৭. আঘাত পেয়েছে হুরোতাস

মাথায় বেশ ভালোভাবেই আঘাত পেয়েছে হুরোতাস। কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যাচ্ছে মুখ, এবং পুব তীরে পৌঁছানোর পর যখন পরিস্থিতি নিরাপদ হয়ে এলো তখনো সোজা হয়ে বসতেই পারছিল না সে। অগত্যা আমি নিজে এগিয়ে গিয়ে ওকে খোলের সাথে হেলান দিয়ে সোজা করে বসিয়ে দিলাম। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই আবার পড়ে গেল সে। একা একা আমার পক্ষে স্রোতের বিপরীতে এই ভারী নৌকা দাঁড় টেনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, বুঝতে পারলাম আমি। শেষ পর্যন্ত নৌকার সাথে একটা দড়ি বেঁধে নিলাম, তারপর তাই ধরে টেনে নিয়ে চললাম। অনেক সময় লেগে গেল কাজটা করতে। যখন আমাদের শিবিরের কাছাকাছি পৌঁছলাম তখন নেকড়ের প্রহর শুরু হয়ে গেছে। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোরের ঠিক মাঝামাঝি সময়কে বলা হয় নেকড়ের প্রহর, এবং এই সময়ের মাঝেই বেশির ভাগ মানুষ মারা যায়। ঘুম সবচেয়ে গাঢ় হয় এই সময়ে, দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠে অনেক বেশি ভয়ংকর। আর এই সময়েই ঘুমহীন ব্যক্তিদের তাড়া করে ফেরে তাদের মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা ভয়। এমন একসময় যখন প্রেতাত্মা আর দানবরা হয়ে ওঠে সবেচেয়ে শক্তিশালী। নেকড়ের প্রহরেই মৃত ব্যক্তিদের জন্য সবচেয়ে বেশি শোক করি আমরা।

তবে পৌঁছানোর পর দেখলাম আমাদের শিবিরের সবাই জেগে আছে, এবং চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে সেখানে। দাগীমুখোর আক্রমণ থেকে তিনজন পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিল, আমাদের আগেই শিবিরে ফিরে এসেছে তারা। এবং সবাইকে জানিয়েছে যে আমি এবং হুরোতাসসহ আমাদের দলের প্রত্যেকে মারা পড়েছে এক ভয়ংকর তীরন্দাজের আক্রমণে। ফলে তেহুতি ও সেরেনাসহ রাজপরিবারের নারী সদস্যরা ষোলোজন রাজা এবং তাদের দরবার, সেইসাথে আমাদের পুরো সেনাবাহিনীর মাঝে নেমে এসেছে তীব্র শোকের ছায়া। সূর্য ডোবার পর থেকেই মৃত্যুদেবতার প্রতি উৎসর্গ করে শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে শিবিরে, সেইসাথে মৃত আত্মাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গাওয়া হচ্ছে শোকগাথা।

শিবিরের মাঝে সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য খালি মদের বোতল। বোঝা গেল এগুলোর সাহায্যেই শোক ভুলে থাকার চেষ্টা করেছে সবাই। পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফালি ফালি করে ফেলেছে মেয়েরা, আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে নিজেদের চেহারা। মাটিতে পা ঠুকে আর বুক চাপড়ে শোক প্রকাশ করেছে পুরুষরা, সেইসাথে শপথ নিয়েছে প্রতিশোধের। আমাদের প্রত্যেকের প্রাণের বদলে শত্রুপক্ষের এক শ জনকে হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছে তারা।

নেকড়ের প্রহর শুরু হওয়ার সাথে সাথে যখন আকাশের সর্বোচ্চ অবস্থানে এসে পৌঁছায় ইনানার তিনটে তারা; ঠিক সেই সময় অন্ধকারের মাঝ থেকে শেষকৃত্যের আগুনের আলোতে এসে দাঁড়ালাম আমি। আমার বাহুতে ভর দিয়ে রয়েছে প্রায় অচেতন রাজা হুরোতাস। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে আমাদের পোশাক, কাদাপানি মেখে একাকার। যে কারো ধারণা হতে পারে যে কবর থেকে উঠে এসেছি আমরা। কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে আমাদের চেহারা, চোখগুলো বিস্ফারিত; যেন পাতাল এবং মৃত্যুর দেবতা হেডিসের প্রবেশদ্বার পেরিয়ে এসেছি আমরা।

আমাদের দেখতে পাওয়ার সাথে সাথে মৃত্যুর মতোই নীরবতা ভর করল সবার ওপর। ভয়ে পিছিয়ে গেল সবাই, ধরেই নিয়েছে যে মৃত্যুর ওপার থেকে উঠে এসেছি আমরা। বেপরোয়া হয়ে উপস্থিত সবার মাঝ থেকে সেরেনা আর তেহুতিকে খুঁজে বের করতে চাইলাম আমি, যাতে ওদের বিশ্বাস করানো যায় যে আমরা মরিনি, বেঁচেই আছি। দেখলাম দুটো অগ্নিকুণ্ডের মাঝখানের জায়গাটায় পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। দুজনই বিস্মিত, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ওদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু বলার জন্য মুখ খুললাম আমি; কিন্তু স্বাভাবিক কোনো কথার বদলে স্রেফ একটা রোমহর্ষক গোঙানি বেরিয়ে এলো আমার গলা দিয়ে। তার পরেই মাটিতে পড়ে গেলাম আমি, আমার ওপর পড়ল হুরোতাস। এরপর আমার যা মনে আছে তা হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী দুই নারী আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, চুমুয় চুমুয় ভরিয়ে দিচ্ছে।

হঠাৎ করেই অদ্ভুত রকমের বাস্তব একটা অনুভূতি হলো আমার। মনে হলো যেন মরে গেছি আমি, তারপর প্রবেশ করেছি স্বর্গে।

কয়েক দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল হুরোতাস। মাথার আঘাতের জন্য একটা দারুণ ওষুধ আছে আমার কাছে, সেটা এবার জাদুর মতো কাজ করল। অনেক বছর আগে হিকসসদের হাত থেকে পালিয়ে রানি লসট্রিসকে নিয়ে আমি যখন নীলনদের উৎসমুখের দিকে পালিয়ে গিয়েছিলাম তখন এক হাবশি ওঝা আমাকে দিয়েছিল এই ওষুধটা।

তবে ইউনিকনে টানা রথে চড়ে ওই রহস্যময় দাগীমুখো লোকটার আগমনে আমাদের যুদ্ধপ্রস্তুতিতে বেশ ভালো রকমের একটা ছেদ পড়ল। সবাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে এখন। কেউ জানে না যে তাকে কোথা থেকে জোগাড় করেছে উটেরিক; কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণ হয়ে গেছে যে, নীলনদের পশ্চিম তীরে এখন শুধু তারই একচ্ছত্র রাজত্ব। অনায়াসে আমাদের সৈন্যদের বারবার প্রতিহত করছে সে। আমরা যখনই নদী পার হয়ে আবু নাসকোসে উটেরিকের দুর্গ দখল করার চেষ্টা করি না কেন ইউনিকর্ন বাহিনী নিয়ে আমাদের তাড়া করে সেই রহস্যময় তীরন্দাজ। অকল্পনীয় দক্ষতার সাথে একের পর এক তীরবর্ষণ করে সে আমাদের ওপর, ফলে পালিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না আমাদের। আমাদের রথে আঘাত করেছিল এমন বেশ কয়েকটা তীর সংগ্রহ করতে পারলাম আমি, আরো কয়েকটা তীর পাওয়া গেল আমাদের লোকদের মৃতদেহের সাথে। তীরগুলো দেখতে আমাদের তীরের চাইতে খুব বেশি আলাদা কিছু নয়। কিন্তু নিজের ওই ধনুকটা দিয়ে অনায়াসে আমাদের চাইতে দ্বিগুণ দূরত্বে তীর ছুঁড়তে পারে লোকটা। বেশ কয়েকবার তাকে তীর ছুঁড়তে দেখলাম আমি। বুঝলাম এক একবারে একসাথে চার-পাঁচটা তীর ছুঁড়ে দিতে পারে সে এবং তাদের ভেতর খুব কমই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

আমাদের সৈনিকদের মাঝে সবচেয়ে সাহসী ছিল যারা তারাও এখন ধীরে ধীরে নিরাশ হয়ে পড়ছে। মিত্র রাজাদের কেউ কেউ তো বিড়বিড় করে বলে বেড়াচ্ছে যে এই অভিযান ইতোমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে, এখন এসব ঝামেলা থেকে সরে আসা উচিত। জাহাজে করে সাগর পাড়ি দিয়ে উত্তরে ফিরে যেতে চায় তারা, খুব সম্ভব নিজেদের বুড়ি মুটকি বউদের কোলে শুয়ে ঘুমাতে ইচ্ছুক।

তবে এমনকি সব সময়ের আশাবাদী আমি নিজেও যখন ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠছি তখন ওদের ঠিক দোষ দেওয়া যায় না। রাতের বেলায় প্রায়ই উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখি ইদানীং, তাতে আমার প্রিয় দেবী ইনানা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। এটা বুঝতে পারছি যে আমার প্রার্থনা এবং পুজোর কোনো জবাবই দিচ্ছে না সে। ক্ষতবিক্ষত চেহারার ওই শত্রু নিঃসন্দেহে অন্য কোনো স্থান এবং কাল থেকে উঠে এসেছে; এবং তার মোকাবিলা করতে হলে আমার ইনানার সাহায্য একান্তভাবে দরকার। ধারণা করছি যে, আবু নাসকোস বরাবর নীলনদের বুকে যে চারটে দ্বীপ রয়েছে সেগুলোকেই আপাতত নিজের বাসস্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে দেবী। তাই তাকে পেতে হলে ওখানে খুঁজতে হবে আমাকে।

*

তিন রাত পর অভিযানের ক্লান্তি থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলাম আমি। সেই দিন রাতে চাঁদ ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম, তারপর ঘুমন্ত শিবিরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে। প্রহরীরা জানে যে প্রায়ই রাতে এমন ঘুরে বেড়াই আমি, তাই কেউ কিছু বলল না। নীলনদের কিনারে এসে নেমে পড়লাম পানিতে, তারপর সাঁতার কাটতে শুরু করলাম। একবারও না থেমে পার হয়ে এলাম মৎস্যদ্বীপ এবং পক্ষীদ্বীপ, এবং একটু পরেই রাতের বুকে বিশাল একটা ছায়ার মতো জেগে উঠল তৃতীয় দ্বীপটা। তারার আলোতে কিছুটা আলোকিত হয়ে আছে। এখানে আগে কখনো আসিনি আমি, জায়গাটা আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। যদিও দূর থেকে প্রথম দুটো দ্বীপের মতোই মনে হচ্ছে; কিন্তু আমি আসলে জানি না যে ওখানে কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

দ্বীপের কাছাকাছি চলে আসার পর হাত দিয়ে দ্বীপের গায়ে স্পর্শ করে বুঝলাম সত্যিই আগের দুটো দ্বীপের সাথে মিল আছে এটার। একই রকম খাড়া এবং উঁচু হয়ে উঠে গেছে পানি থেকে এবং অত্যন্ত দক্ষ ও সাহসী লোক ছাড়া এর গা বেয়ে ওপরে উঠতে পারবে না কেউ। তবে ব্যাপারটা আমাকে দমাতে পারল না। দ্বীপের ধার বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে খেয়াল করলাম আগের দুটো দ্বীপের তুলনায় এই দ্বীপে কালের আঁচড় যেন আরো কম পড়েছে। কয়েকটা পাথরের গায়ে তো প্রাচীন মিস্ত্রিদের বাটালির দাগও বোঝা যাচ্ছে। দ্বীপের ওপরে উঠতে বোঝা গেল একই রকমের পাথরের টুকরো সাজিয়ে তৈরি হয়েছে এই দ্বীপটাও। যদিও পরে তার ওপর বড় বড় গাছ জন্মেছে এবং তাদের শিকড়ের চাপে জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে পাথরের গাঁথুনি। প্রথম দুটো দ্বীপের মতো এই দ্বীপের ওপরও নানা রকম ঝোঁপঝাড় আর গাছপালায় ভর্তি।

ইতোমধ্যে দিগন্তের বেশ ওপরে উঠে এসেছে চাঁদ। পূর্ণিমা নয় আজ অর্ধেকটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তবে আকাশে কোনো মেঘ না থাকায় বাধা পাচ্ছে না তার আলো। ঘন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম আমি। দ্বীপের ঠিক মাঝখানে এসে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম একটা চওড়া কূপের মতো গর্ত রয়েছে এখানে, আর তার মাঝ দিয়ে নেমে গেছে একটা প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত প্যাচানো সিঁড়ি। প্রাচীনরা কোন যুক্তিতে এই সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিল? নদীর তলদেশে পৌঁছানোর এতই শখ হয়েছিল তাদের? তারপর বুঝতে পারলাম সুড়ঙ্গ আসলে স্রেফ একটা নাও হতে পারে। কে জানে হয়তো চারটি দ্বীপের প্রত্যেকটাতেই এমন একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম আমি, প্রতি মুহূর্তে ভয় পাচ্ছি যে পা পিছলে পড়ে গিয়ে ঘাড় ভাঙবে। কিন্তু কিছু দূর নামার পরেই দেখলাম শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে জমা হওয়া ময়লা-আবর্জনা জমা হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে সামনে এগোনোর পথ।

সুড়ঙ্গটা অন্য কোনো দিকে মোড় নিয়েছে কি না সেটাও বোঝার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু দেয়ালের গায়ে সেই টালির সারি ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাওয়া গেল না। এই টালিগুলোতে যে প্রাণীর ছবি আঁকা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে ভোদড়। মাছ সুড়ঙ্গ, পাখি সুড়ঙ্গ এবং ভেঁদড় সুড়ঙ্গ। কিন্তু কোনো সুড়ঙ্গ ধরেই তো বেশি দূর এগোনোর উপায় নেই।

রেগেমেগে দেবী ইনানাকে উদ্দেশ্য করে একটা গালি ছুড়লাম আমি, কারণ ইদানীং মনে হচ্ছে আমাকে ভুলেই গেছে সে। মনের ঝাল মেটাতে একটা লাথি মারলাম সুড়ঙ্গের ভেতর জমে থাকা আবর্জনার স্তূপের গায়ে। কিন্তু কাজটা ভুল হলো, কারণ দারুণ ব্যথা লাগল পায়ে। মনে হলো দুই-একটা আঙুল বোধ হয় ভেঙেই গেছে। তাড়াতাড়ি বসে আহত পা-টা মালিশ করতে শুরু করলাম। সৌভাগ্যক্রমে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি আমার পায়ের আঙুলে। এবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠে এলাম সুড়ঙ্গের ওপরে।

কে যেন কিছু একটা বলল আমার নামে?

পেছন থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেয়েই অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করল আমার ভেতরে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম সুড়ঙ্গের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে দেবী। বরাবরের মতোই অনিন্দ্যসুন্দরী লাগছে তাকে দেখতে। চাঁদের আলোয় যেন ঝিলিক দিচ্ছে তার চেহারা, সত্যি কথা বলতে গেলে চাঁদের চাইতেও উজ্জ্বল লাগছে তাকে। আগের চাইতেও যেন মনোমুগ্ধকর মোহন রূপ নিয়েছে তার হাসি।

আমার ধৃষ্টতাকে ক্ষমা করে দিও, হে পবিত্র দেবী। আসলে নিজেকে গালিগালাজ করছিলাম আমি, তোমাকে নয়। হাঁটু গেড়ে বসে সম্মান জানানো উচিত আমার; কিন্তু এখনো দপদপ করছে পায়ের আঙুলটা।

তাই নাকি, প্রিয় টাইটা? এখন তাহলে আমার নামটাকে নিজের নাম হিসেবে ব্যবহার করছ তুমি? ব্যাপারটা শুনে ভালো লাগছে ঠিকই; কিন্তু ঠিক বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না।

নিজের কথার প্যাঁচে নিজেই আটকে গেছি আমি। অগত্যা হার মেনে নিলাম, তারপর বদলে ফেললাম আলাপের বিষয়বস্তু। জিউসের প্রিয়ভাজন তুমি। আমাকে বলতে পারো এই সুড়ঙ্গ কোথায় গেছে? প্রশ্ন করলাম আমি।

তোমার মন যেখানে যেতে চায় সেখানেই। এখনো আমাকে শাস্তি দিতে চাইছে সে। আপত্তি করলাম না আমি। তার পরই কোনো বিরতি না দিয়েই প্রসঙ্গ বদল করল দেবী। কিন্তু এই মুহূর্তে তোমার সবচেয়ে বড় সমস্যাটা বোধ হয় অন্য জায়গায়, তাই না?

কার কথা, অথবা কীসের কথা বলছ তুমি? সাবধানে প্রশ্নটা ছুড়লাম আমি।

এই দেখো, তুমি এমনকি তার নামও জানো না, মিষ্টি গলায় ঠাট্টা করে উঠল। ইনান। তার পরিচয়ই যদি না জানতে পারো তাহলে তার বিরুদ্ধে জয়লাভ করবে কীভাবে?

আমার ধারণা দাগীমুখোর কথা বলছ তুমি, তাই না? বলে উঠলাম আমি।

ওই নামে ভালো বা খারাপ কোনো ব্যক্তিকেই চিনি না আমি। আবারও হেয়ালি করছে দেবী।

কিন্তু এমন একজন ব্যক্তিকে তুমি নিশ্চয়ই চেনো, যার চেহারার সাথে এই নামের বর্ণনা মিলে যায়? যার চেহারায় সত্যিই এমন কাটাছেঁড়ার দাগ আছে? তার নাম টেরামেশ, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ইনানা। হেকাটি এবং ফন্টাসের সন্তান সে।

হেকাটি যে জাদুবিদ্যা, প্রেতাত্মা এবং শবসাধনার দেবী তা তো সবাই জানে, বললাম আমি। কিন্তু ফন্টাস নামে কাউকে তো চিনি না আমি?

তার কথা খুব কম লোকেই জানে টাইটা, আমাকে জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল ইনানা। পৃথিবীতে সবার প্রথমে যেসব মানুষের আগমন ঘটেছিল তাদের একজন সে। হেকাটিকে অপহরণ করেছিল এই ফন্টাস, ধর্ষণ করেছিল তাকে। তার ফলেই জন্ম হয় টেরামেশের। এর অর্থ হলো হেকাটের ছেলে একই সঙ্গে অর্ধ-মানুষ, অর্ধ-দেবতা। দেবত্বের চিহ্ন আছে তার শরীরে; কিন্তু সে নিজে দেবতা নয়। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর নিজের পিতার সাথে লড়াইয়ে নামে টেরামেশ। তার মা হেকাটির ওপর নির্যাতন করার কারণে ফন্টাসকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল সে। এক দিন এক রাত লড়াই হয় তাদের মধ্যে এবং শেষ পর্যন্ত নিজের পিতাকে হত্যা করতে সক্ষম হয় সে। কিন্তু তার বদলে ফন্টাসের হাতে দারুণভাবে আহত হতে হয় তাকে। তার মাথা এবং মুখের বাম পাশে সেই আঘাতেরই চিহ্ন রয়েছে।

যদি সত্যিই ফন্টাসের কাছে এমন আঘাত পেয়ে থাকে টেরামেশ তাহলে এখনো আমাকে জ্বালানোর জন্য কীভাবে বেঁচে আছে সে?

মাথা ঝাঁকাল ইনানা, বোঝাতে চাইছে যে, আমার প্রশ্নটা আসলেই যৌক্তিক। টেরামেশ যখন মৃত্যুশয্যায় তখন তার মা হেকাটি আসে তার কাছে। ছেলের ওপর মন্ত্রশক্তি প্রয়োগ করে সে এবং মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরিয়ে আনে তাকে। তারপর হেকাটি টেরামেশকে এই বলে আশীর্বাদ করে যে, মুখের ডান পাশে একই রকম আরেকটি আঘাত ছাড়া কিছুতেই তাকে খুন করতে পারবে না। কেউ, এবং বাম দিকের আঘাতটা যে অস্ত্র দ্বারা করা হয়েছিল শুধু সেই একই অস্ত্রের আঘাতের মাধ্যমেই তাকে হত্যা করা যাবে। আর কোনো অস্ত্রই তার ক্ষতি করতে পারবে না।

সেই অস্ত্রটা এখন কোথায়? ব্যগ্র গলায় প্রশ্ন করলাম আমি। সেটা কোথায় খুঁজে পাব আমি?

ছেলেকে সুরক্ষার জন্য দারুণ বুদ্ধি খাঁটিয়েছে হেকাটি। তান্তিকা নদীর উত্তরে আমারোদা মরুভূমির এক গুহার ভেতর অস্ত্রটা লুকিয়ে রেখেছে সে।

নদীটা আমি চিনি। নীলনদের একটা শাখা নদী ওটা। এখান থেকে খুব বেশি হলে তিন কি চারদিন লাগবে ওই নদীর কাছে পৌঁছতে, উত্তেজিত গলায় বলে উঠলাম আমি।

হ্যাঁ। কিন্তু সেই গুহার অবস্থান লুকিয়ে রাখার জন্য হেকাটি নিজে এক গোপন জাদু প্রয়োগ করেছে সেখানে।

সেই জাদুকে কীভাবে ভাঙতে হবে তা নিশ্চয়ই জানা আছে তোমার?

এমন কিছুই নেই আমি জানি না, গম্ভীর গলায় বলে উঠল দেবী। ভেতরে ভেতরে বেশ চমকে গেলাম আমি। এমন কিছু দাবি করার আগে, এমনকি আমাকেও বেশ দ্বিধা করতে হবে। অবশ্য এটাও ঠিক যে ইনানার বুদ্ধি আমার চাইতে কোনো অংশে কম নয়, বরং অনেক দিক দিয়েই বেশি।

তাহলে আমাকে বলল, অনুনয় করলাম আমি।

তার আগে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে তোমার।

অন্য কারো সাহায্য কেন লাগবে আমার? প্রতিবাদ জানালাম আমি।

কারণ হেকাটি এমন ব্যবস্থা করেছে যে, দেবত্বের অধিকারী এমন কমপক্ষে দুজন মানুষ যদি একই সঙ্গে ওই মন্ত্র উচ্চারণ না করে তাহলে খুলবে না গুহার দরজা। আর শুধু দরজা খুললেই হবে না, কারণ ব্যাপারটাকে আরো জটিল করে তোলার জন্য গুহার মাঝে অন্তত কয়েক শ নানা রকমের অস্ত্র রেখে দিয়েছে হেকাটি। ওগুলোর মাঝ থেকে আসল অস্ত্রটা খুঁজে বের করতে হবে তোমাকে।

ব্যস, এটুকুই? ব্যঙ্গ ফুটে উঠল আমার গলায়।

না, আরো আছে। হেকাটির ছেলে টেরামেশের বিরুদ্ধে কেবল একজন রাজাই অস্ত্র ধরতে পারবে। তার শরীরে যে দেবত্ব থাকতে হবে এমন নয়; কিন্তু আঘাত করার সময় একটি নির্দিষ্ট রণহুংকার উচ্চারণ করতে হবে তাকে। তা হলে লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে তার আঘাত।

এই সব যোগ্যতা পূরণের ক্ষমতা রাখে এমন সঙ্গী আমি খুঁজে বের করতে পারব বলেই আমার বিশ্বাস।

মাথা ঝাঁকাল ইনানা। তোমার মতো কারো জন্য অনেক শতাব্দী ধরে অপেক্ষা করছি আমি। অসংখ্য নিরপরাধ প্রাণকে কেড়ে নিয়েছে হেকাটির সন্তান টেরামেশ। কিন্তু এখন অবশেষে তার অন্তিম সময় উপস্থিত হয়েছে।

তোমার কথাকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করছি আমি। কিন্তু যাওয়ার আগে তোমার সাথে এই দ্বীপগুলোর ব্যাপারে আরেকটু আলোচনা করা দরকার। বলে ইনানা যেখানে বসে আছে সেই পাথরগুলোর ওপর চাপড় মারলাম আমি। এই পথটা কোথায় গেছে?

তোমার জন্ম তো এক শতাব্দীরও বেশি আগে। এত বয়স হলো তোমার, এর মাঝে নিশ্চয়ই একটু হলেও ধৈর্য ধরতে শিখেছ? দুষ্টুমির স্বরে বলল সে।

উঁহু, মোটেই না, জবাব দিলাম আমি। কিন্তু আমার কথায় কর্ণপাত না করে আরো একবার হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সে।

*

দ্বীপ থেকে নীলনদের পুব তীরে সাঁতার কেটে ফিরে আসতে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। কিন্তু অত্যন্ত দ্রুত কেটে গেল সময়টা, কারণ ইনানার সাথে কথাবার্তা বলার পর চিন্তাভাবনার জন্য বেশ কিছু খোরাক পেয়েছি আমি। শেষ পর্যন্ত যখন তীরে এসে উঠলাম তখনো অন্ধকার কাটেনি। শরীর মোছার জন্য সময় নষ্ট করলাম না মোটেই, বরং এক দৌড়ে হাজির হলাম রামেসিসের তাঁবুর সামনে। রাজদম্পতির ঘুমের ব্যাঘাত ঘটার অজুহাত দিয়ে আমাকে থামাতে চেষ্টা করল প্রহরীরা। কিন্তু বেশি কিছু বলার আগেই এক হাত তুলে তাদের মুখ বন্ধ করে দিলাম আমি।

শোনো, গাধার দল! সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল সবাই। এবং সাথে সাথেই তাঁবুর ভেতর থেকে চাপা হাসি আর উচ্ছ্বসিত গলার আওয়াজ ভেসে এলো। এই যদি হয় তাদের ঘুম তাহলে এমন ঘুম কীভাবে ঘুমোতে হয় তা এখনো শেখা হয়নি আমার, প্রহরীদের উদ্দেশ্য করে বললাম আমি। তারপর গলা চড়িয়ে বলে উঠলাম, মহামান্য ফারাও, আপনি জেগে আছেন?

সাথে সাথেই একটা নারীকণ্ঠে আমার জিজ্ঞাসার জবাব এলো: টাটা! এসেছ তুমি? এইমাত্র শেষ হলো আমার আর রামেসিসের। তুমি ছিলে কোথায় সারা রাত? গতকাল রাতের ভোজেও তোমাকে দেখিনি আমরা। ভেতরে এসো! ভেতরে এসো! দেখে যাও রামেসিস কী এনেছে আমার জন্য।

রাজদম্পতির শোয়ার তাঁবুতে ঢুকতেই দুজন বিছানার ওপর সরে বসে জায়গা করে দিল আমার জন্য। ধমকের সুরে বলে উঠল সেরেনা, শরীর এত ঠাণ্ডা হয়ে আছে কেন তোমার? মনে হচ্ছে যেন মধ্য শীতের রাতে ট্যাগেটাস পর্বতের মাথায় গিয়ে শুয়ে ছিলে? দীর্ঘ সময় সাঁতার কেটে আসার ফলে শীতে কাঁপছি আমি, দুজনের চাপিয়ে দেওয়া উটের চামড়ার তৈরি কম্বলগুলো তাই কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করলাম।

বেশ কিছুক্ষণ এটা-সেটা নিয়ে আলাপ করলাম আমরা। তারপর পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে দুজনকে খুলে বললাম দাগীমুখো শয়তানটাকে পরাজিত করার জন্য আমার সাজানো পরিকল্পনার কথা। তবে দেবী ইনানার সাথে আমার যে বিশেষ একটা সম্পর্ক রয়েছে সেটার ব্যাপারে ওদের বা আর কাউকে কিছু বলার উপায় নেই আমার।

তাই ওদের জন্য আগেই একটা গল্প বানিয়ে রেখেছি আমি। সেই গল্পে দেবী ইনানা হচ্ছে একজন জ্ঞানী বৃদ্ধা মহিলা, যে মাঝে মাঝেই আমার সাথে দেখা করতে আসে। টেরামেশের জন্ম এবং তাকে পরাজিত করার উপায় সম্পর্কে আমার গল্পটা দারুণ মনোযোগের সাথে শুনল ওরা। গল্প থেকে শুধু সেরেনার দেবত্ব সম্পর্কিত কথাগুলো বাদ দিয়ে গেলাম আমি। ব্যাপারটা এখনো ও নিজেও জানে না এবং না জেনেই বরং ভালো আছে। আমার গল্প যখন শেষ হলো তখন ওরাও আমার মতো অভিযানে বের হওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। পারলে এখনই রওনা দেয় আমারোদা মরুভূমির উদ্দেশ্যে, খুঁজে নিয়ে আসে টেরামেশকে হত্যা করার সেই অব্যর্থ অস্ত্র। দিনের বাকি সময়টা আমাদের কেটে গেল এই অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে।

সৌভাগ্যক্রমে আমারোদা মরুভূমির অবস্থান নীলের পুব তীরেই। তাই টেরামেশের মোকাবিলা করার মতো প্রস্তুতি ছাড়াই আরো একবার নদী পার হয়ে তার সামনে পড়ার ঝুঁকি নিতে হচ্ছে না আমাদের। তিনজনের বেশি আর কাউকে সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না আমরা, সাথে নিলাম সর্বোচ্চ দশ দিনের রসদ। খাওয়ার পানির কোনো অসুবিধা হবে না বলে আশা করা যায়। প্রথমে নীলনদের তীর ঘেঁষে এগিয়ে যাব আমরা, তারপর তান্তিকা নদীর মুখে পৌঁছে সেখান থেকে গুহা পর্যন্ত অনুসরণ করব তান্তিকার গতিপথ। হুরোতাস এবং হুইকে অবশ্য আমাদের অভিযানের কথা জানাতেই হলো। সব শুনে ওরাও আমাদের সাথে যেতে চাইল। তবে আমার সবটুকু বুদ্ধি খাঁটিয়ে ওদের বিরত করলাম আমি। বললাম যে, সেনাবাহিনীর সাথে থাকাটাই এখন ওদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য, কারণ ওরা না থাকলে ষোলোজন মিত্র রাজার মাঝে বিবাদ বাধতে একটুও সময় লাগবে না। হুরোতাস এবং হুই উপস্থিত থাকার পরেও তাদের সবাইকে সামলে রাখতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। কেউ কেউ তো ইতোমধ্যে টেরামেশের তীরবৃষ্টির মুখে ভয় পেয়ে মিশর আক্রমণ বাদ দিয়ে আকারে ইঙ্গিতে বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলতে শুরু করেছে।

সঙ্গে খুব বেশি বোঝা নেই আমাদের, তাই অত্যন্ত দ্রুত পথ চলতে পারলাম। শিবির ছেড়ে রওনা দেওয়ার পর চতুর্থ দিন বিকেলে তান্তিকা নদীর মুখে পৌঁছে গেলাম আমরা। ইনানার সাথে নদীর এই বিশেষ জায়গাতেই দেখা হওয়ার কথা ছিল আমার। তাই এবার দুই সঙ্গীকে তাঁবু খাটানোর কাজে লাগিয়ে দিলাম আমি, সেইসাথে ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাওয়াতে বললাম। নীলের পানি তুলে এনে ঘোড়াগুলোকে দিল ওরা। আর আমি সেই ফাঁকে চললাম নদীর মুখ লক্ষ্য করে। ভাবছি এবার কোনো ছদ্মবেশ ধরে আসবে দেবী?

আবু নাসকোস ছেড়ে রওনা দেওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও গোসল করার সুযোগ হয়নি আমার। এবার তাই প্রথম সুযোগেই গোসলটা সেরে নিলাম। গোসলের পর নদীর পাশে একটা উষ্ণ পাথরে বসে ইনানার দেখা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি, একই সাথে হালকা বাতাসে শুকিয়ে নিচ্ছি ভেজা শরীর। ইতোমধ্যে একটা বড়সড় সবুজ ব্যাঙ, একটা ছোট বাদামি সাপ এবং বেশ কিছু অন্যান্য পোকামাকড় এবং বন্য প্রাণীকে ইনানা ভেবে ভুল করেছি আমি। শেষ পর্যন্ত মরুভূমির স্তব্ধতা ধীরে ধীরে ঘিরে ধরতে লাগল আমাকে। মনে পড়ল নীলনদের তীরে অবস্থিত আমাদের শিবির ছেড়ে আসার পর ঘুমোনোর সুযোগ খুব কমই পেয়েছি।

শেষবার যখন আমাদের দেখা হলো তখন ধৈর্য নিয়ে একটা কথা বলেছিলাম আমি, মনে আছে? হঠাৎ করেই বলে উঠল সে। দেখা যাচ্ছে আগের চাইতে বেশ উন্নতি হয়েছে তোমার। ব্যাপারটা দেখে খুশি হলাম।

চমকে ঝিমুনি থেকে জেগে উঠলাম আমি, এদিক-ওদিক তাকালাম। আমার হাতের কাছেই পানির ওপর ভাসছে একটা ছোট্ট কচ্ছপ। আমি তো ভেবেছিলাম আরেকটু উষ্ণ রক্তের, আরেকটু সুন্দর কোনো প্রাণীর বেশ ধরে আসবে তুমি, বললাম আমি। পাল্টা জবাব দিতে আমিও কম যাই না।

আরো সুন্দর কোনো প্রাণী মানে নিশ্চয়ই কোমল পালকে ঢাকা কোনো পাখির কথা বলছ? আবার বলে উঠল ইনানা; কিন্তু এবার আমার পেছন থেকে ভেসে এলো তার কণ্ঠ। সাথে সাথে ঘাড় ঘোরালাম আমি। দেখলাম কাছেই একটা পাথরের ওপর বসে আছে সুন্দর ছোট্ট একটা মরু বুলবুল। মাখনরঙা পালকে ঢাকা সরু বুক পাখাগুলো গাঢ় লালচে-বাদামি রঙের। আমার চোখের সামনেই একটা পাখা ছড়িয়ে দিয়ে ঠোঁট দিয়ে পালকগুলো পরিপাটি করতে শুরু করল সে।

রংটা খুব মানিয়েছে তোমাকে, প্রিয়তমা, তাকে বললাম আমি।

পছন্দ হয়েছে তোমার? কী যে ভালো লাগল শুনে, পাখির মতোই কিচিরমিচির করে উঠল সে। না হেসে পারলাম না এবার।

সুন্দর লাগছে তোমাকে বরাবরের মতোই, হাসতে হাসতে জবাব দিলাম আমি। কিন্তু এখন যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলতে হবে তোমার সাথে। তোমাকে পরিচিত চেহারায় না দেখতে পেলে কেমন অস্বস্তি লাগবে আমার।

তাহলে এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টিটা অন্যদিকে ফেরাও, বলল সে। বাধ্য ছেলের মতো চোখ ঘুরিয়ে পানিতে ভাসতে থাকা কচ্ছপটার দিকে তাকালাম আমি। ঠিক আছে, এবার তাকাতে পারো।

আবার ঘাড় ঘোরালাম। দেখলাম সেই পরিচিত মোহময়ী ইনানা বসে আছে। পাথরটার ওপর। এক গোছা চুল নিয়ে একবার আঙুলে পেঁচাল সে, তারপর উঠে দাঁড়াল। পরনের পোশাকটার নিচের অংশ ফুলে উঠল বাতাসে। তারপর এগিয়ে এসে বসে পড়ল আমার পাশে, হাঁটুগুলো ভাঁজ করে বুকের কাছে তুলে নিয়ে এলো।

বলো কী জানতে চাও, আমাকে আহ্বান জানাল ইনানা। বুঝতে পারছি প্রশ্ন করার জন্য ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছ তুমি।

এত সহজেই বুঝে ফেলা যায় আমাকে?

তুমি নিজেও জানো না কাজটা কত সহজ, প্রিয় টাইটা।

বেশ। তাহলে বলো, হেকাটির গুহা এখান থেকে কোন দিকে?

সরাসরি তোমার নাক বরাবর দিগন্তের দিকে তাকাও। কী দেখতে পাচ্ছ?

আকাশের গায়ে শুয়ে থাকা তিনটি পাহাড়ের চূড়া দেখতে পাচ্ছি।

ঠিক মাঝখানের পাহাড়টার গোড়ায় রয়েছে সেই গুহার প্রবেশপথ, যা তুমি খুঁজছ।

ভেতরে ঢোকার জন্য গোপন সংকেতটা কী?

এই কথাটা তিনবার বলতে হবে-হে জোড়া মুখবিশিষ্ট জ্যানাস, খুলে যাও!

সহজেই মনে রাখা যাবে কথাটা, আনমনে মাথা ঝাঁকালাম আমি। জ্যানাস হচ্ছে প্রবেশপথ এবং দরজার পৃষ্ঠপোষক দেবতার নাম।

তাহলে কখন রওনা দিচ্ছ তোমরা?

ঘোড়াগুলো ক্লান্ত হয়ে গেছে। আমাদের নিজেদের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। তাই ঠিক করেছি আজ রাতটা এখানেই বিশ্রাম নেব, তারপর কাল ভোরে আলো ফোঁটার সাথে সাথে রওনা দেব, জবাব দিলাম আমি।

গন্তব্যে পৌঁছেই আমাকে দেখতে পাবে তুমি, প্রতিশ্রুতি দিল ইনান, তারপর যেন মরীচিৎকার মতো মিলিয়ে গেল বাতাসে।

*

পরদিন সকালে সূর্য ওঠারও আগে তান্তিকা নদী ছেড়ে রওনা দিলাম আমরা, এগিয়ে চললাম সমভূমি ধরে। যাত্রাপথের প্রথম দিকে আমাদের সঙ্গী হলো হাজারে হাজারে পরিযায়ী গ্যাজেল হরিণ। পঁাচানো বাঁশির মতো শিং এদের, মুখে ডোরাকাটা বাদামি দাগ। আকারে ছোটখাটো, লাফিয়ে লাফিয়ে চলাচল করে মরুভূমির ওপর দিয়ে। ওদের সৌন্দর্য দেখে একটা গান রচনা করে ফেলল সেরেনা। তারপর গানটা গাইতে শুরু করতেই কান খাড়া করে শুনতে লাগল হরিণগুলো, বড় বড় উজ্জ্বল কালো চোখগুলো অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। সেরেনার মাঝে দেবত্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে ওরা, কারণ ঘোড়া নিয়ে ওকে এগিয়ে আসতে দেখেও কেউ জায়গা ছেড়ে নড়ল না। একসময় সেরেনা ওদের এত কাছে পৌঁছে গেল, যেন হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে পারবে। গান শেষ হতেই দলবেঁধে দৌড়াতে শুরু করল হরিণগুলো, নিমেষের মাঝে চলে গেল বহু দূরে। খুরের ঘায়ে ধুলো উড়িয়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দিগন্তের ওপাশে এমনভাবে হারিয়ে গেল, যেন ছিলই না কখনো।

মরুভূমিতে যেমনটা হয় সাধারণত, তিন পাহাড়ের চূড়াকে যতটা দূরত্বে ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক দূরে অবস্থিত ওগুলো। মাঝখানের পাহাড়টার গোড়ায় যখন আমরা পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। নির্দিষ্ট জায়গায় এসে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলাম আমরা, মুখ তুলে চূড়ার দিকে চাইলাম। যা ভেবেছিলাম তার চাইতে পাহাড়টা অনেক উঁচুও বটে।

ঢালের নিচের দিকে ঘন সবুজ ঘাস জন্মেছে। তাই সেখানেই আমাদের ছোট্ট তাঁবুটা খাটালাম আমরা। তারপর ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিলাম ঘুরে ঘুরে ঘাস খেতে।

তারপর তিনজন মিলে ঢালের নিচের দিকটা তল্লাশি করতে বের হলাম। এমন কিছু খুঁজছি, যা দেখে হেকাটির গুহার অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। ইনানাকে কোথায় পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে অবশ্য ইতোমধ্যে একটা আন্দাজ করে ফেলেছি আমি। আমার জানা আছে, তিনজন একসাথে থাকলে দেখা দিতে চাইবে না সে। তাই রামেসিস আর সেরেনাকে উল্টো দিকে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর একা একা এগিয়ে গেলাম ঢালের উত্তর দিকটায়। এবং এখানেই ইনানাকে খুঁজে পাওয়া গেল, বা বলা যায় তার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। একটা পাথরের ওপর বসে বসে পালকগুলো পরিপাটি করছে সে, সেইসাথে মাঝে মাঝে কিচিরমিচির করে উঠছে মিষ্টি গলায়। তার পাশে পাথরটার ওপর গিয়ে বসলাম আমি। আরো কিছুক্ষণ মিহি সুরে গান গাইল সে, তারপর কথা বলে উঠল আমাকে উদ্দেশ্য করে।

হেকাটি এখানে এসেছিল, বলল সে। তোমাদের আসার কথা জানে সে। তার ইচ্ছে ছিল ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবে তোমাদের। গুহার মুখটা নিজে পাহারা দিয়ে গোপন করে রাখতে চেয়েছিল সে; কিন্তু আমি তাকে ভাগিয়ে দিয়েছি।

খবরটা শুনে চমকে গেলাম আমি। অনুভব করলাম গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে; যেন একগাদা বিষাক্ত পোকা হেঁটে বেড়াচ্ছে সেখানে। এদিক-ওদিক তাকালাম তাড়াতাড়ি। মনে হলো এই বুঝি গোখরা সাপের মতো ফণা তুলে হাজির হবে হেকাটি, হিসিয়ে উঠবে আমার দিকে তাকিয়ে। এমনটা করার ক্ষমতা আছে তোমার? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

আমি হচ্ছি আর্টেমিস, জিউসের কন্যা, একেবারে স্বাভাবিক গলায় জবাব দিল ইনানা। আমার সামনে পড়ে শেষ পর্যন্ত ভয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে পালিয়ে গেছে হেকাটি। তারপর হঠাৎ লাফ দিয়ে আমার কাঁধের ওপর উঠে বসল সে। আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, একটা জিনিস সব সময় মনে রাখবে, টাইটা। তুমি আমার অন্যতম প্রিয় মানুষগুলোর একজন। আর সে জন্যই তোমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে মজা করি আমি। এসো এখন, তোমাকে ওই ডাইনি বুড়ির লুকানো গুহাটার পথ দেখিয়ে দিই।

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলাম আমরা। আমার কাঁধে বসে মিষ্টি সুরে কিচিরমিচির করতে লাগল ইনানা, মাঝে মাঝে আবার আমাকে পথের নির্দেশ বলে দিতে লাগল। পাহাড়ের গোড়া থেকে একটুখানি ওপরেই পাথরের একটা দেয়াল তৈরি হয়েছে। এখানে এসে হঠাৎ আমাকে একটু থামতে বলল ইনানা।

কেন? প্রশ্ন করলাম আমি।

বাকি দুজন ফিরে আসছে, আমাকে জানাল সে। যদিও ব্যাপারটা সে কীভাবে বুঝল আমার জানা নেই, তবে এ নিয়ে আর তর্ক না করাই ভালো হবে বলে মনে হলো আমার। এবং সত্যিই কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেরেনার সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম আমি, এবং তার সাথে রামেসিসের অপেক্ষাকৃত ভারী গলা। নিজেদের মাঝে কথা বলতে বলতে এদিকেই আসছে ওরা। কাছাকাছি এগিয়ে আসার সাথে সাথে আরো জোরালো হয়ে উঠতে লাগল ওদের কণ্ঠস্বর। এবার আমার কাধ ছেড়ে উড়ে গিয়ে দেয়ালটার ওপরে গিয়ে বসল ইনানা। আর সেই একই মুহূর্তে পাথুরে দেয়ালের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো রামেসিস আর সেরেনা, হাত নাড়ল আমাকে দেখতে পেয়ে। ইনানার সময়জ্ঞান একেবারে নিখুঁত, ওরা দুজন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে দেয়ালের ওপর বসে থাকা ছোট্ট সুন্দর পাখিটার সাথে আমার কোনো রকম সম্পর্ক থাকতে পারে। কিছু পেলে? কাছে আসতে ওদের জিজ্ঞেস করলাম আমি।

না, কিছুই পাইনি, জবাব দিল রামেসিস। তোমার কী খবর?

আমিও একই জবাব দিতে যাব, এই সময় কী মনে হতে ওপরে তাকালাম। এবার এমন একটা জিনিস চোখে পড়ল আমার, যেটা এক মুহূর্ত আগেও দেখতে পাইনি। এই দেয়ালটার ওপাশে পাহাড়ের গায়ে একটা ফাটল দেখা যাচ্ছে। ওটা একবার পরীক্ষা করে দেখা দরকার। তাড়াতাড়ি আমার পাশে চলে এলো দুজন। এবার ওদেরকে ফাটলটা আঙুল দিয়ে দেখালাম আমি। পাহাড়ের গায়ে জন্মানো ঘন জঙ্গল আর ঝোঁপের কারণে প্রায় ঢেকে গেছে ফাটলের মুখটা। বোঝাই যাচ্ছে যে বহু বছরের মধ্যে কোনো মানুষ বা জীবজন্তু এই পথ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেনি।

পাহাড়ের গায়ে ফাটলটা খুব বেশি চওড়া নয় অবশ্য, স্রেফ তিনজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারবে এমন। কোমর থেকে তলোয়ারটা বের করে আনলাম আমি, তারপর প্রবেশপথের মুখে এসে জমা ঝোঁপঝাড় আর গাছের ডালপালা কেটে পরিষ্কার করতে শুরু করলাম। রামেসিসও হাত লাগাল আমার সাথে। সেরেনা দাঁড়িয়ে রইল পেছনে, উৎসাহ দিতে লাগল আমাদের। মাথার ওপর ছোট্ট বুলবুল পাখিটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে ডাকাডাকি করতে করতে এই ঝোঁপ থেকে ওই ঝোপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফাটলের মুখটা পরিষ্কার হয়ে আসতেই ভেতরে ঢুকলাম আমরা। প্রায় বিশ কদমের মতো এগোনোনার পর বিশাল গোলাকার একটা পাথর চোখে পড়ল। গুহার প্রবেশপথকে সম্পূর্ণ আটকে রেখেছে পাথরটা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে বহু বছর ধরে এই একই জায়গায় রয়েছে ওটা, সময়টা এমনকি কয়েক শতাব্দীও হতে পারে। পাথরের সামনে জন্মানো ঝোঁপঝাড়গুলো পরিষ্কার করলাম আমরা। তারপর সেরেনার দিকে তাকালাম। প্রশ্ন করলাম, গোপন সংকেতটা মনে আছে তো?

অবশ্যই মনে আছে, জবাব দিল। সংকেতটা হচ্ছে, হে জোড়া মুখ—

দাঁড়াও! গলাটা সামান্য চড়িয়ে ওকে বাধা দিলাম আমি। আমরা দুজনই প্রস্তুত হওয়ার আগে কথাগুলো উচ্চারণ করার দরকার নেই।

এই কথাটা ধমক দিয়ে বলার কোনো দরকার ছিল না, অভিমানের সুরে বলল সেরেনা।

তোমার গলা টিপে ধরার চাইতে ধমক দেওয়াই উত্তম, তাই না? বললাম আমি।

এভাবে বললে অবশ্য তোমার সাথে একমত হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না, ক্ষমা প্রার্থনার হাসি ফুটল সেরেনার ঠোঁটে। তারপর হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। সেটা ধরলাম আমি, তারপর বিশাল পাথরটার সামনে এসে দাঁড়ালাম পাশাপাশি। রামেসিস রইল আমাদের পেছনে।

বুলবুলটাও কখন যেন গুহার ভেতর এসে ঢুকেছে। এবার উড়ে এসে বিশাল পাথরটার ওপরে বসল সে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলাম আমি। কেন জানি না হঠাৎ করেই কিছুটা ভয় ভয় লাগতে শুরু করেছে। সেরেনার হাতে একবার চাপ দিলাম, তারপর দুজন একসাথে মুখ খুললাম।

হে জোড়া মুখবিশিষ্ট জ্যানাস খুলে যাও! একই সাথে বলে উঠলাম আমরা, তারপর থেমে গেলাম।

হে জোড়া মুখবিশিষ্ট জ্যানাস, খুলে যাও! আরো একবার একই সাথে উচ্চারণ করলাম কথাটা। তারপর আবার লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে তৃতীয় ও শেষবারের মতো বলে উঠলাম: হে জোড়া মুখবিশিষ্ট জ্যানাস, খুলে যাও!

মনে হলো যেন বাজ পড়ল গুহার ভেতর। কান ফাটানো শব্দের সাথে সাথে পাথরটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল, হাজারটা ছোট-বড় পাথরের ছিন্নভিন্ন টুকরো ছড়িয়ে গেল এদিক-ওদিক। লাল ডানার বুলবুলটা সরাসরি পাথরের ওপর বসে ছিল। বিস্ফোরণের ধাক্কায় সই করে ওপরে উঠে গেল তার ছোট্ট শরীরটা, ভয়ে আর আতঙ্কে তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠল সে। যদিও আমার নিজের অবস্থাও খুব একটা সুবিধার নয়, তবু মনে মনে কৃতজ্ঞ বোধ করলাম এই ভেবে যে, ইনানা অমর এবং পার্থিব, কোনো আঘাতে তার কোনো ক্ষতি হতে পারে না। তা না হলে এই বিস্ফোরণের ফলে দারুণ আঘাত পেতে পারত সে। সেরেনা আর আমি নিরাপদ দূরত্বেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, তা সত্ত্বেও উড়ে গিয়ে পড়লাম পেছনে। অজস্র পাথরের টুকরো আর ধুলোবালিতে ভরে গেল আমাদের শরীর। রামেসিস ছিল আমাদের চাইতে দ্বিগুণ দূরত্বে; কিন্তু ও একজন সাধারণ মানুষ মাত্র। ফলে সেরেনা এবং আমার চাইতে অনেক বেশি আঘাত সহ্য করতে হলো ওকে। সেরেনা অবশ্য প্রায় সাথে সাথেই ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, যেটা নিঃসন্দেহে যে কাউকে আবেগপ্রবণ করে তোলার জন্য যথেষ্ট। তবে আমার কেন যেন মনে হলো যে ইচ্ছে করেই একটু বেশি অভিনয় করছে রামেসিস। যাই হোক ওদেরকে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগ দিয়ে পাথরের ধ্বংসস্তূপটার ওপর দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি। গুহার মুখটা খুলে গেছে এখন, এবার উঁকি দিলাম তার ভেতরে।

দেখে মনে হলো এটাই হেকাটির সেই গুহা, যেখানে আরো অনেকগুলো অস্ত্রের সঙ্গে সেই বিশেষ অস্ত্রটাকেও লুকিয়ে রেখেছে সে। ওটাকে খুঁজতেই এখানে এসেছি আমরা, ওই অস্ত্রের সাহায্যেই ঘায়েল করা যাবে টেরামেশকে। কিন্তু বিস্ফোরণের ফলে ধুলোর মেঘ উড়তে শুরু করেছে গুহার ভেতরে, এর মাঝ দিয়ে কোনো কিছু পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়া অসম্ভব। সব কিছু ঝাপসা হয়ে আছে এখন। তাই দারুণ অস্থির হয়ে ওঠা সত্ত্বেও ধৈর্য ধরতে হলো আমাদের তিনজনকে। ধুলোর মেঘ মেঝেতে নেমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমরা। এরই মাঝে কখন যেন পাহাড়ের ওপাশে ডুব দিল সূর্য।

সৌভাগ্যক্রমে শুকনো নলখাগড়া আর জ্বালানি কাঠ দিয়ে তৈরি অনেকগুলো মশাল নিয়ে এসেছিলাম আমি। এবার সেগুলো থেকে তিনটে মশাল চকমকির সাহায্যে জ্বালানো হলো, তারপর সেগুলো হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলাম গুহার কাছে। মশালের আলোতে ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা।

পাথরটা সরে যাওয়ার ফলে যে গুহাটা উন্মোচিত হয়েছে তা আদতে খুব বেশি বড় নয়। ভেতরটা দেখলে প্রথমেই মনে পড়ে কোনো জাহাজের অগোছালো ক্যাপ্টেন কর্তৃক রক্ষিত গুদামঘরের কথা, যা দুই-এক শতাব্দীর মাঝে কখনো পরিষ্কার করা হয়নি। দেয়ালের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ছাদ সমান উঁচু স্তূপ করে রাখা হয়েছে নানা জিনিস, যেগুলোর বেশির ভাগই এখন আর চেনার উপায় নেই। কয়েকটা জিনিস যেগুলো আমরা চিনতে পারলাম সেগুলো হচ্ছে একসাথে বাঁধা তীর, হাতকুড়াল, তলোয়ার এবং অন্যান্য ধারালো অস্ত্র।

গুহার অন্যান্য জিনিসের মধ্যে আরো রয়েছে শত শত অগুরুত্বপূর্ণ জিনিস, একটার ওপর আরেকটা স্তূপ করে রাখা। তাদের ওপর পড়েছে শত বছরের ধুলোর আবরণ, সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়েছে জিনিসগুলোর পরিচয়। এখান থেকে সব কিছু বাইরে নিয়ে যেতে হবে আমাদের, তারপর ওপর থেকে ময়লা পরিষ্কার করে পরীক্ষা করতে হবে বুঝে মনে মনে দমে গেলাম আমি। অনেক শতাব্দী আগে কোন অস্ত্রের আঘাতে টেরামেশ আহত হয়েছিল তা খুঁজে বের করা মোটেই সহজ হবে না। যদিও দীর্ঘজীবন এবং একই সাথে দেবত্বের অধিকারী আমি; কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এই ক্ষেত্রে এসে আমার কোনো দক্ষতাই কাজে লাগবে বলে মনে হলো না।

লাল ডানার বুলবুলটার খোঁজে এদিক-ওদিক তাকালাম আমি। কিন্তু দেবী হলে কী হবে, মেয়েমানুষ তো। দরকারের সময় কখনোই তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

বেশ, কী আর করা। কাজ শুরু করে দিই, গলায় কিছুটা উৎসাহ আনার চেষ্টা করলাম আমি; কিন্তু খুব একটা লাভ হলো না।

মন খারাপ কোরো না, টাটা, বলল সেরেনা। সব কাজ শেষ করতে বেশি সময় লাগবে না আমাদের; এই ধরো বড়জোর এক মাস।

গুহার ভেতরে একবারে একজনের বেশি কাজ করার মতো জায়গা নেই। তাই রামেসিস আর আমি পালা করে ঢুকতে লাগলাম ভেতরে। অন্য দুজন প্রবেশপথের মুখে অবস্থান নিল; তারপর প্রতিটি জিনিসকে হাত বদল করে গুহার বাইরে নিয়ে রাখতে লাগল। ধীরে ধীরে দারুণ পরিশ্রমের সাথে এগোতে লাগল কাজ। নাক আর মুখের সামনে কাপড় বেঁধে নেওয়ার পরেও ধুলোয় দম আটকে আসতে লাগল আমাদের। কিছুক্ষণ পরপরই অবস্থান বদল করতে বাধ্য হলাম আমরা।

আকাশে চাঁদ উঠল একসময়, ধীর গতিতে গড়িয়ে গড়িয়ে চলতে লাগল এক প্রান্ত ধরে। কিন্তু কাজ থামালাম না আমরা। মধ্যরাতের কিছু আগে গুহার ভেতর রামেসিসকে আসতে বলে বাইরে গুহার প্রবেশপথে বেরিয়ে এলাম আমি। মাথার ওপর দেয়ালের গায়ে একটা আংটার সাথে একটা মশাল ঝুলিয়ে রেখেছি এখানে, ভালোই আলো দিচ্ছে ওটা।

রামেসিসের কাছ থেকে এক এক করে বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে এসে ফাটলের কাছাকাছি দাঁড়ানো সেরেনার হাতে তুলে দিতে লাগলাম আমি। এভাবে কতক্ষণ চলল মনে নেই, তবে হঠাৎ করেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যে একঘেয়েমি কেটে গেল আমার। প্রাচীন শুকনো চামড়ার একটা থলে আমার হাতে তুলে দিল রামেসিস। ওর হাত থেকে থলেটা নিয়ে একটু সামনে আসতেই ছিঁড়ে গেল সেটা, ভেতরের জিনিসগুলো ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। বিড়বিড় করে একটা গাল দিলাম আমি, তারপর হাঁটু গেড়ে বসলাম জিনিসগুলো তোলার জন্য। থলের ভেতরে ছিল ব্রোঞ্জের তৈরি চারটি তীরের ফলা। কিন্তু ফলাগুলো তোলার জন্য হাত বাড়িয়েও থমকে গেলাম আমি। চারটির মধ্যে তিনটি ফলা কালের আবর্তনে ক্ষয়ে গেছে, এখন আর প্রায় চেনারই উপায় নেই সেগুলোকে। কিন্তু চতুর্থ ফলাটা এমনভাবে ঝকঝক করছে, যেন এইমাত্র বেরিয়ে এলো কামারের হাতুড়ির নিচ থেকে। উজ্জ্বল ধারালো শরীর ওটার, মশালের আলোতে চকচক করে উঠল।

ফলাটা তুলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম আমি। কিন্তু আমার আঙুলগুলো ওটাকে স্পর্শ করার সাথে সাথেই চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিলাম আবার, বিস্ময়ের অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে। গরম হয়ে আছে ফলাটা। তবে এত গরম নয় যে হাতে ঘঁাকা লাগবে। রামেসিসের দিকে পেছন ফিরে আছি আমি, ফলে আমার প্রতিক্রিয়াটা দেখতে পায়নি ও। গুহামুখে দাঁড়িয়ে আছে সেরেনা; কিন্তু এই মুহূর্তে ও আমার দিকে পেছন ফিরে আছে; গুহার বাইরে পাঠানো জিনিসগুলো সাজিয়ে রাখছে এক এক করে। কেউই। বুঝতে পারেনি যে কী আবিষ্কার করেছি আমি।

চারটি ফলাই হাতে তুলে নিলাম এবার। তবে এবার মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম বলে ফলাটার উষ্ণতা আর অবাক করতে পারল না আমাকে, বরং যেন আরাম লাগল হাতে। ফলাগুলো নিয়ে গুহার বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। আমাকে দেখে ক্লান্ত একটা হাসি উপহার দিল সেরেনা।

কাজ আর কত দূর বাকি? প্রশ্ন করল ও।

এই ধরো অর্ধেক কাজ বাকি এখনো, জবাব দিলাম আমি। হতাশ একটা দৃষ্টি ফুটল সেরেনার চোখে। ক্ষয় হয়ে আসা ফলা তিনটি ওর হাতে দিলাম আমি। ফলাগুলো নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে যাবে ও; কিন্তু তার আগেই বাধা দিলাম আবার। আর একটা আছে, বললাম আমি। ঘুরে দাঁড়াল সেরেনা, হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। চতুর্থ ফলাটা ওর বাড়ানো হাতের তালুতে রাখলাম আমি। সাথে সাথে এমনভাবে ঝাঁকি খেল ও, যেন বোলতায় হুল ফুটিয়েছে ওর হাতে। অন্য হাতে রাখা বাকি তিনটি ফলা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল এবার, তারপর দুই হাতে এমনভাবে চতুর্থ ফলাটাকে চেপে ধরল যেন ওটা সাধারণ কোনো তীরের মাথা নয় বরং বহুমূল্য কোনো রত্ন।

পাওয়া গেছে, টাটা! চকচকে ফলাটা মুখের কাছাকাছি তুলে এনে ওটার দিকে চেয়ে রইল সেরেনা। এই অস্ত্রটাকে খুঁজছি আমরা।

কীভাবে বুঝলে? প্রশ্ন করলাম আমি।

আমি জানি। কীভাবে জানি তা বলতে পারব না; কিন্তু জানি। আর তুমিও এটা জানো টাটা। চোখে অভিযোগ নিয়ে আমার দিকে তাকাল ও। ফলাটা আমার হাতে দেওয়ার আগেই বুঝতে পেরেছিলে তুমি, তাই না?

হাসলাম আমি। বললাম, তোমার বন্ধু রামেসিসকে ডেকে নিয়ে এসো। এখনই আবু নাসকোসে তোমার বাবার শিবিরের উদ্দেশ্যে রওনা দেব আমরা। আর ফলাটা কিন্তু হারিয়ে ফেলো না, সাবধান। তোমার রাজ্য এবং তোমার স্বামীর জীবন হয়তো এর ওপরই নির্ভর কড়ছে।

*

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘোড়ায় উঠে বসলাম আমরা এবং ভোর হওয়ার আগেই পৌঁছে গেলাম তান্তিকা নদীর মুখে। এখানে এসে ঘোড়াগুলোকে পানি খাইয়ে নিলাম, তারপর সারা দিন পথ চললাম। বিকেল হলে তিন ঘণ্টার জন্য বিশ্রাম দিলাম ঘোড়াগুলোকে, নিজেরাও একটু চাঙ্গা হয়ে নিলাম। তারপর দ্বিতীয় রাতের পুরো সময়টা কাটালাম পথে। রাতের শেষ দিকে এসে বেঁকে বসল দুটো ঘোড়া। সেগুলোকে ওখানেই রেখে আবার এগিয়ে চললাম আমরা। পরের দিনের শেষ দিকে আরো দুটো ঘোড়া হারাতে হলো আমাদের। তবে ভোর হওয়ার আগেই পৌঁছে যেতে পারলাম আবু নাসকোসের বিপরীতে রাজা হুরোতাসের তাঁবুতে। তিন দিনের মধ্যে হেকাটির গুহা থেকে হুরোতাসের শিবিরে ফিরে এসেছি আমরা, যেটা নিঃসন্দেহে অহংকার করার মতো একটা কাজ। কিন্তু কাজটা করতে গিয়ে বেশ কয়েকটা ঘোড়াকে হারাতে হয়েছে। আমার এবং এটা নিয়ে আমি মোটেই গর্বিত নই।

শিবিরে পৌঁছে আবিষ্কার করলাম আমাদের অবর্তমানে পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি বা অবনতি হয়নি। নীলের দুই তীরে দুই পক্ষের সেনাবাহিনী অনেকটা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে, কেউই কাউকে বিরক্ত না করে সময় কাটাচ্ছে নিজ নিজ এলাকায়। নদী পার হয়ে টেরামেশের তীরবৃষ্টির মুখোমুখি হওয়ার জন্য উৎসাহী কাউকে পাওয়া যায়নি আমাদের লোকদের মধ্যে।

একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন যেটা ঘটেছে তা হলো একের অপমান মানে সবার অপমান- এই শপথ ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মিত্র রাজাদের মাঝে দুজন। নিজ নিজ সেনাবাহিনী নিয়ে জাহাজে উঠে পড়েছে তারা, তারপর নীলনদ ধরে ভূমধ্যসাগরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সেখান থেকে নিজেদের রাজ্যে চলে যাওয়ার ইচ্ছে তাদের, অবশ্য সার্বক্ষণিক ঝড়ের ঝাঁপটায় বিপর্যস্ত এবং জলদস্যুদের আখড়া এক টুকরো পাথুরে দ্বীপকে যদি রাজ্য বলা যায় আর কি। হুরোতাস জানাল সব মিলিয়ে দেড় শর বেশি হবে না দলত্যাগীদের সংখ্যা, এবং দুই রাজাসহ তাদের প্রত্যেকেই ছিল কাপুরুষ এবং দুর্বল চিত্তের অধিকারী।

হুরোতাস এবং হুইয়ের সাথে প্রাথমিক কথাবার্তা শেষ করার পর আমার পরবর্তী কাজ হলো সভ্য দুনিয়ার সবচেয়ে দক্ষ তীর-ধনুক নির্মাতা টাৰ্মাকাটকে ডেকে নিয়ে আসা। আমার পুরনো বন্ধু সে, ফলে একবার ডাকতেই চলে এলো আমার সাথে দেখা করতে। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানালাম আমি। তারপর বললাম, আমি চাই আমার জন্য সবচেয়ে নিখুঁত এবং শক্তিশালী একটা তীর বানিয়ে দেবে তুমি। বলা যায় না, তোমার দক্ষতার ওপরই হয়তো নির্ভর করছে মানবসভ্যতার ভাগ্য।

এমন একটা দায়িত্ব পাওয়ার জন্যই আমি সারা জীবন ধরে অপেক্ষা করছি, বলল সে। প্রথমে ধনুকটা দেখাও আমাকে। তারপর ওটার জন্য সম্পূর্ণ নিখুঁত একটা তীর বানাব আমি।

তাকে নিয়ে তাবুর পেছনের রাখা হাতির দাঁতের টেবিলটার কাছে চলে এলাম আমি, তারপর টান দিয়ে সরিয়ে ফেললাম টেবিলটাকে ঢেকে রাখা সিল্কের চাদর। টেবিলের ওপর পড়ে আছে একটা ছিলাবিহীন ধনুক। সেটার দিকে এগিয়ে গেল টার্নাকাট। ধনুকটা স্পর্শ করার আগেই বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠল তার চেহারায়।

এই ধনুকের সাথে যোগ্যতায় পাল্লা দিতে পারে এমন ধনুক এর আগে শুধু তিনটি দেখেছি আমি, বলল সে। ধনুকের হাতলটার ওপর সোনার তার জড়িয়ে তৈরি করা সূক্ষ্ম কারুকাজের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে তার আঙুলগুলো। এবং তিনটেই ছিল কোনো না কোনো রাজা বা ম্রাটের ব্যক্তিগত সম্পদ।

এবং এটাও ঠিক তাই, প্রিয় টাৰ্মাকাট। উচ্চ এবং নিম্ন মিশরের ফারাও প্রথম রামেসিসের ব্যক্তিগত ধনুক এটা।

এর চাইতে কম কিছু আশা করিনি আমি, টাইটা। এখনই কাজ শুরু করব আমি। অনেক সময় নষ্ট করেছি আমার জীবনে, আর নষ্ট করতে চাই না।

আমি তোমাকে সাহায্য করব, তাকে বললাম আমি। সারা জীবন ধরে তীর ধনুক তৈরির নিখুঁত সব কাঁচামাল সংগ্রহ করে নিজের কাছে রেখেছে টাৰ্মাকাট। সেগুলোর মাঝ থেকে সবচেয়ে উন্নত উপাদানটা খুঁজে বের করতে এবং তা দিয়ে চারটি তীর তৈরি করতে আরো দুই দিন সময় লাগল আমাদের। তারপর ওগুলোর মাঝে নিখুঁত ভারসাম্য তৈরি করল টার্মাকাট, যেন অন্তত দুই শ কদম দূরত্ব পর্যন্ত লক্ষ্যভেদ করতে একটুও বিচ্যুতি না আসে। সব শেষে এক এক করে প্রতিটি তীরের মাথায় হেকাটির গুহা থেকে নিয়ে আসা সেই ফলাটা জোড়া দিলাম আমরা, যেটা আমি আর সেরেনা খুঁজে পেয়েছিলাম। প্রত্যেকটা তীরকে একবার করে ছুড়ল রামেসিস। এবার ওগুলোর মাঝে যেটা সবচেয়ে নিখুঁত লক্ষ্যে আঘাত হানতে পারল সেটাকেই বেছে নিলাম আমরা। লক্ষ্যবিন্দুর মাত্র আধ ইঞ্চি দূরে লেগেছে এই তীরটার আঘাত।

সেই দিন সন্ধ্যায় নীলনদের বুকে অবস্থিত চারটে দ্বীপের মাঝে তৃতীয় দ্বীপটায় সাঁতরে গিয়ে উঠলাম আমি। ইনানার সাথে দেখা করতে হবে আমার। তার আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে প্রাচীন লোকগুলোর বানানো সেই সুড়ঙ্গপথটা আরো একবার পরীক্ষা করে দেখলাম। বুঝতে পারলাম এখনো এই পথ তৈরির উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো ধারণা কাজ করছে না আমার মাথায়। শেষ পর্যন্ত যখন ইনানা দেখা দিল তখন যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। শেষবার যখন দেবীর সাথে আমার দেখা হয় তখন সে হেকাটির গুহার মুখে আটকে বসে থাকা বিশাল পাথরটার ওপর বসে মিষ্টি সুরে গান গাইছিল। তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম সেই ঘটনার কথা এখন দেবীকে মনে করিয়ে না দিলেই ভালো হয়।

হয়তো এ কারণেই প্রথমবারের মতো অন্ধকারের মাঝ থেকে বেরিয়ে এসে সরাসরি আমার দিকে এগিয়ে এলো সে, তারপর আমার দুই গালে চুমু খেল। তারপর সাঁতার কেটে আসার ফলে আমার ভেজা শরীরের দিকে গ্রাহ্য না করেই বসে পড়ল আমার কোলের ওপর।

তুমি এবং তোমার বন্ধু টাৰ্মাকাট মিলে নিখুঁত একটা তীর তৈরি করতে পেরেছ দেখে খুব খুশি হয়েছি আমি, কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বলে উঠল সে।

কখনো কোনো কিছু তোমার চোখ এড়ায় না, তাই না? প্রশ্ন করলাম আমি। তার চুমুগুলো এখনো যেন লেগে রয়েছে আমার গালে, এবং ব্যাপারটা আমি দারুণ উপভোগ করেছি বুঝতে পেরে নিজেই অবাক হয়ে উঠলাম। কিন্তু ওই তীরটা কখনো ব্যবহার করার সুযোগ কি আসবে আমাদের হাতে?

আমার প্রশ্নটা অগ্রাহ্য করল সে। নীলনদের পশ্চিম তীরে আবু নাসকোসে উটেরিকের দুর্গের পেছনে যে জঙ্গল তার মাঝে লুকানো আছে এক তৃণভূমি। ছেলের জন্য আশ্রয় এবং আত্মগোপনের স্থান হিসেবে জায়গাটাকে তৈরি করেছে হেকাটি।

লুকানো তৃণভূমি বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ? প্রশ্ন করলাম আমি।

যা মুখে বলেছি ঠিক তাই। জায়গাটা লুকানো কারণ দেখার মতো চোখ এবং শোনার মতো কান যাদের আছে তারা ছাড়া আর কেউ ওই জায়গার সন্ধান পায় না।

এমন চোখ আর কান আমি কোথায় পাব?

শুধু আমাদের কারো কাছ থেকে, যারা অলিম্পাস পর্বতের বাসিন্দা।

তার মানে কোনো দেবতা বা দেবী? এমনকি দেবত্বের অধিকারী কাউকে দিয়েও কাজ হবে না?

প্রিয় টাইটা, মাঝে মাঝে তোমার বুদ্ধি দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যাই আমি! ঠিক ধরেছ, আমি ঠিক এটাই বলতে চেয়েছি।

তোমার রসবোধ যতটা তীক্ষ্ণ, আমার বুদ্ধিও ঠিক ততটাই, গলা নামিয়ে বলে উঠলাম আমি।

কথাটা আমার কানে যায়নি সে জন্য আমি খুশি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল ইনানা। তবে এখন বুদ্ধি এবং রসবোধের চাইতে আরো গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময়। দেবী হেকাটির ছেলে টেরামেশ এই মুহূর্তে তার লুকানো বাগানেই রয়েছে। কিন্তু অস্থির হয়ে উঠেছে সে। এমনকি আমি নিজেও জানি না যে আগামীকাল সকাল নাগাদ সে একই জায়গাতে থাকবে কি না।

আমাদেরকে কত দ্রুত ওখানে নিয়ে যেতে পারবে তুমি?

দেখি আমার লাল ডানার বুলবুল বন্ধুটি কী বলে, জবাব দিল ইনান। তারপর মৃদু হাসল সে। আশা করি হেকাটির গুহার মুখ খোলার সময় যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল তা থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল বেচারা।

*

ইনানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি যখন তৃতীয় দ্বীপ থেকে আবার তীরে ফিরে এলাম তখনো রাতের অর্ধেক পার হয়নি। রামেসিস আর সেরেনাকে আগেই বলে গিয়েছিলাম, আমি ফিরে আসার সাথে সাথেই যেন কাজে নামা যায় এমনভাবে প্রস্তুত থাকতে। আমার তাঁবুতে ঢুকে দেখলাম যেকোনো মুহূর্তে পথে নামার উপযোগী পোশাক পরে আমার বিছানার ওপর ঘুমিয়ে আছে দুজন, একবার ডাকতেই ধড়মড় করে উঠে বসল। আগেই তাবুর পেছনে আস্তাবলে ঘোড়া প্রস্তুত করে রেখেছিলাম আমি, যাতে দরকারের সময় সাথে সাথে রওনা দেওয়া যায়।

এ ছাড়াও নদীর তীরে কিছু দূর পর পর নির্দিষ্ট জায়গায় ডিঙি নৌকা লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছি আমি। প্রধান শিবিরের উজান এবং ভাটি- দুই দিকেই রয়েছে নৌকাগুলো, কারণ এখনো আমার জানা নেই যে ঠিক কোন জায়গা দিয়ে নদী পার হতে হবে। তবে রওনা দেওয়ার পর দেখা গেল আমাদের শিবির থেকে খুব বেশি হলে দুই লিগ ভাটিতে অবস্থিত টেরামেশের লুকানো আস্তানা। নীলনদের পুব তীরে তার বাগান বরাবর আমরা যখন নৌকা থেকে নামলাম তখন সবে ভোর হচ্ছে। ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিলাম, যাতে ওরা নিজেদের ইচ্ছেমতো শিবিরে ফিরে যেতে পারে আবার। তারপর এগিয়ে গেলাম নদীর তীরের দিকে। সেখানে বেশ কিছু শুকনো ঘাস এবং অন্যান্য আবর্জনার নিচে লুকানো অবস্থায় পাওয়া গেল একটা ডিঙি নৌকা। ময়লাগুলো পরিষ্কার করে ফেললাম আমরা, তারপর রামেসিস আর আমি মিলে নদীর কিনারে টেনে নিয়ে গেলাম নৌকাটাকে। চামড়ার তৈরি লম্বা ধনুকের খাপ এবং অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আমাদের অনুসরণ করল সেরেনা। নৌকায় উঠে পড়লাম আমরা, তারপর কিনারে ঠেলা দিয়ে সরে এলাম নদীর ভেতরে, অপর তীর লক্ষ্য করে বৈঠা বাইতে শুরু করলাম। নদী পার হয়ে নৌকাটাকে আবারও কিছু গাছপালা আর ঘাস ব্যবহার করে লুকিয়ে রাখছি, এই সময় একটা পরিচিত কিচিরমিচির শব্দ ভেসে এলো কানে। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের মাথার ওপর একটা গাছের ডালে অধৈর্য ভঙ্গিতে লাফালাফি করছে সেই বুলবুল পাখিটা। কাজ শেষ হতে এবার উত্তর দিক লক্ষ্য করে হালকা চালে দৌড়াতে শুরু করলাম আমরা। তার আগে ধনুকে ছিলা পরিয়ে নিল রামেসিস, দেখে নিল তূণের ভেতর প্রয়োজনীয় তীরটা আছে কি না। বাকি দুজনের কেউই বুঝতে পারল না যে আমি আসলে পাখিটাকে অনুসরণ করছি। এমনকি ওটার উপস্থিতি সম্পর্কেও কিছু আন্দাজ করতে পারেনি কেউ। সকালের অর্ধেকটা সময় জুড়ে দৌড়াতে হলো আমাদের। যদিও নির্দিষ্ট কোনো পথ বা রাস্তাঘাট নেই তবে বুলবুল পাখিটা প্রত্যেকবারই আমাদের সামনে সবচেয়ে সহজ রাস্তাটুকু বাতলে দিতে লাগল। ঘন জঙ্গলে ভর্তি কিছু পাহাড় টপকাতে হলো আমাদের। যতই সামনে এগোলাম ততই ঘন হয়ে উঠতে লাগল জঙ্গল।

হঠাৎ কোনো রকম সংকেত ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে গেল বুলবুল পাখিটা। থমকে দাঁড়ালাম আমরা। আশান্বিত চোখে আমার দিকে তাকাল রামেসিস আর সেরেনা। যদিও আমি নিজেও ওদের মতোই বিভ্রান্ত বোধ করছি তবে চেহারায় তার কোনো ছাপ ফুটতে দিলাম না। তার বদলে কণ্ঠস্বরে আত্মবিশ্বাস এনে বললাম, এখানেই দাঁড়াও। আমি যাব আর আসব। দেখতে হবে যে সামনের পথটুকুর কী অবস্থা।

এই বলে ওদের রেখে সামনে গিয়ে গেলাম আমি। প্রায় দুর্ভেদ্য কাঁটাঝোঁপের দেয়াল ভেদ করে সামনে এগোতে হলো আমাকে। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে বুঝলাম দেখতে যদিও কাটাঝোঁপগুলো বেশ ভয়ংকর; কিন্তু আমাকে কোনো রকম বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। আমার শরীর এবং জামাকাপড়ের ওপর দিয়ে যেন আলতো পরশ বুলিয়ে দিয়ে সরে যেতে লাগল ওরা, কোথাও কোনো আঁচড় বা কাটাছেঁড়ার চিহ্ন পড়ল না। তবে কিছুক্ষণ পরেই আবিষ্কার করলাম অদ্ভুত এক ক্লান্তি আর অবসাদ ঘিরে ধরেছে আমাকে। ধীর হয়ে এলো আমার পদক্ষেপ, থেমে পড়লাম আমি। ইচ্ছে হচ্ছে এখানেই একটু বসে বিশ্রাম নিই, আর যদি সম্ভব হয় তাহলে একটু ঘুমিয়েও নিই। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে শুরু করল আমার। এবং কেবল তখনই আমি বুঝতে পারলাম অন্য কোনো অস্তিত্ব বা সত্তা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। কোনো ধরনের মানসিক বাধার মুখোমুখি হয়ে পড়েছি আমি। বুঝতে পারছি টলছে আমার পা দুটো, অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে শরীরের ভার আর বইতে পারছে না ওরা। মাথার ভেতর যেন কুয়াশার মেঘ জমছে, পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে পারছি না। আর সামনে এগোনো সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

তার পরেই আমার কাঁধের ওপর কীসের যেন ওজন অনুভব করলাম। কানে শুনতে পেলাম ইনানার মিষ্টি কণ্ঠ: হাল ছেড়ো না টাইটা! তোমার সাথে কী হচ্ছে খুব ভালো করেই জানো তুমি। এটাকে কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা আছে তোমার।

লম্বা করে দম নিলাম আমি, শ্বাসনালি আর বুকের ভেতর শিসের মতো শব্দ উঠল। ইনানার কণ্ঠ শুনতে লাগলাম কান পেতে। একই সাথে অনুভব করলাম আমার মনের ওপর যে কালো মেঘের ছায়া নেমে এসেছিল তা ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছে, সরে যাচ্ছে। আবারও পায়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলাম আমি। তারপর জোর করে এগিয়ে গেলাম আরো এক পা।

এই তো টাইটা। চাইলেই এই বাধাকে কাটিয়ে উঠতে পারবে তুমি। নিজের এবং ভালোবাসার মানুষদের কথা চিন্তা করে নিজেকে শক্ত রাখো। এখন তোমাকে দরকার ওদের।

আরো একটা পা ফেললাম আমি, তারপর আরেকটা। এখনো গায়ে কাঁটার খোঁচা লাগছে না, আমার কিন্তু অবচেতন মনে বুঝতে পারছি যে ইনানার কাজ এটা। ইচ্ছে করেই কাঁটাগুলোর মুখ ঘুরিয়ে দিচ্ছে সে।

তারপর হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল শরীরের ওপর কাঁটার স্পর্শ। বন্ধ চোখের ওপরে আলোর স্পর্শ টের পেলাম আমি। চোখ খুললাম এবার এবং অসাধারণ এক দৃশ্য দেখতে পেলাম আমার চোখের সামনে। ধারালো কাঁটায় ভর্তি সেই কাঁটাঝোঁপগুলো আর নেই এখন। তার বদলে অদ্ভুত সুন্দর এক বাগান উন্মোচিত হয়েছে আমার সামনে। বাগানের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট ছোট হ্রদ আর স্রোতস্বিনী ঝরনাধারা, সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে তাদের পানিতে। তার সাথে আরো রয়েছে ঘন সবুজ রঙের নানা রকম গাছে ভর্তি বন। তাদের উঁচু উঁচু ডালগুলোতে ফুটে আছে নানা রঙের ফুল, নিচ থেকে মনে হচ্ছে যেন চুনি আর নীলা পাথর সাজিয়ে রেখেছে কেউ। আর তার নিচে বিছিয়ে আছে ঘন সবুজ ঘাসের গালিচা।

হ্রদের ওপাশে জঙ্গলের মাঝ থেকে বেরিয়ে এলো এক দল কুচকুচে কালো ইউনিকর্ন। এগুলোকেই দেখেছিলাম টেরামেশের সেই ভয়ংকর রথটাকে টানতে। তবে এখন আর লাগামের বন্ধনে আবদ্ধ নয় প্রাণীগুলো, মুক্ত সবাই। তরুণ ঘোড়ার মতো লাফাতে লাফাতে পানি খাওয়ার জন্য হ্রদের কিনারে এগিয়ে এলো দলটা। খাওয়া শেষ হতে আবার জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল তারা, অদৃশ্য হয়ে গেল গাছগুলোর মাঝে।

এটাই তাহলে টেরামেশের লুকানো বাগান, বলে উঠলাম আমি। ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ফিরে পাচ্ছি আবার এবং বুঝতে পারছি যে গন্তব্যে পৌঁছে গেছি আমরা। আমাকে সমর্থন জানিয়েই যেন কিচিরমিচির করে উঠল কাঁধে বসে থাকা পাখিটা। কিন্তু টেরামেশ কোথায়? প্রশ্ন করলাম আমি।

ঘুমাচ্ছে।

তুমি কি নিশ্চিত, ইনানা?

ভয় পেও না। আমি যতক্ষণ আছি তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ।

ভয় পাচ্ছি না আমি, একটু আহত গলায় তাকে শুধরে দিলাম আমি। শুধু একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে এই যা। তারপর চলে এলাম অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলোর আলোচনায়। এখন টেরামেশকে যেভাবেই হোক এমন একটা অবস্থানে নিয়ে আসতে হবে যেখান থেকে তার মুখের অক্ষত পাশটায় তীর দিয়ে আঘাত করার সুযোগ পাবে রামেসিস।

সমস্যাটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করলাম আমরা। পাখির রূপ ছেড়ে মানুষের রূপ ধারণ করল ইনানা, যাতে তার মতামতগুলো আরো ভালোভাবে বোঝাতে পারে আমাকে। বাগানের যে অংশটাকে সে টেরামেশকে খুন করার জন্য বেছে নিয়েছে সেটা এবার দেখাল আমাকে। তারপর বুঝিয়ে দিল যে টেরামেশকে কীভাবে এই জায়গার ভেতরে নিয়ে আসতে হবে এবং সে আসা পর্যন্ত আমি রামেসিস এবং সেরেনা কোথায় অপেক্ষা করব।

আর আগে কখনো সেরেনাকে দেখেনি সে, বলল ইনানা। তাই স্বভাবতই ধরে নেবে যে সেরেনা সম্ভবত কোনো অপার্থিব সৃষ্টি, যাকে তার মা হেকাটি অথবা অন্য কোনো খারাপ দেবতা তার মনোরঞ্জনের জন্য পাঠিয়েছে। এর আগে বহুবার এ ধরনের উপহার পেয়েছে টেরামেশ। ফলে সেরেনাকে দেখে একটুও চমকাবে না সে, কোনো প্রতিক্রিয়াই হবে না তার মাঝে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘাসে ঢাকা জমিটুকুর ঠিক মাঝখানে জন্মানো একটা বিশাল গাছের দিকে ইঙ্গিত করল ইনানা। ওই ডুমুর গাছটার গুঁড়ির ভেতরটা ফাঁপা। তুমি আর রামেসিস ওর ভেতরে লুকিয়ে থাকবে। সেরেনা যখন তোমাদের শিকারকে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে আসবে তখন রামেসিস তাকে তার নাম ধরে ডাক দেবে। ডাক শুনে ঘুরে তাকাবে টেরামেশ, এবং তখনই বাকি কাজটুকু শেষ করবে রামেসিস। অদ্ভুত সুন্দর চোখগুলো দিয়ে আমার দিকে তাকাল ইনানা। আর কিছু জানার আছে তোমার?

হ্যাঁ আছে। সেরেনা আর রামেসিসকে ওই কাঁটাঝোঁপের মাঝ দিয়ে কী করে নিয়ে আসব আমি? ওখান দিয়ে আসতে গেলেই তো ঘুমিয়ে পড়বে ওরা।

কোনো একটা বুদ্ধি নিশ্চয়ই চলে আসবে তোমার মাথায়, আমি নিশ্চিত, জবাব দিল সে। তার পরেই মানুষ থেকে আবার পরিণত হলো ছোট্ট পাখিটায়, বাতাসে তখনো তার দুষ্টুমিভরা হাসির প্রতিধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই আশা করছ না যে এই চেহারায় আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব?

অগত্যা কাঁটাঝোঁপের মাঝ দিয়ে আবার ওপাশে ফিরে গেলাম আমি। দেখলাম রামেসিস এবং সেরেনাকে যেখানে রেখে গিয়েছিলাম সেখানেই আমার জন্য উদ্বিগ্ন অবস্থায় অপেক্ষা করছে ওরা। কোথায় গিয়েছিলে টাইটা? আমাকে দেখে একসাথে জানতে চাইল দুজন। খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমাদের।

 এখন তোমাদের সামনে দুশ্চিন্তা করার মতো একটা ব্যাপারই আছে। সেটা হচ্ছে এই আমার কাঁধে চড়ে এই কাঁটাঝোঁপের জঙ্গল পার হতে হবে তোমাদের। দয়া করে তর্ক কোরো না। আমাদের হাতে মোটেই সময় নেই। কিন্তু- আহত গলায় বলতে শুরু করল রামেসিস।

কোনো কিন্তু নয়, প্রিয় স্বামী। টাটার কথা শুনেছ তুমি। প্রথমে তোমার পালা, কড়া গলায় তাকে বলে উঠল সেরেনা। সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল রামেসিস।

বোঝাই যাচ্ছে স্ত্রী হিসেবে নিজের অবস্থানটা বেশ ভালো মতোই পোক্ত করে নিয়েছে সেরেনা।

নিজের ধনুকের খাপটাও সাথে করে নিয়ে যেতে চাইল রামেসিস, তবে আমার কথায় শেষ পর্যন্ত ওটা সেরেনার কাছে রেখে যেতে সম্মত হলো। কাঁটাঝোঁপের মাঝ দিয়ে অর্ধেকের মতো দূরত্ব অতিক্রম করতে পারল ও, তার পরেই হঠাৎ যেন শরীরে ভার ছেড়ে দিল তার পা দুটো। মাটিতে পড়ে গেল ও, মৃদু নাক ডাকতে শুরু করেছে। ঠোঁটে আরামের মৃদু হাসি। বেশ বড়সড় মানুষ রামেসিস, পেশিবহুল দেহ। তা সত্ত্বেও ওকে এক কাঁধের ওপর তুলে নিতে পারলাম আমি, বয়ে নিয়ে এলাম গোপন বাগানটার ভেতরে। বিশাল ডুমুর গাছটার গোড়ায় শুইয়ে দিলাম রামেসিসকে। গাছের ডালে বসে বুলবুল পাখিটা নজর রাখল ওর ওপর।

এবার সেরেনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফিরে এলাম আমি। কোনো রকম আপত্তি ছাড়াই এক লাফে আমার কোলে চড়ে বসল ও, তারপর দুই হাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরল।

অপেক্ষা করছিলাম যে কখন আমাকে নিতে আসবে তুমি, খুশি খুশি গলায় বলল সেরেনা। ওর স্বামীর ওজন বহন করার পর ওকে বইতে কোনো কষ্টই হলো না। ধনুকের খাপ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসগুলোও সহজেই সাথে করে নিতে পারলাম আমি। যখন ওকে ডুমুর গাছের নিচে রামেসিসের পাশে শুইয়ে দিলাম তখন আরাম করে গুটিসুটি মেরে শুলো ও, তবে কেউই জাগল না ঘুম থেকে। পাশে বসে মিনিটখানেক ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম আমি। দুজনকে এত সুন্দর মানিয়েছে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তে হয়।

বাহ, কী আরামে ঘুমোচ্ছে, যেন নিজের বাড়ি পেয়েছে, মাথার ওপর গাছের ডাল থেকে বলে উঠল পাখিটা। আমি তাহলে একটা ঘুমপাড়ানি গান শোনাই, কি বলো?

*

রামেসিস আর আমি অনেক আগেই একমত হয়েছি যে, পঁয়ষট্টি কদম দূর থেকেই ওর তীর ধনুকের নিশানা সবচেয়ে নিখুঁত হয়। এই দূরত্ব থেকে একটা ভুট্টার দানার সমান ছোট্ট লক্ষ্যেও একের পর এক নিখুঁত নিশানায় তীর ছুঁড়ে যেতে পারে ও। এবার ওর দুই গালে কয়েকটা চাপড় মেরে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললাম আমি। উঠে বসে অবাক চোখে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল রামেসিস, বাগানের সৌন্দর্য দেখে বিস্মিত হয়ে গেছে। ওর বিস্মিত কথাবার্তার শব্দে সেরেনারও ঘুম ভাঙল। দুজনের প্রাথমিক বিস্ময়ের ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার পর এবার ওদের বুঝিয়ে দিলাম আমি কাকে কী করতে হবে।

ধনুকের খাপের সাথে নিয়ে আসা প্রসাধন এবং অন্যান্য মেয়েলি দ্রব্যাদি তুলে দিলাম সেরেনার হাতে। এগুলোর সাহায্যে নিজের নিখুঁত সৌন্দর্যকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলবে ও। তারপর ওকে প্রসাধন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার সুযোগ দিয়ে আমি আর রামেসিস ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নির্দিষ্ট জায়গাটার দূরত্ব মাপতে। হ্রদের সামনে মাঠের মাঝখান বরাবর ফুটে আছে অত্যন্ত সুন্দর কিছু নীল রঙের বুনো ফুল। ওটাই আমাদের নির্দিষ্ট জায়গা এবং ওখান থেকে ডুমুর গাছের ফাঁপা গুঁড়িটা পর্যন্ত দূরত্ব মেপে দেখলাম আমরা।

ইনানা আমাকে আগেই জানিয়েছে হ্রদের ওপাশে জঙ্গলের ভেতর ঘুমিয়ে আছে টেরামেশ। এখনো সেই লাল ডানার বুলবুল পাখিরই রূপ ধরে আছে সে, গিয়ে বসেছে টেরামেশ যে গাছের নিচে ঘুমাচ্ছে তার ডালে। আমার এবং রামেসিসের প্রস্তুতি নেওয়া শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানেই থাকবে সে, ঘুম পাড়িয়ে রাখবে তাকে। হ্রদের মাঝ দিয়ে এ পারে আসার একটা পথ আছে। ঘুম থেকে ওঠার পরেই টেরামেশকে ওই পথ দিয়ে এদিকে আসার জন্য প্ররোচিত করবে ইনানা। অবশেষে ফাঁদ পাতা এবং তাতে টোপ বসানোর কাজ শেষ হলো। ডুমুর গাছের ফাঁপা গুঁড়ির ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নিলাম আমি এবং রামেসিস। ধনুকে সেই বিশেষ তীরটা জুড়ে নিল রামেসিস। খাঁটি সোনার মতো উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তীরের মাথাটা। কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইল ও যেন প্রার্থনা করছে। তারপর আবার চোখ খুলে আমার দিকে ফিরে মাথা ঝকাল। এবার গুঁড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে এসে গাছটার সামনে দাঁড়ালাম আমি, সবুজ চত্বরটার দিকে তাকালাম। পুরো বাগানকে ঘিরে রাখা জাদুর কাটাঝোঁপের সামনে চত্বরের অপর প্রান্তে গাছপালার সাথে মিশে গিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সেরেনা। আমার কাছ থেকে সংকেত পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে ও। মাথার ওপরে এক হাত তুলে নাড়লাম আমি। সংকেত পেয়ে উঠে দাঁড়াল ও, তারপর ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে নীল রঙের বুনো ফুলের ঝোঁপটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এটা একই সঙ্গে যেমন আমার প্রতি ওর সংকেত হিসেবে কাজ করল তেমনি ইনানার প্রতি আমার সংকেত হিসেবেও কাজ করল। আমি জানি হ্রদের অপর পাশে গাছের ডালে বসে আমাদের দিকেই চোখ রেখেছে সে।

বিয়ের দিন যে সিল্কের পোশাকটা পরেছিল সেটাই এখন পরে আছে সেরেনা। ওর হাঁটার তালে তালে ঢেউ উঠল সেই পোশাকে, শরীরের প্রতিটি বাঁক আর ওঠানামা নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলল। তার সাথে যখন ওর লম্বা সোনালি চুলে সূর্যের আলোর ছোঁয়া লাগল আর প্রসাধনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা চেহারা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল তখন, যেন আশপাশের সব কিছুই ম্লান হয়ে গেল ওর সামনে।

জোর করেই ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে আনলাম আমি, হ্রদের অন্যদিকে তাকালাম। প্রায় সাথে সাথেই জঙ্গলের মাঝ থেকে বেরিয়ে এলো টেরামেশের দীর্ঘদেহী অবয়ব। সেখানে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল সে, প্রকাণ্ড হাঁ করে হাই তুলল। তারপর পায়ে হাঁটা পথটা ধরে এগিয়ে আসতে শুরু করল এ পাশে। সাথে কোনো অস্ত্র নেই তার, না ধনুক, না তলোয়ার। পরনে কেবল শুধু ছোট্ট একটা নেংটি, ফলে পেশিবহুল দেহের প্রায় সবটুকুই উন্মুক্ত। মনে হলো যেন চওড়া হাড় আর ফুলে থাকা পেশি ছাড়া আর কিছুই নেই তার শরীরে; কিন্তু কোনোটার সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখেনি কোনোটা। যতটা না মানুষ তার চাইতে কোনো বুনো জন্তুর সাথেই যেন তার মিল বেশি।

ধাতব শিরস্ত্রাণটা দিয়ে কেবল তার মুখের একটা পাশ ঢাকা রয়েছে। অন্য পাশটায় কোনো লোম বা চুল নেই, শুধু অজস্র কাটাকুটির ক্ষত আর দাগে ভর্তি। দেখলে মনে হয় মানুষের স্বাভাবিক চেহারাকে ব্যঙ্গ করছে ওই অংশটা। আর এই উন্মুক্ত ক্ষতবিক্ষত চেহারার ঠিক মাঝখানে রয়েছে পাতাবিহীন চোখটা, পলকহীন চেয়ে আছে সামনে।

পথের অর্ধেকটা আসার পরেই সামনের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা সেরেনার উপস্থিতির কথা বুঝতে পারল টেরামেশ। মাঝপথে থমকে দাঁড়াল সে, তারপর খোলা চোখটার নির্লিপ্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিদ্ধ করল সেরেনাকে।

একই রকম ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তার চোখে চোখ রাখল সেরেনা। তারপর দুই হাত বুকের কাছে তুলে আনল, থুতনির নিচের বোতামটা থেকে শুরু করে এক এক করে খুলতে শুরু করল সবগুলো বোতাম। পোশাকের কোমর পর্যন্ত খুলে ফেলল ও, তারপর দুপাশ দুদিকে সরিয়ে দিতেই বেরিয়ে এলো স্তন দুটো। বড় গোলাকার মাখনরঙা ত্বক, মাঝখানে খাড়া হয়ে আছে বোটা। দুই আঙুলের মাঝে একটা বোঁটা ধরে টেরামেশের দিকে তাক করল ও, আস্তে আস্তে ডলতে শুরু করল; যতক্ষণ না এক ফোঁটা স্বচ্ছ তরল পদার্থ বেরিয়ে এলো সেটা থেকে। একই সাথে ঢুলুঢুলু হয়ে এলো ওর চোখ জোড়া, মনে হলো যেন নারীসুলভ কমনীয়তা এবং অদম্য কামের এক অসাধারণ মিশ্রণ ঘটেছে ওর মাঝে।

দুই হাত উঁচু করে শিরস্ত্রাণটা ধরল টেরামেশ, তারপর সেটাকে মাথা থেকে তুলে এনে ফেলে দিল মাটিতে। তার চেহারার দুই পাশে যে অমিল তা দেখলে চমকে উঠতে হয়। বাম পাশের কর্কশ ক্ষতবিক্ষত অংশের সাথে একেবারেই মেলে না চেহারার ডান অংশের অভিজাত অবয়ব। কিন্তু চোখের দৃষ্টি একই রকম নির্লিপ্ত, এবং ঠোঁটের কোণে পরিষ্কার নিষ্ঠুরতার ছাপ। ঠোঁটের অক্ষত অংশ বাঁকিয়ে হাসল সে; কিন্তু কোনো দয়া বা রসবোধের চিহ্ন রইল না সেই হাসিতে; স্রেফ উদগ্র যৌন কামনার প্রকাশ।

এবার দুই হাতে পরনের নেংটিটা খুলে এক পাশে ফেলে দিল সে, ফলে উন্মুক্ত হলো তার যৌনাঙ্গ নরম হয়ে ঝুলছে দুই পায়ের মাঝে। এক হাতে পুরুষাঙ্গটা ধরে ওপরে নিচে ডলতে লাগল টেরামেশ। ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে ফুলে উঠতে লাগল সেটা, মনে হলো টেরামেশের মুঠিতে আঁটবে না ওটার পরিধি। সামনের চামড়া সরে গিয়ে মাথাটা বেরিয়ে এলো। গোলাপি রং, পাকা আপেলের সমান আকারে। প্রায় তার বাহুর সমান আকৃতি নিয়ে দেহের সামনে ঠেলে দাঁড়িয়ে রইল অঙ্গটা।

সেরেনাকে দেখে মনে হলো এই দৃশ্য দেখে ও নিজেও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। পোশাক এবার সম্পূর্ণ খুলে ফেলল ও, তারপর দুই হাত দিয়ে ঊরুসন্ধি ঢেকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল। কোমরটা ঠেলে দিয়েছে সামনের দিকে, ঠোঁটে মদির আহ্বানের হাসি। ওর কাছ থেকে এমন নির্লজ্জ আচরণ দেখে বেশ অবাক হয়ে গেলাম আমি, যদিও জানি যে এই সবই ওর অভিনয়।

 সামনে এগিয়ে এলো টেরামেশ। হ্রদের ওপরের পথটা ছেড়ে নেমে এলো সে, ঢাল বেয়ে নেমে আসতে শুরু করল সেরেনার দিকে। ডুমুর গাছের গোড়ায় যেখানে আমি এবং রামেসিস লুকিয়ে আছি তার কাছ দিয়েই হেঁটে গেল সে। এত কাছ দিয়ে গেল যে তার নাক দিয়ে বেরিয়ে আসা উত্তেজিত শব্দও শুনতে পেলাম আমি, যেন মৈথুনের আগ মুহূর্তে কোনো বুনো শূকর; যৌন উত্তেজনার গন্ধ এসে লাগল আমার নাকে, যেন কোনো ছোঁয়াচে বসন্ত রোগের দুর্গন্ধ।

টোমেশকে বিশ কদম এগিয়ে যাওয়ার সময় দিলাম আমি, তারপর আলতো করে স্পর্শ করলাম রামেসিসের কাঁধ। একই সাথে লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে এলাম আমরা। আমার কাছ থেকে তিন কদম আগে বেড়ে দাঁড়াল রামেসিস, যাতে তীর ছুঁড়তে কোনো রকম বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। তারপর তীরন্দাজের অভ্যস্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে গেল ও। এক হাতে ধরে রেখেছে ধনুকটা, আরেক হাতে বিশেষ তীরটা জুড়ে ধরেছে ছিলার সাথে। ওদিকে টেরামেশ তখন সেরেনার কয়েক কদমের মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সেরেনার সামনে পাহাড়ের মতো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সে, ওকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে আমাদের দৃষ্টিপথ থেকে।

সেই একই মুহূর্তে যেন বজ্রপাত বর্ষিত হলো রামেসিসের কণ্ঠ থেকে; এত জোরে যে আগে থেকে প্রস্তুত থাকার পরেও আমি পর্যন্ত চমকে গেলাম, ফন্টাসের পুত্র, তোমার বাবা তোমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে!

চরকির মতো ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদের মুখোমুখি হলো টেরামেশ। সাথে সাথে যেন জমে গেল সে, পাথরের মতো তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে। তারপর সব কিছু যেন একই সাথে ঘটতে শুরু করল। এক লাফে ঘাসের মাঝে মুখ খুঁজে শুয়ে পড়ল সেরেনা, ফলে পরিষ্কার হয়ে গেল রামেসিসের তীর নিক্ষেপের পথ। এবং একই মুহূর্তে অভ্যস্ত দ্রুততার সাথে ধনুকটা সামনে তুলে আনল রামেসিস। তীরটা আগেই ছিলায় জোড়া ছিল, এবার সেটাকে এক টানে কানের কাছে এনেই ছেড়ে দিল ও। তীক্ষ্ণ প্রায় সুরেলা একটা ঝংকার বেরিয়ে এলো ছিলা থেকে, ছুটে গেল তীর।

টেরামেশের প্রতিক্রিয়াটা হলো তাৎক্ষণিক। কিন্তু মৃত্যুর প্রতিনিধি তীরটা থামানোর জন্য যথেষ্ট দ্রুত হলো না তা, কারণ সেটা ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি দূরত্ব পেরিয়ে গেছে। অর্ধবৃত্ত রচনা করে ছুটছে ওটা, এবং টেরামেশ এক চুল নড়ার আগেই বৃত্তের সর্বোচ্চ বিন্দু পার হয়ে নেমে আসতে শুরু করেছে। তার বীভৎস চেহারা আর বিশাল পুরুষাঙ্গ- দুটোই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই এক ফালি সূর্য কিরণের মতো নেমে এলো তীরটা। টেরামেশের বিস্মিত চোখের ঠিক মাঝখানে ঢুকে গেল, এক ঝলক স্বচ্ছ তরল বেরিয়ে এলো সাথে সাথে। পালকসহ তীরের প্রায় দেড় হাতের মতো বেরিয়ে রইল তার চোখের ফুটো থেকে। যে অবস্থানে ভেতরে ঢুকেছে ওটা তাতে আন্দাজ করা যায় যে, নিশ্চিতভাবেই তার মস্তিষ্ক ছিদ্র করে দিয়েছে। ভেবেছিলাম সাথে সাথেই মাটিতে পড়ে যাবে সে, আর উঠতে পারবে না। কিন্তু তার বদলে দৌড়াতে শুরু করল টেরামেশ, একই সাথে গলা থেকে বেরিয়ে আসছে প্রলম্বিত টানা লয়ের চিৎকার। সরাসরি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে সে। প্রথমে মনে হলো আমাদের ওপর আক্রমণ করতে চায়; কিন্তু আমাদেরকে দেখতে পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখলাম না তার মাঝে। কাছাকাছি এগিয়ে আসতেই রামেসিস আর আমি লাফ দিয়ে সরে গেলাম তার সামনে থেকে। ওদিকে দৌড়ে ঢালু জমি বেয়ে হ্রদের দিকে নেমে যেতে লাগল টেরামেশ, অন্ধ ক্রোধ আর যন্ত্রণায় চিৎকার করেই চলেছে।

দুজনেই তলোয়ার বের করে তাকে ধাওয়া করলাম আমরা; কিন্তু দৌড়ে পেরে উঠলাম না কেউই। তারপর দৌড়াতে দৌড়াতেই বিশাল ডুমুর গাছটার সাথে ধাক্কা খেল টেরামেশ, গাছটা দেখতেই পায়নি সে। সংঘর্ষের ফলে তীরটা সম্পূর্ণ ঢুকে গেল তার মাথার ভেতর, খুলি ফুটো করে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে এলো। কিন্তু তবু পড়ল না সে, টলোমলো পায়ে চক্কর খেতে লাগল বারবার। এখনো বন্ধ হয়নি তার চিৎকার। এবার মাংস খসে আসতে শুরু করল তার মাথা থেকে, যেন পচে-গলে খসে পড়ছে। সূর্যের আলোতে চকচক করে উঠল খুলির সাদা হাড়। তারপর তাতেও পচন ধরতে শুরু করল।

এবার মাথা থেকে বাহু আর বুকের মাংসে নেমে এলো পচন। প্রথমে কালো হয়ে এলো মাংস, তারপর টুকরো টুকরো হয়ে খসে পড়তে লাগল নিচে। তীব্র ভারি দুর্গন্ধে ভরে উঠল বাতাস। সে গন্ধ এতই তীব্র যে নাকে মুখে হাত চাপা দিয়ে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলাম আমরা। ঝাঁকি খেতে লাগল শরীরটা, মোচড় দিতে লাগল বারবার। তারপর ওভাবেই একসময় পরিণত হলো পচা মাংসের একটা স্কুপে। তারপর সেটাও পরিণত হলো ধুলোয়, হ্রদের ওপর থেকে বয়ে আসা হালকা বাতাসের সাথে উড়ে যেতে শুরু করল। তবে যে তীরের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে সেটা পড়ে রইল ওখানেই। একটু দ্বিধা করে সামনে এগিয়ে গেল রামেসিস, ঝুঁকে তীরের ফলাটা তুলে নিতে চাইল। কিন্তু তার ছোঁয়ার আগেই কালো হয়ে এলো ধাতুর রং, তার পরই ক্ষয় হয়ে মিশে গেল মাটির সাথে। শেষ পর্যন্ত টেরামেশের অস্তিত্বের আর কোনো চিহ্নই রইল না কোথাও। আক্ষরিক অর্থেই বাতাসে মিলিয়ে গেছে সে।

অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলাম আমরা। তারপর একসময় চোখ সরিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম সেরেনা যেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে। ওর দুপাশে বসলাম আমরা দুজন। ওর কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরল রামেসিস, আর তার কাঁধে হেলান দিল সেরেনা। প্রসাধনের নিচে বরফের মতো সাদা হয়ে গেছে ওর চেহারা, চোখে টলমল করছে অশ্রু।

রীতিমতো জোর করে দৃশ্যটা দেখছিলাম আমি। কী ভয়ানক! ফিসফিস করে বলে উঠল ও। তারপর টেরামেশের মৃতদেহ যে জায়গাটায় বাতাসে মিশে গেছে সেদিকটায় আঙুল তাক করে বলল, দেখো, টেরামেশের লুকানো বাগানের কী পরিণতি হচ্ছে।

আমাদের চোখের সামনেই শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে হ্রদ আর ঝরনাগুলো। এখন সেগুলো স্রেফ উঁচু-নিচু মাটির ঢিবি আর গর্তে পরিণত হলো, তার ওপরে লেগে রইল সবুজ শেওলা। জঙ্গলের গাছগুলো থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘন সবুজ ডালপালা আর রঙিন ফুলের বাহার। গুঁড়িগুলো শুকিয়ে কালো হয়ে এলো। শুকিয়ে বাদামি হয়ে গেল গাছগুলোর নিচে জন্মানো সবুজ ঘাসের গালিচা। বিশাল ডুমুর গাছটার বড় বড় ডালগুলো খসে পড়ল, কাটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো পড়ে রইল নিচে। লুকানো বাগানকে ঘিরে রাখা কাটাঝোঁপটা আবারও রুক্ষ নিষ্প্রাণ চেহারা নিয়ে মাথা তুলল; কিন্তু তা কেবল কয়েক মুহূর্তের জন্য। তার পরেই ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করল তাদের বিস্তার। টেরামেশের সেই বিশাল ইউনিকনগুলোকে আর দেখা গেল না। লুকানো বাগানের সাথে সাথে তারাও অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন এখানে কেবল মৃত্যু আর ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই নেই। সব কিছুর মাঝে পড়ে রইল টেরামেশের সেই শিরস্ত্রাণ। এগিয়ে গিয়ে ওটাকে এই আশ্চর্য ঘটনার একমাত্র স্মৃতি হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্য তুলে নিলাম আমি।

এখানে আর এক মুহূর্তও থাকার কোনো প্রয়োজন দেখছি না, রামেসিস আর সেরেনার কাছে ফিরে আসতে আসতে বললাম আমি। সেরেনাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল রামেসিস। ফিরতি পথে রওনা দিলাম আমরা, গন্তব্য নীলনদের তীর, যেখানে সেই ডিঙি নৌকাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। কেউই একবারের জন্যও পেছনে তাকালাম না।

*

হুরোতাসের শিবিরে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। ডিঙিতে বসা আমাদের তিনজনকে চিনতে পেরেই উল্লসিত চিৎকারের স্রোত বয়ে গেল উপস্থিত প্রহরীদের মধ্যে। কয়েকজন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের নৌকাটাকে টেনে তীরে নিয়ে এলো। ডাঙায় নামতে নামতে প্রায় অর্ধেক সেনাবাহিনী এসে জড়ো হলো আমাদের স্বাগত জানাতে। তার পরেই তাঁবুর ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এলো হুরোতাস আর তেহুতি। দৌড়ে এসে সেরেনাকে জড়িয়ে ধরল হুরোতাস, তারপর বুকে জড়িয়ে রেখেই তাঁবুতে নিয়ে গেল। ওদিকে তেহুতি আনন্দে প্রায় নাচতে শুরু করল, একই সাথে মেয়েকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে সকল দেবতাকে। একটু দূরত্ব রেখে ওদের অনুসরণ করলাম আমি আর রামেসিস, অপেক্ষা করছি যে কখন মেয়ের দিক থেকে আমাদের দিকে মনোযোগ ফেরাবে হুরোতাস। ভাগ্যই বলতে হবে, টেরামেশের শিরস্ত্রাণসহ অন্য যেসব জিনিস আমরা সাথে নিয়েছিলাম সেগুলো সব এখন একটা থলের মাঝে রয়েছে আমার সাথে।

অবশেষে মেয়েকে বুকে টেনে নিল তেহুতি, তারপর অন্য মহিলাদের সাথে নিয়ে যোগ দিল মেয়েদের নিজস্ব আলোচনা সভায়। প্রায় সাথে সাথেই আমাদের দিকে এগিয়ে এলো হুরোতাস। এসো আমার সাথে! হুকুম দিল সে। যা যা ঘটেছে সব শুনতে চাই আমি, সেইসাথে বিশেষভাবে জানতে চাই যে সেই দানবটার কী গতি করে এলে তোমরা।

হুরোতাসের সাথে তার ব্যক্তিগত তাঁবুতে ঢুকলাম আমরা। ভেতরে ঢুকে আরাম করে বসলাম আমরা দুজন, আর ওদিকে বড় এক বোতল লাল মদ নিয়ে এলো হুরোতাস। তিনটি বড় বড় পেয়ালায় মদ ঢালল সে। এই পেয়ালাগুলো কেবল বিশেষ বিশেষ উপলক্ষেই বের করা হয়। বোঝাই যাচ্ছে দারুণ খুশি হয়ে আছে সে।

এবার বলো। সব কিছু একেবারে প্রথম থেকে, আমাদের মুখোমুখি নিজের সিংহাসনে বসতে বসতে বলল হুরোতাস।

আমার দিকে তাকাল রামেসিস। লুকানো বাগান থেকে এখানে আসার পথেই আমি আর রামেসিস আলোচনা করে নিয়েছি যে, টেরামেশের সাথে আমাদের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনার ব্যাপারে কতটুকু বলা হবে হুরোতাসকে। আমাদের দুশ্চিন্তা হচ্ছিল এই ভেবে যে, আজ যা যা ঘটেছে তাকে বলা যায় একেবারেই অবিশ্বাস্য। যে এই ঘটনা নিজের চোখে দেখেনি সে হয়তো কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইবে না। তবে শেষ পর্যন্ত আমরা ঠিক করেছি যে, হুরোতাসের কাছে অন্তত কিছুই লুকাব না আমরা, তা সে যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক না কেন। যদি আমাদের বক্তব্য তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে না হয় তাহলে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তো তার আপন মেয়েই আছে। সেরেনার কথাকে নিশ্চয়ই কখনো ফেলতে পারবে না সে।

লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলাম আমি, তারপর লম্বা একটা চুমুক দিলাম মদের পেয়ালায়। অনেকটা মানসিক শক্তি ফিরে পেলাম এবার। তারপর বলতে শুরু করলাম সব। দীর্ঘ সময় ধরে বলতে হলো আমাকে, এমনকি আমার স্বাভাবিক সময়ের চাইতেও বেশি। যদিও ঘটনাপ্রবাহে সেরেনার ভূমিকার কিছু কিছু ব্যাপারে হালকা চেপে গেলাম আমি। হাজার হোক হুরোতাসের আপন মেয়ে সেরেনা। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, রামেসিস তার তীর ছোঁড়ার আগে সেরেনা কীভাবে টেরামেশকে অন্যমনস্ক করে তুলেছিল তার নিখুঁত বর্ণনা হুরোতাসের না শুনলেও চলবে। আমার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল হুরোতাস, মাঝে মাঝে আপন মনে মাথা ঝাঁকাল। বোঝা গেল এই বিবরণে কোথাও কোনো সন্দেহ নেই তার।

আমার কথা শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সে। তারপর বলল, তার মানে টেরামেশের মাথাটা তোমরা সাথে করে নিয়ে এসেছ, যাতে তার মৃত্যু সম্পর্কে সবাই নিঃসন্দেহ হতে পারে। তাই তো?

না, হালকা গলায় তার ভুলটা শুধরে দিলাম আমি। কথাটা ওভাবে বলিনি আমি।

তুমি কী বলেছ তা তো আমি নিজের কানেই শুনেছি, এবং বিশ্বাসও করেছি। কিন্তু জল ঘোলা করে কী লাভ বলো? আমাদের শিবিরের আশপাশে খুঁজলেই অনেক খুলি পাওয়া যাবে। ওগুলোর মাঝে যেকোনো একটাকে টেরামেশের মাথার খুলি বলে চালিয়ে দিতে পারব আমরা। আবু নাসকোসের দুর্গ দখল করার জন্য সৈন্যদের নদীর ওপারে পাঠাতে চাই আমি। টেরামেশের বেঁচে থাকার এবং সৈন্যদের ওপর আক্রমণ করার সামান্যতম সম্ভাবনা থাকলেও ওরা কেউ যেতে চাইবে বলে মনে হয় না। ওদেরকে বোঝানোর জন্যই একটা খুলি দরকার আমাদের। সুন্দর দেখে একটা পরিষ্কার খুলি জোগাড় করব আমরা, বা ময়লা হলেও অসুবিধা নেই; যেটা দেখলে ওরা বিশ্বাস করবে যে নদীর ওপারে ওদের জন্য ওত পেতে বসে নেই টেরামেশ।

রামেসিসের দিকে তাকালাম আমি। দাঁত বের করে হাসল ও। বলল, আমার বিয়ে খুব বেশি দিন হয়নি। তবে এর মধ্যেই একটা জিনিস শিখে গেছি আমি। সেটা হচ্ছে বউ এবং শ্বশুরের সঙ্গে কখনো তর্কে যেতে হয় না।

পরদিন সকালে মিশরের ফারাও প্রথম রামেসিস স্পার্টা ও ল্যাসিডিমনের রাজা হুরোতাস এবং বাকি চৌদ্দজন মিত্র রাজার সকল সৈন্য এক জায়গায় জড়ো হলো। তবে তাদের জায়গাটা এমনভাবে বেছে নেওয়া হলো যেন নদীর ওপারে আবু নাসকোস দুর্গ-প্রাচীরের ওপর থেকে কিছু দেখা না যায়। সৈন্যদের বেশির ভাগই বেশ মনমরা হয়ে আছে। পরে শুনেছিলাম নীলনদের ওপারে অভিযান থেকে আমরা গতকাল বিকেলে ফিরে আসার পর থেকেই নাকি তাদের মধ্যে একটা গুজব ঘুরে বেড়াচ্ছিল। গুজবের সারমর্মটা এ রকম যে, উটেরিক টুকরা এবং তার সর্বশেষ নিয়োগপ্রাপ্ত ভয়ংকর যোদ্ধা টেরামেশের বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা বাদ দিতে যাচ্ছি আমরা। হুরোতাস এবং তার মিত্ররা খুব শীঘ্রই নাকি যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করে স্পার্টায় পালিয়ে যাবে। রামেসিস আর তার নববিবাহিত স্ত্রীও যাবে তাদের সাথে।

সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যদের সামনে তৈরি করা মঞ্চে এবার উঠে দাঁড়াল রাজা হুরোতাস এবং ফারাও রামেসিস। পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াল তারা; কিন্তু সৈন্যদের মাঝ থেকে কোনো উল্লাসধ্বনি ভেসে এলো না। ঢালের সাথে তলোয়ারের বাড়ি দিয়ে তাদের স্বাগত জানাল না কেউ।

বেশ কিছুক্ষণ বিরাজ করল এই গম্ভীর নীরবতা। তারপর একটা ইশারা করল হুরোতাস। সংকেত পেয়ে দুই দাস উঠে এলো মঞ্চের ওপর। দুজন মিলে বেতের তৈরি বড় একটা ঝুড়ি বয়ে এনেছে তারা। হুরোতাসের নির্দেশ পেয়ে সেটা এবার রাখল মঞ্চের সামনে। তারপর পিছিয়ে গেল আবার, যাওয়ার আগে মঞ্চের কাঠের মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে কুর্নিশ করে যেতে ভুলল না। আরো কয়েক মুহূর্ত নীরবতার পর কথা বলতে শুরু করল হুরোতাস।

দুই দিন আগে ফারাও রামেসিস এবং তার স্ত্রী ফারাওইন সেরেনা নীলনদ পাড়ি দিয়ে গোপনে শত্রু এলাকায় প্রবেশ করে। তাদের সঙ্গী হয়েছিল সম্মানিত টাইটা। আমরা সবাই যাকে দাগীমুখো তীরন্দাজ বলে জানি সেই শয়তানটার খোঁজেই গিয়েছিল তারা।

সৈন্যদের মাঝ থেকে একটা সম্মিলিত রাগান্বিত গুঞ্জন উঠল। হাতের ইশারায় তাদের চুপ করতে বলল হুরোতাস, তারপর বলে চলল আবার।

এই তীরন্দাজের আসল পরিচয় হচ্ছে টেরামেশ, অজেয় যার উপাধি। আমি আমার বীর প্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়েছিলাম তার আস্তানা খুঁজে বের করতে, তারপর তাকে উপযুক্ত উপায়ে শাস্তি দিয়ে তার কাটা মাথাটা আমার কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু এটাও বলে দিয়েছিলাম যে, এখানে আসার পর আমার আগে যেন আর কাউকে না দেখানো হয় সেই কাটা মাথা। এই পর্যায়ে আসার পর অনেকেরই মনোযোগ এখন হুরোতাসের দিকে নিবদ্ধ হয়েছে। ধীরে ধীরে মনমরা ভাবও কাটিয়ে উঠছে তারা। এমনকি সব ঘটনার সক্রিয় অংশগ্রহণকারী আমি নিজেও হুরোতাসের বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এবার হাতের ইঙ্গিতে সামনে রাখা বেতের ঝুড়িটার দিকে নির্দেশ করল হুরোতাস। সাথে সাথে উপস্থিত রথচালক, পদাতিক এবং তীরন্দাজদের সবগুলো চোখ যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো ঘুরে গেল সেদিকে। এবার সামনে এগিয়ে এসে ঝুড়ির ডালাটা খুলে দিল হুরোতাস, তারপর ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল একটা মানুষের মাথা। সেটাকে সবার দেখার জন্য উঁচু করে ধরল সে।

মাথাটার সাথে এখনো লেগে আছে পচা চামড়া আর মাংস। মুখটা হাঁ করে খোলা, নীলচে জিভটা বেরিয়ে আছে সেখান দিয়ে। চোখের কোটরগুলো শূন্য, যেন জিভ বের করে ভ্যাঙাচ্ছে সবাইকে।

এই যে সেই টেরামেশের মাথা! গর্জে উঠল হুরোতাস। উপস্থিত কেউই তার কথায় এক চুল সন্দেহ প্রকাশ করল না, কারণ মাথাটার সাথেই বাঁধা রয়েছে সেই সোনালি শিরস্ত্রাণ, যাকে সৈন্যরা সবাই খুব ভালো করেই চেনে এবং মৃত্যুদূতের মতো ভয় পায়। সাথে সাথে আট হাজার গলার সম্মিলিত জয়োল্লাসে কেঁপে উঠল চারপাশ।

টেরামেশ! টেরামেশ! টেরামেশ! তলোয়ার বের করে আনল সবাই, তারপর ঢালের সাথে তলোয়ারের বাঁট ঠুকতে লাগল উচ্চকিত চিত্তারের তালে তালে। মনে হলো যেন মানুষের কণ্ঠস্বর নয় বরং বজ্রপাত হচ্ছে একের পর এক।

বেশ কিছুক্ষণ তাদের চিৎকার করার সুযোগ দিল হুরোতাস। তারপর তাদের গলা যখন কর্কশ হয়ে এসেছে তখন কাটা মাথা থেকে শিরস্ত্রাণটা খুলে আনল সে, তারপর উঁচু করে ধরল সবার সামনে।

আসন্ন যুদ্ধে যে সেনাদল সবচেয়ে বেশি নৈপুণ্য প্রদর্শন করবে তাদেরকেই উপহার দেওয়া হবে এটা, ঘোষণা করল সে। সাথে সাথে আবার সিংহের মতো গর্জন করে উঠল সবাই। তারপর অন্য হাতে শূন্য অক্ষিকোটর আর ঝুলে পড়া জিভসহ কাটা মাথাটা উঁচু করে ধরে বলল, এবং এই মাথাটাকে উপহার দেওয়া হবে পরলোকের শাসনকর্তা হেডিসকে। আর তার কাছে এটা বয়ে নিয়ে যাবেন অগ্নিদেবতা হেফাস্টাস।

এই বলে মাথাটা নিয়ে কাছের অগ্নিকুণ্ডের দিকে এগিয়ে গেল সে, তারপর আগুনে ছুঁড়ে দিল। আমাদের সবার চোখের সামনে পুড়ে ছাই হতে লাগল সেটা। বিচক্ষণ রাজার মতোই সিদ্ধান্ত নিয়েছে হুরোতাস, ভাবলাম আমি। এখন আর কেউ খুলিটার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না, কারণ আর ওটার অস্তিত্ব রইল না।

*

সমস্ত দিন জুড়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে কাটাল সৈন্যরা। ধনুকে ছিলা জুড়ল তারা, তলোয়ারে ধার দিল, মেরামত করিয়ে নিল ঢাল আর বর্ম, সেইসাথে যতটুকু পারে বিশ্রাম নিয়ে নিল। আকাশের ক্ষয়টে চাঁদটা ডুবে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করলাম আমরা। তারপর যখন রাত নামল, সারি ধরে এগিয়ে নদীর তীরে হাজির হলো সবাই, উঠে পড়ল নিজেদের নির্ধারিত জাহাজে। কেউ কোনো রকম আলো জ্বালছে না, ফিসফিস করে নির্দেশ জানাচ্ছে। অধিনায়কেরা। এক এক করে রওনা দিল সৈন্যবোঝাই জাহাজগুলো, আলাদা আলাদা পথ ধরে এগিয়ে চলল উজানে। বিগত দিন এবং সপ্তাহগুলোতে নদীর ওই পারে আমাদের সৈন্যদের অবতরণের জন্য বেশ কিছু জায়গা বেছে রাখা হয়েছে সতর্কতার সাথে, এখন সেদিকেই এগিয়ে চলেছে ওরা।

আমরা ঠিক করেছিলাম শত্রুদের পাহারাদারদের চমকে দেব, এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের নিরাশ হতে হলো না। টেরামেশের সুরক্ষার কারণে নিজেদের নিরাপদ ভাবতে শুরু করেছিল উটেরিক এবং তার লোকেরা। জানা গেছে এই সুরক্ষার বদলে তাকে দশ লাখ রৌপ্যখণ্ড দিয়েছিল উটেরিক। তবে এখন পর্যন্ত সে জানে না যে তার নিয়োগকৃত পাহারাদার আর বেঁচে নেই। আর এর ফলে উটেরিকের সৈন্যদের মধ্যে অর্ধেকই এখন আবু নাসকোস দুর্গের বাইরে অবস্থান করছে। সেখানে শস্য এবং সবজি চাষ করছে তারা, সেইসাথে গরু এবং ছাগল পালনের ব্যবস্থা করছে। অভিযানের সামনের দিনগুলোতে এগুলো দিয়েই নিজেদের রসদ জোগানোর পরিকল্পনা করেছে তারা।

মধ্যরাতের পরেই নদীর অপর তীরে নামলাম আমরা এবং আক্রমণ করলাম তাদের ওপর। বেশির ভাগই তখন গভীর ঘুমে মগ্ন, এমনকি প্রহরীরা পর্যন্ত। সবাই ধরে নিয়েছে যে তাদেরকে রক্ষা করার জন্য টেরামেশই যথেষ্ট। আমাদের রণহুংকারে তাদের ঘুম ভাঙল ঠিকই; কিন্তু বেশির ভাগই লড়াই করার চেষ্টা না করে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা এবং কাপুরুষতার সাথে পালিয়ে গেল দুর্গ-প্রাচীরের দিকে। অর্ধেকেরও বেশি সেখানে আশ্রয় নিতে পারল। বাকিরা হয় মারা পড়ল না হয় বন্দি হলো আমাদের হাতে।

স্বাভাবিকভাবেই আমাদের সৈন্যরা পলাতকদের পিছু ধাওয়া করতে কিছুটা ভয় পাচ্ছিল। যদিও হুরোতাস তাদের সামনে একটা মাথা দেখিয়েছে এবং গতকালই দারুণ সাহসের পরিচয় দিয়েছে সবাই; কিন্তু অনেকেই ভয় পাচ্ছিল যে এই বুঝি হাজির হলো টেরামেশ।

তার পরও উটেরিকের লোকদের মধ্য থেকে প্রায় এক শর মতো লোককে বন্দি করতে সক্ষম হলাম আমরা। তাদের মধ্যে দুজনকে আমি চিনতে পারলাম। . ভালো লোক তারা, ভাগ্যের ফেরে উটেরিকের লোকদের সাথে বাধা পড়ে গেছে। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ওদের এক পাশে সরিয়ে নিয়ে এলাম আমি। ওরা আমাকে মনে করিয়ে দিল যে, ওদের নাম যথাক্রমে বাতুর এবং নাসলা। দুই ভাই ওরা, হিকসসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে আমার সাথে। একটা মদের বোতল খুলে দুজনের হাতে দুটো মদভর্তি পেয়ালা ধরিয়ে দিলাম আমি। কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে পড়ে গেল কতটা ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা। প্রত্যেক পেয়ালা মদ পেটে পড়ার সাথে সাথে আরো দিলদরিয়া হয়ে উঠল দুই ভাই। আবু নাসকোস দুর্গের ভেতরের অবস্থা সম্পর্কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওদেরকে প্রশ্ন করলাম আমি। দুই ভাইও কোনো দ্বিধা না রেখেই জবাব দিল আমার সব জিজ্ঞাসার। জানাল, যেকোনো ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধেই প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ উটেরিকের দুর্গ। প্রবেশপথ কেবল একটাই এবং সেটাও নীলনদের বিপরীত দিকের দেয়ালে অবস্থিত। বিশাল এক জোড়া দরজা পেরিয়ে ঢুকতে হয় সেই পথ দিয়ে। দুর্গ-প্রাচীরের গঠন সম্পর্কে ওদের কাছে জানতে চাইলাম আমি। জানা গেল একটার ভেতরে আরেকটা- এভাবে সব মিলিয়ে তিন পাল্লা দেয়াল রয়েছে সব দিকে, এবং প্রত্যেকটাই অত্যন্ত দুর্ভেদ্যভাবে তৈরি করা। ওরা মতামত দিল যে, আক্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হবে প্রাচীরের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ভেতরে প্রবেশ করা। তারপর জানতে চাইলাম, এমনিতে দুর্গের নিচ দিয়ে কোনো ভূগর্ভস্থ পথের কথা জানে কি না ওরা। কিন্তু এ ব্যাপারে দুই ভাইই জোর দিয়ে বলল যে, এমন কোনো পথের কথা তাদের জানা নেই। বোঝা গেল তেমন কোনো আশা নেই আমাদের সামনে। সমগ্র মিশরের মাঝে যে দুৰ্গটাকে রক্ষা করা সবচেয়ে সহজ সেটাই বেছে নিয়েছে উটেরিক, ভেবে এক টুকরো তিক্ত হাসি ফুটল আমার ঠোঁটে।

বাতুর আর নাসলার কাছ থেকে আরো জানা গেল যে, উটেরিক তার বেশির ভাগ ঘোড়া এবং রথকেই দুর্গ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। খুব সম্ভব নীলনদের অববাহিকার কাছে তার যেসব দুর্গ আছে সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ওগুলোকে, যাতে আমরা তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে না পারি। তবে চল্লিশটার মতো রথ এবং ঘোড়াকে দুর্গেই রেখে দিয়েছে সে। ঘোড়াগুলো রয়েছে দুর্গের আস্তাবলে। হয়তো যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবে। তবে আমার মনে হলো যে যুদ্ধের জন্য নয় বরং দরকার হলে যেন পালাতে পারে সে জন্যই ওগুলো রেখে দিয়েছে উটেরিক।

এবার উটেরিকের পরিচয় নিয়ে যে বিভ্রান্তি সে ব্যাপারে দুই ভাইয়ের সাথে আলাপ করলাম আমি। ওরাও একমত হলো আমার সাথে। বলল, নিজের শত্রুদের অর্থাৎ হুরোতাস এবং রামেসিসকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য নিজের নকল ব্যবহার করছে উটেরিক। তবে বাতুর এবং নাসলা দুজনই উটেরিকের কাছাকাছি থেকে কাজ করেছে এবং ওরা দাবি করল যে, আসল এবং নকল উটেরিকের মধ্যে তফাত ধরার ক্ষমত্ম আছে ওদের। তা যদি সত্যি হয় তবে বলতেই হবে যে ওরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল আমাদের কাছে। তারপর জানা গেল প্রতিটা দিনই উটেরিকের উন্মাদনা নাকি আরো বাড়ছে, বাস্তবতা থেকে ক্রমেই আরো দূরে সরে যাচ্ছে সে। মনের ভেতর চলমান আকাশকুসুম কল্পনার কাছে হার মানছে তার বাস্তব জ্ঞান। এই খবরটা শুনে অবশ্য খুব বেশি অবাক হলাম না আমি। উটেরিকের মানসিক অবস্থা কখনোই সুস্থ ছিল না।

গত দুই বছর ধরে আবু নাসকোস দুর্গে বসবাস করে আসছে দুই ভাই। বিশাল ওই দুর্গের বেশির ভাগ গোপন পথ ঢোকা এবং বের হওয়ার রাস্তা এবং অন্যান্য অনেক কিছুই ওদের জানা হয়ে গেছে। যখন আমি জানতে চাইলাম যে ওরা কীভাবে উটেরিকের জালে ধরা পড়ল তখন ওরা বলল, নিতান্তই তরুণ অবস্থায় ফারাও টামোসের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল ওরা। টামোস যখন হিকসসদের হাতে মারা পড়লেন তখন তার বড় ছেলে উটেরিকই ফারাওয়ের মুকুট পরেছিল। কিন্তু খুব দ্রুতই উটেরিকের প্রতি সকল শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছিল দুই ভাই। দুজনই আমাকে আশ্বস্ত করল যে, অনেক আগে থেকেই ফারাও রামেসিসের পক্ষে যোগ দেওয়ার কথা চিন্তা করছিল তারা। রামেসিসকেই তারা সম্মান করে এবং ফারাও হিসেবে দেখতে চায়।

দুজনকে রামেসিসের সামনে নিয়ে এলাম আমি। সেও চিনতে পারল ওদের। বলল, এদের সম্পর্কে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। দুই ভাইকে গোপনে আমাদের গুপ্তচর হিসেবে কাজে লাগানোর প্রস্তাবে একমত হলো ও। বলল, ভবিষ্যতে কোনো না কোনো উপায়ে দুর্গে ঢুকতে হলে এদের সাহায্য কাজে আসতে পারে আমাদের। দুই ভাইয়ের মধ্যে বাতুরই বয়সে বড়। আবু নাসকোসে ফিরে যেতে সম্মত হলো সে। সেখানে গিয়ে সে অজুহাত দেখাবে এই বলে যে, হুরোতাসের সৈন্যদের হাতে সে ধরা পড়েছিল ঠিকই; কিন্তু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। তারপর সবার চোখে ধুলো দিয়ে ঢুকে পড়েছে আবু নাসকোসের ভেতরে। ছোট ভাইয়ের নাম নাসলা। দুর্গের বাইরে আমাদের সাথেই থাকবে সে, দুর্গের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার উটেরিক সম্পর্কে পরামর্শ ও তথ্য দিয়ে সাহায্য করবে আমাদের। নিজেদের মধ্যে দূর থেকে গোপনে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য এক জটিল পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে তারা, ফলে তাদের তথ্য আদান-প্রদানে কোনো অসুবিধা হবে না বলেই আশা করা যায়।

ওরা যে আমাদের অত্যন্ত কাজে আসবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই আমার মনে।

*

পরের কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল নদীর ওপার থেকে আমাদের সকল সৈন্যকে এ পারে নিয়ে আসতে, তারপর দুর্গের চারপাশে তাদের মোতায়েন করতে। উটেরিকের আস্তানার ওপর মরণকামড় বসানোর পরিকল্পনা করছি আমরা। শেষ পর্যন্ত যখন আমাদের আক্রমণের পদক্ষেপ শুরু হলো, বোঝা গেল যে আনুষ্ঠানিক নাচের সময় যেমন তিন পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে আসতে হয় এখানেও ঠিক তাই ঘটতে যাচ্ছে। আমাদের প্রকৌশলীরা দুর্গের প্রচীর অভিমুখে পরিখা এবং সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজে হাত দিয়ে ফেলল খুব তাড়াতাড়ি। দুর্গ-প্রাচীর থেকে নিরাপদ দূরত্বে এই কাজ শুরু করল তারা, যাতে প্রাচীরের ওপর দাঁড়ানো শত্রু তীরন্দাজদের তীরবৃষ্টির মুখে পড়তে না হয়। উটেরিকের লোকেরা রাতের বেলায় বের হয়ে এসে চেষ্টা করতে লাগল আমাদের সুড়ঙ্গ এবং পরিখা খোঁড়ার কাজে বাগড়া দেওয়ার। যার ফলে নিশ্চিদ্র অন্ধকারের মাঝে তাদের সাথে লড়াই করতে বাধ্য হলাম আমরা, যেখানে শত্রু-মিত্র চেনার কোনো উপায়ই থাকে না।

প্রতি রাতে এমন লড়াই হওয়ার পর সকালে উঠে ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করে দেখি আমরা, তারপর আবারও হাত লাগাই নষ্ট হয়ে যাওয়া সুড়ঙ্গ মেরামতের কাজে। চেষ্টা করি মাটির নিচ দিয়ে দুর্গের দুর্ভেদ্য দেয়ালের দিকে এগিয়ে যাওয়ার। বলাই বাহুল্য যে, কাজটা আমার খুব একটা পছন্দ হলো না। তাই দুর্গ-প্রাচীর ভেদ করার মতো কঠিন কাজটা রামেসিস এবং হুরোতাসের মতো অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ এবং ধৈর্যশীল লোকদের ওপরই ছেড়ে দিলাম আমি।

নীলনদের বুকে অবস্থিত সেই চারটি দ্বীপের চিন্তা আবারও ফিরে এলো আমার মাথায়। মনে পড়ল দেবী ইনানার কথা, ওই দ্বীপগুলোতে প্রায়ই যার দেখা পাওয়া যায় এবং আমাকে সাহায্য করার জন্য যে দারুণ আগ্রহী। নদীর পুব তীর থেকে শুরু করে তিনটে দ্বীপেরই সব কিছু পরীক্ষা করে দেখা হয়ে গেছে আমার, এখন কেবল আবু নাসকোস দুর্গের সবচেয়ে কাছে যে দ্বীপটা রয়েছে সেটাই পরীক্ষা করে দেখা বাকি। কিন্তু এই দুর্গের প্রাচীর থেকে ইচ্ছে করলে দুরপাল্লার তীর ছুড়লে তা এই দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। এই কথা মাথায় রেখে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, নদীর পুব তীরে যেখানে কিছুদিন আগেও হুরোতাসের শিবির ছিল সেখান থেকেই এই দ্বীপটার দিকে এগোনোর চেষ্টা করব। তবে তাতে করে অনেক লম্বা পথ সাঁতার কেটে পাড়ি দিতে হবে আমাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে শীতকালও এগিয়ে আসছে। তাই শেষ পর্যন্ত সাঁতার কেটে বরং ডিঙি নৌকা নিয়ে রাতের অন্ধকারে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আশা করা যায় যে, রাতের অন্ধকারে তীরন্দাজদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে হবে না আমাকে।

প্রথম যে রাতে আমি কাজটা করার চেষ্টা করলাম সে রাতে আকাশে আধখানা চাঁদ ছিল। ফলে চারপাশ দেখার জন্য যথেষ্ট আলো থাকলেও এত বেশি নয় যে দুর্গ-প্রাচীরের ওপর থেকে আমার ডিঙি নৌকাটাকে দেখা যাবে। দুর্গের উল্টো দিক থেকে দ্বীপটার দিকে এগোতে এগোতে আমি বুঝতে পারলাম অন্য তিনটি দ্বীপের সাথে এটারও অদ্ভুত রকমের মিল রয়েছে। চারটি দ্বীপের মধ্যে কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকার ব্যাপারে যেটুকু সন্দেহ ছিল মনে তাও এখন দূর হয়ে গেল। দ্বীপের কাছাকাছি আসার পর ওপর থেকে পানির কাছাকাছি ঝুলে থাকা একটা লিয়ানা লতার সাথে নৌকা বাঁধলাম আমি। প্রথম যে জিনিসটা আমার চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে অন্য তিনটি দ্বীপের তুলনায় এই দ্বীপের গঠনশৈলী তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি অক্ষত। এখানে এমনকি পাথরের আলাদা আলাদা টুকরোগুলোকেও চেনা যাচ্ছে। দেয়ালের গায়ে রয়েছে পা রাখার জায়গা, যেগুলোর সাহায্যে ওপরে ওঠার কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল। দ্রুত ওপরে উঠে এলাম আমি; দারুণ উত্তেজিত হয়ে আছি। ওপরে ওঠার সাথে সাথেই পেয়ে গেলাম সেই খাড়া নেমে যাওয়া সুড়ঙ্গটা, ঠিক যেখানে থাকবে বলে ভেবেছিলাম। দ্বীপের মাঝখানেই রয়েছে ওটা। তবে রাতের অন্ধকারের কারণে সুড়ঙ্গটার মুখ দিয়ে বেশি দূর ভেতরে দেখার উপায় নেই।

বুঝতে পারলাম সাথে করে নিয়ে আসা মোমবাতিগুলোর একটা জ্বালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। কয়েক দিন আগেই নলখাগড়া বা ঘাসের তৈরি মশালের বদলে এই মোমবাতিগুলো ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। মৌমাছির মোম থেকে বানিয়েছি এগুলো, এবং জিনিসটা নিঃসন্দেহে কাজের। কিন্তু এর কুফল হলো এই উজ্জ্বল আলো অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। তবে দুর্গ-প্রাচীরের ওপরে অবস্থান নেওয়া প্রহরীদের চোখে ধরা পড়ে যেতে পারি জেনেও ঝুঁকিটা নিলাম আমি। প্রথমে সুড়ঙ্গের মুখ বেয়ে নেমে এলাম বেশ কিছুটা, অন্তত যতটুকু নিরাপদ মনে হলো। তারপর চকমকি পাথর ঘষে আগুন ধরালাম কিছু কাঠের গুঁড়োতে। তারপর সেই আগুন থেকে ধরিয়ে নিলাম মোমবাতির সলতে।

উজ্জ্বল আলোতে প্রায় সাথে সাথেই খাপ খাইয়ে নিল আমার চোখ। এদিক ওদিক তাকালাম আমি, এবং বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো আমার মুখ দিয়ে। যে সুড়ঙ্গের প্রবেশপথে আমি প্রবেশ করেছি তার দেয়ালে লাগানো রয়েছে অসংখ্য হালকা সবুজ টালি। প্রতিটি টালির গায়ে একটা করে চোখা কানওয়ালা মরুশেয়ালের ছোট্ট ছবি।

তবে অন্য তিনটি সুড়ঙ্গের তুলনায় এই সুড়ঙ্গের অবস্থা যথেষ্ট ভালো, সময়ের কামড় এখানে অন্য গুহাগুলোর তুলনায় লাগেনি বললেই চলে। টালিগুলোর মাঝে কমপক্ষে চার ভাগের এক ভাগ এখনো অক্ষত রয়েছে। আমার পায়ের নিচে সিঁড়ির ধাপগুলো হালকা ক্ষয়ে গেছে শুধু, খুব সম্ভব প্রাচীনকালে এখান দিয়ে চলাচল করা সেই অজানা জাতির লোকদের পায়ের ঘষায়।

সুড়ঙ্গটা দুই কি তিন জায়গায় পাথর ধস এবং অন্যান্য আবর্জনা পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। তবে খালি হাতেই সেগুলো সরিয়ে পথ করে নিতে পারলাম আমি। সিঁড়িটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে খাড়া নেমে গেছে দ্বীপের মাঝখান দিয়ে। নামার সময় ধাপগুলো গুনতে লাগলাম আমি। দেড় শ ধাপের মতো গুনলাম, তারপর হঠাৎ চমকে উঠে উপলব্ধি করলাম যে এতক্ষণে নদীর তলদেশের চাইতেও অনেক নিচে নেমে আসার কথা আমার।

এখন যেকোনো মুহূর্তে পানিতে ডুবে মরতে পারি আমি। সুড়ঙ্গের মাঝে আচমকা ছুটে আসতে পারে পানির বিপুল তোড়, চিরকালের জন্য ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে আমাকে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলাম আমি। সকল দেব-দেবীর প্রতি মনে মনে প্রার্থনা করছি, বিশেষ করে ইনানার প্রতি। আবেদন জানাচ্ছি আমাকে যেন কিছুতেই এভাবে একা একা ভূগর্ভ থেকে বহু নিচে মৃত্যুবরণ করতে না হয়।

সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখে যখন এসে পৌঁছলাম তখন হাপরের মতো হাঁপাচ্ছি আমি, নিঃশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। দুটো পায়ের মধ্যে একটা পায়ের পাতা ভিজে গেছে কেবল; কিন্তু বাকি শরীর একেবারে খটখটে শুকনো। সুড়ঙ্গের প্রথম সিঁড়িতে বসে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম আমি। বুঝতে পারলাম অন্তত একবারের জন্য হলেও হিসাবে ভুল হয়েছে আমার, যদিও সেটা অত্যন্ত বিরল একটা ঘটনা। নদীর নিচে যদি কোনো সুড়ঙ্গ বা পথ থাকে তাহলে যে তাতে পানি ঢুকবেই এমনটা নাও হতে পারে।

তবে আমাকে দোষও দেওয়া যায় না। জীবনে এই প্রথমবারের মতো নদীর নিচ দিয়ে চলে গেছে এমন কোনো সুড়ঙ্গ দেখলাম আমি। বিশেষ করে নীলনদের মতো শক্তিশালী নদীর নিচে এমন পথ থাকতে পারে তা কেউ ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করবে না। আমার মাথাতেও এমন চিন্তা কখনো আসেনি। কিন্তু এখন নিজের চিন্তাধারাকে বদলানো ছাড়া কোনো পথ দেখছি না। এবং এই চিন্তাটা মাথায় আসার পরেই আমি ধরে ফেললাম আমার আগের ধারণায় ঠিক কোন অংশটা ভুল ছিল।

নৌকা যখন পানিতে ভাসে তখন তার খোলের ভেতর পানি ওঠে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তরটা হলো, পানি খোলের ভেতরে ঢোকার কোনো পথ পায় না। কিন্তু খোলে যদি একটা ছিদ্র করে দেওয়া হয় তাহলে সাথে সাথে তার ভেতর দিয়ে পানি উঠে ভরে যায়! যে পৃথিবীর ওপর আমরা বাস করছি তার উপরিভাগ চ্যাপ্টা হওয়ার ব্যাপারটার মতোই এই ধারণাটাও যৌক্তিক বলে মনে হতে লাগল আমার কাছে।

তবে এটা স্বীকার করছি যে, একটা নৌকার খোল আর নীলনদের নিচে একটা সুড়ঙ্গের মাঝে যে বিশাল তফাত আছে সেটাকে প্রয়োজনের খাতিরেই এড়িয়ে গেলাম আমি।

অধৈর্য হয়ে ইনানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি, মনে মনে চাইছি দ্রুত দেখা দিক সে। তাহলে এই ব্যাপারটা নিয়ে তার সাথে আলোচনা করা যাবে, পরামর্শ নেওয়া যাবে। কিন্তু আজ নিশ্চয়ই নারীসুলভ খামখেয়ালিতে পেয়েছে তাকে, দেখা দেওয়ার কোনো লক্ষণই নেই। এভাবেই একসময় ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকলে দুর্গ প্রাচীরের ওপর দাঁড়ানো প্রহরীরা আমাকে দেখে ফেলতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব ভাগতে হবে এখান থেকে।

দিনের বাকি সময়টা আমার কাটল রাত নামার জন্য অস্থির অপেক্ষায়। তবে এই সময়ের মাঝে একজন সহকারীকে খুঁজে বের করলাম আমি, যে ভবিষ্যতে আমাকে সাহায্য করতে পারবে। এই কাজের জন্য আমার প্রথম পছন্দ হলো নাসলা। শুধু অল্পবয়স্ক এবং শক্তিশালী বলে নয়, আবু নাসকোস দুর্গ সম্পর্কে দুই পক্ষেরই সমস্ত সৈন্যদের চাইতে ওর জ্ঞান অনেক বেশি। নদীর মাঝে অবস্থিত দ্বীপ এবং সেগুলোর সুড়ঙ্গ সম্পর্কে আমার কাছ থেকে জানতে পেরে সেও একই রকম উত্তেজিত হয়ে উঠল, এক কথায় রাজি হয়ে গেল আমার সাথে যেতে।

*

সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে ডিঙি নৌকা নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। দ্বীপের গোড়ায় পৌঁছে নৌকা বেঁধে রাখলাম গতকালের মতো, তারপর ওপরে উঠে এলাম। সুড়ঙ্গটা দেখেই বিস্মিত হয়ে উঠল নাসলা। প্রশ্ন করল, কিন্তু এই সুড়ঙ্গটা কোথায় গিয়ে থেমেছে প্রভু?

এখনো জানি না। তবে সেটা জানার জন্যই এখানে এসেছি আমরা।

আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমিই প্রথমে যেতে চাই, বলল নাসলা। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে নাসলার জন্য জায়গা করে দিলাম আমি। অবশ্য এমনটা ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই যে আমি ভয় পেয়েছি। সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে ওর কণ্ঠস্বর ভেসে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আমি। দেখলাম অনেক নিচ থেকে ভেসে আসছে নাসলার হাতে ধরা মোমবাতির আলো।

নিচে নেমে এসেছি আমি প্রভু টাইটা। আপনি কি আসছেন? চিৎকার করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে। শুনে মনে হলো না যে পানিতে ডুবে মরার মতো কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। আমার ধারণায় যে আসলেই কোনো ফুটো নেই সেটা ধরতে পেরে বেশ খুশি হয়ে উঠলাম আমি। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম নিচে, যেখানে নাসলা অপেক্ষা করছে আমার জন্য। একদম নিচে নেমে আসার পর দেখলাম সুড়ঙ্গটা এখান থেকে খাড়া নেমে যাওয়ার বদলে সমান্তরালভাবে এগিয়ে গেছে এক দিকে।

আর সামনে গেছ নাকি তুমি? নাসলাকে প্রশ্ন করলাম আমি।

না প্রভু। আমার মনে হয়েছিল এই সম্মান আপনারই প্রাপ্য।

তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে তাকালাম আমি, বোঝার চেষ্টা করছি যে ব্যাটা ঠাট্টা করছে কি না। তবে মোমবাতির আলোতে ওর চেহারা যতটুকু দেখা গেল তাতে ঠাট্টার কোনো চিহ্ন দেখা গেল না। তাহলে এসো আমার সাথে, নাসলা। লোকটাকে যত দেখছি আমি ততই পছন্দ করে ফেলছি। সুড়ঙ্গ ধরে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি, নাসলা রইল পেছনে। বহু শতাব্দীর মাঝে আমরাই খুব সম্ভব প্রথম মানুষ যারা এখানে পা রাখল। মাথার ওপরে পানির বিপুল চাপ কাজ করছে, তা সামলানোর জন্য নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গের এই অংশকে অনেক বেশি পোক্ত করে বানানো হয়েছে। লাল রঙের মাটির ইট দিয়ে সুড়ঙ্গটা তৈরি করেছে প্রাচীনরা, ওপরে যেমন সুন্দর পোড়ামাটির টালি দেখেছিলাম তেমন নয়। ইটগুলোর মাঝে জোড়া এত মিহি যে প্রায় বোঝাই যায় না। কয়েকটা জোড়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলাম আমি। পানি চোয়ানোর কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। এবার আমরা যে সমান্তরাল সুড়ঙ্গে প্রবেশ করেছি সেটাকে দেখলাম ভালো করে, তারপর যে খাড়া সুড়ঙ্গটা ধরে নিচে নেমে এসেছি সেটার সাথে মিলিয়ে দেখলাম। যা আশা করেছিলাম ঠিক তাই। এই সুড়ঙ্গটা এগিয়ে চলেছে পশ্চিম দিকে অর্থাৎ আবু নাসকোসের দুর্গ অভিমুখে। যদিও ধারণাটাকে প্রমাণ করার জন্য জাদুর মাছটা এখন নেই আমার কাছে।

এসো, নাসলা, তাকে বললাম আমি, তারপর দুজন মিলে আবার এগিয়ে চললাম সুড়ঙ্গ ধরে। হাঁটার সময় পদক্ষেপগুলো জোরে জোরে গুনতে লাগলাম আমি। প্রায় তিন শ দশ পা সোজা এগিয়ে গেলাম আমরা। পায়ের নিচে টালিগুলো সব শুকনো। সুড়ঙ্গের ভেতরের বাতাসটা ঠাণ্ডা, একটু শুকনো শুকনো। তবে নিঃশ্বাস নিতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তাতে।

তারপর হঠাৎ করেই আমাদের পায়ের নিচের মেঝে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করল। মোমবাতির শিখার ওপর দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল নাসলা। কী ঘটেছে তাকে বুঝিয়ে বললাম আমি। নদী পার হয়ে পশ্চিম তীরের কাছে চলে এসেছি আমরা। এখন ওপরের দিকে উঠছি। আমার ধারণা দুর্গের ভিত্তির দিকে এগিয়ে গেছে এই পথ। যদিও এখনো সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই; কিন্তু এই দেয়ালগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখো।

সুড়ঙ্গের দেয়ালগুলোতে আরো একবার শুরু হয়েছে রঙিন পোড়ামাটির টালির আবরণ। বোঝা যাচ্ছে আমাদের মাথার ওপর এখন আর নীলনদের পানি বয়ে চলছে না বা বইলেও তার পরিমাণ খুবই কম। এই টালিগুলোর ওপরে অবশ্য কোনো ছবি আঁকা নেই, তবে প্রাচীন কোনো এক রহস্যময় ভাষায় কিছু একটা লেখা রয়েছে। বুঝতে পারলাম এই সুড়ঙ্গের নির্মাতারাই লিখে রেখে গেছে এগুলো। হয়তো নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার প্রশস্তি লিখে রেখে গেছে তারা। তবে লেখাগুলোর পাঠোদ্ধার করার জন্য কোনো সময় নষ্ট না করে সামনে এগিয়ে গেলাম আমি, সুড়ঙ্গটা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে দেখার জন্য আর তর সইছে না। আরো দেড় শ কদমের মতো এমন ঢালু সুড়ঙ্গ বেয়ে ওঠার পর হঠাৎ করেই থেমে যেতে হলো আমাদের। মনে হলো যেন কোনো একসময় পাথরধস নেমে বন্ধ হয়ে গেছে সামনে এগোনোর পথ। আর সামনে যাওয়ার উপায় নেই। ব্যাপারটা এমন খেপিয়ে তুলল আমাকে যে, এমন কিছু একটা করে বসলাম যেটা কখনো করি না আমি। চেঁচিয়ে একটা গালি দিয়ে উঠলাম, তারপর সামনে পথ আটকে থাকা পাথরের স্কুপের গায়ে ঘুষি মারার জন্য পিছিয়ে আনলাম হাত।

পেছন থেকে আমার মুঠি পাকানো হাতের কনুই ধরে ফেলল নাসলা, ডান হাতের হাড়গুলো ভেঙে ফেলা থেকে বিরত করল আমাকে। কয়েক মুহূর্ত ওর কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করলাম আমি, তারপর হার মেনে নিলাম।

ধন্যবাদ, বললাম নাসলাকে। তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আমি। তুমি না থাকলে হয়তো দেয়ালটার আরো বেশি ক্ষতি হয়ে যেত।

কোনো অসুবিধা নেই প্রভু। এমন কাজ করার অভ্যাস আছে আমার। আমার ভাই বাতুরও দারুণ বদমেজাজি। কথাটা এমন মিষ্টি, বন্ধুত্বপূর্ণ গলায় বলল সে, কয়েক মুহূর্তের জন্য দেয়ালের গায়ে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখলাম আমি, প্রাণপণ চেষ্টায় সামলে নিলাম আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাওয়া ক্রোধকে।

তারপর ফিসফিসিয়ে কিন্তু তীক্ষ্ণ গলায় বললাম, আর কিছু বলার দরকার নেই, নাসলা। এবার যে পথে এসেছি সেই পথেই আবার ফিরে যাব আমরা। একটু তাজা বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়া দরকার। তা না হলে আমাদের দুজনের মাঝে। কেউ একজন হয়তো এখানেই মারা পড়বে।

তাই বলে এমনটা যেন কেউ না ভাবে যে আমি আমার মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। পরদিন সকাল নাগাদ প্রায় সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম আমি। বুঝতে পারলাম এটা সাময়িক একটা ঝামেলা মাত্র। সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেও রামেসিসের দক্ষ চিন্তাভাবনা এবং সুচিন্তিত মতামতের প্রয়োজন আমার। নীলনদের পশ্চিম তীরের কাছে পাওয়া গেল ওকে, হুরোতাসের সাথে দুর্গের দেয়াল বরাবর সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ তদারকিতে ব্যস্ত। রানি সেরেনা ক্লিওপেট্রাও ওর সাথে রয়েছে দেখে আরো খুশি হয়ে উঠলাম, কারণ আমি আশা করছিলাম যে ওকেও এখানেই পাওয়া যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *