প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

২.০৬-১০ অবনীমোহন কলকাতা থেকে ফিরে

২.০৬

অবনীমোহন কলকাতা থেকে ফিরে এসেছেন। খবর পেয়েই মজিদ মিঞা কেতুগঞ্জ থেকে ছুটে এল। বলল, তাহলে আর দেরি করনের কাম নাই মিতা। আপনের জমিন বুইঝা লন। কবে রেজিস্টারি করবেন, কন?

হেমনাথ কাছেই ছিলেন। হেসে ফেললেন, জমিটা অবনীকে না দেওয়া পর্যন্ত তোর দেখি ঘুম আসছে না!

তা যা কইছেন। মজিদ মিঞা বলতে লাগল, কুনো ব্যাপার একবার মাথার ভিতরে ঢুকলে যতক্ষণ হেইটা না হইতে আছে, আমার সোয়াস্তি নাই। হে কথা যাউক। আর কয়দিনের মইদ্যে ধান কাটা আরম্ভ হইয়া যাইব। তহন আর উয়াস (নিশ্বাস) ফেলানের সময় পামু না। ধানকাটার আগেই আমি জমিন রেজিস্টারি করতে চাই।

স্নেহলতা এ আসরে আছেন। তিনি বললেন, সেই ভাল। ধানকাটা শেষ হতে হতে পৌষ মাস হয়ে যাবে। পৌষ মাসে শুভ কাজ করতে হবে না। কেনাকাটা যা করবার এই অঘ্রাণেই একটা ভাল দিন দেখে সেরে ফেলা উচিত।

তক্ষুনি একটা পঞ্জিকা এসে পড়ল। পাতা উলটে উলটে সপ্তাখানেক বাদে একটা শুভদিনও ঠিক করে ফেললেন হেমনাথ।

দিন তারিখ স্থির হবার পর মজিদ মিঞা বলল, এইর ভিতরে একখান কথা আছে কিলাম মিতা–

অবনীমোহন শুধোলেন, কী কথা?

যে জমিন আপনেরে দিমু হেয়াতে ধান আছে। এই সনের ধান কিন্তুক আপনে পাইবেন না, কারণটা হইল বর্গাদারেরে উই জমিন চাষ করতে দিছিলাম। আমি ছাইড়া দিলেও বর্গাদার তো ছাড়ব না। ধান উইঠা গ্যালে জমিনের দখল পাইবেন।

অবনীমোহন তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, কী আশ্চর্য, ও ধান আমি নেব কেন? যারা খেটেছে ও ফসল তাদেরই প্রাপ্য।

তা হইলে কথা পাকা হইয়া গ্যাল।

জমি কেনার ব্যবস্থা পাকা হয়ে যাবার পর একদিন দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে সুধা সুনীতি আর বিনু পুকুরঘাটে আঁচাতে যাচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তার দিক থেকে উঁচু গলার ডাক ভেসে এল, হ্যামকত্তা আছেন, হ্যামকত্তা–

বিনুরা দাঁড়িয়ে পড়ল।

একটু পর রাস্তার দিক থেকে বাগানের ভেতর যে এসে পড়ল তার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথার চুল কাঁচা পাকায় মেশানো। শরীরের কোথাও বিন্দুমাত্র মেদ নেই। ছোটখাটো মানুষটি। চোখের দৃষ্টি কিছুটা অন্যমনস্ক, অনেকখানি উদাস। পোশাক আশাক আর কাঁধের ঝোলাখানা দেখে টের পাওয়া গেল, সে ডাক পিওন।

বিনুদের দেখে লোকটা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, আপনেরা?

লোকটা কী জানতে চায়, বুঝতে পেরেছিল সুনীতি। নিজেদের পরিচয় দিল সে। হেমনাথের সঙ্গে সম্পর্ক কী, তাও বলল।

লোকটার চোখমুখ আলো হয়ে উঠল, তিন মাস আমি এই বাড়ি আসি নাই। হেইর লেইগা জানতে পারি নাই। আগে আইলে আপনেগো লগে চিনা পরিচয় হইত। আমার নামখান কইয়া রাখি– নিবারণ ভুইমালী। আমি ডাকপিওন। হে যাউক, একখান কথা জিগাই–

কী?

আপনাগো ভিতরে কেও সুনীতিরানী বসু আছেন—

সুনীতি যেন চমকে উঠল, কেন?

নিবারণ বলল, একখান চিঠি আইছে।

কাঁপা গলায় সুনীতি এবার বলল, দিন। আমার নাম সুনীতি–

ঝোলার ভেতর থেকে একটা খাম বার করল নিবারণ। সুনীতির ডান হাত এঁটো, ভাত টাত মাখানো রয়েছে। কাজেই বাঁ হাতে খামটা নিল সুনীতি। খামের ওপরকার নামঠিকানা চোখ পড়তেই তার মুখে রক্তোচ্ছাস খেলে যেতে লাগল।

বিনু পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সুনীতির মুখের দ্রুত রংবদল দেখতে দেখতে সে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। ভেবেই পেল না, সুনীতিকে কে চিঠি লিখতে পারে!

নিবারণ এই সময় বলে উঠল, হ্যামকায় বাড়ি আছেন?

সুনীতি বুঝিবা শুনতে পেল না। হাতের খামটার দিকে পলকহীন তাকিয়ে ছিল। তার মুখে নানা রঙের খেলা চলতে লাগল।

ওধার থেকে সুধা উত্তর দিল, দাদু নেই। সকালবেলা উঠে বেরিয়ে গেছেন। সন্ধের আগে ফিরবেন না।

নিবারণ এবার শুধলো, বৌ-ঠাইরেন আছে তো?

নিবারণ যে স্নেহলতার কথা বলছে, সুধা বুঝতে পারল। বলল, আছেন।

যাই, বৌ-ঠাইরেনের লগে দেখা করি গা। ঘরের দুয়ারে আইসা তেনার লগে দেখা না করলে রক্ষা নাই। নিয্যস আমার গর্দান যাইব। নিবারণ বড় বড় পা ফেলে ভেতর-বাড়ির দিকে চলে গেল।

একটু নীরবতা।

তারপর সুনীতির দিকে ঝুঁকে সুধা বলল, কার চিঠি রে দিদি? তার মুখচোখ থেকে কৌতূহল যেন উপচে পড়ছিল।

সুনীতি চকিত হয়ে বলল, কারোর না। বলে শাড়ির ভেতর খামটা লুকোতে যাবে, তার আগেই ডিঙি মেরে দেখে নিল সুধা।

বিনুরও খুব ইচ্ছে করছিল, সুধার মতো পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে দেখে নেয়, কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেল। ততক্ষণে চিঠিটা অদৃশ্য হয়েছে।

এদিকে সুধার চোখ কৌতুক এবং দুষ্টুমিতে ঝকমকিয়ে উঠেছে। ঠোঁট ছুঁচলো করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে খুব রগড়ের গলায় সে বলল, ফ্রম আনন্দ ঘোষ। আনন্দচন্দ্র তা হলে কথা রাখল। চিঠি দেবে বলেছিল, ঠিক দিয়েছে।

শিউরে ওঠার মতো করে চারদিক একবার দেখে নিল সুনীতি। তারপর ভীতু গলায় বলল, অ্যাই সুধা, আই–চেঁচাচ্ছিস কেন? কেউ শুনতে পাবে।

শুনবে না। আমরা ছাড়া এখানে কেউ নেই।

না থাক, তুই মোটে চেঁচাবি না।

এক শর্তে চেঁচানো থামাতে পারি।

সংশয়ের গলায় সুনীতি শুধলো, কী? সুধা বলল, আমাকে চিঠিটা পড়াবি। আনন্দ মহাপ্রভু কেমন করে তোর ভজনা করেছে, দেখতে হবে।

জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সুনীতি বলে, না না না–

তা হলে কিন্তু আমি সব্বাইকে বলে দেব।

সুনীতি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, হাত শুকিয়ে কড়কড়ি হলে গেল। চল আঁচিয়ে আসি।

সুধা বলল, আঁচাবার পর কিন্তু পড়াবি। না পড়ালে ছাড়ছি না।

পুকুরঘাটের দিকে যেতে যেতে সুনীতি ফিসফিস করল, কী অসভ্য লোক ভাই—

কার কথা বলছিস?

আহা, কার কথা যেন বুঝতে পারছে না–আনন্দদার কথা।

সুধা বলল, অসভ্যের কী হল?

সুনীতি বলল, এমন করে চিঠি কেউ লেখে!

ঢঙ করিস না দিদি।

ঢঙের কী হল?

আনন্দদার চিঠির জন্যে তো হা-পিত্যেশ করে বসে ছিলি।

তোকে বলেছে!

বলিস নি। তবে–

তবে কী?

চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুধা বলল, যেরকম উদাস উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতিস আর ফোত ফেঁত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতিস তাতে মনে হচ্ছিল আনন্দদার চিঠি না এলে বুজি আত্বহত্যা করে বসবি।

তবে রে বাঁদর মেয়ে–সুনীতি করল কি, এঁটো হাতেই সুধার পিঠে দুম করে কিল বসিয়ে দিল। পিঠ বাঁকিয়ে নাকি সুরে উঁ উঁ করতে করতে সুধা বলল, পেটে খিদে মুখে লাজ। সত্যি কথা বললেই দোষ।

সত্যি কথা তোকে বলাচ্ছি। আয়—

দ্বিতীয় কিলটি পড়বার আগেই ছুটে দূরে সরে গেল সুধা।

পুকুরঘাটে আঁচাতে আঁচাতে সুনীতি বলল, ভাগ্যিস পিত্তনটার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গিয়েছিল। বাবা কি দাদু টাদুর হাতে চিঠিটা পড়লে কী হত বল দেখি!

এক মুখ জল নিয়ে পিচকিরির মতো ছুঁড়ে দিল সুধা। তারপর বলল, খুব ভাল হত। ওঁরা বুঝতে পারতেন কী পাকাটাই না তুই পেকেছিস।

আমাকে নিয়ে বেশি মজা করো না, নিজের কথাটা একটু ভেবে দেখো।

আমার আবার কী কথা? সুধার চোখ কুঁচকে গেল।

সুনীতি বলল, শ্রীমান হিরণকুমার ঢাকায় বসে আছেন। তিনিও এইরকম চিঠি ছাড়তে পারেন। আর তা দাদু কি বাবার হাতে পড়তে পারে।

চমকে ওঠার মতো করে সুধা বলল, কক্ষনো না–

না নয়, হ্যাঁ।

সুধাকে এবার চিন্তিত দেখাল, তাই তো রে দিদি, কী করা যায় বল দেখি–

নারকেল-গুড়ি দিয়ে বাঁধানো ঘাটে দুই বোন পাশাপাশি বসল। বিনু তাদের সঙ্গেই ছিল, হাত নেড়ে নেড়ে হেমন্তের স্থির জলে ঢেউ তুলতে লাগল। কান দুটো কিন্তু তার সুধা সুনীতির দিকেই ফেরাননা।

সুনীতি বলল, আজই কলকাতায় চিঠি লিখে জানিয়ে দেব, আমাকে যেন আর চিঠি টিঠি না লেখে–

সুধা বলল, তোর কথা শুনবার জন্যে বসে আছে আনন্দদা।

তা হলে হিরণকুমারও তা-ই।

যা বলেছিস। বারণ করলে ওরা আরও বেশি করে চিঠি লিখবে।

একটু ভেবে সুনীতি হঠাৎ খুব উৎসাহিত হয়ে উঠল, একটা ফন্দি মাথায় এসেছে রে সুধা–

সুধা উৎসুক চোখে তাকাল, কী?

উত্তর না দিয়ে সুনীতি বিনুকে ডাকল। বিনু তাকাতেই বলল, পোস্ট অফিসটা কোথায় জানিস?

বিনু ঘাড় কাত করল, অর্থাৎ জানে।

দু’দিন পর পর একবার করে পোস্ট অফিসে যাবি ভাই?

কেন?

সুধার কি আমার চিঠি থাকলে নিয়ে আসবি।

চোখ কুঁচকে একটু ভাবল বিনু। তারপর বলল, যেতে পারি। কিন্তু—

সুনীতি উঠে এসে বিনুর গা ঘেঁষে বসে পড়ল, কিন্তু কী?

আমাকে কী দিবি?

কী আবার দেব? যাবি তো বাবা এখান থেকে ওখানে—

এখান থেকে ওখানে! সেই স্টিমারঘাট বরফকল ছাড়িয়ে তবে পোস্ট অফিস। পাক্কা দেড় দু’মাইল রাস্তা। এমনি এমনি অতখানি পথ আমি যেতে পারব না।

সুনীতি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আচ্ছা আচ্ছা, কী নিবি বল—

বিনু বলল, যেদিন পোস্ট অফিসে যাব সেদিন দু’আনা পয়সা দিবি।

দু’আনা! সুর টেনে সুনীতি বলল, তুই কী ডাকাত রে—

তা হলে যেতে পারব না।

আচ্ছা আচ্ছা, দু’আনাই দেব।

ওদিক থেকে সুধা ডাকল, দিদি—

সুনীতি আবার সুধার কাছে ফিরে গেল, কী বলছিস?

পোস্ট অফিসের ব্যাপারটা তো মিটল। এবার আনন্দদার চিঠি বার কর।

না না—

না বললে শুনছি না। বার কর– সুনীতির শাড়ির আড়াল থেকে চিঠিটা বার করার জন্য টানাটানি শুরু করে দিল সুধা।

শাড়ি সামলাতে সামলাতে বিব্রতভাবে চেঁচামেচি জুড়ে দিল সুনীতি, এই সুধা, এই—

সুধার এক কথা, বার কর, বার কর–

আত্মরক্ষার জন্য সুনীতি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ছাড় ছাড়, কী ছেলেমানুষি করছিস! বিনু রয়েছে না?

বিনু গেলে চিঠি দেখাবি?

সে দেখা যাবে।

সুধা এবার বিনুর উদ্দেশে বলল, তুই এখন যা তো বিনু—

বিনুর মোটেই যাবার ইচ্ছে নেই। আনন্দদা সুনীতিকে কী লিখেছে, জানবার ভারি কৌতূহল হচ্ছিল। সে বলল, না, যাব না।

যাবি না?

না।

একটা ছোটখাটো খণ্ডযুদ্ধ বেধে যাবার সম্ভাবনা ছিল। তার বদলে অগ্নিদৃষ্টিতে একবার বিকে দেখে নিয়ে সুধা বলল, চল দিদি, আমরা ওদিকে যাই। হনুমান ছেলে এখানে বসে থাক। সুনীতিকে সঙ্গে নিয়ে বাগানের উত্তর দিকে ঘন রোয়াইল আর সিনজুরি ঝোঁপের ভেতর চলে গেল সুধা।

একা একা ক্ষুণ্ণ মনে কিছুক্ষণ পুকুরঘাটে বসে থাকল বিনু। তারপর একসময় টুক করে উঠে পড়ে চঞ্চল পাখির মতো অস্থির পায়ে বাগানের ভেতর ঘুরে বেড়াতে লাগল। একবার ইচ্ছে হল, বোয়াইল আর সিনজুরি বনে ঘন ছায়ার ভেতর সুধা সুনীতি যেখানে বসে আছে সেখানে চলে যায়। পরক্ষণেই ভাবল ওরা যখন তাকে ফেলে চলেই গেছে, আর হ্যাংলার মতো যাবে না।

অনেকক্ষণ পর বাড়ির ভেতর চলে এল বিনু। এসেই অবাক।

রান্নাঘরের দাওয়ায় নিবারণ পিওন একটা মোটা গামছা পরে প্রায় খালি গায়ে তেল মাখছিল। কোথায়ই বা তার ইউনিফর্ম, কোথায়ই বা তার চিঠি পত্তরের ঝোলা! তার মুখে অনবরত খই ফোঁটার মতো কথা ফুটছিল।

স্নেহলতা-সুরমা-শিবানী-অবনীমোহন, বাড়ির প্রায় সবাই নিবারণের সামনে দাঁড়িয়ে। পায়ে পায়ে বিনুও গিয়ে সেখানে দাঁড়াল। তার মনে হল, এত যখন তেল মাখার ঘটা, নিবারণ এখানে খাবেও।

নিবারণ বলছিল, চিঠি লইয়া এই বাড়িত যেদিনই আসি হেইদিনই ছান-খাওয়া সাইরা যাই। হেইদিন খাওন আমার বান্ধা। না খাইয়া গ্যালে হ্যামকত্তা আর বৌ-ঠাইরেন আস্তা রাখব না।

কথাগুলো অবনীমোহনের উদ্দেশ্যে বলা। অবনীমোহন উত্তর দিলেন না, নিঃশব্দে হাসলেন শুধু।

নিবারণ বলতে লাগল, রাইজদার হ্যামকার বাড়ি, বাজিতপুরে অভয় কবিরাজের বাড়ি, সুনামগঞ্জে ইসমাইল মেরধার (মৃধা) বাড়ি, গিরিগুঞ্জে ছোভান (সোভান) আলি মৌলবীর বাড়ি, হাসাড়ায় মল্লিকগো বাড়ি–এই কয় বাড়িতে চিঠি লইয়া গ্যালে খাইতে হইবই।

অবনীমোহন এবার ঈষাৎ বিস্ময়ের সুরে বললেন, আপনি তো অনেকগুলো গ্রামের নাম করলেন—

হ।

এত এত গ্রামে আপনাকে ঘুরতে হয়?

মোটে তো চাইরখান গেরামের নাম কইলাম। আমারে বিশখান গেরামে ঘুরতে হয় জামাইকত্তা

অবনীমোহন হেমনাথের ভাগনী-জামাই। সেই সুবাদে এরই ভেতর জামাই কত্তা’ ডাকতে শুরু করেছে নিবারণ।

অবনীমোহন বললেন, বিশখানা গ্রাম একদিনে যান কী করে?

একদিনে ক্যাঠা (কে) যায়!

তবে?

নিবারণ এবার যা উত্তর দিল, সংক্ষেপে এইরকম। রাজদিয়া এবং আশেপাশের কুড়িখানা গ্রাম নিয়ে একটা মাত্র পোস্ট অফিস, আর ডাক পিওন বলতে একা নিবারণ। মস্ত ঝোলায় চিঠিপত্র বোঝাই করে প্রতি সোমবার সে বেরিয়ে পড়ে। পথে নদী খাল বিল পড়লে, নৌকোর মাঝিদের ডেকে ডেকে পাড়ি জমায়, কখনও বা ‘গয়নার নৌকো’ ধরে নেয়। যেখানেই যাক, এই জলের দেশে মানুষ বড় ভাল, বড় দয়ালু। দু’মুঠো না খাইয়ে কেউ ছাড়তে চায় না। রাত্রিবেলা কোথাও

কোথাও একটা আশ্রয় জুটে যায়ই।

সোম থেকে শনি, একটানা ছ’দিন চিঠি বিলির পর রাজদিয়ায় ফিরে আসে নিবারণ। মাঝখানে রবিবারটা বিশ্রাম। তারপর আবার সোমবার দূরের গ্রাম-গঞ্জ-জনপদে বেরিয়ে পড়া। পঁচিশ তিরিশ বছর ধরে এই রকমই চলছে।

সব শুনে অবনীমোহন কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই স্নেহলতা বলে উঠলেন, বকবকানি থামিয়ে এখন চান করতে যা নিবারণ। তোকে খেতে দেবার পর আমরা খাব।

‘এই যাই–’ ব্যস্তভাবে নিবারণ পুকুরঘাটের দিকে চলে গেল। একটু পর ফিরে এসে যখন খেতে বসল তখনও তার কথার শেষ নেই। খেতে খেতে গল্প করতে লাগল সে।

একধারে দাঁড়িয়ে বিনুর মনে হল, লোকটা যেন বকবক করার কল। দম দেওয়াই আছে, সব সময় গল গল করে কথা বেরিয়ে আসছে।

খাওয়াদাওয়ার পর নিবারণ বিনুকে নিয়ে পড়ল, তোমার লগে ভাল কইরা আলাপই হইল না নাতিবাবু। লও যাই, ইট্র গপসপ করি। বিনুকে সঙ্গে নিয়ে যুগলের ঘরে গিয়ে ঢুকল সে। বোঝা গেল, এ বাড়ির সব অন্ধিসন্ধিই তার চেনা। টের পাওয়া গেল, এতক্ষণ বকবক করেও তার সাধ মেটে নি, আরও কিছুক্ষণ সে গল্প করতে চায়।

লোকটাকে খুব খারাপ লাগছিল না বিনুর। যুগলের নিচু তক্তপোষে নিবারণের পাশাপাশি বসে উন্মুখ হয়ে থাকল সে।

একটা বিড়ি ধরিয়ে নিবারণ বলল, তোমরা তো কইলকাত্তার পোলা?

বিনু মাথা নাড়ল।

কইলকাত্তা দ্যাশখান ক্যামন কইবা—

কলকাতা কেমন শহর, কথায় কথায় তার মোটামুটি ছবি এঁকে নিবারণের চোখের সামনে যেন সেঁটে দিল বিনু।

শুনে কিছুক্ষণ বোবা হয়ে থাকল নিবারণ। তারপর বলল, আলিসান ব্যাপার,?

হ্যাঁ।

কইলকাত্তার কথা তো শুনলাম। এইবার আমাগো জলের দ্যাশের গপ শোন।

বলুন–

দেখা গেল নিবারণ লেকটা সত্যি সত্যি গল্পের খনি। বিপুল অভিজ্ঞতা তার। কবে কার্তিক মাসের ঝড়ে বড় গাঙে গয়নার নৌকো’ উলটে গিয়ে মরতে বসেছিল, তার পর দু’খানা মোটে হাতের ভরসায় দু’মাইল উথলপাথল নদী পাড়ি দিয়েছিল, কবে চরের মুসলমানদের সঙ্গে শুধু লাঠি পেটা করে একটা প্রকাণ্ড কুমির মেরে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছ থেকে দশ টাকার পুরস্কার পেয়েছিল, কবে কোথায় সাক্ষাৎ যমের মত ডানাওলা উড়ন্ত সাপ দেখেছিল, কোথায় দু’শ’ বছরের এক বুড়ো ফকিরের অলৌকিক মন্ত্রবলে বিশাল দীঘির সব জল দুধ হয়ে গিয়েছিল–হাত-পা চোখমুখ নেড়ে কত বিচিত্র বিস্ময়কর গল্প যে নিবারণ বলে গেল হিসেব নেই।

গল্প বলতে জানে বটে লোকটা! মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনে যাচ্ছিল বিনু। তার চোখে পলক পড়ছিল না।

গল্পে গল্পে বিনুকে জয় করে বিকেলের খানিক আগে নিবারণ চলে গেল। এখান থেকে পথে কারোর নৌকো ধরে সোজা সুজনগঞ্জ যাবে সে।

.

নিবারণ চলে যাবার কিছুক্ষণ পরে হেমন্তের ছায়া তখন আরও দীর্ঘ এবং ঘন হল সেই সময় সিনজুরি বন থেকে বেরিয়ে সুধা সুনীতি বাড়ি চলে এল।

পুবের ঘরের দাওয়ায় বসে সুরমা চুল বাঁধছিলেন। বিনু তার কাছেই ছিল। মেয়েদের দেখে সুরমা বললেন, কোথায় ছিলি রে তোরা এতক্ষণ?

সুনীতি বলল, বাগানে—

কী করছিলি?

গল্প।

কলকাতা থেকে নাকি চিঠি এসেছে?

সুনীতি থতমত খেয়ে যায়। আধফোঁটা গলায় বলল, হ্যাঁ।

সুরমা শুধলেন, কার চিঠি?

আমার–

তোকে আবার কে চিঠি দিলে?

আমার কলেজের এক বন্ধু, সেই যে বেলা বলে মেয়েটা, কলকাতায় আমাদের বাড়ি আসত–

সুরমা আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।

বিনু লক্ষ করল, সুধা সুনীতি চোরা চাহনিতে পরস্পরকে দেখতে দেখতে ঠোঁট টিপে হাসছে। বিনুর একবার ইচ্ছে হল, চিঠির আসল রহস্যটা ফাঁস করে দেয়। কী ভেবে শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকল, কিছু বলল না।

.

২.০৭

অঘ্রাণের মাঝামাঝি বিনুদের জমি কেনা হয়ে গেল।

রেজিস্ট্রি হবার পর অবনীমোহন বিনু আর সুরমা রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। মজিদ মিঞা, হেমনাথ তখনও অফিসের ভেতর। সুরমাকে এতদূর আসতে হয়েছে, কেননা জমি তার নামেই কিনেছেন অবনীমোহন।

হঠাৎ একটা লোকমাথার চুলে জট বাঁধা, মুখময় দাড়ি-গোঁফ, ভাঙা-ভাঙা নখ, পায়ে হাজা, লালচে উভ্রান্ত চোখ, সব মিলিয়ে পাগলাটে চেহারা–অবনীমোহনের সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, সালাম বাবু। আপনে বুঝিন জমিন কিনলেন?

অবনীমোহন অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, হ্যাঁ, কেন?

আপনের লগে একখান কথা আছে।

অবনীমোহন বললেন, কী কথা?

হলদে হলদে অসমান দাঁত বার করে লোকটা বলল, কার জমিন কিনলেন?

মজিদ মিঞার।

চোখের ওপর হাত রেখে ভুরু কুঁচকে লোকটা ভাবতে চেষ্টা করল যেন। বলল, কোন মজিদ মেঞা কন দেখি? বাড়ি কুনখানে?

অবনীমোহন বললেন, কেতুগঞ্জে। কেতুগঞ্জের মজিদ মো বড় ভালা মানুষ। লোকটার চোখমুখ আলো হয়ে উঠল, মেঞাভাইর কুন জমিন কিনলেন?

উত্তরের দিকের মাঠের।

উত্তরে চকের জমিন? বড় বাহারের জমিন। হেই ধারে সুজনগুঞ্জের হাট, আর এইধারে ধলেশ্বরীর গাঙ–এইর ভিতরে অ্যামন ভালা জমিন আর নাই।

অবনীমোহন অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, তুমি এখানকার সব জমি চেনো নাকি।

চিনি আবার না! হগল চিনি, মোভাইর যেই জমিন আপনে কিনলেন হেয়াতে ধান দ্যান, পাট দ্যান, মুঙ-মুসৈরকলই–যা ইচ্ছা দ্যান, ফলন যা হইব—চোমৎকার–চোমৎকার–

একটু চুপ।

তারপর লোকটাই আবার শুরু করল, আপনের লগে এত কথা কইলাম, আপনে কে, হেয়াই জানলাম না।

অবনীমোহন নিজের পরিচয় দিলেন।

অপার বিস্ময়ে লোকটা খানিকক্ষণ হাঁ হয়ে থাকল। তারপর বলল, আপনে হ্যামকত্তার জামাই!

অবনীমোহন আস্তে করে মাথা নাড়লেন। হেমনাথের সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটাই যেন এখানে পরমাশ্চর্য ঘটনা। এ লোকটার চোখেমুখে যে বিস্ময় তা রাজদিয়াবাসী প্রতিটি মানুষের চোখেই আগে দেখেছেন অবনীমোহন।

লোকটা বলল, আপনে নিয্যস কইলকাত্তায় থাকতেন?

হ্যাঁ। তোমায় কে বললে?

কে কইছিল মনে নাই। তয় শুনছিলাম, কইলকাত্তা থিকা হ্যামকত্তায় ক্যাঠা যিনি আইছে। ভাবছিলাম আপনেরে দেখতে যামু

যাও নি তো–

না।

গেলেই পারতে।

একটু ভেবে লোকটা বলল, যাওনের সোময় কই? চকে চকে মাঠে ঘাটে ঘুইরা দিন কাইটা যায়। কুনোখানে যাওনের ফুরসুত নাই।

বিনু একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভেবেই পেল না, মাঠে ঘাটে এত কী কাজ লোকটার! ইচ্ছে হল একবার জিজ্ঞেস করে, কী ভেবে আর করল না।

অবনীমোহন বললেন, নামটা কী ভাই?

তালেব–তালেব মেঞা—

তুমি এই রাজদিয়াতেই থাকো?

না।

তবে?

তালেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর উদাস গলায় অন্যমস্কের মতো বলল, বাড়ি আমার এই দ্যাশে না।

অবনীমোহন শুধদলেন, কোথায়?

হেই ম্যাঘনার পারে। তয়–

কী?

দ্যাশ কইতে কিছু নাই আমার। ম্যাঘনায় ঘরবাড়ি খাইছে, ভাসতে ভাসতে এইখানে চইলা আইলাম। দশ বিশ বচ্ছর ধইরা এইখানেই আছি।

তোমার কে কে আছে?

কেউ না। এক্কেরে ঝাড়া হাত-পাও।

অবনীমোহন হয়তো কৌতূহল বোধ করছিলেন, এখানে কোথায় থাকো তুমি?

তালেব বলল, থাকনের ঠিকঠিকানা নাই। যহন যেইহানে পারি হেইখানে পইড়া থাকি। তয় মাঠে ঘাটেই থাকি বেশি।

রাত্তিরেও?

হ।

সঙ্গে সঙ্গে কিছু বললেন না অবনীমোহন।

তালেব আবার কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় মজিদ মিঞাকে নিয়ে হেমনাথ এসে পড়লেন। এতক্ষণ রেজিস্ট্রি অফিসের ভেতর মুহুরি আর উকিলের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন তারা।

হেমনাথকে দেখে অনেকখানি ঝুঁকে সম্ভ্রমের গলায় তালেব বলল, ছালাম বড়কত্তা, শরীল গতিক ভালা তো?

হেমনাথ বললেন, ভাল। তুই কেমন আছিস তালেব?

আপনেরা য্যামন রাখছেন।

আমরা রাখবার কে? আকাশের দিকে দেখিয়ে হেমনাথ বললেন, ভাল মন্দ যা রাখবার ওই ওপরওলাই রাখবেন।

তালেব জোরে মাথা নেড়ে বলল, লাখ কথার এক কথা। খোদাতাল্লা ছাড়া কে আর রাখতে পারে।

ওপাশ থেকে মজিদ মিঞা বলে উঠল, জমিন রেজিস্টারির খবর বুঝি পাইয়া গেছস?

নোংরা জট-পাকানো দাড়িগোঁফের ভেতর জগতের সরলতম হাসিটি ফুটিয়ে তালেব মাথা হেলিয়ে দিল।

মজিদ মিঞা আবার বলল, গন্ধ পাইয়াই বুঝি লৌড়াইয়া (দৌড়ে) আইছস?

হ।

হেমনাথ এই সময় তাড়া দিলেন, এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। বেলা হেলতে চলল, এবার বাড়ি ফেরা যাক।

মজিদ মিঞা ব্যস্ত হয়ে উঠল, হ হ, শুদাশুদি খাড়ইয়া থাকনের কুন কাম? লন যাই।

সুরমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। রাজদিয়ার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত, এতখানি রাস্তা তার মতো দুর্বল রোগা মানুষের পক্ষে একবার হেঁটে এসে আবার ফিরে যাওয়া অসম্ভব। শরীরে তা হলে আর কিছুই থাকবে না। তাই সকাল বেলাতেই লারমারের ফিটনখানা আনিয়ে রেখেছিলেন হেমনাথ।

সামনের দিকে একটা ডালপালা-ওলা বিশাল জামরুল গাছের তলায় লারমোরের ফিটনটা দাঁড়িয়ে ছিল। বয়স্ক, রুণ ঘোড়াটা আর কোচোয়ান কাদের দুজনেই ঝিমুচ্ছিল। হেমনাথরা সোজা সেখানে চলে এলেন।

মজিদ মিঞা গলা চড়িয়ে ডাকল, কাদের—

অতি কষ্টে চোখের পাতা দুটো ওপর দিকে টেনে তুলল কাদের। ঘুমন্ত গলায় সাড়া দিল, হ–

ঘুমাস নিকি?

না। বলতে বলতেই আবার কাঁদেরের চোখ বুজে এল।

ঘুমাস না তো চোখ বুইজা আছস ক্যান? মজিদ মিঞা বলতে লাগল, নে, চোখ টান কর। তর ঘোড়ারে জাগা। আমাগো কাম হইয়া গ্যাছে। এইবার বাড়ি যামু।

একে একে সবাই ফিটনে উঠল।

হেমনাথের সঙ্গে জামরুল তলায় তালেবও এসেছিল। সবাইকে গাড়িতে উঠতে দেখে সে উৎকণ্ঠিত হল। ফিটন ছাড়বার মুখে তাড়াতাড়ি অবনীমোহনকে ডাকল, জামাইকত্তা

অবনীমোহন তাকালেন, কী বলছ?

আমার হেই কথাখান কিলাম কওয়া হয় নাই।

অবনীমোহনের মনে পড়ে গেল। সাগ্রহে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, বল—

তালেব বলল, জমিন কিনলেন, ধান রুইবেন তো?

সেইরকমই ইচ্ছে। চাষ না করলে আর কিনলাম কেন? অবনীমোহন হাসলেন।

অঘ্‌ঘান, পৌষ মাসে ধান কাটার পর–তালেব বলতে লাগল, আপনের জমিনে যা দুই চাইর দানা পইড়া থাকব, হেগুলান কিলাম আমার। ইন্দুরের গাদে (ইঁদুরের গর্তে) যা ধান থাকব হেও (তাও) আমার।

কিন্তু—

কী?

মাটির সঙ্গে যে ধান মিশে থাকবে তা তুলবে কী করে?

হে আমি য্যামনে পারি। আপনে খালি কথা দ্যান, উই ধান আমারে দিবেন।

সংশয়ের গলায় অবনীমোহন বললেন, তুমি যদি তুলে নিতে পার, আমার আপত্তি নেই।

তালেবের চোখমুখ থেকে আনন্দ যেন উছলে পড়তে লাগল। এত বড় জয় যেন আর কখনও হয়নি তার। উৎফুল্ল সুরে মাথা হেলিয়ে সে বলতে লাগল, কথা দিলেন কিলাম, পাকা কথা

হ্যাঁ হ্যাঁ, পাকা কথা বৈকি—

একসময় ফিটন চলতে শুরু করল।

অনীমোহনের বিস্ময় আর কাটছিল না। বললেন, অদ্ভুত লোক—

হেমনাথ বললেন, হ্যাঁ, অদ্ভুতই। প্রায়ই এই রেজিস্ট্রি অফিসে এসে বসে থাকে। আর যে জমি কেনে তাকে গিয়ে ধরে, যাতে ধান ওঠার পর ঝড়তি পড়তি ফসল ও কুড়িয়ে নিতে পারে।

আর কিছু করে না?

না। করতে তো অনেকেই বলে। আমি বলেছি, মজিদ বলেছে, রামকেশব বলেছে, গুয়াখোলার রহিম মিঞা বলেছে। কামলার তো সবারই দরকার। আমরা ওকে বাড়িতে এসে থাকতে বলেছি। কিন্তু কে কার কথা শোনে!

ধান কুড়িয়ে দিন চলে?

ভগবান জানে।

সারা রাস্তা তালেবের কথাই হল। কথায় কথায় একসময় বরফ কল, স্টিমারঘাট, সারি সারি মিঠাইর দোকান পেরিয়ে ফিটন হেমনাথের বাড়ি এসে থামল।

.

২.০৮

পুজোর আগে সেই যে ঝিনুক এ বাড়ি এসেছিল, এখনও যায়নি। ভবতোষ অবশ্য মাঝে মধ্যে এসে মেয়েকে দেখে গেছেন। ঠিক হয়েছে এখানে থেকেই পড়াশোনা করবে ঝিনুক। ইংরেজি নতুন বছর পড়লে স্কুলে ভর্তি হবে।

এখনও মাছের বড় টুকরোটা নিয়ে, দাদুর কাছে শোওয়া নিয়ে, স্নেহলতার ভাগ নিয়ে বিনুর সঙ্গে সমানে হিংসে করে যাচ্ছে ঝিনুক। তবে পুজোর ছুটিতে কলকাতা থেকে ঝুমারা আর পর ঝিনুক যেমনটি হয়ে উঠেছিল, এখন তেমন নেই। তখন সব সময় বিনুর দিকে তাকিয়ে থাকত। সে। বিনু কী করে, কোথায় যায়, সব তীক্ষ্ণ ধারাল চোখে লক্ষ করত। ঝুমার সঙ্গে বিনু খেলা করলে, কথা বললে, কিংবা বেড়াতে গেলে রাগে-আক্রোশে-বিদ্বেষে জর্জরিত হয়ে যেত ঝিনুক। আজকাল সে ভাবটা নেই তার।

একটা ব্যাপার বিনু লক্ষ করেছে, লেখাপড়া খেলাধুলো কিংবা তার সঙ্গে হিংসের ফাঁকে ফাঁকে কখনও কখনও পুবের ঘরের দাওয়ায় চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে ঝিনুক, উদাস চোখে হেমন্তের অনুজ্জ্বল ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। যে ঝিনুক হিংসে করে, যে ঝিনুক দাদু-দিদার ভাগ নিয়ে গাল ফুলিয়ে দুর্বিনীত ঘাড় বাঁকিয়ে থাকে, তাকে তবু চেনা যায়। কিন্তু এই মেয়েটা বড় অচেনা, তাকে বড় দূরের মনে হয় তখন।

এমনিতে ঝিনুককে বিশেষ পছন্দ করে না বিনু, আবার অপছন্দও করে না। কিন্তু নির্বাক বিষণ্ণ, প্রতিমার মতো এই সুদূর, অচেনা মেয়েটা তাকে যেন অসীম আকর্ষণে টানতে থাকে।

একেক সময় বিনু তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, এখানে বসে কী করছ?

প্রথমটা হয়তো শুনতেই পায় না ঝিনুক। দু’চারবার ডাকাডাকির পর সে চমকে তাকায়। বিনু আগের প্রশ্নটাই আবার করে, এখানে কী করছ?

গাঢ় বিষাদের গলায় ঝিনুক বলে, মা’র কথা ভাবছি।

দুঃখী মেয়েটা নিমেষে যেন বিনুকে অভিভূত করে ফেলে। তার অনেকখানি কাছে গিয়ে অপার সহানুভূতির সুরে সে শুধোয়, মা’র জন্যে মন কেমন করছে?

আস্তে আস্তে কোঁকড়ানো চুলে-ভরা মাথাটা নেড়ে অস্ফুট গলায় বিনুকে বলে, হুঁ– রুপোর মতো বড় বড় চোখদুটো প্রথমে জলে ভরে যায়, তারপর ফোঁটায় ফোঁটায় টপ টপ ঝরে পড়তে থাকে।

এই সময়টা একেবারে দিশেহারা হয়ে যায় বিনু। কিভাবে ঝিনুককে সান্ত্বনা দেবে, কেমন করে কোন সমবেদনার কথা বললে মেয়েটা শান্ত হবে, সে ভেবেই পায় না। বিমূঢ়ের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গম্ভীর ভারী গলায় বিনু বলে, কেঁদো না।

কান্না থামে না। ঝিনুক ফুলে ফুলে ফেঁপাতেই থাকে, আর ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, মাকে আমি আর কক্ষণো দেখতে পাব না।

গলার কাছটা, বুকের ভেতরটা কেমন ভারী হয়ে আসে বিনুর। কান্নার মতো কিছু একটা উথলে বেরিয়ে আসতে চায়, কিন্তু পথ পায় না। ফিসফিস করে বিনু এবার যা বলে, ঝিনুক তো নয়ই, নিজেও স্পষ্ট বুঝতে পারে না।

.

২.০৯

অঘ্রাণের শেষাশেষি একদিন হেমনাথ বললেন, মাঠের ধান তো পেকে এল। আর কদিন পর কাটা শুরু হবে। তার আগে একটা কাজ করা দরকার।

স্নেহলতা-অবনীমোহন-সুধা-সুনীতি-বিনু, এমনকি যুগলও কাছাকাছি ছিল। সবাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল, কী?

ধানকাটার পরই তো যুগলের বিয়ে। তার আগে একখানা ঘর তুলতে হয়। নইলে—

স্নেহলতা বললেন, নইলে কী?

হেমনাথ বললেন, নতুন বৌ এসে থাকবে কোথায়? যুগল যে ঘরে থাকে সেখানে নতুন বৌকে তো তোলা যায় না।

সে তো ঠিকই। স্নেহলতা উৎসাহিত হয়ে উঠলেন, তা ঘর উঠবে কোথায়?

উত্তর না দিয়ে হেমনাথ যুগলের দিকে তাকালেন, কি রে, কোথায় ঘর তুলবি?

যুগল ঘাড় গুঁজে এক মনে নখ খুঁটে যাচ্ছিল, আরও ঝুঁকে পড়ল সে, জবাব দিল না।

হেমনাথ বললেন, লজ্জায় তো একেবারে গেলি! তাড়াতাড়ি বল, কাল থেকে কামলা লাগাব।

যুগল আর বসে থাকতে পারল না, উঠে বার-বাড়ির দিকে দৌড় লাগাল।

হেমনাথ হেসে উঠলেন, দেখাদেখি অন্য সবাইও হাসল।

সেইদিনই ঘুরে ঘুরে যুগলের ঘরের জন্য জায়গা ঠিক করে ফেললেন হেমনাথ। দক্ষিণের ঘরের গা ঘেঁষে পেঁকিঘর। তার পেছন দিকে কইওকড়া আর চোখ-উদানে গাছের ঝুপসি জঙ্গল। স্থির হল, এই জায়গাটা সাফ-টাফ করে কাল থেকে ঘর ভোলা হবে। পঁচিশের বন্দ’র মস্ত ঘর।

হেমনাথ যা বলেছিলেন তাই করলেন। পরের দিনই মজুর লাগিয়ে দিলেন।

ঢেঁকিঘরের পাশে যুগলের জন্য নতুন ঘর উঠতে লাগল। আর এদিকে হেমনাথ তাঁর পুকুরে মাঝধরা’ দিলেন।

অঘ্রাণ মাসের শুরু থেকেই এদেশের পুকুরগুলো খারাপ হয়ে যায়। যত কচুরিপানা, টোপাপানা, বাইচা (এক জাতের জলজ আগাছা)। সব পচতে শুরু করে। ফলে জল যায় নষ্ট হয়ে, তার রংও যায় বদলে। কালচে দুষিত জল থেকে দুর্গন্ধ উঠতে থাকে। এই সময় জলের ভেতর মাছেদের বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। পাবদা-ট্যাংরা-ফলুই-নলা-গরমা-বোয়াল-বজুরি-ভাগনাআঁক বেঁধে পুকুরের সব মাছ জলতল থেকে আধমরার মতো ওপরে উঠে ভাসতে থাকে। এদেশে একে বলে, মাঝ গাবানো।

মাছ গাবাতে শুরু করলে ধরে ফেলতেই হবে। নইলে জলজ আগাছার সঙ্গে মাছ মরে পচতে থাকলে আবহাওয়া বিষাক্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু একসঙ্গে এত মাছ দিয়ে কী হবে? তাই বড় বড় গৃহস্থরা মাছধরা দেয়। রাজ্যের লোক জুটিয়ে এনে গাবানো মাছ’ ধরিয়ে ফেলে। যে যতটা ধরতে পারে সবটাই তার। এর জন্য পুকুরের মালিককে ভাগ দিতে হয় না।

‘মাছধরা’ দিলে দুদিক থেকে সুবিধে। এক, মরা আধমরা মাছগুলো জল থেকে হেঁকে আনা যায়। দুই, অসংখ্য মানুষ মাছধরার ফলে পুকুরের সমস্ত আগাছা যায় সাফ হয়ে।

‘মাছধরা’ দেবার জন্যে ঢেঁড়া দিতে হয় না। দু’চারজনের কানে তুলে দিলেই হল। তারাই খবরটা দিগদিগন্তে পৌঁছে দেয়।

একদিন সকালবেলা বিনু দেখল কয়েক শ মানুষ পলো, ধর্মজাল, ঝাঁকিজাল নিয়ে তাদের পুকুরে এসে পড়েছে। তারপর সমস্ত দিন ধরে জল তোলপাড় করে চলল মাছধরা। মানুষের সঙ্গে মাছরাঙা আর শঙ্খচিলেরাও মাছ ধরবার জন্য পাল্লা দিতে লাগল।

বেলা একটু বাড়লে বিনুও বায়না ধরে যুগলের সঙ্গে পুকুরে নামল। এবং কী আশ্চর্য, সারা গায়ে জল আর পাঁক মেখে দুটো মেনি আর একটা সরপুঁটি মাছ ধরেও ফেলল।

শুধু হেমনাথের পুকুরেই না। পর পর ক’দিন রাজদিয়ায় আরও অনেক পুকুরে মাছধরা চলল। যুগলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সে সব জায়গা থেকেও মাছ নিয়ে এল বিনু।

.

দেখতে দেখতে পৌষ মাস পড়ে গেল।

আশ্বিনের শুরুতে মাঠময় শুধু ছিল জল। অথৈ অপার সমুদ্র হয়ে শরতের মাঠ দিগদিগন্ত জুড়ে দুলতে থাকত। তার ওপর আমন ধানের চারাগুলো মাথা তুলে ছিল। তখন যেদিকে চোখ যেত, সবুজ আর সবুজ।

কার্তিকের গোড়াতেই জলে টান ধরেছিল। পৌষ মাস পড়তে না পড়তেই মাঠ একেবারে শুকনো, এক ফোঁটাও জল নেই। অবশ্য মাটি এখনও নরম, কোথাও কোথাও কাদা জমে আছে।

তবে সব চাইতে বিস্ময়কর যা, তা হল ধানগাছগুলো। কোন এক জাদুকরের ছোঁয়ায় সেগুলো এখন সোনা হয়ে গেছে। মাঠের ঝাপি ফসলের লাবণ্যে ভরে উঠেছে।

হেমনাথ একদিন বললেন, আর দেরি করা যাবে না। দু’একদিনের মধ্যে ধানকাটা শুরু করতে হবে।

একটু চিন্তা করে অবনীমোহন বললেন, কিন্তু মামাবাবু—

হেমনাথ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।

অবনীমোহন বলতে লাগলেন, আপনার জমি এক শ’ কানির মত। বার মাসের লোক বলতে মোটে দু’জন-যুগল আর করিম। দুটো লোকের পক্ষে এত জমির ধান কেটে ঘরে তোলা অসম্ভব। আরও কয়েকজন তো দরকার।

হেমনাথ কিন্তু আদৌ চিন্তিত নন। ব্যাপারটা যেন কোনও সমস্যাই নয় এমনভাবে বললেন, তা তো দরকার।

দু’একদিনের মধ্যে যদি ধানকাটা শুরু করেন, অন্তত আজকালের ভেতর লোকজন যোগাড় করে নিতে হবে।

সে ঠিক জুটে যাবে।

হেমনাথকে যতখানি ভাবনাশূন্য দেখাল, অবনীমোহন কিন্তু ততখানি নিশ্চিন্ত নন। কিভাবে কোত্থেকে এত লোক যোগাড় হবে, তিনি ভেবে উঠতে পারছিলেন না। অবশ্য এ প্রসঙ্গে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না।

হেমনাথ বুঝিবা অবনীমোহনের মনোভাব টের পেয়েছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, দেখো, লোক ঠিক বাড়িতে এসে হাজির হবে।

আপনি আগেই ঠিক করে রেখেছেন?

না।

তবে? অবনীমোহনকে ঈষৎ বিমূঢ় দেখাল।

হেমনাথ বললেন, আগে থেকে ঠিক করার দরকার নেই। সময়মতো ওদের পাওয়া গেলেই তো হল।

হেমনাথ যা বলেছিলেন তা-ই। লোক যোগাড় করতে হিল্লি দিল্লি ছুটতে হল না, ঘরে বসেই পাওয়া গেল।

সেইদিনই বিকেলবেলা লক্ষ্মীছাড়া চেহারার একদল মানুষ এসে হাজির। হাত-পা তাদের ফাটা ফাটা, চামড়া থেকে খই উড়ছে। চুল জট পাকাননা, চিরুনি এবং তেলের সঙ্গে সেগুলোর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। পরনে চিটচিটে লুঙ্গি আর চেক-কাটা জামা কিংবা গেঞ্জি। সবার হাতেই দু’টো করে ধানকাটা কাস্তে। চেহারা এবং পোশাক আশাক দেখে এক পলকেই বোঝা গেল, ওরা খুব গরিব মুসলমান।

সবার আগে ছিল বুড়োমতো একটা লোক, সম্ভবত সে-ই দলপতি। হেমনাথের কাছে এগিয়ে এসে বলল, আদাব হ্যামকত্তা

অন্য লোকগুলোও বিনীত সুরে বলে উঠল, আদাব আদাব—

হেমনাথও হাতজোড় করে বললেন, আদাব। তারপর কী খবর বল। আজই এলে নাকি?

জি– সবার প্রতিনিধি হিসেবে বুড়ো লোকটা বলল, দেরি নি হইয়া গেল কত্তা?

না। ঠিক সময়েই এসেছ?

ধানকাটা কামলা রাখেন নাই তো?

না। তবে আজকালের মধ্যে তোমরা না এলে অন্য লোক দেখতে হত।

নসিব ভাল, আইজই আমরা আইছি। তা ধানাকাটা আরম্ভ হইব কবে?

এসেই যখন পড়েছ, কাল থেকেই আরম্ভ করব ভাবছি।

হেই ভালা। আইলসা বইসা থাইকা লাভ কী?

হেমনাথ শুধোলেন, তোমরা ক’জন এসেছ?

বুড়ো লোকটা জানাল, পঁচিশ জন।

ঠিক আছে। পঁচিশ জনই আমার দরকার। হেমনাথ গলা তুলে ডাকলেন, যুগল, যুগল–

যুগল বার-বাড়ির দিক থেকে ছুটে এল। হেমনাথ দলটাকে দেখিয়ে বললেন, এদের থাকার ব্যবস্থা করে দে।

আরেক প্রস্থ আদাব জানিয়ে লোকগুলো যুগলের সঙ্গে চলে গেল।

অবনীমোহন অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, এরা কারা?

হেমনাথ বললেন, চরের কৃষাণ।

আপনি জানতেন, ওরা আসবে?

জানতাম। প্রত্যেক বছরই ওরা আসে। হেমনাথ এরপর যা বললেন, সংক্ষেপে এইরকম।

অঘ্রাণের শেষাশেষি ধলেশ্বরীর চরগুলো থেকে এবং সুদূর ভাটির দেশ থেকে দলে দলে ভূমিহীন গরিব কৃষাণ রাজদিয়ার দুয়ারে দুয়ারে এসে হানা দেয়। ফি বছরই এই সময়টা ওরা এখানে আসে। শুধু অঘ্রাণেই না, বৈশাখ-জষ্ঠি-আষাঢ়ে-ধান-পাট রোয়ার দিনগুলোতেও আসে। দরকার মতো সম্পন্ন গৃহস্থেরা তাদের কাজে লাগায়, সাময়িক প্রয়োজন ফুরোলে তারা আবার দল বেঁধে ফিরে যায়। যে লোকগুলোকে আজ হেমনাথ রেখেছেন তারাও নির্ভুম, নিরন্ন চাষী।

অবনীমোহন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। এই বিশাল দেশে যেখানে এত প্রাচুর্য, জিনিসপত্র এত অকল্পনীয় রকমের শস্তা, সেখানেও মানুষের দুমুঠো ভাত জোটে না? পূর্ব বাংলার দিগদিগন্ত জুড়ে ফসলের মাঠ ছড়ানো। অথচ এদেশে বেশির ভাগ মানুষই নাকি ভূমিহীন। অবনীমোহন আরও জানতে পারলেন, জমিজমাগুলা বড় বড় গৃহস্থের বাড়িতে বছরে মোটে চার মাসের মত তারা কাজ পায়।

অবনীমোহন শুধোলেন, বাকি আট মাস ওদের কিভাবে কাটে?

আন্দাজ কর না– হেমনাথ হাসলেন।

বুঝতে পারছি না।

হেমনাথ এবার বিশদভাবে বুঝিয়ে দিলেন। চার মাস লোকের জমিতে ধান-পাট বুনে এবং খেটে ওদের কাটে। সারা বছরে এই সময়টাই যা একটু সুখের মুখ ওরা দেখতে পায়। একমাস কাজ করে পানের বরজ-এ। মাস দুয়েকের মতো মুত্রা আর বাঁশ দিয়ে ধামা কুলো-পাটি, এই সব বুনে হাটে হাটে বেচে। তা ছাড়া, খালে-বিলে-নদীতে মাছমারা তো আছেই। জীবনধারণের জন্য তাদের নির্দিষ্ট সম্মানজনক কোনও জীবিকা নেই, আছে হাজার রকমের উঞ্ছবৃত্তি।

হেমনাথ বলে যাচ্ছিলেন, দু’চারটে মাস বাদ দিলে দুর্ভিক্ষ ওদের নিত্য সঙ্গী। কত কষ্টে যে ওরা দিন কাটায় ভাবতে পারবে না।

একটু ভেবে অবনীমোহন বললেন, আমার ধারণা ছিল, এদেশের সব মানুষ খুব সুখে আছে।

ধারণাটা ঠিক নয়।

তাই তো দেখছি।

একটু নীরবতা। তারপর অবনীমোহনই আবার শুরু করলেন, এত প্রচুর ফসল এদেশে, এত শস্তাগণ্ডা, তবু লোকে খেতে পায় না! আশ্চর্য ব্যাপার।

হেমনাথ আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন। আবছা গলায় বললেন, সত্যিই আশ্চর্য।

আচ্ছা মামাবাবু—

বিল—

এভাবে এত কষ্টের ভেতর কতদিন মানুষ বাঁচতে পারে?

বংশ পরম্পরায় ওরা বেঁচে আছে। আমাদের সমাজ-ব্যবস্থাই এইরকম। কী আর করা যাবে!

অবনীমোহন উত্তর দিলেন না।

একধারে চুপচাপ বসে দাদু আর বাবার কথাগুলো শুনছিল বিনু। সব বোঝে নি সে। তবু গরিব ওই মানুষগুলোর জন্য অসীম দুঃখে তার বুক ভারী হয়ে গেল।

পাঁচশ জন লোক রেখেছেন হেমনাথ। তারা সবাই ধলেশ্বরীর চর থেকে এসেছে। উদয়াস্ত খাটলেও এক শ’ কানি জমির ধান কাটতে, সেই ধান ঝেড়ে শুকিয়ে ডোলে তুলতে কম করে মাস দুই লাগবে। নতুন লোকগুলো ততদিন এখানেই থাকবে। অর্থাৎ ফিরে যেতে যেতে তাদের সেই ফাল্গুন মাস।

যতদিন ধানকাটা চলবে ততদিন খোরাকি পাবে লোকগুলো। মুজরি হিসেবে টাকাপয়সা অবশ্য দেবেন না হেমনাথ, দু’মাস পর দেশে ফেরার সময় প্রত্যেককে তিন মণ করে ধান, দু’খানা করে নতুন লুঙ্গি আর গামছা দেবেন।

উত্তর আর দক্ষিণের দু’খানা ঘর লোকগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা তাদের নিজেদের। অবশ্য চাল-ডাল-তেল-মশলা স্নেহলতা পাঠিয়ে দেন। রান্নাবান্না ওরা করে নেয়।

.

লোকগুলো কাজে লাগবার পর থেকেই ছায়ার মতো বিনু তাদের সঙ্গে সঙ্গে আছে। ভোরবেলা উঠেই কাঠকুটো জ্বেলে ওরা রান্না চড়িয়ে দেয়। তারপর উনুনের চারধারে গোল হয়ে বসে হাত পা সেঁকতে থাকে। তখনও কুয়াশা আর হিমে চারদিক ঝাঁপসা, সূর্যের তো দেখাই পাওয়া যায় না। তার বদলে আকাশের দূর প্রান্তে প্রভাতিয়া তারাটা জ্বলজ্বল করতে থাকে।

ওদের ওঠার আওয়াজ পেয়েই আজকাল ঘুম ভেঙে যায় বিনুর। ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। প্রতিদিনই উঠে সে দেখে, হেমনাথ বসে আছেন। এমনিতেই হেমনাথ তাড়াতাড়ি ওঠেন। ইদানীং ধানকাটা শুরু হবার পর তাঁর চোখ থেকে ঘুম গেছে। সারারাত বোধহয় জেগেই থাকেন।

তাড়াতাড়ি দাদুর সঙ্গে সূর্যবন্দনা সেরে সকালবেলার খাবার খেতে খেতে রোদ উঠে যায়। শীতের নিরুত্তাপ, স্তিমিত রোদ।

এদিকে অবনীমোহনও উঠে পড়েন। ওদিকে লোকগুলোর খাওয়াও হয়ে যায়। সকালবেলায় অবশ্য ওরা ভরপেট খায় না। নাকেমুখে দু’চার গরাস কোনও রকমে খুঁজে বাকি ভাত-তরকারি আর নুন লঙ্কা-পেঁয়াজ মেটে পাতিলে ভরে গামছায় বেঁধে নেয়।

সকালে খাওয়া হলে আর এক দণ্ডও বসে থাকে না লোকগুলো। ধানকাটা কঁচি, ভাতের পাতিল আর তামাকের যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে ঝাঁক বেঁধে বেরিয়ে পড়ে। হেমনাথ, অবনীমোহন আর বিনুও রোজ তাদের সঙ্গে চলে যায়। ধানকাটা শুরু হতেই লেখাপড়া একরকম বন্ধ করে দিয়েছে বিনু।

এমনিতে কোনও রাস্তা নেই। জমির আলের ওপর দিয়ে পথ। পথের ঘাস শিশিরে ভিজে থাকে। পৌষ মাসের সকালে তার ওপর দিয়ে যেতে যেতে পা শিরশির করতে থাকে বিনুর। অঘ্রাণের মাঝামাঝি থেকেই উত্তুরে হাওয়া ছাড়তে শুরু করেছিল। পৌষ মাসে তার যেন দাঁত বেরিয়েছে। শরীরের যে জায়গাগুলো ভোলা, বাতাস যেন সেখানে কেটে কেটে বসে।

যতখানি সম্ভব বিনুরা দামী গরম জামা-কাপড়ে গা মুড়ে আসে। কিন্তু ধানকাটা এই লোকগুলোর বড় কষ্ট। আচ্ছাদন বলতে লুঙ্গি আর মার্কিন কাপড়ের পিরহানের ওপর জ্যালজেলে চাদর। অনেকে আবার চাদরটাও জোটাতে পারেনি। পৌষ মাসের শীতল প্রভাতে খোলা আকাশের তলায় হু হু উত্তরে বাতাসের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে লোকগুলো হি-হি করে কাঁপতে থাকে। রোদ থেকে যে ভরসা পাবে তারও উপায় নেই। এই শীতে সূর্যালোক বড় কৃপণ, বড় কুণ্ঠিত, বড় নিস্তেজ। যদিও রোদ উঠে যায়, কাছে-দূরে কুয়াশার পর্দাগুলো ঝুলতে থাকে। কুয়াশার জন্য পরিষ্কার কিছুই চোখে পড়ে। উত্তরের চক, দক্ষিণের চক, পুব-পশ্চিমের আদিগন্ত ধানের খেত-সব কিছুই ঝাঁপসা, নিরবয়ব।

যেতে যেতে লোকগুলো বলাবলি করে, এই বছর বেজায় শীত। জবর হিয়ল (কুয়াশা)।

হ।

হাত-পাও কালাইয়া (শীতে জমে যায়) যায়।

হ।

সুজনগুঞ্জের হাট থন একখান চাদর যদি কিনতে পারতাম।

চাদরের যা দাম!

কত?

আড়াই ট্যাহা, তিন ট্যাহা—

হায় আল্লা, অত ট্যাহা কই পামু।

একটু চুপচাপ।

তারপর কে একজন ডেকে ওঠে, বছির ভাই–

বছির নামে লোকটি তক্ষুনি সাড়া দেয়, কী কও তাহের ভাই–

তাহের বলে, ধান কাটতে বাইর হওনের সোময় ছোট মাইয়াটার ধুম জ্বর দেইখা আইছিলাম—

হ।

অহন ক্যামন আছে, ক্যাঠা (কে) জানে।

মনখান খারাপ লাগে?

হ।

মাইয়ার ব্যারাম, তোমার বাইরন (বার হওয়া) ঠিক হয় নাই।

বিষণ্ণ গলায় তাহের বলে, তুমি তো কইলা বাইরন ঠিক হয় নাই। কইয়াই খালাস। কিন্তুক–

কী? জিজ্ঞাসু সুরে বছির শুধোয়।

তাহের বলে, ধানকাটা হইয়া গ্যালে তিন মণ ধান পামু। লুঙ্গি গামছা পামু দুইখান কইরা। মাইয়া লইয়া ঘরে বইসা থাকলে কে আমারে এই হগল দিব? এই ধানটা পাইলে দুই মাসের লেইগা নিশ্চিন্তি–

তয় আড়বুইঝার (অবুঝ) লাখান কথা কইতে আছিলি যে বড়। মাইয়া বাচুক-মারুক, এইটা কি আমাগো ঘরে বইসা থাকনের সোময়?

না।

বাইচা থাকলে মাইয়া লইয়া পরে সুহাগ করন যাইব।

হ।

একটু চুপ করে থেকে বছির বলে, তোমার মাইয়ার কথায় আমার একখান কথা মনে পড়ল তাহের ভাই–

তাহের বলে, কী?

আহনের সোময় বিবির হাতে তিনখান ট্যাহা দিয়া আইছিলাম। ঘরে আছিল তিন পাসারি চাউল, দুই স্যার তিল আর এক আগইল (ধামা) কাঐনের (কাউনের) চাউল। দুইটা মাস চাইরটা পোলা লইয়া ক্যামনে যে চালাইব!

তাহের উত্তর দেয় না।

বছির আবার বলে, ঘরে এক টুকরা সোনা দানা নাই যে বেইচা, কি বান্ধা দিয়া দুইটা পয়সা পাইব! কী যে করব বউটা!

তাহের এবার বলে, ভাইবা কী করবা? পথ আছে কুনো? শুদাশুদি মন খারাপ। তার থনে যা করতে আছ, কর।

ধানকাটা লোকগুলোর টুকরো টুকরো ঘর সংসারের কথা শুনতে শুনতে একসময় বিনুরা জমিতে এসে পড়ে।

ধানখেতে এসে প্রথমে লোকগুলো এক ছিলিম করে তামাক খেয়ে গা গরম করে নেয়। তারপর জামাটি খুলে সযত্নে গাছের ডালে ঝুলিয়ে লুঙ্গিতে মালকোচা মারে, তারও পর খাঁজকাটা বাঁকানো ধারাল কাস্তেটি হাতে নিয়ে জমিতে নামে। শুরু হয়ে যায় ধানকাটা। সমস্ত মাঠ জুড়ে শব্দ ওঠে খসর-খ। গোড়া থেকে খড়সমেত ধানের গোছা কেটে একেক জন একেক জায়গায় স্থূপাকার। করতে থাকে।

হেমনাথের বসবার সময় নেই। মাঠময় ঘুরে ঘুরে তিনি ধানকাটা তদারক করতে থাকেন। অবনীমোহন আর বিনুও বসে থাকে না। হেমনাথের পিছু পিছু ঘুরতে থাকে।

কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ধানকাটার পর নতুন লোকগুলোর ভেতর থেকে কেউ হয়তো বলে ওঠে, মুখ বুইজা কাম করন যায় না। এই ছ্যামরারা একখান গীত ধর

সঙ্গে সঙ্গে তালমাত্রাহীন বেসুরো গলায় গান শুরু হয়ে যায়।

দোহাই আল্লা মাথা খাও
হামাক ফেইল্যা কই বা যাও
বিদ্যাশ গ্যালে এবার তুমার
সঙ্গ ছাড়ম না–আ-আ—
পো নাই মোর, মাও নাই,
একলা ঘরে কাল কাটাই,
গোসা করলে আর তো
আমি ছালুন রাম না–আ-আ-আ–
নয়া শীতের জারেতে
যাইবা যহন ধান দাইতে,
তুমার কচি-ক্যাথা, হক্কা-তামুক
দিমু না–আ-আ-আ–
খসম আমি তুমার
সঙ্গ ছাড়ম না-আ-আ-আ–
নিদয় হইলে মানুষ পাইবা
পিরীত পাইবা না–আ-আ-আ—

রোজই অবশ্য গান হয় না। কোনও কোনও দিন অল্পবয়সী ছোকরারা দলের সব চাইতে বর্ষীয়ান কৃষাণটিকে ডেকে বলে, একখান কিচ্ছা কও খলিল চাচা।

খলিল বলে, কী কিচ্ছা শুনবি?

হেই ‘গুলেবাখালি’ রাজকইন্যার—

রাজকইন্যার কিচ্ছায় বড় রস, না?

ছোকরারা কিছু বলে না, শব্দ করে হাসতে থাকে শুধু।

বুড়ো খলিল ধবধবে দাড়ি আর শীৰ্ণ হাত নেড়ে গল্প জুড়ে দেয়, এক আছিল রাজকইন্যা। তার চিকন চিকন চুল, চাম্পা ফুলের লাখান বন্ন (রং), মুক্তার লাখান দাঁত। হেয় হাসলে হাজারখান চান্দ য্যান ঝলমলাইয়া ওঠে–

কাজের ফাঁকে ফাঁকে গান কিংবা গল্প। গানে গানে, গল্পে গল্পে বেলা দুপুর হয়ে যায়। শীতের সূর্য খাড়া মাথার ওপর এসে ওঠে। এ সময়টা ধানকাটা বন্ধ রেখে লোকগুলো পাশের একটা খাল থেকে হাত-মুখ ধুয়ে, ভাতের পাতিল খুলে, আলের ওপর সারি সারি খেতে বসে যায়।

দুপুরবেলায় হেমনাথ মাঠে থাকেন না। অবনীমোহন আর বিনুকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। জিরোবার সময় নেই। কোনওরকমে চান-খাওয়া সেরেই আবার ধানখেতে ছোটেন। এ বেলাও অবনীমোহন এবং বিনু তার সঙ্গে সঙ্গে যায়।

সূর্যটা পশ্চিম আকাশের ঢাল বেয়ে খানিক নেমে গেলেই ধানকাটা বন্ধ করে দেয় লোকগুলো। তখন ফেরার পালা। সকাল থেকে একটানা পরিশ্রমে যে শস্য কেটে কেটে স্থূপাকার করা হয়েছিল, কৃষণেরা এবার তা মাথায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। একবারে তো এত ফসল নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই বার বার তাদের মাঠে আসতে হয়।

সমস্ত শস্য বাড়ি নিয়ে তুলতে সন্ধে নেমে যায়। তারপর পুকুরে হাত-পা ধুয়ে এসে লোকগুলো উত্তর আর দক্ষিণের ঘরে বসে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়।

সারাদিন তো কাছে কাছেই থাকে, বাড়ি ফিরেও তাদের সঙ্গ ছাড়ে না বিনু। উত্তর কি দক্ষিণের ঘরে গিয়ে ওদের কথা শোনে।

লোকগুলোকে সারাদিন দেখেও বিনুর বিস্ময় কাটে না। কোথায় কতদূরে তাদের দেশ, কে জানে। ঘর-সংসার ছেলেমেয়ে ফেলে শুধু দুমুঠো ভাতের জন্য তারা এখানে পড়ে আছে। কতদিন ওরা বাড়ি নেই, বাবাকে না দেখে ওদের ছেলেমেয়েদের মন খারাপ হয়ে যায় না? বিনু ভাবতে চেষ্টা করে।

সমস্ত দিন তো কথা বলার ফুরসত নেই। সন্ধেবেলা মাঠ থেকে ফেরার পর লোকগুলো বিনুর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়।

বছির বলে, অ বাবুগো পোলা—

বিনু তক্ষুণি সাড়া দেয়, কী বলছ?

আপনের নাম কী?

বিনু–বিনয়কুমার বসু।

বড় বাহারের নাম। বছির বলতে থাকে, কিষাণগো কাম আপনের ভাল লাগে?

বিনু ঘাড় হেলিয়ে বলে, হ্যাঁ।

আমাগো লগে ধান নি কাটবেন?

বিনু উত্তর দেবার আগেই ওধার থেকে বুড়ো খলিল বলে ওঠে, কী যে কস বছিরা, বাবুগো পোলায় ধান কাটব কোন দুঃখে? লিখাপড়া শিখা দারোগা হইব, ম্যাজিস্টর হইব।

বছির বলে, আমি তামসা করলাম স্যান–

এমনি টুকরো টুকরো কথা। কথায় কথায় শীতের রাত ঘন হতে থাকে। উত্তরে বাতাস বাগানের গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে শনশনিয়ে ছুটে যায়। কোথায় যেন কালাবাদুড় ডানা ঝাঁপটায়, রাতজাগা পাখিরা গাঢ় গলায় খুনসুটি করে। ভারী কুয়াশা জমে জমে চারদিক ঝাঁপসা হয়ে যায়।

হঠাৎ একসময় খেয়াল হতে ব্যস্তভাবে কেউ বলে ওঠে, রাইত মেলা হইল, আর কত গপ করবি? ভাত বসাইতে হইব না?

সবাই চকিত হয়ে উঠে পড়ে।

ওদিকে ভেতর-বাড়ি থেকে স্নেহলতার গলা ভেসে আসে, বিনু–বিনু, খাবি আয়—

লাফ দিয়ে উত্তর কি দক্ষিণের ঘর থেকে বেরিয়ে বিনু ছুট লাগায়।

.

শুধু হেমনাথের জমিতেই নয়, চকের পর চক জুড়ে এখন ধানকাটা চলছে। শীতের নিস্তেজ রোদেও কৃষাণদের হাতের কাস্তেগুলো ঝকমক করতে থাকে।

হেমনাথের জমির পশ্চিমে রামকেশবের জমি, উত্তরে লারমারের। ধানকাটা তদারক করার ফাঁকে ফকে লারমার আর রামকেশব গল্প করতে আসেন।

রামকেশব বলেন, এইবার ফলন বেশ ভাল।

হেমনাথ আর লারমোর মাথা নাড়েন, হ্যাঁ—

আমার পঞ্চাশ কানি জমিতে কম করে পাঁচ শ’ মণ ধান উঠবে।

হেমনাথ বলেন, অত ধান নিয়ে কী করবি?

রামকেশব বলেন, বছরের খোরাকি রেখে বাকিটা বেচে দেব।

আমারও তাই ইচ্ছে। তা দরটর কেমন শুনছিস?

দর বেশ তেজী। সেদিন নিত্য দাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, সে বলল।

বাজার তেজী থাকলে ভালই। দুটো পয়সা হাতে আসবে। হেমনাথ বলতে থাকেন, তবে একটা কথা।

কী? জিজ্ঞাসু চোখে তাকান রামকেশব।

আমাদের তো সুবিধেই। কিন্তু যাদের জমিজমা নেই, শরীরের খাটুনিই ভরসা, তারা খুব মুশকিলে পড়ে যাবে।

একটু নীরবতা।

একসময় হেমনাথ বলেন, যা হবার তা হবে। তারপর লালমোহন—

বল– লারমোর মুখ তুলে তাকান।

খুব তো ধানখেতে এসে বসে আছ, তোমার রোগীরা ছাড়লে? হাটে যাচ্ছ না আজকাল?

হেমনাথের কোনও নেশা নেই। চা-পান-বিড়ি-সিগারেট কিছুই খান না। রামকেশবও তা-ই। লারমোর কিন্তু নেশার জিনিসটা হাতে পেলে ছাড়াছাড়ি নেই। পেলেন তো দিনে দশ বার চাই খেলেন। বান্ডিল বান্ডিল বিড়ি শেষ করলেন। না পেলেন তো বছরখানেক কিছুই খেলেন না।

আলে কৃষাণদের হুঁকো-কলকে-তামাক, সব কিছু মজুদ থাকে। পরিপাটি করে এক ছিলিম তামাক সেজে আয়েস করে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে লারমোর বলেন, ধানকাটার জন্যে কদিন রোগীদের কাছ থেকে ছুটি নিয়েছি। বলেছি, তেমন জরুরি কেস থাকলে গির্জায় আসে যেন। বুঝতেই তো পারছ, এই সময়টা ধান টান ঠিকমতো তুলতে না পারলে সারা বছর না খেয়ে থাকতে হবে।

হেমনাথ হাসেন, ত্যাগব্রতী হলে কী হবে, আসল ব্যাপারে টনটনে—

লারমোর জোরে জোরে মাঠ কাঁপিয়ে হাসতে থাকেন, যা বলেছ।

.

ধানকাটার মধ্যেই একদিন সময় করে নিলেন হেমনাথ। বললেন, আজ বিনুদাদা আর আমি মাঠে যাব না। কৃষাণদের নিয়ে অবনী একলা যাবে।

অবনীমোহন শুধোলেন, আপনার কোনও কাজ আছে?

হ্যাঁ।

কী?

আজ বিনুদাদাকে স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে যাব।

হঠাৎ যেন কথাটা মনে পড়ে গেছে, এমনভাবে অবনীমোহন বললেন, ও হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি তো একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম।

হেমনাথ বললেন, তুমি মাঠে গিয়ে একালা অতগুলো লোককে সামলোতে পারবে তো?

পারব।

দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর হেমনাথের সঙ্গে স্কুলে রওনা হল বিনু। স্টিমারঘাট, বরফকল, মাছের আড়ত পেরিয়ে ল্যান্ড রেভিনিউ অফিসের গায়ে স্কুলবাড়িটা। নাম রাজদিয়া হাই স্কুল।

স্কুল বাড়িটাকে ঘিরে কোনও বিস্ময় নেই। টিনের চাল আর কাঁচা বাঁশের বেড়া লাগানো অসংখ্য ঘর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। সামনের দিকে প্রকান্ড মাঠ, সবুজ সতেজ ঘাসে ছেয়ে আছে। মাঠটার দু’ধারে বাঁশের গোলপোস্ট।

রাজদিয়ার এ প্রান্তে কতবার এসেছে বিনু, যাতায়াতের পথে দূর থেকে স্কুল-বাড়িটাকে দেখেছে। ভেতরে অবশ্য ঢোকেনি।

আজ হেমনাথের সঙ্গে সামনের মাঠখানা পেরিয়ে স্কুলের দিকে যেতে যেতে বুকের মধ্যেটা কেন যেন দুরু দুরু করতে লাগল বিনুর। হঠাৎ সে ডেকে উঠল, দাদু

কী রে– হেমনাথ মুখ ফিরিয়ে তাকালেন।

ভর্তি হতে হলে পরীক্ষা দিতে হবে, না?

নিশ্চয়ই দিতে হবে।

বিনু কী বলতে গিয়ে থেমে গেল। তার চোখমুখ দেখে কিছু অনুমান করলেন হেমনাথ। বললেন, আর কিছু বলবি?

হুঁ–

কী?

খানিক ইতস্তত করে বিনু বলল, হেডমাস্টার মশায়কে তুমি চেনো?

হেমনাথ বললেন, চিনব না কেন?

তুমি তাকে একটু বলবে–

কী বলব?

আমার পরীক্ষা যেন না নেন–

পূর্ণ দৃষ্টিতে হেমনাথ বিনুকে দেখলেন। তারপর খুব গম্ভীর গলায় বললেন, না। ওটা বলতে পারব না। ভর্তি হতে হলে পরীক্ষা দিতেই হবে।

বিনু চমকে উঠল। আশ্বিনের শুরুতে রাজদিয়া এসেছে তারা। এখন পৌষ মাস। হেমনাথের এমন কণ্ঠস্বর আগে আর কখনও শোনেনি সে।

.

২.১০

সামনের মাঠখানা পার হয়ে স্কুলবাড়ির বারান্দায় উঠলেন হেমনাথরা। লম্বা মাটির বারান্দা, তার শেষ প্রান্তে হেডমাস্টারের ঘর। সেখানে উঁচু টুলের ওপর দপ্তরী জাতীয় একটা লোক বসে আছে।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এই সময়টা স্কুল বন্ধ। ক্লাসঘরগুলোতে তালা লাগানো রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে যাবার কথা। খুব সম্ভব রেজাল্টও বেরিয়ে গেছে। ইংরাজি নতুন বছর না পড়লে নতুন করে ক্লাস শুরু হবে না। সারা বছর একটানা খাটুনির পর ক্লান্ত স্কুলবাড়িটার গায়ে এখন ছুটি আর আলসেমির আমেজ লেগেছে।

দূর থেকেই হেমনাথ চেঁচিয়ে ডাকলেন, এই উপেন—

টুলের ওপর থেকে দপ্তরীটা চকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল, আইজ্ঞা—

হেডমাস্টার আছে রে?

উপেন বলল, আছেন–

কথা বলতে বলতে এগিয়ে এসেছিলেন হেমনাথ। বিনুকে সঙ্গে নিয়ে পর্দা ঠেলে হেডমাস্টারের ঘরে ঢুকলেন।

ঘরখানা প্রকান্ড। চারদিকে সারি সারি কাঁচের আলমারি। সেগুলোর ভেতর শুধু বই আর বই। আলমারিগুলোর মাথায় গ্লোব, ডাস্টার, ঝাড়ন, চকের বাক্স এবং অসংখ্য জিনিস সাজানো। দেওয়ালে দেওয়ালে মাহাপুরুষদের ছবি। গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্র বিবেকানন্দ তিলক বিদ্যাসাগর–এমনি অসংখ্য। তাদের কাউকে কাউকে চেনে বিনু, অনেকেই অচেনা।

রবীন্দ্রনাথের ছবিটার তলায় একটা গোলাকার বড় ঘড়ি। তার তলায় মস্ত একখানা টেবিল। টেবিলের এধারে অনেকগুলো কাঠের চেয়ার। ওধারে একটি মাত্র চেয়ারে যিনি বসে আছেন তাঁর বয়স ষাটের কাছাকাছি। পরনে মোটা খদ্দরের ধবধবে পাজামা এবং পাঞ্জাবি। চোখে পুরু লেন্সের গোল চশমা।

ভদ্রলোকের গায়ের রং টকটকে, ধারাল নাক, তীক্ষ্ণ চিবুক। দীর্ঘ চোখ দু’টি অত্যন্ত সজীব, দূরভেদী। মুখময় কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথাটা কিন্তু একেবারেই সাদা, একটি কালো চুলও সেখানে খুঁজে বার করা যাবে কিনা সন্দেহ। এই বয়সেও মেরুদন্ড আশ্চর্য ঋজু, চামড়ায় তেমন ভাজ পড়েনি।

ঘরে আর কেউ ছিল না। বিনু বুঝতে পারল, ইনিই হেডমাস্টার। তার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল।

হেমনাথকে দেখে হেডমাস্টার উঠে দাঁড়লেন। একটু অবাক হয়ে বললেন, হেমদাদা যে—

হেমনাথ হাসলেন, খা, আমিই—

হেডমাস্টার বললেন, আপনি হঠাৎ স্কুলে?

সাধে কি আর এলাম রে, দরকারে আসতে হল। তারপর কেমন আছিস মোতাহার?

ওই একরকম। আপনি?

খুব ভাল। কখনও আমি খারাপ থাকি?

তা বটে। হেডমাস্টার অর্থাৎ মোতাহার সাহেব হাসলেন, কতকাল আপনাকে দেখছি। খারাপ আছেন, এমন কথা কক্ষণো শুনিনি। বলতে বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, এ কি হেমদাদা, দাঁড়িয়ে কেন? বসুন–বসুন–

হেমনাথ বসলে মোতাহার সাহেব বসলেন। বিনুও নিঃশব্দে দাদুর গা ঘেঁষে বসে পড়ল।

হেমনাথ বললেন, ব্যাপার কী রে? স্কুলে ছুটি, তুই একা একা এখানে কী করছিলি?

নতুন বছরের বুক লিস্টটা এখনও তৈরি হয় নি। তা-ই করছিলাম।

স্কুল কতদিন বন্ধ থাকবে?

জানুয়ারির দু’তারিখ পর্যন্ত।

তারপর অন্য সব খবর টবর কী?

কোন খবর জানতে চান, বলুন—

একটু ভেবে হেমনাথ বললেন, তোর খবর তো মোটে দুটো। এক কংগ্রেস আর এই স্কুল।

মোতাহার সাহেব কিছু বললেন না, চশমার কাঁচ মুছে গভীর দৃষ্টিতে হেমনাথের দিকে তাকালেন।

হেমনাথ থামেননি, বিয়ে করলি না, শাদি করলি না, ঘর নেই, সংসার নেই। চিরটা কাল স্কুল আর কংগ্রেস নিয়েই থাকলি।

মৃদু গলায় মোতাহার সাহেব বললেন, কিছু একটা নিয়ে থাকতে হবে তো। সত্যি বলছি হেমদাদা, স্কুল আর কংগ্রেস ছাড়া আমি আর কিছু ভাবতেই পারি না। বলে হাসলেন।

হেমনাথ বললেন, অনেক দিন তোর কাছে আসা হয়নি। তা স্কুল কেমন চলছে?

ভালই। তবে—

কী?

আমার বড় ইচ্ছা স্কুলবাড়িটা পাকা হোক–

মোতাহার সাহেবের কথা শেষ হবার আগেই হেমনাথ বলে উঠলেন, এক শ’ বার হওয়া উচিত। দু’চার বছর পর পর বর্ষায় কাঁচা বাঁশের বেড়া নষ্ট হয়ে যায়, মাটির ভিত ধসে যায়। সে সব কতবার তো পালটালি। বার বার কামলা লাগিয়ে খরচও তো কম হয় না।

খরচ বলে খরচ। স্কুলের কত আর আয় বলুন। বেশির ভাগ ছেলেই তো ফ্রি, হাফ ফ্রি’তে পড়ছে–

হেমনাথ বললেন, একবার একটু কষ্ট করে পাকাপাকি বন্দোবস্ত করতে পারলে সব দিক থেকেই ভাল।

মোতাহার সাহেব বললেন, কিন্তু টাকা পাব কোথায়? আপনি তো জানেন, গভর্নমেন্ট থেকে একটা পয়সাও পাওয়া যাবে না।

কেন যাবে শুনি? সারা গায়ে কংগ্রেসের গন্ধ মাখিয়ে রেখেছিস, ইংরেজদের তাড়াবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিস। আর ওরা দেবে টাকা!

হাসতে হাসতে মোতাহার সাহেব বললেন, তাই ভাবছিলাম, দু’একদিনের ভেতর আপনার কাছে যাব।

পাকা ভুরু কুঁচকে হেমনাথ বললেন, আমার কাছে কেন?

শুরু কে কখনও বিমুখ হয়ে উদার হেমনাথ মিত্রের

আপনার কাছে ছাড়া আর কার কাছে যেতে পারি?

আমি বুঝি তোর স্কুলের জন্যে টাকার থলে নিয়ে বসে আছি?

তা জানি না।

তবে কী জানো শুনি?

মোতাহার সাহেব গম্ভীর গলায় বলেন, একটা কথাই জানি। তা হল, রাজদিয়ার হেমনাথ মিত্রের কাছে কোনও শুভ কাজের আর্জি নিয়ে গেলে কেউ কখনও বিমুখ হয়ে ফেরে না।

হেমনাথ বললেন, আমাকে তোরা কল্পতরু পেয়েছিস নাকি?

পেয়েছিই তো।

কিন্তু—

জিজ্ঞাসু চোখে মোতাহার সাহেব বললেন, কী?

চিন্তিত মুখে হেমনাথ বললেন, স্কুল বিল্ডিং করে দেবার মতো অত টাকা তো আমার নেই। অবশ্য একটা কাজ করা যেতে পারে–

কী কাজ?

সবার কাছ থেকে টাকা তোলা। যার যেমন সাধ্য সে তেমন দেবে। মোট কথা, একটা ফান্ড খোলা দরকার।

সে আপনি যা ভাল বোঝেন—

তুই কবে আমার বাড়ি যাচ্ছিস?

কবে যেতে বলেন?

যেদিন তোর খুশি—

পরশু সকালে যাব।

আচ্ছা।

একটু নীরবতা।

তারপর মোতাহার সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, যাক, আমার দুর্ভাবনা কাটল। স্কুলবাড়ি এবার হয়ে যাবেই।

হেমনাথ হাসলেন, স্কুলের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আমার ভালই লাভ হল দেখছি। তারপর তোর কংগ্রেসের খবর কী?

নিমেষে হাসি থেমে গেল। কপালে অসংখ্য রেখা ফুটল মোতাহার সাহেবের। গম্ভীর গলায় বললেন, খুবই সাঙ্ঘাতিক। খবরের কাগজে নিশ্চয়ই দেখেছেন ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্টে ছোট বড় সব নেতাই অ্যারেস্টেড। সত্যাগ্রহ শুরু হয়ে গেছে।

দেখেছি। তোর কী মনে হয়?

আমার তো মনে হয়, ভেতরে ভেতরে ইংরেজরা খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভেতরে যত কাবু হচ্ছে, বাইরে অত্যাচার ততই বেড়ে চলেছে।

তুই তো এখানকার কংগ্রেসের সেক্রেটারি। তোকে কি অ্যারেস্ট করবে?

বুঝতে পারছি না। তবে–

কী?

গেল সপ্তাহে দুতিন বার পুলিশ এসেছিল।

হেমনাথ বললেন, এখানে কি সত্যাগ্রহ শুরু করবি?

মোতাহার সাহেব বললেন, এখনও কিছু ঠিক করিনি। আরও কয়েক দিন দেখি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেমনাথ এবার শুধোলেন, যুদ্ধের হালচাল কেমন বুঝছিস মোতাহার?

খুব খারাপ। মিত্রশক্তি চারদিকেই মার খাচ্ছে। ইউরোপ আফ্রিকার কথা থাক, ইস্টার্ন ওয়ার্ল্ডের অবস্থাও ভাল নয়। আমার ধারণা, কলকাতায় যে কোনও দিন বোমা পড়তে পারে। কলকাতায় বোমা পড়া মানে সারা বাংলাদেশ তোলপাড় হওয়া। কী যে হবে!

সেদিন কাগজে পড়লাম, কলকাতায় ব্ল্যাক-আউটের মহড়া চলছে। এয়ার-রেডের সবরকম প্রিকশানও নেওয়া হয়েছে।

হ্যাঁ। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন মোতাহার সাহেব।

হেমনাথ বললেন, তোর কী ধারণা, এ যুদ্ধে ইংরেজরা হারবে?

বলা মুশকিল। হারুক জিতুক, আমি একটা ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি।

কী?

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা খুব বেশি দূরে নেই।

হঠাৎ তোর এ ধারণা হল?

মোতাহার সাহেব থেমে থেমে বলতে লাগলেন, হিটলারের বোমা খেয়ে খেয়ে ইংল্যান্ডের আর কিছু নেই। যতই ওরা গলা ফাটাক আমাদের কিছু হয়নি, লোক তা বিশ্বাস করে না। আমরা তো আর ঘাস খাই না, আসল ব্যাপারখানা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারি। যুদ্ধ থেমে গেলে ইংল্যান্ডে রিকনস্ট্রাকশনের প্রশ্ন দেখা দেবে। তখন নতুন করে পোড়া ঘর তুলবে, না এতদূরে ইন্ডিয়ার কলোনি সামলাবে? অবশ্য–

কী?

এই হচ্ছে সব চাইতে বড় সুযোগ। আমাদের তা হাতছাড়া হতে দেওয়া উচিত নয়। একবার যদি এ সুযোগ আমাদের হাতের বাইরে চলে যেতে দিই, পরে আপসোস করেও কূলকিনারা পাব না।

হেমনাথ বললেন, সুযোগ বলতে?

মোতাহর সাহেব ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন, ইংরেজ এখন যুদ্ধ নিয়ে অস্থির হয়ে আছে। ইউরোপে এশিয়ায়-আফ্রিকায়, যেদিকেই তাকানো যাক, শুধু বারুদের গন্ধ। এ সময় সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে যদি একটা আন্দেলন করা যেত।

হেমনাথ বললেন, তোর কি ধারণা, শিগগিরই কোনও মুভমেন্ট শুরু হবে?

আমার তো তাই মনে হয়। এ সময় যদি মুভমেন্ট না করা যায় তবে আর কবে হবে? দেখা যাক, নেতারা কী করতে বলেন–

হেমনাথ এবার আর কিছু বললেন না। তার পাশে বসে দাদু আর মোতাহার সাহেবের কথা শুনছিল বিনু। অল্পস্বল্প বুঝতে পারছিল সে, তবে বেশির ভাগই অবোধ্য।

একটুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর মৃদু হেসে মোতাহার সাহেব বললেন, দেশের কথা, কংগ্রেসের কথা এখন থাক। তখন কী একটা দরকারের কথা বলছিলেন যেন– বলতে বলতে হঠাৎ বিনুর দিকে নজর পড়ল, ছেলেটি কে হেমদাদা?

আমার নাতি।

কিরকম নাতি?

কিরকম, হেমনাথ বুঝিয়ে দিলেন।

মোতাহার সাহেব বললেন, শুনেছিলাম বটে, কলকাতা থেকে আপনার আত্মীয়স্বজন এসেছে। তা হলে এরাই?

হ্যাঁ।

এবার বলুন দরকারটা কী।

বিনুকে দেখিয়ে হেমনাথ বললেন, দরকারটা এর জন্যেই। ওকে তোর স্কুলে ভর্তি করতে এসেছি।

মোতাহার সাহেব ঈষৎ অবাক হলেন, ভর্তি করতে এসেছেন মানে! ওরা কি এখানেই থাকবে?

হ্যাঁ।

কলকাতা ছেড়ে এই গ্রামে থাকতে ভাল লাগবে।

ওর বাবার খেয়াল। কলকাতায় ব্যবসা ট্যবসা ছিল। সব তুলে দিয়ে এখানে জমিজমা কিনেছে। ইস্টবেঙ্গল নাকি ওর খুব ভাল লেগেছে।

খুব ইন্টারেস্টিং তো৷ মোতাহার সাহেব কৌতূহলের গলায় বললেন, ভদ্রলোকের সঙ্গে একদিন আলাপ করতে হয়।

হেমনাথ বললেন, পরশু আমাদের বাড়ি যাচ্ছিস তো, তখন আলাপ করিয়ে দেব’খন।

আচ্ছা। কিন্তু হেমদাদা–

কী বলছিস?

সামান্য একটা ভর্তির জন্যে আপনি আবার কষ্ট করে নিজে এসেছেন কেন? এখন তো স্কুল বন্ধ। জানুয়ারির ফাস্ট উইকে কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। ভর্তি করে নেব।

উঁহু– জোরে জোরে প্রবল বেগে মাথা নাড়তে লাগলেন হেমনাথ, আমার খাতিরে এমনি এমনি ভর্তি করলে চলবে না। যে ক্লাসে ভর্তি হবে তার যোগ্য কিনা পরীক্ষা করে নিতে হবে।

স্থির চোখে হেমনাথকে দেখলেন মোতাহার সাহেব। তারপর অসীম সম্ভ্রমের সুরে বললেন, পরীক্ষা করে নেবার কথা কোনও অভিভাবকই বলে না। আপনার ওপর আমার শ্রদ্ধা দশগুণ বেড়ে গেল হেমদাদা। আপনি যখন চাইছেন, পরীক্ষা আমি নেব।

আজ যখন এসে পড়েছি, আজই নিয়ে নে। পরে না হয় মাইনেপত্তর দিয়ে ফি-বুক, বুকলিস্ট নিয়ে যাবে।

মোতাহার সাহেব অদ্ভুত হাসলেন।

হেমনাথ শুধোলেন, হাসলি যে?

আমাকে বুঝি আপনার বিশ্বাস নেইপাছে অন্য কারোর সঙ্গে পাঠালে পরীক্ষা না নিই তাই এখনই নিতে বলছেন।

বিব্রতভাবে হেমনাথ বললেন, না, ঠিক তা নয়।

হাসতে হাসতে মোতাহার সাহেব বললেন, বেশ বেশ, আপনার যখন এতই অবিশ্বাস তখন পরীক্ষাটা নিয়ে নিচ্ছি।

দাদুর ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল বিনুর। হেডমাস্টারমশাই যেখানে এমনিতেই ভর্তি করে নিতে চাইছেন সেখানে দাদু পরীক্ষা’ পরীক্ষা করে অস্থির হয়ে উঠছেন। শুধু রাগই না, তার সঙ্গে অভিমানও মিশল।

চোখে প্রায় জলই এসে যাচ্ছিল বিনুর। সেই সময় মোতাহার সাহেবের গলা শোনা গেল, তোমার নাম কী?

বিনু চমকে উঠল। বুকের ভেতরটা ভয়ানক দুলতে লাগল তার। কাঁপা গলায় বলল, বিনয়কুমার বসু–

বাবার নাম?

অবনীমোহন বসু

চোখ কুঁচকে মোতাহার সাহেব বলেন, শুধু অবনীমোহন বসু? বাবার নামের আগে একটা শ্ৰীযুক্ত বসাতে হয় তাও জানো না?

মুখ নিচু করে বসে রইল বিনু।

কলকাতায় কোন স্কুলে পড়তে?

সাউথ সাবারবনে—

কোন ক্লাস ছিল?

সেভেন।

তার মানে এইটে ভর্তি হবে?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আচ্ছা, ওই ছবিটা কার বল তো?

চোখ তুলতেই বিনু দেখতে পেল, মোতাহার সাহেব ডানদিকের দেওয়ালে একটা ছবির দিকে আঙুল নির্দেশ করেছেন।

ছবির মানুষটিকে বিনু চিনত। বলল, উনি রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়—

গুড–বলেই আরেকটা ছবি দেখালেন মোতাহার সাহেব, উনি?

লালা লাজপত রায়।

আচ্ছা বলতে পার, বঙ্গভঙ্গ আন্দেলন কবে হয়েছিল?

ভাগ্য ভাল, উত্তরটা জানা ছিল বিনুর। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ১৯০৫-এ—

ভেরি গুড—

নিঃশব্দে বসে ছিলেন হেমনাথ। হঠাৎ বলে উঠলেন, এ সব কী পরীক্ষা রে মোতাহার?

এগুলোই তো আসল পরীক্ষা দাদা’ মোতাহার সাহেব বলতে লাগলেন, দেশের ছেলে দেশের সত্যিকার খবর রাখে কিনা সেটা জানা দরকার।

একটু পড়াশোনার কথাও জিজ্ঞেস কর—

নিশ্চয়ই করব।

গোটা পাঁচেক ট্রানস্লেশন ধরলেন মোতাহার সাহেব, বিনু তিনটে পারল। অ্যালজেব্রার ফরমুলাগুলো ঠিক ঠিক বলল। বাংলা ব্যাকরণের উত্তরগুলোও নির্ভুল হল।

পরীক্ষা হয়ে যাবার পর মোতাহার সাহেব বললেন, বিনয়বাবু আমাদের বেশ ভাল ছেলে। স্কুল খুললে রোজ ক্লাস করবে, বুঝলে? একদিনও ফাঁকি দেবে না।

আজ্ঞে না–বিনু আধফোঁটা গলায় বলল। তারপর মাথা হেলাল।

হেমনাথ বললেন, ক্লাস এইটে ও পারবে তো?

মোতাহার সাহেব বললেন, নিশ্চয়ই পারবে। দেখবেন, স্ট্যান্ড করবে।

আরও কিছুক্ষণ এলোমলো কথার পর হেমনাথ বললেন, এবার তা হলে উঠি—

এখনই উঠবেন?

হ্যাঁ, ধানকাটা চলছে। একবার মাঠে যাওয়া দরকার। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন হেমনাথ। তারপর হঠাৎই যেন কথাটা মনে পড়ে গেল। বিনুর দিকে ফিরে বললেন, মাস্টারমশাইকে প্রণাম কর।

মোতাহার সাহেবকে প্রণাম করে বিনু যখন উঠে দাঁড়াল, হেমনাথ আবার বললেন, এঁকে আজ প্রথম দেখলে, ভবিষ্যতে অনেক বার দেখবে। জীবনে এই মানুষটির মতো হবার চেষ্টা করো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *