ঋজুদার সঙ্গে আন্ধারী তাড়োবাতে

ঋজুদার সঙ্গে আন্ধারী তাড়োবাতে

কী সুন্দর হ্রদটা, না? কী নাম বললে? তাড়োবা হ্রদ? তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, হ্যাঁ। ভারতে আর কোনও অভয়ারণ্যেই এত বড় ও সুন্দর হ্রদ নেই।

ভটকাই বলল, শুনেছি রানথামবোরে আছে। রাজস্থানের রানথামবোরে।

রানথামবোরে আমি গেছি। সে হ্রদ এই হ্রদের চেয়ে অনেকই ছোট। তা ছাড়া সেটি হ্রদ নয়, পুকুর গোছের ব্যাপার। রাজার শুটিং লজ ছিল। রানথামবোরের দুর্গও ছিল। হয়তো পরিযায়ী পাখিরা এসে বসবে বলে, এবং রাজস্থানের প্রখর রুখু গ্রীষ্মে লজের কাছে ওই জলা থাকাতে একটু ঠান্ডাও হবে বলেই খোঁড়া হয়েছিল ওই পুকুরটি।

আমি বললাম, আরও একটা কারণ হয়তো ছিল।

তিতির বলল, কী কারণ।

রুক্ষ্ম প্রকৃতির মধ্যের জংলি জানোয়ারেরা জল খেতে আসত ওই জলাতে, শিকারের সুবিধা হত হয়তো।

ঋজুদা বলল, তা মনে হয় না। তখনকার দিনে রাজা-রাজড়ারা অঢেল এবং দৃষ্টিকটু সংখ্যাতে শিকার যে করতেন তা ঠিক, সেই শিকারের পরিমাণ অনেক সময়েই লজ্জাকরও হয়ে উঠত কিন্তু তারা তবুও অধিকাংশ সময়েই শিকার করতেন শিকারের আইন মেনেই। তৃষ্ণার্ত জানোয়ার যখন জল খেতে আসে তখন তাকে মারাটা কোনও ভাল শিকারির কাজ নয়।

ভটকাই বলল, ভালই ব্যাপার। জল খেতে আসার সময়ে তাদের মারাটা খারাপ কাজ আর জল খেয়ে ফিরে যাবার সময়ে মারাটা ভাল কাজ। নিজেদের চোখ-ঠারার এর চেয়ে কু-দৃষ্টান্ত বোধ হয় খুব বেশি নেই।

ঋজুদা হেসে বলল, ভালই বলেছিস।

তারপরে বলল, তা নয়। ব্রিটিশ আমলে আমরা যখন আইন মেনে শিকার করতে দেখেছি জেঠুমনিদের তখন তো গরমের সময়ে সব শিকার করাই বারণ ছিল। তখন ছিল closed-season. শিকারেও closed-season ও open-season ছিল। তা ছাড়া, ভারতের সব জঙ্গলেই বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ ছিল পয়লা জুলাই থেকে তিরিশে সেপ্টেম্বর। বেড়াতে যেতেন হয়তো কেউ কেউ এবং বনবিভাগের আমলারা যেতেন কাজে কিন্তু অন্যদের ঢোকা মানা ছিল। শিকারের তো প্রশ্নই ওঠে না। এখনও সব জঙ্গলই ওই সময় বন্ধ থাকে।

তাই? তিতির বলল।

হ্যাঁ। তবে রানথামবোরের জলার সঙ্গে ওই তাড়োবা হ্রদের এক ব্যাপারে মিল আছে।

কোন ব্যাপারে?

ভটকাই জিগ্যেস করল।

ভটকাই যে অনেকক্ষণ চুপ করে ধৈর্য ধরে ঋজুদার কথা শুনল তা দেখে অবাক হলাম। এবারে নাগপুরে আসার পর থেকেই দেখছি ওর চরিত্রে চাপল্য কিছু কমেছে। ঋজুদার প্রশ্রয়ে ক্রমেই ও একটি বাঁদরে পরিণত হচ্ছে। মাঝে মাঝে সত্যিই অসহ্য লাগে।

এই দুজায়গার জলেই কুমির আছে। মানুষ নামলে তো ধরেই, এমনকী পাড়ে উঠে এসেও ধরে। আর জলে নামলে তো কথাই নেই। শম্বর বা হরিণেরা গরমের সময়ে জল খেতে নামলে তাদের হাঁটু বা গোড়ালি কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে যায়। একে কুমিরের সঁতের কামড়, তার উপরে জলে ডুবে দমবন্ধ হয়ে মরার কষ্ট।

ঈসস।

তিতির স্বগতোক্তি করল।

মহারাষ্ট্রের এই তাড়োবা টাইগার রিজার্ভ কিন্তু আমাদের দেশের অন্যতম পুরনো অভয়ারণ্য। বেতলা, হাজারিবাগ, কাজিরঙ্গা ইত্যাদিরা এর জন্মের অনেকেই পরে জন্মেছে। গোঁন্দ আদিবাসীদের বাস ছিল এই পুরো অঞ্চলে। আগে এই সব অঞ্চলকে বলত চান্দা। এখনও চন্দ্রপুর বলে বড় জায়গা আছে। ওখানের প্রবল প্রতাপ গোঁন্দ রাজাদের সকলেই সমীহ করত। তাদের রমরমা ছিল নাগপুর অবধি বিস্তৃত–আগের বিদর্ভ আর কী! ফেরার সময়ে আমরা চন্দ্রপুর হয়ে ফিরব নাগপুরে। তখন দেখবি ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্টের একটি থার্মাল স্টেশানও আছে সেখানে।

বাঃ!

আমি বললাম।

তিতির বলল, ঋজুকাকা তুমি প্রথম কবে এসেছিলে এখানে?

সে কি আজকের কথা! তখন আমি স্কুলে পড়ি। জেঠুমনির সঙ্গে এসেছিলাম। তখনও গোঁদের বস্তিগুলোকে অভয়ারণ্য এলাকার মধ্যে থেকে বনবিভাগ সরিয়ে নেননি। সেই সময়ে এখানে একটা কানা বাঘ গোন্দদের গোরু-মোষ তো মেরে শেষ করছিলই, মানুষ ধরাও আরম্ভ করেছিল। কানিটকার সাহেব, এস. পি. কানিটকার, তখন মধ্যপ্রদেশের বনবিভাগের একজন হোমরাচোমরা ছিলেন। জেঠুমনির পূর্ব-পরিচিত। নাগপুরে জেঠুমনি একটা বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন সেবারে। নাগপুরের বাঙালিদের স্কুল ও লাইব্রেরি তাকে নিমন্ত্রণ করেছিল। নাগপুর ক্লাবে জেঠুমনির সঙ্গে হঠাৎ এক রাতে কানিটকার সাহেবের দেখা হওয়াতে জেঠুমনিকে অনুরোধ করেছিলেন বাঘটা মেরে দিতে।

ভটকাই, বলল, কেন মধ্যপ্রদেশে কি শিকারির খরা চলছিল যে কলকাতায় জেঠুমনিকে উনি ওই বাঘ মারার অনুরোধ করলেন? গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করল ঋজুদাকে। রীতিমতো অপ্রতিভ করে দিল।

শিকারির অভাব কোনওদিনই কোথাওই ছিল না। কিন্তু শিকারি মাত্রই যে সম্ভ্রান্ত তা বলা যায় না। অনেক শিক্ষিত শিকারিও চুরি করে জানোয়ার মারেন। শিকারের শখ ঘোড়ার শখের চেয়েও সাংঘাতিক। তোর রেসুড়ে বড়মামুর থেকে আমার শিকারি জেঠুমনি অনেক বিপজ্জনক হতে পারতেন। কিন্তু হননি তাঁর সংযম ছিল বলে। তোর বড়মামু যেমন নর্থ ক্যালকাটার তেরোটি বাড়ি ঘোড়ার শখে বেচে দিলেন জেঠুমনিও শিকারের শখে অনেক বিপজ্জনক ও বে-আইনি কাজ করতে পারতেন। কানিটকার সাহেব তা জানতেন বলেই জেঠুমনিকেই অনুরোধ করেছিলেন। তা ছাড়া অভয়ারণ্যর মধ্যে বাঘ শিকারের অনুমতি দেওয়ার মধ্যে অনেক ঝুঁকিও ছিল। বিধানসভাতে এবং লোকসভাতেও প্রশ্ন উঠতে পারত। কানিটকার সাহেবের চাকরি চলে যেতে পারত। মধ্যপ্রদেশের কোনও শিকারিকে এই অনুরোধ করলে ব্যাপারটা জানাজানিও হয়ে যেতে পারত। নানা কথা ভেবেই ওই অনুরোধ তিনি জেঠুমনিকে করেছিলেন চুপিসারে কাজ যাতে হাসিল হয়।

ভটকাই বলল, উপন্যাসের চেয়ে উপক্রমনিকা লম্বা হয়ে যাচ্ছে। কানা বাঘটা মেরেছিলেন শেষ পর্যন্ত জেঠুমনি?

জেঠুমনি মারেননি তার বকলমে আমিই মেরেছিলাম।

ভটকাই বলল, ছিঃ ছিঃ। তুমি! একটা কোটেশানের বইয়ে পড়েছিলাম, “When a man kills a tiger, he calls it sport but when a tiger kills a man he calls it ferocity.” বেচারি কানা বাঘ!

বেশি ফিলসফাইজিং কোরো না ভটকাই।

তিতির বলল।

তোর বড় জ্ঞান বেড়েছে। বাড়ও বেড়েছে।

আমি বললাম।

ঋজুদা বলল, তোরা ওর পেছনে লাগলি কেন। ও খারাপ কিছু তো বলেনি।

ইতিমধ্যে বাংলোর বাইরে একটি গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। টায়ারের নীচে কাঁকরের কিরকির শব্দ।

তিতির বলল, ওই প্রদীপকাকুরা এলেন। আমরা এবার জঙ্গল দেখতে যাব তো? নাকি আরও চা খাবে তোমরা?

না, না, এবারে যাওয়া যাক। তাড়োবাতে রাত নেমে গেলে জঙ্গলে ঘোরাটা বে-আইনি। সন্ধে সাতটার পর জঙ্গলে থাকা মানা।

তাই!

হ্যাঁ।

প্রদীপকাকু, মানে নাগপুরের প্রদীপ গাঙ্গুলি, তাপস সাহা এবং সঞ্জীব গাঙ্গুলি একটি কালিস গাড়ি থেকে নামলেন। বাংলোর বারান্দাতে উঠে ঋজুদাকে বললেন, চা-টা খাওয়া হল? এবার কি বেরোবেন নাকি দাদা? ঘণ্টা দুয়েক ঘোরা যাবে।

ঋজুদা বলল, চলো চলল। আর দেরি করে কী হবে।

প্রদীপদা বললেন, আপনার জন্যে এই এয়ারকন্ডিশানড কালিস গাড়িটা আনিয়েছি। টাটা সুমোতে আসতে আপনার কষ্ট হয়েছে। এই কালিস গাড়িটা উঁচু আছে। তা ছাড়া ইন্ডিপেন্ডেন্ট সাসপেনশান। এ গাড়িতে বসে জানোয়ার দেখতেও সুবিধা হবে।

ভটকাই ফিসফিস করে আমাকে বলল, Qualis, কালিস। কালিস মানে কী রে?

আমি জবাব দিলাম না।

আমরা টাটাসুমোতে এসেছিলাম, সেটাও অবশ্য এয়ারকন্ডিশানড। যদিও জানুয়ারি মাসের শেষ কিন্তু মাঝে মাঝেই গরম হয়ে যাচ্ছে আবহাওয়া।

ঋজুদা বলল, জঙ্গলে ঘুরতে এখন কোন গাড়ি সবচেয়ে ভাল বলো তো প্রদীপ?

কোন গাড়ি?

মাহিন্দ্রর বোলেরো। সবদিক দিয়ে ভাল গাড়ি। টাটা সুমোর সামনের সিটটা একটু ছোট। লম্বা চওড়া মানুষের বসতে অসুবিধে। কালিসও অবশ্য ভাল গাড়ি কিন্তু বোলেরোর মতো নয়। তা ছাড়া দিশি গাড়ি। দেশের জিনিস যদি পাওয়া যায় তবে বিদেশি জিনিস ব্যবহার না করাই ভাল।

কেন টাটা সুমোও তত দিশি।

তা ঠিক, তবে বোলেরো নয়। বোলেরোর চেয়েও ভাল গাড়ি আনছে মাহিরা, নাম Scorpion।

মানে, বিছে? ভটকাই বলল।

হ্যাঁ। গাড়ির মতো গাড়ি। আগামী বছরেই এসে যাবে।

টয়োটা কালিসও তো দেশেই তৈরি হচ্ছে।

হলে কী হয়! তাদের মুনাফা তো সব জাপানেই চলে যাবে। মারুতির মালিকানাও তো এখন বেশিটাই জাপানি। তাদের মুনাফাও জাপানে যাবে। থাম্বস আপ, পেপসি, কোকাকোলা এইসব কোম্পানির পয়সা যাবে আমেরিকাতেই।

সত্যি! ভটকাই বলল, ছাতার বিশ্বায়ন করে দেশের কোন উপকারটাই বা হল! দিশি ব্যবসাগুলো সব লাটে উঠল। তা ছাড়া, ওরা যদি অনেক ভারতীয়কে চাকরি-টাকরি দিত তাহলেও না হয় বোঝা যেত, এখন তো কম্পুটারের ঝিং-চ্যাক যুগ। খুব অল্প লোকেই মস্ত মস্ত কারখানা চালানো যায়।

তিতির বলল, সত্যি কথাই। মুনাফাও তো বিদেশে চলে যাচ্ছে, দেশের লোকের কর্মসংস্থানও হচ্ছে না তবে এই বিদেশিদের কাছে দরজা-জানলা খুলে দিয়ে দেশের উপকার কতটুকু হল?

প্রদীপকাকু আমাদের জাতীয়তাবাদী আলোচনার মধ্যেই বললেন, চলুন দাদা, এবারে ওঠা যাক।

প্রদীপকাকু, তাপসকাকু, আর সঞ্জীবকাকু গিয়ে ফরেস্টার সাহেবের জিপে উঠলেন। একজন ফরেস্ট গার্ড উঠল আমাদের কালিস-এর পিছনে। ঋজুদা সামনে আর আমরা তিনজন পেছনে। চলল গাড়ি।

.

০২.

তাড়োবা হ্রদ-এর চারপাশ দিয়ে এই তাড়োবা টাইগার প্রিসার্ভ। এবং অভয়ারণ্য। পুরো নাম, তাড়োবা-আন্ধারী টাইগার প্রিসার্ভ। আন্ধারী একটি নদীর নাম।

মুম্বাই শহরের একটা পাড়ার নাম যেমন আন্ধেরী।

ভটকাই বলল।

না, সেটা আন্ধেরী, এনদীর নাম আন্ধারী। গান্ধারীর বোন বলতে পারিস। আমি বললাম।

এই আন্ধারীকে এখন দেখা পর্যন্ত যায় না। জলরেখা পর্যন্ত মুছে গেছে কিন্তু বর্ষাতে এর রূপ নাকি হয় প্রলয়ঙ্করী। ঋজুদা নাগপুর থেকে আসবার সময়ে বলছিল।

তাড়োবা নামের কি কোনও মানে আছে?

তিতির শুধোল।

জনশ্রুতি আছে যে এক সময়ে এই উষর বনময় অঞ্চলে একদল মানুষ এই বনের মধ্যে পিপাসার্ত হয়ে মরতে বসেছিল তখন জঙ্গলের দেবতা ‘তাভু’ ওদের স্বপ্নাদেশ দিলেন যে ওরা যদি একটা নরবলি দেয় তবে দেবতা ওদের জল দেবেন।

অত্যন্তই বাজে দেবতা বলতে হবে। Very mean।

তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, তারপরে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে ওরা একজন মানুষকে বলি দিল। তারপরই জঙ্গলের মধ্যে দেবতা তাভুর দয়াতে এই বিশাল হ্রদ-এর সৃষ্টি বলে এর নাম তাড়োবা বলে প্রচারিত হল।

গাড়ি চলছিল। আগে আগে জিপ চলেছে। আমরা কাঁচ উঠিয়ে এয়ারকন্ডিশনার খুব কম করে চালিয়ে দিয়েছি পাছে ধুলো খেতে হয়। দুপাশেই বাঁশের জঙ্গল। অনেকটা অমরকন্টকের পথের অচানকমারের জঙ্গলের মতো। আমাদের উত্তরঙ্গে বা আসামে বা ওড়িশাতে যেমন মোটা মোটা বাঁশ হয়, ওড়িশাতে যাকে ‘ডবা বাঁশ’ বলে, সেরকম বড় বাঁশ গাছ নেই এখানে; এমনকী বাংলার গ্রামাঞ্চলে যে বাঁশঝাড় দেখি আমরা এই বাঁশগুলো তার চেয়েও অনেক সরু–মধ্যপ্রদেশের বাঁশের এই বোধহয় বিশেষত্ব। অনেকটা ওড়িশার ‘কন্টা বাঁশ’-এর মতো এগুলো।

ইচ্ছে আছে বড়মামার শান্তিনিকেতনের বাড়ির বাগানের জন্যে কটি চারাগাছ নিয়ে যাব ফেরার সময়ে।

পথের দুপাশেই বাঁশ। ভিতরে ভিতরে অন্য গাছ-গাছালি আছে, অসন, শাল, হলুদ, ধ, সিধা, অর্জুন, শিমূল, সেগুন ইত্যাদি। সেগুনই বেশি।

হঠাৎ একদল হৃষ্টপুষ্ট শম্বর, দলের সবকটিই মেয়ে-শম্বর বদিক থেকে ডানদিকে দৌড়ে রাস্তা পার হল।

ভটকাই বলল, জঙ্গলি ঘোড়া। দ্যাখ দ্যাখ।

তিতির বলল, ঘোড়া তো নয়, ঘোড়ার ডিম।

আমরা হেসে উঠলাম।

ভটকাই লজ্জা পেয়ে বলল, ঘোড়া নয়?

আমি বললাম, আজ্ঞে না। এগুলো শম্বর।

তার পরক্ষণেই একদল নীলগাই ডানদিকের জঙ্গল থেকে বাঁদিকের জঙ্গলে গেল ধড়ফড়িয়ে। এমন ধড়ফড় করে বলেই বোধহয় বিহারে এদের ‘ঘোড়ফরাস’ বলে। যদিও নামে নীলগাই মধ্যপ্রদেশের নীলগাইয়েদের চেহারাতে নীলের চিহ্নও নেই, যদিও অন্য অনেক রাজ্যের যেমন বিহারের, নীলগাইয়েদের চেহারাতে একটু নীলাভ ভাব থাকে।

ভটকাই বলল, এগুলো তো ঘোড়া!

আমি বললাম, হাজারিবাগের রাজডেবোয়াতে তো তুই দেখেছিস নীলগাই। তবুও চিনতে পারলি না?

অত ঘন ঘন জানোয়ার বেরিয়ে পড়লে চিনব কী করে।

আমরা সকলেই হেসে উঠলাম। ঋজুদাও।

পরক্ষণেই ঋজুদা বলল, চুপ কর। ডানদিকে দ্যাখ।

তাকিয়ে দেখি একটা বড় লেপার্ড ডানদিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের জঙ্গলে যাবে বলে এগোচ্ছে। আগের জিপটা চলে যাওয়ার অপেক্ষাতেই সে ছিল। জিপটা এগিয়ে যেতেই সে পথ পেরুবার জন্যে পা ফেলেছে, প্রায় শব্দহীন এঞ্জিনের কালিস গাড়িটা ও নজরই করেনি।

ঋজুদা ডান হাত দিয়ে ড্রাইভার মামাজির স্টিয়ারিং ধরা ডান হাতে হাত ধুইয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে বলল। আমাদের গাড়ি আরও এগোলে লেপার্ড হয়তো রাস্তা না পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যাবে, শেষ বেলায় গোধূলি আলোতে তাকে রাস্তা পেরোতে দেখা যাবে না। হলও তাই। আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়তেই সে বড় বড় পা ফেলে লাল ধুলোর রাস্তাকে ডানদিক থেকে পেরিয়ে বাঁদিকে গেল। সে এক আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য।

সে বাঁদিকের ঘন বাঁশের জঙ্গলে মিলিয়ে যেতেই মৃদু গুঞ্জরন উঠল গাড়ির মধ্যে।

তিতির বলল, হোয়াট আ গ্রান্ড সাইট।

ভটকাই বলল, এমন দিনের আলোতে আর কখনও চিতা দেখেছ তুমি ঋজুদা?

অনেকবারই দেখেছি। যদিও চিতা, বাঘের চেয়েও অনেক বেশি সাবধানী এবং বেশি নিশাচর। তবে একবারের কথা বললে তোরা মজা পাবি।

বলো, বলো, আমরা ধরে পড়লাম।

আসামের তামাহাট থেকে যমদুয়ারের জঙ্গলে যাচ্ছি জেঠুমনির সঙ্গে। জেঠুমনি অত্যন্তই উদারহৃদয় মানুষ। যাওয়ার কথা ছিল জিপে কিন্তু সকলেই “আম্মা যাব” “আম্মা যাব” করাতে শেষ পর্যন্ত ট্রাক রিকুইজিশান করতে হল। ট্রাকে চড়ে, হোলডল, ঝুড়ি ঝুড়ি কমলালেবু, হাঁসের ডিম, নানারকম সবজি পাঁউরুটি, বিস্কিট, ঝুড়ি ভর্তি মুরগি নিয়ে যখন আমরা রাইমানা থেকে যমদুয়ারের দিকে ঢুকেছি তখন এমনই বিকেল। আর পঁয়তাল্লিশ মিনিট এক ঘণ্টার মধ্যেই সন্ধে নামবে। শীতকাল। আসামের বিরাট বিরাট শাল সেগুনের ফাঁকে ফাঁকে অস্তগামী সূর্যর আলোর লালচে আভা পশ্চিমাকাশে দেখা যাচ্ছে, এমন সময় দেখা গেল এক চিতা বাবাজি পথ পেরিয়ে অন্য দিকে যাচ্ছেন, এই চিতা বাবাজিরই মতন।

তা তোমরা গুলি করলে না কেউ? আমি জিজ্ঞেস করলাম। সে তো আর অভয়ারণ্য নয়।

গুলি কে করবে। সকলের বন্দুক রাইফেলই তো বাক্সবন্দি অবস্থাতেই ছিল। আর সেই সব বাক্সর ওপরে ছিল মুড়ির বস্তা, ফুলকপি, বাঁধাকপি। জেঠুমনির এক আর্কিটেক্ট বন্ধু হাতের কমলালেবুই ছুঁড়ে মারলেন চিতার দিকে। নিরামিশাষীর নৈবেদ্য। চিতা একটু অবাক দৃষ্টি হেনে সোঁদা সোঁদা গন্ধের বড় বড় মহীরুহের গায়ের কাছে বর্ষার পরে গজানো নিবিড় ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে অচিরেই মিলিয়ে গেল। অমন অপ্রস্তুতে কোনও চিতাই ফেলেনি আজ অবধি। তাড়োবা তো

অভয়ারণ্য। যমদুয়ারের জঙ্গল তো আর পঞ্চাশের দশকে অভয়ারণ্য ছিল না। কিন্তু কপালে ছিল না, লেপার্ড মারা হল না।

যমদুয়ার? বেড়ে নাম তো জায়গার।

ভটকাই বলল।

শুধু নামই নয়। সত্যি সত্যিই যমদুয়ার। পশ্চিমবঙ্গ, ভুটান আর আসামের সীমান্তে অবস্থিত সেই যমদুয়ার। বাঘ, হাতি, বুনোমোষ, চিতা, শম্বর, নানা হরিণ, কী ছিল না সেই জঙ্গলে। ভুটানের মহারাজা হেলিকপ্টার করে এসে নামতেন যমদুয়ারে শিকার করার জন্যে। পাশ দিয়ে সংকোশ নদী বয়ে গেছে। মানাসের ছোট বোনের মতো। তার স্বচ্ছ জলের নীচ দিয়ে মহাশোল মাছেদের ঝাক সাঁতরে চলে যেত আর পিংকহেডেড পোচার্ড থেকে শুরু করে নাকটা, গার্গনি, পিন-টেইল ইত্যাদি কত পরিযায়ী হাঁস এসে আস্তানা গাড়ত শীতকালে এই নদীতে। ভুটান থেকে ভুটানিরা পিঠে করে কমলালেবু বয়ে নিয়ে আসত। কচি শুয়োর, আরও কত কী। যমদুয়ারের কথা মনে হলেই রোমাঞ্চ জাগে মনে।

আমাদের তো নিয়ে গেলে না একবারও ঋজুকাকা।

তিতির বলল।

এখন আর যাবার উপায় আছে কি? আলফা ও বোডড়া জঙ্গিদের আড্ডা হয়েছে সেখানে, পালামৌতে যেমন হয়েছে এম.সি.সি.-র আড্ডা। এখন বনজঙ্গলের অধিকাংশই আর নিরাপদ নয়। বড় অস্থির এক সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি আমরা। জঙ্গল কেটে সাফ করে দিচ্ছে, জানোয়ার মেরে মাইলের পর মাইল জঙ্গল জানোয়ারহীন করে দিচ্ছে, গাছপালা কেটে মরুভূমি করে দিচ্ছে। ক্রুদ্ধ বাঘ যেমন লুকোনো শিকারির গুলি খেয়ে কে তাকে এমন ব্যথা দিল অদৃশ্যে থেকে তা বুঝতে না পেরে অন্ধ ক্রোধে তার নিজের লেজে কামড়ে ধরে, এই সব মানুষেরাও তেমনই।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, তাদের প্রতি অন্যায় ও অবিচার করা হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কালের পর কাল, যুগের পর যুগ অন্যায় করা হয়েছে কিন্তু তার প্রতিবাদ নিজের নিজের লেজে কামড় দিলে কি করা হবে? যা তাদেরই পরম সম্পদ, তাদের অস্তিত্বর সঙ্গে, তাদের অতীত ইতিহাস, লোকগাথা, তাদের পুরাণ তাদের গান ও নাচের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যা, তারই সবকিছুর সর্বনাশ সাধন করে তারা কী পাবে তা তারাই জানে। ওদের বোঝানো দরকার। সহানুভূতি, সহমর্মিতার সঙ্গে ওদের বোঝাও দরকার। ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড এইসব নতুন রাজ্যের জন্ম হল বটে কিন্তু ওই বিচ্ছিন্নতাবাদকে সুসংহত না করতে পারলে ভারতবর্ষ টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তাতে দেশ ও দেশবাসীর লাভ হবে না কোনওই।

তুমি বোঝাও না কেন?

আমি তো activist নই। রুদ্র যেমন তার কলম দিয়ে লিখেও অনেক অন্যায়ের উৎস মূলে আঘাত করতে পারে, সে তো আদিবাসীদের নিয়ে অনেক লিখেওছে, ও নিজে অনেক অন্ধকে পথ দেখাতে পারে আমার তো তেমন করার ক্ষমতা নেই। তা ছাড়া, তোরা তো জানিস, আমার আরও অনেক কিছু করতে হয়, মেধা পাটকার বা অরুন্ধতী রায় বা মহাশ্বেতা দেবীর মতো আন্দোলন করার সময় ও হয়তো মানসিকতাও আমার নেই। তাই আমি নীরব দর্শক হয়ে থাকি আর দুঃখ পাই। ওই পাগলপারা মানুষদের জন্যে দুঃখ পাই, ওই বৃক্ষহীন অরণ্যের মধ্যে দুঃখ পাই। জন্তু জানোয়ারহীন বনের জন্যে দুঃখ পাই, দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না আমি। জানি না, এই অন্ধ রোষের নিবৃত্তি কবে হবে।

অনেক গভীর বিষয়ে তলিয়ে যাচ্ছি আমরা। আমরা আদার ব্যাপারী জাহাজের খবরে আমাদের দরকার কী?

দরকার আছে। সকলেই আদার ব্যাপারী বলে দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে এই দেশ ছারেখারে যাবে। এই দেশ তো তোরও। একথা ভুলে গেলে চলবে কেন?

যাকগে, আমাদের তাহলে যাওয়া হবে না কখনও যমদুয়ারে?

রুদ্র দুদিকে দুহাত ছুঁড়ে বলল।

কখনও যাওয়া হবে কি না জানি না যমদুয়ারে, তবে শিগগিরি হবে না। এখন তো মানাস-এও যাওয়া যায় না, ছত্তিশগড়ের ও ঝাড়খণ্ড-এর অনেক জায়গাতেই যাওয়া যায় না। কত প্রিয় সব জায়গা, কত স্মৃতি, কত বনের কত মানুষের, সবই পিছনে ফিরে তাকালেই এখন স্বপ্ন বলে মনে হয়।

আমরা সকলেই চুপ করে রইলাম।

সামনেই একটা মস্ত তৃণভূমি জেগে উঠল। তাতে কম করে এক হাজার চিতল হরিণ চরে বেড়াচ্ছে। দৌড়াচ্ছে, খেলছে।

বাঃ। হরিণ তো খুব বেড়েছে এদিকে।

ঋজুদা স্বগতোক্তি করল।

গার্ড পিছন থেকে বলল, গার্ডদাদার নাম বিষেন, হ্যাঁ স্যার। হগ ডিয়ারও বেড়েছে প্রচুর। শম্বর নীলগাইও বেড়েছে। আর সামনের বাঁদিকে মোড় নিলেই হয়তো একটা বাঘিনীকে দেখতে পাব আমরা। তার রোদে বেরুবার সময় হয়েছে এখন। তিনটি বাচ্চাও আছে তার সঙ্গে। এখন অবশ্য বেশ বড়ই হয়ে গেছে। গত বছর রেঞ্জার সাহেব ভিডিও ক্যামেরাতে ছবি তুলেছিলেন, বাংলোতে আছে ক্যাসেটটা, আপনারা দেখতে পারেন, তখন বাচ্চাগুলো ছোট ছিল।

ঋজুদা বলল, মনে করিস তো রুদ্র, বাংলোতে ফিরে গিয়ে দেখতে হবে ফিল্মটা।

গার্ড বলল, শুধু হরিণ ও অন্যান্য তৃণভোজীই নয়, ঢোলও বেড়েছে এদিকে। তিন চারটে দল আছে।

তিতির বলল, তিন চারটে!

হ্যাঁ মেমসাহেব।

ভটকাই বলল, কী সব বলছ তোমরা বুঝছি না। ঢোল তো বাজায় জানি। ঢোল-এর আবার দলই বা কী আর বাড়-বাড়ন্তই বা কী?

আমরা হেসে উঠলাম সবাই। গার্ড বিষেন বাংলা বোঝে না। সে আমাদের হাসিতে যোগ দিতে পারল না।

তিতির বলল, ভাব তো দেখাও এমন, যেন সবজান্তা। ভারতের বনে জঙ্গলে ঘোরো আর ঢোল কাকে বলে জানো না?

ঋজুদা ভটকাইকে আরও হেনস্থা থেকে বাঁচানোর জন্যে বলল, ঢোল মানে হচ্ছে জংলি কুকুর। ইংরেজিতে যাদের বলে ওয়াইল্ড ডগস। তারা যে জঙ্গলে থাকে সেই জঙ্গলে বাঘও সাবধানে থাকে।

বাঘ অবশ্য আরও সাবধানে থাকে যেখানে ডাঁশ থাকে।

আমি বললাম।

ডাঁশটা আবার কী বস্তু?

ভটকাই রীতিমতো চুপসে গিয়ে বলল।

আমি ঋজুদা আর তিতির পুব-আফ্রিকাতে সেতসি মাছির কামড় খেয়ে দেখেছি। যদিও তা আদৌ সুখাদ্যের মধ্যে গণ্য নয়। কিন্তু তা বলে ভঁশের কামড়। খেলে কি আর বাঁচব!

তারপরই ঋজুদাকে বললাম তুমি তো পৃথিবীর তাবৎ খাদ্য-অখাদ্য খেয়েছ, ভঁশের কামড় কখনও খেয়েছ কি?

ঋজুদা হেসে বলল, একবার খেয়েছিলাম। একবারই যথেষ্ট আর খাবার কোনও ইচ্ছা নেই।

কোথায় খেয়েছিলে ঋজুকাকু?

তিতির বলল।

আরে ভঁশ ব্যাপারটা কী তা জানার জন্যে আমি যে হাঁসফাস করছি সেদিকে তো তোমাদের কারও খেয়াল নেই, নিজেরাই কথা বলে চলেছ।

আমি বললাম, শোনো মিস্টার সবজান্তা ভটকাই। উঁশ হচ্ছে আদি ও অকৃত্রিম ভারতীয়। একরকমের মাছি। কাটালে মাছির দশ বারো গুণ বড় হয়। তার কামড়ে বাঘের মতো জানোয়ার পর্যন্ত দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে জঙ্গল ছেড়ে পালায়।

জঙ্গলে কথা বলা বারণ কিন্তু আমাদের গাড়ির সব কাঁচই ওঠানো এবং আমরা নিচু গ্রামেই কথা বলছিলাম তাই সম্ভবত বাইরে গাড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে সে শব্দ যাচ্ছিল না।

গার্ড বলল, দেখিয়ে সাহাব।

মামাজি গাড়ি দাঁড় করাতেই আমরা দেখলাম পথের বাঁদিকে জঙ্গলের মধ্যের একটা শুড়িপথ দিয়ে বেরিয়ে এসে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে, যাকে বিহারে বলে নরপাঠা। জবরদস্ত শিঙাল শম্বর। তার শিঙের বাহার দেখার মতো। চেহারাতেও প্রায় ঘোড়ারই মতো। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম আমরা।

তিতির ফিসফিস করে ভটকাইকে বলল, দ্যাখো ভটকাই, ঘোড়ার ফার্স্ট কাজিন।

ঋজুদা স্বগতোক্তি করল, ঠিক এইরকম একটা শম্বর মেরেছিলাম ওড়িশার টুল্বকার জঙ্গলে। সেই জঙ্গলে কিছু পেল্লায় পেল্লায় বাইসন আর শম্বর ছিল বটে।

হাতিও ছিল বিস্তর।

তিতির বলল, এমন সুন্দর একটা প্রাণীকে মেরে তোমার অনুতাপ হয়নি ঋজুদা?

ঋজুদা একটু চুপ করে থেকে বলল, যখন মেরেছিলাম তখন আমি কলেজে পড়ি। ওই বয়েসে এক ধরনের বাহাদুরি-প্রবণতা থাকে সকলের মধ্যেই। তা ছাড়া ভাল শট হলে জেঠুমনি হ্যান্ডশেক করতে, পিঠ চাপড়ে দিতেন যাকে বলে pat on the back। তবে শুধু আমি একাই কেন কনজার্ভেশানের মস্ত বড় বড় প্রবক্তারা প্রথম জীবনে সকলেই শিকার করেছিলেন। ভাল শিকারিরাই পরে ভাল কনজার্ভেটর হন।

তিতির বলল, যেমন?

যেমন জিম করবেট, সালিম আলি, অ্যান রাইট। আরও অগণ্য নাম বলতে পারি।

ভটকাই বলল, যেমন তুমি।

কাদের সঙ্গে কার তুলনা!

ঋজুদা বলল।

ঋজুদা যাই বলুক, আমাদের কাছে ঋজুদাই হিরো নাম্বার ওয়ান। শম্বরটা আধ মিনিটটাক দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে পথ পার হল। আর আন্ধারী-তাড়োবা অভয়ারণ্য বলেই বন্যপ্রাণীদের ভয় ভেঙে গেছে। অন্য জায়গা হলে শম্বর এতক্ষণ দাঁড়াতনা, মুহূর্তের মধ্যে পালাত এবং রাস্তাও পেরোত না, যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ দিয়েই ফিরে যেত।

অত বড় শিং আটকে যায় না জঙ্গলের ডালপালাতে?

ভটকাই শুধোল।

ঋজুদা হাসল, বলল, ছেলেবেলায় আমারও মনে এই প্রশ্ন জাগত। কিন্তু শুধু শম্বরই কেন, সব শিঙাল জানোয়ারই যখন জঙ্গলের মধ্যে দৌড়ে যায় তাদের শিংগুলি পিঠের উপর শুইয়ে দেয় প্রায়, মুখটা উঁচু করে। তাদের তখন দেখতে ভারী সুন্দর লাগে।

একটু পরেই সূর্য ডুবে গেল। এমন সময় হঠাৎ একটা ফ্ল্যাশ বা জ্বলে উঠল পথের বাপাশে।

কী ব্যাপার?

গার্ড বিষেন বলল, পথের ধুলোর নীচে অদৃশ্য তার পাতা আছে। যে কেউই এই পথ মাড়িয়ে যাবে, সে বাঘই হোক আর চিতা বা চোরা শিকারি বা তাদের গাড়ি, অটোম্যাটিক ক্যামেরাতে তাদের ছবি উঠে যাবে। পরদিন রেঞ্জ অফিসে এই ফিল্ম ডেভলাপ করা হবে।

বাঃ। চমৎকার ব্যাপার তো।

তিতির বলল।

ঋজুদাও বলল, তাড়োবাতে অনেক কিছুই আছে যা অন্য টাইগার প্রিসার্ভে নেই। বহু পুরনো তো এই প্রিসার্ভ। ওরা এখানে খুবই অর্গানাইজড।

ঋজুদার কথা শেষ হতে না হতে দেখা গেল পথের উলটোদিক থেকে একটা বিরাট ভাল্লুক, স্লথ বেয়ার গাড়ির দিকে আসছে। একেবারে ডোন্ট কেয়ার।

এ কীরে! কী চেহারা রে। এ যে দেখছি আমেরিকার ইয়ালোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক-এর বাদামি ভাল্লুকের মতো পেল্লাই। ও কি কালিস গাড়ির সঙ্গে কুস্তি লড়বে না কি?

ভটকাই বলল।

ততক্ষণে ভালুক বাবাজি একেবারে কাছে এসে গেছে। কাছে আসতেই সে পেছনের দুপায়ে দাঁড়িয়ে উঠল। তার বুকের সাদা v চিহ্নটা পরিষ্কার দেখা গেল। v মানে ভিক্টরি, v মানে V.I.P.-র আদ্যক্ষর। সে আমাদের তার ভিজিটিং কার্ড দেখিয়ে জঙ্গলের ডানদিকে ঢুকে গেল।

গার্ড আমাদের দেখাল, এদিকে খুব বড় বড় উইয়ের ঢিপি আছে। উই খেতে যাচ্ছে। মহুয়ার সময় এখনও আসেনি। মহুয়ার সময়ে মহুয়া, আমের সময় আম, জামের সময় জাম, ভাল্লুকের এসব অত্যন্ত প্রিয় জিনিস।

সামনের জিপটাকে এবারে পেছনে আসতে বলে আমরা কয়েকটা নুনি দেখে বাংলোতে ফেরার পথ ধরলাম। নুনিগুলো বনবিভাগের বানানো। কিছু স্বাভাবিকও আছে। পাশে জলও আছে। ছোট ছোট পুকুর খুঁড়েছে। এই ঊষর মধ্যপ্রদেশে জল বিরল। অত বড় হ্রদ তাড়োবা অথচ কুমিরের জন্যে সেখানে জলে নামার উপায় নেই এদের।

কতগুলো কুমির আছে তাড়োবা হ্রদে? ঋজুদা গার্ডকে শুধোল।

সেনসাস তো নেহি কিয়া হ্যায় মঞ্জুরকা লিয়ে হুজৌর। খয়ের পঞ্চাশ-ষাট তো হোগা জরুর। হর সাল আট দশ গো হিরণ পাকড় লেতা হ্যায়।

বোঝে একবার ব্যাপারখান! ভটকাই ফুট কাটল।

ঋজুদা পথের দুপাশে কী যেন খুঁজছিল মাথা এপাশ ওপাশে করে। তারপরে হঠাৎই মামাজিকে বলল, গাড়ি থামাতে।

ঋজুদা বলল কাঁচগুলো নামা এবারে। এয়ারকন্ডিশনার বনধ কর দেনা মামাজি। বনের গন্ধ ও শব্দ নাকে আর কানে না গেলে জঙ্গলে এসে লাভ কী?

তারপর বলল, তোদের এইবার একটা জিনিস দেখাব যা তোরা কোথাওই দেখিসনি আগে, না অন্য কোনও জায়গায় দেখতে পাবি। ওই দ্যাখ, বলেই বাঁদিকে বনের গভীরে আঙুল তুলে বলল, ওই দ্যাখ ভূত।

সত্যিই তো! আমরা সবিস্ময়ে সকলে দেখলাম সদ্য-ডোবা সূর্যের মাছের রক্তধোওয়া একেবারে ফিকে লাল আলোর মধ্যে ধবধবে সাদা কী একটা দাঁড়িয়ে আছে। তিন চার মানুষ লম্বা, লম্বা লম্বা হাত ছড়িয়ে, অনেকগুলো হাত। মামদো ভূত দাঁড়িয়ে আছে।

ভটকাই বলল, ঈরে বাবা, ইটা কে গো?

তিতিরও যেন ভয় পেয়েছে মনে হল। বলল, এটা কী ভূত?

ঋজুদা বলল, ভূত-প্রেতের কি একরকম? ভুশন্ডির মাঠের কাঁড়িয়া পিরেত থেকে পালামৌর জঙ্গলের দারহা ভূত, যারা রাতের বেলা একা মানুষ পেলেই তাকে কুস্তি লড়তে বলে আর সে মানুষ কুস্তি লড়তে গেলেই খাপু খাপ খাপ খাপু করে ডাকতে ডাকতে রাতের আকাশে অদৃশ্য হয়ে যায়।

তারপর বলল, তোরা তো জানিসই ওড়িশার কালাহান্ডি জেলায়, বাঘডুম্বা ভূত আছে। অরাটাকিরির বাঘ মারতে গিয়ে সেই ভূতের কথা তো তোরা শুনেছিস। এই বন-পাহাড়ের প্রকৃত ভারতবর্ষ তো হ্যালোজেন আর মার্কারি ভেপারের আলো-জ্বালা ভারতবর্ষ নয়, কম্প্যুটার ইন্টারনেট আর বিশ্বায়নের ভারতবর্ষ নয়, এই হল আদিম ভারতবর্ষ। এই পথের দুপাশে কত গোঁন্দ সৈন্যের স্মৃতি, কত আহত সৈন্যের দীর্ঘশ্বাস, কত মৃত সেনার আত্মা আছে তা কে বলতে পারে।

তিতির অনুযোগের স্বরে বলল, ভাল হচ্ছে না ঋজুকাকা। বলোই না ওটা কী?

ঋজুদা একটু চুপ করে থেকে বলল, ওটা একটা গাছ। এখন গাছে পাতা নেই, তাই আরও ভয়াবহ দেখাচ্ছে। একটাও পাতা নেই এখন। এই গাছগুলোর নাম Ghost tree, অন্য নাম Karu-Gum tree, একরকমের আঠা হয় এই গাছ থেকে।

তারপরই পুরনো কথা মনে পড়ে যাওয়াতে বলল, যখন জেঠুমনির সঙ্গে এখানে এসেছিলাম তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। একটা গোঁন্দ মেয়েকে ধরে ছিল কানা বাঘে। বছরের এই সময়েই। আমি মাচা বেঁধে বসেছিলাম। একা। জেঠুমনিরই নির্দেশে। যাত্রাপার্টি আর মানুষখেকো বাঘ শিকার এক কথা নয়। এখানে বাঘও একা শিকারিও একা। দুজনের বুদ্ধি, ধৈর্য আর সাহসের পরীক্ষা দিতে হয় একা একা। ভয় পেলে জেঠুমনি বা পিসিমার নাম ধরে চেঁচিয়ে লাভ নেই। যখন মাচাতে বসেছিলাম, তখন লক্ষ করিনি। রাত নামলেই দেখি ধবধবে সাদা শাড়ি পরা ভূত পেত্নী চারিদিকে। কী ভয় যে পেয়েছিলাম, কী বলব। জেঠুমনি বলতেন, সমস্ত ভয়েরই উৎস হচ্ছে অজ্ঞতা। ভারী রাগ হচ্ছিল জেঠুমনির কথা মনে পড়ায় তখন। ভাবছিলাম, সেই রাতেই তো ভূতেরা আমাকে নিয়ে গেলি খেলবে। কাল অবধি বেঁচে থাকলে না জেঠুমনির কাছ থেকে এই ভয়ের উৎস জানা যাবে। তার আগেই তো দফা রফা।

সত্যি! না জানলে যে কোনও ভীরু ও অনভিজ্ঞ মানুষ জঙ্গলে হঠাৎ রাতের বেলা এই গাছ দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। ভারী আশ্চর্য তো।

ঋজুদা বলল, এই আমাদের সুন্দর দেশ। বিরাট, স্বরাট দেশ ভারতবর্ষ। কত বৈচিত্র্য এখানে, কত কী জানার, শেখার। এক জীবনে আমরা এর কতটুকুই বা জানতে শিখতে পারব। এমন দেশে জন্মে মানুষে যে কেন বিদেশে ছুটি কাটাতে যায় আমি ভেবেই পাই না।

আমি বললাম, আমাদের মধ্যে অনেকেই বোধ হয় এক ধরনের হীনমন্যতাতে ভুগি। ভাবি, ইউরোপ আমেরিকা জাপান ঘুরে এসে বুঝি আমাদের লেজ গজালো।

ঠিক তা নয়। তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, বিদেশে যাওয়া দোষের নয় কিন্তু একজন ভারতীয়র চোখ দিয়ে বিদেশকে দেখতে হবে। আমাদের সঙ্গে তাদের কোথায় অমিল, তাদের জনসংখ্যা কত কম, তাদের নিয়মানুবর্তিতা, তাদের আত্মসম্মানজ্ঞান, তাদের স্বয়ম্ভরতা কত অন্যরকম আমাদের চেয়ে, তারা কত আত্মবিশ্বাসী, পরমুখাপেক্ষী বা পরদয়া-নির্ভর কত কম এই সবই জানতে বুঝতে হবে। তবেই না দেশ বেড়ানো সার্থক। নইলে, দেশে ফিরে চালিয়াতি করাই যায় শুধু, গরিব বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছে ফাঁকা বাহাদুরিই নেওয়া যায়। তেমন দেশ দেখতে যাঁরা যান তাদের যাওয়া-না-যাওয়া সমান।

কাল দিনের বেলা আবার এসে এই ভূত-গাছকে ভাল করে দেখতে হবে। আমি বললাম।

ঋজুদা বলল, একটা নাকি? অজস্র আছে এই গাছ। তোদের কালকে হ্রদের ওপারে নিয়ে যাব–দেখবি। ওপারেই তো কানা বাঘটাকে মেরেছিলাম।

সেই বাঘ মারার গল্পটা আমাদের বলবে না?

ঋজুদা বলল, হবে ‘খন। প্রদীপরাও শুনতে চেয়েছিল। আমরা তো আছি এখানে তিনদিন, হবে হবে, সময়মতো হবে। সকলে এক সঙ্গে হলে বলা যাবে।

.

০৩.

নাগপুর থেকে তাড়োবা এসেছিলাম আমরা চম্পা হয়ে অম্বা নদীর ব্রিজ পেরিয়ে এসে উমরের ভিওয়ানপুর ও সারু নদী পেরিয়ে। তারপর জাম্বুল ও চিমুরঘাটা হয়ে ষোলো সতেরো কিমি এসে বাঁদিকে ঢুকতে হয় তাড়োবা যাওয়ার জঙ্গলের পথে। এই পথে উমরের এক বড় জনপদ। এ ছাড়া আর তেমন উল্লেখযোগ্য জনপদ নেই ওপথে এলে তাড়োবা আর নাগপুরের মধ্যে। অন্য পথ দিয়েও যাওয়া যায়। সোজা চিমুর থেকে এসে চন্দ্রপুর, গোঁন্দদের ‘চান্দা’ পেরিয়ে মোহার্লি গেট হয়ে অন্যদিক থেকে ঢুকতে হয় তাড়োবাতে। তাড়োবা থেকে ও পথে নাগপুরে যেতে মোহার্লি গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে চন্দ্রপুর পেরিয়ে ওয়ারোরো ও বুটিবারি হয়ে ফিরতে হবে। নাগপুর থেকে আন্ধারী-তাড়োবার দূরত্ব একশো পঞ্চাশ কিমি আর চন্দ্রপুর থেকে পঁয়তাল্লিশ কিমি।

ঋজুদা জঙ্গল থেকে ভি.আই.পি. বাংলোতে ফেরার সময় বলল, কাল সকালে আমরা মোহার্দি গেট অবধি যাব। প্রদীপ বলছিল, সেখানে একটি ইনফরমেশান সেন্টার বানিয়েছে বনবিভাগ রেঞ্জার নীতিন কাকোডকার এর তত্ত্বাবধানে। সেটি নাকি দেখবার মতো।

ওদিকে গেলে, কপাল ভাল থাকলে ঢোলও দেখতে পারবেন সাহেব। গার্ড বিষেন বলল, মোহার্লির নাম শুনে।

তাহলে তো খুবই ভাল। খুব ভোরে উঠে এক কাপ করে চা খেয়ে বেরিয়ে পড়ব আমরা। ফিরে ব্রেকফাস্ট করব।

ঠিক আছে।

তিতির বলল।

ঠান্ডাও কমে গেছে। ভোরে উঠতে কষ্ট কী?

আফ্রিকার শীতকালে অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে ভুষুণ্ডার খোঁজে ঘুরতে যারা অভ্যস্ত তাদের আবার শীতের ভয় কী। আমি বললাম।

তা ঠিক। তবে শীতের কথাই যদি বলিস সমতলে তবে আমি বলব হাজারিবাগের শীতের কথা।

তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তুই যখন আমার সঙ্গে মুলিমালোয়াতে গেছিলি অ্যালবিনোর পটভূমিতে তখন তো শীত ছিল না, গ্রীষ্মকালই বলা চলে। তাই…।

তারপর বলল, তুই ‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’ আর ‘রুআহা’ বই দুটো কিন্তু ভারী ভাল লিখেছিলি রুদ্র। মাঝে মাঝে অবসর পেলে বইগুলো পড়ি, সেইসব দিনে ফিরে যাই। তোর কিছু মনেও থাকে। কী ডিটেইলস-এই না লিখেছিলি! ‘ঋজুদা সমগ্র’র কোন খণ্ডে আছে যেন?

প্রথম খণ্ডেই তো। তোমার সমগ্রর হিসেব দিয়ে কী কাজ? তোমার কাছে তো আমার সব কটি বইই আছে।

তা ঠিক। তবে সমগ্রর সব খণ্ডই হাতের কাছে থাকলে যখন যেটা খুশি পড়া যায়।

তারপর বলল, পাঁচ খণ্ড বেরুবে না রে? বেরুবে। নতুন বইগুলো লিখি আগে। এই তাড়োবা নিয়েও লিখব একটা আর তুমি যদি এপ্রিল মাসে ছত্তিশগড়ের বস্তারে নিয়ে যাও তবে সেই বস্তার নিয়েও লিখব আর একটা।

তাঁ। মনে হয়, বস্তারে তোদের সকলেরই যাওয়ার সুযোগ হয়তো হবে। গভর্নর সিনহা সাহেবের অতিথি হয়ে যাব। এমনই কথা আছে। প্রিন্সিপাল ফরেস্ট সেক্রেটারি চক্রবর্তী সাহেবও এখন থেকেই সব ডি.এফ.ও.-দের চিঠি দিয়ে রেখেছেন আমাদের দেখভালের জন্যে সব ফরেস্ট ডিভিশনে। ছত্তিশগড় সরকার এয়ারকন্ডিশানড টাটা সুমো দেবেন একটা। রায়পুর ও জগদলপুর-এ এয়ারকন্ডিশনড হোটেলে থাকার বন্দোবস্ত, নারায়ণপুরে পি. ডাব্লু. ডি.-র চমৎকার বাংলো আর বনবিভাগের ছোট্ট বাংলোতে থাকব আমরা। ভাগ করে। এসব বন্দোবস্তই করেছে প্রদীপ মৈত্র, রায়পুরের।

তিনি কে?

তিনি এই প্রদীপেরই বন্ধু। হিন্দুস্থান টাইমস-এর চিফ রিপোর্টার রায়পুরের। খুবই ভাল ছেলে। তোরা সুদীপ্তকেও দেখিসনি। সেও খুব ভাল। স্কলাস্টিক। নাগপুরের সবচেয়ে বড় স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল। সুদীপ্ত ভট্টাচার্যি খুবই পড়াশুনো করে।

তাই? তিতির বলল।

ওই প্রদীপকাকু আর অন্যান্যরা কী করেন? মানে, এবারে আমাদের যারা নিয়ে এলেন।

প্রদীপ গাঙ্গুলি হল নাগপুরের ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট-এর ইঞ্জিনিয়র। নাগপুর শহরের পথেঘাটে কত সব ক্রিয়াকাণ্ড হচ্ছে দেখলি না। বিরাট চওড়া চওড়া সব রাস্তা, ফ্লাইওভার, এসবই প্রদীপের ডিপার্টমেন্টের কাজ। আর তাপস সাহা হল ভারত হেভি ইলেকট্রিকাল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার। ও খুব মেধাবী ছাত্র ছিল যাদবপুরের। টারবাইন স্পেশ্যালিস্ট। সারা বছর ওকে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হয় আর ওর স্ত্রী মুনমুন, সেও যাদবপুরেরই ছাত্রী, মেয়ে কুর্চিকে নিয়ে প্রায় একাই থাকে নাগপুরে।

প্রোষিতভর্তিকা!

আমাদের সবাইকে তো বটেই এমনকী ঋজুদাকেও চমকে দিয়ে বলল ভটকাই।

সেটা কী বস্তু রে? বাংলাতে খারাপ ঋজুদা জিগ্যেস করল।

যে মহিলার স্বামী প্রবাসে থাকেন তাকে বলে প্রোষিতভর্তিকা।

বাবাঃ! ভটকাই তো বাংলাতে পণ্ডিত হয়ে উঠেছে রে।

ভটকাই চুপ করে থেকে প্রশংসাটা রেলিশ করল।

আর সঞ্জীবকাকু কী করেন? কথা বলেন কম কিন্তু এক মিনিট অন্তর ছবি তোলেন।

তিতির বলল।

ও ছবি তুলবে না তো কে তুলবে? সঞ্জীব তো দারুণ ফটোগ্রাফার। হিন্দুস্থান টাইমস-এর চিফ ফটোগ্রাফার। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। ও এত ভাল ছবি তোলে যে ইচ্ছে করলে শিবকে বাঁদর আর বাঁদরকে শিব করে দিতে পারে ওর হাতের গুণে। ভারী মজার ছেলে। এই যে টুপিটা পরে আছি আমি নাইকের ওটা ওরই দেওয়া। গত বছর একটা মারাঠি গামছা দিয়েছিল, ভারী মোটা আর নরম। ওর স্ত্রী সুচিত্রা নাগপুরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তারও আসবার খুব ইচ্ছে ছিল। পারেনি। হয়তো বস্তারে যেতে পারে যদি স্কুল আর মেয়ের একটা বন্দোবস্ত করতে পারে।

ভটকাই অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। ভেরি আনইউজুয়াল ফর হিম। এবারে কিছু একটা কেলো করবে। ওর মৌনতাই তা বলছে।

আমিই ওকে খুঁচিয়ে দিয়ে বললাম, এ তো আর ডেভিল’স আইল্যান্ডে যাবার সময়কার মোটর-বোট নয়। এখানের বাবুর্চিকেও কি পকেটে পুরেছিস না কি? রাতের খাওয়া-দাওয়ার কী হবে? তুই তো একটি জিনিয়াস এ ব্যাপারে।

তা পকেটে পুরতে হয়েছে বই কী?ছ প্যাকেট সিগারেট এবং বহু ডজন গুটকা নিয়ে এসেছিলাম নাগপুর থেকে। এসেই কিচেনে ঢুকে ঘুষ দিলাম।

গুটকাটা কী জিনিস আবার?

ঋজুদা বলল।

সে আছে। তুমি এবারে পাইপ ছেড়ে দিয়ে গুটকা ধরো। পাইপে বড় ঝকমারি।

ভাল মনে করেছিস। অনেকক্ষণ পাইপটা খাওয়া হয়নি। এখন তো কাঁচ খোলা। ধরাই এবারে।

ঋজুদা বলল।

ধরাও।

খাবি তোরা আর বদনাম আমার।

ভটকাই বলল।

তা আজ রাতের মেনুও কি তুইই ঠিক করে দিয়ে এলি নাকি?

আমি বললাম।

বলতে পারিস, তাইই।

তিতির বলল, মেনু কী?

এই জঙ্গলে বেশি কী আর পাওয়া যাবে? তা ছাড়া, আসবার আগে নাগপুর থেকে বাজার করে নিয়ে এলেও কথা ছিল। প্রদীপকাকু তো বলেইছিলেন ঋজুদার তাড়াতেই তা পারলেন না। উমরের এমনই এক জায়গা যে তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। তোরাও সবাই তাড়া দিলি। সঞ্জীবকাকু মুরগিও জোগাড় করতে পারলেন না। ভিন্ডি আর পেঁপে নিয়েছেন বিস্তর, কিছু বেগুন টোম্যাটো, আলু পেঁয়াজ আর ডিম নিয়েছেন কিছু।

তা মেনুটা কী তা তো বলবি?

ভাত, যারা রুটি খাবে রুটি, ভাজা মুগের ডাল, লঙ্কা আর বেগুন ভাজা, স্টাফড টোম্যাটো।

কী দিয়ে হবে স্টাফিং। না মাছ আছে, না কিমা।

হবে আন্ডা দিয়ে। ডিমের ডেভিল খেয়েছিস তো? আজকে আমার ডিরেকশানে ডিম দিয়ে স্টাফড টোম্যাটো খেয়ে দেখিস। ফ্রিজে টক দই ছিল রায়তা বানাতে বলেছি। আর ক্যারামেল কাস্টার্ড–সুইড ডিশ।

সুইট ডিশ বলতে কি তুই একমাত্র ক্যারামেল কাস্টার্ডই জানিস?

হুঁ। একে মায় রাঁধে না তপ্ত আর পান্তা।

ভটকাই বলল। তারপর বলল, তা কেন। সঞ্জীবকাকুর সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। কাল চন্দ্রপুর থেকে মাটন আসবে, কলা ও অন্যান্য ফল, মুরগি, যথেষ্ট পরিমাণ আন্ডা এবং বাসমতি চাল। কাল তোদের দুপুরে পোলাও আর পাঁঠার মাংস খাওয়াব। আফটার লাঞ্চ সুইট ডিশ কালাকাঁদ। রাতে মুরগির রোস্ট, টোস্ট, আর সুইট ডিশ হবে ব্যানানা ফ্রিটারস। কানু ছাড়া যেমন গীত নাই আমি ছাড়াও তোদের গতি নাই।

অন্ধকার হয়ে গেছিল।

আমরা বাংলোর দিকে ফিরে যাচ্ছিলাম। জিপটা, আগেই বলেছি, পেছনে পেছনে আসছিল। হঠাৎই পথের ডানদিকে হাজার হাজার জোনাকি জ্বলে উঠল একসঙ্গে। চিতল হরিণের ঝক, মানে, তাদের চোখে গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়ল, তাই। হেড লাইটের আলোতে তাদের চোখগুলি সত্যিই জোনাকিরই মতো ঝিকমিকিয়ে উঠল।

বাঃ! মনটা ভরে গেল।

তিতির স্বগতোক্তি করল।

আন্ধারী নদীটা কোথায়? টাইগার প্রিসার্ভের নাম যে আন্ধারী-তাড়োবা। আর কোনও নদীই তো দেখলাম না! তাড়োবা হ্রদ ঠিক আছে, কিন্তু নদীও তো দেখা চাই। আমি বললাম।

কাল সকালে মোহাৰ্লি দেখে ফেরার সময় দেখাব। আসলে আন্ধারী ওই পুরা প্রিসার্ভ-এর মধ্যে দিয়েই বয়ে গেছে। ফরেস্টার সাহেবকে বলে দিলে তিনি গার্ডকে বলে দেবেন আমাদের দেখাতে। না বললেও হয়। উনি তো জিপে থাকবেনই। দিনের আলোতে ভাল করে দেখা যাবে।

তিতির বলল, এত বড় যে তাড়োবা হ্রদ তাতে পরিযায়ী পাখিরা আসেনি কেন। শীত তো এখনও আছে একটু একটু। সবে জানুয়ারির শেষ।

ঠিক বলতে পারব না। ঋজুদা বলল।

আসবে কী করে? কুমিররা ঠ্যাং ধরে জলের গভীরে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলবে না।

বলেই ভটকাই বলল, একটা গল্প শুনবে ঋজুদা?

কী গল্প?

কুমিরের।

বল।

একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য বড়লোক তার ছেলেকে মানুষ করার জন্যে একজন মাস্টারমশাই রেখেছেন। তা মাস্টারমশাই রোজই আসেন, পড়ান পৌনে এক ঘণ্টা এক ঘণ্টা। এদিকে বছর শেষের স্কুলের পরীক্ষাতে ছাত্র ঢ্যাঁঢ়ল।

ঢ্যাঁঢ়াল মানে কী? ঋজুদা বলল।

আঃ। তোমার বাংলা ভোকাবলরি বড় পুওর। ভটকাই বলল, ঋজুদাকে।

আমি বললাম, তাঁঢ়াল মানে ফেল করল।

অ।

পাইপ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে বলল ঋজুদা।

তারপর বলল। তিতির বলল।

তারপর মাস্টারমশাইকে তলব করলেন ছেলের বাবা। তাকে ভাল করে মিষ্টি-টিষ্টি খাইয়ে বললেন, এটা কী হল মাস্টের? এতই যদি পড়ালে পেটালে তো ছেলে আমার এমন সব নম্বর পেল কেন? এ জন্যেই কি আর পেরাইভেট মাস্টের রেখেছিলাম? সরকার যে প্রাইভেট টুশান বন্দ করার কতা বইলতেছেন ভালই কইরতেছেন।

মাস্টারমশাই বললেন, আমার কথাটা শুনুন স্যার। মানে, ব্যথাটা।

কী কথা আর ব্যথা, বলুন।

আমি তো চাদু খোকাকে সবই পড়িয়েছিলাম। কিন্তু একটা কুমির…

কুমির? তুমি বলছ কী মাস্টের। এ মদ্দি কুমির এল কোথ্বিকি?

এল কোথ্বিকি সে কথা তো আমিও ভেবে পাই নাই স্যার কিন্তু কুমির এয়েছে। বিলক্ষণ এয়েছে।

মাস্টারমশাই কঁদো কাঁদো মুখে বললেন।

আমি তো তোমার কথা কিছুই বুঝতিচিনা মাস্টের।

তখন মাস্টারমশাই বললেন, আচ্ছা আপনের সামনেই আমি চাঁদু খোকাকে কোশ্চেন করতিচি, আপনি দেইকে নেন কুমিরের মাহাত্ম্য।

করো তোমার কোশ্চেন।

মাস্টারমশাই বললেন, অ চাঁদু-খোকা, তুমি গোরু সম্বন্ধে কী পড়েছ তোমার বাবাকে শোনাও দিকি, আমাকেও শোনাও।

চাদু খোকা দুচোখ বড় বড় করে বলল, ও গলু? গলু মাত্তামতাই?

হ্যাঁ বাবা গোরু।

গলু অতি উপকারি দস্তু। গলু আমাদের দুধ দেয়। গলুর তামলা দিয়ে ঢাক হয়, ঢোল হয়, খোল হয়, আমাদের দুতো হয়, গলুর থিং দিয়ে নানালকম জিনিস তৈরি হয়।

তারপর?

একদিন হয়েছে কি মাত্তামতাই, গসুটা না মাঠে তলতিল, তলতে তলতে নদীল এক্কেবারে পাথে তলে গেথে, নদীল কুবই কাথে আর অমনি একতা কুমিল দল থেকে উটে গলুটার পা কামলে দলে তাকে নদীতে, মানে নদীর গবিলে নিয়ে তলে গেল।

মাস্টারমশাই বললেন, দেখুন তো স্যার। গোরু সম্বন্ধে আরও কত পড়িয়েছিলাম কিন্তু গোরুকে যদি কুমিরেই ধরে জলের তলে নিয়ে যায় তাহলে নম্বর দেবেন কী করে স্কুলের মাস্টারমশাইরা।

চাঁদুবাবার বাবা বলেন, আরও প্রশ্ন করুন তো দেখি। ইত বড় পোবলেম দেকতিচি।

মাস্টার বললেন, পোবলেম বলে পোবলেম।

তারপর বললেন, চাঁদুবাবা তুমি রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে কী জানো বলো তো দিকি।

ও লবীন্দনাথ? লবীন্দ্রনাথ ঠাকুল খু্ব বড় কবি তিলেন। তিনি নোবেল পেরাইজ পেয়ে তিলেন। তিনি গীতাঞ্জলী লিকেতিলেন, আড়াই হাদার গান লিকেতিলেন, তাঁর বড় বড় দাড়ি থিল, তিনি দমিদার থিলেন।

বাঃ। তারপর?

তাপ্পর তিনি তো জমিদার থিলেন। শিলাদহে তাঁর দমিদারি ধিল। পদ্মা নামের তাঁর একটা লৌকা থিল। সেই পদ্মাতে বথে তিনি অনেক কবিতা লিখতেন। পদ্মা নদীর উপলে ভাসতে ভাসতে…

বাঃ। তারপর?

তাপ্পর একদিন তিনি পদ্ম নৌকা থেকে নেমে পদ্মা নদীর চরে নেমে আলখাল্লা গায়ে দিয়ে পায়তালি করতিলেন…

তারপর?

করতিলেন, পায়তালি করতিলেন, এমন সময় মাত্তামতাই একতা মত্ত কুমির এতে তাঁর পা কামলে ধলে নিয়ে নদীর মধ্যে নিয়ে গেল…

মাস্টার কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, দেখলেন স্যার। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আরও কত কী পড়িয়েছিলাম, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি, অবন ঠাকুর, গগন ঠাকুর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাদম্বরী দেবী, শান্তিনিকেতন, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী আর একটা হতভাগা কুমির এসে…

চাঁদু খোকার বাবা খুবই চিন্তান্বিত হয়ে বললেন এ তো সত্যিই ভারী পোবলেম দেকতিচি। তারপর একটু ভেবে বললেন, আচ্ছা, কুমিরে ধরতে না পারে এমন কিছু পড়াননি ছেলেকে আপনি?

হ্যাঁ তাও পড়িয়েছি।

বলেই বললেন, আচ্ছা চাঁদু খোকা, তুমি এরোপ্লেন সম্বন্ধে কী জানো বলল তো?

বাবা বললেন, এইবারে কুমির জব্দ, এইবারে হারামজাদা কুমির কী করে দেখি।

বলব মাত্তামতাই?

হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা বলল।

এলোপ্লেন আকাশে ওলে। তার দুতো ডানা থাকে। আকাথের অনেক উপল দিয়ে উলে যায় এলোপ্লেন। লাতেল বেলা তাল অনেক দানালা দিয়ে আলো দেকা দায়। অনেক লোক বথে থাকে দালানার পাথে।

তারপর? তাপ্পরে প্লেনটা অনেক উঁচু দিয়ে উলতে উলতে দাত্তে অনেক দুলের দেশে, এমন সময় ইঞ্জিনে গ-গোল হয়ে প্লেনটা একটা মত্ত নদীর মদ্দে এতে পড়ল আর…

আর কী?

আল কী? এত্তা কুমিল, দুতো কুমিল, তিনতে কুমিল, তারতে কুমিল অনেক কুমিল এসে সব লোকদের কেয়ে ফেলল…

ভটকাই-এর গল্প শেষ হবার অনেক আগে থেকেই আমরা খকখক করে হাসছিলাম। এরোপ্লেনেরও এই অবস্থা হল দেখে আর হাসি চাপতে না পেরে সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। আর আমরা যখন হাসছি তখন ভটকাই গম্ভীর।

হাসি থামলে তিতির বলল, তুমি একটি এক নম্বরের বাফুন হয়েছ।

ঋজুদা বলল, যাই বলিস তোরা, তাই বলিস, ভটকাই সঙ্গে না থাকলে ব্যাপারটা ঠিক জমে না আজকাল। ও রীতিমতো ইনডিসপেনসিবল হয়ে উঠেছে।

ভটকাই একবার আমার আর তিতিরের দিকে অপাঙ্গে চেয়ে সিরিয়াস মুখ করে ডানদিকের জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।

একটু পরই ভি. আই. পি. গেস্ট হাউসের আলো দেখা গেল জঙ্গলের ফাঁকে, ফাঁকে। ওখানে প্রদীপকাকুরাও নামবেন এখন। তারপর চা-টা খেয়ে, পরে গল্প-টল্প করে একেবারে ডিনার খেয়ে কাছেই অন্য বাংলোতে শুতে যাবেন। এই বাংলোটা সত্যিই দারুণ। এয়ারকন্ডিশানার আছে, রুম হিটার আছে, ডাইনিং ড্রয়িং রুম, বিরাট বিরাট বাথরুম, সঙ্গে ড্রেসিং রুম। এলাহি ব্যাপার। সামনে লন। লন আর বারান্দাতে বসে তাড়োবা হ্রদ দেখা যায়।

গাড়ি থেকে নেমেই ঋজুদা বলল, প্রদীপ দেখো তো বাঘিনী আর তার তিন বাচ্চার ভিডিও ফিল্মটা কার হেপাজতে আছে।

ফরেস্টার সাহেব নিজেও নামলেন ওঁদের সঙ্গে। বললেন, সকলে ড্রইংরুমে আসুন। টি. ভি.-টা আর ভি. সি. পি. তো ড্রয়িংরুমেই আছে। ওখানে বসেই দেখব সকলে।

তারপর বললেন, বেয়ারা, বারান্দাসে কুর্সি অন্দর করো। সোফা যে কটা আছে। তাতে এতজন আঁটবে না।

চা খেতে খেতে অনেকক্ষণ ধরে আমরা ভিডিও ফিল্মটা দেখলাম, তিনটি বাচ্চা নিয়ে বাঘিনী মোহার্লির পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছে। কোনও বাচ্চা পেছিয়ে পড়ছে বা এদিক ওদিক চলে যাচ্ছে, তাকে গুঁক করে অস্ফুট আওয়াজ করে বকে দিচ্ছে মা।

বাঘিনীর চেহারা বেশ রোগা-সোগা। চারজনের খাবার জোটাতে হচ্ছে তো। তাদের খাবার তো ডাইনিং রুমে সার্ভড হয় না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অনেক পরিশ্রম, অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়ার পরই শিকার জোটে তাদের কপালে। রীতিমতো মেহনত করতে হয় তাদের। সেদিক দিয়ে ভাবলে দুনিয়ার সকলেই ‘মেহনতি মজদুর’। যেসব মেহনতি মজদুর ভাবেন যে তাঁদের মালিকেরা সবাই পায়ের উপরে পা তুলে খান তারা ঠিক জানেন না। মেহনত মালিককেও কম করতে হয় না, ঝক্কি কম পোয়াতে হয় না, তবে তাদের মেহনতির রকমটা আলাদা। মজদুরের মেহনতিটা সাদা চোখে সহজে দৃশ্যমান কিন্তু মালিকের মেহনতিটা সহজে দৃশ্যমান নয়। তার চিন্তা ভাবনা, হাইপারটেনশান, এত মানুষের দায়িত্ব নেবার দুশ্চিন্তা এবং অবশ্যই মুনাফা করার দুশ্চিন্তাও তাকে সবসময়েই ভাবিত করে রাখে।

বাচ্চাগুলোর বয়স তিন-চার মাস হবে। এখনও অনেকদিন তাদের শিক্ষানবিশি করতে হবে তাদের মায়ের পায়ে পায়ে ঘুরে, তারপর একা একা শিকার ধরতে শিখতে হবে। সেইসব নতুন অনভিজ্ঞতার দিনে তাদের বোকাও বনতে হবে কম নয়, নিজেদের নির্বুদ্ধিতার লজ্জাতে নিজেদেরও লজ্জিত হতে হবে। ময়ুর, বাঁদর এসব ধরতেও যে মুনশিয়ানা লাগে, ক্ষিপ্রতা লাগে, এবং ইংরাজিতে যাকে বলে স্ট্র্যাটেজি, লাগে তা তাদের প্রত্যেককে শিখতে হবে। তার উপরে আছে মানুষ নামক শত্রুর লীলাখেলা। মানুষের ভয় এই অভয়ারণ্যর মধ্যে কম কিন্তু ওইসব অভয়ারণ্যর বাইরে যেসব বাঘ থাকে বা আগে থাকত তাদের বিপদের লেখাজোখা নেই ও ছিল না। বাঘের মতো সৎসাহসী মাথা উঁচু ভদ্রলোক খুব কমই আছে। সৎসাহসী মাত্রই সরল। তাই তারা সহজে মরে, তা সে বাঘই হোক, কী মানুষ। যেসব বাঘ মানুষখেকো হয়ে যায় তাদের কথা আলাদা কিন্তু সে তো মানুষের মধ্যেও যারা মানুষখেকো তাদের কথাও আলাদা। সাধারণভাবে বিচার করলে একজন মানুষের তুলনায় একজন বাঘ অনেক বোকা, ভাল এবং সরল যে, যাঁরাই বাঘের সঙ্গে ওঠাবসা করছেন তারাই জানেন। কোনও বাঘকে মারতে যে কোনও ভাল মানুষেরই খুব কষ্ট হয়। আর এক ধরনের শিকারি আছেন বা ছিলেন যারা বাঘ মেরে বাঘের গায়ের উপরে পা রেখে বন্দুক রাইফেল হাতে ছবি তোলাতেন। তাঁদের দেখে লজ্জা হয় আমার। বাঘ মেরে বাঘকে প্রণাম করা উচিত। অমন একটি প্রাণ নিধন করার অপরাধ ক্ষমা করার প্রার্থনা করা উচিত।

ওধরনের শিকারিরা এক গভীর হীনম্মন্যতাতে ভোগেন, এঁদেরই জ্ঞাতিগুষ্ঠিরা চিড়িয়াখানার গরাদে বন্দি বাঘকে ছাতার খোঁচা দেন, চিনাবাদাম ছুঁড়ে মারেন, শ্যালিকার কাছে নায়ক হবার জন্যে। তাদের মতো এমন নীচ ও কাপুরুষ জানোয়ার পৃথিবীর কোনও জঙ্গলের কোনও জানোয়ারই নয়।

ফিল্মটা বার বার রিওয়াইন্ড করে ঘুরিয়ে দেখার পর প্রদীপকাকুরা বললেন ঋজুদাকে, এবারে সেই কানা বাঘের গল্পটা হোক।

ফরেস্টার সাহেবও এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। যে সময়ের ঘটনা সে সময়ে অবশ্য তিনি রায়পুরের কাছের এক গ্রামের বাড়িতে হামাগুড়ি দেন। তার বহু বহু বছর পরেই বনবিভাগে ঢুকেছেন।

ঋজুদা বলল, সে গল্পের জন্যে তোমাদের একটি সন্ধে পুরো দিতে হবে অত অল্প সময়ে তা বলা যাবে না।

ওঁরা সকলেই বললেন, তাহলে শুভস্য শীঘ্রম। আমরা তো পরশু সকালে ব্রেকফাস্টের পর ফিরেই যাব নাগপুরে, তাহলে কাল সন্ধেবেলা জঙ্গল থেকে ঘুরে এসেই হোক।

ঋজুদা বলল, ঠিক আছে।

ভটকাই বলল, তাহলে কাল রাতের মেনুটা এইরকম করা যাক। ভুনি খিচুড়ি, ভাজা মুগ ডালের, মধ্যে কিসমিস, বাদাম এসব দিয়ে। খুব করে লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে পেঁয়াজি, ব্যাসন দিয়ে কড়া করে বেগুনি আর কঁচা লঙ্কা ভাজা, আর সঙ্গে মুরগি ভাজা।

তাপসকাকু চশমার আড়াল থেকে চোখ তুলে বললেন, আর সুইট ডিশ।

সুইট ডিশ হবে মালপো।

মালপোয়া এখানে কে বানাবে।

আমি বানাব। সদর্পে বলল, ভটকাই। এমন করে বলল, যেন মানুষখেকো বাঘই মারবে বলে হলপ করেছে।

তারপর বলল, দুপুরে আমি বন্দোবস্ত করে রাখব। সঞ্জীবকাকুকে শুধু বলবেন চন্দ্রপুর থেকে কেজি ছয়েক চিনি এনে দেবেন আমাকে একস্ট্রা আর পাঁচশো গ্রাম সুজি।

অত কী হবে। তিতির বলল।

আহা! বাবুর্চিখানার সৈন্যদল, ফরেস্টার সায়েব, গার্ডেরা কি বাদ পড়বেন মাস্টার ভটকাই-এর রান্না করা মালপো থেকে? কথাই বলে মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ। আমি বললাম।

আমরা কি সব ইতর জন? ভটকাই বলল।

আমি জিভ কাটলাম।

.

০৪.

যখন আমরা বেড-টি খেয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম তখন সবে পুবের আকাশে সালের ছোপ লেগেছে। আমরা আমাদের কালিস গাড়িতে উঠতে না উঠতে প্রদীপকাকুদের নিয়ে ও ফরেস্টার সাহেবকে নিয়ে জিপটাও এসে গেল। ফরেস্ট গার্ড মহেন্দ্র সিং বিযেন আমাদের পেছনে উঠে বসতেই গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট করল মামাজি।

ঋজুদা বলল, এখন ধুলো নেই। তা ছাড়া ধুলো থাকলেও জঙ্গলের মধ্যে গাড়ির কাঁচ কেউ নামাবি না। এসিও চলবে না। জঙ্গলে এসে যদি জঙ্গলের শব্দ ও গন্ধই না পাওয়া গেল তাহলে না আসাই ভাল।

আট দশ মিনিট আমরা গেছি, পেছনে জিপে প্ৰদীপকাকু, তাপসকাকু সঞ্জীবকাকুরা আসছেন। ঋজুদা গাড়ির সামনের সিটে এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা পাইপের গোল্ডক তামাকের সুগন্ধে ভরে গেল। যেন আনন্দে ভরে গেল। ঋজুদা কোনও বাড়িতে ঢুকলে বা ঘরে ঢুকলেও এমনই হয়। কিছু একটা আছে মানুষটার মধ্যে যা আনন্দ আর মজা বিকিরণ করে। সমস্ত পরিবেশকে জীবন্ত, আনন্দময় করে তোলে।

গাড়িটা বাঁদিকে একটা বাঁক নিতেই ভটকাই চেঁচিয়ে উঠল, রোক্কিয়ে মামাজি, রোক্কিয়ে।

কী হল তা বোঝার আগেই ভটকাই চেঁচিয়ে বলল, ওয়াইল্ড বাফেলো। বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি, একদল ভারতীয় বাইসন বা গাউর ডানদিকের বাঁশঝাড়ে চরাবরা করতে করতে কচি বাঁশ পাতা খাচ্ছে। প্রায় দশ বারোটা হবে। তার মধ্যে প্রকাণ্ড বড় মাপেরও আছে দু-তিনটে।

ঋজুদা বিরক্ত গলাতে ভটকাইকে বলল, জঙ্গলে অমন হঠাৎ চেঁচাবি না। তিতির বলল, মিস্টার ভটকাই, এগুলো বুনো মোষ নয়, এগুলো গাউর বা ভারতীয় বাইসন। আমেরিকান বাইসনেরা এদের কাছে শিশু, অনেকই ছোট।

আমি বললাম, দেখছিস না এদের পায়ে সাদা লোমের মোজা পরানো আছে, কপালেও সাদা লোমের ইলিবিলি। আমেরিকান বাইসনদের রং বাদামি হয়। আমাদের বাইসনদের রংও অনেক সময়ে বাদামি হয় যখন তারা খুব বুড় হয়ে যায়। এমনিতে রং একেবারে জেল্লাদার কালো।

ঋজুদা বলল, বুড়ো হয়ে গেলে চিতল বা শম্বরও অমন বাদামি হয়ে যায়।

তারপর বলল, ভাল করে দ্যাখ ভটকাই। তারপর অবাক হয়ে স্বগতোক্তি করল, এখন পর্যন্ত ভটকাই গাউর দেখেনি এতদিন আমাদের সঙ্গে ঘুরেও। কীরকম চেলা তৈরি করলি রুদ্র তুই!

মামাজি গাড়ি দাঁড় করিয়েই রেখেছিলেন।

আমি বললাম, ও আমার চেলা? ভালই বলেছ। হিন্দিতে একটা কথা আছে না, মুলিমালোঁয়ার বিষেনবাবু বলতেন, গুরু গুড়, চেলা চিনি। তাই।

তারপরে ঋজুদা বলল, আসলে বনের গাছপালা এবং বনের আবহাওয়া অনুযায়ী জানোয়ারদের গায়ের রং পালটে যায়, পরিবেশের সঙ্গে যাতে মিশে যেতে পারে সে জন্যেও রঙের তারতম্য ঘটে তা সেই প্রাণী তৃণভোজীই হোক কি মাংসাশী। সুন্দরবনের বাঘ বা হরিণের চেহারা ও গায়ের রঙের সঙ্গে বিহার বা মধ্যপ্রদেশ বা আসাম বা রাজস্থানের বন্য প্রাণীদের চেহারা ও গায়ের রঙের কোনওই মিল নেই। তা ছাড়া, শীত যেখানে বেশি, সেখানের জানোয়ারদের গায়ে বড় বড় লোম হয়, যেমন রাজস্থানের আলোয়ারের সারিসকাতে।

আমি বললাম, তুমি কিন্তু আমাদের সারিসকাতেও নিয়ে যাওনি কখনও ঋজুদা।

ঋজুদা বলল, নিয়ে যাব একবার। আলোয়ারের রাজার শুটিং প্রিসার্ভ ছিল আগে যে জঙ্গলে সেই জঙ্গলেই এখন সারিসকা টাইগার রিসার্ভ হয়ে গেছে। রাজার শুটিং লজটি এখন একটি হোটেল হয়ে গেছে। দারুণ তার স্থাপত্য। অনেকখানি জায়গা নিয়ে ছড়ানো, একতলা। সেই হোটেলের বারান্দাতে বসে সোজা দেখা যায় যোধপুরের লাল পাথরে তৈরি মস্ত উঁচু ফটক। সেই ফটক পেরিয়েই মহারাজা ও তাঁর ইয়ার-দোস্তরা শিকারে যেতেন। তবে কংক্রিটের টাওয়ার, যাতে বসে বাঘ মারা হত, সেটা শুটিং লজ-এর ডানদিকে, একটি নদীর ধারে, পিচ রাস্তারও ডানদিকে। যখন যাবি, দেখাব। সাধারণ ট্যুরিস্টরা তার খোঁজ জানে না।

এত কথাবার্তাতেও ভটকাই যে বাইসনকে মোষ বলে ফেলে বেইজ্জত হয়েছিল সেটা ভোলেনি। হারবার বা দমবার পাত্র সে একেবারেই নয়। আমাদের ভটকাইচন্দ্রর এটি একটা বিশেষ গুণ।

সে হঠাৎ বলল, তোরা কেউ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক পড়েছিস?

তিতির বলল, যে না পড়েছে সে বাঙালিই নয়, এবং শিক্ষিত তো নয়ই।

তবে তো পড়েইছ। সেখানে বন্য মহিষদের দেবতা যে টাড়বারো’ তার কথাও নিশ্চয়ই পড়েছ?

পড়েছিই তো। আমি বললাম, তারপর বললাম, হঠাৎ এ কথা?

না। মনে পড়ে গেল হঠাৎ তাই-ই বললাম।

তিতির বলল, তুমি অ্যালগারনান ব্লাকউড-এর কোনও বই পড়েছ?

আঃ। বোরা বড় বাক্যবাগীশ হয়েছিস। দুদিকের জঙ্গল দ্যাখ, যা দেখতে এসেছিস। এই সময়ে আর সন্ধেবেলায়ই তো জানোয়ার দেখার মাহেন্দ্রক্ষণ।

আসলে, ঋজুদা ভটকাইকে বাঁচানোর জন্যেই এমন করল। বুঝলাম আমরা। আমরা ঋজু বোস না হতে পারি কিন্তু তার দৌলতে কম বন-জঙ্গল তো ঘুরলাম না এ পর্যন্ত! একেবারেই কিছু জানি না এমন তো নয়। ভটকাই তো দলে ভিড়ল মাত্র সেদিন, আমিই খাল কেটে কুমির আনলাম আর সেই এমন ভাব করে মাঝে মাঝে সে বলার নয়। দুদিনের বৈরাগী ভাতকে বলে অন্ন।

পনেরো মিনিট পরেই বাঁদিকে একদল ঢোল দেখা গেল। একটা পেল্লায় বড় দাতাল শুয়োরকে তারা কবজা করার চেষ্টা করছিল। এগোচ্ছিল, পেছোচ্ছিল, কেউ কেউ লাফ দিয়ে তার ঘাড়ে আর পেটে পিঠে কামড় বসাবার চেষ্টা করছিল। মুখ দিয়ে আমাদের পোষা কুকুরদেরই মতো এক ধরনের কুঁই কুঁই আওয়াজ করছিল। কিন্তু সে বন্য বরাহ তো নয়, রীতিমতো বরাহ অবতার। যেমন তার ভীষণ চেহারা তেমনই তার গায়ের জোর। পিঠের উপরে শিরদাঁড়া বরাবর কালো লোমের গোছ খাড়া হয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই শুয়োর বুনো কুকুরদের স্তম্ভিত করে তাদের ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এবং আমাদেরও হতবাক করে দিয়ে ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে বনের গভীরে অন্তর্হিত হয়ে গেল। ঢোলেরা কিছুক্ষণ ভ্যাবা গঙ্গারাম হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ভটকাই স্বগতোক্তি করল, পিঠ তো নয়, ইংল্যান্ডের বেকহ্যামের মাথা।

আমরা হেসে উঠলাম, ওই টেনশানের মধ্যেও।

বুনো কুকুরদেরও আত্মসম্মান আছে, যা অনেক মানুষের নেই। একবারের সম্মিলিত চেষ্টাতেও যখন ওরা ব্যর্থ হল তখন সেই শুয়োরের পেছনে ওরা আর দৌড়ল না। বনের আইনে সেই বিরাট বরাহর আয়ু দীর্ঘায়িত হল। কোনওদিন সে হয়তো কোনও বাঘ বা চিতা বা ভাল্লুকের সঙ্গে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হয়ে ওই বনের কোনও গভীর অন্ধকার রাতে অথবা রূপ-রস-গন্ধ-শব্দে ভরা কোনও আলোকোজ্জ্বল সকালে সম্মানজনক মৃত্যু বরণ করবে কিন্তু জীবন্ত অবস্থায় তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ খুবলে খুবলে খাবে বুনো কুকুরেরা এমন নারকীয় মৃত্যুর হাত থেকে সে আপাতত বাঁচল। তবে এ যাত্রা বেঁচে সে গেল বটে তার সর্বাঙ্গ কুকুরদের সঁতে নখে ফালা ফালা হয়ে গেছিল নিশ্চয়ই।

আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়েই ছিল। হঠাৎ দেখি পেছনের জিপ থেকে নেমে পড়ে সঞ্জীবকাকু টেলিফটো ফিল্ম দিয়ে ঢোলগুলোর ছবি তুলছেন নানাভাবে। সোজা, দাঁড়িয়ে, মাটিতে বসে, কেতরে, পথের উপরে শুয়ে।

তিতির বলল, ধরে ফেলল বলে ঢোলেরা। একেবারে ধরলে হাত পা ধড় মুণ্ডু নিমেষে আলাদা করে দেবে তা কি উনি জানেন না।

ঋজুদা বলল, খবরের কাগজের লোকদের বুনো কুকুরেরাও এড়িয়ে চলে। ওরা জানে যে সাংবাদিক ও ‘পাপারাৎজি’-দের কোনওক্রমে খেতে পারলেও, খেলেও, হজম কিছুতেই করতে পারবে না। ঢোলদের পেছন দিয়ে ফিল্মের নিউজপ্রিন্ট বা নেগেটিভ বেরোতে আরম্ভ করবে হয়তো।

তবুও, নামা উচিত হয়নি। আমি বললাম।

মুখে তো চেঁচিয়ে ওকে বারণও করতে পারছি না। বনের মধ্যে যে চেঁচামেচি করা বারণ।

ঋজুদা বলল, একবার পালামৌর বেতলার টুরিস্ট লজ-এর পেছনের ঘরের লাগোয়া বারান্দাতে বসে সকালে চা খাচ্ছি। ডিসেম্বর মাস। আর বারান্দাটা পশ্চিমমুখো। রোদ আসে না। তিন চার কাপ চা খেয়েও গা গরম হচ্ছে না। এমন সময়ে হঠাৎই গা গরম হয়ে গেল। দেখি, একটা বিরাট শিঙাল চিতল হরিণকে তাড়া করে নিয়ে আসছে একদল ঢোল। হরিণটা বাংলোর দিকে দৌড়ে আসছিল এই ভেবে যে মানুষের কাছে এসে পৌঁছতে পারলে ঢোলেরা হয়তো ভয় পেয়ে তাকে নিষ্কৃতি দেবে। কিন্তু কথায় বলে না, লজ্জা মান ভয় তিন থাকতে নয়। ঢোলেদের হচ্ছে তাই-ই। আমি যেখানে বসেছিলাম সেই বারান্দা থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে হরিণটাকে ধরে ফেলল ওরা, মানে, শিঙাল হরিণটা মুখ থুবড়ে পড়ে গেল মহুয়া গাছতলায়। তারপর মাত্র পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে তারা তাদের কাজ শেষ করে কুঁই কুঁই করে ডাকতে ডাকতে ফিরে গেল অন্য শিকারের খোঁজে। শিঙালের কঙ্কালটা আর বিরাট শিংটা পড়ে রইল শুধু। ওদের খিদে ব্ল্যাস্ট ফারনেসের মতো। একবার তা জ্বললে কখনই নেভে না মৃত্যুর আগে। শকুন বা কাক যে কিছু খাবে এমন অবশিষ্টও রইল না কিছু, মাংস ও চামড়ার।

ভটকাই বলল, তুমি চেঁচালে না? বন্দুক রাইফেল ন্যাশনাল পার্ক এর মধ্যে–হয় নাই ছিল, পিস্তল তো ছিলই, গুলি করলে না একটাও?

কেন?

একে বলে Balance of Nature। খাদ্য ও খাদক দুই-ই ঈশ্বরের সৃষ্টি। হরিণ ঘাস খায়। পাতা খায়। মহুয়া এবং অন্যান্য নানা গাছের ফুল ফল খায়, সেই ঘাসপাতা ফুল ফলবাহী গাছেদেরও তো প্রাণ আছে। না কি? আর হরিণকে খায় বাঘ, চিতা এবং ঢোল। মানুষ যখন হরিণ মেরে খায় সেটা স্বাভাবিকতা নয়, কিন্তু বাঘ চিতা বা ঢোল যখন হরিণ মারে তখন সেটা পরম স্বাভাবিকতা। প্রকৃতির মধ্যে অগণ্য খাদ্য ও খাদকের যে সহাবস্থান এবং ভারসাম্য আছে তাকে নষ্ট বা ভ্রষ্ট করার অধিকার আমাদের কারওরই নেই। বাঘ বা চিতা যখন হরিণ শম্বর খায়, ডোল যখন কোনও প্রাণীকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায় তখন সেটা স্বাভাবিকতা কিন্তু বাঘ চিতা যখন মানুষ ধরে খায় তখন সেটা অস্বাভাবিকতা। অস্বাভাবিক কাজ করেছে। বলেই মানুষখেকো বাঘ বা চিতাকে আমরা মারতে বাধ্য হই।

তা তো হও। কিন্তু সঞ্জীবকাকুকেই যদি ঢোলে খেয়ে ফেলে অস্বাভাবিকতার চরম করে আমাদের নানা পোজ-এর ছবি তুলবে কে? তিতির বলল।

ঋজুদা হেসে বলল, খাবে না।

কী করে জানছ। তিতির বলল।

তুমি এত শিওর কী করে হলে? আমি জিগগেস করলাম।

ঋজুদা বলল, সংস্কার। সুন্দরবনে অস্বাভাবিকতার চরম করে তা প্রায়। স্বাভাবিকতাতেই পর্যবসিত করে বাঘে আকছার মানুষ ধরছে, মধু পাড়তে যাওয়া, কাঠ কাটতে যাওয়া, মাছ ধরতে যাওয়া মানুষকে ধরছে সকলের সামনেই। নোঙর করা জলি বোট থেকে, বড় মহাজনী নৌকা এবং ডিঙি থেকেও মানুষকে ধরে আনছে তারা বহুযুগ হল কিন্তু আজ অবধি কোনও মোটর বোট থেকে মানুষ ধরেনি একটিও।

সত্যি? একটিও না?

না।

কারণ?

কারণ, এটা সুন্দরবনের বাঘেদের সংস্কার। হয়তো মোটর বোটেও আগেকার দিনে আগ্নেয়াস্ত্র থাকত যে সে কথা তারা জানে বলেই ধরে না। কেন যে ধরে না তা কেউই জানে না। কিন্তু ধরে না। এ এক অসীম রহস্য তেমনই আজ অবধি। কোনও ঢোল কোনও মানুষের কোনও ক্ষতি করেনি।

তিতির বলল, পড়েছি, রাশিয়াতে নেকড়েরা মানুষ খায়।

রাশিয়াতে নেকড়েরা দলবদ্ধ হয়ে মানুষ তো বটেই ঘোড়াগাড়ির ঘোড়াকে পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছে বলে পড়েছি কিন্তু আমাদের নেকড়েরা কখনও-সখনও ছোট ছেলেমেয়ে জঙ্গলের লাগোয়া গ্রাম থেকে নিয়ে গেলেও প্রাপ্তবয়স্ক কোনও মানুষকে কোনওদিনও আক্রমণ করেনি। তবে আমাদের নেকড়েরা দলেও থাকে না।

তবে?

জোড়ায় থাকে।

তারপর বলল, ভারতের কোনও রাজ্যেই কিন্তু ঢোলেরা মানুষকে আক্রমণ করেনি, তাই সঞ্জীব গাঙ্গুলি পুরোপুরি নিরাপদ। তাদের কোনও চিন্তা নেই।

ফরেস্ট গার্ড মহেন্দ্র সিং বিষেন বলল, কাল যে বাঘিনী ও বাচ্চাগুলোর ছবি দেখলেন তারা গত বছর এই ব্লক-এই ছিল। এখন পশ্চিম দিকে সরে গেছে।

কোনও গুহায় কি? তিতির শুধোল।

বিষেন বলল, কোনও গুহা তো আন্ধারী-তাড়োবার কোর এরিয়ার মধ্যে নেই। কোর এরিয়ার পুরোটাই সমান অঞ্চল। তবে বাইরে পাহাড় আছে রুখুসুখু অঞ্চল সেটা।

তিতির ঋজুদাকে জিগগেস করল, ব্লক কাকে বলে ঋজুদা?

বলছি। এই তাড়োবা ন্যাশনাল পার্ক-এর এলাকা হচ্ছে পাঁচশো আট বর্গ কিমি আর তাড়োবার টাইগার রিসার্ভ হচ্ছে একশো ষোলো কিমি, মানে তাড়োবা-আন্ধেরী অভয়ারণ্য। সবই তাড়োবা টাইগার রিসার্ভ-এর মধ্যে পড়ে। পুরো জঙ্গলটা একটা ডিভিশনের অন্তর্গত। সেই ডিভিশানে অনেকগুলো রেঞ্জ আছে। সব জঙ্গলেই থাকে। অল্প কিছুটা এলাকাকে বলে কম্পার্টমেন্ট। তিন চারটি কম্পার্টমেন্ট মিলিয়ে একটি বিট হয়।

বিট মানে?

মানে তো বললামই। বানান Beat। এসব ভাগাভাগি সেই সাহেবদের আমল থেকেই ভারতের সব বনেই হয়ে আসছে বনাঞ্চলের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ও দেখভাল-এর জন্য। এই এক একটি Beat একজন ফরেস্ট গার্ড-এর অধীন। আবার তিন-চারটি বিট নিয়ে Round হয়। সেই রাউন্ড থাকে একজন ফরেস্টারের অধীনে। তিন-চারটে রাউন্ড নিয়ে একটা Range হয়। Range থাকে একজন Ranger-এর অধীনে। এবং তিন চারটি Range নিয়ে একটি ডিভিশান হয়, যার উপরওয়ালা হন একজন ডিভিশানাল ফরেস্ট অফিসার বা ডি. এফ. ও.। কয়েকটা ডিভিশানের উপরওয়ালা হন একজন কনজার্ভেটর। আবার তিন-চারজন কনজার্ভেটরের উপরে থাকেন একজন চিফ কনজার্ভেটর। কয়েকজন চিফ কনজার্ভেটরের উপরে থাকেন প্রিন্সিপাল চিফ কনজার্ভেটর। তারও উপরে ফরেস্ট সেক্রেটারি। অনেক রাজ্যের বনের এলাকা যেখানে খুব বড়, যেমন ছত্রিশগড়, সেখানে আবার একাধিক ফরেস্ট সেক্রেটারি থাকেন। সেখানে তাদের উপরে থাকেন প্রিন্সিপাল ফরেস্ট সেক্রেটারি। তারও উপরে বনমন্ত্রী। যাকে বলে এম. আই. সি. অর্থাৎ মিনিস্টার ইন চার্জ। তার নীচে মিনিস্টার অফ স্টেট থাকতেও পারেন নাও থাকতে পারেন। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন নিয়ম। বুঝলে এবার।

রেঞ্জারদের এখন ডেপুটি কনজার্ভেটরও বলে। ভারত জুড়ে সব দপ্তরেই এখন পদমর্যাদাতে সকলেই এক ধাপ উপরে উঠতে চাইছেন যে এ তারই নজির।

বুঝলাম, কিন্তু তবে মাথা ধরে গেল।

সব গুলিয়েও গেল। তিতির বলল।

মাথা ধরে গেলেও এই অঙ্কটা জেনে রাখবি। এত বনে ঘুরে বেড়াস তোরা তাদের আর বনের অ্যাডমিনিস্ট্রেশান সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা না থাকাটা লজ্জার কথা।

এবারে দেখা গেল সঞ্জীবকাকু অবশেষে জিপে উঠেছেন এবং জিপ স্টার্ট নিল। তা দেখে মামাজিও স্টার্ট দিলেন।

এই দিকেই রামদেগি মন্দিরে যাবার পথ আছে। অনেকে ট্রেকিং করে যান। ফরেস্ট গার্ড বিষেন বলল।

ঋজুদা বলল, হ্যাঁ। আমি যেবারে জেঠুমনির সঙ্গে এসেছিলাম, রামদেগি মন্দিরে গেছিলাম হেঁটে। তোরা যেতে চাস তো যা।

এসেইছি তো মোটে আড়াইদিনের জন্যে। এর মধ্যে কি অত হয়। আমি বললাম।

তা অবশ্য ঠিক।

এ জঙ্গলে দেখছি শাল গাছই নেই। সেগুনই বেশি আর বাঁশ। একেবারে বংশীবদন নাম দিলেও ক্ষতি ছিল না। তিতির বলল।

ভটকাই বলল, খুব জুতসই হত নামটা।

ঋজুদা বলল, সেগুন ছাড়া এইন গাছ আছে, মধ্যপ্রদেশের নিজস্ব গাছ। আমাদের উত্তরবঙ্গ বক্সার জঙ্গলের নিজস্ব আকাতরু, লালি, দুধে লালি, চিকরাশির মতন। সেগুন আর এইন ছাড়াও এখানে আছে বিজা, ঢাওডা, হলুদ, সালাই, টেণ্ডু, কেন্দু, অর্জুন, জাম এবং মহুয়া। এইসব গাছ অন্যান্য রাজ্যের জঙ্গলেও দেখা যায়।

এই আইন না এইন বললে, এর সঙ্গে সুন্দরবনের বাইন গাছের নামের মিল আছে, তাই না।

ভটকাই বলল।

বাবাঃ। বেশ বলেছিস তো। তা তুই তো সুন্দরবনে যাসনি, তুই বাইন গাছের নাম জানলি কী করে?

বই পড়ে। শিবশঙ্কর মিত্রর সুন্দরবনের আজান সর্দার’ পড়েছি। ও বই পড়লেই সুন্দরবনের ওপরে থিওরিতে অন্তর অথরিটি হয়ে যাওয়া যায়।

এ যা পড়াশুনা শুরু করেছে ন্যাশানাল লাইব্রেরিও তো ফেল পড়বে রে রুদ্র। ঋজুদা বলল।

আমি বললাম, তাই তো দেখছি।

ড্রাইভার মামাজি হঠাৎ বললেন, দেখিয়ে, দেখিয়ে সাব। প্রথমে তার কথাটা বোঝা যায়নি কারণ মুখ ভর্তি গুটকা ছিল। সম্ভবত ভটকাই-এরই সাপ্লাই।

আমরা শুনলাম খেঁকিয়ে খেঁকিয়ে।

গাড়ি ততক্ষণে থেমে গেছে। সামনের বাঁকে পথের মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা চৌশিঙা হরিণ। যার ইংরেজি নাম Four-hom antelop, বড় শিঙাল। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রভাতী আগন্তুকদের দেখছে। তার উন্নত মাথাতে সকালের রাঙা রোদ পড়েছে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে আমাদের দিকে। আমরাও তাকে মুগ্ধ নয়নে দেখলাম। অনেকক্ষণ। যতক্ষণ সে দেখতে দিল আমাদের। তারপর একটি লাফ মেরে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গেল।

এখানে চৌশিঙা আছে কিন্তু বারাশিঙা নেই। বারাশিঙার জায়গা হচ্ছে মধ্যপ্রদেশের কানহা-কিসন্সি। বান্ধবগড়েও আছে। এই চৌশিঙা বারাশিঙা বা শম্বরদের মতো বিরাট নয় তবে ওরা অন্যরকম। আমাদের এই ভারতবর্ষে কতরকম হরিণ আর এন্টেলপই যে আছে। যদিও বৈচিত্রে তারা আফ্রিকার মতো নয়। তবু, চিঙ্কারা, কৃষ্ণসার, হগ ডিয়ার, সোয়াম্প ডিয়ার, বার্কিং ডিয়ার, মাউস ডিয়ার, মাস্ক ডিয়ার, পাহাড়ি ঘুরাল, আরও কতরকমের।

ঋজুদা বলল, এখন একটাও নাইজার দেখতে পাচ্ছিস না, লক্ষ করেছিস?

ওরা তো নিশাচর। তিতির বলল।

গত সন্ধেতে কেমন লাল লাল ভূতুড়ে চোখ নিয়ে পথের মধ্যে বসে ছিল আর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বসে থেকে একেবারে গাড়ির বনেট প্রায় ফুঁড়ে উড়ে যাচ্ছিল উপরে, মনে আছে?

মনে আবার নেই। তারাই তো জঙ্গলকে রহস্যময় করে তোলে। রাত যত গম্ভীর হয় ততই তাদের হরক বাড়ে তবে এখানে তো ভোর ছটা থেকে সন্ধে সাতটা অবধিই জঙ্গলে থাকা চলে। আমি বললাম।

তুই চাইলে, রাতেও আসতে পারিস। তুই হচ্ছিস গিয়ে চিফ কনজার্ভেটর সাহেবের অতিথি।

আমি হেসে বললাম, আমি না ছাই। পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী। আসল তো তুমি।

ভটকাই খুবই বিরল তারিফ জানাল আমাকে, বলল, জিতা রহো।

তিতির বলল, ঋজুকাকা গতকাল বিকেলে যে বিরাট তৃণভূমিতে আমরা হাজার হাজার চিতল হরিণ দেখেছিলাম সেটা কি স্বাভাবিক না বনবিভাগ তৈরি করেছে।

ঋজুদা বলল, বলতে পারিস মাঝামাঝি। এই তাড়োবা-আন্ধারী টাইগার প্রিসার্ভ-এর মধ্যে দুটো মস্ত গ্রাম ছিল এক সময়, যখন আমি কানা মানুষখেকোটা মারি সেই সময়েই ছিল। বনবিভাগ ওই দুটি গ্রামকে উচ্ছেদ করে গ্রামবাসীদের অন্যত্র নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়েছে।

তিতির বলল, মাধুকরী’ উপন্যাসের ঠুঠা বাইগার গ্রামেরই মতো, তাই না?

তাই। ঠুঠা বাইগার গ্রাম যেখানে ছিল সেখানে জঙ্গল এমন করে জমি জবরদখল করে নিয়েছিল যে সেই গ্রাম শত চেষ্টাতেও ঠুঠা আর খুঁজে পায়নি। জঙ্গলের মধ্যে অন্য জঙ্গল হয়ে তা জঙ্গলের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে গেছিল। কিন্তু এখানে বনবিভাগ গ্রামবাসীদের উৎখাত করে সেই এলাকাতে অন্য প্ল্যানটেশান তো করেইনি চারপাশের জঙ্গলকেও জবরদখল করতে দেয়নি সেই গ্রামের এলাকাটুকু। ফলে তৃণভূমি হয়ে গেছে বিশাল। তাড়োবাতে যে দুটি বিরাট তৃণভূমি আছে সেই দুটিই এক সময়ের গ্রামের স্মৃতিকে বহন করেছে।

ভটকাই বলল, সেই লোকগুলো কি সুখী হয়েছে নতুন জায়গাতে গিয়ে? যাঁরা বাংলা ছেড়ে পশ্চিমবাংলাতে চলে এসেছিলেন তারা কি সুখী হয়েছিলেন? তাঁদের মধ্যে যারা মরে গেছেন তো গেছে এখন যারা বেঁচে আছেন তাদের ফেলে-আসা ভিটেমাটির স্মৃতি তাদের দুঃখী করেই। নিজেদের জন্মস্থান, বাল্যের লীলাভূমি, যৌবনের বিচরণভূমি, মানুষদের পরিবারের নানা ও নানারকম স্মৃতি এসব কি ভুলে যাওয়ার? না কোনও মানুষ ভুলতে পারে। যেসব ইহুদি জার্মানি ছেড়ে পালিয়ে গেছিল প্রাণ নিয়ে তারা কি জার্মানিকে ভুলতে পারে? তবে এই সব ঘামের মানুষদের সান্ত্বনা এই যে তারা একটা মহৎ ব্যাপারের জন্যে উদ্বাস্তু হয়েছে। দেশ ভাগের মধ্যে তো কিছু ক্ষমতালোভী ও গদিলোভী মানুষের ঘৃণা ও চক্রান্ত ছিল কোনও মহৎ ব্যাপার তো ছিলনা। তাই তাদের যন্ত্রণাটাও দ্বিগুণ ছিল।

আমি বললাম, প্রদীকাকু বলছিলেন এখানে নাকি আফ্রিকার মতো উড়ন্ত কাঠবিড়ালি আছে? ফ্লাইং-স্কুইরেল?

আছেই তো। প্রদীপ ঠিকই বলেছে। প্রদীপরা সকলেই বন আর বন্যপ্রাণী খুব ভালবাসে। বেশ জানেশোনেও। ছুটিছাটা পেলেই সপরিবারে জঙ্গলে চলে আসে। ছেলেমেয়েদের জঙ্গল ও জঙ্গলের প্রাণীদের চেনায়। ওরা বুদ্ধিমান বলেই বুঝতে পেরেছে যে আধুনিক নাগরিক মানুষের বাঁচার শেষ পথ হচ্ছে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, প্রকৃতির সঙ্গে যোগসূত্র বজায় রাখা।

তারপর বলল, বাঘ চিতা নানারকম বাজ ও পেঁচা ছাড়াও এখানে নিশাচর প্রাণী আরও আছে।

যেমন? তিতির শুধোল।

যেমন ছোট ভারতীয় সিভেট ব্যাট, পাম সিভেট, র‍্যাটেল আর ফ্লাইং-স্কুইরেল তো আছেই।

ওই যে এসে গেলাম আমরা মোহার্লি। দেখা যাচ্ছে ঘর বাড়ি। ভটকাই বলল।

ঘর বাড়ি আবার কী। বনবিভাগেরই যা বাড়ি। এখানে কি আর বসতি আছে। মোহার্লির পশ্চিম দিকে তরাই বাঁধ আছে। সেই বাঁধের জলাধারে জলও আছে। আর আছে তরাই ব্যাকওয়াটার। ভারী সুন্দর। মোহার্লির পুবেই কোলসা বলে একটি জায়গা আছে সেখানেও বনবাংলো আছে। সবাই-ই তো তাড়োবার ভি. আই. পি. বাংলোতে জায়গা পান না–তোরা চিফ কনজার্ভেটরের অতিথি বলে পেলি। জেঠুমনির সঙ্গে যখন এসেছিলাম তখন কোলসাতে উঠেছিলাম। বাঘের বিচরণভূমি কাছে হবে বলে। তা ছাড়া এই ভি.আই.পি. বাংলো তো তখন বানানোই হয়নি, তবে অন্য বাংলো ছিল।

আমি যদি কোনওদিন বিয়ে করি ঋজুকাকা তবে প্রদীপকাকুকে বলে ওই কোলসার নির্জন বাংলো বুক করে হানিমুন করব। এই ভি.আই.পি. বাংলোটা বড় হোটেল হোটেল।

আসিস। ঋজুদা বলল হেসে। জঙ্গলের মতো জায়গা আছে হানিমুনের আর?

আমিও যদি কোনওদিন বিয়ে করি, বুঝলি তিতির, আমিও কোনও জঙ্গলেই এসে হানিমুন করব।

ঋজুদার বিয়ে করার কথায় আমরা সকলেই হেসে উঠলাম।

হাসছিস কেন তোরা? আমার কি বিয়ে করার কোনও আশাই আর নেই?

তাতে আমরা আরও জোরে হেসে উঠলাম।

ভটকাই বলল, মণিপুরের আর স্যেশেলস-এর এই দুই কন্যাকেই তুমি দুঃখ দিয়ে এলে আর তুমি বিয়ে করেছ। তাদের অভিশাপ লেগেছে না?

কী ব্যাপার? তিতির বলল।

ভটকাই বলল, তুমি রুদ্রর লেখা ‘ঋজুদার সঙ্গে স্যেশেলস-এ’ আর ‘কাঙ্গপোকপি’ এই বই দুটো পড়ে ফেলল।

তিতির বলল, ইয়ার্কি হচ্ছে? আমি বুঝি কাঙ্গপোকপিতে যাইনি?

গেছিলে? ভাল। মনেও নেই। অ্যাডভেঞ্চার তো আমাদের কম হল না। মনেও থাকে না ছাই!

ভটকাই-এর কথাতে হেসে উঠলাম আমরা।

তবুও ভটকাই তিতিরকে প্রশ্ন করল, বলো তো কাঙ্গপোকপি’ কোন ভাষার শব্দ। আর শব্দটার মানে কী?

তিতির বলল, নাগা ভাষার শব্দ আর মানে হচ্ছে মশার জন্মস্থান।

রাইট। একশোতে একশো। তবুও তুমি গেছিলে বলে আমার মনে পড়ছে না মণিপুর নাগাল্যান্ডে আমাদের সঙ্গে। না গিয়েও তো জানতে পারো। ভাল করে মনে করতে হচ্ছে।

মোহাৰ্লির ইনফরমেশান সেন্টার দেখে ফেরার সময়ে আমরা আন্ধারী নদীর রেখা আর গত বর্ষাতে তার ক্রিয়াকাণ্ডও দেখে এলাম।

পথের পাশে পাথরের স্তম্ভ আছে একটু দূরে দূরে গোঁন্দা রাজাদের বানানো। তাদের মাথাতে মাথাতে তার বা দড়ি বাঁধা থাকত–রাজধানী চান্দা থেকে সংকেতে খবর আদান-প্রদানের জন্যে। গ্রাহাম বেল যখন টেলিফোন আবিষ্কার করেননি তারও বহু আগে হয়তো এই টেলিফোন ব্যবহৃত হত। স্তম্ভগুলো আজও অটুট আছে। কত দিন আগের তা কে জানে। পড়াশোনা করে জানতে হবে।

.

০৫.

তাড়োবাতে ফিরেই ভটকাই-এর তাড়নাতে সঞ্জীবকাকু আর তাপসকাকুদের মামাজিকে পাকড়াও করে গাড়ি নিয়ে চন্দ্রপুর যেতে হয়েছিল। ভটকাই নিজেও যেতে চেয়েছিল, ঋজুদার পারমিশান না পাওয়াতে যেতে পারেনি। চন্দ্রপুর এখান থেকে পঁয়তাল্লিশ কিমি। কোলসা থেকেও পঁয়তাল্লিশ কিমি। তিতির হানিমুন করতে যদি প্লেনে করে আসে অথবা ট্রেনে করে নাগপুরে তাহলে নাগপুর থেকে আন্ধারী-তাড়োবা পড়বে একশো পঞ্চাশ কিমি। কোলসাও হয়তো ওইরকমই পড়বে নভেগাঁও হয়ে না ঢুকে যদি মোহার্লি দিয়ে ঢোকে।

তারপর ভাবলাম, যার হানিমুন সে বুঝবে। আমি ভেবে মরি কেন? তা ছাড়া বলেছে ‘যদি কোনওদিন বিয়ে করি।যদিকে ফেলি নদীতে।

তাপসকাকুরা ব্রেকফাস্টও করলেন না। বললেন, ভটকাই-এর যা ফরমাশ তাতে দেরি করলে হবে না। চন্দ্রপুর গিয়েই বরং গরম গরম জিলিপি-সিঙ্গাড়া দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারব বাজার করতে করতে।

ভটকাই আমাদের পোলাও মাংস না খাইয়েই ছাড়বে না, যদি তাও নিজের রোজগারে খাওয়াত। ও এবং আমিও অথবা তিতিরও রোজগার তো এখনও কেউই করি না। কিন্তু অন্য ভাল মানুষের ঘাড় ভেঙে এই প্রকার অত্যাচার আমাদের একেবারেই পছন্দ হয় না। তবে খাই আমরাও যে, সে কথা ঠিক। মদত দেওয়ার দোষে আমরাও দোষী। তবে ঋজুদা, একমাত্র যে ভটকাই-এর এইসব বাঁদরামো বন্ধ করতে পারত, করে না। ঋজুদা অবশ্য এমন কোনও মানুষেরই আতিথেয়তা নেয় না যার উপরে তার দুশো ভাগ দাবি নেই। অথচ এই দাবিটা রক্তের আত্মীয়তার নয়, ব্যবসার নয়, স্বার্থর নয়, এই দাবি শুধুই স্বার্থহীন ভালবাসার। প্রদীপদারা সকলেই ঋজুদাকে শুধু মুখেই দাদা বলে না, নিজের দাদার মতোই ভালবাসে। শ্রদ্ধা করে।

ঋজুদা একদিন খুব দামি একটা কথা আমাদের খেলার ছলে বলে ফেলেছিল। বলেছিল, বুঝলি রে, এই সংসারে দেওয়াটা ভারী সোজা নেওয়াটাই ভারী কঠিন। যারা দেয়, বা যারা কারও জন্যে কিছু করে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই মনে করে যে, দিয়েই ধন্য করল বুঝি। আসলে তারা বোঝার ক্ষমতাই রাখে না যে, যাকে দিল তার বাহাদুরিটা অনেকই বেশি। নিতেও জানা চাই। যাঁরা, কেন? কেন? না, না। একী করছেন! এইসব বলেন নেওয়ার সময়ে, তারা নিতে জানেন না।

তারপর বলেছিল, তোরা রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা পড়েছিস কেউ?

তিতির বলল, পড়েছি।

তবে তো পড়েইছিস, লাবণ্য অমিতকে সেই যে শেষ চিঠি লিখল, তাতে লিখছে ‘গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়’, ব্যাপারটা অনেকটা সেইরকমই। দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা ভারি গোলমেলে।

তারপর বলল, প্রদীপ আর তাপস যদি আমাদের পোলাও মাংস খাইয়ে সুখী হয় তা হোকই না।

বাঃ রে। ওঁরা তো ভটকাই-এরই প্ররোচনাতে এই ঝকি নিতে বাধ্য হলেন।

তা হোকই না। ভাল কাজ কারওর প্ররোচনাতে করলেও তা ভাল কাজই।

তিতির বলল, তুমি আজকাল বড় গোলমেলে কথা বলো ঋজুকাকা, ঠিক বুঝতে পারি না।

পারবি রে পারবি। তোরা সব আজকালকার ছেলেমেয়ে। বাঙালির সাহেব-মেম ছেলেমেয়ে। তোরা বলিস boneless fish খাব, কাটা খেতে পারি না। আমার কথাগুলোও ওই মাছেরই মতো হয়ে যায়। কাঁটাওয়ালা। যে ছাড়িয়ে খেতে পারে, সে মানে বোঝে। যে পারে না, সে বোঝে না। সকলকেই যে সবই বুঝতে হবে তার মানেই বা কী আছে। আমার কথা না বুঝলেও তো তোর দিনযাপনের, আনন্দ-দুঃখের এতটুকু হেরফের হবে না। তবে এ নিয়ে মিছে চিন্তা কেন? এ প্রসঙ্গ থাক এখন। এখন বল দেখি মোহার্লির ইন্টারপ্রিটেশান সেন্টারটা কেমন দেখলি?

ভটকাই এইসব কথা শোনেনি। ভটকাই কিচেনে গেছিল। যুদ্ধ শুরু হবে ঘণ্টা দেড়েক বাদে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রস্তুতি কেমন তাই দেখতে গেছিল। যাকে বলে সরেজমিনে তদন্ত করা আর কী? নির্দেশনামা দিতে গেছিল। ফিরে এল কী যেন কুটুর কুটুর করে কামড়াতে কামড়াতে।

তোর মুখে কী? আমি বললাম।

গুটকা।

ছিঃ ছিঃ।

কেন? ছিঃ ছিঃর কী হল। দেশ সুদ্ধ লোকে, যাকে বলে আপামর জনসাধারণ খাচ্ছে তা খেলে ছিঃ ছিঃ করার কী আছে।

ওহে, তোমার যে ক্যানসার হবে। তিতির বলল।

গলায় তো হবে? ভটকাই বলল।

হ্যাঁ।

ঋজুদা পাইপ খায়, ঋজুদার জিভেও ক্যানসার হতে পারে। অনেকেরই হয়। যারা গুটকা খায় বা বেশি পান-জর্দা তাদের গলাতে ক্যানসার হতে পারে। আর তোমাদের মতো, যারা কিছুই খাও না কিন্তু কলকাতা শহরে বাস করো তাই। তোমাদের শরীরের যেখানে-সেখানে ক্যানসার হতে পারে। লাংগস-এ তো হতে পারেই, ব্রেইন-এ হতে পারে, যদি ব্রেইন থেকে থাকে, লিভারে হতে পারে, পাকস্থলীতে হতে পারে, নাকে কানে, হাতে পায়ে সর্বত্র হতে পারে। নিজেরা খাও না খেও না, তবে জ্ঞান দিও না বেশি।

আমি বললাম, কোনও ভদ্রলোক গুটকা খায় না। এই তথাকথিত ভদ্রলোকেরাই তো দেশটাকে ডোবাল। তোর গায়ে কি লেবেল মারা আছে যে তুই ভদ্রলোক? এই বাবুর্চিখানার মেহনতি ভাইয়েরা, এই কালিস গাড়ির ড্রাইভার মামাজি গুটকা খায় বা আমি খাচ্ছি বলেই কি তোর চেয়ে নিকৃষ্ট তারা অথবা আমি?

ঋজুদা হাসতে হাসতে বলল, তুই পড়াশোনা ছেড়ে রাজনীতিতে যা, তোর হবে ভটকাই।

পড়াশুনো ছেড়ে যাব কেন?

না, পড়াশুনো বেশি করলে আবার রাজনীতি করা যায় না তো।

ওসব পুরনো কথা। গ্রাজুয়েশনটা অন্তত করতে তো হবে। নইলে আজেবাজে নেতাও হ্যাঁটা দেবে। মানুষের সঙ্গে একাত্ম বোধ করি, তাদের সুখ দুঃখ বুঝি, তাদের সকলকে নিয়ে এক সঙ্গে চলতে চাই, তাদের সামনে নিজের বক্তব্য প্রাঞ্জলভাবে রাখতে পারি শুধু সেই জন্যেই যদি তোমরা আমাকে দোষী করো তাহলে আমার কিছুই বলার নেই।

আমরা সকলেই এবারে একসঙ্গে হেসে উঠলাম। তিতির তো ওর বক্তব্য রাখা’ শুনে হাততালিই দিয়ে উঠল। তিতির বলল, তোমার হবে।

হবে আবার কী? হয়ে গেছে। পাজ রসুন আদা গরমমশলা বাটা আরম্ভ হয়ে গেছে, কিসমিস এলেই কিসমিস বাছা আরম্ভ হয়ে যাবে, বেগুন বাসন্তীটা এই মধ্যপ্রদেশের এই জঙ্গলের বাবুর্চি বেচারারা কখনও রাঁধেনি, নামও শোনেনি। দেখলাম ফ্রিজে ভাল পরিমাণ দইও আছে। গতকাল সঞ্জীবদা নিষ্ঠুনদের বেগুন খাওয়াবেন বলে উমরেরের বাজারে যা বেগুন পেয়েছেন তার সবই প্রায় তুলে এনেছেন–অতএব বেগুনেরও কমতি নেই। সুতরাং এদের একটি টিপিক্যাল বাঙালি পদ রাঁধতে শিখিয়ে এলাম। তোমরা খেয়ে বলো। দুঃখের বিষয় এই যে এখানে নারকেল নেই, পাওয়াও যায় না। থাকলে তো নারকেল কুরে উপরে উপরে একটু ছড়িয়ে দিতাম। তবে বেগুন আমি লম্বা করে কেটে দিয়ে এসেছি, ওরা বেগুন হাতে পেলে তো চারকোণা টুকরো করে কেটে ফেলত। তাই রিসক নিলাম না। নিজেই কেটে রেখে এলাম। তবে এও জানি যে, পাঁচ দশ বছর পরে যদি এখানে ফিরে আসি তবে এরা বেগুন বাসন্তীই পরিবেশন করে নাম বলবে ‘বেগুন ভটকাই’। ওদের আমার নামটা ভারি পছন্দ হয়ে গেছে। তা ছাড়া জনপ্রতি, দুটি করে গুটকার প্যাকেট দান করেছি যে। বুঝলিরে রুদ্র, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়লেই লেজ গজায় না। মানুষের সঙ্গে, সব স্তরের মানুষের সঙ্গে যদি সমানভাবে এবং তাদের মতো করে মিশতেই না পারিস তবে লেখাপড়া শেখা না শেখা সমান।

এবারে চুপ করবি ভটকাই।

অশেষ ধৈর্যসম্পন্ন ঋজুদারও যেন ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।

ভটকাই চুপ না করে বলল, নাগপুরে আমরা যেখানে উঠেছিলাম, সেই সেমিনারি হিলএর মহারাষ্ট্র স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড-এর দারুশ গেস্ট হাউসের মালির নাম কি জানিস তোরা?

অবাক হয়ে আমি আর তিতির বললাম, কী?

হেমরাজ চিঞ্চিকেডে। ঋজুদা তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেছে তাও কি জানিস? পাইপের সুগন্ধি টোব্যাকো তাকে খইনি করে খেতে দিয়ে পুটুর পুটুর করে কত গল্প করেছে তার সঙ্গে তা জানিস?

ঋজুদা এবারে অবাক হয়ে বলল, তুই জানলি কী করে?

জানতে হয়।

তারপর বলল, তুমি তো আমাকে তোমার চেলা বলেই মানতে চাও না, আমি বড়লোক নই। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়ি, কিন্তু আমার মতো চেলা তোমার আর কেউই নেই। আমিও চিঞ্চিকেডের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি। ওর দাদু মানে ঠাকুরদা আন্ধারী-তাড়োবাতে ছিল। বহুদিন আগে। বনবিভাগে কাজ করত। ওর বড়পিসিকে একটি কানা বাঘে এই জঙ্গলে খেয়েছিল। মানুষখেকো বাঘ। আমি নাগপুরে ফিরে যখন হেমরাজ চিঞ্চিকেডেকে ডেকে বলব যে তুমিই সেই শিকারি যে ওই মানুষখেকো বাঘটিকে মেরেছিল তখন তোমার খাতির দেখবে তুমি!

ঋজুদা স্তম্ভিত হয়ে গেল।

বলল, কখন তুই এত গল্প করলি তার সঙ্গে। তোরা তিনজনে তো সব সময়েই একসঙ্গে ছিলি যদিও তিতির আলাদা ঘরে ছিল।

সেটা কোনও কথা নয়। তুমিও তো সব সময়ে কত মানুষ পরিবৃত ছিলে, তুমিই বা তার মতো ইতরজনের সঙ্গে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে কখন এত গল্প করলে!

ঋজুদা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, এ তো ভারি গোলমেলে ব্যাপার দেখছি। যাকগে এসব প্রসঙ্গ। মোহার্লির ইনফরমেশান আর ইন্টারপ্রিটেশান সেন্টার কেমন দেখলি তাই বল। সকলকেই জিগগেস করছি।

দুর্দান্ত। তিতির বলল।

পশ্চিমবঙ্গের রাজভাতখাওয়া এবং আফ্রিকার গোয়রাংগোররাতেও ইন্টারপ্রিটেশান সেন্টার দেখেছি কিন্তু এটি একেবারে অন্যরকম। রেঞ্জার নীতিন কাকোডকর-এর ইমাজিনেশান আছে। একটি গোঁন্দ মেয়ের ফোটোর ও বয়ানের মাধ্যমে যেমন করে বন বন্যপ্রাণী, প্রাকৃতিক সম্পদের কদর এবং তা রক্ষা করার বিষয়গুলি বুঝিয়েছেন আগন্তুকদের তার কোনও তুলনা নেই। আদিবাসী চারুকলা, নানা মোটিফ, ভিতরের এবং বাইরের কোরা রঙের দেওয়ালে কালো ও লাল রঙে আঁকিয়ে পুরো সেন্টারটাকেই এক অন্য উচ্চতাতে পৌঁছে দিয়েছেন। এমন গুণী, দরদি, মস্তিষ্ক এবং হৃদয়ওয়ালা রেঞ্জার দেশের সমস্ত জঙ্গলেই দরকার।

আমি বললাম।

তারপর বললাম, তোমার কিন্তু সি. সি. এফ. সাহেবকে এই নীতিন কাকোড়কর রেঞ্জার সম্বন্ধে জানানো উচিত। ওঁর খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি হওয়া উচিত।

সত্যিই উচিত। তবে এখানের ডেপুটি রেঞ্জারেরও কৃতিত্ব থাকতে পারে কিছু। সেটা জিগগেস করে জানতে হবে।

প্রদীপদাদের সঙ্গে যিনি ঘুরছেন তার নাম কী?

তার নাম জি. কে. বশিষ্ঠ। লেখেন Washistha৷ আর অন্যজনের নাম এস. আর. গায়কোয়াড়। তাকে দেখিনি। নাগপুরে গেছেন।

ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে বলল।

তারপর ভটকাইকে বলল, এই যে কিচেন ম্যানেজার, এক কাপ কফি কি পেতে পারি? একটু দ্যাখ না?

বাই ওল মিনস।

ভটকাই বলল।

ভটকাই চলে গেলে ঋজুদা বলল, দ্যাখ, তোদের সঙ্গে মিশে ছেলেটা আদবকায়দা এবং ইংরেজিটাও কী দ্রুত শিখে নিচ্ছে। ও যদি তোদের মতো ভাল ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ার সুযোগ পেত তবে আরও কত ভাল হতে পারত।

মস্ত বাঁদরও হতে পারত ঋজুকাকা। তিতির বলল।

তারপর বলল, তুমি কি ভাব ভাল স্কুলে আজকাল সব ছাত্রই ভাল পরিবার থেকে, সৎ পরিবার থেকে আসে? অসৎ ব্যবসাদার, ঘুষখোর, ঘুষের দালাল, রাজনীতির মাস্তান, স্মাগলার এদের ছেলেমেয়েতেই এখন ভাল স্কুলের অধিকাংশ ভরে গেছে। লাখ লাখ টাকা ডোনেশান দিয়ে ছেলেমেয়েদের ভরতি করেছে তারা। যোগ্য ছেলেমেয়েরা ঢুকতে পারছে না। একটা সময় আসবে ঋজুকাকা যখন সমাজের মধ্যমণি হবে এই শ্রেণীর মানুষদের ছেলেমেয়েরাই। এই দেশের ভবিষ্যৎ খুবই খারাপ। তা ছাড়া, ছেলে বা মেয়ে ভাল বা মন্দ হয় নিজের পারিবারিক পটভূমির গুণে এবং নিজের নিজের ভাল হওয়ার জেদে। স্কুল যেমন তাকে অনেক সাহায্য করতে পারে আবার যার নিজের তাগিদ নেই তার কিছুমাত্রই উন্নতি করতে পারে না। ভটকাই ভাল হতে চায়, শিখতে চায়, তাই শিখেছে, শিখছে।

তা ঠিক। ঠিকই বলেছিস তিতির।

ভটকাই ফিরে এসে বলল, কফি আসছে। আজ লাঞ্চও খেতে খেতে দেরি হবে তাই সঙ্গে একটু ডালের বড়াও করে দিতে বললাম তোমাকে।

কী ডালের বড়া?

মটরের। সঙ্গে পেঁয়াজ কুঁচি কাঁচা লঙ্কা দিয়ে।

হাসি মুখে ঋজুদা বলল, আমি একা খাব? তোরা খাবি না।

আমরাও খাব। তোমার প্রসাদ বলে কথা। ভটকাইচন্দ্র বলল।

ঋজুদা বলল, আজকে বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি করে বেরোতে হবে Ghost Tree ভাল করে দেখাতে হবে তোদের। এই গাছেদের জানিস তো? বিভিন্ন ঋতুতে গায়ের রং বিভিন্ন হয়। পত্রশূন্য যখন হয় তখনই এমন অদ্ভুত সাদা হয়ে যায়। এদের গায়ের আঠা দিয়ে নানারকম ওষুধ-বিষুধ তৈরি হয়, যে আঠার নাম Karu-Gum.

গাছগুলোর বটানিকাল নাম কি জানো ঋজুকাকা?

জানি।

কী? Sterculia Urens.

তারপর বলল, ওই যে মোহার্লি যেতে যোগাযোগের প্রাচীন স্তম্ভগুলি দেখলি, সেগুলি গোঁন্দ রাজারা চন্দ্রপুর থেকে মোহার্লি-খাটোডা-জামনি-চিমুর এবং উমরের হয়ে নাগপুর পর্যন্ত পথের পাশে গেঁথেছিলেন। ওইভাবে কমুনিকেশান চালু রাখতেন গো রাজারা। এখন বড় রাস্তার স্তম্ভগুলো হয়তো লোপাট হয়ে গেছে কিন্তু বনের মধ্যে এই মোহার্লির পথে এখনও সেগুলো অটুট আছে। আশ্চর্য! কতদিন আগেকার!

এই ইন্টারনেটের দিনে দড়ি টেনে ক্যুনিকেশানের কথা ভাবা যায়! বলল ঋজুকাকা! কম্যুনিকেশানের কী উন্নতিই না হয়েছে এখন।

আমি বললাম, সত্যি!

ভটকাই বলল, সত্যই সেলুকাস কী বিচিত্র এই দ্যাশ!

তারপর বলল, এই ওভার কম্যুনিকেশানই একদিন মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনবে। কোনও কিছুরই বাড়াবাড়ি ভাল নয়। দেখে নিস তোরা।

তিতির বলল, কথাটা সত্যিই ভাববার।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়াটা, বলাই বাহুল্য, খুবই জোর হল। ভটকাই-এর জয়জয়কার। প্রদীপদারা তো বেগুন বাসন্তী খেয়ে মুগ্ধ। পাঁঠাটাও খুবই ভাল এনেছিলেন সঞ্জীবকাকুরা। ইনটেলিজেন্টদের মাংস খাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি কখনও তবে পাঠাদের মধ্যে এমন পাঁঠা বেশি খাইনি।

তাপসকাকু বললেন ঋজুদাকে, ভটকাইকে আমরা আপনার সঙ্গে যেতে দেব, নাগপুরে আটকে রাখব দু-তিনদিন। আমাদের স্ত্রীদের ও বেগুন বাসন্তী এবং অন্যান্য রান্না শিখিয়ে দেবে। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে চলে এসেছে এই প্রবাসে ঘর করার জন্যে। মা-ঠাকুরমার কাছে থেকে ভাল বাঙালি রান্না শেখার সুযোগ ও সময়ও পায়নি ওরা।

ভটকাই বলল, আপনারা খেতে জানেন না, তাই বউদিরা রাধেন না। নিশ্চয়ই সব রান্নাই জানেন। গাইয়ের মতো রাঁধুনিকেও প্রশংসা করে করে গাওয়াতে হয় এবং রাধাতে হয় তবে না ভিতরের আসল জিনিসটা বেরুবে।

তিতির বলল, সাবাস। এবারে কিন্তু ঋজুদা ভটকাই একেবারে অপ্রতিরোধ্য, সব ব্যাপারেই।

আমি বললাম, একশোতে দুশো।

প্রদীপদা বললেন, না। রাঁধতে অনেকেই জানতে পারেন কিন্তু অল্প বয়সে এরকম বড় একটা দেখা যায় না।

ও সব ব্যাপারেই এঁচড়ে পাকা।

আমি বললাম।

ভটকাই বলল, বেশি ট্যাক ট্যাক করিস না। রাতে লুচি, আলুর চোকা, লিভারের চাট আর পেঁপের প্লাসটিক চাটনি করতে বলেছি। বেশি পেছনে লাগলে সব কেঁচিয়ে দেব।

সঞ্জীবকাকা বললেন, তোমার বাবুর্চি-বাহিনীর সঙ্গে তোমার একটা ছবি তুলে দিতে হবে খাওয়া শেষ হলেই। ওদেরও ছবির কপি পাঠিয়ে দেব ডেপুটি রেঞ্জারের কাছে। তার ছবিও তো থাকবে।

তার কীসের ছবি?

বুনো কুকুরদের স্নিফার ডগ-এর ট্রেনিং দিচ্ছেন সকালবেলা, তার ছবি।

তাই?

বলে, হেসে ফেলল ঋজুদা।

বিকেলে এক কাপ করে চা খেয়েই আমরা সাড়ে চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। বেরোবার আগে আমরা তো বটেই সঞ্জীবকাকুরাও ঋজুদাকে বললেন, আজকে জঙ্গল থেকে ঘুরে এসেই সেই কানা বাঘের গল্পটা কিন্তু শুনব ঋজুদা।

প্রদীপ কাকু বললেন এই সেশানে কি হবে?

হবে না কেন? যতক্ষণে বাঘ শিকার না হচ্ছে আমরা ছাড়ব না। তাপসকাকু বললেন।

আমি সকলকে পোটাটো ফিঙ্গার-চিপস উইথ টোমাট্যো গার্লিক সস সাপ্লাই করে যাব। সঙ্গে চা এবং কফি, যার যা পছন্দ। টার্টার সস থাকলে জমে যেত। কিন্তু মালমশলা যে নেই, বানাব কী করে।

ভটকাই বলল।

তুমি গল্প শুনবে না?

তিতির শুধোল ভটকাইকে।

শুনব নিশ্চয়ই।

তবে এতসব রান্নাবান্না করবে কে?

আমার সৈন্যদল। সব ফিট করে দেব। জেনারাল কি নিজে হাতে রাইফেল চালায় নাকি কখনও? ডাইরেকশান দিয়ে দেব আর তার একজিকুশানটা দেখবি তোরা।

ঠিক আছে এবারে কথা বন্ধ করে গাড়িতে ওঠো।

ঋজুদা ফরমান জারি করল।

আজ বিকেলে একেবারে অন্য দিকে গেলাম আমরা। এদিকটাতে আগে কখনও আসিনি। বিষেনদাদা তাড়োবা হ্রদের মধ্যে কুমির নাক উঁচিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তা দেখাল।

‘এই কুমির তোর জলে নেমেছি’ খেলাটা খেলব? ছেলেবেলাতে যেমন খেলতাম বন্ধুদের সঙ্গে? তিতির বলল।

আজ্ঞে না। এ কুমির সেই কুমির নয়। একবার পা কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে গেলে কারওর-ই করার কিছুই থাকবে না। ভটকাই-এর গল্প শুনলি না। মাত্তামতাই একটা কুমির।

ইঁহাকি মগ্‌গর সব খতরনাক হ্যায়। হরসাল জংলি জানোয়ার তো পাকড়াতাহি হ্যায় আদমিভি এক-দো পাকড় লেতা। ইয়ে পানিকি নজদিক যানা বিলকুল নেহি চাহিয়ে।

শম্বর, নীলগাই আর বাইসনও অনেক হয়েছে এখানে। চোরা শিকার সম্ভবত একদমই হয় না। খুবই টাইট-অ্যাডমিনিস্ট্রেশান, কোর এরিয়াতে অবশ্যই। Buffer-এলাকা আর পার্ক-এর পেরিফেরিতে কেমন অবস্থা জানা নেই। ঋজুদা বলল।

সংখ্যাতে বেড়েছে চিতল। হাজারে হাজারে আছে, কানহা এবং পালামৌতে যেমন আছে। তবে পালামৌতে এখন কেমন আছে কে জানে। জঙ্গিগোষ্ঠীর ছেলেরা শুনতে পাই মাংসের জন্যে হরিণ শম্বরও মারছে। জঙ্গলের মালিক এখন তারাই।

আজও একটা ভাল্লুক দেখা গেল এবং বেশ কয়েকটা শুয়োর। গতকাল সকালের সে বরাহ বাবাজিকে দেখা গেল না। কোন নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছে সে খবরটা তো আমাদের জানা নেই। দিন দশ পনেরো লাগবে তার আবার স্বাভাবিক হতে, যতই টগবগিয়ে সে পালাক না কেন, জখম তো কম হয়নি।

মনে হল এখানে পাখি কম। সে কথা বলতেই বিষেনদাদা প্রতিবাদ করে বলল, এখানে একশো পঁচানব্বই রকম পাখি আছে। গাড়ির শব্দে কি পাখির ডাক শোনা যায়। পাখির ডাক শুনতে হলে জঙ্গলের মধ্যে সকালে বা সন্ধেবেলা চুপ করে বসে থাকতে হবে। তবে তিতিরের টিউ টিউ এবং বটের বাহিনীর পথ পেরুনোও কেন শোনা বা দেখা গেল না তাই ভাবছিলাম।

তিতির বলল, এখানে আর কী কী আছে?

আছে একচল্লিশ রকমের জানোয়ার, মানে mammals, তিরিশ রকমের সাপ, বিছে ইত্যাদি, ছাব্বিশ রকমের মাকড়শা, চুয়াত্তর রকমের প্রজাপতি, তেইশ রকমের মাছ, তাড়োবা হ্রদ এবং বর্ষার আন্ধারীতে, আর পাঁচরকমের উভচর আছে।

উভচর মানে? স্যালামান্ডার? তিতির বলল।

ফ্লাইং-স্কুইরেলও উভচর। প্রথমজন জল ও স্থলে বিচরণ করে আর দ্বিতীয়জন হল ও শূন্যে।

ভটকাই বলল, বিষেনদাদা বনবিভাগের প্যামপ্লেট মুখস্থ করে আমাদের উপরে ঝেড়ে দিল। এত সব থোড়াই দেখা যায়।

এক সঙ্গে হয়তো দেখা যায় না তবে দেখা না গেলে বনবিভাগের কর্মীরা কি আর ব্রোশিওরে লিখতেন। দেখা কি সব অত সহজে যায় আড়াইদিনে! এই আমাদের শহুরেদের রোগ। সারা বছর শীত গ্রীষ্ম বর্ষা বসন্ত হেমন্ততে এঁরা এখানেই থাকেন দিন রাতের চব্বিশ ঘণ্টা। এঁদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমাদের এই হারিকেন ট্যুরের অভিজ্ঞতা কি এক হতে পারে। জঙ্গলে এসে জঙ্গলকে সময় দিতে হয়, এ তো আর কুতুবমিনার দেখা নয়। সময় দিলে তবেই জঙ্গল নিজেকে খোলে মেলে। প্যাকেজ ট্যুর-এর ট্যুরিস্টদের মতোই আমাদের হাবভাব। জঙ্গলের প্রেমিককে অন্য প্রেমিকের চেয়েও অনেক বেশি ধৈর্য ও ভালবাসা দিতে হয়। হুট করে চলে যাব, আবার সব জানব দেখবও তা তো হয় না। ঋজুদা বলল।

আমরা সকলেই মানলাম কথাটা। বাংলা না বুঝলেও, মনে হল। বিষেণদাদাও ঋজুদার কথাগুলোর সারমর্ম বুঝে খুশি হল।

ঠিক সেই সময়ে একটা চমৎকার কাঠঠোকরা তার দুই ডানাকে চক্রাকার করে বাঁদিকের কোনও গাছের ডাল থেকে ডানদিকের জঙ্গলে উড়ে গেল। শেষ সূর্যের আলো তার বহুবর্ণ ডানার রঙের গুণকে গুণান্বিত করল। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম আমরা।

ঋজুদা বলল, এই তো তাড়োবাতে আসা সার্থক হয়ে গেল। আর কিছু দেখা যাক আর নাই যাক। আসল বনের মধ্যে এলেই যে ভাললাগা, বাঁশপাতার মধ্যে হাওয়ার মর্মর, পাতা খসার শব্দ, সকাল সন্ধের বনজ গন্ধ এই সবই তো যথেষ্ট। তারপর এবারে খুব কমই বা দেখলি কি তোরা? লেপার্ড থেকে শুরু করে চিতল। চৌশিঙা, বাইসন, নীলগাই, শুয়োর, ভাল্লুক মায় বুনো কুকুর পর্যন্ত। এই তো যথেষ্ট।

আর বাঘ! ভটকাই বলল।

আরে এমন মানুষ অনেক আছে ভারতের নানা গভীর বনের অভ্যন্তরের গ্রামের বাসিন্দা, যারা জন্মেছে জঙ্গলের মধ্যে মরেওছে জঙ্গলেই কিন্তু সারাজীবন একটাও বাঘের দেখা পায়নি। মানে, নিজে চোখে দেখেনি। কথায়ই বলে না, টাইগার লাক। বাঘ দেখতে ভাগ্য থাকা চাই। বাঘের জঙ্গলে এলেই বাঘ দেখা যায় না। যে সব জঙ্গলে বাঁধা মোষ খাইয়ে খাইয়ে বাঘকে গৃহপালিত পশুর মতো করে ফেলার হয়েছে, গলায় রেডিও কলার লাগিয়ে দিয়ে ক্লিপ-ক্লিপ শব্দ শুনে হাতির পিঠে ট্যুরিস্ট নিয়ে গিয়ে নির্ঘাৎ বাঘ দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেখানের বাঘ আর বাঘ নেই। জঙ্গলের মধ্যে স্বাভাবিক বাঘ দেখার উন্মাদনা, ভয়, উত্তেজনাই আলাদা। ওইরকম করে বাঘ দেখার চেয়ে সারাজীবন বাঘ না দেখার আক্ষেপ নিয়ে মরাও ভাল। রাজদর্শন কি সহজে হয়? তা ছাড়া বাঘ হল জাত শিকারি। তোকে সে দেখে যাবে, এপাশ থেকে দেখবে, ওপাশ থেকে দেখবে, সামনে থেকে দেখবে পেছন থেকে দেখবে অথচ তুই টেরটি পর্যন্ত পাবি না। এমনই হচ্ছে বাঘের হরকৎ। এমনি এমনিই কি সে বিশ্বসেরা জানোয়ার!

পথটা ডানদিকে একটা বাঁক নিয়েছে। তাড়াবার জঙ্গলে এমনিতে সমানভূমিতে যদিও অভয়ারণ্যর বাইরের এলাকা রুক্ষ, বন্ধুর ও পাহাড়ময়। তা ছাড়া এখানে অধিকাংশ পথও প্রায় সোজাই। পথের পাশে পাশে বানাওটি নুনি আর কুদরতি নুনি। অর্থাৎ Man made and Naturall বনবিভাগও ছোট ছোট পুকুর খুঁড়েছে সেই সব জায়গাতেও যাতে বনে বেড়াতে আসা ট্যুরিস্টদের জানোয়ার দেখানো যায়। আসলে অধিকাংশ ট্যুরিস্টরাই তো ভটকাইয়ের মতো। জঙ্গল দেখা মানে ভাবে জানোয়ার দেখা। দু-তিনদিনের মধ্যে জানোয়ার দেখতে না পেলে বলে ধুসস। বোগাস। এ জঙ্গলে কিসসুই নেই। জঙ্গল দেখতে জানে কজন মানুষ!

ডানদিকে পথটা পুরো ঘুরতেই শম্বর। শম্বরদের একটা দল। তবে সবই মেয়ে শম্বর। এই দলটাতে শিঙাল নেই। হয়তো আশেপাশে আছে, আমাদের দৃষ্টিগোচর হল না। কিছুক্ষণ আমাদের দেখে তারা দৌড়ে পালাল জঙ্গলের ভিতরে। তারা সরে যেতেই তাদের পেছনে মস্ত একটা Ghost Tree দেখা গেল। সত্যি? কী আশ্চর্য সাদা। যেন মনে হচ্ছে স্পেশাল সাদা স্নোসেম দিয়ে রং-মিস্ত্রিরা এসে পুরু করে রং লাগিয়ে গেছে।

মাঝে মাঝেই বড় বড় উইয়ের ঢিবি। ঢিবি মানে, গোলাকৃতি নয়, সোজা উঁচু হয়ে উঠেছে, ভাঙা ভাঙা। ভালুকবাবাজিরা তাতে নাক ঢুকিয়ে সোঁ সোঁ করে শুষে নিয়ে উই খায়।

বনবিভাগ জঙ্গলের মধ্যে যেখানে দোলা মতো আছে সেখানে আরও খুঁড়ে শুয়োর, শম্বর, বাইসনদের গা ডুবিয়ে থাকা বা wallowing-এর জন্যে তা আরও গভীর ও বিস্তৃত করে দিয়েছেন। আন্ধারী নদীর রেখাতেও যেখানে যেখানে গাড়হা আছে সেখানে সেখানেও ওরকম করে রেখেছেন তারা। বনের মধ্যে নানা ওয়াচটাওয়ার আর হাইডসও আছে। বনপ্রেমী যাত্রীরা যাতে উপরে উঠে তাতে বসে অথবা হাইড-এর আড়ালে লুকিয়ে থেকে জানোয়ার দেখতে পারেন সে জন্যে।

কত বাঁশ, না? তিতির বলল।

ঋজুদা বলল, এই জঙ্গল তো বাঁশ আর সেগুনেরই। জানিস তো। বাঁশ গাছে তাদের জীবনে একবার মাত্র ফুল আসে। ফুল আসা কিন্তু ওদের কাছে সুখবাহী ঘটনা নয়। ফুল এলে বাঁশ গাছ মরে যায়। অবশ্য প্রাকৃতিক নিয়মে ফুলের থেকে বীজ ঝরে পড়ে নীচে এবং তা থেকে বৃষ্টির পর আবার নতুন বাঁশ গাছ জন্মায়। এই তাড়োবা-আন্ধারীতে শুনেছি উনিশশো বিরাশি-তিরাশিতে সব বাঁশ বনে ফুল এসেছিল এবং সব গাছই মরে গেছিল। এখন আমরা যে বাঁশ বন দেখতে পাচ্ছি তা ওই আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ঝরে-পড়া বীজ থেকে নতুন গজানো বাঁশঝাড়।

তারপর ঋজুদা বলল, এখনও তো গরম পড়েনি। গরম পড়ার আগেই জঙ্গলের মধ্যে মধ্যে ‘ফায়ার লাইন’ করবে বনবিভাগের কর্মীরা বন কেটে। গরমের সময় দাবানল লাগলে যাতে হাওয়াতে আগুন এক জঙ্গল থেকে ছড়িয়ে অন্য জঙ্গলে যেতে না পারে তাই ছমিটার থেকে বারো মিটার জায়গা থেকে সব গাছগাছালি ঘাস পাতা নির্মূল করে দেয় বনবিভাগের লোক যাতে আগুন সেই ফাঁকা জায়গাতে এসে বুড়ির মতো বিড় বিড় করে মরে যায়, অন্য জঙ্গলে আর পৌঁছতে না পারে। ভারতে সব জঙ্গলেই এমন করা হয় চোত-বোশেখ-এর আগে আগেই। এই fire line করা বনবিভাগের কর্মীদের এক বিশেষ কাজ। অনেক সময়ে গাছও কাটতে হয়। দুভাবে কাটেন।

এক ক্লিয়ার ফেলিং আর অন্য কপিসিং ফেলিং। ক্লিয়ার ফেলিং মানে, যেখানে জঙ্গল একেবারে সাফ করে নতুন প্ল্যানটেশান করা হয়, আর কপিসিং ফেলিং মানে বেছে বেছে মার্কা মেরে দিয়ে গাছ কাটা। তাড়োবা দেখে মনে হচ্ছে এই বনে বেশ কিছুদিন হল সব felling-ই বন্ধ আছে ভবিষ্যতে কখনও হয়তো হবে। সচরাচর টাইগার প্রিসার্ভ বা অভয়ারণ্যের গাছ কাটা এমনিতেও হয় না, জানোয়ারদের এবং বিশেষ করে বাঘেদের অসুবিধা ও বিরক্তি না ঘটাতে।

মেলঘাট টাইগার প্রিসার্ভটা নাগপুরের কোন দিকে ঋজুদা?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

ঠিক কোন দিকে তা ম্যাপ দেখে বলতে হবে। সে এলাকা পাহাড়ি কিন্তু নাগুরের কাছেই। আমাদের তো ওখানেই যাবার কথা ছিল কিন্তু সি. সি. এফ. সাহেব শেষ মুহূর্তে প্রদীপকে আন্ধারী তাড়োবাতেই যেতে বলেন। আমার অনুমান, এখানে ভি. আই. পি. বাংলোটি খুব ভাল বলেই। ভাবলেন, ঋজু বোসের মেলঘাটে যদি অসুবিধে হয়। তবে ভালই হয়েছে, আমি তাড়োবাতে এলেও তো এসেছি সেই কোন কালে আর তোরা তো দেখিসইনি।

আমরা তো মেলঘাটও দেখিনি।

সে তো আমিও দেখিনি। যাওয়া যাবে কখনও পরে। বলব প্রদীপকে। ৫৬

একবার এ তল্লাট ছেড়ে গেলে আর কি আসা হবে! কোথায় হুট করে চলে যেতে হবে তোমাকে গোয়েন্দাগিরি করতে বা শিকার করতে। তোমার সময় আবার কবে হবে তা ভগবান ছাড়া আর কেউ জানেন না।

তিনিই তো সর্বজ্ঞ। তিনি জানলেই হল।

আরে যদি যাইও তোদের মধ্যে কেউ কেউ তো যাবিই আমার সঙ্গে না কি? একা তো কতদিন হয়ে গেল আমি কোথাওই যাইনি। তোরা আমার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিস, পরনির্ভর হয়ে যাচ্ছি আমি, এটা আমার চরিত্রের পক্ষে ভাল নয়। না কি বুড়ো মেরে যাচ্ছি? কে জানে।

যাই বলো আর তাই বলল, আমাদের ফেলে কোথাওই যাওয়া চলবে না।

আমরা সমস্বরে বললাম।

সামনেই পথের উপরে শেষ বিকেলের একটি ছোট্ট সাদা মন্দির। তার মধ্যে লালরঙা দেবতার সিঁদুর চর্চিত মূর্তি দেখা যাচ্ছে।

তিতির বিষেণদাদাকে শুধোল, কোন দেবতার মন্দির?

বিষেণদাদা বলল, মারুতি।

ভটকাই বলল, মারুতি সুজুকি? এখানেও এই জঙ্গলেও তারা গাড়ি বিক্রি করে নাকি?

ঋজুদা হো হো করে হেসে উঠল। আমি চালাক চালাক মুখ করে চুপ করে রইলাম।

তিতির বলল, মারুতি মানেও জানো না? মারুতি গাড়ি তো খুব চড়ো দেখি।

সে মেজ জ্যাঠার গাড়ি। আমাদের কি গাড়ি আছে নাকি? ভটকাই বলল।

মারুতি হল পবন নন্দনের নাম। পবন দেবতা। হনুমানজি, বুঝেছ সবজান্তা মিস্টার ভটকাই।

অনেকক্ষণ পরে ভটকাই একটু ভেটকে গেল।

শুনে বলল, তাই?

ইয়েস। তিতির বলল।

.

০৬.

বাংলোতে ফিরে আমরা বারান্দাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম। ওয়াশিষ্ট সাহেবও এসে বসলেন আমাদের সঙ্গে। প্রদীপকাকু, তাপসকাকু এবং সঞ্জীবকাকু। দিনে কি রাতে ছবি তোলার বিরাম নেই।

প্রদীপকাকু তাই বললেন, দাদা যখন গল্পটা বলবেন তখন বিরক্ত কোরো না সঞ্জীব। ছবি তোলার সুযোগ পরেও পাবে। গোটা দশেক রিল তো শেষ করেছ। আর না তুলেও চলবে।

ঠিক আছে। যদিও নিসপিস করবে হাত। তবু, তুমি যখন বলছ তখন চুপ করেই বসে থাকব।

ভটকাই বলল, আমি কিচেনে ইনস্ট্রাকশনটা দিয়ে আসছি দশ সেকেন্ডে। আমি ফেরার আগে আরম্ভ কোরো না কিন্তু।

ঠিক আছে। আয়।

তারপরে ঋজুদা বলল, ট্রিগার টানলাম, হয় গুলি লাগল নয় লাগল না, এই তো শতকরা নব্বইভাগ শিকারের গল্প। কিন্তু গুলি লাগল কিন্তু বেজায়গাতে লাগল যখন, তখনই শিকার বিপজ্জনক। এবং বিপজ্জনক বলেই সেখানে গল্প জমে।

ভটকাই ফিরে আসতেই ঋজুদা শুরু করল। গরমের দিন। এপ্রিলের প্রথম অথচ তখনও যা গরম তা বলার নয়। লু চলতে শুরু করেছে। আমরা উঠেছিলাম কোলসার বাংলোতে। তবে ঘটনা যা ঘটার তা ওই তাড়োবাতেই ঘটেছিল। কাল বিকেলে যেখানে মস্ত মাঠটাতে, মানে তৃণভূমিতে আমরা হাজার হাজার চিতল হরিণ দেখলাম সেইখানেই ছিল মস্ত একটি গ্রাম। গোন্দদের গ্রাম। আমরা আসার একমাস আগে প্রথম মানুষ মারে বাঘটা অন্য গ্রামে। পরে আরও দুটি। তারপরে আমরা পৌঁছবার দিন পনেরো আগে আরও একটি মানুষ মারে।

জেঠুমনি আমাকে নিয়ে গ্রামে এসে গাঁওবুড়োদের সঙ্গে কথা বলল। বুড়ো বলল, সব সাহায্য দেবে। বাঘটা মেরে দিলে খুবই কৃতজ্ঞ থাকবে ওরা। প্রথমে ওই গাঁওবুডোর নাতিকেই ধরেছিল বাঘটা। বাঘের প্রথম কিল। ধরে, বাঁশবনের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে প্রায় সবটুকুই খেয়ে ফেলে কোমর আর ডান পায়ের কিছুটা ফেলে চলে রেখে গেছিল। Kill বা মড়িতে আর ফিরে আসেনি। ছেলেটা গোরু চরাবার জন্যে গেছিল গ্রামের লাগোয়া বনে। সকালবেলাই বাঘটা তাকে ধরাতে কেউ জানতেও পারেনি। দুপুরে তার জন্যে ছোট ভাই খাবার নিয়ে গিয়ে তাকে দেখতে না পেয়ে ফিরে আসার পরে গ্রামে খোঁজ পড়ে এবং তারপর খোঁজাখুঁজির পরে বিকেলে তার দেহাবশেষ নিয়ে এসে দাহ করা ওরা। তারপর থেকে বাঘের আর খোঁজ নেই।

তবে পায়ের দাগ দেখেছিল গাঁয়ের লোকেরা। গরমের দিন, মাটির ওপরে। ধুলোর আস্তরণ ছিল তাই পায়ের ছাপ দেখতে অসুবিধে হয়নি ওদের। ওরা বলল, খুব বড় বাঘ, হয়তো বুড়োও হবে, মদ্দা বাঘ, ওরা এও বলল যে এই জঙ্গলের বাঘেদের পায়ের ছাপ ওরা চেনে। এ বাঘের পায়ের ছাপ আগে ওরা নাকি কখনও দেখেনি।

জেঠুমনি সে কথা শুনে আমাকে বললেন হতেই পারে না। এক বাঘের এলাকার মধ্যে অন্য বাঘ চলে এল বিনা লড়াইয়ে তা তো হয় না।

ওদের কোথাও ভুল হচ্ছে।

প্রদীপকাকু বললেন, ফেরোমন স্প্রে করে বাঘেরা তাদের সীমানা চিহ্নিত করে রাখে। অন্যের সীমানার মধ্যে বড় বাঘ ঢুকে পড়ল আর বিনাযুদ্ধে সেখানে রয়ে গেল এমন তো সত্যিই হবার কথা নয়।

ঠিক। বলল, ঋজুদা।

তারপর বলল, গোরু না চরাতে গিয়ে যদি মোষ চরাতে যেত তাহলে বাঘ অত সহজে ছেলেটাকে ধরে নিয়ে যেতে পারত না। মোষেরা বাধা দিতই আর জঙ্গুলে এলাকার গৃহপালিত মোষেরাও বুনো মোষেরই মতো শক্তিধর। তারা বাঘকে অত সহজে কাজ হাসিল করতে দিত না।

একটা অর্জুন গাছের নীচে আমরা একটা গোরু বেঁধে বসব ঠিক হল। গ্রামের লোকেরা বলল, জঙ্গলের এই অঞ্চলেই সেই বাঘের পায়ের ছাপ বেশি দেখা গেছে গত কদিনে। গত এক মাসে চারটি গোরুও মেরেছে বাঘে। ছোট গোরু মারে বা বাছুর। সামান্য দুরে টেনে নিয়ে গিয়ে একটুখানি খায় কিন্তু মাচা বেঁধে বসলে মড়িতে ফিরে আসে না। অথচ যতখানি খায় ততখানি একটি পূর্ণবয়স্ক বাঘের খাদ্যের তুলনায় খুবই কম। হয়তো বাঘটার দাতে কোনও গোলমাল আছে অথবা মুখে। বাঘটার গায়ে শক্তি কম অথবা তার খিদে কম। তা নয়তো বাঘটার লিভার ফাংশান ভাল না। জেঠুমনি সাব্যস্ত করলেন। অথবা অন্য যে কোনও কারণেই হোক বাঘটা স্বাভাবিক নয়। আর স্বাভাবিক হলে সে মানুষই বা মারবে কেন? মানুষ তো বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য নয়।

নাগপুর থেকে জিপে কোলসাতে আসার সময়েই জেঠুমনির লু লেগে গেছিল। তখন কোনও গাড়িই এয়ারকন্ডিশানড ছিল না। খাওয়ার জলও ঠান্ডা পাওয়া যেত না। একমাত্র সম্ভব ছিল আইসবক্সে করে আনলে। সেও মহা ঝক্কির ছিল। ভিস্তিওয়ালারা যে চামড়ার ছাগলে করে জল দেয়, এখনও দেখতে পাবি কলকাতার যেসব অঞ্চলে জলাভাব আছে ভিস্তিওয়ালারা ভিস্তিতে করে জল দিচ্ছে, সেই ছাগলে জল ভরে জিপের বনেটের সামনে শক্ত করে দড়ি বেঁধে নিয়ে তখন গরমের মধ্যে পথ চলতে হত। তাহলে চলন্ত গাড়ির কারণে জলে ভেজা ভিস্তিতে হাওয়া লাগায় ভিস্তির জল ঠান্ডা থাকত। ওই জল খেতে খেতে এগোতে হত পথে। আমরাও তেমন করেই এসেছিলাম। কিন্তু লু বইছিল পুরো পথে। আমরা ভোরে রওয়ানা হয়েও দুপুরে একটার আগে পৌঁছতে পারলাম না কোলসাতে। পথেই জেঠুমনির লু লেগে গেছিল। তখন রাস্তাঘাটও এত ভাল ছিল না। অনেকখানি পথই কঁচাও ছিল জঙ্গলের বাইরেও।

কোলসা পৌঁছে বিকেলেই আমরা তাড়োবার ওই গ্রামে এসে সব বন্দোবস্ত করলাম। মাচাও বাঁধানো হল অর্জুন গাছটাতে। গাছটা আমার পছন্দ হল না কিন্তু ওই গাছটাতে বসেই পথের দুদিক এবং জঙ্গলের গভীরেও অনেকখানি দেখা যাবে। পাহাড়ি জায়গা হলে জুতসই উঁচু পাথরে বসা যেত কিন্তু তোমরা তো দেখলেই তাড়োবার টাইগার রিজার্ভ এর এলাকা প্রায় সমতলই। এখানে গাছে বসা ছাড়া উপায় নেই।

জেঠুমনি বলে গেলেন আমরা কাল এসে বসব। আমার লু লেগে গেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু বাঘ রাতে যদি কোনও গোরু বা মানুষ ধরে তবে সকালেই খবর পাঠাবে কোলসাতে। আমরাও আসব। যদি আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি তাহলে এই বাবু আসবে।

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। সবে গোঁফ গজিয়েছে। আমার মুখের দিকে ভাল করে তাকিয়ে বুড়ো বলল, এ খোকাবাবু কি পারবে?

জেঠুমনি বিরাট এক ধমক দিয়ে আমার প্রতি তার সব অভক্তি গায়ের জোরেই মেরে দিলেন। বলল, সে চিন্তা তোমার নয়, আমি বুঝব।

রাতে জেঠুমনির জ্বর বাড়ল। ভুল বকতে লাগলেন। ফরেস্টার সাহেবকে বললাম, সকালেই ডাক্তারের বন্দোবস্ত করতে হবে। তিনি বললেন ডাক্তার তো আনতে হবে চন্দ্রপুর থেকে। এখান থেকে প্রায় তিরিশ মাইল। তখন তো মাইল ছিল।

জেঠুমনি জ্বরের মধ্যেই বলতে লাগলেন বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাব আমি। আমার জন্যে চিন্তা নেই। তারপর বললেন, সকালে উঠেই ভরপেট খেয়ে জলের বোতলে জল, পাঁচ ব্যাটারির টর্চ আর রাইফেল নিয়ে তুই জিপ নিয়ে চলে যা। কানিটকার সাহেব যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা পালন না করতে পারলে মুখ থাকবে না। জিপটা তোর কাছেই রাখবি। ড্রাইভারকে গোঁদের কারও ঘরে রাতে শোওয়ার বন্দোবস্ত করবি যদি রাতে ফিরতে না পারিস। তোর উপরে আমার ভরসা আছে। আমি অযথা চিন্তা করব না।

বললাম, কোন রাইফেল নিয়ে যাব জেঠুমনি?

আমার ফোর ফিফটি ফোর-হান্ড্রেডটা নিয়ে যা। মানুষখেকো বাঘ বলে কথা। হালকা রাইফেল নিয়ে কাজ নেই। আর আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করে যাবি কাল যখন বেরবি।

কী জেঠুমনি? কীসের প্রতিজ্ঞা?

প্রতিজ্ঞা করে যাবি যে বাহাদুরি করবি না, রাতে বাঘকে মাচা থেকে গুলি করে মাচা থেকে নামবি না। বাঘ যদি আহত হয়, না মরে তবে তাকে ব্লিড করার সময় দিবি। প্রয়োজনে সারা রাত, যাতে সে দুর্বল হয়ে যায় তোর সঙ্গে মোকাবিলা করার সময়ে। এই হল বাঘ শিকারের নিয়ম।

তারপর বললেন, ওড়িশাতে বাঘকে কী বলে ডাকে শুনিসনি? মহাবল। সে হচ্ছে মহাবলী জানোয়ার। এখানে আমিই তোর বাবা-মা। তোকে নিজে হাতে যমের মুখে পাঠালে অনুতাপে আমি আর বাঁচব না। তবে তুই আমার চেলা, ভয় করবি না কিছুকেই। আমি জানি, তুই একাই পারবি। আমার চেলাগিরি তো কমদিন করলি না।

তিতির বলল, সত্যি। এমন বাঙালি গার্জেনের কথা ভাবা যায় না।

ভটকাই বলল, “সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।”

প্রদীপকাকু বললেন, একসেপশন প্রভস দ্য রুল।

সঞ্জীবকাকু বললেন, তোমরা মধ্যে কথা বলে ঋজুদার কনসেনট্রেশান নষ্ট করে দিও না।

তা ঠিক।

তাপসকাকু বললেন, বাঘ মারতে যেমন কনসেনট্রেশান লাগে, বাঘ মারার গল্প বলতেও লাগে।

সঞ্জীবকাকু বললেন, বিশেষ করে মানুষখেকো বাঘ মারার গল্প।

তারপর? প্রদীপকাকু বললেন।

ঋজুদা বলল, সেই রাত যে কী করে কাটল! বাঘ মারতে যাব কী, মাঝে মাঝেই মনে হতে লাগল, জেঠুমনি বোধহয় এই রাতেই দেহ রাখবেন। কী যে করি! বারবার চিনি নুনের শরবত আর গ্লুকোজের জল খাইয়ে খাইয়ে শেষ রাতের দিকে ঘুমোলেন জেঠুমনি। আমিও ঘুমোলাম ওঁরই সঙ্গে।

তারপর?

সকালে ঘুম ভেঙে দেখি জেঠুমনি বাংলোর বারান্দার যেদিকটাতে রোদ পড়েনি সেদিকে ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। আমি উঠতেই বললেন, তোর জন্যে নাস্তা বানাতে বলেছি। একবারে পেট ভরে খেয়ে যা। পরে গ্রামে কিছু পেলি তো খেলি, যদি ওরা খেতে দেয়। টুপি তো নিয়ে যাবিই, একটা গামছাও নিয়ে যা। মাঝে মাঝেই ভিজিয়ে মাথায় দিয়ে তার উপরে টুপিটা চাপাবি। ছটা গুলি নিয়ে যা। দুটো দু ব্যারেলে রাখবি আর চারটে বুশ-কোটের ডান পকেটে রাখবি। পকেটের বোতাম খুলে রাখবি যাতে প্রয়োজনে তাড়াতাড়ি গুলি বের করতে পারিস। জঙ্গলে যতক্ষণ থাকবি ব্যারেলে গুলি রাখবি। সেফ করে নিয়ে মাঝে মাঝেই সেফটি ক্যাচে আঙুল ছুঁইয়ে দেখবি ক্যাচটা ঠিক আছে কি না।

.

০৭.

গরমের সময়ে তরিতরকারি তো কিছু পাওয়া যায় না, রুটি আর আলুর চোকা খেলাম, কঁচা পেঁয়াজ আর লঙ্কার সঙ্গে। জেঠুমনি চারটে আস্ত কাঁচা পেঁয়াজ রাখতে দিলেন বুশ কোটের বাঁ পকেটে। বললেন, খিদে পেলে পেঁয়াজ খাবি। না খেলেও পকেটে থাকলে লু থেকে বাঁচবি। নাগপুর থেকে আসার সময় ভুলে গেছিলাম আমি। রাখলে আর পেঁয়াজ খেলে লু লাগত না।

তারপর বললেন, বয়স যে হচ্ছে এবার বুঝতে পারছি রে ঋজু। তোমার হল শুরু আমার হল সারা।

আমি তৈরি হয়ে জেঠুমনিকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লাম। জেঠুমনি রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আমায় হাত নাড়লেন।

বললাম, সারাদিন পান্তাভাত খেয়ে ঘুমোও।

ঠিক আছে। বললেন জেঠুমনি।

জিপটা কোলসার বাংলোর হাতার বাইরে বেরোতেই আমি বললাম ড্রাইভারকে, সঙ্গে ফরেস্টার বাবুও ছিলেন, যে আমাকে ও গ্রামে নামিয়ে সোজা মোহার্লি হয়ে চন্দ্রপুর চলে যেতে। সবচেয়ে ভাল ডাক্তারকে সঙ্গে করে কোলসাতে এনে জেঠুমনিকে দেখিয়ে ডাক্তারবাবুকে আবার চন্দ্রপুরে পৌঁছে দিয়ে তারপর আমার কাছে আসতে। তারপরই ঠিক করব রাতে মাচাতে বসব না কোলসাতে ফিরে আসব।

ভাবছিলাম, কানিটকার সাহেব কে আমি জানি না। আমার কাছে জেঠুমনিই সব। বাঘ মারা যাক আর নাই যাক জেঠুমনির শরীরের খোঁজটা আগে রাখতে হবে।

ফরেস্টার বাবু বললেন, টাকা? বড় ডাক্তার এত দূরে এলে তো অনেক টাকা চাইবেন।

টাকা ইজ নো প্রবলেম। বাইরে বেরিয়ে আমিই হলাম জেঠুমনির ক্যাশিয়ার। নিজের হাতে টাকার মতো নোংরা জিনিস ছোঁওয়া জেঠুমনি পছন্দ করতেন না। আমি পার্স খুলে একটি হাজার টাকার নোট বের করে দিলাম।

ফরেস্টার বাবুকে বললাম, ডাক্তারবাবুকে রোগের বর্ণনা দিয়ে সম্ভাব্য সব ওষুধপত্রও সঙ্গে নিয়ে আসতে বলবেন। বলবেন লু লেগে গেছে। পথ্যও যা বলবেন চন্দ্রপুর থেকে কিনে নেবেন, কিছুরই যেন ঘাটতি না পড়ে।

ফরেস্টারবাবু এবং ড্রাইভারদের মুখ দেখেই বোঝা গেল যে আগে কখনও হাজার টাকার ইয়া বড় নোট দেখেননি ও দেখেনি। তখনকার দিনে টাকার মূল্য ছিল অনেক। দশ টাকার বাজার করলে থলে ভরে যেত। আর একশো টাকায় তো কত কিছুই করা যেত। তখন পাঁচশো টাকার নোট ছিল না তাই হাজারের নোট দিলাম। কত বড় ডাক্তারবাবু জানি না। তার সারা দিনের পসার নষ্ট তার উপর ওই খারাপ জায়গায় লুবওয়া দিনে অতখানি পথ আসা-যাওয়া।

জিপ আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলে একটি নিমগাছের নীচে চৌপাইতে বসে কালকে আমার চলে যাবার পরের খবরাখবর নিলাম। কোনও খবর নেই। তবে মাচাটা আমার যেখানে বেঁধেছিলাম এবং গোরুও যার সামনে বাঁধা ছিল, বাঘ তার খুব কাছ দিয়ে এবং বড় রাস্তার উপর দিয়েই দু’দুবার হেঁটে গেছে। গোরুটাকে ছোঁয়নি। আমার মনে হল গোরু না বেঁধে একটা বাছুর বাঁধলে হত। গাঁওবুড়ো আমাকে একটি যুবককে সঙ্গে দিলেন। তার নাম ঢাকিল। তার হাতে একটি মস্ত টাঙ্গি। এই গ্রামে কারওর কাছেই কোনও আগ্নেয়াস্ত্র নেই। এমনকী গাদা বন্দুকও নেই। বনবিভাগের ভয়ে বে-আইনি কাজ করে না কেউই কিন্তু এখন যে প্রাণ বিপন্ন। এখন বনবিভাগ তাদের বাঁচাবার জন্যে কী করছে? না একটা সদ্য গোঁফ-ওঠা ঘোড়াকে পাঠিয়েছে বড় এবং বুড়ো বাঘের সঙ্গে ইয়ার্কি মারার জন্যে। এই রকম কিছু বলাবলি করছিল ওরা নিজেদের মধ্যে। নইলে অত দুঃখের মধ্যেও এ ওর গায়ে হেসে গলে পড়ছিল কেন ওরা। বিশেষ করে মেয়েরা।

রাগে অপমানে আমার দু কান লাল হয়ে উঠল।

আমি বললাম, মাচার দিকে যাব। সঙ্গে ঢাকিল আর একজন মারাঠি ফরেস্ট গার্ড। তার নাম তেন্ডুলকার। সে মিনিটে মিনিটে পকেট থেকে বের করে লম্বা চুট্টা ধরায় আর শেষ হয়ে এলে সাবধানে মাটিতে ফেলে পায়ের জুতো দিয়ে নিভিয়ে দেয় যাতে আগুন না লেগে যায় বনে।

তুমি কি তখন পাইপ খেতে? আমি বললাম।

পাগল! পাইপ খেতে শুরু করি গ্র্যাজুয়েশনের পরে। তখন তো ক্লাস নাইনে পড়ি।

বলেই বলল, যাক ভাল কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছিস। গলাটা শুকিয়ে এসেছে। একটু পাইপ খেয়ে নিই। এক ফিল।

বলেই, ভটকাইকে বলল, কীরে! ফিঙ্গার চিপস আর কফি-টফির গল্প তো খুব শোনালি। কিন্তু এল কই?

টাইম ইজ নট রাইপ ইয়েট। বলল ভটকাই। এক্কোবারে সাহেবি কেতায়।

আমি আর তিতির মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।

তারপর ঋজুদাকে বলল, ঋজুদা যেন ওর ইয়ার, তোমার গল্প তো এখনও শিশু। সে যুবক হোক তখন আসবে। সব ইনস্ট্রাকশান দেওয়া আছে। ঘাবড়িও না।

সমবেত জনমণ্ডলী ভটকাইকে যতই দেখছেন ততই তার বিভিন্নমুখী প্রতিভা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে একেবারে অবাক হয়ে যাচ্ছেন। আমি আর তিতির কোনও ফ্যাকটরই নই। ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

তিতির মনটা অন্যদিকে করার জন্যে বলল, বলো ঋজুকাকা, পাইপটা একটু খেয়ে।

হ্যাঁ বলি।

আমরা তিনজনে আধ কিলোমিটার, তখন মাইল ছিল, আধ মাইল হেঁটে সেই অর্জুন গাছটার কাছে পৌঁছে দেখি গোরুটা তাকে রাতে যে ঘাস পাতা-টাতা খেতে দেওয়া হয়েছিল তা খেয়ে শেষ করে শুয়ে আছে। তার পিপাসাও নিশ্চয়ই পেয়েছে খুবই। ঢাকিল ভাল হিন্দি বলতেও পারে না, বুঝতেও পারে না। তেন্ডুলকারকে বললাম যে গোরুটাকে খুলে ঢাকিল যেন গ্রামে পৌঁছে দিয়ে আসে। তাকে দানা ও পানি খাইয়ে বিশ্রাম দিতে বললাম। বিকেলে এ জায়গাতেই তাকে আবার বাঁধা হতে পারে। ঢাকিল গোরুটাকে, গোরু তো নয় বলদ, নিয়ে গেল, ফিকে লাল রঙা বলদটা, এদের শিং বাংলার গোরুর মতো নয়।

ঢাকিলকে বলতে বললাম যে বলদটাকে পৌঁছে দিয়েই সঙ্গে সঙ্গে সে যেন আমাদের কাছে ফিরে আসে।

ওই গাছটার কাছে পথের ধুলোর উপরে বাঘটার পায়ের দাগ দেখলাম। সত্যিই বিরাট বাঘ। মদ্দা। তার পায়ের ছাপ দেখে তার পায়ে, কোনও পায়েই যে কোনও খুঁত আছে তা আমার মনে হল না। অবশ্য তখন আমার অভিজ্ঞতাই বা কতটুকু। জেঠুমনির কাছে শিক্ষানবিশি করে যতটুকু শেখা। তবে শিকার শুরু করার আগে থেকেই সাউথ ক্যালকাটা রাইফেল ক্লাবে ও লেকে পয়েন্ট টু-টু রাইফেল নিয়ে শ্যাডো প্র্যাকটিস করে পরে রাইফেল ছোঁড়া শিখেছিলাম। ক্লাস সিক্স-এ পড়ার সময় থেকেই জেঠুমনির সঙ্গে পাখি শিকারে যেতাম। সে সব অনেক কুকীর্তি। এখন ভাবলে বড় পাপবোধ করি। জেঠুমনির মুখের বুলিই ছিল ‘মার! মার! সে পাখিই হোক, কী বড় প্রাণী! শিকার করতেই শিখেছিলাম, যে বয়সে পশুপাখি চেনা দরকার, একা একা বনেবাদায় ঘুরে সত্যিকারের ভাল শিকারি হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল, তা না হয়ে জেঠুমনির শিকারের যাত্রাদলের সভ্য হয়েছিলাম। জেঠুমনির শিকারে খাওয়া-দাওয়া হল্লাগুল্লা যে পরিমাণ হত সে পরিমাণ শিকার হত না। শিকারও এক সাধনার ব্যাপার। সেই সাধনাও একক নির্জনের সাধনা। দলে বলে যাত্রাপার্টিতে তা হয় না। তবুও শিখেছিলাম কিছু। ভাল ভাল শিকারি বন্ধু বান্ধব ছিলেন অনেক জেঠুমনির। তারাও যেতেন আমাদের সঙ্গে। তাঁদের কাছেও অনেক শিখেছিলাম।

যাই হোক, আমরা বাঘের পায়ের দাগ অনুসরণ করে আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম যে তার পায়ের দাগ ডানদিকের গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেছে।

আধ মাইল যদিও জঙ্গলের মানুষের কাছে কোনও দূরত্বই নয়, তবু ঢাকিল ওই মানুষখেকোর জঙ্গলে একা একা ফিরে আসবে বলেই জঙ্গলের গভীরে না ঢুকে একটা বড় মহুয়া গাছের নীচে আমি আর তেন্ডুলকার ওর ফেরার অপেক্ষাতে বসে রইলাম। |||||||||| বাঘ শিকারে বিশেষ করে মানুষখেকো বাঘ শিকারে ধৈর্য ও ঈশ্বরের দয়া ছাড়া কিছুই ঘটে না। কালকে মারেনি বলে বলদটাকে আজও ধরতে আসবে না এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। মিনিট পনেরো কুড়ি অপেক্ষা করার পর সোজা রাস্তাতে অনেক দূরে ঢাকিলকে আসতে দেখে আমরা বাঘ যেখানে ডানদিকের জঙ্গলে ঢুকেছে সেখানে এসে দাঁড়ালাম। বাঘ বোধ হয় ঘন বাঁশের জঙ্গলের ছায়াতে বিশ্রাম করবে বলেই ওখানে ঢুকেছিল। রাতে সেও ঘুমোয়নি। আমিও ঘুমোইনি রাত চারটে অবধি।

ঢাকিল প্রায় পৌঁছে গেছে আমাদের কাছে এমন সময়ে জঙ্গলের বাঁদিকের থেকে হঠাৎই একসঙ্গে নানা পাখির উত্তেজিত ডাক, ইংরাজিতে যাকে বলে ‘ক্যাকোনি’ তাই শোনা গেল। আমি ওদের দুজনকে মহুয়া গাছটাতে চড়ে পড়তে বলে সেই আওয়াজ যেখান থেকে হল সেদিকে রাইফেলটাকে রেডি পজিশনে ধরে সন্তর্পণে এগোতে লাগলাম। জঙ্গলে ঢোকামাত্র চোখে পড়ল যে এখানে কটি আমগাছ আছে একসঙ্গে। অথচ আন্ধারী-তাড়োবাতে আম নেই বললেই চলে। আমের গাছে আম এসেছে। কাঁচা আম। জংলি আম সকালে ভাল্লুক আর শয়েরা হয়তো খেতে আসবে কিন্তু কাঁচা আমে তাদের বিশেষ রুচি নেই। পনেরো কুড়ি পা যেতেই আমার কেমন গা-ছমছম করতে লাগল। একটা ভয়ের আর বিপদের অনামা অনুভূতি। বাঘের তো ডানদিকের জঙ্গলে যাবার কথা। এদিকে ভয়ের কী?

শ’ খানেক গজ এগোতেই একটা হুপী পাখি হুপী হুপী হুপী করতে করতে তীব্র বেগে প্রায় আমার নাকমুখ খিমচে দিয়ে বনের ভিতর থেকে উড়ে বাইরে চলে গেল। ময়ুর ডাকতে লাগল কেঁয়া কেঁয়া কেঁয়া করে। আরও দু পা গিয়েই আমি থমকে দাঁড়ালাম। আমার গা গুলিয়ে উঠল, মাথা ঘুরে গেল। আমার বয়সি একটি গোঁন্দ মেয়ে সম্পূর্ণ নিরাবরণা, আমার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে আর তার মাথার কাছে তার শতচ্ছিম রক্তমাখা শাড়িটা ফালাফালা হয়ে পড়ে আছে।

দেখলাম মেয়েটির অনেক অংশই বাঘে খেয়ে নিয়েছে, সেখানে দগদগে বিরাট বিরাট ক্ষত। ডান কাঁধের কাছ থেকেও খেয়েছে কিছুটা। রাইফেলের সেফটি ক্যাচটা ঠেলে আনসেফ করে আমি রাইফেল শুটিং পজিশানে ধরে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘাড় না ঘুরিয়ে চোখ ঘুরিয়ে দুদিকে দেখলাম। শিকারি মাত্ৰকেই ছেলেবেলা থেকে একশো আশি ডিগ্রি vision-এ অভ্যস্ত হতে হয়। চোখ সোজা রেখেও একশো আশি ডিগ্রি দেখতে না শিখলে পায়ে হেঁটে শিকার করতে যাওয়া মুর্খামি।

বাঘ, মানুষ এবং সব জানোয়ারকেই পেছন থেকে এবং বাঁদিক থেকে আক্রমণ করে নেহাত বেগতিক না দেখলে। যে-কোনও মুহূর্তে বাঘ আমার ওপর লাফিয়ে পড়তে পারে। বাঁ পাশ থেকে বা ডান পাশ থেকেও। এক একটি মুহূর্ত কাটছে না যেন ঘণ্টা কাটছে। একবার মনে হল জেঠুমনির কাছে ফিরে গিয়ে, যদি ফিরে যেতে পারি আদৌ, তো গিয়ে বলি, জেঠুমনি, আমার ভয় করছে ভীষণ, আমার দ্বারা মানুষখেকো বাঘ মারা হবে না। কিন্তু পরমুহূর্তে নিজের বুকে অসীম সাহস ফিরে এল।

সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও বাঘের কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। বুঝলাম যে বাঘও জানে এই কথাটা যে Discretion is the better part of val our. কারণ বাঘ তার চেহারা একবার দেখালে ফোর-হানড্রেড ফোর ফিফটি রাইফেলের গুলি তাকে নড়তে দিত না, তার উপরে বাঁদিকের ব্যারেলও ফায়ার করতাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। আজকে বাঘের সঙ্গে আমার dating হল না। দিনের বেলা বলেই হয়তো হল না। বাঘ হয়তো রাতেই dating করতে ভালবাসে।

বাঘ যে তার মুখের স্বাদু খাবার ছেড়ে সরে পড়েছে কোনও দুর্বোধ্য কারণে সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আমি ওদের নেমে আসতে বললাম গাছ থেকে।

খাবে বলে মানুষ মেরে তাকে ফেলে রেখে বাঘ চলে যে যায় না তা নয়, অনেক মানুষের সম্মিলিত চিৎকারে, আওয়াজে বন্দুকের গুলির শব্দে সে অসীম বিরক্তিতে মুখের খাবার ফেলে রেখে সরে যায় কিন্তু এমনই নিঃশব্দে সে একজন নিঃশব্দ এবং আনাড়ি শিকারির আগমনে যে চলে গেল এটা বড় অবাক করল। এমন ঘটনা বড় বড় শিকারিদের অভিজ্ঞতাতেও বেশি ঘটেছে বলে জানি না।

ওরা এলে আমি জেঠুমনির দেওয়া গামছাটা, যেটা টুপির নীচে জলে ভিজিয়ে পরেছিলাম, খুলে দিলাম। মেয়েটির শাড়িটার আর কিছু ছিল না। সেই গামছা দিয়ে কোনওক্রমে মেয়েটিকে জড়িয়ে নিল ঢাকিল। তার ঘাড় ভেঙে গেছিল এবং ঘাড়ের কাছে বাঘের ক্যানাইন দাঁতের দুটো গভীর দাগ ফুটে ছিল। রক্ত ঝরছিল তা থেকে অবিরাম। ঢাকিল তার পরনের হাফ হাতা নীলরঙা জামাটাও খুলে পরিয়ে দিল মেয়েটিকে।

ঘটনাটা সম্ভবত ঘটেছিল এরকম। পরে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা। করে এই রকম ধারণাতেই আসি। মেয়েটি আম পাড়তে এসেছিল। এই গরমে আমবাটা চাটনি বা আমগোড়া শরবত খেত হয়তো। মানুষখেকো বাঘের জন্যেই এসব অঞ্চলে আজকাল ফরেস্ট গার্ডরাও আসে না। এই সুযোগে সে আম পাড়তে এসেছিল। মেয়েটির কাছে ফরেস্ট গার্ড যতখানি ভয়াবহ মানুষখেকো বাঘ তার চেয়ে বেশি ভয়াবহ ছিল না। তাই সে সাহস করে ওই সুযোগটি নিয়ে এসেছিল। ও যখন আমগাছের দিকে যাবে এমন সময় দূর থেকে উর্দিপরা তেন্ডুলকারকে সে সম্ভবত দেখে ফেলে। দেখে ফেলে, খুব তাড়াতাড়ি জঙ্গলের গভীরে আমগাছ তলাতেই লুকাবে বলে জঙ্গলের ভিতরে এগিয়ে যায়। এদিকে ডানদিকের জঙ্গলের থেকে বেরিয়ে বাঘ রাস্তা ধরে আমাদের পেছনে পেছনে সামান্য এসেই রাস্তা ছেড়ে বাঁদিকের জঙ্গলের ভিতরে ভিতরে আমাদের বাঁদিক দিয়ে পেছন পেছন আসতে থাকে। সে যে রাস্তা পার হয়েছে আমরা এগিয়ে আসার পরে আমাদের পিছন দিয়ে, তা আমরা বুঝতেও পারিনি। তার পায়ের দাগ পরে দেখতে পাই।

এমন সময় আমগাছের নীচে সে মেয়েটিকে দেখে অথবা হয়তো মেয়েটিকে আমাদের আগে আগে যেতে দেখেই তার পিছনে পিছনে তাকেই অনুসরণ করে সে যায়, আমাদের নয়। মেয়েটি চিৎকার করতে পারেনি। ফরেস্ট গার্ড তার চিৎকার শুনলেও তার বিপদ হত। বাঘ শুনলেও তাই।

এত সব তত্ত্ব আমরা পরে গাঁওবুড়ো এবং আরও কয়েকজন অভিজ্ঞ মানুষকে সঙ্গে করে অকুস্থলে ফিরে এসে, মেয়েটির পায়ের দাগ, বাঘের পায়ের দাগ এসব দেখে সকলে অনুমান করি। ওদের অভিজ্ঞতা আমার চেয়ে অনেকেই বেশি। মৃত্যুই হাতছানি দিয়ে ওকে আমগাছগুলোর কাছে নিয়ে যায়।

এবারে কফি এসে গেছে ঋজুদা।

ভটকাই অ্যানাউন্স করল।

ফাইন। বলল, ঋজুদা।

চা খাবেন কি কেউ? ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

তিতির হাত তুলল। প্রদীপকাকুও। আমিও বললাম চা-ই খাব।

ফিঙ্গার চিপসগুলো দারুণ হয়েছে। ক্রিসপ। কিন্তু গল্পটা তার চেয়েও দারুণ। তাপসকাকু বললেন।

প্রদীপকাকু বললেন, তারপরে বলুন দাদা। কেউ কথা বোলো না। উনি ডিসট্রাকটেড হয়ে যাচ্ছেন।

হ্যাঁ। ঋজুদা বলল, সচরাচর হিউম্যান কিল যদি ম্যানইটার করে, তবে সেই কিল-এর ওপরেই শিকারির বসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার পক্ষে ওই সুন্দরী যুবতী মেয়েটিকে দেখার পরে আমারই সামনে বাঘ তাকে টুকরো করে ছিঁড়ে খাবে এই ভাবনাই বরদাস্ত হচ্ছিল না। তা ছাড়া, মেয়েটির স্বামী ও মা-বাবা তার সৎকারের জন্যেও অধীর ছিল। অপঘাতে মৃত্যু হলে তো পোড়ায় না, ওকে কবর দেওয়া হল গ্রামের কবরভূমিতে। আমার মনে একটু সুখ হল মেয়েটির শেষতম পরিণতিটা বাঘের দাঁতে হল না বলে। আমি ভাবছিলাম, অত বড় বাঘটা যে অদৃশ্য হয়ে গেল, কেমন করে অদৃশ্য হয়ে গেল? তার আওয়াজ পর্যন্ত আমি পেলাম না। ভোজবাজির মতো।

এই হল বাঘ। বাঘকে যারা ভাল করে জেনেছেন শুধু তারাই জানেন বাঘ কী!

গ্রামের লোকেরা ইতিমধ্যেই আমার বিরুদ্ধে অনুযোগ করতে শুরু করেছিল। তারা বলেছে, দিনের বেলায় হাতে রাইফেলধারী শিকারির নাকের ডগা থেকেই যখন বাঘ মেয়েটিকে ধরে ফেলে মেরে ফেলল, আর একটু হলে পুরোপুরি খেয়েও ফেলত, সেই শিকারি রাতের বেলা এ বাঘ মারতে পারবে তার স্থিরতা কী? এদিকে এ নিয়ে অতজন মানুষ মরল বাঘের হাতে। এই সদ্য গোঁফ গজানো শিকারিকে চলে যেতে বলে কোনও পাকা শিকারিকে আনা হোক। এখনই।

তাদের ভাবনা ও দাবি যে অনায্য এমনও বলতে পারি না। আদৌ পারি না। বাঘের সঙ্গে যোগাযোগ কেন যে হল না তা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবে এটুকু বুঝেছিলাম যে অকুস্থলে আমি গিয়ে পৌঁছানোর আগেই বাঘ সরে পড়েছিল।

আমি পড়লাম ভারী বিপদে। পরামর্শ করার মতোও কেউ নেই।

ওরা দুপুরে আমাকে ভাত-তরকারি খেতে দিয়েছিল। আমি খেলাম না। খুব করে জল আর একটা পেঁয়াজ খেয়ে একটি বড় সেগুন গাছের নীচে ঘুমাবার চেষ্টা করতে লাগলাম যাতে বুদ্ধিটা খোলে এবং গত রাতের ক্লান্তিটাও যায় সেই জন্যে। কিন্তু এই গরমে ঘুম কিছুতেই এল না। বাইরের গরমের মতো মাথাও গরম ছিল খুবই।

বিকেলে নোটাতে ফোঁটানো দুধসর্বস্ব চা খেলাম। চা তৈরি হয়েছিল তেন্ডুলকারের নির্দেশে। তারপর বলদটার দড়ি ধরে আমরা এগোলাম সেই অর্জুন গাছটার দিকে। বাঘ সারাদিন এবং গত রাতেও কিছু খায়নি। কপাল ভাল থাকলে সে হয়তো বলদটাকে আজ মেরে খাবার জন্যে আসতে পারে। সে প্রায় অভুক্তই। আছে। বাঁধা খাবারের লোভ না ছাড়তেও পারে।

বাঘ খুব একটা দূরেও নেই। সকালে সে যখন এতটাই কাছে ছিল, এই লুবওয়া দুপুরে সে নিশ্চয়ই খুব দূরে যায়নি। কোনও জলা বা ভেজা জায়গাতে কোনও বড় গাছের নীচে বা বাঁশঝাড়ের মধ্যে নিশ্চয় সে দুপুরে শুয়ে ছিল। অর্জুন গাছটা থেকে দুশো গজের মধ্যে বনবিভাগের খোঁড়া একটা পুকুর মতো আছে। সেখানে বাঘের পানীয় জলের সংস্থান হতে পারে। কাঁচা রক্ত-মাংস খাবার পর ওদের পিপাসা পায় খুব। অনেক ভেবেচিন্তে আমার আর কোনও চয়েস না থাকাতেই ওই অর্জুন গাছেই বসব পাঁচটার আগে গিয়ে এমনই ঠিক করেছিলাম। ঢাকিল আমার সঙ্গে মাচাতে বসতে চাইছিল কিন্তু ভাষা একটা বড় সমস্যা। যদিও মানুষখেকো বাঘের অপেক্ষায় বসে থাকা শিকারির কথা বলা তো দূরস্থান নড়াচড়াও করা বারণ। ইঙ্গিতেই সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে হয়। অনেক বিশ্বস্ত সঙ্গীও গুবলেট করে ফেলে মোক্ষম সময়ে আর এ তো সম্পূর্ণই অপরিচিত আমার। তেন্ডুলকারকে বসতে অনুরোধ করলাম। কিন্তু হুশিয়ার সে বলল, অভয়ারণ্যের মধ্যে বাঘ শিকার, এতে আমি অংশ নিলে পরে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি, সে বাঘ মানুষখেকোই হোক আর যাই হোক। কানিকটার সাহেবের মতো সাহসী তো সবাই নয়। তা ছাড়া কানিটকার সাহেবের সঙ্গে আপনাদেরও বিপদ হতে পারে পরে। এই ব্যাপারটা তাড়াতাড়ি খতম হলে এক কথা। যতই দেরি হচ্ছে ততই এতে ঝুঁকি বাড়ছে সকলেরই। কারণ বনবিভাগের ওপরতলাতে কানিটকার সাহেবের ওপরেও আরও অনেক সাহেব আছেন।

ব্যাপারটা যে আমি বুঝলাম না, তা নয়। ভাল করেই বুঝলাম, কিন্তু করণীয় কী?

ডাক্তার রাঠোরকে নিয়ে জিপ চন্দ্রপুর চলে গেছিল। শুনলাম জেঠুমনি খুবই রাগ করেছেন আমার ওপরে। ড্রাইভার বলল। জিপটি ফিরল তিনটে নাগাদ। আমি জিপটাকে আটকে রাখলাম। আমার মাথাতে অন্য বুদ্ধি খেলল। ঠিক করলাম রাত এগারোটা অবধি মাচাতে বাঘের জন্যে অপেক্ষা করে তারপর বাকি রাত খুব আস্তে আস্তে জিপ নিয়ে চক্কর দেব পুরো জঙ্গলে। সব কিছুই তো বে-আইনিই হচ্ছে, পুরোটাই বে-আইনি হোক, যদি বাঘটাকে মারা যায়। কৃষ্ণপক্ষের রাত। বাঘের চোখ চিনে নিতে ভুল হবে না আমার পাঁচ ব্যাটারির বন্ডের টর্চের আলোতে। তা ছাড়া জিপের হেডলাইট তো থাকবেই। আমেরিকান আর্মির ডিসপোজালের জিপ। তার স্টিয়ারিং তিন পাক ফলস।

জিপের ড্রাইভারকে বললাম যে, রাত এগারোটা অবধি যদি মাচার দিক থেকে গুলির শব্দ না শোনো তবে এগারোটাতে তুমি ওই গাছটার কাছে আসবে জিপ চালিয়ে।

মুঝে খা লেগা বাঘ। মাফ কিজিয়েগা হুজৌর।

সে ভয়ার্ত গলাতে বলল। মেয়েটির পরিণতির কথা সে ফেরামাত্র শুনেছিল।

বলল, হামকি চার গো লেড়কি হ্যায় বাবু। এককোভি কি সাদি নেহি হুয়ি। হামকো মারাইয়ে মাৎ।

আমি বললাম, তুম পাগল হো! কুছ নেহি হোগা। তোমার তো জিপ থেকে নামতে হবে না। হেডলাইট জ্বালিয়ে ও এঞ্জিন পুরো স্টার্টে রেখে তুমি জিপের মধ্যেই বসে থাকবে। আমি মাচা থেকে নেমে তোমার জিপে এসে উঠব। আর যদি মাচার দিক থেকে গুলির শব্দ পাও গ্রামে বসে তবে তার আধ ঘণ্টা পরে ওই ভাবেই জিপ নিয়ে আসবে। তোমার কোনওই ভয় নেই। পৃথিবীর কোনও বাঘ স্টার্টে-থাকা আলো জ্বলা জিপ থেকে মানুষ নেয়নি। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।

বলদটাকে নিয়ে মাচা অবধি এলাম। পেছন পেছন জিপও এল। আমি আর তেন্ডুলকার হেঁটে গেলাম। আমি রাইফেল হাতে আর তেন্ডুলকার বলদের দড়ি হাতে। বলদটাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। উৎফুল্ল, কারণ সারাদিন সে বিশ্রাম পেয়েছে, খাদ্য-পানীয়ও পেয়েছে। জন্মাবধি এত খাতির সে কখনওই পায়নি। তবে গত রাতে বড় বাঘটা দুবার এসেছিল তখন সে দড়ির শেষ প্রান্তে টান মেরে বাঁধন ঘেঁড়ার চেষ্টা করেছিল খুব, কিন্তু পারেনি। তারপর দু-দুবারই বাঘ তাকে দেখে চলে গেছিল। এসব মাচার নীচে নানা চিহ্ন দেখেই বুঝেছিলাম আমরা।

জলের বোতল, টর্চ এবং রাইফেল এক এক করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে তেন্ডুলকার এবং ঢাকিল জিপে উঠল। আমি মাচায় ওঠার আগেই ওদের বললাম, আমি মাচাতে বসলে তোমরা তিনজনে খুব হল্লাগুল্লা করতে করতে জিপ খুব আস্তে আস্তে চালিয়ে ফিরে যাবে যাতে বাঘ ভাবে যারা এসেছিল তারা সকলেই ফিরে গেল। এরা একজনও ভিতু নয়। বরং আমার চেয়েও অনেকই সাহসী। আমার হাতে তো জেফরির ফোর-ফিফটি ফোর হান্ড্রেড ডবল ব্যারেল রাইফেল আছে। ওরা যে নিরস্ত্র। সাহসের ওদের সত্যিই অভাব নেই। তেন্ডুলকার বলল, ম্যায় জাগতে রহে গা। ড্রাইভারকি সাথ ম্যায় ভি আওয়েগা।

কী আর বলি! বললাম সুক্রিয়া।

কে জানে! বাঘ আমাদের কথোপকথন শুনল কি না? শুনলেও বুঝত না নিশ্চয়ই। জেঠুমনির কাছে শুনেছিলাম যে উত্তরবঙ্গের এক চা বাগানে বাঘ মারার জন্যে ক্ষেপে-ওঠা এক কলকাত্তাইয়া শিকারি জেঠুমনিকে বলেছিলেন, May I Speak in English? মাচায় বসে কথা বলতে বারণ করাতেই উনি এই প্রশ্ন করেছিলেন। অর্থাৎ দিশি বাঘ, বিলিতি বুলি কি বুঝবে?

জিপটা এবং সঙ্গে ওরাও চলে গেলে হঠাৎই জঙ্গলটা খুব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। আমার খুব ভয় করতে লাগল। এক জোড়া কপারস্মিথ ডাকছে। একটা আছে জঙ্গলের ডানদিকে অন্যটা বাঁদিকে। দোসর। সাড়া দিচ্ছে একে অন্যকে। এই জঙ্গলে র‍্যাকেট-টেইলড ড্রঙ্গো আছে। তারাও ডাকছে তাদের ধাতব শব্দে। ওই পাখিগুলোই সকালকে পথ দেখিয়ে আনে। আলো ফোঁটার অনেক আগে থাকতে এদের ঝগড়া ঝগড়া খেলার ধাতব শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। এরা জাগার অনেকেই পরে জাগে বনমোরগ এবং ময়ুর, বুলবুলি, নানা ফ্লাইক্যাচার, থ্রাশার, হানিসাকার ইত্যাদিরা। এদের ডাক শুনলেই বোঝা যায় ভোর হতে খুব দেরি নেই, আধঘন্টাটাক পরেই আলো ফুটবে।

চারদিকে চেয়ে দেখলাম অনেকগুলো ভূত গাছ আছে ওখানে। আশ্চর্য! আগে কেন যে লক্ষ করিনি কে জানে। বোতল খুলে ভাল করে জল খেয়ে নিলাম। এখনও বেশ গরম। হাওয়াটা এখন মরে গেছে একেবারে। গরম হোক আর যাই হোক, হাওয়া থাকলে তাও একরকম। হাওয়াহীন দাবদাহ অসহ্য।

বসে বসে নানা কথা ভাবছি। ভাবছি, জেঠমনি এখন কেমন আছেন? ডাক্তার নাকি বলেছেন যে কালকের মধ্যে ফিট হয়ে যাবেন। হলেই ভাল। ভাবছি, বাঘটা দুপুরে কোথায় কোন দিকে বিশ্রাম নিচ্ছিল। বাঘ জীবনে খুব কমই ডাকে। শিকারের সময়ে সে কখনওই ডেকে তার অবস্থান জানায় না। যখন বাঘিনীর সঙ্গে থাকে বা সঙ্গী খোঁজার আগে বাঘ ডাকে। তখনকার ডাক যারা শুনেহেন শুধু তারাই জানেন। আর বাঘ যখন কখনও কখনও গুলি খেয়ে হুংকার দেয় রাগে, তখনকার ডাকও যারা শুনেছেন তাঁরাও জানেন তার প্রকৃতি। বাঘ কিন্তু অনেক সময় গুলি খেয়েও ডাকে না। এরকম সংযম আর কোনও প্রাণীর আছে কি না জানি না, মানুষের তো নেই-ই। গুলি খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মরে গেলে তো গেলই কিন্তু মারাত্মক আহত হয়েও টু শব্দটি করে না বাঘ পাছে তার অবস্থান জানান দেওয়া হয়। বাঘ এক আশ্চর্য জানোয়ার। অসীম সাহসী, ব্যক্তিত্বময়, ধৈর্যবান এবং সাধক। বড় সাধু-সন্ন্যাসীদেরই মতো তার সাধনা নিন এককের। চেলা-চামুন্ডাতে তার বিশ্বাস নেই। সে স্বয়ম্ভর, একাই একশো।

তারপর? থামলে কেন? বলো ঋজুকাকু। তিতির বলল।

কখন যে দিন চলে গিয়ে রাত এল বোঝা পর্যন্ত গেল না। বুনো হাঁসেরা যেমন করে বালিয়াড়ি ছেড়ে জলে নামে জলে প্রায় কাঁপন না তুলেই তেমনি করে দিন রাতের মধ্যে মিশে যায়। যেন বলে তারা ফুটে উঠল একে একে। সন্ধ্যাতারা, কালপুরুষ, শতভিষা, ক্রতু, পুলত, স্বাতী কত নাম জানা ও অজানা তারা। অন্ধকার যতই আঁকিয়ে বসতে লাগল ততই ভূত গাহুগুলো তাদের আধিভৌতিক সাদা চেহারা এবং ডালপালা অনেক সাদা হাতের মতো অন্ধকারে বিস্তার করে একেক জন একেক পোজে দাঁড়িয়ে রইল। তারা কি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে? না কি তারা চলছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই-ট্রেডমিল টেস্ট করার মতো। গাহেরা যুগ যুগ ধরে এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে কত না পথ, পৌঁছে যাচ্ছে কত না দেশে। ভাবলেও রোমাঞ্চ হয়।

পথের পিছন দিক থেকে একটি ইয়ালো-ওয়াটেল ল্যাপউমিঙ্গ টিটিরটা ঢিটিরটি করে ডাকতে ডাকতে উড়ে আসতে লাগল আমায় মাচার দিকে।

বাঘ কি চলতে শুরু করেছে? বাঘ নাও হতে পারে। ওরা বনে-জঙ্গলে কোনও নড়াচড়া দেখলেই ওমনি করে ডাকে এবং চলমান জানোয়ার বা মানুষের মাথার ওপরে উড়তে উড়তে ওদের লম্বা লম্বা পা দোলাতে দোলাতে চলতে থাকে হাওয়াতে ভেসে। ওদের চোখ এড়ানো সবচেয়ে বড় শিকারি বাঘের পক্ষেও সময়ে সময়ে অসম্ভব হয়।

একটা হুতোম প্যাচা ডেকে উঠল বিকট শব্দ করে উলটোদিকের বন থেকে। অন্ধকারে তার সাদা ডানা মেলে দিয়ে একটি লক্ষ্মী প্যাচা উড়ে এসে একটি ভূত গাছে বসতেই ভূত গাছের সাদাতে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারাদের নীলাভ আলো ভূত গাছেদের গায়ে হালকা নীলের আভাস ছোঁয়ান্স। শম্বর ডাকল মোহার্সির দিক থেকে ঘা-ঘা-ঘা করে। একটা কোটরা হরিণ হঠাৎই ভয় পেয়ে অ্যালসেশিয়ান কুকুরের মতো ঘাউ ঘাউ ঘাউ করে ডেকে বনের মধ্যে এক আলোড়ন তুলে দিল। তার ডাক প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল উলটোদিকের বন থেকে।

রাত আটটা নাগাদ কোনও একটা জানোয়ার, মাংসাশী জানোয়ার এল, মাচার পেছন দিক থেকে এসে বলদটাকে দেখতে লাগল। সে যে মাংসাশী তা বোঝা গেল বলদটার হাবেভাবেই। সে ভয় পেয়েছে। যেদিকে জন্তুটা আছে তার একেবারে বিপরীতে দড়ির শেষ প্রান্তে খোটার সঙ্গে টান দিয়ে চার পা গুটিয়ে বলদটা ধড়ফড় করছে। জানোয়ারটা কোনও চিতা-ফিতাও হতে পারে। আমি উদগ্রীব, উৎকর্ণ, উৎকণ্ঠিত হয়ে দু উরুর উপরে শোয়ানো রাইফেলের ট্রিগার-গার্ডে আঙুল ছুঁইয়ে বলদটার দিকে চেয়ে বসে আছি। ফিকে লালরঙা বলদটাকে নিকষ কালো অন্ধকারে সাদাই দেখাচ্ছে।

বাঘ এলে, আমায় অন্ধকারেই গুলি করতে হবে। রাইফেলে অন্ধকারে মারা যায় না কারণ রাইফেলে দুটি সাইট থাকে। ব্যাক সাইট ও ফ্রন্ট সাইট। শটগান থাকলে রাতে মারতে সুবিধা হত। শটগানের শুধু মাছি থাকে একটা দু নলের প্রান্তে, মাঝখানে। নিশানা না নিয়েও শটগানে মারা যায়। তবে আমি তখনও তত পোক্ত হইনি। তা ছাড়া শটগান তো আছে মেনির কাছে। বাঘ যদি বলদটাকে ধরতে আসে তবে গুলি খেয়ে বাঘ মারাত্মক জখম হবে, তারপর সেই আহত বাধাকে মারতে হবে। অত শত ভাববার সময় নেই এখন আর। আজ রাতের মধ্যেই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে।

বলদটা আবার স্বাভাবিক হল। বুঝলাম যে আগন্তুক এসেছিল ফিরে গেল, সে কে এবং কোথায় গেল সেই হচ্ছে কথা।

রাত কত তা কে জানে। আমার ঘড়ির ডায়ালে রেডিয়াম নেই। টর্চও জ্বালা যাবে না। অতএব কত রাত তা জানা গেল না। ভারী ঘুম পাচ্ছে। কাল রাত চারটে অবধি জেগে আজও দুপুরে ঘুম হয়নি। ঘুমে চোখের পাতা বুজে এসেছিল। হঠাৎই একটা অস্বস্তি হওয়াতে চোখ খুলে দেখি সকালের কালো গোঁন্দ মেয়েটি মাচার সামনে, বলদটার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। সে খুব হাসছে। কিন্তু তার রং ছিল ঘোর কালো, চুলে একটা লাল রিবন ছিল। এখন তার সর্বাঙ্গ সাদা, তার মাথার চুলও সাদা। সে দুটি হাত দুদিকে ছড়িয়ে যেমন করে মাটিতে শুয়েছিল যেমন করে শূন্যে ভাসতে ভাসতে একটা ভূত গাছে গিয়ে বাঁদিকের ডালে বসল যেন। কিন্তু তারপরেই তাকে আর দেখা গেল না। ভূত গাছের উজ্জ্বল সাদা রং তাকে গ্রাস করে ফেলল। আর তার আলাদা কোনও অস্তিত্ব রইল না।

আমার ঘুম-টুম সব উবে গেল। সে মিলিয়ে যেতে আমার যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।

আবারও কি ঘুম বা ঘোর এসেছিল? বলতে পারব না, ঘোর ভাঙল জিপের ইঞ্জিনের শব্দে। তার মানে এগারোটা বেজেছে। হেডলাইটের আলোর বন্যা বইয়ে জিপটাকে এনে পথের উপরে যখন দাঁড় করাল ড্রাইভার ঠিক তখনও গ্রামের দিক থেকে পাখিটা খুব জোরে জোরে ডাকতে লাগল, ডিড উ্য ডু ইট ডিড ঊ্য স্যু ইটটিটিরটি টিটিরটি টিটি টিটি। আমি ওয়াটারবটল গলায় ঝুলিয়ে এক হাতে টর্চ আর অন্য রাতে রাইফেল নিয়ে মাচা থেকে নেমে জিপের সামনের সিটে বসতেই তেন্ডুলকার বলল, দিল কহতা হ্যায় কি বাঘ গাওকি তরফ গ্যয়া।

কী করে বুঝলে?

গ্রামের কুকুরগুলো খুব চিৎকার করছিল।

চিতা-টিতাও দেখে থাকতে পারে।

নেহি। ইক কুটরা ভি বহত তড়পতাত্মা গাঁও কি নজদিকহি মে। আদমি পাকড়নেকি লিয়ে বাঘ সায়েদ গ্রামহিমে ঘুষা। উওতো জানতাই হ্যায় যো উসকি ডরনেকা কোঈ বাত নেহি গাঁওমে।

আমার বুক ধ্বক করে উঠল। সকালে মেয়েটিকে মারল আবার রাতে যদি আর কারওকে মারে তবে আর লজ্জা রাখার জায়গা থাকবে না সবে গোঁফ-ওঠা শিকারির।

আমি বললাম, ড্রাইভারকে, তাড়াতাড়ি জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে গ্রামের দিকে চলল।

ড্রাইভার তাড়াতাড়ি জিপ ঘুরিয়ে গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল।

গ্রামের কাছাকাছি যেতেই, সকালে যে মহুয়া গাছটার নীচে গাঁওবুড়োর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তারই একটু পরে গ্রামের দিকে একটি বিরাট লাল উজ্জ্বল চোখ দেখা গেল। বাঘের চোখ। কিন্তু একটা কেন? একটাই কোনও সন্দেহ নেই। দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। জিপটা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে ওই জায়গাতে।

পথের পাশে নালা কাটা ছিল বনবিভাগের। এও এক ধরনের ফরেস্ট লাইন। আগুন লাগলে আগুন গর্তে পড়ে যাতে মরে যায় সে জন্যে। বাঘটা নিশ্চয়ই সেই নালার মধ্যে নেমেছে লুকোবার জন্যে। তেন্ডুলকার আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরা সত্ত্বেও, ড্রাইভার জোরে জোরে মাৎ উতারিয়ে, মাৎ উতারিয়ে বলা সত্ত্বেও আমি রাইফেল হাতে লাফিয়ে নামলাম জিপ থেকে। আমার খুন চেপে গেছিল। দিগ্বিদিক জ্ঞান ছিল না। ড্রাইভার জিপটাকে বাঁদিকে সাইড করে দাঁড় করাল। ওর বুদ্ধি থাকলে ও জিপটাকে একটু ব্যাক করে দাঁড়াতে পারত যাতে জায়গাটা হেডলাইটের আলোতে দেখা যায়। জিপটা বাঁদিকে সরে যেতেই আমি অন্ধকারে পড়ে গেলাম কিন্তু জিপ থেকে নেমেই আমি নালার পাশে চলে এসেছিলাম। এসেই দেখি বাঘ নালা ধরে দৌড়ে পালাচ্ছে। বেশ দূরেই চলে গেছিল, প্রায় ষাট গজ হবে। রাইফেল তুলে অন্ধকারেই আমি গুলি করলাম বাঘের পিঠ লক্ষ করে। একেবারে যে অন্ধকার তা নয়, জিপের হেডলাইট পেছনে থাকলেও আলোর আভাস ছিল একটু।

গুলি করতেই, বাঘটা একটা বিরাট লাফ মারল। সোজা উপরে। অনেক দূর উঠে গেল। নালাতেই যখন পড়ল তখন তার মুখটা হল আমার দিকে। নালাতে পড়েই সে সারা শরীর মাটিতে শুইয়ে দিয়ে কান দুটো পেছনে লেপটে দিয়ে লেজ সোজা করে উল্কার মতো আমার দিকে যেন উড়ে আসতে লাগল। বুঝতে পারলাম যে গুলি পিঠে লেগেছে। কিন্তু মেরুদণ্ডে লাগেনি।

তারপর? তারপর? তুমি কী করলে?

দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ভটকাই বলল।

আমি আর তিতির তো বটেই অন্য সকলেই উৎকর্ণ হয়ে বসেছিলেন। গল্প শুনেই আমার যাকে বলে সিটিং উইথ আওয়ার হার্টস ইন আওয়ার মাউথ।

ঋজুদা বলল, তখন কিন্তু আমি একটুও হড়বড় করলাম না। কোথা থেকে জানি না, মনের মধ্যে খুব জোর এল, মাথা ঠান্ডা হল, সমস্ত একাগ্রতা দিয়ে বাঘকে দেখতে লাগলাম আমি।

আজকে পেছনে তাকিয়ে যখন ভাবি তখন ষোলো বছরের একটি ছেলের দুঃসাহসের কথা ভেবে নিজেই অবাক হয়ে যাই। ট্রিগারে আঙুল, পেছনের ট্রিগারে, নতুন গুলি ভরার সময় তো নেই। বাঘ আরও কাছে এলে তার মাথা আর ঘাড়ের সংযোগস্থলে বাঁদিকের ব্যারেলের গুলিটি দেগে দেব সেই প্রতীক্ষাতে অধীর হয়ে রুদ্ধশ্বাসে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। তিরিশ-চল্লিশ গজ আসতে বাঘের তিরিশ সেকেন্ডও লাগেনি। বাঘ নালার বুক বেয়ে এসে আমাকে যখন প্রায় ধরে ফেলবে, জেঠুমনির বন্ধু দুর্গা রায়ের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, তখন ‘পাইড়্যা ফেলাইবে’ ঠিক তখনই আমি ট্রিগারটা টেনে এক লাফে ডানদিকে রাস্তার মাঝখানে পড়েই রাইফেলের ব্রিচ খুলে পকেটে রাখা গুলি তুলি নিয়ে এক ঝটকায় দুটো গুলি ভরে নিয়ে আবারও এক লাফে বাঁদিকে সরে নালার দিকে এগিয়ে গেলাম রাইফেল বাগিয়ে ধরে।

ততক্ষণে নিরস্ত্র তেন্ডুলকার অসীম ও অবিশ্বাস্য সাহসে টর্চটা হাতে ধরে জিপের পেছন থেকে নেমে টর্চ জ্বালিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বাঘটা নালাতেই পড়ে আছে-নালাটা বাঘের শরীরে ভরে গেছে। তার দুচোখের উপরে বন্ড-এর টর্চ-এর আলো পড়তেই অঙ্গারের মতো জ্বলে উঠল এক চোখ। এবারে তার দুচোখের মাঝে ডানদিকের ব্যারেলের গুলি দেগে দিলাম আমি। সেই গুলিটি লাগতেই খোলা চোখটি আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে এল।

তেন্ডুলকার আনন্দের চোটে আমার হাত থেকে রাইফেলটা ছিনিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে বাঁদিকের ব্যারেলটা ফায়ার করেই রাইফেলের ধাক্কাতে নিজেই মাটিতে পড়ে গেল। হো হো করে হাসতে হাসতে আমি রাইফেলটাকে কোনওক্রমে ধরে সেটাকে জখমের হাত থেকে বাঁচালাম। হেভি রাইফেল দিয়ে গুলি করার সময়ে ‘হোল্ডিং’ যদি ভাল না হয় তবে কলার বোনও ভেঙে যেতে পারে। ড্রাইভার আনন্দে জিপের হর্নের ওপর শুয়ে পড়ল। যদিও তা করাটা খুবই অন্যায়। অভয়ারণ্যে হর্ন বাজানোই মানা। সেখানে হর্ন এর উপরে শুয়ে পড়লে জন্তুদের খুবই বিরক্তি উৎপাদন করা হয় কিন্তু কখনও গ্রামবাসীদের আনন্দও উৎপাদন করা হয়।

ওরা ক্রমশ এই বাঘের বিভীষিকাকে মেনে নিয়ে এক কাফু কবলিত জীবনে অভ্যস্ত হওয়া শুরু করেছিল, ঠিক সেই সময়েই তাদের মুক্তি এল সবে গোঁফ-গজানো আমার হাত দিয়ে।

তারপর? তারপর? মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল। একজন মহাবলের এই রকম মৃত্যুর কথা ভেবে।

বলেই, ঋজুদা বলল, আর কোনও প্রশ্ন নয়। ভটকাই, ডিনার সার্ভ করতে বলো। অদ্যই শেষ রজনী। কাল খুব ভোরে উঠে জঙ্গলে যাব তারপরে ফিরে চান করে ব্রেকফাস্ট করে আন্ধারী-তাড়োবাকে এবারের মতো টা টা করে দিয়ে নাগপুরের দিকে রওয়ানা হব আমরা মোহাৰ্লি গেট হয়ে চন্দ্রপুর হয়ে।

ভটকাই বলল, জি হুজৌর।

ঋজুদা বলল, আমি আর কোনও প্রশ্নের জবাব দেব না কিন্তু তোমাদের সকলকে কটি প্রশ্ন করব। তোমরা ভাববা, আলোচনা করো, তারপরে নাগপুরে ফিরে সন্ধেবেলা প্রশ্নগুলির উত্তরগুলো দিয়ে।

কী প্রশ্ন? সকলেই প্রায় সমস্বরে বলে উঠলাম ও উঠলেন।

প্রথম প্র: বাঘটা মানুষখেকো হল কেন?

দ্বিতীয় প্রশ্ন: বাঘটা বেশি খেতে পারত না কেন?

তৃতীয় প্রশ্ন: বাঘটা কানা হয়েছিল কোন কোন সম্ভাব্য কারণে?

তার চামড়া ছাড়ানোর সময়ে আমরা দেখেছিলাম যে সে খুবই রোগা হয়ে গেছিল। এবং তার একটা চোখ কানা ছিল। বাঘটার শরীরে কোনও ক্ষত ছিল না, মানে কোনও শিকারির গুলিতে আহত হয়ে তার এই বৈকল্য ঘটেনি।

বাঘটার কি পোস্টমর্টেম হয়েছিল? তিতির বলল।

হয়েছিল। বনবিভাগেরই একজন ভেট করেছিলেন।

তার রিপোর্ট কী ছিল? প্রদীপকাকু জিজ্ঞেস করলেন।

তা বলব না। মানে, নাগপুরেই বলব যা বলার। তোমরা এ দুদিন গেসওয়ার্ক করো।

এ তো মহা কুইজ দিলে তুমি। ভটকাই বলল।

তারপর বলল, রাতের খাওয়াটাই বরবাদ হয়ে যাবে, রাতে ঘুমও হবে না। কোনও মানে হয়। বলেই দাও না বাবা উত্তরগুলো।

ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে বলল, বলব। নাগপুরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *