০২. ব্যক্তিত্ব ও শক্তির সফলতা

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ব্যক্তিত্ব ও শক্তির সফলতা

যে যেখানেই থাক, নিজের বলে বড় ও উন্নত হতে চেষ্টা করা। জীবনের সকল অবস্থায় নিজকে বড় করে তোলা যায়-এ তুমি বিশ্বাস করা।

জাতীয়তা ও স্বাধীনতার কথা ভাববার আগে তুমি নিজকে মানুষ করো। মানুষের ব্যক্তিত্বের উন্নতি ও মার্জিত-বিকাশ ছাড়া স্বাধীনতা আর কিছুই নয়। এক ব্যক্তি বলেছেন-স্বাধীনতা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দেশের এক একটা মানুষের আত্মোন্নতির কথা মনে না করে আমি থাকতে পারি না।

তুমি তোমার ব্যক্তিত্ত্বকে দৃঢ় করে তোল। কেউ তোমার উপর অন্যায় আধিপত্য করতে পারে না– একথা দার্শনিক মিল বলেছেন।

তুমি যদি নিজের ক্ষতি নিজে কর, অজ্ঞতা ও পাপে নিজের উপর অত্যাচার আরম্ভ করো, তাহলে কে তোমাকে বড় করবে? তুমি কাজ করাতোমার বন্ধু তুমি-হীন নও। তোমার ভিতরে যে শক্তি আছে, সেই শক্তির চর্চা তুমি কর, তুমি মহামানুষ হতে পারবে।

তুমি ছোট বংশে জন্মগ্রহণ করেছ বলে তোমায় যে ছোট করে রাখতে চায়-সে। বড় ছোট। তুমি মানুষ, তোমার ভিতরে আত্মা আছে, ইহাই যথেষ্ট। বিশ্বাস কর, তুমি ছোট নাও।

খুব বড় বড় রাজরাজড়ারাই যে জগতে কীর্তি রেখে যাবে, এমন কোন কথা নয়। শিক্ষা শুধু ভদ্রনামধারী একশ্রেণীর জীবের জন্য নয়। বস্তুত ভদ্রবেশী বলে কোন কথা নাই। ক্ষুদ্র, ছোট এবং নগণ্য যারা তারাও ভদ্র হতে পারেতাদেরও শক্তি আছে, একথা তারা বিশ্বাস করুক।

শিক্ষা, জ্ঞানালোচনা, চরিত্র ও পরিশ্রমের দ্বারা দরিদ্র মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র তুমি হতে পার। যে অবস্থায় থাক না কেন-জ্ঞান অর্জন করু, পরিশ্রমী হও। মানুষ তোমাকে শ্রদ্ধা করবে। তুমি ব্যবসায়ী, তুমি সামান্য দরজী, তুমি পৃথিবীর এক কোণে পড়ে আছ—তুমি যদি সাধু ও চরিত্রবান হও, সেই অবস্থায় মনের দীনতা ও মূর্থিতা দূর করতে একটু একটু পড় ও বড় বড় লোকদের উপদেশাবলী ও জ্ঞানের কথা আলোচনা কর, দেখতে পাবে, দিন দিন তোমার সকল দিক দিয়ে উন্নতি হচ্ছে-তোমার সম্মান, তোমার অর্থ সবই বেড়ে যাচ্ছে।

মেহের উল্লাহ যশোহর জেলার সামান্য দরজী ছিলেন।

পরীক্ষায় তুমি কৃতকার্য হও নাই, বিদ্যালয় বা কলেজে তুমি ঢুকতে পাের নাই, সেজন্য দুঃখিত হয়ে না। মানুষ চায় চরিত্র, জ্ঞান, ব্যক্তিত্ব ও শক্তি।

মানব-সমাজে, রাস্তাঘাটে, দোকানীর দোকানে, রেলে, স্টিমারে—লক্ষ্য করে পর্যবেক্ষণ কর, তুমি যদি ইচ্ছা কর প্রভূত জ্ঞানলাভ করতে পারবে। নিজের চিন্তা করবার শক্তি জাগিয়ে তােল, দৃষ্টি খুলে যাবে। সে দৃষ্টি দিয়ে সব কিছুর ভিতর-বাহির দেখতে থাক, তুমি মানুষ হবে।

কলেজ তোমার শুধু পথ দেখিয়ে দেয়-সারাজীবন তোমায় দেখতে হবে, শিখতে হবে, জ্ঞানার্জন করতে হবে।

কলেজের কাজ তোমাকে স্বার্থপর, চতুর, অর্থগৃধবু ও তস্কর করা নয়। বাড়িতে দালান দেবে, চাের-দারোগী হয়ে, পুকুর কেটে সমাজে মর্যাদা লাভ করবে। সে জন্য কলেজ নয়। কলেজ তোমাকে জীবনের কর্তব্যপথ দেখিয়ে দেয়; তােমাকে দৃষ্টিসম্পন্ন, কর্তব্যপরায়ণ ও চরিত্রবান, আত্মনির্ভরশীল, বিনয়ী ও সৎসাহসী হতে বলে। কলেজের যে এই লক্ষ্য, তা তুমি ঠিক করে নিয়ে নিজেকে নিজে গঠন করতে চেষ্টা করো। তোমার কলেজে যাবার দরকার হবে না।

কলেজে বা স্কুলে যাবার সুযোগ হলে খুব ভাল। যদি তা তোমার অবস্থায় না। কুলায়, তাহলে নিরাশ হয়ে না। তোমাকে ছোট হয়ে থাকতে হবে না। জীবনের সকল অবস্থায়, সকল বয়সে তুমি চেষ্টার দ্বারা বড় হতে পার। তুমি মানুষ, তুমি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, তোমার পতন নাই, তোমার ধবংস নাই। অর্থ ও পশুসুখের বিনিময়ে জীবনের অপমান করো না।

শেকসপীয়র একজন সামান্য লোকের ছেলে ছিলেন, আমাদের দেশে হলে তাকে ছোটলোকের ছেলে ছাড়া আর কেউ কিছু বলতো না। যে মহামানুষের কাছে সমস্ত ইংরাজ জাতির শক্তি ও সভ্যতা অনেক অংশে ঋণী, তিনি ছিলেন সামান্য লোকের ছেলে। জ্ঞানচর্চার দ্বারা নিজের ব্যক্তিত্ত্বকে তিনি এত বড় আসন দিতে সক্ষম হয়েছিলেন; যার তুলনা পাওয়া কঠিন।

ডাক্তার লিভিংস্টোনের নাম তোমরা জান? লিভিংস্টোন ছিলেন একজন জোলা।

নৌযুদ্ধ বিশারদ স্যার ক্লাউডেসলে শোভেল (Sir Cloudeswly Shovel), তড়িৎ তত্ত্ববিদ স্টার্জন, লেখক সোমুয়েল ড্র, পাদরী উইলিয়ম ক্যারি চামারের কাজ করতেন।

সাধনার দ্বারা এঁরা জগতে কীর্তি রেখে গিয়েছেন। যে কীর্তি শ্রেষ্ঠ মানুষেরা রেখে যেতে পারে না। বস্তুত কর্ম ও কীৰ্তিহীন শ্রেষ্ঠ মানুষের কোন মূল্য নাই।

সমুদ্র উপকূলের এক নগরে এক ইংরাজ বালক কোন এক দরজীর দোকানে কাজ করছিল। নিকট দিয়ে একখানা যুদ্ধ জাহাজ যাচ্ছিল। ছেলেদেরই মতো সে সেই জাহাজের দৃশ্য দেখতে গেল। জাহাজের মূর্তি দেখে সহসা তার ইচ্ছা হলো, সে জাহাজে কোন কােজ নেয়। তাড়াতাড়ি একখানা নৌকা নিয়ে সুচকাঁচির কথা ভুলে বালক জাহাজের অধ্যাক্ষের নিকট উপস্থিত হলো। অধ্যক্ষ বালকের উৎসাহ দেখে চমৎকৃত হলেন এবং তাকে গ্রহণ করলেন। এই সামান্য দরজী বালক শেষে এডমিরেল (Admiral) হয়েছিলেন।

আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক এগুরু জনসনকে এক সময়ে একজন ঠাট্টা করে বলেছিল–দেশমান্য রাষ্ট্রনায়ক হলেও আপনি এক কালে দরজী ছিলেন। নায়ক সে কথায় লজ্জিত না হয়ে বললেন-দরজী ছিলাম, কিন্তু সবসময়েই ঠিক কাজ করেছি, কোন দিন কাউকেই ঠিকাইনি।

তুমি যে কাজই কর না, লজ্জা নাই। লজ্জা হয় অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করায়, ভিক্ষা করায় কিংবা মুর্থ হয়ে থাকায়। জ্ঞান লাভ কর, নিজের ভিতরে যে শক্তি আছে তাই জাগিয়ে তোল, তুমি ছোট হয়ে পড়ে থাকবে না।

নিজকে নিজে বড় কর, জগৎ তোমাকে বড় বলে মেনে নেবে। নিজকে নিজের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র করে তোল-মানুষের শ্রদ্ধা তুমি লাভ করবে। মানুষ কার কাছে মাথা নত করে? কারা পায়ে ভক্তি-অশ্রদ্র ফেলে?

জর্জ স্টিফেনসন ছিলেন কয়লাওয়ালা।

নিউটন চাষার ছেলে। মিলটনের বাবা পোদ্দার।

স্যার হ্যামফ্রে ডেভি বলেছেন–তার উচ্চাসনের কারণ তার চেষ্টা। রাজা এড্রিয়ান যখন বালক, তখন তাঁর পড়বার তেল জুটত না। রাস্তার আলোতে তিনি পড়তেন। এই সহিষ্ণুতা এবং এই সাধনাই তাকে বড় করেছিল–অদৃষ্ট নহে।

ফক্স সাহেব যখন বক্তৃতা দিতে উঠতেন, তখন প্রত্যেক বারেই এই কথা বলে আরম্ভ করতেন—যখনই নরউইচ শহরে তাঁতের কলের চাকর আমি ছিলাম…

ইংলন্ডের বহু মনীষীর জন্মবৃত্তান্ত খুবই হীন। পরিশ্রম ও জ্ঞানার্জন দ্বারা তাঁরা মানুষ হতে সক্ষম হয়েছিলেন। তুমি কেন পারবে না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *