০২. দুপুরের অর্ধেকটা বাদলার উপর দিয়েই গেল

পরদিন সকাল আর দুপুরের অর্ধেকটা বাদলার উপর দিয়েই গেল। ফেলুদা কোত্থেকে জানি একটা ১৯৩২ সালের ক্যালকাটা অ্যান্ড হাওড়ার ম্যাপ জোগাড় করেছে; দুপুরে খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খেয়ে পান মুখে পুরে একটা চারমিনার ধরিয়ে ও ম্যাপটার ভাঁজ খুলল। সেটাকে মাটিতে বিছনোর জন্য টেবল চেয়ার সব ঠেলে দেয়ালের গায়ে লাগিয়ে দিয়ে মেঝের মাঝখানে ছ-ফুট বাই ছ-ফুট জায়গা করতে হল। ম্যাপের উপর হামাগুড়ি দিয়ে আমরা কলকাতার রাস্তাঘাট দেখছি, ফেলুদা বলছে ‘রজনী সেন খুঁজিস না, এ অঞ্চলটা তখন জঙ্গল,’ এমন সময় জটায়ু এলেন। আজ আর ধুতি-পাঞ্জাবি নয়, গাঢ় নীল টেরিকটের প্যান্ট আর হলুদে বুশ শার্ট। ‘ছিয়াত্তরটা গাছ পড়েছে কালকের ঝড়ে’ ঢুকেই ঘোষণা করলেন ভদ্রলোক। ‘আর আপনার কথা রেখেছি মশাই, এখন আর হর্ন শুনলে হিন্দি ফিল্মের কথা মনে পড়বে না।’

আজ তাড়া নেই, তাই চা খেয়ে বেরোনো হল। ছিয়াত্তরটা গাছ পড়ার খবর কাগজে পড়ে বিশ্বাস হয়নি, কিন্তু পার্ক স্ট্রিট থেকে নিজের চোখে উনিশটা গাছ বা গাছের ডাল পড়ে থাকতে দেখলাম, তার মধ্যে সাদার্ন এভিনিউতেই তিনটে। তাও তো এর মধ্যে কত ডালপালা সরিয়ে ফেলা হয়েছে কে জানে।

গোরস্থানের গেটের সামনে যখন পৌঁছলাম (এখানে আসছি সেটা ক্যামাক স্ট্রিটের আগে ফেলুদা আমাদের বলেনি) তখন জটায়ুর দিকে চেয়ে দেখি তাঁর স্বাভাবিক ফুর্তি ভাবটা যেন একটু কম। ফেলুদা তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিতে ভদ্রলোক বললেন, ‘একবার এক সাহেবকে কবর দিতে দেখেছিলুম—ফর্টিওয়ানে— রাঁচিতে। কাঠের বাক্সটা গর্তে নামিয়ে যখন তার উপর চাবড়া চাবড়া মাটি ফেলে না—সে এক বীভৎস শব্দ মশাই।’

‘সে শব্দ এখানে শোনার কোনও সম্ভাবনা নেই,’ বলল ফেলুদা। ‘এই গোরস্থানে গত সোয়াশো বছরে কোনও মৃতব্যক্তিকে সমাধিস্থ করা হয়নি।’

গেট দিয়ে ঢুকতেই ডাইনে দারোয়ানের ঘর। দিনের বেলা যে-কেউ এ গোরস্থানে ঢুকতে পারে, তাই দারোয়ানের বোধহয় বিশেষ কোনও কাজ নেই। ‘তবে হ্যাঁ,’ বলল ফেলুদা। ‘একটা ব্যাপারে একটু নজর রাখতে হয়—যাতে সমাধির গা থেকে কেউ মার্বেলের ফলক খুলে না নেয়। ভাল ইটালিয়ান মার্বেল বাজারে বিক্রি করলে বেশ দু পয়সা আসে।—দারোয়ান!’

দারোয়ান ঘর থেকে বেরিয়ে এল। দেখে বলে দিতে হয় না সে বিহারের লোক; খৈনিটা মনে হয় সবেমাত্র পুরেছে মুখে।

‘কাল এখানে একজন বাঙালিবাবু জখম হয়েছেন—মাথায় গাছ পড়ে?’

‘হাঁ বাবু।’

‘সে জায়গাটা দেখা যায়?’

‘উয়ো রাস্তাসে সিধা চলিয়ে যান—একদম এন্ড তক্‌। বাঁয়ে ঘুমলেই দেখতে পাবেন। অভিতক্ পড়া হুয়া হ্যায় পেড়।’

আমরা তিনজন ঘাস-গজিয়ে-যাওয়া বাঁধানো রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে গেলাম। দুদিকে সমাধির সারি—তার এক-একটা বারো-চোদ্দো হাত উঁচু। ডাইনে কিছু দূরে একটা সমাধি প্রায় তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু। ফেলুদা বলল, ওটা খুব সম্ভবত পণ্ডিত উইলিয়াম জোন্‌স-এর সমাধি, ওর চেয়ে উঁচু সমাধি নাকি কলকাতায় আর নেই।’

প্রত্যেকটা সমাধির গায়ে সাদা কিংবা কালো মার্বেলের ফলকে মৃতব্যক্তির নাম, জন্মের তারিখ, আর মৃত্যুর তারিখ, আর সেই সঙ্গে আরও কিছু লেখা। কয়েকটা বড় ফলকে দেখলাম অল্প কথায় জীবনী পর্যন্ত লেখা রয়েছে। বেশির ভাগ সমাধিই চারকোনা থামের মতো, নীচে চওড়া থেকে উপরে সরু হয়ে উঠেছে। লালমোহনবাবু সেগুলোকে বললেন বোরখাপরা ভূত। কথাটা খুব খারাপ বলেননি, যদিও এ ভূতের নড়াচড়ার উপায় নেই। এ ভূত প্রহরী ভূত; মাটির নীচে কফিনবন্দি হয়ে যিনি শুয়ে আছেন তাঁকেই যেন গার্ড করছেন এই ভূত। ‘এই স্তম্ভগুলোর ইংরিজি নামটা জেনে রাখ তোপ্‌সে। একে বলে ওবেলিস্ক।’ লালমোহনবাবু বার পাঁচেক কথাটা আউড়ে নিলেন। আমি বাঁ দিক ডান দিক চোখ ঘোরাচ্ছি আর ফলকের নামগুলো বিড়বিড় করছি—জ্যাকসন, ওয়ট্‌স, ওয়েল্‌স, লারকিন্‌স, গিবন্‌স, ওল্ডহ্যাম…। মাঝে মাঝে দেখছি পাশাপাশি একই নামের বেশ কয়েকটি সমাধি রয়েছে—বোঝা যাচ্ছে সবাই একই পরিবারের লোক। সবচেয়ে আগের তারিখ যা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েছে তা হল ২৮ শে জুলাই ১৭৭৯। তার মানে ফরাসি বিপ্লবেরও বারো বছর আগে।

রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছে বুঝতে পারলাম গোরস্থানটা কত বড়। পার্ক স্ট্রিটের ট্রাফিকের শব্দ এখানে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ফেলুদা পরে বলেছিল, ‘এখানে নাকি দু হাজারের বেশি সমাধি আছে। লালমোহনবাবু লোয়ার সার্কুলার রোডের দিকটায় গোরস্থানের গায়ে-লাগা একটা ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে দেখিয়ে বললেন, ওঁকে লাখ টাকা দিলেও নাকি উনি ওখানে থাকবেন না।

গাছ যেটা ভেঙেছে বলে কাগজে বেরিয়েছে, সেটা আসলে শাখা-প্রশাখা সমেত একটা প্রকাণ্ড আম গাছের ডাল। সেটা পড়েছে একটা সমাধির বেশ খানিকটা ধ্বংস করে। এ ছাড়াও আরও অনেক ডালপালা চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে।

আমরা সমাধিটার দিকে এগিয়ে গেলাম।

এটা অন্যগুলোর তুলনায় বেঁটে, লালমোহনবাবুর কাঁধ অবধি আসবে বড় জোর। বোঝা যায় এমনিতেই সেটার অবস্থা বেশ কাহিল ছিল। যেদিকে ডালের ঘা লাগেনি সেদিকটাও ফাটল ধরে চৌচির হয়ে আছে, পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে আছে। ঘা লাগার দরুন শ্বেত পাথরের ফলকটাও ভেঙেছে; তার খানিকটা সমাধির গায়ে এখনও লেগে আছে, বাকিটা আট-দশ টুকরো হয়ে ঘাসের উপর পড়ে আছে। বৃষ্টি হয়ে চারিদিকটা এমনিতেই জলকাদায় ভরা, কিন্তু এখানে যেন কাদাটা অন্য জায়গার চেয়ে একটু বেশি। ‘আশ্চর্য’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘গড কথাটা কিন্তু এখনও সমাধির গায়ে লেগে আছে।’

‘শুধু গড নয়,’ বলল ফেলুদা, ‘তার নীচে সালের অংশ দেখতে পাচ্ছেন নিশ্চয়ই।’

‘ইয়েস। ওয়ান এইট-ফাইভ—তারপর ভাঙা। বোঝাই যাচ্ছে এই গড হল আপনার সেই ঈশ্বর সকলের কর্তা-র গড।’

‘তাই কি?’

ফেলুদার প্রশ্ন শুনে তার দিকে চাইলাম। তার ভুরু কুঁচকোনো। বলল, ‘আপনি অন্য সমাধিগুলো বিশেষ মন দিয়ে দেখেননি দেখছি। দেখুন না ওই পাশেরটার দিকে।’

পাশেই আরেকটা বড় সমাধি রয়েছে। তার ফলকে লেখা—

To the Memory of

Capt. P. O’reilly, H. M. 44th Regt.

who died 25th May, 1823 aged 38 years

‘লক্ষ করুন, নামের নীচেই আসছে সাল-তারিখ। বেশির ভাগ ফলকেই তাই। আর, গড কথাটা অন্য কোনও ফলকে দেখলেন কি?’

ফেলুদা ঠিকই বলেছে। এই পথটুকু আসার মধ্যে আমি নিজেই অন্তত ত্রিশটা ফলকের লেখা পড়েছি, কিন্তু কোনওটাতেই গড দেখিনি।

‘তার মানে বলছেন, গড হল মৃতব্যক্তির নাম?’

‘গড কারুর নাম হয় বলে আমার মনে হয় না, যদিও ঈশ্বর বা ভগবান নামটা হিন্দুদের মধ্যে আছে। লক্ষ করুন, গড-এর জি-এর বাঁ দিকে ইঞ্চি-খানেক ফাঁক দেখা যাচ্ছে—অর্থাৎ বাঁ দিকে ওর গায়ে গায়ে কোনও অক্ষর ছিল না। কিন্তু ডি-এর ডান দিকটায় ফাঁক আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না—কারণ সে-জায়গায় পাথরটা ভেঙে পড়ে গেছে। আমার ধারণা এটা যার কবর তার পদবির প্রথম তিনটে অক্ষর হল জি-ও-ডি; যেমন গডফ্রি বা গডার্ড।’

‘সে তো পাথরের টুক্‌রোগুলো জড়ো করে পাশাপাশি—’

লালমোহনবাবু কথাটা বলতে বলতে ভাঙা ডালপালার উপর দিয়ে সমাধিটার দিকে এগিয়ে তার ধারে পৌঁছোতেই হঠাৎ সড়াৎ করে খানিকটা নীচের দিকে নেমে গেলেন। গর্তে পা পড়লে যেমন হয় ঠিক তেমনি। কিন্তু ফেলুদা ঠিক সময়ে তার লম্বা হাত দুটি বাড়িয়ে তাঁকে খপ্ করে ধরে টেনে তুলে শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়ে দিল? ব্যাপারটা কী? ওখানে গর্ত হল কী করে? ‘কেমন যেন খট্‌কা লাগছিল,’ বলল ফেলুদা, ‘ভাঙল আমগাছ, অথচ আমপাতার সঙ্গে জাম-কাঁঠাল কী করছে তাই ভাবছিলাম।’

লালমোহনবাবু এমনিতেই গোরস্থানে এসে একটু গুম্ মেরে গিয়েছিলেন, তার উপর এই ব্যাপার। প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে ‘এ একটু বাড়াবাড়ি মশাই’ বলে ভদ্রলোক একপাশে সরে গিয়ে আমাদের দিকে পেছন করে বোধ হয় নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করলেন।

‘তোপ্‌সে-খুব সাবধানে ডালপালাগুলো সরা তো।’

আমি আর ফেলুদা গর্ত বাঁচিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করতেই বেশ বোঝা গেল কবরের পাশটায় হাত-খানেক গভীর খালের মতো রয়েছে। সেটা আগেই ছিল, না সম্প্রতি কেউ খুঁড়ে করেছে সেটা ফেলুদা বুঝে থাকলেও, আমি বুঝলাম না।

ফেলুদা এবার মার্বেলের টুকরোগুলোয় মন দিল। দুজনে মিলে এগারোটা টুকরো জড়ো করে মিনিট দশেক ঘাসের উপর জিগ-স পাজ্‌ল খেলে সেগুলোকে ঠিক ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিলাম। তার ফলে জিনিসটা এইরকম দাঁড়াল—

Sacred to the Memory of

THOMAS-WIN

Obt. 24th April—8, AET. 180—

‘গডউইন’, বলল ফেলুদা, ‘টমাস গডউইনের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে। ওবিটি হল “ওবিটুস” অর্থাৎ মৃত্যু, আর এ ই টি হল “এই টাটিস” অর্থাৎ বয়স। এখন কথা হচ্ছে—’

গোরস্থানে সাবধান

‘ও মশাই!’

জটায়ু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে আমাকে বেশ চমকে দিলেন। ঘুরে দেখতেই ভদ্রলোক একটা চৌকো চ্যাপটা কালো জিনিস আমাদের দিকে তুলে ধরে বললেন, ‘সাঁইত্রিশ টাকায় ব্লু-ফক্সে তিনজনের ডিনার হবে কি?’

‘কী পেলেন ওটা?’

আমরা দুজনেই বেশ আগ্রহের সঙ্গে এগিয়ে গেলাম।

লালমোহনবাবুর বাঁ হাতে একটা কালো মানিব্যাগ, আর ডান হাতে তিনটে দশ, একটা পাঁচ, আর একটা দু টাকার নোট। টাকা আর ব্যাগ দুটোরই অবস্থা বেশ শোচনীয়। ভদ্রলোকের ভয় কেটে গিয়ে এখন একটা বেশ মারদিস্ ভাব; বেশ বুঝতে পারছেন যে, ফেলুদার জন্য একটা ভাল ক্লু জোগাড় করে দিয়েছেন।

ফেলুদা ব্যাগটা খুলে খাপগুলোর ভিতর যা ছিল সব বার করল। চার রকম জিনিস বেরোল খাপ থেকে। এক নম্বর—এক গোছা ভিজিটিং কার্ড, যাতে ইংরিজিতে লেখা এন এম বিশ্বাস। ঠিকানা টেলিফোন নেই। ফেলুদা বলল, ‘দেখেছেন খবরের কাগজের কাণ্ড—নরেন্দ্রমোহনকে নরেন্দ্রনাথ করে দিয়েছে।’

দুই নম্বর হচ্ছে দুটো খবরের কাগজের কাটিং। একটাতে এই সাউথ পার্ক স্ট্রিটে গোরস্থান প্রথম যখন খুলল তার খবর, আর আরেকটাতে আজকাল যাকে শহিদ মিনার বলি, সেই অকটারলোনি মনুমেন্ট তৈরি হবার খবর। তার মানে দুটো কাগজের টুকরোই দেড়শো-দুশো বছরের পুরনো। ‘বিশ্বেস মশাই এত প্রাচীন কাগজের কাটিং কোত্থেকে জোগাড় করলেন জানতে ভারী কৌতূহল হচ্ছে—’ মন্তব্য করল ফেলুদা।

তিন নম্বর হচ্ছে পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বুক কোম্পানির একটা বারো টাকা পঞ্চাশ পয়সার ক্যাশমেমো; আর চার হল এক টুকরো সাদা কাগজ, যাতে ডট পেনে ইংরিজিতে কয়েকটা লাইন লেখা। লেখার মাথামুণ্ডু বুঝলাম না, যদিও ভিক্টোরিয়া নামটা পড়তে পেরেছিলাম।

‘অকটারলোনি মনুমেন্ট নিয়ে যে একটা লেখা দেখলুম সেদিন কাগজে’, হঠাৎ বলে উঠলেন লালমোহনবাবু, ‘আর যদ্দূর মনে পড়ছে লেখকের পদবি ছিল বিশ্বাস। হ্যাঁ—বিশ্বাস। কারেক্ট।’

‘কোন কাগজ?’ ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।

‘হয় “লেখনী” না হয় “বিচিত্রপত্র”। ঠিক মনে পড়ছে না। আমি বাড়ি গিয়ে চেক্ করব।’

জটায়ুর স্মরণশক্তি তেমন নির্ভরযোগ্য নয় বলেই বোধ হয় ফেলুদা এ ব্যাপারে আর কিছু না বলে সাদা কাগজের লেখাটা তার নিজের নোটবুকে কপি করে নিয়ে আসল কাগজ আর অন্য জিনিসগুলো মানিব্যাগে ভরে সেটা পকেটে নিয়ে নিল। তারপর মিনিট পাঁচেক ধরে কবরের আশপাশটা ভাল করে দেখে আরও দুটো জিনিস পেয়ে সেগুলোও পকেটে পুরল। সে-দুটো হচ্ছে একটা ব্রাউন রঙের কোটের বোতাম আর একটা নেতিয়ে যাওয়া রেসের বই।—‘চল, দারোয়ানের সঙ্গে একবার কথা বলে বেরিয়ে পড়ি। আবার মেঘ করল।’

‘ব্যাগটা কি ফেরত দেবেন?’ জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।

‘অবিশ্যি। কোন্ হাসপাতালে আছে খোঁজ করে কাল একবার যাব।’

‘আর সে-লোক যদি মরে গিয়ে থাকে?’

‘সেই অনুমান করে তো আর তার প্রপার্টি আত্মসাৎ করা যায় না। সেটা নীতিবিরুদ্ধ।—আর সাঁইত্রিশ টাকায় ব্লু-ফক্সে তিনজনের চা-স্যান্ডউইচের বেশি কিছু হবে না, সুতরাং আপনি ডিনারের আশা ত্যাগ করতে পারেন।’

আমরা আবার উলটোমুখে ঘুরে কবরের সারির মাঝখানের পথ দিয়ে গেটের দিকে এগোতে লাগলাম। ফেলুদা গম্ভীর। এরই ফাঁকে একটা চারমিনার ধরিয়ে নিয়েছে। এমনিতে ও সিগারেট অনেক কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রহস্যের গন্ধ পেলে নিজের অজান্তেই মাঝে সাঝে সাদা কাঠি মুখে চলে যায়।

অর্ধেক পথ যাবার পর সে হঠাৎ থামল কেন সেটা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারিনি। তারপর তার চাহনি অনুসরণ করে একটা জিনিস দেখে আমার হাঁটার হার্টবিটটাও সঙ্গে সঙ্গে এক পলকের জন্য থেমে গেল।

একটা গম্বুজওয়ালা সমাধি—যার ফলকে মৃতব্যক্তির নাম রয়েছে মিস মারগারেট টেম্পলটন—তার ঠিক সামনে ঘাসে পড়ে থাকা একটা পুরনো ইটের উপর একটা সিকিখাওয়া জ্বলন্ত সিগারেট থেকে সরু ফিতের মতো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠছে। বৃষ্টি হবে বলেই বোধহয় বাতাসটা বন্ধ হয়েছে, না হলে ধোঁয়া দেখা যেত না।

ফেলুদা এগিয়ে গিয়ে দু ইঞ্চি লম্বা সিগারেটটা তুলে নিয়ে মন্তব্য করল, ‘গোল্ড ফ্লেক।’ জটায়ু বলল, ‘বাড়ি চলুন।’ আমি বললাম, ‘একবার খুঁজে দেখব লোকটা এখনও আছে কি না?’

‘সে যদি থাকত’, বলল ফেলুদা, ‘তা হলে সিগারেট হাতে নিয়েই থাকত; কিংবা হাত থেকে ফেলে পা দিয়ে মাড়িয়ে নিবিয়ে দিত। আধখাওয়া অবস্থায় এভাবে ফেলে যেত না। সে লোক পালিয়েছে, এবং বেশ ব্যস্তভাবেই পালিয়েছে।’

দারোয়ান ঘরে ছিল না। মিনিট তিনেক অপেক্ষা করার পর সে পশ্চিম দিকের একটা ঝোপের পিছন থেকে বেরিয়ে হেলতে দুলতে এগিয়ে এসে বলল, ‘আভি এক চুহাকো খতম্ কর দিয়া।’

বুঝলাম, ওই ঝোপের পিছনে চুহার সৎকার সেরে তিনি ফিরছেন, ফেলুদা কাজের কথায় চলে গেল।

‘যার উপর গাছ পড়েছিল তাকে জখম অবস্থায় প্রথম দেখল কে?’

দারোয়ান বলল যে সেই দেখেছিল। গাছ পড়ার সময়টা সে গোরস্থানে ছিল না, তার নিজের একটা শার্ট উড়ে গিয়েছিল পার্ক স্ট্রিটে, সেটা উদ্ধার করতে গিয়েছিল। ফিরে এসে ব্যাপারটা দেখে। দারোয়ান ভদ্রলোকের মুখ চিনত, কারণ উনি নাকি সম্প্রতি আরও কয়েকবার এসেছেন গোরস্থানে।

‘আর কেউ এসেছিল কালকে?’

‘মালুম নেহি বাবু। হাম্ যব দৌড়কে গিয়া, উস টাইমমে তো আউর কোই নেহি থা।’

‘এইসব সমাধির পিছনে লুকিয়ে থাকতে পারে তো?’

এটা দারোয়ান অস্বীকার করল না। আমারও মনে হচ্ছিল যে এই গোরস্থানের চেয়ে ভাল লুকোচুরির জায়গা বোধহয় সারা কলকাতায় আর একটিও নেই।

নরেন বিশ্বাসের অবস্থা দেখে দারোয়ান রাস্তায় বেরিয়ে এসে এক পথচারী সাহেবকে খবরটা দেয়। বর্ণনা থেকে মনে হল সেন্ট জেভিয়ার্সের ফাদার-টাদার হতে পারে। তিনিই নাকি ট্যাক্সি ডাকিয়ে নরেন বিশ্বাসকে হাসপাতালে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেন।

‘আজ একটু আগে কাউকে আসতে দেখেছিলে?’

‘আভি?’

‘হ্যাঁ?’

না, দারোয়ান কাউকে আসতে দেখেনি। সে গেটের কাছে ছিল না। সে গিয়েছিল চুহার লাশ নিয়ে ওই ঝোপড়াটার পিছনে। ওটা ফেলে দিয়েই ওর কাজ শেষ হয়নি, কারণ একটু পিপাসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

‘রাত্রে তুমি এখানে থাক?’

‘হাঁ বাবু। লেকিন রাতকো তো পহারেকা কোই জরুরৎ নেহি হোতা। ডর কে মারে কোই আতাহি নেহি। পহলে লোয়ার সারকুলার রোড সাইডমে দিওয়ার টুটা থা, লেকিন্ আজকাল রাতকো কোই নেহি আতা সমনটরিমে।’

‘তোমার নাম কী?’

‘বরমদেও।’

‘এই নাও।’

‘সালাম বাবু।’

দারোয়ানের হাতে দু টাকার নোটটা গুঁজে দেবার ফল অবিশ্যি আমরা পরে পেয়েছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *