১২. শারীরিক পরিশ্রম

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
শারীরিক পরিশ্রম

এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক চমৎকার ঘর তৈরী করতে পারতেন। এক সাহেবকে জানতাম, তিনি চেয়ার বেঞ্চ তৈরী করতে পারতেন।

সংসারের কাজগুলি যদি তুমি নিজের হাতে তৈরী করতে শেখ, তাহলে তোমার জীবনের গুণ বেড়ে যাবে।

হাতের কাজে যে অগৌরব নাই, এ আর বারে বারে বলে। লাভ কি? আগৌরব হয় মিথ্যায়। আর নীচতায়।

এক ব্যক্তি একদিন আমার কাছে গৌরব করে বলেছেন-আমি কোন দিন বাজারে যাই না। তিনি যে একজন অপদাৰ্থ ব্যক্তি, একথা তোমাকে বলে রাখছি।

বেড়ার বাঁধন ও ঘর ছাঁইতে জানা, ঝাড়ন, ঝাটা বঁধতে পারা, এসব জীবনের গুণ। কাজ জান না বলে তুমি যদি গৌরব কর, তাহলে বলবো তুমি একটা মুর্থ। সম্মান হয় কিসে? জ্ঞান, চরিত্র ও মনুষ্যত্ত্বে। সংসারের কাজ না জানার মধ্যে সম্মান নাই।

তুমি রান্না করতে জান না-তোমাকে কি সেজন্য বাহাদুর বলা হবে? তোমাকে কি বলা হবে-তোমার মতো ভদ্রলোক আর নাই?

তোমার অবস্থা খারাপ—তুমি সাধু, তুমি মহৎ, তুমি জ্ঞানী, তুমি সংসারের কাজ করতে লজা বোধ করা না-আমি তোমাকে হীন মনে করি না।

কোন এক স্কুলের ছাত্র ডিসেম্বর মাসে ধান কেটে যে পয়সা পেতো তা গরীব ছাত্ৰাদিগকে দান করতো। এ দৃষ্টান্ত কি খুব মহৎ নয়?

গ্রামের ভিতর এক দুঃখীর ঘর দিয়ে বর্ষার জল পড়ে—আহা! কি কষ্ট। তোমরা দশজন মিলে তার ঘরখানা যদি সেরে দাও, তাহলে তোমাদের সম্মান কমে যাবে না। কিন্তু তোমাদের সে দক্ষতা ও হৃদয়বল নাই।

মানুষকে পয়সা দিয়ে সাহায্য করা কি সব সময়ে সম্ভব? যদিও মৌখিক সহানুভূতির মূল্য এক পয়সা নয়।

মহৎ হতে চেষ্টা কর, অপদাৰ্থ মানুষকে অনুকরণ করে নিজের মনুষ্যত্বকে হীন করো না। শুধু অর্থ ও দালানের সামনে মাথা যেন নত না হয়।

একটা গল্প আছে, নবাবকে বন্দী করতে শক্ৰ আসছে, জুতো পরানোর লোক নাই বলে তিনি পালাতে পারলেন না। এই নবাবকে তুমি কি মনে করা?

একবার শুনেছিলাম, পঞ্চাশ-ষাটজন স্কুলের ছেলে কোদাল-কুড়ি নিয়ে একটা জলের খাল কাটছে। এ কথা যখনই আমি ভাবি, তখনই মনে আমার প্রভূত আনন্দের সঞ্চার হয়। জনৈক মহৎ প্ৰাণ ব্যক্তিকে কলকাতার কুলী-মজুর শ্রেণীর লোকের কাছে সুই, সুতা, চা বেচিতে দেখেছি। স্বভাবে তাঁর কিছুমাত্র অহঙ্কার নাই— আমি এঁকে শ্রদ্ধা করি।

যখন তুমি স্কুলের বালক, তখন পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের অনেক কাজ শিখে রাখতে পার। ছোট একটা বাক্সে একটা হাতুড়ি, একটা বাটালি, একখানা করাত তোমার বইয়ের পাশে থাকলে কোন ক্ষতি নাই। বৈজ্ঞানিক নিউটন যখন বালক, তখন তার বইয়ের পাশে হাতুড়ি করাতের স্থান ছিল। পড়তে মন চায় না, হাতুড়ি নিয়ে কাজ কর। প্রতি রবিবারে তুমি বাড়ীতে যেয়ে একটু ছুতোরের কাজ শিখতে পার। তাতে তোমার সম্মানহানি হবে না।

অপদার্থ মানুষের সমালোচনাকে ভয় করবে। কারা? যারা চিরকাল ছোট হয়ে থাকবে।

তোমার বাড়ীর কাছে কামারের বাড়ী। ক্ষতি কি, যদি তুমি জেনে ফেলো কেমন করে তারা কোদাল তৈরী করে, কেমন করে পোড়ান লাল লোহার উপর হাতুড়ি পিটে তারা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বের করে।

রান্না করতে জানা, পুকুর হতে ঘড়া ভরে জল টানতে পারায় গৌরব ছাড়া আগৌরব নাই। পত্নীর অসুখ, চাকর আসে নাই বলে না খেয়ে ভদ্রলোক সাজতে যেয়ো না।

বাবুয়ানা করে চাকর-চাকরানীর উপর রান্নার ভার দেওয়াতে মর্যাদা নাই।

দাসী না রেখে নিজে কাজ চালান যদি সম্ভব হয়, তবে তাই ভাল। যার বাড়ীতে যত দাসী, সে তত ভদ্রলোক- এই বিশ্বাস অসভ্য জাতির মাথায়ই প্ৰবেশ করে।

সংসার-যাত্রা নির্বাহের জন্য যত প্রকার কাজ শেখা সম্ভব, সে সব শিখে রাখায় আদৌ অমর্যাদা নাই। সত্য ও মনুষ্যত্বের উপরই তোমার মর্যাদার ভিত্তিএকথা সব সময়ে যেন তোমার মনে থাকে। সংসারে চিন্তাশূন্য ব্যক্তিত্বহীন মানুষকে দেখে ভয় পেয়ে না। অপেক্ষা কর, মানুষ শেষে তোমাকেই অনুকরণ করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *