• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৬. সবুজের হিন্দুয়ানি

লাইব্রেরি » অতুলচন্দ্র গুপ্ত » শিক্ষা ও সভ্যতা » ০৬. সবুজের হিন্দুয়ানি

সবুজের হিন্দুয়ানি

সম্পাদক মহাশয় শুনেছেন অনেকের আশঙ্কা, নবপর্যায়ের ‘সবুজপত্র’ নাকি হবে জীর্ণ হিন্দুয়ানির আতপত্র। কথা কী করে রটলো বলা যায় না, তবে এ কথা বলা যায় যে, ভয় একেবারে অমূলক নয়। শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী মহাশয়ের বয়স হয়ে আসছে; আর প্রথম বয়সের ইংরাজি-পড়া তার্কিক যে শেষ বয়সে শাস্ত্ৰভক্ত গোঁড়া হিন্দু–এই হচ্ছে সাধারণ নিয়ম। কাজেই যাদের ভাবনা হয়েছে পুনরুদগত ‘সবুজপত্র’ আধুনিকতার প্রখর রশ্মি থেকে প্রাচীন হিন্দুত্বকে ঢেকে রাখবে, তাদের ভয়কে অহেতুক বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন যে, শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরীর সম্বন্ধে সাধারণ নিয়মটা খাটে না। কারণ তিনি কেবল ইংরেজিনবিশ নন, ইউরোপের আরও দু-একটা আধুনিক ভাষা ও সাহিত্যনবিশ; যার ফলে ইংরেজি মদের নেশা কোনওদিনই তাকে বেসামাল করতে পারেনি। আর হিন্দুশাস্ত্রচর্চাও তিনি শেষ বয়সে ‘বঙ্গবাসী’র অনুবাদ মারফত আরম্ভ করেননি, তরুণ বয়স থেকেই শাস্ত্রকারদের নিজ হাতের তৈরি খাঁটি জিনিসে নিজেকে অভ্যস্ত করে এসেছেন। এখন আর ওর প্রভাবে ঝিমিয়ে পড়বার তাঁর কোনও সম্ভাবনা নেই।

এ কথার মধ্যে কিছু সত্য আছে। কিন্তু হিন্দুত্ব ও হিন্দুশাস্ত্রের উপর চৌধুরী মহাশয়ের ভক্তি যে গোঁড়া গদগদ ভক্তি নয়, তার যথার্থ কারণ এ দুয়ের উপর তাঁর অসীম প্রীতি, কেননা ওখানে তার নিগূঢ় মমত্ববোধ রয়েছে। জাতিতে ব্ৰাহ্মণ হলেও চৌধুরী মহাশয়ের শরীরে প্রাচীন শাস্ত্রকারদের রক্তের ধারা কতটা অক্ষুন্ন আছে, এ নিয়ে হয়তো শ্ৰীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ তর্ক তুলতে পারেন, কিন্তু তাঁর বুদ্ধি ও মনোভাব যে প্রাচীন আৰ্য শাস্ত্রকারদের বুদ্ধি ও মনোভাবের অক্ষুন্ন ধারা, এতে আর তর্ক চলে না। শাস্ত্রকার মনু কি ভাষ্যকার মেধাতিথি, এঁদের সঙ্গে আজ মুখোমুখি সাক্ষাৎ হলে তাঁরা অবশ্য চৌধুরী মহাশয়কে নিজেদের বংশধর বলে চিনতে পারতেন না; বরং পোশাক পরিচ্ছদ, চাল-চলনে প্রত্যন্তবাসী কশ্চিৎ ম্লেচ্ছ বলেই মনে করতেন। কিন্তু দু’-চার কথার আদানপ্রদানে টপ হ্যাট ও ফ্রক কোটের নীচে যে মগজ ও মন রয়েছে, তার সঙ্গে পরিচয় হবামাত্র তাঁরা নিশ্চয়ই চৌধুরী মহাশয়কে এই বলে আশীৰ্বাদ করতেন–

‘আত্মা বৈ পুত্রনামাসি সজীব শরদাং শতম্‌।’

‘হে পুত্র! আমাদের আত্মাই তোমাতে জন্ম পরিগ্রহ করেছে। তুমি শত বৎসর পরমায়ু নিয়ে অযজ্ঞীয় ম্লেচ্ছপ্রায় বঙ্গদেশে ইস্পাতের লেখনীমুখে আৰ্যমনোভাব প্রচার ও তার গুণ কীর্তন কর।’

এই আর্যমনোভাব বস্তুটি কী, একটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক। কারণ প্রমথবাবু যদি ‘সবুজপত্রে’ হিন্দুয়ানি প্রচার করেন, তবে এই মনোভাবেরই প্রচার করবেন।

যে প্রাচীন আর্যেরা হিন্দুসভ্যতা গড়েছে, তাদের সকলের মনোভাব কিছু একরকম ছিল না। হিন্দুসভ্যতার জটিল বৈচিত্র্য দেখলেই তা বোঝা যায়। যাঁরা উপনিষদ রচেছে ও যাঁরা ভক্তিশাস্ত্র লিখেছে; পুরুষাৰ্থ সাধন বলে যাঁরা যাগযজ্ঞবিধির সূক্ষ্ম বিচার ও বিচারপ্রণালীর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনা করেছে; ও যাঁরা চতুরার্য সত্য ও অষ্টাঙ্গ মার্গ উপদেশ করেছে; যাঁরা শ্রুতিকে ধর্মজিজ্ঞাসুদের পরম প্রমাণ বলেছে; ও যাঁরা বলেছে বেদ লোকযাত্ৰাবিদদের লোকনিন্দ থেকে রক্ষার আবরণ মাত্র(১); ন্যায়-দর্শন যাদের তত্ত্বপিপাসার নিবৃত্তি করেছে, ও যাঁরা অখণ্ড অদ্বয়-বাদে না পৌছে থামতে পারেনি–তারা সবাই ছিল আৰ্য, এবং হিন্দুসভ্যতা গড়ার কাজে সবারই হাত আছে। একদল অনুশাসন দিয়েছে গৃহস্থাশ্রমে যজ্ঞানুষ্ঠানে দেবঞ্চণ ও প্রজোৎপাদনে পিতৃঋণ শোধ দিয়ে তবে বানপ্ৰস্থী হয়ে মোক্ষ চিন্তা করবে, নইলে অধোগতি হবে; অন্য দল উপদেশ করেছে যেদিন মনে বৈরাগ্য জগবে সেইদিনই প্ৰব্ৰজা নেবে। রাজ্যরক্ষা ও রাজ্যবৃদ্ধির উপায় রাজাকে শেখাবার জন্য একদল ‘অর্থশাস্ত্ৰ’ রচনা করেছে; অপর দল ‘ধর্মশাস্ত্ৰ’ লিখে সে পথ দিয়ে হাঁটতে রাজাকে মানা করেছে। কেউ বলেছে পুত্রের জন্মমাত্র সে পৈতৃক ধনে পিতার মতোই স্বত্ব লাভ করে, কেউ বিধান দিয়েছে পিতা যতদিন বেঁচে আছে পুত্রের ততদিন কোনও স্বত্ব নেই। যে লৌকিক প্রবচন বলে, এমন মুনি নেই যার ভিন্ন মত নেই, তার লক্ষ হিন্দু-সভ্যতা-স্রষ্টাব্দের এই মতবিরোধের বৈচিত্ৰ্য।

এতে আশ্চর্য কিছু নেই, বিশেষত্বও কিছু নেই। যে-কোনও বড় সভ্যতার মধ্যেই এই বিরোধ ও ভেদ দেখতে পাওয়া যাবে। সভ্যতা হল মনের স্বচ্ছন্দ লীলার সৃষ্টি। বহু মনের লীলাভঙ্গি বিচিত্র না হয়ে যদি সৈন্যের কুচের মতো একেবারে একতন্ত্র হত, তবে সেইটেই হত অতি আশ্চর্য ব্যাপার। কিন্তু তবুও যদি জাতি-বিশেষের নামে কোনও সভ্যতার নামকরণ করি, যেমন হিন্দুসভ্যতা-তখন যে কেবল এই খবর জানাতে চাই যে, কতকগুলি বস্তুজগতের ও মনােরাজ্যের সৃষ্টি বংশপরম্পরাক্রমে মোটামুটি এক জাতির লোকের কাজ, তা নয়। প্রকাশ্য বা নিগৃঢ়ভাবে এই ইঙ্গিত প্রায় সকল সময়ে থাকে যে, ওই সব বিচিত্র, বিভিন্ন, এমনকী বিরোধী সৃষ্টিগুলির মধ্যে একটা ঐক্যের বাঁধন আছে, যে ঐক্য কেবল জন্মস্থান-সমতার ঐক্য নয়, ভাবগত ও রুচিগত ঐক্য। খুব সম্ভব। এ ঐক্যের মূল ওই জন্মগত ঐক্য। কারণ ওই সৃষ্টিগুলির যাঁরা কর্তা, তাদের শিরার রক্ত ও মাথার মগজের এক মূল জীব থেকে উৎপত্তি, এবং তাদের প্রাকৃতিক ও মানসিক পারিপার্শ্বিকও অনেক অংশে এক৷ অতিবড় প্রতিভাশালী স্রষ্টাও এর প্রভাব এড়াতে পারে না ও এড়াতে চায় না। ফলে তাদের সৃষ্ট সভ্যতা তার বহুমুখী বৈচিত্র্য ও নানা পরিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যেও ভিতরের কাঠামোখনি প্ৰায় বাহাল রাখে। ঘরের চাল বদলে যায়, দরজা জানালার পরিবর্তন হয়, পুরনো বেড়া তুলে ফেলে নতুন বেড়া বসানো হয়, কিন্তু মাঝের ‘ফ্রেমটি বজায় থাকে। আৰ্যমনোভাব হিন্দু-সভ্যতার এই ‘স্টিলফ্রেম’।

বলা বাহুল্য এ ‘স্টিলফ্রেমে’র শলাকা চোখে দেখা যায় না। চুম্বকের ‘লাইনস অব ফোর্সেস’ শক্তিসঞ্চার পথের মতো সেগুলি অদৃশ্য। তাদের উপাদান কোনও বস্তুসমষ্টি নয়, এমনকী রাষ্টিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানও নয়। চিন্তা বা মননের কতকগুলি বিশেষ ভঙ্গি, ভাব ও অনুভূতির কয়েকটি বিশেষ্যমুখী প্রবণতা দিয়ে এ ‘ফ্রেম’ তৈরি। সুতরাং আৰ্যমনোভাব জিনিসটিকে রূপরেখায় চোখের সুমুখে ফুটিয়ে তোলা সহজ নয়। প্রাচীন হিন্দুসভ্যতার সৃষ্টিগুলির সঙ্গে কিঞ্চিম্মাত্রও প্রত্যক্ষ পরিচয় হলে এ মনোভাবের যে সুস্পষ্ট ছবি মনে একে যায়, ভাষায় তার মূর্তি গড়া সুদক্ষ শিল্পীর কাজ। সে অনধিকার চেষ্টায় উদ্ধাহু না হয়ে সাদা কথায় তার দু’-একটা লক্ষণের কিছু আলোচনা ও বিশ্লেষণের চেষ্টা মাত্র করব। ইংরেজিতে যাকে ‘সেন্টিমেন্টালিজম’ বলে, আমরা তার বাংলা নাম দিয়েছি ভাবালুতা। ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালি সমাজে বিগত শতাব্দীর শেষ ত্ৰিশ বছর ছিল এই ভাবালুতার পুরো জোয়ারের সময়। উনবিংশ শতাব্দীর যে ইংরেজি কাব্য ও সাহিত্যে তখন শিক্ষিত বাঙালির মন পুষ্ট হচ্ছিল, সে কাব্য সাহিত্য ‘সেন্টিমেন্টালিজম’-এর রসে ভরা; সুতরাং তার প্রেরণায় বাঙালি যে সাহিত্য সৃষ্টি করছিল, তা ভাবালুতায় ভরপুর। এবং প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের মাত্র যে অংশের তখন শিক্ষিত বাঙালির উপর প্রভাব ছিল, সেই বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যও এই ভাবালুতার অনুকূল। এই মানসিক আবেষ্টনের মধ্যে বর্ধিত হয়ে প্রাচীন আৰ্যমনোভাবের যে লক্ষণ শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী মহাশয়ের চোখ ও মন সবচেয়ে সহজে ও সবলে আকর্ষণ করেছে, সে হচ্ছে ‘সেন্টিমেন্টালিজম’ বা ভাবালুতার অভাব; এবং কেবল অভাব নয়, বিরোধী ভাবের আধিপত্য। কারণ প্রাচীন হিন্দুর মনোভাবের এমন একটা ঋজু কাঠিন্য ছিল, যা কি শরীর কি মনের সমস্ত রকম নুইয়ে-পড়া ও লতিয়ে-চলার বিরুদ্ধ। কালিদাস আৰ্যরাজার মৃগয়াকৰ্ষিত শরীরের যে ছবি এঁকেছেন, সেটা প্রাচীন আৰ্যমনেরও ছবি।

‘অপচিতমপি গাত্ৰং ব্যায়তত্বাব্দলক্ষ্যং
গিরিচর ইব নাগঃ প্ৰাণসারং বিভৰ্ত্তি।’

‘মোদহীন কৃশতা ঋজু দীর্ঘতায় কৃশ বলে লক্ষ্য হয় না। পর্বতচারী গজের মতো দেহ যেন কেবল প্ৰাণের উপাদানেই গড়া।’ অথচ এই মেদশূন্য কৃশতা কল্পনা-অকুশল মনের বস্তৃতান্ত্রিক রিক্ততা নয়। হিন্দুর বিরাট পুরাণ ও কথাসাহিত্য, বৌদ্ধ ও জৈন গাথার বিপুলতা ভারতীয় আৰ্যমানের অফুরন্ত কল্পনালীলার পরিচয় দিচ্ছে। এ কাঠিন্যও শুষ্কপেশি কঙ্কালসার কাঠিন্য নয়। ভাবের দীনতা, রসবোধ ও রসসৃষ্টির অক্ষমতা জাতির মনকে বিধিনিষেধ-সর্বস্ব যে শুষ্ক কঠিনতা দেয়, সে কাঠিন্য হিন্দুর কখনও ছিল না। বেদসূক্তের উষার বন্দনা থেকে ভর্তৃহরির শতক ত্রয় পর্যন্ত ভাব ও রসের সহস্র ধারা তাকে পাকে পাকে ঘিরেছে। তার ভৌগকে শোভন ও জীবনযাত্রাকে মণ্ডনের জন্য চৌষট্টি কলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সমস্ত ভাব ও কল্পনা, রস ও কলাবিলাসের মধ্যে একটা সরল, কঠিন মেরুদণ্ড সব সময়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। প্রাচীন আৰ্যমনে ভাবের অভাব ছিল না। কিন্তু আমরা যাকে বলি ‘ভাবে গলে যাওয়া’, তার মাধুর্য সে মনের রসনা আস্বাদ করেনি। ভগবান বুদ্ধ লোকের জন্মজরামরণের দুঃখে স্ত্রী, পুত্র, রাজ্য, সম্পদ ছেড়েছিলেন, কিন্তু চোখের জল ছাড়েননি।

পণ্ডিত লোকে এমনও বলেছেন যে, প্রাচীন আর্যজাতি মূলে ছিল যাযাবর লুঠতরাজের দল-’প্ৰিডেটারি নোমাডস’। অন্য ধ্রুবশীল সভ্যজাতির ঘাড়ে চেপে তাদের পরিশ্রমের অন্ন খেতে খেতে তাদেরই সংস্পর্শে তাঁরা ক্ৰমে সভা হয়েছে। এই ধার-করা সভ্যতার বীজ উর্বরা জমিতে খুবই ফলেছে বটে, কিন্তু তার শিকড় আদিম যাযাবরত্বের প্রস্তরকঠিন অন্তর ভেঙে মাটি করতে পারেনি, ফুলপাতায় ঢেকে রেখেছে মাত্র। এ মতের ঐতিহাসিক মূল্য যতটা থাক না থাক, এটি স্পষ্টই প্রাচীন আৰ্যমনোভাবের একটা পৌরাণিক অর্থাৎ ইভলিউশনারি’ ব্যাখ্যা। একটি ছোট উদাহরণ দিই। নাটক ও নাট্যাভিনয় প্রাচীন হিন্দুর প্রিয়বস্তু ছিল। হিন্দু আলংকারিকেরা কাব্যের মধ্যে নাটককেই সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দিয়েছেন। তাদের শিল্পকলার সংখ্যাও গণনায় চৌষট্টি পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কিন্তু হিন্দুর ধর্মশাস্ত্র ও অর্থশাস্ত্ৰ একযোগে বিধান দিয়েছে–কারুকর্ম ও কুশীলবের কর্ম শূদ্রের কাজ, আর্যের নয়।’(২) উদাহরণে পুথি বেড়ে যায়। কিন্তু আৰ্যমনের এই কাঠিন্য যে কত কঠোর, তা তাঁরা নিজেদের জীবনে অপরাহ্নকালের জন্য যে দুটি আশ্রমের ব্যবস্থা করেছিলেন, তার কথা একটু কল্পনা করলেই উপলব্ধি হয়।

‘গৃহস্থস্তু যদা পশ্যেদ্বলীপালিতমাত্মনঃ।
অপত্যস্যৈব চাপত্যং তদারণ্যং সমাশ্রয়েৎ ।৷’ (মনুঃ, ৬/২)

‘গৃহস্থ যখন দেখবে গায়ের চামড়া শিথিল হয়ে আসছে, চুলে পাক ধরেছে, ও পুত্রের পুত্র জন্মেছে, অর্থাৎ বার্ধক্যের অপটু শরীরে গৃহের ছোটখাটো সুখস্বাচ্ছন্দ্য, পুত্র পৌত্রের সেবা ও শ্রদ্ধা সবচেয়ে কাম্য হয়ে এসেছে, তখন ঘর ছেড়ে বনে প্রস্থান করবে।’ হতে পারে সে বন খুব বন্য ছিল না। কিন্তু পুরাতন প্রিয় গৃহ ও সমাজের সঙ্গে সমস্তরকম সম্বন্ধচ্ছেদের নির্মমতাতেই তা ভীষণ।

‘ন ফালকৃষ্টমশ্ৰীয়াদুৎসৃষ্টমপি কেনচিৎ।
ন গ্রামজাতন্যাৰ্ত্তোহপি মুলানি চ ফলানি চ ৷।’ (মনুঃ, ৬/১৬)

‘ভূমিকৰ্ষণে যা জন্মেছে, পড়ে পেলেও তা আহার করবে না। আর্ত হলেও গ্রামজাত ফলমূল গ্ৰহণ করবে না।’ এই বনবাসে উগ্ৰ তপস্যায় নিজের দেহ শোষণ করাই ছিল বিধি।

‘তপশ্চরংশ্চোগ্রতরাং শোষয়েদেহমাত্মনঃ।।’ (মনুঃ, ৬/২৪)

কিন্তু মৃত্যুকে অভিনন্দন করে এ জীবনেরও সংক্ষেপ কামনা করা নিষিদ্ধ ছিল।

‘নাভিনন্দেত মরণং নাভিনন্দেত জীবিতম্‌।
কালমেব প্রতীক্ষেত নির্দেশং ভৃতকো যথা ।।’ (মনুঃ, ৬/৪৫)

‘মরণকেও কামনা করবে না, জীবনকেও কামনা করবে না। ভৃত্য যেমন ভৃতিপরিশোধের অপেক্ষা করে, তেমনি কালের অপেক্ষা করবে।’

বানপ্রস্থের উপর শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী মহাশয়ের কতটা অনুরাগ আছে জানিনে, কিন্তু মনের যে বীৰ্য নিজের বার্ধক্যদশার জন্য এই বানপ্রস্থের বিধান করেছিল, সেই বীর্য তার মনকে মুগ্ধ করেছে। তিনি আধুনিক হিন্দুর মনে প্রাচীন আৰ্যমনের এই বীৰ্য ফিরিয়ে আনতে চান। এবং বর্তমানের মধ্যে অতীতকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা যদি reactionary হয়, তবে চৌধুরী মহাশয়কেও reactionary বলতে হবে।

হিন্দুমনের কাঠিন্য ও বীৰ্য কালবশে কমে আসছিল, এবং মুসলমান-বিজয়ের পর থেকে কমার বেগ ক্ৰমে দ্রুত হয়ে এখন প্ৰায় লোপের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। মনের একটা কোমলতা, গুটিকয়েক রসে আবিষ্টতা ও ভাবে বিহ্বলতা, তার খালি জায়গা অনেকটা জুড়ে বসেছে। হিন্দুর সচল মন নিশ্চেষ্ট থাকেনি। এই নতুন মনোভাবের উপযোগী ধর্মসাপনা, কাব্য ও দর্শন গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এর সাধক শ্রীচৈতন্য, কবি চণ্ডীদাস, দার্শনিক শ্ৰীজীব গোস্বামী। প্রমথবাবু যদি সবুজপত্রে’ প্রাচীন হিন্দুয়ানি প্রচারও করতে চান, তবে এই নবীন হিন্দুয়ানির সঙ্গে তাঁকে লড়তে হবে। কারণ ‘পুরুষ ব্যাঘ বনাম মানুষ মেষ’-এর মামলায় তিনি যে বেদখল বাদীর পক্ষে সরাসরি একতরফা ডিক্রি পাবেন, এমন মনে হয় না। প্ৰথম তো তামাদি দোষ কাটাতে বেগ পেতে হবে। তারপর সভ্যতার ইতিহাসে বাঘের চেয়ে মেষ হয়তো সভ্যতার জীব। এবং ‘দাসমনোভাবের চেয়ে যে, ‘প্ৰভুমনোভাব’ শ্রেষ্ঠ, তাও বিচার সাপেক্ষ। যাহোক, এ-তর্ক যদি প্রমথবাবু সত্য সত্যই তুলতে পারেন, তবে বাংলাসাহিত্যে শাক্ত-বৈষ্ণবের দ্বন্দ্বের একটা নতুন সংস্করণ অভিনয় হবে। কারণ অসম্ভব নয় যে, বাংলার তান্ত্রিক সাধনার মধ্যে প্রাচীন হিন্দুর কতকটা কাঠিন্য ও বীর্য বিকট ছদ্মবেশে লুকানো আছে।

কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবত্বই প্রমথবাবুর একমাত্র প্রতিমাল্ল হবে না। বাঙালির ইংরাজি-শিক্ষিত মন আজকার দিনে অনেক রকম সমন্বয়’ সাধন করেছে। বৈষ্ণব আচার্যেরা যে রসতত্ত্ব প্রচার করেছিলেন, সে রস ইক্ষুরস। সাংসারিক ভোগসুখ, গাৰ্হস্থ্য ও সামাজিক জীবন সমস্ত পিষে ফেলে তবে সে রস নিঙড়ে নিতে হয়। কিন্তু আমাদের ইংরেজি শিক্ষায় ‘একলেকটিক’ মন ইউরোপীয় বৈশ্যত্বের সঙ্গেও রসাতত্ত্বের সমন্বয় ঘটিয়েছে। অফিস, আদালত, শেয়ার মার্কেট, খবরের কাগজ, এ সব বাহাল রেখেই আমরা ও-রস ভোগ করছি। অর্থাৎ ও-রস এখন আর ইক্ষুদণ্ডে বন্ধ নেই, পেটেন্ট করে বোতলে পোরা হয়েছে। দিনের কাজের শেষে, কি ছুটির দিনে, খুব সুখে ও সহজে ওকে ঢেলে সম্ভোগ করা চলে। প্রাচীন হিন্দুর পক্ষ নিলে এ সমন্বয়ের সঙ্গে প্রমথবাবুকে যুদ্ধ করতে হবে। এবং ধর্মশাস্ত্রকারেরা বর্ণসংকরের বিরুদ্ধ হলেও আধুনিক বিজ্ঞান নাকি তার সপক্ষ। সুতরাং এ যুদ্ধ জেতাও সহজ হবে না। মোট কথা প্রাচীন হিন্দুয়ানির যুদ্ধে লড়তে হলে, প্রাচীন হিন্দুমনের কাঠিন্য ও বীর্যের প্রয়োজন হবে। শ্ৰীযুক্ত প্রমথ চৌধুরীর মনে ও-গুণ আছে বলেই জানি। সুতরাং তিনি এতে সাহসী হলেও হতে পারেন।

ভাদ্র ১৩৩২

———————-
(১) বাৰ্ত্তা দণ্ডনীতিশ্চেতি বার্তম্পত্যাঃ, সংবরণ মাত্ৰং হি ঐয়ী লোকযাত্ৰাবিদ ইতি।’ (কৌটিল্য, ১/২)
(২) শূদ্ৰস্য দ্বিজাতি শুশ্ৰষা বাৰ্ত্তী কারুকুশীলবকৰ্ম্ম চ’-(কৌটিল্য, ১/৩)

Category: শিক্ষা ও সভ্যতা
পূর্ববর্তী:
« ০৫. বৈশ্য
পরবর্তী:
০৭. ধর্ম-শাস্ত্ৰ »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑