১১. শম্বুক ও মায়াতি: সমাজে শূদ্রের অবস্থান বিষয়ে একটি বিচার

শম্বুক ও মায়াতি: সমাজে শূদ্রের অবস্থান বিষয়ে একটি বিচার

এক

শূদ্র বিষয়ে অধ্যাপক আর এস শর্মার প্রসিদ্ধ বইটি এবং অন্যান্য লেখকের কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষার পরে প্রাচীন বর্ণবিভক্ত সমাজে শূদ্রের স্থান আমাদের সবার কাছে মোটামুটি পরিষ্কার। তেমনই পরিষ্কার রামায়ণ-এর শেষ কাণ্ডে শম্বুক উপাখ্যান। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য শম্বুকের কাহিনির তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ পরীক্ষা করা এবং প্রাক্-মধ্যযুগীয় একটি পুরাণের থেকে একটি চতুর্থ প্রাসঙ্গিক অংশ যোগ করা।

উত্তরকাণ্ডে দেওয়া প্রাচীনতম শম্বুক কাহিনিতে বলা হয়েছে, ‘রাজার কোনও ত্রুটির ফলেই কেবল প্রজাদের অকাল মৃত্যু ঘটতে পারে।’ এ কথা বলেছিল সেই ব্রাহ্মণ যার পুত্র বাল্যকালে মৃত হয়েছিল; সে রামকে সম্পূর্ণ ভাবে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছিল।’[১] তাই রাম বেরিয়ে পড়লেন, কোথায় তাঁর শাসনে ত্রুটি হয়েছে দেখতে; তিনি দেখলেন শূদ্র শম্বুক তপস্যা করছে এবং নারদ এর মধ্যেই ব্রাহ্মণ বালকের অকাল মৃত্যুর হেতু খুঁজে পেলেন।[২] তৃতীয় যুগ দ্বাপরে সুবর্ণময় সত্যযুগের তুলনায় অনেক পাপ ঢুকেছিল, তাই বৈশ্যেরা তখন তপস্যা করতে পারত এবং করতও। কিন্তু শূদ্র? কখনওই না। তাদের একমাত্র ধর্ম উচ্চতর তিন বর্ণের দীন ভাবে সেবা, মনু ও অপর ধর্মশাস্ত্রগুলি যে বিধান দিয়েছেন সেই অনুযায়ী কাজ করা। শুধু তাই নয়, যে রাজার রাজত্বে শূদ্র তপস্যা করে, সেই রাজা নরকে যান। নারদের কথায় রাম শূদ্রকে সম্ভাষণ করে তার পরিচয় এবং তার প্রযত্নের হেতু জিজ্ঞাসা করলেন শূদ্র উত্তর দিল, ‘আমি এই নশ্বর দেহে দেবত্ব লাভ করতে চেষ্টা করছি।’ কিন্তু সে যখন এই কথা বলছে, তখনই রাম তাঁর উজ্জ্বল তরবারি নিষ্কোষিত করে তার মুণ্ড কেটে ফেললেন। তৎক্ষণাৎ দেবতারা রামের উপরে পুষ্পবৃষ্টি করলেন, তাঁর এই কর্মের প্রশংসা করলেন এবং বললেন রাম দৈবকার্য সাধিত করেছেন। তাঁরা তাকে বর দিতে চাইলেন, তাই দিয়ে রাম ব্রাহ্মণ কুমারকে বাঁচিয়ে তুললেন।

রামায়ণ-এর অন্তিম সংযোজন সম্পূর্ণ হওয়ার প্রায় দুই শতাব্দী পরে কালিদাস তাঁর রঘুবংশ-তে এই ইতিবৃত্ত তুলে নিলেন। সেখানে পঞ্চদশ সর্গে (৫০-৫৫ শ্লোকে) আমরা এই উপাখ্যানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পাই। কালিদাস বাল্মীকির মূল ইতিবৃত্ত থেকে ব্যতিক্রম ঘটাতে সাহস পাননি এবং তাঁর সামাজিক মূল্যবোধ মূলত বাল্মীকির সঙ্গে একই ছিল, কারণ তিনি রঘুবংশ রচনা করেছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের ব্রাহ্মণ্য পুনরুত্থানের যুগে। তিনি রঘুবংশের প্রতিষ্ঠাতাকে প্রশংসা করেছেন, ‘যাঁর প্রজারা মনুর বিধান থেকে রেখামাত্রও সরে যায়নি।’ (১ম সর্গ, ১৭শ শ্লোক)

কিন্তু ধার্মিক শূদ্রের এই তাৎক্ষণিক বধের বিষয়ে তাঁর ভিতরের কবি স্বস্তিবোধ করেননি। রামের কাজটি সমর্থন করা ছাড়া তাঁর কোনও উপায় ছিল না, কারণ, বাল্মীকিও তাই করেছেন, কিন্তু তিনি যা করতে পারতেন এবং করেওছেন, তা হল একটি মর্মস্পর্শী চিত্রকল্পের মাধ্যমে তাঁর কবিসুলভ অন্তর্দৃষ্টির প্রকাশ। ‘রাম শম্বুকের কণ্ঠ থেকে তার সেই মুখখানা বিচ্যুত করলেন, যা হেমাঙ্গ পরাগবিশিষ্ট পদ্মের মতো, তার প্রান্ত দেবতার শ্মশ্রু, তাতে যেন উজ্জ্বল বিন্দু ঝুলে আছে।’ (১৫:৫২)। মৃত্যুর ফলে শূদ্র ধার্মিকদের স্থান পেল; কঠোর তপস্যাতেও সে তার নিজের পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি, কালিদাস খুব সূক্ষ্ম ভাবে বাল্মীকি বর্ণগ্রস্ত উপাখ্যান আগে বিচার করেছেন, বিধ্বস্ত পরাগযুক্ত পদ্মের কোমল চিত্রকল্প দিয়ে এবং শ্মশ্রুর প্রান্তদেশ উজ্জ্বলরূপে চিত্রিত করে। তারপরে তিনি শম্বুকের সামাজিক কলঙ্ক দূর করেন, ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়ায় তাকে ধার্মিকদের স্থান প্রাপ্ত করিয়ে।

প্রায় তিন শতাব্দী পরে ভবভূতি একই কাহিনি তুলে নিলেন তাঁর উত্তর রামচরিত-এর দ্বিতীয় অঙ্কে। তিনি দ্রুত প্রথম অংশটির উপর আচ্ছাদন ফেলে রামকে দিয়ে বলান, তাঁর মতো নিষ্ঠুর ব্যক্তি, যিনি স্নেহময়ী, নিষ্পাপ পত্নীকে গৃহচ্যুত করেছেন, তাঁর পক্ষে হতভাগ্য শূদ্রকে বধ করা তুচ্ছ ব্যাপার। তারপর এক দৈবী মূর্তি মঞ্চে প্রবেশ করে নিজেকে শম্বুক বলে পরিচয় দেয়; রামের হাতে মৃত্যু তাকে দৈব তেজ দিয়েছে।

রাম শম্বুককে আশীর্বাদ করেন, ‘বৈভ্রাজ নামে তেজোময় লোক, যেখানে ধার্মিকতা থেকে উৎসারিত হয় আনন্দ ও উল্লাস, তা চিরদিন তোমার হোক।’ আমরা লক্ষ্য করি, এই আশীর্বাদ শ্লোকের প্রথম পাদ সরাসরি ঋগ্বেদ (৯:১১৫:১১) থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, যেখানে তাদের কাল্পনিক লোকে সোমপায়ীদের ভোগের বর্ণনা আছে। রাম শূদ্র শম্বুকের জন্য স্বর্গভোগ কামনা করেছেন, যে শূদ্রকে তিনি নির্মম ভাবে হত্যা করেছেন— বাল্মীকির বর্ণনা অনুযায়ী স্বয়ং দেবতারা তাঁর যে কাজের প্রশংসা করেছেন। কালিদাস শূদ্রকে আশীর্বাদ করেছেন, বরপ্রাপ্তদের লোকে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। ভবভূতি সেই আশীর্বাদ কার্যে পরিণত করেছেন এবং শূদ্রকে অধিকার লঙ্ঘনের অপরাধ থেকে মুক্ত করেছেন।

এই থেকেই প্রকাশ পায় একটি স্বীকৃত ও উত্তরাধিকারলব্ধ উপাখ্যানের পরই কবিদের চিন্তাধারার পরিবর্তন; যে নতুনত্ব তাঁরা উপস্থাপিত করেছেন, তা কবিদের ব্যক্তিগত সহানুভূতিরই সাক্ষ্য বহন করে, শূদ্রের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কোনও নমনীয়তার প্রমাণ নয়। কালিদাস ও ভবভূতির মাঝামাঝি সময়ে রচিত পুরাণগুলিতে, এমনকী তার পরে রচিত যেগুলি তাতেও, শূদ্রের প্রতি ক্রমশ দৃষ্টিভঙ্গির কঠোরতাই ধীরে ধীরে প্রতিফলিত হয়। তার একমাত্র কর্তব্য হল অপর তিন বর্ণের সেবা করা, তার অধিকার শাস্ত্রগত ভাবে ক্রমশই খারিজ করা হচ্ছে এবং তাকে উত্তরোত্তর সমাজের শত্রু হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কলিযুগে শূদ্র তার স্বীকৃত অধিকার লঙ্ঘন করবে, আরও বেশি সামাজিক সম্মান লাভ করবে, এবং সমাজের অন্যান্য অংশের উপর কর্তৃত্ব করার ভান করবে। সে গুরুতর ধর্মসঙ্কট ও সমাজের সত্যকার বিপদ হওয়ার পথে চলেছে।

দুই

এই ব্যাপার যে ঘটছে, তার একটি প্রমাণ হল, তথাকথিত অপকর্মের নিয়ম, যেগুলি অনুসারে শূদ্র আপৎকালে উচ্চতর তিন বর্ণের কিছু কিছু জীবিকা অবলম্বন করতে পারে। বলাই বাহুল্য, পুরাণের এই অংশগুলি বাস্তবে যা ঘটছে তারই সমর্থন ও গ্রহণের জন্য কল্পিত; কোনও কোনও শ্রেণির শূদ্র কিছু শিক্ষা পেয়েছে, কিছু ধন সঞ্চয় করেছে, সমাজে অস্বীকৃত সম্মান লাভ করেছে। এই উন্নতিশীল শ্রেণির শূদ্রকে বলা হত সচ্ছূদ্র (সচ্ছূদ্রৌগোপনাপিতৌ)। মনু তাকে বলেছেন পতিত বৈশ্যের সন্তান (১০:২২); যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, সে বৈশ্য মাতা ও শূদ্র পিতার সন্তান (১:৯২); মহাভারত-এর আদিপর্বে বলা হয়েছে, তার পিতা ক্ষত্রিয় ও মাতা বৈশ্য, জীবিকার দিক দিয়ে করণ হল লেখক। বৃহদ্ধর্ম পুরাণ-এ বলা হয়েছে, ‘করণ চিরদিন শ্রীযুক্ত হোক। সে বিনয়ের সঙ্গে কথা বলে ও আচরণ করে; সে রাজকার্যে নিযুক্ত এবং নীতিজ্ঞ। সে ব্রাহ্মণ ও দেবতার প্রতি ভক্তিমান। সচ্ছূদ্র নিঃসন্দেহে এমন হবে। সে ব্রাহ্মণ ও দেবতার আরাধনায় রত। সচ্ছূদ্রের লক্ষণ অমাৎসর্য এবং সুশীলতা।[৪]

বর্ণনায় কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়: করণের সম্পত্তি (শ্রী) আছে, কিন্তু তার আচরণ বিনীত, সে ব্রাহ্মণ ও দেবগণের প্রতি ভক্তিমান; কোনও করণিকস্তরে সে রাজকর্মচারী। যেহেতু সে লিখতে পারে এবং তার কাজ তাকে রাজ্যসভার সন্নিকটে নিয়ে যায়, তার ভাগ্যে অবশ্যই অভিষিক্ত রাজকীয় প্রসাদ জোটে, যার সঙ্গে কিছু সামাজিক সম্মান যুক্ত থাকতে পারে। এই শ্লোকের তাৎপর্য হল, সজ্জুদ্র দরিদ্র ও সমাজে শক্তিহীন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সত্যকারের শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।

ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ-এর একটি পাঠে এর সমর্থন পাওয়া যায়। একটি অংশে বলা হয়েছে, নরমেধ যজ্ঞে অশ্বমেধযজ্ঞের অর্ধেক পুণ্য হয়। (প্রকৃতিখণ্ড ২৭:১২০) দুর্গার উদ্দেশ্যে ‘একটি মায়াতি’, একটি মহিষ, একটি ছাগ এবং একটি সুলক্ষণ মেষ নিবেদন করা উচিত। তাঁর উদ্দেশ্যে মায়াতি নিবেদন করলে দুর্গা সহস্রবর্ষ প্রসন্ন থাকেন। (প্রাগুক্ত ৫৫:৯১, ৯২) ‘শোনো, হে ঋষিশ্রেষ্ঠ, মায়াতির (এই) লক্ষণ; এগুলি অথর্ববেদ অনুসারে; এর অবহেলা হলে সব সুফল বিনষ্ট হয়। এক তরুণ পিতৃমাতৃহীন (যুবক), স্বাস্থ্যবান, প্রসন্নভাব, বিবাহিত এবং সদ্বংশের অজারজ সন্তান, দীক্ষিত সদ্র, বংশের একমাত্র মূল, এমন (ব্যক্তিকে) প্রকৃত মূল্যের অধিক মূল্য দিয়ে তার বান্ধবদের কাছ থেকে কিনে নিতে হবে। ধার্মিক ব্যক্তি তাকে স্নান করিয়ে বস্ত্র, চন্দন, মালা ও ধূপ দিয়ে পূজা করে একজন চর সঙ্গে দিয়ে (সম্ভবত যাতে সে পালাতে না পারে) এক বৎসরের জন্য বাইরে ঘুরতে পাঠানো হবে (অশ্বমেধের অশ্বের মতো)। এক বৎসর পূর্ণ হলে তাকে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিতে রাত্রিকালে দুর্গার উদ্দেশে নিবেদন করতে হবে।[৫]

সুতরাং ছাগ বা মেষের মতো মায়াতিও বলির পশু— সেই ভাবেই তাকে কেনা হয়, স্নান করানো হয়, সাজানো হয়, এক বছর সেই ভাবেই ঘোরানো হয় (অশ্বমেধের অশ্ব তুলনীয়), এবং সেই ভাবেই বলি দেওয়া হয়। উদ্দেশ্যও একই, দেবীর প্রসন্নতা— এ ক্ষেত্রে সহস্রবৎসরের জন্য— যাতে যজমানের পরিবারে বর প্রবাহিত হয়।

কিন্তু এ ছাড়াও এই হতভাগ্য মায়াতি, যার মৃত পিতামাতা বংশ রক্ষার প্রয়োজনে আর সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না, যার নিজের বিধবা পত্নী নিঃসন্তান অবস্থায় পরিত্যক্ত হবে, যেহেতু তার স্বামী মায়াতি হল মূলক অর্থাৎ বংশের শেষ জীবিত পুরুষ, সে স্বাস্থ্যবান, সুতরাং ভাগ্য ভাল হলে যে সুখী, সমৃদ্ধ পরিবার ও একাধিক সন্তান নিয়ে সংসার করতে পারত, যার চারিত্রিক কোনও দোষ নেই, শারীরিক সুস্থতা আছে, কিছু অর্থ ও শিক্ষালাভ করেছে (দ্রষ্টব্য, তার করণের বৃত্তি এবং সভায় তার জীবিকা), এবং সেই কারণে যে কিছু সামাজিক ক্ষমতা ও সম্ভবত কিছু রাজনৈতিক সম্মানেরও অধিকারী— এমন একজন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তে জীবনচ্যুত। সমাজের ক্ষমতাশালী রাজনীতিবিদদের একটি ভাবী বিপদ এমনি ভাবেই দূর করা হল।

তিন

শম্বুক উপাখ্যান যে পর পর তিন কবির দ্বারা তিন ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তাতে কবিদের মর্মগ্রাহিতারই সাক্ষ্য রয়েছে, স্পষ্ট ভাবেই নিরপরাধ এক শূদ্রের নিষ্ঠুর হত্যার বিষয়ে তাঁদের অস্বস্তি পরবর্তী দুটি সংস্করণ থেকে প্রমাণিত হয়। অতি কল্পনার দ্বারাও কবিদের সমসাময়িক সমাজের চিত্র বলে একে গ্রহণ করা যায় না। খুব সম্ভব ধর্মশাস্ত্রের অনুশাসন অনুযায়ী শূদ্রদের এবং নিপীড়িত শ্রেণির উপরে অমানবিক নিষ্ঠুরতার উত্তরোত্তর বৃদ্ধিই কবিদের অনুপ্রেরিত করেছিল তাঁদের সৃষ্টিতে সামাজিক কুপ্রথার কিছুটা প্রশমন অথবা তার কতকটা ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করতে। উপরন্তু, শিক্ষিত ও সম্পন্ন শূদ্রেরা সমাজের উচ্চতর শ্রেণির চোখে বিপদ, তারাই হয়তো তাদের বিষয় কবিদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। কবিরা বুঝেছিলেন, তারা উচ্চতর বর্ণের অনেকের চেয়ে মন্দ নয়।

সপ্তম শতাব্দীতেই বাণভট্ট অচ্ছুৎ চণ্ডালকন্যা ও তার পিতাকে জাতিচ্যুত শবর শিকারীদের এবং অন্যান্য শূদ্র চরিত্রগুলিকে কবিসুলভ যে মর্মস্পর্শিতার সাহায্যে চিত্রিত করেছেন, তা করুণা, মানসিকতা এবং কতকটা সহানুভূতিতেও সজীব। হয়তো তিনিও শিল্পী হিসেবে প্রতিবাদ করেছিলেন ক্রমবর্ধমান বর্ণভেদের অনমনীয়তায় গড়ে ওঠা এক সমাজের, যে সমাজ দ্রুত চলেছে নরমেধ যজ্ঞের দিকে, তার বলি অবদমিত শূদ্র মায়াতি, যে উন্নতিশীল শূদ্রগোষ্ঠীর প্রতিভূ। অন্য সব দিক দিয়ে ভাল, স্বাস্থ্যবান, শিক্ষিত এই যুবককে বলির পশুর মতো হত্যা করার যে এই অত্যন্ত অমানবিক আচরণের দৃষ্টান্ত মেলে, তা একদিকে সম্ভাব্য সামাজিক প্রতিস্পর্ধীর ভয়ের দ্বারা প্ররোচিত এবং অন্য দিকে লোভের দ্বারা— রক্তপিপাসু দেবীকে অপর কোনও মানুষ বলি দিয়ে সহস্রবর্ষ প্রসন্ন রাখার লোভ। নরমেধ যজ্ঞ সম্ভবত ঋগ্বেদ রচনার পূর্ব থেকেই বাস্তব, হয়তো খাদ্যাভাবের সময়ে যুদ্ধ বন্দিদের এই দুর্ভাগ্য হত (এবং বন্দিদের শুধু বন্ধনকারীদের স্বল্প খাদ্য থেকেই খাওয়াতে হত)। কিন্তু এর চিহ্ন এবং স্মৃতি সাহিত্যে রয়ে গেছে (দ্রষ্টব্য, শাস্ত্রে উল্লিখিত নরমেধ যজ্ঞ), যা পরবর্তীকালে একটি প্রতীকে পর্যবসিত হয়েছিল। একটি রক্তমাংসের মায়াতিকে বলি দেওয়ার এই অনুষ্ঠানে নরবলির পুনরুত্থান ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে এবং তৎকালীন অবদমিত শ্রেণির উন্নতিতে বিপন্ন এক সমাজ যে কত নিম্নস্তরের নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতাকে স্বীকৃতি দেয় এবং প্রশংসা করে, তাই প্রকাশ করে। মনে পড়ে কলিযুগে শূদ্রদের মানবিক অধিকার ও সম্মান অর্জনের স্পর্ধা যে তাদের দীন ভূমিকা ভুলিয়ে দেবে তার বারে বারে উল্লেখ। এই হল তাহলে বাধা পাওয়ার উপায়: আনুষ্ঠানিক ভাবে এক সাধু, পুণ্যবান, স্বাস্থ্যবান, সমর্থ শূদ্রকে হত্যা করে সমাজ শূদ্রকের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে সমাধান বাণী শোনাচ্ছে। এমন নির্মম আনুষ্ঠানিক হত্যার কথা মনে হলে শিহরিত হতে হয়, যে হত্যা পরিপূর্ণ ভাবে এবং বারে বারে ঘটলে ক্রমে ক্রমে শূদ্রদের উৎকৃষ্ট ও উচ্চতর গোষ্ঠীর বিনাশ ঘটবে।

সূত্রাবলি

১. দ্রঃ রাজদোষৈবিপর্যদ্যন্তে প্রজা হ্যবিধিপালিত
অসদ্‌বৃত্তে হি নৃপতাবকালে ম্রিয়তে জনঃ।। ৭:৭৩:১৩]

২. ৭:৭৪:২৫

৩. ৭:৭৬:১-১৪]

৪. অয়ন্তু করণো নাম শ্রীযুক্তো বর্ততাম্ সদা।
বিনয়াচারসম্পন্নো সুষ্ঠু বচনং চোক্তবান্।।
রাজকার্যং করোত্যেষ নীতিজ্ঞো দৃশ্যতে হ্যয়ম্।
ব্রাহ্মণে ভক্তি মাংশ্চৈব দেবেম্বপি ভবত্যপি।।
এষ এব হি সচ্ছ্বদ্রো ভবত্যেব ন সংশয়ঃ।
ব্রাহ্মণে ভক্তি মস্তস্ত দেবতারাধনে চাতঃ।
অমাৎসর্যং সুশীলত্বম্ এতৎ সচ্ছৃদ্ৰলক্ষণম্।।
(উত্তরখণ্ড, ১৪। ৩০-৩২)
রচনার নিম্নমান, অকারণ পুনরুক্তি, ব্যাকরণগত এবং ভাষাবিধিগত ভ্রান্তিগুলি থেকে এর রচয়িতা কোনও অর্ধশিক্ষিত পুরোহিত বলেই অনুমান হয়।

৫. মায়াতিনাং চ নির্ণীতং শয়তাং মুনিসত্তম।
রক্ষ্যমথর্ববেদোক্তং ফলহানির্ব্যতিক্রমে।।
পিতৃমাতৃ বিহীনং চ যুবকং ব্যাধিবর্জিতম্।
বিবাহিতং দীক্ষিতঞ্চ পরদারবিহীকম।।
অজারজং বিশুদ্ধঞ্চ সদ্রং মূলকং বরম্।
তদ্‌বন্ধুভ্যো ধনং দত্ত্বা ক্রীতং মূল্যাতিরেতঃ।।
স্নাপয়িত্ব। চ তং ধর্মী সম্পূজ্য বস্ত্ৰচন্দনৈঃ।
মালৈন্যের্ধূপৈশ্চ সিন্দুরৈর্দধিগোরোচনাদিভিঃ।
তং চ বর্ষং ভ্রাময়িত্বা চরদ্বারেণ যত্নতঃ।
বর্ষান্তে চ সমুৎসৃজ্য দদ্যান্মায়াতিমেব চ।।

(প্রকৃতিখণ্ড, ৬৫:১০০-১০৫)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *