• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৯. নৌকার দোলনে দুলিয়া

লাইব্রেরি » মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় » পুতুলনাচের ইতিকথা (উপন্যাস) » ০৯. নৌকার দোলনে দুলিয়া

নৌকার দোলনে দুলিয়া চুলিয়া কুসুমের বাবার ঘুম আসে। কুসুম ছইয়ের মধ্যে পিছনে হালের দিকে তাহার শোবার ব্যবস্থা করিয়া দিল। সে ঘুমাইয়া পড়িলে শশীকে ডাকিয়া বলিল, হঠাৎ আমাকে বাপের বাড়ি পৌঁছে দেবার শখ হল কেন শুনি?

বলিয়া মৃদু হাসিল কুসুম।

শশী বলিল, তুমি ভাবছ কাজ নেই, না? তোমার জন্য যাচ্ছি শুধু? উকিলের সঙ্গে দেখা করব।

মামলা আছে বুঝি?

মামলা তো দুটো-একটা লেগেই আছে, সেজন্য নয়। কী কারণে যেতে লিখেছেন, জরুরি। তবে আজ না-গেলেও চলত।

কুসুম একটু হাসিল।

আড়চোখে একবার বাপের দিকে চাহিয়া কুসুম বলিল, আমার জন্য এলেন আজ, না?

শশী বলিল, হ্যা।

গভীর সুখে কুসুমের মুখখানা উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। তবু নিশ্বাস ফেলিয়া দুঃখের সঙ্গেই বলিল, ভেবেছিলাম বাপের বাড়ি গিয়ে কমাস থাকব, তা আর হবে না বুঝতে পারছি।

আশ্চর্য চরিত্র কুসুমের! এতক্ষণে শশী একটু লজ্জা বোধ করিলা সেদিন রহস্য সৃষ্টি করে নাই কুসুম। ওরকম বাঁকা তার মনের কথা বলিবার ধরন। সে কিছু বুঝিবে না, কিছু মানিবে না। কেন ভাবিয়া মরে শশী? সেদিন কুসুমের ব্যবহারের মানে ছিল শুধু এই। আর এক বিষয়ে শশী বিস্মিত হয়! সেদিন সে গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া যাইবার কথা বলিয়াছিল। সে সম্বন্ধে কুসুমের কি বলিবার কিছু নাই? কথাটা সে বিশ্বাস করে নাই নাকি?

বাজিতপুরের ঘাটে নৌকা বাঁধিয়া শশী নামিয়া গেল। গোবর্ধনকে বলিয়া দিল, কুসুমকে বাপের বাড়ি পৌঁছাইয়া দিয়া বিকালে যেন নৌকা আনিয়া ঘাটে রাখে।

বাজিতপুরের সিনিয়র উকিল রামতারণবাবুর কাছে মকদ্দমা উপলক্ষে শশীকে মাঝে মাঝে আসিতে হয়, এবারেও দেখা করিবার জন্য দিনতিনেক আগে তার একখানা চিঠি পাইয়া শশীর কোনো অসাধারণ প্রত্যাশা জাগে নাই। ব্যাপার শুনিয়া খানিকক্ষণ তাই সে বিস্ময়ে হতবাক হইয়া রহিল। দশটা গ্রামকে বিচলিত ও উত্তেজিত করিয়া যাদব মরিয়াছেন, কিন্তু আরও যে চমক তিনি সঞ্চিত করিয়া রাখিয়া গিয়াছেন সকলের জন্য, শশী তো তাহা ভাবিতেও পারে নাই।

গ্রামে একটি হাসপাতাল করার জন্য যা-কিছু ছিল যাদবের, সব তিনি দান করিয়া গিয়াছেন। ব্যবস্থার ভার শশীর, দায়িত্ব শশীর।

কী ছিল যাদবের? হাসপাতাল করার উপযুক্ত দান হিসাবে অত্যধিক কিছু নয়, যাদবের দান হিসাবে বিস্ময়কর, প্রচুর। হাজার পনেরো টাকার কোম্পানির কাগজ, বারো-তেরো হাজার নগদ, আর যেখানে যাদব বাস করিতেন সেই বাড়ি ও জমি। এত টাকা ছিল যাদবের? পুরানো ভাঙা বাড়িটার সাতস্যাতে ঘরে যাদব ও পাগলদিদির সাদাসিধে ঘরকন্নার ছবি শশীর মনে পড়িতে লাগিল, ক-খানা বাসন, মাটির হাড়িকলসি, কাঠের জীর্ণ সিন্দুক-গৃহসজ্জার অভাবজনিত দীনতা। তাও অপূর্ব ছিল সত্য,– সে ঘরের পরিচ্ছন্নতা, ধূপগন্ধী শান্ত আবহাওয়া চিরদিন শশীকে অভিভূত করিয়াছে, কিন্তু টাকার ছাপ তো কোথাও ছিল না সেই গৃহী সন্ন্যাসীর গৃহে!

রামতারণের বয়স হইয়াছে। আদালতে যাওয়া তিনি অনেক কমাইয়া ফেলিয়াছেন। ভোর চারটেয় উঠিয়া আহ্নিক করিতে বসেন,–মানুষটা ধাৰ্মিক। বলিলেন, স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করবেন এরকম একটা খবর কানে এসেছিল, গুজব বলে বিশ্বাস করিনি। নইলে একবার দেখতে যেতাম। এখন আপসোস হয়। কতবার পায়ের ধূলো দিয়েছেন, এর বড়ো মহাপুরুষ ছিলেন জানলে পরকালের কিছু কাজ করে নিতাম। এসেছেন গিয়েছেন, টেরও পাইনি কী জিনিস ছিল তার মধ্যে।

শশী বলিল, অনেকে সিদ্ধপুরুষ বলত।

তাই ছিলেন। এমন আত্মগোপন করে থাকতেন, বুঝবার কোনো উপায় ছিল না। আগে যদি জানতাম!

অনেক কথা হয়, অনেক আলোচনা, অনেক পরামর্শ। রামতারণের ছেলে, জামাই, মুহুরি, আমলারা চারিদিকে ঘিরিয়া আসিয় স্তব্ধ বিস্ময়ে শশীর কথা শুনিয়া যায়। যাদবের দেহত্যাগের বর্ণনা শুনিতে শুনিতে রামতারণ আবেগের সঙ্গে বলেন, মরছে সবাই, অমন মরণ হয় কজনের? অসুখ নেই বিসুখ নাই, ইচ্ছা হল আর দেহ ছেড়ে আত্মা অনন্তে মিশিয়া গেল। তোমার ডাক্তারি শাস্ত্রে একে কী বলে শশী?

কী বলবে? কিছুই বলে না।

রামতারণ আরও আবেগের সঙ্গে বলেন, কোথেকে বলবে? ভারতবর্ষ ছাড়া জগতের কোথায় আছে এ জ্ঞান? ভাবলেই গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। দুপাতা ইংরেজি পড়ে এসব আমরা অবিশ্বাস করি, ফাকি বলে উড়িয়ে দিই-কই এবার বলুক দেখি কেউ কোথায় এতটুকু ফাকি ছিল? নিজে তুমি ডাক্তার মানুষ আগাগোড়া দাড়িয়ে সব দেখেছ। যাও শশী, সমস্ত বিবরণটা লিখে কাগজে ছাপিয়ে দাও, পড়ে মতিগতি একটু ফিরুক মানুষের।

অল্পবয়স হইতে এ-বাড়িতে শশীর আনাগোনা আছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করিয়া এখানেই সে বিশ্রাম করিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে শহরে আসিয়া যাদব শেষ উইল করিয়া গিয়াছিলেন। প্রাণ ও মন বাঁচানোর জন্য পালানোর পরামর্শ দিয়া যেদিন শশী তার বকুনি শুনিয়াছিল, তারও পরে। মরিবার জন্য যাদব হয়তো সেই সময়েই মনস্থির করিয়াছিলেন, তার আগে বোধহয় নয়! শশী আজ সব বুঝিতে পারে। যেরকম অপূর্ব ও লোভনীয় হইয়া উঠিয়াছিল মরণ, মানুষ কি সে লোভ ছাড়িতে পারে? নিজে দাঁড়াইয়া সব সে দেখিয়াছিল আগাগোড়া, মরণ এবং কারণ চিরদিনের জন্য তারই মনে গাঁথা হইয়া রহিল।

তাকে জড়াইয়া গেলেন কেন? সে স্লেচ্ছ নাস্তিক, শেষপর্যন্ত সে অবিশ্বাস করিয়া আসিয়াছে যাদবের অলৌকিক শক্তিতে; তবু হাসপাতাল করার ব্যাপারে তারই হাতে সমস্ত কর্তৃত্ব ছাড়িয়া দিয়া গেলেন। তাকে বিশ্বাসী করার জন্য কী ব্যাকুলতা ছিল যাদবের, শশীর সে কথা মনে পড়ে। মানুষটার চরিত্রের কত আশ্চর্য দিক যে একে একে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে থাকে। এই উইলের বিষয় তাকে কিছু না-জানানো, এও এক অসাধারণত্ব যাদবের। জানাইয়া গেলে ভার গ্রহণ করিতে সে অস্বীকার করিতে পারিত না, তবু যে যাদব জানান নাই তার কারণ হয়তো আর কিছুই নয়,-এতগুলি টাকা তার অধিকারে রাখিয়া যাওয়ার জন্য যদি তার সহজ ব্যবহারের ব্যতিক্রম হয়? কৃতজ্ঞতায় হোক আর যে কারণেই হোক, মন-রাখা কথা যদি শশী বলে? শেষ কয়েকটা দিনে তার যোগসাধনার ক্ষমতায় শশীর বিশ্বাস জন্মিলে যদি বুঝিতে না পারা যায় ও-বিশ্বাস স্বতোৎসারিত, এর পিছনে আর কোনো পার্থিব বিবেচনার প্রেরণা নাই?

বিকালে গোবর্ধন আসিল। গ্রামে ফিরিতে হইয়া গেল রাত। শশীর কাছে সমস্ত কথা শুনিয়া বিস্ময়াবিষ্ট গোপাল বলিল, এত টাকা লোকটা পেল কোথায় রে, এ্যা?

বড়লোকের ছেলে ছিলেন বোধ হয়।

ওয়ারিশ থাকিলে খবর পেয়ে তারা বোধহয় গোলমাল করবে শশী, মামলা মোকদমা না করে ছাড়বে না সহজে। তুই না বিপদে পড়িস শেষে।

আমার কিসের বিপদ? আমাকে তো দেননি টাকা! এসব উইল সহজে ওলটায় না।

গোপাল অকারণে গলা নিচু করিয়া বলিল, কারো কাছে হিসাবনিকাশ দিতে হবে না তোকে?

শশী বলিল, টাকাপয়সার ব্যাপার হিসাবনিকাশ থাকবে না? তবে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে না কারো কাছে। আমার খুশিমতো তিনজন ভদ্রলোককে বেছে নিয়ে কমিটি করব, তারা শুধু আমাকে পরামর্শ দেবেন,–সববিষয়ে কর্তৃত্ব থাকবে আমার।

এত খাটবি-খুটবি, তুই কিছু পাবি না শশী?

হাসপাতালের ডাক্তার হিসাবে ইচ্ছা করলে কিছু মাইনে নিতে পারব।

সমস্ত রাত ভাবিয়া পরদিন গোপাল বলিল, দ্যাখ শশী, তুই ছেলেমানুষ, এসব গোলমেলে ব্যাপারে তোর থেকে কাজ নেই,–এসব নিয়ে থাকলে ডাক্তারি করবি কখন? হাঙ্গামা তো সহজ নয়! তার চেয়ে আমার হাতে ছেড়ে দে সব, আমি সব ব্যবস্থা করব। গাঁয়ের হাসপাতাল হবে, এতসব বয়স্ক বিচক্ষণ লোক থাকতে সব ব্যাপারে ছেলেমানুষ তুই তোর কর্তৃত্ব থাকলে সকলে চটে যাবে শশী, শক্রতা করে সব পক্ষ করে দেবে। তুই সরে দাঁড়া।

শশী বলিল, তা হয় না।

হয় না? কেন হয় না শুনি? তুই বুঝি অবিশ্বাস করিস আমাকে?

শশী এবার বিরক্ত হইয়া বলিল, অবিশ্বাসের কথা কোথা থেকে আসে? আর কারোকে ভার দেবার অধিকার নেই। আমি দায়িত্ব না নিলে গভর্নমেন্টের হাতে চলে যাবে।

গোপাল বোধহয় কথাটা বিশ্বাস করিল না। পরদিন সে চলিয়া গেল বাজিতপুর। ফিরিয়া আসিয়া বলিল, উইলটা দেখে এলাম শশী। সব দায়িত্ব তোকে নিতে হবে, কিন্তু কাজের কনট্রাক্ট তুই যাকে খুশি দিতে পারিস, তাতে কোনো বাধা নেই। তাই দে আমাকে। এজেন্ট করে নে আমায়।

শশী বলিল, কোথাও কিছু নেই, আগে থেকে আপনি এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন?

গোপাল বলিল, ব্যস্ত কি হই সাধে? তুই ছেলেমানুষ, কী করতে কী করে বসবি–

আপনার সঙ্গে পরামর্শ করেই করব।

একজন সৎকাজে যথাসর্বস্ব দান করিয়া গিয়াছে, আর একজন তাতে কিছু ভাগ বসাইতে চায়। কিছু ভালো লাগে না শশীর। অসংখ্য দুর্ভাবনা ঘনাইয়া আসে। এদিকে অবিশ্রাম বর্ষা নামিয়াছে। তাও অসহ্য। গ্রাম! কী শ্রীহীন কদার্য প্রকৃতির এই লীলাভূমি বর্ষার নির্মল বারিপাতে গলিয়া হইল পাক, পচিয়া হইল দুৰ্গন্ধ। পালানোর দিন আরও কতকাল পিছাইয়া গেল কে জানে। কুসুম ফিরিবার আগে গ্রাম ছাড়িতে পারিলে হইত। আর সে উপায় নেই! দেশে এত গণ্যমান্য লোক থাকিতে যাদব শেষে এমন বিপদে ফেলিয়া গেলেন তাহাকেই।

যাদবের মহামৃত্যুর উত্তেজনা এখনো কাটিয়া যায় নাই, উইলের খবরটা প্রকাশ পাওয়া মাত্র আর একদফা উত্তেজনার প্রবাহ বহিয়া গেল। শীতলবাবু শশীকে ডাকিয়া সব শুনিলেন, বলিলেন, পণ্ডিতমশাই বলে এবং তিনি স্বর্গীয় বলে শশী, নইলে, আমি থাকতে আমার গায়ে আমাকে ডিঙিয়ে হাসপাতাল দেবার স্পর্ধা কখনও সইতাম না। তা শোনো তোমার ফান্ডে আমি হাজার টাকা চাঁদা দেব।

শশীর ফান্ড! টাকাগুলি যাদব যেন শশীর কল্যাণেই দান করিয়া গিয়াছেন। গ্রামের মান্যবরেরাও সদলে শশীর কাছে যাতায়াত শুরু করিলেন। শীতলবাবুর মতো মনে সকলের আঘাত লাগিয়াছে। এতসব ধনী নামি বয়স্ক লোক থাকিতে এতবড় একটা ব্যাপারের সম্পূর্ণ ভার শশীকে দিয়া গেলেন, কী বিস্ময়ের কাণ্ড যাদবের কী অপমান সকলের অপমান বোধ করিয়াও তাহারা কিন্তু থাকিতে পারলেন না দূরে, শশীকে ছকিয়া ধরিলেন। তিনজনের বদলে অযাচিতভাবে পরামর্শদাতা ত্রিশজন সভ্যের কমিটিই যেন গড়িয়া উঠিল শশীকে ঘিরিয়া। আর গোপাল অবিরত ছেলের কানে মন্ত্র জপিতে লাগিল, পারবি না শশী তুই, পারবি না,-আমায় ছেড়ে দে সব।

যাদবের ভাঙা ঘরের চাবি গ্রামের জমিদার হিসাবে শীতলবাবুর কাছে জমা ছিল। একদিন দেখা গেল তালা ভাঙিয়া ঘরের জিনিসপত্র কে তছনছ করিয়াছে, এখানে ওখানে শাবল দিয়া করিয়াছে গভীর গর্ত। ঘটিবাটি কয়েকটি যায় নাই দেখিয়া বোঝা গেল ঘরে ছ্যাঁচড়া চোর আসে নাই, আসিয়াছিল কল্পনাপ্রবণ অনুসন্ধিৎসু,–গুপ্তধনের সন্ধানে।

শ্রীনাথ চেঁচাইয়া বলিতে লাগিল, মরবে ব্যাটারা, মরবে।-যে হাত দিয়া শাবল ধরেছিল খসে খসে পড়বে ব্যাটাদের।

আইনঘটিত হাঙ্গামাগুলি সহজে মিটিল না। সাধারণের উপকারার্থে দান করা অর্থের উপর একজন যুবকের অধিকার, উইলে স্পষ্ট লেখা থাকিলেও, আইনের চোখে কেমন কটু ঠেকিতে লাগিল। কোন পক্ষ হইতে ঠিক বোঝা গেল না, সম্ভবত আকাশ ফুড়িয়া গোপাল দাসের ছেলেটার পকেটে এতগুলি টাকা আসিবার সম্ভাবনায় গায়ে যাদের ধরিয়া গিয়াছিল জ্বালা, তাদের পক্ষ হইতেই তদ্‌বিরের ফলে, উইলের কয়েকটা গলদ বাহির করিয়া উইল বাতিল করার চেষ্টাও হইল হইল। অনুসন্ধান হইল অনেক, শশী বাজিতপুরে ছুটাছুটি করিল অনেকবার, উইলের সাক্ষীদের অনেক জেরা করা হইল, তারপর বেওয়ারিশ যাদবের অর্থ ও সম্পত্তি দিয়া গাওদিয়া হাসপাতাল করিবার অধিকার শশী পাইল। কমিটি গঠন করিবার সময় শশী পড়িল আর এক বিপদে কাকে রাখিয়া কাকে আহবান করিবে? উইলে নির্দেশ আছে মান্যগণ্য তিনজন বয়স্ক ভদ্রলোক। মান্যগণ্য ভদ্রলোকের অভাব নাই, কিন্তু শশী যাদের মানে, কমিটিতে আসিলে শশীকে তারা মানিবেন না, শশীর যারা অনুগত তারা আসিলে অনুগতেরা অগ্নিশৰ্মা হইয়া উঠিবে। শীতলবাবুকে অনুরোধ করিতে তিনি অস্বীকার করিলেন, রাগও করিলেন। শশী কর্তালি করিবে, গ্রামের জমিদার, তিনি শুধু দিবেন পরামর্শ? স্পর্ধা বটে শশীর।

শশী সবিনয়ে বলিল, আমি কেন, আপনিই সব বিষয়ে হেড থাকিবেন।

উইলে তো কই তা লেখেনি বাপু?

অবস্থা বিবেচনা করিয়া শশী তখন বলিল, তবে থাকে, ব্যস্ত মানুষ আপনি, এসব হাঙ্গামায় আপনার থেকে কাজ নেই। হাসপাতাল হলে যে স্থায়ী কমিটি হবে আপনাকে তো তার প্রেসিডেন্ট হতেই হবে। মাঝে মাঝে আমি আসব, উপদেশ নিয়ে যাব আপনার। আপনি সহায় না থাকলে এতবড় ব্যাপার আমি কেন সামলাতে পারব বলুন?

প্রেসিডেন্ট হতে হবে নাকি আমায়?

আপনি থাকতে আর কে প্রেসিডেন্ট হবে?–শশী যেন আশ্চর্য হইয়া গেল।

তখন প্রীত হইয়া শীতল শশীকে খাতির করিয়া বসাইলেন, হুকুম দিলেন জলখাবার আনিবার। বলিলেন, আর কে কে থাকিবে কমিটিতে?

শশী বলিল, কাকে নিয়ে সুবিধা হয় আপনিই যদি তা বলে দিতেন–

শীতল বলিলেন, আমাদের মুনসেফকে নাও না, উখারার সত্যহরিবাবুকে? আইনজ্ঞ মানুষ।

শশী বলিল, বলব ওঁকে। তা হলে দুজন হল—আপনি আর সত্যহরিবাবু। আরও একজন চাই। সাতগাঁর হেডমাস্টার কেশববাবুকে নিলে কেমন হয়?

এমন কৌশলে শীতলকে বশ করিতে পারায় এবার সহজেই যথারীতি কমিটি গঠিত হইল। শীতলের গৃহে সভ্যেরা একত্র হইয়া পরামর্শ করিতে লাগিলেন। মতান্তরের যে আশঙ্কা শশীর ছিল, দেখা গেল সেটা প্রায় অমূলক। মতান্তরের ভয়টা তার চেয়ে ওঁদেরও কম নয়। বিনয় ও নম্রতার মধ্যেও কোনো বিষয়ে শশীর দৃঢ়তা উকি দিলে শীতলও সে বিষয়ে আর প্রতিবাদ করেন না, সংঘর্ষ বাঁচাইয়া চলেন। সত্যহরি ও কেশৰ বৃদ্ধ, অত্যন্ত নিরীহ মানুষ। ঠিক হইল, ফল্ড খুলিয়া চাদা তোলা হইবে, যাদবের ভাঙা বাড়ি ও জমি বেচিয়া সাতগাঁ, উখরা ও গাওদিয়ার সংযোগস্থলে হাসপাতালের জন্য জমি কেনা হইবে। শীতলের সভাপতিত্বে একদিন গ্রামে একটা সভা হইয়া গেল। সভায় নিজের বক্তৃতা শুনিয়া নিজেই শশী হইয়া গেল অবাক। কে জানিত সে এমন সুন্দর বলিতে পারে। সভায় যথেষ্ট উৎসাহ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল বটে কিন্তু শেষের দিকে হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামায় উত্তেজনা একটু নরম হইয়া আসিল। ছেলেরা চাদরের প্রান্ত ধরিয়া অর্থ সংগ্রহের জন্য সভায় ঘুরিতে আরম্ভ করা মাত্র মেঘের অজুহাতে অনেকে বাড়িও চলিয়া গেল।

প্রথমে অনেক ভয়-ভাবনা ছিল, এখন শশীর মন উৎসাহে ভরিয়া উঠিয়াছে। বড় কিছু করিবার যে আগ্রহ চাপা পড়িয়া তাহাকে উতলা করিয়া তুলিয়াছিল, তারই যেন একটা মুক্তি হঠাৎ তাহার জুটিয়া গিয়াছে। সারাদিন জলকাদায় ছুটাছুটি করিয়া হিসাবের খাতাপত্র বগলে বাড়ি ফিরিয়া সে গভীর শ্রাস্তি ও নিবিড় তৃপ্তি অনুভব করে। জীবনে নতুনত্ব আসিয়াছে, বৈচিত্র্য আসিয়াছে। যাদবের কাছে সে বোধ করে কৃতজ্ঞতা। তার সম্বন্ধে গ্রামবাসীর মনে যে দ্রুত পরিবর্তন আসিতেছে তাতেও শশী এক উত্তেজনাময় আনন্দের স্বাদ পায়। এতদিন সে ছিল ডাক্তার, এবার যেন আপন হইতে ছোটখাটো একটি নেতা হইয়া উঠিতেছে। কাজের মানুষ বলিয়া গ্রামের ছেলেরা শশীকে এতদিন এড়াইয়া চলিত, এবার দল বাঁধিয়া আসিয়া কাজের নামে হৈচৈ করার সুযোগ প্রার্থন করিতেছে শশীর কাছে।-এই বর্ষায় গায়ে গায়ে শশীর নির্দেশমতো সকলে তাহারা চাঁদা সংগ্ৰহ করিতে ছুটিয়া গেল উখারায় পাশের গ্রামে কিসের সভা হইবে, ডাক আসিল শশীর কিছু বলা চাই। শুধু তাই নয়, গ্রামের সামাজিক ব্যাপারের জটলায় জীবনে এবার প্রথম ছেলেমানুষ শশীর আহবান হইল, সে গিয়া না-পৌঁছানো পর্যন্ত সভার কাজ স্থগিতও রাখা হইল। যারা বয়স্ক, শশীর বয়স যেন তারা ভুলিয়া গিয়াছেন।

কিন্তু সামাজিক ব্যাপারে শশী যোগ দিল না। সে জানে এ শুধু বার্ধক্যের অস্থায়ী আবেগ, যৌবনের সঙ্গে দুদিনের অন্ধ সন্ধি। আজ যে ইকা ও কাশির শব্দে মুখরিত সভায় তাকে সম্মানের আসন দেওয়া হইবে, কাল সেখানে তার জুটিবে টিটকরি!

এদিকে গেপাল কেমন যেন মুষড়াইয়া গেল। হাসপাতাল-সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে শশী যে তাকে হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার দিল না তা যেন তাকে গভীরভাবে আঘাত করিল। উদ্ধত প্রকৃতি গোপালের, অভিমানী মন। শশী তার একমাত্র ছেলে। তার কাছে এমন ব্যবহার গোপাল কল্পনা করিতে পারিত না। মাঝে মাঝে সে অবাক হইয়া শশীর দিকে চাহিয়া থাকে, কিছু যেন বুঝিতে পারে না। ছেলের মনেও শ্রদ্ধা বজায় রাখিতে হইলে নিজের জীবনকে যে বাপের পর্যন্ত শ্রদ্ধার উপযুক্ত করিয়া রাখতে হয় এ শিক্ষা গোপালের ছিল না। অদৃষ্টকে দোষারোপ করিয়া সে তাই মনে-মনে হায় হায় করে। অনুতাপও যেন আসে গোপালের। মাঝে মাঝে সে ভাবে যে, যত অন্যায় করিয়াছে জীবনে এই তার শাস্তি!

একদিন সে শশীকে বলিল, জানিস শশী, অনেক পাপে ভগবান আমাকে তোর মতো ছেলে দিয়েছেন। তোর এত মহত্ত্ব কিসের তা কি আমি আর কিছু বুঝি না ভাবিস। আমার সঙ্গে রেষারেষি করিস তুই, আমাকে লজ্জা দেবার জন্য ন্যায়বান সেজে থাকিস!—মহত্ত্ব! বাপ পাপিষ্ঠ, উনি মহৎ লজ্জা করে না শশী তোর?

গোপালের মুখ দেখিয়া শশী একটু ভীতভাবে বলিল, আপনাকে আমি কখনও সমালোচনা করিনি বাবা।

অবিশ্বাস তো করিস।

শশী মৃদুস্বরে বলিল, কিছু বোঝেন না, যা-তা ভেবে রাগ করেন। এতে বিশ্বাসঅবিশ্বাসের কথা তো কিছুই নেই। আপনি যা বলেছিলেন তা যদি করতাম, লোকে বলত না বাপ-ব্যাটায় মিলে হাসপাতালের টাকা লুটছে?

কথাটা সাময়িকভাবে গোপালের কানে লাগে। তবে গোপালের অভিযোগ তো শুধু যাদবের টাকাগুলি নাড়াচাড়া করার অধিকার হইতে বঞ্চিত হওয়ার জন্য নয়। যত দিন যাইতেছে সে টের পাইতেছে, শশীর মনে, শশীর জীবনে তার স্থান আসিতেছে সংকুচিত হইয়া। শশী যে তাকে শুধু শ্রদ্ধা করে না তা নয়, সেজন্য আপসোসও যেন শশীর নাই। এইটুকুই গোপালকে পাগল করিয়া দিতে চায়।

গোপাল কত কী ভাবে। রাত্রে তার ঘুম হয় না। মাঝরাত্রে ঘুম ভাঙিয়া শশী তাহার তামাক টানার শব্দ শুনিতে পায়। সামান্য একটু সুবিধার জন্য মানুষের জীবন নষ্ট করিয়া যে মানুষটার একমুহুর্তের জন্য কখনও অনুতাপ হয় নাই, গভীর ও অপরূপ এক হীনতা থাকার জন্য যার কঠোর কর্মঠ প্রকৃতি শুধু নিষ্ঠুতায় গড়া; শশী কি তাকে ভাবপ্রবণ করিয়া তুলিল? সেনদিদির কাধে হাত রাখিয়া সে যখন শ্রান্ত গলায় বলে, জনিস সরোজ, ছেলেমেয়ের কাছ থেকে একদিনের তরে সুখ পেলাম না-তখন কাছে উপস্থিত থাকিলে শশী বোধ হয় চমকিয়া যাইত। সেনদিদির কাধে হাত রাখিবার জন্য নয়, গোপালের মুখ দেখিয়া, গলার স্বর শুনিয়া। হয়তো সে বুঝিতেও পারিত কত দুঃখে কানা সেনদিদির কাছে গোপাল আজ সাস্তুনা খুঁজিয়া মরে।

একদিন গোপাল একেবারে পাঁচশত টাকা শশীর হাতে তুলিয়া দিল।

কিসের টাকা?

হাসপাতাল ফন্ডে আমি দিলাম শশী।

শশী বলিল, মোটে পাঁচশো লোকে কী বলবে বাবা?

কী আশা করিয়াছিল গোপাল, কী বলিল শশী! নোটগুলি গোপাল ছিনাইয়া লইল, আগুন হইয়া বলিল, কত দেব তবে? লাখ টাকা? দেব না যা এক পয়সা আমি!

শশীকে ঘিরিয়া যখন এমনি গোলমাল চলিতেছে একদিন আসিল কুসুম, কয়েক দিন পরে আসিল মতির খবর।

Category: পুতুলনাচের ইতিকথা (উপন্যাস)
পূর্ববর্তী:
« ০৮. গ্রামে না-ফিরিবার প্রতিজ্ঞা
পরবর্তী:
১০. মতির কথা »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑