৯-১০. পৈশাচিক প্রতিহিংসা

. পৈশাচিক প্রতিহিংসা

দানবের কথায় তার যেমন ভয়ও হল, মানসিক অশান্তিও তত বেড়ে গেল। এইরকম মানসিক অবস্থায় বেড়িয়ে ফিরতেও ভালো লাগে না। তাই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আবার জেনেভায় ফিরে এলেন। এলিজাবেথ তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু মনে তার শান্তি নেই।

কিছুই ভালো লাগছে না তার। শুধু থেকে-থেকে মনে হয় সেই দানবের কথা। সে আবার দেখা করবে বলেছে। ওই দানবটির হাত থেকে পরিত্রাণের কী উপায় থাকতে পারে তিনি বুঝে উঠতে পারেন না।

একদিন সন্ধ্যার পর এলিজাবেথের সঙ্গে বেড়িয়ে ফিরছেন তিনি, মনে হল পিছন পিছন কে যেন আসছে! চমকে পিছন ফিরলেন, দূর অন্ধকারে একটা কালো বিদ্যুৎ যেন চকিতে মিলিয়ে গেল। তার ভয় হল। এই বীভৎস দানবটির অস্তিত্বের কথা তিনি এলিজাবেথের কাছে গোপন রাখতে চাইলেন। তাই তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা চালালেন।

এইভাবে তার দিন কাটে। বুঝতে পারেন সেই দৈত্যটি তার কাছেই ঘুরছে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে কেউ থাকার জন্য সামনে আসছে না। একদিন তিনি একা একা ক্লেরভালের বাড়ি থেকে ফিরছেন, এমন সময় পিছন থেকে কে যেন তাঁর হাত চেপে ধরল। এরকমই তিনি আশা করছিলেন, তবু চমকে উঠলেন। যা ভেবেছিলেন তাই; বললেন–আবার কী চাই তোর?

দৈত্যটি বলল–বলেছিলাম আবার আসব, তাই এসেছি। আজ আমার সব কথা ওনতে হবে।

একটা গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। দৈত্যটি বলল–হে আমার প্রভু, আমি একজন সঙ্গী চাই, আমি চাই ভালোবাসা। আমি জানি কোনো মানুষই আমার সঙ্গে মিশবে না। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছে, আমার মতো আর একটি কদাকার কুৎসিত দানব সৃষ্টি করো–সে আমার সঙ্গী হবে। সে আমাকে ঘৃণা করবে না। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসব। এই দুর্বহ জীবনে তবেই পাব শাস্তি।

তিনি প্রশ্ন করলেন–তোকে বিশ্বাস কী? যদি দলে ভারী হয়ে তোরা আরো বেশি অত্যাচার করিস? দৈত্যটি বলল–কেন অবিশ্বাস করছ প্রভু বলেছি তো আমি হত্যা করেছি সঙ্গী পাইনি বলে–ভালোবাসা পাইনি বলে। যদি সঙ্গী পাই, তবে তোমাদের এই লোকালয় ত্যাগ করে আমরা অনেক দূরে চলে যাব–আর আসব না এখানে মানুষের ঘৃণা কুড়োতে।

তিনি বললেন–তোকে সৃষ্টি করেই আমি জগতের সবচেয়ে বেশি অপকার করেছি। আর আমার পাপ বাড়াতে পারি না। আমি আর কিছু করতে পারব না।

দৈত্যটি বলল–এই তোমার শেষ কথা! বেশ, তবে তোমাকেও শান্তিতে থাকতে দেব না। আগে তোমার সমস্ত আত্মীয়, তারপর একে একে আর্নেস্ট, তোমার বাবা, এলিজাবেথ, বন্ধু ক্লেরভাল–সকলকে হত্যা করব। তুমি দেখবে এক-একদিন কেমন করে এক-একজন তোমার চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। তখন তুমি খুব শান্তিতে থাকবে। নিঃসঙ্গ জীবন যখন তোমাকে পাগল করে তুলবে, যখন তোমার জীবন আমার জীবনের মতো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, তখন বুঝবে নিঃসঙ্গ জীবনে কত আনন্দ, তখন তুমি আমাকে ভালোবাসবে। আমার সঙ্গী হবে।

বড় ভয় হল তার। নিজের প্রাণের ভয়ে নয়–তার আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের জীবন-সংশয়ে ভীত হয়ে তিনি আর একটি জীব সৃষ্টি করতে সম্মত হলেন। বললেন–বেশ, আমি এটি তৈরি করে দেব। কিন্তু তোর প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে। তোর সঙ্গী পেলেই তোরা লোকালয় ছেড়ে দূরদেশে চলে যাবি। আর কোনোদিন এদেশে ফিরে আসবি না। আর নরহত্যাও করতে পারবি না।

দৈত্যটি বলল–তাই হবে প্রভু।

তিনি বললেন–বেশ! তবে কালই আমি আবার ল্যাবরেটরিতে ফিরে যাব।

বাড়িতে গিয়ে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন জানালেন যে পরদিনই তাঁকে ফিরতে হবে ল্যাবরেটরিতে বিশেষ কাজে। মাত্র কয়েকদিন তারপর ফিরে এসে তিনি এলিজাবেথকে বিবাহ করবেন।

.

তারপর আবার সেই আগের মতো পাহাড়প্রমাণ অস্থি সগ্রহ, আর জোড়াতালি দিয়ে মনুষ্যাকৃতি গড়া। কিন্তু এবার আর আগেকার মতো উৎসাহ নেই। সব সময়ে মনে ভয় হয়; ভয় কেন–তিনি স্থিরই জানেন এবারেও যাকে তিনি সৃষ্টি করবেন, সে মানুষ হবে না। সে হবে ঠিক আগেকার মতোই এক অতি কুৎসিত ও কদাকার দানব।

বেশ জানেন তাঁর ওপর লক্ষ রেখেছে সেই দৈত্যটা। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই তার অস্তিত্ব তিনি অনুভব করেন। মাঝে মাঝে শার্সিতে তার ছায়া দেখতে পান, আর তার সমস্ত অঙ্গ বিকল হয়ে আসে। শুধু প্রাণের ভয়েই তার আদেশ পালন করছেন তিনি! তাঁরই সৃষ্টির ক্রীড়নক আজ তিনি! ভাগ্যের এতদূর পরিহাস!

মাঝে মাঝে ভাবেন, এ কী সর্বনাশ করতে চলেছেন তিনি। একটি দানবকে নিয়েই এত অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে, আর একটি হলে তো সমস্ত পৃথিবী ছারখার হয়ে যাবে। না–আর তিনি এ-কাজ করতে পারবেন না।

আবার মাঝে মাঝে মনে পড়ে সমস্ত আত্মীয়স্বজন, বাবা, আর্নেস্ট, ক্লেরভাল আর এলিজাবেথের মুখ। দৈত্যটি শাসিয়ে গেছে যে, তার সঙ্গী না করে দিলে আর কারুর নিস্তার নেই। একদিকে এত আত্মীয়, প্রিয়জন আর একদিকে আর এক দানব সৃষ্টি।

দেখেন, যতই নতুন দৈত্যটির রূপ-সৃষ্টি অগ্রসর হচ্ছে ততই সেই দৈত্যটির চোখমুখ ঝলমল করছে, সারা দেহে যেন আনন্দ উথলে পড়ছে। তবে কি দৈত্যটি বিশ্বাসঘাতকতা করবে? একটি সঙ্গী পেলে এতদিনের সমস্ত ঘৃণার প্রতিহিংসা নেবে মানুষের ওপর?

কাজে বাধা পড়ে। আর কাজ করতে তার মন বসে না। তিনি কী করবেন তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। তারপর হঠাৎ মনে হল দানবের কথার কোনো দাম নেই। জগতের যে সর্বনাশ তিনি করেছেন তা-ই পূর্ণ করতে পারবেন না কোনোদিন–মিছে আর কেন ধ্বংস ডেকে আনা?

মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। আর তিনি ভাবতে পারেন না। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন সেই আধা-গড়া মনুষ্যমূর্তিটির দিকে, তারপর তাকে আঘাতের পর আঘাতে ভেঙে টুকরো-টুকরো করে ফেললেন। শব্দ শুনে দৌড়ে এল দৈত্যটি। বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই ভাঙা অস্থিপঞ্জরের দিকে! চোখের কোণে কয়েক ফোঁটা জল টলটল করে উঠল।

করুণ আর্তনাদে ভেঙে পড়ে বলল–ভেঙে ফেললে! তবে তুমি কি আমাকে একটি সঙ্গী তৈরি করে দেবে না!

তিনি চিৎকার করে উঠলেন–না, না দেব না। তোকে সৃষ্টি করেই আমি জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ কুড়িয়েছি, আর নয়। এবার দূর হয়।

চোখদুটো তার জ্বলে উঠল। বলল-দূর হব? বেশ দূরই হব! এতদিনেও যে তোমার শিক্ষা হয়নি তা বেশ বুঝতে পারছি। ধ্বংসের কথা বলছিলে, অভিশাপের কথা বলছিলে? এতদিন তো তুমি ধ্বংস কাকে বলে দেখতে পাওনি। এইবারে তাই দেখবে। দেখব সুখী হও কিনা। যাবার আগে বলে যাচ্ছি যে কাল থেকে মানুষের কান্নায় সারা পৃথিবী ভরে উঠবে। আর তার জন্য একমাত্র দায়ী তুমি! হে ভগবান, তুমি–তুমি–

কিছুদূর চলে গেল সে। সেখান থেকে চিৎকার করে বলল–আমাকে নিঃসঙ্গ করে তুমি সুখে ঘর বাঁধবে? বেশ! তোমার বিয়ের রাতে আবার আমার দেখা পাবে। প্রস্তুত থেকো, প্রভু, সেই রাতের জন্য প্রস্তুত থেকো।

.

অত্যন্ত অসুস্থ দেহ মন নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে এলেন। সকলে সশঙ্ক হয়ে উঠল। এ কী হয়েছে তার চেহারার? কারো সঙ্গে আলাপ করতেও তাঁর ভালো লাগে না।

কিন্তু দিন কেটে যায়। আর প্রতিদিনই বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের ভৌতিক মৃত্যুকাহিনীর খবর পান। সশস্ত্র পুলিশবাহিনী খুঁজে বেড়াচ্ছে আসামিদের। তিনিই শুধু জানেন এই হত্যাকারী কে। অথচ তাদের এ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেন না; কারণ কেউ বিশ্বাস করবে না।

তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। প্রতিদিন বন্দুক হাতে বের হন সেই দানবটির সন্ধানে। এতদিন যা পারেননি এবার তা-ই করবেন। দেখা পেলেই আর কথা নয়…অব্যর্থ সন্ধানে দানবটিকে ভূপাতিত করবেন।

সে নিশ্চয়ই তাঁর ওপর লক্ষ রাখে। কারণ তিনি যেদিন যেদিকে দানবটির খোঁজে বের হন, ঠিক তার বিপরীত দিকে সেদিন হত্যাকাণ্ড চলে।

এলিজাবেথকে ডেকে নিয়ে তিনি বললেন–আমি জানি কে এই হত্যা করছে।

এলিজাবেথের মুখ ভয়ে পাংশু হয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করল–কে?

সেকথা আপাতত গোপন থাক। তবে সে মানুষ নয়।–বললেন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।

এলিজাবেথ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল–তুমি অসুস্থ। তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন।

এদিকে বিবাহের দিন ঘনিয়ে আসে; তবু তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। এখন অবশ্য আর হত্যাকাহিনী শোনা যাচ্ছে না। তবে কি সে এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে? সে কি সত্যিই বুঝেছে যে প্রতিহিংসা দিয়ে শান্তি আসে না।

বিবাহের দিন হঠাৎ তার মনে হল–আজই তো তার দর্শন দেবার কথা। তিনি রিভলভার নিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইলেন।

ক্লেরভালের সঙ্গে তাঁর গল্প করতে ভালো লাগছিল না। মাঝে মাঝে চমকিয়ে ওঠেন। ক্লেভাল জিজ্ঞাসা করেন–তোমার কী হয়েছে বলো তো?

কিছুই হয়নি–উত্তর করেন তিনি।

.

বিবাহ নির্বিঘ্নে শেষ হল। শেষ হল সমস্ত মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। বিদায় জানিয়ে

অতিথিরা চলে গেলেন একে একে। এলিজাবেথ চলে গেল তার নিজের ঘরে।

ক্লেরভালের সঙ্গে নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠের আর্তনাদ তার কানে ভেসে এল। পরমুহূর্তে কয়েকজনের ছুটে আসার শব্দ, কতগুলো আর্তনাদ–এই বিশৃঙ্খলা! একমুহূর্তের জন্য তিনি বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন, তারপর ক্লেরভালের হাত ধরে ছুটে গেলেন বাড়ির ভেতরে।

সিঁড়ির ওপরে পড়ে আছে তার বাবার মৃতদেহ। গলাটি কে যেন মুচড়িয়ে ভেঙে দিয়ে গেছে। এলিজাবেথের ঘরে গিয়ে দেখেন এলিজাবেথের সুন্দর ফুলের মতো দেই অসাড় হয়ে মাটিতে লুটোচ্ছে।

আর দাঁড়াতে পারলেন না, ঐ দৃশ্য দেখতেও ইচ্ছা করে না। টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর্নেস্টের ঘরে গিয়ে দেখলেন ঠিক সেই অবস্থা। আর্নেস্টের প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে তার বিছানায়।

সেখানেই বসে পড়লেন তিনি।

জানলার পাশ থেকে একটি অত্যন্ত পরিচিত কণ্ঠ শোনা গেল–তোমার সঙ্গীও এখন আর কেউ রইল না। এবারে তুমি বুঝবে নিঃসঙ্গ জীবন কেমন আনন্দের! প্রভু, এবার তুমি আর আমি একা!

উঠতে চেষ্টা করলেন তিনি, কিন্তু পারলেন না। তাঁর জ্ঞানহীন দেহ সেখানেই লুটিয়ে পড়ল।

.

১০. সব শেষ

অত্যন্ত দুর্বলতা ও ক্লান্তির মধ্যে তাঁর জ্ঞান ফিরে এল। মনে হল কী যেন হারিয়েছে, আর কী যেন তিনি ভুলে গেছেন। একটু ভাবতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু মাথা ঝিমঝিম করে উঠল।

হঠাৎ শুনলেন কে যেন বলছে–হে আমার প্রভু, এবারে তুমি আর আমি একা। তোমার জীবন দিয়ে আমার নিঃসঙ্গ জীবনের সুখ অনুভব করো।

তারপর শার্সিতে দেখা গেল একটি কদাকার মুখ। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে পড়ে গেল সমস্ত কথা। ওই দানবটি আজ রাত্রে আর একটু আগে তাঁদের বাড়িতে এক প্রলয়কাও বাধিয়েছে। নিমেষের মধ্যে হত্যা করেছে এলিজাবেথ, আর্নেন্ট আর তার বাবাকে–

তিনি কম্পিত হাতে বন্দুকটা তুলে নিয়ে গুলি ছুড়লেন।

ততক্ষণে সেই দানবটি অশরীরী ছায়ার মতো সাদা বরফের পাহাড়ের মধ্যে মিশে গেছে, কিন্তু দূর থেকে তার অট্টহাসি তখনো শোনা যাচ্ছিল।

বন্দুকের শব্দে ছুটে এলেন ক্লেরভাল। বললেন–কী হয়েছে বন্ধু?

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন বললেন–বন্ধু, আজ আমি তোমাকে সব কথা বলব। কিন্তু বলো–অবিশ্বাস করবে না?

ক্লেরভাল বললেন–অবিশ্বাস করব তোমাকে!

তিনি বললেন–হ্যাঁ বন্ধু। আমার কাহিনী শুনলে তুমি আমাকে পাগল ভাববে। আর বলবে, এতগুলো শোকে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

ক্লেরভাল ভার বেদনার্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন — না বন্ধু, তোমাকে অবিশ্বাস করব না।

ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তখন বললেন–তবে শোনো। আমার গবেষণার বিষয় ছিল সাধারণ লোকের কাছে অবিশ্বাস্য, এমনকি বৈজ্ঞানিকদের কাছেও অসম্ভব কল্পনার মতো। আমার গবেষণার বিষয় ছিল মৃতদেহে প্রাণ দান করা, তাকে অতিমানুষে রূপায়িত করা। এই নিয়ে বছরের পর বছর আমি পরীক্ষা করে চলেছি। একদিন আমার সাধনা সফল হল। মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করতে পারলাম।

মানুষ তৈরি করলাম বটে, কিন্তু প্রাণ পেয়ে সে হল দানব। একদিন সে ডক্টর নীল আর বেয়ারাকে হত্যা করে ওখান থেকে পালাল। তারপর যেখানে যত পৈশাচিক খুন হয়েছে, সব ওই দৈত্যের কাজ। উইলিয়মকে হত্যা করেছে ও, আর কাল এসে আমাদের বাড়ির সকলকে খুন করে গেছে। আমি আর একটু আগেও তাকে দেখেছি। তাই বলছি বন্ধু, জনকতক লোক জোগাড় করো, সশস্ত্র হয়ে চলো–আমরা ওকে হত্যা করব। নয়তো পৃথিবীতে কেউ শান্তিতে থাকতে পারবে না।

ক্লেরভাল বিস্ময়-বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। কথাগুলো যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ তারা দুজনেই দেখলেন জানলার কাছে এক কদাকার মুখ। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক নিয়ে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ওইদিকে ছুটে গেলেন।

বন্ধুকে ওভাবে অনিশ্চিত আতঙ্কের মধ্যে ছুটে যেতে দেখে ক্লেরভালও তার কর্তব্য স্থির করে নিলেন। আধঘণ্টার মধ্যে থানা থেকে নিলেন কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ এবং কয়েকটি কুকুর। তারপর ছুটে চললেন বন্ধুর উদ্দেশে।

ঘণ্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর দেখলেন, তাঁর বন্ধু উত্তেজনায় শ্রান্তিতে ও ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহ নিয়ে টলতে টলতে ছুটে চলেছেন সেই বিকটাকার দানবের পিছনে। কতবার তার দেই অবসন্ন তুহিন বরফের উপর পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি স্থির হতে পারছেন না। পরক্ষণেই উঠে ছুটে যাচ্ছেন গলা বরফের উপর দানবের পায়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে।

ক্লেরভাল একবার গুলি ছুঁড়ে বন্ধুকে জানাতে চাইলেন যে তিনি তাঁর সাহায্যে এসেছেন। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন শুনতে পারলেন কি না বোঝা গেল না। শীতে ও ভয়ে অবসন্ন হাত থেকে কখন তাঁর বন্দুক পড়ে গেছে, কাঁটাগাছে বিধে জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে তবু দানবটিকে একবার শিক্ষা দেওয়ার নেশায় ছুটে চলেছেন তিনি।

কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, কোনো জ্ঞানও নেই–শুধু সেই পিশাচটিকে লক্ষ্য করে ছুটে চলেছেন তিনি। বরফ-ঢাকা বিরাট পাহাড় অতি সহজে পার হয়ে যাচ্ছে দানবটি, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনও মরিয়ার মতো সেই দুরধিগম্য পাহাড় সমানতালে ডিঙিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সমস্ত দেহে যেন এক অমানুষিক শক্তি ভর করেছে। সুস্থ দেহে ও মনে যে ঝুঁকি নেওয়া যায় না, যে পাথর লাফিয়ে যাওয়া যায় না, যে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা যায় না–সেই দৈত্যকে ধরার জন্য তা সবই অবলীলাক্রমে করে যাচ্ছেন। পুলিশের দলবল নিয়ে ক্লেভাল তার বন্ধুর কাছ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। এত তাড়াতাড়ি তাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না।

হঠাৎ ক্লেরভাল সভয়ে শিউরে উঠলেন। একজায়গায় বরফ গলে জল হয়ে গেছে। ছোট ছোট বরফের টুকরোয় সেই জলের স্রোত আরো ভীষণ বেড়ে গেছে। দানবটি অতি সহজেই সেই জলাটি পার হয়ে চলে গেল। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন উন্মাদের মতো সেই জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারপর কিছুক্ষণ আর কিছু দেখা গেল না। একটু পরে ক্লেরভাল দেখলেন যে, দানবটি তাঁকে ধরে তুলে নিজের কাছে নিয়ে এল।

ক্লেরভাল এবার তাঁর দলবল নিয়ে তাড়াতাড়ি ছুটে খানিকটা ঘুরে সেইখানে এলেন। ভীত-বিহ্বল হয়ে দেখেন তার মৃত বন্ধু ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের নিঃসাড় দেহ একটা পাথরের উপর শোয়ানো আর এক বিরাট দৈত্য ঝুঁকে পড়ে ছলছল কণ্ঠে বলছে : হে আমার স্রষ্টা, আমি এ কী করলাম! আমিই তোমাকে মেরে ফেলেছি। কিন্তু আমি তো তোমাকে হত্যা করতে চাইনি, তবু তুমি আমারই জন্য মারা গেলে। আমি শুধু তোমাকে শাস্তি দিতে চেয়েছি যেমন তুমি আমাকে শাস্তি দিয়েছ। তবু তোমার–আমার স্রষ্টার– হত্যাকারী আমি, আমার এ পাপের স্থান নেই। হে ভগবান, তোমার মৃত্যুতেই আমার সমস্ত অভিমানের অবসান হল। তোমাকে একাকী নিঃসঙ্গ জীবনের অনুভূতি দিতে পেরেছি, আমার আর বাঁচার প্রয়োজন নেই। আমিও শিগগিরই তোমার সঙ্গে মিলিত হব। সারাজীবন আমি একাকী সঙ্গীহীন ছিলাম, মৃত্যুও হবে সঙ্গীহীন। কোনো এক উত্তরমেরু দেশে নিজের চিতা নিজে প্রস্তুত করে আমার এই ঘৃণিত জীবন আহুতি দেব। আর-একবার এই সুন্দর পৃথিবীর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে শেষ দেখা দিয়ে যাব আমার জন্মস্থান, তোমার অক্লান্ত কর্মের পীঠস্থানকে, তারপর সব শেষ ! বিদায় স্রষ্টা–বিদায়।

দানবটি হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়েই দেখল বিস্মিত ক্লেরভালকে এবং সঙ্গে সঙ্গে একলাফে অনেকদূর চলে গেল। ক্লেরভালও তাঁর বন্দুক তুলে গুলি ছুড়লেন। হয়তো সে আহত হল, এক আর্তনাদও শোনা গেল–আঁ আঁ আঁ….

স্রষ্টার শোকে হয়তো সে আবার তার ভাষা হারিয়েছে, আবার পেয়েছে সে তার জনুক্ষণের ভাষা।

পুলিশবাহিনী তাদের কুকুর নিয়ে এগিয়ে চলল। ক্লেরভাল বললেন–আমরা ল্যাবরেটরির দিকে যাব। দানবটি নিশ্চয় সেখানেই যাবে। আমি শুনেছি তার কথা।

কিছুক্ষণ পর আর সেই দৈত্যটিকে দেখা গেল না। সকলে অবাক হয়ে গেল; কিন্তু পরক্ষণেই দেখা গেল কাছের একটি পাহাড় থেকে সে নেমেই দুটো কুকুরকে নিয়ে অন্তর্ধান হল। ব্যাপারটা এত আকস্মিক ঘটল যে তারা কিছুই করতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পরে কুকুরদুটোর মৃত্যু-আর্তনাদ শোনা গেল।

কিন্তু পরাজয় স্বীকার করলে চলবে না। পুলিশবাহিনী তার পায়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে ছুটে চলেছে, সবার আগে ক্লেরভাল। কুকুরগুলো চারদিক থেকে চিৎকার করতে করতে তাড়া করেছে। একবার সেই দৈত্যকে দেখা যায়, আবার সে হারিয়ে যায়। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ–একটা আর্তনাদ। আবার হয়তো দু-একটি কুকুরের মৃত্যু-আর্তনাদ শোনা যায়। কোথাও-বা দু-একটি পুলিশের মৃতদেহও গড়িয়ে পড়ে। তবু থামা নয়, পুলিশবাহিনী এই হত্যাকারীকে ধরবার অদম্য সাহস নিয়ে এগিয়ে চলে।

এক ঝলক কুয়াশায় সমস্ত পৃথিবী ঢাকা পড়ে গেল। সামনে-পেছনে কিছুই দেখা যায় না। চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল সেই শয়তান।

একটু পরে কুয়াশা কেটে গেলে তাকে দেখা গেল আর একটি উঁচু পাহাড় বেয়ে সে উঠছে; উঠছে সে উধ্বমুখী পাইন, চেরি, দেওদারের সারি ছাড়িয়ে তুষারাবৃত সরু পাহাড়ি পথ বেয়ে উঁচুতে–আরো উঁচুতে, আর পিছনের নৃশংস অনুসরণকারীদের দিকে তাকিয়ে দাঁত খিচোচ্ছে। এই হয়েছে মানুষের বুদ্ধি, মানুষের সাহস। তাকে ধরবার জন্য মানুষের কী আপ্রাণ চেষ্টা! কত লোক, কত কুকুর, কত বন্দুক, কত গুলি! তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। এইভাবে এত লোকের সঙ্গে সে একা যুদ্ধ করবে কী করে? এক-একজন আসুক–আপত্তি নেই। সে দেখিয়ে দেবে মানুষের চেয়েও সে শ্রেষ্ঠতর–মানুষের চেয়েও তার স্থান উচ্চে।

তাকে লক্ষ্য করে কুকুরগুলো ডাকতে ডাকতে ছুটছে। মুহুর্মুহু গুলিও ছোঁড়া হচ্ছে। তাকে একমুহূর্ত আর চোখের আড়াল করা হচ্ছে না। যেমনভাবেই হোক আজ এই বিরাট দানবটির সঙ্গে শেষ খেলা খেলে যেতে হবে।

এতক্ষণে সে ল্যাবরেটরির কাছে এসে পড়েছিল। ক্লেরভাল বললেন–ওকে ল্যাবরেটরিতে ঢুকতে দিও না। একবার ল্যাবরেটরিতে ঢুকলে আর কেউ ওকে ধরতে পারবে না, অথচ আমরা সকলেই প্রাণ হারাব।

সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশরা হাত-বোমা ছুঁড়ে মারল। হাত-বোমা কিন্তু কয়েকবার লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। তারপর একবার প্রবল বিস্ফোরণে ল্যাবরেটরিতে উঠবার সিঁড়িটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ল্যাবরেটরিতে ওঠার আর কোনো উপায় রইল না।

দানবটি দারুণ আক্রোশে তখন চিৎকার করে উঠল–আঁ আঁ আঁ…

তারপর সে পিছনদিকের খাড়া পাহাড় বেয়ে নিজের জীবন তুচ্ছ করে উপরে উঠতে লাগল। যেন ওই ল্যাবরেটরির মধ্যে নিহিত আছে তার যথাসর্বস্ব–তার জীবন-প্রদীপ।

দানবটি ল্যাবরেটরির ছাদের কাছাকাছি পৌঁছুতেই নিচ থেকে বন্দুক গর্জে উঠল–দুড়ুম…দুড়ুম…দুড়ুম…।

দুটি গুলি তার পিঠে লাগল। কিন্তু তবু সে তার সংকল্প হারাল না। হিংসায় বিদ্বেষে রুক্ষ হয়ে সে আরো তাড়াতাড়ি ল্যাবরেটরিতে উঠতে লাগল। আজ তাকে চূর্ণ করে, ধ্বংস করে, লাল আগুনের লেলিহান শিখায় সমস্ত আকাশ ভরিয়ে দিয়ে তার ঘৃণিত জীবনের ওপর শত শত অত্যাচারের প্রতিফল দিয়ে সে বিদায় নেবে।

আবার গুলি ছুটল। সে কোনো রকমে ছাদের কার্নিশের উপর এল। পুলিশের গুলি অবিশ্রান্ত তার দিকে ছুটে যাচ্ছে। কতগুলো যে তার গায়ে লাগছে, বোঝা যাচ্ছে না–সে শুধু ভাষাহীন অমানুষিক চিৎকার করছে এই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে।

তারপর সে আর পারল না, পারল না আর সশস্ত্র সভ্য মানুষের সম্মিলিত আক্রমণের বিরুদ্ধে একা নিরস্ত্র যুদ্ধ করতে–রক্তাক্ত দেহে সে কার্নিশের উপর শুয়ে পড়ল। একবার সে তার হাত তুলতে চেষ্টা করল–একবার অনুসরণকারী ক্রুদ্ধ জনতার দিকে তাকাতে চেষ্টা করল। দু-একবার তার অসাড় ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠল। তারপর শেষবারের মতো সে তার বিধাতার কাছে এই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে চোখ বুজল।

তখন ভোরের আকাশ স্বচ্ছ হয়ে আসছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *