• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • PDF
  • Bookmarks

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

Bookmarks

১.১-২ বিশাল ডানা মেলে

লাইব্রেরি » সেবা প্রকাশনী » মাসুদ রানা সিরিজ » প্রবেশ নিষেধ » ১.১-২ বিশাল ডানা মেলে

প্রবেশ নিষেধ-১ – মাসুদ রানা
কাজী আনোয়ার হোসেন – সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর, ১৯৭৫

০১.

বিশাল ডানা মেলে কে এল এম ডিসি এইট নেমে এল শিফল এয়ারপোর্টের রানওয়ের ওপর, মাইল দেড়েক দৌড়ে গতিটা একটু সামলে নিয়ে ধীরে সুস্থে। এসে দাঁড়াল এয়ারপোর্টের টারমিনাল বিল্ডিং ঘেঁষে। শেষবারের মত ছোট্ট গর্জন ছেড়ে বন্ধ হয়ে গেল এঞ্জিন।

সবার আগে সিটবেল্ট খুলে উঠে দাঁড়াল রানা। সোহানা চৌধুরী এবং তার পাশে বসা, তারই মত চোখা সুন্দরী মারিয়া ডুকুজের দিকে একটি বারও না চেয়ে হালকা এয়ার ব্যাগটা কাঁধে বুলিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল সে এগজিট লেখা দরজার দিকে। যেন চেনেই না ওদের।

 স্টুয়ার্ডেসের মিষ্টি হাসির প্রত্যুত্তরে যতটা না হাসলেই নয় সেটুকু হেসে ডিজএমবাকেশন টিউবে উঠে পড়ল রানা। হাসি আসছে না ওর। কয়েকটা দুশ্চিন্তা এক সঙ্গে ঘুরছে মাথার মধ্যে। প্রথমত, সোহানা এবং মারিয়া এই দুই বোঝা দুই কাঁধে চেপে যাওয়ায় যারপরনাই বিরক্ত হয়েছে সে মনে মনে, কিন্তু কিছুই বলার উপায় নেই-একজনকে চাপিয়েছেন বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কর্ণধার মেজর জেনারেল রাহাত খান, অপরজনকে ইন্টারপোলের নার্কোটিকস ডিভিশনের কট্টর চীফ ফিলিপ কাটারেট। এরা মনে করেছেন রানার এবারের বিপজ্জনক অ্যাসাইনমেন্টে ডাইভার্শন তৈরি। করতে হলে দুজন মেয়েকে সাথে নিয়ে যাওয়া ওর একান্ত দরকার। দুই সুন্দরীই জীবনের প্রথম পা রাখছে অ্যামস্টার্ডামের মাটিতে। প্রতি পদে কাজে বাধার সৃষ্টি করবে এরা, সুবিধের চেয়ে অসুবিধে যে কত বেশি হবে নিজে বুঝতে পারছে রানা পরিষ্কার, কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারেনি সে দুই বুড়োর একজনকেও। এদের দুজনই কাজ করছে ড্রাগসের ওপর বেশ কয়েক বছর। ধরে, তথ্যের দিক থেকে এরা একেকজন তিনটে মাসুদ রানার সমান জ্ঞান। রাখে। কিন্তু ভয়ঙ্কর, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে জ্ঞান••• যাকগে, মেনে যখন নিতেই হবে, মেনে নিয়েছে রানা–আসল কাজের সময় এদের কিভাবে দূরে সরিয়ে রাখবে সে প্ল্যানও ঠিক করে নিয়েছে আগেই; আসল দুশ্চিন্তা এরা নয়, ইসমাইলের পাঠানো কোডেড মেসেজটা। রওয়ানা হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পেয়েছে মেসেজ বিশেষ জরুরী কিছু তথ্য নিয়ে। অপেক্ষা করবে ইসমাইল শিফল এয়ারপোর্টে। মাটি স্পর্শ করবার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলো নাকি রানার দরকার, এবং সেই তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত। পরিবর্তন করা দরকার প্ল্যান-প্রোগ্রাম। এই রকম একটা মেসেজের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি রানা, তবে এর মধ্যে একটা জরুরী ভাব যে রয়েছে সেটা অনুভব করতে অসুবিধে হয়নি ওর। কি আবার ঘটল এখানে যার জন্যে, বারণ সত্ত্বেও এইভাবে এয়ারপোর্টে দেখা করতে চাইছে ইসমাইল ওর সঙ্গে? এইভাবে রানাকে এক্সপোজ করে দেয়ার ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে কেন লোকটা?

ইসমাইলের যোগ্যতা সম্পর্কে কোন রকমের কোন সন্দেহ নেই রানার। ঘুঘু লোক সে। গত তিনটে, মাস ধরে কাজ করছে সে অ্যামস্টার্ডামে রানার সুবিধের জন্যে কিছুটা গ্রাউন্ডওয়ার্ক করে রাখবার জন্যে। একটা মাস চুপচাপ থেকে হঠাৎ কি এমন জরুরী তথ্য পেয়ে গেল লোকটা যে গোপনীয়তার ইম্পাদৃঢ় নিয়ম ভঙ্গ করবার দরকার হয়ে পড়ল ওর? যোগ্যতা আছে ঠিকই, কিন্তু ভুলও তো মানুষের হয়রানার ভয়টা ওখানেই। এই লাইনে সামান্য কোন ভুল যে কত মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে, ভাল করেই জানা আছে ওর।

কোরাগেটেড ডিজএমবার্কেশন টিউব ধরে এগিয়ে চলেছে রানা টার্মিনাল ফ্লোরের দিকে। দুটো চলন্ত প্ল্যাটফর্ম দেখতে পেল সে সামনে-ইমিগ্রেশন থেকে একটা এদিকে আসছে, আরেকটা এদিক থেকে চলেছে ইমিগ্রেশনের। দিকে। ওদিক থেকে যে প্ল্যাটফর্মটা এদিকে আসছে সেটার এদিকের মাথায় রানার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাঝারি উচ্চতার এক শুকনো-পাতলা নিষ্ঠুর চেহারার লোক। মাথায় ঘন কালো চুল, মুখে বয়সের ভাজ খুব সম্ভব চুলগুলো কালো করা হয়েছে ডাই করে। দুই চোখের নিচে ফুলে আছে দুটো থলে। কালো একটা স্যুটের ওপর কালো ওভারকোট চাপানো, হাতে একটা সদ্য-কেনা এয়ারব্যাগ। এক নজরেই অপছন্দ হলো রানার লোকটাকে। মনে মনে ঠিক করল, এই ধরনের লোকের সাথে মেয়ের বিয়ে দেবে না সে কোনদিন অবশ্য, যদি কোনদিন তার মেয়ে হয়।

বেশ অনেকটা কাছে এসে রানা দেখতে পেল, ইমিগ্রেশনের দিক থেকে প্ল্যাটফর্মে চড়ে জনা চারেক লোক আসছে এইদিকে। সবার আগে ছাইরঙা স্যুট পরা দীর্ঘ, একহারা লোকটাকে দেখেই চিনতে পারল সে-ইসমাইল! অবাক হলো রানা লোকটার অস্থিরতা দেখে। এখানে এল কি করে? ইমিগ্রেশন ডিঙিয়ে এতদূর আসতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। ইসমাইলকে। ব্যাপারটা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ না হলে এত কষ্ট করতে যেত না সে। এতই জরুরী, যে বাইরে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবার ধৈর্য নেই, চলে এসেছে ভিতরে, একেবারে প্লেনের গায়ের কাছে ব্যাপার কি?

রানাকে দেখেই একগাল হেসে হাত নাড়ল ইসমাইল, রানাও হাত। নীড়ল-কিন্তু কেন যেন পলকের জন্যে কালো একটা অশুভ ছায়া পড়ল ওর। মনের আয়নায়। মুহূর্তে মিলিয়ে গেল ওর মুখের হাসি। কেন ব্যাপারটা ঘটল, কি দেখে কি বুঝল সে, কিছুই বলতে পারবে না রানা, কিন্তু মুহূর্তে সজাগ সতর্ক হয়ে উঠল ওর চোখ কান।

 ইসমাইলের চোখের দৃষ্টি সামান্য একটু বাঁকা হতেই ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে নিষ্ঠুর লোকটাকে দেখল সে আবার। লোকটা এখন আর রানার দিকে মুখ করে নেই, একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়িয়েছে ইসমাইলের মুখোমুখি। এয়ারব্যাগটা এখন আর লোকটার হাতে ঝুলছে না, অদ্ভুত ভঙ্গিতে ধরা আছে। বগলের নিচে। চট করে ইসমাইলের মুখের দিকে চেয়ে ভীতি দেখতে পেল। রানা, এবং পরিষ্কার ভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝাঁপ দিল সামনের দিকে।

চোখের পলকে ঘটে গেল কয়েকটা ঘটনা। প্রস্তুত ছিল লোকটা। রানা ঝাঁপ দিতেই সাই করে ব্যাগটা ঘুরিয়ে মারল সে রানার নাভীর ছয় ইঞ্চি ওপরে, সোলার প্লেকসাসে। এয়ারব্যাগ সাধারণত নরম হয়, কিন্তু এটা সেরকম না–অত্যন্ত শক্ত কিছু জিনিসের প্রচণ্ড গুতো খেয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল রানা। তীব্র ব্যথায় গোঙাবার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলল সে। জ্ঞান হারাল না, কিন্তু সারা শরীর অসাড় অবশ হয়ে গেল ওর মুহূর্তে। দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু চোখ ছাড়া আর কিছু নড়াবার ক্ষমতা নেই।

পরবর্তী কয়েকটা সেকেন্ড রানার মনে হলো যেন সো মোশন ছায়াছবি দেখছে। চারপাশে চাইল আতঙ্কিত ইসমাইল, কিন্তু পালাবার পথ পেল না। কোনদিকে। তিনজন লোক, যেন কি ঘটতে চলেছে কিছুই টের পায়নি, দাঁড়িয়ে রয়েছে ইসমাইলের পিছনে। পিছনে পালাবার রাস্তা নেই। সামনে। নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগোনো ছাড়া আর কোন পথ নেই ইসমাইলের।

এদিকে এয়ারব্যাগের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা কালো নলের মাখা। চিনতে পারল রানা-সাইলেন্সর সিলিন্ডার। এরই গুতোয় অবশ হয়ে। গেছে ওর সর্বশরীর। উঠে বসবার চেষ্টা করল সে, পারল না। লোকটার ডান হাত এয়ারব্যাগের মধ্যে। আর একটু উঁচু হলো হাতটা। মুখের ভাবে কোন। পরিবর্তন নেই, ধীরে সুস্থে ঠাণ্ডা মাথায় কাজটা করবে বলে বাড়ি থেকে স্থির। করে এসেছে যেন লোকটা। প্রফেশনাল।

মড়ার মত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ইসমাইলের মুখটা। কি ঘটতে চলেছে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে। চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে আছে ভয়ে, কিন্তু তারই মধ্যে ডান হাতটা চলে গেল ওর কোটের ভিতর। পিছনের তিনজন লোক ঝপ করে বসে পড়ল একসঙ্গে। পরমুহূর্তে হাতটা বের করে আনল। ইসমাইল কোটের ভিতর থেকে, হাতে পিস্তল। ঠিক সেই সময় দুপ করে আওয়াজ হলো একটা এপাশ থেকে, মৃদু। একটা গর্ত দেখা দিল ইসমাইলের কোটে। বাম পাশে, বুকপকেটের ঠিক নিচে। কেঁপে উঠল ওর শরীরটা চমকে ওঠার ভঙ্গিতে, তারপর এলোপাতাড়ি পা ফেলে দুপা সামনে এগিয়ে পড়ে গেল মুখ থুবড়ে। চলন্ত ট্রাভেলেটার বয়ে নিয়ে এল লাশটা, ধাক্কা খেলো সেটা রানার গায়ে।

যাদুমন্ত্রের মত কাজ করল রানার মধ্যে মৃতদেহের স্পর্শটা। টলতে। টলতে উঠে দাঁড়াল সে, ব্যথায় কুঁচকে গেছে মুখ, দাতে দাঁত চেপে রেখেছে শক্ত করে। পিস্তল নেই রানার সাথে, গোপনে ওটাকে কাস্টমস ব্যারিয়ার পার  করবার জন্যে পুরে দিয়েছে সুটকেসের তলার এক গোপন কম্পার্টমেন্টে। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় খুনীর পেছনে ধাওয়া করা ঠিক হবে কি হবে না ভেবে চিন্তে-বুঝে নেয়ার আগেই টলতে টলতে এগোল সে ইমিগ্রেশনে যাওয়ার প্ল্যাটফর্মের দিকে। বমি আসছে রানার, মাথা ঘুরছে। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে এগোচ্ছে সে, মনে হচ্ছে দুলছে সবকিছু, ঠিকমত দেখতে পাচ্ছে না চোখে। থেমে দাঁড়িয়ে চট করে একহাতে চোখ মুছল রানা। দেখল, আসলে রক্তে বুজে গেছে ওর চোখ। মেঝেতে পড়ে কেটে গেছে কপালের একপাশ। রুমাল বের করে বার দুয়েক মুছতেই আবার পরিষ্কার হয়ে গেল ওর দৃষ্টি। অনুভব করল বুকের কাছে,ব্যথাটা কমে আসছে দ্রুত।

সমস্ত ব্যাপারটা ঘটে যেতে লাগল বড়জোর দশ সেকেন্ড, কিন্তু। ইতিমধ্যেই বেশ ভিড় হয়ে গেছে লাশটা ঘিরে। প্লেনের যাত্রী, পিছনের সেই তিনজন লোক, সেই সঙ্গে আরও কয়েকজন হাজির হয়ে গেছে যেন মাটি। ফুড়ে। জটলা হবে, হাঁকডাক হবে, এক-আধজন মহিলা চেঁচিয়ে উঠবে ভয়ে, এখন কি করতে হবে বুঝে উঠতে পারবে না কেউ প্রথমটায়–এই-ই নিয়ম, সেই ফাঁকে গা ঢাকা দেবে খুনী।

 চোখ তুলেই দেখতে পেল রানা লোকটাকে। ইমিগ্রেশনে যাবার প্ল্যাটফর্মের অর্ধেকের বেশি চলে গেছে সে, স্ট্র্যাপ ধরে ব্যাগটা ঝোলাতে। ঝোলাতে হেলেদুলে হাটছে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। এদিকে কি ঘটে গেছে যেন টেরও পায়নি। সহজ ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে, কোন ব্যস্ততা নেই। লোকটার আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হলো রানা, ওর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কেউ কোন প্রমাণ খাড়া করতে পারবে না, কাজেই এই লোকটা হাতছাড়া হয়ে গেলেই ইসমাইলের হত্যার সমস্ত সূত্র ছিন্ন হয়ে যাবে।

দৌড়াতে শুরু করল রানা।

ট্র্যাভেলেটারের মাঝামাঝি পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল রানা। পিছনে পায়ের। শব্দে সই করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে লোকটা, এক ঝাঁকিতে ব্যাগটা বগলের নিচে নিয়ে এসে ডান হাতটা পুরে দিয়েছে ভেতরে। নিরস্ত্র অবস্থায় নিশ্চিত খুনীর পিছু ধাওয়া করা যে কতখানি বোকামি, বুঝতে পারল রানা মুহূর্তে। পরিষ্কার। বুঝতে পারল, কোন দ্বিধা করবে না লোকটা গুলি করতে, আগামী কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ইসমাইলের সাথে মোলাকাত হবে ওর পরপারে। ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল রানা মেঝের ওপর, এমনি সময়ে দেখল সামান্য একটু সরে। গেল পিস্তলের মুখ, লোকটার দৃষ্টিও রানার ওপর থেকে সরে সামান্য একটু বায়ে স্থির হয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। পিছন ফিরে না চেয়েও রানা বুঝতে পারল মৃতদেহের কাছে দাঁড়ানো লোকগুলো দৌড়োতে দেখে নিশ্চয়ই ইসমাইলকে ছেড়ে ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে, এবং তাই দেখে দ্বিধায় পড়েছে। খুনী।

শেষ মাথায় পৌঁছে অপ্রস্তুত অবস্থায় হোঁচট খেলো নিষ্ঠুর চেহারার লোকটা, টাল সামলে নিয়ে দেখল পৌঁছে গেছে ওপারে। ঝট করে ঘুরেই দৌড়াতে শুরু করল সে। এতগুলো লোকের সামনে খুন করতে দ্বিধা হওয়াই স্বাভাবিক, তবে রানা বুঝতে পারল, সেই কারণে যে লোকটা রেহাই দিয়েছে তাকে তা নয়, প্রয়োজন মনে করলে কয়েক হাজার দর্শকের সামনেও খুন করতে পারবে এই নোক, আসলে রানাকে হত্যা করবার প্রয়োজন বোধ করেনি লোকটা। আবার ছুটতে শুরু করল রানা।

শরীরে খানিকটা বল ফিরে পেয়ে জোরে দৌড়ে কাছে চলে আসছিল। রানা, ইমিগ্রেশন অফিসারদের অবাক করে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল সামনের। লোকটা ওপাশের খোলা দরজা দিয়ে। সাধারণত লোকে ধীরস্থির ভাবে ঢেকে ইমিগ্রেশন হলে, অফিসারদের সামনে থেমে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট দেখায়, প্রশ্নের উত্তর দেয়-এটাই নিয়ম; দৌড়ে পেরিয়ে যায় না কেউ এই এলাকা। কিন্তু রানা আবার যখন ওদের অবাক করবার চেষ্টা করল ততক্ষণে হুশ ফিরে। পেয়ে সতর্ক হয়ে গেছে তারা। সাঁ করে একজন লোক বেরিয়ে চলে গেল, তার পিছু পিছু রক্তাক্ত চেহারায় আরেকজনকে ছুটতে দেখে থামাবার চেষ্টা, করল দুজন অফিসার রানাকে। এক ঝটকায় ওদের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে দরজার দিকে ছুটল রানা। কিন্তু কপালের ফেরে বাধা পড়ল ঠিক দরজার মুখেই।

ওপাশ থেকে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে একজন। একটা মেয়ে। ডানদিকে সরল রানা, মেয়েটা সরল বামদিকে; বামদিকে সরল রানা, মেয়েটা সরল ডানদিকে। ফুটপাথে প্রায়ই দেখা যায় এই ঘটনাসামনাসামনি পড়ে যেতেই একজন ভদ্রতা করে একপাশে সরে যায়, অপরজনও ভদ্রতার দিক। থেকে কম যায় না, সে-ও সঙ্গে সঙ্গে সরে পথ দিতে চেষ্টা করে, ফলে দেখা যায় আবার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে দুজন দুজনের। অতি বিনয়ী দুজন মুখোমুখি পড়লে অনির্দিষ্টকালের জন্যে চলতে পারে এই ক্যারিক্যাচার। কিন্তু ভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখবার মূডে নেই রানা এখন, মোটমাট বার তিনেক ডাইনে-বায়ে করে খপ করে মেয়েটার কাঁধ  চেপে ধরে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল ওকে সামনে থেকে। মেয়েটা কিসের সাথে গিয়ে ধাক্কা খেলো, ব্যথা পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল। কেন, সে সব দেখবার প্রয়োজন বোধ করল না সে, ছুটল সামনের দিকে। পরে ফিরে এসে মাফটাফ চেয়ে নিলেই হবে।

 খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসতে হলো রানাকে। দরজার গোড়ায় রানার কয়েক সেকেন্ড ভদ্রতার সুযোগ নিয়েছে সামনের লোকটা পুরোপুরিই। লোকের ভিড়ে মিশে গেছে বেমালুম। তিন মিনিট খোঁজাখুজি করে ফিরে এল হতাশ রানা। পরিষ্কার বুঝতে পারল, এখন এয়ারপোর্ট পুলিসের কাছে রিপোর্ট করে কোন লাভ নেই, যতক্ষণে সে নিজের পরিচয় দিয়ে এদের কাজে নামতে বাধ্য করবে, ততক্ষণে একেবারেই পগার পার হয়ে যাবে লোকটা। প্রফেশনাল কিলার তার পালাবার পথ প্রশস্ত রেখেই নামে কাজে। এইলোক যে প্রফেশনাল তাতে রানার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আপাতত এর পেছনে। আর সময় নষ্ট করবার কোন অর্থই হয় না। ইমিগ্রেশন হলে ফিরে এল সে। ভারী পায়ে। মাথার ভিতরটা দপ দপ করছে, বেশ খানিকটা ফুলে গেছে কপালের একপাশ, পেটে সেই তীক্ষ্ণ যন্ত্রণাটা নেই, কিন্তু ব্যথা-ব্যথা একটা ভাব রয়েছে বলে গা-টা গুলাচ্ছে। ঘরে এসে ঢুকতেই ইউনিফর্ম পরা দুই পুলিস দুদিক থেকে ধরল রানার দুই হাত।

ভুল লোককে ধরেছ, বলল রানা। দয়া করে হাত সরাও। সরে দাঁড়াও–শ্বাস নিতে দাও আমাকে।

একটু ইতস্তত করে রানার হাত ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেল লো দুজন–প্রায় দুই ইঞ্চি দূরে। লম্বা করে দম নিয়ে মেয়েটার দিকে চাইল রানা। বাইশ-তেইশ বছর বয়স হবে, ঘন নীল রঙের কোট পরেছে, কোটের নিচে সাদা পোল-নেক জাম্পার। সুন্দরী। জুলফির কাছে খানিকটা কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। রুমাল দিয়ে মুছছে। মেয়েটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একজন সুদর্শন। উচ্চপদস্থ এয়ারপোর্ট অফিশিয়াল-প্রশ্ন করছে ওকে, দেখে মনে হচ্ছে প্রেম। নিবেদন করছে।

ইয়াল্লা! বলল রানা। আমি ওই দশা করেছি বুঝি আপনার?

না, না, মোটেই না, চাপা ফ্যাসফেসে গলায় বলল মেয়েটা। আজ সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে কেটে ফেলেছি।

আমি সত্যিই দুঃখিত, দুঃখ দুঃখ চেহারা করল রানা। একটা খুনীকে তাড়া করছিলাম। খুন করে পালাচ্ছিল লোকটা। আপনি পড়ে গিয়েছিলেন আমার সামনে পালিয়ে গেল লোকটা, সেই সুযোগে।

আমার নাম মর্গেনস্টার্ন। এখানেই কাজ করি এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি। বলল মেয়েটার পাশে দাঁড়ানো লোকটা। চোখা চেহারা, বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, চেহারায় দায়িত্ববোধের ছাপ পড়েছে। খুনের খবরটা শুনেছি। খুবই দুঃখজনক। এই রকম একটা কাণ্ড শিফল এয়ারপোর্টে ঘটে যাবে, ভাবাই যায় না।

মাথা ঝাঁকাল রানা। বলল, আমার তো মনে হয় আপনাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করায় মৃত লোকটার লজ্জা পাওয়া উচিত।

এই ধরনের কথায় কারও কোন উপকার হয় না, মর্গেনস্টার্নের কণ্ঠে ভর্ৎসনার আভাস। মরা লোকটা আপনার পরিচিত?

কি করে হবে? এইমাত্র নেমেছি আমি প্লেন থেকে। বিশ্বাস না হয়। স্টুয়ার্ডেসকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। এখানকার কিছু চিনি না আমি একেবারে নতুন।

আমার প্রশ্নের উত্তর দেননি আপনি। গম্ভীর কণ্ঠে বলল মর্গেনস্টার্ন। রানা, বুঝল, শুধু চেহারায় নয়, সবদিক থেকেই লোকটা চোখা।

পরিচিত কিনা? না। এই ভিড়ের মধ্যে লাশটা যদি দাঁড় করিয়ে দেন, চিনতে পারব না।

রানা। মাসুদ রানা।

হয়তো স্বীকার করবেন, মিস্টার রানা, সাধারণ কোন লোক সাধারণত সশস্ত্র খুনীকে তাড়া করে না।

হয়তো সাধারণের চেয়ে একধাপ নিচে আছি আমি।

কিংবা হয়তো আপনার কাছেও পিস্তল রয়েছে?

জ্যাকেটের দুটো বোতাম খুলে লোকটার সন্দেহ ভঞ্জন করল রানা।

আচ্ছা, খুনীকে কি কোনভাবে আপনার পরিচিত মনে হয়েছে? মানে, আগে কোনদিন

কোনদিন না। সত্যি কথাটাই বলল রানা। তবে জীবনে কোনদিন ওই চেহারাটা ভুলতে পারবে না সে, এটাও সত্যি কথা–কিন্তু এ সত্য প্রকাশ করল না সে; মেয়েটির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আপনাকে দুএকটা কথা। জিজ্ঞেস করতে চাই, মিস–

মিস শেরম্যান, বলল মর্গেনস্টার্ন।

আপনি তো খুনীটাকে দেখেছেন। চেহারাটা মনে আছে? মেয়েটা মাথা। নাড়ছে দেখে বলল, মনে থাকার কিন্তু কথা। কাউকে দৌড়াতে দেখলে সবাই সেইদিকে তাকায়। আপনি একেবারে সামনে থেকে দেখেছেন ওকে।

দেখেছি। কিন্তু চেহারা মনে নেই।

মৃত লোকটাকে হয়তো আপনি চিনতে পারবেন। দেখবেন নাকি এক নজর?

শিউরে উঠে মাথা নাড়ল মেয়েটা।

হঠাৎ সরাসরি প্রশ্ন করল রানা, কাউকে রিসিভ করতে এসেছেন?

 ঠিক বুঝতে পারছি না একটু যেন অবাক দেখাল মেয়েটাকে।

ইমিগ্রেশনের দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাই জিজ্ঞেস করছি। কেউ আসছে এই প্লেনে?

আবার মাথা নাড়ল মেয়েটা। রানা লক্ষ করল, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মেয়েটার মুখ। ঈষৎ বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রয়েছে রানার মুখের দিকে। ভয়। পাচ্ছে পরের প্রশ্নটা কি হবে ভেবে।

 তাহলে কেন এসেছেন? ভুরু নাচাল রানা। দৃশ্য দেখতে? এখানে তো, দেখার মত কিছুই নেই?

এসব প্রশ্নের কোন যৌক্তিকতা দেখতে পেল না মর্গেনস্টার্ন, ঠাণ্ডা দৃষ্টি রাখল রানার চোখে।

হয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে। খামোকা প্রশ্ন করে ভদ্র মহিলাকে আর বিব্রত করলেও চলবে। এ ধরনের প্রশ্ন করবার অধিকার রয়েছে কেবল পুলিস। অফিসারের।

আমি একজন পুলিস অফিসার, বলল রানা। পাসপোর্ট আর ওয়ার‍্যান্ট কার্ড বের করে এগিয়ে দিল অফিসারের দিকে। ঠিক সেই সময়ে ইমিগ্রেশনে। এসে ঢুকল সোহানা ও মারিয়া। কপালকাটা রানার রক্তাক্ত চেহারা দেখেই থমকে দাঁড়াল লোহানা, চোখে-মুখে উদ্বেগের ছায়া ফুটে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু রানার কড়া ভ্রুকুটি দেখে সামলে নিল মুহূর্তে। ঘাড় ফিরিয়ে মর্গেনস্টার্নের দিকে চাইল এবার রানা। মুখের ভাব সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে লোকটার।

তাই বলুন! আবার চোখ রাখল সে ওয়ার‍্যান্ট কার্ডে। মেজর মাসুদ রানা, প্যারিস ব্যুরো অফ ইন্টারপোল। এবার বোঝা যাচ্ছে কেন খুনীর। পেছনে ওভাবে দৌড়েছিলেন আপনি, কেন জেরা শুরু করেছিলেন পুলিসের। মত। যাই হোক, আপনার এই পরিচয়পত্র একটু চেক করে দেখতে হবে। আমার।

দেখুন। যেমন ভাবে খুশি পরীক্ষা করে দেখুন। তবে আমার মনে হয়, সেন্ট্রাল হেডকোয়াটারের কর্নেল ভ্যান গোল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলে অনেক খাটুনি বেঁচে যাবে আপনার।

কর্নেলকে চেনেন আপনি?

মাথা ঝাঁকাল রানা। বলল, তিনিও আমাকে চেনেন। যাই হোক, যা চেক করবার জলদি করুন, আমি বারে গিয়ে বসছি, ওখানেই পাবেন আমাকে। এগোতে গিয়েও থেমে দাঁড়াল রানা তাগড়া পুলিশ দুজনকে অনসূরণ করতে দেখে। বলল, এদের জন্যে, ড্রিঙ্কস কিনতে পারব না আমি, জানিয়ে দিচ্ছি আগে থেকেই।

ঠিক আছে, হাত নেড়ে পুলিস দুজনকে পিছু নিতে বারণ করল মর্গেনস্টার্ন। মেজর মাসুদ রানা পালাবে না।

 যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কাগজপত্রগুলো আপনার কাছে রয়েছে, ততক্ষণ তো নয়ই। মেয়েটার দিকে ফিরল রানা। মিস্ শেরম্যান, আপনার ওই জখমের জন্যে আমি আন্তরিক দুঃখিত। দেখে মনে হচ্ছে খুবই কাহিল হয়ে। পড়েছেন। আসুন না, একটা ড্রিঙ্ক নিন?

আপনার সাথে? জুলফির পাশে রুমাল চাপা দিয়ে এমন ভাবে চাইল মেয়েটা রানার দিকে যেন কুষ্ঠরোগী দেখছে। মুখ ফিরিয়ে নিল।

কাঁধ  ঝাঁকিয়ে এগোল রানা বারের দিকে। হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে অবাক হলো সে। প্লেন থেকে নামার পর মাত্র আট মিনিট পার হয়েছে এতক্ষণে। এই আট মিনিটে কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেছে ওর কাছে এক–অত্যন্ত সুসংগঠিত দলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে সে এবার; দুই-এত গোপনীয়তা সত্ত্বেও কবে, কখন, কোন প্লেনে করে ইন্টারপোলের লোক আসছে জানা হয়ে। গিয়েছিল ওদের, ইসমাইলের হাত নাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রানার চেহারাও চেনা হয়ে গিয়েছে; তিন-হঠাৎ সামনে পড়ে যায়নি মিস শেরম্যান, ইচ্ছে করেই নষ্ট করা হয়েছে রানার কয়েকটা মূল্যবান সেকেন্ড।

কোথাও মস্ত কোন ভুল করেছিল ইসমাইল, সে ভুলের অর্ধেক মাশুল শোধ করে গেছে সে নিজের জীবন দিয়ে, বাকি অর্ধেকটা চেপে গেছে এখন রানার কাঁধে।

.

০২.

আপাতত আগের প্ল্যান-প্রোগ্রামই অনুসরণ করবার সিদ্ধান্ত নিল রানা। হলুদ মার্সিডিজ ট্যাক্সি এসে থামল ফাঁইভ-স্টার হোটেল কার্লটনের সামনে। মালপত্রের ভার ডোরম্যানের হাতে ছেড়ে দিয়ে ঢুকে পড়ল রানা ভিতরে। রিসিপশন ডেস্কের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে ছিমছাম পোশাক পরা স্মার্ট চেহারার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। সরু গোঁফ, ব্যাকরাশ চুল, মুখে উজ্জ্বল হাসি-সামনের লোকটা পিঠ ফেরাবার সঙ্গে সঙ্গেই যেটা অদৃশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু ঝট করে পেছন ফিরলে দেখা যাবে মুহূর্তে ফিরে এসেছে হাসিটা, আগের চেয়েও উজ্জ্বল।

ওয়েলকাম, মিস্টার রানা, বলল লোকটা। আশা করি অ্যামস্টার্ডাম আপনার কাছে ভাল লাগবে।

এ ব্যাপারে অতটা আশাবাদী হতে পারল না রানা, কাজেই জবাব না। দিয়ে রেজিস্ট্রেশন কার্ড পূরণে মন দিল সে। যেন মহামূল্যবান রত্নের অলঙ্কার। নিচ্ছে, এমনি ভাবে পূরণ করা কার্ডটা হাতে নিল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। রানাকে আর এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে বুড়ো বেল বয়ের দিকে চাইল সে। শরীরের ওপরের অংশ একপাশে বাকিয়ে রানার ভারী সুটকেস হাতে। এলোমেলো পা ফেলে এদিকে এগোচ্ছে বেল বয়।

বয়! ছশো বাইশ নম্বর।

কথাটা বলেই অত্যন্ত বিনয় সহকারে রানার হাতে তুলে দিল সে একটা, চাবি। চাবিটা পকেটে ফেলে দুই পা এগিয়ে বুড়োর হাত থেকে সুটকেসটা নিল রানা ঝ হাতে, টিপস দিয়ে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। আমিই নিতে পারব।

কিন্তু সুটকেসটা অনেক ভারী মনে হচ্ছে, মিস্টার রানা, বলল। অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আন্তরিক কণ্ঠে। ওটা ওখানেই নামিয়ে দিন, আমি অন্য লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি ওপরে।

মৃদু হেসে ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল রানা সুটকেস হাতে। ভারী তো মনে হবেই ভাবল সে। পিস্তল, গোলাবারুদ, সাইলেন্সর, বার্গলার্স-টুল, এবং সেই সঙ্গে আরও কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি মিলে কমপক্ষে দশ সের ওজন বাড়িয়ে দিয়েছে সুটকেসের। কিন্তু তাই বলে ওর অনুপস্থিতিতে ভিতরের জিনিসপত্র ঘাঁটবার সুযোগ সে দিতে পারে না কাউকে। একবার হোটেল কক্ষে পৌঁছতে পারলে ওসব লুকিয়ে রাখবার জায়গার অভাব হবে না, কিন্তু তার আগে সুটকেসটা হাতছাড়া করা যায় না।  

সিক্সথফ্লোরের বোতাম টিপে দিল রানা এলিভেটরে উঠে রওয়ানা হওয়ার আগের মুহূর্তে দরজার গায়ের গোল কাঁচের জানালা দিয়ে রিসিপশন ডেস্কের দিকে চাইল সে। হাসি নেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের মুখে। গভীর ভাবে কি সব বলছে লোকটা টেলিফোনের রিসিভারে।

সাততলার লবিতে বেরিয়েই দেখতে পেল রানা ছোট্ট একটা টেবিল, টেবিলের ওপর একটা টেলিফোন, ওপাশে একটা চেয়ার, চেয়ারে বসা ইউনিফর্ম পরা এক স্বাস্থ্যবান ওয়েটার। লোকটার চোখে মুখে একটা বেপরোয়া ভাব লক্ষ করল সে। এই ধরনের লোকের ব্যবহারে আবছা একটা। বেয়াড়াপনা, একটা তির্যক বেয়াদবি মেশানো থাকে, কিন্তু স্পষ্টভাবে কোন দোষ ধরবার উপায় নেই যে নালিশ করা যায় কর্তৃপক্ষের কাছে।

ছশো বাইশ নম্বরটা কোনদিকে? জিজ্ঞেস করল রানা।

ভুরুজোড়া আধ ইঞ্চি ওপরে উঠল লোকটার, বুড়ো আঙুল দিয়ে দেখাল। ডানদিকে। তিনটে ঘর ছেড়ে তার পরেরটা। উঠে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, বাক্যের শেষে ছোট্ট একটা স্যার যোগ করাও বাহুল্য বলে বোধ করল সে। মনে মনে বিরক্ত হলো রানা, ইচ্ছে হলো এক থাবড়া দিয়ে ওর চাদিটা ঘোলা। করে দেয়, কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু না বলে আনন্দটা ভবিষ্যতের জন্যে জমা করে রাখাই স্থির করল। যাবার আগে এই লোকটাকে একটু টাইট করে দিয়ে যাবে সে।

তুমি ফ্লোর ওয়েটার না? যেন বেয়াদবিটা চোখেই পড়েনি ওর, এমনিভাবে জিজ্ঞেস করল রানা।

ইয়েস, স্যার, বলে উঠে দাঁড়াল লোকটা। এত সহজে লোকটা কাবু হয়ে যাওয়ায় মন খারাপ হয়ে গেল রানার। যেন রসভঙ্গ হয়ে গেল।

আমার জন্যে খানিকটা কফির ব্যবস্থা করো।

এগিয়ে গিয়ে ছশো বাইশের দরজায় চাবি লাগাল রানা। প্রশস্ত বেডরূম, একটা মাঝারি সিটিংরূম, ছোট্ট একটা কিচেন আর অ্যাটাচড বাথরূম নিয়ে চমৎকার এক সুইট। পিছনে.চওড়া একটা ব্যালকনি।

সুটকেসটা ঘরের কোণে নামিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল রানা। ঠিক নিচেই ব্যস্ত রাজপথ–প্রায় সত্তর ফুট নিচে। খটখটাং শব্দে ট্রাম চলছে, হর্ন বাজাচ্ছে চলন্ত গাড়ি, কিলবিল করছে শয়ে শয়ে মোটর-স্কুটার আর বাইসাইকেল যেন আত্মহত্যার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে ওরা প্রত্যেকে।

ওপর দিকে চাইল রানা। সুইট রিজার্ভ করবার সময়েই টপ ফ্লোরের। কথা বলে দিয়েছিল সে বিশেষ করে। এখান থেকে সবচেয়ে সহজে কিভাবে ছাতে ওঠা যায় বুঝে নিয়ে ফিরে এল ঘরে। সুটকেস খুলে যেসব জিনিস সে আর কারও চোখে পড়তে দিতে চায় না সেগুলো বের করে রাখল রানা। কার্পেটের ওপর। হোলস্টারে পোরা ওয়ালথার পি.পি.কে. ঝুলিয়ে নিল বগলের নিচে, এক্সট্রা ম্যাগাজিন গুঁজে দিল প্যান্টের পেছনের পকেটে। এবার। ক্যানভাসের বেল্টে আঁটা বার্গলার্সটুল কোমরে বেঁধে নিয়ে ভ্রুড্রাইভারটা বের করুল তার থেকে। কিচেনে রাখা ছোট্ট পোর্টেবল ফ্রিজের পেছনটা খুলে এবার বাদবাকি সব জিনিস ঢুকিয়ে দিল সে ওখানে, তারপর দরজা খুলে হাক ছাড়ল। ওয়েটারের উদ্দেশে।

কি হলো? কফি কোথায়?

এবার এক হাঁকেই উঠে দাঁড়াল ওয়েটার, ভাঙা ইংরেজিতে বলল, আসছে, স্যার। এলেই আমি পৌঁছে দেব।

জলদি করো, বলেই দরজা ভিড়িয়ে দিল রানা।

কোমরে বাঁধা বেল্ট থেকে একগোছা চাবি বের করে দরজার চাবির ফুটোয় একের পর এক লাগাতে শুরু করল সে। সপ্তম চাবিটা লেগে গেল। নম্বরটা দেখে নিয়ে যথাস্থানে রেখে দিল সে গোছাটা আবার। বাথরূমে ঢুকে শাওয়ার খুলে দিয়ে ফিরে এল সে বেডরূমে, স্যুটগুলো ঝুলিয়ে দিল ওয়ারড্রোবের হ্যাঁঙ্গারে, একটা সিগারেট ধরিয়ে কয়েক টান দিয়ে জ্বলন্ত অবস্থায় অ্যাশট্রের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল। ঠিক এই সময়ে বেল বেজে উঠতেই একলাফে চলে গেল সে বাথরূমের দরজার সামনে, ওয়েটারকে ভিতরে আসতে বলে ভিতরে ঢুকে ভিড়িয়ে দিল বাথরুমের দরজা, নিচু হয়ে চোখ রাখল কী হোলে।

 নাহ, যা আশা করেছিল তার কিছুই ঘটল না। রানা ভেবেছিল, ও বাথরূমে মনের সুখে ভিজছে মনে করে এই সুযোগে তালাহীন সুটকেসের মধ্যে কি আছে দেখবার চেষ্টা করবে ওয়েটার, অন্তত চারপাশে উৎসুক দৃষ্টি বুলাবে. সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে কিনা দেখবার জন্যে কিন্তু না, কোনদিকে না চেয়ে সোজা টেবিলের ওপর কফির ট্রে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল লোকটা। যাবার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে দিতে ভুলল না।

এতে অবশ্য কিছুই প্রমাণ হয় না, বুঝতে পারল রানা। এর ফলে, ধরে নেওয়া যায় না যে এই হোটেলে শত্রুপক্ষের কেউ নেই, কিংবা ওর পরিচয় ও উদ্দেশ্য এদের সবার অজানা। বাথরূম থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই করিডরে বেরোবার দরজায় তালা দিল, তারপর কফিগুলো বেসিনে ঢেলে দিয়ে বন্ধ করে দিল শাওয়ার। চলে এল ব্যালকনিতে।

ব্যস্ত সড়কের দিকে চেয়ে রানা বুঝল ওখান থেকে ওর কার্যকলাপ দেখার উপায় নেই কারও, সামনের দালানগুলোর কোন জানালা বা ব্যালকনিতেও কাউকে দেখতে পেল না সে। সামনে ঝুঁকে আশেপাশের কোন ঘরের ব্যালকনি থেকে এদিকে কেউ চেয়ে রয়েছে কিনা দেখল ডাইনে বায়ে মাথা ঘুরিয়ে। না। কেউ নেই দুপাশের কোন ব্যালকনিতে। রেলিঙের ওপর দাঁড়িয়ে এক হাতে একটা পাইপ আর এক হাতে হাতের কার্নিস ধরে. উঠে পড়ল সে ওপরে।

 কেউ নেই ছাতে, উঁকি দিয়ে দেখে নিয়ে টেলিভিশনের এরিয়েল বাঁচিয়ে এগোল সে ফায়ার এসকেপের দিকে। তেতলা পর্যন্ত নেমে এল রানা ফায়ার এসকেপের সিঁড়ি বেয়ে, তারপর চাবি লাগাল করিডরের দরজায়। বার কয়েক চেষ্টা করতেই খুলে গেল তালা, দরজাটা সামান্য ফাঁক করে শূন্য করিডর দেখে বেরিয়ে এল সে দরজার ওপাশ থেকে। এবার হেলেদুলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে।

রিসিপশনে নতুন লোক। সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, বেল বয় বা ডোরম্যান, কাউকেই দেখতে পেল না সে। একদল সদ্য আগত টুরিস্ট ভিড় করে আছে রিসিপশন ডেস্কের সামনে। ভিড় ঠেলে, এর ওর কাঁধে মৃদু টোকা দিয়ে ডেস্কের কাছাকাছি পৌঁছল রানা, হাত বাড়িয়ে ডেস্কে জমা দিল ঘরের। চাবিটা, তারপর ধীর পদক্ষেপে চলে গেল বারে। সেখানেও থামল না, একটা সাইড ডোর দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে।

মুষল ধারে বৃষ্টি হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে, রাস্তাঘাট ভেজা। কিন্তু এখন একফোঁটাও পড়ছে না আর। ওভারকোটটা খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিল, চারপাশে উৎসুক দৃষ্টি ফেলতে ফেলতে এগোল সে, যেন নৈশ-অ্যামস্টার্ডামের রূপ। একেবারে মুগ্ধ করে ফেলেছে তাকে।

হেরেনগ্র্যাচে সপ্তদশ শতাব্দীর রাজকুমারদের বাড়িগুলো দেখছিল রানা, হঠাৎ ঘাড়ের পেছনে কেমন যেন একটা সুড়সুড়ির মত অনুভূতি হলো ওর। এক্সট্রা সেনসরি পার্সেপশন হোক বা যাই হোক, নিজের মধ্যে একটা ক্ষমতা আছে–অনুভব করে রানা। পরিষ্কার বুঝতে পারল, অনুসরণ করা হচ্ছে ওকে।

কিছুদূর এগিয়ে একটা খালের ধারে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল সে, যেন প্রাকৃতিক শোভা দেখছে। একটা সিগারেটের আধা-আধি শেষ করে বুঝতে পারল আপাতত ওকে খুন করবার ইচ্ছে নেই কারও। সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও বেশি কাছে এল না লোকটা, বিশগজ দূরে আরেকটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে সে-ও শোভা দেখছে। শিফল এয়ারপোর্টের পিস্তল তুলে গুলি করেনি ইসমাইলের হত্যাকারী, এই নির্জন খালের পারে জায়গামত একটা গুলি ঢুকিয়ে দিয়ে সম্মানের সাথে পানিতে নামিয়ে দিলে টেরও পাবে না। কাকপক্ষী–কিন্তু সে চেষ্টা করল না কেউ। আপাতত এরা শুধু ওর গতিবিধি। আর কাজকর্মের ওপর দৃষ্টি রাখতে চাইছে। ভালই তো-রাখুক।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল রানা, হাই তুলল, তারপর উঠে _এল বড় রাস্তায়। ডানদিকে মোড় নিয়ে লীডেস্ট্রাট ধরে এগোল সহজ ভঙ্গিতে। মাঝে মাঝে টুকিটাকি উইন্ডো শপিং করছে, সেই ফাঁকে কাঁচের গায়ের। প্রতিফলন দেখে বুঝে নিচ্ছে অনুসরণকারীর অবস্থান। রানা থামলেই সেই লোকটাও থেমে দাঁড়িয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করে কোন দোকানের ডিসপ্লে। ছাই রঙের স্যুট ও সোয়েটার নোকটার, টুপিটাও ছাই রঙের।

সামনের মোড়ে আবার ডানদিকে ঘুরল রানা। সিঙ্গেল ক্যানেলের তীরে সারর্বাধা ফুলের দোকান। বেশ কিছুদূর এগিয়ে একটা টকটকে লাল গোলাপ কিনে গুজল কোটের কলারে। ত্রিশ গজ দূরে সেই লোকটাও ফুল কিনছে। রওয়ানা হয়ে গেল রানা।

সামনের মোড়ে আবার ডানদিকে ঘুরল রানা। লোকটা চোখের আড়াল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত দ্রুত পায়ে এগোল ভিযেলস্ট্রাট ধরে। চল্লিশ কদম, গিয়েই চট করে ঢুকে পড়ল একটা ইন্দোনেশিয়ান রেস্তোরাঁর ভেড়ানো দরজা ঠেলে। সোজা গিয়ে টয়লেটে ঢুকল।

দশ সেকেন্ডের মধ্যে বেরিয়ে এল সে টয়লেট থেকে। ওভারকোটটা গায়ে চড়িয়ে নিয়েছে, পকেট থেকে একটা নরম ফেল্টের ট্রিলবি হ্যাট বের। করে পরে নিয়েছে, চোখে চড়িয়েছে জিরো পাওয়ারের একজোড়া পুরানো মডেলের তারের চশমা। রানা যখন রেস্তোরাঁর দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় পড়ল, ঠিক সেই সময়ে হন্তদন্ত হয়ে চারপাশে চাইতে চাইতে সামনের দিকে চলেছে ছাই-রঙা অনুসরণকারী। ওভারকোট পরা পরিবর্তিত রানাকে ভালমত দেখবারও প্রয়োজন বোধ করল না লোকটা, একবার আবছাভাবে চোখ বুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশে খুজছে সে রানাকে। এই দরজায় ওই দরজায় উঁকি দিয়ে দেখছে সে রানা ঢুকেছে কিনা।

রাস্তা পেরিয়ে ওপাশে চলে গেল রানা। লোকটার বেশ খানিকটা পেছন পেছন চলল। শখানেক গজ গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে আবার ফিরে আসতে শুরু করল লোকটা। চোখেমুখে স্পষ্ট উদ্বেগ। ফিরতি পথে প্রত্যেকটা খোলা। দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে খুঁজছে সে রানাকে। ইন্দোনেশিয়ান রেস্তোরাঁতেও ঢুকল, দুশ সেকেন্ড পর বেরিয়ে এল সেখানে রানাকে না পেয়ে। রেমব্র্যান্ট হোটেলে ঢুকে লবি, লাউঞ্জ, বার খুঁজে ফিরে এল সে রাস্তায়। পাগল-দশা হয়েছে ওর। উদভ্রান্ত ভঙ্গিতে চাইছে এদিক ওদিক, দিশাহারার মত পথ চলতে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে লোকের গায়ে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ একটা টেলিফোন বুদে ঢুকল লোকটা, দুই মিনিট পর বেরিয়ে এল কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে যেন মেরেছে কেউ। সোজা মাল্টপ্লেইনের ট্রাম স্টপেজের দিকে চলল লোকটা। এবার, পিছু পিছু গিয়ে রানাও দাঁড়াল লাইনে।

তিন কোচের একটা ট্রাম এসে দাঁড়াতেই প্রথম কোচে উঠে পড়ল ছাই রঙা লোকটা, দ্বিতীয় কোচে উঠে বসল রানা। একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে বসল, যাতে নজর রাখা যায় লোকটার ওপর।

ড্যাম-এ পৌঁছেই নেমে পড়ল লোকটা, রানাও নামল। এই ড্যামই হচ্ছে। অ্যামস্টার্ডামের মেইন স্কয়ার। রাজপ্রাসাদ, নিউ চার্চ, ইত্যাদি অনেক ঐতিহাসিক দর্শনীয় বস্তু সাজানো রয়েছে রাস্তার দুই ধারে। কিন্তু এসব কোনকিছুর প্রতি ক্ষেপ না করে হোটেল ক্র্যাসনাপোলস্কির পাশ দিয়ে একটা সাইড রোড ধরে এগিয়ে গেল লোকটা, তারপর বায়ে মোড় নিয়ে ডকের। দিকে এগোল আউডেজি ভুর্বাগোয়াল খালের ধার ঘেঁষে। আধ মাইল এগিয়ে ডাইনে ঘুরে গুদাম আর পাইকারী বিক্রেতাদের ওয়্যারহাউজে ঠাসা পূরানো। শহরের দিকে চলল সে এবার। লোকটাকে অনুসরণ করবার ব্যাপারে কোন সমস্যা দেখা দিল না, ডাইনে-বায়ে কোনদিকে না চেয়ে এক মনে হেঁটে, চলেছে সে মাথা নিচু করে, ধমক ও গালাগালির উত্তরে কি কি জবাব দেবে খুব সম্ভব তারই মহড়া চলেছে ওর মাথায়।

সরু একটা গলিতে ঢুকল লোকটা, একটু ইতস্তত করে গলিমুখে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল রানা। যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে বিদেশী পর্যটক, কোনদিকে যাবে ভাবছে, যদিও জানে যে কোন একদিকে রওনা দিলেই চলে, ওর কাছে সব রাস্তাই সমান। লোকটার চলার গতি বেড়ে যাওয়ায় রানা বুঝতে পারল, গন্তব্যস্থলের খুব কাছাকাছি এসে গেছে বলেই এই কর্ম তৎপরতার আভাস। ঠিকই। মান আলোকিত গলিটার মাঝামাঝি গিয়ে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে তরতর করে উঠে গেল লোকটা কয়েক ধাপ, চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে গেল একটা স্টোর হাউজের ভিতর।

ধীরে পায়ে এগোল রানা। সরু রাস্তার দুপাশে পাঁচতলা উঁচু সারি সারি পুরানো দালান, মনে হয় এক্ষুণি বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে ঘাড়ের ওপর। প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে সাইনবোর্ড লাগানো কোন না কোন কোম্পানীর। স্টোর হাউজ। কেমন একটা ছমছমে ভাব নির্জন রাস্তাটায়। যেতে যেতে সহজ ভঙ্গিতে চাইল রানা ডানপাশে। যে দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়েছে ছাই-রঙা লোকটা তার গায়ে লেখা–ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানী। যেমন চলছিল। ঠিক সেই গতিতেই এগিয়ে গেল রানা সামনের মোড়ের দিকে।

.

অত্যন্ত সাদামাঠা এক হোটেল-যেমন বাইরেটা, তেমনি ভেতরটা। খটখটে কয়েকটা আসবাব, দেখে মনে হয় নিলামে কেনা। বিছানার ওপর পাশাপাশি বসে আছে সোহানা ও মারিয়া। রানা বসল ঘরের একমাত্র আরাম কেদারাটায়।

কি খবর? মায়াময় নৈশ অ্যামস্টার্ডামের এক নির্জন হোটেলকক্ষে অপরূপ সুন্দরী দুই রমণী–একা। সব ঠিকঠাক তো?

না, জবাব দিল মারিয়া এক অক্ষরে।

না? অবাক হওয়ার ভান করল রানা। না মানে?

হাত তুলে কামরাটার চারদিকে দেখাল মারিয়া। দেখুন, নিজেই চেয়ে। দেখুন না।

চারদিকে চেয়ে কিছুই বুঝতে পারল না রানা। দেখলাম, কিন্তু বুঝলাম না।

এই ঘরে মানুষ বাস করতে পারে? আপনি পারবেন?

ও, এই কথা? হাসল রানা। না। সত্যি বলতে কি, এই ঘরে আমি বাস। করতে পারব না। কিন্তু তোমাদের মত খেটে খাওয়া টাইপিস্টকে তো আর। ফাঁইভ-স্টার হোটেলে নিয়ে গিয়ে তুলতে পারি না। এই ঘর তোমাদের জন্যে। ঠিকই আছে। এখানে কারও চোখে পড়বার সম্ভাবনা নেই। অন্তত এটাই আশা করছি। তোমাদের বক্তব্য কি? তোমাদের চিনতে পেরেছে কেউ? মাথা নাড়তে দেখে বলল, তোমরা কাউকে চিনতে পেরেছ প্লেনে?

ঠিক একই ভাবে মাথা নেড়ে একই সঙ্গে বলল দুজন, না।

শিফলে পৌঁছে পরিচিত কাউকে দেখেছ?

না।

কেউ কোন বিশেষ আগ্রহ দেখায়নি তোমাদের প্রতি?

না।

ঘরটা পরীক্ষা করে দেখেছ? লুকোনো মাইক্রোফোন বা কিছু পেলে?

না।

বাইরে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

কেউ অনুসরণ করেছিল?

না।

তোমাদের অনুপস্থিতিতে সার্চ করা হয়েছে এ ঘর?

না।

মারিয়ার ঠোঁটে হাসির আভাস দেখে হাসল রানা প্রশ্রয়ের হাসি। বলল; বলে ফেলো। মজার ব্যাপারটা কি ঘটল?

না। মানে… একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল মারিয়া, এই চোর-পুলিস খেলার কি সত্যিই কোন মানে, দুজন নিরীহ বিদেশী টাইপিস্ট আমাদের পেছনে কেন কেউ

আহ, থামো! মারিয়াকে থামিয়ে দিল সোহানা। এর মধ্যে হাসির কিছুই নেই।

এয়ারপোর্টের ঘটনা সম্পর্কে জানা আছে তোমাদের? জিজ্ঞেস করল রানা।

খুনের ব্যাপারে তো? বলল মারিয়া। কে একজন খুন হয়েছে। এয়ারপোর্টে। শুনোছ, আপনি নাকি চেষ্টা করেছিলেন খুনীকে ধরতে…

ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম…

কেন? জিজ্ঞেস করল সোহানা।

কি কেন? অবাক হলো রানা।

কে কোথায় খুন হলো, সেজন্যে পুলিস বিভাগ রয়েছে–তুমি কেন তা! করতে গেলে? কোথাও কোন খুন-খারাবি হলেই তোমার পিছু ধাওয়া করতে হবে?

যাকে খুন করা হলো, সে যদি আমার ঘনিষ্ঠ কেউ হয়? ধরো, তুমি বা মারিয়া.. কথাটা শেষ করল না রানা একসঙ্গে ওদের দুজনকে চমকে উঠতে দেখে।

ঘনিষ্ঠ নোক মানে? ছানাবড়া হয়ে গেল মারিয়ার চোখজোড়া। আপনি চেনেন লোকটাকে? যে মারা গেল

আমারই লোক। জরুরী খবর নিয়ে দেখা করতে এসেছিল, আমার সঙ্গে। নিজের মোক বলেই বলছি না, অত্যন্ত সাবধানী এবং বুদ্ধিমান লোক ছিল ও। আমি ছাড়া আর কারও পক্ষেই জানা সম্ভব ছিল না যে ও আসছে শিফলে আমার সাথে দেখা করতে–এতই সাবধানে মেসেজ পাঠিয়েছিল ও তিন হাত ঘুরিয়ে। কিন্তু পৌঁছে কি দেখলাম? আরও কেউ জেনে গিয়েছে এই গোপন সাক্ষাতের কথা, কথা শুরু করবার আগেই শেষ করে দিয়েছে ইসমাইলকে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যেটা তা হচ্ছে আমার একজন সহকর্মী। সম্পর্কে ওরা এতটা ওয়াকিফহাল; বাকি দুজন সম্পর্কে ঠিক কতটা ওদের জানা আছে বুঝে নেয়া দরকার প্রথমে। আর ইউ শিওর ইউ আর ইন ক্লিয়ার?

 ব্যাপারটার গুরুত্ব টের পেল ওরা। পরস্পরের মুখের দিকে চাইল সোহানা ও মারিয়া। তারপর নিচু গলায় বলল মারিয়া, তা কি করে বলব? আমরা যতদূর জানি এখন পর্যন্ত ঠিকই আছি আমরা। কেউ আমাদের চিনে রেখেছে কিনা সেটা তো সেই বলতে পারবে। আপনার কি মনে হয়। আমাদেরও প্রাণের আশঙ্কা…

আছে। সেইজন্যেই অত আপত্তি করেছিলাম আমি তোমাদেরকে সাথে আনতে।

বিপদের সম্ভাবনা বেশ সহজ ভাবেই গ্রহণ করল ওরা দুজন। রীতিমত ট্রেনিং পাওয়া এজেন্ট ওরা, একটুতেই ঘাবড়ে যাওয়ার মত ঠুনকো নয়। রানার চোখে চোখ রাখল সোহানা। তোমার পেছনে নিশ্চয়ই লেগে গেছে। ওরা? রানাকে মাথা ঝাঁকাতে দেখে বলল, কোথায় কোন হোটেলে উঠেছ। জানা আছে ওদের?

নিশ্চয়ই। তা নইলে হোটেলের অর্ধেক স্টাফ আমার ওপর নজর রাখতে যাবে কেন? সাইড ডোরেও ওয়াচার বসানো হয়েছে, আমি বেরোতেই গুটগুট। করে হাঁটতে শুরু করল পেছন পেছন।

খসিয়ে দিয়েছেন ওকে? জিজ্ঞেস করল মারিয়া।

হয় অযোগ্য ছিল, নয়তো প্রোতভাকেট করবার চেষ্টা করছে। আক্রমণের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ওদের ছোট ছোট চালে আমার কি রি অ্যাকশন হয় তাই লক্ষ করছে ওরা দূরে বসে।

কিছু দেখতে পেয়েছে? জানতে চাইল সোহানা।

পাবে, উঠে দাঁড়াল রানা। যতটা আঘাত করবে, ঠিক ততটাই প্রত্যাঘাত পাবে ওরা আমার কাছ থেকে। চলি এখন। দেখা হবে কাল।

চট করে রানার হাত ধরল সোহানা।

সাবধানে থেকো, রানা। তুমি একা, ওরা অনেক।

তবু ভয় পাচ্ছে ওরা আমাকে। হাসল রানা। ভেব না, কোন কোন সময় আমি একাই একশো হয়ে যেতে পারি। তোমরা এখন সাবধানে থাকতে পারলে হয়।

« পূর্ববর্তী:
পরবর্তী: »
১.৩-৪ টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ – PDF

Return to top