• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

সিদ্ধান্ত – পারভেজ হোসেন

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » গল্প » সিদ্ধান্ত – পারভেজ হোসেন

বইমেলায় আজ একদম ধুলো নেই। গতকাল যে রকম বৃষ্টি হয়েছে তাতে ধুলোই মরেছে শুধু, গাছের পাতারা পরিষ্কার হয়নি। কোথাও একফোঁটা জল জমে পথ কাদা করেনি। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে তুলোর মতো স্বচ্ছ মেঘ আর ঝিরঝিরে ফাল্গুনের বাতাস। রাস্তার কৃষ্ণচূড়াগুলো লাল লাল ফুলে দগ্ধ। শহরে এসবের বৈভব খুব যে ফুটতে পারে তা নয়, বরং ইটপাথরের চাপে, বিজ্ঞাপন আর বিজলির দাপটে কেমন মনমরা হয়ে থাকে।
মানুষের তেমন হয় না। ভেতরে যা-ই থাকুক মানুষ বেরিয়ে পড়ে। সেজেগুজে যেন শুধু হাঁটতেই বেরোয়। কোনো উৎসব অথবা পার্বণ যেটাই সামনে পায় মানুষ ঘরদোর ছেড়ে সমস্ত মনমরাকে, মনোবেদনাকে পায়ে দলে নেমে পড়ে।
যেমন আজ সাত দিন পর ঘর থেকে বেরোল আনু। নতুন একটা শাড়ি পরে কালো কপালে কুচকুচে কালো টিপ আর হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে, খোলাচুলে যখন গেট পার হলো সে, বাইরের অদ্ভুত খোলা নীল আকাশ আচমকা আহ্বানে সব কেড়ে নিল তার। এমন একটা বিকেল যেন এইমাত্র দেখছে। দীর্ঘ গ্রীবার এলোমেলো চুলে আঙ্গুল চালায় আনু, রিকশা ডাকে। বইমেলায় যাবে। কত দিন নতুন কোনো বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টায়নি। কী করে ওল্টাবে? নিজেই যে উল্টে থাকে।
মধ্যমেলায় ঠাসাঠাসি একটু থাকলেও উপচেপড়া ভিড় নেই। স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে বইপত্র ঘেঁটে দেখা যায়। আনু ঘুরতে ঘুরতে বয়রাতলায় চক্কর খেয়ে পুকুরের পশ্চিম পাড়ের কম ভিড়ে আনমনে কিছুক্ষণ হাঁটে, মানুষ দেখে, বই দেখে আবার মেলার মূল ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে মাইকে বেজেচলা পুরোনো দিনের একটা গ্রাম্যগানে মন দেয়। গানগুলোর প্রাণে এত জোর যে বহুকাল পার হয়েও এত জীবন্ত এত বিদগ্ধ-পুড়ে যাওয়ার আর্তির তাপ হৃদয়ে ছাঁৎ করে লাগে।
এ রকম ভিড়ের মধ্যেও কেমন একলা হয়ে পড়ে। তা ছাড়া পরিচিত কারও সাথেই তো দেখা হলো না। চারদিক আঁধারে ছেয়ে না যেতেই মেলাজুড়ে বাতিগুলো পটাপট সব জ্বলে উঠেছে। খোলা আকাশের নিচে, উঁচু উঁচু সব বৃক্ষের তলায় দিন আর রাত্রির পার্থক্য বিজলির আলো দিয়ে বাঁধা যায় না।
বর্ধমান হাউসের সিঁড়ির এক কোণে দেয়ালে হেলান দিয়ে একটু আরাম করে বসে আনু। দীর্ঘ শরীরে এতক্ষণ টানা হাঁটাহাঁটির ক্লান্তি শুধু। লম্বা অবসাদ ভেঙে গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ানো মেয়েটির দেহে এটুকু ক্লান্তি স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক হয়তো এই-নৈমিত্তিক জ্বালা থেকে, এক অব্যক্ত গা ঘিনঘিন করা পরিবেশ থেকে, সত্যমিথ্যার নানা কুহক থেকে নিজেকে টেনে তুলে সমাজ ও সংসারের গূঢ়-গাঢ় বন্ধন ছিঁড়ে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো একটা সিদ্ধান্ত নিতে পেরেও সে কী করে গোটা বছর ধরে ক্রমান্বয়ে কর্মহীন, বন্ধুহীন, পরিজনহীন হয়ে মায়ের ঘরে নিজেকে কোণঠাসা করে রাখল? এক বছর হয়ে গেল, না এক যুগ! গত মেলায়ও একসঙ্গে ঘুরেছে ওরা। যত তিক্ততাই থাক বাইরে ওদের মেলামেশাটায় তার ছায়া পড়ত না। আনু এমন একটা মেয়ে যে হাসলে-কাঁদলে কিংবা আমোদ করলে চারপাশের চোখে পড়ত। স্বাভাবিক বাঙালির তুলনায় দীর্ঘাঙ্গী সে, চটপটে, কালো রঙের মোহ ছড়ানো লাবণ্যে সিক্ত। আর আদনান একটু ভারী, গোছানো মানুষ-মুখে সারল্যের ছায়ায় যা ঢেকে থাকে। ওরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল এটা বলা যায় না। আদনানই বরং লেগে ছিল তিন বছর। মাঝে মাঝে এমন করত লোকটা ওর মতো গম্ভীর স্বভাবের পুরুষের হ্যাংলামোতে বিরক্ত হতো আনু। ভাবত, ব্যাটাগুলো যে কী-যেন ওরা ছুঁতে পারলেই বাঁচে। কেমন তৃষ্ণা নিয়ে ছটফটায়। এমন একটা ভাব করে যেন সব উজাড় করে হলেও মেয়েটাকেই চাই। এ কেমন চাওয়া, এ কেমন প্রেম-তল পেত না আনু। তখন আরও মরিয়া হতো আদনান। পৃথিবী রুগ্‌ণ আর অসাড় হয়ে উঠত। পরিস্থিতির পুরো চাপটাই তখন গিয়ে পড়ত আনুর ওপর-শত হলেও বন্ধু তো! বন্ধুর দায় একসময় আর এড়াতে পারে না সে। আদনানের মিনতির কাছে কোমল হয়ে বিয়ে করে ফেলে আনু।
এরপর দাঁত কামড়ানো পাঁচটা বছর। বুক চিরে বানানো পথে পিচ ঢালাইয়ের মতো সেঁটে গেল ‘মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর নিতান্তই মাটির মনে হয় সোনার মোহর!’ সিঁড়ি ছেড়ে উঠে পড়তে চায় আনু কিন্তু বল পায় না, তবুও ওঠে। ভাবে, আসলেই কি সে সোনার মোহর? আদনান সত্যিই কি পেয়েছিল তাকে? পাওয়াটা কী? সত্যিই কি কাউকে কেউ পায়?
ভিড় ঠেলছে, এর-ওর গায়ে ধাক্কা লাগছে কিন্তু কিছুই যেন টের পাচ্ছে না আনু। সে হাঁটছে উত্তরে না দক্ষিণে, পুবে না পশ্চিমে? এত কোলাহল, মাইকে কান ফাটানো বই বিজ্ঞাপন, ঝকঝকে আলো, মিডিয়ার ক্যামেরা ঘিরে জটলা সব ফেলে হাঁটছে আনু-কিন্তু এ কোথায় এসে থমকে দাঁড়াল সে?
আসলে পথ আগলে ছিল আদনান, কেমন আছ আনু? প্রায় তের মাস পর এমন একটি কণ্ঠস্বরে সম্বিত ফেরে ওর। স্বাভাবিক হতে সময় লাগে। বলে, ভালো, তুমি?
এই যেমন রেখেছ।
উত্তরটায় আছাড় খায় আনু। এক ফোঁটাও বদলায়নি লোকটা। আট বছর ধরে তো দেখেছে। ওর হাড়-মাংসে গোঁয়াতুêমি ভরা। কী বলবে ভাবতে সময় দেয় না আদনান। বলে, চলো ওই দিকটায় গিয়ে দাঁড়াই, কফি খাবে না আইসক্রিম?
কোথাও যাবে না কিচ্ছু খাবে না সে, কোনো কথাও শুনবে না শুধু চলে যেতে চায় আনু কিন্তু পারে না। হাত ধরে টেনে না হলেও প্রায় আগলে ওকে নিয়ে কফি কর্নারের কোনায় আসে আদনান। অর্ডার দেয়। এখানে খাবার পেতে সময় লাগে। বিরক্তিকর অপেক্ষা। হু হু হাওয়া বইছে। চুল এলোমেলো করা আউলা বাতাস। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে ভেতরে গুমরানো অস্থিরতা একটু শান্ত হতেই কফি আসে। ব্যাগ খুলে ছোট্ট বোতলের পানি খায় আনু, কফির গরম গ্লাস হাতে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।
দুই·
চাকরিটা কি ছেড়েই দিয়েছিলে?
হ্যাঁ। কোর্ট থেকে ফিরে সাত দিনের মাথায় ওটা ছেড়েছি। ওভাবে অফিস করা যায়? আর পারছিলাম না। আমি চলে আসাতে ওরাও হয়তো বেঁচে গেছে। প্রতিদিন একটা না একটা ঝামেলা।
আজ অসুস্থ, কাল দেরি, পরশু মন খারাপ, কাজে ভুল-ভাল হয়ে বসের ধমক। তখন তো প্রায়ই লেগে থাকত দুজন আর ওসব তারই প্রভাব, কাজের মানুষের জন্য যা একদম বাড়াবাড়ি, অযৌক্তিক, অন্যায়। বেশি দিনের কথা নয়। একদিন একদিন করে আদনানের সব মনে পড়ে। ও তখন করত না কিছু। অন্য সবকিছুর সঙ্গে সেটাও একটা বড় কারণ ছিল হয়তো। তা ছাড়া আনুর কাছে যখন-তখন হাত পাততে হতো। আনু এ নিয়ে কখনো কিছু বলেনি তো! তবুও ছোটখাটো কথা দিয়েই যা শুরু শেষটা আর সেখানে থাকত না। স্পষ্ট মনে আছে আনুর, প্রায়ই সে বলত, মনমতো একটা চাকরি তুমি খোঁজো, কত অভিজ্ঞতা তোমার, চার বছর টানা কত ভালো কাজ করেছ, একটা দুর্ঘটনায় না-হয় চাকরি ছেড়েছ, তাতে কী? সময় লাগে লাগুক তুমি কাজ খোঁজো। আমি যা আয় করছি চালিয়ে নেব তত দিন।
রোজ তোমার কাছে টাকা চাই সেটা যে বেশ ভালো লাগে তোমার তা আমি বুঝি না, না?
অপ্রস্তুত আনুর মুখ ফসকেই কথার পিঠে কথা বেরিয়ে গেল কি না কে জানে, তা হলে নাও কেন? বাপ-মায়ের কাছে চাও।
এ কথায় কেন বাপ-মা এল-এই একটা বিষয় নিয়ে সেদিন আর অফিস যাওয়া হলো না আনুর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত চলল। ভাত খেতে ডাকতে গিয়ে অকথ্য কথার সূত্র ধরে থাপ্পড় খেল আনু। আদনানের হাত সে-ই প্রথম উঠল ওর গায়ে।
রাতে আদনান আনুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল, তোমার গায়ে হাত তুলেছি, আমি একটা বজ্জাত লোক। আজও সেই কথা তুলে চোখ কোমল হলো আদনানের।
রাত্রের ভিড়টা কমতে শুরু করেছে কেবল। ওরা বসেছিল মাসকাবারি অনুষ্ঠানমালার মঞ্চের পাশে কাঁঠালগাছের নিচে, ঘাসে। পুরো মেলায় এই একটুখানি জায়গা যেখানে বসা যায় কিন্তু কেউ বসে না, কেননা জায়গাটা অন্ধকার আর পাশেই ওয়াসার গাড়ি। পানি পড়ে পড়ে ওদিকটা কাদা হয়ে আছে।
আদনানের ধরা গলা আর আর্দ্র চোখ আনুর দৃষ্টি এড়ায়নি। কত কথা মনে ভাসছে। ছেঁড়া ছেঁড়া বিক্ষিপ্ত সেসব অতীত এড়িয়ে যেতে পারল না সে। বলল, শোচনায় যে ভোগোনি তা নয় কিন্তু হাতাহাতিটা বন্ধ হলো কই? তোমার গায়ে হাত তুলে আমারও কি কম যাতনা হয়েছে? নিজেকে কতবার ধিক্কার দিয়েছি। আজ থাক ওসব। অন্য কথা বলো। তোমার চাকরি এখন কোথায়?
কোথাও না। বেকার। ঘুরে বেড়াই।
এভাবে পারছো থাকতে? তোমার বাবা-মা ভাই-বোন?
ওদের সাথেই আছি, বলে কেমন স্তব্ধ হয়ে যায় আদনান।
মঞ্চের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। চারদিক এখন অনেকটা নীরব। ওরা পরস্পরের কথাগুলো বেশ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। আনু বলে, তোমার মতো মানুষ, কারও কাছে হাত পাততে যার এত দ্বিধা, কিছু না করে চলছে?
ওসব নিয়ে আর ভাবনা হয় না। দিন চলে যায়। কেমন নির্বিকার আদনান কথাগুলো বলে যায়। বলে, তবে কি জান, কোর্টের সিঁড়ি থেকে নেমে, তুমি তখনো রিকশা পাওনি, আমার দম আটকে আসছিল। মনে হচ্ছিল দৌড়ে গিয়ে তোমাকে বলি, আনু, আমার কথা শোনো···
কী শোনাতে চেয়েছিলে? ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে আনু, তোমার কথা তো কম শুনিনি, কী হয়েছে শুনে?
ওর গলায় মৃদু ঝাঁঝ। একটা তপ্তশ্বাসও আলগোছে বেরিয়ে যায় যেন! আদনান আর কিছু বলে না, আনমনা চেয়ে থাকে। চোখ নামায় আনু। পরিচিত মুখটা এত অপরিচিত হয়ে গেছে যে ঠিকভাবে তাকাতে সাহস হয় না। একটা শুকনো কাঠি দিয়ে ঘাসের গোড়া খুঁচতে খুঁচতে বলে, আমিও তোমাকে কম ত্যক্ত করিনি আদনান। এত সাবধান হয়েছি যাতে পেটে বাচ্চা না আসে। তুমি এত উতলা হয়েছিলে কেন জানি না। কী জানি তোমার কী মনে হয়েছিল। আমাকে আটকাবার ওই একটা পথই হয়তো জানা ছিল তোমার। সত্যি কি আমি উড়াল দিতে চেয়েছিলাম? তুমি কি ওরকম ভেবেছিলে কিছু?
চোখ বড় বড় করে তাকায় আদনান, তুমি তাহলে ইচ্ছে করে···
না ঠিক তা নয়, আসলে তোমাকে ভরসা করতে পারিনি। কোনো ভরসা দাওনি তুমি। মাকে, বোনকে, আত্মীয়স্বজনকে উপেক্ষা করে বিয়ে করেছিলাম তোমার কারণেই। আমার আর কী অবলম্বন ছিল বলো? তোমারও কি সত্যি কোনো আস্থা ছিল আমার ওপর? শুধু পেতে চেয়েছ, নিংড়ে নিংড়ে ব্যবহার করতে চেয়েছ।
মাটি খোঁচাতে থাকা কাঠিটা কেড়ে নিয়ে ওর একটানা কথাগুলো সরিয়ে নেয় আদনান। বলে, সবকিছু এইভাবে ভাবাটা তোমার একটা রোগ। দিন দিন তুমি মানসিক রোগী হয়ে উঠছিলে।
হয়তো তাই। কেমন রাগ উঠতে থাকে আনুর। আজকাল এমন হয়েছে অল্পতেই ধৈর্য হারায়। বিবেচনাও কি হারায়? সামান্য মমতা? ব্যাগের চেইনটা টেনে, খুলে রাখা স্যান্ডেল কুড়িয়ে উঠে পড়তে চায় সে। শাড়ির পাড়ের একটা অবাধ্য সুতা পায়ের আংটিতে জড়িয়ে গেলে নুয়ে পড়ে প্যাঁচ খুলতে যায়। আচমকা হাত ধরে টেনে বসায় আদনান, রাগছ কেন, আর একটু বসো। আর এই হাত ধরতে গিয়েই ভেতরটা যেন দুলে যায় আদনানের। প্রাণটা আধখানা হয়ে পড়ে, এই স্পর্শের মধ্যে তা অপ্রকাশ্য থাকে না।
মুঠো থেকে কবজি ছাড়াতে ছাড়াতে বসে আনু। ধাতস্থ হয় আর ভাবে, কেমন অসহায় হয়েছে লোকটা। কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না, মাকে সরল শিশু যেভাবে আটকায় সেভাবেই যেন ওকে আটকাল।

মেলার স্টলে বই গোছানো শেষ করে পর্দা ঝোলাচ্ছে অনেকেই। মঞ্চের এদিকটা প্রায় জনশূন্য। সব গেট বন্ধ হয়েছে বলে দোকানিরা শুধু মূল পথ দিয়েই বেরোবে। সারা দিনের সমস্ত কোলাহল আবার জমে উঠবে কাল, এভাবে পুরো মাস, ফিবছর।
গত মেলায় তো আমরা প্রায় রোজই এসেছি তাই না? আদনান জিজ্ঞেস করে।
আমি রোজ না এলেও তুমি হয়তো আসতে। অফিস থেকে ফিরে প্রতিদিন ভালো লাগত না।
মেলায় আসাটা নেশার মতো, এক মাসের আশ্চর্য নেশা! গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে আমার, বোতলটা একটু দেবে?
আনু ওকে দিতে যেয়ে দেখে বোতলে এক ঢোঁক পানিও নেই। ব্যাগ ঘেঁটে একটা আমসত্ত্বর স্টিক বাড়িয়ে বলে, খাবে?
আদনান দাঁত দিয়ে আমসত্ত্ব পলিটা ছিঁড়তে চায়, পারে না। স্টলগুলোর বাতি নিভল যখন পুরো প্রাঙ্গণের চেহারাটাই বদলে গেল মুহূর্তে। ঘনসবুজ গাছগুলোর মাঝে জ্বলে থাকা টিউবের আলো থম ধরে থাকলেও বাতাসে পাতারা চিকচিক করে দুলছে। দুজন গার্ড এসে উঠিয়ে দিলে ওরা হাঁটতে হাঁটতে এসে বটতলার বেদিতে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।
আদনান বলে, মনে হচ্ছে শাড়িটা তুমি পরনি কখনো।
বুঝলে কী করে? তোমার মনে আছে?
অনেক ঘুরে কিনেছিলাম, তাও আবার আপার কাছ থেকে টাকা ধার করে।
ধার করেছিলে?
হ্যাঁ, টাকা পাব কোথায়?
আনুর সব মনে পড়ে। এই তো সেদিন, ওর অফিসে একটা চিঠি পেল। পাঁচ হাজার টাকা বেতন বেড়েছে। একটা বেশ গর্ব নিয়ে আনন্দে বাড়ি এল। কথাটা বলল, রাতে, শুতে গিয়ে। আদনান গম্ভীর হয়ে শুনল। খুশি হলো। ঘুমাল। কিন্তু পরদিনই এই কাণ্ডটা করেছিল সে। বরাবর এ রকম একটা অভ্যাস ওর ছিল। কোনো আনন্দে ছোট কি বড় একটা উপহার যে করেই হোক নিয়ে আসত সে। আনু বলত, মেয়ে পটাতে তোমার মতো ওস্তাদ কেউ নেই। সেদিনও ও এনেছিল, এই শাড়িটা।
আসলে তুমি এত ফরমাল, বলে আনু।
আদনান বলে, আমার ভালো লাগে কিন্তু সেদিন ওরকম হবে বুঝিনি। সরি হয়েছিলাম তো।
সরি বললেই সব সেরে যায় না আদনান। তুমি তো জানতে ওদিন ছিল আমার বাবার মৃত্যুদিন। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। সারা দিন বাবার জন্য দোয়া করেছি। ডায়েরি বের করে লিখেছি। বিকেলে বাবার কবরে গিয়েছি। সন্ধ্যায় আমার এত খারাপ লাগছিল, হু হু কান্না থামাতে পারছিলাম না। তুমি তো জান বাবা আমার কী ছিল। তোমাকে তো লুকাইনি কিছু। আর সেই তুমি রাতে ফিরে আনন্দে আটখানা হয়ে নতুন শাড়ি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে তোমার চাহিদা তুমি মেটালে। শাড়িটা পরা দেখে আজ তুমি কী ভেবেছ জানি না, তবে চাকরি ছাড়ার পর একটা সুতাও আমি কিনিনি। মেলায় আসব, নতুন কাপড় বলতে এই শাড়িটাই হাতের কাছে পেয়ে কোনো কিছু না ভেবেই পরেছি। বলতে বলতে বুক উথলে উঠলে কেঁদে ফেলে আনু-বিশেষ করে বাবার প্রসঙ্গে বরাবর ও এ রকম। আদনান তা জানে আর জানে বলেই এ মুহূর্তেও কিছু বলে উঠতে পারে না।
শাড়ির আঁচল টেনে চোখ চাপে আনু। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, সরি। ভয় পেয়ো না, আমি অনেক শক্ত হয়েছি এখন।
না, না, বলো, বলেও যদি তোমার হালকা লাগে।
হালকা লাগবার জন্য নয় আদনান। আর এসব যে তুমি জানো না তাও তো না। তোমার সাথে আমার এমন কিছু নিয়ে কিছু হয়নি যা তোমার অগোচর, যা তুমি শোনোনি। কিন্তু তোমার বিবেচনা হয়নি। কোনো দিন তুমি বোঝোনি যে আর একটা লোককে বুঝতে হয়। নিজের বাইরে তুমি তাকাতে শেখোনি। এত বুদ্ধি এত পড়াশোনা সেই তুমি কিনা···
অক্নাৎ গার্ডের হুইসেল বেজে উঠতেই কথা থেমে যায় আনুর।
গেট বন্ধ করে দেবে, যাই।
আদনান বলে, না বলো, যা বলতে চেয়েছিলে বলো।
কী আর বলব, সবটাই তো পুরোনো কাসুন্দি। আমার একলার প্রলাপ।
হোক প্রলাপ, আমি শুনতে চাই।
নিজেকে খানিকটা দৃঢ় করেই দাঁড়ায় আদনান।
কথায় কথা বাড়বে শুধু। ঝগড়া হবে। পুরোনো সত্য খুঁচিয়ে কী লাভ! তা ছাড়া কী বলতে কী বলব, আবার তোমাকে সরি বলতে হবে।
আদনানের অবিশ্বাস হয় না যে, ওদের তিক্ততাটা বেড়েই গিয়েছিল। সামান্যতেই এমনসব নাজুক ঠোকাঠুকি হতো, পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্মানের কিছু অবশিষ্ট ছিল কি?
আনুও ভাবে, এক ছাদের নিচে পাঁচটা বছর কত কী নিয়ে কত তাড়াতাড়ি কেটে তো গেছে! তবুও কেন অত অধীর হলাম? বিযুক্তির পূর্বরাতে খাবার টেবিলে সিদ্ধান্তটা হয়েই গেল! কিন্তু সেকি মুহূর্তের ব্যাপার? বিয়ের রাতে যে লোকটা তিন-তিনবার সেক্স করে গাঢ়-গভীর ঘুমে ডুবেছিল, জ্বরে কাঁপা মেয়েটার কথা মনেও করেনি, অসুখ কি তখনই বাসা বেঁধেছিল? নিজেকে বোঝাতে পারে না আনু। বলে, এটা তো ঠিক স্বেচ্ছায় আমরা আমাদের জীবন বেছে নিয়েছি! হয়তো তাই। বলে আদনান। তারপর মাথা নাড়িয়ে শোনা যায় না এমন কিছু স্বগতোক্তি করে। সেই শূন্যতাটুকু আনুর কাছে অজান্তে পৌঁছয়।

গার্ডের বারবার হুইসেলে ওরা আর দাঁড়াতে পারে না। আকাশে একটাও তারা নেই। আজও বৃষ্টি হতে পারে, হলে রাস্তায় কিছু জুটবে না যে। বাড়ি ফেরাটা মেলা ঝক্কির হবে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১২, ২০০৯

Category: গল্পTag: পারভেজ হোসেন
Previous Post:স্মৃতি-বিস্মৃতির বিটিভি – মুস্তাফা জামান আব্বাসী
Next Post:বইপত্র – মশিউল আলম

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑