৫. ওসিরিসের মন্দিরে

ওসিরিসের মন্দিরে রাজার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটলো শতাব্দী প্রাচীন উৎসবের।

মন্দিরের উঁচু বেদীতে স্থাপিত সিংহাসনে বসে ভাষণ দেবেন ফারাও। দ্বৈত-মুকুট তার মস্তকে শোভাবর্ধন করছে। লসট্রিস আর আমার জন্যে ভালো একটা জায়গা বেছে রেখেছিলাম, ভীষণ ভীড়ের মাঝেও সবকিছু যেনো পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। সিংহাসনের ঠিক বিপরীতে, রাজার মাথার উচ্চতার চেয়ে সামান্য উপরে আমাদের অবস্থান হওয়ায় পুরো মন্দিরের সবকিছু আমাদের দৃষ্টিসীমায় রয়েছে। মেষের পালক ভরা একটা নরম বালিশ, ঝুড়িতে কিছু ফলমূল, শরবত, সুরা তৈরি রেখেছিলাম লসট্রি সের জন্যে।

আমাদের চারপাশে মিশরের তাবৎ মহৎ প্রাণ, জমিদার, ভদ্রমহিলা, রাজবধূ বসা; অভিজাত সাজ-পোশাকে সেজেছেন তাঁরা।

মন্দিরের প্রতিটি কোণ লোকে লোকারণ্য। ভীড়ের চাপে দেয়াল ভেঙে পড়ার উপক্রম। সারাজীবনেও এতো লোক দেখিনি আমি। গোনা সম্ভব নয়, তবে আমার ধারণা দুই লক্ষ লোক সেদিন সমবেত হয়েছিলো মন্দির প্রাঙ্গন, পবিত্র আভেন্য আর বাগানের মাঠ মিলিয়ে। যেনো অতিকায় কোনো মৌমাছির আঁক সর্বক্ষণ গুনগুন ধ্বনি উঠছে।

সিংহাসনের চারপাশে, ফারাও-এর পায়ের সমতলে বসে উচ্চ-পদস্থ ব্যক্তিবর্গ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ওসিরিসের মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। আগেরজন ইতিমধ্যেই এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে অন্যরাজ্যের পশ্চিমধারের মাঠ পেরিয়ে স্বর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করেছেন। এই জন বয়সে তরুণ শক্ত-পোক্ত মানুষ। একে খুব সহজে হাত করতে পারবেন না ইনটেফ–আমার মনে হলো। ইতিমধ্যেই যে বিভিন্ন বিষয়ে আমার সাথে পরামর্শ করেছেন নতুন পুরোহিত, আমার ধারণা, ইনটেফ তার খবর রাখেন না।

যা হোক, ফারাও নন, উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্র ছিলেন রাজ-উজির ইনটেফ। সবার নজর কাড়ছিলেন তিনি। লম্বা, শক্তিশালী অত্যন্ত সুদর্শন দেখাচ্ছিলো তাকে। ঠিক যেনো কিংবদন্তির কোনো বীর। তার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে র‍্যাসফার।

চিরকালীন রীতি অনুযায়ী সিংহাসনের সামনের ছোট্ট খোলা স্থানে দাঁড়িয়ে রাজাকে যমজ নগরী থিবেস-এ আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানালেন ইনটেফ। উনি যখন কথা বলছিলেন, ত্যাড়ছা চোখে আমার কর্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঘৃণা আর ক্রোধে জ্বল জ্বল করছে তার মুখাবয়ব। পরিষ্কার, মুক্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। মনে হলো, ওকে সতর্ক করে দিয়ে বলি, চারপাশের মানুষজন টের পেয়ে যেতে পারে তার ভাবাবেগ। কিন্তু এতে করে অন্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে ভেবে বাদ দিলাম চিন্তাটা।

দীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন ইনটেফ। তার অর্জন, বিগত বছরগুলোতে ফারাও-এর প্রতি তার সেবার ইতিহাস কিছুই বাদ গেলো না। এতো মানুষের গায়ের উত্তাপ, তার সঙ্গে মাথার উপরের নির্দয় সূর্যের খরতাপে গা যেনো পুড়ে যাবে। একজন মহিলাকে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়তে দেখলাম আমি।

অবশেষে, ইনটেফের বক্তব্য শেষ হতে, তাঁর জায়গা নিলো প্রধান পুরোহিত। থিবেসের ধর্ম বিষয়ক আচার-অনুষ্ঠানের কথা বর্ণনা করলেন তিনি। এদিকে, দুপুর গড়িয়ে যাওয়ায় গরম আর দুর্গন্ধ বাড়তে লাগলো। সুগন্ধি তেল এখন আর ঘামের গন্ধ ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। এই ভীড় থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রকৃতির ডাকে যে সাড়া দেবে কেউ এমন উপায় নেই। কি পুরুষ কি নারী যে যেখানে আছে, সেখানেই প্রাকৃতিক কাজ সারলো। ঠিক গণ-শৌচাগারের মতো অবস্থা দাঁড়ালো মন্দিরের। সুগন্ধি-ভেজানো একটা রুমাল লসট্রিসের হাতে দিলাম আমি, ওটা দিয়ে মুখ চেপে রাখলো সে।

শেষমেষ যখন দেবতা ওসিরিসের নামে রাজার উপরে শান্তি বর্ষণের আহ্বান জানিয়ে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন পুরোহিত, স্বস্তির ধ্বনি উঠলো জনতার মধ্য থেকে। ইনটেফের পেছনে, নিজের জায়গায় বসে পড়লেন তিনি। প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ নীরব হলো জনতা। ফারাও-এর ভাষণ শোনার জন্যে আগ্রহে সামনে ঝুঁকে বসলো তারা।

দাঁড়ালেন রাজা। এতোটা সময় ধরে ঠিক মূর্তির মতো বসেছিলেন তিনি। দুই হাত ছড়ালেন ফারাও; আর ঠিক সেই মুহূর্তে উপস্থিত জনতা, পুরোহিত, মহৎপ্রাণ, জমিদার সবাইকে হতবুদ্ধ করে দিয়ে চিরকালীন প্রথার অন্যথা ঘটলো। এর পর যা হলো, তাতে অবশ্য অবাক-না-হওয়া সামান্য কিছু মানুষের মধ্যে আমি একজন–কেননা, এই ঘটনাবলিতে আমার নিজেরও অংশগ্রহণ ছিলো।

মঠের বিশাল, পালিশ করা তামার দরোজা হা হয়ে খুলে গেলো। মনে হলো, যেনো অদৃশ্য কোনো শক্তি ওটা খুলেছে, কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

অবিশ্বাসে শ্বাস ফেললো জনতা, মন্দির প্রাঙ্গনে যেনো বাতাসের মতো বয়ে গেলো সেই শব্দ। আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো একটা নারী কণ্ঠ, সাথে সাথেই অশরীরী হুঙ্কারে কেঁপে উঠলো সবাই। কেউ কেউ হাঁটু গেড়ে বসলো, কেউ আবার মাথা নিচু করে দুই হাত উঁচিয়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো অতীন্দ্রিক শক্তির কাছে। সাথের চাদরে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো বহুজন।

মঠের দরোজা ঠেলে প্রবেশ করলো একজন দেবতা; লম্বা, আতঙ্ক-জাগানিয়া, কাঁধের দুই পাশে উড়ছে বিশাল আলখাল্লার প্রান্ত। মাথার আচ্ছাদন ঈগলের পালকে শোভিত, অর্ধেক মানব অর্ধেক ঈগলের অবয়ব বিশাল, ধাতব। চোখের জায়গায় দুটো কালো গর্ত।

আকহ্ হোরাস! চেঁচিয়ে উঠে ঢলে পড়লো একটা মেয়ে।

আকহ্ হোরাস! জনতার ঠোঁটে উচ্চারিত হতে লাগলো সেই চিৎকার। এ যে দেবতা স্বয়ং! সারিবদ্ধভাবে একে একে হাঁটু গেড়ে সম্মান প্রদর্শন করতে লাগলো তারা। এমনকি, সিংহাসনের চারপাশে উপবিষ্ট মহৎ প্রাণেরা পর্যন্ত নিচু হলেন। সমগ্র মন্দিরে কেবল দু জন মানুষ এখন দাঁড়িয়ে আছেন রঙ করা মূর্তির মতো নিজের সিংহাসনের ধাপে ফারাও, আর থিবেসের রাজ-উজির।

রাজার সামনে এসে থামলো আকহ্ হোরাস। তামার শিরস্ত্রাণের ভেতর থেকে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। এখনো এক চুলও নড়েননি ফারাও। তাঁর প্রসাধন-চর্চিত গাল মরার মতো সাদা, চোখ দুটো কী একটু জ্বলছে? ধর্মীয় কোনো আবেগে? নাকি ভয়ে?

কে তুমি? জানতে চাইলেন ফারাও। ভুত নাকি মানব? আমাদের এই পবিত্র অনুষ্ঠানে কেনো বাধা দিলে? পরিষ্কার, জোরালো স্বরে বললেন তিনি। গলার স্বরে কোনো কম্পন নেই, তার প্রতি আমার ভক্তি বেড়ে গেলো। হতে পারে তিনি দুর্বল, বয়স্ক; কিন্তু এখনো সাহস অটুট আছে বৃদ্ধের । ঠিক যোদ্ধার মতোই কী মানুষ কী দেবতা যে কারো মোকাবেলা করতে সক্ষম তিনি।

মুখ খুললো আকহ্ হোরাস। পাথরের থামে প্রতিধ্বিনিত হলো তার আওয়াজ। মহান ফারাও, আমি ভুত নই, একজন মানুষ। আমি আপনারই লোক। আপনারই নির্দেশে আজ আপনার সামনে এসেছি। দুই বছর আগে, ঠিক এই দিনে, ওসিরিসের উৎসবে আপনি আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই কারণে এসেছি।

মাথার আচ্ছাদন খুলে ফেলতে আগুন-রঙা চুলগুলো ট্যানাসের কাঁধে ছড়িয়ে পড়লো। সাথে সাথেই তাকে চিনে ফেললো জনতা। এতো জোরে চেঁচিয়ে উঠলো তারা, মন্দিরের ভিত্তিমূল কেঁপে উঠলো।

প্রভু ট্যানাস! ট্যানাস! ট্যানাস!

আমার ধারণা, সবার চেয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো আমার কর্ত্রী । আর একটু হলেই বধির হয়ে গেছিলাম আমি, ওর হুঙ্কারে।

ট্যানাস! আকহ্ হোরাস! আকহ হোরাস! এই জোড়া নাম এক হয়ে আছড়ে পড়তে লাগলো মন্দিরের দেয়ালে।

সমাধি থেকে উঠে এসেছে সে! দেবতা হয়ে গেছে আমাদের ট্যানাস!

খাপ থেকে তরবারি খুলে মেলে ধরলো ট্যানাস, নীরবতা কামনা করছে। চুপ হলো জনতা।

মহান মিশর, কথা বলার অনুমতি প্রার্থনা করছি।

ইশারায় সায় দিলেন ফারাও। সিংহাসনে বসে পড়লেন, যেনো পায়ে বলো। পাচ্ছেন না।

জোরালো স্বরে বলতে লাগলো ট্যানাস। দুই বছর আগে বিষাক্ত খুনী আর দস্যুদের নির্মূল করার ভার আপনি আমার উপর অর্পণ করেছিলেন, যারা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির জীবন বিপন্ন করে তুলেছিলো। আপনি আমাকে বাজপাখির প্রতীক দিয়েছিলেন।

আলখাল্লার আড়াল থেকে নীল মূর্তিটা বের করে সিংহাসনের ধাপে রাখলো ট্যানাস। এক পা পিছিয়ে আবার বলতে শুরু করলো।

রাজার নির্দেশ পালনে সুবিধার জন্যে আমি মৃত্যুর অভিনয় করেছিলাম। আগন্তুক একজনের দেহ মমি করে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো।

বাক্-হার! চেঁচিয়ে উঠলো একটা নিঃসঙ্গ কণ্ঠ । এক হাজার কণ্ঠ সেই ধ্বনি ঠোঁটে তুলে নেয়। আবারো নীরবতা কামনা করতে হলো ট্যানাসকে।

নীল কুমির বাহিনীর একশ যোদ্ধাকে নিয়ে মরুতে অভিযান চালিয়েছি আমি; দুর্গম অঞ্চলে হানা দিয়ে ধ্বংস করেছি শ্রাইকদের দুর্গ। কাতারে কাতারে মেরে ফেলে পথের ধারে জড়ো করে রেখেছি শয়তানগুলোর মুণ্ডু।

বাক্-হার! সোৎসাহে চেঁচিয়ে উঠে জনতা। সত্যি কথা। আকহ্ হোরাস তাই করেছে! আবারো, তাদের গর্জন থামায় ট্যানাস।

শ্রাইক-নেতাদের নিকেশ করেছে আমি। তাদের অনুসারীদের কোনোরকম দয়া দেখিয়ে কতল করেছি। সমগ্র মিশরে এখন কেবল একজন আছে, নিজেকে শ্রাইক বলে দাবি করে।

এবারে নীরবে কথা গিলতে থাকে জনতা। এমনকি, ফারাও পর্যন্ত অধৈৰ্য্য গোপন রাখতে পারলেন না। বলো, লর্ড ট্যানাস যাকে লোকে এখন আকহ-হোরাস নামে জানে বলো, কে এই ব্যক্তি। ফারাও-এর প্রতিশোধ কী, সে জানে না।

আকহ্‌-সেথ নামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখে সে। গর্জে উঠলো ট্যানাস। ঠিক অন্ধকারের দেবতাদের মতো।

তার সত্যিকারের নাম জানাও, উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন ফারাও। এই শেষ শ্ৰাইকের নাম বলো আমাকে!

ধীরে কাজ শুরু করে ট্যানাস। ইচ্ছেকৃতভাবে পুরো মন্দিরে দৃষ্টি বোলায় সে। আমার চোখে চোখ পড়তে হালকা করে মাথা নেড়ে সায় দিলাম, একটুও না চমকে ধীরে মঠের দরোজায় দৃষ্টি ফেরায় ট্যানাস।

সবার মনোযোগ এখন ট্যানাসের উপর নিবদ্ধ; কেউ টেরও পায় না একদল সৈন্য খুব দ্রুততার সাথে মঠের দরোজা গলে ঢুকে অবস্থান নিয়ে ফেলেছে। পুরোদস্তুর যুদ্ধের পোশাকে থাকা সত্ত্বেও তাদের বেশিরভাগকেই চিনতে পারলাম আমি। আসতেস, রেমরেমসহ নীল বাহিনীর পঞ্চাশজন বীর রয়েছে সেখানে। চমৎকার পেশাদারিত্বের সাথে সিংহাসনের চারিদিকে অবস্থান করে নেয় তারা। ইনটেফের পেছনে দাঁড়ায় রেমরেম এবং আসতেস। ওদের অবস্থান নেওয়া শেষ হতে, মুখ খুললো ট্যানাস।

মহান ফারাও, এই আকহ্ সেথ্‌ এর নাম বলবো আমি। আপনারই সিংহাসনের ছত্রছায়ায় নির্লজ্জের মতো বসে আছে সে, হাতের তলোয়ার দিয়ে দেখায় ট্যানাস। ওই তো সে প্রশংসার স্বর্ণ-শেকল পরে আছে বিশ্বাসঘাতক গলায়। ওই তো দাঁড়িয়ে সে ফারাও-এর রাজত্বেকে যে দস্যু আর বর্বরের লীলাভূমি বানিয়ে রেখেছিলো। ও-ই আকহ্ সেথ থিবেসের পরিচালক, উচচ-রাজ্যের রাজ-উজির!

অসাধারণ গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেলো মন্দিরের ভেতরে। ইনটেফের হাতে নির্যাতিত বহু লোক আছে এখানে, যারা তাকে দারুনভাবে ঘৃণা করে; কিন্তু একটি কণ্ঠও আনন্দ উল্লাসে মত্ত হয়না। সবাই জানে, তার ক্ষমতার পরিধি কতো ব্যাপক। বাতাসে যেনো তাদের ভীতির গন্ধ পেলাম আমি। প্রত্যেকে জানে, এমনকি ট্যানাসের অর্জন, তার শক্তিমত্তা পর্যন্ত কোনোরকম প্রমাণ ছাড়া ইনটেফের বিরুদ্ধে করা এই অভিযোগ থেকে তাকে রক্ষা করার জন্যে যথেষ্ট নয়। আর এই অনুষঙ্গে আনন্দ প্রকাশ করার অর্থ হলো নিশ্চিত মৃত্যু।

এরই মাঝে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন ইনটেফ। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ট্যানাসের দিকে পিঠ ফিরিয়ে সরাসরি ফারাও-এর উদ্দেশ্যে বললেন, মরুর সূর্যে সম্ভবত বেচারার মগজ পুড়ে গেছে। পাগল হয়ে গেছে সে। এক বর্ণও সত্যি নয়, যা সে বলছে। আমার হয়তো রাগ করা উচিত, কিন্তু একজন দক্ষ যোদ্ধার এহেন অধঃপতনে দারুন দুঃখ পেলাম। দুই হাত উঁচু করে মর্যাদার সাথে বলে চললেন ইনটেফ। সারাজীবন ফারাও আর তার লোকেদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছি। আমার মর্যাদা এমন নয় যে, কোনো পাগলের কথায় প্রতিবাদ করতে হয়। কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই পবিত্র সিংহাসনের সিদ্ধান্তে আস্থা পোষণ করলাম নিজেরে জিহ্বার চেয়ে আমার কর্ম এবং ফারাও-এর প্রতি আমার ভালোবাসা আমার হয়ে কথা বলুক।

রাজার প্রসাধন-চর্চিত মুখে ফুটে উঠলো দ্বিধা আর সিদ্ধান্তহীনতা লক্ষ্য করলাম আমি। ঠোঁট কাঁপছে, ভ্রু কুঞ্চিত। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা তার কোনো কালেই ছিলো না। কিছু সময় পর মুখ খুললেন তিনি, কিন্তু কিছু বলার আগেই তরবারি উঁচিয়ে মঠের খোলা প্রবেশ পথের দিকে ইশারা করে ট্যানাস।

এমন অদ্ভুত মানুষের কাফেলা প্রবেশ করতে থাকে মঠে, বিস্ময়ে মুখ ঝুলে পড়লো ফারাও-এর। লোকগুলোর নেতৃত্বে রয়েছে ক্ৰাতাস; তার পেছন পেছন শুধুমাত্র নেংটি পড়া, খালি হাত-পায়ের মানুষ হেঁটে আসছে। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ঠিক যেনো দাস বিক্রির হাটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের।

ইনটেফের চেহারার দিকে চেয়ে ছিলাম আমি। দেখলাম, ঘটনার আকস্মিকতায় আঁতকে উঠেছেন তিনি, যেনো কিছু একটা আঘাত করেছে মুখে। বন্দী লোকগুলোকে অবশ্যই চিনেছেন তিনি, হয়তো ভেবেছিলেন, বহু আগেই মারা গেছে তারা। লিনেনের পর্দা দিয়ে আড়াল করা ছোট্ট দরোজার দিকে আড়চোখে তাকালেন বার কয়েক। একমাত্র ওখান দিয়ে সম্ভব পলায়ন করা। কিন্তু এগিয়ে এসে দরোজা আটকে দাঁড়ালো রেমরেম, পালানোর সমস্ত পথ এখন রুদ্ধ। সিংহাসনের দিকে তাকিয়ে এবারে গলার স্বর্ণের হারে হাত বোলালেন ইনটেক; আত্মবিশ্বাসী ভাবভঙ্গি।

হাত বাঁধা অবস্থায় সিংহাসনের সামনে এসে দাঁড়ালো ছয় বন্দী। ক্রাতাসের নরম স্বরের আদেশে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করলো তারা।

এরা কারা? জানতে চাইলেন ফারাও। প্রথমজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ট্যানাস, বাধা-হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো। বন্দীর চামড়ায় গুটি বসন্তের বিচ্ছিরি দাগ, অন্ধ চোখটা রুপোর মুদ্রার মতো ধ্বক ধ্বক করছে।

মহান ফারাও তোমার পরিচয় জানতে চাইছেন, নরম স্বরে বললো ট্যানাস। তার প্রশ্নের উত্তর দাও!

মহান মিশর, আমি শুফতি, বলে উঠে বন্দী। আমি শাইকদের একজন নেতা ছিলাম। কিন্তু আকহ্ হোরাস, তার বাহিনী নিয়ে গালালা মরুতে আমার বাহিনী ধ্বংস করেছে।

রাজাকে বলো–কে তোমায় আদেশ দিতো?

আকহ,সেথ্‌ ছিলেন আমার প্রভু। উত্তরে বলে চলে শুফতি। রক্ত শপথ করেছি তার প্রতি, লুটের এক চতুর্থাংশ তাকে দিয়ে এসেছি। বদলে, আইনের হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়ে এসেছেন তিনি, আমার শিকারদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন।

যাকে আকহ্ সেথ বলে জানো, দেখাও তাকে! গর্জে উঠে নির্দেশ দেয় ট্যানাস। যেনো নিতান্ত অনিচ্ছায় ধীরে হেঁটে ইনটেফের সামনে দাঁড়ায় শুফতি। একগাদা থুতু ছুঁড়ে মারে রাজ-উজিরের পরিপাটি পোশাকে। এ-ই হলো আকহ্ সেথ্‌! নরকে পঁচে মরুক শালা!

একপাশে টেনে নিয়ে যায় ক্ৰাতাস তাকে। পরবর্তী বন্দীকে টেনে দাঁড় করিয়ে দেয় ট্যানাস, বলো, কে তুমি।

আমি আখেকু, শাইকদের নেতা ছিলাম। আমার সমস্ত লোক নিহত এখন।

কে ছিলো তোমার নির্দেশদাতা? কাকে লুটের বখরা দিতে তুমি?

ইনটেফ ছিলেন আমার মালিক। তাকে বখরা দিয়ে এসেছি আমি।

গর্বিত ভঙ্গিতে ঠায় বসে রইলেন ইনটেফ, যেনো এ সবে তার কিছুই আসে যায় না। একের পর এক শ্রাইক নেতা রাজা সামনে এসে সত্য বয়ান করতে থাকে, কোনো প্রতিবাদ করলেন না ইনটেফ।

ঠিক গরমের মতোই অসহ্য হয়ে উঠে মন্দির প্রাঙ্গনের নীরবতা। ঘৃণা, নিঃশব্দ আতঙ্ক, অথবা অবিশ্বাস আর দ্বিধা নিয়ে তাকিয়ে রইলো জনতা। কিন্তু একজনও ইনটেফের বিরুদ্ধে কোনো শব্দ করার সাহস দেখালো না।

শেষ দস্যু নেতাকে ইনটেফের সামনে হাজির করানো হলো। লম্বা, পাতলা গড়নের মানুষ সে, রোদে-পোড়া চামড়া । এর রক্ত বেদুইনের কালো চোখ, উঁচু নাক। ঘন, কোঁকড়ানো দাড়ি, হাবভাবে হামবড়া।

আমার নাম বাস্তি, সবচেয়ে পরিষ্কার স্বরে বলে উঠলো সে। লোকজন অবশ্য আমাকে নিষ্ঠুর বাস্তি বলে জানে–কেনো, কে জানে! হেসে উঠে যোগ করলো বাস্তি । আমি ছিলাম শ্রাইকদের বাহিনীর একজন নেতা, আকহ হোরাস আমার লোকজনকে মেরে ফেলেছে। ইনটেফ আমার নেতা।

অন্যদের মতো তাকে অবশ্য টেনে সরিয়ে নেওয়া হলো না। তার উদ্দেশ্যে ট্যানাস বললো, রাজাকে বলো–পিয়াংকি, প্রভু হেরাবকে কী তুমি চিনতে?

নিশ্চয়ই। তার সাথে আমার ব্যবসা ছিলো।

কী সেই ব্যবসা? ভয়ঙ্কর কণ্ঠে জানতে চায় ট্যানাস।

তার ক্যারাভানগুলো ধ্বংস করেছিলাম আমি। ফসল জ্বালিয়ে দিয়েছি, সেস্রাতে তার খনিগুলোতে হানা দিয়ে তার লোকজনকে মেরেছি। পুড়িয়ে দিয়েছি তার আবাস। আমার লোকজন পাঠিয়ে শহরে তার নামে কুৎসা রটিয়েছি, যাতে করে তার সততা আর একনিষ্ঠতায় কালি পড়ে। অন্যদেরকেও ইন্ধন জুগিয়েছি তার অনিষ্ঠ সাধনে। শেষমেষ, নিজের পাত্র হতে ধুতুরা বিষ খেয়ে মরেছে ব্যাটা।

রাজ্যের প্রতীক হাতে ধরা আঙুলগুলো কাঁপছে ফারাও-এর–লক্ষ্য করলাম ।

কার নির্দেশে এগুলো করেছিলে?

ইনটেফ। এক টাখ বিশুদ্ধ সোনা উপহার হিসেবে আমাকে দিয়েছিলেন তিনি।

প্রভু হেরাবকে ধ্বংস করে ইনটেফের কী লাভ?

দাঁত বের করে হাসলো বাস্তি। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, ইনটেফ হলেন রাজ উজির; আর কোথায় পিয়াংকি? কবরে।

তুমি স্বীকার করছো, আমার নিকট থেকে কোনোরকম চাপের বশবর্তী না হয়ে এগুলো বলছো? জানো, এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড?

মৃত্যু? অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বাস্তি। জীবনেও ওটাকে ভয় পাইনি আমি। কত শত জনকে মরণ উপহার দিয়েছি, ইয়ত্তা নেই। আর এখন আমি ভয় পাবো?

ট্যানাসের চোখে খুনে দৃষ্টি। তলোয়ারের বাটে ধরা হাত সাদা হয়ে গেছে তার।

নিয়ে যাও একে! হুঙ্কার ছাড়ে সে। রাজার শাস্তির জন্যে অপেক্ষা করুক! নিজের সাথে যুদ্ধ করে ভাবাবেগ সামলালো সে। রাজার সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বসলো।

যা কিছু আপনি আমাকে বলেছিলেন, অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি মহান মামোস, কেমিট-এর প্রভু। আপনার পরবর্তী আদেশের অপেক্ষায় থাকলাম।

অনুভব করলাম, কি যেনো একটা দলা পাকিয়ে গেছে গলার ভেতর।

এখনো নীরবতা বজায় রয়েছে মন্দিরের ভেতরে । লসট্রিসের বড়ো বড়ো শ্বাসের শব্দ পাচ্ছি।

মুখ খুললেন ফারাও। বিস্ময়ের ব্যাপার, দ্বিধা আর হতাশা তাঁর কণ্ঠে। যেনো এ সব সত্যি, এ তিনি মেনে নিতে পারছেন না। এতো গভীর বিশ্বাস ছিলো তার ইনটেফের প্রতি, নাড়া খেয়ে গেছেন।

লর্ড ইনটেফ, তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনেছো? কী বলার আছে তোমার?

মহান ফারাও, এগুলো কোনো অভিযোগ হলো? ইর্ষা আর হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকা একজন মাথা গরম তরুণের কল্পনা এসব। একজন ঘৃণ্য আসামী এবং বিশ্বাসঘাতকের পুত্রের কাছ থেকে এর বেশি কী আশা করেন আপনি? ট্যানাসের উদ্দেশ্যে পরিষ্কার। তার ধারণা, বিশ্বাসঘাতক পিয়াংকি আমার স্থানে রাজ-উজির হতো। যেনো তার বাবার অধঃপতনের জন্যে আমি দায়ী!

তাচ্ছিল্যের সাথে ট্যানাসের কথা উড়িয়ে দিলেন ইনটেফ। এতো চমৎকার অভিনয়ের সামনে আরো দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন রাজা। সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে তার।

আর শ্রাইকদের নেতাদের সাক্ষ্য? জানতে চাইলেন ফারাও। সে সম্পর্কে কী বলবে?

নেতা? ইনটে যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। এ ধরনের উপাধি দিয়ে ওদের সম্মান দেওয়ার কী আছে? বদমাশের শিরোমণি এরা খুনী, চোর, ধর্ষকামী । জঙ্গলের প্রাণীর মতো কতকগুলো লোকের কথায় বিশ্বাস করার কোনো মানে হয় না। সত্যিই, অর্ধ-নগ্ন, হাত-বাঁধা লোকগুলোকে জম্ভর মতোই দেখাচ্ছে। তাকান ওদের দিকে, পবিত্র ফারাও। এদেরকে দিয়ে তো মার আর অর্থের বিনিময়ে যে কোনো কিছু বলিয়ে নেওয়া সম্ভব। আপনার সেবক একজনের বদলে এদের কথা শুনবেন আপনি?

হালকা করে মাথা নাড়লেন ফারাও, ঠিক যেমন করে বন্ধুর কথায় সায় দেয় মানুষ।

সত্যি। তোমার সেবা আমি সব সময় পেয়েছি। আর এই বদমাশগুলো সত্যিই জংলী। হতে পারে, তাদের হয়তো মিথ্যে বলানো হচ্ছে।

ফাঁক পেয়ে গেছেন ইনটেফ।

এ পর্যন্ত কেবল শুনেই গেলাম, মহান প্রভু। নিশ্চই, সত্যিকারের কোনো প্রমাণ আছে আমার বিরুদ্ধে? মুখের কথা নয়, এই মিশরে কি এমন কেউ আছেন যার কাছে আমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ আছে? থাকলে, সামনে এসে দাঁড়াক সে। আমি জবাবদিহি করবো।

একেবারে হকচকিয়ে গেছেন ফারাও এই কথায়। মন্দির প্রাঙ্গনে দৃষ্টি বুলিয়ে যেনো কাউকে খুঁজলেন।

ট্যানাস, বর্বর এই লোকগুলোর মুখের কথা ছাড়া আর কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?

নিজের সমস্ত চিহ্ন ভালো মতোই মুছে এসেছে সে। স্বীকার গেলো ট্যানাস। ইনটেফের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই আমার কাছে। কিন্তু, নিশ্চই কারো না কারো কাছে আছে। এমন কেউ, যে আজকের ঘটনাবলিতে সাহস পেয়ে মুখ খুলবে। হে মহান মিশর, আপনি আপনার লোকেদের জিজ্ঞেস করুন–এমন কেউই কি নেই, যার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?

ফারাও, এ যে ইন্ধন জোগানো। এখন আমার শত্রুরা উৎসাহিত হয়ে মিথ্যে বলবে, করুণ স্বরে বলে উঠলেন ইনটেফ। কিন্তু হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন ফারাও। মিথ্যে কথা বললে নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়বে তারা। এরপর, জনতার উদ্দেশ্যে আহ্বান জানালেন ফারাও।

হে আমার দাসেরা! থিবেস-এর নাগরিক! আমার বিশ্বস্ত, প্রিয় উজিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনেছো তোমরা। কারো কাছে ট্যানাসের বক্তব্যের প্রমাণ থাকলে সামনে এসে দাঁড়াও!

কিছু বোঝার আগেই দেখি, দাঁড়িয়ে পড়েছি আমি। নিজের কণ্ঠস্বরের প্রাবল্যে নিজেই চমকে গেলাম।

আমি টাইটা–এক সময় ইনটেফের দাস ছিলাম। চিৎকার করে বললাম। দ্রু কুঁচকে আমার পানে তাকালেন রাজা। আমার কিছু বলার আছে, মহান মিশর।

সামনে এসে দাঁড়াওচিকিৎসক। তোমার কী বলার আছে?

নিজের অবস্থান ছেড়ে রাজার সম্মুখে যেতে যেতে ইনটেফের দিকে চাইলাম। আর একটু হলে পড়ে গিয়েছিলাম, এমন তীব্র ঘৃণা তার চোখে-মুখে ।

পবিত্র মিশর–এ ব্যাটা হলো গে চাকর! শান্ত স্বরে বললেন ইনটেফ। একজন। চাকর অভিযুক্ত করবে থিবেসের অভিভাবককে? এ কেমন তামাশা?

রাজ-প্রতাঁকের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলেন রাজা। তোমার সম্পর্কে আমাদের ভালো ধারণা রয়েছে, ইনটেফ। আইন আমারই তৈরি, আমিই তা লঙ্ঘন করতে পারি। যে কারো মতো প্রকাশের অধিকার আছে উঁচু বা নিচু।

মাথা ঝুঁকিয়ে চুপ করলেন ইনটেফ। কিন্তু চেহারাই বলে দিলো, এবারে ভয় পেয়ে গেছেন।

এবারে, আমার দিকে দৃষ্টি দিলেন রাজা। বেশ অপরিকল্পিত ঘটনাবলি ঘটছে আজ। যা হোক, দাস টাইটা–একটা ব্যাপারে তোমাকে সতর্ক করে দিতে চাই, আজে-বাজে, ভিত্তিহীন কিছু বলার অর্থ হবে মৃত্যুদন্ড।

কেঁপে উঠলাম আমি। যখন ইনটেফের দাস ছিলাম, আমি ছিলাম তার বার্তাবাহক এবং চর।

প্রত্যেকটি শ্রাইক নেতাকে আমি চিনি। ক্রাতাসের জিম্মায় থাকা বন্দীদের দিকে দেখিয়ে বললাম। আমিই ইনটেফের নির্দেশ নিয়ে ওদের কাছে যেতাম!

মিথ্যে কথা! অন্তঃসারশূন্য কোনো প্রমাণ নেই, আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন ইনটেফ। কী প্রমাণ আছে?

থামো! হিংস্র কণ্ঠে সাবধান করে দিলেন রাজা। দাস টাইটার সাক্ষ্য শুনবো আমরা। সরাসরি আমার চোখে তাকালেন তিনি।

বাস্তির কাছে আমি নিয়ে যেতাম ইনটেফের নির্দেশ। পিয়াংকি, প্রভু হেরাবের সমস্ত সম্পত্তি ধ্বংসের নির্দেশ ছিলো সেগুলো। আমি জানতাম, রাজ-উজিরের পদ অত্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত ছিলো ইনটেফের। তার সমস্ত নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছিলো তখন। শেষ হয়ে গিয়েছিলেন প্রভু হেরাব; ফারাও-এর আনুকূল্য-ভালোবাসা হারিয়ে নিরুপায় হয়ে শেষমেষ ধুতুরার বিষ পান করেন তিনি। আমি, টাইটা, এর সাক্ষ্য দিচ্ছি।

ঠিক, বাঁধা-হাত সিংহাসনের দিকে তাক করে বাস্তি। টাইটা যা বলছে প্রতিটি কথা সত্য।

বাক-হার! শ্রাইক নেতারা সমস্বরে বলে উঠে, সত্যি কথা। টাইটার প্রতিটি কথা সত্য।

কিন্তু, এ সবই কথা, রাজা বললেন, প্রমাণ কী?

জীবনের বেশিরভাগ সময় রাজ-উজিরের লিপিকার এবং কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছি। সমস্ত হিসাব তাঁর হয়ে আমি রাখতাম। রাহা-খরচ, সম্পদের হিসাব সমস্ত লেখা আছে আমার স্লোলে। শ্রাইকদের দেওয়া মোটা অঙ্কের অর্থের সব কিছু লেখা আছে।

ওই স্ক্রোলগুলো দেখাতে পারবে, টাইটা? ধন-সম্পদের উল্লেখে পূর্ণিমার চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো ফারাও-এর মুখাবয়ব। এখন তার পূর্ণ মনোযোগ আমার উপর নিবদ্ধ।

না, ম্যাজেস্টি, পারবো না । ওগুলো সব সময় ইনটেফের কাছে থাকতো।

হতাশা গোপনের কোনো চেষ্টা করলেন না ফারাও; শক্ত মুখে বসে রইলেন । ওদিকে আমি বলে চললাম, স্ক্রোলগুলো আমি দেখাতে পারবো না, কিন্তু আপনার এবং জনগনের যে সমস্ত ধন-সম্পদ ইনটে চুরি করে জমা করেছেন, সেগুলো কোথায় রাখা আছে সম্ভবত সেখানে নিয়ে যেতে পারবো। আমি নিজেই সেই গোপন প্রকোষ্ঠগুলো তৈরি করেছিলাম। শ্রাইক নেতাদের থেকে পাওয়া সমস্ত রত্ন-ভাণ্ডার সেখানে লুকিয়ে রাখা আছে। ফারাও-এর খাজনা আদায়কারীরা সেই সম্পদের কোনো হদিশ পায়নি।

আবারো, আগ্রহের আতিশায্যে সামনে ঝুঁকে বসেন রাজা। সরাসরি না তাকিয়েও, ইনটেফের মনোভাব বুঝতে চাইলাম। বেশ বড়ো একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি; যেখানে দেখে এসেছিলাম লুকোনো সম্পদ, এখনো সেখানেই আছে এটা ঠিক নাও হতে পারে। তবে এতো বিশাল পরিমাণ সম্পদ অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আর তাছাড়া, ইনটেফ ভাবতেন আমি মারা গেছি।

মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছি আমি। দম আটকে রেখে, তামার দরোজায় ইনটেফের প্রতিবিম্ব দেখতে লাগলাম মনোযোগ দিয়ে। তার চেহারার আতঙ্কই যা বলার বলে দিলো জিতে গেছি আমি। যেখানে দেখে এসেছি, ওখানেই আছে সব ধন-সম্পদ। এখন আমি জানি, ফারাওকে গোপন প্রকোষ্ঠে নিয়ে যেতে পারবো আমি।

কিন্তু এতো সহজে হেরে যাওয়ার মানুষ ইনটেফ নন। ডান হাতে কিছু একটা ইশারা করলেন তিনি, ঠিক বুঝলাম না, কার উদ্দেশ্যে। যখন বুঝলাম, বড়ো দেরি হয়ে গেছে।

উত্তেজনায় এতোক্ষণ র‍্যাসফারের কথা ভুলে গেছিলাম। ইনটেফের ইশারায়, শিকারী কুকুরের মতো ঝট করে লাফিয়ে উঠলো সে। সমস্ত হিংস্রতা নিয়ে আমার উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো র‍্যাসফার। মাত্র দশ গজ দূর থেকে তলোয়ার বাগিয়ে ছুটে আসছে সে।

ক্রাতাসের দুইজন যোদ্ধা র‍্যাসফারের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে। দুই জনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় র‍্যাসফার, একজন হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ে ট্যানাসের সামনে, ওর পথ আটকে। অসহায় আমি দাঁড়িয়ে রইলাম র‍্যাসফারের সম্মুখে, দুই হাতে তলোয়ার উঁচিয়ে ধরে সে যেনো আমার খুলি ফুটো করে পুরো সেঁধিয়ে দেবে ফলা। নড়াচড়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেললাম।

জানি না, কীভাবে, নিজের তলোয়ার ছুঁড়ে দিয়েছিলো ট্যানাস। সময় ধীরে বয়ে যেতে লাগলো আমার জন্যে, মনে হলো, শূন্যে তলোয়ারের প্রতিটি ঘূর্ণন দেখতে পারছি। পুরো এক পাক ঘোরার আগেই হাতলটা আছড়ে পড়লো র‍্যাসফারের মাথায়। ঠিক ঝড়ো বাতাসে নাড়া খাওয়া গাছের শাখার মতো ল্যাগব্যাগিয়ে উঠলো র‍্যাসফারের ঘাড়; কোটড়ের মধ্যে পাক খেলো চোখ দুটো।

আমার উদ্দেশ্যে হানা আঘাত শেষ করতে পারলো না বর্বরটা। প্রচণ্ড শব্দে মাটিতে আছাড় খেলো সে। অবশ হাত থেকে ছুটে গেলো অস্ত্রটা, শূন্যে পাক খেয়ে আছড়ে পড়লো ফারাও-এর সিংহাসনের এক ধারে, গেঁথে গিয়ে কাঁপতে লাগলো। বিস্ময়ে মুখ হা-সেদিকে চেয়ে রইলেন রাজা। ধারালো ফলায় তার হাতের চামড়া কেটে গেছে, ফারাও-এর শ্বেত-শুভ্র বস্ত্রে ঝরলো ফোঁটা ফোঁটা রক্ত।

অসহনীয় নীরবতা ভেঙে গেলো ট্যানাসের বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বরে, মহান মিশর, আপনি দেখেছেন, শয়তানটাকে কে ইশারা করেছিলো। আপনার জীবন যে বিপদে ফেলে দিয়েছে, আপনি চিনলেন তাকে। সামনের যোদ্ধার থেকে জট ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো ট্যানাস, লাফিয়ে ইনটেফের সামনে গিয়ে এক হাতে ধরে মোচড় দিতে লাগলো যতক্ষণ পর্যন্ত না হাঁটুর উপর পড়ে গিয়ে ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলেন রাজ-উজির।

এ সব আমাকে দেখতে হবে, ভাবি নি কোনোদিন, রাজ-উজিরের দিকে তাকিয়ে দুঃখ ভরে বললেন ফারাও। সারাজীবন তোমাকে বিশ্বাস করে এসেছি, ইনটেক, আর তুমি আমার উপর থুতু ছুঁড়ে মারলে!

মহান মিশর, আমার কথা শুনুন! নিচু হয়ে বললেন ইনটে, কিন্তু ফারাও তাঁর মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন অন্যদিকে ।

অনেক শুনেছি তোমার কাছ থেকে। ট্যানাসের উদ্দেশ্যে মাথা ঝাঁকালেন রাজা। তোমার লোকেদের বলল, একে পাহাড়া দিয়ে রাখতে। যথাযথ সম্মান অবশ্যই দেবে, কেননা তার কোনো অপরাধ এখনো প্রমাণিত হয়নি।

সবশেষে, জনতার মুখোমুখি হলেন তিনি। বড়ো আশ্চৰ্য্য আর অনির্ধারিত ঘটনা ঘটে গেলো। দাস টাইটার দেওয়া প্রমাণ খতিয়ে দেখা পর্যন্ত এই সমাবেশ আমি মুলতবি করলাম। আগামীকাল দুপুরে, ঠিক এইখানে, আমার রায় শোনার জন্যে আবার জড়ো হবে থিবেসবাসী। এ আমার নির্দেশ।

*

রাজ-উজিরের প্রাসাদের দর্শনার্থী কক্ষের প্রধান দরোজা গলে ঢুকলাম আমরা। কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন রাজা; র‍্যাসফারের আঘাতে সৃষ্ট তার ক্ষতটা এমন মারাত্মক কিছু নয়, তবু সাদা লিনেন কাপড়ে ওটা মুড়ে দিয়েছি আমি।

পুরো কক্ষটা ধীরে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন ফারাও। লম্বা কক্ষের শেষ মাথায় রয়েছে রাজ-উজিরের সিংহাসন। অ্যালাস্টারের নিখাদ একটি খন্ড থেকে তৈরি ওটা। গজ-দ্বীপে, ফারাও-এর সিংহাসনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কামরার উঁচু দেয়ালগুলো মসৃণ কাদা মাটিতে লেপা, তারই উপর আঁকা রয়েছে সমগ্র মিশরের সেরা দেয়ালচিত্র আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ ওগুলো। বিশাল কক্ষটাকে যেনো আমোদ-প্রমোদের স্বর্গেরাজ্যে পরিণত করেছে চিত্রকর্মগুলো। ইনটেফের দাস ছিলাম যখন, তখনকার সৃষ্টি এরা, আজ আমি নিজেও যেনো আবেগে কেঁপে উঠলাম দেখে।

কেবলমাত্র এই কাজগুলোর জন্যেই মিশরের ইতিহাসের সেরা শিল্পীর উপাধি পাওয়ার যোগ্য আমি; বাকি কাজের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। দুঃখের বিষয়, এখন আমাকেই এগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে।

কক্ষের ভেতর দিয়ে ফারাওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললাম। সমস্ত রাজকীয় আচরণ বাদ দিয়ে একেবারে বাচ্চাদের মতো আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এতো নিকটে দাঁড়িয়ে আমার পিছু পিছু চলছিলেন, বারবার পায়ে ধাক্কা লাগছিলো। পেছন পেছন তার আগ্রহী সভাদ।

সিংহাসনের পেছনের দেয়ালের কাছে তাদের নিয়ে চললাম আমি । সূর্যের দেবতা, আমন রার বিশাল একটি ম্যুরালের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কিছু সময় মুগ্ধ নয়নে চিত্রকর্মটির দিকে তাকিয়ে রইলেন ফারাও।

আমাদের পেছনে, পুরো কক্ষটি অর্ধেক ভরে গেছে সভাষদ, যোদ্ধা, জমিদারবর্গের কাফেলায়; রাজ-বধূ আর উপপত্নীদের কথা না হয় বাদ দিলাম প্রসাধনে মুখ ঢেকে দারুন উৎসাহ নিয়ে তারাও সামিল হয়েছেন এই অনুষঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই আমার কর্ত্রী একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে। রাজার এক পা পেছনে ট্যানাস। রাজ প্রহরীদের দায়িত্ব এখন নীল কুমীর বাহিনী পালন করছে।

ট্যানাসের দিকে ফিরলেন রাজা। তোমার লোকেদের বলল, লর্ড ইনটেফকে নিয়ে আসতে।

বরফ শীতল ভাবাবেগের সাথে ইনটেফকে দেয়ালচিত্রের সামনে নিয়ে এলো ক্ৰাতাস, নগ্ন তলোয়ারের ফলা তাক করে রেখেছে তার দিকে।

টাইটা, তুমি এগোও! রাজা আমাকে নির্দেশ দিতেই দেয়ালের মাপজোক শুরু করলাম। দেয়ালের সবচেয়ে দূরবর্তী কোণ থেকে ঠিক ত্রিশ পা সরে এলাম আমি, হাতের চক দিয়ে চিহ্ন দিয়ে রাখছি।

এই দেয়ালের ওপাশে রয়েছে রাজ-উজিরের নিজস্ব সম্পদশালা, রাজাকে ব্যাখ্যা করে বললাম। শেষবার যখন মেরামতের কাজ করা হয়েছিলো প্রাসাদে, কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। ইনটে সব সময় তার সম্পদ হাতের কাছেই রাখতে চাইতেন।

কোনো কোনো সময় তুমি বেশ বাঁচাল, টাইটা, প্রাসাদের স্থাপত্য সম্পর্কিত আমার বর্ণনায় একটু বিরক্ত হলেন রাজা। কী দেখাবে দেখাও। কী লুকোনো আছে ওখানে, দেখতে উতলা হয়ে আছি আমি।

রাজ-মিস্ত্রিরা এগিয়ে আসুক! হাঁক দিতেই, চামড়ার থলেতে নিজেদের সরঞ্জাম নিয়ে এগিয়ে এলো মিস্ত্রিদের ছোট্ট একটা দল। ফারাও-এর সমাধি মন্দিরের নির্মাণ কাজ ছেড়ে ওদের নিয়ে এসেছি আমি, নদীর ওপার থেকে।

একজনের হাত থেকে মাপজোকের যন্ত্র নিয়ে কাদার দেয়ালে চিহ্ন আকলাম। এরপর পেছনে সরে, রাজমিস্ত্রিদের নেতাকে আহ্বান জানিয়ে বললাম, ধীরে। দেয়ালচিত্রটা যতোটা সম্ভব রক্ষা করার চেষ্টা করুন। অসাধারণ একটা শিল্পকর্ম ওটা।

হাতুড়ি, বাটাল আর ছেনি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো রাজমিস্ত্রির দল, দেয়ালচিত্র রক্ষা সম্পর্কিত আমার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করলো না। রঙ, ধুলো, কাদামাটির স্তর ভেঙে পড়লো নিমিষেই। পশমী শাল দিয়ে মুখ-মাথা ঢেকে রাখলো রাজ-বধূরা।

ধীরে পলেস্তারার নিচ থেকে উদয় হলো পাথুরে চৌকোনা মুখ। বিস্ময়ধ্বনি বেরুলো ফারাও-এর কষ্ঠ চীরে, ধুলো-ময়লা অগ্রাহ্য করে সামনে এগোলেন তিনি। পাথরের খণ্ডগুলোর মধ্যে একটি খণ্ড একটু আলাদা, ঠিক যেখানটায় চক দিয়ে এঁকেছিলাম আমি।

ওটার পেছনে লুকোনো দরোজা আছে! চেঁচিয়ে উঠলেন রাজা। ভাঙো, ঢোকো ওখানে!

রাজার উৎসাহে জোর হাত লাগালো মিস্ত্রির দল। দ্রুতই পথ করে ফেললো ভেতরে ঢোকার। কালো গর্তের মতো প্রবেশমুখের সামনে দাঁড়িয়ে মশাল জ্বালানোর নির্দেশ দিলেন ফারাও।

এই দেয়ালের পেছনে পুরো স্থানটাই একটা লুকোনো প্রকোষ্ঠ। তাকে বললাম আমি। ইনটেফের নির্দেশে আমি তৈরি করেছিলাম এটা।

মশাল জ্বালানো হতে, সেটা হাতে রাজার সামনে পথ দেখালো ট্যানাস। ফারাও এর ঠিক পেছনেই রইলাম আমি ।

বহুদিন হলো, ওখানে শেষবার পা রেখেছি, অন্য সবার মতোই আমিও দারুন আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলাম চারপাশে। কিছুই পাল্টে নি। সিডার আর একাশিয়া কাঠের বাক্সগুলো আগের মতোই আছে, ঠিক যেমন করে সাজিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। যে বাক্সগুলো আগে দেখা প্রয়োজন, ওগুলো চিহ্নিত করতে রাজা হাঁক দিয়ে উঠলেন, অভ্যর্থনা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হোক বাক্সগুলো!

শক্ত লোক দরকার হবে, শুষ্ক কণ্ঠে যোগ করলাম। প্রচুর ভারী ওগুলো।

নীল বাহিনীর তিন তিনজন দশাসই লোক দরকার হলো বাক্সগুলো বহন করে নিয়ে যেতে।

জীবনেও ওগুলো দেখিনি, প্রতিবাদ করে বললেন ইনটেফ যখন রাজ-উজিরে সিংহাসনের সামনে একে একে জড়ো করা হলো বাক্সগুলো। দেয়ালের ওপাশের গোপন প্রকোষ্ঠের কথা আমার জানা ছিলো না। নির্ঘাত আমার পূর্বসুরি কেউ তৈরি করেছেন ওটা।

ম্যাজেস্টি, বাক্সের ঢাকনার সীলটি ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, আমার অনুরোধে উঁকি মেরে দেখলেন ফারাও, বাক্সের ভেতরে।

ওটা কিসের প্রতীক? জানতে চাইলেন তিনি।

রাজ-উজিরের মধ্যমার আংটিটি লক্ষ্য করুন, বিড়বিড় করে জানালাম, দয়া করে। একটু মিলিয়ে দেখুন দুটো প্রতীক।

লর্ড ইনটেক, তোমার আংটি আমাকে দাও দয়া করে, ব্যঙ্গপূর্ণ কণ্ঠে সম্মান জানালেন ফারাও। কিন্তু বাম হাত শরীরের পেছনে আড়াল করলেন ইনটেফ।

মহান মিশর, গত বিশ বছর ধরে ওই আংটি আমার হাতে আছে। আঙুল মোটা হয়ে গেছে তো, এখন আর খুলতে পারি না।

লর্ড ট্যানাস, ট্যানাসের দিকে ফিরে বললেন রাজা। তলোয়ার হাতে নাও। আংটিসহ ইনটেফের আঙুল কেটে আমার সামনে উপস্থাপন করা হোক। বাধ্যগতের মতো তলোয়ার বের করার ভঙ্গি করে সামনে এগুলো ট্যানাস–ঠোঁটে ক্রুর হাসি।

আমার ভুলও হতে পারে, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন ইনটেফ। দেখি, খুলতে পারি কি না। সহজেই আঙুল থেকে খুলে এলো আংটিটা। এক হাঁটুর উপর ভর করে রাজার সামনে সেটা পেশ করলো ট্যানাস।

মনোযোগের সাথে বাক্সের ঢাকনার সঙ্গে আংটির প্রতীক মিলিয়ে দেখলেন ফারাও। যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর মুখ ক্রোধের আগুনে জ্বলছে।

একদম মিলে গেছে। এই প্রতীক তোমার আংটির, ইনটেফ। কিছুই বললেন না ইনটেফ এই কথায়। দুই হাত ভাঁজ করে বুকে বেঁধে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।

সীল ভাঙ্গো! খোলো এই বাক্স! ফারাও-এর নির্দেশে বাক্সের মুখ খুলে ফেললো ট্যানাস। ঢাকনা খুলে পড়ে যেতে ভেতরের সম্পদ দৃশ্যমান হলো। চেঁচিয়ে উঠলেন ফারাও, দেবতাদের কসম! হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো সবার মধ্যে, ভেতরে কী আছে দেখতে উদগ্রীব তারা।

স্বর্ণ! দুই হাতে স্বর্ণের আংটি মুঠো ভরে তুললেন রাজা, তাঁর আঙুলের ফাঁক গলে ঝরতে লাগলো সোনালি জলপ্রপাত। একটি আংটি চোখের সামনে ধরে ভালো করে লক্ষ্য করলেন ফারাও। দুই ডেবেন স্বর্ণ। এই বাক্সে এ রকম আর কয়টি আছে, আর এরকম বাক্সই বা কয়টি আছে ওখানে? বিস্ময়াভূত হয়েই প্রশ্নটা করেছিলেন তিনি, কিন্তু উত্তরে আমি বললাম, এই বাক্সে আছে ঢাকনার নিচে আমারই লিখে রাখা হিসাব দেখে নিলাম। এতে আছে এক টাখ তিনশো ডেবেন বিশুদ্ধ স্বর্ণ। আর আমার স্মৃতি প্রতারণা না করে থাকলে, তেপান্নো বাক্স স্বর্ণ আর তেইশ বাক্স রৌপ্য আছে গোপন স্থানে। তবে, অলঙ্কার কতগুলো আছে, এ আমার মনে নেই।

এমন কেউ কী নেই, যাকে বিশ্বাস করতে পারি আমি? হাহাকার ধ্বনিত হলো ফারাও-এর কণ্ঠে। তুমি ইনটেফ তোমাকে আপন ভাইয়ের চেয়ে কিছু কম মনে করিনি কখনো। এমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই, যা তুমি পাওনি আমার দরবার থেকে। এইভাবে প্রতিদান দিলে তার?

*

সেদিন রাতে রাজার শয্যাকক্ষে যখন তার ক্ষতের পরিচর্যা করছিলাম, প্রধান খাজনা আদায়কারী এলেন দেখা করতে। সমস্ত ধন-সম্পদের সম্পূর্ণ হিসাব পেশ করলেন তারা। বিস্ময়ে, রাগে, আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন রাজা।

বদমাশটা দেখছি আমার চাইতেও ধনী ছিলো। এমন শয়তানের জন্যে কোনো শাস্তিই যথার্থ নয়। আমাকে, আমার খাজনা-আদায়কারীদের সে ধোঁকা দিয়ে ডাকাতি করেছে!

শুধু তাই নয়, প্রভু হেরাবের সমস্ত সম্পদ নষ্ট করে তাকে খুন করেছে, মনে করিয়ে দিয়ে বললাম আমি। হয়তো এটা বলা আমার পক্ষে একটু ধৃষ্টতা ছিলো, কিন্তু তততদিনে আমার কাছে অনেক ঋণ হয়ে গেছে ফারাও-এর এতোটুকু ঝুঁকি তো আমি নিতেই পারি।

ঠিক, সায় দিলেন ফারাও। সমুদ্রের মতো গভীর তার পাপ, আকাশ সমান উঁচু। উপযুক্ত শাস্তির ব্যাপারে ভাবতে হবে আমাকে। ফাসীর দড়ি এর জন্যে কিছুই নয়।

ম্যাজিস্টি, আপনার চিকিৎসক হিসেবে বলছি, এখন বিশ্রাম প্রয়োজন আপনার। প্রচুর ধকল গিয়েছে আজ।

ইনটেফ কোথায়? সে শাস্তি না পাওয়া পর্যন্ত আমার স্বস্তি নেই।

নিজের প্রকোষ্ঠে বন্দী আছে সে। নীল বাহিনীর যোগ্য যোদ্ধারা পাহারা দিচ্ছে। দোনোমনো করে যোগ করলাম, র‍্যাসফারকেও পাহারা দিয়ে রাখা হয়েছে।

র‍্যাসফার ইনটেফের দোসর ওই যে কুৎসিত শয়তানটা? ওসিরিসের মন্দিরে যে তোমাকে মেরে ফেলতে চাইছিলো? ট্যানাসের মার থেকে বেঁচে গেছে সে?

বেঁচে গেছে, সায় দিলাম। মহান ফারাও কী জানেন, বহুকাল আগে এই র‍্যাসফারই আমাকে খোঁজা করেছিলো? রাজার চেহারায় ফুটে উঠলো দুঃখবোধলক্ষ্য করলাম আমি।

ঠিক ওর প্রভুর মতোই গতি হবে ওর, প্রতিজ্ঞা করলেন ফারাও। ইনটেফের শাস্তি সেও পাবে। তাতে চলবে তো, টাইটা?

মহান সম্রাটের সিদ্ধান্ত ন্যায্য তিনি সর্বজ্ঞ। ধীরে তার শয্যাপাশ ছেড়ে লসট্রিসের খোঁজে চললাম।

আমারই জন্যে অপেক্ষা করছিলো সে। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে ততক্ষণে, আমিও ক্লান্ত, কিন্তু কিছুতেই ছাড়বে না লসট্রিস। উত্তেজনায় কলকল করছিলো সে। জানি ঘুমোতে দেবে না আমাকে, বাধ্য হয়ে ট্যানাস আর বিভিন্ন বিষয়ে ওর বকবক শুনতে ব্যাপৃত হলাম।

*

ঘুমের স্বল্পতা সত্ত্বেও পরদিন সকালে ওসিরিসের মন্দিরে যখন পৌঁছলাম, বেশ তরতাজা বোধ করছিলাম।

আগের দিনের চেয়েও যেনো বেশি লোক সমবেত হয়েছে আজ। রাজ-উজিরের শাস্তি শুনতে থিবেসের প্রতিটি মানুষ উদগ্রীব। এমনকি, যারা তার সংস্পর্শে থেকে লাভবান হয়েছে, তারা পর্যন্ত ইনটেফের বিরুদ্ধে যেতে সময় নেয়নি একটুও; ঠিক হায়েনার পালের মতো ঘিরে ধরেছে নিজেদের এতদিনের অভিভাবককে।

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় হাজির করা হলো শ্রাইক নেতাদের। ইনটেফ এলেন দারুন লিনেন কাপড় আর রুপোর স্যান্ডল পড়ে। চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, মুখে প্রসাধন, গলায় ঝুলে আছে প্রশংসার স্বর্ণ শেকল।

শ্ৰাইক নেতারা নিচু হয়ে দাঁড়ালো রাজার সামনে। কিন্তু এমনকি প্রহরীর তলোয়ারের খোঁচা খেয়েও নিচু হতে অস্বীকৃতি জানালেন ইনটেফ। রাজা ইশারায় বাধা দিলেন প্রহরীকে।

তাকে দাঁড়াতে দাও! নির্দেশ দিলেন ফারাও। কবরে তো বহুকাল শুয়েই থাকবে! এরপর, স্বর্ণালঙ্কার আর রাজকীয় পোশাকে সজ্জিত রাজা উঠে দাঁড়ালেন। সত্যিই, অন্তত একবারের জন্যে, সত্যিকারের রাজা মনে হচ্ছিলো তাঁকে; তার বংশধারার প্রথমজনের মতো। এমনকি আমি যে জানি তার সমস্ত দুর্বলতা পর্যন্ত মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না।

লর্ড ইনটেফ, বিশ্বাসঘাতকতা আর হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত তুমি। লুটপাট, ষড়যন্ত্র, আরও অন্তত একশ অপরাধ–যার শাস্তিঅবশ্যম্ভাবী তুমি করেছে। সকল রকম পেশার পঞ্চাশজন নাগরিক আমার কাছে দেবতাদের নামে কসম কেটে বলেছে, তা সে জমিদার হোক বা দাস। রাজকোষ থেকে তোমার চুরি করা সমস্ত সম্পদ আমি নিজ চোখে দেখেছি। তোমার ব্যক্তিগত সীল ছিলো সেই বাক্সে। এ সমস্ত কারণেই, তোমার অপরাধ অন্তত হাজার বার প্রমাণিত হয়েছে। আমি, মামোস, বংশধারার অষ্টম সম্রাট, ফারাও এবং এই মিশরের শাসক, এতদ্বারা তোমাকে দোষী বলে ঘোষণা করলাম; এবং যে কোনো রকম রাজ-ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ থেকে তোমাকে অযোগ্য ঘোষণা করলাম।

ফারাও দীর্ঘজীবি হোন! হুঙ্কার দিয়ে উঠলো ট্যানাস। সেই চিৎকার ঠোঁটে তুলে নেয় থিবেসের হাজারো জনতা। ফারাও চিরজীবি হোন!

নীরবতা নেমে আসতে আবারো মুখ খুললেন ফারাও। লর্ড ইনটেফ, প্রশংসার স্বর্ণ শেকল পড়ে আছো তুমি । একজন বিশ্বাসঘাতকের গলায় ওটা মানায় না, ট্যানাসের উদ্দেশ্যে তাকালেন তিনি, হে বীর, আসামীর গলা থেকে ওটা খুলে নাও!

ইনটেফের গলা থেকে হারটা খুলে নিয়ে রাজার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ট্যানাস, দুই হাতে ওটা ধরলেন তিনি। কিন্তু ট্যানাস ফিরে যেতে উদ্যত হতেই ওকে থামালেন।

বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রে লর্ড হেরাব নামটি কলঙ্কত হয়েছে। পিতার নির্দোষীতা প্রমাণ করেছো তুমি পিয়াংকি, লর্ড হেরাবের বিরুদ্ধে সমুদয় শাস্তি রহিত করলাম আমি; এবং মৃত্যু-পরবর্তী সমস্ত সম্মান এবং উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করলাম যা জীবদ্দশায় কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো তার কাছ থেকে। সমস্ত উপাধি এবং সম্মান এখন উত্তরাধিকারসূত্রে তোমার উপর বর্তালো।

বাক্-হার! চেঁচিয়ে উঠে জনতা। ফারাও চিরজীবি হোন! জয়, ট্যানাস-প্রভু হেরাবের জয় হোক!

উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া উপাধি ছাড়াও, নতুন করে সম্মান দিতে চাই আমি তোমাকে। আমার দেওয়া আদেশ তুমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। শ্রাইকদের ধ্বংস করে তাদের নেতাদের আইনের হাতে সমর্পণ করেছে। ম্রাটের প্রতি এই সেবার জন্যে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করলাম তোমাকে। নিচু হও, লর্ড হেরাব, রাজার পুরস্কার গ্রহণ করো!

বা হার! আনন্দে ফেটে পড়লো জনতা। মাত্রই ইনটেফের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া স্বর্ণের হারের সঙ্গে বীরের প্রতীক একটি তারকা যোগ করে ট্যানাসের গলায় পরিয়ে দিলেন ফারাও।

প্রভু হেরাবের জয় হোক!

ট্যানাস তার জায়গায় ফিরে যেতে আসামীর দিকে দৃষ্টি ফেরালেন ফারাও। থিবেসের অভিভাবক উপাধি কেড়ে নেওয়া হলো তোমার কাছে থেকে, ইনটে। সমস্ত ভাস্কর্য, মূর্তি, দলিল থেকে তোমার নাম মুছে ফেলা হবে। মহৎ প্রাণের উপত্যকায়, যেখানে নিজের সমাধি তৈরি করেছে সেখান থেকেও। তোমার সম্পদ, চুরি করা ছাড়াও যেগুলো অর্জন করেছিলে, রাজকোষে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। কেবল, পিয়াংকি, লর্ড হেরাবের সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া হবে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী, পুত্র ট্যানাস, লর্ড হেরাবকে।

বাক্ হার! ফারাও সর্বো! তিনি চিরজীবি হোন! জনতার গগনবিদারী হুঙ্কারের সাথে আনন্দে নেচে উঠলো আমার কর্ত্রীও; শুধু ও-ই নয়, সমস্ত মেয়েরা নাচছে এখন।

এবারে, আমাকে অবাক করে দিয়ে সরাসরি লসট্রিসের পাশে বসে থাকা আমার দিকে তাকালেন ফারাও। আরো একজন আছে, যার সেবা পেয়েছি আমি; লুকোনো সম্পদের হদিশ যে বাতলে দিয়েছিলো। দাস টাইটা, সামনে এসে দাঁড়াক!

সিংহাসনের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম। মৃদু কণ্ঠে রাজা বলে উঠলেন, বিশ্বাসঘাতক ইনটেফ আর তার দোসর, বদমাশ র‍্যাসফারের হাতে অপূরণীয় ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছে। তাদের চাপে পড়ে এমনকি ম্রাটের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়েছে তোমাকে। কিন্তু এ সমস্তই তুমি করেছো ইচ্ছের বিরুদ্ধে; দাস বলে মালিকের ইচ্ছেয় নিষেধ করার কোনো উপায় ছিলো না তোমার। আজ, তোমার উপর থেকে যে কোনো রকম দায়-দায়িত্ব তুলে নিলাম আমি। আমার চোখে তুমি নিষ্পাপ; রাজার প্রতি তোমার আনুগত্যের জন্যে দুই টাখ সেরা স্বর্ণ পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করলাম ইনটেফের চুরি করা সম্পদ থেকে ওটা দেওয়া হবে তোমাকে।

বিস্ময়ের ধ্বনি উঠলো সবার মধ্যে। দম আটকে ফেললাম আমি। বিশাল একটা পরিমাণ ওটা দেশের সম্পদশালী অনেক জমিদারেরও এতো অর্থ নেই। নদীর ধারের সবচেয়ে উর্বর জমি কেনা থেকে শুরু করে রাজকীয় বাড়ি তৈরি, তিনশো শক্তিশালী দাস ক্রয়; এমনকি আমাদের বাহিনীর সমস্ত জাহাজ সজ্জিত করে পুরো পৃথিবী ঘুরিয়ে আনা যাবে ওই অর্থ দিয়ে। আমার কল্পনার চেয়েও বেশি ওই পরিমাণ। কিন্তু রাজার কথা এখনো শেষ হয়নি।

যেহেতু তুমি একজন দাস–এই পুরস্কার সরাসরি তোমাকে দেওয়া হবে না। কিন্তু লসট্রিস যে তোমার কর্ত্রী, ফারাও-এর কনিষ্ঠ পত্নী, তার জিম্মায় রাখা হবে সমুদয় অর্থ। আমার বোঝা উচিত ছিলো, এতো সম্পদ পরিবারের মধ্যেই রাখতে চাইবেন ফারাও।

আমি, মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে যে মিশরের শ্রেষ্ঠ ধনবান ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলাম, রাজাকে কুর্নিশ করে আমার কর্ত্রীর পাশে নির্ধারিত স্থানে চলে এলাম। আমার হাতে চাপ দিয়ে সান্তনা দিতে চাইলো লসট্রিস, অবশ্য একটুও অসুখী ছিলাম না তখন, সত্যি বলছি। আমাদের নিয়তি একই সুতায় গাঁথা পার্থিব কোনো কিছুই আমাদের সম্পর্কে চির ধরাতে পারবে না।

সবশেষে, সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা আসামীদের শাস্তি শোনাতে মুখ খুললেন ফারাও, যদিও পুরোটা সময় ইনটেফের দিকেই তাকিয়ে রইলেন।

তোমাদের অপরাধের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। পূর্ববর্তী যে কোনো সময়ের যে কোনো শাস্তি এর জন্যে যথেষ্ট নয়। তো আমার রায় হলো–ওসিরিসের উৎসব শেষে, আগামী সূর্যোদয়ের পরে থিবেসের রাস্তা ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তোমাদের, হাত-পা বাঁধা অবস্থায়, নগ্ন শরীরে। জীবিত দেহে পেরেক ঠুকে শহরের প্রধান ফটকের সাথে গাঁথা হবে তোমাদের মাথা ঝুলবে নিচে। কাকে না ঠুকরে খাওয়া পর্যন্ত ওখানেই ঝুলবে তোমরা। এরপর, সমস্ত হাড় গুঁড়ো করে ফেলা হবে নীল মাতার জলে।

ইনটেফ পর্যন্ত টলে উঠলেন এমন ঘোষণায়। শবদেহ মমি করার কোনো উপায় রাখেননি ফারাও। চিরতরে অভিশপ্ত হয়ে থাকবে তাদের আত্মা। একজন মিশরীর মানবের জন্যে এরচেয়ে ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে না। স্বর্গের জমিনে কোনোদিনও স্থান হবে না এদের।

*

শাস্তির দিন সকালে, প্রাসাদের বাগানগুলো তখনো অন্ধকারে আচ্ছন্ন, হারেম ছেড়ে রওনা হলাম আমি । জল-বাগানের ধার ঘেঁষে যেতে যেতে কালো পানির বুকে তারাদের প্রতিবিম্বে চোখ আটকে গেলো। ইনটেফের ব্যক্তিগত প্রকোষ্ঠে, যেখানে আটকে রাখা হয়েছে তাকে, তার কাছাকাছি পৌঁছতেই ভেতরে মশালের আলো চোখে পড়লো । চিৎকার করে কেউ নির্দেশ দিচ্ছে অপর কাউকে। সাথে সাথেই বুঝলাম, গোলমেলে কিছু একটা ঘটছে ওখানে। দৌড়ে চললাম। আর একটু হলেই প্রকোষ্ঠের রক্ষী বর্শা বিধিয়ে দিয়েছিলো শরীরে, শেষ মুহূর্তে আমাকে চিনতে পেরে ক্ষান্ত দিলো সে।

প্রকোষ্ঠের সামনের স্থানে দাঁড়িয়ে ট্যানাস। ফাঁদে পড়া সিংহের মতো গর্জন করছে সে, যেনো সামনে আসছে ঘুষি পাকিয়ে তেড়ে যাচ্ছে তার দিকে। এমন রাগ করতে কখনো দেখিনি ওকে। কথা বলার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে যেনো। তার বাহিনীর সাহসী যোদ্ধারা কেউ সামনে যেতে পারছে না।

সোজা তার দিকে গিয়ে একটা ঘুষির নিচে মাথা নামালাম; চেঁচিয়ে বলছি, ট্যানাস! সামলাও নিজেকে! পাগল হয়ে গেলে নাকি?

প্রায় মেরে বসেছিলো ও আমাকে, এরপর নিজের সাথেই যুদ্ধ করে থামলো।

দেখো, এদের জন্যে কিছু করার আছে কি না! প্রকোষ্ঠের সামনের ঘরে এলোমেলোভাবে পড়ে থাকা শরীরগুলো দেখিয়ে বললো সে। যেনো যুদ্ধ হয়ে গেছে এখানে।

আঁতকে উঠে লক্ষ্য করলাম, তাদের মধ্যে রয়েছে খেতখেত-বাহিনীর জ্যেষ্ঠ যোদ্ধা, খুব পছন্দ করতাম আমি একে। প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে, পেট চেপে ধরে আছে। সে। গালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখলাম মৃতের মত ঠাণ্ডা।

আফসোসে মাথা নেড়ে বললাম, আর কিছু করার নেই। বন্ধ চোখের পাতা উল্টাতে দৃষ্টিহীন চোখদুটো নজরে এলো। ঝুঁকে পড়ে মুখের গন্ধ নিতে চাইলাম। পরিচিত সেই গন্ধ।

বিষ, দাঁড়িয়ে বললাম। বাকিদের ক্ষেত্রেও একই কথা। মেঝেতে আরো পাঁচটি দেহ পড়ে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে।

কেমন করে? কষ্টার্জিত স্বরে জানতে চাইলো ট্যানাস, নিচু টেবিলের উপর থেকে পাত্রগুলো তুলে নিলাম আমি, কোনো সন্দেহ নেই ওগুলো থেকেই রাতের আহার করেছিলো সৈন্যরা। শুঁকে দেখতে বিষের গন্ধ এখানেও নাকে এসে ঝাঁপটা মারলো।

রাধুনিকে জিজ্ঞেস করে দেখা যায়, বললাম। এরপর রাগের আতিশায্যে দেয়ালে ছুঁড়ে ফেললাম একটা পাত্র। আমার প্রাণপ্রিয় পোষ্যরা ঠিক একইভাবে মরেছিলো, আজ মরলো প্রিয় বন্ধু খেতখেত।

বড়ো একটা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস পেলাম। নির্ঘাত বন্দী পালিয়েছে? কিছু না বলে ইনটেফের শয্যাকক্ষের দিকে চলে ট্যানাস। শূন্য কক্ষের শেষ মাথার দেয়ালে কালো গর্তটা সাথে সাথেই নজরে এলো।

তুমি জানতে, এখান দিয়ে পালানোর গোপন পথ আছে? ট্যানাসের প্রশ্নের উত্তরে নীরবে মাথা নাড়লাম এপাশ-ওপাশ।

ভেবেছিলাম, সবকিছু জানা আছে আমার; ভুল, হতাশা ঝরে পড়লো আমার কণ্ঠে। কেনো জেনো আমার মন বলছিলো, ইনটেফকে কখনো বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো যাবে না। অন্ধকারের দেবতারা তাকে রক্ষা করবে।

রাসফারও কি পালিয়ে গেছে, ইনটেফের সাথে? নেতিবাচক ঢঙে মাথা নাড়ে ট্যানাস।

না, তাইক নেতাদের সাথে বাহিনীর বন্দীশালায় আটক আছে সে। তবে ইনটেফের দুই ছেলে, মেনসেট আর সোবেক পালিয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই, আমার লোকেদের হত্যা আর পিতার পলায়নের পেছনে এদেরই হাত ছিলো। উন্মত্ত রাগে লাগাম টেনেছে ট্যানাস। তুমি ইনটেফকে সবচেয়ে ভালো চেনো, টাইটা। কী করবে সে এখন? কোথায় যাবে? কেমন করে ধরবো তাকে?

একটা কথা বলতে পারি এমন দিনের কথা আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন ইনটেফ। জানি, আগে থেকেই নিম্ন-রাজ্যে নিজের জন্যে সম্পদ লুকিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা ছিলো তার। এমনকি, ভুয়া ফারাও-এর সাথেও তার যোগসাজশ ছিলো। মনে হয়, যোদ্ধাদের গোপন খবর সে-ই পাচার করতো ওখানে। উত্তরে বিশাল অভ্যর্থনা অপেক্ষা করছে তার জন্যে।

ইতিমধ্যেই পাঁচটি গ্যালি উত্তরের উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি, ট্যানাস জানালো। যে জাহাজই পাক, আমার কাছে নিয়ে আসার হুকুম রয়েছে।

লোহিতসাগরের ওপারে বহু বন্ধু-বান্ধব আছে ইনটেফের, বললাম। উত্তর সাগরের তীরে, সেই গাঁজা এলাকার বণিকদের কাছে নিজের জন্যে সম্পদ পাঠিয়েছিলেন ইনটেফ। বেদুঈনদের সাথেও দহরম-মহরম আছে তার; অনেকে বেতনও পায় তার কাছে থেকে। ওরা তাকে নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও মরু পেরোতে সাহায্য করবে।

হে হোরাস! এ যে দেখছি ইঁদুরের মতো বহু ফাঁকফোকর রয়েছে বেরুনোর জন্যে, হতাশ ভঙ্গিতে বলে উঠলো ট্যানাস। কেমন করে এর সবগুলো বন্ধ করবো আমি?

পারবে না, আমি বললাম। আর এখন, ফারাও তো বসে আছেন শাস্তি কার্যকর দেখার জন্যে। তাঁকে এ সমস্তই জানাতে হবে তোমার।

উনি খেপে যাবেন, অবশ্য কারণও আছে। ইনটেফকে পালিয়ে যেতে দিয়ে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি আমি।

ট্যানাসের কথা অবশ্য ভুল প্রমাণিত হলো। ইনটেফের পলায়নের খবর শান্ত ভাবেই গ্রহণ করলেন রাজা। এর পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না; হয়তো এতো বিশাল সম্পদের হঠাৎ-প্রাপ্তিতে মজেছেন তিনি। হতে পারে, হৃদয়ের গভীর কোনো কোণে ইনটেফের জন্যে হয়তো কিছুটা স্নেহ এখনো আছে তাঁর। আবার, এমনও হতে পারে, কাউকে পেরেক-বিদ্ধ করার মতো নৃশংস দৃশ্য তার দয়ালু মনে খুব একটা আগ্রহ জাগায় নি।

অবশ্য, কিছুটা রাগের বহিঃপ্রকাশ ছিলো তার কথায়; এই যেমন, বিচার প্রতারণার শিকার হলো ইত্যাদি ইত্যাদি; কিন্তু যতোটা সময় তাঁর কাছে ছিলাম, কেবল উদ্ধার করা ধন-সম্পদে নিবদ্ধ ছিলো দৃষ্টি। এমনকি, আসামী পলায়নের পুরো দায়ভার যখন নিতে চাইলো ট্যানাস, পাত্তাই দিলেন না ফারাও।

রক্ষিদের নেতার সব দোষ; আর বিষের পাত্র থেকে খেয়ে মরে গিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করেছে সে। পলাতকের পেছনে বাহিনী আর গ্যালি পাঠিয়ে যা করার, করেছো তুমি। এর বেশি আর কিছু করার ছিলো না। এখন, বাদবাকি আসামীদের শাস্তি কায়েম করা হোক।

ফারাও কী শাস্তিপ্রদর্শন দেখার ইচ্ছে করেন? ট্যানাসের প্রশ্নের উত্তরে যেনো অযুহাত তৈরির জন্যেই নিজের চারপাশের ধন-সম্পদ আর খাজনা-আদায়কারীদের প্রতিবেদনের দিকে তাকালেন ফারাও।

এখানে আমার অনেক কাজ পড়ে আছে, লর্ড ট্যানাস। যা করার, করো। শাস্তি পালিত হলে আমাকে জানিয়ো।

*

সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের শাস্তি দেখতে আমিও জড়ো হয়েছিলাম লাখো থিবেসবাসীর মতো। সরাসরি র‍্যাসফারের দিকে তাকিয়ে নিজের ঘৃণার আগুনে ঘি ঢালতে চাইলাম। প্রতিটি হিংস্র, নৃশংস আচরণ, যা আমার সাথে করেছে র‍্যাসফার, তার সবকিছু মনে করিয়ে দিলাম নিজেকে। সেই খোঁজা করা ছুরি, চাবুকের আঘাত, এলাইদা সবকিছু। কিন্তু যতটুকু ঘৃণা এ বদমাশের প্রাপ্য, ততোটা হয়তো বুকে ধারণ করতে পারলাম না।

দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে দাঁত বের করে হাসলো সে। অবশ মুখের এক পাশ হাসলো শুধু, ব্যাঙ্গের হাসি; শুনলাম র‍্যাসফার বলছে, আমাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে দেখছি খোঁজা ব্যাটাও এসেছে! কে জানে, স্বর্গের জমিনে তোর সাথে আবার দেখা হবে আমার; ওখানে তাহলে আর একবার বিচি কাটার সুযোগ পাবো!

ওর প্রতি আমার ঘৃণা আরো বেশি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বদমাশটা; কিন্তু কেনো যেনো, পারলাম না। উত্তরে বললাম, নদীর তলায় কাদা মাটিতে যাচ্ছো তুমি, স্বর্গে নয় হে। এর পরেরবার যে মাছটা ধরে ভেজে খাবো, ওটার নাম র‍্যাসফার রাখবো আমি!

কাঠের প্রধান ফটকে প্রথমে ভোলা হলো র‍্যাসফারকে। তিনজন দড়ি-দড়া সহ উপরে রইলো, প্যারাপিটে, আরো চারজন প্রয়োজন হলো নিচে। ওরা ধরে রাখলো তাকে, ওদিকে সেনাবাহিনীর একজন যোদ্ধা পাশের মই বেয়ে উপরে উঠে এলো, হাতে পাথরের মাথাওয়ালা হাতুড়ি।

তামার তৈরি প্রথম পেরেক যখন মাংস গলে ঢুকে পড়লো, তামাশা ভুলে গেছে র‍্যাসফার; তার বিশাল পায়ের হাড় ফুড়ে গেঁথে গেছে পেরেক। মোচড়ে উঠে, গগনবিদারী আর্তনাদে কেঁপে উঠলো বর্বরটা; ওদিকে নেচে-গেয়ে, উৎসাহ দিয়ে চললো জনতা।

অবশেষে, সমস্ত পেরেক গাথা শেষ হতে যখন নিচে নেমে নিজের হাতের কাজ দেখতে লাগলো হাতুড়ে সৈনিক, শাস্তির নির্মমতা প্রত্যক্ষ হলো। উল্টো করে ঝুলে থাকা রাসফারের পা বেয়ে রক্ত ঝরছে। পেটের থলথলে চর্বি উল্টো দিকে ঝুলে পড়েছে, বিশাল জননাঙ্গ বাড়ি খাচ্ছে পেটের চামড়ায়। নড়াচড়া সাথে সাথে পায়ের আঙুলের মাঝখান দিয়ে পথ করে এগোলো পেরেক, মাংস, চামড়া, মাংসপেশি ফুঁড়ে বেরিয়ে গেলো। মাটিতে আছড়ে পড়লো র‍্যাসফার। চেঁচিয়ে উৎসাহ জোগালো জনতা, এ হিংস্র প্রদর্শনী দারুন মনে ধরেছে তাদের।

প্রয়োজনীয় উৎসাহ পেয়ে আবারো রাসফারকে উপরে তুলে পেরেক গেঁথে দিলো যোদ্ধারা। বিশাল ওজন ধরে রাখার জন্যে ট্যানাসের পরামর্শে হাত এবং পায়ে তামার মোটা পেরেকগুলো গাঁথা হলো এবারে।

সত্যিই, প্রচেষ্টা সার্থক হলো বলা যায়। মাথা নিচে, অতিকায় কোনো তারামাছের মতো হাত-পা ছড়িয়ে থিবেসের প্রধান ফটকের সঙ্গে লটকে থাকলো র‍্যাসফার। পেটের ভেতরের নাড়ি-ভুড়ি উল্টো চাপ দিচ্ছে ফুসফুঁসে, চিৎকার বন্ধ হয়ে গেছে তার। ফুঁপিয়ে শ্বাস টানছে এখন।

একের পর এক অভিশপ্ত আসামীদের পেরেক-গাঁথা করা হলো প্রধান ফটকে। হুঙ্কার, চেঁচামেচিতে উন্মাদ হয়ে গেছে জনতা। শুধুমাত্র বাস্তির গলা থেকে কোনো আওয়াজ বেরুলো না; নিষ্ঠুর বাস্তি বলে দুর্নাম আছে তার।

দিন গড়িয়ে চললো। তপ্ত সূর্য প্রখর রৌদ্র বিতরণ করলো ক্রুশবিদ্ধ আসামীদের। শেষ বিকেল নাগাদ ব্যথা, তৃষ্ণা আর রক্ত ক্ষরণে এতো দুর্বল হয়ে পড়লো তারা, জীবনের চিহ্ন পর্যন্ত টের পাওয়া গেলো না। উৎসাহ হারিয়ে যে যার পথে চলে গেলো জনতা। সারাদিন টিকে রইলো বাস্তি। ঠিক যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে, শেষবারের মতো কেঁপে উঠে শ্বাস নিয়ে নিথর হয়ে গেলো তার দেহ।

সবার চেয়ে বেশি সময় ধরে বেঁচে রইলো র‍্যাসফার। গাঢ়, কালচে রক্ত এসে জমা হয়েছে তার মুখে, স্বাভাবিকের প্রায় দ্বিগুন আকৃতি পেয়েছে। কলিজার রঙের জিহ্বা ঠোঁটের ফাঁক গলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কিছু সময় পর পরই জান্তব একটা আওয়াজ বেরুলো তার গলা চীরে, কেঁপে উঠে খুলে যেতে লাগলো চোখ দুটো। ঠিক যতোবার ওরকম করলো র‍্যাসফার, ওর যন্ত্রণা বুঝতে পারলাম আমি। ঘৃণার শেষ বিন্দুটুকুও বহু আগেই নিঃশেষিত হয়েছে আমার, করুণায় ভরে গেলো ভেতরটা, ঠিক কোনো নির্যাতিত জন্তুর প্রতি যেমন করুণা বোধ করে মানুষ।

অনেক আগেই চলে গেছে জনতা। একা আমি বসে আছি দর্শক হয়ে। রাজার নির্দেশে এহেন বর্বর দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বলে খেদ প্রকাশে কোনো কমতি করলো না ট্যানাস,–সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিজের অবস্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। শেষমেষ অধঃস্তন একজন যোদ্ধাকে পাহারায় রেখে প্রস্থান করলো ট্যানাস।

এখন প্রধান ফটকের নিচে জনা দশ প্রহরী, আমি আর কয়েকজন ভিক্ষুক-ভবঘুরে ছাড়া কেউ নেই। ফটকের দুই পাশে জ্বালানো মশালের আলো থেকে থেকে নিভু নিভু হয়ে যাচ্ছে নদী থেকে আসা দমকা বাতাসে, ভয়াল দৃশ্যের উপর ভূতুরে আলো ছড়াচ্ছে ।

আবারো গুঙ্গিয়ে উঠলো র‍্যাসফার। এবারে আর সহ্য করা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। সঙ্গে করে নিয়ে আসা থলে থেকে সুরার পাত্র বের করে ট্যানাসের অধঃস্তন সৈনিকের উদ্দেশ্যে এগোলাম। সেই মরুর লড়াইয়ের সময় পরিচয় হয়েছিলো এর সঙ্গে, আমার অনুরোধ শুনে ক্লিষ্ট হেসে মাথা নাড়লো সে, তুমি একটা নরম মনের বোকা মানুষ, টাইটা। অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে বদমাশটা, ওকে নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। বললো সৈনিক। ঠিক আছে। কিছু সময়ের জন্যে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকবো আমি, কী করবে, করো। কিন্তু তাড়াতাড়ি।

প্রধান ফটকের কাছে হেঁটে গেলাম আমি। র‍্যাসফারের মাথা এখন আমার মাথার সমানে ঝুলছে। নরম স্বরে তার নাম ধরে ডেকে উঠতেই কেঁপে খুলে গেলো চোখ দুটো। জানি না, কতটুকু কি বুঝলো সে, আমি বললাম, সামান্য একটু মদ আছে আমার কাছে।

শুষ্ক গলায় ঢোক গেলার চেষ্টা করলো র‍্যাসফার। চোখ দুটো আমাকেই দেখছে। যদি এখনো অনুভব শক্তি থেকে থাকে তার, তো তৃষ্ণায় দারুন কষ্ট পাচ্ছে। ধীরে, কয়েক ফোঁটা করে মদ ঢেলে দিতে লাগলাম র‍্যাসফারের শুষ্ক জীভে, একটি ফোঁটাও যেনো নাকে না ঢোকে, সেদিকে লক্ষ্য রাখলাম। দুর্বল ভঙ্গিতে গিলতে চাইলো সে, কিন্তু কারো পক্ষেই ব্যাপারটা সম্ভব হতো না, এমনকি ভয়াল র‍্যাসফারের জন্যেও না; পানিটুকু ঠোঁটের কোণ বেয়ে গড়িয়ে ময়লা চুলের জটে হারিয়ে গেলো।

বন্ধ হয়ে গেলো র‍্যাসফারের চোখ, এর অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। পশমের চাদরের ভেতর থেকে ছুরিটা বের করে হাতে নিলাম, ধীরে বর্বরটার কানের পেছনে ফলাটা নিয়ে সোজা হাতল পর্যন্ত সেঁধিয়ে দিলাম ওটা। শেষ যন্ত্রণায় বাঁকা হয়ে গেলো র‍্যাসফার, এরপর শিথিল হয়ে গেলো দেহ। টেনে ছুরি বের করতে সামান্য একটু রক্ত বেরুলো। চাদরের ভাজে ওটা লুকিয়ে চলে যাওয়ার জন্যে ঘুরলাম আমি।

স্বর্গের সুখ-স্বপ্ন দেখে ভালো করে ঘুমাও, টাইটা, প্রহরী যোদ্ধা ডেকে উঠলো পেছন থেকে। গলায় স্বর নেই আমার, কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। কখনো ভাবিনি, র‍্যাসফারের জন্যে কাঁদবো; হয়তো তা করিও নি। হয়তো নিজের জন্যেই কেঁদেছিলাম সেদিন, কে বলতে পারে?

*

ফারাও এর ঘোষণায় গজ-দ্বীপে আমাদের ফিরতি যাত্রা প্রাথমিকভাবে এক মাসের জন্যে পিছিয়ে গেলো। নতুন সম্পদে মোহাবিষ্ট রাজা দারুন ঘোরে আছেন। কখনো তাঁকে এতেটা তৃপ্ত, সন্তুষ্ট হতে দেখিনি। বুড়ো মানুষটাকে ততদিনে ভালো লাগতে শুরু করেছে আমার। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে তার সাথে মাঝে মধ্যে সম্পদের তালিকা তৈরি করতে সহযোগীতা করলাম লিপিকারদের।

অন্যান্য সময়ে, সমাধি-মন্দির এবং রাজ-সমাধির বিভিন্ন অংশের নকশার পরিবর্তন নিয়ে আমার পরামর্শ চাইলেন ফারাও। এখন যেহেতু নতুন সম্পদ উদ্ধার করা হয়েছে, খরচ বাড়লেও তাতে আপত্তি নেই তার। হিসাব করে দেখলাম, উদ্ধারকৃত সম্পদের প্রায় অর্ধেকই চলে যাবে নতুন নকশার সমাধিতে। ইনটেফের স্বর্ণালঙ্কার থেকে বেছে বেছে সেরা পনেরো টাখৃ স্বর্ণ পাঠানো হলো সমাধি-মন্দিরের স্বর্ণকারদের; ওগুলোকে সমাধি-সজ্জার কাজে লাগাবেন তারা।

সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতে অবশ্য মাঝে-মধ্যে ট্যানাসকে ডেকে পাঠালেন তিনি। তার বাহিনীর সেরা একজন সেনাপতি হিসেবে ইতিমধ্যে ট্যানাসকে বিবেচনা করতে শুরু করেছেন ফারাও।

এর কয়েকটি সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। নিম্ন-রাজ্যের ভুয়া ফারাও-এর আক্রমণের হুমকি সব সময়ই আছে। দারুন চাতুরতার সাথে এই ভয় কাজে লাগালো ট্যানাস; ফারাওকে ইনটেফের চুরি করা ধন-সম্পদ থেকে ছোট্ট একটা অংশ ব্যয় করে পাঁচটি নতুন যুদ্ধ গ্যালি তৈরি করিয়েছিলো সে, নতুন অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত করেছিলো। প্রহরীদের। যোদ্ধাদের বেতন চুকিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তার অনুরোধ রেখেছিলেন ফারাও। প্রায় অর্ধ-বছর পেরিয়ে গেছে, তখনো বেতন পায়নি অনেক যোদ্ধা। এই প্রাপ্তিতে তাই দারুন খুশি হলো তারা, বিলক্ষণ বুঝলো, কার প্ররোচনায় বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ফারাও। তাই যখনই ট্যানাস পরিদর্শনে আসতো, সিংহের মতো গর্জন করে, হাত উঁচিয়ে সালাম জানিয়ে নিজেদের কৃতজ্ঞতা আর আনুগত্য প্রদর্শন করতে তারা।

যখনই কোনো কারণে রাজসভায় ট্যানাসের উপস্থিতি ঘটতো, কোনো না কোনো অজুহাতে লসট্রিস থাকতো সেখানে। অবশ্য, পর্দার আড়ালেই থাকতো সে, তবে মাঝে-সাজে তার এবং ট্যানাসের দৃষ্টি বিনিময় ঘটলে কেবল আমি টের পেতাম, কতোটা আবেগ লুকিয়ে আছে ওই দৃষ্টিতে।

যদি লসট্রিস জেনে ফেলতো, ট্যানাসের সাথে ব্যক্তিগত কোনো কারণে দেখা হবে আমার আবেগপূর্ণ, বিশাল বার্তা পাঠাতো সে। ফিরতি পথে আবার একই রকমের বড়ো উত্তর নিয়ে আসতাম, ট্যানাসের পক্ষ থেকে। অবশ্য একই কথাই বারবার বলতো দু জনেই মনে রাখতে খুব একটা সমস্যা হতো না আমার।

যে কোনো অযুহাতে আবার ট্যানাস এবং তার একান্তে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্যে আমাকে খুব করে বলতো মিসট্রেস। ওর নিজের এবং অনাগত সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে; সবচেয়ে বড়ো কথা, নিজের চামড়া বাঁচানোর তাগিদে ওদের দু জনের দেখা করানোর ব্যাপারে সম্মত হলাম না আমি। ট্যানাসকে একবার এ নিয়ে দোনোমনো করে কী একটা বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়লো সে, ট্রাস-এর গোরস্থানের সেই মিলন ছিলো পাগলামী, টাইটা। কখনোই রাজ-পত্নীর অসম্মান করা আমার উদ্দেশ্যে ছিলো না, কিন্তু ওই খামসিন ওটার কারণে…। আবারো সেই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। ওকে বলো, নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি আমি ওকে। বলো, সারাজীবন ওর অপেক্ষায় থাকবো।

এমন ভালোবাসার বার্তা পেয়েও আমার মিসট্রেস রাগে মাটিতে পা ঠকতো, বলতো, তার প্রিয়তম মূলত একটা একরোখা মূর্খ, কোনোদিকেই কোনো খেয়াল নেই তার। এক-দুটা পাত্র ভেঙে, রাজার উপহার দেওয়া সাজ-সজ্জার আয়না পানিতে ছুঁড়ে ফেলে শেষমেষ বিছানায় পড়ে রাতের খাবার সময় অবধি কাঁদতো সে।

*

যুদ্ধ গ্যালি তৈরি পরিদর্শনের সামরিক দায়িত্বের বাইরে আজকাল আরো একটি কাজ করে ট্যানাস; উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির দেখভাল সেটি।

এই বিষয়ে প্রায় প্রতিদিন আমার সঙ্গে পরামর্শ করে সে। যেহেতু, সম্পত্তিগুলো এতোকাল ইনটেফের দখলে ছিলো, ওতে শ্রাইকদের হাত পড়েনি। কাজেই রাতারাতি উচ্চরাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনবান ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছে ট্যানাস। আমার শত বাধা সত্ত্বেও নিজের বাহিনীর লোকেদের ভরণ-পোষণ আর অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত করার পেছনে বেশিরভাগ সম্পদ ব্যয় করতে লাগলো সে। এই উদারতার জন্যে মিশরীয় সেনাবাহিনীতে দারুন সম্মানের স্থান পেলো সে।

কেবল এ-ই নয়, আসতেস, রেমরেম এবং ক্ৰাতাসকে পাঠিয়ে বিগত সমস্ত নদীপথের যুদ্ধে আহত, পঙ্গু, অন্ধ যোদ্ধা থিবেসের পথে পথে ভিক্ষা করে বেঁচে থাকাই হয়ে পড়েছে যাদের নিয়তি, তাদের বরণ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলো ট্যানাস। উপত্যকার উপরে, নিজের মালিকানাধীন এলাকায় তাদের জন্যে আশ্রম করে ভালো খাওয়া-দাওয়া আর পানীয়ের বন্দোবস্ত করলো সে। থিবেসের রাস্তায় রাস্তায়, অলিতে-গলিতে তার সুস্বাস্থ্য কামনা করে পান করতে লাগলো সাধারণ জনতা, সৈনিক।

আমার কর্ত্রীকে ট্যানাসের এহেন বাড়াবাড়ির কথা বলতেই, দারুন উৎসাহিত হয়ে নিজের হাজার ডেবেন অর্থ ব্যয় করে বিভিন্ন ভবনে গরিবের জন্যে আশ্রয়কেন্দ্র আর হাসপাতাল নির্মাণে লেগে পড়লো সেও। যতোই বললাম, এ ঠিক হচ্ছে না, পাত্তাই দিলো না লসট্রিস।

বলার অপেক্ষা রাখে না, কীর এই নতুন পাগলামী পালন করার জন্যে ছুটোছুটির বেশিরভাগটাই করতে হলো দাস টাইটাকে; অবশ্য লসট্রিস নিজে প্রতিদিন পরিদর্শন করতো এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো। কাজেই, থিবেসের কোনো ভিক্ষুক, মাতালের জন্যে একবেলা ভালো আহার করা কোনো ব্যাপারই ছিলো না সেই সময়ে। আর, অনেক সময় তো আমার কী নিজ হাতে আহার, পানীয় বিলাতেন। অসুস্থ লোকগুলোর পঁচা ক্ষত চিকিৎসায় আমাদের এই মিশরের সেরা চিকিৎসক তার হাত লাগালো।

এমন কয়েকজন লিপিকার আর পুরোহিতের খোঁজ পেলাম আমি, যারা টাকা বা দেবতাদের চেয়ে মানুষকে বেশি ভালোবাসেন। তাদেরকে চাকরিতে নিয়ে নিলো আমার কর্ত্রী। রাতে, শহরের গলি-ঘুপচি আর পথে পথে ঘুরে ফিরতাম আমরা, রাস্তার এতিম ছেলেমেয়েদের কুড়িয়ে নিতাম। বন্য বেড়ালের মতোই আঁচড়ে-কামড়ে তবেই আমাদের সাথে আসতে সম্মত হলো তারা।

আমার কর্ত্রীর নতুন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর একটিতে রাখার বন্দোবস্ত করা হলো তাদের। ওখানে, পুরোহিতেরা ধৈর্য্যের সাথে শিক্ষাদানে নিয়োজিত হলেন। লিপিকারেরা শেখাতে লাগলেন পড়াশোনার প্রথম পাঠ। বেশিরভাগ শিশুই পাঁচদিনের মধ্যে পালিয়ে গেলো; নিজেদের দুর্গন্ধময় আস্তাকুঁড় তাদের কাছে বড়ো বেশি আরাধ্য। কিন্তু কিছু ছেলেমেয়ে রয়ে গেলো। প্রায় জন্তু থেকে মানুষে ধীরে উত্তরণ ঘটতে লাগলো তাদের; দারুন আনন্দে যেনো পাগল হয়ে গেলো লসট্রিস।

বলার অপেক্ষা রাখে না, বিধবা আর পঙ্গু লোকগুলো হাত তুলে আমার মিসট্রেসকে আশীর্বাদ করতো। বুনো ফুল, সস্তা রুটি, ছেঁড়া প্যাপিরাসে মৃতের পুস্তক থেকে বিভিন্ন উদ্ধৃতি লিখে তাকে উপহার হিসেবে দিতো তারা। যখন হেঁটে যেতো লসট্রিস, সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ওর ছোঁয়া পেতে চাইতো তারা; যেনো একটু ছোঁয়া তাদের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেবে। ময়লা শিশুদের চুমো খেতো সে, আমি সতর্ক করে দিয়েছিলাম, ওটা স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর; তামার মুদ্রা বৃষ্টির মতো বর্ষণ করতো সে ওদের মাঝে।

এটা আমার নগরী, আমাকে বলেছিলো লসট্রিস, একে, এর প্রতিটি লোককে আমি ভালোবাসি। ওহ টাইটা, গজ-দ্বীপে ফিরতে হবে ভাবলে খুব খারাপ লাগছে। এই থিবেস ছাড়া কোথাও ভালো লাগে না আমার।

সত্যিই কী এই শহর ছাড়তে খারাপ লাগবে তোমার? আমি জানতে চাইলাম, নাকি, এখানে বসবাসকারী কোনো এক মূর্খ সৈনিককে ছেড়ে যেতে? হেসে উঠে আমাকে চড় কষালো ও।

কিছুই কি তোমার কাছে পবিত্র বলে মনে হয় না? এমনকি, সত্য-শুভ্র প্রেমও নয়? যতোই ওই স্ক্রোল লেখো আর ভালো ভালো কথা বলো ভেতরে ভেতরে তুমি একটা বর্বর!

*

দিনগুলো দ্রুত কেটে যেতে লাগলো আমাদের সবার জন্যে। হঠাৎই একদিন দিনপঞ্জি হিসাব করে দেখি, ফারাও-এর শয্যাপাশে লসট্রিস যাওয়ার পর দুই মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। যদিও ওকে দেখে এখনো কিছু বোঝার কোনো উপায় নেই, ফারাওকে তাঁর আসন্ন পিতৃত্বের সুসংবাদ দেওয়ার সময় এসে গেছে। যখন লসট্রিসকে জানালাম এ কথা, শুধু একটা ব্যাপারেই মনোযোগী হয়ে উঠলো সে। প্রথমেই আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিলো, ফারাওকে জানানোর আগে আমি যেনো ট্যানাসের সাথে কথা বলে তাকে জানাই, অনাগত সন্তানের প্রকৃত পিতা সে-ই। সেই বিকেলেই কাজে নেমে পড়লাম। নদীর পশ্চিম তীরে, জাহাজ তৈরির কারখানায় ট্যানাসকে খুঁজে পেতে দেখি, কাজে ভুল হলে শ্রমিকদের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে কুমীরের খাদ্য বানানোর হুমকি দিচ্ছে সে। অবশ্য, আমাকে দেখতে পেয়ে রাগ কমলো ওর, সেই সকালেই পানিতে নামা নতুন একটা গ্যালির উপরে গিয়ে বসলাম আমরা। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হলে কী করে পাটাতনের উপর থেকে পাম্পের সাহায্যে পানি নেমে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে গর্বের সাথে আমাকে দেখালো ট্যানাস। ও সম্ভবত ভুলেই গেছে, আমি নিজে সেই যন্ত্রের নকশা প্রস্তুত করেছিলাম; শেষমেষ চাতুর্যের সাথে মনে করিয়ে দিতে হলো।

পরে দেখা যাবে, নিজের পরিকল্পনার জন্যে আমার কাছে অর্থ চাইছো তুমি, বুড়ো বন্ধু। কসম, তুমি একেবারে সিরিয় বণিকদের মতোই ধূর্ত। আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে পাটাতনের শেষ মাথায় নিয়ে গেলো ট্যানাস, ওখান থেকে যোদ্ধারা আমাদের কথা শুনতে পাবে না। গলা নামিয়ে বললো, তোমার কর্ত্রীর কী খবর? গতরাতে স্বপ্নে দেখেছি তাকে। ভালো আছে তো সে? আর, ওর এতিম সন্তানগুলোর কী খবর? কতো সুন্দর ওর মন, দেখেছো! থিবেসের সবাই ওকে ভালোবাসে। যেখানেই যাই, কেবল ওর নাম শুনি। সত্যি, যেনো বর্শার মতো আমার বুকে বিধে ওই নাম!

খুব শীঘ্রই একটি নয়, দুটো নাম পাবে ভালোবাসার জন্যে, বললাম আমি। বিস্ময়ে অভিভূত ট্যানাস হা হয়ে চেয়ে থাকে আমার পানে। খামসিনের রাতে, ট্রাস এর সমাধিতে আরো বেশি কিছু ঘটেছিলো হে!

এতো জোরে আমাকে জড়িয়ে ধরলো ট্যানাস, আর একটু হলে দম বন্ধ হয়ে মারা পড়তাম। এ কি কোনো ধাঁধা? পরিষ্কার করে বলো, না হয় পানিতে ছুঁড়ে ফেলবো! কী বলছো, বুড়ো বন্ধু? শব্দের খেলা খেলো না আমার সাথে!

লসট্রিস তোমার সন্তার বহন করছে পেটে। ও পাঠিয়েছে আমাকে, তুমিই প্রথম ব্যক্তি যে এই কথা জানলো, এমনকি রাজারও আগে। মুখ খুলে শ্বাস নিলাম আমি। এবারে ছাড়ো আমাকে! না হয় মরে যেতে পারি! হঠাৎই ছেড়ে দিতে আর একটু হলে পড়ে গিয়েছিলাম।

আমার সন্তান! আমার ছেলে! ফুঁপিয়ে উঠলো ট্যানাস। কী আশ্চর্য, ওরা দু জনেই জন্মের আগেই সন্তানের লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে এতোটা নিশ্চিত ছিলো! এ যে অত্যাশ্চর্য ঘটনা! হোরাসের উপহার ও!

আমার ছেলে! বোকার মতো হাসছিলো সে। আমার নারী আর আমার ছেলে। এখনি ওর কাছে যাবো আমি! পাটাতন ধরে রওনা হলো সে, দৌড়ে পেছন থেকে গিয়ে ধরলাম। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আটকে রাখলাম ওকে, না হয়, একছুটে প্রাসাদের হারেমে গিয়ে থামতো। শেষমেষ, ট্যানাস শান্ত হতে বন্দরের কাছেই একটা পানশালায় গেলাম দুজনে। আগে থেকেই নীল বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য ছিলো সেখানে, তাদের সবাইকে মুফতে পানাহারের ঘোষণা করলো ট্যানাস।

মদ্য পান শেষ হতে সরাসরি প্রাসাদে চললাম আমি। আমাকে দেখে যার-পর নাই আনন্দিত হলেন ফারাও। এখনি তোমাকে খুঁজতে লোক পাঠাচ্ছিলাম, টাইটা। আমার ধারণা, সমাধি-মন্দিরের দরোজাটা একটু রাজকীয় হলে ভালো হয়

ফারাও! চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। মহান, পবিত্র মিশর! দারুন সুখবর আছে আমার কাছে! দেবী আইসিস তার প্রতিজ্ঞা রেখেছেন! আপনার বংশধারা চির অমর। আমন রার ইন্দ্রজাল সত্যি হতে চলেছে। আমার কর্ত্রীর রজঃচক্র মিশরীয় সঁড়ের খুঁড়ের ঘায়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তার পেটে এখন আপনারই সন্তান!

অন্তত একবারের জন্যে হলেও সমাধি-মন্দিরের সমস্ত চিন্তা ফারাও-এর মন থেকে সরে গেলো। ঠিক ট্যানাসের মতোই, তার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিলো লসট্রিসের কাছে ছুটে যাওয়ার। রাজার নেতৃত্বে প্রাসাদের গলিপথ ধরে ছুটলাম আমরা; সভাষদ, মহপ্রাণ সবাই যেনো নীলের অপ্রতিরোধ্য এল-প্রবাহের মতো ছুটছি। হারেমের বাগানে অপেক্ষায় ছিলো লসট্রিস। নারী চরিত্রের ধূর্ততার পরিচয় দিয়ে দারুন সুন্দর করে সেজেছে সে। চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে ফুলের সমারোহ; তারই মাঝে উঁচু একটা ঢিবিতে বসেছিলো ও, পেছনে চিরবহতা নীল নদ। একবার মনে হলো, রাজা হয়তো ঝুঁকে আদর করবেন ওকে, কিন্তু এমনকি অমরত্বের হাতছানিও তাকে তার মর্যাদা ভুলিয়ে দিলো না।

বদলে, শুভেচ্ছা আর প্রশংসার বন্যায় তাকে ভাসিয়ে দিলেন ফারাও। খুব করে খোঁঝ-খবর করলেন তার স্বাস্থ্যের। সর্বক্ষণ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রইলো লসট্রিসের পেটে, যেখানে লুকিয়ে আছে তার অমরত্বের চিহ্ন। যাওয়ার আগে জানতে চাইলেন, প্রিয়, নিজের সুখের জন্যে আর কিছু কি আছে, যা তোমার প্রয়োজন? এই সময়ে তোমার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে কিছু কী করার আছে আমার?

আবারো, আমার কর্ত্রীর জন্যে গর্বে ভরে গেলো বুকের ভেতরটা। মূলত, তার সময়জ্ঞান এতো প্রখর ছিলো, ইচ্ছে করলেই বিজ্ঞ সমরনায়ক না হয় শস্য-বণিক হতে পারতো ও। সম্মানিত ফারাও, বললো লসট্রিস, থিবেস আমার জন্মের স্থান। মিশরের আর কোথাও এতোটা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পাই না, যতোটা এখানে পাই। আপনার উদারতা আর বিচক্ষণতার প্রতি আমার আস্থা আছে; আমি চাই আপনার সন্তান এই থিবেসেই জন্ম নিক। দয়া করে গজ-দ্বীপে ফিরে যেতে বলবেন না আমাকে।

শ্বাস আটকে ফেললাম আমি। এক শহর থেকে অন্য শহরে পুরো রাজসভা পরিবর্তন কোনো চাট্টিখানি কথা নয়। মাত্র ষোলো বছর বয়সী কোনো নারীর অনুরোধে এমনটি ঘটে না প্রতিদিন।

এমন অনুরোধে যেনো বিস্ময়াভূত হয়ে পড়লেন রাজা; কিছু সময় নকল দাড়িতে হাত চালালেন। তুমি থিবেসে বসবাস করতে চাও? ঠিক আছে, তবে তাই হোক! এখন থেকে রাজসভা থিবেসে বোসবে! এরপর আমার দিকে ফিরলেন ফারাও। টাইটা, নতুন একটি প্রাসাদের নকশা করো। মিসট্রেসের দিকে ফিরে যোগ করলেন, পশ্চিম তীরে হলে কেমন হয়, প্রিয়তমা? নদীর ওপারে আঙুল তুলে নির্দেশ করলেন তিনি।

মাথা নেড়ে সায় দেয় লসট্রিস।

তাহলে পশ্চিম তীরেই হবে প্রাসাদ। টাইটা, নকশা যেনো অসাধারণ হয়। ফারাও-এর পুত্রের বাসস্থান যেনোতেনো ভাবে করলে হবে না। আমি ওর নাম দিলাম মেমনন–প্রভাতের শাসক! ওই প্রাসাদ হবে মেমননের প্রাসাদ।

এইভাবেই, সামান্য দু একটি কথায় আমার উপর গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দিলো লসট্রিস। পেটের বাচ্চার দোহাই দিয়ে সেই থেকে এটা-ওটা নানান কিছু রাজার কাছে আবদার করে হাসিল করতো সে। এরপর থেকে লসট্রিসের কোনো ইচ্ছেতেই অমত করেননি ফারাও; তা সে ওর প্রিয়জনকে সম্মানিত পদ বা উপাধি দেওয়া হোক বা ওর আশ্রয়ে থাকা কাউকে আর্থিক সাহায্য প্রদানই হোক। দুষ্ট কোনো বাচ্চার মতোই নিজের এই হঠাৎ পাওয়া ক্ষমতার পরিধি পরীক্ষা করে দেখছিলো সে।

কখনো তুষার দেখেনি লসট্রিস। অবশ্য, আমার ফিকে হয়ে আসা স্মৃতি থেকে এ সম্পর্কে শুনছে সে। পাহাড়ি এলাকায় জন্মেছিলাম আমি। তো, নীলের তপ্ত উপত্যকায় গরমে অতিষ্ট হয়ে তুষারের ঠাণ্ডা অনুভব করার খায়েশ হলো লসট্রিসের। সাথে সাথেই বিশেষ একটি শরীর কসরৎ প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন ফারাও। উচ্চ-রাজ্যের দ্রুততম একশ দৌড়বিদ অংশগ্রহণ করবে সেই প্রতিযোগীতায়। আমার নকশা করা একটি বিশেষ বাক্সে করে সেই সিরিয়া থেকে তুষার নিয়ে আসতে হবে তাদের। সম্ভবত লসট্রিসের অপূর্ণ মনোবাঞ্ছণা কেবল এটিই ছিলো, কেননা, সেই দূর দূরান্ত থেকে যখন ফিরে এলো তারা বাক্সে কেবল সামান্য ভেজা ভাব ছাড়া আর কিছুই নেই।

অন্য সমস্ত ক্ষেত্রে তার ইচ্ছেমতো হয়েছিলো সব কিছু। একবার, ট্যানাস যখন মিশরীয় নৌবাহিনীর বিন্যাস নিয়ে রাজার সাথে কথা বলছিলো, লসট্রিস উপস্থিত ছিলো সেখানে। ট্যানাসের বক্তব্য শেষ হওয়া পর্যন্ত পর্দার অন্তরালেই রইলো সে; অবশেষে, ট্যানাস চলে যেতে নরম স্বরে মন্তব্য করলো, আমি শুনেছি, আমাদের সেনাপতিদের মধ্যে ট্যানাস শ্রেষ্ঠ বীর। তাকে মিশরের সাহসী সিংহ উপাধিতে ভূষিত করে উত্তর বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করাটা কি যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন, মহান ফারাও? আবারো, তার এহেন বাড়াবাড়ি মন্তব্যে শ্বাস আটকে ফেললাম আমি। ফারাও অবশ্য চিন্তাযুক্তভাবে মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

একই কথা আমার চিন্তাতেও এসেছে, প্রিয়তমা। যদিও এমন গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য তার বয়সটা বেশি কম হয়ে যায়।

পরদিন, রাজসভায় ডেকে পাঠানো হলো ট্যানাসকে। সেই দিনই, মিশরের সাহসী সিংহ উপাধি এবং উত্তর মিশরীয় বাহিনীর প্রধান নির্বাচিত হলো সে। তার পূর্ববর্তী বৃদ্ধ সেনাপ্রধানকে উপযুক্ত সম্মান এবং ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করে অব্যহতি দেওয়া হলো। এখন ট্যানাসের কতৃত্বে রয়েছে তিনশো যুদ্ধ গ্যালি আর প্রায় ত্রিশ হাজার যোদ্ধা। এই পদোন্নতির ফলে নেমবেট এবং আর কয়েকজন মাত্র বৃদ্ধ সেনাপতির পরেই রইলো ট্যানাসের অবস্থান।

লর্ড ট্যানাস একজন গর্বিত মানুষ, লসট্রিস জানালো আমাকে, যেনো আমি তাকে চিনিই না। তার পদোন্নতির পেছনে আমার হাত আছে–এ কথা যদি কখনো তাকে বললো তুমি, সাথে সাথেই প্রথম সিরিয় বণিকের কাছে তোমাকে বিক্রি করে দেবো খন!

এই সময়ে প্রায় প্রতি দিনই একসময়ের মসৃণ, সুন্দর পেটটা বড়ো হতে লাগলো লসট্রিসের। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মতো এর খবরও প্রতিদিন শুধু ফারাওকে নয়, উত্তর মিশরীয় বাহিনীর প্রধানকেও জানাতে হলো আমাকে।

*

ফারাও-এর নির্দেশের পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে মেমনন প্রাসাদের নির্মাণকাজ আরম্ভ করলাম আমি। এতোটা সময় চূড়ান্ত নকশা তৈরির জন্যে ব্যয় হলো। রাজা এবং আমার কর্ত্রী দু জনেই এক বাক্যে স্বীকার গেলো, আমার নকশা তাদের প্রত্যাশার চাইতেও ভালো হয়েছে। মিশরের বুকে এটাই হবে শ্রেষ্ঠ বাসস্থান।

যেদিন কাজ শুরু হলো, সেদিনই লাল-ফারাও-এর বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে উত্তর থেকে আসা জাহাজ নোঙর করলো থিবেসে। বিব্লস থেকে সিডার কাঠ নিয়ে এসেছে ওটা। জাহাজের অধিনায়ক আমার বন্ধু মানুষ; সে জানালো তার কাছে নাকি আমার জন্যে খবর আছে।

প্রথমত, সে বললো, ইনটেফকে গাঁজায় দেখা গেছে। বহু দেহরক্ষি সমেত পুবের উদ্দেশ্যে চলছিলেন তিনি। নিঃসন্দেহে সেক্ষেত্রে সিনাই মরু পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছেন; অথবা, নীল নদের মুখ বরাবর সামনে এগোনোর জন্যে কোনো জাহাজের সাহায্য পেয়েছিলেন, সাগরের তীর ঘেঁষে এরপর পুবে এগিয়েছেন।

আরো কিছু খবর ছিলো জাহাজীর কাছে, যা সেই মুহূর্তে খুব একটা গুরুত্ববহ মনে হয়নি; কিন্তু আমাদের এই মিশর এবং যারা নীল নদের তীরে এই দেশে বাস করে, তাদের সবার ভাগ্য পাল্টে দিয়েছিলো সেই সংবাদ। উড়ো সংবাদে জানা গেছে, সিরিয়ার পূবে কোনো এক অজানা স্থান থেকে যুদ্ধবাজ একটা গোত্র মিশরের দিকে আসছে। কেউই এদের সম্পর্কে সঠিক করে কিছু বলতে পারলো না; তবে তারা নাকি বিশেষ এক ধরনের যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করেছে, যা আগে কেউ কখনো দেখেনি। বিশাল দূরত্বে এক লহমায় পেরিয়ে যেতে পারে তারা, পৃথিবীর কোনো সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কিছুই নয়।

আমাদের মিশরে এ ধরনের গুজবের খুব প্রচলন ছিলো, সব সময়ই কোনো না কোনো বাহিনীর আক্রমণের কথা শুনে আসতাম আমরা। এর আগেও প্রায় পঞ্চাশবার এর ধরনের কথা শুনেছি আমি–একটুও পাত্তা দিলাম না। তবে, সেই জাহাজী অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য লোক ছিলো, তাই পরবর্তী সাক্ষাতে এই সংবাদটা ট্যানাসকে জানালাম আমি।

কোনো বাহিনীই এই রহস্যময় দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না? ট্যানাস হাসে। আমার যোদ্ধাদের সাথে লেগে দেখুক, পরাজয়ের স্বাদ নিতে দেরি হবে না। কি বললে, কী নাম এদের?

শোনা যায়, তারা নাকি নিজেদের রাখাল-রাজা বলে ডাকে, উত্তরে আমি বললাম। হিকসস্। যদি তখন আমি বুঝতাম, আমার উচ্চারিত ওই শব্দ পুরো পৃথিবীকে নাড়া দেবে, তবে হয়তো অতোটা সহজভাবে উচ্চারণ করতাম না।

রাখাল, হুম? ঠিক আছে, আমার যোদ্ধারা এতো সহজে চড়াবার মতো কোনো জন্তু নয়। এ বিষয়ে শেষ কথা বলে দিয়ে ইনটেফের খবরে আগ্রহ দেখালো ট্যানাস। যদি তার অবস্থানের সঠিক খোঁজ-খবর পেতাম, লোক পাঠিয়ে ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করা যেতো। আজকাল মনে হয়, বাবার আত্মা আমার সঙ্গে আছে। তার হয়ে প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।

এতো সহজ নয়, মাথা নেড়ে বললাম, মরুর শেয়ালের মতোই ধূর্ত ইনটেফ। আমার মনে হয়, মিশরে আর কখনো তার টিকিটিরও দেখা মিলবে না। জানি না, আমার এই কথায় হয়তো অন্ধকারের দেবতারা মুচকি হেসেছিলেন তখন।

*

আমার কর্ত্রীর গর্ভাবস্থা এগিয়ে যেতে ওর স্বাধীন চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলাম আমি। হাসপাতাল বা আশ্রমগুলোতে ওর যাওয়া বন্ধ করতে হলো, পাছে অনাগত সন্তানের নাজুক শরীরে কোনো অসুখ ছড়িয়ে পরে। রাজ-উজিরের জন্যে জলবাগানে যে বারাঙ্খা তৈরি করেছিলাম, দিনের গরমের সময়টাতে ওখানে বিশ্রাম নিতে বললাম লসট্রিসকে। এ ধরনের অলস জীবনযাত্রায় ও বিরক্ত হয়ে যেতে বাদকদল পাঠিয়ে দিলেন ফারাও; বাগানে সুর বাজিয়ে লসট্রিসের মনোরঞ্জনে ব্যাপৃত হলো তারা। মেমননের প্রাসাদের নির্মাণ কাজ ফেলে রেখে আমাকে সারাদিন ওর পাশে বসে থাকতে হলো; গল্প-কথা, ট্যানাসের সর্বশেষ বীরত্ব ইত্যাদি নানান বিষয়ে তার আগ্রহের কোনো শেষ নেই।

লসট্রিসের খাবার নিয়ে বিশেষ সতর্ক থাকলাম, এক বিন্দু মদও মুখে তুলতে দিলাম না ওকে। তাজা ফলমূল, শাক-সবজি খেতে দিয়ে সমস্ত চর্বিযুক্ত খাবার বর্জন করলাম। জানি, ওতে করে পেটের বাচ্চাটা থলথলে হবে। নিজ হাতে ওর খাবার প্রস্তুত করতাম আমি, প্রতিরাতে শোবার আগে বিশেষ শক্তি বর্ধক মিশ্রণ খাইয়ে দিতাম–এতে করে পেটের শিশু আরো শক্ত হবে।

যখনই লসট্রিস ঘোষণা করলো, গ্যাজেলের যকৃত এবং বৃক্ক থেকে তৈরি পায়া খাবে সে; অথবা কাঠ বেড়ালীর ঝলসানো মাংস তার মনে ধরেছে, সাথে সাথে একশ শিকারী পাঠিয়ে মরু থেকে ওসব আনার বন্দোবস্ত করলেন ফারাও। ট্যানাসকে অবশ্য লসট্রিসের এ ধরনের বিচিত্র খায়েশের কথা বলিনি আমি, সেক্ষেত্রে হয়তো ভুয়া ফারাও-এর সাথে যুদ্ধ ফেলে রেখে গ্যাজেল শিকারে রওনা হতো উত্তরের বাহিনী।

ওর বাচ্চা হওয়ার সময়কাল এগিয়ে আসতে চিন্তায় রাত জেগে কাটালাম আমি। রাজকুমার জন্মানোর প্রতিশ্রুতি করেছি ফারাওকে; কিন্তু এতো দ্রুত পুত্রের জন্মের আশা করছেন না তিনি। এমনকি, একজন দেবতার পর্যন্ত ওসিরিসের উৎসবের সময়কাল থেকে এখন পর্যন্ত দিনক্ষণ হিসেব করতে পারার কথা। যদি, ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়, কিছুই করবার নেই আমার; কিন্তু অন্তত তাড়াতাড়ি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে তাকে প্রস্তুত রাখতে তো পারি।

ইদানীং গর্ভাবস্থা এবং সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া নিয়ে ফারাও-এর উৎসাহ, মন্দির আর সমাধি নিয়ে মাতামাতিকে ছাড়িয়ে যেতে বসেছে। প্রায় প্রতিদিন তাঁকে অভয় দিয়ে আমাকে বলতে হলো, লসট্রিসের সরু কোমর, সন্তান জন্মানোর পথে কোনো অন্তরায় নয়। এবং, ওর কম বয়স আসলে সন্তান ভূমিষ্ঠের জন্যে উপযোগী।

এই সুযোগে তাকে জানিয়ে রাখলাম, পৃথিবীর তাবৎ বিখ্যাত যোদ্ধা, মহান বীরদের জন্ম সময়ের আগেই হয়েছিলো।

আমার মনে হয়, ম্যাজেস্টি, এ অনেকটা অলস লোকের মতো যারা বহুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থেকে শক্তি, সময়ের অপচয় করে; অন্যদিকে মহান মানুষ মাত্রেই আগে ঘুম ভেঙে উঠেন। আমি লক্ষ্য করেছি, মহান ফারাও, আপনি সূর্যোদয়ের আগেই বিছানা ছাড়েন। কোনো সন্দেহ নেই, আপনি নিজেও সময়ের আগেই পৃথিবীতে চলে এসেছিলেন। আমি অবশ্য জানতাম, ফারাও মোটেও সময়ের আগে জন্মাননি, কিন্তু কিছু বললেন না তিনি। যদি আপনার পুত্র তার পবিত্র পিতাকে অনুকরণ করে একটু আগেই পৃথিবীতে চলে আসে তবে বুঝতে হবে, ওর উপর দেবতাদের আশীর্বাদ রয়েছে। আশা করছি, আমার এই বাগাড়ম্বরে কাজ হয়েছে, কেননা সন্তুষ্ট চিত্তে মাথা দোলালেন ফারাও।

শেষমেষ অবশ্য নির্ধারিত সময়ের পরও দুই সপ্তাহ মায়ের পেটে থেকে আমার কাজ সহজ করে দিলো বাচ্চাটা, আমিও তাড়াতাড়ি ওকে পৃথিবীর আলো দেখানোর কোনো চেষ্টাই করলাম না। এখন, প্রত্যাশিত সময়ের এতো কাছাকাছি চলে এসেছে জন্মক্ষণ, কারো রা করার উপায়টি নেই। অবশ্য, ফারাও-এর কাছে সময়ের আগে জন্মানো বরঞ্চ কাঙ্ক্ষিত হয়ে পড়েছিলো।

এতে বিস্ময়ের কিছু নেই যে আমার কর্ত্রীর গর্ভযন্ত্রণা শুরু হলো সবচেয়ে অদ্ভুত সময়ে। রাতের তৃতীয় প্রহরে পানি ভাঙলো ওর। আমার কাজ সহজ করার মতো কিছু কখনো করেনি সে, এবারেও তার ব্যত্যয় ঘটবে কেনো? এতে করে অবশ্য ওই নোংরা ধাত্রীগুলোর সাহায্য না নেওয়ার উপযুক্ত কারণ পেয়ে গেলাম আমি।

ঘুম ভেঙে জেগে উঠে, গরম মদে হাত ধুয়ে আমার যন্ত্রপাতিগুলো আগুনে শুকিয়ে নিলাম; এই সময় গুঙিয়ে উঠে আমুদে স্বরে লসট্রিস জানালো, একবার একটু দেখো তো, টাইটা। আমার মনে হয়, কিছু একটা ঘটছে ওখানে। একবার তাকিয়েই চেঁচিয়ে দাসী মেয়েগুলোকে ডাকলাম আমি।

তাড়তাড়ি যাও, অলস শয়তানের দল! রাজবধুদের ডেকে নিয়ে এসো!

কোন্ জন?

যে কোনো একজনকে! সবাইকে! যদি জন্মদান প্রক্রিয়া না দেখা হয়, তবে কোনো রাজকুমারই দ্বৈত-মুকুটের উত্তরাধিকার পাবে না।

প্রথমবারের মতো নিজেকে প্রদর্শন করলো শিশুটা, ঠিক এমন সময়ে এলো রাজবধুদের দল। দারুন ব্যথায় মোচড় খেয়ে উঠলো লসট্রিস, মাথা দেখা গেলো বাচ্চার। আমি ভয় করছিলাম, আগুনে-লাল রঙের চুলে মাথা ভরা থাকবে ওর; কিন্তু বাদামি রঙের ঘন চুল দেখে আশ্বস্ত হলাম। পরে অবশ্য, ওগুলোর ডগা থেকে লাল আগুন ঠিকই দেখা দিয়েছিলো কিন্তু সে অনেক পরের কথা।

চাপ দাও! লসট্রিসকে বললাম, জোরে! প্রচণ্ড ব্যথায় দাঁতে দাঁত চেপে সাড়া দেয় সে। ওর কোমরের তরুণ হাড় ফাঁক হয়ে গিয়ে পথ করে দেয় নবজাতককে; পিচ্ছিলকারক যথেষ্ট তরল অবশ্য ছিলো ওখানে। একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় আমার হাতে চলে এলো শিশুটা। গুলতি থেকে ছুটে আসা পাথর খণ্ডের মতো গতিতে আমার হাতে এসে পড়লো ওটা, আর একটু হলে পড়ে গিয়েছিলো পিছলে।

বাচ্চাটাকে ঠিকমতো ধরার আগেই কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে মাথা উঁচালো লসট্রিস, ঘামে ভিজে মাথার সাথে লেপ্টে গেছে মাথার চুল; মুখাবয়বে দারুন উৎকণ্ঠা । ওটা কী ছেলে? বলো আমাকে।

আমাদের পৃথিবীতে নবজাতকের প্রথম কর্ম সম্পাদনের সময় ঝুঁকে এলো কক্ষভর্তি মহিলারা। আমার কড়ে আঙুলের সমান পুরুষাঙ্গ থেকে প্রায় ছাদ ছুঁয়ে দেওয়া ঝর্ণাধারা ছুঁড়ে দিলো রাজকুমার মেমনন ওই নামধারী প্রথম ফারাও। মৃদু গরম সেই জলধারার পথে পড়লাম আমি, একেবারে ভিজে গেলো মুখ।

লসট্রিসের প্রশ্নের জবাবে একযোগে চেঁচিয়ে উঠে রাজবধুরা।

ছেলে! জয় হোক মেমননের! মিশরের রাজকুমারের জয় হোক!

কথা বলতে পারছিলাম না আমি। শুধু যে রাজকীয় সূত্র আমার চোখে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছিলো, তা নয়, স্বস্তি আর খুশির কান্না কাঁদছিলাম। ওদিকে, চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলো মেমনন-রাগে যেনো ফেটে পড়ছে!

হাত-পা নেড়ে এতো জোরে লাথি কষালো ও, আর একটু হলে আমার হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিলো। দৃষ্টি পরিষ্কার হতে একমাথা গাঢ় চুলের, শক্তপোক্ত, গর্বিত মস্তকের ছোট্ট শরীরটা দেখলাম প্রাণ ভরে।

*

উত্তরসূরি প্রাপ্তির গর্বে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন ফারাও। নবজাতকের সম্মানে মুক্ত ভোজের আয়োজন করলেন তিনি। পুরো এক রাত জুড়ে নেচে গেয়ে উৎসব করলো উচ্চ-মিশরের প্রতিটি জনতা। ফারাও-এর দেওয়া মাংস আর মদে ডুবে থেকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ জানালো রাজকুমার মেমননকে। এমননিতেও লসট্রিসকে দারুন ভালোবাসতো তারা, তাই রাজকুমারের প্রতি তাদের অনুভূতি ছিলো স্বতস্ফূর্ত।

এতো তরুণী আর শক্ত মনের ছিলো আমার কর্ত্রী, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ছোট্ট শিশু মেমননকে বুকে নিয়ে জনতার সামনে এলো সে। রাজার নিম্নবর্তী সিংহাসনে উপবিষ্ট লসট্রিসকে সত্যিই অপরূপ দেখাচ্ছিলো। যখন বাচ্চা কোলে নিয়ে একটা দুধের বোঁটা এগিয়ে দিলো সে, ছোট্ট রাজকুমার মুখে নিতে চাইলো ওটা। এতো জোরে আওয়াজ করে উঠলো আনান্দাচ্ছল জনতা, থুতু মেরে মুখ সরিয়ে নিয়ে ভীষণ চিৎকার জুড়ে দিলো সে। সাথে সাথে নিজেদের বুকে রাজকুমারকে জায়গা দিয়ে দিলো উপস্থিত জনতা।

সে একটা সিংহ, তারা ঘোষণা করলো। যোদ্ধা আর রাজার রক্ত বইছে ওর শরীরে!

অবশেষে, মাতৃদুগ্ধ মুখে নিয়ে যখন শান্ত হলো রাজকুমার, উঠে দাঁড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ফারাও।

এই শিশুকে নিজের পুত্র, এবং আমার বংশধারার সরাসরি উত্তরাধিকারী হিসেবে গ্রহণ করলাম। এ হলো আমার প্রথম পুত্রসন্তান, আমার পরবর্তী ফারাও। সমস্ত মহৎপ্রাণ, রাজবধুদের সামনে আমি রাজকুমার মেমননের অভিভাবকত্ব স্বীকার করছি।

জনতার গগনবিদারী হর্ষোধ্বনি যেনো থামবেই না।

এসব কিছুর সময়ে অন্যান্য চাকর এবং দাসদের সঙ্গে সভার উপরের দর্শনার্থীস্থানে ছিলাম আমি। ঘাড় ঘুরিয়ে ট্যানাসের লম্বা অবয়ব আবিষ্কার করলাম ভীড়ের মাঝে। নেমবেট এবং আরো কয়েকজনের সঙ্গে সিংহাসনের নিচে তৃতীয় সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলো সে। অন্য সবার মতোই হর্ষোধ্বনিতে মুখরিত হচ্ছিলো, কিন্তু ওর চওড়া, খোলা মুখের অনুভূতি ছিলো বানোয়াট। তারই পুত্র অপর একজনের অভিভাবকত্বে চলে যাচ্ছে, অথচ এটা প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই ওর। এমনকি, আমি যে ট্যানাসকে সবেচেয়ে ভালো জানি পর্যন্ত অনুভব করতে পারছিলাম না কতোটা কষ্ট বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ও সেদিন।

এবারে, সবার নীরবতা কামনা করলেন রাজা, শোরগোল কমে আসতে আবারো মুখ খুললেন তিনি, রাজকুমারের মা, লেডি লসট্রিসকে আমার অভিনন্দন। হে আমার প্রাণপ্রিয় জনতা, তোমরা জেনে রাখো, সে আমার সিংহাসনের অত্যন্ত নিকটজন। আজকের দিন থেকে লসট্রিস, আমার জ্যেষ্ঠ স্ত্রীর মর্যাদায় আসীন। তাকে এখন থেকে রাণী লসট্রিস নামে অভিহিত করা হবে। পদমর্যাদায় স্বয়ং ফারাও এবং রাজকুমারের পরেই তার অবস্থান। এতদ্বারা আমি ফারাও আরো ঘোষণা করছি, রাজকুমার সাবালক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমার অবর্তমানে, অথবা অসুস্থ অবস্থায় রাণী লসট্রিস সমস্ত শাসনক্ষমতার কর্ত্রী হিসেবে পরিগণিত হবে।

উচ্চ-রাজ্যে এমন কেউ নেই যে লসট্রিসকে ভালোবাসে না; শুধুমাত্র রাজার বয়োজ্যেষ্ঠ স্ত্রীরা ছাড়া, যারা তাকে ছেলেসন্তানের উত্তরাধিকারী দিতে পারেনি। তারা ছাড়া আর সবাই উদ্বেলিত হলো এমন ঘোষণায়।

ফারাও-এর উত্তরাধিকারীর নাম নির্বাচনের অনুষ্ঠানের জন্যে সভাস্থল ত্যাগ করলো রাজকীয় পরিবার। প্রাসাদের মূল সভাকক্ষে রাজকীয় স্লেজে চড়লেন ফারাও; তাঁর পাশে রাণী লসট্রিস বসলো রাজকুমারকে কোলে নিয়ে। সাদা রঙের ষাঁড়ের একটি দল রামজি আভেন্য ধরে জেটা টেনে নিয়ে চললো ওসিরিসের মন্দিরে। ওখানে দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলিদান করবেন রাজা। থিবেসের হাজারো জনতা পবিত্র এই আভেন্যুর দুই পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানালো। ফারাও, তার স্ত্রী এবং রাজকুমারের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলো তারা গগনবিদারী হুঙ্কারে।

সেই রাতে যখন লসট্রিস আর ওর শিশুপুত্রের সান্নিধ্যে ছিলাম, ও ফিসফিস করে বললো, টাইটা, ভীড়ের মধ্যে ট্যানাসকে দেখেছিলে? দুঃখ আর সুখের একটি মিশ্র দিন ছিলো এটা। ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো আমার প্রিয়তমের জন্যে। কী লম্বা আর সাহসী ওআর, আর নিজের সন্তানকে অন্যের হতে দেখতে হলো তাকে! ইচ্ছে করছিলো, সটান দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলি, এই পুত্রসন্তান, ট্যানাস, লর্ড হেরাবের।

আমাদের সবার জন্যেই আমি আনন্দিত; অন্তত একবারের জন্যে হলেও নিজের বড়ো জীভটাকে সামলে রাখতে পেরেছিলে, মহারাণী।

খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে লসট্রিস এই কথায়। কী অদ্ভুত কী বললে যেনো মহারাণী! নিজেকে কেমন প্রকাণ্ড মনে হলো! এক বুক থেকে থেকে অপর বুকে শিশু মেমননকে স্থানান্তর করলো ও। এই নড়াচড়ায় বিকট শব্দে বায়ু নির্গমন করে দিলো মেমনন।

বোঝাই যাচ্ছে, কোনো এক মরুঝড়ের সময়ে পেটে ধরেছিলে ওকে! আমার শুষ্ক স্বরে করা মন্তব্যে লসট্রিস হেসেই খুন। পরপরই অবশ্য মন খারাপ করে ফেললো সে।

ট্যানাস কখনো এমন মুহূর্তগুলোয় ভাগ বসাতে পারবে না। একবার ভেবে দেখেছো, মেমননকে এমনকি একবার কোলেও নেয়নি ও? আর পারবেও না কোনোদিন। আমার আবার কান্না পাচ্ছে, টাইটা।

নিজেকে প্রবোধ দাও, মিসট্রেস। কাঁদলে, বুকের দুধ নোনা হয়ে যাবে যে! মোটেও সত্যি নয় কথাটা, তবে কাজ হলো এতে। কান্না গিলে ফেললো লসট্রিস।

কোনো উপায় কী নেই, যাতে করে ট্যানাস বাচ্চাটাকে কাছে পেতে পারে?

কিছুসময় ভেবে নিয়ে একটা পরামর্শ দিলাম। শুনে খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলো মিসট্রেস। যেনো আমার কথায় সায় দিতেই, আবারো বায়-ত্যাগ করে দিলো রাজকুমার।

ঠিক তার পরদিন যখন ফারাও তার পুত্র-সন্তানকে দেখতে এলেন, আমার পরামর্শ মতো কাজ শুরু করে দিলো লসট্রিস। প্রিয় স্বামী, রাজকুমার মেমননের আনুষ্ঠানিক শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন কি?

প্রশ্রয়দানের ভঙ্গিতে হাসলেন ফারাও। আরে, ও তো এখনো শিশু। আগে হাঁটা চলা, কথাবার্তা শিখুক তো, তারপর না হয় অন্য কিছু শিখবে।

আমার মনে হয়, এখনি ওর শিক্ষক নিয়োগ দিলে ভালো হয়। এতে করে ও যেমন তাকে চিনতে শিখবে, তাঁরাও ওকে ভালো বুঝবেন।

ঠিক আছে, হেসে ছোট্ট রাজকুমারকে হাঁটুর উপর নিলেন রাজা। কাকে উপযুক্ত মনে হয় তোমার?

বিদ্যাশিক্ষার জন্যে আমাদের সেরা পণ্ডিতকে প্রয়োজন। এমন একজন, সকল বিজ্ঞান আর রহস্যে যার দখল আছে।

রাজার চোখজোড়া ঝিক করে উঠলো। এমন মাত্র একজনের কথাই আমার মনে আসছে, বলে, আমার উদ্দেশ্যে হাসলেন তিনি। বাচ্চা হওয়ার পর থেকে ফারাও-এর হাবভাব পাল্টে গেছে; মেমননের জন্মের পর থেকেই আমুদে হয়ে গেছেন তিনি। ক্ষণিকের জন্যে ভাবলাম, হয়তো চোখ টিপবেন তিনি, কিন্তু অতোটা বাড়াবাড়ি অবশ্য করলেন না।

এই প্রতিক্রিয়ায় একটুও ভ্রূক্ষেপ না করে রানি বলে চললো, রণ-কৌশলে পারদর্শী একজন যোদ্ধারও প্রয়োজন হবে আমাদের। ওকে লড়াইয়ের কৌশল শেখানো জন্যে। আমার মতে, তরুণ আর বীর কেউ হলে সবচেয়ে ভালো। বিশ্বাসী, সিংহাসনের প্রতি অনুরক্ত–এমন কেউ।

ওই পদের জন্যে কার নাম প্রস্তাব করছো তুমি, প্রিয়তমা? খুব কম সৈনিকেরই এমন গুণাবলি আছে। ফারাও-এর মনে কোনো দুরভিসন্ধি ছিলো বলে আমার মনে হয় না, কিন্তু আমার কর্ত্রী তো আর গর্দভ নয়। রাজকীয় ভঙ্গিমায় মাথা নেড়ে সে বললো, আপনি জ্ঞানী মানুষ, নিজের বাহিনীকে সম্যক চেনেন। আপনার সিদ্ধান্তই যথার্থ।

পরবর্তী রাজসভায় রাজকুমারের শিক্ষক নিয়োগ করলেন রাজা । ক্রীতদাস এবং চিকিৎসক টাইটার উপর ভার পড়লো রাজকুমারের বিদ্যাশিক্ষা দানের। এতে অবশ্য কেউই তেমন অবাক হলো না, কিন্তু ফারাও-এর পরবর্তী বক্তব্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেলো। অস্ত্রশিক্ষা এবং সমরকৌশলের জন্যে মিশরের সাহসী সিংহ, লর্ড হেরাবকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। অবশ্যই, যুদ্ধ বিরতিতে এই দায়িত্ব পালন করবেন লর্ড হেরাব।

নদীর ওপারের প্রাসাদে লসট্রিসের বাসস্থান নির্মাণ পর্যন্ত হারেম ছেড়ে রাজ উজিরের প্রাসাদে উঠেছে সে, ওর বাবার জন্যে আমার তৈরি করা জল-বাগানের কাছাকাছি একটা কক্ষে। রাজার প্রধান স্ত্রী এবং মহারানি পদমর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলো সেটা। লসট্রিসের উপস্থিতিতে, জল-বাগানের বারাজ্জায় অনুষ্ঠিত হলো রাজকুমার মেমননের শিক্ষক নিয়োগ অনুষ্ঠান। মাঝে মধ্যেই ফারাও এবং উচ্চ-মর্যাদার সভাষদের আগমন ঘটতো ওখানে, কাজেই বেশ চাপের মুখেই রইলাম আমরা।

অবশ্য, মাঝেমধ্যেই দেখা যেতো কেবল আমরা চারজন উপস্থিত বারাজ্জায়। প্রথম এ ধরনের সুযোগ আসতেই বাবার কোলে রাজকুমারকে তুলে দিলো রানি। যে অনুপম আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলো ট্যানাসের মুখ, যখন ছেলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলো সে–তা ভুলার নয়। বাবার সামরিক পোশাকের সামনের অংশটা কামড়ে ধরে তাকে যেনো স্বাগত জানিয়েছিলো মেমনন।

সেই থেকে, ট্যানাস আমাদের সঙ্গে থাকলে রাজকুমারের বিশেষ কোনো পারদর্শিতা প্রদর্শনে ওকে উৎসাহিত করতাম আমরা। বুকের দুধ ছেড়ে প্রথম ট্যানাসের চামচ থেকেই খাবার খেলে মেমনন। অবশ্য, নতুন স্বাদে বিরক্ত হয়ে সাথে সাথেই মুখ বিকৃত করে তারস্বরে কান্না জুড়ে দিয়েছিলো সে। লসট্রিস যখন কোলে নিয়ে আবারো বুকের দুধে ওর মন ভরাতে চাইলো, মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইলো ট্যানাস। হঠাৎ করেই হাত বাড়িয়ে মেমননের মুখের ভেতর থেকে দুধের বৃন্ত সরিয়ে দিলো সে, এহেন সামরিক ব্যবহারে সাথে সাথেই আবার কান্না জুড়ে দিলো রাজকুমার। ওদিকে চমকে উঠলাম আমি। যদি এই মুহূর্তে রাজা এখানে প্রবেশ করে এই চিত্র দেখতেন, তার প্রতিক্রিয়া কী হতো সহজেই অনুমেয়।

আমি বাধা দিয়ে উঠতেই মিসট্রেস বলে উঠলো, বৃদ্ধা মহিলাদের মতো আচরণ করো না, টাইটা। আমরা তো কেবল নির্দোষ মজা করছিলাম।

মজা–ঠিক আছে, কিন্তু নির্দোষ কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে বটে, বিড়বিড় করে বললাম। পরস্পরের ছোঁয়ায় ওদের মুখের জ্যোতি আমি লক্ষ্য করেছি। জানি, নিজেদের বেশিদিন ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না ওরা, এমনকি ট্যানাসের দায়িত্ববোধ আর রাজার প্রতি সম্মানও এর জন্যে যথেষ্ট নয়।

সেই সন্ধাতেই, হোরাসের মন্দিরে ধরনা দিয়ে দান করে এলাম আমি। প্রার্থনায় বসে তার কাছে ফরিয়াদ জানালাম, ইন্দ্রজালের ঘটনাবলিকে খুব বেশি দেরি করিয়ে দিয়ো না, হোরাস। নিজেদের বাধা দিয়ে রাখতে পারবে না ওরা। এর অর্থ হবে, আমাদের সকলের অসম্মান আর মৃত্যু।

কখনো ঐশ্বরিক ঘটনাপ্রবাহে মানবের হস্তক্ষেপ না করাই সর্বোত্তম। আমাদের প্রার্থনা অনেক সময়ই এমন বিচিত্র উপায়ে সত্যি হয়ে যায়, তা একাধারে যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি বেদনাদায়ক।

*

আমি ছিলাম রাজকুমারের চিকিৎসক। কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যায় আমার দক্ষতার তেমন কোনো প্রয়োজন হলো না ওর। বাবার কর্কশ, অসাধারণ স্বাস্থ্য আর শক্তিমত্তা পেয়েছিলো সে। মেমননের ক্ষুধা আর হজমশক্তি ছিলো উদাহরণযোগ্য। যা কিছু মুখে দেওয়া হতো, গোগ্রাসে গিলে ফেলতো সে।

নিরবচ্ছিন্ন ঘুম দিয়ে উঠেই খাবারের জন্যে গর্জে উঠতো সবসময়। একটা আঙুল তুলে ওর সামনে রেখে এদিক-ওদিক যখন নাড়াতাম আমি, বড়ো বড়ো কালো চোখে ওটাকে অনুসরণ করতে মেমনন; সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা ধরে উঠে বসতে চাইতো। আমার দেখা যে কোনো বাচ্চার চেয়ে দ্রুত বসতে শিখেছিলো সে। যখন উঠে বসে হামা দিতো ও, ততদিনে অনেক বাচ্চা বসতেও শিখেনি। আবার, যেদিন প্রথম টলোমলো পা ফেললো, অনেক বাচ্চাই অতুটুক বয়সে কেবল হামা দিতে শিখেছে।

সেদিন ট্যানাস ছিলো আমাদের সাথে। গত দু মাস ধরেই যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলো সে, লাল-ফারাও ততদিনে আয়ুত দখল করে ফেলেছে। ফারাও-এ নির্দেশে জলপথে সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে সেই নগরীর দখল ফিরে পাবার জন্যে লড়ছিলো উত্তুরে বাহিনী।

পরে কাতাসের কাছে শুনেছিলাম, কী ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছিলো সেখানে; অবশেষে শহরের দেয়াল ভেঙে ট্যানাসের নেতৃত্বে দখল প্রতিষ্ঠা করেছিলো নীল বাহিনী। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে লাল ফারাও-এর বাহিনীকে বিতারিত করেছিলো তারা।

থিবেস প্রত্যাবর্তনের পর উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলো ট্যানাস। ওর গলায় সম্মানসূচক সেরা সমরনায়কের পদক পড়িয়ে দিয়ে বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে অর্থ পুরস্কার দিলেন ফারাও।

রাজার কাছ থেকে সরাসরি বারাজ্জায় চলে এলো ট্যানাস, ওর অপেক্ষাতেই বসে ছিলাম আমরা। প্রবেশমুখে পাহাড়ায় থাকলাম আমি, ওদিকে দারুন আবেগে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলো ওরা দুজন। শেষমেষ, আমি গিয়ে আলাদা করলাম ট্যানাস এবং লসট্রিসকে।

প্রভু ট্যানাস, তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠলাম, রাজকুমার অধৈৰ্য্য হয়ে পড়েছেন। অনিচ্ছার ভঙ্গিতে আলিঙ্গন ভেঙে, ছায়ার নিচে শেয়ালের চামড়ার উপর হাত-পা ছড়িয়ে ন্যাংটো পড়ে থাকা মেমননের দিকে এগোলো ট্যানাস। এক হাঁটুতে ভর দিয়ে ওর উদ্দেশ্যে নিচু হলো সে।

অভিবাদন, সম্মানিত রাজকুমার! আমাদের বাহিনীর বিজয়ের খবর নিয়ে এসেছি আমি– বাপকে চিনতে পেরে খুশিতে আওয়াজ করে উঠলো ছোট্ট মেমনন। চকচকে স্বর্ণের হারটা তার দৃষ্টি কেড়েছে। জোর এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো ও, টলোমলো পায়ে চারকদম এগিয়ে দুই হাতে জাপটে ধরলো ওটা।

আমরা খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠতেই চমকে পেছন ফিরে চাইলো মেমনন, তখনো ধরে রেখেছে স্বর্ণের হারটা।

হোরাসের ডানার কসম, তোমার চেয়ে স্বর্ণের প্রতি ওর লালসা কম নয়, টাইটা! হেসে উঠে বলে ট্যানাস।

স্বর্ণ নয়, সম্মানটাই ওর কাম্য, আমার কী শুধরে দিলো। একদিন, ওর গলাতেও শোভা পাবে শ্রেষ্ঠ সমরনায়কের পদক।

কোনো সন্দেহ নেই! মেমননকে উঁচতে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিলো ট্যানাস। খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে পা ছুঁড়ে আবারো ওটা করার নির্দেশ দিলো রাজকুমার।

এভাবেই, ট্যানাস এবং আমার জন্যে নদীর উথান আর পতনের মতোই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে লাগলো ছোট্ট শিশু মেমনন। আর, পুত্র এবং ভালোবাসার মানুষের সান্নিধ্যে কেটে যেতে লাগলো আমার মিসট্রেসের একান্ত প্রহরগুলো। ট্যানাসের সঙ্গে বিচ্ছেদের সময়টা যেনো আর কাটতো না ওর, প্রতিটি একান্ত মুহূর্ত আরো অসহ্য রকম ক্ষণস্থায়ী হয়ে উঠলো বারবার।

*

সেই গ্রীষ্মে নদীর পাবন গজ-দ্বীপের জলউৎসবে ঘোষিত পূর্বানুমান মতোই যথেষ্ট ছিলো। বন্যার পানি নেমে যেতে, কালো পলিতে চকচক করে উঠলো আমাদের ফসলের মাঠ । ক্রমেই, ঘন সবুজ শস্য আর ফলমূলে ভরে উঠতে লাগলো জমিন। যতদিনে শক্ত করে পা ফেলতে শিখলো রাজকুমার, রাজ্যের প্রতিটি গোলাঘর কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। এমনকি, মিশরের সবচেয়ে দরিদ্র ব্যক্তির ভাঁড়ারেও পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত রইলো। পশ্চিম তীরে মেমননের প্রাসাদ ধীরে ধীরে আকৃতি পাচ্ছিলো; ওদিকে, ভুয়া ফারাও-এর সাথে উত্তরের যুদ্ধ ক্রমেই আমাদের অনুকূলে চলে আসছে। ফারাও আর তার রাজ্যের প্রতি কৃপাদৃষ্টি পড়েছে দেবতাদের।

একমাত্র অসন্তুষ্টি বলতে, প্রেমিক যুগলের মধ্যকার দূরত্ব এতো কাছাকাছি থাকার পরও যেনো আমাদের এই নদীবিধৌত উপত্যকার চেয়েও চওড়া। লসট্রিস ও ট্যানাস দু জনেই সুযোগ পেলে আমন রার ইন্দ্রজালে আমার দেখা ভবিষ্যদ্বানী নিয়ে কটাক্ষ করতো, যেনো ইন্দ্রজাল সত্যি করার দায়িত্ব আমারই। মিনমিন করে বোঝাতে চাইতাম, আমি ভবিষ্যতের ঘটনাবলির আয়না হতে পারি, কিন্তু নিয়তির বাও খেলার ঘুটি তো আমার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়।

বছর কেটে গেলো। আবারো, পূর্বের অসংখ্যবারের মতো বন্যার পানিতে উঁচু হলো নদীর পানির সমতল। আমার ইন্দ্রজালে ভবিষ্যৎ অবলোকনের পর এ হলো চতুর্থ বন্যা। ওদের মতো আমিও এ বছরের শেষ নাগাদ ইন্দ্রজালের কথা সত্যি হওয়ার অপেক্ষায় আছি। তা যখন ঘটলো না, আমার কর্ত্রী এবং ট্যানাস দুজনেই ভীষণ করে ধরলো আমাকে।

কবে আমি ট্যানাসের হতে পারবো? রানি লসট্রিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছু একটা করো না, টাইটা।

আমাকে নয়, দেবতাদের বলো ও কথা। আমি তো কেবল প্রার্থনা করতে পারি, আর কিছু নয়।

অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটলো না। এভাবেই কেটে গেলো আরো একটি বছর। এমনকি, ট্যানাস পর্যন্ত অধৈৰ্য্য হয়ে উঠলো। তোমার উপর এতোটা বিশ্বাস করেছিলাম আমি, টাইটা, ভবিষ্যতের সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তোমার কথার উপর ছেড়ে দিয়েছি। কসম, যদি দ্রুত কিছু একটা না করো হঠাৎ থেমে পরে আমার দিকে করুণ চোখে চেয়ে থাকতো ও।

আরো একটি বছর কেটে গেলো। ততদিনে নিজের ভবিষ্যৎ-দর্শনে আমার বিশ্বাস টলে যেতে বসেছে। বিশ্বাস করতে বসেছি, দেবতারা তাদের ইচ্ছে পাল্টে ফেলেছেন, নচেৎ আমি নিজেই আকাঙ্ক্ষাপ্রসূত কল্পনার আশ্রয় নিয়েছিলাম তখন।

রাজকুমার মেমননের বয়স তখন পাঁচ, ওর মায়ের একুশ। এ সময়ই, হঠাৎ একদিন উদভ্রান্ত অবস্থায় উত্তর থেকে খবর নিয়ে এলো একটা টহলদার গ্যালির বার্তাবাহক।

ডেল্টার পতন ঘটেছে। লাল-ফারাও নিহত হয়েছেন! আগুন জ্বলছে নিম্ন-রাজ্যে। ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে মেমফিস এবং আভারিস নগরী। মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে সমস্ত মন্দির, দেবতাদের মূর্তিগুলো সব ধুলোয় লুটাচ্ছে, চেঁচিয়ে ফারাওকে বললো গ্যালির যোদ্ধা । উত্তরে তিনি বললেন, এটা সম্ভব নয়। বিশ্বাস হয় না। আমরা টের পাবার আগে কেমন করে ঘটলো এতোকিছু? যথেষ্ট শক্তিশালী বাহিনী রয়েছে উত্তরের জবর-দখলকারী ফারাও-এর, বিগত পনেরো বছর ধরে চেষ্টা করেও তাকে উপড়ে ফেলতে পারিনি আমরা। একদিনের মধ্যে কেমন করে এটা সম্ভব হলো? কার দ্বারা?

ভয় আর উত্তেজনায় কাঁপছিলো বার্তাবাহক, বহুদূর পথ ছুটে এসেছে সে।

তলোয়ার খাপ থেকে বের করার আগেই নিহত হয়েছেন লাল-ফারাও। যুদ্ধের দামামা পর্যন্ত বেজে উঠেনি তার বাহিনীতে তখনো।

কেমন করে সম্ভব হলো এটা?

মহান মিশর, কেমন করে বলবো বলুন? শুনেছি, ভয়ঙ্কর এক বাহিনী হানা দিয়েছে সেই পুব থেকে বাতাসের মতো দ্রুত, কোনো জাতীর সাধ্য নেই তাদের সামনে দাঁড়ায়। উত্তর সীমান্ত থেকে পিছু হটছে আমাদের বাহিনী, সবচেয়ে বীর যোদ্ধারও সাহস নেই তাদের মুখোমুখি হওয়ার।

কে এই শত্রু? ফারাও জানতে চাইলেন, প্রথমবারের মতো ভয় ফুটে উঠলো তার কণ্ঠস্বরে।

তার নাম রাখাল রাজা। হিকসস্‌।

একদিন ওই নাম নিয়ে তামাশা করেছিলাম আমি আর ট্যানাস। আর কখনোই করবো না সেটা।

*

যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করে উপদেষ্টাদের নিয়ে গোপন সভায় বসলেন ফারাও। এরও বহুদিন পরে, ক্রাতাসের কাছ থেকে শুনেছিলাম, কী আলোচনা হয়েছিলো সেদিনের সভায়। শপথ ভেঙে গোপন আলোচনার কোনোকিছু এমনকি লসট্রিস বা আমাকেও বলার লোক নয় ট্যানাস। কিন্তু আমার ধূর্ত বাক্যবাণে অবশেষে সবকিছু বলতে বাধ্য হয়েছিলো ক্ৰাতাস।

তাকে দশ হাজারের সেরা পদবিতে উন্নিত করে নীল কুমির বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেছিলো ট্যানাস। ওদের দুজনার মধ্যকার বন্ধুত্ব তখনো অটুট। কাজেই, বাহিনীগুলোর অন্যতম প্রধান হওয়ায় গোপন সভায় উপস্থিত থাকতে পেরেছিলো সে, যদিও নীচু পদমর্যাদার কারণে কোনো বিষয়ে মতো প্রকাশ করতে পারেনি। যা যা ঘটেছিলো সেদিন, সবই আমার আর মিসট্রেসের কাছে বলেছিলো সে।

নেমবেটের নেতৃত্বে প্রাচীনপন্থিরা আর ট্যানাসের নেতৃত্বে তরুণ যোদ্ধারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছিলো সভায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেষপর্যন্ত মূল দায়িত্ব ন্যস্ত হলো বয়োজ্যেষ্ঠ যোদ্ধাদের হাতে; তাদের প্রাচীন সমরকৌশল অনুসরণ করা ছাড়া কোনো গতান্তর রইলো না তরুণদের জন্যে।

ট্যানাসের মতে, মূল সমরাঙ্গন থেকে সেনাবাহিনীকে পিছু হটিয়ে নদীর গতিপথ বরাবর কয়েকটি স্থানে শক্ত ঘাঁটি গড়ে শক্রর জন্যে অপেক্ষা করাই শ্রেয়; একইসঙ্গে ছোটো ছোটো প্রহরী এবং পর্যবেক্ষক বাহিনী পাঠিয়ে রহস্যময় এই শত্রুর গতিপ্রকৃতি অনুধাবন করার পরামর্শ দিয়েছিলো সে। উত্তরের সমস্ত শহরে তার চর মজুদ আছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে কারো কাছ থেকেই কোনোরকম সংবাদ আসছে না। কাজেই, তাদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করে মূল বাহিনীকে একত্র করতে চাইছিলো সে।

যতক্ষণ পর্যন্ত না জানতে পারছি, কাদের সাথে লড়তে হচ্ছে আমাদের, সঠিক রণ-কৌশল বের করা মুশকিল, সভায় বলেছিলো সে।

নেমবেট আর তার সহযোগী বয়োজ্যেষ্ঠরা বিরোধিতা করেছিলো ট্যানাসের বক্তব্যে। রাজকীয় জলযান রক্ষার ঘটনায় ট্যানাসের দ্বারা অপমানিত হওয়ার কথা কখনো ভুলে যাননি বৃদ্ধ এই সমরনায়ক। যুক্তির চেয়ে একগুঁয়েমির কারণেই মূলত ট্যানাসের সমস্ত বক্তব্যে বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।

আমাদের এই পবিত্র ভূমির এক ইঞ্চি মাটিও শত্রুর কাছে ছেড়ে আসবো না! অমন চিন্তা করাও কাপুরুষের কাজ। বরঞ্চ আগে বেড়ে, যে-ই হোক, তাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া উচিত! গ্রাম্য কুমারীদের মতো লজ্জাবনত চিত্তে আগুপিছু করার কোনো মানে হয় না!

মহান ফারাও! কাপুরুষ অভিধায় গর্জে উঠে ট্যানাস। কেবলমাত্র একজন গর্দভ–বুড়ো গর্দভের পক্ষেই সম্ভব শক্রর সম্পর্কে কোনেকিছু না জেনে লড়তে যাওয়া । নির্বুদ্ধিতার সময় অবশিষ্ট নেই আর

কোনো লাভ হলো না ট্যানাসের কথায়। সেনাবাহিনীতে তার চেয়ে অভিজ্ঞ সমরনায়কদের কথা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।

সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরে গিয়ে পলায়নরত সেনাবাহিনীকে সুস্থির করার আদেশ দেওয়া হলো ট্যানাসকে। সম্মুখ সমরে নিজেদের সীমানা ধরে রাখার জন্যে প্রাণপণ লড়তে হবে তাকে। এমনকি, আসয়ূত নগরের সীমানায়, যেখানে পাহাড়ের সারি প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষায় ভূমিকা রাখবে এবং শহরের দেয়াল দ্বিতীয় প্রতিরক্ষাব্যুহ হিসেবে কাজ করবে, কৌশলগত পশ্চৎপসরণ করে সেই পর্যন্ত আসতেও কঠোর ভাষায় নিষেধ করা হলো তাকে।

এই সময়ে দক্ষিণের সেই কুশ থেকে বাকি সেনাবাহিনীকে একত্র করে নিয়ে আসবে নেমবেট। এহেন বিপদজনক পরিস্থিতিতে আফ্রিকার হুমকিকে গণ্য না করলেও চলবে। যোদ্ধাদের একত্র করা শেষ হতে নেমবেট উত্তরের বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে আক্রমণ চালাবেন। একমাসের মধ্যেই ষাট হাজার যোদ্ধা এবং চারশো গ্যালির এক অজেয় বাহিনী তৈরি হবে আসয়ূত নগরে। ইত্যবসরে, যে কোনো মূল্যে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে ট্যানাসকে।

কঠোর একটি ঘোষণার মাধ্যমে বক্তব্য শেষ করলেন নেমবেট। সীমান্তে তার সমস্ত যোদ্ধা মজুত রাখার জন্যে লর্ড হেরাবকে আদেশ দেওয়া হলো। কোনো ধরনের পর্যবেক্ষক বাহিনী বা কৌশল না করারও পরামর্শ দেওয়া হলো তাকে।

সাহসী নেমবেট, এ সমস্ত ঘোষণা আমাকে, আমার তলোয়ারধারী হাতকে বেঁধে ফেলছে। বীরোচিত এবং ফলপ্রসু উপায়ে লড়ার সমস্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে আমাকে। ট্যানাসের প্রতিবাদে কাজ হলো না। তরুণ এই প্রতিযোগীর উপর নিজের আদেশ চাপিয়ে দিতে পেরে আত্মপ্রসাদ লাভ করছিলেন নেমবেট, এতে করে যেনো প্রতিশোধ নেওয়া হলো তার। কত মামুলি মানবিক আবেগ একটি জাতীর নিয়তি পাল্টে দিতে পারে, ভেবে অবাক হতে হয় আজো।

সেনাবাহিনীর প্রথম সারিতে নিজে অবস্থান নেয়ার ইচ্ছে পোষণ করলেন ফারাও। ইতিহাসের সমস্ত নিয়তি নির্ধারণের যুদ্ধে ফারাও নেতারা সেনাবাহিনীর প্রথম সারিতে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁর সাহসীকতাকে শ্রদ্ধা করলেও এই সময়ে এ ধরনের ইচ্ছে পোষণ না করাই সঠিক বলে আমার মতো। ফারাও মামোস, মোটেও বীরযোদ্ধা নন; তার উপস্থিতি এমন কোনো সুবিধা এনে দেবে না। হতে পারে, তার উপস্থিতিতে উৎসাহ বাড়বে যোদ্ধাদের, কিন্তু বিশাল সভাষদ ট্যানাসের রণ-কৌশলে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ।

রাজা তো আর উত্তরের যুদ্ধের ময়দানে একা যাবেন না। রানি এবং রাজকুমার সহ পুরো সভাষদ তাঁর সঙ্গী হবে। আমাকেও তাই যেতে হচ্ছে আসয়ূতের রণক্ষেত্রে।

কেউ কিছু জানতো না আমাদের এই নতুন শত্রু সম্পর্কে। অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে আমার রানি আর রাজকুমার। অন্যদিকে, একজন ক্রীতদাসের নিরাপত্তার প্রশ্ন তোলাটাই অবান্তর, তবে ক্রীতদাসের নিজের কাছে হয়তো তা নয়। বন্যা প্লাবিত নদীতে ভেসে উত্তরের সমরাঙ্গনের উদ্দেশ্যে পাল তোলার আগের রাতটা তাই নিধুম কাটলো আমার।

*

যতোই উত্তরে ভেসে চললো আমাদের জাহাজবহর, অসংখ্য ভয়ঙ্কর সংবাদ, গুজব কানে আসতে লাগলো সামনের রণাঙ্গন থেকে। ভয় আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব আমাদের ইতিমধ্যেই ক্ষয়িষ্ণু আত্মবিশ্বাসের মূলে আঘাত হানলো। যাত্রার সময়ে প্রায়ই আমাদের গ্যালিতে এসে এ সমস্ত খবর-গুজব নিয়ে আলোচন করতো ট্যানাস। অধশ্য, কিছুটা সময় রাজকুমার আর তার মার সঙ্গে কাটাতো সে।

যুদ্ধ চলাকালে সেনাবাহিনীতে নারীর উপস্থিতি কখনোই সঠিক বলে মনে হয়নি আমার। কী শান্তির সময়, কী যুদ্ধের সময় নারীর মতো মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আর কিছুর বা কারোর নেই। এমনকি, ট্যানাসের মতো একজন বীরের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। এই মুহূর্তে আসন্ন যুদ্ধের দিকেই শুধু ওর মনোযোগ থাকা উচিত; আমার এই মন্তব্যে ট্যানাস হাসে।

ওদের দেখে বরং যুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই, বুড়ো বন্ধু। ঠিক সিংহের মতোই লড়বো, দেখে নিও!

কয়েকদিনের মধ্যেই পলায়নপর সেনাদের প্রথম দলটাকে ধরে ফেললাম আমরা। নদীর তীর ধরে দক্ষিণে পালানোর পথে গ্রামের পর গ্রাম লুট করছে তারা। কোনো রকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই শ খানেক যোদ্ধার কল্লা ফেলে দিয়ে বর্শার ডগায় গেঁথে নদীর পারে সাজিয়ে রাখলো ট্যানাসসতর্কবানী হিসেবে। এরপর বাকিদের উপযুক্ত সেনাপতির অধীনে নিয়োজিত করে দিলো। পালানোর কথা ভুলে নতুন উদ্যমে সামনে এগিয়ে চললো তারা।

নদী তীরবর্তী দেয়ালঘেরা শহর, আসমূত-এ পৌঁছলো আমাদের নৌবহর। নেমবেট-এর নির্দেশ অমান্য করে রেমরেম-এর অধীনে পাঁচ হাজার যোদ্ধার একটা দল এখানে মোতায়ান রাখলো ট্যানাস। আরো উত্তরে ভেসে চললাম আমরা। সীমান্তে, যেখানে অপেক্ষায় রয়েছে রহস্যময় রাখাল রাজার বাহিনী।

নদীর উপর যুদ্ধের ভঙ্গিমায় নোঙর করলো আমাদের গ্যালিগুলো। মূল যোদ্ধাদের দলটা নদীর পুব তীর ধরে ওত পেতে থাকলো।

বড়ো, আরামদায়ক জলযানে রাজকুমার আর রানির অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখার কথা বললাম আমি ফারাওকে। পানির উপরে বাতাস শান্ত; আর তাছাড়া, বেগতিক দেখলে পালানো সহজ হবে এতে করে ।

দলবলসহ জমিনে নেমে, উঁচু একটা স্থানে ক্যাম্পে চলে গেলেন ফারাও। যেখানে নেমেছি, পরিত্যক্ত একটা গ্রাম এটা; বহুকাল আগে ভুয়া-ফারাও-এর সঙ্গে যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে পালিয়ে গিয়েছিলো অধিবাসী কৃষকেরা। অভিশপ্ত এই গ্রামের নাম আবনুব।

আবনুবে আমরা পৌঁছার আগে থেকেই বন্যার প্লাবন কমে আসছিলো, যদিও সেচের জন্যে তৈরি খালগুলো এখনো পানিতে টইটুম্বর, ফসলের মাঠে কালো পলিমাটির চিহ্ন রেখে নেমে গেছে নীল নদের পানি।

নেমবেটের আদেশ অনুযায়ী শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলার জন্যে তৈরি হলো ট্যানাস। যুদ্ধ-ক্রম অনুযায়ী ক্যাম্প ফেললো বাহিনী। নদীপথে গ্যালিগুলোর নেতৃত্বে রইলো আস্ তেস। রণক্ষেত্রের কেন্দ্রে রইলো ট্যানাস, ডানদিকে থাকলো ক্রাতাসের দল।

সেই পুব দিগন্ত পর্যন্ত যেদিকে নজর যায়, কেবল ধু ধু মরু৷ গনগনে রোদে তপ্ত, পানিবিহীন ওই জায়গায় কোনো সেনাবাহিনী টিকতে পারে না। তাই আমাদের ডান দিক থেকে আক্রমণের কোনো ভয় নেই।

হিকসস্‌ সম্পর্কে যতটুকু শুনেছি, তার নিজস্ব কোনো নৌবহর নেই; জমিন হয়ে এসেছে। কাজেই স্থলযুদ্ধে তার সাথে লড়ার প্রস্তুতি নিয়েছে ট্যানাস। সে জানে, নদী পার হওয়ার কোনো উপায় নেই রাখাল রাজার। এমনিতে সে নিজে অবশ্য আবনুবে থাকতো না, কেবল নেমবেটের নির্দেশ বলে কথা।

ছোটো একটা ঢালে আবব গ্রামের অবস্থান। চারপাশে জংলাঘেরা ফসলের মাঠ। অন্তত, শত্রুপক্ষ আক্রমণ করার অনেক আগেই তাদের দেখতে পাবো আমরা।

মিশরের শ্রেষ্ঠ ত্রিশ হাজার যোদ্ধা রয়েছে ট্যানাসের অধীনে। এতো বড়ো বাহিনী জীবনেও দেখিনি আমি। নীল নদের উপত্যকায় কোনোদিনও এতো বিশাল বাহিনী একসাথে হয়নি। ওদিকে আরো ত্রিশ হাজার সৈনিক নিয়ে আসছেন নেমবেট । ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী হতে যাচ্ছে এটা।

এদেরকে হারিয়ে দিতে পারে, এমন কোনো শক্তি নেই। পালিশ করা চামড়ার মাথার আচ্ছাদনের নিচে বারো হাজার তীরন্দাজ, আট হাজার বর্শা নিক্ষেপকারী, চিতার চামড়ার টুপি পরা দশ হাজার তলোয়ারবাজ; পাথর নিক্ষেপকারী গুলতি সহ কয়েক হাজার যোদ্ধা। পঞ্চাশ গজ দূর থেকে খুলির হাড় ফাটিয়ে দিতে পারে এরা।

দিনদিন আশান্বিত হয়ে উঠতে থাকি আমি। কেবল একটা ব্যাপার আশঙ্কা জাগায়, হিকসস্‌ দের শক্তিমত্তা সম্পর্কে কিছুই জানি না আমরা। ওদিকে, ট্যানাসের উপর কঠোর নির্দেশ আছে যেনো পর্যবেক্ষক দল না পাঠানো হয় সামনে। কিন্তু যুদ্ধ গ্যালি সামনে পাঠানোর ব্যাপারে তো নিষেধ করা হয়নি। ট্যানাসকে বললাম সে কথা।

তোমার আসলে আইন-লেখক হওয়া উচিত ছিলো, ট্যানাস হাসে। শব্দ-খেলায় তোমার জুড়ি নেই। খালি ফাঁক-ফোকড় বের করো! এরপর, হুইকে একটা ছোটো গ্যালি নিয়ে মিনিয়ে নগরী পর্যন্ত এগোনোর নির্দেশ দিলো সে। একসময়ের শ্রাইক, বর্তমানে ট্যানাসের গুণমুগ্ধ শিস্য, হুই তার গ্যালি নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো।

কোনো রকম লড়াইয়ে না গিয়ে কেবল সংবাদ সংগ্রহের কঠোর নির্দেশ ছিলো ওর উপর। ঠিক চতুর্থ দিনে প্রত্যাবর্তন করলো সে। সেই মিনিয়ে পর্যন্ত ঘুরেও একটি জাহাজ বা শক্রর কোনো রকম চিহ্ন দেখেনি সে। নদীর ধারের গ্রামের পর গ্রাম নাকি এখন মৃতপুরী। জ্বলছে মিনিয়েহ্ নগরী।

অবশ্য, ভুয়া ফারাও-এর ছত্রভঙ্গ সেনাবাহিনীর বেশ কিছু যোদ্ধাকে ধরে নিয়ে এসেছে সে। হিকসস্‌ আক্রমণের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রথমবারের মতো প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম আমরা। কিন্তু, এমনকি একবারের জন্যেও রাখাল রাজার সাথে যুদ্ধ করেনি তাদের কেউই। শক্রর আগমনের সংবাদেই চম্পট দিয়েছে। কাজেই, তাদের মুখে কেবল শোনা-কথা আর গুজব, যার সত্যতা কতটুকু কে জানে।

কেমন করে এটা বিশ্বাস করি, বাতাসের মতো দ্রুতগতির জাহাজে করে মরু পাড়ি দিয়েছে কোনো সেনাবাহিনী? তাদের মতে, সেই জাহাজের সামনের ধুলোর মেঘ নাকি এতো ভীষণ লম্বা যে কোনো যোদ্ধার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যাবে।

ওরা মানুষ নয়, একবাক্যে জানালো বন্দীরা, অন্ধকার জগতের শক্তি তারা। আর, শয়তানের পাখায় ভর দিয়ে উড়ে মরু পাড়ি দেয়!

এমনকি, গরম কয়লা চাঁদিতে রাখার পরও নিজেদের গল্প পরিবর্তন করলো না তারা। এ ধরনের খবর বাহিনীতে ছড়িয়ে পড়লে আত্মবিশ্বাস টলে যাবে। কাজেই, ভুয়া ফারাও-এর যোদ্ধাদের মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করা হলো।

*

আবনুবে আমাদের অপেক্ষার দশম দিনে খবর পাওয়া গেলো শেষপর্যন্ত তাঁর বাহিনীকে একত্র করে রওনা দিয়েছেন নেমবেট; দুই সপ্তাহের মধ্যে আসয়ুতে পৌঁছানোর আশা করছেন তিনি। দারুন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুঁসে উঠলো যোদ্ধারা, এক লহমায় চড়ুইপাখি থেকে ঈগলে পরিণত হলো এই সংবাদে। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ সুরা আর মাংসের বাড়তি অংশ বরাদ্দ করলো ট্যানাস সবার জন্যে। আবব গ্রামের সমভূমিতে রান্নার অগ্নিকুণ্ড যেনো আকাশের তারা হয়ে জ্বললো সেই রাতে। ঝলসানো মাংসের জীভে জল আসা গন্ধে মৌ মৌ করছে বাতাস। রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত হাস্যরস আর গানের শব্দে মুখরিত হলো আমাদের ক্যাম্প।

রাজকুমারসহ মিসট্রেসকে গ্যালিতে রেখে ট্যানাসের আহ্বাণে জমিনে চলে এসেছিলাম আমি। নিজস্ব বাহিনীর প্রধানদের সাথে নিয়ে শেষবারের মতো পরামর্শসভায় বসেছে সে, চায় আমি যেনো সভায় উপস্থিত থাকি। তুমি সব সময়ই পরিকল্পনার ডিপো একটা, বুড়ো বন্ধু । বাতাসে ভর দিয়ে মরুর উপর দিয়ে উড়ে আসে–এমন জাহাজ ধ্বংস করার জন্যে তোমার কাছে হয়তো কোনো উপায় আছে, কী বলো?

মধ্যরাতের পর পর্যন্ত চললো আমাদের তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু এবারে আমিও মূল্যবান কিছু বাতলাতে পারলাম না। বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় জাহাজে ফেরার উপায় রইলো না। ওর তাবুর এক কোণে মাদুর বিছিয়ে আমাকে শুয়ে পড়তে বললো ট্যানাস। স্বভাবগত কারণেই সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম, দেখি, ট্যানাস নেই বিছানায়। তাঁবুর লিনেন পর্দার ওপাশে এখনো ঘুমে নিমগ্ন ক্যাম্প। মরুর বুকে সকাল জেগে উঠার দৃশ্য দেখতে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়লাম আমি।

ক্যাম্পের পেছনের পাহাড়ে চড়ে দৃষ্টি দিলাম নদীর দিকে। রান্নার আগুন থেকে সরু সুতার মতো উঠে আসা নীল ধোয়ার রেখা পুরো আকাশে লেপ্টে গেছে এখন, নদীর বাতাসের কুয়াশার সাথে মিলেমিশে একাকার। জাহাজগুলোর ভেতরে জ্বলা মশালের আলো এসে পড়ছে কালো পানির বুকে। অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না, আমার কী কোন্ জাহাজটায় আছে।

এরপর পুব দিগন্তে দৃষ্টি ফিরালাম আমি। ধীরে মরুর বুকে জেগে উঠছে সূর্য, আলোর আভায় মুক্তোর মতো জ্বলছে। আলো পরিষ্কার হয়ে আসতে কেমন নরম আর সুন্দর দেখালো মরুর বালিয়াড়ি, বিষণ্ণ আর গাঢ় পার্পল বর্ণে ঢাকা পড়ে গেছে। স্বচ্ছ আলোয় এতো কাছে দেখালো দিগন্ত, যেনো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।

তখনই, পরিষ্কার-স্বচ্ছ আকাশের নিচে, দিগন্তরেখার কাছে দেখতে পেলাম ভীষণ ঘন মেঘমালা। আমার বুড়ো আঙুলের প্রান্তের চেয়ে কোনো অংশেই বড়ো নয় ওটা, কিছু সময় পেছনে তাকিয়ে আবার সেই মেঘে ফিরে এলো আমার দৃষ্টি। প্রথমটায় কোনো সতর্কঘণ্টা ধ্বনিত হলো না মাথার ভেতর; এরপর ভালো করে তাকাতে টের পেলাম–নড়ছে ওটা।

অদ্ভুত তো, জোরে বলে উঠলাম, হয়তো, মরুঝড় আসছে। কিন্তু এখন খামসিনের মৌসুম নয়, আর বাতাসেও নেই কোনো স্থবিরতা। ঠাণ্ডা, শান্তিময় সকাল চারিদিকে।

আমার দৃষ্টির সামনেই দূরের সেই মেঘ ক্রমশ লম্বা হতে লাগলো। মেঘের চওড়া অংশটা উপরে নয়, রয়েছে জমিনে; কিন্তু এতো দ্রুতগতির এতো প্রশস্ত আকৃতি স্থলে তৈরি হবে কেমন করে। একঝাক পাখি হয়তো এতো দ্রুত উড়তে পারে, একপাল কীটপতঙ্গের মেঘও অমন হতে পারে কিন্তু কেনো যেনো মনে হলো, এ দুটোর কোনোটাই নয় ওটা।

ধূসর-হলুদ ছিলো সেই মেঘের রঙ, প্রথমটায় বিশ্বাস করতে মন সায় দিলো না যে ওটা ধুলোর মেঘ। বালির উপর একশর বেশি শিং ওয়ালা ওরিক্স দাবড়াতে দেখেছি আমি, কিন্তু ওগুলোর খুড়ের ঘায়েও এতো বড়ো ধুলোর মেঘ তৈরি হয়নি। যদি মরুতে পুড়ে যাওয়ার মতো কিছু থাকতো, তা হলে না হয় ধরে নিতাম ওটা আগুনের ফলে সৃষ্ট। এ ধুলোর মেঘ না হয়ে যায় না, কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার পরেও আমার মন সায় দিতে চাইলো না। অসম্ভব দ্রুতগতিতে কাছে চলে আসছে ওটা, বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম আমি।

আচমকা, ভীষণ উঁচু সেই মেঘের নিচে একটা আলো চমকাতে দেখলাম। সাথে সাথেই আমার মন ফিরে গেলো আমন রার ভবিষ্যতের ছবিতে। ঠিক এই দৃশ্যই ছিলো সেটা। কিন্তু এখনকার দৃশ্য ভবিষ্যতের কিছু নয়, জ্বলজ্যান্ত বাস্তব। আমি জানি, ওই আলোর ঝলকানি মূলত বর্ম আর চকচকে বর্শা থেকে ঠিকরে আসা সূর্যরশ্মি। দাঁড়িয়ে পাহাড়ের মাথার উপর থেকে চেঁচিয়ে সতর্ক করে দিতে চাইলাম আমাদের যোদ্ধাদের, কিন্তু বাতাসের বিপরীতে থাকায় কেউ শুনতে পেলো না আমার কথা।

এরপরই, নিচে ক্যাম্পে বেজে উঠা যুদ্ধ-দামামা আমার কানে পৌঁছুলো। প্রহরীদের চোখে অবশেষে ধরা দিয়েছে অত্যাশ্চর্য এই মেঘ, ওরাই সতর্ক করেছে সবাইকে। এই রণ-দামামাও তো আমার ভবিষ্যত-দর্শনের অংশ ছিলোমনে পড়লো। ভীষণ তীক্ষ্ণ সেই আওয়াজ যেনো খুলি ফাটিয়ে দেবে, শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা মেরে যাবে যেনো। আমি জানি, আজকের দিনে পতন ঘটবে এক সাম্রাজ্যের; পুব থেকে আসা কীটপতঙ্গ আমাদের এই মিশরের অধিকার নেবে। আমার কর্ত্রী আর তার শিশুপুত্রের জন্যে মন কেঁদে উঠলো–ওই ছোট্ট রাজকুমারই যে ফারাও-এর শেষ বংশধর।

আমার নিচে, ক্যাম্পের সমস্ত যোদ্ধারা অস্ত্র হাতে ছুটছে। ঠিক যেনো তছনছ হওয়া আবাস ছেড়ে আসা মৌমাছির ঝাঁক, যে যেভাবে পারছে হুঙ্কার দিয়ে ছুটছে। তীক্ষ্ণ রণ-সংগীতে তলিয়ে গেলো সেনাপতিদের চিৎকার।

দেখলাম, নিজের তবু ছেড়ে সশস্ত্র যোদ্ধাদের একটি দলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো ফারাওকে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তাকে বহন করে ছুটলো যোদ্ধার দল, সমতলের উপরে পাথরের উপর অবস্থিত তার সিংহাসনে নিয়ে যাচ্ছে। ওখানে বসিয়ে, হাতে রাজ্যের প্রতীক আর মাথায় দ্বৈত-মুকুট পরিয়ে দিলো তারা। ছাই বর্ণ ধারণ করেছে ফারাও-এর মুখাবয়ব, মার্বেল পাথরের মূর্তির মতো স্থির বসে রইলেন তিনি; ওদিকে তাঁর নিচে রণক্ষেত্রে বিন্যস্ত হতে শুরু করেছে সেনাবাহিনী। প্রথম সতর্কধ্বণীর পর দ্রুতই নিজের যোদ্ধাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে ট্যানাস।

দৌড়ে ঢাল বেয়ে নেমে ফারাও-এর কাছে চলে এলাম আমি। ওদিকে, মরুর বুকে ছড়িয়ে পড়েছে ট্যানাসের বাহিনী। ভীষণ ধুলোর মেঘের সঙ্গে লড়ার জন্যে প্রস্তুত।

নিজের যোদ্ধাদের নিয়ে ডান ধারে রইলো ক্ৰাতাস। প্রথম ঢালের মাথায় তার লম্বা অবয়ব চিনতে পারলাম আমি। চারপাশে ঘিরে আছে সেনাপতিরা, নদীর মৃদুমন্দ বাতাসে কাঁপছে তাদের মাথার আচ্ছাদনের পাখির পালক। আমার ঠিক নিচেই অবস্থান নিয়েছে ট্যানাস আর তার যোদ্ধারা; এতো কাছে, ওদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি আমি। ধীর, অকম্পিত কণ্ঠে আগুয়ান বাহিনীকে নিয়ে আলাপে মগ্ন তারা।

ধ্রুপদি ভঙ্গিতে নিজের যোদ্ধাদের সাজিয়েছে ট্যানাস। সামনের সারিতে রয়েছে ভারী বর্শাধারীরা; তাদের বর্ম পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লেগে অবিচ্ছিন্ন দেয়াল করেছে। বর্শার হাতল মাটিতে ঠেকানো। নরম সূর্যালোকে ঝকঝক করছে ওগুলোর ডগা। যোদ্ধাদের মুখাবয়বে নিষ্ঠুর কাঠিন্য। এদের পেছনেই রয়েছে তীরন্দাজের দল, ধনুকের ছিলো টেনে অপেক্ষায় আছে তারা। প্রত্যেকের পেছনে তীর রাখার থলে হাতে নিয়ে একজন করে বালক দাঁড়ানো। যুদ্ধের উন্মত্ততার মধ্যে শক্রর ছোঁড়া তীর সংগ্রহ করে তীরের মজুত বাড়াবে ওরা। সবচেয়ে পেছনে, সুরক্ষিত অবস্থায় আছে তলোয়ারবাজেরা। ছোটোখাটো এই দলগুলো তড়িৎ গতিতে শত্রু শিবিরের কোনো ফাঁক-ফোকড় গলে যেমন ঢুকে যেতে পারে, তেমনি নিজস্ব বাহিনীর প্রতিরক্ষাবুহ্যের দুর্বল অংশগুলো মেরামত করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

যুদ্ধের ময়দানের কলা-কৌশল অনেকটা বাও খেলার মতো। ধ্রুপদি শুরু, সঠিত প্রতিরক্ষা শতকের পর শতক ধরে যা চলে আসছে। এ বিষয়ে প্রচুর পড়ালেখা করেছি আমি। রণ-কৌশলের উপর আমার লেখা তিনটি স্ক্রোল এখন থিবেসের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণে অবশ্য পাঠ্য।

এই মুহূর্তে ট্যানাসের কৌশল পর্যবেক্ষণ করে কোনো ভুল পেলাম না। আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া লাগলো আমার । কেমন করে এমন শক্তিশালী, অভিজ্ঞ, যুদ্ধের ময়দানের কৌশল সম্পর্কে দারুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি সেনাবাহিনী হেরে যেতে পারে? এরা কখনো কোনো লড়াইয়ে হারে নি।

এবারে আমাদের বাহিনীকে ছাড়িয়ে দূরের ঘূর্ণায়মান, ভীষণ হলুদ ধুলোর মেঘের দিকে তাকালাম । আমার আত্মবিশ্বাস যেনো টলে গেলো। সামরিক ইতিহাসের যে কোনো কিছুর সাথে এর কোনো মিল নেই; আমাদের দেশের দীর্ঘ লড়াইয়ের কোনো সমরনায়কের নেই এ জিনিস দেখার অভিজ্ঞতা। এরা আসলে মরণশীল মানুষ, নাকি গুজবে যেমন বলা হয়েছে সেই অন্ধকারের শক্তি?

এখন এতো কাছে চলে এসেছে পাক খেয়ে ওঠা ধুলোর মেঘ, তার মাঝে কালো কালো অবয়ব দেখতে পাচ্ছি আমি। ঠিক যেমন বলেছিলো নিম্ন-রাজ্যের বন্দীরা, সেই রকম অদ্ভুত জাহাজ এগিয়ে আসছে বালির উপর দিয়ে। কিন্তু জলপথের যে কোনো সময়ের যে কোনো বাহনের চেয়ে দ্রুত এগুলোর গতি, আকৃতিতেও ছোটো। মাটির বুকে যা কিছু চড়েছে আজ অবধি, তার কোনোটিই এর চেয়ে দ্রুতগামী নয়।

চোখ দিয়ে অনুসরণ করা যায় না এই বাহনগুলোকে, ঠিক মশালের চারিপাশে নৃত্যরত পোকা-মাকড়ের মতো দ্রুত এরা। অগ্রসরমান মেঘের ভেতর ঘুরে ঘুরে, নিমিষে অদৃশ্য হয়ে আবার দেখা দিচ্ছিলো। বোঝার কোনো উপায় নেই, সেই একই বাহন দেখা যাচ্ছে বারবার, নাকি অন্য একটা? গুনে দেখার উপায় নেই, কেউ বলতে পারবে না কয়টি বাহন আমাদের যোদ্ধাদের প্রথম সারির উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসছে। ওগুলোর পেছনে, সেই দিগন্তরেখা পর্যন্ত উঁচু হয়ে আছে ধুলোর মেঘ।

যদিও শক্ত-কঠোর ভঙ্গিতে নিজেদের অবস্থানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো আমাদের যোদ্ধারা, ওদের বিস্ময় আর দুশ্চিন্তা ঠিকই টের পেলাম আমি। দলনেতাদের সাথে ট্যানাসের কথোপকথন থেমে গেছে অনেক আগেই। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে শত্রুর প্রদর্শনী দেখছে তারা।

হঠাৎ টের পেলাম, আর সামনে এগোচ্ছে না ধুলোর মেঘ। আকাশে ঝুলে রইলো ওটা; ধীরে পরিষ্কার হতে লাগলো আকাশ। সামনের সারির থেমেপড়া বাহনগুলোর দিকে নজর দিলাম আমি। কতগুলো আছে বোঝা সম্ভব হলো না।

পরে জেনেছিলাম, এই নিশ্চলতা মূলত রাখাল রাজার নিজস্ব কৌশল। তখন বুঝতে পারি নি, এই সময়ে নিজেদের সংগঠিত করে চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো হিকসস্‌ বাহিনী।

ভয়ঙ্কর নীরবতা বিরাজ করছে আমাদের শিবিরে। বাতাসের ফিসফিসানি পর্যন্ত পরিষ্কার শোনা যায়; চারপাশের ছোটো পাহাড়ে লেগে থেকে থেকে গুঙিয়ে উঠছে।

ধীরে, ধুলোর মেঘ থিতিয়ে আসতে সারি সারি হিকসস্‌ বাহন দৃষ্টিগোচর হলো। এখনো যথেষ্ট দূরে, খুটিনাটি বোঝার উপায় নেই; কিন্তু লক্ষ্য করলাম, পেছনের বাহনগুলো সামনেরগুলোর তুলনায় বেশ বড়ো । মনে হলো, কাপড় বা চামড়ার তৈরি আচ্ছাদন দিয়ে ছাদ তৈরি করা হয়েছে ওগুলোর উপর। সেই বিশাল বাহনগুলো থেকে বড়ো বড়ো পাত্রে করে পানি নামানো হচ্ছে সম্ভবত। এতো পানি কারা পান করে, কে জানে। এই ভিনদেশি আক্রমণকারীরা যা-ই করছে, অত্যন্ত দুর্বোধ্য ঠেকছে আমার কাছে। কিছুই বুঝতে পারছি না।

নীরবতা অসহ্য হয়ে উঠলো আমাদের জন্যে। শরীরের প্রতিটি পেশি টানটান হয়ে আছে, স্নায়ুগুলো যেনো ছিঁড়ে যাবে। হঠাই, আবারো জেগে উঠলো শত্রু শিবির।

সামনের সারি থেকে কিছু বাহন সরাসরি এগিয়ে আসতে লাগলো আমাদের উদ্দেশ্যে। ওগুলোর গতি দেখে অবাক বিস্ময়ে বিড়বিড় করে উঠলো যোদ্ধারা। অল্প কিছু সময়ের বিশ্রাম যেনো তাদের গতিবেগ দ্বিগুন করে ফেলেছে। আরো কাছে চলে এলো বাহনগুলো, আবারো বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলাম আমরা যখন টের পেলাম ওগুলোকে টেনে নিয়ে আসছে এক জোড়া অদ্ভুত জীব।

বুনো ওরিক্সের মতো লম্বা, সেই রকমেরই ঋজু আকৃতির; বাঁকা ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে রয়েছে কেশর। অবশ্য ওরিক্সের মতো শিং নেই এদের, কিন্তু দারুন সুন্দর গড়ন মাথার । বড়ো বড়ো চোখ, নাকের পাটা ফুলে উঠছে থেকে থেকে। খুরওয়ালা পা গুলো লম্বা, অদ্ভুত এক ছন্দে পা ফেলছে, যেনো বালিতে ঘষা খাচ্ছে কেবল।

এখনো, এতো বছর পরেও, প্রথমবারের মতো ঘোড়া দেখার উত্তেজনা মনে আছে আমার। এতো সুন্দর প্রাণীর তুলনায় শিকারী চিতা কিছুই নয় । ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো ক্যাম্পের প্রতিটি যোদ্ধা। শুনলাম, আমার কাছের একজন সেনাপতি চেঁচিয়ে বোলছে, নির্ঘাত এই দৈত্যগুলো খুনে, মানুষের মাংস খায়! এ কী ভয়ঙ্কর পরীক্ষায় পড়েছি আমরা?

আতঙ্কে সিটিয়ে গেছে বাহিনীর যোদ্ধারা। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে জন্তুগুলো, ঠিক মাংসাশী সিংহের মতো! কিন্তু নেতৃত্বে থাকা বাহনটি বাঁক ঘুরে আমাদের সামনের সারির সমান্তরালে দাঁড়ালো। পাক খেতে থাকা চাকতির উপর চলছে ওটা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম আমি। প্রথম কয়েক মুহূর্ত এতোটাই বিস্ময়ে ছিলাম, কী দেখছি বিশ্বাস করতে মন চাইলো না। টেনে চলা ঘোড়াগুলোর মতোই জীবনে প্রথমবারের মতো রথ দেখে একেবারে নাড়া খেয়ে গিয়েছিলাম। ঘোড়াদুটোর মাঝখানে লম্বা একটা তক্তা, যা সংযুক্ত আছে একটা কাঠামোর সাথে পরে জেনেছিলাম, তার নাম এক্সেল। উঁচু কাঠামোটা স্বর্ণের পাতায় মোড়া; দুই পাশের দেয়াল নিচু করে তৈরি করা হয়েছে যেনো তীরন্দাজরা সেদিক দিয়ে তীর চালাতে পারে অনায়াসে।

এ সবই এক লহমায় দেখে নিলাম, এরপর আমার সমস্ত মনোযোগ গিয়ে পড়লো সেই ঘুরন্ত চাকতিতে যার উপর ভর করেই এতো দ্রুত আর মসৃণ গতিতে ছুটছে হিকসস্‌ রথ। হাজার বছর ধরে এই পৃথিবীর সবচেয়ে শিক্ষিত আর সভ্য মানুষ আমরা, মিশরীয়রা; কি বিজ্ঞান কি ধর্ম সব বিষয়েই বাদবাকি সমস্ত জাতি আমাদের নিচে রয়েছে। কিন্তু এতো প্রজ্ঞা আর দীক্ষা থাকা সত্ত্বেও এমন কোনো বস্তু তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। ষাঁড়ের শক্তিতে সমতল জমিনের উপর হেঁচড়ে চলে আমাদের স্লেজ; ভীষণ ভারী প্রস্তরখণ্ড স্থানান্তরের জন্যে কাঠের বড়ো বড়ো গুঁড়ি ব্যবহার করি আমরা কিন্তু এ ধরনের অভিনব চাকতির কথা কেউ কখনো শোনেনি।

জীবনে প্রথমবারের মতো চাকা দেখেছিলাম সেদিন; এর সাধারণত্ব আর সৌন্দর্য্য যেনো আমার মাথার ভেতর বিস্ফোরণ ঘটালো। সাথে সাথেই নিজেকে তিরস্কার করলাম, কেননা এ জিনিসের পরিকল্পনা আমার মাথায় আসেনি। এ বস্তু নিঃসন্দেহে অত্যন্ত প্রতিভাবান কোনো এক জাতির, বুঝলাম, আজ এখানে ধ্বংস হয়ে যাবো আমরা ঠিক যেমন নিম্ন-রাজ্যের লাল-ফারাও-এর বাহিনী উড়ে গেছে এদের সামনে।

সোনালি সেই রথটা দ্রুত গতিতে চলে গেলো আমাদের সামনে দিয়ে, তীর-ছেঁড়া দূরত্বের সামান্য বাইরে থেকে। বাহনটা ঘুরে পিছন ফিরতেই চমৎকার ঘুরন্ত চাকতি আর রথ টেনে চলা সেই ভয়ঙ্কর জীবের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাটাতনে বসা লোক দু জনের দিকে তাকালাম। একজন নিঃসন্দেহে রথ-চালক। প্রাণী দুটোর মাথার সাথে আটকে রাখা চামড়ার লম্বা ফিতে টেনে ধরে ওগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে সে। লম্বা অবয়বের যে লোকটি তার পাশে বসে আছে, সে হলো হিকসস্‌ রাজা। রাজকীয় পোশাক দেখে ভুল করার কোনো উপায় নেই।

সাথে সাথেই বুঝলাম, সে একজন এশীয় লোকচকচকে ধাতুর মতো তামাটে ত্বক, বাঁকা নাক। মুখে ঘন কালো দাড়ি, কোঁকড়া, রঙিন ফিতায় সজ্জিত। বুকের বর্মে তামার তৈরি মাছের আঁশের মতো নকশা, মাথার মুকুট লম্বা আর চৌকোনা। মূল্যবান পাথর আর স্বর্ণের উপর বিভিন্ন বিচিত্র দেব-দেবীর মূর্তি খোদাই করা। রথের দুই পাশের দেয়ালে ঝোলানো আছে তার অস্ত্র একেবারে হাতের নাগালে। চামড়ার খাপে রাখা তলোয়ারের ফলা বেশ চওড়া, হাতলটা স্বর্ণ আর হাতির দাঁতে তৈরি। এছাড়াও, গোড়ায় পাখির পালক সমৃদ্ধ তীরে ভর্তি দুটি থলেও রয়েছে। পরে জেনেছিলাম, জমকালো রঙ দারুন ভালোবাসতো হিকসস্‌ রা। রাজার পেছনে রাখা ধনুকটি বেশ অদ্ভুত-অমন ধনুক আমি কখনো দেখিনি এর আগে। মিশরীয় ধনুকের মতো সাধারণ কিছু নয় সেটা; হিকসস্‌ ধনুকের প্রান্ত দুটো বিপরীত দিকে বাঁকানো।

আমাদের যোদ্ধাদের সামনে দিয়ে যেনো উড়ে গেলো হিকসস্‌ রাজাকে বহন করা রথটা, একটু নিচু হয়ে মাটিতে কিছু একটা ছুঁড়ে দিলো রাজা স্বয়ং। লাল-রঙা পতাকার মতো কিছু। সাথে সাথেই প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করে ফেললো যোদ্ধারা। কী করছে সে? কী ওটা? কোনো ধর্মীয় প্রতীক, নাকি হুমকি?

কেঁপে উঠে পতাকাটা হাতে নিলাম আমি, উত্তেজনায় অবশ আঙুলে কোনো অনুভূতি নেই। ঠিক তীরের নাগালের বাইরে দিয়ে উড়ে চলে গেলো সোনালি রথ; এশীয় রাজা আরো একটি পতাকা গেঁথে গেলো জমিনে, তারপর আবারো ফিরে এলো। সিংহাসনে বসা ফারাওকে দেখেছে সে, তার সামনে এসে থামলো রথ। ঘামে ভিজে সপসপ করছে ঘোড়াগুলো, মুখের কোণায় সাদা ফেনা। চোখ দুটো হিংস্র ভঙ্গিতে ঘুরছে কোটরের ভেতর, নাকের পাটা ফুলে উঠছে বারবার। সুগঠিত, গর্বিত মস্তক ঝাঁকাতে উড়লো কাঁধের কেশরগুলো, ঠিক রমনীর চুলের মতো।

ফারাও মামোসকে অভিবাদন জানালো হিকসস্‌ রাজা; ব্যাঙ্গের সুরে হাসলো সে। ভাষার ভিন্নতা সত্ত্বেও তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার ফারাওকে দ্বন্দযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছে সে। এহেন তাচ্ছিল্যে রাগে গর্জে উঠলো মিশরীয় সেনাবাহিনীর যযাদ্ধারা। যেনো বজ্রপাত ঘটলো কোথাও।

আমার নিচে কিছু একটা নড়ে উঠতে দৃষ্টি সরিয়ে দেখলাম, এক সামনে এগিয়ে বিশাল লানাটা ধনুক কাঁধে তুলে নিচ্ছে ট্যানাস। একটা তীর ছুঁড়লো সে। দুধ সাদা আর নীল আকাশের বুকে বাঁকা পথে ছুটলো সেটা। অন্য যে কোনো ধনুকের নাগালের বাইরে হলেও লানাটার নাগালের মধ্যে আছে হিকসস্‌ রথ । গতিপথের শীর্ষে পৌঁছে বাজপাখির মতো ছোটো মারার ভঙ্গিতে নিচে নামতে লাগলো তীরটা। ঠিক এশীয় রাজার বুকের মধ্যখান লক্ষ্য করে । তিনশো গজ পর্যন্ত উড়ে গেছে তীর, শেষ মুহূর্তে বর্ম তুলে ধরলো হিকসস্‌ রাজা-ওটার মধ্যে গেঁথে গেলো তীরটা। এতো চমৎকার দক্ষতার সাথে ঠেকালো সে, অবিশ্বাসে গুঙ্গিয়ে উঠলো মিশরীয় যোদ্ধারা।

এরপর, নিজের পাশ থেকে অদ্ভুত ধনুকটা তুলে নিলো হিকসস্‌ রাজা। ঝটকা মেরে একটা তীর টানলো ধনুকে, টেনেই ছেড়ে দিলো। ট্যানাসের লানাটা থেকে ছোঁড়া তীরের চেয়েও উঁচুতে উঠলো সেটা। ট্যানাসের মাথা ছাড়িয়ে সোজা আমার উদ্দেশ্যে ধেয়ে এলো। নড়তেও যেনো ভুলে গেছি, আমার মাথাটা মাত্র এক হাত দূরত্বের জন্যে রক্ষা পেলো। ফারাও-এর সিংহাসনের পাদদেশে গিয়ে বিধলো তীরটা। অপমানজনক ভঙ্গিতে সিডার কাঠের ভেতর গাঁথা অবস্থায় কাঁপলো ওটা, আবারো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো হিকসস্‌ রাজা; সমতলের উপর দিয়ে সোজা নিজের বাহিনীর দিকে ঘুরিয়ে নিলো রথ।

জানি, শেষ হয়ে গেছি আমরা। এমন দ্রুতগামী রথ আর আমাদের সেরা তীরন্দাজকে অনায়াসে পরাজীত করা প্রান্ত-বাঁকানো ধনুকের বিরুদ্ধে কী করে লড়বো আমরা? রথ বাহিনী যখন একত্র হয়ে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্যে আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো, হতাশার ধ্বনি উঠলো মিশরীয় শিবিরে। এখন বুঝলাম, কেমন করে তলোয়ার বের করার আগেই নিহত হয়েছেন উত্তরের ফারাও।

ছোটার মধ্যেই এক সারিতে চারটি করে রথ সাজিয়ে ফেললো হিকসস্ বাহিনী। ভীষণ গতিতে ধেয়ে আসছে তারা। সম্বিৎ ফিরে পেতে ঢাল বেয়ে দৌড়াতে শুরু করলাম আমি। হাঁপাতে হাঁপাতে ট্যানাসের পাশে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, ওই পতাকাগুলো দিয়ে আমাদের রক্ষণবুহ্যের দুর্বল অংশগুলো চিহ্নিত করেছে সে! ওই অবস্থান দিয়েই মূল আক্রমণ শানাবে এরা!

কেমন করে যেনো আমাদের যুদ্ধ-ক্রম আর রক্ষণবুহ্যে দুর্বলতা জেনে গেছে হিসসসেরা। ঠিক আমাদের বিভাজন রেখায় পতাকা ফেলে গেছে তাদের রাজা। আমাদের মধ্যেই একজন বিশ্বাসঘাতকের কথা তখনো মাথায় এসেছিলো, কিন্তু উত্তেজনায় ভুলে গেছিলাম।

সাথে সাথেই চিৎকার করে পতাকাগুলো তুলে আনার নির্দেশ দেয় ট্যানাস। কিন্তু সময় নেই আর। আমাদের যোদ্ধারা ওগুলো তুলে ফেলার আগেই বর্শা সমেত হিকসস্‌ রথ চড়ে বসলো তাদের উপর। দূরের রথগুলো থেকে ছোঁড়া তীরের আঘাতে ধরাশায়ী হলো বহু যোদ্ধা শত্রু-তীরন্দাজদের নিশানা অপূর্ব।

প্রথম চোটে বেঁচে যাওয়া সৈন্যারা প্রাণপণে ছুটে আসতে লাগলো আমাদের রক্ষণবুহ্যের দিকে। অনায়াস দক্ষতায় তাদের পিষে ফেললো শত্রু রথ। ঠিক যেনো জাদুমন্ত্রের মতো চালকের সামান্য টানে বাধ্যগতের মতো এদিক-ওদিক ঘুরলো ঘোড়াগুলো। সরাসরি শিকারের উপের না চড়ে পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেলো প্রতিটি রথ। তখনই ছুরিগুলো দেখতে পেলাম আমি। দৈত্যাকার কোনো কুমিরের মতো চাকার কেন্দ্রস্থল থেকে চোখা প্রান্ত বেরিয়ে এসেছে।

ঘুরন্ত ছোরার ফলায় আঘাত পেতে দেখলাম আমাদের এক যোদ্ধাকে, যেনো রক্তের মেঘ সৃষ্টি হলো তার চারপাশে। একটা ছেঁড়া হাত ছুটে গেলো আকাশ পানে, শরীরের টুকরো টুকরো খণ্ডগুলোকে পিষে ফেললো রথের চাকা। মিশরীয় যোদ্ধাদের সামনের সারির উদ্দেশ্যে ছুটে চললো শত্রু রথ। শুনলাম, ক্ৰাতাস চিৎকার করে তার সৈন্যদের উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে।

বর্ম সমেত বর্শাধারীদের তৈরি প্রথম রক্ষণ দেয়ালে ঝাঁপিয়ে পড়লো হিকসস্‌ রথ। এতো সহজে সেই দেয়াল ভেদ করে ঢুকে পড়লো, যেনো কুয়াশার পাতলা চাদর। এক নিমিষেই আমাদের এতোদিনের অপরাজেয় রক্ষণবুহ্য ভেঙে তছনছ হয়ে গেলো। একবার মিশরীয় বাহিনীর ভেতরে ঢুকে যেতে পেছনের তুলনামূলক অরক্ষিত সৈন্যদের উপর বৃষ্টির মতো তীরের ঝাক বর্ষণ করে এগিয়ে গেলো হিকসস্‌ বাহিনী।

পেছনের এই বর্বর আক্রমণ সামাল দিতে যখন প্রতিআক্রমণ শুরু করলো। আমাদের যোদ্ধাদের বিচ্ছিন্ন একটা দল, খোলা সমভূমি থেকে আরো একদল হিকসস্‌ রথ ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের উপর। প্রথম চোটেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো আমাদের সেনাবাহিনী। ট্যানাস আর ক্রাতাস এখন পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। এরপর, আরো দ্রুতগামী রথবাহিনী ইতিমধ্যেই ছত্রভঙ্গ হওয়া যোদ্ধাদের ছোটো ছোটো দলে ভাগ করে কচুকাটা করতে লাগলো। এখন আর মিশরীয় সেনাবাহিনীর কোনো সংগঠিত দল নেই রণাঙ্গনে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে বোকার মতো লড়ছে কেউ কেউ।

ধুলোর মেঘ তুলে স্রোতের মতো আসতে লাগলো হিকসস্ বাহিনী। দুই চাকার রথের পেছনে রয়েছে চার চাকার বিশাল রথ-দশজন করে সৈনিক বহন করছে ওগুলো। কাঠামোর দুই ধারে নরম পশমের দেয়াল, মিশরীয় যোদ্ধাদের মরিয়া আঘাত বা তলোয়ারের কোপ অনায়াসে আটকে গেলো সেখানে। রথের উপর বসে বর্শার আঘাতের পর আঘাতে আমাদের সৈন্যদের রক্তাক্ত করে ফেললো হিকসস্‌ যোদ্ধারা। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করলো তারা। ভয়ঙ্কর প্রান্ত বাঁকানো ধনুক থেকে ছোঁড়া তীরের নির্ভুল লক্ষ্যভেদে একে একে লুটিয়ে পড়তে লাগলো মিশরীয় সেনাপতিরা।

এখন আর যুদ্ধ নয়, এক তরফা নরহত্যার উৎসবে পরিণত হয়েছে এই লড়াই। আমার ডান ধারে থাকা কাতাসের অবশিষ্ট যোদ্ধাদের তীর ফুরিয়ে গেছে। মাথার আচ্ছাদনে পাখির পালকের কারণে সমস্ত সেনাপতিদের আলাদা করে চিহ্নিত করে এক এক করে তাদের মারতে লাগলো হিকসস্‌রা। অস্ত্র এবং নেতৃত্ব হারিয়ে শেষ প্রতিরোধ পর্যন্ত গড়তে পারলো না মিশরীয় যোদ্ধারা। দৌড়ে পালাতে চাইলো তারা। অস্ত্র ফেলে রেখে কাছের নদীর উদ্দেশ্যে ছুটলো, কিন্তু হিকসস্‌ রথ অত্যন্ত দ্রুতগামী এক নিমিষে ধরে ফেললো তাদের।

ছোটো পাহাড়ের নিচে ট্যানাসের দলের অভ্যন্তরে আশ্রয়ের জন্যে ছুটলো এবারে বেশ কজন সৈনিক। বিশৃঙ্খল, ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় জট পাকিয়ে ফেললো ট্যানাসের যোদ্ধাদের সাথে। তখনো লড়াই করার মতো কিছু সৈনিক ছিলো ট্যানাসের কাছে, কিন্তু সক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়লো ভীতি; এলোমেলো ছুটে পালাতে চাইলো ওর লোকেরা। হিকসস্‌ রথ হিংস্র নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের উপর।

এমন বিশৃঙ্খলা, রক্তাক্ত হত্যাযজ্ঞ আর শোচনীয় পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও নীল বাহিনী তখনো অবিচল। পরাজিত লোকেদের ভীড়ে তারা যেনো এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। শত্রু রথ পর্যন্ত তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি। বিজ্ঞ সমরনায়কের মতো তাদের নিয়ে পিছিয়ে গিয়েছিলো ট্যানাস, পাথুরে-উঁচু-নিচু একটা স্থানে উঠে গেছে যেখানে হিকসস্‌ রথ পৌঁছুতে পারবে না। ফারাও-এর সিংহাসনের চারিদিকে অপ্রতিরোধ্য দেয়াল তৈরি করে রেখেছে নীল কুমির বাহিনী।

রাজার পাশে থাকায় পুরোটা সময়ই এই বীরদের কেন্দ্রে ছিলাম আমি। ছত্রভঙ্গ ডান পাশ থেকে মরিয়া লড়ে আমাদের সাথে যোগ দিতে সমর্থ হলো ক্ৰাতাস। ওর মাথার আচ্ছাদনের পাখির পালক হিকসস্‌ তীরন্দাজদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই বৃষ্টি মতো তীর ছুটে আসতে লাগলো আমাদের উদ্দেশ্যে। শেষমেষ, অক্ষত অবস্থাতেই আমাদের রক্ষণবুহ্যে প্রবেশ করতে পারলো সে। আমার দিকে চোখ পড়তেই কর্কশ হাসলো ক্ৰাতাস। সেথ্‌ এর কসম, টাইটা, ছোট্ট রাজকুমারের জন্যে প্রাসাদ তৈরির চেয়ে ঢের মজা এখানে! নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে যেখানে লড়তে হচ্ছে আমাকে, উত্তর দেওয়ার ফুরসত কোথায়?

ট্যানাস এবং ক্ৰাতাস সিংহাসনের কাছে ঘেষে আসে। গর্দভের মতো তখনো হাসছিলো ক্ৰাতাস। ফারাও-এর সমস্ত সম্পদ দিলেও এটা ফেলে রেখে যাবো না আমি! ওই হিকসস্ স্লেজ আমার চাইই চাই

অভিবাদনের ভঙ্গিতে তার শিরস্ত্রাণ তলোয়ারে চ্যাপ্টা মাথা দিয়ে ঠুকে দেয় ট্যানাস। হালকা স্বরে বললেও ওর অভিব্যক্তি ছিলো সর্বহারার। সম্রাটের উপস্থিতিতে এইমাত্র যুদ্ধ এবং সাম্রাজ্য হারিয়েছে সে।

এখানে আর কিছুই করার নেই, ক্ৰাতাসকে বললো ও। দেখা যাক, যেমন ছুটতে পারে, তেমন করে তারাতে পারে কি না এরা। নদীর উদ্দেশ্যে ফিরে চলো সবাই! কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সিংহাসনের কাছে ছুটে গেলো ওরা দু জন।

ওদের মাথার উপর দিয়ে আমাদের ছোট্ট রক্ষণবুহ্যের বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, নদীর উদ্দেশ্যে ছুটছে যোদ্ধারা এখনো হিকসস্‌ রথ তাড়া করে ফিরছে তাদের।

দলছুট হয়ে হিকসস্‌ রাজার সোনালি রথ হঠাৎ করেই আমাদের দিকে রওনা হলো। পাথরের দেয়ালের সামনে এসে থেমে দাঁড়ালো ওটা। সহজেই পাদানীর উপর দাঁড়িয়ে প্রান্ত-বাঁকানো ধনুক হাতে তুলে নেয় হিকসস্‌ রাজা। মনে হলো, যেনো আমার দিকে তীর তাক করছে। মাথা নিচু করে ফেলতে গিয়ে বুঝলাম, ওটার নিশানা আসলে আমি নই। বাতাসের তীক্ষ্ণ শব্দে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো সেই তীর; ঘাড় ঘুরিয়ে ওটার গতিপথ দেখতে লাগলাম আমি। ফারাও-এর বুকের উপরিভাগে আঘাত করলো তীরটা; অর্ধেক সেঁধিয়ে গেলো মাংস ফুড়ে।

কর্কশ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে টলোমলো অবস্থায় সিংহাসনে টিকে থাকলেন ফারাও। কোনো রক্ত বেরুচ্ছে না ক্ষতটা থেকে, মুখ বন্ধ পুরোপুরি। একপাশে কাত হয়ে সামনে ঝুঁকে পড়লেন ফারাও, পড়ে যাওয়ার আগে ছুটে গিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলাম আমি তাকে। বিশাল ওজনের ধাক্কায় হাঁটুর উপর পরে গেলাম, সোনালি রথের প্রস্থান দেখতে না পেলেও হিকসস্‌ সম্রাটের ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি কানে বাজলো।

ফারাওকে সোজা করে ধরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছি, ট্যানাস ঝুঁকে এলো তার উপর । কতোটা মারাত্মক আঘাত? জানতে চাইলো সে।

উনি শেষ হয়ে গেছেন, নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো শব্দ ক টা। যে কোণে ঢুকেছে তীর, আর যে অবস্থানে ঢুকেছে ওটা এর একটা ফলাফলই হতে পারে। কিন্তু মহান ফারাও মৃত্যুশয্যায় আছেন, এ খবর পেলে আমাদের যোদ্ধাদের হৃদয় ভেঙে যাবে ভেবে চুপ করে রইলাম। শেষমেষ জানালাম, বেশ খারাপ আঘাত। তবে রাজকীয় জলযানে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো এখনো কিছু করা যাবে।

কেউ একটা বর্ম দাও আমাকে! হুঙ্কার দিয়ে উঠে ট্যানাস। এরপর ওটার উপর শুইয়ে দিলো ফারাওকে। এখনো পর্যন্ত রক্ত বেরোয়নি তার দেহের ক্ষত থেকে, কিন্তু আমি জানি, সুরার পাত্রের মতো তার বুকের ভেতরটা ভরে যাচ্ছে রক্তে। তীরের মাথাটা খুঁজে বের করতে চাইলাম, কিন্তু পিঠ ফুঁড়ে বেরোয়নি ওটা। বুকের খাঁচার গভীরে কোথাও আটকে গেছে। বের হয়ে থাকা প্রান্তটা ভেঙে ফেলে দিয়ে, লিনেনের চাদর দিয়ে ঢেকে দিলাম তার শরীর।

টাইটা, ক্ষীণ স্বরে বলে উঠলেন ফারাও। আর কি আমার সন্তানকে দেখতে পাবো না?

নিশ্চই, মহান মিশর। শপথ করে বলছি।

আর, আমার বংশধারা টিকে থাকবে?

ঠিক তাই। আমন রার ভবিষ্যতের ছবি তা-ই তো বলে।

দশজন শক্ত লোক সামনে এগোও! গর্জে উঠে ট্যানাস। ওর চারপাশে ঘিরে আসে যোদ্ধারা। বর্মের উপর শায়িত রাজাকে উঁচু করে ধরে তারা।

কাছিমের আকৃতি নাও! আমার সাথে এসো, বীর সেনারা! একে অপরের বর্ম জোড়া লাগিয়ে একটা দেয়ালের মতো তৈরি করলো যোদ্ধারা, ফারাওকে ঘিরে।

সবাই জাহাজের কাছে ফিরে চলো! দ্রুত!

আমাদের পাথুরে আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আসতেই হিকসস্‌ রথ তেড়ে এলো।

সৈন্যদের নয়, জন্তুগুলোকে মারো! সঠিক উপায় বাতলেছে ট্যানাস! প্রথম রথ, আমাদের কাছাকাছি চলে আসতেই লানাটা কাঁধে তুলে নেয় সে। তার সঙ্গীরা সবাই একসাথে নিজেদের ধনুক তুলে নেয়।

জমিন বন্ধুর হওয়ার কারণে আমাদের ছোঁড়া বেশিরভাগ তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। কিছু কিছু গিয়ে মাথা ঠুকলো রথের কাঠামোতে; আবার কিছু তীর ঘোড়াগুলোর বুকের চারপাশের বর্মে লেগে ছিটকে গেলো।

কেবল একটি ধনুক জায়গামতো আঘাত হানলো। লানাটা থেকে উড়ে যাওয়া তীরটা বাম ধারের ঘোড়ার কপালে সেঁধিয়ে গেলো পুরোপুরি। ঢালু জমিনে আছাড় খাবার মতো করে পড়লো ওটা; দড়ি-দড়া সমেত টেনে নিয়ে চললো রথের কাঠামো, সঙ্গের ঘোড়াটাও ধরাশায়ী হলো নিমিষেই। যন্ত্রণায় পা ছুঁড়তে লাগলো, ধুলোর ঝড় উঠলো চারপাশে। উল্টে পড়া রথ থেকে শূন্যে নিক্ষিপ্ত হলো আরোহীরা। অপর রথগুলো প্রাণপণ চেষ্টায় ধ্বংসাবশেষ এড়িয়ে ডানে বাঁয়ে ছুটলো। উল্লাসমুখর চিৎকার ধ্বনিত হলো নীল বাহিনীর মধ্য থেকে; ভয়ঙ্কর সেই দিনে এ-ই ছিলো আমাদের প্রথম সাফল্য। কর্কশ কণ্ঠে রণ-সংগীত গেয়ে উঠলো তারা, ট্যানাসের নেতৃত্বে। নদীর উদ্দেশ্যে ছুটে চললাম আমরা। প্রথমবারের মতো আক্রমণ শানাতে ইতঃস্তত করলো হিকসস্‌ দের রথবাহিনী। সহযোগী রথের দুর্গতি দেখেছে তারা। তিনটি রথ এবারে আমাদের কাছিমের খোলের আকৃতির সামনের দিকে ধেয়ে আসে।

জম্ভগুলোর মাথায় আঘাত করো! চেঁচিয়ে উঠলো ট্যানাস, তার ছোঁড়া তীরে আবারো লুটিয়ে পড়লো একটা ঘোড়া। পাথুরে জমিনে উল্টে পরে টুকরো টুকরো হলো রথ। তার সঙ্গী দুটো সাথে সাথে দূরে সটকে পড়তে লাগলো। ধ্বংসপ্রাপ্ত রথটাকে যাত্রাপথে পেয়ে হিংস্র মিশরীয় যোদ্ধারা শত্রু সৈন্য আর ছটফট করতে থাকা প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলতে চড়াও হলো।

দুটো রথের দুরবস্থা দেখে আমাদের ছোট্ট দলটাকে আক্রমণে ক্ষান্ত দিলো হিকসস্‌ বাহিনী, কাদাটে মাঠ আর জলমগ্ন সেচের জমিনের উদ্দেশ্যে দ্রুত এগোতে লাগলাম আমরা । শুধুমাত্র আমি বুঝতে পারলাম, জলায় আমাদের ছুঁতে পারবে না শত্রুর চাকা।

রাজাকে বহনকারী বর্মের পাশাপাশি ছুটলেও যোদ্ধাদের শরীরের ফাঁক-ফোকড় দিয়ে যুদ্ধের ময়দানের বিভিন্ন দৃশ্য আমার চোখে পড়ছিলো ।

এমন নৃশংসতা আমি কখনো দেখিনি। প্রাচীনকালের কোনো যুদ্ধের এমন ভয়াবহ বর্ণনা পড়িও নি। আহত বা সুস্থ-আমাদের লোকেদের ধরে ধরে জবাই করছিলো হিকসস্‌ বর্বরেরা। আবনুবের সমভূমি যেনো রক্তাক্ত প্রান্তর। জায়গায় জায়গায় জট পাকিয়ে পরে আছে মিশরীয় যোদ্ধাদের মৃতদেহ।

এক হাজার বছর ধরে আমাদের সেনাবাহিনী ছিলো অপরাজেয়, আমাদের তরবারি শাসন করেছে পুরো পৃথিবী। এইখানে, আবনুবের সমভূমিতে আজ একটি যুগ শেষ হয়েছে। এমন দুরবস্থার মধ্যেও গেয়ে চললো নীল বাহিনীর যোদ্ধারা; লজ্জায়, শোকে, অপমানে সবার চোখে পানি–তবুও গাইছে তারা।

আর একটু সামনেই প্রথম জলমগ্ন মাঠ। তিনজন সৈন্য সমেত আরো একটি রথ। হঠাৎ কোণাকুনিভাবে ধেয়ে এলো আমাদের ছোট্ট দলটার দিকে। বৃষ্টির মতো তীর ছুটে গেলো সেদিকে, কিন্তু হেষারবে মুখরিত ঘোড়াগুলোকে চাবুক কষিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো শত্রু রথ। ট্যানাসকে দুই বার তীর ছুঁড়তে দেখলাম আমি। প্রতিবারই খানাখন্দে পড়ে নড়ে যাওয়ায় টলে গেলো ওর নিশানা। পরস্পর জোড়া লেগে থাকা বর্মের উপর হামলে পড়লো হিকসস্‌ রথ।

ঘূর্ণায়মান চাকার কেন্দ্রে বসানো ধারালো ফলার আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো ফারাওকে বহনকারী দুজন সৈন্য। উল্টে মাটিতে পড়ে গেলেন আহত ফারাও। হিকসস্‌ ফলার হাত থেকে বাঁচাতে নিজের শরীর দিয়ে তাঁকে আড়াল করে নিঃসারে পড়ে রইলাম আমি। অবশ্য, যেমন এসেছিলো, ঝড়ো গতিতে আমাদের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে গেলো রথ। কোনোক্রমেই আটকে পড়তে চায় না তারা। তলোয়ারধারী যোদ্ধারা কিছু করার আগেই খোলা ময়দানে চলে গেলো হিকসস্‌ রথ।

নিচু হয়ে আমাকে টেনে তুললো ট্যানাস। এখনই যদি মরে যাও, আমাদের বীরত্বগাথা কে লিখবে হে? চিৎকার করে যোদ্ধাদের একত্র করে আবারো ফারাওকে বহন করে নিকটতম জলার উদ্দেশ্যে রওনা হলো সে।

দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসা রথের চাকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি, কিন্তু একবার পিছু ফিরে তাকালাম না। এমনিতে আমি বেশ ভালো দৌড়বিদ, এখন যখন জান হাতে করে ছুটছি, ফারাওকে বহনকারী যোদ্ধাদের গতি আমার কাছে কিছুই নয়। এক লাফে জলমগ্ন জায়গাটা পেরুতে চাইলাম, কিন্তু যথেষ্ট বড়ো ওটা; শেষমেষ এক হাঁটু কাদায় মুখ থুবরে পড়লাম। আমাকে অনুসরণ করা রথটা বাড়ি খেলো জলাভূমির পাড়ে, সাথে সাথে ফেটে গেলো একটা চাকা। রথকাঠামো উল্টে পড়লো জলের মধ্যে, আর একটু হলে পিষে ফেলেছিলো আমাকে। যাই হোক, নিজেকে সামলে নিয়ে আবারো ছুটলাম।

অসহায় অবস্থায় কাদাটে জলায় পড়ে থাকা শত্রুসৈন্য আর ঘোড়াগুলোকে তলোয়ারের কোপে কচুকাটা করে ফেললো আমাদের যোদ্ধারা। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ভালো করে দেখলাম রথটা।

উল্টো পরে থাকা রথের একটা চাকা তখনো ঘুরছিলো। এক হাতে ধরলাম ওটাকে, আমার আঙুলে বাড়ি খেতে দিলাম । তিনবার শ্বাস নিতে যতোটুকু সময় লাগে, কেবল ততক্ষণ দেখলাম; কিন্তু ওইটুকুই যথেষ্ট ছিলো। যে কোনো হিকসসের মতো এখন চাকা বানাতে পারবো আমি, মনে মনে তখনি নকশা করা শুরু করে দিলাম।

সেথ এর পাছার দুর্গন্ধের কসম, টাইটা আমাদের সবাইকে মারতে চাও তুমি! দিবাস্বপ্ন বন্ধ করো! ক্ৰাতাস চেঁচিয়ে উঠে বললো।

ঘোর ভেঙে, রথের এক পাশের দেয়ালে রাখা থলে থেকে একটা প্রান্ত বাঁকানো ধনুক আর গোটা দুই তীর নিয়ে নিলাম আমি। পরে কখনো পরীক্ষা করে দেখা যাবে । এরপর, জলার পানি ভেঙে ছুটতে লাগলাম। আবারো আক্রমণ শানালো হিকসস্‌ রথ বাহিনী; জলাভূমির পার ধরে আমাদের পাশাপাশি ছুটতে লাগলো ওগুলো। আঁকে ঝকে তীর ছুটে আসছে আমাদের দিকে।

রাজাকে বহনকারী যোদ্ধারা আমার থেকে অনেক এগিয়ে গেছে ততক্ষণে। আর অনুসরণ করার উপায় রইলো না রথ বাহিনীর, সামনে শুকনো পথ শেষ হয়ে গেছে। হতাশার ধ্বনি বেরুলো তাদের মুখ থেকে। একের পর এক তীর ছুটে যাচ্ছে আমার চারপাশ দিয়ে, এরই মধ্যে প্রাণ হাতে করে ছুটলাম। একটা তীর আমার কাঁধে আঘাত করলো, কিন্তু শরীরে না ঢুকে পিছলে গেলো ওটা। পরে দেখেছিলাম, সামান্য একটু নীলাফোলা ছাড়া আর তেমন কিছু হয়নি আমার।

যদিও অনেক পিছনে ছিলাম যোদ্ধাদের থেকে, নীল নদের তীরে পৌঁছুতে পৌঁছতে ধরে ফেললাম ওদের। যুদ্ধ-ফেরত মিশরীয় সৈন্যে ভরে গেছে দুই তীর। বেশিরভাগের কাছেই কোনো অস্ত্র নেই; অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই আহত। সবার একই উদ্দেশ্য যতো দ্রুত সম্ভব জাহাজে চড়ে থিবেস প্রত্যাবর্তন।

আমাকে খুঁজে পেতে ডাকলো ট্যানাস। ফারাও-এর দায়িত্ব তোমার হাতে দিলাম, টাইটা। রাজকীয় জলযানে নিয়ে জীবন বাঁচানোর জন্যে যা করার, করো।

তুমি ফিরছো কখন? জানতে চাইলাম।

এখানে, আমার যোদ্ধাদের সাথে থাকবো আমি। এদের সবাইকে বাঁচাতে হবে, এক এক করে জাহাজে তুলে দেবো এখন। দ্রুত আমার দিকে পিছন ফিরে চেঁচিয়ে সেনাপতিদের ডেকে নির্দেশ দিতে লাগলো ট্যানাস।

রাজার কাছে ফিরে গিয়ে ঝুঁকে দেখলাম আমি। এখনো বেঁচে আছেন তিনি। পরীক্ষা করে বুঝলাম, অর্ধ-সচেতন অবস্থায় আছেন। সরীসৃপের মতো শীতল হয়ে গেছে ত্বক, হালকা শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। ক্ষত থেকে উঠে আসা তীরের মধ্যে সামান্য একটু রক্ত লেপ্টে আছে। কিন্তু বুকে কান পেতে শুনতেই টের পেলাম, প্রতিবার শ্বাসের সাথে সাথে গুড়গুড় আওয়াজ করে ফুসফুঁসে ঢুকছে রক্ত। সরু ধারায় মুখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। যা কিছু করার, খুব দ্রুত করতে হবে আমাকে। চিৎকার করে একটা নৌকা ডাকলাম।

ফারাওকে বহনকারী সৈন্যরা একটা তলা-সমান নৌকায় উঠিয়ে দিলো তাঁকে। আমি চড়ে বসতেই রওনা হলো ওটা, দূরে, নীল নদের মূল স্রোতপ্রবাহে নোঙর-ফেলা রাজকীয় জলযানের উদ্দেশ্যে দ্রুত দাঁড় বাইতে লাগলো দুজন।

*

আমাদের দেখে জাহাজের পাশে ভীড় করে এলো সভাষদবর্গ। রাজবধূ, পুরোহিত, রাজকুমারীসহ সাধারণ লোক এরা যুদ্ধে যাদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। কাছাকাছি এসে পড়তে ভীড়ের মাঝে আমার কর্ত্রীকে চিনতে পারলাম। কোলে শিশু সন্তান, ওর মুখ ভয়ে-দুশ্চিন্তায় পাণ্ডুর।

জাহাজের লোকজন যখন বুঝতে পারলো, আমার সাথে নৌকায় শায়িত আছেন ফারাও, মুখ থেকে ছলকে রক্ত পড়ছে তার আহাজারি আর কান্নায় ভারী হয়ে গেলো বাতাস। মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো মেয়েরা, আর পুরুষেরা ভেজা চোখে তাকিয়ে থাকলো।

জাহাজের পাশ দিয়ে রাজাকে উঠানোর সময় সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলো মিসট্রেস। রানি হিসেবে ফারাও-এর সমস্ত পরিচর্যার দায়িত্ব তার উপরই বর্তায়। অন্যরা সরে গিয়ে পথ করে দেয় তাকে। ঝুঁকে, ফারাও-এর মুখমণ্ডল থেকে রক্ত আর কাদামাটি মুছে দিলো লসট্রিস। ওকে চিনতে পারলেন রাজা; বিড়বিড় করে পুত্রের নাম ধরে ডাকলেন। শিশুপুত্রকে এগিয়ে দিতে হাত বাড়িয়ে ওকে ধরতে চাইলেন ফারাও, সরু এক চিলতে হাসি ফুঁসে উঠলো তার ঠোঁটে; কিন্তু শক্তি নেই শরীরে। এক পাশে ঝুলে পড়লো তাঁর হাত ।

দ্রুত ফারাওকে তাঁর প্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলাম আমি জাহাজের নাবিকদের। আমার কাছে এসে নরম অথচ উদ্বিগ্ন স্বরে লসট্রিস জানতে চাইলো, ট্যানাস কোথায়? ও ঠিক আছে? টাইটা, সত্যি কথা বলো!

ট্যানাস নিরাপদ। ওর কিছুই হয়নি। ইন্দ্রজালের কথা তো জানো তুমি। এ সমস্তই লেখা ছিলো। এখন আমার সঙ্গে এসো, রাজার পরিচর্যায় তোমার সাহায্য প্রয়োজন। মেমননকে পরিচারিকাদের কাছে ছেড়ে দাও কিছু সময়ের জন্যে।

ফারাও-এর মতোই আমিও কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে আছি। রানি লসট্রিস এবং আরো দুজন রাজবধুকে বললাম, ফারাওকে গোসল করিয়ে পরিষ্কার পোশাক পরিয়ে দেওয়ার জন্যে। ইত্যবসরে, নদী থেকে তোলা বালতিভর্তি জল দিয়ে নিজে গোসল সেরে নিলাম। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অপরিচ্ছন্নতা রোগীর জন্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর।

শরীরে পানি ঢালতে ঢালতেই পুব কোণে, যেখানে জলাশয়ের নিরাপত্তায় টিকে আছে আমাদের বেঁচে যাওয়া যোদ্ধারা সেদিকে তাকিয়ে দেখলাম। লজ্জা আর ভয়ে আমার হৃদয় পরিপূর্ণ এই ছন্নছাড়া, তাড়া-খাওয়া লোকগুলো নাকি মিশরের শক্তিশালী সেনাবাহিনী। এরপর, ট্যানাসকে দেখতে পেলাম, আহতদের পরিদর্শন করছে। যখনই ওকে দেখতে পেলো সেনারা; কাদা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তারা। এমনকি, তার নামে জয়ধ্বনি পর্যন্ত করছিলো কেউ কেউ।

এখন যদি কোনো মতে এখানে প্রবেশ করতে পারে শত্রুরা, হত্যাযজ্ঞের ষোলোকলা পূর্ণ হবে। আমাদের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর একজন সদস্যও বেঁচে থাকবে না সেক্ষেত্রে, একা ট্যানাস আর কী করবে? কিন্তু ভালো করে তাকিয়েও শত্রু শিবিরের কোনো চিহ্নও দেখতে পেলাম না জলার ধারে।

এখনো, আবনুবের সমভূমির উপর ঝুলে আছে ধুলোর মেঘ, অর্থাৎ রথবাহিনী এখনো সক্রিয় সেখানে, তবে শত্রুর আক্রমণের ভয় না থাকলে এখনো কিছু করার আছে ট্যানাসের। রথ দিয়ে হয়তো যুদ্ধ জেতা যায়, কিন্তু পায়েচলা সৈনিক শুধু পারে বিজয় ধরে রাখতে। পরবর্তী বছরগুলোতে এই জিনিসটি শিখেছি আমি।

নদীর তীরে এখন যে যুদ্ধ চলছে, এ ট্যানাসের একান্ত ব্যক্তিগত কাজ। ওদিকে, রাজকীয় জাহাজের ভেতরে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধে নামতে হচ্ছে আমাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *