বীরভূমের বাইরে কী করে পাবেন? সব তান্ত্রিক পীঠ মহাশ্মশান, এসবই তো দক্ষিণবঙ্গে। এদিকে তো…’

মৃদু হাসলেন মৈত্রমশাই, ’তান্ত্রিক পুঁথি খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে তন্ত্রপীঠের যোগ সামান্যই। আর তন্ত্র তো শুধু হিন্দুদের নয়…’

‘মানে? তন্ত্র হিন্দুদের নয় মানে? ক্রিশ্চানদের বা মুসলিমদের আবার তন্ত্র আছে নাকি?’ সংশয় প্রকাশ করেন লাইব্রেরিয়ান অনিন্দ্য ভুক্ত।

‘না না, সে-কথা বলছি না। যদিও সুলেইমানি তন্ত্র বলে একটি ইসলামিক তন্ত্র প্রচলিত, তবে তার সঙ্গে ইসলামের যোগাযোগ নেই বললেই চলে।’

‘মশাই কি তান্ত্রিক নাকি? তন্ত্র সম্পর্কে এত জ্ঞান, এত তান্ত্রিক পুঁথি খুঁজে বেড়াচ্ছেন… চট করে আচায্যি মশাইকে বলে দিচ্ছেন তেলকল না কিনতে, এদিকে দেখে তো কাপালিক বলে মনে হচ্ছে না মশাই। না লাল পট্টবস্ত্র, না হাতে খাঁড়া। কেসটা কী দাদা?’ জিজ্ঞেস করলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ অতীশ মণ্ডল।

ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠলেন, তারপর হাসিটাসি থামলে বললেন ‘আরে না না দাদা, আমি তান্ত্রিক নই। তন্ত্র নিয়ে উৎসাহী পাঠক বলতে পারেন। আসলে আমরা বৈষ্ণব, যে সে বৈষ্ণব নয় দাদা, খাস নবদ্বীপের বৈষ্ণব। যদিও আমি নিজে শাক্ত। আমার গুরুর আদেশে তন্ত্র নিয়ে একটু রিসার্চ করছি এই আর কী। ওই গুরুর দেখানো পথেই অল্প সামান্য কিছু তন্ত্রাভ্যাস করা আছে, তাই তেলকলের ব্যাপারটা বলতে পেরেছিলাম।’

সবাই হইহই করে উঠল, ‘ওই হল, মানে আপনি আধা তান্ত্রিক। তা দু-একটা নমুনা দেখান না দাদা।’

আবার হেসে ফেললেন ভদ্রলোক, ‘এ কি ম্যাজিক দাদা? যে বললেই দেখানো যায়? একমাত্র মানুষের মঙ্গল করার উদ্দেশ্য ছাড়া গুরুর বারণ আছে এমনি এমনি ক্ষমতা প্রয়োগের। ওতে ক্ষমতা কমে যায়।’

তথাগত ঠান্ডা মাথার মানুষ। তিনি ধীর স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘তন্ত্র জিনিসটা হিন্দুদের নয় বলেছেন মৈত্রমশাই, কিন্তু ব্যাখ্যা দেননি। একটু খুলে বলুন না মশাই। নতুন কিছু শিখলেও তো শিখতে পারি।’

মৈত্রমশাই খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বলতে লাগলেন, ‘তন্ত্র জিনিসটা অনেক পুরোনো জানেন। সভ্যতার আদিমে যখন মানুষ প্রকৃতির হাতে অসহায় ছিল, খাদ্য আর জীবনের তাগিদ তাকে তাড়িয়ে বেড়াত, তখন হয়তো যেন সে বেঁচে থাকে, যেন তার খাবার জোটে, তার জন্যেই বিভিন্নভাবে কোনো সর্বশক্তিমানের কাছে নিজেদের প্রার্থনা নিবেদন করা শিখল। এই নিবেদনের প্রকৃতিটাই তন্ত্র।

ইংরেজিতে এই সব পুরোনো প্রাকৃতিক পূজা পদ্ধতির একটা নাম আছে, পেগানিজম, তন্ত্রের সঙ্গে তার তফাত সামান্যই। সত্যি কথা বলতে কী, সমস্ত প্রাচীন ধর্মগুলিই আসলে ছিল বিভিন্ন প্রাচীন তান্ত্রিক প্রথা, শুধু দেখনদারি বাড়ানোর জন্যে আরও জটিল করে মানুষের সামনে পেশ করা। তন্ত্রের আসল উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষার জন্য ভগবানের কাছে নিবেদন পেশ করার বিভিন্ন আচার-আচরণ বা পূজা পদ্ধতি মানুষকে বলে দেওয়া, সে ফসল ফলানোর আগে সমবেত নাচও হতে পারে, বা মদ তৈরি করার গোপন পদ্ধতিও হতে পারে। অথবা হতে পারে গ্রামরক্ষক দেবীর নামে উৎসর্গ করা ষাঁড়টিকে বলি দেওয়া, অথবা অন্য পশু বলি দিয়ে তার শরীরের প্রজনন অঙ্গগুলিকে চাষের মাঠে ছড়িয়ে দেওয়া।

আমাদের দেশেও হরপ্পা মহেঞ্জোদারোতে তন্ত্র সাধনার অনেক চিহ্ন পাওয়া যায়। তাই এও বলা যায় যে বৈদিক আর্য সভ্যতা আর এদেশীয় তন্ত্রসভ্যতার মধ্যে তন্ত্রসভ্যতাই বেশি প্রাচীন।’

এতটা বলে একটু দম নিলেন মৈত্রমশাই। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনছিলেন তাঁর কথা। সন্ধ্যা হয়ে আসা সত্ত্বেও কারও সে-কথা খেয়াল ছিল না।

* * *

স্যামের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার পর কয়েক দিন সব চুপচাপই ছিল। সেই ক-দিনে স্যাম আর তার বন্ধুদের প্রোফাইল তন্নতন্ন করে খুঁজেছে তিতলি, ভূতগ্রস্তের মতন। ছেলেটাকে জানার জন্যে, চেনার জন্যে। যত জানছিল, তত মুগ্ধ হচ্ছিল তিতলি। যাদবপুরের ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার, ফাইনাল ইয়ার। চাকরিও পেয়ে গেছে এরই মধ্যে, বন্ধুদের সঙ্গে তার পার্টির ছবিও আপলোড করা আছে। সঙ্গে কতগুলো ডাইনি টাইপের গা ঢলানি মেয়ের ছবিও আছে অবশ্য, স্যামের গায়ে গা ঠেকিয়ে, হা হা হি হি না করে যেন চলছেই না। কলকাতার মেয়েগুলো বেহায়া একদম, ওইরকমই ছেলেধরা টাইপের, রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ভাবে তিতলি।

স্যামের নামও জানতে পেরেছে তিতলি, স্যমন্তক সেনগুপ্ত। নাম শুনেই তিতলি আর ভালো লাগা নয়, প্রেমেই পড়েছে ছেলেটার। যেমন করে সাজু পড়েছিল রূপাইয়ের প্রেমে, রোমিও জুলিয়েটের, দিলওয়ালেতে কাজল শাহরুখের, তেমনই তিতলি প্রেমে পড়ল স্যামের। কথা হয়নি তো কি? দেখা হয়নি তো কি? তিতলির ষোলো বছর বয়সের প্রেম কি ফ্যালনা নাকি? গ্রামের মেয়ে বলে হেলাফেলার বস্তু নাকি তিতলির ভালোবাসা?

শেষে যেদিন তিতলির ‘হাই’ এর উত্তরে স্যামের ‘হ্যাল্লো বিউটিফুল’ মেসেজটা তিতলির মোবাইলের স্ক্রিনে সদ্যফোটা পদ্মফুলের মতোই ভেসে এল, সেদিন তিতলির পুজো দেওয়ার ঘটা দেখে বাড়ির লোকজন তো অবাক!

তারপর মেসেজ, চ্যাট, হোয়াটসঅ্যাপ। তিতলি আর স্যামের কথার ঝিরিঝিরি কিশোরী ঝরনাটি কবে বেগবতী নদী হয়েছে, সে তিতলি নিজেই জানে না। ফোনে কথা বলা, হোয়াটসঅ্যাপে সেলফি পাঠানো, কিছুতেই পিছিয়ে থাকেনি তিতলি। এমনকী যেদিন স্যাম ওর স্নান করার ভিডিয়ো পাঠাতে বলল সেদিনও নয়।

বলতেই হবে স্যামের দাবিটা শুনে লজ্জায় কুঁকড়েই গেছিল তিতলি। ছি ছি ছি, ম্যাগো, কী লজ্জা লজ্জা। কী বেহায়া এই স্যামটা। ভাবলে এখনও ফর্সা মুখটা গোলাপি হয়ে আসে তিতলির। বিয়ের আগেই এসব কী, অ্যাঁ? ছিঃ!

শেষে অবশ্য লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে একটা দশ মিনিটের ভিডিয়ো তুলে পাঠিয়েছিল তিতলি। নইলে যদি কলকাতার নিলাজ বেহায়া ডাইনিগুলো তার আগেই এসব দেখিয়ে তার স্যামকে কবজা করে ফেলে? হতেই পারে না। চোয়াল শক্ত করে, মনকে বেঁধে যতটা সম্ভব ব্রীড়া ও কামকলা মিশিয়ে সে একটা ভিডিয়ো পাঠিয়েছে স্যামকে। গ্রামের মেয়ে বলে সে কলকাতার মেয়েদের থেকে কম মডার্ন নাকি? ছোঃ!

মাঝে অবশ্য শবনমদিকে একবার হালকা আভাস দিয়েছিল তিতলি। সবদিক জেনেশুনে শবনমদি সেদিন অনেক রাতে কল করেছিল তিতলিকে। বলেছিল যে এই নামে যাদবপুরে প্রেজেন্ট চার বছরে কেউ পড়ে না, আগের দুই ব্যাচেরও খবর নিয়েছিল, সে ব্যাচেও কেউ পড়েনি। যদিও তিতলি তার একটা কথাও বিশ্বাস করেনি। কারণ সব শোনার পর স্যাম তাকে বুঝিয়েছিল যে শবনম স্যামকে প্রপোজ করে, এবং তিতলির প্রেমে অন্ধ স্যাম তা রিফিউজ করে। তাই শবনম যে মিথ্যে কথা বলে তিতলির মন বিষিয়ে দেবেই এ তো দিনের আলোর মতন পরিষ্কার!

দত্তগুপ্ত বাড়ির ছাদে এসব কথাবার্তা নিয়ে আলোচনা করতে করতে সেদিন হাসি ঠাট্টায় ভেসে যাচ্ছিল বিশ্বচরাচর। তিনটি অবোধ বালিকার ওপর হালকা মিহি চাদরের মতন নেমে আসছিল শীতের হিমেল পরশ। কেউ দেখেনি সেদিন, খুব মিহি মখমলের মতন, গুঁড়ো অন্ধকারের মতন নেমে আসছিল তিনটি নৃত্যরতা রমণীর এক অবিশ্বাস্য ভয়াবহ নাচের সিল্যুয়েট। ধীরে ধীরে সেই তিনটি অন্ধকারের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি সিল্যুয়েট চাদরের মতোই তিনটি অপাপবিদ্ধ কন্যার গায়ে জড়িয়ে গেল, অমোঘ নিয়তির মতোই!

* * *

‘তাহলে তন্ত্র বলতেই সবাই ভয়ংকর কিছু কেন বোঝে?’ অতীশ মণ্ডলের কথাটা ফেলে দেওয়ার মতন না।

স্মিত হাসলেন মৈত্রমশাই, ‘কারণ যে তন্ত্রকে আমরা আজ চিনি, তা আসলে ব্ল্যাক ম্যাজিক ছাড়া আর কিছু নয়, ওটা তন্ত্রের এক বিকৃত রূপ। তন্ত্র বলতেই লোকে মারণ উচাটন, অর্থাৎ খারাপ কিছু বোঝে। এই মারণ, উচাটন, বিদ্বেষন এসবকে বলা হয় কৃষ্ণ ষটকর্ম। এসব তন্ত্রের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। এই কৃষ্ণ ষটকর্মের মতোই আছে শুক্ল ষটকর্মও, যেমন যজন, যাজন, অধ্যয়ন…’

‘ইয়ে, যজন আর যাজন একই জিনিস না?’ সংশয়কারী অনিন্দ্য ভুক্তের প্রশ্ন।

‘না। যজন মানে নিজের জন্যে পূজা ও যাগযজ্ঞ, যাজন মানে অন্য কারো জন্যে পূজা ও যাগযজ্ঞ, যেখান থেকে যজমান শব্দটা এসেছে’, মৈত্রমশাইয়ের হাসিটা কিন্তু অমলিন।

‘সে কি? যজমান শব্দটা তান্ত্রিক নাকি?’ চিন্তিত দেখায় অনিন্দ্য ভুক্তকে।

‘শুধু যজমান কেন? বাঙালি জীবনের প্রতিটি ধর্মকেন্দ্রিক আচরণই আসলে তান্ত্রিক। ইষ্টদেবতা, যজমান, গুরুবাদ, মন্ত্রদান, শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, সবই তান্ত্রিক অভ্যেস। আমরা বাঙালিরা এতই তান্ত্রিক বা তন্ত্রসভ্য জাতি যে আমরা নিজেরাই বুঝি না। আমরা ‘‘সব কাজ পারি’’ বোঝাতে গিয়ে কোন বাক্যবন্ধ ব্যবহার করি? বলি যে ‘‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ।’’ খেয়াল করে দেখবেন, কখনো কিন্তু বেদপাঠের কথা বলি না।’

এতটা বলে একটু সময় নিলেন মৈত্রমশাই, তারপরে অমলিন হাসিমুখে শেষ অস্ত্রটি ছাড়েন, ‘এমনকী যে সমস্ত দেব-দেবীর মূর্তি দেখেন, সবই তন্ত্রমতে কল্পিত, পৌরাণিক হিন্দুধর্মেই এর উৎপত্তি। সনাতন বৈদিক হিন্দুধর্মের সঙ্গে এখনকার হিন্দুধর্মের মিল বড়ো অল্প। আমাদের সমস্ত পূজা ও সাধনপদ্ধতি, অর্ঘ্য অর্পণাদি, পূজামন্ত্র, সব কিছু তান্ত্রিকমতে হয়। ঘটস্থাপন, প্রাণপ্রতিষ্ঠা, চক্ষুদান, মূর্তির সামনে মেঝেতে যন্ত্র অঙ্কন, চারকাঠি বা ধ্বজস্তম্ভ স্থাপন, সবই তান্ত্রিক পূজাপদ্ধতি। এমনকী সরস্বতী পূজার ‘‘জয় জয় দেবী চরাচরসারে’’ থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন ‘‘পিনাকেতে লাগে টঙ্কার’’, সেসবই আসলে তন্ত্রসংগীত।’

শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। শুধু সন্ধের অন্ধকারে ধরা গলায় প্রশ্ন করেন সমীরমোহন, ‘এত যেসব বললেন, এ সবই মনগড়া নাকি ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে কিছু।’

‘অবশ্যই আছে’, সন্ধ্যার অন্ধকারে চোখ দুটি যেন জ্বলে উঠল মৈত্রমশাইয়ের, ‘কিন্তু তার আগে আমার একটি মিনতি আছে দত্তগুপ্ত মশাইয়ের কাছে। আজ রাতটা কি আপনার বাড়িতে কাটাতে পারি?’

প্রস্তাবটা এতই আকস্মিক, যে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেলেন। নিজে যেচে নিমন্ত্রণ নেওয়ার মতন লোক তো মৈত্রমশাইকে মনে হচ্ছিল না।

তবে সামলে নিলেন প্রফেসর দত্তগুপ্ত, ‘সে তো পরম সৌভাগ্য মৈত্রবাবু। মাধবের অতিথি মানে আপনি আমাদেরও অতিথি… আর আমাদের তো শাস্ত্রেই আছে…’

‘সেজন্য নয়, আজ রাত থেকে কাল দুপুর পর্যন্ত আপনাদের সঙ্গে থাকা প্রয়োজন, আশু প্রয়োজন। আপনার পরিবারের ওপর ঘোর অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। ভয় পাবেন না, আমি বদ লোক নই।’

কথাটার মধ্যে কিছু একটা ছিল, এমন করে বললেন মৈত্রমশাই, যে কেউ আর দ্বিরুক্তি করতে পারল না। প্রফেসর দত্তগুপ্ত হেসে বললেন, ‘আরে চলুন চলুন, অত কিন্তু কিন্তু করতে হবে না আমি লোক চিনি। অমঙ্গল হোক না হোক, একদিন অতিথিসেবা তো করতে পারব? তার ওপর আমার গিন্নি আবার লোক খাওয়াতে ভারি ভালোবাসেন। ওহে মাধব, মৈত্রমশাইয়ের টুকিটাকি যা লাগে একটু পরে দিয়ে যেও তো। চলুন মৈত্রমশাই, এই দিকে, আসুন…’

* * *

স্বর্ণালি আর রূপালি অনেক্ষণ হল বাড়ি চলে গেছে। ভারি ভালো মেয়ে, দিদিকে সাহায্য করবে বলে একপায়ে খাড়া, হাজার হোক একদিনের জন্যে একটা অ্যাডভেঞ্চার তো হবে ওদের। ওদিকে স্যামের সঙ্গেও কথা হয়ে গেছে। কাল দুপুর নাগাদ স্যাম আর ওর বন্ধুরা স্টেশনেই ওয়েট করবে, সেখান থেকে কালীঘাট। মা-বাবার কথা ভেবে একটু খারাপই লাগছিল তিতলির, কিন্তু সত্যিই স্যামকে ছাড়া ও আর থাকতে পারছে না। মা-বাবা বুঝবে নিশ্চয়ই… আর পড়াশোনা তো চালিয়ে যাবেই, সেটা তো আর ও ছাড়ছে না। স্যাম তো বললোই ওর মা স্কুল টিচার, এতে কী তিতলির মাধ্যমিক দিতে সুবিধাই কি হবে না? উফ্, আর একটামাত্র রাত। তিতলি প্রায় উড়েই বেড়াতে লাগল…

* * *

মৈত্রমশাই ঘুরে ঘুরে বইয়ের সংগ্রহ দেখছিলেন। এমন সময় তথাগত ঘরে ঢুকতে ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন ‘আপনার তো ঈর্ষণীয় বইয়ের সংগ্রহ মশাই।’ একটু লজ্জাই পেলেন তথাগত, ‘মাস্টারের বাড়ি তো। আসলে আমরা, মানে আমাদের পরিবারের কেউ কোনোদিন গুরুগিরি ছাড়া, বা শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কিছু করেননি। শিক্ষকতা আমাদের জাত ব্যবসা বলতে পারেন।’

সামান্য ভ্রুকুটি করলেন মৈত্রমশাই, ‘সেক্ষেত্রে তো আপনাদের উপাধি আচার্য বা উপাধ্যায় হওয়া উচিত, মানে ভট্টাচার্য বা বন্দ্যোপাধ্যায় ইত্যাদি। অথচ আপনাদের উপাধি দত্তগুপ্ত। এর একটাই মানে হয় কিন্তু।’

‘কী বলুন তো’, কৌতূহলী হলেন তথাগত।

‘আপনারা কোনো এক পর্যায়ে বৌদ্ধ ছিলেন।’

‘কীরকম?’

‘বাংলাদেশ তো সম্পূর্ণ বৌদ্ধদের ঘাঁটি ছিল। শঙ্করাচার্য যখন অদ্বৈতবাদ প্রচার করে হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ঘটালেন, তখন নবম কি দশম শতাব্দী। সেই সময়টা বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের সময়ও বটে। তারপর থেকে প্রচুর বৌদ্ধরা হিন্দুধর্মে ফিরে আসতে থাকে। কিন্তু বর্ণাশ্রম প্রথা চিরকালই হিন্দুধর্মে প্রবল ছিল, তাই যেসব ব্রাহ্মণরা বৌদ্ধ হয়ে গেছিলেন, তাঁদের ফের ব্রাহ্মণ করিয়ে ফেরত নেওয়া হল না, গুপ্ত ব্রাহ্মণ বা বৈদ্য করিয়ে ফেরত নেওয়া হল।’

‘অনেকটা ঠিকই ধরেছেন’ সহাস্যে বলেন তথাগত, ‘আমরা বৌদ্ধই ছিলাম। আমাদের এক পূর্বপুরুষ নাকি বিক্রমশীলা না নালন্দা কোথাকার অধ্যক্ষ ছিলেন, আমরা তাঁরই বংশধর’ তারপর থেমে যোগ করেন, ‘সেই থেকে আমাদের জাত ব্যবসা হল শিক্ষাদান আর বাড়ির ছেলেদের নাম সব ওইরকম। আমার ছেলের নাম শাক্য, আমার বাবার নাম ছিল সিদ্ধার্থ, ঠাকুরদার নাম ছিল বৈরোচন… আমাদের বাড়িতে তো একটা প্রাচীন পুঁথি আছে, তাতে আমাদের ফ্যামিলি লাইনের প্রায় গত এক হাজার বছরের সমস্ত পূর্বপুরুষদের নাম আছে, দাঁড়ান, এক্ষুনি আনছি’ বলে সবেগে বেরিয়ে গেলেন।

ধীরে ধীরে মেঝেতে বসলেন মৈত্রমশাই। তারপর পদ্মাসনে বসে ধ্যানস্থ হলেন। তিনি নিশ্চিত, যে একটি অপঘাত বা অমঙ্গলের কালো ছায়া এই পরিবারের ওপর নেমে এসেছে। এবং নেমে এসেছে সদ্য, এঁদের অজান্তে। বিকেলে প্রফেসর দত্তগুপ্তকে দেখা মাত্র সেই আশঙ্কার কালোমেঘ নজরে পড়েছিল তাঁর। কোনো এক অতিশক্তিশালী তন্ত্রবিষ আশ্রয় নিয়েছে এখানে। বিনা রক্তপাতে সে বিদায় নেবে না, এবং সে কালনাগিনীর ছোবল নেমে আসতে দেরি নেই বিশেষ।

গুরু খুব সম্ভবত এর কথাই বলেছিলেন মৈত্রমশাইকে।

খানিকক্ষণ বাদে খুক খুক কাশির শব্দ শুনে চোখ খুললেন মৈত্রমশাই। বুঝতে অসুবিধা হল না, ভদ্রমহিলা এই বাড়ির গিন্নি, শ্রীমতী দত্তগুপ্ত। ভদ্রমহিলা গলবস্ত্র হয়ে ধরা গলায় ভয়ার্ত মুখে বললেন, ‘নমস্কার ঠাকুরমশাই, আমি ঊর্মিমালা, এ বাড়ির বউ। আপনি যেন কী সব অমঙ্গলের কথা বলছিলেন? আমার উনি এসে বললেন। আমার তো শুনে থেকে ভয়ে বুক কাঁপছে।’

‘ভয়েরই কথা বউদি। তবে চিন্তা করবেন না। অসম্ভব শক্তিশালী একটি তান্ত্রিক আধার আপনাদের অজানিতে এ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। রক্তপাত বা অপঘাত ছাড়া সে বিদায় নেবে না। তবে চিন্তা করবেন না, কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। একটা কথা মন দিয়ে বলুন তো, সদ্য নতুন কিছু কিনেছেন? নতুনও হতে পারে, পুরোনোও। অথবা কিছু পেয়েছেন, বা কিছু এসেছে আপনাদের বাড়িতে?’

‘নতুন কিছু কেনা তো হয়নি’, চিন্তায় ডুবে গেলেন দত্তগুপ্তগিন্নি, ‘তবে কয়েক দিন আগে আমার চেনা একটি মেয়ে একটি ফলক দিয়ে যায় আমাকে, কোথাও একটা কুড়িয়ে পেয়েছিল। অদ্ভুত কিছু মূর্তি আঁকা, আর আলতা সিঁদুর দিয়ে লেপা। আমি তো কোনো দেবী ভেবে ঠাকুরঘরে রাখলাম…’

তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালেন মৈত্রমশাই, ‘এক্ষুনি দেখান আমাকে সেই ফলক।’

ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে এসে ঢোকেন তথাগত, উত্তেজিত গলায় বলেন, ‘পেয়েছি মিস্টার মৈত্র, এই দেখুন। নামটা ভুলে গেছিলাম ওনার। নালন্দা নয়, আজ থেকে হাজার বছর আগে আমাদের এক পূর্বপুরুষ সোমপুরা মহাবিহারের অধ্যক্ষ বা স্থবির ছিলেন। আমরা তাঁরই বংশধর।’

‘সোমপুরা মহাবিহারের মহাস্থবির? কি বলছেন প্রফেসর সাহেব? আপনাদের তো পুন্যবান বংশ তাহলে! নালন্দার পর সোমপুরা, ওদন্তপুরী, জগদ্দল, এই তিনটিই তো ছিল বৌদ্ধদর্শন ও বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়ন ও প্রচারের পীঠস্থান। আর বালুরঘাট থেকে বেশি দূরেও নয় সে জায়গা।’

‘জানি মিস্টার মৈত্র’, তথাগত বলে ওঠেন ‘জায়গাটা এখন বাংলাদেশে, নওগাঁওতে। এখন নাম পাহাড়পুর। এই বাড়ি থেকে পাহাড়পুর অবধি সোজা রাস্তা থাকলে দেড় থেকে দু-ঘন্টার বেশি লাগার কথা না। খুব সম্ভবত তাই আমাদের সেই পূর্বপুরুষের কয়েক জেনারেশন বাদে কেউ এসে বালুরঘাটে বসতি স্থাপন করেন। আমরা বালুরঘাটে আছি কম সে কম পাঁচ-শো বছর, বেশি বই কম নয়। তবে একটা কথা বলতেই হবে, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস নিয়ে আপনার পড়াশোনা কিন্তু ঈর্ষনীয়।’

মৃদু হাসলেন মৈত্রমশাই, ‘তন্ত্র জানতে গেলে তো বৌদ্ধধর্ম জানতেই হবে প্রফেসর সাহেব। তন্ত্রের যে বর্তমান চেহারা আমরা বুঝি বা জানি, তার উদ্ভবই তো বৌদ্ধধর্ম তথা বৌদ্ধতন্ত্র থেকে। আচ্ছা, এখন চলুন দেখি বউদি কী সব ফলক পেয়েছেন। আমার মনে হয় একটি অসামান্য দৈবশক্তিসম্পন্ন কোনো তান্ত্রিক আধার আপনাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। সাধারণভাবে তাকে নাড়াচাড়ার অর্থ সাক্ষাৎ মৃত্যুকে আহ্বান করা। যদি আমার আশঙ্কা ঠিক হয়, কয়েকটা জিনিস কিন্তু আমাকে আনিয়ে দিতেই হবে প্রফেসর সাহেব, যত রাতই হোক, যেখান থেকে খুশি হোক।’

‘আচ্ছা কী কী লাগবে বলে দেবেন একটু। একেবারে অসম্ভব না হলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা হয়ে যাবে’, প্রফেসর সাহেবের গলায় উদ্বেগটা নজর এড়ায় না কারোরই।

‘আর আপনার সেই পূর্বপুরুষের নাম কী? যিনি সোমপুরা মহাবিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন?’

‘মহাস্থবির রত্নাকরশান্তি।’

* * *

ফলকটা হাতে নিয়ে আরক্তমুখে বসে ছিলেন মৈত্রমশাই। তাঁর মুখের ওপর একই সঙ্গে খেলা করে যাচ্ছিল ভয় এবং উদ্বেগ। তাঁর পাশে চুপ করে বসেছিলেন তথাগত এবং ঊর্মিমালা।

ফলকটা দেখেই চমকে উঠেছিলেন তিনি। ঊর্মিমালার মনে হয়েছিল যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতন এক বার কেঁপে উঠলেন মৈত্রমশাই, একদম সিধে হয়ে গেলেন। তারপর খুব সাবধানে, যেন বিষাক্ত কিছু নাড়াচাড়া করছেন এমনভাবে লাল চেলিতে ফলকটি হাতে নিয়ে বৈঠকখানায় এসে অনেক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বিড়বিড় করতে করতে সারা ফলকটাকে ছুঁয়ে দেখলেন। কিছুক্ষণ পর দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘কতগুলো জিনিস একটু আনিয়ে দিতে হবে প্রফেসর সাহেব, বেশি সময় নেই। খুব সম্ভবত পরের বারো ঘন্টার মধ্যেই আপনাদের ওপর একটা বিশাল ফাঁড়া আসতে চলেছে। দেখি কতদূর কী করা যায়।’ এই বলে একটি কাগজে কিছু লিখে দিলেন। প্রফেসর সাহেব তৈরিই ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ লোক পাঠিয়ে দিয়ে এসে মৈত্রমশাইয়ের পাশে গিন্নিকে নিয়ে উদ্বিগ্নমুখে বসলেন, ‘এইবার যে সব কিছু খুলে বলতে হচ্ছে মিস্টার মৈত্র। এ কীসের ফলক, কীসের ভয়, কোন অমঙ্গল আশঙ্কা। আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কারো কোনো ক্ষতি করিনি, আমরা যখন পেরেছি লোকের সাহায্য করেছি। আমাদের তো এসব ঝামেলার মধ্যে পড়ার কথাও নয়।’

খানিকক্ষণ চোখ বুজে থাকার পর মৈত্রমশাই শুরু করলেন,

‘প্রারব্ধ বোঝেন প্রফেসরসাহেব? খুব সম্ভবত প্রাচীন কোনো ঘটনাচক্রের ফলে এই প্রচণ্ড শক্তিশালী তন্ত্রফলকটি আপনাদের কাছে ফিরে এসেছে। তবে আজ রাতটাই। আজ রাতেই আমি এঁর যথাবিহিত পূজা সংস্কার করব, কাল সকালে বা দুপুরে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে আসব। এ জিনিস লোকারণ্যে থাকা ঠিক না।’

‘কিন্তু এটা কীসের ফলক ঠাকুরমশাই। মূর্তিগুলো কার?’

খানিক্ষণের নৈঃশব্দ্য, তারপর ধীরস্বরে বলতে লাগলেন তিনি, ‘বলতে গেলে তো অনেক কথাই বলতে হয় প্রফেসরসাহেব, তবে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে বলছি। ভগবান গৌতম বুদ্ধের পরিনির্বাণের এক-শো বছরের মধ্যে বৌদ্ধসংঘে বিবাদ শুরু হয়। পরের চার-শো বছরের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম দুই ভাগ হয়ে যায়, স্থবিরবাদ বা থেরবাদ বা হীনযান এবং মহাসাংঘিক বা মহাযান।

হীনযান ও মহাযানের মধ্যে দর্শনের পার্থক্য বলতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে, অত সময় আমাদের নেই। হীনযানীরা বুদ্ধের আসল মতবাদ আঁকড়ে রইল। মহাযানীরা বুদ্ধকে লোকোত্তর বলে তাঁকে পূজা করা শুরু করল, নিয়ে এল স্বর্গ নরক, পূজা অর্চনা, ক্রিয়া কাণ্ড ইত্যাদি। এবং তারা শুরু করল আরও একটা জিনিস, মূর্তিপূজা। ভারতবর্ষে মূর্তিপূজার উদ্ভব বৌদ্ধদের হাত ধরেই।’

‘কথাটা অবশ্য ঠিক বৈদিক হিন্দুধর্মে যাগযজ্ঞ ছাড়া আর কোনো পূজাবিধির উল্লেখ নেই। মূর্তিপূজার তো নেই-ই’, তথাগত সমর্থন করেন।

‘ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্ম যখন তিব্বতে ঢুকল পঞ্চম ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ, তখন সেখানকার স্থানীয় বন উপজাতিদের সঙ্গে অনেক লড়াই ও আপোষের পর তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম এক সম্পূর্ণ নতুন রূপ নিল, তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বা বজ্রযান। তাতে মূর্তিপূজা আর মন্ত্রতন্ত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয় শুরু হল, তার জায়গা নিল মন্ত্রযান। বৌদ্ধধর্মের সমস্ত উচ্চ আদর্শ ও ভাব নীতি, যেমন চারটি আর্যসত্য, অষ্টাঙ্গিক মার্গ, পঞ্চশীল বা অষ্টশীল পালন এসব জলাঞ্জলি দিয়ে প্রধান হয়ে উঠল গুরুবাদ, ভূতপ্রেতাদির পূজা, যন্ত্রমন্ত্র মণ্ডল ইত্যাদি। এবং জেনে আশ্চর্য হবেন যে এই মহাযানের বাড়বাড়ন্ত থেকে মন্ত্রযান বা বজ্রযানে অবনতি, পুরো ঘটনাটা ঘটার মধ্যে বাঙালিদের খুব বড়ো ভূমিকা ছিল। পালরাজাদের সময়েই মহাযানপন্থার বাড়বাড়ন্ত, এই সোমপুরা মহাবিহারও সম্রাট দেবপালের তৈরি। পূর্ব বিহার অর্থাৎ অঙ্গ থেকে চট্টগ্রাম অর্থাৎ হরিকেল অবধি, প্রাগজ্যোতিষপুর মানে আসাম থেকে তাম্রলিপ্ত, মানে তমলুক সমস্ত এলাকাটাই তখন বৌদ্ধ, তখন অবশ্য এই মধ্যবর্তী এলাকাটি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত ছিল, যেমন পৌণ্ড্রবর্ধন, সুহ্ম, সমতট বা বঙ্গ ইত্যাদি। তা সব মিলিয়ে সমস্ত বাংলাদেশে তখন বজ্রযান তথা মন্ত্রযানের রাজরাজত্ব। তারপর কালের নিয়মে আদি শঙ্করাচার্য হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ঘটালেন, পালবংশ সরিয়ে শাসন ক্ষমতায় এলেন ‘‘কর্ণাটকদেশাগত ব্রহ্মক্ষত্রিয়’’ সেনরাজবংশ। বৌদ্ধধর্মের গৌরবসূর্য ভাগীরথীর তীরে অস্তমিত হল।’

‘কেন? সেনরাজবংশ কী করল?’ সংশয় ঊর্মিমালার গলায়।

‘সেনরাজবংশ ছিল কট্টর হিন্দু। তারা সমস্ত বৌদ্ধ বিহারকে টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিল। উচ্চপদে বৌদ্ধদের নিয়োগ বন্ধ হয়ে গেল। একে আদর্শের অবক্ষয়, তার ওপর রাজা যদি বিরূপ হন, কোন ধর্মই বা টিকে থাকতে পারে বলুন? যাই হোক, এই পালরাজাদের শাসনের একদম শেষ দিকে, দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বজ্রযান থেকে আরও একটি নতুন ধারার উদ্ভব ঘটে, সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম। এদের প্রচারক ছিলেন সিদ্ধাচার্যরা। এঁরা মানুষের মধ্যে থেকে সহজ ভাষায় জনসাধারণকে উপদেশ দিতেন। চর্যাপদের নিশ্চয়ই নাম জানেন, মানে বাংলা ভাষার প্রথম বই, সেইটিও এঁদেরই লেখা। বাংলাভাষার উদ্ভবও এই সময়েই। বৌদ্ধ ইতিহাস মতে, এই সিদ্ধাচার্যরা সংখ্যায় ছিলেন চুরাশি।’

এতটা বলে একটু জল খেলেন মৈত্রমশাই। ততক্ষণে তথাগতর পাঠানো ছেলেরা লিখে দেওয়া যাবতীয় উপচার নিয়ে ফিরে এসেছে। সেইগুলো রেখে ফিরে এলেন গিন্নিমা, ‘তারপর?’

‘এই চুরাশি জন সিদ্ধাচার্য বড়ো আশ্চর্যজনক লোক ছিলেন। এঁরা থাকতেন খুব সাদাসিদেভাবে এবং কিছুক্ষেত্রে ভারি বিচিত্র জীবিকা পালন করতেন, যেমন দ্বারিকপা বলে একজন ছিলেন, তিনি বেশ্যার দারোয়ান ছিলেন, শবরিপা ছিলেন ব্যাধ বা শিকারি। মজার কথা এই যে, এঁরা প্রত্যকেই কিন্তু অসামান্য এবং অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এই চুরাশি জনের মধ্যে চার জন ছিলেন মহিলা। তাঁদের নাম মণিভদ্রা, লক্ষ্মীঙ্করা এবং মেখলা ও কনখলা নামের দুই বোন। এই চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের সবার নামেই চমৎকার সব গল্প প্রচলিত আছে, তবে সবচেয়ে অদ্ভুত অবিশ্বাস্য বোধ হয় মেখলা ও কনখলা নামে দুই বোনের নামে প্রচলিত ঘটনাটি।’

এতটা বলে থামলেন মৈত্রমশাই। তারপর বললেন ‘হয়তো একটু জটিল বা দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আপনাদের জানা দরকার বলেই বলছি। আমাদের হিন্দুদের অনেক দেব-দেবী বৌদ্ধদের থেকে সরাসরি নেওয়া। বৌদ্ধ দেবতাদের উৎপত্তির কিন্তু সুন্দর সূত্র বা প্রথা আছে, হিন্দুদের মতন এলোমেলো ভাবে কোনো দেবতার উৎপত্তি ঘটেনি বৌদ্ধধর্মে। বৌদ্ধমতে আদিবুদ্ধ থেকে পাঁচ জন ধ্যানীবুদ্ধের উদ্ভব। এই পাঁচ জনের প্রত্যেকের সঙ্গে আবার এক জন করে শক্তি এবং বোধিসত্ত্ব আছেন। এইভাবে সমস্ত বৌদ্ধ দেব-দেবীদের কোনো-না-কোনো ধ্যানীবুদ্ধকুলের অন্তর্গত করা যায়।

আরেকটা কথা, বেশিরভাগ বৌদ্ধ দেব-দেবীই বড়ো ভয়ংকর এবং উগ্রচণ্ডা, শান্তশিষ্ট দেব-দেবী হিন্দুধর্মেই বেশি। একেকজন বৌদ্ধ দেব বা দেবীর রূপবর্ণনা শুনলে অবধি ভয় করে, সামনে উপস্থিত হলে কি হবে জানা নেই। সেই থেকে তান্ত্রিক দেব-দেবী মাত্রেই তার রূপ ভয়ংকর।’

একটু জল খেলেন মৈত্রমশাই, খানিকক্ষণ থেমে তারপর ফের শুরু করলেন,

‘এইরকম এক ধ্যানীবুদ্ধ হলেন অক্ষোভ্য। ইনি পূর্ব দিকের অধিপতি এবং সমস্ত কটু মানে কষাটে স্বাদ এঁর থেকে উৎপন্ন হয়। এঁর এবং এঁর কুলের সমস্ত দেব-দেবীদের রং হল নীল এবং এঁর শক্তির নাম মামকী। এই অক্ষোভ্যকুলেই আছেন বৌদ্ধতন্ত্রের সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী এবং জনপ্রিয় দেবতা হেরুক, একইসঙ্গে সবচেয়ে সাংঘাতিক দেবতাও বটে। হেরুকের চার জন শক্তি, এবং চার জনের সঙ্গে যুগনদ্ধ অবস্থায় এঁর চার রূপ, এবং চার নাম। এই চার শক্তির মধ্যে সবাই উগ্রস্বভাবা এবং প্রাণহন্তারক বটে, তবে ভয়ংকরতমা হলেন যিনি তাঁর নাম দেবী বজ্রযোগিনী। ইনি বৌদ্ধতান্ত্রিকদের সর্বোচ্চ আরাধ্যা দেবী, ইনি ডাকিনীদের অধিষ্ঠাত্রী, প্রজ্ঞা ও ধ্বংসের দেবী, সাক্ষাৎ উগ্রকালস্বরূপিনী। এই দেবী বজ্রযোগিনীরই আরও একটি উগ্রতর রূপ আছে, বজ্রবারাহী। এঁদের পূজা ভয়ানক কঠিন, এবং বিন্দুমাত্র বিচ্যুতিতে সাধকের প্রাণসংশয় উপস্থিত হয়।’

এতটা বলে একটু দম নিলেন মৈত্রমশাই। ঊর্মিমালার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল, তিনি তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন পূজার আয়োজন করতে, অতসীকে বলেছেন আজ রাতে থেকে ওঁকে সাহায্য করে যেতে। একটু পরে ফিরে এলেন, ‘তারপর ঠাকুরমশাই?’

কী যেন ভাবছিলেন মৈত্রমশাই। আস্তে আস্তে তাঁর সমস্ত স্নায়ু সজাগ হয়ে আসছিল, তিনি বুঝতে পারছিলেন উল্কার মতন খুব দ্রুত এক অভিশাপ বিষ নেমে আসছে। সমস্ত রোম খাড়া হয়ে উঠছে তাঁর। যুদ্ধ আসন্ন, এবং এ বড়ো সহজ যুদ্ধ নয়। তিনি জানেন, গুরু তাইই বলেছিলেন তাঁকে। গুরুর গোপন আদেশেই তাঁর এদিকে আসা। এতদিন ধরে খুঁজে খুঁজে অবশেষে বোধ হয় দৈবাৎ তিনি সেই জিনিসটির খোঁজ পেলেন!

ঊর্মিমালার স্বরে সংবিৎ ফিরে পান তিনি, তারপর সমস্ত ইন্দ্রিয়কোষগুলিকে সজাগ করে বলতে থাকেন, ‘মেখলা ও কনখলার কাহিনিটি বড়ো চিত্তাকর্ষক। দক্ষিণ মহারাষ্ট্রে দেবীপট্ট নামক এক জায়গায় এক গৃহস্থের মেখলা ও কনখলা নামের দুটি মেয়ে ছিল, মেখলা বয়সে ছিল বড়ো, দু-বছরের। বিয়ের বয়েস হলে তাদের বাবা এক সম্পন্ন ব্যবসায়ীর দুই ছেলের সঙ্গে তাদের বিয়ে তো দিলেন। কিন্তু তাদের বিবাহিত জীবন ছিল খুবই অভিশপ্ত, বড়ো ছেলেটি ছিল বিকৃতকামী এবং ছোটো ছেলেটি ছিল বিবাহিত জীবনে উদাসীন। ফলে যা হয়, দুই বোনের বিবাহিত জীবন বিষময় হয়ে ওঠে। এরপর যা হয়, এসব কথা পল্লবিত হয়ে পাড়াপ্রতিবেশীদের কাছে পৌঁছয় এবং তাদের নিয়ে গুজব ছড়াতে থাকে। ফলে ঘরে-বাইরে তাদের বেঁচে থাকা দুষ্কর হয়ে ওঠে। একদিন দুই বোন তাদের বাড়িতে বসে নিজেদের দুঃখের কথা বলাবলি করছে, এমন সময় সিদ্ধাচার্য কাহ্নপা বা কৃষ্ণাচার্য সেখান দিয়ে নিজের সাত-শো ডাক ও ডাকিনী নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে দেখে দুই বোনের বড়ো ভক্তি হল, তারা তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে গুরু কাহ্নপার শরণ নিয়ে তাদের সংসারে বীতরাগের কথা জানাল। কাহ্নপা তখন দুইজনকে বজ্রবারাহী মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন এবং নির্জনে গিয়ে সেই মন্ত্রের সাধনা করতে বললেন।’

‘ওদের বাড়ির লোক কেউ খুঁজল না?’ ঊর্মিমালার গলায় স্পষ্টতই উৎকন্ঠা।

‘বউদি, বাড়ির বউ বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে গেলে এখনও, এই আধুনিক কালেও কি আমরা সেই হতভাগীকে ত্যাজ্য করে দিই না? আর এ তো প্রাচীনকালের ঘটনা’, মৃদু হাসেন মৈত্রমশাই।

দুই বোন জঙ্গলে গিয়ে দীর্ঘ বারো বছর ধরে বজ্রবারাহী মন্ত্রে সাধনা করে প্রচুর অলৌকিক শক্তি প্রাপ্ত হয়। তারপর একদিন তাদের ইচ্ছা হয় গুরুর সঙ্গে দেখা করার। খুঁজতে খুঁজতে তারা বাংলাদেশে হেমদল নামের এক জায়গায় এসে গুরুর দেখা পায়। কিন্তু তখন তারা আর সেই যুবতী বউ দুটি নেই, মধ্যবয়সি রুক্ষমূর্তি শুষ্কপ্রায় দুই সাধিকা, কাহ্নপা তাদের চিনতে অস্বীকার করেন।

তখন দুই বোন গুরুকে নিজেদের পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহনের কথা বলেন। তখন কাহ্নপা বলেন, যদি শিষ্যত্বই তারা নিয়ে থাকে, তবে গুরুদক্ষিণা কই? বনচারী কপর্দকহীন দুই বোন জানায় গুরু কী দক্ষিণা চান? কাহ্নপা বলেন, তাঁর দুই বোনের মুণ্ডু চাই!’

‘এ তো সেই শকুন্তলা আর একলব্যের গল্পের মিশেল, মিস্টার মৈত্র’, আশ্চর্য শোনায় দর্শনের অধ্যাপকটির গলা।

একটু থামেন মৈত্রমশাই, তারপর বলেন, ‘তা বটে, তবে এর পরের কাহিনিটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের এবং এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি, মন দিয়ে শুনবেন। এই কথা শোনামাত্র দুই বোন নিজেদের মুখের মধ্যে থেকে তীব্র আলোকময় তীক্ষ্ণ প্রজ্ঞা খড়্গ বার করে নিজেদের মুণ্ড কেটে ফেলে এবং গুরুকে ভেট দেয়। এবং তারপরেই তাদের ধড় দুটি শুরু করে এক অপার্থিব, অলৌকিক নাচ, সেই নাচ বিশ্বচরাচরে আর কেউ কোনোদিন দেখেনি। নাচতে নাচতে তাদের দেহ এক মায়াবী নীল আলোর মধ্যে উঠে যায় উর্ধ্বাকাশে, ডাকিনীদের মধ্যে। ডাকিনীরাও তাদের দেখে উত্তেজিত হয়ে নিজেদের মুণ্ডচ্ছেদন শুরু করে দেয়, তারাও শুরু করে সেই স্বর্গ মর্ত্য পাতাল মথিত করা নাচ। সৃষ্টি রসাতলে যায় যায় প্রায়।’

বলে থেমে যান মৈত্রমশাই, এই শীতেও ঘাম জমেছে ওঁর মুখে, স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন আরেকজনও। ঈষৎ কাঁপা গলায় ঊর্মিমালা জিজ্ঞেস করেন, ‘তারপর? তারপর কী হল?’

‘তারপর, অবশেষে দেবী বজ্রবারাহী স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে ডাকিনীদের নিরস্ত করেন, এবং নিজের হাতে নিজের মুণ্ডচ্ছেদ করে নাচ শুরু করেন। তাঁর সেই কাটা গর্দান থেকে রক্তধারা উপচে পড়ে দুই ডাকিনীর মুখে, বজ্রবৈরোণি এবং বজ্রবর্ণিনী। এরপর গুরু কাহ্নপা নিজের হাত বাড়িয়ে দুই শিষ্যার মাথায় তাদের কাটামুণ্ড জুড়ে দেন এবং তাঁদের সিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। এর পর বেশ কিছু বছর অশেষ লোকহিত করে দুই বোন খেচরে, অর্থাৎ ডাকিনীদের স্বর্গে যান।’

এতটা বলে ফলকটা দু-জনের চোখের সামনে তুলে ধরেন মৈত্রমশাই, উত্তেজনায় তাঁর গলা তখন থরথর করে কাঁপছে ‘ভালো করে দেখুন আপনারা, দুই নাচতে থাকা বোনকে দেখতে পাচ্ছেন? নিজেদের মাথা কাটতে উদ্যত! নীচে পদ্মাসনে বসে আছেন গুরু কাহ্নপা বা কৃষ্ণাচার্য। ওপর থেকে আশীর্বাদ দিচ্ছেন দেবী বজ্রবারাহী।’

‘তার মানে…’ কথার খেই হারিয়ে যায় ঊর্মিমালার…

‘এ কোনো অর্বাচীন জিনিস নয় বউদি, এটি একটি কম করে হাজার বছরের পুরোনো বৌদ্ধতন্ত্রফলক। দেবী বজ্রবারাহীর আরাধনার জন্যে, তাঁকে আহ্বান করার জন্যে এর সৃষ্টি। কোনো অতিলৌকিক প্রতিভার অধিকারী সাধক এর সৃষ্টিকর্তা। এর ইতিহাস অদ্ভুত, ক্ষমতা অসামান্য। এবং এরই মধ্যে এক সুপ্ত অভিশাপ লুকিয়ে আছে। খুব সম্ভবত কোনো শক্তিশালী পুরুষ এই ফলককে অভিশাপ দেন।’

ভয়ে ঊর্মিমালার মুখ বিবর্ণ হয়ে আসে, ‘তাহলে? কী উপায় ঠাকুরমশাই?’

‘আমি আজ সারারাত তন্ত্রমতে দেবীর আরাধনা করব, তাঁকে প্রসন্ন করে সেই প্রাচীন অভিশাপটিকে প্রশমিত করব। যতক্ষণ পূজা চলবে, কারও বাইরে থাকার দরকার নেই। পূজা শেষ হলে, যত রাতই হোক আমি একে নিয়ে চলে যাব, আমার গুরুর আদেশ আছে। আমার ব্যাপারে চিন্তা করবেন না, জগন্মাতার আদেশ হলে আমাদের আবার দেখা হবে।’

‘কিন্তু ইনি তো বৌদ্ধ দেবী বললেন। আপনি হিন্দু ব্রাহ্মণ, আপনি কী করে…’ তথাগতর কথাটা মাঝপথেই থেমে যায়।

শান্তস্বরে বললেন মৈত্রমশাই, ‘আপনি বোধ হয় কাহিনির পুরোটা শোনেননি, তাই না? শেষ দিকটা মনে আছে? ‘‘অবশেষে দেবী বজ্রবারাহী নিজে আবির্ভূত হয়ে ডাকিনীদের নিরস্ত করেন, এবং নিজের হাতে নিজের মুণ্ডচ্ছেদ করে নাচ শুরু করেন। তাঁর সেই কাটা গর্দান থেকে রক্তধারা উপচে পড়ে দুই ডাকিনীর মুখে, বজ্রবৈরোণি এবং বজ্রবর্ণিনী।’’ বজ্রবারাহীর এই রূপের নাম হল ছিন্নমুণ্ডা। বুঝলেন কিছু?’

তথাগতর ঠোঁট দুটো নড়তে গিয়েও থেমে যায়।

গাঢ়স্বরে মৈত্রমশাই বলেন, ‘দেবী বজ্রবারাবীর ছিন্নমুণ্ডা রূপের সঙ্গে মিলিয়ে কোনো হিন্দু দেবীর কথা মনে পড়ে প্রফেসরসাহেব?’

তথাগত নয়, ফিসফিস করে উত্তর দেন ঊর্মিমালা, ‘দেবী ছিন্নমস্তা!’

‘হ্যাঁ বউদি’, ধীর এবং শান্ত স্বরে বলেন মৈত্রমশাই, ‘বৌদ্ধদের দেবী বজ্রবারাহীই আসলে হিন্দুধর্মের দেবী ছিন্নমস্তা।’

নৈঃশব্দ্যের মধ্যে অতসী এসে তামার থালায় করে পূজার যাবতীয় সামগ্রী নিয়ে এল। সেইসব বাড়ির পেছনে বাগানে নিয়ে যেতে বললেন মৈত্রমশাই। সেখানে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে রাখা আছে আগে থেকেই। সেদিকে যাবার জন্যে সবে পা বাড়িয়েছেন, এমন সময়ে ঊর্মিমালা বললেন, ‘ভালো করে পুজো করবেন ঠাকুরমশাই, আপনার যেন কোনো অমঙ্গল না হয়।’

যেতে যেতে কথাটা শুনে থেমে গেলেন প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ, তারপর ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ালেন। ঊর্মিমালার চোখে চোখ রেখে শান্তস্বরে বললেন, ‘যদি বলতেন যেন আপনাদের কোনো অমঙ্গল না হয় সেটা দেখতে, তো বুঝতাম। হঠাৎ আমার অমঙ্গল নিয়ে আপনি চিন্তিত হলেন কেন? আমাকে তো কেউ ডেকে আনেনি বউদি, আমি তো নিজেই এসেছি। বিপদ তো আপনাদের, আপনি আমার জন্যে উতলা হলেন কেন? পুরোহিতের দায়িত্ব যজমানের ভালো মন্দ ভাবার কথা, উলটো হওয়ার তো কথা নয়। এখানে যজমান পুরোহিতের কথা ভাবছে কেন?’

‘বিপদ বুঝে নিজে এগিয়ে এসেছেন, আপনি আমাদের কেউ নন তা জানি। তা অন্যের বিপদের কথা শুনে আজকের দিনে ক-জনই বা সাহায্য করতে আসে বলুন? আর আপনারও তো ঘর আছে, সংসার আছে। আর আমাদের সাহায্য করতে গিয়ে আপনার খারাপ কিছু হলে তাদের কী হবে?’

খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন মৈত্রমশাই, তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘এইখানেই, এই মুহূর্তেই আপনি জিতে গেলেন বউদি। যার মনে সবার জন্য এত দয়া, এত করুণা, কোনো অভিশাপ তার কী করবে? চিন্তা করবেন না বউদি। আমি, নবদ্বীপের মহেশ্বর মৈত্রের জ্যেষ্ঠ সন্তান কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ, কথা দিচ্ছি এ অভিশাপ আপনাদের ছুঁতে পারবে না। উদ্্বেগে ফেলবে, কিন্তু কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আর এই সর্বভূতে দয়ার ভাবটিকে বাঁচিয়ে রাখবেন বউদি, মনে রাখবেন ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড়ো তন্ত্র, সবচেয়ে বড়ো জাদু।’

* * *

এক গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছিল তিতলি। যেন এক মহাশূন্যে সে ভেসে বেড়াচ্ছে, কোনো অবলম্বন নেই, কোনো দিশা নেই, কোনো গভীরতার বোধ নেই। সেই দিকহীন, প্রাণহীন, শব্দহীন, আলোহীন অন্ধকারে সে একলা ভেসে চলেছে। তার নিজের কোনো বোধ নেই, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর কোনো দখল নেই, শুধু তার জাগ্রত চৈতন্য যেন অনুভব করছে যে সে বেঁচে আছে। এমন সময় সেই মহতী অন্ধকারই যেন জমাট বাঁধতে শুরু করল, প্রথমে ধীরে এবং তারপর দ্রুত। শেষে তিনটি জায়গায় তিনটি জমাট অন্ধকার যেন তিনটি মানুষের আকৃতি নিল।

না, মানুষের নয়, মানুষীর। এবং তাদের মাথা নেই, শুধু ধড় তিনটি আছে। আস্তে আস্তে সেই তিনটি প্রাণহীন ধড়ে প্রাণের সঞ্চার হল। তারপর তারা শুরু করল এক অলৌকিক অপার্থিব যৌথনৃত্য। সমগ্র অন্ধকারের সমুদ্র যেন শিউড়ে উঠল সেই নাচ দেখে। রাত্রির প্রতিটি গ্রন্থিতে যেন ভেসে উঠল কান্না, তিনটি অবোধ শিশুর কান্না। তিতলির বুকটা যেন কোন এক অব্যক্ত ব্যথায় মুচড়ে উঠতে লাগল, যেন কোনো এক প্রাচীন অসহায় ফোঁপানির শব্দ আস্তে আস্তে কুরে কুরে খেতে লাগল তার চৈতন্য। মনে হল সেই কান্না, সেই ফোঁপানি, সেই অসহায় আর্তি যেন খেয়ে ফেলতে চাইছে তার সমগ্র সত্তা। কারা যেন কেঁদে কেঁদে বলছে ‘ফিরিয়ে দাও, আমাদের মায়ের কাছে ফিরিয়ে দাও। ওগো, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাদের মায়ের কাছে নিয়ে চল।’ সেই কান্নায়, আর্তিতে আস্তে আস্তে যেন দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল তিতলির। মনে হল যেন সেই অন্ধকার হাহাকার সমুদ্রে যেন ডুবে যাচ্ছে তিতলি। সে চেষ্টা করছে হাত-পা ছুঁড়ে উদ্ধার পাওয়ার, কিন্তু কিছুই সে নাড়াতে পারছে না। তার বোধবুদ্ধি চৈতন্য সমস্তটার ওপর শ্বাসরোধী এক পর্দা নেমে আসছে যেন, তিতলি চাইছে চিৎকার করে উঠতে, হাহাকার করে উঠতে, চেঁচিয়ে উঠতে, কিন্তু তার কোনো ইন্দ্রিয়ই আজ আর তার বশে নেই। চোখের সামনে নেমে আসছে এক কালো পর্দা, নেমে আসছে অমোঘ মৃত্যু, নেমে আসছে, নেমে আসছে, নেমে আসছে…

সেই চূড়ান্ত মৃত্যুর মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই যেন সব কিছু থমকে দাঁড়াল এক বার। কোনো এক অনির্দেশ্য বিন্দু থেকে উদাত্ত এবং গম্ভীর কন্ঠে ভেসে আসছে এক পুরুষের গলা,

‘ওঁ প্রত্যালীঢ় পদাম সদেব ধরিতীম ছিন্নম শিরা কর্তুকাম। দীঘবস্ত্রাম্ স্বকবন্ধ শোণিতসুধা ধরম পিবতীন মুদা। নাগবদ্ধ শিরোমণি ত্রিনয়ণাম্ হৃদ্যু তপালাম কৃতম্। রত্যাসক্ত মনোভব পরিদ্রধান ধ্যায়েৎ।’

ধীরে ধীরে তিতলির চেতনায় সাড় ফিরে আসতে লাগল। স্তিমিত হয়ে এল অন্ধকারের সেই আর্তনাদ। তিতলির মনে হল যেন এক পাতালপুরীর আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়ে সে দ্রুত উঠে আসছে ওপরে, আলোর দিকে। আস্তে আস্তে সমস্ত অন্ধকার কেটে যাচ্ছিল। আলোয়, আশায়, আনন্দে ভরে উঠছিল তিতলির চৈতন্যের প্রতিটি কোণ। আলোর সেই উৎসে পৌঁছোনোর আগে সেই গম্ভীর পুরুষকন্ঠটি শেষ বারের মতন শুনল তিতলি ‘শ্রীঁ ক্লীঁ হ্রীঁ ঐঁ বজ্রবৈরোচনীয়ে হুঁ হুঁ ফট্ স্বাহা’… আর তার পরেই আলো আলো আলো…

হাঁপাতে হাঁপাতে বিছানার ওপর উঠে বসল তিতলি। কী সর্বনাশা ভয়ংকর স্বপ্ন, বাপরে! আর ও ঘুমিয়ে পড়েছিল কোন আক্কেলে? ভাগ্যিস ঘুমটা ভাঙল, নইলে সমস্ত প্ল্যান চৌপট হয়ে যাচ্ছিল আর কী! কাল রাতে কোনো এক পুরুতমশাই নাকি এসেছিলেন কীসব পুজো টুজো করতে, সেই দেখে তো তিতলি আর বেশি কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি দোতলাতে ওর ঘরে চলে এল। ঝিমোতে ঝিমোতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে! কী ভাগ্যিস ঘুমটা ভেঙে গেল।

মোবাইল স্ক্রিন অন করল তিতলি, ভোর পাঁচটা। যাক একদম ঠিক সময়ে উঠেছে ও। চটপট রেডি হয়ে নিল। শীতের সকাল, গরম জামাকাপড় গায়ে চড়াল কিছু। ব্যাগ তো তৈরিই ছিল, সেসব নিয়ে সাবধানে, অতি ধীরে নীচে নেমে এল তিতলি। যাক, সব্বাই মড়ার মতন ঘুমোচ্ছে। অত্যন্ত সন্তর্পণে দরজা খুলে বাইরে এসেই দ্রুত হাঁটা শুরু করল ও। মোড়ের মাথায় আসতেই আরও দুই মূর্তি। কোনো কথা না বলে দ্রুত রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটা মারল তারা। সকালের প্রথম ট্রেন ভোর ছ-টায়।

* * *

ঘুম থেকে উঠতে দেরিই হয়েছিল তথাগতর। যত রাত গড়িয়েছে আরও গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেছিলেন তিনি। এমন অথই ঘুম বহুদিন হয়নি ওঁর। ঘুম ভাঙল ঊর্মিমালার ধাক্কাধাক্কিতে। উঠেই চোখ কুঁচকে ফেললেন তিনি, ইস, এত বেলা হয়ে গেছে…

‘কী হয়েছে? ধাক্কাচ্ছ কেন?’

‘ঠাকুরমশাই নেই, ফলকটাও নেই’, হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন ঊর্মিমালা।

‘তো তাতে হাঁপাচ্ছ কেন? উনি তো বলেইছিলেন যে ফলকটা নিয়ে যাবেন গঙ্গায় ফেলে আসতে, সে যত রাতই হোক। একেবারে সেখানেই গেছেন হয়তো, আমাদের ডাকবেন না, সে তো বলেই গেছিলেন। আমি বরং একবার মাধবদের বাড়িতে খোঁজ করে দেখছি।’

আর্তনাদ করে ওঠেন ঊর্মিমালা, ‘ওগো সর্বনাশ হয়ে গেছে। সকাল থেকে তিতলিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ও বাড়ির সোনাই রূপাইও নেই। তোমার ভাইকে ফোন করলাম, সেখানেও নেই। তিতলি একটা চিঠি লিখে গেছে দেখ’ বলে একটা চিঠি ফেলে দিলেন তথাগতর কোলে।

চিঠিটা পড়তে পড়তে ভয়, উদ্বেগ আর আশঙ্কায় তথাগতর মুখ বিবর্ণ হয়ে উঠল। দ্রুত উঠে পড়েন তিনি। এই মুহূর্তেই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

সর্বনাশ আসবে বলে তৈরিই ছিলেন প্রফেসর তথাগত দত্তগুপ্ত। কিন্তু একচক্ষু হরিণের মতন বিপদটা এল সম্পূর্ণ অন্যদিক দিয়ে, এলও বড়োই দ্রুত। এবং এ বিপদ মহাবিপদ, ঘোর বিপদ।

বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখে জল দেওয়ার সময় বুঝলেন তথাগত, আশঙ্কায় তাঁর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। থরথর করে।

* * *

শিয়ালদা স্টেশনের বাইরে যেদিকটা পায়খানা পেচ্ছাপে, বৈঠকখানা বাজারের নোংরায়, মরা বিড়ালের ছানা, ভাঙা মাটির ভাঁড়, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ আর চোলাইয়ের বোতলে ছাকনাচুর হয়ে থাকে, সেদিকে একটা ভাঙা ঝোপড়ির মধ্যে বসে ইঞ্জেকশনে মিক্সচার টেনে নিচ্ছিল টেনিয়া।

শীতকালের বিকেল, ঠান্ডা লাগছে হেবি। একটু আগেও টেনিয়ার হাড় অবধি জমে যাচ্ছিল ঠান্ডাতে। দুটো শট নিয়ে এসেছে টেনিয়া, তাই বডিটা সামান্য ওম মারছে। আহ, নাসিরভাই উমদা জিনিস ছাড়া দেয় না, মালটাও খিঁচে নেয় তেমনি। শালা চারটে পুরিয়া চার হাজার, হারামিটা এক পয়সা কম নেয় না।

মাথায় দুটো কিক পড়তেই ইন্দ্রিয়গুলো সটাসট চোখা হয়ে ওঠে টেনিয়ার। সেবার তো বৈজনাথের মাথায় দানা ভরে দেবার আগে দুটো ছিলিম গাঁজা উড়িয়ে তারপর একটা নাসিরের দেওয়া শট নিয়ে গেছিল টেনিয়া। আহা, প্রথম দানাটাই সোজা কপালে, আওয়াজ করার সময় অবধি পায়নি হারামিটা। ভাবতেই টেনিয়ার মুখে একটা হাসি খেলে যায়।

পুলিশ অবশ্য ভালো ভাবে নেয়নি ব্যাপারটা। হাড়কাটার একটা বেশ্যার জন্যে টেনিয়া হিট খেয়ে কাউকে উড়িয়ে দিল এটা ওদের বিশ্বাস হয়নি, ভেবেছে গ্যাং ওয়র। তুলে নিয়ে গিয়ে লক-আপে ঢুকিয়ে উলটো করে ঝুলিয়ে কী মার কী মার! সেই থেকে বাঁ-হাতের কড়ে আঙুলটা নাড়াতে পারে না ও। তবে অফিসারটার নাম মনে রেখেছে টেনিয়া, সুবীর সামন্ত। শুয়োরের বাচ্চাটা এখন যাদবপুর থানায় আছে। দুনিয়াটা শালা গোল, মওকা আসবেই, সেদিন হারামজাদাটার খোমা বিলা করে দেবে টেনিয়া।

মিক্সচারটা সিরিঞ্জে প্রায় ডাক্তারের নিষ্ঠায় ভরতে থাকে ও। এদিকে কেউ বিশেষ আসে না। স্টেশনের বাইরে নিজের ভাড়ার ট্যাক্সিটা রেখে এদিকে এসে একটা শট নিয়ে যায়, নইলে ওর চলে না। তামার পয়সা ঘষে দারু, বা হেরোইন চরস ছাড়া ওর নেশা হওয়া মুশকিল, তবে তাতে হেব্বি খরচ। দুয়েকবার চুমকুড়ি, মানে জিভে সাপের ছোবল নিয়ে অবশ্য দেখেছে ও, আহ, নেশার রাজা। কিন্তু ওই যে, কুত্তি পয়সা। শালি কারও শোনে না।

পয়সার জন্যেই তো ও মেয়ে পাচারের ব্যবসাটা শুরু করতে বাধ্য হল।

মেয়ে পাচারের হ্যাপা অনেক, কিন্তু হেভি মাল্লু। গাঁ গঞ্জে মালিকের আড়কাঠি ছড়ানোই আছে। কেউ শালা প্রেম মহব্বতের নাম করে বাচ্চা মেয়েগুলোকে ফুসলিয়ে নিয়ে আসে, কেউ আবার চাকরি দেবার নাম করে। দু-দিন এদিক-ওদিক থাকে, সংসার করে কি কলকাতা দেখে, তারপর একদিন হাত-পা বেঁধে মালিকের লরিতে তুলে দিলেই হল। ইউ পি, দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, বাঙালি মেয়েদের হেবি ডিমান্ড। নরমসরম বডি, পাঁইয়াগুলো বিছানায় হেবি সুখ পায় নিশ্চয়ই? তার ওপর ভীতু বাঙালি, দুটো থাপ্পড় কষালেই চুপ থাকে। সাধে কী শ্লা সেই বাংলাদেশ থেকে বাঁকুড়া অবধি হাজার হাজার বাঙালি মেয়ে বাঁধাকপিগুলোর বিছানা গরম করছে? খুক খুক করে একটু হেসেই নেয় টেনিয়া।

পার মেয়ে দশ মতন পায় ও। মাগি একটু ফর্সা হলে আর মাইফাইয়ের সাইজ ভালো থাকলে তিরিশ অবধিও কামিয়েছে টেনিয়া। তবে এ লাইনের সবচেয়ে সুখ হচ্ছে, মেয়েগুলোকে তৈরি করার দায়িত্বটা টেনিয়াদের ওপরেই পড়ে। আহা, কচি মাল সব, আজকাল তো দশ বারো থেকে মেয়ে তুলতে বলছে মালিক। পনের ষোলোর বেশি হলেই নাকি কাস্টমার নাক সিঁটকোচ্ছে। সেই ভয়ে কাঁটা হয়ে যাওয়া, পেচ্ছাপ করে ফেলা বাচ্চা মেয়েগুলোকে ধরে বিছানায় তুলে আশ মিটিয়ে খাওয়ার মধ্যে যে কী অপার সুখ, সে টেনিয়া বলে বোঝাতে পারবে না।

চাদরের খরচাটা অবশ্য টেনিয়াই দেয়। সাদা চাদর ছাড়া টেনিয়া অন্য চাদর পছন্দ করে না, আর একবারের রক্তমাখা চাদর টেনিয়া দু-বার ব্যবহার করে না। সেইজন্য মালিক তো ওর নামই দিয়েছে চাদ্দরচোদ!

তবে যাতে টেনিয়ার সবচেয়ে বেশি লাভ, সেটা হল ফেসবুক!

ফেসবুকে শালা কিলবিল করছে বাঙালি মেয়ে। খানিকটা ওরই মতন দেখতে একটা ছেলের ছবি দিয়ে ঘ্যামা প্রোফাইল বানিয়েছে ও। বেশ কিছু কচি মাল এসে ঠুকরে যায়। সেক্সি থোবড়া দেখলে বাঙালি মেয়েগুলোরই প্রেম প্রেম বাই উথলে ওঠে বেশি, দেখেছে টেনিয়া। বাকি ওড়িয়া কি বিহারি কি পাঞ্জাবি মেয়েগুলো পাত্তা অবধি দেয় না, শেয়ানা জাতের মাল শালি, মনেমনে খিস্তি করে টেনিয়া। ফেসবুক থেকে মেয়ে তোলার সবচেয়ে ভালো দিক হল নো কাটমানি, শ্লা পুরো মাল্লু নিজের ইয়েতে। আজও একটা শিকার দুপুর তিনটে নাগাদ এসে পৌঁছবে, সঙ্গে দুটো ল্যাংবোট নিয়ে। শাল্লা, এক ছিপে তিন মছলি, আজ তো খুনখারাপির দিন টেনিয়ার!

শট নিয়ে একটা জাম্বোসাইজ বিড়ির মধ্যে তামাক আর টিকটিকির লেজপোড়া ছাই মিশিয়ে ভরে বানাতে বানাতেই পিছনে একটা খ্যাঁক খ্যাঁক আওয়াজ শুনতে পেয়ে হিংস্র কেউটের মতোই ঘুরে বসে ও।

ভিখু, টেনিয়ার এক নম্বর শাগরেদ। পকেটমার ছিল আগে, পরে কয়েক বছরের জন্য একটা গব্বাবাজদের দলে ভিড়ে যায়। ভালো বোম বাঁধতে পারে, যদিও ওই করতে গিয়েই বাঁ-হাতের কয়েকটা আঙুল মায়ের ভোগে যায়। ‘গুরু, এখানে বসে নেশা চোদাচ্ছ, ওদিকে তিনটে ফানটুস মিছরি টেসনের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্চে যে! বাড়ি থেকে পালিয়েচে বোদায়। সাঁটিস মাল গুরু, পুরো চাম্পি। বুকে এত্ত বড়ো মাদার ডেয়ারি নিয়ে ঘুরচে গুরু, টাইট জিন্স পরে আচে তো, ওহ, কী থাপা, কী পাচছল…’

চোখ দুটো সরু করে ভিখুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বিড়িটা ধরায় টেনিয়া। সেই সাপের চাউনির সামনে ভিখু একটু চুপ করে যায়। প্রথম টানটাই টং করে মাথায় গিয়ে লাগে টেনিয়ার, মালগুলো তাহলে এসে গেছে? ফোনটা তাহলে এরোপ্লেন মোড থেকে নর্মাল মোডে আনতে হবে তো!

‘ঠিক দেখেছিস? বিলকুল ফাঁকা? সঙ্গে কোনো আনছান চ্যাংড়া মাসুক নেই তো?’ সাবধান হওয়া ভালো, ভাবে টেনিয়া।

‘না গুরু, ভিখুর মতন আংলিদার আর পাবে না। সোব ছানবিন করে এসেচি। একটা বড়ো, প্পুরো হরিণঘাটা ডেয়ারি, পঁয়েরো ষোলো হবে, বাকি দুটো টুননি, দশ বারো মতন, বড়টা একটা ব্যাগে ভরে কাপড়চোপড় এনেচে, বোদায় বড়োটা বাড়ি থেকে কাল্টি মেরেচে। গরম ছাম মাইরি, বেচতে পারলে ম্যালা সেরকড়ি গুরু, দেড় পেটির কম হবে না। তাড়াতাড়ি করো মাইরি, পুলিশ ঢুকে গেলে কিন্তু এক পয়সা পাবে না শ্লা।’

দেড় পেটি! কথাটা গিয়ে টেনিয়ার মস্তিষ্কে আঘাত করে। এতটা ও নিজেও ভাবেনি। আরেকটা টান মেরে ধীরেসুস্থে ওঠে ও, তারপর ভিখুর ঘাড়টা খপ করে ধরে, ‘ঠিকঠাক ছানবিন করেছিস তো? আর কেউ নেই তো? আনসান খবর হলে কিন্তু তোমার গিনি বাজিয়ে ফাঁট করে দোবো হারামজাদা, খেয়াল থাকে যেন।’

ভিখু প্রায় নুইয়েই পড়ে, ‘মাক্কালির দিব্যি গুরু। এলাকার মেয়ে নয়, তিনটেই আলগা ছাবকি, আর গরম মাল মাইরি, হেব্বি খাম খাম। বড়োটার বোধায় আশিকের সঙ্গে পালিয়ে যাবার ছিল, সে শ্লা চোখ উলটে কেটে পড়েছে! মালটা ফোন কচ্চে আর তারপরেই নামিয়ে রাকচে। মালগুলোর তো শ্লা কেস কিচাইন, সেই এক কোণায় বসে হুসুরফুসুর করচে। গুরু তুমি তো ইংলিস ফিংলিস বলতে পার, গিয়ে ছাম তিনটের সঙ্গে ভাব জমাও না, আজ রাতটা রাজারহাটের ডেরায় তুলে তিনটেকেই ঝিললি পেলে নিই, কাল পরশু আসলামের লরিতে করে…’

‘শালা চামড়াচোর, কমলি দেখলেই চুদুরবুদুর না? আমাকে কাজ শেখাচ্ছিস শালা? চ্যল, চাবিটা নে, গাড়িটা রেডি রাখ। মোবাইল রেডি থাকে যেন, টুং করলেই সোজা পেছনের গেটে, মনে থাকবে?’

চাবিটা ছুঁড়ে দিয়ে ভাঙা চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে স্টেশনের দিকে রওনা দেয় টেনিয়া। না, টেনিয়াকে দেখিয়ে দেওয়ার দরকার নেই মেয়ে তিনটে কোথায় বসে আছে। মোবাইলটার মোড চেঞ্জ করে টেনিয়া। ইসস, অনেকগুলো মিসড কল অ্যালার্ট এসে পড়ে আছে। নিজের ফেসবুকটা অন করে একবার মেসেঞ্জারটা দেখে নিয়েই বন্ধ করে টেনিয়া। স্ক্রিনে ফুটে উঠেছিল প্রায় ওরই মতন আরেকটা ছেলের ফটো, প্রোফাইলে লেখা ছিল একটা ছোট্ট নাম, স্যাম!

* * *

ট্যাক্সির স্টিয়ারিঙে টানটান হয়ে বসেছিল ভিখু। গুরু কখনো ফেল হয় না, একটু পরেই পাক্কা ছবকি তিনটেকে ম্যানেজ করে গুরু সিগন্যাল দেবে। একবার ভুলিয়েভালিয়ে রাজারহাটের ফাঁকা ফ্ল্যাটটায় তুলতে পারলেই,ওহ। শরীরে কিছু চাঞ্চল্য অনুভব করল ভিখু। দুটো দিন তো গুরু রাখবেই। ও আছে, গুরু নিজে আছে, আসলাম আছে, বনোয়ারি আছে, সামন্ত আছে, লোক কম নাকি? দিয়ে থুয়ে খেতে হয়, গুরুর সাফ কথা।

সময় নিচ্ছে গুরু। ভালো, বড়ো মছলি, কিছু সুতো তো খাবেই। তিনটের মধ্যে যেটা সবচেয়ে বড়ো, সেটাকে আগে চেয়ে নেবে ভিখু, ভেবে রেখেছে। উহ, বাতাবির কী সাইজ মাইরি। ভাবতে ভাবতেই ড্যাশবোর্ড খুলে একটা কালো চেপটা বোতল বার করে আনে। বোতলের ছিপিটা খুলতেই একটা উগ্র কটু ঝাঁঝালো গন্ধ ট্যাক্সির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। পাঁইটটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে ভিখু, তারপর সোজা গলায় উপুড় করে দেয়।

গলাটা জ্বলে যায় ভিখুর, মালটা গিলে নিয়ে খানিকক্ষণ চোখ-মুখ কুঁচকে বসে থাকে। আহ, কী ধক মাইরি, শালা পলকে ধরে নেয়। নিউ ব্যারাকপুরের পদ্মবউদির ভাঁটিতে বানানো আসলি চিজ। চুল্লুর সঙ্গে চুন, আরও কী কী কেমিক্যাল মেশানো হয়, তারপর খদ্দের বুঝে ব্যাটারির জল। পদ্মবউদির চুল্লু তেজে পদ্মগোখরোর বিষের থেকে কম কিছু না, লোকে নামই দিয়েছে পদ্মকাঁটা। আগে বলত ফুটুশ। ফুটুশই বটে, বেশিদিন এই জিনিস চালালে পাবলিক ফুটেই যায়, কম লোক তো ভিখু দেখেনি এ লাইনে। ভিখুও ফুটবে, বেশি দিন নেই আর।

ভাবতেই ভাবতেই খি খি খি করে ছোপ ধরা দাঁতগুলো বার করে হেসে ওঠে ভিখু, আর ঠিক সেইসময়ে মোবাইলটা কর্কশ স্বরে বেজে ওঠে। ঝটপট বোতলটা ড্যাশবোর্ডে চালান করে দিয়ে মোবাইলটা তুলে কল অ্যাকসেপ্ট করে কানে দেয় ও, ‘বল গুরু।’

ওপার থেকে টেনিয়ার শান্ত কেউটের মতন গলাটা হিসহিসিয়ে ভেসে আসে ‘বলি দাসদা স্টেশন চত্বরে আছেন নাকি? আপনাকে তো আমার আর তিতলির ব্যাপারে বলেইছিলাম। ও এসে গেছে, বুঝলেন? সঙ্গে আমার দুই শালিও আছে। তা আজকে ঠাকুরমশাই বললেন ভালো লগ্ন নেই, তাই আজ বাদ দিয়ে বিয়েটা আমরা কাল করছি। আজকের রাতটা একটু রাজারহাটে আমার পিসিমার ডেরায় পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে দিন দাদা, প্লিজ। কালকেও কিন্তু সকালে আসতে হবে সক্কাল সক্কাল, মনে আছে তো? কালীঘাটে পৌঁছে দিতে হবে কিন্তু, হেঁ হেঁ…’

ফোনটা কেটে ইঞ্জিন অন করে ভিখু। শাল্লা, আগে থেকে চিনতো তার মানে? অন্য সোর্স থেকে তুলেছে? কী অ্যাকটিং মাইরি, সাধে এই হারামিটাকে গুরু বলে মেনেছে ভিখু? আহ, দুটো দিন। ভদ্র বাঙালি বাড়ির তিনটে নরমসরম বাচ্চা, টাইট নরম থাপকি দুটো, তেমন ছুনমুন গাব্বা ডাব্বা, আহহ, ভাবতে ভাবতেই গিয়ার বদলায় ভিখু।

* * *

ট্যাক্সিটা প্রায় উড়েই চলেছিল সল্টলেকের রাস্তা ধরে। শীতকালের রাত দ্রুত নামে। পিছলে যাওয়া রাস্তার আলোতে ছায়ারা খেলা করে যাচ্ছে পিছনের সিটে বসে থাকা মেয়েগুলোর মুখে। সে মুখে নতুন অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা, বিয়ের চিন্তা, লোকলজ্জার ভয়, নাকি অজানা অচেনা শহরে হারিয়ে যাওয়ার উদ্বেগ, কোনটা বেশি সেটা বলতে পারবে না ভিখু। পাশে টেনিয়া বসে, ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। ওদের যে ঘাঁটি, তার কেয়ারটেকার সামন্তকে বলাই আছে রেডি থাকতে। আধা তৈরি হয়ে পড়ে থাকা বিল্ডিংটায় কেউ থাকে না, তারই একটা ঘর ওরা নিয়ে রেখেছে। একটেরে বিল্ডিং, দূর দূর অবধি কেউ নেই, চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেললেও কেউ শুনতে পাবে না।

টেনিয়ার উদ্বেগ অন্য জায়গায়। মালিককে তিনটেরই ফোটো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে টেনিয়া, মালিক বলছে কালই তুলে দিতে আসলামের লরিতে। কিছু না ভেবেই দু-লাখ চেয়েছিল টেনিয়া, মালিক শোনা মাত্র রাজি হয়ে যায়। এখন আফশোস হচ্ছে টেনিয়ার, আরও কিছু চাইলেই হত। যাকগে যাক। আজ রাতটাই যা…

অনেক্ষণ পর বড়ো মেয়েটা কথা বলে উঠল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি স্যাম’, গলার মধ্যে উদ্বেগ আর উত্তেজনাটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। টেনিয়া একটু খুক করে হেসে নিয়ে বলল, ‘এই তো, আমার পিসির বাড়ি, সামনেই। বড়ো ফ্ল্যাট, পিসি একাই থাকে। আমি বলেই রেখেছি তোমাদের কথা, তোমাদের কোনো অসুবিধাই হবে না, হে হে।’

‘তোমাদের বাড়িতে গিয়ে উঠলে হত না?’

যেন লজ্জাতেই জিভ কাটে টেনিয়া, ‘আরে ছি ছি, বিয়ের আগেই মা তোমাকে দেখবেন নাকি? আজ তো কালরাত্রি না কি একটা বলে না? একেবারে কাল বিয়ে করেই না হয় উঠবে। মা তো বরণডালা সাজিয়েই রেখেছে, হে হে।’

‘এত রাত্রে তিন জন গিয়ে উঠব, পিসিমণি কিছু মাইন্ড করবেন না তো?’ মেয়েগুলোর সারল্য দেখে অবাকই হচ্ছিল ভিখু। তবে আরও অবাক করল টেনিয়া, ‘আরে না না, আমাদের ব্যাপার পিসিমা সওওব জানে। আসলে এখান থেকে কালীঘাট যেতে সুবিধা, আর কালই শুভদিন। এক রাত থাকবে, গল্পগুজব করবে, এ আর এমনকী। আমার পিসি তোমাকে দেখার জন্যে মুখিয়ে আছে বুঝলে! হাজার হোক, বাড়ির বড়ো বউমা বলে কথা!’ ভিখুর তো ইচ্ছে করছিল স্টিয়ারিং ছেড়ে হাততালি দিয়ে ওঠে। শাল্লা, কোথায় লাগে শারুক্ষান, কোথায় লাগে সালমান। সাধে মালিক এত ভালোবাসে গুরুকে?

রাজারহাটের মেইন রাস্তা দিয়ে চলার সময় রিয়ার ভিউ মিররে আরেক বার মেয়ে তিনটের মুখ দেখল ভিখু। উত্তেজনা আর আশঙ্কায় সিটের সঙ্গে প্রায় লেপটে আছে ওরা। ওদিকে টেনিয়া ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে, সেটা ওর আঙুল মটকানো আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখা নিয়েই বোঝা যাচ্ছে।

প্রথম বড়ো সিগন্যাল থেকে গাড়িটা মসৃন সড়ক ছেড়ে ডান দিকের অন্ধকারে খোয়া বিছানো রাস্তা ধরতেই গাড়ির সঙ্গে মেয়ে তিনটেও দুলে উঠল, বড়ো মেয়েটা বলে উঠল, ‘এত অন্ধকার কেন রাস্তায়? আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ বোঝাই যাচ্ছে বিস্তর ভয় পেয়েছে। বাকি বাচ্চা মেয়ে দুটো আঁকড়ে ধরেছে বড়োটার হাত। আধো অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে যে এদের মুখ ভয়ে আতঙ্কে সাদা বিবর্ণ হয়ে গেছে। টেনিয়া একটু কর্কশ গলায় বলে উঠল, ‘আহ, সামনেই বিল্ডিং, ওখানেই পিসিমার ফ্ল্যাট। এত চেঁচামেচি করার কি আছে, অ্যাঁ?’

মেয়েগুলো ধমক খেয়ে থতমত খেয়ে চুপ করে যায়, একটা হালকা ভয়ার্ত ফোঁপানির শব্দ শুনতে পায় ভিখু। এরপর শক্তমুখে বাঁ-দিকে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অন্ধকার বিল্ডিংটার সামনে দাঁড় করায় গাড়িটা।

এরপর একটা আর্ত চিৎকার।

সামন্তকে রাখাই হয়েছে ওই জন্যে অবশ্য। লোকটা আগে পার্টির জন্যে বোম বানাত। একবার ভোটের আগে অপোজিশনের ছেলেরা ধরে মুখের অর্ধেকটা অ্যাসিড আর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। দিনের বেলাতে দেখলেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, রাত্তিরে তো কথাই নেই! রাত্তিরে অন্ধকারে দাঁড়ানো ট্যাক্সির জানালার পাশে এসে এইরকম আধপোড়া মুখ নিয়ে কেউ যদি হাতে আবছা হলুদ এমারজেন্সি লাইট ঝুলিয়ে বলে, ‘নেমে আসুন’, তাতে চমকে যাওয়া স্বাভাবিক। ওখানেই বাচ্চা মেয়েগুলোর নার্ভ ফেল করতে শুরু করে।

এরা অবশ্য যখন থরথর পায়ে নেমে আসে, বাচ্চা মেয়ে দুটো অলরেডি কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। বড়ো মেয়েটাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে ওর পা কাঁপছে, যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যাবে। বাচ্চা দুটো গায়ের সঙ্গে লেপটে আছে পুরো। বড়ো মেয়েটা নেমেই বলল, ‘আমরা এখানে থাকব না স্যাম, আমাদের স্টেশনে ফিরিয়ে দিয়ে এসো প্লিজ, দোহাই তোমার পায়ে পড়ি। আমাকে তো তুমি ভালোবাসো, তাই না স্যাম? প্লিজ স্যাম, লক্ষ্মীটি। আমরা কাল সকালে ঠিক কালীঘাট পৌঁছে যাব, প্রমিশ করছি। আমরা এর ভেতরে যাব না…’

টেনিয়ার থাপ্পড়টা সাপের ছোবলের মতোই নেমে এল মেয়েটার গালে। কোঁক করে একটা আওয়াজ তুলে মেয়েটা মাটিতে পড়ে গেল। বাচ্চা মেয়ে দুটোর যেটা আছে, সেটা ভয় আর আতঙ্ক ছড়িয়েও অনেক বেশি কিছু, মনে হচ্ছে ওদের পাগুলো যেন মাটিতে গেঁথে দেওয়া হয়েছে, এক্ষুনি পেচ্ছাপ করে ফেলবে। ধীরেসুস্থে নীচু হয়ে বড়ো মেয়েটার চুলের গোড়াটা খপ করে ধরল টেনিয়া, ‘শুনে রাখ কুত্তি, টেনিয়ার ডেরায় ঢুকেছিস, তোদের সব নোটঙ্কি এখন থেকে বন্ধ, বুঝলি? আজ রাতটা মস্তি, কাল শ্বশুরবাড়ি, বুঝেছিস? বেচাল যদি দেখেছি, টুকরো করে কেটে পুঁতে দেব। চেঁচালেও আশেপাশে শোনার কেউ নেই, দেখে নে চারিদিকে। ভালো মেয়ের মতো ঘরে বন্ধ থাক। কয়েক ঘন্টা পর কিছু দোস্ত নিয়ে আসছি, কিছু ফুর্তিফার্তা হবে, ন্যাকড়াবাজি একদম নয়, ওক্কে বেব্বি? এখন চ্যল বে, ‘বলে চুলের মুঠি ধরে মেয়েটাকে দাঁড় করায় টেনিয়া। তারপর সিঁড়ি ধরে ছেঁচড়ে তুলতে থাকে। মেয়েটাও বোধ হয় চরম আতঙ্কে বোবা পাথর হয়ে গেছে। রেলিং ধরে ধরে উঠতে লাগল। ভিখু আর সামন্ত বাচ্চা দুটোর ঘাড় ধরে টানতে শুরু করায় ওরাও এগোতে থাকে, বধ্যভূমির দিকে টেনে নেওয়া বলির পশুর মতন।

দোতলায় উঠে ফ্ল্যাটের দরজা খোলে সামন্ত। তিনটে মেয়েকেই ঠেলে দেওয়া হয় ভেতরে। টেনিয়া হিসহিসে গলায় বলে, ‘এখানেই থাকো মামনিরা, ঘণ্টা তিনেক বাদে তোমাদের কিছু আশিক জুটিয়ে আনছি, কেমন? আওয়াজ করলে কিচাইন হয়ে যাবে কিন্তু। এই সামন্তের বাচ্চা, খাবারদাবার যা দেওয়ার এদের দিয়ে দিও। আর তুমি কিন্তু শালা ময়দান ফাঁকা দেখে গোল করতে যেও না, ঝিটনি দুটো খুলে হাতে ধরিয়ে দোবো, মনে থাকে যেন। চ্যল বে ভিখু’, বলে টেনিয়া দ্রুত নেমে যায় সিঁড়ি বেয়ে। রাস্তার ধারে লাগানো এক শীর্ণ ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঘরে ঢুকে আসা ঘোলাটে মৃত আলোর মধ্যে ভূতগ্রস্ত মেয়ে তিনটেকে রেখে দরজা বন্ধ করে সামন্ত।

* * *

রাত দেড়টা নাগাদ যখন বালুরঘাটের বিবেকানন্দ কলোনির দত্তগুপ্ত বাড়ির সামনে পুলিশের জিপটা এসে থামল, তখন শুধু দত্তগুপ্ত বাড়ি কেন, পুরো পাড়াটাই উত্তেজনা আর অমঙ্গল আশঙ্কায় জ্বরো রুগির মতন কাঁপছে। জিপের আওয়াজ শুনে তাই দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে সময় নেননি তথাগত আর ঊর্মিমালা, আর তিতলির বাবা-মা, অতসীও সঙ্গেই ছিল। আশেপাশের বাড়ি থেকেও সটাসট দরজা খুলে উদ্বিগ্ন প্রতিবেশীরা নেমে আসেন। দৌড়ে আসেন স্বর্ণালি আর রূপালির মা-বাবা।

জিপের সামনের সিট থেকে নেমে দাঁড়ান মধ্য চল্লিশের, পেটানো স্বাস্থ্যের দুই পুলিশ অফিসার। আর পেছনের সিট থেকে নেমে আসেন দুই মহিলা পুলিশকর্মী। আর তারপর ধীর পদক্ষেপে, মাথা নীচু করে, বাড়ি থেকে পালানো তিন কন্যে।

‘আপনাদের মেয়ে নাকি?’ চওড়া হেসে বলেন প্রথম জন, ‘আমি প্রবীর ব্যানার্জি, ওসি, সিআইডি স্পেশাল ব্রাঞ্চ। এই তিন মক্কেল শিয়ালদা স্টেশন চত্বরে ফালতু ঘোরাঘুরি করছিল। এই আমার কলিগ ওয়াসিম, ও গেছিল একটা পার্সোনাল কাজে, সন্দেহ হওয়াতে জিআরপিকে বলে তিন জনকে আটকায়। তারপর আর কী। আমাদের বস আবার এইদিককার লোক, আপনার ছাত্র ছিলেন। আপনার নাম শুনেই তিনি আর কোনো রিপোর্টের হাঙ্গামা না বাড়িয়ে, জিআরপিকে বলে কয়ে আমাকে বললেন নিজে থেকে পৌঁছে দিতে। সেই ট্রেন ধরে এসে লোকাল থানা থেকে জিপ নিয়ে… একটু রাত হয়ে গেল বলে সরি…’

ওদিকে কান্না ফোঁপানি হাউমাউ বকাবকি বিবিধ আওয়াজের মধ্যে তথাগত এগিয়ে ওসে ওসির হাত ধরে ফেলেন। কৃতজ্ঞতায় তাঁর গলা থেকে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। শুধু ধরা গলায় বললেন, ‘কি বলে ধন্যবাদ দেব ভাই? এ উপকার জীবনে ভুলব না। আপনার বসের নামটা যদি বলেন। আর বলছি কী, এত রাতে এলেন, অন্তত রাতের খাবারটা খেয়ে যাবেন না?’

‘আরে আমাদের কি সেই কপাল আছে স্যার?’ ফের জিপে বসতে বসতে দুঃখপ্রকাশ করেন ওসি, ‘আমরা হলাম গিয়ে স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ, সর্বঘটে কাঁঠালিকলা। এই তো ট্রেন থেকে নেমেছি কি নামিনি, খবর পেলাম রাজারহাটে কোন এক আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিঙে নাকি দু-পিস বডি পাওয়া গেছে’, বলে তর্জনীটা তুলে গলার এদিক থেকে ওদিক নিয়ে যান, ‘বডি আছে, মুণ্ডু হাপিস। সে নাকি এমন কেটেছে সারা বিল্ডিঙের একতলা রক্তে থইথই। বড়ো সাহেব অত রাতেই ফোন করে বললেন কেসটা যেন আমি আর ওয়াসিম হ্যান্ডেল করি… কী আর বলি, নাওয়া-খাওয়া নেই, দাদা। এত্ত এত্ত ক্রাইম, আর এই কটা মাত্র পুলিশ… এই নিন, কার্ডটা ধরুন, এতে আমার উপরওয়ালার নাম আর মোবাইল নাম্বার, কথা বলে নেবেন। চলি তাহলে? কী রে ওয়াসিম, চল বাপ, স্টিয়ারিং ধর। আজ তোরও উপোস, আমারও…’ বলতে বলতে জিপটা স্টার্ট করে বেরিয়ে যায় পাড়ার মোড়ের দিকে।

* * *

রাত বারোটা নাগাদ ট্যাক্সিটা নিঃশব্দ ঘাতকের মতোই এসে দাঁড়াল রাজারহাটের অভিশপ্ত ফ্ল্যাটটার সামনে। ফটাফট গেট খুলে নেমে এল টেনিয়া, আসলাম আর বনোয়ারি। ভিখু জড়ানো গলায় বলল, ‘গাইটা গ্যাএজ কয়ে আসচি গুউ, শ্লা আগেই সুউ কএ দিও না।’ ওরা তিন জনেই টলছিল। চাঁদের আলো আর শীর্ণ ল্যাম্পপোস্টের মরা আলো মিশিয়ে ভূতুড়ে দেখাচ্ছিল ওদের। যেন নরকের আগুনের আলোছায়ায় দুলছে তিনটে মূর্তিমান পাপ।

আজকে নেশা করেছে ওরা, প্রচুর নেশা। প্রথমে ভিআইপির পাশে এক ডান্স বারে, তারপর আসলামের কৈখালির আড্ডায়। আহা, নম্বরি মাল এনেছিল আজ আসলাম, মালানা ক্রিম! গেটে সামন্ত বসেছিল, টেনিয়া জিজ্ঞেস করে, ‘কি রে হারামি, মালগুলোকে খেতে দিয়েছিলিস?’

‘গেছিলাম দিতে, দরজা খোলেনি।’

‘মানে, কুত্তিগুলো দরজা বন্ধ করে ভাবছে পার পাবে? আব্বে এ ভিখু, জলদি আ বে। চ্যল, ওপরে চ্যল। আগে আমি, ভিখু আর আসলাম, তারপর বাকিরা, কেমন? বেশি আনসান মজাকি করবে না, কোথাও যেন দাগফাগ না পড়ে, হাড়কাটার মাল নয়…’

‘গুউ, বওটা আমাকে দেবে? হেবি ইচ্চে করচে।’

সাপের মতই একটা হিসহিস আওয়াজ করে ভিখুর টুঁটিটা আঁকড়ে ধরে টেনিয়া ‘শালা, ঢ্যামনার শখ দ্যাখ বে! চ্যল, একটা টুননিকে নিয়ে সাইডে ফুটে যাবি। আব্বে এ সামন্তের বাচ্চা, গদ্দা রেডি আছে তো? আর সাদা চাদর?’

বলতে বলতে ওরা একতলায় উঠে আসে নিয়তির অমোঘ অভিশাপের মতো। টেনিয়া ভিখুকে বলে, ‘খট খট কর, দরজা খুলতে বল।’ ভিখু খট খট করতে করতে সুরে বলতে থাকে, ‘রাত হল দোর খোলো খুকুমণি সোনারে, মাসুক এসেচে কত চোক খুলে দেকো রে।’ কোনো সাড়া আসে না, ধমকে ওঠে টেনিয়া, ‘সর বে, ছড়া কেটে শ্লা বাপের বিয়ে দিচ্ছে। চল বে কান্ধা লাগা…’

বলতে বলতে টেনিয়া এগিয়ে এসে ভিখুকে নড়া ধরে তোলে। তারপর দুইজনে এগিয়ে ধাক্কা দিতেই দরজাটা যেন অলৌকিকভাবে হাট হয়ে খুলে যায় এবং তার ফলে হুড়মুড়িয়ে ওরা দু-জনেই ভেতরে হুমড়ি খেয়ে চলে আসে। আর ঠিক তক্ষুনি যেন অলঙ্ঘনীয় ভবিতব্যের মতোই দরজাটা ওদের পিছনে সজোরে বন্ধ হয়ে যায়। যদিও সেটা খেয়াল করার আগে ওরা সামনের দিকে তাকায় এবং চরম অবিশ্বাসে, সর্বগ্রাসী আতঙ্কে আর হাড়হিম করা ভয়ে স্থাণু হয়ে যায়।

সেই অর্ধেক আঁধার ঘরের মধ্যে, আধো চাঁদের আলো আর ল্যাম্পপোস্টের মৃত বিবর্ণ হলুদ আলো মিশিয়ে যেন প্রাগৈতিহাসিক এক সিল্যুয়েট তৈরি করেছে। আর তার মধ্যে ওরা দেখল তিনটি নগ্ন শরীর ঘরের মধ্যে বিচিত্র ভাবে দাঁড়িয়ে! বড়ো মেয়েটির ডান হাতে একটি ভয়ালদর্শন রক্তাক্ত খড়্গ, আর তার মাথার জায়গাটা ফাঁকা! সেটা ধরা আছে তার নিজেরই বাঁ-হাতে! তার সেই কাটা গলা থেকে ঝরনার মতন ছিটকে উঠেছে তিনটি রক্তধারা। তার দুটি ধারা গিয়ে পড়ছে তার দু-পাশে দাঁড়ানো বাচ্চা মেয়েদুটির মুখে, আর তৃতীয়টি নিজেরই কাটা মুণ্ডুটির মুখে। বড়ো মেয়েটির গলায় দুলছে নরকরোটির মালা আর উদ্ধত দুই স্তনের মাঝে পৈতের মতন জড়িয়ে আছে একটি কুচকুচে কালো কেউটে! ঘরের মধ্যে উঠেছে এক চাপা ঘূর্ণি আর সেই প্রবল হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে তাদের খোলা চুল, যেন দাউদাউ করে জ্বলছে নরকের কালো আগুন। বাচ্চা মেয়ে দুটি চোখ খুলে পরম আবেশে পান করে যাচ্ছে সেই অঝোর ধারায় উৎসারিত রক্ত, তাদের হাতেও একটি করে ভীমকায় খড়্গ, রক্তে ভেসে যাচ্ছে তাদের সমস্ত মুখ, রক্তস্নাতা সেই ভয়ংকরী দু-জনকে দেখে মনে হচ্ছে যেন সাক্ষাৎ রক্তপিশাচী ডাইনি! দেওয়ালে, সিলিঙে জানালার কাঠে লেগে আছে তাজা রক্তের ছাপ। সারা মেঝে থইথই করছে রক্তে, যেন আজ বিশ্বচরাচরের সমস্ত রক্ত এই ঘরের মধ্যে।

আওয়াজ শুনে একইসঙ্গে তিনটে মাথাই এদিকে ফেরে। রক্তমাখা মুখে সাদা দাঁত বার করে তিনটে মুখই খল খল খল করে একটু হেসে নেয়। তারপর যেন পাতালের গভীর থেকে, সমুদ্রের বুকের থেকে, আগ্নেয়গিরির আগুন থেকে উঠে এল এক প্রশ্ন, উচ্চারিত হল একইসঙ্গে তিনটি গলায়, ‘কি রে, খাবি না? আমাদের খাবি না? রক্ত খাবি? আয়, খাবি আয়, আয় রে আয়, এদিকে আয়, খেয়ে যা, আয় রে আয় আয় আয় আয়…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *