১.১ আদিকাণ্ড

প্রথম চরণ
আদিকাণ্ড

জিরানিয়ার বিবরণ

অযোধ্যাজী নয়, এখনকার জিরানিয়া। রামচরিত মানসে [১৯]-এর নাম লেখা আছে জীর্ণারণ্য। পড়তে না পারো তা মিসিরজীকে দিয়ে পড়িয়ে নিও। তখনও যা ছিল, এখনও প্রায় তাই। বালিয়াড়ি জমির উপর ছেঁড়া ছেঁড়া কুলের জঙ্গল। রেলগাড়ি ইস্টিশানে পৌঁছবার আগেই ঘুমন্ত যাত্রীদের ঠেলে তুলে দিয়ে লোকে বলে জঙ্গল আ গেয়া, জিরানিয়া আ গেয়া (জঙ্গল এসে গিয়েছে, জিরানিয়া এসে গিয়েছে)।

তাৎমাটুলির লোকেরা একেই বলে টৌন (টাউন)। যেমন-তেমন হেঁজিপেঁজি শহর নয়– ভারী সাহার [২০] পীরগঞ্জ থেকেও বড়, বিসরিয়া থেকেও বড়। পীরগঞ্জে কলস্টর (কালেক্টর) সাহেবের কাছারি আছে? বিসারিয়ায় ধরমশালা আছে? পাদ্রী সাহেবের গীর্জা আছে? ভা-আ-রী সহোর জিরানিয়া। ঘণ্টায় ঘণ্টায় রাস্তা দিয়ে টমটম যায়; পাকা রাস্তা দিয়ে। দোতলা বাড়িও আছে, পাকা দোতলা। চেরমেন (চেয়ারম্যান) সাহেবের।

শহরের বাবুভাইয়ারা সব ছিলেন বাং-গালী; ওকিল, মুখতার, ডকটর, আমলা সব। তাঁদের ছেলেপিলেদেরও এ শহরে গর্ব ছিল তাৎমাদেরই মতো। না হলে সেকালের যুগে কালীবাড়ি কমিটির বার্ষিক রিপোর্ট পড়ার সময় বিরাটবপু রায়সাহেব জিরানিয়াকে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন, এটা একটা সামান্য পণ্ডগ্রাম। ছেলের দল চিৎকার করে তাঁকে আর গণ্ডশ্রম না করে বসে পড়তে বলে। তাদের নাগরিক গর্বে আঘাত লেগেছিল।

[১৯. তুলসীদাসজীর লেখা রামায়ণের নাম রামচরিতমানস। ভারতবর্ষের মধ্যে রামচরিতমানসই। সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় বই। রামচরিত্র মানসসরোবরের ন্যায় বিশাল। এর ভিতর রামকথারূপ হাঁস ঘুরে বেড়ায়। ২০. প্রকাণ্ড শহর।]

.

তাৎমাটুলির কাহিনী

এ হেন শহরের শহরতলি, তাৎমাটুলি; শহর যখন, তার শহরতলি থাকবে না কেন? জিরানিয়া আর তাৎমাটুলির মধ্যে আর কোনো গাঁ নেই। সেই জন্যই তাৎমাটুলিকে বলছি শহরতলি। শহর থেকে মাইল চারেক দূরে হবে; তাৎমারা বলে কোশভর [২১]। তাৎমাটুলির পশ্চিমে শিমুলগাছ-ভরা বকরহাট্রার মাঠ, তারপর ধাঙড়-টুলি। দক্ষিণ ঘেঁষে গিয়েছে মজা নদী কারীকোশী- লোকে বলে মরণাধার। মাঠের বুক চিরে গিয়েছে কোশী শিলিগুড়ি রোড। তাৎমাটুলির লোকেরা এই রাস্তাকে বলে পাক্কী [২২]। বোধ হয় তাৎমারা জাতে তাঁতি। তারা যখন প্রথম আসে, তখন খালি একজনের কাছে ছিল একটা ভাঙাচোরা গোছের গামছা বোনার তাঁত। দ্বারভাঙ্গা জেলার রোশরা গ্রামের কাছ থেকে অনেকদিন আগে এখানে এসেছিল দল বেঁধে- পেটের ধান্ধায়। না এরা চাষবাস করে না, বাসের জমি ছাড়া জমি চায় না আর বাড়িতে একবেলার খাওয়ার সংস্থান থাকলে কাজে বেরোয় না। সেটুকুও বোধ হয় জুটছিল না দ্বারভাঙ্গা জেলায়।

তাই এসে তারা ধন্না দিয়েছিল ফুকন মণ্ডলের কাছে। তিনি তখনকার একজন বড় কিষাণ (জোতদার) [২৩]। তাঁর আবার জমিদার হওয়ার ভারি শখ। নামমাত্র খাজনায় একরকম জোর করে তিনি এদের এই জমিতে রেখেছিলেন। নিজেই এদের বাড়ি করবার জন্য বাঁশ, খড় দিয়েছিলেন। চিঠির কাগজে মনোগ্রাম ছাপিয়ে ছিলেন– বকরহাট্টা এস্টেট, দেউড়ি ফুকননগর। তাঁর দেওয়া ফুকননগর ধোপে টেকেনি। নাম হয়ে গেল তাৎমাটুলি। যতদিন বেঁচেছিলেন, তিনি রোজ এখানে আসতেন। তাঁর পাড়ার বখা ছেলেরা তাঁর আসার পথ ছেড়ে দিত- সরে যা, সরে যা- জমিদার সাহেব ক্যাম্প ট্যাটমাঠোলিতে যাচ্ছেন, নিমাস্তিনের পকেটে এস্টেটের কাছারি নিয়ে। মোটা লেন্সের চশমার মধ্যে দিয়ে তিনি রোজ ধাঙড়টোলার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতেন।-সবুজ বাঁশবনের পিছনে পরিষ্কার করে নিকানো ধাঙড়দের খড়ের ঘরগুলো, এখান থেকেই যেন দেখতে পেতেন। অঙ্গনে, মেঠোপথে, আমগাছের তলায় খড়ের কুটোটি পর্যন্ত নেই। সব ঝকঝকে তকতকে। লোকেরা চকচকে কালো; সুন্দর স্বাস্থ্য। সেখানকার ছাগল, কুকুর, গাছ, ল্যাংটো শিশু, সবই যেন তাজা নধর। এতদূর থেকেও যেন দেখা যায় তাদের কাপড়-চোপড়, বাঁদরার [২৪] ছাইয়ের ক্ষার দিয়ে পরিষ্কার ধবধবে করে কাচা। মাদলের শব্দ যেন কানে আসছে পিড়িং।…

বকরহাট্টা এস্টেটের জমিদারবাবু ভাবেন কেন তাঁর প্রজা তাৎমারা এরকম হল না, কেন তারা ধাঙড়দের মতো ঠিক সময়ে খাজনা দিয়ে দেয় না। জমিদারি থেকে রোজগার না হয় নাই হল, কিন্তু প্রজারা একটু পরিষ্কার-টরিষ্কার থাকলে, একটু পাড়াটা দেখতে ভাল হলে, জমিদারের ইজ্জৎ বাড়ে। বাংগালী উকিল হরগোপালবাবু কতদিনই বা জিরানিয়ায় এসেছেন। এখনও ত্রিশ বছর হয়নি। যেবার রেললাইন হল বাংগালী বাবুভাইরা পিঁপড়ের মতো দলে দলে এসে শহরের এদিকে বাড়ি করলেন। ওদিকে সাহেবদের মহল্লা, সাহেবরাই রেললাইন আনিয়েছে নিজেদের পাড়ার কাছ দিয়ে। ওদিকে তো বাংগালী বাবুদের দাল গলল না। [২৫] ওঁরা এলেন এদিকে। তখন ধাঙড়রা থাকত ঐখানেই। লোক দেখলেই তারা পালায় দূরে। তাই তারা এসে বাসা বাঁধল আজকালকার ধাঙড়টোলায়। ভারি বুদ্ধিমান লোক হরগোপালবাবু পয়সা কামাতে জানেন। কাছারির নিলামে কেনা পড়তী জমি, গরুচরার জন্য লোকে নিত কিনা সন্দেহ, তাই দিলেন ধাঙড়দের মধ্যে বিলি করে। সেই জিনিসই এখন দেখ কেমন ফেঁপে ফুলে উঠেছে। ঐ কিরিস্তান বাংগালীদের সঙ্গেই খাপ খায়। যাকগে মরুকগে! রামচন্দ্রজী! কৃপা তুমহারি সকল ভগবান। [২৬]

এ অনেক দিনের কথা হল।

এর পর বহুবার বকরহাট্টার মাঠ সবুজ হয়ে গেল মরণাধারে জল এসেছে, বহুবার কুল পাকার সময় শিমুল বনে ফুলের আগুন লেগেছে, লু বাতাসে শিমুল তুলো উড়ে যাওয়ার সময় পাক্কীর ধারের নেড়া অশত্থ গাছগুলো তাৎমাদের আচার খাওয়ার জন্য কচি কচি ডগা ছেড়েছে। তাৎমাদের মধ্যে কেউ হিসাব জানলে বলত–এ ঢের সালের [২৭] কথা–দশ সাল, এককুড়ি, দোকুড়ি, তিনকুড়ি সালের কথা। মনে মনে গুনবার মিছা চেষ্টা করত–এর মধ্যে ঝোটাহারা [২৮] কবার স্নান করেছে [২৯]।

[২১. মাত্র এক ক্রোশ। ২২. পাকা রাস্তা। ২৩. জিরানিয়া জেলায় কিষাণ বলতে ঠিক যারা নিজের জমি চাষ করে তাদের বোঝায় না। দশ পনের হাজার বিঘা জমি যার সেও কিষাণ। কেবল গভর্নমেন্ট রেভেনিউ দিলেই তবে তাকে বলে জমিদার। ২৪. একরকম পরগাছা। ২৫. মুরদে কুলোল না; টু ফ্যাঁ চলবে না ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার হয়। ২৬. সবই তোমার কৃপা–তুলসীদাস থেকে। ২৭. অনেক বছর। ২৮. ঝুঁটিয়ালী; তাৎমারা মেয়েদের এই নামেই ডাকে। ২৯. তাৎমা মেয়েরা সাধারণত বছরে একবার ছট পরবের সময় স্নান করত। যে মেয়েরা একটু বেশি ছিমছাম, তারা স্নান করে মাসে একবার।]

.

তাৎমাটুলির মাহাত্ম্য বর্ণন

তাৎমাটুলিতে ঢুকতে হবে পালতেমাদারের ডাল থেকে মাথা বাঁচিয়ে। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই পাড়ার বাইরের দুর্গন্ধটা ঢেকে যায়–শুকনো পাতা পোড়ার গন্ধে। খড়ের ঘরগুলো বাঁকা নড়বড়ে– দেশলাইয়ের বাক্স পায়ের তলায় চেপ্টে যাবার পর ফের সোজা করবার চেষ্টা করলে যেমন হয় তেমনি দেখতে। ফরসা কাপড় পরা লোক দেখলে, এখানকার কুকুর ডাকে; কোমরে ঘুনসি বাঁধা ল্যাংটো ছেলে ভয়ে ঘরের ভিতর লুকোয়; বাঁশের মাচার উপর যে কঙ্কালসার রুগ্ন বুড়োটা ল্যাংটো হয়ে রোদ্দুরে শুয়ে থাকে, সেও উঠে বসতে চেষ্টা করে আদাব করবার জন্য। মেয়েরা কিন্তু একটু অন্য রকম। এর বাড়ির উঠোন আর ওর বাড়ির পিছন দিয়ে তো যাওয়ার পথ। ধোঁদলের হলদে ফুলেভরা একচালাটার নিচে যে মেয়েটা তামাক খাচ্ছে, সে না হুঁকোটা নামায়, না চিরকুট কাপড়কানা সামলে গায়ে দেবার চেষ্টা করে। ইঁদারাতলার ঝগড়া সেইরকমই চলতে থাকে, কেউ ভ্রূক্ষেপও করে না; তেলের বোতল হাতে কুঁজো বুড়িটা ফিক করে হয়তো জিজ্ঞাসাও করে হেসে ফেলতে পারে যে বাবু কোনদিকে যাবেন।

এই হল বাইরর রূপ; কিন্তু বাইরের রূপটাই সব নয়,–

 তাৎমাটোলার লোকেরা বলে- রোজা, রোজগার রামায়ণ, এই নিয়েই লোকের জীবন। অসুখে বিসুখে বিপদে আপদে এদের দরকার রোজার। রোজাকে বলে গুণী। রোজগার এদের ঘরামির কাজ আর কুয়োর বালি ছাঁকার কাজ। জিরানিয়ার অধিকাংশ বাড়িরই খোলার চাল, আর প্রত্যেক বাড়িতেই আছে কুয়ো। তাই কোন রকমে চলে যায়। লেখাপড়া জানে না, কিন্তু রামায়ণের নজির এদের পুরুষের কথায় কথায়, বিশেষ করে মোড়লদের। মেয়েদের না জিজ্ঞাসা করতেই তারা বলে- গাঁয়ে আছে কেবল পঞ্চায়তি আর পঞ্চায়তি আর পঞ্চায়তি [৩০]।

[৩০. পঞ্চায়তদের মোড়লকে বলে মহতো। চারজন মাতব্বরকে এরা বলে নায়েব। আর যে লুটিস তামিল করে, আর লোকজনকে ডেকেডুকে নিয়ে আসে তার নাম ছড়িদার। মহতো আর চারকন নায়েব পঞ্চায়েতে থাকে পাঁচজন, পঞ্চ।]

.

ধাঙড়টুলির বৃত্তান্ত

ধাঙড়টুলির সঙ্গে তাৎমাটুলির ঝগড়া, রেষারেষি চিরকাল চলে আসছে। ধাঙড়দের পূর্বপুরুষরা আসলে ওরাওঁ। কবে তারা সাঁওতাল পরগণা থেকে গঙ্গার এপারে আসে কেউ জানে না। তবে সাঁওতাল পরগণার ওরা ওঁদের ভাষার সঙ্গে তাদের ভাষার মিল আছে। ধাঙড়া ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে কথা বলবার সময় তারা হিন্দীতে কথা বলে। ধাঙড়দের মধ্যে কয়েক ঘর খ্রিস্টান। অধিকাংশ ধাঙড়ই সাহেবদের বাড়ি মালীর কাজ করে, যারা মালীর কাজ না পায় বা পছন্দ না করে তারা অন্য অন্য কাজকর্ম করে।

কুলের ডাল কাটা থেকে আরম্ভ করে মৌচাক কাটা পর্যন্ত কোন কাজেই তাদের আপত্তি নেই। সকলেরই গায়ে অসীম ক্ষমতা, আর কাজে ফাঁকি দেয় না বলে, সকলেই তাদের মজুর রাখতে চায়।

ধাঙড়রা তাৎমাদের বলে নোংরা জানোয়ার। তাৎমারা ধাঙড়দের বলে বুড়বক কিরিস্তান (বোকা খ্রিস্টান)।

ধাঙড়টুলি পরগণা ধরমপুরে, আর তাৎমাটুলি হাভেলী [৩১] পরগণাতে। রাজা তোডরমল্লের যুগে যখন এই দুটি পরগণার সৃষ্টি হয়, তখনও পরগণা দুইটির মধ্যের সীমারেখা ছিল একটি উঁচু রাস্তা। সেইটাকেই এযুগে পাকা করে নাম হয়েছে কোশী শিলিগুড়ি রোড। কিন্তু এখন ঐ রাস্তা কেবল ধরমপুরে আর হাভেলী পরগণার সীমারেখা মাত্র নয়, তাৎমা ও ধাঙড় এই দুটি হৃদয়েরও বিচ্ছেদরেখা। ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তাৎমা আর ধাঙড়দের মধ্যে নিত্য ঝগড়া লেগেই আছে। গায়ে পড়ে ঝগড়া আরম্ভ করে তাৎমারাই। ঝগড়াটা বেশ বেধে যাওয়ার পর পালানোর পথ পায় না। তবু অভ্যাস যাবে কোথায়।

[৩১. অন্দরমহল।]

.

বৌকা বাওয়ার আদিকথা

তাৎমাটুলির বড় রাস্তার ধারে আছে একটা প্রকাণ্ড অশত্থ গাছ। তার নিচে একটি উঁচু মাটির ঢিবি বেশ করে সিঁদুর মাখানো। ইনি হচ্ছেন তাৎমাদের গোঁসাই [৩২]। এই গোঁসায়ের সম্মুখে পোঁতা আছে একটা প্রকাণ্ড হাড়িকাঠ। এই জায়গাটার নাম গোঁসাইথান; লোকে ছোট করে বলে থান। প্রতি বছর ভাইদ্বিতীয়া না তার পরের দিন এই হাড়িকাঠে তেল সিঁদুর পড়ে, একটা নিশান পোঁতা হয়, আর চাঁদা করে কেনা একটা ভেড়া বলি দেওয়া হয়।

এই থানেই বৌকা বাওয়ার [৩৩] আস্তানা। বৌকা বাওয়ার আগে কিংবা পরে তাৎমাদের মধ্যে আর কেউ সাধু সন্ন্যাসী হয়নি। ছোটবেলায় বৌকা তার মার সঙ্গে ভিক্ষা করতে বেরুত। শহরের গেরস্তদের দোরগোড়ায় খোখা- আ নুনু-উউ [৩৪] এই ডাক শুনলেই বাড়ির লোকে বলত, এইরে বৌকামাই [৩৫] এসেছে, এখন দুটি ঘণ্টা চলবে একটানা চিৎকার। দিদিরা ছোট ভাইকে ভয় দেখাত- কাঁদলেই দেব বৌকামাইয়ের কাছে ধরিয়ে। সেই বৌকা বড় হয়ে তার দাড়ি-গোঁফ গজালে, হঠাৎ একদিন দেখা গেল যে, একটা চিমটে আর একটা ছোট ত্রিশূল নিয়ে সেই গোঁসাইথানে বসে আছে। পাড়ার লোকে দেখতে এলে, বৌকা ত্রিশূলটা ইট দিয়ে ঠুকে মাটিতে গেঁথে দিল। সেই দিন থেকে ঐ থানেই তার আস্তানা। এতদিনকার বৌকা ঐদিন থেকেই বৌকা বাওয়া হয়ে গেল। এর কিছুদিন পরের কথা। গোঁসাইথানের পাশেই পথের ধারে একটা ঝড়ে-পড়া পাকুড়গাছ বহুদিন থেকে পড়ে ছিল। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের জিনিস; কিন্তু তাৎমারা নিয়মিত শুকনো গাছটার থেকে জ্বালানি কাঠ নিচ্ছিল। শিকড়ের মোটা কাঠগুলোকে পর্যন্ত তারা গর্ত করে বের করে নিতে ছাড়েনি। পড়ে ছিল কেবল মোটা গুঁড়িটা। এই কাত হয়ে পড়া গুঁড়িটা একদিন সকালে খাড়া দাঁড় করানো অবস্থায় দেখা যায়। আরও দেখা যায় যে, বৌকা বাওয়া হাত জোড় করে গাছের চারিদিকে ঘুরছে আর প্রত্যেক পরিক্রমার পর একবার করে সূর্যদেবকে প্রণাম করছে। লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। রেবণ গুণী বলে, জিনের কাণ্ড। চশমা পরা সর্বজ্ঞ পেশকার সাহেব রায় দিলেন–ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড পথের ধারে ডাল পুঁতে গাছ লাগায়। সেই জন্য এসব গাছে ট্যাপরুট নেই-তা না হলে কি এরকম হয়। বিজনবাবু উকিলের কলেজে পড়া ছেলে ফরিদপুরের সূৰ্য্যোপাসক খেজুরগাছের কথা তোলে। স্কুলের ছেলেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে যে,–নন্তুদা পণ্ডিত হবে না? ও যে কলেজে ভুটানি [৩৬] পড়ে। এসব ব্যাখ্যা তাৎমাধাঙড়দের মনে ধরেনি। এই দিন থেকে বৌকা বাওয়ার পসার-প্রতিপত্তি অনেকগুণ বেড়ে যায়। তার নামডাক তাৎমাটোলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। গোসাইথানের বেদীর উপরের তেল-সিঁদুরের প্রলেপ আরও পুরু হয়ে উঠতে থাকে। বাওয়ার আস্তানার জন্য লোকে নিজে থেকে খড় বাঁশ দড়ি পৌঁছে দেয়।

তাদের বিয়ের সময় কন্যাপক্ষ টাকা পায় বরপক্ষের কাছ থেকে। তাৎমাটুলির বুড়ি বলে, আহা টাকার অভাবে বিয়ে করতে না পেরে বৌকাটা সন্ন্যাসী হয়ে গেল। তাৎমাদের ছেলের বিয়ে হলেই সাহেবদের মতো মা-বাপের থেকে আলাদা হয়ে যায়। এই ভয়ে বৌকার মা ভিক্ষায় জমানো আধলাগুলো একদিনও ছেলের হাতে দেয়নি। বৌকামাই মারা যাওয়ার দিন বৌকা যখন নারকেলের মালায় করে তার মুখে জল দিচ্ছিল, তখন সে ছেলের হাতটা বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল-অযোধ্যাজীতে গিয়ে থাকিস। সেখানে খুব ভিক্ষে পাওয়া যায়। পীপড় (অশত্থ) গাছ কোনোদিন কাটিস না। ধাঙড়টোলার কর্মাধর্মার [৩৭] নাচ দেখাতে যাস না, ওদের মেয়েরা বড় খারাপ। অদৌড়ি [৩৮] খেতে বড় ইচ্ছে করছে। নারকেলের মালা যেখানেই দেখবি তুলে নিস, ও এঁটো হয় না-এর পরের কথাগুলো বৌকা মায়ের মুখের কাছে কান নিয়ে গিয়েও বুঝতে পারেনি। কেবল শুকনো ঠোঁট দুখানা নাড়তে দেখেছিল। মায়ের আধবোজা চোখের কোণ থেকে যে জলের ধারা গড়িয়ে পড়েছিল, সেটাকে মুছিয়ে দিয়েছিল লেঙটের খুঁট খুলে নিয়ে। ঠোঁটের কোণের ছোট্ট লাল পিঁপড়েটাকে দু আঙুল দিয়ে খুঁটে তুলে দূরে ফেলে দিয়েছিল- মেরে ফেলতে মন সরেনি।

[৩২. তাৎমারা সূর্যদেবকেও গোঁসাই বলে; আবার ঐ অশত্থতলায় সিঁদুর মাখানো যিনি আছেন তাঁকেও গোঁসাই বলে। ৩৩. বোবা সন্ন্যাসী। ৩৪. খোকা, ছোট ছেলে। ৩৫. বৌকার মা; কারও নামের সঙ্গে মাই শব্দটি যোগ করলে অর্থ হয় অমুকের মা। ৩৬. Botany। ৩৭. ধাঙড়দের ভাদ্রপূর্ণিমার দিনের উৎসব আর পূজা। ৩৮. আদা দেওয়া একরকম বড়ি।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *