প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

২.৩১-৩৫ আমেরিকান টমি

২.৩১

আমেরিকান টমিদের পেছন পেছন ঘুরে বেড়ানোটা আজকাল বিনুদের নেশায় দাঁড়িয়ে গেছে। টমিদের খোঁজে এখন আর ব্যারাক পর্যন্ত যেতে হয় না। রাজদিয়ার রাস্তায়, স্টিমারঘাটে, নদীর পাড়ে ঝাউবনের দিকটায় সবসময় টমিগুলো টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে।

একদিন বিনুরা দেখতে গেল, তাদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে সেই কাঠের পুলটার ওপর দুই টমি একটা প্রকান্ড পাকা কাঁঠাল নিয়ে বসে আছে। খানিকটা দূরে মুসলমান চাষীদের এক জনতা উদগ্রীব দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে টমি দু’টোকে দেখিয়ে ফিসফিস গলায় নিজেদের ভেতর কী বলাবলি করছে।

বিনুরা প্রথমে চাষীদের কাছে গেল। শ্যামল শুধলল, কী ব্যাপার? কী হয়েছে?

একটি জোয়ান চাষী জনতার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, সাহেবগো কাছে আমরা একখান কাঠল (কাঁঠাল) বেচছি। কত দাম নিছি জানেন?

কত?

চাইর ট্যাকা।

তাই নাকি!

হ। কাঠলটার দাম বড় জোর আষ্ট আনা। নগদ সাড়ে তিনি ট্যাকা লাভ করলাম। একটা কাঠালে সাড়ে তিন টাকা লাভ করা দ্বিগ্বিজয়ের সমান। গর্বে ছোকরার বুক ফুলে উঠছিল।

আরেকটি মধ্যবয়সী চাষী বলল, শালারা যে কই থিকা (কোত্থেকে) আসছে! যা দাম চাই হেই দিয়া দ্যায়। ট্যাকা-পহার উপুর দয়ামায়া নাই। একখান কাঠল বেইচা চাইর ট্যাকা পাওন যায় বাপের জম্মে অ্যামন কথা শুনি নাই।

আরেক জন বলল, যা দ্যাখে শালারা হেই কিনে (তাই কেনে)। হেই দিন আমি তো আড়াই ট্যাকায় একখান কুমড়া বেচছিলাম।

তারপর দেখা গেল, শুধু কুমড়োই না, অবিশ্বাস্য অকল্পনীয় দামে আরও অনেক অনেক কিছু টমিদের কাছে বিক্রি করেছে।

অশোক এই সময় বলে উঠল, কাঁঠাল তো বেচ্ছে, আবার দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন?

সেই জোয়ান চাষীটি বলল, সাহেবরা আমাগো কী জানি কইতে আছে, বুঝতে পারতে আছি না।

মধ্যবয়সীটি বলল, অ্যামন তরাতরি এংরাজি কয় য্যান ছাগলে নাইদা (নেদে) যায়। কার সাইদ্য বোঝে! ভাবখানা এই, তাড়াতাড়ি না বলে ধীরে সুস্থে বললে সে ইংরেজি ভাষাটা অক্লেশে বুঝে ফেলত।

অশোক কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় টমি দুটো ডাকল, ইউ গায়—

বিনুরা ফিরে তাকাতে টমিরা হাতের ইশারায় ডাকল।

টমিদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সাহস বেড়ে গিয়েছিল। এখন আর তাদের ভয় পায় না বিনুরা। অশোক বলল, চল, ব্যাটারা কী বলছে শুনে আসি।

বিনু শ্যামল আর অশোক, তিনজনে পায়ে পায়ে পুলটার ওপর গিয়ে উঠল। উৎসুক জনতা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকল।

একটা টমি শুধোলে, নো ইংলিশ? অর্থাৎ অশোকরা ইংরেজি জানে কি না, সেটাই তার জিজ্ঞাস্য।

অশোক বলল, ইয়েস।

কাঁঠালটা দেখিয়ে এবার টমিটা বলল, উয়াটস দিস?

প্রথমে খুব চাপা গলায় অশোক বাংলায় বলে নিল, ব্যাটারা কী কিনেছে তাই জানে না। তারপর ইংরেজিতে বলল, ফুট।

খায়?

নিশ্চয়ই।

কেমন করে খেতে হয়? বলে দূরের জনতাকে দেখিয়ে টমিরা বলল, ব্লাডিগুলোকে জিজ্ঞেস করছি, কিছু বলছে না।

অশোক বলল, ওরা ইংরেজি জানে না, তাই তোমাদের কথা বুঝতে পারে নি।

দ্যাট মে বি–

এবার কাঁঠালটা ভেঙে খাওয়ার কায়দা দেখিয়ে দিল অশোক। একটা করে কোয়া মুখে পুরতে যেই স্বাদটা টের পাওয়া গেল আর যাবে কোথায়। দুই টমি চার হাতে কোয়া খুলে টপাটপ খেতে লাগল। খাওয়াটা সত্যিই দর্শনীয়। নিশ্বাস ফেলার যেন সময় নেই। বিচিসুদ্ধ কোয়াগুলো মুখ পুরে চিবোতে চিবোতে বিচিগুলো গালের পাশ দিয়ে বার করে দিচ্ছে।

দেখতে দেখতে কাঁঠালটা শেষ হয়ে গেল। পড়ে রইল মাঝখানের মোটা ভুতি আর কর্কশ কাটাওলা ছালটা।

খাওয়া তো হল। তারপরেই দেখা গেল আরেক সমস্যা। কাঁঠালের আঠায় হাত-মুখ, গাল-গলা, নাক, ভুরু, এমনকি জামা পর্যন্ত মাখামাখি হয়ে গেছে। টমিরা যতই ঘষে ঘষে তুলতে চাইছে ততই আঠা লেপটে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত, বিব্রত হয়ে আবার অশোকের শরণ নিল তারা, এ গায়–

অশোক বলল, ইয়েস—

ব্লাডি আঠা তো তুলতে পারছি না।

অশোক চৌকস ছেলে। বিনুদের দিকে তাকিয়ে বলল, শালাদের ট্যাক থেকে কিছু খসাচ্ছি। তারপর থেমে থেমে, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে টমিদের উদ্দেশে বলল, আঠা তুলে দিতে পারি, পাঁচ টাকা লাগবে।

ও, ইয়েস– হিপ পকেট থেকে এক মুঠো রেজগি আর নোট বার করে একটা টমি অশোকের হাতে দিল, গুনল না পর্যন্ত।

অবশ্য গুনল–প্রায় সাত টাকার মতো। টাকাটা পেয়েই সে বিনুকে বলল, তোমাদের বাড়ি তো কাছে। শিশিতে করে সরষের তেল নিয়ে এস। একটু বেশি করেই এনো।

সরষের তেল এলে তিন বন্ধু ডলে ডলে টমিদের হাত আর মুখ থেকে কাঁঠালের আঠা তুলে ফেলল।

টমি দুটো বেজায় খুশি। মাথা নেড়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ, কাম অন– বলে তিনজনের হাত ধরে কঁকিয়ে কঁকিয়ে কাঁধের জোড় প্রায় আলগা করে ফেলল।

উচ্ছ্বাস খানিকটা স্তিমিত হলে টমি দু’টো বলল, সিট ডাউন। এস, তোমাদের সঙ্গে গল্প করি।

বিনুরা বসল।

দুই টমি জড়ানো জড়ানো উচ্চারণে কত কথা যে বলতে লাগল। ক্লাস নাইনের ইংরেজি বিদ্যেয় তার সামান্যই বুঝতে পারল বিন, বেশিটা দুর্বোধ্য থেকে গেল। অশোক অবশ্য টমিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানে ইয়েস’ নো’ করে যেতে লাগল। তবে একটা কথা জানা গেল, রাজদিয়া আসার আগে টমি দু’টো কলকাতায় ছিল।

অনেকক্ষণ গল্পটল্প করার পর একটা টমি হঠাৎ বলে উঠল, হেঃ গায়—

অশোক জিজ্ঞাসু চোখ তাকাল, ইয়েস–

একটি চোখ কুঁচকে আরেকটা চোখ ইঙ্গিতপূর্ণ করে চাপা গলায় টমিটা বলল, বিবি হাউস মালুম? কলকাতায় থাকার ফলস্বরূপ দু’চারটি হিন্দি শব্দও তারা শিখে এসেছে।

একটু ভেবে অশোক বলল ইয়েস—

ইউ গুড গায়। আমাদের নিয়ে চল—

টেন রুপিজ–অশোক বলল। অর্থাৎ দশটি টাকা দিলে, তবেই বিবি হাউসের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে আসবে।

ইয়া ইয়া–হিপ পকেট থেকে আবার এক মুঠো নোট টোট বার করে অশোককে দিল টমিটা।

বিবি হাউসে’র ব্যাপারে টমি দু’টোর প্রচন্ড উৎসাহ। টাকা দিয়েই লাফ দিয়ে উঠে পড়েছে তারা এবং অশোকের হাত ধরে টানাটানি শুরু করেছে।

অগত্যা অশোকদের উঠতেই হল। এই সময় বিনু অশোকের কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, বিবি হাউস কী?

অবাক চোখে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অশোক বলল, জানো না!

না। বিনু বিমূঢ়ের মতো মাথা নাড়ল।

অশোক বলল, পরে বলব। তারপর আঙুল কামড়াতে কামড়াতে গলাটা নামিয়ে দিল, বিবি হাউস’-এর নাম করে তো দশ টাকা আদায় করলাম। এখন ব্যাটাদের কোথায় নিয়ে যাই? পরক্ষণে কী মনে পড়তে তার চোখের তারা নেচে উঠল, হয়েছে–

বিনু শুধলো, কী?

ব্যাটাদের এক জায়গায় নিয়ে যাব।

কোথায়? চলই না। গেলে বুঝতে পারবে।

অশোক টমিদের নিয়ে দক্ষিণ দিকের রাস্তা ধরল।

পুলের তলায় জনতা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। মাঝবয়সী সেই মুসলমানটি ভিড়ের ভেতর থেকে বলে উঠল, বাবু কাঠলের আঠা তোলনের লেইগা কত নিলেন?

অশোক বলল, সাত টাকা।

তাইলে এক কাঠল খাইতে এগার ট্যাকা লাইগা গেল!

উত্তর না দিয়ে অশোক হাসল।

লোকটা আবার শুধলো, সৈন্য দুইটা আরও ট্যাকা দিল না আপনেরে?

দ্বিতীয় বার টাকা দেওয়াও সে তা হলে লক্ষ করেছে। ব্যাপারটা স্বীকার করতেই হল অশোককে।

মধ্যবয়সী বলল, এই টাকাটা পাইলেন কোন খাতে?

খানিক চিন্তা করে অশোক বলল, সে তোমাকে পরে বলব।

অহন ওগো নিয়া চললেন কই?

শ্বশুরবাড়ি দেখাতে।

দক্ষিণ দিকে খানিকটা যাবার পর অশোকরা পুবে ঘুরল। তারপর কোনাকুনি কিছুক্ষণ হেঁটে বাংলো মতো একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বাইরে থেকেই অশোক বলল, যাও, ভেতরে যাও– বলেই পেছন ফিরে বিনুদের নিয়ে দৌড়। মুহূর্তে এর রান্নাঘর, ওর বাগান, তার চেঁকিঘরের ওপর দিয়ে উধাও হয়ে গেল।

বিনুরা থামল একেবারে তাদের পুকুরপাড়ে এসে। ঘাটে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে তিনজন অনেকক্ষণ হাঁপাল।

তারপর বিনু বলল, যেখানে টমি দু’টোকে দিয়ে এলে, ওটা তো পুলিশের বড়সাহেব মিস্টার রজার্সের বাড়ি–

যেন বিরাট এক কীর্তি করেছে, ভুরু নাচিয়ে নাচিয়ে কায়দা করে কিছুক্ষণ হাসল অশোক। তারপর বলল, ইচ্ছে করেই তো দিয়ে এলাম। একটু পর খোঁজ নিলে জানতে পারবে বাছাধনদের হাড় মাংস আলাদা করে রজার্স সাহেব মিলিটারি পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। উল্লুকরা বাংলা দেশে এসে ‘বিবি হাউস’ খুঁজছে!,

চকিতে সে কথাটা মনে পড়ে গেল বিনুর। বলল, ‘বিবি হাউস’ মানে কী, বললে না তো?

কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কী বলল অশোক। শুনতে শুনতে নাকমুখ ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল বিনুর, মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।

কলকাতা থেকে জ্ঞানবৃক্ষের অনেক ফল নিয়ে এসেছে অশোক। একটা একটা করে বিনুকে খাওয়াতে শুরু করেছে সে।

.

২.৩২

দিনকয়েক পরের কথা।

বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরছিল বিনুরা। স্টিমারঘাটের সামনে আসতেই চোখে পড়ল, একটা পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকানে ভিড় জমেছে।

কৌতূহলের বশে বড় বড় পা ফেলে কাছে আসতেই বিনুরা দেখতে পেল, একটা টমি একের পর এক সিগারেটের প্যাকেট কিনছে, তারপর সেগুলো খুলে হরিলুটের মতো ছড়িয়ে দিচ্ছে।

চারপাশের মানুষগুলো যেন চোখমুখ শানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে; সিগারেট ছড়ালেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

বিনুরা একপাশে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগল।

হঠাৎ টমিটার চোখ বোঁ করে ঘুরে এসে পড়ল বিনুদের ওপর। দেখেই বোঝা গেল, মদে চুর হয়ে আছে সে। তারই মধ্যে হিপ পকেট থেকে চ্যাপটা বোতল বার করে মাঝে মাঝে গলায় ঢালছে।

আচমকা টমিটা চেঁচিয়ে উঠল, ইউ ব্লাডি সোয়াইন—

বিনুরা ভয় পেয়ে গেল।

টমিটা ছুটে এসে অশোকের কলার চেপে ধরে চেঁচাল, ইউ আর স্ট্যান্ডিং–

অমন যে তুখোড় ছেলে অশোক, সেও একেবারে তোতলা হয়ে গেল, ইয়ে-এ-এ-এস স্যার—

ওয়াই?

ফর নাথিং স্যার, ফর নাথিং—

টমি গর্জে উঠল, নো–

মাতালটা ঠিক কী বলতে চায়, বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল অশোক। ভয়ে তার হাত-পা কাঁপতে লাগল। চোখের তারা যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে।

হঠাৎ টমিটা ধাক্কা দিয়ে অশোককে দশ হাত দূরে সরিয়ে দিল। তারপর সিগারেট কিনে ছড়াতে ছড়াতে বলল, টেক টেক–

এতক্ষণে বোঝা গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখলে চলবে না, সবার সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে হরির লুটের সিগারেট নিতে হবে। কী আর করা, সিগারেট কুড়োতেই হল।

বিনু আর শ্যামল দাঁড়িয়ে ছিল। টমির ভয়ে তাদেরও সিগারেট কুড়োতে হল। কুড়িয়ে যদি মুক্তি পাওয়া যেত! দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে টমিটা চিৎকার করল, ইউ ব্লাডি স্মোক।

বিনু ভাবল, একদিন আশু দত্ত রুস্তম আর পতিতপাবনের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। এই নদীর পাড়ে স্টিমারঘাটের আশে পাশে এমন কেউ নেই যে তাকে বাঁচাতে পারে।

সিগারেট খাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল বিনুর। হাতের আঙুলগুলো থরথর করছিল। মনে হচ্ছিল, মাথাটাথা ঘুরে পড়েই যাবে।

টমির আরেকটা হুঙ্কারে সিগারেট ধরিয়ে টান লাগাল বিনু।

.

সেই যে একটা নিষিদ্ধ রাজ্যের দরজা খুলে গিয়েছিল, তারপর থেকে নদীর পাড়ে লুকিয়ে ঝাউবনের ভেতর ঢুকে দুই বন্ধুর সঙ্গে সিগারেট খেতে লাগল বিনু। সিগারেট টমিরাই বেশি যোগাত, মাঝে মাঝে তারা নিজেরাও কিনত।

এ ব্যাপারে ভয় আছে, পাছে কেউ দেখে ফেলে। তবু লুকিয়ে লুকিয়ে নিষিদ্ধ কিছু করার ভেতর বিচিত্র এক উত্তেজনাও রয়েছে। সিগারেট টানতে টানতে বিনুর মনে হতে লাগল, সে যেন আর বাচ্চাদের দলে নেই, সিগারেটের ধোঁয়ায় চড়ে হঠাৎ অনেক বড় হয়ে গেছে।

সিগারেট খেয়ে চোরের মতো বাড়ি ফেরে বিনু। চনমন করে সবাইকে লক্ষ করে, সহজে কারোর কাছে ঘেঁষতে চায় না। তার আশঙ্কা, বুঝিবা তার মুখ থেকে কেউ সিগারেটের গন্ধ পেল।

মোটামুটি এইভাবে চলছিল।

হঠাৎ এক ছুটির দিনের বিকেলবেলা বিনু বেরুচ্ছে, ঝিনুক কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, বেড়াতে যাচ্ছ?

শ্যামল আর অশোক স্টিমারঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে। বিনু সংক্ষেপে উত্তর দিল, হ্যাঁ– বলেই ব্যস্তভাবে উঠোনে নেমে গেল।

পেছন থেকে ঝিনুক ডাকল, বিনুদা—

বেরুবার মুখে বাধা পড়ায় বিনু বিরক্ত। পেছন ফিরে রুক্ষ গলায় বলল, কী বলছ?

তোমার সঙ্গে কথা আছে।

পরে শুনব।

না, এক্ষুনি।

লম্বা লম্বা পা ফেলে ঝিনুকের কাছে ফিরে এল বিনু। চোখটোখ কুঁচকে বলল, কী বলবে, তাড়াতাড়ি বল–

ঝিনুক হাসল, অত তাড়া কেন? বন্ধুরা বুঝি দাঁড়িয়ে আছে?

শ্যামল আর অশোক যে তার সব সময়ের সঙ্গী, এ কথা জানতে আর কারোর বাকি নেই। বিনু কিছু বলল না, তার চোখ আরও কুঁচকে যেতে লাগল।

ঝিনুক একটু ভেবে বলল, তুমি আজকাল একটা জিনিস খাচ্ছ?

কী?

তুমিই বল না—

বুঝতে পারছি না।

চারদিক ভাল করে দেখে নিয়ে খুব চাপা গলায় ঝিনুক বলল, সিগারেট।

পলকে মুখখানা একেবারে কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। ভাল করে কথা বলতে পারল না বিনু। তোতলাতে তোতলাতে কোনও রকমে বলল, মিথ্যে কথা।

মিথ্যে? বিনুর চোখের দিকে তাকিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল ঝিনুক।

নিশ্চয়ই–বিনু খুব জোর দিয়ে বলতে চাইল বটে, কিন্তু গলার ভেতর থেকে দুর্বল একটা আওয়াজ বেরুল মাত্র।

তা হলে তোমার পকেট থেকে সিগারেট বেরুল কেমন করে?

আমার পকেট থেকে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, মশাই।

বিনু কিছু বলতে চেষ্টা করল, পারল না। তার বুকের ভেতরটা ঢাকের আওয়াজের মতো গুর গুর করতে লাগল।

ঝিনুক আবার বলল, ধোপাবাড়ি পাঠাবার জন্যে মাসিমা আমাকে তোমার ময়লা জামা আনতে বলেছিল। পকেট টকেটগুলো দেখে নিচ্ছিলাম, যদি পয়সাকড়ি কিছু থাকে। পয়সার বদলে ও মা, একেবারে সাপ বেরিয়ে পড়ল–

বিনুর এবার মনে পড়ে গেল, সেদিন টমিদের কাছ থেকে থেকে অনেকগুলো সিগারেট যোগাড় করেছিল। ঝাউবনে বসে কয়েকটা টেনেছিল, ক’টা রেখেছিল পকেটে। ভেবেছিল, পরে ফেলে দেবে। অসাবধানে ফেলে দিতে ভুলে গেছে।

শ্বাস আটকে আসছিল বিনুর। নাকের ডগাটা ঝি ঝি করছিল। সমস্ত শরীর যেন অসাড় হয়ে আসছে। কোনও রকমে সে বলতে পারল, মাকে সিগারেট দেখিয়েছ নাকি?

আস্তে আস্তে মাথা হেলিয়ে দিল ঝিনুক, হুঁ—

বিনুর হৃৎপিন্ডটা লাফ দিয়ে গলার কাছে উঠে এল যেন, সত্যি?

একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ঝিনুক। তারপর মাথাটা ধীরে ধীরে দু’ধারে নাড়ল। অর্থাৎ বলে নি।

সত্যি বলছ?

হুঁ—

আমাকে ছুঁয়ে বল।

বিনুর গায়ে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, হল তো?

এতক্ষণে সহজভাবে শ্বাস টানতে পারল বিনু। একটু হেসে বলল, বাঁচালে।

এই প্রথম, এই শেষ। এর পর খেলে আর বাঁচাব না। ঠিক মাসিমাকে বলে দেব।

আর খাবই না।

শ্যামলদা আর অশোকদার সঙ্গে মিশে মিশে তুমি খারাপ ছেলে হয়ে যাচ্ছ।

বিনু এ কথার উত্তর না দিয়ে বলল, সিগারেটগুলো কোথায়?

ঝিনুক বলল, আমার কাছে।

বিনু মুখ কাঁচুমাচু করে অনুনয়ের গলায় বলল, আমাকে দিয়ে দাও না—

ঝিনুক বলল, উঁহু—

দাও না, দাও না—

না। ওগুলো আমার কাছে থাকবে।

সিগারেট দিয়ে তুমি কী করবে?

তুমি যদি আমার কথা না শোন, মাসিমাকে-দাদুকে-দিদা, সবাইকে দেখাব।

কী সাঙ্তিক মেয়ে! বিনুর মনে পড়ল, কুমার সঙ্গে কাউফল পাড়তে গিয়ে মাঠের জলে ডুবে গিয়েছিল। সেই কথাটা মাকে বলে দেবে, এই ভয় দেখিয়ে অনেক দিন ঝিনুক তাকে তটস্থ করে রেখেছে, এক মুহূর্তও সুখে থাকতে দেয় নি।

জলে ডোবার ব্যাপারটা মলিন হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে সিগারেট বেরুল। আর কী আশ্চর্য, তার যত কুকীর্তি, সবই কিনা ঝিনুকের হাতে ধরা পড়ছে। ভাগ্যিস ঝিনুক ধরেছে। অন্য কারোর হাতে পড়লে কী যে হত, ভাবতে সাহস হয় না।

বিনু আর পীড়াপীড়ি করল না। শুধু বলল, সিগারেটগুলো একটু লুকিয়ে রেখো, কেউ যেন দেখে না ফেলে।

সে তোমাকে বলতে হবে না। এমন জায়গায় রেখেছি, কাতোর সাধ্যি নেই খুঁজে পায়।

একটু চুপ করে থেকে বিনু বলল, আমি তা হলে এখন যাই?

আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকাল ঝিনুক, উঁহু–এইভাবে মাথা ঝাঁকানো তার কতকালের অভ্যাস।

না গিয়ে এখন কী করব?

আমার সঙ্গে ক্যারাম খেলবে।

নদীর পাড়ে, ঝাউবনে কি স্টিমারঘাটের ওধারে মিলিটারি ব্যারাকে কোথায় অশোকদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে তা নয়। শুধু বাড়িতে বসে থাকো। করুণ গলায় বিনু বলল, ক্যারাম?

হ্যাঁ। নতুন বন্ধু পেয়ে আজকাল বাড়িতেই থাকো না। এখন আমার সঙ্গে খেলতেই হবে।

জলে ডোবার পর এই নতুন এক মারণাস্ত্র পেয়ে গেছে ঝিনুক। নাঃ, মেয়েটার হাত থেকে কোনও দিন মুক্তি নেই।

বিষণ্ণ মুখে ক্যারাম খেলতে বসে গেল বিনু।

.

২.৩৩

ঝিনুকের কাছে ধরা পড়বার পর অশোকদের এড়িয়ে চলতে লাগল বিনু। আজকাল টিফিনের সময় তাদের ফাঁকি দিয়ে স্কুলের পেছন দিকের সোনাল ঝোপে গিয়ে একা বসে থাকে। ছুটি হলেই চোখকান বুজে বাড়ির দিকে ছোটে।

কিন্তু ক’দিন আর। একদিন ছুটির পর চারদিক দেখে ছুটতে যাবে, তার আগেই অশোকরা ধরে ফেলল।

শ্যামল বলল, কি ভাই, আজকাল যে আমাদের সঙ্গে মিশতেই চাও না।

বিনু আবছা গলায় বলল, না, মানে পরীক্ষা এসে গেল। তাই–

চোখের তারা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অশোক বলল, হঠাৎ গুড বয় হয়ে গেলে যে! পরীক্ষা বুঝি আমাদের নেই?

না, মানে—

বার বার মানে মানে কী করছ? এস—

কোথায়?

বা রে, তুমি দেখছি এ ক’দিনে সব ভুলে গেছ! ছুটির পর আমরা যেখানে যাই সেখানেই যাব। স্টিমারঘাটে, টমিদের ব্যারাকে, ঝাউবনে–

তীব্র আকর্ষণ বোধ করছিল বিনু, আবার ভয়ও লাগছিল। শেষ পর্যন্ত ভয়ের দিকটাই ভারী হয়ে দাঁড়াল। বিনু বলল, তোমরাই যাও ভাই, আমার বাড়িতে একটু কাজ আছে।

কোনও কাজ নেই।

জোর করে বিনুকে টানতে টানতে অশোকরা ঝাউবনে নিয়ে গেল। গাছের আড়ালে বসে অশোক পকেট থেকে সিগারেট বার করল।

দেখেই বিনু হাত নেড়ে ভয়ে ভয়ে বলল, আমি কিন্তু ভাই সিগারেট খাব না।

কেন?

ঝিনুকের কাছে যে ধরা পড়ে গেছে তা আর জানায় না বিনু। শুধু বলল, এমনি।

একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আঙুলের ডগায় বিনুর থুতনিটা নাড়তে লাগল অশোক। ঠাট্টার গলায় বলল, সিগারেট তো খাবে না, তা হলে কী খাবে? ডুডু? কচি খোকা! বলতে বলতে একটা সিগারেট বিনুর ঠোঁটের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে ফস করে দেশলাই ধরাল।

.

কয়েক দিনের জন্য ঝিনুক বিনুকে ফিরিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু অশোকদের টান এত প্রবল, নিষিদ্ধ জিনিসের আকর্ষণ এত তীব্র যে আবার সে ভেসে যেতে লাগল।

অশোকদের সঙ্গে ফের ঘুরতে শুরু করেছে বিনু, আবার লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। যুদ্ধ লাগবার পূর্ব বাংলার হৃদয়ের গভীরে লুকানো এই মায়াবী রাজদিয়াকে ঘিরে যে উদভ্রান্ত ঘূর্ণি ঘুরে চলেছে তা যেন হাজার হাতে তাকে টানতে লাগল। বিনুকে ফেরাতে পারে তেমন শক্তি ঝিনুকের ক্ষুদ্র দুর্বল বাহুতে নেই।

অশোকদের পাল্লায় পড়ে সিগারেট টানে বটে, তবে আগের চাইতে অনেক বেশি সাবধান হয়ে গেছে বিনু। বাড়ি ফেরার সময় ভাল করে পেয়ারা পাতা চিবিয়ে নেয়, যাতে মুখে গন্ধ না থাকে। পকেট টকেটগুলো অনেক বার করে দেখে উলটে পালটে।

মোটমুটি এইরকম চলছিল।

হঠাৎ একদিন অঘটন ঘটে গেল। সেদিন আর ঝাউবনে বসে সিগারেট খাচ্ছিল না বিনুরা। সাহস দেখাবার জন্য বড় রাস্তা দিয়ে তিন বন্ধু বুক ফুলিয়ে হাঁটছিল, তাদের ঠোঁটের একধারে সিগারেট ঝুলছে। ভাবখানা এই, কাউকে পরোয়া করি না।

ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে যখন তারা আদালতপাড়ার কাছে এসেছে, সেই সময় বিনু টের পেলে একটা কর্কশ শক্ত হাত কানে সাঁড়াশির মতো চেপে বসেছে।

চমকে পেছনে ফিরতেই বিনু দেখতে পেল–মজিদ মিঞা। মুখ থেকে সব রক্ত যেন নিমেষে নেমে গেল, ঠোঁট থেকে সিগারেট খসে পড়ল। ভয়ে চোখের তারা স্থির, হাত-পা একেবারে জমে গেছে।

মজিদ মিঞাকে চেনে না অশোক। একটি অপরিচিত মুসলমানকে বিনুর কান ধরতে দেখে প্রথমটা হকচকিয়ে গিয়েছিল সে। তার পরেই রুখে উঠল, আপনি ওর কান ধরছেন যে?

মজিদ মিঞা বলল, বেশ করছি।

আপনি কি ওর গার্জেন?

গার্জেন-গুর্জেন উই হগল এংরাজি বুঝি না। অর কানটা যদিন ছিড়াও ফেলাই কেউ কিছু কইব। কানটা তো পেরথমে ছিড়মই। হের পর ভাইবা দেখুম, আর কী করন দরকার– বলে বিনুর কানে প্রচন্ড এক মোচড় দিল মজিদ মিঞা।

অশোক এবার ধমকের গলায় বলল, ভাল চান তো শিগগির ওর কান ছেড়ে দিন।

ছামরা তর কথায় নিকি?

হ্যাঁ, আমার কথায়।

মোচের র‍্যাখ (রেখা) পড়ে নাই, গলায় টিফি দিলে (টিপলে) মায়ের দুধ উইঠা আসব। ওই বসে (বয়সে) সিগরেট খাও, আবার চোখ লাল কর! র’ ছ্যামরা, তরে মজা দেখাই। বিনুর কানটা ডান হাতে ধরা ছিল, বাঁ হাত দিয়ে ঠাস করে অশোকের গালে এক চড় কষিয়ে দিল মজিদ মিঞা। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় ঘুরে পড়ল অশোক।

মজিদ মিঞা একাই ছিল না। তার সঙ্গে অন্য একটা লোকও ছিল। অশোক পড়ে যেতেই মজিদ মিঞা সঙ্গীকে বলল, ধর তো ছ্যামরারে, কত বড় বান্দর হইছে একবার দেখি।

মজিদ মিঞার মুখ থেকে কথা খসবার আগেই লোকটা বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে অশোককে ধরে ফেলল। ব্যাপার সুবিধের নয় বুঝে শ্যামল এই সময় ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট লাগাল।

পেছন থেকে মজিদ মিঞা চেঁচিয়ে বলল, তোমারে আমি চিনি বাসী, তৈলোক্য স্যানের নাতি তুমি। লৌড়াইয়া (দৌড়ে) পলাইবা কই? যাইতে আছি তোমাগো বাড়ি।

এদিকে অশোককে টানতে টানতে সেই লোকটা সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। মজিদ মিঞা তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কাগো বাড়ির পোলা তুমি?

অশোকের অবস্থা অবর্ণনীয়। এত যে তুখোড় সে, এত চৌকস, চোখে মুখে যার কথার খই ফোটে, একটু আগেও যে রুখে উঠছিল, এখন তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখ জলে ভরে গেছে।

মজিদ মিঞা ধমকে উঠল, কী হইল, মুখ দিয়া দেখি রাও (শব্দ) বাইর হয় না!

কাঁদো কাঁদো মুখে অশোক বলল, আর কক্ষনো করব না।

কান্‌তে (কাঁদতে) আরম্ভ করলা দেখি। গজ্জন তজ্জন গ্যাল কই? কান্দনে আমি ভুলুম না। কুন বাড়ির পোলা আগে কও। না কইলে কিলাম ল্যাঠা আছে।

ভয়ে ভয়ে অশোক এবার বলল, গোঁসাইবাড়ির–

তোমার বাপের নাম কী?

অনন্তকুমার গোস্বামী।

হঠাৎ ভীষণ রেগে উঠল মজিদ মিঞা। অশোকের গালের কাছে হাত নিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল, হারামজাদা, বাপেরে সোম্মান দিতে জান না! নামের আগে শিরিযুক্ত বাবু বসাইতে মানে লাগে!

মুখ নামিয়ে চুপ করে রইল অশোক।

মজিদ মিঞা এবার তার সঙ্গীকে বলল, কাশমা, তুই উই ছ্যামরারে গোসাইবাড়ি লইয়া যা। আমি হ্যামকত্তার বাড়ি থিকা আইতে আছি।

কাশমা অর্থাৎ কাশেম অশোককে নিয়ে চলে গেল। আর মজিদ মিঞা বড় রাস্তার ওপর দিয়ে বিনুর কান ধরে টানতে টানতে তাদের বাড়ি নিয়ে গেল। তার এমন ভয়ানক চেহারা আগে আর কখনও দেখেনি বিনু।

হেমনাথ অবনীমোহন স্নেহলতা সুরমা, সবাই বাড়িতেই ছিলেন। মজিদ মিঞা আর বিনুকে এভাবে আসতে দেখে তারা উদ্বিগ্ন মুখে বেরিয়ে এলেন।

হেমনাথ শুধদলেন, কী হয়েছে রে মজিদ?

সংক্ষেপে সব ঘটনা বলে গেল মজিদ মিঞা। শুনতে শুনতে অবনীমোহন সুরমা এবং স্নেহলতার নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল। অবনীমোহন মাথায় হাত দিয়ে সেখানেই বসে পড়লেন। স্নেহলতা আর সুরমা কিছু বলতে চেষ্টা করলেন, গলা দিয়ে তাদের স্বর বেরুল না। সুধা সুনীতি ফিসফিস করে নিজেদের ভেতর কী বলাবলি করতে লাগল। আর স্তব্ধ মুর্তির মতো একধারে দাঁড়িয়ে রইল ঝিনুক।

হেমনাথ একদৃষ্টে, পলকহীন তাকিয়ে ছিলেন। কথাটা যেন তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অনেকক্ষণ পর আস্তে করে বললেন, বলিস কী!

হ ঠাউর ভাই। এইর এট্টা বিহিত করেন। মজিদ মিঞা বলতে লাগল, অহনও সোময় আছে। পোলা চৌখের সামনে নষ্ট হইয়া যাইব, এ আমি সইতে পারুম না।

হেমনাথ হঠাৎ যেন খেপে উঠলেন, বিহিতের জন্যে আমার কাছে ধরে এনেছিস কেন, নিজে শাসন করতে পার নি? তুমি ওর কেউ হও না?

অবনীমোহন এই প্রথম কথা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি যা ভাল বোঝেন করুন। আমি তো ভাবতেই পারি না, ছেলেটা এত বড় উল্লুক হয়ে উঠেছে!

মজিদ মিঞা আবেগের গলায় বলল, হ, আমারই শাসন করা উচিত আছিল। আমি পরের লাখান কাম করছি। এইবার আপন মাইনষের লাখান কাম করি। বলে উঠোনের এক ধারে একটা খুঁটির সঙ্গে বিনুকে কষে বাঁধল। তারপর কোত্থেকে একটা কাঠের লম্বামতো টুকরো যোগাড় করে এনে সমানে। মারতে লাগল।

একেকটা ঘা পড়ছে আর চামড়া ফেটে ফেটে রক্ত ছুটছে। বিনু আকাশ ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল, আমাকে মেরে ফেলল, আমাকে মেরে ফেলল। আর কক্ষনো ও কাজ করব না।

দেখাদেখি ঝিনুকও কান্না জুড়ে দিল। ফেঁপাতে ফেঁপাতে বলল, বিনুদাকে মেরে ফেললে গো–

স্নেহলতাও ঝিনুকের সঙ্গে সুর ধরলেন, মজিদ, আর ওকে মেরো না।

অবনীমোহন বললেন, মারুন আপনি, মেরে শেষ করে দিন। এরকম ছেলের দরকার নেই আমার।

সুরমাও তা-ই বললেন। হেমনাথ উঠে গিয়ে স্নেহলতা আর ঝিনুককে রান্নাঘরে দিয়ে এলেন।

একসময় মেরে টেরে মজিদ মিঞা চলে গেল।

মারের চোটে কত জায়গায় যে কেটে গেছে। হাত-পায়ের আর কিছু নেই, ফুলে ডুমো ডুমো হয়ে উঠেছে। রক্ত জমাট বেঁধে জায়গায় জায়গায় কালশিটে পড়ে গেছে। ব্যথার তাড়সে সন্ধেবেলায় জ্বর এসে গেল বিনুর। ধুম জ্বর।

জ্বর আসার খানিকক্ষণ পর হাঁড়িভর্তি রসগোল্লা, মোহনবাঁশি কলার ছড়া আর একটা নতুন ফুটবল নিয়ে আবার এল মজিদ মিঞা। বাড়িতে পা দিয়েই বিনুর খোঁজ করল।

হেমনাথ বললেন, ওর জ্বর এসেছে।

জুর! মজিদ মিঞা চমকে উঠল, বিনু কই?

পুবের ঘরে শুয়ে আছে।

পাগলের মতো ছুটে পুবের ঘরে ঢুকল মজিদ মিঞা। তারপর বিনুর মাথার কাছে ফুটবল, মিষ্টির হাঁড়িটাড়ি রেখে, তার সারা গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে কাঁদতে লাগল, অয় রে, কী পাষাণ পরান আমার, দুধের শিশুরে মাইরা ফেলাইলাম–

কিছুক্ষণ হাত বুলোবার পর মজিদ মিঞা চলে গেল। ঘন্টাখানেক পর লারমোরকে নিয়ে আবার এসে হাজির হল। বলল, দ্যাখেন লালমোহন সাহেব, পোলায় নি আমার বাচব! বলে তার কী কান্না।

অবনীমোহন হেমনাথ যত বোঝন, জ্বর হয়েছে, সেরে যাবে–মজিদ মিঞা শোনে না। তার কান্না বাড়তেই লাগল, অয় রে, কী পাষাণ পরান আমার–

সারা রাত বিনুর শিয়রে জেগে বসে থাকল মজিদ মিঞা।

.

এরই ভেতর একদিন ঢাকা ইউনিভাটির এম.এ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়ে গেল। যা আশা করা গিয়েছিল, তা-ই হল। হিরণ ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে।

কলেজের চাকরি হয়েই ছিল। রেজাল্ট বেরুবার পর রাজদিয়ায় এসে প্রফেসারি নিল হিরণ।

.

২.৩৪

জ্বর ছাড়ার পর অবনীমোহনের সঙ্গে একদিন সুজনগঞ্জের হাটে গেল বিনু। হেমনাথ আসেন নি। ক’দিন ধরে তার জ্বর, একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। বিনু সেরে উঠবার পরই তিনি জ্বরে পড়েছেন।

দু’বছর হল বিনুরা রাজদিয়া এসেছে। এই প্রথম হেমনাথকে সে অসুস্থ হতে দেখল।

হাটে পা দিতেই বিনুদের কানে এল, সুজনগঞ্জে চাল পাওয়া যাচ্ছে না। এতবড় একটা গঞ্জ, যেখানে ফি হাটে কম করে হাজার, দেড়-হাজার মণ ধান-চাল বিকিকিনি হয় সেখানে একদানা শস্যও নেই। নদীর ধার ঘেঁষে সারি সারি আড়তগুলোতে তালা ঝুলছে। পুব দিকে হাটুরে চালার তলায় চারপাশের গ্রাম থেকে চাষীরা ঘরে ভানা চাল এনে বসত। চালাগুলো আজ ফাঁকা।

চাল নেই, চাল নেই।

তামাকহাটা বেগুনহাটা মরিচবাটা–যেখানেই বিনুরা যাচ্ছে, সন্ত্রস্ত গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছে।

হায় আল্লা, বাজারে চাউল নাই। নিজেরা খাই কী? পোলাপানরে  বাঁচাই ক্যামনে?

হে ভগমান, অদ্দিষ্টে কী যে আছে!

বিনুরা দেখতে পেল, হাটের নানা জায়গায় থোকা থোকা ভিড় জমেছে। সবাই ভয়ার্ত, বিহ্বল, দিশেহারা। চাল ছাড়া আর কেউ কোনও কথা বলছে না।

ঘুরতে ঘুরতে মাছ ব্যাপারি গয়জদ্দির সঙ্গে দেখা। সে বলল, হাটে কুন সময় (কখন) আইলেন জামাইকত্তা?

অবনীমোহন বললেন, একটু আগে।

খপর শুনছেন?

হ্যাঁ, শুনলাম।

পঞ্চাশ ষাইট বচ্ছর ব’স (বয়স) হইল, চাউলের অ্যামন আকাল আর দেখি নাই। ঘরে এক পাসারি চাউল আছে, তিন ওক্ত কইরা খাইলে তিনদিনও চলব না। দুই ওক্ত কইরা খাইলে বড় জোর চাইর রোজ। হেরপর কী যে করুম!

অবাক হয়ে অবনীমোহন বললেন, তোমার ঘরে মোটে এক পসারি চাল থাকবে কেন? তোমার না দশ কানি ধানের জমি!

গয়জদ্দি কপালে চাপড় মেরে বলল, আর কইয়েন না জামাইকত্তা, বুদ্ধির দুষ (দোষ) আর লোভ। দুইয়ে পইড়া এইবার গুষ্ঠিসুদ্ধা মরলাম।

কিরকম?

ধান-চাউলের দর যহন চ্যাতনের (

চার) মুখে হেই সোময় ঘরের বেবাক ধান-চাউল দিলাম বেইচা। টাকা হাতে পাইয়া মাথা গেল গরম হইয়া। চাষীর হাতে কাঁচা ট্যাকা। বুঝলেন জামাইকত্তা, বড় পোলার শাদি দিলাম। শাদির পর পনর দিন ধইরা খাওয়ানের কী চোট! আত্মবান্ধব মিলাইয়া চাল্লিশজন বাড়ি বইসা খাইল। রুজ মাছ। এই ব্যালা চিতল তো উই ব্যালা কাতল। হের উপুর গোস্ত, মিষ্টান্ন, পাতক্ষীর। অন্য পোলারা কমলাঘাটের বড় গুঞ্জ থিকা নয়া জোতা কিনা আনল, পিরহান কিনা আনল। টচ (টর্চ) বাত্তি, লুঙ্গি, ফন্টার পেন (ফাউন্টেন পেন), কত জিনিস যে কিনল! অহন ঘরে চাউলও নাই, ট্যাকাও নাই। অহন খালি কপাল থাপড়াই আর পাছা থাপড়াই। হগলই বুদ্ধির দুষ (দোষ)।

অবনীমোহনদের কথা বলতে দেখে আরও অনেকে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। যেমন মোতালে নিকারি, মনা ঘোষ, বৃন্দাবন ভূঁইমালী- এমনি পনের কুড়িজন। তারাও একই কথা বলল। দর চড়তে দেখে অনেকেই ধান-চাল বেচে দিয়ে কাঁচা টাকা দু’হাতে উড়িয়ে দিয়েছে।

মনা ঘোষ বলল, চাউলের কী করন? একখান বুদ্ধি দ্যান দেখি জামাইকত্তা—

অবনীমোহন বললেন, কী বুদ্ধি দেব, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

বৃন্দাবন ভূঁইমালী বলল, সুজনগুঞ্জে চাউল নাই। কাইল একবার মীরকাদিম, বেতকা, আউশইতে (আউটশাহীতে) যামু। দেখি পাওয়া যায় কিনা–

মোতালেফ নিকারি এই সময় বলে উঠল, কুনোখানে চাউল নাই। আমার বইনের জামাই পরশু ঘুইরা আইছে।

তয়?

তয় আর কি, মরণ। একখান কথা শুনছ?

কী?

কাইল গিরিগুঞ্জের বাজারে দুইটা দোকান লুট হইছে।

নিকি?

হ।

জন্ম ইস্তক চাউল লুটের কথা আর শুনি নাই।

প্যাটের জ্বালায় মাইনষের মাথা ঠিক থাকে! লুটপাট তো হপায় (সবে) আরম্ভ হইল। দ্যাখ না, কী কান্ড হয়!

আরেকখান কথা শুনছ?

কী?

ভাটির দ্যাশে চাউল না পাইয়া মাইনষে শাগ-পাতা খাইতে আছে।

কী যে হইব!

কথায় কথায় দুপুর হয়ে গেল। এখন সুর্যটা খাড়া মাথার ওপর উঠে এসেছে। অবনীমোহন কী বলতে যাচ্ছিলেন, সেই সময় বিষহরিতলার ওধারের মাঠ থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে এল। চমকে বিনু দেখতে পেল, ঢেঁড়াদার হরিন্দ উঁচু প্যাকিং বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তার দুই চেলা কাগা বগা সমানে ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছে। এস.ডি.ও সাহেব একধারে চেয়ারে বসে আছেন, একটা লোক তাঁর মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে। চারপাশে অসংখ্য লাল পাগড়ি। নতুনত্বের ভেতর আজ কয়েকজন মিলিটারি অফিসারকে দেখা যাচ্ছে।

বিনু ফিসফিস করে বলল, বাবা মিলিটারি এসেছে।

অবনীমোহন বললেন, হ্যাঁ।

আগে তো মিলিটারি দেখি নি।

তিন চার হাট তুই আসিস নি, তাই জানিস না। আজকাল ফি হাটে মিলিটারি আসছে।

কেন?

যুদ্ধের জন্যে লোক যোগাড় করছে। একে রিক্রুট করা বলে।

বিনু আবদারের গলায় বলল, বাবা, আমি রিক্রুট করা দেখব।

খুব একটা ইচ্ছা ছিল না অবনীমোহনের। তবু ছেলে যখন ধরেছে, আর না বলতে পারলেন না। বললেন, চল–

বিষহরিতলার কাছে আসতে দেখা গেল, লারমোর ঝাকড়া বটগাছের তলায় যথারীতি তাঁর রোগীপত্তর নিয়ে বসে আছেন। এত যে ডামাডোল, আকাল, যুদ্ধ, সমস্ত জল-বাংলা জুড়ে যে এত দুর্ভিক্ষের দুর্ভাগ্যের ছায়া, সে সবের কোনও দিকেই লক্ষ্য নেই তার। বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় এক প্রশান্ত ধ্যানের ভেতর তিনি মগ্ন হয়ে আছেন।

বিষহরিতলা বাঁয়ে ফেলে খোলা মাঠের কাছে আসতে দেখা গেল, ঢাকের বাজনা থেমে গেছে। এর ভেতর হাটের নানা দিক থেকে মানুষ গিয়ে সেখানে জমা হতে শুরু করেছে।

এস.ডি.ও সাহেব জমায়েতটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মোটামুটি শ’চার পাঁচেক লোক জমেছে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যারা সৈন্যদলে নাম লেখাবে তারা ডান দিকের ওই ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াও।

ভিড়ের ভেতর থেকে একজন দু’জন করে ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে লাগল। বিনুর মনে পড়ল, তিন চার সপ্তাহ আগে যখন সুজনগঞ্জের হাটে এসেছিল তখন রিক্রুমেন্টের কথায় হাটুরে লোকেরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এক মাসের কম সময়ের ভেতর কি এমন ঘটল যাতে তাদের ভয় কেটে গেছে?

হঠাৎ বিনুর চোখে পড়ল, তার ঠিক পাশে খলিল বছির তাহের এবং আরও ক’জন চরের মুসলমান দাঁড়িয়ে আছে। ধানকাটার মরশুমে তারা হেমনাথের বাড়ি আসে। কিছুদিন আগেও তাদের রাজদিয়ায় মাটি ভরাট এবং মিলিটারি ব্যারাক তৈরি করতে দেখা গেছে।

বছিরদের দেখে বিনু অবাক। বলল, তোমরা এখানে?

বছির বলল, যুজ্যে নাম লিখাইতে আইছি।

তোমরা যুদ্ধে যাবে!

হ।

এই সময় অবনীমোহন তাদের দিকে ফিরলেন। বছিরদের শেষ কথাগুলো তিনি শুনতে পেয়েছিলেন। বিস্ময়ের সুরে বললেন, যুদ্ধে যাবে কেন?

বছির বলল, কাম কাইজ নাই। কিছু এট্টা তো করন লাগব।

বিনু বলে উঠল, কাজ নেই মানে! এই তো ক’দিন আগে মিলিটারিদের ওখানে মাটি কাটছিলে। ব্যারাক তৈরি করছিলে–

হে আর কয়দিনের কাম? শ্যাষ হইয়া গ্যাছে।

খানিক ভেবে অবনীমোহন বললেন, আর কোথাও কোনও কাজ পেলে না?

না জামাইকত্তা বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়ল বছির, কুনোখানে কাম নাই। এই দিকে ধান-চাউল মিলে না। আগে চাষবাসের খন্দ গ্যালে মাইনষের বাড়িত্ কামলা খাটতাম। অহন কেও কামলা নেয় না। উপাস দিয়া দিয়া আর পারি না জামাইকত্তা। পোলাপান মরতে বইছে।

তাহের বলল, শুনছি, যুজ্যে গ্যালে প্যাটভরা খাওন মিলব, মাস মাস ট্যাকা পাওন যাইব। না খাইয়া মরার থিকা যুজ্যে যাওন ভালা না?

অবনীমোহন কী বলবেন, ভেবে পেলেন না।

তাহের আবার বলল, আমাগো চরের কেউ আর ঘরে বইসা থাকব না। হগলে যুজ্যে যাইব গিয়া।

খলিল বলল, হুদা (শুধু) আমাগো চরের নিকি, চাইর দিকে যা আকাল লাগছে, হেয়াতে যাগো ঘরে চাউল আছে হেরা (তারা) ছাড়া বেবাক মাইনষে যুজ্যে যাইব। না গিয়া উপায় নাই জামাইকত্তা। নিজেরা না খাইয়া থাকি, হে এক কথা। কিন্তুক চৌখের সামনে পোলা-মাইয়া প্যাটের জ্বালায় দাপাইয়া মরব, এখাইয়া থাকি, হেরা ছাড়া বেকার

অবনীমোহন অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলেন। এবারও কিছু বলতে পারলেন না।

ওদিক থেকে একটা কনস্টেবলের গলা ভেসে এল, যারা যুজ্যে যাইবা, উই ধারে গিয়া লাইন দিয়া খাড়াও–যারা যুজ্যে যাইবা–

প্রথমে এস.ডি.ও সাহেব যুদ্ধে যাবার ডাক দিয়েছিলেন। এখন তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে কনস্টেবলটা চেঁচিয়ে যাচ্ছে। আর এস.ডি.ও সাহেব চেয়ারে বসে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন। তার পাশে বসে আছে মিলিটারি অফিসাররা।

বছির আর অপেক্ষা করল না। ডান দিকে যেখানে লম্বা লাইন পড়েছে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখের পলকে লাইনটা বিশ হাত বেড়ে গেল।

যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক লোকগুলোর সংখ্যা যখন একশ’ ছাড়িয়ে গেছে, সেই সময় এস.ডি.ও সাহেব বললেন, এবার বাছাইয়ের কাজ শুরু কর।

তিন চারটি কনস্টেবল ফিতে দিয়ে ব্যস্তভাবে মাপামাপি শুরু করে দিল। একবার তারা লোকগুলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত মাপছে, তারপর বুকের ছাতি মাপছে।

সেনাদলে যাকে তাকে নেওয়া হয় না। সেখানে নাম লেখাতে হলে বিশেষ শরীরিক উচ্চতা, ওজন আর বুকের মাপ থাকা দরকার। তার কম হলে চলবে না।

কেউ লম্বায় ঠিক হচ্ছে তো বুকের মাপে আটকে যাচ্ছে। কারোর বুকের মাপ ঠিক হচ্ছে তো। লম্বায় আটকে যাচ্ছে।

এর ভেতর যারা চলাক চতুর তারা পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উচ্চতা বাড়াবার চেষ্টা করছে। যাদের বুক রোগা পাখির মতো তারা জোরে ফুসফুঁসে বাতাস টেনে টেনে ফুলিয়ে রাখছে। কিন্তু কনস্টেবলদের চোখে ধুলো ছিটানো সহজ নয়। যারা ডিঙি মেরে লম্বা হয়েছিল রুলের গুতোয় তাদের বেঁটে করে দিচ্ছে তারা। যারা বুক ফুলিয়ে রেখেছে তাদের পেটে ঘুষি মেরে হাওয়া বার করে দিচ্ছে।

যাদের মাপ মিলল, মুরগি বাছাইয়ের মতো তাদের একধারে দাঁড় করিয়ে রাখল কনস্টেবলরা, বাকিদের ভাগিয়ে দিল। দেখা গেল, শ’খানেক লোকের ভেতর অর্ধেকই বাতিল হয়ে গেছে।

বাছাইয়ের প্রথম কাজ হল দৈর্ঘ্য প্রস্থের মাপ নেওয়া। তারপর বাক্সের মতো চৌকো একটা যন্ত্রের ওপর বসিয়ে পছন্দ করা লোবগুলোর ওজন নেওয়া হল। ওজন নিতে গিয়ে আরও কিছু লোক ছাঁটাই হয়ে গেল।

ওজনের পর যারা টিকে রইল এস.ডি.ও সাহেব নিজের হাতে তাদের নাম ঠিকানা লিখে নিলেন। তারপর বললেন, পরশু দিন তোমরা রাজদিয়া মিলিটারি ব্যারাকে চলে যাবে।

লোকগুলো শুধলো, কহন যামু?

সকালবেলা। হ্যাঁ, ভাল কথা, খালি পেটে আসবে। সেদিন তোমাদের মেডিক্যাল হবে।

মেডিক্যাল কী?

স্বাস্থ্য পরীক্ষা।

ঝাড়াই বাছাইয়ের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করে এস.ডি.ও সাহেব মিলিটারি অফিসার এবং পুলিশ বাহিনী নিয়ে চলে গেলেন।

চরের যে মুসলমান কামলারা ধানকাটার সময় হেমনাথের বাড়ি আসে তাদের ভেতর একজনকে মোটে পছন্দ করা হয়েছে। সে তাহের। প্রাথমিক পরীক্ষায় বাকি কারোর যোগ্যতা প্রমাণিত হয় নি।

খলিল বছিররা অযোগ্যতার গ্লানি দুই কাঁধে ঝুলিয়ে হতাশ মুখে ফিরে এল। তাহেরও তাদের সঙ্গে। এসেছে। অন্য কেউ সেনাদলে চাকরি পাবে না, সেজন্য বেচারা প্রাণ খুলে আনন্দ পর্যন্ত করতে পারছে না। রিকুমেন্টের লোকেরা সবাইকে বাদ দিয়ে তাকে পছন্দ করেছে, এ যেন তারই অপরাধ। খলিলদের পিছু পিছু মুখ চুন করে তাহের এসে দাঁড়াল।

বিনুরা এখনও সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

অবনীমোহন বললেন, তোমাদের একজনকে বেছে নাম লিখে নিল, দেখলাম।

খলিল বলল, হ। তাহেররে অগো পছন্দ হইছে। আর আমরা ফ্যালনা, গাঙ্গের পানিতে ভাইসা আসছি।

অবনীমোহন চুপ করে থাকলেন।

খলিল আবার বলল, আমি উচায় (উচ্চতায়) খাটো হইলাম। আরে আমি যে খাটো হেয়াতে কি আমার হাত আছে? খোদায় য্যামন বানাইছে, ত্যামন হইছি। ইচ্ছা কইরা খাটো হইছি?

অবনীমোহন মাথা নাড়েন, তা তো বটেই।

বছির এবার বলল, বুকের মাপে আমি খারিজ হইয়া গেলাম। ছাতির ওসার (প্রস্থ) নিকি আমার কম। কম হইব না তা কি বেশি হইব! উপাস দিয়া দিয়া পরান যায়। ছাতি বড় হইব ক্যামনে? বাইচা যে আছি, হেই না কত?

সবাই ক্ষুব্ধ, আশাহত, দুঃখিত। অবনীমোহনের উত্তর দেবার মতো কিছুই ছিল না।

খলিল বলল, হগলই নছিব জামাইকত্তা। আমরা যুজ্যে গিয়া যে দু’গা খাইয়া বাচুম, খোদাতাল্লায় তা চায় না।

.

২.৩৫

হেমনাথ সেই যে জ্বরে পড়েছিলেন, সারতে দশ দিন লেগে গেল। জ্বর সারলেও দুর্বলতা কাটল না। একটু হাঁটলেই পা ভেঙে আসে, মাথা ঘুরতে থাকে।

চিরকাল বয়সকে অস্বীকার করে এসেছেন হেমনাথ। বয়সও এতকাল উদাসীন ছিল। হঠাৎ সে তাঁর দিকে নজর দিতে শুরু করেছে, এবং প্রথম সুযোগেই বিছানায় ফেলে দিয়েছে।

অসুস্থ, দুর্বল শরীর নিয়ে কোথায় গিয়ে কী বিপদ ঘটাবেন, সেই ভয়ে স্নেহলতা তাকে বাইরে বেরুতে দেন না। পাছে বেরিয়ে যান, সেজন্য চোখে চোখে রাখছেন।

এত বড় সংসার যার মাথায় তার তো এক জায়গায় বসে থাকলে চলে না। কোনও দরকারে উঠে যেতে হলে ঝিনুক কিংবা সুধা সনীতিকে পাহারাদার হিসেবে হেমনাথের কাছে বসিয়ে রেখে যান স্নেহলতা।

হেমনাথ চেঁচামেচি করেন, বসিয়ে বসিয়ে আমাকে একেবারে অথর্ব করে ফেলছ স্নেহ।

স্নেহলতা হাসেন, তাই নাকি?

নিশ্চয়ই। দেখো, আমাকে ঠিক বাতে ধরবে।

তা হলে আমি খুশি হব।

হেমনাথ অবাক হয়ে বলেন, খুশি হবে!

মজার ভঙ্গি করে ঘাড় হেলিয়ে দেন স্নেহলতা, হব হর, একশ’বার হব।

কেন?

বাতে শুয়ে থাকলে অন্তত চরকির মতো ঘোরাটা তোমার বন্ধ হবে। এত বয়েস হল, তবু ঘোরা বাই যাচ্ছে না।

একটু চুপ করে থেকে কৌতুকের গলায় হেমনাথ বলেন, তুমি তো অসুখের জন্যে আমাকে বেরুতে দিচ্ছ না। রাজদিয়ার লোক কিন্তু অন্যরকম ভাবতে শুরু করেছে।

অস্বস্তির সুরে স্নেহলতা জিজ্ঞেস করেন, কী ভাবছে?

বুড়ো বয়েসে তোমার নাকি রস উথলে উঠেছে। দিনরাত আমাকে কোলে শুইয়ে, মুখে মুখ। রেখে—

কথা আর শেষ করতে পারেন না হেমনাথ। তার আগেই স্নেহলতা মুখ লাল করে ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, আহা, কথার কি ছিরি! কিছুই আটাকায় না মুখে!

হেমনাথ হাসতে থাকেন।

স্নেহলতা আগের সুরে বলতে থাকেন, তোমার চালাকি আমি বুঝি। লোকের ওসব কথা বলতে বয়ে গেছে। বললেও তোমাকে বাড়ির বার হতে দিচ্ছ না।

হেমনাথের বন্দিত্ব যেন আর ফুরোতে চায় না। এরই ভেতর একদিন বিকেল বেলা মীরকাদিমের রজবালি শিকদার এসে হাজির।

রজবালির বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। গায়ের রং টকটকে। এই বয়সেও শরীরের বাঁধুনি বেশ মজবুত। হাতের হাড় চওড়া, চোয়াল শক্ত, চিবুক ধারাল। দাড়ি এবং গোঁফ শৌখিন করে ছাঁটা। চোখদুটি সবসময় সজাগ এবং তীক্ষ্ণ। তাকে ফাঁকি দিয়ে কিছু হবার উপায় নেই। যার দিকে রজবালি তাকায় তার বুকের গভীর পর্যন্ত যেন সে দেখতে পায়।

পরনে ডোরাকাটা সিল্কের লুঙ্গি আর ফিনফিনে পাঞ্জাবি। তার তলায় জালিকাটা গেঞ্জির আভাস। মাথায় নকশা করা ধবধবে টুপি। কানে আতর মাখানো গোলাপি রঙের তুলল। পায়ে কাঁচা চামড়ার নাগরা। চোখের কোলে সুর্মার সূক্ষ্ম টান। সব মিলিয়ে মানুষটি রীতিমতো শৌখিন।

মীরকাদিমের গঞ্জে রজবালির ধান-চাল মুগ-মসুর তিল-তিসি ইত্যাদি শস্যের ব্যবসা। শাল কাঠের খিলান-দেওয়া টিনের প্রকান্ড চারটে আড়ত রয়েছে তার। সবসময় সেগুলো বোঝাই, কম করে এক দেড় হাজার মণ শস্য মজুত থাকে। এছাড়া আছে হাঁড়ি বালতির দোকান, মনিহারি দোকান। সব মিলিয়ে এলাহী ব্যাপার।

হেমনাথ বললেন, রজবালি যে, আয়–আয়– বিনু কাছেই ছিল। তাকে একটা জলচৌকি এনে দিতে বললেন।

জলচৌকি এলে তার পর বসতে বসতে রজবালি বলল, ক্যামন আছেন হ্যামকত্তা? শরীল ক্যামন কাহিল কাহিল ঠ্যাকে।

হেমনাথ তাঁর অসুখের কথা বললেন, এবং কিছুদিন ধরে যে বন্দি জীবন যাপন করছেন, তা ও জানলেন।

রজবালি আন্তরিক সুরে বলল, আপনের অ্যামন অসুখ, খপর পাই নাই তো। পাইলে আগেই আসতাম।

হেমনাথের মুখ দেখে মনে হল, রাজবালির আন্তরিকতাটুকু খুবই ভাল লেগেছে তাঁর। মৃদু হেসে বললেন, তোদের খবর ভাল তো?

আপনেরা য্যামন রাখছেন।

আমরা রাখবার কে? যিনি রাখবার তিনিই রেখেছেন।

হে যা কইছেন।

তারপর কী মনে করে? কোনও দরকারে এসেছিস, না এমনি বেড়াতে?

রজবালি হাসল, ব্যবসায়ী মানুষ, বিনা দরকারে কুনোখানে যাওনের উপায় আছে? সোময় কই?

জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন হেমনাথ।

রজবালি বলল, এইখানে যে মিলিটারি আসছে আমি তাগো কাছে ছাপ্লাইয়ের এট্টা অডার’ পাইছি। কী সাপ্লাই?

হাস-মুরগি-পাঠা-ডিম, চাউল-ডাইল–এই হগল। অডারের ব্যাপারটা পাকা করতে আইজ আইছিলাম।

বিনুর হঠাৎ নিত্য দাসের কথা মনে পড়ল। দেখা যাচ্ছে, মিলিটারির কল্যাণে চারদিকের বড় বড় ব্যবসায়ী আর আড়তদাররা রাজদিয়ায় হানা দিতে শুরু করেছে।

হেমনাথ শুধালেন, অর্ডারের কথা পাকা হল?

হ।

কবে থেকে সাপ্লাই দিতে হবে?

রজবালি বলল, পরশু থিকা। ভাবতে আছি রাইজদায় এট্টা বাড়ি ভাড়া নিমু। এইখানে ‘রাখি’ কইরা না রাখতে পারলে রুজ রুজ ঠিক সোময় মাল ছাপ্লাই দিতে পারুম না। এয়া তো এতি-পেতি লইয়া কারবার না, মিলিটারি বইলা কথা। টাইমে দিতে না পারলে ঘেটিতে মাথা থাকব না।

রজবালি আরও জানালো, স্টিমারঘাটের কাছে মন্তাজ মিঞা যে নতুন বাড়িখানা করেছে, সেটাই ভাড়া করতে চাইছে। মোটামুটি কথাবার্তা হয়ে গেছে। কাল পরশু বাড়িটার দখল পাওয়া যেতে পারে।

হেমনাথ এবার অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে এলেন, তোদের ওদিকে ধানচালের খবর কী বল–

জবর খারাপ হ্যামকত্তা। দশ পনর দিন ধইরা মীরকাদিমের বাজারে একদানা চাউল নাই। চাউল বইলা কথা। মাইনষে পাগলের লাখান ঘুরতে আছে।

চিন্তিত মুখে হেমনাথ বললেন, খুবই বিপদের কথা। তা হ্যাঁ রে, তোর আড়তে তো অত ধান ছিল। সব বিক্রি করে ফেলেছিস?

চকিতে চারদিক একবার ভাল করে দেখে নিয়ে রজবালি বলল, না। অত ধান চাউল কি দুই চাইর-দশ দিনে বেচা যায়! ছয় মাস ধইরা বেচলেও শ্যাষ করন যাইব না। একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, হগল ব্যবসায়ীতে যা করছে, আমিও হেই করছি হ্যামকত্তা।

কী করেছিস?

ধান চাউল সরাইয়া ফেলাইছি।

কেন? বিমূঢ়ের মতো জিজ্ঞেস করলেন হেমনাথ।

রজবালি বলল, দর আরও চেতুক (চড়ক), হের পর ছাড়ুম। আমার এক সুমুন্দি মানিকগুঞ্জের উই দিকে চাউলের ব্যবসায়ী। হেয় কইছে, দর আরও চেতবো। যত পারি অহন য্যান ধান-চাউল ‘রাখি’ করি।

হেমনাথ বললেন, ‘রাখি’ তো করছিস। এদিকে দেশের লোক না খেয়ে শুকিয়ে মরছে, সেদিকে খেয়াল আছে?

কথাটা শুনেও শুনল না রজবালি। অন্যমনস্কের মতো বলতে লাগল, আমরা ব্যবসায়ী। দ্যাশের মাইনষের দিকে তাকাইলে আমাগো কি চলে! একটু থেমে আবার বলল, আপনের তো মেলা জমিন। বাড়তি ধান চাউল কিছু আছে? থাকলে আমারে দিতে পারেন। ভাল দাম দিমু।

হেমনাথ মাথা নাড়লেন, নেই। প্রত্যেক বার ধান ওঠার পরই বাড়তি ধান বেচে দিই। এবারও দিয়েছি। বেশি কিছু থাকলেও তোকে দিতাম না। লোককে বিলিয়ে দিতাম।

রজবালি কথাটা গায়ে মাখল না। হাসতে হাসতে বলল, আপনের লগে কার তুলুনা। আপনে নিজে না খাইয়াও মাইনষেরে খাওয়াতেই পারেন। কিন্তু আমরা হইলাম ব্যবসায়ী মানুষ।

হেমনাথ উত্তর দিলেন না।

রজবালি বলল, অনেকক্ষণ আইছি। এইবার যাই হ্যামকত্তা। উঠতে গিয়ে কী মনে পড়তে বসে পড়ল, ভাল কথা, আপনেরে একখান খপর দেওয়া হয় নাই–

কী খবর?

মুছলিম লিগের নাম শুনছেন?

মুসলিম লিগ? শুনব না কেন?

হ। রজবালি মাথা নাড়ল, কয়দিন আগে ঢাকার থিকা মুছলিম লিগের বড় মিঞারা মীরকাদিমে আইসা মিটিন করল। মিটিনে তেনারা কী কইল জানেন?

কী?

মুছলমানগো লেইগা একখান দ্যাশ চাই। তার নাম পাকিস্থান। তেনারা আরও কইল, যেখানে যত মুছলমান আছে হগলের লিগে নাম লিখান দরকার। অত বড় মানুষগুলা কইছে, কেও আর না কইতে পারল না। আমাগো উইদিকের মেলা মাইনষে মুছলিম লিগে নাম লিখাইতে আছে।

একটু পর রজবালি গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *