বাঙালি হিন্দু

বাঙালি হিন্দু

বাঙালি হিন্দু সমাজের ইংরেজি শিক্ষিত উপরের স্তর চঞ্চল হয়ে উঠেছে। এ চাঞ্চলের কারণ বাইরের আঘাত, সুতরাং ও অংশের সজীবতার প্রমাণ।

ভারতবর্ষের ইংরেজ শাসন আমলে সে বিদেশি শাসন তার অধীন দেশের লোককে যতটা সুযোগ দিয়েছিল তার ষোলো আনা সুবিধা নিয়েছিল বাঙালি হিন্দু। রাজার দেশের ভাষা শিখে, এবং মোগল শাসন ও স্বদেশের রাষ্ট্ৰীয় ব্যবস্থা মিশিয়ে কর আদায় ও শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় যে প্ৰকাণ্ড ও জটিল শাসন যন্ত্র ইংরেজ এ-দেশে আমদানি করেছে তার মোটা কলকব্জাগুলো চালাবার বিদ্যা আয়ত্ত করে তার প্রতিষ্ঠা ও চলার কাজে সে কম সাহায্য করেনি। এই মিস্ত্ৰিগিরির মজুরি সে যা পেয়েছে তাই হচ্ছে উচ্চশ্রেণি বাঙালি হিন্দুর এ দেশে প্রতিপত্তি ও নেতৃত্বের বাস্তব ভিত্তি। বাঙালি হিন্দু যে নতুন ভাষা ও বিদ্যায় সহজেই নিজেকে রপ্ত করে তুলেছিল তার এক কারণ তার মনে অতীত গৌরবের এমন কোনও স্মৃতি ছিল না। যার অভিমান এর বাধা জন্মাতে পারে।

ব্রিটেনের রাজতত্তঙ্গ দখল সে সানন্দেই বরণ করেছিল। যার ফলে পাটনা থেকে পেশোয়ার, কটক থেকে মধ্যভারত ইংরেজের বিজয় নিশানের পিছু পিছু সে ছুটেছিল হাতে কলম, বগলে ইংরেজি বিদ্যা শিখবার পুথি। বিজিত দেশে নব শাসন রীতি চলতি করতে, আর সে বিদ্যায় সে দেশের লোকের হাতে খড়ি দিতে। কেরানিগিরি গুরুগিরির এই একচেটি ব্যবসায় উত্তরা পথ জুড়ে বাঙালি হিন্দু বহুদিন কায়েম ছিল। আজও সেখানকার বড় বড় শহরে তার ধবংসাবশেষ আমাদের আপশোস ও আস্ফালনের খোরাক জোগাচ্ছে। স্বভাবতই এ মনপালি’ ছিল সাময়িক; আর তা না হলে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হতাশ হতে হত। যে মাস্টার আশা করে ছেলেরা স্কুলের বিদ্যা শেষ করে নিজেরা কখনও মাস্টার হবে না, নিরাশ তাকে হতেই হয়।

কিন্তু এইটুকুই পুরো সত্য নয়। রাজ শাসনের সঙ্গে সঙ্গে নব ইউরোপের যে সব ভাব ও বিদ্যা ইংরেজ এ-দেশে এনেছিল, সাংসারিক সুবিধার উপায় স্বরূপে ছাড়াও বাঙালি হিন্দুর তা মনে হয়েছিল। পরম উপাদেয়। কারণ যাই হোক হিন্দু বাঙালির মনে এমন কিছু ছিল যা এদের অনুকুল।

সেই জন্য রামমোহন রায়ের মতো আশ্চর্য মানুষের বাংলায় আবির্ভাব হয়েছিল। বিদ্যাসাগরের মতো প্ৰাচীন শিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিত এ নব বিদ্যা ও ভাব প্রচারের অগ্ৰণী হয়ে ছিলেন। এবং প্রথম প্লাবন কেটে গেলে দেখা গেল যে বাঙালির মন এ বন্যায় ডুবে মরেনি, উর্বর হয়েছে।

ফলে ইংরেজ যুগের বাংলা সাহিত্য যা আধুনিক ইউরোপের প্রধান সাহিত্যগুলির তুলনায় নানাদিকে ছোট, কিন্তু কেবল সেই তুলনাতেই ছোট। কারণ ভারতবর্ষ কি এশিয়ার আর কোথাও এর তুল্য মূল্য আধুনিক সাহিত্য আজ নেই। এ সাহিত্যের একটি প্রধান বাণী নব ইউরোপের মুক্তির-বাণী মনে, সমাজে, রাষ্ট্রে। বাংলায় এই মুক্তির বাণী প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে সমস্ত ভারতবর্ষের চিন্তা ও কর্মকে উদ্ধৃদ্ধ করেছে। আর এই বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বাঙালি হিন্দু ভারতবর্ষের জাতীয়তা ও রাষ্ট্ৰীয় ঐক্যের যে বার্তা প্রচার করেছে, বৃহৎ রাষ্ট্ৰীয চেষ্টার দুরূহ। পথে সাহস, নিষ্ঠা ও ত্যাগের যে আদর্শ দেখিয়েছে রাষ্ট্ৰীয় চিন্তা ও কর্মে তা ভারতবর্ষের নবজন্ম। ব্রিটিশ শাসনের কলের মজুরি কেমন করে করতে হয় বাঙালি হিন্দু অর্ধেক ভারতবর্ষকে তা শিখিয়ে ছিল, ভারতবাসীকে মানুষের মতো বাঁচতে ও মরতে হলে ও কলের যে বদল দরকার এ জ্ঞানও বাঙালি হিন্দু ভারতবর্ষকে দীক্ষা দিয়েছে। প্রথম গুরুগিরির পুরস্কার সে ইংরেজের হাতে পেয়েছে। দ্বিতীয় গুরুগিরির দণ্ড ও হাতে না পেলে প্রমাণ হত যে গুরুগিরি নিষ্ফল হয়েছে।

নিষ্ফল কিন্তু হয়নি। ভারতবাসীর বর্তমান রাষ্ট্রীয় চেতনা ভারতবর্ষে সর্বময়ত্বের অবসান সূচনা করেছে। ওর পরিপুষ্টিতে তার ধ্বংস। এ চৈতন্যের প্রধান উৎস যে বাঙালি হিন্দু তাতে অবাঙালি ভারতবাসীর মনে যে মোহই থাকুক ইংরেজের মনে কোনও সংশয় নেই। এই উৎসের মুখ বন্ধ করতে সাম্রাজ্যভোগী ব্রিটিশ শাসক সম্প্রদায়ের যে চেষ্টা হবে তা স্বাভাবিক।

এ শতাব্দীর প্রথমে সে চেষ্টা হয়েছিল বাঙালির রাষ্ট্ৰীয় জীবনকে দুভাগ করে। ফল হল উলটো। রুদ্ধ স্রোত বাধাকে ঠেলে ফেলে ভারতবর্ষময় ছাড়িয়ে পড়ল। যার গতিবেগে ভারতবাসীর রাষ্ট্রীয় চিন্তা ও চেষ্টা আজকের খাদে প্রবাহিত হচ্ছে। এইবার চলেছে। দ্বিতীয় চেষ্টা। পূর্ব ও পশ্চিমে পৃথিবীর অবস্থা ও ভবিষ্যতের আশঙ্কা আজ এমন হয়েছে যে ভারতবর্ষের শাসন ও শোষণের পূর্ব রীতির বদল হয়ে উঠেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পক্ষে

প্রয়োজন। আশা আছে। ওর ভিতরটা বহাল রেখে চেহারাটা বদলে দিলেই এখনকার মতো কাজ চলবে। ব্রিটিশ শাসকেরা যখন এ দেশের রাষ্ট্র ব্যবহার ‘রিফর্মের কথা বলেন তখন সম্ভব তাদের মনে থাকে ধাতুর্থ–ফর্ম’ অর্থাৎ আকারের পরিবর্তন। আর যদি বাধ্য হয়ে

করতে হয় তবে বাকি ভারতবর্ষের মন থেকে বাঙালি হিন্দুর রাষ্ট্ৰীয় চিন্তা ও আদর্শের প্রভাব দূর হলে আপোষ নিষ্পত্তিতে বর্তমান সুবিধার অনেকটাই বজায় থাকবে বলে ইংরেজের বিশ্বাস। বাঙালি হিন্দুর ‘একস্ট্রিমিজম বাদ দিলে বাকি ভারতবর্ষের সুইট ও রিজিনেবল’ হবার আশা আছে। সেইজন্য রিফর্মের শেষ কিস্তিতে বাঙালি হিন্দুকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে বাঙালি মুসলমানের ভোটের চাপে। বাংলাদেশে হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। তার ফলেই বাংলার রাষ্ট্র পরিষদে হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যায় আসবে বেশি, এবং তাতে বাঙালি হিন্দুর রাষ্ট্ৰীয় প্রভাব ও অন্য প্রতিপত্তি ক্ষুন্ন হবে ‘রিফর্ম কর্তারা’ এই ভরসাতেই নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। বাঙালি হিন্দু যে ডেমোক্রেসির বচন আওড়ায় তার পাটিগণিতের মারে তাকে কাবু করে মজা দেখার লোভেও নয়। তাদের মনে এ আশঙ্কা ছিল যে প্রতিনিধি নির্বাচনে হিন্দু মুসলমান মিশিয়ে দিলে হিন্দুয়ানি ও মুসলমানির চেয়ে রাষ্ট্র ব্যাপারে বাঙালি হিন্দু মুসলমানের কাছে বাংলাদেশ বড় হয়ে উঠতে পারে। আর ‘ওয়াইলি’ হিন্দুকে বিশ্বাস কী! সেই জন্য গড়তে হয়েছে ধর্ম সাম্প্রদায়িক নির্বাচন মণ্ডলী। যাতে মুসলমান যে পরিষদে আসবে সে বুঝবে মুসলমান বলেই সে এসেছে। সে মুসলমানের প্রতিনিধি দেশের নয়। আর যাঁরা তাকে পাঠাবে তাঁরাও জানবে রাষ্ট্র ব্যাপারে তাঁরা বাঙালি নয় তাঁরা মুসলমান; প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে এক নয়, যদিও তাদের ভাষা এক এবং রক্তও এক আর দুঃখ সুখের ভোগও এক। এইখানেই শেষ নয়। নষ্ট্রের গোঁড়া গোটা বাঙালি হিন্দু সমাজ নয়, উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু। সুতরাং প্রয়োজন হয়েছে উচ্চ হিন্দু ও অনুচ্চ হিন্দুর মধ্যে প্রাচীর তোলা যাতে উচ্চবর্ণ বাঙালি হিন্দু বাংলাদেশে এক ঘরে হয়। মহাত্মার উপবাস দৈব সুযোগ; ইংরেজের আর পাঁচটা সৌভাগ্যের মধ্যে একটা সৌভাগ্য।

ব্রিটিশ যুগের প্রথম আমলে পশ্চিমের নুতন ভাব ও বিদ্যার দিকে বাঙালি হিন্দুর মতো বাঙালি মুসলমান বুকে পড়েনি। কতকটা রােজ্যাপহারী ইংরেজের উপর আক্রোশে, কতকটা সংস্কারান্ধ মৌলভি মৌলানার বিরোধিতায়। ফলে আধুনিকতার যে নদীতে বাঙালি হিন্দু স্নান করেছে, বাঙালি মুসলমান তখন তার জলে নামেনি। প্রচলিত ধর্ম ও সংস্কারকে বাঙালি হিন্দু যেমন যুক্তির বিচারে যাচাই করতে সাহস করেছে, বাঙালি মুসলমান তা পারেনি। মুসলমান রামমোহন কি মুসলমান বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে সম্ভব হয় নাই। এই আধুনিকতার বিরোধী, ইংরেজি শিক্ষা পরাঘুখ সম্প্রদায়ে আর্থিক সুতরাং সামাজিক বিপ্লব ঘটল। যখন ইংরেজের আপিস আদালতে ফারসির বদলে প্ৰচলন হল ইংরেজি ভাষার। মুনশি মৌলভির হাতের কাজ চলে গেল। ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দুর হাতে। তাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একটা বড় মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠল। যাদের যে শিক্ষা আনলো হাতে অর্থ, সেই শিক্ষায় করল। মনকে সজীব। মুসলমান হয়ে পড়ল দরিদ্র এবং মনে অচল। আধুনিক কালে যখন বাঙালি মুসলমানের চেতনা হল, এবং নব শিক্ষায় তাঁরা শিক্ষা পেতে লাগল। তখন রাজ দরবার ও রাজ সরকারের দেশি লোকের জায়গায় হিন্দুর দখলে এবং ইংরেজি বিদ্যায় উপার্জনের আর যে সব পথ খুলেছে সেখানে হিন্দুর ঠাসাঠাসি ভিড়। নব ব্ৰতী মুসলমানের ওস্তাদ হিন্দুর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মাথা গলান কঠিন।

বাঙালি মুসলমান সমাজের এই অবস্থায় রিফর্মের শেষ চালের লক্ষ্য ব্যর্থ হয়নি। নব শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা বাঙালি হিন্দুর তুলনায় এখনও অতি অল্প। যদি হিন্দুর সঙ্গে বিনা প্রতিযোগিতায় কেবল মুসলমানের খাতিরে, শিক্ষিতের সংখ্যার অনুপাতে নয় মুসলমান সমাজের নিরক্ষরত্বের পরিমাণে শিক্ষাসাপেক্ষ সরকারি চাকরি ও সরকার অনুগৃহীত অর্থাগমের অন্যান্য উপায় মুসলমানের হাতে আসে। তবে এই অল্প সংখ্যক শিক্ষিত মুসলমানের দারিদ্র্য কমে, শিক্ষিত মুসলমানের সন্তান সন্ততিদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ জীবনোপায়ের পথ হয়, দেশে বাঙালি মুসলমানের প্রতিপত্তি ও সম্মান বাড়ে। শুধু যোগ্যতার জোরে যে মুসলমান দোতলা উঠতে পারে না। সাম্প্রদায়িক লিফটে সে অনায়াসে তেতলা উঠে যায়। এ লোভ কম লোভ নয়। সুতরাং বাংলার রাষ্ট্রসভায় যে ইংরেজরা রয়েছেন প্ৰাপ্যের বহু সংখ্যায় রিফর্মের ‘পলিসি’ ইমপ্লিমেন্ট করতে তাদের আওতায় মুসলমান সভ্যদের যেই কিঞ্চিৎ আধিপত্য হয়েছে অমনি চড়াসুর উঠেছে মুসলমানের বিশেষ স্বার্থের। স্থানে এবং অস্থানে মুসলমান ধর্মে ধাৰ্মিকের সংখ্যার অনুপাতে ভাগ বাটোয়ারায় দাবি চলেছে, যা কখনও করুণ কখনও কমিক। এর যুক্তি এক সময় বাঙালি মুসলমানের শিক্ষার দৈন্য যাকে অমুসলমানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ফেলা অন্যায়, অন্য সময় বাঙালি মুসলমানের পৌরুষ যা রাজার জাতিতেই কেবল দেখা যায়। কখনও মুসলমানের ব্রিটিশ রাজভক্তির কাহিনি, কখনও আরবদের বিশ্বজয়ের ইতিহাস। কাজেই সাম্প্রদায়িক ভাগকে আঁকড়ে থাকতে হবে প্ৰাণপণে, এবং সবখানে চাই তার প্রসারমন্ত্রীগিরি থেকে পেয়াদাগিরি পর্যন্ত। এবং এই ভাগাভাগির মূল মালিক ইংরেজকে রাখতে হবে হাতে, কখনও চোখ রাঙিয়ে কখনও চোখ নামিয়ে; এবং সবচেয়ে বড় কথা তার স্বার্থে ঘা না দিয়ে। তার খোদার মেহেরবানিতে এমন দিনও আসতে পারে, যখন বাংলাদেশের চাকরি-বাকরি মুসলমানের হবে একচেট, যেমন এককালে বাঙালি হিন্দুর ছিল। মোট কথা বাঙালি মুসলমান চাকরি চাই–চাকরি আরও চাকরি।

8

উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু যে ক্ষোভ ও আশঙ্কায় চঞ্চল হয়ে উঠবে তাতে বিচিত্র কী! যে ইংরেজিশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাঙালি হিন্দুর মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্ক এই চাকরি তাদের প্রাণস্য প্ৰাণঃ। সরকারি চাকরি, আধা-সরকারি চাকরি, সরকারকে যাঁরা চালায় এবং সরকার যাদের জন্য চলে, সেই ইংরেজ সওদাগরের চাকরি। এ শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে এই চাকরিতে, চাকরিতেই তা বেঁচে আছে, এই চাকরির লোপে তার বিলোপের ভয়। যার এ চাকরি যখন অন্ন তখন বাঙালি হিন্দুর মন ও আনন্দ যে আধুনিক কালচারের ফুল ফুটিয়েছে তার রসও আসছে সেখান থেকেই। সে ‘কালচারের ভালমন্দ যাই থাকুক ভারতবর্ষে তা অদ্বিতীয়। এ সব চাকরির উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন হলেও তার কতকগুলি বিদ্যা ও বুদ্ধিকে প্রয়োগ করে সার্থক করায় সুযোগ, সুতরাং আত্মতৃপ্তির মূল, এবং সম্মান ও প্রতিপত্তির হেতু। এই চাকরির যা এখন বাঙালি হিন্দুর হাতে আছে তার অধিকাংশ অন্যের হাতে যাবার সম্ভাবনার উদ্বেগ ও আশঙ্কা স্বাভাবিক। এবং এমন লোকের হাতে যদি যায় তুলনায় যাদের বিদ্যাবুদ্ধি ও যোগ্যতা কম তাতে ক্ষোভের কারণও আছে যথেষ্ট।

সুতরাং এর প্রতিকারের ডাকে ইংরেজিশিক্ষিত হিন্দু বাঙালির বড় রকম সাড়া পাওয়া যাবে। সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগি বন্ধ করতে হবে। সব অনিষ্টের মূল কারণ সাম্প্রদায়িক নির্বাচন তুলতে হবে। সেজন্য বাঙালি হিন্দুর একজোট হওয়া চাই। জাতীয় কংগ্রেস থেকে সরে দাড়াতে হবে, ‘হিন্দু মহাসভা’র নামে জয়ধ্বনি দিয়ে। ভারতবর্ষের জন্য হিন্দুদের সঙ্গে মিলে সংঘ গড়তে হবে হিন্দুর স্বার্থ রক্ষার জন্য। হিন্দুকে হিন্দু না রাখলে কে রাখবে? মোট কথা ভারতবর্ষ ও বাংলার মুসলমান যেমন হয়েছে কমুন্যাল হিন্দুস্থানের এবং বাঙালি হিন্দুকে হতে হবে তেমনি কমুন্যাল, কথায় না হোক মনে এবং কাজে। মুসলমানের স্বতন্ত্র স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজন যে দেশের হিতের জন্যই মোসলেম লিগের কর্তাদেরও সেই বুলি। বাঙালি হিন্দুর এই নবলব্ধ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি যে মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার প্রতিক্রিয়া তাতে সন্দেহ নেই। সেই জন্য এইসব বক্তৃতায় প্রবল উৎসাহ সঞ্চার হয়, এবং বক্তার নামে ঘন ঘন জয়ধ্বনি ওঠে। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর সব সময় উহ্য থেকে যায় বাংলাদেশে হিন্দুর চেয়ে মুসলমান সংখ্যায় বেশি। বাঙালি হিন্দু যদি বাঙালি মুসলমানের কমুন্যালিজমের আঘাতে ও অনুকরণে তাদের মতোই কমুন্যাল হয় তবে মুসলমানের সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি না কমে অবশ্য বেড়ে যাবে। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ভয়ে মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। ঘাত প্ৰতিঘাতে দু’ পক্ষের সাম্প্রদায়িকতার বৃদ্ধি হবে। দলাদলি করে দলাদলি কমে না, বেড়েই যায়। এমন অবস্থায় যদি কমুন্যাল ইলেক্টোরেটের পরিবর্তে সম্পূর্ণ ডেমোক্রেটিক নির্বাচক মণ্ডলীর ব্যবস্থা হয় তাতে কীসের ভরসা যে মুসলমান নির্বাচিত হবে এখনকার চেয়ে কম সংখ্যায়, বা যাঁরা হবে তাদের কমুন্যাল মনোবৃত্তি হবে বর্তমানের চেয়ে কম। এবং তা না হলে সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগি ও বিশেষ স্বার্থের দাবি কেন দূর হবে, আর হিন্দুর হিত বা দেশের হিত সিদ্ধ হবে কেমন করে! দেশের মন যদি থাকে কম্যুনাল পুরো ডেমোক্রেটিক নির্বাচনের ফলে ঘোর কম্যুনাল রাষ্ট্রসভার সৃষ্টি কিছু অসম্ভব নয়। যাঁরা আশা করেন মিশ্র নির্বাচনের প্রতিযোগিতায় মুসলমানকে কুডুতে হবে হিন্দুর

পড়বে, যাঁরা মধ্যপন্থী তারাই হবে নির্বাচিত তাদের নিরাশ হতে দেরি হবে না। রাগ দ্বেষ যখন প্রবল থাকে তখন ও রকম ভোট ভাগাভাগি বেশি হয় না। তখন হিন্দুয়ানির ডাকে হিন্দু দেবে হিন্দুকে ভোট, মোসলেমের ডাকে মুসলমান দেবে মুসলমানকে ভোট। যাঁরা উৎকট মুসলমান ও উৎকট হিন্দু তারাই যেতে পারবে প্রতিনিধি হয়ে, আপোষ্যপন্থী কাফের ও অনাৰ্য হবে একঘরে। খাঁটি হিন্দু ও খাঁটি মুসলমানের এই মিশ্র নির্বাচনের এমন পরিণতি হতে পারে যে বাঙালি হিন্দুকে ছুটতে হবে ইংরেজের দরবারে ডেমোক্রেটিক কুত্তা বলিয়ে নেবার আর্জি পেশ করতে।

বাঙালি হিন্দু মুসলমানের ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রিক দল গড়ার স্পষ্টাৰ্থ দু’ পক্ষের পাল্লা দিয়ে ইংরেজের আনুগত্য করা। আমরা হিন্দু কারও অহিত করতে চাই না, শুধু চাই নিজেদের ন্যায্য স্বাৰ্থ রক্ষা করতে; আমরা মুসলমান কারও অনিষ্ট চিন্তা করি না, কেবল নিজেদের ন্যায়সঙ্গত দাবির পূরণ চাই এ বুলিতে সত্য উলটে যায় না। সে সত্য হচ্ছে ধর্মমতের তফাত রাষ্ট্রীয় কাজে অবাস্তর। যেখানে পরাধীন দেশে সেই ভেদকে করতে হয়। স্বতন্ত্র অধিকারের ন্যায় অন্যায়ের বাটখারা সেখানে এই বিরুদ্ধ স্বার্থের ‘ব্যালান্স’ রক্ষার ভার যাবেই যাবে তৃতীয় পক্ষের হাতে। সে তৃতীয় পক্ষ নিরাসক্ত মধ্যস্থ নয়। নিজের দিকে পাল্লা ভারী করতে এমনকী মাপ সমান রাখতে তাকে খুশি করতে হবে। তার দাম আছে। শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু যদি সে দাম দিতে রাজি থাকে চেষ্টা করে দেখতে পারে। সে দাম হচ্ছে ভারতবর্ষের বর্তমান জাতীয় আন্দোলন থেকে সরে দাড়াতে হবে। কথায় না হোক কাজে হতে হবে তার পরিপন্থী। এ দেশে ইংরেজের যে শক্তি ও সুবিধা আছে তাকে বহাল রাখতে, এবং বর্তমানে তার যেটুকু লাঘব হয়েছে তার পূরণে ইংরেজের পুরো সহায় হতে হবে।

বাঙালি হিন্দুর বুদ্ধির উপরে ইংবেজের কিঞ্চিৎ আস্থা আছে। দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষ বিজয়ে তার এই সাহায্য ইংরেজ স্বীকার করলেও করতে পারে। এবং তার বিনিময়ে ছোট বড় চাকরি ও আনুষঙ্গিক প্রভাব প্রতিপত্তির আর্জি হয়তো মঞ্জুর হবে। বাঙালি হিন্দুর স্বতন্ত্র স্বাের্থ রক্ষায় হিন্দুর একজোট হওয়ার যে ডাক সে এই পথে চলার ডাক। কিছু কাজ আরম্ভ হলেই তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ভারতবর্ষে মহারাষ্ট্রের স্বপ্ন বাঙালি হিন্দু দেখেছে ও ভারতবাসীদিগকে দেখিয়েছে। সে আদর্শের অনুকরণে মৃত্যুপণ তার নিকট অতীতের ইতিহাস। সে আদর্শ ও ইতিহাসকে অস্বীকার করে খণ্ড খণ্ড স্বার্থের রক্ষায় বিদেশির চির প্রভুত্বই কি সে বরণ করবে? গোয়ালন্দের পদ্মা কি হরিদ্বারের ঘাটে ফিরে যাবে, মহাতীর্থের পুণ্যলোভে? আমাদের যৌবনে স্বদেশীয় যুগে আমরা একটি গান গেয়েছি, যার ভাবাৰ্থ মার দিয়ে দেশকে ভুলাবে আমরা দেশের তেমন ছেলে নই। হাতের মারে আমরা দেশকে ভুলি নাই, ভাতের মারের ভয়ে ভুলি কিনা তার পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছে।

বাঙালি হিন্দু পাশ না ফেল?

তবে এ সাম্প্রদায়িক মহামারী থেকে দেশকে বাঁচাবার কি উপায় নেই? আছে না আছে স্থির করতে এ রোগের নিদান জানা চাই। রোগ জানলেই যে তার ঔষধ আছে এমন নয়, কিন্তু রোগ নির্ণয় না হলে চিকিৎসার চেষ্টাই চলে না হাতুড়ে চিকিৎসা ছাড়া। বর্তমান সাম্প্রদায়িক বোগের ব্যাসিলাই উৎপত্তির প্রধান বীজাণুক্ষেত্র হচ্ছে শিক্ষিত হিন্দু মুসলমানের চাকরির দ্বন্দ্ব, চাকরি এক প্রতিপত্তি, চাকরির ফলে প্রতিপত্তি, প্রতিপত্তির ফলে চাকরি দেশের অশিক্ষিত ও আচাকুরে হিন্দু মুসলমান জনসাধারণ, যাদের নামে এবং ভরসায় এই দ্বন্দ্ব চলে তাঁরা করে এতে লাঠিয়ালি বিনা ভাতায় নিজের খেয়ে। এই লাঠালাঠিতে তাদের নিজের হিত কিছুমাত্র নেই, অহিত আছে। ষোলো আনা, দেশের সকল উন্নতির পথ বন্ধ হয় বা বিপথে চলে। ধর্মের নামে অন্ধ উত্তেজনায় এই অজ্ঞানদের নিজের ভাল মন্দ বোধ লোপ হয়, আর সে উত্তেজনার সৃষ্টি করে শিক্ষিত মুসলমান ও শিক্ষিত হিন্দু নিজেদের শ্রেণির সাংসারিক স্বর্থ ও সাংসারিক ক্ষমতা হাসিল করার অভিসন্ধিতে। কমুনাল রোগের এই নিদান। অন্য সব কারণ এই মূল থেকেই পুষ্টি পেয়ে রোগকে জটিল করে তোলে। সুতরাং এ রোগের চিকিৎসা দেশের জনসাধারণকে মুসলমান চাষি ও হিন্দু চাষিকে, মুসলমান কারিকর ও হিন্দু কারিকরকে, মুসলমান মজুর ও হিন্দু মজুরকে পলিটিকাল দল গড়তে শেখান পলিটিকাল আদর্শ ও উপায়ের ভিত্তিতে। কলমা পড়া ও গায়ত্রী জাপার ভেদ ও সাম্য দলে টানার ফন্দি ও ফাকিতে তাদের সচেতন করা। দেশের হিন্দু মুসলমান জনসাধারণ যেদিন নিজের স্বাৰ্থ মোটামুটিও বুঝবে, যেদিন পলিটিকসে দীন-এর তত্ত্ব ছেড়ে দুনিয়ার তথ্যে চোখ যাবে শিক্ষিত হিন্দু মুসলমানের চাকরি প্রতিপত্তির ঝগড়ার সেই দিন হবে সমাপ্তি। কারণ যে খুঁটির জোরে লড়াই সে আর খুঁটিগিরি করতে রাজি হবে না। কলমা গায়ত্রীর চাকরি ভাগাভাগির দ্বন্দ্ব দেশ তখন বরদাস্ত করবে না। চাকরে হিন্দু মুসলমানের কমুন্যাল বিষ ছড়ান বন্ধ হবে না, যতদিন না। অ-চাকরে জনসাধারণের নিজেদের পলিটিকস সে বিষের থলি উগরে ফেলে। শিক্ষিত হিন্দু মুসলমান অন্যান্যের যুদ্ধ সজ্জার ভয়ে বা যুদ্ধান্তে নিজেরাই চাকরি প্রতিপত্তির একটি রফা নিম্পত্তি করে দেশের বড় কাজে হাত দেবে। সে আশা দুরাশা। চাকরির কামনা চাকরিতে শান্ত হয় না; যত পাওয়া যায় লোভ ততই বাড়ে। হবিষা কৃষ্ণবৰ্ম্মেব ভুয় এবাভি বৰ্দ্ধতে।’ কমুন্যাল রোগের চিকিৎসা দেশের চাকরিপন্থীদের হাত থেকে দেশের পলিটিকসকে ছিনিয়ে নেওয়া।

এ কাজ কঠিন। এ পথ চড়াই উতরাই-এর বিষম পথ; যার মোড়ে মোড়ে বিপদ। এ পথে প্রকাশ্য ও গোপন মুসলমান ও হিন্দু শত্রুর অবধি থাকবে না। স্বর্থনাশের যাদের আশঙ্কা। যাদের মধ্যে কাজ এবং যাদের জন্য কাজ তারাই সন্দেহ করবে ও মারমুখ হবে। তাদের উত্তেজিত করার লোকের অভাব হবে না। কমুনিস্ট বলে পুলিশ লেলিয়ে দেবার কমুন্যালিস্ট জুটবে অনেক। এ কাজের উপায় মানুষের বুদ্ধিকে জাগান, অন্ধ সংস্কারকে উসকান নয়। সবচেয়ে কঠিন কাজ। বিশেষ সে মানুষের দলের অধিকাংশ যখন নিরক্ষর অজ্ঞান। এ কাজের যাঁরা কমী তাদের চেতন ও অবচেতন মনকে করতে হবে সকল রকম সাম্প্রদায়িক রাগ দ্বেষের কলুষমুক্ত। এবং আচার ব্যবহারে যাঁরা ভিন্ন তাদের সঙ্গে শক্রিতায় ক্রোধ ও ঘূণার যে তীব্র মাদকতা তাতে মাতাল হওয়ার আনন্দ এতে নেই। বহু শ্ৰমে ফল ফলবে অল্প, বহু ডাকে সাড়া দেবে অল্প লোক। আশা ভঙ্গ হবে পদে পদে। তবু এই পথই পথ, আর সব অন্ধগলি।

এ পথেও সিদ্ধ যে অবশ্যম্ভাবী তা নয়। জাতির এমন দুর্দিন আসে, যখন ক্ষুদ্র স্বাৰ্থ, ক্ষুদ্র লোভ অন্ধ বিদ্বেষকে দূর করে তার শুভবুদ্ধি কিছুতেই জাগে না। ভারতবর্ষ ও বাংলার যদি এমন দুর্ভাগাই হয়, যদি জাতীয়তার কোনও মন্ত্রেই সাম্প্রদায়িক বিষ ধ্বংস না হয় তবে মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার পালটায়, তার আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা হয়তো অনিবাৰ্য হবে। কিন্তু তাতে উৎসাহের কিছু নেই; সে আমাদের পরাজয়। এমন প্রাণী আছে পারিপার্শ্বিক যখন তাদের স্বাভাবিক জীবনলীলার প্রতিকূল হয় উচুস্তরের প্রাণীর উপযোগী শরীরের যন্ত্রপাতি লোপ হয়ে তাঁরা ধাপে ধাপে নেমে যায় আদিম ভ্ৰাণের পিণ্ডাকার অবস্থায় শুভ দিনের অপেক্ষায়। তবুও বেঁচে থাকে। সে বাঁচা জীবস্মৃত্যু, হিন্দু স্মৃতিকারেরা যাকে বলেছেন জীবন্ত শব। জীবিত এব। শব্বাস্তে তস্মাৎপািরশবা স্মৃতাঃ। জাতির পারিশবত্ব প্ৰাপ্তি জয়ধ্বনির কারণ নয়।

কমুন্যাল সমস্যা মীমাংসার অন্য উপায় যে কল্পনা করা যায় না তা নয়। ভারতবর্ষের বাইশ কোটি হিন্দু আট কোটি মুসলমানকে দমিয়ে ইংরেজকে তাড়ালে, অথবা আট কোটি মুসলমান বাইশ কোটি হিন্দুকে দাবিয়ে ইংরেজকে খেদালে এ সমস্যার অবশ্য মীমাংসা হয়। হিন্দু মহাসভার ভীষ্ম দ্রোণেরা ও মোসলেম লিগের সিংহ ব্যাঘ্ররা চেষ্টা করে দেখতে পারেন। তবে যে শক্তিতে সম্ভব চাকরির ভাগাভাগির উৎসাহে তার সৃষ্টি হয় না। ভাতেব চুল্লির আগুনে ড্রেড নট চলে না।

উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দুর চাকরি ও প্রতিষ্ঠার উপর মুসলমানের সাম্প্রদায়িক অভিযানের একটা সুফল ফলেছে। উচ্চ হিন্দু যে বাঙালি হিন্দু সমাজের ক্ষুদ্র অংশ সে চেতনার শুরু হয়েছে। ভাব ও চিন্তার প্রচার অল্প লোকে করা যায়, তার সৃষ্টি করে আরও অল্প লোক, চাকরি ও প্রতিপত্তি প্রার্থী লোক অনেক হলে বিপদ কিন্তু সংখ্যার চাপ যেখানে প্রয়োজন সেখানে দল বড় না হলে কাজ হয় না। বাঙালি হিন্দুর এই সংখ্যা আছে উচ্চবর্ণের হিন্দুর মধ্যে নয়, নিচু জাতি হিন্দু পল্লির ভিতরে। সুতরাং উচ্চবর্ণের হিন্দু মুখে এনেছে যে উঁচু নিচু সব হিন্দু আমরা পরস্পরের ভাই। আমরা ভিন্ন নই, আমরা এক।

এই নিম্ন শ্রেণি হিন্দুর প্রাণশক্তি যে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে, অর্থহীন ও আত্মঘাতী আচারের নাগপাশে যে তাদের হৃৎপিণ্ড বন্ধ হবার উপক্রম, জীবনকে পঙ্গু করে। মৃত্যুকে ঘনিয়ে আনার যত রকম ফন্দি দিনের পর দিন যে তাঁরা আবিষ্কার করে চলেছে সে দিকেও দৃষ্টি পড়েছে। এরা যে কত দুর্বল, নিজের শক্তিতে কত আস্থাহীন, যেখানে এরা সংখ্যায় অল্প এবং যেখানে এরা সংখ্যায় বেশি প্রতিবেশী দুর্দান্ত মুসলমানের অত্যাচার যে এরা বিনা প্ৰতিকারে সহ্য করে, স্ত্রী কন্যার সম্মান রক্ষায় হাত তুলতে ভরসা করে না সে বার্তাও আমাদের বিচলিত করতে আরম্ভ করেছে। এ সব ব্যাপার নতুন নয়, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের পর থেকে এদের আরম্ভ হয়নি। দু-চারটি সন্ন্যাসী গোছের প্রতিষ্ঠান ছাড়া উচ্চ হিন্দুর ব্যাপক দৃষ্টি এতদিন এদিকে যায়নি। আজ যাচ্ছে নিষ্কাম প্রীতিতে নয়, নিজের গরজে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। কোন আঘাতে চৈতন্য এল সেটা মুখ্য নয়, আশার কথা যে ঘুম ভাঙছে।

এর প্রতিকারের যে উপায় উচ্চবর্ণের হিন্দু ব্যবস্থা করছে তার নাম ‘হিন্দু-সংগঠন’।

হিন্দুর সঙ্গে হিন্দুর, উচ্চ শ্রেণির সঙ্গে নিম্ন শ্রেণির হিন্দুর নডির যোগ এমন দৃঢ় করতে হবে যে এক অঙ্গের আঘাতে সমস্ত শরীর ব্যথা পাবে এবং প্রতিবিধানে তৎপর হবে।

অসহায় নিম্ন শ্রেণির হিন্দুকে ভরসা দিতে হবে, কথায় ও কাজে, যে তাঁরা অসহায় নয়, উচ্চ শ্রেণির শিক্ষিত হিন্দু, যাদের অর্থ আছে, বুদ্ধি আছে, বল আছে, তাঁরা তাদের ভাই, আপদ বিপদে সহায়, সুখ দুঃখের ভাগী। এবং আশা করা অন্যায় হবে না যে এতে নিম্ন শ্রেণির হিন্দু ও উচ্চবর্ণের হিন্দুর আপদ বিপদ নিজেদের আপদ বিপদ মনে করবে, সব কাজে তাদের অনুবতী হবে, সংখ্যার প্রয়োজনে নিজেদের সংখ্যা দিয়ে বাঙালি হিন্দুর অখণ্ড সংখ্যা বাড়াতে দ্বিধা করবে না।

যে সংগঠন’ বাঙালি হিন্দুকে বড় ছোট অভেদে এক গোষ্ঠী করে গডতে চায় তার প্রেরণা যে অবস্থার ফেরেই এসে থাকুক না কেন জাতির পক্ষে তা পরম মঙ্গলের। কিন্তু প্ৰথম উৎসাহের উত্তেজনার ফেনা প্ৰশমন হলেই দেখা যাবে যে এ সংগঠনের যে সব পেটেন্ট মাল মশলার বিজ্ঞাপনে দেশের মনের দেয়াল ভর্তি, গড়নের কাজ তা দিয়ে বেশি দূর এগোয় না। কারণ তাতে আর যাই থাকুক চুন সুবকি নেই। ইট সাজান যায়। কিন্তু তাদের জোড়া লাগান যায় না।

যে আশ্চর্য ভ্রাতৃত্বে ভাইয়ের স্পর্শ অশুচি, তার হাতের অন্ন অমেধ্য, তার সঙ্গে সামাজিক সম্বন্ধ পাতিত্য আনে সেই আধ্যাত্মিক ভ্ৰাতৃত্ব নিয়ে কোনও রকম ব্যাবহারিক একত্ব বন্ধন সম্ভব নয়। অস্পৃশ্যতা বর্জন, মন্দিরের দ্বার মোচন, হাতের জল চল এ সব উপসর্গের চিকিৎসা, রোগকে রহাল রেখে। রোগ থাকতে উপসৰ্গ দমন করা যাবে কিনা সন্দেহ। আর যদি যায়। তবে সে রোগ যে অন্য উপসর্গের আকারে অচিরেই আত্মপ্ৰকাশ করবে তা নিঃসন্দেহ। হিন্দু সমাজের সেই মূল রোগ হচ্ছে জাতি ভেদের গণ্ডি। ওর অভেদ্য খোলার আবরণ সমস্ত সমাজে এক নাড়ির যোগ স্থাপন অসম্ভব করেছে। হিন্দু সংগঠন যদি প্রকৃতই সে কাজ করতে চায়। তবে ওই গণ্ডি তুলতে হবে, ওই খোলা ভাঙতে হবে। জাতির খোপ খোপ যেমন আছে তেমনি থাকবে, শুধু ভাই বলে ডাক শুনে সমস্ত হিন্দুর হবে এক মন, এক প্ৰাণ–এ আশা নিজেকে বঞ্চনা করা, পরকে ফাকি দেওয়া। সামাজিক অসম্বন্ধের গভীর পরিখার যে ভেদ সুস্পষ্ট নামের জোরে সে ভেদ অভেদ প্রমাণ হবে না, কলিতে নামের মাহাত্ম্য যতই প্রবল হোক। আর এ সব বর্জন মোচন আন্দোলনের মধ্যে যে মনুমেন্ট স্পশী দম্ভ রয়েছে। কেবল শুনে শুনে গা সওয়া হয়েছে বলেই আমরা তাতে লজ্জা পাইনে। আমাদের স্পর্শ পেলে নিম্ন হিন্দু কৃতাৰ্থ হবে এ রামচন্দ্ৰত্বের অভিনয় উচ্চবর্ণের হিন্দু করে কোন লজ্জায়! আমাদের দেব মন্দিরে ঢোকার অধিকারে চণ্ডাল হবে। ধন্য দেবতার এ অপমান তাঁরা করে কোন সাহসে যাঁরা গর্ব করে বলে হিন্দুর ‘সৰ্ব্বং খন্বিদং ব্ৰহ্ম’।

এ প্রস্তাবে তর্ক উঠবে জানি ইতিহাস, বিজ্ঞান, শাস্ত্রের তর্ক। এমন কােনও প্রস্তাব আছে পণ্ডিত লোকে যাকে গ্রাহ্য অগ্রাহ্য দুই প্রমাণ করতে না পারে।

অতি বুদ্ধিমান লোক বলে হিন্দু সমাজে উচু জাত যে তার নিচু জাতের হাতে ভাত খায় না, তাদের মধ্যে বিবাহ সম্বন্ধ যে নিষেধ, তার মধ্যে ঘূণা অবজ্ঞার লেশ নেই। ওটা শুধু আচার, যেমন অনেক বিধবা মা ছেলের হাতের ছোয়া খান না। তফাত কেবল এই শূদ্রের উপর ব্ৰাহ্মণের মনোভাব ছেলের উপর মায়ের মেহ নয়, অন্তত শূদ্র তার কোনও প্রমাণ পায় না। অন্য সমস্ত গুণ দোষ নিরপেক্ষ কেবল জন্মের ফলে একদল লোকের শ্রেষ্ঠত্ব ও অন্যদলের হীনত্ব জাতি ভেদের ভিত্তি। মনু বলেছেন বটে যে ব্ৰাহ্মণের শাস্ত্রোক্ত গুণ নেই সে হচ্ছে তেমনি ব্ৰাহ্মণ যেমন কাঠের হাতি ও হাতি। কিন্তু সেই পুতুল ব্ৰাহ্মণেরও শূদ্রের মেয়ে বিয়ে করলে জাত যায়, সে শূদ্রের যতই ব্ৰাহ্মণোচিত গুণ থাকুক না কেন। নিজের শ্রেষ্ঠত্ববোধ ও অন্যের হীনত্বের ধারণা এক বস্তুর দুই পিঠ। একটি ছেড়ে অন্যটি থাকে না। জাত অল্প নিচু হলে তার উপর অবজ্ঞা, আর বেশি নিচু হলে তার উপর ঘূণা এর অবশ্যম্ভাবী ফল। অবশ্য এই অবজ্ঞা ও ঘূণা যখন দু’পক্ষের একান্ত অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন যে ঘূণা করে তার সে মনোভাবে কোনও তীক্ষতা থাকে না, যে ঘূণা পায় তারও অপমানের বোধ থাকে না। ব্যাপারটা দু’ পক্ষের রোদ বাতাসের মতো স্বাভাবিক মনে হয়। দাসত্বের ইতিহাসে বার বার তা প্রমাণ হয়েছে। এটা ঘূণার অভাব নয়, ঘূণার চরম ও ভয়ংকর পরিণতি। যাক এ মনস্তত্ত্বের তর্কে লাভ নেই। যাদের বাঁচিয়ে আচার’ তাঁরা একে অপমান বলে মনে করতে আরম্ভ করেছে। শিক্ষিত ও উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যা তাদের মধ্যে যত বাড়বে এ অপমানের বোধ তত বেশি হবে, এবং জাতের দেয়াল আঁকড়ে থাকলে উচ্চবর্ণের হিন্দুর সঙ্গে তাদের বিচ্ছেদ হবে অনতিক্রমণীয়। এর লক্ষণ চার দিকে দেখা যাচ্ছে ‘হিন্দু সংগঠনে’ যাঁরা উদ্যোগী একে উপেক্ষা করার তাদের উপায় নেই।

ইতিহাসের তর্ক কম নয়। এ জাতিভেদ তো হিন্দু সমাজে হাজার হাজার বছর রয়েছে। আর হিন্দু সভ্যতা আজও টিকে আছে। কোথায় অন্য সব প্রাচীন সভ্যতা! হিন্দু সভ্যতা যে টিকে আছে, অর্থ তার যাই হোক, আর এককালে যে সে সভ্যতা গৌরবের ছিল সেটা জাতিভেদের ফল নয়, জাতিভেদ সত্ত্বেও অন্য গুণে এবং পারিপার্শ্বিকের অনুকুলতায়। বাইরের আঘাত যেই প্রবল হয়েছে অমনি ওই দুর্বলতা তাকে আচ্ছন্ন করেছে। শরীরে অনেক রোগের বীজ থাকে। তা সত্ত্বেও মানুষ বেঁচে থাকে মোটামুটি সুস্থ অবস্থায়, শরীরের অন্য শক্তি যতদিন রোগের বীজ চেপে রাখতে পারে, এবং পারিপার্শ্বিক যতদিন বীজ থেকে রোগ প্রকাশের অনুকুল ক্ষেত্র তৈরি না করে। যখন যা ঘটে তখন জীবনযাত্রার প্রণালী বদলাতে হয়, রোগ প্ৰতিষেধের বিশেষ উপায় করতে হয়। সহজ কথা অবস্থা বদলেছে, বাঁচতে হলে ব্যবস্থা বদলাতে হবে। সেইজন্য হিন্দুর ‘স্মৃতি’ বার বার বদল হয়েছে, এক এক মুনির সঙ্গে অন্য মুনির মতের মিল নেই।

তর্কটা যখন পণ্ডিত লোকেই তোলে তখন দু-একটা কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া অবান্তর নয়। হিন্দুর জাতিভেদের আজ যে চেহারা, ভাতের হাঁড়ির শুচিতা, ও বিবাহে পাথরের বেড়া, হিন্দু সভ্যতার গৌরবের দিনে তার এমন আকার ছিল না। আপস্তম্বের স্মৃতিতে দেখি পাকটা ছিল আৰ্যাশ্রিত শূদ্রের কাজ, কেবল নামটা দেওয়া হয়েছিল। পাকযজ্ঞ। অনুলোম বিবাহ হিন্দু সভ্যতার গৌরবের শেষ যুগ পর্যন্ত চলতি ছিল; স্মৃতি গ্রন্থের পাতায় নয়, সামাজিক ব্যবহারে। একটা দৃষ্টান্ত দিই বাণভট্ট মহারাজ হর্ষবর্ধনের সমসাময়িক; হিন্দু সভ্যতার গৌরবের শেষ যুগ, অনেকের মতে সবচেয়ে গৌরবের যুগ যখন সে সভ্যতা এশিয়ায় সর্বশ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃত হয়েছিল। বাণভট্টের বংশ বেদজ্ঞ ব্ৰাহ্মণের বংশ। যার পরিচয়ে তিনি ‘কাদম্বরী’র প্রস্তাবনা শ্লোকে বলেছেন যে, অনেক গুপ্ত রাজারা তার পূর্ব-পুরুষের পাদপল্লব অৰ্চনা করেছেন। তাদের বাড়ির পোষা শুকপক্ষীও ক্রমাগত তন শুনে বেদমন্ত্র উচ্চারণ করত। সেই বাণভট্ট ‘হর্ষচরিতে’ বিনা দ্বিধায় লিখেছেন যে, তিনি তার পিতার ব্ৰাহ্মণী পত্নীর পুত্র, কিন্তু তাঁর আর দুটি ভাই আছে যাঁরা তাঁর পিতার শূদ্র স্ত্রীর সন্তান; তাদের নামও তিনি দিয়েছেন। সেদিনকার উচ্চ ব্ৰাহ্মণ সমাজে যদি এমন বিবাহে বিন্দুমাত্রও দোষ বর্ণনা থাকত, বাণভট্ট সে কাহিনি কখনই লিখতেন না।

কিন্তু বায়লজি’ কি এ প্রস্তাবের বিরোধী নয়? হিন্দুসমাজে এই যে উচ্চ জাতি নিচু জাতির ভেদ একি কতকগুলি বিশেষ শ্রেষ্ঠ গুণকে রক্ত মিশ্রণে লোপের আশঙ্কা থেকে বঁচিয়ে চিরকালের জন্য রক্ষা করার ব্যবস্থা না? এ ভেদ তুলে দিয়ে একাকার করলে কি বহুকালের গুণের পুঁজি তছরূপ হবে না? বাঙালি ব্ৰাহ্মণ ও বাঙালি শূদ্রের দিকে তাকিয়ে, ও শিক্ষা সমান পেলেও তাদের বুদ্ধির তারতম্যে, যাঁরা জাতির তফাত দেখতে ও ধরতে পারেন, তাঁরা নিশ্চয় অসামান্য লোক! বাঙালি ব্ৰাহ্মণের ফরসা চামড়া, কটা চামড়া, কাককৃষ্ণ চামড়া; উচু নাক, খাদা নাকি; লম্বা মাথা, গোল মাথা সব দেখেও তাদের রক্তের বিশুদ্ধতায় যাঁরা বিশ্বাস হারান না, তাদের বৈজ্ঞানিক মতের দৃঢ়তাও অসাধারণ। মানুষে মানুষে ভেদ আছে, বুদ্ধির শক্তির, নানা পটুতার যা জন্মগত; কোনও শিক্ষার বলে সে ভেদ লোপ করা যায় না। এর চেয়ে স্পষ্ট সত্য আর কী আছে! কিন্তু যাঁরা প্রমাণ করতে চান যে হিন্দুর জাতিভেদ মানুষে মানুষে এই স্বাভাবিক প্রভেদের রেখা ধরে নিজের গণ্ডি এঁকেছে৷ তাঁরা ‘বায়লজি’র নাম নেন বৃথা। বায়লজি’ কেবল প্রমাণ করবে যে এই কল্পনার সঙ্গে পরীক্ষিত সত্যের, সুতরাং বিজ্ঞানের কোনও সম্বন্ধ নেই। জাতিভেদ তুলে দিলে হিন্দু সমাজ একাকার হবে না। অন্য আর সব সমাজের মতো নানা স্বাভাবিক ভেদ বজায় থাকবেই। যেমন শিক্ষিত পরিবারের সঙ্গে অশিক্ষিত পরিবারের বিবাহ সম্বন্ধ ঘটবে কদাচিৎ।

এবং শিক্ষিত হবার সামৰ্থই প্রমাণ দুই পরিবারের জন্মগত গুণের অমিশ্রেয় প্রভেদ কিছু বর্তমান নেই।

প্রাচীন হিন্দু আচার্যেরা জাতিভেদের গুহাস্থিত এই ‘বায়লজির তত্ত্ব অবশ্য অবগত ছিলেন না। মনুর ‘ভাষ্যে’ মেধাতিথি প্রশ্ন তুলেছেন ব্ৰাহ্মণ জাতি ও শূদ্র জাতির এই যে ভেদ এ কেমন ভেদ? একি গোজাতি ও অশ্বজাতির যে দৃষ্ট ভেদ, তাকিয়ে দেখলেই দেখা যায়, সেই রকম ভেদ, অবশ্য নয়; কারণ দেখে কেউ বলতে পারবে না কে ব্ৰাহ্মণ কে শূদ্ৰ। সুতরাং এ ভেদ অদৃষ্ট শাস্ত্রীয় ভেদ, লৌকিক জ্ঞান দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু এ কালের সনাতন পন্থীরা মীমাংসকদের লৌকিক অলৌকিক জ্ঞানের তফাত মানে না। হিন্দুধর্মের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় সুবিধা পেলেই তাঁরা রাজি। প্রাচীন ঋষিদের অভ্রান্ত জ্ঞানের উপর তাদের অগাধ ভক্তি, এবং আধুনিক পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের জড়বাদের উপর তাদের অসীম অবজ্ঞা। কিন্তু ও বিজ্ঞানের কোনও কিছু তাদের সনাতন মতের সমর্থন মনে হলেই তৎক্ষণাৎ তা লুফে নেন। কিছু আশ্চর্য নয়। তাঁরা আঁকড়ে থাকতে চান তাদের সংস্কারগুলিকে, বিনা বিচারে ও বিশ্লেষণে। যদি ঋষিবাক্য পাওয়া যায় ভালই। আর যদি জড়বাদী, ম্লেচ্ছ বৈজ্ঞানিকের সমর্থন পাওয়া যায় সেভি আচ্ছা।

যাঁরা বলেন জাতিভেদ হিন্দু ধর্মের অত্যাজ্য অঙ্গ, ওকে না মানলে ধর্ম হানি হয়, এবং ঐহিকের সুবিধার জন্য পািরত্রিক ক্ষতি মুর্খতা তাদের কোনও তর্কই নেই। বাংলাদেশে ও ভারতবর্ষে হিন্দু বঁচুক কি মরুক সেটা বড় কথা নয়, জাতিভেদের শুচিত রক্ষা তার চেয়ে অনেক বড় কথা। তাঁরা সে শুচিত সযত্নে রক্ষা করুন। তাদের অশূদ্ৰস্পষ্ট স্বর্গের দরজা কেউ অববোধ করবে না।

এত কালের অভ্যস্ত প্ৰথা বর্জন করতে বহু তর্ক ও বহু আন্দোলনের ফলেও সমস্ত বাঙালি হিন্দু একমত হবে সে আশা কেউ করে না। এবং এখানে ওখানে দু-চার জন ন্যায় ও ধর্ম বোধে জাতি বর্জন করলে তাঁরা একঘরে হওয়া ছাড়া বাঙালি হিন্দু সমাজের উপরে তার অন্য ফল আর কিছু ফলবে না। বাঙালি হিন্দুর মধ্যে এ সংস্কার আনার পথ ওকে জাতীয় আন্দোলনের অংশ করা। যাঁরা মনে করে এবং আন্দোলন আলোচনার কালে মনে করবে: ও-ভেদের লোপ জাতির জীবন ও সৃষ্টির জন্য আজ একান্ত প্রয়োজন তাদের দল বেঁধে ওকে বর্জন করতে হবে। হিন্দু থেকে ও হিন্দু সমাজের মধ্যে থেকে জাতিভেদকে অগ্রাহ্য করতে হবে। প্রথম থেকেই সে দল ছোট হবে না, এবং তাকে একঘরে করার চেষ্টা হবে অর্থহীন। দলাদলি অবশ্যই আরম্ভে থাকবে কিন্তু মনে হয় বেশি দিন নয়। ও সংস্কারের মধ্যে সত্যের ও মনুষ্যত্বের যে ভিত্তি এবং প্রয়োজনের যে তাগিদ আছে তাতে অল্প দিনের মধ্যে বিরোধীরাই হবে একঘরে। এবং ফল দেখে চোখের তুলি একবার খুললে স্বাভাবিককেই মনে হবে স্বাভাবিক।

এ কাজ অবশ্য আরম্ভ করতে হবে উচ্চ শ্রেণির হিন্দুর। জাতের গণ্ডি তাঁরা না তুললে শুধু তাদের উপদেশ নিম্নশ্রেণির হিন্দু নিজেদের সব অদ্ভুত ভেদ তুলে দেবে এ মনে করা মূঢ়তা। উচ্চ শ্রেণির হিন্দু অনুকরণেই বাঙালি নিম্ন বর্ণের হিন্দুর মধ্যে জাতির বিভাগ হচ্ছে আদিম cell এর মতো। এক হচ্ছে দুই, দুই হচ্ছে চার। এবং বিবাহের ক্ষেত্র সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়ে বহু শ্রেণির হিন্দু চলেছে লোপের মুখে। উপদেশ বৃথা। নিজের জাত তুলে দিয়ে জাত যে তোলা যায় তা দেখাতে হবে। ‘আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখায়।’ জাতিভেদের উচ্ছেদে বাঙালি হিন্দু যে কেবল নিজেদের যথার্থ এক মনে করে গাঢ়ভাবে সংঘবদ্ধ হবে তা নয়। ওই সংস্কারের চেষ্টায় ও ফলে তার মধ্যে যে শক্তি আজ রুদ্ধ আছে তা প্রকাশের পথ পাবে। এবং তাতে বাঙালি হিন্দুর হবে নবজন্ম, নবশক্তি ও নবদৃষ্টি নিয়ে। বাঙালি হিন্দু আধুনিক ভারতবর্ষকে ভাব ও আদর্শ কম দান করেনি। তার এ চেষ্টা সফল হলে ভারতবর্ষের সমস্ত হিন্দুর উপর তার ফল ফলতে দেরি হবে না।

১০

ইউরোপে যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। অনেকে মনে করেন এ যুদ্ধ ক্ৰমে পৃথিবীব্যাপী হবে, এবং ভরসা করেন তার ফলে মানুষের মধ্যে আসবে এক নবযুগ–‘নিউ অর্ডার’। জাতির সঙ্গে জাতির ও দেশের সঙ্গে দেশের অত্যাচারী অত্যাচারিতের সম্পর্ক আর থাকবে না। পৃথিবীর মানুষ হবে এক গোষ্ঠী, সকলের দরদে হবে সকলে দরদি। এমন যদি ঘটে। তবে কথাই নেই। কোথায় থাকবে বাংলাদেশে ও ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া, আর কোথায় থাকবে বাঙালি হিন্দুর জাতিভেদ ও দুর্বলতা। মহাযুদ্ধের মহামাজিকে ও সব ছোটখাটো ব্যাপার কোথায় তলিয়ে যাবে লক্ষই হবে না। বিনা চেষ্টায় আপনা। আপনি হয়ে যাবে তাদের মীমাংসা।

মানুষের বাইরের ও মনের সভ্যতাকে ধাপে ধাপে টেনে তুলতে হয় প্রাণান্ত পরিশ্রমে। কখনও এক ধাপ উঠে আবার নীচে গড়িয়ে পড়ে। পরিশ্রমের শেষ নেই, আশা ভঙ্গেরও অবধি নেই। যুগ-যুগান্তব্যাপী এই সংগ্রাম জয় হয়ে যাবে একটা মাত্র বিরাট হত্যাকাণ্ডেকারনা আকাঙ্ক্ষা যায় বিশ্বাস করতে! মিরাকলে’ বিশ্বাসের তাই তো মূল।

কুরুক্ষেত্রের ফলে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দাম্ভিক দুৰ্যোধনের রাজ্যহানি ও মৃত্যু এবং মিষ্টভাষী যুধিষ্ঠিরের জয় ও রাজ্যলাভ এ ছাড়া সে ধৰ্মরাজ্যের স্বরূপ কী ছিল বেদব্যাস কিছু বলেননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *