১৩. হঠাৎ চারিদিক অন্ধকার

বৈকালের দিকটা হঠাৎ চারিদিক অন্ধকার করিয়া কালবৈশাখীর ঝড় উঠিল। অনেকক্ষণ হইতে মেঘ মেঘ করিতেছিল, তবুও ঝড়টা যেন খুব শীঘ্ৰ আসিয়া পড়িল। অপুদের বাড়ির সামনে বাঁশঝাড়ের বাঁশগুলো পাচিলের উপর হইতে ঝড়ের বেগে হটিয়া ওধারে পড়াতে বাড়িটা যেন ফাকা ফাকা দেখাইতে লাগিল-ধূলা, বাঁশপাতা, কাঁঠালপাতা, খড় চারিধার হইতে উড়িয়া তাহাদের উঠান ভরাইয়া ফেলিল। দুৰ্গা বাটীর বাহির হইয়া আম কুড়াইবার জন্য দৌড়িল-অপুও দিদিব পিছু পিছু ছুটিল। দুর্গা ছুটিতে ছুটিতে বলিল-শিগগির ছোট্‌, তুই বরং সিঁদুরকৌটাতলায় থাক, আমি যাই সোনামুখী-তলায়-দৌড়ো-দৌড়ো। ধুলায় চারিদিক ভরিয়া গিয়াছে—বড় বড় গাছের ডাল ঝড়ে বাঁকিয়া গাছ ন্যাড়া-ন্যাড়া দেখাইতেছে। গাছে গাছে সোঁ সোঁ, বোঁ বোঁ শব্দে বাতাস বাধিতেছে–বাগানে শুকনা ডাল, কুটা, বাঁশের খোলা উড়িয়া পড়িতেছে-শুকনা বাঁশপাতা ছুঁচালো আগাটা উঁচুদিকে তুলিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে আকাশে উঠিতেছে—কুক্‌শিমা গাছের শুঁয়ার মতো পালকওয়ালা সাদা সাদা ফুল ঝড়ের মুখে কোথা হইতে অজস্র উড়িয়া আসিতেছে-বাতাসের শব্দে কান পাতা যায় না।

সোনামুখী-তলায় পৌঁছিয়াই অপু মহা-উৎসাহে চিৎকার করিতে করিতে লাফাইযা এদিক ওদিক ছুটিতে লাগিল-এই যে দিদি, ওই একটা পড়লো রে দিদি-ওই আর একটা রে দিদি! চিৎকার যতটা করিতে লাগিল তাহার অনুপাতে সে আম কুড়াইতে পারিল না। ঝড় ঘোর রবে: বাড়িয়া চলিয়াছে। ঝড়ের শব্দে আম পড়ার শব্দ শুনিতে পাওয়া যায় না, যদিবা শোনা যায় ঠিক কোন জায়গা বরাবর শব্দটা হইল-তোহা ধরিতে পারা যায় না। দুৰ্গা আট-নয়টা আম কুড়াইয়া ফেলিল, অপু এতক্ষণের ছুটাছুটিতে মোটে পাইল দুইটা। তাঁহাই সে খুশির সহিত দেখাইয়া বলিতে লাগিল—এই দাখ দিদি, কত বড় দ্যাখ-ওই একটা পড়লো-ওই ওদিকে—

এমন সময় হই-হাই শব্দে ভুবন মুখুজ্জের বাড়ির ছেলে-মেয়েরা সব আমি কুড়াইতে আসিতেছে শোনা গেল। সতু চেঁচাইয়া বলিল-ও ভাই, দুগগাদি আর অপু আম কুড়ুচ্ছে–

দল আসিয়া সোনামুখী-তলায় পৌঁছিল। সতু বলিল-আমাদের বাগানে কেন এয়েচ আম কুড়ুতে? সেদিন মা বারণ করে দিয়েচে না? দেখি কতগুলো আম কুড়িয়েচো?

পরে দলের দিকে চাহিয়া বলিল-সোনামুখীর কতগুলো আম কুড়িয়েচে দেখেছিস টুনু?– যাও আমাদের বাগান থেকে দুগ্ৰগদি-মাকে গিয়ে নইলে বলে দেবো।

রানু বলিল-কেন তাড়িয়ে দিচ্ছিস সাতু? ওরাও কুড়ুক-আমরাও কুড়ুই।

-কুড়োবে বই কি! ও এখানে থাকলে সব আমি ওই নেবে। আমাদের বাগানে কেন আসবে ও?–না, যাও দুগগাদি-আমাদের তলায় থাকতে দেবো না।

অন্য সময় হইলে দুৰ্গা হয়তো এত সহজে পরাজয় স্বীকার করিত না-কিন্তু সেদিনইহাদেরই কৃত অভিযোগে মায়ের নিকট মারা খাইয়া তাহার পুনরায় বিবাদ বাধাইবার সাহস ছিল না। তাই খুব সহজেই পরাজয় স্বীকার করিয়া লইয়া সে একটু মনমরা ভাবে বলিল-অপু, আয় রে চল। পরে হঠাৎ মুখে কৃত্রিম উল্লাসের ভাব আনিয়া বলিল-আমরা সেই জায়গায় যাই চলা অপু, এখানে থাকতে না দিলে বয়ে গেল-বুঝলি তো?-এখানকার চেয়েও বড় বড় আম-তুই আমি মজা করে কুড়োবো এখন-চলে আয়-এবং এখানে এতক্ষণ ছিল বলিয়া একটা বৃহত্তর লাভ হইতে বঞ্চিত ছিল, চলিয়া যাওয়ায় প্রকৃতপক্ষে শাপে বর হইল, সকলের সম্মুখে এইরূপ ভাব দেখাইয়া যেন অধিকতর উৎসাহের সহিত অপুকে পিছনে লইয়া রাংচিতার বেড়ার ফাক গলিয়া বাগানের বাহির হইয়া গেল।

রানু বলিল-কেন ভাই ওদের তাড়িয়ে দিলে-তুমি ভারি হিংসুক কিন্তু সতুদা!

রানুর মনে দুর্গার চোখের ভরসা-হারা চাহনি বড় ঘা দিল।

অপু অতশত বোঝে নাই, বেড়ার বাহিরের পথে আসিয়া বলিল-কোন জায়গায় বড় বড় আমি রে দিদি? পুঁটুদের সলতেখাগী-তলায়?

কোন তলায় দুর্গা তাহা ঠিক করে নাই, একটু ভাবিয়া বলিল-চল গড়ের পুকুরের ধারের বাগানে যাবি-ওদিকে সব বড় বড় গাছ আছে—চল্‌—।

গড়ের পুকুর এখান হইতে প্ৰায় পনেরো মিনিট ধরিয়া সুড়িপথে অনবরত বন-বাগান অতিক্ৰম করিয়া। তবে পৌছানো যায়। অনেককালের প্রাচীন আমি ও কঁঠালের গাছ-গাছতলায় বন-চালিতা ময়না-কঁটা ষাঁড়া গাছের দুৰ্ভেদ্য জঙ্গল। দূর বলিয়া এবং জনপ্রাণীর বাস শুন্য গভীর বনের মধ্যে বলিয়া এসব স্থানে কেহ বড় একটা আম কুড়াইতে আসে না। কাছির মতো মোটা মোটা অনেককালের পুরোনো গুলঞ্চ লতা। এ-গাছে ও-গাছে দুলিতেছে-বড় বড় প্রাচীন গাছের তলাকার কঁটাভারা ঘন ঝোপ-জঙ্গল খুঁজিয়া তলায় পড়া আম বাহির করা সহজসাধ্য তো নহেই, তাহার উপর আবার ঘনায়মান নিবিড়-কৃষ্ণ ঝোড়ো মেঘে ও বাগানের মধ্যের জঙ্গলে গাছের আওতায় এরূপ অন্ধকারের সৃষ্টি করিয়াছে যে, কোথায় কি ভালো দেখা যায় না। তবুও খুঁজতে খুঁজিতে নাছোড়বান্দা দুৰ্গা গোটা আট-দশ আম পাইল।

হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল-ওরে অপু-বিষ্টি এল!

সঙ্গে সঙ্গে ঝড়টা যেন খানিকক্ষণ একটু নরম হইল–ভিজে মাটির সোঁদা সেঁন্দা গন্ধ পাওয়া গেল-একটু পরেই মোটা মোটা ফোটায় চড়বড় করিয়া গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়িতে শুরু করিল।

—আয় আমরা এই গাছতলায় দাড়াই-এখানে বিষ্টি পড়বে না—

দেখিতে দেখিতে চারিদিক ধোঁয়াকার করিয়া মুষলধারে বৃষ্টি নামিল-বৃষ্টির ফোঁটা পড়বার জোরে গাছের পাতা ছিঁড়িয়া উড়িয়া পড়িতে লাগিল—ভরপুর টাটকা ভিজা মাটির গন্ধ আসিতে লাগিল। ঝড় একটু যেন নরম পড়িয়াছিল—তাহাও আবার বড় বাড়িল-দুৰ্গা যে গাছতলায় দাঁড়াইয়াছিল, এমনি হয়তো হঠাৎ তথায় বৃষ্টি পড়িত না, কিন্তু পুবে হাওয়ার ঝাপটা গাছতলা ভাসাইয়া লইয়া চলিল। বাড়ি হইতে অনেক দূরে আসিয়া পড়িয়াছে—অপু ভয়ের স্বরে বলিল-ও দিদি—বড্ড যে বিষ্টি এল।

–তুই আমার কাছে আয়-দুর্গা তাহাকে কাছে আনিয়া আঁচল দিয়া ঢাকিয়া কহিল-এ বিষ্টি আর কতক্ষণ হবে-এই ধরে গেল বলে-বৃষ্টি হল ভালেই হল-আমরা আবার সোনামুখী-তলায় যাবো এখন, কেমন তো?

দুজনে চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল—

নেবুর পাতায় করম্‌চা
হে বিষ্টি ধরে যা—

ক্কড়-ক্কড়-কড়াৎ,…প্রকাণ্ড বন-বাগানের অন্ধকার মাথাটা যেন এদিক হইতে ওদিক পর্যন্ত চিরিয়া গেল-চোখের পলকের জন্য চারিধার আলো হইয়া উঠিল—সামনের গাছের মগডালে থোলো থোলো বন-ধুল ফল ঝড়ে দুলিতেছে। অপু দুৰ্গাকে ভয়ে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল-ও দিদি!

–ভয় কি রে! রাম রাম বল-রাম রাম রাম রাম-নেবুর পাতায় করমচা হে বিষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচা হে বিষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচা–

বৃষ্টির ঝাপটায় তাহাদের কাপড় চুল ভিজিয়া টস্টস করিয়া জল ঝরিতে লাগিল—গুমগুমু গুম-ম-ম-চাপা গভীর ধ্বনি-একটা বিশাল লোহার বুল কে যেন আকাশের ধাতব মেঝেতে এদিক হইতে ওদিকে টানিয়া লইয়া বেড়াইতেছে–অপু শঙ্কিত সুরে বলিল-ওই দিদি, আবার–

–ভয় নেই, ভয় কি?–আর একটু সরে আয়-এঃ, তোর মাথাটা ভিজে যে একেবারে জুবড়ি হয়ে গিয়েচে–

চারিধারে শুধু মুষলধারে বৃষ্টিপতনের হুস-স-স-স। একটানা শব্দ, মাঝে মাঝে দমকা ঝড়ের সোঁ-ও-ও-ও, বোঁ-ও-ও-ও-ও রব, ডালপালার ঝাপটের শব্দ-মেঘের ডাকে কানে তালা ধরিয়া যায়। এক-একবার দুর্গার মনে হইতেছিল সমস্ত বাগানখানা ঝড়ে মড়মড় করিয়া ভাঙিয়া উপুড় হইয়া তাহদের চাপা দিল বুঝি।

অপু বলিল-দিদি, বিষ্টি যদি আর না থামে?

হঠাৎ ঝটিকাঙ্কুব্ধ অন্ধকাব আকাশের এপ্রান্ত হইতে লকলকে আলো জিহ্বা মেলিয়া বিদুপোব বিকট অট্টহাস্যের রোল তুলিয়া এক লহমায় ও-প্রান্তের দিকে ছুটিয়া গেল।

ক্কড়—ক্কড়-কড়াৎ!

সঙ্গে সঙ্গে বাগানের মাথায় বৃষ্টির ধোঁয়ার রাশি চিড়িয়া ফাড়িয়া উড়াইয়া, ভৈরবী প্রকৃতিব উন্মত্ততার মাঝখানে ধরা পড়া দুই অসহায় বালক-বালিকার চোখ ঝলসাইয়া তীক্ষ্ণ নীল বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল।

অপু ভয়ে চোখ বুজিল।

দুৰ্গা শুষ্ক গলায় উপরের দিকে চাহিয়া দেখিল,-বাজ পড়িতেছে নাকি?-গাছের মাথায় বনধুধুলের ফল দুলিতেছে।

সেই বড় লোহার বুলটাকে আকাশের ওদিক হইতে কে যেন আবার এদিকে টানিয়া আনিতেছিল–

শীতে অপুর ঠক ঠক করিয়া দাঁতে দাঁত লাগিতেছিল—দুর্গা তাহাকে আরও কাছে টানিয়া আনিয়া শেষ আশ্রয়ের সাহসে বার বার দ্রুত আবৃত্তি করিতে লাগিল-নেবুর পাতায় কবমচা-হে বিষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচা-হে বিষ্টি ধরে যা-নেবুর পাতায় করমচাঁ…ভয়ে তাহার স্বর কাঁপিতেছিল।

 

সন্ধ্যা হইবার বেশি বিলম্ব নাই। ঝড়-বৃষ্টি খানিকক্ষণ থামিয়া গিয়াছে। সর্বজয়া বাহিরের দরজায় দাঁড়াইয়া আছে। পথে জমিয়া যাওয়া বৃষ্টির জলের উপর ছপ-ছপ শব্দ করিতে করিতে রাজকৃষ্ণ পালিতের মেয়ে আশালতা পুকুরের ঘাটে যাইতেছিল। সর্বজয়া জিজ্ঞাসা করিল-হ্যাঁ মা, দুৰ্গা আর অপুকে দেখেছিস ওদিকে?

আশালতা বলিল-না খুড়িমা, দেখিনি তো। কোথায় গিয়েচে? তারপর হাসিয়া বলি-কি ব্যাঙ-ডাকানি জল হয়ে গেল খুড়িমা!

—সেই ঝড়ের আগে দুজনে বেরিয়েচে আম, কুড়োতে যাই বলে আর তো ফেরেনি—এই ঝড়-বিষ্টি গেল, সন্দে হোল, ও মা কোথায় গেল তবে?

সর্বজয়া উদ্বিগ্ন মনে বাড়ির মধ্যে ফিরিয়া আসিল। কি করিবে ভাবিতেছে এমন সময়খিড়কির দরজা ঠেলিয়া খুলিয়া আপাদমস্তক সিক্ত অবস্থায় দুর্গা আগে আগে একটা ঝুনা নারিকেল হাতে ও পিছনে পিছনে অপু একটা নারিকেলের বাগলো টানিয়া লইয়া বাড়ি ঢুকিল। সর্বজয়া তাড়াতাড়ি ছেলে-মেয়ের কাছে গিয়া বলিল-ওমা আমার কি হবে। ভিজে যে সব একেবারে পান্তা ভাত হয়েচিস! কোথায় ছিলি বিষ্টির সময়? ছেলেকে কাছে আনিয়া মাথায় হাত দিয়া বলিল-ওমা, মাথাটা যে ভিজে একেবারে জুবড়ি। পরে আহ্বাদের সহিত বলিল-নারকেল কোথা পেলি রে দুর্গা?

অপু ও দুর্গা দুজনেই চাপা কণ্ঠে বলিল-চুপ চুপ মা-সেজজেঠিমা বাগানে যাচ্ছে—এই গেল-ওদের বাগানের বেড়ার ধারের দিকে যে নারকেল গাছটা, ওর তলায় পড়ে ছিল। আমরাও বেরুচ্চি, সেজজেঠিমাও ঢুকলো।

দুর্গা বলিল-অপুকে তো ঠিক দেখেচে—আমাকেও বোধ হয় দেখেছে। পরে সে উৎসাহের সঙ্গে অথচ চাপা সুরে বলিতে লাগিল—একেবারে গাছের গোড়ায় পড়ে ছিল মা, আগে আমি টের পাইনি, সোনামুখী-তলায় যদি আম পড়ে থাকে তাই দেখতে গিয়ে দেখি বাগলোটা পড়ে রয়েছে। অপুকে বললাম-অপু বাগলোটা নে-মার ঝাঁটার কষ্ট, ঝাঁটা হবে। তারপরই দেখি-হস্তস্থিত নারিকেলটার দিকে উজ্জ্বল মুখে চাহিয়া বলিল-বেশ বড়, না মা?

অপু খুশির সুরে হাত নাড়িয়া বলিল-আমি অমনি বাগলোটা নিয়ে ছুট—

সৰ্ব্বজয়া বলিল—বেশ বড় দোমালা নারকেলটা। ছেচতলায় রেখে দে, জল দিয়ে নেবো–

অপু অনুযোগের সুরে বলিল-তুমি বলে মা নারকোল নেই, নারকোল নেই,–এই তো হল নারকেল! এইবাব কিন্তু বড়া করে দিতে হবে। আমি ছাড়বো না—কখ্‌খনো—

বৃষ্টির জলে ছেলেমেয়ের মুখ বৃষ্টিধোঁয়া জুই ফুলের মতো সুন্দর দেখাইতেছিল। ঠাণ্ডায় তাহাদের ঠোঁট নীল হইয়া গিয়াছে, মাথার চুল ভিজিয়া কনের সঙ্গে লেপটাইয়া লাগিয়া গিয়াছে। সর্বজয়া বলিল-আয় সব, কাপড় ছাড়িয়ে দিই। আগে, পায়ে জল দিয়ে রোয়াকে ওঠ্‌ সব–

খানিক পরে সর্বজয়া কুয়ার জল তুলিতে ভুবন মুখুজ্যের বাড়ি গেল। ভুবন মুখুজ্যের খিড়কিদোর পর্যন্ত যাইতেই সে শুনিল সেজ ঠাকরুন বাড়ির মধ্যে চিৎকার করিয়া বাড়ি মাথায় করিতেছেন।

-একটা মুঠো টাকা খরচ করে তবে বাগান নেওয়া-মাগনা তো নয়। তার কোনো কুটোটা যদি হাঘিরেদের জন্যে ঘরে ঢুকবার জো আছে! এ ছুড়িটা রাদিন বাগানে বসে আছে, কুটো গাছটা নিয়ে গিয়ে ঘরে তুলবে-এতে মাগীরও শিক্ষে আছে, ও মাগী কি কম নাকি?-ও মা, ভাবলাম বিষ্টি থেমেচে, যাই একবার বাগানটা গিয়ে দেখে আসি—এই এত বড় নাককোলটা কুড়িয়ে নিয়ে একেবারে দুড়দুড় দৌড়!–এত শতুরতা যেন ভগবান সহি না করেন—উচ্ছন্ন যান, উচ্ছন্ন যানএই ভস সন্দেবোলা বলচি, আব্ব যেন নারকেল খেতে না হয় —একবাব শিগগির যেন ছাতিমতলা–সই হন–

সর্বজয়া খিড়কির বাহিরে কাঠ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ছেলেমেয়ের বর্ষণসিক্ত কচিমুখ মনে করিয়া সে ভাবিল যদি গালাগাল ওদের লাগে! বাবা যে লোক! দাঁতে বিষ আছে! কি করি? কথাটা ভাবিতেই তাহার গা শিহরিয়া উঠিয়া সর্বশরীর যেন অবশ হইয়া গেল। সে আর মুখুজ্যেবাড়ি ঢুকিলে না-আশশ্যাওড়া বনে, বাঁশঝাড়ের তলায় বর্ষণস্তব্ধ সন্ধ্যায় জোনাকি জুলিতেছে, পা যেন আর উঠিতে চাহে না-ভয়ে ভয়ে সে জল তুলিবার ছোট্ট বালতিটা ও ঘড়া কাঁখে লইয়া বাড়ির দিকে ফিরিল।

পথে আসিতে আসিতে ভাবিল-যদি নারকেলটা ওদের ফেরত দিই।–তাহলেও কি গাল লাগবে? তা কেন লাগবে- যার জিনিস তাকে তো ফেরত দেওয়া হল, তা কখনও লাগে?

বাড়িতে পা দিয়াই মেয়েকে বলিল-দুগ্‌গা, নারকেলটা সন্তুদের বাড়ি দিয়ে আয় গিয়ে।

অপু ও দুর্গা অবাক হইয়া মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল—

দুর্গা বলিল-এখখুনি?

-হ্যাঁ-এখখুনি দিয়ে আয়। ওদের খিড়কির দোর খোলা আছে। চট করে যা। বলে আয়, আমরা কুড়িয়ে পেইছিলাম, এই নাও দিয়ে গেলাম।

–অপু আমাকে একটু দাঁড়াবে না, মা? বড় অন্ধকার হয়েচে, চল অপু আমার সঙ্গে।

ছেলেমেয়ে চলিয়া গেলে সর্বজয়া তুলসীতলায় প্রদীপ দিতে দিতে গলায় আঁচল দিয়া প্ৰণাম করিয়া বলিল-ঠাকুর, নারকেল ওরা শত্তুরতা করে কুড়ুতে যায়নি সে তো তুমি জানো, এ গাল যেন ওদের না লাগে। দোহাই ঠাকুর, ওদের তুমি বাঁচিয়ে-বর্তে রেখো, ঠাকুর। ওদের তুমি মঙ্গল কোরো। তুমি ওদের মুখের দিকে চেয়ো। দোহাই ঠাকুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *